চেতনা (Consciousness)

লেখাটি অধ্যাপক নীহাররঞ্জন সরকারের “মনোবিজ্ঞান ও জীবন” গ্রন্থটি থেকে নেয়া হচ্ছে। টীকা অংশের লেখাগুলো মুনীর তৌসিফের “মতবাদ কোষ” থেকে নেয়া হচ্ছে।

Table of Contents

চেতনা (Consciousness)

উইলিয়াম জেমস (William James, ১৮৯০)-এর তিরোধানের পর এবং বিশেষভাবে আচরণবাদী বা বিহ্যাভিওরিস্ট চিন্তাধারার (টীকা অংশে বিস্তারিত) উদ্ভব হওয়ার ফলে চেতনা সম্বন্ধে মনোবিজ্ঞানীদের আগ্রহ কমে যায়। কিন্তু ১৯৬০ সালের দিকে পুনরায় চেতনা সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানীদের আগ্রহ দেখা দেয়। তখন তাঁরা উত্তেজনা বা উল্লাস সৃষ্টিকারী কতকগুলো ঔষধ (যেমন LSD) নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করেন। তাছাড়া তাঁরা কতকগুলো ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ও অতিন্দ্রীয় বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এগুলো হলো : ধ্যানাবস্থা (Meditation), অতিন্দ্ৰীয় প্রত্যক্ষণ (Extrasensory Perception = ESP), পাশ্চাত্যের ধর্ম-দর্শন এবং গুপ্তবিদ্যা (Occultism)। আধুনিক সমাজের বস্তুবাদ বা জড়বাদের (টীকা অংশে বিস্তারিত) প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে এবং প্রযুক্তির উপর অত্যধিক গুরুত্বরোপ করার কারণে অনেকেই এসবের প্রতি নির্মোহ হয়ে পড়ে। তারা মানুষের অন্তরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চেষ্টা করে। এসব মনোবিজ্ঞানীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করা; তবে এ সময় জ্ঞান-সাধনার চিরাচরিত সেকেলে অন্তর্দৃষ্টিমূলক পদ্ধতিগুলো বর্জন করা হয় এবং পরীক্ষণমূলক পদ্ধতি বেশি করে ব্যবহৃত হয়।

আমেরিকান সমাজের সাধারণ লোকেরা যখন পাশ্চাত্য ধর্ম, গুপ্তবিদ্যা, উত্তেজক ঔষধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে; মনোবিজ্ঞানীরাও তখন এসব নিয়ে পুনরায় অনুসন্ধান শুরু করেন; অথচ এসব বিষয় পূর্বে ছিল প্রায় অবহেলিত। মনোবিজ্ঞানীরা ক্রমশ স্বপ্ন, নিদ্রা, ঔষধের প্রভাব, সম্মোহন ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে শুরু করেন। এভাবে সচেতন অবস্থার বিভিন্ন স্তর বা বহিঃপ্রকাশ সম্পর্কে তাঁরা গবেষণা করতে শুরু করেন। ফলে, এতদিন যে-সব বিষয় সম্পর্কে বিদগ্ধ মহলে অনীহা বিরাজমান ছিল, এখন সেগুলো সুধী মহলে পুনরায় আলোচিত হতে লাগল। সেজন্য মানুষের আচরণে চেতনা কী ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা আবার চিন্তা ভাবনা শুরু করেছেন।

চেতনা এবং আচরণে এর ভূমিকা 

সচেতন অবস্থা এমন একটি প্রাথমিক ধারণা যা ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। সচেতন হওয়ার অর্থ হলো সজাগ হওয়া এবং সক্রিয় হওয়া যেমন নিদ্রা থেকে জেগে উঠা। আরেকটু ব্যাপক অর্থে নিজের সম্বন্ধে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানা। বাইরের জগৎ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান লাভ হয় ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। বাহ্যিক উদ্দীপক আমাদের ইন্দ্রিয়ে যে সাড়া জাগায় তাকে বলা হয় সংবেদন। আবার বাইরের জগত সম্বন্ধে আমরা যে সংবেদন বা তথ্য লাভ করি তা যদি স্মৃতিতে সংরক্ষিত না থাকত তাহলে আমাদের জীবন কঠিন হয়ে উঠত। মনোবিজ্ঞানীরা যখন জানতে চান সংবেদী স্মৃতি কিভাবে সংরক্ষিত হয়, এবং প্রয়োজনবোধে তা পুনরায় প্রত্যাহবান করা হয়— তখন তারা প্রকৃতপক্ষে চেতনা সম্পর্কেই প্রশ্ন করেন। স্মৃতি এবং বর্তমান প্রত্যক্ষণ –এ দুটো প্রক্রিয়াই একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে চিন্তন প্রক্রিয়াকে পরিচালিত করে। চিন্তন প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ ধরণ হলো সমস্যার সমাধান এবং সৃজনধর্মী কল্পনা। ইচ্ছাপূরণ মূলক চিন্তা – যাকে আমরা বলি দিবাস্বপ্ন, এটাও একটা সচেতন প্রক্রিয়া। ঠিক তেমন হলো নৈশকালীন স্বপ্ন যখন মস্তিষ্কের কিছু অংশ সচেতন ও সক্রিয় থাকে। এসব স্বপ্ন পুনরায় স্মরণ করা হলে তা-ও সচেতন ভাবেই করা হয়। এসব সচেতন প্রক্রিয়াগুলো ঘটে থাকে আমাদের আবেগ অনুভূতি এবং তাগিদের পটভূমিতে এবং সৌন্দর্যবোধ ও মানবীয় মূল্যবোধের পটভূমিতে।

অচেতন (Non Conscious), প্রাকচেতন (Pre-Conscious), অবচেতন (Unconscious)

অনেক সময় আমরা লক্ষ্য করি যে, কোন একটি বস্তু আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, আবার পর মুহূর্তেই মনোযোগের বাইরে চলে যায়। আবার এও লক্ষ্য করেছি যে, কোন কোন সময় একটি বিষয় মনে করতে পারি, অর্থাৎ স্মৃতিতে প্রত্যাহবান করতে পারি, আবার কোন সময় পারি না। এ সব দৃষ্টান্ত থেকে বুঝতে পারি যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্দীপক আমাদের চেতনায় প্রতিফলিত হয়, আবার বিভিন্ন সময় হয় না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, চেতনার স্তরভেদ রয়েছে। অর্থাৎ সচেতন অবস্থার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। আলোচনা করা যাক –

অচেতন প্রক্রিয়া (Non-Conscious Processes) : কোন কোন প্রক্রিয়া কখনই চেতনায় প্রতিফলিত হয় না, অর্থাৎ এ সব প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি না। আমাদের খাদ্য পরিপাক ক্রিয়া-যা পাকস্থালীর ভিতরে সম্পন্ন হয়, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোর হরমোন নিঃসরণ, অথবা রক্তে লবণ বা শর্করা জাতীয় উপাদানের পরিমাণ এ সব ক্রিয়া সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারি না। এ সব প্রক্রিয়াকে অচেতন প্রক্রিয়া বলা হয়। তবে এ সব প্রক্রিয়ার শারীরিক বা মানসিক প্রভাব থেকে অনেক সময় এ সব প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি। যেমন বহুমূত্র রোগী বুঝতে পারে কখন তার রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও শরীরের অভ্যন্তরের প্রক্রিয়াগুলো প্রকৃতপক্ষে কীভাবে ঘটছে তা আমরা জানতে পারি না। সেজন্য এ সব প্রক্রিয়াকে অচেতন প্রক্রিয়া বলা চলে।

প্রাকচেতন প্রক্রিয়া (Pre Conscious Processes) : ফ্রয়েডের মতে যে-সব স্মৃতি এই মুহূর্তে আমরা স্মরণ করতে পারি না তবে একটু চেষ্টা করলেই স্মরণ করতে পারি, সেগুলোকে বলা হয় প্রাক্‌চেতন। যেমন গত শীতে আমরা বনভোজনে গিয়েছিলাম। এ ঘটনার স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে আছে, কিন্তু আমি এ মুহূর্তে এ সম্পর্কে সচেতন নই-তবে আমি প্রয়োজনবোধে এ স্মৃতিকে প্রত্যাহবান করতে পারি। তখন উক্ত স্মৃতিটি আমার চেতনার একটি অংশে পরিণত হবে। প্রচলিত পরিভাষায় এ ধরনের স্মৃতিকে “প্রাপ্তব্য স্মৃতি” (Available Memory) বলে। আমাদের এমন অনেক সময় ঘটে যে একজন ব্যক্তির নাম মনে আসার প্রান্তে এসেও আসে না। এ ধরনের ঘটনাকে ইংরেজিতে বালে টিপ অব দ্য টাং পরিসিদ্ধতি (Tip of the tongue phenomenon), অর্থাৎ জিহ্বার ডগায় এসে গেছে কিন্তু বলতে পারছি না। এ ধরনের ঘটনাই হল প্রাক্‌চেতন অবস্থা।

অবচেতন প্রক্রিয়া (Unconsicons Processes) : যেসব প্রক্রিয়া প্রাক-চেতন প্রক্রিয়ার চেয়েও আরো বেশি অগম্য বা দুর্জ্ঞেয় সেগুলোকে বলা হয় অবচেতন প্রক্রিয়া। তবে সম্পূর্ণ অচেতন (Nonconscious) প্রক্রিয়া থেকে এগুলোর পার্থক্য হলো এই যে, এগুলো আমাদের স্মৃতি, আবেগ এবং আচরণসমূহকে প্রভাবান্বিত করে। বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার বিস্মৃতি এবং বহু ধরনের কাজ যেগুলোর অর্থ বোধগম্য হয় না- এ সবের ব্যাখ্যার জন্য অবচেতন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনুমান করা হয়। আমরা অনেক সময় আমাদের অজান্তেই এমন কোন কাজ করে ফেলি -যা হয়ত সচেতনভাবে করতে চাইতাম না। ফ্রয়েড এ সব কাজের ব্যাখ্যার জন্য অবচেতন প্রক্রিয়াকে দায়ী করেছেন। কতকগুলো মানসিক ব্যাধির লক্ষণ, স্বপ্ন, এবং মুদ্রাদোষ (mannerisms) ইত্যাদির মাধ্যমে অবচেতন প্রক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে।

ফ্রয়েড মনে করতেন যে, এ সব সংকেতের অর্থ ব্যাখ্যা করে আমরা অবচেতন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারি। তবে অবচেতন প্রক্রিয়াগুলোর সম্পর্কে অনুমান করতে পারার অর্থ এই নয় যে এগুলোকে আমরা মনের সচেতন স্তরে নিয়ে আসতে পারি। অনেক সময় অর্ধচেতন (Subconscious) এবং অবচেতন (Unconscious) প্রক্রিয়াসমূহকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। তবে হিলগার্ড ও তার সঙ্গীরা (Hilgard. Atkinson and Atkinson. 1979) দেখিয়েছেন যে, এ দুটো প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা যায়।

অর্ধচেতন অভিজ্ঞতাগুলো অনেকটা চেতন প্রক্রিয়ার মতোই কাজ করে, তবে চেতনার বাইরের দিকের প্রান্তে অবস্থিত বলে এগুলো সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকি না। যেমন একটা ঘন্টার ঢং ঢং আওয়াজ হতে থাকলে প্রথম দিকে হয়তো আমরা সচেতন হই না, কিন্তু কয়েকবার আওয়াজ হওয়ার পরে হঠাৎ যেন আমাদের সম্মিত বা চেতনা ফিরে আসে। তখন আমরা মোট কয়টি শব্দ হয়েছিল তা গুনতে পারি- যদিও সবগুলো শব্দ হয়ত আমরা শুনেছি কি না তা জানি না। অর্থাৎ এ শব্দগুলো আমাদের অর্ধচেতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রভাবান্বিত করছে। আজকার মনোবিজ্ঞানীরা সংবেদন-প্রারম্ভ সীমার নিম্ন তীব্রতাসম্পন্ন উদ্দীপকের প্রত্যক্ষণ (বা Subliminal Preception) সম্পর্কিত যেসব গবেষণা করেছেন, সেগুলোকে অর্ধচেতন প্রক্রিয়া বলে গণ্য করা যায়। সংবেদী প্রারম্ভ সীমার চেয়েও কম তীব্র উদ্দীপককে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য উপস্থিত করে দেখা গেছে, সেগুলো মানুষের সচেতন প্রত্যক্ষণ বা প্রেষণাকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। এ থেকে অনুমান করা হয় যে, যদিও এসব উদ্দীপক সচেতনভাবে প্রত্যক্ষণ করা যায়না তবু আমাদের ইন্দ্রিয় এগুলো শনাক্ত করতে পারে এবং এসব উদ্দীপকের ছাপ আমাদের আচরণের প্রভাব ফেলে। এ ধরনের প্রত্যক্ষণকে অর্ধচেতন প্রক্রিয়া বলে গণ্য করা, হয়। তবে অর্ধচেতন প্রত্যক্ষণের জন্য উদ্দীপকটি যে শারীরবৃত্তীয় সীমার নিচে অবস্থিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যেকোন উদ্দীপক যা আমাদের মনোযোগের প্রান্তে অবস্থান করে, অথবা সচেতনভাবে যার প্রতি মনোযোগ দেই না তেমন উদ্দীপকমাত্রই অর্ধচেতন প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হতে পারে।

পক্ষান্তরে, অবচেতন প্রক্রিয়াকে ফ্রয়েড একটি সক্রিয় মানসিক অবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। ফ্রয়েডের মতে সচেতন প্রক্রিয়ার মতো অবচেতন প্রক্রিয়াও সক্রিয়ভাবে ঘটে থাকে, তবে এগুলো সম্পর্কে আমরা সজাগ থাকি না বা অবহিত থাকি না। কতকগুলো প্রেষণা চরিতার্থতার জন্য অথবা বেদনাদায়ক আবেগ থেকে সচেতন অভিজ্ঞতাকে মুক্ত রাখার জন্য কতকগুলো ঘটনার স্মৃতিকে আমরা সচেতন স্তর থেকে সরিয়ে রাখি। যে প্রক্রিয়ায় কতকগুলো অ-গ্রহণযোগ্য প্রেষণা বা বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাকে সচেতন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয় তাকে ফ্রয়েড বলেছেন অবদমন (Repression)। কিন্তু এসব অবদমিত স্মৃতি কখনই মরে যায় না বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। অবচেতনের গভীরে থেকেও এসব স্মৃতি সক্রিয়ভাবে আমাদের আচরণকে প্রভাবান্বিত করে। এসব প্রক্রিয়াই প্রকৃতপক্ষে মানসিক ব্যাধির লক্ষণ, স্বপ্ন বা অন্যান্য আচরণের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে-যার অর্থ সহজে বোঝা যায় না। অর্থাৎ অবচেতন প্রক্রিয়াসমূহকে সরাসরি শনাক্ত করা যায় না, তবে অযৌক্তিক আচরণ বা মানসিক ব্যাধির লক্ষণাবলি কিংবা স্বপ্নের সংকেতগুলো থেকে এগুলো সম্পর্কে অনুমান করা যায়। ফ্রয়েড স্বপ্ন বিশ্লেষণ, সম্মোহন, স্মৃতিচারী অনুষঙ্গ বা অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতির মাধ্যমে অবচেতন প্রক্রিয়াগুলোবে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছিলেন। বিষঙ্গ প্রতিক্রিয়া (Dissociative Reaction) নামক মানসিক ব্যাধিতে এ ধরনের অবচেতন প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

চেতন-প্রক্রিয়ার স্বরূপ (Nature of Consciousness)

বহু ধরনের মানসিক প্রক্রিয়াকে চেতন প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে প্রকাশভঙ্গি বা অভিব্যক্তি অনুসারে সবরকম চেতন-প্রক্রিয়াকে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করা যায় ও নিষ্ক্রিয় গ্রহণমূলক অবস্থা (Passive Receptive States) এবং সক্রিয় উৎপাদনমুখী মানসিক অবস্থা (Active productive mental activties)।

নিষ্ক্রিয় অবস্থা (Passive Mode) : জ্ঞানেন্দ্রিসমূহের কাজ হলো বাইরের পরিবেশ থেকে সংবাদ গ্রহণ করে আমাদের চারপাশে এবং শরীরের অভ্যন্তরে কী ঘটেছে সে সম্বন্ধে আমাদের অবহিত করা। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহের উত্তেজনার মাধ্যমে আমরা বাইরের জগৎ সম্বন্ধে এবং আমাদের শরীরের ভেতরের অবস্থা সম্বন্ধে যে সংবাদ পাই সেগুলো হলো চেতনার নিষ্ক্রিয় অবস্থা। সংবেদী অভিজ্ঞতাসমূহ (Sensory Experiences) বিভিন্নভাবে স্মৃতি, কল্পনা, যত্ন, আশা-আকাক্ষা এবং আবেগের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আমাদের চেতনায় প্রতিফলিত হয়। আমরা যখন আমাদের অভিজ্ঞতাসমূহকে মূল্যায়ন করি বা বিচার করি তখন আমরা আনন্দ ও বেদনা সম্পর্কে জানতে পারি। অর্থাৎ এ অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের চেতনায় প্রতিফলিত হয়। কোন কোন অভিজ্ঞতা আমরা পছন্দ করি আর অন্য কতকগুলো পছন্দ করি না। সুতরাং আমাদের সংবেদন গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে একটি সৌন্দর্য বোধ বা সৌন্দর্য চেতনা সংযুক্ত হয়। যেসব অভিজ্ঞতা আমাদের আনন্দ দেয় আমরা সেসব অভিজ্ঞতা খুঁজে বেড়াই এবং সে সমস্তগুলোকে ধরে রেখে চেখে চেখে অনুভব করতে চেষ্টা করি। আমাদের অভিজ্ঞতাসমূহের মধ্যে যেহেতু একটা নিরবচ্ছিন্নতা রয়েছে এবং আমাদের স্মৃতিই এই নিরবচ্ছিন্নতা দান করে, সেহেতু আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজেদেরকে অন্যান্যদের চেয়ে বেশি জানি এবং সেভাবে মূল্যায়ন করি। এসব কারণে যারা সমাজের সঙ্গে খাপ যাওয়াতে পারে না তারা তাদের চেতনার মধ্যে নিজেদের খুঁজে পেতে চেষ্টা করে এবং নিজের চেতনার মধ্যে নিজেকে নির্লিপ্ত করে হয়ত কিছুটা আত্মতৃপ্তি পেতে চায় অথবা বৈরী পরিবেশের সঙ্গে সমঝোতা করতে চায়। প্রাচীন ভারতের যোগীরা নিষ্ক্রিয় চেতনার উপলব্ধিকে অত্যন্ত বেশি মূল্য দিতেন এবং এ উপলব্ধির চূড়ান্ত রূপকে তারা সমাধি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ অবস্থায় ব্যক্তির চেতনা অতীতের স্মৃতি বা ভবিষ্যতের কল্পনা থেকে মুক্ত হয়ে বর্তমানের ধ্যানের বিষয়বস্তুর ওপর কেন্দ্রীভূত হয় এবং ব্যক্তির নিজস্ব অস্তিত্ব বোধ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ সমাধির অবস্থায় যোগীর অস্তিত্ব ধ্যানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিশে যায় এবং ব্যক্তি অপার শান্তি ও আনন্দ লাভ করে। ১৯৬০ সালের দিকে আমেরিকানরা যোগসাধনার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তখন হতাশাগ্রস্ত আমেরিকান যুব সমাজ চেতনার নিষ্ক্রিয় উপলব্ধির ওপর গুরুত্বরোপ করে এবং ধ্যানের মাধ্যমে আনন্দ পেতে চেষ্টা করে। যাই হোক, নিষ্ক্রিয় গ্রহণাবস্থা বা সংবেদনশীলতা চেতনার একটি বিশেষ ধরনের অভিব্যক্তি মাত্র।

সক্রিয় অবস্থা (Active Mode) : চেতনার সক্রিয় অবস্থা হলো পরিকল্পনা তৈরীকরণ অথবা সমস্যার সমাধানমূলক প্রক্রিয়া। ব্যক্তি কখনও একটি বাড়ী তৈরির পরিকল্পনা করে, আবার কখনও বা একটি চিঠি ডাকে ফেলার মতো সহজ সরল পরিকল্পনা করে- যা সহজেই বাস্তবে পরিণত করা যায়। ব্যক্তি কখনও স্বল্পমেয়াদি আবার কখনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে ফোনে ডাক্তারী পড়ার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তির চেতনায় এমন সব ঘটনা প্রতিফলিত হয় যেগুলো পূর্বে ঘটে নি। এসব অবস্থায় ব্যক্তি কতকগুলো সম্ভাব্য ফলাফলের বিষয়ে কল্পনা করে, বিকল্প ঘটনাবলি সম্বন্ধে কল্পনা করে, বিভিন্ন সম্ভাবা পরিকল্পনার মধ্য থেকে একটিকে নির্বাচন করে এবং উপযুক্ত কর্মতৎপরতা শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিল্পী বা প্রকৌশলী বা আবিষ্কারক প্রথমে কিছুটা অস্পষ্টভাবে একটি অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু সৃষ্টির স্বপ্ন দেখে বা কল্পনা করে, তারপর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আস্তে আস্তে তাঁর কল্পনাকে রূপায়িত করে। আমরা যখন ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে কোন পরিকল্পনা করি, নিজেদের সৃষ্টিকে কল্পনার ছবির সাথে মিলিয়ে দেখি এবং ব্যর্থতা ও আশার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমাদের কল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের সাথে অগ্রসর হই তখন আমাদের চেতনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোন একটি পরিকল্পনা তৈরি করা ও সে অনুযায়ী উপযুক্ত আচরণ সৃষ্টি করা এবং লক্ষ্য বাস্তবায়নে সতর্কভাবে আচরণকে পরিচালিত করা- এগুলো চেতনার সক্রিয় ভূমিকা নির্দেশ করে।

চেতনার নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা 

এতক্ষণ চেতন-প্রক্রিয়ার বিভিন্ন অভিব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। আমরা যদিও অচেতন, প্রাচেতন, অবচেতন এবং সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় চেতন প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছি, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য খুবই অস্পষ্ট। অর্থাৎ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমারেখা টানা প্রায় অসম্ভব। এ বিষয়টি আরো ভালভাবে বোঝা যায় যখন আমরা আচরণের নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াটি লক্ষ্য করি। আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস (১৮৯০) এবং তাঁর মত আরো অনেকেই চেতন এবং ঐচ্ছিক নিয়ন্ত্রণকে একই অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ জেমস-এর ধারণা ছিল যে সচেতন হওয়া মানে আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা। জেমস-এর ভাষায় ভবিষ্যতের কোন লক্ষ্যবস্তুর প্রতি ধাবিত হওয়া বা সেটি অর্জনের জন্য উপায় নির্বাচন করা হলো কোন একটি ঘটনায় (মানসিক ক্রিয়ার) চেতনায় উপস্থিতির মাপকাঠি বা বৈশিষ্ট্য। জেমস-এর মতে যেকোন নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়াই হল চেতন-প্রক্রিয়া তবে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণই ঐচ্ছিক প্রক্রিয়া নয়। ঐচ্ছিক এবং অনৈচ্ছিক প্রক্রিয়াসমূহের মাধ্যমে দু’ধরনের নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ পাওয়া যায় – সচেতন ও অচেতন বা অবচেতন। অর্থাৎ ঐচ্ছিক ক্রিয়ায় সচেতন নিয়ন্ত্রণ বর্তমান থাকে, কিন্তু অনৈচ্ছিক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকি না। কিন্তু ঐচ্ছিক বা অনৈচ্ছিক যাই হোক না কেন, কোন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে হলে কোন না কোন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকতেই হবে।

প্রথমে সচেতন নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। কোন একটি প্রক্রিয়া যত বেশি ঐচ্ছিক সেটি তত বেশি সচেতন। ‘ঐচ্ছিক’ শব্দের অর্থই হল যৌক্তিকভাবে নির্বাচিত পরিকল্পিত এবং কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের প্রতি পরিচালিত কোন প্রক্রিয়া। এখন প্রশ্ন হলো, অনৈচ্ছিক প্রক্রিয়াসমূহ নিয়ন্ত্রিত হয় কী ভাবে? আমাদের শরীরে এমন কতকগুলো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা রয়েছে যেগুলো আমাদের অনৈচ্ছিক প্রক্রিয়াসমূহকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পরিচালিত হয় স্নায়ুতন্ত্র এবং অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমূহের মাধ্যমে। স্নায়ুতন্ত্রের স্বয়ংক্রিয় অংশ আমাদের অজান্তেই দেহের রাসায়নিক পদার্থ, জলের পরিমাণ, তাপমাত্রা, হরমোন নিঃসরণ ইত্যাদি প্রক্রিয়াসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে। শরীরের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য স্থাপন প্রক্রিয়াসমূহ যে অবচেতনভাবেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তার প্রমাণ হলো এসব প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা অবগত থাকি না এবং সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।

কোন কোন আচরণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমরা সচেতন থাকলেও অনেক সময় ক্রমাগত অভ্যাসের ফলে এসব আচরণ স্বয়ংক্রিয়ভাবইে চলতে থাকে এবং এগুলো সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকি অথবা একবারেই সচেতন থানি না। তবে কাজ যে চেতনা/সজ্ঞা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না তা নয়। হয়ত কাজটি পূর্বে যে পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হতো এখনও হয়ত সে পর্যায়েই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তবে এখন শুধু ওই নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াটি চেতন প্রক্রিয়া থেকে বিযুক্ত বা আলাদা হয়ে পড়ছে। এ ধরনের ঘটনাকে মনোবিজ্ঞানীরা বিষঙ্গ প্রক্রিয়া (dissociation) বলে থাকেন। সাইকেল চালনা শিক্ষা করার সময় প্রচুর মনোযোগ দিতে হয়। কিন্তু একবার শিক্ষা করা হয়ে গেলে আচরণটি হাঁটার মতই স্বাভাবিকভাবে চালনো যায়। অবশ্য, হাঁটাও একদিন চেষ্টা করে শিখতে হয়েছিল। এ ধরনের নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি যে কোন কাজের নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব সচেতন প্রক্রিয়া থেকে পরিবর্তন করে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার উপরে ন্যস্ত করে। ঠিক যেমন বিমান চালনার সময় বিমান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মানব পাইলটের বদলে অটামেটিক পাইলটের নিকট হস্তান্তর করা হয় যাতে মানব পাইলট অন্য কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে, (হিলগার্ড ও অন্যন্য ১৯৭৯)। এ ধরনের কাজ প্রথমে শুরু করার জন্য সচেতন সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয় কিন্তু একবার শুরু হয়ে গেলে তা অভ্যাসের দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে থাকে। তখন এসব কাজের নিয়ন্ত্রণ সচেতনভাবে করা হয় না। আমরা যেমন হাঁটার সময় কথা বলতে পারি; হাঁটার কাজটি ময়ংক্রিয় ব্যবস্থার অবচেতনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু কথা বলার সময় আমরা সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে কথাবার্তা নিয়ন্ত্রণ করি। আমাদের ‘স্বপ্ন’ নিদ্রাকালে অনেকটা অবচেতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে কিন্তু আমরা সে স্বপ্ন সচেতনভাবে স্মরণ করি এবং মনে করি স্বপ্নের নাটকটি আমাদেরই সৃষ্টি এবং স্বপ্ন দেখেছি।

এখন আমরা বুঝতে পারছি যে, বহু ধরনের আচরণ এবং কাজের নিয়ন্ত্রণ সুস্পষ্টভাবে সচেতন প্রক্রিয়া। কিন্তু অভ্যাসগত আচরণের নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা কম এবং বহুসংখ্যক আচরণ সম্পূর্ণভাবে অবচেতন প্রক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ একই সময় বা একভাবে ঘটতে পারে।

অবচেতন প্রক্রিয়াসমূহ যেহেতু প্রায়শ আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেজন্য আমাদের চেতনা প্রায়শ দ্বিধাবিভক্ত হয়। কারণ, অবচেতন প্রক্রিয়ার অনেক বৈশিষ্ট্য চেতন প্রক্রিয়ার মতই। বহুদিন থেকেই বিশ্বাস করা হয় যে, চেতনা একটি অখণ্ড (unified) প্রক্রিয়া, কারণ আজকের ‘আমি’ এবং গতকালের আমি একই বলে আমরা মনে করতে পারি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি হলো স্মৃতির দ্বারা সৃষ্ট একটি প্রহেলিকা। আমি গতকাল যা ছিলাম আজও তাই আছি-এই অভিজ্ঞতার কারণ হলো স্মৃতি। যদিও মাঝখানে নিদ্রা বা অসারকারী ঔষধ প্রযোগের ফলে আমাদের চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়, তবু আমি গতকালের স্মৃতিগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারি। এই সম্মতির পুনরুৎপাদনের জন্য আমাদের চেতনার বিচ্ছিন্ন সুত্রগুলো জোড়া দিতে পারি এবং আমাদের চেতনার একটি ধারাবাহিকতা উপলব্ধি করি। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি যে, মাঝে মাঝেই অবচেতনের অনুপ্রবেশের ফলে আমাদের চেতনার ঐক্য খণ্ডিত হয়। এবারে খণ্ডিত চেতনার বিভিন্ন অতিব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।

খণ্ডিত চেতনা (Divided Consciousness)

সাধারণত দু’ধরনের ঘটনার মাধ্যমে খন্ডিত চেতনার প্রমাণ পাওয়া যায় (১) বিভক্ত মনোযোগ এবং (২) বহু ব্যক্তিত্ব (Multiple personality)। এই দু’ধরনের ঘটনা আলোচনা করা যাক।

বিভক্ত মনোযোগ (Divided Attention)

অন্ধকারে আলোক বিন্দুর মত আমাদের মনোযোগ সতত একটি বিষয়বস্তু থেকে অন্য আরেকটি বিষয়বস্তুতে পতিত হয়। আমাদের অবধান বা জ্ঞান এই মূহূর্তে হয়ত আমাদের শরীরের কোন ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার উপর নিবদ্ধ রয়েছে, কিন্তু পরমূহূর্তেই আমরা বাইরের কোন ঘটনার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছি। অথবা হয়তো কোন ঘটনা স্মরণ করছি বা কোন বিষয় সম্বন্ধে কল্পনা করছি। এমন কি যখন আমরা সাধারণভাবে কোন ব্যক্তির সাথে আলাপ-আলোচনা করছি তখনও আমাদের মনোযোগ একাদিক্রমে অথবা একইসঙ্গে বহু বিষয়ের উপর নিবন্ধ হয়। যখন আমরা একজনের সাথে কথা বলছি তখন হয়ত তার কথা শুনছি তার পর আবার নিজের কথা বলছি, আবার যখন কথা বলছি তখনও পরের বারে কি বলব তা পরিকল্পনা করছি। এমনিভাবে একইসঙ্গে বহুমুখী স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। যেমন – শোনা, কথা বলা, সমালোচনা করা বা পরিকল্পনা করা। কখনও কখনও ব্যক্তি তার পরিবেশের অনেকগুলো জিনিসের মধ্যে থেকে শুধু একটি জিনিসের প্রতি মনোযোগ দেয়, অন্য জিনিসগুলো মনোযোগের কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান করে – অর্থাৎ ব্যক্তি যেগুলোর প্রতি মনোযোগ দেয় না। অন্যকথায় বলা যায়, ব্যক্তি কতকগুলো বিষয়ের প্রতি সচতেন থাকে, অন্যগুলোর প্রতি থাকে না।

একটি পরীক্ষণে দুটি খেলার ভিডিও টেপ (Video Tape), কতকগুলো পরীক্ষণ পাত্রকে একই সঙ্গে দেখানো হয়েছিল। একট খেলা ছিল এমন যে, একজন বাক্তি তার হাত সরিয়ে নেয়ার আগেই আরেকজন তার হাতে চড় মারবে। অন্য খেলাটি ছিল বল নিয়ে ভলি খেলা। দু’জন ব্যক্তি পরস্পরের মধ্যে বল আদান-প্রদান করে। খেলা দুটো একই সঙ্গে একটির উপরে আরেকটি উপস্থাপিত করে দেখানো হয়। পরীক্ষণ পাত্রদের যেকোন একটি খেলা লক্ষ্য করতে বলা হয়, অন্যটিকে অস্বীকার বা লক্ষ্য না করতে বলা হয়। লক্ষ্যবস্তু যো দেখতে হবে। প্রতি মিনিটে ৪০ বার উপস্থিত করা হয়। পরীক্ষণে দেখা যায় যে, পরীক্ষণ পাত্ররা যখন একটি খেলা দেখে তখন অন্য খেলাটি কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। কোন ব্যক্তি ৩% এর বেশি ভুল করে না। কিন্তু দুটি খেলা একইসঙ্গে লক্ষ্য করতে চাইলে ভুলের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে মনে হচ্ছে ব্যক্তি শুধু একটি খেলার প্রতি মনোযোগ দেয়। যদিও অন্য খেলার সংবেদন তার ইন্দ্রিয়ে আঘাত করে তবু তা মনোযোগের কেন্দ্রে পৌঁছায় না। অর্থাৎ ব্যক্তির চেতনার কেন্দ্র বিন্দুতে উপস্থিত হয় না। এই পরীক্ষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, চেতনা বিভক্ত হতে পারে। যার ফলে আমরা একই সঙ্গে উপস্থিত বহুসংখ্যক উদ্দীপকের মধ্যে একটি উদ্দীপকের প্রতি মনোযোগ দিতে পারি এবং অন্যগুলো অগ্রাহ্য করতে পারি।

এখন প্রশ্ন হলো, চেতনার এ ধরনের বিভক্তি কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? তথ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ তত্ত্ব বা Information Processing Theory অনুসারে আমরা প্রকৃতপক্ষে এক সময়ে মাত্র একটি জিনিসের প্রতি মনোযোগ দিতে পারি। তথ্যের একটি উৎস থেকে অন্য আরেকটি উৎসের প্রতি মনোযোগের দ্রুত পরিবর্তন (Shift)- এর জন্যই আমাদের কাছে আপাতত মনে হয় যে আমরা দুটি জিনিসের প্রতি একইসঙ্গে মনোযোগ দিতে পারি। একটি জিনিস থেকে আরেকটি জিনিসের প্রতি মনোযোগের এ ধরনের পরিবর্তনকে বলা হয় সবিরাম (Intermrttent) প্রক্রিয়াজাতকরণ বা ক্রমিক প্রক্রিয়াজাতকরণ (Serial processing। পক্ষান্তরে, মনোযোগ দুটি জিনিসের মধ্যে বিভক্ত হতে পারে। দুটি বস্তুর প্রতি মনোযোগ যদি একইসময়ে দেয়া হয়, তাহলে তাকে বলা হয় সমান্তরাল প্রক্রিয়াজাতকরণ (Parallel Processing)

সমান্তরাল প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি বিশেষ অভিব্যক্তিতে মনোযোগ প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনাকরণ আমাদের সচেতন অবধান ছাড়াই চলতে থাকে। একটি বিষয়বস্তু বা উৎস থেকে আগত তথ্য সচেতনভাবে এবং অন্য উৎসের তথ্য অবচেতনভাবে প্রক্রিয়াজাত হতে থাকে। চলমান চিন্তা ও মনোযোগের যে ধারাটি আমাদের অবধান বা সজ্ঞার অন্তরালে থেকে যায়, সেটিকে আমরা বলি চেতনা বা অভিজ্ঞতা থেকে বিযুক্ত (dissociated) অংশ (হিলগার্ড, এটাকিনসন ও এটকিনসন, ১৯৭৯)।

বহু ব্যক্তিত্ব (Multiple Personalities)

চেতনার বিভক্ত হওয়ার জন্য আমরা একসঙ্গে একাধিক কাজ করতে পারি যেমন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি গানের সুর গুনগুন করে গাইতে পারি। কিন্তু এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলে আমাদের কাছে মনে হয় না। কারণ, আমরা ইচ্ছে করলেই একটি বিষয়বস্তু থেকে মনোযোগ সরিয়ে অন্য আরেকটি বিষয়ের উপর নিবন্ধ করতে পারি। কোন কোন সময় মানুষের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসমূহ যেগুলোর সাহায্যে সে বিভিন্ন আচরণ ও অভিজ্ঞতাসমূহ পরিচালিত করে সেগুলো তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ ধরনের ঘটনার একটি চূড়ান্ত উদাহরণ হলো বহু ব্যক্তিত্ব (Multiple personalities)। বহু ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে গবেষণা করে চেতনার জটিল অভিব্যক্তিগুলো সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়।

বহু ব্যক্তিত্বের বেলায় একজন ব্যক্তির ইচ্ছা, আকাক্ষা ও অভিজ্ঞতাগুলো একাধিক সংগঠনে সংঘবদ্ধ হয়। তারপর প্রত্যেকটি সংগঠন একটি আলাদা স্বাধীন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় (Sub Personalities)। একটি ব্যক্তিত্বে ব্যক্তি হয়ত সুখী ও খামখেয়ালী, আবার অন্য বক্তিত্বে সে হয়ত উদ্বিগ্ন ও গম্ভীর প্রকৃতিবিশিষ্ট। ব্যক্তির মধ্যে এ দুটি ব্যক্তিত্ব একান্তরভাবে বা পালাক্রমে প্রকাশিত হতে পারে। তবে একটি ব্যক্তিত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য একটি ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারে। বহু ব্যক্তিত্বের কয়েকটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হলো ইভ হোয়াইট-যার একান্তর ব্যক্তিত্ব ছিল ইভ ব্ল্যাক ও জেন (Thigpen এবং Cleckly. 1957)। আরেকজন মহিলার নাম ছিল ইভলিন। তার মধ্যে তিনটি ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। কোন সময় সে হতো গিনা (Gina), কোন সময় মেরী (Mary) এবং কোন সময় ইভলিন (Evelyn)। এই দৃষ্টান্তটি উল্লেখ করেছেন অসগুড ও সহকর্মীরা (১৯৭৬)। ল্যুদবিগ ও সহকর্মীরা (Ludvig and Others. 1972) সাম্প্রতিকালের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন।

জোনাহ নামের ২৭ বছরের একটি যুবক মাথা ব্যথা ও তারপর পরই স্মৃতি শক্তি লোপ পাওয়ার লক্ষণ নিয়ে হাসপতালে আসে। হাসপাতালের নার্সগণ ঐ লোকটির মধ্যে ব্যক্তিত্বের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করে এবং মনোচিকিসক বিভিন্ন দিনে তাকে পরীক্ষা করে তার মধ্যে চারটি আলাদা ব্যক্তিত্বের প্রকাশ দেখতে পান। যে চারটি ব্যক্তিত্ব মোটামুটি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে সেগুলো হলো (১) জোনাহ- এটি ছিল তার মূল ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্বে সে ছিল লাজুক, নম্র, কিছুটা নিষ্ক্রিয় এবং অলস। চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় সে মাঝে মাঝে ভীতসন্ত্রস্ত হতো এবং বিভ্রান্তি প্রকাশ করতো। জোনাহ অন্য ব্যক্তিত্বগুলো সম্পর্কে সচেতন ছিল না। (২) সাম্মী – এই ব্যক্তিত্বে তার স্মৃতিশক্তি প্রখর, সে জোনাহ সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং সে জোনাহর সাথে সহাবস্থান করতে পারত বা জোনাহকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারত। জোনাহর অসুবিধা হলে সে তাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকত। এই ব্যক্তিত্বে তাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যেত। এই ব্যক্তিত্বটি তার ছয় বছর বয়স থেকে দেখা যায়। যখন সে তার পিতাকে তার মাকে ছুরিকাঘাত করতে দেখে এবং সে তার পিতামাতাকে ছেলেমেয়েদের সম্মুখে ঝগড়া না করতে বাধ্য করে। (৩) কিং ইয়ং – এই ব্যক্তিত্বটির প্রকাশ জোনাহর ছয় সাত বছর বয়সে। এই ব্যক্তিত্বটি গঠিত হয় জোনার যৌন চরিত্রের সরাসরি সার্থক পরিণতি দানের উদ্দেশ্যে। চারিত্রটিকে “প্রেমিক” বলে আখ্যায়িত করা যায়। এই ব্যক্তিত্বটি ক্রমশ প্রকাশিত হয় যখন থেকে তা মা বাড়িতে তাকে মাঝে মাঝে মেয়েদের পোশাক পরাত। সে স্কুলে গিয়ে ছেলেও মেয়েদের নামের মধ্যে পার্থক্য করতে পারত না। কিং ইয়ং সব সময় জোনাহর যৌন আকাক্ষাগুলো চরিতার্থ করতে চেষ্টা করছে। সে তার নিজের মধ্যে একাধিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অস্পষ্টভাবে সচেতন ছিল। (৪) ইউসোফা আবদুল্লাহ -এটাও জোনাহর আরেকটি ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্বে সে একজন শীতল (আবেগহীন), রাগী এবং মারমুখো ব্যক্তি। প্রায় দশ বছর বয়স থেকে তার এই ব্যক্তিত্ব দেখা দেয়। যেকোন কষ্ট অস্বীকার করে জোনাকে রক্ষা করাই তার কাজ ছিল। এটা ঘটেছিল একদিনের ঘটনা থেকে যে দিন একদল শ্বেতাঙ্গ ছেলে কালো মানুষ হিসেবে জোনাহকে পিটিয়েছিল। জোনাই ছিল অসহায়, তখন তার মধ্যে থেকে আবদুল্লাহর আবির্ভাব ঘটে এবং সে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ করে। সেজন্য তার এই ব্যক্তিত্বকে যোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করা যায়। সে অন্যান্য ব্যক্তিত্বগুলো সম্পর্কে অস্পষ্টভাবে জ্ঞাত ছিল। ব্যক্তিত্বের অভীক্ষায় কতকগুলো বিষয়ে তাদের সাফল্যাঙ্ক ছিল। সম্পূর্ণ পৃথক, তবে বুদ্ধি ও ভাষা সম্পর্কিত অভীক্ষায় সব ব্যক্তিত্বেই সে একই সাফল্যাঙ্ক লাভ করতো। মনোসমীক্ষণ পদ্ধতির চিকিৎসায়, বিশেষ করে সম্মোহন-এর মাধ্যমে এই ব্যক্তির চারটি ব্যক্তিত্ব একটি অখন্ড ব্যক্তিত্বে পরিণত করার চেষ্টা সফল হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি।

সুতরাং এসব চিকিৎসামূলক দৃষ্টান্ত থেকে চেতনার বিভাজ্যতা সম্পর্কে অর্থাৎ চেতনা যে বিভক্ত বা খণ্ডিত হতে পারে সে সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়। বহু ব্যক্তিত্ব হলো সে ধরনের ঘটনা যেখানে একই ব্যক্তির শরীরে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হলো চেতনার বিভক্ত হওয়ার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।

নিদ্রা ও স্বপ্ন (Sleep and Dreams)

যাভাবিক জাগ্রত অবস্থার বাইরেও বিভিন্ন পদ্ধতিতে সচেতন প্রক্রিয়া ঘটে থাকে। এসব অবস্থাকে চেতনার পরিবর্তিত অবস্থা (Altered States of Consciousness) বলা হয়। মনোযোগের দোদুল্যমানতা, বা চেতনার বিভক্তির সঙ্গে পরিবর্তিত অচেতন অবস্থার একটি পার্থক্য হলো এই যে, পরিবর্তিত অবস্থায় একটি সাধারণ পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেখানে বিশেষ ধরনের সচেতন প্রক্রিয়া ঘটে থাকে। যেমন, একজন ব্যক্তি যদি মদ পান করে তাহলে সে একটি সামাজিক পরিস্থিতিতে এমন কতকগুলো আচরণ করে যেগুলো সে স্বাভাবিক অবস্থায় করতো না। সেজন্য মাতাল অবস্থা হলো এমন একটি পরিবর্তিত সচেতন অবস্থা যে অবস্থায় ব্যক্তির বিচার (Judgement) বা আচরণ কিভাবে প্রভাবান্বিত হয় তা অনুসন্ধান করা যায়। এসব পরিবর্তিত চেতন অবস্থার মধ্যে আমরা বিশেষ কয়েকটি সম্বন্ধে এখানে আলোচনা করা যাক। এগুলোর মধ্যে আছে নিদ্রা ও স্বপ্ন, ধ্যান (Meditation), নিদ্ৰাকারী ও উত্তেজক ঔষধ বা Drug এবং সংবেশন (Hypnosis)।

চেতনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে নিদ্রা ও জাগরণের মাঝখানে। নিদ্রাকে সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থা বলা চলে। না। কারণ, তাই যদি হত, তাহলে এটাকে পরিবর্তিত সচেতন অবস্থা বলা যেত না। বরং নিদ্রা হলো একটি সাধারণ অবস্থা যেখানে বিভিন্ন ধরনের চিন্তন ক্রিয়া ঘটে এবং এসব চিন্তন ক্রিয়া অনেকগুলো স্বপ্নের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে। জৈবিক দিক থেকে নিদ্রা হলো একটি পুনরুদ্ধারমূলক অবস্থা। অর্থাৎ দেহকে ক্লান্তি মুক্ত করার জন্য এটা আংশিকভাবে একটি বিশ্রাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিদ্রা আরও জটিল একটি অবস্থা। কারণ, শরীরের অবস্থা যাই থাকুক না কেন, একজন ব্যক্তি ইচ্ছানুসারে ঘুমাতে পারে এবং জেগে থাকতে পারে। নিদ্রা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় অবস্থা নয়, কারণ কিছু কিছু লোক নিদ্রায় হেঁটে বেড়াতে পারে। নিদ্রায় সংবেদনের বিলুপ্তি ঘটে না, কারণ মা তার শিশুর কান্নায় জেগে ওঠে। নিদ্রা পরিকল্পনাবিহীনও নয়, কারণ একজন ব্যক্তি রাত্রির একটি সময়ে ইচ্ছা করলে জেগে উঠতে পারে কিন্তু তবু নিদ্রাই হল চেতনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তিত অবস্থা। আমরা অনেকেই অন্ততঃপক্ষে দিনে দুইবার নিদ্রা ও জাগরণের মধ্যবর্তী সংক্রমণমূলক অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করি।

নিদ্রা (Sleep)

নিদ্রা একটি আচরণ। বিশেষ করে নিদ্রার তিনটি বৈশিষ্ট্য বিচার করলেই নিদ্রার জটিলতাগুলো ধরা পড়বে। এগুলো হচ্ছে নিদ্রার নির্ঘণ্ট বা সময়সূচি (Sleep Schedules), নিদ্রার গভীরতা (Depth), এবং নিদ্রাবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী ঐচ্ছিক শর্তগুলো।

নিদ্রার সময়সূচি (Sleep Schedule) : নবজাত শিশুর মধ্যে নিদ্রা ও জাগ্রত অবস্থার ঘনঘন আবর্তন দেখা যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে দিবা ও রাত্রিকালীন চক্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম ৬ মাসেই নিদ্রার সময় ১৬ ঘণ্টা থেকে কমে ১৩ ঘণ্টা হয়। পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তি রাত্রে গড়ে প্রায় ৭.৫ ঘণ্টা ঘুমায়, আবার অনেকেই রাত্রে তিন ঘণ্টা ঘুমায়। এতে তাদের কোন অসুবিধা হয় না (জোনসও অজওয়ার্ল্ড, ১৯৬৮)। এক মহিলার বিবরণ থেকে জানা যায় তিনি রাত্রে ৪৫ মিনিট ঘুমাতেন (মেভিস পিয়ারসন এবং ল্যাক্সফোর্ড ১৯৭৩)। তাছাড়াও এমন বহু লোক আছে যারা ভরত পাখীর মতো সন্ধ্যার পর পর নিদ্রা যায় এবং খুব ভোরে উঠে, আবার কেউ আছে পেঁচার মতো যারা বেশি রাত্রে ঘুমায় এবং দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে (ওয়েব, ১৯৭৫)।

অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো মানুষের শরীরেও একটি জৈবিক প্রক্রিয়া বর্তমান যাকে বলা হয় সার্কেডিয়ান রিদম (Circadian Rhythm) বা সার্কেডিয়ান চক্র। এই চক্র দিন ও রাত্রির আবর্তনের মত চক্রাকারে আবর্তিত হয়। কোন বাধা বিপত্তি না থাকলে এই চক্র ২৫ ঘণ্টায় একবার আবর্তন করে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলির প্রভাবে এটা পরিবর্তিত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় আবর্তন করে (এসকফ, ১৯৬৫)। এই সার্কেডিয়ান চক্রের জন্যেই বহুসংখ্যক ব্যক্তি যারা দ্রুতগামী জেট প্লেনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে চলে যান, তারা নতুন দেশে গিয়ে সে দেশের দিনরাত্রির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। এ অসুবিধা বেশ কিছু দিন চলতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, আবার আমেরিকায় ফিরে আসার পর নতুন করে আমেরিকান সময় চক্রের সাথে খাপ খাওয়াতে সময় লেগেছিল ১০ দিন। খাপ খাওয়ানোর এই অসুবিধা পরিমাপ করা হয়েছিল হস্তকৌশল কাজের দক্ষতার পরিমাপের দ্বারা। অবশ্য সম্পূর্ণ নতুন একটি সময়-চক্রের সাথে খাপ খাওয়ানোর চাইতে পুরাতন চক্রের সাথে খাপ খাওয়ানো অপেক্ষাকৃত সহজ। পরীক্ষণ থেকে দেখা গেছে যে, সময় চক্রের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর এই অসুবিধার জন্য ঘুম নষ্ট হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই, বরং এ জন্য স্বাভাবিক নিদ্রা চক্রের ব্যাঘাতই দায়ী (ওয়েব, এগনিউ ও উইলিয়ামস, ১৯৭১)।

নিদ্রার গভীরতা (Depth of Sleep) : কিছু কিছু লোক আছে যারা সামান্য শব্দ বা স্পর্শেই ঘুম থেকে জেগে উঠে, কিন্তু কারো কারো নিদ্রা সহজে ভাঙে না। ১৯৩০ সালের দিকে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু হয় এবং এমন কতকগুলো ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে যার মাধ্যমে নিদ্রা কখন কতটুকু সুগভীর হয় এবং নিদ্রিত ব্যক্তি কখন স্বপ্ন দেখে তা জানা যায় (ডিমেন্ট এবং ক্লিটম্যান, ১৯৫৭)।

এসব গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, নিদ্রা সাধারণত পাঁচটি স্তরে ঘটে থাকে। এদের মধ্যে চারটি স্তর গভীর নিদ্রাবস্থার এবং শেষের স্তরটি দ্রুত চক্ষু সঞ্চালনের। এই শেষের স্তরটিকে বলা হয় দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন স্তর (Rapid Eye Movement = REM)। এ স্তরেই মানুষ সাধারণত স্বপ্ন দেখে। যখন কোন ব্যক্তি জাগ্রত থেকে চক্ষু বন্ধ করে এবং মাংসপেশী শিথিল করে, তখন মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ তরঙ্গ লিপিবদ্ধ করা হলে প্রতিসেকেন্ডে ৮-১৩টি নিয়মিত স্পন্দন (Hz) পাওয়া যায়। এ ধরনের তরঙ্গকে আলফা তরকা (alpha wave) বলে। রাক্তি যখন নিদ্রার প্রথম স্তরে পৌঁছে তখন মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলো অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং এদের উচ্চতা কমে যায় এবং আলফা তরঙ্গ প্রায় থাকে না। নিদ্রার দ্বিতীয় স্তরে মস্তিষ্কের তরঙ্গ সংখ্যা আলফা তরঙ্গের চেয়ে প্রায় কিছুটা বেশি হয়, সেকেন্ডে স্পন্দন সংখ্যা ১৩-১৬টির মত হয়, এবং মাঝে মাঝে স্পিন্ডল (জট) দেখা দেয়। স্পিন্ডল-এ ছোট ছোট ছন্দোময় তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এই স্তরে মস্তিষ্ক তরঙ্গের উচ্চতা কখনও বেশি কখনও কম হয়। নিদ্রার তৃতীয় ও চতুর্থ স্তর আরো সুগভীর এবং এই স্তরে ধীর গতিসম্পন্ন মস্তিষ্ক তরঙ্গ পাওয়া যায়। এই তরঙ্গকে ডেল্টা তরঙ্গ বলে। এ দুটি স্তরে ব্যক্তিকে সহজে ঘুম থেকে জাগানো যায় না। তবে এই স্তরে কখনও কখনও পরিচিত কণ্ঠস্বরে, বা পরিচিত কোন নাম উচ্চারণ করলে ব্যক্তি সহজে সাড়া দিয়ে থাকে, তবে উচ্চ শব্দ বা এ ধরনের কোন অ-ব্যক্তিবাচক উদ্দীপকের প্রতি সহজে সাড়া দেয় না।

ব্যক্তির নিদ্রাকাল এক ঘণ্টা অতিক্রান্ত হলে, মস্তিষ্ক তরঙ্গ প্রথম অবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু ব্যক্তি ঘুম থেকে জেগে ওঠে না। তবে সেই সময় দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন (REM) ঘটতে থাকে এবং এগুলো লিপিবদ্ধ করা যায়। এ ধরনের দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন অন্য কোন স্তরে ঘটে না। এ সময় ব্যক্তিকে নিদ্রা থেকে জাগানো হলে সে সাধারণত একটি স্বপ্ন দেখেছিল বলে বর্ণনা করে। যদিও আপাতঃদৃষ্টিতে এই স্তরের নিদ্রা অতটা গভীর বলে মনে হয় না, তবুও এই স্তরে দ্বিতীয় স্তরের মতই ব্যক্তিকে সহজে ঘুম থেকে জাগানো যায় না।

যথেষ্ট ব্যক্তিগত পার্থক্য থাকা স্বত্ত্বেও প্রায় সকলের মধ্যেই নিদ্রার এই পাঁচটি স্তর লক্ষ্য করা যায়। নিদ্রার শুরু থেকে পুনরায় জেগে উঠা পর্যন্ত প্রথমে আলফা তরঙ্গ, তার পরে আরো তিনটি সুগভীর নিদ্রার স্তর এবং সর্বশেষে দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন (REM) স্তর। সাধারণত মধ্য রাত্রির পর গভীর নিদ্রার স্তর (অর্থাৎ ৩য় ও ৪র্থ স্তর) অন্তর্হিত হয় এবং ক্রমশ দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন স্তর (REM Stage) স্পষ্ট হতে থাকে।

নিদ্রার এচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক নিয়ন্ত্রণ

নিদ্রাকে কি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? আমরা সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেখি যে নিদ্রাকে ইচ্ছানুসারে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যারা অনিদ্রায় ভোগেন তারা অনেক সময় ঘুমাতে পারেন না বা সারা রাত্র ঘুমিয়ে কাটাতে পারেন না। বয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে যে, প্রায় ১৪% নারী এবং ৬% পুরুষ প্রায়ই বা বেশ ঘন ঘন অনিদ্রার কথা বলেন (Kripke এবং Simons, 1976)। অবশ্য যারা অনিদ্রায় ভুগছেন বলে মনে করেন তাদের অনেকেই যত কম ঘুমান বলে মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে তত কম ঘুমান না। কারণ তারা ঘুমের সময়গুলোর কথা ভুলে যান, কিন্তু অনিদ্রার সময়গুলোর কথা বেশি মনে রাখেন। অনিদ্রায় ভূগেছেন বলেছেন এমন বহুসংখ্যক ব্যক্তিকে অনুসরণ করে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক লোক প্রকৃতপক্ষে রাত্রে ঊর্ধ্বে ৩০ মিনিট বিনিদ্র ছিলেন (Carskadon. “Mitler এবং Demnet. 1974)।

সাধারণত আমরা কখন ঘুমাব আর কখন জাগব তা অনেকটা ইচ্ছেমতই নিয়ন্ত্রণ করি। কলেজের ছাত্ররা উপযুক্ত অবস্থাদি বর্তমান থাকলে ইচ্ছেমতো দিনের যেকোন সময় ঘুমাতে যেতে পারেন বা জেগে থাকতে পারেন। দিনের বেলায় ঘুমানোর অভ্যাস না থাকলেও তারা তা করতে পারেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৩০ জন ছাত্রের মধ্যে ৬০% ছাত্র দিনের বেলায় অল্প সময়ের জন্য ঘুমান। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রায়ই তা করেন এবং কেউ কেউ মাঝে মাঝে দিবা নিদ্রা দেন। বাকী ৪০% দিনের বেলায় মোটেই ঘুমান না। যারা দিনের বেলায় ঘুমান তাদের ২২% মনে করেন, তাদের ঘুমের প্রয়োজন নেই, তবে তারা দিনের বেলায় ঘুমিয়ে আনন্দ পান বলে ঘুমান, বাকী ৭৮% মনে করেন, তারা কয়েকদিন কম ঘুমানোর ফলে অথবা পূর্বের রাত্রিতে কম ঘুমিয়েছেন বলে ঘুমের অভাব পূরণ করার জন্য দিনের বেলায় ঘুমান।

ঘুমের অসুবিধা (Sleep Disorders)

সাধারণ অনিদ্রার চেয়ে আরও গুরুতর ধরনের অনিদ্রা হলো নারকোলেপসি (Narcolepsy) এবং এপনিয়া (apnea)। নারকোলেপসি হলো অনিয়ন্ত্রণযোগ্য নিদ্রালুতা। এই অসুখে কোন ব্যক্তি যে কোন কাজের মধ্যে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে, যেমন একজন কথাবার্তা বলার সময়েই হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে বা মোটরগাড়ি চালাতে থাকাকালীন ঘুমিয়ে পড়ে। হিলগার্ড এবং এটকিনসন (১৯৭৯) উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, ক্লাসের বক্তৃতা শোনার সময় একজন ছাত্র ঘুমিয়ে পড়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু বক্তৃতা দেওয়ার সময় যদি অধ্যাপক ঘুমিয়ে পড়েন তাহলে সেটা নারকোলেপসি। একটি গবেষণায় ১৯০ জন লোককে পরীক্ষা করা হয় যারা দিনের বেলায় জেগে থাকতে পারত না বলে জানিয়েছিল। এদের মধ্যে ৬৫% এর মধ্যেই নারকোলেপসি ব্যাধি রয়েছ বলে শনাক্ত করা হয়েছিল (গুলেমিনট এবং অন্যান্য, ১৯৭৫)। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমন কতকগুলো কাজ করে থাকে যেগুলো সম্পর্কে পরে তারা ভুলে যায়। এমন কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে যারা কয়েক মাইল দূরে গাড়ি চালিয়ে চলে গিয়ে কোন হোটেলে ওঠে, কিন্তু পরমূহূর্তেই তারা ভুলে যায় তারা কীভাবে এবং “কেন এখানে এসেছিল। এক হিসেবে দেখা যায়, আমেরিকার প্রায় ৩ লক্ষ লোক এই ব্যাধিতে ভুগছেন। পূর্বোক্ত গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, শতকরা ২২ জন এপনিয়াতে ভুগছেন। এই ব্যাধিতে ব্যক্তি ঘুমানোর সময় নিঃশ্বাস নিতে পারে না। সেজন্য ব্যক্তিকে বাঁচতে হলে মাঝে মাঝে নিদ্রা ভঙ্গ করে শ্বাস নিতে হয়। নিদ্রার সময় এসব লোকের শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যায় (হিলগার্ড ও এটনিকসন ১৯৭৯)।

স্বপ্ন (Dreams)

স্বপ্ন হলো কল্পনার সৃষ্টি-যেখানে অতীতের স্মৃতি অথবা অলীক চিন্তা (Fantasy)- কে বাস্তব বলে ভুল করা হয়। স্বপ্ন স্বতঃস্ফুর্তভাবে এবং অনৈচ্ছিকভাবে ঘটে থাকে। এই অনৈচ্ছিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত বৈশিষ্ট্যের দ্বারা স্বপ্নকে সুশৃঙ্খল ও যৌক্তিক চিন্তন থেকে আলাদা করা যায়। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বপ্ন সংঘটিত হয়, তা সুপ্ত থাকে বলে স্বপ্নকে চেতনার বিভক্তির একটি বিশেষ ধরন বলে মনে করা হয়। এটি এক ধরনের বিষঙ্গ প্রতিক্রিয়া (Dissociation)। রাশিয়ান শারীরতত্ত্ববিদ আইভান প্যাভলভের (১৮৮১-১৯৩৬) চিন্তাধারা অনুসরণ করে প্ল্যাটোনভ (১৯৬৫) বলেছেন যে, স্বপ্ন হলো নিদ্রিত ব্যক্তির চেতনার বিশেষ একটি অবস্থা, যে অবস্থায় কতকগুলো স্মৃতি-ছাপ (image) মস্তিকে উদিত হয়। এসব স্মৃতি-ছাপ উদিত হওয়ার কারণ হলো সেরিব্রাল করটেক্স বা গুরু মস্তিক্ষের উর্ধাংশের কতকগুলো স্নায়ুকোষের উত্তেজনা যে কোষগুলো মস্তিষ্কের অন্যান্য কোষের মতো অবদমিত অবস্থায় থাকে না। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, স্বপ্নাবস্থায় মস্তিষ্কে যে-সব কল্পনার উদয় হয় সেগুলো অতীতের কোন-না-কোন স্মৃতির ছাপ বা অনুসংবেদনের অদ্ভুত মিশ্রণ ছাড়া আর কিছু নয়। নিদ্রা যখন অগভীর থাকে তখন মস্তিক্ষের বেশির ভাগ কোষ অনঅবদমিত বা উত্তেজিত থাকে। কখনও কখনও মস্তিষ্কের বেশির ভাগ কোষ অবদমিত হয়ে পড়ে – এর ফলে সুগভীর তন্দ্রা উপস্থিত হয়। সুগভীর তন্দ্রায় স্বপ্ন অপেক্ষাকৃত কম হয় অথবা হয় না। স্বপ্ন কিভাবে ঘটে সে সম্পর্কে কয়েকটি মতবাদ রয়েছে। এসব মতবাদের মধ্যে প্যাভলভের “অবদমন ও উত্তেজনা” (Inhibition and excitation) এবং ফ্রয়েডের অবচেতন (unconscious) মতবাদ বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে।

ফ্রয়েড (১৯০০) মনে করতেন যে, স্বপ্ন আমাদের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষাসমূহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষের কোন ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা যখন বিবেকের নিকট থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন তা মনের অবচেতন স্তরে লুকিয়ে থাকে এবং স্বপ্নের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু যত্নের মধ্যেও এসব আকাঙ্ক্ষা বিবেকের পাহারা এড়াবার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করে। ফ্রয়েড বলেছেন যে, স্বপ্ন হলো অবদমিত ইচ্ছাসমূহ পূরণের প্রচেষ্টা। আমরা বাস্তব জগতে যা করতে পারি না স্বপ্নের মাধ্যমে সেগুলো পূরণ করি। সেজন্য স্বপ্নের দুটো অর্থ থাকে-একটি হলো বাহ্যিক অর্থ (Manifest Content) অর্থাৎ স্বপ্নের অভিজ্ঞতা এবং আরেকটি হলো অন্তর্নিহিত অর্থ (Latent Content)। স্বপ্নের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো যেসব প্রেষণা বা কামনা বাহ্যিক ছদ্মবেশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে যেমন কোন ব্যক্তি যদি স্বপ্ন দেখে যে, সে সাঁতারাচ্ছে তাহলে এটা হলো স্বপ্নের বাহ্যিক অর্থ বা manifest content, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো যৌন কামনার পরিতৃপ্তি। ফ্রয়েডের মতে স্বপ্ন নিদ্রাকে সুরক্ষা করে, কারণ তা না হলে ব্যক্তির মনে উদ্বেগ বা জটিল চিন্তার সৃষ্টি হতো যার ফলে ব্যক্তি ঘুমাতে পারত না। তবে অনেক সময় স্বপ্নের মধ্যেও ব্যক্তির মনে উদ্বেগ বা ভয় সৃষ্টি হতে পারে, তখন ব্যক্তির নিদ্রা ভেঙে যায় (ফ্রয়েড, ১৯৫৩)।

ইয়ুং (Jung. 1986) স্বপ্নের আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তার মতে মানুষের অচেতন মনে কতকগুলো চিরন্তন ধারণা লুকিয়ে থাকে যেগুলোকে তিনি বলেছেন আরকিটাইপ (archetype)। যেমন ঈশ্বরের ধারণা সব লোকের মধ্যেই পাওয়া যায়। সেজন্য ইয়ং এসব ধারণাকে “সমষ্টিগত অবচেতন” (Collective unconscious) মন বলে অভিহিত করেছেন। এসব ধারণা অবচেতন এবং চেতন মনের পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে ছদ্মবেশে আংশিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। যেমন স্বপ্নে চারজন ব্যক্তি উপস্থিত হতে পারে, প্রত্যেক ব্যক্তি এক একটি দিকের প্রতিনিধিত্ব করে- যেমন ভাল-মন্দ, পুরবালী-মেয়েলীপণা ইত্যাদি। অন্যান্য মনোবিজ্ঞানী- যেমন, ফ্রেঞ্চ এবং ফ্রম (French and Fromm, 1963), হল (Hall 1966) প্রমুখ মনে করেন যে স্বপ্ন একটি সমস্যার সমাধানমূলক প্রক্রিয়া। স্বপ্নের মাধ্যমে ব্যক্তি রূপক, উপমা বা সংকেতের সাহায্যে তার ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যার সমাধান করে।

প্যাভলভ (১৯২৭) বলেছেন যে, স্বপ্নের কারণ হলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষসমূহের উত্তেজিত অবস্থা। নিদ্রার সময় মস্তিষ্কের বেশির ভাগ কোষ অবদমিত অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেয়। কিন্তু যখন কতকগুলো বিশেষ বিশেষ কেন্দ্র স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং অতীতের অনুসংবেদনগুলোকে জাগিয়ে তোলে, তখনই আমরা স্বপ্ন দেখি। মস্তিষ্কের কোষসমূহের অবদমন ক্রিয়া জোড়ালো হলে ব্যক্তির নিদ্রা গভীর হয় এবং কোন স্বপ্ন সৃষ্টি হয় না।

আধুনিক গবেষণার ফলাফল থেকে ফ্রয়েডের তত্ত্বের স্বপক্ষে তেমন কোন জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া যায় না। নিদ্রার REM অবস্থা, অর্থাৎ যখন দ্রুত চক্ষুসঞ্চালন ঘটে, ঠিক তখন ব্যক্তিকে ঘুম থেকে জাগানো হলে সে স্বপ্নের কথা বলে। কিন্তু নিদ্রার অন্যান্য স্তরেও (Non-REM) ব্যক্তিদের জাগানো হলে তারা স্বপ্নের কথা না বললেও তারা কিছু জিনিস চিন্তা করেছিলেন বলেন (মনরো ও অন্যান্য ১৯৬৫)। তবে REM স্তরে নিদ্রিত ব্যক্তিদেরকে সহজে জাগানো সম্ভব নয় বলে ফ্রয়েডের তত্ত্ব আপাত সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু প্রতিবার REM উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই ব্যক্তিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলে ব্যক্তি সে রাত্রের মত কোন স্বপ্ন না দেখেই ঘুমায়। তবে পরের রাত্রে REM এর স্থায়িত্ব বেশি হয়। অর্থাৎ মনে হয় ব্যক্তি REM এর ব্যাঘাতের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। এর থেকে ফ্রয়েডের তত্ত্ব যাতে বলা হয়েছে যে স্বপ্ন নিদ্রাকে রক্ষা করে কিছুটা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। তবে অন্যান্য গবেষকগণ (Foulkes, 1971) বলেছেন যে, শিশুদের নিদ্রায় চক্ষু সঞ্চালন বেশি থাকে, তাছাড়া নিম্নস্তরের প্রাণীদের মধ্যেও REM লক্ষ করা যায়। সুতরাং স্বপ্ন যে শুধু ইচ্ছাপূরণ এমন বলা যায় না, বা এটা যে নিদ্রাকে সুরক্ষা করে তাও বলা যায় না। স্কুল বয়সের ছেলেমেয়েদের স্বপ্নে বাস্তব জীবনের ঘটনাবলি বেশি প্রতিফলিত হয় এবং বাস্তব জীবনের আবেগের বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তাদের স্বপ্নেও এ ধরনের আবেগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং এসব গবেষণা থেকে ফ্রয়েডের তত্ত্বের স্বপক্ষে তেমন প্রমাণ মেলে না।

স্বপ্ন সম্পর্কে কিছু জ্ঞাতব্য বিষয়

স্বপ্ন সম্পর্কিত গবেষণার বেশি অগ্রগতি না হলেও বহু প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেছে। যেমন চক্ষুসঞ্চালন (REM) গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, প্রায় সবাই স্বপ্ন দেখে এবং যারা মনে করতে পারে তারা যতবার দেখে, যারা মনে করতে পারে না তারাও ততবারই দেখে (গুডেনাফ না ও অন্যান্য ১৯৫৯)।

কোন কোন লোক স্বপ্ন দেখে ঠিকই কিন্তু স্বপ্নের কথা মনে করতে পারে না। এর ব্যাখ্যা হিসেবে কেউ কেউ বলেছেন যে, এসব ব্যক্তি জন্মগতভাবেই এমন হয় যে, তারা তাদের স্বপ্ন মনে রাখতে পারে না (Lewis and Others, 1966)। আরেকটি ব্যাখ্যা হলো কোন কোন ব্যক্তি স্বপ্নের মধ্যেই অথবা যা একই কথা REM স্তর শুরু হতে না হতেই জেগে উঠে। সেজন্য তারা স্বপ্নের কথা বেশি মনে করতে পারে। মোট কথা হলো, আমরা স্বপ্নের মধ্যে জেগে উঠলেই শুধু স্বপ্নের কথা মনে করতে পারি (Webb and Kersey, 1967)। তবে এ কথা ঠিক যে স্মরণ করতে পারুক বা না পারুক, সবাই স্বপ্ন দেখে।

স্বপ্ন সাধারণত খুব দীর্ঘ হয় না। সবচেয়ে দীর্ঘ স্বপ্নও মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বহুসংখ্যক দৃশ্যাবলি চেতনায় দ্রুতগতিতে উপস্থিত হতে পারে। দেয়াল ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজ হওয়ার সাথে সাথেই আগুন লাগা এবং দমকল বাহিনীর আগুন নেভানোর সম্পূর্ণ নাটক অভিনীত হতে পারে। চক্ষু সঞ্চালনের রেখাচিত্র (REM) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে REM এর স্থায়িত্বের সাথে স্বপ্নের দৈর্ঘ্যের সম্পর্ক আছে (ডিমেন্ট এবং ওলপার্ট ১৯৫৮)। একটি মাত্র উদ্দীপক-যেমন এলার্ম ঘড়ির আওয়াজ-অতীত স্মৃতির একটি সম্পূর্ণ দৃশ্য চেতনায় প্রতিফলিত করতে পারে। স্বপ্ন সৃষ্টি করার জন্য উদ্দীপক সংক্ষিপ্ত হলেও আমরা জেগে উঠে স্বপ্নের যেসব বর্ণনা স্মরণ করতে পারি সেগুলো অনেক বেশি জটিল হতে পারে। অনেক সময় বাহ্যিক উদ্দীপক যত্নের মধ্যে প্রতিফলিত হতে পারে। যেমন ঘুমন্ত অবস্থায় একটি মশারীর দণ্ড গলার উপরে পড়ে গেলে ব্যক্তি ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে এমন স্বপ্ন দেখতে পারে। বার্জার (১৯৬৩) বলেছেন REM অবস্থায় ব্যক্তির কানে কিছু নাম উচ্চারণ করলে ব্যক্তি তার স্বপ্নে সেগুলো অঙ্গীভূত করে নেয়।

আমরা জানি যে, কিছু কিছু লোক ঘুমন্ত অবস্থায় কথা বলে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই (৭৫-৮০%) চক্ষু সঞ্চালনবিহীন পর্যায় (Non-REM) এরূপ কথা বলে থাকে। মাত্র ২০-২৫% ক্ষেত্রে তারা REM পর্যায়ে কথা বলে (Arkin ও অন্যান্য ১৯৭০)। যারা স্বপ্নচারিতা (Sleep Walking) রোগে ভোগে তারাও চক্ষু সঞ্চালনবিহীন পর্যায়ে (Non-REM) হেঁটে বেড়ায়। তবে ঘুমন্ত অবস্থায় এসব ব্যক্তি যেসব কাজ করে, জেগে উঠলে তারা সেগুলো স্মরণ করতে পারে না। অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে স্বপ্নরত অবস্থায় বহু ব্যক্তি স্বপ্ন সম্পর্কে সচেতন হতে পারে (রাউন ও কার্টরাইট ১৯৭৮)।

স্বপ্ন বঞ্চনা (Dream Deprivation)

কোন ব্যক্তিকে নিদ্রার একটি বিশেষ পর্যায় থেকে বঞ্চিত করা হলে ব্যক্তির উপর কী প্রভাব পড়বে? ১৯৬০ সালে উইলিয়াম ডিমেন্ট (William Dement, 1960) একটি পরীক্ষণের বর্ণনা দিয়েছিলেন। এ পরীক্ষণে তিনি কয়েকজন পরীক্ষণপাত্রকে REM পর্যায় থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। প্রত্যেক ব্যক্তির চক্ষু সঞ্চালন (REM) এবং মস্তিষ্ক তরঙ্গ (EEG) থেকে যখনই বোঝা যেত স্বপ্ন শুরু হতে যাচ্ছে তখনই তাদের জাগিয়ে দিতেন। এভাবে তিনি স্বপ্ন দেখার সময়কে প্রায় ৮০% কমিয়ে দিয়েছিলেন। যদি কোন পরীক্ষণ পাত্র ইতোমধ্যে স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিত, তাহলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের জাগানো হতো না। এভাবে পাঁচ দিন স্বপ্নের মধ্যে পরীক্ষণ পাত্রদের বাধা দেওয়ার পরের দিন অর্থাৎ পঞ্চম দিন তাদের বিনা বাধায় ঘুমাতে দেয়া হয়েছিল। স্বপ্ন হীনতার কারণে পরীক্ষণ পাত্রদের উপরে কী প্রভাব পড়ল সে সম্মন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য একই পরীক্ষণ পাত্রদের প্রথমে পাঁচদিন চক্ষু সঞ্চালন বিহীন নিদ্রার মধ্যে (Non-REM stage) জাগানো হয়েছিল। অর্থাৎ উভয়ক্ষেত্রে নিদ্রার ঘটতির পরিমাণ সমান সমান ছিল। নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়-অর্থাৎ যখন NREM পর্যায়ে তাদের জাগানো হয়েছিল, তখন স্বপ্নের মধ্যে অতিবাহিত সময়ের পরিমাণ গড়ে স্বপ্ন বঞ্চনার পূর্ববর্তী পরিমাণের সমান সমান ছিল। কিন্তু যে পাঁচদিন স্বপ্নের মধ্যে তাদের জাগানো হয়েছিল, তার পরের দিন স্বপ্নের সময়ের পরিমাণ অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল। স্বপ্ন বঞ্চনার প্রথম দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী পাঁচ দিনের প্রত্যেক দিন তাদের REM পর্যায়কে অবদমন করার জন্য ক্রমশ বেশিবার জাগাতে হয়েছিল। আটজন পরীক্ষণ পাত্রকে গড়ে ২১.৭ বার করে জাগাতে হয়েছিল। আরো দেখা গেল, স্বপ্ন বঞ্চনার পূর্বে পরীক্ষণ পাত্রেরা যেখানে রাত্রের মোট ১৯.৪% সময় স্বপ্ন দেখত, যত্ন বঞ্চনার পরে তারা মোট রাত্রের ২৭.৩% সময় স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্ন বঞ্চনার পরের রাতে মাত্র একজন পরীক্ষণ পাত্রের স্বপ্ন দেখার সময়ের পরিমাণের কোন পরিবর্তন হয় নি। প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করেও এ ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে। এ থেকে মনে হয় পরীক্ষণ পাত্রেরা স্বপ্ন-বঞ্চনার পরিমাণকে পরবর্তী রাত্রগুলোতে পুষিয়ে নিয়েছিল।

ডিমেন্ট-এর গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, REM পর্যায় থেকে বঞ্চিত হলে পরবর্তী রাত্রগুলোতে যে পরীক্ষণ পাত্রেরা বেশি স্বপ্ন দেখে তাই নয়, তাদের জাগ্রত অবস্থা ও চেতনার গভীর পরিবর্তন ঘটে। কিছুসংখ্যক পরীক্ষণ পাত্রের চেতনার অস্থিরতা দেখা দেয় – যেমন অলীক প্রত্যক্ষণ, অঙ্গ সঞ্চলনে সমন্বয়ের অভাব, তীব্র টানভাব বা স্ট্রেস ও উদ্বেগ, স্মৃতির গোলযোগ, খিটিখিটে মেজাজ, আক্রমাণাত্মক মনোভাব (Hostility), এবং সময় সম্পর্কে বিভ্রান্তি (ফিশার, ১৯৬৫)। ডিমেন্ট বলেছেন যে, ১৫/১৬ দিন স্বপ্ন-বঞ্চনা সৃষ্টি করা হলে ব্যক্তিদের মধ্যে তীব্র মনোবিকৃতি বা সাইকোটিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তবে এ পরীক্ষণে দুটি ত্রুটি উল্লেখযোগ্য –

(১) স্বপ্ন-বঞ্চনার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষণ পাত্রদের উপরে এমফেটামিন নামক মাদক দ্রব্য প্রয়োগ করা হয়েছিল (২) পরীক্ষণ পাত্রদের অন্তত একজনের মধ্যে স্কিজোয়েড লক্ষণ পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালের গবেষণায় ডিমেন্ট যেসব আচরণ বিকৃতির কথা বলেছেন সেগুলো সমর্থিত হয় নি।

ধ্যানাবস্থা (Meditation)

নিদ্রা ও স্বপ্নে চেতনা যতঃস্ফূর্তভাবে পরিবর্তিত হয়, কিন্তু সক্রিয় প্রচেষ্টা দ্বারা ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি করা হয়। ধ্যানের মধ্যে ব্যক্তি চেতনার একটি ইপ্সিত বা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে চেষ্টা করে। আমরা যেহেতু চিন্তা করতে পারি এবং স্বপ্ন দেখতে পারি, সেজন্য আমরা বাস্তব জগতের ঊর্ধ্বে উঠে একটি আদর্শ অবস্থার কথা বা কাল্পনিক জগতের কথাও চিন্তা করতে পারি। প্রাচীন যুগে সাধকগণ নির্জন গুহায় বা পাহাড়ের চূড়ায় ধ্যান করতেন এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে (যেমন, উপবাস, পূজা বা প্রার্থনা) অভূতপূর্ব ও নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করতে চেষ্টা করতেন। এসব সাধনার ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল। সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্য জগতের বহু লোক প্রাচ্যের সাধনাকে গ্রহণ করেছেন এবং অনেকেই বৌদ্ধ ধর্ম, কিম্বা যোগ সাধনা বা এ ধরনের আধ্যাত্মিক ধ্যান ধারণা অভ্যাস করছেন। অনেক সময় এসব সাধনার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক অনুভূতি লাভ করা, আবার অনেক সময় এসবের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে শুধু উদ্বেগ ও টান ভাব বা স্ট্রেস থেকে মুক্তি পাওয়া বা নিজের সম্বন্ধে নিজের উপলব্ধিকে বাড়ানো।

তুরীয় ধ্যান (Transcendental Meditation)

তুরীয় বা অতীন্দ্রিয় ধ্যান প্রাচীন ভারতের যোগ সাধনা। কিন্তু হিন্দু ধর্মীয় প্রথা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এটিকে আধুনিক ও সর্বজনীন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন মহাঋষি মহেশ যোগী (১৯৬৩)। তিনি বহুসংখ্যক আমেরিকান শিষ্যদের মধ্যে যোগ সাধনা শিক্ষা দেন। তিনি তার শিষ্যদের বিশেষ পদ্ধতিতে ‘ধ্যান’ করতে বলেন, যাকে বলা হয় তুরীয় ধ্যান বা অতীন্দ্রিয় ধ্যান (Transcendental Meditation বা TM)।

তুরীয় ধ্যানের কৌশল সহজসাধ্য হলেও একজন অভিজ্ঞ গুরু (Instructor) প্রয়োজন যিনি তার শিষ্যকে সঠিক পন্থাটি নির্দেশ করেন। গুরু শিষ্যকে একটি মন্ত্র শিখিয়ে দেন। প্রত্যেক শিষ্যের মন্ত্র আলাদা। এ মন্ত্র হলো কতকগুলো শব্দ সমষ্টি যেগুলো বারংবার শুদ্ধ চিত্তে উচ্চারণ করতে হয়। এই মন্ত্র একাগ্রচিত্তে উচ্চারণের ফলে ব্যক্তি গভীর বিশ্রাম এবং চেতনার বিশুদ্ধ স্তরে উপনীত হয়। তখন ব্যক্তি নিজেকে অতিক্রম করে যায় এবং অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি লাভ করে। মহাঋষি মহেশ যোগী বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির দেহগত স্পন্দন (Vibrations) আলাদা। এটাই মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জন্য দায়ী। সেজন্য প্রত্যেক ব্যক্তির ধ্যানের বা চিন্তার বিষয়বস্তু আলাদাভাবে স্থির করতে হবে। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক মন্ত্র না হলে সে ধ্যানাবস্থায় পৌঁছতে পারবে না। এ বিষয়ে গুরু তাকে সাহায্য করেন।

ধ্যান-অবস্থায় পৌঁছবার জন্য আমেরিকায় বহু ধরনের সাধন মার্গ বা পদ্ধতি (cult) সৃষ্টি হয়েছে। এসব প্রথা পদ্ধতিতে যেসব বিষয় সম্পর্কে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, বা যেসব ধারণা ব্যবহার করা হয়, মানুষ বিনা প্রমাণেই অনেক ক্ষেত্রে এগুলো বিশ্বাস করে। এ ধরনের বহু সাধন পদ্ধতি আমেরিকায় ষাটের দশকে প্রচলিত হয়। ১৯৭৭ সালে মহেশ যোগী দাবি করেন যে, তিনি তার শিষ্যদের সিদ্ধিলাভ করাতে সক্ষম। সিদ্ধিলাভ হলে ব্যক্তি অধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করে, যেমন ওজন শূন্য হয়ে আকাশে ভাসমান অবস্থায় থাকা বা পানির উপর দিয়ে হাঁটা বা দেওয়াল ভেদ করে চলে যাওয়া ইত্যাদি কাজ করতে পারে।

ধ্যানের মাধ্যমে শ্লথন (Relaxation Through Meditation)

তুরীয় ধ্যানের একজন অনুসারী মনে করেন যে, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক সংযোগ ছাড়াই গবেষণাগারে ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব। তিনি তার পরীক্ষণ পাত্রদের কতকগুলো নির্দেশের মাধ্যমে ধ্যান করতে শিক্ষা দেন। এই ধ্যানের উদ্দেশ্য হলো মাংসপেশী ও স্নায়ুমণ্ডলীর শ্লথন। ধ্যানের মাধ্যমে শ্লথন আনতে গেলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করতে হয় Benson, 1975. Benson ও অন্যান্য, ১৯৭৭)।

  • (১) শান্তভাবে আরামদায়ক ভঙ্গিতে বসে চোখ বন্ধ কর।
  • (২) পা থেকে শুরু করে ক্রমশ সমস্ত উর্ধাঙ্গের মাংসপেশীগুলোকে শিথিল কর (টান ভাব দূর কর)। সমস্ত মাংসপেশী গুলোতে শিথিল ভাব বজায় রাখ।
  • (৩) নাক দিয়ে নিঃশ্বাস গ্রহণ কর। নিঃশ্বাস গ্রহণ সম্পর্কে সচেতন হও। শ্বাস ছাড়ার সময় মনে মনে ‘এক’ কথাটি উচ্চারণ কর যেমন, শ্বাস গ্রহণ কর….. ছাড়….. এক। আবার শ্বাস গ্রহণ কর…. ছাড়….. এক। এভাবে ২০ মিনিট অভ্যাস কর। ২০ মিনিট সময় হলো কি না দেখার জন্য চোখ খোলা যাবে, তবে এলার্ম ঘড়ি ব্যবহার করা যাবে না। ২০ বার শ্বাস গ্রহণ ও ছাড়া হয়ে গেলে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাক, তার পর চোখ মেলে কিছুক্ষণ বসে থাক।
  • (৪) প্রথম প্রথম মাংসপেশীর গভীর শ্লথন না হলেও ঘাবড়াবে না, সর্বদা একটি নিষ্ক্রিয় ভাব বজায় রাখবে এবং শ্লথন নিজের গতিতে আসতে দেবে। অন্য চিন্তা আসতে পারে, যখন অন্য চিন্তা আসে তখন মনে করবে ‘ঠিক আছে,’ তারপর ‘এক’ শব্দটি উচ্চারণ করে যাবে। অভ্যাস করতে থাকলে শ্লথন ক্রমশ সহজে আসবে।
  • (৫) প্রতিদিন একবার বা দুইবার ধ্যানে বসতে হবে, অর্থাৎ উক্ত প্রক্রিয়ায় শ্লথন অভ্যাস করতে হবে। তবে খাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে নয় (বেনসন ও অন্যান্য ১৯৭৭)।

ডীন (Dean, 1970) গবেষণা করে বলেছেন যে, এ পদ্ধতিতে ধ্যান করলে অক্সিজেনের প্রয়োজন কমে যায়, কার্বন-ডাই-অক্সইড নিঃসরণ কমে যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ধীরগতিতে চলে। এগুলো সবই শ্লথনের ফল। তাছাড়া, পরীক্ষণ পাত্রেরা অন্যান্য ধ্যানপদ্ধতি যারা অভ্যাস করে তাদের মতোই অভিজ্ঞতা লাভ করে। যেমন, মনের শান্তি, জগতের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক, আত্মতৃপ্তি এবং আনন্দ। তবে ধ্যানের কোন বিষয়টির জন্য এসব মানসিক অনুভূতির সৃষ্টি হয় তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।

মাদক দ্রব্যের প্রভাবে চেতনার পরিবর্তন 

প্রাচীনকাল থেকেই নানা ধরনের অসুখের চিকিৎসার জন্য, ব্যথা নাশ করার জন্য বা অনিদ্রার চিকিৎসার জন্য বহু ধরনের ঔষধ বা ভেষজ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অতি পরিচিত কতকগুলো ভেষজ, যেমন ক্যাফেইন (Caffeine), তামাক (Tobacco) এবং সুরা বা মদ (alcohol) সাধারণ লোকেরা এত বেশি ব্যবহার করে যে এগুলোকে আর ঔষধ বলে গণ্য করা হয় না। কিন্তু অন্যান্য ঔষধ যেমন আফিম (Opium) থেকে তৈরি কতকগুলো ঔষধ মানুষের মানসিক অবস্থা ও সামাজিক আচরণের উপর এত বেশি ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করে যে আইন করে এগুলোর ব্যবহার সীমিত রাখতে হয়।

আফিমজাত ঔষধগুলো (Opium Derivatives) একবার গ্রহণ করলে ব্যক্তি এসব ঔষধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং ব্যক্তির ব্যক্তিগত অভিযোজন এবং সামাজিক অভিযোজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থাকে বলা হয় মাদক-আসক্তি (Drug Addiction)। মাদক আসক্তি একটি সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খুব প্রকট আকার ধারণ করেছে। আসক্তি শুধু ব্যক্তিকেই মানসিক ও সামাজিকভাবে পঙ্গু করে ফেলে না, নানা ধরনের সামাজিক অপরাধেরও জন্ম দেয়। সেজন্য প্রত্যেক দেশের চিকিৎসক সমাজ, শিক্ষিত ব্যক্তিবৃন্দ এবং সরকার এ সমস্যা লাঘব করার চেষ্টা করছেন। শুধু আইন প্রণয়ন করেই এসব ভেষজের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্য সমস্যাটিকে মোকাবেলা করার জন্য অভিভাবকবৃন্দ ও দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সচেতন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হওয়া উচিত।

বিভিন্ন ধরনের ভেষজ এবং মাদক দ্রব্য কী ধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বা ব্যক্তির সচেতন অবস্থার কী ধরনের পরিবর্তন ঘটায় তা আলোচনা করা যাক। ভেষজগুলোকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করে আলোচনা করা যায় – (১) অবসাদ সৃষ্টিকারী (Depressants) (২) উত্তেজক (Stimulants) এবং (৩) অলীক প্রত্যক্ষণ সৃষ্টিকারী বা হেলুসিনোজেন (Hallucinogens)। অবসাদ সৃষ্টিকারী ঔষধসমূহের মধ্যে আছে ক্যাফেইন, তামাক, মদ এবং হেরোইন (Heroin) ইত্যাদি। এখানে শুধু মদ (alcohol) এবং হেরোইন (Heroin) সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। তাছাড়া উত্তেজক ঔষধসমূহের মধ্যে এমফেটামিন এবং কোকেইন এবং দুটি অলীক প্রত্যক্ষণ সৃষ্টিকারী ঔষধ LSD এবং ম্যারিজুয়ানা সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হবে।

অবসাদ সৃষ্টিকারী ভেষজ (Depressants)

মদ (Alcohol) : ‘অল্পমাত্রায় সেবন করা হলে মদ কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মদ একটি অবসাদ সৃষ্টিকারী বা বিমর্ষতা সৃষ্টিকারী ঔষধ। মদ সেবনের ফলে ব্যক্তি তার সামাজিক আচরণের উপর সংযম হারিয়ে ফেলে। প্রথমে ব্যক্তি নিরুদ্বেগ অনুভব করলেও ক্রমশ তার আচরণ ক্রুদ্ধও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তার কিছু পরে ব্যক্তি ক্রমশ অবসাদগ্রস্ত হয়, নিদ্রালু হয় এবং ঘুমিয়ে পড়ে। .০৩ থেকে .০৫ ভাগ মদ শরীরে প্রবেশ করানো হলে মাথা হাল্কা বোধ হয়। শ্লথন (relaxation) বা টানভাব হ্রাস এবং অবদমন হ্রাস করে। রক্তে মদের পরিমাণ ১০ শতাংশ হলে বেশিরভাগ সংবেদন ও পেশীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। রক্তে মদের প্রবণ ২০ শতাংশ হলে ব্যক্তির সংবেদী ও পৈশিক ক্রিয়া দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয় এবং রক্তে মদের ঘনত্ব ৪০ শতাংশ হলে ব্যক্তি মারা যেতে পারে। রক্তে মদের পরিমাণ ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হলে আইনগতভাবে তাকে বিষমাত্রা বলে গণ্য করা হয়। এ ধরনের ব্যক্তির জন্য মোটরগাড়ি চালনা বা কলকারখানায় কাজ করা বিপজ্জনক।

মদ পানের ফলে মানুষ নেশাগ্রস্ত হয়, তার চেতন অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং কতকগুলো মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বিষঙ্গ-প্রতিক্রিয়া (dissociation) প্রধান। ব্যক্তি নেশার মধ্যে যেসব কাজ করে, নেশা টুটে গেলে সে ঐসব কাজের কথা মনে করতে পারে না। তবে পুনরায় নেশাগ্রস্ত হলে পূর্ববর্তী নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সে যা যা করেছিল তা স্মরণ করতে পারে (Overton, 1972)। এ ধরনের আচরণকে State Dependent. Learning বা অবস্থা-নির্ভর শিক্ষণ বলা হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যক্তি A পরিস্থিতিতে যা শেখে তা B অবস্থায় ভুলে যায়, কিন্তু পুনরায় A অবস্থায় স্মরণ করতে পারে। যেসব ঔষধ মদের মতো এ ধরনের অবস্থা-নির্ভর শিক্ষণ সৃষ্টি করে সেগুলোকে বিষঙ্গতা সৃষ্টিকারী ঔষধ (Dissociative Drugs) বলা হয় (Ho Chute and Richards, 1977)।

বেশি মদ পান করলে ব্যক্তি নানারকম অলীক প্রত্যক্ষণ করে। এ অবস্থায় অলীক বীক্ষণ দু’ধরনের হয়ে থাকে –

  • (১) ডেলিরিয়াম ট্রিমেন্স (Delirium tremens) – এ ধরনের অলীক বীক্ষণে ব্যক্তিকে সাপ বা অন্যান্য ভয়ঙ্কর প্রাণী ভয় দেখায়। এটা হলো মদের বিষক্রিয়ার ফল। মদ্যপানে আসক্ত ব্যক্তিদের মদ খেতে না দিলে এই লক্ষণ দেখা দেয়। ডেলিরিয়াম ট্রিমেন্স অতি মারাত্মক লক্ষণ এবং এতে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
  • (২) মদ্যপানজনিত অলীক বীক্ষণ (Alcoholic Hallucinosis) – এই অবস্থায় ব্যক্তি নানাররকম শব্দ শোনে, কিন্তু অন্যান্য জ্ঞান ঠিক থাকে। এ অবস্থাটিকে সিজোফ্রোনিয়ার লক্ষণের সঙ্গে তুলনা করা যায়। হয়তো বা ব্যক্তিত্বের বিশেষ ধরনের সমস্যা এই লক্ষণের মূলে কাজ করে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্রবণের চেয়ে দর্শন সংক্রান্ত ভ্রান্তি বেশি দেখা যায় (Zikmund (১৯৭২)।

হেরোইন (Heroin) : অপিয়াম (Opium) বা আফিমজাত মাদক দ্রব্যকে নারকোটিক (Narcotic) জাতীয় দ্রব্য বলা হয়। আফিমজাত দ্রব্য চিকিৎসা কাজে এবং অবৈধভাবে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। অপিয়াম পপি (Opium Poppy) নামক এক জাতীয় গাছ থেকে অপিয়াম তৈরি করা হয়। অপিয়াম থেকে পুনরায় নির্যাস তৈরি করে মরফিন (Morphine) এবং কোডিন (Codeine) তৈরি করা হয়। কোডিন কম শক্তিশালী, কিন্তু মরফিন বেশি শক্তিশালী ভেষজ। মরফিন থেকে তৈরি করা হয় হেরোইন- যা আরো শক্তিশালী। একই পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা হলে হেরোইন মরফিন থেকে তিনগুণ বেশি শক্তিশালী।

সাধারণত বাজারে যেসব হেরোইন বিক্রি হয়, সেগুলোতে ভেজাল মিশ্রিত থাকার জন্য খাঁটি হেরোইন থেকে কম শক্তিশালী। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা অপিয়াম বা আফিম গিলে খায় অথবা ধোঁয়ার সাথে পান করে, মরফিন ইনজেকশনে গ্রহণ করে, আর হেরোইন ইনজেকশন বা ধোঁয়ার সঙ্গে গ্রহণ করে। যে পদ্ধতিতে হেরোইন গ্রহণ করা হয়, তার উপর এর কার্যকারিতা নির্ভর করে। যেসব উদ্দেশে হেরোইন গ্রহণ করা হয় তা জটিল। প্রথমত হেরোইন একটি আরামদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি করে। যারা হেরোইন ব্যবহার করে তাদের বিবরণ থেকে জানা যায়, ইনজেকশান গ্রহণের দুই এক মিনিটের মধ্যে প্রচুর আনন্দ উপস্থিত হয়-এই আনন্দানুভূতিকে ‘চরম সুখ’ বলে অভিহিত করা হয়। যে সব বিপথগামী যুবক এই দ্রব্যটি গ্রহণ করে তারা বলে যে এর ফলে তারা সব দুশ্চিন্তা, সব দুঃখ ভুলে যায় (Chein ও অন্যান্য, ১৯৬৪)। এই দ্রব্যটি গ্রহণ করার পর তারা সবকিছু পেয়ে যায় বলে মনে করে- তাদের ক্ষুধা থাকে না, ব্যথা থাকে না এবং যৌনস্পৃহা থাকে না। হেরোইন গ্রহণের ফলে ব্যক্তির ঝিমুনি আসে, এবং ক্রমান্বয়ে নিদ্রালু ও জাগ্রত অবস্থার মাঝে সে টেলিভিশন দেখতে পারে বা বই পড়তে পারে। তবে তার বুদ্ধিমূলক ক্রিয়া বা হস্ত কৌশলের অবনতি ঘটে না এবং কদাচ আক্রমণাত্মক আচরণে লিপ্ত হয়। হেরোইন গ্রহণের ফলে চেতনার বিরাট পরিবর্তন দেখা যায় না। তেমন কোন অলীক বীক্ষণ ঘটে না বা অন্য কোন জগতে চলে যাওযার মত অনুভূতিও হয় না। বরং হেরোইন আবেগের পরিবর্তন সৃষ্টি করে। আত্মবিশ্বাস কিছুটা বৃদ্ধি করে এবং উদ্বেগ কমায়। অনেকেই বলেন ব্যক্তি নিজের মধ্যেই আনন্দের উৎস খুঁজে পায় বলে সামাজিকভাবে পালিয়ে থাকে বা অন্যের থেকে দুরে থাকে। এসব অভিজ্ঞতার জন্যই মারাত্মক ফলাফলের কথা না ভেবে কেউ কেউ এই বিপজ্জনক বস্তুটি গ্রহণ করে। একবার দুইবার গ্রহণ করার পর এ থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম এবং কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যক্তি আর পৃথিবীর আলো দেখে না।

উত্তেজক ভেষজ (Stimulants)

এমফেটামিনস (Amphetamines) : এমফেটামিন জাতীয় ঔষধ অত্যন্ত উত্তেজক। এগুলো মেথিড্রিন (Methidrine), ডেক্সিড্রিন (Dexedrine), বেনজেড্রিন (Benzedrine) ইত্যাদি বিভিন্ন নামে বাজারজাত করা হয়। এগুলোকে আমেরিকায় লোকেরা স্পীড (Speed), আপার (Upper), বেনিস (Bennies) ইত্যাদি নামে ডেকে থাকে। এসব ঔষধ সেবনের অব্যবহিত পরেই সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তি সজাগ হয়ে ওঠে, তার ক্লান্তি এবং একঘেয়েমি দূর হয়ে যায়। যেসব কাজ শ্রমসাপেক্ষ ও কষ্টদায়ক সেসব কাজ সহজে করা যায় (Weiss এবং Laties, 1962)। অন্যান্য মাদক দ্রব্যের মতোই এসব ধনাত্মক প্রভাবের জন্যই এগুলোর প্রতি মানুষ ঝুঁকে পড়ে। ক্ষুধা নাশকরার মাধ্যমে শরীরের ওজন কমানোর জন্য এবং হাইপার-একটিভ শিশুদের চিকিৎসার জন্য ঔষধটি ব্যবহার করা হয়। তবে অসাবধানতাবে ব্যবহার করলে ঔষধটি ভালর চেয়ে মন্দই বেশি করে। এই ঔষধটির তিন রকম ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় :

  • (১) অল্পমাত্রায় এবং অল্প সময়ের জন্য নৈশকালীন মোটর চালকগণ, সামরিক বাহিনীর লোকজন অথবা পরীক্ষার ভীতি বা জড়তা দূর করার জন্য এটি সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা চলে। তবে মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়।
  • (২) বিষণ্ণতা ও ক্লান্তি দূর করার জন্য এবং ওজন কমানোর জন্য দীর্ঘ দিন অল্পমাত্রায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কতকগুলো ক্ষতিকর ফলাফল লক্ষ্য করা যায়, যেমন অকারণ সন্দেহ, শত্রুতা এবং শাস্তি মূলক ভ্রান্ত বিশ্বাস জন্মগ্রহণ করতে পারে। (Synder, 1973)।
  • (৩) ইনজেকশনের মাধ্যমে বেশি মাত্রায় ব্যবহার করা হলে সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আনন্দানুভূতি বা ফ্লাস (flash) সৃষ্টি হয়, তারপর পরই খিটখিটে মেজাজ, অসস্থি ইত্যাদির সৃষ্টি হয়, যার ফলে ব্যক্তি আবার ইনজেকশন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। শেষপর্যন্ত ব্যক্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং গভীর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে। নিদ্রাশেষে উপস্থিত হয় শৈথিল্য এবং বিষাদ। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যক্তি শেষপর্যন্ত অন্য কোন নিদ্রাকারী বা উত্তেজনা প্রশমনকারী ঔষধের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।

কোকেন (Cocain) : কোকেন এর প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা কম হয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোকেন ধূমপানের মাধ্যমে বা নাকের সাহায্যে গ্রহণ করলে তৎক্ষণাৎ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ব্যক্তি উত্তেজনার চরমে পৌঁছে যা দশ মিনিটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় এবং ৩০ মিনিটের মধ্যে দূরীভূত হয়। ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রহণ করা হলে দ্রুতগতিতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং ক্ষুধা কমে যায়। তবে ব্যবহারকারীর শারীরিক শক্তির কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি (Resnick, Destenbaum, এবং Schwartz, 1977)। ব্যবহারের উভয় পদ্ধতিতেই অল্পমাত্রায় ব্যবহারে আনন্দদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি করে, তবে কেউ কেউ বিষাদময় অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। বেশি মাত্রায় ব্যবহার করা হলে হৃদপিণ্ডের গতি এত বৃদ্ধি পায় যে তা ব্যক্তির কাছে বেদনাদায়ক হতে পারে। ক্ষুধা একোবরেই থাকে না। কোকেন এবং এমফেটামিন ক্ষুধা নষ্ট করে এবং উল্লাস সৃষ্টি করে। উভয়েই সাময়িক এবং তীব্রভাবে ভ্রান্ত বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে ব্যক্তিকে ভ্রান্তবিশ্বাসযুক্ত স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগী বলে মনে হতে পারে (হিলগার্ড ও অন্যান্য, ১৯৭১)।

অলীক প্রত্যক্ষণ সৃষ্টিকারী ভেষজ (Hallucinogens)

কিছু কিছু তেযজ অলীক প্রত্যক্ষণ বা অলীক দৃশ্য প্রত্যক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এসবের মধ্যে আছে ম্যাসকালিন (Mascaline) এবং সাইলোসাইবিন (Psilocybin)। ম্যাসকালিন ক্যাকটাস থেকে এবং সাইলোসাইবিন ছত্রাক থেকে তৈরি হয়। এই দুটি ঔষধকে সাইকিডেলিক (Psychedelic) ভেষজ বলা হয়। এ বিশেষ শ্রেণীর ভেষজের বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এগুলো প্রত্যক্ষণ ও চেতনার পরিবর্তন ঘটায়। এ শ্রেণীর অন্তর্গত আরো কয়েকটি ভেষজ হলো LSD (Lysergic acid diethylamide), DMT (Dimethyl Triptamine), DOM (Dimethoxy mehtyl-amphetamine) বা STP (For Serenity Tranquility and Peace) ইত্যাদি। বিভিন্ন সাইকিডেলিক ভেষজের কার্যকারিতা ও প্রভাবের স্থায়িত্বও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন DMT -র প্রভাব এক ঘন্টা স্থায়ী হয়, কিন্তু LSD এবং Mascaline- এর প্রভাব ৮-১২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়।

আরো কয়েকটি ঔষধ যেগুলো অলীক প্রত্যক্ষণ সৃষ্টি করে এবং সাথে সাথে অন্যান্য প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে সেগুলো থেকে সাইকিডেলিক ঔষধগুলোকে পৃথক করা হয়। একটি মারাত্মক ঔষধ হলো ফেনসিক্লিডিন (PCP) । এটিকে এনজেল ডাস্ট (angel dust) বা জীনের গুঁড়া বলা হয়। যদিও ঔষধটি অলীক প্রত্যক্ষণ (Hallucination) সৃষ্টি করে, তবু এটি অভূতপূর্ব বা আকস্মিক কতকগুলো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে যেগুলো সম্পর্কে পূর্বে থেকেই ধারণা করা যায় না। যেমন, এ ঔষধটি কখনও খিটখিটে মেজাজ এবং কখনও কখনও উন্মত্ত আচরণ সৃষ্টি করতে পারে। দুটি সাইকিডেলিক ঔষধ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক – LSD এবন মারিজুয়ানা বা গাঁজা।

এল. এস. ডি. (LSD) : এল. এস. ডি.-কে অনেকে শুধু ‘এসডি’ বলে অভিহিত করে। এক সময় এ ঔষধটির ব্যবহার খুব বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্মদ্ধে লোকের জ্ঞান বৃদ্ধি পাওয়াতে এখন এর ব্যবহার কমে গেছে। এল. এস. ডি., ঔষধটির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এই যে এটি একেক ব্যক্তির মধ্যে একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ ঔষধটি কোন কোন ব্যক্তির মধ্যে জাজ্বল্যমান চাক্ষুষ এবং শ্রাব্য অলীক প্রত্যক্ষণ সৃষ্টি করে এবং কোন কোন লোকের মধ্যে আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে। আবার পূর্বে LSD গ্রহণের মাধ্যমে সুখানুভূতি লাভ করছে এমন লোকের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে। LSD গ্রহণের প্রভাব এত ক্ষতিকারক হয় যে রোগী শেষপর্যন্ত মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিতে আসে।

LSD গ্রহণের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া হলো ফ্ল্যাশব্যাক (flashback)। এক্ষেত্রে ব্যক্তির অলীক দর্শন বা শ্রবণ সম্পর্কিত অভিজ্ঞাতগুলো, শেষবার LSD গ্রহণের কয়েকদিন, কয়েক সপ্তাহ অথবা কয়েকমাস পরে হঠাৎ উপস্থিত হতে পারে। ব্যক্তি অধ্যাসে আক্রান্ত হতে পারে, যেমন কোন স্থির বস্তুকে গতিশীল বা চলমান মনে হয়, কোন প্রতিবিম্ব বা ছবিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, অথবা ঔষধটি গ্রহণ করার সময় যে ধরনের অলীক প্রত্যক্ষণ হয়েছিল পুনরায় সে ধরনের প্রত্যক্ষণ হতে পারে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে LSD গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এটি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। সুতরাং ব্যক্তির অদ্ভূত অভিজ্ঞতার পুনরাবির্ভাবের জন্য স্মৃতির প্রত্যাহবান প্রক্রিয়াকে দায়ী করা চলে।

LSD গ্রহণকারীদের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো বাস্তব সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া এবং আধ্যাত্মিক বা রহস্যময় জগতে বিচরণ করা। এসব অভিজ্ঞতার ফলে তারা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং বাস্তব জ্ঞান বহির্ভূত কাজ করে বসতে পারে। এমন একজন ব্যক্তি তার বহুসংখ্যক শিষ্যকে বিষ পানে প্ররোচিত করে এবং এক নারকীয় হত্যালীলা সংঘটিত করে। LSD সেবনের পরে কোন কোন ব্যক্তিকে উচ্চস্থান থেকে লাফিয়ে পড়তে শোনা গেছে।

গাঁজা (Marijuana) : এক ধরনের গাছের পাতা। গাঁজার পাতা চিবিয়ে বা শুকনো পাতা ধোঁয়ার সাথে গ্রহণ করা যায়। গাঁজা সেবীরা উৎফুল্লভাব ও উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য গাঁজা সেবন করে। গাঁজার সক্রিয় উপাদান হলো THC (Tetra hydro cannabiol)। এ উপাদানটি অল্পমাত্রায় (৫ থেকে ১০ মিলিগ্রাম) গিলে খেলে মৃদু উৎফুল্লতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বেশি মাত্রায় (৩০ থেকে ৭০ মিলিগ্রাম) সেবন করলে সাইকিডেলিক ঔষধের মতো এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এটির প্রভাব মদের প্রতিক্রিয়ার মতো দুই স্তরে ঘটে। প্রথম পর্যায়ে মৃদু উত্তেজনা ও উৎফুল্লতা এবং তার পরে বিষ মাত্রায় সেবনে অবসন্নতা বা প্রশান্তি ও নিদ্রা। অল্পমাত্রায় সেবনে মদ ও গাঁজার প্রতিক্রিয়া প্রায় এক রকম হলেও গাঁজার বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এতে সময় জ্ঞান থাকে না।

টার্ট (Tart, 1971) ১৫০ জন গাঁজা সেবীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তাদের কতকগুলো অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। এসব ব্যক্তি অন্ততঃপক্ষে সপ্তাহে এক বা দুই বার গাঁজা সেবন করেছিল। গাঁজা সেবীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাদের স্থান ও সময় জ্ঞানের বিকৃতি ঘটেছিল, সামাজিক অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষণের পরিবর্তন ঘটেছিল এবং আধিভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। অনেকেই উৎফুল্লতা ও আনন্দানুভূতি লাভ করেছিল, আবার অনেকেই মনে করত যে তারা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করতে পারে।

বিভিন্ন ধরনের ভেষজ সম্পর্কে যেসব গবেষণা করা হয়েছে সেগুলো থেকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো সহজেই পাওয়া যায়

  • (১) একই ঔষধ বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আত্মগত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
  • (২) একই ব্যক্তি বিভিন্ন ঔষধের প্রতি বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করে।
  • (৩) ভেষজের প্রতিক্রিয়া মাত্রা ও গ্রহণের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে।
  • (৪) ঔষধ সেবনের ফলে পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের পরিবর্তন এক এক ব্যক্তির বেলায় এক এক রকম হতে পারে।
  • (৫) যে সামাজিক পরিস্থিতিতে ঔষধটি গ্রহণ করা হয় সেই পরিস্থিতি বা পরিবেশ ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া ও অভিজ্ঞতাকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত করে।
  • (৬) ঔষধের দ্বারা সৃষ্ট অভিতোগুলো কিছুদিন পর পুনরায় উপস্থিত হওয়ার ঘটনা থেকে মনে হয় এসব ঔষধ মস্তিষ্কের স্নায়বিক প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করে।
  • (৭) হিলগার্ড, এটকিনস্ ও এটকিনসন ১৯৭৯) মনে করেন যে, যেসব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যক্তির ইচ্ছাধীন ছিল, ঔষধ গ্রহণের পর এসব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যক্তি ঔষধের উপরে অর্পণ করে।

সংবেশনের প্রভাবে চেতনার পরিবর্তন (Hypnotically Produced Changes in Concesiousness)

সংবেশন সম্পর্কে মানুষের মনে নানারকম অলৌকিক ও বিস্ময়কর ধারণা রয়েছে। সেজন্য বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করেছেন। এখনও সংবেশন সম্পর্কে অনেক অজ্ঞতা, অনিশ্চয়তা রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক কিছু সুস্পষ্টভাবে জানা গেছে।

সংবেশনের অভিজ্ঞতা (Hypnotic Experience)

সংবেশিত হতে হলে একজন ব্যক্তিকে ইচ্ছুক হতে হবে এবং সংবেশকের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। যে ব্যক্তি সংবেশিত হতে ইচ্ছুক নয় এবং সহযোগিতা করতে রাজী নয় তাকে সংবেশিত করা দুঃসাধ্য। সংবেশক (Hypnotist) কতকগুলো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে সংবেশিত করেন যার ফলে সম্মোহিত ব্যক্তি তার আচরণের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সংবেশকের উপরে ছেড়ে দেয় এবং বাস্তব জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার কিছুটা বিকৃতি প্রকাশ করে। সংবেশনের প্রক্রিয়া হিসেবে সংবেশক একজন ব্যক্তিকে একটি ক্ষুদ্র বস্তু (যেমন দেওয়ালে একটি বিন্দু)-এর উপরে দৃষ্টি নিবন্ধ করতে বলেন, এই বস্তুটির উপর সমস্ত চিন্তাধারাকে কেন্দ্রীভূত করতে বলেন এবং ধীরে ধীরে মাংসপেশী শ্লথন করতে এবং নিদ্রাবিষ্ট হতে বলেন। ব্যক্তিকে ক্রমাগত, “আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন, আপনার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে” এভাবে শ্লথনের জন্য অভিভাবন (Suggestion) দেয়া হয়। ক্রমশ ব্যক্তির চেতনা বাহ্যিক জগৎ থেকে সরে এসে শুধু সংবেশকের কণ্ঠস্বরের প্রতি নিবন্ধ হয়। এ অবস্থায় ব্যক্তিকে অভিভাবন দেয়া হয় যেন সে সংবেশকের কথা ছাড়া অন্য কারো কথা শুনতে না পায়। যেমন বলা হয়, “আপনি শুধু আমার কথা শুনছেন।

অন্যান্য পদ্ধতিতেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া সম্ভব। কোন কোন সংবেশক ব্যক্তির মধ্যে অতি সংবেদনশীল এবং অতি উত্তেজনাময় অবস্থার সৃষ্টি করেন। সংবেশিত অবস্থায় ব্যক্তিকে অভিভাবন দেয়া হয় যে, সে ক্লান্তি অনুভব করবে না। অসীম শক্তি লাভ করবে। এ অবস্থায় সে কোন ক্লান্তি অনুভব না করেই বহুক্ষণ ধরেই গবেষণাগারে বিশেষভাবে নির্মিত সাইকেল চালাতে পারে এবং একইসঙ্গে সংবেশকের অভিভাবনের প্রতি সাড়া দিতে পারে। (Banya; এবং Hilgard.১৯৭৬)। আধুনিককালে পূর্বের সংবেশকদের মতো ব্যক্তিকে কর্তৃত্বপূর্ণ নির্দেশ বা অভিভাবন দিতে হয় না, বরং কিছু কিছু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজে নিজে সংবেশিত হতে পারে। সঠিক অবস্থার সৃষ্টি করা হলে ব্যক্তি সহজেই সংবেশিত অবস্থায় প্রবেশ করে, সংবেশক শুধু উপযুক্ত অবস্থা সৃষ্টিতে সহায়তা করেন। সংবেশিত অবস্থায় ব্যক্তির চেতনায় নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা যায় :

  • (১) সংবেশিত অবস্থায় ব্যক্তি নিজে কোন কাজের উদ্যোগ নিতে পারে না, বরং কি করতে হবে তার জন্য সংবেশকের অভিভাবনের জন্য অপেক্ষা করে।
  • (২) মনোযোগের পুনর্বণ্টন ঘটে। সাধারণ অবস্থার তুলনায় সংবেশিত অবস্থায় ব্যক্তির মনোযোগ খুব বেশি নির্বাচনমুখী হয়। ব্যক্তিকে যদি অভিভাবন নেয়া হয় যে, সে শুধু সংবেশকের কথা শুনবে, তাহলে বহুসংখ্যক লোক উপস্থিত থাকলেও অন্য কারো কথা শুনবে না।
  • (৩) সংবেশকের অভিভাবন অনুসারে ব্যক্তি বাস্তব জগতের যেকোন ধরনের বিকৃতি বিনা বিচারে গ্রহণ করে, যেমন একখণ্ড খড়ি মাটিকে সংবেশক রসগোল্লা বললে সংবেশিত ব্যক্তি তাই বিশ্বাস করে এবং সে তা খেয়ে ফেলে।
  • (৪) অভিভাবনশীলতা (suggestibility) বৃদ্ধি পায়। বহু গবেষক (Ruch. Morgan এবং Hillgard, 1973) বলেন যে সংবেশিত ব্যক্তির অভিভাবনশীলতা কিছুটা বৃদ্ধি পায়।
  • (৫) সংবেশিত ব্যক্তি সহজেই যে কোন ধরনের কাজ করতে পারে যা স্বাভাবিক অবস্থায় পারে না। সংবেশিত ব্যক্তি যেকোন ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে।
  • (৬) সংবেশিত অবস্থার ঘটনাবলির কথা সংবেশনোত্তর কালে ভুলে যায়। গভীরভাবে সংবেশিত করা হলে ব্যক্তি ক্রমশ নিদ্রাবিষ্ট অবস্থায় পৌঁছে এবং এমনকি সংবেশকের কথাও শুনতে পায় না। তবে সংবেশনের মাধ্যমে প্রদত্ত সংকেতের প্রতি সাড়া দিতে পারে। এ অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকে বলেন যে, তারা একটি আধিভৌতিক অভিজ্ঞতা লাভ করে, যেন তাদের মন দেহ থেকে বাইরে বেরিয়ে জগতের সঙ্গে মিশে যায়। অথবা তারা যেন অতীন্দ্রিয় জান লাভ করে।
  • (৭) ব্যক্তি সংবেশনোত্তর অভিভাবনের প্রতি সাড়া দিতে পারে। সংবেশনের মাধ্যমে সংবেশিত ব্যক্তিকে যদি নির্দেশ দেয়া হয় যে সংবেশন থেকে জেগে ওঠে সে তার জামাকাপড় খুলে টেবিলের উপরে রাখবে, তাহলে পরবর্তীকালে সে তাই করে। ফ্রয়েড সংবশন-উত্তর অভিভাবনের মাধ্যমে কিছু কিছু অস্বাভাবিক আচরণের চিকিৎসা করেছিলেন। যেমন সংবেশিত অবস্থায় একজন ব্যক্তিকে যদি বলা হয় যে, সে সংবেশন থেকে মুক্ত হয়ে আর ধূমপান করবে না। তাহলে পরবর্তীকালে সে আর ধূমপান করবে না। কিন্তু এ ধরনের আরোগ্য বেশি দিন স্থায়ী হয় না; একজনকে বলা হয়েছিল যে সংবেদন থেকে মুক্ত হয়ে তিনবার গলাখাকারি দিবে (কাশি দিবে)। সত্যি সত্যি সে তাই করেছিল। তার এরূপ করার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে সে বলল, “অনেকক্ষণ নীরবে বসে থেকে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।” তবে ওই একটি মাত্র আচরণ ছাড়া তার অন্যান্য আচরণ স্বাভাবিক ছিল।
  • (৮) বয়সানুক্রমিক প্রত্যাবৃত্তি (Age Regression) : সংবেশিত অবস্থায় ব্যক্তিকে অভিভাবন দেয়া হলে তার শৈশবের আচরণ ও অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটানো যায়। যেমন একজনকে যদি বলা হয় আপনার বয়স এখন ছয় বছর। এ বয়সে আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন। তখন ব্যক্তি তার অতীত স্মৃতি হুবুহ স্মরণ করে, ঘটনার বর্ণনা দেয় এবং অন্যান্য সব আচরণ পুরাবৃত্তি করে। এই সময়ে তার হাতের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে ছয় বছরের লেখার সঙ্গে মিলে যায়।
  • (৯) সংবেশিত অবস্থায় ব্যক্তি পরস্পর বিরোধী দুটি কাজ করতে পারে। চেতন ও অবচেতনের ক্রিয়া একই সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারে। অর্থাৎ চেতন ক্রিয়া অবচেতনের ক্রিয়ার উপরে কোন বাধার সৃষ্টি করে না। যেমন একজন ব্যক্তি এক হাতে এক একটি জটিল কাজ করতে পারে (যেমন দুটি চাবিতে একান্তর ভাবে চাপ দেওয়া), আবার একই সঙ্গে একটি সচেতন কাজ (যেমন কতকগুলো রঙের চাকতি দেখে সেগুলোর নাম বলা) করতে পারে।

টীকা

বস্তুবাদ বা জড়বাদ বা Materialism

বস্তুবাদ এটি হচ্ছে এমন দর্শনতত্ত্ব, যাতে বলা হয় – matter is the only reality বা বস্তুই হচ্ছে একমাত্র বাস্তবতা। ম্যাটেরিয়ালিজম হচ্ছে এক ধরনের ফিলোসফিক্যাল মনিজম বা দার্শনিক একত্ববাদ, যাতে ধরে নেয়া হয় ম্যাটার হচ্ছে প্রকৃতিতে একমাত্র মৌলবস্তু। আর মেন্টাল থিংস ও কনশাসনেস সহ সব থিংস হচ্ছে ম্যাটেরিয়াল ইন্টারেকশনের ফল। ম্যাটেরিয়ালিজম গভীরভাবে ফিজিক্যালিজমের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফিজিক্যালিজম হচ্ছে একটি দর্শনগত প্রতিপাদ্য বা থিসিস। এই ফিসিক্যালিজম বলে – ‘everything is physical’, অর্থাৎ there is nothing over and above the physical। সোজা কথা যা কিছু অস্তিত্বশীল, সবই ফিজিক্যাল বা ভৌত। দর্শনগত ফিজিক্যালিজমের উদ্ভব ম্যাটেরিয়ালিজম বা বস্তুবাদ থেকেই, ফিজিক্যাল সায়েন্স বা ভৌতবিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। যেমন: স্পেসটাইম, ফিজিক্যাল এনার্জি, ফোর্সেস, ডার্কমেটার ও এমনি আরো অনেক কিছু আবিষ্কারের মাধ্যমে। এর ফলে কেউ ম্যাটেরিয়ালিজমের চেয়ে ফিজিক্যালিজম পদবাচ্যটির ওপর অগ্রাধিকার দেন বেশি। অন্যেরা একটিকে অপরটির সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেন ম্যাটেরিয়ালিজম বা ফিজিক্যালিজমের সাথে দ্বান্ধিক যেসব মতবাদকে সামনে আনা হয় সেগুলোর মধ্যে আছে – আইডিয়ালিজম, প্লুরালিজম, ডুয়েলিজম ও বিভিন্ন ধরনের মনিজম বা অদ্বৈতবাদ ও আধ্যাত্মবাদকে।

ম্যাটেরিয়ালিজমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় মনিস্ট অনটোলজি বা অদ্বৈতবাদী দর্শনের শ্রেণীতে, যেনো এটি ডুয়েলিজম বা পুৱালিজমভিত্তিক দর্শনতত্ত্বাবলি থেকে আলাদা। এসব নানা ধরনের দর্শনবাদ থাকা সত্ত্বেও সবগুলো দর্শনই পড়ে দর্শনের প্রাথমিক দুই ভাগের একটিতে। একটি হচ্ছে আদর্শবাদ বা আইডয়ালিজম, অপরটি হচ্ছে ম্যাটেরিয়ালিজম বা বস্তুবাদ। আইডয়্যালিস্টদের কাছে স্পিরিট অথবা মাইন্ড কিংবা অবজেক্টস অব মাইন্ড (আইডিয়া) হচ্ছে প্রাইমারি বিষয়, আর ম্যাটার হচ্ছে সেকেন্ডারি। অপরদিকে, ম্যাটেরিয়ালিস্টদের কাছে ম্যাটার হচ্ছে প্রাইমারি বিষয়, আর স্পিরিট বা মাইন্ড কিংবা আইডিয়া হচ্ছে সেকেন্ডারি বিষয়। বস্তুবাদী ধারণা সম্ভবত সর্বোত্তমভাবে বোঝা যায়, যখন এটি বিরোধিতা করে “ডকট্রিন অব ম্যাটেরিয়াল সাবস্ট্যান্সকে”, যা ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত সুপরিচিতভাবে রেনে দেকার্তের মাধ্যমে ব্যবহার হয়ে আসছে মাইন্ডের ওপর। তা সত্ত্বেও, ম্যাটেরিয়ালিজমে এমন কিছুই বলা হয়নি, কী করে ম্যাটেরিয়াল সাবস্ট্যান্স বৈশিষ্ট্যায়িত করা উচিত।

১৯শ শতাব্দীজুড়ে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস সম্প্রসারিত করেছেন ম্যাটেরিয়ালিজমের ধারণাকে। তারা এ কাজটি করেছেন ইতিহাসের একটি বস্তুবাদী ধারণাকে আরো বিস্তৃত করার জন্য। তারা এ ধারণাকে কেন্দ্রীভূত রাখেন শ্রম সহ এর অনুশীলনের ওপর। তারা ডায়ালেকটিক ম্যাটেরিয়ালিজম বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ধারণা গড়ে তোলেন ও এটাকে পরে মার্কসবাদী দর্শন ও পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সম্ভবত ম্যাটেরিয়ালিজম স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠে ইউরেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৮০০-২০০ সময় পরিধিতে। এই সময়টাকে কার্ল জেসপার উল্লেখ করেছেন অ্যাক্সিয়াল এইজ নামে। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে ম্যাটেরিয়ালিজমের উদ্ভব খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দের দিকে অজিতা কেশকম্বলি, পায়াসি, কণাদ ও চার্বাক দর্শন মতের সমর্থকদের লেখালেখির মাধ্যমে। কণাদ ছিলেন প্রথমদিকের অ্যাটমিজম বা পরমাণুবাদের সমর্থকদের একজন। বুদ্ধিস্ট অ্যাটমিজম ও জৈন মতবাদ অব্যাহত রাখে অ্যাটমিক ট্র্যাডিশন। শুনৎষি (Xunzi) (খ্রিষ্টপূর্ব ৩১২-২৩০ অব্দ) প্রাচীন চীনে উদ্ভাবন করেন রিয়্যালিজম ও ম্যাটেরিয়েলিজমকেন্দ্রিক কনফুসিয়ান মতবাদ।

থেলিস, আনাক্সাগোরাস, এপিকিউরাস ও ডেমোক্রিটাসের মতো প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকেরা ছিলেন বস্তুবাদী। প্রথম দিকের কমন এর চিন্তাবিদদের বলা হয় ম্যাটেরিয়ালিস্ট। এদের মধ্যে আছেন ইয়াং জিয়াং (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫৩-১৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং ওয়াং চুং (খ্রিস্টাব্দ ২৮-১০০)। এরও পর ভারতীয় বস্তুবাদী জয়রাশি ভট্ট (ষষ্ঠ শতাব্দী) তার লেখা বই ‘তত্ত্বপাপলবাসিমল’-এ (দ্য আপসেটিং অব অব প্রিন্সিপল) হিন্দু দর্শনের ভিত্তিমূলক গ্রন্থ ন্যায়সূত্র এর সার-সংক্ষেপ ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করেন। ১৪০০ সালের কিছু পর বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের মৃত্যু ঘটে। চতুর্দশ শতাব্দীতে মাধবাচার্য ‘সর্ব-দর্শনাসমগ্র’ সঙ্কলন করেন। সেখানে চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন নিয়ে সেভাবে কিছু ছিল না। ১২শ শতাব্দীতে আরবের দার্শনিক আল-আন্দালুস, ইবনে তোফায়েল (আবু বাকের) দর্শনবিষয়ক অভিসন্দর্ভ Hayy ibn Yagdhan (Philosophus Autodidactus)-এ বস্তুবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেন।

আচরণবাদ বা Behaviorism

আচরণবাদ একটি মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ। এর সারকথা হচ্ছে, মানুষের সব আচরণ বিশ্লেষণযোগ্য এবং কার্যকর নীতির মাধ্যমে পরিচালিত। এই মতবাদ ফিলোসফি, মেথডোলজি ও থিওরির উপাদানগুলোকে একসাথে মিলিয়ে দেয়। বস্তুবাদী মনস্তত্ত্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২০শ শতাব্দীর শুরুতে এ মতবাদের আবির্ভাব। এর আগে বস্তুবাদী মনস্তত্ত্বে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন হয়ে পড়ত যে, মানুষের আচরণ ব্যাপক পরীক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। এ মতবাদের প্রাথমিক বিশ্বাসের কথাগুলোর উল্লেখ আছে আচরণবাদের প্রতিষ্ঠাতা ও আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদ জন বি. ওয়াটসন, আচরণবাদী মনস্তত্ত্ববিদ-লেখক-উদ্ভাবক-সামাজিক দার্শনিক বি. এফ. স্কিনার ও অন্যান্যদের লেখায়। এই প্রাথমিক বিশ্বাস হচ্ছে— মনস্তত্ত্বে বিবেচ্য হবে মানুষ ও প্রাণীর পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণ। মানুষ ও প্রাণীর মনে ঘটে চলা অপর্যবেক্ষণযোগ্য ঘটনাবলি মনস্তত্ত্বের বিবেচ্য বিষয় নয়। আচরণবাদীরা মনে করেন, আচরণ বৈজ্ঞানিকভাবে বর্ণনা করা যায়। এ জন্য আভ্যন্তরীণ মনস্তত্ত্বিক ঘটনাবলি কিংবা চিন্তা ও বিশ্বাসের মতো অনুমিত প্রপঞ্চের তথা হাইপোথেটিক্যাল কনস্ট্রাক্টের আশ্রয় নিতে হয় না।

১৯শ শতাব্দীর প্রথমদিক থেকে মনস্তত্ত্ব ও আচরণবাদী চিন্তাধারা একসাথে হাত ধরাধরি করে চলে। ২০শ শতাব্দীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণগত (সাইকোঅ্যানালাইটিক) ও মনস্তাত্ত্বিক Gestalt movement-এর সাথে এর মিল পাওয়া যায়। অবশ্য আচরণবাদের সাথে গেস্টাল্ট সাইকোলজিস্টদের মেন্টাল ফিলোসফির মধ্যে পার্থক্যও আছে। রুশ শারীরবৃত্তবিদ ইভান প্যাভলভের ওপর বিহেভিয়ারিজমের প্রভাব ছিল। তিনি পরীক্ষা চালিয়ছিলেন ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিংয়ের ওপর, তবে তিনি অপরিহার্যভাবে বিহেভিয়ারিজম ও বিহেভিয়ারিস্ট এডয়ার্ড লি মডাইক ও জন বি ওয়াটসনের সাথে একমত হতে পারেননি, যিনি ইনট্রোস্পেকটিভ মেথড বাতিল করেছিলেন এবং সাইকোলজিকে কঠোরভাবে এক্সপেরিমেন্টাল মেথডের গণ্ডির ভেতরে রেখেছিলেন। স্কিনারের সাথেও ইভানের মতপার্থক্য ছিল। ওপারেন্ট কন্ডিশনিংয়ের ওপর স্কিনার গবেষণা করেছেন।

১৯৫০-এর দশকে শুরু হয় কগনিটিভ রেভ্যুলেশন নামের একটি বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলন। সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন কগনিটিভ সায়েন্স তথা বোধবিজ্ঞােেনর মধ্যে যোগাযোগ ও গবেষণার সম্মিলন ঘটায় এই আন্দোলন। এতে সম্মিলন ঘটে মনস্তত্ত্ব, নৃ-বিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান এবং সাম্প্রতিক কালের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, কম্পিউটার সায়েন্স ও নিউরোসায়েন্সের। এই কগনিটিভ বিপ্লবের ফলে ২০শ শতাব্দীর শেষার্ধে বিহেভিয়ারিজম ব্যাপকভাবে অন্ধকারে চলে যায়। বিহেভিয়ারিজম ও কগনিটিভ বিপ্লবের চিন্তাধারার মনস্তত্ত্ববিদদের তত্ত্বে মিল না থাকলেও এরা পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে প্র্যাকটিক্যাল থেরাপিউটিক অ্যাপ্লিকেশনে কাজ করেছেন। বিহেভিয়ারিজম চেষ্টা করেছে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আচরণের একটি ব্যাপকভিত্তিক মডেল সৃষ্টি করতে।

বিহেভিয়ারিজমের শ্রেণিবিভাজন নিয়ে সার্বজনীন ঐকমত্য নেই। ওয়াটসনের মেথডোলজিক্যাল বিহেভিয়ারিজমে বিহেভিয়ারের অবজেকটিভ স্টাডি কথা বস্তুনিষ্ঠ সমীক্ষা পাওয়া যায়। এর অর্থ ভাবনা ও মনের অনুভূতি দিয়ে প্রভাবিত হয় এমন কিছু নয়, বরং বিষয়মুখ বাস্তব আচরণ নিয়ে সমীক্ষা চালাতে হবে। এতে মানসিক জীবন ও মনে আভ্যন্তরীণ বিষয় বিবেচ্য নয়। স্কিনারের র‍্যাডিকেল বিহেভিয়ারিজমকে র‍্যাডিকেল বিবেচনা করার কারণ এটি আচরণের নীতিকে সম্প্রসারণ করে অরগ্যানিজমের প্রক্রিয়া পর্যন্ত। এটি মেথডোলজিক্যাল বিহেভিয়ারিজমের বিপরীত। স্কিনার-উত্তর টেলোলজিক্যাল বিহেভিয়ারিজম অভীষ্ট উদ্দেশ্য সাধনমুখী কাজ করে, ব্যাষ্টিক অর্থনীতির মতো। এটি বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের ওপর নজর দেয়। স্কিনার-উত্তর থিওরটিক্যাল বিহেভিয়ারিজমে গ্রহণ করা হয় মনের পর্যবেক্ষণযোগ্য অভ্যন্তরীণ অবস্থাও। স্কিনার-উত্তর বায়োলজিক্যাল বিহেভিয়ারিজম কেন্দ্রীভূত হয় আচরণ তত্ত্বব্যবস্থার মধ্যে। আর্থার ডব্লিউ স্টার্টসের সাইকোলজিক্যাল বিহেভিয়ারিজম সূচনা করে মৌল ও প্রায়োগিক আচরণ বিশ্লেষণ। র‍্যাডিকেল বিহেভিয়ারিজম সংজ্ঞায়নে স্কিনার ছিলেন খুবই প্রভাবশালী একজন। তার বিহেভিয়ারিজম দর্শন তথা ‘এক্সপেরিমেন্টাল অ্যানালাইসিস অব বিহেভিয়ার’ নামের গবেষণা খুব প্রভাবশালী ছিল। অসংখ্য পদ্ধতিগত ও তাত্ত্বিক বিষয়ে আচরণ সম্পর্কিত অন্যান্য গবেষণার সাথে এর পার্থক্য ছিল।

২১শ শতকের তথা আধুনিক দিনের বিহেভিয়াজিম পরিচিত ‘বিহেভিয়ার অ্যানালাইসিস’ নামে, যা একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবিএআই (অ্যাসোসিয়েশন ফর বিহেভিয়ার অ্যানালাইসিস ইন্টান্যাশনাল)-এর ৩২টি স্টেট বা রিজিওন্যাল চাপ্টার রয়েছে। এশিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রয়েছে এর আরও ৩০ টি অতিরিক্ত চাপ্টার। এবিএআই আমেরিকা ও কানাডায় বছরে ৩৪টি সম্মেলনের আয়োজন করে। সময়ের সাথে সাথে বিহেভিয়ার অ্যানালাইসিসের প্রতি ক্রমশ আগ্রহ বাড়ছে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.