ক্ষমতা ও রাজনীতি

রাজনীতির অন্যতম প্রতিপাদ্য হলো ক্ষমতা। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংঘটিত সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে কোন না কোনভাবে ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী কিংবা রাষ্ট্র সকল পর্যায়ে ক্ষমতাই হলো মূলকেন্দ্র (Pivot)। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় তার মৌল দলিল সংবিধান দ্বারা। সংবিধানকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে S.E. Finer (Modern Government) একে ক্ষমতার সম্পর্কের আত্মজীবনী (Autobiography of Power Relationship) বলে উল্লেখ করেন। সংবিধানে ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র তথা সরকার পর্যন্ত সকলে কতখানি ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং এর ভিত্তিতে ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে সবকিছুই সুনির্দিষ্ট থাকে। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তাই ক্ষমতার কর্তৃত্বমূলক বণ্টন ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তার অনুসৃত আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে ক্ষমতা অর্জনের জন্য। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে সরকার আইন প্রণয়ন করে, তার ব্যাখ্যা করে এবং বাস্তবায়ন করে। এসব কাজের ভিত্তি হলো ক্ষমতা। রাষ্ট্রে অনিয়ম দূর করা বা বিশৃঙ্খলা রোধে সরকার বলপ্রয়োগ করে অথবা বলপ্রয়োগের হুমকি দেয়, যার উৎস হলো ক্ষমতা। সব ক্ষেত্রে না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক সম্পর্কের অন্যতম উপাদান হলো ক্ষমতা।

ক্ষমতার সংজ্ঞা

ক্ষমতা হলো সমাজে এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা অন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সমাজের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য।

  • Max Weber-এর মতে ক্ষমতা হলো “The chance of a man or a number of men to realize their own will in a communal action even against the resistance of others who are participating in the action.” (Cited in M. Haralambos and Rafin Heald Sociology: Thems and Perspective, Delhi, 1980, p-98.)
  • একজন ব্যক্তির পক্ষে একা ক্ষমতাবান হওয়া সম্ভব নয়। ব্যক্তি ক্ষমতাশালী হয় দলগতভাবে বা অন্যের সমর্থন নিয়ে। ব্যক্তির সাথে সমাজের অপরাপর ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক কেমন হবে তা নির্ভর করে তার ক্ষমতার উপর। সমাজে কারো হাতে ক্ষমতা থাকে কারো হাতে থাকে না। একজন ব্যক্তির ক্ষমতার মাত্রা সমাজের অন্যরা তার ইচ্ছাকে কতটা মেনে নেয় বা প্রাধান্য দেয় তার উপর নির্ভরশীল। কাজেই ক্ষমতা হলো সামাজিক সম্পর্কের একটি দিক। “Power is therefore an aspect of social relationship.” (Ibid, p-98.)
  • “ক্ষমতা হ’ল সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এবং ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা – লোকেরা যেভাবে আচরণ করে তা প্রভাবিত করা এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমাজের সংস্থানগুলিকে (resources) একত্রিত ও বরাদ্দ করা।” (R.C. Federico, Sociology, 1979, p-462)
  • Tom Bottomore ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, “The ability of an individual or a social group to pursue a course of action (to make and implement decisions, and more broadly to determine the agenda for decision making) if necessary against the interests, and even against the opposition, of other individuals and groups. ” (Tom Bottomore, Political Sociology, 1979, London, p-1.)
  • A. K. Mukhopadhya তার ‘Political Sociology’ গ্রন্থে ক্ষমতার সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন এভাবে, “Power, thus, is the capacity to affect others behaviour by the use or the threat of the use of positive or negative sanctions. Positive sanction in the form of a promise of reward, however, may in some cases get transformed into a negative sanction” (p-30)।

রাজনৈতিক ক্ষমতা (Political Power)

শাস্তি আরোপের অথবা পুরস্কার প্রদানের ক্ষমতা প্রধানত রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে থাকে। অন্যকথায় যারা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে বা পরিচালনায় থাকে তাদের হাতে এ ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। সমাজের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এ ক্ষমতার ব্যাপ্তি। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষমতার বিবেচনায় সরকার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ক্ষমতার কর্তৃত্বমূলক বণ্টন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, দেশের সংবিধান বিধিসম্মতভাবে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সরকারের তিনটি শাখা বা অঙ্গকে ক্ষমতা বণ্টন করে দেয়। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ বা চর্চা করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ ক্ষমতার বৈধতা থাকে পুরোপুরি। একনায়কতন্ত্রে তা Coercion বা বলপ্রয়োগের পর্যায়ে চলে যায়। তবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়া হয়ে থাকে। সাধারণভাবে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের ক্ষমতাকে কর্তৃত্ব পর্যায়ে ফেলা যায়। কাজেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বলতে আমরা সরকারের বৈধ কর্তৃত্ব, জনগণের ক্ষমতা, জন প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত আইনসভার ক্ষমতাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক বা সরকারি প্রতিষ্ঠানাদিতে কর্মরত অধস্তনদের উপর বৈধ কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতাকে বুঝতে পারি। কাজেই ক্ষমতা হলো নিজের স্বার্থের অনুকূলে অন্যের আচরণ, কাজ বা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য।

ক্ষমতার প্রকারভেদ

ব্যক্তি হতে শুরু করে গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সকল ক্ষেত্রে মানুষ ক্ষমতার চর্চারত। ব্যক্তিগতভাবে বা দলগতভাবে ব্যক্তি বিশেষ করে সরকারের কাজ ও সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার চেষ্টারত। ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতা চর্চার সুযোগ কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নেই বললেই চলে। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি কোন সরকারি দপ্তরে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা প্রাপ্ত হতে পারে।

বিভিন্ন গোষ্ঠী আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করে। বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক দলীয় প্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠীগুলো তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাব পৌঁছানো ও চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারে। আবার বিভিন্ন গোষ্ঠী সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় বা প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে সরকারের সিদ্ধান্তকে যেমন প্রভাবিত করতে পারে তেমনি চাপ সৃষ্টি বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমেও ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, যেমনঃ শ্রমিক সংঘ, স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর আইনসভায় প্রতিনিধি নির্বাচন। আবার, লবিং এর মাধ্যমেও সরকারি সিদ্ধান্তকে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারে। এ বিচারে ক্ষমতার নিম্নরূপ শ্রেণী বিভাজন করা যেতে পারে। R.C. Federico তার ‘Sociology (1979)’ গ্রন্থে এটি দেখিয়েছেন:

The Types of Power

এখানে,

  • Power (ক্ষমতা)
  • Formal (আনুষ্ঠানিক)
  • Authority (কর্তৃত্ব)
  • Informal (অনানুষ্ঠানিক)
  • Influence (প্রভাব)
  • Coercion (বলপ্রয়োগ)
  • Legal (আইনগত)
  • Traditional (সনাতন)
  • Charismatic (সম্মোহনী)

১। কর্তৃত্ব (Authority): বিধিসম্মত বা বৈধ ক্ষমতাকে কর্তৃত্ব বলে। অর্থাৎ বৈধ প্রন্থায় প্রাপ্ত ক্ষমতাকে কর্তৃত্ব বলে। “Power that is regarded as legitimate by those whom it effects.” (Federico, Sociology p-462), যে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা চর্চার বিষয়টি সমাজের মানুষ মেনে নিয়েছে কিংবা তার প্রতি আনুগত্য দেখায় সে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, বা প্রতিষ্ঠানের এমন ক্ষমতাকে কর্তৃত্ব বলা হয়।

  • “Authority is that form of power which is accepted as legitimate, that is, as right, and just, and therefore obeyed on that basis.” (Federico)
  • “Authority, therefore, is a special kind of power; power when legitimised, gives rise to authority.” (Amal Kumar Mukhopadhya, Political Sociology, 1997, p-60.)
  • “Authority is the faculty of inducing assent. To follow an authority is a voluntary act. Authority ends where voluntary assent ends.” (S.N. Eisenstadt, “Bureaucracy, Bureaucratization, and Debureaucratisation” in A. Etzioni (ed) A Sociological Reader on Complex Organisations, Hold, Rinehart and Winston, Inc. . 1969, p-305.)

সমাজের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কর্তৃত্বের অস্তিত্ব বিদ্যমান, যদিও রাজনীতির ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব বেশি দৃশ্যমান ও আলোচিত হয়। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি ছাড়া একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হতে পারে না। আর রাজনৈতিক ক্ষমতা যতক্ষণ না বৈধ কর্তৃত্বে রূপলাভ করছে ততক্ষণ রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈধতা আসে না। একজন ব্যক্তির ক্ষমতা ব্যবহারের সামর্থ্য-থাকতে পারে, কিন্তু তার ক্ষমতা ব্যবহারের অধিকারই তার ক্ষমতাকে বৈধতা দান করে। আর তখনই তা হয় কর্তৃত্ব। তবে কর্তৃত্ব ব্যবহারের অধিকার থাকাই যথেষ্ট নয়, সাথে সাথে অন্যদের আনুগত্য থাকতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার পার্থক্য হলো এই যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা অবশ্যম্ভাবীভাবে কর্তৃত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট, অন্যদিকে সামাজিক ক্ষেত্রে তা নয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ছাড়া ক্ষমতা দেখা যায় না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈধ ক্ষমতাই কর্তৃত্ব। আর এ কর্তৃত্ব হলো কোন বিধি- নিষেধ আরোপের মাধ্যমে অথবা আরোপের ভয় দেখিয়ে অন্যের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করা, তবে বিধি বা নিষেধ দণ্ড আরোপের বিষয়টি অত্যাবশ্যক নয়, যেহেতু কর্তৃত্বের বিষয়টি আনুগত্যের সাথে জড়িত। “Authority thus, may be defined as the recognised right to exercise power irrespective of the sanctions the power holder is able to apply.” (Mukhopadya. p-61) কর্তৃত্ব শুধু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিষয় নয়, এ ছাড়াও কর্তৃত্ব রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, যেমন: একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী তার অযোগ্য কর্মচারীকে ছাঁটাই করতে পারে।

কর্তৃত্বের প্রকারভেদ : Max Weber তিন ধরনের কর্তৃত্ব চিহ্নিত করেছেন। (Max Weber, The Theory of Social and Economic Organisations, ed. Talcott Parson, New York, 1966, p-328.)

  • (ক) সনাতন কর্তৃত্ব (Traditional authority): এটি প্রতিষ্ঠিত সামাজিক প্রথা বা রীতিনীতি ভিত্তিক কর্তৃত্ব। “The right to power results from reverence for the old established patterns of order.” (Mukhopadya, p-63)। অর্থাৎ সমাজে প্রতিষ্ঠিত পুরোনো প্রথাভিত্তিক কর্তৃত্ব যার প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ ও আনুগত্য রয়েছে এবং জনগণ প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যের পবিত্রতায় বিশ্বাস করে। যেমনঃ উপজাতীয় রাজা, ব্রিটেনের রাজা। “Hence the obligation of obedience is not based on the impersonal order, but a matter of personal loyalty within the area of accustomed obligation.”
  • (খ) বিধিবদ্ধ/আইনগত কর্তৃত্ব (Legal authority): এটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-নীতি নির্ভর কর্তৃত্ব। বৈধ রাজনৈতিক বা অন্য ক্ষমতা বলতে যা বোঝায় তাই আইনগত কর্তৃত্ব। এ কর্তৃত্বের বৈধতা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্ট নিয়ম-নীতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোন দপ্তর হতে পাওয়া যায়, যা অধিকার ও দায়িত্ব হতে উৎসারিত; যেমন- একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত কোন দপ্তর প্রধানের কর্তৃত্ব। এ ক্ষেত্রে অন্যদের আনুগত্য কোন ব্যক্তির প্রতি নয় বরং বিধিসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রতি প্রদর্শিত হয়। “It extents to the persons exercising the authority of office under it only by virtue of the formal legality of their commands and only within the people of authority of the office.” (Weber) যেমন: দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা কোন দপ্তর প্রধানের কর্তৃত্ব।
  • (গ) সম্মোহনী কর্তৃত্ব (Charismatic authority): এটি অসাধারণ ব্যক্তিগত গুণসম্পন্ন কর্তৃত্ব যা সনাতন প্রথা বা আইনসঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। সম্মোহনী নেতাগণ তাদের অসাধারণ নেতৃত্বের গুণাবলি দ্বারা জনগণকে প্রভাবিত করেন (ঐক্যবদ্ধ করেন) ও তাদের আনুগত্য অর্জন করেন।) “It is the charismatically qualified leader as such who is obeyed by virtue of personal trust in him and his revelation, his heroism and or his exemplary qualities so far as they fall whithin the scope of the individual’s belief in his charisma.” (Weber) যেমন: মার্টিন লুথার কিং, ফিডেল ক্যাষ্ট্রো, মহাত্মা গান্ধী, শেখ মজিবুর রহমান। সম্মোহনী ক্ষমতার উদ্ভব ঘটে নেতার সাথে মানুষের বন্ধন ও তার প্রতি বিশ্বাস হতে। এ জন্য সম্মোহনী কর্তৃত্ব খুবই শক্তিশালী, একই সাথে ক্ষণস্থায়ী।

এটি স্পষ্ট যে, আইনগত কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য হলো নৈর্ব্যক্তিক ব্যবস্থার প্রতি, অন্যদিকে সনাতন ও সম্মোহনী কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য হলো সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। আইনগত কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তির দপ্তর থাকে যা নির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতে চলে এবং বৈধতা পায় বলে এর স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত। এটি সুব্যবস্থিত থাকে, ব্যক্তির কাজের সমালোচনা বা বৈধতার প্রশ্ন এ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে না। যেমন: প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সমালোচনার কারণে তার দপ্তরের স্থায়িত্ব কিংবা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় কোন প্রভাব পড়ে না।

২। প্রভাব (Influence): প্রভাব হলো অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতা যা শক্তি বা আইনগত অবস্থানের (Position) উপর নির্ভর করে না। এটি ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত। প্রভাব হতে পারে ব্যক্তির আকর্ষণ বা মনোহারিত্ব (Charm), সম্পদ, শক্তি, অন্যকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য, জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা বা অন্য কোন ব্যক্তিগত গুণের ভিত্তিতে অন্যের আচরণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। কোন ব্যক্তি; গোষ্ঠী কোন আনুষ্ঠানিক পদ বা অবস্থানে না থেকেও সংগঠনে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা চর্চা করতে পারে; যেমন: উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দুর্বলতার সুযোগে সামরিক বাহিনী বেসামরিক প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, বা সেনাবাহিনীর নিম্ন পদের অফিসারগণ তাদের দৈনন্দিন কাজের সুবাদে অধিনস্ত ইউনিটের সাথে ঘনিষ্ঠ থাকার কারণে উচ্চ পর্যায়ের অফিসারদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আবার সমাজের এলিট শ্রেণীর সদস্যগণ কোন আনুষ্ঠানিক পদে না থেকেও সমাজ এমনকি সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারেন। সুতরাং প্রভাব হলো সে অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতা যা দ্বারা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যের আচরণ বা সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। প্রভাব বলতে অন্যের আচরণকে প্রভাবিত ‘করার ক্ষমতাকে বোঝায়। “Influence is a person’s capacity to affect other’s behaviour in a way willed by the former it involves an interaction, be that interrelation between individuals, groups, associations, organisation or state. Secondly, the intentions of the actor influencing are highly important for establishing a relation of influence.” (Mukhopadhya p-27)। ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানের কারণে সমাজে তার একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এটি হতে পারে সামাজিক অবস্থান, কিংবা অর্থ-প্রতিপত্তির কারণে। অর্থ-প্রতিপত্তি বা সামাজিক অবস্থানের কারণে তার সাথে অন্যদের সামাজিক সম্পর্ক এমনভাবে গড়ে ওঠে যে, সে প্রায় সকল বিষয়ে অন্যের আচরণ ও কর্মকে প্রভাবিত করতে পারে। এ প্রভাব তার নিজ স্বার্থে যেমন হতে পারে, তেমনি জনগণের কল্যাণেও হতে পারে। সমাজে ব্যক্তির প্রভাব থাকবে কি থাকবে না কিংবা কতখানি থাকবে তা অনেকটা তার অভিপ্রায়ের উপরও নির্ভর করে। প্রতিপত্তির সাথে সাথে তার অভিপ্রায়ের সমন্বয় সাধন জরুরি। আর একজন ব্যক্তির প্রতিপত্তির ভিত্তি হতে পারে অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা বা প্রজ্ঞা, যেগুলোর কারণে সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়। গ্রহণযোগ্যতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা না থাকলে অন্যের আচরণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা থাকলেও তা সব সময় সফল হয় না বা হতে পারে না। সমাজে ব্যক্তির দু’ধরনের প্রভাব থাকতে পারে; যথা: প্রকৃত প্রভাব ও কার্যকর প্রভাব (Actual and Potential Influence)। ব্যক্তির কার্যকর প্রভাব নির্ভর করে তার অর্থ-প্রতিপত্তির পরিমাণ এবং তা ব্যবহারে তার দক্ষতার উপর। অন্যদিকে তার প্রকৃত প্রভাব কম হতে পারে যদি ব্যক্তি প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে তার অর্থ-প্রতিপত্তির পূর্ণ ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়। আবার সামাজিক সম্পদ (অর্থ-প্রতিপত্তি ইত্যাদি) যেহেতু সমানভাবে সবার থাকে না তাই ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে প্রভাবও কম-বেশি হয়। কোন ব্যক্তির প্রভাব পরিমাপ করা যেতে পারে তিনটি বিষয় যাচাই এর দ্বারা:

  • (ক) মাত্রা (Weight);
  • (খ) এলাকা (Domain) এবং
  • (গ) পরিধি (Scope)

“The weight of influence is the degree to which policies are affected; the domain of influence, the persons whose policies are affected; the scope of influence, the values implicated in the policies.” (Harold Lasswell and Abraham Kaplan, Power and Society, New Haven, 1961, p-73.) অর্থাৎ প্রভাবের মাত্রা বলতে বোঝায় ব্যক্তি অন্যের আচরণ বা নীতিকে কতখানি প্রভাবিত করতে পারে তা। অন্যকথায়, অন্যের আচরণ বা নীতির উপর ব্যক্তির প্রভাবের গভীরতাকে বোঝায়। এলাকা বলতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কতজনকে প্রভাবিত করতে পারে তা বোঝায়। পরিধি বা Scope বলতে ব্যক্তি কতকগুলো বিষয়কে প্রভাবিত করে তা বোঝায়। কোন এক ব্যক্তি এক হাজার লোককে প্রভাবিত করতে পারে, অন্য ব্যক্তি পাঁচ শত লোককে প্রভাবিত করে। কিন্তু প্রথম ব্যক্তি যে কয়টি বিষয়কে প্রভাবিত করে দ্বিতীয় ব্যক্তি তার চেয়ে অধিক বিষয়কে প্রভাবিত করে। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বেশি প্রভাবশালী বলা হবে। অর্থাৎ প্রভাবের Scope বলতে ক্ষেত্রকে বোঝায়। যে ব্যক্তি অধিক সংখ্যক বিষয়কে প্রভাবিত করে তার প্রভাব পরিধি বেশি। আবার, এক ব্যক্তি জনগণের সামাজিক বিষয়কে প্রভাবিত করে, দ্বিতীয় ব্যক্তি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়কে প্রভাবিত করে। কাজেই দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রভাব পরিধি বেশি।

৩। শক্তি/বলপ্রয়োগ (Coercion): বলপ্রয়োগ হলো “Power (specially the use of force) that is regarded as illegitimate by those whom it affect.” (Federico p-462)। বল/ চাপপ্রয়োগ করেও নিজের স্বার্থের অনুকূলে অন্যের মতামত, আচরণ বা নীতিকে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু যাদের উপর বলপ্রয়োগ করা হয় তারা এটিকে অনুমোদন করে না। কর্তৃত্ব যাদের উপর প্রয়োগ করা হয় তারা তা মেনে নেয় বা অনুমোদন করে। প্রভাব ব্যক্তির নিজস্ব গুণাবলির ক্ষমতা, কিন্তু বল/চাপ অনুমোদিত ক্ষমতাও নয়। এ ক্ষমতার চর্চা শুধুই বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। “Coercion is that form of power which is not regarded as legitimate by those subject to it.” (Haralambos, p-98)

ক্ষমতার উৎস

ক্ষমতা, হোক তা কর্তৃত্ব, প্রভাব বা শক্তি/চাপ, রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ক্ষমতার কারণে সমাজে বা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে-ক্ষমতার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক কেমন হবে তা নির্ভর করে ক্ষমতার উপর। আর ক্ষমতার পেছনে কিছু উৎস থাকে। সমাজের জনগণ কোন ব্যক্তির প্রতি অনুগত থাকতে পারে কিছু পাবার আশায়, ভিতির কারণে কিংবা ঐ ব্যক্তির ব্যক্তিগত গুণাবলির কারণে তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে। সামাজিক সম্পদ (Social Resources) যেহেতু সমাজে সমভাবে বণ্টিত হয় না, সবাই ক্ষমতাবান হয় না বা সবার ক্ষমতা সমান হয় না। কাজেই সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষমতার একটি অন্যতম উৎস। আবার জাতিগত বিচারে কোন জাতি ক্ষমতাবান হতে পারে শক্তিশালী অর্থনীতি, সামরিক শক্তি, কুটনৈতিক শক্তি ইত্যাদির কারণেও। Ronald C. Federico তার ‘Sociology’ গ্রন্থে (pp 464 466) দু’টি উৎসের কথা উল্লেখ করেন: (ক) পুরস্কার ও শাস্তির উপর নিয়ন্ত্রণ (Control of Reward and Punishment); (খ) ব্যক্তিগত গুণাবলি (Personal Qualities: Expertise and referent ability)। দু’টি ধারায় আমরা ক্ষমতার উৎসকে ভাগ করতে পারি।

১। সমাজ অভ্যন্তরীণ (Intra Societal):

  • (ক) অর্থ ও সামাজিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ (Control on wealth and social resources),
  • (খ) পুরস্কার ও শাস্তির উপর নিয়ন্ত্রণ (Control of Reward and Punishment);
  • (গ) ব্যক্তিগত গুণাবলি (Personal Qualities);
  • (ঘ) গোষ্ঠী সংহতি (Group Integrity);
  • (ঙ) সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের মাত্রা (Frequency of participation in decision making process)।

২। বহিঃসামাজিক (Extra Societal)/বিশ্ব পরিমণ্ডলেও

  • (ক) সামরিক শক্তি (Military power);
  • (খ) অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic Development) এবং
  • (গ) কূটনৈতিক দক্ষতা (Diplomatic Efficiency)।

১। অর্থ ও সামাজিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ (Control of Wealth and Social Resources): সমাজের কোন ব্যক্তি বা পরিবার সমাজের অন্যদের মতামত বা আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি সম্ভব হয় উক্ত ব্যক্তি বা পরিবার অর্থ-সম্পদ, প্রতিপত্তি ইত্যাদির অধিকারী হয়। উন্নয়নশীল দেশে যদি গ্রামীণ এলাকায় এখনো সামাজিক মর্যাদা ও ভূমিকা নির্ধারিত হয় পারিবারিক বা সামাজিক পরিচিতি ও অর্থ- সম্পদের মালিকানার ভিত্তিতে। গ্রাম পঞ্চায়েত, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনে এ বিষয়গুলোর বিশেষ প্রভাব রয়েছে। স্থানীয় সরকার বা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারে সমাজের এলিটগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। জাতীয় রাজনীতিতেও সম্পদশালীগণ বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আইনসভার সদস্য নির্বাচনে সব গণতান্ত্রিক দেশেই সম্পদশালীগণ অধিক হারে অংশগ্রহণ করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেন- কখনো প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে আবার কখনো চাপ সৃষ্টি করে।

১২। পুরস্কার ও শাস্তির উপর নিয়ন্ত্রণ (Control of Reward and Punishment) : পুরস্কার ও শাস্তির ভয় ক্ষমতার অন্যতম দুটি উপাদান। কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ পুরস্কার প্রদান ও শাস্তি প্রদানের অধিকারী হলে অন্যরা তার আদেশ মান্য করে, তার প্রতি অনুগত থাকে। অর্থাৎ সে ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ অন্যদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করতে পারে। Federico বলেন, “Award is what they want or enabling them to avoid what they do not want. Conversely, punishment is preventing other from getting what they want or injuring them physically or psychologically,” (Federico, p-465)। রবার্ট ডল যেমন বলেন যে, ক্ষমতার সাথে শাস্তি আরোপের (Sanction) বিষয়টি সম্পর্কিত। একটি কোম্পানি বা সংস্থার কর্তৃপক্ষের সে কোম্পানির শ্রমিকদের/কর্মচারীদের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে কারণ সে কর্তৃপক্ষের হাতে শ্রমিকদের মজুরি দেয়া বা শাস্তি দেয়ার বৈধ ক্ষমতা রয়েছে। (যেমন: চাকরিচ্যুতি), ফলে কর্তৃপক্ষ শ্রমিক কর্মচারীদেরকে কোম্পানির স্বার্থে ও প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে। অর্থাৎ তাদের কাজ ও আচরণকে প্রভাবিত করে। একটি দেশের সরকার বৈধ ক্ষমতার অধিকারী। দেশের সুষ্ঠু পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতি অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকার সুবাদে সরকার বলপ্রয়োগ (শাস্তি আরোপ) বা প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণ ও কাজকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারে। বৈধ ক্ষমতা না থাকলেও অনেক সময় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী চাপপ্রয়োগে (আন্দোলন বা আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে) সরকারের নীতি বা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে; যেমন: রাজনৈতিক দল বা স্বার্থ গোষ্ঠী। চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি আদায়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার দ্বারা তাদের স্বার্থের অনুকূলে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে ক্ষমতা চর্চার সফলতর ও কার্যকরী উপায় হলো পুরস্কারের মাধ্যমে জনগণের আচরণকে প্রভাবিত করা। বলপ্রয়োগ বা শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে জনগণকে প্রভাবিত করা যায়, তবে জনগণ শাস্তি এড়াতে বিকল্প হিসেবে আনুগত্য দেখায়। এ বিবেচনায় শাস্তি প্রদানকে নেতিবাচক উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পুরস্কার অন্যের আচরণে অনেক বেশি স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম। সাধারণভাবে এটি আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্বের প্রতি নির্দেশ করে।

৩। ব্যক্তিগত গুণাবলি (Personal Quality): পুরস্কার ও শাস্তির নিয়ন্ত্রণ আনুষ্ঠানিক ক্ষমতার নির্দেশ করে, যেটি কোন না কোন দপ্তরের (সরকারি বা বেসরকারি) সাথে সংশ্লিষ্ট। ক্ষমতার এ উৎসটি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট। কোন দপ্তরে কর্মরত ব্যক্তি বিশেষ ক্ষেত্রে তার বিশেষায়িত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার কারণে অন্যদের চেয়ে বেশি ক্ষমতা চর্চার সুযোগ পেতে পারেন। তার এ ব্যক্তিগত গুণের দ্বারা তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্যদের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারেন। আবার আনুষ্ঠানিক কোন দপ্তরে সংশ্লিষ্ট না থেকেও বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতার কারণে কোন ব্যক্তি অন্যের মতামত বা আচরণকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ আমরা ডাক্তার, প্রকৌশলী বা আইনজীবীদের পরামর্শের কথা উল্লেখ করতে পারি। তারা অন্যকে তাদের পরামর্শ মানতে বাধ্য করতে পারেন না, কিন্তু বিশেষায়িত জ্ঞান দ্বারা অন্যের ইচ্ছাকে নির্দিষ্ট দিকে চালিত করায় প্রভাবিত করতে পারেন। “A power holder may have his outstanding skill as his power base. Sometimes power itself may be a power base. Power over one issue-area may often serve as a good base for extending power to other issue-areas.” (Mukhopadya, p. 37.). Referent ability বলতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সে গুণকে বোঝায় যার দ্বারা অন্যরা তার সাথে একাত্ম হতে এবং তার অনুসারী হতে উদ্বুদ্ধ হয়। এটি অন্যের আচরণকে নিজের মত রূপ দিতে পারার সামর্থ্য, যার কারণে অন্যরা তাকে খুশি করতে বা নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার পরামর্শ পেতে আগ্রহী হয়। সম্মোহনী নেতাগণ এ ক্ষমতার অধিকারী যার দ্বারা তারা জনগণকে নির্দেশনা দেন, ঐক্যবদ্ধ রাখেন এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করায় জনগণকে চালিত করেন।

৪। গোষ্ঠী সংহতি (Group Coercion): সমাজে বা একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোন একটি গোষ্ঠী তাদের অভ্যন্তরীণ সংহতির কারণে সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং অন্যকে প্রভাবিত করার সাথে সাথে সরকারের সিদ্ধান্তকে নিজ স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারে; যেমনঃ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র নিজেদের সাংগঠনিক ঐক্য ও সংহতির কারণে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে থাকে। এসব দেশে রাজনৈতিক এলিট ও রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতার সুযোগে স্বার্থ গোষ্ঠী হিসেবে বেসামরিক আমলাতন্ত্র তাদের অভিজ্ঞতা, বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। আবার বেসামরিক কর্তৃপক্ষের বা এলিটদের অতিমাত্রায় সামরিক বাহিনী নির্ভরতা সামরিক আমলাদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ফলে সামরিক বাহিনী তাদের গোষ্ঠী স্বার্থ সিদ্ধিতে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে এবং অনেক সময় তাদের স্বার্থের অনুকূলে প্রতিরক্ষা নীতি গ্রহণ বা বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধিতে চাপ সৃষ্টি করে। একটি সুসংগঠিত গোষ্ঠী হিসেবে সামরিক বাহিনী এ ক্ষমতা (প্রভাব) চর্চার সুযোগ পায়। দেশে শান্তি বজায় রাখা, সহিংসতা রোধ ইত্যাদি কাজে সামরিক বাহিনী সরকারকে সাহায্য করে এবং তাদের বিশেষ দক্ষতা বা সামর্থ্যের কারণে সরকারকে প্রভাবিত করতে পারে।

৫। সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের মাত্রা (Participation Level in Decision Making) : ক্ষমতা অনেক সময় ক্ষমতা বৃদ্ধির উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়। কোন ব্যক্তি তার প্রজ্ঞা ও দক্ষতার কারণে অধিক হারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। ব্যক্তি যতবেশি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় ততবেশি তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। ফলে আরো বেশি মাত্রায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং তার ক্ষমতা চর্চার পরিধি বিস্তৃত হয়।

৬। সামরিক শক্তি (Military Force) : একটি জাতির ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বা অন্যান্য জাতির উপর প্রাধান্য বিস্তার করার ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি একটি বিশেষ উৎস হিসেবে কাজ করে। পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে পরাশক্তিগুলো ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আসছে দ্বিতীয বিশ্ব যুদ্ধত্তোরকাল হতে। সামরিক শক্তির সুবাদে এসব শক্তিশালী রাষ্ট্র বিভিন্ন জোটের মাধ্যমে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্রনীতি, সামরিক নীতি, প্রতিরক্ষা নীতি এসব কিছুকে প্রভাবিত করে আসছে।

৭। অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic Development): আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলনামূলক ক্ষমতার বিষয়টি স্পষ্ট। বিশ্বের সব জাতি সমান ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালী নয়। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি জাতিকে অন্যান্য জাতির তুলনায় বেশি প্রভাবশালী করে তুলতে পারে যার দ্বারা সে অন্যান্য জাতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। যেমন দেখা যায় দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর একটা নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। উন্নত দেশের উপর নির্ভরশীলতার কারণে উন্নয়নশীল দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এসব দাতা দেশগুলোর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বের মোট সম্পদের অধিকাংশের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকার সুবাদে দাতা দেশগুলো তাদের স্বার্থের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাধ্য করে।

৮। কূটনৈতিক দক্ষতা (Diplomatic Efficiency): অপরাপর রাষ্ট্রগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে জাতীয় শক্তি বা ক্ষমতা চর্চার অন্য একটি মাধ্যম হলো কূটনৈতিক দক্ষতা। কূটনৈতিক দক্ষতা ও তৎপরতার গুণে সামরিক বা অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশও অন্য দেশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।

ক্ষমতা বণ্টন (Distribution of Power)

সমাজ হলো বিভিন্ন ক্ষমতার সম্পর্কের জটিল জাল-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি। তবে সমাজ অভ্যন্তরে সকল ক্ষমতার উর্ধ্বে ও সকল ক্ষমতার উপর প্রাধান্য বিস্তারকারী ক্ষমতা হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা। রাজনৈতিক ক্ষমতা অন্যান্য ক্ষমতা সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ সমাজের মূল চালিকাশক্তি ও কেন্দ্র (Pivot) হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা। রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য যেমন ক্ষমতা তেমনি রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনা আবর্তিত হয় ক্ষমতার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে ঘিরে। কাজেই ক্ষমতার বণ্টন বলতে রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টনকেই বোঝায়। সমাজে সম্পদ যেমন সমবণ্টিত নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতাও সমভাবে বণ্টিত হয় না। সব সমাজেই ক্ষমতা কতিপয় ব্যক্তিবর্গের হাতে কুক্ষিগত থাকে। যাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত থাকে তারা হলো এলিট। তবে কারো কারো মতে ক্ষমতার কেন্দ্র একক নয়, বরং ক্ষমতা বহুকেন্দ্রিক। ক্ষমতা বণ্টনের ব্যাখ্যা দু’টি দৃষ্টিভঙ্গিতে করা যায়:

(ক) কেন্দ্রাবর্তনী তত্ত্ব (Centralist Theory) : ক্ষমতা সমাজের উচ্চস্তরের কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। যাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে তাদের সামাজিক পটভূমির বিচারে দু’টি তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে- (অ) মার্ক্সবাদী তত্ত্ব (Marxist view) এবং (আ) এলিটবাদ (Elitist View)

(অ) মার্ক্সবাদী তত্ত্ব (Marxist view): মার্ক্সের মতে উৎপাদন উপকরণের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে সে পুঁজিপতি শ্রেণী সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাদের স্বার্থ রক্ষা ও সমুন্নত করায় নিয়োজিত থাকে সর্বক্ষণ। মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে, পুঁজিবাদ কখনো অল্প কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের স্বার্থ রক্ষা করে না। অর্থ যেহেতু সমাজের মূল চালিকাশক্তি মার্ক্সবাদীগণ মনে করেন যে, অর্থের নিয়ন্ত্রণ দ্বারা পুঁজিপতি শ্রেণী সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সমাজে প্রাধান্য বিস্তারকারী একটি শ্রেণী অন্যদের স্বার্থের বিনিময়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে। এ শ্রেণী নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ক্ষমতা ব্যবহার করে, যে স্বার্থ অন্যদের স্বার্থের সাথে প্রত্যক্ষ দ্বান্দ্বিক অবস্থানে বিরাজ করে। মার্ক্সবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, সমাজে ক্ষমতার উৎস হলো অর্থনৈতিক কাঠামো। সব সমাজেই উৎপাদন শক্তি (Forces of production-Land, Labour, Money, Machine, Raw materials) একটি ছোট শাসকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ নিয়ন্ত্রণ উক্ত শ্রেণীকে প্রাধান্য এনে দেয়। ছোট এ গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতা ব্যবহার করে যা অবৈধ, যাকে কর্তৃত্ব না বলে Coercion বলে অভিহিত করে মার্ক্সবাদীগণ। কারণ এ ক্ষমতা চর্চা হয় জনগণের স্বার্থ পরিপন্থীভাবে।

মার্ক্স বলেন, সব সমাজে রাজনৈতিক ক্ষমতা অসমভাবে বণ্টিত হয়। এখানে অর্থশালী একটি শ্রেণী (যার হাতে উৎপাদন শক্তি) উৎপাদন উপকরণের নিয়ন্ত্রণ থাকে, তারা অন্যান্য অধিন্যস্ত শ্রেণীগুলোর উপর ক্ষমতা চর্চা করে। শাসকশ্রেণী রাজনৈতিকভাবে প্রাধান্য বিস্তারকারী কারণ অধিকাংশ উৎপাদন উপকরণ তাদের দখলে। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে সামরিক শক্তিও তাদের নিয়ন্ত্রণে। মার্ক্স ক্ষমতা বণ্টনের এ ধারাকে অপরিবর্তনীয় মনে করেন না। এক শ্রেণীর এক চেটিয়া প্রাধান্য এবং অন্যদের বঞ্চনার কারণে সমাজে সবসময় শাসক (শোষক) ও শাসিতের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বাবস্থা বিরাজমান। ফলে সমাজে মেরুকরণ হতে বাধ্য-ধনী ও দরিদ্র বা সর্বহারা। দু’মেরুর দ্বন্দ্বে সমাজে সংঘাত অনিবার্য। বৃহত্তর সর্বহারাশ্রেণী ধনিকশ্রেণীকে হটিয়ে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে এবং রাষ্ট্র পরিচালিত হবে জনগণের স্বার্থে, অর্থাৎ বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর স্বার্থে ক্ষমতা ব্যবহৃত হবে। প্রাথমিকভাবে সর্বহারাগণ দলীয় সংগঠনের মাধ্যমে ক্ষমতা চর্চা করবে। দলের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক, পরিকল্পনাবিদ ইত্যাদি কার্য পরিচালনা করবে। কালক্রমে শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে। সমাজে প্রাধান্য বিস্তারকারী বিশেষ কোন শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকবে না। ক্ষমতার অধিকারী হবে সমাজের সকল জনগণ।

মার্ক্সবাদী তত্ত্বটি মূলত শ্রেণীতত্ত্বের নামান্তর। সব সমাজই শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এবং এ শ্রেণীগুলোর মধ্যে যে বৈষম্য ও তার কারণে সৃষ্ট শ্রেণী দ্বন্দ্ব মার্ক্সবাদে ফুটে উঠেছে। এ তত্ত্বে শ্রেণীসংগ্রাম বা দ্বন্দ্বকে ঐতিহাসিক পটভূমিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অর্থনৈতিক অসাম্যকে প্রাধান্য দিয়ে। মার্ক্স ও তার অনুসারীগণ যৌক্তিকভাবেই তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। ১৯১৭ সালে জ্যার শাসিত রাশিয়ায় লেনিন যে সফল বিপ্লব ঘটিয়েছেন তার মূলে ছিল মার্ক্স-এর এ সমাজবাদ। তবে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা খুব সহজ কাজ নয় এবং এর নজিরও বিরল। মার্ক্সবাদী তত্ত্বে সর্বহারার শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে একটি এলিট শ্রেণী, সাধারণ জনগোষ্ঠী নয়। তাছাড়া সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার যে কথা মার্ক্সবাদীগণ তুলে ধরেছেন তা খোদ রাশিয়াতেও সাত দশকে প্রতিষ্ঠা পায় নি। সর্বোপরি মার্ক্সবাদে শুধু অর্থনৈতিক কাঠামোকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাজের অন্যান্য বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণ অবহেলা করা হয়েছে। তাই বলা যায় মার্ক্সবাদের ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ।

(আ) এলিট তত্ত্ব মতবাদ (Elitist View): সমাজবিজ্ঞানী Gaetano Mosca, Vilprado Pareto, Robert Michels, মার্ক্সবাদী চিন্তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এলিট তত্ত্ব তুলে ধরেন। পরবর্তীতে C. W. Mills প্রমুখ এর সম্প্রসারণ ঘটান। এলিট তাত্ত্বিকগণ সমাজে বিশেষ সুবিধাভোগী এলিটশ্রেণীকে ক্ষমতার কেন্দ্র বলে মনে করেন। তাদের মতে অর্থনৈতিক বিষয় সমাজে ক্ষমতা কাঠামো নির্ধারণের একমাত্র বিষয় নয়, ব্যক্তিগত গুণাবলিই শাসক ও শাসিতকে পৃথক করে। মসকা মনে করেন সাংগঠনিক সামর্থ্য এলিটকে নেতৃত্বের (ক্ষমতার) ভিত্তি প্রদান করে; কিংবা Pareto যেমন বিশ্বাস করেন উচ্চ মাত্রার বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা ক্ষমতার পূর্বশর্ত। তবে পরবর্তী এলিটবাদীগণ ব্যক্তিগত গুণের চেয়ে সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করে। তাদের মতে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির উত্তরাধিকারমূলক সংগঠন সমাজে ছোট এলিট শ্রেণীকে ক্ষমতার একচেটিয়া আধিপত্য প্রদান করে। এ মতবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, সমাজে দু’টি শ্রেণী বিদ্যমান- ক্ষুদ্র শাসক শ্রেণী ও শাসিত। যদি সর্বহারার বিপ্লব সংঘটিত হয়ও, তা হলো শাসকশ্রেণীর পরিবর্তন মাত্র। অর্থনৈতিক কাঠামো, পুঁজিবাদী বা সমাজবাদী, এলিট শাসনের অবসান ঘটাতে পারে না। ব্যক্তিগত গুণাবলি ছাড়াও এলিটশ্রেণী তার অভ্যন্তরীণ সংগঠনের কারণে ক্ষমতার অধিকারী হয়। কারণ এলিট শ্রেণী অনেক বেশি সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ, সাধারণ জনগণের মধ্যে যার অভাব রয়েছে।

মসকা (Mosca) বলেন, সমাজে যে দু’টি শ্রেণী রয়েছে তাদের মধ্যে সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণী সকল রাজনৈতিক কার্য সম্পাদন করে, একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করে এবং ক্ষমতার সুবাদে সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। দ্বিতীয় শ্রেণী সংখ্যাগুরু হলেও প্রথম শ্রেণী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রথম শ্রেণী তাদের অর্থনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় গুণাবলির কারণে সমাজে নেতৃত্ব প্রাপ্ত হয়। একবার নিয়ন্ত্রণ প্রাপ্ত হয়ে এ শ্রেণী সাংগঠনিক ক্ষমতা বলে নেতৃত্ব ধরে রাখতে সক্ষম। একটি ছোট গোষ্ঠী হিসেবে এ শ্রেণী অনেক সুসংহত এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম। মসকা বলেন, “The power of the minority is irresistable as against each single individual in the majority, who stands alone before the totality of the organized minority.” (G. Mosca, The Ruling class, 1939, p-53.) এলিটশ্রেণী তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম-বিধি (রাজনৈতিক সূত্র) সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম।

Michels-এর মতে, (Political Parties, 1949) আধুনিক সংগঠিত সমাজই এলিট এর জন্ম দিয়েছে। তার মতে, আধুনিক সমাজব্যবস্থায় কোন আন্দোলন বা দলই সংগঠন ছাড়া সফল হতে পারে না। যে কোন ছোট-বড় সংগঠনে নেতৃত্ব অপরিহার্য। আর কোন সংগঠন নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ক্ষমতা বা সুবিধা না দিয়ে সফলভাবে চলতে পারে না। তার মতে, সংগঠন মানে কতিপয় ব্যক্তির কর্তৃত্ব (Oligarchy)। সংগঠনের আকার যত বড় হবে এর পরিচালনার জন্য বিশেষায়িত জ্ঞান প্রয়োজন হবে, যা সংগঠিত এলিট শ্রেণীর কাছ থেকে পাওয়া যায়। সাধারণ জনগণ দিক-নির্দেশনার জন্য এলিটদের মুখাপেক্ষি হয়ে পড়ে। ফলে কতিপয় ব্যক্তির (Elite) কর্তৃত্ব স্থায়ীরূপ লাভ করে, তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। দলের মাধ্যমে নির্বাচন করে সাধারণ জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এ নির্বাচিত প্রতিনিধিগণই এলিট, এরা কর্তৃত্ব করে।

Vilfredo Pareto তার ‘The Mind and Society’ গ্রন্থে বলেন যে, প্রতিটি সমাজ জনসংখ্যার একটি উৎকৃষ্ট উপাদান বা এলিট শ্রেণী দ্বারা শাসিত হয়। এলিট শ্রেণী শাসন কার্য পরিচালনা করে, কারণ এ শ্রেণীর সদস্যগণ স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে সর্বাধিক গুণ বা যোগ্যতাসম্পন্ন। Pareto এলিট শ্রেণীকে দু’ভাগে ভাগ করেন; যথা: শাসক এলিট ও অশাসক এলিট। এ দু’গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ করে। এলিট শ্রেণী তাদের বুদ্ধিবৃত্তি, দক্ষতা, বিচক্ষণতা, পরিচালনা কৌশল, দেশপ্রেম, রক্ষণশীলতা ইত্যাদির দ্বারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে। এলিট শ্রেণী অন্য শ্রেণীর বা জনগণের মধ্য থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে এবং সম্মতি ও শক্তিপ্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম। Pareto, Mosca ও Michels বিশ্বাস করেন যে, এলিট শ্রেণী স্থির নয়। মার্ক্সবাদীগণ যেমন মনে করেন যে শাসক শ্রেণী নির্দিষ্ট, এলিটবাদীগণ মনে করেন যে, এলিটদের আবর্তন ঘটে। সমাজে সাধারণ জনগণের মধ্য থেকে যোগ্যতা অর্জনকারী গুণসম্পন্ন ব্যক্তিগণ এলিটে পরিণত হন। প্রথমে অশাসক এলিট, অশাসক এলিট থেকে শাসক এলিট-এ পরিণত হন। শাসক এলিটদের মধ্য থেকে কেউ অশাসক এলিট এবং অশাসক এলিট থেকে সাধারণে পরিণত হতে পারেন। এভাবে এলিট আবর্তন (Circulation of Elite) ঘটে। এ ছোট সংগঠিত শ্রেণী সমাজে ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে।

C. W. Mills (The Power Elite, 1956) রাজনৈতিক এলিটের উদ্ভবে উৎপাদন উপকরণের উপর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি গ্রহণ করেন নি। তিনি তার ব্যাখ্যায় ক্ষমতার এলিট (Power Elite) শব্দটি ব্যাবহার করেন। তার মতে, ক্ষমতা সবসময় প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত। রাজনৈতিক এলিট বা Power Elite প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সৃষ্টি। Power Elite বলতে তিনি তাদের বুঝিয়েছেন যারা নেতৃত্বের অবস্থানে আছেন। তার মতে, সমাজে কিছু প্রতিষ্ঠান চালকের আসনে থাকে এবং সমাজের নেতৃত্বের অবস্থানে থাকা কিছু ব্যক্তি এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে অবস্থান করে। এরাই Power Elite, কারণ তারা সমাজে নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠানের পদসোপানে শীর্ষে অবস্থান করে। এ গোষ্ঠী সচেতনভাবে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ক্ষমতা দখল করে না; বরং বিভিন্ন সংস্থা ও সামরিক বাহিনী যখন প্রসারিত হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া যখন জটিলতর, আমলাতান্ত্রিক ও কেন্দ্রীকৃত হয় তখন অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক এলিটদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সমাজে এ গোষ্ঠী তাদের গোষ্ঠী সংহতি ও পারস্পরিক সংযোগের সুবাদে অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক এ তিনটি প্রধান প্রতিষ্ঠানে নেতৃস্থানীয় অবস্থান দখল করে রাখে। অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর একটি ত্রিমুখী ক্ষমতা বলয় (Triangle of Power) সৃষ্টি হয়। এলিট তাত্ত্বিকগণ কয়েকটি ধারায় ক্ষমতা বণ্টনের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন:

  • (ক) Mosca ও Michels-এর সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গি;
  • (খ) Pareto-এর মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি;
  • (গ) Mills-এর প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি।

তবে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা বক্তব্য তুলে ধরেন না কেন কিংবা যে নামেই এলিটকে অভিহিত করুন না কেন- রাজনৈতিক এলিট, শাসক এলিট বা ক্ষমতার এলিট, সবারই মূল দৃষ্টি ছিল ক্ষুদ্র একটি শ্রেণীর প্রতি যেটি সমাজে আধিপত্যকারী এলিট হিসেবে পরিচিত। সব এলিট তাত্ত্বিক কিছু বিষয়ে একমত-

  • (ক) রাজনৈতিক ক্ষমতা কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে।
  • (খ) রাজনৈতিক এলিট ক্ষমতাধর কারণ তারা সংখ্যালঘু ও সংগঠিত, এবং বিশেষ ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে গুণান্বিত এবং তারা প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানসমূহে শীর্ষাবস্থানে আসীন থাকে;
  • (গ) এলিট শ্রেণী সবসময় সচেতন, ঐক্যবদ্ধ (সংহত) এবং ষড়যন্ত্রকারী।
  • (ঘ) ক্ষমতা হলো ক্রমবর্ধিষ্ণু, ক্ষমতা আরো অধিক ক্ষমতা আনয়ন করে।

রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টন পর্যালোচনায় এলিট মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। প্রথমত, এলিটবাদে চিন্তাবিদদের মধ্যে প্রত্যয়গত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়; যেমন: রাজনৈতিক এলিট, শাসক এলিট, ক্ষমতার এলিট। আবার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও রয়েছে। কোন চিন্তাবিদ ক্ষমতাকে বিবেচনা করেছেন সাংগঠনিক দিক হতে, কোন চিন্তাবিদ প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে, আবার কেউ বা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে। দ্বিতীয়ত, এলিট তত্ত্ব কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, (i) সব সমাজে সবসময় কি রাজনৈতিক ক্ষমতার একটাই কেন্দ্রবিন্দু থাকে? (ii) রাজনৈতিক এলিট কি সবসময় সুসংহত ও আত্মসচেতন? বর্তমানে এলিটদের বিভিন্ন গোষ্ঠী পর্যায়ে বিভাজিত হতে দেখা যায়। জাতীয় পর্যায়ে এলিট পর্যালোচনা তাই কিছুটা হলেও কষ্টকর। এলিটবাদীগণ রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের উপর বেশি জোর দিয়েছেন। এলিটবাদে বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রসূত পর্যালোচনা কৌশল অনুপস্থিত। সামাজিক পটভূমিতে এলিটদের গুণাগুণ ও আচরণ বিশ্লেষণের চেষ্টার মাধ্যমে ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাবার চেষ্টা যথাযথ নয়। তবুও বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষমতা বলয় বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব ব্যবহার করা যায়। এলিট বিশ্লেষণ প্রকৃত ক্ষমতা চর্চাকারীদের সনাক্ত করতে সাহায্য করে। ক্ষমতা চর্চাকারীদের আচরণ ও কার্যাবলি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এলিট তত্ত্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার অবস্থান পর্যালোচনা করতে সাহায্য করে।

(খ) বহুত্ববাদ (Pluralism): মার্ক্সবাদী তত্ত্ব ও এলিট তত্ত্বের বিপরীতে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতা বণ্টনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতেই মূলত বহুত্ববাদী তত্ত্বের উদ্ভব। মার্ক্সীয় তত্ত্ব ও এলিট তত্ত্বে ক্ষুদ্র একক গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়। অন্যদিকে বহুত্ববাদে ক্ষমতা সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টনের কথা বলা হয়। এ মতবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, সমাজ বহুবিদ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান সমন্বয়ে গঠিত। কারণ শিল্পায়িত সমাজ কর্ম পৃথকীকরণের ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোষ্ঠী স্বার্থে বিভক্ত। প্রতিটি সামাজিক ও পেশাভিত্তিক গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট স্বার্থ রয়েছে। ফলে এ নানামুখী স্বার্থের কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে, যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এ সব সংগঠন স্বার্থের কারণে কখনো সহযোগিতা, কখনো প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কে সম্পর্কিত। এখানে ইস্যুর ভিত্তিতে নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয় এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। সুতরাং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াও বিকেন্দ্রীকৃত। এ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় শ্রমিক সংঘ, বৃহৎ সংস্থা, কৃষি সম্প্রদায়, রাজনৈতিক দল প্রভৃতি। তবে ক্ষমতার অসমতার কারণে সব গোষ্ঠীর প্রভাব সমান নয়। তুলনামূলকভাবে কম ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাহীন গোষ্ঠী বিরাজমান ক্ষমতা গোষ্ঠী বা কাঠামোকে (Power group or structure) চ্যালেঞ্জ করে। ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে নতুন কাঠামোর উত্থান ঘটে; যেমন: শ্রমিক সংঘ, রাজনৈতিক দল।

Robert A. Dahl তার Connecticut-এর New Haven অঞ্চলের স্থানীয় রাজনীতি ও ক্ষমতা বলয় সম্পর্কিত রচনা ‘Who Governs? -এ যুক্তি দেখিয়ে বলেন যে, ক্ষমতা বণ্টন বুঝতে হলে প্রকৃত সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। তিনি দাবি করেন যে, ক্ষমতা বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজিত থাকে এবং এলিটদের এ বহুত্ব অভিন্ন স্বার্থে ঐক্য প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব এলিট স্থানীয় রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হয় একমাত্র তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। Dahl ‘অর্থনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে’ এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে বলেন অর্থনৈতিক এলিটগণ সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠীর মতই একটি গোষ্ঠী মাত্র। তিনি তিনটি ক্ষেত্র পর্যালোচনা করেন- (ক) নগর উন্নয়ন, (খ) মেয়র পদের নির্বাচনে রাজনৈতিক মনোনয়ন, (গ) শিক্ষাব্যবস্থা (বিদ্যালয়ের আসন, শিক্ষকদের বেতন)।

তিনি দাবি করেন যে, তিনটি বিষয় যেমন পৃথক তেমনি প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীগণও ভিন্ন। এখানে স্থানীয় রাজনীতি কোন একক এলিট শ্রেণী কর্তৃত্বের পরিবর্তে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমঝোতার ভিত্তিতে চলে। মেয়র বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর সাথে আলোচনা-পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ও সর্বজনীন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং ক্ষমতা এককেন্দ্রিক (Centripetal) নয় বরং ক্ষমতা বহুমুখী (Centrifugal)।

সার্বিক আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে, এককেন্দ্রিক তত্ত্ব (Centralist)-মার্ক্সীয় ও এলিট তত্ত্ব, এবং বহুত্ববাদী তত্ত্বের পার্থক্য যাই থাকুক না কেন উভয় তত্ত্বে একটি বিষয় স্বীকার করা হয় যে, কোন সমাজেই রাজনৈতিক ক্ষমতা সমবণ্টিত নয়। কতিপয় ব্যক্তি বা ক্ষমতাবান কারা এ নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সবসময়ই কতিপয় কর্তৃক গৃহীত হয়। বিভিন্ন স্বার্থের বা স্বার্থ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকলেও জনগণ (Mass People) সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেয় না। সনাতন ও উন্নয়নশীল সমাজে এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত এককেন্দ্রিকতার দোষে দুষ্ট, যদিও উদারনৈতিক ব্যবস্থা বিকাশের সাথে সাথে এ অবস্থায় পরিবর্তন আসছে। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা অনেক বেশি পৃথকীকৃত। তবে সমাজে সব গোষ্ঠী যেহেতু সমান ক্ষমতাবান নয় ক্ষমতাও সমভাবে বণ্টিত নয়।

ক্ষমতার সম্পর্ক (Relation of Power)

ক্ষমতা হলো অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করা বা অন্যের আচরণকে প্রভাবিত করা, নিজ স্বার্থের অনুকূলে। এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর ক্ষমতাবান হতে পারে। এটি হতে পারে প্রতিপত্তি বা সম্পদের কারণে। একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের চেয়ে ক্ষমতাবান হতে পারে প্রধানত দু’টি কারণে অর্থনৈতিক শক্তি ও সামরিক শক্তির কারণে। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের ক্ষমতাকে Relational Power বা আপেক্ষিক ক্ষমতা বলা হয়। আবার একাধিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রেও ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচিত হতে পারে। এক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের কার্য বা দৃশ্যমান আচরণে অন্যের আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করার বিষয়টি বোঝা যায়। এ ক্ষেত্রে উভয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আচরণগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। উন্নত দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারের আচরণের উপর উন্নত দেশের প্রভাব দৃশ্যমান। কিংবা বাংলাদেশের সাথে ভারতের আচরণগত পার্থক্য। উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতার সম্পর্ক বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারি। এ ধরনের ক্ষমতাকে আচরণগত ক্ষমতা (Behavioral Power) বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে পরিস্থিতির কারণে ক্ষমতা, প্রভাবের তারতম্য হতে পারে। কোন একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের প্রভাব বেশি হতে পারে। পরিস্থিতির কারণে একের ভূমিকা অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে; যেমন: আইনসভার অধিবেশনে স্পিকার সবার উপর ক্ষমতাবান, কিন্তু একজন সদস্যের সামাজিক পটভূমিতে বা অন্য কোন ক্ষেত্রে স্পিকারের কোন প্রভাব থাকে না। অথবা রাষ্ট্রপক্ষে সরকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী হওয়া সত্ত্বেও উদ্ভূত কোন পরিস্থিতিতে ছোট কোন একটি গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এ ধরনের ক্ষমতাকে Situational Power বলা হয়ে থাকে। উপরোক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্ষমতার সম্পর্ক স্পষ্ট। পরিবেশ- পরিস্থিতির কারণে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলাতে পারে এবং প্রভাব বিস্তারকারী পক্ষগুলোর ক্ষমতা পরিবর্তিত হতে পারে। প্রভাবের পরিবর্তনের এ বিষয়টি ক্ষমতার সম্পর্ক হিসেবে পরিচিত।

Robert A. Dahl তার ‘Modern Political Analysis’ গ্রন্থে নির্দিষ্ট অবস্থার প্রেক্ষিতে চার ধরনের ক্ষমতার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন –

  • প্রথমত, কোন দপ্তরে এক জনের ক্ষমতা পরিমাপ করার দ্বারা, যেহেতু একমাত্র আনুষ্ঠানিক দপ্তরের কাঠামোতে ক্ষমতা ক্রিয়াশীল থাকে। এ মাপকাঠিতে দপ্তরবিহীন কোন ব্যক্তির ক্ষমতা নেই বলে ধরে নেয়া হয়। যারা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের উচ্চ পদে আসীন আছেন তাদেরকে অধিক ক্ষমতাবান বলে বিবেচনা করা হবে এবং সর্বোচ্চ দপ্তরটি যার অধীনে তিনি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর হিসেবে বিবেচিত হবেন অন্যদের তুলনায়। যেমন: বাংলাদেশের যে কোন প্রশাসনিক দপ্তর প্রধান কোন বিভাগের সচিব। তিনি উক্ত বিভাগের অন্য সবার চেয়ে ক্ষমতাবান এবং অন্যরা তার অনুগত থাকে। তার সাথে অন্যদের সম্পর্ক হলো আদেশ প্রদান ও পালনের।
  • দ্বিতীয়ত, সকল ক্ষেত্রে বা সময় আনুষ্ঠানিক দপ্তর নির্দিষ্ট করা যায় না। অনেক সময় দপ্তরের অন্তরালে ক্রিয়াশীল ক্ষমতার অস্তিত্ব থাকে এবং দপ্তর অধিকারীকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ দপ্তরের নেপথ্যে থেকে আনুষ্ঠানিক দপ্তর পরিচালককে বা নিয়ন্ত্রণকারীকে নিয়ন্ত্রণ করে। নিবীড় পর্যবেক্ষণের দ্বারা দপ্তর প্রধানকে নিয়ন্ত্রণকারীকে সনাক্ত করা যেতে পারে। তবে এ প্রক্রিয়াটি সহজ নয়।
  • তৃতীয়ত, ক্ষমতা সম্পর্ক নির্ণয়ের তৃতীয় কৌশলটি হলো প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার উপর/প্রতি মনোনিবেশ করা। এ কৌশলে কোন্ ধরনের লোক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অর্থাৎ প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণের ধরন এবং পর্যায় পর্যবেক্ষণ করা। এ প্রক্রিয়ায় যে ব্যক্তি বেশি সংশ্লিষ্ট এবং সক্রিয় তাকে অধিকতম ক্ষমতাবান বলে বিবেচনা করা হয়। একজন শীর্ষ ব্যক্তির সাথে তার একান্ত সচিবও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। এখানে শীর্ষ ব্যক্তিটিকে ক্ষমতাবান হিসেবে বিবেচনা করা যায় তার সচিবকে নয়। অর্থাৎ শুধু অংশগ্রহণই ক্ষমতা পরিমাপ করার জন্য যথেষ্ট নয়।
  • চতুর্থত, ক্ষমতার সম্পর্ক পরিমাপের চতুর্থ কৌশল হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের কর্ম পরিধি ও ভূমিকার তুলনামূলক পরিমাপের দ্বারা ক্ষমতার ধরন ও বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কে বেশি প্রস্তাব উপস্থাপন করলেন এবং তার মধ্য হতে কত বেশি প্রস্তাব নীতি হিসেবে গৃহীত হলো। আবার কে প্রস্তাবগুলোর বিরোধিতা করল এবং কতটি ক্ষেত্রে সফল হলো। এ কৌশলেরও সমস্যা থেকে যায়। একজন অংশগ্রহণকারীর দু’টি প্রস্তাব বিরোধিতা ছাড়া গৃহীত হলো এবং অন্যজনের একটি প্রস্তাব প্রবল বিরোধিতার মুখে গৃহীত হলো। এ দু’জনের মধ্যে কে বেশি ক্ষমতাবান তা নির্ধারণ সহজ নয়। তবে সমস্যা থাকলেও এ কৌশলগুলো নিষ্ফল নয়। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর এবং সতর্কতার উপর। তবে ক্ষমতার বিচার করতে তিনটি বিষয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাত্রা; সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রের বিস্তৃতি।

ক্ষমতার সম্পর্ক শুধু আদেশ দান ও আনুগত্যের হবে এমন নয়, আদেশের বিরোধিতাও থাকতে পারে। বিরোধিতা না থাকলে ক্ষমতার সম্পর্ক পূর্ণ হয় না। অন্যের আচরণের উপর প্রভাব বিস্তারের বিরোধিতাও থাকতে পারে। বিরোধিতা থাকলে বল (Sanction) প্রয়োগের ব্যাপারটিও থাকবে। তাই Dahl মনে করেন যে, Sanction ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এর দ্বারা ক্ষমতা চর্চাকারী অন্যদের স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেন বা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন। Herbert Godhamer and Edward A Shils-এর মতে, “A person may be said to have power to the extent that he influences the behaviour of others in accordance with his own intention. ” (Types of Power and Status, in Sydney Ulmer, Introductory Readings in Political Behaviour, Chicago, 1962, p-344.) অর্থাৎ কোন ব্যক্তিকে তখনই ক্ষমতাবান বলা যাবে যখন সে অন্যের আচরণকে নিজের উদ্দেশ্যানুসারে প্রভাবিত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানের উদ্দেশ্য জানতে হবে এবং দেখতে হবে যার উপর ক্ষমতা চর্চা করা হলো সে ঐ উদ্দেশ্য অনুসারে নীতি গ্রহণ করে কি না। যদি তাই হয় তবে পূর্বজন অন্যজনের উপর ক্ষমতাবান। একটি জাতি অন্য কোন শক্তিশালী জাতির প্রভাবে/চাপে নিজের স্বাভাবিক কার্য পদ্ধতি পরিবর্তন করতে পারে; যেমন: উন্নত দাতা দেশের সাথে নির্ভরশীল জাতিগুলোর সম্পর্ক। যদিও দ্বিতীয় জাতি এ চাপের বিষয়টি স্বীকার করে না।

একাধিক বক্তি, গোষ্ঠী বা জাতির ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে হলে ক্ষমতার ভিত্তি জানা প্রয়োজন। ক্ষমতার অনেক ভিত্তি থাকতে পারে যা সংস্কৃতি ভেদে বা ক্ষমতা কাঠামোর কারণে ভিন্ন হতে পারে। উন্নত দেশগুলো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর ক্ষমতাবান এবং তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে ও তাদের নীতি ও কার্যক্রমকে অনেকাংশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার সামরিক শক্তির কারণে একটি জাতি অন্য জাতির উপর ক্ষমতাবান হতে পারে। কিংবা সহিংসতার উপকরণের উপর দখল বা অসাধারণ ক্ষমতার কারণে অন্যের উপর ক্ষমতাবান হতে পারে। কখনো বা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর দক্ষতা একজন ব্যক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তবে শুধু ক্ষমতার ভিত্তি যাচাই যথেষ্ট নয়। ক্ষমতার ভিত্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করাও অন্যের উপর ক্ষমতা ভোগের জন্য জরুরি। “The power base coupled with this ability constitutes the capability for power. In addition to this capability, to constitute power relation what is necessary is a will or desire on the part of the actor influencing to control the actions of others. Thus power emerges whenever the capacity for power is combined with a will to affect the behaviour of others.” (Mukhapadhya, p-37)

সমাজে সব লোকই ক্ষমতা চায়। একজন ব্যক্তির ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা কতটা সফলভাবে পূর্ণ হবে তা নির্ভর করে তার কতখানি সামর্থ্য ও ইচ্ছা আছে তার উপর। কাজেই ক্ষমতা প্রত্যাশি ক্ষমতাবান হবে এমন নয়। ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার যশ, খ্যাতি, নিরাপত্তা, সম্মান, প্রীতি, সম্পদ ও অন্যান্য প্রত্যাশা পূরণে ক্ষমতা ব্যবহার করে (একে ক্ষমতার ব্যবহারিক মূল্য বলে)। তাই ক্ষমতা প্রাপ্ত হলে ব্যক্তি ক্ষমতার ব্যবহারিক মূল্যের কারণেই তা বৃদ্ধি করতে চায়। তার ক্ষমতা বৃদ্ধির এ আকাঙ্ক্ষা অন্য ক্ষমতাবান ব্যক্তি দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ক্ষমতাবান ব্যক্তি অধিকতর ক্ষমতাবান কর্তৃক অবদমিত হতে পারে। এভাবে ক্ষমতা যেমন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আবার, ক্ষমতা ক্ষমতাকে সীমিত করে। এ ছাড়া, অন্যান্য বিষয় দ্বারাও ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যেমনঃ ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, বিশেষ কৌশলগত পরিবেশ, অধিক ক্ষমতা অর্জনের প্রয়োজনীয় দক্ষতা। “The social order is equally important as a limitation on power. The mores at any given times may put outside the scope of power such practices as those of religion or sex. In some societies mores directly concern power itself, sanctions being, for example, to any sort of personal ambition or aggressiveness.” (Lasswell and Kaplan, OP. Cit, p-96.) তাছাড়া স্থায়ী ক্ষমতার সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ক্ষমতা ব্যবহার করার সামর্থ্যই যথেষ্ট নয়, বরং ক্ষমতা ব্যবহারের অধিকারও আবশ্যক যা অন্যদের আনুগত্য লাভ করে। অর্থাৎ ক্ষমতার সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ক্ষমতার বৈধতা আবশ্যক। আর বৈধ ক্ষমতাই যেহেতু কর্তৃত্ব, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কর্তৃত্ব শুধু আবশ্যকই নয়, এটি ক্ষমতা চর্চাকারীর জন্য সুবিধাজনকও বটে। কারণ ক্ষমতা চর্চার সাথে সম্পদ ও শক্তির ব্যবহার জড়িত।

বৈধতা (Legitimacy)

ক্ষমতার সাথে বৈধতার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ব্যবহৃত ক্ষমতা কিংবা সে ক্ষমতা বলে সম্পাদিত কার্যাবলি বৈধ কি না তা নির্ভর করে তার ক্ষমতার বৈধতার উপর। কোন কর্তৃপক্ষ যে ক্ষমতা চর্চা করে সে ক্ষমতা চর্চার যথার্থতা অর্থাৎ ক্ষমতা চর্চার অধিকার বৈধতার প্রতি ইঙ্গিত করে। রাজনৈতিক অঙ্গনে কর্তৃত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও দৃষ্টি আকর্ষণী বিষয়। কারণ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থায়ী হতে পারে না যদি না এর ক্ষমতার ভিত স্থায়ী হয়। বৈধতার মাধ্যমেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কর্তৃত্বে পরিণত হয় এবং বৈধ ক্ষমতা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে ভিত্তি প্রদান করে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈধতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের প্রতিটি স্তরেই ক্ষমতা বৈধতা দাবি করে। কাজেই ক্ষমতার স্থায়ী সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতা চর্চাকারী ক্ষমতা ব্যবহার বা চর্চার সামর্থ্য যেমন জরুরি, ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষমতা চর্চার অধিকার এবং ক্ষমতাধীন ব্যক্তিবর্গের স্বীকৃতি ও আনুগত্য, অর্থাৎ ক্ষমতার বৈধতা। অন্যের আনুগত্য লাভের অধিকার প্রাপ্তির জন্য ক্ষমতার বৈধতা আবশ্যক। বলপ্রয়োগে আনুগত্য আদায় হতে পারে, কিন্তু ক্ষমতার সম্পর্ক স্থায়ী করার জন্য বৈধতা প্রয়োজন। মোটকথা হলো বৈধতা অর্জন করতে হয়। “Legitimacy involves the capacity of the system to angender and maintain the belief that existing political institutions are the most appropriate ones for the society.” (S. Lipset, The Political Man, p-77) সুতরাং বৈধতা বলতে ক্ষমতা চর্চার অধিকারের স্বীকৃতিকে বোঝান হয়। সরকার বৈধ ক্ষমতা চর্চা করে। সরকারের এ কর্তৃত্বও বৈধতা দাবি করে। “রাজনৈতিক কাঠামোর বৈধতা নির্ভর করে রাজনৈতিক কাঠামোর দক্ষতা, সফল কার্যকারিতা ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা, আবেদন ও আস্থার উপর। ” (ড. মোহাম্মদ সোলায়মান, ‘রাজনৈতিক কাঠামোর অবক্ষয় ও বৈধতার সংকট: এরশাদের শাসনামল’, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি পত্রিকা, ১৯৯৩।) Lipset বলেন, “Belief that the structure, procedures, acts, decisions, polices, officials, or Leaders of government possess the quality of ‘rightness’, propriety, or moral goodness and should be accepted because of this quality- irrespective of the specific content of the particular act in question-is what we mean by legitimacy.” (Robert A. Dahl, Modern Political Analysia, New Delhi, 1965, p-19.)

বৈধতার প্রকারভেদ

বৈধতার প্রধানত দু’টি দিক রয়েছে:

১। আইনগত বৈধতা (Legal Legitimacy): কোন কর্তৃত্ব তখনই আইনগতভাবে বৈধ হয় যখন সে কর্তৃত্ব অর্জিত হয় যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে; যেমনঃ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার। নির্বাচন একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি, সে বিচারে আইনগত বৈধতাকে রাজনৈতিক বৈধতাও বলা যেতে পারে। সরকার ছাড়াও আইনগত বৈধ কর্তৃত্ব রয়েছে; যেমন: আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় মনোনীত বা সরকার কর্তৃক মনোনীত অথবা নিয়োগপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা আইনগত বৈধতাসম্পন্ন কর্তৃত্ব অর্জন করেন। উদাহরণস্বরূপ কোন সাংবিধানিক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা- নির্বাচন কমিশনের সদস্য, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাবৃন্দ। আইনগত বৈধতা সাধারণত সরকারি কোন দপ্তরের রাজনৈতিক কাঠামোর সাথে সংশ্লিষ্ট; যেমন: প্রধানমন্ত্রীত্ব (Prime ministership) বা রাষ্ট্রপতিত্ব (Presidency) ইত্যাদি। এ কর্তৃত্ব নৈর্ব্যক্তিক এবং দপ্তরের মাধ্যমে বৈধতা পায় বলে এ কর্তৃত্ব বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে না। ব্যক্তি পরিবর্তিত হলেও দাপ্তরিক বৈধতা স্থায়ী রূপ পায়। তবে আইনগত বৈধতার সাথে সামাজিক বৈধতার সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও জনগণের সমর্থন হারালে আইনগত বৈধতা ভোগকারী কর্তৃত্বও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। সমাজের জনগণের সমর্থন হারালে কোন ব্যক্তি নির্বাচনের মাধ্যমে আইনগত বৈধ কর্তৃত্ব হিসেবে ক্ষমতায় আসীন হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। আবার আইনগতভাবে নির্বাচিত কর্তৃপক্ষ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন হারালে তার সামাজিক বৈধতা নষ্ট হয়ে যায়।

২। সামাজিক বৈধতা (Social Legitimacy): কর্তৃত্বাধীন জনগোষ্ঠীর কাছে কর্তৃত্বের (অন্যকথায় কর্তৃপক্ষের) গ্রহণযোগ্যতা ও জনগণের সমর্থন থাকাকে সামাজিক বৈধতা বলে আখ্যায়িত করা হয়। রাজনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ঐকমত্য প্রতিফলিত হলে উক্ত কাঠামোর সামাজিক বৈধতা নিশ্চিত হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ফলে প্রাপ্ত কর্তৃত্বের আইনগত বৈধতা ছিল না। তবে তৎকালীন রাজনৈতিক সংকট ও পরিস্থিতির কারণে জিয়া জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছেন বলে তার সামাজিক বৈধতা ছিল বলা যায়। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুতে উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার সাহেবের ক্ষমতা প্রাপ্তি ছিল আইনগতভাবে বৈধ। সামাজিক বৈধতা দু’টি দিক রয়েছে- সনাতন কর্তৃত্বের বৈধতা, অন্যটি হলো সম্মোহনী কর্তৃত্বের বৈধতা। এ দুটি কর্তৃত্বের বৈধতা সৃষ্টি হয় উপযোগিতার কারণে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থনের মধ্য দিয়ে। এ ধরনের কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ব্যক্তিগত পর্যায় ছাড়িয়ে রাজনৈতিক কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে এবং বৈধ দপ্তরের মাধ্যমে কর্তৃত্ব চর্চা হয় যেমন: ব্রিটেনের রাজতন্ত্র।

কর্তৃত্বের ভিত্তি (Basis of Authority)

কর্তৃত্বের বৈধতা অর্জনের বিষয়। কর্তৃত্ব প্রাপ্তি বড় কথা নয়, বরং এ কর্তৃত্ব ব্যবহারের বা ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কর্তৃত্ব চর্চার কৌশল এবং কর্তৃত্ব চর্চায় দক্ষতা দু’টো বিষয় বৈধতা অর্জনে প্রভূত ভূমিকা পালন করে। বৈধতা অর্জনের বিভিন্ন পন্থা রয়েছে, যেগুলোকে বৈধতার ভিত্তি হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়ঃ

  • ১। নেতৃত্বের সামাজিক ভিত্তি (Social base of leadership): সমাজে বা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তির ক্ষমতা চর্চার অধিকারের (কর্তৃত্ব) সামাজিক স্বীকৃতি থাকা জরুরি। কর্তৃত্ব চর্চাকারী ব্যক্তি পরিস্থিতির কারণে কখনো কখনো বলপ্রয়োগ (Sanction) করতে পারেন অথবা কার্য-সম্পাদনে প্রয়োগের ভয় দেখাতে পারেন। তার এমন পদক্ষেপ কার্যকর হবে কি না তা নির্ভর করে তার প্রতি জনগোষ্ঠীর আনুগত্যের উপর। আর আনুগত্য নির্ভর করে সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা ও সামর্থ্যের উপর। সমাজের সকল মানুষ তার সমর্থক নাও হতে পারে, কিন্তু তার প্রতি অনুগত হতে পারে। তার কোন প্রশ্নসাপেক্ষে বা বিতর্কিত কার্য এমনকি তার সমর্থকদের নিকট ও অগ্রহণযোগ্য প্রতীয়মান হতে পারে। কাজেই বৈধতার জন্য সামাজিক ভিত্তি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় সংকট সৃষ্টি হতে বাধ্য।
  • ২। রাজনৈতিক আদর্শবাদ/মতাদর্শ (Political ideology): মতাদর্শ হলো জীবন, সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত ধারণার সমষ্টি, যা দীর্ঘ দিনের প্রচারণা ও চর্চার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যময় বিশ্বাসে (Dogma) পরিণত হয়। “It is a theory of social life which approaches social realities from the point of view of a political ideal and interpretes them consciously or unconsciously to prove the correctness of the analysis and to justify the ideal. ” (Joseph Roucek, Introduction to Political Science, p-1.) রাজনৈতিক মতাদর্শ সুন্দর ও সুখী জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমাজে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব চর্চায় গৃহীত পদক্ষেপ বা কার্যক্রম পরিচালনার নীতিমালা বা পূর্ব-নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে দিক-নির্দেশনা প্রদান করে বা পরিচালনা করে। রাজনৈতিক আদর্শবাদের প্রবক্তা বা প্রচারক তার মতাদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব গণমানুষের কল্যাণে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক নীতিমালা বা কর্মসূচি তাদের সামনে তুলে ধরে ও এসব নীতিমালার প্রতি তার দায়বদ্ধতা প্রমাণ করে জনগোষ্ঠীর নিকট গ্রহণযোগ্যতা লাভের মাধ্যমে বৈধতা অর্জন করে; যেমন: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র।
  • ৩। রাজনৈতিক দর্শন ও মূল্যবোধ (Political philosophy and values): রাজনৈতিক দর্শনের উদ্দেশ্য অনেক বিস্তৃত এবং এটি মানুষের রাজনৈতিক জীবনের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। রাজনৈতিক দর্শন মানুষের রাজনৈতিক জীবন ও কর্মকাণ্ডের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে। রাজনৈতিক দর্শন রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য, মানুষের অধিকার ও কর্তব্য, রাষ্ট্রে এবং রাষ্ট্রের আদর্শ অর্জনে ব্যক্তির অবস্থান আলোচনা করে। একজন রাজনৈতিক দার্শনিক রাজনৈতিক জীবনের স্থায়ী উপাদানের উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং রাজনৈতিক জীবনের উদ্দেশ্যগুলো কিভাবে সাধন করা যায় সে চেষ্টা করেন। তিনি মানুষের রাজনৈতিক জীবনের জটিলতার স্থায়ী সমাধান খোঁজেন। রাজনৈতিক দর্শনের কোন স্থান-কালের গণ্ডি সীমিত নয়। এভাবে তিনি মানুষের আস্থা অর্জন করেন ও কর্তৃত্বকে বৈধতা দান করেন।
  • ৪। ক্ষমতার উৎস (Sources of power): কর্তৃত্বের বৈধতা ক্ষমতার উৎসের উপরও অনেকখানি নির্ভর করে। কর্তৃত্ব কিভাবে অর্জিত হলো বৈধতার জন্য তা বিবেচনায় আসে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইনগত প্রক্রিয়ায় অর্জিত কর্তৃত্ব অবশ্যই বৈধ। কারণ এ কর্তৃত্বের প্রধান উৎস জনগণের সম্মতি। অন্যদিকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় আরোহণে কর্তৃত্ব পাওয়া যায় ঠিক, কিন্তু তার বৈধতার ভিত মজবুত নয়। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সম্মতি কর্তৃত্বের বৈধতার ভিত্তি।
  • ৫। রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা (Political Commitment): কর্তৃত্বের বৈধতার জন্য নেতৃত্বের সামাজিক ভিত্তি, রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন থাকাই যথেষ্ট নয়। জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে অনুসৃত রাজনৈতিক আদর্শ এবং তাদের সামনে তুলে ধরা দর্শনের প্রতি নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা/অঙ্গিকারবদ্ধতা থাকা আবশ্যক। রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শনের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার সাথে সাথে রাজনৈতিক আদর্শ যে সকল কর্ম সম্পাদনের দাবি রাখে সেগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গিকারবদ্ধতা থাকতে হবে। অন্যথায় কর্তৃত্বের বৈধতার ভিত দুর্বল হতে বাধ্য।
  • ৬। সাংগঠনিক সামর্থ্য ও রাজনৈতিক কাঠামোর কার্যকারিতা (Organisational capability and effectiveness of political structure): রাজনৈতিক নীতিমালা ও আদর্শ বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের বা ক্ষমতা চর্চাকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক সামর্থ্য আবশ্যক। নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তির জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক সামর্থ্য প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করতে খুবই প্রয়োজন। কারণ কর্তৃত্বের বৈধতা অনেকাংশে নির্ভর করে রাজনৈতিক কাঠামোর কার্যকরী ভূমিকার উপর। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হলে কাঠামোগত পৃথকীকরণ ও পৃথকীকৃত কাঠামোগুলোর মধ্যে সমন্বয়সাধন জরুরি। পাশাপাশি জনগোষ্ঠীর কাছে রাজনৈতিক কাঠামোর গ্রহণযোগ্যতা ও আবেদন নিশ্চিত করতে হবে। আর এ জন্য কর্তৃপক্ষের সাংগঠনিক সামর্থ্য থাকা অতি আবশ্যক।
  • ৭। কর্তৃত্বের যৌক্তিকীকরণ (Rationalization of authority): জনগণের সম্মতির সাথে সাথে বৈধতার জন্য ব্যাপক সচেতন গণঅংশগ্রহণ জরুরি। আইনগত পদ্ধতিতে কর্তৃত্ব অর্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের সম্পৃক্ততাও সমোধিক গুরুত্ব রাখে। নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সম্মতিতে কর্তৃত্ব অর্জন করা যায়। কিন্তু সে নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংগঠিত হতে হবে। আবার, দাপ্তরিকভাবে প্রাপ্ত কর্তৃত্বের ভিত্তি ক্ষমতার যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দ্বারা মজবুত করা যায়।

বৈধতার সংকট (Legitimacy Crisis)

সাধারণভাবে বৈধতার সংকট সরকারের সাথে সম্পর্কিত। সরকারের কর্তৃত্বের প্রকৃতি এবং জবাবদিহিতার ধরন সরকারের নীতি ও আদর্শ, সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক, সরকারের এখতিয়ারের সীমা এসব বিষয়ে ঐকমত্যের অভাব বা সংকটকে বৈধতার সংকট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকার বিষয়ে ঐকমত্যের অভাবও বৈধতার সংকটের আওতাভুক্ত। নব্য স্বাধীন একটি দেশে সরকার কাঠামোর প্রকৃতি বিষয়ে মতানৈক্য বৈধতার সংকটের জন্ম দিতে পারে, যদি সরকারের সাথে সমাজের বৃহৎ একটি অংশ একমত পোষণ না করে। “In transitional societies there can be a deep crisis of authority because all attempts at ruling are challenged by different people for different reasons, and no leaders are able to going a full command of legitimate authority.” (Lucian W. Pye, Aspects of Political Development, Boston, 1966, p-63.) সরকারের আদর্শ, নীতি ইত্যাদি গ্রহণ ও এগুলো বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা বা কর্মসূচির ব্যাপারে মতানৈক্য বৈধতার সংকট সৃষ্টি করতে পারে; যেমনঃ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ‘মুজিববাদ’ তৎকালীন সরকারকে সংকটে ফেলে দিয়েছিল। শাসকগোষ্ঠীর গৃহীত নীতি ও পদক্ষেপের প্রতি কোন কোন গোষ্ঠীর বিরূপ মনোভাবের কারণেও বৈধতার সংকট দেখা দিতে পারে। যেসব কারণে কর্তৃত্ব বৈধতার সম্মুখীন হতে পারে সেগুলো নিম্নরূপ:

  • ১। ক্ষমতা প্রাপ্তির উপায় (Way of obtaining power): ক্ষমতা কিভাবে অর্জিত হলো তা বৈধতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক সময় ক্ষমতা অর্জনের উপায় কর্তৃত্বের বৈধতার সংকটের জন্য দায়ী। শাসন এলিট বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক এলিট যদি বৈধ উপায়ে ক্ষমতা লাভ না করে তাহলে বৈধতার সংকট থেকেই যায়, প্রকৃত (Dejure) ও বাস্তব (Defacto) সার্বভৌমত্ত্বের প্রভেদের কারণে। একটি রাষ্ট্রে সামরিক শাসক বাস্তব ক্ষমতা ভোগ ও চর্চা করেন যদিও তার ক্ষমতা লাভ বৈধ নয় এবং তিনি বাস্তব ক্ষমতার অধিকারী হলেও আইনগত ক্ষমতার অবস্থান ভিন্ন জায়গায় (Position) রয়ে যায়। সামরিক শাসন ছাড়াও বৈধতার সংকট সৃষ্টি হতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষমতাও বৈধতার সংকটে ভুগতে পারে যদি ভোট কারচুপির ব্যাপক অভিযোগ থাকে। রাজনৈতিক সংকটের অজুহাতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার অবৈধ দখলকে প্রাথমিকভাবে জনগণ স্বাগত জানালেও (সামাজিক বৈধতা) কিছু দিন পরই তাদের মোহমুক্তি ঘটে, কারণ সামরিক বাহিনী রাষ্ট্র পরিচালনায় অদক্ষতার পরিচয় দেয়। ফলে দেশে অর্থনৈতিক সংকট সহ নানা সমস্যার উদ্ভব ঘটে। আইনগত বৈধতাহীন সামরিক শাসক সামাজিক বৈধতা হারায়।
  • ২। রাজনৈতিক আদর্শ ও অঙ্গিকারবদ্ধতা (Political ideology and commitment): জনগণের সামনে সার্বজনীন কল্যাণ নিশ্চিতকারী রাজনৈতিক আদর্শ তুলে ধরতে ব্যর্থ হলে শাসক বৈধতার সংকটে নিমজ্জিত হতে পারে। আবার সর্বজনগ্রাহ্য রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণ করেও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা কিংবা তার প্রতি অঙ্গিকারবদ্ধতার অভাবে শাসক শ্রেণী বৈধতার সংকটে পড়তে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক জাতি-গোষ্ঠীর বাস। সার্বজনীন রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসব জাতি-গোষ্ঠীকে একটি রাজনৈতিক পরিচয়ের আওতায় আনা ও তার মাধ্যমে এদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হলে সংহতির সংকট বৈধতার সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
  • ৩। অনুপ্রবেশ (Penetration): জনগণের আস্থা অর্জন ও তাদের সমর্থন লাভ ছাড়া সরকারের পক্ষে তার অনুসৃত নীতিমালা ও তা বাস্তবায়নে গৃহীত কর্মসূচি সম্পাদন সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের নীতিমালা ও কর্মসূচি সম্পর্কে জনগণকে অবহিতকরণ আবশ্যক। তাছাড়া রাজনৈতিক আদর্শ থাকাই যথেষ্ট নয়। এ আদর্শ জনগণের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। Aristotle যেমন বলেছেন জনগণকে সংবিধানের আলোকে শিক্ষিত করে তোলা। “To carry out significant development policies a government must be able to reach down to the village level and touch the daily lives of the people.” (Pye, p-64)। এ ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মাধ্যম ও সংস্থাকে শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠা ও কাজ করার সুব্যবস্থা করতে হবে (কাঠামোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা)। অন্যথায় যোগাযোগ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা ও অকার্যকারিতা জনগণের কাছে (Gross root level) সরকারের অনুপ্রবেশের পথে বাধা সষ্টি করবে। সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করবে। ফলে গণবিচ্ছিন্নতা সরকার ও জনগণের সম্পকর্কে দুর্বল করে দেবে।
  • ৪। অতিমাত্রায় কেন্দ্রীকরণ (High degree of centralization): ক্ষমতার অতিমাত্রায় কেন্দ্রীকরণ বৈধতার সংকট সৃষ্টি করতে পারে। তবে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সাথে সাথে ক্ষমতা প্রত্যর্পণও আবশ্যক। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সাথে সাথে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে ব্যর্থ হলে জনগণের অংশগ্রহণ বিঘ্নিত হবে, ক্ষমতার যৌক্তিকীকরণ ব্যাহত হবে। শাসক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনমনীয় হলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণেচ্ছু নব্য গতিশীলতাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অসন্তোষ, হতাশা ও ক্ষোভ ঘনীভূত হবে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈধতার সংকট সৃষ্টি হবে। সামরিক শাসকগণের ক্ষমতার অধিক মাত্রায় কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সীমাহীন ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা প্রয়োগ বৈধতার সংকট সৃষ্টি করে।
  • ৫। অসাম্য (Inequality): রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যখন কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণীকে বেশি সুযোগসুবিধা প্রদান করে তখন সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনে অসাম্যের ধারণা জন্ম নেয়া স্বাভাবিক। কয়টি ক্ষেত্রে সাম্যের বিষয়ে তাই সতর্ক থাকা আবশ্যক। (ক) রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সমতাভিত্তিক সুযোগ দিতে হবে; (খ) আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করতে হবে। সবাইকে আইনের সমান আশ্রয় পাবার নিশ্চয়তা দিতে হবে; (গ) বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে সমতাভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে; এবং (ঘ) ক্ষমতা, সেবা ও সম্পদ বণ্টনে অনিয়ম ও অসমতা দূর করতে হবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে না পারলে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ কারনে বিরোধী দলগুলো কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকারের বৈধতার প্রশ্ন ঘুরে ফিরে উত্থাপিত হয়।
  • ৬। শাসক শ্রেণীর আচরণ (Behaviors of the ruling class): সামরিক শাসকের সকল নীতি, আচরণ ও কর্মকাণ্ডে স্বৈরাচারী মনোভাব ফুটে ওঠে। এ ছাড়া, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারও অনেক সময় স্বৈরাচারী মনোভাব দেখায়। সরকারের দমন নীতি ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা বৈধতার সংকট সৃষ্টি করে।
  • ৭। ব্যক্তি কেন্দ্রীকতা (Personality Cult): বিশেষ করে সম্মোহনী কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি লক্ষণীয়। সম্মোহনী কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য যেহেতু ব্যক্তিগত, সম্মোহনী কর্তৃত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের Personality cult দেখা যায়। এ ধরনের নেতা যখন দলীয় নেতৃত্ব কিংবা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে থাকেন তখন কর্তৃত্ব ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় স্থানান্তরিত হয় ঠিকই কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের সামনে অন্যরা নিষ্প্রভ থাকে। ফলে দলীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তি কেন্দ্রীকতার উদ্ভব ঘটে। কখনো কখনো ব্যক্তিগত ইমেজ সৃষ্টি হতে পারে; যেমন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। উন্নয়নশীল দেশে সম্মোহনী কর্তৃত্ব ছাড়াও Personality cult দেখা যায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলে পরিবারতন্ত্র এবং গণতন্ত্র চর্চার অভাবে; যেমনঃ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি। তবে এটি খুব দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয় না। এক পর্যায়ে নেতার সম্মোহনী কর্তৃত্ব কমতে থাকে। দলে কিংবা রাষ্ট্রে (সমাজে) এ ধরনের একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে এবং কর্তৃত্বের বৈধতা হুমকির সম্মুখীন হয়।

বৈধতার প্রশ্নটি সব সমাজে বা সব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এক রকম নয়; কিংবা বৈধতার সংকটের মাত্রাও এক রকম নয়। উন্নত শিল্পায়িত দেশগুলোতে কর্তৃত্ব বা তার বৈধতা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এ বিষয়টি প্রকট। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক আদর্শের দুর্বলতা, বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব বা গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বিকশিত না হওয়া, অনুন্নত সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইত্যাদি, সর্বোপরি একাত্মতার সংকট। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠার জন্য নিম্নরূপ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে:

  • ১। ক্ষমতার নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তন দরকার। নির্দিষ্ট সময়ে ও সুনির্দিষ্ট সর্বজনীন প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা পরিবর্তনের নিশ্চয়তা বিধান। শুধু সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকাই যথেষ্ট নয়। সব শ্রেণীগোষ্ঠীর সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া আবশ্যক।
  • ২। সমাজের সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুচিন্তিত (আবেগি নয়) রাজনৈতিক আদর্শ/মতাদর্শ স্থির করা এবং মতাদর্শের বাস্তবায়নে অঙ্গিকারবদ্ধতা আবশ্যক। তাহলে জনগণের আস্থা অর্জন করা যাবে।
  • ৩। জনগণের আস্থা সৃষ্টির জন্য সরকারি নীতি ও কর্মসূচি জনগণের নিকট পৌছানো জরুরি। এ জন্য যোগাযোগ কাঠামোকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা এবং প্রচার মাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সরকারের স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা বিধান করা গেলে বৈধতার সংকট প্রশমিত হতে পারে।
  • ৪। কর্তৃত্বের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক। বিকেন্দ্রীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু আজ্ঞাবহ হলে জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় না।
  • ৫। রাজনৈতিক অসাম্য দূর করতে হবে। সমাজে যথার্থ অর্থে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, সরকারি ক্ষমতা, সম্পদ ও সেবার সুষ্ঠু ও সুসমন্বিত বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে।
  • ৬। সরকারের আচরণে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। সকলকে প্রতিহিংসা পরায়ণতা, স্পর্শকাতরতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, বিদ্বেষ পরিহার করতে হবে।
  • ৭। রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। রাজনৈতিক কাঠামোর যথার্থ বিকাশ ঘটাতে হবে। সুনির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে গড়ে তুলতে হবে এবং তার ভিত্তিতে চলতে দিতে হবে। কোন প্রকার ব্যক্তিগত বা অন্য কোন রকমের হস্তক্ষেপ বা প্রভাব থেকে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে বৈধতার সংকট দূরীভূত হবে। তবে ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে দীর্ঘ প্রচেষ্টায় তা সম্পন্ন করতে হবে। রাতারাতি বা উচ্চাভিলাষী মনোভাব নিয়ে এ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা অসম্ভব।

তথ্যসূত্র 

  • রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব, মোকাদ্দেসুর রহমান, আজিজিয়া বুক ডিপো, ঢাকা, ২০১৩
  • অন্যান্য তথ্যসূত্র নিবন্ধের মধ্যেই রয়েছে

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.