মেজাজের বিকৃতি বা মুড ডিজর্ডার : ডিপ্রেশন, বাইপোলার, আত্মহত্যা

এখানে মেজাজের বিকৃতি (Mood Disordes) সম্বন্ধে আলোচনা করা হবে। প্রথমে DSM-IV অনুসারে মেজাজের বিকৃতিগুলোর সাধারণ লক্ষণাবলীর বর্ণনা করা হবে ও মেজাজের বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি, বিশেষ করে হর্ষোন্মত্ততা ও বিষণ্ণতা ও দ্বিমেরু বিশিষ্ট বিকৃতি (Bipolar disorder) সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। এর পরে এসব বিকৃতির কারণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি আলোচনা করা হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আশির দশকের পূর্বে এসব বিকৃতিকে আবেগীয় বিকৃতি (Affective disorder) বলা হত; এবং যে আবেগীয় বিকৃতিতে হর্ষোন্মত্ততা (Mania) ও বিষণ্ণতা— উভয় ধরনের লক্ষণ উপস্থিত থাকত তাকে ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস (Manic-Depressive Psychosis) বলা হত। বর্তমানে এই বিকৃতিকে দ্বিমেরু বিশিষ্ট বিকৃতি বা দ্বিমুখী বিকৃতি (Bipolar Disorder) বলা হয়।

Table of Contents

বিষণ্ণতা (Depression) ও হর্ষোন্মত্ততার (Mania) সাধারণ বৈশিষ্ট্য

বিষণ্ণতা (Depression) একটি আবেগীয় অবস্থা যার লক্ষণ হল গভীর দুঃখবোধ (Sadness) ও আশঙ্কা (apprehension) বা উৎকণ্ঠা, খারাপ একটি ঘটনা ঘটবে বলে ভয়; নিজেকে অপদার্থ মনে করা ও অপরাধবোধ, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া (withdrawal from others), নিদ্রাহীনতা, ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যাওয়া, যৌন স্পৃহার অভাব বা অবলুপ্তি, দৈনন্দিন কাজকর্মে আনন্দ ও আগ্রহের অভাব। জীবনে চলার পথে আমরা অনেকেই যেমন মাঝে মাঝে উদ্বেগে ভোগি, ঠিক তেমনিভাবে মাঝে মাঝে বিষাদগ্রস্তও (বিষণ্ণ) হই। কিন্তু এই বিষণ্ণতা ও উদ্বিগ্নতার মাত্রা বা পৌনঃপুনিকতা সাধারণতঃ খুব বেশি হয় না, যাতে আমাদের বিষণ্ণতার রোগী বলে চিহ্নিত করা যায়। অনেক সময় বিষণ্ণতার সঙ্গে আরো কিছু সমস্যা থাকতে পারে- যেমন, আতঙ্ক গ্রস্ত হওয়া (Panic attack), মাদকাসক্তি (Substance abuse), যৌন অক্ষমতা এবং ব্যাক্তিত্বের বিকৃতি।

যারা বিষণ্ণতায় ভুগছে তারা কোন বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে না, অল্পতেই ক্লান্তিবোধ করে এবং মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটে। অন্যেরা কি বলছে তা সে গ্রহণ করতে পারে না। সে যদি বই পড়ে তাহলে কি পড়ছে তা গ্রহণ করতে পারে না- অর্থাৎ আশে-পাশে যা ঘটছে তার প্রতি সে মনোযোগ দিতে পারে না। তার জন্য কথা বলাটাও একটি ক্লান্তিকর কাজ। তারা খুব আস্তে আস্তে কথা বলে- যেমন একটি শব্দ উচ্চারণ করার পর অনেকটা সময় বিরতি দিয়ে আরেকটি শব্দ উচ্চারণ করে। তারা খুব কম কথা বলে এবং এক ঘেয়ে সুরে কথা বলে। অনেকেই একাকী এবং নিরব থাকতে পছন্দ করে। আবার কেউ কেউ উত্তেজিত (agitated) থাকে এবং স্থির হয়ে বসতে পারে না। তারা ক্রমাগত পায়চারি করে, হাত মোচড়ায়, ক্রমাগত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, অথবা অভিযোগ করে। একটি সমস্যা উপস্থিত হলে তা সমাধানের জন্য তাদের মাথায় কোন ধারণা বা চিন্তা (idea) সৃষ্টি হয় না। প্রত্যেকটি মুহূর্ত তাদের কাছে ভারী বলে মনে হয়, আর তাদের মাথায় সব সময় আত্ম-অভিযোগ বা নিজেকে সবকিছুর জন্য দোষী করার চিন্তা ঘুরপাক খায়। তারা নিজেদের স্বাস্থ্যের যত্ন নেয় না, নিজেদের পরিচ্ছন্নতা এবং বেশ ভূষার প্রতি নজর দেয় না, এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যথা বেদনা এবং শারীরিক অসুবিধার কথা বলে – যেগুলোর পেছনে স্পষ্টতঃ কোন শারীরিক ভিত্তি থাকে না। তারা বেশিরভাগ সময় সম্পূর্ণভাবে হতাশ, হতোদ্যম, শঙ্কিত, উৎকণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন এবং মন-মরা থাকে।

বিষণ্ণতার লক্ষণাবলী জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। অর্থাৎ বয়সের সঙ্গে এসব লক্ষণের সম্পর্ক রয়েছে। শিশু-কিশোরদের বিষণ্ণতা শুরু হয় শারীরিক ব্যাধির অভিযোগের মধ্য দিয়ে। যেমন প্রথমে তারা মাথা ব্যথার কথা বলে অথবা পেট ব্যথা বা এমনি ধরনের শারীরিক অসুবিধার কথা বলে। কিন্তু বেশি বয়সে প্রথমে শুরু হয় মনোযোগ নিবিষ্ট করার অসুবিধা এবং কোন কিছু মনে না রাখতে পারার (স্মৃতি নষ্ট হওয়া) অভিযোগ দিয়ে। বিভিন্ন দেশে এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যেও লক্ষণের পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্যের জন্য দায়ী হল গ্রহণযোগ্য আচরণের সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের পার্থক্য। উদাহরণসরূপ, ল্যাটিনো সংস্কৃতিতে লোকেরা স্নায়ু (nerves) এবং মাথা ধরার অভিযোগ বেশি করে, পক্ষান্তরে এশীয়রা দুর্বলতা ও ক্লান্তির অভিযোগ বেশি করে। তবে সৌভাগ্যের কথা হল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে বিষণ্ণতা কেটে যায়, যদিও এর পুনরাবৃত্তি হয় খুব বেশি। তবে একবার বিষণ্ণতা দেখা দিলে তা এক নাগাড়ে গড়ে ছয় থেকে আটমাস বা তারো বেশি স্থায়ী হতে পারে এবং এই সময়টা রোগী এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিকট আরো দীর্ঘ মনে হয়। বিষণ্ণতা স্বল্পস্থায়ী (acute) হতে পারে অথবা দীর্ঘস্থায়ী (chronic) হতে পারে। বিষণ্ণতা যখন দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়, তখন ব্যক্তি মাঝে মাঝে সুস্থ হলেও সে কখনও অসুখের পূর্বের কর্মোদ্যম ও কর্মক্ষমতা ফিরে পায় না।

হর্ষোন্মত্ততা (Mania)

ইংরেজী ম্যানিয়া (mania) শব্দটির বাংলা করা হয়েছে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ততা, অথবা প্রবল বাতিক (বাংলা একাডেমী ইংরেজী-বাংলা অভিধান, পৃঃ ৫৪৩, ১৯৯৩)। অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞানে ম্যানিয়া (mania) শব্দটির দ্বারা একটি বিশেষ ধরনের আবেগীয় অবস্থা বা মেজাজকে বোঝানো হয় যখন ব্যক্তি কোন কারণ ছাড়াই তীব্র আনন্দ অনুভব করে। এর সঙ্গে থাকে সহজে বিরক্ত হওয়ার প্রবনতা, অতিরিক্ত চঞ্চলতা বা সক্রিয়তা (Hyperactivity), বেশি কথা বলার প্রবণতা, নতুন নতুন ভাব বা চিন্তার উদয় হওয়া, মনোযোগের চঞ্চলতা (সহজে মনোযোগের বিচ্যুতি), এবং অবাস্তব জাকজমকপূর্ণ পরিকল্পনা। যেহেতু এই বিকৃতিতে অতিরিক্ত আনন্দোচ্ছ্বাস এবং তীব্র উত্তেজনা বা সক্রিয়তা বর্তমান থাকে সেজন্য এটিকে হর্বোন্মত্ততা [= হর্ষ (আনন্দ) + উন্মত্ততা] বলা হচ্ছে। অনেক রোগীর মধ্যে পালাক্রমে বিষণ্ণতার পর্যায় ও হর্ষোনাত্ততার পর্যায় উপস্থিত হয়। অর্থাৎ রোগী কিছুদিন খুব বিমর্ষ এবং মনমরা থাকে তারপর আবার খুব বেশি হৈ চৈ করে আনন্দোল্লাস করে, আবার সে ক্রমশঃ ক্লান্ত ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে। আবার তিন মাস / চারমাস পর হঠাৎ করে উত্তেজিত উদ্বেলিত, অতিশয় কর্মমুখর হয়ে উঠে। তবে অনেকের মধ্যে একটি মাত্র পর্যায় ঘটতে দেখা গেছে। যেমন শুধু উত্তেজিত পর্যায় আবার কারো মধ্যে শুধু বিষণ্ণতার মাত্রাধিক্য। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা কম।

হর্ষোন্মত্ততার পর্যায় (Manic episode) শুরু হলে তা কয়েকদিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এ পর্যায়ে ব্যক্তি অনর্গল উচ্চৈস্বরে কথা বলতে থাকে; তামাশা-মস্করা করে, হাসির ফোয়ারা ছোটায়, আশে-পাশের ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করে, কবিতা বলে, বন্ধুবান্ধবকে পুনঃপুন টেলিফোন করে। তার কথাবার্তায় ছেদ টানা অসম্ভব এবং এর মধ্যেই হর্ষোন্মত্ত লোকদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য – ভাবের চঞ্চলতার (flight of ideas) পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যক্তির কথা অথবা বাক্যাংশগুলো সঙ্গতিপূর্ণ বা সুশৃঙ্খল থাকলেও সে খুব ঘনঘন প্রসঙ্গ/বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে। তারা কোন না কোন কাজে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখতে চায়। এজন্যই তারা বিরক্তিকরভাবে সামাজিক আচরণ করতে শুরু করে। যেমন, যাকেই সামনে পায় তাকেই প্রশ্ন করে, গায়ে পড়ে আলাপ জমায়, সময়ে অসময়ে প্রতিবেশীর বাড়ীতে গিয়ে কথা বলতে চায়, সব সময়ই অথবা কোন সময় কোন কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই ব্যস্ত থাকে। এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ তার প্রচেষ্টা বা পরিকল্পনার ভুলত্রুটিগুলোর প্রতি তার কোন নজর থাকে না। তার এসব প্রচেষ্টায় বা চলন্ত কার্যাবলীতে বাধা দিলে সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে। এ ধরনের অতি-উত্তেজিত অবস্থা বা হর্ষোন্মত্ত অবস্থা হঠাৎ করে আসে এবং এক বা দুই দিন থাকতে পারে। একজন চিকিৎসকের সঙ্গে একজন হর্মোন্মত্তরোগীর (পুরুষ) সংলাপের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল :

  • চিকিৎসক : আচ্ছা, আপনাকে আজকে বেশ খুশি মনে হচ্ছে?
  • রোগী : খুশি। বেশ খুশি লাগছে আমার। আপনি কমিয়ে বলার ওস্তাদ। [আসন থেকে লাফিয়ে উঠে।] আমি আজ মহাখুশি। স্বর্গীয় আনন্দ পাচ্ছি। কারণ, আমি আজই পশ্চিম উপকুলে (West coast) -এ রওনা হচ্ছি। আমার মেয়ের সাইকেলে করে যাব। মাত্র ৩১০০ মাইল। এটা কিছুই না, আপনি জানেন। আমি হেঁটেও যেতে পারতাম। কিন্তু সেখানে আগামী সপ্তাহের মধ্যে পৌঁছাতে চাই। আমি যখন যাব তখন রাস্তায় অনেক লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার মাছ ধরার যন্ত্রপাতির আয়োজনে তাদের অর্থ বিনিয়োগ করতে বলব। এভাবে আমার বহু লোকের সঙ্গে চেনা জানা হবে। ডাক্তার! সেই জানাটা হবে বাইবেলের অর্থে [চিকিৎসকের প্রতি প্রলুদ্ধকরভাবে হাসে]। আহ্, একি! আমার কি ভাল লাগছে। আমি যেন চরম যৌন সুখ ভোগ করছি- যা কোনদিন থামবে না।

এই সংলাপে হর্ষোন্মত্ত রোগীর সংশোধনের অতীত বা অতিরিক্ত আশাবাদ (optimism) এবং উক্তত্য করার প্রবণতা (provocativeness) প্রকাশিত হয়েছে।

রোগ নির্ণয়

DSM-IV অনুসারে দুটি প্রধান মেজাজের বিকৃতির নামকরণ করা হয়েছে যথাক্রমে গুরুতর বিষণ্ণতা (Major depression) যাকে একমুখী বা এক মেরু-বিশিষ্ট বিষণ্ণতাও (Unipolar Depression) বলা হয় এবং দ্বিমুখী বিকৃতি বা দ্বিমেরু-বিশিষ্ট বিকৃতি (Bipolar Disorder)। এখন এ দুটো বিকৃতির নির্ণায়ক লক্ষণগুলোর কথা আলোচনা করা হল।

গুরুতর বিষণ্ণতা (Major Depression)

গুরুতর বিষণ্ণতা বা একমুখী বিষণ্ণতার রোগীকে চিহ্নিত করতে হলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর যেকোন পাঁচটি কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে বর্তমান থাকতে হবে। এই পাঁচটি লক্ষণের একটি অবশ্যই বিষণ্ণ মেজাজ অথবা আগ্রহ এবং আনন্দের অভাব হতে হবে।

  • (১) প্রায় প্রতিদিন, অথবা দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যক্তি দুঃখিত ও বিষণ্ণ মেজাজে থাকে।
  • (২) নিজের বাস্তব কাজকর্মের প্রতি আগ্রহ ও আনন্দহীনতা।
  • (৩) অনিদ্রা (নিদ্রাহীনতা), সহজে ঘুমায় না, মাঝরাতে জেগে উঠলে আর সারারাতে ঘুম আসে না। কেউ কেউ ভোরে শয্যা ত্যাগ করে। কোন কোন রোগী বেশি সময় ধরে ঘুমাতে চায়।
  • (৪) সক্রিয়তার মাত্রায় পরিবর্তন ঘটে, হয়ত অলস (lethargic) হয়ে যায়— এটাকে বলা হয় মানসিক ও অজ্ঞাসালনমূলক প্রতিবন্ধিতা (Psychomotor retardation) অথবা উত্তেজিত হয়ে যায়।
  • (৫) ক্ষুধা কম থাকে, ওজন কমে যায়, অথবা ক্ষুধা বেড়ে যায় এবং ওজন বাড়ে।
  • (৬) শক্তি খরচ হয়ে যায় এবং ব্যক্তি ক্লান্ত বা অবসন্ন বোধ করে।
  • (৭) নেতিবাচক আত্মধারণা, নিজেকে দোষ দেওয়া, নিজেকে অপদার্থ মনে করা এবং অপরাধবোধ ।
  • (৮) রোগী মনোনিবেশ করতে পারে না বলে অভিযোগ করে, বা প্রতীয়মান হয় যে তারা চিন্তার গতি কমে যায় এবং সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।
  • (৯) পুনঃপুন আত্মহত্যা অথবা মৃত্যুর চিন্তা করে।

আমেরিকায় এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা প্রায় ১০% [এটা হল জীবন ব্যাপী প্রচলন হার]। এটা পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেশি হয়, নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকদের মধ্যে এবং নবযৌবন প্রাপ্তদের মধ্যে (Young adults) বেশি সংখ্যায় দেখা যায় এবং ব্যাধিটি একজনের হলে বারবার হয়, এবং এক বছরে পুনরাবৃত্তির হার ৮০%। অর্থাৎ একজনের একবার বিষণ্ণতা দেখা দিলে এক বৎসরের মধ্যেই ৮০% ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার আক্রমণ ঘটে (Coryell et al., 1994)। প্রায় ১৫% লোক দীর্ঘ স্থায়ী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়- যাদের মধ্যে এটা দুই বৎসরের ও বেশি সময় স্থায়ী হয়। Klerman (1988)-এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই ব্যাধিতে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা বিগত পঞ্চাশ বৎসরে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত পঞ্চাশ বৎসরে যে সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে- যেমন যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গেছে, পরিবারের সমর্থন কমে গেছে, চিরাচরিত প্রথা পদ্ধতি ও মূল্যবোধ শিখিল হয়ে গেছে, গীর্জার প্রভাব কমে গেছে ও ব্যক্তিজীবনের সংকট ও সমস্যা বেড়েছে। এসবের কারণেই এখন বিষণ্ণতার রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রথম প্রকারের দ্বিমুখী বিকৃতি (Bipolar I disorder)

যখন একজন ব্যক্তির মধ্যে হর্ষোন্মত্ততা (Mania) এবং বিষণ্ণতা (Depression) একই সঙ্গে উপস্থিত থাকে, অথবা পালাক্রমে উপস্থিত হয়, তখন উক্ত রোগীকে দ্বিমুখী বিকৃতির রোগী বলা হয়। বেশিরভাগ রোগীর বেলায় হর্ষোন্মত্ততা ও বিষাদ পালাক্রমে আসে। আনুষ্ঠানিকভাবে (Formal) রোগ নির্ণয় করতে হলে হর্ষোন্মত্ত পর্যায়ের জন্য উল্লসিত মেজাজ বা খিটখিটে মেজাজসহ নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর মধ্যে? তিনটি (খিটখিটে মেজাজের জন্য ৪টি) লক্ষণ উপস্থিত থাকতে হবে :

  • (১) কর্ম তৎপরতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া (কর্মক্ষেত্র বা চাকুরী ক্ষেত্রে, সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, যৌন- সম্পর্কের ক্ষেত্রে)।
  • (২) অনর্গল বা অতিরিক্ত কথা বলা, এবং দ্রুতগতিতে কথা বলা।
  • (৩) চিন্তাস্রোত দ্রুতগতিতে প্রসঙ্গ বদল করে, মনে হয় যেন চিন্তা এক বিষয় থেকে দ্রুত গতিতে অন্য বিষয়ে দৌড়াচ্ছে।
  • (৪) প্রয়োজনের তুলনায় ঘুমের পরিমাণ কম হওয়া।
  • (৫) আত্মমর্যাদার অনুভূতি বৃদ্ধি পাওয়া, একজন হঠাৎ করে মনে করতে শুরু করে যে তার অনন্য সাধারণ প্রতিভা রয়েছে, সে অসাধারণ ক্ষমতা বা শক্তির অধিকারী।
  • (৬) মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে না পারা, মনোযোগ সহজে ব্যাহত হয়।
  • (৭) আনন্দ স্ফূর্তিতে বেশি মাতামাতি করা, বিশেষতঃ যেসব কাজের পরিণতি বিপজ্জনক হতে পারে সেসব কাজে ঝাপিয়ে পড়া (যেমন প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করা, জোরে গাড়ী চালাতে শুরু করা)।

মায়ারস (Mayers 1984) এর গবেষণা থেকে জানা যায় যে, গুরুতর বিষণ্ণতার চেয়ে দ্বিমুখী বিকৃতির রোগীর সংখ্যা কম। জনসংখ্যায় এর জীবনব্যাপী প্রচলন হার ১% এর কাছাকাছি। পুরুষ ও মহিলা রোগীর সংখ্যা সমান। বিশ বছরের উপরে এবং ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্ব প্রথম এ রোগ দেখা দেয়।

মহিলাদের মধ্যে বিষণ্ণতার উপাখ্যান (episode) বেশি এবং হর্ষোন্মত্ততার উপাখ্যান কম উপস্থিত থাকে। গুরুতর বিষণ্ণতার মতই দ্বিমুখী বিকৃতির ও পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রায় ৫০% রোগী চারবার বা তারো বেশি বার আক্রান্ত হয়। অনেক মনোবিজ্ঞানী অতিরিক্ত স্ফূর্তি বা আনন্দোচ্ছ্বাসকে হর্ষোন্মত্তার মূল লক্ষণ বলতে চান না; বরং হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে ওঠা বা খিটখিটে হওয়া, এমনকি বিষণ্ণতাকেও এর মৌলিক লক্ষণ বলে মনে করেন। কোন কোন মনোবিজ্ঞানী মাইকেল এভোলো, ভ্যান গগ, টিচাইকোভস্কি, গগিন (Gauguin), টেনিসন (Tennyson), শেলী প্রভৃতি সৃজনশীল প্রতিভাকে দ্বিমুখী বিকৃতির রোগী হিসাবে শনাক্ত করেছেন। কারণ দ্বিমুখী বিকৃতির হর্মোন্মত্ত পর্যায়ে চিন্তার যে প্রসঙ্গান্তর ঘটে তাতে অনেক বিপরীত ধর্মী বা পৃথক ধরনের ভাবের সমন্বয় ঘটতে সাহায্য করে, তাছাড়া ব্যক্তির সক্রিয়তা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তাই বলে এ রোগ হলেই যে সৃজনধর্মী কাজ (Creative art) বৃদ্ধি পাবে, বা যাদের এ রোগ নেই তারা সৃজনশীল কাজ করে না এমন নয়। অর্থাৎ যাদের প্রতিভা আছে তাদের বেলায় হর্ষোন্মত্ততা সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সামান্য সহায়তা করতে পারে। বড় বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকদের মধ্যে এ ধরনের মানসিক বিকৃতি দেখা দেয়নি।

একমুখী ও দ্বিমুখী মেজাজের বিকৃতির পার্থক্য

কয়েক দশক আগেও বিভিন্ন ধরনের মেজাজের বিকৃতি বা আবেগীয় বিকৃতির মধ্যে পার্থক্য দেখা হত না। কিন্তু বর্তমানে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, একমুখী (Unipolar) মেজাজের বিকৃতি ও দ্বিমুখী (Bipolar বিকৃতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে –

বৈশিষ্ট্য একমুখী বিষণ্ণতা দ্বিমুখী বিষণ্ণতা
অঙ্গসঞ্চালন (Motor activity) সাধারণতঃ উত্তেজিত (Typically agitated) সাধারণতঃ বিষণ্ণ অবস্থায় প্রতিবন্ধিতা (Retarded)
নিদ্রা (Sleep) ঘুমাতে অসুবিধা হয়, অনিদ্রা বিষণ্ণ অবস্থায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘুমায়
কোন বয়সে প্রথম শুরু হয় ত্রিশ বছরের কাছাকাছি বয়স থেকে চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে ত্রিশ বছর
পারিবারিক ইতিহাস  নিকট আত্মীয়দের মধ্যে একমুখী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি নিকট আত্মীয়দের মধ্যে একমুখী ও দ্বিমুখী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি
লিঙ্গ (Gender) নারীদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি পুরুষ ও নারীদের মধ্যে প্রাদুর্ভাবের হার প্রায় সমান
ভেষজ চিকিৎসা  লিথিয়াম মোটামুটি ফলপ্রসূ, কিন্তু ত্রিচক্র বিশিষ্ট ঔষধে ভাল কাজ দেয় লিথিয়ামে সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া যায়

উল্লিখিত পার্থক্যগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, একমুখী ও দ্বিমুখী মেজাজের বিকৃতির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা যুক্তি সঙ্গত ও যথার্থ। তবে বংশগতির গবেষণা (Genetic research) থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে মনে হয়, একমুখী ও দ্বিমুখী বিষণ্ণতা একই ব্যাধি। কারণ, একমুখী বিষণ্ণতার রোগীদের নিকটআত্মীয়দের মধ্যে একমুখী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি বেশি, কিন্তু দ্বিমুখী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীদের নিকট আত্মীয়দের মধ্যে একমুখী ও দ্বিমুখী উভয় ধরনের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি (Gerson, 1990)। সেজন্য অনেকেই বলেছেন যে, এদুটি ব্যাধি আসলে আলাদা নয়, বরং দ্বিমুখী বিষণ্ণতা প্রকৃত পক্ষে একমুখী বিষতারই একটি তীব্র রূপ।

একই শ্রেণীর অন্যান্য ব্যাধির সঙ্গে পার্থক্য (Heterogeneity within the categories)

বিভিন্ন ধরনের মেজাজের বিকৃতির শ্রেণী বিন্যাস করা বেশ অসুবিধাজনক। এর কারণ হল এদের মধ্যে প্রচুর পার্থক্য বিদ্যমান।

কিছুসংখ্যক দ্বিমুখী বিষণ্ণতার রোগী প্রত্যেক দিন হর্ষোন্মত্ততা ও বিষণ্ণতার সবগুলো লক্ষণ প্রকাশ করে, সেজন্য এসব রোগীকে মিশ্র উপাখ্যানের রোগী (mixed episode) বলা হয়। অন্যান্য রোগীরা একবার রোগ লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর একবারে (একটি উপাখ্যানে একটি আক্রমণে)-শুধু বিষণ্ণতায় ভোগে অথবা শুধু হর্ষোন্মত্ততায় ভোগে। তথাকথিত ২য় শ্রেণীর দ্বিমুখী রোগীদের (Bipolar II patients) বেলায় গুরুতর বিষণ্ণতার পর্যায়ের সঙ্গে অল্পমাত্রার হর্ষোন্মত্ততা (Hypomania) দেখা দেয় যখন মেজাজের পরিবর্তন পূর্ণমাত্রার হর্ষোন্মত্ততার চেয়ে কম তীব্রতা সম্পন্ন হয়।

কোন কোন বিষণ্ণতার রোগীকে সাইকোটিক রোগী হিসাবে রোগ নির্ণয় করা হয়— যদি তাদের মধ্যে বিষণ্ণতার সঙ্গে ভ্রান্তবিশ্বাস (delusion) এবং অলীক প্রত্যক্ষণ (hallucination) থাকে। একমুখী বিষণ্ণতার রোগীদের মধ্যে ভ্রান্তবিশ্বাস থাকা আর না থাকার ভিত্তিতে পার্থক্য নিরূপণ করা অত্যাবশ্যক। কারণ, যেসব বিষণ্ণতায় রোগীর ভ্রান্তবিশ্বাস থাকে (delusins ) তারা বিষণ্ণতায় সাধারণভাবে ব্যবহৃত ঔষধে আচরণের উন্নতি দেখায় না (অর্থাৎ বিষণ্ণতার সাধারণতঃ ব্যবহৃত ঔষধে কোন উপকার হয়। না। কিন্তু এসব ঔষধের সাথে স্কিজোফ্রেনিয়ার মত সাইকোটিক বিকৃতিতে যেসব ঔষধ ব্যবহৃত হয়, সেগুলো ব্যবহারে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। তাছাড়া সাইকোটিক বিষণ্ণতার ফলাফল বা গতি প্রকৃতি (Course) দ্বিমুখী বিষণ্ণতার গতিপ্রকৃতির চেয়ে গুরুতর। এবং এরফলে ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুবার আক্রমণের মাঝখানের সময় কম থাকে।

বিষণ্ণতায় আক্রান্ত কোন কোন রোগীকে মেলাঙ্কোলিয়া (Melancholia) উপশ্রেণীতে ফেলা হয়। তারা কোন কাজেই আনন্দ পায় না; এমন কি একটি ভাল ঘটনা ঘটলেও তারা ক্ষণিকের জন্যও ভাল অনুভব করে না। তাদের বিষণ্ণ মেজাজ সকালে বেশি খারাপ থাকে, আর দুপুরের দিকে কিছুটা উন্নতি হয়। অন্যের চেয়ে দুই ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে ওঠে। ক্ষুধা কমে যায়, ওজন কমে যায়। এবং অলস বা নিষ্ক্রিয় থাকে অথবা উত্তেজিত থাকে। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার আগে এদের ব্যক্তিত্বে কোন ত্রুটি থাকে না এবং ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। তবে ভ্রান্তবিশ্বাস সহ আর ভ্রান্তবিশ্বাস ছাড়া এ দু ধরনের বিষণ্ণতার পার্থক্য এখনও সুপ্রতিষ্ঠিত নয়।

হর্ষোন্মত্ততা এবং বিষণ্ণতার উপাখ্যান (episodes) উভয় সময়েই রোগীর মধ্যে ক্যাটাটোনিয়ার (Catatonia) বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকতে পারে যেমন হাত-পায়ের গতিশূন্যতা বা জড়তা (immobility) অথবা অতিরিক্ত মাত্রায় উদ্দেশ্যবিহীন কর্মচঞ্চলতা।

হর্ষোন্মত্ততা ও বিষণ্ণতা অনেক সময় সন্তান জন্মদানের চার মাসের মধ্যে দেখা দিতে পারে। তখন এটাকে প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা বলা হয়। বিষণ্ণতা বা হর্ষোন্মত্ততা যদি ভৌগলিক ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়, তবে তাকে মৌসুমী বিষণ্ণতা (Seasonal depression) বলা হয়। যেমন অনেকেই গ্রীষ্মকালে হর্ষোন্মত্ততা আর শীতকালে বিষণ্ণতায় ভোগে। শীতকালীন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীদের উজ্জ্বলতা ও সাদা আলোর প্রতি উন্মুক্ত করে চিকিৎসা করলে ভাল ফল পাওয়া যায় (Blehar or Rosenthal, 1989)|

দীর্ঘস্থায়ী মেজাজের বিকৃতি (Chronic Mood Disorder)

DSM-IV-এ দু’ধরনের দীর্ঘস্থায়ী (Chronic) মেজাজের বিকৃতির কথা বলা হয়েছে যেগুলোতে মেজাজের গোলযোগের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এদুটোর একটি হচ্ছে সাইক্লোথাইমিক বিকৃতি (Cyclothymic disorder) আর অন্যটি হচ্ছে ডিসথাইমিক বিকৃতি (Dysthymic disorder)।

সাইক্লোথাইমিক বিকৃতিতে রোগীর বিষণ্ণতা এবং আনন্দোচ্ছাস (Hypomania) খুব ঘনঘন আবর্তিত হয়। এ দুটো অবস্থার মধ্যবর্তীকালে ব্যক্তি স্বাভাবিক আচরণ করে এবং এই সময়টি দুমাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এসব রোগীর বিষণ্ণতা ও আনন্দের লক্ষণগুলো যেন জোড়া মেলানো। যেমন তারা বিষণ্ণতার উপাখ্যানে নিজেদের অক্ষম (Inadequate) ভাবে। আবার আনন্দের উপাখ্যানে তাদের আত্মমর্যাদা (Self esteem) বেড়ে যায়। বিষণ্ণতার সময় তারা অন্য সবার কাছ থেকে সরে যায়, আর আনন্দের সময় তারা মানুষের সাহচর্য পেতে অদম্য হয়ে উঠে।

ঠিক তেমনিভাবে বিষণ্ণতায় কম ঘুমায় আর তার পরবর্তী পর্যায়ে বেশি ঘুমায়। সাইক্লোথাইমিক রোগীরা যখন বিষণ্ণ থাকে তখন কোন কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না এবং তাদের লেখা ও কথা বলার ক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু আনন্দের পর্যায়ে তাদের চিন্তা ক্ষুরধার হয়, সৃজনশীল হয় এবং তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সাইক্লোথাইমিয়ার রোগী অনেক সময় পরিপূর্ণ হর্ষোাত্ততা ও বিষণ্ণতার লক্ষণ দেখাতে পারে।

ডিসথাইমিক বিকৃতিতে আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘস্থায়ীভাবে বিষণ্ণতায় ভোগে। ব্যক্তি দুঃখভারাক্রান্ত বা বিষণ্ণ থাকে এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম ও খেলাধূলা বা শখের জিনিসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাছাড়াও এসব রোগী আরো কতকগুলো লক্ষণ প্রকাশ করে। যেমন, অনিদ্রা অথবা অতিশয় নিদ্রালুতা, অক্ষমতাবোধ (feeling of inadequacy), নিজের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার অনুভূতি, শক্তিহীনতা বা ক্লান্তি, নৈরাশ্য (pessimism); মনোযোগ নিবিষ্ট করার অক্ষমতা, স্বচ্ছ চিন্তার অক্ষমতা এবং অন্যান্য লোকের সঙ্গ পরিত্যাগ করার ইচ্ছা। কিন (Klein et al., 1988) ও তার সঙ্গীরা ব্যাপক তথ্য সংগ্ৰহ করে বলেছেন যে, ডিসথাইমিক বিকৃতি মেজাজের বিকৃতির অতি গুরুতর একটি রূপ। ডিসথাইমিয়ায় আক্রান্ত অনেক রোগী দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতায় ভোগে এবং তাদের মধ্যে গুরুতর বিষণ্ণতার উপাখ্যান (episodes of major depression) দেখা যায়।

মেজাজের বিকৃতির কারণ

মেজাজের বিকৃতির কারণগুলোকে বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টি ভঙ্গি অনুসারে বিশ্লেষণ করা হয়। এখানে এসব তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা হল।

বিষণ্ণতার মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব (Psychoanalytic Theory of Depression)

ফ্রয়েড ১৯১৭ সালে “Mourning and Melancholia” শিরোনামে একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, বিষণ্ণতার সম্ভাবনা অতিশৈশবেই সৃষ্টি হয়। শিশু-বিকাশের মৌখিক স্তরে (oral stage) যখন শিশুর তাগিদগুলো খুব কম পরিমাণে অথবা খুব বেশি পরিতৃপ্ত হয় (insuffteenfly gratified or oversufficiently gratified) তখন শিশুর বিকাশ ঐ পর্যায়ে থেমে যায়। এটাকে ফ্রয়েড বলেছিলেন সংবন্ধন বা স্থিরীভবন (fixation)। এর জন্যই শিশু ঐ বয়সের সহজাত সন্তুষ্টির উপরে নির্ভরশীল হয়ে পরে। শিশুর স্বাভাবিক যৌন-মানসিক পরিপক্বতা ব্যাহত হওয়ার ফলে মৌখিক স্তরে এই স্থিরীভবনের ফলে ব্যক্তি তার আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য অন্য লোকের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু অন্যের উপর অভিমাত্রায় নির্ভরশীলতার ফলে ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয় কিভাবে?

এর একটি জটিল ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফ্রয়েড। ফ্রয়েডের ব্যাখ্যাটি আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর পর যে শোক উপস্থিত হয়, তার ব্যাখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি বলেছেন যে, প্রিয়জনের মৃত্যু হলে অথবা শিশুর জন্য যেটা খুব সাধারণ ঘটনা, প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বা প্রিয়জনের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলে, শিশু সর্ব প্রথম প্রিয়জনকে অন্তঃপ্রক্ষেপ করে (Introjection)। অর্থাৎ প্রয়াত / বিচ্ছিন্ন প্রিয়জনকে হারাতে চায় না বলে তাকে নিজের ভেতরে গ্রহণ করে। এটা হল হারানোর বেদনা থেকে রেহাই পাওয়ার একটি প্রচেষ্টা। ফ্রয়েড মনে করেন যে, যাকে আমরা ভালবাসি তার জন্য অবচেতন মনে ঘৃণাও লুকিয়ে থাকে। তারপর এই ঘৃণা এবং ক্রোধ নিজের উপরে এসে পড়ে। শিশু ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য নিজেকে দায়ী করে এবং কল্পিত বা বাস্তব পাপের জন্য যার জন্য সে প্রিয়জনকে হারিয়েছে তার মধ্যে অপরাধবোধ তৈরী হয়। আত্মীয় বিয়োগের পরে ঘটে অন্তঃপ্রক্ষেপন, তারপর শোক পালন (mourning) এর পরবর্তীকালে এই শোকই লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে নিজের উপর এসে পড়ে। সে তখন নিজেকে দোষ দেয়, নিজেকে কষ্ট দেয়, এবং বিষণ্ণতায় ভোগে। এটা বিশেষ করে হয় যারা নির্ভরশীল থাকে তাদের মধ্যে। এসব ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির সঙ্গে, বা যার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার সঙ্গে আবেগীয় কখন ছিন্ন করতে পারে না। বরং এই পরিস্থিতির জন্য তারা নিজেদের দোষী মনে করে। তারপর তার ক্রোধ নিজের প্রতি ধাবিত হয়। সুতরাং ফ্রয়েডীয় ধারণা অনুযায়ী বিষণ্ণতা হল নিজের বিরুদ্ধে পরিচালিত ক্রোধ। “Depression is anger turned against one self (Davison & Neale, 1998)। এই তত্ত্বের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বহু সাক্ষ্য প্রমাণ আছে তবে এটা এখনও নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি।

বিষণ্ণতার জ্ঞানীয় তত্ত্ব (Cognitive Theory of Depression)

বিষণ্ণতার ব্যাখ্যার জন্য কমপক্ষে তিনটি জ্ঞানীয় তত্ত্বের প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলোর একটি হল এরন বেক-এর তত্ত্ব (Aron Beck’s theory), একটি হল অসহায়ত্বের তত্ত্ব বা আশাহীনতার তত্ত্ব (Helplesshess / Hopelessness theory) এবং এই তত্ত্বের সর্ব শেষ সংস্করণ বা আশাহীনতার তত্ত্ব (Hopelessness theory)।

বেকের তত্ত্ব (Beck’s theory)

সবগুলো জ্ঞানীয় তত্ত্বই বিশ্বাস করে যে, বিষণ্ণতার একমাত্র কারণ হল ব্যক্তির নিজের চিন্তধারার বিশেষ ত্রুটি (Beck, 1967, 83, 87)। বেক মনে করেন যে, বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিষণ্ণ অনুভূতির কারণ হল তাদের চিন্তাধারায় ঘটনাবলীর ব্যাখ্যায় নেতিবাচক ঝোঁক বা পক্ষপাতিত্ব (negative blas toward interpretation)। বিষণ্ণতার পেছনে জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার তিন পর্যায়ে যে পারস্পরিক ক্রিয়া দায়ী তা নিম্নলিখিত মডেল এর মাধ্যমে উপস্থিত করা হয়েছে –

বেকের তত্ত্বে তিন ধরণের জ্ঞাণীয় প্রক্রিয়ার পারস্পরিক ক্রিয়া

বেক (Beck) মনে করেন, শৈশবে এবং কৈশোরে এসব ব্যক্তি (যারা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়) কতকগুলো ঋণাত্মক ঘটনার অভিজ্ঞতা – যেমন পিতা বা মাতার মৃত্যু; ক্রমাগতভাবে সংঘটিত কতকগুলো বিয়োগান্তক ঘটনা, সমবয়সীদের দ্বারা সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, শিক্ষকবৃন্দের সমালোচনা অথবা পিতামাতার বিষাদমূলক দৃষ্টিভঙ্গির (Depressive aptitude) ফলে পৃথিবীকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার একটি মানসিক ছাঁচ (Schema) অর্জন করে। এধরনের নেতিবাচক স্কিমার জন্যই ব্যক্তি বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। প্রত্যেক ব্যক্তিই পৃথিবীকে দেখার ও ঘটনাবলীকে ব্যাখ্যার জন্য একটি স্কিমা বা প্রত্যক্ষণমূলক প্রস্তুতি অর্জন করে। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তি যে নেতিবাচক স্কীমা তৈরী করে পুরাতন পরিস্থিতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নতুন কোন পরিস্থিতি ঘটলেই তার সেই নেতিবাচক স্কীমা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তদুপরি বিষাদগ্রস্ত লোকদের কতকগুলো জ্ঞানীয় ঝোঁক তাদের নেতিবাচক স্কিমাকে উস্কে দেয় যা ব্যক্তিকে বাস্তব ঘটনাটিকে ভুলভাবে প্রত্যক্ষণ করাতে বাধ্য করে। একজন ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক স্কীমা গঠন করতে পারে। যেমন কারো যদি নিজেকে অদক্ষ/অপটু তাবার একটি স্কীমা তৈরী হয়, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে কোন কঠিন কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তি ব্যর্থ হবে বলে আশঙ্কা করবে। কারো যদি আত্মগ্লানিমূলক স্কীমা বা নিজেকে দোষ দেওয়ার স্কীমা থাকে তাহলে সব ধরনের ব্যর্থতার জন্য সে নিজেকে দোষী বা দায়ী সাব্যস্ত করবে, আর কারো যদি নেতিবাচক আত্মমূল্যায়ন স্কীমা থাকে, তাহলে সে সব সময় নিজেকে অপদার্থ, ক্ষমতাহীন ভাববে।

ব্যক্তি যে নেতিবাচক স্কীমা তৈরী করে তার সঙ্গে জ্ঞানীয় ঝোঁক বা বিকৃতি (Distortions) একত্রিত হয়ে ত্রিবিধ (ত্রয়ী) নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে বা বজায় রাখে। (১) নিজের সম্মন্ধে নেতিবাচক মনোভাব (২) জগত সম্বন্ধে নেতিবাচক মনোভাব এবং (৩) ভবিষ্যত সম্মন্ধে নেতিবাচক মনোভাব- এই ত্রয়ী (Triad) নেতিবাচক মনোভাবের জন্য ব্যক্তি মনে করে “পরিবেশের দাবী এবং দায়িত্ব আমি সামলাতে পারব না।” এ ধরনের মূল্যায়ন ব্যক্তির নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত ঘটনাবলী সম্পর্কে। ব্যক্তির সঙ্গে যেসব ঘটনার সম্পর্ক নেই সেগুলো সম্পর্কে নয়। বিষণ্ণ ব্যক্তিদের জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ায় যেসব নেতিবাচক ঝোঁক (cognitive biases) থাকে সেগুলোর মধ্যে আছে –

  • (১) খুশিমত অনুমান করার প্রবণতা (Arbitrary inference) অর্থাৎ যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই একটি সিন্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা। যেমন তিনি একটি পার্টি দিচ্ছেন (ভোজের আয়োজন) এমন সময় বৃষ্টি এলে তিনি মনে করেন তিনি একটি অপদার্থ লোক।
  • (২) নির্বাচিত বিমূর্তন প্রক্রিয়া (Selective abstraction) : সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বা অনুমান করার সময় তিনি পরিস্থিতির সবগুলো বিষয় বা শর্ত লক্ষ্য করেন না। যেমন একটি যন্ত্র কাজ করছে না বলে তিনি নিজেকে দায়ী করলেন, যদিও এই যন্ত্রটি অনেকে মিলে তৈরী করেছেন।
  • (৩) অতি সাধারণীকরণ (Overgeneralization) : একটি সামান্য ঘটনার উপরে ভিত্তি করে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। যেমন একটি মাত্র পরীক্ষায় খারাপ করার পর ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিল যে এই পরীক্ষাই তার নির্বুদ্ধিতা এবং অপদার্থপনার প্রমাণ।
  • (৪) বড় করে দেখা বা ছোট করে দেখা (Magnification or minimization) : কোন ঘটনাকে বাড়িয়ে দেখা, অতিরঞ্জিত করা অথবা এর গুরুত্ব কমিয়ে দেখা।

বেকের তত্ত্বে মনে করা হয় যে, আমরা পৃথিবীর ঘটনাবলীর প্রতি বা আমাদের অভিজ্ঞতাগুলোর প্রতি কোন্ ধরনের আবেগ নিয়ে সাড়া দেব তা নির্ভর করে আমরা এসব ঘটনাকে কিভাবে প্রত্যক্ষণ করছি, বা কিভাবে ব্যাখ্যা করছি তার ওপর। সুতরাং বেক মনে করেন যে, যে সব ব্যক্তি বিষণ্ণতায় ভোগে তাদের জন্য অযৌক্তিক আত্ম-মূল্যায়নই (self judgments) দায়ী। ব্রাউন ও তার সঙ্গীদের (Brown et. al., 1995) গবেষণায় বেকের তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এ তত্ত্বের অসুবিধা হল এই যে, বিষণ্ণতার ফলে নেতিবাচক চিন্তা হয়, না নেতিবাচক চিন্তার ফলে বিষণ্ণতা হয়, এটা নির্ধারণ করা সহজ নয়। সেজন্য বিষণ্ণতা ও নেতিবাচক চিন্তার মধ্যে অনুবদ্ধ থাকলেও তা কার্যকারণ সম্পর্ক নির্দেশ করে না। তবে সম্পর্কটি এমন হতে পারে যে, বিষণ্ণতা ব্যক্তির চিন্তাকে নেতিবাচক করে তোলে, আবার নেতিবাচক চিন্তা পুনরায় বিষণ্ণতা সৃষ্টি করে এবং তা বাড়িয়ে দেয়। বেকের তত্ত্ব পরীক্ষার জন্য Dysfunctional atitude scale এর সাহায্যে ব্যক্তির নেতিবাচক চিন্তা পরিমাণ করা যায়।

বিষণ্ণতার অসহায়ত্ব/আশাহীনতার তত্ত্ব (Helplessness/Hopelessness Theory)

এই তত্ত্বের প্রধান ধারণাটি হল এই যে, বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা দেখা দেয় ও তারা তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম-এ ধরনের ধারণা পোষণ করে। এগুলো তারা শিখেছে ছোটবেলা থেকে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা বা আঘাত যেগুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল, সেসব অভিজ্ঞতা থেকেই। তারা নিজেদের অসহায় ভাবতে শিখেছে এবং এই অসহায়ত্ববোধ থেকেই বিষণ্ণতার সৃষ্টি হয়।

এ তত্ত্বটি তৈরী হয়েছে একটি অন্তবর্তী প্রক্রিয়ামূলক শিক্ষণ তত্ত্ব (Mediational learning theory) থেকে, যেটি তৈরী করা হয়েছিল গবেষণাগারে কুকুরদের অসহায় আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। কুকুরদের নিয়ে এধরনের শিক্ষণের পরীক্ষণ করা হয়েছিল। কুকুরদের বৈদ্যুতিক আঘাত (electric shock) দেওয়া হত যা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। প্রথম কয়েকবার বৈদ্যুতিক আঘাত দেওয়ার পরপরই কুকুরগুলো যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে খাঁচার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করা বন্ধ করে দেয়। মনে হচ্ছিল যেন কুকুরগুলো বৈদ্যুতিক আঘাত থেকে পালানোর সব প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেয় এবং নিষ্ক্রিয়ভাবে বেদনাদায়ক বৈদ্যুতিক আঘাত গ্রহণ করতে শুরু করে। পরবর্তী পর্যায়ে পরীক্ষণমূলক পরিস্থিতিটিকে এমনভাবে পরিবর্তিত করা হয় যে, কুকুরগুলো চেষ্টা করলে বৈদ্যুতিক আঘাত এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু দেখা গেল, নিয়ন্ত্রিত আরেক দল কুকুরের মত পরীক্ষণমূলক কুকুরগুলো দক্ষভাবে এবং কার্যকরীভাবে পরিহারমূলক প্রতিক্রিয়া অর্জন করেনি।

বরং এসব কুকুর বৈদ্যুতিক আঘাত এলেও খাঁচার কোণে শুয়ে থাকত এবং গরগর আওয়াজ করত। এসব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সেলিগম্যান (Seligman, 1974) প্রস্তাব করেন যে, অপ্রতিরোধ্য বা অবশ্যম্ভাবী প্রতিকারবিহীন বেদনাদায়ক উদ্দীপকের সম্মুখীন করা হলে কুকুরগুলো এক ধরনের অসহায়ত্ববোধ অর্জন করে। এ ধরনের অসহায়ত্ববোধ অর্জিত হলে পরবর্তীকালে যেসব পীড়নমূলক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেসব পরিস্থিতিতেও তাদের কর্মসম্পাদন ( performance) গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত + প্রতীয়মান হয়। যে, তারা যেন বেদনাদায়ক উদ্দীপকের প্রতি দক্ষ ও কার্যকরী প্রতিক্রিয়া (আচরণ) শিক্ষণের ক্ষমতা ও প্রেষণা হয়। হারিয়ে ফেলে। নিয়ন্ত্রণ করা যায় না— এমন পীড়নমূলক পরিস্থিতিতে প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে বহুসংখ্যক পরীক্ষণ চালিয়ে সেলিগম্যান (Seligman) ধারণা করেন যে, প্রাণীদের শিক্ষার্জিত “অসহায়ত্ববোধ” মানুষের কোন কোন ধরনের বিষণ্ণতাকে ব্যাখ্যার জন্য একটি মডেল বা নকশা হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। তিনি গবেষণাগারে অসহায়ত্ববোধের যেসব প্রকাশ (লক্ষণ) পর্যবেক্ষণ করেন, সেগুলোর সঙ্গে মানুষের বিষণ্ণতার লক্ষণের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন :

  • (১) বিষণ্ণতায় আক্রান্ত অনেক মানুষের মত গবেষণাগারের প্রাণীদেরও পীড়নমূলক উদ্দীপকের প্রতি নিষ্ক্রিয় (passive) থাকতে দেখা যায়। এবং যেসব প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে পীড়নমূলক পরিস্থিতির মোকাবেলা করা সম্ভব হত সে ধরনের প্রতিক্রিয়া করতে ব্যর্থ হয়।
  • (২) তাদের খাদ্যগ্রহণের সমস্যা হয়, এমনকি যা খায় তাও পেটে রাখতে পারে না এবং ক্রমশঃ তাদের ওজন কমে যায়।
  • (৩) মানুষের বিষণ্ণতার জন্য যে স্নায়বিক বার্তাবাহক (neurotransmitter) পদার্থটির অভাবকে দায়ী করা হয় (অর্থাৎ এপিনেফ্রিন) সেলিগম্যানের প্রাণীদের মধ্যেও সেই পদার্থটির ঘাটতি বা কমতি হতে দেখা গেছে।

দোষ আরোপকরণ ও অর্জিত অসহায়ত্ব (Attribution and learned Helplessness)

সেলিগম্যানের গবেষণার পর অসহায় আচরণকে ব্যাখ্যা করার জন্য মানুষদের নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ১৯৭৮ সনের দিকে অর্জিত অসহায়ত্ব তত্ত্বের অনেকগুলো ত্রুটি নির্ণয় করা হয় এবং দেখা যায় যে এই তত্ত্বের মাধ্যমে বিষণ্ণতার সবগুলো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেজন্য ১৯৭৮ সালে এব্রামসন, সেলিগম্যান এবং টিসডেল (Abramson. Seligman and Teasdale, 1978) অর্জিত অসহায়ত্ব তত্ত্বের সংশোধন করেন। মানুষের উপর পরিচালিত কিছু সংখ্যক গবেষণায় দেখা যায়, অসহায়ত্ব সৃষ্টি করা হলে পরবর্তীকালে তাদের কার্যসম্পাদনের উন্নতি ঘটে। তাছাড়া যারা বিষণ্ণতায় ভোগে তাদের অনেকেই তাদের ব্যর্থতা এবং হতাশার জন্য নিজেদেরকে দায়ী করে। তাদের মধ্যে যদি অসহায়ত্ববোধই সৃষ্টি হত, তাহলে তারা তাদের ব্যর্থতার জন্য নিজেদের দায়ী করবে কেন? অসহায়ত্বের সংশোধিত তত্ত্বে এট্রিবিউশন (attribution) বা দোষ আরোপ করণের ধারণাটির মাধ্যমে বিষণ্ণতার আচরণকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সংশোধিত তত্ত্বে বিষণ্ণতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য শিক্ষণের উপাদান ও জ্ঞানীয় উপাদানকে একযোগে ব্যবহার করা হয়েছে। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, একটি পরিস্থিতিতে ব্যক্তি যখন হতাশ হয় (লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়) তখন সে ওই ব্যর্থতার জন্য একটি কারণকে দায়ী করতে চায়। নিচের ছকে এই তত্ত্ব অনুসারে গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড পরীক্ষায় (GRE) একটি ছাত্র অঙ্কে ফেল করে সে কিভাবে এ ঘটনাটির জন্য একটি কারণকে দায়ী করে তা দেখানো হয়েছে –

বিষণ্ণতার কারণ ব্যাখ্যায় বিভিন্ন ধরনের দোষ দেওয়ার স্কীম বা নকশা : আমি কেন জিআরই গণিতে (GRE Math) ফেল করলাম?

মাত্রা (Degree)  অভ্যন্তরীণ/ব্যক্তিগত   বাহ্যিক/পরিবেশগত 
  স্থায়ী   অস্থায়ী   স্থায়ী  অস্থায়ী 
সামগ্রিক (Global)  আমার বৃদ্ধি নেই  আমি ক্লান্ত  এসব পরীক্ষা সঠিকভাবে হয়না  আজ একটি অশুভ তারিখ ১৩ই ফেব্রুয়ারি, শনিবার 
নির্দিষ্ট ( Specific)  গণিতে আমার ক্ষমতা নেই  আমি গণিতের ব্যাপারে ক্লান্ত  গণিতের পরীক্ষা সঠিকভাবে হয়না  আমার পরীক্ষার রোল নং ছিল ১৩, অশুভ সংখ্যা 

এই তত্ত্বটি তিনটি প্রশ্নের উত্তরের উপর ভিত্তি করে তৈরী করা হয়েছে :

  • (১) ব্যক্তি কি ব্যর্থতার কারণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ (ব্যক্তিগত) নাকি বাহ্যিক (পরিবেশগত) কারণকে দায়ী করে?
  • (২) সমস্যাটি কি স্থায়ী না অস্থায়ী?
  • (৩) ব্যক্তি সাফল্যের অক্ষমতাকে বিশেষভাবে দেখে নাকি সামগ্রিকভাবে (Global) দেখে?

অসহায়ত্বের জন্য দায়ীকরণ (Attributional theory) তত্ত্বে মনে করা হয় যে, হতাশার পরিণতি কি হবে তা নির্ভর করে ব্যক্তি তার ব্যর্থতার জন্য কাকে দায়ী করছে বা ব্যর্থতাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করছে তার উপর –

  • ব্যক্তি যদি একটি সামগ্রিক (Global) ব্যাখ্যা দেয় (যেমন, আমি কখনও কোন জিনিস ভালভাবে করতে পারি না) তাহলে হতাশার ফলাফলের সামান্যীকরণ বা সাধারণীকৃত হওয়ার সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করে;
  • স্থায়ী শর্তকে দায়ী করলে (যেমন আমি গনিতে কখনও ভাল করি না), ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে;
  • আর ব্যর্থতার জন্য ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যকে দায়ী করলে (যেমন আমি বোকা — I am stupid) ব্যক্তির আত্মমর্যাদায় হানি ঘটে। বিশেষ করে যদি ব্যক্তির ব্যক্তিগত কারণটি (দোষটি) স্থায়ী হয়, এবং সামগ্রিক হয়।

সুতরাং এই তত্ত্ব অনুসারে, যখন ব্যক্তি তার জীবনের নেতিবাচক ঘটনাগুলোর জন্য স্থায়ী এবং সামগ্রিক কারণকে (Glabal causes) দায়ী করে, তখনই ব্যক্তি বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। আত্মমর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে কিনা তা নির্ভর করে তারা নেতিবাচক ঘটনাটির জন্য তাদের ব্যক্তিগত অক্ষমতাকে দায়ী করছে কিনা তার উপর। অর্থাৎ যারা জীবনের নেতিবাচক ঘটনাবলীর জন্য তাদের চরিত্রের ব্যক্তিগত সামগ্রিক ও স্বায়ী বৈশিষ্ট্যগুলোকে দায়ী করে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। কোন ব্যক্তির মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা থাকলে (diathesis) সে যদি পীড়নমূলক ঘটনার সম্মুখীন হয়, তখন তার আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে এবং তার মধ্যে বিষণ্ণতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি হবে (Peterson and Seligman, 1994)।

আশাহীনতার তত্ত্ব (Hopelessness theory)

এই তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, কোন কোন ধরনের বিষণ্ণতা – যেগুলোকে আশাহীনতাজনিত বিষণ্ণতা (Hopelesness-depression) বলা হয়- সেগুলোর জন্য ব্যক্তির মধ্যে একটি আশাহীন বা নিরাশ অবস্থাকে (State of hopelessness) দায়ী করা হয়। এটি হল এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তি আশঙ্কা করে যে, আকাঙ্খিত কোন ফলাফল ঘটবে না, অথবা আশঙ্কা করে যে অনাকাঙ্খিত ফলাফল ঘটবে এবং ব্যক্তির নিকট পরিস্থিতিটি পরিবর্তন করার জন্য উপযুক্ত প্রতিক্রিয়ার উপস্থিতি নেই। (এই সংজ্ঞায় শেষের বাক্যটিতে যা বলা হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে অসহায়ত্ববোধ— যা পূর্ববর্তী দুটো তত্ত্বের মতই।) দোষ- আারোপমূলক তত্ত্বের মতই আশাহীনতার তত্ত্বেও মনে করা হয় যে, ব্যক্তি জীবনের নেতিবাচক ঘটনাগুলোর সঙ্গে (stressors) ব্যক্তিত্বের গঠন (diathesis) এর পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে ব্যক্তির মধ্যে আশাহীনতা (hopelessless) সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিত্বের গঠনের (Diathesis) একটি উপাদান হল দোষ আরোপনের প্রকৃতি (attributional pattern) — যেখানে ব্যক্তি নেতিবাচক ঘটনার জন্য স্থায়ী এবং সামগ্রিক শর্তগুলোকে দায়ী করে। ব্যক্তিত্বের আরেকটি প্রবণতা সৃষ্টিকারী উপাদান হল নিম্ন মানের আত্মমর্যাদাবোধ (Low self-esteem) এবং নেতিবাচক ঘটনার মারাত্মক পরিণতি ঘটবে বলে ব্যক্তির বিশ্বাস বা প্রত্যাশা। আশাহীনতার তত্ত্বের স্বপক্ষে Metalsky ও সঙ্গীরা (1993) পরীক্ষণমূলক প্রমাণ উপস্থিত করেছেন।

লেউইনশন ও তার সঙ্গীরা (Lewinsohn et al., 1994) তাদের গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন যে, ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্ণতামূলক দোষারোপের প্রবণতা (Depressive attributional style) এবং নিচুমাত্রার আত্মমর্যাদাবোধ— এদুটো বৈশিষ্ট্য একত্রে কিশোর ও যুবকদের মধ্যে বিষণ্ণতার পূর্বাভাস দিতে পারে। বিষণ্ণতামূলক দোষারোপের প্রবণতা বলতে বোঝায়, ব্যক্তি নেতিবাচক ঘটনার জন্য স্থায়ী এবং সামগ্রিক শর্তগুলোকে দায়ী করে। ব্যক্তি আশাহীনতায় ভোগে। এর সাথে যুক্ত হয় তার নিচুমাত্রার আত্মমর্যাদাবোধ যা ব্যক্তির মনে বিষণ্ণতামূলক বিকৃতি সৃষ্টি করে।

আশাহীনতা তত্ত্বের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এই যে, এই তত্ত্ব অনেকগুলো উদ্বেগজনিত বিকৃতি ও বিষণ্ণতাজনিত বিকৃতির সহ-অবস্থান (Co-morbidity) কে ব্যাখ্যা করতে পারে। যেমন আতঙ্কজনিত বিকৃতি (Panic disorder), জনতার ভীতি (Agoraphobia), বাধ্যতাধর্মী বিকৃতি (obsessive compulsive disorder) এবং আঘাত পরবর্তী পীড়ন জনিত বিকৃতি (PTSD)-এই সবগুলো বিকৃতির সঙ্গে বিষণ্ণতা উপস্থিত থাকতে পারে। এই ধরনের বিকৃতি যেখানে বিষণ্ণতার সঙ্গে উপস্থিত থাকে সে ধরনের বিকৃতিগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য অন্য কোন তত্ত্ব প্রযোজ্য নয়। অন্যান্য সব তত্ত্ব শুধু একটি বিকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে পারে।

বহুসংখ্যক গবেষণা থেকে এলয় ও তার সঙ্গীরা (Alloy et al. 1990) বলেছেন যে, অসহায়ত্বের প্রত্যাশা উদ্বেগ সৃষ্টি করে। যখন এই অসাহায়ত্বের প্রত্যাশা সুনিশ্চিতভাবে প্রমানিত হয়, তখন বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের মিশ্রণে কতকগুলো লক্ষণ উপস্থিত হয়। শেষ পর্যায়ে, যখন নেতিবাচক ঘটনা ঘটবার প্রত্যাশিত সম্ভাবনা সুনিশ্চিত হয় তখন আশাহীনতা শুরু হয়।

আন্তঃব্যক্তিক তত্ত্ব (Interpersonal Theory)

আন্তঃব্যক্তিক তত্ত্বে বিষণ্ণতাগ্রস্ত রোগীর সঙ্গে সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির সম্পর্ক এবং আচরণ নিয়ে আলোচনা করা হয়। সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে বিষণ্ণতাগ্রস্ত রোগীর সম্পর্ক ও আচরণের পর্যবেক্ষণ থেকে এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে যেগুলো বিষণ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্য বা সুস্থতা তার সামাজিক সমর্থনের উপরে অনেকখানি নির্ভর করে। এই ধারণাটি বিষণ্ণতার রোগীদের বেলায়ও প্রযোজ্য। বিষণ্ণ ব্যক্তিদের সামাজিক যোগাযোগ বেশ বিচ্ছিন্ন থাকে। অর্থাৎ তারা সামাজিক সম্পর্কের জটিল বুনন (net work) বা যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে কোন সামাজিক সমর্থন পায় না। সামজিক সমর্থন কমে গেলে ব্যক্তির নেতিবাচক ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা কমে যায়, এবং ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয় (Billings, Cronkite & Moos, 1983)। কয়েন (Coyne, 1976) এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিষণ্ণ ব্যক্তিরা অন্যান্য ব্যক্তিদের নিকট থেকে ঋণাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিষণ্ণতাগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে অন্যান্য ব্যক্তিদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে : যেমন টেলিফোনে আলাপ করা, বিষণ্ণতার রোগীদের অডিও টেপ দেখা/শোনা, এমন কি বিষণ্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে মুখোমুখী আলোচনা করা।

সব ধরনের পরিস্থিতিতেই দেখা গেছে যে, বিষণ্ণ লোকদের আচরণ অন্যান্য ব্যক্তিদের নিকট প্রত্যাখ্যাত হয়। “Behaviour of depressed people elicits rejection from others” (Coyne, 1976)। গবেষণা লব্ধ তথ্য থেকে দেখা যায়, বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ছাত্রদের সহপাঠীবৃদ্ধ, যারা একই কক্ষে অবস্থান করে তাদের কম আনন্দ মুখর এবং বেশি আক্রমণাত্মক মনে করে। যারা মৃদু বিষণ্ণতায় আক্রান্ত তারা তাদের বন্ধুগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয় (Joiner, Alfano & Metalsky, 1989)। অন্য কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায় যে, বিষণ্ণতা এবং বৈবাহিক জীবনের বিশৃঙ্খলা সহ-সম্পর্কযুক্ত এবং স্বামী স্ত্রী উভয়েই পরস্পরের প্রতি ক্রুদ্ধ আচরণ করে। যেসব দম্পতির যেকোন একজন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত তারা, যাদের একজনের মধ্যেও এধরনের অসুস্থতা নেই তাদের তুলনায় বিবাহিত জীবনে বেশি অসুখী।

বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে সমাজে একজন ব্যক্তি যে প্রত্যাখ্যাত হয়, এটা কি তার ভাগ্য? এটা হয়তঃ সত্যি, কিন্তু এই ভাগ্যের জন্য তারাও কম দায়ী নয়। যারা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয় তাদের সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের দক্ষতা কম থাকে। যেমন, তাদের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সম্পর্কের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কম থাকে, তাদের কথাবার্তা বলার ধরণ ভিন্ন থাকে যেমন তারা ধীরে ধীরে কথা বলে, কথা বলার সময় আমতা আমতা করে, দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। নিজেদের নেতিবাচক দিকগুলো উন্মোচন করে (Negative self disclosure) এবং তারা চোখের দিকে তাকায়না। হাম্মেন (Hammen, 1991) বলেছেন যে, যারা বিষণ্ণতায় ভোগে তারা সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রচুর পীড়নের সম্মুখীন হয়, এবং তাদের নিজেদের আচরণ থেকেই এই পীড়নের সৃষ্টি হয়। সামাজিক সম্পর্কে দক্ষতার অভাব এবং এর ফলাফল থেকে যে বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয় তা নিম্নলিখিত গবেষণামূলক তথ্য থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে :

  • (ক) যেসব প্রাথমিক স্কুলবয়সী ছেলেমেদের পিতামাতা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত, তাদের বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষকবৃন্দ তাদের নেতিবাচক মূল্যায়ন করে (Weintraub, Liebert, Neale, 1975)।
  • (খ) প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের মধ্যে দেখা গিয়েছে যে, যেসব শিশুর সামাজিক দক্ষতা কম, তাদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্যদের তুলনায় বেশি (Cole et al., 1996)।
  • (গ) সামাজিক পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার দক্ষতা কম থাকলে কৈশোরে অথবা বয়ঃসন্ধিতে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে (Davila et al., 1995 )।

সুতরাং এসব গবেষণা থেকে সামাজিক দক্ষতার অভাবকে বিষণ্ণতার একটি কারণ হিসাবে দায়ী করা যায়।

দ্বিমুখী বিকৃতির মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব (Psychological Theories of Bipolar Disorders)

মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দ্বিমুখী বিকৃতির উপর তেমন নজর দেওয়া হয়নি। দ্বিমুখী বিকৃতির বিষণ্ণতাকে ব্যাখ্যার জন্য যে তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো একমুখী বিষণ্ণতার তত্ত্বের মতই। হর্ষোন্মত্ত পর্যায়কে একটি মারাত্মক মানসিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা হয়। তবে ঠিক কোন নেতিবাচক অবস্থাটি ব্যক্তি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছে বা বর্জন করতে চেষ্টা করছে তা বিভিন্ন তত্ত্বের বেলায় আলাদা। তবে বহু সংখ্যক ব্যক্তি-ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, দ্বিমুখী বিকৃতির রোগীদের হর্ষোম্মত্ত পর্যায়টি একটি প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করে। ডেভিসন ও নীয়েলের (1998) একজন রোগীর ব্যক্তি ইতিহাস ছিল নিম্নরূপ :

একজন ৪২ বৎসর ব্যক্তি তৃতীয় বারের মত হর্ষোম্মত্ততায় আক্রান্ত হয়। প্রত্যেকবার হর্ষোন্মত্ততায় আক্রান্ত হওয়ার পর সে হর্ষোন্মত্ততার অতি পরিচিত লক্ষণগুলোই প্রকাশ করেছে। এবং তার হর্ষোন্মত্ত পর্যায়ের ভ্রান্তবিশ্বাসগুলো জাকজমকপূর্ণ ছিল। সে বিশ্বাস করত যে, সে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী। একবার চিকিৎসা শুরু করার আগে সে বলেছিল, ” আপনি কি শুনেছিলেন যে আমি আজই ২০টি কোম্পানী কিনে নিয়েছি? ”এমন কি গেট্টি বা রকেফেলারেরও আমার চেয়ে বেশি সম্পত্তি নেই।” মনোচিকিৎসার অধিবেশনগুলো চলাকালে এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, এই লোকটির সবচেয়ে বড় চিন্তা ও চাহিদা ছিল ব্যবসায়ের সাফল্যকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সে সফল হতে পারেনি। তার পিতামাতা তাকে ব্যবসা কোম্পানী নতুন করে শুরু করার জন্য বেশ কয়েকবার টাকা দিয়েছে কিন্তু প্রত্যেকবার সে দেউলিয়া হয়েছে। সে তার পিতার মত সফল ব্যবসায়ী হবে— এটা ছিল তার স্বপ্ন এবং কিভাবে বড় ব্যবসায়ী হবে এ চিন্তা তাকে পেয়ে বসেছিল। কিন্তু ক্রমে সবগুলো সুযোগ তার হাতছাড়া হয়ে যায়। সুতরাং মনে হচ্ছিল যে তার জাকজমকপূর্ণ ভ্রান্তবিশ্বাসটি (অর্থাৎ সে যে পৃথিবীর সেরা ধনী ব্যক্তি হয়ে গেছে) তাকে ব্যবসায়িক ব্যর্থতার গ্লানি থেকে রক্ষা করছে। কারণ সে এই বাস্তব সত্যের মুখোমুখী হলে তার গভীর বিষণ্ণতা দেখা দিত। (Davison & Neale, 1998)

যারা দ্বিমুখী বিকৃতিতে ভোগে তাদের সম্পর্কে চিকিৎসামূলক অভিজ্ঞতা থেকে এবং তাদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে দেখা যায় যে, দুটি পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময়ে তারা মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক এবং অভিযোজিত অবস্থায় যাকে। কিন্তু হর্ষোন্মত্ততাকে যদি একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা যায় তাহলে প্রশ্ন হল, কিসের বিরুদ্ধে তাদের এই প্রতিরক্ষা? তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুটি উপাখ্যানের মধ্যবর্তী অবস্থায় তাদের স্বাভাবিক মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে তারা তা নয়। উইন্টারস্ ও নিয়েল (Winters and Neale 1985) বিশেষভাবে নির্মিত অভীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, এমনকি দুটি উপাখ্যানের (পর্যায়ের) মধ্যবর্তী সময়েও হর্ষোন্মত্ততার রোগীদের আত্মমর্যাদা নিচুমানের থাকে।”

একদল দ্বিমুখী বিকৃতির রোগী- যারা বর্তমানে সুস্থ, একদল একমুখী বিষণ্ণতার রোগী, এবং একদল স্বাভাবিক লোককে একটি আত্মমর্যাদার প্রশ্নগুচ্ছ এবং বিশেষভাবে নির্মিত একটি স্মৃতির অভীক্ষা দেওয়া হয়। দ্বিতীয় অভীক্ষাটির উদ্দেশ্য ছিল হর্মোন্মাদ ব্যক্তিদের আত্মমর্যাদাবোধ সূক্ষভাবে পরিমাপ করা।

স্মৃতির অভীক্ষায় ব্যক্তিদের কতকগুলো ঘটনার বিবরণ পড়তে দেওয়া হয়। এসব ঘটনার ধনাত্নক অথবা ঋণাত্নক ফলাফল হতে পারে। পরে তাদের একটি স্মৃতির পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেকটি গল্প স্মরণ করতে বলা হয়। স্মৃতির পরীক্ষায় কিছু প্রশ্ন ছিল যেগুলো ছিল তথ্যভিত্তিক, বা ঘটনার বাস্তব বিবরণ সম্বলিত। কিন্তু কিছু সংখ্যক প্রশ্ন এমন ছিল যে, সেগুলোর উত্তর দিতে গেলে প্রদত্ত তথ্যের বাইরে গিয়ে কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। অর্থাৎ কিছু অনুমান করতে হবে। যেমন একটি গল্প ছিল এমন যে, একজন ব্যক্তির বর্তমানে কোন কাজ নেই (বেকার)। গল্পে ব্যক্তির বেকার থাকার কোন কারণ বর্ণনা করা হয়নি।

কিন্তু গল্পটি এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যে যেকোন ধরনের একটি অনুমান করা যায়। কেউ অনুমান করতে পারে যে ব্যক্তিটির বেকার থাকার জন্য সে নিজে দায়ী নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থাই তার জন্য দায়ী। আবার কেউ অনুমান করতে পারত যে, ব্যক্তিটির কাজের ইতিহাস খারাপ থাকায় সে কোন কাজ পাচ্ছে না। যাদের আত্মমর্যাদা (Self esteem) কম তারা দ্বিতীয় ধরনের উত্তর দিবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল।

ফলাফলে বাস্তবিক পক্ষে তাই পাওয়া গেল। আত্মমর্যাদার অভীক্ষার (প্রশ্নগুচ্ছের) ফলাফলে দেখা গেল, স্বাভাবিক ব্যক্তিরা এবং হর্ষোন্মাদ ব্যক্তিরা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে। কিন্তু স্মৃতির পরীক্ষায়, হর্ষোন্মাদ ব্যক্তিরা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমান নম্বর পেয়েছিল। অর্থাৎ তারা উভয়েই বেকারত্বের এমন কারণ নির্দেশ করেছিল যাতে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তাদের আত্ম-মর্যাদাবোধ কম। অর্থাৎ যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, হর্ষোন্মত্ততায় আক্রান্ত রোগীদের আত্ম-মর্যাদাবোধ (Self-esteem) খুব কম হতে পারে। তবে, সাধারণত তারা অক্ষমতাবোধকে সফলভাবে প্রতিরোধ করে হর্ষোন্মত্ততা থেকে আত্মরক্ষা করে। “Thus the self esteem of manic individuals may be very low. Generally, however, they successfully defend against their feeling of Inadequacy without becoming manic.” (Davison and Neale, 1998)।

মেজাজের বিকৃতির জৈবিক তত্ত্ব (Biological Theories of Mood Disorders)

মেজাজের পরিবর্তণের সঙ্গে যেহেতু জৈবিক প্রক্রিয়াসমূহের সম্পর্ক রয়েছে, সেহেতু বিষণ্ণতা, হর্বোন্নত্ততা, এবং দ্বিমুখী বিকৃতির জন্য বংশগত উত্তরাধিকার, মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থের অস্বাভাবিকতা, স্নায়বিক বিকৃতি ইত্যাদি কারণকে দায়ী করা হয়েছে। এগুলো এখানে আলোচনা করা হল।

স্নায়ু রসায়ন (Neuro chemistry)

বিগত কয়েক দশক ধরে গবেষকগণ মেজাজের বিকৃতিতে (Mood Disorders) স্নায়বিক বার্তাবাহক (neurotransmitter) পদার্থের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন। সবচেয়ে বেশি গবেষণা করা হয়েছে দুটি পদার্থ নিয়ে – (১) নর-এপ্রিনেফ্রিন (Norepinephrine), (২) সেরোটনিন (Serotonin)। দ্বিমুখী বিকৃতির (Bipolar Disorder) ব্যাখ্যায় নর-এপিনেফ্রিনের ভূমিকা সম্পর্কিত তত্ত্বটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতে বলা হয়েছে যে, শরীরে নর-এপ্রিনেফ্রিনের মাত্রা কম হলে বিষণ্ণতা ও উচ্চ তীব্রতা সম্পন্ন হর্ষোম্মত্ততা দেখা দেয়। সেরোটনিন সম্পর্কিত তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, শরীরে সেরোটনিনের মাত্রা কমে গেলে বিষণ্ণতা দেখা দেয়। এ দুটি তত্ত্বের জন্ম হয়েছিল বিষণ্ণতার চিকিৎসায় উল্লিখিত ঔষধগুলো ব্যবহারের ফলশ্রুতি হিসেবে। ১৯৫০ সালের দিকে আবিষ্কৃত হয় যে, ত্রি-চক্র বিশিষ্ট ঔষধ (Tricyclics) এবং মনো-এমাইন এক্সাইডেজ অবদমনকারী (Monoamine oxidase inhibitors)-এই দুই শ্রেণীর ঔষধ বিষণ্ণতা দূর করতে পারে।

ত্রি-চক্রবিশিষ্ট ঔষধগুলোর এ নাম হওয়ার কারণ হল এসব ঔষধের রসারায়নিক গঠনে তিনটি অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত চক্র (ring) পাওয়া যায়। এই ঔষধগুলো বিষণ্ণতা কমাতে পারে বলে এগুলোকে বিষণ্ণতা-বিরোধী ঔষধ (antidepressants) বলা হয়। স্নায়ু প্রবাহ একবার সৃষ্টি হওয়ার পর এই ঔষধগুলো স্নায়ুসন্ধির পূর্ববর্তী স্নায়ুকোষ কর্তৃক পুনরায় নর-এপিনেফ্রিন ও সেরোটনিন গ্রহণের মাত্রা কমিয়ে দেয়, এর ফলে স্নায়ুসন্ধিতে বেশি পরিমাণ বার্তাবাহক পদার্থ (neurotransmitter) থেকে যায়, যা পরবর্তী স্নায়ু প্রবাহের সঞ্চালনকে সহজতর করে। মনোএমাইন অক্সাইডেজ অবদমনকারী ঔষধসমূহ (MAOI) ব্যবহারের ফলে স্নায়ুসন্ধিতে নরএপিনেফ্রিন, ডোপামিন এবং সেরোটনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ জন্যই মনোএমাইন অক্সাইডেজ অবদমনকারী ঔষধগুলো বিষণ্ণতাকে দূর করে। অর্থাৎ এ ঔষধগুলো মনোএমাইন অক্সাইডেজ নামক এনজাইমকে অবদমন করার মাধ্যমে স্নায়ুসন্ধিতে সেরোটনিন এবং নরএপিনেফ্রিনের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করে।

উল্লিখিত ঔষধসমূহের কার্যকারিতার জন্য ধারণা করা হচ্ছে যে, বিষণ্ণতাও হর্ষোন্মত্ততা সেরোটনিন ও নর-এপিনেফ্লিনের সক্রিয়তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কয়েকটি নতুন ঔষধ যেমন ফ্লুক্সেটিন (fluoxetin) যা প্রোজাক (Prosac) নামে বাজারজাত করা হয়- এগুলো পূর্ববর্তী ঔষধগুলোর তুলনায় আরো সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করে। বিশেষ করে এগুলো সেরোটনিনের পুনরায় গ্রহণকে (re-uptake) রোধ করে। যেহেতু এই ঔষধগুলো একমুখী বিকৃতিতে (unpolar disorder) বেশি ফলপ্রসূ সেজন্য সেরোটনিনের মাত্রার সাথে বিষণ্ণতার সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এসব তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়, অন্য কতকগুলো গবেষণা থেকে। বানি ও মারফির (১৯৭০) গবেষণায় দেখা যায় যে, দ্বিমুখী বিকৃতিতে আক্রান্ত রোগীরা যখন বিষণ্ণতায় ভোগে তখন তাদের প্রস্রাবে নর-এপিনেফ্রিনের মাত্রা কমে যায়, আবার তারা যখন হর্ষোম্মত্ত অবস্থায় থাকে তখন তাদের প্রস্রাবে নর-এপিনেফ্রিনের মাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু এধরনের তথ্যের ব্যাখ্যার একটি অসুবিধা হল এই যে, প্রস্রাবে নর-এপিনেফ্রিনের এই বৃদ্ধি ব্যক্তিদের কর্মতৎপরতার বৃদ্ধির ফলেও ঘটতে পারে। অর্থাৎ হর্ষোম্মত্ততায় কর্মতাৎপরতার যে বৃদ্ধি ঘটে তার ফলে নরএপিনেফ্রিনের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, দ্বিমুখী বিকৃতির রোগীদের মধ্যে হর্ষোম্মত্ততা দেখা দেয়ার পূর্বমুহূর্তে নর-এপিনেফ্রিনের মাত্রা বেড়ে যায়। নর-এপিনেফ্রিন ভেঙ্গে গেলে যে পদার্থগুলো তৈরী হয় সেগুলো পরীক্ষা করেও উল্লিখিত তত্ত্বের সমর্থন পাওয়া গেছে।

অতি সাম্প্রতিককালের গবেষণায় জি-প্রোটিন (G-Protein) নামক এক ধরণের আমিষ অণুর সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো সন্ধি-উত্তর কোষের আবরণীতে অবস্থান করে। এই প্রোটিনগুলো সন্ধিপূর্ব কোষ থেকে সন্ধি-উত্তর কোষের মধ্যে স্নায়ুপ্রবাহ সঞ্চালিত করে এবং স্নায়বিক সংকেতকে পরিববন্ধন করে। হর্ষোম্মত্ততায় আক্রান্ত রোগীদের শরীরে উচ্চমাত্রায় জি-প্রোটিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। হর্ষোম্মাদ রোগীদের জন্য লিথিয়াম (Lithium) ভাল কাজ দেয়। এর কারণ হল লিথিয়াম জি-প্রোটিনের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে (Manji, et al., 1995)।

হরমোন ও স্নায়বিক তন্ত্র (Neuro-endocrine system)

বিষণ্ণতায় অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মস্তিষ্কের সীমান্ত তন্ত্র বা লিমবিক সিস্টেম (Limbic system) আবেগের সঙ্গে জড়িত। লিমবিক সিস্টেমের সঙ্গে হাইপোথ্যালামাসের যোগাযোগ রয়েছে। হাইপোথ্যালামাস বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির কাজ নিয়ন্ত্রণ করে এবং এসব গ্রন্থি থেকে কি পরিমাণ হরমোন তৈরী হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। হাইপোথ্যালামাস যেসব হরমোন তৈরী করে সেগুলো আবার পিটুইটারী গ্রন্থির হরমোন ক্ষরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিষণ্ণতায় যেসব শারীরিক লক্ষণ দেখা যায় যেমন, খাদ্যে অনীহা, ঘুমের ব্যাঘাত (অতিনিদ্রা বা অল্পনিদ্রা)-এগুলোর জন্য হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারী ও এড্রেনাল কর্টেক্স-এই সংগঠনগুলোর অতিরিক্ত সক্রিয়তাকে দায়ী করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এ তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন, বিষণ্ণতার রোগীদের শরীরে কর্টিসলের (Cortisol) মাত্রা বেশি থাকে। হাইপোথ্যালামাসের উত্তেজনা থাইরোট্রপিন যুক্তকারী হরমোন বৃদ্ধি করে, এবং তা কর্টিসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। (এড্রেনাল কর্টেক্স থেকে কর্টিসল উৎপন্ন হয়)। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীদের কর্টিসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার দরুণ তাদের এড্রেনাল গ্রন্থি বড় হয়ে যায়। সুতরাং অতিরিক্ত বিষণ্ণতার রোগীদের শনাক্ত করার জন্য ডেক্সামেথাসোন অবদমন পরীক্ষা (Dexamethasone suppression Test) ব্যবহার করা যায়। ডেক্সামেথাসোন ইনজেকশন দেওয়া হলে কর্টিসল উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিষণ্ণতার রোগীদের, বিশেষ করে যারা মেলাঙ্কেলিয়ায় আক্রান্ত, তাদের এই পদার্থটির মাধ্যমে এক রাত্র ব্যবধানে পরীক্ষা করা হলে তাদের মধ্যে কর্টিসলের পরিমাণ কমতে দেখা যায় না। এর অর্থ হল ডেক্সামেথাসোন কর্টিসলের পরিমাণ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ হাইপোথ্যালাথাস-পিটাইটারী এবং এড্রেনাল কর্টেক্স অতিরিক্ত সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু বিষণ্ণতা কেটে গেলে উক্ত পদার্থটি (ডেক্সামেথাসোন) আবার স্বাভাবিকভাবে কাজ করে।

কুশিং-এর লক্ষণ (Cushins’s syndrome) সংক্রান্ত গবেষণা থেকেও বিষণ্ণতার সঙ্গে উচ্চমাত্রার কর্টিসলের সম্পর্ক পাওয়া গেছে। এড্রেনাল কর্টেক্স-এর ওপরে টিউমার (tumour) হলে কর্টিসল ক্ষরণের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং বিষণ্ণতার লক্ষণ দেখা দেয়। তাছাড়া উচ্চমাত্রায় কর্টিসল নিঃসৃত হলে সেরোটনিন গ্রহণকারী কোষের সংখ্যা কমে যায়। (“High levels of cortisol may lower the density of serotonin receptors” Roy et al., 1987) এবং নর-এড্রিনালিন গ্রাহক কোষের কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত করে। অবশেষে আরো তথ্য থেকে মনে হয় দ্বিমুখী বিষণ্ণতায় হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারী এবং থাইরয়েড গ্রন্থির সম্মিলিত ক্রিয়ারও অবদান রয়েছে। দ্বিমুখী বিকৃতির রোগীদের থাইরয়েড গ্রন্থির ক্রিয়ায় গোলযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব রোগীদের থাইরয়েড হরমোন ইনজেকশন দিলে হর্ষোন্মত্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। এসব তথ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বিষণ্ণতার জন্য জৈবিক শর্তগুলো দায়ী। তবে এসব জৈবিক শর্ত আচরণে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে তা ব্যাখ্যা করার জন্য মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো আমাদের সাহায্য করতে পারে।

মেজাজের বিকৃতির চিকিৎসা (Therapies For Mood Disorders)

মনোসমীক্ষণমূলক চিকিৎসা (Psychoanalytic therapy)

(১) মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব অনুসারে মনে করা হয় যে, ব্যক্তির হতাশা, কোন কিছু হারানোর বেদনা বা রোধ যখন বহির্মুখী না হয়ে ব্যক্তির নিজের প্রতি ধাবিত হয়, তখনই বিষণ্ণতা দেখা দেয়। সেজন্য মনোসমীক্ষণ পদ্ধতির চিকিৎসায় ব্যক্তির অবদমিত দ্বন্দ্বগুলোর প্রতি অর্ন্তদৃষ্টি লাভ করতে ব্যক্তিকে সাহায্য করতে হয়, এবং ব্যক্তির নিজের প্রতি ক্রোধকে বাইরে প্রকাশ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। মনোসমীক্ষণ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির প্রচ্ছন্ন তাগিদ/চাহিদাগুলোকে জানা- যেগুলো তার বিষণ্ণতার জন্য দায়ী। উদাহরণ স্বরূপ, একজন হয়তঃ তার মা-বাবা তাকে স্নেহ করে না বলে নিজের উপর দোষ দিতে পারে। কিন্তু এই বিশ্বাস তার মধ্যে বেদনা ও ক্রোধ সৃষ্টি করে বলে সে তা অবদমন করে। চিকিৎসক রোগীকে এমনিভাবে পরিচালিত করবেন যেন সে তার ঐ অবদমিত বিশ্বাসটির সম্মুখীন হতে পারে। তারপর তিনি রোগীকে সাহায্য করবেন যাতে সে বুঝতে পারবে যে তার অপরাধবোধটি অযৌক্তিক। রোগীর শৈশবের যেসব বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে অক্ষমতাবোধ ও হতাশা জন্ম নিয়েছে সেগুলো পুনরুদ্ধার করা হলে অসুখ ভাল হয়ে যেতে পারে। তবে মনোসমীক্ষণ পদ্ধতিতে বিষণ্ণতা দূর হয় কিনা, বা রোগটি সেরে যায় কিনা এ বিষয়ে তেমন কোন গবেষণা হয়নি। মনোসমীক্ষণ পদ্ধতিসমূহের মধ্যে প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। একারণে এ পদ্ধতিগুলোর সাফল্য যাচাই করা কঠিন।

(২) তবে আন্তঃব্যক্তিক চিকিৎসা (Interpersonal Theriapy= IPT) নামে একটি বিশেষ ধরনের মনোসমীক্ষণ পদ্ধতির কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। এই পদ্ধতিটি প্রবর্তন করেছেন ক্লারম্যান ও ওয়াইজম্যান (Klerman and Weissman)। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিক পরিবেশের বর্তমানকালের পারস্পরিক ক্রিয়ার উপরে গুরুত্ব আরোপ করেন। এই পদ্ধতিটি একমুখী বিষণ্ণতার চিকিৎসায় কার্যকরী এবং ফলাফলের উন্নতি ধরে রাখতে সক্ষম। এই পদ্ধতির মূল কৌশলটি হচ্ছে যে, রোগীর যেসব আচরণ সামাজিক সম্পর্ক থেকে আনন্দ উপভোগ করতে বাধা দেয়, রোগীকে সেগুলো পরীক্ষা করতে সাহায্য করা। উদাহরণস্বরূপ, রোগীকে শেখানো যায় যে, সে কিভাবে কথাবার্তা বললে সহজে তার চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে এবং কিভাবে আচরণ করলে সামাজিক সম্পর্কগুলো সন্তোষজনক এবং সমর্থনমূলক হবে।

জ্ঞানীয় ও আচরণমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি (Cognitive And Behaviour Therapy)

জ্ঞানীয় তত্ত্ব অনুসারে মনে করা হয় যে, বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীর গভীর দুঃখবোধ এবং আত্মমর্যাদা বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হল ঐসব ব্যক্তির ভুল/ত্রুটিপূর্ণ চিন্তাধারা। বেক ও তার সঙ্গীরা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনুপযোগী চিন্তাধারা পরিবর্তন করার জন্য একটি জ্ঞানীয় চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে হলে চিকিৎসক বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে এবং ব্যক্তির নিজের সম্মন্ধে রোগীর যেসব মতামত থাকে সেগুলো বদলাতে চেষ্টা করেন। যেমন, একজন রোগী যখন বলে যে সে একটি অপদার্থ লোক। কারণ, তার কোন কাজই সঠিকভাবে হচ্ছে না, এবং সে যে কাজেই হাত দেয় তাই নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে চিকিৎসক কতকগুলো বিপরীত দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন যেগুলোতে ব্যক্তি কিছু না কিছু সাফল্য পেয়েছে, বা তিনি তার অন্যান্য ক্ষমতাগুলো সম্মন্ধে তাকে অবহিত করেন যেগুলো রোগী এড়িয়ে গেছে। তাছাড়া, চিকিৎসক আরো উপদেশ দেন যাতে রোগী তার ব্যক্তিগত বা গোপনীয় স্বগতোক্তি এবং চিন্তাগুলোকে পরীক্ষা করতে পারে যেগুলো বিষণ্ণতায় অবদান রাখতে পারে। তারপর চিকিৎসক রোগীকে শিখিয়ে দেন যাতে সে তার নেতিবাচক চিন্তাধারাগুলোকে বিশ্লেষণ করতে পারে এবং বুঝতে পারে এগুলো কিভাবে তাকে বাস্তবধর্মী এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দিচ্ছে। বেকের চিকিৎসা পদ্ধতিতে কতকগুলো আচরণগত কৌশলকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। যেমন :

  • (১) বেক রোগীদের কিছু কাজ করতে দেন – যেমন সকালে ঘুম থেকে ওঠা, অথবা হাঁটতে বা বেড়াতে যাওয়া।
  • (২) তিনি রোগীদের কিছু দায়িত্বপূর্ণ কাজ দেন, যেগুলো সম্পন্ন করলে রোগীর ইতিবাচক বা সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা হয় এবং তারা নিজেদের সম্বন্ধে ভাল চিন্তা করতে পারে।

কিন্তু মূল চিকিৎসাটি হল জ্ঞানীয় পুনঃসংগঠন (Cognitive restructuring)- যার উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিকে আলাদাভাবে চিন্তা করতে শেখানো। বেক মনে করেন ব্যক্তির চিন্তাধারা পরিবর্তন না করে শুধু আচরণ পরিবর্তন করে স্থায়ী সুফল পাওয়া যায় না। বিভিন্ন মনোচিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে ভেষজ চিকিৎসার তুলনা করে ডেভিসন ও তার সহকর্মী (Davison and Neale, 1998) বলেছেন যে, জ্ঞানীয় চিকিৎসা পদ্ধতির ফলাফল ভাল হলেও এটি ইমিপ্রামিন (Imipramin)-এর মাধ্যমে চিকিৎসা অথবা আন্তঃসামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে চিকিৎসার (Interpersonal therapy) চেয়ে বেশি কার্যকরী কিনা তা বলা সম্ভব নয়।

জৈবিক চিকিৎসা (Biological Therapies)

অনেক ধরনের জৈবিক চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দুটি প্রধান পদ্ধতি হল তড়িতাঘাতমূলক চিকিৎসা (Electroconvulsive therapy = ECT) এবং ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা (Drug therapy) ।

তড়িতাঘাতমূলক চিকিৎসা (ECT)

সর্বপ্রথম সারলেটি (Cerletti) এবং বিনি (Bini) নামক দুজন ইটালীয় চিকিৎসক ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। সারলেটি মৃগী রোগ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি চেষ্টা করছিলেন কিভাবে কৃত্রিমভাবে মৃগী রোগের মতন মূর্ছা তৈরী করা যায়। কসাইখানা দেখতে গিয়ে তিনি সে উপায় আবিষ্কার করলেন। কসাইরা গরু-মহিষদের মাথায় বিদ্যুৎ প্রবাহ স্বল্পক্ষণের জন্য চালিত করে এসব প্রাণীকে অচেতন করত, তারপর জবাই করে ফেলত। তিনি মানুষদের নিয়েও পরীক্ষা করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন মানুষের মাথার দুই পার্শ্বে তড়িতাঘাত প্রয়োগ করে মৃগী রোগের মত মূর্ছা সৃষ্টি করা যায়। তারপর তিনি রোমে ১৯৩৮ সালে সর্বপ্রথম একজন স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগীর চিকিৎসার জন্য এ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।

এরপর থেকে স্কিজোফ্রেনিয়া এবং বিষণ্ণতার রোগীদের চিকিৎসার জন্য মস্তিষ্কের দুপাশে তড়িতাঘাত প্রয়োগে চিকিৎসা করা হচ্ছিল। পদ্ধতিটি হল এই যে, রোগীর মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ৭০ থেকে ১৩০ ভোল্ট তীব্রতাসম্পন্ন বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিত করে রোগীর মধ্যে মূর্ছা এবং অচৈতন্য অবস্থা সৃষ্টি করা হয়। আগে মাথার দুপাশে ইলেকট্রোড স্থাপন করে বিদ্যুতাঘাত দেওয়া হত যাতে বিদ্যুৎপ্রবাহ মস্তিষ্কের উভয় গোলার্ধের মধ্যদিয়ে অতিক্রম করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে শুধু একপার্শ্বে বিদ্যুতাঘাত দেওয়া হয়— যে পার্শ্বটি অপ্রধান।

পূর্বে বৈদ্যুতিক আঘাত দেওয়ার আগে রোগী সচেতন থাকত এবং জেগে থাকত। ফলে বৈদ্যুতিক আঘাত দেওয়ার সাথে সাথে মাংস পেশীতে খিঁচুনী হত, দাঁত কপাটি লাগত এমনকি অনৈচ্ছিকভাবে হাত পা ছোড়ার ফলে রোগীর হাড় ভেঙ্গে যেত। কিন্তু বর্তমানে প্রথমে রোগীকে একটি স্বল্পস্থায়ী চেতনা নাশক ঔষধ (Anesthesia) দেওয়া হয়, তারপর পেশী শ্লথ করার জন্য একটি শক্তিশালী শ্লথনকারী ঔষধ ইনজেকশান দেওয়া হয়, এবং তার পরে তড়িতাঘাত প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে রোগী অচৈতন্য হয়ে পড়ে। কিন্তু বেশি বিচুনী হয় না। রোগী স্বল্পক্ষণ পরে চেতনা ফিরে পায় কিন্তু বৈদ্যুতিক আঘাতের কথা স্মরণ করতে পারে না। কিন্তু বিদ্যুতাযাত কিভাবে স্কিজোফ্রেনিয়া এবং বিষণ্ণতা হ্রাস করে তা বলা মুশকিল। এটা সম্ভবতঃ মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত করে এবং মস্তিষ্কের কোষগুলোর বিশৃঙ্খল ক্রিয়াকে অবদমন করে। এই পদ্ধতিটি শুধু তীব্র বিষণ্ণতা এবং স্কিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়, অন্য কোন অসুখে নয়। তবে পদ্ধতিটি কষ্টদায়ক এবং রোগী সজ্ঞানভাবে সম্মতি দেয় না বলে অনেকেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত নয় বলে মনে করেন। তবে অন্যান্য চিকিৎসায় কাজ না হলে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা (Drug Therapy)

মেজাজের বিকৃতির চিকিৎসার জন্য জৈবিক ঔষধ এবং রাসায়নিক ঔষধ উভয় ধরনের ঔষধই খুব কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে এসব ঔষধ সবার জন্য কাজ করে না এবং এগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কোন কোন সময় গুরুতর হতে পারে। এগুলোর উপযুক্ত মাত্রা (Dose) নির্ধারণ করা বেশ জটিল ব্যাপার। বিষণ্ণতার কারণ অনুসন্ধানে যেসব জৈবিক শর্ত নিয়ে গবেষণা হয়েছে সেগুলো আলোচনা করতে গিয়ে তিন শ্রেণীর বিষণ্ণতা বিরোধী ঔষধের কথা বলা যায় :

  • (১) তিন-চক্র বিশিষ্ট ঔষধ- যথা ইমিপ্রামিন (টোফানিল), এমিট্রিপটাইলিন (Amitriptyline) (বিশেষমার্কা হল ইলাভিন (Elavll))।
  • (২) নির্বাচিত সেরোটনিন পুনঃগ্রহণ অবদমনকারী ঔষধ (Selective serotonin reuptake inhibitors)— যেমন, ফ্লোক্সেটিন (প্রোজাক) (Floxetin (Prozac))।
  • (৩) মনোএমাইন অক্সাইডেজ অবদমনকারী ঔষধ (Monoamaine oxidase inhibitors, সংক্ষেপে MAO inhibitors)। এ ধরনের একটি ঔষধ হল পারনেট (Parnate)।

এসব ঔষধের শ্রেণীবিভাগ, সাধারণ নাম, ট্রেডমার্ক এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিম্নোক্ত ছকে দেয়া হল :

মেজাজের বিকৃতির চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধসমূহের নাম ও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া (উৎস : ডেভিসন ও নীয়েল, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ২৪৬)

শ্রেণী  সাধারণ নাম   ট্রেডনাম  পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া 
তিনচক্র বিশিষ্ট বিষণ্ণতা (Tricyclic antidepressants)  ইমিপ্রামিন, এমিট্রিপ্টাইলিন  টোফ্রানিল, ইলাভিল (যথাক্রমে)  হৃদরোগ, পক্ষাঘাত (Stroke), রক্তচাপ কমে যাওয়া, ঝাপসা দেখা, উদ্বেগ, ক্লান্তি, পেটের গোলযোগ, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, লিঙ্গ উত্থিত না হওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া। 
মনো এমাইন অক্সাইডেজ অবদমন কারী ঔষধ (MAO inhibitors)  ট্রানিল সিপ্রোমাইন (Tranyl cypromine)  পারনেট (Parnate)  রক্তচাপের মারাত্মক বৃদ্ধি, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, মাথাঘোরা, বমিভাব ও মাথাধরা। 
নির্বাচিত সেরোটনিন পুনঃগ্রহণ অবদমনকারী (Selective serotonin reuptake inhibitors)  ফ্লোক্সেটিন (Fluoxetine)  প্রোজাক (Prozac)  নার্ভাস হওয়া, ক্লান্তি, পেটের গোলযোগ, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, অনিদ্রা। 
লিথিয়াম (Lithium)  লিথিয়াম (Lithium)  লিথিয়াম (Lithium)  শরীরের কম্পন, পেটের গোলযোগ, অঙ্গ সঞ্চালনে সমন্বয়ের অভাব, মাথা ঘোরা, হৃদ স্পন্দনের অস্বাভাবিকতা (বুক ধড়ফড় করা), ঝাপসা দেখা, ক্লান্তি। 

মনোএমাইন অক্সাইডেজ অবদমনকারী (MAO inhibitors) ঔষধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুতর হতে পারে বলে অন্যান্য ঔষধগুলোর তুলনায় এটি কম ব্যবহৃত হয়। মেজাজের বিকৃতির চিকিৎসায় মনোএমাইন অক্সাইডেজ অবদমনকারী ঔষধ ব্যতীত অন্য ঔষধগুলো বেশি জনপ্রিয়। নির্ধারিত মাত্রায় বেশ কিছুদিন (অর্থাৎ এক কোর্স) ঔষধ খেলে ৬৫% থেকে ৭০% রোগী আরোগ্য লাভ করে। তিন শ্রেণীর ঔষধের সবগুলোই স্নায়ুপ্রবাহের পরিবহন ত্বরান্বিত করে মেজাজের বিকৃতি নিরাময় করে। তবে ঔষধের মাধ্যমে আরোগ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং রোগের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। সেজন্য এসব আরোগ্য লাভের পরও ঔষধ চালিয়ে যেতে থাকলে বিষণ্ণতার পুনরাবৃত্তি বোধ করা যায়। তবে তার জন্য ইমিপ্রামিন এর মাত্রা কার্যকরী প্রাথমিক মাত্রার সমান হতে হবে (কম নয়)। সব সময়ই, বিষণ্ণতা বিরোধী ঔষধও মনোচিকিৎসা একত্রে ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। তবে একটি কথা মনে রাখা উচিত যে, এসব ঔষধ সাময়িকভাবে রোগ নিরাময় করলেও এর মূল্য কম নয়। কারণ, তীব্র বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগী আত্মহত্যা করতে পারে এবং রোগীর নিজের কষ্ট ও পরিবারের সদস্যদের যে অসুবিধা হয়, বিষণ্ণতাবিরোধী ঔষধগুলো তার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। অনেক মনোচিকিৎসক মনে করেন ঔষধ ব্যবহার না করাই ভাল। কারণ রোগীটি মনোচিকিৎসার মাধ্যমেও আরোগ্য লাভ করতে পারে এবং ঔষধ ব্যবহার ছেড়ে দিলে রোগটির পুনরাবৃত্তি হওয়ার যে সম্ভাবনা থাকে তা এড়ানো যায় এবং ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়।

যাদের মেজাজ ওঠানামা করে বা চক্রাকারে আবর্তিত হয়, যেমন দ্বিমুখী বিকৃতি, সেসব রোগীদের জন্য লিথিয়াম (Lithium) একটি ভাল ঔষধ। এটি লিথিয়াম কার্বনেট (Lithium Carbonate) লবণ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। এই ঔষধটি ব্যবহারে দ্বিমুখী বিকৃতিতে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৮০% রোগী মোটামুটি আরোগ্য লাভ করে। এই ঔষধটি বিষণ্ণতা ও হর্ষোন্মত্ততা উভয় অবস্থায়ই আবেগের প্রশমন ঘটায়। সেজন্য এটি একমুখী বিষণ্ণতার চেয়ে দ্বিমুখী বিকৃতিতে বেশি উপযোগী। কিন্তু লিথিয়াম যেহেতু ধীর ধীরে কার্যক্ষমতা প্রকাশ করে, সেজন্য প্রথমে চিকিৎসা শুরু করার সময় অনেকে লিথিয়ামের সাথে একটি সাইকোসিস-বিরোধী ঔষধ, যেমন হ্যালডল (Haldol) ব্যবহার করেন। এতে দ্রুতগতিতে আবেগের প্রশমন ঘটে। লিথিয়াম গ্রহণ করা ছেড়ে দিলে হর্ষোন্মত্ততার পুনরাবির্ভাব ঘটে। সেজন্য লিথিয়াম দীর্ঘদিন গ্রহণ করতে হয়। তবে রক্তে এর বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে মাঝে মাঝে রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। এই ঔষধটির ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যেসব রোগী লিথিয়ামের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে পারে না, তাদের জন্য, যদি তারা দ্বিমুখী বিকৃতির রোগী হয়, অন্য দুটি ঔষধ ব্যবহার করা যায় : একটি কার্বামেজাপিন (Carbamazapine), আরেকটি ডাইভালপ্রয়েক্স সোডিয়াম (Divalproex sodium)-যা ডেপাকোট (Depakote) নামে বিক্রি হয়। এদুটো ঔষধ অনেক সময় মূর্ছা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হত।

শৈশব ও কৈশোরের বিষণ্ণতা (Depression in Childhood and Adolescence)

আমাদের মস্তিষ্কে শিশু-কিশোরদের যে ছবি আছে তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শিশুরা এবং কিশোররা হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল। কিন্তু আমরা যখন দেখি বয়স্কদের মত তারাও গুরুতর বিষণ্ণতা (major depression) এবং ডিথসাইমিয়ার শিকার হয় তখন আমাদের হৃদয় দুঃখভারাক্রান্ত হয়। DSM-IV-এ শিশুও কিশোরদের মেজাজের বিকৃতিকে বয়স্কদের বিষণ্ণতার অধীনে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে।

শিশু ও কিশোরদের মধ্যে বিষণ্ণতার ব্যাপকতা ও লক্ষণাবলী

লক্ষণাবলীর দিক থেকে শিশুও কিশোরদের গুরুতর বিষণ্ণতার সঙ্গে বয়স্কদের বিষণ্ণতার পার্থক্য রয়েছে, আবার অনেকগুলো লক্ষণের সাদৃশ্যও রয়েছে। সাত থেকে ১৭ বৎসর বয়স্ক শিশু-কিশোরদের বিষণ্ণতা আর বয়স্কদের বিষণ্ণতা আবেগীয় দিক থেকে একই রকম। তারা আনন্দের অনুভূতি লাভ করে না, ক্লান্ত বোধ করে, মনোনিবেশ করার সমস্যা থাকে, এবং আত্মহত্যার চিন্তা করে। কিন্তু বয়স্কদের সঙ্গে শিশু কিশোরদের বিষণ্ণতার কয়েকটি লক্ষণের পার্থক্য রয়েছে। যেমন : আত্মহত্যার প্রচেষ্টা, অপরাধবোধ (guilt) শিশু-কিশোরদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। পক্ষান্তরে, খুব ভোরে জেগে ওঠা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া এবং সকাল বেলার বিষণ্ণতা (early morning depression)-এই লক্ষণগুলো বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার গবেষণায় দেখা যায় জীবনের যাবতীয় ঘটনাগুলোকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার প্রবণতা— যাকে বলা হয় নেতিবাচক স্কিমা— স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত শিশু কিশোর মধ্যে বেশি নেতিবাচক এবং এদিক দিয়ে তারা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত বয়স্ক রোগীদের মতই। এই তথ্য শিশুদের বিষণ্ণতার সঙ্গে বয়স্কদের বিষণ্ণতার যোগসূত্র স্থাপন করে এবং বেক (Beck) এর বিষণ্ণতার তত্ত্বের মাধ্যমে তা ব্যাখ্যা করা যায়। বয়স্কদের মতই শিশু কিশোরদের মধ্যে বিষণ্ণতার আক্রমণ পুনঃপুনঃ ঘটে। প্রথম বার আক্রান্ত হওয়ার চার থেকে আট বৎসর পরেও শিশু-কিশোরদের মধ্যে এসব লক্ষণ বজায় থাকতে দেখা যায়।

বিভিন্ন বয়সে ও বিভিন্ন দেশে বা একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই রোগে আক্রান্ত শিশু-কিশোরদের সংখ্যার পার্থক্য দেখা যায়। সাধারণভাবে, স্কুলে যাবার আগে ১% এর কম শিশু এ রোগে আক্রান্ত হয়, স্কুল বয়সের শিশুদের ২%-৩%, এ রোগে আক্রান্ত হয়। কিশোরদের মধ্যে এ রোগের হার বয়স্কদের হারের মতই তবে মেয়েদের মধ্যে কিছুটা বেশি হারে (৭%-১৩%) ঘটতে দেখা যায়। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত শিশু কিশোরের মধ্যে ৭০% বিষণ্ণতাসহ উদ্বেগজনিত বিকৃতিতে ভোগে। আবার অনেকের মধ্যে বিষণ্ণতাসহ চরিত্রের বিকৃতি (Conduct disorder), এবং মনোযোগের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিষণ্ণতার সঙ্গে অন্য কোন মানসিক বিকৃতি থাকলে বিষণ্ণতা আরো গুরুতর হয় এবং সুস্থ হতে বেশি দিন লাগে।

শিশু-কিশোরদের বিষণ্ণতার কারণ

শিশু-কিশোরদের গুরুতর বিষণ্ণতার কারণ হিসাবে নিম্নলিখিত শর্তগুলোকে দায়ী করা হয় :

  • (১) বংশগতি বা জিনসংক্রান্ত কারণ (genetic factors) : পিতা-মাতার এরোগ থাকলে সন্তানদের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাছাড়া, নিকট আত্মীয়দের মধ্যে এ রোগের হার বেশী।
  • (২) পীড়নপূর্ণ/ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক : বিষণ্ণতায় আক্রান্ত শিশু-কিশোরদের সঙ্গে তাদের পিতা-মাতার পারস্পরিক সম্পর্ক গোলযোগপূর্ণ বা নেতিবাচক হয়। যেমন স্নেহের অভাব থাকে, রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া (Hostility) বেশি থাকে।
  • (৩) বিষণ্ণতায় আক্রান্ত শিশু কিশোরদের সামাজিক দক্ষতা (social competence) কম থাকে।
  • (৪) তাদের বন্ধুবান্ধব কম থাকে এবং বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক আনন্দদায়ক বা সন্তোষজনক থাকে না, অন্যেরা তাদের সঙ্গ পছন্দ করে না। এর ফলে তাদের আত্ম-ধারণা আরো বেশি নেতিবাচক হয়ে ওঠে।
  • (৫) পিতামাতার তিরস্কার এবং বিরূপ সমালোচনা শিশুর সক্ষমতার ধারণাকে নষ্ট করে দিতে পারে। এবং আত্মাবমাননার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।
  • (৬) জ্ঞানীয় প্রতিক্রিয়ার বিকৃতি এবং নেতিবাচক দোষারূপ করার দৃষ্টিভঙ্গি।
  • (৭) সঞ্চিত গবেষণালদ্ধ তথ্য নির্দেশ করে যে, পরিবারের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে পিতামাতা শিশুদের সাথে কিভাবে আচরণ করে, তার ফলে শিশুর মধ্যে একটি জ্ঞানীয় কাঠামো এবং চিন্তাধারার সূত্রপাত ঘটায় যা শিশু কিশোরদের মধ্যে বিষণ্ণতার কারকতা সৃষ্টি করে।

শিশু কিশোরদের বিষণ্ণতার চিকিৎসা

বয়স্কদের জন্য বিষণ্ণতার চিকিৎসা নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, শিশু কিশোরদের বিষণ্ণতা নিয়ে তত হয়নি। তবে ঔষধে কোন উন্নতি হয় না বলে মনে হয়। কিছুকিছু মনোসামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণে সুফল পাওয়া যায়। যেমন :

  • (১) আন্তঃব্যক্তিক চিকিৎসা (Interpersonal therapy) : এ চিকিৎসায় সমবয়সীদের পীড়ন, পিতা-মাতার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং কৃতিত্ব সম্বন্ধীয় সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করা হয়।
  • (২) জ্ঞানীয় আচরণমূলক চিকিৎসা (Cognitive behavior therapy) : এ চিকিৎসায় ভূমিকা অভিনয় (role playing), সামাজিক দক্ষতা অর্জন, পীড়নমূলক সামাজিক পরিস্থিতিতে সমস্যার সমাধান, সামাজিক কৌশল প্রশিক্ষণ-এসব কৌশল অবলম্বন করা হয়। শিশুকে আনন্দপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান, আনন্দময় পরিবেশের সুযোগ প্রদান ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হয়। শিশুরা যাতে ভাল ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারে, এবং সমবয়সীদের সঙ্গে মিলে মিশে কাজ করতে পারে এবং এসব সম্পর্ক যাতে সন্তোষপ্রদ অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে তার ব্যবস্থা করা হলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
  • (৩) শিশুর নেতিবাচক জ্ঞানীয় কাঠামোর পরিবর্তন এবং সেই সাথে শ্লথন অভ্যাস করলে সুফল পাওয়া যায়।
  • (৪) শিশুর পিতামাতা শিশুর মধ্যে নৈরাশ্যবাদ সংক্রমিত করে। সেজন্য পিতামাতাদের প্রতি নজর দিতে হবে। এ বিষয়ে স্কুল ও স্কুল পরিবেশকে ব্যবহার করা যায়।
  • (৫) শিশুদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে কিভাবে আরো কার্যকরী বাহ্যিক আচরণের মাধ্যমে পীড়নমূলক সামাজিক সম্পর্কগুলোর সাথে মোকাবেলা করা যায়। এসব শিশুকে শেখাতে হবে কিভাবে বন্ধুবান্ধদের সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া করতে হয়, এবং কিভাবে নিজেকে আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। যার ফলে শিশুটি রুদ্ধ আচরণ ও পলায়নের মাঝামাঝি আরো কিছু সুস্থ উপযোগী আচরণ করতে পারে। শিশুর ভালো দিকগুলোকে প্রশংসা করতে হবে এবং উপযুক্ত আচরণ করে দেখিয়ে দিতে হবে অথবা সে যখন উপযোগী আচরণ করে তখন পুরস্কৃত করতে হবে।

আত্মহত্যা (Suicide)

ভূমিকা

খ্রীষ্ট যুগের পূর্বে রোমে একজন কত দীর্ঘ দিন বাঁচে তার চেয়ে বেশি দাম দেওয়া হত একজন কেমন ভাবে বাঁচে অর্থাৎ তার জীবন যাত্রার মানের উপর। “Living is not good, but living well. The wise man, therefore, Ilves as well as he should, not as long as he can….. He will always think of life in terms of quality, not quantity (Seneca, undated).” অর্থাৎ একজন ব্যক্তি বেশি দিন বাঁচলে তার কোন সার্থকতা নাই, বরং ভালো ভাবে বেঁচে থাকার সার্থকতা আছে। তারপরে প্রথম খ্রীষ্টাব্দে খ্রীষ্টানগণ শাস্তিভোগ করে গর্ববোধ করত। অনেক খ্রীষ্টান দেশের ষার্থে শহীদ হওয়ার জন্য আত্মবলি দিয়েছেন। কিন্তু চতুর্থ শতকে এসে পশ্চিমা চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বদলে যায়। এই সময় সেন্ট অগাস্টিন ঘোষণা করেন যে আত্মহত্যা মহাপাপ। এর কারণ হল এই যে, আত্মহত্যা করলে বাইবেলের নির্দেশ “Thou shalt not kill.” অমান্য করা হয়। সেন্ট থমাস একুইনাস ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উল্লিখিত মতামত কে আরো সম্প্রসারিত করেন। তিনি বলেন যে, আত্মহত্যা একটি মারাত্মক পাপ। কারণ এটা জীবন ও মৃত্যুর উপর ঈশ্বরের ক্ষমতা জবর দখল করে। সুতরাং খ্রীষ্টানদের Old Testament এবং New Testament উভয়টিতেই পরিষ্কারভাবে আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করা না হলেও পশ্চিমা দুনিয়ায় আত্মহত্যাকে পাপ বলে মনে করা হত। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস হল এই যে, যে খ্রীষ্টধর্মে জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখিয়ে আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরাই যারা আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করে তাদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়েছিল। ১৮২৩ সালেও দেখা গেছে, লণ্ডনের কেউ আত্মহত্যা করলে, তাকে বুকে পেরেক মেরে কবর দেওয়া হত এবং ১৯৬১ সনের পূর্ব পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হত। কিন্তু যারা আত্মহত্যায় সফল হয়েছে তাদের কিভাবে শাস্তি দেওয়া হবে? কোন কোন রাজ্যে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে লঘু অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় কিন্তু এসব অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয় না। অনেক রাজ্যে আইন করা হয়েছে যে, আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত করা বা উপদেশ দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ (Shneldman, 1987)। বর্তমান অধ্যায়ে আত্মহত্যা সম্পর্কে আলোচনা করার কারণ হল এই যে, যারা বিষণ্ণতা অথবা দ্বিমুখী বিকৃতিতে (Bipolar disorder) (অর্থাৎ যে বিকৃতিতে হর্ষোম্মত্ততা ও বিষণ্ণতা পালাক্রমে ঘটে) ভোগে তাদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যার চিন্তা করে এবং অনেক সময় নিজের জীবন অবসান করার জন্য সত্যি সত্যি চেষ্টা চালায়। বিশ্বাস করা হয় যে, যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক ব্যক্তি সেই সময় বিষণ্ণতায় আক্রান্ত এবং হতাশ থাকে। তবে যারা বিষণ্ণতায় ভোগে না তাদের মধ্যেও অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে। আরো কিছু মানসিক ব্যাধির সঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টার সম্পর্ক রয়েছে, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। পুরুষদের মধ্যে যারা অতিরিক্ত মদ্যপান করে (alcoholic), তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার হার সাধারণ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার হারের চেয়ে বেশি। যারা অতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্ত এবং একই সঙ্গে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত আত্মহত্যার হার তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ১৩% আত্মহত্যা করে (Roy, 1982)। আমরা আত্মহত্যার সেই সব ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা হবে যেগুলো অন্যকোন রোগের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত নয়।

আত্মহত্যা সম্পর্কিত কিছু তথ্য

নিজের ইচ্ছায় নিজের জীবন হরণ করার কাজটি অত্যন্ত জটিল এবং বহুমুখী ঘটনা (Berman & Jobep. 1991: Fremouw et al., 1990 Hendin, 1982: Wright, 1992)। কোন তত্ত্বই এখনো আত্মহত্যাকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। আত্মহত্যার সঙ্গে অনেক কাল্পনিক কাহিনী জড়িত রয়েছে। এখানে আত্মহত্যা সম্পর্কে কিছু তথ্য সমাবেশ করা হলো :

  • (১) পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক বিশ মিনিটে একজন পুরুষ অথবা মহিলা আত্মহত্যা করে। এই হিসাবে আমেরিকায় বৎসরে ৩০,০০০ লোক আত্মহত্যা করে। সম্ভবত সত্যিকার আত্মহত্যার সংখ্যা আরো বেশি। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যার হার প্রতি লক্ষে ১২ জন। কিন্তু এই হার বৃদ্ধ বয়সে আরো বেশি, বিশেষ করে ৭৫ থেকে ৮৪ বৎসর বয়স্কদের মধ্যে প্রতি ১০০,০০০ জনে ২৪ জন আত্মহত্যা করে।
  • (২) আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রে যারা আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করে তাদের মধ্যে প্রতি ২০০টি প্রচেষ্টার মধ্যে ১টি চেষ্টা সফল হয়। এর অর্থ হচ্ছে প্রতি বছর অন্ততঃ ষাট লক্ষটি আত্মহত্যার প্রচেষ্টা হয়।
  • (৩) যারা আত্মহত্যা করে, তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক এর আগে অন্ততঃ আরেক বার আত্মহত্যা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যারা একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের বেশির ভাগই দ্বিতীয় বার চেষ্টা করে না। যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের মধ্যে অনেকেই সত্যি সত্যি মরতে চায় না, বিশেষ করে তারা যদি শিশু ও কিশোর হয়। যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে, আর যারা জীবনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয় তাদের পার্থক্য নিচের ছকে দেখানো হলো –

যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে, আর যারা সফল হয় তাদের পার্থক্য :

বৈশিষ্ট্য (Characteristics)  যারা চেষ্টা করে (Attempters)  যারা সফল হয় (Completers) 
লিঙ্গ   বেশিরভাগ মহিলা  বেশিরভাগ পুরুষ 
বয়স  প্রধানত যুবক  বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ঝুঁকি বেশি হয় 
পদ্ধতি  কম মারাত্মক (ঘুমের বড়ি খাওয়া, শরীর কেটে ফেলা)  বেশি মারাত্মক – যেমন বন্দুক বা উঁচু দালান থেকে লাফিয়ে পড়া 
সাধারণ রোগ নির্ণয়  ডিসথাইমিক ডিস-অর্ডার, প্রান্তীয় ব্যক্তিত্ব, স্কিজোফ্রেনিয়া  গুরুতর মেজাজের বিকৃতি, মদ্য পানে আসক্তি 
প্রধান আবেগ  ক্রোধ সহ বিষণ্ণতা  হতাশা সহ বিষণ্ণতা 
প্রেষণা  অবস্থার পরিবর্তন করা, সাহাজ্যের জন্য চিৎকার করা  মৃত্যু কামনা 
হাসপাতালে চিকিৎসার পরিণতি  বিষাদ থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভ   
আত্মহত্যার প্রচেষ্টার প্রতি মনোভাব  বেঁচে যাবার স্বস্তিবোধ, আর চেষ্টা না করার প্রতিশ্রুতি    
  • ৪) পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার মহিলাদের চেয়ে বেশি। অবশ্য মহিলাদের মধ্যে বর্তমানে আত্মহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। (বাংলাদেশে আত্মহত্যার যত ঘটনা ঘটে তার প্রায় সবই মহিলা। বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলায় আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে এবং যারা আত্মহত্যা করে তারা সবাই যুবতী বা পৌঢ়া মহিলা। আত্মহত্যার ঘটনা হিসাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও সম্ভবতঃ এসব মৃত্যুর অধিকাংশই হত্যাকাণ্ড। এই অঞ্চলে যুবকদের মধ্যে বহু বিবাহের প্রবণতা এবং যৌতুক প্রথা সর্বজন বিদিত।)
  • (৫) পুরুষদের চেয়ে তিনগুণ বেশি মহিলা আত্মহত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু মরে না।
  • (৬) বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটা ও বিধবা হওয়া, এ দুটো ঘটনা আত্মহত্যার ঝুঁকি চার থেকে পাঁচগুণ বৃদ্ধি করে। এই ঝুঁকির পরিমাণ বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে। একজন বিবাহিতা, নাকি বিধবা বা বিপত্মীক – ইত্যাদি শর্ত তার সামাজিক সমর্থন অনেকখানি নির্ধারণ করে। সামাজিক সমর্থন কমে গেলে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • (৭) বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালে আমেরিকায় আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে।
  • (৮) আমেরিকায় সাইকিয়াট্রিস্ট, ভেষজ চিকিৎসক (physician), আইনজীবী ও মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অন্যান্য পেশার লোকদের চেয়ে বেশি এবং যদি তারা মহিলা হন তাহলে এই ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। এছাড়াও পুলিশের লোক, গায়ক বা সঙ্গীত শিল্পী এবং দন্ত চিকিৎসকদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশি।
  • (৯) একজন আত্মহত্যা করলে তার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবরা দীর্ঘমেয়াদী ভাবে যত কষ্ট পায়, অন্য কোন কারণে মৃত্যু হলে এসব অনুভূতি তত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একটি পরিবারে এক জনের আত্মহত্যার পর যারা বেঁচে থাকে তারাও মৃত্যুর কোলে সহজে ঢলে পড়ে। প্রিয়জনের আত্মহত্যার পর জীবিতদের মধ্যে একই বৎসরে মৃত্যুর হার বেশি থাকে।
  • (১০) আমেরিকায় আত্মহত্যার সবচেয়ে সাধারণ উপকরণ হল বন্দুক। আমেরিকায় প্রায় ৬০% আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বন্দুকের মাধ্যমে। অন্যান্য কারণ বাদ দিলেও আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতাই স্বাধীনভাবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ শর্ত। পুরুষরা সাধারণত নিজেদের গুলি করে অথবা ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে, আর মহিলারা সাধারণত ঘুমের বড়ি খায়, যে কারণে অনেক মহিলা আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বেঁচে যায়। বাংলাদেশের পুরুষরা বেশির ভাগ উদ্বন্ধনে (গলায় দড়ি দিয়ে) অথবা বিষপানে আত্মহত্যা করে। শহরাঞ্চলে পুরুষরা নিজের বন্দুক থেকে গুলি করে অথবা উঁচু দালান থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশের মহিলারা ঘুমের বড়ি খেয়ে অথবা কীটনাশক ঔষধ যেমন এড্রিন পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
  • (১১) সাধারণ ভাবে আমেরিকান বয়স্ক লোকদের মৃত্যুর জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হয় তাদের মধ্যে আত্মহত্যা অষ্টম স্থানের অধিকারী; যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪-এর মধ্যে তাদের মৃত্যুর কারণের মধ্যে আত্মহত্যার স্থান তৃতীয়; প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে আছে দুর্ঘটনা এবং খুন। এই বয়সের শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে আত্মহত্যায় মৃত্যুর হার দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী। ডেভিসন ও নীয়েল (১৯৯৮) বলেছেন যে, প্রতি বৎসর আমেরিকায় দশ হাজারের বেশি কলেজ ছাত্র/ছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এবং ২০% ছাত্র/ছাত্রী কলেজ জীবনের কোন না কোন সময় অন্ততঃ একবার আত্মহত্যার চিন্তা করে।
  • (১২) আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এবং আমেরিকান আদিবাসী যুবকদের মধ্যে আত্মহত্যার হার আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। যদিও শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে আফ্রিকান- আমেরিকানদের মধ্যে আত্মহত্যার হার শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। অনুরূপ পরিস্থিতি হল, শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে আফ্রিকান বংশোদ্ভুত আমেরিকানদের মধ্যে খুন এবং দাঙ্গা হাঙ্গামার কারণে মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে বেশি। আমেরিকানদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি হল পঞ্চাশোর্ধ বয়সের শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিককানদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশী হল, ১৫ থেকে ২৪ বৎসর বয়স্কদের মধ্যে।
  • (১৩) আমেরিকায় শিশু ও কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ক্রমশঃ বাড়ছে। প্রতি বৎসর প্রায় ৩০০০ যুবক-যুবতী যাদের বয়স ১৫ থেকে ১৯, আত্মহত্যা করে; এমনকি ছয় বৎসরের শিশুরাও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। তবে এই বয়সে আত্মহত্যার হার বয়স্কদের আত্মহত্যার হারের চেয়ে অনেক কম।
  • (১৪) যারা আত্মহত্যা করে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হল মেজাজের বিকৃতির (যেমন বিষণ্ণতা) রোগী এবং অতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্ত।
  • (১৫) প্রায় অর্ধেক সংখ্যক আত্মহত্যার পেছনে শারীরিক ব্যাধি যেমন এইডস এবং মালটিপল স্ক্লেরোসিস (multiple sclerosis) – যা একটি রক্ত সঞ্চালন তন্ত্রের ব্যাধি, সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রান্তীয় অসুস্থতার কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য চিকিৎসক রোগীর মৃত্যুতে সাহায্য করেন (যদিও এটা বেআইনী)।
  • (১৬) হাঙ্গেরীতে আত্মহত্যার সংখ্যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। চেক রিপাবলিক, ফিনল্যাণ্ড, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যাণ্ডে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। পক্ষান্তরে, গ্রীস, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস এবং যুক্তরাজ্যে আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে কম। আমেরিকায় আত্মহত্যার হার মাঝমাঝি।
  • (১৭) কোন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে সে দেশে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়, তবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বছরগুলোতে আত্মহত্যার হার অপরিবর্তিত থাকে, আবার যুদ্ধের সময় আত্মহত্যার হার কমে।

আত্মহত্যার কারণ

ভূমিকা

আত্মহত্যার কথা কল্পনা করতেই আমাদের এমন একজন ব্যক্তির কথা মনে হয়, যে একটি নাটকীয় ঘটনার মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ তার জীবনের ইতি ঘটানোর জন্য সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে। যেমন একটি মহিলা, গ্যারেজে গিয়ে তার গাড়ির মোটর চালু করা অবস্থায় গাড়িতে বসে আছে, অথবা একজন পুরুষ মানুষ বন্দুক নিয়ে বসে আছে, অথবা একটি শিশু তার বাবা-মার ঘুমানোর ওষুধের বড়ির বোতল নিয়ে ঘরের মধ্যে একা বসে আছে। এই হতভাগ্য মানুষগুলো হয়তো নিজের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই একটি নাটকীয় মুহুর্তের অপেক্ষায় বসে আছে। কিন্তু অনেক মানুষ তিলে তিলে সেচ্ছায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। যখন তারা জেনে শুনে একটি আত্মবিধ্বংসী আচরণে নিজেকে সমর্পন করে যেসব আচরণ গুরুতর শারীরিক অনিষ্ট করে এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুকে এগিয়ে নিয়ে আসে। উদাহরণ স্বরূপ, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি যখন ইনস্যুলিন ইনজেকশন নেয় না এবং খাওয়া দাওয়ার নিয়ম অনুসরণ করে না তখন সে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যায়। অথবা একজন মদ্যপায়ী যখন তার শরীরের ক্ষতি হচ্ছে জেনেও মদ্যপান অব্যাহত রাখে এবং চিকিৎসকের সাহায্য নেয় না, তখন সে অচিরেই যকৃতের ব্যাধি (Cirrhosis)-তে আক্রান্ত হয় যা অনেক সময় মৃত্যু ডেকে আনে। এ ধরনের প্রায় আত্মহত্যার ঘটনাগুলোকে বলে Sub intentional death বা প্রায়-সেচ্ছা মৃত্যু। এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনাগুলো আত্মহত্যার কারণ বুঝতে অসুবিধা সৃষ্টি করে। নাটকীয়ভাবে যখন ব্যক্তি তার জীবনাবসান ঘটায়, তখন তার পেছনে হতাশা, অপরাধবোধ, অপমান, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদি সক্রিয় থাকে। দীর্ঘমেয়াদী স্বেচ্ছামৃত্যুর পেছনে এসব কারণ থাকে না। দীর্ঘমেয়াদী স্বেচ্ছামৃত্যুতে ব্যক্তি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জেনেও প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয় না বা ধ্বংসাত্মক আচরণ পরিহার করে না।

আত্মহত্যার প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা বহু স্থানে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের ডায়েরী ও চিঠি থেকে আত্মহত্যার কারণ ও পরিস্থিতি সম্বন্ধে রূপতাত্ত্বিক বিবরণ পাওয়া যায়। বহু দার্শনিক যেমন দেকার্তে (Descartes), ভলটেয়ার (Voltaire), কান্ট (Kant), বিশেষ করে অস্তিত্ববাদী দার্শনিকগণ যেমন, হেইডেগার (Heidegger) এবং ক্যামুস (Camus) আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকগণ মনে করেন মৃত্যু অবধারিত এবং প্রত্যেকের মধ্যেই অনস্তিত্বের ভয় কাজ করে। সেজন্য আপাতঃ অর্থহীন জীবনকে অর্থপূর্ণ করার দায়িত্ব প্রত্যেকেরই নিতে হবে। শোপেনহাওয়ার মনে করতেন, জগতের সব সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্টের মূলে আছে বেঁচে থাকার ইচ্ছা। সুতরাং বেঁচে থাকার ইচ্ছা এমন কি সব ধরনের ইচ্ছাকে পরিত্যাগ করাই মুক্তি লাভের উপায়। সুতরাং মুক্তি পেতে হলে অর্থাৎ দুঃখ যাতনা থেকে চিরস্থায়ীভাবে মুক্তি পেতে হলে আমাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে ধ্বংস করতে হবে।

আত্মহত্যার পেছনে কি প্রেষণা কাজ করে? অর্থাৎ মানুষ আত্মহত্যা করে কেন? আত্মহত্যার জন্য বহু প্রেষণাকে দায়ী করা হয়েছে (Mintz, 1968)। যেমন, ক্রোধ যখন অর্ন্তমুখী হয় (Aggression turned inward), তখন মানুষ আত্মহত্যা করে। ঠিক তেমনি ভাবে, অন্যের মধ্যে অপরাধবোধ সঞ্চালিত করে প্রতিশোধ নেওয়া, অন্যের কাছে থেকে ভালবাসা আদায় করা, অতীতের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করা বা সংশোধন করতে চেষ্টা করা, অযাচিত বা অবাঞ্ছিত অনুভূতি থেকে নিজেকে রক্ষা করা, যেমন একই লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করা, পুনর্জন্ম লাভের চেষ্টা করা, মৃত প্রিয়জনের সাথে মিলিত হওয়া, পীড়ন থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করা বা পালিয়ে যেতে চেষ্টা করা, অঙ্গহানি বা শারীরিক বিকৃতি ঘটা, অসহ্য ব্যাথা, অথবা আবেগীয় শূন্যতাবোধ। অনেক আধুনিক পেশাদার মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, সাধারণভাবে আত্মহত্যা হল একটি সমস্যা-সমাধানের প্রচেষ্টা- যা ব্যক্তি বেশ পীড়নমূলক পরিস্থিতিতে গ্রহণ করে এবং যখন ব্যক্তির নিকট খুব সীমিতসংখ্যক বিকল্প পন্থা উন্মুক্ত থাকে যার মধ্যে আত্মবিনাশকে ব্যক্তি সবচেয়ে সহজ বলে মনে করে। (Linehan and Shearin, 1988) সমাজ মনোবিজ্ঞান ও ব্যক্তিত্ব মনোবিজ্ঞানের গবেষণার উপরে ভিত্তি করে নির্মিত একটি তত্ত্বে মনে করা হয় যে, বর্জন মূলক অবহিতি থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থেকেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। বর্জনমূলক অবহিতি বলতে বোঝায় ব্যক্তি কোন প্রেষণার হতাশার জন্য তার নিজের অক্ষমতাকে দায়ী করে। “Some suicide arise from a strong desire to escape from aversive self awareness, that is, from the painful awareness of shortcomings and lack of success that the person attributes to himself or herself” (Baumeister, 1990).

এ ধরনের অবহিতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয় এবং প্রচন্ড আবেগীয় পীড়ন এবং সম্ভবতঃ বিষণ্ণতা সৃষ্টি করে। এই তত্ত্ব অনুসারে অবাস্তব উচ্চাশা এবং তা পূরণের ব্যর্থতা আত্মহত্যার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আত্মহত্যার জন্য বিশেষ ভাবে দায়ী হল ঘনিষ্টতা স্থাপনের উচ্চাকাঙ্খা এবং বাস্তব ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সাফল্যের মধ্যকার ব্যবধান। যেমন একজন ভালবেসে যা পেতে চায়, ভালবাসার পাত্র তা দিতে পারে না- সেজন্য যে হতাশা সৃষ্টি হয় তাই আত্মহত্যার জন্য দায়ী (Stephens, 1985)। মৃত্যুকে বরণ করে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে বেদনাময় অবহিতির চেয়ে কম কষ্টকর। বেশকিছু গবেষণা থেকে এই তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফিলিপস্ (Phillips 1974, 1977, 1985) -এর কতকগুলো গবেষণা প্রবন্ধ পর্যালোচনা করে বাদুরা (Bandura, 1986) বলেছেন যে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার বিবরণী মানুষকে আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত করতে পারে। তিনি দেখান যে,

  • (১) মেরিলীন মনরোর মৃত্যু সম্পর্কে সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পরের মাসে আত্মহত্যার ঘটনা ১২% বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  • (২) শুধুমাত্র বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মহত্যার পরে নয়, অন্য লোকদের আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং ব্যক্তির খ্যাতি নয় বরং প্রচারই আত্মহত্যার মত ঘটনার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে বলে মনে হয়।
  • (৩) খুন-আত্মহত্যার ঘটনা প্রকাশিত হলে, বিমান দুর্ঘটনা এবং মোটর যানের দুর্ঘটনা বেশি হয়, যেখানে চালকসহ অন্যান্যরা মারা যায়।
  • (৪) বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্বাভাবিক মৃত্যুর খবর প্রচারিত হলে তা আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধি করে না।

এ থেকে মনে হয় যে, আত্মহত্যার ঘটনার জন্য মানুষের মধ্যে শোক দায়ী নয়। আত্মহত্যার ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য আরো কয়েকটি দৃষ্টিভঙ্গি বা তত্ত্ব আলোচনা করা হলো :

আত্মহত্যা সম্পর্কে ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব (Freud’s Psychoanalytic Theories)

আত্মহত্যাকে ব্যাখ্যা করার জন্য ফ্রয়েড দুটো অনুমান তৈরি করেছিলেন। একটি অনুমান হল তার বিষণ্ণতার তত্ত্বের সম্প্রসারণ। এই তত্ত্বে আত্মহত্যাকে এক ধরনের খুন (murder) বলে মনে করা হয়। একজন ব্যক্তি যদি এমন কাউকে হারায় যার প্রতি তার ভালবাসা ও ঘৃণা মিশ্রিত ছিল এবং সে যদি মৃত ব্যক্তিকে আত্তীকরণ করে থাকে, তাহলে ঘৃণা এবং ক্রোধ তার নিজের প্রতি ফিরে আসে। এসব অনুভূতি যদি খুব তীব্র হয়, তাহলে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে। দ্বিতীয় তত্ত্বে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মরণ প্রবৃত্তি (Thanatos) অন্তর্নিহিত থাকে যা ব্যক্তির নিজের প্রতি ফিরে আসতে পারে এবং নিজেকে মেরে ফেলতে পারে।

ডুরখাইমের সমাজবিজ্ঞান ভিত্তিক আত্মহত্যার তত্ত্ব (Durkheim’s Sociological Theory of Suicide)

এমিল ডুরখাইম (Emil Durkheim, 1897) ছিলেন একজন বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ। তিনি বিভিন্ন দেশের এবং বিভিন্ন যুগের আত্মহত্যার বিবরণ বিশ্লেষণ করে বলেন যে, আত্মহত্যার সমাজতাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। তিনি তিন ধরনের আত্মহত্যাকে পৃথক করেন, যেমন : আত্মাভিমানী বা আত্মগর্বিত আত্মহত্যা (legoistic suicides) যাদের পরিবারের প্রতি কোন বন্ধন নেই, যাদের বন্ধুবান্ধব কম, সমাজ বা গোষ্ঠীর সাথে যাদের বন্ধন কম আছে তারাই এধরনের আত্মহত্যা করে। এধরনের ব্যক্তি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং সমাজে স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে গেলে যেসব সামাজিক সমর্থন দরকার সেগুলো তাদের থাকেনা।

পরার্থবাদী আত্মহত্যা (Altruistic suicides) – এধরনের আত্মহত্যা ঘটে সমাজের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে। কিছু কিছু লোক আছে যারা সমাজেরই একজন সদস্য হিসাবে নিজেদের মনে করে এবং তারা মনে করে সমাজের ভাল করার জন্য তাদের আত্মোৎসর্গ করা উচিত। যুদ্ধের সময় বৌদ্ধ সন্যাসীরা ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে আমেরিকার অন্যায় যুদ্ধের প্রতিবাদে আত্মহত্যা করেছিলেন। তাদের আত্মহত্যা ছিল পরার্থবাদী।

আরেক ধরনের আত্মহত্যা হল নীতিহীন আত্মহত্যা (anomic suicide) – এ ধরনের আত্মহত্যা ঘটে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্কের হঠাৎ অবনতির ফলে। একজন সফল বিজনেস এক্সিকিউটিভ (বা ব্যবসায় প্রতিষ্টানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা)— যদি হঠাৎ আর্থিক সংকটে পড়েন তাহলে তিনি এনোমি (anomle) বা নীতিহীনতায় ভুগতে পারেন এবং দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়তে পারেন— কারণ তিনি আগে যাকে জীবন যাপনের স্বাভাবিক পদ্ধতি হিসাবে বিশ্বাস করতেন এখন আর তা সম্ভব নয় বলে মনে করেন। যে সমাজে এধরনের নীতিহীনতা চলতে থাকে, সেই সমাজে আত্মহত্যার হিড়িক পড়ে যায়। এনোমিক (anomic) বা নীতিহীনতা জনিত আত্মহত্যার সাম্প্রতিককালের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, ব্রাজিলের গুয়ারানি নামক একটি রেড ইন্ডিয়ান উপজাতির মধ্যে। ১৯৯৬ সালে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ছিল প্রতি ১০০,০০০ এ ১৬০টি। এই হার আমেরিকার হারের চেয়ে (প্রতি ১০০,০০০ জনে ১২ জন) অনেক উঁচুতে। ঐ আদিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মহ্যতার অত্যন্ত উঁচু হারের কারণ হল তাদের জীবন যাত্রার ব্যবস্থায় আকস্মিক পরিবর্তন। শিল্পায়নের ফলে এ সম্প্রদায়ের লোকদের জমি-জমা বেহাত হয়ে যায়। শিল্পোদ্যোক্তারা তাদের জমি ছলে বলে কৌশলে হাতিয়ে নেয়। যে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো বনেজঙ্গলে পশু শিকার করে আর মাছ ধরে জীবন ধারণ করত, এখন তাদের স্বল্পপরিসরের সংরক্ষিত এলাকায় থাকতে হচ্ছে। এই স্বল্প এলাকা তাদের জীবন ধারণের সুযোগ সুবিধা দিতে পারছে না। আশে পাশে শহরগুলো তাদের শিল্পদ্রব্যের দ্বারা আকৃষ্ট করছে, কিন্তু তাদের আয় কম থাকায় তারা সেগুলো ব্যবহার করতে পারছেনা। শিকার করা, কৃষিকাজ করা এবং পারিবারিক জীবন যাপন — এগুলোর মধ্যে ধর্মীয় যোগসূত্র বিদ্যমান। সুতরাং শিকার, কৃষি, এগুলো ধ্বংস হওয়াতে গুয়ারানি সম্প্রদায়ের লোকদের জীবনের অর্থ বা তাৎপর্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেক আদিবাসী তাদের জীবনের অর্থ খুজে পাচ্ছেনা। সেজন্য তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। তবে ডুরখাইমের তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে পারে না কেন একই অবস্থায় সব ব্যক্তি আত্মহত্যা করে না। ডুরখাইম এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র মেজাজ (Temperament)-এর কথা বলে। সামাজিক পরিস্থিতির সাথে ব্যক্তিগত মেজাজ পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য ব্যক্তিকে নির্দেশ দেয়।

স্নেইডম্যানের তত্ত্ব (Shneidman’s Approach to Suicide)

স্নেইডম্যান যুক্তি দিয়েছেন যে, যারা আত্মহত্যা করে তাদের কোন না কোন মানসিক ব্যাধি থাকে, DSM-এর নিদান অনুসারে যার একটি নাম দেওয়া যায় (যেমন স্কিজোফ্রেনিয়া বা বিষণ্ণতা, ইত্যাদি)। কিন্তু তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, স্কিজোফ্রেনিয়া ও বিষণ্ণতার রোগীদের বেশির ভাগ রোগী আত্মহত্যা করে না। তিনি আরো বলেন যে, আত্মহত্যার রোগীদের মনের যে বিক্ষিপ্ত অবস্থা থাকে, এটা মানসিক ব্যাধি নয়। আত্মহত্যা সম্পর্কিত স্লেইউম্যানের মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সার সংক্ষেপ নিচে দেখানো হবে, যেখানে আত্মহত্যার সবচেয়ে সাধারণ দশটি বৈশিষ্ট্য দেখানো থাকবে। প্রত্যেক আত্মহত্যার ক্ষেত্রেই উক্ত দশটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে না। স্নেইডম্যান মনে করেন, আত্মহত্যা হল একটি তীব্র যন্ত্রনাদায়ক সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যক্তির একটি সচেতন প্রচেষ্টা। যিনি কষ্ট পাচ্ছেন, এই সমাধানটি তার সচেতনতা এবং অসহ্য বেদনার অবসান ঘটায়। এ ধরনের কষ্ট বা যন্ত্রণাকে মেলভিল তার “Moby Dick” গ্রন্থে insufferable anguish (অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা) বলে অভিহিত করেছিলেন। যখন ব্যক্তির সব আশা এবং গঠনমূলক কাজের স্পৃহা অন্তর্হিত হয়, তখন ব্যক্তি চেতনার অবসান ঘটায়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও এবং এটাই আত্মহত্যা প্রতিরোধের একটি যুক্তি যে, যারা আত্মহত্যা করে বসে তারা উভয়বলতা বা দ্বিধায় (ambivalent) ভোগে। এর একটি দৃষ্টান্ত হল- একজন ব্যক্তি যখন নিজের গলায় ছুরি চালায় এবং একই সঙ্গে বাঁচাও! বাঁচাও! বলে চিৎকার করে, এবং তাদের দুটো কাজই সমান আন্তরিক। (সত্যি সত্যি জীবনাবসান ঘটাতে চায়, আবার আন্তরিক ভাবে বাঁচার জন্য সাহায্য চায়।) অর্থাৎ তাদের যদি এটা না করতে হত তাহলে তারা আত্মহত্যা না করে সুখী হত। ব্যক্তি এমন পরিস্থিতিতে পড়ে যে, তার বিকল্প সমাধানের সংখ্যা খুব কম থাকে। ব্যক্তি যখন আত্মহননমূলক, উত্তেজিত এবং বিক্ষুদ্ধ অবস্থায় না থাকে, তখন পীড়নের মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন পন্থার মধ্যে তুলনা করে একটি পন্থা পছন্দ করতে পারে, কিন্তু উত্তেজিত অবস্থায় তা পারে না। যারা আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে তারা সাধারণত তাদের এ ধরনের ইচ্ছার কথা অন্যকে জানায়। অনেক সময় সাহায্যের আবেদন করে, কখনও নিজেকে অন্য সবার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়— এভাবে আত্মহত্যার ইঙ্গিত দেয়। সে যেন পৃথিবীর কোলাহল থেকে মুক্তি চায়। (He is in search of inviolacy)। অনেক সময় তাদের সজ্জিত ধন, বা ভালাবাসার জিনিস অন্যকে বিলিয়ে দেয় বা ব্যাঙ্কে বা অন্যত্র টাকা পয়সার হিসাব মিটিয়ে ফেলে, সম্পত্তি ভাগ করে দেয়।

আত্মহত্যার দশটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য (স্নেইডারের তত্ত্ব অনুসারে) –

  • ১. আত্মহত্যার সাধারণ উদ্দেশ্য হল একটি সমস্যার সমাধান খোঁজা।
  • ২. আত্মহত্যার সাধারণ লক্ষ্য হল চেতনার অবসান ঘটানো।
  • ৩. আত্মহত্যার সাধারণ উদ্দীপক হল অসহ্য মানসিক কষ্ট বা যন্ত্রণা।
  • ৪. আত্মহত্যার জন্য দায়ী পীড়নের উৎস হল মানসিক তাগিদগুলোর হতাশা।
  • ৫. আত্মহত্যার সাধারণ আবেগ হল আশাহীনতা এবং অসহায়ত্ববোধ।
  • ৬. আত্মহত্যার সাধারণ জ্ঞানীয় অবস্থা হল উভয়বলতা বা দ্বিধা (ambivalence)।
  • ৭. আত্মহত্যার সাধারণ প্রত্যক্ষণমূলক অবস্থা হল সংকোচন।
  • ৮. আত্মহত্যায় সাধারণ প্রতিক্রিয়া হল নিজের প্রতি ক্রোধ (aggression) বা আক্রমণ।
  • ৯. আত্মহত্যায় সাধারণ পারস্পরিক ক্রিয়া হল আত্মহত্যার ইচ্ছা জানানো।
  • ১০. আত্মহত্যায় সাধারণ মিল (সামঞ্জস্য) হল জীবনব্যাপী অভিযোজনের পদ্ধতি।

স্নায়ু-রসায়ন ও আত্মহত্যা (Neurochemistry And Suicide)

সেরোটোনিনের মাত্রাল্পতা যেমন বিষণ্ণতার সঙ্গে সম্পর্কিত, ঠিক তেমনি গবেষণায় দেখা যায় সেরোটোনিন (serotonin) -এর সঙ্গে আত্মহত্যা এবং ঝোঁকের বশে বা মুহূর্তের উত্তেজনায় কাজ করার প্রবণতার (Impulsivity) একটি সম্পর্ক রয়েছে। সেরোটোনিনের বিপাক ক্রিয়ার একটি উপজাত, যার নাম 5-HIAA, আত্মহত্যার রোগীদের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যেমন বিষণ্ণতা, স্কিজোফ্রেনিয়া বা অন্যান্য ব্যক্তিত্বের বিকৃতি ইত্যাদিতে খুব কম পরিমাণে পাওয়া গেছে। যে সব ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছিল তাদের মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে সেরোটোনিন সংগ্রাহক কোষের সংখ্যাধিক্য লক্ষ্য করা গেছে। সম্ভবত এটা হল সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যাওয়ার দরুণ একটি ক্ষতিপূরণমূলক প্রতিক্রিয়ার ফল। 5-HIAA-র মাত্রার সঙ্গে আত্মহত্যার সম্পর্কটি সবচেয়ে জোরালো হল, প্রচণ্ডতার মাধ্যমে আত্মহত্যা এবং ঝোঁকের বশে আত্মহত্যার বেলায় ( Roy, 1994. Traskman et al., 1981)। তাছাড়া 5-HIAA – এর মাত্রার সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণের পরিমাপ এবং ঝোঁকের বশে কাজ করার সম্পর্ক পাওয়া গেছে (Brown & Goodwin, 1986)।

আত্মহত্যা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীকরণ (Prediction of suicide)

একজন ব্যক্তির আত্মহত্যা করার সম্ভাবনা কতটুকু তা যদি ভবিষ্যদ্বাণী করা যেত, তাহলে অনেক লোকের প্রাণ বাঁচানো যেত এবং তাত্ত্বিক অগ্রগতি সাধিত হত। মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষার মাধ্যমে আত্মহত্যার ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা করা হয়েছে। আত্মহত্যার ইচ্ছার সঙ্গে আশাহীনতা ( hopelessness) এর তাৎপর্যপূর্ণ সহ-সম্পর্ক (correlation) পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে এ্যারণ বেকের একটি অনুসরণমূলক গবেষণা (prospective study)-র ফলাফল উল্লেখযোগ্য। এ্যারণ বেক (Beck, 1986. Beck et. al., 1985, Beck et al., 1990 ) দেখেছেন যে, আশাহীনতা আত্মহত্যার একটি শক্তিশালী নির্দেশক। আশাহীনতা এমন কি আত্মহত্যার ভবিষ্যদ্বাণী করণে বিষণ্ণতার চেয়েও শক্তিশালী। ব্যক্তি যদি আশঙ্কা করে যে, ভবিষ্যতের কোন এক সময় পরিস্থিতি বর্তমানে যা আছে তার চেয়ে খুব বেশি ভাল হবে না, যা বিষণ্ণতার অনুভূতির একটি অংশ বিশেষ এবং যারা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত নয় তাদের মধ্যেও ধারণাটি থাকতে পারে কিন্তু শুধুমাত্র বিষণ্ণতার চেয়ে বরং এই অনুভূতিটিই আত্মহত্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপক শর্ত হিসাবে কাজ করে। বেক ও তার সহকর্মীরা আরো দুটি অভীক্ষা তৈরী করেছেন যেগুলো ব্যবহার করে কারো আত্মহত্যার ঝুঁকি থাকলে তা শনাক্ত করা যায়। একটি অভীক্ষার নাম হল “Suicidal Intent scale”— যেটি তৈরী করেছেন বেক, স্কুইলার ও হারম্যান ( Beek. Schuyler and Herman, 1974) এবং আরেকটির নাম হল “Scale for Suicide Ideation”, এটি তৈরি করেছেন Beck, Kovacs and Weissman, (1979)। আরেকটি আত্মবিবরণীমূলক অভীক্ষা হল মার্শা লিনেহানের (Marsha Linehan)-এর Reasons For Living (REL) ইনভেন্টরী। এই অভীক্ষায় কতকগুলো প্রশ্নগুচ্ছ রয়েছে যেগুলোতে জানতে চাওয়া হয়, ব্যক্তির কাছে কি কি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব এবং সন্তানদের বিষয়ে উন্নিতা। এই পদ্ধতিটি অন্যান্য পদ্ধতি থেকে এই জন্য আলাদা যে, এই পদ্ধতিতে ব্যক্তির নৈরাশ্য বা নেতিবাচক চিন্তা সম্বন্ধে না জেনে ব্যক্তির জীবনের সেই সব চিন্তাগুলোকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করা হয়, সেগুলো ব্যক্তিকে আত্মহত্যা থেকে বিরত রাখে। সুতরাং REL-ইনভেন্টরীর একদিকে যেমন পরিমাপক হিসাবে মূল্য আছে, আবার অন্যদিকে হস্তপেক্ষ মূলক (intervention) মূল্য আছে। এই ইনভেন্টরীটি ব্যবহার করে যাদের আত্মহত্যার প্রবনতা নেই, তাদের পৃথক করা যায়। তাছাড়া এটি, ব্যক্তি কেন মরতে চায় অথবা কেন মরতে চায় না, তা জানতে পারার ফলে, চিকিৎসককে আত্মহত্যার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করে।

কিছুসংখ্যক গবেষণা থেকে যারা আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করে তাদের জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যগুলো সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায়। এসব গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, যেসব ব্যক্তি আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করে তারা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে অন্যান্য ব্যক্তির চেয়ে বেশি জড়তাগ্রস্ত (Rigid), এবং তাদের চিন্তাধারা অন্যান্য লোকদের চিন্তাধারা থেকে কম নমনীয় বা কম পরিবর্তনশীল। তাদের চিন্তাধারার জড়তা বা সংকীর্ণতার জন্য তারা জীবনাবসান ঘটানো ছাড়া অন্য কোন ভাবে সমস্যার সমাধানের চিন্তা করতে পারে না। অর্থাৎ তারা বিকল্প সমাধানের চিন্তা করতে পারে না (Linehan et al., 1987)। সুতরাং এসব গবেষণা থেকে রেইডম্যান ও তার সঙ্গীদের তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। রেইডম্যানের তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, যারা আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করে তারা অদূরদর্শী এবং সমস্যার বিকল্প সমাধানের চিন্তা করতে অক্ষম। সেজন্য তারা সমস্যার সমাধানের জন্য আত্মহত্যাকেই একমাত্র পথ হিসাবে বেছে নেয়।

তবে উল্লিখিত অভীক্ষাগুলোর মাধ্যমে যেসব বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করা হয় সেগুলোর উপরে ভিত্তি করে আত্মহত্যা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না, কারণ মানুষের আচরণ ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ছাড়াও উপস্থিত পরিবেশগত শর্ত, পীড়নমূলক পরিস্থিতি ইত্যাদির উপরে নির্ভর করে। আমরা কি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি একজন ব্যক্তি কখন চাকুরীচ্যুত হবে, অথবা কখন তার বিবাহিত জীবনে সমস্যা দেখা দিবে, অথবা কখন তার প্রিয়জন মারা যাবে? অথবা কখন সে একটি যানবাহন দুর্ঘটনায় পতিত হবে? ঠিক তেমনি ভাবে একজন ব্যক্তি সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করবে কি না সে সম্মন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা একটি কঠিন ব্যাপার, কারণ আত্মহত্যার ঘটনা খুব কদাচিৎ ঘটে এবং এর পেছনের সবগুলো শর্ত আমাদের জানা থাকে না।

আত্মহত্যা প্রতিরোধকরণ (Preventing Suicide)

আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের বেশির ভাগই চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করতে পারে এমন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকে। এসব ব্যাধির মধ্যে প্রধানতঃ অন্তর্ভুক্ত হল বিষণ্ণতা (depression), স্কিজোফ্রেনিয়া, মাদকাসক্তি (substance abuse) বা মাদকের অপব্যবহার এবং সীমান্তবর্তী ব্যক্তিত্বের বিকৃতি (borderline personality disorder)। সুতরাং কেউ যদি বেকের তত্ত্ব অনুসরণ করে রোগীর বিষণ্ণতাকে কমাতে পারে, তাহলে তার আত্মহত্যার ঝুঁকি আগের চেয়ে অনেক কমে যাবে। অথবা কেউ যদি মার্শা লিনেহ্যানের (Marsha Linchan, 1993) চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে সীমান্তবর্তী ব্যক্তিত্বের বিকৃতিকে পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে সেই ধরনের ব্যক্তির আত্মহত্যার ঝুঁকি কমে যাবে। আত্মহত্যার মনোবিজ্ঞান বিষয়ে যাদের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি তারা বলেছেন যে, ব্যক্তির অন্তর্নিহিত মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা করাই আত্মহত্যা প্রতিরোধের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মানসিক ব্যাধি কোন ব্যাপারই নয়, বরং ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবর্তন করতে পারলেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। অর্থাৎ যে বৈশিষ্ট্যগুলো বিভিন্ন ধরনের মানসিক ব্যাধির চেয়েও বেশি মৌলিক এবং মানসিক ব্যাধিকেও অতিক্রম করে (transcend)।

এ ধরনের মনোভাব পোষণ করেন এডুইন স্নেইডারম্যান (Edwin Schneiderman) যার সম্বন্ধে ইতোপূর্বে বলা হয়েছে। স্নেইডারম্যান (১৯৮৫, ১৯৮৭) মনে করেন, তিনটি সাধারণ কৌশল (strategy) – এর মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব :

  • (১) তীব্র মানসিক বেদনা ও কষ্ট হ্রাস করা।
  • (২) চোখের সম্মুখ থেকে পর্দা উঠিয়ে ফেলা, অর্থাৎ ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে দাও, যাতে সে অনস্তিত্ব এবং অনন্ত দুঃখ কষ্ট ভোগ করা ছাড়া অন্যান্য বিকল্প সম্পর্কে ভাবতে পারে তার জন্য তাকে সাহায্য করা।
  • (৩) আত্মবিধ্বংসী কাজ থেকে সামান্য পরিমাণে হলেও তাকে পিছু হটতে বা বিরত রাখতে উৎসাহিত করা।

স্নেইডম্যান একটি ধনী কলেজগামী মেয়ের আত্মহত্যার প্রচেষ্টার উদাহরণ দিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন কিভাবে আত্মহননে উদ্যত, অস্থির, ক্ষুদ্ধ একটি মেয়েকে তিনি শান্ত করেছিলেন এবং আত্মহত্যা থেকে বিরত করেছিলেন। মেয়েটি একটি ধনী পরিবারের সন্তান, কলেজে পড়ে এবং অবিবাহিতা। সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং আত্মহত্যা করতে চায়। সে আত্মহত্যার জন্য একটি পরিষ্কার পরিকল্পনাও তৈরি করে ফেলেছে। আত্মহত্যা ছাড়া অন্য বিকল্প হিসাবে সে শুধু ভাবতে পারতো যে সে কোন দিন গর্ভবর্তী হত না এবং যদি সম্ভব হত পুনরায় কুমারীত্বে প্রত্যাবর্তন করত।

“আমি (চিকিৎসক) একটু কাগজ নিলাম এবং তার মনের জানালাগুলো খুলতে লাগলাম। তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে লাগলাম।” আমি অনেকটা এরকম বললাম, ”এসো, আমরা দেখি কি করা যায়, তুমি স্থানীয় হাসপাতালে গিয়ে সন্তানটি ফেলে দিতে পারতে।” সে বলল, “আমি তা করতে পারতাম না।” আমি আবার বললাম, “তুমি অন্য কোথাও চলে যেতে পারতে এবং এবরশান (abortion) বা গর্ভপাত ঘটাতে পারতে।” “আমি তা পারতাম না।” তুমি সন্তানটিকে বড় হতে দিতে পারতে এবং সন্তানটিকে তোমার কাছে রাখতে পারতে।” “আমি তা পারতাম না।” “তুমি সন্তানটিকে নিতে পারতে এবং পরে দত্তক দিতে পারতে।” এমনি ভাবে আরো কয়েকটি বিকল্প তার সম্মুখে উপস্থিত করা হলে সে সবগুলোই একই ভাবে নাচক করে দেয়। যখন আমি বললাম, ‘তুমি সব সময়ই আত্মহত্যা করতে পার, কিন্তু স্পষ্টতঃ আজকেই তোমার এটা করার প্রয়োজন নেই। তখন মেয়েটি কোন উত্তর দিলো না। আচ্ছা, এখন আমরা এই তালিকাটির দিকে লক্ষ্য করি এবং কোনটিই সর্বোত্তম নয়, এটা ভেবে আমরা এগুলোকে পছন্দের ক্রমানুসারে সাজাই।” (Shneidman, 1987, P. 171).

স্নেইডম্যান বলেছেন যে, এমনি ধরনের একটি তালিকা প্রস্তুত করারও একটি প্রশান্তিকর প্রভাব রয়েছে। ছাত্রীটির আত্মঘাতী প্রচেষ্টা অর্থাৎ খুব শিঘ্র তার নিজেকে হত্যা করার প্রেষণা— ক্রমশঃ দূরে সরে যায় এবং সে তালিকার বিকল্পগুলোকে ক্রমান্বয়ে সাজায়, যদিও প্রত্যেকটি বিকল্প সম্পর্কে তার আপত্তি ছিল। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সে মৃত্যুর কিনারা থেকে সরে এসেছে এবং কুমারীত্বে ফিরে যাওয়া এবং মৃত্যু ছাড়া অনেকগুলো বিকল্প নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করেছে। “সে সময় আমরা শুধুমাত্র জীবন নিয়ে দর কষাকষি করছিলাম, যা একটি সম্ভাব্য সমাধান”— পৃষ্ঠা ১৭১।

আত্মহত্যার প্রতিরোধ কেন্দ্র (Suicide prevention center)

আমেরিকায় বহু সংখ্যক আত্মহত্যা প্রতিরোধ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এধরনের কেন্দ্র ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে এবং আত্মহননেচ্ছু ব্যক্তিদের পরামর্শ ও সেবা দিয়ে থাকে। এসব কেন্দ্রে যারা কর্মী থাকে তারা অপেশাদার স্বেচ্ছাসেবক। তারা পেশাদার মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মীদের তত্ত্বাবধানে কাজ করেন। এসব কর্মী সাধারনতঃ ডেমোগ্রাফিক তথ্য (যেমন বয়স, সন্তান সংখ্যা, বৈবাহিক অবস্থা) –এর উপরে ভিত্তি করে ঝুঁকির পরিমান নির্ধারণ করে। কর্মীদের সম্মুখে একটি তালিকা থাকে যার উপরে ভিত্তি করে কর্মীরা ফোনে কেউ সাহায্য চাইলে বিভিন্ন প্রশ্ন করে নির্ধারণ করে ব্যক্তিটির আত্মহত্যার ঝুঁকি কতটুকু এবং কত দ্রুত সাহায্যের প্রয়োজন। যেমন— এমন কেউ যদি টেলিফোন করেন যিনি পুরুষ, মধ্য বয়সী, তালাক প্রাপ্ত, যিনি একাকী বসবাস করছেন এবং ইতোপূর্বে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন— তাহলে তার জীবনের ভয়ঙ্কর ঝুঁকি রয়েছে। যে ব্যক্তি আত্মহত্যার জন্য যত বিস্তৃতভাবে এবং বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা করে, তার ঝুঁকি তত বেশি।

আত্মহত্যার প্রতিরোধ সম্পর্কে এই গ্রন্থের অন্য অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। যারা আত্মহত্যা করে তারা যেসব চিঠি বা চিরকুট লিখে যায়, সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা মৃত্যুর আগে কিছু নির্দেশ দেয়, এবং তাদের চিঠিতে তীব্র মনোকষ্ট এবং ক্রোধ (Hostility) প্রকাশ পায়, যা একই বয়সের স্বাভাবিক লোকজন যারা আত্মহত্যার চিন্তা করেনি তাদের কল্পিত (simulated) আত্মহত্যার পূর্বের চিঠিতে থাকে না। আত্মহত্যাকারীর ভূমিকা কল্পনা করে যারা চিঠি লেখে তাদের চিঠিতে দার্শনিক ভাব বেশি থাকে, কিন্তু বাস্তবিক যারা আত্মহত্যা করে তাদের চিঠিতে দার্শনিক বা সাধারণ বক্তব্য থাকে না। বাস্তবে আত্মহত্যাকারীর চিঠিতে থাকে, “বিদ্যুতের বিল দিতে ভুলো না।” কথিত আত্মহত্যাকারীর চিঠিতে থাকে “অন্যের প্রতি সদয় হও” — ধরনের ভাষা (Baumeister, 1990)।

আত্মহত্যার মোকাবেলায় চিকিৎসামূলক ও নৈতিক সমস্যা

যারা আত্মহত্যা করে তারা আত্মহত্যা করার সময় অথবা আত্মহত্যার চেষ্টা করার সময় যে বিষণ্ণ থাকবেই এমন কোন কথা নেই। তবে তারা গভীর বিষণ্ণতায় ভুগছে এবং তাদের চিকিৎসা করার সময় অবশ্যই আত্মহত্যার বিপদ আসতে পারে। বিষণ্ণতার রোগীদের হতাশা এবং তাদের জীবনধারনের আশাহীনতা এত তীব্র হয় যে, তারা আত্মহত্যার ছাড়া আর কোন সমাধান দেখতে পায় না। দুর্বিষহ জীবন থেকে পলায়নই একমাত্র রাস্তা হিসাবে ভাবে। যে কারণে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত একজন রোগী আত্মহত্যা করে না তাহল এই যে, একটি আত্মহত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করার জন্য যে শক্তিটুকু দরকার তা তারা সংগ্রহ করতে পারে না। সেজন্য একজন গুরুতর বিষণ্ণতার রোগীকে চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসককে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে যখন রোগীটি বিষণ্ণতার নীচু খাদের থেকে কিছুটা উন্নতির দিকে যাচ্ছে, সেই সময়টা বিপজ্জনক। কারণ দুঃখবোধ এবং আশাহীনতা তখনও যথেষ্ট শক্তিশালী থাকে এবং ব্যক্তি আত্মহত্যাকেই একমাত্র বিকল্প হিসাবে ভাবতে পারে এবং সেই সময় সে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য যথেষ্ট শক্তি সংগ্রহ করে ফেলতে পারে। যেহেতু যারা আত্মহত্যা করে তাদের অনেকেই বিষণ্ণ থাকে, সেজন্য চিকিৎসকগণ আশা করেন যে, বিষণ্ণতার চিকিৎসা করা হলে আত্মহত্যার ঝুঁকি কমে যাবে।

পেশাদার কর্মীদের সংগঠন সমূহ যেমন আমেরিকান সাইকিয়াট্রিষ্ট এসোসিয়েশন, ন্যাশনাল এসেনিয়েশন অফ সোস্যাল ওয়াকার্স এবং আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন তাদের সদস্যদের উপর দায়িত্ব অর্পন করেছে লোকেরা যাতে নিজেদের ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। এমনকি এটা করতে গিয়ে যদি মক্কেল চিকিৎসকের সম্পর্কের গোপনীয়তা ভঙ্গ করতে হয়, তাহলেও মানুষের জীবন রক্ষা করা উচিত। একজন চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন কোন রোগী আত্মহত্যা করলে প্রায় সবসময়ই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। রোগীর পক্ষের লোক যদি প্রমাণ করতে পারে যে, চিকিৎসক ঠিকমত রোগীর মানসিক অবস্থার মূল্যায়ন করেন নি, অথবা আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন করেন নি, তাহলে চিকিৎসক হেরে যান। উপযুক্ত বা যুক্তিযুক্ত যত্ন নেয়া বলতে কি বোঝায় সে সম্পর্কে ঐক্য মতে পৌঁছানো কঠিন। বিশেষত যদি রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হয়, তাহলে চিকিৎসকের পক্ষে তাকে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখা অসম্ভব। রোগী যদি তার নিজের জীবনাবসান ঘটাতে চায়, তাহলে রোগীর সেই অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য চিকিৎসকদের নিজেদের নৈতিক মানদণ্ড নির্ধারণ করা উচিত। একজন লোক যদি আত্মহত্যা করতে চায়, তাহলে চিকিৎসক কি কি ব্যবস্থা নিতে ইচ্ছুক? তিনি কি রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করবেন? অথবা তিনি কি তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘুমের ঔষধ দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে রাখবেন? এ ধরনের অস্বাভাবিক ব্যবস্থা তিনি কত দিন চালিয়ে যাবেন? চিকিৎসকরা জানেন যে, রোগীর সঙ্কট একদিন কেটে যাবে, তখন রোগীটি যে মনে করেছিল আত্মহত্যা ছাড়া তার অন্য পথ নেই, সে হয়ত চিকিৎসককে তার জীবন রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু এই মধ্যবর্তী সময়ে চিকিৎসক একজন রোগীকে আত্মহত্যা থেকে বিরত রাখার জন্য কতদূর চেষ্টা করতে পারেন? এ সম্পর্কে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। অনেকে বলেন রোগীর ইচ্ছার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত এবং চিকিৎসক তার উপর জোর করে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিবেন না। আবার অনেকেই তা মনে করেন না।

চিকিৎসকের সহায়তায় মৃত্যুবরণ (Physician Assisted suicide)

চিকিৎসক একজন রোগীকে আত্মহত্যা করতে সাহায্য করবেন কিনা এটি একটি আবেগীয় এবং নৈতিক প্রশ্ন। এ প্রশ্নটি দেখা দিয়েছিল যখন মিশিগানের একজন চিকিৎসক যার নাম ডঃ জ্যাক কেভরকিয়ান (Dr- Jack Kevorkian)- একজন আলজাইমারের ব্যাধিতে আক্রান্ত ৫০ বৎসর বয়সী মহিলাকে আত্মহত্যা করতে সাহায্য করেছিলেন। আলজাইমারের ব্যাধি একটি ক্রমাবনতিশীল ব্যাধি যা স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে, মস্তিষ্কের ক্ষতি করে এবং শেষ পর্যন্ত ভাল হয় না। চিকিৎসক একটি যান্ত্রিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যাতে একটি বোতামে চাপ দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শরীরে একটি ইনজেকশন ঢুকবে এবং চেতনা নাশ করবে, তারপর বেশি মাত্রায় পটাশিয়াম ক্লোরাইড (Potassium chloride) শরীরে প্রবেশ করে হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ করে দেয় (Egan; 1990)। মৃত্যুর সময় কোন ব্যাথা হবে না। কেভরকিয়ানকে কয়েকবার বিচারের সম্মুখীন করা হয়, কিন্তু খুনের জন্য বা পেশাগত অসদাচরণের জন্য তার শাস্তি হয়নি। এর পর থেকে তিনি প্রায় চার ডজনের বেশি মরণাপন্ন রোগীকে স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করতে সাহায্য করেছেন এবং তিনি সক্রিয়ভাবে একটি আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন যে, কোন কোন পরিস্থিতিতে চিকিৎসক স্বেচ্ছামৃত্যুকে সাহায্য করতে পারেন। মিশিনগানে যখন দুবার দুটি আত্মহত্যায় সাহায্য করার জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা চলছিল। এবং দুবারই তিনি নিরাপরাধ প্রমাণিত হয়েছিলেন তখন নর্থডিস্ট্রিক্ট এর ফেডারেল কোর্ট ৬ই মার্চ ১৯৯৬ তারিখে একটি রুল জারী করেন যাতে চিকিৎসকের সাহায্যে আত্মহত্যার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে শর্ত থাকে যে রোগীটি প্রান্তিক ভাবে অসুস্থ (মৃত্যু অবধারিত এমন একটি ব্যাধিতে আক্রান্ত) এবং মানসিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম ( mentally competent)। বিচারক স্টিফেন রেইন হার্ড (Stephen Reinhardt) মন্তব্য করেছিলেন যে, একজন মানসিকভাবে সুস্থ বা সক্ষম ব্যক্তির, যে প্রান্তীয় ব্যাধিতে আক্রান্ত, তার একটি সম্মানজনক ও মানবীয় মৃত্যুকে বেছে নেওয়ার জোরালো স্বাধীনতা রয়েছে, যাতে তাকে শিশুর মত অসহায়, নিদ্রিত, অক্ষম অবস্থায় অস্থিত্ব বিসর্জন দিতে না হয়। তবে একজন চিকিৎসক অন্যকে মরতে সাহায্য করতে পারেন কি না এ বিতর্ক এখনো চলছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে রোগীর আত্মীয় স্বজনরা এর সুযোগ নিয়ে রোগীকে আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত করতে পারে। এমনকি রোগী তার ছেলে, মেয়ে বা আত্মীয় স্বজনকে ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য অর্থ ব্যয় করার দায় থেকে রক্ষা করার জন্য নিজেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং চিকিৎসককে সাহায্য করতে বলতে পারে। বিশেষ করে আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন এবং ক্যাথলিক চার্চ আত্মহত্যার প্রচেষ্টায় সাহায্য করার বিপক্ষে। আবার আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন সহ অনেকেই মনে করেন, মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের অসহা কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাদের স্বেচ্ছামৃত্যুবরণে চিকিৎসকদের সাহায্য করা উচিত। তারা মনে করেন একজন রোগী কিভাবে নিজের জীবনের অবসান ঘটাবে তা স্থির করা তার অবিচ্ছেদ্য অধিকার; এতে রাষ্ট্রের নাক গলানো উচিত নয়। উক্ত রুলিংয়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপীল করা হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে চিকিৎসকের সতর্ক থাকা উচিত এবং রাষ্ট্রীয় নীতি বিবেচনা করা উচিত। আত্মহত্যায় উদ্যত রোগীদের চিকিৎসার জন্য কিছু নির্দেশনা এখানে দেওয়া হল –

সাধারণ পদ্ধতি (General Procedures)

  • ১. আত্মহত্যা সম্পর্কে খোলাখুলি ভাবে এবং বাস্তব সম্মত ভাবে কথা বলুন।
  • ২. আত্মঘাতী আচরণ বা প্রেষণার কদর্থ বা নেতিবাচক ব্যাখ্যা পরিহার করতে হবে।
  • ৩. আত্মহত্যার সমস্যা সমাধানমূলক তত্ত্ব উপস্থিত করুন এবং এটি যে একটি অন-অভিযোজনমূলক আচরণ তেমন দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখুন।
  • ৪. সমস্যাটির সমাধানে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করুন, এমন কি অন্যান্য চিকিৎসকদেরও সম্পৃক্ত করুন।
  • ৫. ঘন ঘন রোগীর সাথে বসার বা আলোচনা করার জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করুন, এসব অধিবেশনে কিছুটা সময় দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যয় করুন।
  • ৬. রোগীর উপরে অসংখ্য শর্তের প্রভাবের কথা চিন্তা করুন এবং নিজের উপর রোগীর সব দায়িত্ব নেবেন না।
  • ৭. অন্য সহকর্মীদের সাথে পেশাগত আলোচনা রক্ষা করে চলুন।
  • ৮. যেসব রোগী চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের সাথে মাঝে মাঝে যোগাযোগ রাখুন।

সংকটপূর্ব-পরিকল্পনা (Pre crisis Planning Procedures)

  • ৯. সংকটকালের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকুন এবং পরিকল্পনা করুন।
  • ১০. আত্মহত্যার ঝুঁকি সব সময় মূল্যায়ন করুন।
  • ১১. রোগী আপনার সাথে যেকোন সময় যোগাযোগ এবং সাক্ষাৎ করতে পারে, এভাবে নিজেকে সহজলভ্য করুন।
  • ১২. স্থানীয় জরুরী সেবা ব্যবস্থা বা আত্মহত্যার জন্য যেসব সেবা ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলোর সাহায্য নিন ।
  • ১৩. রোগীকে একটি ক্রাইসিস কার্ড (সঙ্কটকালীন কার্ড) দিন। এতে চিকিৎসকের টেলিফোন, পুলিশের টেলিফোন, হাসপাতালের টেলিফোন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির টেলিফোন নাম্বার থাকবে।
  • ১৪. নিজের কাছে রোগীর ও তার গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয় স্বজনের টেলিফোন নাম্বার রাখুন।
  • ১৫. স্বল্পকালীন আত্মহত্যা বিরোধী চুক্তি করুন এবং তা হালনাগাদ রাখুন।
  • ১৬. রোগীর শারীরিক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন এবং অতিরিক্ত ঔষধের ঝুঁকি সম্পর্কে আলোচনা করুন।

চিকিৎসামূলক সংরক্ষণ পদ্ধতি (Therapeutic Maintenance Procedures)

  • ১৭. আপনার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের জন্য রোগীকে আত্মহত্যার কথা আলোচনা করতে বাধ্য করবেন না।
  • ১৮. আপনার সেবা যত্নের কথা প্রকাশ্যে বলুন, নিঃশর্ত স্নেহ এবং মনোযোগ দিন।
  • ১৯. সমস্যার সমাধানে আত্মহত্যা ছাড়া অন্যান্য প্রচেষ্টাগুলোকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরুন এবং পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহিত করুন।
  • ২০. রোগীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করুন এবং তার আত্মহত্যার প্রচেষ্টার প্রতি চিকিৎসকসুলভ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করুন (যেমন রোগী যদি মারা যায় তাহলে চিকিৎসক দুঃখিত হবেন, তবে তিনি কোন মতে প্রাণধারণ করবেন)।
  • ২১. ভবিষ্যতে আত্মহননমূলক আচরণের প্রতি অন্যেরা কি প্রতিক্রিয়া করতে পারে এসম্পর্কে রোগীকে বাস্তবমুখী প্রত্যাশা করতে উদ্বুদ্ধ করুন।

তথ্যসূত্র 

  • অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান : মানসিক ব্যাধির লক্ষণ, কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, অধ্যাপক নিহাররঞ্জন সরকার, ডাঃ তনুজা সরকার, পৃষ্ঠা ৩৫৭-৩৯৮

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.