শরিয়াহ্‌ বা ইসলামী আইন ও মুসলিম আইন সম্প্রদায়সমূহ

ইসলামী আইন

ভূমিকা

গোটা ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন কোরানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামী আদর্শবাদ এবং এর সামাজিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতিমালা, বিধি-নিষেধ ও আইন-কানুনের মূল উৎস কোরান। কোরানের বাণীতে আল্লাহ মানুষকে যে আদর্শ আচরণবিধি উপহার দিয়েছেন, তাই শরিয়া বা শরিয়ত বা ইসলামী আইন বলে পরিচিত। ইসলাম মতে এই আইন মনে প্রাণে গ্রহণ করে এবং এর প্রতি অনুগত থেকেই মানুষ মুসলমান হতে পারে। যে ব্যক্তি শরিয়তের বিধি-নিষেধকে অবশ্য-কর্তব্য বলে গ্রহণ করে এবং সেই অনুসারে তার চিন্তা ও আচরণকে পরিচালিত করে, সেই মুসলমান। শরিয়তের সব বিধি-বিধান কারাে পক্ষে সর্বতােভাবে পালন করা সম্ভব নাও হতে পারে; কিন্তু তবু সে মুসলমান থেকে যাবে, যদি সে সেই আইনে আস্থাশীল ও বাধ্য থাকে। শরিয়ত এমনই একটি বিধান, যা স্থান-কাল-নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মুসলমানকে একটি উম্মা বা মানবসংঘে অন্তর্ভুক্ত করে। ইসলাম মতে শরিয়ত হলো একটি আইনব্যবস্থা যার গ্রহণ, অনুশীলন ও প্রয়ােগ মানুষকে ইহলােকিক ও পারলৌকিক শান্তি ও স্থিতির নিশ্চয়তা দেয়। 

শরিয়ত

আক্ষরিক অর্থ : ‘শরিয়া’ বা ‘শর’ শব্দটির মূল অর্থ জলের দিকে চালিত পথ, অর্থাৎ প্রাণের উৎস -নির্দেশক পথ। ‘শরা’ ক্রিয়াপদটি জলের দিকে চালিত, অর্থাৎ প্রাণরক্ষাকারী পথের সনাক্ত করাকে বােঝায়। এই আদি অর্থে শরিয়া বলতে বােঝানাে হয় ধর্মীয় মূল্যবােধের ভিত্তিস্বরূপ শুভজীবনের প্রশস্ত পথকে। এই পথ আল্লাহর পথ, এমন পথ সার্থক ও সুষ্ঠু মানববাচিত জীবনের জন্য যার অনুসরণ আবশ্যক। 

শরিয়ত বনাম তরিকত : এখানে শরিয়া কথাটার সঙ্গে তরিকা কথাটার তুলনা প্রাসঙ্গিক। উভয় শব্দই পথের নির্দেশক। কিন্তু শরিয়া বলতে বােঝায় কোরানে নির্দেশিত সেই বিধি-বিধানকে, যা সব মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ শরিয়া একটি ব্যাপক ও বাধ্যতামূলক পথকে বােঝায়। কিন্তু ‘তরিকা’ বলতে বােঝায় সেই আধ্যাত্মিক অনুশীলনাদির পথকে যা শুধু গভীর ধী ও জ্ঞানের অধিকারী সুফিসাধকরা অনুশীলন করেন। জীবনমাত্রই পথপরিক্রমাস্বরপ, যদিও কেউ নির্বাচন করেন শরিয়তের বিস্তৃত পথকে, আর কেউ অপেক্ষাকৃত সীমিত আধ্যাত্মিক ও অপরােক্ষ জ্ঞানের সেই পথকে যা তরিকত নামে পরিচিত। 

শরিয়তের পরিসর : শরিয়তকে আল্লাহর পথ বলা হয় কারণ তাতে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ বিধৃত থাকে। প্রত্যেক ধর্মে “ঐশী ইচ্ছা” বা ঈশ্বর নিজেকে কোনাে-না-কোনােভাবে অভিব্যক্ত করে, এবং সব ধর্মের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নির্দেশাবলির উৎপত্তিকে স্বর্গীয় হিসেবে ধরা হয়। ইসলামের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এর আইন কিছু সার্বিক নির্দেশের সমাহারই নয়, বরং বিশেষ অবস্থায় মানুষের বাস্তব পদক্ষেপেরও ইঙ্গিতবাহী। যেমন এখানে মানুষকে শুধু দয়াশীল, বিনয়ী ও নম্র হতেই বলা হয়নি, বরং জীবনের কোন কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে তা হতে হয়, তাও বলা হয়েছে। জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে আল্লাহর ইচ্ছা কীভাবে প্রযুক্ত হবে শরিয়া তার নির্দেশ বহন করে। সুন্নাহ বলতে যেমন মুহাম্মদ অনুসৃত আদর্শ জীবনাচরণকে বােঝায়, শরিয়া বলতে কিন্তু তেমন কারাে অনুসৃত জীবনাচরণকে না বুঝিয়ে আল্লাহ -নির্দেশিত জীবনাদর্শকে বোঝায়। শরিয়তকে একটি পূর্ণাঙ্গ ঐশী আইনব্যবস্থা বলে দাবি করা হয়, এবং বলা হয় এতে মানুষের গােটা জীবন এবং জীবনের সব কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশ রয়েছে। অর্থাৎ মানবজীবনের এমন কোনাে দিক বা বিষয় নেই যা শরিয়তের অন্তর্গত নয়।

এবাদত ও মুয়ামালাত : তবে মানবজীবনের বিভিন্ন দিক বিবেচনার জন্য শরিয়তেরও একাধিক দিক রয়েছে। কোনাে কোনাে পণ্ডিতব্যক্তি শরিয়তকে উপাসনাক্রিয়া (এবাদত) ও পার্থিব কাজকর্ম (মুয়ামালাত), এ দুটি শাখায় বিভক্ত করেছেন। এই গতানুগতিক বিবেচনা করতে গিয়ে কোনাে কোনাে আধুনিক চিন্তাবিদ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, শরিয়তের উল্লিখিত এবাদতের দিকটিকে যেখানে সংরক্ষিত বা অপরিবর্তিত রাখা হয় সেখানে দ্বিতীয় শাখাটিকে পরিবর্তন করা যায় সময়ের প্রয়ােজনে। তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে দুটি দিক সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। যেমন, জামাতে নামাজ পালন, রােজা রাখা প্রভৃতি উপাসনাক্রিয়ার অবশ্যই একটি সামাজিক পার্থিব দিক রয়েছে। কারণ, প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষভাবে গােটা সমাজই এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে হাট-বাজারে গিয়ে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে একজন মানুষ কীভাবে আচরণ করে, এই পার্থিব ক্রিয়াটিও সেই ব্যক্তির এবাদত বা প্রার্থনার গুণ ও মর্যাদাকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, মানুষের পার্থিব আচার-আচরণ ও পারস্পরিক সম্বন্ধকে আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করার কোনাে উপায় নেই। মানুষের ইহজাগতিক ও পারলৌকিক, পার্থিব ও ধর্মীয় দিক অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, এবং শরিয়তের লক্ষ্য হচ্ছে এ দুটি দিককে তার আওতাভুক্ত করে মানবজীবনের ঐক্য ও অখণ্ডতাকে সংরক্ষিত করা। শরিয়তের বিভিন্ন দিক এ লক্ষ্যে মানবজীবনের বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও সামাজিক দিককে সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে চায়।

শরিয়ত ও দ্বীন : এখানে শরিয়ত ও দ্বীন, এ দুটি শব্দের অর্থের পার্থক্য ব্যাখ্যা করা আবশ্যক। শরিয়ত বলতে যেখানে বােঝায় পথনির্দেশনাকে, সেখানে দ্বীন বলতে বােঝায় সেই পথের প্রতি আস্থা ও আনুগত্যকে। শরিয়ত আল্লাহ-নির্দেশিত পথ, আর দ্বীন সেই পথেরই অনুসরণ। তবে পথ এবং সেই পথের অনুসরণ যেহেতু শেষ বিশ্লেষণে পরস্পরবিছিন্ন নয়, সেকারণে শরিয়ত ও দ্বীনকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এদের উভয়েরই প্রতিপাদ্য ও লক্ষ্যবস্তু ধর্ম, আর এজন্যই এদের উভয়কেই অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত বলে ধরে নেয়া যায়। 

ব্যবহারিক ধারণা : তবে শরিয়ত কোনাে নিছক তাত্ত্বিক শব্দ নয়, বরং একটি পুরােদস্তুর ব্যবহারিক ধারণা, কারণ তা মানুষের আচরণের সঙ্গে যুক্ত। এ আচরণ দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক, এ সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। একই কারণে তা বিশ্বাস ও অনুশীলন – উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। নামাজ রােজা প্রভৃতির অনুশীলন যেমন ধর্মীয় কর্তব্য, তেমনি আল্লাহয় বিশ্বাস এবং তার নির্দেশ মােতাবেক কাজ করাও শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত। সেই সাথে, যাবতীয় ব্যক্তিগত আচার, ব্যবহার তথা সব আইনবিষয়ক ও সামাজিক আদান-প্রদান শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত। মােট কথা, শরিয়ত এমন একটি ব্যাপক নীতি যাকে যথার্থই অভিহিত করা যায় একটি সর্বাত্মক জীবনপদ্ধতি বলে। 

শরিয়তের বিকাশধারা

ইল্‌ম ও ফিক্‌হ : মুহাম্মদের তিরােধানের পরবর্তী প্রথম কিছুকাল ধরে শুধু কোরান ও সুন্নাহকে শরিয়তের উৎস হিসেবে স্বীকার করা হতাে। কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভবের ফলে কোরান ও সুন্নাহ-নির্দেশিত সমাধান যখন আর পর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হলাে না, তখন এ দুই আদি ও মৌল উপকরণের সঙ্গে জ্ঞান বা শিক্ষা (ইল্‌ম) এবং বােধ বা উপলব্ধি (ফিক্‌হ) – এ দুটি নতুন নীতি যুক্ত হলাে। সাধারণত ইল্‌ম বলতে কোরান ও হাদিসের সঙ্গে পরিচিতিকে এবং ফিক্‌হ বলতে কোরান ও হাদিসের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন এবং তা থেকে নতুন সিদ্ধান্ত নিঃসৃত করার ক্ষমতাকে বােঝায়। এ অর্থে ফিক্হ শব্দটি রায় বা সুচিন্তিত অভিমতের সমার্থক। এ থেকে ইল্‌ম বা ফিক্‌হ, এ দুয়ের আরেকটি পার্থক্য স্পষ্ট হয়। ইল্‌ম বলতে কোনােকিছুর সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়া, আর ফিক্‌হ বলতে কোনােকিছু সম্পর্কে কারাে ব্যক্তিগত অভিমত বা আত্মগত বিবেচনাকে বােঝায়। প্রথমটিকে বলা হয় বস্তুগত (objective), আর দ্বিতীয়টিকে বলা হয় আত্মগত (subjective)। অর্থাৎ ইল্‌ম বলতে এমন একটি জ্ঞানপ্রক্রিয়াকে বােঝায় যা কিছু বস্তুনিষ্ঠ ও সুশৃঙ্খল উপাত্তকে নির্দেশ করে, অন্যদিকে ফিক্‌হ কোনাে নির্দিষ্ট শৃঙখল বা বস্তুনিষ্ঠ সিস্টেমকে নির্দেশ না করে কোনােকিছুকে বােঝার উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত কর্মপ্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে। 

ফিক্‌হ এর অর্থের পরিবর্তন : এই হলাে ইল্‌ম ও ফিক্‌হ কথার আদি অর্থ, কিন্তু চিন্তা ও আলােচনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিষয়াদির ক্রমবর্ধমান প্রাধান্যের সঙ্গে ফিক্‌হ কথাটির অর্থ ক্রমশ সীমিত হয়ে যায়। এই পরিবর্তিত ও সংশােধিত অর্থে ফিক্‌হ ধর্মীয় বিশ্বাস ও কর্ম, আইন ও আচরণ, এক কথায় ধর্মীয় চিন্তার গােটা পরিমণ্ডলকে নির্দেশ করে। এজন্যই দেখা যায়, হানাফি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা (মৃ. ৭৬৭) রচিত বৃহত্তর ফিক্‌হ নামক গ্রন্থটি সর্বতােভাবে ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নাবলির আলােচনায় সীমিত। ইসলামী আইনের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে, বিশেষত কোরান ও সুন্নাহ ব্যাখ্যার সহায়ক নীতি হিসেবে, ইজমা ও ইজতেহাদের প্রচলনের ফলে ফিক্‌হ-এর স্বরূপ ও পরিসর সম্পর্কে আরাে নতুন ধারণার সৃষ্টি হয়। এ পর্যায়ে ফিক্‌হ ব্যক্তিগত ক্রিয়পরতার পর্যায়ে সীমিত না থেকে একটি কাঠামােবদ্ধ শৃঙ্খলা এবং সেই শৃঙখলাপ্রসূত জ্ঞানব্যবস্থায় বিস্তৃত হয়ে যায়। এই জ্ঞানব্যবস্থা তখন একটি বস্তুগত শৃঙ্খলা হিসেবে সংহতি ও সুস্থিতি লাভ করে। আর এই পর্যায়েই ফিক্‌হ তার প্রারম্ভিক অভিমতের ব্যক্তিগত পর্যায় পেরিয়ে ইল্‌ম বা জ্ঞানের বৃহত্তর পর্যায়ে উত্তরণলাভ করে। আদি অর্থে যেখানে বলা হতো, ‘প্রত্যেকের উচিত ফিক্‌হ ব্যবহার করা’, সেখানে এখন নতুন অর্থে বলা শুরু হলাে, ‘প্রত্যেকের উচিত ফিক্‌হ জানা ও অধ্যয়ন করা’। স্পষ্টতই আদি অর্থ বিস্তৃত হয়ে ফিক্‌হ এখানে জ্ঞানের বিষয়ে পরিণত হয়। এর পরও এ ধারণাটির আরাে এক ধাপ বিকাশ ঘটে, এর অর্থ আরাে সঙ্কুচিত হয়, আর তখন তা ইসলামী আইন ও আইনবিজ্ঞানকে (jurisprudence) নির্দেশ করা শুরু করল। এই পর্যায়ে ফিক্‌হ আইনবিজ্ঞানের সমার্থক হয়ে যায়। অর্থাৎ, একসময় যে ফিক্‌হ ছিল কোরান ও সুন্নার জ্ঞানকে অনুধাবন করে সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার সাবজেক্টিভিটি, সেখানে পরবর্তীতে সেই সাবজেক্টিভিটির সমস্ত অপশন বন্ধ হয়ে এটি একটি কাঠামোবদ্ধ, বিধিবদ্ধ, বেঁধে দেয়া একগুচ্ছ আইন ও আইনব্যবস্থায় পরিণত হয়।

কোরানের সীমাবদ্ধতা : মুসলমানদের কাছে শরিয়ত একটি শাশ্বত স্বর্গীয় আইন। এই আইন কীভাবে লিপিবদ্ধ ও সবিস্তারে সংবদ্ধ করা হলাে, এ প্রশ্ন সবসময়ই কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে শরিয়ত যে আকারে কাছে তা একদিনে তৈরি হয়নি, ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। পণ্ডিতদের মতে, ক্রমবিকাশের মাধ্যমে শরিয়তের বর্তমান লিপিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করাটা শরিয়তের আইনের স্বর্গীয় গুরুত্বকে খাটো করে না, কারণ এর সারভাগ বা নির্যাস কোরান থেকেই প্রাপ্ত। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, আইনের নীতি বিষয়ে কোরানে শুধু ইঙ্গিত করা হয়েছে, বিস্তৃত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়া হয়নি। গতিশীল জীবনের নতুন নতুন সমস্যার সমাধান স্পষ্ট করে কোরানে ব্যাখ্যা করা হয়নি (অনেকের মতে তা আশা করাও ঠিক নয়)। কোরানের প্রায় আশিটি আয়াতে আইনের বিশেষ বিশেষ দিকের কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন, বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার বিষয়ে পরিষ্কার বিধি রয়েছে, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে শুধু অস্পষ্ট ইঙ্গিতই রয়েছে। এসব ইঙ্গিতকে ব্যাখ্যা না করে মানবাচরণের বিধি হিসেবে প্রয়ােগ করা যায় না। 

হাদিস ও সুন্নাহ্‌ এর গুরুত্ব : পণ্ডিতদের মতে, নবুয়তপ্রাপ্তি থেকে পরলােকগমন পর্যন্ত তেইশ বছরের জীবনে মুহাম্মদ নিষ্ঠার সাথে এ ধরনের ব্যাখ্যা করেছেন। তাই তার দেয়া সিদ্ধান্ত ও আচরণবিধি, অর্থাৎ হাদিস ও সুন্নাহ শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ইসলামের নীতিমালা তিনি কিভাবে প্রয়ােগ করেছেন তাই ছিল মানবসমাজে শরিয়ত প্রয়ােগের প্রথম পর্ব। মদিনার জনগণের বেলায় এটা বিশেষভাবে সত্য, কারণ ওখানেই মুহাম্মদ পর্ববর্তী সব সংকীর্ণ গােত্রীয় বন্ধনকে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন এবং এর স্থলে নতুনভাবে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরিবর্তনশীল জীবনের নতুন কোনাে সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান না পেলেই কৌতূহলী মুসলমানরা মুহাম্মদের শরণাপন্ন হতেন এবং তার কাছ থেকে সমাধান নিয়ে আসতেন। কখনাে কখনাে অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হলে সঠিক ও সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তের জন্য মুহাম্মদ তার সাহাবা বা সহচরদের সাথে পরামর্শ করতেন। আবার কখনাে কখনাে কেউ কেউ তার দেয়া সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পােষণ করতেন বলে জানা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার সিদ্ধান্তই ছিল কোরানের পর ইসলামী আইনের দ্বিতীয় অকাট্য উৎস ও ভিত্তি। অর্থাৎ কোরানের পর মুহাম্মদের হাদিস ও সুন্নাহই ইসলামী আইনের উৎস, মুহাম্মদের জীবনধারার সর্বতােমুখী ও পূর্ণাঙ্গ বিবরণপঞ্জি, তার নবী-জীবনের সব কর্মের, আলাপ-আলােচনার, উৎসাহের ও বিরক্তির, অনুমােদনের ও অননুমােদনের লিপিবদ্ধ বিবরণ; অর্থাৎ হাদিস ও সুন্নাহই ইসলামী আইনের ভিত্তিতে পরিণত হয়। উল্লেখ্য, হাদিস বলতে মুহাম্মদের বাণী এবং সুন্নাহ বলতে তার কর্ম ও আচরণকে বােঝা হয়। তবে সামগ্রিকভাবে সুন্নাহ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ অর্থে মুহাম্মদ তার নবুয়তপ্রাপ্ত জীবনে যা বলেছেন, যা করেছেন এবং অপরের যেসব অভিমত ও আচরণে অনুমােদন করেছেন – এ সবই তার হাদিস ও সুন্নাহর অন্তর্গত। ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে হাদিস ও সুন্নাহর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, মুহাম্মদের দেয়া ব্যাখ্যা ও ভাষ্যের মাধ্যমেই সেদিনের মুসলমানদের কাছে কোরানের বাণী স্পষ্ট হয়েছে। এদিক থেকে হাদিস কোরানবহির্ভূত নতুন কিছু নয়, বরং তারই ভাষ্য ও বিশ্লেষণ। কোরানে যেসব বিষয়ের শুধু ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, যেগুলাে থেকে সরাসরি বিস্তৃত আচরণের নির্দেশ পাওয়া অসম্ভব, সেগুলােকেই হাদিসে স্পষ্ট ও সম্প্রসারিত করা হয়েছে। যেমন, কোরানে কেবল নামাজ পড়া ও জাকাত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে এ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করা যাবে, সে বিষয়ে বিস্তৃত বিধিমালার প্রয়ােজন ছিল, আর মুহাম্মদের কর্মে ও বাণীতে তাই করা হয়েছে। এজন্যই কোরান যেমন ইসলামী জীবনব্যবস্থার একটি উৎস বলে গৃহীত, তেমনি মুহাম্মদের হাদিস ও সুন্নাহ ইসলামী আইনের অপর একটি উৎস হিসেবে গৃহীত, তাই কোরানের মত হাদিসও তেমনি মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক। 

খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে ক্বারি ও মুফতির মাধ্যমে আইনব্যবস্থার বিকাশ : মুহাম্মদের পর প্রথম খােলাফায়ে রাশেদিনের আমল সূচিত হয়। এ সময়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের নতুন নতুন পরিস্থিতিতে কোরানের শিক্ষা এবং মুহাম্মদ-স্থাপিত দৃষ্টান্ত প্রযুক্ত হয়। আইনের সঠিক সহজ ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য স্বয়ং মুহাম্মদ উপযুক্ত শিক্ষক ও ক্বারি নিয়ােগের ব্যবস্থা করেছিলেন বলে জানা যায়। কোরানের সঠিক আবৃত্তি ও ভাষ্যপ্রদান, সাপ্তাহিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ভাষণদান এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সরকারি দায়িত্বপালন ছিল ক্বারিদের কাজ। ক্বারিদের কেউ কেউ কোরানপাঠ ও অনুশীলনে সর্বতােভাবে নিয়ােজিত থাকতেন, অতি সহজ অনাড়ম্বর জীবন পালন করতেন। মহৎ আচরণের অধিকারী এসব ব্যক্তি ওলামা (আলেম কথার বহুবচন) বলে সমাজে স্বীকৃতি ও সম্মান লাভ করেন। এদের থেকেই কেউ কেউ মুফতি হিসেবে মনােনীত হলেন। মুহাম্মদ-প্রবতিত এই রীতি খােলাফায়ে রাশেদিন আমলেও অনুসৃত হয় এবং কোরানের সঠিক আবৃত্তি, নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানসংক্রান্ত বিধি কার্যকর করার জন্য প্রাদেশিক প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়। ইসলামের ক্রমবিস্তারের সঙ্গে যখন নতুন নতুন দেশ ও এলাকা মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে, তখন খলিফা ওমর সেসব অঞ্চলে বিচারের ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিয়ে কাজি ও ক্বারি পাঠান। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের রীতি-নীতি ও প্রথা-প্রচলন ভিন্ন ছিল বলে, ধর্মীয় আইন প্রয়ােগের আঞ্চলিক প্রথা-প্রচলনের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হত। এভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যের সর্বত্র উত্তরাধিকার, তালাক, বিবাহ, অপরাধ-দমন প্রভৃতি বিভিন্ন আইন চালু করা হয়। এসব ব্যবস্থাগ্রহণের মধ্য দিয়েই ইসলামী আইনব্যবস্থা ক্রমশ বিকাশ লাভ করতে থাকে। 

নতুন প্রশ্নের উত্থান, বিতর্ক ও বিভিন্ন রীতি-নিয়মের সূচনা : এসব সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও প্রায় এক দশক ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে অনুসৃত আইনবিষয়ক সিদ্ধান্ত নিয়ে নানারকম মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। স্থানে স্থানে কোরানে উল্লেখ নেই এবং মুহাম্মদের জীবনে ঘটেনি, এমন অনেক নতুন নতুন ঘটনা ঘটতে থাকে, এবং আগে দেখা দেয়নি এমনসব নতুন প্রশ্ন দেখা দিতে শুরু করে। সাংবিধানিক প্রশ্ন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা এবং ধর্মীয় মতাবলি, বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনকেন্দ্রিক রীতি-নিয়ম চালু হতে থাকে, এবং এগুলাে প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষভাবে মুসলিম আইনের উপকরণ ও কাঠামােকে প্রভাবিত করে।

ইজমা ও কিয়াস : কোরান ও হাদিসের মূল শিক্ষার আলােকে ইসলামী আইনকে বিস্তৃত ও বিকশিত করার লক্ষ্যে আরাে কিছু সহায়ক নীতি অনুসত হয়েছে। এসব নীতির মধ্যে কিয়াস ও ইজমা প্রধান। প্রচলিত রক্ষণশীল মতে, কোরান ও হাদিসের পর কিয়াস ও ইজমা শরিয়তের অন্য দুটি প্রধান উৎস। তবে কোরান ও হাদিস সব সম্প্রদায়ের কাছে আইনের উৎস বলে স্বীকৃত হলেও কিয়াস ও ইজমার বৈধতা ও গুরুত্ব নিয়ে কোনো কোনাে মহলে বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। 

কিয়াস

মূল অর্থ ও অর্থের পরিবর্তন : কিয়াস বলতে সাদৃশ্যানুমানিক (analogical) যুক্তিকে বােঝায়। এই নীতি অনুসারে, কোনাে একটি নির্দিষ্ট নীতি যদি পূর্ববর্তী কোনাে ঘটনায় প্রযুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে সেই একই নীতি পরবর্তী কোনাে নতুন সদৃশ ঘটনার বেলায়ও প্রযােজ্য। মুহাম্মদের সহচর এবং তাদের শিষ্য ও প্রশিষ্যদের কাছে যখনই কোনাে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে, তখনই তারা যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন এবং কোরান ও হাদিসে মীমাংসিত সদৃশ ঘটনার আলােকে সেসব সমস্যার যৌক্তিক সমাধানের চেষ্টা করেছেন, যেমন, ইসলামের সূচনালগ্নে আঙুরের মদ প্রচলিত ছিল, কিন্তু এর মাদকতা মানুষের পক্ষে অনিষ্টকর বলে কোরানে সেই মদকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে। আঙুরের মদ ও মাদকতার এই কোরানীয় যুক্তি সম্প্রসারিত করেই পরবর্তীকালের মুজতাহিদরা সবরকম মদ্যপানকে নিষিদ্ধ বলে ঘােষণা করেন। (মুজতাহিদ বলতে এমন ব্যক্তিকে বােঝায় যিনি কোরান ও হাদিসের মূলনীতির আওতায় যেকোনাে জটিল প্রশ্নের উত্তরানুসন্ধানে তার বিচারবুদ্ধির সযত্ন ও সনিষ্ঠ প্রয়ােগ করেন।) এভাবে নতুন সমস্যার সমাধানে কোরান ও হাদিসের মৌল নীতির যৌক্তিক সম্প্রসারণ ও বাস্তব প্রয়ােগই কিয়াস। পরবর্তীকালের কিয়াস কথাটাকে সহানুমানিক যুক্তি (syllogism) প্রয়ােগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এ অর্থে কথাটা সুস্পষ্টভাবে জ্ঞাত অবস্থা থেকে অজ্ঞাত পরিস্থিতিতে চিন্তার অগ্রগমনকে বুঝিয়ে থাকে।

আদিতম রূপ হলো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা সুচিন্তিত ব্যক্তিগত অভিমত এবং তা নিয়ে মতভেদ : কিয়াসের উদ্ভবে হয়তাে বা কোনাে বিজাতীয় উৎস খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মুসলিম ধর্মতত্ত্বে এর একটি নিজস্ব সুসংবদ্ধ বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই সাদৃশ্যানুমানিক যুক্তি প্রয়ােগের আদিতম রূপটিকে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা সুচিন্তিত ব্যক্তিগত অভিমত (রায়) বলে অভিহিত করা হয়। এ পর্যায়ে ব্যক্তিগত অভিমতের ওপর যেহেতু সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরােপ করা হতাে, সেকারণেই ধর্মীয় ও আইনগত ব্যাপারাদি নিয়ে বিভিন্ন আইনজ্ঞ ও ধর্মবেত্তার মধ্যে প্রচুর মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। তবে এই ব্যক্তিগত বিভিন্নতা সত্ত্বেও প্রথম থেকে একটি অভিন্ন পদ্ধতিকে হয়তােবা অবচেতনভাবেই অনুসরণ করা হতাে। ঐ সময় এমন কোনাে নতুন বা জটিল প্রশ্ন যদি দেখা দিত, যার সুস্পষ্ট সদুত্তর কোরান ও সুন্নাহ্‌য় নেই, তাহলে কোরানের কোনাে বাণী কিংবা সুন্নাহ থেকে কোনাে একটি দৃষ্টান্ত নিয়ে তার আলােকে সেই নতুন জটিল প্রশ্নের সুরাহা করা হতাে। তবে কোরান বা হাদিসের যে দৃষ্টান্ত বা নীতির আলােকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হত, তার সঙ্গে যেমন নতুন ঘটনার সাদৃশ্য নিয়ে মতবিরােধ দেখা দিত, তেমনি সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া নিয়েও মতবিরােধ দেখা দিত এবং কিয়াসের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তকে কোনাে কোনাে সময় যথেচ্ছ বলে সমালােচনা করা হতাে। এভাবে বেশ কয়েক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত অভিমতের যথার্থতা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং ৮ম শতকের প্রথমার্ধে মদিনা ও ইরাকে আরাে সুসংবদ্ধ চিন্তার উদ্ভব ঘটে।

কিয়াসপদ্ধতির বিলোপসাধন ও ইজমার বিকাশে গুরুত্ব : মদিনায় মালেক (মৃ. ৭৯৫) রায় কথাটিকে ব্যবহার করলেও এর প্রয়ােগপদ্ধতিতে যথেষ্ট সুসংবদ্ধতা সংযােজিত করেন। এ সময় অবশ্য মদিনার একাধিক পণ্ডিতব্যক্তির ঐকমত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ইজমা নীতিও চালু হয়ে যায়। কিন্তু ইরাকে ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী চিন্তার অনুসারী বলে পরিচিত আবু হানিফা ও তার অনুসারীরা সিদ্ধান্ত নেয়ার নতুন ক্ষেত্রে যেকোনাে বিশেষ ঘটনাকে একটি নীতি বা ক্যাটেগরিতে স্থাপনের চেষ্টা শুরু করেন। একই সঙ্গে ইজতেহাদ বা স্বাধীন সুসংবদ্ধ মৌলিক চিন্তা (যা ৮ম শতকের দিকে প্রথম শুরু হয়) একটি শক্তিশালী নীতিতে পরিণত হয়। এবং ৮ম শতকের শেষ ও ৯ম শতকের দিকে তা সম্পূর্ণরূপে কিয়াসপদ্ধতির বিলােপ ঘটায়। রায় হিসেবে কিয়াসনীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ৮ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। পরবর্তীকালে ৯ম শতকে দাউদ (মৃ: ৮৮২)-এর নেতৃত্বে আক্ষরিকবাদী (জাহেরি) নামে পরিচিত একটি ক্ষুদ্র আইন সম্প্রদায় এ নীতি প্রত্যাখ্যান করেন। সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে যে, আইনের উৎস বিষয়ে প্রথম লেখক আস সাদি (মু. ৮১৯) কিয়াসকে নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু তিনি যে ভঙ্গিমায় এ শব্দটির ব্যবহার করেন তা থেকে মনে হয়, আগে থেকেই তা চালু ছিল। যাই হােক, ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপের কারণে কিয়াস যতই সমালােচনার সম্মুখীন হয়ে থাক না কেন, তা অনেক বিশেষজ্ঞের ঐকমত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত অপেক্ষাকৃত উন্নত নীতি ইজমার বিকাশের পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক ছিল। 

ইজমা

আক্ষরিক অর্থ : ইজমা শব্দের আক্ষরিক অর্থ মতের ঐক্য বা ঐকমত্য। এ অর্থে কোনাে বিতর্কিত বিষয়ে শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তই ইজমা। মুসলিম আইনবেত্তাদের মতে, কোনাে জটিল প্রশ্নের সদুত্তর অনুসন্ধানের মুজতাহিদদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তই ইজমা। এ নীতি অনুসারে সেসব বিশ্বাস ও আচরণই বৈধ যেগুলাে বিদ্বৎসমাজ, বিশেষত আলেমদের স্বীকৃতি ও অনুমােদন লাভ করে। যেসব সিদ্ধান্ত জনমতের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, সেগুলো নিছক ব্যক্তিগত অভিমতের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেগুলাে ইজমাপরিপন্থী, এবং সেকারণেই আইনগত দিক থেকে অগ্রাহ্য।

ইজমার বৈধতার পক্ষে যুক্তি : প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে ইসলামী আইন ঐশী নির্দেশ ও অনুমােদনের ওপর প্রতিষ্ঠিত, এবং সেখানে কোরান ও হাদিসের বাইরে যুক্তিবিচার বা মানবীয় ঐকমত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্ত (ইজমা) কি ইসলামী আইন বলে গৃহীত হতে পারে? উত্তরে পণ্ডিতগণ বলেন, ইজমা কোরান ও হাদিসের বিরােধী নয়, বরং এদেরই ব্যাখ্যা ও সম্প্রসারণমূলক পরিপূরক নীতি, এমন নীতি কোরান ও হাদিসে যার স্বীকৃতি রয়েছে। সব জিনিসকে চিন্তাভাবনা করে উপলব্ধি করার জন্য কোরানে মানুষকে বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। যে মানুষ চিন্তা করে না, যারা অলসভাবাপন্ন কোরানীয় মতে তারা যথার্থ মনুষ্য পদবাচ্য নয়। ‘তােমরা কি চিন্তা কর না? তােমাদের কি জ্ঞান নেই?’ – মানুষকে লক্ষ্য করে কোরানে আল্লাহকে এমন আরাে অনেক প্রশ্ন করতে দেখা যায়, যেগুলো ইজমার বৈধতা বিষয়ে কোরানের ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে।

সুন্নাহ্‌ ও ইজমার পার্থক্য : সুশৃঙ্খল যুক্তিপ্রয়ােগ-প্রক্রিয়া হিসেবে কিয়াস ইজমার প্রস্তুতিপর্বস্বরূপ, এবং আদি সম্প্রদায়গুলােও একে এভাবেই দেখত। কিন্তু তারা একদিকে সুন্নাহ ও অন্যদিকে ইজমার মধ্যে গুণগত পার্থক্যও করে থাকত। এজন্যই সুন্নাহ ও ইজমাকে একই পর্যায়ভুক্ত করা যায় না। সুন্নাহ বলতে বােঝায় মুহাম্মদের বাণীসমূহকে, এবং তার সহচরদের অনুসত নীতিকে ব্যাপক অর্থে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয় এজন্য যে, তাদের মাধ্যমেই মুহাম্মদের বাণী প্রচার লাভ করে। ইজমার সূত্রপাত ঘটে মুহাম্মদের সহচরদের থেকে এবং তা বিস্তৃত হয় পরবর্তী অনেক প্রজন্ম পর্যন্ত।

ইজমার মাধ্যমে কোরান ও সুন্নাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা : আদি আইন সম্প্রদায়সমূহের প্রতিনিধিরা ইজমা নীতিকে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী এবং প্রতিটি ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে স্বীকৃতি দেন। বস্তুত, ইজমাকে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল শুধু বর্তমান ও ভবিষ্যতের সত্য আবিষ্কারের বাহন হিসেবেই নয়, বরং অতীতের বিষয়াদির ব্যাপারে সিদ্ধান্তের বাহন হিসেবেও। এ মতে, ইজমার মাধ্যমেই মুহাম্মদের হাদিসকে যথার্থভাবে চিহ্নিত করা এবং কোরানকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তাই বলা যায় যে, ইজমার মাধ্যমেই কোরান ও সুন্নাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছিল। পণ্ডিতদের মতে, অতীতের ব্যাপারাদি বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া এবং ভবিষ্যতে সঠিক পথের সন্ধান আবিষ্কার করার প্রচেষ্টাতেই ইজমার নির্যাস নিহিত। এ নীতি ভ্রান্তি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার এবং সুনিশ্চিতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি প্রমাণিক উপায়স্বরূপ। 

ইজতেহাদ

আক্ষরিক অর্থ : ইসলামী আইনের অপর এক সম্পূরক সহায়ক নীতি ইজতেহাদ নামে পরিচিত। এ নীতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কোনাে নীতি নয়, বরং ইজমার পরিপূরক। এর আক্ষরিক অর্থ বুদ্ধির প্রয়ােগ তথা আপন সত্তাকে কাজে লাগানাে। অর্থাৎ মুক্তবুদ্ধি বা স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং কোরান ও হাদিসের মূলনীতিমালার আলােকে ধর্মীয় সমস্যাবলিসহ জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান এ নীতির লক্ষ্য। ইসলামে এর অনুমােদন সেই প্রথম থেকে; আর খ্রিস্টানরা এর ব্যবহার করে ১৬শ শতকে রক্ষণশীল ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে মার্টিন লুথারের সবিচার আন্দোলনের সমর্থন দ্বারা।

ইজমা নিয়ে রক্ষণশীল ও উদারপন্থীদের মতভেদ : যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা সমস্যা সমাধানের জন্য কোরানে, বিশেষত হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এসব নির্দেশে কোনাে কালের উল্লেখ নেই। এ থেকে বােঝা যায় যে, যুক্তির আলােকে সমস্যা সমাধান সর্বকালের সব মুসলমানের বেলায়ই প্রযােজ্য। মুহাম্মদের সাহাবা এবং তাদের শিষ্য বা প্রশিষ্যগণ বরাবর ইজতেহাদ প্রয়ােগ করেন। অবশ্য ধর্মীয় সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিগত যুক্তিবিচার প্রয়ােগের এ অধিকারকে সব মহলের মুসলমানরা একই অর্থে নেয়নি। রক্ষণশীল মহল এক সঙ্কুচিত অর্থে এ নীতি গ্রহণ করে। এ অর্থে ইজতেহাদ শুধু তখনই অনুমােদনযােগ্য হয় যখন তা ইজমার অনুমােদন লাভ করে। এ সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল মুসলমানদের ধারণা তুলনামূলক উদার, তারা মনে করেন, ইজতেহাদের সঠিক প্রয়ােগ দ্বারা অতীতের যেকোনাে প্রতিষ্ঠিত নীতির খণ্ডন বা প্রত্যাখ্যান সম্ভব। এ অর্থে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য যা কল্যাণকর বলে প্রমাণিত হয়, তাই গ্রহণযােগ্য ও বৈধ।

ইজতিহাদের গুরুত্ব : ধর্মবেত্তারা ইজতেহাদকে ইসলামের প্রাণশক্তি বলে অভিহিত করেছেন। ইসলামে এই নীতির অনুমােদন ছিল বলেই ‘অজ্ঞতার যুগে’ মুসলমানদের পক্ষে জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভাবিত অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হয়েছিল। তাতে করেই তারা কোরান ও হাদিস থেকে যুগে যুগে এবং অবস্থা বিচারে সঠিক পথের সন্ধান লাভ করতে পেরেছিল। পণ্ডিতদের মতে, পরিবর্তনশীল আধুনিক পৃথিবীতে ইসলামের সেই গতিশীলতাকে চালু এবং ইসলামের সজীব প্রাণবন্ততাকে অক্ষুন্ন রাখতে হলে ইজতেহাদের আশ্রয় নিতে হবে, মনে রাখতে হবে, পরিবেশের পরিবর্তন এবং বিবর্তন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার প্রয়ােজনেই ধর্মকে যুক্তির আলােকে দেখতে হয়, অতীতের সব ভুল-ত্রুটি সংশােধনও করতে হয়। আর তা করতে গেলেই ইজতেহাদের প্রয়ােগ ও অনুশীলন আবশ্যক হয়। এই যুক্তিতেই শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি সকল যুগের জন্য ইজতেহাদকে অনিবার্য বলে মনে করেন। তার মতে, অতীতের মুজতাহিদদের দেয়া সিদ্ধান্ত যে আজও কার্যকর হবে, এমন কোনাে কথা নেই। বস্তুত, ইসলামী আইনের বিকাশের মূলে এ ধারণাই ছিল কার্যকর। মানব সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে মানবজীবনের সব সমস্যার সমাধানের প্রয়ােজনে মুসলমানরা ইজতেহাদ প্রয়ােগ করেছে এবং ভবিষ্যতেও প্রয়ােগ করবে। তবে পণ্ডিতগণ এও বলেন, আজকের দিনে ইজতেহাদকে অতীত যুগের মুজতাহিদদের লিপিবদ্ধ নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হলে চলবে না। যারা আজ ইজতেহাদ প্রয়ােগ করবেন তারা অতীতকে উদারতার সঙ্গে বিবেচনা করবেন এবং বর্তমান সমস্যার বিচারে সময়ােপযােগী সিদ্ধান্ত নেবেন। যারা কোরান-হাদিসে সুপণ্ডিত এবং চারিত্রিক মাধুর্য ও মহৎ গুণাবলিমণ্ডিত, শুধু তাদের কাছ থেকেই একদিকে ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং অন্যদিকে যুক্তির কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত সঠিক যৌক্তিক সমাধান আশা করা যায়। 

মূল্যায়ন

মুসলিম আইনের উৎস হিসেবে কিয়াস ও ইজমার বিকাশ : মুসলিম আইন বিকাশের এই সংক্ষিপ্ত আলােচনা থেকে এটুকু স্পষ্ট যে, আইনের উৎস হিসেবে একমাত্র কোরানই তার স্বাতন্ত্র্য অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া সুন্নাহ, কিয়াস ও ইজমা এ তিনটি নীতি ক্রমশ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। একথা ঠিক যে, সুন্নাহ ও ইজমা মূলত স্বতন্ত্র, কিন্তু এগুলাের একটি অপরটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। আর কিয়াস তাদের মধ্যকার সেতুবন্ধস্বরূপ। সুসংবদ্ধ যুক্তিপ্রয়ােগ নীতি হিসেবে কিয়াস শুধু মুহাম্মদের সুন্নাহকেই আইনে রূপায়িত করেনি, একই সঙ্গে নতুন সামাজিক ও প্রশাসনিক অনুষ্ঠানাদি ও অনুশীলনগুলোকে সুন্নাহর সঙ্গে প্রাণবন্ত মুসলিম রীতি হিসেবে সমন্বিত করেছিল। এভাবেই কিয়াস সুন্নাহর অভ্যন্তরে নিজের স্থান করে নিয়েছিল। অন্যদিকে আবার বিরােধ, অপােস ও খাপ খাওয়ানাের প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে অর্জিত কিয়াস সিদ্ধান্ত তার চেয়েও অধিকতর সিদ্ধান্তমূলক ও কর্তৃত্বমূলক ইজমার পথ সুগম করে দিয়েছিল।

মুতাযিলাদের মতে নীতিবােধ আইনের অধীন নয়, বরং স্বাধীন বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত : আদি ইসলামে ফিক্হ ও ইল্‌মকে সম্পূরক বলে মনে করা হতাে এবং তখন প্রজ্ঞা ও প্রত্যাদেশ কিংবা প্রজ্ঞা ও শরিয়তের মধ্যে পার্থক্য করা হতাে না। কিন্তু খ্রিস্টীয় ৮ম ও ৯ম শতকের দিকে মুতাযিলা বুদ্ধিজীবীরা প্রজ্ঞা (আকল) ও প্রাধিকার (সাম) বা শরিয়তের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। ইতিমধ্যে ইজমার মাধ্যমে আইন এবং আইন প্রণয়নের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তখন থেকে আইন পরিণত হয়ে যায় প্রাধিকার (authority) কিংবা প্রথার অংশে। মুতাযিলারা প্রচলিত আইনের কাঠামােকে এবং আইনের অন্তর্ভুক্ত নৈতিক নিয়মাবলিকে নির্বিচারে মেনে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাদের মতে নীতিবােধ আইনের অধীন নয়, বরং স্বাধীন বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের মতে, ধর্মতত্ত্ব ও নৈতিক নিয়মাবলিকে বুদ্ধির আলােকে অনুসন্ধান করতে হবে। নৈতিক নিয়ম গ্রহণযােগ্য এজন্য নয় যে তা আল্লাহ-নির্দেশিত, বরং এজন্য যে তা যুক্তিসিদ্ধ। যেমন, তাদের মতে আল্লাহ হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছেন বলেই যে তা খারাপ তা নয়, বরং খারাপ বলেই আল্লাহ একে নিষিদ্ধ করেছেন। মুতাযিলারা আইনের স্বর্গীয় ও বাধ্যতামূলক প্রকৃতিকে অস্বীকার করেননি। তবে যেখানে তারা বুদ্ধির অবাধ প্রয়ােগের পক্ষপাতী ছিলেন সেসব নৈতিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক বিষয় থেকে তারা শরিয়তকে আইনের পর্যায়ে সীমিত রেখে দেন এবং একে স্বতন্ত্র বলে মনে করেন।

আল-আশারির দ্বারা বিচারবুদ্ধিকে নৈতিকতা ও আইন থেকে বিচ্ছিন্নকরণ : রক্ষণশীল মহল থেকে তাদের এই ধারণার বিরােধিতা আসে। রক্ষণশীলরা নীতিবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বকে আইনের মতােই শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত রাখার চেষ্টা করে এবং আল্লাহর সর্বময় কর্তৃত্বের কথা বলে সবকিছুকে মানুষের তর্কবিচারের ঊর্ধ্বে বলে অভিমত দেয়। ১০ম শতকে আল-আশারি তার কালামতত্ত্বে যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন তাতে আইন ও নীতিবিদ্যাসহ ব্যবহারিক জীবনের সব কর্ম ও আচরণকে শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত এবং ধর্মতাত্ত্বিক ও অধিবিদ্যক বিষয়াদিকে ‘আকল’ বা বিচারবুদ্ধির আওতাভুক্ত বলা হয়। এর ফলে আইন বা নীতিবিদ্যা থেকে ধর্মতত্ত্ব আলাদা হয়ে যায়। এই মতে, ধর্মতত্ত্ব ধর্মের নীতিমালার (উসুল আল-দীন) দিকটি ধর্মতত্ত্বের এবং নৈতিক ও আইনগত বিষয়াদি শরিয়তের অন্তর্গত। বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার সাহায্যে কোনাে সার্বিক নৈতিক নিয়ম আবিষ্কার করা যায় না – এই দাবি উত্থাপন করেই মুতাযিলাদের বিরুদ্ধে নৈতিকতাকে শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এ যুক্তিতে ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা প্রভৃতি মানুষের আবেগ-অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল, কোনাে সার্বিক নিয়মের ওপর নয়। এ কারণেই ঐশ্বরিক বিধান বা শরিয়া দ্বারা নৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়ােজন। এ যুক্তিতেই আল-গাজালি বলেন : “কোনাে দায়িত্ববােধ যুক্তিবিচার থেকে অনুসৃত হয় না, হয় শরিয়া থেকে।”

ধর্মতত্ত্বের অবস্থান : নৈতিকতা ও আইন শরিয়া থেকে উদ্ভূত, তা না হয় বােঝা গেলাে। কিন্তু ধর্মতত্ত্বের অবস্থান কোথায়? এ প্রসঙ্গে আল-গাজালি রক্ষণশীল সুফিদের সমর্থক এবং মধ্যপথের অনুসারী। কালামের নৈয়ায়িক আকারবাদের (formalism) প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি সুফিপদ্ধতিকে কালাম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেন এবং একধরনের আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধি বা পরিষ্করণের মাধ্যমে বৌদ্ধিক বিশ্বাসসমূহকে ঢালাই করার কথা বলেন। এ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েই তিনি আল্লাহর বিশুদ্ধ প্রগাঢ় প্রেমকে শরিয়তের প্রকৃত অর্থ বলে ব্যাখ্যা করেন। বিশ্বাসের এই অন্তর্মুখিনতাকেই তিনি দ্বীন বলে ঘােষণা করেন। এ অর্থে দ্বীন শরিয়তের নির্যাসের অন্তর্নিহিত প্রাণ। দ্বীন ছাড়া শরিয়ত কেবলই একটি শূন্য খােলস, এবং শরিয়ত ছাড়া দ্বীনও অচল।

দ্বীন ও শরিয়তের মধ্যে পার্থক্য এবং সুফিবাদ ও শরিয়তের মধ্যে বিবাদ : আল-গাজালির এত চেষ্টার পরও দ্বীন ও শরিয়তের মধ্যে পার্থক্য বহাল থেকে যায়। বিশেষত, পরবর্তীকালের সুফিবাদ ও শরিয়তের মধ্যে বিবাদ দেখা দেয়। তখন থেকে রক্ষণশীল কালামতত্ত্ব ও সুফিবাদের অনুধ্যানিক ধর্মতত্ত্ব – এ দুই স্বতন্ত্র প্রকারে ধর্মতত্ত্ব বিভক্ত হয়ে যায়। শরিয়ত ও মরমিবাদী পথের পার্থক্যের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সুফিবাদী ধর্মতত্ত্বের বিকাশ ঘটে। রক্ষণশীল ধর্মতত্ত্ব (কালাম) শরিয়তের মৌল কাঠামােকে যুক্তি দিয়ে সমর্থনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। কিন্তু এর ফলে ধর্মতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক পাঠ ও অধ্যয়নের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দেয়। কেউ কেউ ধর্মতত্ত্ব ও অধিবিদ্যাকে পৃথক করার কথা বলেন। তাদের মতে, ধর্মতত্ত্বের কাজ হলো শাস্ত্রের সমর্থনদান, আর অধিবিদ্যার কাজ হলো যথার্থ দর্শনের মৌল প্রশ্নাবলি অনুসন্ধান। এ প্রসঙ্গে অধিকাংশ ধর্মবেত্তার মতে, এর ফলে শরিয়তবহির্ভূত নতুন জ্ঞানের বিস্তার ঘটবে, এবং এ আশঙ্কায়ই তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মতে, যৌক্তিক প্রমাণাদি দ্বারা শাস্ত্রীয় বিধানসমুহের সমর্থন এবং যৌক্তিক পদ্ধতিতে তাদের অনুসন্ধান ও ভাষ্যপ্রদানই ধর্মতত্ত্বের কাজ হবে।

ধর্মতত্ত্বের দ্বারা অধিবিদ্যার বলয় দখল ও স্বাধীনভাবে চিন্তার দাবি প্রত্যাখ্যান : এভাবে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন অধিবিদ্যার গােটা বলয়টাকে দখল করে ফেলে এবং জগৎ ও জীবন বিষয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার দাবি প্রত্যাখ্যান করে। শরিয়ত আবার দ্বীনের সমার্থক হয়ে যায়। ইতিমধ্যে আইন বিকশিত হয়ে যায় ধর্মতত্ত্বনিরপেক্ষভাবে এবং আইনবিদরা ধর্মের সমার্থক হিসেবে কালাম-ধর্মতত্ত্বের বৈধতাকে স্বীকার করে নিলেও আইন কর্তৃপক্ষ তখন ধর্মতত্তের গতিপ্রকৃতি ও পরিসীমা নির্ধারণ করে দেয়। বিশিষ্ট আইনবিজ্ঞানী আল-শাতিবি (মৃ. ১৩৮৮) আইনদর্শন ও আইনবিজ্ঞান বিষয়ে রচিত কিতাব আল-মুবাফাকাত গ্রন্থে ধর্মবিশ্বাসের বিষয়াদিকে আইনবিজ্ঞান থেকে পৃথক করার পরামর্শ দেন এবং যেকোনাে তাত্ত্বিক ও নিছক বৌদ্ধিক আলােচনাকে শরিয়ত বিরােধী, এবং সে কারণে ধর্মতত্ত্বের আওতাবহির্ভূত বলে মন্তব্য করেন।

উপসংহার : ইসলামী জীবনের ব্যাখ্যা ও অনুশীলনে বুদ্ধিবাদ, সুফিবাদ, ধর্মতত্ত্ব ও আইন – এই চারটি স্রোত লক্ষ্য করা যায় এবং এগুলােই খ্রিস্টীয় ১০ম শতক থেকে মুসলিম জীবনে ক্রমবর্ধমানভাবে নতুন নতুন প্রশ্নের উদ্রেক করে। এদের সবগুলাের নিয়ন্ত্রক নীতিকে যদি কোনাে একটি বিশিষ্ট নামে চিহ্নিত করতে হয়, তা হলে সেটি নিঃসন্দেহে হবে শরিয়া, যদিও এই একই কথাকে তারা নিজ নিজ বিশিষ্ট অর্থে ব্যবহার করেছেন।

মুসলিম আইন সম্প্রদায়

আইন সম্প্রদায়গুলোর উদ্ভব

ইসলামি আইনের বিকাশপ্রক্রিয়া সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কোরআন ও হাদিসকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করায় কারো কোনো আপত্তি ছিল না; এবং মুহাম্মদের তিরোধানের পরও কোরআন ও হাদিসে যেসব সমস্যার সমাধান পাওয়া যেত, সেগুলো নিয়ে বড়রকমের সমস্যা দেখা দেয়নি। কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্যবিস্তারের ফলে ইসলামের সঙ্গে যখন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির সংযোগ ঘটতে শুরু করে, তখন তাদের প্রচলিত আচার-অনুশীলন ও নিয়ম-কানুনকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করে দেখতে হয় এবং কোন্ বিশেষ বিষয়টি ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আর কোন্‌টি তার পরিপন্থী, তা-ও স্থির করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া নামাজ, রোজা, বিবাহ, তালাক ও ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। মোট কথা, সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে মুসলমানদের সামনে দিনদিন এমনসব নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিতে লাগলো, যেগুলোর সুস্পষ্ট সমাধান কোরআনে কিংবা হাদিসে নেই। এ অবস্থায় স্বভাবতই মুসলমানরা পড়লো বিপাকে। তখনই দেখা দিল মতদ্বৈধ, তখনই প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ালো বাধ্যতামূলক বিস্তৃত আইনকানুনের। আইনের এ প্রয়োজন মেটাবার লক্ষ্যে আইনতত্ত্বে পারদর্শী যেসব আদি মুসলমান হাদিস থেকে আইনের সূত্র আহরণে আত্মনিয়োগ করেন এবং এ দুরূহ কর্ম যোগ্যতার সঙ্গে সম্পন্ন করে যারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, তারা হলেন হযরত আলী, হযরত ওমর, ইবনে ওমর, ইবনে মাসুদ এবং ইবনে আব্বাস। তাদের সুচিন্তিত প্রাজ্ঞ অভিমতের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ইসলামি আইনের বহু সূত্র। এভাবে আইন নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে চিন্তা-ভাবনার এক সুস্পষ্ট পর্ব সূচিত হয় খ্রিস্টীয় ৭ম ও ৮ম শতকের দিকে। ওই সময়েই ইরাক, হেজাজ, সিরিয়া ও বিভিন্ন স্থানে বিকশিত হয় আইনবিষয়ক কিছু সুনির্দিষ্ট মত, এবং এগুলোর ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে চারটি সুন্নি মজহাব। এ চারটি মজহাবই প্রতিষ্ঠা লাভ করে আব্বাসীয় শাসনামলে। এ মজহাব চতুষ্টয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রত্যেকেই অর্জন করেছিলেন জনগণের ব্যাপক স্বীকৃতি ও সম্মান, এবং এজন্যই মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনপ্রণালী প্রসঙ্গে তাদের রায় বিবেচিত হতো প্রায় অবশ্যপালনীয় বলে। তাদের অনুসৃত গুরুত্বপূর্ণ ইজতেহাদ মুসলিম জাতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। (ইজতেহাদ একটি আরবি শব্দ। এর আক্ষরিক অর্থ প্রয়োগবুদ্ধির ব্যবহার। মুসলমানদের কোনো জটিল ধর্মীয় সমস্যার সমাধানে কোরআন, হাদিস কিংবা অতীতের অন্য কোনো প্রামাণিক সূত্র থেকে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত পাওয়া না গেলে কোরআনের মূলনীতির অবলম্বনে যুক্তিপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকে ইজতেহাদ বলে।) ফলে আজ পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান তাদের কোনো-না-কোনো একজনের নির্দেশিত পথের অনুসারী। মূলনীতির দিক থেকে এ চারটি মজহাবের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই বটে; কিন্তু আইনের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই স্বতন্ত্র।

হানাফি সম্প্রদায়

প্রথম মজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবু হানিফা (৬৯৯-৭৬৭) এবং তার নামানুসারে তা পরিচিত হানাফি মজহাব নামে। আবু হানিফার আবির্ভাব ঘটে ইরাকে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেকের আমলে। কিন্তু তার কার্যকলাপ বিস্তৃত ছিল আব্বাসীয় খেলাফতের আঠারো বছর অবধি। তিনি দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেন আইনবিজ্ঞান অধ্যয়নে এবং স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ হিসেবে। আইন বিশ্লেষণে তিনি যে প্রগাঢ় নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন তা সব মহলে স্বীকৃত। আইনতত্ত্বের সূত্র ও নীতি প্রণয়নে তিনি ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন বলে তার প্রতিষ্ঠিত হানাফি মজহাবকে অভিমতবাদী (আহলুর রায়) বলে অভিহিত করা হয়। তার আগে আইনের সহায়ক উৎস হিসেবে কিয়াস প্রচলিত থাকলেও তিনিই এ নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেন মুসলিম আইনের উৎস হিসেবে। তার প্রবর্তিত আইনের নীতিমালা ইসতিহসান নামে পরিচিত। বাস্তবতার সঙ্গে আইনের সাযুজ্য অনুসন্ধানই ছিল এ নীতির মূলকথা। হানাফি মজহারকে আরো প্রণালীবদ্ধ ও সংহত করেন আবু হানিফার দুই বিশিষ্ট শিষ্য আবু ইউসুফ (মৃ. ৭৯৭) এবং মোহাম্মদ আলি সায়বানি (মৃ. ৮০৫)। স্বাধীন মতবাদ প্রয়োগের জন্য বিখ্যাত এ সম্প্রদায়টিকে আব্বাসীয় খলিফারা বিশেষ সম্মানের চোখে দেখতেন। কিন্তু স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগের কারণেই তারা ৮ম ও ৯ম শতকের দিকে স্বাধীন মতবাদবিরোধী আহলে আল-হাদিস সম্প্রদায় দ্বারা কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানরা এ মজহাবের অন্তর্গত।

মালেকি সম্প্রদায়

মালেক ইবনে আনাস (৭১৩-৯৫) মদিনায় প্রতিষ্ঠা করেন মালেকি সম্প্রদায়। তিনি তার সমসাময়িক কালের হাদিসশাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত। আইনতত্ত্বে তার প্রধান গ্রন্থ আল মুবাত্তা। এ গ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকেই শুরু হয় মালেকি সম্প্রদায়ের বিকাশ। তার সঙ্গে আবু হানিফার মতের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে তিনি ব্যক্তির অভিমতের চেয়ে হাদিসের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। এ ছাড়া মদিনায় প্রচলিত রীতিনীতিগুলোকেও তিনি আইনের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে তিনি এগুলোর সমর্থনের প্রয়োজন মনে করতেন প্রামাণিক হাদিস দ্বারা। (বিভিন্ন অঞ্চলের রীতি ও প্রথার যৌক্তিক বিচার প্রয়োগের ফলে যেসব আইন গড়ে ওঠে সেগুলোকেও সুন্নাহ বলা হতো।) তিনি যেসব আইনবিষয়ক রীতি সংগ্রহ করেন এবং যেগুলোকে মদিনার প্রচলিত আচারের আলোকে পরীক্ষা করেন, সেগুলোর সমবায়েই রচনা করেছিলেন আল-মুবাত্তা। বর্তমানে মক্কা, মদিনা, পশ্চিম আফ্রিকা, উত্তর মিশরের অধিকাংশ অঞ্চল এবং জর্দান নদীর পশ্চিম অঞ্চলের বেশিরভাগ মুসলমান এই মজহাবে বিশ্বাসী।

শাফি সম্প্রদায়

তৃতীয় প্রভাবশালী আইন সম্প্রদায়ের নাম শাফি সম্প্রদায়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইসলামি আইনের প্রথম ধ্রুপদী (classical) ব্যাখ্যাতা বলে পরিচিত মোহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আস-শাফি (৭৬৭-৮১৯)। তিনি ছিলেন ইমাম মালেকের ছাত্র। কিন্তু আইনবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি তার গুরুকে ছাড়িয়ে যান। ইসলামি আইনের বিকাশে তার প্রভাব অপরিমেয়। তার প্রধান গ্রন্থ রিসালা আইনবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের দিকে হাদিসের বহু সংস্করণ লক্ষ্য করা যায় এবং এগুলোর প্রামাণিকতা পরীক্ষারও প্রয়োজন দেখা দেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা সমাধানে কোরআন ও হাদিসের ওপর নির্ভরশীলতার পরিমাণ, কোরআন ও হাদিসে যেসব সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান নেই, সেগুলোর সমাধানে কী করণীয়, প্রামাণিক ও অপ্রামাণিক কোরআনীয় বাণী কিংবা হাদিসের মধ্যে পার্থক্য করা যায় কীভাবে প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যখন উত্তপ্ত আলোচনা ও অস্বস্তিকর বিতর্ক চলছিল, তখনই এগিয়ে এসেছিলেন আস-শাফি।

তিনি বিরাজমান প্রয়োগপদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং হাদিস উপকরণসমূহকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণের পক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তির অবতারণা করেন। তার মতে, আল্লাহর বাণী হিসেবে কোরআন ইসলামি আইনের অকাট্য ভিত্তি, আর হাদিস ও সুন্নাহ এর পরিপূরক। কোরআন ও হাদিসের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, থাকতেও পারে না। দুটি হাদিস পরস্পরবিরোধী হতে পারে, একথাও তিনি সহজে মেনে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তবে যেসব ক্ষেত্রে বিরোধটা খুবই স্পষ্ট বলে চিহ্নিত হতো সেখানেও তিনি সংশ্লিষ্ট হাদিসের এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতেন, যার ফলে একটি হাদিসকে আর অপরটির বিরোধী বলে মনে হতো না। সব ক্ষেত্রেই যে এ ধরনের সমন্বয়ধর্মী ভাষা সম্ভব, তা দেখাবার উদ্দেশ্যেই তিনি রচনা করেছিলেন তার কিতাব ইখ্‌তেলাফ আল-হাদিস নামক গ্রন্থটি। এ বিষয়ে তার সিদ্ধান্তটি ছিল এরকম : “কোরআন হাদিসের বিরোধী নয় এবং মহানবীর হাদিস কোরআনকে ব্যাখ্যা করে। সুন্নাহ শুধু কোরআনের ব্যাখ্যা দেয়, কখনো এর বিরোধিতা করে না। কোনো হাদিসকেই কোরআনের সুস্পষ্ট অর্থের বিরোধী বলে বিবেচনা করা যায় না। সুন্নাহ কখনো কোরআনের বিরোধী নয়, তা শুধু কোরআনের অর্থকেই বিশিষ্টরূপে চিহ্নিত করে।” (J. Schacht The Origins of Muhammadan Jurisprudence. p. 15)

শাফির মতে, মহানবীর হাদিস ও খলিফাদের অনুসৃত রীতির মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে হাদিসকে গ্রহণ এবং সেসব রীতিকে বাতিল করতে হবে। ধর্মপ্রাণ খলিফাদের রীতি চূড়ান্ত বলে গ্রাহ্য হবে শুধু সেসব ক্ষেত্রে, যেখানে কোরআন কিংবা হাদিসে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে তিনি একথা জোর দিয়ে বলেন যে, মহানবীর প্রত্যেকটি হাদিসকে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের ধারাবাহিক প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত হতে হবে। শাফি আরো বলেন: যদি কোনো হাদিস এ পর্যন্ত জানা না-ও হয়ে থাকে, অথচ এর প্রামাণিকতা নিঃসন্দেহ, তা হলে একে আইন বলে গ্রহণ করা এবং এর আলোকে সব পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বা ফতোয়াকে বাতিল বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। শাফি বিভিন্ন হাদিস নিয়ে আলোচনা করেন এবং দীর্ঘ যুক্তির অবতারণা দ্বারা প্রমাণ করতে চান যে, বহুসংখ্যক হাদিস স্ববিরোধী কিংবা অবাস্তব ছিল না। শাফির মতে, ইসলামি আইনের উৎস নিম্নরূপ প্রথমে কোরআন, এরপর হাদিসে বিধৃত মহানবীর সুন্নাহ, তৃতীয়ত সমাজের আলেমদের ইজমা (ঐকমত্য) এবং সবশেষে কিয়াসের মাধ্যমে ব্যবহৃত আলেমদের মৌলিক চিন্তার প্রয়োগ (ইজতেহাদ)।

আইনের দিক থেকে শাফির মতবাদ হাদিসবিজ্ঞান বিকাশের পেছনে একটি উল্লেখযোগ্য প্রেরণা হিসেবে বিবেচিত। মুসলিম আইনের সব ক্লাসিক্যাল মতবাদের উৎস বলেও তা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। বুখারি, মুসলিম ও আরো অনেকে আজীবন নিযুক্ত ছিলেন হাজার হাজার হাদিসের প্রামাণিকতা পরীক্ষার দুঃসাধ্য কাজে। তারা যে কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন, তা শুধু একটি দৃষ্টান্ত থেকেই অনুমেয়। বুখারি ৬ লক্ষ হাদিসের উৎস খুঁজে বের করেন এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এগুলোর মধ্যে তিন হাজার হাদিসই কেবল নিশ্চিতভাবে প্রামাণিক। বর্তমানে মিশর, সিরিয়া দক্ষিণ আরব, পশ্চিম আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়ায় শাফির অনেক অনুসারী রয়েছে।

হাম্বলি সম্প্রদায়

৯ম শতকের খলিফা মুতাওয়াক্কিলের রাজত্বকালে আহমদ ইবনে হাম্বলের (৭৮০-৮৫৫) নেতৃত্বে একটি নতুন সম্প্রদায় শাফি সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে আসে। প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, হাদিসে সুপণ্ডিত ও রক্ষণশীলপন্থী ইবনে হাম্বলের নামানুসারেই এই সম্প্রদায় হাম্বলি সম্প্রদায় নামে পরিচিত। হাদিসের সর্বাত্মক ও সঠিক অনুসরণই তার প্রবর্তিত আইনের মূল সূত্র। হাম্বলের শিক্ষাকে সুসংবদ্ধ করেছিলেন তার শিষ্যেরা। চৌদ্দ শতক পর্যন্ত এর অনুসারীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এরপর বিভিন্ন সময়ে এর কিছু শক্তিশালী প্রবক্তা আবির্ভূত হলেও তাদের সংখ্যা দিনদিন হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে কেবল আরবেই এর কিছু সমর্থক রয়েছে। আঠারো শতকে ওয়াহাবিরা তাদের মতবাদের উৎস ও প্রেরণা লাভ করেছিলেন হাম্বলিদের কাছ থেকে।

মহানবীর বাণী ও রীতির অনুশীলনকে হাম্বলিরা ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ বলে মনে করেন। বিশেষত হাম্বলি মতের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে হাম্বল হাদিস ব্যাখ্যায় অনমনীয় মনোভাব পোষণ করেন। তিনি ইজমা বা কিয়াসের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না, এবং তার মতে ব্যাখ্যার মাধ্যমে হাদিসের প্রসারণ কিংবা সংকোচন অনুমোদনযোগ্য নয়। তিনি ছিলেন শাফির অনুসারী, এবং ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে যেন কোনো প্রগাঢ় আলোচনা করা না হয় সেজন্য তিনি এক নতুন ধরনের যুক্তির অবতারণা করেন। তার মতে, মহানবী আলোচনা করেননি এমন যে-কোনো বিষয়ের আলোচনা ভ্রান্তিজনক এবং সেজন্যই অবাঞ্ছনীয়।

মোট কথা, হাম্বলিরা হাদিস বিষয়ে কোনোরকম প্রশ্ন উত্থাপন করাকে অনুচিত বলে মনে করতেন। এভাবে বিনা প্রশ্নে ও নির্বিচারে কোনোকিছু মেনে নেয়ার মানসিকতাকে তারা শুধু ধর্মীয় ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, বিস্তৃত করেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে। ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা অনুচিত, এ যুক্তিতে ইবনে হাম্বল ধর্মবিরুদ্ধতা নিয়েও আলোচনা করার বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, ধর্মবিরুদ্ধতা খণ্ডনও অবাঞ্ছিত ; কারণ ধর্মবিরোধী মতাবলি খণ্ডন করতে হলে সেসব মত পাঠ ও অধ্যয়ন করতে হবে এবং তাতে মানুষ ধর্মবিরোধী মত জানতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। হাম্বল ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান নিরাপোস হাদিসপন্থী ধর্মতাত্ত্বিক। তার মতে, বিনা আলোচনায় ও বিনা প্রশ্নে হাদিসকে গ্রহণ করতেই হবে। কোরআন ও মহানবীর সুন্নাহর অধ্যয়নে বুদ্ধির প্রয়োগকে তিনি কঠোরভাবে নিন্দা করেন। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত শক্তিশালী বাগ্মী, এবং এজন্যই তার এ নির্বিচার বিশ্বাসের প্রতি অনেক শিষ্য আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।

আল-আশারি (মৃ. ৯৩৫) প্রথম ইবনে হাম্বলের অনুগামী ছিলেন এবং যারা আল্লাহর দেহ আছে বলে মত পোষণ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি করেন। মুতাযিলাদেরও তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি হাম্বলিদেরও প্রবল বিরোধিতা করেন এবং কোরআন ও সুন্নাহয় উল্লেখ নেই এমন বিষয়ের আলোচনাকে নিষিদ্ধ করায় তাদের নিন্দা করেন। হাম্বলিদের মতের বিরোধিতা করে তিনি বলেন যে, কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা করতে হবে বুদ্ধির আলোকে এবং আমাদের বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে হবে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে।

বুয়ায়হিদদের আধিপত্যের আমলে সুন্নি রক্ষণশীলতা স্তব্ধ হয়ে যায়। খলিফা আল-কাদির বিল্লাহ এবং তার পুত্র বুয়ায়হিদদের ক্ষমতাচ্যুত করার পথ সুগম করেন। এ কাজে তাদের সহায়তা করেন গজনির মাহমুদ। হাম্বলি সম্প্রদায় বুয়ায়হিদদের বিরুদ্ধে বাগদাদে ও সামারায় বিক্ষোভের আয়োজন করে। তারা এই মর্মে আন্দোলন শুরু করে যে, আব্বাসীয়রা কুরাইশ বংশের এবং মহানবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত; সুতরাং তারাই যথার্থ খলিফা হতে পারে। খলিফা আল-কাদির বিল্লাহকে মান্য করা এবং দেশের অখণ্ডতা ও শৃঙ্খলারক্ষায় তাকে সহায়তা করা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কর্তব্য।

নিজামুল মুলক ও ব্যাবার

সেলজুকদের শাসনামলে সুন্নি রক্ষণশীল মতবাদ সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজামুল মুলক ছিলের সেলজুক সুলতান মালিক শাহের মুখ্যমন্ত্রী। নিজামুল মুলক তার বিখ্যাত সিয়াসাত নামাহ রচনা করেন এবং একে দেশের আইন বলে ঘোষণা করেন। এ গ্রন্থে শাসককে আল্লাহর পার্থিব প্রতিনিধি বলে বর্ণনা করা হয়। এ মতে, আল্লাহই যথার্থ সার্বভৌম শাসক, আর মানুষ তার প্রতিনিধি। ধর্মীয় আইন নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা বিতর্ক অবাঞ্ছনীয়। এ যুক্তিতেই নিজামুল মুলক ধর্মীয়, এমনকি পার্থিব বিষয়াদি নিয়েও দার্শনিক আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দেন। তিনি বয়স্কশিক্ষার জন্য নিজামিয়া মাদ্রাসা স্থাপন করেন। এর পাঠ্যসূচি নিয়ন্ত্রিত ছিল রক্ষণশীল ধর্মীয় ভাব দ্বারা এবং এর মূল পাঠ্যসূচি ছিল ধর্ম ও আইনবিজ্ঞান। দর্শনপাঠ ছিল নিষিদ্ধ। খেলাফতের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে মুসলিম বিদ্যাচর্চায় স্থবিরতার সূত্রপাত হয় এবং কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া সব বিষয়ের লেখকরা কাজ করেন নিছক ভাষ্যকার হিসেবে, বিচারমূলক আলোচক হিসেবে নয়। আল-মালির নেতৃত্বে পরিচালিত মূল নিজামিয়া মাদ্রাসায় আল-গাজালি পড়াশোনা করেন। কিন্তু ওখানকার রক্ষণশীল পরিবেশ তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। ফলে শেষ পর্যন্ত তিনি সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এরপর তিনি চেষ্টা করেন রক্ষণশীল বিশ্বাসে মরমি অভিজ্ঞতা সন্নিবেশ দ্বারা সুফি ও রক্ষণশীল সম্প্রদায়সমূহকে সমন্বিত করতে। কিন্তু তার এ চেষ্টা এমনকি সেলজুক আমলেও সফল হয়নি; কারণ মালেকি, হানাফি, শাফি ও হাম্বলি—এ চারটি আইন সম্প্রদায়কে সমন্বিত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মুসলিম আইনবিজ্ঞানীদের আইনকানুন মানবাচরণের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে বটে; কিন্তু একে সর্বতোভাবে কার্যকর করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। ফলে আইনের কার্যকারিতা ক্রমশ শিথিল হয়ে যায়। এর ফলে ইসলামি আইনের সঙ্গে বিদেশী আচারাদি মিশ্রিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন পরিবেশ থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত ব্যক্তিরা নিজ নিজ আঞ্চলিক রীতি-নীতি ও প্রথা প্রচলনকে ইসলামি আচারের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে।

সুলতান ব্যাবারের দ্বারা চার সম্প্রদায়ের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা

সুন্নি মতবাদের চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয় সুলতান ব্যাবার-এর শাসনামলে। ফাতেমীয়দের কাছ থেকে মিশর জয় করে তিনি কায়রোতে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই মর্মে নির্দেশ জারি করেন যে, চারটি আইন সম্প্রদায়ের সবগুলোই সুন্নি বিশ্বাসের এবং সুন্নি পদ্ধতির অন্তর্গত। আইন অনুশীলনে ও প্রয়োগে চারটি সম্প্রদায়ের অনুসারীরা যেন সমান মর্যাদা পেতে পারে সেজন্য তিনি কায়রোতে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একজন করে কাজি নিযুক্ত করেন। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে মিশর বিজয়ের পর সুলতান প্রথম সেলিম নিজেকে একাধারে খলিফা ও সুলতান বলে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তার উত্তরসূরিরাও এভাবেই চলতে থাকেন। অটোমান সুলতানদের মতে, নিজামিয়া মাদ্রাসাগুলোর মাধ্যমে চিন্তার নিয়ন্ত্রণ খুব কার্যকর ছিল না। সেজন্য তারা এ নিয়ন্ত্রণ আরো কঠোরভাবে আরোপ করেন এবং চারশো বছর ধরে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক উঁচু পদে লোক নিয়োগ করেন।

ব্যাবার সুন্নি মতবাদের যে চূড়ান্ত রূপ দেন তার ফলে প্রারম্ভিক পর্বের ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনবিষয়ক বিতর্কের অবসান ঘটে। মালেকি, হাম্বলি, শাফি ও হানাফি – এ চারটি বিশিষ্ট মুজতাহিদ সম্প্রদায়ের প্রত্যেকটির অভিমতকে কোরআনের ব্যাখ্যায় এবং যেকোনো বিচারবিষয়ক সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত বলে মনে করা হয়। (চারটি আইন সম্প্রদায়ের প্রবক্তারা মিলে যেসব গ্রন্থে আইনবিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করেন সেগুলো ‘হেদায়াহ’ বলে পরিচিত। উত্তরাধিকার, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, যুদ্ধ, সন্ধি ও করনীতি সহ বিভিন্ন ধর্মীয় আচার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হেদায়াহর অন্তর্গত। এ বিষয়ে শ্রম ও মেধা ব্যয় করে যারা মুসলমানদের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছেন, তারা মুজতাহিদ নামে পরিচিত। আল্লাহ কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে নির্দেশ জারি করেছেন; আর মুজতাহিদরা সেসব নির্দেশকেই কার্যকর করেছিলেন বিস্তৃত বিধিমালার আঙ্গিকে।) একজন বিচারক যে সম্প্রদায়ের অনুসারী বিচার ক্ষেত্রে তিনি সেই সম্প্রদায়ের নিয়ম (হেদায়াহ) থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না, শুধু সেই সিদ্ধান্তই ঘোষণা করতে পারেন অনুরূপ ক্ষেত্রে অতীতে যা করা হয়েছিল। অতীতে দৃষ্টান্ত নেই এমন কোনো নতুন বিষয় যদি বেশ কিছুদিন ধরে সাধারণ্যে অনুমোদন লাভ করে, তা হলে তা ইজমা দ্বারা বাধ্যতামূলক হিসেবে অনুমোদন লাভ করে।

লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, শরিয়তের বিকাশ কার্যত বন্ধ হয়ে যায় ১২শ শতক থেকে। ইজমার ওপর অতিশয় নির্ভরশীলতা আইনের স্বাভাবিক বিকাশকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে। খেলাফতের অবসান এবং সুন্নি রক্ষণশীল মতের প্রভাব বৃদ্ধি নির্বিচার বিশ্বাসের দাবিকে জোরদার করে। কর্তৃপক্ষীয় মহল থেকে দাবি করা হয় যে, শাস্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হতে হবে নিঃশর্ত ও বিচারবিহীন, এবং যথার্থ বিশ্বাসী বলে ঘোষণা করা হয় তাদের যারা নির্বিচারে সব নির্দেশ মেনে নেয় (মুকাল্লিদ)। কোনো ধর্মীয় ব্যাপারে, এমনকি কোরআন ও হাদিসের সমর্থনের বরাত দিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না; কারণ, সব ধর্মীয় প্রশ্নের সদুত্তর আগেই চূড়ান্তভাবে নির্ণীত হয়েছে এবং আচার ও আইনসংক্রান্ত যাবতীয় বিশ্বাসও অকাট্যভাবে প্রণীত হয়েছে এক সর্বাঙ্গীণ ঐশ্বরিক আইনব্যবস্থার আওতায়। মোট কথা, তাকলিদ, অর্থাৎ নির্বিচারে প্রচলিত আইনকে মেনে নেয়ার নীতি, তখন আইনের বিকাশের পথে এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এর পরবর্তী প্রজন্মের আলেমরা পূর্ববর্তীকালের আলেমদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত আইন পরিবর্তনের সাহস পাননি। স্বাভাবিকভাবেই আইনবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সৃজনশীলতার পক্ষে। তাকলিদ বা নির্বিচার বিশ্বাসকে যখন এভাবে বাধ্যতামূলক করা হলো, তখন আইনের স্বাভাবিক বিকাশ যে কিছুটা স্তব্ধ হবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

ইবনে তাইমিয়া

এই অস্বস্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতির বিরুদ্ধেই প্রথম প্রতিবাদ জানান বিশিষ্ট হাম্বলি আইনবিজ্ঞানী ইবনে তাইমিয়া (১২৬৩-১৩২৮)। ইবনে তাইমিয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শরিয়া আইনের পুনবর্ণনা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সমর্থন। তার মতে, শরিয়া একটি ব্যাপক ধারণা, এবং তাই সুফিদের আধ্যাত্মিক সত্য (হাকিকা), দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকদের যৌক্তিক সত্য (আকল) এবং আইন—এ সবই শরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কোনো পর্যায়ে গতানুগতিক প্রাধিকার ও বুদ্ধির মধ্যে হয়তো-বা বিরোধ দেখা দিয়ে থাকতে পারে; কিন্তু আসলে এ দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, থাকতে পারেও না। তেমনি শরিয়া নিতান্তই কতকগুলো বাহ্যিক আইনবিষয়ক নীতি বা সিদ্ধান্ত, এবং এর কোনো আধ্যাত্মিক বা অভ্যন্তরীণ ভিত্তি নেই – একথাও ঠিক নয়। সুফিরাই এ ভুল ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন। আসলে শরিয়া আইনকে সম্ভব ও ন্যায়ানুগ করে এবং আইনি ও আধ্যাত্মিক বিষয়কে একটি সজীব ধর্মীয় সমগ্রে সমন্বিত করে।

শরিয়াকে এ ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার পর পরবর্তী প্রয়োজন ধর্মতত্ত্ব ও আইনের মধ্যে একটি বাস্তব ও সজীব যোগাযোগ স্থাপন; কারণ, অন্যথায় ধর্মতত্ত্ব একটি শূন্য, কঠিন ও নিষ্প্রাণ খোলসে পরিণত হয়ে যেতে পারে। এজন্যই প্রয়োজন দেখা দেয়, ধর্মতত্ত্বকে নতুন করে উপস্থাপনের, এমনভাবে উপস্থাপনের যেন তাতে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। গতানুগতিক ধর্মতত্ত্বে আল্লাহর ইচ্ছার (কদর) যে একপেশে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তাতে ধর্মীয়-নৈতিক জীবনে বিঘ্ন ঘটে। আল্লাহর ক্ষমতা ও ইচ্ছাকে তার ও তার সৃষ্টির বিরুদ্ধে ব্যবহারের কোনো মানে নেই। সুফিরা এ বিষয়টির ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা নৈতিক নৈরাজ্যের অবতারণা করেছিলেন। গতানুগতিক ধর্মতত্ত্বও আল্লাহর ইচ্ছার বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে সবকিছুর মূলে আল্লাহকে দাঁড় করাবার এবং তাকে মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখাবার প্রয়াস পেয়েছে। এভাবে ধর্মের অনুসারী ও ব্যাখ্যাতারাই অগ্রাহ্য করেছেন আল্লাহর সেসব নির্দেশকে, যেগুলো প্রকৃতই ধর্মীয় চিন্তা ও কর্মের প্রাণকেন্দ্র ও প্রেরণার উৎসস্বরূপ।

তাইমিয়ার মতে, ওলামা সমাজ এ ব্যবস্থার মাধ্যমে কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আলেমদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত অনেক আইনবিষয়ক সিদ্ধান্ত ধর্মানুগ না হয়ে হয়েছে ধর্মবিরুদ্ধ। কারণ, আলেমরা তাদের সিদ্ধান্ত শাস্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতেও নারাজ। তাইমিয়া বিশেষত অসন্তুষ্ট ছিলের সেসব সুফি দরবেশদের আচরণে, যারা (তার মতে) গানবাজনা ও নাচ (সামা ও রাকস) এবং পীর-দরবেশদের মাজার উপাসনার প্রথা প্রবর্তন দ্বারা ইসলামি আইনকে দূষিত করেছে। উল্লেখ্য যে, রক্ষণশীল ইসলামের সঙ্গে সুফিবাদের এ মিশ্রণ প্রথম সংগঠিত হয় আল-গাজালির সময়। ইবনে তাইময়া ইসলামকে বিশ্বশক্তির মর্যাদা থেকে অধঃপতিত করার জন্য সুফিদের দায়ী করেন। তিনি চেয়েছিলেন বিশুদ্ধ ইসলামকে সুফিদের হাত থেকে রক্ষা করে পূর্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে। তাই তিনি ধর্মপ্রাণদের আহ্বান জানালেন কোরআন ও সুন্নাহয় ফিয়ে যাওয়ার জন্য।

ইবনে তাইমিয়া ছিলেন দামেস্কের মামলুক সুলতানদের আমলের একজন হাম্বলি আইনবিজ্ঞানী। তিনি সুন্নি রক্ষণশীল ধর্মমতকে সেখানে নিয়ে যেতে চান যেখানে একে রেখে গিয়েছিলেন ইবনে হাম্বল। হাম্বলের পরবর্তী সময়ে সুন্নি রক্ষণশীল মতে যেসব অনাবশ্যক নতুন জিনিস সংযোজিত হয়, তিনি সেগুলো বর্জন করার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে তিনি ক্ষমতাসীন শাসকদের সবকিছু অনুমোদন করার জন্য সরকারি আলেমদের দায়ী করেন। ইবনে তাইমিয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এখানে যে, তিনি সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে সব দল-মতের বিচারশীল ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। সত্য কারো একচেটিয়া সম্পদ নয়, বরং সব শ্রেণীর মতে ও পথে পরিব্যাপ্ত – এই ছিল তার ঘোষণা। তার মতে, শরিয়তের যথার্থ বিকাশের জন্য মানুষের স্বাধীন তৎপরতা আবশ্যক।

ইবনে তাইমিয়ার মতের তাৎক্ষণিক প্রভাবে কোনো বিরাট বিশাল আন্দোলন গড়ে ওঠেনি ঠিক; কিন্তু ক্রমশ এ মতের প্রভাব বিদ্বৎসমাজে পরিব্যাপ্ত ও অনুভূত হতে থাকে। ১৮শ শতকের ওয়াহাবি আন্দোলন এর প্রভাবেরই একটি লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-৮৭) ছিলেন ইবনে তাইমিয়ার মতোই হাম্বলি পন্থি। তিনি পীর-দরবেশের মাজার উপাসনাসহ বিভিন্ন সুফি আচার-অনুশীলনকে অনৈসলামিক বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, কোরআন ও সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, এমন যে-কোনো চিন্তা ও কর্ম অধার্মিকতার নামান্তর। ইসলামি আইনবিজ্ঞানের বিকাশে ইবনে তাইমিয়া ও আবদুল ওয়াহাবের এই সংস্কারধর্মী প্রচেষ্টার প্রভাব অনস্বীকার্য। এর প্রভাবে ক্রমশ এমন এক আইনদর্শনের বিকাশ শুরু হয় যা আইনের নৈতিক-ধর্মীয় ভিত্তি, উৎস, উপজীব্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়। তাই দেখা যায় যে, খ্রিস্টীয় ১৪-১৮ শতকে অনেক বিশিষ্ট পণ্ডিত ও আইনবেত্তা আইনব্যবস্থার যৌক্তিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

শিয়া আইন

আইনের উৎপত্তি ও প্রয়োগের ব্যাপারে সুন্নি ও শিয়া মতে কিছু পার্থক্য আছে। যেমন, সুন্নি মুসলমানদের নেতা ও প্রতিনিধি হলেন খলিফা। তিনি অন্যান্য মানুষের মতোই একজন মানুষ। কিন্তু তিনি খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন নিজ যোগ্যতাবলে। কর্তব্যে অবহেলা, দুর্নীতি বা অন্য কোনো কারণে তিনি যদি জনসমর্থন হারান এবং জনসাধারণ যদি তাকে না চান তা হলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। তবে খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকাকালে তিনিই মুসলমানদের দুনিয়া ও দ্বীন উভয় ব্যাপারের তত্ত্বাবধান করবেন, শরিয়তভিত্তিক আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করবেন এবং শরিয়তের আলোকে যে-কোনো নতুন সমস্যার সমাধান দেবেন। কিন্তু মুসলিম জাহানের নেতার স্বরূপ ও ক্ষমতা, তথা আইন বিষয়ে শিয়াদের ধারণা ভিন্নতর। তাদের মতে, মুসলিম জাহানের যথার্থ নেতা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত খলিফা নন, বরং স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ইমাম। ইমামই কেবল আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। তিনি সবাক কোরআন (নাতিক)-স্বরূপ। ইমাম লুক্কায়িত আছেন বলে মুজতাহিদগণ (আইনবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ সেসব পণ্ডিতব্যক্তি যারা ইজতিহাদ প্রয়োগ করতে সক্ষম) তার পক্ষে আইন ব্যাখ্যার কাজ করতে পারেন। শিয়া আইন প্রণয়নের সঙ্গে যে ইমামের নাম বিশেষভাবে যুক্ত, তিনি হলেন ষষ্ঠ ইমাম জাফর আস্ সাদিক। তার নামানুসারেই শিয়া আইনকে অভিহিত করা হয় জাফরি আইন বলে।

শিয়া মতে, ইমাম যেহেতু আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত এবং মুহাম্মদের অনুপস্থিতিতে তিনি যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকেই আইন ঘোষণা করেন, সেজন্য তার বাণীকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হয় হাদিসের, যদিও মুহাম্মদের হাদিসকে মুখ্য এবং তাদের হাদিসকে গৌণ বলে পৃথক করা দরকার। তাদের মতে, ইমামের মাধ্যমে আইন প্রতিনিয়ত প্রণীত হয়ে চলছে। ইসমাঈলীয়দের (Ishmaelites) ইমাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে আছেন; কিন্তু বারোপন্থী শিয়াদের (Twelver Shi’ism) মতে ইমাম যদিও বেঁচে আছেন এবং জগৎ শাসন করছেন, তবু তিনি প্রকাশ্যে থাকেন না, আছেন লুক্কায়িত। শিয়াদের মতে, আইনবিজ্ঞান অধ্যয়ন ও অনুশীলনে যারা উল্লেখযোগ্য দক্ষতা অর্জন করেছেন, তারা মুজতাহিদ হতে পেরেছেন। অর্থাৎ তারাই আইনের ব্যাপারে ইজতেহাদ বা স্বাধীন অভিমত প্রকাশ করতে সক্ষম। এরাই আইনের প্রাণবন্ত ভাষ্যকার, এবং ইমামের অনুপস্থিতিতে তার পক্ষ থেকে তারাই আইন ব্যাখ্যার কাজে নিয়োজিত। প্রত্যেক শিয়া মতাবলম্বীর এমন একজন মুজতাহিদকে অনুসরণ করতে হয় যিনি ধারাবাহিকভাবে আইনের ব্যাখ্যার কাজে নিয়োজিত।

মজহাব চতুষ্টয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুন্নি-জাহানে ইজতেহাদের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছে; কিন্তু শিয়া আইনে ইজতেহাদ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং এর দরজা কখনো বন্ধ হয় না, হতে পারে না। এর অর্থ অবশ্য শরিয়তের গুরুত্ব অস্বীকার করা নয়। এর দ্বারা শুধু এটুকুই বোঝানো হচ্ছে যে, সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে নতুন নতুন পরিস্থিতিতে আইনকে প্রয়োগ করতে হবে পরিস্থিতির প্রয়োজনে। ইসলামে ইজতেহাদের প্রয়োগ বলতে আইন প্রণয়ন করাকে বোঝায় না, বোঝায় আইনকে শরিয়তের মূলনীতির অনুসরণে নতুন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করাকে। শিয়া মতে, যথার্থ অর্থে ইজতেহাদ আইনকে মানুষের খেয়াল-খুশির হাতে ছেড়ে দেয়াকে বোঝায় না, বোঝায় অবস্থার তাগিদে আইনের মূল নির্যাসকে যুক্তির আলোকে নতুন করে প্রয়োগ করাকে।

বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগের ব্যাপারে শিয়া ও সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ই প্রায় সদৃশ মতের অনুসারী। তবে মুসলিম রাষ্ট্রের শাসক কে হবেন, উত্তরাধিকারের ব্যাপারে পুরুষ ও নারীর অংশীদারিত্ব প্রভৃতি কোনো কোনো বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশেষ পার্থক্য লক্ষগোচর। বারোপন্থী শিয়াদের মতে, দ্বাদশ ইমাম মেহেদির অনুপস্থিতিতে কোনো যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গ সরকার থাকে না। এ অবস্থায়ও সমাজের সম্মতিক্রমে রাজতন্ত্র বা সালতানাতই সর্বোত্তম সরকার, যদিও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। অপরদিকে সুন্নিদের মতে, খলিফা সরকারের বৈধ প্রতিনিধি। খলিফা আল্লাহ ও তার নবীর প্রতিনিধি ; তিনি মহানবীর পক্ষ থেকে আল্লাহর আইন প্রয়োগ করার অধিকারী। খলিফার দায়িত্বই হচ্ছে শরিয়ত সংরক্ষণ ও প্রয়োগ করা। তিনি মানবসমাজের আইনের প্রতীকস্বরূপ।

আবার শিয়া আইনে নারী-উত্তরাধিকারীরা পুরুষ-উত্তরাধিকারীদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে, যা কিনা সুন্নি আইনের চেয়ে স্বতন্ত্র। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যাপারে তাদের মধ্যে বড় একটা পার্থক্য নেই। সুন্নি আইন সম্প্রদায়ের মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গির কিছু পার্থক্য রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, হানাফিরা কিয়াসের ওপর এবং হাম্বলিরা হাদিসের ওপর বেশি নির্ভরশীল। কিন্তু এটা কোনো মৌলিক পার্থক্য নয়; আর তা নয় বলেই এক মজহাবের লোক একই সময়ে অন্য মজহাবে আস্থাশীল থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে এ-ও উল্লেখ্য যে, প্রায় দুই শতাব্দী আগে পারস্যবাসী নাদির শাহ জাফরি আইনকে চারটি সুন্নি মজহারের পর ইসলামের পঞ্চম মজহাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সুন্নি ও শিয়া আইনের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মূলত রাজনৈতিক কারণে সেদিনের অটোমান খলিফা নাদির শাহের এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। সুন্নি ও শিয়া বিশ্বাসের মধ্যে আপোসরফার এ প্রচেষ্টা আজও কোনো কোনো মহলে অব্যাহত পয়েছে।

তথ্যসূত্র

  • J. Schacht The Origins of Muhammadan Jurisprudence.
  • ডঃ আমিনুল ইসলাম, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.