দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুগোস্লাভিয়া, টিটো এবং গ্রিস

হিটলার-বিরোধী কোয়ালিশনকে ১৯৪৩ সালের শরৎকালে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের জটিল রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামাতে হয়েছিল। পোল্যাড ও চেকোস্লোভাকিয়ার সীমানা, সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, ভবিষ্যৎ পোলিশ ও চেক সরকারের গঠন ইত্যাদি সমস্যার ব্যাপারে ইঙ্গ-মার্কিন মহলের প্রতিক্রিয়া রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে মাঝে মাঝে ঘোলাটে করে তুলছিল। এই সমস্ত সমস্যার সঙ্গে যুগোস্লাভিয়া ও গ্রিসের প্রশ্নও উদ্বেগের সঞ্চার করছিল, কেননা এই দেশগুলোতে হিটলার-বিরোধী একাধিক স্বদেশপ্রেমী দল যে পার্টিজান যুদ্ধ চালাচ্ছিল, তাদের পরস্পরের মধ্যে কোন ভাবগত ঐক্য ও সহযোগিতা ছিল না, বরং এদের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতার বদলে তীব্র দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধ আত্মপ্রকাশ করছিল। সন্দেহ নেই যে মিত্রপক্ষের কাছে এই অবস্থাটা অত্যন্ত অশ্বস্তিকর ছিল, কেননা ফ্যাসিস্ট দখলদারদের থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যারা অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছিল, তারাই অনেক সময় নিজেদের মধ্যে লড়াই করে শক্তিক্ষয় করছিল। অথচ যুদ্ধজয়ের অপরিহার্য প্রয়োজনেই পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির একান্ত দরকার ছিল। যারা এই গৃহযুদ্ধে চালাচ্ছিল, তাদের এক পক্ষের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল পশ্চিমা পক্ষের দিকে বা প্রচলিত শাসনব্যবস্থা বজায় রাখার দিকে, আর অন্য পক্ষের আদর্শ ছিল সমাজতান্ত্রিক বা বৈপ্লবিক সামাজিক পরিবর্তনের দিকে। অর্থাৎ সহজ কথায় পশ্চিমী গণতন্ত্র ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্র – এই দুই মতবাদের ভিত্তিতেই ইউরোপের নাৎসীদের হাতে পদানত বিভিন্ন রাজ্যে নাৎসীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত হচ্ছিল। কিন্তু পারস্পরিক বিরোধ ও প্রতিরোধ যুদ্ধে যুগোস্লাভিয়া ও গ্রিসের দেশপ্রেমী যোদ্ধারা বোধ হয় শীর্ষ স্থানে ছিলেন। মিত্রপক্ষ স্বভাবতই এই গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দিতে চাচ্ছিল, কেননা এর দ্বারা একমাত্র লাভবান হচ্ছিল ঘরের ও বাইরের শত্রুরাই। আরও দুর্ভাগ্যের কথা হচ্ছে পার্টিজানদের এই গৃহযুদ্ধের ফলে জনসাধারণের মধ্যেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছিল।

ইউরোপের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দরিদ্র ও শোষিত দেশগুলোর অন্যতম ছিল যুগোস্লাভিয়া। জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ ছিল গ্রামের বাসিন্দা এবং তাদের জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত নীচু। নানা জাতি-অধিজাতিদের ভীড়ের জন্য সমগ্র যুগোস্লাভিয়ার ঐক্য ও সংহতি যেমন দানা বাঁধতে পারেনি, তেমনি এই সমস্ত জাতি-অধিজাতি ও নৃতত্ত্ব-ঘটিত প্রশ্নের জন্য যুগোস্লাভিয়ার সমস্যাও ছিল অত্যন্ত জটিল। সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, মন্টেনিগ্রো, বোসনিয়া ও মেসিডোনিয়া – এই সমস্ত রাজ্য-উপরাজ্যে যুগোস্লাভিয়া বিভক্ত ছিল। যেগুলোর মধ্যে সার্বিয়ায় অন্যান্য সমস্তের উপর আধিপত্য খাটাতে চাচ্ছিল। ফলে যুগোস্লাভিয়ার বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব এবং সার্বিয়ার বিরুদ্ধে প্রচুর বিক্ষোভ ছিল, আর হিটলারও সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণের আগে তার পার্শ্ববর্তী বলকান অনেক গ্রাস করতে চাচ্ছিলেন। ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে জার্মানী ৫২ ডিভিসন সৈন্য নিয়ে যুগোস্লাভিয়া আক্রমণ ও দখল করে ৷ এই ৫২ ডিভিসন সৈন্যের মধ্যে ছিল ২৪ জার্মান, ২৩ ইতালীয় এবং ৫ হাঙ্গেরীয় ডিভিসন আর ২২০০টি জঙ্গী বিমান।

মাত্র ১১ দিনের যুদ্ধে যুগোস্লাভিয়ার পতন হল এবং জার্মান, ইতালীয়, হাঙ্গেরীয়, বুলগেরীয় ও আলবেনীয় – এই কয়টি শক্তির চধ্যে যুগোস্লাভিয়া ১টি অংশে বিভক্ত হয়ে গেল। কিন্তু সরকারী সৈন্যবাহিনী পদস্ত হলেও যুগোস্লাভিয়ার জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম গভীর ছিল। ফলে, যুগোস্লাভিয়ার যে ঐতিহাসিক প্রতিরোধ-যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হল, তা আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধের একদিকে ছিলেন সার্বিয়ার ড্রাজা মিহাইলোভিচ এবং অন্যদিকে ছিলেন ক্রোয়েশিয়ার জোসিপ ব্রোজ টিটো। বলা বাহুল্য যে, মিহাইলোভিচ ছিলেন জঙ্গী জাতীয়তাবাদী নেতা এবং কমিউনিস্টদের একান্ত বিরোধী। এরা চেৎনিক নামে পরিচিত ছিলেন। আর অন্যদিকে ছিলেন যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির অধিনায়ক এবং আন্তর্জাতিকতাবাদী দেশপ্রেমিক যোদ্ধা টিটো। জার্মানী কর্তৃক যুগোস্লাভিয়া দখলের পরেই ১৯৪১ সালের মে মাস থেকে কমিউনিস্ট নেতা টিটো ফ্যাসিস্টদের বিরদ্ধে মৃত্যুপণ যুদ্ধের সংকল্প ঘোষণা করলেন। কিন্তু যুগোস্লাভিয়ার উপরের তলার ভদ্র ও বিত্তবান শ্রেণী কমিউনিস্টদের বিপক্ষে ছিলেন। পরাজিত যুগোস্লাভ গভর্নমেন্ট ও বালক রাজা পিটার লন্ডনে গিয়ে আশ্রয় নিলেও টিটোর প্রতিরোধ যুদ্ধকে সমর্থন করলেন না। তারা কর্নেল মিহাইলোভিচকে স্বীকৃতি দিলেন এবং তাকেই সরকারী প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রধান সেনাপতিরূপে মেনে নিলেন। এই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার জন্য চেৎনিকরা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তা এবং গোড়ার দিকে মিত্রপক্ষীয় মহলে স্বীকৃতি ও প্রশংসা পাচ্ছিল। মিহাইলোভিচ ও তার দলবলের গেরিলা যুদ্ধের জবাবে জার্মান ফ্যাসিস্টরা বর্বর প্রতিহিংসার আশ্রয় নেয় এবং রাজধানী বেলগ্রেডে এক-এক বারে ৪/৫ শত বাছাই করা নাগরিকদের ধরে এনে হত্যা করতে শুরু করে। এভাবে জার্মানী যে ‘টেরর’ বা ত্রাস সৃষ্টি করল তার ফলে, মিহাইলোভিচের সেনাপতিরা নাৎসীদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় এলো। ফলে ১৯৪১ সালের শরৎকালে সার্বিয়ার কিংবা মিহাইলোভিচের প্রতিরোধ যুদ্ধ কেবল নামমাত্রই থেকে গেল। কেবল যে, প্রতিরোধ সংগ্রামে ভাঁটা পড়ল এমন নয়, তারা কমিউনিস্টদের প্রতি বিরূপতার জন্য জার্মান নাৎসীদের সঙ্গে সহযোগিতাও করতে লাগল, ফলে চেৎনিক ও টিটোর পার্টিজান যোদ্ধাদের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধ দেখা দিল এবং সেই বিরোধ শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের আকার নিল, কারণ যুগোস্লাভিয়াতে এই সময়-জার্মান পক্ষপাতী ছদ্মবেশী ফ্যাসিস্ট এবং কুইসলিং বা বিশ্বাসঘাতকদেরও অভাব ছিল না।

মিহাইলোভিচের চেৎনিক এবং টিটোর পার্টিজান বাহিনীর মধ্যে ৩টি মূলগত বৈষম্য ছিল –

  • (ক) সামরিক প্রক্রিয়ার দিক থেকে চেৎনিকরা ব্রিটিশ রণনীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিল এবং তাদের আশা ছিল যে, মিত্রপক্ষ বলকান অঞ্চল আক্রমণ করলে তারা তাদের সঙ্গেই সহযোগিতা করবে এবং তাদের রণনীতি সেই সহযোগিতার ভূমিকা স্বরূপে ছিল। কিন্তু টিটোর পার্টিজান বাহিনী কোন বাইরের প্রত্যাশায় ছিল না। তারা ফ্যাসিস্ট শত্রুর বিরুদ্ধে নির্মম গেরিলা যুদ্ধ চালাবার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল।
  • (খ) রাজনৈতিকভাবে টিটোর বাহিনী চেৎনিকদের তুলনায় প্রায় বিপরীত কোণে ছিল, কারণ এই পার্টিজান বাহিনী কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্গত ছিল এবং মস্কো থেকে তারা সাহায্য ও সহযোগিতা পাচ্ছিল। তারা সার্বিয়ার আধিপত্য ও রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিল। অপরপক্ষে চেৎনিকরা ছিল জাতীয়তা ও রাজতন্ত্রবাদী এবং তারা বালক রাজা পিটারের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিল।
  • (গ) জাতিগতভাবে চেৎনিকরা ছিল প্রধানত সার্বিয়ার অধিবাসী এবং তাদের সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার থেকে দেড় লক্ষের মধ্যে। অপরপক্ষে টিটোর পার্টিজানরা সমগ্র যুগোস্লাভিয়ার সমস্ত জাতি ও অধজাতির প্রতিনিধিস্থানীয় ছিল। (The Second Great War-Vol, VII, P. 2728.)

সুতরাং এই রাজনৈতিক ও রণনৈতিক বৈষম্য উভয় পক্ষের মধ্যে হিংস্রতা ও প্রতিহিংসার প্ররোচনা দিল। বিশেষত চেৎনিকরা টিটোর যুদ্ধরত বাহিনীর খবরাখবর গোপনে জার্মান ফ্যাসিস্টদের কানে পৌঁছে দিত। এজন্য চেৎনিকদের বিরদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ উঠেছিল। এই অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল না, ব্রিটিশ সূত্রেই এগুলোর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল। কেননা, গোড়ার দিকে ব্রিটিশ সরকার মিহাইলোভিচের দলবলের সঙ্গেই যোগাযোগরক্ষা করে চলছিল। বরং চার্চিল লিখেছেন যে, জার্মানদের পাশবিক প্রতিহিংসা-নীতির ফলে চেৎনিকদের বাধা দান হ্রাস পেয়ে গেল। এমন কি জার্মানদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার মনোভাব পর্যন্ত গড়ে উঠেছিল। অপর পক্ষে কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষিত টিটো এবং তার দলবল দেশের মুক্তি-যজ্ঞে আত্মাহুতি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। এই মুক্তি সংগ্রামে তাদের কাছে জীবন মত্যুর সীমারেখা মুছে গেল তারা উপলদ্ধি করলেন যে, তাদের যখন মরতেই হইবে, তখন শত্রুকে নাশ করে মরাই ভালো। এমন বেপরোয়া, দুর্ধর্ষ ও দঃসাহসী পার্টিজান বাহিনীকে জার্মানীরা দমন করার কোন উপায় খুঁজে পেল না। বরং তারা জার্মানদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে জার্মানদেরই শেষ করতে লাগল। নাৎসীদের হাতে শতশত প্রতিশোধাত্মক হত্যাকাণ্ডেও টিটোর অনুচরেরা পিছপা হল না। উল্টে জার্মানদের নৃশংস অত্যাচারের ফলে টিটোর পার্টিজানবাহিনীর সংখ্যা দিন দিন বাড়িতে লাগল এবং তারা নাৎসিদের হাত থেকে দেশের পর্বত অরণ্য-সংকুল বৃহত্তর অংশ ক্রমাগত কেড়ে নিতে লাগল।

…This confronted the Germans with a problem which could not be sloved by the mass executions of notables or persons of substance. They found themselves confronted by desperate men who had to be hunted down in their lairs. Toe Partisans under Tito wrested weapons from German hands. They grew rapidly in numbers. No reprisals, however bloody, upon hostages or villages deterred them. For them it was death or freedom. Soon they began to inflict heavy injury upon the Germans and became masters of wide regions. (Churchill Vol, V, P. 409)

চার্চিলের এই বর্ণনা থেকেই বোঝা যাবে যে, যুগোস্লাভিয়ার মুক্তির জন্য টিটো এবং তার পার্টিজান যোদ্ধারা কি ভয়ঙ্কর সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। টিটোর শ্লোগানই ছিল Death to Fascism, Freedom to the people, অর্থাৎ ফ্যাসিজমের মত্যু এবং জনগণের মুক্তি। কোন প্রকার অত্যাচার কিংবা কোন ত্রাসসৃষ্টির দ্বারাই যুগোস্লাভিয়ার গণমুক্তি আন্দোলনকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। জার্মান সূত্রেই স্বীকার করা হয়েছে যে, মাত্র এক বছরের মধ্যে জার্মান সৈন্য ও পুলিশেরা যুগোস্লাভিয়ার ৫০ হাজার নাগরিককে হত্যা করেছিল এবং তার চেয়েও বেশী সংখ্যক লোককে তারা বন্দীনিবাসের মত্যুশিবিরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এক একটা অভ্যুত্থানের প্রতিশোধ নেবার জন্য তারা সমস্ত বাসিন্দাসহ গ্রামকে গ্রাম ধ্বংস করে ফেলেছিল। (Yugoslavia in the Second World War, P. 91.)

তবুও গোড়ার দিকে রাজতন্ত্রের পক্ষপাতী চার্চিল বা ব্রিটেন যুগোস্লাভ গভর্নমেন্ট (লন্ডন প্রবাসী) কর্তৃক স্বীকৃত জেনারেল মিহাইলোভিচকেই যুগোস্লাভিয়ার দেশপ্রেমিক যোদ্ধা হিসেবে মেনে আসছিলেন। কিন্তু অবস্থার চাপে পড়ে ১৯৪৩ সালের মে মাস থেকে ব্রিটেন তার এই নীতির সংশোধন করল। মধ্যপ্রাচ্যের ব্রিটিশ সেনানীমণ্ডলীর প্রধান যুগোস্লাভিয়ার আভ্যন্তরীণ অবস্থার সংবাদ নিয়ে রিপোর্ট দিলেন যে, চেৎনিকরা নয়, আসল প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাচ্ছে টিটোর গেরিলাবাহিনী। তিনি চেৎনিকদের কার্যকলাপ সম্পকে বিরূপ মন্তব্য করলেন, এমনকি তাদেরকে সাবধান করেও দিলেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর যুগোস্লাভ গভর্নমেন্টের উপর এই মর্মে চাপ সৃষ্টি করলেন যে, মিহাইলোভিচ যেন নাৎসীদের সঙ্গে সহযোগিতা না করেন।

চার্চিল বরাবরই বলকান অঞ্চলের পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন, কেননা ভূমধ্যসাগর, ইতালি ও বলকান – এই গোটা অংশের রণনৈতিক গুরুত্ব চার্চিলের নিকট অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল। তাই যখন তিনি দেখলেন যে, বলকানে আসন্ন প্রতিরোধ যুদ্ধে চালাচ্ছেন টিটোর গেরিলাবাহিনী এবং সেই বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে ২ লক্ষে দাঁড়িয়েছে, তখন তিনি ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টিটোর নিকট একটি ব্রিটিশ মিশন পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য তার আগেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যুগোস্লাভিয়ার দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং নানাভাবে তাদেরকে সাহায্য দিয়ে আসছিলেন।

যুগোস্লাভিয়ার নানা অংশে টিটোর গেরিলাবাহিনী জয় অর্জন করছিল। তাই নভেম্বর মাসের শেষে তিনি একটি রাজনৈতিক সম্মেলন আহ্বান করলেন এবং সেই সম্মেলন থেকে যুগোস্লাভিয়ায় একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করলেন। কায়রোতে অবস্থিত রয়েল যুগোস্লাভ গভর্নমেন্টকে অস্বীকার করলেন এবং যুগোস্লাভিয়ার পূর্ণ মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত রাজা পিটারকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিষেধ করলেন। এদিকে চার্চিলের চাপে পড়ে পিটারও মিহাইলোভিচকে তার মন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত করলেন। ডিসেম্বর মাসের গোড়ায় ব্রিটেন মিহাইলোভিচের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করল এবং যে সমস্ত ব্রিটিশ মিশন মিহাইলোভিচের এলাকায় কাজ করছিল, সেগুলোকে প্রত্যাহার করে আনা হল। এই পটভূমিকার মধ্যে তেহরান সম্মেলনে চার্চিল রুজভেল্ট-স্ট্যালিনের বৈঠকে যুগোস্লাভিয়ার বিষয় বিবেচনা করা হল এবং ১লা ডিসেম্বরের এক ঘোষণায় যুগোস্লাভ পার্টিজান যোদ্ধাদের সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল, অর্থাৎ টিটো এবং তার বাহিনী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করলেন। যুগোস্লাভিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পুনঃসংস্থাপনের জন্যও সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। তেহরান সম্মেলনের পর ১৯৪৪ সালের প্রথম ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগোস্লাভ সদর দপ্তরে একটি মিলিটারি মিশন পাঠাল এবং যুগোস্লাভ ন্যাশনাল কমিটিও মস্কোতে অনুরূপ একটি মিশন পাঠাল। এদিকে চার্চিলও যুগোশ্লাভ মুক্তিবাহিনীর প্রধান মার্শাল টিটোর সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ দূত মারফৎ ব্যক্তিগত পত্র পাঠালেন এবং টিটোও তার যথারীতি উত্তর দিলেন। চার্চিল তার চিঠিতে এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রতিরোধ সম্পর্কে কমন্স সভার বক্তৃতায় (২২শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৪) টিটো এবং তার প্রতিরোধবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করলেন।

টিটো এবং তার গেরিলাবাহিনী অমানষিক যুদ্ধ ও প্রচণ্ড ত্যাগ স্বীকারের দ্বারা ক্রমে ক্রমে যুগোস্লাভিয়ার সমস্ত অংশ দখল করে নিলেন এবং বলকানের ভিতর দিয়ে অগ্রসরমান লালফৌজের সহযোগিতায় জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে কাবু করে ফেললেন। এই দিক দিয়ে মার্শাল টিটো এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তার গণমুক্তি ফৌজের হাতে যুগোস্লাভিয়ার মুক্তি ঘটল এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক’ প্রতিষ্ঠিত হল। টিটোর ন্যাশনাল কমিটিকেই মঙ্কো যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি দিল।

মুক্তিবাহিনীর চার বছরের যুদ্ধে যুগোস্লাভ সৈন্য নিহত হয়েছিল ৩ লক্ষ ৫ হাজার, আহত ৪ লক্ষের বেশী। যুগোস্লাভিয়ার মোট প্রাণের ক্ষতি হয়েছিল ১৭ লক্ষ। জার্মানী ও ইতালী মোট ৬টি অভিযান চালিয়েও টিটোকে ঘায়েল করতে পারল না – এটা কম আশ্চর্যের কথা নয়। এদিকে নাৎসী পক্ষপাতী ও কমিউনিস্টবিদ্বেষী মিহাইলোভিচ তার অননুচরদের নিয়ে বোসনিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করলেন। কিন্তু ১৯৪৬ সালে মিহাইলোভিচ ধরা পড়লেন এবং দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তার বিচার অনুষ্ঠিত হল এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল।

যুগোস্লাভিয়ার মত জার্মান অধিকৃত গ্রিসেও দেশপ্রেমিক গেরিলা যোদ্ধদল দেখা দিল এবং ফ্যাসিস্ট জার্মানবাহিনী অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাথে তাদেরকে দমন করার চেষ্টা করল। যুগোস্লাভিয়ার মত গ্রিসেও বাম ও দক্ষিণ দুটি প্রতিরোধ বাহিনী সংগঠিত হল। কিন্তু যুগোস্লাভিয়ার মত এই প্রতিরোধ যুদ্ধে মার্শাল টিটোর মত কোন অসামান্য নায়ক ও যোদ্ধা গ্রিসে দেখা দিল না, ফলে জার্মনিদের বিরুদ্ধে পার্টিজান যোদ্ধা হিসাবে এমন কোন রণনায়কের আবির্ভাব ঘটল না, যিনি মিত্রপক্ষের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে পারেন। অথচ গ্রিসেও দুইটি প্রতিরোধ বাহিনী গঠিত হয়েছিল – একটির নাম ছিল ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা ই. এ. এম. এবং তাদের সামরিক সংগঠনের নাম ই. এল. এ. এস. কিংবা গ্রীক পপুলার লিবারেশন আর্মি। এরা ছিলেন বামপন্থী কিংবা কমিউনিস্ট। এদের বিরোধী ছিলেন দক্ষিণপন্থীরা, এদের সংগঠনের নাম ছিল ই. ডি. ই. এস. বা গ্রীক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক আর্মি। দক্ষিণ ও বাম এই দুই সংগঠন জার্মানদের বিরুদ্ধে গেরিলা যাদ্ধ চালালেও নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চালাতে কম উৎসাহী ছিল না। এখানেও ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৪৪ থেকে ১১ই জানুয়ারী ১৯৪৫ পর্যন্ত যুগোস্লাভিয়ার মত হিংস্র তীব্র ও তিক্ত গৃহযুদ্ধের অনুষ্ঠান হল। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের রণনীতির বিচারে চার্চিল তথা ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট গ্রিসকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন এবং তারা এই দুই বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে আপোস রফা বিধানেরও চেষ্টা করেছিলেন।  কিছু দিন এই আপোসরফার চুক্তি পালিতও হয়েছিল, কিন্তু তারপর আবার গৃহযুদ্ধে আত্মপ্রকাশ করল। এখানেও রাজতন্ত্র কিংবা রাজা দ্বিতীয় জর্জকে নিয়ে প্রবল মতবিরোধ দেখা দিল এবং বিশেষভাবে কমিউনিস্ট পন্থী ই. এল. ই. এস. রাজার বিরোধী ছিলেন। যখন সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানবাহিনী গ্রিস ছেড়ে পলায়ন করতে শুরু করল, তখন চার্চিল গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টিজান বাহিনী নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ বোধ করলেন, কেননা তার আশঙ্কা হল যে, জার্মানদের শূন্যস্থানে কমিউনিস্টরা দখলদার হয়ে বসবে এবং রাজাসহ বাকী দক্ষিণ-পন্থীদেরকে উৎখাত করবে। তাই চার্চিলের নির্দেশে ও পরামর্শে গ্রিসকে কমিউনিস্টদের কবল থেকে রক্ষার জন্য ব্রিটিশবাহিনী গ্রিসে অবতরণ করল এবং কঠোর হস্তে কমিউনিস্ট ও অন্যান্য গেরিলাবাহিনীকে দমন করল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সোভিয়েত রাশিয়া এই ব্যাপারে কোন বাধা সৃষ্টি করেনি, কিংবা যুগোস্লাভিয়াতে টিটোর পিছনে যেমন তারা সর্বপ্রকার সহায়তা দিয়েছিল, গ্রিসের কমিউনিস্টদের বেলা তারা সেই সহায়তা দেয়নি – গ্রিসের ভাগ্য যেন একমাত্র ব্রিটেনের হাতেই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.