ওয়াগনার অভ্যুত্থানের পর পুতিন তার সামরিক জেনারেলদের “গ্রেপ্তার” করেছেন

মূল অংশ

আজ সবচেয়ে বড় খবর হলো সের্গেই প্রিগোজিন কারাগারে নেই। গতকাল মস্কো টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াগনার বিদ্রোহে জড়িত থাকার দায়ে তিনি কারাগারে আছেন। তবে আজকের প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়েছে যে তিনি কারাগারে নেই বরং একটি নিরাপদ স্থানে রয়েছেন যেখানে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাখা হয়েছে এবং এফএসবি কর্মকর্তারা ওয়াগনার বিদ্রোহে তার ভূমিকা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। আমি জানি এটি একটি কারাগারের মতো শোনাচ্ছে, তবে ক্রেমলিন স্পষ্ট করেছে যে এটি অবশ্যই কারাগার নয়। উপরন্তু, এমন খবর রয়েছে যে প্রিগোজিন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছেন এবং তাই তার যোদ্ধারা ইউক্রেনের সংঘাতে অংশ নেবে না। এটি অবশ্যই ইউক্রেনের জন্য ভাল খবর, এবং এটি রাশিয়াকে মরিয়া করে তুলছে।

গতকাল নিউইয়র্ক টাইমস, মস্কো টাইমস এবং আরও কয়েকটি বড় সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে যে পুতিন অভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখার জন্য রাশিয়ার জেনারেল সের্গেই সোতোভিকিন এবং তার ডেপুটিকে গ্রেপ্তার করেছেন। জেনারেল সোতোভিকিন একজন সম্মানিত সামরিক নেতা যিনি গত বছর ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের পরে যুদ্ধের লাইনজুড়ে প্রতিরক্ষা জোরদার করতে সহায়তা করেছিলেন। জানুয়ারিতে তাকে শীর্ষ কমান্ডার হিসাবে প্রতিস্থাপিত করে গেরাসিমভকে শীর্ষ কমান্ডারের পদ দিয়ে তাকে গেরাসিমভের অধীনস্ত করা হয়, তবে তিনি প্রভাব বজায় রেখেছিলেন এবং যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, সেই সাথে তিনি সৈন্যদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। সুতরাং মনে হচ্ছে, তার ভক্ত সৈন্যরা যাতে ক্ষেপে না যায় তাই ক্রেমলিন এখন তাকে ও তার ডেপুটিকে গ্রেফতারের প্রতিবেদনগুলি ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। গতকাল ক্রেমলিনের মুখপাত্র পেসকভ এসব খবর অস্বীকার করলেও আজ সোতোভিকিনের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে তার কষ্ট হচ্ছে।

  • প্রশ্ন: জেনারেল সোতোভিকিন ও তার পদত্যাগ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছে। আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন যে তার সাথে কি ঘটছে? তাকে কি বরখাস্ত করা হয়েছে?
  • উত্তর: না, দুর্ভাগ্যবশত, না, এবং আমি আপনাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেব। এটা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার।
  • প্রশ্ন: বিষয়টি হল, আমরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং কোনও মন্তব্য পাইনি। কিন্তু আমরা কি জানি জেনারেল সোতোভিকিন এখন কোথায় আছেন, এবং এটা কি সত্যিই রিপোর্ট করা হয়েছে যে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে?
  • উত্তর: আমার এখানে যোগ করার কিছু নেই কারণ আমি ইতিমধ্যে এই বিষয়ে সবকিছু বলেছি।

এরপর মস্কো রেডিওর ইকো এর সাবেক প্রধান সম্পাদক অ্যালেক্সি বেনেডিক্টফের একটি প্রতিবেদন আসে। তিনি বলেছিলেন যে সোতোভিকিন তিন দিন ধরে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করছেন না এবং তার দেহরক্ষীরাও যোগাযোগের চেষ্টায় সাড়া দিচ্ছেন না। এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে গিয়ে সোতোভিকিনের মেয়ে বলেছিলেন যে তার বাবা কাজ করছেন এবং তার সাথে সবকিছু ঠিক আছে।

  • উত্তরঃ সত্যি বলতে, না, তার কিছুই হয়নি। তিনি তার কর্মস্থলে আছেন।
  • প্রশ্ন: আপনি তার সাথে যোগাযোগ করছেন, তাই না?
  • উত্তর: হ্যাঁ, তিনি ভালো আছেন।
  • প্রশ্ন: তিনি কোথাও নিখোঁজ হননি, কেউ তাকে গ্রেপ্তার করেনি?
  • উত্তর: না, অবশ্যই না। আর, তিনি মিডিয়াতে আসেনই বা কখন? তিনি কখনও মিডিয়ায় আসেননি।
  • প্রশ্ন: এবং আপনি তার সাথে যোগাযোগ করছেন, এবং আপনি তার সিকিউরিটির সাথে যোগাযোগ করছেন, এবং এর কোনওটিই সত্য নয়, তাই না?
  • উত্তর: আমার যেটা মনে হচ্ছে, সব কিছু যেমন চলার তেমনই চলছে। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আছে, সবকিছু ঠিক আছে।

এখন এমন হতেই পারে যে, এই সব কিছুই সবাইকে বিশ্বাস করানোর জন্য একটি বিস্তৃত প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে, আর দেখানো হচ্ছে যে, সোতোভিকিনকে গ্রেপ্তার করা হয়নি কারণ গ্রেপ্তারের খবরটি রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতে আরও ফাটল তৈরি করতে পারে। তিনি যদি প্রকৃতপক্ষে মুক্ত হতেন, তাহলে কেন তিনি প্রকাশ্যে এসে তা বলতেন না? আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রিগোজিন যখন তার অভিযান শুরু করেছিলেন তখন তিনিই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি প্রকাশ্যে একটি ভিডিও বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন। আর সেই তিনিই কিনা এখন সবার সামনে এসে স্পষ্ট করে বলছেন না যে, তার গ্রেপ্তারের গুজব মিথ্যা।

ক্রেমলিন এখানে যে গল্পটি সেল করার চেষ্টা করছে তা খুব বেশি অর্থবহ নয়। এই পুরো গণ্ডগোলের মধ্যে কেবল মাত্র একটি তথ্য বিশ্বাসযোগ্য। যদিও ওয়াগনার বিদ্রোহের পরে জেনারেল সের্গেই সোতোভিকিনের অবস্থান অজানা, তবে তিনি লেফোর্তোভো কারাগারে বিচার-পূর্ব আটকে বা প্রি-ট্রায়াল ডিটেনশনে নেই, যেমনটি গতকাল রিপোর্ট করা হয়েছিল।

সোতোভিকিনের অবস্থান সম্পর্কে ভিসিএইচকে-ওজিপিইউ-এর (VCHK-OGPU) একটি সূত্র বলছে, “আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে সোতোভিকিন এবং তার খুব কাছের একদল লোক দু’দিন ধরে যোগাযোগের বাইরে ছিল। এখন সবাই যোগাযোগের বাইরে, এমনকি যারা দীর্ঘদিন ধরে তার সঙ্গে আছেন তারাও। মিখাইল কোরোকোভস্কির ডসিয়ার সেন্টার অনুসারে, ওয়াগনার নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের দীর্ঘদিনের মিত্র সোতোভিকিন ওয়াগনার গ্রুপের একজন অনারারি মেম্বার, এবং তার সাথে আরও ৩০ জন রাশিয়ান জেনারেল এবং কর্মকর্তা রয়েছেন যারা ওয়াগনার গ্রূপের সাথে ঘনিষ্ঠ। তারা সবাই এখন সন্দেহের তোপে।

ব্লুমবার্গ আরও রিপোর্ট করেছে যে, জেনারেলকে এক জায়গায় রাখা হচ্ছে, তবে তিনি কারাগারে নেই, এবং তদন্তকারীরা সেনাবাহিনীর সাথে সোতোভিকিনের রেকর্ড ও এচিভমেন্ট এডমায়ার করা ভক্ত সৈন্যদের শত্রুতে পরিণত করা এড়াতে সতর্কতার সাথে তার সাথে আচরণ করছেন। সের্গেই সোতোভিকিনকে সামরিক প্রসিকিউটরদের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তারা প্রিগোজিনের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন।

জেনারেল সোতোভিকিনের ডেপুটি, বিমান বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল কোল উডেনকে রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে, তবে এই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তাই এটি সম্ভবত এখনও কেবল একটি গুজব।

প্রিগোজিন নিয়ে কিছু খবর অনুসারে তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছেন, এবং এখন এর অর্থ হ’ল ওয়াগনার রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানে লড়াই করবে না। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা কমিটির প্রধান আন্দ্রেই কারপোভভ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন এবং ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান কিরিল বন্ডারেঙ্কো বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ওয়াগনার সত্যিই এই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসেছে, যা ইউক্রেনের জন্য দুর্দান্ত খবর কারণ ওয়াগনার রাশিয়ার সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং কার্যকর বাহিনীগুলির মধ্যে একটি ছিল।

এছাড়াও, মনে হয়না প্রিগোজিনের ক্রিয়াকলাপে কারও অবাক হওয়া উচিত। তিনি একজন ব্যবসায়ী, এবং ওয়াগনার তার কাছে একটি ব্যবসা ছিল। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য তাকে অর্থ প্রদান বন্ধ করে দেয় তখন তিনি তার সেবা বন্ধ করে দেন। যাই হোক, এটি সাম্প্রতিক ঘটনা হয়তো রাশিয়াকে যুদ্ধে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। এই মঙ্গলবার দোনেৎস্ক অঞ্চলের ক্রামাতোস্ক শহরে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রুশ সেনাবাহিনী। একটি ক্ষেপণাস্ত্র শহরের মধ্যাঞ্চলের একটি রেস্টুরেন্টে আঘাত হানে এবং দ্বিতীয়টি একটি গ্রামের একটি রেস্টুরেন্টে আঘাত হানে। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলায় মোট ১২ জন নিহত এবং আরও ৬৫ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিন শিশুও রয়েছে, যারা পিজেরিয়ায় নিহত হয়েছে।

যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ায় জরিপের ফলাফল

যাই হোক, যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ায় প্রকাশিত হওয়া জরিপের কথা বলে শেষ করছি। রাশিয়ার নতুন জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে এই যুদ্ধ সম্পর্কে রাশিয়ানরা কীভাবে ভাবছে সে সম্পর্কে আরও আলোকপাত করা হয়েছে। এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে এই জরিপগুলি ওয়াগনার বিদ্রোহের আগে পরিচালিত হয়েছিল এবং প্রায় সমান সংখ্যক রাশিয়ানরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বা শান্তি আলোচনা শুরু করতে চায়। যাইহোক, ৬৪% কিয়েভের উপর একটি নতুন আক্রমণ সমর্থন করে, এবং ৫৮% বিশ্বাস করে যে যুদ্ধ ঠিকঠাক চলছে। ৪৫% উত্তরদাতা যুদ্ধ অব্যাহত রাখার পক্ষে এবং ৪৪% শান্তি আলোচনা দেখতে চান। পুতিন যদি আবার কিয়েভ আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন, তবে ৪৫% সমর্থন করবে, এবং ৪৪% তা করবে না। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যদি একটি নতুন মোবিলাইজেশনের প্রয়োজন হয় তবে শান্তি আলোচনা সমর্থনকারী সংখ্যাটি ৫৩% হয়ে যাবে।  আর ৩৫% আরেকটি মোবিলাইজেশন বা ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে সেনা সমাবেশ হলেও যুদ্ধকে সমর্থন করবে।

৭২% পুতিনকে আগামীকালই শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে মত দেবেন। তবে ২০% শতাংশ লড়াই চালিয়ে যেতে চান। ৫৮% বিশ্বাস করেন যে যুদ্ধ ভাল চলছে, মাত্র ২১% বিশ্বাস করেন যে এটি খারাপভাবে চলছে। ২০২২ সালের এপ্রিলের পর থেকে এই সংখ্যাটি খুব কমই পরিবর্তিত হয়েছে, এর মধ্যে রাশিয়ার সমস্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও। মাত্র ১২% ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার প্রত্যাহারকে সমর্থন করে, ৩৯% নতুন আক্রমণ দেখতে চায়, অন্য ৩০% ইউক্রেনে রাশিয়ার বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে পছন্দ করে। ৭৩% উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন যে রাশিয়া এখন সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং ৬৯% বিশ্বাস করে যে যুদ্ধ বিশ্বে রাশিয়ার কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করছে। রাষ্ট্রপরি চালিত টেলিভিশনের দর্শকদের মধ্যে এই সংখ্যা ৮২% বৃদ্ধি পেয়েছে, যখন মাত্র ২১% একমত নয়। ৭২% মনে করেন যে তারা যুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে ঝুঁকিতে নেই, প্রায় ২০% মহিলা ৫৮% পুরুষের চেয়ে বেশি ঝুঁকি অনুভব করেন। যুদ্ধ নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালিত গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সম্পর্কে ব্যাপক অবিশ্বাস রয়েছে, ৪৬% বিশ্বাস করে এবং ৪৫% বিশ্বাস করে না। ৪৫% বলে যে তারা  যুদ্ধের খবরে ক্লান্ত নয়, কিন্তু ৪০% বলেছেন যে তারা এতে ক্লান্ত। ৮১% কোকোভকা বাঁধ ধ্বংসের কথা শুনেছেন, এবং ৪১% ইউক্রেনকে দোষারোপ করেছেন, অন্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে (প্রায় ১২%), রাশিয়া (৩৯%) বা ইউরোপকে (৩০%) দোষারোপ করেছেন। বয়স্ক ব্যক্তি এবং যারা অভ্যাসগতভাবে রাষ্ট্রপরিচালিত টিভি থেকে তাদের তথ্য পান তাদের পক্ষে ইউক্রেনকে দোষারোপ করার সম্ভাবনা বেশি।

৩৫% বলেছেন যে তারা পারলে টাইম মেশিনে করে যুদ্ধ পূর্ব সময়ে চলে গিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইবেন, তবে ৪৯% বলেছেন যে তারা এই ধরনের বাতিলের বিরোধিতা করেন। পুরুষেরা, এবং ৪৯ বছরের বেশিরা যুদ্ধ বন্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার প্রবণতা দেখান। ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণরা বলছে যুদ্ধ করা উচিত ছিল না।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.