মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্ট

ভূমিকা

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিলগ্রাম অবিডিয়েন্স টু অথোরিটি বা অথোরিটি বা কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য নিয়ে বেশি কিছু সোশ্যাল সাইকোলজি এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন, এগুলোই মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্টস নামে পরিচিত। গবেষণাগুলোতে বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিভিন্ন পেশার পুরুষদেরকে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়, পরীক্ষাগুলোতে দেখা হয় কোন অথোরিটি ফিগার যদি তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে কোন কাজ করতে ইনস্ট্রাকশন দেয়, তাহলে তাদের সেই কাজ করার প্রতি কেমন ইচ্ছা কাজ করে। পার্টিসিপেন্টদের এই বিশ্বাস করানো হয় যে তারা একটি এক্সপেরিমেন্টে হেল্প করছে, যার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই, সেখানে তাদেরকে একজন “লার্নার”কে ইলেক্ট্রিক শক দিতে হবে, আর সেই ফেইক ইলেক্ট্রিক শকের (তাদেরকে বলা হয়েছে রিয়াল) মাত্রা বাড়তে বাড়তে এমন মাত্রায় পৌঁছবে যা সেই শক রিয়াল হলে সেই “লার্নার” মৃত্যুবরণ করত। এক্সপেরিমেন্টগুলোতে পাওয়া গেল উচ্চ সংখ্যক মানুষ অনিচ্ছুকভাবে হলেও অথোরিটি ফিগারের ইনস্ট্রাকশন পুরোপুরি ফলো করে। ১৯৬৩ সালে মিলগ্রাম প্রথম গবেষণার ফল প্রকাশ করেন, ১৯৭৪ সালে তার গ্রন্থ অবিডিয়েন্স টু অথোরিটি : এন এক্সপেরিমেন্টাল ভিউ-তে তিনি তার গবেষণার ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা করেন। ১৯৬১ সালে এক্সপেরিমেন্টগুলো সংঘটিত হয় ইয়েল ইউনিভার্সিটির লিন্সলি-চিটেনডেন হলে, জেরুজালেমে নাৎসি ওয়ার ক্রিমিনাল এডলফ আইকমানের ট্রায়ালের তিন মাস পর। সেই সময় একটা প্রশ্ন প্রিন্ট মিডিয়া জুরে ঘুরে ঘুরে আসছিল – “এমন কি হতে পারে যে, আইকম্যান আর তার মিলিয়ন সঙ্গীরা যে হলোকাস্ট বা ইহুদি গণহত্যা ঘটাতে সাহায্য করেছিল তা কি কেবলই অর্ডার ফলো করছিল? তাদের প্রত্যেককেই কি আমরা হত্যায় সহযোগী বা একমপ্লিস বলতে পারি?” মিলগ্রামকে এই প্রশ্ন ভাবায়, তিনি জেনোসাইডের এই সাইকোলজি ব্যাখ্যা করতে চান, আর তারপর তার বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা শুরু করেন। তার সেই এক্সপেরিমেন্ট অনেকবার বিশ্বের অনেক জায়গায় সংঘটিত হয়েছে পরবর্তীকালে, প্রত্যেকবার একই রেজাল্ট এসেছে।

পরীক্ষা পদ্ধতি

যাই হোক, প্রশ্ন হচ্ছে এই এক্সপেরিমেন্টটা কীভাবে করা হয়েছিল। এক্সপেরিমেন্টের বিষয় হচ্ছে মানুষের আনুগত্য পরীক্ষা করা, একজন মানুষ কোন অথোরিটি ফিগারের প্রতি অনুগত হতে গিয়ে কতটা অনৈতিক হতে পারে, কতটা বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্মম কাজ করতে পারে সেটা বের করা। আর এটা করতে হলে অবশ্যই যাকে নিয়ে পরীক্ষাটি করা হচ্ছে, মানে পরীক্ষার সাবজেক্টের সাথে ছলনার আশ্রয় নিতে হবে, কারণ অবশ্যই তাকে জানতে দেয়া যাবে না যে তাকে দিয়েই একজন অথোরিটি ফিগারের নির্দেশনায় অনৈতিক কাজ করা হচ্ছে। আর পরীক্ষণের সময় তো আর অনৈতিক কাজ করা যায়না, অবশ্যই এখানে কোন অনৈতিক কাজের অভিনয় জড়িত থাকতে হবে, যেখানে সাবজেক্ট বা যে ব্যক্তির আনুগত্য নিয়ে পরীক্ষাটি হচ্ছে সেই ব্যক্তি এই অভিনয়ের ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও টের পাবেন না, তিনি জানবেন যে তিনি আসলেই অথোরিটি ফিগারের আদেশে বিবেক বিরোধী কাজ করছেন। এবার এই কন্ডিশনগুলো মাথায় রেখে এক্সপেরিমেন্টের ডিজাইনের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। মিলগ্রাম চমৎকারভাবে এক্সপেরিমেন্টটা ডিজাইন করলেন। এক্সপেরিমেন্টে তিনজন মানুষ থাকবেন – এক্সপেরিমেন্টর, সাবজেক্ট আর এক্টর। মানে এক্সপেরিমেন্টে এক্সপেরিমেন্টর বা পরীক্ষক ছাড়াও একজন থাকবেন এক্টর বা অভিনেতা, আরেকজন হবেন সাবজেক্ট হিসেবে যার আনুগত্য নিয়ে এক্সপেরিমেন্টটা করা হবে। এদেরকে নির্বাচন করা হলো। এরপর অভিনেতাকে এক্সপেরিমেন্টের পরিকল্পনা সম্পর্কে আর কিভাবে অভিনয় করতে হবে সে সম্পর্কে সবটা জানানো হলো। পরীক্ষার দিনে অভিনেতা ও সাবজেক্ট উভয়কেই গবেষণাগারে আসতে হবে। উভয়কেই পরীক্ষার ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আসতে বলা হয়েছে, অভিনেতা জানেন তিনি কী করবেন, কিন্তু সাবজেক্ট জানেন অন্য কিছু। তাকে জানানো হয়েছে যে এই গবেষণাটি হচ্ছে মেমোরি ও লার্নিং সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা। এই গবেষণায় দেখা হবে যে পানিশমেন্ট বা শাস্তি কোন ব্যক্তির মুখস্থ করার সামর্থকে বৃদ্ধি করে কিনা। আর এই পানিশমেন্টটা হচ্ছে ইলেক্ট্রিক শক। যে দুজন এসেছেন তাদের একজনকে টিচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে, আরেকজনকে লার্নারের ভূমিকায়। লার্নারকে মুখস্ত করার পরীক্ষা দেবে আর তার ভুল হলে টিচার তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে পানিশ করবেন। কে কোন ভূমিকা পাবেন তা ঠিক করার জন্য তাদেরকে চিরকুট তুলতে দেয়া হলো, সাবজেক্ট তো জানেননা যে তিনি যে চিরকুটই তুলুন না কেন, তার ভূমিকা টিচারেরই, কেননা দুটো চিরকুটেই “টিচার”-ই লেখা ছিল। অভিনেতা আগ বাড়িয়ে বললেন, তার কপালে লার্নারের ভূমিকা জুটেছে, তাকেই ইলেক্ট্রিক শকের মধ্য দিয়ে যেতে হবে আর যথারীতি সাবজেক্ট টিচারের ভূমিকায়।

এবারে টিচার আর লার্নারকে পাশাপাশি দুটো ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে যেখানে লার্নারকে ইলেক্ট্রিক চেয়ারের মতো কিছু একটার সাথে বেঁধে দেয়া হলো। এক্সপেরিমেন্টার ল্যাব কোট পরে অথোরিটি ফিগার সজে টিচার বা আসল সাবজেক্টকে বললেন তাকে লার্নারকে বেঁধে রাখা হয়েছে যাতে পানিশমেন্ট পেয়ে সে পালিয়ে যেতে না পারে। টিচারকে একটি স্যাম্পল ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হয়, যাতে এক্সপেরিমেন্টের প্রথমে টিচার বুঝতে পারে যে লার্নার যে ইলেক্ট্রিক শক নিতে যাচ্ছেন তাতে কেমন লাগে। যাই হোক, টিচার ও লার্নার দুটো আলাদা রুমে থাকলেও তারা একে অপরের সাথে কথা বলতে পারেন, কিন্তু কেউ কাউকে দেখতে পারেননা। টিচারকে, অর্থাৎ এক্সপেরিমেন্টের সাবজেক্টকে ওয়ার্ড পেয়ার বা শব্দ-জোরের লিস্ট দেয়া হলো, মানে লিস্টের প্রতিটি শব্দ জোরায় জোরায় আছে। তিনি এই জোরায় জোরায় শব্দগুলো লার্নারকে শোনাবেন, লার্নারকে তা মনে রাখতে হবে। এরপর তিনি জোরার একটি শব্দ উচ্চারণ করে লার্নারকে চারটে অপশন দেবেন, লার্নার বাটন প্রেস করে চারটির একটি নির্বাচন করবেন, যা টিচারের কাছে চলে আসবে। যদি উত্তর সঠিক হয় তাহলে টিচার নতুন প্রশ্নে চলে যাবেন, আর যদি ভুল হয় তাহলে তিনি লার্নারকে ইলেক্ট্রিক শক প্রদান করবেন। ইলেকট্রিক শক প্রদানের ক্ষেত্রে মোট ১৫ ভোল্ট থেকে ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত মোট ৩০টি বোতাম আছে, প্রতিটির ক্ষেত্রে ১৫ ভোল্ট করে শকের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, মানে ১৫, ৩০, ৪৫… এভাবে ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত। এগুলোতে কথায় স্লাইট শক থেকে সিভিয়ার শক পর্যন্ত কথাগুলো লেখা আছে, মানে টিচার বা সাবজেক্ট শক দেবার সময় জানতে পারছেন যে তিনি যে শকটা লার্নারকে দিচ্ছেন তা কতটা মারাত্মক। কথা হলো, টিচার যদিও বা মনে করছেন যে তিনি সত্যি সত্যি ইলেক্ট্রিক শক দিচ্ছেন, আসলে এগুলো ফেইক শক মাত্র। প্রতিটি শকের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা সাউন্ড হয়, সেই সাউন্ড আগেভাগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল, প্রতিটি শকের ক্ষেত্রে সেই সাউন্ড বাজানো হয়, লার্নারও বুঝতে পারে কী মাত্রার শক দেয়া হচ্ছে, আর তার ওপর ভিত্তি করে তিনি ব্যাথা পাবার অভিনয় করেন। লার্নার ইচ্ছা করেই প্রশ্নগুলোর ভুল উত্তর দিতে থাকেন, আর টিচারও ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বর্ধিত মাত্রায় ইলেক্ট্রিক শক দিতে থাকেন। শক পেয়ে লার্নার বা অভিনেতা রেসপন্স করেন, প্রতিবাদ করেন, যেমন তিনি শকের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে তার চিৎকারের মাত্রা বৃদ্ধি করেন, যে দেয়ালটি লার্নারকে টিচারের থেকে পৃথক রেখেছে তাতে বারবার আঘাত করতে থাকেন। কিন্তু এসবের পরও টিচার বা সাবজেক্টকে শকের মাত্রা বৃদ্ধি করে করে শক দিতে হবে।

ইনস্ট্রাকশন অনুসারে, ইলেক্ট্রিক শকের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে লার্নার বা অভিনেতা প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদের মাত্রা বৃদ্ধি করতে থাকে। দশম শকের পর, অর্থাৎ ১৫০ ভোল্ট শকের পর লার্নার বা অভিনেতা তাকে ছেড়ে দিতে দাবি করতে শুরু করে। লার্নারের এরকম প্রতিক্রিয়া দেখে টিচার বা সাবজেক্টও প্রতিক্রিয়া জানান, তিনি আর এগোতে চাননা। কিন্তু এক্সপেরিমেন্টরদেরকেও তাদের ভূমিকা শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। টিচারের প্রতি এক্সপেরিমেন্টার বা পরীক্ষক কী কী বলবেন তাকে চারটা ধাপে ভাগ করা যায়। টিচার যদি পরীক্ষাটি এগিয়ে নিয়ে যেতে নিরুৎসাহ দেখায় তাহলে প্রথম ধাপে পরীক্ষক বলবেন, “অনুগ্রহপূর্বক চালিয়ে যান”। যদি তাতেও কাজ না হয়, তাহলে পরীক্ষক দ্বিতীয় ধাপে বলবেন, “এই পরীক্ষাটির সার্থক হবার জন্য আপনার কাজটি চালিয়ে যাওয়াটা দরকার”, তাতে কাজ না হলে তিনি তৃতীয় ধাপে বলবেন, “আপনার এই কাজটি চালিয়ে যাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ”, তাতেও কাজ না হলে পরীক্ষক চতুর্থ ধাপে বলবেন, “আপনার হাতে আর কোন অপশন নেই, আপনাকে পরীক্ষাটি চালিয়ে যেতে হবে”। এবারেও যদি টিচার চালিয়ে যেতে না চান তাহলে পরীক্ষাটি সেখানেই শেষ, তা নাহলে পরীক্ষাটি সর্বোচ্চ মাত্রার ইলেক্ট্রিক শক ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্তই চলবে। এই চারটি ধাপ ছাড়াও পরীক্ষকদেরকে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে কী কী বলতে হবে তাও শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। যেমন টিচার যদি জিজ্ঞেস করেন, এক্ষেত্রে লার্নারের কোন স্থায়ী ক্ষতি হবে কিনা, তাহলে পরীক্ষক তাকে বলবেন, “এই শক পেইনফুল হলেও এতে কোন পারমানেন্ট টিস্যু ড্যামেজ হবে না, তাই অনুগ্রহপূর্বক চালিয়ে যান”। যদি টিচার বলেন, “লার্নার স্পষ্টভাবে পরীক্ষা থামিয়ে দিতে বলছেন”, তখন পরীক্ষক বলবেন, “লার্নার চাক বা না চাক, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি সকল ওয়ার্ড পেয়ার ঠিকভাবে শিখছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে পরীক্ষাটি চালিয়ে যেতে হবে, তাই অনুগ্রহপূর্বক চালিয়ে যান।” ইনস্ট্রাকশন অনুসারে ২০ নং শকের পর থেকে, অর্থাৎ ৩০০ ভোল্ট শকের পর থেকে লার্নার ব্যাথা পায় ঠিকই, কিন্তু উত্তর দেয়া বন্ধ করে দেয়। টিচার বা সাবজেক্ট তা দেখতে পেয়ে যদি বলেন, লার্নার আর উত্তর দিচ্ছে না, পরীক্ষা বন্ধ করে দিন, তখন এক্সপেরিমেন্টর বলেন, কোন উত্তর না দিলে একটা নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করার পর ভুল উত্তর ধরে নিয়ে শকের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে। যাই হোক, ইতিমধ্যে বলা হয়েছে যে, চতুর্থ ধাপের পরও যদি টিচার বা সাবজেক্ট গবেষণা চালিয়ে যেতে না চান তাহলে পরীক্ষাটি সেখানেই শেষ, তা নাহলে পরীক্ষাটি সর্বোচ্চ মাত্রার ইলেক্ট্রিক শক ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্তই চলবে। ইনস্ট্রাকশন অনুসারে, সর্বোচ্চ মাত্রা ৪৫০ ভোল্টে লার্নার বা অভিনেতা কোন রকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে একেবারে চুপ হয়ে যান। টিচারকে তখন বলা হয় ৪৫০ ভোট দিয়ে পরপর তিনবার টেস্ট করতে। যথারীতি একবারও লার্নার বা অভিনেতা কোনরকম সাড়াশব্দ দেন না। এবারে পরীক্ষাটি সমাপ্ত হয়।

প্রেডিকশন, ফলাফল ও জেনোসাইড সাইকোলজির প্রতিফলন (?)

এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনার পূর্বে মিলগ্রাম ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌদ্ধ জন সিনিয়র ইয়ার সাইকোলজি মেজোরকে ডেকে এনে একটা পোল করেছিলেন, প্রশ্ন ছিল এই এক্সপেরিমেন্টের রেজাল্ট কী হবে বলে তারা মনে করে, ১০০ জন সাবজেক্টের মধ্যে কত জন লার্নারকে সর্বোচ্চ অর্থাৎ ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত শক দেবেন। এদের কারও প্রেডিকশনই ১০০ জনের মধ্যে ৩ জনের ওপর ওঠেনি, গড় রেজাল্ট ছিল ১.২ জন মাত্র, মানে এদের মতে মাত্র ১.২% লোক, ৪৫০ ভোল্ট অব্দি যাবেন। মিলগ্রাম তার কলিগদের নিয়ে একটি ইনফর্মাল পোল করেন এই বিষয়েই, তারাও মএন করে খুব কম সাবজেক্টই খুব শক্তিশালী শক অতিক্রম করবেন। তিনি মেডিকেল স্কুল থেকে চল্লিশ জন সাইকিয়াট্রিস্ট নিয়েও এই পোল করলেন, আর তারা বললেন, ১০ম শকের পর যখন লার্নার তাকে ছেড়ে দিতে বলতে শুরু করবেন তখনই বেশিরভাগ সাবজেক্ট এক্সপেরিমেন্ট থামিয়ে দেবেন, আর ৩০০ ভোল্টের পর লার্নার উত্তর দেয়া বন্ধ করার পরও মাত্র ৩.৭৩ শতাংশ লোক এক্সপেরিমেন্টটি চালিয়ে যাবেন। অনেকে বললেন মাত্র ১০% সাবজেক্ট ৪৫০ ভোল্ট অব্দি যাবে। মিলগ্রাম ব্যক্তিগতভাবে মনে করতেন আমারিকান পার্টিসিপেন্ট ও জার্মান পার্টিসিপেন্টদের মধ্যে এই বিষয়ে পার্থক্য থাকবে, আমেরিকানরা জার্মানদের থেকে অনেক কম অবিডিয়েন্স দেখাবে। আর এভারেজ জার্মানদের আচরণই যেহেতু নাৎসিদের আচরণের সবচেয়ে কাছাকাছি হবে তাই আমেরিকানদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনার পর জার্মানদের নিয়ে এই এক্সপেরিমেন্টটা করতে হবে। কিন্তু আমেরিকানদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার পর তিনি এতটাই অপ্রত্যাশিত ফলাফল পেলেন যে, পরে জার্মানদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ইচ্ছা বাতিল করেন। প্রশ্ন হলো, কী ছিল এই অপ্রত্যাশিত ফলাফল…

মিলগ্রাম তার এই প্রথম এক্সপেরিমেন্টে ৪০ জন সাবজেক্টকে নিয়ে কাজ করেন, এদের মধ্যে ২৬ জনই, অর্থাৎ ৬৫%-ই সর্বোচ্চ ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত শক প্রদান করেন, আর প্রত্যেকেই, মানে ১০০% সাবজেক্টই অন্তত ৩০০ ভোল্ট শক প্রদান করেন, উল্লেখ্য ১৫০ ভোল্টের পর থেকেই লার্নাররা কিন্তু তাদেরকে ছেড়ে দেবার জন্য চিৎকার করছিলেন, আর ৩০০ ভোল্টের পর তারা প্রশ্নের উত্তর দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মিলগ্রাম উল্লেখ করেন, এই সাবজেক্টরা এই এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যেতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন, তারা বিভিন্ন মাত্রার টেনশন ও স্ট্রেস শো করছিলেন, এর সাইনগুলোর মধ্যে ছিল ঘামা, কাঁপা, তোতলানো, ঠোঁট কামড়ানো, গোঙ্গানো, চামড়ায় নোখ দিয়ে আঁচড়ানো, আর কেউ কেউ নার্ভাস হয়ে হাসছিলেন (নার্ভাস লাফিং), আবার কারও মধ্যে খিঁচুনি বা সিজারও দেখা গিয়েছিল। ১৪ জনের মধ্যে নার্ভাস লাফিং বা নার্ভাস স্মাইলিং এর স্পষ্ট সাইন দেখা গেছ। প্রত্যেক পার্টিসিপেন্টই অন্তত একবার এই এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কিন্তু এক্সপেরিমেন্টর তাদেরকে আশ্বস্ত করার পর বেশিরভাগই এক্সপেরিমেন্টটি চালিয়ে যান। কোন কোন সাবজেক্ট বলেছিলেন এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহণ করার জন্য তারা যে অর্থ পাচ্ছেন তা তারা ফিরিয়ে দেবেন।

মিলগ্রাম তার ১৯৭৪ সালের আর্টিকেল “দ্য পেরিলস অফ অবিডিয়েন্স”-এ লেখেন, “অবিডিয়েন্স বা আনুগত্যের আইনগত ও দার্শনিক দিকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু (আইন ও দর্শনের লোকেদের) বেশিরভাগই এটা দেখেন না যে আসল পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষ কিরকম আচরণ করেন। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে আমি কেবলই একটা সিম্পল এক্সপেরিমেন্ট সেটাপ করেছিলাম, কেবল এটা জানতে যে একজন সাধারণ নাগরিক একজন এক্সপেরিমেন্টাল সাইন্টিস্টের নির্দেশের কারণে আরেকজন ব্যক্তিকে কতটা ব্যাথা দিতে পারেন। আর গবেষণায় দেখা গেল, অন্যকে আঘাত না করার শক্তিশালী নীতিবোধের বিরুদ্ধে খুবই দৃঢ় অথোরিটি প্রোথিত হয়ে আছে, আর সাবজেক্টদের কানে বারবার ভিক্টিমদের আর্তচিৎকার বাজলেও বেশিরভাগের ক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত অথোরিটিই জয়লাভ করছে। গবেষণাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে যে, কেবল অথোরিটির আদেশের কারণে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কতটা দূর যেতে পারে, আর খুব দ্রুত ব্যাখ্যার দাবি রাখে। সাধারণ মানুষের কাছে এটা কেবলই একটা চাকরির মতো, এখানে তারা যদি কোন হুমকির মুখে না পড়ে তবে তারা ভয়াবহ ধ্বংসকারী প্রক্রিয়ার এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে। এমনকি তাদের এই কাজের ধ্বংসাত্মক পরিণাম যদি তাদের কাছে খুব স্পষ্টও হয়ে ওঠে, বা এই কাজ যদি তাদের ফান্ডামেন্টাল মোরাল স্ট্যান্ডার্ডের সম্পূর্ণ পরিপন্থীও হয় তারপর অনেক কম লোকেরই সেই অথোরিটির প্রভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকবে।”

পরবর্তীতে মিলগ্রাম ও অন্যান্য সাইকোলজিস্টগণ বিশ্বজুড়ে এই এক্সপেরিমেন্টের বিভিন্ন ভেরিয়েশন নিয়ে কাজ করেন। এরপর মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্টটি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে না করে তার নিকটে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের একটি অফিসে করেন, এটা দেখার জন্য যে তাতে অবডিয়েন্সের মাত্রায় কতটা পরিবর্তন আসে। দেখা গেল তাতে অবিডিয়েন্স হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু  খুব একটা কমেনি। মিলগ্রাম বলেছিলেন, গবেষণায় যেসব সাবজেক্ট লার্নারকে ফাইনাল শক দিতে অস্বীকার করেছেন তারাও কখনও গবেষণাটি বন্ধ করতে জোর করেননি, তাছাড়া তাদের কেউই এক্সপেরিমেন্টরের অনুমতি ছাড়া ভিক্টিমের অবস্থা চেক করার জন্য তাদের কক্ষও ত্যাগ করেননি, অর্থাৎ অবিডিয়েন্সের বিরুদ্ধে গিয়ে ভিক্টিমকে আঘাত করা তারা বন্ধ করলেও তার অবিডিয়েন্স কখনও পুরোপুরি দূর হয়নি। মিলগ্রাম এই এক্সপেরিমেন্ট ও তার রেজাল্ট নিয়ে “অবিডিয়েন্স” নামক একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছলেন। তিনি পাঁচটি সোশ্যাল সাইকোলজি ফিল্মের সিরিজও তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে কয়েকটি এই এক্সপেরিমেন্টগুলো নিয়েই ছিল। মিলগ্রামের এক্সপেরিমেন্টের বিভিন্ন ভেরিয়েশনগুলো হচ্ছে –

  • “অবিডিয়েন্স টু অথোরিটি : অ্যান এক্সপেরিমেন্টাল ভিউ” (১৯৭৪) গ্রন্থে মিলগ্রাম তার এক্সপেরিমেন্টের ১৯টি ভেরিয়েশনের কথা বর্ণনা করেছেন। কয়েকটা এক্সপেরিমেন্টে পার্টিসিপেন্ট ও লার্নারের মধ্যে বিভিন্ন রকম দূরত্ব নিয়ে গবেষণা করা হয়। দেখা যায়, পার্টিসিপেন্ট লার্নারের যত কাছাকাছি থাকে, অথোরিটি ফিগারের প্রতি তাদের আনুগত্য তত হ্রাস পায়। লার্নার ও সাবজেক্টের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানের এক্সপেরিমেন্টের ক্ষেত্রে সাবজেক্টকে লার্নারের হাত ধরে শক প্লেটে নিয়ে যেতে হতো, ইলেকট্রিক শক দেয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে মাত্র ৩০% সাবজেক্ট এক্সপেরিমেন্টটি কমপ্লিট করতে পেরেছিলেন।
  • এদিকে এক্সপেরিমেন্টার যদি সাবজেক্ট থেকে দূরে অবস্থান করে তাহলেও আনুগত্য হ্রাস পায়, যেমন দ্বিতীয় এক্সপেরিমেন্টে এক্সপেরিমেন্টর টেলিফোনে সাবজেক্টকে ইনস্ট্রাকশন প্রদান করেন। তাতে সাবজেক্টের আনুগত্য ২১% হ্রাস পায়, কোন কোন সাবজেক্ট এক্সপেরিমেন্টারের সাথে ছলনার আশ্রয় নেয়, তারা এক্সপেরিমেন্ট করেননি, কিন্তু ভান এক্সপেরিমেন্টটি শেষ করার ভান করেছেন।
  • অষ্টম এক্সপেরিমেন্টে সকল লার্নার নারী ছিলেন আর সকল সাবজেক্টচ ছিলেন পুরুষ। এতে অবিডিয়েন্সে খুব একটা তারতম্য ঘটেনি, যদিও নারীরা অধিক মাত্রায় স্ট্রেস দেখাচ্ছিলেন।
  • ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিজস্ব প্রেস্টিজ ছিল। সেটা দূর করার জন্য কানেক্টিকাটের ব্রিজপোর্টের “রিসার্চ এসোসিয়েটস অফ ব্রিজপোর্ট” নামে একটা অফিসে এক্সপেরিমেন্টটি করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল যে, ইয়েল ইউনিভার্সিটির প্রেস্টিজের প্রভাবটা বাদ দিলে আনুগত্য কতটা হ্রাস পায়। দেখা যায় এক্ষেত্রে আনুগত্য ৪৭.৫% হ্রাস পেয়েছে, যদিও পার্থক্যটা স্ট্যাটিস্টিকালি সিগনিফিক্যান্ট ছিলনা।
  • মিলগ্রাম অথোরিটির সাথে কনফর্মিটির এফেক্ট কম্বাইন করেও কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট করেন। সেই এক্সপেরিমেন্টগুলোতে পার্টিসিপেন্টদের সাথে আরও একজন বা দুইজন অতিরিক্ত ‘টিচার’ অংশগ্রহণ করেছিলেন, এরাও লার্নারের মতই অভিনেতা ছিলেন। এদেরকে কখনও বলা হয়েছিল শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাটি চালিয়ে যেতে, আবার কখনও বলা হয়েছিল পরীক্ষাটি বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে না যেতে অর্থাৎ আনুগত্য প্রদর্শন না করতে, আর তার প্রভাবে সাবজেক্ট কিরকম আচরণ করেন, অর্থাৎ অন্য টিচারদের দেখে তার আনুগত্য কতটা প্রভাবিত হয় তা দেখার উদ্দেশ্যই ছিল মিলগ্রামের। দেখা যায় এতে রেজাল্ট অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। ১৭ নং এক্সপেরিমেন্টে দুজন অভিনেতা টিচার আনুগত্য প্রদর্শন করতে অস্বীকার করেন, এর ফলে দেখা যায় ৪০ জন পার্টিসিপেন্ট এর মধ্যে মাত্র ৪ জন এক্সপেরিমেন্টটি শেষ পর্যন্ত নিয়ে যান। ১৮ নং এক্সপেরিমেন্টে পার্টিসিপেন্ট আরেকজন টিচারের সাথে একটি সাবসিডারি টাস্কে অংশ নেন (যেমন একসাথে মাইক্রোফোনে প্রশ্ন পড়া বা লার্নারের উত্তর রেকর্ড করা), সেই আরেকজন টিচার পুরোপুরি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন। দেখা যায় এক্ষেত্রে ৪০ জন পার্টিসিপেন্ট এর মধ্যে ৩৭ জনই এক্সপেরিমেন্টটি সমাপ্ত করেন, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য প্রকাশ করেন।
  • মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্লস শেরিডান ও ক্যালিফোর্নিয়ার রিচার্ড কিং, হাইপোথেসাইজ করেন যে মিলগ্রামের সাবজেক্টদের কেউ কেউ বুঝে যান যে লার্নার আসলে ব্যাথার অভিনয় করছেন। তাই তারা অভিনেতার জায়গায় রিয়াল ভিক্টিম নিয়ে এক্সপেরিমেন্টটি করেন, অবশ্যই এই রিয়েল ভিক্টিম মানুষ ছিলেন না, বরং ছিল একটি কিউট ফ্লাফি কুকুরের ছানা। দেখা গেল এক্ষেত্রেও এক্সপেরিমেন্টের ফল মিলগ্রামের এক্সপেরিমেন্টের মতই ছিল, পুরুষের মধ্যে ১৩ জনের মধ্যে ৭ জন এক্সপেরিমেন্টটি পুরোপুরি চালিয়ে নিয়ে যান, আর নারীদের মধ্যে ১৩ জনই এক্সপেরিমেন্টটি পুরোপুরি চালিয়ে যান। অনেক সাবজেক্ট উচ্চমাত্রার ডিস্ট্রেস দেখান, কেউ কেউ প্রকাশ্যে কাঁদেন। এছাড়া শেরিডেন ও কিং দেখেন যে শকের মাত্রা যত বৃদ্ধি পায় শকের সময় কাল তত হ্রাস পায়, অর্থাৎ পার্টিসিপেন্টরা তত বেশি হেজিটেন্ট হতে থাকেন।

এই গবেষণাটি নিয়ে তদকালীন সংবাদ মাধ্যমে বেশ তোলপাড় শুরু হয়। অনেক সমালোচকই অভিযোগ তোলেন যে এই গবেষণায় রিসার্চ এথিক্সকে লঙ্ঘন করা হয়েছে, কেননা এর মাধ্যমে পার্টিসিপেন্টদেরকে মানসিকভাবে পীড়া দেয়া হয়েছে। জবাবে মিলগ্রাম বলেছিলেন, এরকম সমালোচনা করা হচ্ছে কারণ, এই গবেষণাটি মানব প্রকৃতির খুব ডিস্টার্বিং ও আনওয়েলকাম ট্রুথকে প্রকাশ করেছে (যা অনেকে নিতে পারছেন না)। উল্লেখ্য, পার্টিসিপেন্টরা গবেষণার সময় বা গবেষণার অব্যবহিত পর বেশ স্ট্রেসড থাকলেও পরবর্তীতে তাদের অনেকেই মিলগ্রামকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানান, তাদের ভেতরের বায়াসটি দিনের আলোর মতো তুলে ধরার জন্য। এই প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করতেই হবে। মিলগ্রামের এক্সপেরিমেন্টটির অনেকবার রেপ্লিকেশন, অর্থাৎ একই এক্সপেরিমেন্ট অনেকবার করা হয়, কারণ এক্সপেরিমেন্টটা পপুলার ছিল, সেই সাথে বিভিন্ন ভৌগলিক স্থানে এক্সপেরিমেন্টের ফল একই কিনা তা দেখার জন্য। সব জায়গায় একই ফলাফল পাওয়া যায়। যাই হোক, ১৯৭৩-৭৪ সালে অবিডিয়েন্স টু অথোরিটি গ্রন্থটি প্রকাশ করার সময় অস্ট্রেলিয়ার লা ট্রোবি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সপেরিমেন্টটির একটি ভারশন পরিচালনা করা হয়। পরবর্তীতে পেরি তার ২০১২ সালের গ্রন্থ “বিহাইন্ড দ্য শক মেশিন” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, এই এক্সপেরিমেন্টটির সমাপ্তির পর পার্টিসিপেন্টদেরকে ভালোভাবে তা ডিব্রিফ করা হয়নি, অর্থাৎ আসল ঘটনা খুলে বলা হয়নি। এর ফলে পার্টিসিপেন্টদের অনেকের মধ্যেই দীর্ঘদিনের সাইকোলজিকাল এফেক্ট ছিল। তাই বলা যায় এরকম এক্সপেরিমেন্টের ক্ষেত্রে পার্টিসিপেন্টদেরকে ঠিকভাবে ডিব্রিফ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই যে নাৎসিদের যুদ্ধাপরাধের সাইকোলজি বুঝতে এই গবেষণাটি করা হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্যসাধনে গবেষণাটি কতটা সফল হলো। মানে পরীক্ষাগারে সাধারণ মানুষের অথোরিটি বায়াস কি আসলেই নাৎসি গণহত্যাকারী, বা অন্য কোন গণহত্যাকারীর অপরাধকে রিফ্লেক্ট করছে? সাধারণ মানুষের মধ্যেই এই বায়াস উপস্থিত – এটা দেখিয়ে নাৎসি বা অন্যান্য গণহত্যায় অংশগ্রহণকারীদের অপরাধকে লঘু করে দেখা যায়? উত্তর হলো – না। কেন নয়, সেই বিষয়ে কিন স্টেট কলেজের হলোকাস্ট ও জেনোসাইড স্টাডির চেয়ার জেমস ওয়েলার চারটে যুক্তি দিয়েছেন – প্রথমত, মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্টের সাবজেক্টদেরকে বলা হয়েছে তাদের দ্বারা লার্নারদের কোন রকম পার্মানেন্ট ফিজিকাল ড্যামেজ করা হবে না, কিন্তু হলোকাস্টের পার্পাট্রেটরগণ পুরোপুরিভাবে অবগত ছিলেন যে তারা ভিক্টিমদেরকে হত্যা করতেই সহায়তা করছেন। দ্বিতীয়ত, ল্যাবটেরি সাবজেক্টরা তাদের ভিক্টিমকে চিনতেন না, এবং তাদের এই আঘাত প্রদানটি তাদের মধ্যে থাকা রেইসিজম বা এরকম কোন বায়াস দ্বারা প্রভাবিত ছিলনা, কিন্তু হলোকাস্ট পার্পাট্রেটরগণ যাদের হত্যা করায় সহায়তা করেছিলেন তারা জানতেন যে তারা ইহুদি, তারা ইহুদিদের প্রতি গভীরভাবে অমর্যাদা দেখিয়েছেন যা তারা তাদের সারাজীবনব্যাপী আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন। তৃতীয়ত, গবেষণাগারের সাবজেক্টরা কেউ স্যাডিস্ট ছিলেন না, হেইট-মঙ্গার ছিলেন না, এবং তারা প্রায়শই এক্সপেরিমেন্ট চলাকালীন সময়ে স্ট্রেস শো করেছেন, মানে তাদের কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু হলোকাস্টের ডিজাইনার বা এক্সেকিউশনারদের মধ্যে স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল, যা তারা অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে এসেছিলেন। চতুর্থত, এই এক্সপেরিমেন্টটা মাত্র এক ঘণ্টাব্যাপী সময় ধরে হয়েছে, যেখানে এক্সপেরিমেন্টের সাবজেক্টরা তাদের কাজের পরিতাপের জন্য কোন সময় পাননি, কিন্তু হলোকাস্ট ঘটেছিল কয়েক বছরব্যাপী, যারা হলোকাস্টে সাহায্য করেছেন তাদের নিজেদের কাজের নৈতিক মূল্যায়ন ও পরিতাপের জন্য অনেক সময় পেয়েছেন। ওয়েলারের পয়েন্টগুলো খুব যৌক্তিক। তাই বলা যায়, এই অথোরিটি বায়াস কতিপয় নাৎসি ব্যুরোক্র্যাটের ইহুদিভর্তি জাহাজকে অসউইজ অব্দি পৌঁছে দেয়ার ডিউটি পালন করার ব্যাপারটা যদিও বা ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু এটা অসউইজে যারা এদেরকে আটকে রেখেছে, নিয়ম করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে গেছেন, ক্রিমেশনের কাজ করেছেন… এদের আচরণকে ব্যাখ্যা করার জন্য জাস্ট অথোরিটি বায়াস যথেষ্ট নয়, এদের মধ্যে থাকা ইহুদিবিদ্বেষকে অবশ্যই এখানে বিবেচনা করতে হবে।

ব্যাখ্যা ও ফ্যাক্টরসমূহ

(১) থিওরি অফ কনফর্মিজম ও ফ্যাক্টর হিসেবে কনফর্মিটি : এটা মিলগ্রামের দেয়া দুটো ব্যাখ্যার একটি। এটি সলোমন অ্যাশের কনফর্মিটি এক্সপেরিমেন্টের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা কোন রেফারেন্স গ্রুপের সাথে ইন্ডিভিজুয়াল ব্যক্তির মধ্যকার মৌলিক সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে, এক্ষেত্রে যে ব্যক্তির কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন সামর্থ বা এক্সপার্টিজ থাকেনা, সেই ব্যক্তি বিশেষ করে সংকটকালীন সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব গ্রুপ ও গ্রুপের হায়ারার্কির ওপর ছেড়ে দেয়, আর গ্রুপের হায়ারার্কি অনুসারে অথোরিটি ফিগারের সিদ্ধান্তকেই সে সঠিক বলে মনে করে। উল্লেখ্য, কনফর্মিটির দ্বারা অথোরিটি কিরকম প্রভাবিত হয় তা বোঝার জন্য মিলগ্রাম অথোরিটির সাথে কনফর্মিটির এফেক্ট কম্বাইন করেও কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট করেন। সেই এক্সপেরিমেন্টগুলোতে পার্টিসিপেন্টদের সাথে আরও একজন বা দুইজন অতিরিক্ত ‘টিচার’ অংশগ্রহণ করেছিলেন, এরাও লার্নারের মতই অভিনেতা ছিলেন। এদেরকে কখনও বলা হয়েছিল শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাটি চালিয়ে যেতে, আবার কখনও বলা হয়েছিল পরীক্ষাটি বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে না যেতে অর্থাৎ আনুগত্য প্রদর্শন না করতে, আর তার প্রভাবে সাবজেক্ট কিরকম আচরণ করেন, অর্থাৎ অন্য টিচারদের দেখে তার আনুগত্য কতটা প্রভাবিত হয় তা দেখার উদ্দেশ্যই ছিল মিলগ্রামের। দেখা যায় এতে রেজাল্ট অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। ১৭ নং এক্সপেরিমেন্টে দুজন অভিনেতা টিচার আনুগত্য প্রদর্শন করতে অস্বীকার করেন, এর ফলে দেখা যায় ৪০ জন পার্টিসিপেন্ট এর মধ্যে মাত্র ৪ জন এক্সপেরিমেন্টটি শেষ পর্যন্ত নিয়ে যান। ১৮ নং এক্সপেরিমেন্টে পার্টিসিপেন্ট আরেকজন টিচারের সাথে একটি সাবসিডারি টাস্কে অংশ নেন (যেমন একসাথে মাইক্রোফোনে প্রশ্ন পড়া বা লার্নারের উত্তর রেকর্ড করা), সেই আরেকজন টিচার পুরোপুরি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন। দেখা যায় এক্ষেত্রে ৪০ জন পার্টিসিপেন্ট এর মধ্যে ৩৭ জনই এক্সপেরিমেন্টটি সমাপ্ত করেন, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য প্রকাশ করেন। এখান থেকে বোঝা যায়, কনফর্মিটি অথোরিটিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে অথোরিটি বায়াসের পেছনে আসলে কনফর্মিজম কাজ করে – এই তত্ত্বটা ঠিক হতে হবে। এরা স্বাধীনভাবেই কাজ করতে পারে, এবং একটি আরেকটি প্রভাব বৃদ্ধি করে থাকতে পারে। তাই কনফর্মিটি আসলে অথোরিটির এক্সপ্লানেশন না হয়ে কেবল ফ্যাক্টর হিসেবেই কাজ করে থাকতে পারে।

(২) এজেন্টিক স্টেট থিওরি : এটি মিলগ্রামের দেয়া দুটো থিওরির মধ্যে দ্বিতীয়টি। তার মতে, অবিডিয়েন্স বা আনুগত্যের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে এজেন্টিক স্টেট কাজ করে, এক্ষেত্রে অনুগত ব্যক্তি নিজেকে তিনি যার প্রতি অনুগত তার ইচ্ছানুরূপ পালনের একটি ইনস্ট্রুমেন্ট বা যন্ত্র হিসেবে দেখে, আর সেজন্য তারা নিজেকে তাদের কোন কাজের জন্য দায়ী বা রেসপন্সিবল বলে মনে করেনা। ব্যক্তির মধ্যে এই রেসপন্সিবিলিটি থেকে মুক্তির এই ক্রিটিকাল শিফটটা ঘটলেই তার মধ্যে আনুগত্যের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা দিতে শুরু করে।

(৩) বিলিফ পারসিভারেন্স : বিলিফ পারসিভারেন্স বা কনসেপচুয়াল কনজার্ভেটিজম বলতে এমন মানসিক অবস্থা বোঝায় যেখানে নিজের কোন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হলেও মানুষ তা বিশ্বাস করা চালিয়ে যায়। বিলিফ পারসিভারেন্স মানুষের মনে অথোরিটি বায়াস তৈরির পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি অথোরিটি বায়াসকে প্রভাবিত করে এভাবে – একজন মানুষ যখন কোন অথোরিটিকে ভালো বলে মনে করে, তখন সেই অথোরিটি আসলে খারাপ এরকম অনেক এভিডেন্স সামনে এলেও তাকে আর খারাপ বলে মন মানতে চায়না, তাকে ভালো হিসেবেই মনে করার প্রবণতা কাজ করে এই বিলিফ পারসিভারেন্সের জন্য, আর সেজন্য সেই অথোরিটি কোন অনৈতিক নির্দেশ দিলেও তা আসলে অনৈতিক নয়, বা আসলে ভালর জন্যই হচ্ছে এমন বিশ্বাস কাজ করে। ২০০৯ সালে প্রকাশিত বিবিসি সায়েন্স ডকুমেন্টারি সিরিজ “হরাইজনে” এই ব্যাখ্যাটা সমর্থন পায়। সেখানে মিলগ্রামের এক্সপেরিমেন্টটা রেপ্লিকেট করা হয়েছিল। ১২ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে মাত্র ৩ জনই সেখানে এক্সপেরিমেন্টের শেষ পর্যন্ত অগ্রসর হননি। এপিসোডটির সময় সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট ক্লিফোর্ড স্কট এর কারণ হিসেবে বিলিফ পারসিভারেন্স থেকেই ব্যাখ্যা দেন। তিনি এখানে বলেন, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা সম্পর্কিত একটি আইডিয়ালিজম বা আদর্শবাদ কাজ করেছে। এক্সপেরিমেন্টর সায়েন্সের সাথে সম্পর্কিত একজন লোক, আর পার্টিসিপেন্টরা সায়েন্সকে খুব ইতিবাচকভাবেই দেখে, কেননা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা সমাজের জন্য উপকারী হয়ে থাকে। তাই মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্টের ইনস্ট্রাকটরকে তারা একজন ভালো অথোরিটি হিসেবে দেখেছেন, কিন্তু তিনি যখন একটি মন্দ কাজ করতে সাবজেক্টদেরকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন, তখন তারা নিজেরা তাকে মন্দ ভাবলেও একজন ভালো অথোরিটির নির্দেশনা পাবার কারণে ভেবেছেন যে ইনি কোন মন্দ কাজ করতে বলতেই পারেন না, আর এই বিশ্বাসে অটল থেকেই তারা লার্নারকে কষ্ট দিয়ে গেছেন, তারা মনে করেছেন লার্নাররা কষ্ট পেলেও এগুলো তারা ভালর জন্যই করছেন।

(৪) এংগেজড ফলোয়ারশিপ : সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, যদি মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্টে এক্সপেরিমেন্টর নির্দেশনাগুলো আদেশের মত করে দেন তাহলে তার প্রতি অনুগত হবার সম্ভাবনা কম থাকে, কিন্তু যদি নির্দেশনা এমনভাবে দেয়া হয় যে এই কাজটা করা বৃহত্তর পরিসরে মঙ্গলজনক হবে তাহলে তার প্রতি অনুগত হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, যেমন মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্টে সাবজেক্টদেরকে বলা হয়েছিল, “আপনার এই এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ”। এখানে এংগেজড ফলোয়ারশিপের ব্যাপার আসে, যেখানে সাবজেক্ট কেবই অর্ডার ফলো করছেন না, বরং এর দ্বারা যার প্রতি আনুগত্য কাজ করছে তার বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য অর্জিত হবে তার জন্য এই কাজটি করছেন।

তথ্যসূত্র

  1. Milgram, Stanley (1963). “Behavioral Study of Obedience”. Journal of Abnormal and Social Psychology. 67 (4): 371–8.  CiteSeerX10.1.1.599.92.  doi:10.1037/h0040525.  PMID14049516
  2. Milgram, Stanley (1974). Obedience to Authority; An Experimental View. Harpercollins. ISBN 978-0-06-131983-9.
  3. Milgram, Stanley (1974). “The Perils of Obedience”. Harper’s Magazine.
  4. Blass, Thomas (1999). “The Milgram paradigm after 35 years: Some things we now know about obedience to authority”. Journal of Applied Social Psychology. 29 (5): 955–978. doi:10.1111/j.1559-1816.1999.tb00134.x
  5. Abelson, Robert P.; Frey, Kurt P.; Gregg, Aiden P. (April 4, 2014). “Chapter 4. Demonstration of Obedience to Authority”. Experiments With People: Revelations From Social Psychology. Psychology Press. ISBN 9781135680145.
  6. James Waller (February 22, 2007). What Can the Milgram Studies Teach Us… (Google Book). Becoming Evil: How Ordinary People Commit Genocide and Mass Killing. Oxford University Press. pp. 111–113. ISBN 978-0199774852.
  7. Nissani, Moti (1990). “A Cognitive Reinterpretation of Stanley Milgram’s Observations on Obedience to Authority”. American Psychologist. 45 (12): 1384–1385. doi:10.1037/0003-066x.45.12.1384.
  8. “How Violent Are You?”. Horizon. Series 45. Episode 18. BBC. BBC Two
  9. Haslam, S. Alexander; Reicher, Stephen D.; Birney, Megan E. (September 1, 2014). “Nothing by Mere Authority: Evidence that in an Experimental Analogue of the Milgram Paradigm Participants are Motivated not by Orders but by Appeals to Science”. Journal of Social Issues. 70 (3): 473–488. doi:10.1111/josi.12072.  hdl:10034/604991. ISSN 1540-4560.
  10. Haslam, S Alexander; Reicher, Stephen D; Birney, Megan E (October 1, 2016). “Questioning authority: new perspectives on Milgram’s ‘obedience’ research and its implications for intergroup relations” (PDF). Current Opinion in Psychology. Intergroup relations. 11: 6–9. doi:10.1016/j.copsyc.2016.03.007. hdl:10023/10645
  11. Sheridan & King (1972) – Obedience to authority with an authentic victim, Proceedings of the 80th Annual Convention of the American Psychological Association 7: 165–6

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.