বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ

(সুযশ ভট্টাচার্যের “বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য কথা” গ্রন্থ থেকে এগুলো লেখা হচ্ছে। চলবে…)

২। লুইপাদ

চর্যাপদের প্রথম কবিতা লুইপার লেখা। কবিতাটি এ রকম : “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।/ চঞ্চল চীএ পইঠো কাল॥/দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।/ লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ॥/ সঅল সহিঅ কাহি করিঅই।/ সুখ দুখেতে নিচিত মরিঅই ॥/ এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আসি।/ সুনুপথ ভিতি লেহু রে পাস ॥/ ভণই লুই আমহে ঝাণে দিঠা।/ ধমণ চমণ বেণি পিত্তি বইঠা ॥” আধুনিক বাংলা : “শ্রেষ্ঠ তরু এই শরীর, পাঁচটি তার ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করে। চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ কর। লুই বলেন, গুরুকে শুধিয়ে জেনে নাও। কেন করা হয় সমস্ত সমাধি? সুখে দুঃখে সে নিশ্চিত মারা যায়। ছলবন্ধ কপট ইন্দ্রিয়ের আশা পরিত্যাগ কর। শূন্যতা পক্ষে ভিড়ে পার্শ্বে নাও। লুই বলেন, আমি ধমন চমন দুই পিঁড়িতে বসে ধ্যানে দেখেছি।” সাধারণত লুই পাকে আদি সিদ্ধাচার্য বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও রাহুল সংকৃত্যায়ন তাকে প্রথম বলে স্বীকার করেন না। লুই পা বাঙালি বলে অনুমিত। উড়িষ্যায় তার জন্মস্থান বলে কারও কারও ধারণা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, তারানাথের মতে লুই বাংলাদেশের গঙ্গার ধারে বাস করতেন। তিনি প্রথম জীবনে উদ্যানের (সােয়াতের) রাজার কায়স্থ বা লেখক ছিলেন। তখন তার নাম ছিল সামন্ত শুভ। তিনি উড়িষ্যার রাজা ও মন্ত্রীর গুরু ছিলেন। লুইপার জীবৎকাল ৭৩০-৮১০ সাল। সংস্কৃত ভাষায় তিনি চারটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তার একটি গ্রন্থের নাম ‘অভিসময়বিভঙ্গ’। 

“কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।/ চঞ্চল চী এ পইঠো কাল।।” কায়া তরুর মতাে; পাঁচটি তার ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল (মৃত্যু) প্রবেশ করেছে। গাছের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়তা অতি প্রাচীন। সভ্যতার প্রাথমিক স্তরে গাছই ছিল মানুষের সবচেয়ে পরিচিত মূক এক স্বজন। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও বৃক্ষের সঙ্গে মানুষের উপমা দিয়ে বলা হয়েছে, গাছের দেহে যেমন পাতা, বল্কল, রস, কাঠ তেমনি মানুষের দেহে লােম, চামড়া, রক্ত, হাড় ও মজ্জা। কায়াতরুর পাঁচ ডাল অর্থাৎ আমাদের শরীরবৃক্ষের পাঁচটি ইন্দ্রিয়। পালযুগের বাঙালি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ এই রূপকল্পের কবি। বৌদ্ধসাধনার মধ্যে যে মনন অনন্ত ভারতধর্মের সন্ধান পেয়েছিলেন সেই মননের কায়সাধনা করেই এক বাঙালি মনীষী অনন্তের পথযাত্রী হয়ে নির্বাণ লাভ করেছিলেন। 

অন্য মতে অবশ্য লুইপাদ সিংহলের রাজপুত্র ছিলেন। অনুমান করা যায়, বাঙালি রাজা বিজয়সিংহ সিংহল দ্বীপ অধিকার করে যে বাঙালি উপনিবেশ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, সেই রাজবংশের রাজকুমার ছিলেন শ্ৰীমন্ত। কিন্তু রাজপুত্র অবস্থায় রাজভােগ্য বিলাসের পরিমন্ডলে শ্রীমন্তের মন টিকল না। সেই যেন রাজপুত্র গৌতমের দশা। ভােগবৃত্তিতে অনীহা। সংকীর্ণ রাজকীয় প্রাসাদের ঝাড়লণ্ঠনের রােশনাই লাস্যময়ী যৌবনউচ্ছলা রাজনৰ্তকীর নৃত্যকলা, ইন্দ্রিয়সুখের সহস্র বিন্যাস—ভাল লাগল না রাজপুত্র শ্ৰীমন্তের। সােনামুক্তোমাণিকের দেয়াল, রাজভােগের অজস্র বিলাস ভাল লাগল না। তবে কি ভাল লাগল সিংহলরাজ নন্দনের? অনেক দূর, যতদূর সবুজ মখমল ঘাস, শস্যক্ষেত্র, অরণ্য, নদী সরােবর—রূপময় ভারতভূমি, মন্দিরময় সাধনভূমি যেন শ্ৰীমন্তকে হাতছানি দেয়। মরকতমণির মতাে ঝকঝকে আকাশের সূর্য, তারাভরা আকাশের আঙিনায় রূপপার থালার মতাে পূর্ণচন্দ্র কলাক্ষয়ে ক্ষীণ হচ্ছে আকাশের প্রান্তে—এই সব পৃথিবীদেশকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গার কুল ধরে হেঁটে চলেছে পীতাম্বর সন্ন্যাসীর দল—মুখে শান্তির বাণী। ত্যাগের শরণমন্ত্র—শ্ৰীমন্ত এদের সঙ্গ নেয় মনে মনে। অজ্ঞাত সংঘারামে তার আসন পাতা।

রাজার মৃত্যুর পর শ্ৰীমন্ত রাজার শূন্য সিংহাসনে বসবেন, তাই তাে কথা ছিল রাজ্যের লােকেদের কানে। শ্ৰীমন্ত জনপ্রিয়। আর্ত মানুষ, দরিদ্র প্রজার প্রতি শ্ৰীমন্তের সদয় আচরণ, সকলের প্রতি সুভদ্র ব্যবহার রাজপুত্রকে লােকপ্রিয় করে তুলেছিল। রাজসত্তার ঐশ্বর্য নয়, আধ্যাত্মিক ভাবসম্পদ ছিল শ্ৰীমন্তের সর্বগত্ব। দরিদ্রের পর্ণকুটির, কামারের কারখানা, চাষীর খেতখামার, নদীর মাঝি – সর্বত্র গমন করেন অপার করুণায়। রাজজ্যোতিষীও গণনা করেছেন, সিংহলের রত্নসিংহাসনের যােগ্য উত্তরাধিকারী রাজপুত্র সুশীল শ্ৰীমন্ত। শ্রীকান্তি, শ্রীজ্ঞান, শ্রীধী রাজকুমার। রাজ্যের সৌভাগ্য বৃদ্ধি পাবে, রাজলক্ষ্মী অচলা হবেন এই দ্বীপরাজ্যেশ্ৰীমন্ত রাজা হলে প্রজা সুখী হবে। কিন্তু না, শ্ৰীমন্ত ব্যাকুল প্রত্যাখ্যান করলেন। “না, আমি রাজা হতে চাই না।” এই রাজপ্রাসাদ, ভােগবিলাস, এই ইন্দ্রিয়বিলাস তার পছন্দ নয়। শ্ৰীমন্ত ঘােষণা করলেন তিনি যােগী সন্ন্যাসী হবেন। 

অন্য রাজকুমাররা, প্রাসাদের আত্মীয়পরিজন শ্ৰীমন্তের এই বৈরাগ্যভাবনাকে মনােবিকার ভাবলেন। আরাে নারী, আরাে সুরা, আরাে বিলাসে ডুবিয়ে রাখা হল শ্ৰীমন্তকে। কিন্তু ভাবের কুটিরে যে সাধক পদ্মাসনে বসে পড়েছেন সহজ আধ্যাত্মিক বৈরাগ্যে, তাকে কে আটকায়? কিন্তু রাজকুমারকে সবাই চেনে। যতবার রাজপুত্র সােনার শেকল ছিড়ে বাইরে যান, ততবার লােকে তাকে আটকায়। ফিরিয়ে আনে সােনার গারদে, সিংহলের রাজবাড়িতে। বৈরাগ্য তত রাজকুমারকে যােগের পথে নিয়ে যায়। এই মহাবােধি শ্ৰীমন্ত লাভ করেছিলেন সংসারবন্ধন ছিন্ন করার প্রয়াসগুলিতে। 

সাধু তাে মনে মনে। বনে যাওয়া বা দেবতীর্থে অধিবাস, সে তাে বহিরঙ্গে। আমাদের দেহ এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয় নিয়ে এই আমরা সংসারজীব। আহারনিদ্রাঅশনবসন ভয়মৈথুনময় ভবলীলা। সাংসারিক বিষয়ের আকর্ষণে এবং প্রভাবে আমাদের চিত্ত চঞ্চল হয়। আমরা নানা দুঃখ ভােগ করি এবং শেষে কালের কবলে পড়ে ভবলীলা শেষ করি। তাই শূন্যতার সাধনা। শ্ৰীমন্ত অন্তরের ডাক শােনেন। এড়িয়ে যাও বাসনার বন্ধন ও ইন্দ্রিয়। পরিতৃপ্তির আশা পরিত্যাগ কর। আমি নেই, তুমি নেই। আছে শূন্যতা আছে অনন্ত।

শ্ৰীমন্ত শেষে উৎকোচ দিয়ে রাজপ্রাসাদের রক্ষীদের বশ করলেন। একজন বিশ্বস্ত অনুচরকে সঙ্গী করে যােগী সন্ন্যাসীর বেশে শ্ৰীমন্ত রাজ্য অতিক্রম করলেন। সমুদ্র অতিক্রম করলেন নবীন সন্ন্যাসী। তীর্থব্রত পালন করলেন ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্রান্তিক তীর্থ সেতুবন্ধ রামেশ্বরে। সেই তীর্থে সাগরবেলায় যােগসাধনা শুরু করলেন রাজকুমার। এই পর্যায়ে শাক্যমুনি বুদ্ধের সঙ্গে এই নবীন সন্ন্যাসীর অনেক মিল। রাজভােগ, স্বর্ণসিংহাসন ত্যাগ করে সংসার থেকে সম্যক সংবিৎ, বন্ধন থেকে কৈবল্য, রূপ থেকে অরূপেইন্দ্রিয়সুখ থেকে মহাসুখের নিত্য আনন্দ। শাক্যমুনি বােধিবৃক্ষের তলে পদ্মাসনে বসেছিলেন আর সিংহলরাজনন্দন বসলেন দক্ষিণ সমুদ্রের রামেশ্বরম্ তীর্থের চবুতরায়। সুকল্যাণ শংখনাদ আর শংখচিলের আঁক বেঁধে আকাশচারিতা—শ্ৰীমন্ত আসীন হলেন যােগাসনে। শূন্যতার মধ্যে শূন্যতার সাধনা, অন্যথায় চঞ্চল চিত্তে কাম বাসা বাঁধে। রাজপ্রাসাদের পরিবর্তে পর্ণকুটির, রাজপালংকের মখমলগদি ছেড়ে অজিনাসন ও ভূমিশয্যা বেছে নিলেন নবীন যুবা। মহামূল্য রাজপােষাক ছেড়ে রামেশ্বর শিবের মতাে সর্বাঙ্গে ভস্ম মাখা এক প্রাকৃত যােগী শিবসাধনায় মগ্ন হলেন।

যােগীর সৌন্দর্য, অভিজাত রূপ যেন মানুষকে টানে। ভিক্ষায় বেরিয়ে যােগী বুঝতে পারেন, গৃহবধূ, গাঁয়ের বধূ তাকে ভিক্ষা দিতে চায়। দেবকান্তি চেহারা, নম্র ব্যবহার, রূপবান যােগীপুরুষকে সবাই খাতির করে, সন্ত্রম করে। রামেশ্বর তীর্থে পূজা শেষ হল একদিন। শিব, ব্রহ্ম এবং বুদ্ধ – তিন পর্যায়ের তিন ঈশ্বরবােধ অথবা পৃথিবীর মানুষকে ভালবেসে সাধনার ভূর্ভুবঃ স্বঃ—আয়ত্ত করলেন রাজবংশজ এই নতুন বুদ্ধ। দক্ষিণ সমুদ্রের উপকূলে রামেশ্বরের অঙ্গনে নবীন সাধক মনােময় অনুভূতিপ্রধান এক মহৎ উপলব্ধিতে পৌঁছালেন। বােধি বা পরমজ্ঞান লাভের কথা অন্য সাধারণ লােকের তাে দূরের কথা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যকথা বুদ্ধদেবও জানতেন না, – বুদ্ধোইপি ন তথা বেত্তি যথায়মিত-রাে নরঃ। ঐতিহাসিক বা লৌকিক বুদ্ধের স্থানই বা কোথায়। সকলেই তাে বুদ্ধত্ব অর্জন করার অধিকারী এবং এই বুদ্ধত্বের অধিষ্ঠান দেহের মধ্যে। শাস্ত্র তাে অনেক পড়েছেন রাজকুলগুরুর কাছে। বেদান্ত উপনিষদ, বৌদ্ধদর্শন, ত্রিপিটক, প্রজ্ঞাপারমিতা। উপনিষদ মহাবাক্যতত্ত্বমসি। অহং ব্রহ্মাস্মি। এই শরীরেই পুণ্য। শরীরেই পাপ। শরীরেই সুখানন্দ। শরীরেই রোগযন্ত্রণা, ত্রিতাপদুঃখ। গরু, ভেড়া, পাখি – এরাও তাে দেহকেন্দ্রিক। ঈশ্বর যা সৃষ্টি করেন, তাতেই তার প্রতিচ্ছবি। মানুষেরই শুধু পাঁজিপুথি ঠাকুর দেবতা মন্দির, চৈত্য, বিহার, মসজিদ, গীর্জা। মানুষেরই মনেই শুধু ইতিমুখ আর নেতিমুখ। এই তভিন্নত্ব, মানুষ ছাড়াও ঈশ্বরের প্রকাশ, শরীরধারী জীবপ্রকৃতিকে বােঝার জন্যই নানা অবতার। ভিন্ন ভিন্ন জীবসত্তায়, বৃষ, হরিণ, মৎস্য, কুম্ভীর, অথবা ব্রাত্য শরীরে, কুম্ভকার, সূত্রধার, ব্যাধ, শবর, শ্বপাক হয়ে বােধিসত্ত্বের ফিরে ফিরে আসা। ঈশ্বর ও সংসারের মধ্যে এই সম্পর্ক বােঝাতেই তাে মহাত্মা কৃষ্ণ ব্রজের রাখাল হয়ে আভীরপল্লীতে জন্ম নিলেন। যমুনার জলের গন্ধ; কদম্বতরুমূলে মাটির সংসারে কৃষ্ণের যতেক লীলা, সর্বোত্তম নরলীলা, নরবপু তাহার স্বরূপ।” 

শ্ৰীমন্ত-হাঁটছেন দক্ষিণ দেশের পথে পথে গ্রামে গঞ্জে। হাঁটছেন নতুন বােধির পথে। হাঁটছেন এক রাজকল্প যােগী। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছেন তথাগত বােধিসত্ত্ব। নানারূপে নানাকল্পে। অনন্ত বুদ্ধ। হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালেন বুদ্ধগয়ায়। বুদ্ধদেব এই নদীপ্রান্তিক গয়াতীর্থে ফল্গু নদীর ধারে বটগাছের নীচে তার বহুকল্পদুর্লভ বােধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন। শ্ৰীমন্ত মনের চোখে দেখলেন নৈরঞ্জনা নদীর বালুকাময় তাতল সৈকতে পদচিহ্ন এঁকে এঁকে হিন্দুরাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম বেদ উপনিষদের ধর্মসাধনার সম্পূর্ণ মনােলীন আত্মময় স্বভাবটি নিয়ে বােধিবৃক্ষের প্রকান্ড ছায়ার দিকে চলেছেন। কায়া তরুবর, তার পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়ের শাখা মেলে দিয়েছে। কায়সাধনার লক্ষ্যে বােধিজ্ঞান অর্জনের জন্য নবীন হিন্দু সন্ন্যাসী বটগাছের নীচে মাটির বেদিটিতে বসলেন। গােপপল্লীর সুজাতা প্রতিদিন সেই নিকানাে মাটির বেদীতে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। বৃক্ষদেবতার পূজা করেন একান্ত লুইপাদ প্রাকৃত কামনায়। শ্ৰীমন্ত তখন নিজেই বৌদ্ধ। বােধিসত্ত্ব তীর্থে এসে তার বুদ্ধদর্শন হল। যে নারীকে তিনি ফেলে এসেছেন সুদূর সিংহল দ্বীপের রাজঅন্তঃপুরে, সেই নারীর কথা তার মনে এল সুজাতার অনুষঙ্গে। সুজাতা সেই সহজ সঙ্গিনী। বুদ্ধগয়ায় এসে সিদ্ধার্থ গৌতম সেই পথ খুঁজে পেলেন। মানবিক বৃত্তির ওপরেই ধর্মসাধনার সমস্ত পথ নির্দিষ্ট করতে হবে, কারণ মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। দেহকে স্বীকার করতে হবে, দেহজ কামনা বাসনাকে অস্বাভাবিকভাবে দমন বা ধ্বংস না করে তার সহজ স্বাভাবিক রূপান্তর বা উগতির কথা ভাবতে হবে। সর্বদর্শী এবং সর্বজ্ঞ কালচক্র ভূত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘুরছে। এই কালচক্রই আদিবুদ্ধ ও সকল বুদ্ধের জন্মদাতা। এই সুজাতার বেদীতে গৌতম সিদ্ধার্থ তন্ময় হলেন বােধিজ্ঞানের তপস্যায়। সুজাতাদের আভীরপল্লীর লােকায়ত জীবনরসের স্পর্শে এক জ্ঞানান্বেষী রাজপুত্র নতুন মানুষ হলেন জীবনের সঙ্গে জীবনযােগ করে, সিদ্ধার্থ প্রাথমিক যােগ্যতা অর্জন করলেন এই বুদ্ধগয়ায় সাধারণ মানুষের ধর্মপালনে। সারা দেশ থেকে এই সত্য সংগ্রহ করে গৌতম তার চরম তপস্যায় লীন হলেন। অতীতে অনেকবার ধ্যানে বসেছেন কিন্তু সফল হতে পারেন নি। নানা বাধা, বিঘ্ন এসে তপস্যা ভেঙে দিত গৌতমের। এবার তা হল না। জীবন্ত ধর্ম দেখেছেন – নানা সাধনা নানা ভাবনা, বহুতর উপলব্ধির মহাসঙ্গম। রাজপুত্র থেকে পরিব্রাজক। ভারতবর্ষের সমাজ সমীক্ষক গৌতম নৈরঞ্জনাতীরে উপবিষ্ট হলেন আসনে। 

দুহাজার বছর আগের বুদ্ধদেবকে যে মনশ্চক্ষে দেখলেন রাজপুত্র সন্ন্যাসী শ্ৰীমন্ত। কানে শুনলেন বুদ্ধের সংকল্প – ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং, ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু। নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে অপ্রাপ্য বােধিং বহুকল্প দুর্লভম্। সেখান থেকে পাটলিপুত্র। গঙ্গানদীর তীরে মনােহর বৌদ্ধনগর। গঙ্গার ধারে বৌদ্ধবিহার। সেই আশ্রমে কিছুদিন বাস করে শ্রীমন্ত তন্ত্রবিদ্যা অধ্যয়ন করলেন। তন্ত্রশিক্ষার সময় শ্ৰীমন্ত ভিক্ষান্নে জীবিকাসংস্থান করতেন। গঙ্গার ধারে মহাশ্মশানে রাত্রিবাস করতেন। তান্ত্রিক সাধুর কাছে শ্মশানভূমি রাত্রিযাপনের উপযুক্ত স্থান। একদিন বাজারগঞ্জে ভিক্ষা করতে করতে সাধু এক সরাইখানায় ঢুকে পড়লেন। সরাইখানাও বটে বেশ্যাবাড়িও অমােঘ এক আকর্ষণ বােধ করলেন বৌদ্ধ তান্ত্রিক। একটি সুন্দরী নারী হাতছানি দিয়ে ডাকল। যােগী শ্ৰীমন্ত তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন, এই মা আসলে মহাশক্তিশালিনী, ডাকিনী, রূপান্তরে এখানে থাকে। প্রণাম করে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন যােগী। বৌদ্ধতন্ত্রে ডাকিনী হচ্ছেন কুলপ্রজ্ঞা। ডােমনী, নটী বা বেশ্যা, রজনী চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী – এই পাঁচ রূপ কুলপ্রজ্ঞার। মানবদেহ আবার পাঁচ স্কন্ধ-রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, বিজ্ঞান ও সংস্কার – এদের সারাৎসার দিয়ে গঠিত। যে সাধকের মধ্যে যে স্কন্ধের প্রাধান্য অর্থাৎ যে দিকটি সক্রিয়, সেই অনুযায়ী কুলপ্রজ্ঞা ও সাধন স্থির করা হােত। গুরুই এসব ঠিক করে দিতেন। কাছে এসে সেই বারাঙ্গনারূপিণী ডাকিনী গভীর অন্তদৃষ্টি মেলে নীরব চোখে শ্ৰীমন্তকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন – তােমার মধ্যে চারটি মনােগত স্নায়ুশক্তি যথার্থ শুদ্ধভাবে আছে। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা ও বিজ্ঞান। কিন্তু পঞ্চম ক্ষেত্রে সংস্কার একটু জট পাকিয়ে আছে। ছােট মটরশুটির মতাে ঔদ্ধত্য বিরাজ করছে তােমার হৃদয়ে।” এই বলে সেই দেবী যােগী শ্ৰীমন্তের ভিক্ষাপাত্রে কিছু পচা বাসী খাবার দিলেন। তারপর চলে যেতে বললেন। 

সরাইখানা থেকে রাস্তায় নেমে বিক্ষুব্ধ যােগী সেই পচা খাবার খুঁড়ে ফেলে দিলেন রাস্তার ধারে আবর্জনার মধ্যে। ডাকিনী তাকে ঘরের জানলা থেকে লক্ষ্য করছিলেন। শ্রীমন্তের আচরণ দেখে উপহাস করে ডাকিনী বিদ্রুপ করলেন – “তােমার মতাে লোক কেমন করে নির্বাণ লাভ করবে?” ডাকিনীর এই বিদ্রুপবাক্য কানে যেতেই স্তম্ভিত হলেন তান্ত্রিক যােগী। তাহলে কি তার মধ্যে তখনও থেকে গেছে রাজপ্রাসাদের খুঁতখুঁতে ভােগবিলাস? খাদ্যাখাদ্যের পছন্দ অপছন্দ? বাহ্যিক সম্পদভােগের রাজসিক রুচি এখনও কি সূক্ষ্মভাবে মিশে আছে তার মনে? ছােট্ট মটরদানার মতাে ঔদ্ধত্যের অস্তিত্ব পরীক্ষা করছেন ডাকিনী? তার বাসনা কামনা এখনও যা কিছু ভাল, তাই বেছে নেয়। সরাইখানার সামনে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে এই নগরীর বহুবল্লভ নটী তাকে এই সতর্কবাণী শােনাল। তার জীবনসাধনার লক্ষ্য যে বুদ্ধত্ব অর্জন, তার পথে তার এই ত্রুটি রয়ে গেল। 

লুইপাদ যােগী তৎক্ষণাৎ সংকল্প করলেন, সকল সুপ্ত সংস্কার ধ্বংস করে তার চিন্তাভাবনার পদ্ধতি আমূল পাল্টাতে হবে। পাল্টাতে হবে জীবনচর্যা। এই নতুন জীবনবােধ এবং বুদ্ধত্ব অর্জনের পুনঃসাধনা – দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা, কঠোর তন্ত্রসাধনা, সিংহল সমুদ্র হতে দাক্ষিণাত্য তীর্থবাস, সেখান থেকে ভারতবর্ষ পর্যটন অনন্তের অন্বেষণে – পাটলিপুত্রের গঙ্গাবিধৌত নগরপ্রান্তে। এক সামান্য গঞ্জের বেশ্যাগৃহে এক বারাঙ্গনার বিদ্রুপে সম্যক বােধি জাগ্রত হল এই মহাসাধকের হৃদয়ে। স্বরূপ এতদিন আবৃত ছিল তন্ত্রমন্ত্রসন্ন্যাসের বিপুল বিন্যাসে। আত্মরূপটি না চিনলে তাে “অহং ব্রহ্মাস্মি” অথবা “আমিই বুদ্ধ” এই জ্ঞান হয় না। ভারতবর্ষ এই চেতনাকেই তার সহস্রারে প্রতিষ্ঠা করেছে – মূলাধার থেকে ষটচক্র ভেদ – তারপর ব্রহ্মজ্ঞান – আর বাছাবাছি থাকে না। অমৃত আর বিষ্ঠায় সমদর্শন হয়। (তুলনীয় : অষ্টাদশ শতকের সুখের পায়রা মহাধনী লালাবাবু সাঁঝবেলার এক শান্ত সময়ে এক রজকিনীর সামান্য বাক্য শুনলেন – বেলা যে পড়ে এল, বাসনায় আগুন দে।” তা শুনে লালাবাবু বুঝলেন, স্বরূপের উদ্বোধন। হৃৎকমলে ধ্বনিত হ’ল কৃষ্ণ নাম। অন্য বার্তা।)

গঙ্গার ধারে মেছােদের বস্তি। মাছমারা জেলেরা মাছ ধরে। মাছ ধােয়। পচা মরা মাছ, মাছের পিত্তি পটকা কুকুরদের খাওয়ায় তারা। সেই সব ফেলে দেওয়া মাছের নাড়িপিত্তপটকা ছিল যােগী শ্ৰীমন্তের খাদ্য। বারাে বছর ধরে রাজকীয় এই যােগী এই সহজ জীবনের সহজ সাধনা করে বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হলেন। মাছের বর্জ্য পদার্থ খেতেন বলে জেলেরা এই বুদ্ধের নাম দিল। লুইপাদ বা লুইপা। নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্ত চেতনার অমৃত আস্বাদন করে লুইপা আবিষ্কার করলেন, সকল পদার্থ বা বস্তুর প্রকৃতি হল শূন্যতা। 

পালযুগের বাংলায় দীর্ঘকাল বিরাজ করেছিলেন এই সন্ন্যাসী। আদিযুগের বাংলাভাষায় লুইপাদ অজস্র পদরচনা করেছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য। দেহ হচ্ছে মন্দির, সেই মন্দিরকে যত্ন করে বােধিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা হােক—এই ছিল লুইপা-র বাণী। ভাবতে ভাল লাগে, প্রাচীন বাংলার এই মহাসাধক আজও তিব্বতের সিকিমের বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে সম্মানিত হন। পালযুগের আধ্যাত্মিক ভাবের এই সিদ্ধাচার্য বাঙলার গৌরব। 

৭। গোরক্ষপাদ

“জন্ম তােমার কোথায় জানা নেই। উচ্চবংশ, না মধ্যবর্গে, না নীচঅন্ত্যজ পরিবারে – তােমার জন্মসূত্র নিয়ে কোন সমস্যা নেই। তােমার জীবনের ঘটনাবলীর পূর্ণ আস্বাদন নাও। জীবনের কর্মস্রোত তােমাকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। অনুভব করাে।” বাংলার গৌরবময় এক চিন্তন যুগের চিন্তাযােগী সিদ্ধাচার্য গােরক্ষপাদ এইভাবে অনুভবের সিঁড়ি বেয়ে শাক্যমুনির অবতংস হতে পেরেছিলেন। গাে অর্থাৎ গরুদের রক্ষাকর্তা। রাখালবালক। নদীর তীরে, জলাধারের শ্যামল তীরে প্রচুর ঘাসের কোমল সম্ভার। একপালি চাল, কোঁচড়ভরা মুড়িমুড়কির বিনিময়ে রাখালিয়া জীবিকা। কদমগাছের ছায়ায়, বটগাছের নিবিড় ছায়ায় রাখাল বালকের মূর্তিটি ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ গ্রামজনপদে এক পরিচিত বিভাব। অনুভবের রাধাকে খোঁজে রাখালের মােহনবাঁশিটি। কালীধবলীগৌরীশ্যামলী – ভারতের গাভীদের এই সব নাম। ভারতীয় সমাজে গাভী গােসম্পদ। কন্যার মতাে, মায়ের মতাে যত্ন পায় পরিবারের দুহিতার মতাে, পরিবারের মাতৃমর্যাদায়। গােপূজার গােকুল। পৃথিবীর অন্য নাম গাে। প্রেম প্রকৃতি ও নদীজলের এই পটভূমিটিই ব্রজভূমি। নীল যমুনা কালস্রোত সম। ভূমণ্ডলের সমস্ত প্রকৃতিতেই এই যমুনাপুলিন। ব্রজের রাখাল এই পৃথিবীর ব্রজভূমিতে গােরক্ষক। পথের ধূলায়, শ্যামল দূর্বাঘাসে রাখালই প্রেমের মুরলীধর। ‘বাঁশির শবদে মাের আউলাইল রন্ধন’ বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা এই কথা বলে। জগৎবাসীও সেই অনুভবের বাঁশির শব্দে জীবমুক্তির আস্বাদন পায়। নদীর স্নিগ্ধতায়, আকাশের উদার নীলে, বসন্তের পুষ্পপরিমলে, বাদলের কৃষ্ণমেঘের নীপকুঞ্জে – পৃথিবীর রক্ষা, ধৃতি, পুষ্টি। স্বরূপকৃষ্ণ এই প্রেমের উদ্বোধন করেন। অনন্ত সম্ভাবনা আন্তরিক আরাধনাই রাধা। সেই রাধা আমাদের হৃদকমলে হ্লাদিনী শক্তি। গােরক্ষক কৃষ্ণ গােপবংশজাত। তাকে ভগবানের প্রতিভাস বললে আপত্তি হয় না। শাক্যমুনি রাজবংশজাত ঐশ্বর্যভােগী। বাঁশির শব্দে রাজ্যপাট ভােগবিলাস ভেসে গেল। নৈরঞ্জনা যেখানে বয়ে যায় কুলকুল বেগে, সেইখানে সবুজ অববাহিকায় গােপপল্লীর সুজাতা, সেই গোপকন্যার আপ্যায়নে গৌতম সিদ্ধার্থ বহুকল্পদুর্লভা বােধি অর্জন করেছিলেন। অনুভবের বাঁশি “প্রবেশে নির্বাণধাম”। 

বঙ্গভূমি তখন বৃহত্তর। মহারাজ দেবপালের শাসনে তখন বাংলাবিহারউড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসাম সহ এক মহারাজ্য। পালযুগের ধর্মীয় উদারতা ও সমন্বয়ধর্মের মেলবন্ধন ঘটেছিল বৌদ্ধধর্মের নিবিড় চর্চায়। বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার মনন বেদ উপনিষদ পুরাণ স্মৃতির সঙ্গে বৌদ্ধ ত্রিপিটক ও নির্বাণ গ্রন্থের এক সাদৃশ্য আবিষ্কার করেছিল। হিন্দুদের মধ্যে শতধা ঈশ্বরমূর্তি পৃথক সম্প্রদায় শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, আউল, বাউল, দরবেশ, পীর, দশনামী। একটি প্রাচীন বটগাছের যেমন অনেক ঝুরি অনেক শাখা। কোনটি যে আসল গুড়ি, তা বােঝা যায় না। 

পিতা শিবপদ সামান্য কারিগর। ধূপধুনােঅগুরুচন্দনের দোকানদার। গ্রামের মন্দিরে বাড়িতে বাড়িতে পূজার উপকরণ যােগান দেওয়া তার জীবিকা। জমিজমা কিছু নেই। বড়াে গরীব। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ছােট ছেলের নাম চন্দন। শিবপদ ছােট ছেলেকে গরুবাগালির কাজে লাগিয়ে দিল। গাঁয়ের প্রায় প্রতি গৃহস্থের বাড়ি গােরুবাছুর থাকে। সেইসব গােরুবাছুর নিয়ে নদীর ধারে বনের ধারে, পাহাড়তলির নিবিড় ঘাসজমিতে নিয়ে যেতে হবে সকালবেলা। সারাদিনমান চরবে, ঘাসপাতা খাবে গরুর পাল, চন্দন তাদের ওপর নজর রাখবে। সূর্যাস্তের কিছু আগে পশ্চিম দিগন্ত যখন অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় লাল হয়ে যায়, তখন সেই গােধূলিবেলায় গরুর পালকে ফিরিয়ে আনে রাখাল। একপালি চাল, কিছু আনাজপাতি, আর কোচড়ভরা মুড়িমুড়কি চন্দনের মজুরি। চন্দন বেশ হাসিখুশি। গৃহস্থের গাভীগুলি তাকে ভালবাসে। চন্দন প্রতিটি গাভীকে নাম ধরে ধরে চেনে। তাদের যত্ন করে, আদর করে। কচি ঘাসপাতা খাওয়ায়। গাছের ছায়ায় ঝর্নার ধারে চন্দন বসে থাকে, শুয়ে থাকে, গাছে উতে ফলফুল পাড়ে। আর, বাঁশি বাজায় কোমল সুরে। সবুজ প্রকৃতির রূপে, তা মর্মরধ্বনি, জলতরঙ্গ আর ঝরাপাতার সমাবেশে শান্ত প্রাণীদের সঙ্গে এ ভাল থাকে রাখাল বালক। ঝরণার জলপতন, বনবৃক্ষের উদার অভ্যুদয়, পাখির কলতান ঝাকে ঝাকে উড়ে চলা – বেশ একটা আবেশ আনে, ভাব আনে রাখালবালকের মনে। ধর্ম বা ঈশ্বরবােধ তার নবীন চোখে প্রাকৃত বিন্যাস মাত্র। গাঁয়ের বধূরা, মা বােনেরা যে ভগবান বুদ্ধের স্তুপে সন্ধ্যাদীপ জালিয়ে দেয়, ব্রাহ্মণ শালগ্রাম শিলা বুকে চেপে নামাবলী গায়ে মন্দিরে যায়, চন্দন রাখালিয়া তার কোন বিশেষ অর্থ বােঝে না।

একদিন শেষ দুপুরবেলায় বনের ধারে গাছের ছায়ায় নরম ঘাসের ওপর অন্যান্য রাখালদের সঙ্গে গল্পগুজব করছে চন্দন। সেইসময় হঠাৎ এক বিরাট পরুষ কোথা থেকে আবির্ভূত হলেন সেই রাখালছেলেদের মধ্যে। উদার উন্নত এক সন্ন্যাসী। সৌম্য বয়ানে তার অপার লাবণ্য দুটি উজ্জ্বল চোখে বিশ্বের করুণা। বৈরাগ্যের পট্টবাস, উত্তরীয় অঙ্গে, আজানুলম্বিত দুই বাহু। ওঁ নমাে ভগবতে তথাগতায়। স্বাভাবিক শ্রদ্ধায় ও সম্ভ্রমে আভূমি প্রণত হয় রাখালছেলেরা। গােটা দেশ গ্রাম জনপদ জানে এই সিদ্ধাচার্যকে। মহাযােগী অচিন্ত্যপাদ। দক্ষিণবাংলার সাগরােপান্তে মৎস্যজীবী পল্লীতে এই সাধকের প্রথম আবির্ভাব। বৃহত্তর বঙ্গভূমির অগণিত মানুষের পরম শ্রদ্ধার পাত্র মহাসিদ্ধ মীনাপা অচিন্ত্যপাদ নামেও পরিচিত। মানুষের দুঃখদীর্ণ জীবনে শাক্যমুনি তথাগতের শান্তির বাণী সহজ সরল ভাষায়, গানের সুরের মূর্ছনায় বাঙালির নন্দনবােধকে জাগ্রত করেছেন মহাযােগী অচিন্ত্যপা। আজ তিনি রাখালবালকদের মধ্যে এলেন। তাদের প্রতিনমস্কার জানিয়ে আশীর্বাদ জানালেন শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে। তারপর দূরের বনভূমির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখালেন। কম্বুকণ্ঠে সন্ন্যাসী বললেন—“ঐখানে অনেক শকুন চক্রাকারে উড়ছে, দেখছাে? একটি গাছের নীচে নিরালা বনচ্ছায়ে তৃণভূমিতে একজন আহত রাজপুত্র শুয়ে আছে। দস্যুরা রাজপুত্রকে মারাত্মক অস্ত্রাঘাত করেছে। তার হাত পা কাটা, তরুণ রাজপুত্র মৃতপ্রায় অচেতন। শকুনরা তার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় আছে। মুমূর্ষ ঐ তরুণকে কে রক্ষা করবে, কে তাকে সেবাযত্ন করবে?” ‘আমি। আমি রক্ষা করবাে। বাঁচাবাে তাকে।’ তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠল গােরক্ষক চন্দন। “কিন্তু একটি শর্ত আছে, ভদন্ত, আমি আপনার আদিষ্ট কর্ম করবাে। আপনি আমার গােরুগুলির দেখাশােনা করবেন। ওরা যেন অরক্ষিত না থাকে আমার অনুপস্থিতিতে।’ 

শর্ত অনুমােদন করলেন মীনাপা। তিনি রাখালের পাঁচন হাতে গােরুর পাল রক্ষা করতে বসলেন, আর বালক চন্দন ছুটল সেই শকুনির ঝাক লক্ষ করে। বেশভূষা ছিন্নভিন্ন, রক্তসিক্ত সর্ব অঙ্গ। হাতদুটি অস্ত্রাঘাতে দেহবিচ্ছিন্ন। দুটি পা কাটা। রক্তের ধারা ভিজিয়ে দিয়েছে বৃক্ষতল। সবুজ তৃণরাশির মধ্যে জমাট খয়েরী শােণিত। অস্ত্ৰদীর্ণ মাংসছিন্ন অঙ্গ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। বােধ হয়, দণ্ড দুই তিন আগে এই নরহত্যার প্রয়াস করেছে এই বনপ্রদেশের দস্যুরা। রাজপুত্রের সুগৌর মুখমণ্ডলে যন্ত্রণার কালিমা। দুটি দীর্ঘ চোখ বন্ধ। রাজপুত্র হতচেতন। চন্দন নাসিকারন্ধ্রে হাত দিয়ে ক্ষীণ শ্বাসবায়ুর স্পর্শসন্ধান পেল। প্রাণ আছে। তাই আশা করেছেন সিদ্ধাচার্য। রক্তরস আস্বাদন করার কাজে লেগে পড়েছে বনমক্ষিকা। শােণিতকর্ম ঘিরে আরণ্যক পিপীলিকার সারি দেখা যাচ্ছে। ওরা শকুনির ঝাকের মতাে অপেক্ষা করে না। চন্দন তাড়াতাড়ি নিজের পরণের কাপড় ছিড়ে রাজপুত্রের ক্ষতস্থান, পরিষ্কার করে পরিচিত ভেষজওষধিসহ পট্টি বেঁধে ফেলল। রক্তক্ষরণ বন্ধ হল। রাজপুত্রকে কিছুটা স্বস্তি দিয়ে চন্দন ফিরে এল মীনাপার কাছে। আচার্যকে জানালাে সে কি দেখেছে ও করেছে। রাজপুত্র চেতনায় ফিরে এসেছে। 

‘রাজার ছেলেকে কী করে খাবার খাওয়াবে, ভেবেছাে তুমি?’ মীনাপা জিজ্ঞাসা করেন। মীনাপার ভাল লেগেছে ছেলেটির তৎপরতা ও নিষ্ঠা। ‘হ্যা, ভেবেছি’, গ্রামের রাখাল উত্তর দিল, আমার গাভীযুথের গােস্বামী সকাল সন্ধ্যায় আমাকে খাবার দেন, পানীয় দেন। আমি যা পাবাে, রাজার ছেলের সঙ্গে ভাগ করে খাবাে। বাঃ! খুশি হলেন গুরু মীনাপা। তিনি রাখালবালককে নির্দেশ দিলেন কি করে আহত রাজকুমারকে যত্ন করতে হবে। বাঁচতে হলে রােগীকে জীবনের চারটি প্রধান কাজ করতে হবে-খাদ্যগ্রহণ, পান, নিদ্রা ও কোষ্ঠশুদ্ধি। অনুগত রাখাল ফিরে চলল আহত রাজপুত্রের সেবায়। তার জন্য গাছের ডালপালা দিয়ে একটি কুটির বানালাে। দিনের পর দিন দুই তরুণ পূর্ণ মনুষ্যত্ব অর্জন করলাে। চন্দন তার পাওনা খাবার ভাগ করে রাজপুত্রকে খাওয়াতাে, তার ক্ষতস্থানগুলির রক্তপূজ পরিষ্কার করে নিয়মিত ওষধি প্রয়ােগ করতাে, প্রাণপণে রােগীর সেবা করতো। 

বারাে বছর কেটে গেল সেইখানে সেই সেবায়। একদিন সন্ধ্যাবেলায় সর্য অস্ত যাবার পরে পশ্চিম আকাশে যখন সিঁদুর রঙের খেলা চলছে, গাভীযুথের গােস্বামীর বাড়ি থেকে যথারীতি রাতের খাবার আনছে রাখাল যুবক চন্দন।বনের ধারে গাছের তলায় সেই কুটিরের সামনে বিস্ময়কর এক দর্শন। বিস্ময় অবিশ্বাস্য। রাজপুত্র দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘ বারাে বছর ধরে হাত পা কাটা শরীরটা স্থবির হয়ে জীবিত ছিল। আজ সেই রাজপুত্র বলিষ্ঠ দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু তা নয়, দুটি পেশিবহুল বাহু প্রসারিত করে দিয়েছেন। রাজকুমার সুললিত কণ্ঠে বললেন, তুমি আগে মুখ বন্ধ করাে, মাছি ঢুকে যাবে যে। এই বলে তিনি শূন্যে লাফ দিলেন ও শূন্যে ভেসে চললেন রাখালের মাথার ওপর। ‘মহাযােগী মীনাপা আমাকে একটি যােগাভ্যাস শিক্ষা দিয়েছেন, যার ফলে আমার কাটা হাত পা আবার জন্মেছে। তুমি আমাকে যথেষ্ট সেবাযত্ন করেছাে, তুমি যদি চাও, আমি তার বিনিময়ে তােমাকে এই যােগশিক্ষা দিতে পারি।’ অস্বীকার করলাে রাখাল। ‘ধন্যবাদ, প্রভু! কিন্তু আমি তা চাই না। আমার এক গুরু আছেন যার নির্দেশে আমি এতদিন ধরে আপনাকে সেবা করে চলেছি।’

ভক্ত রাখাল তখন আবার গরুচরানাের কাজে ফিরে এল। অনতিবিলম্বে মীনাপা এলেন তার কাছে, জানতে চাইলেন তার দায়িত্ব সে কতটা পালন করেছে। চন্দন রাখাল তখন সিদ্ধাচার্য মহাযােগীকে জানালেন রাজপুত্রের অলৌকিক আরােগ্য সংবাদ। গুরু মীনাপা সন্তুষ্ট হলেন এই সরল রাখাল যুবকের শ্রমসাধ্য বিশ্বস্ততায়। তৎক্ষণাৎ সেই তৃণভূমিতে দীক্ষা দিলেন, শক্তি দিলেন। সযতনে নির্দেশ দিলেন কিভাবে সে সাধনক্রিয়া অনুষ্ঠান করবে ক্রমান্বয়ে। 

রাখাল যুবক চন্দনের দীক্ষান্ত সন্ন্যাস নাম হল গােরক্ষপাদ। অতীতের গােরক্ষাব্রত ক্ৰমশঃ মানুষের পৃথিবীকে রক্ষা করার উন্নত স্তরে উপনীত করল গােরক্ষপাদকে। যমেবৈষ বৃণুতে। সামান্য এক গোপালকের মধ্যে জাগ্রত মহাযোগী গােরক্ষী। ভগবান অমিতাভের কৃপা পেলেন গােরক্ষ। গুরু মীনাপার আদেশে দূরদেশে ধ্যান ও যােগ অনুশীলন করতে গেলে গোরক্ষদেব। যখন তিনি চেতনার গভীরে নিলীন হলেন, সেইসময় আবির্ভূত হলেন গুরু মীনপা। যতদিন মা তুমি কোটি কোটি মানুষের মুক্তি আনতে পারছো, ততদিন পর্যন্ত পূর্ণতা ও পবিত্র বােধিতে পৌঁছতে পারবে না। গুরু এর দিব্যযােগকে পার্থিব জগতে নিয়ে এলেন। নিরালা আশ্রমের ধ্যানকে লোকশিক্ষার কাজে লাগালেন। জ্ঞান যখন আরণ্যক, যথা শ্রুতি ঈশ্বর তখন অপ্রত্যক্ষ অতীন্দ্রিয়। ঈশ্বর আছেন ঈশ্বরের জগতে, বিচিত্র সংসারে। পাঁজিতে লেখা আছে আজ খুব বৃষ্টি হবে। ঠাকুর বললেন – পাঁজি নিড়ালেও এক ফোটা জল পাবে না। গুরু মীনাপা সেই ঠাকুরের প্রাক্পু‌রুষ হয়ে প্রিয় শিষ্য গােরক্ষকে গ্রামেগঞ্জে হাটেমাঠে মানুষের মুক্তি আনার কথা বললেন। শ্রীরামকৃষ্ণের দেশে ১২শ শতাব্দীর বাংলায়। বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়।

গুরুর বাক্যে এত বিশ্বাস যে, গােরক্ষ তার নির্জন আশ্রমপদ ছেড়ে নেমে এলেন লােকসংসারে। মুক্তির আস্বাদ দিতে হবে ব্রাত্যজীবনের অসংখ্য রুদ্ধ প্রাণকে। অতি উৎসাহে গােরক্ষ পথে ঘাটে যাকে পান, তাকেই ধরে ধরে মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষা দেন। তলিয়ে দেখেন না, কোন লােক দীক্ষা নেবার যােগ্য না অযােগ্য। ভক্তের চিত্তে যখন ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়, আচারে আচরণে সাধারণ মানুষ যখন দৈবী অধিচেতনায় উন্নীত হয়, তখন নির্বাণমন্ত্রে দীক্ষা সম্পূর্ণ হয়। গােরক্ষ গুরুনির্দেশ পালন করতে লাগলেন তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য না বুঝে। পরম দেবতা শিবের ভাল লাগলাে না গােরক্ষের এই মুক্তিপ্রচার। অসংখ্য মানুষের দীক্ষা সমাবর্তনে উপস্থিত হলেন যােগীন্দ্র মহাদেব। গােরক্ষকে ভর্তসনা করে সতর্ক করলেন। ‘যে সজ্জন ভক্ত তােমার কাছে এসে তােমার ধর্মকথা শুনতে চাইবে, তুমি তাকে বিবেচনা করে দীক্ষা দেবে। যাদের বিশ্বাস নেই অথবা শুদ্ধ বুদ্ধি নেই, তাদের কখনাে দীক্ষা দেবে না।’ গােরক্ষ গুরু মীনাপার আদেশ বুঝতে পারলেন সিদ্ধাচার্যোত্তম মহাদেবের উপদেশে। নতুন দীক্ষাতে তিনি নির্বাণ শিক্ষা দিলেন অগণিত যােগ্য ভক্তকে। আজও তিনি গােরক্ষক রূপে শিক্ষা দিচ্ছেন পৃথিবীর মানুষকে। 

যে সমস্ত সৎচিত্ত, পুণ্যমনা ভক্ত মুক্তিমন্ত্রের দীক্ষা নিতে চায়, তারা গােরক্ষপাদের বাদ্যধ্বনি আজও শুনতে পায়। কারণ গোরক্ষপ অমর। ক্ষুদ্ৰহৃদয় সংকীর্ণ-চিত্ত পাপীর কাছে গােরক্ষপা নীরব ও অদৃশ্য থাকেন। ‘কানু, তুই কোথা গিয়ে করিবি নিবাস? যারা মনগােচর, তারাই উদাস।’ অবিদ্যা অজ্ঞান দ্বারা পরমার্থতত্ত্বজ্ঞ হবার পথ রুদ্ধ হয়, মহসুিখের আস্বাদ লাভ করা যায় না। বাঙালির উপনিষদ চর্যাপদ এই কথা জানায়। 

১১। চৌরঙ্গীপাদ 

অনাদি অনন্ত সময়ধারা থেকে অজ্ঞানের মহাতরু কুসংস্কারের জলধারায় বেড়ে উঠেছে। মহামােহের ফল ফলছে, জ্ঞানহীনতার শাখাপ্রশাখার ঝােপঝাড়ে। গুরুর নির্দেশকুঠার দিয়ে সেই অজ্ঞানবৃক্ষ কেটে ফেল। গুরুর কথা শােন। গুরুর বাণী চিন্তা কর। অনুশীলন করাে সিদ্ধির সাধনা।… তাই সিদ্ধাচার্য সরহপাদ নিজের চিত্তকে ডেকে বলছেন – মন রে, তুই অবিদ্যার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারছিস না বলে তাের মােহস্বপ্ন ভাঙছে না। লােকে স্বপ্নে যেমন বিষয় কামনা করে, তুই তেমন মােহস্বপ্নে বিষয়বাসনায় ডুবে আছিস। এসব ছেড়ে সগুরুর উপদেশে বিহার কর, চোখ ঢাল বলদের মতাে মিছে ঘুরে মরিস। হে আমার অবিদ্যাপরবশ মন, সহজানন্দরূপ অমৃত আস্বাদন করলে তুই বিষয়বিষ হজম করতে পারবি। নিজের দেহে যে স্বীয় প্রকৃতি নৈরাত্মা আছে, তাকে বুঝলে তাের রাগদ্বেষমােহভাণ্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। সর্বভাবের শূন্যতা। অন্ধকার যেমন রাতিময়, আকাশ, পৃথিবীময় অন্ধকার। আলাে যেমন দিনময় আকাশ পৃথিবী আলােকময়। অবিদ্যা ও বিদ্যা দুই সমধর্মী। যােগবাশিষ্ঠ বললেন – চঞ্চলতা মনােধর্ম, ঠিক যেমন বহ্নির ধর্ম উষ্ণতা। ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ বললেন – মম যােনিৰ্মহ ব্রহ্ম তস্মিন্ গর্ভং দধামহ্যম।’ এই ব্রহ্মযােনি থেকেই জীবের সৃজন। তাতেই আবার জীবের লয়। বিশ্বের লয় এই ব্রহ্মযােনিতত্ত্ব জানতেন যে আনন্দ, তাই তাে ব্রহ্মানন্দ। গুরুর কৃপায় এই ব্রহ্মানন্দ লাভ হয়। ব্রহ্মবিৎ ব্রহ্মে অবস্থিত। জগদগুরু তথাগত বুদ্ধদেব ও ব্রহ্ম সাধকের কাছে পৃথক নয়। সেই সর্বচৈতন্যরূপা আদ্যাবিদ্যাকে ধ্যান করি। এই ব্রহ্মানন্দে একটি শক্তি ফুটে উঠছে – সেটি ঈশ্বর, প্রত্যগাত্মা বা শব্দব্রহ্ম। খ্রিস্টধর্মের verbum (মূল কথা)। হিন্দুধর্মে তিনি তার নিত্যধামে পরব্রহ্মে চির অবস্থিত। বৌদ্ধশাস্ত্রে তিনিই মহামূর্তি, বিশ্বরূপ। তিনি স্বয়ম্ভু, মহাবুদ্ধ, আদিনাথ ও মহেশ্বর। 

বাংলার স্বর্ণযুগ পালবংশের রাজত্বকাল। রাজা দেবপালের আমলে বাংলার ধর্ম কৃষ্টি সংস্কৃতি সাহিত্য চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। এই উৎকর্ষের হেতু হিসেবে অনেকে ভগবান বুদ্ধের বােধিসত্তার কথা বলেন। হিন্দুধর্মের ব্রহ্মসত্তার সঙ্গে বােধিসত্ত্বের মেলবন্ধন ঘটেছিল—শিব ও বুদ্ধের সমতাবােধ এসেছিল। বুদ্ধশরণ, ধর্মশরণ ও সংঘশরণ – এই তিন জীবনদর্শন বঙ্গবাসীর জীবনের চত্বরে সমৃদ্ধির ফসল তুলেছিল। রাজা দেবপালের মহিষী ছিলেন সুচন্দ্রা। একান্ত ভক্তিমতী সাধ্বী সুচন্দ্রা রাজপত্নী হলেও সহজ সরল জীবনযাপন করতেন রাজঅন্তঃপুরে। বাংলার স্নিগ্ধ প্রকৃতির মতােই রাজমহিষী ছিলেন সাত্ত্বিক। বৌদ্ধধর্ম ও তার অমৃতধারায় বাংলার পরিমণ্ডল তখন অভিনন্দিত। ভােরের শিশিরের নীরব অবস্থানের মতাে, কাননপুষ্পের উজ্জ্বল ফুটে ওঠার মতাে বাংলার চিত্তকুসুম প্রফুল্ল। 

ছােট রাজনন্দন সুনন্দ তখন মা ছাড়া কাউকে চেনে না। রাজার অন্দরমহলেই রাজপুত্রের বিচরণ। রাজা দেবপাল দয়ালু প্রজাবৎসল, রাজকার্যে ও রাজধর্মে তার গভীর মনােযােগ। সুনন্দ পিতার কাছে পৌঁছতে পারে না। পিতা যখন নিজে আসেন অন্তঃপুরে তখন সুনন্দ তার খেলাধূলার জগতে থাকে বা ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়। মায়ের সঙ্গেই তার যত মেলামেশা। মা সুচন্দ্রা তাকে শিবমহিমা স্তোত্র শেখান, বৌদ্ধগাথা শােনান। লুইপা, কাহ্নপার চর্যাগীতি শােনান। গৌতমের বােধিজ্ঞানের কাহিনী শােনান। 

রাজকুমারের বয়স যখন বারাে তখন তার মায়ের কঠিন রােগ হল। মৃত্যুশয্যায় রাজমাতা সুনন্দকে কাছে ডাকলেন। প্রিয় পুত্রকে, অনেক আদর করলেন। তার ধর্মউপলব্ধির কথা বললেন। প্রাণাধিক প্রিয় সুনন্দকে বললেন, পাপকর্ম ও পুণ্যকর্মের মধ্যে আনন্দ ও দুঃখের মূল নিহিত। যদি তােমার জীবন বিপন্ন হয়, তবু তুমি পাপকর্ম করবে না। তরুণ সুনন্দ মায়ের এই উপদেশ উপলব্ধি করার চেষ্টা করল। মায়ের পূজাআচ্চা, প্রার্থনা, ধূপদীপের তথাগত আরাধনা তার মনে গভীর আলিম্পন এঁকে দিল। প্রাসাদকাননের মধ্যে ছােট বৌদ্ধমন্দিরটি একদিনের জন্যও বন্ধ হলোনা। তরুণ ভক্ত সুনন্দের উদ্যোগে স্তোত্রকীর্তন, শঙ্খঘণ্টা, আত্মমন্ত্র, শাক্যসিংহের কথা একদিনের জন্য বন্ধ হল না। এমন ঘর দিস্‌ মা, যার চারিদিকে খােলা। চিত্তের কুঠুরী তাে দেয়াল মানে না। মা হলেন সুনন্দের প্রথম গুরু। মৃত্যুর আগে জ্ঞানের কাজল দিয়ে সাধ্বী রাজমাতা ভক্তপুত্রের দুটি চোখ খুলে দিয়ে গেলেন। 

রাজা দেবপাল শাক্যমুনির উপাসক হলেও জিতেন্দ্রিয় নন। রাজকর্ম করার জন্য, রাজ্যশাসন করার স্বার্থে তিনি রাজভােগে আসক্ত। উপাসনার সময় রাজা ধ্যানপূজায় আসনস্থ হন। তিনি এক তরুণী সুন্দরী নারীকে বিবাহ করে রাজঅন্তঃপুরকে সমৃদ্ধ করলেন। লােকভাবে তিনি বিশাল রাজ্যের অধিপতি, তাই রাজপত্নী ছাড়া রাজধর্মাচরণ সম্ভব নয়। আবার অলােকচিন্তনে তিনি নৈরাত্ম উপাসক। বিবাহের কিছুদিন পরে রাজা দেবপাল কিছুদিনের জন্য ধ্যান অভ্যাস করতে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে অরণ্যনিবাসে গেলেন। তরুণী নববধূ প্রাসাদের কাননে, অলিন্দে একাকিনী ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। নববধূর বিরহজ্বালা ক্রমশঃ অসহ্য হল। একদিন অপরাহ্নকালে নববধূ শীতল বায়ুসেবন করার জন্য প্রাসাদশীর্ষে ভবনবলভীতে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক শােভা উপভােগ করছিলেন। এমন সময় নীচে প্রাসাদঅঙ্গনে তিনি তরুণ রাজপুত্র সুনন্দকে দেখলেন। সুকান্তি লাবণ্যময় এই বলিষ্ঠ তরুণকে দেখে রাজপত্নী কামমােহিত হলেন। ভুলে গেলেন এই সুনন্দ সম্পর্কে তার সন্তান। তথাপি কাম অন্ধ। কাম চরিতার্থ করতে নবকিশাের সুনন্দকে চাই। এক দাসীকে দূতী করে বাসনার আমন্ত্রণ পাঠালেন রাজমহিষী।

সুনন্দ সেই প্রস্তাব শুনে স্তম্ভিত। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন এই কামনার ডাক। সুনন্দর প্রত্যাখ্যান রাজ্ঞীকে প্রতিশােধপরায়ণ করে তুলল। সুনন্দর প্রতি সমস্ত অনুরাগ পরিণত হল বিদ্বেষে। তার বাসনার আগুন তাকে যেমন পীড়িত করল, তেমনই প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠল সুনন্দর জীবনকে দগ্ধ করার চিন্তায়। সতীনপুত্রকে গােপনে হত্যা করার চক্রান্ত করলেন রানি। কিন্তু রাজপ্রাসাদের সকল দাসদাসী জন্ম থেকে সুনন্দকে ভালবাসে। রাজকুমার নির্দোষ। বালক মাত্র। তাকে হত্যা করতে কেউ রাজী নয়। রানি উৎকোচ দিয়ে কোন রাজকর্মচারীকে রাজি করাতে পারলেন না। নির্মল নিস্পাপ সুনন্দ সকলের নয়নের মণি। তখন রানি ছলনার আশ্রয় নিলেন। অরণ্যবাস থেকে রাজার ফেরার সময় হয়ে আসছে। দুএকদিনের মধ্যে রাজা অন্তঃপুরে ফিরছেন। যুবতী রানি দাসদাসীদের তাড়ালেন। শয়নকক্ষের আসবাবপত্র এলােমেলাে করে দিতে নিজের কাপড়চোপড় ছিড়লেন, কবরী শিথিল করলেন, নিজের সারা দে রক্তাক্ত আঁচড় এঁকে দিলেন। শয়নকক্ষের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে রা. পাগলের মতাে কাদতে শুরু করলেন। যেন সদ্য ধর্ষিতা নিপীড়িত হয়েছে। 

রাজা দেবপাল নিজের পত্নীর এই দুর্দশা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন – কে তােমাকে এইভাবে অত্যাচার করেছে? ‘আপনার পুত্র, সুনন্দ। আমি তাকে বাধা দেবার অনেক চেই করেছিলাম … মহারাজ।’ “সুনন্দ আর আমার পুত্র নয়। আমি তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম। প্রাসাদরক্ষীদের আদেশ দিলেন ক্রুদ্ধ রাজা – “সুনন্দকে অরণ্যে নিয়ে যাও। দুটি পা ও দুটি হাত কেটে ফেলে দাও। হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা হিংস্র শ্বাপদ ওকে শেষ করবে। এই ওর শাস্তি।” রানি বললেন, না, ওর কাটা হাতপাগুলাে প্রহরীরা নিয়ে আসবে – রাজার আজ্ঞা যে পালিত হয়েছে, তার প্রমাণ হিসেবে। দুই রাজপ্রহরী এই রাজাজ্ঞা শুনে কেঁদে ফেলল। নিস্পাপ রাজপুত্র সুনন্দকে তারা নিজেদের ছেলের চেয়েও বেশি ভালবাসে। এই রাজকুমারকে তারা হত্যা করতে পারবে না। তাই তারা পরিকল্পনা করল, রাজকুমারকে না মেরে তাদের কারুর ছেলেকে হত্যা করবে। কিন্তু সুনন্দ যখন জানতে পারল যে তার পরিবর্তে অন্য কোন ছেলেকে হত্যা করার কথা ভাবছে তার অনুগত রাজভৃত্যরা, তখন সে তীব্র আপত্তি জানাল। তার মা মৃত্যুর আগে যে উপদেশ দিয়ে গেছেন তার কথা বলল।  ‘আমার জায়গায় অন্য কোন নিরপরাধ মরবে না। এতে আমার পাপ লাগবে। তােমরা আমার পিতার নির্দেশ পালন কর।’ শােকে কাতর ভৃত্যরা রাজকুমারকে অরণ্যের নিরাপদ অংশে একা গােচারণভূমির পাশে নিয়ে গেল। তাতে লােকজন এসে পড়লে রাজকুমার প্রাণে বেঁচে যেতে পারে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেই তৃণভূমির প্রান্তে এক গাছের তলায় রাজকুমারের হাতদুটি ও পাদুটি কেটে নিল। কাটা হাতপাগুলি নিয়ে গেল প্রতিহিংসাপরায়ণা সেই রানির কাছে। 

চৌরঙ্গীপাদ ভৃত্যরা চলে যেতেই যােগী মীনাপা সেই মুমূর্ষু বালকের কাছে আবির্ভূত হলেন। রাজা দেবপালের রাজত্বে তিনি অচিন্ত্য বলেও পূজিত হতেন। যােগী মীনাপা হাতপা কাটা সেই ধীমান বালককে সেই রক্তলিপ্ত বৃক্ষতলে মন্ত্রদীক্ষা দিলেন। শক্তি আরােপ করলেন, কুম্ভক প্রাণায়ামের কৌশল শিক্ষা দিলেন। মীনাপা আশ্বস্ত করলেন সুনন্দকে বললেন, “এই অনুশীলন যেদিন সফল হবে সেদিন তােমার দেহ আবার পূর্ণ হবে।” এই বলে মীনাপা আহত বালককে সেই গাছতলায় রেখে চলে গেলেন। তৃণভূমির পারে একদল রাখাল গােরু চরাচ্ছিল। গুরু মীনাপা তাদের নির্দেশ দিলেন আহত সুনন্দকে সেবাশুশ্রুষা করতে হবে। রাখাল বালকরা আহত রাজকুমারের দেখাশােনা করতে লাগল।

বারাে বছর রাজপুত্র সেই বিকলাঙ্গ শরীরে ধ্যান করলেন, গুরু মীনাপার শিক্ষা অনুসারে প্রাণায়াম করলেন। বারাে বছর শেষ হবার আগের দিন সন্ধ্যাবেলা, রাজকীয় বণিকরা রাজপুত্রের ধ্যানাসনের কাছে রাতের শিবির পাতল। তাদের সঙ্গে ছিল মূল্যবান হীরে মণিমাণিক্য, সােনা, রূপাে বণিকদের আশংকা হল, রাতে ডাকাত পড়তে পারে। রাত নামতে বণিকরা ঠিক করল, যাবতীয় ধনরত্ন তারা শিবির থেকে কিছুদূরে বনের মধ্যে মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখবে। অন্ধকার নামলে বণিকরা যখন সেই গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন গম্ভীর গলায় কেউ জিজ্ঞাসা করল – কে যায় ? বণিকরা খুব ভয় পেয়ে গেল। তবে কি না জেনে তারা ডাকাতদের ডেরার আশেপাশে তাবু খাটিয়েছে। সেই ভেবে বণিকরা উত্তর দিল, “আমরা কাঠকয়লা তৈরি করি। আমরা কয়লা বিক্রি করি।” তবে তাই হােক। কণ্ঠ গম্ভীর। পরের দিন ভােরে, সূর্য ওঠার পর বণিকরা মাটি খুঁড়ে তাদের লুকানাে ধনরত্ন তুলতে এল। কিন্তু গর্তে ধনরত্নের পরিবর্তে বড় বড় কাঠকয়লার টুকরাে দেখে তারা অবাক হয়ে গেল। সর্বনাশ। রাজার নির্দেশমতাে ঐ ধনরত্ন রাজধানীতে পৌছে দেবার কথা। কাঠকয়লা নিয়ে যাবে এখন! বণিকদের মাথায় হাত। তারা তখন রাজদণ্ড থেকে রেহাই পাবার জন্য পালিয়ে যাবার কথা ভাবছে। এমন সময় তাদের মধ্যে বুদ্ধিমান একজন বলল – মনে পড়ছে একটা কণ্ঠস্বর গত রাতে আমাদের ডেকেছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেই কণ্ঠস্বর কোন মহাত্মা সাধুর কষ্ঠ। যার প্রতিটি কথা সত্য, শুদ্ধ আত্মার কথা সত্য হয়। চলাে, আমরা তাকে খুঁজি। আমাদের তাে আর হারানাের কিছু নেই। 

তখন সেই বণিকরা পথে পথে খুঁজতে লাগল। সেই বড় গাছের তলা হাতপা কাটা এক মহাত্মা ধ্যানে মগ্ন। ধ্যানীর চারপাশে উপবেশন করে বণিকরা তাদের দুঃখের কথা বলল। ধ্যানী যােগীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল তারা। যােগী রাজকুমার চোখ মেললেন। হয়তাে আমি ধ্যানস্থ অবস্থায় কথা বলেছি। আমার কণ্ঠস্বর তােমাদের বস্তুসম্পদের আকার পালটে দিয়েছে। আমার তা জানার কোন উপায় নেই। কিন্তু তার জন্য আমি যদি দায়ী হই, তাহলে সেই কাঠকয়লা আবার ধনরত্নে রূপান্তরিত হােক। নিত্য শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত হৃদয়ের উৎস থেকে উৎসারিত যে বাক্যবন্ধ, তা সত্য হল। যােগীর কথার পর বণিকরা তাদের কাঠকয়লাভরা থলিগুলাে মাটিতে উপুড় করে দিল। ভােরের রৌদ্রকিরণে ঝলমল করে উঠল সােনারূপা, হীরা, খণ্ডিতহস্তপদ সাধুকে। 

সুনন্দ বণিকদের মতাে চমৎকৃত হল। তার মনে পড়ল বারাে বছর আগে মহাগুরু মীনাপার বাণী। আজ তাহলে কি তার দীর্ঘ সাধনা সার্থক হয়েছে? ঋষিযােগীর ভবিষ্যদবাণী কি আজ সার্থক হবে! হারিয়ে যাওয়া হাত পা কি আবার সৃষ্টি হবে তার দেহে! বণিকের দল তৃপ্ত হয়ে রাজধানীতে চলে গেছে। সেদিন সেই বৃক্ষতল আশ্চর্য সাধনার মহান বেদিপীঠ হয়ে গেল। একটু পরেই গােরু চরাতে আসবে বনের ধারের গ্রামের রাখাল। আনবে পাতায় মােড়া আহার্য, মাটির পাত্রে দুধ, প্রতিদিনের সেবা, যেমনটি তারা করে আসছে সেই খণ্ডিতদেহ আশ্চর্য যােগীর জন্য। যােগী মীনপার বাক্য স্মরণে ধ্যানে বিলীন হলেন রাজপুত্র। প্রাথনা করলেন, তার হাত ও পা নতুন করে সৃষ্টি হােক। সূক্ষ্ম বায়ুস্তর থেকে বাস্তবায়িত হল তার চতুরঙ্গের প্রার্থনা। নব্য যােগী উপলব্ধি করতে লাগলেন, মা পৃথিবী যেমন সকল জীবজগত ও উদ্ভিদজগতের জন্ম দেন, গাছের কাণ্ড থেকে যেমন করে ধীরে উদ্গত হয় শাখা-প্রশাখা, তেমনভাবেই পরিব্যাপ্ত এক নির্বিকল্প শূন্যতা থেকে উদ্গত হচ্ছে তার দুই বাহু, দুই পা। মীনাপা তার দীক্ষান্ত নাম রাখলেন চৌরঙ্গিপাদ। – সেই গাছ যা তার বারাে বছরের নিরলস সত্যসাধনার সাক্ষী, ডালপালা মেলে আজও বেঁচে আছে। পার্থিব কামনাবাসনার রাজত্ব থেকে, প্রতিহিংসার রুদ্ধ নরক থেকে বহুদূরে বনভূমির ছায়ানিবিড় শান্ত কোন তৃণভূম্যংশে সেই সত্যসাধনা আজও প্রত্যক্ষ করছে সেই গাছ। 

১৯। কাহ্নপাদ

চর্যাপদের কবিগণের মধ্যে সর্বাধিক পদরচয়িতার গৌরবের অধিকারী কাহ্নপাদ। তার তেরটি পদ চর্যাপদ গ্রন্থে গৃহীত হয়েছে। এই সংখ্যাধিক্যের পরিপেক্ষিতে তাকে কবি ও সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করা যায়। কানু পা কৃষ্ণপাদ ইত্যাদি নামেও তিনি পরিচিত। বিভিন্ন পদে কাহ্ন, কাহ্নূ, কাহ্নু, কাহ্ণ, কাহ্নি, কাহ্নিলা, কাহ্নিল্য প্রভৃতি ভণিতা লক্ষ করা যায়। খ্রিস্টিয় ৮ম শতকে কানু পার আবির্ভাব হয়েছিল বলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মনে করেন। কানু পার বাড়ি ছিল উড়িষ্যায়, তিনি সােমপুর বিহারে বাস করতেন। রাহুল সংকৃত্যায়ন কাহ্ন পা বা কৃষ্ণ পাদ বা কৃষ্ণাচার্য পাদ বা কৃষ্ণব পদকে অভিন্ন ব্যক্তি মনে করেন। তিনি দেব পালের রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন। তার জীবকালের উর্ধ্বসীমা ৮৪০ সাল। তিনি বর্ণে ব্রাহ্মণ এবং ভিক্ষু ও সিদ্ধ। তিনি পণ্ডিত-ভিক্ষু নামে খ্যাত ছিলেন। চর্যাপদ ছাড়াও তিনি অপভ্রংশ ভাষায় দোহাকোষ রচনা করেছিলেন। বিষয়বস্তুর বিচারে কাহ্ন পা সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যােগী ছিলেন বলে অনুমিত হয়। ড. সুকুমার সেনের মতে, ‘কাহ্নুর চর্যাগীতির রচনারীতিতে অস্পষ্টতা নাই। কয়েকটি প্রেমলীলা-রূপকমণ্ডিত চর্যাকে সেকালের প্রেমের কবিতার নিদর্শন বলিয়া লইতে পারি।’ কাহ্ন পা রচিত চর্যাগীতির একটি নিদর্শন : “এবংকার দৃঢ় বাখােড় মােড়িউ।/ বিবিহ বিআপক বান্ধণ তােড়িউ ॥/ কাহ বিলসঅ আসব মাতা।/ সহজ নলিনীবণ পইসি নিবিতা ॥/ জিম জিম করিণা করিণিরে রিসঅ।/ তিম তিম তথতা মঅগল বরিসঅ ॥/ ছড়গই সঅল সহাবে সুধ।/ ভাবাভাব বলাগ ন ছুধ৷৷/ দশবর রঅণ হরিঅ দশ দিসেঁ।/ বিদ্যাকরি দম জা অহিলেসে ॥” এর আধুনিক বাংলা : এবংকার দৃঢ় বন্ধনস্তম্ভ মথিত করে, বিবিধ ব্যাপক বন্ধন ভেঙে ফেলে আসবমত্ত কানু বিলাস করে। সে শান্ত হয়ে সহজ নলিনীবনে প্রবেশ করে। হস্তী যেমন হস্তিনীতে আসক্ত হয় তেমনি মদকল তথতা বর্ষণ করে। ষড়গতি সকল স্বভাবে শুদ্ধ। ভাবে ও অভাবে এক চুলও ক্ষুব্ধ হয় না। দশদিকে দশবল রত্ন আহরণ করে বিদ্যারূপ হস্তীকে অক্লেশে দমন কর। 

কৃষ্ণপাদাচার্য বাংলার পালযুগের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। বাংলার নিজস্ব মৌলধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম এই সময় এক বিচিত্র সংমিশ্রণ, ভিন্ন মাত্রা, আস্বাদন লাভ করেছিল। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে কৃষ্ণাচার্যের রচিত তেরােটি পদ উদ্ধার করা হয়েছে। দীর্ঘ সাধনজীবনে কৃষ্ণপাদাচার্য বা কানহুপা বা কাহ্নাপা অসংখ্য পদ রচনার মাধ্যমে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও বােধিচিত্তের প্রসার করেছিলেন। পদকর্তা কবি, মনীষী এবং বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য। 

গৌড়বাংলায় গঙ্গাতীরে এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম সুবর্ণপুরে ব্রাহ্মণ দেবকায় লিপিকারের জীবিকা অবলম্বন করেছিলেন। মহাকাব্য, পুরাণ, জাতকের কাহিনী, কবি কালিদাস, ভটি, ত্রিপিটক ইত্যাদি বিখ্যাত বিখ্যাত পুঁথির লিপি প্রস্তুত করাটা কেবল তুলি ও কলমের ও তালপাতা ভূর্জপত্রের শিল্প ছিল না। তার সঙ্গে ছিল ব্রাহ্মণমস্তিষ্ক। প্রখর কাব্যবােধ, শাস্ত্রজ্ঞান ও ব্যাকরণজ্ঞান না থাকলে মহাকাব্য, পুরাণ, শ্রুতি, স্মৃতি প্রভৃতির অনুলিপি প্রস্তুত করা যায় না। কারণ সামান্য বর্ণবিভ্রাটে, সন্ধি সমাসের বর্ণভ্রান্তিতে শাস্ত্রের অর্থবােধ বদলে যায়। 

পালযুগে কাব্যশাস্ত্রব্যাকরণপুরাণ চর্চা বাংলার ঘরে ঘরে। বিশেষ করে, বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে গণভাষা পালিভাষা তখন বেশ চর্চিত ও জনপ্রিয়। তাই এই সব চর্চার জন্য শাস্ত্রপুরাণমহাকাব্য ইত্যাদি পুঁথির অনেক সংস্করণ প্রয়ােজন ছিল। মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা তাে ছিল না সেদিন। তাই পুঁথির নকল বা অনুলিপি প্রস্তুত করাটা তখন ভাল জীবিকার উপায় ছিল। ব্রাহ্মণপণ্ডিত দেবকান্ত সেই ধরণের লিপিকার ছিলেন। তিনি ধ্রুপদী সাহিত্য, শাস্ত্রপুরাণ প্রভৃতির নতুন পাঠ লিখতেন। সেই সঙ্গে বৌদ্ধজাতক বা পুজা উপাসনার পুঁথিও লিখতেন। 

এই লিপিকার সম্প্রদায় তৎকালীন গৌড়বাংলায় বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। সুবৰ্ণপুরে দেবকান্ত শর্মার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কৃষ্ণ। শ্যামবর্ণ লাবণ্যময় বালক মেধাবী ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়ায় কৃষ্ণের দক্ষতা দেখে সোমপুর বিহারের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করলেন পিতা। সােমপুর বিহারে প্রধান আচার্য গুরু জালন্ধর কৃষ্ণকে হেবজ্র দেবতার মণ্ডলে দীক্ষিত করলেন। বালক কৃষ্ণের প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করেছিল। তখনকার দিনে বিভিন্ন বৌদ্ধদেবদেবীর সাধনার শ্রেণি থাকতাে বিহার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এক একটি বিদ্যাবিভাগের এক একজন দেবতা, সেই বিভাগের প্রধান একজন গুরু। গুরু জালন্ধর তেমনই হেবজ্রসাধনমণ্ডলের আচার্য গুরু। 

আচার্য জালন্ধর কৃষ্ণকে দীর্ঘ সাধনার কথা পূর্বেই জানিয়ে বলেছিলেন— ‘বৎস! চাকা না থাকলে যেমন তুমি রথ চালাতে পারাে না, তেমনই গুরু বিনে তুমি পরম সাধনার বিভিন্ন স্তরে সিদ্ধিলাভ করতে পারাে না। বিশাল দুই সাদা ডানা উৰ্দ্ধ আকাশে মেলে দিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টি ঈগলপাখি যেমন ওড়ে অসাধারণ নৈপুণ্যে, তেমন করেই গুরুর চিদাকাশের শক্তিমান উপদেশগুলো শিষ্যযােগীকে পরম কঠিন সন্তোষ দান করতে পারে। সােমপুর বিহারে বারাে বছর ধরে জালন্ধর আচার্যপাদের নির্দেশে সাধনা করলেন কৃষ্ণ। যেদিন কৃষ্ণ শর্মা এক যুগব্যাপী কঠোর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলেন; সেদিন সােমপুরীতে কি বিস্ময়! অন্যান্য আচার্যপাদ, ভিক্ষু, শ্রমণ, ক্ষপণক সকলেই সমবেত হয়েছেন সােমপুর বিহারের মহাসমাবর্তনে। চারিদিকে সমারােহ, মৃদঙ্গ, পটহ ধীরলয়ে গভীর নাদে বেজে উঠছে। গুরু জালন্ধর তার প্রিয় শিষ্যের সাফল্যে আনন্দিত। বারাে বছর পর এবার তিনি তীর্থপর্যটনে বেরােবেন। 

লিপিকার দেবকান্তপুত্র কৃষ্ণ উপাধি পেলেন সাফল্যের পুরস্কার। কৃষ্ণপাদ। স্বয়ং হেবজ্র দর্শন দিয়েছেন বলে কৃষ্ণপাদের পদতলে কেঁপে উঠল পৃথিবী। স্বয়ং হেবজ্র তার ভক্তকে কৃপা করেছেন বলে কৃষ্ণপাদের সঙ্গে পাঠিয়েছেন হেবজ্ৰমণ্ডলীর যােগীপার্ষদদের। এই সাফল্যের অহংকারে স্ফীত হলেন কৃষ্ণপাদ। তিনি ভাবলেন, হেবজ্রদেবের কৃপায় তিনি চরম পূর্ণতা পেয়েছেন। পরম সিদ্ধি এবার তার হাতের মুঠোয়। যে মুহূর্তে সাধক এই উপলব্ধি করলেন, যে ক্ষণে সাধক পরম আত্মতৃপ্তি বােধ করলেন, তখনই এক ডাকিনী আবির্ভূত হলেন তার সামনে। কৃষ্ণপাদকে তিরস্কার করে সতর্ক করে দিলেন যে, সাধক যেভাবে সাধনসিদ্ধি পেয়েছেন, তা সাধনার প্রথম পর্যায়। এ সিদ্ধি পরম প্রাপ্তি নয়। অনুতপ্ত কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ আবার তার নিভৃত সাধনায় বসলেন। তার যে সাফল্য এসেছিল, অহংকার তাকে নষ্ট করেছে। কৃষ্ণ দ্বিতীয় সাধনায় মনােনিয়ােগ করলেন। 

তবুও মাঝে মধ্যে নিজ সাধনার ফলপ্রাপ্তি পরখ করার লােভ সম্বরণ করতে পারলেন না সাধক। একদিন তিনি এক কঠিন পাথরের ওপর ধীরে পা দুটি রাখলেন। তারপর পা নামিয়ে দেখলেন, কঠিন পাথরের বুকে তার পদচিহ্ন আঁকা হয়ে গেছে। আবার সেই ডাকিনী ফিরে দেখা দিলেন। তিরস্কার করলেন। আবার ধ্যানাসনে ফিরতে আদেশ হল। তৃতীয়বারে, যখন কৃষ্ণপদ দীর্ঘ সমাধি থেকে জেগে উঠলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি ভূমি আসন থেকে অনেক ওপরে শূন্যে ভাসছেন। পরমুহূর্তে সেই কুপিতা ডাকিনী আবির্ভূত হয়ে তিরস্কার করলেন। তখনও তার সাধনফল পরীক্ষার সময় হয় নি। আবার ধ্যানক্ষেত্রে ফিরে যেতে আদেশ হল।  চতুর্থবার, যখন যােগী কৃষ্ণ তার ধ্যানচেতনা থেকে উত্থান করলেন, তখন তিনি দেখলেন সাতখানি রাজকীয় চন্দ্রাতপ তার মাথার ওপরে ভাসছে। সাতটি করােটি নির্মিত ডম্বরু বাজছে মহাশূন্যে গম্ভীর নাদে। তৃপ্ত কৃষ্ণপাদ তার শিষ্যদের বললেন – ‘এবার কেউ আমাকে বলতে পারবে না যে, আমি আমার সাধনলক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি নি।… তােমরা সকলে চলাে আমার সঙ্গে শ্রীলংকাদ্বীপে। সেখানে সিংহল জনপদের অসভ্য অধিবাসীদের দীক্ষিত করব শাক্যমুনির পবিত্র অষ্টাঙ্গিক মার্গে।’ 

তিনহাজার শ্রমণ শিষ্য নিয়ে দক্ষিণভারত যাত্রা করলেন কৃষ্ণপাদাচার্য। মূল ভারতভূখণ্ড থেকে সমুদ্রপ্রণালী যেখানে শ্রীলংকাদ্বীপভূমিকে বিচ্ছিন্ন করেছে, সেই সমুদ্রপারে পৌঁছে কৃষ্ণপদ মনঃস্থির করলেন, এবার তিনি তার সাধনক্ষমতা প্রদর্শন করবেন। সেই সমুদ্রতীরে তিনহাজার শিষ্য, দক্ষিণভারতের উপস্থিত ভক্তজন সবিস্ময় দেখল সিদ্ধসাধক কাহ্নপা সমুদ্রের জলের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন সিংহল দ্বীপভূমিতে। ‘আমার পরম গুরু সিদ্ধাচার্য জালন্ধরও এই কাজ করতে পারেন না’ স্বগতােক্তি করলেন পরিতৃপ্ত কাহাপা সমুদ্রের ওপর ভাসতে ভাসতে।  এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের টুকরাের মতাে টুপ করে জলের গভীরে তলিয়ে গেলেন কাহ্নপা। তারপর জলের স্রোতে ও ঢেউএ ভেসে হাবুডুবু খেয়ে কাশতে কাশতে বিষম খেয়ে তীরে আনীত হলেন যােগী। সৈকতভূমিতে চিৎ হয়ে শুয়ে নােনা জলসহ বালি উগরে দিতে দিতে বেচারি সাধক চোখ মেললেন আকাশে।  দেখলেন, ঠিক তার ওপরে গুরু জালন্ধর শূন্যে ভাসমান। প্রশান্ত প্রসন্ন মহাসাধক। গম্ভীর কণ্ঠে শূন্য থেকে জিজ্ঞাসা করলেন গুরু জালন্ধর। ‘একটু অসুবিধে হচ্ছে, বােধকরি! ‘হ্যা, আচার্য! আমি স্বীকার করছি, এ আমার গর্ব ও অহংকারের ফল। লজ্জিত কাহাপা মাথা নত করলেন। হাে হাে করে শূন্যে প্রতিধ্বনিত হ’ল গুরু জালন্ধরের অট্টহাসি। তারপর তার করুণা হ’ল অপরাধী শিষ্যের ওপর। আদেশ করলেন – ‘তুমি পাটলিপুত্র নগরীতে যাও। লােকহিতৈষী রাজা ধর্মপাল সেই রাজ্য শাসন করেন। সেখানে আমার এক শিষ্য আছে। তাঁত বােনে সে, জাতে জোলা। তাকে খুঁজতে হবে। সে যা যা করতে বলবে, তা যদি তুমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করাে, তবেই তুমি চরম ও পরমসত্য উপলব্ধি করতে পারবে। তােমাকে এটা বুঝতে হবে, বৎস। 

এই কথাগুলো বলে শূন্যে বিলীন হলেন গুরু জালন্ধর। অকস্মাৎ, কাহ্নপা দেখলেন আকাশে আবার দেখা দিল সুন্দর চন্দ্রাতপগুলো, করােটিবাদ্য বেজে উঠল। তিনি অনুভব করলেন, তার সাধনালব্ধ শক্তিগুলো আবার ফিরে আসছে তার মধ্যে – আবার তিনি শূন্যে ভাসতে পারবেন, জলের ওপর হাঁটতে পারবেন, পাথরের ওপর মুদ্রিত হবে তার চরণচিহ্ন। তখনই গুরুর আদেশ মেনে শিষ্যদের নিয়ে কাহ্নপা যাত্রা করলেন গঙ্গাতীরে বঙ্গপ্রদেশে পাটলিপুত্র নগরে। পাটলিপুত্রে পৌঁছে কানহাপা তাঁর শিষ্যদের রেখে দিলেন নগরীর বাইরে। তার আত্মবিশ্বাস, তিনি খুঁজে পাবেন সেই ঈপ্সিত মহাজনকে। ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তাঁতিপল্লীর রাস্তায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি প্রত্যেক তাঁতির তাঁত বােনার যন্ত্র ও তাঁতের মাকুর আনাগােনা লক্ষ্য করতে লাগলে দেখতে দেখতে শেষ পর্যন্ত এক তাঁতির কাছে এসে থামলেন। সেই মানুষটি তাঁতের দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে আছেন আর মাকুটি নিজে নিজে সতে মধ্যে যাতায়াত করে চমৎকার কাপড় বুনে চলেছে। কাহ্নপা বুঝলেন, তার খোঁজাখুঁজি সফল। তিনি সেই তাঁতির সামনে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করলেন। তারপর তাঁতির চারপাশে পবিত্র মন্ত্রধ্বনি করে মহাজনকে প্রদক্ষিণ করলেন। তারপর সবিনয় আবেদন জানালেন, তিনি তার কাছে পরম সত্য জ্ঞান শিক্ষা করতে চান। জোলা মহাজন কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘যা করতে বলব, তা তুমি করবে, এই শপথ নিতে হবে।’ ‘শপথ করলাম’ – কাহ্নপা করজোড়ে বললেন। সাধনগুরু জোলা তখন কাহ্নপাকে নিয়ে গেলেন শ্মশানে। চিতার পাশে শায়িত শবদেহ। যাও, ঐ শবদেহ থেকে একখণ্ড মাংস ভক্ষণ কর। কাহ্নপা শবদেহের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একটি ছুরি দিয়ে শবদেহ থেকে মাংস কাটতে উদ্যত হলেন। মূর্খ! গর্জে উঠলেন জোলাগুরু। ঐভাবে নয়, এইভাবে। সঙ্গে সঙ্গে জোলা নেকড়ে বাঘের চেহারায় রূপান্তরিত হলেন। শবদেহের ওপর ঝাপিয়ে দাঁত দিয়ে নরমাংস ছিড়ে ছিড়ে খেতে লাগলেন নেকড়েরূপী জোলাসাধক। শব-মাংস খাওয়া শেষ করে আবার মানুষের রূপে ফিরলেন সেই জোলা। বিস্মিত শিষ্যকে বললেন—নরমাংস খেতে হলে তােমাকে জানােয়ার হতে হবে। তারপর সেই শ্মশানভূমিতে চিতাভস্মের মাঝে উবু হয়ে বসে মলত্যাগ করলেন জোলা। তিনভাগে মলত্যাগ করে একটুকরাে মল তুলে কাহ্নের হাতে দিয়ে বললেন- “এটা খাও”। না, না, আমি এ কাজ করতে পারি না। যদি কেউ দেখে ফেলে কানহাপা প্রতিবাদ করলেন। তখন সেই সাধক তাতি এক অংশ বিষ্ঠা নিজে ভক্ষণ করলেন। দ্বিতীয় ভাগ নিবেদন করলেন দেবতাদের উদ্দেশ্যে আর তৃতীয় ভাগ বিষ্ঠা নাগদের মাধ্যমে নরকে প্রেরণ করলেন।

এর পর তারা নগরে ফিরে এলেন। নগরের দোকান বাজার ঘুরে জোলাগুরু পাঁচটি পয়সা দিয়ে খাবার ও মদ কিনলেন। “নাও, তােমার সব চ্যালাদের ডেকে আনে এবার। আমরা গণচক্র অনুষ্ঠান করবাে, খানাপিনা হবে।” কাহ্নপা বিস্মিত হলেন। এই পাঁচপয়সার খাদ্য ও পানীয় এত সামান্য যে এতে একজনের পেটও ভরে না। জোলাগুরু এত লােকজনকে আপ্যায়ন করবেন কী করে? লােকজন যখন এসে উপস্থিত হল গণচক্র অনুষ্ঠানে, জোলাসাধক তখন দেবতাকে নিবেদন করলেন সেই খাদ্য ও পানীয়; তারপর মুঠো করে ছড়াতে লাগলেন চারিধারে। তারপর যেন কোন স্বর্গীয় ইন্দ্রজালে খাবার পাত্রগুলোতে অফুরন্ত উৎকৃষ্ট অন্ন, নানাবিধ মিষ্টান্ন, ব্যঞ্জন, মাছ, মাংস ভরে উঠল। সাতদিন ধরে সেই মহাভােজসভা চলল। দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত সেই ভােগ অফুরন্ত রয়ে গেল। উদ্দাম লাস্যে পানভােজনে অক্লান্ত সেই ব্রাত্য সাধক নৃত্যগীতে মুখর হলেন। হাল ছেড়ে কাহ্নপা বলে উঠলেন – “আর একটুও খেতে পারবাে না। গলা দিয়ে আর কিছু নামবে না। অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট খাদ্যপানীয় ক্ষুধার্ত প্রেতেদের জন্য উৎসর্গ করে কাহ্নপা তার অনুগামীদের ডেকে নিয়ে পাটলিপুত্র ছেড়ে চললেন। জোলাগুরুর মতাে সাধনা তিনি করবেন না। গুরু জালন্ধর তাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছেন। জোলাসাধক কাহাপার সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। গীত গাইলেন পরম সত্যের। ওরে হতভাগা, শিশুরা! পালিয়ে কোথায় যাবি? কি পাবি তােরা? বিশুদ্ধ অন্তর্দৃষ্টির শূন্যতা থেকে আলাদা হয়ে তােরা তােদের বিনাশ করছিস। জীবনের সক্রিয় করুণা থেকে আলাদা হয়ে ধ্বংস করছিস নিজদের তােরা। শূন্যে ভাসমান চন্দ্রাতপ আর করােটিবাদ্য— বাস্তবের সত্য রূপের উপলব্ধির তুলনায় কিছুই নয়। তােরা ফিরে আয় সহজ সাধনায় … 

এই ডাকে সাড়া দিলেন না কানহাপা। তিনি ফিরলেন না। পাটলিপুত্র থেকে সাড়ে চারশ মাইল পথ হেঁটে তিনি এসে পৌঁছলেন পূর্বদেশে, ভদোকোরা নামে এক নতুন নগরে। নগরােপান্তে স্নিগ্ধ বনানী। দেখলেন এক পূর্ণ লিচুগাছ, পাকা ফলে নুয়ে পড়েছে সেই গাছের ডালপালা। এক সুন্দরী মেয়ে সেই গাছের ছায়ায় বসে আপনমনে ধীরে ধীরে গান গাইছে। শিষ্ট বাক্য উচ্চারণ করলেন কাহ্নপা। স্মিত মুখে সম্বােধন করলে অনুমতি চাইলেন, কিছু ফল তিনি সংগ্রহ করতে পারেন কি না। মেয়েটি ঘাড় নেড়ে জানালাে, না, ফল পাড়া যাবে না। রাগে ফেটে পড়লেন কাহ্নপা। “আমাকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস কি করে হয় তােমার মতাে এক সামান্য কন্যার?” লিচুগাছের দিকে চোখ মেললেন শুধু কাহ্নপা। ফল ঝরে পড়ল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে সেই ঝরে পড়া ফলগুলোকে নিজ দৃষ্টিক্ষমতার জোরে গাছে তাদের জায়গায় ফিরিয়ে দিল সেই মেয়ে। বােঝা গেল, এ তাে মেয়ে মেয়ে নয়, ডাকিনী নিশ্চয়। এসব দেখে শুনে ডাকিনীর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কাহ্নপা এত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন, যে সেই দেবাংশী মেয়েকে আবেদন না করে, খুশি না করে তিনি অভিশাপ দিলেন মন্ত্র উচ্চারণ করে। এত শক্তিশালী অভিশাপ যে মেয়েটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল। তার নাকমুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। সবুজ ঘাস রক্তের রেখায় কলংকিত হল। 

কিছুক্ষণের মধ্যে অভিশপ্ত মেয়েটির চারধারে এলাকার লােকজন ভিড় করে এল। রক্তাক্ত মেয়েটিকে ছটফট করতে দেখে আর ক্রোধে বিস্ফারিত নয়ন বৌদ্ধযােগীকে দেখে তারা ঘটনার কারণ বুঝে নিল। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল সেই জনতা। “ভগবান বুদ্ধের শিষ্যরা করুণাময় হন। এই সন্ন্যাসীটি বৌদ্ধ হলে রক্তলােভী।” এই কথা কানে যেতে কাহ্নপা সম্বিত ফিরে পেলেন। বুক পারলেন, অতি ক্রোধ তাকে অধঃপতিত করেছে। তিনি তার অভিশাপ প্রত্যাহার করলেন মেয়েটির ওপর থেকে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে। রক্তলিপ্ত মুখে সেই কাতর ডাকিনী পাল্টা অভিশাপ দিয়েছে। অভিশপ্ত কাহ্নপা তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। প্রবল রক্তবমি করতে শুরু করলেন। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তিনি তাঁর প্রিয় ডাকিনী সঙ্গিনী ভাণ্ডেকে আহ্বান করলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ আবির্ভূত হয়ে মৃতপ্রায় গুরুর সেবা করতে লাগলেন। কাহ্নপা তাকে অনুরােধ করলেন দাক্ষিণাত্যে শ্রীপর্বতে যাবার জন্য। সেই পর্বতের সানুদেশে এক বিশেষ ওষধিগাছ আছে। সেই ওষধি আনলে তার প্রাণরক্ষা হবে। উদ্বিগ্ন ডাকিনী ভাণ্ডে তৎক্ষণাৎ যাত্রা করলেন দাক্ষিণভারতের শ্রীপর্বতে। যোগবলে ছয় মাসের পথ তিনি অতিক্রম করলেন মাত্র সাত দিনে। শ্রীপর্বতের কুয়াশাঢাকা অরণ্যে ঘুরে ঘুরে তিনি সেই ভেষজ ওষধি সংগ্রহ করলেন। ব্যাকুল হয়ে তিনি দ্রুতগতিতে বাংলার দিকে যাত্রা শুরু করলেন।

ছয়দিনের দিনে যখন তিনি প্রায় এসে পড়েছেন কাহ্নপার কাছে, রাস্তার ধারে এক জরাগ্রস্ত বুড়ির অসহায় কাতর কান্না শুনে ভাণ্ডেকে থামতে হল। ডাকিনী হয়েও তিনি বুঝতে পারলেন না মায়াপটিয়সী সেই ডাকিনীকে, যে তার প্রভুকে অভিশাপ দিয়েছে। ভাণ্ডে সেই বুড়ির কাছে গিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্ন করলেন – আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন, বুড়িমা?’ বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বলল – মহাযােগী কাহ্নপার মৃত্যু হয়েছে বলে আমি কাঁদছি, মা।’ গুরুর মৃত্যুসংবাদ শুনে গভীর হতাশায় ভেঙে পড়লেন কাহ্নপার প্রিয় ডাকিনী। এত কষ্ট করে এতটা পথ বেয়ে তিনি দুর্লভ মৃত্যুঞ্জয়ী ওষধি সংগ্রহ করলেন, সে সব ব্যর্থ হল। রাগেশােকে হতাশায় ডাকিনী সেই ওষধিসংগ্রহ ফেলে দিলেন। দ্রুত ফিরে চললেন বাংলার সেই কাননে যেখানে এতক্ষণ কানহাপার ভক্তরা প্রয়াত গুরুর চিত্যাশয্যার আয়ােজন করছে। যদি একবার শেষ দেখা হয়ে যায়। কিন্তু না। গুরু কানহাপা মরেন নি। তখনও তিনি মৃত্যুযন্ত্রণা ভােগ করছেন, আশা করে আছেন তার প্রিয় সঙ্গিনী তার জন্য ওষধি আনবেন।। গুরুর কাছে এসে অনুশােচনায় বিলাপে ভেঙে পড়লেন ভাণ্ডে। রাস্তার ধারে সেই বুড়িই তাহলে …। যােগী কাহাপা বুঝতে পারলেন সব। আর সাতদিন মাত্র তার আয়ু থাকবে। তিনি তার সব শিষ্যদের ডাকলেন এবং দেহত্যাগের আগে তিনি তাদের সাধনাশিক্ষা সম্পূর্ণ করলেন। ছিন্নমস্তা বজ্রবারাহী সাধনা-বজ্রযানী বৌদ্ধদের পরম সাধনা।

গুরুর দেহরক্ষার পর তার প্রিয় সঙ্গিনী ভাণ্ডে সেই হত্যাকারী ডাকিনীকে খুঁজতে স্বর্গ, মর্ত, পাতাল অভিযান করলেন। শেষে এক বিশাল সম্ভিলা বৃক্ষের কোটরে সেই দুষ্টা ডাকিনীকে পেলেন এবং সেই ডাইনীর পাদুটি ধরে মাটিতে আছাড় দিলেন। এমন করে অভিশাপ দিলেন যে সেই দুষ্টা ডাইনী চিরদিনের জড়মূর্তিতে পরিণত হল। এভাবে এক বিদ্যা থেকে অন্য বিদ্যায় উত্তীর্ণ হরেছিলে বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য বাঙালি যােগী কৃষ্ণপাদাচার্য বা কাহ্নপা। যােগসাধনার বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা যেমন অনন্ত, রহস্যাবৃত, তেমনত রহস্যময় ছিল এই সিদ্ধাচার্যের জীবনসাধনা। অনেক শতাব্দীর পর আর এক যােগীন্দ্র গীত গাইলেন – অস্ফুট মনঃআকাশে জগতসংসার ভাসে। ওঠে ভাসে ডুবে পুনঃ অহংস্রোতে নিরন্তর। ধীরে ধীরে ছায়াদল মহালয়ে প্রবেশিল। বহে মাত্র আমি আমি এই ধারা অনুক্ষণ, সে ধারাও বদ্ধ হইল, শূন্যে শূন্য মিলাইল অবামনসােগােচর … 

২১। শবরীপাদ

শবর পা ছিলেন বাঙালি এবং তিনি ছিলেন ব্যাধ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে শবর পা ৬৮০ থেকে ৭৩২ সালে বর্তমান ছিলেন। রাহুল সংকৃত্যায়নের মতে, শবর পা ছিলেন বিক্রমশীলা নিবাসী, কুলে ক্ষত্রিয় এবং অন্যতম সিদ্ধাচার্য। তিনি ৮৮০ সালের দিকে বর্তমান ছিলেন। তিনি ছিলেন বহু গ্রন্থের প্রণেতা। ড. সুকুমার সেনের মতে, লুই পার গুরু শবর পার জীবকাল আট শতকের প্রথমার্ধ।

বাংলার উত্তরভাগে হিমালয় তার বিস্তৃত অরণ্য সানুদেশ নিয়ে সে আরণ্যক জনপদ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে, সেই জনপল্লীতে অনতিউচ্চ পর্বতমালায় মন্ত্রপাহাড়। দূরের সূর্যকরােজ্জ্বল আকাশপটে দেখা যাস তুষারমৌলী কাঞ্চনজংঘাসহ অন্যান্য গিরিশৃঙ্গ। সেই বনপল্লীতে বাস করতে শ্রীধর নিষাদ বন্য পশু শিকার করে তার মাংস হাটে বিক্রি করে সেই হিংসাজীবী নিষাদ। বন্য বর্বর জাত শবর। বাঁচার জন্য পশুহত্যা এবং পশুহত্যার জন্য বাঁচা এই কর্মচক্রে বর্বর শবরজীবন কাটে শ্রীধরের। বনের এই পার্বত্য উপজাতির সব নিষাদেরই এই জীবনচর্যা। দারিদ্র্য, সারল্য এবং জীবনের তামস গরল নিষাদের নিত্যসঙ্গী। এই শ্রীধর একদিন হরিণ শিকার করে মৃত হরিণটি কাঁধে ফেলে বনপথে বাড়ি ফিরছিল। তখন দিনান্ত অরণ্যের গােধূলিবেলায় শ্রীধরকে দেখলেন শ্ৰমণ লােকেশ্বর, করুণার বােধিসত্ত্ব। ব্যাধের বসন বলতে কটিতে নিবদ্ধ অজিন, পশুর শুষ্ক নাড়ি দিয়ে বাঁধা। নগ্নগাত্রে শিকারীর পরিশ্রমের স্বেদবিন্দু। কাধে ধনুক, পিঠে তীরের তৃণ, কোমরে দীর্ঘ ছুরিকা। হরিণের রক্ত এখনও বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ছে বনের মাটিতে। কিছু রক্ত লেগে আছে ব্যাধের পেশীবহুল নির্মেদ শরীরে। মূর্তিমান হিংসার প্রতিচ্ছবি যেন। 

লােকেশ্বর তখন স্বয়ং নিষাদরূপ ধরে বনের পথে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্মজীবনের পাপচক্র থেকে ব্যাধকে তিনি মুক্ত করতে চাইলেন। নবাগত ধনুর্ধারী ব্যাধকে দেখে শ্রীধর বিস্মিত। এতকাল এই বনাঞ্চল তার মৃগয়াক্ষেত্র। এই ব্যাধকে কোনদিন এই বনে শিকার করতে সে দেখেনি। লােকেশ্বরের সামনে এসে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে শ্রীধর প্রশ্ন করে। ‘কে তুমি? তােমাকে তাে আগে কোনদিন এ অঞ্চলে দেখিনি!’ ‘আমি তােমারই মতাে, একজন ব্যাধ। ‘কোথা থেকে এসেছ, তুমি ?’ শ্রীধরের সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা। ‘সে অনেক দূর থেকে’ – লােকেশ্বরের ভাসা ভাসা উত্তর। শ্রীধরের ইচ্ছে হল, আগন্তুকের পরীক্ষা নেবে। কেমনধারা ব্যাধ এই লােকটা? ‘যদি তোমার একটিমাত্র তীর থাকে, তাহলে কটা হরিণ মারতে পারবে?’ ‘তা ধরাে, শতিনেক’। শান্ত উত্তর নিষাদবেশী বােধিসত্তের। শ্রীধর পাকা শিকারী। ‘তােমাকে করে দেখাতে হবে।’ ‘বেশ, দেখাবাে। আগামীকাল খুব ভােরে।’ বলে বােধিসত্ত্ব অরণ্যের লায়মান সন্ধ্যার অন্ধকারে যেন মিলিয়ে গেলেন। 

পরের দিন ভােরবেলা উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত তরাই বনক্ষেত্রে দেখা গেল শ্রীধর ও লােকেশ্বর – এই দুই ব্যাধ ধনুর্বাণ নিয়ে হরিণ শিকারে বেরিয়েছে।। হরিণের দেখা নেই। হঠাৎ দূরে নিবিড় বনের মধ্যে হরিণের পালকে চরতে দেখা গেল। পাঁচশো হরিণ একসাথে। যেন মায়ামন্ত্রে হরিণযুথের আবির্ভাব। ঐ দ্যাখাে। হরিণের পাল। ফিসফিস করে বলল শ্রীধর। ‘দেখি, তুমি এক তীরে কত হরিণ মারতে পারাে?’ ‘পাঁচশাে হরিণ আছে। সব কটাকেই মারবাে?’ ‘না, না, শখানেক মারলেই হ’ল’। শ্রীধরের কন্ঠে ব্যঙ্গের সুর। বােধিসত্ত্ব একটি তীর ধনুকে গুণ টেনে হরিণের পালের দিকে নিক্ষেপ করলেন। একশাে হরিণ তৎক্ষণাৎ মরে মাটিতে পড়ে গেল। বাকি হরিণগুলি প্রাণভয়ে ছুটে পালাল। তখন বােধিসত্ত্ব একটি মৃত হরিণকে তুলে নিতে বললেন শ্রীধরকে। বলবান ব্যাধ শত চেষ্টা করেও তুলতে পারল না সেই মৃত শিকারকে। হরিণের একটা পাও সে তুলতে পারলনা। কাঁপতে কাঁপতে ক্লান্ত শ্রীধর বসে পড়ল। আজ তার সকল অহংকার খর্ব হল। 

‘তুমি আমাকে ধনুর্বিদ্যা শিখিয়ে দাও। তুমি কেমন করে তীর ছোঁড়, তা আমাকে শেখাও।’ মিনতি করল নতজানু শ্রীধর। ‘শেখাতে পারি তীরচালনা, একটি শর্তে।’ ‘কি শর্ত?’ “তুমি ও তােমার স্ত্রী একমাস জীবহিংসা করবে না। মাংস খাবে না।” শ্রীধর সম্মত হল বােধিসত্ত্বের এই শর্তে। এরপর এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয় নি, বােধিসত্ত্ব ফিরে এলেন শ্রীধরের কাছে। একটি শর্ত আরাে জুড়ে দিলেন। শ্রীধর শবর যদি ধনুর্বিদ্যা শিখতে চায়, তবে তাকে ধ্যানে বস সকল জীবের প্রতি প্রেম, দয়া এবং করুণার ধ্যান। শিকারী শ্রীধরন রাজি হল। একমাস পরে বােধিসত্ত্ব শ্রীধরের কাছে ফিরলেন। শ্রীধর আর তার তখন ব্রত মেনে জীবপ্রেমের ধ্যানে রত। বােধিসত্ত্বের প্রত্যাবর্তনে শ্রীতে আনন্দ হল। পর্ণকুটিরে সাদর অভ্যর্থনা জানাল সে ব্যাধগুরুকে। পাদ্যঅর্ঘ্য নিবেদন করল তাকে। তখন বােধিসত্ত্ব কুটিরের মৃন্ময় কুট্টিমে একটি বৃত্তাকার মণ্ডল অংকন করলেন। তার মধ্যে আটটি উপমণ্ডল। ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিলেন সেই মণ্ডলের ওপরে। শ্রীধর ও তার পত্নীকে বললেন বােধিসত্ত্ব – আমার আঁকার দিকে নজর দাও গভীর মনােযােগ দিয়ে। তারপর তােমরা কি দেখতে পাচ্ছাে, আমার বলাে। মেঝেতে আঁকা সেই অলৌকিক বৃত্ত, দেখতে দেখতে নিষাদদম্পতির মুখমণ্ডল পাংশু ও ম্লান হয়ে গেল। গভীর হতাশায় দুজোড়া চোখ বন্ধ করে দিল। শ্রীধরও কথা বলে না, তার স্ত্রীও কথা বলে না।। বােধিসত্ত্ব জানতে চাইলেন—বলাে, তােমরা কি দেখছাে। শ্রীধর ফুপিয়ে কেঁদে উঠল—“আমাদের দেখছি। আটটি বিশাল নরকের আগুনে পুড়ছি আমরা। ও! কি ভয়ংকর!” ‘তােমরা ভয় পাচ্ছাে না? ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা ভয়ে কাতর’— দম্পতির আর্ত কণ্ঠ। ‘এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তােমরা কি করবে?’ ‘সব কিছু।’ কাতরােক্তি উচ্চারিত হল শবরমিথুনের ক্ষীণ কণ্ঠে। 

অরণ্যে তখনও দিন ও রাত্রির প্রকৃতি লীলা করছে। বনময় গাছেদের প্রশান্তি। পাখির কূজন। মৃগমিথুনের নিবিড় জীবন আচ্ছন্ন করছে লতাবিতান। মৌমাছি আর ভ্রমরের অবিরাম ওড়াউড়ির যেন শেষ নেই। বােধিসত্ত্বের সৌম্য বয়ানে স্মিত আনন্দ। তখন সেই পর্ণকুটিরের মার মেঝেতে তৃণাসনে উপবেশন করলেন সন্ন্যাসীবর। তার সামনে সেই ব্যাস্ত সংসারচক্র, মেঝেতে অংকিত। চক্রের বিপরীতে বসে স্তব্ধবাক্‌ নিষাদদম্পতি। তারা সরল মনে ব্রত পালন করেছে। জীবহিংসা করে নি। পশুপাখির মাংস খায় নি। সকল জীবজগতের প্রতি করুণা, দয়া ও প্রেমের কথা ভেবেছে। 

এবার সময় হয়েছে; ভগবান শাক্যমুনির পবিত্র বনামৃত শােনাবার লগ্ন। প্রবের প্রতি অপরিমেয় করুণা পােষণ করবে। মা যেমন সন্তানের প্রতি মমত্বস্নেহ ধারণ করেন। জ্ঞান ও জ্ঞানের বিষয় অভিন্ন। প্রেম ও প্রেমের পাত্র জীবসংসার অভিন্ন। জ্ঞান ও বিষয়ের যে ভেদ আমরা অনুভব করি, তা মিথ্যা। অরণ্য দেখে সবুজজ্ঞানের সত্যতা। সবুজবন ও সবুজজ্ঞান অভিন্ন। মানুষকে দুঃখনিবৃত্তির পথের সন্ধান দেয়াই লক্ষ্য ছিল শাক্যসিংহের। সকল মানুষের দুঃখনিবৃত্তির চেষ্টা করতে হবে। হরিণের মতােই কোন সব দেহে যদি বিষমাখানাে তীর বিদ্ধ হয়, তখন আগে শরীর থেকে টিকে না তুললে মানুষটি মারা যাবে। আগে তাকে যন্ত্রণা থেকে বাঁচাও, তারপর তীরের ফলা, আকৃতি, বিষের সংজ্ঞা—এসব নিয়ে আলােচনা কর। তথাগত সর্বদাই তাই দুঃখ, দুঃখের উৎপত্তি, দুঃখ নিবৃত্তি, দুঃখ থেকে মুক্ত হবার উপায় সম্পর্কে উপদেশ দিতেন। তাহলে এই সংসারচক্রের মণ্ডলে যে আটটি ভয়ংকর নরক দেখালেন, তার থেকে আমাদের মুক্তি হবে কেমন করে? উপায় আছে। হে নিষাদ, এই আট নরক এই জীবনেই মানুষকে দগ্ধ করে। আবার আটটি উপায় বা পথও আছে এই জীবনসংসারতাপ থেকে মুক্ত হবার জন্য। আটটি পথ হ’ল—সম্যক দৃষ্টি, সম্যক্ সংকল্প, সম্যক্ বাক্, সম্যক্ কর্মান্ত বা পঞ্চশীল, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক্ স্মৃতি এবং সম্যক সমাধি। অনেকক্ষণ ধরে বােধিসত্ত্বের বচনামৃত শুনল শ্রীধর ও তার স্ত্রী। তারা বুঝতে পারল, কেন তাদের মাংস খেতে বারণ করা হয়েছিল, কেন তাদের ধ্যান করতে বলা হয়েছিল করুণা দয়া ও প্রেমের ধারাপথে। 

এবার শ্রীধর উপলব্ধি করতে পারল, জীবহত্যা কেবল পুনরায় হত্যার ইচ্ছাকে বাড়িয়ে তােলে। হিংসার এই জীবনচর্যাকে সকলে হীন ও অসম্মানজনক মনে করে। এই পাপকর্মের ফলে সংসারের আটটি নরকে আবার ফিরে ফিরে জন্ম নিতে হয় মানুষকে। ধীর গম্ভীর কন্ঠে বােধিসত্ত্ব ব্যাখ্যা করলেন—“যদি তুমি অপরের জীবনকে খর্ব করে দাও, তাহলে তুমি ধরে নিতে পারাে, তােমার জীবনও ছােট হবে, খর্ব হবে। কেন তুমি শিকার ও হিংসাবৃত্তি ছেড়ে তােমার মন প্রদীপ্ত জ্ঞানের আলােতে নিবেদন করছাে না? যখন তােমার হত্যা করার ইচ্ছা কমে যাবে, তখন তুমি ক্রমশঃ প্রভূত প্রতিভা ও গুণাবলী অর্জন করবে।” শ্রীধর দম্পতি এইভাবে ভগবান অমিতাভ বুদ্ধের পথে দীক্ষিত, শপথ গ্রহণ করল। বােধিসত্ত্বের কথামৃতে প্রভাবিত হয়ে হিংসাবতি। করে তারা অষ্টাঙ্গিক সাধনায় মগ্ন হল। স্বাস্থ্যদীপ্ত আনন্দময় জীবনলাল দরিদ্র শবরদম্পতি। জীবনচক্রের আবর্তনে দুঃখভােগ যে সত্য, সেই দুঃখ থেকে মুক্তি পায় জন্য যথার্থ সাধনায় সফল হবার জন্য শ্রীধর নির্জন পর্বতাশ্রমে ধ্যানে বসে দীর্ঘ বারাে বছর অনির্দেশ নিরাকার করুণার চিন্তাশূন্য সূক্ষ্ম স্তরে মগ্নসাধনা পর সেই ব্রাত্য শবরসাধক মহামুদ্রাসিদ্ধি লাভ করলেন। পূর্বতন শিকারী ব্যাধ তখন তার বােধিসত্ত্বগুরুকে পরবর্তি শিক্ষানির্দেশের জন্য আহ্বান করলেন। দুঃখনিবৃত্তির সাধনায় অসামান্য সাফল্যের জন্য শিষ্যকে প্রশংসা করে তার নতুন নাম দিলেন শবরীপাদ। 

“শবরীপাদ! তােমার সংসারবিমুক্তি তােমার একক নির্বাণ যেন না হয়। রাখাল ঘাসের আগুন যেমন পদাঘাত করে নির্বাপিত করে, তেমনভাবে যে সাধক কামনাবাসনার মূল থেকে নিবৃত্তি করে একার মুক্তি চায়, তেমন মুক্তি তােমার জন্য নয়। যে অগণন মানুষ এখনও জন্মমৃত্যুর চাকায় ঘুরছে, তাদের মুক্তির জন্য তুমি সেই সংসারচক্রে অবস্থান কর। তাদের জীবনমুক্তির জন্য তাদের করুণা কর। এই বিশ্বাত্মক মােক্ষসাধনের দ্বারা তুমি গণনাতীত আত্মার রক্ষা করতে পারবে।” 

বৌদ্ধগুরু লােকেশ্বর বােধিসত্ত্ব প্রায় বারােশাে বছর পূর্বে তার অন্ত্যজ শবরশিষ্য শবরীপাদকে লােকমুক্তির উদার শিক্ষা দিয়েছিলেন। বারােশাে বছর পরে অপর এক বােধিসত্ত্বগুরু দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তার কায়স্থ শিষ্য নরেন্দ্রনাথকে চলিত বাংলাভাষায় এই কথাই বলেছিলেন। মুক্তিপাগল নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবের সময় না সমাধি চেয়েছিলেন। সেদিন অবতারবরিষ্ঠ বলেছিলেন—নিজের মুক্তির জন্য নয়। তুই বটগাছ হবি, সকলে তােকে আশ্রয় করে মুক্তি পাবে। স্বার্থপরের মতো আত্মনির্বাণ নয়, লােকহিতায় মােক্ষসাধনা।” 

এই ঘটনার কয়েক দশক পরে শ্রীরামকৃষ্ণ তার প্রিয় শিষ্য শ্রীঅন্নদাকেও এই উদার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তবে একটু অন্যভাবে। শিষ্যকে প্রলুব্ধ করে যাচাই করে নেবার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ অন্নদাকে নরক দর্শন করিয়েছিলেন। স্বর্গে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করেছিলেন। মানবপ্রেমিক অন্নদা জগৎস্নগসারের ত্রিতাপদহনে জর্জরিত আর্ত মানুষের পৃথিবীতে থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলেন। জীবনের পরম প্রাপ্তি শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গে স্বর্গলোক – অন্নদা সেই পরম পাওয়াকে অস্বীকার করে জীবসেবাকে বরণ করে নিয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্য আত্মমোক্ষকে কৈতব বলে চিহ্নিত করেছিলেন। যাই হোক, বােধিসত্ত্বগুরুর এই উপদেশ শিরােধার্য করে সিদ্ধাচার্য শবরীপাদ নিজের দেশে ফিরে এলেন। পার্বত্য অঞ্চলে সিকিম, ভুটান, তিব্বত, নেপালে শবরীপাদ “মাজিগােচেন” নামে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও “ময়ুরকলাপধারী’, ‘রিত্রোগােমপাে’, ‘পর্বতাশ্রমের রক্ষক’, প্রভৃতি নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। আজও তিনি ভাগ্যবান শিষ্যদের মধ্যে সঙ্গীত ও নৃত্যের মাধ্যমে শিক্ষা দেন। এইভাবেই শবরীপা শিক্ষা দেবেন, যতদিন না প্রেমের বুদ্ধ মৈত্রেয় নতুন যুগের অমৃত উপদেশ দিতে সংসারে আবির্ভূত। “অদ্যাপী লীলা করে গােরা রায়, কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।।” 

৩০। ভুসুকু (শান্তিদেব) পাদ

চর্যাগীতি রচনার সংখ্যাধিক্যে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হলেন ভুসুকু পা। তার রচিত আটটি পদ চর্যাপদ গ্রন্থে সংগৃহীত হয়েছে। নানা কিংবদন্তি বিচারে ভুসুকু নামটিকে ছদ্মনাম বলে মনে করা হয়। তার প্রকৃত নাম শান্তিদেব। তিনি সৌরাষ্ট্রের রাজপুত্র ছিলেন এবং শেষ জীবনে নালন্দায় বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে নিঃসঙ্গভাবে অবস্থান করেন। সেজন্য ভুক্তির ভু, সুপ্তির সু এবং কুটিরের কু—এই তিন আদ্যক্ষর যােগে তাকে ভুসুকু বলে পরিহাস করা হত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে শান্তিদেব ভুসুকু ৭ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন। রাহুল সংকৃত্যায়নের মতে ভুসুকুর জীবকালের শেষ সীমা ৮০০ সাল। ধর্মপালের রাজত্বকালে (৭৭০-৮০৬ সাল) ভুসুকু জীবিত ছিলেন। তিনি রাউত বা অশ্বারােহী সৈনিক ছিলেন। পরে ভিক্ষু ও সিদ্ধাচার্য হন। তবে অনেকে এই শান্তিদেব ভুসুকু ও চর্যা রচয়িতা ভুসুকুকে পৃথক ব্যক্তি বলে অনুমান করেছেন। কারও কারও অনুমান চর্যার ভুসুকুর সময় ১১শ শতকের মধ্যভাগ। ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী।/ নিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলী।’—ভুসুকুর এই উক্তিকে প্রমাণ স্বরূপ মনে করে তাকে বাঙালি অনুমান করা হয়। ভুসুকু রচিত চর্যাপদের নমুনা : ‘কাহৈরি ঘিনি মেলি অচ্ছ কীস।/ বেটিল ডাক পড়অ চৌদীস ॥/ আপণা মাংসে হরিণা বৈরী।।/ খুনহ ন ছাড়অ ভুসুকু আহেরী ॥/ তিণ ছুপই হরিণা পিবই ন পাণী।/ হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জানী ॥/ হরিণী বােলঅ সুণ হরিআ তাে।।/ এ বণ ছাড়ী হােন্ত ভান্তো ॥/ তরন্তে হরিণার খুর ণ দীস।/ভুসুকু ভণই মুঢ়া হিঅহি ণব পইসঈ ॥” আধুনিক বাংলা : কাকে নিয়ে কাকে ছেড়ে কেমন করে আছি। চারপাশ ঘিরে হাক পড়ে। আপন মাংসের জন্যই হরিণ শত্রু। এক মুহূর্তের জন্যও শিকারি ভুসুকু ছাড়ে না। হরিণ ঘাসও ছোঁয় না, জলও পান করে না। হরিণ হরিণীর নিলয় জানা যায় না। হরিণী বলে হরিণ তুমি শােনাে, এ বন ছেড়ে চলে যাও। লাফ দেওয়ার জন্য হারণের খুর দেখা যায় না। ভুসুকু বলেন—এ তত্ত্ব মূঢ় ব্যক্তির হৃদয়ে প্রবেশ করে না। 

বাংলায় তখন দেবপাল রাজত্ব করছেন। বাংলার মাটি বৌদ্ধধর্মকে সহজরূপে গ্রহণ করেছে, রাজা দেবপালের বিচক্ষণ পৃষ্ঠপােষকতায় সেই বৗদ্ধধর্ম লােকধর্মরূপে জনপ্রিয় হয়েছে, ফলে বাংলার সমাজে সুস্থিতি ফিরে এসেছে। ভগবানরূপে পূজিত হচ্ছেন বােধিসত্ত্বাবতার মঞ্জুশ্রী। বাংলার বৌদ্ধবিহারগুলো জ্ঞানচর্চা বিজ্ঞানসাধনার কেন্দ্ররূপে গড়ে উঠেছে। বিক্রমশীলা মহাবিহার নালন্দা মহাবিহার তখন বিশ্বখ্যাত বিদ্যাচর্চাকেন্দ্র। মহাসংঘিকার শৃংখলা এই বিদ্যাবিহারের পরম বৈশিষ্ট্য। যে কোন নতুন বিদ্যার্থী এলে তাকে এই মহাসংঘিকার নিয়মাবলী অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়। মহাবােধিচর্যাবতারের সুকান্ত প্রসন্ন ধ্যানমূর্তি সেই মহাশৃংখলার প্রতীক।

সেই জ্ঞানগঞ্জে সেই বিশ্ববিদ্যানিকেতনে বঙ্গদেশের এক রাজপুত্র অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে ভর্তি হল। ভর্তি হল কথাটা সত্য নয়, এক রাজপুত্রকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্য রাজার পক্ষ থেকে ভর্তি করা হল। অশনবসন, ভােগবিলাস সেই রাজনন্দনকে ভােগসর্বস্ব অলস ইন্দ্রিয়পরায়ণ করে তুলেছে, রাজপরিবারের পিতামাতা তাই বিজ্ঞজনের পরামর্শ শুনে সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় ও জীবনসাধনার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান নালাবিহারে নিয়ে এলেন তাদের অপদার্থ জড়বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্রকে। রাজকীয় আভিজাত্যের উপযুক্ত করে উত্তরাধিকারীকে সুশিক্ষিত করে তুলতে হলে বিশ্ববিশ্রুত এই শিক্ষায়তনে রাজপুত্র সুনন্দকে শিক্ষালাভ করতে হবে শ্রেষ্ঠ অধ্যাপকদের। অভিজ্ঞ শিক্ষাদানে কৃতী জীবন লাভ করবে উচ্ছৃঙ্খল এক তরুণ রাজপুত্র।

সুনন্দ নালন্দায় ভর্তি হলেও তার স্বভাব খুব একটা পাল্টালাে না। ছােটবেলা থেকে রাজপরিবারের আরামবিলাস আদর ও প্রশ্রয়ে কেটেছে তার বাল্যকাল। সেই এলােমেলাে খেয়ালখুশির জীবন নালন্দাবিহারের শৃঙ্খলাপরায়ণ পবিত্র বাতাবরণে এসে আরাে অস্থির হয়ে উঠল। প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ করে সমশ্রেণীর ছাত্ররা যখন শাস্ত্রপঠনে ও নিত্যব্রতে ব্যস্ত হয়, সুনন্দ তখনও তার শয্যায় অলসশয়ন। তার আর সকাল হয় না। সতীর্থ ছাত্ররা যখন ভগবান শাক্যসিংহের স্মৃতিবিজড়িত চৈত্যবিহারে শাহ শ্লোক উচ্চারণে অভ্যাস করছে প্রাথমিক উপাসনার মন্ত্রাবলী তখন ঘুমচোখে বিরক্তি ও আলস্য নিয়ে বিছানায় পড়ে আছে রাজার দুলাল সুনন্দ। সতীর্থ বন্ধুরা যখন মঠের নিয়মবিধি অনুসারে দৈনন্দিন ধ্যানাসনে যােগাভ্যাস করে, অবাধ্য সুনন্দ তখন বিহারের সাজানাে পুষ্পোদ্যানে ঘুরে বেড়ায়। বুদ্ধের প্রতি, বুদ্ধের মতবাদের প্রতি, কিংবা ফুলের শােভা উপভােগ করার জন্য সুনন্দের কোন আগ্রহ নেই। বিহারের বিশাল উদ্যানে সে ঘুরে বেড়ায় হজমের জন্য। কারণ আশ্রমের একটি ব্যাপারেই তার আগ্রহ। তা হলো, নিয়মিত সময়ে প্রচুর অন্নব্যঞ্জন ভক্ষণ করা। শােয়া ও খাওয়া এই দুটি কর্মে সুনন্দ আগ্রহী। সুনন্দের এই আলস্য ও ভােজনবিলাস তার সতীর্থ ছাত্রদের ভাল লাগত না। প্রতিটি দিন তাদের জন্য পরিশ্রম ও সুকঠোর অধ্যয়নের কঠোর শৃংখলা নিয়ে আসতাে। আর সুনন্দ ফাঁকি দিত সব কাজে। বন্ধুরা তাই তাকে নাম দিয়েছিল “ভুসুকু” বা অলসনিষ্কর্মা। সতীর্থ সমবয়সীরা ভুসুকু’র পেছনে তার বিরুদ্ধে অনেক কটু কথা বলত, সামনাসামনিও গালিগালাজ করতাে আর মনে মনে আশা করতাে, একদিন তাদের এই অলসনিষ্কর্মা সহপাঠী তার কৃতকর্মের ফল পাবে। 

নালন্দা বিহারের নিয়ম ছিল, গােটা শিক্ষাবর্ষকাল জুড়ে প্রতিটি সকাল, প্রতিটি দুপুর এবং প্রতিটি রাতে একের পর এক শাস্ত্রপাঠ করতে হবে। প্রত্যেক ছাত্ৰশ্ৰমণ পর্যায়ক্রমে কোন কোন অধ্যায় পাঠ করবে, তা নির্দিষ্ট করে দিতেন বরিষ্ঠ সন্ন্যাসীগণ। নিয়ম ছিল, ধর্মছত্রের তলায় মন্দিরের সামনে স্থাপিত প্রস্তরনির্মিত বেদীতে বসে, এক এক জন শ্ৰমণ একটি করে নির্দেশিত মন্ত্রঅধ্যায় মুখস্ত করে উদাত্ত কণ্ঠে এই পবিত্র আশ্রমপদের পবিত্র বাতাবরণকে বৌদ্ধবাণীতে প্রতিধ্বনিত করবে। তথাগত বুদ্ধের অপরিমেয় ধর্মমৈত্রী, করুণা সেই মন্ত্রধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে নালন্দার বৃক্ষলতা, সুবিশাল বিদ্যাভবনের প্রতিটি কোণে প্রতিনিনাদ হয়ে দশহাজার শিক্ষার্থী ও সহস্র অধ্যাপককে উদ্বোধিত করে তুলতো অহরহ। বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ—এই ত্রিরত্নকে নালন্দার সর্বস্ব বলে মান্যতা দিত শ্রমণরা। অলস ‘ভুসুকু’ নামক শ্ৰমণটি এই শাস্ত্রমন্ত্র উচ্চরণে অক্ষম। কোন সময়েই তার রুচি হয় না, ঐ অবােধ্য মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রমণকতব্য সম্পন্ন করার। সকালে অনেক বেলা হয়ে যায় ঘুম থেকে জাগতে। দুপুরে স্নানাহার পর্বটি সে যত্নসহকারে সম্পন্ন করে। তারপর আবার দিবানিদ্রা। রাতের অলস ভ্রমণ ও নৈশাহার, আবার ঘুম। ভুসুকুর সময় কোথায়, ঐ সব শক্ত শক্ত দুর্বোধ্য মন্ত্র মুখস্ত করবে! স্বভাবতঃই সদ্ধর্মের মহাবিহার নালন্দায় রাজনন্দন সুনন্দ এক বিরক্তিকর বিশৃংখলা। তার কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই। 

ক্রম অনুযায়ী পালা আসে তার, তখন সুনন্দ ভুসুকু অদৃশ্য। কারণ আর কিছু নয়, সূত্র ও মন্ত্র মুখস্ত হয় না তার। সে এড়িয়ে যায়। তার সতীর্থ শ্রমণরা সে সংবাদ দিয়ে দেয় প্রধান অধ্যাপককে। ভুসুকুর ফাঁকি, ভুসুকুর আলস্য এই বৌদ্ধবিদ্যালয়ের আবাসিকজীবনে অপরাধ বলেই ধরা যায়। ভুসুকুর এই অনাচার, এই স্বেচ্ছাচার, এই শৃংখলাভঙ্গের বৃত্তান্ত বিহারের মহাথের অধ্যক্ষের কানে গেল। ভুসুকুকে ডেকে অধ্যক্ষ কঠোরভাবে তিরস্কার করলেন। জানিয়ে দিলেন ভুসুকু সুনন্দ যদি এইভাবে আশ্রমজীবন চালায়, যদি না সে নিজকে সংশােধন করে আশ্রমের শৃংখলা অনুসরণ করে, তাহলে তাকে নালন্দা মহাবিহার থেকে বহিষ্কার করা হবে। অধ্যক্ষ আরাে কঠোর হয়ে জানালেন, আগামীকাল সকালে মন্ত্রপীঠে বসে সুনন্দকে শাস্ত্রপাঠ করতে হবে এবং তা সম্পূর্ণ মুখস্ত করে উচ্চারণ করতে হবে। এরপর থেকে প্রতিটি পর্যায়ে অন্যান্য শ্রমণদের মতােই তাকে মন্ত্র আবৃত্তি করতে হবে মুখস্থ করে। অন্যথায় তাকে নালন্দা থেকে চলে যেতে হবে। ঈর্ষাতুর সহপাঠীরা চাপা হাসি হাসল। এইবার জব্দ হবে অলসশয়ন নিষ্কর্মা এই বড়লােকের আদুরে ছেলে। কাল সকালে ভুসুকু কী পড়বে? সে তাে শাস্ত্রই পড়ে না, মুখস্থ বলা তাে দূরের কথা। আত্মপক্ষ সমর্থনে ভুসুকু বলে—“কিন্তু আমি তাে শপথ ভঙ্গ করিনি এখানের। কেবল ছাত্র হিসাবে আমি ভাল নই, আমি মুখস্থ করতে পারি না যে। আমাকে বহিষ্কার করার জন্য এটাই কি যথেষ্ট কারণ?” মহাথের কঠোর। আগামী সকালে ভুসুকুর মন্ত্র পড়বার পালা। কাল যদি সে আবৃত্তি করতে না পারে তাহলে তাকে পথ দেখতে হবে। সতীর্থরা ভাবল, বেশ হবে তাহলে! অপদার্থ এই শ্ৰমণ নালন্দার কলংক।

কঠোর সাবধান করলেও মহাথের এই প্রবীণ সন্ন্যাসী ছিলেন সদয়, বিশেষতঃ এই অপদার্থ অলস ছাত্রের প্রতি তার স্নেহ ছিল যথেষ্ট। রাতে যখন অন্যান্য সতীর্থ ছাত্ররা তাদের শয্যায় শুয়ে পড়েছে, তখন ভুসুকুর কুঠিয়ায় প্রবেশ করলেন। দুর্বল এই ছাত্রের প্রতি তার কিছু উপদেশ দেবার আছে। ‘বৎস! তুমি খুব সংকটে পড়েছাে। তুমি খাওয়ার জন্য ও ঘুমানাের এতদিন নষ্ট করেছে। কোন একটি সূত্রের ছয়টি পংক্তির সারাংশও তুমি অভ্যাস করাে নি। তাই আজ আমি তােমাকে যে উপদেশ দেবাে, তা না পালন করলে তুমি আগামীকাল সকালে অবধারিতভাবে ব্যর্থ হবে।” আচার্যের পায়ে আভূমি প্রণত হল ভুসুকু। যা বলবেন, ভদন্ত। আপনি আমাকে নির্দেশ দিন। আমি তা পালন করব। “ঠিক আছে। তবে তা মানতে হলে আজ রাতে তােমার ঘুম হবে না। তােমাকে জেগে থাকতে হবে।’ গম্ভীর নির্দেশ। সচেতন হয় ভুসুকু। স্বয়ং মহাথের তার প্রতি কৃপা করে তার সাফল্যের কামনা করতে তার কক্ষে এসেছেন। ‘আমি তাই করব, প্রভু!’ ‘একটাই আশা আছে, তােমার জন্য। মেধা ও চৈতন্যের বােধিসত্ত্ব হলেন মঞ্জুশ্রী। সেই মঞ্জুশ্রীর মন্ত্র আবৃত্তি করবে রাতভাের। অর্পনা মন্ত্র। সকালে পাখিডাকা পর্যন্ত অবিরাম আবৃত্তি করবে। তুমি সফল হবে।’ মহাস্থবির তখন প্ৰণত ভুসুকুকে মঞ্জুশ্রীসাধনায় দীক্ষা দিলেন। মন্ত্রের সারাৎসার শিক্ষা দিলেন তারপর অনুতাপজৰ্জর ছাত্রকে ধ্যানাসনে অভিষিক্ত করে তার কক্ষ থেকে বিদায় নিলেন। 

ভুসুকু বােঝেন তার নিদ্রালু ইন্দ্রিয়বিলাস যে কোন সময় তাকে ব্রতশিথিল করতে পারে। তাই তিনি কক্ষের ছাত থেকে মােটা একটা মোটা দড়ি বেঁধে তার চীবরের সঙ্গে যােগ করলেন। রাতে মন্ত্র আবৃত্তি করার সময় যদি ঘুমে ঢলে পড়েন, তখন তার ঘাড়ে জড়ানাে চীবরের টান পড়বে মােটা দড়ির। তারপর সারারাত তিনি গুরুর নির্দেশমতাে মঞ্জুশ্ৰীমন্ত্র আবৃত্তি করতে থাকলেন। নিদ্রা তন্দ্রা জয় করলেন। প্রবল ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়লেও দৃঢ় সংকল্প সেই শ্ৰমণ মঞ্জুশ্ৰীমন্ত্র জপ করে চললেন। সকালের ঠিক আগে ভুসুকুর সাধনকক্ষ ভরে গেল হঠাৎ-আলাের ঝলকে। সচকিত শ্রমণ জপ করতে করতে চোখ খুললেন। ভাবলেন, সুর্য উদয় হয়েছে, তিনি ধ্যানাসনে বসে আছেন, কোন পরিবর্তন দেখতে পেলেন না নিজের মধ্যে। আগেরদিনে উনি যেমন ছিলেন, আজ ভােরেও তিনি তেমনই আছেন, তফাৎ শুধু আজ এই প্রত্যুষে তিনি পদ্মাসনে মন্ত্র উচ্চারণ করছেন অবিরাম।

‘তুমি কী করছাে, তুমি জানাে?’ অচেনা এক গম্ভীর কণ্ঠ শােনা গেল। সবে মুখ তুলে অবসন্ন সন্ন্যাসী দেখলেন, এক বিরাট মূর্তি শুন্যে অবস্থান করছেন তার মাথার ওপর। ‘আমি প্রভু মঞ্জুশ্রীর আবাহন মন্ত্র জপ করছি। তার সাহায্যে আমি আজই সত্ৰ আবৃত্তি করব। আমি কিছুই শিখিনি এতদিন। কিন্তু আপনি কে? আমার কাছে আপনি কি চান?’ অপ্রাকৃত সেই আগন্তুক জবাব দিলেন—“নির্বোধের মতাে প্রশ্ন করছে। অর্ধরাত্রি ধরে তুমি তাে আমাকেই ডাকছো।’ ‘আ-আ-পনি ভগবান মঞ্জুশ্রী!’ ভুসুকুর পরম বিস্ময়। ‘হ্যা, আমিই মঞ্জুশ্রীর প্রকাশ। তুমি কী চাও বলাে। আমাকে আমার কাজ করতে হবে।’ ভুসুকুর ইচ্ছে হল, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন তার ইষ্টদেবতাকে, কিন্তু ছাদের দড়ির সঙ্গে তার ঘাড়ের চীবরখণ্ড আটকানাে, তাই দুটি হাত অঞ্জলি করে প্রণাম করলেন। ‘প্রভু আমার! আমাকে বােধশক্তি দিন। আমি যেন প্রতিসূত্র উচ্চারণ ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করি।’ মঞ্জুশ্রী পদ্মপাণি আশীর্বাদ করলেন – “তথাস্তু। যখনই তােমাকে আহ্বান করা হবে, তখন তুমি সূত্র আবৃত্তি করবে আপন অনুভবে।’ এই আশীর্বাদ করে মঞ্জুশ্রী অন্তর্ধান করলেন। গভীর নব আনন্দে আলােকিত ভুসুকু ধ্যানাসনে বসে রইলেন। সূর্য তখনও ওঠেনি। পাখিরা জাগেনি। 

সকাল হতেই চারিদিকে রটে গেল, আজ এক শ্ৰমণকল্প নির্বোধ অপদার্থ ভােজনবিলাসী মূখকে হাস্যাস্পদ করা হবে। রাজা দেবপাল তার সভাসদদের নিয়ে সকালবেলা নালন্দাবিহারে এসেছেন এই প্রদর্শনী দেখতে। ভগবান তথাগতের স্তুপপদমূলে পুষ্পের সুগন্ধ অঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্র উচ্চারণের বেদাপীঠের সামনে বিস্তৃত ভবনে সহস্র সহস্র অধ্যাপক শ্ৰমণদের, শিক্ষার্থী সতীর্থদের সমাবেশ। যথাসময়ে সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন ভুসুকু। সমবেত শ্রোতাম ফিসফাস গুঞ্জন শুরু হল। গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে নবদীক্ষিত শ্রমণ মন্ত্রবেদীপীঠের সােপান বেয়ে মন্দিরের সিংহাসনে উঠে এলেন। দেখতে উদগ্রীব নালন্দাবিহারের সর্বাপেক্ষা অলস নির্বোধ এক ছাত্র ও বৌদ্ধসূত্র আবৃত্তি করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হন। সকল দর্শক শ্রোতা সবিষ্ময়ে দেখল, সেই তরুণ শ্ৰমণ সন্ন্যাসীর মাথার চীবর পরিধান করলেন সিংহাসনের ওপর পদ্মাসনে আসীন হলেন। তারপর দর্শকবৃন্দের প্রতি প্রশান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। ধীরে ধীরে দর্শকপরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে নীরবতা নেমে এল। সকল দর্শক নীরব। নালন্দাবিহারের সকল কলরব কোলাহল ঘন্টাধ্বনি থেমে গেছে। কেবল ফুলের বাগানে পাখিদের কলধ্বনি ভােরের বাতাসকে নন্দিত করছে। স্তব্ধভাষ বিস্ময়ে দর্শকমণ্ডলী দেখল, সিংহাসন থেকে পদ্মাসনে আসীন সন্ন্যাসী ক্ৰমশঃ শূন্যে উঠছেন এবং তার সেই ধ্যানসুন্দর ঋজু দেহ থেকে আশ্চর্য আলাে বিকীর্ণ হচ্ছে। সমগ্র প্রেক্ষাগৃহ আলােকিত হয়ে উঠল শন্যে ভাসমান সেই সাধকের প্রভায়। যে সমস্ত দর্শক ব্যঙ্গের হাসি হাসবে বলে সভায় এসেছিল, তারা একেবারে চুপ। অবাক বিস্ময়ে তারা এ ওর মুখের দিকে চাইল। 

রাজাকে সম্বর্ধনা জানিয়ে ভুসুকু প্রশ্ন করলেন—আমি কি ঐতিহ্য অনুযায়ী সনাতনসূত্র আবৃত্তি করে শােনাব, মহারাজ? অথবা স্বরচিত কিছু শ্লোক শােনাব আপনাদের? রাজা দেবপাল গুণগ্রাহী; তিনি স্মিতমুখে বললেন, আমি শুনেছি, আপনার অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসের কথা। আপনার নিদ্ৰাপ্রিয়তা, আপনার পদচারণা সতীর্থ শ্ৰমণদের কাছে বিস্ময়কর। আপনি সব বিষয়েই অসামান্য। মৌলিক স্বভাব আপনার স্বরচনায় ভাস্বর হয়ে উঠুক আজকের এই মহতী সভায়। তখন ভুসুকু অনবদ্য ও ভাবপূর্ণ স্তোত্র এবং ভাষ্য রচনা করতে লাগলেন ও আবৃত্তি করতে লাগলেন। সেই স্তোত্র ও ভাষ্যই পরবর্তীকালে “বােধিচর্যাবতার” বা আলােকিত পথের দিশা হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিল। দশম ও শেষ অধ্যায় রচনা করে ভুসুকু শুন্যে বিরাজমান হলেন। উপাই বুদ্ধানুরাগী শ্ৰমণ ও ভক্তরা সেদিন নতুন বিশ্বাসে উদ্বোধিত হল। 

অলস অকর্মণ্য আহার-নিদ্ৰাসর্বস্ব ভুসুকু রূপান্তরিত হলেন মহর্ষি শান্তিদেব মূর্তিতে। দেশের ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পণ্ডিত অধ্যাপকরা অনুরোধ করলেন শান্তিদেবকে, বােধিচর্যাবতারের একটি টীকা রচনা করার জন্য। শান্তিদেব টীকা রচনা করলেন কিন্তু শত অনুরােধ সত্ত্বেও তিনি মহাবিহারের অধ্যক্ষ হতে রাজি হলেন না। সেই রাতেই শান্তিদেব, তার অল্পবস্ত্র, ভিক্ষাপাত্র ও অন্যান্য পূজাউপকরণগুলো পূজাবেদিতে ত্যাগ করে গােপনে বেরিয়ে গেলেন আশ্রম থেকে। বিভিন্ন দেশ দেশান্তর ভ্রমণ করে তিনি এক জনপদে বাস করতে শুরু করলেন। একটি কাঠের তরবারি নির্মাণ করে তিনি তাকে সােনার রঙে সুদৃশ্য করে তুললেন। পরের দিন তিনি ঐ স্বর্ণবর্ণের তরবারি নিয়ে রাজার দরবারে গিয়ে প্রাসাদপ্রহরীর পদ প্রার্থনা করলেন। রাজা তার দেহকান্তি ও তরবারি দেখে তৎক্ষণাৎ তাকে উপযুক্ত বেতন দিয়ে নিযুক্ত করলেন প্রাসাদরক্ষী হিসাবে। দীর্ঘ বারাে বছর শান্তিদেব রাজার সেবা করলেন। দিনের বেলা তিনি সাধারণ সৈনিক হয়ে কাজ করতেন, রাতে তিনি সাধনা করতেন। প্রতি শারদোৎসবে তিনি মন্দিরে যেতেন সাধারণ ভক্ত হিসাবে। তার প্রকৃত পরিচয় কেউ জানতে পারে নি।

একদিন সৈন্যরা যখন নিজ নিজ তরবারি ও অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করছিল, শাণ দিচ্ছিল, তখন একজন সৈন্য কৌতুহলবশত শান্তিদেবের তরবারিটি হাতে নিয়ে বুঝতে পারল, সেটি কাঠের তৈরি। রক্ষী তৎক্ষণাৎ শান্তিদেবের এই ধাপ্পার কথা, নকল তরবারির কথা রাজাকে গিয়ে জানিয়ে দিল। রাজা ডেকে পাঠালেন শান্তিদেবকে। শান্তিদেব রাজদরবারে উপস্থিত হলেন। ‘দেখি, তােমার তরবারিখানি দেখি।’ রাজা দেখতে চাইলেন। “নিশ্চয় দেখাবাে, মহারাজ। তবে এই তরবারি যদি দেখাই, তাহলে আপনার খুব ক্ষতি হবে।” “যা বলছি তাই করাে। ক্ষয়ক্ষতি যা হয় তােক আমার।” রাজার আদেশ। তার কোমরবন্ধনীতে আঁটা তরবারির হাতলে হাত রেখে শান্তিদেব অনুরােধ করলেন, “মহারাজ, অন্তত একটি চোখ বুজুন।” তার কথা শুনে রাজা ও সভাসদরা হেসে উঠলেন। কী কথা প্রাসাদরক্ষীর! তবু তার কথামতাে রাজা ও তার সভাসদরা তাদের চোখ বন্ধ করলেন। 

তখন শান্তিদেব তার চেতনার তরবারি কোষমুক্ত করলেন। দশটি সূর্য যেন ঝলসে উঠল রাজসভায়। প্রতিটি খােলা চোখ অন্ধ হয়ে গেল অসহ্য আলাের সম্পাতে। রাজা তখন সিংহাসন থেকে নেমে শান্তিতে চরণে প্রণত হলেন। প্রচ্ছন্ন যােগী শান্তিদেব তখন তার দক্ষিণ করতলের তর্জনীতে মুখের হাত নিয়ে সকলের অন্ধচোখে বুলিয়ে দিলেন। যাদুর ছোঁয়ায় সকলে চোখের দৃষ্টি ফিরে পেলেন। রাজা তাকে প্রাসাদের পুরােহিত পদে নিযুক্ত হয়ে বাস করতে অনুরােধ করলেন। শান্তিদেব আর থাকলেন না। সেইদিনই তিনি প্রাসাদ ছেড়ে, সেই জনপদ ছেড়ে চলে গেলেন। 

এরপর তিনি পাহাড়ের অরণ্যসংকুল এক নির্জন গুহায় কঠোর সাধনায় মগ্ন হলেন। সেই অরণ্যের শিকারী মৃগয়াজীবী ও অধিবাসীরা নজর রাখতে তার গতিবিধির। একদিন রাজার কাছে খবর এল, সন্ন্যাসী শান্তিদেব হরিণ শিকার করেন, তারপর হরিণের মাংস তার যজ্ঞধূনিতে ঝলসে আহার করেন। এই গুরুতর অভিযােগের তদন্ত করতে রাজা তার প্রহরীদের নিয়ে সেই পাহাড়ের গুহায় অভিযান করলেন। দেখলেন, এক বিশাল কালাে পাথরের দেওয়ালের সামনে মৃগচর্মের আসনে ধ্যান করছেন। রাজা বললেন, “হে মনস্বিন! আপনি শিক্ষা দিয়েছেন অহংকার দূর করার, আপনি আপনার অলৌকিক ক্ষমতায় আমাদের চোখের অন্ধত্ব দূর করেছেন। আপনি আপনার এই সাধনার শক্তি দিয়ে অরণ্যের নিরীহ মৃগদের হত্যা করছেন কেন?” “আমি হত্যা করি না। আমি আরােগ্য করি।” এই বলে শান্তিদেব তা হাত তুললেন। তার পেছনের পাথরের দেওয়াল সরে গেল। ভেতরের থেকে অজস্র হরিণ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা আঁকে আঁকে বেরিয়ে এসে পাহাড় অরণ্য ভরিয়ে তুলল। রাজা বিস্মিত হয়ে প্রাণের এই বিপুল উদ্দীপন প্রত্যক্ষ করলেন। তারপর সেই প্রাণীরা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন তারা ছিল না। রাজা দেখলেন। 

‘পঞ্চভূতে দৃশ্যমান সব কিছু স্বপ্ন, মায়া। শান্তিদেব বললেন। অনুভব কর, উপলব্ধি কর, এসব সংসারই অসার, এসব কল্পনা, মানবমনের প্রতিফলন। মুক্তির পথে প্রবেশ করাে। মাংসের জন্য যে হরিণ আমি নিয়েছিলাম, তা কখনই ছিল না এই বনে। থাকবেও না। এরকম হরিণ যদি না থাকে, তাহলে তার কোন শিকারী নেই, শিকারও নেই। এই যে আমি অলস ভুসুকু ধ্যানে বসে, এও আমি নই। সেই মহারণ্যে সেই তপােভূমিতে গান বেজে উঠল ঋষিকণ্ঠে – “নাহি প্রাণ, নাহি প্রাণী, নাহি হত্যা, নাহি অত্যাচার। জন্ম নাহি, মৃত্যু নাহি, নাহি সুখ-দুঃখ হাহাকার। ছিন্ন হােক মােহবন্ধ সব। মিথ্যা দৃষ্টি হােক তিরােহিত। মহাব্যোম-সমান-শূন্যতা—শান্ত শিব, প্রপঞ্চ-অতীত।”

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.