ওয়াহাবি ও সেনুসি আন্দোলন, শাহ ওয়ালিউল্লাহ্‌ এর দর্শন, ফারাইজি, আহলে হাদিস ও কাদিয়ানি মতবাদ

ওয়াহাবি ও সেনুসি আন্দোলন

ভূমিকা

জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও মুক্তবুদ্ধির অনুশীলনে মুসলমানরা মধ্যযুগে যে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রচনা করেছিল, ক্রমশ তা তার শক্তি ও গতি অনেকটা হারিয়ে ফেলে। বিশেষত ইবনে রুশ্‌দ-এর পর থেকে মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক ভুবন সমাচ্ছন্ন হতে থাকে এক অতিশয় রক্ষণশীল, কোথাও কোথাও প্রতিক্রিয়াশীল মনোবৃত্তি দ্বারা। যেমন, ইবনে রুশ্‌দ-এর দার্শনিক রচনাবলিকে প্রত্যাখ্যান ও নিন্দা করা হয় ধর্মবিরোধী বলে, ইজমা ও ইজতিহাদকে প্রত্যাখ্যান করা হয় একই অজুহাতে। প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য মুসলমানদের প্রতি ইসলামের যে নির্দেশ, এ সময়ের মুসলমানরা বহুলাংশে ব্যর্থ হলো তা পালন করতে। প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে অনেকেই আকৃষ্ট হয়ে পড়লো অতিপ্রাকৃতের প্রতি এবং ইহলোকের কথা ভুলে গিয়ে ভাবতে লাগলো কেবল পরলোকের কথা। ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো পীর-দরবেশ ও সুফি সম্প্রদায়ের সংখ্যা।

এমনিতে মরমিবাদ কিছু দোষের নয়, বরং আমরা লক্ষ্য করেছি যে, মুসলিম চিন্তায় অতীতে এমন কিছু সুফি ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল যাঁরা মুসলিম দর্শন ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন নানাভাবে। কিন্তু আলোচ্য অবক্ষয়ের আমলে সুফিরা ব্যর্থ হলেন অতীতের সেই সজীব শক্তি হিসেবে কার্যকর থাকতে এবং প্রচার ও অনুশীলন করলেন এক জীবনবিমুখ জীবনাচরণ। স্বাভাবিক কারণেই এর ফল হলো মারাত্মক। মুসলমানদের মধ্যে বিস্তার লাভ করলো দারিদ্র্য, কুসংস্কার ও অনৈক্য এবং মুসলিম দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে অব্যাহত রইলো ক্রমিক অবক্ষয়।

ওয়াহাবি আন্দোলন

মুসলমানদের করুণ অবস্থা এবং মুসলিম সমাজের বিরাজমান বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে প্রথম সংস্কারধর্মী প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় ১৮শ শতকের আরবে রচিত ওয়াহাবি আন্দোলনে। অজ্ঞতার (জাহেলিয়া) শক্তিসমূহের মোকাবেলা করতে এবং মুসলমানদের আদি ইসলামের গৌরবময় অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৮৭) ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। স্বভাব ও আচরণের দিক থেকে তিনি ছিলেন শুদ্ধাচারী এবং তার চরিত্রের আধ্যাত্মিক প্রভাব দ্রুত বিস্তার লাভ করে মুসলিম জাহানের সর্বত্র, বিশেষত ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন সহ আরব রাষ্ট্রসমূহে। আবদুল ওয়াহাব একাধারে ছিলেন একজন সুপণ্ডিত, ধর্মসংস্কারক, মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রবক্তা এবং সর্বোপরি একজন সুবক্তা। এসব গুণের কল্যাণেই তিনি একদিকে অর্জন করেন ব্যাপক খ্যাতি এবং অন্যদিকে রেখে যান তার ব্যক্তিত্বের সুগভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। বস্তুত, তার সমসাময়িক আরবদের মধ্যে এমন কেউ ছিলেন না যিনি মানুষের আস্থা ও সম্মান অর্জনে এবং জনমনে প্রভাববিস্তারে তার সমকক্ষতা দাবি করতে পারেন।

আবদুল ওয়াহাব আরবদেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নাজদের অন্তর্গত ওনায়না নামক একটি ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শিক্ষাদীক্ষা ও ধার্মিকতার জন্য তা ছিল বিখ্যাত। তার দাদা ও বাবা ছিলেন হাম্বলিপন্থী ধর্মীয় বিচারক (কাজি)। সেই হাম্বলি পরিবেশেই প্রতিপালিত হন তিনি এবং আস্থাশীলও থাকেন হাম্বলি ভাবাদর্শের প্রতি। তার ধর্মীয় পড়াশোনা শুরু হয় নিজ বাড়িতে। কিন্তু পরবর্তীতে উচ্চতর শিক্ষালাভ করেন মদিনা, বসরা ও দক্ষিণ ইরাকে। তিনি পারস্যসহ বহু দেশ পর্যটন করেন এবং শেষ পর্যন্ত স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন জন্মস্থানে। শৈশব থেকেই ওয়াহাব গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন কোরআন ও হাদিস অধ্যয়নে এবং তখনই সংকল্প গ্রহণ করেন মুসলমানদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সর্বশক্তি নিয়োগের। এ লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টায় তিনি যাতায়াত করেন আরবদেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে এবং উচ্চারণ করতে থাকেন ‘ইসলামে ফিরে যাও’ ধ্বনি। এ ধ্বনি নিয়ে তিনি যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানকার জনমানসে সঞ্চার করেছেন নবপ্রাণ ও প্রেরণার এবং মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেছেন অন্ধকারময় ও অবক্ষয়গ্রস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণ লাভে।

কিছুদিন যেতে না যেতেই আবদুল ওয়াহাব অনুভব করলেন যে, রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া নিছক প্রচারণা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফলপ্রসূ হলেও এ দিয়ে জনমনে কোনো বড়রকমের পরিবর্তনসাধন সম্ভব নয়। এজন্যই তিনি সিদ্ধান্ত নেন আরবদেশের বিভিন্ন গোত্রের মানুষকে একটিমাত্র পতাকার নিচে সমবেত করার। এ সিদ্ধান্ত অনুসারেই তিনি শরণাপন্ন হলেন উবাইনার আমিরের। শুরুতে আমিরের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত অনুকূল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। ওলামাসমাজসহ বিভিন্ন মহলের বিরোধিতার মুখেই ওয়াহাব অব্যাহত রাখেন তার আন্দোলন এবং তার মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে। এরপর তিনি সরকারি সমর্থন লাভ করেন এবং শেষ পর্যন্ত একতাবদ্ধ করে ফেলেন আরবদেশের মুসলমানদের। তার এই একতার বাণী যথার্থই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মহানবী-প্রতিষ্ঠিত মুসলমানদের আদি ঐক্যের কথা।

১৭৮৭ সালে আবদুল ওয়াহাবের মৃত্যুর পর বাদশা সাউদ নিষ্ঠার সঙ্গে ওয়াহাব প্রণীত কর্মসূচি কার্যকর করেন। নতুন ওয়াহাবি রাষ্ট্রটি পরিচালিত হতে থাকে আদি মক্কীয় খেলাফতের আদলে। (Stoddard, The New World of Islam (New York, 1925) p. 28) দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে সূচিত হয় এক বড়রকমের পরিবর্তন। সুদৃঢ় সামরিক শক্তির অধিকারী হয়েও বাদশা সাউদ ভাবতে শুরু করেন নিজেকে জনমতের কাছে জবাবদিহি করার কথা এবং বিরত থাকেন প্রজাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ থেকে। সৌদি সরকার ছিল অত্যন্ত কঠোর মনোভাবাপন্ন, অথচ সফল ও ন্যায়নিষ্ঠ ওয়াহাবি বিচারকরাও ছিলেন যোগ্য ও সৎ। চুরিডাকাতি ছিল প্রায় অনুপস্থিত, এবং সর্বত্র বিরাজ করে শান্তি-শৃঙ্খলা।

নাজদকে রাজনৈতিক দিক থেকে একতাবদ্ধ করার পর সাউদ হাত দিলেন ইসলামকে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অনৈসলামিক বিশ্বাস ও আচার থেকে মুক্ত করার কাজে এবং সংহত করে তুললেন মুসলমানদের আদি ইসলামে ফিরিয়ে নেয়ার আন্দোলনকে। তিনি মুসলমানদের মুক্ত করতে চাইলেন মধ্যযুগের ধর্মতাত্ত্বিকদের স্কলাস্টিক ভাষ্য, পীর-দরবেশের উপাসনা প্রভৃতি সেসব আচার-আচরণ ও কুসংস্কার থেকে যেগুলোর পেছনে কোনো শাস্ত্রীয় অনুমোদন নেই। ফলে কঠোরভাবে নিন্দা করা হয় এসব ভ্রান্ত আচারের এবং জোর তাগিদ দেয়া হয় এগুলো বর্জনের। মহানবীর আমলের বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদ (তৌহিদ) অনুশীলনের কথা প্রচার করা হয় এবং কোরআন ও সুন্নাহকে ঘোষণা করা হয় মানুষের বিশ্বাস ও আচরণের উৎস বলে। মোট কথা, সমকালিন পতনের সঙ্গে যুক্ত শৈথিল্য ও দুর্নীতি, মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধি, মরমিবাদী তন্ময়তা ও পারলৌকিক ধার্মিকতা এবং দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত বুদ্ধিবাদকে প্রত্যাখ্যান ও সচেতন ইসলামি আইনের ওপর নিরঙ্কুশ গুরুত্ব অরোপের মাধ্যমে মুসলিম জাতিকে তার আদি পবিত্রতায় ফিরিয়ে নেয়া এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের ঘোষিত লক্ষ্য। আবদুল ওয়াহাব ও তার সমর্থকদের মতে, সর্বপ্রকার অভিনবত্ববিবর্জিত সঠিক আইনানুশীলনের মধ্যেই নিহিত যথার্থ ধার্মিকতা এবং ধার্মিকতার অনুশীলনেই নিহিত ইসলামের অকৃত্রিম আদর্শ। এ ছাড়া অন্য সবকিছুই বাহুল্য, সবকিছুই ভ্রান্ত।

ওয়াহাবি মতবাদ সৌদি আরবের সরকারি দৃষ্টিতে যথার্থ ইসলামি মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি ও সমর্থন লাভ করেছে। ওখানকার রাজপরিবার সর্বতোভাবে ওয়াহাবি মতাদর্শে দীক্ষিত। রাষ্ট্রের মুফতি ও প্রধান কাজি ওয়াহাবি ধারণার প্রতি আস্থাশীল এবং তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন ওলামাসমাজকে। কোরআনকে গ্রহণ করা হয়েছে রাষ্ট্রের সংবিধান হিসেবে এবং শরিয়া আইন ও এর অন্যান্য উৎসসমূহকেও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বাদশা ও প্রজাদের সকলের জন্য। তবে সৌদি আরবের বাইরে ওয়াহাবি সমর্থকদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। বিশেষত ইয়েমেন ও দক্ষিণ আরবে ওয়াহাবি সমর্থকদের সংখ্যা খুবই কম। ওমানের কিছু কিছু গোত্র ১৯শ শতকের প্রথম থেকেই ওয়াহাবি মতবাদের প্রতি আস্থাশীল। ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের ব্যাপ্তি খুবই সীমিত বটে; কিন্তু বিগত দুই শতকে এ মতের প্রভাব খুবই ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী প্রমাণিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের এক বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তি ওয়াহাবি মতবাদকে আধুনিক ইসলামের একটি মুখ্য ও প্রভাবশালি মতবাদ বলে অভিহিত করেছেন। (W. Cantwell Smith. Islam in Modern History. p. 41)।

ওয়াহাবিবাদ সুফিবাদের অনুমোদন করে না বটে; কিন্তু এ দুটি আন্দোলনের মধ্যে বেশকিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ১৯শ শতকের এক মহান সুফি ও সাধক আহমদ বিন ইদ্রিস আরবে বসবাস করেন এবং সেখানেই ১৮৩৭ সালে পরলোকগমন করেন। ঠিক সেবছরই তার শিষ্য মোহাম্মদ বিন আলি আল-সেনুসি মক্কায় প্রতিষ্ঠা করেন তার সম্প্রদায়ের মূলমন্ত্র। ইদ্রিসিয়া ও সেনুসিয়া উভয় সম্প্রদায়ই কমবেশি ওয়াহাবিবাদের সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া মরমিবাদের বিরোধী হলেও ওয়াহাবিবাদের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল ওয়াহাব ত্রিশের বয়সসীমা পর্যন্ত ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান সুফি।

কেউ-কেউ অবশ্য ওয়াহাবি আন্দোলনকে একটি অতীতমুখী রক্ষণশীল আন্দোলন বলে সমালোচনা করেছেন। তা ঠিক, কিন্তু আরবদের জন্য এই রক্ষণশীলতা ইতিবাচক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এ আন্দোলন আরবদের শুধু আত্মসমালোচনা ও আত্মানুসন্ধানের জন্যই সজাগ করে দেয়নি, একই সঙ্গে তাদের জাগিয়ে দিয়েছে সেই মোহনিদ্রা থেকে যা নিহিত ছিল যাকে তারা অবক্ষয় বলে মনে করে তার মূলে। এ আন্দোলন তাদের মনে যে শক্তি ও গতির সঞ্চার করে তা-ই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল একাধিক কর্মসূচি গ্রহণে। তা তাদের এ শিক্ষা দিয়েছিল যে, ইসলামের নবজাগরণের উদ্বোধন ঘটাতে শুধু কিছু গৌণ সূত্র ও গতানুগতিক প্রথার ওপর নির্ভর করলেই চলবে না, সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হবে সমকালীন বাস্তবতাকে। ইসলামের অকৃত্রিম আদি ভিত্তির ওপরই রচনা করতে হবে নতুন অগ্রগতির কর্মসূচি। ইসলামের সঙ্গে যুক্ত সুস্থিত সাংস্কৃতিক কাঠামো থেকে বিচ্যুত হওয়া এবং নতুন অনৈসলামিক সামাজিক আদর্শ অনুসন্ধান মুসলমানদের মধ্যে নবপ্রাণের সঞ্চার করবে না, বরঞ্চ ইসলামি সংস্কৃতির জন্য ডেকে আনবে ক্রমিক অবক্ষয় ও অধঃপতন।

সেনুসি আন্দোলন

ইসলামের আদি পবিত্রতা ও শক্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ইসলামি জগতের দিকে দিকে যেসব নবজাগরণের আন্দোলন রচিত হয় সেনুসি আন্দোলন সেগুলোর একটি। বহিরাক্রমণের ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশ রোধ করা, ইসলামের আদি পবিত্রতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি পৃথিবীর সব মুসলিম দেশের মধ্যে একটি সুদৃঢ় ঐক্য সংস্থাপন ছিল এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। সেনুসি আন্দোলন ও দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আলজেরিয়ার সাইয়েদ মোহাম্মদ বিন আল-সেনুসি (১৭৮৭-১৮৫৯)। তার আবির্ভাব ঘটে এমন এক সময়ে যখন অটোমান শাসকদের দুঃশাসনের ফলে আলজেরিয়ায় দেখা দেয় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। দেশের এ দুরবস্থা এবং শাসকদের নির্যাতনমূলক আচরণ প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত বোধ করেন সেনুসি। তিনি প্রয়াসী হলেন এ সঙ্কট থেকে উত্তরণলাভে।

সেনুসি আলজেরিয়ার বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষকের কাছে কোরআন, হাদিস ও মুসলিম আইনবিজ্ঞানে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এরপর তিনি মরক্কোতে যান এবং ফেজ শহরে দীর্ঘ আট বছর অধ্যয়ন করেন। অতঃপর ত্রিশ বছর বয়সে তিনি মিশরে যান এবং সেখানে আরো কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষকের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন। শুধু তা-ই নয়, মিশর থেকে তিনি হেজাজে যান এবং সেখানেও বিভিন্ন বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষকদের কাছে অধ্যয়ন করেন। এসব শিক্ষকের সংস্পর্শে থাকাকালেই সেনুসি তাদের সুফি মতাবলির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তবে কিছুটা প্রভাবিত হলেও তিনি তাদের কারো শিক্ষাই সর্বতোভাবে গ্রহণ করেননি। তার উদ্দেশ্য ছিল এদের সকলের ধারণা ও আচারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং এসব ধারণার মধ্যে যেগুলো গ্রহণযোগ্য কেবল সেগুলোকেই গ্রহণ করা।

বিভিন্ন দেশ সফর করে এবং বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সেনুসির মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হলো যে, সমগ্র মুসলিম-জগতের মধ্যে ঐক্যপ্রতিষ্ঠা এবং ইসলামের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার একমাত্র উপায় প্রথমেই ইসলামের আদি বিশুদ্ধতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। আর এ লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়াকেই তিনি স্থির করলেন তার জীবনের এক প্রধান কর্তব্য বলে। তার মতবাদ প্রচারের জন্য তিনি কিছু সাথী ও শিষ্য নিয়ে তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিশর, হেজাজ প্রভৃতি বহু স্থান পর্যটন করেন এবং বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের বিরোধিতার সম্মুখীন হন। কিন্তু এ সত্ত্বেও সেনুসি মতবাদ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে এবং ১৮৫৯ সালে সেনুসির মৃত্যুকাল অবধি বহু শিষ্য এ মতে দীক্ষালাভ করে। সেনুসি মতের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও সমর্থনদৃষ্টে তদানীন্তন অটোমান সরকার এ মতের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। কথিত আছে যে, সেনুসি মতের প্রতি অটোমান সরকারের সমর্থন ও আনুকূল্যের নিদর্শনস্বরূপ সুলতান আবদুল মজিদ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সেনুসি সম্পত্তিকে সরকারি করমুক্ত করে একটি ফরমান জারি করেছিলেন।

সেনুসির মৃত্যুর পর ১৮৫৯ সালে তার পুত্র সাইয়েদ মোহাম্মদ আল-মাহাদি সেনুসি সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মাহাদির নেতৃত্বে এ সম্প্রদায়ের আরো বিস্তার ঘটে। বস্তুত, সম্প্রদায়টি তখন এতই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে, শুধু তুর্কি সরকারই নয়, নেতৃস্থানীয় ইউরোপীয় শক্তিসমূহও তখন এর মিত্রতা কামনা করে। কিন্তু সরকারি সমর্থন পেলেও সেনুসি নেতৃত্ব সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকেন এবং রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণের সরকারি অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। ইউরোপীয় শক্তিসমূহের সঙ্গেও সেনুসিদের সম্পর্ক ছিল খুবই সংযত। ১৮৭২ সালে জার্মানি সাইয়েদ আল-মাহাদিকে উত্তর আফ্রিকায় ও পশ্চিম আফ্রিকায় ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য প্ররোচিত করে ব্যর্থ হয়। ১৮৮১ সালে সেনুসিরা ইতালীয়দের অনুরূপ একটি অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।

১৮৯৯ ও ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ফরাসি সৈন্যদের সঙ্গে স্থানীয় সেনুসি শক্তির অনেকগুলো সংঘর্ষ ঘটে। তাতে কখনো সেনুসিদের এবং কখনো ফরাসিদের বিজয় ঘটে। কিন্তু ১৯০২ সালে সাইয়েদ আল-মাহাদির মৃত্যুর ফলে সেনুসি সম্প্রদায়ের বিরাট ক্ষতি হয় এবং ফরাসিদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। পরবর্তী সেনুসিপ্রধান সাইয়েদ আহমদ আল-শরিফ অবস্থা সুবিধা নয় দেখে ফরাসিদের অগ্রযাত্রা এবং আফ্রিকা-দখলের অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সতর্ক হয়ে যান। তিনি ছিলেন গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী, এবং এজন্যই তিনি সামরিক শক্তি প্রয়োগের চেয়ে ধর্মকর্মে নিয়োজিত থাকাকে অধিকতর শ্রেয় বলে মনে করেন। তার এ সিদ্ধান্তের ফলে সাইয়েদ আল-মাহাদির আমলে অর্জিত রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এ ছাড়া সাইয়েদ আল-মাহাদির মৃত্যুর পর সেনুসি পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার বিরোধ সম্প্রদায়টির ঐক্য, শক্তি ও প্রভাবকে বিঘ্নিত করে। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ইতালি যখন লিবিয়া আক্রমণ করে, তখন সেনুসি সম্প্রদায় ছিল সুনিশ্চিত পতনের মুখে।

সেনুসি দর্শন

সেনুসি আন্দোলন ছিল মূলত একটি শুদ্ধাচারী ও সংস্কারধর্মী আন্দোলন। এর লক্ষ্য ছিল ইসলামকে ধর্মবিরুদ্ধ বিদেশী বিশ্বাস ও আচরণ থেকে মুক্ত করা এবং ইসলামের আদি বিশুদ্ধতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তবে প্রারম্ভিক পর্বে শুধু ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হলেও ক্রমশ তা এক রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ লাভ করে। সম্প্রদায়টি ছিল মূলত সুফি মতবাদে বিশ্বাসী এবং এর আহ্বান ছিল শুদ্ধাচার ও ইসলামের যথার্থ নির্দেশ ও আচরণসমূহে প্রত্যাবর্তনের। এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব আত্মার বিশুদ্ধতা অর্জনের মাধ্যমে। আর ঐশী যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব কেবল আত্মাকে কলুষমুক্ত ও বিশুদ্ধ করার মাধ্যমে। সেনুসি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আল-সেনুসি এমন সাতটি পর্বের কথা উল্লেখ করেন যেগুলোর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আত্মা পরিষ্কৃত ও আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হতে পারে। মুসলমানরা তাদের দৈনন্দিন এবাদতের সময় যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং হাদিসকে কীভাবে বুঝতে ও অনুশীলন করতে হয়, সে সম্পর্কেও তিনি বিস্তৃত আলোচনা করেন।

তবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে অন্যান্য সুফি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সেনুসিদের বেশকিছু মতপার্থক্য ছিল। যেমন, অন্যান্য সুফি সম্প্রদায় গভীর ধ্যান, সরব জিকর, গান-বাজনা প্রভৃতি অনুশীলনের সমর্থন করে এ যুক্তিতে যে, এসবের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট সুফি তার দৈহিক অহং থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। এ ধারণার বিরোধিতা করে সেনুসি মতের প্রবক্তারা ধর্মব্যাখ্যায় যৌক্তিক পদ্ধতি অনুশীলনের পরামর্শ দেন। সেনুসি দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এখানে একদিকে ওলামা-অনুসৃত শরিয়া এবং অন্যদিকে সুফিদের অনুসৃত অনুধ্যানিক পদ্ধতি – ইসলামি ধর্মীয় চিন্তার এ দুটি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে সংযুক্ত ও সমন্বিত করার চেষ্টা করা হয়। এ প্রসঙ্গে সেনুসি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ শেখ সেনুসি ছিলেন ইবনে তাইমিয়ার মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত, যদিও সুফিদের প্রতি মনোভাবের দিক দিয়ে তাইমিয়ার সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেননি। তাইমিয়া যেখানে ছিলেন সবরকম সুফি শিক্ষা ও পদ্ধতির বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেখানে সেনুসি এবং তার অনুগামীরা সুফিদের প্রতি ছিলেন সহিষ্ণু ও শ্রদ্ধাশীল।

সাইয়েদ সেনুসি তার নিজের সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার আগে প্রচলিত সব সুফি সম্প্রদায়ের তত্ত্ব ও আচারসমূহ সতর্কতার সঙ্গে অধ্যয়ন ও পরীক্ষা করে দেখেন এবং তাদের যেসব ধারণা ও আচারকে তিনি উত্তম ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন, সেগুলোকে তার নিজের মতের অন্তর্ভুক্ত করেন। এদের সবগুলোকে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অধ্যয়ন করেছেন এবং এদের দ্বারা তিনি প্রভাবিতও হয়েছেন বটে, কিন্তু একথা বলা সংগত নয় যে, তার মতটি ছিল এসব মতেরই নিছক সংমিশ্রণ। বরং পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, সেনুসি মতবাদটি ছিল একটি সুসংবদ্ধ ও সুচিন্তিত জীবনদর্শন।

সেনুসি আন্দোলন ইসলামে কোনো নতুন মৌলিক উপকরণ সংযোজন করেনি। এটি ছিল নিতান্তই একটি আধুনিক পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন। এ আন্দোলন ছিল সুন্নি ভাবাদর্শ থেকে উদ্ভূত, এবং একে যথার্থই অভিহিত করা যায় একটি রক্ষণশীল মতবাদ বলে। এর অনুপ্রেরণার উৎস ছিল মালেকি সম্প্রদায়। সাইয়েদ সেনুসি নিজে কোরআন ও হাদিসকে ইসলামি আইনের মূল উৎস বলে মনে করতেন। আইনের উৎস হিসেবে কিয়াস (সাদৃশ্যানুমান) ও ইজমা (ঐকমত্য)-কে স্বীকৃতি দিলেও তিনি এদের মনে করতেন গৌণ গুরুত্বের অধিকারী বলে। অবশ্য ইজতিহাদ (স্বাধীন চিন্তার অধিকার) বিষয়ে খোদ সেনুসি যে অবস্থান গ্রহণ করেন, সেটি ছিল খুবই বলিষ্ঠ। তার মতে, ইসলামের যথার্থ উপলব্ধি ও বিকাশের জন্য যুক্তির স্বাভাবিক প্রয়োগ প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। তার এ দুঃসাহসিক মতবাদ সেদিনের মিশর ও হেজাজের ওলামা সম্প্রদায়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং তাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ত রূপ ধারণ করে।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ

ভূমিকা

পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে কোনোমতেই উপেক্ষা করা যায় না, এই চেতনা ও দাবি থেকেই মুসলিম জাহানে সূত্রপাত ঘটেছিল আধুনিক যুগের। কিন্তু এ দাবির বাস্তবায়ন ছিল এক সুকঠিন ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একথা অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি সত্য ভারতীয় উপমহাদেশের বেলায়। পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে ইসলামের সম্মিলন ও সমন্বয়ের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র বিরোধ। কিন্তু এ সত্ত্বেও যারা এ সমন্বয়কে মুসলমানদের যথার্থ উন্নতির জন্য আবশ্যিক বলে মনে করেন এবং সেই লক্ষ্যে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে দিল্লির বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন অন্যতম।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-৬২) ইসলাম ধর্ম পুনর্ব্যাখ্যার এমন এক নতুন পদ্ধতি সমর্থন ও প্রচার করেন যা ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করে সকমালীন ও পরবর্তীকালের মুসলিম-মানসে ইউরোপের সঙ্গে ওয়ালিউল্লাহর কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না বটে; কিন্তু এ সত্ত্বেও তার চিন্তা ও রচনায় যে সমন্বয়ধর্মী চেতনা লক্ষণীয় তা ইসলামি ও ইউরোপীয় উভয় সংস্কৃতি আত্তীকরণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্বরূপ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি ওয়ালিউল্লাহ ইসলামি বিজ্ঞানসমূহে ব্যাপক ও প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং তার পিতা পরিচালিত একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ঊনত্রিশ বছর বয়সে তিনি হজপালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় যান এবং ওখানে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। আরবদেশে দু’বছর অবস্থানের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং রচনাকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। ৬৩ বছর বয়সে পরলোকগমন পর্যন্ত তিনি বিদ্যাচর্চা ও সংস্কারধর্মী প্রয়াসে নিয়োজিত ছিলেন। ওয়ালিউল্লাহ যেসব বিষয়ে মূল্যবান রচনা রেখে যান সেগুলোর মধ্যে রয়েছে তসফির, হাদিস, ইসলামি আইন, অধিবিদ্যা প্রভৃতি।

সংস্কার পরিকল্পনা

শাহ ওয়ালিউল্লাহ নিঃসন্দেহে ছিলেন এ উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত। কিন্তু এটিই তার একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি ছিলেন একাধারে একজন অসাধারণ চিন্তাবিদ, পণ্ডিত ও সংস্কারক। তার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনাকে সুদৃঢ় ও সংহত করা এবং তাদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা সৃষ্টি করা। তার মতে, ইসলাম ধর্ম ও ইসলামি আইনের চূড়ান্ত উৎস কোরআনের বিচারশীল অধ্যয়ন ও উপলব্ধি ব্যতিরেকে এ কাজ সম্পন্ন করা কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু এই ধর্মগ্রন্থ যেখানে রচিত আরবি ভাষায়, সেখানে অনেক মুসলমানের প্রধান ভাষা ফার্সি। এ কারণেই অধিকাংশ মুসলমান কোরআনের অর্থ অনুধাবনে সমর্থ নয়। মুসলমানদের এ অসুবিধার কথা বিবেচনা করেই শাহ ওয়ালিউল্লাহ ব্রতী হলেন কোরআনের ফার্সি অনুবাদে এবং এ কাজ তিনি সম্পন্ন করলেন ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে। উল্লেখ্য যে, তার অনুবাদ ছিল কোরআনের প্রথম ফার্সি অনুবাদ। এভাবে কোরআন পরিচিত হয়ে উঠলো ফার্সি ভাষার সঙ্গে পরিচিত সব মহলে এবং তা-ই উন্মোচিত করলো উপমহাদেশে ইসলামি অধ্যয়নের এক নতুন দিগন্ত। তার দুই পুত্র রফিউদ্দিন ও শাহ আবদুল কাদের অনুসরণ করলেন পিতার পদাঙ্ক এবং কোরআনের অনুবাদ করলেন উর্দু ভাষায়।

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর (১৭০৭) মুসলিম শক্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ১৭৩১ সালে শাহ ওয়ালিউল্লাহ যখন কাবা শরিফের চতুরে ধ্যানমগ্ন, তখন তিনি স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ লাভ করেন স্বদেশের সংস্কারকর্মে আত্মনিয়োগের। তখন থেকে তিনি যে সংস্কার আন্দোলন রচনা করেন তাতে রয়েছে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা নারীর পুনর্বিবাহের অধিকার প্রতিষ্ঠা, বিবাহের সময় অত্যধিক দেনমোহর ধার্য রহিত করা, বিবাহ অনুষ্ঠানে অতিমাত্রায় অর্থ খরচ বন্ধ করা প্রভৃতি কর্মসূচি।

আধুনিক মুসলমানদের প্রতি ওয়ালিউল্লাহর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান এই যে, কোনো ধর্মীয় নির্দেশ গ্রহণ কিংবা ধর্মীয় কর্তব্য পালনের নিহিতার্থকে তিনি ধর্মীয় ও দার্শনিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। তাই দেখা যায় হুজ্জাত আল্লাহ আল-বালিগাহ নামক তার প্রধান গ্রন্থে তিনি ধর্মের সুগভীর অর্থ (আসরার আল-দ্বীন) নিয়ে আলোচনা করেন। বস্তুত, ধর্মই ছিল ওয়ালিউল্লাহর দার্শনিক চিন্তার ভিত্তি। তার মতে, ধর্মই মুসলমানদের শক্তির উৎস এবং ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণা ও বিরাগের ফলেই সংঘটিত হয় তাদের পতন। সুতরাং মুসলমানদের হৃত ঐতিহ্য ও মর্যাদা ফিরে পেতে হলে তাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে ইসলামের যথার্থ শিক্ষায়। এ উদ্দেশ্যেই তিনি প্রয়াসী হন যথার্থ ইসলামি নীতি ও আদর্শকে যাবতীয় অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত এবং সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত বৌদ্ধিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার কাজে।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর আগে ধর্মকে বিবেচনা করা হতো নিতান্তই একটি বিশ্বাস ও উপাসনার বিষয় হিসেবে। কিন্তু তিনি পরিবর্তন ঘটালেন এই প্রচলিত মতের। তার যুক্তিটি ছিল এরকম ধর্ম নিতান্তই একটি মানসিক কিংবা তাত্ত্বিক ব্যাপার নয়। ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক ভূমিকা রয়েছে। ধর্ম নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করে আমাদের জীবনকে এবং পরিণামে তা আমাদের পরিণত করে উৎকৃষ্টতর ও উন্নততর মানুষে।

অন্যান্য সব প্রাচীন মুসলিম চিন্তাবিদের ন্যায় ওয়ালিউল্লাহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা থেকে উদ্ভূত অধিবিদ্যক সমস্যাবলি। অন্যান্য অঙ্গনের ন্যায় এখানেও তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমন্বয়ধর্মী এবং তার মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন বিবদমান চিন্তাস্রোতসমূহকে সমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা। বিশেষত তিনি ইবনুল আরাবিমুজাদ্দিদ, এ দু’জন সুফির বিরোধী মতবাদসমূহকে সমন্বিত করার প্রয়াস পান।

আল্লাহ, জগৎ ও মানুষ

শাহ ওয়ালিউল্লাহর মতে, জড়জগৎ ও তার স্রষ্টার মাঝখানে রয়েছে এক আধ্যাত্মিক জগৎ। আল্লাহর সব পরিকল্পনা প্রথমে প্রতিফলিত হয় আধ্যাত্মিক জগতে এবং এরপর সেগুলো বিভিন্ন আকারে বাস্তবায়িত হয় জড়জগতে। আধ্যাত্মিক ও বাস্তব জগতের সম্বন্ধ খুবই নিকট ও নিবিড় এ অর্থে যে, আধ্যাত্মিক জগতে যা থাকে স্রেফ পরিকল্পনার পর্যায়ে, তা-ই বাস্তব রূপ লাভ করে পার্থিব জড়জগতে। ওয়ালিউল্লাহ এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন স্বপ্নের দৃষ্টান্ত দিয়ে। স্বপ্নে দেখা ঘটনাবলি প্রথম পরিলক্ষিত হয় এমন অস্তিত্ববিহীন ছায়া বলে যা জড়ীয় মূর্ত রূপ লাভ করতে পারে জাগ্রত জীবনে। এ অর্থে যে-কোনো প্রামাণিক স্বপ্নকে তুলনা করা যেতে পারে আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে। একজন সাধারণ মানুষের কাছে আধ্যাত্মিক জগতের ঘটনাবলিকে অবাস্তব ও বিমূর্ত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু নবী-পয়গম্বরদের কাছে সেগুলোই বাস্তব ও মূর্ত।

দেশ ও কালের স্বরূপ প্রসঙ্গে ওয়ালিউল্লাহ বলেন। কাল ব্যতিরেকে দেশ এবং দেশ ব্যতিরেকে কাল অভাবনীয়। এ দুটি পৃথক ক্যাটেগরি নয়, বরং একই দেশ-কাল ধারাবাহিকতার অংশস্বরূপ। দেশ ও কাল অবিচ্ছেদ্য, এবং তাদের সম্বন্ধ যদি তেমনটি না হতো তা হলে পৃথিবী নিপতিত হয়ে যেত অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় এবং পরিণামে জগৎ হতো অনিবার্য ধ্বংসের সম্মুখীন। (Shah Wali Allah, al-Khair al kathir (ed Bashir Ahmed, Benares). pp. 29-30) আমরা যাকে জড় বলি তা দেশ-কালেরই বাহ্য আকারস্বরূপ। বস্তুত, দেশ-কালের আলোকেই জড়কে বোঝা ও উপলব্ধি করা যায়।

ইচ্ছার স্বাধীনতা

ইচ্ছার স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণবাদবিষয়ক ঐতিহাসিক বিতর্কেও ওয়ালিউল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমন্বয়বাদী। তার মতে, অদৃষ্ট নিতান্তই একটি বিশ্বাসের ব্যাপার এবং এর বাস্তবতা কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত ও বিধৃত। কোরআনের মতে, এ জগতের সব সত্তা ও ঘটনা সচেতন ঐশ্বরিক ইচ্ছার ফল। আল্লাহর ইচ্ছা থেকে এক তিল বিচ্যুত হওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। (Cf Hujjal Allah al balighah vol pp 65-66.) তবে ওয়ালিউল্লাহ বলেন একথার অর্থ এই নয় যে আমাদের স্বাধীনইচ্ছার অস্তিত্ব অস্বীকার ও অনপেক্ষ নিয়ন্ত্রণবাদ গ্রহণ করতে হবে। আসলে মানুষ নিষ্প্রাণ পুতুল নয়; এবং তাকে পর্দার অন্তরাল থেকে কেউ ধাক্কা দিয়েও চালাচ্ছে না। যদি তা-ই হতো, তা হলে কৃতকর্মের জন্য তাকে দায়ী করা যেত না, নৈতিক শুভাশুভের পার্থক্য করারও কোনো অবকাশ থাকত না। প্রকৃত ইসলাম মানুষকে তার সব কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে দায়ী বলে ঘোষণা করেছে। আল্লাহ ন্যায়পর। আর এ ন্যায়পরতার খাতিরেই পাপের পথ পরিহার ও পুণ্যপথ অনুসরণ করার জন্য মানুষকে স্বাধীনতা প্রদান আবশ্যক। বলা বাহুল্য, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটি শুভ ও একটি অশুভ, এ দুটি প্রবণতা বিদ্যমান। আর এ দুটির মধ্যে একটিকে নির্বাচন করার ক্ষমতা মানুষের অবশ্যই আছে। সুতরাং মানুষের কাজের জন্য আল্লাহকে দায়ী করার প্রশ্ন ওঠে না, উঠতে পারে না।

আন্দোলনের পরবর্তী ধারা : বেরেলভি

শাহ ওয়ালিউল্লাহ রচিত আন্দোলনকে এগিয়ে নেন তার তিন বিশিষ্ট পুত্র। তার তৃতীয় পুত্রের নাম শাহ আবদুল আজিজ। তিনিও ছিলেন ইসলামি বিজ্ঞানে সুপণ্ডিত ছিলেন। পিতা রচিত আন্দোলনকে তিনি সজীব ও গতিশীল রাখেন সামাজিক সংস্কারের এক গঠনমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে। এ আন্দোলনকে সজীব ও সুদৃঢ় করার ব্যাপারে এরপর যারা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল আজিজের বিশিষ্ট শিষ্য সৈয়দ আহম্মদ বেরেলভি। বেরেলভি ও তার সহকর্মীদের (বিশেষত শাহ ইসমাঈল শহীদের) চেষ্টায় এ আন্দোলন মসজিদের মিম্বর থেকে ছড়িয়ে পড়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তম পরিমণ্ডলে। এ আন্দোলনের প্ররম্ভিক লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার; কিন্তু অচিরেই তা প্রবাহিত হলো রাজনৈতিক ও সামাজিক খাতে। এ সময়ে পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের একটা বিরাট অংশ ছিল শিখদের অধীনে। এরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে প্রায়শই বিঘ্ন ঘটায় এবং মুসলমানদের নানাভাবে নির্যাতন করে। এর প্রতিবাদেই সৈয়দ আহম্মদ বেরেলভি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন (শাহ আজিজের পরামর্শক্রমে) শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনার।

এ উদ্দেশ্যেই বেরেলভি তার সাথী ও শিষ্যদের নিয়ে শিখ অঞ্চলে প্রবেশ করেন। এবং বাহওয়ালপুর, সিন্ধু, আফগানিস্তান প্রভৃতি স্থানে জেহাদ শুরু করেন। প্রথমে মুজাহিদরা বিজয়ী হন এবং এর ফলে রঞ্জিত সিংহ নিযুক্ত আফগান গভর্নরকে পেশোয়ার ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু এরপর শিখরা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও নানারকম কূটকৌশল অবলম্বন করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফেলে। বিশেষত তারা মুজাহিদ শিবিরে গুপ্তচর পাঠিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং সৈয়দ আহম্মদ বেরেলভির সংস্কার কর্মসূচি অনৈসলামিক বলে প্রচারণা শুরু করে। ফলে আন্দোলনে সৃষ্টি হয় ফাটল। অবশেষে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে বালাকোটে বেরেলভির সেনাদলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী শত্রুপক্ষের সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করে সৈয়দ আহম্মদ বেরেলভি, শাহ ইসমাঈল শহীদ এবং এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আরো অনেক নেতা নিহত হন।

ফারাইজি  ও তাইওনিয়া মতবাদ

ভূমিকা

১৮শ ও ১৯শ শতকের বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে এমন কিছু আচার ও প্রথা প্রচলিত ছিল যেগুলোর সমর্থনে ইসলামি আইনের কোনো অনুমোদন ছিল না। হিন্দু সমাজের ন্যায় মুসলিম সমাজে বর্ণভেদ প্রথার প্রচলন, মুসলমান কবিদের হিন্দুগীতির প্রতি আকর্ষণ প্রভৃতি আরো অনেক বিরাজমান প্রথাকে ওলামাসমাজ অনৈসলামিক বলে ঘোষণা করেন এবং এগুলো পরিবর্তনের জন্য তাগিদ দিতে থাকেন। এ ধরনের অনৈসলামিক রীতিনীতি ও প্রথা-প্রচলন সংস্কারের কর্মসূচি নিয়েই ১৯শ শতকের বাংলাদেশে অবির্ভূত হন মওলানা কারামত আলি ও হাজী শরীয়তউল্লাহ এবং রচনা করেন যথাক্রমে তাইওনিয়া ও ফারাইজি আন্দোলন। গান-বাজনা, নাচ, পীর-দরবেশের মৃত্যুদিবস উপলক্ষে ওরস অনুষ্ঠান, মাজারে ফুল ও ফলপ্রদান, প্রয়াত ব্যক্তির আত্মার মাগফেরাতের জন্য ফাতেহা অনুষ্ঠান প্রভৃতি আচার-অনুশীলনের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে রচিত হয় তাইওনিয়া আন্দোলন। অন্যদিকে বিয়ে শাদি ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া উপলক্ষে ব্যয়বহুল জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রভৃতির বিরোধিতা করা হয় ফারাইজি আন্দোলনে।

ফারাইজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তউল্লাহ (১৭৭৯-১৮৪০) ছিলেন এক আকর্ষণীয় চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার জন্ম ফরিদপুর জিলার অন্তর্গত শামাইল গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে। মাত্র আট বছর বয়সে তার পিতৃবিয়োগ ঘটে। এরপর তিনি তার এক নিঃসন্তান মামার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন। বারো বছর বয়সে তিনি মামাবাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যান এবং ওখানে এক কোরআন স্কুলের শিক্ষকের সহায়তায় সেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। ওই স্কুলে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা সম্পন্ন হলে উক্ত শিক্ষকের পরামর্শে তিনি ফুরফুরা গমন করেন এবং ওখানে আরবি ও ফার্সি ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি তার অপর এক মামার আনুকূল্যে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ওই সময়েই একদিন তিনি তার মামা ও মামির সঙ্গে নৌকাযোগে গ্রামের বাড়ি শামাইল যাত্রা করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে নৌকাডুবিতে তার মামা ও মামি প্রাণ হারান। এই আকস্মিক দুর্দৈব তার মনে এক বড়রকমের পরিবর্তন ঘটায় এবং তিনি বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে কলকাতা চলে যান। কলকাতায় তিনি আবার তার আগের সেই শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তার সঙ্গে মক্কা যাওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেন। বিশ বছর মক্কায় অবস্থানের এবং ইসলামি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর হাজী শরীয়তউল্লাহ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন এবং তার সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন।

ফারাইজি আন্দোলনের একটি শিক্ষা ছিল এই যে, ভারতবর্ষ যতদিন বিজাতীয় ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের (ব্রিটিশ) শাসনাধীন থাকবে ততদিন এ দেশ ইসলামি দেশ নয়, বেদীনের দেশ (দারুল হারব)। সুতরাং এ অবস্থায় এখানে সাপ্তাহিক জুম্মার নামাজ ও ঈদের নামাজ আদায় করা যায় না। পীর-দরবেশে অতিমানবিক শক্তি আরোপ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা ও রথযাত্রার অনুকরণে হৈ-চৈ করে মহররম পালন, বিয়ে-শাদি কিংবা প্রয়াত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রভৃতির বিরোধিতা করা হয় ফারাইজি আন্দোলনে। এ ছাড়া অতীত পাপের জন্য অনুতাপ এবং ভবিষ্যতে সৎ ও পুণ্য জীবনযাপনের সংকল্পগ্রহণও ছিল এ মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।

শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ মোহসিন ওরফে দুদু মিঞা (১৮১৯-১৮৬০) ফারাইজি আন্দোলনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যে পিতার সমকক্ষ না হলেও ব্যবহারিক প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য তিনি ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বস্তুত, তার সুদক্ষ নেতৃত্বে ফারাইজিরা পরিণত হয়েছিল একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী সঙ্ঘে। সাংগঠনিক সুবিধার্থে তিনি সমগ্র পূর্ববাংলাকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক অঞ্চল দেখাশোনার জন্য একজন করে খলিফা নিযুক্ত করেন। খলিফারা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতাকে অবহিত রাখতেন এবং নিজ নিজ এলাকার জনসাধারণকে জমিদারের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন।

হিন্দু জমিদার এবং ব্রিটিশ প্রশাসকদের বিরুদ্ধে ফারাইজিদের মনোভাব ছিল নিরপেক্ষ, আর এজন্যই এ আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান বিস্তারদৃষ্টে শঙ্কিত হয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন শাসকচক্র। হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকর সাহেবরা ফারাইজি সমর্থকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে এবং তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করে। যেমন, তারা হাজী শরীয়তউল্লাহকে তার নিজ গ্রাম থেকে বহিষ্কার করে এবং দুদু মিঞাকেও একাধিকবার গ্রেফতার করে। এসব অমানুষিক লাঞ্ছনা-নির্যাতন সত্ত্বেও দুদু মিঞা জীবিত থাকাকালে এ আন্দোলন ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকে। কিন্তু এরপর হাজী শরীয়তউল্লাহ কিংবা দুদু মিঞার মতো আর কোনো নেতার আবির্ভাব না ঘটায় এবং রক্ষণশীল আলেমদের তীব্র বিরোধিতার কারণে ফারাইজি আন্দোলন ক্রমশ শক্তি হারিয়ে ফেলে।

ফারাইজি আন্দোলনের বিরুদ্ধে সেদিনের আলেমদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছিলেন তিনি হলেন মওলানা কারামত আলি। তিনি ফারাইজিদের ধর্মবিরুদ্ধ অভিনবত্বের (বেদাত) উদ্ভাবক এবং বাংলাদেশের খারিজি বলে নিন্দা করেন। মুসলিম আইনের বিভিন্ন খুঁটিনাটি ব্যাপারেও তিনি ফারাইজিদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। তবে যে মূল কারণে কারামত আলি ফারাইজি আন্দোলনের বিরোধিতা করেন সেটি হলো বৃটিশ শাসনের প্রতি ফারাইজিদের কঠোর মনোভাব। ফারাইজিরা যেখানে ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে ‘দারুল হারব বলে ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে মওলানা কারামত আলি ফতোয়া দিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। তার মতে ইংরেজ শাসনাধীন হলেও ভারতবর্ষ প্রকৃতপক্ষে ‘দারুল ইসলাম’। তার যুক্তিটি এরকম যেহেতু বহুসংখ্যক ভারতবাসী মুসলমান এবং যেহেতু তারা তাদের ধর্মানুশাসন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে সক্ষম, সে কারণে এ দেশকে দারুল হারব বলা সংগত নয় এবং একই কারণে সংগত নয় ‘দারুল ইসলাম’-এর সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা।

আহলে হাদিস

ভূমিকা ও উদ্ভব

মুসলিম জাহানে যেসকল ধর্মীয় সম্প্রদায় অত্যন্ত শুদ্ধাচারী বলে তার মধ্যে আহলে হাদিস অন্যতম। ভারতীয় উপমহাদেশের অপর একটি প্রভাবশালি আন্দোলন। একটি সুনির্দিষ্ট মতবাদের প্রবক্তা হিসেবে আহলে হাদিসের আবির্ভাব যদিও ১৯শ শতকের শেষদিকের ব্যাপার, এর উৎস খুঁজে পাওয়া যায় তারও বহু আগে। যেমন, ইসলামি নীতিমালা পুনর্ব্যাখ্যার প্রয়াসে এবং ইসলামি আইন সম্প্রদায়গুলো তাদের বিধিসমূহকে কোন ধরনের কর্তৃত্বের ওপর দাঁড় করাতে চায় তা আবিষ্কারের জন্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ এর আগে হাদিস অধ্যয়নকে উৎসাহিত ও সংগঠিত করেছিলেন। ওয়ালিউল্লাহ আইন সম্প্রদায়সমূহকে প্রত্যাখ্যান করেননি বটে, তবে তিনি একথা বলেছিলেন যে, অবস্থার তাগিদে প্রত্যেক বিবেকবান মানুষ এমন নতুন সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে পারেন যা তার নিজস্ব মযহাবের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ না-ও হতে পারে। অবশ্য এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেই ব্যক্তিকে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে যে, তার এই নতুন সিদ্ধান্ত হাদিস দ্বারা অধিকতর সমর্থিত। আহলে হাদিস সম্প্রদায়কে কেউ-কেউ ওয়াহাবি বলে অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়; কারণ, ওয়াহাবিরা হাম্বলি সম্প্রদায়ের প্রতি অনুগত, কিন্তু আহলে হাদিস কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি আস্থাশীল নয়।

মাযহাব বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও আহলে হাদিস সাম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাসে মাযহাব পন্থীদের ভূমিকা রয়েছে। আহলে হাদিস শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ইসলামের চারটি বড় মাযহাবের একটি মালিকী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম মালিক ইবনে আনাস। হাদিস সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই ইমামের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তিনি হাদিস সংগ্রহের জন্যে একটি সংগঠন করেছিলেন। এই সংগঠনের নাম দিয়েছিলেন ‘আহলে হাদিস’। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে এবং ইমাম মালিকের এর শিষ্য মুহম্মদ ইবনে ইয়াহিয়ার সম্পাদনায় ‘কিতাবুল মুয়াত্তা’ নামে একটি হাদিস সংকলন প্রকাশিত হয়। মুসলিম বিশ্বে প্রসিদ্ধ ছয়টি হাদিস গ্রন্থ বা সিহাহ্ সিত্তার পরই এই হাদিস গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত। যাহোক, এই ‘আহলে হাদিস’ সংগঠন এর সদস্যগণ মাযহাব বিশ্বাস করতেন। তারা ফিকাহ্ শাস্ত্রের ওপরও আস্থাবান ছিলেন। আহলে হাদিস সম্প্রদায় বলতে সমকালীন যুগে যে ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বোঝানো হয় তারা এই হাদিস সংগ্রাহক আহলে হাদিস সম্প্রদায় নয়। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে যে আহলে হাদিস সম্প্রদায় রয়েছে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আহলে হাদিস সম্প্রদায়। অর্থাৎ এরা মাযহাব বিরোধী, পীর-মুরীদি বিরোধী, সুফিবাদের বিরোধী এবং একমাত্র কুরআন হাদিস নির্ভর এবং শুদ্ধাচারী সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের উদ্ভব ভারতবর্ষেই। ভারতের বিশিষ্ট ধর্মতাত্ত্বিক শাহ অলিউল্লাহ্ এই সম্প্রদায়ের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি প্রচলিত চারটি মাযহাবের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন, ইসলামকে অন্যান্য অনৈসলামি সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য সারা জাগানো ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি এক্ষেত্রে হাদিস তথা সুন্নাহের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেন। তার প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনই আহলে হাদিস নামে এই উপমহাদেশে পরিচিত লাভ করেন।

এ আন্দোলন রচিত হয় ১৯শ শতকের কিছুসংখ্যক আলেমের উদ্যোগে। তাদের মধ্যে সিদ্দিক হাসান খান ও নাজির হুসাইন ছিলেন অগ্রণী। শাহ ওয়ালিউল্লাহ হাদিস অধ্যয়ন ও উপলব্ধির ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং কোরআন ও হাদিসকে মুসলিম বিশ্বাস ও আচরণের ভিত্তি বলে যে ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আহলে হাদিস আন্দোলন ছিল সেটি দ্বারা অনুপ্রাণিত। বস্তুত, ঐ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের প্রবক্তা ও সমর্থকগণ কোরআন ও হাদিসকে ঘোষণা করলেন মুসলিম বিশ্বাস ও কর্মের ভিত্তি বলে। তারা শুধু মুহাম্মদের আমলে সংগৃহীত হাদিসসমূহকে খাঁটি বলে গ্রহণ করেন। এ ছাড়া অন্যসব হাদিসই তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। প্রামাণিক ও অপ্রামাণিক বলে হাদিসের মধ্যে যে তারতম্য করা হয়, তারা সে নীতিকেও প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মতে, বুখারি ও মুসলিম প্রমুখ প্রাচীন বিশেষজ্ঞ হাদিসবেত্তাদের পক্ষেই কেবল হাদিসের উৎস, প্রামাণিকতা এবং খাঁটি ও প্রামাণিক হাদিসের মধ্যে পার্থক্য করার দুরূহ কাজ সম্ভব ছিল। আধুনিক কালের পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ হাদিসের আদি সংগ্রহকে কেবল সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যা করবেন, এ সম্পর্কে কোনো মূল্যায়ন বা বিচার করতে পারবেন না।

আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের জীবনদর্শনের মূল কথা হল : ইসলামের মৌলিক ধর্মগ্রন্থ তথা কুরআন হাদিসের সাথে অন্য কোন মতাদর্শের কোন আপস হতে পারে না। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত কুরআন ও সুন্নাহকে অবিকলভাবে অনুসরণ করা। আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের মতে, কুরআন ও হাদিস ইসলামি জীবনব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত। তাই ফিকাহশাস্ত্রের দরকার নেই। তারা যুক্তি দেখান যে, ফিকাশাস্ত্র যুক্তি নির্ভর হলেও অনেক সময়ই এই শাস্ত্রের মধ্যে বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। তাই একই সাথে দু’টি পরস্পর বিরোধী মত যেহেতু সত্য হতে পারে না, তাই ফিকাশাস্ত্র সংশয়যোগ্য, একে গ্রহণযোগ্য দলিল হিসেবে মান্য করা সমস্যার ব্যাপার।

উপযোগী ও নিষ্ফল জ্ঞান

উপযোগী ও নিষ্ফল, এ দু’রকম জ্ঞান থাকতে পারে। কোরআনে উপযোগী জ্ঞানকে সমর্থন এবং নিষ্ফল জ্ঞানকে বিভ্রান্ত মানুষের আগ্রহের বিষয় বলে নিন্দা করা হয়েছে। ধর্মীয় বিষয়াদির অধ্যয়নেও উপযোগী ও নিষ্ফল জ্ঞানের এই মানদণ্ড প্রযোজ্য। হাদিস নিয়ে বিবাদ ও বাগ্‌বিতণ্ডা সৃষ্টি করা এবং মুতাযিলাদের ন্যায় আল্লাহর গুণাবলি, দিব্যদর্শন, স্বাধীনইচ্ছা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দ্বান্দ্বিক ও পরাতাত্ত্বিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া ধর্মীয় ক্ষেত্রে নিষ্ফল বা অহেতুক জ্ঞানের দৃষ্টান্ত। আদি ইসলামের পণ্ডিত ও ধর্মবেত্তাদের জ্ঞান ছিল আধুনিক কালের আলেম বিশেষজ্ঞদের জ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্ক ও পাকাপোক্ত। কারণ, তারা ছিলেন ইসলামের নবীর (যিনি ছিলেন ধর্মীয় জ্ঞানের উৎস ও কর্তৃপক্ষস্বরূপ) কাছাকাছি। সুতরাং অতীতের সংগৃহীত জ্ঞানকে বিচার-বিশ্লেষণ বা তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে খগুনের আধুনিক প্রচেষ্টা অহেতুক ও নিষ্ফল। সবরকম অভিনবত্ব (বেদাত) মহানবীর অনুসৃত আদর্শ ও আচরণের পরিপন্থী, এবং সেকারণেই পরিত্যাজ্য। কোরআনে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশিত আল্লাহ, তার প্রেরিত গ্রন্থাবলি, তার নবীগণ এবং তার ফেরেশতারাই ছিল আহলে হাদিসের বিশ্বাসের মৌলিক বিষয়। আল্লাহর বিশ্বাস এমন একটি অচ্ছেদ্য সমগ্র যা রচিত কোরআন ও হাদিসে নির্দেশিত বাণীর আলোকে। আর কোরআন ও হাদিসের কোনো বাণীকে কোনোভাবে পরিবর্তন, সংকোচন, রহিতকরণ, কিংবা অকারণে বিশ্লেষণ করা অবৈধ। বলা বাহুল্য, আহলে হাদিসের এ ধারণা গ্রহণ করার অর্থই হবে মুতাযিলা, আশারিয়া কিংবা অন্য যে কোনো দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বুদ্ধিবাদী বিশ্লেষণকে অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য বলে মেনে নেয়া।

বিশ্বাসের স্বরূপ

আহলে হাদিস মতে ইসলাম, ঈমান এবং ইহসান (beneficence)—এই তিন পথেই মানুষ লাভ করে আল্লাহর দয়া। বিশ্বাসের নিম্নতম পর্যায়ের একজন মুসলমান প্রগাঢ় ধর্মীয় ঈমানের পর্যায়ে উপনীত হতে পারেন কেবল তখনই যখন তার চিন্তা ও কর্ম শুধু আল্লাহর বাণী ও মহানবীর হাদিস দ্বারা পরিচালিত হয়। একজন মুসলমান যখন এভাবে পরিচালিত হন, তখনই তিনি উত্তরণ লাভ করেন বিশ্বাসের সেই উচ্চতর পর্যায়ে যাকে আলেমরা বলেন ইহসান, আর মরমিবাদীরা বলেন সুলুক।

আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের প্রবক্তারা কোরআন ও হাদিসকে যেভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণের ভিত্তি বলে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে তাদের পক্ষে প্রচলিত চারটি মুসলিম আইন সম্প্রদায়ের (মযহাব) শিক্ষাকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা সম্ভব হয়নি। শুধু তা-ই নয়, তাদের মতে সহজ অভিজ্ঞতা ও প্রচলিত বুদ্ধির অতীত যাবতীয় নিগূঢ়তত্ত্ব (আল-গায়েব) মানুসের উপলব্ধির আওতাবহির্ভূত, এবং এজন্যই এগুলো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ বা ধ্যান-অনুধ্যান করা নিষ্ফল ও অহেতুক। পীর-দরবেশে বিশ্বাসকেও তারা (পরোক্ষভাবে হলেও) প্রত্যাখ্যান করার প্রয়াস পেয়েছেন। আহলে হাদিস’রা মাযহাব পন্থীদের বিদা’তী বলে চিহ্নিত করেন। তাদের মতে, মুসলমানদের মাযহাব একটাই তা হল মুহাম্মদী মাযহাব। মুহাম্মদের পরে যেহেতু নবী-রাসূল আল্লাহ্ পাঠাননি তাই কোন মাযহাবী ধর্মীয় নেতা বা মাযহাবী ইসলামেরও দরকার নেই। মুহাম্মদই সর্বকালের জন্য একমাত্র ‘রাহ্মাতুল্লিল আ’লামীন’। তাই তিনিই যথেষ্ট। যদি মাযহাবী হতে হয় তবে আহলে হাদিসগণ বলেন : ‘আমরা তাহলে মুহাম্মদ (সা.) মাযহাবী। আমরা তার সুন্নতের অবিকৃত অনুসারী।’ ইসলামের প্রসিদ্ধ চার ইমাম হযরত আবু হানিফা, হযরত আব্দুল মালিক, হযরত শাফেয়ী এবং হযরত হাম্বলকেও আহলে হাদিসগণ বিদা’য়াতী বলে চিহ্নিত করেন। সুফিদের অন্যতম নীতি পীরভক্তিকে আহলে হাদিস সম্প্রদায় পীরপুজা বলে চিহ্নিত করেন। তাদের যুক্তি হল অধিকাংশ পীরভক্তি শিরকের পর্যায়ে পড়ে। পীরকে অনেক মুরিদ অসীম ক্ষতার ধারক বলে মনে করে। কাউকে অসীম বলে মনে করা শিরক্ করা বা আল্লাহর সাথে শরীক করার সামিল। তাই পীরভক্তি একটি পরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তাছাড়া এটা অপ্রয়োজনীয়ও বটে। লমান হতে হলে আল্লাহর কুরআন ও রাসূলের (সা.) সুন্নাহ বা আচরণ অনুশীলন করলেই যথেষ্ট।

আহলে হাদিসগণ ইসলামের বেশ কিছু ইবাদতমূলক অনুষ্ঠানের বিষয়েও দ্বিমত প্রকাশ করেন। যেমন তারা রাসূলের শানে মিলাদ মাহফিল করা বিদাত মনে করেন। তাদের মতে, এগুলো কোন আবশ্যিক ইবাদত নয়। তারা আরও মনে করেন যে, এগুলো করার মাধ্যমে কোন ব্যক্তির আল্লাহর চাইতে নবী-রাসূলদের প্রতি অতিমাত্রায় ভক্তি প্রকাশিত হতে পারে। আহলে হাদিসগণ বাতেনী বা আধ্যাত্মিক সাধনাকে গুরুত্ব দেন না। তাদের মতে, আধ্যাত্মিক সাধনা বা বাতেনী জ্ঞানচর্চার নামে ইসলামে অনেক ভণ্ডামী অনুপ্রেবেশ করে যা এই ধর্মের ভাবমূর্তিকে খর্ব করতে পারে।

আহলে হাদিস সম্প্রদায় শুদ্ধাচারী। তারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে আঁকড়ে থাকতে চান। তবে এখানে একটি অসুবিধা হল কুরআন ও হাদিসে যে সব বিষয় সরাসরি নেই যে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ফিকাহশাস্ত্র বা ইজমা, কিয়াস, ইত্তেহাদ দরকার হয়ে পড়ে। তাই এসব চর্চাকে বিদাত বললে ইসলামের ব্যাপকতা রক্ষা করা মুশকিল হয়ে পড়ে।

আহমদিয়া বা কাদিয়ানি সম্প্রদায়

সাম্প্রতিককালের ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে আহমদিয়া বা কাদিয়ানি সম্প্রদায় একটি। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পাঞ্জাবের অন্তর্গত কাদিয়ান গ্রামের অধিবাসী মির্জা গোলাম আহমদ (মৃ ১৯০৮)। তিনি নিজেকে প্রতিশ্রুত মেহদি বলে ঘোষণা করেন। ১৯শ শতকের শেষপাদে তার কাছে বহু শিষ্য ও ভক্তের সমাগম ঘটে এবং তার মতাদর্শ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিস্তার লাভ করে। আহমদের মৃত্যুর পর কিছুসংখ্যক শিষ্য তার সম্প্রদায় ত্যাগ করে লাহোরে একটি নতুন সম্প্রদায় গঠনের চেষ্টা করে। যারা মূল সম্প্রদায়ে আস্থাশীল থেকে যায় তারা পরিচিতি লাভ করে কাদিয়ানি নামে। আহমদের মর্যাদা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ থেকে তাদের এই বিচ্ছেদ ঘটে। কাদিয়ানিদের মতে আহমদ ছিলেন একজন নবী। পক্ষান্তরে বিদ্রোহীদের মতে তিনি ছিলেন একজন সমাজসংস্কারক। কাদিয়ানিদের মূল মতবাদসমূহ এরকম –

  • ১। কোরআনের কোনো বাণী দ্বারা অন্য কোনো বাণী বাতিল হয়ে যাওয়ার ধারণা ভ্রান্ত। কোরআনকে দেখতে হবে একটি একক সমগ্র হিসেবে। কোরআনের কোনো আয়াতের সঙ্গে অন্য কোনো আয়াতের বিরোধ দেখা দিলে বুঝতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা ও ভাষ্যে কোনো না কোনো ত্রুটি হয়েছে।
  • ২। ধর্মবিস্তারের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জেহাদ, অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ এখন আর বাঞ্ছনীয় কিংবা অনুমোদনযোগ্য নয়, কারণ যুদ্ধমাত্রই হবে সম্পূর্ণ আত্মরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়। ধর্মযুদ্ধের পর্ব অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। সুতরাং এখন আর ধর্মের নামে কোনোরকম বাধ্যবাধকতা বাঞ্ছনীয় নয়। মহানবীর নবুয়ত শেষ হয়ে যায়নি। তিনি নবীদের মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণ।
  • ৩। কিন্তু তবু মুসানবীর পরে যেমন হিব্রু নবীদের আবির্ভাব ঘটেছে, তেমনি হজরত মোহাম্মদের (স) পরেও নবী-পয়গম্বর আবির্ভূত হতে পারেন।
  • ৪। অন্য নবীদের ন্যায় যিশুখ্রিস্ট পরলোকগমন করেছেন, এবং তিনি দৈহিকভাবে স্বর্গে আরোহণ করেননি।
  • ৫। দোজখ অনন্ত নয়।
  • ৬। ধর্মত্যাগের কারণে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না।
  • ৭। ধর্মানুশীলনের যে-কোনো অভিনবত্ব (বেদাত) একটি অপরাধ। পির-দরবেশের উপাসনা একটি অনৈসলামিক অনুশীলন এবং তা আল্লাহর অধিকারে আক্রমণস্বরূপ।
  • ৮। ইজমার অধিকার শুধুমাত্র মহানবীর সহচরদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
  • ৯। ওহি বা প্রত্যাদেশ যথার্থ ধর্মবিশ্বাসীদের একটি অধিকারস্বরূপ।
  • ১০। মির্জা গোলাম আহমদ আল-কাদিয়ানিকে মেহেদি বলে বিশ্বাস করা ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গস্বরূপ।
  • ১১। ধর্মীয় ব্যাপারে আধ্যাত্মিকতা আইনানুগত্যের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন আহমদিয়ার কোনো মযহাবের প্রতি অনুগত থাকা অনাবশ্যক।
  • ১২। কোরআন ও হাদিস ব্যাখ্যায় মধ্যযুগের আলেমদের অনুশীলন না করলেও চলে। পরিশেষে উল্লেখযোগ্য যে, কোনো কোনো বিশেষজ্ঞতের মতে আহমদিয়া বা কাদিয়ানির মুসলমান নয়।

তথ্যসূত্র

  • ডঃ আমিনুল ইসলাম, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন
  • ডঃ মোঃ গোলাম দস্তগীর, ডঃ মোঃ শওকত হোসেন, ইসলামি দর্শনের রূপরেখা

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.