ইসলামী ইতিহাসের রিভিশনিস্ট স্কুল ও প্রচলিত ইতিহাসের বিরোধিতা

(এই আর্টিকেলটি অরুণাভ করের “মুহম্মদের ঐতিহাসিকতা ও ঐতিহাসিক মুহম্মদ” নামক ব্লগ সিরিজকে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে বানানো হয়েছে)

Table of Contents

ইসলামী ইতিহাসের ক্রমবিবরণী

৫৭০ খৃষ্টাব্দ: মুহম্মদের জন্ম
৬১০ খৃষ্টাব্দ: মু্হম্মদের নবুওত প্রাপ্তি
৬২২ খৃষ্টাব্দ: হিজরা বা মহম্মদ ও তার অনুগামীদের মদিনায় আশ্রয়লাভ
৬২৪ খৃষ্টাব্দ: বদর যুদ্ধ
৬২৫ খৃষ্টাব্দ: উহুদ যুদ্ধ
৬২৭ খৃষ্টাব্দ: খন্দক যুদ্ধ
৬২৮ খৃষ্টাব্দ:হুদাইবিয়ার সন্ধি
৬৩০ খৃষ্টাব্দ:মহম্মদের মক্কা বিজয়
৬৩২ খৃষ্টাব্দ: মহম্মদের মৃত্যু, খলিফায়ে রাসেদিনের শুরু
৬৩২-৩৩ খৃষ্টাব্দ: রিদ্দার যুদ্ধ, মুহম্মদের মৃত্যু সংবাদে ইসলামত্যাগ করে মূর্তাদ হবার ধুম পরে যায়। খলিফা আবু বকর এই বিদ্রোহীদের দমন করেন।
৬৩৩ খৃষ্টাব্দ: ইয়ামানার যুদ্ধ, সিরিয়ার ধর্মপ্রচারক মুসায়লামার অনুগামীদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা যুদ্ধযাত্রা করে। মুসায়লামার জনপ্রিয়তা সম্ভবত মুহম্মদের থেকে কম ছিল না। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৬৩৩ খৃষ্টাব্দ: আরবদের ইরাক আক্রমন
৬৩৪-৬৪৪ খৃষ্টাব্দ: খলিফা উমরের আমল
৬৩৬-৩৭ খৃষ্টাব্দ: আরবদের সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইন জয়
৬৩৯ খৃষ্টাব্দ: আরবদের আর্মেনিয়া ও মিশর জয়
৬৪৪ খৃষ্টাব্দ: আরবদের পারস্য দখল
৬৪৪-৬৫৬ খৃষ্টাব্দ: খলিফা উসমানের আমল
৬৫৩ খৃষ্টাব্দ: উসমান কোরান সংকলিত করেন
৬৫০-৬০ খৃষ্টাব্দ: আরবরা উত্তর আফ্রিকা জয় করল
৬৫৪ খৃষ্টাব্দ: আরবদের সাইপ্রাস ও রোডস দখল
৬৫৬-৬৬১ খৃষ্টাব্দ: খলিফা আলির আমল
৬৬১ খৃষ্টাব্দ: আলির মৃত্যু, খলিফায়ে রাসেদিনের সমাপ্তি
৬৬১-৬৮০ খৃষ্টাব্দ: উমাইয়া শাসনের সূত্রপাত, মুআবিয়ার আমল
৬৭৪ খৃষ্টাব্দ খৃষ্টাব্দ: আরবদের কনস্ট্যানটিনোপল অবরোধ
৬৮০-৮৩ খৃষ্টাব্দ: প্রথম ইয়াজিদের শাসন
৬৮৫-৭০৫ খৃষ্টাব্দ: আবদ আল মালিকের শাসন। কিছু ইসলামী সূত্র অনুসারে তিনি কোরান সংকলিত করেন
৬৯১ খৃষ্টাব্দ: Dome of the Rock লিপি। প্রথমবারের মত কোরানের আয়াত উৎকির্ণ হল।
৬৯০ খৃষ্টাব্দ: ইসলামী সূত্র অনুসারে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কোরান সংকলিত করেন। কোরানের অনান্য সংস্করণ পান সেগুলো পুড়িয়ে ফেলেন। সূত্রমতে তিনি কোরান পরিবর্তনও করেন
৭০৫-১৫ খৃষ্টাব্দ: প্রথম আল ওয়ালিদের শাসন।
৭১১-১৩: মহম্মদ বিন কাসেমের ভারত অভিযান। আরবদের সিন্ধু জয়
৭১১-১৮ খৃষ্টাব্দ: মুসলিমদের স্পেন জয়
৭৩২ খৃষ্টাব্দ: ত্যুরের যুদ্ধে চার্লস মার্টেল মুসলিমদের অগ্রগতি রোধ করলেন।
৭৫০ খৃষ্টাব্দ: আব্বাসীয় বিপ্লব, উমাইয়া শাসনের অবসান
৭৫০-৬০ খৃষ্টাব্দ: ইবনে ইশাক প্রথম সিরাত গ্রন্থ লিখলেন
৮৩০-৬০ খৃষ্টাব্দ: ৬টি প্রধান হাদিস এই সময়ের মধ্যে লেখা হয়

রিভিশনিস্ট স্বেন কালিচ

২০০৮ সালের নভেম্বরে জার্মানীর মুনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক মুহম্মদ স্বেন কালিচ তার দীর্ঘদিনের গবেষণার ফল ঘোষনা করেন এবং দুটো বিষয় তুলে ধরেন –
(১) ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদের সম্ভবত কোন অস্তিত্ব ছিল না।
(২) যদি ইসলামের ইতিহাসে কোন মুহম্মদ যদি থেকেও থাকে তার সাথে ইসলামিক বিবরণের মুহম্মদের কোনই সম্পর্ক নেই। বস্তুত ইসলমিক বিবরণের সবটাই প্রায় গল্পকথা মাত্র যা অনেক পরে রচিত হয়েছে।

আরও অনেক ঐতিহাসিক ইসলামিক বিবরণে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, আর এমনটা দাবি করেছেন। তবে কালিচের এই ঘোষনার তাৎপর্য হল প্রথমত তিনি ছিলেন মুসলিম (জার্মানীর প্রথম ইসলামিক ধর্মতত্বের অধ্যাপক ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি ইসলাম পরিত্যাগ করেন) আর দ্বিতীয়ত তার আগে কেউই এত দৃঢ়ভাবে মুহম্মদের অস্তিত্ব নাকচ করতে পারেনি।

মুহম্মদের কর্মকান্ডের কোন ঐতিহাসিক প্রমান নেই, কোন শিলালিপি নেই যা তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে, সমকালীন কোন অমুসলিম উৎস্য মুহম্মদের নিশ্চিত প্রমাণ দেয়না। ধর্মীয় সাহিত্যকে এত নিশ্চিতভাবে ইতিহাস হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে না যার মধ্যে আবার অসংখ্য পরস্পরবিরোধী ও অসংলগ্ন তথ্য রয়েছে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের ১৬০ কোটি মানুষ এত দৃঢ়ভাবে ইসলামিক সূত্রে আস্থাশীল যে তাদের বিশ্বাসের জোর দেখে অনেক গবেষক পর্যন্ত প্রভাবিত হয়েছেন। ফলস্বরুপ কোরান ও অনান্য ইসলামিক সূত্রের অনুসন্ধান কোন নির্মোহ সংশয়ী দৃষ্টি নিয়ে করা হয়নি। যারাই এ বিষয় নিয়ে গভীর চর্চা করেছেন তারাই এ বিষয়ে ক্রিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবের কথা লিখেছেন।

রিভিশনিস্ট আর্থার জেফারি ও অ্যান্ড্রু রিপিন

গবেষক আর্থার জেফারি ১৯৩৭ সালে দেখেছিলেন-“ কোরানের সমালোচনামূলক তদন্ত হচ্ছে এমন একটি অধ্যয়ন যা এখনও শৈশবেই রয়েছে।”. প্রায় ৫০ বছর পর ১৯৯০ সালেও অ্যান্ড্রু রিপিনের লেখায়ও সেই একই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই- “আমি প্রায়ই হিব্রু বাইবেল ও খ্রিস্টধর্ম নিয়ে ঐতিহাসিক গবেষণা করেছেন এমন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করি, যারা ইসলামের প্রাথমিক ধর্মগ্রন্থগুলো নিয়ে সমালোচনা চিন্তাধারার অভাব নিয়ে আশ্চার্যান্বিত হন। ‘ইসলাম ইতিহাসের স্পষ্ট আলোয় জাত” এই ধারণাটি এখনও অনেক লেখককে ধরে নিতে দেখা যায়” (Andrew Rippin,1990)

রিভিশনিস্ট স্কুলের গবেষকগণ

এরপরও বলতেই হবে যে বহু ঐতিহাসিক বিভিন্ন সময়ে ইসলামিক বিবরণের ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করেছেন এবং বিভিন্ন ইসলামিক উৎসের মধ্যেকার বৈপরীত্য খুঁজে বের করেছেন এবং সর্বশেষে ইসলামিক বিবরণের সাথে অমুসলিম উৎসের পার্থক্য দেখিয়েছেন। এভাবে তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন Revisionist School of Islamic Studies। জন ওয়ানসব্রাউ, গান্টার লুলিং, ক্রি্স্তোফ লুক্সেমবার্গ, মাইকেল কুক, পাট্রিসিয়া ক্রোন – এই সমস্ত গবেষকদের যে বিশাল গবেষণা রয়েছে তার উপর দাঁড়িয়ে অতি সহজেই হাদিস ও সিরাত কে ঐতিহাসিক প্রমান্য গ্রন্থ হিসাবে অস্বীকার করা যায়। কারণ দেখা যায় –

১।মু্হম্মদের সমকালীন অর্থ্যাৎ সপ্তম শতাদ্বীর প্রথম চার দশকের কোন লেখায় মুহম্মদের কোন উল্লেখ নেই। শুধু তাই নয় ইসলাম বা মুসলিম শব্দটি আছে এমন কোন লেখা পাওয়া যায়নি। ৬৩৪ খ্রীস্টাব্দে রচিত একটি প্রায় ধূসর হয়ে যাওয়া ছোট চিরকুট আকারের বিবরণে মুহম্মদের নাম আছে বলে মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ওই চিরকুট থেকে কিছুই প্রমাণ করা যায়না। প্রথমবারের মত নিশ্চিতভাবে মুহম্মদের উল্লেখ পাওয়া যায় আর্মেনীয় খৃষ্টান বিশপ সেবিওসের বিবরণে।এটি ৬৭০ সালের দিকে রচিত হয়েছিল, মহম্মদের কথিত কর্মকান্ডের অন্তত ৩০-৪০ বছর বাদে।

২। এই বিবরণেও মুহম্মদের অনুগামীদের মুসলিম বলা হয়নি, বলা হয়েছে ইসমেলাইট। এর আগের সব লেখাতেই আরবদের দ্বারা বিজিত মানুষরা তাদের সারাসেন, ইসমেলাইট, হাজারীয় ইত্যাদী হিসাবে চিহ্নিত করেছে, মুসলিম হিসাবে নয়।

৩। কোরানে মুহম্মদের উল্লেখ আছে মাত্র চার বার। যেখানে মোসেস বা মুসা নবী ১৩৬ বার উল্লিখিত হয়েছে। এমনকি ফেরাউনের উল্লেখ আছে ৭৬বার। যে সমস্ত সুরায় মুহম্মদের নাম আছে সেখানেও প্রসঙ্গ পরিস্কার নয়। এসব জায়গায় অনায়াসে Mu-ammad শব্দের আভিধানিক অর্থ নিযুক্ত বা প্রসংশিত ব্যক্তি অনায়াসে লাগানো যেতে পারে।

৪। সিরা বা মুহম্মদের জীবনীগ্রন্থগুলো ইসলামিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রথম সিরাত গ্রন্থটি লেখেন ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৭) মুহম্মদের মৃত্যুর ১০০-১২৫ বছর পরে। এই বইটি ঘোষিতভাবেই পরবর্তী সব মুসলিম ঐতিহাসিকদের সোর্স হিসাবে ব্যাবহৃত হয়েছে। হাদিসগুলো লেখা শুরু মুহম্মদের কথিত মৃত্যুর অন্তত দুশ বছর পরে।

৫। ৬-৭ প্রজন্ম পরে লেখা হাদিসগুলোকে কোন আধুনিক ঐতিহাসিকই ঐতিহাসিক বিবরণ হিসাবে স্বীকার করেন নি। সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় এধরনের বিবরণ সম্পূর্ণভাবে প্রচলিত মিথের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য। মুসলিম স্কলাররাও অনেকেই জাল হাদিসের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন। অনেক সময়ই অনেক মুসলিমকে কোন হাদিস নিয়ে অস্বস্তিতে পড়লে তাকে জাল হাদিস বলে আখ্যায়িত করতে দেখা যায়।

৬। দেখা যায় পরবর্তী ঐতিহাসিক আল ওয়াকিদি (৭৪৫-৮২২) অনেক বিষয়েই ইবনে ইশাকের থেকে বেশী জানেন। যেমন যেসব অভিযানে যুদ্ধ হয়নি- কেন, কি কারণে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন ওয়াকিদি- যেখানে ইবনে ইশাক শুধু উল্লেখ করেছেন। আল তাবারীর ইতিহাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভাল করে লক্ষ্য করলে পুরোটাকেই বানানো গল্পের একটা ট্রাডিশন ছাড়া কিছুই মনে হয়না।

৭। একাধিক হাদিস পাওয়া যায় যেখানে দেখা যাচ্ছে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কোরান সংকলিত করছেন যেটা তার অন্তত ৪০ বছর আগেই উসমানের আমলে হয়ে যাওয়ার কথা। অন্য হাদিস অনুসারে মসজিদে কোরান তিলাওয়াত প্রথাও তিনিই চালু করেন।

খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে খ্রিস্টীয় মতবাদ এরিয়ানিজম ও আরবে এর অনুসারীদের ক্ষমতালাভের সুযোগ

৩১৩ সালে রোমান সম্রাট প্রথম কনষ্টানটাইন খৃষ্টধর্মকে বৈধতা প্রদান করেন। সম্রাট দূরদর্শী ছিলেন সন্দেহ নেই। তার এই সিদ্ধান্ত যে শুধু সাম্রাজ্যের অন্তর্দন্দ্ব রোধ করে তাই নয়, আরো এক হাজার বছর সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যাথলিক পোপতন্ত্র। ক্যাথলিক চার্চের সাথে খৃষ্টধর্মের অনান্য শাখার বিরোধ গোড়া থেকেই ছিল। অনান্য শাখাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ এবং আলেকজান্দ্রিয়ার কপটিক চার্চ। এখানে আলোচিত খৃষ্টধর্ম হচ্ছে চতুর্থ আরেক ধরনের খৃষ্টধর্ম। খৃষ্টধর্মের এই শাখায় যীশুর ঐশ্বরিকতা স্বীকার করা হত না। এই খৃষ্টধর্মের পুরোধাদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায় তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সম্রাট কনষ্টানষ্টাইনের সমসাময়িক আলেকজান্দ্রিয়ার যাযক এরিয়াস। খৃষ্টধর্মে যীশুর মর্যাদা নিশ্চিত করতে সম্রাট ৩২৫ খৃষ্টাব্দে নিসাইয়াতে প্রথম খৃষ্টীয় ধর্মসম্মেলন আহ্বান করেন। এরিয়াসের তত্ত্ব অর্থ্যাৎ যীশু ঈশ্বরের অংশ নন- নিসাইয়াতে পর্যুদস্ত হয় এবং এরিয়াসকে ধর্ম থেকে বহিস্কার করা হয়। তা সত্ত্বেও বহুদিন ধরে তার প্রভাব বজায় ছিল। এমনকি একসময়ে তার অনুগামীরা নিসাইয়ার সিদ্ধান্তকে বাতিল করার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন।

তা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে এরিয়াসের অনুসারীরা অতি দ্রুত কোনঠাসা হতে থাকেন। তারা আলেকজান্দ্রিয়া ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্য চলে যান। পরে মধ্যপ্রাচ্যেও ক্যাথলিক খৃষ্টধর্ম প্রভাব বিস্তার করতে থাকলে তারা আরও ভেতরে আরবের মরু অঞ্চলে সরে যান। কোরানে একেশ্বরবাদী হানিফদের উল্লেখ আছে; নবী ইব্রাহিমকে হানিফ বলা হয়েছে- “ইব্রাহীম ইহুদী ছিলেন না এবং নাসারাও ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন `হানীফ’ অর্থাৎ, সব মিথ্যা ধর্মের প্রতি বিমুখ এবং আত্নসমর্পণকারী, এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না” (সুরা আলে ইমরান, ৬৭ )। অর্থ্যাৎ বোঝা গেল হানিফরা ইহুদী নয় ক্যাথলিক খৃষ্টানও নয়, আবার মুশরিক বা মূর্তিপূজকও নয়। তাহলে হানিফদেরকে ট্রিনিটির ধারণা অস্বীকারকারী খৃষ্টান বলা হলে খুব একটা ভূল হয়না।

প্রকৃতপক্ষে এই গোষ্ঠী ধীরে ধীরে কয়েক শতাব্দী ধরে খৃষ্টধর্ম থেকে সরে যাচ্ছিল আর গঠন করছিল নতুন ধর্মের অঙ্কুর। এই বিচ্ছিন্নতার উপাদান অবশ্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলেই বর্তমান ছিল। উপজাতীয় সমাজ, কোন কেন্দ্রীয় শাসনের অনুপস্থিতি, বিশাল মরুভূমি, রোমের বিলাস ব্যাসনের তুলনায় অতি কঠোর জীবন এই সমস্ত কিছুই এই অঞ্চলের খৃষ্টধর্মকে ভিন্নভাবে বিবর্তিত হতে বাধ্য করেছে। যীশুর অনৈশ্বরিকতা আগ্রাসী একেশ্বরবাদে রূপ নিতে চলেছিল। ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল, ইতিহাস শুধু অপেক্ষা করছিল অনুকূল সময়ের, এই অঞ্চলে রোমান কর্তৃত্ব দুর্বল হওয়ার দরকার ছিল। সেই সুযোগ এসে যায় ৬১০ খৃষ্টাব্দে যখন সাসানীয় সম্রাট দ্বিতীয় খসরৌ পুরো মধ্যপ্রাচ্য দখল করে নিলেন। ইসলামী বিবরণ অনুসারে ৬১০ সালেই মুহম্মদ নবুওত প্রাপ্ত হন।

মক্কা নিয়ে সোভিয়েত প্রাচ্যবাদীরা

সোভিয়েত প্রাচ্যবিদরা ১৯৩০ এর দশক থেকে ইসলামী বিবরনের ঐতিহাসিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন। সোভিয়েত ঐতিহাসিক ক্লিমোভিচ ইসলামকে একটি আন্দোলন হিসাবে দেখেছেন যা আদিতে ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। মুহম্মদ এই আন্দোলনের নেতৃত্বে এসে একে একটি ধর্মীয় চরিত্র দেন। একই সাথে আন্দোলন তার প্রগতিশীল ও দরদী চরিত্র হারায়। তার মতে মক্কা ছিল প্রধান বানিজ্যকেন্দ্র, মক্কার বাসিন্দারা প্রায় সকলেই ব্যবসায়ী ছিলেন। অথচ বাণিজ্যের প্রধান উৎস্য ছিল কাবার তীর্থযাত্রীগন, আর কাবার দখল ছিল কিছু ধনী কুরাইস পরিবারের হাতে। এই অল্পসংখ্যক ধনী কুরাইস পরিবারের বিরুদ্ধে দরিদ্রতর শ্রেণীর শ্রেণীসংগ্রাম হিসেবে ইসলাম জন্ম নেয়।

মক্কার তদকালীন ঐতিহাসিকতার সমালোচনা ও পেট্রিশিয়া ক্রোন

আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার আলোকে ক্লিমোভিচের এই বিশ্লেষন গ্রহণযোগ্য নয় কারণ মক্কা থেকে ইসলামের উদ্ভব তত্ত্বে সংশয় প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ আছে। প্যাট্রিসিয়া ক্রোন দেখিয়েছেন বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মক্কার উল্লেখ সমকালীন (মুসলিম এবং অমুসলিম) কোন উৎস্যেই পাওয়া যায় না (Meccan trade: Patricia Crone), যা একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা কেননা পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর দক্ষিনের সব বাণিজ্যপথগুলো মক্কায় এসে মিলিত হত, মক্কার মাধ্যমেই ভারতের বিলাসদ্রব্য আরবের বণিকদের মাধ্যমে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে ঢুকত। ঐতিহাসিক ওয়াট বলেছেন, ৬ষ্ঠ শতকের শেষ দিকে কুরাইশরা ইয়ামেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বেশিরভাগ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, কিন্তু মুহম্মদের কথিত জন্মের ৫ বছর আগে ৫৬৫ খৃষ্টাব্দে লেখা ষষ্ঠ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক Procopius of Caesarea তার বিবরণে মক্কার কোন উল্লেখ করেননি। মুসলিম ঐতিহাসিকরা অনেকসময় টলেমির বিবরনে প্রাপ্ত মাকোরাবা নামে একটি স্থানের উল্লেখ দেখিয়ে তাকে মক্কা দাবি করেছেন। বাণিজ্যকেন্দ্র হঠাৎ করে গড়ে ওঠে না। কিন্তু সমসাময়িক গ্রিক, রোমান, আরামায়িক, সিরিয়ান কোন বিবরনেই মক্কার উল্লেখ নেই।

পৃথিবীর মানচিত্রে মক্কার ভৌগলিক অবস্থান লক্ষ্য করলে, সবদিক থেকে সমস্ত বাণিজ্যপথগুলো মক্কায় এসে মিলছে এরকম কল্পনা করা যায়না। একাদশ শতকের মুসলিম ঐতিহাসিক আল আজরাকি (১০৭০ সাল) ইসলামপূর্ব আরবের তীর্থস্থান যেমন মিনা, আরাফা, উকাজ, মাজান্না ইত্যাদির নাম উল্লেখ করেছেন, কিন্তু মক্কার নাম নিতে ভূলে গেছেন। দ্বিতীয়বার ভাবনার পর পরিশিষ্ট অংশে মক্কার স্থান হয়েছে। প্যাট্রিসিয়া ক্রোন এটাও দেখান বিভিন্ন গোষ্ঠীতে অধ্যুষিত আরবে সমস্ত তীর্থস্থান অবস্থিত থাকার কথা ফাঁকা মরুভূমিতে যেখানে কোন পক্ষেরই কর্তৃত্ব থাকত না, মক্কার মতো কোন শহরে নয়।(Meccan Trade: Patricia Crone)। কোরানের আল্লাহ্‌ অবশ্য মক্কাকে একেবারে ভুলে যাননি, তিনি শুধু একবার মক্কার উল্লেখ করেছেন – “তিনি মক্কা উপত্যকায় তাদের হাত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাত তাদের থেকে নিবারিত করেছেন, তাদের উপর তোমাদের বিজয়ী করার পর, তোমরা যাকিছু কর আল্লাহ্‌ তা দেখেন” (সুরা ফাতহ, আয়াত ২৪ বা ৪৮ঃ২৪) (সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদ কর্তৃক অনুমোদিত কোরানের বাংলা অনুবাদ থেকে গৃহীত)। কিন্তু এথেকে কিছু বোঝার উপায় নেই।

মক্কা ও মদিনায় পুরাতাত্বিক খননকার্য চালাতে পারলে হয়ত এই রহস্যের সমাধান পাওয়া যেতে পারত। গবেষণার ফলাফল ইসলামের বিরুদ্ধে যেতে পারে এই আশংকায় সৌদি ও অনান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিরপেক্ষ দলকে কোনরকম অনুসন্ধানের সুযোগই দেয় না। তাই পরোক্ষ উপাদানের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।

বহু ঐতিহাসিক মক্কা ও মদিনা থেকে ইসলামের উদ্ভবের কাহিনীতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। প্যাট্রিশিয়া ক্রোন সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্যালেষ্টাইনের নাম করেছেন। প্যালেষ্টাইনকে ইসলামিক ধর্মতত্বে যে মারাত্বক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তার দিকে তাকালে এই মতামত বিশেষ অবাস্তব বলেও মনে হয় না।

কোরানের দুর্বোধ্যতা ও ব্যাকরণগত সমস্যা

মুসলিমদের কাছে কোরান আল্লার বাণী, আল্লা নিজেই বলেছেন এই সেই গ্রন্থ যাতে কোন ভূল নেই। কিন্তু কোরানের ভাব ও ভাষা দুটোই এমন মাত্রায় এলোমেলো আর দুর্বোধ্য যে তাফসিরের সাহায্য ছাড়া সরাসরি আরবী কোরান পড়ে এর অর্থ বোঝা অসম্ভব। কোরানে আরবী ব্যাকরণের আদ্যোশ্রাদ্ধ করা হয়েছে। কোরানে আরবী ব্যকরণের সাধারণ নিয়মাবলী ও বাক্যগঠনগত দিক থেকে অন্তত একশটি ভূল পাওয়া যায় (Ali Dasti; “23 Years”)। ব্যাকরণগত ভূলগুলো এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে না, তা আলী দস্তি রচিত ‘বিশত ও সেহ সাল’ (ইংরাজীতে 23 Years) গ্রন্থের সংশ্লিষ্ট অংশে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। মুসলিমদের মধ্যে গোড়ামি ও অত্যুক্তি চেপে বসার আগে বহু ধর্মীয় দার্শনিক যেমন মুতাজিলা দার্শনিক ইব্রাহিম আন-নাজ্জাম (৭৭৫-৮৪৫) খোলাখুলি স্বীকার করেছেন কোরানের বিন্যাস ও বাক্যগঠন অলৌকিক কিছু নয় এবং অন্য কোনো খোদাভীরু মানুষের পক্ষে একই ধরনের কাজ এর থেকেও বেশি সাহিত্যমানসম্পন্ন করে করা সম্ভব।

আলী দস্তির মতে- “কোরানের বাক্যসমূহ অসম্পূর্ণ এবং সম্পূর্ণভাবে বোধগম্য হবার ক্ষেত্রে এগুলোর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। এতে অনেক বিদেশি শব্দ, অপ্রচলিত আরবি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনেক শব্দ রয়েছে যেগুলোকে স্বীয় সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। লিঙ্গ এবং সংখ্যার অন্বয়সাধন না করে বিশেষণ এবং ক্রিয়াপদের ধাতুরূপ করা হয়েছে। অনেক সময় সংশ্লিষ্টতা নেই এমন অপ্রয়োজনীয় ও ব্যাকরণগতভাবে ভুল সর্বনাম পদ ব্যবহার করা হয়েছে এবং ছন্দবদ্ধ অনুচ্ছেদসমূহে এমন অনেক বিধেয় পদ ব্যবহার করা হয়েছে যার সাথে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে আলোচ্য মূল বিষয়ের সাথে এগুলোর কোনো মিল নেই। ফলে ভাষাগত এমন অনেক অগ্রহণযোগ্য বিষয়াদি কোরানের সমালোচকদের (যারা কোরানের বোধগম্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন) সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। এই সমস্যাগুলো নিষ্ঠাবান মুসলমানদের মনেও যথেষ্ট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে কোরানের তফসিরকারকরা কোরানের বক্তব্যের ব্যাখ্যা খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। কোরান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মতভিন্নতার পিছনে যেসব কারণ রয়েছে, এ বিষয়টি তাদের মধ্যে অন্যতম।……. বলা বাহুল্য, কোরানের তফসিরকারকদের এই অসংলগ্নতাগুলোকে ব্যাখ্যা এবং সমর্থনীয় করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তাদেরই একজন হচ্ছেন পারস্যের বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ও ভাষাবিদ এবং জার-আল্লাহ (আল্লাহর প্রতিবেশি) খেতাবে ভূষিত আলজামাখশারি, পুরো নাম আবু আল-কাশিম মাহমুদ ইবনে উমর আল-জামাখশারি (জন্ম হিজরি ৪৬৭ বা ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দ-মৃত্যু হিজরি ৫৩৮ বা ১১৪৪ খ্রিস্টাব্দ) যার সম্পর্কে একজন মুরীয় (উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার আরব মুসলমান) লেখক বলেছেন, ‘ব্যাকরণঅনুরাগী এই তাত্ত্বিক একটি গুরুতর ভুল করেছেন। আরবি ব্যাকরণের সাথে মিল রেখে কোরান পড়ানো আমাদের দায়িত্ব নয়। বরং আমাদের উচিত সম্পূর্ণ কোরান যেভাবে আছে সেভাবে একে গ্রহণ করা এবং আরবি ব্যাকরণকে এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা।” (আলী দস্তি, নবী মুহম্মদের ২৩ বছর)

মুসলিম স্কলারদের এইরকম চরম অবস্থানের ফলে আমাদের অমুসলিম স্কলারদেরই অনুসরণ করতে হবে যারা প্রকৃতই নির্মোহভাবে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। দেখা যায় কোরান বারবার বলেছে যে তা আরবী ভাষায় লিখিত- দ্রষ্টব্য ১৬:১০৩,১৩:৩৭,২৬:১৯২-৯৫,১২:১,৪৩:৩। সুরা শুয়ারার ১৯৫ নং আয়াত অনুসারে কোরান সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে। কোরানের ভাষা কি রকম স্পষ্ট তা এমনকি যে কোরানের মূলানুগ অনুবাদও পড়ার চেষ্টা করেছে সেই জান। গবেষকরা জানাচ্ছেন কোরানের প্রতি পাঁচটি বাক্যের একটির কোনই অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না, অর্থাৎ তা অর্থহীন (ভাষাবিদ গার্দ আর. পুইনের মত, অধিকাংশ অমুসলিম স্কলার সমর্থন করেছেন)। প্রশ্ন হচ্ছে, কোরানের এই বিশাল ভাষাগত অসংলগ্নতার কারণ কি।

কোরানের আরবি ভাষায় রচিত হবার কথার পৌণপুণিক উল্লেখ

কোরান কেন বারবার বলছে তা আরবি ভাষায় লিখিত। সুরা নাহলের ১০৩ নং আয়াতে দেখা যায়- “আমি তো ভালভাবেই জানি যে, তারা বলে তাকে জনৈক ব্যক্তি শিক্ষা দেয়। যার দিকে তারা ইঙ্গিত করে, তার ভাষা আরবি নয় এবং এ কোরআন পরিষ্কার আরবি ভাষায় লেখা।”। কুরাইশরা নাকি কোরানের পার্থিব উৎসের দিকে ঈঙ্গিত করাতে এই আয়াত নাজিল হয়েছিল। সিরাত লেখক ইবনে ইশাক এই আয়াতে উল্লিখিত অনারব ব্যক্তির পরিচয় দিয়েছেন – তিনি হলেন খৃষ্টান ধর্মালম্বী জাবর, বানু আল-হাঁদরামির ক্রীতদাস যার থেকে মুহম্মদ শিক্ষা নিতেন বলে কথিত রয়েছে। উপরে অল্প কয়েকটা আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু অজস্র আয়াতে একই ধরণের বক্তব্য পাওয়া যায়। মূল ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়তে গিয়ে সন্দেহ জাগে না যে এটি হিব্রু ভাষায় রচিত নয়, গীতা পড়তে গিয়ে কারো মনে হয় না যে সেটা ধ্রুপদী সংস্কৃততে রচিত নয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কোরানে সম্পূর্ণ অপ্রাসাঙ্গিক বিষয় বারবার কেন উল্লেখ করছে, বারংবার অপ্রাসঙ্গিকভাবে আরবীর উল্লেখ ঈঙ্গিত করছে কিনা, কোরান আসলেই আরবি ভাষায় লিখিত ছিল কিনা।

কোরানের অজানা শব্দগুলোর অনেকগুলো অর্থ প্রস্তাব করা

কোন আলেমের কাছে গেলে তিনি বলবেন কোরানের সবচেয়ে রহস্যময় অংশ হল আলীফ-লাম-মীম; চৌদ্দশ বছরেও এর অর্থ বোঝা যায়নি- এর অর্থ শুধু আল্লাহই জানেন। কোরানে বিস্তর শব্দ আছে যেগুলো আরবী ভাষার শব্দ তো নয়ই, জানা কোন ভাষার শব্দও নয়। কোরানের তাফসিরকারক ও অনুবাদকরা এসব শব্দের একেকরকম অর্থ করেছেন। সাধারণভাবে মুসলিম স্কলাররা এসব বিষয়ে একমত হলেও তাদের ঐক্যমত্য কোন ভাষাতাত্বিক বিবেচনা থেকে নয় বরং তারা শুধুমাত্র একেকজন স্কলার তাদের পূর্বসূরীকে অনুসরণ করেছেন। এর অর্থ হল তারা কোন একটি প্রথার অনুসরণ করেছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা একেবারেই একমত হতে পারেন নি। কোরানের ১০৮ নং সুরার নাম হল আল-কাওসার। এই সুরার প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে “নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি”। কিন্তু কাওসার এর অর্থ এই সুরার বাইরে সম্পূর্ণ অপরিচিত। সাধারণভাবে কোরান অনুবাদকরা এর অর্থ করেছেন প্রাচুর্য বা আধিক্য। জনপ্রিয় তাফসির তাফসির আল-জালালাইন ব্যাখ্যা করেছে – কাওসার হল জান্নাতের উদ্যানে অবস্থিত একটি নদী যার মাধ্যমে সেখানকার অধিবাসীদের জল দেওয়া হয়। এর অর্থ অসীম মঙ্গল নবুয়ুৎ, কোরান, ইবাদত ও অনান্য বস্তুর আকারে (Al-Mahali and as-Suyuti, Tafsir al-Jalalayn)। অনান্য কোরানীয় স্কলাররা আদৌও নিশ্চিত নন কোরান বিশেষজ্ঞ আল-কুরতুবী (১২৭৩ খৃষ্টাব্দ) কাওসার শব্দের ১৭টি অর্থ দিয়েছেন আরেক বিশেষজ্ঞ কুরতুবীর সমসাময়ীক ইবন আন-নাকিব (১২৯৮খৃষ্টাব্দ) দিয়েছেন ২৬ টি। বোঝাই যায় তাদের শব্দটির অর্থ জানা ছিল না। তারা প্রকৃতপক্ষে সর্বোচ্চ সংখ্যক আন্দাজ করছিলেন।

কোন শব্দের এতগুলী অর্থ থাকতেই পারে না। কোন শব্দের পরস্পর থেকে পৃথকযোগ্য চার-পাঁচটির বেশী অর্থ থাকলেই তার ব্যবহার সেই ভাষায় যথেষ্ট ambiguity বা দ্বার্থকতার সৃষ্টি করবে। ফলে দ্বার্থকতার নিরসন করার জন্য শেষ পর্যন্ত শব্দটির ব্যবহার কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে সীমিত হয়ে যাবে। অর্থ্যাৎ শব্দটি আর এতগুলী অর্থে ব্যাবহার হবে না।

কোরানের অজানা শব্দগুলোর সিরিয়াক বা সিরো-আরামাইক উৎস্য

এরকম আরেকটি শব্দ হচ্ছে ‘কালালা’ (৪:১২)। ঐতিহাসিক ও কোরান বিশেষজ্ঞ মু্হম্মদ ইবনে জারির আট-তাবারী (৮৩৯-৯২৩) তিনটি পৃথক সনদ অনুসরণ করে শব্দটির তিনটি পৃথক অর্থ ধার্য করেছেন। সুরাটি থেকে আদপেই এর অর্থ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। আরেকটি শব্দ হল সিজ্জিন (৮৩:৭-৯), যেটি আরবী শব্দ নয় এবং অন্য কোন ভাষারও শব্দ নয়। তাফসিরকারকরা জানাচ্ছেন সিজ্জিন হল এমন একটি জায়গা যেখানে পাপীদের আমলনামা রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সিজ্জিনের অর্থ শুধু পাপীদের আমননামা। পূর্বেই বলা হয়েছে এই ধরণের অনুমানের পেছনে যেসব ভাষাতাত্বিক বিবেচনা দেখানো হয় সেগুলো যে দুর্বল শুধু তাই নয় একেবারে যদৃচ্ছ। একই ধরণের শব্দ সিজিল (sijill) পাওয়া যায় সুরা আম্বিয়ার ১০৪ নং আয়াতে- “সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব সিজ্জিলের মতো”। আরবেরীর মতো কোরান অনুবাদকরা সিজিলের অনুবাদ করেছেন স্ক্রল বা গুটানো দলিল। কিন্তু সিজ্জিল একটি নামবাচক বিশেষ্যও হতে পারে।

আর্থার জেফারী তার বই ‘The Foreign Vocabulary of Qur’an’ এ দেখিয়েছেন কোরানের আদি ব্যাখ্যাকারদের এই শব্দটির অর্থ পুরোপুরি অজানা ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর জনপ্রিয় তাফসিরকারক ইবনে কাসীর তার প্রবর্তিত তাফসিরে লিখেছেন- “সিজিল বলতে যা বোঝায় তা হল কিতাব। আস-সুদ্দী এই আয়াতের বিষয়ে বলেছেন- আস-সিজিল একজন ফিরিস্তা যার উপর দলীল রক্ষার দায়িত্ব রয়েছে; যখন কোন ব্যক্তি মারা যায় তার আমলনামা আস-সিজিলের কাছে চলে যায়”। জেফারীর মতে সিজিল কোন আরবী শব্দই নয়। এই শব্দটি এসেছে গ্রীক ‘sigillion’ থেকে যার অর্থ রাজকীয় ফরমান। বিতর্ক রয়েছে সুরা আল ইখলাসের ২ নং আয়াত – ‘আল্লা-হুসসামাদ’(Allahu as-samad) নিয়েও। আবদুল্লা ইউসুফ আলী আয়াতটির অনুবাদ করেছেন Allah, the eternally Besought of all। আরবেরী অনুবাদ করেছেন God, the everlasting Refuge। কিন্তু তাদের কেউই নিশ্চিত ছিলেন না যে as-samad বলতে কি বোঝায়। তাবারি এই শব্দটির অনেকগুলি অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। সবকিছু ক্ষতিয়ে দেখে ঐতিহাসিক ফ্রানজ রোসেনথাল সিদ্ধান্ত করেন যে as-samad প্রকৃতপক্ষে ছিল উত্তর-পশ্চিম সেমিটিক ধর্মীয় পরিভাষা। মনে হয় মুহম্মদ বা যিনি কোরান সংকলন করেছিলেন তিনিও এর অর্থ জানতেন না।

ওল্ড টেস্টামেন্টের সাথে যদি মিলিয়ে দেখেন আপনার চোখে পড়বে প্রায় সমস্ত পৌরাণিক কাহিনী এক থাকলেও চরিত্রগুলির নাম অনেকাংশে পালটে গেছে। ফ্যারাও হয়ে গেছে ফেরাউন, মোজেস হয়ে গেছে মুসা, বাইবেলের নোয়া হয়ে গেছে নুহ, আব্রাহাম হয়ে গেছে ইব্রাহিম, জেসাস অর্থ্যাৎ যীশু হয়ে গেছেন ইশা (যদিও এই বিষয়টি বাকিগুলোর থেকে আলাদা), রাজা ডেভিড হয়ে গেছে দাউদ, যীশুর মা মেরী হয়ে গেছেন মরিয়ম। কারণটা আর কিছুই নয় কোরানে এই নামগুলো সরাসরি হিব্রু থেকে নেওয়া হয়নি, বরং সিরিয়াক থেকে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বহুল প্রচলিত প্রায় সমস্ত ধর্মীয় পরিভাষা যেমন ১. আয়াত ২. কাফির ৩. সালাত ৪. নাফস ৫. জন্নৎ ৬. তাঘুত ৭. মসিহ প্রকৃতপক্ষে সিরিয়াক উৎস থেকে আগত। খৃষ্টান বোঝাতে কোরানে নাসারা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটি সিরিয়াক ভাষা থেকে আগত কারণ সিরিয়াক ছাড়া আর কোন ভাষা নেই যেখানে এর কাছাকাছি কোন প্রতিশব্দ আছে। (রোমান সাম্রাজ্যে এমনকি আংশিকভাবে পারসীক সাম্রাজ্যেও অখৃষ্টানরা খৃষ্টানদের nasraye নামে ডাকত। সেখান থেকেই সিরিয়াক ভাষায় পদটি এসে থাকবে।)

শুধুমাত্র ধর্মীয় শব্দই নয় কোরান সাংস্কৃতিক ও আইনগত শব্দও সিরিয়াক থেকে ধার করেছে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হল জিজিয়া (Alphonse Mingana “Syriac Influence on the Style of the Koran” in Ibn Warraq “What the Koran Really Says”)। কোরানে সিরিয়াক প্রভাব শুধু শব্দ ধার নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সেমিটিক ভাষার প্রবাদ প্রতিম গবেষক আলফোনসে মিঙ্গানা (১৮৭৮-১৯৩৭) কোরানের বাক্যগঠনের উপর সিরিয় ব্যাকরণের প্রভাব তুলে ধরেছেন। মিঙ্গানা দেখিয়েছেন যে সুরা বাকারার ৮৫ নং আয়াতের অংশ যার সাধারণভাবে অনুবাদ হয়ে থাকে – “তোমারাই তো সেই লোক যারা পরস্পর খুনোখুনি করছ” আরবী ভাষায় যথেষ্ট অদ্ভুত বাক্যগঠন। কারণ সাপেক্ষ সর্বনাম ছাড়াই নির্দেশক সর্বনামের ব্যাবহার আবরীর বৈশিষ্ট নয় বরং সিরিয়াক ভাষার বৈশিষ্ট্য। এই ধরণের গঠন কোরানে বেশ কিছু পাওয়া যায় যেগুলো সিরিয় ব্যাকরনের আলোকেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। এরকম আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় – “তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যদি কেউ হাতছাড়া হয়ে কাফেরদের কাছে থেকে যায়” (৬০:১১)। এখানে স্ত্রী অর্থে ‘শাই’ (Shai) শাই শব্দটি রয়েছে যা আদৌ মানুষ বোঝাতে ব্যবহার করা হয় না। এরকম সাংঘাতিক অসংলগ্নতার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাফসিরকারক ও অনুবাদকরা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন।

কোরানের সিরো-আরামায়িক উৎস্য ও ইসলামের ভিত্তি দেবার জন্য আরবীতে অনুবাদ

সিরিয়াক প্রকৃতপক্ষে আরামায়িক ভাষার একটি উপভাষা। একে সিরিয়-আরামায়িক নামেও উল্লেখ করা হয়। ইসলামের উত্থানের যুগে সিরিয়াকের ব্যাপক প্রচলন ছিল। যিনিই কোরান সংকলন করে থাকুন না কেন দেখে মনে হয় আরবী ভাষার থেকে তার সিরিয়াক ভাষাতেই দখল বেশী ছিল। তাই মনে হয় কোরান প্রাথমিকভাবে ছিল সিরিয়াক গ্রন্থ যা পরবর্তীকালে খৃষ্টধর্ম থেকে পৃথক ধর্ম হিসাবে ইসলামকে ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজনে আরবীতে অনুবাদ করা হয় এবং মৌলিক আরবী গ্রন্থ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেক্ষেত্রে অবশ্য কোরানের ভাষাগত অসংলগ্নতার দায় অনায়াসে অযথার্থ অনুবাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। তবে এখানে শুধুমাত্র ভাষাতাত্বিক বিবেচনাই যথেষ্ট নয়, অসংলগ্নতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য আরো কিছু উপাদান পাশাপাশি কাজ করেছে। এই অনুমান মেনে নিলে কোরানের বারংবার আরবী গ্রন্থ হিসাবে দাবীরও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

কোরানের প্রাথমিক পাণ্ডুলিপিতে অস্পষ্টতা নিয়ে গার্দ আর. পুইন

১৯৭২ সালে ইয়েমেনের রাজধানী সানার একটি মসজিদে কোরানের প্রাচীন হিজাজী লিপিতে প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া সর্বপ্রাচীন (পরবর্তীকালে বারমিংহামে আরো প্রাচীন কোরানের দুটি পৃষ্ঠা আবিষ্কৃত হয়েছে) কোরানের পাণ্ডুলিপি আবিস্কার হয়। ইয়েমেনী সরকার এই পাণ্ডুলিপি পুনরুদ্ধারের যে প্রকল্প নেন তার প্রধান ছিলেন গার্দ আর. পুইন। তিনি বর্তমানে প্রচলিত কোরানের সাথে সানায় প্রাপ্ত কোরানের বহু পার্থক্য লক্ষ্য করেন। তার মতে, “আমার ধারণা হল কোরান হল বিভিন্ন গ্রন্থের একরকম মিশ্রণ, যার অর্থ মুহম্মদের সময়েও বোঝা যেত না। এগুলোর অনেকগুলো ইসলামের প্রায় একশো বছর পুরনো হয়ে থাকতে পারে। এমনকি ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যেই প্রচুর পরিমাণে স্ববিরোধী তথ্য রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খ্রিস্টীয় সাবস্ট্রেট আছে, কেউ চাইলে এগুলো থেকেই পূর্ণাঙ্গ ইসলামী প্রতি-ইতিহাস তৈরি করতে পারবেন।” তিনি আরও বলেন, “কোরান নিজেই বলে যে, এটি ‘মুবিন’ বা ‘স্পষ্ট’, কিন্তু যদি তুমি এর দিকে তাকাও, তাহলে লক্ষ্য করবে, প্রতি ৫টির মধ্যে ১টির কোনও অর্থ নেই। অনেক মুসলিম ও প্রাচ্যবাদী অবশ্যই অন্যরকম বলবে, কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে কোরানীয় গ্রন্থের এক পঞ্চমাংশ কেবলই অবোধ্য। এটিই অনুবাদের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত উদ্বিগ্নতার কারণ। যদি কোরান অবোধ্য হয়, তবে এটাকে আরবিতেও বোঝা যাবার কথা নয়, তাই এটি অনুবাদযোগ্যও নয়। মানুষ এই বিষয়টিকে ভয় পেত। আর এখানে কোরান বারবার দাবি করছে যে তা স্পষ্ট, কিন্তু অবশ্যই সেটা নয়, এমনকি আরবিভাষীরাও তাই বলবে। এটি স্পষ্ট একটি স্ববিরোধিতা। অবশ্যই এখানে কোনও ঘাপলা আছে।”

কোরান ছিল সিরিয়াক ভাষার খ্রিস্টীয় ধর্মীয় স্ত্রোত্রসংকলন

গার্দ আর. পুইনের এই কথাগুলো রিভিশনিষ্ট স্কূল অফ ইসলামিক স্ট্যাডিসের মূল ধারণার একটি চুম্বকাংশ। অন্য অধিকাংশ ধর্মীয় শব্দের মত আরবী কুর’আন (Quran) শব্দটিও সিরিয়াক উৎস থেকে আগত। এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ধর্মীয় স্তোত্রসংকলন। কোরানিক স্কলার এরভিন গ্রাফ দেখিয়েছেন সিরিয়াক শব্দটি খৃষ্টীয় স্তোত্র বোঝাতেই ব্যাবহার হত। আরবি বর্ণমালার অনেকগুলো বর্ণ দেখতে একই রকম, তাদের উপরে নিচে নানারকম চিহ্ন দিয়ে পার্থক্য বোঝানো হয়। কোরানের প্রাচীন ম্যানুস্ক্রিপ্টগুলোতে কোনটিতেই এই চিহ্নগুলোই নেই। এগুলো পরে বসানো হয়েছে। কোরানের দুর্বোধ্য ও অসংলগ্ন অংশগুলো পরিস্কার হয়ে যায় যদি এইসমস্ত চিহ্নগুলো সরিয়ে দিয়ে নতুন করে অর্থ করবার চেষ্টা করা হয়।

উপরের আলোচনার ভিত্তিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, কোরান যেসব আয়াতে নিজেকে পৃথক শাস্ত্র হিসাবে দাবি করছে সেগুলোর কি হবে- যেমন “এগুলো সুস্পষ্ট গ্রন্থের আয়াত। আমি একে আরবী ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার” [ সুরা ইউসুফ ১২:১-২ ]।এক্ষেত্রে সিরিয়াক উৎসের পর্যালোচনা করে লুক্সেমবা্র্গ এইভাবে অনুবাদ করেছেন- “এটি হল সুষ্পষ্ট গ্রন্থের লিখিত প্রতিলিপি। আমি একে আরবী স্তোত্রসংকলন রূপে অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার”।(Luxemberg, Syro-Armaic)। প্রকৃতপক্ষে কোরান হল স্তোত্তসংকলন, এর আর কোন দ্বিতীয় অর্থ নেই। ওল্ড ও নিউ টেষ্টামেন্টের নির্দিষ্ট শ্লোকসমষ্টি বোঝাতে এই শব্দটি ব্যাবহার হত।

সুরা আলাক ও এর সমস্যা

বাংলা অনুবাদ নিয়ে কোরানের ভাষাগত অসঙ্গতি বোঝা যায়না, কারণ সৌদি আরবে গৃহীত মান অনুসরণ করে সাম্প্রতিক কালে যেসব অনুবাদ বেড়িয়েছে সেগুলোতে অসঙ্গতি যথাসাধ্য পরিহার করে একটি সুষ্ঠু, সামঞ্জস্যপূর্ণ, মার্জিত কোরান তৈরী করার চেষ্টা হয়েছে। অন্ততপক্ষে কোরানের মূলানুগ ইংরাজী অনুবাদ ছাড়া গবেষনামূলক লেখার সম্পূর্ণ তাৎপর্য বোঝা সম্ভব হবে না।

সুরা আলাক –
১. পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। ২. সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট-বাঁধা রক্তপিন্ড হতে। ৩. পড়, আর তোমার রব মহামহিম।  ৪. যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।  ৫. তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না। ৬. মোটেই নয়, নিশ্চয় মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। ৭. কেননা সে নিজেকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ৮. নিশ্চয় তোমার রবের দিকেই প্রত্যাবর্তন। ৯. তুমি কি তাকে দেখেছো যে বাধা দেয়।  ১০. এক বান্দাকে, যখন সে সালাত আদায় করে?  ১১. তুমি কি ভেবে দেখেছ, যদি সে সৎ পথে থাকে।  ১২. অথবা তাকওয়ার নির্দেশ দেয়?  ১৩. তুমি লক্ষ্য করেছ কি যদি সে মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়?  ১৪. সে কি জানেনা যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ দেখেন?  ১৫. মোটেই নয় নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি তাকে কপালের সম্মুখভাগের চুল ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাব।  ১৬. মিথ্যাচারী পাপাচারী চুলগুচ্ছ  ১৭. অতএব, সে তার সভাসদদের আহবান করুক।  ১৮. অচিরেই আমি ডেকে নেব জাহান্নামের প্রহরীদেরকে।  ১৯. মোটেই নয়, তুমি তার আনুগত্য করবে না। আর সিজদা কর এবং নৈকট্য লাভ কর।
(কোরানের অনুবাদগুলি মূলত www.hadithbd.com থেকে নেওয়া হয়েছে। আরো আট-দশটি অনুবাদ মিলিয়ে দেখা হয়েছে)

এই সুরাটি প্রথম আট আয়াতে মানুষের সৃষ্টি রহস্য আর আল্লার কৃপা ব্যাখ্যা করার পর আচমকা আমাদের একজন লোকের কথা বলতে থাকে যে তার বান্দাকে নামাজ পড়তে বাঁধা দিচ্ছিল। ইসলামিক স্কলার ইবনে রাওয়ান্দির মতে গোটা সুরাটিই মোটের উপর অর্থহীন প্রলাপ। (Ibn Rawandi, On Pre-Islamic Christian Strophic Poetical Texts in the Koran: acritical look at the work of Gunter Luling” in Ibn Warraq “What the Koran really says”) কাল্লা “মোটেই নয়” (no, indeed) শব্দটি সমগ্র সুরায় তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনে রাওয়ান্দি দেখিয়েছেন যে ষষ্ঠ আয়াতে কাল্লা- (এর অর্থ ‘মোটেই নয়’) এর কোনই অর্থ নেই কারণ এটি আগের আয়াতের (বা আয়াতগুলির) অস্বীকৃতি হতে পারে না। দেখা যায়, সুরাটি দুটি অংশে বিভক্ত, কারণ দুটি অংশের বক্তব্য বিষয় আলাদা এমনকি ভাষাতাত্বিক গঠনও আলাদা।

সুরা আলাকের খ্রিস্টীয় পুনর্গঠন ও অধিকাংশ মক্কী সুরার খ্রিস্টীয় স্তোত্রে পুনর্গঠনের সম্ভাব্যতা

সংশ্লিস্ট বিষয়ে স্কলারদের বিশাল গবেষণা আছে, তা এখানে আনা সম্ভব নয়, সরাসরি দেখা যাক স্কলাররা কি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। পরিস্কারভাবে সুরাটিতে সম্পাদনার চিহ্ন বর্তমান। প্রথম আটটি আয়াত প্রচলিত ইসালামিক বিবরণের সাথে পরিস্কারভাবে মিলে যায়। কিন্তু পরের আয়াতগুলির অর্থ বোঝা যায়না। গবেষক গান্টার লুলিং তার লেখায় দেখিয়েছেন সুরা ৯৬ প্রকৃতপক্ষে হয়ত ছিল একটি খৃষ্টীয় প্রার্থনা সঙ্গীত, যেটাকে পরবর্তীকালে কিছুটা পরিবর্তিত করে ইসালমী বিন্যাসের সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রাচীন আরবী ম্যানুস্ক্রীপ্টের উপর ভিত্তি করে লুলিং সুরাটির ৯ থেকে ১৮ নং আয়াতের পুনর্গঠন করেছেন। “তুমি কি তাকে দেখেছো যে বাধা দেয় এক বান্দাকে, যখন সে সালাত আদায় করে?” (আয়াত ৯-১০) লুলিঙের পুনর্গঠনে এটি হয়েছে – “তুমি কি কখনও দেখছো তিনি তার বান্দাকে অস্বীকার করেন যে তার উপাসনা করে। উষ্ণ সতর্কবানী “তুমি লক্ষ্য করেছ কি যদি সে মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়?”। “সে কি জানেনা যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ দেখেন?” (আায়াত ১৩-১৪) হয়ে দাঁড়িয়েছে খৃষ্টীয় ঈশ্বরের আন্তরিকতার বার্তা – “তুমি কি কখনও দেখেছো তিনি মিথ্যা আরোপ করেছেন ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন? তুমি কি জাননা যে ঈশ্বর সব দেখেন।” অত্যন্ত অবান্তর “অতএব, সে তার সভাসদদের আহবান করুক, অচিরেই আমি ডেকে নেব জাহান্নামের প্রহরীদেরকে।” (আায়াত ১৭-১৮) এটাকে অনুবাদ করা হয়েছে ঈশ্বরের স্বর্গীয় সভা ও দেবদূতদের প্রতি আহ্বান হিসাবে- “অতএব আহ্বান কর তার উচ্চ সভাসদদের! তারপর স্বর্গীয় দেবদূতদের আহ্বান করা হবে”। (Ibn Rawandi, On Pre-Islamic Christian Strophic Poetical Texts)

লুলিং এর পুনর্গঠনে সুরাটি হয়ে দাঁড়াল একটি প্রার্থনাসঙ্গীত যেখানে ধার্মিক ব্যক্তিবর্গকে ঈশ্বরের আহ্বান করতে বলা হচ্ছে এবং ঈশ্বরের আন্তরিকতা সম্পর্কে আস্বস্ত করা হচ্ছে। এখানে আল্লা হল ঈশ্বরের আরবী প্রতিশব্দ মাত্র, মুসলিম-খৃষ্টান-ইহুদী নির্বিশেষে সমস্ত আরববাসী ঈশ্বরকে ওই নামে ডাকে। দেখা যাচ্ছে ইসলামী অনুশাসনের বাইরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করা হলে, প্রসঙ্গহীন, বিশৃঙ্খল এই কোরানিক সুরাটির স্পষ্ট অর্থ করা সম্ভব হয়। শুধুমাত্র এই সুরাটিই নয় প্রায় অধিকাংশ মক্কী সুরাকেই সামান্য যৌক্তিক অদলবদলের সাহায্যে খৃষ্টীয় শ্লোকে বদলে ফেলা যায়।

সুরা আলাক শুরু হচ্ছে ‘ইকরা’ (iqra) শব্দটি দিয়ে। তাফসিরকারক ও অনুবাদকরা এর অর্থ করেছেন পড় বা পাঠ কর ইত্যাদী। প্রাচীন আরবী ভাষাবিদ আবু উদায়দার গারিব আল-হাদিস (৮১৮ খৃঃ) গ্রন্থে পাওয়া যায় যে ক্রিয়াপদ qara- এর অর্থ হল পাঠ করা, iqra হল তার অনুজ্ঞাসূচক রূপ; অন্য একটি ক্রিয়াপদ dakara এর সমার্থক- অর্থ আহ্বান করা (invoke)। ইবনে রাওয়ান্দি এবং রবার্ট লুলিং দুজনেই ‘ইকরা’ এর অর্থ আহ্বান করা ধরেছেন। যেহেতু যে কোন ধর্মীয় স্তোত্রই উচ্চস্বরে, সুর করে পড়া হয় তাই এই দুই অর্থের মধ্যে পার্থক্য বিশেষ থাকে না। ‘ইকরা’ এর অর্থ invoke বা আহ্বান করা ধরলে সুরার প্রথম বাক্য আমাদের স্মরন করিয়ে দেয় হিব্রু বাইবেলের অত্যন্ত পরিচিত শব্দবন্ধ “qara be shem Yahwe” – প্রভুর নামে আহ্বান কর (জেনেসিস ৪:২৫-২৬। )

শুধু লুলিং নয়, আরো অসংখ্য স্কলার কোরানে ইসলামিক কাঠামোর নিচে খৃষ্টীয় উপস্তরের অস্তিত্ব প্রমান করেছেন। এই বিষয়টি এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে একে আর অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। কোরান আসলে ছিল খৃষ্টীয় ধর্মসঙ্গীত সংকলন। পরবর্তীকালে ইসলামী বিবরণ অর্থাৎ মুহম্মদ, জিব্রাইল, ওহী আসা ইত্যাদী প্রচারিত হওয়ার পর সম্পাদনার মাধ্যমে ইসলামিক বিন্যাসের সাথে খাপ খাইয়ে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সুরা আল-মুদ্দাসসির ও এর সমস্যা অর্থহীনতা

সুরা আল- মুদ্দাসসির এর কিছু আয়াত উল্লেখ করা হল –
১. ওহে বস্ত্র আবৃত  ২. ওঠ, সতর্ক কর।  ৩. আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর।  ৪. তোমার পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ।  ৫. অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক।  ৬. অনুগ্রহ করো না অধিক পাওয়ার উদ্দেশ্যে।  ৭. আর তোমার রবের জন্যই ধৈর্যধারণ কর।  ৮. যেদিন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে,  ৯. সেদিনটি হবে বড়ই কঠিন দিন,  ১০. কাফিরদের জন্য মোটেই সহজ নয়।  ১১. আমাকে ছেড়ে দাও এবং তাকে, যাকে আমি সৃষ্টি করেছি অসাধারণ করে।  ১২. আমি তাকে দিয়েছি বিপুল ধন সম্পদ।  ১৩. আর উপস্থিত অনেক পুত্র  ১৪. আর তার জন্য সুগম স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছি।  ১৫. এসবের পরেও সে আকাঙ্ক্ষা করে যে, আমি আরো বাড়িয়ে দেই।  ১৬. কখনো নয়, নিশ্চয় সে ছিল আমার নিদর্শনাবলীর বিরুদ্ধাচারী।  ১৭. শীঘ্রই আমি তাকে ওঠাব শাস্তির পাহাড়ে
১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল  ১৯. সে ধ্বংস হোক! কীভাবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল?  ২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কীভাবে!  ২১. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো।  ২২. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল।  ২৩. এবং ঘোষণা করল, এতো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু ভিন্ন আর কিছু নয়।  ২৪. এটা তো মানুষের কথামাত্র’।  ২৫. আমি তাকে নিক্ষেপ করব সাকার-এ  ২৬. তুমি কি জান সাকার কি?  ২৭. এটা অবশিষ্টও রাখবে না এবং ছেড়েও দেবে না।  ২৯. চামড়াকে দগ্ধ করে কালো করে দেবে।  ৩০. তার উপর রয়েছে ঊনিশ  ৩১. আর আমি ফেরেশতাদেরকেই জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক বানিয়েছি। আর কাফিরদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ আমি তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করেছি। যাতে কিতাবপ্রাপ্তরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে; আর মুমিনদের ঈমান বেড়ে যায় এবং কিতাবপ্রাপ্তরা ও মুমিনরা সন্দেহ পোষণ না করে। আর যেন যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা এবং অবশিষ্টরা বলে, এরূপ উপমা দ্বারা আল্লাহ কী ইচ্ছা করেছেন? এভাবেই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন আর যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আর তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। আর এ হচ্ছে মানুষের জন্য উপদেশমাত্র” (আয়াত ১-৩১) (কোরানের আয়াতগুলি মূলত https://www.hadithbd.com/ থেকে নেওয়া। মূলানুগ ইংরাজী অনুবাদ অনুসরণ করে দু-একটি জায়গায় পরিবর্তন করা হয়েছে।)

ইসলামী সূত্র থেকে জানা যায়, সুরা আল-মুদ্দাসসির সর্বপ্রথমে নাজিলকৃত সুরা আলাকের পরেই নাজিল হয়েছিল। অর্থাৎ নাজিলের সময়কালের দিক থেকে সুরা আল-মুদ্দাসসিরের স্থান হল দু নম্বর। কোরানের বহু মক্কী সুরার মতোই তাফসিরের সাহায্য ছাড়া এই সুরাটির অর্থ বোঝা দুঃসাধ্য। বক্তব্যের বিষযবস্তুর দিক থেকে প্রথম দশটি আয়াতের সাথে পরবর্তী আয়াতগুলোর দূর-দূরান্তরেও কোন সম্পর্ক নেই।  ১১ নং আয়াত- “যারনী ওয়া মান খলাক’তু ওয়াহ’ঈদাঁ” ইউসুফ আলী যার অনুবাদ করেছেন- Leave me With him whom I created alone, আগের (এবং পরেরও) আয়াতগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে অর্থহীন প্রলাপ বলেই মনে হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ আবার কার সাথে নিজেকে ছেড়ে দেয়ার দাবী করছেন। পরের আয়াতগুলোর সাথেও বিশেষ কোন সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। –
১২. আমি তাকে দিয়েছি বিপুল ধন সম্পদ।  ১৩. আর উপস্থিত অনেক পুত্র  ১৪. আর তার জন্য সুগম স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছি।  ১৫. এসবের পরেও সে আকাংখা করে যে, আমি আরো বাড়িয়ে দেই।  ১৬. কখনো নয়, নিশ্চয় সে ছিল আমার নিদর্শনাবলীর বিরুদ্ধাচারী।  ১৭. শীঘ্রই আমি তাকে উঠাব শাস্তির পাহাড়ে।

ইসলামী সূত্র অবশ্য যথারীতি গল্প নিয়ে হাজির হয়। চতুর্দশ শতকের তাফসিরকারক ইবনে কাসীর আমাদের জানান যে, এই সমস্ত আয়াতে কুরাইশ নেতা ও মুহম্মদের বিরোধী ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার কথা বলা হয়েছে। মুগীরা অপরাপর কুরাইশদের মতো কোরানকে আল্লার বাণী হিসাবে অস্বীকার করায় আল্লা এইসমস্ত আয়াত নাজিল করেন। তামাম বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ্‌ এক ব্যক্তির প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে কুড়িটি আয়াত ধরে তাকে অভিশাপ দিচ্ছেন, এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়।

সুরা মুদ্দাসসিরের খ্রিস্টীয় পুনর্গঠন ও খ্রিস্টীয় স্তোত্রসঙ্গীতের ছন্দ আবিষ্কার

গবেষক গান্টার লুলিঙ তার A Challenge to Islam for Reformation এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, রাসম অর্থ্যাৎ মূল নথী পর্যালোচনা করে ১১ নং আয়াতে জারনী- ‘একা ছেড়ে দাও’ এর জায়গায় লুলিং জারানী ‘তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন’ অর্থ ধরেছেন। তার পুনর্গঠনে ১১-১৭ নং আয়াত দাঁড়িয়েছে-
১১. তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন অসামান্য জীবরূপে  ১২. তিনি তাকে সৃষ্টি করলেন তার অনুগত দাসরূপে  ১৩. তিনি তাকে দেখা দিয়ে অস্তিত্ব প্রমান করলেন  ১৪. এবং তাকে পথপ্রদর্শন করলেন  ১৫. তারপর তিনি চাইলেন সে বড় হোক  ১৬. তা নয় সে তার নির্দেশ অমান্য করল  ১৭. সেজন্য শেষে তিনি তাকে সুউচ্চ মৃত্যুর পথে ফেলে দিলেন।

লুলিঙ লক্ষ্য করেছেন যে সুরার ১ থেকে ৩০ নং আয়াত পর্যন্ত্য ভাষাগত দিক থেকে সুরাটি মোটামুটি সমসত্ব। ৩০ নং আয়াত পর্যন্ত ছন্দোবদ্ধ বিন্যাস রয়েছে এবং প্রতিটি আয়াত গড়ে তিন চারটি করে শব্দ নিয়ে গঠিত। ৩১ নং আয়াত বিশাল বড় এবং বাকি আয়াতগুলোর মতো ছন্দের বুননে বাঁধা নয়। সুতরাং, বোঝা যায় আয়াত ৩১ সুরার অংশ ছিল না। আয়াতটিকে দেখে ৩০ নং আয়াতের টিকা বলে মনে হয়। ৩১ নং আয়াত যে তুলনামূলকভাবে পরবর্তীকালে সন্নিবেশিত হয়েছে, এমনকি ইসলামী সূত্র থেকেও সে বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইসলামী সূত্র মতে সুরা আল মুদ্দাসসিরের ৩০ নং আয়াত পর্যন্ত নাজিল হওয়ার পর আবু জাহেল ও তার সঙ্গী কুরাইশরা জাহান্নামের প্রহরীদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। কুরাইশদের মধ্যে থেকে কালাদাহ নামের এক ব্যক্তি বলেন যে জাহান্নামের ১৯ জন প্রহরীর মধ্যে ১৭ জনকে তিনি একাই দেখে নেবেন। তার উত্তরে আয়াত ৩১ নাজিল হয়। বস্তুত, এই আয়াতটিকে ঢোকানো হয়েছে মূলত ৩০ নং আয়াতকে ব্যাখ্যা করতে। ৩০নং আয়াতে উনিশ সংখ্যা দিয়ে কি বোঝানো হচ্ছে একেবারেই পরিস্কার নয়। মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যে খৃষ্টধর্ম বিভিন্ন ধরনের যাদুবিদ্যা, উইচক্রাফট ইত্যাদীর সাথে সংযুক্ত হয়ে পরেছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক একে যাদুবিদ্যায় ব্যাবহৃত কোন মিরাকেল সংখ্যা হিসাবে গণ্য করেছেন। এই বিষয়ে আরো গবেষনার প্রয়োজন আছে। তার পরের আয়াত ৩২ থেকে অবশিষ্ট সুরার বিষয়বস্তু ও গঠন উভয়েই আলাদা। এমনকি অনুবাদেও বিষয়টা বোঝা যায়-
৩২. কখনো নয়, চাঁদের কসম!  ৩৩. রাতের কসম, যখন তা সরে চলে যায়,  ৩৪. প্রভাতের কসম, যখন তা উদ্ভাসিত হয়।  ৩৫. নিশ্চয় জাহান্নাম মহাবিপদসমূহের অন্যতম।  ৩৬. মানুষের জন্য সতর্ককারীস্বরূপ।  ৩৭. তোমাদের মধ্যে যে চায় অগ্রসর হতে অথবা পিছিয়ে থাকতে, তার জন্য।  ৩৮. প্রতিটি প্রাণ নিজ অর্জনের কারণে দায়বদ্ধ।  ৩৯. কিন্তু ডান দিকের লোকেরা নয়,  ৪০. বাগ-বাগিচার মধ্যে তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করবে,  ৪১. অপরাধীদের সম্পর্কে,  ৪২. কিসে তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করাল?  ৪৩. তারা বলবে, ‘আমরা মুসুল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না’।  ৪৪. ‘আর আমরা মিসকিনদের খাদ্য দান করতাম না’।  ৪৫. ‘আর আমরা অনর্থক আলাপকারীদের সাথে মগ্ন থাকতাম’।  ৪৬. ‘আর আমরা প্রতিদান দিবসকে অস্বীকার করতাম’  ৪৭. আমাদের নিকট মৃত্যুর আগমন পর্যন্ত।  ৪৮. অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না।  ৪৯. তাদের কি হয়েছে যে, তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় উপদেশ হতে?  ৫০. তারা যেন ভয়ে সন্ত্রস্ত গাধা,  ৫১. সিংহের সামনে থেকে পালাচ্ছে।  ৫২. বরং তাদের মধ্যকার প্রত্যেক ব্যক্তিই কামনা করে যে তাকে উন্মুক্ত গ্রন্থ প্রদান করা হোক।  ৫৩. কখনও নয়! বরং তারা আখিরাতকে ভয় করে না।  ৫৪. কখনও নয়! এটিতো উপদেশ মাত্র।  ৫৫. অতএব যার ইচ্ছা সে তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করুক।  ৫৬. আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করতে পারে না। তিনিই ভয়ের যোগ্য এবং ক্ষমার অধিকারী। (সুরা আল- মুদ্দাসসির, ৩২-৫৬) ( সূত্র https://www.hadithbd.com/)

কিছুটা একই রকম বক্তব্যসম্বলিত দুটি পৃথক স্তোত্তকে ৩১ নং আয়াত দিয়ে জোড়াতালি লাগিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সিরিয়াক উৎসে কুর’রান অর্থে Liturgical Text বা খৃষ্টীয় স্তোত্তসংকলন ছাড়া আর কিছুই বোঝাত না। লুলিং দেখিয়েছেন কোরানের অধিকাংশ মক্কী সুরা আসলে কয়েকটি স্ট্রোফিক স্তোত্তের সমষ্টি। স্ট্রোফিক বিন্যাস হল মূলত ধর্মসঙ্গীতে ব্যাবহৃত ছন্দ ও সুরের এক ধরনের বিন্যাস। মধ্যযুগে সংকলিত অধিকাংশ খৃষ্টীয় সঙ্গীত মূলত এক ধরনের স্ট্রোফিক বিন্যাসে রচিত হত। মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত খৃষ্টীয় গীতির সাথে তুলনা করে গবেষক গান্টার লুলিং প্রমাণ করেছেন যে সামান্য যৌক্তিক অদল বদলের সাহায্যে অধিকাংশ মক্কী সুরাকে খৃষ্টীয় ধর্মগানে বদলে ফেলা যায়। শুধু তাই নয় অসাধারণ বিশ্লেষনের সাহায্যে A Challenge to Islam for Reformation বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন যে কোরানে ব্যাবহৃত স্ট্রোফিক ছন্দের সঙ্গে খৃষ্টীয় শ্লোকে ব্যাবহৃত স্ট্রোফিক ছন্দবিন্যাসের ব্যাপক মিল বর্তমান যা কাকতালীয় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অবশ্য পুনর্গঠন ছাড়া স্ট্রোফিক বিন্যাস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। উদাহরণস্বরূপ কোরানের ৮৯ তম সুরা আল ফজরের ৭ ও ১৪ নং আয়াতে রাব্বু ‘তোমার রব’ শব্দটি আছে। লুলিং দেখিয়েছেন আয়াতদ্বয় থেকে শব্দদুটি বাদ দিলে স্ট্রোফিক ছন্দ পুরোপুরি পাওয়া সম্ভব হয়।

মক্কী সুরাসমূহের বিকাশে খ্রিস্টীয় স্তোত্রসঙ্গীতের পরিবর্তন

খৃষ্টীয় ধর্মগীতিকে ইসলামিক আবরণ দিতে গিয়ে ব্যাপক সম্পাদনার প্রয়োজন হয়েছে। তার উপর আছে অর্থবিকৃতি। যেহেতু কোরানের মূল নথীতে প্রাচীন যেকোন আরবী লিপির মতোই অক্ষরবাচক চিহ্নগুলি ছিল না, (সম্ভবত ইচ্ছাকৃত) অনায়াসে অর্থবিকৃতি ঘটানো সম্ভব হয়েছে। তারপর এই বনিয়াদের উপর গড়ে উঠেছে তাফসির, সিরাত, হাদিস। যেহেতু শত শত বছর ধরে কোরান সংকলিত হয়েছে মানুষ ভূলেই গিয়েছিল এইসব ধর্মীয় স্তোত্তের আদত অর্থ কি। খোদ ইসলামী বিবরণেই অনেকবার কোরান সংকলনের কথা পাওয়া যায়। লুলিং তার বইতে কোরানের অনেকগুলি সুরাকে খৃষ্টীয় শ্লোকে পুনর্গঠিত করে দেখিয়েছেন যে এই পদ্ধতিতে কোরানের ভাষাগত অসংলগ্নতা সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব হয়।

“হুর” শব্দের খ্রিস্টীয় ঐতিহ্য

কোরানিক শব্দ হুর (Hur) সাধারনভাবে কুমারী অর্থে অনুবাদ হয়ে থাকে। কোরানের আল্লা্হ্‌ প্রত্যেক জান্নাতিকে ৭২ টা হুর দেবার প্রতিজ্ঞা করেছেন। তাও আবার কোরান অনুসারে মুসলিমরা তাদের স্ত্রীদের নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন [সুরা যুখরুফ,৭০]। এখানে একটি বৈপরীত্য দেখা যায়, যদি না কল্পনা করা হয় যে পার্থিব স্ত্রীরা দুঃখ ও ঈর্ষা নিয়ে হুরের সাথে তাদের স্বামীদের লীলাখেলা দেখবে। অনেকেই শুনলে অবাক হবেন যে হুর শব্দের আভিধানিক অর্থ হল শুধুমাত্র সাদা। কোরান অনুবাদ করা এর অর্থ করেছেন শ্বেতচক্ষুবিশিষ্ট, বৃহৎ চক্ষুবিশিষ্ট, লাস্যময়ী ইত্যাদী। এখন কোন নারীর চোখের প্রশংসায় কি সাদা চোখ অভিধা ব্যবহার হয় নাকি হওয়া সম্ভব। সাহিত্যে সুন্দরী রমনীর হয় কালো চোথ না হলে নীল চোখের বর্নণা ঝুড়ি ঝুড়ি পাওয়া যায়; কিন্তু সাদা কখনও পাওয়া যায়না। আরবীতে কুমারীর প্রতিশব্দ হল হুরী (Houri)। কোরানে তাহলে হুরীর বদলে হুরের উল্লেখ করা হল কেন? এক্ষেত্রে গবেষক ক্রিস্তোফ লুক্সেমবার্গ অসাধারণ বিশ্লেষনের সাহায্যে সমস্যার সমাধান করেছেন। যে সমস্ত প্রসঙ্গে হুর উল্লিখিত হয়েছে, সেগুলী খতিয়ে দেখে তার অভিমত এখানে প্রকৃতপক্ষে সাদা কিশমিস অর্থ্যাৎ আঙুরের কথা বলা হয়েছে। এই আঙ্গুর খৃষ্টীয় স্বর্গের ধারণার সাথে পরিপূর্ণভাবে মিলে যায়। বহু খৃষ্টীয় শ্লোকে স্বর্গের দ্রাক্ষাকুঞ্জের সন্ধান পাওয়া যায়। লুক্সেমবার্গ নিজেই একটির উল্লেখ করেছেন – সিরিয় সেন্ট এফ্রাইমকৃত খৃষ্টীয় চতুর্থ শতকের একটি শ্লোক যেখানে স্বর্গীয় দ্রাক্ষাকুঞ্জের উল্লেখ আছে। লুক্সেমবার্গের মতে, আরবীতে দ্রাক্ষাকুঞ্জ ব্যকরণগতভাবে স্ত্রীলিঙ্গ, এর থেকেই কোরানের ভূল ব্যাখ্যা প্রচলিত হয়ে থাকবে (Robert Spencer, “Did Muhammad Exist”)।

প্রাচীন আরবি লিপি পাঠোদ্ধারে সমস্যা

প্রাচীন আরবী লিপির পাঠোদ্ধারের কোন পদ্ধতিই একেবারে বিতর্কমুক্ত নয়। এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বা গবেষকদের কোন দোষ নয়। কারণ –

১। আরবী বর্ণমালায় স্বরধ্বনিগুলোর জন্য নির্দিষ্ট কোন বর্ণ নেই। ব্যঞ্জনবর্নগুলির উপরে নিচে নানারকম চিহ্নের সাহায্যে স্বরধ্বনিগুলোর উচ্চারণ বোঝানো হয়। (আরবী বর্ণমালার প্রথম বর্ণ হল আলেফ, যা অবস্থানগতভাবে রোমান বর্ণমালার ‘a’ এর সমতুল্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সব ধরণের দীর্ঘস্বরের ব্যবহার বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়।) শুধু আরবী লিপি নয় সিরিয়াক, হিব্রু, আরামায়িক, ফিনিশিয় সমস্ত সেমিটিক ভাষাশ্রয়ী লিপিগুলিতেই এই বিশেষ প্যাটার্ন দেখা যায়।

২। শুধু তাই নয় অনেকগুলি আরবী বর্ণই দেখতে প্রায় একই রকম যেমন উদাহরণস্বরূপ আরবী বর্নমালার পঞ্চম বর্ন ‘জিম’ [ج], ষষ্ঠ বর্ণ ‘হা’ [ ح], সপ্তম বর্ণ ‘খা’ [خ] দেখতে অনেকটা একি রকম। এদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে শুধু একটি ফুটকিতে। প্রাচীন লিপিতে অনেক সময়ই এইসমস্ত চিহ্নগুলি না থাকায় বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে পার্থক্য করা দুস্কর হয়ে পরে। কোন প্রাচীন আরবী বিবরনেই এসব চিহ্ন পাওয়া যায় না। এমনকি প্রাচীন কোরানের যে সমস্ত পুথি পাওয়া গেছে সেগুলোতেও এই সমস্ত চিহ্নগুলো অনুপস্থিত।

বাইজানটাইন-সাসানীয় যুদ্ধ ৬০২-৬২৮

ইসলামী বিবরণের ঐতিহাসিকতা সন্দেহজনক হলেও, ইসলামের সাথে যুক্ত একটি বিষয় রয়েছে ইতিহাসে যার অস্তিত্ব সন্দেহাতীত। সেটা হল হিজরী সন ৬২২ খৃষ্টাব্দে এই সনের সূচনা হয়, একে মুহম্মদের কথিত হিজরতের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। ইসলামের উত্থানের কারণ ও তাৎপর্য বুঝতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা সবসময়েই সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অবহেলা করেছেন ধর্মীয় দিকের উপর জোর দিয়েছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাইজানটাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্য পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ চালিয়ে উভয়েই দুর্বল হয়ে পরে। ফলস্বরুপ, তার ঠিক পরেই মুসলিম আগ্রাসনকে আর তারা প্রতিরোধ করতে পারেনি। অধিকাংশ আধুনিক ঐতিহাসিক বিষয়টিকে ঠিক এইভাবে দেখেছেন।

সাত শতাব্দী ধরে রোমান ও পারসিকদের মধ্যে যুদ্ধ চললেও তা চরম সীমায় পৌঁছোয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে (বাইজানটাইন-সাসানীয় যুদ্ধ ৬০২-৬২৮)। এই যুদ্ধের প্রথম দিকে সাসানীয় সম্রাট দ্বিতীয় খোসরৌ প্রচুর সাফল্য পেলেও যুদ্ধের শেষ হয় তার চরম পরাজয়ে। ৬০৯ খৃষ্টাব্দে সাসানীয়রা আর্মেনিয়া ও উত্তর মেসোপটেমিয়া বিধ্বস্ত করে গুরুত্বপূর্ণ রোমান নগরী এদেসা দখল করে নেয়। ৬১০ খৃস্টাব্দের মধ্যে পুরো আর্মেনিয়া তাদের হাতে চলে আসে। ৬১৩ খৃষ্টাব্দে দামাস্কাস, আপামিয়া ও এমেসা দখল করে সাসানীয় বাহিনী জেরুসালেমে ঢুকে ধংসযজ্ঞ চালায়। জানা যায় যে এই যুদ্ধে ইহুদীরা সাসানীয় বাহিনীকে সাহায্য করছিল। ৬১৫ তে তারা আনাতোলিয়ার রাজধানী আঙ্কারায় পৌছে যায়। ৬২১ সালে তারা মিশর দখল করে নেয়। ৬২২-২৩ খৃস্টাব্দের মধ্যে পূর্ব এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলো তাদের হস্তগত হয়। ইতিমধ্যে খোসরৌর আহ্বানে সারা দিয়ে আভার ও স্লাভরা উত্তর দিক থেকে বাইজানটাইন রাজধানী কনষ্টানটিনোপলের উপর আক্রমন চালাতে থাকে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এত শোচনীয় হয়ে ওঠে যে সম্রাট হিরাক্লিয়াস রাজধানী কার্থেজে সরিয়ে নেবার কথা ভাবতে শুরু করেন।

এখানেই ৬২২ সালের গুরুত্ব দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়া বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের কাছে এটা ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। বাইজানটাইন সাম্রাজ্য রক্ষার যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে ধর্মযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল, প্রত্যেক খৃষ্টানকে ধর্মযুদ্ধে যোগ দিতে উৎসাহিত করা হয়। সম্রাট তার নিজের পুত্র হেরাক্লিয়াস কনস্টানটাইন ও ধর্মগুরু সারজিয়াসের উপর রাজধানী রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে এশিয়া মাইনরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। হিরাক্লিয়াস যীশুর প্রতিক্রৃতি সামনে রেখে নিজে এই যুদ্ধের নেতৃ্ত্ব দেন। ঐতিহাসিক ওয়ালটার কেগীর মতে, হিরাক্লয়াসের সৈন্যসংখ্যা খুব সম্ভবত ২০,০০০ – ২৪,০০০ এর মধ্যে ছিল, খুব বেশী হলেও তা ৪০,০০০ এর বেশী হবে না। পারসীক বাহিনীকে পরাজিত করে প্রথমেই তিনি রোমান শৌর্য-বীর্যের প্রতিক আনাতোলিয়ার সিজারিয়া শহরটি দখল করেন। এরপর তিনি পারসীক অধিকৃত আর্মেনিয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন। ইতিমধ্যে তিনি দ্বিগুণ শক্তিশালী এক সাসানীয় বাহিনীর সম্মুখে পরেন। হিরাক্লিয়াসের বাইজানটাইন সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন কল্পনাই থেকে যেত যদি না এই সময়ে আরব উপজাতিদের এক বড় বাহিনী হিরাক্লিয়াসের সাহায্যে এগিয়ে না আসত। আরবদের সাহায্যেই হিরাক্লিয়াস পারসিক বাহিনীকে ধ্বংস করেন। এরপর আরব ও হিরাক্লিয়াসের যৌথ বাহিনী রোমানদের হৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করে এবং শেষপর্যন্ত ৬২৭ খৃষ্টাব্দে নিনেভের যুদ্ধে সাসানীয় শক্তির চরম বিপর্যয় ঘটে।

যুদ্ধে আরব ঘাসানিদদের ভূমিকা ও মুয়াবিয়া এর মুদ্রায় ক্রুশ

ইতিহাসের এই ক্রান্তিকাল আরবদের নেপথ্য ভূমিকা দেখা যায়। উত্তর আরবে এসময় ছিল ঘাসানিদ নামে আরবদের এক উপজাতি জোট। তারা ছিল খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী এবং বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সাথে শক্তিশালী মিত্রতার বাঁধনে আবদ্ধ। আরো ভেতরে মধ্য আরবের মরু অঞ্চলে সম্ভবত কোনরুপ শিথিল ধরনের খৃষ্টান ধর্ম প্রচলিত ছিল (বিতর্কিত বিষয়)। আরবরা কেন বাইজানটাইন-সাসানীয় যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল; কারণ এটা ছিল পুরো খৃষ্টান বিশ্বের ধর্মযুদ্ধ। মোদ্দা কথা হল বহুল প্রচলিত বিশ্বাস যে ইসলাম পূর্ব যুগের আরবরা ছিল মুশরিক বা প্যাগান তার বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই। ইবনে ইশাকের বিবরণেই বহুবার আরবি খৃষ্টানদের উল্লেখ আছে। বাইজানটাইন শক্তির চরম বিপদের দিনে আরবরা সাহায্যে এগিয়ে আসে। রোমান সেনাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ চালায়। বহু স্কলার মনে করেন যে আদি ইসলাম ছিল খৃষ্টধর্মের একটি শাখা অথবা ঘুরিয়ে বলা যায় খৃষ্টধর্মের একটি শাখা হিসাবেই ইসলামের অঙ্কুরোদগম হয়েছিল।

প্রচলিত প্রাথমিক মুসলিম ইতিহাসের বিরোধিতা, সাসানীয় সাম্রাজ্য আক্রমণ (৬২৮-৬৩২ খ্রি.) ও হিজরি সনের সূচনা

কিছুদিন আগে পর্যন্ত্য পারস্য জয় সংক্রান্ত ইসলামী বিবরণ প্রায় বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া হত। কিন্তু বর্তমানে অধ্যাপিকা Parvaneh Pourshariati তার অত্যন্ত বিশ্লেষনধর্মী আলোচনায় দেখিয়েছেন আরবরা ৬২৮-৬৩২ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই পারস্য আক্রমণ করে, ইসলামী বিবরণে যেমন রয়েছে সেরকম ৬৩৬ খৃষ্টাব্দে নয়। পুরো সাসানীয় সাম্রাজ্য দখল করতে স্বাভাবিকভাবেই প্রায় দুদশক লেগে গিয়েছিল কারণ প্রথমত, সাম্রাজ্যের বিশাল আয়তন, দ্বিতীয়ত ভূপ্রকৃতিগত কারণেই সাসানীয় সাম্রাজ্য দখল করা ছিল সময়সাপেক্ষ। সাম্রাজ্যের মধ্য অংশে ছিল বিশাল ইরানের মরুভূমি। সাসানীয় সামাজ্যের সবচেয়ে বড় প্রদেশ ছিল খোরাসান (বর্তমান আফগানিস্থান)। দুর্গম পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে এখানে আক্রমন চালানো ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। এটি সম্ভব যে, আরবদের যুদ্ধপ্রচেষ্টা ৬২২ খৃষ্টাব্দেই সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সহযোগী হিসাবে শুরু হয়েছিল, এরপরে বাইজানটাইন সম্রাট নিজ দেশে ফিরে গেলে তারা স্বাধীনভাবে ৬২৮ খৃষ্টাব্দ থেকে দুর্বল সাসানীয় সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ চালায়। এভাবে সাসানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ইরাক দখলের মাধ্যমে তাদের জয়যাত্রা শুরু হয় যা পরবর্তী এক শতাব্দী ধরে চলতে থাকে।

৬২২ খৃষ্টাব্দের এই তাৎপর্যের কারণেই আরবরা এই সাল থেকে একটি অব্দ বা সন চালু করে থাকতে পারে। এভাবেই সৃষ্টি হয় হিজরী সন; পরবর্তীকালে ইসলামের জন্মের পর যাকে মুহম্মদের কল্পিত হিজরতের সাথে জুড়ে দেওযা হয়েছে। আরবের মরু অঞ্চলে সেসময় যে কিছু ঘটছিল তার কোন প্রমানই নেই।

ঐতিহাসিক বিবরণে মুহম্মদের নিরুল্লেখ ও হিরাক্লিয়াসের উল্লেখ

ইসলামী বিবরণ অনুযায়ী মুহম্মদ যদি প্রকৃতই ৬৫-১০০টি যুদ্ধ করে থাকতেন তবে তার কিছু না কিছু চিহ্ন অবশ্যই থাকার কথা। এমন নয় যে সমকালীন ঐতিহাসিক বিবরণে আরবের উল্লেখ নেই। কিন্তু কোথাও মুহম্মদ এমনকি ইসলামের নামগন্ধ নেই। আরব সাম্রাজ্য বহুদূর বিস্তৃত হওযার পরই হঠাৎ করেই যেন ইসলাম ও মুহম্মদ আবির্ভূত হয়।

রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস সম্পর্কে একটি হাদিস পাওয়া যায়। (সহী বুখারী, ওহীর সূচনা অধ্যায়, হাদিস নং ৬, অনেক বড় হাদিস; শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক অংশ দেওয়া হল।) “……তারপর হিরাকল তাদের বললেন, ‘ইনি (রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ) এ উম্মতের বাদশাহ। তিনি আবির্ভূত হয়েছেন।’ এরপর হিরাকল রোমে তার বন্ধুর কাছে লিখলেন। তিনি জ্ঞানে তার সমকক্ষ ছিলেন। পরে হিরাকল হিমস চলে গেলেন। হিমসে থাকতেই তার কাছে তার বন্ধুর চিঠি এলো, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আবির্ভাব এবং তিনিই যে প্রকৃত নবী, এ ব্যাপারে হিরাকলের মতকে সমর্থন করছিল। তারপর হিরাকল তার হিমসের প্রাসাদে রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ডাকলেন এবং প্রাসাদের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দলেন। দরজা বন্ধ করা হলো। তারপর তিনি সামনে এসে বললেন, ‘হে রোমবাসী, তোমরা কি কল্যাণ, হিদায়ত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহলে এই নবীর রায়’আত গ্রহণ কর।’ এ কথা শুনে তারা জংলী গাধার মত ঊর্ধ্বশ্বাসে দরজার দিকে ছুটল, কিন্তু তারা তা বন্ধ অবস্থায় পেল। হিরাকল যখন তাদের অনীহা লক্ষ্য করলেন এবং তাদের ঈমান থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন বললেন, ‘ওদের আমার কাছে ফিরিয়ে আন।’ তিনি বললেন, ‘আমি একটু আগে যে কথা বলেছি, তা দিয়ে তোমরা তোমাদের দীনের উপর কতটুকু অটল, কেবল তার পরীক্ষা করেছিলাম। এখন আমি তা দেখে নিলাম।’ একথা শুনে তারা তাকে সিজদা করল এবং তার প্রতি সন্তুষ্ট হলো। এই ছিল হিরাকল এর শেষ অবস্থা।”

উপরোক্ত হাদিসে বাইজানটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে একজন ইসলাম অনুরাগী ব্যক্তি হিসাবে দেখা যাচ্ছে। আবার ইতিহাস থেকে জানা যায়, হিরাক্লিয়াসের নেতৃত্বেই আরবরা তাদের যুদ্ধযাত্রা শুরু করে।

৬৩৪ সালে মুহম্মদ অর্থ আরব্য

সপ্তম শতাব্দীর একটি সিরিয়াক ম্যানুস্ক্রিপ্টে মুহম্মদের উল্লেখ আছে বলে মনে করা হয়েছে। “এজি ৯৪৫, ৮নং ইনডিকশন, শুক্রবার ৪ ফেব্রুয়ারী [অর্থাৎ ৬৩৪ খৃষ্টাব্দ/ ১২ হিজরী, জ্বিলকদ মাস], নবম প্রহরে প্যালেষ্টাইনের গাজার ১২ মাইল পূর্বে রোমানদের সাথে মহম্মদের আরবদের (সিরিয়াক-tayyāyē d-Ṃhmt) একটি যুদ্ধ হয়ে গেছে। রোমানরা পালিয়ে যায়, প্যাট্রিশিয়ান YRDN (সিরিয়াক BRYRDN) কে ফেলে; যাকে আরবরা হত্যা করে। প্রায় ৪০০০ প্যালেষ্টাইনি অসহায় গ্রামবাসী; ক্রিশ্চিয়ান, ইহুদী ও সামারিটান, নিহত হয়েছে। আরবরা পুরো এলাকায় ধংসযজ্ঞ চালিয়েছে।”

সিরিয়াক tayyāyē শব্দের আদত অর্থ যাযাবর, পরবর্তী নথিতে এই শব্দটি দ্বারা বিজয়ী আরবদের বোঝানো হয়েছে। তাই থেকে এক ঐতিহাসিক রবার্ট.জি.হলান্ড tayyāyē d-Ṃhmt –এর অনুবাদ করেছেন মুহম্মদের আরবরা। পাঠক লক্ষ করুন নামবাচক শব্দের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি লিপিকৃত করা হচ্ছে। কিন্তু আসল সমস্যা হল-সিরিয়াক লিপি ‘t’ আর ‘d’ এর মধ্যে পার্থক্য করে। সেখানে মুহম্মদ শব্দটি ‘Ṃhmd’ এই আকারে পাবার কথা। যদি আমরা মেনেও নি এখানে tayyāyē d-Ṃhmt –এর সঠিক অনুবাদ ‘মুহম্মদের আরবরা’, তাহলেও এর থেকে মুহম্মদ সম্মর্কে কিছুই জানা যায় না।

সারাসেনীয়দের নবী ৬৩৪-৬৪০ সালেও সক্রিয়

৬৩৪ থেকে ৬৪০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে লেখা ডকট্রিনা জাকবি নামে আর একটি দলিলে পাওয়া যায়, “যখন ক্যানডিদেতাস [রোমান রাজকীয় রক্ষীবাহিনীর এক সদস্য] সারাসেনীয়দের দ্বারা হত হল তখন আমি সিজারিয়াতে ছিলাম এবং তারপর নৌকায় চড়ে রওনা দিলাম সায়কামিনার উদ্দশ্যে। লোকে বলছিল ক্যানডিদেতাস মারা গেছে আর আমরা ইহুদীরা অত্যন্ত খুশী হলাম। তারা আরো বলছিল একজন ধর্মপ্রচারক আবির্ভূত হয়েছেন, তিনি আসছেন সারাসেনীয়দের সঙ্গে, এবং আগমন ঘোষনা করেছেন অভিষিক্তজনের, খৃষ্ট- যার আসার কথা ছিল। সায়কামিনায় আসার পর আমার সাথে একজন ধর্মজ্ঞানী বৃদ্ধ মানুষের দেখা হল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “সারাসেনীয়দের মধ্যে যে নবী আবির্ভূত হয়েছেন তার বিষয়ে তুমি কিছু জানাতে পার?” সে কাতর স্বরে বলল “সে হল ভূয়া, কারণ ধর্মপ্রচারকরা তলোয়ার হাতে আসেন না। আজকে চারদিকে যে বিশৃঙ্খলা চলছে তাতে আমি আতঙ্কিত যে, প্রথম খৃষ্ট খৃষ্টানরা যার আরাধনা করে তিনি ঈশ্বর দ্বারা প্রেরিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা এখন এক খৃষ্টবিরোধীকে গ্রহন করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।…..অতএব আমি, আব্রাহাম, খোঁজ করলাম এবং শুনলাম তাদের থেকে যারা তাকে দেখেছে যে এই তথাকথিত নবীর কোনই সত্যতা নেই, শুধুই মানুষের রক্তপাত। সে আরো বলে যে তার হাতে রয়েছে স্বর্গের চাবি, যা একেবারে অবিশ্বাস্য।”

এই বিবরণে বর্ণিত নবী তখনও অর্থ্যাৎ ৬৩৪-৬৪০ খৃষ্টাব্দেও আরবদের মধ্যে সক্রিয়; যেখানে ইসলামী বিবরণে বর্ণিত নবী মুহম্মদ কয়েক বছর আগেই মারা গিয়েছেন। এখানে ইসলাম বা কোরানের কোন উল্লেখ নেই, এমনকি আক্রমনকারীদের মুসলিম বলেও অভিহিত করা হয়নি, বলা হয়েছে সারাসেনীয়। অনান্য বহু সমসাময়িক দলিল পাওয়া গেছে কোনটিতেই ইসলাম, মুহম্মদ ও কোরানের কোনই উল্লেখ পাওয়া যায় না। কোরানের অনুপ্রেরণা বুকে নিয়ে, নবীর আদর্শকে সামনে রেখে যে দুঃধ্বর্শ মুসলিম বাহিনী আরবের মরুভূমি থেকে বেড়িয়ে এসে সারা মধ্যপ্রাচ্য জয় করে নেয়, সাসানীয় সাম্রাজ্য তাদের হাতে বিধ্বস্ত হয় আর বাইজানটাইন সাম্রাজ্যকে এক বিরাট অংশ হারাতে হয়- আশ্চর্যের ব্যাপার সেই কোরান আর নবী মুহম্মদেরকেই ঐতিহাসিক দলিলে খুঁজে পাওয়া যায় না।

৬৭০ খ্রিস্টাব্দের বিশপ সেবিওসের বিবরণ, প্রথম মুহম্মদের উল্লেখ, কিন্তু কেন্দ্রীয় নন

যেসব ইসলামী উৎসগুলো থেকে ইসলামের ইতিহাস জানা যায় সেগুলো বহু পরে রচিত। সমকালীন উৎস থেকে বিষয়গুলোর সত্যতা প্রতিপাদনের চেষ্টা করলেই অবাক হয়ে দেখা যায় যে সমকালীন উৎস সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দিচ্ছে। সমকালীন কোন বিস্তারিত ইসলামী বিবরণ না থাকায় নির্ভর করতে হয় অমুসলিম উৎসের উপর। অমুসলিম দলিল যেখানেই মুহম্মদ, ইসলাম বা কোরানের উল্লেখ করেছে সেখানে কোন ক্ষেত্রেই প্রায় মুসলিম বিবরণের সাথে মেলে না।

প্রথম যে অমুসলিম বিবরণ পাওয়া যায় যেখানে নিশ্চিতভাবে মুহম্মদের উল্লেখ আছে তা হল বিশপ সেবিওসের বিবরণ- “তারা যাত্রা শুরু করল মরুভূমির মধ্য দিয়ে এবং চলে এল আরবে, ইসমায়েলের পুত্রদের মধ্যে; তারা তাদের সাহায্য প্রার্থনা করল, এবং তাদেরকে ব্যাখ্যা করল যে তারা বাইবেল অনুসারে তাদের (আরবদের) আত্মীয়। যদিও তারা (ইসমেলাইটরা) এই আত্বীয়তা স্বীকার করতে প্রস্তুত তবুও তারা (ইহুদীরা) কখনই জনগণ প্রত্যয়দানে সক্ষম হল না, কারণ তাদের ধর্মসম্প্রদায় ছিল পৃথক।

এই সময় সেখানে ছিলেন মহমেত নামে এক ইসমেলাইট, একজন বণিক, তিনি নিজেকে তাদের সামনে উপস্থিত করলেন ঈশ্বরের আদেশপ্রাপ্ত, সত্যের পথচারী; এক ধর্মগুরু হিসাবে তাদের আব্রাহামের ঈশ্বরকে জানতে শেখালেন, কারণ তিনি জানতেন ও ভালভাবে মোসেসের কাহিনীর সাথে পরিচিত ছিলেন। যেহেতু স্বর্গ থেকে আদেশ এসেছে, তাই তারা সবাই সেই মানুষের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হল; একি আইনের অধীনে এবং মিথ্যা ধর্মাচরণকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফিরে গেল জীবিত ঈশ্বরের কাছে যিনি নিজেকে আব্রাহামের কাছে প্রকাশ করেছিলেন। মহমেত তাদেরকে নিষেধ করলেন মৃত পশুর মাংস খেতে, মদ্যপান করতে, মিথ্যা কথা বলতে ও ব্যাভিচার করতে। তিনি আরো বলেন “ঈশ্বর এই ভূমি আব্রাহামকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং বংশপরম্পরায় চিরকালে জন্য; যিনি সেই প্রতিশ্রুতি অনুসারে চলেছেন কেননা তিনি ইসরায়েলকে ভালবাসতেন। এখন তোমরা, ইসরায়েলের পুত্ররা, ঈশ্বর তোমাদের দ্বারাই আব্রাহাম ও তার বংশধরদের দেওয়া সেই প্রতিশ্রতি পূর্ণ করবেন। এস এবং অধিকার কর সেই দেশ যা ঈশ্বর তোমাদের পিতা আব্রাহামকে দিয়েছিলেন, কেউই তোমাদের প্রতিরোধ কলতে পারবে না কারণ ঈশ্বর আছেন তোমাদের সাথে”

এর পরে আছে আরব ও ইহুদীদের মিলিত অভিযানের বিবরণ যার সাথে ইতিহাসের কোনই সম্পর্ক নেই। শুধু তাই নয় লেখক বহু স্থানের উল্লেখ করেছেন যেগুলোর উৎস হল বাইবেলের জেনেসিস। লেখক মনে হয় বাস্তব ঘটনাবলি বর্ণনা করার চেয়ে গোটা বিষয়টিকে পৌরাণিক চরিত্র দিতেই বেশী আগ্রহী ছিলেন। যদি মেনে নেয়া হয় এই বিবরণ বিকৃতভাবে হলেও কিছুটা ঐতিহাসিক সত্য উপস্থাপনা করে, সেক্ষেত্রে ইসলামের আদি যুগের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পাওয়া যায় যা এমনকি খোদ কোরানের সাথেই সংঘাতপূর্ণ- ‘অবশ্য মুমিনদের প্রতি শত্রুতায় ইয়াহুদী আর মুশরিকদেরই তুমি সর্বাধিক উগ্র দেখিবে’(সুরা মায়েদা, ৮২)। মুহম্মদের নির্দেশে মদিনার ইহুদীদের উপর অত্যাচার ও বিতারন করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় কোরান যেখানে ইহুদীদের সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু বলে অভিহিত করছে , সেখানে সমকালীন খৃষ্টান নথির এই বর্ণনা পুরো ইসলামী ইতিহাসের সত্যতা সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলে দেয়।

বিশপ সেবিওস পরে উল্লেখ করেছেন, মুয়াবিয়া, তৎকালীন সিরিয়ার শাসনকর্তা এবং পরবর্তী খলিফা, ৬৫১ খৃষ্টাব্দে বাইজানটাইন সম্রাটকে একটি চিঠি পাঠান। তাতে তিনি সম্রাটকে খৃষ্টধর্ম ত্যাগ করে আব্রাহামের ঈশ্বরকে গ্রহন করতে বলেছেন, “যদি শান্তিতে বাস করতে চাও… নিজের মিথ্যা ধর্ম ত্যাগ কর যে ধর্মে তুমি ছোটো থেকে প্রতিপালিত হয়েছ। ত্যাগ কর ওই যীশুকে এবং চলে এস মহান ঈশ্বর যার আমি ইবাদত করি, আমাদের পিতা আব্রাহামের ঈশ্বরের কাছে।…… যদি না কর তবে যে যীশু, যাকে তুমি খৃষ্ট বলে ডাক, যে নিজেকেই বাঁচাতে পারেনি ইহুদীদের হাত থেকে, সে তোমাকে আমার হাত থেকে কিভাবে বাঁচাবে।” কোরান অনুসারে যীশু বা ঈসা নবীর মৃত্যু হয়নি- “….এটি নিশ্চিত যে তারা তাকে হত্যা করেনি” (সুরা আল নিসা, আয়াত ১৫৭) “বরং আল্লাহ তাকে তার নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (সুরা আল নিসা, আয়াত ১৫৮) এখানে আবার দুই বিবরণের অসঙ্গতি ও বৈপরীত্যের সম্মুখীন হতে হয়। তাছাড়া বিশপ সেবিওসের এই চিঠিতে ইসলামের কেন্দীয় চরিত্র মুহম্মদের কোন উল্লেখ নেই। আদি ইসলামে মুহম্মদ কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিলেন কিনা সন্দেহ হয়।

৬৭৭-৭৮ সালে মুয়াবিয়ার নির্মিত বাঁধে খোদাইতে ইসলাম ও মুহম্মদের নিরুল্লেখ

খলিফা মুয়াবিয়ার আমলে ৬৭৭ বা ৬৭৮ খৃষ্টাব্দে নির্মিত একটি বাঁধে খোদিত আছে -“ এই বাঁধ ঈশ্বরের দাস মুয়াবিয়ার (অধীনস্ত) বিশ্বাসীজনের সেনাপতি আবদুল্লাহ বিন সাখর নির্মান করেছেন ঈশ্বরের আদেশানুসারে ৫৮ সনে। আল্লাহ্‌! আপনার এই দাস মুয়াবিয়াকে মার্জনা করুন বিশ্বাসীজনের সেনাপতি, তার স্থান অনুমোদন করুন ও তাকে সাহায্য করুন এবং বিশ্বাসীরা তার অবস্থানে খুশী হোক, লেখেন আমর বিন হাব্বাব/জনাব”। এখানে মুয়াবিয়াকে বিশ্বাসীদের সেনাপতি বলা হয়েছে কিন্তু তার বিশ্বাস সম্পর্কে কিছুই জানা সম্ভব হয় না।

৬৮৮ সালে প্রাপ্ত মিশরের ফুসতাতে প্রাপ্ত লিপিতেও নিরুল্লেখ

একইভাবে ৬৮৮ খৃষ্টাব্দের এক লিপি যেটা মিশরের ফুসতাতে একটি সেতুর উপর পাওয়া গেছে, তাতে বলা হচ্ছে- “এটাই সেই খিলান যা আমীর, আবদ আল-আজিজ বিন মারওয়ানের আদেশে নির্মিত হয়েছে। আল্লাহ্‌! তার সর্বকর্মে আশীর্বাদ করুন, তার কর্তৃত্ব অনুমোদন করুন যেমনভাবে আপনি চান এবং তার ও তার পরিবারকে সর্বসুখী করুন। সাদ আবু উসমান নির্মান করেছেন এবং আবদ আর-রহমান লিখেছেন ৬৯ সনের সফর মাসে।”

এখানেও একইভাবে না মুহম্মদ, না ইসলাম না কোরান। যেটা আমাদের সবচেয়ে বিস্মিত করে তা হল ইসলামী প্রথা অনুসারে বিসমিল্লাহ-এর অনুপস্থিতি। ইসলামী প্রথায় যে কোন রচনার শুরুতে বিশমিল্লাহির রাহমানীর রহিম বা (পরম করুনাময় আল্লার নাম নিয়ে শুরু করছি) লেখা হয়ে থাকে। অথচ সপ্তম শতাদ্বীর একদম শেষভাগের আগে পর্যন্ত এ সম্পর্কে কেউ কিছু জানত বলে তো মনে হয় না। দেখা যায় শাহাদা বা ইসলামে বিশ্বাসের ঘোষণাও আবদ আল মালিকের শাসনকালের আগে চালু হয়নি।

আরব খ্রিস্টানদের আল্লাহ্‌ শব্দের ব্যবহার

সপ্তম শতাব্দীর আরব বিজেতারা যে কোরানের অনুপ্রেরণা ও কথিত মুহম্মদের আদর্শকে ধারণ করে দুর্দমনীয় গতিতে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলল, আশ্চর্যের বিষয় সেই মুহম্মদ আর কোরানকেই সংশ্লিষ্ট সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের পাওয়া যায় কেবল তার বহু পরে লেখা বিবরণীতে। এমন নয় যে সমসাময়িক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের অভাব আছে। আরব বিজেতাদের সবচেয়ে পুরানো যেসব মুদ্রা পাওয়া গেছে তাতে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ (bism Allah অর্থাৎ আল্লাহর নামে) খোদিত রয়েছে। আল্লাহ হল ঈশ্বরের আরবী প্রতিশব্দ মাত্র। ইহুদী ও খৃষ্টান আরববাসীরাও তাদের ঈশ্বরকে আল্লাহ নামে ডেকে থাকে। অনান্য যেসব মুদ্রা পাওয়া গেছে তাতে ‘বিসমিল্লাহ রাব্বি’- অর্থাৎ আমার প্রভু আল্লার নামে, ‘রাব্বি আল্লাহ’- আমার প্রভু আল্লাহ, ‘বিসমিল্লাহ আল-মালিক’- মহাসম্রাট আল্লাহর নামে ইত্যাদী লেখা পাওয়া যায়। যদি এসময়ের একটিও মুদ্রা পাওয়া যেত যেখানে ‘মুহম্মদ রাসুলাল্লাহ’ অর্থাৎ মু্হম্মদ আল্লার রাসুল- খোদিত আছে, সেক্ষেত্রে অন্তত আংশিকভাবে সাম্রাজ্যের ইসলামিক চরিত্র নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যেত, কিন্তু সেরকম একটিও পাওয়া যায় না।

৬৪৭-৬৮৩ এর মুদ্রা ও লিপিতে ক্রুশ ও মুহম্মদ একসাথে, মুহম্মদ অর্থ নিযুক্ত বা প্রশংসিতজন ও খ্রিস্টীয় শাসক খলিফা

৬৪৭-৬৫৮ এর মধ্যে মধ্যে ছাপানো একটি মুদ্রায় অবশ্য Muhammad লিপিকৃত রয়েছে। কিন্তু এর উল্টো পিঠে মুসলিম শাসকের প্রতিকৃতি দেখা যায়। এই রকম বেশ কিছু মুদ্রা এর পর থেকে পাওয়া যেতে শুরু করে। ছবি বা মূর্তির ব্যাপারে ইসলামের প্রবল সংবেদনশীলতার কথা মনে রেখে এসব লিপিকে মুসলিম শাসনের প্রমাণ হিসাবে মেনে নেওয়া শক্ত। বরং এটাই প্রতীয়মান হয় যে এসময় ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলো আদপেই প্রচলিত হয়নি। আদি ইসলামে মুহম্মদ বলতে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের তথাকথিত নবীকে বোঝাত না, মুহম্মদ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘নিযুক্ত, প্রশংসিত জন’ বোঝাত। এই মুদ্রাগুলোতে প্রকৃতপক্ষে খলিফাকে ঈশ্বর দ্বারা নিযুক্ত/প্রশংসিত ব্যক্তি হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, বেশ ভাল সংখ্যক মুদ্রায় খলিফার একহাতে একটি ক্রুশ দেখা যায়।

ইসলামের পঞ্চম খলিফা মুআবিয়ার আমলে ছাপা মুদ্রায় দেখা যাচ্ছে মুসলিম শাসক একটি ক্রুস বহন করছেন, অপর পিঠে সম্ভবত মহম্মদের নাম রয়েছে। অতএব, এটাই বেশি সম্ভাব্য যে আরবি খৃষ্টানদের মধ্য থেকেই ইসলামের উদ্ধব হয়েছিল, মূর্তিপূজক সর্বশ্বরবাদীদের মধ্য থেকে নয়।

মুয়াবিয়ার আমলে প্যালেষ্টাইনের গাদারায় আর একটি লিপি পাওয়া গেছে। এটি ৬৬২ খৃষ্টাব্দে একটি স্নানাগারের উপরে উৎকীর্ণ হয়েছিল। লিপিটি শুরু হচ্ছে একটি ক্রুশের চিহ্ন দিয়ে। মনে রাখা দরকার এটি ছিল সরকারি স্নানাগার, খলিফার নির্দেশেই লিপিটি উৎকীর্ণ হয়েছিল। তার প্রমান লিপিতেই দেখা যায়- এখানে মুয়াবিয়াকে আল্লার দাস, রক্ষকদের নেতা ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে। মুয়াবিয়ার উত্তরসূরী প্রথম ইয়াজিদের (৬৮০-৬৮৩) মুদ্রাতেও একইভাবে খলিফার ক্রুশবহনকারী প্রতিমূর্তি পাওয়া যায়।

ক্রুশ হল খ্রিস্টধর্মের প্রতীকচিহ্ন। তাই মনে হচ্ছে, আদি ইসলামিক খলিফারা নিজেদের খৃষ্টান শাসক বলে মনে করতেন। যদিও উমাইয়া খলিফারা ধর্মীয় শিথিলতার জন্য ঈশ্বরহীন খলিফা নামে আখ্যায়িত হয়েছেন (বহু পরে রচিত ইসলামিক সূত্র আমাদের সেইরকমই জানায়); ধর্মের বিষয়ে শিথিলতা দেখানো এক বিষয় আর পুরোপুরি আলাদা ধর্মের প্রতীয়চিহ্ন ধারণ করা সম্পূর্ন অন্য বিষয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে নতুন ধর্ম ইসলামের উদ্ধব ঘটল কখন।

৬৯০ খ্রিস্টাব্দে কপটিক বিশপ জনের ক্রনিকলে সর্বপ্রথম মুসলিম শব্দের ব্যবহার?

৬৭০ খৃষ্টাব্দের সেবিওসের বিবরণের সাথে প্রচলিত ইসলামী কাহিনীর বিপুল পার্থক্য দেখা যায়। তবে সেই বিবরণ থেকে ঐতিহাসিক তথ্য বিশেষ কিছুই জানা যায় না। সেবিওসের বিবরণে নবীর অনুসারীদের মুসলিম বলা হয়নি, বলা হয়েছে সারাসেনীয়। সর্বপ্রথম যে বিবরণে মু্হম্মদ অনুসারীদের মুসলিম বলা হয়েছে সেটি হল নিকিউর কপটিক বিশপ জনের ক্রনিকল, যা সম্ভবত ৬৯০ খৃষ্টাব্দে রচিত হয়েছিল।

“এবং এখন বেশ কিছু মিশরীয় যারা কিনা ছিল ভূয়া খৃষ্টান, অর্থোডক্স বিশ্বাস আর জীবনদায়ী ব্যাপটিসম ত্যাগ করেছে; আলিঙ্গন করে নিয়েছে ঈশ্বরের শত্রু মুসলিমদের ধর্ম, আর গ্রহণ করেছে পশুর ন্যায় ঘৃণিত মুহম্মদের মত; এবং তারা মূর্তিপূজকদের সাথে মিলে পাপে নিমজ্জিত হয়েছে, অস্ত্র তুলে নিয়েছে হাতে এবং যুদ্ধ করেছে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে” [https://wikiislam.net/wiki/Historicity_of_Muhammad]

এই বক্তব্যে মনে হচ্ছে, লেখক মুসলিমদের ক্রিশ্চিয়ানিটি থেকে অধঃপতিত একটি সম্প্রদায় হিসেবে বিবেচনা করেন, কোন নতুন ধর্ম হিসাবে নয়। এই ক্রনিকলে মুসলিম শব্দের উল্লেখ থাকলেও একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে ওই সময় এই শব্দটি প্রচলিত ছিল। মূল ক্রনিকলটি পাওয়া যায় না। বর্তমানে যেটা আছে সেটা হল ১৬০২ খৃষ্টাব্দে আরবী থেকে অনুদিত একটি সংস্করণ। এই আরবী নথিটি আবার মূল গ্রিক বা ওই ধরণের কোন ভাষা থেকে অনুদিত। সম্ভবত জন তৎকালীন সময়ে প্রচলিত অন্য কোন শব্দ ব্যাবহার করেছিলেন, পরবর্তী অনুবাদক সেটা পালটে মুসলিম করে দিয়েছেন। আমাদের এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হচ্ছে কারণ সংশ্লিষ্ট সময়ের কোন ঐতিহাসিক দলিলেই মুসলিম শব্দটি নেই। এমনকি পঞ্চম পর্বের ‘ডোম অফ দ্য রক লিপি’তেও এটা পাওয়া যায় না।

৬৯১ সালে আব্দ আল মালিকের (৬৮৫-৭০৫ খ্রি.) সময় ডোম অফ দ্য রকে খোদাই ও কোরানের সাথে সম্পর্ক

প্রকৃতপক্ষে আবদ আল মালিকের (৬৮৫-৭০৫) রাজত্বকালের আগে কোনরকম জোরালো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় না যা খাঁটি ইসলামিক বলে গণ্য হতে পারে। আবদ আল মালিকের রাজত্বকালে নির্মিত Dome of the Rock মসজিদে (জেরুজালেমে অবস্থিত কুব্বাত আল-সাখরা) প্রাপ্ত লিপিই হল ইসলামিক ধর্মতত্বের প্রথম ঐতিহাসিক ঘোষনা। ৬৯১ সালে কৃত এই শিলালিপিটিতে কোরানের আয়াত খোদাই করা হয়েছে। মসজিদের একটি অষ্টাভূজ তোরণের ভেতরের অংশে এই লেখটি উৎকীর্ণ আছে-

“পরম করুনাময় আল্লাহর নামে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ এক, তার কোন সঙ্গী নেই (কিছু অতিরিক্ত বক্তব্যের সাথে শাহাদার প্রথম অংশ)

আধিপত্য তারই এবং প্রশংসা তারই, তিনি জীবনদান করেন ও তিনি মৃত্যু ঘটান এবং তিনি সর্ববিষয়ে শক্তিমান (সুরা তাগাবুনের ১ নং আয়াত ও সুরা হাদিদের ২নং আয়াতের কিছু অংশ মিশ্রিত)

মুহম্মদ আল্লার বান্দা ও তার রাসুল (একটু পরিবর্তিতভাবে শাহাদার শেষ অংশ)

আল্লাহ নবীর প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তার ফিরিসতারাও নবীকে অনুগ্রহ করেন, হে মুনিনগন, তোমরাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও (সুরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াত সম্পূর্ণ)

আল্লাহর অনুগ্রহ তার উপর এবং তার উপরে শান্তি বর্ষিত হোক ও আল্লাহর করুণা থাকুক তার উপর (কোরানের অংশ নয়)

হে আহলে-কিতাবগণ, তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ্‌র শানে নিতান্ত সত্য ছাড়া কোন কথা বলো না। নিঃসন্দেহে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা আল্লাহর রসূল এবং তার বাণী যা তিনি মরিয়মের কাছে প্রেরণ করেছেন এবং রূহ-তার কাছ থেকে আগত। অতয়েব, তোমরা আল্লাহকে এবং তার রসূলগণকে মান্য কর। একথা বলো না যে, তিন, থাম; তোমাদের মঙ্গল হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ একক উপাস্য। সন্তান-সন্ততি হওয়াটা তার যোগ্য বিষয় নয়। যা কিছু আসমানসমূহ ও জমিনে রয়েছে সবই তার। আর কর্মবিধানে আল্লাহই যথেষ্ট। মসীহ আল্লাহর বান্দা হবেন, তাতে তার কোন লজ্জাবোধ নেই এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাদেরও না। বস্তুতঃ যারা আল্লাহর দাসত্বে লজ্জাবোধ করবে এবং অহংকার করবে, তিনি তাদের সবাইকে নিজের কাছে সমবেত করবেন। (সুরা নিসা আয়াত ১৭১-৭২ সম্পূর্ণ),

হে আল্লাহ, আপনার রাসুল ও বান্দা মরিয়ম পুত্র ঈসাকে অনুগ্রহ করুন (অব্যয়ের চিহ্ন, পরবর্তী ভাষ্যকে সূচিত করে)

তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক যেদিন তিনি জন্মলাভ করেছিলেন যেদিন তার মৃত্যু হয় এবং যেদিন তিনি পুনরুত্থিত হবেন (সুরা মরিয়ম, আয়াত ৩৩ সম্পূর্ন; শুধুমাত্র সর্বনাম পদগুলি উত্তম পুরুষ থেকে প্রথম পুরুষে পরিবর্তিত হয়েছে।)

এই মারইয়ামের পুত্র ঈসা। সত্যকথা, যে সম্পর্কে লোকেরা বিতর্ক করে। আল্লাহ এমন নন যে, সন্তান গ্রহণ করবেন, তিনি পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা, তিনি যখন কোন কাজ করা সিদ্ধান্ত করেন, তখন একথাই বলেনঃ হও এবং তা হয়ে যায়। (সুরা মরিয়ম, আয়াত ৩৪-৩৫ সম্পূর্ণ)

নিশ্চই আল্লাহ আমার পালনকর্তা ও তোমাদের পালনকর্তা। অতএব, তোমরা তার এবাদত কর। এটা সরল পথ। (সুরা মরিয়ম, আয়াত ৩৬, সুরার শুরুতে একটি সংযোযক অব্যয় ‘এবং’ বাদ দেওয়া হয়েছে)

আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম। এবং যাদের প্রতি কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও ওরা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ, যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি কুফরী করে তাদের জানা উচিত যে, নিশ্চিতরূপে আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত দ্রুত। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮-১৯ সম্পূর্ণ)।

ডোম অফ দ্য রকের খোদাই এর ব্যাখ্যা

এখানে এলোমেলোভাবে বিভিন্ন আয়াতের অংশ লিপিতে উঠে এসেছে। কোরান থেকে যদি সরাসরি লিপিকৃত করা হত তাহলে একই জায়গায় একটি সম্পূর্ণ সুরা বা তার অংশবিশেষ পাওয়া যেত। ব্র্যাকেটের মধ্যের অংশগুলি মূল কোরানের সাথে এই লিপির পার্থক্য ও ঘনিষ্ঠতা বোঝাবার জন্য দেওয়া হয়েছে। কোরানের আয়াত বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে আজকে যে আকারে কোরানকে পাওয়া যায় তার সাথে বহু ছোটোখাটো পার্থক্য রয়েছে। হয়ত তুচ্ছ পার্থক্য এতে অর্থের পরিবর্তন ঘটছে না, কিন্তু মনে রাখা দরকার একজন মুসলিমের কাছে কোরান আল্লাহর বাণী। তাই একজন ধার্মিক মুসলিম জেনেশুনে কোরানের আয়াত পরিবর্তিত করছে এটা অচিন্তনীয়। সুতরাং মনে হয় ওই সময় পর্যন্ত কোরান (অন্তত আজকের আকারে) প্রচলিত ছিল না। কোরান চালু থাকলে কখনই আয়াতগুলি পরিবর্তিত আকারে পাওয়া যেতনা।

প্রশ্ন আসছে এই লিপি থেকেই পরবর্তীকালে কোরানের সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো সংকলিত হয় কিনা। এই সম্ভাবনাটি যথেষ্ট বিচারযোগ্য কিন্তু গবেষক এসটেল হোয়েলান এই যুক্তির অসাড়তা দেখিয়েছেন। যদি কোরানের অংশবিশেষ এই শিলালিপি থেকে গৃহীত হয়ে থাকে তবে সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো একেবারে এই লিপির আকারেই পাওয়ার কথা। সবচেয়ে বড় কথা হল-“আধিপত্য তারই এবং প্রশংসা তারই, তিনি জীবনদান করেন ও তিনি মৃত্যু ঘটান এবং তিনি সর্ববিষয়ে শক্তিমান”- সেক্ষেত্রে এই লেখটির একটি অংশ এক সুরায় এবং অপর অংশ অন্য সুরায় ঢোকাবার কোনই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এটা অত্যন্ত অবিশ্বাস্য যে একই জায়গা থেকে নেওয়া এই বাক্যটিকে ভেঙ্গে প্রথম অংশকে সুরা তাগাবুনে ঢোকানো হল আর পরেরটিকে সুরা হাদিদে ঢোকানো হল। এরপর আমাদের হাতে আর একটিমাত্র বিকল্প থাকে তা হল, কোরান এবং Dome of the Rock লিপি দুটিই কোন পূর্ববর্তী উৎস থেকে এসেছে; যেটির এখন আর কোন অস্তিত্ত নেই।

ডোম অফ দ্য রকের মুহম্মদ বা রাসুল আসলে যীশু খ্রিস্ট

মোট উৎকীর্ণ লিপির সামান্য অংশই তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তারপরও বারবার পড়লে দেখা যায়, Dome of the Rock লিপি আল্লাহ্‌র গুনকীর্তন ছাড়া মূলত বলতে চাচ্ছে যে, ঈসা নবী অর্থাৎ যীশু খৃষ্ট ঈশ্বর নন, তিনি ঈশ্বরের পুত্রও নন; তিনি আল্লাহর বান্দা ও সুসংবাদ দানকারী মাত্র। দেখলে মনে হবে যেন কোরানের ঈসা নবী সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোই বেছে বেছে তুলে আনা হয়েছে। ঈসা নবীকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হচ্ছে, পূর্বেই বলা হয়েছে মু্হম্মদ শব্দের আবিধানিক অর্থ হল নিযুক্ত/প্রশংসিত ব্যক্তি, যেটা প্রকৃতপক্ষে একটা উপাধি। আল-মুহম্মদ হল সঠিকভাবে আরবীতে প্রশংসিত ব্যক্তি। ক্রিস্তোফ লুক্সেমবার্গ নামে এক ভাষাবিদ দেখিয়েছেন আরবী নির্দেশক পদ ‘আল’ বাদ দিয়ে শুধু ‘মুহম্মদ’ শব্দটি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এতে করে “মুহম্মদ আল্লার বান্দা ও তার রাসুল” বাক্যটির অনেক বেশী যৌক্তিক অর্থ হয় -“(সকল) প্রশংসা আল্লার বান্দা ও রাসুলের”। তার মতে গোড়ায় মুহম্মদ শব্দটি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য হিসাবেই ব্যবহার হত, পরবর্তীকালে কোরানের কয়েকটি আয়াতের উপর ভিত্তি করে এটি ব্যক্তিনাম হিসাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

প্রশ্ন হল আল্লাহর রসুল বা বার্তাবহনকারী এখানে কে।  Dome of the Rock লিপি পরিস্কার উত্তর দিচ্ছে “নিঃসন্দেহে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা আল্লাহর রসূল”। এখান থেকে মনে হয়, ঈসা বা যীশু খৃষ্টই ছিলেন আদি ইসলামের কেন্দ্রীয় চরিত্র। মুহম্মদের প্রথম জীবনীকার ইবনে ইশাক লক্ষ্য করেছেন বাইবেলে ‘Munahhemana’ শব্দটি আছে যার অর্থ ‘The Comforter’(খৃস্টধর্মের হোলি ট্রিনিটির তিন অংশের এক অংশ)। ইবনে ইশাক বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার পর আমাদের জানাচ্ছেন “মুনাহেমানা, ঈশ্বর তাকে অনুগ্রহ ও রক্ষা করুন, সিরিয়াক ভাষায় হলেন মুহম্মদ; গ্রীক ভাষায় হলেন প্যারাক্লিট” সিরাত রসুল উল্লাহের ইংরাজী অনুবাদক Alfred Guillaume দেখিয়েছেন যে মুনাহেমানা এই শব্দটি দ্বারা প্রাচ্যের খৃষ্টীয় সাহিত্যে আদতে যীসু খৃস্টকে বোঝানো হত। অর্থাৎ মুনাহেমানা বা মুহম্মদ এই উপাধীটির আদি গ্রাহক ছিলেন যীশু খৃষ্ট। খোদ কোরানেই ঈসার উল্লেখ আছে ২৫ বার, মুহম্মদ শব্দটি এসেছে মাত্র ৪ বার। তবে মনে রাখা দরকার খৃষ্টধর্মের শাখা হিসেবে আদি ইসলামের সূচনা হলেও এর সাথে রোমান ক্যাথলিসিজমের প্রবল বৈপরীত্য রয়েছে। বারবার যীশুর ঐশ্বরিকতা অস্বীকার করার প্রচেষ্টাতেই এটা পরিস্কার। উপরের লিপিটি অনুসারে, ঈশ্বর তিন নন, ঈশ্বর এক ইত্যাদি বলে খৃষ্টধর্মের হোলি ট্রিনিটির ধারণাকে সরাসরি নাকচ করছে। আর পরবর্তী ইসলামে সেটাই কোরানে গৃহীত হয়।

মাদানী সুরাসমূহে সম্পাদনার চিহ্ন আবিষ্কার ও সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনীয়তার প্রতিফলন

আরেকজন কোরান বিশেষজ্ঞ রিচার্ড বেল (১৮৭৬-১৯৫২) কোরানের বহু স্থানে সম্পাদনার চিহ্ন আবিস্কার করেছেন।

যেমন সুরা বাকারায় –
১১৬। তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি তো এসব কিছু থেকে পবিত্র, বরং নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তার আজ্ঞাধীন।  ১১৭। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে একথাই বলেন, `হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।  ১১৮। যারা কিছু জানে না, তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কেন কথা বলেন না? অথবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন কেন আসে না? এমনি ভাবে তাদের পূর্বে যারা ছিল তারাও তাদেরই অনুরূপ কথা বলেছে। তাদের অন্তর একই রকম। নিশ্চই আমি উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করেছি তাদের জন্যে যারা প্রত্যয়শীল।  ১১৯। নিশ্চয় আমি আপনাকে সত্যধর্মসহ সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে পাঠিয়েছি। আপনি দোখজবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন না।  ১২০। ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন। বলে দিন, যে পথ আল্লাহ প্রদর্শন করেন, তাই হল সরল পথ। যদি আপনি তাদের আকাঙ্খাসমূহের অনুসরণ করেন, ঐ জ্ঞান লাভের পর, যা আপনার কাছে পৌঁছেছে, তবে কেউ আল্লাহর কবল থেকে আপনার উদ্ধারকারী ও সাহায্যকারী নেই।  ১২১। আমি যাদেরকে গ্রন্থ দান করেছি, তারা তা যথাযথভাবে পাঠ করে। তারাই তৎপ্রতি বিশ্বাস করে। আর যারা তা অবিশ্বাস করে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।

বেল দেখিয়েছেন আয়াত ১১৬-১১৭ হল ১২০ নং আয়াতে যে দাবী করা হয়েছে ইহুদী ও খৃষ্টানরা কখনই সন্তুষ্ট হবে না তার ব্যাখ্যা। প্রকৃতপক্ষে এই আয়াতদুটি ১২০ এর পরে আসা উচিত। ১১৮-১৯ আয়াতে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু বক্তব্য দেখা যায়, যার সাথে অন্য তিনটি আয়াতের কোন সম্পর্ক নেই। এই আয়াতদুটিকে অন্যকোথাও থেকে তুলে আনা হয়েছে। বেল আয়াতগুলিকে পরপর সাজিয়েছেন এইভাবে-
১২০। ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন। বলে দিন, যে পথ আল্লাহ প্রদর্শন করেন, তাই হল সরল পথ। যদি আপনি তাদের আকাঙ্ক্ষাসমূহের অনুসরণ করেন, ঐ জ্ঞান লাভের পর, যা আপনার কাছে পৌঁছেছে, তবে কেউ আল্লাহর কবল থেকে আপনার উদ্ধারকারী ও সাহায্যকারী নেই।  ১১৬। তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি তো এসব কিছু থেকে পবিত্র, বরং নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তার আজ্ঞাধীন।  ১১৭। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে একথাই বলেন, `হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়। 
১২১। আমি যাদেরকে গ্রন্থ দান করেছি, তারা তা যথাযথভাবে পাঠ করে। তারাই তৎপ্রতি বিশ্বাস করে। আর যারা তা অবিশ্বাস করে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।

কোরানের সুরা নিসার নিচের অংশেও সম্পাদনার চিহ্ন বর্তমান-
“তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভ্রাতৃকণ্যা; ভগিনীকণ্যা তোমাদের সে মাতা, যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ-বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মাতা, তোমরা যাদের সাথে সহবাস করেছ সে স্ত্রীদের কন্যা যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে। যদি তাদের সাথে সহবাস না করে থাক, তবে এ বিবাহে তোমাদের কোন গোনাহ নেই। তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রী এবং দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করা; কিন্তু যা অতীত হয়ে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকরী, দয়ালু” (সুরা নিসা,২৩)

এই আয়াতে পূর্নাঙ্গ বিবাহ আইন বর্ণিত হয়েছে যা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বস্তুত আরবে তৎকালীন যুগে প্রচলিত আইনকেই ধর্মীয় নিয়ম হিসাবে কোরানের অন্তর্ভূক্ত করা হল। তার পরের আয়াত –

এবং নারীদের মধ্যে তাদের ছাড়া সকল সধবা স্ত্রীলোক তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ; তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিক হয়ে যায় – এটা তোমাদের জন্য আল্লাহর হুকুম। এদেরকে ছাড়া তোমাদের জন্যে সব নারী হালাল করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তাদেরকে স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য-ব্যভিচারের জন্য নয়। অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা ভোগ করবে, তাকে তার নির্ধারিত হক দান কর। তোমাদের কোন গোনাহ হবে না যদি নির্ধারণের পর তোমরা পরস্পরে সম্মত হও। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, রহস্যবিদ” (সুরা নিসা, ২৪)

“আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বাধীন মুসলমান নারীকে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না, সে তোমাদের অধিকারভুক্ত মুসলিম ক্রীতদাসীদেরকে বিয়ে করবে। আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত রয়েছেন। তোমরা পরস্পর এক, অতএব, তাদেরকে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে বিয়ে কর এবং নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর এমতাবস্থায় যে, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে-ব্যভিচারিণী কিংবা উপ-পতি গ্রহণকারিণী হবে না। অতঃপর যখন তারা বিবাহ বন্ধনে এসে যায়, তখন যদি কোন অশ্লীল কাজ করে, তবে তাদেরকে স্বাধীন নারীদের অর্ধেক শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ ব্যবস্থা তাদের জন্যে, তোমাদের মধ্যে যারা ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে ভয় করে। আর যদি সবর কর, তবে তা তোমাদের জন্যে উত্তম। আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়” (সুরা নিসা,২৫) (Richard Bell, “From Introduction to Koran” in Ibn Warraq Ed “What the Koran really says”)

পরিস্কারভাবে আয়াত ২৪ এ বিকল্প সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বেলের মতে সাম্রাজ্য বিস্তৃত হবার ফলে পরবর্তীকালে বিবাহ আইনের কিছু শিথিলতা প্রয়োজন হয়ে পরে। তখন নতুন আয়াত যুক্ত করে নতুন পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়। প্রসঙ্গত সুরা নিসা আর সুরা বাকারা ইসলামী আইনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন উপাদান।

সুরা বাকারা, নিসা প্রভৃতি মাদানী সুরার পরবর্তী প্রবেশ ও এর স্পষ্টীকৃত ও ছন্দহীন অবস্থা

সুরা বাকারা ও সম্ভবত সুরা নিশা বহু পরে কোরানে ঢুকেছে। বস্তুত সুরা বাকারা, সুরা নিশা, সুরা তওবা ইত্যাদী মাদানী সুরাগুলি বহু পরে সরাসরি কোরানে ঢুকেছে। এগুলো খৃষ্টীয় শ্লোক ছিল না, তাই সম্পাদনারও প্রয়োজন পড়েনি। জিহাদ আর গণিমতের মালে মাখামাখি এইসব সুরায় ভাষাগত অসংলগ্নতা অনেক কম, বক্তব্য পরিস্কার ও স্পষ্ট, সাথে সাথে বিশেষ কোন ছন্দগত বৈশিষ্ট্য নেই। সে কারণে মক্কী ও মাদানী সুরার যে বিভাজন রয়েছে রিভিশনিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে তার পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন।

মক্কী ও মাদানী সুরার পার্থক্য

গবেষক গান্টার লুলিং অধিকাংশ মক্কী সুরাকে খৃষ্টীয় শ্লোকে পুনর্গঠিত করে দেখিয়েছেন। মক্কী ও মাদানি সুরার মধ্যে ভাষাগত ও বক্তব্যগত উভয়দিক থেকেই বিপুল তফাৎ রয়েছে। কোরানের ভাষাগত অসংলগ্নতার যে অভিযোগ তা মূলত মক্কী সুরাগুলোকে ঘিরেই। মক্কী সুরাগুলোর বিষয়বস্তু হয় নীতিকথা না হয় পুরাকালের নবীদের গালগল্প। অপরদিকে মাদানি সুরাগুলোর বক্তব্য পরিস্কার, কিন্তু বিশেষ কোন ছন্দগত বৈশিষ্ট্য নেই। প্রকৃতই মক্কী সুরার সাথে মাদানি সুরার মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য হল দৃষ্টিভঙ্গীর। নিচে কতগুলি মক্কায় অবতীর্ণ (ইসলামী বিবরণ অনুসারে)আয়াত দেওয়া হল-
১. “আমি তো একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র” [সূরা – আনকাবুত ২৯:৫০] ( মক্কায় অবতীর্ণ)
২. “তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে” [সূরা কাফিরুন -১০৯: ০৬] ( মক্কায় অবতীর্ণ)
৩. “কাফেররা বলেঃ তাঁর প্রতি তাঁর পালনকর্তার পক্ষ থেকে কোন নিদর্শন অবতীর্ণ হল না কেন? আপনার কাজ তো ভয় প্রদর্শন করাই এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে পথপ্রদর্শক হয়েছে”[সূরা রাদ -১৩: ৭] ( মক্কায় অবতীর্ণ)
৪. “আর তোমার পরওয়ারদেগার যদি চাইতেন, তবে পৃথিবীর বুকে যারা রয়েছে, তাদের সবাই ঈমান নিয়ে আসতে সমবেতভাবে। তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তী করবে ঈমান আনার জন্য?” [ সুরা ইউনুস ১০:৯৯ ] ( মক্কায় অবতীর্ণ)
৫.“অতএব, আপনি উপদেশ দিন, আপনি তো কেবল একজন উপদেশদাতা, আপনি তাদের শাসক নন” (সুরা গাশিয়াহ, ৮৮:২১-২২) (মক্কায় অবতীর্ণ)

কতগুলি মাদানি সুরা-
১. যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে| এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি|[সুরা মায়েদা, ৫:৩৩] (মদিনায় অবতীর্ণ)
২. তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবে র ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তার রসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে। [সুরা তাওবা, ৯:২৯] (মদিনায় অবতীর্ণ)
৩. অভিশপ্ত অবস্থায় তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে, ধরা হবে এবং প্রাণে বধ করা হবে। [ সুরা আহযাব ৩৩:৬১ ] (মদিনায় অবতীর্ণ)
৪. আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই গর্দানের উপর আঘাত হান এবং তাদেরকে কাট জোড়ায় জোড়ায়।[ সুরা আনফাল ৮:১২ ] (মদিনায় অবতীর্ণ)
৫. সুতরাং যদি কখনো তুমি তাদেরকে যুদ্ধে পেয়ে যাও, তবে তাদের এমন শাস্তি দাও, যেন তাদের উত্তরসূরিরা তাই দেখে পালিয়ে যায়; তাদেরও যেন শিক্ষা হয়। [ সুরা আনফাল ৮:৫৭ ] (মদিনায় অবতীর্ণ)
৬. যুদ্ধ কর ওদের সাথে, আল্লাহ তোমাদের হস্তে তাদের শাস্তি দেবেন। তাদের লাঞ্ছিত করবেন, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের জয়ী করবেন এবং মুসলমানদের অন্তরসমূহ শান্ত করবেন। [ সুরা তাওবা ৯:১৪ ] (মদিনায় অবতীর্ণ)

দুটি ক্ষেত্রে মাদানি সুরায় উপরোল্লিখিত মক্কী আয়াতের মতো সহনশীলতা চোখে পড়বে। একটা হল অতিপরিচিত সুরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াত – দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই (২:২৫৬) আর একটা হল সুরা মায়েদার ৩২ নং আয়াত- “যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে” (৫:৩২)। কিন্তু সুরা মায়েদার একেবারে পরের আয়াতেই একেবারে উল্টো বক্তব্য আছে। আর বাকারার এই সহনশীল আয়াতটির সামনে পেছনে উগ্র বক্তব্যযুক্ত বিস্তর আয়াত পাওয়া যাবে। এই আয়াতদুটি অনায়াসে প্রক্ষিপ্ত অংশ হতে পারে।

মক্কী-মাদানী সুরার ভুল ও প্রচলিত ব্যখ্যা

যাই হোক, মক্কী ও মাদানী সুরাসমূহের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। আলী দস্তিকে অনুসরণ করে অনেকেই ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, মক্কায় মুহম্মদ ছিলেন একজন সামান্য ধর্মপ্রচারক, তার অনুগামীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। সংখ্যালঘু হওয়ার ফলে তার কারুর বিরুদ্ধে জিহাদ করার বা প্রতিশোধ নেওয়ার সাধ্যই ছিল না। তাই তখন তার মুখ দিয়ে বেড়িয়েছে শান্তির বাণী। অপরপক্ষে মদিনায় যখনই তার যুদ্ধ করার মত সামর্থ্য হয়েছে এই শান্তির ধর্মপ্রচারক পরিণত হয়েছেন যুদ্ধবাজ নেতায়। সুতরাং মুহম্মদের এই পরিবর্তিত মানসিকতারই প্রতিফলন ঘটেছে তার রচিত মাদানি সুরায়। কিন্তু এই বিশ্লেষণগুলোর সাথে একমত হওয়া যায়না, কেননা কোরান আর যাই হোক না কেন মুহম্মদ নামক কোন ব্যক্তির রচিত নয়। শুধু মুহম্মদ কেন কোরান কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে রচিত হয়নি। পূর্নাঙ্গ ধর্মগ্রন্থ উদ্ধৃত হবার আগে হিসাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কোরান সংকলন ও সম্পাদনা চলতে থেকেছে।

ইসলামিক বিবরণের বেশীরভাগটাই অতিকথন, যেখানে খোদ মুহম্মদের ঐতিহাসিক অস্তিত্বই সন্দেহজনক সেখানে মক্কী ও মাদানি সুরার পার্থক্য যে পুরোপুরি যদৃচ্ছ হতে বাধ্য, কারণ মক্কী ও মাদানি সুরায় কোরানের বিভাজনের সাথে কথিত মুহম্মদের জীবন জড়িত। সরল যুক্তি অনুসারে মক্কী ও মাদানি সুরার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্যই থাকা উচিত নয়। কারণ এই পরিভাষা দুটির সাথে জড়িয়ে থাকা প্রায় সমস্ত কাহিনীই শুধুমাত্র পৌরাণিক গল্প। অথচ এই দুই ধরণের সুরা দুটি প্রায় বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ প্রচলিত ইসলামিক অর্থে না হলেও মক্কী ও মাদানি হিসাবে কথিত দুই ধরণের সুরার মধ্যে প্রকৃতই পার্থক্য রয়েছে।

মক্কী ও মাদানী সুরার প্রকৃত ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা

আসলে মক্কী সুরাগুলো মধ্যপ্রাচ্যের এক ক্ষুদ্র খৃষ্টীয় ধর্মীয় আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে যা রোমান ক্যাথলিসিজম থেকে ক্রমাগত নিজেদের আলাদা করে নিচ্ছিল। কয়েকশত বছরের ব্যবধানে যেটা নতুন ধর্ম হিসাবে উদ্ধৃত হয়। আর মাদানি সুরাগুলো প্রতিনিধিত্ব করে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের, যার আয়াতগুলোতে একজন যুদ্ধবাজ সম্রাটকে দেখা যায়, যিনি তার অধীনস্থ সেনাদলকে শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিচ্ছেন। এভাবে সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে তৈরী হয় একটা গোটা ধর্ম। ইসলামের যে আগ্রাসী রূপের সাথে মানুষ পরিচিত তার মূল উৎস কল্পিত মুহম্মদের জীবনের মধ্যে নয় বরং তদকালীন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে।

খৃষ্টীয় স্তোত্রকে বারবার সম্পাদনার মাধ্যমে ইসলামিক বিন্যাসের সাথে মিলিয়ে নিতে হয়েছে। বারবার সম্পাদনা করতে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ভাষাগত অসংলগ্নতা। এ কারণেই মক্কী সুরাগুলোর অর্থ অতি দুর্বোধ্য, এমনকি তাফসিরকারকরা পর্যন্ত্য অনন্যোপায় হয়ে অযৌক্তিক সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে মাদানি সুরাগুলো খৃষ্টীয় শ্লোক ছিল না, তাই সম্পাদনারও প্রয়োজন পরে নি। সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক প্রয়োজনে পরবর্তীকালে ঢোকানো হয়েছে। তাই এই সুরাগুলোর ভাষা ও বক্তব্য উভয়েই যথেষ্ট সুসঙ্গত। রিভিশনিষ্ট পর্যবেক্ষণ এভাবে একটি সামগ্রিক চিত্র হাজির করে যা ইতিপূর্বের বিশ্লেষণে অনুপস্থিত ছিল।

৬৮৫-৭০৫ সালে খলিফা আল-মালিকের কোরানে বাকারা, নিসা ও আল-ইমরানের অন্তর্ভূক্তির আদেশ

এই দুটো সুরা ইসলামী আইনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে আরব সাম্রাজ্য মধ্যপ্রাচ্যের সীমা অতিক্রম করে পশ্চিমদিকে উত্তর আফ্রিকা ও পূর্বদিকে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই বিশাল সাম্রাজ্যে আরবে প্রচলিত উপজাতি আইন চাপিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় ছিল আইনকে ধর্মের সাথে যুক্ত করা। আবদ-আল মালিক আর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ – এই দুজন শাসকের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকগুলো ইসলামী সূত্র জানায় আবদ আল-মালিক ৬৮৫ থেকে ৭০৫ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত খলিফা ছিলেন এবং তার অধীনস্থ প্রশাসক হজ্জাজ বিন ইউসুফ কোরান সংকলন করেছিলেন। আবদ আল মালিক বলেন – আমি কোরান সংগ্রহ করেছি “জামা’তুল কুর’আনা”(Mingana, The Transmission of Koran)। একাধিক হাদিসে দেখা যায় হজ্জাজ ইবনে ইউসুফ কোরান সংগ্রহ ও সম্পাদনা করছেন। হজ্জাজ এমনকি কোরানের এগারোটি শব্দ পালটে দিয়েছিলেন বলেও কথিত আছে। একটা হাদিস পাওয়া যায় যেখানে এক মুসলিমের জবানিতে বলা হচ্ছে – “আমি হজ্জাজ বিন-ইউসুফ কে বলতে শুনেছি ‘কোরান রচনা কর যেমনভাবে জিব্রাইল তা রচনা করেছিলেন, তার অন্তর্ভূক্ত হবে গাভী সংক্রান্ত পাঠ, অন্তর্ভূক্ত হবে নারী সংক্রান্ত পাঠ এবং অন্তর্ভূক্ত হবে ইমরানের পরিবার সংক্রান্ত পাঠ” (Ibn Hajar al-Asqalani, Tahdhib al- Tahdhib, vol 4, 195-197 n-386)। পরিস্কারভাবে এখনে সুরা বাকারা, সুরা নিসা ও সুরা আলে ইমরানের কথা বলা হচ্ছে।

মনে হয় আবদ আল-মালিক ও ইউসুফ বিন-হাজ্জাজের আগে কোরান সংকলিত হয়নি। ঐতিহাসিক তথ্যও সেই দিকেই ঈঙ্গিত করছে। উসমানের কোরান সংকলন সম্ভবত গাল গল্প ছাড়া কিছু নয়। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে কোরান কোন নির্দিষ্ট সময়ে অবতীর্ণ হয়নি। কোন নির্দিষ্ট সময়ে বা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে কোরান রচিত হয়নি। কোরান হল ইভলভড টেক্সট বা ধাপে ধাপে উদ্ধুত ধর্মগ্রন্থ। যেটা প্রায় এক শতাব্দী ধরে বহু গ্রহন-বর্জনের মধ্য দিয়ে পূর্নাঙ্গ চেহারা নিয়েছে।

৭১০ সালে প্রথম কোরানের উল্লেখ

প্রথমবারের মত কোরানের উল্লেখ পাওয়া যায় ৭১০ খৃষ্টাব্দে। এক আরব অভিজাতের সঙ্গে বিতর্ক করতে গিয়ে এক খৃষ্টান পাদ্রী কোরানের নামোল্লেখ করেন। তার কথায় – “আমার ধারণা যে এমনকি তোমার জন্য প্রযোজ্য সমস্ত আইন ও নির্দেশাবলী যা মুহম্মদ তোমাকে শিখিয়েছে, সবকিছু কোরানে নেই। সে কিছু কোরান থেকে নিয়েছে, কিছু সুরা আল-বাকারা, কিছু গাইগি (gygy) এবং কিছু তোরাহ (twrh) থেকে”। (Monk of Beth Hale, Disputation, fol. 4b; Quoted in Hoyland-Seeing Islam)

শেষপর্যন্ত আরব বিজয়ের প্রায় আট দশক পরে কোন ব্যক্তি প্রথম সরাসরি কোরানের উল্লেখ করলেন। এর থেকে বোঝা যায় এই সময়কালের মধ্যে কোরান (এবং মুহম্মদের গল্প) প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। আবার এই উদ্ধৃতি থেকে এটাও প্রতিয়মান হয় এই খৃষ্টান যাযক যে কোরানের কথা জানতেন সুরা আল বাকারা (কোরানের দ্বিতীয় এবং সর্ববৃহৎ সুরা) তার অংশ ছিল না। এখানে দেখা যাচ্ছে তিনি সুরা বাকারাকে কোরান, গাইগি অর্থ্যাৎ গসপেল (ইসলামিক পরিভাষায় ইঞ্জিল) এবং তৌরাতের মতো আলাদা গ্রন্থ হিসাবে বিবেচনা করছেন। এটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভূল বলে মনে হয় না। কারণ সাধারণভাবে কেউ একটি পাঠ্যাংশকে সম্পূর্ণ গ্রন্থের সাথে গুলিয়ে ফেলে না।

৭৩০ সালে জন অফ দামাস্কাসের লেখায় প্রথম নতুন ধর্মসম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিতকরণ এবং কোরানের বাইরে বাকারা ও নিসার অস্তিত্বের উল্লেখ

পুরো সপ্তম শতাব্দী জুড়ে ইসলামী ধর্মততত্বের কোন অস্তিত্বই ছিল না। ৭৩০ খৃষ্টাব্দের খৃষ্টীয় ধর্মতাত্বিক জন অফ দামাস্কাস এই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন। জন অফ দামাস্কাস ধর্মদ্রোহিতা বা Heresy -এর বিবরণ হিসাবে লিখিত তার বইতে এক আজব নতুন ধর্মের উল্লেখ করেছেন, এই ধর্মের সাথে যুক্ত সম্প্রদায়কে তিনটি নামে চিহ্নিত করেছেন সারাসেন, হাজারীয় আর ইসমেলাইট। এই নির্দিষ্ট ধর্ম প্রসঙ্গে তিনি তার বইতে একটি অধ্যায়ও যুক্ত করেছেন। তিনি মামেদ নামে ভণ্ড নবীর কথা উল্লেখ করেছেন যে নাকি এক খৃষ্টীয় সন্যাসীর থেকে ওল্ড আর নিউ টেষ্টামেন্টের গল্পগুলো জেনে নিয়ে নিজের ধর্মদ্রোহী চিন্তাভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটায়। ধার্মিকতার ভান করে মানুষকে সংগঠিত করে আর তারপর স্বর্গীয় গ্রন্থের গুজব রটায় যে সেটা তার উপর অবতীর্ণ হয়েছে।

এরপর জন এই ধর্মের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন যা মোটামুটি ভাবে ইসলামের সাথে মিলে যায়। তার লেখাতেই ইতিহাসে প্রথম বারের মত কাবার উল্লেখ পাওয়া যায়। জন কোরানের বিষয়বস্তু সম্পর্কেও জ্ঞাত ছিলেন। কোরানের চতুর্থ সুরা ‘সুরা নিসা’ সম্পর্কে তার বক্তব্য হল এইরকম- “এই মামেদ, যেমন আগে বলা হইয়াছে, বিস্তর অসার কাহিনী রচনা করিয়াছিল- তাদের প্রতিটিকে সে একটি নাম দ্বারা চিহ্নিত করত যেমন কিনা নারী সংক্রান্ত অধ্যায় (অর্থ্যাৎ সুরা নিসা)।এতে সে স্পষ্টরুপে চার স্ত্রী ও সহস্র উপপত্নী গ্রহন করিতে বলিয়াছে, যদি তা সম্ভব হয়”।

বস্তুত, প্রকৃতই সুরা নিসায় চার স্ত্রী গ্রহন ও যৌনদাসী ব্যাবহারের বৈধতা দেওয়া হয়েছে (৪:৩ দ্রষ্টব্য)। জন সুরা বাকারারও উল্লেখ করেছেন- “গাভী সংক্রান্ত অধ্যায় (সুরা বাকারা), এবং আরো বহু নির্বোধ ও হাস্যকর বিষয়বস্তু যার সংখ্যাধিক্যের জন্য আমার ধারণা (আমার) উপেক্ষা (এই আলোচনায়) করা উচিত”। কোরানের যেসব জায়গায় ইসা অর্থ্যাৎ যীশু খৃষ্টের উল্লেখ আছে জন তার বিস্তারিত বর্নানা দিয়েছেন- “সে (অর্থ্যাৎ নবী মু্হম্মদ) বলত যে খৃষ্ট ঈশ্বরের বানী ও তার রুহ (কোরান ৯:১৭১), সৃষ্ট (৩:৫৯) এবং তার বান্দা (৪:১৭২, ৯:৩০, ৪৩:৫৯), তার জন্ম মেরী হতে(৩:৪৫) যিনি মোসেস ও অ্যারোনের ভগিনী (১৯:২৪) কোন বীজ ছাড়াই (৩:৩৭, ১৯:২০, ২১:৯১, ৬৬:১২)। …. ঈশ্বর জিজ্ঞাসা করিলেন: যীশু; তুমি কি বলতে যে আমি ঈশ্বরের পুত্র এবং ঈশ্বর। এবং (মুহম্মদের জবানীতে) তিনি উত্তর করলেন দয়া করো, প্রভু, তুমি জান আমি এরূপ কিছুই বলিনি (কোরান ৫:১১৬)।” (John of Damascas, De Haeresibus C/C1(patralogia Greca 94) ; Quoted in Hoyland-Seeing Islam)

জন কোরানের আয়াত উল্লেখ করেন নি। তার বর্ণনার সাথে বর্তমান কোরানের বেশ কিছু অসাঞ্জস্য দেখা যায়। যেমন সুরা মায়েদার ১১৬ নং আয়াতে তে আল্লা যীশুকে জিজ্ঞাসা করেন নি যে সে নিজেকে ঈশ্বর বলে অভিহিত করেছে কিনা? বরং “আল্লাহ বললেন- হে ঈসা ইবনে মরিয়ম! তুমি কি লোকদেরকে বলে দিয়েছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে উপাস্য সাব্যস্ত কর?” আর যীশুর উত্তর “ঈসা বলবেন; আপনি পবিত্র, আমার জন্যে শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোন অধিকার আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি, তবে আপনি অবশ্যই পরিজ্ঞাত, আপনি তো আমার মনের কথা ও জানেন এবং আমি জানি না যা আপনার মনে আছে। নিশ্চয় আপনিই অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত” (৫:১১৬)।

এই অসঙ্গতি ছাড়াও কোরানের বহু সংশ্লিষ্ট আয়াত জনের বিবরণে স্থান পায়নি বিশেষ করে মুহম্মদের আগমন সংক্রান্ত বিষয়ে যীশুর ভবিষ্যৎবাণী – “স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা (আঃ) বলল, হে বনী ইসরাইল, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহ্‌র প্রেরিত রসুল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তার নাম আহমদ। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বলল এ তো এক প্রকাশ্য যাদু”(৬১:৬)। একজন খৃষ্টীয় ধর্মতাত্বিক হিসাবে এই আয়াতটি তার আগ্রহের বিষয় হবার কথা ছিল কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এর কোন উল্লেখ তার লেখায় নেই। তিনি কোরান নামেরও উল্লেখ করেননি। বোঝা যায় বিশপ জনের হাতে কোন লিখিত কোরান ছিল না, তিনি সম্ভবত মৌখিক ট্রাডিশনের উপর নির্ভর করেছিলেন যা কোরান হিসাবে সংকলিত হয়ে থাকবে।

৭৩৬ সালে মৃত কাতাদা ইবনে ডায়মার লেখায় সুরা বাকারার আলাদা অস্তিত্ব

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, সুরা বাকারা এবং সম্ভবত সুরা নিসা কোরানে অনেক পরে ঢোকানো হয়েছে। এই বিষয়ে এই দুটো অমুসলিম সাক্ষ্য ছাড়াও মুসলিম সাক্ষ্যও রয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর ইসলামী ইতিহাসবিদ কাতাদা ইবনে ডায়মা (মৃত্যু ৭৩৬) লিখেছেন যে ৬৩০ খৃষ্টাব্দে হুনায়ুনের যুদ্ধে মুহম্মদের চাচা আল-আব্বাস তার সেনাদলকে এই বলে আহ্বান করেন – ইয়া আসাব সুরাত আল-বাকারা অর্থ্যাৎ ‘হে, সুরা বাকারার অনুসারীরা’ (Premare, ‘Abd al-Malik b. Marwan’)। বোঝা গেল সুরা বাকারা সমান গুরুত্বপূর্ণ একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবে সংশ্লিষ্ট সময়ে অবস্থান করত।

হাদিস বা সুন্নতের প্রচার আল মালিকের (৬৮৫-৭০৫) সময় থেকে, পূর্বে সুন্নতের ভিন্ন অর্থ

আবদ-আল মালিকের(৬৮৫-৭০৫) রাজত্বকালের আগে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলো চালু হয়নি। উমাইয়া খলিফা আবদ-আল মালিক তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনাকারী বিদ্রোহীদের আল্লা ও নবীর সুন্নাহ মানতে আহ্বান করেছিলেন। যেখানে পূর্ববর্তী খলিফা মুয়াবিয়া উমরের সুন্নাহের উল্লেখ করেছেন (আল-ইয়াকুবী ২:২৬৪)। এর থেকে মনে হতে পারে যে আবদ-আল মালিকের আমলে হাদিস প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল এবং সেসময় নবীর সুন্নাহ রাষ্ট্রের আইন হিসাবে সংকলিত ও প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু দেখা যায় উমাইয়া শাসনের বিদ্রোহীরাও নবীর সুন্নতের প্রসঙ্গ তুলে নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করছে। প্যাট্রিশিয়া ক্রোন (Patricia Crone) এবং মার্টিন হিন্ডস (Martin Hinds) তাদের রচিত গ্রন্থ God’s Caliph: Religious Authority in the First Centuries of Islam তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, পুরো সপ্তম শতাব্দী জুড়ে নবীজির সুন্নৎ শব্দবন্ধের কোনই অর্থ ছিল না। কেউ নবীর সুন্নৎ পালন করে – এ কথার অর্থ সাধারণভাবে বোঝাত সেই ব্যক্তি খুব ভাল লোক, নির্দিষ্ট করে কিছুই বোঝাত না। কিন্তু এভাবে বেশি দিন চলতে পারে না। অতি দ্রুত খিলাফৎকে সংহত করার প্রয়োজনে নবীর সুন্নাহ বলতে কি বোঝায় তা নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন দেখা দেয়, কারণ স্বঘোষিতভাবেই খিলাফৎ হল নবীর উত্তরাধিকারী। এই পদ্ধতিতে সমসাময়িক আরবের পৌরাণিক ধারণা, রীতি-নীতি, আচার-আচরণ আর্থ-সামায়িক পরিস্থিতিজনিত বাধ্যবাধকতা সবই হাদিস হিসাবে স্থায়ীভাবে ধর্মের অংশ হয়ে গেছে।

৭৪১ সালে মৃত আজ-জহুরির কথায় হাদিস জালিয়াতির সাক্ষ্য

প্রাচীন ইসলামিক স্কলার মুহম্মদ ইবন শিহাব আজ-জুহরী (মৃত্যু ৭৪১ খৃষ্টাব্দ) অভিযোগ করেছিলেন যে এমনকি তার সময়েও আমীররা মানুষকে হাদিস লিখতে বাধ্য করতেন (Al-Khatib, Taqyid 107 (Quoted in Goldziher, Muslim Studies))। এমনকি খলিফা আল-মাহদির (৭৭৫-৮৫) উপরেও জাল হাদিস রচনার আরোপ আছে (As-Suyuti, Tarikh, 106, 22; 109, 17 (Quoted in Goldziher, Muslim Studies))।

উমাইয়া আমলের হাদিসে উমাইয়া-আলীর দ্বন্দ্বের সাক্ষ্য

ইসলামী বিবরণ অনুসারে ৬৬১ খৃষ্টাব্দে দীর্ঘ বিরোধ অন্তর্দদ্বের নিষ্পত্তি হয় আলীর মূত্যুর মধ্য দিয়ে। এরপর মুয়াবিয়া সিংহাসনে বসেন এবং খলিফায়ে রাসেদিন (সঠিকভাবে পরিচালিত খলিফাদের রাজত্ব) শেষ হয়। ইসলামী বিবরণ থেকে দেখা যায়, খিলাফতের শুরুর দিন থেকেই সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীন কোন্দল ছিল দৈনন্দিন বিষয়, যা হাদিসের মধ্যে খুবই স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। একটি হাদিসে দেখা যায় মুয়াবিয়া তার অধঃস্তন কর্মচারীকে পরামর্শ দিচ্ছে “থেমে যেও না আলীকে গালি দিতে ও অপমান করতে, আহ্বান কর উসমানের প্রতি আল্লার করুণা, আলীর অনুগামীদের অপদস্থ কর, ……” (At Tabari, Vol 2, 112 (Quoted in goldziher)। উমায়িয়ারাও কম যায় না, তারা হাদিস বানিয়ে ফেলল যে আলীর পিতা আবু তালিব জাহান্নামের আগুনে পুড়ছেন।
(বুখারী, পঞ্চম খন্ড, ২২৪) “আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, যখন তারই সামনে তার চাচা আবূ তালিবের আলোচনা করা হল, তিনি বললেন, আশা করি কিয়ামাতের দিনে আমার সুপারিশ তার উপকারে আসবে। অর্থাৎ আগুনের হালকা স্তরে তাকে ফেলা হবে, যা তার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছবে আর এতে তার মগজ ফুটতে থাকবে।” (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৫৯৭, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৬০২)

উমাইয়া আমলে শিয়া প্রভাবিত হাদিস

শেষ পর্যন্ত আলীর অনুগামীরা পর্যুদস্তু হয়ে মূলধারার ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বটে, তবে রেখে গেল বিপুল সংথ্যক হাদিস যাতে আলীকে রাসুলের উত্তরসূরী হিসাবে দেখানো হয়েছে। একটা হাদিসে দেখা যায় মুহম্মদ বলছেন, “আমি কোরানের স্বীকৃতির জন্য যুদ্ধ করব, আর আলী যুদ্ধ করবে কোরানের ব্যাখ্যার জন্য।” (Ibn Hajar, 1:59 (Quoted in Goldziher, Muslim Studies))।

আবদ আল মালিকের খিলাফতের সময় থেকেই হাদিস ব্যাপক আকারে প্রচারিত হতে শুরু করে। কারণ এই সময় থেকে রাজকীয় মুদ্রায় হাদিস লিপিকৃত আকারে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এই সময় থেকেই রাজনৈতিক প্রযোজনে হাদিস জাল করারও সূত্রপাত হয়। আবদ আল মালিক রাজত্বের এক সন্ধিকালে হেজ্জাজের নিয়ন্ত্রন হারান বিদ্রোহী অধিকর্তার হাতে। সেই সময়ে তার প্রয়োজন ছিল মক্কায় তীর্থযাত্রা রোধ করা। কারণ তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে তার প্রতিপক্ষ হজযাত্রীদের মধ্য থেকে অনুসারী পেয়ে যেতে পারে। এই সময়কালে একাধিক হাদিস রচিত হয় যার বক্তব্য বিষয় হল জেরুজালেমে নামাজের উপযোগিতা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা সহী হাদিস গ্রন্থে পাওয়া যাবে।

৭৫০ সালের দিকে উমায়িদ-আব্বাসিদ দ্বন্দ্বর কারণে তৈরি হাদিস

হাদিসের জালিয়াতি প্রসঙ্গে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল ইমাম মেহেদী নামক এক ব্যক্তি নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে অনেক ধরণের গল্প চালু আছে। এই ব্যক্তি নিয়ে গল্পের মূল বিষয় হচ্ছে উনি একদিন পৃথিবীতে আসবেন এবং মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দিবেন, মুসলিম উম্মাহ সাফল্যের শিখরে উঠবে, এরপর কিয়ামত হবে। ধারনা করা হয় আব্দুল্লাহ বিন-সাবাহ নামে একজন (আগে ইহুদী ছিল, পরে মুসলমান হয়) প্রথমে যিশু ও মেহেদীর পৃথিবীতে আগমনের ধারণা দেন। এমনকি তিনি মুহাম্মদের পৃথিবীতে পুনরায় আগমনেরও ধারণা দেন। সেই সময়ে এই ধারণাগুলো জনপ্রিয়তা না পেলেও ৭৫০ সালের দিকে উমাইয়া খিলাফত এবং আব্বাসীয়দের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠলে আবু মুসলেম খোরসানি নামে ইস্ফানে জন্ম নেয়া ও কুফায় বেড়ে ওঠা একজনের আবির্ভাব দেখা যায়। মুহাম্মদ আব্বাসির ছেলে ইব্রাহিম তার মেধায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে তার পক্ষে প্রচারনা চালানোর দায়িত্ব দেন। তিনি প্রচার করেন যে খুব শীঘ্রই ইমাম মেহেদী খোরাসান প্রদেশ থেকে আসবেন এবং তার সেনাবাহিনীর পতাকা এবং পোশাকের রং হবে কাল। এই প্রচার যখন চরমে পৌঁছে, তখন তিনি খোরাসান থেকে নিজে কাল পাতাকাবাহী এবং কাল রঙের পোশাক সম্বলিত সেনাবাহিনী নিয়ে বের হন এবং উমাইয়া খিলাফত আক্রমণ করে তাদেরকে পরাজিত করেন। “ইমাম মেহেদীর” সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার মানসিক জোর তখন উমাইয়া খিলাফতের ছিলনা বলেই মনে হয়। এভাবেই উমাইয়া খিলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আব্বাসীয় খিলাফতের শুরু হয়। আব্বাসীয় খলিফা তার মেধায় মুগ্ধ হয়ে এবং তার ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে , যাতে ভবিষ্যতে নিজেরা এই ধরনের বিপদে পড়তে না পারে সেজন্য তাকে হত্যা করেন। এভাবে ইমাম মেহেদী নাটকের মধ্য দিয়ে এক ক্ষমতার পালা বদল, এবং এই ধরানার উৎপত্তি।

৭৫০ সালের পর আব্বাসিদদের তৈরি হাদিস

তবে উমায়িয়া-আব্বাসীয় দন্দ্বের প্রতিফলন এখানেই শেষ। সমস্ত সহী হাদিস গ্রন্থ লেখা হয় আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে। ফলে উমায়িয়া আব্বাসীয় দন্দ্বের প্রেক্ষাপটে প্রায় সব উমায়িয়া খলিফাকেই নেতিবাচক আলোকে দেখানো হয়েছে। উমাইয়াদের Goodless Caliph বা ঈশ্বরহীন খলিফা বলে অভিহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে উমায়িয়া রাজবংশের প্রথম খলিফা মুয়াবিয়া ও তার পুত্র ইয়াজিদকে। তাদেরকে অধার্মিক ও ইসলামের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন বলে আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এটা সত্যিই বোঝা কঠিন ইসলামের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন উমাইয়ারা কিভাবে ইসলামী খিলাফৎ পরিচালনা করল। কিভাবেই বা তাদের রাজত্বে ইসলামের এত প্রসার হল। বোঝাই যায় পুরোটাই খিলাফাতের অন্তর্দন্দ্বের ফসল। উমায়িয়ারাও সময়ে সময়ে পাল্টা হাদিস নিয়ে হাজির হয়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও ধর্মীয় প্রেরণা থেকে একটি হাদিসের বিরোধীতা করার সবচেয়ে সহজ উপায় হল পাল্টা আর একটি হাদিস প্রচার করা। আর হাদিস জাল করতে পারলে হাদিসের সনদ জাল করা কোন ব্যাপারই নয়। আসলেই একই হাদিসের শত শত সনদ পাওয়া যায়।

তাই হাদিসকে বাতিলযোগ্য ধরে নেয়া যায়। তাহলে প্রশ্ন আসে, যদি হাদিস সম্পূর্ণ বাতিল করা হয় তবে মুহম্মদের ইতিবৃত্ত জানার উপায় কি। হাদিসের অনির্ভরযোগ্যতা মুহম্মদ বিষয়ক যে কোন তথ্যকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। প্রামাণ্য ঐতিহাসিক তথ্য সম্পূর্নরূপে ইসলামী বিবরণের বিরুদ্ধে যায়। এতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে মুহম্মদের ঐতিহাসিকতাও।

৭৭৪-৭৭৫ সালে লিখিত আকারে সংকলন শুরু হওয়া প্রথম হাদিস মুয়াত্তা ও অন্যান্য হাদিস

হাদিসগুলি যে ঐতিহাসিক আলোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন সে বিষয়ে বহু আগে থেকেই মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে স্কলাররা একমত। মুসলিম স্কলাররা সাধারণত প্রচলিত ৬টি হাদিস সংকলনকে সসীহ বা অথেনটিক হিসাবে গ্রহণ করেন, এগুলো হল- ইমাম বুখারীর (৮১০-৮৭০)সহী বুখারী, মুসলিম ইবনে আল-হা্জ্জাজের (৮২১-৮৮৭) সহী মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ (৮১৮-৮৮৯), সুনানে ইবনে মাজাহ (৮২৪-৮৮৭) তিরমিসির (৮২৪-৮৯২) জামি , ইবনে নাসাই (৮২৯-৯১৫) এর আস-সুনান আস সুঘ্রা। অবশ্য এর বাইরেও বহু সংখ্যক হাদিস সংকলন রয়েছে। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে সহী হাদিস সংকলকরা সবাই প্রায় মুহম্মদের কথিত সময়কালের দু শতক পরের মানুষ। ইসলামিক সূত্র প্রথম হাদিস সংকলক হিসাবে মালিক ইবনে আনাস (৭১৭-৭৯৫) নাম উল্লেখ করে, যার সংকলিত মুয়েত্তা এখনও ইসলামী আইনের-কানুনের প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর (৭৫৪-৭৭৫) এর আমলে সংকলিত এই মুয়েত্তা মুহম্মদের কথিত মৃত্যুর অন্তত চৌদ্দ দশক পরে রচিত হয়েছিল। এর অর্থ হাদিসগুলো এর আগে কোন লিখিত আকারে প্রচলিত ছিল না, মানুষের মুখে মুখে হয়ত বা প্রচলিত ছিল। যে কোন ঐতিহাসিক ঘটনা পৌরাণিক রূপ পরিগ্রহ করার পক্ষে দেড় শতাব্দি যথেষ্ট ভাল সময়। ফলে মুহম্মদ যদি ঐতিহাসিক চরিত্র হয়েও থাকেন, দেড় শতাব্দি পরে লোকমুখে প্রচারিত গল্পের মাধ্যমে পৌরাণিক নবী হিসাবে পরিগণিত হতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। এই গাল-গল্পগুলোই পরবর্তীকালে হাদিস হিসাবে স্থান পেয়েছে।

হাদিসের সত্যতা নিয়ে সমস্যা

হাদিস গবেষনা প্রসঙ্গে যার নাম না করলেই চলে না তিনি হলেন হাঙ্গেরীয়ান স্কলার ইগনাচ গোল্ডজিহের (22 June 1850 – 13 November 1921)। তার ধ্রুপদী গবেষণার উপর দাঁড়িয়েই পরবর্তী গবেষকরা ইসলামী বিবরণের বিপরীতে ভিন্নভাবে ভাবতে পেরেছেন। তিনি তার গবেষণাগুলো তার লেখা Muslim Studies গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এত বিপুল সংখ্যক হাদিস রয়েছে, আর এই হাদিসের মধ্যে পরস্পরবিরোধী হাদিসের সংখ্যা এত বেশী যে আলেম-উলেমারাও হাদিস নিয়ে সমস্যায় পরে যান। এই কারণে মুসলিম পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় প্রায় সমস্ত বিতর্কিত ও অস্বস্তিকর হাদিসকে জাল ও জইফ হাদিস হিসেবে বাতিল করার চেষ্টা হয়েছে। হাদিসে বেশ কিছু স্ববিরোধিতা দেখা যায়। কিছু উদাহরণ দেয়া হল –

মুহম্মদ কি আল্লাহকে দেখেছেন?-
১.উত্তর না
(সহী বুখারী, তাওহীদ অধ্যায়, হাদিস ৭০৩১)
“আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তোমাকে বলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় রবকে দেখেছেন, সে মিথ্যা বলল। কেননা আল্লাহ্ বলছেন, চক্ষু তাকে দেখতে পায় না। আর যে ব্যক্তি তোমাকে বলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়েব জানেন, সেও মিথ্যা বলল। কেননা আল্লাহ্ বলেন, গায়িব জানেন একমাত্র আল্লাহ্। [৩২৩৪] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৮৬৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৮৬৬)”
২.-উত্তর হ্যাঁ
(সহী মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, হাদিস নং ৩২৪)
আবূ বাকর ইবনু আবূ শাইবাহ (রহঃ) ….. আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে “নিশ্চয়ই তিনি (মুহম্মদ) তাকে (আল্লাকে) আরেকবার দেখেছিলেন”-

মু্হম্মদ উযুতে কতবার করে ধুতেন?
উত্তর- একবার।
(“মুহম্মত ইবনে ইউসুফ(র)….. ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী এক উযুতে একবার করে ধুতেন”- (সহী বুখারী, উযু অধ্যায়, হাদিস ১৫৯)
উত্তর- দুবার
(“আবদুল্লাহ্ ইব্ন যায়দ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ‘নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উযূতে দু’বার করে ধুয়েছেন।“ (সহী বুখারী, উযু অধ্যায় হাদিস (ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ) ১৬০)
উত্তর- তিনবার
(“হুমরান (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি ‘উসমান ইবনু আফ্ফান (রাযি.)-কে দেখেছেন যে, তিনি পানির পাত্র আনিয়ে উভয় হাতের তালুতে তিনবার ঢেলে তা ধুয়ে নিলেন। অতঃপর ডান হাত পাত্রের মধ্যে ঢুকালেন। তারপর কুলি করলেন ও নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করলেন। তারপর তার মুখমন্ডল তিনবার ধুয়ে এবং দুহাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধুলেন। অতঃপর মাথা মাসেহ করলেন। অতঃপর দুই পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধুলেন। পরে বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি আমার মত এ রকম উযূ করবে, অতঃপর দু’রাক‘আত সালাত আদায় করবে, যাতে দুনিয়ার কোন খেয়াল করবে না, তার পূর্বের গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহী বুখারী, উযু অধ্যায় হাদিস (ইসলামী ফাউন্ডেশন) ১৬১)

এরকম আরও অনেক স্ববিরোধিতা পাওয়া যাবে। শিয়া বিবরনের সঙ্গে সুন্নী বিবরণ মিলিয়ে দেখলে এই স্ববিরোধিতা আরও বেশি পাওয়া যাবে, তবে তার জন্য তার সুন্নী হাদিস সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা প্রয়োজন। (শিয়া ওয়েবসাইটের লিংক https://www.al-islam.org)

হাদিসের রুচিহীনতা

যে কোন রুচিশীল ভদ্রলোক যদি হাদিস পড়তে থাকেন, কিছু দূর গিয়েই ধাক্কা খাবেন। একটি হাদিসে দেখা যায় নবীজির দাসী উম আয়মান ভূলবশত নবীজির প্রস্রাব খেয়ে ফেলার পর নবীজিকে জানালে তিনি তাকে আস্বস্ত করেন:
Tabarani said: Hussain bin Is’haq al-Tustari informed us, who was informed by Uthman bin Abi Shaybah, who was informed by Shababah bin Sawwar, who was informed by Abu Malik al-Nakha’i who narrated from Aswad bin Qays, who narrated from Nubayh al-Anazi, who narrated from Umm Ayman, who said: ‘‘One night the Prophet got up and went to a side to urinate in the bowl. During the night, I rose and was thirsty so I drank whatever was in it and I did not even realize what it was. In the morning, He said, ‘Oh Umm Ayman! Throw away whatever is in the bowl’. I replied, ‘I drank what was in the bowl’. He thereafter smiled as such that His teeth appeared and said, ‘Beware! You will never have stomach pain’’.
(Tabarani Kabir 20740, Mustadrak al-Hakim 6912, Dalail al-Nubuwwah li-Isfahani 355)

আর একটি হাদিসে দেখা যায় মুহম্মদ তার পৌত্র হাসান ও হুসেনের লিঙ্গে চুমু খাচ্ছেন। (দ্রষ্টব্য- মাজমা আল জাওয়াইদ, ২৯৯/৯)। এরকম কুরুচিকর বর্ণনাসম্বলিত হাদিস গণ্ডায় গণ্ডায় পাওয়া যায়। একজন পৌরাণিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বাস্তব-অবাস্তব যত রকমের কল্পনা সম্ভব সবই স্থান পেয়েছে হাদিস গ্রন্থে। প্রশ্ন হচ্ছে এই উদ্ভট হাদিসগুলো ধর্মগ্রন্থ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেল কি করে।

কোরান ব্যাখ্যাকারী হিসেবে হাদিস

ইসলামী ধর্মতত্বে হাদিসের প্রথম কাজ হল কোরান ব্যাখ্যা করা। শনে নজুল নামক উপাদান হাদিসেই পাওয়া যায়, যার থেকে কোন পরিস্থিতিতে কোন আয়াত নাজিল হয়েছিল তা জানা যায়। কোরান অতিমাত্রায় দুর্বোধ্য, এলোমেলো একটি গ্রন্থ, তাফসিরের সাহায্য ছাড়া কোরান বুঝে পড়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। হাদিসের বর্ণনা ঐতিহাসিকভাবে যাচাই করার কোনই উপায় নেই। ইসলামী স্কলাররা অনেক সময়ই এনিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন। কোরানের বহু সুরারই অনেক বেশী যৌক্তিক ব্যাখ্যা হাজির করা যায় যদি ইসলামী বিবরণের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করা হয়। ইসলামের প্রথম চার খলিফা কোন হাদিস সংকলন করেন নি। ইসলামী সূত্র থেকে জানা যায় যে খলিফা উমর খলিফা যাবতীয় হাদিসসংকলন পুড়িয়ে ফেলেছিলেন; কারন তার মনে হয়েছিল হাদিস কোরানের প্রতিযোগী হয়ে যেতে পারে। প্রশ্ন হল তা হলে পরবর্তী মুসলিমরা এত এত হাদিস কোথা থেকে পেলেন।

হাদিসের সনদের সমস্যা

হাদিসকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য এর সাথে সনদ অর্থ্যাৎ মুহম্মদের সমসাময়িক কাল থেকে হাদিস সংকলনের সময় পর্যন্ত বর্ণনাকারীদের নাম পরপর এর সাথে যুক্ত করা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামিক স্কলারদের কাছে এই সনদই হল হাদিসের সত্যতা নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি। এখানে দুটি বিষয় বিবেচনা করার প্রয়োজন-
(১) যদি জাল হাদিস বানানো সম্ভব হতে পারে তাহলে জাল সনদ বানানোও সম্ভব। বাস্তবে এটি প্রথমটির থেকে অনেক সোজা।
(২) বহুক্ষেত্রে একই হাদিসের অনেক রকম সনদ পাওয়া গেছে। এমন হাদিসও পাওয়া যায় যার প্রায় ৭০০ রকম সনদ আছে। (বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কৃত বুখারী হাদিসের প্রথম খন্ডের ভূমিকায় বলা হয়েছে) সনদ যে জাল করা হত এটি তার বড় প্রমাণ।

দীর্ঘ সময় ধরে সনদ টিকে থাকার অসম্ভাব্যতা, স্মৃতিশক্তির মিথ, ব্যক্তিগত স্বার্থ

তারপরেও যদি এক মূ্হুর্তের জন্য মেনে নেয়া হয় যে হাদিসের সনদে উল্লিখিত সাহাবী ও পরবর্তী বর্ণনাকারীরা কেউ কাল্পনিক নন, তারা আসলেই তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হাদিসগুলো পৌঁছে দিতেন, এটা আদপেই বিশ্বাসযোগ্য নয় যে, এভাবে কোন লিখিত নথি ছাড়াই এত বিপুল পরিমাণ তথ্য দুই শতাব্দী ধরে কোন বিকৃতি ছাড়াই টিকেছিল। অনেকে হয়ত এ প্রসঙ্গে প্রাচীন আরবদের কিংবদন্তীসুলভ স্মৃতিশক্তির কথা তুলবেন। এর উত্তরে বলা যায় এটা কোন নির্দিষ্ট মানুষের স্মরণশক্তির সমস্যা নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হাদিস প্রচলিত হতে থেকেছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পালটেছে, নতুন নতুন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, সর্বোপরি যারা হাদিস বর্ণনা করছেন তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক আনুগত্য হাদিস সংকলনে কোন প্রভাব ফেলেনি এটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। আর আরবদের অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি মিথ ছাড়া কিছু না। ইসলামী বিবরণ থেকেই এটা অনায়াসে দেখানো যায়। ইসলামী বিবরণ অনুসারে যার উপর কোরান নাজিল হয়েছিল এই মুহম্মদ নিজেই কোরানের আয়াত ভূলে যেতেন –
“আবূ বাকর ইবনু আবূ শায়বা ও আবূ কুরায়ব (রহঃ) … আয়িশা (রাঃ) সুত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে এক ব্যাক্তিকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনালেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তাকে রহম করুন। সে আমাকে অমুক অমুক আয়াত স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যা অমুক সূরা থেকে আমি বাদ দিয়েছিলাম” (সহী মুসলিম, অধ্যায় ৭, হাদিস নং ১৭১০)।

৭৭৩ এ মৃত ইবনে ইসাকের লেখা প্রথম মুহম্মদের জীবনী বা সিরাত

মুহম্মদের তমশাচ্ছন্ন ইতিবৃত্তকে উজ্জ্বল ইতিহাসের আলোকে নিয়ে আসার কৃতিত্ব যায় মুহম্মদের সর্বপ্রথম জীবনীকার মুহম্মদ ইবনে ইশাক ইবনে ইয়াসার এর উপর যিনি মূলত ইবনে ইশাক নামেই পরিচিত। তার রচিত গ্রন্থটি প্রথম সিরাত গ্রন্থ এবং পরবর্তী সব ইসলামী ইতিহাস গ্রন্থের উৎস। ইবনে ইশাক মুহম্মদের (মৃত্যু ৬৩২ খৃষ্টাব্দ) একেবারে প্রথম জীবনী রচনা করলেও তিনি মু্হম্মদের সমসাময়ীক ছিলেন না, এমনকি তার পরের প্রজন্মের মানুষও ছিলেন না। তার মৃত্যু হয় ৭৭৩ খৃষ্টাব্দে, অর্থ্যাৎ মুহম্মদের মৃত্যুর প্রায় দেড় শতাব্দী পরে।

৮৩৪ সালে মৃত হিশামের দ্বারা ইসাকের রচনার সম্পাদনা

তার রচিত সিরাতের মূল সংস্করণ পাওয়া যায় না। সিরাত রসুলউল্লাহ নামে যা প্রচলিত তা হল ইবনে হিশাম সম্পাদিত (ব্যাপকভাবে সংক্ষেপিত) সংস্করণ। ইবনে হিশামের মৃত্যু হয় ৮৩৪ খৃষ্টাব্দে অর্থ্যাৎ ইবনে ইশাকের ষাট বছর পরে। এ ছাড়াও আল-তাবারীর মতো অনান্য সিরাত লেখকরা বিচ্ছিন্নভাবে ইবনে ইসাককে উদ্ধৃত করেছেন।

সম্পাদিত গ্রণ্থের ভূমিকায় তার কৃত কাটছাটের ব্যাখ্যায় ইবনে হিশাম লেখেন যে তিনি সেই সমস্ত বিষয়গুলি বাদ দিয়েছেন ১. যেগুলীর আলোচনা অত্যন্ত লজ্জাজনক ২. যেসমস্ত বিষয় নির্দিষ্ট কিছু মানুষের কাছে অস্বস্তিকর হতে পারে ৩. কিছু বক্তব্য যা আল-বাক্কাই (ইবনে ইশাকের ছাত্র) নির্ভরযোগ্য নয় বলে তাকে জানিয়েছেন। মনে রাখা দরকার ঠিক এই সময়েই আব্বাসীয় খিলাফতের আমলে একের পর এক সহী হাদিস গ্রন্থগুলো রচিত হতে থাকে। দেখা যাচ্ছে ইবনে হিশামের কাছেই সিরাতের এক বড় অংশ গ্রহনযোগ্য বলে বিবেচিত হয় নি। অনান্য ইসলামিক ধর্মতাত্বিকরা ইবনে ইশাকের বিষয়ে আরো কঠোর ধারণা পোষন করতেন। হাদিস সংগ্রাহক আবদুল্লাহ ইবনে নুমায়ির, ৮১৪ খৃষ্টাব্দে যার মৃত্যু হয়, বলেছেন, ইবনে ইশাকের সিরাতের অধিকাংশ উপাদান খাঁটি হলেও বহু ‘ফালতু বক্তব্য’ রয়েছে যেগুলো তিনি অজানা মানুষজনের থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। হাদিস বিশেষজ্ঞ আ্হমেদ ইবনে হানবাল (৮৩৪ খৃষ্টাব্দ) ইবনে ইশাকের সিরাতকে ইসলামী আইনের উৎস হিসাবে গন্য করতেন না, তবে একান্তভাবে মুহম্মদের জীবনের সাথে যুক্ত ঘটনা জানার জন্য নির্ভরযোগ্য বলে মনে করতেন। প্রথম হাদিস সংকলক মালিক ইবনে আনাস ( যে সমস্ত হাদিস আমাদের হাতে এসেছে তার মধ্যে মালিক ইবনে আনাস রচিত মুয়েত্তাই সর্বপ্রথম) সরাসরি ইবনে ইসাককে মিথ্যাবাদী ও ঈশ্বরদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করেছেন।

এর অর্থ এই নয় যে সব মুসলিম ধর্মবেত্তা ইবনে ইশাককে বাতিল করে দিয়েছেন। বরং প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আজ অবধি ইবনে ইসাক ও আল তাবারি দুজনের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যেই যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। পরবর্তী সিরাত রচয়িতারা আল তাবারি না হয় ইবনে ইসাককে উৎস হিসাবে ব্যাবহার করেছেন। ইবনে ইসাক তার রচনার জন্য তথ্যের কারণে হাদিসের মতোই লোকমুথে প্রচলিত কাহিনীর উপর নির্ভর করেছিলেন। হাদিসের মতোই প্রতিটি ঘটনার উৎস উল্লেখ করেছেন বর্ননাকারীদের শৃঙ্খল অর্থ্যাৎ সনদ হিসাবে। সহজ কথায় হাদিসকে যে কারণে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হচ্ছে না, একই কারণে ইবনে ইসাককেও বাতিল করা যায়। কারণ সিরাতে উল্লিখিত কোন ঘটনাই ঐতিহাসিকভাবে প্রমানিত নয়। যেমন, বদর যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রমাণের জন্য অবধারিতভাবে সিরাত হাদিসের শরণাপন্ন হতে হবে, কারণ বদর যুদ্ধের অস্তিত্ব শুধু সিরাত-হাদিসের পাতাতেই আছে। বস্তুত সিরাত হাদিসে উল্লিখিত ঘটনাবলির সত্যতা কোনভাবেই যাচাই করা সম্ভব হয় না। সৌদি আরবে ব্যাপক প্রত্নতাত্বিক খননকার্য চালানো গেলে হয়তো অনেক কিছুই প্রকাশিত হত, কিন্তু তার কোন সুযোগই দেওয়া হয়নি।

সিরাতে অধিমাসের সমস্যা

ইবনে ইশাক তার সিরাতে শুধুমাত্র মুহম্মদের জীবনের প্রতিটা গুরুত্বপূর্ন ঘটনা বর্ননা করেননি, তার সাথে কোন মাসে ঘটনাটা ঘটেছিল প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তার উল্লেখ করেছেন। মূলত এই কারণে এখনও ইবনে ইসাকের বিবরণ সাধারণভাবে ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা পায়। ইসলাম-পূর্ব যুগের আরবরা ইসলামিক যুগের মতোই চান্দ্র ক্যালেন্ডার ব্যাবহার করত। এতে বছর ছিল ৩৫৪ দিনের, সৌরবছরের মতো ৩৬৫ দিনের নয়। প্রতি তিন বছর অন্তর একটি অধিমাস (leap Month) যোগ করে নেওয়া হত। এই ব্যাবস্থা ৬২৯ পর্যন্ত চলেছিল। তারপর কোরান অনুসারে আল্লাহ্‌ বিরক্ত হয়ে আয়াত নাজিল করে এই পদ্ধতি রদ করেন – “এই মাস পিছিয়ে দেয়ার কাজ কেবল কুফরীর মাত্রা বৃদ্ধি করে, যার ফলে কাফেরগণ গোমরাহীতে পতিত হয়” (সূরা আত তাওবা, ৩৭)

এখন ৬২৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত্য মুহম্মদের নবয়ুতির প্রায় ২০ বছর হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে অতি অবশ্যই অন্তত ৬টি অধিমাস মুহম্মদের জীবনে এসেছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল সিরাতে এর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। এটি সম্ভব নয় যে, মুহম্মদের জীবনের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটিও অধিমাসে সংঘটিত হয় নি, তাহলে প্রশ্ন হল তিনি সেই সময়টায় কি করতেন। পাঠকরা জানেন যে মুহম্মদের মদিনা পর্ব বিপুল ঘটনাবহুল। মাত্র দশ বছরের মধ্যে তিনি বিভিন্ন মতানুসারে ৬৭-১০০ টি যুদ্ধযাত্রা করেন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি দু-এক মাসে একটি হামলা বাঁধা ছিল। এমনকি যে মাসগুলোতে তিনি মদিনায় অবস্থান করেছেন সেই সময়েরও বিস্তারিত উল্লেখ আছে। মুহম্মদের জীবনের এই ৬ মাস গায়েব হয়ে যাবার কোনই ব্যাখ্যা হয় না। অবশ্য এটা যদি কোন কুদরতি ক্রিয়া হয় তাহলে আলাদা কথা। সবদিক বিচার করে গবেষক জোহানস জেমসন বলেছেন – ইবনে ইসাকের জীবনী সেই সময়কেই নির্দেশ করে যখন মানুষজন ভুলেই গিয়েছিল একসময়ে অধিমাসের অস্তিত্ত্ব ছিল। জেমসন সিদ্ধান্ত করেছেন “ ইবনে ইসাকের এই সমস্ত কাহিনী আদৌ অতীতের ঘটনাবহুল স্মৃতি তুলে ধরার কোন উদ্যোগ নয়, বরং সেগুলো পাঠককে বিশ্বাস করাতে চায় যে এইসমস্ত গাল-গল্পের নায়ক, মুহম্মদ, প্রকৃতপক্ষেই ঈশ্বরের দূত।”

সিরাতে অলৌকিকত্বের সমস্যা

ইবনে ইসাকের সিরাতে বিপুল সংখ্যায় আলৌকিক ঘটনার উল্লেখ আছে। উহুদ যুদ্ধে এক সাহাবীর চোখে আঘাত লাগে, অক্ষিকোঠরের বাইরে এসে ঝুলতে থাকে। মুহম্মদ নিজের হাতে সেটাকে সস্থানে বসিয়ে দেন এবং তারপর থেকে সেটাই হয় তার সবচেয়ে শক্তিশালী চোখ। আরেকটি অনুরুপ ঘটনা পাওয়া যায়- খন্দক যুদ্ধের সময় মুহম্মদের জনৈক অনুসারী একটি ছোট্ট দুম্বা রান্না করে মুহম্মদকে খেতে ডাকে। মুহম্মদ কর্তাকে আশ্চর্য করে যতজন তার সাথে পরিখা খোঁড়ার কাজে নিয়োজিত ছিল তাদের সবাইকে নিমন্ত্রন করেন। তার পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। আল্লার কুদরতে মুহম্মদ যতখানি খেলেন ততখানি খাবার সবারই জুটল। সবাই তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত্য খাদ্য শেষ হল না। যীশুর ‘ফিডিং দ্য মালটিচিউুড’ ঘটনার সাথে এর মিল পাওয়া যায়। সমস্যা হল কোরান তো বারবার দাবী করছে আল্লার রাসুলের কোন অলৌকিক ক্ষমতা নেই, তিনি সুসংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তি মাত্র (২:১১৮, ৬:৩৭, ১০:২০, ১৩:৭, ১৩:২৭)। খোদ আল্লা অভিযোগ করেন, “তারা বলে, তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে তার প্রতি কিছু নিদর্শন অবতীর্ণ হল না কেন? বলুন, নিদর্শন তো আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আমি তো একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। এটাকি তাদের জন্যে যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্যে রহমত ও উপদেশ আছে” {সুরা আনকাবুত, ৫০-৫১)। কুরাইশরা বারবার অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে মুহম্মদকে তার নবয়ুতির প্রমান দিতে বলছিল তার উত্তরে আল্লা (বা বকলমে মুহম্মদ) জানান যে মুহম্মদের কোন অলৌকিক ক্ষমতা নেই, তিনি একজন বার্তাবাহক মাত্র। এই আয়াতের বক্তব্যকে যদি সত্যি বলে ধরে নেয়া হয় সেক্ষেত্রে সিরাত কোরানের সাথে সুস্পষ্ট সংঘাতে অবতীর্ণ হয়।

সিরাতে অসামঞ্জস্যতার সমস্যা

মুহম্মদ বালক বয়সে সিরিয়ায় গিয়ে পাদ্রী বাহিরার সম্মুখীন হন। পাদ্রী বাহিরা বিভিন্ন আলৌকিক লক্ষ্যণ দেখে মু।হম্মদের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি জিজ্ঞেস করেন – “হে বৎস, আমি তোমাক লাত ও উজ্জার দোহাই দিয়ে অনুরোধ করছি, আমি যা জিজ্ঞেস করবো তুমি তার জবাব দেবে।” বাহিরা লাত ও উজ্জার দোহাই দিলেন এই জন্য যে, তিনি কুরাইশদেরকে পরস্পর কথাবার্তা বলার সময় ঐ দুই মূর্তির শপথ করতে শুনেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাকে লাত-উজ্জার দোহাই দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আল্লাহর শপথ, আমি ঐ দুই দেবতাকে সর্বাধিক ঘৃণা করি।” বাহীরা বললেন, “আচ্ছা তবে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, যা জিজ্ঞেস করবো তার জবাব দেবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, কি কি জানতে চান বলুন।” অতঃপর বাহীরা তাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। তার ঘুমন্ত অবস্থার কথা, তার দেহের গঠন-প্রকৃতি ও অন্যান্য অবস্থার কথা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সব প্রশ্নের যা জবাব দিলেন, তা বাহীরার জানা তথ্যের সাথে হুবহু মিলে গেল। তারপর তিনি তার পিঠ দেখলেন। পিঠে দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুওয়াতের মোহর অংকিত দেখতে পেলেন। মোহর অবিকল সেই জায়গায় দেখতে পেলেন যেখানে বাহীরার পড়া আসমানী কিতাবের বর্ণনা অনুসারে থাকার কথা ছিল।”

খৃষ্টান ধর্মবেত্তারা যদি বুঝেই থাকবেন যে মুহম্মদ স্বর্গীয় নবী তাহলে তারা ইসলাম গ্রহন করেননি কেন। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে খৃষ্টানরা ওই সময় আরবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। খৃষ্টানরা মুহম্মদকে অনুসরণ করলে এত কষ্ট করার প্রয়োজনই হত না। অনুরুপভাবে মদীনায় ইহুদী রাব্বী আবদুল্লাহ বিন সালাম মুহম্মদকে নবী হিসাবে স্বীকার করেন। ইবনে ইসাক আবদুল্লাহর জবানীতে লিখেছেন- “যখন আমি নবীর বিষয়ে শুনতে পেলাম, আমি তার বর্ননা, নাম এবং তার আবির্ভূাবের সময় থেকে জানতাম যে তিনিই সেই ব্যক্তি যার জন্য আমরা অপেক্ষা করে আছি”। ইমান বুখারী আরো বিস্তৃত বর্ননা দিয়েছেন –

“আবদুল্লাহ ইবনু সালামের নিকট রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মদিনায় আগমনের খবর পৌঁছল, তখন তিনি তার নিকট আসলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি আপনাকে এমন তিনটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই যার উত্তর নবী ব্যতীত আর কেউ জানে না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
১. কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন কী?
২. আর সর্বপ্রথম খাবার কী, যা জান্নাতবাসী খাবে?
৩. আর কী কারণে সন্তান তার পিতার মত হয়? আর কী কারণে (কোন কোন সময়) তার মামাদের মত হয়?
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এই মাত্র জিবরাঈল (আঃ) আমাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন। …… রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন হলো আগুন যা মানুষকে পূর্ব হতে পশ্চিম দিকে তাড়িয়ে নিয়ে একত্রিত করবে। আর প্রথম খাবার যা জান্নাতবাসীরা খাবেন তা হলো মাছের কলিজার অতিরিক্ত অংশ। আর সন্তান সদৃশ হবার ব্যাপার এই যে পুরুষ যখন তার স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে তখন যদি পুরুষের বীর্য প্রথমে স্খলিত হয় তবে সন্তান তার সদৃশ হবে আর যখন স্ত্রীর বীর্য পুরুষের বীর্যের পূর্বে স্খলিত হয় তখন সন্তান তার সদৃশ হয়। তিনি বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি- নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রাসূল” (বুখারী, ৩৩২৯)

যদি এই প্রশ্নগুলির উত্তর নবী ছাড়া আর কেউ নাই জেনে থাকে তাহলে তিনি মুহম্মদের দেওয়া উত্তরের সত্যতা বিচার করলেন কি করে। মু্হম্মদকে নাহয় জিব্রাইল এসে উত্তর বলে দিয়ে গেল। কিন্তু আবদুল্লাহ কিভাবে উত্তর জানলেন। তাহলে কি তিনিও আরেকজন নবী?

৯ম ও ১০ম শতকে সিরাতের আরও পরিবর্তন ও তাদের সিরাতে পুঙ্খানুপুঙ্খতার সমস্যা

বস্তুত, যেকোন চিন্তাশীল মানুষের কাছে একটা মাত্র সিদ্ধান্ত পরে থাকে। তা হল পুরোটাই কল্পকাহিনী, মু্হম্মদকে নবী হিসাবে প্রমান করাই এর উদ্দেশ্য। ইবনে ইসাকের পরে বহু সিরাত গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আল তাবারি (৮৩৯–৯২৩ খ্রি.) ও আল ওয়াকিদির (৭৪৭ – ৮২৩ খ্রি.) রচনা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ইবনে ইসাকের ঠিক পরবর্তী ঐতিহাসিক আল ওয়াকিদি অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় বেশি জানেন। যেমন খাররার অভিযানের বর্ননায় ইবনে ইসাক লিখেছেন- “এরমধ্যে আল্লাহ্‌র নবী সাদ বিন আবি আক্কাসকে আটজন মুজাহিদ সহ পাঠালেন। তিনি হিজাজের খাররার পর্যন্ত গিয়েছিলেন, তারপর ফিরে আসেন শত্রুর সাথে কোন সংঘর্ষ ছাড়াই।” এই একই অভিযানের বর্ননা ওয়াকিদি দিয়েছেন- “এই বছর (হিজরতের প্রথম বর্ষ) জিল-হজ মাসে আল্লাহর নবী সা’দ বিন আবি ওয়াককাসকে একটি সাদা ব্যানার সহ আল খহাররার অভিযানে পাঠান। সাদের দলের সবাই ছিল মুহাজির।

আবু বকর বিন ইসমাইল < তার পিতা < আমির বিন সা’দ < তার পিতা (সা’দ বিন আবি ওয়াককাস) হতেবর্ণিত: আমি ২০-২১ জনের একটি দলকে নিয়ে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করেছিলাম। যাত্রার পঞ্চম দিন সকালে আল খাররার পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত আমরা দিনের বেলায় আত্মগোপন করে থাকতাম এবং রাত্রি বেলা পুনরায় যাত্রা শুরু করাতাম। আল্লাহর নবী আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন আমি আল খাররার অতিক্রম না করি। কিন্তু আমাদের আল খাররার পৌঁছার এক দিন আগেই বাণিজ্য কাফেলাটি আল খাররার অতিক্রম করে। সেই কাফেলার দলে ৬০ জন লোক ছিল।”

ঐতিহাসিক পাট্রিশিয়া ক্রোন লক্ষ্য করেছেন যে, শুধুমাত্র বিস্তারিত বর্ননাই নয় তিনি অভিযানের নেতার বরাত দিয়ে পুরো ঘটনা বর্ননা করেছেন। ওয়াকিদি খায়বার হামলার এত বিস্তৃত বর্ননা দিয়েছেন যে আপনি আমি খায়বারে হাজির থাকলেও এত জানতে পারতাম কিনা সন্দেহ। যদিও তত্বগতভাবে এটা সম্ভব যে ওয়াকিদি হয়ত কোন মৌখিক উৎস পেয়েছিলেন যেটা ইবনে ইসাকের কাছে অপরিচিত ছিল। যৌক্তিক বিচারে ওয়াকিদির বর্ননাকে পৌরাণিক কাহিনীর স্বাভাবিক সম্প্রসারণ বলেই মনে হয়।

সিরাতের অগ্রহণযোগ্যতা ও স্কলারদের গোজামিল

ইবনে ইসাক থেকে আল ওয়াকিদি এই স্বল্প সময়ে যদি গল্পের গরু এই পরিমাণ গাছে উঠতে পারে, তাহলে সহজেই অনুমেয় মুহম্মদের কথিত জীবদ্দশা থেকে ইবনে ইসাকের সিরাত- এই সুবিশাল দেড় শতাব্দী সময়কালে কাহিনী চাঁদে পৌছে যাওয়ার কথা। আর হয়েছেও তাই।

তা সত্বেও বিংশ শতাব্দীর ইসলামিক স্টাডিসের স্কলার মন্টগোমারী ওয়াট (১৯০৯-২০০৬) পৌরাণিক কল্পকাহিনী থেকে ঐতিহাসিক সত্য বার করার চেষ্টা করেছেন। তিনি অতি সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তা হল অলৌকিক ঘটনা বাদ দিয়ে সিরাতের বাকিটাকে ঐতিহাসিক সত্য হিসাবে মেনে করা। ব্যাপারটা দাঁড়ায় মু্হম্মদ উম্মে হানীর ঘরে যেতেন এটা সত্য, কিন্তু উম হানীর ঘর থেকে মেরাজে যাওয়ার গল্প মিথ্যা। অথচ মূলত এই মেরাজ প্রসঙ্গেই উম্মে হানীর উল্লেখ আছে। অনুরূপভাবে বদর যুদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা, কিন্তু বদরে ফিরিস্তারা এসে লড়াই করেছিলেন এটা কল্পকাহিনী। বদর যুদ্ধ বা ফিরিস্তা দুটোর কোনটারই ঐতিহাসিক প্রমান নেই। ফলে দুটোরই ঐতিহাসিক মূল্য সমান, অর্থ্যাৎ শূন্য। লৌকিক বাস্তবতা ইতিহাসের মাপকাঠি নয়। ফলে এই পদ্ধতি একেবারে যদৃচ্ছ হযে দাঁড়ায়, কারণ তথাকথিত অলৌকিক ঘটনারও লৌকিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। মুহম্মদের বিষয়ে জানতে গিয়ে একই বিবরণকে উভয়দিক থেকে ব্যাবহার করা চলতে পারে না। আর আমরা যদি ইবনে ইসাকের সিরাতকে বাতিল করে দেই, মুহম্মদের আর কিছু বাকি থাকে না।

ইসলাম ধর্মের বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ ও সারমর্ম

নবী মুহম্মদ কি প্রকৃতই ছিলেন ছিল নাকি তিনি শুধুই পরবর্তীকালের কল্পনা? স্বীকার করতেই হবে আমরা নির্দিষ্টভাবে কিছুই জানি না। তবে যে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে তা হল ইসলামী বিবরণের অনির্ভরযোগ্যতা। নবী মুহম্মদের যদি অস্তিত্ব থেকেও থাকে তার ব্যাপারে আমরা প্রচলিত বিবরণ থেকে যা কিছু জানতে পারছি সবই প্রায় অতিকথন।

মধ্যযুগ হল জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বন্ধা যুগ। এইসময় ধর্ম প্রায় পুরো দুনিয়ার দখল নিয়ে নেয়। সব ধর্মই আসলে ঠারে ঠারে বলতে চায় তাদের কল্পিত ঈশ্বর, তাদের চাপিয়ে দেওয়া নৈতিকতা, তাদের নির্দেশিত অনুষ্ঠানাদির বাইরে আর সব মিথ্যা। ধর্মের ব্যাপক প্রভাবের কারণে মধ্যযুগে যে কোন রাজনৈতিক চিন্তাকে ধর্মীয় ভেক নিয়ে আসতে হত। ধর্মের মুলো ছাড়া গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল অসম্ভব। ইসলামের উদ্ভব ও বিস্তারের রাজনৈতিক প্রণোদনা নিয়ে সিরিয়াস গবেষণা খুব কমই হয়েছে, যা দু একটা হয়েছে তার ঐতিহাসিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। ফলে আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর মত অবস্থায় নেই। তবে কিছু যৌক্তিক আন্দাজ অবশ্যই করা সম্ভব।

আধুনিক যুগের আগে প্রতিটি রাষ্ট্রের স্থাপনা হত নির্দিষ্ট ধর্মতত্ত্বের ভিত্তিতে। রোমান সাম্রাজ্য যেমন যেমন প্রসারিত হয়েছিল, রোমান দেবদেবীদের আরাধনা তেমন তেমনই ছড়িয়ে পড়েছিল। আবার মধ্যযুগের ইউরোপে মূল ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল ক্যাথলিক চার্চ। শত অনৈক্যের মধ্যেও পোপতন্ত্র ইউরোপে ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রেখেছিল। পোপ যে কাউকে এমনকি যে কোন সম্রাটকে ধর্মত্যাগী বলে ঘোষনা করতে পারতেন। পোপের এই ঘোষনার পর সেই রাজার পতন অনিবার্য ছিল। ক্যাথলিক চার্চের এই বিপুল ক্ষমতার পিছনে থাকত ইউরোপের মানুষের খৃষ্ট ও বাইবেল বিশ্বাস, চার্চের সিদ্ধান্তকে ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত হিসাবে মান্যতাদান।

আরবরা যখন সপ্তম শতকে রোমানদের তাড়িয়ে প্রথমে মধ্যপ্রাচ্য ও তার কিছুদিন পরে উত্তর আফ্রিকা জয় করল তাদের সামরিক শক্তি যথেষ্ট থাকলেও কোন রাজনৈতিক ধর্মদর্শন (political Theology) ছিল না। রাজনৈতিক ধর্মতত্ব মধ্যযুগে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার আবশ্যিক উপাদান হিসাবে পরিগণিত হত। খিলাফৎ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই আভ্যন্তরীন অন্তর্দন্দ্ব ছিল নিত্যসঙ্গী। ইসলামী বিবরণেই দেখা যায় আদব আল-মালিকের আমলে হেজ্জাজের আধিপত্য চলে যায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে। তার সাথে ছিল বর্হিশত্রুর আক্রমনের আশঙ্কা। কারণ বাইজানটাইন সাম্রাজ্য দুর্বল হলেও গেলেও তা ধংস হয়ে যায় নি। খিলাফতের প্রজাদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিল ক্যাথলিক খৃষ্টান, তাদের স্বাভাবিক আনুগত্য ছিল বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের প্রতি। কারণটা খুব সোজা- বাইজানটাইন সম্রাট হলেন খৃষ্টীয় ঈশ্বরের প্রতিনিধি; তার অনুগত হওয়া প্রত্যেক সৎ খৃষ্টানের কর্তব্য। সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল পারস্যের অগ্নি উপাসকদের। তাদেরও ছিল নিজস্ব রাজনৈতিক ধর্মদর্শন: জরাথুষ্ট্রবাদ। সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে গেলে খলিফাদেরও অনুরূপ একটি ধর্মের মূলো প্রয়োজন ছিল। শুধু অনুরূপ ধর্ম হলেই চলত না এই নতুন ধর্মকে ক্যাথলিক খৃষ্টধর্ম ও জরাথুষ্ট্রবাদের থেকে অধিক আগ্রাসী, অধিক আত্বসচেতন, অধিক একেশ্বরবাদী হতে হত।

ঐতিহাসিক উৎস্যে মুহম্মদের উল্লেখ অনির্দিষ্ট এমনকি পরস্পরবিরোধীও। এর থেকে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন। ঘটনা যাই হোক না কেন মনে হয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিক থেকে উমাইয়ারা এই যুদ্ধবাজ নবীকে সামনে আনতে শুরু করে। কারণ সাম্রাজ্য রক্ষায় ধর্মের গুরুত্ব ততদিনে তাদের সামনে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। এই নতুন ধর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে যুদ্ধবাজ হতেই হত কারণ তা ছাড়া খলিফাদের সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রনীতির কোন বৈধতা দেওয়া যেত না। খিলাফতের মূল শক্তি ছিল আরব উপজাতিরা-যারা সম্ভবত কোনরকম শিথিল খৃষ্টধর্মের সাথে যুক্ত ছিল, দ্বাদশ পর্বে এই খৃষ্টধর্মের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। অতয়েব নবীর আরব উপজাতি পরিচয় ছিল আবশ্যিক, তাকে অবশ্যই মরুভূমির বহু ভিতরের কোন এক অঞ্চলের বাসিন্দা হতে হত। কিংবদন্তী ইতিমধ্যেই তৈরী হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পূর্নাঙ্গ ধর্ম হিসাবে গৃহীত হতে গেলে দরকার ছিল বাইবেলের মত একটি ধর্মগ্রন্থ। এইজন্যই কোরানে বারবার সম্পাদনার চিহ্ন পাওয়া যায়। পুরাতন খৃষ্টীয় স্তোত্রকে নবীন কিংবদন্তীর সাথে মিলিয়ে নিতে যে যথেষ্ট কসরত করতে হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহই নেই।

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.