আন্তর্জাতিক মহলে চীনের দুর্নাম, ও এর সফ্ট পাওয়ার তেমন না থাকার কারণ

চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতা নিয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রে একটি মাত্রা যা প্রায়শই উপেক্ষিত হয় তা হ’ল উভয় দেশের সফ্ট পাওয়ার। এখন, মানুষ যখন আলোচনা করে, চীন-ইউএস প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেলে কে জিতবে, বা চীনের মিলিটারি শীঘ্রই ইউএস এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে কিনা তখন তারা আসলে হার্ড পাওয়ার নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু একটি দেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানের জন্য কেবল হার্ড পাওয়ারই সব নয়। এখানে সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধেরও ব্যাপার আছে যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা ইন্টারন্যাশনালাল কমিউনিটির মধ্যে সেই দেশ সম্পর্কিত পারসেপশন বা উপলব্ধি গঠন করে। আর এটাই সফ্ট পাওয়ার নামে পরিচিত। এই আর্টিকেলে এই সফট পাওয়ারকে ব্যাখ্যা করা হবে, সেই সাথে চীন কীভাবে এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতা করতে চায় এবং কেন তাদের প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ ব্যর্থ হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

সফ্ট পাওয়ার কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ

সফ্ট পাওয়ার শব্দটির প্রবর্তন করেছিলেন আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ নাই (Joseph Nye)। এর দ্বারা বোঝায় কোনোরকম জোর জবরদস্তি বা আগ্রাসন ছাড়াই কোন রাষ্ট্রের অন্য পার্টির আচরণ, সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকে। একটি দেশের সাংস্কৃতিক রফতানি, ব্র্যান্ড এবং সেলিব্রিটিদের মতো বিষয়, সাহিত্য এবং শিল্পে সফ্ট পাওয়ার প্রকাশ দেখি, যা সেই দেশের মূল্যবোধ প্রচার করে।

আমেরিকা হচ্ছে সফ্ট পাওয়ার-যুক্ত দেশের একটি আর্কেটিপিকাল উদাহরণ। স্টারবাকস এবং ম্যাকডোনাল্ডসের মতো আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলি বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এবং হলিউড চলচ্চিত্রের মতো আমেরিকান সাংস্কৃতিক রফতানি বিশ্ববিখ্যাত। এখন, এই বিষয়গুলি সম্মিলিতভাবে আমেরিকান উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং মূল্যবোধকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয় ও এর মাধ্যমে আমেরিকাকে প্রদান করে সাংস্কৃতিক শক্তি, যা দিয়ে দেশটি অন্যান্য দেশের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। এটি হার্ড পাওয়ার থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা, কেননা হার্ড পাওয়ার দ্বারা বোঝায় সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগের আরও কংক্রিট উপায়গুলোকে, কিন্তু এই সফ্ট পাওয়ারও রাষ্ট্রের জন্য হার্ড পাওয়ারের মতোই একরকম শক্তি।

চীনের সফ্ট পাওয়ার প্রচেষ্টা

এখানে আমেরিকার আধিপত্য বা হেজেমনিতে হতাশ হয়ে চীন গত এক দশক ধরে তাদের সফ্ট পাওয়ার অবস্থান বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য চীন ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে উঠছে আর তাই চীনারা তাদের চীনারা চীনের ইমেইজ বা ভাবমূর্তিকে নরম করার প্রয়োজন বোধ করে। ২০১০ সালে, চীনা নেতা হু জিনতাও-এর অধীনে চীনা কর্মকর্তারা চীনের ভাবমূর্তিকে নরম করার প্রয়াসে দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সফ্ট পাওয়ারের বিষয়টাকে অগ্রাধিকার হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের আগমনকে সবার সামনে নিয়ে আসে, এবং সফ্ট পাওয়ার পণ্যগুলির বৃদ্ধি ঘটায়। আর রাষ্ট্রপতি শি এর সময়েও এই প্রচেষ্টাটি অব্যাহত রয়েছে।

একটি সুস্পষ্ট সফ্ট পাওয়ার প্রচেষ্টা হ’ল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই। এটি মূলত ইউরেশিয়া এবং আফ্রিকাকে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে অবকাঠামো প্রকল্পগুলির একটি সিরিজ, তবে এই চীনের তথাকথিত সিল্ক রোড দ্বারা অনুপ্রাণিত প্রকল্পগুলি কেবল অর্থনৈতিক বিনিয়োগই নয়, এর সাথে আরো কিছু। চীন এর মাধ্যমে নিজেকে একটি উদার ঋণদাতা হিসেবে উপস্থাপন করে যা বিশ্বের সাথে আন্তঃসংযোগ তৈরি করতে চায়। আর এর মাধ্যমে তারা অন্যান্য দেশে নিজেদের উপস্থিতি ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে চায়। যেমন, বিআরআই য়ের লক্ষ্য হলো যেই দেশগুলোর তাত্ত্বিকভাবে সমৃদ্ধির জন্য চীনের প্রজেক্টগুলো চলে সেই প্রজেক্টগুলোতে চীনের নাম ট্যাগিং করার মাধ্যমে চীনের পক্ষে ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা। চীন সারা বিশ্বের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট স্থাপনের মাধ্যমে তার সফ্ট পাওয়ার বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। এই কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলি হচ্ছে শিক্ষাকেন্দ্র যা চীনা সংস্কৃতি এবং ভাষাকে উৎসাহিত করে এবং অন্যান্য দেশের সাথে সাংস্কৃতিক বিনিময়কে সহজতর করে।

চীনের সফ্ট পাওয়ার প্রচেষ্টার ব্যর্থতা ও আন্তর্জাতিক মহলে চীনের  এত দুর্নামের কারণ

এখন চীনের এই প্রচেষ্টা কি সফল হয়েছে? হয়নি। প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চীন বিশ্বব্যাপী তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষত পশ্চিমে। পিউ রিসার্চ এর জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালের মে মাসে ১৭টি উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই চীন সম্পর্কে প্রতিকূল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছিল, বিশেষ করে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে। প্রকৃতপক্ষে, গত কয়েক বছরে চীন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক উপলব্ধি মারাত্মকভাবে খারাপের দিকে গেছে। কিন্তু কেন? এর মূল কারণ হলো, চীনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক সংকট দ্বারা আচ্ছাদিত, যেমন, জিনজিয়াংয়ের মানবাধিকার ইস্যু, হংকংয়ের বিক্ষোভ দমন, তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনা এবং কোভিডের সময় চীনের আচরণ। যখন জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলমানদের বিষয়টি আসে, তখন চীন এই বিষয়ে সমালোচনা দূর করার জন্য দুর্দান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, তবে তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে, হংকংয়ে সিসিপিদের দমন-পীড়ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হতবাক করেছে, এবং তাইওয়ানের উপর এর নতুন যুদ্ধ-প্রবণতাও চীনকে ঠিক সাহায্য করছে না। দ্বীপটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনা বাড়ার সাথে সাথে সিসিপি অনেকের কাছে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি রেটোরিকের ব্যবহার করেছে। আরও সাধারণভাবে বলতে গেলে, আঞ্চলিক বিরোধ বা টেরিটোরিয়াল ডিসপুটের ক্ষেত্রে চীনের রেটোরিকগুলো বেশি আক্রমণাত্মক হয়েছে , তা দক্ষিণ চীন সাগর বা জাপান-নিয়ন্ত্রিত সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ যা নিয়েই হোক না কেন। শেষ পর্যন্ত, একে চীনের ওল্ফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসিরই একটি ধারাবাহিকতা বলে মনে হচ্ছে, যা শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীনের দৃঢ় কূটনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। আর সত্যিকার অর্থে এর সূচনা দেখা যায় মহামারীর সময়, যখন চীনা কূটনীতিকরা চীনের বিতর্কিত লক ডাউনকে সমর্থন করতে এবং এর ল্যাব লিক তত্ত্বের বিরোধিতা করতে টুইটারে প্রচুর সময় ব্যয় করেছিলেন।

এভাবে সব মিলে বলা যায়, চীনের সফ্ট পাওয়ার প্রচেষ্টা দেশটির আন্তর্জাতিক সংকটগুলোর ফলে নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। কিন্তু কেবল এটাই একমাত্র কারণ নয়। চীনের সফ্ট পাওয়ার প্রকল্পগুলোও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিআরআই প্রকল্পগুলো অনেক দুর্নামও  কুড়িয়েছে। এমনকি কেউ কেউ এমনকি এটিকে ঋণের ফাঁদ কূটনীতি বা ডেট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি এবং অর্থনৈতিক নব্য উপনিবেশবাদ বা ইকোনোমিক নিওকলোনিয়ালিজমের জন্যেও অভিযুক্ত করেছে। একইভাবে, কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলির বিরুদ্ধে সিসিপি-স্পনসরড প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে, অনেক দেশ এগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার বা তাদের তহবিল প্রত্যাহার করে নেয়ার হুমকি দিয়েছে। এখন, এর মানে এই নয় যে চীনের সফ্ট পাওয়ার প্রচেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে, উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলিতে চীনের প্রতি মনোভাব আরও ভাল হয়েছে, বিশেষত আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং মধ্য প্রাচ্যে। তবুও, বিষয়গুলি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেনি, বিশেষ করে পশ্চিমে কাজ করেনি, এবং চীনের সফ্ট পাওয়ার প্রচেষ্টা এখনও কোনও প্রকৃত ফল নিয়ে আসতে পারেনি।

সফ্ট পাওয়ারের গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন

প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি এসবের কোনো গুরুত্ব আছে? সফ্ট পাওয়ার কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ? অনেকেই মনে করেন যে, একটা সময়ে সফ্ট-পাওয়ারের যত গুরুত্ব ছিল, এখন আর অত নেই, বিশেষত সামরিক সহিংসতার এই নতুন যুগে, যেখানে কঠোর ক্ষমতাই শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরা আরও উল্লেখ করেছেন যে আমেরিকার সফ্ট পাওয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ে দেশটির জনপ্রিয়তা হারানোকে আটকাতে পারেনি। বাইডেনের অধীনে আমেরিকা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মতামতকে কিছুটা পুনরুদ্ধার করা গেছে, যদিও সেটা এখনও ওবামার আমলের তুলনায় অনেক নিচেই রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের শাসনামলে আমেরিকার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি একেবারে ভেঙে পড়েছিল। এমনকি আমেরিকার ন্যাটো মিত্ররাও সাধারণত ট্রাম্পের আমেরিকা সম্পর্কে প্রতিকূল ধারণা পোষণ করতো। তবে, বৈদেশিক নীতির বিভিন্ন ভুল এবং অকার্যকর রাজনীতি সত্ত্বেও, আমেরিকা এখনও চীনের বিরুদ্ধে জনসংযোগ যুদ্ধে জয়লাভ করছে। আর এটা অন্তত এই ইঙ্গিত দেয় যে আমেরিকাকে গুরুতরভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাইলে চীনকে তার সফ্ট পাওয়ারের পেছনে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। এর কারণ হল, হার্ড পাওয়ার যতটা ফিরে আসবে, সফ্ট পাওয়ারকেও তত বেশি ব্যবহার করতে হবে, এই হার্ড পাওয়ারের বাজে প্রভাবগুলিকে প্রশমিত করতে। এবং যদি বিদেশে আমেরিকান পারসেপশন হ্রাস পেতে থাকে তবে এটি চীনকে আমেরিকার সফ্ট পাওয়ারের আধিপত্যকে উৎখাত করার সুযোগ করে দেবে।

তথ্যসূত্র

1 – https://www.pewresearch.org/global/2022/06/29/negative-views-of-china-tied-to-critical-views-of-its-policies-on-human-rights/
2 – https://www.pewresearch.org/global/2020/10/06/unfavorable-views-of-china-reach-historic-highs-in-many-countries/
3 – https://www-economist-com.ezproxy-prd.bodleian.ox.ac.uk/asia/2023/04/05/chinas-huge-asian-investments-fail-to-buy-it-soft-power
4 – https://www.washingtonpost.com/politics/2020/08/24/state-department-labeled-chinas-confucius-programs-bad-influence-us-students-whats-story/
5 – https://www.ft.com/content/1f88e314-3ee9-4ff9-82ed-4cf42e28b6f5
6 – https://www-economist-com.ezproxy-prd.bodleian.ox.ac.uk/china/2017/03/23/china-is-spending-billions-to-make-the-world-love-it

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.