নিও-ক্লাসিসিজম শিল্পরীতি

১৮শ শতকে ইউরোপে এনলাইটেনমেন্ট নামে যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তার প্রভাবেই সমকালীন সংস্কৃতি বিবর্তিত হয়েছে। এই আন্দোলন ঐতিহ্য, বিশ্বাস এবং সব রকমের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদ, দর্শন ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং অনুশীলনের প্রতি গুরুত্ব দেয়। নিও-ক্লাসিক্যাল শিল্পশৈলী এই সময়েরই অবদান যার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শৃঙ্খলা ও প্রাঞ্জলতা। এই দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিল্পীরা ক্লাসিক্যাল পর্বের নতুন ব্যাখ্যা খুঁজেছিল। রোকোকো শিল্পের কিউপিড ও পরীর স্থানে প্রাচীন ইতিহাস থেকে গুরুতর বিষয় নির্বাচন করে চিত্রকররা সেগুলো যথাসম্ভব বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিফলনের চেষ্টা করে। মিথলজির এপিকের বীরদের নিয়েই ছবি আঁকা জনপ্রিয় হয়, আগের মতো দেবতাদের সম্ভোগরত দৃশ্য আর প্রাধান্য পায় না।

নিও-ক্লাসিসিজম শিল্পরীতি ইতালির হারকিউলিয়াম এবং পম্পেই নগরীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার থেকে প্রেরণা লাভ করলেও তার নিছক অনুকরণ ছিল না। অনেক নিও-ক্লাসিক্যাল শিল্পী প্রাচীন গ্রিস ও রোমের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ধারণ করতে সচেষ্ট হয়, আবার কেউ কেউ সেই সময়ের কবি ও বীরদের কথা ও কাহিনি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর আগেও শিল্পের ইতিহাসে ক্লাসিক্যাল ও অন্যান্য পর্বে ক্লাসিক্যাল ঐতিহ্যের পুনর্ব্যাবহার করা হয়েছে কিন্তু ১৮শ শতকের শেষদিকে এবং ১৯শ শতকের প্রথমার্ধে ঐতিহাসিক ঘটনা ও বিষয়ের সত্যতা এবং নির্ভুলতার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।

ফ্রান্সে ১৮শ শতকের শেষদিকে যেসব ঐতিহাসিক দৃশ্যভিত্তিক ছবি আঁকা হয় সেগুলি রোমান সাম্রাজ্যের প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তখন মনে হয়েছে যে এই সব ছবির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রচারণা করার প্রয়াস রয়েছে। জ্যাক ডেভিড নামের শিল্পীর ফরাসি বিপ্লবোত্তর রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা ও কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে এই ধারণা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। তাঁকে প্রথমদিকে নিও-ক্লাসিক্যাল ধারার শিল্পী মনে হলেও পরবর্তী সময়ে রোমান্টিক শৈলীর অনুসারী হতে দেখা যায় যার মাধ্যমে তিনি বিপ্লবের দর্শনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তাঁর আঁকা ‘ইন্টারভেনশন অব দ্য স্যাবাইন উয়োম্যান‘ শীর্ষক ছবিটি দেখে এই ধারণার পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। ছবিটিতে দেখা যায় গৃহরমণীরা ছুটে এসে যুদ্ধরত রোমান ও স্যাবাইনদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করছে। সমকালে এর রাজনৈতিক বক্তব্য দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেও বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সে এটির বিপ্লব অনুকূল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ডেভিড ছবিতে তাঁর চরিত্রদের রোমানদের মতো পোশাক পরিয়েছেন যার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে রোমান প্রজাতন্ত্রই ফ্রান্সের লক্ষ্য। প্রাচীন রোমান যুগের স্মরণে ডেভিড যে শিল্পশৈলীর প্রবর্তন করেন তার নাম দেওয়া হলো ক্লাসিক্যাল যা পরবর্তী সময়ে নিও-ক্লাসিক্যাল নামে পরিচিত হয়। ডেভিড ও তাঁর অনুসারীরা ক্লাসিক্যাল শিল্পের অনুসরণে চিত্রশিল্পের অনেক রীতিনীতি তৈরি করে সে বিষয়ে লিখেছেন। ডেভিডের একটি বিখ্যাত ছবির নাম ‘ওথ অফ দ্য হোরেটি‘ যেখানে রোমের বীরত্বের কথা বলা হয়েছে। বিপ্লবের পর নেপোলিয়নের রাজত্বের সময় ডেভিড অশ্বারোহী সম্রাটের ছবি এঁকে প্রশংসা অর্জন করেন, যেখানে ক্লাসিক্যাল বীরদের ভঙ্গিতে নেপোলিয়নকে দেখানো হয়েছে। নেপোলিয়নের পর যে সম্রাট ক্ষমতায় আসেন ডেভিড তার কোপানলে পড়ে দেশত্যাগ করে ব্রাসেলসে চলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু ততদিনে ফ্রান্সে তাঁর প্রবর্তিত ক্লাসিক্যাল রীতির কঠোর নিয়মকানুন চালু হয়ে গিয়েছে। ডেভিডের প্রেরণা ছিল প্রাচীন গ্রিক ও রোমান শিল্পকর্ম, তার শিক্ষক যোসেফ ডিয়ে-এর আদর্শ এবং জোহান উইংকেলম্যানের শিল্পতত্ত্ব। শেষের দুজনই প্রাচীন গ্রিক শিল্পের মহান সৌন্দর্য ও জটিলতার প্রশংসা করেছেন। ফলে ডেভিড যে শৈলী উদ্ভাবন করেন তার সরলতা ও প্রাঞ্জলতা ছিল রোকোকোর অভিজাত শিল্পের বিপরীত। ‘ডেথ অব সক্রেটিস‘ ছবিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

তাঁর এক ছাত্র জ্যা অগস্ত দমিনিক অ্যাংগার ছিলেন নকশাবিদ। তাঁর ছবিতে আলো ও রঙের তুলনায় নকশা বা রেখার নৈপুণ্য ছিল বেশি। সব ক্লাসিক্যাল শিল্পীই তাদের ছবিতে রঙের চেয়ে রেখা আর আকারের ওপর প্রাধান্য দিয়েছে। অ্যাংগার সবচেয়ে ভালো আঁকতেন পোর্ট্রেট বা প্রতিকৃতি। যে প্রতিকৃতি তিনি পেন্সিলে এঁকে রং লাগিয়ে দিতেন সেগুলিতে নকশাই বেশি দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। ডেভিডের আর একজন ছাত্র বাঁর প্রো ক্লাসিক্যাল রীতিতে যেসব ছবি আঁকেন সেগুলি প্রশংসা অর্জন করতে পারেনি বরং এই শৈলী থেকে ভিন্ন যে শৈলীতে ছবি এঁকেছেন সেগুলির জন্যই তার খ্যাতি হয়েছে। গ্রো সেইসব ছবি ভালো আঁকতেন যা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। নেপোলিয়ন যখন ক্ষমতায় সেই সময় যুদ্ধে গ্রোকে নিয়ে যেতেন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর ছবি আঁকার জন্য। গ্রো এইভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে ছবি আঁকেন যার ফলে তিনি যুদ্ধের বাস্তবতা এবং ভয়ংকর সব দৃশ্য স্বচক্ষে দেখতে পান।

জোসেফ-মেরি ভিয়েদ্য কিউপিড সেলার‘ নামের যে ছবিটি আঁকেন সেটি নিও-ক্লাসিক্যাল শিল্পশৈলীর অন্যতম প্রধান দৃষ্টান্ত বলে মনে করা হয়। ছবিটির বিষয় রোমের কাছে হারকিউলিয়ামে খনন কাজের পর যেসব প্রাসাদ আবিষ্কৃত হয় তার একটির দেয়ালচিত্রের ওপর ভিত্তি করে আঁকা। ভিয়ে হুবহু অনুকরণ না করে কল্পনার ভিত্তিতে এঁকেছেন এবং সেখানে নতুন বিষয় যোগ করেন, বিশেষ করে ডিটেইলের সমাবেশে ক্লাসিক্যাল চরিত্র আনার জন্য। এ সত্ত্বেও বিষয়ের লঘু মেজাজ ও নারীমূর্তির সৌন্দর্য দেখে রোকোকো শৈলীর কথাই মনে পড়ে। ম্যারি-ভিয়ে শিল্প-ঐতিহাসিক ও ক্লাসিক্যাল শিল্প-বিশারদ উইংকেলম্যানের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তিনি হারকিউলিয়ামে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পর আবিষ্কৃত প্রাচীন শিল্প নিদর্শনের ভিত্তিতে ছবি আঁকার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে সবের মধ্যে গুরুতর ভাব আসার পরিবর্তে প্রীতিকর সৌন্দর্য সৃষ্টি হওয়ার জন্য তাঁকে পুরোপুরি নিও-ক্লাসিক্যাল শৈলীর শিল্পী হিসেবে মনে হয়নি অনেকের কাছে। তাঁর ছাত্র ডেভিড অবশ্য এই প্রত্যাশা পূরণ করেন পরবর্তী সময়ে। জাঁ ব্যাপটিস্ট রেগন্টডেথ অব প্রিয়াম‘ ছবিটি ফরাসি বিপ্লবের আগে আঁকলেও এর রাজনৈতিক তাৎপর্য সবার কাছে স্পষ্ট হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। তাঁর শৈলীতে রেনেসাঁ পর্বের ইতালিয়ান শিল্পীদের প্রভাব ছিল। পিয়ের নার্সিস গুয়েরিদ্য রিটার্ন অব মার্কাস সেক্সটাস‘ নামে যে ছবি আঁকেন সেখানে প্রতিবিপ্লবী চিন্তার আভাস থাকলেও তার উদ্দেশ্য তেমন কিছু ছিল না। ছবিটির বিষয় এবং শৈলী ছিল কাসিক্যাল শিল্পধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।

ব্রাসেলসের জাঁ-অগস্ত দমিনিক ইনগ্রেস নিও-ক্লাসিক্যাল শৈলীর নিরাভরণ ও সরল ব্যাখ্যা দিয়ে প্রথমদিকে ছবি আঁকেন। তাঁর চিত্রকর্মের ভিত্তি হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন নকশা। এই প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, একটা ছবি নিখুঁতভাবে আঁকা হলেই তা অবধারিতভাবে সুন্দর পেইন্টিং হবে। ‘অগাস্টাস লিসেনিং টু দ্য রিডিং অব এনিড” শীর্ষক ছবিতে রং অবদমিত ফিগারগুলো ভাস্কর্যের মতো স্পষ্ট ও কঠিন এবং পরিবেশের প্রতি ছবিটিতে কোনো মনোযোগই দেওয়া হয়নি। ফলে বাস রিলিফের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে ছবিটিতে। তাঁর প্রথমদিকের কাজে মানবদেহকে বিকৃত করে দেখানো ও জটিল পোশাকের জন্য তিনি সমালোচিত হন। এই সব তিনি করেন ছন্দময় লাইন সৃষ্টির জন্য। আঠারো বছর রোমে থাকার পর তিনি প্যারিসে ফিরে আসেন (১৮২৪) এবং স্কুল অব ফাইন আর্টস-এর প্রধান নিযুক্ত হন। তিন বছর পর তাঁর ‘দি অ্যাপোথিয়েসিস অব হোমার‘ শীর্ষক ছবিতে নিজের শৈলীর পরিবর্তে একাডেমির নিয়ম-পদ্ধতির কঠোরতা দেখা যায়। কঠোর সামঞ্জস্যময়তা, নির্দিষ্ট কন্ট্রর, ডিম্বাকার ফর্ম, এই সবের ব্যবহারে রাফায়েলের প্রভাব রয়েছে। ইনগ্রেসকে ডেভিডের উত্তরসূরি বলা হলেও তাঁর নেতৃত্বে একাডেমির প্রশিক্ষণ খুবই রক্ষণশীলভাবে নিয়মতান্ত্রিক ও কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ হয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ড্রইং-ই হলো শিল্পের প্রাণ এবং তীক্ষ্ণভাবে কন্টুর ও মসৃণভাবে ছবি শেষ করা প্রয়োজন। এই রক্ষণশীল মনোভাব সত্ত্বেও তাঁকে নিও-ক্লাসিসিজমের নেতা হিসাবে রোমান্টিসিজমের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করা হয়।

বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ শিল্পী নিও-ক্লাসিক্যাল ধারার ছবি এঁকে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এদের মধ্যে প্রধান ডেভিড হ্যামিলটন। তিনি দীর্ঘকাল রোমে থেকে শিল্পচর্চা করেন এবং তখন উইংকেলম্যান ও মেংগসের সংস্পর্শে এসে তাদের চিন্তা দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। হোমারের ইলিয়াড়’ ভিত্তি করে আঁকা তাঁর কয়েকটি ছবির জন্য তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। ‘দ্য ডেথ অব লুক্রেশিয়া’ শীর্ষক ছবিতে প্রাচীন রোমান ইতিহাসের একটি কাহিনির দৃশ্য আঁকা হয়েছে। ছবিটি ডেভিডের ‘ওথ অব হোরেশিয়া আকায় উৎসাহিত করেছিল। বেঞ্জামিন ওয়েস্ট ইয়র্কের আর্চবিশপের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ‘এপ্রিপিনা ল্যান্ডিং অ্যাট ব্র্যান্ডশিয়াম নামের যে ছবিটি আঁকেন সেখানে নিও-ক্লাসিক্যাল শৈলীর নিরাভরণ কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রয়োগ দেখা যায়। ছবির দৃশ্যটি তিনি রোমান ঐতিহাসিক টেকিটাস বর্ণিত কাহিনির ওপর ভিত্তি করে আঁকেন।

স্যার যোওয়া রেনল্ডস ইংল্যান্ডের নিও-ক্লাসিক্যাল শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তাঁর ‘দ্য মন্টগোমারি সিস্টার্স’ নামের ছবিতে রোমান মিথলজির ব্যবহার করা হয়েছে। রঙের ব্যবহারে তাঁর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং কম্পোজিশনে রয়েছে নৈপুণ্য। ছবির ফিগারগুলোর অঙ্গ-ভঙ্গিতে মূর্ত হয়েছে গতিশীলতার সঙ্গে মুখের নিবিড় অভিব্যক্তি। তিনি ইতালি থেকে ইংল্যান্ডে ফেরার পর শিল্পবোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেন, রেনেসার ছোট মাস্টার্স-মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, রাফায়েল, কোরেঞ্জিও এবং টিশিয়ানদের কাজে দেখা যায় আদর্শ শিল্পরূপ। তিনি কারাচ্চির শিল্প-আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন এবং বিশ্বাস করেন যে শিল্পীদের উৎকর্ষ অর্জনের একমাত্র উপায় ক্লাসিক্যাল মাস্টার্সদের শিল্পকর্মের অনুকরণ, বিশেষ করে রাফায়েলের ড্রইং, টিশিয়ানের রং ব্যবহার ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে তিনি যখন ইংল্যান্ডের রয়্যাল একাডেমি অব আর্টস-এর প্রথম প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন, তারপর একাডেমির নিয়ম-পদ্ধতি বিষয়ে একাধিক ‘ডিসকোর্স’ শীর্ষক প্রবদ লেখেন। এই সব লেখা পড়ে বোঝা যায় যে তিনি সাহিত্যিক-পণ্ডিত ড. জনসনের মতো শিল্পকর্মে নিয়ন্ত্রণ ও রুচি নির্ধারণে অনুশাসনের সমর্থন করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেছেন। যে যদি ছাত্রদের ইতালিয়ান মাস্টারদের শিল্পকর্ম দেখার ও বিশ্লেষণের সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে তারা শিল্পসৃষ্টির সঠিক পদ্ধতি জানতে পারবে। রেনল্ড সপ্তদশ শতকের শিল্প- বিশারদরা ‘ঐতিহাসিক শিল্পের মর্যাদা ও মোহনীয়তা বিষয়ে যা লিখে দিয়েছেন তার সমর্থন করেছেন। তাঁদের মতো তিনিও ইতিহাসবিষয়ক শিল্পকর্মের গুরুত্ব ও মর্যাদায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং আশা করেছেন যে পোর্ট্রেট আঁকার পাশাপাশি এই বিষয়েও ছবি আঁকা হবে। শিল্পী হিসেবে তাঁকে পোর্ট্রেটই আঁকতে হয়েছে বেশি, কেননা তাঁর চাহিদাই ছিল সমাজে। ডাচ শিল্পী ভ্যান ডিক সোশ্যাল পোর্ট্রেট আঁকায় যে মানদণ্ড ও আদর্শ তৈরি করেন রেনল্ড সেখানে যোগ করেন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং পোর্ট্রেটের সামাজিক পরিচিতিমূলক দৃশ্য ও অভিব্যক্তি। একটি শিশুর পোর্ট্রেট আঁকতে দিয়েও তিনি তার পরিবেশ ও মুখের অভিব্যক্তির ওপর জোর দিয়েছেন যার দৃষ্টান্ত ‘মিস বাওলস’ শীর্ষক ছবিটি। এ ধরনের ছবি আঁকার জন্য তাঁকে গভীর পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা করতে হয়েছে। সব শেষে বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে সর্বোচ্চ ইফেক্ট আনার জন্য। এটা করতে গিয়ে হয়তো তিনি কৃত্রিমতার সাহায্য নিয়েছেন কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক অবস্থান প্রতিফলিত করা। স্বতঃস্ফূর্ত না হলেও একে বাস্তবতার প্রতিফলনই বলতে হয়, পূর্বপরিকল্পনা সত্ত্বেও।

ব্রিটেনের শিল্পী অ্যাঞ্জেলিকা রথম্যান রোকোকো শৈলীর অলংকরণের সঙ্গে ক্লাসিক্যাল শৈলীর কাব্যিকতা মিশ্রণ করে ছবি আঁকেন। এর একটি দৃষ্টান্ত ‘দি আর্টিস্ট ইন দ্য ক্যারেক্টর অব দ্য ডিজাইন’। ছবিটি আত্মপ্রতিকৃতি হলেও এখানে অ্যালিগরির ব্যবহার করা হয়েছে এবং তার শিল্পের সাফল্যের পেছনে কাব্যের প্রেরণাদাত্রী মিউজের উল্লেখ করা হয়েছে।

জার্মান যেসব শিল্পী নিও-ক্লাসিক্যাল পদ্ধতিতে ছবি আঁকেন তাঁদের মধ্যে উইলহেম টিসচবেইন উল্লেখযোগ্য। কবি গেইটের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে যে ছবিতে সেখানে ক্লাসিক্যাল শিল্পের প্রতি তাঁর অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। গেইটের ফিগারের পাশে খোদাই করা ভাস্কর্যের ছবি দ্বারা ইউরিপিডিসের ‘ইফিজিনিয়া’ ট্র্যাজিক নাটকের উল্লেখ করা হয়েছে। গেইটে এই নাটকটি ছবি আঁকার অব্যবহিত আগে কবিতায় অনুবাদ করেছিলেন।

রোমে নিও-ক্লাসিসিজম দুজন প্রভাবশালী ব্যক্তির অধীনে বিবর্তিত হয়। এদের একজন জার্মানিতে জন্মগ্রহণকারী উইংকেলম্যান ছিলেন নিও-ক্লাসিক্যাল শিল্পের তাত্ত্বিক। তাঁর বন্ধু চিত্রকর এন্তন রাফায়েল মেঙস উইংকেলম্যানের ধ্যান-ধারণাকে নিজের চিত্রে প্রতিফলনের চেষ্টা করেন। প্রথমে এই প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল ক্লাসিক্যাল ফর্ম বিশ্লেষণ করা এবং তার পুনঃপ্রচলন। এই শৈলী যতই জনপ্রিয় হতে থাকে সেই অনুযায়ী গুরুত্ব পায় প্রাচীন গ্রিস ও রোমের মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা। ফ্রান্সে এর সবচেয়ে সফল বাস্তবায়ন হলেও রোমে মেংগস তাঁর চিত্রকর্মের মাধ্যমে একই উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা করেন। তার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে এই প্রাচীন মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে। ‘জুপিটার কিসিং গ্যানিমেড‘ এমনই একটি ছবি যেখানে তিনি উইংকেলম্যানের চিন্তাধারার প্রতিফলন করতে চেয়েছেন। ছবিটি হারকিউলিয়ামে আবিষ্কৃত প্রাসাদের দেয়ালচিত্রের ওপর ভিত্তি করে আঁকা।

১৯শ শতকের নিও-ক্লাসিক্যাল শিল্প প্রাচীন গ্রিক ও রোমান শিল্পকর্ম থেকে আরো বেশি মাত্রায় ও সুনির্দিষ্টভাবে গ্রহণ করেছে ১৮শ শতকের পূর্বসূরিদের তুলনায়। নিও-ক্লাসিক্যাল শৈলীর নামে যা পরিচিত তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল পূর্বপরিকল্পিত আদর্শরূপের ভিত্তিতে প্রকৃতির নিখুঁত প্রতিকৃতির সৌন্দর্যের সন্ধান। অংশসমূহের স্পষ্টতা, স্থির ভারসাম্য এবং নির্দিষ্ট অনুপাত, যা গ্রিক ও রোমান শিল্পকর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেই সব নিও-ক্লাসিক্যাল শিল্পের মূল বিষয়, এ কথা উপসংহারে বলা হলে বাহুল্য মনে হবে না।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.