অবস্থান্তরের আচার (Rites of Passage)

অবস্থান্তরের আচার (Rites of passage) সমাজ জীবনের চক্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা সকল সমাজে কম-বেশী পালন করতে দেখা যায়। আরনল্ড ভ্যান গেনেপ (Arnold Van Gennep) ১৯০৯ সালে তার ধ্রুপদী গ্রন্থ The Rights of Passage-এ সর্বপ্রথম পদটি ব্যবহার করেন।

অবস্থান্তরের আচার বলতে বোঝায় কোন ব্যক্তির একটি সামাজিক ধাপ হতে আরেকটি সামাজিক ধাপে উপনীত হওয়ার আচার-অনুষ্ঠান। প্রায় প্রতিটি সমাজে ব্যক্তি যখন এক সামাজিক মর্যাদা হতে আরেক সামাজিক মর্যাদায় উপনীত হয় তখন মধ্যবর্তী অবস্থায় কিছু আচার পালিত হয়। যেমন: জন্ম, সাবালক হওয়া, বিবাহ, মৃত্যু ইত্যাদিকে ঘিরে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। আরনল্ড ভ্যান গেনেপ বলেন, “Religious rituals can facilitate change in the lives of indunduals while reinforcing the stability of social order in which those individuals participate” অথ্যাৎ “ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ব্যক্তির জীবনে পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে এবং ঐ সকল আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি সামাজিক শৃঙ্খলার (Social order) স্থিতিশীলতাকে জোরদার করে।” ধর্মের একটি প্রধান কাজই হচ্ছে ব্যক্তি এবং সমাজকে সংকটের মোকাবেলা করতে সাহায্য করা।

অবস্থান্তরের আচারের সংজ্ঞা

১৯০৯ সালে ভ্যান গেনেপ ক্রান্তিকাল পর্ব পদটি ব্যবহার করেন। মানুষের জন্ম মৃত্যু বিবাহ ও যৌবনারম্ভ প্রভৃতি উৎসবের মধ্য দিয়ে সে অন্য একটা স্তরে পৌঁছে। ফলে তার নতুন জীবন শুরু হয়। এ উৎসবের মাধ্যমে সে আগের জীবন থেকে অন্য জীবনে প্রবেশ করে। এ উৎসবের মাধ্যমে মানুষ নতুন ও পুরাতনের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরী করে।

  • জীবনের ক্রান্তিকালীন আচার-অনুষ্ঠানের সংজ্ঞা বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে দিয়েছেন, Conrad Philip Kottak তার ‘Anthropology’ গ্রন্থে Rites De Passage-এর সংজ্ঞায় বলেছেন, “সংস্কৃতিকভাবে ক্রন্তিকালীন উত্তরণ অনুষ্ঠানকে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, যা হচ্ছে মানব জীবনের সেসব এসব কার্যকলাপ যা এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় জীবনের পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।” (Rites of passage is culturally defined activites associate with the transition from one place or stage of life to another.)
  • নৃবিজ্ঞানী G P. Murdock তার ‘Social Structure’ (১৯৬৮) গ্রন্থে বলেন, “Every culture includes customary responses to pregnancy, birth, infant helplessness, the biological vigour of young adulthood, sexual capacity, the decrepitude of old age and death” অর্থাৎ প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই গর্ভধারণ, জন্ম, সন্তান প্রসব, যৌবনে পদার্পণ, যৌনক্ষমতা, বার্ধক্যজনিত অবস্থা এবং মৃত্যুকে ঘিরে কিছু প্রথাগত ক্রিয়াকলাপ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় rites of passage সংস্কৃতির অংশ হওয়ায় একই সাথে তা ধর্মীয় এবং লোকজও বটে। আসলে এ সকল অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি তার জীবনচক্রের একটি ধাপ থেকে অন্য ধাপে পদার্পণ করে। অর্থাৎ এটি পূর্বের অবস্থা ও বর্তমান অবস্থার মধ্যে সংযোগ সাধন করে সামাজিক সংকট মোকাবেলা করে থাকে।

Voictor Turner তার ‘Dramas, Fields and Metaphors. Symbolic Action in Human Society’ (1974) গ্রন্থে Rites of Passage-এর তিনটি পর্যায়ের উল্লেখ করেছেন –

  • ১ম পর্যায় – আলাদাকরণ (Speration) : আলাদাকরণ পর্যায়ে ব্যক্তিকে তার পুরানো দল কিংবা মর্যাদা হতে আলাদা করা হয়। এই পর্বের আচার হচ্ছে পুরনো মর্যাদা কিংবা ব্যক্তিত্বের প্রতীকি রূপ মাথা ন্যাড়া করা কিংবা পুরনো নাম বাতিল করা।
  • ২য় পর্যায় – দোরগোড়া (Liminality) : দোরগোড়া পর্যায়ে ব্যক্তির অবস্থান হচ্ছে মধ্যবর্তী সে পুরনো পর্যায় অতিক্রম করেছে কিন্তু নতুনটিতে এখনো পদার্পণ করেনি। এই পর্যায়ে অনেক সমাজে ব্যক্তিকে পবিত্র হিসেবে দেখা হয়। কারণ মধ্যবর্তী অবস্থা ক্ষমতা এবং বিপদের সাথে সম্পর্কিত বলে ভাবা হয়।
  • ৩য় পর্যায় – পুনঃঅন্তর্ভুক্তিকরণ (Incorporation) : এই পর্যায়ে ব্যক্তিকে তার নতুন মর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পর্বের আচার এবং প্রতীক সাধারণত পুনর্জন্মের সাথে সম্পর্কিত।

সমাজের মানুষ যে সকল Rites of Passage পালন করে তার পিছনে রয়েছে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন বিশ্বাস। এ সকল বিশ্বাস আবার সেই সমাজের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত।

বিশ্বাস (Beliefs)

জন্মের পর থেকে মানব শিশু সমাজের বিভিন্ন রীতিনীতির প্রভাবে সামাজিক হওয়ার শিক্ষা পায়। এই সামাজিক রীতিনীতির ফলে সমাজে কিছু বিশ্বাস, প্রথা সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো আসলে সমাজ ও সংস্কৃতিরই ফসল। তাই কোন সমাজকে জানতে হলে সেই সমাজের বিশ্বাস, লোকাচার এগুলো জানা একান্ত প্রয়োজন। সমাজের এসব প্রথাগত আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে মানুষের মনোজগৎ যেভাবে প্রস্ফুটিত হয়, অন্যকিছুর মাধ্যমে তা হয় না। তাহলে আমাদের জানা দরকার বিশ্বাস কি?

বিশ্বাসের কোন যুক্তিগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। কারণ এটা হল চেতন প্রক্রিয়া। সাধারণত বিশ্বাস হল বাস্তবতার ধারণা ও চেতনা। বিশ্বাস বলতে পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্বন্ধে ব্যক্তির স্থায়ী ধারণা ও জ্ঞানকে বোঝায়। বিভিন্ন বস্তু সম্বন্ধে ব্যক্তির উপলব্ধি ও জ্ঞানের সমন্বিত রূপকেই বিশ্বাস বলা যেতে পারে। সহজ কথায়, বিশ্বাস হল কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়তার অনুভূতি। যেমন: যে ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সে সুনিশ্চিত।

বিশ্বাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Kretch and Crutchfield তাদের ‘Induidual in Society’ গ্রন্থে বলেন, “বিশ্বাস হল ব্যক্তির জগতের কোন একটি দিক সম্পর্কে তার প্রত্যক্ষণ এবং জ্ঞানের একটি স্থায়ী সংগঠন।” যেহেতু কোন প্রত্যক্ষণ বা জ্ঞান নিজেই একটি সংগঠন; বিশ্বাস হলো সংগঠনের সংগঠন। কাজেই বিশ্বাসের একটি বিন্যাস বা কাঠামো আছে এবং এটি অসম্পূর্ণ নয় সম্পূর্ণ। ব্যক্তি কোন কিছু প্রত্যক্ষ করে। ব্যক্তির এই মূল প্রত্যক্ষণগুলো পুনরায় যেভাবে বিন্যস্ত হয়েছে এবং এই পুনঃবিন্যাসের ফলে সেই সম্পর্কে ব্যক্তির যে জ্ঞান হয়েছে- এই সব কিছুর দ্বারা উৎপাদিত বা সৃষ্ট বস্তু হলো ব্যক্তির বিশ্বাস। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোন লোক বিশ্বাস করে যে এই পৃথিবী গোলাকার। ব্যক্তির এই ধরণের বিশ্বাস থাকার অর্থ হল পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন ধরণের জ্ঞানের বা ধারণার সঙ্গে ব্যক্তির এই বিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে। যেমনঃ সে বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীর এক বিশেষ ধরণের আকার রয়েছে। যদিও সে পৃথিবীকে গোলাকার দেখে না তবুও সে বিশ্বাস করে যে পৃথিবী ছেড়ে মহাশূণ্যের বহু উর্ধ্বে গেলে সে পৃথিবীকে গোলাকার কোন বস্তুর মতো দেখবে। বিশ্বাস কথাটি ব্যবহার করার সময় মনে রাখতে হবে যে, জ্ঞান, মত এবং আস্থা বিশ্বাসের অন্তর্গত। বিশ্বাস জ্ঞানমূলক, অনুভূতিমূলক নাকি কর্মপ্রবৃত্তিমূলক-এ সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও বলা যায় যে, বিশ্বাসের মধ্যে তিনটি উপাদানেরই অস্তিত্ব আছে। বিশ্বাসের জ্ঞানমূলক (cognitive) উপাদানের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, বিশ্বাস জ্ঞানের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। বিশ্বাস ছাড়া জ্ঞান হতে পারে না। যে কোন বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই জ্ঞানের অস্তিত্ব আছে।

বিশ্বাস হল অনুভূতিমূলক (Affective)। এই অনুভূতি দুই ধরনের হয়। যথাঃ

  • প্রথমত, যা আমরা বিশ্বাস করি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করতে আমরা বাধ্য হই।
  • দ্বিতীয়ত, বিশ্বাসের মধ্যে একটা স্বস্তির ভাব থাকে। যেমনঃ কোন বিষয়ে সন্দেহ হলে অস্বস্তি হয় আবার সন্দেহ দূর হলে মনে স্বস্তি আসে।

বিশ্বাসের মধ্যে কর্মপ্রবৃত্তিমূলক উপাদানও আছে। পরিবেশ বা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গতি সাধনের জন্য বিশ্বাস অনুযায়ী কর্ম করতে বিশ্বাস আমাদেরকে প্রবৃত্ত করে। যেমন আমার বিশ্বাস আছে জনৈক ব্যক্তি চোর। সেক্ষেত্রে আমি সব সময় সতর্ক থাকি।

বিশ্বাস সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের আচার-ব্যবহারকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের লক্ষ্যকে এবং সেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপায়কে বিশ্বাস প্রভাবিত করে থাকে। ব্যক্তির সকল ক্রিয়াকলাপ-সে ক্রিয়াকলাপ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, জীবিকা নির্বাহ, রাজনৈতিক বা অন্য যেকোন ক্রিয়াকলাপ হোক না কেন, মানুষের বিশ্বাসের দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যক্তির আচরণের বা ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে যেহেতু ব্যক্তির বিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যমূলক ভূমিকা রয়েছে, সেহেতু ব্যক্তির সামাজিক আচরণের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের অনিবার্যতাকে কোনমতেই অস্বীকার করা চলে না।

এখানে সমাজ জীবনের কয়েকটি বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন –

  • ১. স্থান সম্পর্কিত বিশ্বাসঃ স্থানের নাম, পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে কল্পকাহিনী শোনা যায় তাকেই স্থান সম্পর্কিত বিশ্বাস বলে।
  • ২. ব্যক্তি সম্পর্কিত বিশ্বাসঃ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে জনসাধারণ যে গল্পকাহিনী রচনা করে। যেমন- কোন রাজা সম্পর্কে কোন বিশ্বাস।
  • ৩. প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিশ্বাসঃ মাজার, মসজিদ, কবরস্থান, নীলকুঠি ইত্যাদিকে ঘিরে যেসব লোকবিশ্বাস প্রচলিত।
  • ৪. বৃক্ষলতা সংক্রান্ত বিশ্বাসঃ কোন বন বা গাছ সম্পর্কে বিশেষ বিশ্বাস। বিশ্বাসঃ দীঘি, বিল, প্রকুর ইত্যাদি জলাশয়কে ঘিরে কোন বিশ্বাস।
  • ৫. জলাশয় সম্বন্ধীয় যেমন: কোন পুকুর খনন করতে গিয়ে জীব বলি দিতে হয়েছে এরূপ বিশ্বাস প্রচলিত থাকা।

এভাবে দেখা যায় যে, মানব জীবন বিভিন্ন বিশ্বাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

অবস্তান্তরের আচার (Rites of Passage)

Rites of Passage-কে ঘিরে মানুষের যে সকল বিশ্বাস কাজ করে এবং সাধারণভাবে মানুষ যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যার ভিতর দিয়ে সামাজিক পরিবর্তনের সাথে ব্যক্তিকে তাল মিলিয়ে চলতে হয় সেগুলো হলঃ

শিশু জন্ম (Child Birth)

যে সকল আচার-আচরণের মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিক পরিচিতি পূনর্নির্ধারিত হয় সেগুলো প্রত্যেকটি সর্বজনীন সন্ধিক্ষণে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাইরে কিছু নয়। যেমন বেশীর ভাগ সমাজের অনেক আচার অনুষ্ঠান রয়েছে যখন কোন মহিলা গর্ভধারণের মধ্য দিয়ে মাতৃত্বের নতুন সামাজিক ভূমিকা পালন করে। মহিলাদের গর্ভধারণের সময় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়ে থাকে এবং অনেক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর পিছনে যে বিশ্বাস সমাজে প্রচলিত আছে তা হলো এর ফলে মায়ের গর্ভধারণ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হবে এবং নিরাপদে সন্তান প্রসব করতে পারবে।

গর্ভ সূচনা, শিশু জন্ম ও তৎপরবর্তী অবস্থার দ্বৈত ভূমিকা রয়েছে। প্রথমত, নারীর এ অবস্থা অশৌচ, দ্বিতীয়ত, এ অবস্থা নারীকে ভবিষ্যৎ শ্রমশক্তির ধারকরূপে চিহ্নিত করে। গর্ভাবস্থা শারিরীক ও সামাজিকভাবে একটি অসাধারণ অবস্থা। নৃবিজ্ঞানী গেনেপ তার তত্ত্বে River’s- এর গবেষণার উল্লেখ করে ভারতে টোডা সম্প্রদায়ের নারীর গর্ভাবস্থা ও জন্ম সংক্রান্ত আচারাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন-গর্ভসূচনা ও শিশু জন্ম মূলত অশৌচ অবস্থা এবং নারী ও শিশু এ সময় বিভিন্ন অশুভ শক্তির (Evil Spirit) শিকার হতে পারে। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান তাই অশুভ শক্তির নিয়ন্ত্রক হিসেবে পালন করা হয় এবং এ সমস্ত আচার পালনের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা ও নবদায়িত্ব নির্দেশিত হয়। বাংলাদেশে জন্ম সংক্রান্ত প্রচলিত আচারাদি বিশ্লেষণ করলে একই ধরনের ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়। গর্ভসূচনার সাথে সাথে নারীকে তার গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এবং এ অবস্থা শিশু জন্মের পর এক নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এই সময়সীমা উত্তরণকালে কিছু আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নারীকে তার পূর্বতন গোষ্ঠীতে নতুন মর্যাদায় ও দায়িত্বে সংযোজিত করা হয়। গর্ভবতী নারীর চালচলন, খাদ্যগ্রহণ, সামাজিক সম্পর্ক ও আচরণের উপর বিভিন্ন প্রকার Taboo আরোপিত হয়। যেমন ভর দুপুরে বা সন্ধ্যায় গাছতলায় যাবে না, মৃতের বাড়ি যাবে না। কারণ অশুভ শক্তির (যথা ভূত, প্রেত্নী ইত্যাদি) দৃষ্টি পড়তে পারে। প্রচলিত রীতে আছে যে, যন্ত্রণাদায়ক প্রসব বেদনা এড়াতে হলে দ্বার প্রান্তে বসবেনা তদ্রুপ চন্দ্রগ্রহণ, সূর্য গ্রহণের সময় গর্ভবতী নারীর খাদ্য গ্রহণ ও চালচলনে Taboo রয়েছে। এ ধারণাটি ভারতীয় উপমহাদেশে বহুল প্রচলিত। ব্ল্যাঁশে (Blanchet) এর গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশের একটি গ্রাম মিয়াপুরে এর ব্যাখ্যা হিসেবে পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে।

নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় আঁতুড়ঘর বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ফ্রেজার তার The Golden Bough গ্রন্থে আঁতুড় বা জন্মদানের অবস্থানের বর্ণনা দিয়েছেন। আঁতুড়ঘরে অবস্থান এক ধরনের অন্তনবর্তীকালীন অবস্থা, এখানে প্রবেশাধিকার সীমিত। প্রসূতি প্রাকৃতিক প্রয়োজন ভিন্ন এই ঘরের বাইরে আসেনা। উপরন্ত বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় এখানে অবস্থানের সময়সীমা নির্দিষ্ট। যেমন- বুলগেরীয় জন্মসংক্রান্ত আচারে বাংলাদেশের মত ৪০ দিন আঁতুড়ঘরে বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে হয়। মা ও নবজাতক এ অবস্থায় অশৌচ। এমতাবস্থায় তারা যে কোনও মুহূর্তে অশুভ শক্তির অহিতকর বা ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হতে পারে, মা ও নবজাতকের রক্ষাকল্পে নানাবিধ আচার ও রীতিনীতি প্রচলিত রয়েছে। যেমন আঁতুড়ঘরেও আগুন আলো জ্বালিয়ে রাখা হয় অশুভ শক্তি হতে রক্ষাকল্পে। এ রীতিটি শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত নয়, বরঞ্চ পৃথিবীর অন্যান্য সমাজেও প্রচলিত। প্রায় সর্বজনীনভাবে শিশু জন্মের পর কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয় যা মানব শিশুকে মানব সমাজে প্রবেশের প্রতীকীস্বরূপ। আর নবজাতকের মাকে সমাজে মা হিসেবে পরিচয় করায়। যেমন শিশুর জন্মকে ঘিরে আমাদের সমাজের যে সকল আচার অনুষ্ঠান পালিত হতে দেখা যায় তা হল মুসলমানদের মধ্যে শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পরপরই আযান দেওয়া হয়, হিন্দুদের মধ্যে উলুধ্বনি ও শঙ্খ বাজানো হয়। আবার অনেক জায়গায় আঁতুড় ঘরের চারপাশে কাঁটা রাখা হয় বা ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়। কারণ বিশ্বাস করা হয় যে, এগুলো থাকলে কোন অশুভ শক্তি নবজাতককে আক্রমণ করতে পারবে না বা তার ক্ষতি করতে পারবে না। ধারণা করা হয় যে, যেহেতু মা ও নবজাতক এ সময় অশুচি অবস্থায় থাকে ফলে তাদের উপর অশুভ শক্তির আক্রমণ হওয়ার সম্ভবনা বেশী থাকে। শিশু জন্মের ষষ্টদিনের আবার বেশরি ভাগ জায়গায় অনুষ্ঠান পালন করা হয়, সেখানে সাধারণত শিশুর নামকরণ করা হয়ে থাকে। মা ও শিশুর অশৌচ অবস্থা ২১ থেকে ৪০ দিন হতে পারে এবং এ সময়টি উত্তরণকালে নানা আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অশৌচ শোধন করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ শিশুর নখ, চুল ৭ দিন, ১৪ দিন ২১ দিন অথবা ৪০ দিনে কাটা হয়। নখ, চুল ইত্যাদির কাটা অংশ প্রচলিত রীতি মেনে, আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে রূপা/ সোনার দামে দাম ধরে কোন সাধু/ফকিরকে দেওয়া হয় এবং কাটা অংশ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। এ প্রসঙ্গে অপর দুটি জন্ম সংক্রান্ত আচার উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গর্ভফুল (Placenta) মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। World View অনুযায়ী কলা যায় নারী পৃথিবী/ধরিত্রীর প্রতীক। পৃথিবীর উৎপাদন ক্ষমতার সাথে নারীর উৎপাদন ক্ষমতাকে সাদৃশ্য করা হয়, তেমনি পৃথিবী যেমন শুচি/অশুচি সর্বপ্রকার ক্ষমতা ধারণে সক্ষম নারীও তদ্রুপ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নাড়ী (Umbilical Cord) কাটার আচারেও একই ধরনের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। পাঞ্জাবে পুরুষ শিশু জন্মগ্রহণের পর নাড়ী কাটা হয় পিতৃপুরুষের ছুরি দিয়ে, আর মেয়েদের অপেক্ষাকৃত কম শক্ত যে কোনও দ্রব্য দিয়ে। উত্তর আমেরিকার Arizona Oraifi Hopi উপজাতীয় ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তীর ও মেয়েদের ক্ষেত্রে কাঠি যা শস্য একত্রীকরণে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে সাধারণত বাঁশের কঞ্চি অথবা ইদানিং ব্লেড ব্যবহার করা হয়।

তবে অনেক সমাজে মা তার দাঁত দিয়েও নাড়ী কাটে। মনে করা হয় এতে সন্তানের মায়ের প্রতি টান থাকবে। এসবের মাধ্যমে শিশুকে তার জন্মক্ষণে মায়ের গর্ভ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সমাজ জীবনে সংযোজিত করা হচ্ছে এবং শিশুর ভবিষ্যৎ ভূমিকা, মর্যাদা ও দায়িত্ব জন্মক্ষণেই নির্ধারিত হচ্ছে।

পলিনেশিয়ার সামোয়রা এবং টিয়েরা ডেল ফিগার ইয়াগান সমাজে নতুন শিশুকে সমুদ্রে স্নান করানো হয়। কারণ সমুদ্র হচ্ছে তাদের খাদ্যের উৎস। অনেত খ্রিস্টান আছেন যারা অপরাধের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন, প্রতীকিরূপে পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য তাদের শিশুদের জন্মের সাথে সাথে ধৌত করা হয়।

এভাবে জন্ম থেকে বয়ঃপ্রাপ্তির এই ক্রান্তিকাল পর্যন্ত সব সমাজেই শিশুকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠান চলতে থাকে। মানব অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত ধর্মীয় আচারাদির মাধ্যমে ব্যক্তিকে পুরো ধাপে সমাজে সংযোজিত করতে সহায়তা করা হয়েছে। সেই আচার অনুষ্ঠানকে বলা হয় প্রারম্ভিক আচার অনুষ্ঠান, বয়ঃপ্রাপ্তি/বয়ঃসিদ্ধ আচার। যদিও এই অনুষ্ঠানাদি সাধারণভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং মনস্তাত্তিক বয়ঃসিদ্ধির সময় জুড়ে কেন গ্যানেপ যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দেন তা হল তারা সামাজিক বয়ঃপ্রাপ্তির ওপর জোর দেন। তিনি জোর দেন শৈশব থেকে বয়সিদ্ধ হওয়ার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার ক্রান্তিকালের ওপর। এগুলো সবই করা হয়ে থাকে বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এবং ব্যক্তিকে সমাজের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য।

বয়ঃসিদ্ধ আচার (Adulthood Rituals)

বিভিন্ন সমাজ Physical Puberty বা যৌবনপ্রাপ্তিকে Social Rites শব্দটির চাইতে Initiation Rites শব্দটি ব্যবহারের যৌক্তিকতা বোধ করেছেন। বয়োসন্ধি কালে যখন যৌবন প্রাপ্তি ঘটে তখন সাধারণত এ সকল আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। মেয়েদের প্রথম ঋতুস্রাব/রজ-দর্শনের সময়ে কিছু কিছু সমাজে আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন: মার্কিন চিরি কাহুয়া এ্যাপাশে ইন্ডিয়ানদের মধ্যে এই অনুষ্ঠান দেখা যায়। এ অনুষ্ঠানকে ছোট ও বড় এই দু’পর্বে ভাগ করা হয়। প্রথম পর্বে প্রতিটি বালিকার প্রথম রজঃদর্শনে একটি সংক্ষিপ্ত ক্রিয়ানুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে বালিকার পরিবারের সকল সদস্য ও বালিকার সঙ্গিনীরাপে উপস্থিত থাকে একজন বৃদ্ধা। এতে বালিকার দীর্ঘজীবন, নীরোগ স্বাস্থ্য ও মঙ্গলময় ভবিষ্যত কামনা করা হয়; যেখানে একজন শামান ধর্মীয় ও পবিত্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠান শেষে সকলের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য, তামাক ও জিনিসপত্র বিলি করা হয়।

দ্বিতীয় পর্বে এ উপলক্ষে বছরে একটি বড় রকমের অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যে সমস্ত বালিকা এক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো রজঃস্বলা হয়েছে ও প্রাথমিক ক্রিয়ানুষ্ঠানে উত্তীর্ণ হয়েছে তারাই এতে আমন্ত্রিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের বৃহৎ ক্রিয়ানুষ্ঠানে বিবাহযোগ্য যুবতী ও ভবিষ্যতে মা হওয়ার যোগ্য নারীকে আর্শীবাদ করা হয়। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায় যে সমাজে নারীর ঋতুস্রাবের বিপরীতমুখী ও উচ্চশক্তি সম্পন্ন ভূমিকা রয়েছে। প্রথমত: ঋতুস্রাব প্রকৃতিগতভাবে সন্তানধারণের ক্ষমতার নির্দেশক। দ্বিতীয়ত, এটা বিপদজনক ও অশৌচ। সংক্ষেপে বলা যায়, এই দ্বৈত ভূমিকা হচ্ছে গঠন ও ধ্বংস শক্তিসম্পূর্ণ। এখানে সম্পন্ন গঠনশক্তি Natural বা প্রকৃতিগতভাবে নারীর এ ক্ষমতা ভবিষৎ বংশধরের বাহক হিসেবে কার্যকরী। শক্তি হচ্ছে Cultural বা সংস্কৃতিগত। ঋতুস্রাবের গঠনমুখী ভূমিকার জন্য প্রথম ঋতুবর্তী নারীর মর্যাদা ও দায়িত্বের পরিবর্তন ঘটে এবং ধ্বংসশক্তি নিহিত থাকার কারণে অশুভ শক্তি থেকে রক্ষাকল্পে নারীর উপর এ অবস্থায় বিভিন্ন Taboo আরোপিত হয়। উল্লেখিত দ্বৈত ভূমিকার তাৎপর্য বিভিন্ন প্রারম্ভিক আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

ব্ল্যাঁশে, আজিজ ও ম্যালনির গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঋতুমতী হবার ব্যাপারটি অশৌচ ধারণার সাথে যুক্ত এবং নারীর এ অবস্থা ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক। জীবনচক্রে নারীর ঋতুবতী হওয়া ও গর্ভ ধারণের আচারাদি পারিবারিক গভীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে বিবাহ ও মৃত্যু আচার আরও বিস্তৃত। যদিও প্রথম ঋতুবতী হবার ব্যাপারটি মহিলাদের অঙ্গনে সীমাবদ্ধ, তবুও পিতৃতান্তিক ব্যবস্থায় বিষয়টি সম্পর্কে বাড়ির প্রধান পুরুষকে অবহিত করা হয়। কারণ এ ব্যবস্থায় অবিবাহিতা কন্যার কুমারীত্ব রক্ষার দায়িত্ব পরিবারের পুরুষের উপর ন্যস্ত। এ সময় হতে কন্যার সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষার্থে তার চালচলন আহার, শয়নব্যবস্থা ও কর্মের ওপর বিভিন্ন Taboo আরোপিত হয় ও বিবিধ আচার পালিত হয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পর্দা প্রথার বিধি এ সময় কন্যার ওপর আরোপিত হয়।

মুসলমানদের মধ্যে পুরুষ ছেলেদের খৎনা করানো হয়। কোন কোন সমাজে বয়োসন্ধির উৎসবে উপবাসও পালন করানো হয়। আসলে এ সকল আচার পালনের মাধ্যমে তাকে সমাজের সদস্য হিসেবে আকাঙ্ক্ষিত পথে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং তার মর্যাদা ও ভূমিকায় যে পরিবর্তন এসেছে সে বিষয়ে তাকে এবং সমাজকে অবহিত করা হয়।

বিবাহ (Marriage)

বিবাহ মানব সমাজের একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান নর-নারীর সামাজিক মর্যাদার পরিবর্তন ও দায়িত্ব অর্জনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বৈবাহিক আচার জীবনচক্রের সব আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে সবচাইতে বিস্তৃত। কারণ বৈবাহিক আচার অনুষ্ঠান জীবনের অনেকগুলো বিশেষ অবস্থাকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হয় ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করে। এগুলো নীচে উল্লেখ করা হলো:

  • ১। বর ও কনের গোষ্ঠী অর্থাৎ দুটি গোষ্ঠী নতুন আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। (যদি এই দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তের অথবা পূর্বের বৈবাহিক সম্পর্ক না থাকে।)
  • ২। অর্থনৈতিক লেনদেন কন্যাপন অথবা যৌতুক প্রদান, উপহার বিনিময়।
  • ৩। বাসস্থান পরিবর্তন।
  • ৪। সম্পত্তি তথা উত্তরাধিকারের পরিবর্তন এবং
  • ৫। মর্যাদার পরিবর্তন তথা নবদায়িত্ব গ্রহণ।

বৈবাহিক আচার অনুষ্ঠান বাংলাদেশের নারীর Rites de passage হিসেবে কিভাবে কাজ করে তা উপরে উল্লেখিত বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে আলোচিত হবে। বোসেরাপের মতে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে নারী একাধারে অর্থনৈতিক ও জৈবিক উৎপাদক। নারী এ ব্যবস্থায় মূলত গৃহস্থালী কাজসহ ফসল তোলার পরবর্তী সকল প্রকার কাজ (Post harvest operations) করে থাকে। এই দায়িত্বভার পরিবারের গৃহবধূদের উপর ন্যস্ত। অবিবাহিতা যুবতী কন্যার ভূমিকা গৃহস্থালীতে অনেকটা Liminal phase এ থাকে। তাকে সর্বপ্রকার দায়িত্বও দেওয়া হয় না। অথবা যতটা সম্ভব সর্বপ্রকার কায়িক শ্রমসাধ্য কাজে নিযুক্ত করা হয় না। সেজন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে একজন বয়োপ্রাপ্ত কন্যাকে আইনানুগ বয়সের আগেই বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ যে, একজন নারীর কম বয়সে বিয়ে হলে সে বহু সন্তান প্রসব করে ভবিষ্যৎ শ্রম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। সেজন্য এ দেশের কন্যা প্রথম ঋতুমতী হবার পর থেকেই পারিবারিকভাবে পাত্রের সন্ধান হতে থাকে। সাধারণত পাত্র প্রস্তাব আনে ও কনে দেখার দিনক্ষণ স্থির হয়। এসময় থেকে দুটি গোষ্ঠীর (যদি বিয়ে একই গোষ্ঠীর বাইরে হয়) মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠতে থাকে। কনে দেখার পর আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়, বিয়ের দিনক্ষণ ও লেনদেনের আলাপ আলোচনা হয়। এটি একটি প্রাথমিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্থির হয়। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে একে স্থানীয় ভাষায় ‘পানচিনি’ বলা হয়। পাত্র পক্ষ এ অনুষ্ঠানে মিষ্টি, পান ও কনের জন্য কিছু উপহার সামগ্রী নিয়ে আসে। মিষ্টি দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করে, পান Fertility এবং কনেকে উপহার প্রদান তাকে নতুন গোষ্ঠীতে সংযোজিত করার ইঙ্গিত বহন করে এই অনুষ্ঠান থেকে বিয়ের উৎসব পর্যন্ত এ সময়টিতে কন্যার চালচলন, আচরণ ও আহারের উপর কিছু কিছু Taboo লক্ষণীয়। তবে এগুলি ঋতুস্রাব বা গর্ভবস্থা ও জনন্ম সংক্রান্ত Taboo-এর মত ভয়ঙ্কর অথবা অশুচিতার ইঙ্গিত বহন করে না। তবে এ সময়টিকে Rites of Passage-এর অন্তবর্তীকালীন অবস্থা বলা চলে। কারণ কনেকে বিভিন্ন Taboo ও আচারের মাধ্যমে তার গোষ্ঠী হতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন করা হয়। অর্থাৎ বিবাহ ও একটি মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকাল। এ সময় কিছু নতুন নিয়মকানুন মানতে হয়। বিবাহের পূর্বে যৌনতার যে বিধি নিষেধ ছিল তা পরিত্যাগ করতে হয় বিবাহের মাধ্যমে। কারণ Sexual fidelity বা যৌনতার আনুগত্যকে বিবাহের একটি অংশ হিসেবে ধরা হয়। যে সকল ব্যক্তি অবিবাহের অবস্থা থেকে বিবাহের অবস্থায় উপনীত হয় তারা বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই ধরনের পরিবর্তনে গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হয়। বিবাহের মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদায় পরিবর্তন আসে। ব্যক্তি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজে পরিচিতি লাভ করে। আবার স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের মধ্যেও মর্যাদা ও ভূমিকায় পরিবর্তন হয়। আবার বিবাহের সময় যে সকল আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় তা মূলত সামাজিক স্বীকৃতিরই নামান্তর। যেমন: আমাদের দেশে গায়ে হলুদ, ভোজ সভার আয়োজন ইত্যাদি পালন করা হয় যা মূলত সামাজিক আচার অনুষ্ঠান হিসেবে নবদম্পত্তিকে সমাজে পরিচয় করিয়ে দেয়।

মৃত্যু/শেষকৃত্য (Death/Funerals)

মৃত্যু সার্বজনীন প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া জীবনের সাথে জড়িত। সাধারণত মনে করা যেতে পারে, মৃত্যু আচারে Rites de separation কার্যকরী। কিন্তু বিভিন্ন সমাজের মৃত্যু আচার বিশ্লেষণে দেখা যায় Rites of incorporation-এর ভূমিকা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। পেনীয় তত্ত্বে দেখা যায় ক. মৃত্যুতে শোক পালন একটি অন্তবর্তীকালীন অবস্থা; যার শুরু Rites of separation Rites of incompration-এর মাধ্যমে যার শেষ। মৃত্যু আচার ও শোক পালনকাল মূলত গঠিত হয় মৃত ও তার গোষ্ঠী সদস্যদের নিয়ে এবং এর গভীরতা ও স্থায়িত্ব মৃতের আর্থ সামাজিক অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। মৃত্যু ঘিরে শোক পালন এবং মরদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া/মৃতুপরবর্তী আরেকটি ক্রান্তিকালীন অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান মৃতের নিকট আত্মীয়দেরকে শোকের প্রক্রিয়া থেকে সমাজ নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় খাপ খাওয়াতে সহায়তা করে, সমাজ থেকে একজনের অনুপস্থিতির বার্তা সকলকে পৌছে দেয়।

মৃতের শেষকৃত্যানুষ্ঠান সামাজিক সংহতি রক্ষায় ও সহায়তা করে। কারণ সমাজ কোন ব্যক্তিকে ব্যতিক্রমধর্মী দেখতে চায়না। ফলে সকলে মিলিত হয়ে শোক পালন করে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। আবার মৃত্যু দেখে মানুষের মধ্যে ভীতি কাজ করে, যে ভীতি মূলত পাপ- পূণ্যকে ঘিরে। ব্যক্তি তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে যার মাধ্যমেও সামাজিক সংহতি রক্ষা পায়। মৃত্যু আচার নিয়ে বাংলাদেশে পুরোপুরি নৃতাত্ত্বিক গবেষণা হয়নি। তবে ব্ল্যাঁশে এর আলোচনায় দেখা যায় যে, বাঙালী মুসলমানদের কাছে মৃত্যু একটি পবিত্র অবস্থা এবং হিন্দুদের জন্য ঠিক বিপরীত অর্থাৎ অপবিত্র। ব্ল্যাঁশে আরও মত প্রকাশ করেছেন যে, যেহেতু মৃত্যু পবিত্র, তাই শেষকৃত্য সম্পাদনের যাবতীয় আচারাদি পুরুষ পালন করে এবং জন্ম অশৌচ ঘটনা, তাই নারীর দায়িত্ব জন্যআচার পালন করা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আচারাদির গভীরতা ও শোক পালনকাল আর্থ সামাজিক অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। সেজন্য এখানে বলা চলে যে, এদেশে মুসলিম নারীর মৃত্যুআচার তুলনামূলকভাবে পুরুষের চাইতে সীমিত। উপরোক্ত পর্দা প্রথার দরুন ও প্রচলিত স্থানীয় (indigenous) ধর্মীয় বিশ্বাস মতে নারী জানাজায় অংশগ্রহণ করে না এবং কবরস্থানে সাধারণত প্রবেশ করেনা। এখানে লক্ষণীয় যে, শূচি-অশুচি ধারণা কাজ করে। হিন্দু সম্প্রদায়ে জন্মদানকালে ধাত্রীর সাহায্য নেয়, মুসলমানেরাও সাহায্য নেয়। বাংলাদেশে এ সমস্ত ধাত্রীয় মত এক শ্রেণীর মহিলা আছে যারা নারীকে স্নান করায়। তবে এদের সামাজিক মর্যাদা ধাত্রীর চাইতে কিছুটা উর্ধে। মৃত্যুর মাধ্যমে নারীর স্বামীর সাথে সকল বন্ধনের মুক্তি ঘটে। স্বামী-স্ত্রীর মৃতদেহ স্পর্শ করতে পারবেনা। এখানে Rites of separation কাজ করে। আরো উল্লেখ যে, স্বামী জনসমক্ষে বলে যে স্ত্রীর ওপর তার কোন দাবী/ঋণ নেই। এটিও তার স্ত্রীর সামাজিক সম্পর্কের ইতি টানে। মৃত্যু থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন অবস্থা। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ধারণা প্রচলিত আছে যে, এ সময় (সময়ের হের ফের হতে পারে) মৃত আত্মা আত্মীয়স্বজনের আসেপাশে ঘোরাফেরা মৃত্যের আত্মাকে অপর পৃথিবীতে সংযোজিত করবার জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় বিধি পালন করা হয়। যেমন: মুসলমানদের মধ্যে শান্তির জন্য মৃত্যু থেকে ৫ দিন থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত আত্মার যথা অবস্থান ও শক্তির জন্য মিলাদ-মাহফিল, কোরাআন খতম ইত্যাদি ধর্মীয় আচারাদি পালন করা হয়।

Rites of passage বা অবস্থাস্তরের আচার পরিবর্তনে চাপের সাথে তাল মিলিয়ে নিতে সহায়তা করে এবং সফলতার সহিত নতুন ভূমিকার সাথে আত্মীকরণ করাতে চায়। সামাজিকভাবে অবস্থান্তরের আচার সম্প্রদায়কে পরিবর্তনের ব্যাপারে সচেতন করে। ব্যক্তিকে একথা জানিয়ে দেয় যে নতুন পরিস্থিতিতে নতুন ভূমিকায় সঠিকভাবে কি পালন করতে হয়। শিক্ষার মাধ্যমেই তাদের এ পরিবর্তন কার্যকরভাবে সম্পূর্ণ হয়। বিশ্বাসও এভাবে ব্যক্তি Rites of passage-এর মাধ্যমে তার সংস্কৃতির সাথে ধাপে ধাপে নিজেকে খাপ খাওয়ায় এবং সমাজের সাথে একাত্ম হয়।

তথ্যসূত্র

  • নৃবিজ্ঞান পরিচিতি, প্রফেসর আখন্দ মোঃ মোখলেসুর রহমান, শেখ মোহাম্মদ আবু শামীম, মোঃ হুমায়ুন কবীর, লেখাপড়া, ঢাকা

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.