মলদোভার পশ্চিমাপন্থী সরকারের পতনের পেছনে হাত কি রাশিয়ার?

কদিন আগে, মলদোভার পশ্চিমাপন্থী সরকার জীবনযাত্রার ব্যয় (কস্ট অফ লিভিং) সংকটের ভুল ব্যবস্থাপনার ফলে দৃশ্যত কলাপ্স করে। যাইহোক, বেশ কদিন ধরেই আবার রিপোর্টে উঠে আসছে যে, ক্রেমলিন একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছে এবং একটি উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই আর্টিকেলে মলদোভার সাম্প্রতিক পতন, রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এবং কীভাবে এটি ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে তা দেখা হবে।

এই গল্পটি বোঝার জন্য, আপনাকে মলদোভার রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা জানতে হবে এবং বিশেষত কীভাবে মলদোভা ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে স্বাধীনতার পর থেকে রাশিয়াপন্থী এবং পশ্চিমাপন্থী সরকারগুলির মধ্যে একরকম দোদুল্যমান অবস্থায় আছে – সেটা জানতে হবে। মলদোভা রোমানিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যবর্তী একটি ছোট দেশ যার জনসংখ্যা প্রায় ২.৬ মিলিয়ন। ইউক্রেনের মতো, এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অংশ ছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রাক্তন রোমানিয়ান-নিয়ন্ত্রিত বেসারাবিয়া অঞ্চল থেকে তৈরি হয়েছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে মলদোভা পূর্বে রাশিয়া এবং পশ্চিমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যদিও বেশিরভাগ মলদোভীয়রা পশ্চিমের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে সমর্থন করে, সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে যে মলদোভীয়দের ৬৩ শতাংশ ইইউতে যোগদানের পক্ষে ছিল। অন্যদিকে একটি ছোট সংখ্যালঘু অংশ, বিশেষত ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের জাতিগত রাশিয়ানরা রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পক্ষে। ট্রান্সনিস্ট্রিয়া বা রাশিয়াকে বিরক্ত করার ভয়ে অনেক মলদোভীয় রাতারাতি পশ্চিম এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের খুব কাছাকাছি যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক। এই কারণেই মলদোভীয় সরকারগুলি নিয়মিতভাবে উদারপন্থী ইউরোপপন্থী এবং বামপন্থী রাশিয়াপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলির (সাধারণত মলদোভীয় কমিউনিস্ট পার্টি এদের  প্রতিনিধিত্ব করে) মধ্যে দোদুল্যমান অবস্থায় ছিল ও সরকার বদলও এভাবেই ঘটেছে।

মলদোভার কমিউনিজমের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করে যে কেন তুলনামূলকভাবে রাশিয়াপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ব্যালট বাক্সে এত ভাল ফল করেছে, যদিও বেশিরভাগ মলদোভীয়রা পশ্চিমের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চায়। কমিউনিস্টরা ১৯৯৪ সালে মলদোভার প্রথম নির্বাচনে জয়ী হয়, এরপর ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে দ্য অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড রিফর্মস নামে পরিচিত একটি পশ্চিমাপন্থী জোট জয়ী হয়, পরে কমিউনিস্ট পিআরএম ২০০১ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসে, যা মলদোভাকে সোভিয়েত-পরবর্তী প্রথম এবং শেষ রাষ্ট্রে পরিণত করে যেখানে আনরিফর্মড কমিউনিস্টরাই ক্ষমতায় ফিরে আসে।

২০০৯ সালে, পিসিআরএম মূলত একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল, তবে মলদোভীয় সংসদের অ-কমিউনিস্টরা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রপতি প্রার্থীকে ভোট দিতে অস্বীকার করায় নির্বাচনটি দু’বার পুনরায় পরিচালনা বা রিরান করতে হয়েছিল। তৃতীয়বার, কমিউনিস্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং বিভিন্ন বিরোধী দল একটি জোট গঠনের চেষ্টা করেছিল। ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, বরং রাশিয়াপন্থী কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক এবং ছোট ছোট ইউরোপপন্থী দলগুলোর জোটের মধ্যে একটি ক্ষমতার ভারসাম্য কাজ করে।

২০২১ সালের সাম্প্রতিকতম নির্বাচনে এটি পরিবর্তিত হয়েছিল, যা মূলত বর্তমান রাষ্ট্রপতি মায়া সান্ডু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উদারপন্থী পিএএস পার্টি প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিল। তারা মলদোভার পিআর নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে ১০১ আসনের পার্লামেন্টে ৬৩ টি আসন জিতেছিল এবং নাতালিয়া গাভ্রিলিতা দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সাবেক কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভরিনিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিকদের ব্লক বা সংক্ষেপে বিসিএস পেয়েছে ২৭ শতাংশ ভোট ও ৩২টি আসন। অবশেষে, ইহুদি ব্যবসায়ী ইলান সাউল এর নেতৃত্বে পপুলিস্ট রাশিয়াপন্থী এসওআর পার্টি ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল এবং অন্য কোনও দল ৫% এর নির্বাচনী সীমা অতিক্রম করেনি।

যাইহোক, ২০১৪ সালের মলদোভান ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ভূমিকার জন্য ২০১৭ সালে সাউলকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, সেই কেলেঙ্কারির ফলে অনেকগুলো মলদোভীয় ব্যাংক থেকে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি উধাও হয়ে গিয়েছিল। সাউলকে সাড়ে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তিনি ইস্রায়েলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি পলাতক হিসাবে বাস করেন। সাউলের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাথে সরাসরি যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে এবং ওয়াশিংটন পোস্ট গত বছর রিপোর্ট করেছিল যে ক্রেমলিন তার দলকে সরকারের পতন করানোর জন্য সহায়তা করার জন্য তহবিল এবং কৌশলবিদ প্রেরণ করেছিল।

যাইহোক, এই অভূতপূর্ব জয় মলদোভাকে ইউরোপের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। মলদোভা এমনকি গত বছর ইউক্রেনের সাথে ইইউ সদস্যপদের জন্য একটি সরকারী প্রার্থী হয়ে ওঠে, যা গ্যাভ্রিলিতা সরকারের জন্য একটি যুগান্তকারী অর্জন ছিল।

মূলত, নতুন পিএএস সরকার ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত প্রথম কয়েক মাস বেশ অজনপ্রিয় ছিল। তারা নির্বাচনে তাদের বিরোধীদের চেয়ে স্থিতিশীল লিড বজায় রেখেছিল। যাইহোক, মুদ্রাস্ফীতির পরবর্তী উত্থান এবং তারপরে ইউক্রেনের যুদ্ধ দেশটিকে জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট বা লিভিং কস্ট ক্রাইসিসের দিকে ঠেলে দেয়, যা সরকারের জনপ্রিয়তার তীব্র হ্রাস ঘটায়।

পূর্বে, মলদোভা ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে যাওয়া রাশিয়া থেকে গ্যাস পাইপের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল ছিল, যা যুদ্ধের সময় ব্যাহত হয়েছিল। ঘাটতি প্রতিস্থানের জন্য, মলদোভাকে প্রায় তিনগুণ ব্যয়ে রোমানিয়া থেকে বিদ্যুৎ সুরক্ষিত করতে হয়েছিল। গত বছর মুদ্রাস্ফীতি ৩৪ শতাংশে পৌঁছেছে, খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে ৩৯ শতাংশ এবং নিয়মিত ব্ল্যাকআউট চলছেই।

এটি স্পষ্টতই একটি ভয়ানক খবর, তবে মলদোভা ইউরোপের দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে একটি হওয়ায় এর প্রভাব আরও খারাপ হয়েছে। মলদোভার মাথাপিছু জিডিপি মাত্র পাঁচ হাজার ডলার। জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশটির গড় মাসিক মজুরি ৪২০ ইউরো এবং জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে।

আশ্চর্যজনকভাবে, এটি ৬ই নভেম্বর দেশের রাজধানীতে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, ৫০,০০০ মানুষ প্রতিবাদ করতে আসে এবং সরকারের পদত্যাগ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানায়। ক্রেমলিনের সাথে সরাসরি সম্পর্ক এবং এমনকি এফএসবি থেকে সরাসরি তহবিল গ্রহণের অভিযোগে অভিযুক্ত ইলান সাউল এই প্রায় সাপ্তাহিক বিক্ষোভের প্রধান বিরোধী ব্যক্তিত্ব হিসাবে আবির্ভূত হন এবং ফলস্বরূপ নির্বাচনে উত্থান দেখা যায়।

শেষ পর্যন্ত, গ্যাভ্রলিতার মন্ত্রিসভার জন্য চাপটি খুব বেশি ছিল এবং ১০ই ফেব্রুয়ারী সরকার ভেঙে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট সান্ডু স্বাধীন ডরিন রেসিয়ানকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সান্ডু দাবি করেন, রাশিয়া বিদেশি নাশকতাকারীদের ব্যবহার করে তার সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছে।

প্রসঙ্গত, সরকারের পতনের ঠিক একদিন আগে জেলেনস্কি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বলেছিলেন যে তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলি “মলদোভাকে ধ্বংস” করার জন্য রাশিয়ান রাষ্ট্রের পরিকল্পনা উন্মোচন করেছে। মলদোভার গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে নিশ্চিত করেছে যে তারা আমাদের ইউক্রেনীয় অংশীদারদের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছে। ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় বসবাসরত ১৫০০ রুশ সৈন্য এবং বেসামরিক পোশাকে ডাইভার্সনিস্টদের সহায়তায়, এই পরিকল্পনাটি ছিল হিংস্রভাবে সরকারকে উৎখাত করা এবং সরকারী ভবনদখল করা।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এ মাসের শুরুতে মলদোভাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, তারা যদি আরেকটি ‘রাশিয়াবিরোধী প্রকল্পে’ পরিণত হয়, তাহলে তাদেরকেও ইউক্রেইনের মতো একই ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। সান্ডু মলদোভীয় পার্লামেন্টকে দেশটির গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির বিরুদ্ধে আরও কার্যকরভাবে লড়াই করার জন্য প্রয়োজনীয় উপায় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

যদিও এই প্রতিবেদনগুলিতে স্পষ্টভাবে কিছু সত্যতা রয়েছে, তবে এটি মনে রাখা উচিত যে মলদোভার রাজনৈতিক সংকটের প্রাথমিক কারণ হ’ল জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট বা লিভিং কস্ট ক্রাইসিস। তবুও, এটি গভীর উদ্বেগজনক, বিশেষত মলদোভায় ইতিমধ্যে থাকা রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার সাথে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে। পশ্চিমাদেরকে এই দেশটিকে এখন নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

 

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.