ইংল্যান্ডে টিউডর যুগের সূচনা ও সপ্তম হেনরী (১৪৮৫-১৫০৯)

Table of Contents

টিউডর যুগ (১৪৮৫-১৬০৩)

টিউডর বংশের উৎপত্তি বা আদি পরিচয়

ওয়েন টিউডর টিউডর বংশের আদি পুরুষ : ইংল্যান্ডের ওয়েলসে ওয়েন টিউডর নামে একজন নাইট ছিলেন। এ টিউডর পরিবার থেকে ইংল্যান্ডের টিউডর রাজবংশের উৎপত্তি হয়। ওয়েন টিউডর ল্যাঙ্কাস্টার বংশীয় রাজা পঞ্চম হেনরীর (১৪১৩-১৪২২) বিধবা পত্নী ক্যাথারিনকে বিবাহ করেন। তাঁর দুই পুত্র ছিল। তাঁদের নাম ছিল এডমান্ড টিউডর ও জেসপার টিউডর। তাঁরা তাঁদের বৈপিত্রেয় ভাই রাজা ষষ্ঠ হেনরী (১৪২২-৬১, ১৪৭০-৭১) কর্তৃক যথাক্রমে রিচমন্ড ও পেমব্রোকের আর্ল পদে অধিষ্ঠিত হন। এড্‌মান্ড টিউডর ল্যাঙ্কাস্টার বংশীয় সোমারসেটের ডিউকের কন্যা লেডী মার্গারেট বুফোর্টকে বিবাহ করেন। তাঁদেরই একমাত্র সন্তান রিচমন্ডের আর্ল হেনরী টিউডর ইংল্যান্ডের টিউডর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি সপ্তম হেনরী (১৪৮৫-১৫০৯) উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।

টিউডর যুগের (টিউডর শাসনামলের) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • শক্তিশালী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা : প্রথমত, ইংল্যান্ডের টিউডর শাসনকালের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এ যে, এ যুগে ইংল্যান্ডে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। টিউডর রাজাগণ বিভিন্ন পন্থায় সমস্ত শক্তিকে কঠোরভাবে দমন এবং প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে, নতুন নতুন কার্যকরি কেন্দ্রীয় সংগঠন ও বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করে এবং শাসনবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে অনুগত ও বিশ্বস্ত লোক নিয়োগ করে ‘টিউডর স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘নতুন রাজতন্ত্র’ নামে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন।
  • শক্তিশালী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের জন্ম : দ্বিতীয়ত, টিউডর শাসনকালেই পরবর্তীকালের শক্তিশালী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের জন্ম ও প্রতিপালন হয়েছিল। টিউডর শাসকগণ ইচ্ছাকৃতভাবে সামন্ত প্রভুগণকে যথাসম্ভব বর্জন করে বিত্তবান ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত ও প্রতিভাবান ব্যক্তিগণকে শাসনবিভাগের উচ্চ পদে নিযুক্ত এবং পার্লামেন্টের অন্তর্ভুক্ত করতেন। ফলে মধ্যবিত্তরাই ক্রমান্বয়ে দেশের ও জাতির মেরুদণ্ডে পরিণত হয়েছিল।
  • পার্লামেন্টের নীরবে শক্তি সঞ্চয় : তৃতীয়ত, টিউডর যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল, পার্লামেন্ট এ যুগে ধীরে ধীরে ও নীরবে শক্তি সঞ্চয় করেছিল। টিউডর রাজাগণ পার্লামেন্টের বিশেষ পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। যদিও এ পরিবর্তন পূর্ণাঙ্গ ছিল না, তবুও পার্লামেন্ট এ সময়ে এমন সব ক্ষমতা লাভ করতে আরম্ভ করেছিল যা মধ্যযুগীয় পার্লামেন্টের চিন্তার অতীত ছিল।
  • রেনেসাঁ ও রিফরমেশনের আবির্ভাব : চতুর্থত, টিউডর যুগের আর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল রেনেসাঁরিফরমেশন। এ দুটি যুগান্তকারী ঘটনা টিউডর যুগেই ইংল্যান্ডে সংঘটিত হয়। রেনেসাঁ আন্দোলনের প্রভাব সপ্তম হেনরীর (১৪৮৫-১৫০৯) রাজত্বকালে ইংল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছিল এবং মানুষের চিন্তাজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করে তাদের ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী সংস্কার গ্রহণের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলেছিল। পরবর্তী রাজত্বকালে সংঘটিত ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ভিত্তিভূমি ছিল এ রেনেসাঁ। অন্যদিকে, রিফরমেশন ইংল্যান্ডের ধর্মীয় জীবনে এমন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করেছিল যার ফলে ইংল্যান্ডীয় চার্চ রোমীয় চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন জাতীয় চার্চে পরিণত হয়েছিল।
  • ভৌগোলিক আবিষ্কার এবং বহির্বাণিজ্য সম্প্রসারণ : পঞ্চমত, এ যুগ ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ভৌগোলিক আবিষ্কার এবং বহির্বাণিজ্য সম্প্রসারণেরও যুগ ছিল। প্রথম টিউডর রাজা সপ্তম হেনরীর রাজত্বকাল থেকেই ইংরেজ নাবিক ও বণিকগণ সমুদ্রপথে নতুন দেশ আবিষ্কারে অংশগ্রহণ করে আমেরিকার মূল ভূখণ্ডসহ বহু অজ্ঞাত প্রদেশে উপস্থিত হন। এ সকল ভৌগোলিক আবিষ্কার বা সামুদ্রিক অভিযানের ফলে আটলান্টিকের মধ্য দিয়ে আমেরিকা বা এশিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ উন্মুক্ত হয়। আটলান্টিকের পথ উন্মুক্ত হবার পর থেকেই এবং নাবিকদের ক্রমবর্ধমান আবিষ্কারের ফলে ইংল্যান্ডের গুরুত্ব অভাবনীয়রূপে বৃদ্ধি পেতে থাকে। কারণ, এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথ ক্রমশ ইংল্যান্ডের প্রায় দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়। এ অনুকূল ভৌগোলিক পরিস্থিতির ফলে বহির্বাণিজ্যে ইংল্যান্ড প্রধান স্থান অধিকার করতে আরম্ভ করে। ইংরেজ নাবিক ও বণিকগণ ভূমধ্যসাগরের সংকীর্ণ পথ পরিত্যাগ করে মহাসাগরে পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ বাণিজ্য দ্রব্য বিভিন্ন দেশে নিয়ে গিয়ে সে সকল দেশের বাজার দখল করে বসে এবং বিদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্যে বিভিন্ন ব্যবসায়ী কোম্পানি গঠন করেন। এ কোম্পানিগুলোর মধ্যে মাস্কোভী কোম্পানি, লেভান্ট কোম্পানি ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
  • নৌশক্তির প্রাধান্য স্থাপনের এবং ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের সূচনা : ষষ্ঠত, এ যুগে ইংল্যান্ড নৌশক্তিতে প্রাধান্য স্থাপনে এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তারে আত্মনিয়োগ করে। সমুদ্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, বহির্বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং আমেরিকায় ইংল্যান্ডের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দুর্ধর্ষ ইংরেজ নাবিক ও বণিকগণ সমুদ্রপথে স্পেনের পণ্যবাহী ও স্বর্ণবাহী জাহাজ লুণ্ঠন করে এবং স্পেনীয় আমেরিকায় বলপূর্বক পণ্যদ্রব্য ও ক্রীতদাস রপ্তানি করে ক্রমশ স্পেনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। পরিশেষে, সংঘর্ষে স্পেনের ‘অজেয় নৌবহর’ ইংল্যান্ডের হাতে সাংঘাতিকভাবে বিপর্যস্ত হয় এবং সমুদ্রবক্ষে ইংল্যান্ডের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সামুদ্রিক অভিযান এবং বহির্বাণিজ্য প্রসারই ইংরেজগণকে বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ দিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, রানী এলিজাবেথের (১৫৫৮-১৬০৩) রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশে সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।
  • তিন রাষ্ট্রীয় শক্তির মধ্যে মহাঐক্য : সপ্তমত, এ যুগে রাজসরকার, পার্লামেন্ট ও সাধারণ আইন – এ তিনটি রাষ্ট্রীয় শক্তির মধ্যে মহা ঐক্য বিদ্যমান ছিল। এ সময় এ তিনের মধ্যে প্রাধান্য নিয়ে কোনরূপ বৈরিতা বা বিরোধ সৃষ্টি হয়নি এবং কোন মৌলিক শাসনতান্ত্রিক প্রশ্ন দেখা দেয়নি। রাষ্ট্রের মধ্যে সার্বভৌমত্বের অবস্থান নিয়ে কেউই এ সময় কোন প্রশ্ন উত্থাপন করেননি।

আধুনিক যুগের সূচনা : পরিশেষে, টিউডর শাসনকালে শিক্ষার নবজাগরণ, ধর্মসংস্কার, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব, ভৌগোলিক আবিষ্কার ইত্যাদি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের অবসান ও আধুনিক যুগের সূচনা হয়।

টিউডর রাজত্বের প্রাক্কালে বা সপ্তম হেনরীর সিংহাসনারোহণ কালে ইংল্যান্ডের অবস্থা

  • বহির্দেশে ইংল্যান্ডের সম্মান ক্ষুণ্ণ : টিউডর রাজত্বের প্রাক্কালে ইংল্যান্ডের অবস্থা সকল দিক দিয়েই শোচনীয় ছিল। দীর্ঘ ত্রিশ বছর যাবৎ গৃহযুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ড একটি সাম্রাজ্যচ্যুত দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল এবং ওর ক্রেসী ও এগিনফোর্ট বিজয়ের গৌরব অন্তর্হিত হয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ওর খ্যাতি ও গুরুত্ব একেবারে লোপ পেয়েছিল। একমাত্র ক্যালাইস ছাড়া ইউরোপের আর কোন ভূখণ্ড তখন ইংল্যান্ডের অধিকারে ছিল না। সুতরাং এ সময় ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রিয়া, তুরস্ক প্রভৃতির মত শক্তিশালী ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের পাশে ইংল্যান্ডের কোন স্থান ছিল না। সাম্রাজ্যচ্যুত, আত্মকলহে দুর্বল ইংল্যান্ডকে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ফ্লান্ডার্স প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলোও গ্রাহ্য করত না। স্কটল্যান্ড ছিল চিরশত্রু এবং আয়ারল্যান্ডের উপরে ইংল্যান্ডের আধিপত্য ছিল নামে মাত্র।
  • দুর্বল রাজকর্তৃত্ব : ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও সমানভাবে নৈরাশ্যজনক ছিল। রাজার শাসন বা কর্তৃত্ব দেশ থেকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে লোপ পেয়েছিল। এগিনফোর্ট বিজয়ী রাজা পঞ্চম হেনরীর (১৪১৩-১৪২২) পরে ইংল্যান্ডের আর কোন মধ্যযুগীয় রাজা শক্তিশালী সামন্তগণকে সংযত রাখতে সক্ষম হননি। ফলে তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ শুরু হয়।
  • গোলাপের যুদ্ধ, পার্লামেন্টীয় শাসন-ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যর্থ : তাঁর পুত্র রাজা ষষ্ঠ হেনরীর (১৪২২-৬১, ১৪৭০-৭১) রাজত্বের শেষ ভাগে আত্মকলহ চরম আকার ধারণ করে এবং পরিণামে ‘গোলাপের যুদ্ধ’ নামে এক দীর্ঘস্থায়ী ও আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। এ যুদ্ধের ফলে পার্লামেন্টীয় শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। দেশের সর্বত্রই ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং রাজশক্তি শোচনীয়রূপে দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • সামন্তগণ কর্তৃক রাজক্ষমতা গ্রাস : রাজার হাতে কার্যত কোন ক্ষমতাই ছিল না। শক্তিশালী সামন্ত প্রভুগণ রাজক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করেন। শাসনব্যবস্থার সর্বত্রই রাজার পরিবর্তে তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়; তাঁদের হাতেই ছিল পার্লামেন্ট, সৈন্যদল, বিচারক ও জুরি। সুতরাং সাধারণ লোককে নির্ভর করতে হতো তাঁদের অনুগ্রহের উপর।
  • সামস্ত প্রভুদের অত্যাচার : সামন্তগণ সর্বেসর্বা হয়ে শীঘ্রই অশান্তি ও অত্যাচারে সমগ্র দেশকে অতিষ্ঠ করে তোলে। দেশে যে আইন প্রচলিত ছিল, সামন্তগণ তা অগ্রাহ্য করবার ক্ষমতা রাখতেন। তাঁরা নিজস্ব সৈন্যবাহিনী বা লাঠিয়ালদের সাহায্যে প্রায়ই আইন ভঙ্গ করতেন এবং যখন তখন যুদ্ধ বিগ্রহ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করতেন অভিযুক্ত হলে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত সশস্ত্র অনুচরগণ সহ আদালতে উপস্থিত হয়ে বিচারক ও জুরিদিগকে ভীতি প্রদর্শন করে স্বপক্ষে রায় আদায় করতেন।
  • ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্দশা : ফলে, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে; ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কৃষিকার্য চরম দুর্গতির সম্মুখীন হয় এবং সাধারণ লোক সীমাহীন দুর্দশায় পতিত হয়।
  • সমাজ জীবনে বিপর্যয় : শক্তিশালী শাসন ও সুসঙ্গত আইনের অভাবে জনসাধারণের সামাজিক জীবনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দস্যু ও তস্করের উপদ্রবে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে; নিরীহ লোক প্রকাশ্য দিবালোক ছাড়া একাকী রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারত না।

রাজা সপ্তম হেনরী (১৪৮৫-১৫০৯ খ্রিঃ)

সিংহাসন লাভ এবং সিংহাসনের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা

রিচমন্ডের আর্ল হেনরী টিউডর ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে বসওয়ার্থের যুদ্ধে ইয়র্ক বংশীয় শেষ রাজা তৃতীয় রিচার্ডকে (১৪৮৩-১৪৮৫) পরাজিত ও হত্যা করে সপ্তম হেনরী উপাধি নিয়ে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনিই ইংল্যান্ডের প্রথম টিউডর রাজা। হেনরী পিতার দিক থেকে ওয়েলস্-এর টিউডর পরিবারভুক্ত এবং মাতার দিক থেকে ল্যাঙ্কাস্টার বংশীয় ছিলেন। তাঁর পিতা এডমান্ড টিউডর ছিলেন ওয়েন টিউডর পরিচয় নামক ওয়েল্স্-এর একজন নাইটের পুত্র এবং মাতা মার্গারেট বুফোর্ট ছিলেন তৃতীয় এডওয়ার্ডের (১৩২৭-১৩৭৭) ৪র্থ (মতান্তরে তৃতীয়) পুত্র ল্যাঙ্কাস্টারের ডিউক জন অব গন্টের বংশের বুফোর্ট শাখার কন্যা। মাতার দিক থেকে ল্যাঙ্কাস্টার বংশীয় হলেও ইংল্যান্ডের সিংহাসনের উপর হেনরীর আইনসঙ্গত (বংশগত বা উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী) দাবি ছিল খুবই দুর্বল। কারণ, ল্যাঙ্কাস্টার বংশের নিজস্ব অধিকারই সুদৃঢ় ছিল না, তার ওপর ওর বুফোর্ট শাখার মূলত কোন অধিকারই ছিল না। উত্তরাধিকারক্রমে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে ইয়র্ক বংশীয়দের দাবিই অধিকতর আইনসঙ্গত ছিল। সুতরাং চতুর্থ এডওয়ার্ডের (১৪৬১-১৪৭০) ভ্রাতা জর্জের (ডিউক অব ব্যারেন্স) পুত্র এডওয়ার্ড (আর্ল অব ওয়ারউইক) ইংল্যান্ডের সিংহাসনের ন্যায্য উত্তরাধিকারী ছিলেন। বসওয়ার্থের যুদ্ধে জয়লাভ করার পরেই সপ্তম হেনরী তাঁকে বন্দী করে রাখেন। ওয়ারউইকের পরে চতুর্থ এডওয়ার্ডের কন্যা এলিজাবেথ সিংহাসনের ন্যায্য উত্তরাধিকারিণী ছিলেন। কিন্তু বেশ কিছু কারণে তার বদলে সপ্তম হেনরীই সকলের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হন –

  • প্রথমত, দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধে এবং সামন্তগণের অত্যাচার ও অরাজকতায় অতিষ্ঠ হয়ে ইংল্যান্ডের জনসাধারণ তখন শান্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল এবং এমন একজন ক্ষমতাশালী রাজার প্রয়োজন অনুভব করছিল যিনি কঠোর হাতে সর্বপ্রকার উপদ্রব ও অনাচার নিবারণ করে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করতে সক্ষম হবেন। এজন্য সপ্তম হেনরীর মত শক্তিশালী ব্যক্তি ও সুদক্ষ শাসনকর্তা সিংহাসনে আরোহণ করলে কেউই সিংহাসনে তাঁর অধিকার ন্যায্য ও বৈধ কিনা, সে সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করল না।
  • দ্বিতীয়ত, বসওয়ার্থের যুদ্ধের পরে হেনরী লন্ডনে পৌঁছে পার্লামেন্ট আহ্বান করলে পার্লামেন্টও তাঁকে সিংহাসনের যোগ্য, ন্যায়সঙ্গত ও প্রকৃত অধিকারী বলে ঘোষণা করে।
  • তৃতীয়ত, রাজ্যাভিষেকের ছয় মাস পরে হেনরী ইয়র্ক বংশীয় চতুর্থ এডওয়ার্ডের কন্যা এবং সিংহাসনের অন্যতম উত্তরাধিকারিণী এলিজাবেথকে বিবাহ করে সিংহাসনের উপর নিজের দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এ বিবাহের ফলে বিবদমান দুই গোলাপ দলের (ল্যাঙ্কাস্টার ও ইয়র্ক বংশের) মিলন ঘটেছিল।

এরূপে সপ্তম হেনরী বিজয়, জনসমর্থন, পার্লামেন্টের অনুমোদন এবং বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ইংল্যান্ডের সিংহাসনের উপর আপন অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

হেনরীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ

সপ্তম হেনরী ইয়র্ক বংশীয় এলিজাবেথকে বিবাহ এবং পার্লামেন্টের স্বীকৃতি লাভ করলেও ইয়র্ক দলের কিছু সংখ্যক লোক সহজে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেনি। তারা হেনরীর বিরুদ্ধে কয়েকটি ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহে লিপ্ত হয়। তাদের প্রতি চতুর্থ এডওয়ার্ডের ভগিনী ফ্লাভার্সের রানী মার্গারেটের সক্রিয় সমর্থন ছিল। তাই সিংহাসনে আরোহণের অনতিকাল পরেই হেনরীকে এ সকল ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয়েছিল।

১৪৮৬ সালের লোভেল ষড়যন্ত্র : হেনরীর বিরুদ্ধে প্রথম ষড়যন্ত্র হয় তৃতীয় রিচার্ডের মন্ত্রী লর্ড লোভেলের নেতৃত্বে। ইয়র্ক প্রদেশে ইয়র্ক বংশীয়দের প্রচুর সমর্থক ছিল। এ প্রদেশটিকে স্বপক্ষে আনার উদ্দেশে হেনরী স্বয়ং ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়র্কে গমন করেন। এ সময় লর্ড লোভেল তাঁকে বন্দী করার ষড়যন্ত্র করেন; কিন্তু ষড়যন্ত্রটি ব্যর্থ হয় এবং লোভেল ফ্লান্ডার্সে পলায়ন করেন। লর্ড লোভেলের নামানুসারে এ ষড়যন্ত্র ‘লোভেল ষড়যন্ত্র’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে।

১৪৮৭ সালের ল্যাম্বার্টে সিমনেলের বিদ্রোহ : লোভেল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবার পর ইয়র্ক বংশীয় কয়েকজন সামন্ত অক্সফোর্ডের জনৈক বাদ্যযন্ত্র নির্মাতার (পিয়ানো তৈরিকারকের) পুত্র ল্যাম্বার্টে সিমনেলকে চতুর্থ এডওয়ার্ডের ( ভ্রাতুষ্পুত্র এডওয়ার্ড অব ওয়ারউইক বলে ঘোষণা করেন। ইংল্যান্ডের সিংহাসনে হেনরী অপেক্ষা ওয়ারউইকের দাবিই অগণ্য ছিল। কিন্তু প্রকৃত ওয়ারউইক আলটাওয়ারে বন্দী ছিলেন। সম্ভবত তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে একটি জনশ্রুতি রটলে ইয়র্কপক্ষীয়রা উক্ত পন্থা অবলম্বন করেন। আয়ারল্যান্ডে ইয়র্ক দলের অনেক সমর্থক ছিল; সুতরাং সিমনেল সেখানে প্রচুর সমর্থন পান। ফ্লান্ডার্সের রানী মার্গারেট তাঁকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। আয়ারল্যান্ড ও ফ্লান্ডার্সের সাহায্য পেয়ে সিমনেল ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে উপস্থিত হন। রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের ভাগনে আর্ল অব লিঙ্কন তাঁর সাহায্য করার উদ্দেশ্যে তাঁকে সাথে মিলিত হন। হেনরী অবিলম্বে আসল ওয়ারউইককে লোক সমক্ষে বের করে তাদের ভ্রান্তি দূর করেন।

১৪৮৭ সালের স্ট্রোকের যুদ্ধ : তারপর স্ট্রোক নামক স্থানে একটি যুদ্ধে সিমনেল হেনরীর সৈন্যবাহিনীর হাতে পরাজিত ও বন্দী হন। হেনরী ঘৃণাভরে তাকে শান্তি না দিয়ে বাবুর্চিখানার পাচকের সহকারী রূপে নিযুক্ত করেন।

১৪৯২ সালের পার্কিন ওয়ারবেকের বিদ্রোহ : কয়েক বছর পরে সিংহাসনের আর একজন জাল দাবিদারের আবির্ভাব হয়। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে পার্কিন ওয়ারবেক নামে টুর্নাইয়ের এক সুদর্শন যুবক আয়ারল্যান্ডে উপস্থিত হয়ে নিজেকে চতুর্থ এডওয়ার্ডের কনিষ্ঠ পুত্র ইয়র্কের ডিউক রিচার্ড রূপে পরিচয় দিয়ে ইংল্যান্ডের সিংহাসন দাবি করেন। রাজা চতুর্থ এওয়ার্ডের দুই পুত্র ছিল পঞ্চম এওয়ার্ড ও রিচার্ড। গোলাপের যুদ্ধকালে তাঁরা বন্দী হন এবং তাঁদের চাচা রাজা তৃতীয় রিচার্ড তাঁদের বন্দী অবস্থায় টাওয়ার দুর্গেই হত্যা করেন। ওয়ারবেক রিচার্ড সেজে সর্বত্র প্রচার ও দাবি করে বেড়াতে লাগলেন যে, যখন পঞ্চম এডওয়ার্ডকে হত্যা করা হয় তখন তিনি পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। (এ ঘটনা যদি সত্য হতো অর্থাৎ রিচার্ড যদি প্রকৃতই জীবিত থাকতেন, তা হলে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে ওয়ারউইক ও এলিজাবেথ অপেক্ষা রিচার্ডের দাবিই অগ্রগণ্য হতো।)

আয়ারল্যান্ড, ফ্লান্ডার্স, ফ্রান্স ও স্কটল্যান্ড কর্তৃক ওয়ারবেককে সাহায্য ও সমর্থন : ওয়ারবেককে আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী, ফ্লান্ডার্সের রানী মার্গারেট এবং স্কটল্যান্ডের রাজা সমর্থন ও সাহায্য করেছিলেন। ফরাসিরাজ অষ্টম চার্লস (১৪৮৩-১৪৯৮) তাঁকে আমন্ত্রণ করে প্যারিসে নিয়ে যান, কিন্তু ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে ইটাপিস্-এর সন্ধির শর্ত অনুযায়ী আয়ারল্যান্ড, ফ্লান্ডার্স, তাঁকে ফ্রান্স থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হন। ফ্রান্স থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ওয়ারবেক ফ্লান্ডার্সে উপস্থিত হন।

টটনের যুদ্ধ, ওয়ারবেক এবং ওয়ারউইকের মৃত্যুদন্ড : সেখানে রানী মার্গারেটের আশ্রয়ে কয়েক বছর অবস্থান করার পর ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কেন্টে উপস্থিত হন, কিন্তু এ অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ায় তিনি প্রথমে আয়ারল্যান্ড এবং পরে সেখান থেকে স্কটল্যান্ডে গমন করেন। স্কটরাজ চতুর্থ জেমস্ (১৪৮৮-১৫১৩) তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে ইংল্যান্ড আক্রমণে সাহায্য করেন। কিন্তু পরপর দুটি আক্রমণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ এবং ইংল্যান্ড কর্তৃক স্কটল্যান্ড আক্রমণের ভীতি প্রদর্শিত হলে স্কটরাজ ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারবেককে স্কটল্যান্ড ত্যাগ করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হন। ওয়ারবেক তখন আয়ারল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করে কিছু সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং সেখান থেকে হেনরীর বিরুদ্ধে তাঁর শেষ প্রচেষ্টা চালান। কর্নওয়াল হেনরীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে শুনে ওয়ারবেক ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে সেখানে উপস্থিত হন এবং সেন্ট মাইকেলস মাউন্ট অধিকার করে একজটার অবরোধ করেন। কিন্তু টটনের যুদ্ধে (১৪৯৭ খ্রিঃ) হেনরীর সৈন্যবাহিনীর হাতে পরাজিত হবার পর ওয়ারবেক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। হেনরী তাঁকে টাওয়ারে বন্দী করে রাখেন। বন্দী অবস্থায় ওয়ারবেক এডওয়ার্ড অব ওয়ারউইকের সাথে কারাগার হতে পলায়নের চেষ্টা করলে উভয়েরই প্রাণদণ্ড হয় (১৪৯৯ খ্রিঃ)। তাঁদের মৃত্যুতে হেনরীর সিংহাসনের শেষ কণ্টকের উচ্ছেদ সাধন হয়। সুতরাং এরপর হেনরীর বিরুদ্ধে আর কোন ষড়যন্ত্র হয়নি।

সপ্তম হেনরীর স্বরাষ্ট্র (অভ্যন্তরীণ) নীতি : ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বা ‘টিউডর স্বৈরতন্ত্রে’র প্রতিষ্ঠা

রাজনৈতিক সংস্কার

স্বরাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য : নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : সপ্তম হেনরী উপলব্ধি করেন যে, দীর্ঘকালব্যাপী স্থায়ী নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন এবং সে জন্য রাজ-কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা অপরিহার্য। যেহেতু গোলাপের যুদ্ধের ফলে পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছিল, সেহেতু শাসনব্যবস্থায় রাজার কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ভিন্ন অরাজক দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং লুপ্ত রাজশক্তিকে পুনরুদ্ধার করে ইংল্যান্ডে একটি শক্তিশালী বা নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই সপ্তম হেনরীর (এবং টিউডর যুগের) অভ্যন্তরীণ নীতির মুখ্য উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী সামন্ত শক্তিকে খর্ব এবং রাজার আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধন – প্রধানত এ দুই গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করে হেনরী তাঁর স্বরাষ্ট্র নীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে সফল হন। এ সকল কার্য সম্পাদনের দ্বারা তিনি সামন্ত প্রভুদের এবং (সামন্ত পরিচালিত) পার্লামেন্টের প্রভাব থেকে রাজাকে মুক্ত করে রাজতান্ত্রিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

সামন্তনীতি ও সামন্তশিক্তি দমন : সামন্ত প্রধানগণের ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্যে হেনরী যথোপযুক্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কারণ তিনি জানতেন যে, রাজ্যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য মূলত সামন্ত প্রধানগণই দায়ী ছিলেন। এদের অত্যাচারের ফলে জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তার অস্তিত্ব ছিল না। গত ত্রিশ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতায় হেনরী উপলব্ধি করেন যে, এদের দমন করা ভিন্ন সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই তিনি প্রথম থেকেই দৃঢ়চিত্তে ও কঠোর হস্তে সামন্তশক্তিকে ধ্বংস করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এজন্যে তিনি সর্বপ্রথম তাঁদের শক্তির উৎস তাঁদের আশ্রিত অনুচরবর্গ বা ব্যক্তিগত সৈন্যবাহিনীকে বেআইনি ঘোষণা করেন। প্রত্যেক সামন্তের অধীনে ‘রিটেইনার’ (Retainer) নামে একদল সশস্ত্র অনুচর থাকত। তারা নিজ নিজ প্রভুর বা আশ্রয়দাতার বিশিষ্ট প্রতীকের পোশাক পরিধান করত। এরূপ পোশাককে বলা হতো ‘লিভারি’ (Livery)। এ সকল প্রতীকধারী অনুচররা নিজ নিজ প্রভুদের আদেশ-উপদেশ ও নির্দেশমত কার্য করত; পরিবর্তে সামন্তগণ তাদেরকে পালন ও আইনের দণ্ড থেকে রক্ষা করতেন। এজন্য যোদ্ধা অনুচর রাখার এ প্রথাকে ‘লিভারি অ্যান্ড মেনটেনান্স’ (Livery and Maintenance) বলা হতো। এ সকল সশস্ত্র অনুচরে সাহায্যে সামন্তগণ প্রায়ই আইন অমান্য ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করতেন। সামন্ত প্রভু এবং তাঁদের এ সকল বাহিনীর দাপটে বিচারক ও জুরিগণ নির্ভয়ে নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সমাধা করতে পারতেন না। কোন সামন্ত বা তাঁর কোন অনুচর অভিযুক্ত হলে উক্ত সামন্ত তাঁর বাহিনীসহ আদালতে উপস্থিত হয়ে বিচারক ও জুরিগণকে ভয় দেখিয়ে নিজেকে বা তাঁর অভিযুক্ত অনুচরকে আদালতের সাজা থেকে রক্ষা করতেন। এই অবস্থায় সপ্তম হেনরি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন –

  • (১) স্ট্যাটিউট অব লিভারি ও মেনটেনান্স জারি : হেনরী আইন করে সামন্ত শক্তির এ উৎসটি বন্ধ করে দেন। তিনি ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে ‘স্ট্যাটিউট অব লিভারি’ এবং স্ট্যাটিউট অব মেনটেনান্স’ জারি করে সামন্তগণ কর্তৃক এরূপ সশস্ত্র অনুচর রাখা নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় ঘোষণা করেন এবং কঠোরভাবে এ আইনকে বলবৎ করেন। ফলে, অচিরেই সামন্তগণের ব্যক্তিগত সৈন্যবাহিনী লোপ পায় এবং সে সঙ্গে গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। অনুচরহীন অবস্থায় সামন্তগণের পক্ষে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ক্ষমতা লোপ পায়। বিচারক ও জুরিগণও নির্ভয়ে বিচারকার্য সমাধা করার সুযোগ লাভ করেন।
  • (২) স্টার চেম্বার আদালত গঠন : শক্তিশালী, উদ্ধত ও অবাধ্য সামন্ত প্রভুদের দমন করার অন্যতম ব্যবস্থা হিসাবে হেনরী ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্টার চেম্বার আইন নামে পার্লামেন্টের এক আইন বলে কতগুলো বিশেষ অপরাধের বিচারের জন্য প্রিভি কাউন্সিলের কিছু সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। অনেকের মতে এ বিচারসভাই “স্টার চেম্বার আদালত” (Star Chamber) নামে পরিচিত। প্রিভি কাউন্সিলের কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য ছাড়াও দুজন বিচারপতি এ বিশেষ আদালতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ আদালতের কার্যাবলি গোপনে (অভিযুক্ত ব্যক্তির অসাক্ষাতে) এবং জুরির সাহায্য ছাড়া অনুষ্ঠিত হতো এবং বিচারকদের রায়ই চূড়ান্ত ছিল। যে সকল পরাক্রান্ত সামন্তের অপরাধের বিচার সাধারণ আদালতে হওয়া সম্ভব ছিল না, তাদেরই বিচার এখানে করা হতো। বস্তুত এ আদালত প্রতিষ্ঠার দ্বারা অত্যাচারীর অত্যাচার থেকে অত্যাচারিতকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়, যদিও পরবর্তীকালে এটাই আবার প্রজা পীড়নের ব্রহ্মাস্ত্র হয়েছিল। এ আদালত থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তির খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। ফলে কোন সামন্তই আর আইন অমান্য করতে সাহসী হতো না। (হেনরী গ্রাম অঞ্চলেও শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান ও আইনের শাসন কায়েম করার জন্য ‘সার্কিট কোর্ট’ নামক বিচারালয় এবং ‘জাস্টিস অব দি পিস’ নামক এক শ্রেণীর গ্রাম্য বিচারকমণ্ডলী নিয়োগ করেন। এ সকল বিচারকেরা নির্দিষ্ট সময় অন্তর দেশের বিভিন্ন সার্কিট আদালতে উপস্থিত থেকে বিচার কার্য সমাধা করতেন। ফলে গ্রাম অঞ্চলেও সামন্ত প্রভু ও তাদের চেলা-চামুন্ডাদের অত্যাচার বন্ধ হয়ে যায়।)
  • (৩) ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দের বিশেষ আইন : ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে হেনরী একটি আইন দ্বারা ঘোষণা করেন যে, সিংহাসনের উপর রাজার দাবি ন্যায্য কিংবা অন্যায্য যাই হোক না তাঁকে বিপদকালে কোন সামন্তের বিপক্ষে সাহায্য করলে কোন প্রজা দেশদ্রোহিতার অপরাধে দণ্ডনীয় হবে না। ফলে, সামন্ত দমনে হেনরী প্রজাসাধারণের সক্রিয় সমর্থন ও সাহায্য লাভ করেন।
  • (৪) কামান ও গোলাবারুদের প্রচলন : মধ্যযুগে সামন্তগণের শক্তির অন্যতম উৎস ছিল তাদের সুরক্ষিত দুর্গসমূহ। কিন্তু টিউডর যুগের প্রারম্ভে কামান ও গোলাবারুদের প্রচলন এবং তার দ্বারা গোলন্দাজ বাহিনীর সৃষ্টি হওয়ায় এবং কেবল রাজার অধিকারে এ সকল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলন্দাজ বাহিনী থাকায় সামন্তগণের দুর্গগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং তাদের সামরিক শক্তি লোপ পায়।
  • (৫) শাসনব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক নিয়োগ : হেনরী ইচ্ছাকৃতভাবে শাসনবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সামন্তগণকে বহিষ্কার করে তাদের জায়গায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক নিয়োগ করেন। এদের দ্বারা রাজার প্রতি অনুগত এবং রাজকার্য সম্পাদনে বিশ্বস্ত এক নতুন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। এ শ্রেণীর কতিপয় সদস্য ছিলেন রেনেসাঁ লব্ধ জ্ঞানে উদ্ভাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী সন্তান। হেনরী তাঁদের উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত করেন। এছাড়া তিনি সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি, কিছুসংখ্যক ব্যবহারজীবী ও পাদ্রীকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে নিয়োগ করেন। ফলে, রাষ্ট্রীয় কার্যে সামন্তগণের চিরাচরিত প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ হয়।

এরূপে সপ্তম হেনরী ‘স্ট্যাটিউট অব লিভারি অ্যান্ড মেনটেনান্স’, ‘স্টার চেম্বার আইন’, ‘১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দের আইন’, ‘কামান ও গোলাবারুদের ব্যবহার’ এবং ‘গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সামন্তগণকে বহিষ্কার করে সে জায়গায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক নিয়োগ’ -প্রভৃতি ব্যবস্থা অবলম্বন করে সামন্ত প্রধানগণের প্রবল ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ধ্বংস করেন।

অর্থনৈতিক সংস্কার

  • অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থাসমূহ-সামন্ত কর ও বাধ্যতামূলক ঋণ আদায় : পার্লামেন্টের প্রভাব থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য অর্থের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এবং অর্থই রাষ্ট্রীয় ও সকল শক্তির উৎস মনে করে হেনরী বিভিন্ন উপায়ে রাজকোষ পূর্ণ করার ব্যবস্থা করেন। এতদিন ধরে ক্রমাগত যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়েছিল। জনসাধারণ কর বৃদ্ধি পছন্দ করবে না মনে করে এবং পার্লামেন্ট আহ্বান করে অর্থের জন্য আবেদন করা তাঁর মনঃপুত ছিল না বলে হেনরী অর্থ সংগ্রহের জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করেন। তিনি সামন্তকর এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিগণের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক ঋণ (Forced Loan) আদায় করেন।
  • জরিমানা বা নজরানা আদায় : কোন সামন্ত সশস্ত্র অনুচর রাখলে কিংবা কেউ কোন বিস্মৃতপ্রায় ও অপ্রচলিত আইন ভঙ্গ করলে অপরাধের দত্তস্বরূপ জরিমানা আদায় করা হতো। তৃতীয় রিচার্ড (১৪৮৩-১৪৮৫) নজরানা বা প্রীতি উপহার (Benevolence) নেয়া বন্ধ করেছিলেন; সপ্তম হেনরী পুনরায় তা প্রবর্তন করেন। এভাবে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে হেনরীর প্রধান সহায় ছিলেন ডাডলি ও এম্পসন নামে তাঁর দুইজন মন্ত্রী; অর্থ সংগ্রহের কার্যে এদের অদম্য উৎসাহ ছিল।
  • মর্টন ফর্ক; আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক ধার্য : তাছাড়া, আর্কবিশপ মর্টন অর্থ আদায়ের একটি নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেন। তাঁর ব্যবস্থা অনুসারে যারা জাঁকজমক বা সচ্ছলতার সাথে জীবনযাপন করত তাদেরকে বলা হতো যে, তারা রাজাকে অর্থ দিতে সক্ষম, সুতরাং বাধ্য। আবার যারা মিতব্যয়ী ছিল কিংবা কৃপণভাবে অথবা দরিদ্রের ন্যায় বাস করত তাদের বলা হতো যে, তারা অর্থ সঞ্চয় করেছে, সুতরাং তারা রাজাকে অর্থ দিতে বাধ্য। ইতিহাসে মর্টনের অর্থ আদায়ের এ পদ্ধতি ‘মর্টন ফর্ক’ নামে অভিহিত। এ সকল কর আদায়ের জন্যে পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো না। এছাড়া হেনরী দেশের সকল আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্যের উপর শুল্ক ধার্য করেন। এ শুল্ক যাতে বর্ধিত হয় সেজন্যে তিনি অস্ট্রিয়া, ভেনিস ও নেদারল্যান্ডসের সাথে বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষর করেন।
  • শাসন সংক্রান্ত ব্যয় সঙ্কোচন : এছাড়াও হেনরী শাসন সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী ছিলেন এবং প্রতি বছর সাধারণ রাজস্ব হতে কিছু সঞ্চয় করে রাখতেন। এরূপে তিনি প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে রাজতন্ত্রের প্রধান ভিত্তি অর্থবল বৃদ্ধি করেন এবং রাজাকে পার্লামেন্টের প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। মৃত্যুকালে তাঁর রাজকোষে চার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ পাউন্ড মজুত ছিল। এত অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন বলেই তাঁকে কখনও পার্লামেন্টের মুখাপেক্ষী হতে হয়নি।

এরূপে সপ্তম হেনরী একদিকে সামন্ত প্রধানগণের প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ, অপরদিকে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে রাজতন্ত্রের প্রধান অন্তরায়গুলো দূর করেন এবং তার দ্বারা শক্তিশালী টিউডর রাজতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রবর্তিত এ রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ইতিহাসে ‘নিউ মনার্কি’ (New Monarchy) বা ‘নতুন রাজতন্ত্র’ নামে পরিচিত। একে ‘টিউডর স্বৈরতন্ত্র’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। এ ব্যবস্থায় রাজা পার্লামেন্ট ও সামন্ত প্রভুগণের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন এবং শাসনব্যবস্থায় রাজতান্ত্রিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হেনরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ নতুন শক্তিশালী একনায়কত্ব জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছিল। কারণ, এটি ষোড়শ শতাব্দীর দুর্যোগময় সময়ে ইংল্যান্ডকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধির দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।

সপ্তম হেনরীর বাণিজ্য নীতি

সপ্তম হেনরী নিজে বৈষয়িক লোক ছিলেন। কাজেই তিনি ইংল্যান্ডের ব্যবসা- বাণিজ্য বিস্তারের জন্য একান্ত আগ্রহী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে ফ্রান্সিস বেকন লিখেছেন যে, তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের রুগ্ন অবস্থা সহ্য করতে পারতেন না। দেশের সম্পদ ও শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি ব্যবসায়ী ও বণিকদের স্বার্থরক্ষা করার জন্যে বিশেষভাবে পরিশ্রম করতেন। তিনি ইংল্যান্ডের তৎকালীন দুটি প্রধান বাণিজ্যিক শিল্প – বস্ত্রবয়ন ও জাহাজ নির্মাণের উন্নতি বিধানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যান। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ পর্যন্ত বস্ত্রবয়ন ও রপ্তানি এবং জাহাজ নির্মাণই ছিল ইংল্যান্ডের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি।

জাহাজ নির্মাণ কার্যে পৃষ্ঠপোষকতা : হেনরী জাহাজের সাহায্যে মালামাল আমদানি ও রপ্তানিকে ব্যবসায়ের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে এর সম্প্রসারণের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। এজন্যে তিনি জাহাজ নির্মাণ কার্যে জনগণকে উৎসাহিত করেন এবং দূর যাত্রার উপযোগী জাহাজ নির্মাণের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন।

নৌ-আইন প্রবর্তন : ইতোপূর্বে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদেশী জাহাজই বেশি ব্যবহৃত হতো। হেনরী দ্বিতীয় রিচার্ড (১৩৭৭-১৩৯৯) ও চতুর্থ এডওয়ার্ডের (১৪৬১-১৪৭০) আমলের পুরাতন নৌ-আইন (Navigation Act) পুনরায় প্রবর্তন করে বৈদেশিক বাণিজ্যে ইংরেজদের নিজস্ব জাহাজ ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেন।

সামুদ্রিক বাণিজ্য ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে উৎসাহ প্রদান : বিশেষ করে গ্যাসকানী থেকে যাবতীয় মদ সম্পূর্ণরূপে ইংরেজদের নিজস্ব জাহাজে আমদানি করার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে, জাহাজ নির্মাণ ব্যবসায়ে ইংরেজদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ দেখা দেয়। এরূপে হেনরীর পৃষ্ঠপোষকতায় ইংল্যান্ডের সমুদ্র পথে বাণিজ্য প্রসারের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীকালে, বিশেষ করে তাঁর পুত্র ও পৌত্রীর আমলে এর বিপুল বিস্তৃতি ঘটে। সমুদ্র পথে বাণিজ্য প্রসারের অন্যতম ব্যবস্থা হিসাবে হেনরী তৎকালীন ভৌগোলিক আবিষ্কারের অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য ইংল্যান্ডের নাবিক ও বণিকগণকে উৎসাহিত করেন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রিস্টল নিবাসী কয়েকজন বণিক জন ও সেবাস্টিয়ান ক্যাবট নামে দুজন ভেনিশীয় নাবিকের নেতৃত্বে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড আবিষ্কার করেন এবং আমেরিকার মেইনল্যান্ড (Mainland)-এ পদার্পণ করেন। এর ফলে পরবর্তী যুগের ব্যাপক ব্রিটিশ বাণিজ্যিক প্রসারের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

বৈদেশিক বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন : ইংল্যান্ডের আর্থিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় করার জন্য হেনরী বৈদেশিক বাণিজ্যের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের স্বার্থরক্ষা ও বৃদ্ধি করাকে তাঁর পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্যে পরিণত করেন। এজন্যে তিনি কয়েকটি দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করেন।

  • ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি নেদারল্যান্ডসের সাথে ম্যাগনাস ইন্টার কারসাস (Magnus Inter cursus) বা ‘দি গ্রেট ইন্টারকোর্স’ (The Great Intercourse – শ্রেষ্ঠ মিলন চুক্তি) নামে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেন। এর ফলে নেদারল্যান্ডসে ইংল্যান্ডের পশম ও বস্ত্রের বাজার সম্প্রসারিত হয়।
  • দশ বছর পরে (১৫০৬ খ্রিঃ) হেনরী নেদারল্যান্ডসের শাসক ফিলিপের (১৪৮২-১৫০৬) সাথে পূর্বোক্ত চুক্তি অপেক্ষা অধিকতর সুবিধাজনক শর্তে আর একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। এ চুক্তিকে ফ্রেমিশন ম্যালাস ইন্টার কারসাস’ বা ‘দি ব্যাড ইন্টারকোর্স’ (Malas Inter cursus বা The Bad Intercourse) নামে অভিহিত করে। কারণ, এর শর্তাবলি ফ্লেমিশদের অপেক্ষা ইংল্যান্ডের স্বার্থের অধিক অনুকূলে ছিল।

সপ্তম হেনরী যে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষা এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্যে বিশেষ আগ্রহান্বিত ও যত্নবান ছিলেন এ চুক্তিগুলো তার উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করছে। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় এবং বিচক্ষণ বাণিজ্য নীতির ফলে ব্রিটিশ ব্যবসা- বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং ইংল্যান্ডের বণিক সম্প্রদায় অপরিমিতরূপে লাভবান হন। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় বণিক সম্প্রদায় উপকৃত হওয়ায় তাঁরা বিশ্বস্ততার সাথে রাজাকে সমর্থন করতে থাকেন। ফলে রাজশক্তি সুদৃঢ় হয়।

সপ্তম হেনরীর পররাষ্ট্র নীতি

পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য : পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সপ্তম হেনরী শান্তিবাদী নীতি অনুসরণ করেন। তাঁর পররাষ্ট্র নীতির উদ্দেশ্য ছিল-

  • (১) ইংল্যান্ডের সিংহাসনে নিজের এবং নিজের বংশের নিরাপত্তা বিধান করা এবং সে জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়র্ক বংশীয় শত্রুগণকে বৈদেশিক সাহায্য ও সমর্থন লাভ হতে বঞ্চিত করা,
  • (২) বিদেশে ইংল্যান্ডের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, এবং
  • (৩) ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষা ও বৃদ্ধি করা।

শান্তিনীতির প্রয়োজনীয়তা : এ সকল লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি শান্তিপূর্ণ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেন। ইংল্যান্ডের তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে এটি একান্ত কাম্য ও অপরিহার্য ছিল –

  • প্রথমত, সদ্যজাত টিউডর বংশ তখন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি; নিজের সিংহাসনের নিরাপত্তা তখনও সুনিশ্চিত হয়নি; ইয়র্ক বংশের প্রতিদ্বন্দ্বীরা তখনও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং বৈদেশিক রাজাদের সমর্থন ও সাহায্য লাভ করছিল। এ কারণে হেনরী স্বাভাবিকভাবেই অন্য রাষ্ট্রের সাথে সদ্ভাব স্থাপনের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন যাতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়র্ক বংশের লোকেরা বিদেশের সমর্থন লাভ করতে না পারে।
  • দ্বিতীয়ত, হেনরীর সিংহাসনারোহণ কালে বিদেশে ইংল্যান্ডের কোন মর্যাদা ছিল না। দীর্ঘদিনের কলহে দুর্বল ইংল্যান্ড তার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। এমনকি প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোও তাকে গ্রাহ্য করত না। সুতরাং ইউরোপের রাজনীতিতে ইংল্যান্ডের লুপ্ত সম্মান, প্রতিপত্তি ও প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য হেনরী ইউরোপের বড় বড় রাজন্যবর্গের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সে জন্য কোন কোন বৈদেশিক রাজার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তৃতীয়ত, দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভেঙ্গে পড়েছিল। জাতীয় অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের পুনরুত্থান ও সম্প্রসারণ বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এ সকল কারণে হেনরী সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ইংল্যান্ডকে বৈদেশিক যুদ্ধ হতে মুক্ত রাখেন এবং সকল বৈদেশিক শক্তির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ইটাপলস্-এর সন্ধি : কেবলমাত্র ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হেনরী একটা সামরিক অভিযান প্রেরণ করেছেন। এটি ছিল একটা স্বল্পকালীন সামরিক অবরোধ মাত্র। ফরাসি প্রদেশ বৃটানীর ব্যাপার নিয়ে এ যুদ্ধ বাঁধার উপক্রম হয়েছিল। ফরাসিরাজ অষ্টম চার্লসের (১৪৮৩-১৪৯৮) আমলে ফ্রান্সের সমস্ত প্রদেশ একে একে রাজার কর্তৃত্বাধীনে এসেছিল-স্বাধীন ছিল কেবল বৃটানী। চার্লস বৃটানীকে স্বীয় অধিকারভুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। সুযোগও এলো। ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে বৃটানীর ডিউক ফ্রান্সিসের মৃত্যু হলে তাঁর কন্যা অ্যান বৃটানীর উত্তরাধিকার লাভ করেন । চার্লস বৃটানীকে নিজ রাজ্যভুক্ত করার উদ্দেশে অ্যানের সাথে নিজের বিবাহের প্রস্তাব দেন। বৃটানী ছিল মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ডে ইংল্যান্ডের একমাত্র মিত্র শক্তি; এটি ফ্রান্সের সাথে যুক্ত হলে চার্লসের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং ইংল্যান্ড সম্পূর্ণরূপে মিত্রহীন হয়ে পড়বে মনে করে হেনরী তা প্রতিরোধ করতে ইচ্ছা করেন। কিন্তু চার্লস তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে সক্ষম হন। ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি অ্যানকে বিবাহ করে বৃটানীকে নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। হেনরী তখন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। ইংরেজ বাহিনী ফ্রান্স আক্রমণ করে বোলন অবরোধ করে, কিন্তু গুরুতর কোন যুদ্ধ হয়নি। ১৪৯২ সালে অষ্টম চার্লস যুদ্ধ না করে হেনরীকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ সাত লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার ক্রাউন দিয়ে ইংল্যান্ডের সাথে ইটাপলস্-এর সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এ সন্ধিতে কেউ কারও শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবে না বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। এ চুক্তির ফলে ইংল্যান্ডের সিংহাসনের জাল দাবিদার পার্কিন ওয়ারবেক ফ্রান্স থেকে বহিষ্কৃত হন।

নেদারল্যান্ডসের সাথে বাণিজ্য চুক্তি : হেনরী ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক স্বার্থে নেদারল্যান্ডসের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। ইংল্যান্ড থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ পশম নেদারল্যান্ডসে রপ্তানি হতো। এ ব্যবসায়ের উপর উভয় দেশের সমৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভর করত। হেনরী ইংল্যান্ডের এ বাণিজ্যিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে নেদারল্যান্ডসের সাথে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেন। এর ফলে নেদারল্যান্ডসে ইংল্যান্ডের পশম ও বস্ত্রের বাজার সম্প্রসারিত হয়। দশ বছর পরে ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে হেনরী পুনরায় নেদারল্যান্ডসের সাথে পূর্বোক্ত চুক্তি অপেক্ষা অধিকতর সুবিধাজনক শর্তে আর একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। ফলে ইউরোপের সাথে বৃটিশ বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।

স্পেনের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন : রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্ন বিবেচনা করে হেনরী তৎকালীন ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি স্পেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে আগ্রহী ছিলেন। ঘটনাচক্রে সে সুযোগও তিনি লাভ করেন। ইউরোপে ফ্রান্স ও স্পেন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরাজ অষ্টম চার্লস ইতালি আক্রমণ করলে পবিত্র রোমান সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ন (রোমান ও জার্মানদের রাজা ১৪৮৬-১৫১৯, পবিত্র রোমান সম্রাট ১৫০৮-১৫১৯), স্পেনরাজ ফার্দিনান্দ (এরাগন ১৪৭৯-১৫১৬, ক্যাস্টাইল ও লিও ১৪৭৫-১৫০৪) এবং পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার (১৪৯২-১৫০৩) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁরা জানতেন, ফ্রান্স ইংল্যান্ডের চিরশত্রু, তাই তাঁরা সপ্তম হেনরীর সহযোগিতা কামনা করেন। ইতালির ব্যাপারে অংশগ্রহণ করতে হেনরীর ইচ্ছা না থাকলেও সম্ভাব্য ফরাসি হামলা প্রতিরোধ করার জন্য তিনি স্পেনের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। সুতরাং এ সুযোগে তিনি স্পেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। এ সময় ইউরোপে রাষ্ট্রীয় বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রচলিত উত্তম পন্থা ছিল স্বগোত্র বিবাহ অর্থাৎ এক রাষ্ট্রের রাজা বা রাজপুত্রের সাথে অপর রাষ্ট্রের রানী বা রাজকন্যার বিবাহ সম্পাদন। হেনরী এ স্বগোত্র বিবাহের নীতি অবলম্বন করে স্পেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করার ইচ্ছা করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি স্পেনীয় রাজকন্যা ক্যাথারিনের সাথে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র আর্থারের বিবাহের প্রস্তাব করেন। কয়েক বছর আলাপ-আলোচনার পর ১৫০১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে এ বিবাহ সম্পন্ন হয়। কিন্তু বিবাহের অল্পকাল পরে আর্থার মৃত্যুমুখে পতিত হন। স্পেনের সঙ্গে মিত্রতা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হেনরী তখন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র অষ্টম হেনরীর (১৫০৯-১৫৪৭) সাথে বিধবা ক্যাথারিনের পুনরায় বিবাহের ব্যবস্থা করেন। এজন্যে তিনি পোপের বিশেষ অনুমতি গ্রহণ করেন। কারণ, রোমান ক্যাথলিক আইন অনুসারে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিধবা পত্নীর সাথে কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিবাহ অবৈধ ছিল। এরূপে হেনরী স্পেন ও ইংল্যান্ডের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করেন।

স্কটল্যান্ডের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন : বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে স্পেনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে হেনরী স্কটল্যান্ডের সাথেও সম্পর্ক উন্নয়নে যত্নবান হন। ফ্রান্সের ন্যায় স্কটল্যান্ডও ইংল্যান্ডের চিরশত্রু ছিল। প্রায় দুইশত বছর যাবৎ উভয় দেশের মধ্যে বিবাদ চলছিল। হেনরী স্কটল্যান্ডের শত্রুতা দূর করার জন্য স্কটরাজ চতুর্থ জেমসের (১৪৮৮-১৫১৩) সাথে স্বীয় জ্যেষ্ঠা কন্যা মার্গারেটের বিবাহের প্রস্তাব করেন। দীর্ঘদিনের বৈরী ভাবাপন্ন স্কটরাজ প্রথমে এ প্রস্তাবে সম্মত হননি, কিন্তু হেনরীর ক্রমাগত আন্তরিক চেষ্টার ফলে ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে এ বিবাহ সম্পন্ন হয়। হেনরী আশা করেন যে, এ বিবাহের ফলে ফ্রান্সের সাথে স্কটল্যান্ডের মৈত্রীর অবসান ঘটবে এবং ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড শত্রুতা পরিহার করে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসবে। এ বিয়ে থেকে তিনি সম্ভবত স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মহামৈত্রীর কল্পনাও করেছিলেন। ফলে তাঁর এ স্বপ্ন সার্থক হয়েছিল।

স্পেন ও স্কটল্যান্ডের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ফল : ইংল্যান্ডের ইতিহাসে স্পেন ও স্কটল্যান্ডের সাথে হেনরীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ফল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। স্পেনীয় রাজকন্যা ক্যাথারিনের সাথে তাঁর পুত্র হেনরীর বিবাহসূত্রেই পরবর্তীকালে পোপ ও স্পেনের সাথে ইংল্যান্ডের বিবাদের সৃষ্টি হয়। এ বিবাদের ফলে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। স্কটল্যান্ডের রাজার সাথে তাঁর কন্যা মার্গারেটের বিবাহের ফলে একশত বছর পরে ১৬০৩ সালে মার্গারেটের বংশধর স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস্ (স্কটল্যান্ড ১৫৬৭-১৬২৫, ইংল্যান্ড ১৬০৩-১৬২৫) মার্গারেটের উত্তরাধিকার সূত্রে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ফলে, আরও একশত বছর পরে ১৭০৭ সালে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাষ্ট্রিক মিলন ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। আশু ফলস্বরূপ হেনরী এ দুটি বিবাহ-সম্বন্ধ দ্বারা বৈদেশিক শত্রুতা থেকে প্রায় নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন। এরূপে সময়োপযোগী ও দূরদর্শিতাপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করে সপ্তম হেনরী ইউরোপীয় রাষ্ট্রনীতিতে ইংল্যান্ডের হৃত মর্যাদার অনেকাংশ পুনরুদ্ধার করতে এবং টিউডর বংশকে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সপ্তম হেনরীর আইরিশ নীতি

এডওয়ার্ড পায়নিংস আয়ারল্যান্ডের শাসনকর্তা নিযুক্ত : আয়ারল্যান্ডে ইয়র্ক দলের প্রভাব খুব বেশি ছিল। সেখানে হেনরীর বিরোধী যে কেউ বিশেষ সাহায্য পেত। সিমনেল, ওয়ারবেক প্রমুখ বিদ্রোহীরা সেখানে প্রচুর সমর্থন পেয়েছিল। সুতরাং আয়ারল্যান্ডকে নিজ আয়ত্তে আনার জন্য হেনরী স্যার এডওয়ার্ড পয়নিংস নামক এক ব্যক্তিকে আয়ারল্যান্ডের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠান।

১৪৯৪ সালের পয়নিংস আইন : পয়নিংস ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে দ্রোহেডায় অনুষ্ঠিত আইরিশ পার্লামেন্টে দুটি আইন বিধিবদ্ধ করেন। এর দ্বারা ঘোষণা করা হয় যে, ইংল্যান্ডের প্রচলিত সকল আইন আয়ারল্যান্ডেও বলবৎ হবে এবং রাজা ও রাজ পরিষদের (Privy Council) অনুমোদন ছাড়া আইরিশ পার্লামেন্টে গৃহীত কোন প্রস্তাব অথবা আইন কার্যকরী হবে না। এ আইন ‘পয়নিংস আইন’ (Polyning’s Law) নামে প্রসিদ্ধ।

সপ্তম হেনরীর ১৫০৯ সালে মৃত্যু, চরিত্র ও কৃতিত্ব

মৃত্যু : অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রায় পঁচিশ বছর রাজত্ব করার পর ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে সপ্তম হেনরী মৃত্যুমুখে পতিত হন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার পুত্র (অষ্টম) হেনরীকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।

চরিত্র : সপ্তম হেনরী সাহসী, দৃঢ়চিত্ত, চতুর ও দূরদর্শী ছিলেন। তিনি প্রশান্ত ও গম্ভীর প্রকৃতির লোক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি নিরলসকর্মী ছিলেন এবং কখনও আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হতেন না।

সপ্তম হেনরির কৃতিত্বসমূহ হচ্ছে –

  • টিউডর রাজবংশের প্রতিষ্ঠা : টিউডর রাজবংশের প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী ও কল্যাণকর রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন, অরাজক দেশে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ইংল্যান্ডের সম্ভাবনাময় মহান ভবিষ্যতের ক্ষেত্র প্রস্তুত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড সপ্তম হেনরীর বা তাঁর রাজত্বকালের স্মরণীয় কীর্তি। জনপ্রিয় টিউডর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে হেনরী ইংল্যান্ডের ইতিহাসে স্থায়ী আসন অধিকার করেছেন। ইংল্যান্ডের সিংহাসনকে কেন্দ্র করে ল্যাঙ্কাস্টার ও ইয়র্ক বংশীয়দের মধ্যে সংঘটিত দীর্ঘকালের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে তিনি শক্তিশালী টিউডর রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এ রাজবংশের অধিকাংশ শাসক তাঁদের কর্মদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির দ্বারা দেশের অশেষ মঙ্গল সাধন করেন।
  • শক্তিশালী ও কল্যাণকর নতুন রাজতন্ত্র বা টিউডর স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা : হেনরী কেবল একটি নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না; একজন চতুর, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বলিষ্ঠ ও সুদক্ষ শাসক হিসেবেও তিনি ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছেন। তিনি গোলাপের যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট দীর্ঘকাল স্থায়ী অরাজকতা, অত্যাচার ও নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে দেশে শান্তি, শৃঙ্খলা ও জাতীয় ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি লুপ্ত রাজশক্তিকে পুনরুদ্ধার করে একটি শক্তিশালী ও কল্যাণকর রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা ষষ্ঠ হেনরীর আমল থেকে রাজার কর্তৃত্ব ক্রমান্বয়ে লোপ পাচ্ছিল। শক্তিশালী সামন্ত প্রভুরা রাজার ক্ষমতা হ্রাস করে শাসনব্যবস্থার সর্বত্রই রাজার পরিবর্তে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এর ফলে দেশ থেকে আইনের শাসন উঠে গিয়েছিল। সামন্তবর্গের অত্যাচার, অনাচারে জনগণের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। জনগণ তাদের ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকত। সপ্তম হেনরী এ সকল দুর্বিনীত, উদ্ধত ও অত্যাচারী সামন্ত প্রভুদের দমন করে রাজকর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার করেন। তিনি সামন্তগণের ব্যক্তিগত সৈন্যবাহিনীর বিলোপ সাধন, স্টার চেম্বার আদালত প্রতিষ্ঠা এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে সামন্তগণের পরিবর্তে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক নিয়োগ করে সামন্তশক্তিকে ধ্বংস করেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন উপায়ে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে রাজশক্তির উৎস অর্থবল বৃদ্ধি করেন এবং রাজাকে পার্লামেন্টের প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। এরূপে হেনরী ইতিহাসে ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বা “টিউডর স্বৈরতন্ত্র’ নামে প্রসিদ্ধ শক্তিশালী এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সামন্তশক্তি খর্ব ও শক্তিশালী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা সপ্তম হেনরীর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছিল। এটি তাঁর দেশের জন্য অশেষ কল্যাণ বহন করে এনেছিল। এর ফলে দীর্ঘস্থায়ী নৈরাজ্য ও অনিশ্চয়তার অবসান হয়; দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়; জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে আসে এবং সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের উদ্‌ঘাটিত হয়।
  • ব্যবসা-বাণিজ্য ও জাহাজ নির্মাণ কার্যের উন্নতি : ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জাহাজ নির্মাণ কার্যের পৃষ্ঠপোষকতার দ্বারা ইংল্যান্ডের আর্থিক বুনিয়াদকে সুদৃঢ় করা হেনরীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায়, সমুদ্র পথে ইংল্যান্ডের বাণিজ্য প্রসারের সূত্রপাত হয়। বাণিজ্য সম্প্রসারণকল্পে তিনি জাহাজ নির্মাণের জন্য জনগণকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন। তিনি দূর যাত্রার উপযোগী জাহাজ নির্মাণের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন এবং নৌ-আইন প্রবর্তন করে বৈদেশিক বাণিজ্যে ইংরেজদের নিজস্ব জাহাজ ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেন। ফলে, জাহাজ নির্মাণ ব্যবসায়ে ইংরেজদের মধ্যে বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি হয় এবং ব্যবসা- বাণিজ্য বিস্তার লাভ করে। এ ছাড়া হেনরী বৈদেশিক বাণিজ্যের উন্নতিকল্পে অন্য রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেন। ফলে, ইউরোপের সাথে ব্রিটিশ বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। হেনরীর বাণিজ্য নীতি জনগণের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করে এবং তৎসঙ্গে এটি রাষ্ট্রীয় শক্তিকে সুদৃঢ় করতেও সহায়তা করে।
  • ভৌগোলিক আবিষ্কার ও সামুদ্রিক অভিযানে অংশগ্রহণ : হেনরী তৎকালীন ভৌগোলিক আবিষ্কারে ও সামুদ্রিক অভিযানে অংশগ্রহণের জন্যে ইংরেজ বণিক ও নাবিকগণকে উৎসাহিত করেন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ইংরেজ বণিকগণ ভেনিশীয় নাবিক জন ও সেবাস্টিয়ান ক্যাবটের নেতৃত্বে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড আবিষ্কার করেন এবং আমেরিকার ‘মেইনল্যান্ড’ (Mainland)-এ উপনীত হন। এরূপে সপ্তম হেনরী পরবর্তী যুগের ব্যাপক ব্রিটিশ বাণিজ্যিক প্রসার ও সামুদ্রিক কার্যকলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন।
  • দূরদর্শিতাপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি : পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে হেনরী দূরদর্শিতাপূর্ণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর শান্তিপূর্ণ বৈদেশিক নীতি টিউডর বংশের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত এবং ইংল্যান্ডকে ইউরোপীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সম্মানের আসন দান করেছিল। তিনি ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দের দুর্বল ইংল্যান্ডকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। স্বগোত্র বিবাহ নীতি গ্রহণ করে হেনরী তৎকালীন ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি স্পেনের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন এবং চিরশত্রু স্কটল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে সক্ষম হন। ফ্রান্সের সাথে ইটাপস্-এর সন্ধি এবং স্পেনের সাথে মৈত্রী স্থাপন করে তিনি ফ্রান্সের সম্ভাব্য শত্রুতা প্রতিহত এবং ইয়র্ক বংশীয় শত্রুদিগকে ফরাসিরাজের সাহায্য প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত করতে সক্ষম হন। অধিকন্তু, তিনি নেদারল্যান্ডসের সাথে দুটি চুক্তি করে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক স্বার্থ সম্প্রসারিত করেন।

পরিশেষে, হেনরী ইংল্যান্ডের প্রয়োজন বুঝতে পেরে স্বীয় শক্তি, উদ্যম ও কর্মদক্ষতার বলে সে প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হন এবং তার মাধ্যমে স্বদেশে ও বিদেশে ইংল্যান্ডের গৌরব বৃদ্ধি করেন। তিনি ইংল্যান্ডকে সর্বদিকে সংগঠিত করে ওকে সম্ভাবনাময় মহান ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করেন।

সপ্তম হেনরীর রাজত্বকালের গুরুত্ব

বিভিন্ন দিক দিয়ে সপ্তম হেনরীর রাজত্বকাল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে –

  • গৃহযুদ্ধ ও অরাজকতার অবসান এবং নতুন দিনের সূচনা : প্রথমত, তাঁর রাজত্বকালেই দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ ও অরাজকতার অবসান হয়। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে ল্যাঙ্কাস্টার ও ইয়র্ক বংশীয়দের মধ্যে গৃহযুদ্ধের ফলে সমগ্র দেশে চরম অরাজকতা বিরাজ করছিল; জাতীয় জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার নাম মাত্র ছিল না; উদ্ধত ও দুর্বিনীত সামন্তগণের অত্যাচারে দেশের সর্বত্র বিভীষিকার রাজত্ব চলছিল এবং রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে চরম দুর্যোগ দেখা দিয়েছিল। হেনরীর দ্বারাই এ দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং তাঁর সুদক্ষ ও বলিষ্ঠ শাসনাধীনে সকল দুর্যোগ ও অত্যাচারের অবসান হয়; জাতির জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফিরে আসে এবং জনগণ সুখ-শান্তি ও সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী আলোকবর্তিকা দেখতে পায়।
  • শক্তিশালী রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা : দ্বিতীয়ত, সপ্তম হেনরীর রাজত্বকালেই ‘টিউডর স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘নতুন রাজতন্ত্র’ নামে অভিহিত শক্তিশালী রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ল্যাঙ্কাস্ত্রীয় আমলে পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বার্থ হয়েছিল; শক্তিশালী সামন্তপ্রভুরা রাজার ক্ষমতা হ্রাস করে সর্বক্ষেত্রে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং দেশে চরম অশান্তি আনয়ন করেছিল। হেনরী শক্তিশালী ও উদ্ধত সামন্তগণকে কঠোর হাতে দমন করে এবং রাজার আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধন করে লুপ্ত রাজক্ষমতা পুনরুদ্ধার এবং রাজতান্ত্রিক একাধিপত্য স্থাপন করেন। সামন্তশক্তি খর্ব এবং রাজকর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই সপ্তম হেনরীর রাজত্বকাল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সর্বকালের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে। কারণ, তাঁর প্রতিষ্ঠিত সামন্ত-প্রভাব মুক্ত নতুন একনায়কত্ব ব্যবস্থা দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত এবং পরবর্তী যুগের ব্যাপক বৈষয়িক ও রাষ্ট্রিক উন্নতির পথ সুগম করেছিল।
  • বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি : তৃতীয়ত, হেনরীর শাসনকালেই ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি এবং সাম্রাজ্য স্থাপনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। হেনরী ইংল্যান্ডের আর্থিক বুনিয়াদকে সুদৃঢ় করার জন্য বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশে জনগণকে জাহাজ নির্মাণ কার্যে উৎসাহিত, দূর যাত্রার উপযোগী জাহাজ নির্মাণের জন্য আর্থিক সাহায্য দান এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে ইংরেজদের নিজস্ব জাহাজ ব্যবহারের জন্য নৌ-আইন প্রবর্তন করেন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ইংরেজ নাবিক ও বণিকগণ তৎকালীন ভৌগোলিক আবিষ্কারে ও সামুদ্রিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এরূপে হেনরীর শাসন আমলেই পরবর্তী যুগের ব্যাপক ব্রিটিশ বাণিজ্যিক প্রসার, সামুদ্রিক কার্যকলাপ, নৌশক্তি গঠন এবং ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপনের ভিত্তি রচিত হয়েছিল বলে তাঁর রাজত্বকাল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
  • মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভ্যুদয় : চতুর্থত, হেনরী সামন্তগণকে যথাসম্ভব বর্জন করে বিত্তশালী ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত ও প্রতিভাবান ব্যক্তিগণকে শাসনবিভাগের উচ্চ পদে নিযুক্ত এবং পার্লামেন্টের অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর উত্তরাধিকারীরাও এ নীতির অনুসরণ ও সম্প্রসারণ করেন। ফলে মধ্যবিত্তরাই ক্রমান্বয়ে দেশের ও জাতির মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। এরূপে হেনরীর রাজত্বকালেই পরবর্তী যুগের সমগ্র ইংরেজ জাতির চেতনাশক্তির পথপ্রদর্শক ও অগ্রনায়ক মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উত্থান সূচিত হয়েছিল। এ কারণেও তাঁর রাজত্বকাল উল্লেখযোগ্য।
  • জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার : পঞ্চমত, হেনরীর শাসনকালেই ইংল্যান্ডে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটে। গ্রোসিন, লিনাকর, জন কোলেট, ইরাসমাস, টমাস মুর এবং অন্যান্য বিখ্যাত পণ্ডিত রোম-গ্রীসের নব্য জ্ঞান অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন এবং ইংরেজি রেনেসাঁর ভিত্তি স্থাপন করেন। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীক ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয়, এবং রেনেসাঁর শিক্ষা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, হেনরীর রাজত্বকালেই পরবর্তী যুগের ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। এ কারণেও হেনরীর রাজত্বকালের গুরুত্ব কম নয়। এতদ্ভিন্ন, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রিক মিলনের ক্ষেত্রও হেনরীর দ্বারাই রচিত হয়েছিল।
  • বহির্দেশে ইংল্যান্ডের মর্যাদা বৃদ্ধি : ষষ্ঠত, হেনরীর রাজত্বকালেই বিদেশে ইংল্যান্ডের হারানো মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইউরোপীয় রাজনীতিতে ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণের সূত্রপাত হয়।

সংক্ষেপে, দীর্ঘস্থায়ী অরাজকতার অবসান, শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সামন্তশক্তি খর্ব, রাজক্ষমতার পুনরুদ্ধার, শক্তিশালী একনায়কতন্ত্রের প্রবর্তন, বাণিজ্য, জাহাজ নির্মাণ ও সামুদ্রিক অভিযানের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিদেশে ইংল্যান্ডের সম্মান ও প্রতিপত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে হেনরী ইংল্যান্ডের গৌরবময় ভবিষ্যৎ গঠনের এবং পরবর্তী শাসকদের সাফল্যের পথ সুগম করে যান। আর তাই ইংল্যান্ডের ইতিহাসে তাঁর রাজত্বকাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

সপ্তম হেনরীর রাজত্বকাল হচ্ছে নিরাময় ও বীজ বপনের কাল (A period of remedy and seed time)

নিরাময়ের যুগ – বিশৃঙ্খলার অবসান : সপ্তম হেনরীর রাজত্বকালকে নিরাময় ও বীজ বপনের কাল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। টিউডর পূর্ববর্তী যুগে সামন্তগণের অত্যধিক ক্ষমতা এবং রাজার আর্থিক অসচ্ছলতা প্রধানত এ দুটি কারণে ইংল্যান্ডে রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং সা দেশে চরম অরাজকতা, অশান্তি ও গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়েছিল। এ অবস্থা থেকে হেনরী ইংল্যান্ডকে উদ্ধার করেছিলেন বলেই তাঁর রাজত্বকালকে “নিরাময়ের যুগ’ (A period of remedy) বলা হয়েছে। সামন্ত প্রধানগণ কর্তৃক সশস্ত্র অনুচর বাহিনী পালন করবার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন, স্টার চেম্বার নামক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষ আদালত গঠন এবং শাসনকার্যে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোক নিয়োগ করে হেনরী সামন্ত প্রধানগণের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ করেন এবং সামন্ত কর, আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক, বাধ্যতামূলক ঋণ দান, নজরানা এবং বিভিন্ন অপরাধের দণ্ডস্বরূপ জরিমানা আদায় এবং ব্যয়সঙ্কোচন নীতি অবলম্বনের দ্বারা প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে রাজশক্তির অন্যতম প্রধান উৎস অর্থবল বৃদ্ধি করেন। এরূপে হেনরী সামন্তপ্রধানগণের ক্ষমতা ধ্বংস এবং রাজার দরিদ্রতা দূর করে রাজতন্ত্রের প্রধান প্রতিবন্ধকগুলো নির্মূল করেন এবং তার দ্বারা শক্তিশালী অথচ জনপ্রিয় টিউডর স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে ইংল্যান্ডে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত এবং জাতীয় সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত হয়। এ কারণে হেনরীর রাজত্বকালকে ‘নিরাময়ের যুগ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

বীজ বপন : হেনরীর রাজত্বকালকে ‘বীজ বপনের সময়’ (A period of seed time) বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ, তাঁর সময়ে ভবিষ্যতের জন্য ব্যাপক ফলপ্রসূ কতগুলো কার্যের ভিত্তি পত্তন হয়েছিল। যথা-

  • (১) টিউডর স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন : তাঁর রাজত্বকালেই ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বা ‘টিউডর স্বৈরতন্ত্র’ (New Monarchy or Tudor Despotism)-এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এ শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা হেনরী ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের আমলে দেশের অনেক কল্যাণ সাধন করেছিল।
  • (২) বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি, নৌ-শক্তি ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন : হেনরীর বাণিজ্য নীতি এবং জাহাজ নির্মাণ ও সামুদ্রিক অভিযানে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ইংল্যান্ডের গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। হেনরী নিজে বৈষয়িক লোক ছিলেন। তাই তিনি ইংল্যান্ডের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য একান্ত আগ্রহী ছিলেন। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে তিনি যে দুটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেন।
  • (৩) ভৌগোলিক আবিষ্কার : তার ফলে ইউরোপের সাথে ব্রিটিশ বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশে হেনরী জাহাজ নির্মাণ কার্যে জনগণকে উৎসাহিত করেন এবং দূর যাত্রার উপযোগী জাহাজ নির্মাণের জন্য তাদের আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন। তিনি দ্বিতীয় রিচার্ড ও চতুর্থ এডওয়ার্ডের আমলের পুরাতন নৌ-আইন (Navigation Act) পুনরায় প্রবর্তন করে বৈদেশিক বাণিজ্যে ইংরেজদের নিজস্ব জাহাজ ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেন। ফলে জাহাজ নির্মাণ কার্যে ইংরেজদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ দেখা দেয় এবং তার দ্বারা ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে এবং ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নৌ-শক্তির ভিত্তিও স্থাপিত হয়। হেনরীর রাজত্বকালেই কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন এবং ভাস্কো-ডা-গামা উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করেন। ইংরেজ নাবিক ও বণিকগণও এ সময়েই হেনরীর পৃষ্ঠপোষকতায় সমুদ্রপথে নতুন দেশ আবিষ্কারের কার্যে অংশগ্রহণ করতে আরম্ভ করেন । ১৪৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিস্টল নিবাসী কতগুলো ব্যবসায়ী জন ও সেবাস্টিয়ান ক্যাবট নামে দুজন ভেনিশীয় নাবিকের নেতৃত্বে সমুদ্র যাত্রায় বহির্গত হয়ে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড আবিষ্কার করেন এবং আমেরিকার ‘মেইনল্যান্ড’ (Mainland)-এ পদার্পণ করেন। এ সমস্ত ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে আটলান্টিকের মধ্য দিয়ে আমেরিকা বা এশিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল। এতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশসমূহ অধিক লাভবান হয়েছিল। ইতোপূর্বে ভূমধ্যসাগর যখন ইউরোপের বাণিজ্যের রাজপথ ছিল, তখন ইংল্যান্ডের ভৌগোলিক অবস্থিতিই ছিল ইংরেজ জাতির প্রসার লাভের অন্তরায়। কিন্তু আটলান্টিক মহাসাগরের পথ উন্মুক্ত হবার পর হতেই ইংল্যান্ডের গুরুত্ব অভাবনীয়রূপে বৃদ্ধি পেতে থাকে। নাবিকদের আবিষ্কার-কার্য যতই অগ্রসর হতে থাকে, ইংল্যান্ডের গুরুত্বও ততই বেড়ে যায়। কারণ, আটলান্টিকের পথ উন্মুক্ত হবার পর এবং নাবিকদের ক্রমান্বয়ে অধিক আবিষ্কারের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ ক্রমশ ইংল্যান্ডের প্রায় দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। এ অনুকূল ভৌগোলিক পরিস্থিতির ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড প্রধান স্থান অধিকার করতে আরম্ভ করে। এটাই ইংরেজগণকে বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য স্থাপনের সুযোগ দিয়েছিল। এর ফলেই ইংল্যান্ড সমগ্র পৃথিবীতে নৌ-শক্তিতে প্রধান স্থান অধিকার করেছিল। সুতরাং সপ্তম হেনরীর রাজত্বকাল পরবর্তী যুগের ব্যাপক ব্রিটিশ বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সাফল্যজনক সামুদ্রিক কার্যকলাপের প্রস্তুতির সময় ছিল। ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপন ও নৌ-শক্তি গঠনের ভিত্তি তাঁর রাজত্বকালেই রচিত হয়েছিল। এরূপে হেনরীর বাণিজ্য নীতি এবং জাহাজ নির্মাণ ও সামুদ্রিক অভিযানে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ইংল্যান্ডের গৌরবোজ্জল ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির দ্বার উন্মুক্ত করেছিল।
  • (৩) রেনেসাঁর প্রভাব ও ধর্ম-সংস্কারের সূচনা : সপ্তম হেনরীর রাজত্বকালেই রেনেসাঁর প্রভাব ইংল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। প্রোসিন, লিনাকর, জন কোলেট, ইরাসমাস ও অন্যান্য বিখ্যাত সুধীবৃন্দ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে রেনেসাঁর শিক্ষা প্রদান করেন। রেনেসাঁলব্ধ জ্ঞান জনগণের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে তাদেরকে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলেছিল। পরবর্তীকালের ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তিভূমি ছিল এ রেনেসাঁ। এরূপে হেনরীর রাজত্বকালেই ইংল্যান্ডে ধর্ম-সংস্কারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল।
  • (৪) ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাষ্ট্রিক মিলন : হেনরীর স্বগোত্র বিবাহনীতি ভবিষ্যতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী ঘটনার ভিত্তি রচনা করেছিল। তাঁর পুত্র অষ্টম হেনরীর সাথে স্পেনীয় রাজকন্যা ক্যাথারিনের বিবাহ সূত্রেই পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। তাঁর কন্যা মার্গারেটের সাথে স্কট-রাজ চতুর্থ জেমসের বিবাহ সূত্রেই অবশেষে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাষ্ট্রিক মিলন ঘটেছিল ( ১৭০৭ খ্রিঃ)। অতএব, সপ্তম হেনরীর রাজত্বকাল নিঃসন্দেহে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ‘বীজ বপনের কাল’ (Seed time) ছিল।

সপ্তম হেনরীর শাসনকাল নবযুগের সূচনা

সপ্তম হেনরীর শাসনকাল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল। নিম্নলিখিত কারণে তাঁর রাজত্বকালে নবযুগের সূচনা হয় –

  • (১) স্বৈরতান্ত্রিক রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা : এ সময় ইংল্যান্ডে স্বৈরাচারী একনায়কত্ব শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এ শাসনব্যবস্থায় রাজতান্ত্রিক একাধিপত্য কায়েম হয়েছিল; রাজা পার্লামেন্ট ও সামন্ত প্রভুগণের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। ল্যাঙ্কাস্ত্রীয় আমলে নিয়মতন্ত্রের পরীক্ষা ব্যর্থ হয়। স্বার্থান্ধ সামন্তগণ সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাজশক্তিকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেশে চরম অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি করেন। অতঃপর গোলাপের যুদ্ধে তাদের অসংযত ও অত্যধিক ক্ষমতাই তাদের ধ্বংস করল এবং পার্লামেন্ট ক্ষমতাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। তখনও ক্ষমতাশালী ও স্বাধীন মনোভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত এবং সাধারণ শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ বা জাগ্রত হয়নি; সুতরাং রাজশক্তিকে বাধা দেবার বা দমন করার কেউই ছিল না। এরূপে টিউডোর যুগে স্বৈরতন্ত্রমূলক অথচ জনপ্রিয় রাজশক্তির প্রবর্তন হয়।
  • (২) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান : সামন্তগণের প্রাধান্য ক্ষুণ্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গে বিত্তশালী ব্যবসায়ী অভিজাত শ্রেণী অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠছিল। এ শ্রেণী পরবর্তীকালে সমগ্র জাতির শক্তির আধারে পরিণত হয়। টিউডর শাসকগণ ইচ্ছাকৃতভাবে সামন্তগণকে যথাসম্ভব বর্জন করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত ও প্রতিভাবান ব্যক্তিগণকে শাসনবিভাগের উচ্চ পদে নিযুক্ত করতেন। ফলে, মধ্যবিত্তরাই ক্রমান্বয়ে দেশের মেরুদণ্ডে পরিণত হয়।
  • (৩) রেনেসাঁর সূত্রপাত, হিউম্যানিষ্টদের আবির্ভাব, মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার, অক্সফোর্ডের সংস্কারকগণ : রেনেসাঁ আন্দোলনের প্রভাব এ সময়ে ইংল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিরা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল এবং পাশ্চাত্য শিক্ষাকেন্দ্র (গ্রীক সাহিত্য ও দর্শন চর্চার সর্বপ্রধান কেন্দ্র) কনস্টান্টিনোপল অধিকার করলে সেখানকার পণ্ডিতগণ (গ্রীক অধ্যাপকগণ) সমগ্র ইউরোপে, বিশেষত ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের আগমনে এ সময় শিক্ষার পুনর্জাগরণ (Renaissance) দেখা দেয়; মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে নতুন করে গ্রীক সাহিত্য ও দর্শনের অনুশীলন আরম্ভ হয়। এতদিন এ অঞ্চলে মূল গ্রীক বই বড় একটা পাওয়া যেত না; চার্চের মারফত লোকে গ্রীক বিদ্যার যে পরিচয় পেত তা ছিল অসম্পূর্ণ ও বিকৃত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চার্চের সাধু-সন্ন্যাসীদের দ্বারা পরিচালিত হতো এবং মধ্যযুগের ল্যাটিন ভাষাই ছিল তখন শিক্ষার বাহন। কনস্টান্টিনোপল থেকে অধ্যাপকগণ চলে এলে ইউরোপের সর্বত্র মূল গ্রীক বইয়ের সঙ্গে ক্রমে ক্রমে মনীষীরা পরিচিত হতে থাকেন। তারপর প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য লোকের মনকে প্রাচীন ল্যাটিন সাহিত্যের দিকেও আকর্ষণ করে। শিক্ষিত লোকেরা এভাবে প্রাচীন সাহিত্যের মধ্য দিয়ে স্বাধীন চিন্তার প্রেরণা লাভ করতে থাকেন। তাঁরা কেবল প্রাচীন সাহিত্য, দর্শন, ললিতকলার চর্চা করেই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতার উন্মেষে তাঁরা নতুন নতুন সাহিত্য, দর্শন, ললিতকলা ও বিজ্ঞানকেও সমৃদ্ধ করেন। ফলে সাহিত্যে, দর্শনে, ললিতকলায় সর্বত্রই এক নতুন ভাবের বন্যা দেখা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথলিক চার্চের কুসংস্কার, কলুষ ও অনাচারের এবং চার্চকর্তৃক সত্য বলে প্রচারিত তত্ত্বসমূহের বিরুদ্ধেও প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয়। একদল সংস্কারক প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও বিধি-নিষেধের তীব্র সমালোচনা করতে থাকেন। তাঁরা ‘হিউম্যানিস্ট’ নামে পরিচিত। হিউম্যানিস্টদের সমালোচনা লোকের মনকে ক্রমেই চার্চের অনাচারের বিষয়ে সচেতন করে তুলতে থাকে। ইউরোপীয় প্রতিভার এ অভিনব বিকাশই ইতিহাসে রেনেসাঁ বা শিক্ষার পুনর্জন্ম বলে অভিহিত। এ নবযুগের প্রেরণা হেনরীর রাজত্বকালে ইংল্যান্ডেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে ক্যাক্সটন ইংল্যান্ডে মুদ্রণযন্ত্রের প্রবর্তন করেন। ফলে কষ্টসাধ্য হস্ত লিখিত পুস্তক নকল ও পাঠ করবার প্রথা ও পরিশ্রমের অবসান হয়। পূর্বে হাতে লেখা পুস্তকই ছিল লেখাপড়ার একমাত্র অবলম্বন। ধর্মযাজকরাই নামকরা বইপত্র অশেষ যত্নে নকল করে রাখতেন। একখানি বই নকল করতে মাসের পর মাস কেটে যেত।। ফলে বইপত্রের সংখ্যা যেমন ছিল কম, মূল্যও তেমনি ছিল অপরিমেয়। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সুন্দর মুদ্রিত পুস্তক সকলেই স্বল্পমূল্যে কিনতে সক্ষম হয়। বাইবেল ও অন্যান্য গ্রন্থ বহু সংখ্যায় মুদ্রিত হয়ে সুলভ মূল্যে প্রচারিত হতে থাকে। এর ফলে সর্বত্র স্বাধীন চিন্তার প্রসার ও ধর্ম বিপ্লবের সূচনা হয় এবং বিদ্যাচর্চা সর্বশ্রেণীর মধ্যে আদৃত হয়। উচ্চ শিক্ষা এতকাল চার্চের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে তা ক্রমে সমাজের অন্যান্য স্তরেও প্রবেশ করতে থাকে। ফলে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীক ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয় এবং নতুন শিক্ষা পদ্ধতি ও সে সঙ্গে হিউম্যানিস্টদের ভাবধারা অত্যন্ত সহজে ও দ্রুত গতিতে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অক্সফোর্ডের সংস্কারকগণ (Oxford Reformers ) নামক একটি দল ইংল্যান্ডে নব শিক্ষার প্রবর্তক। এদের মধ্যে জন কোলেট, ইরাসমাস স্যার টমাস মুর সবিশেষ প্রসিদ্ধ। জন কোলেট ও ইরাসমাস ছিলেন রোম-গ্রীসের নব্যজ্ঞানলব্ধ সুপ্রসিদ্ধ হিউম্যানিস্ট। ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা ইংল্যান্ডে আগমন করেন। এ সকল মনীষীর ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে ইংল্যান্ড ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কারের জন্য প্রস্তুত হতে পেরেছিল।
  • (৪) আন্তর্জাতিক রাজনীতির সূত্রপাত : হেনরীর রাজত্বকাল থেকেই ইউরোপের রাজনীতিতে ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণের সূত্রপাত হয়। হেনরী যে সমস্ত বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেন তার ফলে ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতি কেবল স্কটল্যান্ড ও ফ্রান্সে সীমাবদ্ধ না থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করেছিল।
  • (৫) জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও স্বগোত্র বিবাহ নীতি : পরিশেষে সপ্তম হেনরীর রাজত্বকালে বিশ্ব-ইতিহাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়। যথা- প্রথমত, ইউরোপে খ্রিস্টান রাজ্যবাদের স্থলে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। পূর্ব ইউরোপে ফরাসি, ইতালিয়ান প্রভৃতি জাতি ছিল না, ছিল খ্রিস্টান রাজ্য—ধর্মক্ষেত্রে পোপ আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্রাট। ধর্ম বিষয়ে পোপ ও রোমান চার্চের প্রাধান্য সমগ্র ইউরোপ মেনে চলত। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ছিল ঐক্যের বন্ধন। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ইউরোপের বিভিন্ন রাজাগণের নেতৃস্থানীয় ছিলেন। সুতরাং এতদিন ইউরোপ ছিল এক অখণ্ড খ্রিস্টান জনপদ এবং ইউরোপবাসীরা পরস্পর ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ জনসংঘ। কিন্তু সামন্তবাদের পতন, রোমান চার্চের প্রভুত্ব হ্রাস এবং স্বাধীন চিন্তাধারা প্রসারের ফলে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক জীবনে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। এখন জাতীয়তাবাদ (Nationalism) রূপ ধারণ করে। জাতীয়তার পরিপন্থী সামন্ত প্রথা প্রায় লুপ্ত হয়। মধ্যযুগের এক-চার্চ ও এক-রাষ্ট্রের আদর্শ পরিত্যক্ত হয়। ইউরোপের জাতিসমূহ জাতীয় রাষ্ট্রের আবশ্যকতা উপলব্ধি করে আপন আপন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হয়। দেখতে দেখতে ইউরোপ পরস্পর বিরোধী জাতীয় রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর এ সকল রাষ্ট্রগুলোর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই আরম্ভ হয় ইংরেজ, ফরাসি প্রভৃতি জাতিগুলোর রাষ্ট্রীয় প্রগতি। দ্বিতীয়ত, এ সময়েই অবলম্বন শক্তিশালী রাজ্যগুলোর রাজাগণ ভিন্ন দেশীয় রাজবংশের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করে রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারে ও সাম্রাজ্য গঠনে মনোনিবেশ করেন। তৃতীয়ত, এ সময়েই নিত্য নতুন ভৌগোলিক অভিযানের ফলে নতুন দেশ ও বাণিজ্যপথ আবিষ্কৃত হয়েছিল। এ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ফল ইংল্যান্ডেও প্রতিফলিত হয়েছিল। এসব পরিবর্তনের ফলে মধ্যযুগের অবসান ও আধুনিক যুগের সূচনা হয়।

অতএব সপ্তম হেনরীর রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ডে আধুনিক বা নবযুগের সূচনা হয়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সপ্তম হেনরীর (অথবা, টিউডর রাজাগণের) সাফল্যের কারণ

সপ্তম হেনরীর (অথবা টিউডর রাজাদের) স্বৈরতন্ত্র প্রধানত গোলাপের যুদ্ধহেতু সৃষ্ট পরিবর্তিত অভ্যন্তরীণ, বৈদেশিক এবং অন্যান্য অবস্থারই প্রত্যক্ষ ফল। এ ছাড়া আরো অনেক কারণ ছিল যার ফলে সপ্তম হেনরী ও পরবর্তী টিউডর রাজাগণ শক্তিশালী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।

  • (১) অনুকূল অভ্যন্তরীণ অবস্থা ও শাস্তি পিপাসু জনগণ কর্তৃক শক্তিশালী শাসকের কামনা : প্রথমত, সপ্তম হেনরী যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ অবস্থা শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক ছিল। এ সময় ইংল্যান্ডের অবস্থা অত্যন্ত গোলযোগপূর্ণ ছিল। সপ্তম হেনরীর সিংহাসন লাভের পূর্বে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের ফলে দেশের সর্বত্রই অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। সামন্ত প্রভুগণ সর্বেসর্বা হয়ে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশে অশান্তি ও অত্যাচারে জনগণের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছিলেন। তাদের বাধা দেবার মত কোন শক্তি দেশে ছিল না; তাদের হাতেই ছিল পার্লামেন্ট, সৈন্যদল, বিচারক ও জুরি; তাঁরা রাজার ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে হ্রাস করে শাসনব্যবস্থার সর্বত্রই নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সুতরাং দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং সাধারণ লোক সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে পতিত হয়। তাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা ছিল না। তারা নিরাপদে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারত না এবং এমনকি রাত্রে নিজের ঘরেও নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারত না। গোলাপের যুদ্ধের এরূপ পরিণতিতে এবং সামন্তগণের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণ শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়ে। সমগ্র জাতির তখন একমাত্র কাম্য ছিল শান্তি এবং শক্তিশালী শাসনদণ্ড ছাড়া সে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না । গোলাপের যুদ্ধে দুর্বল রাজশক্তির ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করে জনগণ এ সত্য উপলব্ধি করেছিল। তাই তারা এমন একজন শক্তিশালী শাসকের কামনা করছিল যিনি কঠোর হাতে সর্বপ্রকার অত্যাচার ও অনাচার দূর করে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করতে পারবেন। এ কারণে সপ্তম হেনরীর মত শক্তিশালী ও সুদক্ষ শাসনকর্তা সিংহাসনে আরোহণ করলে সকলেই তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন দান করেন। এ প্রবল জনসমর্থনই টিউডর স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রধান কারণ।
  • (২) অনুকূল বৈদেশিকঅবস্থা : দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ডের তৎকালীন বৈদেশিক অবস্থাও শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনুকূল ছিল। সপ্তম হেনরীর সিংহাসনারোহণের সময় বিদেশে ইংল্যান্ডের কোন মর্যাদা ছিল না। দীর্ঘ দিনের গৃহযুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ড একটি সাম্রাজ্যচ্যুত দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ায় এর আন্তর্জাতিক গুরুত্ব লোপ পেয়েছিল। সুতরাং ইংল্যান্ডের জনগণ তাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহান্বিত ছিল। এ কারণেও তারা শক্তিশালী রাজার প্রয়োজন অনুভব করছিল।
  • (৩) ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাজ্যের জন্য বিপজ্জনক যুগ : তৃতীয়ত, ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, স্পেন প্রভৃতি রাষ্ট্র শক্তিশালী রাজাগণের অধীনে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। অথচ ইংল্যান্ড তখনও একটি ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র ছিল এবং ক্ষুদ্র রাজ্যের জন্য সে যুগটি ছিল একটি বিপজ্জনক যুগ। তাছাড়া সে যুগের ধর্মীয় কলহ ইংল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেছিল। সুতরাং এরূপ গোলযোগপূর্ণ যুগে ইংরেজ জাতি ইংল্যান্ডের সম্ভ্রম ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত ছিল। এ কারণেও তারা শক্তিশালী রাজার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল।
  • (৪) গোলাপের যুদ্ধে সামন্ত শক্তির ক্ষয় : চতুর্থত, সামন্তগণ তাদের সৃষ্ট গোলাপের যুদ্ধে নিজেদেরই রাজনৈতিক সমাধি রচনা করেছিল। এ যুদ্ধে তাদের অসংযত ও অত্যধিক ক্ষমতাই তাদের ধ্বংস করে। বহু দুর্দান্ত সামস্ত পরিবার এ যুদ্ধে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে, সপ্তম হেনরীর পক্ষে রাজতান্ত্রিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সহজতর হয়।
  • (৫) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনুপস্থিতি : পঞ্চমত, তখন পর্যন্ত ক্ষমতাশালী ও স্বাধীন মনোভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত ও সাধারণ শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ বা জাগ্রত হতে পারেনি। সুতরাং রাজশক্তিকে বাধা দেবার কেউই ছিল না।
  • (৬) চার্চের প্রভাব হ্রাস : ষষ্ঠত, চার্চের প্রভাবও এ সময় অনেক হ্রাস পায়। লোলার্ড আন্দোলনের ফলে যাজক সম্প্রদায় নিজেদের সম্পত্তি হারাবার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য রাজশক্তিরই ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এ কারণেও রাজশক্তিকে সুদৃঢ় করার পথ প্রশস্ত হয়। এ ছাড়াও অষ্টম হেনরী কর্তৃক রোমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন এবং সন্ন্যাসীদের মঠগুলো উচ্ছেদ করা হলে রাজশক্তি আরও অনেক বৃদ্ধি পায়।
  • (৭) ব্যর্থ পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা : সপ্তমত, ল্যাঙ্কাস্ট্রীয় আমলে পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সময় তখনও পরিণত হয়ে ওঠেনি। এ অনুকূল পরিস্থিতিও টিউডর রাজাগণকে রাজশক্তি সুদৃঢ় করতে সহায়তা করে।

পরিশেষে, সপ্তম হেনরী এবং পরবর্তী টিউডর রাজাগণ দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করে, বৈদেশিক কর্তৃত্ব ও বিপদ দূর করে, ইংল্যান্ডকে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত্তি রচনা করে দেশের সর্বাঙ্গীন যথার্থভাবে জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। এ উন্নতির জন্য টিউডর সকল কারণে টিউডর রাজতন্ত্র সাধারণ লোকের নিকট প্রিয় ছিল। রাজারা সকল এবং প্রভাবশালী শ্রেণী, নতুন অভিজাত সম্প্রদায়, ভদ্রমণ্ডলী, সম্প্রদায়ের সমর্থন আইনজীবী এবং ব্যবসায়ীগণেরও সক্রিয় সমর্থন লাভ করেছিল। টিউডর রাজাগণ ব্যবসা-বাণিজ্য, জাহাজ নির্মাণ, ভৌগোলিক আবিষ্কার, সামুদ্রিক অভিযান প্রভৃতি কার্যে বিশেষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করায় ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্তরা এ সকল বৃত্তি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে একদিকে যেমন জাতীয় উন্নতি বৃদ্ধি পায়, অপরদিকে তেমনি মধ্যবিত্ত ও বণিক সম্প্রদায় উপকৃত হওয়ায় তারা বিশ্বস্ততার সাথে রাজাকে সমর্থন করতে থাকে, ফলে টিউডর রাজাদের হাতে রাজশক্তি আরও সুদৃঢ় হয়।

সপ্তম হেনরীর রাজত্বকালের সংক্ষিপ্ত বিবরণ বা পর্যালোচনা

হেনরী টিউডর ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে বসওয়ার্থের যুদ্ধে ইয়র্ক বংশীয় শেষ রাজা তৃতীয় রিচার্ডকে (১৪৮৩-১৪৮৫) পরাজিত করে সপ্তম হেনরী উপাধি গ্রহণ করে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ইংল্যান্ডের প্রথম টিউডর রাজা। রাজ্যাভিষেকের ছয় মাস পরে হেনরী ইয়র্ক বংশীয় চতুর্থ এডওয়ার্ডের কন্যা এলিজাবেথকে বিবাহ করেন। রাজত্বের প্রথম ভাগে ইয়র্ক বংশের সমর্থকগণ হেনরীর বিরুদ্ধে কয়েকটি ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু হেনরী সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হন।

  • সামন্ত প্রভাব দমন : অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে লুপ্ত রাজশক্তিকে পুনরুদ্ধার করে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করাই সপ্তম হেনরীর রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কার্য ছিল। হেনরী বিভিন্ন উপায়ে সামন্তগণের ক্ষমতাকে ধ্বংস এবং রাজার আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করে ইংল্যান্ডে একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। সামন্তগণের ক্ষমতা ধ্বংস করবার জন্য হেনরী ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্ট্যাটিউট অব লিভারি অ্যান্ড মেইনটেনান্স’ (Statute of Livery and Maintenance) নামে একটি আইন পাস করে সামন্তগণকর্তৃক যোদ্ধা অনুচর রাখা নিষিদ্ধ করেন। ফলে সামন্তগণের ব্যক্তিগত সৈন্য লোপ পায় এবং সে সঙ্গে গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। অনুচরহীন অবস্থায় সামন্তগণের পক্ষে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ক্ষমতা লোপ পায়। হেনরী “স্টার চেম্বার কোর্ট” নামক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশেষ আদালত গঠন করে এর সাহায্যে শক্তিশালী সামন্তগণের বিচার ও দণ্ড বিধান করতেন। ফলে, কোন সামন্তই আর আইন অমান্য করতে সাহস করত না। এ ছাড়া হেনরী ইচ্ছাকৃতভাবে শাসনবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সামন্তগণকে বহিষ্কার করে তাদের জায়গায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে তাঁর কর্মচারী নিযুক্ত করতেন। এর ফলে রাজার প্রতি অনুগত ও রাজকার্য সম্পাদনে বিশ্বস্ত এক নতুন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্রীয় কার্যে সামন্তগণের চিরাচরিত প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ হয়।
  • রাজকোষে অর্থ সঞ্চয় : রাজতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উৎস অর্থবল বৃদ্ধি করার জন্যে হেনরী বিভিন্ন উপায়ে রাজকোষ পূর্ণ করার ব্যবস্থা করেন। তিনি সামন্ত কর এবং অর্থশালী লোকদের নিকট হতে বাধ্যতামূলক ঋণ, দান ও নজরানা আদায় করতেন। কোন সামন্ত সশস্ত্র অনুচর রাখলে কিংবা কেউ কোন বিস্তৃত আইন ভঙ্গ করলে জরিমানা আদায় করা হতো। এ ছাড়া হেনরী দেশের সকল আমদানি ও রপ্তানির উপর শুল্ক নিতেন এবং শাসন সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহে মিতব্যয়িতা অবলম্বন করে প্রতি বছর সাধারণ রাজস্ব থেকে কিছু সঞ্চয় করে রাখতেন। এরূপে তিনি প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করে স্বনির্ভরশীল হয়ে ওঠেন এবং এর মাধ্যমে পার্লামেন্টের প্রভাব হতে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। মৃত্যুকালে তাঁর রাজকোষে চার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ পাউন্ড মজুত ছিল। এরূপে হেনরী একদিকে সামন্ত প্রধানগণের প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ, অপরদিকে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে রাজতন্ত্রের প্রধান প্রতিবন্ধকগুলো দূর করেন এবং এর মাধ্যমে শক্তিশালী টিউডর রাজতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রবর্তিত শক্তিশালী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ইতিহাসে ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বা ‘টিউডর স্বৈরতন্ত্র’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে।
  • শান্তিপূর্ণ বৈদেশিক নীতি : পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে হেনরী শান্তিকামী নীতি অবলম্বন করে ইউরোপের বৃহৎ রাজন্যবর্গের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং কোন কোন বৈদেশিক রাজার সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেন। কেবল ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হেনরী একটি সামরিক অভিযান প্রেরণ করেছিলেন, কিন্তু গুরুতর কোন যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়নি। ফরাসিরাজ অষ্টম চার্লস (১৪৮৩-১৪৯৮) যুদ্ধ না করে হেনরীর সাথে ইটাপলস্-এর সন্ধি করেন ( ১৪৯২ খ্রি.)। এ সন্ধির দ্বারা হেনরী বিশেষ লাভবান হয়েছিলেন। হেনরী ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক স্বার্থে নেদারল্যান্ডসের সাথে দুটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করে নেদারল্যান্ডসে ইংল্যান্ডের পশম ও বস্ত্রের বাজার সম্প্রসারিত করেন। স্পেনের সঙ্গেও হেনরী বন্ধুত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন। স্পেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করবার জন্য তিনি স্পেনের রাজকন্যা ক্যাথারিনের সাথে স্বীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র আর্থারের বিবাহ দেন (১৫০১ খ্রি.)। অল্পদিনের মধ্যে আর্থারের মৃত্যু হলে হেনরী স্পেনের সাথে বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তাঁর দ্বিতীয় পুত্র অষ্টম হেনরীর সাথে বিধবা ক্যাথারিনের বিবাহের বন্দোবস্ত করে রাখেন। স্পেনের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে হেনরী স্কটল্যান্ডের চতুর্থ জেমসের সাথে স্বীয় জ্যেষ্ঠা কন্যা মার্গারেটের বিবাহ প্রস্তাব করেন। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে এ বিয়ে সম্পন্ন হয়। এ দুটি বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপনের দ্বারা হেনরী বৈদেশিক শত্রুতা থেকে অনেকাংশে নিশ্চিন্ত এবং ইউরোপে ইংল্যান্ডের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সপ্তম হেনরী জনপ্রিয় রাজা না হলেও তিনি যে ইংল্যান্ডের অশেষ মঙ্গল ও উন্নতি করে গিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর রাজত্বকালে ইংল্যান্ডে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপিত হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হয় এবং রাজার প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। রাজশক্তির দুর্বলতার কারণসমূহ নির্মূল করে রাজতান্ত্রিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং দেশ থেকে দীর্ঘকালস্থায়ী নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটানোর জন্য তাঁর রাজত্বকালকে ‘নিরাময়ের যুগ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ভবিষ্যতের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের ভিত্তি রচনার জন্য তাঁর রাজত্বকালকে ‘বীজ বপনের সময়’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বৈরতান্ত্রিক রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান, রেনেসাঁর আবির্ভাব, ইউরোপীয় রাজনীতিতে ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণের সূত্রপাত ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের জন্য হেনরীর রাজত্বকালকে ‘নবযুগের সূচনাকারী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এরূপে ইংল্যান্ডের গৌরবোজ্জল ভবিষ্যতের ভিত্তি রচনা করে দীর্ঘ পঁচিশ বছর রাজত্ব করার পর ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে সপ্তম হেনরী ইহলোক ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইংল্যান্ডের ইতিহাস (১৪৮৫ থেকে ১৯৩৬ খ্রিঃ পর্যন্ত), তানজিমুল ইসলাম, বুক চয়েস, ঢাকা, ২০১৮, পৃ. ২১-৪৯

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.