শাহ্‌জলাল ও সিলেটে মুসলমান

(লেখাটি রজনীরঞ্জন দেব এর ১৯০৬ সালে প্রকাশিত “শাহাজলাল বা শ্রীহট্টে মুসলমান” প্রবন্ধের চলিতরূপ। সামান্য কিছু সম্পাদনাও করা হয়েছে।)

শাহ্‌জলাল

যাদুমন্ত্রের তদানীন্তন অন্যতম লীলাভূমি শ্রীহট্ট বা সিলেট প্রদেশে হজরত শাহ্‌জলাল ইসলাম ধর্ম ও শাসন সর্বপ্রথমে প্রবর্তন করেছিলেন বলে একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কিন্তু এই কাহিনি এতই প্রহেলিকাময় ও অলৌকিকতায় পরিপূর্ণ যে হজরত কোন সময়ে ও কি অভিপ্রায়ে সিলেটে পদার্পণ করেছিলেন তা যথাযথ নিরূপণ করা বড়ই কঠিন। প্রাচ্য ভূমিতেই হোক, আর পাশ্চাত্য দেশেই হোক, মানব প্রবৃত্তি ও মানবের ভাব-স্রোত চিরকালই সাধকের জীবনকে সাধারণ মানুষের জীবন হতে উচ্চতর স্তরে স্থাপন করে অলোকসামান্য গুণগ্রামে বিভূষিত দেখতে চায় এবং যুগযুগান্তরের কার্যকলাপ সম্প্রদায় বিশেষের পূজিত মহাপুরুষের নামে স্বল্পবিস্তর সংযুক্ত করে গবেষণার পথ কণ্টকাকীর্ণ করে ফেলে। শাহ্‌জলালের কাহিনিও এইরূপে ভক্তের সমাজে পড়ে ঐতিহাসিক ভাবে যে অনেকটা অসম্ভব হয়ে ওঠে নি —এমন নয়।

শাহ্‌জলাল “সিলেট বিজয়ী” ও সিলেটের “সাধক গুরু” (Patron Saint)। এক পঞ্চাশত পীঠস্থানের অন্যতম পীঠস্থান স্বরূপে, সদানন্দ ভৈরব ও মহালক্ষ্মী দেবীর হাট রূপে সিলেট শহর একদিকে যেমন হিন্দুর নিকটে পবিত্র তীর্থস্থান বলে পরিগণিত হয়ে আসছিল, (সিলেট শহরের দেড় মাইল দূরে পীঠস্থানের পুনরুদ্ধার হয়েছে) শাহ্‌জলালের সমাধিমন্দির বক্ষে ধারণ করে সিলেট শহর অপরদিকে সমস্ত সভ্য মুসলমান জগতের শ্রদ্ধা ও ভক্তি আকর্ষণ করে এসেছে। শাহ্‌জলাল হজরত, মহাপুরুষ সুদূর পারস্য ও মিশর দেশ হতে বহুযাত্রী তাঁর সমাধি মন্দির দেখবার জন্য এসেছেন। শাহ্‌জলাল শুধু মুসলমানেরই পূজ্য নন। প্রথম ইংরেজ গভর্নর লিন্ডসে (Lindsay) সাহেব ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে যখন সিলেটে পদার্পণ করেন, তখন খ্রিস্টান হয়েও প্রচলিত রীতি অনুসারে তাঁকে নগ্নপদে শাহ্‌জলালের সমাধি মন্দিরে গিয়ে নিয়ম মাফিক তাঁকে পীরের সিন্নি দিতে হয়েছিল। (vide : Lives of Lendsays Vol. iii) হিন্দুরাও আজ পর্যন্ত তাঁর নামে ‘চেরাগী’ দিয়ে থাকেন। মহম্মদের ও শিবের নামে যে অনেক উপকথা পল্লিগ্রামে প্রচলিত আছে, অপরাপর অনেক আউলিয়া বাবার বিভিন্ন দেশে হিন্দুরা যেমন সসম্ভ্রমে গ্রহণ করে থাকেন, শাহ্‌জলালের পবিত্র নামের সাথেও এইরূপ অনেক গল্প সংশ্লিষ্ট হয়ে নামটি হিন্দুর নিকটেও প্রিয় হয়ে উঠেছে। গাঁজাখোরদের ভিতরে মহাদেবের নামে কল্কি উৎসর্গ করবার প্রথা এখনও অনেক জায়গায় প্রচলিত আছে। ত্রিশ চল্লিশ বছর পূর্বে শাহ্‌জলালকেও শিবের এক সঙ্গে গঞ্জিকার অগ্রভাগ গ্রহণ করতে আবাহন করা হত। (১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ওয়াইজ সাহেব লিখেছেন, শাহ্‌জালালকে এখনও সঙ্গীতে আহ্বান করা হয় : হো বিশ্বেশ্বর লাল,/ তিললাখ পির শাহ্‌জলাল,/ একবার দুবারা জগন্নাথজিকো পিয়ারা,/ খানেকো দুধ ভাত বাজানেকো দোতারা।।” (LA. S. B. 1873 Part 1)) কিন্তু এইরূপ লোকপ্রিয় প্রসিদ্ধ মহাপুরুষ সম্বন্ধে আমরা অতি অল্প ঐতিহাসিক তথ্য জানি।

গ্রন্থাদি

প্রামাণিক মূল ঐতিহাসিক গ্রন্থের সংখ্যা বিষয়ের গুরুত্বের সাথে তুলনা করে দেখলে খুব অল্প বলে বোধ হয়। সিলেটে প্রচলিত হজরত সম্বন্ধীয় নানারূপ অলৌকিক কাহিনি ও দুই একখানি মাত্র গ্রন্থ এই বিষয়ে আমাদেরকে যৎকিঞ্চিৎ আলোকপ্রদান করছে।

ডক্টর ওয়াইজ সাহেব বলেন যে, ১১২৮ হি. অব্দে ফেরথশিয়ারের রাজত্বকালে “রৌজেতস্ সালাতীন” গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এর রচয়িতা কে জানা যায়নি। (ওয়াইজ সাহেবের এই ধারণা সম্ভবতঃ ঠিক নয়। ‘রৌজেতস সালাস্তীন’ জর্জ উড়নি সাহেবের আদেশে প্রায় ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে গোলাম হোসেন খাঁ রচনা করে (Vide Modern Review, 1907)। বোধহয় পুস্তকখানির নাম Rourzait-el-Safa হবে, এটি মীরখন্দ লিখিত সাত খণ্ডে সমাপ্ত পারস্য দেশের ইতিহাস (see Lee’ silen Battlesh Preface XII) পরন্ত সিলেট মৌলবী বাজারের অন্তঃপাতী তীরযশা গ্রামে ব্যাঘ্র শিকার পটু শাহ হেলিমুদ্দীন নার্নোলির বংশধরগণ অদ্যাপি জীবিত আছেন, কিন্তু তাঁদের বংশে কেউ কোনও রিদ্বালা প্রণয়ন করেছিলেন বলে প্রকাশ পায় না।) গ্রন্থকারের নাম অজ্ঞাত রয়েছে বটে, কিন্তু ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের মুন্সিক নাসিরুদ্দিন হায়দর “সুহেল-ই-এমন” নামক পুস্তকে প্রকাশ করেন, ওয়াইজ সাহেব ইংরাজিতে এর সারাংশ প্রচার করেছেন। উক্ত মূল ফারশি গ্রন্থে লিখিত আছে যে শাহ্‌জলালের অনুচর নানোলবাসী হামিদুদ্দিনের বংশে, গ্রন্থকার জন্মগ্রহণ করেছেন। শাহ্‌জলালের বর্ণনা সম্বলত এটিই সর্বপ্রথম প্রকাশিত পুস্তক।

হিজরি ১১৩৪ অব্দে মহম্মদ শাহ যখন দিল্লির সম্রাট ছিলেন, তখন মুরশিদাবাদের জাফর আলিখার (ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুরশিদকুলি খাঁর) অনুরোধে সিলেটবাসী মুসলমান পণ্ডিত মুহিউদ্দিন খাদিম শাহ্‌জলালের কীর্তি কাহিনি সম্বলত সিলেটের একখানি ‘রিছালা’ প্রণয়ন করেন। (গ্রন্থখানি বর্তমানে অপ্রাপ্য। এশিয়াটিক সোসাইটির Catalogue of Persian Manuscripts-এ এর কোনো উল্লেখ নেই।)

উল্লিখিত পুস্তক দুখানি অবলম্বন করে “সুহেল ই-এমন” গ্রন্থ প্রণীত হয়। ১২৭৮ বঙ্গাব্দে ইলাহি বক্স মুসলমানী বাংলায় এর অনুবাদ লেখেন, এবং ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রে ডক্টর ওয়াইজ উক্ত গ্রন্থের একটি ইংরেজি তর্জমা প্রকাশ করেন। আসামের ইতিহাস প্রণেতা গেইট (Gait) সাহেব ও সিলেটের ডিস্ট্রক্ট গেজেটার সম্পাদক এলেন (B C Allen) সাহেব শাহ্‌জলাল বিষয়ে ওয়াইজ সাহেবেরই অনুসরণ করেছেন। এতদ্ব্যতীত “সিলেটে শাহ্‌জলাল” ও “সিলেট নূর” নামে উক্ত গ্রন্থের দুখানি বাংলা ও “তারিখ-ই-জলালী” নামে একখানি উর্দু তর্জমা সিলেট জেলায় প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ মহাশয় ১৩১১ ও ১৩১২ বাংলার “প্রদীপ” পত্রে শাহ্‌জলাল সম্বন্ধে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন।

১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন ফিসার এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রে, ও কর্নেল ইয়ুল ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে স্বপ্রণীত “Cambay and the way Thilhen” নামক গ্রন্থে এবং ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের “Indian Antiquary” নামক পত্রিকায় শাহ্‌জলাল এবং সিলেট সম্বন্ধে অনেক নতুন কথার অবতারণা করেছেন। এদের বর্ণনায় সিলেটের ইতিহাসে যে একটি নতুন আলোক রশ্মি পতিত হয়েছে তার আলোচনা যথাস্থানে প্রদত্ত হবে।

উপাখ্যান সংক্ষেপ

আরবের অন্তঃপাতী এমন প্রদেশে ‘কনিয়ে” নামক স্থানে ‘কোয়েরেস্ সম্প্রদায়ভুক্ত ‘সেখ-উস-সুমখ’ উপাধিধারী মহম্মদের ঔরসে শাহ্‌জলালের জন্ম হয়। (শাহ্‌জলালের মন্দিরের হুসেনসাহী শিলালিপি দ্রষ্টব্য।) শৈশবে মাতৃহীন হয়ে শাহ্‌জলালউদ্দিন বোখারীর শিষ্য স্বমাতুল সৈয়দ আহম্মদ কবির সুহরবর্দির গৃহে লালিত পালিত হন। পরে অতি অল্পবয়সে বাঘের গালে চপেটাঘাত, জহরপান প্রভৃতি অলৌকিক শক্তির পরিচয় প্রদান করে ১২ জন অনুচরের সাথে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে (ব্রাজ্য বিজয়ের অভিলাষ নয়) হিন্দুস্থানের অভিমুখে যাত্রা করেন। ‘এমন’ দেশের শাহাজাহা এর মুরীদ হয়েছিলেন, পরিণামে সিলেটে তাঁর কাল হয়। দিল্লিতে এসে শাহ্‌জলাল সেথ নিজামুল আউলিয়ার আতিথ্য স্বীকার করেন।

সিলেট রায়নগরের অন্তঃপাতী টুলটিকর গ্রামে বুরহানুদ্দিন নামক মুসলমান বাস করতেন। তিনি পুত্রোৎসব উপলক্ষে গোবধ করেছিলেন। কাক এক খণ্ড গোমাংস চঞ্চুপুটে নিয়ে জনৈক ব্রাহ্মণের (কাহার ও মতে রাজার) বাড়িতে নিক্ষেপ করে। (বুরহানুদ্দীনের বাড়ির নিকটে “হিন্দুয়ানী” বলে একটি অতি পুরাণদিখি আছে। এর চারিদিকে বাঁধা ঘাট ছিল। একটি ঘাটের (উত্তর দিকের) ইটের সিঁড়ি এখনও শীতকালে দেখতে পাওয়া যায়। দিঘির পূর্ব তীরে মোট টিলার উপরে গোবিন্দদের দেবালয় ছিল, তিনশত বছরের প্রাচীন ফারসি কাগজে এর প্রমাণ রয়েছে।) রাজা গৌড়গোবিন্দ দেবালয় কলুষিত হয়েছে জানতে পেরে সপুত্রক বুরহানুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে আনেন, এবং ভীমের জরাসন্ধ বধের ন্যায় শিশুটিকে দুই খণ্ড করে ফেলেন, ও পিতার ডান হাত কর্তন করেন। বুরহানুদ্দিন গৌড়ের মুসলমান নবাব খিজির খাঁর পৌত্র আলাউদ্দিনের আশ্রয় গ্রহণ করেন। (তারিখ-ই-জালালী গ্রন্থে দিল্লির নবাবের উল্লেখ আছে।)

গৌড়েশ্বর তার ভ্রাতুষ্পুত্র সুলতান সিকন্দরকে তৎক্ষণাৎ ব্রহ্মপুত্র ও সোনারগাঁও অভিমুখে অগ্রসর হতে আদেশ প্রদান করেন। কিন্তু যাদুবিদ্যা বিশারদ হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দ অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে সোনারগাঁওর নিকটে সিকন্দরকে পরাস্ত করেন, এবং সিকন্দর প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন। এই সংবাদ দিল্লিতে পৌঁছলে সম্রাট আলাউদ্দিন সিপাহি সালর সৈয়দ নসিরুদ্দিন চিরাগ্-ই-দিল্লিকে গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।

সেই বছর ৩৬০ জন দরবেশ নিয়ে শাহ্‌জলাল হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপৃত হয়েছিলেন। সিকন্দর ও নসিরুদ্দিন প্রয়াগে শাহ্‌জলালের সাহায্য ভিক্ষা করেন। শাহ্‌জলাল তাদেরকে উৎসাহিত করলেন, এবং ধীরে ধীরে সুমা নদীর তীরে এসে উপস্থিত হলেন। শাহ্‌জলালের নাম শুনিয়ে গৌড়গোবিন্দ ভয় পেলেন এবং আগন্তুকের শক্তি পরীক্ষার্থে লৌহধনু পাঠিয়ে দিলেন শাহ্‌জলালের জনৈক অনুচর লৌহ ধনুতে গুণ যোজনা করে দিলে শাহাজালাল আজান দিতে লাগলেন, একে একে কাফের রাজার সপ্ততল হর্ম ভেঙে পড়ল। শাহ্‌জলাল বিজয়ীর বেশে নগরে প্রবেশ করলেন, গৌড়গোবিন্দ কোহিস্থানে (পার্বত্য প্রদেশে পেঁচাগড়ে) প্রস্থান করলেন। মৃত্তিকার গন্ধে ও বর্ণে সিলেট ইয়ামেন দেশের অনুরূপ দেখে শাহ্‌জলাল সিলেটে বাস করতে মনস্থ করলেন। কিছুদিন পরে সিলেটে নসিরুদ্দিনের মৃত্যু হল। কিন্তু তার কবর হয়নি, তার মৃতদেহ শাহ্‌জলালের তেজো প্রভাবে শূন্যে মিশে গিয়েছিল। ৫৯১ হিঃ অব্দে, ত্রিশ বছর সিলেটে অবস্থানের পর, ৬২ চান্দ্র বছর বয়সে শাহ্‌জলালের মৃত্যু হয়। মুসলমানের সিলেট বিজয়ের এটিই কথা ইতিহাস। এটি কতদূর বিশ্বাসযোগ্য তাই বিবেচ্য।

ব্লোকম্যান সাহেবের মতে এই উপাখ্যানের তারিখগুলি অসামঞ্জস্যে পরিপূর্ণ। তিনি বলেন যে, “৫৯১ হিজরিতে তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তিনি দিল্লিতে নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে, যিনি ৭২৫ হিজরিতে মারা যান। কিংবদন্তী অনুসারে, সিকান্দার শাহের শাসনামলে রাজা শামসুদ্দিন দ্বারা ১৩৮৪ খ্রিস্টাব্দ বা ৭৮৬ হিজরিতে গৌর গোবিন্দার কাছ থেকে জেলাটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই রাজা শামসুদ্দিন দ্বারা কেবল সিকান্দারের বাবা শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে বোঝাতে পারেন।”His death is put down as having occurred in 591 AH and he is said to have visited Nizamuddin Aulia at Delhi who died in 725 A D. According to the legend, the District was wrested from Gour Gobinda by king Shamsuddin in 1384, A.D. or 786 A.H. during the reign of Sekandar Shah, whilst king Shamsuddin can only refer to Shamsudding lays Shah, Sikndar’s father. (Vide : J A S B 1873 part 1). অর্থাৎ ৫৯১ হিঃ অব্দে তাঁর মৃত্যু হয়, অথচ কথা আছে যে, ৭২৫ হিঃ অব্দে মৃত নিজামুদ্দিন উলিয়াকে তিনি দিল্লিতে দর্শন করেছিলেন। পুনশ্চ ৭৮৬ হিঃ অব্দে নবাব সামসুদ্দিন কর্তৃক সিকন্দর শাহের রাজত্বকালে গৌড়গোবিন্দের নিকট হতে সিলেট জেলা জয় করা যায়, এবং নবাব সামসুদ্দিন বলতে আবার সিকন্দরের পিতা সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকেই বুঝে থাকি।

এই অবস্থায় শাহ্‌জলাল কোন সময়ের লোক ছিলেন, তা ঠিক করা সহজ নয়, আমরা সর্বপ্রথমে বুরহানুদ্দিনের ও সিলেট বিজয়ের বিষয় আলোচনা করা যাক।

বুরহানুদ্দিনের কাহিনি

বুরহানুদ্দিনের পুত্রোৎসবের হিন্দুরাজার অমানুষিক আচরণের ও মুসলমান পীরের প্রভাবে কাহিনি পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে বিরল নয়। সিলেটের গৌড়গোবিন্দের নামে যে বীভৎসতার উল্লেখ দৃষ্ট হয়, তার অনুরূপ কাহিনি রামপালের রাজা প্রখ্যাত নামা বল্লালসেনের নামে, (Vide : Bradley Birt’s “A Romance of an Eastern Capital), বগুড়া মহাস্থানগড়ের শেষ রাজা পরশুরামের নামে (Vide : J.A.S B 1875), এবং সিলেটের তরপ ও বিশাগাঁওর রাজা আচকনারাইনের নামেও জড়িত রয়েছে। রামপালে বাবা আদম বল্লাল সেনকে “বুজুরকি” দেখিয়ে পরাস্ত করেছিলেন। কিন্তু রাজার করুণ ক্রন্দনে তাঁকে আবার রাজ সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। মহাস্থানগড়ে সেখ আউলিয়া পরশুরামকে মুসলমান অত্যাচারী বলে নিহত করেছিলেন। তরপের রাজা আচক নারাইন পীরের হস্তে বন্ধন প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই সকল কাহিনি পরম্পরার ভিতরে পূর্ব বাংলায় মুসলমান প্রতিভা স্ফুরণের পূর্বাভাস পাওয়া যায়, কিন্তু এই সকল গল্প হতে ঐতিহাসিক তথ্য নিষ্কাশন করা সুকঠিন। বল্লাল সেন ১১০৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন, এবং O’ Donnell সাহেব বলেন যে, পরশুরাম খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের লোক ছিলেন। আর ১১৬৪ খ্রিস্টাব্দে শাহ্‌জলাল সিলেট প্রবেশ করেন, “সুহেল-এ-এমন” গ্রন্থ হতে এইমাত্র আমরা জানতে পারি। কিন্তু নসিরুদ্দিন হায়দর শাহ্‌জলালের তারিখ নিরূপণ বিষয়ে কতদূর সিদ্ধকাম হয়েছেন, তার আলোচনা আবশ্যক।

প্রচলিত গ্রন্থসমূহে দেখতে পাওয়া যায় যে, সিলেট শহরের পূর্বাংশে টুলটীকর মহলে বুরহানুদ্দিন বাস করতেন। শহরপল্লি রায়নগরের দক্ষিণ পূর্বাংশে টুলটীকর নামে একটি ক্ষুদ্র মুসলমান গ্রাম বর্তমান আছে। কিন্তু সেই স্থানে বুরহানুদ্দিনের বাড়ির কোনও চিহ্ন বর্তমান নেই, লোকেরাও এত দূর অতীতের কোনও সন্ধান বলতে পারে না। তবে টুলটীকর গ্রামের নিকটে ‘টাইটীকর” নামে অপর একটি গ্রাম আছে, সেই স্থানে গৌড়গোবিন্দের নামের সাথে সংসৃষ্ট কোনও “উজীরের” পুকুর ও বাড়ির ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান রয়েছে। বস্তুতঃ ভূগর্ভনিহিত সুবিস্তর ইষ্টকস্তর এবং বৃহৎ জলাশয় দেখলে মনে হয় যে, এটি তদানীন্তন আমলের মন্ত্রীর অনুপযুক্ত আশ্রয়স্থান ছিল না।

এখন বুরহানুদ্দিন কে ছিলেন, তার আলোচনা প্রয়োজন। ব্লোকম্যান সাহেব লিখেছেন যে, মুসলমান তাপসদের জীবনীতে জালালুদ্দিন বা বুরহানুদ্দিনের কোনও উল্লেখ নেই। (Vide : J.A.S.B 1873.)

ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগের সেখ জামালি কনবওয়াল লিখিত “সিয়ার-উল-আরিফিন” নামক “তজ্‌কিরাতে” বুরহানুদ্দিন নামের উল্লেখ আছে কিনা জানি না। তবে Beale সাহেবের লিখিত “Oriental Biographical Dictionary” গ্রন্থে এগারজন বুরহানুদ্দিনের উল্লেখ আছে। এর ভিতরে অনেকেই প্রসিদ্ধ গ্রন্থকার বলে পরিচিত। একজন কাজি বুরহানুদ্দিনের উল্লেখ আছে, তিনি শিবগঞ্জের অধিপতি বলে বর্ণিত হয়েছেন। ১৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে তুর্কি সুলতান তাঁর সম্পত্তি দখল করেন। টাই-টীকরের অতি নিকটে শিবগঞ্জ নামে। প্রসিদ্ধ বাজার আজও বর্তমান আছে এবং তবকত্-ই-নসিরি গ্রন্থে সিলেট ‘তুর্কিস্থান’ বলেও উল্লিখিত হয়েছে। বিশেষতঃ আমরা শাহাজালালের যে সময় নিরূপণ করব, তার সাথে এর জীবিত কালের কোন অনৈক্য নেই, এই অবস্থায় শিব পঞ্জেশ্বর (Lord of the city of Sivas) কাজি বুরহানুদ্দিনকে আমাদের বর্ণিত বুরহানুদ্দিন বলে গ্রহণ করতে আপত্তি ছিল না, তবে “City of Sivas” শিবগঞ্জ Cappadocia or Caramenia প্রদেশে অবস্থিত বলে বর্ণনা রয়েছে। এই সঙ্কটে আপাততঃ কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়াই সমীচীন। অপর দশজনের মধ্যে একজন বুরহানুদ্দিন ১১৬৪ খ্রিস্টাব্দে জীবিত ছিলেন, তিনি “হিদায়-সরাবদিয়ে” নামক মুসলমান আইন সম্বন্ধীয় গ্রন্থের লেখক, কিন্তু তিনি মধ্য এশিয়ার লোক ছিলেন, ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি সিলেটে এসে বসবাস করেছিলেন, এমন কোনও প্রমাণ নাই। বিশেষতঃ সিলেটের বুরহানুদ্দিনের জীবনের পরবর্তী ঘটনায় এই সিদ্ধান্তের বা কল্পনার বিরুদ্ধ প্রমাণ রয়েছে।

আবার সিলেট বিজয় সংক্রান্ত বিষয় লিপ্ত বুরহানুদ্দিন নির্যাতন প্রাপ্ত হয়ে খিজির খাঁর পৌত্র দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিনের আশ্রয় ভিক্ষা করেন বলে উল্লেখ আছে। (Vide : Tawarikh-i-Jellali.) অবশ্য খিজির খাঁর (পৌত্র নয়) প্রপৌত্র একজন আলাউদ্দিন ৮৮৫ হিঃ অব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরূঢ় হন এবং পরিশেষে সুলতান বল্লাল লোদী কর্তৃক বেদায়ুনের সিংহাসনে স্থাপিত হন।” (Montak halew-t-Tawarikh. Vol. 1. P 402) এর সময়ে সুলতান সিকন্দর কিংবা নসিরুদ্দিন বর্তমান ছিলেন না। অতএব বুরহানুদ্দিন বাংলার সুবাদার আলাউদ্দিনের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করেছিলেন বলে যে অপর একটি মত আছে তাই আমরা গ্রহণ করলাম; তবে বুরহানুদ্দিনের সিলেটে আগমনের উদ্দেশ্য ও তাঁর প্রকৃত পরিচয় এখনও অজ্ঞাত।

সিলেট বিজয়

৭৪২ হিজিরিতে (১৩৪১ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ জুন) আলুউদ্দিন আলি শাহ্‌ বাংলার মসনদে আরোহণ করেন। হাজি ইলিয়াস তাঁর ভ্রাতা (Foster Brother) ছিলেন। (Vide : Thomas’s pathan kings.) সুলতান সিকন্দর হাজি ইলিয়াসের পুত্র আলাউদ্দিনের ভ্রাতুষ্পুত্র। (As karrated in “Suhail-1, yemen.”).

হাজি ইলিয়াস তাঁর ভ্রাতা আলাউদ্দিনকে হত্যা করে ১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দে সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নামে বাংলার স্বাধীন নরপতি বলে নিজকে ঘোষণা করেন। এটিতে বোঝা যায়, যে আলাউদ্দিনের জীবদ্দশায় ১৩৪১ হতে ১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দের ভিতরে বুরহানুদ্দিন গৌড়গোবিন্দের বিরুদ্ধে সাহায্য ভিক্ষা করায় নবাব আপন ভ্রাতুষ্পুত্র সুলতান সিকন্দরকে সেনাপতিরূপে অভিযানে প্রেরণ করেছিলেন। সিকন্দর দুইবার সিলেটের রাজা গৌড়গোবিন্দের হস্তে পরাস্ত হন, এবং আপন অপমান ক্ষত ঢেকে রাখিবার জন্য প্রচার করেন যে, কাফের রাজা বড় যাদুবিদ্যা বিশারদ, কারণ গৌড়গোবিন্দের অগ্নিবাণের তেজ মুসলমান বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দেয়। আলাউদ্দিনের সময় হতে সিলেটবিজয় আরম্ভ হয় এবং সুলতান সিকন্দরের পিতা সামসুদ্দিন হাজি ইলিমাসের সময় সম্পন্ন হয়েছিল বলে বোধ হয়। সামসুদ্দিনের বিষয়ে উল্লেখ আছে যে, “He was the first recognised and effectively independent Muslim Sultan of Bengal, the annals of whose reign have been so often imperfectly reproduced in prefatory introduction to the relation of the magnificient future his successors were destined to achieve as holders of the interest and commercial prosperity of delta of the Ganges, to whose heritage indeed, England, owes its effective ownership of the continent of India at the present day.” (Vide : Thomas’s pathan kings.). অর্থাৎ তিনিই বাংলাদেশের সর্বপ্রথম স্বাধীন নরপতি। এর বংশধরেরা গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত বিশাল দেশের রাজত্ব পেয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে গৌরবোজ্জ্বল কীর্তি রাখিয়াছেন, সেই সম্পর্কে আমরা এর রাজত্বকালের অনেক অসম্পূর্ণ বিবরণ প্রাপ্ত হই। আর আজ ইংলন্ড প্রথমে ঐ রাজ্যের কর্তৃত্ব পেয়ে ভারত মহাদেশকে শাসন করছে!

এইরূপ অনুমানে নসিরুদ্দিন চিরাগী সম্বন্ধে কোনও অসামঞ্জস্যের ভয় নেই। মকদুম সেখ নসিরুদ্দিন চিরাগই দিল্লি ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ তোগলককে গোপনে দিল্লির সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করবার অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বন্দিভাবে ফাঁসিতে নীত হয়েছিলেন”, (Vide : Al Badaoni Vol. 1. P. 322), সিলেটে তার কাল প্রাপ্তি হয়, অতএর ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দের পরে তিনি সিলেটে এসেছিলেন, বন্দি হওয়ার পর হতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর কার্যকলাপ অনেকটা কুটিকা সমাচ্ছন্ন রয়েছে। Beale সাহেব বলেন, He is also called by Firistha, Nasiruddin Mahmud Awadhi, surnamed Chiragh-i-Delhi, or the Candle of Delhi, a celebrated Mahomedan Saint, who was a disciple of Shaikh Nizamuddin Aulia, whom he suceeded on the masnad of Irthad or Spiritutual Guide, and died on Friday, the 16th September, A D. 1356, 18th Ramzan, A H 757. He is buried at Delhi in a Mausolem which was built before his death by Sultan Firoze Shah Barbek One of his disciples, and close to his tomb Sultan Ballol was afterwards buried. He is the another of a work called Khair-ul-Majalis. অর্থাৎ ফিরিস্তা তাঁকে নসিরুদ্দিন মামুদ আওয়াধি বলে উল্লেখ করেছেন। “দিল্লি প্রদীপ” তার উপাধি ছিল, তিনি সেখ নিজামুল আউলিয়ার শিষ্য ছিলেন, এবং আউলিয়ার মৃত্যুর পর তিনি গুরুর পদ লাভ করেন। ১৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১৬ সেপ্টেম্বর (৭৫৭ হিঃ ১৮ রমজান) তারিখ তার মৃত্যু হয়। তাঁর শিষ্য সুলতান ফিরোজ বারবেক কর্তৃক দিল্লির উপকণ্ঠে নির্মিত মন্দিরে তার সমাধি হয়, (৭৭৫ হিঃ অব্দের একখানি শিলালিপি দিল্লির উপকণ্ঠে সাপুর ও খিঁকি নিকটে বর্তমান আছে। সৈয়দ আহম্মদ বলেন যে “The shrine seems to have orginally been erected in 775 A D by Firoze Shah” Thamas P. 286. এটি সত্য হলে Beale সাহেবের অভিধান হতে উপরিউদ্ধৃত “his death” কথার অর্থে ফিরোজ শাহের মৃত্যুই বুঝতে হবে।) এবং ভবিষ্যতকালে সুলতান বল্লাল লোদী তাঁর সমাধির নিকটে প্রোথিত হন। “খায়ের-উল-মজালিস” গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন।

সিলেটে নসিরুদ্দিনের মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু কবর হয়নি, খাটখানি মাত্র চকিদিঘি মহলায় নিহত হয়। শাহ্‌জলালের অলৌকিক প্রভাবে তাঁর শবদেহ শূন্যে মিশে গিয়েছিল। এটিতে আমরা অগত্যা এই বুঝতে পারি যে, নসিরুদ্দিনের প্রিয় শিষ্য সম্রাট ফিরোজের আদেশে তাঁর শবদেহ দিল্লিতে নীত হয়ে সাপুর ও থির্কির কাছে সমাহিত হয়েছিল। অতএব তিনি ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দের পরে এবং ১৩৫৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সিলেট বিজয়ে লিপ্ত ছিলেন।

১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ফিরোজশাহ পূর্ববাংলা আক্রমণ করতে গিয়ে একচালা দুর্গের সম্মুখে লাঞ্ছিত হন, এবং ইলিয়াস খাঁজে সুলতান সামসুদ্দিন খেংরার সাথে সন্ধি করে এগার মাস পরে দিল্লিতে প্রত্যাগমন করেন। (Vide : Stewart, Edition 1813. pp. 84.85) দিল্লির প্রদীপ নাসিরুদ্দিন এই সময় সম্রাটের সাথে পূর্ব বাংলায় আগমন করেন, এটিই খুব সম্ভবপর। বিশেষতঃ যে সময়ে তিনি দিল্লি প্রদীপ উপাধি পান সেই সময়ে তিনি “শকপালা” শিবিরে বাস করছিলেন, এইরূপ বর্ণনা আছে। এগার মাস য়া অভিযানের সময় বা তার পরে, ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগে, সুলতান সিকদার মকদুম সেখ নসিরুদ্দিনের অনুগ্রহ লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এটি হতে এই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, ১৩৪১ খ্রিস্টাব্দের পরে সুলতান সিকন্দরের প্রথম অভিযান হয়, এবং ১৩৫৩ হতে ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নসিরুদ্দিনের জীবদ্দশাতে মুসলমানরা সিলেট দেশ জয় করেন। এই বিজয় ব্যাপারে শাহ্‌জলালের সংস্রব ছিল কিনা, তাই এখন বিবেচ্য।

সিলেটে মুসলমান

শাহ্‌জলাল সিলেটের প্রথম মুসলমান বিজেতা, এবং ইসলাম ধর্মের আদি প্রচারক বলে কথিত হন, এটি কতদুর সত্য তার আলোচনা করা যাচ্ছে। শাহ্‌জলালের পূর্বে সিলেটে মুসলমান বুরহানুদ্দিনের অস্তিত্বে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, রিছালা-প্রণেতা-সিলেটবাসী মুসলমান পণ্ডিত মুহীউদ্দিন খাদিম এদের অন্যতম। কিন্তু এই সন্দেহ অমূলক, কারণ ১৩৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেও কয়েকবার সিলেটে মুসলমান সৈন্য প্রবেশ করে জয়-পরাজয়ের রসাস্বাদন করেছিল। বেদায়ুনীর পুস্তকে দেখতে পাই, “Husamuddin Khilji, one of the Khilji, one of the Khilji and Garmsir tribe and one of the servants of Md Bakhtyr became possessed of the whole country of Tirhut and Bangala and Jajnagar and Kamrud and gained the title of Sultan Chiyasuddin in the months of the year 621 A.” (All Badaoni Vol. 1, p 86.) অর্থাৎ হুসামুদ্দীন খিলিজি নামক খিল্জ ও গার্নসারের জনৈক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, বক্তিয়ার খিলজির কর্মচারী, ৬২১ হিঃ অব্দে ত্রিহুত, বাংলা, যাজনগর (ত্রিপুরা) এবং কামরূপের সমস্ত প্রদেশ জয় করে সুলতান গিয়েসউদ্দিন নাম ধারণ করেন। এই বর্ণনায় মনে হয় তিনি হয়ত, ত্রিপুরা ও কামরূপের মধ্যবর্তী সিলেট প্রদেশ স্ববশে আনতে পেরেছিলেন, বিশেষত ত্রিপুরা হতে সিলেট দিয়ে কামরূপ প্রবেশের পথ প্রশস্ত ছিল। কিন্তু দুই বছরের ভিতরে তাকে কামরূপ অঞ্চল পরিত্যাগ করতে হয়েছিল, এবং সিলেট নিজ স্বাধীনতা লাভ করে। তারপর ৬৪২ হিঃ অব্দে (১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে) মালিক বুজবেক সিলেট আক্রমণ করেছিলেন।

“In the following year (ie 642 AH 1244 AD) he (i.e. Ikhtyaruddin Toghril Khan, Malik Yuzileek,) invaded the territories of the Raja of Azmurdun and took the capital of that princes, with all his treasures and elephants.” (History of Bengal Ed. 1813 P. 65) অর্থাৎ ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারুদ্দিন তুঘ্রিল খাঁ আজমরদাঁরে রাজার রাজ্য আক্রমণ করে রাজধানী অধিকার করেন, এবং তার সমস্ত ধনরত্ন ও হস্তীসকল হস্তগত করেন।

স্টুয়ার্ট সাহেব এই আজমরদাঁকে সিলেটের অন্তঃপাতী আজমীরিগঞ্জ বাজার বলে মনে করেন। ক্যাপ্টেন ফিসার সাহেবের মতে আরোও দশ বছর পরে অর্থাৎ ১২৫৪ খ্রিস্টাব্দে মালিক ইউজবেক সিলেট আক্রমণ করেন, এবং বানিয়েচঙ রাজার পূর্বপুরুষদেরকে পরাস্ত করেন। তিনি বলেন, “The Beniyachung Raja’s ancester was probably the party attacked in 1254 by Malik Yuzbek, the Governor of Bengal, who afterwards lost his life in the south of Assam.” (Vide : J. A. S. B. 1840.)

বানিয়েচঙ ও আজমীরিগঞ্জ পরস্পর নিকটবর্তী, এটিতে স্টুয়ার্ট ও ফিসার সাহেবের মত পার্থক্যে বিশেষ কিছু আসে যায় না। তবে বানিয়েচঙ ৬৫০ বছরের প্রাচীন স্থান বলে মনে হয় না, এবং মোগল ঔরংজীবের সময়ে লাউড়ের ব্রাহ্মণ রাজা গোবিন্দ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়ে বানিয়েচঙ গিয়ে বাস করেন, ও তার সঙ্গে সঙ্গে ঐ স্থানে সমৃদ্ধি লাভ করে, এটিই সাধারণ বিশ্বাস। কিন্তু সে যাই হোক, সিলেট তখনও স্বাধীন ছিল।

১২৯০ খ্রিস্টাব্দেও সিলেট স্বাধীন ছিল, মার্কোপোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্তে দেখতে পাই যে, “Bangala is a province towards the South which up to the year 1290 had not yet been conquered.” (Ibid Vol. ii P. 128.) এইস্থানে “বাংলা” বলতে “সিলেট” বলে মনে হয়। কারণ, “Marco conceives of it, not as in India, but as being like Mliui (Burma ) a province on the confines of India on the other hand, the circumtances of manners and products so far as they go, do belong to Bengal.” (Ibid Vol. i. P.128) অর্থাৎ মার্কো বাংলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন না, কিন্তু ব্রহ্মদেশের মত একটি সীমান্ত প্রদেশ বলে মনে করেন। অথচ আচার ব্যবহারে উৎপন্ন পদার্থে উক্তদেশ আমাদের বাংলারই অনুকূল। এটিতে ‘বাংলা’ শব্দে সিলেট বা তন্নিকটবর্তী প্রদেশকেই বোঝাচ্ছে। তবে বক্তিয়ার খিলিজির আসাম বাহিনীও সিলেটের ভিতর দিয়ে গিয়েছিল বলে কেউ কেউ অনুমান করেন। “Both these invasions of Kamrup (one in 1205-6 and the other in 1253-7) appear to have been directed through the Silhat Territory and then accross the passed of the Kasia or Jaintia Hills into Assam.” (Vide : Cathay and the way Thither P. 515.) অর্থাৎ ১২০৫-৬ খ্রিস্টাব্দের ও ১২৫৩-৭ খ্রিস্টাব্দের কামরূপ অভিযান সিলেট জেলা পার হয়ে খাঁসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের পথ দিয়ে প্রেরিত হয়েছিল বলে মনে হয়। পুনশ্চ, It is expressly stated that the Mohomedan army crossed the mountains before they reached the bridge and before the Raja submitted. 1 conclude that they entered lower Assam not by Goalpara, but by the Kasia or Cachar mountains in 1256AD Malik yuzbek, who had invaded Kamrup from Bengal was killed while retrerating “across the mountains” (and that between 1489 and 1499) Alauddin having first overrun Assam proceeded westword to the of conquest of Kamrup which of course is impossible on any others supposition than that he entered Assam by the way either of Hirumbha (Cachar) or Silhat. (Captain Fisher in J.A.S.B. 1840.) অর্থাৎ এটি স্পষ্টই উল্লিখিত হয়েছে যে, মুসলমান সৈন্য সেতুর নিকটে পৌছবার পূর্বে এবং তাদের নিকট রাজার বশ্যতা স্বীকার করবার পূর্বাহ্নেই তারা পর্বতমালা পার হয়ে গিয়েছিল। এটিতে গোয়ালপাড়ার পথে না গিয়ে খাসিয়া বা কাছাড়ের পর্বত অতিক্রমপূর্বক তারা নিম্ন আসামে উপস্থিত হয়েছিলেন বলে সিদ্ধান্ত করা যায়। ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে কামরূপ আক্রমণ কালে পর্বতের উপর দিয়ে ফিরে আসবার সময় মালিক ইউজবেক নিহত হয়েছিলেন। ১২৮৯-৯৯ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন সমস্ত আসাম বিধ্বস্ত করে পশ্চিমমুখে কামরূপ বিজয়ে অগ্রসর হন। হিড়িম্ব বা সিলেট দেশ দিয়ে আসামে প্রবেশ না করলে এই পশ্চিমমুখী অভিযান অর্থহীন হয়ে যায়।

তারপর ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত Tabaquat-i-Nasiri পুস্তকে বক্তিয়ার খিলজির বিষয়ে উল্লেখ আছে যে, “When several years elopsed he read information about the territories of Turkesthan and Tibet, to the East of Lakhnauti, and he began to entertain a desire of taking Tibet and Turkesthan.” লক্ষ্মণাবতীর পূর্বে অবস্থিত যে তুর্কিস্থানের উল্লেখ রয়েছে তা অন্যত্র “তুর্কি চেহারাওয়ালা লোকদের বাসভূমি” বলে উক্ত হয়েছে যথা, “A chief of one of the mountain tribes (Amir Ali Masif) who were all of Turkish countenance adopted the religion of Islam and agreed to act as guide to Muhammed Bakhtyar.” (Mantakhabu-t-Tawarikh vol. 1, p. 86). ক্যাপ্টেন ফিসার সাহেব এই আমীর আলি মাদুক বা আলি মিকাকে একজন খাসিয়া বলে অনুমান করেন। পরন্ত আলিমিকা মেক বা কুচ বলেও স্থানান্তরে উল্লিখিত হয়েছেন।

এই সকল ঘটনা পরম্পরায় এটি সম্পূর্ণ রূপে প্রমাণ হচ্ছে যে ১৩৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দের অনেক পূর্ব হতেই সিলেট অঞ্চলে মুসলমান ছিল, তবে দেশ হিন্দুরাজার অধীনে থাকায় উক্ত ধর্মের প্রসার হতে পারেনি। অতএব শাহ্‌জলালকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগের লোক বলে ধরে লইলে তিনি কিছুতেই সিলেটে সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মপ্রচারক বলে গণ্য হতে পারেন না—তিনি সর্বপ্রধান হতে পারেন, সর্বপ্রথম প্রচারক নন।

এখন তিনি চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগের লোক কিনা তার আলোচনা আবশ্যক।

শাহ্‌জলালের পরিচয়

Rauzat-el-Safa নামক পারস্য দেশের ইতিহাস প্রণেতা মীরখণ্ডের পূর্বপুরুষ নামৌলবাসী হামিদুদ্দিন (হোলিমুদ্দিন?) শাহ্‌জলালের অনুচর ছিলেন বলে উল্লিখিত হয়েছেন। নানৌল এই শব্দের বিভিন্ন অক্ষরের পরিমাণ গণনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, উক্ত নগরী ৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল। G. Yazdani সাহেব বলেন,”By the mode of computation called abjad, the word gives the number 337 which representing the Hijra year, is equivalent to 949 A.D.” (J.A.S.B. 1907). নানৌলের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই যে, ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে শাহা বিলায়ত নামক একজন প্রসিদ্ধ ফকির ঐ অঞ্চলে আগমন করেন। শাহ্‌জলালের ত্রিশ বছর সিলেটে অবস্থানের পর ইন্তিকাল হয়েছিল। ‘মুহেল-ই এমনের’ মতে ৫৬১ হিজরিতে অর্থাৎ ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে শাহ্‌জলাল সিলেটে এসেছিলেন এবং তখন তাঁর বয়স ৩২ বছর ছিল। অতএব ১১৩২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়েছিল এবং তিনি প্রথম যৌবনে দেশ ভ্রমণে বহির্গত হয়েছিলেন, এই অবস্থায় ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে না হোক ১১৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নানৌল প্রভৃতি অঞ্চলে তাঁর আবির্ভাব হতে পারে, এই ধারণায় কেউ কেউ তাকে শাহাবিলায়তের সঙ্গে অভিন্ন ব্যক্তি বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু তা ভুল, কারণ শাহ, বিলায়ত দেশীয় রাজন্যবর্গের সাথে সংগ্রামে নিহত হন এবং নানৌলে অদ্যাবধি তাঁর সমাধি রয়েছে।

অপরদিকে হুসেন শাহের আমলে ৯২১ হিজিরিতে খোদিত শিলালিপিতে লিখিত আছে যে শাহ্‌জলালের আদেশে মন্দির নির্মিত হয়েছিল। Blochmann সাহেব এই আদেশকে শাহ্‌জলাল তাব্রিজি যেভাবে আলি শাহকে আদেশ করেছিলেন সেইরূপ স্বপ্নাদেশ বলে মনে করেন, এবং তাই ঠিক। ভক্তের দ্বারে ভিখারি সেজে স্বপ্নাদেশ প্রদান করা প্রাচ্যভূমিতে দেবতা বা দেবতাস্থানীয় মহাপুরুষদের দেবযোগ্য শিষ্টাচার বিরুদ্ধ নয়। সমর ভূমিতে অদৃশ্যভাবে অবতীর্ণ হয়ে ভক্তের পক্ষ সমর্থন করাও দেব চরিত্রে নতুন নয়।

আবার হজরত শাহজলাল সশরীরে রণভূমিতে পদার্পণ না করে হয়ত অদৃশ্যভাবে দৈবশক্তি সম্পন্ন নসিরুদ্দিনের বীরতেজ বৃদ্ধি করে দিয়েছিলেন, তখনকার লোকের এইরূপ ধারণা হয়ে থাকতে পারে। “Shah Jalal encouraged them by repeating a certain prayer” শাহ্‌জলাল কোনও প্রার্থনা মন্ত্র জপ করে সৈন্যদেরকে উৎসাহিত করেছিলেন। এইটুকু কাজের জন্য সমরক্ষেত্রে তাঁর সশরীরে উপস্থিতি প্রয়োজনীয় না হতে পারে, অতএব ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে শাহ্‌জলালের মৃত্যু হলেও ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে নসিরুদ্দিনকে সশরীরে উৎসাহিত করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর না হোক নিজে সিদ্ধপুরুষ নসিরুদ্দিন ভক্তির প্রাচুর্যবশতঃ সিলেট বিজয় শাহ্‌জলালের তেজোপ্রভাবে সম্পন্ন হয়েছিল বলে স্বীকারপূর্বক নিজ সৈন্য প্রকাশ করেছেন মাত্র। এই যুক্তি অবলম্বন করে কোনও গ্রন্থকার আজ পর্যন্ত ‘সুহেল-ই-এমন’ গ্রন্থের তারিখ সমর্থন করবার প্রয়াস পাননি। এই অবস্থায় আমরা “সুহেল-ই-এমন” গ্রন্থের কাল নির্ণয়ে আস্থা স্থাপন করতে পারলাম না।

সিলেটে মুসলমান ও শাহ্‌জলালের আগমন সম্বন্ধে এইরূপ নানা বিষয়ের আলোচনা দ্বারা এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ১৩৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দেই সুলতান সিকন্দর ও নসিরুদ্দিন চিরাগ-ই-দিল্লির সহযোগে শাহ্‌জলাল সিলেটে পদার্পণ করেছিলেন। এই সিদ্ধান্তে কোন ঐতিহাসিক অসামঞ্জস্য নেই। তবে আফ্রিকার অন্তঃপাতী তাঞ্জিয়ার দেশ নিবাসী মুসলমান পণ্ডিত আবু আবদাল্লা মহম্মদ বিন আবদাল্লা আল লওয়াছি (যিনি সচরাচর ইবন্ বোততা নামে পরিচিত হয়ে এসেছেন তিনি) শাহ্‌জলালকে সিলেটে দর্শন করেছিলেন বলে একটা কথা আছে। এটি যে সম্পূর্ণ অসম্ভব আমরা তার বিশিষ্ট প্রমাণ দিচ্ছি।

ইবন বোততা

মহম্মদ তোগলকের সমকালীন নবাব ফকরুদ্দিন যখন বাংলার মসনদে সমাসীন, (৭৩৯-৭৫১ হিঃ) তখন ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে ইবন বোততা মালদ্বীপ হতে প্রত্যাবর্তন কালে ‘সাদকাওন’ গ্রামে অবতীর্ণ হন, তৎপরে সেই স্থান হতে ‘কামরূ’তে গমন করেন। ‘কামরূ’ হতে ফিরে আসবার সময় সেখ জলালুদ্দিন তাব্রিজিকে সন্দর্শন করে পরিতৃপ্ত হন, এবং তৎপরে “আল নহরন আখজর” নদীর তীরস্থ “হবাঙ্ক” নগরে গমন করেন। Colonel Yule বলেন, “Kamru is of course Kamrup a tern of somewhat wide application but which anciently included Silhet… The Sheikh Jalaluddin was, I doubt not, the patron-saint of Silhet now. known as Shah-Jalal, the subject of many legends, to whom is ascribed the conversion of the people of that country to Islam and whose Shrine at Silhet, flanked by four mosques, is still famous.” অর্থাৎ কামরূ বলতে কামরুপ বুঝিয়েছেন যার মধ্যে প্রাচীনকালে সিলেট অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি আরও বলেন, The city of Habank is, I doubt not Silhet or its medixual representative” পুনশ্চ, “Akzar river is no doubt the Surma, by descending which the traveller would come direct upon Sonergawn.” (Indian Antiquary 1874 P. 210.)। কর্নেল ইয়ুলের মতো বিদ্বানলোক প্রাচ্য প্রত্নতত্ত্ববিদ বলে পরিচিত হলেও, আমরা তাঁর “নিঃসন্দেহে” (“I doubt not”) সত্য বলে গৃহীত অনুমানকে অভ্রান্ত বলে গ্রহণ করতে দ্বিধা বোধ করছি।

প্রথমতঃ সিলেটের শাহ্‌জলাল ইয়ামেন দেশবাসী ছিলেন, তিনি তাব্রিজি ছিলেন না, এর কৈফিয়ৎ দিতে গিয়ে ইউল সাহেব বলেছেন যে, ‘তাব্রিজ’ ও ইয়ামেন নিকটবর্তী জনপদ, উভয়স্থলই আরবের অন্তর্গত অতএব এইরূপ ভুল হওয়া ইবন বোততার পক্ষে সম্ভবপর। কিন্তু বোততা আরবদেশ দেখে ভারতে এসেছিলেন। তাই তাঁর ভুল হয়েছিল এটি বোধ হয় না। বরং তাব্রিজি শাহজলাল ভিন্নব্যক্তি ছিলেন, তিনি ৬৪২ হিজরিতে একশত বছর পূর্বে গৌড়ে (?) প্রাণত্যাগ করেন। যাই হোক কর্নেল ইয়ুলের এই কৈফিয়ৎ মেনে নিলেও আমরা তাঁর সাথে একমত হতে পারি না।

মুর পরিব্রাজক ইবনে বোততার যে শাহজলালের সাথে সাক্ষাত হয় তিনি বোগদাদের শেষ আব্বাছিদ খলিফা মোস্তাছিম বিল্লাকে দর্শন করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। ইবন বোততা বলেন, “He told me that he had seen El Mosta asim the Calif in Bagdad.” (Lee’s Iben Batutah p. 197.) রসিমুদ্দিন লিখেছিলেন যে, “The evening of Wednesday. the 14th of Safar, 656 A H (20th, February 1258), Califa was put to death in the village of wakf with his eldest son and 5 eunuchs who had never qutitted him.” (Vide : Col. Yule’s Marco Polo Vol. i, P. 67) অর্থাৎ খলিফা মোস্তাসিম বিল্লাহ্‌ ১২৫৮ সালে মারা যান। বোততা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন। এই সময়ের ৮৮ বছর পূর্বে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফার মৃত্যু হয়, এবং বোততার বর্ণনারূপ শাহ্‌জলালের বয়স তখন ১৫০ বছর হলে, খলিফার মৃত্যুর সময়ে জলালের ৬২ বছর বয়স ছিল। (১) চিরকুমার শাহ্‌জলাল ৬২ বছর জীবিত ছিলেন, (২) ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগত শাহ্‌জলাল তাব্রিজি ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে নিহত খলিফাকে দেখে থাকতে পারেন, (৩) খলিফার মৃত্যুর ৮৮ বছর পরে ইবন বোততা পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন, (৪) ৮৮ ও ৬২ এই দুই রাশি যোগ করলে শাহ্‌জলালের বয়স ২৫০ হয়, (৫) এবং সুহেল-ই-এমনের মতে ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে শাহ্‌জলালের মৃত্যু হলে ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২৫০ শত বছর চলে গিয়েছিল, এই কয়েকটি কথার অদ্ভুত সংমিশ্রণে বোততার বিবরণ পণ্ডিতদেরকে গোলমালে ফেলেছে বলে মনে হয়। কারণ পাদ্রী লি সাহেব ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে এই বোততা শাহ্‌জলাল কাহিনি যেরূপ ভাষায় অনুবাদ করেছেন, তা হতে কিছুই প্রমাণ হয় না। লি সাহেবের বর্ণনার নমুনা এইরূপ, “The Sheikh had also lived to a remarkably great age. He told me that he had seen El. Mosta’ asim, the Calif in Bagdad and his companions told me after wards (when ?) that he died at the age of 150 years; that he fasted through a space of about 40 years. It was by his means that the people of these montains become Mahomedans and on thus account it was that he resided among them. One of his companions told me that on the day before his death he invited them all to come to him…the Sheikh embraced me.” (P. 197)

এই বর্ণনার উপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন, এটি হতে কোন তথ্য নির্ণয় করা যায় না। দ্বিতীয়ত, “আল নহরল্ আখজার” নদী ও শূর্মানদী অভিন্ন বলে কর্নেল সাহেব ঠিক করেছেন। তিনি বলেন, “It is possible that the name of the river Surma suggesting the black collyrium so called, many have originated the title used by Ibn Batutah.” (Vide : Cathay and the way Thither P. 517). প্রাচ্যনামের বুৎপত্তিগত অর্থের অন্বেষণ স্পৃহা এই নতুন নয়। আসাম অঞ্চলে একটি “কৃষ্ণতোয়া” নদীর পরিচয় উপলক্ষে এই কর্নেল সাহেবই অন্যত্র লিখেছেন যে, অর্ধশতাব্দী ব্যাপি ইংরেজ ও ফরাসিদের ভিতরে এই বিষয় নিয়ে বাদানুবাদ জাতীয় কলহে পরিণত হয়েছে (“Degenerated into a national dispute”); ঘটনাটি এইরূপ Queii Yuann নামক একজন চীনদেশীয় ঐতিহাসিক “Cheng Vou-tei” নামক গ্রন্থে “Le grand Teinn-ene-teiang” (স্বর্ণরেণু প্রবাহিনী) নামে একটি বৃহতী নদীর উল্লেখ করেছেন, এবং আরও বলেছেন যে উক্ত নদী “Eau Noire” (কৃষ্ণতোয়া) নামে ও কথিত হয়। কেউ বলেন যে এই নদী ব্রহ্মপুত্র, অপর কেউ বলেন এটি ইরাবতী, এবং সর্বশেষ Imboult-calliet সাহেব বলেন যে এটি মেকিয়ং কিংবা সেলুয়েন নদীও হতে পারে। (Vide : Canquete de la Birmanie in Journal Asiatique Paris, 1878.) আসাম ও চীনের সীমান্ত দেশে একটি নদীর অবস্থান নির্দেশ করতে গিয়ে, অর্ধশতাব্দীর বাদানুবাদের পরেও যখন কিছু ঠিক হয়নি, এবং পণ্ডিতেরা যখন সিদ্ধান্ত করেছেন যে এটি বাংলা হতে আরম্ভ করে প্রশান্ত মহাসাগরের ভিতরে যে কোনও একটি নদী হতে পারে, তখন “আল্ নহরল্ আখজর” বলতে আবার ঐ পণ্ডিতদের নির্দেশানুসারে নিঃসন্দেহে এটিকে ‘সূর্মানদী বলে ধরে নিতে পারি না। বিশেষতঃ ‘হাবাঙ্ক’ নগরের স্থান নির্দেশে ইয়ুল সাহেব ভ্রান্তিতে পতিত হয়েছেন, আমরা এখন ‘হাবাঙ্ক’ নগরের স্থান নির্দেশ সম্বন্ধে কিছু বলব।

কর্নেল সাহেব বলেন, ‘হাবাঙ্ক’ নগর সিলেট শহর। তার যুক্তি এইরূপ, শাহ্‌জলাল চারিস্থানে তার অনুচর পীরদেরকে স্থাপন করেন, যথা (১) সিলেট, (২) সিলেট শহরের ছয় মাইল উত্তরে চেঙ্গের খালের তীরে, (৩) চরগোলা টিলাতে এবং (৪) হাবাঙ্গীয়া টিলাতে। হাবাঙ্গীয়া টিলার সম্বন্ধে তিনি বলেন যে, ‘কেউ কেউ তাকে দিনারপুরের পাহাড় বলে মনে করেন। সিলেট জেলার দিনারপুর পরগণার কাছে হাফানিয়ের টিলা বলে একটি ক্ষুদ্র গিরিরেখা ছিল, এবং এই ‘হাফানিয়ে’ কথাটি শব্দতত্ত্ববিদদের চাতুর্যে পর পর ‘হাবাঙ্গীয়া’, ‘হাবাঙ্গ’, ‘হাবান্ধ’ ও সর্বশেষ পাদ্রী লি সাহেবের ‘যবন্ধ’ শব্দে পরিণত হয়ে সিলেট জেলার সাথে একস্থান বাচক হয়ে পড়ে। এটিই কর্নেল সাহেবের সিদ্ধান্ত। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিকোণমিতি জরিপের সময়ে ও আবাঙ্খির টিলা বলে একটি স্থানের নির্দেশ হয়েছে। এটি উল্লেখ করেও তিনি আপন যুক্তির সমর্থন করেন।

এখন আমাদের বক্তব্য এই যে, ৪০/৫০ মাইল দূরবর্তী ক্ষুদ্র একটি পাহাড়ের নামে সিলেট জেলা পরিচিত ছিল এটি সম্ভবপর নয়। ‘যবন্ধ’ শব্দকে ‘যবনক’ অর্থাৎ যবনাধিকৃতদেশ বলে পরিচয় দিলেও চলে না, কারণ সিলেট তখনও হিন্দুর অধীন। তারপর সিলেট শহর অতি পুরাতন শহর, পীঠস্থান বলে এই নামেই পুরাণাদিতে অভিহিত হয়ে আসছে। এর অপর নাম ‘শ্রীক্ষেত্র’ ছিল। সংস্কৃত গ্রন্থে না হোক, অন্ততঃ M. Vivien de st. Martin সাহেবের গ্রন্থেও কর্নেল সাহেব এটি জানতে পারিতেন। চীন পরিব্রাজক হয়েহুসং এর সময়েও, সিলেট শহর বিদ্যমান ছিল। তিনি “শিলেচতাল’ বলে এর উল্লেখ করেছেন। Cunningham সাহেব বলেন, “Shi-le-cha-tolo, which was situated in a valley near the great sea to the N.E. of Samatalta. The name is probably intended for Sri-hata or Sylhet to the N.E of the Gangetie Delta. This town is situated in the valley of the Megna river, and although it is at a considerable distance from the sea, it seems most probable that it is the place intended by the pilgrim.” (Ancient Geography of India Vol. i, p. 503)

সুরমানদীর পারে সিলেট শহর হতে প্রায় ৪০ মাইল উপরে ভাঙারবাজার বলে একটা স্থান আছে। প্রায় শতবছর পূর্বে এটি ‘বঙ্গ’ বলে পরিচিত ছিল। (Rennell’s Memour of Hindustan). বঙ্গ শব্দ ‘হাবাং’ শব্দের ভগ্নাবশেষ এটি কর্নেল সাহেবের মত। কিন্তু তন্নির্ধারিত হাবাঙ্গীয়ার টিলা ও বঙ্গ প্রায় ৭০ মাইল দূরে অবস্থিত। ইবন্ বোততা বলেন, “When. however, I had bid farewell to Sheikh Jaladuddin, I traversed to the city Jabank, which is very large and iful. It is divided by the river which descends from the mountains of Kamru. called the Blue River By descending this, one may travel to Bengal and the countries of Lakhnauti upon it are gardens melts and villages which it refreshes and gladdens like the Nile of Egypt.” (Lee. pp. 197-8.)

শহরের ঐশ্বর্যের বর্ণনা পড়ে হাবাঙ্গকে আপাততঃ সিলেট বলে মনে হতে পারে, অপিচ সিলেট শহর তখন সূর্মানদীর উভয় পারে বিদ্যমান ছিল। শাহাজালালের সময়ে নদীর দক্ষিণ পারে অবস্থিত বর্তমান ‘কালপাড়া’ একটি ক্ষুদ্র শহর ছিল। তবে ‘বঙ্গ’, ‘হাবাঙ্গ’ বা আধুনিক “ভাঙারবাজার” শাহ্‌জলালের পীঠস্থান সিলেট শহর হতে উজানে অবস্থিত। শাহ্‌জলালের পীঠস্থান হতে ‘বঙ্গ’ যেতে হলে সোনারগাঁ অভিমুখে যাওয়া যায় না, বিশেষতঃ সূর্যা নদী কামরূপের (খাসিয়া ও জয়ন্তিয়ার) পাহাড় হতে বাহির হয়নি। এই অবস্থায় ‘হাবাঙ্ক’, ‘’বঙ্গ’, ও সিলেট’ এক জেলার নানা জায়গার নাম হলেও বোততার শেখ জালালুদ্দিন আরও উজান দেশের কাছাড় প্রভৃতি অঞ্চলের, কিংবা কামরূপের অন্তর্ভুক্ত কোনও পাহাড়ের অধিবাসী ছিলেন। তিনি সিলেটের শাহ্‌জলাল হতে পারেন না, কর্নেল সাহেবের বর্ণনা হতে এটিই ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত।

পরস্তু সৌমার দেশ হতে আগত আসামের রাজা চুকামগর ইতিহাসে আমরা হাবুঙ্গ নগরের উল্লেখ দেখতে পাই। তিনি মুংকং দেশ হতে চোমদেও হরণ করে বর্তমান আসামের নানাস্থানে ভ্রমণপূর্বক নাগাদের সাথে রণ করে নামরূপ গমন করেন। বর্তমান লখীপুর জেলায় নামরূপ একটি রেলওয়ে স্টেশন। তিনি ‘একবছর কাল’ নামরূপে অবস্থানের পর (১২২৮ খ্রিঃ-১২৪২ খ্রিঃ) তিপাস, সলগুড়ি, হাবুদ ও সিমুলগুড়ি এই সকল স্থানে স্থানে দুই তিন বছর থাকিয়া সেই সেই স্থানের নীতিধারা বুঝে শিবসাগর অন্তর্ভুক্ত চরাইদেও পাহাড়ে নগর স্থাপন করেন। যারা বীরত্বে ‘অসম’ ছিল, শাজাদের নামে একটি বিস্তীর্ণ ভূভাগ আজও “আসাম” বলে পরিচিত হচ্ছে। চুকামগ সেই আহোম জাতির নেতা ও সর্বপ্রথম রাজা। তিনি নীতি শিক্ষার জন্য যে নগরে কালযাপন করেছিলেন, সেই হাবুঙ্গ নগরের ঐশ্বর্যের চিত্রই বোততার লেখনী মুখে প্রকাশিত হয়েছে, তা সিলেটের চিত্র নয়। (Vide : Assam Buranji PP. 11-14.)

এই হাবুঙ্গনগর দিহিং নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। কারণ ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে আসামের রাজার সগর্ভা ছোট রানিকে সপত্নীর আক্রোশ হতে রক্ষা করবার জন্য বুড়া গোহাঁই ডাঙ্গরিয়া “ভূরত তুলি সেই কুঁঅরিক দিহিঙ্গিত উঠাইদিলে” অর্থাৎ সেই রানিকে ভেলা বান্ধিয়া দিহিং নদীতে ভাসাইয়া দিল; ভেলা এসে হাবুঙ্গ শহরে ঠেকিল। পরিশেষে চুড়াঙ্গমগ (ওরফে বামনী কুঁতর) নামক, ছোটরানির গর্ভসম্ভূত ব্রাহ্মণ প্রতিপালিত রাজা হাবুঙ্গ শহর হতে বাহির হয়ে অরাজকতাপূর্ণ অসমরাজ্যে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে শান্তি স্থাপন করেন। এই সকল ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, কামরূপ রাজ্যে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, বোততার আগমন সময়ে হাবুঙ্গ, একটি অপ্রসিদ্ধ নগর ছিল না। বিশেষতঃ দিহিং নদী বাহিয়া ব্রহ্মপুত্র দিয়ে সোনারগাঁও যাওয়ার পথ খুব প্রশস্ত ছিল। এই অবস্থায় কষ্ট কল্পনার আশ্রয় না নিয়ে সিলেটকে হাবুঙ্গ বা হাবস্ক বলে ধরে নিতে পারি না। যে তিনটি নামের নদী, নগর, ও পীরের নামের সাহায্যে কর্নেল সাহেব আপন মত স্থাপন করতে প্রয়াস পেয়েছেন, তার তিনটিই অসম্ভব কল্পনা। ইবন বোততা সিলেটে পদার্পণ করেন নাই–এটিই আমাদের স্থির সিদ্ধান্ত। অতএব বোততার কাহিনি পরিত্যাগ করলেও ১৩৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দে শাহ্‌জলাল সিলেটে এসেছিলেন বলে স্থির করলে, বর্তমান জ্ঞাত অপর কোনও প্রকৃষ্ট প্রমাণ আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হতে পারে না।

শিলালিপি

শাহ্‌জলালের মন্দিরে আজ পর্যন্ত সাতটি প্রস্তর ফলক পাওয়া গিয়েছে। প্রথমটি য়ুসুফশাহী শিলালিপ বলে অভিহিত হয়। য়ুসুফশাহী লিপি সুন্দর তুগ্রা অক্ষরে লিখিত, এর অনেক অংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে, যা পড়িতে পাওয়া যায় তার অনুবাদ এইরূপ, “Abu Muzaffar yusuf Shah, son of Barbekshah the king, son of Mahumud Shah, the king, may God perpetuate his rule and kingdom! And the builder is the great and exalted Majlis, the Wazır (Dastur) who excells himself in good deeds and pious acts the Majlis-i- Ala may God preserve him against the evils end..”

উপরে ব্রোকম্যান সাহেবের অনুবাদ প্রদত্ত হল। শিলালিপির অবিশিষ্ট অংশ, ফুলার সাহেবের আদেশে ও গভর্নমেন্টের ব্যয়ে প্রাচীরগাত্র হতে সম্প্রতি বাহির করা হয়েছে। তাতে এই প্রমাণ হয় যে ৮৭৫ হিঃ অব্দে ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দে য়ুসুফসা যখন সিলেটের নবাব ছিলেন তখন তার আদেশে এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। এই লিপিতে বর্ণিত মন্দির নির্মাণকারী ‘মজলিস’ কে? শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মজুমদার মহাশয় লিখেছেন যে, “কথিত আছে দিল্লির আকবর শাহ্‌ ঈশাখাকে ‘মসনদ আলী’ উপাধি প্রদান করে দ্বাদশ পরিষদ সহ এতদ্দেশে (ময়মনসিংহ অঞ্চলে) প্রেরণ করেন। এই দ্বাদশজন মধ্যে চারজন গাজি ও চারিজন মজলিস বংশীয় পরিষদ ছিল। ঈশাখাঁর মৃত্যুর পর গাজিগণ সেরপুর ও ভাওয়াল পরগণা এবং মজলিসগণ নসিরাজিয়াল ও খালিয়াজুরী পরগণা গ্রহণ করেন। (ময়মনসিংহের বিবরণ ২৭ পৃ.)

খালিয়াজুরী পরগণা সরকার ‘বাজুহা’র ভিতরে ছিল এবং সরকার বাজুহার অংশবিশেষ সিলেটের অন্তর্গত ছিল। (J.A.S.B. 1873.). সিলেটের দরগা নির্মাণকারী প্রতাপশালী মজলিস ঈশা খাঁর সমকালীন লোক বলে প্রচলিত কথা, হয়ত, ভিত্তিহীন হবে। দ্বিতীয় শিলালিপি হুসেন শাহের সময়ে ৯১১ হিজিরিতে (১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে) খোদিত হয়, এর অনুবাদ এইরূপ, “In the name of God, the merciful and the element! He who ordered the erection of this blessed building attached to the house of benefit (Silhat) may God protect it against the ravages of them! is the devotee, the high, the great Sheikh Jalal, the hermit of Kanye-May God Alumightly sanctify his dear secret! It was built diring the reign of Sultan ‘Alauddunya Waddin Abu Muzaffar Hussain Shah, the king. by the great Khan, the exalted Khaqan, Khatic Khan, Keeper of the word robe outside the palace, Commander and Wazir of the District Muazzamabad in the year 911 (A.D. 1505).” (Vide : Pathan kings P. 253.).

এই লিপিতে বর্ণিত মুয়াজমাবাদ শহরে বাংলার সাতটি টাকশালার অন্যতম টাকশালা ছিল। সুলতান সিকন্দর কর্তৃক এই নগর ৭৫৮-৫৯ হিজরিতে অর্থাৎ ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল বলে টমাস সাহেব অনুমান করেন। এটি সম্ভবপর, কারণ ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে সিলেট বিজয়ের পরে অল্পকালের মধ্যে সুলতান সিকন্দরের নৌকা “ভাটি” অঞ্চলে জলমগ্ন হয়েছিল ‘সুহেল-ই-এমন’ গ্রন্থে এইরূপ বর্ণনা আছে। এই ঘটনা নসিরুদ্দিন চিরাগীর মৃত্যুর পরে ঘটিয়াছিল। মুয়াজমাবাদ সোনারগাঁয়ের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ছিল, এবং ‘ভাটি’, প্রদেশেও (সিলেট ও ময়মনসিংহের মধ্যবর্তী জলাভূমি) সোনারগাঁয়ের পূর্বেই, অবস্থিত রয়েছে।

মুয়াজমাবাদ কোথায় অবস্থিত তা ঠিক হয়নি। ৭৬০ হিজরিতে এটি “ইক্লিম মুয়াজমাবাদ” বলে কথিত হত, এবং ৭৮০ হিজরিতে এটি ইলমুয়াজন মুয়াজনাবাদ বলদাই” অর্থাৎ “মহানগরী মুয়াজমাবাদে” পরিণত হয়। Blochmann সাহেব বলেন, “The name occurs on coins and on Sunergaon inscriptions, once in conjunction with Laur, and once with Tipperah and it seems, therefore as if the “Iqlim” extended from the Megna to NE Mymensingh and right bank of the Surma.”

লাউড়ের সাথে মুয়াজমাবাদের নাম কি রকমে যে একত্র লিখিত হত তা বিবেচ্য। অদ্বৈতাচার্য নবগ্রামে ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কুবের পণ্ডিত লাউড়ের রাজা দিব্য সিংহের মন্ত্রী ছিলেন। এই দিব্য সিংহই বৃদ্ধাবস্থায় রাজ্যভার পুত্রের হস্তে সমর্পণ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ‘লাউড়িয়া কৃষ্ণদাস’ নামে বৈষ্ণব সাধক ও লেখকদের ভিতরে একজন প্রধান ব্যক্তি হয়ে উঠেন। অদ্বৈতের বাল্যলীলা শেষ হবার পরে দিব্যসিংহ বানপ্রস্থ অবলম্বন করেন এবং লাউড় রাজ্য তখনও স্বাধীন ছিল, এটি সিলেটের লোকের ধারণা। ইতিহাসেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আকবরের সময়ে লাউড় প্রথম মুসলমান অধিকারভুক্ত হয়, অতএব মুসলমানাধিকৃত মুয়াজামাবাদের তঙ্কায় ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত যে হিন্দু রাজ্য স্বাধীন ছিল তার নাম কেন রয়েছে বোঝা যায়না, এবং ত্রিপুরার নামই বা কেন থাকবে, তারও আলোচনা হওয়া উচিত। তৃতীয় শিলালিপি আরবি অক্ষরে ও পারস্য ভাষায় লিখিত। এর তারিখ জানা যায় না। চতুর্থ শিলালিপি দ্বারা এই প্রমাণ হয় যে, সৈয়দ জলাল নামে জনৈক ব্যক্তি ১০৭৪ হিঃ অব্দে (১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে) একটি মন্দির নির্মাণ করেন। বড় গম্বুজে একটি লিপি খোদিত রয়েছে, তা দ্বারা প্রমাণ হয় যে, ফরহাদ খাঁ ১০৮৮ হিঃ অব্দে, ঐ গম্বুজ তৈরি করেছিলেন। ফরহাদ খাঁ প্রখ্যাত নামা নবাব শায়েস্তা খাঁর অধীনে সিলেটের আমিল নিযুক্ত হন, তৎপরবর্তী নবাব ফেদাই খাঁর ও সুলতান মহম্মদ আজিমের সময়েও তিনি সিলেটের আমিল বা শাসনকর্তা ছিলেন। রায়নগরের গোয়ালিনী ছড়ার উপরে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত পুলে তার শিলালিপি এখনও বিদ্যমান আছে, এবং এই পুলের দ্বারা তাঁর স্মৃতি আজও লোক সমাজে সজীব রয়েছে। এতদ্ব্যতীত সিলেটের আরো নানাস্থানে তৎপ্রতিষ্ঠিত বহুতর স্থাপত্যের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। সিলেটের স্থায়ী সৌন্দর্য বৃদ্ধি কল্পে তাঁর আয়াস ও অর্থব্যয় চিরস্মরণীয়। আর একটি শিলালিপিতে দেখতে পাওয়া যায়, যে বাংলার স্বাধীন নবাব আলিবর্দির আমলে ফৌজদার বাহারাম শাহা ১১৫৭ হিঃ অব্দে দক্ষিণের মন্দিরটি প্রস্তুত করিয়ে দেন। এতদপূর্বে নবাব ঔরঙজেবের আমলে ১১১০ হিঃ অব্দে আমিল মিল আবদুল্লা সিরাজ একটি প্রস্তর নির্মিত মন্দির প্রস্তুত করাইয়া ছিলেন। ঔরঙজীবের রাজত্বে সিলেটে মুসলমান কর্মতৎপরতার পরাকাষ্টা সাধিত হয়েছিল।

শাহ্‌জলালের বিষয় আরো দুই একটি কথা বলা দরকার। একটা কথা আছে যে, শাহ্‌জলাল মজররদের সাথে আরো তিন জন শাহ্‌জলাল সিলেটে এসেছিলেন – (১) শাহ্‌জলাল তাব্রিজি, (২) শাহ্‌জলাল বোখারী, (৩) শাহাজালাল গঞ্জারওয়া। এটি কতদূর সত্য তা বলা যায়না। একজন তাব্রিজির মন্দির পাণ্ডুয়াতে রয়েছে তিনি চিরকুমারের প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন, এটিতে তাঁকে ভিন্ন ব্যক্তি বলে স্বীকার করতে হয়। পরস্তু পাণ্ডুয়ার তাব্রিজির গুরুভক্তির বিষয় যেসকল ঘটনার উল্লেখ আছে মজররদের অনুচর তাব্রিজির বর্ণনাও সেইরূপ। এই অবস্থায় আবার দুই ব্যক্তিকে ভিন্নলোক বলে মনে হয় না। তারপর মজররদের গুরুর গুরু প্রখ্যাতনামা শাহ্‌জলাল বোখারী যে মজররদের অনুচর হয়ে সিলেটে এসেছিলেন তা সম্ভবপর নয়—তবে শাহ্‌জলালের ত্রিশ বছর য়া সিলেটে অবস্থানের সময় দেশ দর্শনের জন্য সিলেটে আসতেও পারেন—এটি অসম্ভব নয়। বিশেষতঃ সাংসারিক সম্বন্ধেও ‘বোখরী’ ‘মঞ্জুররদের’ মাতামহ ছিলেন। বরং রংপুর জেলার কসবা নামক স্থানে একটি প্রাচীন দরগা আছে, এটি জনৈক শাহাজ্জাল বোখারীর সমাধি মন্দির বলে কথিত হয়। মুলতানে ও আগ্রায় আর দুই জন বোখারীর সমাধি রয়েছে বটে, তবে মুলতানের ও আগ্রার বোখারীদের ভিতরে কেউ শাহ্‌জলালের অনুচর ছিলেন না, এটিই আমাদের বিশ্বাস। ‘গঞ্জরওয়া’ যে কে ছিলেন, তাঁর বিষয়ে আমরা বিশেষ কিছু অবগত নহি। সন্দ্বীপ প্রভৃতি অঞ্চলে তার সমাধি রয়েছে বলে কেউ বলে থাকেন।

শাহ্‌জলালের সঙ্গে মলঙ্গের ফৌজ ছিলেন বলে উল্লেখ মাছে। রংপুরের রাজা নীলাম্বর ইসমাইল গাজির অধীনস্থ ফৌজের আক্রমণ হতে স্বরাজ্য রক্ষা করবার জন্য কোমতাপুর হতে ঘোড়াঘাট অবধি বহুতর দুর্গ নির্মাণ করেন, সেই সকল দুর্গ অদ্যাবধি মলঙ্গ দুর্গ বলে কথিত হয়। ইসমাইল গাজি বারবক শাহার অধীনে একজন সেনানায়ক ছিলেন। শাহ্‌জলালের মসজিদে বাংলার নবাব বারবক শাহের সময়ের ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দের খোদিত শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে, অন্যদিকে দিনাজপুর জেলায় গোপালগঞ্জের মসজিদে জনৈক বারবক শাহের নামাঙ্কিত আর একখানি শিলালিপি বাহির হয়েছে, তার তারিখ ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দ। এই অবস্থায় শেষোক্ত বারবক শাহ বলতে বাংলার নবাব ভিন্ন অপর কোনও ব্যক্তিকে বুঝতে হবে। ইসমাইল গাজির কবর দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট নামক স্থানে অবস্থিত রয়েছে। বোধহয় ইসমাইল গাজি দিনাজপুরের বারবক শাহের অধীনস্থ কর্মচারী ছিলেন, এটি সত্য হলে শাহ্‌জলাল ও ইনি এক সময়ের লোক তা আমরা এখন অনেকটা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করতে পারি।

দ্বিতীয়তঃ কেউ কেউ শাহ্‌জলালের সিলেট বিজয়ে গৌড়গোবিন্দের ভীরুতার অপবাদ দিতে পারেন—কিন্তু তা সমীচীন নয়। সমালোচকদের মনে রাখতে হবে যে, শাহ্‌জলাল ও গৌড়গোবিন্দ উভয়েই প্রাচ্যদেশের অধিবাসী। সত্যপ্রিয়তা ও ব্যক্তিগত বীরত্বের সম্মান চিরকালই এদেশে আদর্শ স্থানীয় বলে আদৃত হয়ে আসছে। ইতিহাসে দেখা যায় যে অনেক যুদ্ধের মীমাংসাই দ্বন্দ্ব যুদ্ধে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। যারা এগারসিন্ধুর দুর্বার প্রাঙ্গণভূমে হিন্দুস্থান বিজয়ী বীর মানসিংহের লাঞ্ছনার কথা জানেন, তারা গৌড়গোবিন্দকে ভীরুতার অপবাদ দিতে পারেন না। মুসলমানেরা লৌহধনুতে গুণযোজনা করতে পারলে হিন্দুরাজা পরাজয় স্বীকার করবেন—এইরূপ ‘বাজি’ রেখে শেষে তথা পালন করতে গিয়ে গৌড়গোবিন্দ হিন্দুর সত্যপ্রিয়তা, বীরত্বের আদর ও ত্যাগ স্বীকারের এমন একটি সুরম্যচিত্র ব্যক্তিগত জীবনে ফুটিয়ে তুলেছেন তা বস্তুতঃ গৌরবের জিনিস।

শাহ্‌জলাল মজবরূদ (১) ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন, ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে, (২) সুলতান সিকন্দর ও নসিরুদ্দিন চিরাগীর একযোগে সিলেট জয় করেন, (৩) শ্রীহটে ৩০ বছর কাল জীবিত থাকিয়া ১৩৮৪ খ্রিস্টাব্দে ৭৮ বছর বয়সে প্রাণত্যাগ করেন। এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হলে প্রচলিত কাহিনির অধিকাংশের সাথে কোনও বিরোধ থাকে না। শাহ্‌জলালের এটিই প্রকৃত ইতিহাস তিনি Suhail-i-yemen গ্রন্থানুযায়ী— ৫৬১ হিজরীতে প্রাণত্যাগ করেননি। ইবন বোততার সাথে তাঁর সিলেটে সাক্ষাত হয়নি। তার পূর্বেও সিলেটে মুসলমান ছিল। তিনি সিলেটে সর্বপ্রধান স্থায়ী মহম্মদীয় ধর্মপ্রচারক, সর্বপ্রথম আগন্তুক নন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.