ফিনল্যান্ডের ক্ষমতায় এবারে দক্ষিণপন্থী দলগুলোর জোট সরকার, কিন্তু টিকবে কি?

এপ্রিলে ফিনল্যান্ডে জাতীয় নির্বাচন শুরু হয়। ২০১৯ সালের শেষ নির্বাচনের পর থেকে ফিনল্যান্ডকে শাসন করছে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এসডিপি) নেতৃত্বাধীন মধ্য-বাম জোট। এখন এই জোটের নেতৃত্বে ছিলেন মূলত এসডিপির প্রবীণ নেতা আন্তি রিনে (Antti Rinne), তবে ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিবাদগুলি ঠিকমত সামলাতে না পারার কারণে কয়েক মাস পরেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এর ফলে ক্ষমতায় আসেন ৩৪ বছর বয়সী সানা মারিন (Sanna Marin), দেশটির সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী হয়ে। আর এরপর তিনি একরকম রাজনৈতিক রক স্টার হয়ে ওঠেন ও গোটা ইউরোপ জুড়ে বিখ্যাত হন। তো সানা মেরিনা জন্য এসডিপির ভোট শেয়ার ২০১৯ সালের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দুৰ্ভাগ্যবশত এই এপ্রিলের নির্বাচনে তার দোল মধ্য-ডানপন্থী ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টির কাছে পরাজিত হয়, আর এর মাধ্যমে ক্ষমতা চলে যায় ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টির কাছে। এভাবে এই বছরে ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টি ডানপন্থী ফিনস পার্টি ও সাথে আরো তিনটি দল নিয়ে জোট সরকার গঠন করে, যাদের মোট সিট সংখ্যা হয় ১০৯।

তবে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর ফিন্স পার্টি থেকে আসা তিন মন্ত্রীর বিদ্বেষী কমেন্টগুলো প্রকাশিত হয়েছে, একজন পদত্যাগও করেছে, একের পর এক সংকট লেগেই আছে। এবারে এই আর্টিকেলে ফিনল্যান্ডের নির্বাচন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলি কীভাবে কাজ করে, নির্বাচনে কী ঘটেছিল, কেন সানা মারিন পরাজিত হল আর দক্ষিনপন্থীরা জিতে গেল, ফিনল্যান্ডের নতুন এই কোয়ালিশন সরকর কিভাবে গঠিত হল ও এই সরকার কী সংকটে আছে তা নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিশাল টপিক, গোটা ফিনল্যান্ডের রাজনৈতিক পালাবদলের কাহিনীই আলোচিত হচ্ছে, তবে এটা কেবল ফিনল্যান্ডেরই কাহিনী না, অনেক উন্নত দেশকেই এটি রিপ্রেজেন্ট করবে। সেই সাথে কিছু জেনারেল বিষয় যেমন ফিস্কাল কঞ্জারভেটিজম ও ফিস্কাল লিবারালিজমের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ইমিগ্রেশন বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের দ্বন্দ্ব নিয়ে কিছুটা আলোচনা আছে। তাই একটু ধৈর্য ধরে পড়তে অনুরোধ করা হচ্ছে।…

ফিনল্যান্ডের নির্বাচনী ব্যবস্থা

ফিনল্যান্ডের সরকার ব্যবস্থা একটি আধা-রাষ্ট্রপতি বা সেমি-প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, যার অর্থ হচ্ছে এখানে দুই সেটের জাতীয় নির্বাচন হয় – প্রতি ছয় বছর পরপর হওয়া রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, যেখানে রাষ্ট্রপতি মূলত ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতি রক্ষণাবেক্ষণ করেন, এবং প্রতি চার বছর পর পর হওয়া সংসদীয় নির্বাচন। এপ্রিলেরটা ছিল সংসদ, প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার নির্বাচন করার জন্য সংসদীয় নির্বাচন। ফিনল্যান্ডের ইলেকটোরাল সিস্টেম হচ্ছে প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন। মানে হচ্ছে প্রতিটি কনস্টিটুয়েন্সির জন্য একাধিক সিট থাকে। ফিনল্যান্ডে এরকম ১৩টি মাল্টি-মেম্বার কনস্টিটুয়েন্সিতে ২০০টি সিট রয়েছে, মানে ২০০ জন এমপি নির্বাচিত হন। এখন, প্রতিটি কনস্টিটুয়েন্সি বা নির্বাচনী এলাকার এমপিদের সংখ্যা নির্বাচনী এলাকার জনসংখ্যার আনুপাতিক বলে ফিনল্যান্ডের সংসদ সাধারণত ইলেক্টরেটগুলোর ভোট শেয়ারকেই প্রতিফলিত করে। তাই যদি কোনও দল ২০% ভোট পায় তবে সম্ভাবনা রয়েছে যে তারা প্রায় ৪০ টি আসন পাবে।

এখন ইলেকটোরাল সিস্টেম প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন হলে সুবিধা হচ্ছে এতে সংসদে ভোটারদের রিপ্রেজেন্টেশন সর্বোচ্চ হয়। কিন্তু এতে অসুবিধাও আছে , আর তা হচ্ছে মূলত কোয়ালিশন সরকারের প্রতিষ্ঠা, যার ফলে সংসদের ডিসিসিভ স্টেপ নিতে সমস্যা হয়। তো ফিনল্যান্ডেও কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠায় একরকম রীতি হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে, ফিনিশ রাজনীতিতে তিনটি সুপ্রতিষ্ঠিত দল আধিপত্য বিস্তার করেছে: মধ্য-ডানপন্থী কোকোমাস, যা ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টি হিসাবে পরিচিত; মধ্যপন্থী সেন্টার পার্টি এবং মধ্য-বাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, যা সাধারণত এসডিপি নামে পরিচিত। এখন, ৮০-এর দশক থেকে, এই তিন পার্টি সাধারণত মোট ভোটের ১৫-৩০% এর মধ্যে পায়, এবং এই তিনের মধ্যে যারাই শীর্ষে আসে তারা একটি জোট সরকার বা কোয়ালিশন গঠন করে, আর তারা সেটা করে সাধারণত ছোট দলগুলির পুরো লোডের সমর্থন নিয়ে।

ফিন্স পার্টির উত্থান

তবে, গত এক দশকে ফিনিশ রাজনীতি ফিনস পার্টির উত্থানের কারণে পরিবর্তিত হয়েছে, যা পূর্বে ট্রু ফিনস নামে পরিচিত ছিল। এরা মূলত একটি ডানপন্থী পপুলিস্ট পার্টি যা ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফিনিশ রুরাল পার্টির উত্তরসূরি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আর অভিবাসনের উপর ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করেছিল। এখন, আধুনিক ইতিহাসের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এরা প্রায় ৫% ভোট পেয়ে এসেছে, তবে তারা ২০১১ সালের নির্বাচনে ১৯.১% ভোট এবং ৩৯ টি আসন জিতে একটি বিশাল নির্বাচনী সাফল্য অর্জন করে, ও সেন্টার পার্টিকে ছাড়িয়ে ফিনিশ পার্লামেন্টে তৃতীয় বৃহত্তম দল হয়ে ওঠে। আর তারপর থেকে, তারা ফিনল্যান্ডের রাজনীতিতে একটি বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। তারা ২০১৫ সালে সিটের কাউন্টে পার্লামেন্টে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হয়ে ওঠে এবং বিজয়ী সেন্টার পার্টির সাথে একটি জোট সরকার গঠন করে। আর ২০১৭ সালে অর্ধেক এমপি হারানোর পরেও এরা এদের অধিকতর মধ্যপন্থী অফশুট, ব্লু পার্টি ২০১৯ সালে বেশ ভাল করেছে, পুনরায় দ্বিতীয় স্থান দখল করে। তবে ২০১৯ সালে বিজয়ী দল ছিল এসডিপি, তবে সেই বছরও এই ফিনস পার্টিই ১৭.৭% ভোট এবং ৩৮ টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। এসডিপি নিজেদের মতাদর্শের ভিত্তিতে ফিনসদের সাথে জোট গঠন করতে অস্বীকার করে ও এদের ছাড়াই সেন্টার পার্টি এবং আরও তিনটি ছোট বামপন্থী দল – গ্রিন লীগ, লেফট এলায়েন্স, এবং সুইডিশ পিপলস পার্টি সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে।

সানা মারিনের ক্ষমতা গ্রহণ, নির্বাচনে তার ও তার দল এসডিপির পরাজয়ের কারণ 

যাই হোক, আন্তি রিনের স্থানে সানা মারিন আসার পর থেকে সানা মারিন মোটামুট ভালভাবেই টার্মটা অতিক্রম করে, বেশিরভাগ মানদণ্ড থেকেই। কোভিড-১৯ এর সময় ফিনল্যান্ডের অর্থনীতি ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের তুলনায় ভাল করেছে, তাছাড়া মারিন ইউক্রেনে পুতিনের আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। পুতিন যখন ইউক্রেনীয় সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করছিলেন, তখন তিনি প্রথমে ন্যাটোতে যোগদানের ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন তবে পুতিন আক্রমণ করার পরে দ্রুত ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে চলে যান, এবং এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ন্যাটোতে যোগদানই ফিনিশ জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে গত বছর মারিনকে ঘিরে একটি “সেমি-স্ক্যান্ডালের” ঘটনা ঘটে, যেখানে তাকে বন্ধুদের সাথে নাচের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, তবে এটি তার এপ্রুভাল রেটিং-কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে মনে হয় না। ডিসেম্বরে ফিনল্যান্ডের একটি প্রধান সংবাদপত্রের একটি জরিপে দেখা গেছে যে, দেশটির ৬৪% পুরুষ এবং ৬৯% নারী সানার মেয়াদকে ইতিবাচক বলে মনে করেছেন।

এজন্যই ৬ই এপ্রিলে প্রকাশিত নির্বাচনের ফাইনাল রেজাল্টে যখন সানা মারিনের এসডিপি এর পরাজয় রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ ধাক্কা দেয়। ফলাফলে দেখা যায়, মারিনের এসডিপি ন্যাশনাল কোয়ালিশন ও ফিনস পার্টি উভয়ের কাছেই হেরেছে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে যে, আপাতদৃষ্টিতে মারিন এত জনপ্রিয় হলেও কেন পরাজিত হয়েছিল? কারণ মূলত তিনটি – প্রথমত, মারিন ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয় হলেও তার কোয়ালিশন ছিল না। নির্বাচনে ন্যাশনাল কোয়ালিশন স্থিতিশীলভাবে বা কন্সিস্টেন্টলি এগিয়ে গেছে, এবং মারিনের এসডিপি আসলে ২০১৯ সালের চেয়ে ভাল ফল করলেও, তার  কোয়ালিশনের অন্যান্য পার্টিগুলো আগের চেয়েও বেশি খারাপ করেছে। এই ফলাফলগুলি আরও ইঙ্গিত দেয়, এখানে কিছুটা ট্যাকটিক্যাল ভোটিং কাজ করেছে, বামপন্থী ভোটাররা ছোট দলগুলি থেকে দূরে সরে গিয়ে এসডিপির দিকে ঝুঁকছেন যাতে মারিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে , ২০২১ সালে ফিনস পার্টিতে নতুন নেতা আসার পর তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নেতা এসে পার্টির লক্ষ্য ও নীতিতে কিছু পরিবর্তন এনেছেন। এখনও এই পার্টি আগের মতোই ইমিগ্রেশন-বিরোধী, কিন্তু তারা আর চায়না যে ফিনল্যান্ড ইইউ থেকে বেরিয়ে যাক, মানে কিছুটা ইইউ বিরোধিতা থাকলেও তারা আগের চেয়ে নরম হয়েছে। আর সেই সাথে তাদের যে সোশ্যাল স্পেন্ডিং প্রোগ্রাম ছিল তা তারা কমিয়ে এনেছে, মানে তারা আরও বেশি করে ফিসকাল কনজারভেটিজমের দিকে মানে সরকারি স্পেন্ডিং কমানোর দিকে ঝুঁকেছে যা সাধারণভাবে দক্ষিণপন্থী পার্টিগুলোর নীতি হয়ে থাকে (আর এভাবে তারা আরও বেশি করে দক্ষিণপন্থী ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে)। মারিনের পরাজয়ের তৃতীয় কারণটি হচ্ছে দেশের অর্থনীতি বিষয়ে তার অবস্থান ও প্রচারণা। ফিনল্যান্ড স্টেইট ডেফিসিট ও ঋণের সংকটে আছে। একজন বামপন্থী হিসেবে তিনি দেশে বাইরে থেকে তরুণ ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে এসে রেভিনিউ বারবার মাধ্যমে এর সমাধান প্রস্তাব করেন, কিন্তু বিরোধীরা এটার বদলে দেশটির ওয়েলফেয়ার স্পেন্ডিং কমানো প্রস্তাব করে। জনগণের পরের অপশনটিই পছন্দ ছিল। এই ব্যাপারে একটু ডিটেইলে আলোচনা করা যাক…

ফিনল্যান্ডের অর্থনৈতিক সংকট ও তা নিয়ে ফিস্কাল লিবারেলিজম বনাম ফিস্কাল কঞ্জারভেটিজম

ফিনল্যান্ডের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার বর্তমানে ৮.৮%, যার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার সুদের হার কমিয়ে রাখতে হচ্ছে। এদিকে দেশটি একটি উদার কল্যাণ রাষ্ট্র মানে ব্যয় ও ট্যাক্স অনেক বেশি। আবার তার ওপর দেশটির জনসংখ্যা এজিং বা ক্রমশ বয়স্ক হচ্ছে, কর্মক্ষম তরুণদের অভাব দেখা যাচ্ছে। আর এই তিনটি বিষয়ই ফিনল্যান্ডের উৎপাদন ও রেভিনিউ বা রাজস্বে। (বিজনেস খারাপ গেলে স্বাভাবিকভাবেই সেখান থেকে ট্যাক্সও কম আসবে যা দেশের রাজস্বের অন্যতম প্রধান উৎস্য, তাছাড়া ইনফ্লেশন হলে অনেক সময় ট্যাক্স কাটও করতে হয়।) তো এভাবে দেশটির রেভিনিউ বা রাজস্ব কমে যাচ্ছে। গভর্নমেন্ট স্পেন্ডিং বা সরকারি খরচ যদি দেশের রাজস্বের চেয়ে বেশি হয় তবে স্টেইট ডেফিসিট হয়। স্পেন্ডিং এর থেকে রেভিনিউ বিয়োগ করলে যা পাওয়া যায় তাই স্টেইট ডেফিসিট। ফিনল্যান্ড একটি উদার কল্যাণ রাষ্ট্র হওয়ায় এর স্পেন্ডিং অনেক বেশি, কিন্তু ইনফ্লেশন ও এজিং পপুলেশনের জন্য রেভিনিউ কমে যাচ্ছে, তাই দেশটির স্টেইট ডেফিসিট বাড়ছে। স্টেইট ডেফিসিট বাড়লে রাষ্ট্রকে ডোমেস্টিক বা ইন্টারন্যাশনাল বা উভয় রকমের ঋণ নিয়ে এই ডেফিসিটকে কাভার করতে হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্ট্যাবিলিটি এন্ড গ্রোথ প্যাক্ট অনুসারে তার সদস্য রাষ্ট্রকে ডেট (Debt) টু জিডিপি রেশিও (মোট ঋণ জিডিপির যত পার্সেন্ট হয়) ৬০% ও স্টেইট ডেফিসিট টু জিডিপি রেশিও ৩% এর মধ্যে রাখতে হয়। কোন দেশের ডেট টু জিডিপি রেশিও ৬০% এর উপরে গেলে ইইউ এর অর্থনৈতিক অবস্থা মনিটরিং করতে শুরু করে ও রিকমেন্ডেশন দেয়, আর স্টেইট ডেফিসিট টু জিডিপি রেশিও ৩% ছাড়িয়ে গেলে ইইউ এক্সেসিভ ডেফিসিট প্রসিডিউরের মাধ্যমে দেশের ইকোনোমিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ব্যবস্থা করে। ফিনল্যান্ডের ডেট টু জিডিপি রেশিও ইতিমধ্যেই ৭৩%, আর এভাবে যদি চলতে থাকে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশটির স্টেইট ডেফিসিট জিডিপির ৩% হয়ে যাবে, যা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বেঁধে দেয়া ম্যাক্সিমাম। ইইউ এর কোন দেশের ফিসকাল ডেফিসিট জিডিপি এর ৩% ছাড়িয়ে গেলেই চুক্তি অনুসারে ইইউ দেশটির ওপর এক্সেসিভ ডেফিসিট প্রসিডিউর (ইডিপি) আরোপ করবে। এই প্রসিডিউর দেশের ইকোনোমিক পলিসি ও একটিভিটি নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারগুলো থাকে, যেমন স্পেন্ডিং কমানো, ট্যাক্স বাড়ানো, প্রয়োজনে ইকোনোমিক স্ট্রাকচারে সংস্কার আনা ইত্যাদি।

সে যাই হোক, এই অবস্থায় মারিনের প্রচারিত সমাধান কী ছিল সেদিকে যাবার আগে, এরকম ট্রেড ডেফিসিট হলে কোন দেশের বামপন্থী ও ডানপন্থীরা কী অবস্থান নেয় সেটা নিয়ে একটু বলে নেই। স্পেন্ডিং থেকে রেভিনিউ বিয়োগ করলেই ডেফিসিটি আসছে। তাই ডেফিসিটি কমানো যাবে স্পেন্ডিং কমালে ও রেভিনিউ বাড়ালে। এখন বামপন্থীরা গভার্নমেন্ট স্পেন্ডিং সাপোর্ট করে, যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বেশি সরকারি স্পেন্ডিং বাড়িয়ে একে আরো বেশি করে জনসাধারণের জন্য এভেইলেবল করা, ও এর মধ্য দিয়ে সোশ্যাল ইকুয়ালিটি বাড়ানো। তাই স্টেইট ডেফিসিট কমানোর জন্য বামপন্থীরা গভর্নমেন্ট স্পেন্ডিং-এ  হাত দিতে চায়না। বরং বিভিন্নভাবে রেভিনিউ বাড়ানোর মাধ্যমে ডেফিসিট কমাতে চায়। রেভিনিউ বাড়ানোর উপায় হিসেবে তারা বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়, আর যদি দেশে পপুলেশন বেইজিং হয়, যা উন্নত দেশগুলোর অন্যতম সমস্যা, সেক্ষেত্রে তারা ইমিগ্রেশনকে সাজেস্ট করে, মানে বাইরের দেশ থেকে ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিয়ে শ্রমঘাটতি পূরণ করতে চায়। এদিকে দক্ষিনপন্থীরা তুলনামূলক জাতীয়তাবাদী অবস্থান নেয়, তারা বেশি ইমিগ্রেশন পছন্দ করেনা তাতে সোশ্যাল ইনস্ট্যাবিলিটির সম্ভাবনা বাড়তে পারে ভেবে। আর সেই সাথে তারা যেহেতু তারা বিজনেসে সরকারি হস্তক্ষেপ কমাবার পক্ষে থাকে তাই তারা ট্যাক্স কাট ও গভর্নমেন্ট স্পেন্ডিং কমিয়ে আনার পক্ষে থাকে। আর তাই ট্রেড ডেফিসিট কমানোর জন্য তারা গভর্নমেন্ট স্পেন্ডিং কমিয়ে আনার পক্ষপাতী হয়। আর এভাবেই এই বিষয়ে বামপন্থী ও ডানপন্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ তৈরি হয়।

আরও জেনারেলি বলতে গেলে বামপন্থীরা ফিসকাল লিবারেলিজম ও ডানপন্থীরা ফিসকাল কনজারভেটিজম অনুসরণ করে। (যারা এই ব্যাপারে অলরেডি জানেন তারা এই প্যারাটা স্কিপ করবেন।) ফিসকাল লিবারালিজমের ক্ষেত্রে এক্সপ্যানশনারি ফিস্কাল পলিসি নেয়, মানে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ও সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারে স্পেন্ডিং বাড়ায়। এক্ষেত্রে বাজেট ডেফিসিটকে খুব একটা কেয়ার করা হয়না, প্রয়োজনে শর্টটার্মের জন্য বাজেট ডেফিসিট ঘটিয়ে, ঋণ নিয়ে ইকোনোমিক এক্টিভিটিকে স্টিমুলেট করে বেকারত্বের মতো ইকোনোমিক প্রবলেমকে ট্যাকল দেয়া হবে। কিন্তু ঋণ বাড়তে বাড়তে দেশের ডেট টু জিডিপি রেশিও খারাপের দিকে গেলে, ওয়েলফেয়ার স্পেন্ডিং বাড়তে বাড়তে স্টেইট ডেফিসিট টু জিডিপি রেশিও খারাপ দিকে গেলে (যেমনটা ফিনল্যান্ডে দেখা যাচ্ছে) আর বাজেট ডেফিসিটকে অবহেলা করা যায়না, তখন ফিসকাল লিবারেলিজম স্পেন্ডিং কমানোর বদলে বিভিন্নভাবে ইনভেস্টমেন্ট প্রমোট রেভিনিউ বাড়াতে বলে, দেশ রিসেশনের দিকে গেলে এরা দেশে এগ্রিগেট ডিমান্ড বাড়াতে গভর্নমেন্ট স্পেন্ডিং বাড়ায়, ট্যাক্স কাট করে। অন্যদিকে ফিস্কাল কনজারভেটিভরা মানে দক্ষিনপন্থীরা বাজেট নিয়ে সবসময় মনোযোগী হয় ও এটার ব্যালেন্স মেইনটেইন করার চেষ্টা করে, কখনোই ঋণ জমতে দিতে চায়না। তারা ফিস্কাল ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করতে চায়, সরকারের স্পেন্ডিং কমাতে চায়, সরকারের ইকোনোমিক সাইজ কমাতে চায়, পাবলিক প্রোগ্রাম ও সার্ভিসের স্কোপকে সীমাবদ্ধ করতে চায়। এরা ট্যাক্স কাট ও ডিরেগুলেট করে প্রাইভেট সেক্টরে ইনসেন্টিভাইজ করে, জব ক্রিয়েশন, ইকোনোমিক গ্রোথ সাপোর্ট করে। ইকোনোমিক এক্টিভিটিতে তারা যতটা সম্ভব কম ইন্টারভিন করতে চায় ও রিসোর্স এফিসিয়েন্সি বারবার জন্য ফ্রি-মার্কেট মেকানিজম প্রমোট করতে চায়।

ইমিগ্রেশন ও ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে বামপন্থী বনাম ডানপন্থী

এখন মাইগ্রেশনের বিষয়টাও এসেছে বলে এটা নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধটা নিয়েও বলা দরকার। এখন মাইগ্রেশন নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয় কেবল ইকোনোমিক নয়, সাথে সাথে সোশ্যালও। কিন্তু সোশ্যাল দিকগুলোও ইকোনোমিকাল কন্সিডারেশনের ঊর্ধ্বে না। ফিস্কাল লিবারাল বা বামপন্থীরা লেবর গ্যাপ কমানোর জন্য ও এর মাধ্যমে ইকোনোমিক গ্রোথ বাড়ানোর জন্য, আর তার মাধ্যমে রেভিনিউ বাড়ানোর জন্য দেশে তরুণ ও কর্মক্ষম মাইগ্রেন্টদের নিয়ে আসতে চায়, বা একে এই সমস্যাগুলোর সমাধানের একটি উপায় বলে মনে করে, কেননা এটি তাদেরকে ওয়েলফেয়ারের জন্য স্পেন্ডিংকে আপোষ না করে ইকোনোমিক গ্রোথকে বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। এছাড়াও এরা ওয়ার্কফোর্সে এলে এদের থেকো ট্যাক্স কালেকশন করা যাচ্ছে, ফলে এই দিক দিয়েও সরকারের রেভিনিউ বাড়ছে। এই দুটো ডিরেক্ট ইকোনোমিক বেনিফিট ছাড়াও কিছু ইন্ডিরেক্ট ইকোনোমিক বেনিফিটের কথা বামপন্থীরা বলেন, যেমন ইমিগ্রেন্টরা ভিন্নভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড, সমাজ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ট্যালেন্ট ও যোগ্যতা নিয়ে আসার ফলে দেশে সামাজিক ও সাংষ্কৃতিক সমৃদ্ধি আসে, এর ফলে দেশে ইনোভেশন বা আবিষ্কার উৎসাহিত হয়, যার ফলে বিজনেস বৃদ্ধি পায়। দেশে বিভিন্ন রকমের মানুষ থাকলে মার্কেট ডাইভার্স হতে পারে, তা ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিটিভনেসেও হেল্প করতে পারে, কারণ দেশে ডাইভার্স মার্কেট ধরার প্র্যাকটিসের মধ্যে দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্ষেত্রেও সেটা করার সম্ভব হয়। দেশে বিভিন্ন কালচার বিদ্যমান থাকলে তা ট্যুরিস্ট এট্রাকশন হতে পারে। এর ফলে মানুষের মধ্যে অন্যান্য কালচারের প্রতি সহনশীলতা বাড়ে, সোশ্যাল কোহেশন বাড়ে, আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাড়ে, এর মাধ্যমে সোশ্যাল স্ট্যাবিলিটি বাড়ে, ফলে ইনভেস্টমেন্ট আসে, একই সাথে এর ফলে ট্রাস্ট বাড়ে, ইকোনোমিক একটিভিটি বাড়ে। বিভিন্ন দুর্দশাগ্রস্ত দেশ থেকে মাইগ্রেশন সাপোর্ট করলে তা ইন্টারন্যাশনাল রেপুটেশনও বৃদ্ধি করে, সফ্ট পাওয়ার বাড়ে, এতে অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক ভালো হয়, লেনদেন বাড়ে, সেই সাথে গ্লোবাল ওয়ার্কফোর্স মেবিলিটিও বাড়ে, দরকারে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রয়োজনীয় ট্যালেন্ট ও এক্সপার্টিস সহজে পাওয়া যায়।

ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে ফিসকাল কনজারভেটিভ বা দক্ষিণপন্থীদের কনসার্ন ও বিরোধিতারও ইকোনোমিক ও সোশ্যাল দিক আছে, আর সোশ্যাল দিকগুলোরও ইকোনোমিক দিক আছে। তারা মনে করে ইমিগ্রেন্টরা দরিদ্র দেশ থেকে আসে ও গরিব হয়, তাদের স্কিলও খারাপ হয়, অনেকে রিফিউজি চ্যানেল থেকে আসে। দেশের সার্ভিসগুলোতে এরা এফিশিয়েন্টলি কাজ করেন, অন্যদিকে ঠিকই এদের এডুকেশন, হেলথ সব বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচুর গভর্নমেন্ট স্পেন্ডিং হয়, যা উল্টে দেশের ইকোনমির জন্য ক্ষতিকর হয়। ইমিগ্রেন্টরা অনেক কম মজুরির বিনিময়ে দেশের লেবর মার্কেটে প্রবেশ করে, এর ফলে লেবর কস্ট কমে যায়, ফলে নেটিভ লোকেরা যথেষ্ট মজুরি পায়না, তাদের চাকরির অভাব ঘটে, বেকারত্ব  বাড়ে, অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়, সোশ্যাল স্ট্যাবিলিটি কমে। এদের অনেকে মনে করে, ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা বেড়ে গেলে দেশের কালচার, সোসাইটি, ভাষায় যে পরিবর্তনগুলো আসে তার মধ্যে দিয়ে কালচারাল কোহেশন ও ন্যাশনাল আইডেন্টিটির জায়গা লোপ পায়। শেয়ার্ড সেন্স অফ ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কমে যাওয়ায় তার এফেক্ট জাতির মধ্যে একে অপরের প্রতি ট্রাস্টে পড়ে ও ইকোনোমিক এফিসিয়েন্সি কমে যায় (একই যুক্তি ফিসকাল লিবারেলরা মাইগ্রেশনের পক্ষে দেয়, তাদের মতে দীর্ঘমেয়াদে এতে ট্রাস্ট ও কোহেশন বৃদ্ধি পায়)। তাদের মতে, মাইগ্রেন্টদের সাথে নেটিভদের বিরোধিতা সোশ্যাল স্ট্যাবিলিটিতেও বিঘ্ন ঘটায়, এটার প্রভাব সরাসরি ইকোনোমিতে পড়ে (অন্যদিকে ফিস্কাল লিবারালদের মতে এর ফলে ইমিগ্রেন্টদের প্রভাবে সোশ্যাল স্ট্যাবিলিটি বাড়ে)। ফিসকাল লিবারালরা যেখানে বলে ইমিগ্রেন্টদের প্রভাবে তাদের কালচার ডাইভার্সিফিকেশনের ফলে সমৃদ্ধ হয় আর তা বিভিন্নভাবে ইকোনমির বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে, সেখানে ফিস্কাল কনজারভেটিভ বা দক্ষিনপন্থীরা বলে, ইমিগ্রেন্টরা উল্টে কালচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এতে নেটিভ কালচার প্রিজার্ভড হয়না বা রক্ষিত হয়না। এর ফলে হিস্টোরিক্যাল সিগ্নিফিকেন্স আছে এরকম সোশ্যাল ভেল্যুস, কাস্টমস, ইনস্টিটিউশনের ক্ষতি হয়। এর ফলে  ট্যুরিজম,কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি, কালচারাল এন্ট্রাপ্রিনিউয়ারশিপ, সফ্ট পাওয়ার সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর তারা এই যুক্তিও দেয় যে, ন্যাশনাল আইডেন্টিটি ও সোশ্যাল কোহেশন বা সামাজিক সংশক্তির ফলে মানুষ স্বেচ্ছায় প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে একে অপরকে সহায়তা করে, এর ফলে গভর্নমেন্ট ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রাম কম লাগে, গভর্নমেন্ট স্পেন্ডিংও কম হয়, যেটা ফিস্কাল কনজারভেটিভরা পছন্দ করে। কিন্তু ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা বেড়ে গেলে এই ন্যাশনাল আইডেন্টিটি ও সোশ্যাল কোহেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার ফলে মানুষ আর প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে একে অপরকে সহায়তা তেমন করেনা, ফলে গভর্নমেন্ট  স্পেন্ডিং বেড়ে যায়।

যাই হোক, এবারে মূল আলোচনায় ফিরে যাই। স্টেইট ডেফিসিটর ফলে বামপন্থী ও ডানপন্থীদের মধ্যে যে মতভেদ হবার কথা, ফিনল্যান্ডেও তাই হয়। স্টেইট ডেফিসিটের অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য, মারিন এবং এসডিপি বলে, ফিনল্যান্ডকে আরও তরুণ অভিবাসীদেরকে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া দরকার, পাশাপাশি দেশের দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় আরও কঠোর বিনিয়োগ করা দরকার। কিন্তু তার বিরোধীরা দ্বিমত পোষণ করে বলে, এই সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের কল্যাণ ব্যয় বা ওয়েলফেয়ার স্পেন্ডিং হ্রাস করা দরকার। আর দুর্ভাগ্যবশত, ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দেশটির লোকেরা উত্তর ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই ফিস্কাল কনজারভেটিভ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। তারা এক মেয়াদের মধ্যে দেশের ডেট টু জিডিপি রেশিও ৬০% এর নিচে নামিয়ে আনতে চায়। তাই তারা ন্যাশনাল কোয়ালিশন ও ফিন্স পার্টিকেই ভোট দিয়েছে।

ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টির জোট সরকার গঠন ও ফিন্স পার্টির সাথে জুড়তে বাধ্য হওয়া

এবারে ২০২৩ এর নির্বাচনে ৪৮টি সিট পেয়ে ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টি প্রথম স্থানে আসে, আর মোট ভোটের ২০.১ শতাংশ ও ৪৬টি আসন জিতে ফিন্স পার্টি আসে দ্বিতীয় স্থানে। এর ফলে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কার্যকর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ন্যাশনাল কোয়ালিশনের জন্য ফিন্স পার্টির সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। কিন্তু ফিন্স পার্টির সাথে জোট সরকার গঠন করা সবসময়ই কঠিন ছিল। ২০১৫ সালেও ফিন্সরা ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু সেটা ভাল যায়নি। তখন কোয়ালিশনের অন্যান্য দলগুলি সংসদের মাঝখানেই ফিন্স পার্টির সদস্যদের ত্যাগ করতে চেয়েছিল। এটা করলে সরকার পতন হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত ফিন্স পার্টির ২০ জন সংসদের পদত্যাগের মাধ্যমে সরকার পতনকে এড়ানো গিয়েছিল। কিন্তু কেনই বা এরকম হয়েছিল? স্লাভিক ভাষাবিদ জুসি হালা-আহুর (Jussi Halla-aho) ফিন্স পার্টির নেতা হিসেবে নির্বাচনের ফলে এই সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল, যিনি অভিবাসন ও মাল্টিকালচারালিজমের বিরোধিতা করে একটি সুপরিচিত ব্লগ লিখতেন, আর তিনি বিশেষ করে ইসলামিক সংস্কৃতির সমালোচনা করতেন। তিনি ইসলামকে পেডোফাইলদের ধর্ম বলেছিলেন, আর বলেছিলেন যেহেতু এদের জন্য দেশে ধর্ষণ বৃদ্ধি পাবেই, তাই গ্রিন লেফটিস্টদেরকেই রেইপ করা উচিৎ। তার এই সব মন্তব্য বিতর্কের সৃষ্টি করে। ২০০৮ সালে এথনিক এজিটেশনের জন্য তাকে নিয়ে তদন্ত করা হয়েছিল। যাই হোক, আশা করি বুঝতে পারছেন ফিন্স পার্টির সাথে কোয়ালিশন করাটা কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তারপর এবারে ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টিকে তাদের সাথে কোয়ালিশনে যেতে হয়েছে, কারণ তা ছাড়া উপায় ছিলোনা।

আর এই কারণে ন্যাশনাল কোয়ালিশনেরও অনেক সময় লাগে নতুন সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সাথে নিজেদের শর্তাবলি ঠিক করে নিতে। এই কোয়ালিশন নেগোসিয়েশন চলে দীর্ঘ ৭৪ দিন ব্যাপী। যা ফিনল্যান্ডের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কিন্তু শেষ-পর্যন্ত জুনের মাঝামাঝি সময়ে ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টি ঘোষণা করে যে তারা ফিন্স পার্টি, সুইডিশ পিপলস পার্টি এবং ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটদের সাথে মিলে একটি চার-দলীয় জোট গঠন করবে, যারা একসাথে ফিনিশ পার্লামেন্টের ২০০ টি আসনের মধ্যে ১০৯ টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই জোটের নীতিগুলির মধ্যে রয়েছে কল্যাণ ব্যয় বা ওয়েলফেয়ার স্পেন্ডিং হ্রাস করে ন্যাশনাল বাজেটের ভারসাম্য বজায় রাখা, (যেখানে গত সংসদে মারিন ন্যাশনাল বাজেটকে প্রসারিত করেছিলেন), কঠোর অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত লক্ষ্যগুলি শিথিল করা। সম্ভবত এখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল সুইডিশ পিপলস পার্টির অন্তর্ভুক্তি, সংসদে যাদের আসন সংখ্যা এখন ১০টি। আগের মেয়াদে তারা এসপিডি এর সাথে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় ছিল, আর এবারে ন্যাশনাল কোয়ালিশনের সাথে জোট করে ক্ষমতায় থাকছে। কিন্তু কেন, যেখানে তারা গত চার বছর মূলত বামপন্থী অবস্থানই গ্রহণ করেছিল। তাদের নেতা আনা ময় হেনড্রিকসন নির্বাচনের পূর্বে বলেছিলেন, সরকার যদি ফিন্স পার্টির পলিসিগুলো বাস্তবায়ন করে তবে তিনি সরকারে থাকবেন না। কিন্তু প্রথম দিকে তিনি কঠোর অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে থাকলেও শেষ পর্যন্ত দলের আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে কোয়ালিশনে যুক্ত হলেন।

ফিন্স পার্টি নিয়ে জোট সরকারের সংকট ও সরকার পতনের সম্ভাবনা

যাইহোক, ক্ষমতায় আসার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, ফিন্স পার্টি ইতিমধ্যে কোয়ালিশনকে এমন একটি সংকটের দিকে টেনে এনেছে যা সরকারের পতনের হুমকি দিচ্ছে। নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার কয়েক দিনের মধ্যে, প্রকাশিত হয় যে, ফিন্স পার্টি থেকে আসা ফিনলেনদের নতুন ইকোনোমিক এফেয়ারস মিনিস্টার ভিলহেম জুনিলা পূর্বে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় আফ্রিকায় গর্ভপাতকে সমর্থন করার জন্য ফিনল্যান্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং নব্য-নাৎসিদের উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। জুনিলো ২০১৯ সালে হাইল হিটলারের সংখ্যাসূচক কোড ৮৮ নম্বর নিয়ে একটি কৌতুক করেছিলেন এবং হোয়াইট ক্রিসমাস উদযাপনের সময় ফেসবুকে কু ক্লাক্স ক্লান স্নোম্যানের একটি পোস্ট করেছিলেন। জুনিলা অনাস্থা ভোটে বেঁচে গেলেও সুইডিশ পিপলস পার্টির সাতজন এমপি তার বিপক্ষে ভোট দেন, এবং যদি বিরোধী দলের সকল সদস্য ভোট দিতেন তবে তিনি হেরে যেতেন। যাই হোক, শেষে তিনি অফিসে বসার মাত্র ১০ দিন পর পদত্যাগ করেন।

এরপর থেকে ফিন্স পার্টির মন্ত্রীদের অন্যান্য মন্তব্যও তদন্তের আওতায় আসতে শুরু করে। এই পার্টি থেকে আসা অন্য দুই মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মারি রানতানেন এবং বাণিজ্যমন্ত্রী ভিলা তাভলো স্পষ্টতই তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট থিওরির পক্ষে বক্তব্য করেছেন, যা অনুসারে, ইউরোপে জাতিগত শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী অ-শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা (সাধারণত সাধারণত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলি থেকে আসা) প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাভলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈশ্বিকতাবাদ বা ইইউ গ্লোবালিজমকে একটি নতুন ধরণের ফ্যাসিবাদ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন যে উরসুলা ভ্যান ডার লিয়ানের গায়ে আলকাতরা ও পালক লাগিয়ে অপমান করা উচিৎ। তাছাড়া এই নতুন সরকার জুসি হালা-আহোকে পার্লামেন্টের স্পিকার বানিয়েও সমালোচনার শিকার হয়েছে, যার কারণে ২০১৭ সালে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি ফিনল্যান্ডের সুপার-পপুলার প্রেসিডেন্ট সাওলী নিনিস্তো, যিনি রাজনীতি নিয়ে কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকেন, তিনিও স্বীকার করেছেন যে, পুরো ব্যাপারটা খুব বিব্রতকর হয়ে উঠেছে।

এমনকি এই সংকটের পূর্বেও একটি জরিপে ফিনল্যান্ডের জনগণ এই কোয়ালিশন পার্টি নিয়ে বেশ হতাশাবাদী ছিল, এবং ৪৯% বলেছিল এই জোট সরকার পুরো মেয়াদ টিকবে না, যেখানে মাত্র ২৮% বলেছিল, জোট সরকার পুরো টার্ম জুড়ে টিকে থাকবে। ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেত্তেরি অপ্পোও জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেছেন, এখন থেকে সব কিছু স্মুদলি বা নির্বিঘ্নেই এগোবে। কিন্তু এই জোট সরকার যদি এই এন্ডলেস কন্ট্রোভার্সি থেকে মুক্তি না পায়, তবে স্পষ্টতই এই সরকার পতনের একটি সম্ভাবনা থেকেই যায়। যা ২০১৭ সালে হয়নি, তা এবারে হয়ে যেতেও পারে।

তথ্যসূত্র 

1 – https://www.theguardian.com/world/2023/mar/21/putins-two-day-charm-offensive-with-xi-underlines-whos-boss
2 – https://www.china-briefing.com/news/the-putin-xi-summit-their-joint-statement-and-analysis/
3 – https://foreignpolicy.com/2021/04/20/china-russia-military-attention-us-policy-xi-putin-biden-taiwan-ukraine/
4 – http://en.kremlin.ru/supplement/5770
5 – https://www.fmprc.gov.cn/eng/zxxx_662805/202303/t20230321_11045496.html
6 – https://oec.world/en/profile/country/rus
7 – https://www.ft.com/content/e592033b-9e34-4e3d-ae53-17fa34c16009
8 – https://twitter.com/policytensor/status/1637134981116968960/photo/1
9  – https://www.theguardian.com/world/2023/jun/30/far-right-finnish-minister-vilhelm-junnila-resigns-after-10-days-over-nazi-comments
10 – https://en.wikipedia.org/wiki/2011_Finnish_parliamentary_election
11 – https://www.euronews.com/2023/06/20/racism-and-rape-fantasies-the-pr-headache-facing-finlands-new-right-wing-government
12 – https://en.wikipedia.org/wiki/Jussi_Halla-aho
13 – https://www.politico.eu/article/finland-conservative-government-far-right-petteri-orpo/
14 – https://yle.fi/a/74-20036889
15 – https://www.helsinkitimes.fi/finland/finland-news/politics/23755-shift-to-the-right-finland-s-new-coalition-government-is-formed-and-program-released.html
16 – https://www.euronews.com/2023/06/16/5-things-we-already-know-about-finlands-new-right-wing-government
17 – https://www.bbc.co.uk/news/world-europe-66066910
18 –  https://www.eurointelligence.com/

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.