সুফি অধিবিদ্যা : ইবনাল আরাবি ও জালাল উদ্দিন রুমির দর্শন

ইবনাল আরাবি (১১৬৫-১২৪০)

জীবন ও কর্ম

পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত সুফিবাদী দার্শনিক, আমেরিকার Stony Brook University এর এশিয়ান আমেরিকান স্টাডিজের প্রফেসর ও বর্তমান শতকের স্বনামধন্য ইসলামী দার্শনিক সাইয়িদ হুসেন নাসরের PHD গবেষক ছাত্র William Chittick ইবনাল আরাবি সম্পর্কে Stanford Encyclopedia of Philosophy-তে বলেন, আধুনিক মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে ইবনাল আরাবি সর্বশ্রেষ্ঠ। তার দর্শন কেবল কোরান ও হাদিসের ওপর তাফসিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ইসলামী বিজ্ঞানের সকল শাখা, বিশেষ করে ফিক্‌হ শাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, মরমীবাদে তার অবদান রয়েছে। তার ইসলামী মরমীবাদ ‘ওয়াহাদাত আল-ওযুদ’ মতবাদের জন্য বিশেষভাবে আলোচিত, যে মতবাদের সূত্রপাত ইবনে সিনা করেছিলেন। সুফিবাদে তার বিশেষ খ্যাতির জন্য পরবর্তীকালের সুফিরা তাকে ‘আশ-শেখ আল-আকবার’ বা ‘বিখ্যাত সুফিশেখ’ নামে অভিহিত করেন। ধর্মের প্রতি তার অনুরাগ ও অবদানের জন্য তাকে ‘মুহিউদ্দিন’ অর্থাৎ ‘ধর্মের পুনরুজ্জীবনকারী’ বলা হয়। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, দার্শনিক, মরমীবাদী এবং সাধক। তিনি ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলামী সংস্কৃতির অপূর্ব পরিবেশ আন্দালুসিয়ার (বর্তমান স্পেইন) দার্শনিক।

আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আল-আরাবি ১১৬৫ সালের ২৮ জুলাই স্পেনের মুরসিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা তাকে অতি অল্প বয়সে বিখ্যাত ফিকহ শাস্ত্রবিদ আবুবকর ইবনে খালাপের কাছে কোরান শিক্ষার জন্য প্রেরণ করেন। তিনি সাতভাবে কোরান তেলাওয়াত করতে শিখেছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ইসলামী মরমীচিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন এবং এ সময় থেকেই তিনি নির্জন স্থানে ঈশ্বরের চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন। একবার তিনি এক নৈশভােজে যােগ দিয়েছিলেন। সেখানে মদ পরিবেশন করা হয়। তিনি এক কাপ মদ নিয়ে পান করার জন্য যেইমাত্র ঠোঁটের কাছে আনলেন, তখনই এক গায়েবী আওয়াজ তার কানে এল : ‘‘হে মুহাম্মদ, এ কাজের জন্য তােমাকে সৃষ্টি করা হয় নি।’ তিনি তৎক্ষনাৎ মদের কাপ ফেলে দিলেন এবং সেদিন থেকেই পার্থিব ভােগ-বিলাসের প্রতি মােহ ত্যাগ করতে শুরু করেন এবং ঈশ্বরের অনুসন্ধানে চিন্তামগ্ন থাকতেন। এটাই সুফিদের প্রথম বৈশিষ্ট্য। তিনি দাবি করেন যে, তিনি মুসা, ঈসা, এবং মুহাম্মাদকে দিব্যদৃষ্টিতে দেখেন এবং তার মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে। তার পিতা তার মধ্যে এ পরিবর্তন লক্ষ্য করে তাকে সে সময়ের বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে রুশদের কাছে প্রেরণ করেন। ইবনে রুশদ নবাগত ছাত্রকে কিছু প্রশ্ন করেন এবং সে সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করলে ইবনে রুশদ মন্তব্য করেন: “আমি এ মত প্রদান করছি যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতিরেকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব, কিন্তু আমি এর পূর্বে এমন কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করি নি, যিনি এ জ্ঞান অভিজ্ঞতায় অনুভব করেছেন।’

শেখ আল-উরায়বী ইবনাল আরাবিকে শেখ খিজিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেন। এরা দুজনই ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত মরমী চিন্তাবিদ। ইবনাল আরাবিকে শেখ খিজির বলেছিলেন, “তােমার শিক্ষাগুরুর কথা মেনে চলাে।” ইবনাল আরাবির এটাই ছিল খিজিরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। ১১৯৩ সালে ২৯ বছর বয়সে ইবনাল আরাবি তিউনিসে গমন করেন। তিনি সেখানে আবদুল আযিয মাহদায়ি এবং আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-কিনানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখানে প্রায় এক বছর অতিবাহিত করে ঈশ্বরের সেবক বা দাস হবার যােগ্যতা অর্জনের গুণাবলী শিক্ষালাভ করেন। তিউনিস থেকে ফেরার পথে তার খিজিরের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। এক পর্ণিমার রাতে তিনি যখন নৌকায় করে তিউনিস থেকে ফিরছিলেন তখন দেখলেন যে, এক ব্যক্তি জলের ওপর দিয়ে হেঁটে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। নৌকার কাছে এসে ব্যক্তিটি জলের ওপর দাঁড়িয়ে তার পা দেখিয়ে ইবনাল আরাবিকে বললেন যে, “দেখাে, আমার পা শুকনাে। কোথাও কোন জল লাগে নি।” (Yahia, Osman, Mu’allafat Ibn Arabi: Tārīkhuhā Wa-Tasnīfuhā, Cairo: Dār al Sabuni, 1992, P. 192) এ ব্যক্তিই খিজির। খিজির তার সঙ্গে এমন ভাষায় কথা বললেন যে, তা ইবনাল আরাবির বােধগম্য হল না। আন্দালুসিয়াতে পৌছানাের পর ইবনাল আরাবি তৃতীয়বারের মতাে শেখ খিজিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এবার তিনি একটি অলৌকিক ঘটনার নিদর্শন দেখান ইবনাল আরাবির সঙ্গির প্রমাণের জন্য, যিনি অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করতেন না। এভাবে, শেখ খিজিরের মতাে একজন অতি সমৃদ্ধশালী সুফির সাহচর্যের মাধ্যমে ইবনাল আরাবি আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর স্তরের জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন।

কথিত আছে যে, ৫৮৬ হিজরী সনে করডােভাতে ইবনাল আরাবি এক অবিশ্বাস্য দিব্যদৃষ্টি লাভ করেন। তিনি হযরত আদম থেকে হযরত মুহাম্মদ পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলের আধ্যাত্মিক সত্তার সাক্ষাৎ পান। হযরত হুদ তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন এবং তাদের সকলের একসঙ্গে ইবনাল আরাবির সঙ্গে সাক্ষাতের কারণ ব্যাখ্যা করেন। এ বিষয়টি তিনি ‘আর রুহ আল-কুদস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। (Ibn Arabī, “Rūh al-Quds,” p. 116)। ১৯৯৪ সালের দিকে ইবনাল আরাবি উত্তর আফ্রিকা থেকে আন্দালুসিয়াতে প্রত্যাবর্তন করার পর তার বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ লেখার কাজে মনােযােগ দেন। এ বিষয়ে Stephen Hartenstein তার Unlimited Mercifier গ্রন্থে বলেন: “ইবনাল আরাবির তিউনিসিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আমরা তার মধ্যে প্রথম লেখালেখির খবর পাই। পরে ১৯৯৪ সালে তিনি ‘মাশাহিদ আল-আসরার আল-কুদুসিয়া’ (পবিত্র রহস্যের ওপর অনুধ্যান) নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। একই বছর মাত্র চারদিনের ব্যবধানে তিনি শেখ আবু মুহাম্মদ আল-মওরুরীর জন্য ‘তাদবিরাত আল-ইলাহিয়া’ (ঐশী শাসন) নামে বিশালাকৃতির গ্রন্থ রচনা করেন।” (Hirtenstein, S., The Unlimited Mercifier: The Spiritual Life and Thought of Ibn al-Arabi, Oxford: Anqa Publishing, 1999, p. 91)।

ইবনাল আরাবি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন মরমী সাধক ছিলেন। তিনি তার অসংখ্য গ্রন্থে কীভাবে দিব্যদৃষ্টিতে মিরাজ, নবী-রাসূলের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথােপকথন, কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ করেন সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেন। তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল যেমন প্রখর ও প্রগাঢ়, তেমনি দৈহিক পরিভ্রমণের ক্ষমতাও ছিল প্রবল। তিনি মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, জেরুজালেম, প্যালেস্টাইন, মিসর, আফ্রিকা, ইরাক, আনাতােলিয়া প্রভৃতি স্থানে পরিভ্রমণ করেন এবং অসংখ্য সুফিসাধকের সান্নিধ্যে আগমন করেন। তার রচনা সমন্বয়ধর্মী। তিনি প্রেম বন্ধনে সকল জাতি, সকল ধর্ম, সকল গােত্রকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। তার দর্শন মানেই সুফিবাদী বা মরমী দর্শন, যেখানে তিনি ভালবেসেছেন সকল মানুষকে, কেননা তিনি ঈশ্বরকে সন্ধান করেছেন সবার মাঝে। আর নিজের ক্বলবে বা হৃদয়ে পেয়েছেন সকলের উপাস্যকে। তাই তারজুমান আল-আশওয়াখ গ্রন্থে তিনি বলেন: “My heart has become capable of every form: it is a pasture for gazelles and a convent for Christians And a temple for idols and pilgrim’s Ka’ba and the tablet of the Torah, and the book of the Qur’an. I follow the religion of Love: whatever way Love’s camels take, that is my religion and my faith.” (Ibn al-Arabi, Tarjuman al-Ashwag, trans. by R. A. Nicholson, London, 1911, p. 67; আরও দ্রষ্টব্য Nasr, S. H., Sufi Essays, New York, 1972, p. 147)। অর্থাৎ, “আমার হৃদয় যে কোন আকার ধারণেই সক্ষম হয়েছে : এটি হরিণদের তৃণক্ষেত্র, এবং খ্রিস্টানদের কনভেন্ট, এবং মূর্তিদের মন্দির, এবং কাবার তীর্থ, এবং তোরাহ্‌র ট্যাবলেট, এবং কোরান। আমি প্রেমের ধর্মকে অনিসরণ করি : প্রেমের উট যে পথ দিয়েই যাবে, তাই আমার ধর্ম ও বিশ্বাস হবে।”

রচনা

ইবনাল আরাবি ঠিক কয়টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তার সঠিক হিসাব নেই। তবে রচনার সংখ্যা ৩৫০-এর অধিক বলে মনে করা হয়, যেগুলাের মধ্যে প্রধান হল ‘ফুফুস আল-হিকাম’, যা ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের নবীদের জ্ঞানের অন্তর্নিহিত আর নিয়ে লিখিত। এতে ২৭টি অধ্যায় আছে, যার প্রতিটি এক একজন নবী বা রাসুলের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মর্মবাণী নিয়ে রচিত। কয়েক শতক ধরে এটি পাঠ্য পুস্তক হিসেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানাে হতাে এবং অসংখ্য ভাষায় এর ওপর শতাধিক ভাষ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ৫৯৪ হিজরীতে ৩৩ বছর বয়সে ইবনাল আরাবি আধ্যাত্মিকভাবে মিরাজ করেন, যেখানে তার আত্মার আলাে উর্ধাকাশে ভ্রমণ করে। এটি মুহাম্মাদের মতাে দৈহিক কোন মিরাজ নয়, বরং এ ছিল তার স্বপ্নে বা ক্বলবে আত্মিক পরিভ্রমণ। ইবনাল আরাবি এ মরমী অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যে গ্রন্থ রচনা করেন তার নাম ‘কিতাব আল-ইশরা’। এছাড়া আছে ‘ফুতুহাত আল-মাক্কিইয়া’, যা মরমী দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি সেমিটিক ধর্মের আধ্যাত্মিক জ্ঞান নিয়ে রচিত। এটি সুফিবাদের সর্ববৃহৎ বিশ্বকোষ। এতে মােট ৫৬০টি অধ্যায় আছে, যা ৬টি খণ্ডে বিভক্ত। যথা- (১) আল মা’রিফা (আধ্যাত্মিক জ্ঞান), (২) আল-মালুমাত (আধ্যাত্মিক আচরণ), (৩) আল-আহওয়াল (আধ্যাত্মিক অবস্থা), (৪) আল-মানযিল (আধ্যাত্মিক ঠিকানা), (৫) আল-মুনাযালাত (আধ্যাত্মিক সাক্ষাৎ) এবং (৬) আল-মাকামাত (আধ্যাত্মিক গন্তব্যস্থল)। এ বিশ্বকোষ তিনি সম্পূর্ণভাবে ঐশি প্রেরণায় রচনা করেছিলেন বলে দাবি করেন। এছাড়া তিনি হযরত আবদুল কাদির জিলানীর কয়েকজন খ্যাতনামা শিষ্যের সঙ্গে সাক্ষাতের পর রচনা করেন ‘তানাজ্জ্বলাত আল-মাওসিলিয়া’, ‘কিতাব আল-জালাল ওয়াল জামাল’ এবং ‘কুনহ মা লা বুদ্দালিল মুরিদমিনহু’। তিনি কাব্যগ্রন্থও রচনা করেন। ‘দিওয়ান’ এবং ‘তারজুমান আল-আশওয়াখ’ হল আরবী ভাষায় লিখিত তার দুটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। ইবনাল আরাবির রচনা কোরানকে কেন্দ্র করে রচিত এবং সর্বজনীন। তার মতে, প্রত্যেক মানুষের একটি স্বতন্ত্র পথ আছে, যে পথ ধরে সে ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে। আর পরিণামে সকল পথ একত্রিত হয়ে এক ঈশ্বরের কাছে পৌঁছেছে। যেমন- ‘ফুসুস আল-হিকাম’ গ্রন্থে ইবনাল আরাবি বলেন: “যদি কোন বিশ্বাসী ‘জলের রং হল পাত্রেরই রং’ একথার মর্ম বুঝত, তাহলে সে সকল ধর্মের বৈধতা স্বীকার করত এবং ঈশ্বরকে সব আকারে এবং সব বিশ্বাসের বিষয় হিসেবে চিনতে পারত।” তার দর্শন কেবল ইসলামী জগত নয়, পাশ্চাত্যের দর্শনেও প্রভাব ফেলেছে। তার প্রজ্ঞা আজকের আধুনিক যুগের মানুষকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে। ১২৪০ সালের ১০ নভেম্বর ৭৫ বছর বয়সে এই মহান সুফি দার্শনিকের প্রাণাবসান ঘটে। 

‘ওয়াহ্‌দাতুল ওযুদ’

মহিউদ্দিন ইবনাল আরাবি সুফিতত্ত্ব নিয়ে আলােচনা করতে গিয়ে ‘ওয়াহদাতুল ওযুদ’ বা ‘ওযুদিয়া’ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু সাইয়িদ হােসেইন নাসরের মতে, ‘ওযুদ’ শব্দটি প্রথম ইবনে সাবিন (১২১৭-১২৬৯) ব্যবহার করেন। ইবনে সাবিন ছিলেন শেষ আন্দালুসিয়ান সুফি দার্শনিক। এই মতবাদ সর্বেশ্বরবাদ এবং ইসলামের একত্ববাদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত। 

ইসলাম একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই এক ঈশ্বরবাদকে সর্বেশ্বরবাদের সাথে সমন্বয় করে ইবনাল আরাবি দেখান যে, জগতের সবকিছুই এক ঈশ্বরের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। একমাত্র ঈশ্বরের সত্তাই বিদ্যমান। বাকী সব তার সত্তারই অংশ (অদ্বৈতবাদের সাথে তুলনীয়)। ঈশ্বর সৃষ্টির প্রথমে একাই ছিলেন। ঈশ্বরের এই সত্তা হচ্ছে বাতেনী বা গুপ্ত সত্তা। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন নিজেকে প্রকাশ করার। তাই তিনি নিজেকে প্রকাশ করার নিমিত্তে জগত সৃষ্টি করলেন। হাদিস-ই-কুদসিতে বলা হয়েছে : “ঈশ্বর গুপ্ত ভাণ্ডারে ছিলেন। তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলেন। তাই তিনি সৃষ্টি করলেন জগত সংসার।”

ইবনাল আরাবি দেখান যে, ঈশ্বর সবকিছুকেই নিজের মধ্যে ধারণ করছেন। জগতের সবকিছুর অস্তিত্ব ঈশ্বরের অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। তার মতে: “ওগাে, তুমিই পয়দা করেছ সবকিছুকে/ তুমি ঐক্যবদ্ধ কর তাদেরকে যাদেরকে সৃষ্টি করেছ তুমি।/ যা কিছু সৃষ্টি করেছ তুমি/ তার অস্তিত্ব তােমারই মাঝে/ অনন্তকাল ধরে,/ কেননা তুমি সংকীর্ণ ও সর্বব্যাপী দুই-ই। (Nasr, S. H., Islamic Philosophy from Its Origin to the Present: Philosophy in the Land of Prophecy, State University of New York Press, 2006, p. 156)।

ইবনাল আরাবি মনে করেন যে, ঈশ্বরের সকল গুণাবলী তার সৃষ্টির মাঝে বিশেষ করে মানুষের মাঝেই বিকশিত হয় এবং তার দরুণ মানুষ সৃষ্ট জগতের ওপর কর্তৃত্ব করে। ঈশ্বর মানুষের জন্যই ফেরেশতাদের কটাক্ষ করেছিলেন। কারণ তারা মানুষের মূল্য জানতাে না। ঈশ্বর আদি এবং অন্ত উভয়ই। আমরা তার কাছ থেকেই এসেছি, তাই তিনি আদি। আবার তার কাছেই ফিরে যাবাে, তাই তিনি অন্ত। কোরানের রয়েছে, “ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।” ইবনাল আরাৰি তাই বলেন : “তুমিই মানুষ, তুমিই ঈশ্বর।/ তাহলে তুমি কার সৃষ্টি?/ তুমিই ঈশ্বর, তুমিই মানুষ/ তাহলে তুমি কাকে ডাকছাে?” ইবনাল আরাবির মতে, ঈশ্বরের সৃষ্টির মধ্যেই ঈশ্বর বিরাজ করেন। তাই ঈশ্বরের সৃষ্টিকে সর্বদা সুনজরে দেখা উচিত। তিনি তাই বলেন: “কেউ যদি ঈশ্বরের সৃষ্টিকে অকারণে ধ্বংস করতে চায়, তবে সে নিজেকেই ধ্বংস করবে।” 

ইবনাল আরাবি আরও মনে করতেন যে, ঈশ্বরের সাথে মানুষ একাত্ব হয়ে যেতে পারে। যে কোন মানুষই সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরপ্রাপ্তি লাভ করতে পারে। মানুষের। আধ্যাত্মিক উন্নতির চারটি স্তর তিনি চিহ্নিত করেছেন। তা হল : ১. ঈমান, ২. ওলিয়া, ৩. নব্যুয়ত এবং ৪. রিসালাত। প্রথম দু’টির ব্যাপারে যে কোন শরিয়তপন্থি মানুষের কোন বিতর্ক থাকতে পারে না। তবে শেষ দু’টির ক্ষেত্রে কিছুটা বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কেননা নব্যুয়ত ও রিসালাতের সমাপ্তি ঘটেছে হযরত মুহাম্মদেরর সময়ে এসে। কিন্তু ইবনাল আরাবি একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। নবী-রাসূল আসবেন না বলতে তিনি বুঝিয়েছেন যে, ঈশ্বরের কিতাব বা ওহী নিয়ে আর কেউ জগতে আসবেন না। কিন্তু ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা ঈশ্বরের সত্তার সাথে নিজের সত্তাকে বিলীন করে দেয়ার মতাে মানুষ যুগে যুগেই আবির্ভুত হবেন। বস্তুত ঈশ্বরের সত্তার অপরিহার্য অংশ হিসেবেই মানুষ ঈশ্বরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এবং তার সান্নিধ্য লাভে সক্ষম। তার মতে, ঈশ্বরের সাথে মানুষের পরম মিলনের বাসনা সহজাত। কেননা ঈশ্বর এবং মানুষ পরস্পর অবিচ্ছেদ্য কার্যকারণ সম্পর্কে সম্পর্কিত। 

ইবনাল আরাবির মতে, ঈশ্বরের বহুবিধ গুণ রয়েছে। এই বহুবিধ গুণের বহুমুখী প্রকাশ ঘটে এই বিচিত্র জগতে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার দ্বারা এই গুণসমূহকে বিশেষ বিশেষভাবে উপলব্ধি করলেও এগুলাে মূলত পরমগুণ। পরমগুণের অংশবিশেষই আমরা জানি। ঈশ্বর তার পরমগুণের দ্বারাই জগতের সবকিছু তৈরী করেছেন। আর জগতের সবকিছুও তাই ঈশ্বরের পরমগুণের মধ্যে নিহিত। ইবনাল আরাবি দেখান যে, ঈশ্বর একই সাথে অতিবর্তী এবং অন্তর্বর্তী উভয় গুণের ধারক। ঈশ্বরের এবং জগতের মধ্যে যে আপাত বিরােধ দেখা যায় তা তার অতিবর্তী গুণের প্রকাশ। আবার সমস্ত জগত যে ঈশ্বরের সত্তার ওপর নির্ভরশীল এবং তিনিই সবকিছুর ধারক তাই তিনি অন্তর্বর্তী। তাই তার সুফিবাদে আমরা সর্বজনীন প্রত্যাদেশের সন্ধান পাই। তিনি ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: “জেনে রাখতে হবে যে, মহান ঈশ্বর যখন সৃষ্টজগতকে সৃষ্টি করলেন, তখন তিনি তাদের প্রত্যেককে এক একটি শ্রেণীতে ও ধরণে সৃষ্টি করেন। তারপর প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে তিনি উত্তমকে মনােনীত করেন। এরা হলেন বিশ্বস্ত, মুমিন। আর তিনি মুমিনদের মধ্য থেকে অভিজাত শ্রেণীকে নির্বাচন করেন। এরা হলেন সুফি। আর এই অভিজাত শ্রেণী থেকে উৎকৃষ্টকে মনােনীত করেন। এরা হলেন নবী-রাসূল। আর এই উৎকৃষ্ট শ্রেণী থেকে তিনি সর্বোত্তম অংশকে বেছে নিলেন। এরা সেই নবী, যারা ঐশি বিধান এনেছেন।” (Ibn Arabi, Al-Futuhat al-Makkaiyya, Cairo, 1293, vol. II, pp. 73-74)।

ইবনাল আরাবির মতে, সুফিরা ইসলামের প্রহরীস্বরূপ। তারা ঈশ্বরের একত্ব এবং ঐক্য সঠিকভাবে ধারণ করতে সক্ষম। জগতের সবকিছু যেমন ঈশ্বরের প্রকাশ, তেমনি সবকিছু তার গুণগান গায়, তারই প্রশংসায় মগ্ন থাকে। আর এটাই সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। জগতের প্রতিটি সত্তা ঈশ্বরের ঐশী জাতের এক একটা তাজাল্লি। একইভাবে প্রতিটি ধর্ম ঐশি জাত ও সিফাতের এক একটি অংশ প্রকাশ করে। সুতরাং জগতের বহুত্ব এবং বহু ধর্ম এক অসীম সত্তার অসীম গুণাবলীর এক একটি প্রকাশ মাত্র। জগতের প্রতিটি সত্তা, প্রতিটি ধুলিকণা জানে কীভাবে তার স্রষ্টাকে স্মরণ করতে হয়। ইবনাল আরাবির এই মতের সঙ্গে আল-যিলির মতের সাদৃশ্য আছে। ‘আল ইনসান আল কামিল’ গ্রন্থে আল-যিলি বলেন: “অস্তিত্বে এমন কিছুই নেই তার অবস্থায়, বচনে বা কর্মে ঈশ্বরকে উপাসনা করে না, হতে পারে তা তার সত্তা এবং গুণে। আর যা কিছু অস্তিত্বে বর্তমান তা পরম পরাক্রমশালী ঈশ্বরকে মান্য করে। কিন্তু ঐশী নাম ও গুণের পার্থকের কারণে উপাসনার ধরনেও পার্থক্য আছে।” (Al-Jili, Al-Insan al-Kamil, II, pp.76-77)

মূল্যায়ন

মুহিউদ্দিন ইবনাল আরাবি তার সুফিদর্শনে ঈশ্বরের একত্ববাদকে যেভাবে সর্বেশ্বরবাদী ধারণায় পরিণত করেছেন তা মূল্যায়নের দাবি রাখে –

  • ১. ইসলাম চরম একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই একত্ববাদে ঈশ্বরকে জগত থেকে স্বতন্ত্র করে পরমসত্তার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আর এই পরমসত্তার একত্বের প্রতি ইসলাম পরম গুরুত্ব প্রদান করেছে। কখনাে এই পরমসত্তার সাথে জাগতিক সত্তার তুলনা করেনি। 
  • ২. ইবনাল আরাবি যেভাবে সৃষ্ট সত্তা এবং ঈশ্বরের মাঝে একাত্বতা কােন করেছেন, অনেকের মতে তা প্রায়ােগিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হয়। কেন ঈশ্বরের সত্তাকে জাগতিক সত্তার তথা মানবিক সত্তার সাথে সমন্বয় করতে গেলে মানুষের মনে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে। 
  • ৩. ইবনাল আরাবি তার অধিবিদ্যক তত্ত্বের সাথে জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শনের সমন্বয় মাধ্যমে সর্বেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। কিন্তু কারও কারও মতে এই প্রচেষ্টা স্বার্থক হয়নি, কারণ তাদের মতে মানুষের সীমিত বুদ্ধি ঈশ্বরের অসীম সত্তাকে উপলব্ধিক জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতার অধিকারী নয়। ইমাম গাযালির মতে, কেবলমাত্র যেসকল ভাগ্যবান ব্যক্তিকে ঈশ্বর অনুগ্রহ করেছেন, তারাই তাকে অনেকটা উপলব্ধি করার সুযােগ পেয়েছেন। 
  • ৪. ইবনাল আরাবি তার সুফি সাধনার পরম স্তরে ফানা ও বাকার কথা বলেছেন। এবং সেই স্তরে গিয়ে একজন সুফিসাধক ঈশ্বর এবং মানবিক সত্তার মধ্যে এক পরম মিলন লক্ষ্য করেন বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অনেকের মতে এ বিষয়টিকে সাধারণভাবে উপস্থাপন করা যথেষ্ট পরিমাণে ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ। ইমাম আল-গাযালির মতে, মানবিক সত্তার সাথে ঈশ্বরের সত্তার কিছু প্রতীকী সাদৃশ্য থাকতে পারে। কিন্তু এ দুই সত্তার মধ্যে আক্ষরিক অর্থে মিল দেখানাের প্রচেষ্টা অবান্তর। 
  • ৫. জগতের সবকিছু যদি ঈশ্বরের সত্তার অংশ হয়, তাহলে এই অর্থে ঈশ্বরকে ‘জনক’ বলেই চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু কোরানে সূরা ইখলাসে বলা হয়েছে, “তিনিই এক, অদ্বৈত ঈশ্বর। ঈশ্বর সবার নির্ভরস্থল। তিনি কারও জনক নন। তিনি কারও জাতকও নন। তার সমতুল্য কেউ নেই”। (সূরা: ১১২, আয়াত : ১-৪)। তাই জগতকে ঈশ্বরের সত্তার অংশ এবং মানুষকে ঈশ্বরের সত্তার সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা অনেকের মতে কোরানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়।
  • ৬. ইবনাল আরাবি ঈশ্বরের গুণের সাথে মানবিক গুণের ঐক্য বিধান করতে চেয়েছেন। কেননা তার মতে, মানুষ ঈশ্বরের সত্তা ও গুণাবলীর অংশ। কিন্তু “তােমরা ঈশ্বরের গুণে গুণান্বিত হও।” ঈশ্বরের গুণের সাথে মানুষের গুণের একাত্বতা থাকলে হাদিসে হয়তাে বলা হতাে: ‘তােমরা স্বকীয় গুণে গুণান্বিত হও”। তাই কোরান অনুসাএ, ঈশ্বরের গুণ এবং মানুষের গুণ কখনাে এক হতে পারে না। 

ইবনাল আরাবির সর্বেশ্বরবাদী চিন্তাসমৃদ্ধ তার ওযুদিয়া মতবাদ উপযুক্ত দিক থেকে সমালােচনার শিকার হলেও তার মূল লক্ষ্য ও প্রচেষ্টার দৃষ্টিকোণ থেকে এই মতবাদ সমালােচনা করা যায় না। কেননা তার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামের একত্ববাদকে চরমভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। এটা করতে গিয়েই তিনি ঈশ্বরের সত্তাকে চুড়ান্ত সত্তার মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। তিনি যেভাবে খোদাকে সবকিছুর ধারক বলেছেন, সেই অর্থে ঈশ্বরের সাথে মানুষের একান্ত সম্পর্ক থাকলেও তিনি কখনো এমনটি বলতে চাননি যে, মানুষ ও খেদা অভিন্ন। তাই সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তার মতবাদকে উপযুক্ত সমালােচনা থেকে মুক্ত মনে করা যায়। তার দর্শনে এক ধরনের সর্বজনীন সমন্বয়ী প্রবণতা সাক্ষ্য করা যায়। তিনি সকল ধর্মকেই সমভাবে মর্যাদাপূর্ণ বলেছেন, কেননা, প্রতিটি ধর্মই ঈশ্বরেরই প্রত্যাদেশের এক একটি খণ্ডিত অংশ। ইবনাল আরাবির এই সুফিবাদী সর্বজনীন মতবাদ প্রাশ্চাত্য বিশ্বে বিশেষভাবে সমাদৃত, কেননা তা সকল ধর্মের মানুষকে এক স্রষ্টার সৃষ্টির ধারায় একত্রিত করে, যা আজকের হানাহানির যুগে বিশ্বশান্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকে যারা আন্তঃধর্মীয় সংলাপের কথা বলেন তারা ‘ইবনাল আরাবির মতাে সুফি শেখদের দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত।

জালাল উদ্দিন রুমি (১২০৭-১২৭৪) 

জীবন ও কর্ম

মহান মরমী কবি ও সাধক জালাল উদ্দিন রুমি ১২০৭ খ্রিস্টাব্দে ৩০ সেপ্টেম্বর খােরাসানের বলখ নামক একটি ছােট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাওলানা বাহাউদ্দিন যিনি তৎকালীন সময়ে খােরাসানে একজন আলেম ও সাধক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার পিতামহ মাওলানা হােসায়েন বলখিও খ্যাতিমান আলেম ছিলেন। জালাল উদ্দিন শৈশবকালে তার পিতা বাহাউদ্দিন খােরাসানের তৎকালীন শাসকের বিরাগভাজন হন। এক পর্যায়ে তিনি দেশ ত্যাগ করেন। এ সময় থেকে এক যুগেরও বেশী সময় তিনি বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত রােমে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। রােমের তৎকালীন শাসনকর্তা সুলতান কায়কোবাদ তাকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন। রােমে বসবাস করার কারণে জালাল উদ্দিন পরবর্তীতে রুমি নামে পরিচিতি লাভ করেন। 

জালাল উদ্দিন তার পিতার কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এর পর পিতার শিষ্য বুরহান উদ্দিন তাকে সুফিতত্ত্বের ব্যাপক জ্ঞান ও তালিম প্রদান করেন। এরপর তিনি শামসে তাব্রিজ নামক আর এক আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে এলমে মারেফাতের অনেক বিষয় চর্চা করেন। রুমি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দিক থেকে অনেক উচ্চ আসনের ব্যক্তি হলেও একজন মিস্টিক বা মরমী কবি হিসেবেই তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে অধিক পরিচিতি লাভ করেন। সাম্প্রতিক যুগেও রুমির কাব্যসমূহ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তার লিখিত তিনটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হলাে : মসনবী, রুবাইয়াৎ এবং দেওয়ান-ই শাসসে তাব্রিজ। এর মধ্যে মসনবী সবচেয়ে জনপ্রিয়। পৃথিবীর প্রায় সকল প্রধান ভাষায় গ্রন্থটি অনুদিত হয়েছে। ২০১০ সালে গ্রন্থটি আমেরিকার বেস্ট সেল বই-এর তালিকায় স্থান পায়। 

রুমির কাব্য-সাহিত্যে তার সুফি ভাবধারা, বিশেষ করে, ঈশ্বরপ্রেমের নানান বর্ণনা উঠে এসেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সুফি সাধকগণ সত্যের দিশারী। তারা সমাজের জন্য ঈশ্বরের রহমতের নহর সচল রাখতে সাহায্য করেন। মসনবী’তে তিনি বলেন : “যে মসজিদ নির্মিত হয় সুফিদের হৃদয়পটে/ সেথায় উপাসনা করে সকলেই বটে,/ যেহেতু সেথা বাস করে সদা/ সকলেরই ঈশ্বর।/ যতিদন পীড়িত না হয়/ কোন সুফির হৃদয়,/ ততদিন কোন জাতির বিনাশ/ ঈশ্বর করেন না কখনই।” (দেখুন, দস্তগীর, ড. মাে. গােলাম, (সম্পাদিত) বাংলাদেশে সুফিবাদ : খাজা এনায়েতপুরীর জীবনদর্শনের আলােকে, হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১১, (ভূমিকা))। ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর এই সাধক মনীষী মৃত্যুবরণ করেন।

সৃষ্টিতত্ত্ব

জালাল উদ্দিন রুমির মতে, জগতের দু’টি দিক আছে। দৈহিক এবং আত্মিক। এই উভয় দিকই ঈশ্বরের সত্তার অন্তর্ভুক্ত। জগতের কোন স্বতন্ত্র আস্তিত্ব রুমি স্বীকার করেন নি। ঈশ্বরকে তিনি পরমাত্মা বলে চিহ্নিত করেছেন। ঈশ্বর পরম একক। এই এক থেকে বিশেষ বিশেষ আত্মা নিঃসৃত হয়। ঈশ্বরই তার একক সত্তা থেকে বহুকে নির্গত করেছেন। তবে কীভাবে এই এক থেকে বিশেষ বা বহুর উৎপত্তি হলাে, রুমির মতে, তা অজ্ঞাত। তিনি ব্যক্তির অভিন্নতায় বিশ্বাস করতেন। ব্যক্তিগত আত্মার স্বাতন্ত্র তিনি স্বীকার করেছেন। এই আত্মা দেহ ধারণ করে থাকে। জগত, বস্তুগত বিষয় বা দেহ হচ্ছে আত্মার খাচা। পার্থিব জগতে বিভিন্ন বিশেষ আত্মা পৃথক হলেও একক আত্মা বা পরমাত্মার সাথে তার বন্ধন অটুট থাকে। এই দিক থেকে আত্মা একেবারে পুরােপুরি বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র সত্তা নয় (অদ্বৈতবাদের সাথে তুলনীয়)। আত্মার উৎস ঈশ্বর। দেহ বিশেষ বিশেষ আত্মার নিবাস। দেহ বস্তুজগতের অংশ। তবে মানবদেহ অনেক বিবর্তনের মাধ্যমে গঠিত।

রুমি ঈশ্বরকে জগতের স্রষ্টা বলছেন। তবে তার সৃষ্টি প্রক্রিয়া বিবর্তনিক। অর্থাৎ এক ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর জগতের সবকিছুকে গড়ে তােলেন। এই প্রক্রিয়ার শুরুতে ঈশ্বর নিজেকে ব্যক্ত করার ইচ্ছায় একটি আরশি সৃষ্টি করলেন। এটি এমন একটি সৃষ্টি যার সামনে আত্মিক সত্তা এবং পেছনে বস্তুজগত। বস্তুজাগতিক নানান উপাদান আগুন, বায়ু, জল ইত্যাদির মধ্যে প্রাথমিক আত্মা মিশে থাকে। এক পর্যায়ে এসব অজৈব বা জমাদির বিবর্তনে উদ্ভিদ সৃষ্টি হয়। উদ্ভিদ এক পর্যায়ে প্রাণিসত্তায় বিবর্তিত হয়। আর প্রাণিসত্তার উচ্চতর স্তর হল মানুষ। মানুষ মৃত হয়ে ফেরেশতা সৃষ্টি করে থাকে। এবং এই ফেরেশতা থেকে অনন্ত সত্তায় এই বিবর্তন প্রক্রিয়া মিশে যায়। রুমির এই বিবর্তনমূলক সৃজন প্রক্রিয়াটি বিংশ শতাব্দির ফরাসি দার্শনিক হেনরি বার্গসোঁর সৃজনমূলক বিবর্তনবাদের সাথে বিশেষ সাদৃশ্যপূর্ণ। বার্গসোঁ তার বিবর্তনবাদী তত্ত্বে প্রথমে উদ্ভিদ, তারপর ইতরপ্রাণি, তার মানুষ-এর উদ্ভব হয় বলে বর্ণনা করেছেন। বার্গসোঁ তার বিবর্তন প্রক্রিয়ার সর্বকালে প্রাণের উপস্থিতি আবশ্যিক রেখেছেন। তিনি একে প্রাণপ্রবাহ (elan vital) বলেছে রুমিও তার বিবর্তনমূলক সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় আত্মার উপস্থিতি আবশ্যিক রেখেছেন। পরমাত্মা বা ঈশ্বর থেকেই সকল বিবর্তন প্রক্রিয়া নির্গমিত বলে রুমি মনে করেন। অন্যদিকে বার্গসোঁ প্রাণপ্রবাহ নামক এক আধ্যাত্মিক সত্তার বিবর্তনের মধ্যে তার সৃজনক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন যা সব অবস্থাতেই বিদ্যমান থাকে। বিশিষ্ট লেখক D. M. Datta বার্গসোঁর এই প্রাণপ্রবাহের বর্ণনায় বলেছেন : “…a common. living force which is striving to express itself along divergent paths and striving constantly for balance and harmony. This force he (Bergson) calls the vital impetus, the elan-vital.”) (Datta, D. M. The Chief Currents of Contemporary Philosophy, The University of Calcutta, 1970, p. 262.)

রুমি ঈশ্বরের সৃজনপ্রক্রিয়াকে মানবিক অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির দ্বারা অবােধগম্য বলে মনে করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি স্বজ্ঞা বা মারেফাতের জ্ঞান চর্চাকে প্রাধান্য দেন। হেনরি বার্গসের সৃজনমূলক বিবর্তনে প্রাণ প্রবাহ নামক আধ্যাত্মিক সত্তার গতিবিধিকে তথা সৃজনমূলক বিবর্তন প্রক্রিয়াকে অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধির দ্বারা বোঝা যায় না বলে মত প্রদান করেছেন। তিনিও এক্ষেত্রে স্বজ্ঞার দারস্থ হয়েছেন। স্বজ্ঞাকে তিনি বৌদ্ধিক সহানুভূতি (intellectual sympathy) বলে উল্লেখ করেছেন।  

রুমি ভাববাদী। জগতের আদি উপাদানকে তিনি ঈশ্বরের সত্তা থেকে নিঃসৃত করেছেন। তিনি যে ‘আরশি’র কথা বলেছেন তা একটি আধ্যাত্মিক প্রতীতি। তার মতে, জড়ের কোন স্বাধীন সত্তা নেই। হেনরি বার্গসোঁ তার বিবর্তনবাদে ভাববাদের আশ্রয় নেন। তার বর্ণিত সৃজনমূলক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মূল নিয়ামক elan-vital বা প্রাণপ্রবাহ একটি আধ্যাত্মিক সত্তা। বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারাকে তিনি প্রাণ থেকে প্রাণে প্রত্যাবর্তন বলে বর্ণনা করেছেন। জড়কে তিনি বিবর্তনের ব্যতিক্রম ধারার সৃষ্ট বিষয় বলে চিহ্নিত করেন। রুমির মতে, বিবর্তন প্রক্রিয়ার মূল প্রেষণা হচ্ছে প্রেম । প্রেমই হল মূল চালিকা শক্তি। উন্নততরভাবে বিকশিত হবার প্রবল আশক্তিই বিবর্তন প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। নতুন নতুন সৃজন সম্ভব হয়। বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারা তাই উন্নতির দিকে।

ঈশ্বরতত্ত্ব

অধিবিদ্যার আলােচনার প্রধান বিষয়গুলাের মধ্যে ঈশ্বর বা ঈশ্বর সংক্রান্ত আলােচনা অন্তর্ভুক্ত। রুমি তার আলােচনায় ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত মত প্রদান করেছেন। তিনি সুফি ভাবাদর্শ চর্চা করতেন। অনেক সুফিই সর্বেশ্বরবাদী অর্থাৎ সবকিছুকেই ঈশ্বর এবং ঈশ্বরের মধ্যে সবকিছু এমন বলে মত প্রদান করেন। তাদের অনেকে ব্যক্তিসত্তার স্বাতন্ত্রও স্বীকার করেন না। রুমিকে সর্বেশ্বরবাদী বলা যায় না। তিনি জগতের উদ্ভবের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের সত্তার নির্গমনকে স্বীকার করলেও ব্যক্তিসত্তার স্বাতন্ত্র স্বীকার করেন। তাই ইসলামের মূল শিক্ষা ও ভাবধারার সাথে তার ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা সঙ্গতিপূর্ণ। রুমির ঈশ্বরতত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে যে দিকগুলাে লক্ষণীয় তা নিচে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল :

  • এক. ঈশ্বর সর্বোচ্চ সত্তা। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে। জাগতিক কোন গুণাবলী দ্বারা ঈশ্বরকে পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কেননা তিনি উপমাযােগ্য নন। জগতের কোন বস্তু বা বিষয় দিয়ে তার কোন গুণ যথার্থভাবে ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। তবে রুমি ঈশ্বরের গুণ স্বীকার করেছেন। তার মতে, তিনি অনন্য গুণের ধারক।
  • দুই. ঈশ্বর এক। তিনি একক সত্তা। তার শক্তি, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা, অস্তিত্ব সবই অনন্য। তার সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি কোন কিছু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন।
  • তিন. ঈশ্বর চিরন্তন। তিনি আছেন, ছিলেন এবং থাকবেন। তিনি কোন কালের অধীন নন। কাল তার অধীন। তিনি একমাত্র চিরন্তন সত্তা। আর কোন কিছুই চিরন্তন নয়। সবই নশ্বর।
  • চার. ঈশ্বর সর্বব্যাপী। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তবে কোন সত্তা তার মত নয়। তিনি সব কিছুকেই ধারণ করে আছেন।
  • পাঁচ. জগত ঈশ্বরের প্রকাশ। ঈশ্বর জড় ও আত্মাসহ জগতের সবকিছুরই স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক। তিনি তার ইচ্ছা শক্তির বলে জগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি ‘হও’ বললেই যে কোন কিছু হয়ে যায়। একমাত্র তিনিই কোন কিছু ছাড়াই সবকিছু সৃষ্টি করতে পারেন।
  • ছয়, মানুষ ঈশ্বরের সর্বোত্তম সৃষ্ট জীব। মানুষ ঈশ্বরের গুণ অনুশীলন করতে পারে। কিন্তু ঈশ্বরের সত্তার সমকক্ষ বা তার মতাে হওয়া সম্ভব নয়।
  • সাত, ইসলাম অবতারবাদে বিশ্বাসী নয়। রুমির মতে, ঈশ্বরের কোন অবতার নেই। তিনি মানবরূপে বা কোন বস্তুগত শরীর ধারণ করে ধরাধামে বিচরণ করেন না।
  • আট. জগতের সবকিছু ঈশ্বরের জানা। তার অগােচরে কিছুই নেই। তিনি সর্বদ্রষ্টা। তিনি সব দেখেন, সব শােনেন, সব বােঝেন। তাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।
  • নয়. ঈশ্বরকে দেখা সম্ভব নয়। তিনি দৃশ্যযােগ্য সত্তা নন। মানুষের চোখ দিয়ে তাকে দর্শন সম্ভরপর নয়।
  • দশ. ঈশ্বর এক অনন্ত জ্যোতির ধারক। কোন মানবসত্তা এই জ্যোতির নিশানা পেতে পারে না।

উপর্যুক্ত বর্ণনায় জালাল উদ্দিন রুমি ঈশ্বরের প্রকৃতির যে ব্যাখ্যা প্রদান করতে চেয়েছেন তা সাধারণ মুসলমানের বিশ্বাসের অনুকুলে। শরিয়তের সাথে সাঙ্গতিপূর্ণ নয় তেমন কিছু তার চিন্তায় খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। তিনি সুফি ভাবাদর্শের হলেও অধিকাংশ সুফির মতাে তিনি সর্বেশ্বরবাদী ছিলেন না। বরং তার ঈশ্বর সংক্রান্ত চিন্তায় সুফিভাবধারা এবং শরিয়তের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা লক্ষ্যনীয়। 

প্রেমতত্ত্ব

জালাল উদ্দিন রুমি ছিলেন একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী মনীষী। তিনি ছিলেন একাধারে একজন কবি, সুফিতত্ত্ববিদ, মৌলবীয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা, সর্বপরি একজন সাধক-পুরুষ। সুফিদর্শনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি ব্যাপক আলােচনা করেছেন। বিশেষকরে তার কাব্যে সুফিজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সাবলীলভাবে প্রকাশিত হয়েছে যে মরমী দর্শনের বাণী তিনি কাব্যিক ছন্দে প্রকাশ করেছেন, তার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব, তার মধ্যে প্রেমতত্ত্ব অন্যতম। জানাল উদ্দিন রুমি তার বিখ্যাত ‘মসনবী’ কাব্যে এবং অন্যান্য লেখনীতে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রেমের রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন। প্রেমের স্বরূপ, বিষয় ও বিষয়ী এবং প্রেমের প্রক্রিয়া এবং লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এগুলাের বিবরণের মাধ্যমেই তার প্রেমতত্ত্ব বিকশিত হয়েছে। নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে রুমির প্রেমতত্ত্বের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা প্রদানের চেষ্টা করা হল – 

  • ১. রুমির মতে, প্রেমের স্বরূপ ভাষায় বর্ণনা করার মতাে নয়। প্রেম একটি বর্ণনাতীত মানসিক ব্যাপার। এর বস্তুগত সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। এর কিছু রূপক উপমা দেয়া যেতে পারে। প্রেমের অনুভূতি কেবল প্রেমিক বা প্রেমিকাই উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু নিজের এই একান্ত অনুভূতি ভাষা দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। 
  • ২. রুমির মতে, প্রেম জীবনের সর্বাপেক্ষা জটিল হেয়ালি। তিনি সংগীতের উপমায় বিষয়টি বোঝানাের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন : “বাঁশরীর সুর-মুছনায় এমন একটি রহস্য আছে, যা প্রকাশ পেলে বস্তুনিচয়ের পরিকল্পনাকে ওলােট-পালােট করে দিত। কে দেখেছে বাঁশীর মতাে বিষ ও প্রতিষেধক? কে দেখেছে বাঁশীর মতাে সংবেদনশীল প্রেমিকত্ব?” (Dr. K. A. Hakim: The Metaphysics of Rumi, p-44)।
  • ৩. প্রেম শুধু সংগীতের মতােই নয়; বরং সংগীতের মাধ্যমে প্রেমকে প্রকাশ করা যায়, প্রেম লাভ করা যায় এবং প্রেমের তৃপ্তি লাভ করা যায়। তিনি ‘সামা’ বা ঐশী সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরপ্রেমে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করার কথা বলেছেন। 
  • ৪. রুমির প্রেম ঈশ্বরকে প্রাপ্তির নিমিত্তে নিবেদিত। এটি কোন মানব-মানবীর স্কুল প্রেম নয়। এ প্রেমের প্রেমাস্পদ হচ্ছেন স্বয়ং ঈশ্বর। 
  • ৫. রুমির মতে, প্রেমের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ঈশ্বরের পরম সান্নিধ্য লাভ। রুমি তাই বলেন : “আমার ঐশী সত্তা দৈহিক সত্তায় মিশে গেছে, আর দৈহিক সত্তা ঐশী সত্তা লাভ করেছে, আমার ঈশ্বরের পিয়ালা আমার ক্ষুধা মিটিয়েছে, প্রেমের এই তাে মহৎ লক্ষণ।” (আব্দুল মওদূদ : মুসলিম মনীষা)
  • ৬. প্রেমের জন্য যে কোন দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। সত্যিকারের প্রেমিক প্রেমের জন্য সবকিছুকেই ত্যাগ করতে পারে, সহ্য করতে পারে যে কোন ধরনের দুঃখ-দুর্দশা। রুমির ভাষায় : “যে প্রেমে দুঃখের দহন আনে, তাই ভালাে, কারণ দুঃখ যে এড়াতে চায় সে প্রেমিক নয়। সেই প্রকৃত পুরুষ যে প্রেমের প্রয়ােজনে জীবন উৎসর্গ করে- যদি প্রেম তাই চায়।” 
  • ৭. প্রকৃত প্রেম নিজের সত্তাকে প্রেমাষ্পদের সত্তার সাথে বিলীন করে দেয়। নিজেকে এভাবে হারিয়ে ফেলাই প্রেমের স্বার্থকতা। রুমির ভাষায় : “লােহার রং আগুনের রং-এ মিলে যায়/ কিন্তু লােহা আগুনে রাঙা হয়ে আগুনের মতাে দেখায়।” রুমির মতে, ঈশ্বরের প্রেমে মানুষ তার স্বীয়সত্তাকে এভাবে বিলীন করে দিতে পারলেই প্রেমের চরম স্বার্থকতা মিলবে। 
  • ৮. রুমির মতে, প্রেম যুক্তিতর্কের দ্বারা শর্তায়িত নয়, যুক্তি মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে বলে রুমি মনে করতেন না। তার মতে, এক অনন্ত প্রেমের প্রগাঢ় আবেগই মানবজীবনকে চালিত করতে পারে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের দিকে। যুক্তি মানুষকে অনেক সময় বিপদে ফেলে। কিন্তু খাটি প্রেম মানুষকে যথার্থ পথের সন্ধান দেয়- রুমি তাই বলেন : “যুক্তিকে বিশ্বাসের মূলধনে কিনে ফেললা,/ যুক্তি শয়তানের, কিন্তু প্রেমই আদর্শের মূলধন।”
  • ৯. রুমির প্রেমতত্ত্ব উদ্দেশ্যহীন কল্পনা বা বিশ্বাসই নয়। বরং এটা জীবনের গভীর রহস্যের এবং জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধিতে সহায়ক। 
  • ১০. রুমির মতে, প্রেম শুধু জীবনের স্বার্থকতার বাহকই নয়। বরং প্রেমই জগতের আদি কারণ। ঈশ্বর প্রেমের কারণেই সৃষ্টি করেছেন জগত সংসার। গভীর ঈশ্বরপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষকেও তাই প্রেমের মূল্য দিতে হয়। 
  • ১১. প্রেম যেমন অনন্ত, তেমনি অবিনশ্বর। প্রেমের মাধ্যমে জগত সংসার সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু জগত, সংসার, জীবন সবই ক্ষণস্থায়ী হওয়া সত্ত্বেও প্রেম অনন্ত যৌবনা। রুমির ভাষায় : “প্রেম অনন্তও অনন্তকাল থাকবে,/ প্রেমের পূজারী কোটি কোটি জীবন-জীবিত।”

মূল্যায়ন

রুমির প্রেমতত্ত্ব একটি আধ্যাত্মিক প্রেমের দিকনির্দেশনা প্রদান করে, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য ঈশ্বরের সত্তায় আত্মবিলুপ্তি। এ প্রেম কোন স্বাভাবিক প্রেম নয়। এ ভালােবাসায় কোন পরিবর্তন নেই, স্বার্থচিন্তার হীন বাসনা লুকায়িত নেই; নেই কোন কিছু হারানাের স্থূল আক্ষেপ। ইংরেজ কবি শেলীর মতের প্রতিধ্বনিই আমরা রুমির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করি । শেলীর ভাষায় : “For love and beauly and delight,/There is no death, nor change…” তার মরমী প্রেমতত্ত্ব প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক পারমেনাইডিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পারমেনাইডিস বলেছিলেন, “The first thing all the gods,/ Indeed planned- he love.” এছাড়া দার্শনিক প্লেটোর ‘Symposium’ এ বর্ণিত প্লেটোনিক প্রেমতত্ত্বের সাথেও রুমির প্রেমতত্ত্বের কিছু মিল লক্ষ্য করা যায়। তবে রুমির প্রেমতত্ত্বের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এখানেই যে, তিনি প্রেমকে একাধারে জীবনের লক্ষ্য এবং লক্ষ্য অর্জনের পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, “প্রেমই জীবনের উৎপত্তির কারণ,/ প্রেমই জীবনের লক্ষ্য এবং প্রেমেই জীবনের পরম স্বার্থকতা।” ধর্মতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক, আধিবিদ্যক এবং নৈতিক দিক থেকে রুমির প্রেমতত্ত্ব তাই অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। 

আত্মাতত্ত্ব

‘মসনবী’সহ বিভিন্ন গ্রন্থে রূমি আত্মাকে একটি অতীন্দ্রিয় সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই সত্তার বিভিন্ন প্রকার বৈশিষ্ট্য তিনি তার বিভিন্ন লেখায় বিস্তারিতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন; এ সবের ভিত্তিতে রুমির আত্মার স্বরূপ নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে বােঝানাে হল : 

  • ১. আত্মা একটি আধ্যাত্মিক সত্তা : রুমির মতে, আত্মা কোন দৈহিক বিষয় নয়, দেহের মধ্যে এটি সাময়িকভাবে অবস্থান করে মাত্র। মানুষের জৈবিক দেহ জড়বস্তু থেকে তৈরি, কিন্তু এর ভেতর যে আত্মা অবস্থান করে তা আধ্যাত্মিক প্রকৃতির। রুমির এই মতের সাথে পবিত্র কোরানের নিম্নোক্ত বাণীর সাদৃশ্য রয়েছে। “স্মরণ কর তােমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বলেছেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করব কাদা-মাটি হতে, যখন আমি একে (কাদা-মাটির দেহ) সুষম করব এবং তাতে আমার থেকে রূহ প্রবেশ করাব, তখন তােমরা এর প্রতি সিজদায় অবনত হবে।” (সূরা ৭, আয়াত ৭১-৭২)।
  • ২. আত্মা ঈশ্বর থেকে এসেছে : রুমির মতে, জগতের সবকিছুর মত আত্মাও ঈশ্বরের সৃষ্টি। তবে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, আত্মা সম্ভবত ঐশ্বরিক সত্তারই অংশ। কোরানের উপর্যুক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, “… আমার থেকে রূহ প্রবেশ করাব, …” এতে করে রুমির উপরােক্ত দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। 
  • ৩. আত্মার সাথে পরমাত্মা বা ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য : রুমির মতে, আত্মা যেহেতু ঈশ্বরের সত্তা থেকে অনিবার্যভাবে এসেছে তাই আত্মার সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। রুমি ‘আলাের’ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। সূর্য থেকে যেমন আলাে চারিদিকে ছড়িয়ে যায় পরমাত্মা থেকেও আত্মা সেভাবে ছড়িয়ে পড়ে। 
  • ৪. আত্মা অভিন্ন : রুমির মতে, জগতের সকল আত্মা তাদের অভিন্ন উৎস পরম আত্মা থেকে এসেছে, পরম আত্মাই তাদের প্রাথমিক এবং চূড়ান্ত নিবাস। তাই আত্মা এক ও অভিন্ন। রুমির এই মত কোরানের নিম্নোক্ত উক্তির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোরানে বলা হয়েছে, “তিনিই ঈশ্বর, যিনি তােমাদের এক আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন।” 
  • ৫. আত্মা সৃষ্ট ও অসৃষ্ট উভয়ই : রুমির মতে, বস্তুজগতে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির দেহে যে আত্মা রয়েছে একে সৃষ্ট আত্মা বলা যায়। কিন্তু আত্মাকে যদি পরম আতার অংশ ভাবা হয় তাহলে আত্মা চিরন্তন, আর এই অর্থে তাই আত্মা অসৃষ্ট। 
  • ৬. আত্মা দেশ, কালের উর্ধ্বে : আত্মা যেহেতু একটি আধ্যাত্মিক সত্তা তাই এটা দেশ, কালের উর্ধ্বে। তাছাড়া ঈশ্বরের অংশ হিসেবে এটা অনন্ত এবং শাশ্বত। 
  • ৭. আত্মা ইন্দ্রিয়শক্তির ধারক : রুমি দেখান যে, আমাদের বিভিন্ন দৈহিক ইন্দ্রিয়ের যে কার্যকরী শক্তি তার মূলে রয়েছে আত্মার শক্তি। আত্মার শক্তিই জীবের বিভিন্ন অঙ্গের শক্তি প্রদান করে বা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্য থেকে আত্মা তার শক্তির প্রকাশ ঘটায়। 
  • ৮. মানবাত্মা পরমাত্মার সাথে মিলিত হতে পারে : রুমির মতে, মানবাত্মা মূলত পরমাত্মারই অংশ, তাই পরমাত্মার সাথে এর মিলিত হওয়ায় কোন বাধা থাকতে পারে না। সাধনার ফলে আত্মা পরমাত্মার সাথে মিশে যেতে পারে। 
  • ৯. আত্মা সর্বদা পরমাত্মার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে : আত্মা যেহেতু পরমাত্মারই অংশ তাই প্রতিটি মানবাত্মাই পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়ার এক সহজাত প্রবণতা অনুভব করে। 
  • ১০. আত্মা অমর : রুমির মতে, দৈহিক সত্তার বিলুপ্তি হলেও আত্মার কোন বিলােপ হয় না। আত্মা অমর। মৃত্যুর পরে জীবাত্মা পরমাত্মার সাথে মিশে যায়। 

আত্মার অমরত্ব

রুমি আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করতেন, তার মতে বিশ্ব-আত্মা ও ব্যক্তিআত্মা উভয়ই অমর। আত্মার অমরতের পক্ষে রুমি যে সকল যুক্তি দিয়েছেন তা নিম্নোক্তভাবে আলােচনা করা যেতে পারে –

  • ১. রুমির মতে, আত্মা একটি আধ্যাত্মিক সত্তা, কোন আধ্যাত্মিক বিষয়ের ধ্বংস হয় না। তাই আত্মাও ধ্বংসযােগ্য নয়। 
  • ২. ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে একমাত্র ঈশ্বর বা পরমাত্মাই অমর। কিন্তু রুমি যুক্তি দেখান যে, পরমাত্মা বা ঈশ্বরের করুণার দ্বারাই আত্মা অমরত্ব লাভ করে। মত্যুর পর আত্মা যখন পরমাত্মায় একাত্ম হয় তখন তা অমরত্ব লাভ করে। 
  • ৩. রুমি ব্যক্তিগত আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না, তার মতে, পরমাত্মায় অবস্থান করলেই মাত্র আত্মা অমরত্ব লাভ করবে। তার ভাষায়, “একমাত্র ঈশ্বরের সত্তা ছাড়া সবকিছুই ধ্বংসশীল, যখন আপনি তার মাঝে অবস্থান করেন না তখন আপনি। অমরত্ব লাভ করার আশা করতে পারেন না।” 
  • ৪. পরমাত্মা বা ঈশ্বরের সাথে স্বীয় সত্তাকে সম্পূর্ণ বিলীন করে দিলে অমরত্ব লাভ করা যায়। ‘ফানা’ অর্থ নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নয়, বরং ঈশ্বরের সত্তার মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিয়ে অমর হয়ে থাকা। 
  • ৫. রুমির মতে, ঈশ্বর বা পরমাত্মা হচ্ছেন পরশ পাথরের মত। পরশ পাথরের সংস্পর্শে আসলে যেমন লােহা সােনায় রূপান্তরিত হয়, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করলে মানুষ তেমনি অমরত্ব লাভ করতে পারে। 
  • ৬. রুমি দেখান যে, মানবাত্মায় আপতিত বিভিন্ন গুণাবলি ধ্বংস হয়। কিন্তু আত্মার সারসত্তা কখনও ধ্বংস হয় না। এটা পরমাত্মার সাথে একাত্ম হয়ে অমর হয়ে থাকে। 
  • ৭. রুমি পরমাত্মার সাথে ব্যক্তিআত্মার অঙ্গাঅঙ্গি (organic relation) সম্পর্কে বিশ্বাসী। তিনি দেখান যে, পরমাত্মা হচ্ছে একটি বিশাল ‘ঐশী দেহ’ আর মানবাত্মা হচ্ছে তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মত। সার্বিক ঐশী সত্তা যেহেতু অমর তাই তার অঙ্গসমূহও অমর।

মূল্যায়ন

রুমি আত্মসত্তার প্রকৃতি বর্ণনায় যে অভিমত তুলে ধরেছেন তাতে তার মরমী ধ্যান-ধারণারই পরিপূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে। রুমি ছিলেন এমন একজন সাধক কবি যিনি মরমী সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত করেছিলেন। তবে আত্মাকে তিনি যেভাবে ব্যক্তিআত্মা ও পরমাত্মায় ভাগ করেছেন তাতে করে তার অভিমত অনেকটা Platonic মরমীবাদের সাথে একাত্ম হয়ে পড়েছে। কেননা, প্লেটো বিশ্বআত্মার ধারণা স্বীকার করেছিলেন। ইসলামী শরিয়তেও আত্মার অমরত্বের কথা এবং তার আধ্যাত্মিক প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। তবে আত্মা সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট বর্ণনা দেওয়া হয়নি। যেমন, কোরানে বলা হয়েছে : “তােমাকে তারা আত্মা সম্পর্কে প্রশ্ন করে, বল, আত্মা আমার প্রতিপালকের আদেশ ঘটিত এবং এ সম্পর্কে তোমাদের সামান দেওয়া হয়েছে।”

তবে রুমি যেভাবে আত্মাকে ঈশ্বরের সত্তার অপরিহার্য অংশ বলে মনে করেছেন তাও কোরানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কেননা, কোরানে বলা হয়েছে “স্মরণ কর, তােমার প্রতিপাত ফেরেশতাদের বলেছেন আমি মানুষ সৃষ্টি করব কাদা-মাটি হতে, যখন আমি এতে (কাদা-মাটির দেহ) সুষম করবাে এবং তাতে আমার থেকে ‘রূহ’ প্রবেশ করাবাে, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হবে।” (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ৮৫ , সূরা ৭, আয়াত ৭১-৭২)। তাই ব্যক্তিমানুষের আত্মা ঈশ্বরের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, সে কারণেই আত্মাকে অমর বলে ও মেনে নেয়া যায়। তাছাড়া শরিয়তে সরাসরিভাবেই অত্যিকে অমর বলা হয়েছে। 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.