দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের দুর্ভোগ ও তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ

১৯৩৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর, যেদিন ব্রিটেন জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, সেদিন ভারতের ব্রিটিশ বড়লাটও সঙ্গে সঙ্গে ভারতকে যুদ্ধরত বলে ঘোষণা করলেন। কিন্তু, বড়লাট লর্ড লিনলিথগো এতবড় একটা ঘোষণা দিতে গিয়ে ভারতীয় জনমতের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করলেন না। জাতীয় জীবনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শের কোন প্রয়োজন বোধ করলেন না। যুদ্ধ ঘোষণার শুরুতেই ব্রিটিশ ভাইসরয় যে স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্মম্ভরিতার পরিচয় দিলেন, সেই স্বেচ্ছাচারিতা কার্যত যুদ্ধের আগাগোড়া বজায় রইল। কিন্তু পরাধীন ভারত ব্রিটেনের আজ্ঞাবহ-ভৃত্যরূপে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে রাজি ছিল না। ফলে যেদিন যুদ্ধ ঘোষিত হল, সেদিনই মাদ্রাজে যুদ্ধের বিরুদ্ধে হাজার হাজার লোক প্রতিবাদ জানাল, বিক্ষোভ মিছিল বের করল। আর ২রা অক্টোবর ১৯৩৯ সালে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত হল শ্রমিকদের বিরাট ধর্মঘট – যুদ্ধের বিরদ্ধে ৪০টি কারখানার ১০ হাজার শ্রমিকের এটাই ছিল প্রথম রাজ – নৈতিক ধর্মঘট। এরপর জামসেদপুরের বিখ্যাত টাটা কোম্পানীর কারখানার শ্রমিকেরাও যুদ্ধের বিরদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ধর্মঘটের অননুষ্ঠান করল। দেশের বহু স্থানে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও যুবকেরা মিলিত হয়ে ভারতকে যুদ্ধের মধ্যে টেনে নেয়ার বিরদ্ধে সরকারী নীতির প্রতিবাদ করল এবং একটি জাতীয় সরকারের হাতে সরকারী ক্ষমতা অর্পণের জন্য দাবি জানাল।

পরাধীন ভারতকে জোরপূর্বক যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়ার বিরদ্ধে ভারতীয় জনমত প্রতিবাদ জানাল বটে, কিন্তু, এই জনমত যেমন সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছিল, তেমনি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে ছিল। ইউরোপে ফ্যাসিজম ও নাৎসীবাদের অভ্যুদয়ের পর থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। ১৯৩৬ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে যখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স ‘নন- ইন্টারভেনশন’-এর (হস্তক্ষেপ না-করা) ভণ্ড নীতি অনুসরণ করে কার্যত ফ্যাসিস্ট শক্তিসমূহের পৃষ্ঠপোষকতা করছিল, তখন কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ঐবছর ডিসেম্বর মাসে ফৈজপুর কংগ্রেস থেকে ঘোষণা করা হল যে ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন বেড়ে যাচ্ছে এবং ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে জোট পাকিয়ে পাকাইয়া ও পারস্পরিক মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করে যুদ্ধ বাঁধতে  এবং ইউরোপ ও সারা দুনিয়ার ওপর প্রভুত্ব কায়েম করে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা ধ্বংস করতে চাচ্ছে। পৃথিবীর সামনে যে নতুন উৎপাত দেখা দিয়েছে, সেই উৎপাতের মুখোমুখি হবার জন্য পৃথিবীর সমস্ত প্রগতিশীল জাতি ও জনগণের মধ্যে যে সহযোগিতা প্রয়োজন কংগ্রেস সেই সম্পর্কে পূর্ণভাবে সচেতন ছিল। তাই দেখা যাচ্ছে যে, কংগ্রেস বহু আগে থেকেই ফ্যাসিজমের বিপদের বিরদ্ধে লড়বার জন্য প্রস্তুত ছিল। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে হরিপুরা কংগ্রেস থেকেও ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের নিন্দা এবং যৌথ নিরাপত্তার (কালেকটিভ সিকিউরিটি) নীতির ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। যে কুখ্যাত মিউনিখ চুক্তির দ্বারা চেকোশ্লোভাকিয়াকে ভাকিয়াকে বলি দেয়া হয়েছিল, কংগ্রেস সেই চুক্তি এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির বিরদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। অপর দিকে জাপানী আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে জাপানী পণ্য বয়কটের জন্যও আহ্বান জানাল। অর্থাৎ ভারতীয় কংগ্রেস যুদ্ধ ও ফ্যাসিজম সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই সচেতন ছিল।

তবুও ১৯৩১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর যখন ভারতকে যুদ্ধরত বলে ঘোষণা করা হল, তখন বড়লাট ভারতীয় জনমতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একবারও পরামর্শ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন না। তার ওপর, বড়লাটকে প্রায় ডিক্টেটরি ক্ষমতা দিয়ে ১১ মিনিটের মধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি আইন পাশ করানো হল এবং এই আইনের বলে বড়লাট কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধিবিধান লঙ্ঘনের অধিকারী হলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভারতরক্ষা আইন জারী করা হল এবং এই আইনের বলে গভর্নমেন্টের হাতে স্বেচ্ছাচারিতার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হলো, দেয়া হল বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারি থেকে শত্রু করে মৃত্যুদণ্ডদান পর্যন্ত ক্ষমতা। (India Today – Rajani Palme Dutt, 1970, P. 552.)

১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস দীর্ঘ গবেষণার পর যে বিবৃতি প্রচার করল, তাতে স্পষ্ট করে ঘোষণা করা হল যে, যে যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় পরিচালিত হচ্ছে এবং যে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ভারতে ও অন্যত্র সাম্রাজ্যবাদকে পরিপুষ্ট করা। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সেই যুদ্ধের সঙ্গে কোন সম্পর্ক’ রাখতে কিংবা সহযোগিতা অর্পণ করতে পারে না। কংগ্রেস সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গীতে জানতে চাইল- যুদ্ধের উদ্দেশ্য কি তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হোক। গণতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের মতলব কি এবং ভারতবর্ষ সম্পর্কে ব্রিটেনের উদ্দেশ্য কি ও কিভাবে এই সমস্ত নীতি বর্তমানে কার্যকর করতে চান, সেই সম্পর্কে সস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হোক। ভারতবর্ষকে স্বাধীন জাতি হিসাবে গণ্য করার এবং ভারতীয় জনগণের ইচ্ছানাসারে গভর্নমেন্ট পরিচালনা করার অধিকার দিতে ব্রিটেন প্রস্তুত আছে কি?

বলা বাহুল্য যে, জাতীয় কংগ্রেসের এই সরাসরি প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ সরকার স্পষ্টাক্ষরে ‘না’ বলল এবং সেই প্রথম মহাযুদ্ধের আমলের ডোমিনিয়ন স্টেটাসের প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করল, যে প্রতিশ্রুতি গত ২২ বছরেও পালন করা হয়নি। উল্লেখযোগ্য যে, এই ডোমিনিয়ন স্টেটাসও অবিলম্বেই দেয়া হবে না, যুদ্ধের পর কোন দূর ভবিষ্যতে দেয়ার প্রস্তাব করা হল। আর অনতিবিলম্বে দেওয়া হল একটি ‘পরামর্শ’ কমিটি” গঠনের প্রস্তাব, অর্থাৎ যুদ্ধে পরিচালনা ও ভারতকে দাবিয়ে রাখার জন্য বড়লাটকে পরামর্শ দেয়ার উদ্দেশ্যে যে কমিটি গঠিত হবে, তাতে ভারতীয়দিগকে গ্রহণ করা হবে। বলা বাহুল্য যে, এমন প্রস্তাব স্বাধীনতাকামী ভারতের পক্ষে নিতান্তই অসম্মানজনক। তাই ব্রিটেন কর্তৃক কংগ্রেসের দাবি অগ্রাহ্য হবার পর প্রতিবাদস্বরূপ ১১টি প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার মধ্যে ৮টি কংগ্রেসী মন্ত্রিসভাই পদত্যাগ করলেন (মানে সিন্ধু, পঞ্জাব ও বাংলা বাদে, যেহেতু এই তিনটি প্রদেশে কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা ছিল না।)

ঘুদ্ধের গোড়া থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতীয় স্বাধীনতাকামী জনমতের বিরুদ্ধে দমন ও পীড়ন নীতি অনুসরণ করতে লাগল। বিশেষভাবে যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধেনীতির বিরদ্ধাচরণ করছিল, তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডনীতি উগ্র হয়ে উঠল। দ্বিতীয়ত হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে পারষ্পরিক বিরোধ ও সাম্প্রদায়িকতা উস্কিয়ে দিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে ঘায়েল করতে চাইল এবং তৃতীয়ত ভারতের উচ্চতর শ্রেণীকে, অর্থাৎ সম্পত্তি ও মূলধনওয়ালা মালিকপক্ষকে যুদ্ধের পর কিছু সযোগ-সুবিধাদানের ও যুদ্ধের সময় প্রচুর মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে হাত করতে চাইল। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করছিল। তাই কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনী ঘোষণা করা হল এবং নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করা হল। ১৯৪০ সালে ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়ম ও ফ্রান্সের পতন এবং ডানকার্ক থেকে ব্রিটিশ সৈন্যদের পলায়ন – পরপর এই নাটকীয় ঘটনাগুলোতে সারা পৃথিবীতে তুমল উত্তেজনার সৃষ্টি হল। বিশেষভাবে পশ্চিম রণাঙ্গনের যুদ্ধে ফ্রান্সের মত রাষ্ট্রশক্তির দ্রুত পতনে সারা পৃথিবী স্তম্ভিত হয়ে গেল। ফ্রান্স এবং পরাজিত পক্ষের প্রতি জাতীয়তাবাদী ভারতের যেমন সহানুভূতির উদ্রেক হল, তেমনি জার্মান ফ্যাসিজমের অগ্রগতিতে প্রবল উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হল।

এই সময় জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আর একবার আপোস-মীমাংসার চেষ্টা করল। চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারীর উদ্যোগে এই প্রস্তাব আগেকার তুলনায় অনেকখানি নরম করা হল। এই প্রস্তাব ভারতীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং কেন্দ্রে একটি ‘জাতীয় সরকার’ অর্থাৎ নানা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে একটি ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠার দাবি করা হল। কিন্তু এর জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নতুন কোন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল না, প্রচলিত ভারত সরকারের আইনের মধ্যে থেকেই বড়লাট কর্তৃক একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করা হল এবং যদি এই দাবি পূরণ করা হয় তবে ভারতের পক্ষ থেকে যুদ্ধের সমস্ত প্রকার সহযোগিতা করা হবে। ‘It asked for a recognition of Indian freedom and the establishment of a national Government at the centre, which meant the co-operation of various parties. No fresh legislation by the British Parliament was envisaged at that stage. Within the legal framework then existing, Congress proposed that national government be formed by the viceroy……full co-operation in the war effort was offered’.

কিন্তু, এমন একটি নরম প্রস্তাবও ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গ্রাহ্য হল না ৷ কিন্তু, এই প্রস্তাব উপলক্ষে গান্ধীজীর সঙ্গে কংগ্রেসের বিচ্ছেদ ঘটে গেল, কেননা ভারত কর্তৃক যুদ্ধে সহযোগিতা দানের অর্থ ছিল গান্ধীজীর শান্তিবাদ ও অহিংস নীতির প্রত্যাখ্যান। যদিও গান্ধীজী অহিংস নীতির বিসর্জন দিয়ে সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তবুও জুলাই, ১৯৪০-এ মেজরিটি ভোটের জোরে তার অহিংস নীতি অগ্রাহ্য হল। কিন্তু, স্বাধীনতাকামী ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার কোন আপোসরফায় সম্মত ছিল না। সমস্ত কর্তৃত্ব, শাসন ও যুদ্ধ পরিচালনা তারা নিজেদের হাতেই রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এর প্রতিবাদে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে ব্যক্তিগত বা একক সত্যাগ্রহের আন্দোলন সংগঠিত হল এবং নেতৃবৃন্দসহ প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার লোক কারারুদ্ধ হলেন, যারা অক্টোবর, ১৯৪০ থেকে এক বছরেরও বেশী জেলে ছিলেন। ইতিমধ্যে ১৯৪১ সালের জান মাসে হিটলারী জার্মানী কর্তৃক সোভিয়েত রাশিয়া আক্রান্ত হল এবং ৪ঠা ডিসেম্বর অধিকাংশ কংগ্রেসী নেতা মুক্তি পেলেন। এর তিন দিন পর জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রমণ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অভিযান শুরু হল। সহসা যেন সমগ্র পৃথিবীর পট পরিবর্তন ঘটে গেল।

সোভিয়েত রাশিয়ার জন্য ভারতবর্ষে প্রচুর সহানভূতি ও সমর্থন ছিল। ফলে সোভিয়েত রাশিয়া হিটলার কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ায় যুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের যেমন পরিবর্তন ঘটে গেল তেমনি হিটলার-বিরোধী মহাজোট ক্রমে ভারতীয় জনমতের নিকট ফ্যাসিবিরোধী মুক্তি সংগ্রামের রূপ গ্রহণ করতে লাগল। ১৯৪২ সালের জানুয়ারী মাসের গোড়ায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে ফ্যাসিজমের বিরোধিতা ও ভারতীয় স্বাধীনতার দাবির ওপর পুনরায় জোর দিয়ে বলা হল যে, একমাত্র স্বাধীন ভারতই ফ্যাসিবিরোধী মহাজোটের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করতে সক্ষম। রাশিয়া আক্লান্ত হওয়ার পর বিশ্বযুদ্ধের চরিত্রের যে পরিবর্তন ঘটে গেল সেকথা স্বয়ং জওহরলাল নেহরু তার এক ঘোষণায় স্বীকার করলেন : ‘The progressive forces of the world are now aligned with the group represented by Russia, Britain, America and China’. পৃথিবীর প্রগতিকামী শক্তিগুলো এক্ষণে সেই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, যে গোষ্ঠীর সঙ্গে রয়েছে – রাশিয়া, ব্রিটেন, আমেরিকা ও চীন – ডিসেম্বর ১৯৪১।” কংগ্রেসের একটি প্রস্তাবে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হল : Reflecting the mood of the broad masses whose sympathies. were on the side of the U. S. S. R. and who were clamouring for active aid to the Soviet people in their struggle against the fascist aggressors, the All India Congress Committee passed an emergency resolution expressing its sympathy with the Soviet people and pointing out the historical significance of the measures undertaken to build a new society in the U. S. S. R. It also expressed the sympathy of the Congress with the Chinese people in their struggle against Japanese aggression.

কিন্তু কংগ্রেসের এই মনোভাবের সাথে ভারতীয় জনমতের সকলেই সম্পূর্ণ একমত ছিলেন একথা বলিলে নিশ্চই ভুল করা হবে। কারণ গান্ধীজীর যুদ্ধবিরোধী অহিংসনীতির প্রতি যেমন নেতৃত্বের একাংশে সমর্থন ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতেও তেমনি অনেকেই অনিচ্ছুক ছিল। তবে, কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আজাদ ও জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস হিটলার বিরোধী কোয়ালিশনের প্রতি পূর্ণ সহানভূতিসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু চার্চিলের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকার বিন্দুমাত্র নত হলেন না। বরং ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে চার্চিল-রুজভেল্ট কর্তৃক যে ঐতিহাসিক ‘আটলান্টিক সনদ’ ঘোষিত হয়েছিল চার্চিল তার ব্যাখ্যা করে ঘোষণা করলেন যে, নাৎসী অধিকৃত ইউরোপীর রাজ্য ও জাতিগুলো সম্পর্কেই আটলান্টিক সনদ প্রযোজ্য, ভারতবর্ষ, ব্রহ্মদেশ বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশগুলোর প্রতি এই সনদ প্রযোজ্য নয়।

কিন্তু, ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আটলান্টিক সনদের এই চার্চিলীয় ব্যাখ্যার প্রতিবাদ করে বললেন – আটলান্টিক সনদ কেবল আটলান্টিক মহাসমদ্রের তীরবর্তী দেশগুলোর প্রতিই প্রযোজ্য নয়, সারা পৃথিবীর পক্ষেই তা প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে রাজভেল্টের এই ঘোষণার দ্বারা কার্যত ভারতের স্বাধীনতার দাবির প্রতিই সমর্থন জানানো হল ৷ এই সময় অস্ট্রেলিয়া গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ এইচ. ভি. ইভাটও ভারতীয় জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতা দিলেন। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জেনারেল চিয়াং কাইশেক ও তার স্ত্রী পত্নী ভারত পরিদর্শনে এলেন এবং তারাও প্রকাশ্যেই ভারতের দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কাছে আবেদন জানালেন। চিয়াং কাইশেকের এই আবেদনে ‘ভারতবাসীদের হাতে প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্পণের প্রস্তাব ছিল – যে প্রস্তাব কংগ্রেসের জাতীয় দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

আটলান্টিক সনদের ব্যাখ্যায় চার্চিল যে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যে মনোভাবের প্রতিবাদ করেছিলেন সেকথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তা ছাড়াও রুজভেল্ট ভারতীয় স্বাধীনতার দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সরাসরি চার্চিলকে অনুরোধ করেছিলেন। যুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালের জুন মাসে “ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ পত্রিকায় প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব সামনার ওয়েলস কর্তৃক লিখিত এক প্রবন্ধে চার্চিলের নিকট রুজভেল্টের এই প্রস্তাবের কথা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই প্রবন্ধের গোড়ায় স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল : “In 1942 when Japanese menace was at its height and when unrest in India was acute, President Roosevelt urged Mr. Churchill to agree that Indian independence should be no longer delayed and that the Indian leaders should be given the chance to frame a national constitution patterned upon the American Articles of Confederation…” (India To-day-R. Palme Dutt, P. 559.)

এখানে স্মরণে রাখা উচিত যে, ১৯৪২ সালে ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন ও বিশ্বযুদ্ধে যেন চুড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাচ্ছিল, অথচ সেই সময় ভারতবর্ষে চলছিল ব্রিটেনের বিরদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও অসন্তোষ। ঠিক এই সন্ধিক্ষণে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে আপোস মীমাংসার জন্য ব্রিটেনের উপর চাপ পড়ছিল। তাই ৮ই মার্চ যখন জাপানীদের হাতে রেঙ্গুনের পতন ঘটল, তখন অকস্মাৎ ১১ই মার্চ ব্রিটিশ সরকার ভারতের জন্য ক্রিপস মিশনের কথা ঘোষণা করলেন ! ব্রিটিশ যাথমন্ত্রিসভা ভারতের জন্য একটি নতন সাংবিধানিক পরিকল্পনার খসড়া রচনা করেছিলেন এবং স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপসের ওপর ভার দিয়েছিলেন সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে মীমাংসার উদ্দেশ্যে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার জন্য। এই পরিকল্পনার দুটি অংশ ছিল – একটি যুদ্ধোত্তর ভারতের জন্য এবং অপরটি চলতি যুদ্ধকালীন অবস্থার জন্য –

১। যুদ্ধোত্তর ভারতের জন্য প্রস্তাব করা হল :

  • (ক) যুদ্ধের পর ভারতকে ডোমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়া হইবে এবং ইচ্ছে করলে ভারত ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবে।
  • (খ) যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই একটি সংবিধান রচনা পরিষদ গঠিত হবে। যুদ্ধের পর প্রাদেশিক বিধানসভাগুলোর সদস্যগণের দ্বারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে এবং দেশীয় রাজ্যসমূহের জনগণের সংখ্যানুপাতিক হিসাবে নৃপতিবর্গ কর্তৃক আংশিকভাবে মনোনীত সদস্যগণের দ্বারা ভারতের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে এই পরিষদ গঠিত হবে ৷
  • (গ) ব্রিটিশ ভারতের যে কোন প্রদেশ কিংবা যে কোন দেশীয় রাজ্য ইচ্ছে করলে ভরতীয় ইউনিয়নের বাইরে থাকিতে পারবে কিংবা বর্তমান ভিত্তির ওপরেই চলতে পারবে অথবা সমান অধিকার সহ আলাদা ডোমিনিয়ন হিসেবে একটি নতুন সংবিধানও রচনা করতে পারবে।
  • (ঘ) ভারতের জাতিগত ও ধর্মগত সংখ্যালঘুদেরকে রক্ষা করার যে বাধ্যবাধকতা ব্রিটিশ সরকারের রয়েছে সেই অনুসারে সংবিধান রচনাকারী পরিষদের সঙ্গে ব্রিটেন ও ভারতের মধ্যে একটি সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হবে।

২। যুদ্ধকালীন অবস্থার জন্য আশা প্রস্তাব এই – ভারতীয় প্রতিনিধিগণের সঙ্গে পরামর্শমূলক সহযোগিতার অধিকার সহ ব্রিটেন কর্তৃক সমস্ত ক্ষমতা সংরক্ষণ।

ব্রিটিশ সরকার খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ভারতের সঙ্গে মীমাংসা করার নামে যে ক্রিপস প্রস্তাব বা পরিকল্পনা পেশ করলেন, আসলে সেই পরিকল্পনা কেবল অন্তসারশূন্যই ছিল না, বিপজ্জনকও ছিল, কেননা যুদ্ধকালীন অবস্থায় ভারতের হাতে বিন্দুমাত্র ক্ষমতা দেয়া হল না, জাতীয় সরকার গঠনের কোন অধিকার স্বীকার করা হল না, অধিকন্তু ভবিষ্যৎ ভারতকে বিভিন্ন অংশে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা করা হল। এর দ্বারা একাধিক পাকিস্তান সৃষ্টির যেমন প্রস্তাব করা হল, তেমনি দেশীয় রাজ্যগুলোকে (যেগুলোর মোট সংখ্যা ৬ শতাধিক) আলাদা হয়ে যাবারও অধিকার দেয়া হল। আরও মজার কথা এই যে, কংগ্রেসের নেতৃবর্গ যখন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের সঙ্গে এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করলেন, তখন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব উঠলে নেতৃবৃন্দকে বলা হল যে, ভারতীয় মন্ত্রী শুধু সৈন্যদের জন্য ক্যান্টিন ও স্টেশনারী দোকান চালাবার আধিকার পাবে। এছাড়া ক্রিপস পরিকল্পনাকে গ্রহণযোগ্য করার উদ্দেশ্যে যখন ভাগে ভাগ বিবেচনার কথা উঠল, তখন  ক্রিপস সাহেব পরিষ্কার বললেন – “Take it or leave it” – হয় গোটাটা গ্রহণ করতে হবে, নতুবা গোটাটাই বর্জন করতে হবে। (রজনী পাম দত্ত – পষ্ঠা ৫৬০-৬১)

বলাই বাহুল্য যে, ক্রিপস প্রস্তাব জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হল। জওহরলাল নেহেরু লিখেছেন যে, ব্রিটিশ প্রস্তাব কেবল যে কংগ্রেসই অগ্রাহ্য করল এমন নয়, প্রকৃতপক্ষে ভারতের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। এমন কি ভারতীয় রাজনৈতিক মহলের মধ্যে সবচেয়ে মডারেটপন্থী যাঁরা, তারাও ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণের অযোগ্য বলে বিবেচনা করল। (ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া – পৃষ্ঠা ৪৭)। অথচ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, ব্রিটেনের একজন বামপন্থী ও প্রগতিবাদী নেতারূপে পরিচিত ছিলেন। এমন কি ভারত সম্পর্কে তার সহানভূতির মনোভাবও ছিল। তাই ১৯৪২ সালের ২২ মার্চ যখন তিনি ব্রিটেনের যুদ্ধ মন্ত্রিসভার প্রস্তাব সহ লন্ডন থেকে নয়াদিল্লীতে পৌঁছলেন তখন স্বভাবতই ভারতীয় রাজনৈতিক মহলে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবন্দের সঙ্গে তার আলোচনায় দেখা গেল যে, ব্রিটেন ভারতীয়দের হাতে কোন ক্ষমতা অর্পণ করতেই প্রস্তুত নয়, বরং ভবিষ্যতে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে ভারতকে খণ্ড-বিখণ্ড করার বিপজ্জনক চক্রান্ত ছিল ক্রিপস প্রস্তাবে। প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আলোচনার কিংবা ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (কংগ্রেসের প্রস্তাবিত) সংক্রান্ত চিঠির শেষ জবাব দেয়ার আগেই স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস হঠাৎ ১২ই এপ্রিল নয়াদিল্লী ত্যাগ করে বিমানযোগে লন্ডনে ফিরে গেলেন এবং যাবার আগে এমন একটি বিবৃতি দিয়ে গেলেন, যাতে ভারতবর্ষে তীব্র ক্ষোভ ও তিক্ততার সৃষ্টি হল।

এদিকে ক্রিপস প্রস্তাব কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখ্যান উপলক্ষ করে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা ও তাদের অন্ধ সমর্থকগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও মিত্রপক্ষীয় দেশগুলোতে ভারতের বিরদ্ধে অত্যন্ত জঘন্য মিথ্যা প্রচার করতে শুরু করল, কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও মিত্রপক্ষীয় দেশগুলোতে ভারতের জাতীয় দাবি ও ফ্যাসিবিরোধী মনোভাবের প্রতি প্রভূত সমর্থন ও সহানভূতি ছিল। আসলে, সাম্রাজ্যবাদী চার্চিল ভারতীয় স্বাধীনতার এক নম্বর শত্রু ছিলেন এবং ব্রিটিশ যুদ্ধ মন্ত্রিসভাও ভারতের প্রতি একেবারে সহানভূতিশূন্য ছিল। সেই সময় ভারতের বড়লাট লর্ড ওয়েভেল স্বয়ং তার ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন যে, চার্চিল ভারতকে ঘৃণা করতেন এবং ব্রিটেনের যুদ্ধ মন্ত্রিসভাও ভারত সম্পর্কে আন্তরিক ছিলেন না কিংবা তাদের কোন দূরদৃষ্টি বা রাজনৈতিক সাহসও ছিল না। গান্ধীজী সম্পর্কে উইনস্টোন চার্চিলের এমন অবজ্ঞা ছিল যে, ১৯৪৪ সালের ৮ই মে তিনি লর্ড ওয়েভেলকে এক তারবার্তা পাঠিয়ে জানতে চাইলেন যে, গান্ধী এখনও মারা যান নি কেন? (Winston sent me a peevish telegram to ask why Gandhi had not died yet?) সোজা কথায় ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতীয় জাতীয় দাবির প্রতি খড়্গহস্ত ছিলেন এবং চার্চিল সমগ্র যুদ্ধটাই ব্রিটেনের পক্ষ থেকে পরিচালনা করছিলেন একাস্তরূপে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য। তাই ভারতের সঙ্গে অতি তীব্র ও তিক্ত সম্পর্কে’র উদ্ভব হল। ভারতীয় জনমত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, যার পরিণতিতে ঘটল সেই ইতিহাস বিখ্যাত ‘কুইট ইণ্ডিয়া’ প্রস্তাব, গান্ধী ‘হরিজন’ পত্রিকায় এই চাঞ্চল্যকর দাবি তুললেন। ১৯৪২ সালের ৭ই এবং ৮ই আগস্ট বোম্বাইতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় এই দাবি উত্থাপিত হল এবং ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে কুইট ইন্ডিয়া প্রস্তাবটি সমগ্র জাতির কাছে একটি রণধ্বনি বা শ্লোগানের মত প্রতিধ্বনিত হল ! ভারতের আত্মসম্মান ও স্বাধীনতার অপরিহার্য দাবির মর্যাদা রক্ষার জন্য পুনরায় গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস অহিংস গণ-আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করল। ভারতবর্ষের সঙ্কট চরম পর্যায়ে পৌঁছল।

‘অবিলম্বে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান দাবি করে বোম্বাইতে কংগ্রেস প্রস্তাব গৃহীত হবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, অর্থাৎ ৯ই আগস্ট ভোরবেলা ভারত সরকার গান্ধী, নেহরু, আজাদ, প্যাটেল, কৃপালিনী, রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখ সমস্ত জাতীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করল। একমাত্র বোম্বাইতেই ১৪৮ জন ধৃত হল। ভারত সরকার পূর্বাহ্ণেই গ্রেপ্তারি পরিকল্পনাসহ প্রস্তুত হয়েছিল। কংগ্রেস বে-আইনী ঘোষিত হল এবং সমগ্র ভারতে ধরপাকড় ও দমননীতি প্রসারিত হল। কিন্তু সারা ভারতের পরিস্থিতি ইতিমধ্যে বিস্ফোরণের অবস্থায় পৌঁছেছিল। তাই জাতীয় নেতৃবন্দের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল, যে বিদ্রোহ ১৯৪২ সালের ‘আগস্ট বিপ্লব’ নামে ভারতের ইতিহাসে খ্যাত। এই বিদ্রোহ ঘটল স্বতস্ফূর্ত ভাবে, কেননা, কংগ্রেস এই বিদ্রোহে ডাক দেয়নি এবং বিশিষ্ট নেতারা সকলেই ছিলেন কারা-অন্তরালে। ফলে জনগণের এই স্বতস্ফূর্ত বিদ্রোহ ছিল নেতৃত্ব-বিহীন। অন্য পক্ষে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ, নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী হয়ে উঠল। সারা ভারতে পুলিশ ও মিলিটারি যাচ্ছেতাই গুলি চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে মরিয়া হয়ে উঠল। নয়াদিল্লীর কেন্দ্রীয়: ব্যবস্থা পরিষদে ভারত সরকারের হোম মেম্বর এক বিবৃতিতে বললেন যে, ৯ই আগস্ট, থেকে ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৪২-এই কয় মাসে ৬০,২২৯ জন লোককে গ্রেপ্তার, ১৮,০০০ ব্যক্তিকে ভারত রক্ষা আইনে আটক, পুলিশ ও মিলিটারির গুলিতে ৯৪০ জনকে নিহত এবং ১,৬৩০ জনকে আহত করা হয়েছে।

জওহরলাল নেহরু লিখেছেন যে, জনগণের অবরুদ্ধ ক্রোধ ফেটে পড়তে লাগল ব্রিটিশ শাসন ক্ষমতার প্রতীক স্বরূপ তারা হাতের কাছে যা কিছু পেল আক্রমণ করতে লাগল। থানা, পুলিশ, রেললাইন, রেলস্টেশন, ডাকঘর, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার ইত্যাদি ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে লাগল। নেতাশূন্যে, অস্ত্রশূন্য এই জনতা পুলিশ ও মিলিটারির গুলির মুখে দাঁড়াল। সরকারী বিবৃতিতে উল্লেখ করা হল যে, ৫৩৮টি ঘটনা উপলক্ষে গুলি চালনা করা হয়েছে এবং আকাশের নিচ দিয়ে উড়ে গিয়ে বিমান থেকে মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। আর চার্চিল দম্ভভরে কমন্স সভায় ঘোষণা করলেন যে, সরকার কঠোর হস্তে গোলযোগ দমন করেছেন এবং ভারতে এই সময় এত বেশী গোরা সৈন্য ছিল যে, ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে তা অভুতপূর্ব ! (ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া—পৃষ্ঠা ৪৯৬)। আগস্ট বিপ্লবে সারা ভারতে জনতার হাতে প্রায় শ’খানেক লোক মারা গিয়েছিল। কিন্তু, সরকারী হিসেবেই প্রকাশ করা হলো যে, আগস্ট বিপ্লব দমন করতে গিয়ে পুলিশ ও মিলিটারি ১০২৮ লোককে নিহত এবং ৩২০০ লোককে আহত করেছে। কিন্তু বেসরকারী মতে ২৫ হাজার লোক নিহত হয়েছিল। অপর পক্ষে নেহরুর ধারণা মোট নিহতের সংখ্যা ১০ হাজার। (পূর্বোত পুস্তক, পৃষ্ঠা 600)। গ্রেপ্তারি, আটক ও হতাহত ছাড়া অন্যান্যভাবেও অত্যচার করা হয়েছিল। বহু জায়গায় কংগ্রেসের দপ্তর ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল এবং কমন্স সভায় ভারত সচিব মিঃ আমেরী স্বীকার করেছিলেন যে ভারতীয় জনগণের ওপর ৯০,০০,০০০ টাকা পাইকারী জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল এবং এর মধ্যে ৭৮,৫০,০০০ টাকা আদায় করা হয়েছিল। অর্থাৎ দরিদ্র ভারতবাসীর রক্ত মোক্ষণ করে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার এই বিপুল পরিমাণ জরিমানার টাকা আদায় করেছিল।

নির্মমতা ও প্রতিহিংসার দ্বারা ব্রিটিশ শাসন কর্তৃপক্ষ ভারতের আগস্ট বিপ্লব দমন করেছিল এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সেই কুখ্যাত দম্ভোক্তি পুরোপুরি বজায় ছিল – ‘I have not become the King’s first minister in order to preside over the liquidition of the British Empire.’ অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কারবারে লালবাতি জ্বালাবার জন্য আমি সম্রাটের প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। যদিও যুদ্ধোত্তর পথিবীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কারবারে লালবাতি জ্বলেছিল এবং স্বয়ং চার্চিলই স্বচক্ষে সেই লালবাতির রক্তশিখা দেখে গিয়েছিলেন, তবু একথা সত্য যে, ১৯৪২ সালে চার্চিল ভারতের জাতীয় দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র আপোসের মনোভাব দেখাননি এবং ফ্যাসিজমের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতাকামী ভারতকে যেন বন্দীশালায় আটক করে রাখা হয়েছিল।

১৯৪২ সালে ব্রিটেনের সহিত জাতীয়তাবাদী ভারতের বিচ্ছেদ ও আগস্ট বিদ্রোহের পর ১৯৪৩ সালে ভারতের অবস্থা ক্রমশ চরম পর্যায়ের দিকে যাচ্ছিল। যুদ্ধের সুযোগে ভারতের এক শ্রেণীর লোক গভর্নমেন্ট সমরবিভাগের সঙ্গে সহযোগিতার দ্বারা প্রচুর অর্থোপার্জন করল বটে, কিন্তু জনসাধারণের স্কন্ধে যুদ্ধের বোঝা অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগল। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত যদিও আসল রণক্ষেত্রে থেকে অনেক দূরে ছিল, তবুও জনগণের ওপর অর্থনৈতিক দুর্গতির চাপ কম ছিল না। দারিদ্র্য ও অন্নাভাব জনসাধারণের জীবনযাত্রাকে ক্লেশকর করে তুলেছিল। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের জনগণের অবস্থা অনেক বেশি দুর্বিষহ হয়ে উঠল। অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি এবং শেষ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ভারত একটা যুদ্ধের ঘাঁটিতে পরিণত হল এবং তার দুই পার্শ্বদেশে পশ্চিমে ইরান ও মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব দিকে ব্রহ্মদেশ ও মালয় ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের মধ্যে পড়ল। ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর নৌ-অভিযানের আওতার মধ্যে এল। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ জাপানী অধিকারে চলে গেল এবং যেকোন মহূর্তে সিংহল দ্বীপ ও ভারতীয় উপকূলভাগ জাপানী নৌ ও বিমান আক্রমণের সম্ভাবনার মধ্যে পড়ল। এছাড়া পূর্বে ভারতে জাপানী স্থলসৈন্যের অনুপ্রবেশ ও আক্রমণের সম্ভাবনা আতঙ্ক বিস্তার করল। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত জাপানী বোমারু অভিযানের আশঙ্কা জনগণকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলল। আর সেই সঙ্গে ব্রহ্মদেশ থেকে পলায়িত অজস্র ভারতীয় নাগরিকের পূর্ব ভারতে আশ্রয় প্রার্থীরূপে আগমন এবং তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কাহিনী সারা ভারতে তুমুল উত্তেজনা ও আতঙ্কের সঞ্চার করল। পূর্বে দিক থেকে শত্রুর আগমন প্রথমে পূর্ববঙ্গেই ঘটবে অনুমান করে সরকারী কর্তৃপক্ষ “পোড়া মাটির নীতি” অনুসরণ করতে চাইলেন এবং এজন্য পূর্ব বঙ্গের হাজার হাজার নৌকা ধ্বংস করে ফেলা হল। অথচ অজস্র নদীনালা ও খাল বিলের দেশ পূর্ববঙ্গে নৌকাই ছিল জনগণের সবচেয়ে বড় বাহন। এভাবে নৌকা ধ্বংস হবার ফলে পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ যেমন একে অপরের কাছ থেকে যোগাযোগের অভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, তেমনি তাদের জীবিকার্জনের প্রধান অবলম্বন নষ্ট হয়ে গেল। পঞ্চাশের মন্বন্তরে পূর্ববঙ্গে অজস্র মানষের মৃত্যুর এটাও ছিল অন্যতম কারণ। ভারতের সরকারী কর্তৃপক্ষ জাপানীদের আক্রমণের আশঙ্কায় এমন ‘নার্ভাস’ হয়ে পড়েছিলেন যে, ভারত মহাসাগরে জাপানী নৌবহরের অভিযান ও মাদ্রাজ আক্রমণের গুজবে বিশ্বাস করে মাদ্রাজ থেকে সরকারী অফিসারেরা পালিয়ে যায় এবং মাদ্রাজের পোতাশ্রয়ের একটা অংশ পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলে। (পার্বোশ্বত পুস্তক – পৃষ্ঠা ৪৭৫)

দক্ষিণ এশিয়াতে ভারত যুদ্ধের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়। লক্ষ লক্ষ ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্য ছাড়াও আফ্রিকান আমেরিকান ও চীনা সৈন্য ভারত ও ব্রহ্মদেশে ভীড় করে এবং এদের খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব ভারতের কাঁধে পড়ল। অপরদিকে বিদেশ থেকে যুদ্ধের আগে ভারতে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টন যে খাদ্য-শস্য আমদানি হত, জাপানের প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে এবং ইন্দোচীন, থাইল্যান্ড ও বার্মার পতনের ফলে সেই সমস্ত আমদানি বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৪২ সালের শরৎকালে মেদিনীপুরে ভয়াবহ সাইক্লোন ও বন্যার ফলে প্রচুর শস্যহানি (১০ লক্ষ টন) ঘটল। এদিকে গভর্নমেন্টের হাতে জনসাধারণের জন্য কোন মজুত শস্যভাণ্ডার ছিল না, কারণ জনসাধারণকে খাদ্য সরবরাহের দায়িত্বের কথা তারা চিন্তাও করেনি। যুদ্ধের জরুরি অবস্থায় যে কন্ট্রোল ও রেশনিং অপরিহার্য ছিল শাসন কর্তৃপক্ষ অনেকদিন পর্যন্ত সেই দিক দিয়ে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করেনি। তাই ক্রমে ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের প্রথম পদধ্বনি যখন শোনা গেল, তখন গভর্নমেন্টের ঔদাসীন্য ভঙ্গ হলো না। বরং ভারত রক্ষা আইন অনুসারে সংবাদপত্রে দুর্ভিক্ষ এমনকি সাইক্লোনের সংবাদ ও ফটো ছাপানো পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল।

ইংরাজী ১৯৪৩ সাল কিংবা বাংলা ১৩৫০ সাল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জন্য ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। বাংলার জনগণের কাছে এই দুর্ভিক্ষ ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত। ১৯৪৩ সালে প্রথমে বোম্বাইতে এর আরম্ভ, তারপর ক্রমে দেশের বৃহত্তর অংশে তা ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা, মাদ্রাজ, বিহার, ওড়িশা ও আসাম পর্যন্ত দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। ভারতের সমগ্র জনসংখ্যার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ কিংবা ১২ কোটি ৫০ লক্ষ লোক দুর্ভিক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হয়। প্রধানত গ্রাম্য অঞ্চলের গরীব চাষী, ভূমিহীন মজুর ও কারিগর শ্রেণীর লোকেরাই সবচেয়ে বেশী মারা পড়ে। এই দুর্ভিক্ষ সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে বাংলায়। বাংলার গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে ও কলকাতার রাস্তায় হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেই সময় কলকাতা মহানগরীর গৃহস্থ বাড়ীর দরজায় প্রায়শই অনাহারক্লিষ্ট নরনারী ও শিশুর করুণ আর্তনাদ শোনা যেত ‘মাগো, একটু ফ্যান দাও।’

১৭০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে এমন ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ আর কখনও হয়নি৷ বাংলায় ও বিহারে যখন ব্রিটিশ শাসন প্রথম প্রতিষ্ঠিত হল, সেই ১৭৬৬ থেকে ১৭৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষের সঙ্গেই পঞ্চাশের মন্বন্তরের তুলনা দেয়া যেতে পারে। দুর্ভিক্ষের পথ ধরে গ্রামে গ্রামে যে মহামারী দেখা দিল তার ফলেও অগণিত মানুষ প্রাণ হারাল। কত লক্ষ লোক যে এই মন্বন্তরের ফলে মারা গেছে, তার সঠিক হিসেব কোন দিন নির্ণীত হবে না । স্যার জন উডহেডের নেতৃত্বে যে সরকারী দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল, সেই কমিশনের মতে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে বাংলার ১৫ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় জনমতের নিকট এই সংখ্যা সঠিক বলে গৃহীত হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালায়র নৃতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ থেকে এই সম্পর্কে যে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে মৃতের সংখ্যা ৩৪ লক্ষ বলে ঘোষিত হয়েছিল। শ্রী কালীচরণ ঘোষ তার বাংলার দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত গ্রন্থে (মস্কো থেকে প্রকাশিত) মৃতের সংখ্যা ৩৫ লক্ষ থেকে ৪৫ লক্ষ পর্যন্ত বলে উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু এই দুর্ভিক্ষ একমাত্র যুদ্ধের জন্য কিংবা প্রকৃতিক দুর্যোগের জন্যই সংঘঠিত হয়নি। স্বয়ং জওহরলাল নেহরু এই দুর্ভিক্ষকে ‘মনুষ্য সৃষ্ট’ বলে নিন্দা করেছেন। গভর্নমেন্টের অবহেলা, সরকারী আমলাতান্ত্রিক গাফিলতি এবং সরকার নিযুক্ত এজেন্টদের মিনাফাখোরি, মজুতদারি ও কালোবাজারির জন্যই এই প্রচণ্ড বিপর্যয় ঘটেছিল। ব্রিটিশ ও ভারতীয় পুঁজিপতিদের হাতে সরকারী খাদ্য ব্যবসায় ও বণ্টনের ভার ছিল এবং তারা ইচ্ছামত দাম ছড়িয়ে মুনাফাবাজির চরম করেছিল। এছাড়া মিলিটারি কনট্রাকটারদের হাতে প্রচুর খাদ্যশস্য মজুত ছিল। এরাও মজুতদারি ও মুনাফাবাজির দিকে ঝুঁকেছিল। সরকারী অক্ষমতা, হৃদয়হীনতা, দুর্নীতি ও অপরিমিত লোভের কারসাজির জন্য পঞ্চাশের মন্বন্তর এত ব্যাপক ও ভয়াবহ হয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ভারতীয়দের জীবন ও নিরাপত্তা বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিল। বলা বাহুল্য যে, যুদ্ধের সময়কালে ব্রিটেনে যখন রেশনিং ও কন্ট্রোল সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল এবং জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছিল, তখন ব্রিটিশ- ভারতের লক্ষ লক্ষ লোক না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল। সেই সময় থেকেই ভারতীয় ব্যবসার সঙ্গে মজুতদারি, মুনাফাবাজি ও কালোবাজারি শব্দগুলোর ব্যাপকভাবে প্রচার হতে থাকে এবং বিশ্বযুদ্ধের পরেও সমাজজীবনে এই পাপ প্রচণ্ডভাবে চলতে থাকে।

বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী ভারতে এত ব্যাপক মজুতদারি, মুনাফাবাজি ও কালোবাজারি ছিল না। ভারতীয় সমাজজীবনে এটা ছিল বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিশাপ। সমাজের নৈতিক পতন ও দুর্নীতির আর একটা বড় দিক এই সময় থেকে প্রাধান্য লাভ করতে থাকে। অর্থাৎ গণিকাবৃত্তি ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। এমনকি, তথাকথিত ‘ভদ্রমহলে’ পর্যন্ত এটি গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করেছিল। বিদেশী সৈন্য ও অফিসারদের মনোরঞ্জন ও অবসর বিনোদনের নাম করে সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গণিকাবৃত্তির বহুল প্রচলন হয়েছিল। মিলিটারির নানা শাখায় মেয়েদের চাকুরী এই দুর্নীতিকে বিশেষভাবে পরিপুষ্ট করেছিল।

অর্থাৎ ১৯৪৩ সাল যুদ্ধক্লিষ্ট  ভারতের সমাজ জীবনে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মৃত্যু, মহামারী ইত্যাদি যেমন ডেকে এনেছিল তেমনি আর্থিক লালসা ও দুর্নীতির বানও ডেকেছিল। স্যার জন উডহেডের নেতৃত্বে সরকার নিযুক্ত দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি ও অনাচারের জন্য কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক উভয় সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে এবং মন্তব্য করা হয়েছে যে সরকার যদি উপযুক্ত সময়ে সাহসিকতাপ,র্ণ ব্যবস্থা অবলম্বন করত, তবে এই ব্যাপক বিপর্যয় ঘটত না। কিন্তু, সরকারী ঔদাসীন্য, অক্ষমতা এবং সমাজের মধ্যে আর্থিক লালসা এই বিপর্যয়কে গভীর করে তুলল। কমিশন মন্তব্য করেছে : ‘Enormus profits were made out of the calamity, and in the circumstances, profits for some meant death for others. A large part of the community lived in plenty while others starved, and there was much indifference in face of suffering. Corruption was widespread throughout the province and in many classes of society.” “The total profit made in this traffic of starvation and death is estimated at 150 crores of rupees (Rs. 1,500 millions). Thus if there were a million and a half deaths by famine, each death was balanced by roughly a 1,000 rupees of excess profits!’

অর্থাৎ এই বিপর্যয় থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জন করা হয়েছিল এবং যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে কিছু লোকের মুনাফার অর্থই অপরের মৃত্যু। অপর সমস্ত লোক যখন অনাহারে প্রাণত্যাগ করেছে, তখন সমাজের এক বহুৎ অংশ দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাস করেছে এবং অপরের দূর্ভোগের জন্য তাদের কোন মাথাব্যথাও ছিল না। সমগ্র প্রদেশব্যাপী এবং সমাজের বহু অংশে দূর্নীতি ছেয়ে গিয়েছিল। ক্ষুধা ও মৃত্যুর এই ব্যবসায়ে মোট ১৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জিত হয়েছিল। অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের ফলে যদি ১৫ লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটে থাকে, তবে, প্রতি মৃত্যুর জন্য হাজার টাকা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জিত হয়েছে! (দি ডিসকভারি অব ইন্তিরা-জওহরলাল নেহর, পৃষ্ঠা ৫১১)

দুর্ভিক্ষের ফলে সরকারী মতে যদি ১৫ লক্ষ লোকেরও মত্যু হয়ে থাকে, তবে মজুমদারেরা ও ব্যবসায়ীরা প্রতি মৃত্যুর জন্য এক হাজার টাকা করে লাভ করেছে! পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বোধ হয় চরম মূল্য দিয়েছেন গ্রাম-বাংলার গরিব মানুষেরা। দ্বিতীয় বিশুযুদ্ধে পৃথিবীর অন্য কোথাও দুর্ভিক্ষে এত লোকের প্রাণ যায়নি, এমন করুণ দৃশ্যেরও আর কোথাও অবতারণা হয়নি। ৩৫ থেকে ৪০ লক্ষ লোক অনাহারে মারা গেল, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকের হৃদয় এতটুকু টলল না। ভারতের স্বাধীনতার দাবি যেমন অগ্রাহ্য হল, তেমনি লক্ষ লক্ষ লোকের অনাহারে মৃত্যুও উপেক্ষিত হল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম বিশ্বনেতা উইনস্টোন চার্চিল বহুগুণের অধিকারী ছিলেন বটে, কিন্তু ভারতবাসীর প্রতি তার অবজ্ঞার সীমা ছিল না। তার সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির নিকৃষ্টতম উদাহরণ ভারত সম্পর্কে তার এই ঘূর্ণিত মনোভাব! – যে মনোভাবের জন্য ভারতের স্বাধীনতা ও ঐক্য পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়েছিল।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.