তুরস্কের সুইডেনকে ন্যাটোতে অনুমোদন, রাশিয়াকে ত্যাগ করে পশ্চিমমুখী হওয়া, এবং এর ইইউ সদস্য হবার দাবি ও সম্ভাবনা

সোমবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোয়ান “তুরস্ক অবশেষে সুইডেনকে ব্লকে প্রবেশ করতে দেবে” – এই ঘোষণা দিয়ে ন্যাটোকে চমকে দিয়েছিলেন। এই আর্টিকেলে এরদোয়ান কী বলেছিলেন, কেন তিনি সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন এবং এর অর্থ তুরস্ক ইইউতে যোগ দিতে চলেছে কিনা তা দেখতে যাচ্ছি। সেই সাথে তুরস্কের রাশিয়ার থেকে দূরে সরে আসা ও পশ্চিমের দিকে সরে আসা নিয়ে, এবং তুরস্ক আসলেই ইইউতে যোগ দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা হবে।

সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশে তুরস্কের এতদিনের অস্বীকৃতি 

গত এক বছর ধরে তুরস্ক সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। গত জুনে ফিনল্যান্ড সহ দুই দেশ ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে, যেখানে মূলত বলা হয়, তিনটি কাজ করলে তুরস্ক সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে দেবে। এক্ষেত্রে প্রথমত, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংসতার জন্য দায়ী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে সম্পর্কিত কিছু কুর্দি সংগঠনকে ও তুর্কি ধর্মীয় নেতা ফেতুলা গুলেনকে (যাকে এরদোয়ান ২০১৬ সালে অভ্যুত্থান চেষ্টার জন্য দায়ী করেছেন) সমর্থন না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। দ্বিতীয়ত, ২০১৯ সালে এরদোয়ান সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সৈন্য পাঠানোর পর দেশ দুটো তুরস্কের ওপর অনানুষ্ঠানিকভাবে যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তা প্রত্যাহার করে নেয়। এবং তৃতীয়ত, চুক্তিটি ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে যে কোনও ‘সন্ত্রাসী সন্দেহভাজনকে’ তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য করে।

সুইডেন এই তিনটি মানদণ্ড পূরণ করেছে বলে দাবি করেছে, তবে এরদোয়ান এবং তুর্কি সরকারের অন্যান্য ব্যক্তিরা দাবি করেছেন যে সুইডেন এখনও পিকেকেকে নীরবে সমর্থন করছে কারণ সুইডিশ কর্তৃপক্ষ কুর্দিপন্থী এবং পিকেকেপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে স্টকহোমে বিক্ষোভ করার অনুমতি দিয়েছে এবং গত মাসে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ কুরআন পোড়ানো ইনভলবড ছিল এমন প্রতিবাদকে অনুমোদন দেয়ায় তারা বিশেষভাবে বিরক্ত হয়েছে। সুইডেন জোর দিয়ে বলেছে যে তারা এই প্রতিবাদগুলোকে দমন করতে পারে না কারণ পিকেকে এবং কুরআন পোড়ানো বিক্ষোভ সুইডেনে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত বাক স্বাধীনতারই প্রকাশ। এখন, এরদোয়ানের বিরক্তি সম্ভবত সত্য, এবং তিনি সম্ভবত চান যে সুইডেন প্রতিবাদ করার জন্য আরও প্রচেষ্টা করুক, হয়তো ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত অব্দি যাক তারা। সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সুইডেনের অবস্থান নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগ ছিল। তারা সুইডেনের কাছে স্পষ্টভাবে এই উদ্বেগগুলি প্রকাশ করেছিল এবং সুইডেন অবিলম্বে সেগুলো সমাধানের জন্য তাদের নিজস্ব আইনগুলিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করেছিল। (সুইডেনকে কেন তুরস্ক ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়নি সেই বিষয়ে ইতিমধ্যে পোস্ট করেছি।)

সুইডেনের ন্যাটোতে প্রবেশকে অনুমোদন দেয়া, বিনিময়ে তুরস্কের দাবি 

তবে এটি সর্বজনবিদিত যে সুইডেন এভাবে তার সংবিধান সংশোধন করতে পারে না। তাই এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এরদোয়ানের বিরক্তিটি জেনুইন হয়ে থাকলেও তিনি আসলে সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদের উপর তার প্রভাব ব্যবহার করে অন্যান্য ন্যাটো সদস্যদের কাছ এমন কোন ছাড় খুঁজছেন যার সাথে সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির কোন সম্পর্কই নেই। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হ’ল এফ-16 যুদ্ধবিমান অধিগ্রহণ। তুরস্ক, অন্যান্য অনেক দেশের মতোই তার বিমান বাহিনীর জন্য আমেরিকান এফ-16 এর উপর নির্ভর করে। ২০১০ এর দশকের শেষের দিকে এরদোয়ান উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এফ-35 কিনে তুরস্কের বিমান বাহিনীকে উন্নত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা মূলত এফ-16 এর উন্নত সংস্করণ। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেম তুরস্কে বিক্রি না করায় ২০১৯ সালে তুরস্ক রাশিয়ার তৈরি এস-400 এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিনেছিল। এরদোয়ান সম্ভবত ভেবেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতারণা করছে, কিন্তু তারা তা করেনি। এবং তারা অবিলম্বে তুরস্ককে এফ-35 প্রোগ্রাম থেকে বাদ দিয়েছে, যদিও তুরস্ক ইতিমধ্যে চারটি এফ-400 এর জন্য অর্থ প্রদান করে ফেলেছে, যার দাম ১.৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। এর কয়েক বছর পর তুরস্ক আরও ৭০টি এফ-16 বিমান কিনতে চাইলেও কংগ্রেস তার অনুমতি দেয়নি। স্পষ্টতই, এরদোয়ান এতে খুশি ছিলেন না, তবে তিনি এই বছরের শুরু পর্যন্ত এটি সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে নীরব ছিলেন। কিন্তু এরপরই তিনি এই বিষয়টি নিয়মিতভাবে উত্থাপন শুরু করেছিলেন। এফ-16 যে দরকষাকষির চিপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা এপ্রিলে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের এফ-16 আপগ্রেড সফটওয়্যার বিক্রি করতে সম্মত হওয়ার পরপরই তুরস্ক সুইডেনের সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে সম্মত হয়।

তবে সোমবার এরদোয়ান একটি নতুন দাবি নিয়ে আসেন। ন্যাটো সামিটের জন্য লিথুয়ানিয়ায় যাবার উদ্দেশ্যে রওনা দেবার পূর্বে ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বলেন, ‘যদি ন্যাটো সুইডেনকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, তবে তুরস্ককে আগে ইইউতে প্রবেশ করতে দিতে হবে।’ পরে তিনি তার এই নিজের দাবিকে জাস্টিফাই করার জন্য বলেন, ইইউ ও ন্যাটো সদস্যপদের ক্ষেত্রে অনেক ওভারল্যাপ আছে। এটি সবার জন্য একটি বিশাল বিস্ময় হিসেবেই এসেছিল, অন্তত এজন্য যে, ইইউ-তুরস্ক সম্পর্ক এই মুহুর্তে ভাল নয়। তুরস্ক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক ২০১৬ সাল থেকেই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বলেন, ‘যারা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দরজায় অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে, আমি তাদের আহ্বান জানাচ্ছি। তুরস্কের জন্য পথ প্রশস্ত করুন এবং আমরা সুইডেনের জন্য পথ প্রশস্ত করব।” এর কয়েক ঘণ্টা পর এরদোয়ান হঠাৎ ঘোষণা দেন, “তুরস্ক সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে দিচ্ছে”। বিনিময়ে, তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-16 এবং কানাডা থেকে রফতানি নিয়ন্ত্রণ অপসারণ সহ বেশ কয়েকটি লেভারেজ পায়, তবে সেই সাথে কিছু ইইউ-নির্দিষ্ট লেভারেজও পায়। সুইডেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বলেছে যে, তারা ন্যাটোতে তুরস্কের সদস্যপদকে পুরোপুরি সমর্থন করে এবং এরকমও কিছু সাজেশনের ব্যাপারে শোনা গেছে, অন্ততপক্ষে মিডিয়ায় শোনা গেছে যে, ইইউ তুরস্কের জন্য তার ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার হ্রাস করবে।

এই মুহুর্তে ইইউ-তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ভিসা, বিশেষ করে মহামারীর আগের তুলনায় এখন তুর্কি নাগরিকদের ভিসা আরো বেশি করে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। মহামারীর আগে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও ১০% এর নিচে ছিল। তবে মহামারী চলাকালীন সময়ে যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশ লকডাউনের অধীনে ছিল, তখন তুর্কি নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার ১৭%-এ উন্নীত হয়, এবং এখন তুরস্কের নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রত্যাহারের হার ১৫% এর উপরে রয়েছে। এক্ষেত্রে ইইউ এর যুক্তি হচ্ছে, এটি মূলত তুর্কি নাগরিকদের পূর্বের চেয়ে বেশি পরিমাণে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আশ্রয় বা এসাইলামের আবেদন বৃদ্ধির কারণে হয়েছে। তবে এরদোয়ান এবং অন্যান্য সিনিয়র তুর্কি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, এটির আসল কারণ হচ্ছে ইইউ এর তুর্কি-বিরোধী পক্ষপাত। তারা উল্লেখ করেছেন যে, কেবল এসাইলাম-প্রার্থীরাই নয়, সুপরিচিত সাংবাদিক এবং পেশাদারদেরও প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে।

এরপর সোমবার সন্ধ্যায় ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ হঠাৎ ঘোষণা করেন যে, এরদোয়ান সুইডেনের অন্তর্ভুক্তি প্রোটোকলটি এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছেন, ও এর মাধ্যমে অবশেষে সুইডেনের অন্তর্ভুক্তির পথ প্রশস্ত করেছেন। বিনিময়ে, সুইডেন সম্মত হয়েছে যে, তারা তুরস্কের পক্ষে কাস্টমস ইউনিয়ন আপডেট করতে এবং ভিসা উদারীকরণ করতে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করবে। এরপর মঙ্গলবার সকালে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, তারা তুরস্কের কাছে এফ-১৬ বিমান হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছে।

তুরস্কের এই পরিবর্তনের কারণ 

এটি এরদোয়ানের পশ্চিমের দিকে বৃহত্তর পরিবর্তনের অংশ বলে মনে হচ্ছে। এটা অর্থনৈতিক কারণে হতে পারে। তুরস্কের অর্থনীতি বর্তমানে এরদোয়ানের অপ্রচলিত ও সুদ-বিরোধী আর্থিক নীতির পরিণতি ভোগ করছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেশটির ইকোনোমিক বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করতে পারে। আরেকটি কারণ হতে পারে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান দূরত্ব। একদিকে তুরস্ক একটি ন্যাটোভুক্ত দেশ, অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে দেশটির সম্পর্ক তুলনামূলভাবে বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ। কাজেই ইউক্রেনে পুতিনের আগ্রাসনের পর থেকে এতোদিন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোয়ানকে দুই দিকেই ব্যালেন্স মেইনটেইন করে চলতে হয়েছে। তুরস্ক রাশিয়ার ওপর ওয়েস্টার্ন স্যাঙ্কশনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং ন্যাটোতে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের আবেদনও আটকে রাখে। এসব কাজ নিঃসন্দেহে ন্যাটোকে করে বিরক্ত ও রাশিয়াকে করে খুশি। তবে গত এক সপ্তাহে এরদোয়ান অন্তত তিনটি কাজ করেছেন যা ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি মূলত পুতিনকে ত্যাগ করে ন্যাটোকেই বেছে নিয়েছেন, যেগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অবশেষে সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া। তাই এরদোয়ানের দু’পক্ষের মধ্যে ব্যালেন্স রক্ষার ইতিহাস কী, কিভাবে এরদোয়ান সম্পত্তি পুতিনকে ত্যাগ করেছেন ও কেন তিনি ওয়েস্ট বা পশ্চিমের দিকে শিফট করতে পারেন এই প্রশ্নগুলোরও উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।

তুরস্কের রাশিয়া ও ন্যাটোর সাথে সম্পর্কে ব্যালেন্স রক্ষার ইতিহাস

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের আগে এরদোয়ান ও পুতিন এক রকম একে অপরের ফ্রেনেমিস ছিলেন (মানে বন্ধু ও শত্রুর মিশ্রণ)। তারা অনেক বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন, বিশেষ করে পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে, কিন্তু দুই নেতার মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, যা ২০১৬ সালে তুরস্কে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর বিকশিত হয়েছিল। তারা নিয়মিত মিলিত হতেন এবং পুতিন একবার এরদোয়ানকে প্রশংসা করে বলেছিলেন, তিনি এমন একজন নেতা যিনি একজন সত্যিকারের মানুষের মতো প্রতিশ্রুতি পালন করেন। যুদ্ধ শুরু হলে এরদোয়ান ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে একটি মধ্যবর্তী স্থানে থাকার চেষ্টা করেন। তুরস্ক ন্যাটোর অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়ার ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে “বিশেষ সামরিক অভিযানকে” যুদ্ধ হিসাবে বর্ণনা করতে বা স্যাংকসনে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিল। কিছুটা হলেও সেটা কাজে দেয়। তুরস্কে ২০২২ সালের মার্চে রাশিয়া ও ইউক্রেইনের মধ্যে শান্তি আলোচনা হয়েছিল, যা ব্যর্থ হয়, ২০২২ সালের জুলাইয়ে তুরস্ক জাতিসংঘের সাথে কৃষ্ণ সাগরের শস্য চুক্তি বা গ্রেইন ডিল সফলভাবে সম্পাদন করেছিল, যা ইউক্রেনের কৃষকদেরকে তুর্কি কর্তৃপক্ষের নজরদারির সাথে তুর্কি প্রণালীর মাধ্যমে তাদের শস্য রফতানি করার অনুমতি দেয়।

এরদোয়ানের এই নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে তুরস্কের অর্থনীতিও লাভবান হয়েছে। এর ফলে রাশিয়ার মূলধন তুরস্কে প্রবাহিত হয়েছিল ও আঙ্কারাকে বৈদেশিক মুদ্রার একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উত্স সরবরাহ করেছিল, এবং তুরস্ক সস্তায় রাশিয়ান তেল এবং গ্যাস কিনতে সক্ষম হয়েছিল। এটি অবশ্যই এরদোয়ানের জন্য একটি বড় ফ্যাক্টর ছিল। তুর্কি অর্থনীতি তখনও ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির সংকটে রয়েছে সাথে লড়াই করছিল এবং এরদোয়ান সম্ভবত উপলব্ধি করেছিলেন যে তুর্কি অর্থনীতি তার হাইড্রোকার্বন আমদানির বৃহত্তম উত্সটি বন্ধ করতে পারবে না।

সম্প্রতি তুরস্কের রাশিয়া থেকে দূরে সরে আসা

তবে গত এক সপ্তাহ ধরে মনে হচ্ছে এরদোয়ান পুতিনের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছেন। তিনটি প্রমাণ এটি নির্দেশ করে। প্রথমটি হচ্ছে তুরস্কে থাকা ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দীদেরকে ইউক্রেনে ফিরিয়ে দেয়া। প্রসঙ্গত, গত বছর নৃশংস যুদ্ধ ও অবরোধের পর রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বন্দর নগরী মারিউপোল দখল করে নেয়। ইউক্রেনের আজোভ ব্যাটালিয়নের শত শত সৈন্য আত্মসমর্পণ করে এবং রাশিয়া তাদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে নিয়ে যায়। বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসাবে নিম্ন স্তরের অনেক সৈন্যকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তবে ইউক্রেন, রাশিয়া এবং তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যা অনুসারে পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ আজোভ কমান্ডারকে তুরস্কে প্রেরণ করা হয়, যেখানে তাদের যুদ্ধের সময়কালটুকু থাকার কথা ছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে, গত সপ্তাহে, রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি তুরস্ক সফরে যান ও এই পাঁচ কমান্ডারকে তার সাথে ইউক্রেইনে নিয়ে আসেন, এই পদক্ষেপটিকে ক্রেমলিন ইউক্রেন এবং তুরস্কের মধ্যকার চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন হিসাবে বর্ণনা করেছে।

দ্বিতীয়ত, তুরস্ক একতরফাভাবে শস্য চুক্তি বা গ্রেইন ডিলের মেয়াদ বাড়ানোর কথা ভাবছে বলে খবর পাওয়া গেছে। স্পষ্টতই, রাশিয়া এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, তবে তুর্কি নৌবাহিনীও বলেছে যে চুক্তি না থাকলেও তারা তুর্কি প্রণালী দিয়ে রফতানি করা ইউক্রেনীয় জাহাজগুলির সাথে থাকবে বা সুরক্ষা প্রদান করবে। এর অর্থ হচ্ছে তুরস্ক একতরফাভাবে ইউক্রেনীয় রফতানিকারকদেরকে রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবে, যা অবশ্যই মস্কোর ভাল লাগার কথা না।

আর তৃতীয় প্রমাণটি প্রায় সকলেরই জানা। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করার এক বছরেরও বেশি সময় পর এরদোয়ান এ সপ্তাহে ঘোষণা করলেন যে, ন্যাটোতে যোগদানের জন্য সুইডেনের আবেদনের বিরোধিতা থেকে তুরস্ক অবশেষে সরে আসছে। এর মানে এখন তুরস্ক পুতিনকে খুশি করার জন্য যে সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তিকে বাধা দিয়েছিলেন, তা নয়। বরং এরদোয়ান ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৬ জেট বিমানসহ ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে আনরিলেটেড লেভারেজ পাবার জন্য তার ভেটো ব্যবহারের চেষ্টা করছিলেন। তবে এরদোয়ানের বিরোধিতা পুতিনকে অবশ্যই খুশি করেছিল। আর এরদোয়ানের এই বিরোধিতাকে তুলে নেয়ার ব্যাপারটি অবশ্যই ক্রেমলিনের ভাল লাগেনি, যেখান থেকে বলা হচ্ছে যে, এই পদক্ষেপের পরিণতি অবশ্যই নেতিবাচক হবে।

ন্যাটো ও আজোভ কমান্ডারদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ও ব্যয় বিষয়ক ফেডারেশন কাউন্সিল কমিটির প্রধান ভিক্টর বন্দারেভ বলেছেন, তুরস্ক একটি নিরপেক্ষ দেশ থেকে ‘অবন্ধুত্বপূর্ণ দেশের’ দিকে ধাবিত হচ্ছে। এদিকে রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস জানিয়েছে, ক্রেমলিন তার তুর্কি পার্টনারদেরকে ইউরোপে যাওয়ার সময় গোলাপ রঙের চশমা খুলে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে, আর সেই সাথে বলেছে, কেউই তুরস্ককে ইউরোপের অংশ হিসেবে দেখতে চায় না, এমনকি ইউরোপীয়রাও নয়।

কেন তুরস্ক রাশিয়ার থেকে দূরে সরে গিয়ে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকছে?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরদোয়ান এটা কেন করলেন? কেন এরদোয়ান পুতিনকে ছেড়ে দেওয়ার বা অন্তত পশ্চিম দিকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? এর তিনটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তুরস্কের অর্থনীতি। তুর্কি অর্থনীতি বর্তমানে এরদোয়ানের অপ্রচলিত (সুদ-বিরোধী) আর্থিক নীতির পরিণতি ভোগ করছে। তার নীতিগুলোর মধ্যে ছিল মুদ্রাস্ফীতির প্রতিক্রিয়ায় সুদের হার হ্রাস করা, কিন্তু এর ফলে লিরার মূল্য দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। আর তুরস্কের অর্থনীতি টিকে আছে কেবল রাশিয়ান ইনফ্লো এবং এরদোয়ানের উপসাগরীয় মিত্রদের উদার বিনিয়োগের কারণে। এই বিনিয়োগ হিসেবে সৌদি আরবের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ রয়েছে, যারা স্পষ্টতই তুরস্কে দেশে তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এরদোয়ানের নতুন অর্থমন্ত্রী ধীরে ধীরে সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছেন, তবে লিরা এখনও হ্রাস পাচ্ছে এবং তুরস্ক আনসাস্টেইনেবল ক্যাপিটাল আউটফ্লোতে ভুগছে। তুরস্ক সম্ভবত আশা করছে যে, দেশটি যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদানের মাধ্যমে ইইউ সদস্যপদের সাথে জড়িত সমস্ত আর্থিক সহায়তা নাও পায়, তবুও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমে দেশটি তার অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও সচল রাখতে পারবে।

দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের পর এরদোয়ানের পলিটিকাল স্পেস বেশি। এরদোয়ান এখন নতুন পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন, যার অর্থ তিনি পশ্চিম দিকে সরে যাবার মতো যথেষ্ট সময় ও পলিটিকাল স্পেইস পেয়েছেন। তবে এর ফলে তার জনপ্রিয়তা তেমন হ্রাস পাবে বলে মনে হয়না। এরদোয়ান অতীতে একজন অসাধারণ চতুর রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তিনি তার দুই দশকের ক্ষমতায় ইইউ থেকে শুরু করে কুর্দিশ কোয়েশ্চেন পর্যন্ত সব কিছুতে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বদাই পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন।

তৃতীয় কারণটি হচ্ছে রাশিয়ায় ওয়াগনারের অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা। এই অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যে রাশিয়ায় সরকার পরিবর্তন বা পলিটিকাল কলাপ্সের ঝুঁকি রয়েছে এবং এটি এরদোয়ানের হিসাবকে প্রভাবিত করতে পারে, কারণ পুতিনের যদি শীঘ্রই ক্ষমতা হারাবার সামান্য সম্ভাবনাও থেকে থাকে, তাহলেও তিনি পুতিনের সাথে সম্পর্কের জন্য খুব বেশি এফোর্ট দিতে চাইবেন চান না, কেননা তিনি অনিরাপদ কোন কিছুর জন্য ন্যাটো ও পশ্চিমাদের সাথে তার সম্পর্ক কম্প্রোমাইজ করবেন না।

শেষ পর্যন্ত, এরদোয়ান পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছেনা এমন অনেক প্রমাণ থাকলেও, এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, তিনিই সম্ভবত ভূ-রাজনীতিতে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ব্যক্তি, এবং তার এই অবস্থানটি যে স্থায়ী হবে এটা বলার সময়ও এখনও আসেনি।

তুরস্ক কি ইইউতে যোগ দিতে পারবে?

যাই হোক, এর মানে কি এই যে, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে যাচ্ছে? তুরস্কের ইইউতে যোগদানের এই প্রচেষ্টা নিয়ে ২০০৫ সাল থেকেই আলোচনা চলছে। এখন, তুরস্কের ইইউতে প্রবেশের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ইইউ-তুরস্ক সম্পর্কের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করে নিতে হবে, আর তারপর তুরস্ক আসলেই ইইউতে যোগ দিতে পারবে কিনা সেই আলোচনায় প্রবেশ করা যাবে।

ইইউ-তুরস্ক সম্পর্কের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ইইউ তুরস্ক সম্পর্ক মূলত তিনটি সময়কালে বিভক্ত করা যেতে পারে: প্রাক-২০০৫, ২০০৫ থেকে ২০১৬, এবং ২০১৬ পরবর্তী। ২০০৫ সালের আগে তুরস্ক ধীরে ধীরে ইউরোপের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এবং শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় কমিউনিটিতে এর অন্তর্ভুক্তি একটি সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে হয়েছিল। তুরস্ক ১৯৬৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বসূরি ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটির সহযোগী সদস্য বা এসোসিয়েট মেম্বার হয়ে ওঠে এবং ১৯৮৭ সালে পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে। তবে তুরস্ক ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি কাস্টমস ইউনিয়ন চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ১৯৯৯ সালে ইউরোপীয় কাউন্সিলের হেলসিঙ্কি শীর্ষ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ সদস্যপদের প্রার্থী হিসাবে স্বীকৃত হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইইউতে তুরস্কের চূড়ান্ত অন্তর্ভুক্তি একটি সম্ভাবনা বলে মনে হয়েছিল। ২০০৩ সালে যখন এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুরস্কের ক্ষমতায় বসেন, তখন তুরস্কে ইইউতে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। ইইউতে অন্তর্ভুক্তির নিয়ে এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে বের করে দিতে, এবং মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা এবং কুর্দি ভাষাকে ব্রডকাস্ট করার অনুমতি প্রদানের মতো বেশ কিছু সুন্দর সংস্কারবাদী অভ্যন্তরীণ নীতি প্রবর্তন করেছিলেন। তুরস্কের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে তুরস্কের ইইউতে যোগদান নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ছিল এবং তুর্কি নির্মাতারা তাদের পণ্যের রফতানির জন্য একটি বিশাল উন্মুক্ত বাজারের ধারণায় খুব আগ্রহী ছিলেন।

এরপর তুরস্ক যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউতে অন্তর্ভুক্তির আলোচনা বা নেগোশিয়েশন শুরু করে, তখন শুরু হয়  তুরস্ক-ইইউ সম্পর্কের দ্বিতীয় পর্যায়, মনে ২০০৫ থেকে ২০১৬ সালের পর্যায়। তুরস্ক ইইউতে অন্তর্ভুক্ত হবার আলোচনায় যাবার পর খুব দ্রুত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তুরস্কের শীঘ্রই ইইউতে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা কম। প্রায় দুই দশকের আলোচনার মধ্যে তুরস্ক প্রয়োজনীয় ৩৫টি অধ্যায়ের মধ্যে মাত্র ১৬টিতে আলোচনা শুরু করেছে এবং বিজ্ঞান ও গবেষণা বিষয়ক মাত্র একটি অধ্যায় নিয়ে দুপক্ষ প্রভিশনালি, মানে অস্থায়ীভাবে বা অন্তত কিছু ক্ষেত্রে একমত হয়েছে (তবে পুরোপুরিভাবে তা ফাইনালাইজড হয়নি)। ২০০৫ সালে ইইউতে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তি কতটা কঠিন হবে তা উপলব্ধি করে ইউরোপীয় নেতারা একটি “ওপেন-এন্ডেড প্রসেস” বা “উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার” উপর জোর দিয়েছিলেন, যেখানে তুরস্ক আদৌ ইইউতে যোগ দেবে কিনা তা নিয়ে কোন গ্যারান্টি ছিলোনা। পরবর্তী এক দশক ধরে আলোচনা চলতে থাকে, কিন্তু ২০১৬ সালে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তুরস্ক শীঘ্রই ইইউতে যোগ দেবে না।

২০১৬ সালে ইইউ তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি বড় ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমটি ঘটেছিল বছরের শুরুতে যখন উভয় পক্ষ একটি অভিবাসী চুক্তি বা মাইগ্রেন্ট ডিল স্বাক্ষর করেছিল, যা মূলত ছিল এই যে, তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য থেকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপে আসা অভিবাসীদের আটকাবে, কিন্তু বিনিময়ে তুরস্ককে কয়েক বিলিয়ন ইউরোর আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে, এবং সাধারণ তুর্কিদের জন্য ইউরোপে প্রায় ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের ইইউতে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা ত্বরান্বিত হবার কথা ছিল, তবে হয় উল্টো। চুক্তিটির কার্যকারিতা সত্ত্বেও এটি প্রকৃতপক্ষে তুরস্ক-ইইউ সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তোলে। এটি এরদোয়ানকে ইউরোপের উপর অস্বস্তিকর রকমের বেশি সুবিধা দেয়, যা ইউরোপীয় নেতাদেরকে এরদোয়ান সম্পর্কে আরও সতর্ক করে তোলে।

দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল, জুলাই মাসে তুরস্কে ঘটা অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা। তুর্কি সেনাবাহিনীর একটি অংশ এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছিল এবং এরদোয়ানকে আক্ষরিক অর্থেই একটি তুর্কি টিভি চ্যানেলে এসে অভ্যুত্থানকারীদের পদত্যাগ করতে এবং তুর্কি জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলেছিল। এরদোয়ান স্পষ্টতই ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীরব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ক্ষুব্ধ ছিলেন, যারা এরদোয়ানের সমর্থনে এগিয়ে আসতে ধীর ছিল এবং অভ্যুত্থানের পরে বেসামরিক কর্মচারী বা সিভিল সার্ভেন্টদেরকে যে শুদ্ধিকরণ বা পাৰ্জ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তা নিয়ে সমালোচনা করেছিল। ঠিক এই সময় থেকে তুর্কি মিডিয়া ইইউকে আক্রমণ করতে শুরু করে, এবং ২০১৬ সালের শেষের দিকে এরদোয়ান সাজেস্ট করেন যে, তুরস্ক সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনে (এসসিও) যুক্ত হবার ব্যাপারে বিবেচনা করছে, যা ইইউ এর বিকল্প হিসেবে তখন রাশিয়া, চীন. কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান নিয়ে গঠিত ছিল, এবং ভারত ও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি শুরু হয়েছিল (২০১৭ সালের মাঝামাঝি এদের অন্তর্ভুক্তি সমাপ্ত হয়)। বিপরীতে, এই সময়েই এরদোয়ান পুতিনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ হতে শুরু করেছিলেন। অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ানের সমর্থনে প্রথম বিশ্ব নেতাদের মধ্যে পুতিন ছিলেন একজন, এবং মাত্র এক বছর আগে ২০১৫ সালে তুর্কি-সিরিয়া সীমান্তের কাছে আকাশসীমা বিরোধের সময় তুর্কি সামরিক বাহিনী রাশিয়ার একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পরে তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্ক খুব দ্রুত শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল।

তুরস্ক কি আসলেই ইইউতে যোগ দিতে পারবে?

এর মানে কি এই যে, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে যাচ্ছে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হল, না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই এনলারজমেন্ট ফেটিগ ভুগছে এবং কিছু ইইউ দেশ, বিশেষত ফ্রান্স মনে করে যে আরও কোনও দেশকে নেওয়ার আগে ইইউকে সংস্কার করা দরকার। ইইউ অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনের সদস্যপদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং এটি কমপক্ষে আগামী কয়েক বছরের জন্য তাদের অগ্রাধিকার হতে চলেছে। এই এনলারজমেন্ট ফেটিগের কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন পশ্চিম বলকানের মতো ছোট দেশগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছে না, তুরস্ক তো দূরের কথা। এমনকি তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আনার লজিস্টিকগুলিও কঠিন, কমপক্ষে এজন্য যে তুরস্ক জনসংখ্যার দিক থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম দেশ হবে। কিন্তু লজিস্টিক্স যদি কঠিন হয়, তাহলে রাজনীতি আরও খারাপ হবে।

তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রিসের মধ্যে সাইপ্রাস নিয়ে একটি চলমান সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। তুরস্ক বিশ্বের একমাত্র দেশ যা তুর্কিশ রিপাবলিক অফ নর্দার্ন সাইপ্রাসকে স্বীকৃতি দেয়, আর এই উত্তর  প্রকৃতপক্ষে সাইপ্রাসের উত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আর বাকি বিশ্ব এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই অঞ্চলটিকে সাইপ্রাসের অংশ হিসাবে বিবেচনা করে। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের যদি নিষ্পত্তি হয়ও, তাহলেও যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের সঙ্গে চলাচলের স্বাধীনতা বা ফ্রিডম অফ মুভমেন্টে সম্মত হবে তা কল্পনা করা কঠিন, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে অভিবাসন নিয়ে ইউরোপের কিছু দেশে উদ্বেগের কারণে। শুধু গত কয়েক মাসেই পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে অভিবাসী বিরোধী বা এন্টি-মাইগ্রেন্ট মনোভাবের ঢেউ দেখা গেছে। পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন অভিবাসন চুক্তিতে বা মাইগ্রেশন প্যাক্ট স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছে, এএফডি জার্মানির নির্বাচনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ফিনল্যান্ডে নেটিভিস্ট ফিন্স পার্টি এই বছরের শুরুতে ফিনল্যান্ডের নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে এবং এখন সরকারী জোটে রয়েছে (এটা নিয়ে ইতিমধ্যে পোস্ট করা হয়েছে)।

এখন, এর মানে এই নয় যে তুরস্ক কখনই ইইউতে যোগ দেবে না, এবং সম্ভবত এটি এরদোয়ানের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে স্থায়ী শিফ্টের সূচনা। তবে, বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, শীঘ্রই এটি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

তথ্যসূত্র

সুইডেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করার কারণ

1 – https://www.nato.int/nato_static_fl2014/assets/pdf/2022/6/pdf/220628-trilat-memo.pdf
2 – https://www.reuters.com/article/us-turkey-sweden-idUSKBN26Y2GX
3 – https://www.independent.co.uk/news/world/americas/us-politics/turkey-f35-fighter-jets-s400-missile-defence-russia-shanahan-a8950361.html
4 – https://www.iiss.org/publications/strategic-comments/2019/turkey-the-s400-and-the-f35
5 – https://twitter.com/ragipsoylu/status/1619763375243935744
6 – https://twitter.com/ragipsoylu/status/1619763375243935744
7 – https://www.ft.com/content/cf7f5967-a524-4e0c-ab12-b2bf4ca70472
8 – https://www.middleeasteye.net/opinion/turkey-eu-schengen-visa-debacle-resolve-how
9 – https://www.middleeasteye.net/opinion/turkey-eu-schengen-visa-debacle-resolve-how
10 – https://twitter.com/jensstoltenberg/status/1678484703060324359?s=20
11 – https://twitter.com/ragipsoylu/status/1678485573663617037
12 – https://www.ft.com/content/cd8e7cc1-30c8-4b53-a605-8524d5815156
13 – https://twitter.com/Maks_NAFO_FELLA/status/1678353423148765184
14 – https://twitter.com/BBCSteveR/status/1678310415087063040?s=20
15 – https://twitter.com/ragipsoylu/status/1677743886066696192?s=20
16 – https://twitter.com/SamRamani2/status/1678529424839278592?s=20

রাশিয়াকে ত্যাগ করা

1 – https://www.europarl.europa.eu/RegData/etudes/BRIE/2021/679090/EPRS_BRI(2021)679090_EN.pdf
2 – https://www.aljazeera.com/news/2023/7/8/ukraines-zelenskyy-returns-azov-commanders-released-to-turkey
3 – https://twitter.com/FHeisbourg/status/1678092036241489922?s=20
4 – https://tass.com/defense/1645291
5 – https://archive.ph/QQtHT
6 – https://tass.com/politics/1645243
7 – https://twitter.com/RobinBrooksIIF/status/1550829073319878657

ইইউতে যুক্ত হবার সম্ভাবনা

1 – https://en.wikipedia.org/wiki/Accession_of_Turkey_to_the_European_Union
2 – https://www.economist.com/europe/2016/10/13/turkeys-bid-to-join-the-eu-is-a-bad-joke-but-dont-kill-it
3 – https://www.consilium.europa.eu/en/policies/enlargement/turkey/
4 – https://www.economist.com/europe/2021/08/26/the-fiction-that-turkey-is-a-candidate-to-join-the-eu-is-unravelling
5 – https://www.economist.com/europe/2016/05/26/europes-murky-deal-with-turkey
6 – https://www.economist.com/europe/2016/12/01/turkeys-effort-to-join-the-eu-is-on-life-support
7 – https://www.ft.com/content/cf7f5967-a524-4e0c-ab12-b2bf4ca70472

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.