গ্রিক দর্শনে ভারতীয় প্রভাব?

ভারতীয় বিভিন্ন দর্শন যেমন লোকায়তিকদের জড়বাদ, চার উপাদানবান, জৈনদের জীববাদ, পরমাণুবাদ, বহুত্ববাদ, স্যাৎবাদ, নীতিবাদ, বৌদ্ধদের নৈরাত্মবাদ, নিরীশ্বরবাদ, জন্মান্তরবাদ, অবভাসবাদ, ক্ষণিকবাদ, শূন্যবাদ, নীতিবাদ, ন্যায়-তত্ত্ব, হিন্দু বা বেদবিশ্বাসীদের ষড়-দর্শন ও উপনিষদের দার্শনিক মতবাদসমূহের সাথে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের দর্শনের সামঞ্জস্য লক্ষ করে ম্যাক্সমুলার প্রমুখ পণ্ডিত ও গবেষক বলেন যে, অতিপ্রাচীনকালেই এই দুই দেশের ধর্ম, দর্শন ও সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময় ঘটেছিল। ম্যাক্সমুলারের ভাষায়, “We seem within our right when we look upon the numerous coincidences between the fables occuring in Sanskrit and Pali literature as proving the fact that there was a real literary exchange between India. Persia Asia-minor and Greece beginning with the Sixth century B.C.” (Max Muller on Coincidence Fortnightly Review, July 1896, নবভারত, অষ্টাদশ খণ্ড, চতুর্থ সংখ্যা, ১৩০৭, পৃ. ১০৫ পাদটীকা উদ্ধৃত)।

ম্যাক্সমুলার, ওয়েবার প্রমুখ পণ্ডিতগণ লোকায়ত দর্শন, বেদ-বেদান্ত দর্শন প্রভৃতির সাথে গ্রিক দর্শনের, বিশেষত থেলিস, এনক্সিমান্ডার, এনাক্সিমিনিস, এস্পেকস, হেরাক্লিটাস, জেনোফেনিস, পারমেনিডাইস, প্লেটো প্রভৃতি দার্শনিকদের দর্শনের সামঞ্জস্য দেখান। ফরাসি দার্শনিক ফুজে বলেন, ভারত উপমহাদেশের দর্শন অবলম্বন করে গ্রিক দর্শনের বিকাশ ঘটে। এই ধরনের আরো বহু উদ্ধৃত আছে। কিন্তু অধ্যাপক স্টেচ, গমপার্জ প্রমুখ পণ্ডিতগণ এরিস্টটলের উক্তির উপর নির্ভর করে বলেন গ্রিক দর্শনের উৎস গ্রিস, ভারতবর্ষ উপমহাদেশ বা অন্য কোনো দেশ নয়। এরিস্টটল বলেছেন : “We have no works of predecessors to assist us in this attempt to construct a science of reasoning our own labour has done it all.” (Quoted by G. H. Lewis, Biographical History of Philosophy. p. 247.)

এরিস্টটল একজন মহাপণ্ডিত ব্যক্তি। তাঁর উক্তি অভ্রান্ত ধরে নিয়ে অতীতকাল হতে বর্তমানকাল পর্যন্ত রচিত গ্রিক দর্শন অর্থাৎ দর্শনের ইতিহাসে বলা হচ্ছে যে গ্রিক দর্শন সৃষ্টির সহায়ক হতে পারে এমন দর্শন প্রাচীনকালে কোনো দেশেই ছিল না। কিন্তু অনেকে এর বিরোধিতা করেন। স্যার উইলিয়াম জোনস বলেন যে, এরিস্টটলের ভাগিনেয় কলিসথেনিস ভারতীয়দের কাছ থেকে যুক্তিবিদ্যার উপাদান সংগ্রহ করে এরিস্টলের নিকট পাঠিয়ে দেন যার উপর ভিত্তি করে এরিস্টটল তার যুক্তিবিদ্যা রচনা করেন। তার ভাষায় : “Kallisthenes found a complete system of Logic among the Indians, and sent it to his uncle Aristotle.” (Asiatic Rescarches, Vol IV. p. 163.).

প্রসিদ্ধ দার্শনিক ভুগান্ড স্কুয়ার্ট বলেন এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা পাঠ করলেই বোঝা যায় যে তা কোনো প্রাচীন ন্যায়দর্শন হতে সংগৃহীত হয়েছে। এরিস্টটলের রচনাবলির উপর মন্তব্য করে পণ্ডিত ফুলারের উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “His (Aristotle) writings were the outcome of a profound and minute study of an overwhelming mass-data draw from every conceivable field of contemporary scientific research. Mathematics, Physics, Astronomy, Biology, Physiology, Anatomy, fotary, Natural history, Psychology, Politics, Ethics, Logic, Rhetoric, Art, Theology- All were grist to his mill.” (Fuller, B. A. G. Histroy of Greek Philosophy, N. Y. 1931. p. 18.) হয়তো ‘We have no works of predecessors’ অর্থাৎ ‘আমাদের পূর্বসূরীদের কোনো গ্রন্থ ছিল না।’ এরিস্টটলের এই উক্তির দ্বারা গ্রিসে কোনো পূর্বসূরী ছিল না বুঝতে হবে।

গ্রিক বীর আলেকজান্ডার ও তাঁর পিতা ফিলিপের পৃষ্ঠপোষকতায় এরিস্টটলের শত শত পণ্ডিত ও ক্রীতদাস নিযুক্ত করে ও হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে পাণ্ডুলিপি ক্রয়ের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত বর্তমান আছে। ভারতবর্ষ, মিশর, মেসোপোটেমিয়া প্রভৃতি দেশ হতে সংগৃহীত জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপাদানের উপর ভিত্তি করে, একমতে দীর্ঘ ১২ বছর অন্যমতে ১৩ বছর ধরে তাঁর প্রধান প্রধান গ্রন্থাবলি রচনার পর খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ অব্দে এরিস্টটল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বিদেশ হতে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য এরিস্টটল হাজার হাজার টাকা ব্যয় করেছেন এমন প্রমাণ প্রচুর আছে। (Will Durant, The Story of Philosophy, N. Y. 1953, pp. 41-15.). সক্রেটিসের ‘Know thyself’ বা ‘নিজেকে জান’ এবং প্লেটোর ধারণাবাদ বা ভাববাদের সাথে বেদান্ত দর্শনের যথেষ্ট মিল আছে। প্লেটো সম্পর্কে পণ্ডিত জিমারম্যান বলেন, ‘Plato attempt of translate oriental maysticism into scientific speculation ends in New-Platonism, with a retraslation of thought into images.” (Zemerman, Quoted in নবভারত, ১৩০৭, পৃ. ১৯৯ পাদটীকা).

অবশ্য ইউবার উইগ, স্টেচ প্রমুখ পণ্ডিতগণ গ্রিকদর্শনের উপর ভারত প্রভৃতি দেশের দর্শনের প্রভাব অস্বীকার করেন। অধ্যাপক স্টেচ এখানে তিনটি আপত্তি উত্থাপন করেন – ১. ভারতের দর্শন ধর্ম ও নীতিবিজ্ঞান হতে স্বতন্ত্র হতে পারেনি। কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি বাংলাদেশ দর্শন সম্পর্কেও এই উক্তির পুনরাবৃত্তি করেছেন। ২. এদেশের দার্শনিকদের চিন্তাধারা কাব্যিক, দার্শনিক নয়, এর মধ্যে কোনো যুক্তিবাদী বিচার বিশ্লেষণ নেই। গ্রিক দর্শন প্রকৃতিবাদী আর এদেশের দর্শন ভাববাদী, এবং ৩. ভারতবর্ষের সাথে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ হতে চতুর্থ (৩২৩) শতাব্দী পর্যন্ত যোগাযোগের অভাব। যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রমাণের অভাবে দুই দেশের দর্শনের মধ্যে যথেষ্ট সামঞ্জস্য স্বীকার করেও পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার ও নিকলসন বলেন যে, দুটি দেশে স্বতন্ত্রভাবে একইরকম দর্শন সৃষ্টি হতে পারে। তারা বলেন মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এক জাতির পক্ষে যা সম্ভব হয়েছিল তা অন্য জাতির পক্ষেও সম্ভব, এমন অবস্থায় এক জাতির উপর অন্য জাতির প্রভাব স্বীকার না করলেও চলে। দুটি জাতি স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করে একই রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। একই সময়ে স্বতন্ত্রভাবে দুই দেশে একইরকম দর্শন সৃষ্টি হওয়া সম্ভব বলার পর উভয় দেশের দর্শনের সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্য সম্পর্কে ম্যাক্সমুলার বলেন যে, এটা সত্যিই আশ্চর্যজনক এমন কি বিস্ময়করও বটে তাঁর ভাষায় : “A wider study of mankind has taught us that what was possible in our country was possible in another also. But the fact remains nevertheless that the similarities between these two streams of philosophical thought in India and in Greece are very startling, may sometimes be most perplexing.” (Max Muller, Vedanta Philosophy, p-69)

অধ্যাপক স্টেচের এবং ভারতবর্ষের কোনো কোনো চিন্তাবিদের অনুরূপ আপত্তি পরীক্ষা করে বলা যায় যে, তারা ভারতবর্ষের দর্শনের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, তবে দর্শনের স্বরূপ সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেন। কিন্তু প্রশ্ন এই নয় যে ভারতীয় দর্শনের স্বরূপ কী। মনে রাখতে হবে ভারতবর্ষ গ্রিস, ফরাসি, কিংবা ইংল্যান্ড নয় এবং এখানকার মুনি ঋষি, দার্শনিক ওই সকল দেশের মুনি ঋষি দার্শনিক নয়। এই সকল দেশের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক পরিবেশ হুবহু এক নয়। সুতরাং এক দেশের ও এক যুগের দার্শনিক মানদণ্ডে অপর দেশের ও অপর যুগের দর্শন বিচার করা চলে না, যদিও কখনও কখনও আংশিকভাবে এই বিচার সম্ভব হয়। ধর্মীয় ও নৈতিক প্রভাব মুক্ত নয় বলে ভারতীয় দর্শনকে দর্শনের ইতিহাস হতে বর্জন করলে, গ্রিসের পিথাগোরাস, জেনোফেনিস, পারমেনিডাইস, এনাক্সোগোরাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, প্লাটিনাস, এমনকি প্রথম দার্শনিক থেলিসও দর্শনের ইতিহাস হতে বাদ পড়ে যেতে পারে; কারণ তাদের দর্শনও সম্পূর্ণরূপে ধর্ম ও নীতিবিজ্ঞানের প্রভাবমুক্ত নয়। কিন্তু তাদের ‘চিন্তা’কে দর্শন বলে স্বীকার করা হয়েছে। সুতরাং ধর্মীয় ও নৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত ভারতীয় দর্শনও দর্শন নামে স্বীকৃতি লাভের দাবি রাখে।

আধুনিককালের যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা বলেন তত্ত্ববিদ্যা, পরাতত্ত্ববিদ্যা তথা দর্শন থাকবে না, থাকবে শুধু যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ। দর্শনের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা নেই বলে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীর পক্ষে এমন উক্তি করা সম্ভব হয়েছে। আর তাদের প্রত্যক্ষবাদী যাচাইকারী মানদণ্ডের বিচারে সম্প্রদায়ম্ভর দর্শনের অস্তিত্ব থাকে না। তাই বলে অপরাপর দর্শনের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। যৌক্তিক বিশ্লেষণের বিচার মানদণ্ড সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের দর্শন অস্বীকার করে বলে দর্শনের ক্ষেত্র হতে তাকে বহিষ্কার করা হয় না, ঠিকও নয়। দর্শনের সংজ্ঞার বদল করে নতুন নতুন বহু রকম দার্শনিক মতবাদের উদ্ভব দেখা যায়। গ্রিক দর্শন সম্পর্কেও একথা সত্য। এক সম্প্রদায়ের দার্শনিক কর্তৃক অন্য সম্প্রদায়ের দার্শনিক সংজ্ঞা অস্বীকার করার প্রবণতা ভারতবর্ষে নতুন নয়। সমগ্র দর্শনের ইতিহাসেও এই প্রবণতা অভিপ্রবল। সম্ভবত প্রাচীন মিশর, ব্যাবিলন, মেসোপোটেমিয়া, ভারতবর্ষের প্রাচীনকালের দর্শনের সংজ্ঞা বদল করে দিয়ে গ্রিকরা তাকে ‘শরীরবিজ্ঞান’ বলেন। দর্শন নামকরণ পরবর্তী কালের। জ্ঞানের খাতিরেই জ্ঞানার্জন, বা জানা ও বোঝার জন্যই, জ্ঞানান্বেষণ মুক্তির কারণে নয়, শব্দগুলো দর্শনশাস্ত্রের নতুন সংজ্ঞা সৃষ্টির সহায়ক। ঐতিহাসিক ঘটনাবলির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় যে প্রাচীনকালের ভারতের ধর্মীয় ও নৈতিক প্রভাবযুক্ত সাধারণ জনগণ গ্রিসের সাধারণ জনগণের মতই ছিল। এই দুটির একটিকে দর্শন নামে স্বীকার করলে অপরটিকেও দর্শন নামে স্বীকার করতে হয়। গ্রিসের জনগণ মুক্তিকামনা করতেন না, এমন বলা যায় না। দার্শনিক থেলিসের জল দৈবশক্তিতে পরিপূর্ণ উক্ত বিভিন্ন শব্দ, পরিভাষা ও বাক চাতুর্যের আড়ালে ধর্মীয় প্রভাবেরই পরোক্ষ স্বীকৃতি। অন্যতম দার্শনিক পিথাগোরাসের জন্মান্তরবাদ, জেনোফেনিসের সর্বেশ্বরবাদ, পারমেনিডাইসের একসত্তাবাদ মতান্তরে অদ্বৈতবাদ, সক্রেটিসের “নিজেকে জান’ নৈতিক মতবাদ ইত্যাদি ধর্মীয় ও নৈতিক প্রভাব মুক্ত নয়। দার্শনিক এরিস্টটলের আকারই (Form) সর্বশেষে পরম সত্তা বা ঈশ্বরের স্থান দখল করে। তাঁর নীতিবিদ্যার ‘সুবর্ণ মধ্যম’ নৈতিক দর্শনের অন্যতম প্রধান নীতি। অর্থাৎ গ্রিসের দার্শনিকগণও ধর্মীয় ও নৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। সক্রেটিস নৈতিক নিয়ম পালন করতে গিয়ে, উপদেশ দিতে গিয়ে আপন জীবন উৎসর্গ করেন। প্লেটোর ধারণাবাদী দর্শন, নব্যপ্লেটোবাদীদের ভাববানী দর্শন আধ্যাত্মিক তথা ধর্মীয় প্রভাবে ভরপুর। সুতরাং গ্রিকদর্শনও ধর্মীয় ও নৈতিক প্রভাব মুক্ত নয়। যদিও তা হুবহু ভারতীয় ধর্ম ও নীতিবিজ্ঞানের প্রভাবজাত মতবাদের মত নয়।

অধ্যাপক স্টেচ নিজেও স্বীকার করেছেন যে, দর্শন ও ধর্মের মূল বিষয়বস্তু অভিন্ন, তবে উপস্থাপনা স্বতন্ত্র। ভারতীয়দের নিকট মূল বিষয়বস্তুই প্রধান, উপস্থাপনা নয়, অবশ্য উপস্থাপনাও তারা সম্পূর্ণরূপে সর্বত্রই উপেক্ষা করেন না। স্টেচ প্রমুখ চিন্তাবিদরা ভারতবর্ষের চিন্তাবিদদের দর্শন চর্চার মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করার পরেও প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, ধর্ম ও নীতিবিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে দেখতে চেয়ে কিছুটা ভুল করেছেন। দর্শন, ধর্ম, নীতিবিজ্ঞান, বিজ্ঞান ইত্যাদি শ্রেণী বিভাগ আধুনিক কালের। প্রাচীনকালে গ্রিকদর্শনকে শরীর বিজ্ঞান (physiology) বলা হতো, দর্শন নয়। আধুনিক কালের মানদণ্ডে প্রাচীন কালের দর্শনের বিচার অচল, যেমন অচল যুক্তিবাদের বিচারে অভিজ্ঞতাবাদ ও স্বজ্ঞাবাদ। আধুনিক কালের মন নিয়ে প্রাচীন বা মধ্যযুগের দর্শনের গন্তব্যস্থলে উপনীত হওয়ার পরস্পর নির্ভরশীল কতকগুলো পথ মাত্র। আর এদিক থেকে বিচার করলে বলা যায় যে ভারতীয় দর্শন গ্রিক দর্শন অপেক্ষা অধিক ব্যাপকতর ও সমৃদ্ধশালী। যে জ্ঞানান্বেষণ কেবল জ্ঞানের খাতিরেই হয় মানুষের জীবনের মূল গন্তব্যস্থলে উপনীত হতে সাহায্য করে না, ভারতের আস্তিক্যবাদী দার্শনিকরা তাকে জ্ঞান বলে স্বীকার করেন না। সুতরাং জ্ঞানের খাতিরে জ্ঞানান্বেষণ মানদণ্ড দ্বারা ভারতের দর্শনের বিচার অচল।

গ্রিক দর্শন প্রকৃতিবাদী, ভারতের লোকায়ত দৰ্শন, বৌদ্ধ দর্শন প্রভৃতি জড়বাদী বা প্রকৃতিবাদী দর্শন। ভারতের দর্শনের স্বরূপ বিচারের সময় গ্রিসের ভাববাদী দর্শন এবং লোকায়ত দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন প্রভৃতি উপেক্ষা করে কেবল বেদান্ত দর্শন হিসেবে নিয়ে আসায় ভারতের দর্শনকে ভাববাদী ও অধ্যাত্মদর্শন বলা সম্ভব হয়েছে। বিচারের সময় অপ্রাসঙ্গিক বিষয় এমন কি বিপরীতধর্মী বিষয় দ্বারা বিচার করায় অধ্যাপক স্টেচ এমন ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত করে থাকতে পারেন। সক্রেটিস-পূর্ব দর্শনের সাথে লোকায়ত দর্শন এবং প্লেটো এরিস্টটল ও প্লটিনাসের দর্শনের সাথে বেদান্তদর্শনের তুলনা করলে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেত।

অধ্যাপক স্টেচ প্রমুখ পণ্ডিতগণ বলেন যে, ভৌগোলিক অবস্থার ও নানা প্রকার বাধার জন্য এদেশের দার্শনিকদের চিন্তাধারা বিশ্বের অন্যান্য দার্শনিকদের চিন্তাধারা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, সুতরাং দর্শনের ইতিহাসে তা কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এই আপত্তি দ্বারা তাঁরা বলতে চান যে ভৌগোলিক অবস্থান অর্থাৎ ভারত ও গ্রিসের মধ্যে বহু দূরত্ব থাকায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় আর পণ্ডিত ব্যক্তিদের কূপমণ্ডূকতা প্রভৃতি থাকায় দুই দেশের মধ্যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ধ্যানধারণার যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। কিন্তু প্রাচীনকালের ভারতবর্ষ, পারস্য ও গ্রিসের রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় যে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী, এমনকি তারও বহু পূর্ব হতে এই উপমহাদেশের সাথে পারস্য ও গ্রিসের যোগাযোগ ছিল, যা অধ্যাপক স্টেচ প্রমুখ চিন্তাবিদদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মাঝমাঝি সময়ে পারস্য সম্রাট সাইরাস (৫৫৮-৫৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ভারত আক্রমণ করেন ও দখল করেন। এর পর দারায়ুস (৫২২-৪৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) গান্ধার ও সিন্ধু উপত্যকায় পারসিক আধিপত্য বিস্তার করেন। দারায়ুসের সাম্রাজ্য আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এশিয়ার পারসিক সাম্রাজ্যের এই অংশটিই ছিল সর্বাপেক্ষা জনবহুল, সম্পদশালী, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চায় উন্নত। তাই হতেই পারে যে, প্রাচীনকালের ভারতের বিভিন্ন দর্শন সেই সব অঞ্চলে প্রবেশ করে।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর গ্রিসের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৬-৫৪৫ অব্দে পারস্যের নিকট গ্রিসের আয়োনিয়ার পতন ঘটে এবং দার্শনিক জেনোফেনিস একজন ক্রীতদাসকে সঙ্গে করে বাংলার বাউলদের মতো একতারা হাতে পথে-ঘাটে, নগর- বন্দরে গান গেয়ে বেড়াতেন। (Zeller, F. Outlines of the History of Greek Philosophy, London, 1963, p. 41, tr. by Palmer L. R., Gomperz. T., Greek Thinkers Vol I London, 1964, p. 156.). এদিকে ভারতবর্ষ ও অন্যদিকে গ্রিস পারস্য সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ায় গ্রিস হতে ভারত ও ভারত হতে গ্রিসে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভাববিনিময় গড়ে উঠে ও ঘনিষ্ঠ হতে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। গ্রিসের সাথে ভারতের সম্পর্ক বিষয়ে ডক্টর কালিদাস নাগ বলেন, ‘ভারতে পারসিক অধিকারের ফলে স্বভাবতই পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে এদেশের কৃষ্টিগত যোগ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকে। ভারতবাসীর পক্ষে পারস্য ও পশ্চিম-এশিয়ায় গমনাগমনের পথও নিরাপদ ও সুগম হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। উত্তরকালে পারস্য সম্রাট জারেক্সেস গ্রিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে অনেক ভারতীয় সৈন্যও তার অধীনে ইয়োরোপ গমন করেন।’ (ডক্টর কালিদাস নাগ, স্বদেশ ও সভ্যতা, পৃ. ৩৫). এই ঐতিহাসিক ঘটনাবলি হতে প্রমাণিত হয় যে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাংলাদেশ ভারতের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল এবং উভয় দেশের লোক ইচ্ছে করলে একে অপরের নিকট হতে ধর্ম, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে অন্যকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে গ্রিস হতে পণ্ডিতব্যক্তিরা এদেশে এসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপাদান সংগ্রহ করেছেন। এরিস্টটলের ভাগিনেয় কলিসথেনিস তার বাস্তব দৃষ্টান্ত। আলেকজান্ডারের ভারত বিজয়ের পর থেকে এই যোগাযোগ ও ভাববিনিময় ব্যবস্থা আরও বেড়ে যায়। এই ব্যাপারটি ভারত ও গ্রিসের দর্শনের সাদৃশ্যের একটি কারণ হয়ে থাকতে পারে।

এখানে গ্রিক দর্শনে ভারতীয় প্রভাব থাকার একটি সম্ভাবনার কথা বলা হল মাত্র। যদি হয় তাহলে বলতে হয় যে এরিস্টটলের দর্শনে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত্তিস্বরূপ হিসেবে কাজ করেছে, সেই দর্শন নিজেই আমাদের ভারতবর্ষের বা প্রাচ্যের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সেক্ষেত্রে আমরা এতকাল ধরে যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার মধ্যে বিভাজন করে আসছি অন্তত উৎপত্তির দিক দিয়ে তা অতটাও ভিন্ন নয়। আমি এখানে ভারতীয় দর্শনের মহিমা প্রচার করছি না, জাত্যাভিমান দেখাচ্ছি না। খালি একটা জায়গায় ফোকাস করতে চাচ্ছি। তা হলো, জ্ঞান জ্ঞানই, দর্শন দর্শনই, এখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিভাজন ঠিক নয়। দর্শন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নির্বিশেষে সকলের জন্যই। যে কেউ যেকোনো রকম দর্শনে প্রভাবিত হয়ে নিজস্ব চিন্তাদর্শ ডেভেলপ করতে পারে, এখানে কোনটা প্রাচ্য কোনটা পাশ্চাত্য তা ধরে জাজ করার কিছু নেই, জ্ঞানের জাজমেন্ট কেবল জ্ঞানের ভিত্তিতেই হতে পারে, ভৌগোলিক প্রভাব দিয়ে নয়, আর সম্ভবত দর্শনের সুচনাতেও এই প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিভেদটা আমরা আজ যেরকম ভাবি সেরকমটা ছিলনা।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.