বিংশ শতকের প্রারম্ভে বাংলায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমত, গুপ্তসমিতির গঠন, কার্জন ও বঙ্গভঙ্গের পূর্বের অবস্থা

(সকল উদ্ধৃতি চলিতকৃত)

ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে বিভিন্ন কারণে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর অসন্তোষ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যারা মনে-মনে বিশ্বাস করতেন যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যেসব অভাব ও অভিযোগ যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে সরকারের কর্ণগোচর করা হয় তা শীঘ্রই দূর হবে এবং শাসনকাজের উন্নতির জন্য যেসব প্রস্তাব পেশ করা হয় তা কাজে পরিণত হবে, তারা ক্রমশঃই নিরাশ হয়ে পড়লেন। কারণ, কংগ্রেসের কুড়িটি বার্ষিক অধিবেশনের (১৮৮৫-১৯০৫) পরেও ভারতের রাজনীতিক অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা গেল না। কংগ্রেসের বহুপূর্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলার ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটেনে পার্লামেন্টের কাছে এক আবেদনপত্রে যে সব দাবি করেছিল, কংগ্রেস ১৯০৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত তার বেশী কিছু প্রার্থনা করেনি। সুতরাং অর্ধশতাব্দীর চেষ্টায়ও যখন কোন ফল পাওয়া গেল না, তখন কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের পন্থার ওপর লোকে ক্রমশঃই বীতশ্রদ্ধ হতে লাগল।

কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গঠন

কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই দেশাত্মবোধ ও রাজনীতিক আন্দোলন বাংলায় প্রবল হয়ে উঠেছিল। বাংলায় যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমত ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছিল। কিন্তু এ বিষয়ে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ মুম্বাই (তদকালীন বোম্বাই) থেকে প্রকাশিত ‘ইন্দুপ্রকাশ’ নামক পত্রিকায় ১৮৯৩-৯৪ সালে যে এগারোটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। (এর মধ্যে প্রথম আটটি ও একাদশ-মোট নয়টি প্রবন্ধ Prof. Haridas Mukherjee Prof. Uma Mukherjee প্রণীত Sri Aurobindo’s Political Thought (1958), Part II, pp. 61-123. গ্রন্থে পুনমুদ্রিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলোর নাম “News Lamps for Old” বিশেষ অর্থসূচক।) তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন:

  • “কংগ্রেসের আদর্শ ও লক্ষ্য ভ্রান্ত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত, এর কাজপ্রণালী ভ্রমাত্মক, এর নেতৃবৃন্দের কাজে ও আচরণে আন্তরিকতা, অকপটতা ও একাগ্রতা নেই-সুতরাং তারা নেতা হবার অযোগ্য। এককথায় বলতে গেলে লোকেরাও যেমন অন্ধ, নেতারাও তেমনি অন্ধ, অন্ততঃ এক চক্ষুহীন কানা। ….আমরা কথায় কথায় গণতন্ত্রের দোহাই দেই, কিন্তু যে কংগ্রেসের সঙ্গে জনসাধারণের কোন সম্বন্ধ নেই, এবং যা কেবলমাত্র অতি অল্পসংখ্যক এক শ্রেণীর লোকের প্রতিনিধি, তাকে কোন মতেই ‘জাতীয়’ এই আখ্যা দেয়া যায় না।”
  • অন্যত্র অরবিন্দ লিখেছেন, “ক্ষয়রোগে আক্রান্ত রোগীর মতো বাংলায় কংগ্রেস দিন দিন মৃত্যুপথে চলছে। ডব্লিউ, সি. বনার্জি (ব্যানার্জী), লালমোহন ঘোষ প্রমুখ কংগ্রেসের নেতৃবর্গ এখন আইনসভার (Legislative Council) উর্দ্ধ আবহাওয়ায় বিচরণ করেন এবং যুব সম্প্রদায়ের সাথে তাদের কোন সম্বন্ধ নেই। কিন্তু দেশে প্রকৃত দেশপ্রেমের উদ্দীপনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।”

কংগ্রেসের সমালোচকেরা বলতেন,

  • “কংগ্রেসের প্রধান উদ্যোক্তা হিউম সাহেব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে যে বাণী (manifesto) প্রচার করেছিলেন (মার্চ, ১৮৮৩) এবং প্রধানতঃ যা কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা জুগিয়েছিল, তাতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন: (১) ব্যক্তির ন্যায় জাতির উন্নতিরও প্রধান উৎস অন্তরের প্রেরণা। (২) যারা স্বাধীনতা চায় তারা নিজেরাই এর জন্য সংগ্রামে প্রথম অবতীর্ণ হবে। (৩) আত্মোৎসর্গ ও নিঃস্বার্থপরতা ছাড়া ব্যক্তি বা জাতির সুখ ও স্বাধীনতা লাভ সম্ভব নয়।”
  • “কিন্তু বিগত বিশ বছরের মধ্যে কংগ্রেস এই মহৎ আদর্শের অনুযায়ী কোন কাজই করেনি-ব্রিটিশ সরকারের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে নিজেরা চুপ করে বসে আছে।”
  • বাংলার বাইরে মহারাষ্ট্রে বালগঙ্গাধর তিলক ও পঞ্জাবে লালা লাজপৎ রায়ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করতেন।
  • কংগ্রেসের সমালোচকেরা বলতেন, কেবলমাত্র এর বার্ষিক অধিবেশনে কয়েকটি মন্তব্য পাশ করে ফল পাওয়া যাবে না। এসব আবেদন-নিবেদনের পরিবর্তে আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং গঠনমূলক কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে একমত হলেও এই আত্মনির্ভরতার প্রকৃতি সম্বন্ধে গুরুতর মতভেদ দেখা যায়।

দেশের উন্নতির জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা

একদল আর্থিক উন্নতির দিকেই জোর দিলেন। দেশীয় শিল্পের উন্নতির জন্য স্বদেশী দ্রব্যের দোকান ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশী কাপড়ের দোকান খুললেন (১৮৯৭)-এর নাম ছিল ‘স্বদেশী ভাণ্ডার’। ১৯০১ সালে যোগেশ চৌধুরী ‘ইণ্ডিয়ান স্টোর্স’ (Indian Stores) এবং দুই বছর পরে সরলা দেবী খুললেন ‘লক্ষ্মী-ভাণ্ডার’। জামসেদপুরের লৌহখনির আবিষ্কর্তা প্রমথনাথ বসু দেশীশিল্পের প্রদর্শনী এবং এই বিষয়ের একটি কনফারেন্সের ব্যবস্থা করলেন।

শিক্ষাবিষয়ে আত্মনির্ভরতার দৃষ্টান্তস্বরূপ সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-প্রবর্তিত ‘ডন সোসাইটি’ (১৯০২), ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ‘সারস্বত আয়তন’ এবং বোলপুরে রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’ (১৯০১) প্রভৃতির উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯০৪ সালে যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের চেষ্টায় একটি সমিতি গঠিত হল। এটি আর্থিক বৃত্তি দিয়ে বাঙ্গালী যুবকদেরকে কাজকরী শিল্প শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাত। এরকম বৃত্তিভুক্ত অনেক যুবক দেশে ফিরে শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতি সাধন করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে অনেকগুলি প্রবন্ধে অননুকরণীয় ভাষায় কিভাবে সরকারের ওপর নির্ভর না করে বাঙ্গালী সব বিষয়ে আত্মনির্ভর হতে পারে তার নির্দেশ দিয়েছেন। এই বিষয়ে কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ (১৩০৮-১২ বাংলা সালে লিখিত) ‘আত্মশক্তি’ নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় (‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ তৃতীয় খণ্ড (বিশ্বভারতী) ৩য় সংস্করণ ১৩৪৮, পৃ. ৫১৭-৬৩৬)।

  • এর মধ্যে ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আত্মনির্ভরতার সমর্থনে তিনি লিখেছেন: “আমাদের দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকাজ রাজা করেছেন। কিন্তু বিদ্যাদান থেকে জলদান পর্যন্ত সবই সমাজ সহজে সম্পন্ন করেছে।”
  • এই ব্যবস্থার পুনঃপ্রচলনের সম্বন্ধে লিখেছেন: “স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হবেন। পূর্বে যখন রাষ্ট্র সমাজের সাথে অবিচ্ছিন্ন ছিল তখন রাজারই এই পদ ছিল। এখন, আমাদের সমাজপতি চাই। তার সঙ্গে তার পার্ষদ-সভা থাকবে, কিন্তু তিনিই আমাদের সমাজের অধিপতি হবেন। এর অধীনে দেশের ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট অংশে ভিন্ন ভিন্ন নায়ক নিযুক্ত হবেন। সমাজের সমস্ত অভাব মোচন, মঙ্গলকর্ম চালনা ও ব্যবস্থা রক্ষা এঁরা করবেন এবং সমাজপতির কাছে দায়ী থাকবেন।”
  • ১৮৯৬ সালে কংগ্রেস সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব ইতিমধ্যেই আলোচিত হয়েছে। বাংলার প্রভিনশ্যাল কনফারেন্স সম্বন্ধে আট বছর পরে তিনি লিখেছেন: “এ কনফারেন্স দেশকে মন্ত্রণা দেয়ার জন্য সমবেত, অথচ এর ভাষা বিদেশী। আমরা ইংরেজিশিক্ষিতকেই আমাদের কাছের লোক বলে জানি-আপামর সাধারণকে আমাদের সঙ্গে অন্তরে অন্তরে এক করতে না পারলে যে আমরা কেউই নই, একথা কিছুতেই আমাদের মনে হয় না।”
  • তারপর তিনি লিখেছেন, “আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী…পলিটিক্যাল সাধনার চরম উদ্দেশ্য একমাত্র দেশের হৃদয়কে এক করা।… দেশের হৃদয় লাভকেই যদি চরম লাভ বলে স্বীকার করি… তবে দেশের যথার্থ কাছে যাবার কোন কোন পথ চিরদিন খোলা আছে, সেগুলোকে দৃষ্টির সামনে আনতে হবে। মনে করো, প্রোভিনশ্যাল কনফারেন্সকে যদি আমরা যথার্থই দেশের মন্ত্রণার কাজে নিযুক্ত করতাম, তবে আমরা কী করতাম? তা হলে আমরা বিলাতি ধাঁচের একটা সভা না বানিয়ে দেশী ধরনের একটা বৃহৎ মেলা করতাম। সেখানে যাত্রা- গান-আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূর দূরান্ত থেকে একত্র হত। সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হত। সেখানে ভালো কথক, কীর্তন-গায়ক ও যাত্রার দলকে পুরস্কার দেয়া হত। সেখানে ম্যাজিক লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ লোকদেরকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশ সুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয়া হত এবং আমাদের যা কিছু বলার কথা আছে, যা কিছু সুখদুঃখের পরামর্শ আছে তা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলে সহজ বাংলা ভাষায় আলোচনা করা যেত।”
  • কিন্তু এসব সত্ত্বেও যে পুরাতন যুগের পরিবর্তে এক নূতন যুগের সূচনা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন: “কিন্তু বাঙ্গালির চিত্ত ঘরের মুখ নিয়েছে-নানা দিক থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কেবল যে স্বদেশের শাস্ত্র আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করছে এবং স্বদেশী ভাষা স্বদেশী সাহিত্যের দ্বারা অলংকৃত হয়ে উঠছে তা নয়, স্বদেশের শিল্পদ্রব্য আমাদের কাছে আদর পাচ্ছে, স্বদেশের ইতিহাস আমাদের গবেষণাবৃত্তিকে জাগ্রত করছে, রাজদ্বারে ভিক্ষাযাত্রার জন্য যে পাথেয় সংগ্রহ করেছিলাম, তা প্রত্যহই একটু একটু করে আমাদেরকে গৃহদ্বারে পৌঁছে দেবারই সহায়তা করছে।”

রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্লেষণ, বিশেষতঃ তিনি যে-প্রতীকারের পন্থা নির্দেশ করেছেন তার মূল্যায়ন সম্বন্ধে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিস্থলে বাংলার ইতিহাসে যে এক যুগসন্ধি উপস্থিত হয়েছিল একথা স্বীকার করতেই হবে।

যুবকদের মধ্যে অভূতপূর্ব উত্তেজনা ও আখড়ায় ব্যায়াম শিক্ষা

এই প্রসঙ্গে পূর্বোক্ত ‘ডন সোসাইটি’র উল্লেখ করা যেতে পারে। এর প্রতিষ্ঠাতা সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই যুগের উপযুক্ত মানুষ তৈরী করার জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভগিনী নিবেদিতা, সখারাম গণেশ দেউস্কর প্রভৃতি অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন। সখারামের গ্রন্থ ‘দেশের কথা’ সেযুগে যুবকদের মনে অভূতপূর্ব উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। এখানে শিক্ষাপ্রাপ্ত বহু যুবক পরবর্তীকালে সশস্ত্র বিপ্লব ও অন্য নানারকম উপায়ে দেশসেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের প্রেরণায় শারীরিক উন্নতিসাধনের দিকেও জাতীয়তাবাদীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। “নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ”- বিবেকানন্দের এই উক্তি জাতীয়তার মন্ত্র বলে অনেকে গ্রহণ করলেন। “বাঙ্গালী জাতিকে শৌর্যে বীর্যে বড় হতে হবে”- নানা স্থানে নানা ভাবে স্বামীজি এটি উদাত্তস্বরে ঘোষণা করলেন। এর জন্য তিনি যুবকদেরকে ‘গীতা’-পাঠ এর চেয়ে ফুটবল খেলায় বেশী মনোযোগ দিতেও আহ্বান করেছিলেন।

কলকাতার বিভিন্ন স্থানে ‘আখড়া’ স্থাপিত হল। এখানে প্রধানতঃ ডন, বৈঠক, মুগুর, কুস্তি প্রভৃতি ব্যায়াম শিক্ষা দেয়া হত। বাঙ্গালীর ভীরুতার অপবাদ দূর করা এবং সার্কাস প্রদর্শনীতে শ্যামাকান্তের শারীরিক ব্যায়ামের অদ্ভুত কৃতিত্ব এবং শক্তি ও সাহসের পরিচয় এসব ব্যায়ামাগারের প্রেরণা যুগিয়েছিল। শ্যামাকান্ত পরবর্তীকালে সন্ন্যাস গ্রহণ করে ‘সোহং স্বামী’ নামে পরিচিত ছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দশকে এবং বিশ শতকের প্রথম দশকে এরকম বহু সমিতি গড়ে উঠে।

১৮৯৭ সালে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ‘আত্মোন্নতি সমিতি’, ১৯০০-১৯০১ সালে ময়মনসিংহের ‘সুহৃৎ সমিতি’, ১৯০২ সালে চন্দননগরে গোন্দলপাড়ায় ‘বান্ধব সম্মিলনী’, ১৯০৪ সালে চিংড়িপোতায় (২৪ পরগণা) ‘স্বাস্থ্য কেন্দ্র’, ১৯০৫ সালে ঢাকায় ‘মুক্তি সংঘ’ ও বরিশালে ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’, ১৯০৬ সালে ফরিদপুরে ‘ব্রতী সমিতি’, ১৯০৭ সালে আহিরীটোলা লেনে ‘স্বদেশ সেবক সমিতি’ ও রাণাঘাটে ‘শক্তি সমিতি’, এবং ১৯০৮ সালে কলকাতায় ‘যুবক সমিতি’ প্রভৃতি এবং এগুলি ছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন পল্লীতে ও বাংলার প্রায় সব জেলাতেই এরকম সমিতি গড়ে উঠেছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্যচর্চা, সাহিত্য এবং নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের আলোচনা, জনশিক্ষা ও জনসেবা। ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সরলা দেবীর ‘লক্ষ্মী ভাণ্ডার’ ছিল কিছুটা আখড়া, কিছুটা ভাণ্ডার এবং মূলতঃ দেশসেবক দলের মিলনক্ষেত্র। ১৯০৪ সালে তিনি বালিগঞ্জে ‘স্বাস্থ্য অ্যাকাডেমী’ (academy) স্থাপন করেন। এইখানে দস্তুরমত আক্রমণ ও প্রতিরোধ প্রণালী, লাঠি, ছোরা, তলোয়ার পরিচালনা, যুযুৎসু, বক্সিং, ড্রিল প্রভৃতি শিক্ষা দেয়া হত এবং প্রথম তিনিই এসব কাজের যোগ্য শিক্ষক মূর্ত্তাজা সাহেবকে নিযুক্ত করেন। বড় লাঠিখেলায় তিনি কয়েকজন বিখ্যাত শিষ্য তৈরী করেছিলেন, তাদের মধ্যে পুলিন দাস অন্যতম। ১৯০৪ সালে সরলা দেবী ‘বীরাষ্টমী ব্রতে’র প্রবর্তন করেন। এখানে নানারকম শক্তির পরীক্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত। তিনি নিজে রঙ্গমঞ্চে অসিহস্তে এটি চালনার দক্ষতা প্রদর্শন করতেন।

লোকের মনে বিপ্লবাত্মক ভাবের জাগরণ

এসব সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান প্রধান পরিচালকবর্গের মধ্যে অনেকে পবরর্তীকালে বিপ্লবী নেতারূপে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিলেন এবং বাইরের কুস্তির আখড়া প্রভৃতি বিপ্লবী কেন্দ্রের বহিরাবরণ ছিল মাত্র। পূর্বোক্ত গঠনমূলক কর্ম ছাড়াও দেশের খুব অল্পসংখ্যক লোকের মনে বিপ্লবাত্মক ভাবও ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। অনেক দেশের ইতিহাসে দেখা যায় যে, বিদেশী অথবা দেশীয় স্বেচ্ছাচারী শাসনের দুর্গতি ও লাঞ্ছনা দূর করার অন্য কোন উপায় না দেখে একদল লোক গুপ্ত সমিতি গঠনপূর্বক হিংসাত্মক ও বিপ্লবাত্মক কার্যপদ্ধতি অবলম্বন করে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে যে, উনিশ শতকের শেষদিকেই এই মনোবৃত্তির বীজ বাংলায় উপ্ত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) যে পরবর্তীকালে বাংলার বিপ্লবীদের প্রেরণা যুগিয়েছিল তা তাদের অনেকেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু তার পূর্বেই সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর ম্যাৎসিনির (Mazzini) ও ইতালীর মুক্তিসংগ্রাম সম্বন্ধে ওজস্বিনী বক্তৃতা (১৮৭৫) এবং প্রায় ঐ সময়েই যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘আর্য-দর্শন’ পত্রিকায় এই সম্বন্ধে প্রবন্ধাবলী যে যুবকদের মনে কিরকম উদ্দীপনা জাগিয়েছিল ও এর ফলে কতকগুলি গুপ্ত সমিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা বিপিনচন্দ্র পাল তার আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধও করেছেন (B.C. Pal. Memoirs of My Life and Times 1. pp. 245-6)। তিনি নিজে এরকম এক সমিতির সভ্য ছিলেন। এর সভ্যদেরকে নিজের গায়ের রক্তে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করতে হত (তদেব, পৃ. ২৪৬-৮)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘জীবন স্মৃতি’ গ্রন্থে এরকম একটি গুপ্ত সমিতির উল্লেখ করেছেন। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। “কলকাতার এক গলির মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে সেই সভা বসত। দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার, দীক্ষা আমাদের ঋষ্মন্ত্রে”। বলা বাহুল্য, এসব সমিতি অনেকটা ছেলেখেলার মত ছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এসব সভা “বীরত্বের প্রহসন অভিনয় করছিল মাত্র। অভিনয় সাঙ্গ হয়ে গিয়েছে, ফোর্ট উইলিয়ামের একটি ইটও খসেনি” ( “জীবন স্মৃতি” (১৯৪০) পৃ. ১৪৮-৪৯)। কিন্তু ক্ষুদ্র বীজ মাটির অন্তরালে থাকলেও তা থেকে বিশাল বটবৃক্ষের জন্ম হয়। বাংলা যে এককালে সশস্ত্র বিপ্লববাদের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এবং তা কেবল ফোর্ট উইলিয়াম নয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করেছিল, এই সব প্রচেষ্টা তার ভূমিকাস্বরূপ ছিল। কিভাবে বিপ্লববাদ ভারতের মুক্তিসংগ্রামের একটি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সেই আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে এই বিপ্লববাদীদের প্রহসন অভিনয়ের পরিবর্তে প্রকৃত বিপ্লববাদের সূচনা ১৯০৫ সালের পূর্বেই যে আবার ধীরে ধীরে দেখা দিয়েছিল তার সম্বন্ধে এখানে কিছু উল্লেখ করা হবে।

শ্রীসতীশচন্দ্র বসুর উক্তি

এ সম্বন্ধে শ্রীসতীশচন্দ্র বসুর উক্তিই বিশেষ প্রামাণিক বলে মনে হয়। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা) তার ‘ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নামক সুপরিচিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে এই উক্তি উদ্ধৃত করেছেন (তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৪৯ পৃ. ১৭৯-১৯৪)। এই উক্তির তারিখ ১৭ই নভেম্বর ১৯৪৭, অর্থাৎ এটি বর্ণিত ঘটনার প্রায় চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর পরে স্মৃতির ওপর নির্ভর করে লিখিত; সুতরাং এতে ভুলভ্রান্তি থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু এর চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য কোন বিবরণ এখনও পাওয়া যায়নি। তাই অনুশীলন সমিতির উৎপত্তি নিয়ে তার সুদীর্ঘ বিবরণের সারমর্ম দেয়া যাক –

  • “আমি আগে নারায়ণচন্দ্র বসাকের আখড়ায় (গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রীট) ব্যায়াম করতাম। এখান থেকে আমি জেনারেল এসেমন্ত্রী কলেজের জিমনাষ্টিক ক্লাবে ভর্তি হই। গৌরহরি মুখোপাধ্যায় (ডা. যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের খুল্লতাত) এই ক্লাবের মাষ্টার ছিলেন। কলেজের অধ্যাপক Wann উপরোক্ত ব্যায়াম ক্লাবের সভাপতি ছিলেন, কিন্তু ঐ ক্লাবে লাঠিখেলার অনুমতি পাওয়া যায়নি। এজন্য এর পর মদন মিত্র লেনে একটি ছোট লাঠিখেলার ক্লাব স্থাপন করলাম। আমরা উপদেশ গ্রহণের জন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে যেতাম-যথা, রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী সারদানন্দ, Sister Nivedita (সিষ্টার নিবেদিতা) প্রভৃতি। ভগিনী নিবেদিতা বললেন, ‘তোমরা স্বামীজির উপদেশ জান, বস্তীতে স্বাস্থ্যসম্বন্ধীয় কাজ করবে, লাঠি, মুগুর খেলা করবে, শরীর চর্চা করবে’। এই সূত্রে তেঘরিয়ার শশী চৌধুরী আমাদেরকে ব্যারিষ্টর আশুতোষ চৌধুরীর কাছে নিয়ে যান। আমি শশীদাকে বলি আমাদের সভাপতি বা নেতা নেই। চৌধুরী ক্লাবের কথা শুনে বললেন, এই কাজের উপযুক্ত লোক হচ্ছেন ব্যারিষ্টর প্রমথনাথ মিত্র। চৌধুরী মিত্রের নামে পত্র দিয়ে তার কাছে আমাদের পাঠিয়ে দেন। তাকে সব কথা বললে তিনি excited হয়ে আমাকে জাপটে ধরলেন। পরে তিনি ক্লাবের Commander-in-Chief বা পরিচালক হলেন। সাতদিন বাদে তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘বরোদা থেকে একটা দল এসেছে-তোমাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী উদ্দেশ্য তাদেরও। সব রকম training (সামরিক শিক্ষা) তারা দেবে। তাদের সাথে তোমাদের amalgamate (সংযোগ) করতে হবে’। আমরাও রাজী হলাম। এই সময়ে উভয় দলে মিল হয়ে গেল। তার ফলে যে দল গঠিত হল তার সভাপতি হলেন প্রমথনাথ মিত্র, সহকারী সভাপতি হলেন চিত্তরঞ্জন দাশ (দেশবন্ধু)অরবিন্দ ঘোষ, কোষাধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সঙ্গে দলে এলেন, অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্রনাথ হালদার (চিত্তরঞ্জনের শ্যালক) ব্যারিষ্টরদ্বয়। সভ্যদের ঘোড়ায় চড়া অভ্যাস করার জন্য হালদার মহাশয় একটি ছোট ঘোড়া দলকে দান করেছিলেন। এই সঙ্গে একটি ব্যায়ামের আখড়া (১০৮ নং) আপার সার্কুলার রোডে স্থাপিত হল। বরোদা থেকে আগত যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, মদন মিত্র লেনের আখড়া পৃথকভাবে থাকুক। আমাদের অল্প বয়সের সভ্যেরা (Junior members) মদন মিত্র লেনের আখড়ায় থাকুক, আর বয়স্ক সভ্যেরা (Senior members) যতীনবাবুর নেতৃত্বে আপার সার্কুলার রোডের আখড়ায় ব্যায়াম অভ্যাস করুক। এই সময়ে অরবিন্দ একবার ছদ্মবেশে মদন মিত্র লেনের আখড়ায় এসেছিলেন। এই কথা আমি মিত্র মহাশয়ের কাছ থেকে শুনি।”
  • সমিতির নামকরণ সম্বন্ধে সতীশচন্দ্র বসু বলেন মদন মিত্র লেনে ক্লাব স্থাপনের পরে “আমরা নরেন্দ্রবাবুকে (নিউ ইণ্ডিয়ান স্কুলের হেডমাষ্টার নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) আখড়ার নামকরণের জন্য অনুরোধ করলাম। তাতে তিনি ‘অনুশীলন সমিতি’ এই নাম ধার্য করেন। এই নামটি বঙ্কিমবাবুর সাহিত্য থেকে গৃহীত হয়।” ‘অনুশীলন সমিতি’ সম্বন্ধে সতীশচন্দ্রের বিবৃতি থেকে আরও অনেক কথা জানা যায়। তা সংক্ষেপে বলছি। “এই সময়ে যে দীক্ষামন্ত্র গ্রহণ করতে হত, তাতে ‘ধর্মরাজ্য সংস্থাপন’ করার কথার উল্লেখ ছিল বলে আমার মনে হয়”। …”যতীনবাবুর নেতৃত্বে সার্কুলার রোডে আখড়া স্থাপিত হয় এবং তৎসংলগ্ন একটি বাড়ীতে তিনি সপরিবারে এবং দলের সভ্য অবিনাশ ভট্টাচার্য, রবীন্দ্র বসু এবং বারীন ঘোষ প্রভৃতি কর্মীদের সাথে বাস করতে থাকেন। ইতিমধ্যে জনকতক কর্মী কড়েয়ায় রাজনৈতিক ডাকাতি করেন। একজন ফিরিঙ্গিকে ধরে তার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। তারকেশ্বরে এরকম প্রচেষ্টা প্রথম হয়। একবার এই উদ্দেশ্যে কেউ ভগ্নী নিবেদিতার কাছ থেকে তার রিভলবার চাইতে গিয়েছিলেন। তাতে তিনি বিষম রাগান্বিত হন, এবং এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দেন। মিত্র সাহেবও এসব ডাকাতির বিপক্ষে ছিলেন”। এই সময়ে যতীনবাবু ও বারীন ঘোষের মধ্যে ঝগড়ার ফলে সার্কুলার রোডের আখড়া উঠে যায়। যতীনবাবু দেশে চলে যান। অরবিন্দ দ্বিতীয়বার কলকাতা এসে বলেন, যতীনবাবুর যে ক্লাবটা উঠে গেছে তা পুনঃস্থাপন করতে হবে এবং তদনুযায়ী নলিনী মিত্রের সাথে পরামর্শ করে তার বাড়ীর কাছে নন্দনবাগান (?) মাঠে ‘Boxing Club’ খুললাম।”
  • “যতীনবাবু পরে সোহম্ স্বামীর কাছ থেকে নিরালম্ব স্বামী নাম গ্রহণ করে সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং নিজ গ্রামে একটি আশ্রম স্থাপন করেন। সোহম্ স্বামীর পূর্বের নাম ছিল শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি সার্কাসে বাঘের সাথে লড়তেন এবং যাতে ব্যায়াম রীতি দেশে প্রচলিত হয় তার চেষ্টা করতেন। এক অনুগত বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন, ‘কতকগুলি মানুষ প্রস্তুত কর’।”
  • “এখন দলের কথায় ফেরা যাক। একই পার্টির আখড়ার নাম ছিল ‘অনুশীলন সমিতি’ আর কাগজের নাম ছিল ‘যুগান্তর’। এটি দলের বিভিন্ন বিভাগ মাত্র। ভূপেন দত্ত ছিল অনুশীলন ও যুগান্তরের intermediary link (মধ্যবর্তী সংযোগস্থল)”।
  • স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫ সন) ও তার পরবর্তীকালের কিছু বিবরণ সতীশচন্দ্র বসুর এই উক্তিতে পাওয়া যায়-তাও সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক। “স্বদেশী আন্দোলন উপলক্ষে পূর্ববঙ্গে ভ্রমণকালীন (পি.) মিত্র সাহেব ১৯০৫ সালে শ্রীপুলিন দাস ও জুনিয়ার উকিল আনন্দ চক্রবর্ত্তী (পাকড়াশী) এই দুই জনকে দলভুক্ত করেন। পরে তিনি অনুশীলনের কর্মস্থল এভাবে নির্ধারিত করেন। কলকাতার অনুশীলন হবে Head Office (কেন্দ্রীয় স্থান)। কলকাতার অধীনে ঢাকায় পুলিন দাসের একটা Head Quarter থাকবে। বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, রাজশাহী, মালদহ পুলিন দাসের কর্তৃত্বের বাইরে থাকবে।”
  • “একবার ১৯০৫ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় Bampfylde Fuller কে বরিশাল থেকে তাড়াবার জন্য Anti-Circular Society এর ছেলেদের পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তারা পুলিশের কাছে মার খায়। এই কাজে অশ্বিনী দত্ত মহাশয় তার বরকন্দাজ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই দল পুলিশের হাতে অপমানিত হয়ে ফিরে আসে। এরপর সুরেন্দ্রবাবুর অনুরোধে মিত্রসাহেব অনুশীলন থেকে বারজন খেলোয়াড় পাঠান। তারা পুলিশকে লাঠি খেলায় হারায়। এতে মুসলমান জনতা পুলিশকে মারতে যায়। কিন্তু আমি ও বরিশাল কলেজের অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাদের বাধা প্রদান করি। মুসলমানেরা বলল ‘লাট সাহেবকে এখানে ঢুকতে দেব না আর অনুশীলন বাবুরা যা বলবে তা করব’। ফুলারের স্টীমার ঘাটে এলে অনুশীলনের ছেলেরা চীৎকার করে বলল, ‘Fuller go back’। ফুলারকে প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল।”
  • “১৯০৮ সালে অনুশীলন সমিতি বেআইনী প্রতিষ্ঠান বলে ঘোষিত হলে সব শাখা পৃথক হয়ে যায়। এর পর এই সমিতির নাম পরিবর্তিত করে আমরা ‘Bengal Youngmen’s Zamindary Co operative Society’ নাম রাখি। মিত্র মহাশয় জজ সারদাচরণ মিত্রকে এই নতুন সমিতির সভাপতি করে দেন।
  • “ঢাকার অনুশীলন সমিতি বাহ্রার ডাকাতির পর পুনরায় ডাকাতি করে। এতে প্রমথনাথ মিত্র মহাশয় পুলিন দাসকে এই প্রতিষ্ঠান থেকে তাড়াইয়া দেন। মিত্র মহাশয় ডাকাতির বিপক্ষে ছিলেন।”
  • অস্ত্রসংগ্রহ সম্বন্ধে সতীশচন্দ্র বসু বলেন: “প্রথম যুদ্ধের সময় ঢাকার অবনী আমেরিকা থেকে ফিরে এসে আমাকে প্রথমে একটা রিভালবার দেন; পরে তার সন্ধান দ্বারা আমি আরো ১১টা পাই। এই সময়ে আমরা অনেক রিভালবার পাই। আমরা চন্দননগরে শিশিরকুমার বসুর মারফৎ কয়েকটি অস্ত্র লুকিয়ে রাখি। পরে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও মালদহে বেশী পরিমাণে অস্ত্র যায়। আশুবাবু চারিদিকে এসব মাল পাঠান। ঢাকায় মাল সবচেয়ে বেশি প্রেরিত হয়, তারপর রংপুরে যায়।”
  • “১৯১৪ সালে যখন সর্বদল এক হয়ে বৈপ্লবিক কাজ করতে লাগল তখন কেবল পুলিন দাস (ঢাকার অনুশীলন) আমাদের সাথে যোগদান করেনি। এর ফলে, ময়মনসিংহ, বরিশাল প্রভৃতি স্থানের অনুশীলনের বিশিষ্ট কর্মীরা কলকাতায় আমাদের সাথে এক যোগে কাজ করতে লাগল। খুলনা ও যশোরের অনুশীলন বিশিষ্টভাবে ঢাকার দলের বিপক্ষে ছিল। নোয়াখালী, ত্রিপুরা, বরিশালের অনুশীলন কলকাতার সাথে এক যোগে ছিল।”
  • “যুদ্ধের সময় ঢাকার অনুশীলন ছাড়া বাংলার সব কর্মীই এক হয়েছিল। যুদ্ধের সময় আমরা arms smuggling (গুপ্তভাবে অস্ত্র সংগ্রহ) করেছি। আমরা প্রত্যেক জেলায় অনুশীলন এবং তার বাইরের কর্মীদের এই মাল দিতাম। কর্মী হলেই তাকে আমরা মাল দিতাম। মাল দেবার পর কর্মীদের কাছে বুয়ার যুদ্ধের কয়েদীদের দ্বারা লিখিত পুস্তিকা বিতরণ করতাম। এই পুস্তিকাতে গেরিলা যুদ্ধ কি করে করতে হয় তা বিবৃত আছে। ছেলেরা training পেয়ে excursionএ -যেত। যুদ্ধের সময় কেবল কর্মীদের সস্তায় মাল প্রদত্ত হয়েছে। যুদ্ধের পর গভর্নমেন্টের চারদিকে অনুসন্ধান আরম্ভ হলে কর্মীরা অস্ত্রশস্ত্র নদী বা সাগরের জলে ভাসিয়ে দেন।”

শ্রীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যের উক্তি

ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের পূর্বোক্ত গ্রন্থে বিপ্লবী দলের একজন বিশিষ্ট কর্মী শ্রীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য ‘বৈপ্লবিক সমিতির প্রারম্ভ কালের ইতিহাস’ সম্বন্ধে যে বিবৃতি লিপিবদ্ধ করেন (১০ই নভেম্বর, ১৯৪৭) তার সংক্ষিপ্ত সারমর্ম দেয়া যাক –

  • “১৯০২ সালে অরবিন্দ কর্তৃক গুপ্ত সমিতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়ে যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১০৮ এ বা বি আপার সার্কুলার রোডে অবস্থান করেন। সেই সময় থেকে জেলে যাওয়া (সাত বছরের জন্য দ্বীপান্তর) পর্যন্ত যতীন ও বারীনদের সঙ্গে বিপ্লবের কাজে লিপ্ত ছিলাম।”
  • এর পর আখড়ার বিবরণ দিয়ে তিনি এই কাজের জন্য চাঁদা আদায়ের প্রসঙ্গে বলেন, “অরবিন্দ প্রথম থেকেই মোটা টাকা দিতেন-আসলে অরবিন্দের টাকাতেই চলিত।-সি. আর. দাশ ও অন্যান্য লোকের কাছ হতে চাঁদা আদায় করতাম।”
  • “বারীনের সঙ্গে যতীন্দ্রের মনান্তর হওয়ায় আখড়া ভেঙ্গে যায়-অরবিন্দ এসে ঝগড়া মিটিয়ে দেন। আমরা আলাদা হলেও বারীন ও আমার এবং যতীনবাবুর খরচা অরবিন্দ বরাবর দিয়ে যেতেন।
  • “বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ‘No Compromise’ নামক pamphlet নিয়ে সুরেন্দ্রনাথের কাছে যাই। তিনি সেটা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে চমকে উঠলেন এবং বললেন, এই রকম ইংরেজী কে লিখেছেন, কোন বাঙ্গালী এই রকম লিখতে পারেন না। আমি উত্তরে তখন অরবিন্দের পরিচয় তার কাছে দিলাম। আমি যখন সুরেন্দ্রবাবুকে আমাদের কথা বলি, তিনি চমকে ওঠেন, একটি গুপ্তস্থানে গিয়ে উভয়ের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বাবা, এসব তোমরা কর, এতে তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। আমি যতদূর সম্ভব তোমাদের আর্থিক সাহায্য করব কিন্তু তোমাদের এই কাজে আমি যেতে পারব না। আমরা বুড়ো হয়ে গিয়েছি। তোমরা youngmen, তোমরা এটা কর’।
  • “এই সময়ে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের কাছেও যাই। তিনি আমাদের খুব উৎসাহিত করেন। অশ্বিনীকুমার দত্তও উৎসাহিত করেন। তার সঙ্গে কলকাতায় দেখা হয়। তিনি বলেন, আমরা এখন বুড়ো হয়ে পড়েছি; এখন আমাদের শক্তিতে কুলোয় না। তোমরা এই গাছটাকে একবার নাড়া দিয়ে দাও, যাতে পাখিগুলা কিচির-মিচির করে জেগে ওঠে অর্থাৎ যাতে দেশের লোকের ঘুম ভাঙ্গে।”
  • “পুনরায় যতীনবাবু আমাদের সঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে যান, তার সঙ্গে আমাদের বনত না।”
  • “১৯০৬ সালে সুবোধ মল্লিকের বাড়িতে Party Conference হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে সভ্যেরা আসেন। প্রত্যেকেই নিজের জেলার কাজের progress (উন্নতি) বিষয়ে সংবাদ পেশ করেন। ১৯০৭ সালে উক্ত স্থানে পুনরায় conference হয়। উদ্দেশ্য ছিল পথ ও কর্ম-পদ্ধতি বিষয় নির্ধারিত করা।” অবিনাশচন্দ্র মহারাজা সূর্যকান্ত, গগন ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অবিনাশ চক্রবর্তী (মুন্সেফ) প্রভৃতির অর্থসাহায্য উল্লেখ করেছেন-সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর রিভলবার জোগাতেন।
  • তারপর অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন: ” ‘যুগান্তর’ আমাদের দেশের কাজের জন্য উৎসর্গীকৃত কাগজ ছিল। এটি আমাদের বৈপ্লবিক দলের কাগজ ছিল। পার্টি মেম্বার প্রকাশ মুজমদারের প্রেসে যুগান্তর প্রথম ছাপা হয়। তিন সপ্তাহ সেখান থেকে কাগজ বের হয়। এই প্রেস কুমারটুলীতে ছিল। তারপর যুগান্তরের নিজের প্রেস হয় (সাধনা প্রেস)।”
  • “প্রকাশচন্দ্র মজুমদার এম. এ. প্রথমে কটকে মাষ্টার ছিলেন। সেখানে তিনি দলভুক্ত হন। আমার নামেই প্রেসটা ক্রয় করা হয়। প্রকাশবাবুর কাছ থেকে ধারে প্রথমে প্রেসটা কেনা হয়। অবিনাশ চক্রবর্ত্তী ও মেদিনীপুরের জমিদার নন্দ অর্থ সাহায্য করতেন”।

অরবিন্দ ঘোষ, যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগিনী নিবেদিতা

অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যের বিবৃতিতে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষের উল্লেখ আছে। ইনি পরে কেবল রাজনীতি ক্ষেত্রে নয়, আধ্যাত্মিক শক্তির জন্য সমগ্র জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। বাংলার বিপ্লববাদ প্রতিষ্ঠায় অরবিন্দের অবদান সম্বন্ধে সঠিক সংবাদ সাধারণের মধ্যে খুব বেশী প্রচলিত নয়। সুতরাং এ সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন। ১৮৭২ সালে ১৫ই অগষ্ট তার জন্ম হয়। তার পিতা ছিলেন একজন উগ্র সাহেব। তাই তিনি শিশু অরবিন্দকে বাংলা ভাষায় কথা বলতেও শেখাননি। আট বছর বয়সেই তাকে ব্রিটেন পাঠান। সেখানে তিনি ব্রিটেনী পরিবারের ব্রিটেনী আবহাওয়ায় মানুষ হবেন, এটাই ছিল তার পিতার সঙ্কল্প। অথচ অরবিন্দের পিতা ‘Bengalee’ সংবাদপত্র থেকে ইংরেজের অত্যাচারের কাহিনী কেটে পুত্রের কাছে পাঠাতেন এবং চিঠিতে ইংরেজ সরকারকে নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী বলে তীব্র নিন্দা করতেন। এসব পাঠ করে অতি অল্পবয়স থেকেই অরবিন্দের মনে ইংরেজশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ জাগে। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং ‘মজলিস’ নামে ভারতীয় ছাত্রবৃন্দের আলোচনাসভায় ভারতে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বহু বক্তৃতা করতেন। তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, কিন্তু ইংরেজ সরকারের অধীনে জজ-ম্যাজিষ্ট্রেটগিরি করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। এই কারণে উক্ত পরীক্ষার একটি অঙ্গ হিসাবে অশ্বারোহণের পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকায় তার চাকুরী হল না। কেউ কেউ বলেন, কেমব্রিজ মজলিসে তার বিদ্রোহাত্মক বক্তৃতার জন্যই ইংরেজ সরকার এই অজুহাতে চাকুরী দিলেন না। ব্রিটেনে ছাত্র অবস্থায়ই অরবিন্দ Lotus and Dagger নামে এক গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির সভ্য ছিলেন। দেশে ফিরে (১৮৯৩ সন) অরবিন্দ বরোদা কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন। এই সময়েই তিনি যে মুম্বাই থেকে প্রকাশিত ‘ইন্দু প্রকাশে’ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। বিপ্লববাদের সাথেও তার কিছু সংস্রব ছিল। কারণ তিনি তার আত্মজীবনীতে পশ্চিমভারতে একজন রাজপুত ঠাকুরের নেতৃত্বে গঠিত একটি গুপ্ত সমিতির বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। এই সময়েই তিনি বাংলায় গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠার কল্পনা করেন।

অরবিন্দ ঘোষের বাংলায় গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তার প্রধান সহায় ও পরামর্শদাতা ছিলেন শ্রীযতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি বাঙ্গালী জাতিকে বীর্যবান করার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি বরোদায় গিয়ে সৈন্যদলে ভর্তি হলেন। তখন বাঙ্গালীর পক্ষে কোন সৈন্যদলে যোগ দেয়া খুবই কঠিন ছিল। যতীন্দ্রনাথ নিজের উপাধি উপাধ্যায় রূপে পরিবর্তিত করে অবাঙ্গালী পরিচয়ে সৈন্যদলে ভর্তি হলেন। অরবিন্দ যতীন্দ্রনাথকে বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলায় পাঠালেন। কলকাতায় তার কার্যাবলি সম্বন্ধে অবিনাশ ভট্টাচার্যের বিবরণ আগেই দেয়া হয়েছে। কিন্তু যতীন্দ্রনাথ কলকাতায় আসেন ১৯০০ বা ১৯০১ সালে-অবিনাশবাবু যে ১৯০২ সাল লিখেছেন, তা ঠিক নয়। যতীন্দ্রনাথ কিছুকাল পরে, সম্ভবতঃ পি. মিত্র ও বারীনের সাথে মতভেদ হওয়ার ফলেই, কলকাতার গুপ্ত সমিতির সংস্রব ত্যাগ করে দেশভ্রমণে বের হলেন। পুলিশ রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, তিনি দার্জিলিং, নেপাল, তিব্বত, বিহার ও উত্তর প্রদেশের বহু স্থানে তিন বছর ঘুরে পেশোয়ার যান (১৯০৭ সন)। পথে পথে সামরিক ছাউনিতে দেশীয় সৈন্যদের সঙ্গে তিনি দেখা করতেন। পেশোয়ারে পুলিশ সন্দেহ করে তিনি সৈন্যদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছেন এবং সরকারী আদেশে তিনি ঐ প্রদেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হন (১৯০৭ সন)। তারপর পঞ্জাবে তিনি বহু বিপ্লবী নায়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এদের মধ্যে লালা লাজপৎ রায়, সর্দার অজিত সিং, লালা আমির চাঁদ, ভগৎ সিংহের পিতা সর্দার কিষণ সিং, লালা হরদয়াল (তখন ছাত্র), লালচাঁদ ফলক (১৯১৫ সালে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী) প্রভৃতির নাম করা যেতে পারে (A.C. Guha-First Spark of Revolution (1971) p. 104.)। কেউ কেউ বলেন যে পরবর্তীকালে পঞ্জাবীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে বিখ্যাত ‘গদর পার্টি‘ নামে বিপ্লবী সমিতি গঠন করে এবং রাসবিহারী বসু পঞ্জাবে যে বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন তার বীজ বপন করেন যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। এর সম্বন্ধে বিশেষ কোন প্রমাণ নেই। তবে বাংলায় তিনি ১৯০৩ সালের পরে কোন বিপ্লবী সমিতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। পঞ্জাব থেকে তিনি তার জন্মভূমি চান্না গ্রামে (বর্ধমান জেলা) ফিরে যান এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করে সেখানেই আশ্রম স্থাপন করেন। তখন তিনি নিরালম্ব স্বামী নামে পরিচিত হন। অনেকের মতে “যতীন্দ্রনাথই বাঙ্গলায় বিপ্লবী ভাবধারা বহন করে এনে কলকাতায় সর্বপ্রথম বিপ্লবী সঙ্ঘ গড়ে তুলেছিলেন” (শ্রীকালীচরণ ঘোষ-“জাগরণ ও বিস্ফোরণ”-প্রথম ভাগ, পৃ. ৯৮)।

বিপ্লবী নেতাদের মধ্যে যে অনেকের ওপর ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল তার বিশিষ্ট প্রমাণ এই যে, যতীন্দ্রনাথের ন্যায় আরও কয়েকজন বিপ্লবী পরবর্তী জীবনে রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়েছিলেন অথবা স্বতন্ত্রভাবে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করেছেন। এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দকেই তারা গুরুর পদে বরণ করেছিলেন। স্বয়ং শ্রীঅরবিন্দ যে স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিনি নিজেই এটি স্বীকার করেছেন।

এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই মহীয়সী আইরিশ মহিলা ধর্মপ্রাণা ছিলেন। ধর্মশিক্ষা ও সাধনার জন্যই স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এদেশে আসেন। কিন্তু এদেশে এসেই তিনি ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি যে সশস্ত্র বিপ্লবীদের নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছেন এবং সাহায্য করেছেন সে- বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শ্রীঅরবিন্দ নিজেই ব্যক্ত করেছেন, নিবেদিতা তার দলে ছিলেন। “বিপ্লবী ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা, তাদের বিপদে-আপদে সাহায্য করা, টাকা দিয়ে, অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে, আবার বোমা তৈরী শিখবার জন্য বিদেশে ছেলে পাঠানো ইত্যাদি কত কি”। শ্রীঅরবিন্দের মতে, “এক কথায় বলা যায়, বিপ্লবীদের সাফল্যের মূলে তার দান অপরিসীম।” (তদেব, পৃ. ১০২)

কংগ্রেস নিয়ে হতাশা, পুরোনো কংগ্রেসের যুগের সমাপ্তি ও বঙ্গভঙ্গের মাধ্যেম নবযুগের আগমন

এসব ও অনুরূপ আরও অনেক ঘটনা আলোচনা করলে বেশ বোঝা যায় যে, বিশ শতকের গোড়ার দিকে ও তার কিছু পূর্ব থেকে বাংলার একদল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং এর কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে উদাসীন বা হতাশ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ দেশের অগ্রগতির জন্য জাতীয় সংগঠন ও জাগরণের অন্য রকম নানা উপায় বা পথের অনুসন্ধান ও আলোচনা করছিলেন। এই পরিবর্তন কেবল বাংলাতাই সীমাবদ্ধ ছিল না। ভারতের অন্য প্রদেশেও এর সূচনা দেখা দিয়েছিল। মহারাষ্ট্রে গণপতি ও শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করে তিলক জাতীয় চেতনা উদ্বোধনের চেষ্টা করেন। ১৮৯৬ সালে দুর্ভিক্ষের সময়ও তিনি খাজনা বন্ধ করার জন্য কৃষকদের উপদেশ দেন।

১৯০১ সালে পঞ্জাবকেশরী লালা লাজপৎ রায় লিখলেন, প্রতি বছর ইংরেজী শিক্ষিত সম্প্রদায় কংগ্রেস নামে যে উৎসবের অনুষ্ঠান করেন তার চেয়ে শিল্পশিক্ষা এবং পণ্যোৎপাদনের সম্বন্ধে আত্মনির্ভরতা (Technical Education and Industrial Self-help) আমাদের পক্ষে বেশি প্রয়োজনীয়। এই প্রসঙ্গে তিনি আরো একটি উক্তি করেন, যা পরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই মূল্যবান। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে রাজনীতিক ক্ষেত্রে একটি বিরোধের ভাব ছিল, সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে উত্তরভারতের অনেক মুসলমানই কংগ্রেসের বিরোধী ছিলেন এবং তার ফলে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এই প্রভেদ চরমে পৌঁছেছিল। লাজপৎ রায় লিখেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের মিলন অসম্ভব (chimera), সুতরাং কংগ্রেসকে স্পষ্টভাষায় খোলাখুলিভাবে কেবল হিন্দুর সংগঠন বলেই ঘোষণা করতে হবে।

উপরোক্ত বিবরণ থেকে এই সিদ্ধান্তে অনায়াসে আসা যায় যে, বাংলা তথা ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে পুরনো কংগ্রেসের যুগ শেষ হয়েছে এবং এক নতুন যুগের সম্ভাবনা ক্রমশঃই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই নবযুগ কীভাবে প্রকট হবে এবং এর প্রকৃতি কী হবে অর্থাৎ ভবিষ্যৎ মত ও পথের সন্ধান সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও অনিশ্চিত ছিল। এই সময়ে এমন একটি ঘটনা ঘটল যার প্রভাবে এই অনিশ্চয়তা দূর হল। প্রথমে বাংলা এবং পরে তার অনুকরণে সমগ্র ভারতবর্ষ যে নতুন পথের সন্ধান পেল সেই পথে অগ্রসর হয়েই ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ঘটনাটি হল ১৯০৫ সালের বঙ্গ বিভাগ। এই বঙ্গ-ভঙ্গের জন্য প্রধানতঃ দায়ী তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জন।

লর্ড কার্জন

লর্ড কার্জন ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই জানুআরি ভারতের বড়লাট হয়ে আসেন এবং ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই নভেম্বর পদত্যাগ করেন। মাঝে তিনি ছুটি নিয়ে ব্রিটেন গিয়েছিলেন এবং ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল থেকে ৯ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে অনুপস্থিত ছিলেন। তার সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় কয়েকটি তথ্যই উল্লেখ করা যাক –

  • প্রথমতঃ, তিনি কলকাতা পৌরসভায় (Municipal Corporation) জনসাধারণের ক্ষমতা লোপ করে একে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। ঐ বছর জাতীয় কংগ্রেসে একটি প্রতিবাদসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
  • দ্বিতীয়তঃ, তিনি কলকাতা (ও অন্য দুইটি) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় সরকারী কর্তৃত্বের প্রাধান্য স্থাপন করেন এবং আরও কয়েকটি অনিষ্টকর ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। 
  • তৃতীয়তঃ, ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুআরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে চ্যান্সেলারের ভাষণে কার্জন বলেন, প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের লোকের মধ্যে যে শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক গুরুতর প্রভেদ বর্তমান, তা এককথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয় যে প্রাচ্যদেশবাসীরা “অত্যুক্তিবাদী ও অতিরঞ্জনপ্রিয়। এ দেশীয় সংবাদপত্র সম্বন্ধে এই উক্তি বিশেষভাবে প্রযোজ্য” (If I were asked to sum up in a single word the most notable characteristics of the East-physical, intellectual as compared with the West, the word exaggeration or extravagance is the one that I should employ. It is particularly patent on the surface of the Native press. (Convocation Address, Calcutta University, p. 924)- Releigh, Vol. II, pp. 216-7.)। ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই ফেব্রুআরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে কার্জন বলেন, “সত্যবাদিতার উচ্চতম আদর্শ প্রধানতঃ পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য…. পাশ্চাত্যে যখন সত্যবাদিতা একটি উচ্চ স্তরের নীতি বলে সম্মান লাভ করে, তখনও প্রাচ্যে এই ধারণার অস্তিত্ব ছিল না, বরং ছল চাতুরী দ্বারা সত্য গোপন করাই তখন প্রশংসার যোগ্য বলে বিবেচিত হত।… ইউরোপীয়ানরা মিথ্যাকে যেরূপ ঘৃণা করে এ দেশবাসী যে তেমন করে না এতে কোন সন্দেহ নেই।” কার্জনের এই উক্তিটি তখন এদেশে বিষম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণ এর তীব্র নিন্দায় সোচ্চার এবং বিশেষ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু সত্তর বছর পরে আজ এই ভাষণ পড়লে কার্জনের উক্তি যে খুবই আপত্তিজনক ও নিন্দনীয়, এরকম মনে হয় না। অতি প্রাচীন ভারতে সত্যের উচ্চ আদর্শ সম্বন্ধে কার্জনের ঠিক জ্ঞান ও ধারণা ছিল না, এটা সত্য হলেও মোটামুটি বিগত চার-পাঁচ শতাব্দীর কথা মনে করেই তিনি এই উক্তি করেছিলেন বলে মনে হয়। কার্জনের উক্তি অপ্রিয় হলেও সত্য-আমরা মোটামুটি শাস্ত্রবাক্য পালন করি: “সত্য বলবে কিন্তু অপ্রিয় সত্য বলবে না”-কার্জন এই নীতি লঙ্ঘন করেছেন, কিন্তু এটাই তার উক্তি সমর্থন করে। কার্জনের শাসন-নীতির বিরুদ্ধে জনমত ন্যায্য ও সঙ্গত ছিল। কিন্তু ইতিহাসের অপক্ষপাত বিচারে মনে হয় যে ন্যায্য ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ থাকার জন্যই সমসাময়িক ভারতীয়েরা কার্জনের উক্তির জন্য তার প্রতি সুবিচার করেনি। তার মূল উক্তিটি ছিল এখানে উল্লেখ করা যাক (Extract from the speech of Lord Curzon at the Calcutta University Convocation held on 11th February, 1905.)

“The highest ideal of Truth is to a large extent a Western conception….Undoubtedly Truth took a high place in the moral codes of the West before it had been similarly honoured in the East.. We may prove it by the common innuendo that lurks in the words “oriental diplomacy” by which is meant something rather tortuous and hypersubtle. The same may be seen in oriental literature. In your epics truth will often be enrolled as a virtue; but quite as often it is attended with some qualification and very often praise is given to successful deception practised with honest aim. I remember reading in an Indian newspaper the following paragraph:

“There is not a question but that lying is looked upon with much more disfavour by European than by Native society. The English opinions on this subject are strong, distinct and uncompromising in the abstract. Hindu and Mohammedan opinions are fluctuating, vague and to a great extent dependent upon times, place and persons”:

(1) The allunion was to many well-known passages in the Ramayana, Mahabharata and other works. In one place the Mahabharata says, “There in nothing higher that to speak the truth. Yet, it is better to speak what is beneficial than to speak the truth”. In another place the permissible kinds of falsehood are stated to be five in number “on an occasion of marriage or of love or when life is in danger, or when one’s entire property is about to be taken away, or for tha sake on a Brahaman.”

(2) The Indian Mirror, a Bengali daily, Published in Calcutta.

N. B. The above two footnotes are probably added by Sir Thomas Raleigh from whose book “Lord Curzon in India” (1906, pp. 222-3) the above extract is quoted (omitting some passages as indicated by asterisks).

  • চতুর্থতঃ, অনেকেই মনে করেন যে ভারতবাসী, বিশেষতঃ বাঙ্গালীর প্রতি কার্জন অবজ্ঞার ভাব পোষণ করতেন। এ সম্বন্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার আত্মজীবনীতে নিজের যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তা সংক্ষেপে বলা যাক – “১৮৯৯ ফেব্রুআরি মাসে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কার্জনকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাবার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ ও আরও কয়েকজন সদস্য বড়লাটের ভবনে উপস্থিত হন। সদস্যদের মধ্যে দুইজন “পাম্প শু” জুতা পায়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। বড়লাটের এডিকং আদেশ করেন, হয় তারা জুতা খুলে আসবেন নচেৎ চলে যাবেন। তারা চলে এলেন। কিন্তু আরও দুই- একজন সদস্য তাদের সঙ্গে চলে আসতে চাইলে এতে বড়লাটের প্রতি অসৌজন্য দেখানো হবে ভেবে সুরেন্দ্রনাথ তাদেরকে নিরস্ত করলেন।” লর্ড কার্জন ব্যক্তিগতভাবে এই রূঢ় আচরণের জন্য কতদূর দায়ী ছিলেন তা বলা যায় না। হয়ত এই রীতিই তখন প্রচলিত ছিল। তবে কার্জনের গর্ব ও ঔদ্ধত্য নানাভাবে পরিস্ফুট হওয়ায় এটিও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; কিন্তু, এই ব্যবহারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবে প্রতিবাদ না-করায়-বরং তাতে বাধা দেয়ায়, বিশ শতকের প্রথমে বাঙ্গালীর (তথা ভারতবাসীর) যে দাসত্বসুলভ মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়, বাংলার ইতিহাসে তা উল্লেখযোগ্য। স্বদেশী আন্দোলনের পরে এর দৃষ্টান্ত বড় একটা পাওয়া যায় না। এই আন্দোলনে যে গুরুতর জাতীয় পরিবর্তন ঘটেছিল, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত।
  • পঞ্চম ও সর্বশেষ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুতর ঘটনা বাংলার ব্যবচ্ছেদ-যা বঙ্গভঙ্গ বলে সুপরিচিত। যে স্বাধীনতা-সংগ্রাম ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে এক যুগান্তর আনয়ন করেছিল বঙ্গব্যবচ্ছেদে তার সূচনা হয়।

লর্ড কার্জন ভারতীয় সেক্রেটারী অব ষ্টেটকে লিখেছিলেন যে, তার ভারতশাসন শেষ হবার পূর্বেই তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সমাধি রচনা করবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি বঙ্গভঙ্গ দ্বারা ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমাধিমন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। কলকাতার ময়দানে তাজমহলের সমকক্ষতাস্পর্ধী যে ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল’ লর্ড কার্জনের গৌরব বহন করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তাকে ভারতে ব্রিটিশশাসনের সমাধিমন্দির বললে বিশেষ অত্যুক্তি করা হবে না। কার্জনের সাথে সম্পর্কিত বঙ্গভঙ্গ এর আলোচনাই বাংলার ইতিহাসে প্রাসঙ্গিক, কিন্তু অন্যান্য ঘটনা-যেমন নতুন পৌরশাসন-বিধির পরিবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠন, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠা, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নতুন ব্যবস্থা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সম্বন্ধে নতুন নীতি, তিব্বত অভিযান-প্রভৃতির দ্বারা বঙ্গদেশ প্রভাবান্বিত হলেও এগুলি মুখ্যতঃ ভারতীয় প্রসঙ্গ। তাই বাংলার ইতিহাসে এসবের আলোচনা আনা হবেনা। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, যখন কলকাতা হতে ব্রিটিশভারতের রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয় তখন লর্ড কার্জন এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।

তথ্যসূত্র 

  • বাংলা দেশের ইতিহাস, চতুর্থ খন্ড (১৯০৫-১৯৪৭) (মুক্তিসংগ্রাম), শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার, পৃ. ১৫-৩৩
  • অন্যান্য তথ্যসূত্রসমূহ লেখার মধ্যেই

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.