(ভবিষ্যতে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হতে পারে)
Table of Contents
ভূমিকা
মার্ক্সবাদ শ্রেণীহীন সমাজ ও সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৈরি একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ। এই মতাদর্শ অনুযায়ী সমাজব্যবস্থা ভিত্তি ও উপরিকাঠামো নিয়ে গঠিত। এখানে ভিত্তি হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থা, আর ধর্ম, আইনকানুন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সব উপরিকাঠামোর অন্তর্গত। উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিই নির্ধারণ করে দেয় উপরিকাঠামোর কার্যক্রম কোন ধরনের হবে। মার্ক্সের ভাষায়, উৎপাদন ব্যবস্থাই সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তির জীবন প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে। মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বের প্রথমে যে ভাষ্য সেখানে শিল্প ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যকার সম্পর্ক সমাজের আদর্শকে প্রতিফলিত করে। এই তত্ত্ব প্রতিফলন তত্ত্ব বা রিফ্লেকশন থিওরি নামে পরিচিত। এই প্রতিফলন তত্ত্ব অনুযায়ী প্রথমদিকের মার্ক্সীয় সমালোচনাতত্ত্বে শিল্পের ভূমিকাকে খুব সক্রিয়ভাবে দেখা হয়নি। মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বের এই ধারার প্রধান প্রবক্তাদের একজন গিওর্গি প্লেখানােভ (Georgi Plekhanov, ১৮৫৬-১৯১৮, রুশ বিপ্লবী, দার্শনিক, তাত্ত্বিক)। প্রতিফলন তত্ত্ব অনুযায়ী তিনি বলেন, একটি অবক্ষয়প্রাপ্ত বা ডেকাডেন্ট যুগের শিল্পও অবক্ষয়েরই প্রতিফলন হবে। সাম্প্রতিককালের মার্ক্সীয় নন্দনতাত্ত্বিকেরা, যেমন- লুই আলথুসার (Louis Althusser, ১৯১৮-৯০, ফরাসী দার্শনিক) এবং পিয়ের মাশারে (Pierre Macherey, ১৯৩৮ – বর্তমান, ফরাসী তাত্ত্বিক) শিল্প ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলকভাবে জটিল সম্পর্কের কথা ভেবেছেন। তারা শিল্পের স্বশাসনের বা অটোনমির কথাও উল্লেখ করেছেন। শিল্পের স্বশাসনের অর্থ হচ্ছে শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তি, এমনকি রাজনীতির দ্বারাও প্রভাবান্বিত নয়। কিন্তু মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বকে তার আদর্শগত মতবাদের পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব না এবং সেই কারণে এখানে অর্থনৈতিক বা উৎপাদন ব্যবস্থাগত ভিত্তির গুরুত্ব এখানে সমধিক।
সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা বা সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম
মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বের প্রথম দিকের ভাষ্য অনুযায়ী শিল্পের আলাদা কোন নান্দনিক ভূমিকা নেই, এর একটা ভুমিকা, তাহল শিক্ষামূলক। এই শিক্ষা হল সমাজ-বাস্তবতার শিক্ষা, আরও স্পষ্ট করে বললে মার্ক্সবাদ অনুসারে যা সমাজের বাস্তবতা সেই বাস্তবতার শিক্ষা, যাকে মার্ক্সীয় তাত্ত্বিকরা বলেছেন সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা বা সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম। এই তত্ত্বটিও মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্ব নিয়ে দার্শনিক আলোচনার সময়ই উদ্ভূত। এই তত্ত্ব অনুসারে যেসব শিল্পকর্ম সমাজবাস্তবতাকে অস্বীকার করে সেসব শিল্পকর্ম অবাঞ্ছনীয় ও পরিত্যাজ্য। এই সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা অনুযায়ী শিল্পের লক্ষ্য কোন নান্দনিক গুণ বা বৈশিষ্ট্যে-কেন্দ্রিক নয়, শৈল্পিক গুণের সৃষ্টি, পাবলিককে বিনোদিত করা শিল্পের উদ্দেশ্য নয়। বরং শিল্পের উৎকর্ষ, অপকর্ষ এখানে বিচার্য হয় সমাজ গঠনে তার ভূমিকার মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য হল বাস্তবতার প্রতিফলন , শ্রেণিসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, বিপ্লবকে উদ্বুদ্ধ করা, বিপ্লবােত্তর সমাজে সমাজতন্ত্র গঠনে নর-নারীকে অনুপ্রাণিত ও সঞ্জীবিত করা।
সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের বিরোধিতা
সব মার্ক্সীয় নন্দনতাত্ত্বিকরাই যে বাস্তবতার এ ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন তা নয়। বার্টল্ট ব্রেশট (Bertolt Brecht, ১৮৯৮-১৯৫৬, জার্মান তাত্ত্বিক ও নাট্যকার), ওয়ালটার বেনজামিন (Walter Benjamin, ওয়াল্টার বেঞামিন, ১৮৮২-১৯৪০, জার্মান দার্শনিক), ডাভা আন্দোলনের (Dada) সদস্যরা এবং পরাবাস্তববাদী (surrialism) শিল্পী সাহিত্যিকদের অনেকে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে কাঠামোবাদী মার্ক্সবাদীরা (স্ট্রাকচারালিস্ট মার্ক্সিস্ট যেমন আলথুজের, মাশারে) সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শিল্পের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। আধুনিকতাবাদী বা মডার্নিস্টদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল।
১৯৩০ এর দশকে স্ট্যালিনিজম ও সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার আগে কনস্ট্রাক্টিভিজম নামে রাশিয়ায় একটি আন্দোলন দেখা যায়। সেখানে কিছু শিল্পী এই সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার মার্ক্সীয় ঐতিহ্যের বিরোধিতা করে পরীক্ষামূলক কাজের দিকে ঝুঁকেছিলেন। এদের স্টাইলের সাথে কিউবিজমের সাদৃশ্য ছিল। কিন্তু গোরা মার্ক্সিস্টদের বিরোধিতায় আলেক্সান্দার রদচেঙ্কোর (Alexander Rodchenko, ১৮৮১-১৯৫৬, রুশ শিল্পী, একাধিক বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন) মত শিল্পীদের অচিরেই বিদায় নিতে হয়। শেষপর্যন্ত মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বে বাস্তবতা ও বাস্তবতার বিরোধিতার প্রশ্নই বড় হয়েছে, এবং এই দুই ধারাকে কেন্দ্র করেই মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্ব সামনে এগিয়েছে।
চিত্রকলা ও সাহিত্যে সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম, প্লেখানোভ ও স্দানোভের চিন্তা, নিওক্লাসিসিস্ট প্রভাব
সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের মূলে রিফ্লেকশন থিওরি। এটা অনুসারে সামাজিক পরিবর্তন ও প্রবণতাগুলো ধারণ করার মধ্যেই শিল্পের মূল্য । প্লেখানোভ বলেন, কোন ঐতিহাসিক পর্ব বুঝতে হলে সেই পর্বের শিল্প সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যথেষ্ট, কারণ সেই শিল্প ইতিহাস পর্বকেই আদর্শের ভিত্তিতে বর্ণনা করে, যেমন ডেকাডেন্ট যুগে অপসংস্কৃতিই সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে প্রগতিশীল সময়ে জীবনমুখী ও জনমানসে প্রেরণা সৃষ্টিকারী শিল্প তৈরি হয়। তিনি অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট বা বিমূর্ত শিল্পের তীব্র সমালোচনা করেন, কিউবিজমকে কলাকৈবল্যবাদী বলে সমালোচনা করেন। তার মতে, এগুলো জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে দেয় না, তাদেরকে সামাজিক বাস্তবতা উপলব্ধিতেও সাহায্য করে না। মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বের এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী শিল্প হলো প্রচারধর্মী, এটি প্রতিকৃতি বা ফিগারেটিভ ভিত্তিক নরনারীর আদর্শ রূপ বা ফর্ম সৃষ্টিতে জোর দেয়না। রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত মার্ক্সীয় বাস্তবতার প্রতিফলনের মাধ্যমেই এখানে শিল্পের মুল্য এখানে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
চিত্রকলার মত অন্যান্য সংস্কৃতিতেও সোশ্যালিস্ট রিয়ালিওম প্রয়োগ করা হয়। ১৯৩৪ সালে আন্দ্রেই স্দানোভ (Andrei Zhdanov, ১৮৯৬-১৯৪৮, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি লিডার) লেখকদেরকে মানুষের আত্মা নির্মাণের কারিগর হবার ও বৈপ্লবিক প্রেক্ষাপটে বাস্তব তুলে ধরার দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান। প্লেখানোভের মত তিনি সাহিত্যকে প্রচার কাজের উপায় হিসেবে ও রাজনৈতিক উদ্দশ্যে ব্যবহৃত হওয়ায় গুরুত্ব দেন।
অনেকের মতে, এদের বক্তব্যে সমাজ পরিবর্তনে শিল্পের ভূমিকা হিসেবে প্লেটোর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়, যার কাছে রাজনৈতিক বিবেচনা মুখ্য ছিল ও শিক্ষা ছিল শিল্পের গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি। তাদের মতে, সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের মূল বক্তব্য দেখা যায় নিওক্লাসিসিজম বা নব্যধ্রুপদী চিন্তাধারায় যেখানে প্লেটো, এরিস্টোটল, হোরেসের মত দার্শনিকের প্রভাব ছিল। রেনেসাঁ থেকে ১৮ শতকের শেষ পর্যন্ত ইউরোপের নন্দনতত্ত্বে এই প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। তবে নিওক্লাসিসিস্টরা কেবল শিল্পকে শিক্ষা প্রদান বা ডিডাক্টিভ ইম্পারেটিভ নয়, আনন্দ প্রদান ও উপভোগের কথাও বলতেন।
সার্ত্রের চিন্তার লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা
স্দানোভের অনেক পরে জাঁ পল সার্ত্রে (Jean-Paul Sartre, ১৯০৫-৮০, ফরাসী অস্তিত্ববাদী দার্শনিক) স্দানোভের আত্মার কারিগর’ তত্ত্বের নতুন ও সংশােধিত এক ভাষ্য তৈরি করেন ও বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর রাজনৈতিক ইস্যুগুলাের সঙ্গে লেখকদেরকে সম্পৃক্ত হয়ে সমাজের অগ্রগতির জন্য লিখতে বলেন। হােয়াট ইজ লিটারেচার (What Is Literature?) (১৯৪৮) গ্রন্থে তিনি বলেন, লেখা জীবন নয়। আবার প্লেটোনিক সারবক্তা অনুধাবন বা সৌন্দর্যের আদর্শ সম্বন্ধে চিন্তাভাবনার জন্য জীওন থেকে পালানোও সাহিত্য নয়। এটি একটি পেশার অনুশীলন যার জন্য শিক্ষানবিশ, কঠোর পরিশ্রম, দায়িত্ববােধ ও পেশাগত সচেতনতা প্রয়ােজন। এই দায়িত্ববােধ থেকে একজন লেখককে এমনভাবে লিখতে হবে যেন পাঠক পৃথিবী ও পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে অজ্ঞ না থাকে এবং লেখক সম্বন্ধে কেউ যেন একথা না বলে যে, তিনি তার চারপাশে সব কিছু যা ঘটছে সে সম্বন্ধে নির্বিকার। তিনি স্ট্যালিন বা ঝাডানোভের সমর্থন ছিলেন না, কিন্তু ঝাডানোভের সাথে তার মিল পাওয়া যায় কারণ তিনি তাত্ত্বিক ও নাট্যকার হিসেবে বাস্তববাদী ছিলেন। স্দানোভের সাথে তার পার্থক্য শিল্পে রাষ্ট্রের ভুমিকা নিয়ে। তার মতে, রাষ্ট্রের প্রচারে নয়, নিজস্ব চেতনার ভিত্তিতে ব্যক্তি হিসেবে লেখক ও শিল্পীদেরকে বাস্তবতার প্রতিফলনে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
গিওর্জ লুকাচের ক্রিটিকাল রিয়ালিজম ও আধুনিকতাবাদের সমালোচনা
গিওর্জ লুকাচ (György Lukács, ১৮৮৫-১৯৭১, হাঙ্গেরীয় মার্ক্সবাদী দার্শনিক) স্দানোভের সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের সংশোধন করেন ও তা ব্যবহার করে ক্রিটিকাল রিয়ালিজম বা সমালোচনামূলক বাস্তবতাবাদ নামে নতুন বাস্তবতাবাদের ধারণা দেন। তার এই নতুন বাস্তবতাবাদের সাহায্যে তিনি নন-মার্ক্সিস্ট শিল্পীদের শিল্পের মুল্যায়ন করার কথা বলেন। তিনি সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের বিরোধী নন, কিন্তু অ্যাস্থেটিক থিওরি হিসেবে তার এটা নিয়ে দ্বিধা ছিল। সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের ভিত্তিতে কোন শিল্পকর্মের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা নিয়ে তিনি সন্দিহান। তার মতে শিল্পকর্মকে কেবল পলিটিকালি কারেক্ট হলেই হবে না, শিল্পগুণ বিশিষ্টও হতে হবে। তিনি তার ‘দ্য মিনিং অফ কনটেম্পোরারি রিয়ালিজম” (১৯৬৩) গ্রন্থে দেখান, ২০ শতকের বুর্জোয়া সাহিত্যকে আধুনিকতাবাদী ও সমালোচনামূলক বাস্তবতাবাদী এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
আধুনিকতাবাদ বা মডার্নিজম – এখানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ও বিষয়ের পরিবর্তে আঙ্গিকের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একে সমাজ ও অন্যান্য ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, প্রাধান্য পেয়েছে ব্যক্তিভিত্তিক অন্তর্মুখিতা। হেগেল বা হেগেলিয়ানরা বলেন এই বিচ্ছিন্নতাবোধ বা এলিয়েনেশন উদ্ভূত হয় মানুষের প্রকৃতি থেকে। অন্যদিকে মার্ক্সিস্টদের মতে এই এলিয়েনেশনের উদ্ভব হয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থায়, বিশেষ করে বুর্জোয়া পুঁজিবাদে। আধুনিকতাবাদের আদর্শ নিয়েই জেমস জয়েস, কাফকা ও বেকেটের লেখাগুলো লেখা হয়েছে।
সমালোচনামূলক বাস্তববাদ বা ক্রিটিকাল রিয়ালিজম – ১৯ শতকের বাস্তবতার যে আদর্শের নিরিখে সরল রৈখিক বর্ণনা, বাস্তবজীবনের ভিত্তিতে সৃষ্ট চরিত্র, মার্জিত ও স্বচ্ছ লেখন শৈলি ব্যবহার করা হয়েছে তার অনুসারী হল ক্রিটিকাল রিয়ালিজম। এর সঙ্গে লুকাচ যোগ করেন সমালোচনামূলক নিস্পৃহ ও নির্বিকার মনোভাব। টমাস ইয়ানের লেখা বাডেন ব্রুকস ও ডক্টর ফাউস্টাস উপন্যাসের কথা উল্লেখ করে তিনি দেখান, এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গত ব্যবহার করা হলে নির্বিকার নিস্পৃহতা তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে আধুনিক অভিজ্ঞতাকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখে বৃহতের অংশ হিসেবে এর যে স্বীকৃতি পাওয়া উচিৎ তাই এখানে পাওয়া যায়। লুকাচের দৃষ্টিভঙ্গিতে বুর্জোয়া সাহিত্যের মূল্য তার অন্তর্গত বাস্তবতার আধেয়তে অর্থাৎ সামাজিক ক্রিয়াকর্মের প্রকৃতি সম্বন্ধে তার সমালোচনামূলক সচেতনতায়। সার্ত্রের মত লুকাচ বলতে চান, লেখক এমনভাবে লিখবে যেন কেউ তার পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে অজ্ঞ বা অনবহিত না থাকে। কাল্পনিক চরিত্রকেও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে রেখে উপস্থাপিত করতে হবে এখানে যার ফলে যে আদর্শ তার সামাজিক অস্তিত্ব তৈরি করেছে তা স্পষ্ট হয়। যেহেতু আধুনিকতাবাদে ব্যক্তিকে রাজনীতি নিরপেক্ষ হয়ে পৃথক ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দেখানো হয়, যেমন কাফকার যোসেফকে বা বেকেটের এস্ট্রাগঁ ও ভ্লাদিমিরকে, সেজন্য এগুলোর শিল্পমূল্য লুকাচের নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে অনেক কম।
মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বে বাস্তবতার যে আদর্শ লুকাচ সমর্থন করেন সেখানে সন্দেহবশবর্তী হয়ে অতীতমুখিতা আছে (পুনরো লেখার মূল্যায়ন) ও মধ্যবর্তী কোন অবস্থা ছাড়াই ভাল-মন্দ এই দুই বিপরীত অবস্থার নির্দেশ আছে। স্দানোভের মতো লুকাচের মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্ব লেখক-শিল্পীর উপর বিশেষ কর্তব্যের বাধ্যবাধকতা চাপায় না, কিন্তু লেখকের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ মানার বিষয়ে ও মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বের অনুশাসনের কাছে লেখকের আনুগত্য স্বীকারের ক্ষেত্রে তিনিও অনমনীয়।
মার্ক্সবাদী নন্দনতত্ত্বে ফর্ম ও কনটেন্ট, এবং এদের মধ্যে সম্পর্ক
মার্ক্স
গিওর্জ লুকাচ “দি ইভোল্যুশন অফ মডার্ন ড্রামা” তে বলছেন, সাহিত্যের প্রকৃত সামাজিক উপাদান হল ফর্ম বা রূপ। এটা মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বে একটি ব্যতিক্রমী বক্তব্য ছিল, কারণ মার্ক্সবাদী নন্দনতত্ত্বে যেকোন বহিরঙ্গভিত্তিক বৈশিষ্ট্য বা ফরমালিজমকে সন্দেহের চোখে দেখা হয় ও সমালোচনা করা হয়। মার্ক্সিস্টরা মনে করেন এতে সাহিত্যের ঐতিহাসিক তাৎপর্য নষ্ট হয়। রাজনৈতিক বিষয়ের (কনটেন্টের) উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবার জন্য এখানে তার শিল্পরূপ বা ফর্মে, অর্থাৎ বলতে পারেন তার শৈল্পিক সত্তার উপর কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মার্ক্স (Karl Marx, ১৮১৮-১৮৮৩) নিজেও তার উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে লেখা বেশ কিছু লিরিক কবিতা ছিড়ে ফেলেছিলেন কারণ এই কবিতাগুলো লিখতে গিয়ে তার আবেগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।
মার্ক্স কনটেন্ট ও ফর্মের সংহতি বা ইউনিটি ও অবিচ্ছেদ্যতা না ইন্টিগ্রিটিতে বিশ্বাস করতেন। তার মতে, আঙ্গিক বা ফর্মগত বাড়াবাড়ি বিষয়ের দূষণ ঘটায়, ফর্মের মূল্য ও রুচিসম্পন্নতা বিঘ্নিত হয়। ফর্ম ও কনটেন্টের ইউনিটি নিয়ে মার্ক্স হেগেলের অনুসরণ করেন, যেখানে হেগেলে তার ফিলোসফি অফ ফাইন আর্টে (১৮৩৫) বলেন, প্রতিটি নির্দিষ্ট কনটেন্ট তার উপযুক্ত ফর্ম ধারণ করে। মার্ক্স হেগেলের অ্যাস্থেটিক্স পুরোপুরি গ্রহণ করেননি, তবে ফর্ম যে ঐতিহাসিকভাবে কনটেন্ট ছাড়াই নির্ধারিত তা নিয়ে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। মার্ক্সিজমে যেমন সমাজের অন্তর্গত মেটারিয়াল কনটেন্ট বা উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা উপর উপরিকাঠামো নির্ধারিত হয়, তেমনি শিল্প-সাহিত্যে ফর্মের আগে কনটেন্টই প্রধান। ফ্রেডরিক জেমিসন বলেন, উপরিকাঠামোর ভেতরে কনটেন্টের রূপান্তর বা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই ফর্মের জন্ম দেয়।
গিওর্জ লুকাচ ও র্যালফ ফক্স
কার্যন্ত কনটেন্ট ও ফর্ম যে অবিচ্ছেদ্য তা হেগেল ও অনেক মার্ক্সিস্টই মানতেন। লুকাচ ও র্যালফ ফক্স (Ralph Winston Fox, ১৯০০-৩৬, ব্রিটিশ সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক ও কমিউনিস্ট) এর মত কেউ কেউ তাত্ত্বিকভাবে দুটোর পৃথক সত্তাকে স্বীকার করেন। তবে তারা দুজন এই ফর্ম ও কন্টেন্টের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে স্বীকার করে শেষ পর্যন্ত কনটেন্টই যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে রায় দেন। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে যোগ দিয়ে মৃত্যু বরণ করা র্যালফ ফক্স দ্য নভেল এন্ড দ্য পিপল এ লেখেন, ‘কনটেন্ট থেকেই ফর্ম আসে, আর তাই দুটো একই, এবং যদিও কনটেন্টেরই গুরুত্ব বেশি, ফর্ম কনটেন্টের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে সম্পর্কিত। এই সম্পর্ক নিষ্ক্রিয় বা একপেশে নয়।’ ফর্ম ও কনটেন্টের ভেতরের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক একদিক দিয়ে যেমন বহিরঙ্গভিত্তিক ফর্মালিস্টিক ধারা বিরোধী (১৯২০ সালে রাশিয়ার ফর্মালিস্ট শিল্পসাহিত্যিকরা ফর্মের প্রতি ঝোঁকের জন্য, ও ফর্ম কনটেন্টেরই অবদান এই বিশ্বাসের জন্য সমালোচিত হয়), তেমনি “শিল্পের ফর্ম গুরুত্বহীন নির্মাণ, এবং এতি উত্তাল ইতিহাসের অন্তর্গত কনটেন্টের উপর চাপিয়ে দেয়া” – এই মার্ক্সিস্ট ধারণারও বিরোধী।
ক্রিস্টোফার কডওয়েল
ফর্ম গুরুত্বহীন নির্মাণ যা উত্তাল ইতিহাসের অন্তর্গত কনটেন্টের উপর চাপিয়ে দেয়া – এই “মোটা দাগের মার্ক্সিস্ট ধারণা” পাওয়া যায় ক্রিস্টোফার কডওয়েলের (Christopher Caudwell, ১৯০৭-৩৭, ব্রিটিশ মার্ক্সবাদী লেখক) স্টাজিড ইন এ ডাইং কালচার (১৯৩৮) গ্রন্থে। এখানে তিনি সামাজিক অস্তিত্ব ও সামাজিক সচেতনতার রূপের ম্মধ্যে পার্থক্য করেন, যেখানে সেই সামাজিক অস্তিত্ব মানুষের অভিজ্ঞতার ও সহজাৎ প্রবৃত্তি থেকে তৈরি। সামাজিক সচেতনতার রূপ জমাট বেঁধে নিষ্ক্রিয় ও সেকেলে হয়ে গেলে সামাজিক অস্তিত্বের গতিময় ও বাঁধভাঙ্গা অগ্রগতিতে বিপ্লব আসে। কডওয়েল এভাবে সামাজিক অস্তিত্বকে কনটেন্ট হিসেবে দেখেন, যার কোন ফর্ম নেই। আর ফর্মকে তিনি দেখেছেন নিয়ন্ত্রণকারী ও রক্ষণশীল হিসেবে। এই দুই এর ভেতরের সম্পর্কে তিনি দ্বান্দ্বিকতা পান না। তার মতে, ফর্ম কন্টেন্টের উপাদানকে প্রসেস করেনা, কারণ সামাজিক বা সাহিত্যিক কনটেন্ট মার্ক্সিজমে প্রতিষ্ঠিত সত্য যাকে সনাক্ত করার মত গঠনও আছে। কডওয়েলের মতো অনেক ব্রিটিশ মার্ক্সিস্ট সমালোচক কনটেন্টের দৃষ্টিকোণ থেকে লিটারেচারকে বিচার করে তার সঙ্গে ক্লাস স্ট্রাগলের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন। এর বিরোধিতায় লুকাচ বলেন, শিল্পে আইডিওলজির প্রকৃত ধারক ও বাহক হল তার ফর্ম, অ্যাবস্ট্রাক্ট কনটেন্ট নয়। টেরি ইগলটনের (Terry Eagleton, ১৯৪৩-, ব্রিটিশ লিটারারি থিওরিস্ট ও ক্রিটিক) মতেও সাহিত্য সামজিক ইতিহাসের দলিল হিসেবে না, সাহিত্যকর্ম হিসেবেই ইতিহাস সাহিত্যে প্রতিফলিত।
ট্রটস্কি
সাহিত্যে ফর্মের যে আইডিওলজিকাল ভিত্তির কথা লুকাচ ও অন্যেরা বলছেন তার পেছনে যুক্তি কী? লিওঁ ট্রটস্কি (Leon Trotsky, ১৮৭৯-১৯৪০, রুশ বিপ্লবী, তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ) অনেক আগেই তার লিটারেচার এন্ড রেভোল্যুশন (১৯২৪) গ্রন্থে বলেন, আইডিওলজির পরিবর্তনের জন্যই সাহিত্যের ফর্মে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে সাহিত্য নতুন সমাজ বাস্তবতাকে ধারণ করতে সক্ষম হয়, এবং লেখক ও পাঠকের মধ্যে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলে। যেমন, উপন্যাস আদর্শের ভিত্তিতে যেসব আগ্রহ সৃষ্টি করে, ফর্মের মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটে। সাহিত্য অভিজাত শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবার ফলেই উপন্যাসে স্থান পেয়েছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর আইডিওলজির জীবন। টেরি ইগলতনের মতে সাহিত্যে ফর্মের পরিবর্তন ও আর্থসামাজিক ভিত্তিত্তে আইডিওলজির পরিবর্তনতের মধ্যকার সম্পর্কে সিমেট্রি নেই, অর্থাৎ আইডিওলজির পরিবর্তনের সাথে তাল রেখেই যে ফর্মের পরিবর্তন হবে এমন কোন কথা নেই। ট্রটস্কি বলেন, সাহিত্যে ফর্মে বা স্টাইলে স্বশাসন বিরাজ করে, আর সব সময় তা আইডিওলজির পরিবর্তনে পুরোপুরি সাড়া দেয় না।
ইগলটন
ইগলটনের মতে সাহিত্যের ফর্ম তিনটি উপাদানের জটিল মিশ্রণ-
(১) লিটারারি ফর্ম অংশত নির্ধারিত হয় এর তুলনামূলক স্বশাসিত বা অটোনমাস ইতিহাস দ্বারা।
(২) উপন্যাসের মতো সাহিত্য সার্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী আইডিওলজি দ্বারা নির্দিষ্ট।
(৩) ফর্ম লেখক ও পাঠকদের মধ্যে বিশেষ কতকগুলো সম্পর্ক ধারণ করে।
এই তিনটি উপাদানের ভেতরে যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক মার্ক্সীয় নন্দনতাত্ত্বিকরা তাই এনালাইসিস করার চেষ্টা অরে। একটি বিশেষ ফর্ম নির্বাচন করা হলে লেখক দেখতে পারে যে, আইডিওলজির মধ্যে তার পছন্দ অপছন্দের আর কোন সুযোগ খোলা থাকে না। লেখক তার সাহিত্যের ভাষা বা ফর্মকে সংশোধন করতে চাইলে তা কেবল তার ব্যক্তি প্রতিভার উপর নির্ভর করবে না, ইতিহাসের সেই পর্বের আইডিওলজি সেই পরিবর্তনের জন্য উপযোগী কিনা সেটাই এখানে প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়াবে।
লুকাচের বাস্তববাদ ও হেগেলের প্রভাব
লুকাচ হেগেলের মত সাহিত্যকে বুর্জোয়া এপিক হিসেবে দেখেন, দ্য থিওরি অফ দ্য নভেল (১৯১৪-১৫) গ্রন্থে বলেন, এই এপিক ক্লাসিকাল এপিকের বিপরীতে আধুনিক সমাজে মানুষের বিচ্ছিন্নতার পরিচয়কে তুলে ধরে। ক্লাসিকাল চিন্তায় মানুশ ও তার পৃথিবীর সামঞ্জস্যময় সমন্বয় ভেঙ্গে পড়লেই উপন্যাসের জন্ম হয়। লেখক তখন সমগ্রের ও ধ্রুব সত্যের সন্ধানে বের হয়। মার্ক্সীয় নন্দনতাত্ত্বিক হিসেবে তার কাছে সেই লেখক সফল ও মহৎ যে মানুষের জীবন ও সত্তাকে তার সমগ্রতায় ধারণ করতে পারে। পুঁজিবাদের বিচ্ছিন্নতাবোধ বা এলিয়েনেশন দ্বারা সে সমাজে বিশেষ ও সাধারণ, কগনিটিভ ও পারসেপটিভ, সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে নিত্যই বিভেদ সৃষ্টি হয়, সেখানে বড় মাপের লেখক এসব দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়াকে একটি জটিল সমগ্রতার ভেতরে সন্নিবেশ করেন। লুকাচ এসব লেখাকে রিয়ালিস্ট বলেন ও এদের মধ্যে গ্রীক লেখক, শেক্সপিয়রের সাথে বালজাক ও তলস্তয়কে ফেলেন। তার মতে, ঐতিহাসিক বাস্তবতার পর্ব হল গ্রিস, রেনেসাঁ, ও ১৯ শতকের ফ্রান্স।
লুকাচের মতো মার্ক্সিস্টের ধারণায় বাস্তববাদী লেখায় ইতিহাসের সেই পর্বের উপস্থিতি থাকে যা সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল বা ট্রিপিকাল। বাস্তববাদী লেখকের দায়িত্ব হল ব্যক্তি একান্ত নিজস্ব ধারণা কর্মকাণ্ড থেকে এসব প্রতিনিধিত্বশীল প্রবণতা ও শক্তিগুলোকে বের করে এনে সামাজিক সমগ্রতার সাথে যুক্ত করা। এই দায়িত্ব পালনের প্রক্রিয়ায় সামাজিক জীবনের নির্দিষ্ট ও বিশেষ অভিজ্ঞতাকে ইতিহাসের তাৎপর্যময় আন্দোলন বা ঘটনার দ্বারা নিষিক্তও করা হয়। সামগ্রিকতা, প্রতিনিধিত্বশীলতা, বিশ্ব-ঐতিহাসিকতা – লুকাচের এই তিনটি সমালোচনা সূত্রকে মার্ক্সিস্ট না বলে হেগেলিয়ান বলা সমীচীন, যদিও মার্ক্স-এঙ্গেলেস তাদের সাহিত্য সমালোচনায় প্রতিনিধিত্বশীলতার ব্যবহার অরেছেন। তার মতে সব বড় মাপের শিল্পী সামাজিকভাবে প্রগতিশীল এই অর্থে যে লেখকের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দায়বদ্ধতা যাই হোক না কেন, তাদের লেখায় যুগের বিশ্ব-ঐতিহাসিক শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, যার ভিত্তিতে পরিবর্তন ও অগ্রগতি সম্ভব হয়। লেখকের পক্ষে এই উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব হয় কিনা তা শুধু তার নিজের যোগ্যতার উপর নির্ভর করে না, ইতিহাসে তার অবস্থানের ওপরেও নির্ভর করে। সমগ্র সামাজিক প্রক্রিয়ার সম্ভাবনার উপর তার সৃষ্ট চরিত্রদের গভীরতা ও পূর্ণাঙ্গতা নির্ভর করে।
গোল্ডমান ও তার জেনেটিক স্ট্রাকচারালিজম
মার্ক্সিস্ট নন্দনতত্ত্বের লুকাচপন্থী নিওহেগেলিয়ান স্কুলে লুকাচের প্রধান শিষ্য রোমানিয়ান সমালোচক লুসিয়েন গোল্ডমান (Lucien Goldmann, ১৯১৩-৭০, রোমানিয়-ফরাসী দার্শনিক)। একটি সমাজের বা শ্রেণীর সদস্য হিসেবে একজন লেখকের চিন্তার গঠনকে একটি সাহিত্যকর্ম বা টেক্সট কতটুকু ধারণ করে এর বিশ্লেষণই ছিল তার উদ্দেশ্য। টেক্সট সামাজিক শ্রেণীর বিশ্বদর্শন বা ওয়ার্ল্ড ভিশন এর যত কাছাকাছি হবে শিল্পকর্ম হিসেবে তার তাৎপর্য ও মূল্য তত বেশি। এজন্য গোল্ডমানের দৃষ্টিতে টেক্সট কেবল ব্যক্তির প্রয়াস নয়, বরং সেই ব্যক্তি যে গোষ্ঠীর সদস্য তার ধারণা, ভেল্যু ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যা গোষ্ঠীর সামগ্রিক মানসিক গঠন বা মেন্টাল স্ট্রাকচার থেকে উদ্ভূত। গোল্ডম্যান তার এই সমালোচনা পদ্ধতির নাম দেন জেনেটিক স্ট্রাকচারালিজম। স্ট্রাকচারালিজম এজন্য যে তার এই ব্যাখ্যা একটি বিশ্বদর্শন বা ওয়ার্ল্ড ভিশন এর কন্টেন্ট সম্পর্কে ততটা আগ্রহী নয় যতটা আগ্রহী সেই ওয়ার্ল্ড ভিশনের ভিত্তিতে যেসব শ্রেণী বা ক্যাটাগরি দেখা যায় তাদের মেন্টাল স্ট্রাকচারের উপর।
একারণে দুজন পৃথক লেখককে একই সমন্বিত মানসিক গঠন বা মেন্টাল স্ট্রাকচার বিশিষ্ট বলে দেখানো যায়। জেনেটিকের প্রশ্ন আসছে কারণ গোল্ডমান দেখাতে চেয়েছেন কিভাবে এসব মেন্টাল স্ট্রাকচার তৈরি হয়, অর্থাৎ কিকরে একটি ঐতিহাসিক পরিস্থিতি একটি ওয়ার্ল্ড ভিশনকে জন্ম দেয়। গোল্ডমানের মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্সের লক্ষ্য টেক্সট, ওয়ার্ল্ড ভিশন ও ইতিহাস বা কন্টেন্ট এর ভেতরকার স্ট্রাকচারাল সম্পর্ক নির্ণয়।
(সংক্ষেপে সহজভাবে বললে, সমাজের রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাবলি বা ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, যাকে কন্টেন্ট বলা হয়, তার ভিত্তিতে সমালোচনা নয়, বরং এই ঘটনাগুলো বা কনটেন্টগুলো সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে ওয়ার্ল্ড ভিশন তৈরি করে তা লেখায় কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে তার ভিত্তিতে সমালোচনা। সামাজিক শ্রেণী বা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এই ওয়ার্ল্ড ভিশন উদ্ভূত হয় সেই গোষ্ঠীর মানুষের মেন্টাল স্ট্রাকচারের উপর ভিত্তি করে। গোল্ডম্যান টেক্সট, ওয়ার্ল্ড ভিশন ও কনটেন্ট এর মধ্যকার স্ট্রাকচারাল সম্পর্ক নির্ণয় করতে চান, অর্থাৎ কিকরে কনটেন্ট সামাজিক গোষ্ঠীর মেন্টাল স্ট্রাকচার গঠনের মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড ভিশনের জন্ম দেয় তা জানতে চান।)
লুকাচ ও গোল্ডমান দুজনেই হেগেলের সাথে একমত ছিলেন যে শিল্পকর্মকে ঐক্যভিত্তিক সমগ্রতা বা ইউনিফায়েড টোটাল রূপ নিতে হবে। এদিক দিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নন-মার্ক্সিস্ট ক্রিটিকদের সাথে মেলে।
বাস্তবতাবিরোধী মার্ক্সিস্ট ক্রিটিক – ব্রেশ্ট ও বেঞামিন
সব মার্ক্সীয় নন্দনতাত্ত্বিক বাস্তববাদের ভিত্তিতে শিল্পের মূল্যায়ন করেননি। বাস্তববাদের বিপরীতে যে সমালোচনার ধারা দেখা যায় তার পুরোভাগে ছিলেন বার্টোল্ট ব্রেশট, ওয়াল্টার বেঞামিন; আডর্নো (Theodor W. Adorno, ১৯০৩-৬৯, জার্মান দার্শনিক, ক্রিটিকাল থিওরিস্ট) ও মারকুজার (Herbert Marcuse, ১৯০৮-৭৯, জার্মান-আমেরিকান দার্শনিক, ক্রিটিকাল থিওরিস্ট) মত ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা, ফ্রান্সের স্ট্রাকচারালিস্ট মার্ক্সিস্ট চিন্তাবিদরা। এদের মধ্যে রিফ্লেকশন থিওরির প্রতি দ্বিধা ও অবিশ্বাস ছিল। ব্রেশট এদের প্রতিনিধিত্ব করে বলেন, শিল্প জীবনের প্রতিচ্ছবি হলে বলতে হবে এটা খুব বিশেষ রকমের আয়নার সাহায্য হয়।
নাটক সম্পর্কিত অ্যাস্থেটিক্সে ব্রেশটের ধারণা প্রভাব বিস্তার করেছে, আর এই ধারণার প্রকৃতি হচ্ছে বাস্তবতাবিরোধী। ব্রেশটের এপিক থিয়েটারের উদ্দেশ্য হল বাস্তবতার যে মায়া মঞ্চে সৃষ্টি হয় তাকে ছিন্ন করা। তার এই মতবাদ ও নাট্যচর্চার উদ্দেশ্য হল দর্শকরা যেন মঞ্চের অভিনেতাদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ না করে সেটা নিশ্চিত করা। তার মতে, তথাকথিত বাস্তববাদী নাটকে যে মায়া সৃষ্টি হয় তার ফলে চরিত্রদেরকে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে দৃষ্টি প্রতিহত করা হয়। একজন মার্ক্সিস্ট হিসেবে ব্রেশটের কাছে সেই রাজনৈতিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। একটি নাটকীয় মুহূর্তের পেছনে যেসব সামাজিক শক্তিগুলো কাজ করে সেসব খুলে দেখানোই এপিক থিয়েটারের উদ্দেশ্য, সেই শক্তিগুলোকে পুনরায় সৃষ্টি করা নয়। এজন্য দর্শকের সামনে নাটক মঞ্চায়নের প্রক্রিয়াও দেখানো হয়, যেন তারা বুঝতে পারে যে নাটকই অভিনীত হচ্ছে, বাস্তব কোন ঘটনা নয়। কয়েকটি আঙ্গিক বা অরগানিকের সাহায্যে ব্রেশট দর্শক ও নাটকের মধ্যকার এই বিচ্ছিন্নতার সম্পর্কটি তৈরি করেন। এই আঙ্গিকগুলোর মধ্যে আছে খুব আদর্শায়িত ও কৃত্রিম অভিনয় (সার্কাসের অনুকরণে); অতিরঞ্জিত অঙ্গভঙ্গ; মঞ্চের অভিনয়কে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ক্রমাগত সঙ্গীত, আবৃত্তি ইত্যাদির ব্যবহার; বাস্তববাদী পটভূমির দৃশ্য না দেখানো ইত্যাদি। এসব কিছুর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল নাটকের শিক্ষা প্রদানের ভূমিকাকে বড় করে দেখানো, বিনোদন নয়।
নাটকের ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে ব্রেশটের এপিক থিয়েটার মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্সের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে, তা হল ফর্ম ও কনটেন্টের সম্পর্ক আর এ প্রসঙ্গে উত্থাপিত একটি প্রশ্ন। প্রশ্নটি হচ্ছে – কনটেন্টের মতো ফর্মেরও কি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব?
এ প্রসঙ্গেই ১৯৩০ এর দশকে ব্রেখট আর লুকাচের মধ্যে এবং স্দানোভ ও কনস্ট্রাক্টিভিস্টদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছিল। জার্মান মার্ক্সিস্ট দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞামিন এমন একটি বিপ্লবী শিল্পের কথা ভেবেছিলেন যা শুধু নতুন কন্টেন্টের জন্ম দেবে না, প্রকাশের নতুন নতুন আঙ্গিকেরও সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, সমকালে সাহিত্যের প্রয়োজন মেটাবার জন্য উপযোগী সাহিত্যের ফর্ম বা জঁরার প্রয়োজন আছে। ব্রেশটের মতই ওয়াল্টার বেঞ্জামিন শিল্পকে পণ্ডিতদের দ্বারা বিশ্লেষিত হবার মত কোন বস্তু হিসেবে না দেখে একে একটি সামাজিক ক্রিয়া ও চর্চা হিসেবে হিসেবে দেখেছেন। তাদের মতে সাহিত্যকে যেমন টেক্সট হিসেবে দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় সামাজিক কর্মকাণ্ড হিসেবেও। এই দৃষ্টিতে শিল্প একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উৎপাদন পদ্ধতি ও দৃষ্টান্ত। বেঞামিন অবশ্য বাস্তবতার অন্য ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন প্রকৃত বিপ্লবী একে কেবল শিল্পবস্তু হিসেবে দেখে না, একে উৎপাদনের উপায় ও শক্তি হিসেবেও দেখে। সেজন্য উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্কের ভেতর একে স্থাপন করে তিনি এই উৎপাদিকাশক্তির পরিবর্তনের কথা বলেন।
ব্রেশ্টের এপিক থিয়েটার তত্ত্বের সমস্যা হল দর্শকদের একাধিক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা। সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম মতে শিল্পকে যে মানুষের আত্মার কারিগর হিসেবে দেখা হয় এতি তার পরিপন্থী। তাই সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কতটা থাকা প্রয়োজন ও অ্যাস্থেটিক্সে এর ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ তা নিয়ে বাস্তববাদী ও বাস্তবতাবিরোধীদের মধ্যে এই বিতর্ক অবশ্যম্ভাবী হয়েছে।
মডার্নিজমের সমস্যা, আডর্নো ও মারকুজার মত, ও তাদের সমালোচনা
মডার্নিজম মার্ক্সিস্ট থিওরিস্টদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে, উদাহরণ সঙ্গীতে আধুনিকতাবাদ। ১৯৩০ সালে সোস্তাকোভিচ (Dmitri Shostakovich, ১৯০৬-৭৫, রাশিয়ান-সোভিয়েত মিউজিক কম্পোজার ও পিয়ানিস্ট) মডার্নিজমের প্রভাবে এসে লেডি ম্যাকবেথ নামে অপেরা লিখলে তাকে কম্যুনিস্ট পার্টির কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। বাস্তবতার বিষয়টি অবশ্য সঙ্গীতে খুব প্রাসঙ্গিক নয়, বাস্তবতার নামে যা আশা করা হয়েছে তা হল ১৮ ও ১৯ শতকের ক্লাসিকাল সঙ্গীতের সুর ও মূর্ছনা। মডার্নিস্ট সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকাররা ক্লাসিকাল ঐতিহ্যের বিপরীতে ও অ্যাকাডেমিক প্রশিক্ষণকে উপেক্ষা করে উচ্চনাদের ও সামঞ্জস্যহীন যে সুর তৈরি করেন সেগুলো রাজনৈতিকভাবে মূল্যমানের অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত হিসেবে সমালোচিত হয়।
কিছুদিন আগেও আর্নল্ড শোয়েনবার্গের (Arnold Schoenberg, ১৮৭৪-১৯৫১, মিউজিক কম্পোজার ও থিওরিস্ট) উদ্ভাবিত টুয়েল্ভ টোনকে আধুনিকতাবাদের চূড়ান্ত মনে করা হয়েছে, কারণ এখানে অসামঞ্জস্য ও বেসুরের উপস্থিতি প্রবল। মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্স থেকে এর সমর্থন আসা কঠিন। তাও ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের দার্শনিক ও নব্যমার্ক্সবাদী থিওডোর আডর্নো এর পক্ষে জোড়ালো যুক্তি দেন যা তর্কের সৃষ্টি করে। লুকাচের যুক্তিতর্কের পদ্ধতি অবলম্বন করে আডর্নো সঙ্গীত বিষয়ক বিতর্কটিকে শোয়েনবার্গ ও ইগোর স্ট্রাভিনিস্কি – এই দুজনের মিউজিকাল অ্যাস্থেটিক্সের একটিকে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেন। পরে স্ট্রাভিনস্কি মডার্নিজমের ভিত্তিতে ‘রাইট অফ স্প্রিং’ ব্যালে রচনা করলেও আডোর্নো বলেন তিনি নিও-ক্লাসিকালের পুরনো ফর্মের সঙ্গীত রচনায় ব্যস্ত ছিলেন। দুই মিউজিকাল অ্যাস্থেটিক্সের তুলনা ও দুই বিপরীতের মধ্যে পছন্দের বিষয়টি তাই তখন প্রাসঙ্গিক মনে হয়। এরপরে অবশ্য তিনিও টুয়েল্ভ টোনের সঙ্গীত রচনা করেন।
আডর্নোর কাছে মিউজিকে নিও-ক্লাসিকাল স্টাইল ছিল পশ্চাৎমুখী ও সেকেলে যার মধ্যে মধ্যে তিনি লক্ষ্য করেছেন আধুনিক জীবন ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যা এড়ানোর প্রবণতা। স্ট্রাভিনস্কির নিও-ক্লাসিকাল সঙ্গীত রচনায় বিংশ শতাব্দির টেনশন ধরা পড়েনি বলে তার সমালোচনা ছিল, এখানে আডর্নো যেন বেঞামিনের মতোই শিল্পীকে শিল্পের রূপ ও শ্রেণী সম্বন্ধে পুনর্বিবেচনার কথা বলছেন। অন্যদিকে শোয়েনবার্গের শঙ্গীতকে মনে করা হয়েছে প্রগতির সমর্থক ও তাকে বলা হয়েছে বিপ্লবী সুরকার, যিনি সেকেলে বস্তাপচা সঙ্গীতের ফর্মকে পরিত্যাগ করে আধুনিকতার আদর্শকে উঁচু করে ধরেছেন। আডর্নো বলতে চেয়েছেন, রাজনীতির মতই শিল্পের ফর্ম ও স্ট্রাকচারে যদি প্রগতিশীলতা অর্জন করতে হয় তবে এসবে বৈপ্লবক পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে হবে।
এখানে যে বিষয়টি সমস্যার আকার ধারণ করে তা হল শিল্পীর সামাজিক ভূমিকা। প্রশ্ন হল তারা কি শিল্পের বিপ্লবাত্মক ফর্মের চর্চা কি জনগণের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে করছে নাকি রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি কর্তব্য পালন করে? আডর্নো বলেন প্রথমটি। তার এই সঙ্গীততত্ত্বের সমালোচনা করে বলা যায় তিনি রিয়ালিস্টদের মতই ডগম্যাটিক, ভিন্নপথ হলেও তিনি একটি সমাধানের কথাই বলছেন – ঐতিহ্য বিরোধী ও নতুন এক্সপেরিমেন্ট। তখন নতুন প্রশ্ন এসে যায়, শিল্পে বিপ্লবী মনোভাব একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও বৈপ্লবিক হবার সম্ভাবনাও এনে দেয় কিনা। আডর্নোর ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের অন্যতম সহযোগী হার্বার্ট মারকুজা ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত একই ধরণের ইতিবাচক সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছিলেন, অর্থাৎ তারা মনে করতেন ফর্মের এই বিপ্লব রাজনৈতিক বিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত। এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমেই সনাতন প্রতিনিধিত্বমূলকতার ভিত্তিতে কনটেন্টের উপর যে জোর দেয়া হয়েছে তার তুলনায় এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে কন্টেন্টকে আরও বৈশিষ্ট্যময় ও মুক্তির উপযোগী করা সম্ভব কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে মার্ক্সিস্টরা এই দুজনের সমালোচনা করেছেন। তাই বলা যায় মার্ক্সীয় অ্যাস্থেটিক্সে মডার্নিজমের রাজনীতি বেশ জটিল ও সঙ্গীত সেই জটিলতার দৃষ্টান্ত হয়েছিল।
স্ট্রাকচারালিস্ট মার্ক্সিজম, আলথুজের ও মাশারে
ভূমিকা
ইউরোপের এস্থেটিক্সের ধারাটির সাথে এংলো-আমেরিকান অ্যাস্থেটিক্সের পার্থক্য বড় হয়ে যায় স্ট্রাকচারালিজম ও ডিকনস্ট্রাকশনের ধারণার প্রশ্নে। ইরোরোপের ক্ষেত্রে দর্শন ও সমালোচনাতত্ত্বের প্রভাব বেশি ছিল।
আলথুজের
স্ট্রাকচারালিস্ট মার্ক্সিজমের সূচনা করেন লুই আলথুজার যিনি স্ট্রাকচারালিজমকে মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্সের ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেন। স্ট্রাকচারালিজমের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ ছিল এটায় মানুষের ভূমিকা গৌণ। এখানে মানুষের বদলে স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বমূল্যায়িত সামাজিক গঠনগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে (যেমন রোলাঁ বার্থেস প্রমুখের দ্বারা টেক্সটকে বড় করে দেখে লেখকের মৃত্যু ঘোষণা)। আলথুজারের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় স্ট্রাকচারালিস্ট হওয়ায় তাকে নিয়েও একই সমালোচনা হয়। তার সমাজতত্ত্বেও মানুষকে সার্বভৌম ও মনোলিথিক বা ঐকিক কিছু ব্যবস্থা ও নিয়মের অধীনে মানুষকে কাজ করে যেতে হয়। এই নিয়মগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আদর্শগত বা তত্ত্বগত বিশ্বাস নিয়ে। আলথুজার নিজেও তার দর্শনকে মানবতাবাদবিরোধী বলে ব্যক্তি মানুষের স্বশাসনের ক্ষমতা অস্বীকার করেছেন। আইডিওলজি নিয়ে তার চিন্তা ও তত্ত্বই তার দর্শনের সবচেয়ে উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্য, যার সাথে মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্সেরও সম্পর্ক আছে।
ফর মার্ক্স (১৯৬৫) ও রিডিং ক্যাপিটাল (১৯৬৫) গ্রন্থে তিনি আইডিওলজি ও বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। এখানে আলথুজার মার্ক্সিজমকে আইডিওলজি না বলে বিজ্ঞান বলেছেন। আইডিওলজি তার মতে বিশ্বাসের জগৎ যা সমাজ ও পৃথিবী কিভাবে আজ করে সে সম্পর্কে আংশিক ব্যাখ্যাই দিতে পারে। তার মতে মার্ক্সবাদ সমাজ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেয় বলে তা আদর্শকে ছাড়িয়ে যায়, তাই তা বিজ্ঞান। মার্ক্সবাদ কেবল জ্ঞানের ভাণ্ডার নয়, বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটি নতুন জ্ঞানও তৈরিও করে। তিনি উৎপাদন ব্যবস্থাকেই ভিত্তি হিসেবে মেনে নেন যা উপরিকাঠামোর উপর কর্তৃত্ব করে, তারপরও তিনি সমাজের উপরিতল বা সুপারস্ট্রাকচারের বেশ কিছু ব্যবস্থা ও বিষয়ের স্বশাসনের সম্ভাবনার কথাও বলেন। যেমন শিল্পের সাথে আইডিওলজি ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক। শিল্পকে তিনি আইডিওলজির অংশ মনে করেন না, যদিও তাদের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান। তার মতে প্রকৃত শিল্প (এভারেজ নয়) জ্ঞান প্রদান করেনা, তাই এটি বিজ্ঞানের সমর্থক বা বিকল্প নয়, যদিও বিজ্ঞানের সাথে কিছু বিশেষ সম্পর্ক থাকতে পারে, সেই সম্পর্ক দুয়ের মধ্যে অভিন্ন পর্যায়ের নয়, বরং পার্থক্যের। শিল্প বাস্তবের প্রতি ইঙ্গিত দেয় এমন কিছুর অনুধাবনের জন্য সাহায্য করে। তাই শিল্প যে আইডিওলজি থেকে জন্ম নিয়ে পৃথক হয়েছে তা তার অনুধাবনের উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট।
মাশারে
মার্ক্সবাদে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য কিভাবে আইডিওলজির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে ধারণা দেয় সে সম্পর্কে ফরাসি দার্শনিক পিয়েরে মাসারে ব্যাখ্যা করেন। সতর্ক হয়ে ও মনোযোগ দিয়ে পড়লে আইডিওলজির ভিত্তিতে তৈরি হওয়া পদ্ধতিতে স্ববিরোধিতা পাওয়া যায়। আইডিওলজি নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারেনা, তাই তাকে র্যাডিকেল সমালোচনার মুখাপেক্ষী হতে হয়। মাশারে এই রেডিকেল সমালোচনার ভিত্তি তৈরি করে চেয়েছেন, যার ভিত্তিতে সাহিত্যের টেক্সটের ভেতর প্রবেশ করে সেখানে যে আইডিওলজিকাল কনট্রাডিকশন আছে তা শনাক্ত করা যায়। এই গঠন পদ্ধতিকে তিনি বলেছেন স্বভাবের বিরুদ্ধে পড়া বা রিডিং এগেইনস্ট দ্য গ্রেইন। তার কাছে টেক্সট একই সাথে আইডিওলজির উৎপাদক ও প্রতিফলক। তার মতে লেখকরা সৃষ্টি করেন না উৎপাদন করেন, আর সচেতন হয়ে আইডোলজির কাঁচামাল নতুনভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে এই উৎপাদন সম্ভব হয়। একটি টেক্সট কখনও তাই একা থাকে না, এর পেছনে থাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক গঠন বা ফর্মেশন যার উপর তাকে নির্ভর করতে হয়। এখানে স্মর্তব্য, নিউ ক্রিটিসিজমে টেক্সটে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবেই দেখা হয়েছে যা তার অন্তর্গত উপাদানের সম্পর্কের ভিত্তিতেই পাঠ করতে হবে, পেছনে কি সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান তার ভিত্তিতে নয়।
মাশারের আইডিওলজি থিওরি তার অন্তর্গত কনট্রাডিকশনে খুব জোর দেয়, তার মতে আইডিওলজির উদ্দেশ্যই হল তার ভেতরকার কনট্রাডিকশন ও এসম্পর্কিত যত বিতর্ক তা দূর করা, কনট্রাডিকশনকে লুকিয়ে রাখা। টেক্সটের মূল্য ও তার মাধ্যমে ব্যক্ত অ্যাস্থেটিক ভেল্যুর প্রাসঙ্গিকতা এখানে যে, টেক্সট কনট্রাদিকশনকে যেমন ধারণ করে, প্রকাশও করে। আইডিওলজি যে কনট্রাডিকশনকে লুকিয়ে রাখতে চায় টেক্সট তা বানচাল করে। যেসব সমালোচক টেক্সটের কনটেন্ট ও ফর্ম উপাদানের বাইরে যান তারা এগেইন্সট দ্য গ্রেইন পাঠ করেন। তারা এই কনট্রাডিকশন ও ত্রুটি বিচ্যুতি স্পষ্ট দেখতে পান, ফলে তারা শুধু টেক্সটের সমালোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে আইডিওলজির সমালোচনা করেন। ফলে এস্থেটিক ভেল্যুর বিচারে কোন সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক মানদণ্ড থাকার প্রয়োজন হয় না, এখানে স্ট্রাকচারালিজমের প্রসঙ্গ এসে যায়।
স্ট্রাকচারালিজমে যেমন বলা হয়, এখানেও টেক্সটই লেখকের তুলনায় বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে। মার্ক্সবাদের এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা স্বপ্রতিষ্ঠিত সত্য বলে প্রমাণিত হয় যার সাহায্যে আইডিওলজি সহ অন্যান্য সামাজিক, দার্শনিক তত্ত্ব ঠিক না ভুল তা নিয়ে রায় দেয়া সম্ভব হয়। মাশারের লিটারারি থিওরিটি টেক্সট ও লেখক নিয়ে সরাসরি ও পূর্ণাঙ্গ রায় না দিলেও এর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা সন্দেহাতীত কেননা সাহিত্যের মূল্য এখানেই যে পাঠক এগেইনস্ট দ্য গ্রেইন পাঠ করে বুর্জোয়া আইডিওলজির অন্তঃসারশূন্য্যতা ও কনট্রাডিকশন উপলব্ধি করতে পারে। স্ট্রাকচারালিস্ট মার্ক্সিজম অনুসারে সাহিত্য আইডিওলজিকে যতটা না প্রতিফলিত করে, তার চেয়ে বেশি উৎপাদন করে, স্ববিরোধিতা সহই করে। আইডিওলজির কারণে টেক্সটে যদি কিছু লিখতে অসুবিধা থেকে থাকে সমালোচককে তারও সন্ধান করতে হবে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন সমালোচকদের কর্তব্য হল টেক্সটকে মাশারের ভাষায় ইন্টারোগেট করা, যেন মার্ক্সবাদের বৈরী চরিত্র সামনে এনে তার আইডিওলজির গোপন সূত্র প্রকাশ করে দেয়া যায়।
ইগলটনের সমালোচনা
মার্ক্সবাদ কি শিল্পকে রাজনীতির অধীনস্ত করে? মাশারের তত্ত্ব আবার সেই প্রশ্ন সামনে আনে। সাহিত্যকর্মকে সৃষ্টির বদলে উৎপাদন হিসেবে দেখার ফলে সমালোচনার চর্চার সুবিধা হয়, কিন্তু এক টেক্সটকে অন্য টেক্সটি তুলনার ভিত্তিতে কিভাবে মূল্যায়ন করা যাবে সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, মাশারে এই বিষয়ে খুব আগ্রহীও নন। তার কাছে শিল্প আইডিওলজির ভিত্তিতে উৎপাদিত বস্তু। স্ট্রাকচারালিজমের ঐতিহ্য অনুসারে তিনি এর মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে নির্বিকার। সুতরাং মার্ক্সবাদে শিল্প বিচারের জন্য রাজনীতির আইন বা ল অফ পলিটিক্স তৈরি করা হলেও ল অফ আর্ট তৈরি করার অনুকূল ইন্টেলেকচুয়াল বেসিস তৈরি হয়ে নি। শিল্পের আইন বলতে মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্স যা দিয়েছে তা আসলে ছদ্মবেশে রাজনীতিরই আইন।
ইগলটনের ক্রিটিসিজম এন্ড আইডিওলজি (১৯৭৬) গ্রন্থে মার্ক্সিজম এন্ড এস্থেটিক ভেল্যু বলে যে অধ্যায় আছে সেখানে রাজনীতির আইন আর শিল্পের আইনের মধ্যে সংঘাত স্পষ্ট। ইগলটন সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের অপরিপক্কতা ও ক্রিটিকাল রিয়ালিজমের “হয় এটা, নয় সেটা”-কে নিতে অনিচ্ছুক। কিন্তু তিনি শিল্পের মূল্য সম্পর্কে রায় জানতে চান। বেন জনসনের ক্লাসিকাল হিউম্যানিজম ভিত্তিক কবিতা তার কাছে এজন্য প্রিয় যে সেখানে যুগের মানসিকতা আছে, এখানে আডর্নোর নিও-ক্লাসিসিজম বিরোধী মনোভাব দেখা যায়। কিন্তু এর ভিত্তিতে শিল্পের আইন তৈরি করা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। কোন শিল্পী তার লেখায় স্ববিরোধী ও জটিলতার বিষয় আনলে শিল্পমূল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়, কিন্তু এটা শিল্পের আইন তৈরি করতে পারেনা। শেষে তিনি বলছেন, মার্ক্সিজমে অ্যাস্থেটিক মূল্য নিয়ে যে নীরবতা দেখা যায় তার কারণ এই হতে পারে যে, যে বস্তুগত বাস্তবতার পরিস্থিতিতে এধরণের ডিসকোর্স বা আলোচনা সম্ভব তার অস্তিত্ব এখনও দেখা যাচ্ছে না। তাহলে পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ নিরসন না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে আলোচনা স্থগিত রাখতে হয়, সে পর্যন্ত রাজনীতির আইন দ্বারাই শিল্পের বিচার হবে ও শিল্প রাজনীতির অংশ হয়ে থাকবে। আলথুজার শিল্পের যে তুলনামূলক স্বশাসনের কথা বলছেন, তা মার্ক্সিস্ট এস্থেটিক্সে স্বাধীনতার অভাব নিয়ে ইগলটনের মন্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে।
এতক্ষণ যেসব আলোচনা হয়েছে তার ভিত্তিতে এটা মনে না করে উপায় থাকে না যে অ্যাস্থেটিক মূল্য কেবল রাজনৈতিকভাবেই নির্ধারিত হতে পারে, শিক্ষাদানই যার উদ্দেশ্য। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে এই উদ্দেশ্য বাস্তববাদী, আর তাদের বিরোধীদের মধ্যে মতানৈক্য আছে, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার প্রকল্পে শিল্প যে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এই বিষয়টি দুই দলের কেউই অস্বীকার করে না। এই সংস্কারের জন্য শিল্পীরা কিভাবে দায়িত্ব পালন করবে তাই বিবেচ্য।
মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্সের বিভিন্ন ধারা
২০শ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্সে বেশ কয়েকটা ধারা দেখা যায় –
(১) লুকাচের সাথে ব্রেশ্টের বাস্তবতা নিয়ে বিরোধ দেখা যায়, কারণ ব্রেশ্টের মতে আধুনিকতা দর্শকদের কাছে ১৯ শতকের শিল্প সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ আবেদন রাখতে সক্ষম নয়।
(২) শিল্পকে আইডিওলজি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা যার প্রধান প্রবক্তা টেরি ইগলটন
(৩) সমাজ প্রগতির জন্য রাজনীতির সাথে অ্যাস্থেটিক্সের সংযোগের উপর জোড় দেয়া হয়েছে। হার্বার্ট মারকুজার সৌন্দর্যতত্ত্বে এই ধারণা প্রথম দেখা যায়।
(৪) শিল্পের ফর্ম এর সঙ্গে আদর্শ সমাজকে যোগ করার প্রবণতার প্রতি জোর দেন ক্রিস্টোফার কডওয়েল।
(৫) সৌন্দর্যের মূল্যের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গিওর্জ লুকাচ, যে মূল্য বাস্তবতার ভিত্তিতে নিশ্চিত হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বালজাকের উপন্যাসের বাস্তবতার তুলনায় বেকেট বা কাফকার উপন্যাসের বাতুলতা, যা পুঁজিবাদী সমাজের অবক্ষয়ের ফল।
মার্ক্সিজম বনাম মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্স
মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্স একই সাথে ইন্টেলেকচুয়াল ও প্র্যাক্টিকাল। বিজ্ঞানের মত এটি বিষদ জ্ঞানদান করে না কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসকে রক্ষা বা পতনের জন্য এটি কার্যকর করতে পারে। শিল্পের এই ব্যাখ্যার যথার্থতা ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে মার্ক্সিজমের সত্যতার সঙ্গে জড়িত ও তার উপর নির্ভরশীল। শিল্প সার্বিক মার্ক্সিজমের একটি অংশ যা নিয়ে মার্ক্স ও এঙ্গেলস মাঝেমাঝে তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে মার্ক্সবাদ যা বলে তার প্রেক্ষিতে মার্ক্সীয় শিল্পতত্ত্ব স্পষ্ট হয়। মার্ক্সীয় শিল্পতত্ত্বের সন্ধানে সার্বিক মারক্সিজমের যে মূল কথা, সেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে জানা হলেই পৃথক বিষয় হিসবী মার্ক্সিস্ট এস্থেটিক্সের পরিচয় পাওয়া যায়। মার্ক্সিজম এই হিস্টোরিকাল মেটারিয়ালিজমের সত্যতা মার্ক্সিস্ট এস্থেটিক্সের জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ মার্ক্সিস্ট সামাজিকতত্ত্ব যদি ভুল প্রমাণিত হয়ও তবুও মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্স যে ভুল তা নেসেসারি না, একইভাবে হিস্টোরিয়াল মেটারিয়ালিজম সত্য হলেই যে এটার ভিত্তিতে এই অ্যাস্থেটিক্সও প্রতিষ্ঠিত হবে তাও নেসেসারি না। তাই মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্সকে সার্বিকভাবে গোড়ে তোলা মার্ক্সিজম থেকে আলাদাভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। সমাজতন্ত্রের উত্থান বা পতনের সাথে মার্ক্সীয় অ্যাস্থেটিক্সের গুরুত্ব হ্রাস বা বৃদ্ধি পেলেও তা অপ্রাসঙ্গিক হয়না।
মার্ক্সিস্ট অ্যাস্থেটিক্স ও মার্ক্সিজমের গ্রহণযোগ্যতায় পরিবর্তন, নতুন বৈশ্বিক প্রবণতা
৭০ এর দশকের মাঝামাঝু তার শীর্ষ অবস্থা থেকে অবতরণ করে মার্ক্সিজম বেশ নিষ্ক্রীয়। যেমন, পাশ্চাত্যের গুরুত্বপূর্ণ মার্ক্সিস্ট সমালোচক ফ্রেডারিক জেমিসন মার্ক্সবাদে বিশ্বাস রেখেও ৮০ এর দশক থেকে পোস্টমডার্নিজম ও সিনেমা বিষয় নিয়েই বেশি ব্যস্ত। মার্ক্সবাদী সমালোচনাতত্ত্বের এই অবরোহন আশির দশকে ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের আগেই শুরু হয়। এর উৎসে ছিল বিশ্ব বিপ্লবের সম্ভাবনার সংকোচন ও শেষ পর্যায়ে পেছনে হটে আসার দৃষ্টান্ত। ৭০ এর দশক থেকে মার্ক্সবাদী সমালোচনার অচলাবস্থার সূত্রপাতের কারণ তাই দেখতে পাওয়া যায় প্রথম বিশ্বে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার সংকটে। একই সময় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের অনেক বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন আন্দোলনের মার্ক্সবাদ বিরোধী সমালোচনা (সমকামী, নারীবাদী, বর্ণবাদবিরোধী, পরিবেশবাঈ ইত্যাদি) মার্ক্সবাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস করে। শ্রমিক অভ্যুত্থান, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ১৯৬৮ এর ছাত্র আন্দোলন, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পর যে বিপ্লবী পরিস্থিতির উদ্ভব তার ব্যবহারে মার্ক্সবাদী সংগঠনের তুলনায় এসব বিশেষ বিষয়ভিত্তিক দলের আন্দোলন বেশি করে সুযোগ নেয়। যেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য ও পরাস্তযোগ্য মনে হয়নি, তাই সামগ্রিক তত্ত্ব ও আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ পরিবর্তন নয়, নির্দিষ্ট বিষয়ের ভিত্তিতে সমাজ সংস্কারই কাম্য ও বুদ্ধিমানের মনে হয়েছে। নতুন তত্বকে তাই বস্তুগত ও সার্বিকের পরিবর্তে হতে হয়েছে মেটা ন্যারেটিভ বিরোধী, আংশিক, স্থানীয়, বিষয়গত, নিবর্স্তুক, নান্দনিক ও আত্ম-জৈবনিক। এ পরিবর্তন সত্ত্বেও ও প্রয়োগের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে এলেও অ্যাস্থেটিক্স বা নন্দনতত্ত্বে মার্ক্সবাদী ধারণার যে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক তার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে।
তথ্যঋণ
- সবার জন্য নন্দনতত্ত্ব, হাসনাত আবদুল হাই, সন্দেহ প্রকাশনী, ঢাকা, ফ্রেব্রুয়ারী ২০১৭, পৃ – ৩০৩-১৭
Leave a Reply