সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন, খ্রিস্টীয় ২য়-৩য় শতকের খ্রিস্টধর্ম ও তদকালীন খ্রিস্টানদের ওপর রোমান নির্যাতন

সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু

সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের (২২৬-২৬৯ খ্রি.)  কাহিনী নিয়ে অনেক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে সাধারণ হিস্টোরিওগ্রাফি যা বর্ণনা করে তা অনেকটা এরকম – সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমের একজন যাজক ছিলেন, বা মধ্য ইতালির আম্ব্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর টার্নির প্রাক্তন বিশপ ছিলেন। বিচারক অ্যাস্টারিয়াসের অধীনে গৃহ-গ্রেফতার হয়ে থাকবার সময় তিনি অ্যাস্টারিয়াসের সাথে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন। তিনি তাকে যিশুর যথাযোগ্যতা, তার অলৌকিকতা সম্পর্কে বলেন। অ্যাস্টারিয়াস তাকে পরীক্ষা করার জন্য তার অন্ধ দত্তক কন্যাকে তার সামনে নিয়ে আসেন ও বলেন একে সুস্থ করে দিলে তিনি যা চাইবেন অ্যাস্টারিয়াস তাই করবেন। ভ্যালেন্টাইন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে শিশুটির চোখে হাত রাখলেন, শিশুটির দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো। অ্যাস্টারিয়াস বিনীতভাবে ভ্যালেন্টাইনকে জিজ্ঞেস করলেন, এর বিনিময়ে তিনি কী চান। ভ্যালেন্টাইন অ্যাস্টারিয়াসকে বললেন তার নিজের বাড়ির আশেপাশের সকল মূর্তিকে ভেঙ্গে ফেলতে, এরপর তিন দিনের উপবাস করতে ও তারপর চার্চে গিয়ে বাপ্টাইজড বা অভিসিঞ্চিত হতে। বিচারক অ্যাস্টারিয়াস তাই করলেন ও এরপর তার অধীনে থাকা সকল খ্রিস্টান কয়েদীদেরকে মুক্ত করে দিলেন। অ্যাস্টারিয়াসের পরিবারের ও দাস-দাসী সকলেই বাপ্টাইজড বা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। এভাবে রোমান নাগরিকদেরকে ধর্মান্তরিত করার জন্য ভ্যালেন্টাইনকে আবার গ্রেফতার করা হলো এবং রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস গথিকাসের (রা. ২৬৮-২৭০ খ্রি.) সামনে নিয়ে আসা হলো। ক্লডিয়াস তাকে পছন্দ করা শুরু করলেন, কিন্তু ভ্যালেন্টাইন ক্লডিয়াসকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকে। ক্লডিয়াস তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দান করেন। তিনি ভ্যালেন্টাইনকে বলেন তাকে হয় তার ধর্মত্যাগ করতে হবে নাহয় তাকে গদা দিয়ে প্রহার করে শিরোশ্ছেদ করে হত্যা করা হবে। ভ্যালেন্টাইন ধর্মত্যাগ করতে অস্বীকার করে, ফলে ২৬৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে যেভাবে বলা হলো সেভাবে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি অ্যাস্টারিয়াসের কন্যাকে একটি নোট পাঠিয়েছিলেন যেখানে তিনি সাক্ষর করার সময় লিখেছিলেন “from your Valentine”। এই কথাটি আজকের প্রেমবার্তাগুলোতে তুমুলভাবে ব্যবহৃত হয়। তার মৃত্যুদিন ১৪ই ডিসেম্বর আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে নামে পরিচিত, দিনটি ভালোবাসার প্রতিনিধিত্ব করে। ভ্যালেন্টাইনের এই কাহিনীগুলো মধ্যযুগের শেষ পর্বের ক্রনিকলগুলোতে পাওয়া যায়। তিনি যেহেতু একজন খ্রিস্টীয় শহীদ ছিলেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই লোকে মুখে ফিরতে ফিরতে তার কাহিনী বিভিন্ন দিকে ডালপালা ছড়িয়ে নিয়েছে, কিন্তু তারপরও যে ব্যাপারটাকে নিশ্চিত বলা যায় তাহলো সম্রাট ক্লডিয়াস গথিকাসের আমলেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এভাবে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর ঘটনাটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলনা। তিনি যে সময়ে মারা গিয়েছিলেন তার কিছুকাল পূর্বেই খ্রিস্টানরা রোমান শাসকদের হাতে দু’বার নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সেই সাথে খ্রিস্টানদের ওপর জনসাধারণের অসন্তোষও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাই সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুকে বুঝতে হলে তদকালীন রোমান সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকটা নিয়ে জানা দরকার। সেই সাথে সেই সময়ের খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস সম্পর্কেও কিছু জানা দরকার।

খ্রিস্টীয় ২য়-৩য় শতকের খ্রিস্টধর্ম

নস্টিক সম্প্রদায় (Gonostic)

সেন্ট পল এবং সেন্ট জোহনের পত্রাবলিতে নস্টিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে নস্টিক মতের উদ্ভব ঘটেছিল। নস্টিকগণ ইহুদীদিগকে নির্বাচিত জাতি বলে স্বীকার করতাে না। তারা খ্রিস্টান হলেও পুরনাে বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টি, বিবরণ গ্রহণ করেননি। তারা ইন্দ্রিয়সুখ ঘৃণা করতেন। প্রাচীন ইহুদী প্রধানদের বহুবিবাহ, ডেভিডদের নারী প্রিয়তা এবং সলােমনের বহু নারীপূর্ণ অন্তঃপুরের নিন্দা করতেন। ক্যামানদেশ জয় করার সময় ইহুদিগণ সেখানকার নিরীহ প্রাচীন অধিবাসীদের হত্যা করে যে নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন তাও তারা নিন্দা করতেন। তারা বলতেন যে, পশু বলি ও অর্থহীন অনুষ্ঠান যে ধর্মের প্রধান অঙ্গ এবং যে ধর্মে পুণ্যের পুরস্কার ও পাপের শাস্তি উভয়ই দৈহিক, তা হতে কখনাে পুণ্যের প্রতি প্রীতির উদ্ভব অথবা দৈহিক রিপুর সংযম সম্ভবপর হতে পারে না। ছয়দিন ঈশ্বর পরিশ্রম করে অবশেষে বিশ্রাম করলেন – এ কথা তারা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেন। জীবন ও জ্ঞানের বৃক্ষ, নিষিদ্ধফল, পূর্বপুরুষের পাপের জন্য সমস্ত মানবজাতিকে শাস্তি প্রদান প্রভৃতি ইহুদি ধর্মের বক্তব্যের তারা নিন্দা করতেন। তারা বলতাে ইহুদিদের ঈশ্বর, ক্রোধ, খামখেয়ালি, একবার কষ্ট হলে তার ক্রোধের আর উপশম হয় না। তিনি পূজা পাবার জন্য ব্যাকুল, তিনি পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট, একটি মাত্র জাতিকে তিনি রক্ষা করেন। সে রক্ষণও শুধু কেবল ইহ জগতে, এ পার্থিব জীবনে সীমাবদ্ধ। তাতে সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমত্বের কোন লক্ষণ নেই। তাকে বিশ্বের পিতা বলা হয় না। তারা খ্রিস্টকে ঈশ্বরের প্রথম এবং সর্বোত্তম ‘বিকিরণ’ বলে খ্রিস্টের পূজা করতাে। তিনি মানব জাতিকে বিভিন্ন ভ্রান্তি হতে উদ্ধার করার জন্য এবং নতুন সত্য ও পূর্ণতার আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বলে তারা বিশ্বাস করতেন। নস্টিক শব্দ গ্রীক Gno ধাতু (=সংস্কৃত জ্ঞা) হতে উৎপন্ন। এর অর্থ জ্ঞানী। নস্টিকগণ প্রায় সকলেই ‘জেনটাইল’ অর্থাৎ অ-ইহুদি জাতীয় ছিল। যারা এ সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা সিরিয়া অথবা মিশরের অধিবাসী ছিলেন। তৎকালে সমগ্র খ্রিস্টিয় সমাজে নস্টিকগণই সর্বাপেক্ষা বিদ্বান, ভদ্র এবং ধনী ছিলেন। তাদের ধর্মমতে খ্রিস্টের ঈশ্বরত্বে বিশ্বাসের সঙ্গে আরও কতকগুলাে গুহ্যমত মিশ্রিত ছিল। শেষােক্ত মতগুলাে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছিল। ফলে নস্টিক সম্প্রদায় বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরা সকলেই Gnosis নামক এক বিশেষ ধর্মজ্ঞানের দাবি করতেন, যা কেবল তাদের গুহ্যমতে দীক্ষিত ব্যক্তিদের নিকট প্রকাশিত হয়। নস্টিক বিভিন্ন শাখার মধ্যে ব্যাসিলিডিয়ান (Basilidians), ভালেন্টিনিয়ান (Valentinian), মারকিয়নাইট (Marcionite) এবং ম্যানিকিয়ান (Manichaean) শাখা বিখ্যাত ছিল। প্রত্যেক শাখারই স্বকীয় বিশপ এবং গীর্জা ছিল। প্রত্যেক শাখার স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থ ছিল। নস্টিক সম্প্রদায় চতুর্দিকে দ্রুত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এশিয়া, মিশর এবং রােমের অনেকে তাদের মত অবলম্বন করে। চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। পঞ্চম শতাব্দীতে তাদের প্রভাব বিলুপ্ত হয়। নস্টিকদের মতে, ঈশ্বর জগতের সৃষ্টিকর্তা নন। জগৎ সৃষ্টি হয়েছিল ঈশ্বরের অধীনস্থ এক দেবতা কর্তৃক তার নাম ইয়ালদা বাওথ (Ilda Baoth)। তিনি ছিলেন ঐশ্বরিক জ্ঞানের বিদ্রোহীপুত্র। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে যে জিহােবার কথা আছে তিনিই এ ইয়ালদা বাওথ। পুরাতন বাইবেলে সর্পকে পাপী বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সর্পের কোন অপরাধ ছিল না। ইয়ালদা বাওথ ইভকে প্রতারণা করছিলেন, সর্প ইভকে সতর্ক করে দিয়েছিল, এটাই তার অপরাধ। ঈশ্বর বহুদিন ইয়ালদা বাওথের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। অবশেষে মূসার ভ্রান্ত শিক্ষা হতে জগতকে রক্ষা করার জন্য তিনি তার পুত্রকে প্রেরণ করেন। নস্টিকগণ এ মতের সঙ্গে প্লেটোর মত মিশিয়ে নিয়েছিলেন। প্লোটিনাস এ মত খন্ডনের চেষ্টা করেছিলেন। নস্টিকদের কোন এক সম্প্রদায় বিশ্বাস করতাে যে, যিশু একজন মানুষ মাত্র ছিলেন। তার দীক্ষাকালে ঈশ্বরের পুত্র তার দেহে অধিষ্ঠান করেন এবং তাকে যখন ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, তখন ঈশ্বরপুত্র তাকে ত্যাগ করে স্বর্গে প্রস্থান করেন। পরে মুহম্মদ এ মত গ্রহণ করেছিলেন। “আমার ঈশ্বর আমার ঈশ্বর, কেন তুমি আমাকে ত্যাগ করলে?” কুশবিদ্ধ যিশুর এ উক্তি নস্টিকগণ নিজেদের মতের পক্ষে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করতাে। নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ, জন্মের পর জ্ঞানহীন শিশুর জীবন যাপন, অবশেষে ক্রুশে প্রাণ ত্যাগ ঈশ্বরের পুত্রের অনুপযুক্ত বলে নস্টিকগণ মনে করতেন। মুহম্মদেরও ধারণা ছিল পয়গম্বরদের মৃত্যু কখনাে শােচনীয়ভাবে হতে পারে না। নস্টিকগণের মতে যে যিশু মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ক্রুশে প্রাণত্যাগ করেছিলেন তিনি ঈশ্বরের পুত্র নন। মুহম্মদও এ মত গ্রহণ করে বলেন যে, ঈশ্বরের পুত্রের দেহ বাস্তবিক ক্রুশবিদ্ধ হয়নি। একটি ছায়ামূর্তিকে ইহুদিগণ ক্রুশবিদ্ধ করেছিল। আইরেনিয়াস (Ireneus, ১৩০-২০২ খ্রি.) তার ধর্ম বিরুদ্ধ মতের খন্ডন গ্রন্থে নস্টিকদের সম্বন্ধে লিখেছেন, “একশ্রেণীর লােক সত্যকে অগ্রাহ্য করে, তার থলে উপকথা এবং কল্পিত বংশ তালিকা স্থাপন করেছেন। তাতে সন্দেহেরই উদ্ভব হয়। বিশ্বাসের মধ্যে যে ঐশি আলাে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তা তাদের মধ্যে নেই। শাস্ত্রের উৎকৃষ্ট পথ সকলে এরা কদর্য করেছে। বিশ্বাসকে ধ্বংস করে এবং জ্ঞানীর ভান করে এরা লােককে বিপথে চালায়, যিনি বিশ্বকে প্রতিষ্ঠিত করে সুশােভিত করেছেন তার নিকট হতে দূরে নিয়ে যায়। কিন্তু দাবী করে যে, যিনি স্বর্গ ও মর্তের স্রষ্টা, সেই ঈশ্বর হতে উচ্চতর কিছুর শিক্ষা তারা দিচ্ছে।” আইরেনিয়াস নস্টিকদের “মেষচর্মাবৃত ব্যাঘ্র” বলে বর্ণনা করেছিলেন।নস্টিকদের ধর্মবিজ্ঞান সুসঙ্গত ও সুশৃঙ্খল ছিলনা। তাদের সৃষ্টি বিবরণ ছিল কল্প কাহিনীময়। Gnosis নামক গুহ্য ধর্মজ্ঞান ব্যতীত তারা ঈশ্বর ও জগতের মধ্যে কতকগুলাে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতাে, এবং এদেরকে Acnus বলতাে। ফিলোর মতের সাথে কোন কোন বিষয়ে এদের মতের মিল ছিল। ইহুদিগণ খ্রিস্টের ধর্ম গ্রহণ না করে তাকে হত্যা করেছিল বলে খ্রিস্টানগণ তাদের ঘৃণা করতাে। খ্রিস্ট ধর্ম রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা লাভ করার পর এ বিদ্বেষ উৎপীড়নে পরিণত হয়েছিল। ধর্ম বিদ্বেষ ছাড়া আর্থিক কারণও বােধ হয় এ উৎপীড়নের মূলে ছিল।

খ্রিস্টীয়  ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মতত্ত্ব

ইহুদি ধর্ম দার্শনিক আলােচনার ধার ধারতাে না। আলেকজান্দ্রিয়ায় ইহুদি ধর্মের একটা দার্শনিক ব্যাখ্যা দেবার প্রচেষ্টা হয়েছিল বটে কিন্তু তার পূর্বে দর্শনের সাথে সে ধর্মের কোন সম্বন্ধ ছিল না। খ্রিস্টধর্মের উপর গ্রীক প্রভাবের ফলে তার মধ্যে দার্শনিক তত্ত্ব প্রবেশ লাভ করে। ম্যাথু, মার্ক ও লুক প্রণীত তিনখানা খ্রিস্ট চরিত্রেরও বিশেষ দার্শনিক তত্ত্ব কিছু নেই। তা অতি সরল ভাষায় লিখিত এবং সাধারণের বােধগম্য। কিন্তু সেন্ট জোহন খ্রিস্টকে গ্রীক Logos-এর সাথে অভিন্ন বলে বর্ণনা করেছেন। প্রাচীন যাজকগণ সেন্ট জোহনের গ্রন্থকেই প্রাধান্য দিতেন। সেন্ট পলের পত্রাবলিতেও যুক্তি সম্বন্ধে অনেক তাত্ত্বিক কথা আছে। গ্রীক সংস্কৃতির সঙ্গে তার ঘনিষ্ট পরিচয়ের নিদর্শন এ সকল পত্রে রয়েছে। খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন শাখার মধ্যে বিরােধ ও বিতর্কের ফলে খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মবিজ্ঞানের সূত্রপাত হয়। নস্টিকদের মত খন্ডনের জন্য আইরেনিয়াসের ‘ধর্ম বিরুদ্ধ মতের খন্ডন’ নামক গ্রন্থের কথা ইতােমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। আইরেনিয়াসের জন্ম হয় ১১৫ খ্রিস্টাব্দে। জাস্টিন মার্টার প্রাচীন যাজকদের মধ্যে প্রথম ধর্মতাত্ত্বিক পণ্ডিত। ১৬৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। হিপােলাইটাস Philosophumena or Refutation of All Heresies (সর্বপ্রকার ধর্মবিরুদ্ধ মতখন্ডন) নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে যাবতীয় যুক্তির খন্ডন করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনিও একজন খ্যাতিমান পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু তৃতীয় শতাব্দীর পূর্বে সুসংবদ্ধ খ্রিস্টিয় ধর্মবিজ্ঞান বা ধর্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তৃতীয় শতাব্দীর প্রারম্ভে খ্রিস্টধর্মের বিশিষ্ট মতগুলাে শিক্ষা দেবার জন্য আলেকজান্দ্রিয়া নগরে পন্টেনিরাস, ক্লিমেন্ট এবং ওরিজেন কর্তৃক একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ শিক্ষালয়েই খ্রিস্টধর্মবিজ্ঞান বিশিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে।

প্রথম দিকের খ্রিস্টান লেখক বা চার্চ ফাদারগণ

ভূমিকা

খ্রিস্টীয় ২য় শতক থেকে খ্রিস্টধর্ম কিন্তু ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। শহরে, বিশেষ করে গ্রিক ভাষাভাষীদের শহরে ধর্মটি বেশি প্রসার পাচ্ছিল। একইসাথে খ্রিস্টধর্মের ওপর লেখালেখিরও অনেক বেড়ে গেছিল। খ্রিস্টধর্মের কোনাে বিশেষ দিক নিয়ে রােমান সাম্রাজ্য থাকাকালে কিংবা পরে মধ্যযুগেও যারা লিখেছিলেন, তাদের বলা হয় “চার্চ ফাদার”। তারা আবার যে ভাষায় লেখালেখি চর্চা করেছিলেন তার উপর নির্ভর করে এই চার্চ ফাদারগণ গ্রিক ফাদার এবং ল্যাটিন ফাদার নামে দুটো অংশে বিভক্ত। অবশ্য এটা বলা যাবে না যে, কোনাে কোনাে লেখক সেই ফাদারদের মধ্যে থেকে উঠে এসেছিলেন। আবার এটাও বলা যায় না যে, কোনাে কোনাে ফাদার লেখালেখি করেছিলেন। আসলে চার্চ ফাদাররা এই দুই দলের যে কোনাে একটিতে ছিলেন।

জাস্টিন মার্টার (আনু. ১০০ – ১৬৫ খ্রি.)

জাস্টিন মার্টার ছিলেন একজন প্রথম যুগের খ্রিস্টীয় অ্যাপোলজিস্ট ও দার্শনিক। তিনি তদকালীন রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত জুডিয়ার গ্রিক-ভাষী শহর ফ্লেভিয়া নিয়াপলিসে (আধুনিক নাবলুস) জন্মগ্রহণ করেন। তার বেশিরভাগ রচনাই হারিয়ে গেছে, যেগুলোতে খ্রিস্টীয় জীবনের নৈতিকতাকে সমর্থন করা হয়েছিল, এবং রোমান সম্রাট অ্যান্টোনিয়াসকে চার্চের ওপর দমন-পীড়ন না করবার জন্য রাজি করানোর জন্য নৈতিক ও দার্শনিক যুক্তি প্রদান করা হয়েছিল। তিনি দাবি করতেন যিশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্বেই খ্রিস্টধর্মের বীজ বা লোগসের অস্তিত্ব ছিল, সক্রেটিস ও প্লেটোর মতো গ্রিক দার্শনিকরা এই লোগস-প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাই তারা তাদের অজান্তেই খ্রিস্টান ছিলেন। পরবর্তীতে সেইন্ট অগাস্টিন এই ধারণাটি গ্রহণ করেন। তিনি তার ডায়ালগ উইথ ট্রাইফো গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন যে কীভাবে তিনি পূর্বের স্টোইকবাদ, পেরিপেটেটিকবাদ এবং পিথাগোরীয়বাদ সম্প্রদায় হয়ে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হলেন। তিনি সেই গ্রন্থে সংলাপের আকারে উল্লেখ করেন, “তার মধ্যে ঈশ্বরের দূতদের ভালোবাসা এবং খ্রিস্টের বন্ধুরা ভর করেছে।” দর্শনের সাথে খ্রিস্টধর্মের সমন্বয় জাস্টিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জাস্টিন তার শিশ্যদের সমেত শহীদ হয়েছিলেন, খ্রিস্টধর্মের চার্চগুলো তাকে সেইন্ট এর স্বীকৃতি দিয়েছে। জাস্টিন মার্টার তার দুটো রচনার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন – ফার্স্ট অ্যাপোলজি ও সেকন্ড অ্যাপোলজি। রোমান সম্রাট অ্যান্টনিয়াস পায়াসের (৮৬-১৬১ খ্রিস্টাব্দ) বিরুদ্ধে লেখা ফার্স্ট অ্যাপোলজিতে তিনি কেবল খ্রিস্টান হবার জন্য একজন ব্যক্তিকে নির্যাতন করার বিরুদ্ধে যুক্তি দেন এবং সমসাময়িক খ্রিস্টীয় দর্শন, ধর্মীয় অনুশীলন ও আচারের ব্যাখ্যা দেন। তিনি লিখেছিলেন কোন ব্যক্তির ধর্ম তার শাস্তি পাবার জন্য যথেষ্ট হতে পারেনা, কেবল অপরাধকর্মের জন্য মানুশ শাস্তি পাবার যোগ্য হতে পারে। আর কোন খ্রিস্টান যদি অপরাধ করে তাহলে তার খ্রিস্টান হিসেবে নয়, বরং অপরাধী হিসেবেই শাস্তি তার প্রাপ্য হবে। খ্রিস্টানদের যে সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করার জন্য অভিযোগ করা হয় সে ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, খ্রিস্টানরাও কোন রাজ্যের নাগরিক হতে চায়, কিন্তু সেই রাজ্য মানুষের নয় বরং ঈশ্বরেরই। এগুলো ছাড়াও এই রচনায় লোগোসের ধারণা নিয়ে বলা হয়েছে। তার সেকেন্ড অ্যাপোলজি লেখা হয়েছিল একজন রোমান সিনেটকে সম্বোধন করে। এটি লেখার উদ্দেশ্য ছিল সমসাময়িক সাম্প্রতিককালের আর্বিকাসের দ্বারা খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতনের প্রকৃত কারণকে প্রকাশ করা, সেই সাথে এতে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দেয়া অভিযোগ ও প্রোপাগান্ডার অযৌক্তিকতাও প্রকাশ করে। প্রিফেক্ট আর্বিকাসের বিরুদ্ধে বর্ণনা তিনি একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করেন, যেখানে একজন নারী খ্রিস্টান হয়ে যাবার পর তার স্বামীর তার প্রতি অনৈতিক আচরণ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, তাতে কাজ না হলে সে ডিভোর্সের বিল প্রদান করে। তার স্বামী এর বিরুদ্ধে কোন কিছু করতে না পারলে সে খ্রিস্টীয় নেতাদের নেতাদের বিরুদ্ধে যায়, আর তখন প্রিফেক্ট আর্বিকাস খ্রিস্টীয় নেতাদের ওপর নির্যাতন শুরু করেন। এই রচনায় তিনি আরও লেখেন, জাস্টিনের মতে পতিত এঞ্জেল ও দানবরাই (Demon) ঈশ্বরের পুত্র ও ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি সাড়া দেয়া ঈশ্বরের লোকদের বিরুদ্ধে এরকম ঘৃণাকে জাগিয়ে তোলে। খ্রিস্টানদের উপর নরমাংস ভক্ষণ এবং যৌন অনৈতিকতার অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাই এপ্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন করেন, খ্রিস্টানরা যদি আনন্দ উপভোগের দ্বারাই তাড়িত হয়ে থাকে, তাহলে তারা কেন কেন মৃত্যুর ভয় পায়না, এবং তারা যা বিশ্বাস করে তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। এরপর তিনি রোমানদের রোমানদের ধর্মীয় রীতির সমালোচনা করেন।

ক্লিমেন্টস অফ অ্যালেক্সান্দ্রিয়া (আনু. ১৫০ – ২১৫ খ্রি.)

পূর্বদিকে ক্লিমেন্টস অফ অ্যালেক্সান্দ্রিয়া (টাইটাস ফ্লেভিয়াস ক্লিমেনস) ছিলেন সে সময়ের চার্চ ফাদারদের মধ্যে অন্যতম। তার উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টধর্মের উপরে গ্রিক জ্ঞানের আলােকপাত করা। এই ধর্মযাজক ১৫০ খ্রিস্টাব্দে এথিনায় জন্মেছিলেন। তার পিতামাতা ছিল প্যাগান ধর্মের অনুসারী। তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পূর্বেই হয়তাে কিছু প্যাগান শাস্ত্র গ্রহণ করেছিলেন। আর তাই যেখান থেকে তার উদ্ভব, সেই অ্যালেক্সান্ড্রিয়ায় তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানেই থাকতেন। তার শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতিটিকে তাই বলা হতাে অ্যালেক্সান্ড্রিয়ান ধর্মীয় ধারা। ক্লিমেন্ট খ্রিস্টধর্মকে দেখেছিলেন একটি দর্শন হিসেবে। তার মতে এটি কেবল গ্রিক ধর্মীয় পদ্ধতির পরের বিষয় ছিল না, বরং ছিল অনেক উর্ধ্বে। তিনি ইহুদি রচনা থেকে প্রয়ােজনীয় অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে সেগুলাে গ্রিক রচনার চেয়েও প্রাচীন। তিনি এটিও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেন যে গ্রিক ধর্ম ছিল প্রকৃতপক্ষে সেই প্রাচীন ইহুদি ধর্মেরই একটি অংশ মাত্র। তার মতে প্রাচীন কালের ফাদারদের মধ্যে অন্য কেউ গ্রিক দর্শনের ব্যাপারে এত বিস্তারিত পড়াশােনা করেননি।

অরিজেন অফ আলেক্সান্দ্রিয়া (আনু. ১৮৪-২৫৩ খ্রি.)

ক্লিমেন্টের শিষ্যদের মধ্যে এখনও যার নাম উল্লেখযােগ্য মনে করা হয়, তিনি হলেন অরিজেন (অরিজিনেস)। ১৮৫ খ্রিস্টাব্দে অরিজেন অ্যালেক্সান্ড্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। অরিজেন এসেছিলেন অ্যালেক্সান্ড্রিয়ার একটি খ্রিস্টান পরিবার থেকে। তার বাবা খ্রিস্টান হিসেবে শহীদ হন। ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণের জন্য তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওরিজেন আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি প্লোটিনাসের সমসাময়িক ছিলেন। প্লোটিনাসের গুরু আমােনিয়াস স্যাক্কাস তারও গুরু ছিলেন। তার De Principis গ্রন্থের সাথে প্লোটিনাসের অনেক মতের মিল আছে। ওরিজেনের মতে একমাত্র ঈশ্বরই সম্পূর্ণ জড়ত্ব বর্জিত। ঈশ্বরের তিন মূর্তি-পিতা, পুত্র ও পবিত্ৰাত্মা। নক্ষত্রদের প্রাণ আছে, বুদ্ধি আছে, আত্মাও আছে। সে সব আত্ম চিরকালই আছে, তারা সৃষ্টবস্তু নয়। সূর্যও পাপ পুণ্যের অধীন। সূর্যের পক্ষেও পাপ করা সম্ভবপর। মানবাত্মাও সৃষ্টবস্তু নয়, তাদের জন্মপূর্ব অস্তিত্ব আছে। পৃথিবীতে জন্মের সময় যে তাদের সৃষ্টি হয় তা নয়। ভিন্নস্থান থেকে এসে তারা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। Nous ও জীবাত্মা এক নয়, ভিন্ন। Nous-এর যখন পতন হয় তখন তা আত্মায় পরিণত হয়। আবার, আত্মা যখন ধর্মনিষ্ঠ হয় তখন Nous এ পরিণত হয়। এমন সময় আসবে যখন সকলেই খ্রিস্টের আদেশ পালন করবে। তখন কেউরই দেহ থাকবে। না। শয়তানও পরিণামে মুক্তি পাবে। ওরিজেন খ্রিস্টিয় সংঘের প্রাচীন যাজকদের অন্যতম ছিলেন। কিন্তু তা সত্বেও তার সমস্ত মত খ্রিস্টিয় সংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হয়নি। আত্মার জন্মপূর্ব অস্তিত্ব, পৃথিবীতে মানব জন্মগ্রহণের পূর্বেই খ্রিস্টের মানবীয় প্রকৃতির অস্তিত্ব, পূনরুত্থানের পূর্বেই মানবাত্মার জড়দেহের ইথার-দেহে পরিণতি, পরিণামে যাবতীয় মানুষের মুক্তিলাভ এমনকি শয়তানের অনুচরদিগের মুক্তি লাভ– ওরিজেনের এ সব মত খ্রিস্টিয় সংঘ কর্তৃক বর্জিত হয়েছিল।  তার দর্শন এবং তার রচনা মানুষের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে তাকে আগের সব দার্শনিকসহ ধর্মযাজকদের জনপ্রিয়তার উর্ধ্বে তুলে ধরল। তিনি প্রচুর লিখেছিলেন আর বিশেষ করে তাকে সবসময় গ্রিক লেখক সেলসাসের বিপক্ষে সমান একটি প্রতিভা হিসেবে স্মরণ করা হয়। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের পরের প্রথম শতাব্দীর বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার জন্য সেলসাস যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন তা নয়, কিন্তু অরিজেনের দেড় শতাব্দী পরে প্লেটোর দর্শনে বিশ্বাসী হিসেবে তার নামভাক হয়েছিল। সেলসাস খ্রিস্টধর্মের বিপক্ষে একটি সাধারণ এবং অগভীর বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ের দর্শন তখন অল্প কিছু মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। এটাই ছিল প্যাগানদের মধ্যে একজনের লেখা প্রথম একটি বই যেখানে যেখানে খ্রিস্টধর্মকে খুব বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেলসাসের যুক্তিগুলাে ছিল খুবই সাধারণ, যেসব বিষয় নিয়ে আজকের দিনে মুক্তচিন্তার যে কোনাে মানুষ ভাবে। তার উত্থাপিত বিষয়গুলাের মধ্যে কুমারী তরুণীর মা হওয়া, মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ফিরে আসা, আর এছাড়াও বিভিন্ন অসম্ভব ঘটনা যেসব ব্যাখ্যার অতীত। এছাড়াও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কী করে খ্রিস্টধর্ম গ্রিক ধর্মের আদর্শকে ভেঙে ভেঙে তৈরি হলাে এবং পরবর্তীকালে নিজেদের প্রসারের জন্য গ্রিক ধর্মের প্রতিই হুমকি হয়ে দাঁড়াল। বইটি ছিল প্রচণ্ড বাস্তববাদী। সেই সাথে তা ভীষণ জনপ্রিয় একটি সাহিত্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বইটি টিকে থাকতে পারেনি। তাই বইটির কথা তেমন শােনাও যায় না। অরিজেন সেলসাসের জনপ্রিয় বইটিতে যত যুক্তি ছিল তা খণ্ডন করার জন্য Against Celsus (সেলসাসের বিরুদ্ধে) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যাকে তার প্রধান গ্রন্থ বলে ধরা হয়। সেই গ্রন্থে অরিজেন সেলসাসের লেখা বইয়ের নয় দশমাংশই তুলে দিয়েছিলেন যুক্তি খণ্ডনের জন্য। তাই বলতে গেলে অরিজেনের মাধ্যমেই সেলসাসের বইটি টিকে ছিল। অরিজেনের রচনাটি খ্রিস্টধর্মের সপক্ষে লেখা সবচেয়ে জোরালাে একটি বই। ওরিজেন সেখানে সেলসাসের যুক্তিখণ্ডনের প্রয়াসে লিখেছিলেন, ওরিজেন লিখেছিলেন, “গ্রিক দর্শন পাঠ করে যখন বাইবেল পাঠ করা যায়, তখন বাইবেলকে সত্য বলেই প্রতীতি হয়। গ্রীক দর্শনের যুক্তি-তর্ক হতে বাইবেলের প্রমাণ অধিকতর সন্তোষজনক। বাইবেলের এ প্রমাণ প্রণালী ঐশ্বরিক, তার মধ্যে ঈশ্বরের শক্তি অনুপ্রবিষ্ট। বাইবেলের মধ্যে যে সব ভবিষ্যৎ বাণী আছে, খ্রিস্টের আবির্ভাবের দ্বারা তাদের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। বাইবেলে বর্ণিত অদ্ভুত ক্রিয়াসমূহ, এবং বাইবেলের অনুসারে যাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়, তারা যে সকল ক্ষমতা লাভ করে, তা দ্বারা বাইবেলের অনুস্ত ঐশ্বরিক শক্তি প্রমাণিত হয়।” অরিজেন নিজেকে এমনভাবে বঞ্চিত করে রেখেছিলেন যেন নারীর সান্নিধ্য কিংবা সংসারের মােহ তাকে মাঝপথে বিরত করতে না পারে। ইন্দ্রিয় সুখের প্রতি ওরিজেনের বিজাতীয় ঘৃণা ছিল। এ সুখের প্রলােভন হতে নিজেকে মুক্ত করার জন্য তিনি অস্ত্রোপচার দ্বারা নিজকে নপুংসকে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু সংঘ কর্তৃক তার এ কাজ নিন্দিত হয়েছিল। এবং এ জন্য তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছিলেন।

টারটুলিয়ান (আনু. ১৫৫-২৪০ খ্রি.)

মার্কাস অরেলিয়াসের আমলের (১৬১-১৮০ খ্রি.) পরপর পশ্চিম দিকের প্রদেশগুলােতেও চার্চের লেখকদের উদ্ভব হয়েছিল। তখন প্রকৃতপক্ষে দর্শনচর্চা যেন কেন্দ্র গ্রিস ছেড়ে সারা সাম্রাজ্যের উর্বর মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছিল। পশ্চিমা প্রদেশের লেখকদের মধ্যে প্রথমেই যার কথা বলতে হয় তিনি হলেন টারটুলিয়ান (কুইন্টাস সেপটিমিয়াস প্লেরেন্স টারটুলিয়ানাস)। তিনি ১৫০ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রিকভাষা পড়তে ও লিখতে পারা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে লেখালেখি করেছিলেন ল্যাটিন ভাষায়। তিনি প্যাগান পিতামাতার ঘরেই জন্মেছিলেন এবং একটি ভালাে কাজের আশায় রােমে এসেছিলেন। কিন্তু মধ্যযুগের শুরুতে তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি ১৯৭ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজে ফিরে আসেন। আর তারপর থেকে বাকিজীবন সেখানেই বসবাস করেন। তার রচনার মূল দিক ছিল তিনি নস্টিক দর্শনকে জনপ্রিয়তার তালিকা থেকে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই বাস্তবিকভাবে নস্টিক দর্শনের ক্রান্তিকাল আরম্ভ হয়েছিল। টারটুলিয়ান ছিলেন একজন মন্টানিস্ট যিনি জীবনভর খ্রিস্টানদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের ব্যাপারে গোঁড়ামির দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। পরে কার্থাজিনিয়ান চার্চ থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। তিনি নিজের অনুসারী ব্যক্তিদের নিয়ে কাছাকাছি একটি মন্টানিস্ট লােকালয়ে গিয়ে থাকা শুরু করেন। সেখানে তার প্রভাব ছিল সাংঘাতিক। ২২২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকেন। আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হলেন আফ্রিকার সিপ্রিয়ান (থেসিয়াস সিসিলিয়াস সিপ্রিয়ানাস)। তিনি প্রায় ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কার্থেজে জন্মগ্রহণ করেন । তিনিও প্যাগান পিতামাতার ঘরে জন্মেছিলেন এবং মধ্যযুগে এসে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তিনি অবশ্য কার্থেজে চার্চের বিশপ হিসেবেও কাজ করেন। তিনি তার রচনার মধ্যে টেরুলিয়ানের লেখার ধরনটি অবিকৃত রেখেছিলেন। ২৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি শহীদ হন।

তদকালীন দর্শনসমূহের অবস্থা

খিষ্টান ধর্মের ক্ষমতা দিনদিন এতই বেড়ে যাচ্ছিল যে সে সময় সেভেরাস আলেক্সান্ডারের (রা. ২২২-২৩৫ খ্রি.) রােমে সকল ধর্মের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা যে ইচ্ছে ছিল তা নেই হয়ে গেল। ধীরে ধীরে প্যাগান ধর্মের অনুসারী দার্শনিকেরা খ্রিস্টধর্মের বর্ধিষ্ণু জনপ্রিয়তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। এর আগে ছিল স্টয়সিজম বা স্টোইকবাদ যা কিনা অভিজাত শাসক শ্রেণির অল্প কিছু মানুষকে তার আদর্শের দিকে টেনে আনতে পেরেছিল। কিন্তু মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যুর সাথে সাথে সেই আদর্শের জনপ্রিয়তাও যেন হঠাৎ করেই মরে যায়। এরপর যে দর্শন সফলতার মুখ দেখেছিল, তা হলাে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর দর্শন। তার নতুন ধরনের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। জীবন এবং ধর্মকে তিনি নিজস্ব দর্শনে বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন। তখন দার্শনিকদের কাছে নব্য প্লেটোনিক দর্শন এমনই একটি আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিশ্বাস আর না বাড়িয়ে তারা প্লেটোর মতবাদগুলােতেই নিজেদের আবেগ-অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেত। প্লেটোর অনুসারী নব্য দার্শনিকদের মধ্যে যার নাম সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য, তিনি হলেন প্লটিনাস। ২০৫ খ্রিস্টাব্দে রােমান পিতামাতার পরিবারে মিশরে তার জন্ম হয়েছিল। তিনি অ্যালেক্সান্ড্রিয়ায় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং রােমে আসেন ২৪৪ খ্রিস্টাব্দে। তার মৃত্যুর আগে ২৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জটিল দর্শনের শিক্ষাদান করতে থাকেন। যদিও এই নব্য প্লেটোনিজম রােমান সাম্রাজ্যে বিশাল কোনাে প্রতিষ্ঠিত দর্শন হিসেবে নিজের জায়গা করে নিতে সফল হয়নি, কিন্তু প্লেটোর নানান দর্শন কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে খ্রিস্টান চার্চে প্রচলিত হয়েছে। বিশেষ করে সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশে যেখানে খ্রিস্টধর্ম বেশি প্রসার পেয়েছে, সেখানে প্লেটোর দর্শনও জনপ্রিয় হয়েছে।

খ্রিস্টানদের প্রতি অসন্তোষের কারণ ও সম্রাট ডেসিয়াসের দ্বারা খ্রিস্টান নির্যাতন

ডেসিয়াসের নির্যাতন নিয়ে বলার আগে ডেসিয়াসের ক্ষমতায় আগমন ও তদকালীন রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলে নেয়া যাক। ২৩৫ খ্রিস্টাব্দে সেভেরিয়ান রাজবংশের শেষ সম্রাট আলেক্সান্ডার সেভেরাসের (রা. ২২২-২৩৫ খ্রি.) হত্যার পর রোমান সাম্রাজ্যে শুরু হয় অরাজকতার যুগ, যা “ক্রাইসিস অফ দ্য থার্ড সেঞ্চুরি” নামে পরিচিত। এই সময়ে রােমান সাম্রাজ্য খুব দুর্বল হয়ে যায়, কেননা সাম্রাজ্য দখলের জন্য বারবার এই সাম্রাজ্যের উপর দিয়ে একের পর এক যুদ্ধ ঘটে গেছে। কারণ তার আগের পঞ্চাশ বছর ধরে কেবল সাম্রাজ্যের বাইরে থেকে আক্রমণ হয়ে আসছিল। এই আক্রমণগুলোর কারণে সাম্রাজ্য খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরের অর্ধশতাব্দীতে অন্তত ছাব্বিশজন লোক সম্রাটের আসনে আসীন হতে পেরেছিলেন। দেশে এই ক্রমাগত অরাজকতার মূল হিসেবে ছিল সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ। তখন সেনাবাহিনীতে দূর দূরান্তের প্রদেশগুলাে থেকে সেনা এসে যােগদান করতে লাগল। শুধু রোমান নয়, উচ্চমানের ভাতার জন্য হু হু করে উত্তর দিকের জার্মানিক ট্রাইবের লোকেরাও দলে দলে এসে রােমান সেনাবাহিনীতে যােগ দিলাে। সেনাবাহিনীকে এভাবে বড় করার একটা অন্যতম কারণ ছিল এই যে, যাতে সেনাপতিরা তাদের সেনাদেরকে নিয়ে সহজেই অন্য সেনাপতির সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে সম্রাটের পদ দখলে নিতে পারে। ম্যাক্সিমাস নামে একজন গ্রেসিয়ান কৃষক কিছু সংখ্যক বিদ্রোহীদের উস্কে দিয়ে গাউলে সেভেরাস আলেক্সান্ডারকে হত্যা করে নিজে সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেন। কিন্তু পূর্বেকার সামাজিক অবস্থানের জন্যই সেনাবাহিনী তাকে গায়ে লাগায়নি, পরে গর্ডিয়ান নামে এক সম্মানিত ব্যক্তি নিজেকে সম্রাট হলেন, তিনি সেভেরাস আলেকজান্ডারের সময় আফ্রিকার গভর্নর ছিলেন। তার সাথে তার সন্তানও ২য় গর্ডিয়ান নাম নিয়ে সহ-সম্রাট ছিলেন। কিন্তু তারা বেশি দিন টিকতে পারলেন না, প্রতিবাদী সেনাদের হাতেই মারা পড়লেন। এরপর গর্ডিয়ানের ১২বছরের নাতি ৩য় গর্ডিয়ান নাম নিয়ে সম্রাট হলেন। তার সময় রোমের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিদ্রোহ শুরু হলো। সেই সুযোগে পারস্যের সাশানিড বংশের সম্রাট প্রথম শাপুর রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমণ করল। গর্ডিয়ান তখন বিয়ে করে ফেলেছিলেন, শ্বশুর টাইমিসিথিয়াস পারস্যদের পরাজিত করে প্রতিহত করলেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে টাইমিসিথিয়াস মারা গেলে সেই সুযোগ নিয়ে জুলিয়াস ফিলিপাস সম্রাটকে হত্যা করে ২৪৪ সালে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি ৫ বছর শাসন করেছিলেন, তার আমলে সাম্রাজ্যে প্রচুর বিদ্রোহ হয়। ফিলিপ তার পক্ষের লোকদের মধ্য থেকে ডেসিয়াস নামে একজনকে দানিউবের তীরে বিদ্রোহ থামানোর জন্য পাঠান, ডেসিয়াস সেই বিদ্রোহ থামিয়েও দেন। কিন্তু বিদ্রোহী রোমান সেনারা ডেসিয়াসকেই তাদের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দিয়ে করে, ডেসিয়াস বিদ্রোহীদের থামাতে গিয়ে বনে যান বিদ্রোহীদেরই নেতা। এরপর তিনি সেনাসমেত ইতালিতে এসে উত্তর ইতালিতে যুদ্ধে ফিলিপকে পরাজিত করে ২৪৯ সালে নিজে সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেন।  এবারে তদকালীন রোমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানদের দিকে নজর ফেরাই। তবে আগে খ্রিস্টানদের প্রতি রোমানদের অসন্তোষের ব্যাপারে কিছু কথা বলা দরকার। ২৫০ খ্রিস্টাব্দের আগে খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন সাম্রাজ্য জুড়ে সেভাবে দেখা যেত না। সেই সময় খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন ছিল স্থানীয় আকারে ও মূলত জনতার দ্বারা, স্থানীয় শাসক কর্তৃপক্ষ খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন করেছে এরকম ঘটনা হাতে গোনা ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা একই সাথে পাবলিক কাল্ট লিডারও ছিল। রোমান ধর্মগুলো গণ অনুষ্ঠান ও উৎসর্গ অনুষ্ঠানকে ঘিরেই আবর্ত হতো। আধুনিক ধর্মগুলোতে যেরকম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার দেখা যায়, সেসময় এরকম ছিলনা। তাই খ্রিস্টানদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে রোমান এলিটরা কখনও গুরুত্ব দেয়নি। অন্যদিকে রোমান সমাজের পাবলিক রিলিজিয়াস প্র্যাক্টিসগুলোই ছিল লোকাল কমিউনিটি ও সাম্রাজ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক মঙ্গলের জন্য অপরিহার্য উপাদান। এরকম ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে সম্মান দেয়া ছিল তাদের কাছে স্থিতিশীলতা ও সাফল্যের চাবিকাঠি। রোমান সাম্রাজ্যে রিলিজিয়াস সিনক্রেটিজম বা ধর্মীয় সমন্বয়বাদের চর্চা ছিল। সেখানে সবাই নিজ নিজ ধর্ম চর্চা করতে পারত। কোন এক ঈশ্বরের প্রতি অনুগত থাকতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা সেখানে ছিল না। কিন্তু রোমান শাসকগণ রাষ্ট্রের উপর জনগণের আনুগত্য দবি করত। আর প্রজাদেরকে এই আনুগত্য প্রদর্শন করতে হতো সারা বছর জুড়ে এই পাবলিক সেরেমনিরগুলোর মাধ্যমে, অর্থাৎ বিভিন্ন রকম পান-ভোজনোৎসব ও অনুষ্ঠান উদযাপনের সাথে সাথে স্টেট রিলিজিয়নের চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদের প্রকৃতিই এমন যে, তাতে অন্য কোন “ঈশ্বর” জড়িত থাকে এমন কোন আচার পালন করা যাবে না। এজন্য খ্রিস্টানরা ফিস্ট ডেগুলোতে, শোভাযাত্রায়, বলিদান বা ধূপ জ্বালানোর মতো কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করতো না। এটা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্নতার জন্ম দেয়। তারা রোমান সম্রাটের প্রতিও ধূপ দান করতো না, যেখানে সাধারণ জনগণের মনে সম্রাটকে দেবতার মতই দেখা হতো, আর যখন তাকে দেবতার মত করে দেখা হতো তখন তিনি হয়ে উঠতেন সমগ্র সাম্রাজ্যের মানবরূপ। তাই ধর্মীয় কারণে খ্রিস্টানরা সম্রাটের উপরেও আনুগত্য দেখাতো না। রোমান সাম্রাজ্য চাইত না যে রাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোন সত্তা প্রজার আনুগত্যের ক্ষেত্রে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াক। প্রজার কাছে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্রের স্থানই হবে সর্বাগ্রে। কিন্তু খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ছিল দ্বিতীয় সর্বোত্তম। এদিকে খ্রিস্টানরা তাদের কার্যক্রমকে রাজপথ ছাড়িয়ে বাড়িঘর-দোকানপাটের মত প্রাইভেট পরিসরে নিয়ে যায়, আর ধর্ম, ঐতিহ্য এবং নগর ও জাতির মতো পাবলিক ইনস্টিটিউশনের মধ্যে যে স্বাভাবিক বন্ধন ছিল তাতে ভাঙ্গন ধরাতে শুরু করে। এভাবে তাদের দ্বারা “ধর্মের প্রাইভেটাইজিং” ছিল তাদের উপর নির্যাতনের আরেক কারণ। তারা কখনও কখনও গোপনে রাতের বেলায় মিলিত হতো, যা পাবলিক ইভেন্টে অভ্যস্ত প্যাগান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করে। এর ফলে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে যায় যে তারা গোপনে অপরাধমূলক কাজ, লজ্জাজনক পাপ, নরভক্ষণ বা অজাচারের মত কার্যের সাথে জড়িত। এদিকে খ্রিস্টধর্মের ইউক্যারিস্ট আচারের মধ্যে মদকে যিশুরু রক্ত ও রুটিকে যিশুর মাংস ভাবার একরকম সিম্বলিজম রয়েছে, এটা এই গুজবকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দেয়। এছাড়া খ্রিস্টানদের অনেক রীতিনীতি ও ধ্যানধারণাই রোমান ঐতিহ্যের সাথে মিলত না। গিবন বলেন, খ্রিস্টীয় ধর্মান্তরিতগণ তাদের পরিবার ও অঞ্চল ত্যাগ করত, এবং বারবার ভবিষ্যতে দুর্দশা আসতে চলেছে এরকম ভবিষ্যদ্বাণী করার মাধ্যমে তাদের প্যাগান প্রতিবেশীদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করত। প্যাগানদের মধ্যে এরকম ভয় ঢুকে যাবার ফলে যেটা হয়, তারা রোমান সাম্রাজ্যে দুর্ভিক্ষ, মহামারী সহ যেরকম ডিজাস্টারই আসুক না কেন সব দোষ চাপাতো খ্রিস্টানদের ওপর। আমরা দেখি খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষের দিকে টারটুলিয়ান লিখছেন, খ্রিস্টানরা দুর্যোগের জন্য দায়ী নয়, এথেকে তখনকার দিনে খ্রিস্টানদের সম্পর্কে প্যাগানদের ধ্যানধারণা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। রোমানরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাল্টের ইন্টিগ্রিটির সম্মান দিত, তাদের পূর্বপুরুষগত ঐতিহ্যকে সম্মান দিত। আর তাই দীর্ঘদিন ধরে রোমানরা খুবই এক্সক্লুসিভ ইহুদি সম্প্রদায়কে সহ্য করে এসেছে। সাধারণ রোমান জনগণ ইহুদিদেরকে পছন্দ না করলেও রোমান শাসকগণ ইহুদি ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছে। ইহুদিরা তাদের ইহুদি ট্যাক্স দিয়ে তাদের ধর্ম-কর্ম সব পালন করতে পারতো। কিন্তু খ্রিস্টানদের বেলায় তাদের প্রতি সেরকম দৃষ্টিভঙ্গি ছিলনা। যতদিন খ্রিস্টানরা ইহুদিদেরই অংশ ছিল ততদিন কোন সমস্যা ছিলনা, ইহুদিদের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, আর ঐতিহ্যকে রোমানরা শ্রদ্ধার চোখে দেখে। কিন্তু ৯৬ সালের পর রোমানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে খ্রিস্টান আর ইহুদিরা আলাদা। ইহুদিদের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, কিন্তু খ্রিস্টানরা সেই ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসা সম্পূর্ণ নতুন এক সংস্কৃতি। এই নতুন উদ্ভূত সংস্কৃতিকে রোমানরা সুপারস্টিশাস বা কুসংস্কারমূলক হিসেবে দেখত। সেই সময় তাদের কাছে “সুপারস্টিশন” আমাদের কাছে যা কুসংস্কার যেরকম ঠিক সেরকমটা ছিলনা। এর দ্বারা রোমানরা এমন এক ধর্মীয় বিশ্বাসকে বোঝাতো যা সমাজের জন্য হানিকর। তাছাড়া এই খ্রিস্টানরা এমন একজনকে পূজা করত (যিশু) যে কিনা ছিল রোমানদের দ্বারাই এক সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তাদের ধর্মগ্রন্থে ছিল রোমানদের বিরুদ্ধে কটূক্তি। তৃতীয় শতকের প্রথম দিকে দেখা যায় একজন রোমান মেজিস্ট্রেট বলছেন, “আমি সেইসব লোকের কথা অত শুনতে পারব না যারা রোমান ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে কটূ কথা বলে”। এ থেকে এই মনে হয়যে, খ্রিস্টানরা সেসময় রোমান ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে কটূ কথা বলত। এভাবে খ্রিস্টানদের সাজাপ্রাপ্ত আসামীর পূজা করা, রোমান সম্রাটের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য প্রদর্শন ও শপথ না করা, ধর্মগ্রন্থে রোমানদের নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা, আর সন্দেহজনকভাবে গোপনে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার কারণে রোমান শাসক ও প্রজাগণ উভয়পক্ষই খ্রিস্টানদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হতে শুরু করে। উত্তাল জনতা কর্তৃক খ্রিস্টানদের উপর চড়াও হবার ঘটনাও দেখা যেতে থাকে, আর এমন ক্ষেত্রে জনগণকে শান্ত করার জন্য শাসকেরা তাদের ইচ্ছানুসারেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। সব মিলে এসব ঘটনাই খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে খ্রিস্টানদের ওপর ব্যাপক হারে নির্যাতনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ২৪৯ সালে ডেসিয়াস রোমান সম্রাট হলেন। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যপন্থী টাইপের লোক। এসেই তিনি রোমের “স্বর্ণযুগকে” পুনর্জাগরিত করার কাজ শুরু করলেন। তিনি সেন্সরের প্রাচীন কার্যালয় পুনরায় চালু করলেন, কলোসিয়ামও পুনর্নির্মাণ করলেন। এবার তিনি ঐতিহ্যবাহী রোমান রীতিনীতিও চালু করার কাজে হাত দিলেন। শুরুটা হলো ২৫০ সালের ৩ জানুয়ারিতে জুপিটার দেবতার প্রতি বার্ষিক উৎসর্গের মধ্য দিয়ে। তিনি একটি অনুশাসন জারি করেন, যেখানে বলা হয় সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়েই দেবতাদের প্রতি উৎসর্গ দিতে হবে, সাথে দেবতার উদ্দেশ্য ধূপ জ্বালাবার কথাও বলা হয়। তবে ইহুদিদেরকে এই কার্য থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এখন এরকম কোন সাক্ষ্যপ্রমাণও নেই যে এই ডিক্রি ধার্য করার সময় খ্রিস্টানদেরকে টারগেট করা হয়েছিল বা তাদেরকে নির্যাতন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। বরং ডেসিয়াসের এই আদেশকে বিশাল রোমান সাম্রাজ্যকে একতাবদ্ধ করার একটি উপায় হিসেবেই দেখা হয়েছিল। সম্রাটের এই আদেশ পালনকে তার প্রতি একরকম আনুগত্যের শপথ গ্রহণ হিসেবেই দেখা হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, সম্রাটের এই আদেশের ফলে খ্রিস্টানরা প্রথম তাদের উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় চাপের স্বীকার হয়, সম্রাটের আদেশ পালনের এই অর্থ ছিল যে, হয় জুপিটারের উদ্দেশ্য উৎসর্গ করো নয়তো মরো, এটা ছিল খ্রিস্টানদের কাছে “হয় ধর্ম ত্যাগ করো, নয় মরো” টাইপের কথা। খ্রিস্টধর্ম অনুসারে খ্রিস্টানদের জন্য রোমান দেবদেবীদের উপাসনা করা বা সম্রাটের প্রতিকৃতির সামনে ধূপ জ্বালানো নিষিদ্ধ ছিল। তাই অনেক খ্রিস্টানরা সম্রাটের আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানালো। অনেক খ্রিস্টধর্মাবলম্বী রােমের সেই ধর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার চেয়ে শহীদের মৃত্যুবরণ করাকে শ্রেয় মনে করলেন। কিছু বিশিষ্ট খ্রিস্টান, যেমন পোপ ফ্যাবিয়ান, ব্যাবাইলাস অফ অ্যান্টিয়ক ও আলেক্সান্ডার অফ জেরুজালেমকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়। অরিজেন ছিলেন ডেসিয়াসের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য শিকার যিনি সম্রাটের ক্রোধের শিকার হতে হয়। তাকে সরাসরি হত্যা করা হয়নি। তবে এত গুরুতর আহত করে ফেলা হয়েছিল যে তিনি নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হন। প্রচুর খ্রিস্টানকে এই আদেশ না পালন করার জন্য হত্যা করা হয়। রােমের, অ্যান্টিয়ক এবং জেরুজালেমের বিশপদেরকে হত্যা করা হয়েছিল। এটা জানা যায়না যে, সকলের এই আদেশ মানছে কিনা তা কতটা পরিমাণে কর্তৃপক্ষ নজর রাখতে পেরেছিল, কিন্তু জানা যায় যে কার্থেজের বিশপ সাইপ্রিয়ান সহ অনেক খ্রিস্টান সেই সময় লুকিয়েছিলেন। রােম শহরের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা লুকিয়ে লুকিয়ে ধর্মপালন করতে বাধ্য হয়েছিল। তারা ঝােপেঝাড়ে, মাটির নিচের রাস্তায়, শহরের বাইরে কবরস্থানে একত্র হতে শুরু করল। এই জায়গাগুলােকে তারা নির্দিষ্ট দিনে চার্চের মতাে ব্যবহার করতে লাগল। এসব হয়ে দাঁড়ালাে তাদের গােপন ধর্মচর্চার গােপন মিলনস্থান। আবার প্রচুর খ্রিস্টান বাধ্য হয়েই সম্রাটের আদেশ পালন করেছিল। খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ে এই আদেশের ফল ছিল গুরুতর। অনেক খ্রিস্টানই যারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতো তারা এর ফলে ট্রমায় আক্রান্ত হয়। অনেকেই ধর্মত্যাগ করেছিল, কিন্তু এরা পরবর্তীতে পুনরায় খ্রিস্টধর্মে ফিরে আসতে চাইলে এদেরকে আর তার সুযোগ দেয়া হয়নি। ২৫১ সালে সম্রাট গোথ নামক জার্মানিক ট্রাইবের আক্রমণে ডেসিয়াসের মৃত্যু হয়, আর তারপর থেকে তার এই আদেশ কার্যকর করাও বন্ধ হয়। সুতরাং খ্রিস্টানদেরকে খুব বেশিদিন এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি, আঠারোটা মাস তাদেরকে এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু কম সময়ের জন্য হলেও খ্রিস্টানদের কালেকটিভ মেমোরিতে এটি এতটাই গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল যে এই সময়টা চার্চের জন্য একটি দানবীয় স্বৈরাচারের কাল হিসেবে আখ্যাত হয়। তবে ডেসিয়ানের নির্যাতনই খ্রিস্টানদের প্রতি শেষ নির্যাতন ছিলনা। পরবর্তীতে ২৫৭ সালে তারা সম্রাট ভ্যালেরিয়ানের অধীনে নির্যাতনের শিকার হয়, আর ৩০৩ সালে সম্রাট ডিওক্লেশিয়ানের আমলে এই নির্যাতন আরও গভীরতর হয়।

সম্রাট ভ্যালেরিয়ানের দ্বারা খ্রিস্টান নির্যাতন ও ক্লডিয়াস গথিকাস পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্য

সম্রাট ডেসিয়াসের সময় নতুন এক জার্মানিক ট্রাইব গথরা রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমণ করল। ক্যারাক্যালার (২১১-২১৭ খ্রি.) শাসনামলে তারা কৃষ্ণসাগরের তীরে পৌঁছে গেল। তখন তারা দুটো পৃথক দলে ভাগ হয়ে যায় – একটি দল পূর্বদিকে রওনা দিয়ে আজকের ইউক্রেনে আস্তানা গড়েছিল, তারা হলো পূর্বদিকের গোথ বা অস্ট্রোগােথ। (জার্মানিক “অস্ট” মানে পূর্ব দিক), দ্বিতীয় দলটি পশ্চিমদিকেই থেকে গেল ও রােমান প্রদেশ ডেসিয়ায় প্রবেশের জন্য যুদ্ধ করতে লাগল, এদের বলা হয় পশ্চিমা গােথ বা ভিজি গােখ। (“ভিজি” সম্ভবত ওল্ড টিউটোনিক শব্দ যার অর্থ “ভালাে”)। ডেসিয়াসের আমলে গােথ প্রজাতি স্রোতের মতাে ডেসিয়ায় প্রবেশ করতে লাগল ও প্রায় সব জায়গা থেকে রোমানদের উৎখাত করল। এদিকে রোমান সাম্রাজ্য নিজেদের মধ্যে লড়াই করেই দুর্বল হয়ে গেছে। শুরুর দিকে কিছু যুদ্ধে জিতলেও তিনি গোথদের সাথে ২৫১ এর যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। এরপর ডেসিয়াসের কর্মচারী গ্যালাস সম্রাট হলেন। কিছুদিন গোথদের তিনি ধনদৌলত দিয়ে শান্ত রাখলেও তারা আবার গ্রিস ও এশিয়া মাইনোরে আক্রমণ চালায়। যাই হোক, গ্যালাস উপজাতিদের দ্বারা নয়, বরং এক বিদ্রোহী জেনারেলের হাতেই মারা যান। তার মৃত্যু হলে গ্যালাসেরই এক কাছের লোক ভ্যালেরিয়ান তার পুত্র গ্যালিয়েনাসকে নিয়ে ২৫৩ সালে সম্রাট পদে বসেন। তিনি এসে গোথদেরকে পরাজিত করে তাদের গাউল ছাড়তে বাধ্য করেন। কিন্তু পারস্যের সাশানিড সাম্রাজ্যের সম্রাট প্রথম শাপুর আবার রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন। ফলে তিনি ২৫৪ সালে রোম ত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়েন। এই ভ্যালেরিয়ানের হাতে খ্রিস্টানরা আরেক দফা নির্যাতনের শিকার হয়।  ভ্যালেরিয়ান রোমের বাইরে অবস্থান করছেন এমন সময় ২৫৭ সালে তিনি সিনেটে খ্রিস্টানদের সম্পর্কে দুটো চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রথমটিতে তিনি সকল খ্রিস্টান যাজকদেরকে রোমান দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে বলেন, এবং সমাধিস্থলে খ্রিস্টানদের সভা করা নিষিদ্ধ করেন। পরের বছর তিনি খ্রিস্টানদের সম্পর্কে সিনেটে আরেকটি চিঠি পাঠান, সেখানে তিনি লেখেন বিশপ ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ চার্চ কর্মকর্তাদেরকে হত্যা করতে হবে, এবং খ্রিস্টান সিনেটরদেরকে পদচ্যুত করতে হবে, তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিতে হবে, এবং তাদেরকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। সেই সাথে যেসব সরকারী কর্তকর্তা-কর্মচারী ও সম্রাটের স্টাফ ও হাউজহোল্ড মেবার উৎসর্গ করতে চাইবে না তাদেরকেদাস বানানো হবে ও ইম্পেরিয়াল এস্টেটে কাজ করতে পাঠানো হবে। ভ্যালেরিয়ানের এই চিঠিগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে সেই সময় রোমান সাম্রাজ্যের একেবারে কেন্দ্রেই উচ্চপদস্থ খ্রিস্টানরা কাজ করতেন। কথা হলো ডেসিয়াসের নির্যাতন বন্ধ হয়েছিল ২৫১ সালে, আর তার এই নির্যাতন শুরু হয় ২৫৭ সালে। আর এই ৬ বছরের মধ্যেই খ্রিস্টানরা অনেক উচ্চপদস্থ আসলে আসীন ছিলেন। এর থেকে বোঝা যায়, প্রথমত ডেসিয়াসের নির্যাতনের কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদী ছিলনা, এবং খ্রিস্টানরা ধারাবাহিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হতেন না, যে সম্রাট ক্ষমতায় আছেন তার চিন্তাধারার উপর খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতন নির্ভর করত। ভ্যালেরিয়ানের আমলে কার্থেজের বিশপ সাইপ্রিয়ান, রোমের বিশপ দ্বিতীয় সিক্সটাস এবং সেইন্ট লরেন্সের মতো বিশিষ্ট খ্রিস্টীয় যাজককে হত্যা করা হয়েছিল। যাই হোক, এই নির্যাতনও বেশিদিন টেকেনি। তার সেনাবাহিনী অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল, ফলে তিনি পারস্যের সাথে শান্তির চেষ্টা করেন। এই সুযোগে শাপুর তাকে বন্দী করেন। বন্দী অবস্থাতেই তিনি ২৬০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কিভাবে মারা গেলেন সে সম্পর্কে অনিশ্চয়তা আছে, কেউ বলেন সাধারণ মৃত্যু, কেউ বলেন হত্যা করা হয়েছিল। তারপর সম্রাট হলেন তার পুত্র গ্যালিয়েনাস সম্রাট হলেন। ২৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি শাসন করেছিলেন। তিনি খ্রিস্টানদের প্রতি সহনশীল ছিলেন। তার শাসনামলে টাইরান্ট বা স্বৈরাচাররা প্রচণ্ড বিদ্রোহ শুরু করে, তাই এই সমকে ৩০ টাইর‍্যান্টের কাল বলা হয়, ৩০ জনই সম্রাট পদের দাবি করতো। তার জেনারেলরা সাম্রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে তিনটি ভাগ করে নেয়। একজন নেয় গাউল, স্পেইন ও ব্রিটেন অঞ্চল, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সম্রাটের পুত্র মারা গেল, কিন্তু সেই অঞ্চল আর উদ্ধার করা গেলনা। যাই হোক, গ্যালিয়েনাস বাবার বন্দীত্বের পরে সাম্রাজ্য চালানাে শুরু করেন। কিন্তু বিদ্যমান নানান সমস্যার সাথে আরও এত বেশি বেশি উপজাতি হামলার সমস্যা শুরু হলাে যে সেই সময়টিকে বলা হয় “তিরিশ জালিমের আমল”। একই ভাবে অ্যাথিনার ইতিহাসেও সেই সময়টিকে অন্যায় অবিচারের আড্ডাখানা বলা হয়েছে। গ্যালিনিয়াস তার বাবার মতাে অত রাগী ছিলেন না। ডেসিয়ার লোকেরা খ্রিস্টানদের প্রতি তখন মারাত্মক অত্যাচার করছিল। তিনি তার বাবার মতাে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে মােটামুটি সহনশীল থাকার একটি পথ বেছে নিয়েছিলেন। ২৬০ খ্রিস্টাব্দটি রােমান সাম্রাজ্যের জন্য কোনাে সুফল বয়ে আনেনি। এক এক সময় এমনও মনে হয়েছিল যে সাম্রাজ্যটি ভেঙে পড়ছে কিংবা কিছুতেই আবার নতুন করে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। যুগ্ম সম্রাটদের মধ্যে একজন অসহায়ের মতাে বন্দী আর আরেকজন বােকার মতাে যুদ্ধ করেই চলেছে। পশ্চিম দিকের পুরােটা অঞ্চল, যা কিনা সাম্রাজ্যের এক তৃতীয়াংশ, তা যেন ভেঙেই পড়ল। একজন জেনারেল গাউল, স্পেন আর ব্রিটেনসহ সেই পুরাে অঞ্চলটি দখল করে নিয়ে রােমান সাম্রাজ্য থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। গ্যালিয়েনাস সেই জেনারেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, যে যুদ্ধে সম্রাটের পুত্রের মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের ওই প্রদেশগুলাে উদ্ধারের প্রচেষ্টা তাকে বাদ দিতে হয়। পূর্বদিকে শাপুর এশিয়া মাইনোরের দিকে অগ্রসর হন।  আর তারপর পারস্য সাম্রাজ্যও ১৪ বছরব্যাপী স্বাধীন থাকে। এর মধ্যে শাপুর, ভ্যালেরিয়ানকে বন্দী করে তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেব করতে লাগলেন। সিরিয়া তাে তার দখলেই ছিল, এবারে এশিয়া মাইনরের দিকে অগ্রসর হলেন। সেদিকে যেতে যেতে তিনি মরুভূমির মধ্যে কোথাও গিয়ে পৌছেছিলেন। মরুভূমির মধ্যে যেখানে রাজ্য দখলের সীমানা করেছিলেন, সেটি আজও কোনাে ম্যাপে উল্লেখ করা হয়নি। সিরিয়ায়, অ্যান্টিকের ১৫০ কিলােমিটার দক্ষিণপূর্বে একটি শহর ছিল। ইহুদি প্রাচীন কাহিনী অনুযায়ী শহরটির পত্তন করেছিলেন রাজা সােলেমান। শহরটির নাম রেখেছিলেন তাদামাের (“তাল গাছের শহর”)। গ্রিক আর রােমানদের মুখে মুখে এই নামটিই হয়ে দাঁড়ালাে পালমিরা। ভেস্পসিয়ানের সময়ে এই শহরটি রােমের অধীনে চলে আসে। অ্যান্টোনিনাসের সময় আসতে আসতে শহরটি বেশ ধনী হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, কারণ এটি ছিল এমন একটি জায়গা যেখানে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মরুভূমি পার হওয়া ক্যারাভ্যানগুলাে একটু জিরিয়ে নিত। ক্রমে শহরটিতে ভিড়ভাট্টা বেড়ে গেল। হ্যাড্রিয়ান এই শহরটি দেখতে গিয়েছিলেন। আর যখন সেখানকার অধিবাসীরা রােমান নাগরিক হয়ে গেল, ক্যারাক্যালার আমলে নাগরিকত্বের সাথে সাথে তারা প্রত্যেকে রােমান নাম গ্রহণ করল। সেভেরাস আলেক্সান্ডার তার পূর্বদিকের অভিযানের সময়ে পালমিরা শহরে গিয়েছিলেন। তখন একজন নেতাগােছের পালমিরিন নাগরিক অড়েনাথুসকে (সেপটিমিয়াস অডেনাথুস) তিনি সেখানকার সিনেটর হিসেবে নিয়ােগ দেন। সিনেটরের পুত্রকেও একই সমান সম্মান প্রদর্শন করা হয়। রোমান জেনারেল অডেনাথুস পারস্যকে পরাজিত করে। কিন্তু অডেনাথুসের স্ত্রী জেনোবিয়া তাকে বন্দী করে পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলো নিয়ে সাম্রাজ্য গড়ে তুলে সম্রাজ্ঞীর আসন গ্রহণ করেন। এভাবে রোমান সাম্রাজ্য তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ২৬৮ সালে গ্যালিয়েনাস নিজ বাহিনীর হাতে খুন হন। ২৬৪ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিয়েনাসের মৃত্যুর পরে সেনাবাহিনী মার্কাস অরেলিয়াস ক্লডিয়াসকে (রা. ২৬৮-৭০ খ্রি.) সম্রাট ঘােষণা করে। তিনি ইতিহাসে সাধারণত দ্বিতীয় ক্লডিয়াস হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ডেসিয়াস, ভ্যালেরিয়ান এবং গ্যালিয়েনাসের অধীনে খুব সফলভাবে কাজ করে গেছেন। তারপর এখন সম্রাটের আসনে বসে তিনি প্রথমেই আক্রমণকারী উপজাতিদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য কোমর বেঁধে তৈরি হয়েছিলেন। উত্তর ইতালিতে তিনি অ্যালেমান্নিদের পরাজিত করে আল্পস পর্যন্ত ঠেলে পাঠিয়ে দেন। তারপর তিনি মােয়েশিয়ার দিয়ে অপরাজিত হিসেবে খ্যাতি অর্জনকারী গােথদের হটিয়ে দেয়া ও ২৬৯-৭০ সালব্যাপী যুদ্ধ করে তিনি গােথদের শােচনীয় পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করেন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি একজন সাধারণ রােমান নাগরিকের মতােই অসুখে ভুগে মারা যান। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি একজন যােগ্য উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করে দিয়ে সম্রাট হিসেবে তার শেষ দায়িত্ব পালন করেন, তিনি ছিলেন তারই শিষ্য অরেলিয়ান (২৭০-২৭৫ খ্রি.)। 

তথ্যসূত্র

  • The Roman Empire, Isaac Asimov, Houghton Mifflin Company Boston, 1967, p. 194-254
  • Cairns, Earle E. (1996). “Chapter 7:Christ or Caesar”. Christianity Through the Centuries: A History of the Christian Church (Third ed.). Grand Rapids, Michigan: Zondervan. ISBN 978-0-310-20812-9.
  • Frend, W.H.C. (1965). Martyrdom and Persecution in the Early Church: A Study of a Conflict from the Maccabees to Donatus. Cambridge: James Clarke & Co.
  • Castleden, Rodney, “The Book of Saints”. 2006,
  • https://en.wikipedia.org/wiki/Saint_Valentin
  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, প্রাচীন ও মধ্যযুগ, নূরনবী, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ৪২২-২৮

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.