অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ভূমিকা ও প্রাচীন অর্থনৈতিক চিন্তাধারা (হিন্দু, গ্রিক ও রোমান)

Table of Contents

অর্থনৈতিক চিন্তাধারা (Economic Thought)

অর্থনৈতিক চিন্তাধারার উৎপত্তি

জন্মগতভাবেই মানুষ স্বার্থপর। নিজের ও নিজের গোষ্ঠীর বা সম্প্রদায়ের মানুষদের স্বার্থরক্ষা করার জন্যই মানুষ যখন চিন্তা করতে শুরু করে তখন থেকেই মূলত অর্থনৈতিক চিন্তাধারার জন্ম। একটা শিশু যখন একটু বড় হয়ে তার বুদ্ধিবৃত্তি জাগ্রত হয় তখনই দেখা যায়, তার আয়ত্তে কোন জিনিস থাকলে সে সবসময় এটা তার নিজের দখলে রাখতে চায়, অন্য কাউকে দিতে চায়না। মূলতঃ জন্মের পর থেকেই মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা কাজ করে। এই স্বার্থপরতা থেকেই পরবর্তীতে অর্থনৈতিক চিন্তাধারার জন্ম হয়। আদিম যুগে মানুষ বন জঙ্গলে বসবাস করত, বন থেকে ফলমূল সংগ্রহ করে তা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করত। মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ও রক্তের সম্পর্কের কারণে মানুষের মধ্যে গোষ্ঠী প্রথার জন্ম হয়। বনের ফলমূল নিয়মিত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় মানুষ ধীরে ধীরে বনের পশু শিকার করে তাদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। ফলে মানুষের খাদ্যাভাসের মধ্যে পরিবর্তন আসে। আগুন আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে বনের পশু-পাখি শিকার করে তা আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া মানুষের জন্য সহজ হয়। তখন থেকে মানুষ দলগত বা গোষ্ঠীগতভাবে বসবাস ও পশু শিকারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এত পশু শিকার করতে গিয়ে পশু প্রাপ্তিতে অশ্চিয়তার কারণে মানুষ পশু পালন করতে শুরু করে। নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্যের নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলার পর পশুর চারণভূমির সংকট দেখা দেয়। তখনই মানুষ তাদের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে নিজ গোষ্ঠীর পশুর সংখ্যা বাড়ানোর কথা চিন্তা করে। এজন্য মানুষ নিজ গোষ্ঠীকে নিয়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়ে পশু পালনের মাধ্যমে নিজের গোষ্ঠীর পশুর সংখ্যা বাড়ানোর প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। এই পশুগুলো নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য, এক গোষ্ঠীর সাথে অন্য গোষ্ঠীর স্বার্থেও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকেই মূলতঃ অর্থনৈতিক চিন্তাধারার সূত্রপাত হয়। দিনে দিনে অর্থনৈতিক চিন্তাধারা অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে বলা যায় যে, অর্থনৈতিক চিন্তাধারার সূত্রপাত বা উৎপত্তি হয়েছে অনেক আগেই।

অর্থনৈতিক চিন্তাধারার সংজ্ঞা

প্রাচীন কালে মানুষ নিজেদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাতে থেকে রক্ষা করা এবং শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে গুহায় বসবাস করত। আদিম যুগে মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল বিভিন্ন ধরনের ফলমূল। তাই খাদ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে বা খাদ্যের সন্ধানে মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াত। তারপর মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখল। আগুন জ্বালানো শেখার পর থেকে মানুষ ধীরে ধীরে ফলমূলের পাশাপাশি বিভিন্ন বন্য প্রাণীর মাংস পুড়িয়ে খেতে শুরু করল। তখন থেকে বন্য প্রাণীর মাংস তাদের প্রধান। খাদ্য হিসেবে জায়গা করে নেয়। পশুপাখি এভাবে পুড়িয়ে খেতে থাকলে এক সময় বন্য প্রাণী ও পশুপাখির সংকট দেখা দিতে পারে। তখন পশুপালনের চিন্তা মানুষের মাথায় আসে। তখন থেকে পশুপালন যুগের সূচনা হয়। ফলে ব্যক্তিস্বার্থের উন্মেষ ঘটে। যেদিন থেকে ব্যক্তিস্বার্থের উন্মেষ ঘটে সেদিন থেকেই অর্থনৈতিক চিন্তাধারার সূত্রপাত হয়।

সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো অর্থনীতিও একটি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে এবং এখনও অর্থনীতি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সময়ের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন সভ্যতার উত্থান ঘটে এবং অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে। গ্রিক ও রোমান সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং মধ্যযুগীয় ও খ্রিষ্টীয় চিন্তধারার সাথে অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ক্রমবিকাশ ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে বহু চিন্তাবিদের ধ্যান-ধারণা, তত্ত্ব, বক্তব্য ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মযাজকদের প্রভাব থাকায় ইউরোপীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় ধর্মীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাণিজ্যবাদী চিন্তাধারা ও ভূমিবাদী চিন্তাধারা অর্থনৈতিক চিন্তাধারাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। অর্থনৈতিক চিন্তাধারা কোন স্থির বিষয় নয়। কারণ, অর্থনীতি একটি গতিশীল সামাজিক বিজ্ঞান। এজন্য সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ অর্থনৈতিক চিন্তাধারার সাথে যুক্ত হচ্ছে। যেমনঃ ক্লাসিক্যাল চিন্তাধারা, নয়া-ক্লাসিক্যাল চিন্তাধারা, মার্কসীয় চিন্তাধারা, কেইনসীয় চিন্তাধারা, শিকাগো মতবাদ, মুদ্রাবাদী চিন্তাধারা ইত্যাদি ।

সুতরাং উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানব কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যুগে যুগে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ যেসব অর্থনৈতিক বক্তব্য বা মডেল প্রদান করেছেন সেগুলোর সমন্বিত রূপকে বলা হয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারা।

অর্থনৈতিক চিন্তাধারার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা

অর্থনীতির নানাদিক নিয়ে যুগে যুগে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ চিন্তাভাবনা করেন এবং তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন যা অর্থনৈতিক চিন্তাধারা নামে পরিচিত। অর্থনৈতিক চিন্তাধারা অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। তাই তো অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ক্রমবিকাশ থেমে নেই বরং দিন দিন অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। নিম্নে অর্থনৈতিক চিন্তাধারার গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হলো –

  • ১। আত্মরক্ষার প্রকৃতি জানা : আধুনিক মানব সভ্যতা এক বছরে গড়ে ওঠেনি বরং শতকোটি বছরের বিবর্তনের ফল। আদিম যুগে মানুষ তার আত্মরক্ষার জন্য বিভিন্ন অস্ত্র ও কৌশলের উদ্ভাবন করেছে। মানুষের আত্মরক্ষার এসব কৌশল সম্পর্কে জানার জন্য অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা দরকার।
  • ২। বাসস্থান তৈরির ইতিহাস জানা : অর্থনৈতিক চিন্তাধারা পাঠের মাধ্যমে মানুষের বাসস্থান তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। আদিম সমাজে মানুষ রোদ-বৃষ্টি, ঝড়ের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করত। তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বন্য প্রাণীর আক্রমণের মুখে মানুষ নিজেকে অসহায় মনে করত। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং হিংস্র প্রাণীর আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মানুষ পাহাড়ের গুহায় কিংবা গাছের মধ্যে মাটির কিছুটা উপরে বসবাস করা শুরু করে। ধীরে ধীরে মানুষ বাসস্থান নিয়ে চিন্তা করতে করতে আজকের ইটের তৈরি সুউচ্চ দালান কোঠা তৈরি করা শিখেছে। মানুষ চিন্তা করতে শিখেছে যে তার পরিবারের জন্য একটি সুন্দর ও স্থায়ী আবাসস্থান নির্মাণ করা দরকার।
  • ৩। চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা : আধুনিক খাদ্য উৎপাদন ও চাষাবাদ পদ্ধতি হঠাৎ করে শুরু হয়নি। মানুষের খাদ্যাভাসের পরিবর্তনের ফলে ক্রমেই বর্তমান চাষাবাদ ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। প্রথমে মানুষ বন জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে বাঁচত। কিন্তু এক সময় বনের ফলমূলে ঘাটতি দেখা দেয়। তারপর মানুষ পশু শিকার করে আগুনে পড়িয়ে খেতে শুরু করে। কিন্তু এক সময় পশু-পাখির সংকট দেখা দিতে শুরু করে। তখন মানুষ ভূমি কর্ষণের মাধ্যমে আধুনিক চাষাবাদ ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। খাদ্য উৎপাদন ও চাষাবাদ পদ্ধতির বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক চিন্তাধারা অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে।
  • ৪। বিভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কে জানা : পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে প্রাচীনকালেই সভ্যতার বিকাশ ঘটে। যেমনঃ রোমান সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা। অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসব সভ্যতা অবদান রেখেছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন সভ্যতার অবদান সম্পর্কে জানা যায় অর্থনৈতিক চিন্তাধারা অধ্যয়নের মাধ্যমে।
  • ৫। ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান : প্রাচীনকালে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে খ্রিষ্টীয় চিন্তাধারার প্রভাব এতই বেশি দেখা দেয় যে, খ্রিষ্টীয় চিন্তাধারা সে সময়কার অর্থনীতির নানাদিককে প্রভাবিত করেছিল। ধর্মীয় চিন্তাধারার সাথে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় জড়িত থাকতে দেখা যায়। তাই ধর্মীয় দর্শন কিভাবে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে এসব বিষেয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হলেও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাস জানা দরকার।
  • ৬। মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থা বিশ্লেষণ : মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ক্রমবিবর্তনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। যদিও মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ একে অন্যের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতো। তা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অর্থনৈতিক বিবর্তনে মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার অবদান সম্পর্কে জানা যায়।
  • ৭। ধর্মযাজকদের প্রভাব জানা : মধ্যযুগে বিশেষ করে ইউরোপে ধর্মযাজকদের প্রভাব কম ছিলনা। ধর্মযাজকদের দ্বারা শাসক শ্রেণি যেমন প্রভাবিত হত, তেমনি অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে ধর্মযাজকদের প্রভাব ছিল। অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যাবে কিভাবে আধুনিক ইউরোপের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির শুরুতে ধর্মযাজকরা অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
  • ৮। অর্থনীতির পর্যায়ক্রমিক ইতিহাস জানা : অর্থনীতি মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা করে। সময়ের ব্যবধানে মানুষের চিন্তাচেতনা, পেশা ও কাজকর্মের পরিবর্তন হয়। সেই সাথে অর্থনীতির প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং পরিধিরও পরিবর্তন হয়। এজন্য প্রথমে ক্লাসিক্যাল, তারপর নিউ ক্লাসিক্যাল এবং পর্যায়ক্রমে কেইন্‌সীয় চিন্তাধারা ও শিকাগো চিন্তাধারা ইত্যাদি আমরা পর্যায়ক্রমিকভাবে পাই। অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাস অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা অর্থনীতির বিবর্তনের এই পর্যায়ক্রমিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারি।
  • ৯। ক্লাসিক্যাল চিন্তাধারা সম্পর্কে জানা : ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথকে অর্থনীতির জনক বলা হয়। কারণ, এডাম স্মিথ সর্বপ্রথম অর্থনীতির বিভিন্ন ধারণা সুশৃঙ্খলভাবে ব্যাখ্যা করেন। এডাম স্মিথের ধারণাগুলোকে পরবর্তীতে তার অনুসারীগণ আরও প্রসারিত করেন। অর্থনীতিতে ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ তথা ক্লাসিক্যাল অর্থনৈতিক চিন্তাধারার অবদান জানার জন্য অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে অধ্যায়ন করা প্রয়োজন।
  • ১০। নিউ ক্লাসিক্যাল অর্থনৈতিক চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করার জন্য : ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের বক্তব্যের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা দূর করে আরও সংশোধিত ও প্রসারিত উপায়ে অর্থনীতির বিভিন্ন ধারণা ব্যাখ্যা করেন আরেক দল অর্থনীতিবদ যাদেরকে বলা হয় নিউ ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ। নিউ ক্লাসিক্যাল অর্থনৈতিক চিন্তাধারার জনক বলা হয় জে.এম কেইন্‌সকে। ক্লাসিক্যাল স্বয়ংক্রিয় পূর্ণ নিয়োগ ভারসাম্য ধারণা বাতিল করে জে.এম. কেইন্‌স ও তাঁর অনুসারীগণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সরকারের হস্তক্ষেপের অনিবার্যতা ও যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। অর্থনৈতিক চিন্তাধারা অধ্যায়নের মাধ্যমে আমরা অর্থনীতিতে নিউ ক্লাসিক্যাল চিন্তাধারার অবদান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারব।
  • ১১। আধুনিক অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বিশ্লেষণ : সময়ের পরিক্রমায় আধুনিককালে অর্থনীতির বিষয়গুলো জটিল আকার ধারণ করেছে। অর্থনীতির এই জটিল বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার জন্য আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। অর্থনৈতিক চিন্তাধারা অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা আধুনিক অর্থনীতির নানা জটিল বিষয় সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, অর্থনীতির বিভিন্ন নিয়ম, তত্ত্ব ও ধারণাসমূহ ব্যাখ্যা করার জন্য এবং পৃথিবীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস জানার জন্য অর্থনৈতিক চিন্তাধারা অধ্যয়ন অনস্বীকার্য। তাই অর্থনেতিক চিন্তাধারা বিষয়টিকে পৃথকভাবে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক ইতিহাস (Economic History) ও চিন্তাধারার তুলনা

অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংজ্ঞা

কোনো দেশের বা সমগ্র বিশ্বের অর্থনেতিক উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যাকে বলা হয় অর্থনৈতিক ইতিহাস। এই অর্থনৈতিক ইতিহাস কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের হতে পারে, আবার পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের হতে পারে, আবার সকল দেশের সম্মিলিতভাবে কিংবা সমগ্র পৃথিবীর অর্থনৈতিক অগ্রগতির সামগ্রিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হতে পারে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ইতিহাস বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমনঃ বৃটেনের অর্থনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাস আর চীনের অর্থনৈতিক ইতিহাস এক নয়। একইভাবে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাস আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ইতিহাস এক নয়। একেক দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস একেক রকম। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব ও মুক্ত বাণিজ্যের প্রসার, সোভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ খামার, জাপানের বড় ব্যবসায়ীদের বিবর্তন, চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার ইত্যাদি প্রতিটি অর্থনৈতিক ঘটনার ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন।

বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের উন্নয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও এর বৈচিত্র্যতা লক্ষ্য করা যাবে।

  • বৃটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ শুধুমাত্র কাঁচামাল বা প্রাথমিক পণ্য নয় বরং এদেশে উৎপাদিত বস্ত্র বৃটেনে রপ্তানী করা হত। উচ্চ হারে আমদানি শুল্ক বাধা সত্ত্বেও এখন এদেশের বস্ত্র শিল্প পৃথিবীর অনেক দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে।
  • স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের সুখ্যাতি ছিল পৃথিবীব্যপ্তি। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের অদক্ষতা ও চরম অব্যবস্থাপনার কারণে পাট শিল্পের সেই গৌরব আর নেই।
  • তারপর আশির দশকের তৈরি পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল যা আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত। পৃথিবীতে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানীতে তৃতীয় অবস্থানে।

যে বাংলাদেশ এক সময় ছিল তলাবিহীন ঝুড়ি, খাদ্য ঘাটতির দেশ, সেই বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার গত দুই দশক ধরে ৬%-৮% এর মধ্যে। এভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এদেশের সাফল্য ও ব্যর্থতার চিত্র পাওয়া যাবে। একই নিয়মে যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় সে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা কিংবা অর্থনৈতিক পতন ও দুর্বলতার কারণ।

অর্থনৈতিক ইতিহাস ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে পার্থক্য

ইতিহাস ও চিন্তাধারা দু’টো ভিন্ন জিনিস। অতীতে ঘটে যাওয়া একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত ঘটনার বিশ্লেষণকে বলা হয় ইতিহাস। আর, একটি বিষয় সম্পর্কে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি কি বলেছেন, কি চিন্তা করেছেন, তার মতামতের সেই বিশ্লেষণকে বলা হয় চিন্তাধারা। অর্থাৎ ইতিহাস হচ্ছে অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা আর চিন্তাধারা হচ্ছে মতবাদ। একইভাবে কোনো দেশের অতীতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কিংবা উত্থান-পতনের ধারাবাহিক বর্ণনাকে বলা হয় অর্থনৈতিক ইতিহাস। আর, কোনো দেশের অর্থনৈতিক ব্যর্থতার জন্য দায়ী কারণ কী, কিভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যায় সে সম্পর্কে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ কি চিন্তাভাবনা করছেন, মতামত দিচ্ছেন তার বিশ্লেষণ হচ্ছে অর্থনৈতিক ইতিহাস। কাজেই অর্থনৈতিক ইতিহাস আর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা এক নয় বরং দু’টি ভিন্ন বিষয়। অর্থনেতিক ইতিহাস ও অর্থনেতিক চিন্তাধারার মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিম্নে অর্থনৈতিক ইতিহাস ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যকার পার্থক্যগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ

  • ১। নির্দিষ্ট সময়কালে কোনো বিশেষ দেশের বা অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারাবাহিক বর্ণনাই হচ্ছে অর্থনৈতিক ইতিহাস। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা বিকাশ সাধনের ব্যাপারে কোনো অর্থনীতিবিদ কী ভাবছেন সে সম্পর্কিত মতামতকে বলা হয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারা।
  • ২। অর্থনৈতিক ইতিহাস হচ্ছে অতীতের অর্থনৈতিক ঘটনার বর্ণনা। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক চিন্তাধারা হচ্ছে মতবাদ।
  • ৩। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অনুন্নয়নের কারণ ব্যাখ্যা করা হয় অর্থনৈতিক ইতিহাসে। কিন্তু, বিভিন্ন অর্থনীতিবিদের তত্ত্ব, মতামত ও চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটে অর্থনৈতিক চিন্তাধারায়। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অর্থনৈতিক ঘটনাবলীর বর্ণনা করলে তা হবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস। অন্যদিকে, বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ অনুসন্ধান এবং কীভাবে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সে সম্পর্কিত মতামত ও চিন্তাভাবনাকে আমরা অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বলতে পারি।
  • ৪। অর্থনৈতিক ইতিহাস হচ্ছে অতীতে ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক ঘটনাবলীর বর্ণনা যা সত্য ও বাস্তব। কিন্তু অর্থনৈতিক চিন্তাধারা অনুমেয় ও কাল্পনিক। এটা সত্যও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে।
  • ৫। অর্থনেতিক ইতিহাস চিন্তাধারার উপর নির্ভর করে না। কিন্তু অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে অর্থনৈতিক ইতিহাস অধ্যয়ন করা আবশ্যক।
  • ৬। অর্থনৈতিক ইতিহাস এর ক্ষেত্রে গবেষণা অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু অর্থনৈতিক চিন্তধারা এর জন্য গবেষণা খুব একটা জরুরী নয়।
  • ৭। অর্থনৈতিক ইতিহাস বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন জাপানের অর্থনৈতিক ইতিহাস, চীনের অর্থনৈতিক ইতিহাস, ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক চিন্তাধারাও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যথা ক্লাসিক্যাল, নয়া ক্লাসিক্যাল, কেইনসীয় ভূমিবাদী, বাণিজ্য চিন্তাধারা ইতাদি।

উপরের পার্থক্যগুলো থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ইতিহাস এবং অর্থনৈতিক চিন্তাধারা পরস্পরের পরিপূরক। অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ক্রমবিকাশে অর্থনীতির ভাবধারা, নীতিমালা, উদ্ভব ও বিকাশ অর্থনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। অনেক সময় অর্থনৈতিক ইতিহাস অর্থনৈতিক চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে।

অর্থনীতির ইতিহাস (History of Economics) ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের (Economic History) মধ্যে পার্থক্য

একটি দেশের সমগ্র অর্থনীতির উন্নতি, অবনতি ও প্রবণতাকে বলা হয় অর্থনীতির ইতিহাস। যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিহাস, বৃটেনের অর্থনীতির ইতিহাস। বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন হয় কারণ সকল দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো একরকম নয়। তাই কোনো দেশের অর্থনীতির ইতিহাস থেকে জানা যায় সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ও অবনতি সম্পর্কে। অন্যদিকে, যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বলা হয় অর্থনেতিক ইতিহাস। যেমন জাপানের অর্থনেতিক ইতিহাস বলতে বুঝায় জাপানের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও ধারা, বড় ব্যবসায়ী যাইবাতসুদের ভূমিকা, মেইজী পুনরুত্থান মুক্ত বাণিজ্যের ভূমিকা ইত্যাদি। অর্থাৎ একটি দেশের বিভিন্ন অর্থনীতির কার্যকলাপের সাথে সাথে উক্ত অর্থনীতির উন্নয়ন-কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের অবদান ইত্যাদি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করাকে অর্থনৈতিক ইতিহাস বলে। কাজেই, অর্থনীতির ইতিহাস এবং অর্থনৈতিক ইতিহাস এক বিষয় নয়। অনেকেই দু’টি বিষয়কে একই বলে চিন্তা করেন। কিন্তু বাস্তবে অর্থনীতির ইতিহাস ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের মধ্যে কতিপয় মৌলিক পাথক্য রয়েছে। নিয়ে অর্থনীতির ইতিহাস ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের মধ্যকার পার্থক্যগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল –

  • ১। একটি দেশের সমগ্র অর্থনীতির উন্নয়ন, অবনতি ও প্রবণতার বিশ্লেষণকে বলা হয় অর্থনীতির ইতিহাস। যেমন বৃটেনের অর্থনীতির ইতিহাস। অন্যদিকে, একটি দেশের অর্থনীতির যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বলা হয় অর্থনৈতিক ইতিহাস। যেমন আমেরিকার অর্থনৈতিক ইতিহাস।
  • ২। অর্থনীতির ইতিহাসে শুধুমাত্র অর্থনীতির উত্থান-পতন, উন্নতি-অবনতি বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু অর্থনীতির উত্থান-পতন ছাড়াও অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বর্ণনা স্থান পায় অর্থনৈতিক ইতিহাসে।
  • ৩। অর্থনীতির ইতিহাসের পরিধি স্বল্প। কিন্তু অর্থনৈতিক ইতিহাসের পরিধি তুলনামূলকভাবে ব্যাপক ও বিস্তৃত।
  • ৪। অর্থনীতির ইতিহাস মূলতঃ অর্থনৈতিক ইতিহাসের অংশমাত্র। কিন্তু একটি দেশের বিভিন্ন অর্থনীতির ইতিহাস ও সমাজিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সম্মিলন হচ্ছে সে দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস।
  • ৫। অর্থনীতির ইতিহাস শুধুমাত্র ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। এই বিশ্লেষণে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলোকে ব্যাখ্যা করা নাও হাতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক ইতিহাসে কোনো কিছু বাদ পড়েনা, থাকে সকল কর্মকান্ডের বর্ণনা।
  • ৬। একটি দেশের অর্থনীতির ইতিহাস সবসময় নির্ভর করে উক্ত দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ওপর। কিন্তু, একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, শিল্প বিপ্লব ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে সে দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস।

উপরের পার্থক্যগুলো থাকা সত্ত্বেও একথা বলা যায় না যে, অর্থনীতির ইতিহাস ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পরস্পর সম্পর্কিত নয় বরং একটি দেশের অর্থনীতির ইতিহাস ও অর্থনেতিক ইতিহাসের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই কতিপয় অর্থনীতিবিদ অর্থনীতির ইতিহাস ও অর্থনৈতিক ইতিহাসকে আলাদা করতে চাননি।

ভারতীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাস

বহুকাল আগে থেকে অনার্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাস করতো। আর্যদের আগমণের পর থেকে ভারতবর্ষে অনার্যদের প্রভাব কমতে থাকে। অবশ্য আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাস শুরু করার পর তাদেরকে অনার্যদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মুখেমুখি হতে হয়। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার নমুনা থেকে জানা যায় অনার্য সভ্যতা অনেকাংশে এগিয়ে ছিল। অনার্য সভ্যতার প্রভাব থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য আর্যগণ কঠোরভাবে কতগুলো আইন কানুন প্রণয়ন করে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রয়াজনে নয় নিজেদের জাতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বাঁচাবার জন্য নিন্দিত হলেও তাদেরকে বহু শ্রেণিবিভাগ প্রথম প্রচলন করতে হয়। ভারতীয় সমাজতত্ত্ববিদগণ মনে করেন, এটাই ভারতবর্ষে জাতিভেদ প্রথার মূল কারণ। ভারতীয় সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, প্রাচীনকালে রাজারাই ছিলেন জমির মালিক আবার রাজারাই ছিলেন সমাজের সর্বময় কর্তা। অর্থাৎ রাজারাই সমাজের কর্ণধার ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাচীন ভাবধারার কঠোরতা ও জড়তার কারণে প্রাচীন ভারত অর্থনৈতিকভাবে ততটা এগিয়ে যেতে পারেনি। জাতিভেদ প্রথা প্রাচীন ভারতের এগিয়ে না যাবার অন্যতম কারণ। যদিও পরবর্তীতে সুদ ও মুনাফা সম্পর্কে ভারতবর্ষে প্রচলিত চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তিত মতবাদ বা চিন্তাধারার কারণে সেই সময়কার ভারতবর্ষের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার লাঘব হয়েছে- একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়না। আর্যদের সৃষ্ট জাতিভেদ প্রথা ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করে।

ভারতীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বৈশ্যদের আধিপত্য ছিল বেশি। বৈশ্য সম্প্রদায় একচেটিয়াভাবে সুদের কারবার তথা মহাজনী ব্যবসা করত এবং বিভিন্ন প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় তাদের পারঙ্গমতা ছিল। বৈশ্যদের ব্যাপারে কঠোর বিধান প্রচলিত ছিল। কিন্তু কঠোর বিধান প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও বৈশ্যদের একচেটিয়া সুদের কারবার ও অন্যান্য সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। দলে দলে হিন্দুরা সাগর পড়ি দিয়ে জ্ঞান আহরণ করতে ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচলানা করতে বিদেশে পাড়ি জমায়। যদিও সে সময় সাগর পাড়ি দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে প্রথম প্রথম তারা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয় এবং পরবর্তীতে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এ সকল বাধা-বিপত্তি লোপ পেতে শুরু করে। আইনবেত্তারা কোন বিশেষ সময় ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন বিধান জারি করলেও পরবর্তীতে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেসব আইন ও বিধানগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে এ সকল বিধিবিধান অচল হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে। যেমন কোনো বিশেষ অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথার প্রচলন করা হয়েছিল কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন সত্ত্বেও এসব বিধান অপরিবর্তিত থেকে যায়। এটি সমগ্র হিন্দু সমাজে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে। এরূপ অবস্থা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজ বিপুল উন্নতি সাধন করেছিল। উন্নতির সাথে সাথে আইনের কঠোরতা হ্রাস পেতে থাকে। তাহলে দেখা যায়, প্রাচীন ভারতবর্ষে মতবাদের কঠোরতা ও জড়তা উন্নয়নের পরিপন্থী হিসেবে কাজ করেছিল এবং প্রাচীন ভারতকে অনগ্রসর করে রেখেছিল অনেকদিন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হয়েছিল।

প্রাচীন ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকে। এটি শুধু অর্থশাস্ত্র নয় বরং এতে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। এ বইয়ে রাজার কাজকর্ম, রাজার রাজস্ব আহরণ ও প্রাসাদ নির্মাণ এবং সরকারী অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা স্থান পেয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বইয়ে ভারতের আইন-কানুন, শাসন ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, দ্রব্যের দাম নির্ধারণে রাজার ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। কারণ, এ সকল কর্মকান্ডে রাজার যথেষ্ট হাত ছিল। এ বইয়ে পণ্যাধ্যক্ষের মতো একটি পদের কথাও বলা হয়েছে। পণ্যাধ্যক্ষের কর্ম পরিধিও তুলে ধরা হয়েছে। পণ্যের মান নির্ধারণ, মূল্য নির্ধারণ এবং কোন পণ্য লোকের কাছে প্রিয় বা অপ্রিয় সে বিষয়ে পণ্যাধ্যক্ষকে যথেষ্ট জ্ঞান রাখার কথা বলা হয়েছে। এখানে আরও বলা হয়েছে, পণ্যাধ্যক্ষ যে পণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হবে তা একত্র করে মূল্য চড়ায়ে দিবেন এবং সমুচিত মূল্য পাওয়া গেলে পরে এর মূল্যভেদ ঘটাবেন।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বলা হয়, কোনো রাষ্ট্র পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও সংগ্রহের ব্যবস্থা করবেন পণ্যাধ্যক্ষের মাধ্যমে। পণ্য উৎপাদন বেশি হলে উৎপাদক যাতে ন্যায্যমূল্য পায় সেজন্য মূল্য বৃদ্ধি করা যাবে। আবার, সাধারণ ক্রেতাগণ যাতে শোষিত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখবেন পণ্যাধ্যক্ষ। রাষ্ট্রকে নজর দিতে হবে অধিক মুনাফার বিরুদ্ধে এবং জনসাধারণের কষ্ট লাঘবের দিকে। অর্থাৎ আধুনিক অর্থনৈতিক চিন্তাধারার অনেক কিছুই ফুটে উঠেছিল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। তাই ভারতীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাসে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকে একটি মূল্য বা দলিল মনে করা হয়।

গ্রিক অর্থনৈতিক চিন্তাধারা

প্লেটোর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা

প্রাচীন গ্রীসে অসংখ্য দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী ও মনিবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। প্লেটোও জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রাচীন গ্রীসে খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭ সালে। প্লেটো ছিলেন আরেক গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস এর শিষ্য। বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসকে ‘হেমলক’ বিষপানে হত্যার পর তখনকার গ্রিসে প্রচলিত মতবাদগুলোর প্রতি প্লেটোর বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। তাই তিনি নিজে একটি নতুন ধারণা প্রদান করেন এবং তাঁর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। প্লেটো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Republic”এ রাষ্ট্রের শাসকদের সম্পর্কে তাঁর একটি সুন্দর মতামত তুলে ধরেন। রাষ্ট্রের শাসকদের প্রকৃত শিক্ষা, ন্যায়বিচার, সামাজিক শান্তি ও সাম্য ইত্যাদির ওপর জোর দেন এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য তুলে ধরেন। প্লেটো যে কেবল রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের শাসকদের সম্পর্কে শুধু রাজনৈতিক চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করেন তা নয় তাঁর অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়েও চিন্তাভাবনা ছিল। নিম্নে প্লেটোর অর্থনৈতিক চিন্তাধারার নানাদিক নিয়ে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ

  • ১। সম্পদ সম্পর্কিত মতবাদ : প্লেটোর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমেই তাঁর সম্পদ সম্পর্কিত মতামত সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। প্লেটো সম্পদ অর্জনের বিপক্ষে যেমন ছিলেন, তেমনি আবার চরম দারিদ্রোর বিপক্ষেও ছিলেন। প্লেটো সম্পদ অর্জনের বিপক্ষে থাকার দু’টি কারণ ছিল। কারণ দু’টি নিম্নরূপঃ
    • (ক) উৎপাদনের প্রয়োজন : প্লেটো বলেন, শাসকগণ এমনভাবে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন যেন কেই অতিরিক্ত সম্পদ গড়ে তুলতে না পারে আবার অতি গরিবও না হয়। তাঁর মতে, অতিরিক্ত সম্পদ থাকলে উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে সমাজের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি মনে করেন, মানুষের প্রকৃত সুখ এবং অতিরক্তি ধন-সম্পদ একসাথে থাকতে পারেনা। তবে শুধু যারা তৃতীয় শ্রেণীর লোক তাদের হাতে অতিরিক্ত সম্পদ থাকতে পারে।
    • (খ) নৈতিকতার প্রয়োজন : প্লেটো মনে করেন, সুখ ও অতিরিক্ত ধন সম্পদ একসাথে থাকতে পারেনা। কারণ, অতিরিক্ত ধন-সম্পদের একটি অংশ অন্যায়ভাবে অর্জিত। তাই একজন ধনী লোক কখনও সমাজের ভাল লোক নাও হতে পারে বরং অতিরিক্ত ধন-সম্পদ অর্জন মানুষের নৈতিকতার অধঃপতন ঘটার।
  • ২। পেশা সম্পর্কিত মতবাদ : আদিম যুগ হতেই মানুষ পেশা হিসেবে কৃষির ওপর জোর দিয়ো আসছে। তাই প্লেটো নিজেও কৃষিকে আদর্শ পেশা হিসেবে বিবেচেনা করেন। তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের উদাহরণ দিতে গিয়ে মূল্যাবান ধাতুর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। সুদের জন্য টাকা খাটানোকেও প্লেটো সমর্থন করেননি।
  • ৩। শিক্ষা সম্পর্কিত মতবাদ : প্লেটো শিক্ষাকে অতি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। কারণ, নারী পুরুষ সকলে শিক্ষিত না হলে সমাজের উন্নয়ন অগ্রগতি থেমে যায়। তাই তিনি সাধারণ শিক্ষা, ধর্মীয় ও শারীরিক শিক্ষা অর্জনকে সবার জন্য বাঞ্ছনীয় মনে করেন। তবে তাঁর শিক্ষা সম্পর্কিত মতবাদ মুলত শাসক শ্রেণির জন্য। তিনি মনে করতেন, শাসক শ্রেণির অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। একটি আদর্শ রাষ্ট্রের শাসক/অভিভাবকদের অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে।
  • ৪ । অর্থনীতি সম্পর্কিত মতবাদ : প্লেটো তাঁর বিভিন্ন রচনায় অর্থনীতি সম্পর্কেও বক্তব্য রাখেন। তাঁর মতে, অর্থনীতি একটি ন্যায়শাস্ত্র, যা রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। প্লেটো মনে করেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রসারের অভাব, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রসারের অভাব ইত্যাদি কারণে অর্থনীতি একটি আলাদা বিষয় হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের প্রভাবের কারণে ‘অর্থনীতি’ রাজনীতি থেকে আলাদা হয়ে একটি পৃথক বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
  • ৫। জনসংখ্যা সম্পর্কিত মতবাদ : প্লেটো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বা হ্রাসের ওপর জোর দেন। এমকি জনসংখ্যা হ্রাসে তিনি পুরস্কার প্রদানের কথাও সুপারিশ করেন। তিনি মনে করেন, জনসসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে অতিরিক্ত জনসংখ্যায় বসবাসের জন্য নতুন উপনিবেশ স্থাপনের কথা মাথায় আসতে পারে। প্লেটো পঙ্গু শিশু নিয়ে সবচেয়ে নিষ্ঠুর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, কারও পরিপারে পঙ্গু শিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে নির্জন দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ, পঙ্গু শিশু জন্মানোর মাধ্যমে শাসক শ্রেণির রক্তের পবিত্রতা নষ্ট হতে হতে পারে বলে তিনি আশংকা করেন।
  • ৬। নারী-পুরুষ সম্পর্কে মতবাদ : প্লেটো নারী-পুরুষের সম-মর্যাদার অধিকার প্রদানের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। নারী-পুরুষ সম-মর্যাদার অধিকারী না হলে নারীরা অবহেলিত থেকে যাবে এবং সমাজের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে। প্লেটো নারী-পুরুষ সম-দক্ষতা সম্পন্ন না হলেও তাদেরকে সম-অধিকার প্রদানের কথা বলেন। প্লেটো নিজে ছিলেন চিরকুমার। ফলে তখনকার গ্রিক সমাজের নারীদের করুন অবস্থা তাঁর মতবাদকে প্রভাবিত করেছিল। তাই তিনি মনে করেন, সমাজের নারী-পুরুষদের সম-অধিকার থাকা প্রয়োজন।
  • ৭। শ্রমবিভাগ সম্পর্কে মতবাদ : প্লেটো শ্রমবিভাগ সম্পর্কে একটি সুন্দর মতামত দেন। তিনি মনে করতেন, “মানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মানুষ নয়”। যেহেতু মানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্র তাই একটি রাষ্ট্রে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য চার ধরনের শ্রমিক থাকা প্রয়োজন যেমনঃ গৃহ নির্মাণকারী, তাঁতী, কৃষক ও মুচি। এই শ্রমিকেরা যার যার অবস্থানে থেকে সাঠিকভাবে কাজ করে গেলে একটি আদর্শ রাষ্ট্র তৈরি করা সম্ভব হবে। আবার, প্লেটো একটি আদর্শ রাষ্ট্রের জনগণকে পেশা অনুসারে পাঁচ ভাগে ভাগ করেন। সেগুলো হল,
    • (ক) উৎপাদনের জন্য কৃষি বা শিল্প শ্রমিক।
    • (খ) দ্রব্যের বণ্টনের জন্য ব্যবসায়ী।
    • (গ) দ্রব্য পরিবহণের জন্য নাবিক বা জাহাজের মালিক।
    • (ঘ) ক্রেতার হাতে দ্রব্য পৌঁছানোর জন্য খুচরা ব্যবসায়ী।
    • (ঙ) কায়িক শ্রম দেওয়ার জন্য শ্রমিক বা মজুর।
  • ৮। কমিউনিজম সম্পর্কে মতবাদ : প্লেটো মনে করতেন, একটি আদর্শ রাষ্ট্রে দুই শ্রেণির মানুষ থাকে – শাসক ও শাসিত। শাসকগণই রাষ্ট্রের অভিভাবক। আর শাসিতরা হলেন রাষ্ট্রের কারিগর। প্লেটোর মতে শাসকদের মধ্যে কমিউনিজম সীমাবদ্ধ। তিনি মনে করতেন, শাসকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে কিছু নেই। তাই তাদের কোনো ব্যক্তিগত আশা-আকাংখা থাকা উচত নয়। প্লেটোর মতে, পরস্পরের প্রতি মায়া-মমতা, স্নেহ এবং ব্যক্তিস্বার্থের কারণে মানুষ সমাজের প্রতি তার কর্তব্য ভুলে যায়। অতিরিক্ত সম্পত্তির প্রতি লোভের কারণে মানুষের মাঝে দুর্নীতি বাসা বাধে। ফলে সামাজিক ঐক্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। তখন রাষ্ট্র প্রধান দুর্নীতি পরায়ণ হয়ে ওঠে। এ কারণে প্লেটো বলেন, “তুমি নিজেকে ও তোমার সম্পত্তিকে নিজের মনে না করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের গোটা পরিবারের মালিক মনে করবে”। এই বক্তব্যে স্পষ্টতঃই প্লেটোর কমিউনিজমের প্রতি সমর্থন/দুর্বলতা প্রকাশ পায়।

উপরের আলোচনা হতে বুঝা যায়, শ্রমিক, নারী-পুরুষ, জনসংখ্যা, অর্থনীতি, সম্পত্তি ইত্যাদি নানাদিক নিয়ে “The Republic” গ্রন্থে প্লেটো একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতামত অনুযায়ী চললে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে নারী-পুরুষ সকলেই সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে।

এ্যারিস্টটলের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা

এ্যারিস্টটল রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদ দিতে গিয়ে সেখানে তাঁর অর্থনৈতিক ভাবনাও তুলে ধরেন। এ্যারিস্টটল মনে করতেন, “Man is by nature a political animal”। অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই একটি রাজনৈতিক জীব। তাই নিজে নিজেই মানুষ দলবন্ধ হয়ে বসবাস করতে শুরু করে। এজন্য প্রথমে পরিবার, তারপর সমাজ এবং সবশেষে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এজন্য এ্যারিস্টটলের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করতে চাইলে পরিবার সম্পর্কে তার মতবাদ আলোচনা দিয়েই শুরু করতে হবে। নিম্নে এ্যারিস্টটলের অর্থনেতিক চিন্তাধারা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

এ্যারিস্টটলের সংক্ষিপ্ত জীবনী : এ্যারিস্টটল ৩৮৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মেসিডনিয়ার নিকটবর্তী স্ট্যাগিরা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর পিতা নিকোম্যাকাস ছিলেন মেসিডনিয়ার রাজ দরবারের একজন চিকিৎসক। চিকিৎসকের পারিবারিক পরিবেশেই তার শৈশব ও কৈশর কালের অতিক্রমণ ঘটে। ৩৬৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ১৮ বছর বয়সে তিনি এথেন্স যান এবং প্লেটোর একাডেমিতে পড়াশোনা শুরু করেন। প্লেটোর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বৎসর তিনি প্লেটোর একাডেমিতে শিক্ষা লাভ করেন। এরপর এথেন্স নগরী ত্যাগ করে এশিয়া মাইনরে চলে যান। সেখানে তিনি গবেষণা করেন সামুদ্রিক জীবজন্তু নিয়ে। পরবর্তীতে তিনি আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু আলেকজান্ডার যখন দেশ বিজয়ে বের হন তখন তিনি পুনরায় এথেন্সে প্রত্যাবর্তন করেন। ৩৩৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এ্যারিস্টটল তার নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘লাইসিয়াম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই লাইসিয়ামে সাধারণত বাস্তব গবেষণার উপর জোর দেয়া হতো। বস্তুত জ্ঞান ও গবেষণার সংগঠক এ্যারিস্টটল দস্তুর মত একটি জীব গবেষণাগার তৈরি করেছিলেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার পরিচয় লাভের জন্য এ্যারিস্টটল ১৫৮টি রাষ্ট্রের সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার তথ্য সংগ্রহ করে সংবিধানের একটি গ্রন্থাগারও তার লাইসিয়ামে গড়ে তুলেছিলেন। এ্যারিস্টটলের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে The Politics, The Ethics, The Constutution of Athens, The Magna Moralia ইত্যাদি। অবশেষে ৩২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মাত্র ৬৩ বছর বয়সেই তিনি মৃত্যুবরন করেন।

  • ১। পরিবার সম্পর্কিত মতবাদ : পরিবার সম্পর্কে এ্যারিস্টটল পুরোপুরি প্লেটোর মতবাদের বিরোধিতা করেন। প্লেটো বলেছেন, স্ত্রীলোক, সন্তান-সন্ততি রাষ্ট্রের সাধারণ সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। এ্যারিস্টটল মনে করেন, স্ত্রীলোক সন্তান-সন্ততিকে রাষ্ট্রের সাধারণ সম্পত্তি হিসেবে মনে করা হলেও সেক্ষেত্রে পরস্পর পরস্পকে ভালোবাসার সম্পর্কে আকৃষ্ট করবেনা। পিতা যেমন সন্তানদেরকে আপন মনে করবেনা, তেমনি সন্তানরাও পিতাকে আপন মনে করবেনা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের একতার খাতিরে শাসক শ্রেণির জন্য প্লেটো যে সাম্যবাদের কথা বলেছিলেন এ্যারিস্টটল তার বিরোধিতা করেছেন।
  • ২। সম্পত্তি সম্পর্কিত মতবাদ : সম্পত্তি সম্পর্কে এ্যারিস্টটল এমন একটি মতবাদ প্রদান করেন যাকে পুরো সাম্যবাদী যেমন বলা যায়না তেমনি সম্পূর্ণ পুঁজিবাদীও বলা যায়না। এ্যারিস্টটল কিছু সম্পত্তিকে একত্রিত করে ব্যবহার করার অর্থাৎ কিছু সম্পত্তিকে যৌথভাবে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। তিনি মনে করেন সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা থাকা উচিত। কোন কোন ক্ষেত্রে সম্পত্তি যৌথ হতে পারে। প্রত্যেক মালিকের নিজস্ব স্বার্থ থাকবে এবং সে কারণে কেউ কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করবেনা। প্রত্যেকেই যার যার নিজস্ব স্বার্থে কাজ করবে এবং তার মাধ্যমে তারা অধিকতর উন্নতি লাভ করবে। সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের খাতিরে কিছু কিছু জিনিস যৌথভাবে থাকতে হবে। মানুষ তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও এর কিছু অংশ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কিংবা অন্যদের ভোগ ও ব্যবহার করতে দেয়। কোনো কিছু নিজের মনে করে যখন মানুষ তখন তার আনন্দের সীমা থাকেনা। কারণ, প্রকৃতি নিজের জিনিসকে ভালোবাসার আগ্রহ মানুষর অন্তরে নিহিত করে দিয়েছে। আবার, অতিথি পরায়ণতা দেখাতে চাইলেও মানুষের কাছে নিজস্ব সম্পত্তি থাকতে হবে।
  • ৩। কৃষক শ্রেণি সম্পর্কিত মতবাদ : এ্যারিস্টটল মনে করেন, কৃষক শ্রেণি রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের থেকে আলাদা থাকবে। কারণ, রাষ্ট্রের নাগরিকরা যদি কৃষিকাজে নিয়োজিত হয় তবে রাষ্ট্রের নানবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ্যারিস্টটল বলেন, মানুষর কর্ম ও তার প্রতিদান ন্যায়ভিত্তিক হওয়া উচিত। কোনো মানুষ যদি তার কর্মের চেয়ে কম প্রতিদান পায় স্বাভাবিকভাবেই তার মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হবে এবং সে অভিযোগ করবে। এজন্য এ্যরিস্টটল বলেন, কৃষককূল শুধুমাত্র জমি চাষ করবেন আর রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকগণ কৃষকগণের কৃষিকাজে কোনো হস্তক্ষেপ করবেনা।
  • ৪। অর্থনীতি সম্পর্কিত মতবাদ : অর্থনীতির নানাদিক নিয়েও এ্যারিস্টটল কথা বলেন। তিনি মনে করেন, প্রত্যেক পরিবারের অভাব মেটানোর জন্য অনেক দ্রব্য সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। আর পরিবারের ভোগের জন্য যে সমস্ত দ্রব্য সামগ্রীর প্রয়োজন হয় সেগুলোই অর্থনীতির বিষয়বস্তু বলে তিনি উল্লেখ করেন। দ্রব্য ভোগ করার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। আর অর্থের জন্য আয় করা প্রয়োজন। এটাকে এ্যারিস্টটল ‘আয় প্রথা’ হিসেবে অভিহিত করেন। আয় প্রথাকে এ্যারিস্টটল দু’ভাগে ভাগ করেছেন – স্বাভাবিক আয় প্রথা (দ্রব্য বিনিময় প্রথা, কৃষিকাজ ও পশুপালন), এবং অস্বাভাবিক আয় প্রথা (ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রমিক নিয়োগ, সুদের মাধ্যমে আয়)। এ্যারিস্টটলের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বা মতামতের সাথে আধুনিক অর্থনীতিবিদগণের অর্থনীতির চিন্তার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
  • ৫। ব্যবহারিক মূল্য ও বিনিময় মূল্যের ধারণা : এ্যারিস্টটলের মতে, প্রত্যেক দ্রব্যের ব্যবহার দুই ধরনের হয়ে থাকে। আবার, প্রত্যেক দ্রব্যের দুই ধরনের গুণ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল ন্যায় গুণ এবং অন্যটি হল অন্যায় গুণ। উদাহরণস্বরূপ একটি দ্রব্য উৎপাদন করে তা সরাসরি যেমন ব্যবহার করা যায়। আবার বিনিময়ও করা যায়। বিনিময় করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করা যায়। একটি দ্রব্য সরাসারি ব্যবহার করে যে উপকার পাওয়া যায় তাকে বলা হয় উক্ত দ্রব্যের ব্যবহারিক মূল্য। আবার উক্ত দ্রব্য বা সেবার বিনিময়ে যে পরিমাণ অন্য দ্রব্য বা সোনা পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় উক্ত দ্রব্যের বিনিময় মূল্য।
  • ৬। বাণিজ্য সম্পর্কে মতামত : বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কেও এ্যারিস্টটল চমৎকার একটি বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি মনে করেন, একটি দেশ সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী না হলে সে তার প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করতে পারেনা। এজন্য তাকে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার জন্য অন্য কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। কোন একটি দেশ তার উৎপদিত পণ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত পণ্য থাকবে তা অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করবে। আবার, কোন পণ্য নিজ দেশে উৎপাদন না করতে পারলে কিংবা নিজ দেশে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে নিজস্ব অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে না পারলে তা বিদেশ থেকে আমদানি করবে। এভাবে একটি দেশ অন্যান্য দেশের সাথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য তথা বৈদেশিক বাণিজ্যে লিপ্ত হবে। এক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অর্থ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।
  • ৭। সুদ সম্পর্কিত বক্তব্য : এ্যারিস্টটল সুদকে সমর্থন করে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি মনে করতেন, অর্থ একটি জড় পদার্থ। অর্থ ঘরে বাক্সবন্দী করে রেখে দিলে কোনো লাভ নেই। অর্থকে মূলধন হিসেবে কাজে লাগানো দরকার। কারণ, অর্থ উৎপাদন কাজে নিয়োজিত করতে না পারলে তা আর নতুন অর্থ সৃষ্টি করতে পারবেনা। তিনি মনে করেন, অর্থকে উৎপাদন ক্ষেত্রে নিয়োজিত করা যায় বলেই অর্থ ব্যবহার করার জন্য সুদ দিতে হয়।
  • ৮। মুদ্রা সম্পর্কিত বক্তব্য : মুদা সম্পর্কে এ্যারিস্টটল স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। এক সময় মানুষ দ্রব্য বিনিময় প্রথার অধীনে দ্রব্যের সাথে দ্রব্য বিনিময় করতো। কিন্তু দ্রব্য বিনিময় প্রথার অসুবিধা হলো, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রব্য স্থানান্তর করা। তাই দ্রব্য বিনিময় প্রথার অসুবিধা দূর করে এটাকে আরও সহজতর করার জন্য এ্যারিস্টটল মুদ্রার ব্যবহারের কথা বলেন। প্রথমে মানুষ মুদ্রার জন্য ব্যবহৃত ধাতুর আকার ও ওজনের ওপর ভিত্তি করে এর মূল্য নির্ধারণ করতো। পরবর্তীতে ধাতুর মুদ্রার গায়ে সিল মেরে মানুষ মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। না হলে মুদ্রার ওজন করতে সমস্যা হয়। মুদ্রার ওজন করার সমস্যা ও জটিলতা দূর করতেই মানুষ মুদ্রার ওপর সিল মেরে এর মান নির্ধারণ করে দেয়।
  • ৯। দাস সম্পর্কিত বক্তব্য : এ্যারিস্টটল দাস প্রথার কথা স্বীকার করেন। তিনি দুই ধরনের দাগের কথা বলেন – আইনগত দাস, এবং স্বাভাবিক দাস। যুদ্ধে জয়-পরাজয় অবধারিত। আদিম সমাজে গোত্র/গোষ্ঠীগত যুদ্ধের প্রচলন ছিল। এক গোষ্ঠীর সাথে আরেক গোষ্ঠীর যুদ্ধ লেগেই থাকত। যুদ্ধে যে গোষ্ঠী পরাজিত হতো তারা বিজয়ী গোষ্ঠীর দাস হিসেবে নিজেদেরকে মানতে বাধ্য হতো। এভাবে যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে যারা দাস হতো, তাদেরকে এ্যারিস্টটল নাম দিয়েছেন আইনগত দাস। আইনগত দাসদের ভবিষ্যত বংশধররা স্বাভাবিক নিয়মে বংশ পরস্পরায় দাস হিসেবে গণ্য হতো। এ্যারিস্টটল এদের নাম দিয়েছেন স্বাভাবিক দাস। এ প্রসংগে এ্যারিস্টটল বর্বর জাতি সম্পর্কে বলেন, যারা বর্বর জাতি তারা নিজ দেশে উচ্চ শ্রেণির কিংবা উচ্চ বর্ণের হলেও অন্য দেশে দাস হিসেবে গণ্য হবে।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, এ্যারিস্টটল একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজ ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনীতির সকল বিষয় সম্পর্কেই চিন্তা করেছেন। তিনি মনে করেন, সমাজের মানুষের প্রয়োজনীয় অভাব মেটানোর জন্য প্রয়োজন দ্রব্যের। আর দ্রব্য সামগ্রী ক্রয়ের জন্য প্রয়োজন অর্থ।

প্লেটো ও এ্যারিস্টটলের মতবাদের তুলনা

গ্রিক দার্শনিক ও চিন্তাবিদনের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন প্লেটো এবং এ্যারিস্টটল। গ্রিক সভ্যতার প্রথম নিকে যে কয়জন দার্শনিক প্রাচীন গ্রিসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের পুরোধা ছিলেন প্লেটো ও এ্যারিস্টটল। প্লেটো ও এ্যারিস্টটলের মতবাদের মধ্যে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে প্লেটো ও এ্যারিস্টটলের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিয়ে প্লেটো ও এ্যারিস্টটলের অর্থনেতিক চিন্তাধারার মধ্যকার পার্থক্য তুলনাগুলো উল্লেখ করা হলো –

  • ১। সাম্যবাদ নিয়ে বক্তব্য : প্লেটো ও এ্যারিস্টটল দু’জনই সাম্যবাদ নিয়ে বক্তব্য রাখেন এবং সাম্যবাদের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। তবে প্লেটোকে চরম সাম্যবাদী বলা হলেও এ্যারিস্টটলকে চরম সাম্যবাদী বলা যায়না।
  • ২। সম্পত্তি সম্পর্কিত মতবাদ : প্লেটো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিকে যৌথ মালিকানায় থাকার পক্ষে মত দেন। প্লেটোর মতে, যৌথ মালিকানায় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি থাকলে শাসক শ্রেণির রাষ্ট্র শাসনে সুবিধা হয়। কিন্তু এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন এ্যারিস্টটল। এ্যারিস্টটল মনে করেন, একটি আদর্শ রাষ্ট্রের সম্পত্তি যৌথ মালিকানায় থাকা উচিত নয়, আর যদি যৌথ মালিকানায় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি রাখতেই হয় তবে তা তিন প্রকারের ব্যবস্থায় রাখার সুপারিশ করেন তিনি – (ক) কৃষিজমির মালিকানা বিভিন্ন হবে। তবে ভোগের ক্ষেত্রে যৌথ ভোগের অধিকার থাকতে পারে। (খ) কৃষিজমি যৌথ মালিকানার থাকলেও সেখানে উৎপাদিত ফসল জনগণের প্রয়োজন অনুসারে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। (গ) জমিকে যদি উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে মনে করা হয়, তাহলে ভোগকে সার্বজনীন হিসেবে মনে করতে হবে। সেক্ষেত্রে জমির মালিকানা যেমন যৌথ হতে পারে, তেমনি ভোগের ক্ষেত্রেও যৌথ ভোগের মালিকানা থাকা উচিত।
  • ৩। কৃষি ও কৃষকগণ সম্পর্কে বক্তব্য : প্লেটো কৃষকদেরকে রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক বলেই চিন্তা করেছেন। অর্থাৎ সাধারণ নাগরিকদের থেকে কৃষককে আলাদা করেননি। কিন্তু এ্যারিস্টটল মনে করতেন, কৃষকদের জন্য আলাদা শ্রেণি থাকলেই ভালো। আর্থাৎ কৃষকগণ সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে আলাদা। এতে কৃষক শ্রেণি এবং সাধারণ নাগরিক উভয়ের উপকার হতো। উভয়ের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। কৃষকরা জমি চাষ না করে যদি সাধারণ নাগরিকগণ জমি চাষ করে তাহলে বরং অনেক সমস্যা দেখা দেবে। কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদিত ফসল এবং কৃষি শ্রমিকদের মাঝে মজুরি বন্টন ন্যায়ভিত্তিক হওয়া উচিত। এ্যারিস্টটল মনে করেন, যদি কোনো নাগরিক বেশি ফসল উৎপাদন করে কম পারিশ্রমিক পায় তাহলে ঐ নাগরিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করবে। এজন্য উৎপাদিত ফসল ও পারিশ্রমিক ন্যায়ভাবে বণ্টন করা উচিত যেন কেউ বঞ্চিত মনে না করতে পারে নিজেকে।
  • ৩। ধনী সম্প্রদায়ের আচরণ সম্পর্কিত বক্তব্য : প্লেটো রাষ্ট্রের ধনী সম্প্রদায় নিয়ে কিছু বলেননি। অর্থাৎ ধনীদের অভ্যাস ও আচরণ কেমন হবে কিংবা কীরূপ হওয়া উচিত সে সম্পর্কে প্লেটো কোনো বক্তব্য। রাখেননি। কিন্তু এ্যারিস্টটল স্পষ্টভাবে ধীনদের আচরণ ও প্রবণতা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, ধনীরা তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কর্ম প্রচেষ্টা চালায়। এই প্রচেষ্টা এতই প্রবল যে, অর্থ উপার্জনের নেশায় বশবর্তী হয়ে ধনী ব্যক্তিরা বিভিন্ন প্রকার অসুন্দর কাজে অগ্রসর হয়। এ্যারিস্টটল বলেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলে মানুষ উদার হয়, তবে তা সহজ নয়। সমাজের ধনী মানুষরা নিজেদের স্বাভাবিক কর্মকান্ড বলে যা মনে করে, এ্যারিস্টটল তার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক ও অন্যায় আচরণের প্রবণতা খুঁজে পান। এ্যারিস্টটল ধনী ব্যক্তিদের অন্যায় আচরণের এসব প্রবণতা বিশ্লেষণ করেন।
  • ৪। স্ত্রী ও সন্তান সম্পর্কে সাম্যায়ন মতবাদভিত্তিক তুলনা : প্লেটো স্ত্রী, কন্যা-পুত্র সন্তানকে রাষ্ট্রের সাধারণ সম্পত্তি বলে গণ্য করেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সকলেই সমান। এটাই স্ত্রী-সন্তান সম্পর্কিত সাম্যায়ন নীতি। প্লেটো এই সাম্যায়ন নীতির পক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু এ্যারিস্টটল সাম্যায়ন গ্রহণ না করে বরং তার বিরোধিতা করেন। এ্যারিস্টটল মনে করেন, সমাজের উচ্চ শ্রেণির জন্য সাম্যায়ন নীতি প্রযোজ্য নয়। এটা কৃষক সমাজের জন্যই বেশি প্রযোজ্য। কারণ, কৃষক সমাজের মধ্যে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির সাম্যায়ন নীতি থাকলে তাদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধন শিথিল হবে। কৃষক সমাজের শ্রেণিগত বন্ধন শিথিল হলে শাসক শ্রেণির জন্য রাষ্ট্র শাসনে সুবিধা হবে। কৃষক সমাজের মধ্যে ঐক্যের অভাব দেখা দিলে তারা কখনও ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারবেনা। এ্যারিস্টটল মনে করেন, যে রাষ্ট্রে সাম্যায়ন প্রথা প্রচলিত থাকে সেখানে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক গভীর হয়না। পিতা তার নিজ সন্তানকে যেমন আপন মনে করেনা, তেমনি সন্তানও পিতাকে আপন হিসেবে গ্রহণ করেনা, এসব কারণে প্লেটোর সাম্যায়ন নীতির বিরোধিতা করেন এ্যারিস্টটল।
  • ৫। উদারনৈতিক চিন্তাধারা : প্লেটো মনে করেন, সম্পত্তির ব্যাপারে জনগণ উদার মত পোষণ করবে। রাষ্ট্রে চরমভাবে সাম্যবাদ কার্যকর থাকবে। সকল নাগরিক যৌথভাবে উৎপাদন ও ভোগ করবে। কিন্তু প্লেটোর এই চিন্তাধারার সাথে এ্যারিস্টটল এক মত নন। এ্যারিস্টটল মনে করেন, যৌথ নয় সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা থাকা প্রয়োজন। জমিতে উৎপাদিত ফসল যেন সকল নাগরিক ভোগ করতে পারে অর্থাৎ ভোগের ক্ষেত্রে যৌথ ভোগ অধিকার থাকা দরকার। এ্যারিস্টটলের মতে, মানুষ প্রত্যেকেই প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর। তাই তারা কোন দ্রব্য ও সেবাকে নিজের সম্পদ হিসেবে পেলে অনেক আনন্দ পায়। কারণ, নিজের সম্পদকে আপন করে নেওয়ার মতো প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবেই রয়েছে। মানুষের অবশ্য আরেক প্রকৃতি দেখা যায়। তাহল, যে সকল ব্যক্তি সম্পত্তিকে অতিরিক্ত ভালবাসে তাদেরকে সবাই কৃপন মনে করে। তাই মানুষ যখনই বেশি সম্পত্তির মালিক হয়, তখন কৃপণতা থেকে নিজেকে উদ্ধার করার জন্য কিছু দান ও দয়া করে থাকে।

উপরের তুলনামূলক আলোচনা হতে দেখা যায় যে, অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে প্লেটো ও এ্যারিস্টটলের মতবাদের অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্লেটো চরম সাম্যাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু এ্যারিস্টটল পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মিশ্রণে বিশ্বাস করতেন। এ কারণে বলা হয়ে থাকে যে, এ্যারিস্টটল প্লেটোর সাম্যবাদের বিরোধিতা করলেও এ্যারিস্টটলকে পুঁজিবাদের গোড়া পত্তনকারী বা স্থপতি বলা যাবে না।

জেনোফোনের অর্থনেতিক চিন্তাধারা

জেনোফোনের (Xenophon) জীবিকা নির্বাহের অর্থনীতি এবং দাসত্বের একজন উদ্যোগী ডিফেন্ডার ছিলেন। তিনি কৃষিকে মহিমান্বিত করেছিলেন, যার ওপর মানুষের মঙ্গল নির্ভরশীল এবং যার জন্য মানুষ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুই পায়। প্লেটো ও এ্যারিস্টটলের পর গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে জেনোফোন সুস্পষ্টভাবে অর্থনীতির নানাদিক নিয়ে তার বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। নিম্নে জেনোফোন এর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো –

  • ১। সম্পদ সম্পর্কিত মতবাদ : জেনোফোন মনে করেন, কোনো দ্রব্য সম্পদ বলে গণ্য হবে কিনা তা নির্ভর করে উক্ত দ্রব্যের ব্যবহারের উপর। যে কোনো জিনিস একজন ব্যক্তি ব্যবহার করলে তা সম্পদ হিসেবে তার নিকট গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো জিনিসের ব্যবহার জানে তা উক্ত ব্যক্তির প্রয়োজনীয় জিনিস বলে মনে হবে। আর যদি ব্যক্তি উক্ত জিনিসের ব্যবহার না জানে তাহলে উক্ত জিনিস ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনীয় বলে মনে হবে না। যেমন, কোনো ব্যক্তি টাকা-পয়সার ব্যবহার না জানলে তা উক্ত ব্যক্তির নিকট সম্পদ বলে পরিগণিত হবেনা। অর্থাৎ জেনোফোন সম্পদ বলে কোন দ্রব্য বা সম্পদের ব্যবহারিক গুণকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ আলো-বাতাস-পানি, সূর্যের আলো ইত্যাদি জিনিস শুধু তার ব্যবহারিক গুণ হিসেবে সম্পদ বলে গণ্য হবে।
  • ২। কৃষি সম্পর্কিত মতবাদ : প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর ছিল। তাই জেনোফোন কৃষির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কৃষির ওপর জেনোফোনের চিন্তাভাবনা পরবর্তীদের ভূমিবাদী বা ফিজিওক্র্যাটদের প্রভাবিত করেছিল। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক Alexander Gray বলেন, “জেনোফোন প্রধানত একজন কৃষি বিষয়ক লেখক এবং এ কথা সত্যি যে, বহু শতাব্দী পরেও তিনি ভূমিবাদীদের আদর্শের খবর জুগিয়েছেন”। জেনোফোন কৃষিকাজকে মৎস্য চাষ, পশুপালন, উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মত সাধারণ অর্থনৈতিক বলে বিবেচনা করেছিলেন।
  • ৩। শ্রম সম্পর্কিত মতবাদ : জেনোফোনের মতে শ্রমের সাথে কৃষি উৎপাদনের সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর মতে, শ্রম ব্যতিরেকে কৃষিতে উৎপাদন পাওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ শ্রম ছাড়া কৃষি উৎপাদন চলতে পারেনা। শ্রমহীন কৃষিকাজ সম্ভব নয়। কৃষির জন্য শ্রমের ব্যবহার অত্যাবশকীয়। এজন্য কৃষি উৎপাদনের জন্য জেনোফোন শ্রমকে অতি প্রয়োজনীয় উপাদান বলে গণ্য করতেন।
  • ৪। শ্রমবিভাগ সম্পর্কীয় ধারণা : শ্রমবিভাগ সম্পর্কে জেনোফোন স্পষ্ট ধারণা দেন। তাঁর মতে বড় শহর ও ছোট শহরের মধ্যে শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বড় শহরের শিল্প উৎপাদনে শ্রমবিভাগ কার্যকর কিন্তু ছোট শহরে শ্রমবিভাগ খুব একটা চালু নেই। জেনোকোনের শ্রমবিভাগ সম্পর্কীয় ধারণার পিছনে অর্থনেতিক চিন্তাধারার প্রভাব ছিল। তাঁর মতে বাজারের আকার যত বড় হয় জিনিসপত্রের চাহিদাও তত বেশি হয়। তাই বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য বাড়তি পণ্য উৎপাদন করার জন্য শ্রমবিভাগ চালু থাকা প্রয়োজন। বড় শহরে জিনিসপত্রের চাহিদা বেশি থাকায় শ্রমবিভাগ চালু রয়েছে। অন্যদিকে বাজারের আকার ছোট হলে জিনিসপত্রের চাহিদা কম হয়, উৎপাদন কম হয় এবং শ্রমবিভাগের তেমন একটা প্রয়োজন হয়না।
  • ৫। কৃষি উৎপাদন নীতি সম্পর্কে ধারণা : কৃষি উৎপাদন সম্পর্কে জেনোফোন সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন যে, কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন নীতি চালু রয়েছে। তাঁর মতে একজন কৃষক তার জমিতে উৎপাদন করতে কতজন শ্রমিক প্রয়োজন তা বলতে পারে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ করলে লোকসান হবে। তাই জেনোফোনের মতে, কৃষিতে উৎপাদন ব্যবস্থা এমনভাবে পরিচালিত হওয়া দরকার যেন এখানে কোনো লোকসানের আশংকা না থাকে। অর্থাৎ কৃষকেরা অভিজ্ঞতার আলোকে মুনাফাভিত্তিক উৎপাদনের জন্য কৃষি উৎপাদন চালায়।
  • ৬। সরকারি অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা : দেশ পরিচালনায় সরকারের আয় ও ব্যয় নীতি বিরূপ হওয়া প্রয়োজন সে সম্পর্কেও জেনোফোন বক্তব্য রাখেন। তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থভাণ্ডার মজবুত করার জন্য বিদেশিদের ওপর করারোপ করার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, বিদেশিদের দেশে আসতে দেয়া হলে এবং বিদেশিদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হলে ব্যবসা-বণিজ্যের প্রসার ঘটাবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হবে। এজন্য এমনকি তিনি রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় বিদেশিদের নিমন্ত্রণ করার কথা বলেন। প্রতিটি রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় বিদেশিদের বিনা খরচে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার কথা বলেন। বিদেশিরা যেন নিরাপদে দেশে বসবাস করতে পারে সেদিকেও জেনোফোন নজর দেয়ার কথা বলেছেন। রাষ্ট্রীয় যে সকল আইন-কানুন বিদেশিদের মেনে চলতে অসুবিধা মনে হবে তিনি সেই আইনগুলো সংশোধনের সুপারিশ করে বিদেশি-বান্ধব আইন করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। মূলধন কর ধার্য করে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির সুপারিশ করেন এবং তিনি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের বাড়িঘর নির্মাণেরও সুপারিশ করেন। যুদ্ধের বিরোধী না হলেও তিনি শান্তির পক্ষে অবস্থান নেন। কারণ জোনোফোন মনে করেন, যুদ্ধের দ্বারা ধন-সম্পদের আগমন ঘটতে পারে, তবে প্রকৃত ধন-সম্পদের আগমন ঘটে শান্তির মধ্যেমে।

উপরের আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, জেনোফোন অর্থনীতির নানাদিক নিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। তবে তিনি তাঁর বক্তব্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন কৃষির ওপর। কারণ, জেনোফোনের কৃষি সম্পর্কীয় মতবাদই পরবর্তীতে ভূমিবাদীদের নতুন মতবাদ প্রদানে উৎসাহিত করেছিল। অর্থাৎ ভূমিবাদী চিন্তার উৎস হিসেবে আমরা জেনোফোনের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার কথা বলতে পারি।

এ্যারিস্টটল এবং জেনোফোনের অর্থনৈতিক মতবাদের মধ্যে তুলনা

গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল এবং জেনোফোনের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে বেশকিছু মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। খুচরা ব্যবসা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে শুরু করে খনি থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্য আহরণ পর্যন্ত সকল বিষয়ে এ্যারিস্টটলের মতামতের সাথে জেনোফনের মতামতের যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। নিম্নে এ্যারিস্টটল ও জেনোফোনের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যকার পার্থক্যগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো –

  • ১। খুচরা ব্যবসা ও সাধারণ বাণিজ্য সম্পর্কিত পার্থক্য : খুচরা ব্যবসা ও সাধারণ বাণিজ্য সম্পর্কে জেনোফোন যা বলেছেন এ্যারিস্টটল তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বক্তব্য দেন। জেনোফোন রাষ্ট্রের খুচরা ব্যবসায়ী ও সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহ দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু এ্যারিস্টটল বলেছেন খুচরা ব্যবসা একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার।
  • ২। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কিত পার্থক্য : প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য আধুনিক সময়ের মতো এতটা প্রসারিত ছিলনা। তবে ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কাজকর্ম যে একেবারে ছিলনা তা নয়, কেউ কেউ বলেছেন তখনকার সময়েও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অনেক প্রসারিত ছিল। তবে ভৌগলিক কারণে এবং যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কাজকর্ম চলত ছোট ছোট নগরকে কেন্দ্র করে। জেনোফোনের মতে তখনকার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ছিল রাজনীতি, দর্শন ও নীতিশাস্ত্রের সংমিশ্রণ। এ্যারিস্টটলও জেনোফোনের মতই সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে এ্যারিস্টটল এর বক্তব্য ছিল জেনোফোনের বক্তব্যের চেয়ে আলাদা।
  • ৩। উৎপাদন নীতি সম্পর্কিত পার্থক্য : জেনোফোনের বিশ্লেষণে তিনি উৎপাদন নীতি সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ প্রদান করেন তা থেকে বোঝা যায়, তিনি ক্রমবর্ধমান উৎপাদন বিধির স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু এ্যারিস্টটলের চিন্তাধারায় উৎপাদন বিধি সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়না।
  • ৪। স্বর্ণ ও রৌপ্য সম্পর্কীয় মতবাদের তুলনা : জেনোফোন স্বর্ণ ও রৌপ্য সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। তিনি মনে করতেন, যে কোনো জিনিস এমনকি স্বর্ণও মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলন করলে তার বাজার দর হ্রাস পায়। আবার, যে কোনো কাজে অধিক উদ্যোক্তা উদ্যোগী হলে কারও কারও দেউলিয়া হবার আশংকা থাকে। কিন্তু খনি হতে রৌপ্য উত্তোলন করা হলে কারও দেউলিয়া হবার আশংকা থাকেনা। খনি হতে যত বেশি রৌপ্য উত্তোলন করা হবে রাষ্ট্রের তত বেশি মঙ্গল হবে। তাই প্রয়োজনে দাস নিযুক্ত করে খনি হতে অধিক রৌপ্য উত্তোলন করার কথা বলেন জেনোফোন। কিন্তু এ্যারিস্টটল খনি হতে স্বর্ণ ও রৌপ্য উত্তোলন সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কোন বক্তব্য দেননি।

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এ্যারিস্টটল ও জেনোফোনের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে ব্যাপক মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ, তাঁরা দুজনেই তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী থেকে অর্থনীতির বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন এবং মতামত প্রকাশ করেন।

গ্রিক, হিন্দু ও হিব্রু চিন্তানায়কদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে পার্থক্য

অর্থনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, গ্রিক দার্শনিক মতবাদ প্রাচীনকালের ও মধ্যযুগীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারাকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। তবে তখনকার হিন্দু ও হিব্রু চিন্তাবিদদের মতবাদও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। গ্রিক, হিন্দু ও হিব্রুদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যগুলো নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ

  • ১। গ্রিক দার্শনিকরা রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করে তাদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের বর্ণনা মতে, রাষ্ট্রের আকার হবে ছোট যেখানে মাত্র কয়েক হাজার নাগরিক থাকবে। রাষ্ট্র যত ছোটই হোক না কেন প্রত্যেক রাষ্ট্রের নাগরিকদেরই অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে বলে গ্রিক দার্শনিকগণ মনে করেন। হিন্দু মতবাদেও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বলা আছে এবং সকল সমস্যা সমাধানের কিছু ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে। কিন্তু হিব্রু মতবাদে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমস্যা ও সেগুলো সমাধানের ব্যাপারে কোন বক্তব্য নেই।
  • ২। গ্রিক দার্শনিকদের মতে, মানুষের সুযোগ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশের জন্য সম্পদের প্রয়োজন আছে। হিন্দু চিন্তাবিদেরা মনে করতেন, ধন সম্পদের আগমন ঘটে কৃষি অপেক্ষা বাণিজ্য থেকে। অর্থাৎ বাণিজ্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হিব্রু মতবাদে সম্পদের ব্যবহারের সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই।
  • ৩। গ্রিক মতবাদে সুদ গ্রহণ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হিন্দু মতবাদে সুদকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এ মতবাদে হিন্দু সমাজে ৩য় শ্রেণি হল বৈশ্য। এই বৈশ্য সম্প্রদায়ই শুধু সুদের ব্যবসা করতে পারে। কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজ পারে। করবে বৈশ্য সম্প্রদায়। হিব্রু বা ইহুদি মতবাদে সুদ গ্রহণ করা একেবারে নিষিদ্ধ। আবার তাদের কেউ কেউ মনে করতেন, ইহুদিগণ-অইহুদিগণের নিকট থেকে সুদ গ্রহণ করতে পারে।
  • ৪। গ্রিক চিন্তাবিদ প্লেটো তাঁর লিখিত গ্রন্থে স্পষ্ট মতামত প্রদান করেন যে, রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। হিন্দু মতবাদে অর্থনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায় অনেক আগে থেকে। ইহুদি বা হিব্রু মতবাদে রাষ্ট্রের জন্মের কারণ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
  • ৫। প্লেটো ও এ্যারিস্টটল যে দাস প্রথা ও তৃতীয় শ্রেণির অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তা তদানিন্তন সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গ ছিল। কাজেই তখন একই রাষ্ট্রে কেউ থাকতো নাগরিক হিসেবে আর কেউ থাকতো দাস হিসেবে। হিন্দু মতবাদে দাস প্রথার উল্লেখ নেই বটে তবে সমাজে বর্ণবাদ বা বর্ণপ্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু হিব্রু সমাজ ব্যবস্থায় দাস প্রথার অস্তিত্ব ছিলনা।
  • ৬। গ্রিক দার্শনিকদের মতবাদের মূলকথা ছিল, রাষ্ট্রের মানুষের কল্যাণময় জীবনের পথ সুগম করাই রাষ্ট্রের মূল উদ্যেশ্য। বর্তমান যুগের চিন্তাবিদরাও একথা স্বীকার করেন। হিন্দু মতবাদেও এই ভাবধারার প্রকাশ পায়। কিন্তু হিব্রু মতবাদে এই ভাবধারার প্রকাশ ঘটেনি।
  • ৭। গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটলের মতে, সমাজে কেউ দাস হয়ে জন্মায়, আবার কেউ মনিব হয়ে জন্মায়। দাস সম্পত্তির একটা অংশ এবং দাসপ্রথা দাস ও মনিব উভয়ের জন্য কল্যাণকর। আবার প্লেটো মনে করতেন সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস নাগরিকের গুণের কারণে হয়। গুণের কারণে ৩য় শ্রেণির শিশু অভিভাবক শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারে। একইভাবে গুণের কারণে ১ম ও ২য় শ্রেণির শিশু ৩য় শ্রেণিতে নামতে পারে। হিন্দু মতবাদে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। হিব্রু মতবাদেও মনিব ও দাস নিয়ে কোনো বক্তব্য রাখা হয়নি।

উপরের পার্থক্যগুলো বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, অর্থনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পাওয়া যায়, বিভিন্ন দেশের চিন্তাবিদগণ তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোন থেকে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা করেন এবং ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ গড়ে ওঠে। এসব মতবাদের মধ্যে অনেক মিল থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অমিল বা পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। তবে এ সকল মতবাদ প্রভাবিত হয়েছে সে সময়ের চিন্তাবিদদের নিজ নিজ রাষ্ট্রে তখনকার প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ দ্বারা।

রোমানীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারা ও এর বৈশিষ্ট্য

রোমানীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারা

রোম সাম্রাজ্যের বিস্তার ও পতন বিশ্লেষণ করলে রোমান অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীন সব দেশের মতই রোম ছিল একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। ব্যবসা-বাণিজ্য তেমন প্রসারিত ছিলনা। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ ও নানারকম সুযোগ-সুবিধা থাকায় রোমানগণ জাতীয় একতা অর্জন ও উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্য জয় করতে সক্ষম হয়। রাজ্য জয়ের মাধ্যমে দেশে প্রচুর অর্থ-সম্পদ আসে এবং দেশীয় অর্থনীতি উন্নতি লাভ করে। রোমান সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করার সাথে সাথে সমাজে শ্রেণিগত বৈষম্য দেখা দেয়। শাসক শ্রেণি, বড় বড় জমিদার ও ব্যবসায়ীগণ প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী হয়। দেশে আসে প্রাচুর্য্য ও বিলাসিতা। অল্প সময়ের মধ্যেই কৃষক ও জনসাধারণের করভার কমে আসে। কিন্তু ধনী শ্রেণির বিলাসিতার জন্য সমাজে দেখা দেয় অসন্তোষ। বিশাল রাজ্য পরিচালনা ও যুদ্ধের জন্য ব্যয় নির্বাহের অর্থ সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ বিশাল রোম সাম্রাজ্যের দুর্দিন নেমে আসে। এই অবস্থায় যিক দার্শনিকদের মত কিছু রোম লেখক ও চিন্তাবিদদের আবির্ভাব ঘটে যারা রোমান সাম্রাজ্যের অর্থনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করতে থাকেন। রোমান দার্শনিক কৃষির ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তারা সকলে সরল জীবনযাপন করে সকল সমস্যার সমাধান করার উপদেশ দেন। তারা দাসপ্রথার বিরোধী ছিলেন। কারণ, দাস শ্রমিক রাখা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল। রোমান চিন্তাধারা অনেকটাই শাসক শ্রেণির অনুকূলে ছিল। রোমানরা শিল্প ও বাণিজ্যকে নিম্ন শ্রেণির পেশা বলে মনে করতেন। এর মাধ্যমে তদানীন্তন রোমান শাসক শ্রেণির এক বিশেষ মর্যাদাবোধ ও মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তখন উচ্চ শ্রেণির রোমানগণ ছিলেন শাসক, যোদ্ধা, আইনবেত্তা ও বিচারক। দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি ছিল নিম্ন শ্রেণির হাতে। তারাই উচ্চ শ্রেণি ও শাসকদের জন্য কর যোগাতেন। কাজেই শাসক শ্রেণিকে আর অর্থনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য কষ্ট করতে হতনা। কিন্তু রোম সাম্রাজ্য যখন পতনের মুখে, তখন এর অর্থনৈতিক অবস্থা অতি দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন শাসক শ্রেণির পক্ষে দূরের প্রদেশগুলোর ওপর কড়া নজর রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া রাজ্য বিস্তার বন্ধ হয়ে যাবার ফলে নতুন দাস আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু রোমের সমগ্র অর্থনৈতিক কাঠামো, বিশেষ করে বড় বড় জমিদারীগুলো প্রতিষ্ঠিত ছিল দাসপ্রথার ওপর। এজন্য এগুলো ধীরে ধীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে থাকল। রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধির কোন পথ থাকল না। তাই রাষ্ট্রের আয় বাড়ানোর জন্য কর বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা। নিম্ন শ্রেণি বাধ্য হয়েই শাসক শ্রেণিকে মোকাবেলা করতে শুরু করল। এদের মোকাবেলা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র ভেঙ্গে পড়ল। এই অবস্থায় একটি নতুন অর্থনৈতিক ভাবধারার জন্ম নেয় যা অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাসে ‘রোমানীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারা’ নামে পরিচিত।

রোমানীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য

গ্রিক সভ্যতার মতোই আরেকটি প্রাচীন সভ্যতা ছিল রোমান সভ্যতা। রোমান সভ্যতার আমলে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে যে চিন্তাভাবনা প্রচলিত ছিল তা রোমান অর্থনৈতিক চিন্তাধারা নামে পরিচিত। নিম্নে রোমান অর্থনৈতিক চিন্তাধারার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো –

  • ১। গ্রিক চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত : অনেকে মনে করেন, রোমান চিন্তাবিদরা গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। গ্রিক চিন্তাধারা থেকেই পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছিল। আর রোমানীয় চিন্তাধারা পুঁজিবাদকে আরও প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
  • ২। রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সাথে সম্পর্ক : রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই রোমান চিন্তাবিদদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কিত বক্তব্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে রোমানীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারার জন্ম হয়েছে।
  • ৩। ব্যক্তিগত সম্পত্তি : রোমান চিন্তাবিদগণেরা মনে করেন, সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানায় থাকটাই যৌক্তিক। অর্থাৎ তাঁরা সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য অনুসারে ব্যক্তি সম্পদের মালিক হতে পারবে এবং ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তির ওপর তার একচেটিয়া অধিকার থাকবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির মাধ্যমে মূলত রোমানীয় চিন্তাবিদরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে স্বীকার করে নিয়েছেন।
  • ৪। স্থানীয় রীতিনীতি : রোমানীয় অর্থনেতিক চিন্তাধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, রোমানীয় চিন্তাবিদরা তাঁদের আলোচনার স্থানীয় রীতিনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। স্থানীয় জনগণ যেভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন তার ওপর ভিত্তি করেই রোমান চিন্তাবিদগণ তাদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারাকে প্রসারিত করেছেন। তখনকার রোম সাম্রাজ্যে স্থানীয়ভাবে দু’ ধরনের আইন প্রচলিত ছিল – (ক) সাধারণ আইন (Jus Civile), (খ) জেনটাম আইন (Jus Gentium)।
  • ৫। পুঁজিবাদী বিকাশ : অর্থনীতির জনক এডাম স্মিথ রচিত “Wealth of Nations” গ্রন্থটি রোমানীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। Adam Smith তাঁর গ্রন্থে ‘অদৃশ্য হাত’ বা Invisible Hand ধারণাটি ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ Adam Smith রোমান অর্থনৈতিক চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন একটি অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেছেন যেখানে সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অদৃশ্য হাত দ্বারা পরিচালিত হবে এবং অদৃশ্য হাতই সকল অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করবে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, রোমান চিন্তাবিদেরাই সর্বপ্রথম পুঁজিবাদী ধারণার জন্ম দিয়েছেন।
  • ৬। ধর্মের সাথে সম্পর্ক নেই : রোমান অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় চিন্তাবিদরা ধর্মীয় চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁদের বক্তব্য দেননি। ধর্মকে আলাদা রেখে তাঁরা তাঁদের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা করেন। ধর্মীয় চিন্তার জগৎ থেকে তাঁরা অর্থনীতির চিন্তার জগতকে আলাদা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্য ধর্মীয় চিন্তাভাবনার সাথে রোমান অর্থনৈতিক চিন্তাধারার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়না।

উপরের আলোচনা হতে বলা যায় যে, রোমানীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারার কতগুলো স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিত্তিতেই রোমান অর্থনৈতিক চিন্তাধারাকে গ্রিক ও জেনোফোন অর্থনৈতিক চিন্তাধারা থেকে পৃথক করা যায়।

তথ্যসূত্র

  • অর্থনৈতিক চিন্তাধারা, ডঃ নুর ইসলাম, আবুল খায়ের, দি ইউনাইটেড পাবলিশার্স, ২০২২, পৃষ্ঠা – ১-২৭

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.