এলিট তত্ত্ব

১৯৫০-এর দশকে সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। রাজনীতির গতানুগতিক বিশ্লেষণের বিকাশ হিসেবে এলিট মতবাদ তত্ত্বগত মর্যাদা অর্জন করে এ সময়। কারণ এলিট মতবাদ সরকারের রীতি-সিদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক উপাদান বা সংগঠনসমূহের পরিবর্তে সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ক্ষুদ্র একটি শ্রেণীর আচরণের উপর গুরুত্বারোপ করে। এ ছাড়া, সংঘাত ও স্তরবিন্যাসের আলোচনা করে এটি গোষ্ঠী তত্ত্বের প্রতিও হুমকি হিসেবে প্রতিভাত হয়। অন্যদিকে মার্ক্সবাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এলিট বিশ্লেষণের বিকাশ। মার্ক্সবাদ সমাজের স্তরবিন্যাসে উৎপাদন উপকরণকে প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে এবং যেহেতু সমাজে সকল মানুষ সমযোগ্যতাসম্পন্ন নয়, তাই স্তরভিত্তিক বিভাজনকে অপরিহার্য বলে বিশ্বাস করে। “এলিট থিওরিস্টরা যুক্তির দুটি মৌলিক লাইন ব্যবহার করেন। প্রথমত, তারা যুক্তি দেয় যে মানব প্রকৃতির কিছু দিক অভিজাতদের অনিবার্য করে তোলে। দ্বিতীয়ত, তারা যুক্তি দেয় যে কোনও সামাজিক সংগঠনকে কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য অভিজাতরা প্রয়োজনীয়।” (Ted Goertzel op. cit.)

এলিট মতবাদের অগ্রদূত হলেন Vilfredo Pareto, Gaetano Mosca Robert Michels, তবে এর বিস্তৃতি প্রাচীনকাল পর্যন্ত। Plato তার ‘The Republic’ গ্রন্থে দক্ষ শাসন গড়ে তোলার জন্য যেরূপ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলেছেন এবং প্রকৃত জ্ঞানী (দার্শনিক) ব্যক্তির হাতে আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনভার ন্যস্ত করার যে ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন তাতে এলিট শাসনের ধারণাই ফুটে উঠে। Aristotle সমাজকে দাস ও প্রভু দু’শ্রেণীতে ভাগ করেছেন এবং প্রভুদের হাতে শাসনভার তুলে দেয়ার কথা বলেছেন তার The Politics গ্রন্থের দাস তত্ত্বে। মসকার মতে, (The Ruling Class) সেইন্ট সাইমনই প্রথম এলিট মতবাদের ধারণা ব্যক্ত করেন। সাইমন সমাজকে পিরামিডের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এ পিরামিডের শীর্ষে বিজ্ঞানী, শিল্পী ও শিল্পপতিদের থাকা উচিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব তাদের হাতে ন্যস্ত হওয়া উচিত এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে তারা নির্বাচিত হবে, বংশ মর্যাদার ভিত্তিতে নয়। Plato, Aristotle কিংবা Simon একটি স্তরভিত্তিক সমাজের রূপরেখা তুলে ধরেন এবং উচ্চ এলিট শ্রেণীর হাতে শাসনভার অর্পণের কথা বলেন। সাধারণভাবে সব সমাজই স্তরবিন্যস্ত এবং সমাজের উচ্চস্তরে অবস্থানকারী সুবিধাভোগী একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী সমাজের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে সব সময়। এলিট মতবাদীদের মতে, প্রতিটি সমাজই দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত। এদের একটি হলো শাসক (এলিট) ও অপরটি হলো শাসিত (অএলিট)। ব্যক্তিগত গুণাবলিই মানুষকে শাসক ও শাসিত এ দু’শ্রেণীতে বিভাজিত করেছে। সমাজের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য এটি অপরিহার্য। Aristotle তার দাস প্রথায় ব্যক্তিগত গুণাবলির কারণে দাসদের উপর প্রভুদের শাসনের যে যুক্তি দেখিয়েছেন তার সুর ধ্বনিত হয় এখানে। এ ছাড়া H. Taine– এর চিন্তার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এলিটবাদীদের উপর। প্যারেটো, মসকা ও মিশেলস্ তিনজনই তার চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত। Taine ফরাসি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজা, অভিজাতশ্রেণী ও যাজক সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শাসকশ্রেণীর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে ‘The Ancient Regime’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন এলিটশ্রেণী ফরাসি বিপ্লবকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রাচীন চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্য একজন চিন্তাবিদ Gumplowitz-এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তার মতে, রাজনৈতিক এলিট জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় শ্রেষ্ঠ, তাই এ শ্রেণী সংখ্যালঘু হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠদের উপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। অন্যদিকে মার্ক্স শ্রেণী বিশ্লেষণ করলেও এলিটবাদীদের উপর তারও প্রভাব লক্ষণীয়।

এলিটের সংজ্ঞা (Definition of Elite)

এলিট তত্ত্বে শাসক বলতে রাজনৈতিক এলিটকে বুঝানো হয়েছে, যারা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

  • “রাজনৈতিক এলিট হল সেই গোষ্ঠী যা সর্বাধিক রাজনৈতিক ক্ষমতা ধারণ করে এবং যা সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়। এটি সেই সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত যারা রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে সক্রিয়।” (Bill and Hardgrave, p. 144.)
  • “একটি রাজনৈতিক এলিট একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার শীর্ষ শক্তি গোষ্ঠী; তারা এমন লোক যারা ক্ষমতা চালাতে সক্ষম যাতে তারা লক্ষ্য অর্জন করতে পারে।” (The Modernizers, ‘Introduction in Finkle and Gable ed. Political Development and Social Change, (2nd ed.), 1971, p-233.)
  • T.B. Bottomore বলেন, “যে কারণেই হোক না কেন সমাজে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বৃত্তিমূলক, বিশেষ করে পেশাভিত্তিক গোষ্ঠীই হলো এলিট”। (Bottomore, Elite and Society, 1964, p. 8.)
  • “একটি সমাজ যে যোগ্যতাকে পুরস্কৃত করে তার মধ্যে যাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা থাকে তারাই রাজনৈতিক এলিট হয়ে ওঠে।” (Ted Goertzel.)
  • “যে কয়জন যে কোন মূল্যবোধের সবচেয়ে বেশি পায় তারা এলিট , বাকিরা র ্যাঙ্ক এবং ফাইল।” (Harold Lasswell, World Politics and Personal Insecurity, 1964, p. 8.)

 এলিট মতবাদ (The Theory Itself)

এলিট মতবাদ সমাজের স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে উচ্চ মর্যাদাশীল গোষ্ঠীর আচরণ ও মনোভাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক আলোচনার দ্বার উন্মোচন করে। নিচে প্রধান তিন এলিট তাত্ত্বিকের মতবাদ। তুলে ধরা হলোঃ

প্যারেটো (Pareto)

“The Mind and Society’ (1935) গ্রন্থে প্যারেটো তার বক্তব্য তুলে ধরেন। তার মতে, সমাজে সবসময় দু’টি শ্রেণী রয়েছে- জনগণ ও এলিট। “Every people is governed by an elite, by a chosen element in the population… it is always an oligarchy that governs.” (প্রতিটি জাতি একটি এলিট শ্রেণী দ্বারা শাসিত হয়, জনসংখ্যার একটি নির্বাচিত উপাদান দ্বারা… এটি সর্বদা একটি অভিজাততন্ত্র বা অলিগার্কি যা শাসন করে।) তিনি বলেন, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুণসম্পন্ন ব্যক্তিগণই এলিট। এলিট দু’শ্রেণীতে বিভক্ত শাসক এলিট ও অশাসক এলিট। শাসক এলিটগণই মূলত রাজনৈতিক এলিট। প্রত্যক্ষভাবে শাসন কাজে সংশ্লিষ্ট এলিটগণই হলো শাসক এলিট; যেমন: নির্বাহী বিভাগের সদস্যগণ। অন্যান্য রাজনৈতিক এলিটগণ হলো অশাসক এলিট। এলিটদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যক্তিগত গুণাবলি। প্যারেটো এগুলোকে Residues বলে উল্লেখ করেন। Residues ছয় প্রকার হলেও দু’প্রকার গুণাবলিই রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম শ্রেণীর গুণাবলি হলো বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, তথ্যসমৃদ্ধি ও কার্য পরিচালনা কৌশল। দ্বিতীয় শ্রেণীর গুণাবলির মধ্যে শক্তি, আনুগত্য, দেশপ্রেম ও রক্ষণশীলতা অন্যতম। তার মতে, শাসক শ্রেণীর সদস্য হবার ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর গুণাবলির সমন্বয় বা সম্মিলন প্রয়োজন। প্যারেটোর তত্ত্বের অন্য একটি দিক হলো Darivations, যার দ্বারা তিনি কর্মের যৌক্তিকতাকে বুঝিয়েছেন। সমন্বিত গুণাবলি দ্বারা শুধু কার্য সম্পাদনই যথেষ্ট নয়, এর জন্য কর্মের যৌক্তিকতাও (Rationalization) গুরুত্বপূর্ণ।

মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যে এলিট শাসন তার দু’টি দিক রয়েছে। এক শ্রেণীর শাসক এলিট তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি, বিবেচনা ইত্যাদির দ্বারা শাসন পরিচালনা করেন। প্যারেটো পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে এ ধরনের শাসনের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে কিছু শাসক শক্তির প্রয়োগে শাসন পরিচালনা করেন; যেমন: একনায়কতন্ত্র, একদলীয় শাসন, কিংবা সামরিক শাসন।

প্যারেটো তার আলোচনায় এলিটের বিকাশ ও পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরেন এলিট আবর্তন (Circulation of elite) নামে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের কারণে বিশেষ করে শাসক এলিটের মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে। কোন কারণে শাসক এলিটের গুণাবলি হ্রাস পেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এলিট শ্রেণীর প্রতিস্থাপন (Replacement) হতে পারে। আবার, সাধারণের মধ্য থেকে এলিট গুণাবলি অর্জনের দ্বারা কোন অশাসক এলিট শাসক এলিটে পরিণত হতে পারে। “The decay in quality and lose their vigoar, They may become soft and ineffective with the pleasure of easy living and the privileges of power, or set in their ways and too in flexible to respond to changing circumstances.” (M. Haralambos, Sociology, 1980, p. 108.)

সংকীর্ণ বা অনমনীয় শাসক এলিট সমাজে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী। “According to Pareto, a closed and inaccessible political elite is the greatest cause of instability and always foreshadows revolution and upheaval.” (Bill and Hardgrave p-152.)

এলিট আবর্তনের মাধ্যমে এলিটশ্রেণীর গতিশীলতা বজায় থাকে। যে এলিট শ্রেণীতে জনগণের মধ্য থেকে যোগ্যতা অর্জনকারী নতুন এলিটকে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ না থাকে সে এলিটশ্রেণীর বিরুদ্ধে বিপ্লবের আশংকা সৃষ্টি হয়। ফলে সমাজে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।

এলিট আবর্তনের দ্বারা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এলিটশ্রেণীকে বলপ্রয়োগ যেমন করতে হয়, তেমনি শুধু শক্তি প্রয়োগের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে চাইলে সে শাসক এলিটের পতন অনিবার্য। কাজেই এলিট আবর্তন এবং শক্তি ও কৌশলের সমন্বয় সাধন আবশ্যক।

মস্কা (Mosca)

মসকা তার ‘The Ruling Class’ (1939) গ্রন্থে যুক্তিপ্রদর্শনপূর্বক উল্লেখ করেন যে, প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দু’টি শ্রেণী রয়েছে- (ক) রাজনৈতিক শ্রেণী ও (খ) অরাজনৈতিক শ্রেণী (প্যারেটো যেগুলোকে শাসক ও অশাসক এলিট বলেছেন) এবং সব রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই এলিট শ্রেণীর অস্তিত্ব লক্ষণীয়। প্রাচীন সমাজ হতে আধুনিক সমাজ পর্যন্ত, উন্নত অনুন্নত সকল সমাজে দু’টি শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ শাসক শ্রেণী এবং অন্যটি সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসিত শ্রেণী। দ্বিতীয় শ্রেণী প্রথম শ্রেণীর অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগান দিয়েছে এবং রাজনৈতিক কাঠামোর প্রয়োজনীয় প্রাণশক্তির নিয়ামক (সমর্থন) যুগিয়েছে। ফলে সংখ্যালঘিষ্ঠ শাসক শ্রেণী সকল রাজনৈতিক কার্য সম্পাদন করে এবং একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতা চর্চা করে ও ক্ষমতার কারণে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বিতীয় শ্রেণী প্রথম শ্রেণী কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। “In all societies from societies that are very meagerly developed and have barely attained the dawning of civilization, down to the most advanced and powerful societies two classes of people appear – a class that rules and a class that is ruled. The first class always the less numerous performs all political functions, monopolizes power and enjoys the advantages that power brings, whereas the second, the more numerous class, is directed and controlled by the first, in a manner that is now more or less legal, now more or less arbitrary and violent, and supplies the first, in appearance at least, with material means of subsistence and with the instrumentalities that are essential to the vitality of the political organism. ” (যে সমাজগুলো খুবই স্বল্প বিকশিত এবং সবেমাত্র সভ্যতার ঊষালগ্ন হয়েছে, সেসব সমাজ থেকে শুরু করে সবচেয়ে অগ্রসর ও শক্তিশালী সমাজ পর্যন্ত দুই শ্রেণীর মানুষের আবির্ভাব ঘটে- একটি শ্রেণী যা শাসন করে এবং একটি শ্রেণী যা শাসিত। প্রথম শ্রেণী সর্বদাই কম সংখ্যায় সমস্ত রাজনৈতিক কার্য সম্পাদন করে, ক্ষমতার একচেটিয়া অধিকার করে এবং ক্ষমতা যে সুবিধা নিয়ে আসে তা উপভোগ করে, অন্যদিকে দ্বিতীয়টি, অসংখ্য মানুষের শ্রেণি, প্রথমটির দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়, এমনভাবে যা এখন কমবেশি বৈধ, এখন কমবেশি স্বেচ্ছাচারী এবং হিংস্র, এবং প্রথমটি সরবরাহ করে, অন্ততঃ চেহারাতে, জীবিকা নির্বাহের বস্তুগত উপকরণ এবং রাজনৈতিক জীবের জীবনীশক্তির জন্য অপরিহার্য উপকরণগুলির সাথে।) (Mosca, The Ruling Class, p. 50.)

মসকা তার তত্ত্বে কয়েকটি মৌলিক বিষয় তুলে ধরেন:

  • (ক) Social Force ভূমি, অর্থ, শিক্ষা ও সামরিক শক্তির ভিত্তিসমৃদ্ধ ক্ষমতা;
  • (খ) Political Formula সার্বজনীন নৈতিক নীতিমালা যার মাধ্যমে ক্ষমতার চর্চা বৈধতা বা যৌক্তিকতা প্রাপ্ত হয়;
  • (গ) Social Type ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম; সামাজিক বন্ধনের মৌলিক বিষয়, যেমন: একই নৃগোষ্ঠী, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম
  • (ঘ) Judicial Defence-আইনের শাসন যা ব্যক্তির নৈতিক চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলিত করে; এবং
  • (ঙ) Political Class রাজনৈতিক এলিট যারা মূলত শাসন কাজে জড়িত ও রাজনৈতিক কার্য সম্পাদন করে।

প্রধানত দু’টি বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। প্রথমত, রাজনৈতিক শ্রেণীর (এলিট) প্রকৃতি; দ্বিতীয়ত, এলিটের সংরক্ষণ ও পরিবর্তন।

মসকার মতে, এলিট শ্রেণী সমাজে উচ্চমর্যাদার অধিকারী। সব সমাজেই রাজনৈতিক শ্রেণী শাসনকার্য পরিচালনা করে। মসকা বিশ্বাস করেন যে সংখ্যালঘিষ্ঠের শাসন সমাজে অপরিহার্য, কারণ এ গোষ্ঠী বৃহৎজনগোষ্ঠীর চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন। তিনি বলেন, উন্নত-অনুন্নত সব দেশেই এলিট শ্রেণীই শাসন ক্ষমতার অধিকারী। সংখ্যায় কম হলেও এ শ্রেণী সুসংহত হবার কারণে প্রজ্ঞা-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার অধিকারী। তবে এ গোষ্ঠীর মর্যাদা ও ক্ষমতার ভিত্তি (পটভূমি) সমাজ ভেদে ভিন্ন রকম হয়। আদিম সমাজে সামরিক শক্তি (Military Valor) ছিল মর্যাদার ভিত্তি। সমাজের বিবর্তনে ধর্মীয় প্রতীক মর্যাদার ভিত্তি হিসেবে পরিণত হয়। আর একটু উন্নত সমাজে অর্থ এবং আধুনিক সমাজে বিশেষায়িত জ্ঞান-মর্যাদার ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মর্যাদার ভিত্তি অনেক বিস্তৃত। এ সমাজে ব্যাপক সামাজিক পটভূমি হতে এলিট নিয়োগ হবার সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। ফলে শাসনকার্যে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তার মতে, আধুনিক প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্রে সব সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও গণতন্ত্র জনগণ দ্বারা শাসন নয়। কারণ সব গোষ্ঠীর এলিটগণই শাসনের মর্যাদা পায়। সব সমাজেই একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী (Oligarchy) ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থিত এবং রাষ্ট্র সুসংহত এ গোষ্ঠীর হাতিয়ারস্বরূপ।

মসকা মনে করেন যে, এলিটের সংরক্ষণ ও পরিবর্তন বুঝতে পারলে একটি সমাজের ধারাবাহিকতা ও পরিবর্তন বোঝা যাবে। তিনি মনে করেন জীবন পদ্ধতির একাত্মতা (Identity of life way) বা নিজস্বতা রক্ষায় বৈদেশিক হুমকির মোকাবিলার জন্য জনগণ এলিটদের সমর্থন করে। রাজনৈতিক সূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে এলিট তাদের ক্ষমতার নৈতিক ও আইনগত যথার্থতা প্রচার করে। তাছাড়া ধারাবাহিকভাবে এলিট শ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে লোক সংগ্রহ করে বা এলিট শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করে। এভাবে তারা সামরিক বাহিনীর সমর্থনও আদায় করে ও অস্তিত্ব বজায় রাখে (এলিট আবর্তন)। মূলত এলিট শ্রেণী সংখ্যালঘু হয়েও শাসন ক্ষমতায় আসীন থাকে।

রবার্ট মিশেলস (Robert Michels)

এলিট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মিশেলস যে দু’টি বিষয়ের অবতারণা করেন তা হলো কতিপয়ের শাসন (Oligarchy) ও সংগঠন (Organizations)। তার মতে, সব রাজনৈতিক ব্যবস্থা কতিপয়ের শাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বা সংগঠিত (Political Party)। কতিপয় বলতে তিনি শাসক এলিট আর সংগঠন বলতে রাজনৈতিক দলকে বুঝিয়েছেন। মিশেলস্ বলেন যে, সব রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকে কতিপয় ব্যক্তি। দলীয় সংগঠনের জন্য কতিপয় ব্যক্তির কর্তৃত্বকে তিনি অপরিহার্য বলে বিশ্বাস করেন। (The Inevitability of Oligarchy in Party Life. p-ix)। তার মতে, রাজনৈতিক দলের সংগঠনে বাহ্যিকভাবে গণতন্ত্রের প্রকাশ ঘটলেও সকল দলীয় সংগঠনে অভিজাততন্ত্রের বা কতিপয়ের কর্তৃত্বের প্রবণতা লক্ষণীয়। সকল মানবীয় সংগঠনের মধ্যে তিনি কতিপয়ের কর্তৃত্বের তীব্র প্রবণতা লক্ষ্য করেন যার দ্বারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা চলে। কতিপয়ের কর্তৃত্বের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন; যেমনঃ (ক) রাজনৈতিক দল (ও অন্যান্য সংগঠন) কেন সব সময় কতিপয়তন্ত্রে সংগঠিত? (খ) কতিপয়তন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য কেমন? এবং (গ) কতিপয়তন্ত্র কিভাবে নিজেকে সংরক্ষণ করে?

মিশেলস্ কতিপয় বলতে প্যারেটোর শাসক এলিট ও মসকার রাজনৈতিক এলিটের সমার্থক গোষ্ঠীকে বুঝিয়েছেন। এ গোষ্ঠী কিভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে অর্থাৎ রাজনৈতিক সংগঠন কেন কতিপয় দ্বারা সংগঠিত তার যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি এভাবে:

  • ১। যেহেতু যে কোন বৃহৎ সংগঠনে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন তাই কার্যকর ব্যবস্থার স্বার্থে বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। আর বিশেষজ্ঞদের মনোনয়ন বা নির্বাচনের মাধ্যমেই সূচনা হয় কতিপয়ের কর্তৃত্বের।
  • ২। সংগ্রামের মাধ্যম হলো রাজনৈতিক সংগঠন। নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে দল ক্ষমতায় আসীন হতে চায়। কাজেই সংগঠনে নিয়ম-শৃঙ্খলা ও ঐক্যবদ্ধভাবে কার্য পরিচালনা আবশ্যক এবং এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন কতিপয় ব্যক্তির হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন হয়।
  • ৩। এ ছাড়া, কতিপয়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। দক্ষতার অভাবে জনগণ নিজেদের কার্য পরিচালনা করতে অক্ষম এবং অধিকাংশ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ রাজনৈতিক কার্যকলাপে উদাসীন। তাদের পরিচালনা করতে হয়, দিক-নির্দেশনা দিতে হয়। ফলে রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কতিপয় ব্যক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়।

কতিপয়ের আধিপত্য বজায় থাকার ক্ষেত্রে মিশেলস তাদের ব্যক্তিগত গুণাবলি, এ শ্রেণীর গঠন ও সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের (কতিপয়ের) রাজনৈতিক প্রবণতা বা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তার মতে, এ শ্রেণী বুদ্ধিবৃত্তিতে শ্রেষ্ঠ। সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক একদিকে দ্বন্দ্বের, অন্যদিকে সহযোগিতার। দ্বন্দ্ব হলো প্রবীণ ও নবীন সদস্যের মধ্যে। রাজনৈতিক দিক হতে এ শ্রেণী রক্ষণশীল এবং নিজেদের অবস্থান স্থায়ী করতে আগ্রহী। ধারাবাহিক অস্তিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে তারা যেসব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তা হলো: (ক) সাধারণ নৈতিক নীতিমালা অনুসরণ, (খ) সততা, বিশ্বস্ততা, ত্যাগ ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, (গ) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলা ও দায়িত্বহীনতা রোধ, এবং (ঘ) জনগণের মধ্য থেকে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার সামর্থ্য। নিজেদের গৃহীত নীতিমালার পক্ষে সমর্থন আদায়ে কতিপয় শ্রেণী নৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে যাকে মসকা রাজনৈতিক সূত্র এবং প্যারেটো Derivation বলে আখ্যায়িত করেছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এ শ্রেণী সাধারণ স্বার্থের নামে যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে নিজেদের ও তাদের নীতিমালার পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। এ ছাড়া উচ্চ মাত্রায় সততা, ত্যাগ ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম।

তবে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা অনেকখানি অভ্যন্তরীণ বিরোধ এড়িয়ে চলার সময়ের উপর নির্ভর করে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঐক্য বজায়ও জরুরি। তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে এ শ্রেণীর ক্ষমতার অপব্যবহার ও দায়িত্বহীনতার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এ প্রবণতা, নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। জনগণের মধ্য থেকে নতুন সদস্য শ্রেণীভুক্ত করার দ্বারা কতিপয়ের আধিপত্যের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। এ প্রক্রিয়াকে Michels ‘কতিপয়ের কঠোর নিয়ম’ (Iron law of oligarchy), প্যারেটো ও মসকা ‘এলিট আবর্তন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

সি.ডব্লিউ. মিলস্ (C. W. Mills)

এলিট তত্ত্বে C.W. Mills বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি তার ‘The Power Elite’ (1959) নামক গ্রন্থে এলিট বিশ্লেষণকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলেন। তার মতে, “A power elite, meaning those political, economic and military circles which as an intricate set of overlapping cliques share decisions having at least national consequences.” (Cited, in Comparative Politics, Bill and Hardgrave, p163.) (পাওয়ার এলিট হল তারা যারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক বৃত্ত যারা ওভারল্যাপিং চক্রের একটি জটিল সেট হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যেগুলোর ক্ষেত্রে অন্তত জাতীয় মাত্রায় পরিণতি থাকে।) প্যারেটো ও মসকা যেখানে সব সমাজে ক্ষমতার প্রকৃতি ও বণ্টনের সাধারণ সূত্র প্রদানের চেষ্টা করেন মিলস্ এলিট তত্ত্বের বিস্তৃত সংস্করণ উপস্থাপন করেন। অন্য তাত্ত্বিকদের মত এলিট শাসনের অপরিহার্যতায় তিনি বিশ্বাস করেন না। মিলস্ এলিট শাসনকে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিচার না করে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন। তার মতে, মানুষের ক্ষমতার কেন্দ্র হলো প্রতিষ্ঠান। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষমতার উৎস হলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানে তাদের নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থান। প্রতিষ্ঠানই স্থির করে কে ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। এলিটগণ খুব সুসংহত তাও ঠিক নয়। প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্বকারী প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ নিজেদের স্বার্থ অর্জনে যে সুযোগ লাভ করে তার মাধ্যমে তারা সম্মিলিতভাবে সহজে নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করে। ‘এলিটগণ সাধারণ জনগণের চেয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন’ এ কথা তিনি স্বীকার করেন না; বরং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে এলিটগণ ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করে। কিছু প্রতিষ্ঠান সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এবং এলিটগণ এসব প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্বমূলক ও নির্দেশ প্রদানের অবস্থানে থাকে বলেই সমাজে বা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা চর্চা করে। এ প্রসঙ্গে মিলস্ তিন ধরনের (মার্কিন) প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেন। প্রধান সংস্থা, সামরিক বাহিনী ও কেন্দ্রীয় সরকার। এ তিন প্রতিষ্ঠানের এলিটগণ সাধারণ স্বার্থ ও একই প্রকৃতির কাজের দ্বারা পরস্পর সম্পর্কিত ও সংগঠিত। মিলস্ এদেরকে ক্ষমতা এলিট (Power Elite) বলে আখ্যায়িত করেছেন।

মূলত তিনি মার্কিন সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার আলোকে এ ব্যাখ্যা তুলে ধরেন, যেখানে এ তিন শ্রেণী ও ক্ষমতার সমন্বয় সাধিত হয়েছে। মিলস্-এর মতে, সদস্যদের সামাজিক পটভূমি এবং তিন শ্রেণীর সদস্যদের পারস্পরিক বিনিময় এবং আন্তঃশ্রেণী অতিক্রমণ ও মনস্তাত্ত্বিক ঐক্য এলিটদের সংহতিকে দৃঢ় করে। (“The cohesiveness and unity of the power elite is strengthened by the similarity of the social background of its members and the interchange and overlapping of personnel between the three elites.”) মার্কিন সমাজব্যবস্থায় এসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক এলিটগণ সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ এবং তারা নিজ নিজ স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন থেকে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতার ভিত্তিতে ক্ষমতা প্রয়োগ করে।

এলিট তত্ত্বের গুরুত্ব

এলিট তত্ত্ব প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে তুলনামূলক বিশ্লেষণে-সমস্যা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এ পদ্ধতি সমাজে ক্ষমতাভোগী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এটি এলিটদের উদ্দেশ্য ও প্রবণতা বুঝতে সাহায্য করে। এলিট তত্ত্ব প্রকৃত ক্ষমতাভোগী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের বিষয়ে অধিক মনোযোগ আকর্ষণের দ্বারা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের আলোচনার বিকল্প পদ্ধতি দাঁড় করেছে। ক্ষমতাভোগীদের কার্যক্রম চিহ্নিতকরণ ও কার্যাবলি পর্যালোচনা করে এলিটদের রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণে সাহায্য করে এলিট তত্ত্ব। এটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিকারী, সংবিধান পরিবর্তনকারী, পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদানকারী, সিদ্ধান্তগ্রহণকারী বা ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তিবর্গকে গুরুত্ব প্রদান করে। অর্থাৎ উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের কার্যক্রম, আচার-আচরণ বিশ্লেষণের দ্বারা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করতে সাহায্য করে। যেহেতু এলিট তত্ত্ব রাজনৈতিক এলিটকে আলোচনার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করে তাই এতে নিয়ন্ত্রণযোগ্য পর্যালোচনা সম্ভব। ফলে এর গ্রহণযোগ্যতা সর্বাধিক। অন্যদিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ হয় বলে এলিট তত্ত্বে সুস্পষ্ট ও গভীরতম অনুসন্ধান সম্ভব হয়। উপরন্তু সব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যেহেতু এলিট বর্তমান তুলনামূলক আলোচনায় এলিট তত্ত্বের সার্বজনীন ব্যবহার সম্ভব।

উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতি বিশ্লেষণে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে এলিট তত্ত্ব ব্যবহার করা যায়। সমাজে কিছু ক্ষমতাভোগী এলিট যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান না করেও প্রভাব বিস্তার করে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষমতা চর্চা করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মন্ত্রিপরিষদ সকল কার্যক্রম যৌথভাবে পরিচালনা করলেও ছোট একটি গোষ্ঠী সব সময়ই অধিক প্রভাব বিস্তার করে ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামরিক হস্তক্ষেপের পর বেসামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠন ও পরিচালনা করা হলেও প্রকৃত ক্ষমতা থাকে সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে। এলিট বিশ্লেষণ এসব প্রকৃত ক্ষমতাভোগীদের শনাক্ত করতে সাহায্য করে এবং তাদের মনোভাব ও চিন্তাধারার কারণে রাজনীতির নির্দিষ্ট ধারা বিশ্লেষণে সাহায্য করে। এলিট তত্ত্বে সামর্থ্যের বিচারে এলিট শ্রেণীতে সদস্য অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। ব্যক্তির সামর্থ্যের হ্রাস ঘটলে অর্থাৎ কোন সদস্যের ব্যক্তিগত গুণাবলি বা সামর্থ্যের ঘাটতি দেখা দিলে সে ব্যক্তি এলিট শ্রেণীভুক্ত থাকবে না। আবার, জনগণের মধ্যে ব্যক্তিগত গুণাবলি বিকাশের দ্বারা সামর্থ্য অর্জনকারী কোন ব্যক্তি এলিট শ্রেণীভুক্ত হতে পারে। এভাবে এলিট আবর্তনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে এলিট ‘তাত্ত্বিকগণ এলিট শ্রেণীর গতিশীলতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

এলিট তত্ত্বের অন্যতম চিন্তাবিদ Mills এলিট বিশ্লেষণে ক্ষমতাভোগী ও চর্চাকারী, অন্যকথায় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এলিটদের চিহ্নিত করার উপায় নির্দেশ করেছেন। তার মতে, সব সমাজে এমন কতকগুলো প্রতিষ্ঠান থাকে যার কর্তাগণ নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন; যেমনঃ রাষ্ট্রীয় নীতিগুলো রাজনৈতিক পর্যায়ে অর্থাৎ আইনসভায় গৃহীত হয়, কিন্তু এগুলো প্রণীত হয় অরাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিক পর্যায়ে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সচিবগণই প্রকৃত ক্ষমতার চর্চা করেন। মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা চর্চা করেন মন্ত্রিগণ। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় প্রধান নির্বাহী হিসেবে রাষ্ট্রপতি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আমলা, মন্ত্রিসভা, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ছাড়াও আরো কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার কর্মকর্তাগণ ক্ষমতা চর্চা করেন; যেমনঃ বাংলাদেশে পরিকল্পনা কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, কর্পোরেশন, বোর্ড ইত্যাদি। এসব সংস্থার কর্মকর্তাগণ ক্ষমতা প্রয়োগকারী এলিট, যার বিশ্লেষণ এলিট তত্ত্বের মাধ্যমে সম্ভব।

এলিট তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা

নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এলিট তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তথাপি এর কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। একটি তত্ত্ব গড়ে তোলার জন্য যেমন তাত্ত্বিক কাঠামো প্রয়োজন সে তুলনায় এলিট তত্ত্বের কাঠামো অনেক দুর্বল। এলিট তাত্ত্বিকগণ তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধারণা; যেমন: এলিট, ক্ষমতা, প্রভাব, কর্তৃত্ব ইত্যাদি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞায়িত করেন নি। এ প্রত্যয়গুলো তারা কম-বেশি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রয়োগ করেছেন। বিষয়গুলোর ব্যাপারে তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এ ছাড়া, Power elite, Political elite or Ruling elite-এ ধারণাগুলোর বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। ফলে তত্ত্বগত ধারণার ব্যাপারে ঐকমত্য না থাকায় তত্ত্বগঠন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে।

সমাজে এলিট শ্রেণীকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সহজ নয়। কারণ সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিগণ এলিট, আবার কারো কারো মতে এসব শীর্ষ ব্যক্তি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীগণ আত্মপ্রকাশ করে না। ফলে এলিট শ্রেণী চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। এলিট তত্ত্ব একটি এলিট শ্রেণীকে শনাক্ত করার কৌশল ব্যাখ্যা করে না। এলিটদের বৈশিষ্ট্যের তথ্য সংগ্রহ সহজ নয়। রাজনৈতিক এলিটদের আচরণ ও আর্থ-সামাজিক ভূমিকার ব্যাখ্যায় এলিট তত্ত্বে অস্পষ্টতা রয়েছে।

Power elite, Political elite, Ruling elite প্রত্যয়গুলোর মধ্যে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। Power elite বলতে যদি কোন প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীকে বোঝায়, তাহলে প্রশ্ন জাগে যে প্রতিষ্ঠানের বাইরে অবস্থানকারী কোন এলিট কি Power elite-এর সদস্য হতে পারে না? অবশ্যই এ কথা সত্য যে, সব সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার এলিট থাকে না। তাহলে কোন ব্যক্তি কিভাবে বুঝবে যে কোনগুলো প্রধান সিদ্ধান্ত এবং কিভাবে এগুলো গৃহীত হচ্ছে? সুতরাং প্যারেটো, মসকা ও মিশেলস- এর ব্যবহৃত প্রত্যয়গুলো সংশয়পূর্ণ।

এলিট তত্ত্বে সামাজিক পটভূমিতে এলিটদের গুণাগুণ ও আচরণ বিশ্লেষণ করে ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাবার যে চেষ্টা করা হয় তা যথার্থ নয়। “To leap some knowledge of the social backgrounds of national politicians to inferences about the power structure of the society is quite dangerous. Even to proceed from such knowledge to judgements about the political behaviour of these same politicians can be treacherous.” (Frederick W. Frey, the Turkish Political Elite, MIT Press, 1965, p-157.)

প্যারেটো, মসকা, মিশেলস কিংবা মিলস্ এলিট বিশ্লেষণে ভিন্ন কিছু প্রত্যয় ব্যবহার করলেও ধারণার দিক থেকে এগুলো অভিন্ন; যেমন: প্যারেটোর শাসক এলিট, মসকার রাজনৈতিক শ্রেণী, মিশেলস্-এর অক্ষতা ক্ষমতা এলিট (কতিপয় শাসক)। শাসন কৌশলকে প্যারেটো Derivation ও মসকা রাজনৈতিক সূত্র এবং মিশেলস্ বলেছেন সাধারণ নৈতিক নীতিমালা, চিন্তাবিদগত তাদের বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছেন কয়টি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মাধ্যমেঃ অধিক সক্রিয়, (ঘ) রাজনৈতিক এলিটের সাধারণ বৈশিষ্ট্য কেমন? (ঙ) এলিটের সাথে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্ক কেমন? (চ) সমাজে অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে কিভাবে এলিটগণ সম্পর্ক বজায় রাখে? (ছ) রাজনৈতিক এলিট নিজের অবস্থান কিভাবে সংরক্ষণ (ক) কে শাসন করে? (খ) কে/কারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে? (গ) কারা রাজনৈতিকভাবে করে ও সুদৃঢ় করে? এ বিষয়গুলো ইতঃপূর্বে বিচ্ছিন্নভাবে উত্থাপিত হলেও এলিট তাত্ত্বিকগণ বিষয়গুলোকে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। রাজনৈতিক কাঠামোর বিধিবদ্ধ কাঠামোর উপর জোর না দিয়ে তারা উদ্ভাবন করার চেষ্টা করেছেন বাস্তবে কে/ কারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, কিভাবে করে বা কেন করে। এলিট তাত্ত্বিকগণ তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাজনৈতিক এলিটের উপস্থিতির ব্যাখ্যা করেন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক ব্যাখ্যার জন্য তারা এলিট তত্ত্ব গড়ে তোলেন। তবে তাদের মতবাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। মিশেলস্ কিছু তথ্য ব্যবহার করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেও মসকা ও প্যারেটোর আলোচনা ছিল প্রধানত ঐতিহাসিক তুলনায় সীমাবদ্ধ। বিশ্বের বিরাজমান বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদাহরণ বিশ্লেষণ করে তারা উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা সফলভাবে ও কার্যকরভাবে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ করেন নি। এ ছাড়া, ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে বাস্তব অভিজ্ঞতামূলক কৌশল অনুপস্থিত। পর্যবেক্ষণমূলক স্পষ্টতা ও প্রত্যয়গুলোর মধ্যে সম্পর্ক পরিমাপের বিষয়টি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। প্যারেটো ও মসকা তাদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের উপর বেশি নির্ভর করেছেন। প্যারেটো, মসকা ও মিশেলস্-এর পদ্ধতি শুধু কল্পনাপ্রসূত কাঠামোতে সীমিত। তাদের ব্যবহৃত ‘ক্ষমতা’, ‘প্রভাব’, ‘শ্রেণী’, ‘মর্যাদা’ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রত্যয়ের স্পষ্ট কোন সংজ্ঞা তারা দেন নি।

তুলনামূলক রাজনীতিতে প্যারেটো, মসকা ও মিশেলস্-এর অবদান দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। পরবর্তীতে তুলনামূলক রাজনীতির আলোচনায় এলিটদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা অনেক গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। T.B. Bottomore, Suzanne Keller, William Kornhauser, G. Parry, Floyd Hunter. Lasswell, Mills-সহ অনেক চিন্তাবিদ সনাতন এলিটবাদের অনেক উন্নতি সাধন করেছেন। Lasswell বিভিন্ন ক্ষেত্রে সনাতন এলিটবাদ পরীক্ষা ও ব্যবহার করেছেন আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। আন্তঃজাতীয় তুলনামূলক আলোচনায় এলিট মতবাদের ব্যবহার হচ্ছে অনেক।

তথ্যসূত্র 

  • রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব, মোকাদ্দেসুর রহমান, আজিজিয়া বুক ডিপো, ঢাকা, ২০১৩
  • অন্যান্য তথ্যসূত্র নিবন্ধের মধ্যেই রয়েছে

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.