চট্টগ্রামের আদি বা প্রাক-মুসলিম ইতিহাস

‘চট্টগ্রাম’ নামের উৎপত্তি

  • তিব্বতী সূত্রে চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম পাওয়া যাচ্ছে ‘জ্বালনধারা’, অর্থাৎ তপ্তজল সমন্বিত অঞ্চল। (Jurnal of Asiatic society of Bengal (JASB), 1998, 21-23) এখানে কিছুকাল বাস করেছিলেন বলে সিন্ধুদেশীয় বৌদ্ধ সিদ্ধ বালপাদ জ্বালন্ধরী নাম প্রাপ্ত হন। ঝাড়ুদার হাড়ির কাজ করেছিলেন বলে তাকে ‘হাড়িফা’ও  বলা হয়। অগ্নিতপ্ত জল ধারণ করে বলেই হয়তো স্থানটি ‘জ্বালন্ধর’ নামে পরিচিত ছিল। সীতাকুণ্ডে ও বাড়বকুণ্ডে এখনো পর্বতগাত্র থেকে তপ্তজল নিঃসৃত হয়। এরই আরবি-ফারসি নাম সম্ভবত ‘সামন্দর’। সাম (অগ্নি) অন্দরে (অন্তর>অন্দর) আছে যে স্থানে তাই সামন্দর। (Steingass- Comprehensive Persian English Dictionary.)। সামন্দর নামের প্রথম উল্লেখ ইবন খুর্দাদবেহ্‌ এর বর্ণনায় পাওয় যায়। তিনি এই অঞ্চলকে ‘রুহম’ বা ‘রুহমি’ রাজার শাসনভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। সামন্দরের দ্বিতীয় উল্লেখ পাওয়া যায় ‘হুদুদুল আলম গ্রন্থে। এখানে রাজার নাম ‘দহুম’। ডক্টর আহমদ হাসান দানীর মতে, এই দহুম ও রুহুম হলো একই নামের বিকৃতি। দহুম > দহম > দহ্ম > ধর্ম। ইনি বঙ্গের রাজা ধর্মপাল। (Proceedings of Pakistan History Conference 314-15.)। হোদীওয়ালাও এ মত পোষণ করেন। (Hodivala JS: Studies on Indo Muslim history, 4.)।
  • আর এক কিংবদন্তি এই যে, আরাকানরাজ চূড়সিংহ চন্দ্র (Chulataing Tsandaya) ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ চট্টগ্রাম জয় করে সেখানে একটি জয়স্তম্ভ নির্মাণ করান এবং তাতে Tsit Tat Gung ‘যুদ্ধ করা অনুচিত’ –এই বাণী উৎকীর্ণ হয়। এরই বিকৃত রূপ ‘চাটিগাঁও’।
  • চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মতে ‘চৈত্যগ্ৰাম’ থেকে চাটিগ্রাম বা চট্টগ্রাম-এর উৎপত্তি।
  • হিন্দুদের ধারণা ‘চট্ট’ (কুলীন ব্রাহ্মণ) দের নিবাস বলে চট্টল>চট্টলা, কিংবা চট্টগ্রাম হয়েছে।
  • মুসলমানদের বিশ্বাস, শাহ বদর আলম চাটি (মৃতবর্তিকা) জ্বালিয়ে জ্বীন-পরীর কবল থেকে অঞ্চলটিকে মুক্ত করেন বলে, স্থানটি চাটিগ্রাম বা চাটিগাঁও নামে অভিহিত হয়েছে।
  • Bernonilli বলেছেন—আরবি শাত (বদ্বীপ) ও গঙ্গা (নদী) থেকে, অর্থাৎ গঙ্গার মুখস্থিত বদ্বীপ অর্থে আরব বণিকেরা একে ‘শাৎগাঙ’ > শাৎগাঁও নামে অভিহিত করত”, এবং উচ্চারণ বিকৃতির ফলে চাটর্গাও চাটিগাঁও, এবং সংস্কৃতায়নের ফলে চট্টগ্রাম হয়েছে বলে অনুমিত। (Bernonilli: Description Historiqu de ‘e’ Inde. 1.)
  • District Gazetteer Chittagong এ O’ Malley অনুমান করেছেন, সংস্কৃত ‘চর্তুগ্রাম’ বা চারিগ্রাম থেকে ‘চাটিগাঁও’ নামের উৎপত্তি।
  • ‘আহাদিসুল খাওয়ানীন’ লেখক খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খানের মতে হোসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রী.) পুত্র নুসরৎ শাহ ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জয় করে এর নাম দেন ‘ফত্‌হ-ই-আবাদ। এবং শায়েস্তাখান ১৬৬৬ সনে চট্টগ্রাম অধিকার করে আওরঙজেবের অভিপ্রায়ক্রমে এর নাম রাখেন ‘ইসলামাবাদ’। পর্তুগীজ বণিকেরা Porte grando বলেই এর পরিচয় দিত। আল্ ইদ্রিসী কর্ণফুলীর নামানুসারে একে ‘কর্ণবুল’ নামে আখ্যাত করেন।

দেশ-পরিচয়

প্রাচীনকাল থেকেই সামুদ্রিক বন্দর বলে চট্টগ্রামের ইতিহাস একরকম থাকেনি, এখানকাল মানুষের পক্ষে রক্তে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাও তাই সম্ভব হয়নি। নানা জাতির সংমিশ্রণে সঙ্কর সমাজের উদ্ভব যে গোড়া থেকে হয়েছিল, তা সহজেই অনুমান সম্ভব। এমনি সঙ্কর সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনও বৈচিত্র্যে জটিল হয়ে উঠে। ইতিহাসবিহীন প্রাচীন যুগের কোনো সংবাদ আমাদের কালে এসে পৌঁছেনি। তবে পরোক্ষ তথ্যের আলোকে একটি কল্পচিত্র আঁকা যায়।

ঋগ্বেদের আমলে আজকের বাঙলার অধিকাংশ ছিল সমুদ্র। আরো অনেক পরে শুক্লযজুর্বেদের যুগেও গণ্ডকী নদীর পূর্বদিক ছিল জলপ্লাবিত। মহাভারতিক কালেও দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ ছিল সমুদ্রে লীন। পর্যটক স্ট্রাবোর ভারত ভ্রমণ কালে (১৮-২৪ খ্রী.) সমুদ্রের লোনাজল প্রতিরোধের জন্যে বহু নগরের চারদিকে বাঁধ ছিল। হিউএয়নং সাঙও সমতট কামরূপের মধ্যাঞ্চলে প্রায় হাজার ক্রোশব্যাপী হ্রদ প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

তবু বাঙলা ও আসাম যে মহাভারতিক যুগে বসতিবহুল ছিল তা নিশ্চিত। পুণ্ড্রের বসুদেব, ভগদত্তের প্রাগজ্যোতিষপুর (আসাম) ঐ যুগের লেখায় উঠে আসে। (D. C. Sarcar: Select Inscriptions (SI), 500.) ঐতরেয় ব্রাহ্মণে খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতক পুণ্ড্রের জনগণকে দস্যু বলা হয়েছে। ঐতরেয় আরণ্যকে অনার্য বঙ্গ, বগধ (মগধ) ও চের জাতির উল্লেখ রয়েছে। (Majumdar R. C; ed: Histroy of Bengal (HB), 7-8)। এতে অন্তত একটি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে যে খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকেও এদেশে জনবসতি ছিল এবং তাদের সম্বন্ধে কিছু সংবাদ আর্যসমাজে আহৃত হয়েছে।

বৌধায়নসূত্রে অঙ্গ ও মগধের লোকেরা অভিহিত হয়েছে ‘সংকীর্ণযোনি’ (তথা অংশত আর্য বা আর্যরক্ত সম্পৃক্ত) বলে। আর কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও বঙ্গদেশকে তখনো আর্য-বর্জিত অঞ্চল বলে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এদেশে এলে ফিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। এর পরে রচিত একটি শ্লোকে দেখা যায়, তীর্থদর্শনার্থ অঙ্গে, বঙ্গে ও কলিঙ্গে যাওয়ার বিধান রয়েছে। (Bagchi P. C: Pre-Aryans and pre-Dravidians in India. p. 73-74) এতে বোঝা যায়, সমাজক্ষেত্রে উক্ত অঞ্চল তিনটির লোক ঘৃণ্য হলেও তাদের দেশের স্থানবিশেষ তীর্থক্ষেত্রের মর্যাদা লাভ করেছে। এর মধ্যে বাঙলায় আর্য আর আর্যধর্ম ও সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের আভাস অন্তত মেলে। সম্ভবত বাঙলার গঙ্গাসাগর ও উড়িষ্যার বৈতরণী তীরই এই অনুক্ত তীর্থক্ষেত্র। (JASB, 1952 172 মহাভারত, বন পর্ব-তীর্থযাত্রা)।

দুটো লিপির সাক্ষ্যেও প্রমাণিত হয় যে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে এদেশে আর্য-প্রভাব দৃঢ় ও গাঢ় হয়ে উঠেছে। এর একটি খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের এবং মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত (SI 82 83.) এবং অপরটি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের, প্রাপ্তিস্থান নোয়াখালির মিলুয়া গাঁ। (Si 82-83 : Archaeological Survey of India Report, 1230-34,30-39)। এছাড়া বাঙলার বিভিন্নস্থানে প্রাপ্ত কুষাণ আমলের মুদ্রাও আর্যাবর্ত তথা উত্তরভারতের সঙ্গে বাঙলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নিঃসংশয় প্রমাণবাহী। (বন্দোপাদ্যায়, রাখাল দাস: বাংলার ইতিহাস, ১ম খণ্ড ৩য় সংপু, ৩২-৩৩-৩৭-৩৯: JASB: NS XXVIII 172 Journal of Numismatic Society of India (INSI) XIII, 107, Excavations at Bangarh, 30-32.)। এসব থেকে সহজেই অনুমান করা চলে আর্য ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের পূর্বেই বাঙলায় চালু হয়েছে। আর্যবসতি না থাকলে এগুলো কিছুতেই সম্ভব হত না। সিংহলী মহাবংশ বর্ণিত কাহিনীসূত্রে জানা যায় – খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বঙ্গে রাজা ও রাজ্য ছিল। (JSAB 1953, 1974)। এতে বাঙলার বর্বরোত্তর যুগের আভাস পাওয়া যায়।

পুরাণে এবং পরিব্রাজক ও ঐতিহাসিকদের কাছে চট্টগ্রাম

বর্তমান বাংলা যখন বঙ্গসাগরের অতলজলে নিমজ্জিত ছিল, তখনও চট্টগ্রামের অস্তিত্ব ছিল। মহাভারতে সূহ্ম রাজ্য বা সূহ্মদেশ সম্পর্কে জানা যায়। মহাভারতে ভীমসেন তার দিগ্বিজয়ে এই অঞ্চল জয় করেছিলেন। তিনি মহীপতি সমুদ্রসেন, চন্দ্রসেন, কর্ণাটাধিপতি, সূহ্মাধিপতি ও পর্বতবাসী নরপতিগণকে জয় করে সমুদয় ম্লেচ্ছদেরকে পরাভূত করেন বলে উল্লেখ আছে। দিলীপকুমার চক্রবর্তী সহ অনেকে সূহ্মদেশকে মেদিনীপুর জেলা এবং হুগলি ও হাওরার অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে কমল চৌধুরীর মত অনেকে বলেন অতি প্রাচীনকালে কামরূপ ও আরাকান রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানকে আর্যগণ সূহ্মদেশ বলতেন, তাই চট্টগ্রামও সূহ্মদেশের অন্তর্গত ছিল।

স্থানীয় কিংবদন্তি সূত্রে জানা যায় মহাভারতিক যুগে কর্ণের পুত্র বিকর্ণ চট্টগ্রামে রাজত্ব করতেন। তার রাজধানী ছিল কাঞ্চন নগর। পটিয়া ও ফটিকছড়ি থানা অঞ্চলে দুটো কাঞ্চননগর আছে, সাতকানিয়া থানায় আছে ‘কাঞ্চনা’। এ তিনটেই বিকর্ণের রাজধানীর গৌরব দাবী করে। এছাড়া কিংবদন্তি সূত্রে আর কিছু জানা যায় না।

কেউ কেউ মনে করেন, গঙ্গা আগে চট্টগ্রামের পাশে সন্দ্বীপের কাছাকাছি জায়গায় বঙ্গোপসাগরে মিলিত হত। Rennel-এর মানচিত্রেও এর আভাস আছে। আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল বলেন : “(গঙ্গা) উত্তরের দিকে পর্বতমালায় উত্থিত হয়ে, দিল্লি প্রদেশ, ইম্পেরিয়াল আগ্রা এবং এলাহাবাদ এবং বিহারের মধ্য দিয়ে বাংলার প্রদেশে প্রবেশ করে এবং বারবাকাবাদ (Barbakabad) সরকারের কাজিরহাট্টাহ্‌ (Qazirhattah) এর কাছে এটি দুটি প্রবাহে বিভক্ত হয়, এদের একটি চট্টগ্রাম বন্দরের সমুদ্রে পড়ে।” (অনুদিত) (আবুল ফজল : আইন-এ-আকবরী (জ্যারেটের ইংরাজি অনুবাদ, যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, ১৯৪৯) ২য় খণ্ড ১৩৩।)।

খ্রিস্টের জন্মের ৩২০ বছর পূর্বে আলেকজেণ্ডারীয় যুগে প্রাগ-জ্যোতিষপুরের অন্তর্গত চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি প্রদেশ সকলকে প্রাচীন বার্মার লোকেরা “ক্লীং” বা “কালেন” অর্থাৎ পশ্চিমদেশ বলত। বেলফোরের সাইক্লোপিডিয়ায় প্রাচীন বর্মীরা বার্মার পশ্চিমের লোকেদেরকে ক্লিং বা কালন বলত। প্রসিদ্ধ ভৌগোলিক স্ট্রাবো ১৮-২৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতভ্রমণে আসেন। তার ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠে দেখা যায় ভারতবর্ষের অনেক নগরই সমুদ্রজল থেকে রক্ষার জন্য মাটির বাঁধ (কাঠী Embankment) দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। এ থেকে অনুমিত হয় বর্তমান বাংলার সব প্রদেশই তখনই বঙ্গোপসাগরের লবণসলিল থেকে তাদের মস্তক উত্তোলন করছিল, অর্থাৎ এই অঞ্চলগুলো জেগে উঠছিল। কলহনের রাজ-তরঙ্গিণীতে দেখা যায় মাৎস্যন্যায়ের সময়ে ৮ম শতকের দিকে কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য পূর্বে দিগ্বিজয় করার জন্য গৌড় নগরে আসেন। সেখানে উল্লেখ ছিল যে, গৌড় নগরের অনতিদূরেই সমুদ্রের অবস্থিতি ছিল। নদীয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, ২৪ পরগণা ও মুর্শিদাবাদের কিছু অঞ্চল ও ঢাকা জেলার বিক্রমপুর, সোনারগাঁও প্রভৃতি অধিকাংশ স্থানের তখন অস্তিত্ব ছিল না দাবি করা হয় (তবে কিছু কিছু অঞ্চল নিয়ে দ্বিমত আছে, যেমন আর দুশো বছর পরই ১০ম শতকে চন্দ্রবংশের রাজা শ্রীচন্দ্র ঢাকার বিক্রমপুরে তার রাজধানী স্থাপন করবেন, প্রাচীন হরিখেল অঞ্চলকে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল জুড়েই ছিল বলে অনেকে দাবি করেন।)

খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে চীন-পরিব্রাজক হিউয়াংসাং ভারতভ্রমণে আসেন, তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তেও বঙ্গদেশের নাম দেখা যায়না। তিনি পৌণ্ড্র, কর্ণসুবর্ণ, পূর্বদিকে কামরূপ, সমতট, শ্রীচটলো, ব্রহ্মপুর (স্ত্রীরাজ্য)” প্রভৃতি জনপদের নাম উল্লেখ করেছেন। এই শ্রীচটলো বা সিহল-চটলো বা সিহলি-চটলো নিয়ে বিশেষভাবে কিছু বলার আছে। চট্টল শব্দের অপভ্রংশই চটলো। হিউয়েনসাং এর সময়ে পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলেই বৌদ্ধরা ছিল, ফাহিয়েনও উল্লেখ করেছেন এই অঞ্চলে একটি বৌদ্ধমঠ ছিল। উল্লেখ্য, হিউয়েন সাং ভারতবর্ষে ছিল ৬২৯-৪৫ খ্রিস্টাব্দে। এদিকে আরাকানের সিংহবংশীয় রাজা ৬৩৯ সালে রাজত্ব করেন ও পরে চট্টগ্রাম দখল ও অধিকার করেন। এই সিংহরাজ্যকে অনেকে সিহলি চটলো বলতেন। Phayre এর হিস্টোরি গ্রন্থে সিংহ শব্দটির সাথে সিহ ও সিংহল শব্দের সাথে সিহল শব্দের সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে। এদিকে লি দ্বারা চৈনিক ভাষায় বোঝায় দেশ বা অঞ্চল। তাই হিউয়েন সাং আরকানের সিংহ রাজবংশের দ্বারা দখলকৃত চট্টগ্রামকে সিহলি চটলো বলে থাকতে পারেন, যা পরে গ্রিসের মেকাডো ও ব্রিটেইনের ওয়ার্টাসের দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে শ্রী-ছত্র হয়ে গেছে। পূর্ব দিকে সমতটের পর চট্টগ্রাম, আর তারপর ব্রহ্মপুরের কথা উল্লেখ করছেন হিউয়েন সাং। আবার এই ব্রহ্মপুরকে বলছেন স্ত্রীরাজ্য। এই ব্রহ্মপুর মিয়ানমার বা ব্রহ্মদেশ হয়ে থাকবে, আর একে স্ত্রীরাজ্য বলা হতে পারে এজন্য যে এখানে স্ত্রী স্বাধীনতা এখনও দেখা যায়, সেই সাথে সেখানকার আবা প্রভৃতি জনপদের রমনীগণ সুন্দরী বলেও প্রসিদ্ধ। এদিকে হিউয়েন সাং সমতট, সিহলি-চটলো আর ব্রহ্মপুরের নাম একসাথে নিচ্ছেন, আর সমতট যেহেতু পূর্ববঙ্গের বীস্তির্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছি , সিহলি-চটলো চট্টগ্রাম ও ব্রহ্মপুর ব্রহ্মদেশ হলে বলতে হয় হিউয়েন সাং একই সাথে পূর্বদিকের পাশাপাশি অঞ্চলের কথা বলেছেন, যেটা স্বাভাবিক ছিল।

হিউয়াংসাং-এর সময়ে ভাস্করবর্মণ নামে প্রাগজ্যোতিষের এক রাজা ছিলেন। তার ভ্রমণবৃত্তান্ত অনিযায়ী, তার অধীনে কমলাঙ্ক (কুমিল্লা), সমতট (ময়মনসিংহ ও ঢাকার কিছু অংশ), কাছাড়, শ্রীহট্ট বা সিলেট, জয়ন্তা, পশ্চিম আসাম সহ করতোয়া নদীর তীর পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল ছিল। আর শ্রীচটলো (চট্টগ্রাম) কোন সময়ে ব্রহ্ম, আরকান ও কোন সময়ে কামরূপ ও ত্রিপুরার অন্তর্গত ছিল। একদিকে প্রাগজ্যোতিষপুর বা কামরূপের সাথে চট্টগ্রাম যেরকম সংশ্লিষ্ট, অন্যদিকে ব্রহ্মরাজ্য ও আরাকানের সাথেও এর আরও অধিকতর সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। মানচিত্রে ব্রহ্মদেশ, চট্টগ্রাম, আরাকান, প্রাগজ্যোতিষপুর প্রভৃতি সমসুত্রেই গাঁথা। ব্রহ্ম ও আরাকানের ইতিহাস পাঠে অবগত হওয়া যায়, তিব্বত-দেশের পূর্বপ্রান্ত থেকে কতিপয় জাতি ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা দিয়ে ব্রহ্মদেশে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন। ব্রহ্মদের ইতিহাস মহারাজোয়াং ও আরাকানের ইতিহাস রাজোয়াং পাঠে জানা যায়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন ক্ষত্রিয় রাজগণ ব্রহ্মরাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন। এদের মধ্যে ও বিভিন্ন শাখা ও স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র রাজবংশ দেখা যায়। রাজয়োং গ্রন্থে আরাকান রাজার রাজবংশ ব্রহ্মগণের অনেক আগেই ভারত থেকে আগত বলে উল্লেখ আছে। ব্রহ্মদের কেউ কেউ রক্ষঃ বা রক্ষেয়াং বলে থাকে। মগদের মধ্যে রাখ্‌চাঁই নামক একশাখার লোক রাজত্ব করতেন বলে তাদেরকে রক্ষয়াং বলা হয়েছে। আবার কেউ কেউ ক্ষেয়াং বা নদী থেকে রক্ষয়াং, কেউ বা পারসি শব্দ রোখাম্ থেকে রক্ষিয়াং হয়েছে বলেন। ব্রহ্মর পুরনো ইতিহাসে দেখা যায়, বুদ্ধদেব স্বশিষ্যে ছেলুইন নদীর তীর পর্যন্ত পরিভ্রমণে গিয়েছিলেন। নদীর পর পারস্থ লোকগণ তাঁর ধর্ম গ্রহণ না করে তাঁর প্রতি ঢিল নিঃক্ষেপ করেন, সেজন্য তাঁরা রক্ষেয়াং বা (বিধর্মী) বলে তাঁর শিষ্যগণ প্রচার করেন। বিশেষতঃ বৌদ্ধগণের সঙ্গে ব্রাহ্মণগণের এক ঘোরতর বিবাদও বর্ণিত দেখা যায়। বুদ্ধদেব ছেলুউইন নদীর তীর থেকে চট্টগ্রাম (চন্দ্রনাথ), হস্তিগ্রাম (হাইদগাঁও), আম্রগ্রাম (আমতলি) হয়ে জলপথে তিনমাসে কুশীনগরে উপস্থিত হন এবং সেখানে তিনি নির্বাণ প্রাপ্ত হন। উক্ত হাইদগাঁয়ে একটি অতি পুরনো বৌদ্ধচৈত্য আছে। প্রতিবছর বিষুব সংক্রান্তিতে এই স্থানে মেলা বসে, এবং বৌদ্ধগণ সেখানে বুদ্ধপদে পিণ্ড দান করেন। এর নিকটবর্তী স্থানে অনেক বৌদ্ধ-বাসিন্দা ছিল। এখনও ত্রিপুরার দিঘি ও ত্রিপুরার হাট বর্তমান আছে। এরকম বৌদ্ধচৈত্য রামু, চকরে প্রভৃতি স্থানেও দেখা যায়। এসব কারণে, বুদ্ধের আগমন ও ধর্মচক্র স্থাপনের বিষয় প্রতীয়মান হয়।

খ্রিস্টীয় ১ম শতকের প্রথম পাদে গঙ্গামুখ বহির্বাণিজ্যের বন্দর ছিল বলে স্ট্রাবো উল্লেখ করেছেন। গ্রীকরাও গঙ্গার মোহনাস্থিত বন্দরে বাণিজ্য করত। গঙ্গার নৌযানের নাম ছিল কলন্দিয়া (Calandia)। জলবাণিজ্য তত্ত্বের আদিগ্রন্থ Periplus of the Erythrean Sea-তে (খ্রিস্টীয় ২য় শতক) গঙ্গামুখস্থ বন্দরের কথা পাওয়া যায় : “তীরে একটি বাজার শহর রয়েছে যার নাম গঙ্গা নদীর মতো একই। এই স্থানের মধ্য দিয়ে আনা হয় ‘মালাবাথরুম’ (Malabathrum) এবং গাঙ্গেয় স্পাইকনার্ড এবং সেরা ধরণের মুক্তো এবং মসলিন, যাকে গাঙ্গেয় বলা হয়। বলা হয় যে এই জায়গাগুলির কাছাকাছি সোনার খনি রয়েছে এবং একটি সোনার মুদ্রা রয়েছে যা ‘কাল্টিস’ (Caltis) নামে পরিচিত। এবং এই নদীর ঠিক বিপরীতে সমুদ্রে একটি দ্বীপ রয়েছে যা পূর্ব দিকে বিশ্বের শেষ প্রান্তে অবস্থিত, যা উদীয়মান সূর্যের নীচে অবস্থিত। একে ‘ক্রাইস’ (Chryse) বলা হয়, এবং এখানে এরিথ্রিয়ান সাগরের সমস্ত জায়গার সেরা কচ্ছপের শেল এখানে পাওয়া যায়।” (অনুদিত)। (Periplus of the Erythrian Sea. Tr. Schoff 47-48, Sachau: Alberuni’s India I, 201, 206.)। এর সঙ্গে আলবেরুনীর ‘গঙ্গাসাগর’ (গঙ্গা পতিত হয়েছে যে সাগরে?) তুলনীয়। (Periplus of the Erythrian Sea. Tr. Schoff 47-48, Sachau: Alberuni’s India I, 201, 206.)। Bernonilli তার গ্রন্থে আরবি শাত (delta) ও গঙ্গা নদী থেকে গঙ্গার মোহনাস্থিত বদ্বীপ নির্দেশ করবার জন্যে আরবেরা শাতগাঙ (< সাতগাওঁ > কাওন) নাম দান করে বলে যে-মত প্রকাশ করছেন, তাও এ সূত্রে স্মর্তব্য। ইবন বতুতার সাতকাওন (Sudkawan) সম্ভবত এই ‘শাত গাঙ’–এরই বিকৃতরূপ। ইবন বতুতা বলেছেন : “বাংলার প্রথম শহর (লখনৌতি তথা গগৌড় নয়) যেখানে আমরা প্রবেশ করেছিলাম, সেটি ছিল সাতকাওন (Sudkawan), যা মহান সমুদ্রের উপকূলে একটি বড় শহর। এর নিকটে গঙ্গা নদী, যেখানে হিন্দুরা তীর্থযাত্রায় যায়, এবং জুন (Jun বা যমুনা) নদী একত্রিত হয়ে সমুদ্রে একত্রিত হয় এবং একসাথে সমুদ্রে চলে যায়।” -এ অংশের সঙ্গে “ফখরুদ্দীন তার নৌবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বের কারণে লখনাওতির ভূমির বিরুদ্ধে নদীতে অভিযান চালাতেন, কিন্তু যখন বৃষ্টিহীন ঋতু ফিরে আসে, তখন আলি শাহ বাংলায় স্থলপথে অভিযান চালাতেন।” এবং “আমি সাতকাওন থেকে কামরু (Kamru) পর্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম, যা এক মাসের যাত্রা।” আর “পনের দিন ধরে নদী (নীল নদী মেঘনা, কামরু থেকে) এর নিচে রওয়ানা হওয়ার পরে, আমরা সুনারকাওয়ান (sunarkawan) শহরে পৌঁছেছি।” (Gibb H A R. tr : Travels of Ibn Battuta 567-68, 271, 366 note.)। – এগুলো মিলিয়ে পাঠ করলে সন্দেহ থাকে না যে বতুতা

  • (ক) ‘বাঙলা’ অর্থে পূর্ববঙ্গ বুঝেছেন এবং
  • (খ) তার Sudkawan চট্টগ্রামই। এখান থেকেই উজান বেয়ে কামরূপ এক মাসের পথ। সপ্তগ্রাম বাঙলার নয়, লখনৌতির অন্তর্গত। আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল এবং পর্তুগীজ ঐতিহাসিক দ্যা ব্যারোজ বলেছেন, চট্টগ্রামের পাশেই গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে পাওয়া গেছে।
  • (গ) Jun (যমুনা) নামে এখানে ব্রহ্মপুত্র নদকেই নির্দেশ করা হয়েছে।

অতএব, বতুতার Sudkawan চাটগাঁও বলেই মনে হয়। ভাগীরথী, যমুনা পদ্মা ও মেঘনাকে সাধারণভাবে গঙ্গা নামে অভিহিত করার রেওয়াজ বিদেশীদের মধ্যে সুপ্রাচীন। বিশেষ করে যুগদিয়া ও মুলুদিয়া যে দ্বীপ ছিল, তা এ দুটোর নাম ও এ সম্বন্ধে কিংবদন্তি সূত্রেই প্রকাশ। এ তথ্য যদি মেনে নিলে গঙ্গামুখ যে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছেই ছিল তা মানতে দ্বিধা হয়না।

আরব ভৌগোলিকদের মধ্যে সোলায়মান ইবন খোর্দাদবেহ্‌ (৯১২ অথবা ৮৪৪-৪৮) হুদুদুল আলমের অজ্ঞাত লেখক (৯৮২ খ্রী.) আলমাসুদী (৯৫৬ খ্রী.) এবং আল ইদ্রিসীর (১০৭৫-১১০০ খ্রী.) বর্ণনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাঙলা। সোলায়মানের রচনা বলে পরিচিত ‘সিলসিলাত-অল-তওয়ারিখে (৮৫১ ৫১ খ্রী.) বাঙলা দেশের উল্লেখ আছে। কিন্তু ‘সমন্দর’-এর উল্লেখ আছে ইবন খোর্দাদবেহর কিতাব অলমাসালিক ওয়াল মুমালিক’-এ আল মাসুদীর গ্রন্থে আর ‘হুদুদুল আলমে’। ইবন খোর্দাদবেহ বলেন : ‘সমন্দরে চাউল উৎপন্ন হয়, পনেরো-বিশ দিনের পথ কামরূপ ও অন্যান্য স্থান থেকে এখানে চন্দন মুসববর বা ঘৃতকুমারী (Aloe) আমদানি হয়।’

আল ইদ্রিসীর মতে : “সামান্দার একটি বড় শহর, বাণিজ্যিক এবং সমৃদ্ধ, যেখানে ভাল লাভ করা যায়। এটি এই দেশের রাজা কনৌজের উপর নির্ভরশীল একটি বন্দর। এটি কাশ্মীর দেশ থেকে আসা একটি নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে। চাল এবং বিভিন্ন শস্য বিশেষ করে প্রাক্তন সেলেন্ট গম এখানে পাওয়া যায়। ঘৃতকুমারী (Aloe) কাঠ কামরূপ দেশ থেকে আনা হয়, সেই অঞ্চলটি একটি নদী দ্বারা ১৫ দিনের দূরত্বে অবস্থিত যার জল মিষ্টি হয়। সেই দেশ থেকে আসা ঘৃতকুমারী কাঠ উন্নত মানের এবং সেখান থেকে সুগন্ধী পারফিউম পাওয়া যায়। গাছটি করনের (Karan) পাহাড়ে বৃদ্ধি পায়। এই শহর থেকে এক দিনের যাত্রার পর একটি বড় দ্বীপে ভাল মানুষ থাকে এবং সব দেশের ব্যবসায়ীরা সেখানে আসে। এখান থেকে সারানদীব (Sarandib) চার দিনের পথ। উত্তরে, সামান্দার থেকে সাত দিনের দূরত্বে রয়েছে কাশ্মীরের শহর।” এ বর্ণনা অত্যন্ত ভ্রান্তিপূর্ণ হলেও সমন্দর সম্বন্ধে খোর্দাদবেহ্‌ ও আল ইদ্রিসীর উক্তির অনেকাংশে মিল আছে। আল ইদ্রিসীর মতে –

  • (ক) সমন্দর নদীতীরস্থ বাণিজ্যবন্দর;
  • (খ) ধান ও গমাদি নানা শস্য এ বন্দরে পাওয়া যায়;
  • (গ) পনেরো দিনের পথ কামরূপ থেকে নদীপথে এখানে চন্দন আমদানি হয় এবং
  • (ঘ) সমন্দর থেকে একদিনের পথে একটি বড় দ্বীপ আছে, এ দ্বীপও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্দর।
  • (ঙ) হুদুদুল আলমে রাজার নাম ‘দহুম’, আল ইদ্রিসীর মতে কনোজ। কিন্তু aloe সম্বন্ধে তিনজনই একমত।

সোলায়মানের ‘সিলসিলাত অল তওয়ারিখে পাই : “এই তিনটি রাষ্ট্র (Jurz বা গুর্জররাজ, Balhara বা রাষ্ট্রকুটরাজ বল্লভরাজ এবং Tafak) রুহমি নামে একটি রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত যা গুর্জরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। রাজাকে খুব উচ্চ অনুমানে রাখা হয় না। তিনি গুর্জরের রাজা বা তাফাকের রাজার সাথে আছেন বলে তিনি রাষ্ট্রকুটের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। বলা হয়ে থাকে যে তিনি যখন যুদ্ধ করতে বের হন তখন তাকে প্রায় ৫০,০০০ হাতি অনুসরণ করে। তার দেশে এমন একটি জিনিস তৈরি করা হয়েছে যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না: এই উপাদানটি এত সূক্ষ্ম যে এটি দিয়ে তৈরি একটি পোষাক একক আংটি (মসলিন) এর মধ্য দিয়ে যেতে পারে। এটি তুলা দিয়ে তৈরি করা হয় এবং আমরা এটির একটি টুকরা দেখেছি। কড়ির (kauris) মাধ্যমে বাণিজ্য করা হয় যা দেশের বর্তমান অর্থ। তাদের দেশে সোনা ও রৌপ্য রয়েছে, ঘৃতকুমারী (Aloes) এবং সামারা (samara) নামে পরিচিত জিনিস রয়েছে, যা দিয়ে মাদাব (madab) তৈরি করা হয়। স্ট্রিপযুক্ত বুশন (Bushan) বা কারকদদম (Karkaddam) এই দেশে পাওয়া যায়। এটি এমন একটি প্রাণী যার কপালের মাঝখানে একটি মাত্র হোরভিন (horvein) রয়েছে এবং এর শিং-এ মানুষের আঙ্গুলের মত কিছু একটা রয়েছে।” (অনুদিত)। এই উক্তি থেকে পাচ্ছি :

  • (ক) দেশের রাজার নাম রুহমি, তিনি শক্তিমান ও যুদ্ধপ্রিয় রাজা। কেবল গজারোহী সৈন্যের সংখ্যাই তার অর্ধলক্ষ।
  • (খ) এখানে সুচিক্কণ মসলিন পাওয়া যায়। মসলিন ভারতের অন্যত্রও পাওয়া যেত, কিন্তু সেগুলো অত সূক্ষ্ম ছিল না।
  • (গ) এখানে কড়ির মুদ্রা চলে এবং aloe ও গণ্ডার পাওয়া যায়।

হুদুদুল আলমের বর্ণনার সঙ্গে এ বর্ণনা কতেকাংশে মেলে এবং তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হুদুদুল আলমে আছে :

  • (ক) দেশের রাজার নাম দহুম, তিনি শক্তিমান এবং তার ত্রিশ হাজার সৈন্য আছে।
  • (খ) এদেশে ভালো সুতা, চন্দন, হাতী ও সামুদ্রিক শঙ্খ সুলভ।

আল মাসুদীও বলেন : “রাহমা (Rahma) রাজ্য সমুদ্র ও মহাদেশ উভয় দিকেই বিস্তৃত। এটি কামান (Kaman) রাজ্য নামে একটি অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্র দ্বারা আবদ্ধ। রাজ্যের অধিবাসীরা ফর্সা এবং তাদের কান ছিদ্র করা হয়। তাদের হাতি, উট ও ঘোড়া আছে। উভয় লিঙ্গই সাধারণত সুদর্শন হয়। এই রাজ্যে Rahma রাজাদের টাইটেল, একই সাথে এটাই তাদের না।” এ বিষয়ে আল ইদ্রিসী ইরন খোর্দাদবেহ্‌র উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছেন : রাজারা সাধারণত বংশগত উপাধি বহন করে… ভারতের রাজাদের মধ্যে Balhara Jaba Tafir, Hazr, Abar, Dumi (Rahmi?) এবং Kamrun রয়েছে। এই নামগুলি কেবল সেই রাজপুত্ররা নেয় যারা প্রদেশ বা দেশের উপর রাজত্ব করেন, অন্য কারও সেই নাম নেবার অধিকার নেই, তবে যেই রাজত্ব করে সেই নামটি গ্রহণ করে।

এখানে ধারণাটা সত্য হলেও নাম ও বাচীর পার্থক্য নির্ণয়ে ত্রুটি ঘটেছে। তা হোক, কিন্তু সম্ভবত ‘রুহমি’ ‘রুহম’ ও ‘দুহম’ একই নামের বিকৃতি। এ বিষয়ে Hodivala-র অনুমান সমাধানের সহজ পন্থা নির্দেশ করে : ‘আমার কাছে মনে হয় যে, মাসুদি যে রাহমাকে (Rahma) রাজা ও তার রাজ্যের উপাধি বা নাম বলে অভিহিত করা হয়, তা এই সত্যদ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় যে, যে মূল লেখায় এই রাজ্যের বর্ণনা করা হয়েছে (যার কাছে সুলাইমান ও মাসুদি তাদের জ্ঞানের জন্য ঋণী ছিলেন), তা আসলে ছিল ‘মুল্ক-ই-দুহমা’ (‘Mulk-I-Duhma’), যার অর্থ হতে পারে, “ধর্মের রাজ্য”, আবার এও হতে পারে যে এটি, “ধর্মের রাজা”; এখানে ‘dal’-কে ‘re’ এবং ‘re’-কে ‘wav’ ধরা হয়েছে, ফলে শব্দটি ‘মুল্ক-ই-রুহম’ (‘Mulk-I-Ruhm’) বা ‘রুহ্‌মি’ (‘Ruhmi’) এর ‘রুহ্‌মি-রাজ্য’ (‘Ruhmi-kingdom’) হিসেবে ভুলভাবে পাঠ করা হয়।’ এদেশের রাজা ও রাজ্য সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অভাবেই সম্ভবত পূর্বসূরীর অনুসরণে আরব ভৌগোলিকরা গ্রন্থপরম্পরায় একই তথ্য পরিবেশন করেছেন। Jurz যদি গুর্জর হয় আর বলহার যদি রাষ্ট্রকুটরাজ বল্লভরাজ হন, তাহলে পালরাজশ্রেষ্ঠ ধর্মপালই উক্ত ‘দুহম’ বা রুহমি তথা ‘রহম’। কেননা, ধর্মপালের (৭৭০-৮১০) সঙ্গে এদেরই যুদ্ধ হওয়ার কথা।

উপরে পরিবেশিত তথ্যগুলো থেকে চট্টগ্রাম সম্বন্ধে যে-ধারণা পাই তা হচ্ছে এই –

  • ক. চট্টগ্রাম অঞ্চলে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও ভোট-চীনা লোকের বসতিই আদিম।
  • খ. খ্রিস্টোত্তর যুগে বিহার অঞ্চলের আর্য-সংস্কৃতিপুষ্ট লোকেরা এ এলাকায় উপনিবিষ্ট হয় এবং সে সূত্রে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, আর্য ভাষা ও সংস্কৃতি এখানে প্রচার লাভ করে। আর তা পর্বতের বাধা অতিক্রম করে পগাঁঁ ও পেগু (হংসবতী) অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে।
  • গ. খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের দিকে চট্টগ্রামে-আরাকালে বৌদ্ধপ্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে। এ শতকেই সম্ভবত কোনো চন্দ্রবংশীয় রাজা মহামুনি বুদ্ধপ্রতিমা নির্মাণ করান।
  • ঘ. এ অঞ্চল অন্তত ৬ষ্ঠ শতক অবধি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে সমতটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল।
  • ঙ. চট্টগ্রাম প্রাচীনকালে সীতাকুণ্ড ও বাড়ব পর্বতনিঃসৃত তপ্তজলধারা সমন্বিত অঞ্চল – উত্তর-পূর্ব ভারতে জ্বালনধারা নামে পরিচিত ছিল। এই জ্বালনধারাই কালক্রমে জ্বালন্ধর নামে খ্যাত হয়। তা-ই সম্ভবত প্রথম যুগের আরব বণিকদের মুখে সামন্দর হয়ে ওঠে।
  • চ. ধর্মপালের আমলে চট্টগ্রাম হয়তো স্বল্পকালের জন্য পালশাসনভুক্ত হয়।
  • ছ. উত্তরকালীন ‘চাটিগাঁও’ নামের উৎপত্তির অনেকগুলো অনুমিত উৎসের মধ্যে চিৎতৎ-পঙ্গ ও শাৎ-ই গাঙ—এ দুটো বেশি নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিসহ।
  • জ. সুপ্রাচীনকাল থেকেই সিন্ধু এবং গঙ্গা এ দুটোই সুপরিচিত প্রধান নদী। অন্যগুলো এ দুটোর শাখা-প্রশাখা রূপেই পরিগণিত। ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতে সিন্ধু এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে গঙ্গার উল্লেখই বেশি পাওয়া যায় বিদেশীর রচনায়। এজন্যে আমরা দেশী লোকেরা নদী নির্ণয়ে বিভ্রান্ত হই। চট্টগ্রামের পাশেই গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে পড়ত। এ উক্তি থেকে তিনটে ধারণা করা সম্ভব। এক সেকালের গঙ্গা বর্তমানে গতি পরিবর্তন করেছে। দুই মেঘনা বা পদ্মাকে গঙ্গা নামে অভিহিত করা হয়েছে। তিন মেঘনা বা পদ্মাও গতিপরিবর্তন করে চট্টগ্রাম থেকে দূরে সরে এসেছে।
  • ঝ. খ্রিস্টীয় ১০ম-১২শ শতকে চট্টগ্রাম সমতটের সঙ্গে প্রশাসনিক সূত্রে ঐক্যবদ্ধ হয়। অবশ্য সাময়িক বিযুক্তি যে ঘটেনি তা নয়। আর এর তিনদিকে পর্বত ও একদিকে সাগর-বেষ্টিত আরাকান ও চট্টগ্রাম একটি একক অঞ্চল ছিল বলে অনুমান করা চলে।
  • ঞ. চট্টগ্রামের সাথে কামরূপ ও প্রাগজ্যোতিষেরও একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক থেকে থাকতে পারে।

তিব্বতী সূত্রে জানা যায়, লামা তারানাথ চট্টগ্রাম পর্যটন করেননি। (JASB 1896, 21-23)। তিনি ভারতে ও তিব্বতে লোকমুখে শুনে কিংবা ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত কাহিনী ভিত্তি করে চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন। তবু এর মধ্যে কিছু সত্য নিহিত রয়েছে বলে মনে করা হয়। সিংহচন্দ্রের প্রপৌত্র বালচন্দ্রের পৌত্র বিমল চন্দ্রের পুত্র গোপীচন্দ্র বা গোপচন্দ্র চট্টগ্রামকেই শাসনকেন্দ্র করেন। তিনিই গোপীচাঁদ-ময়নামতী মানিকচাঁদ গীতিকার নায়ক। জ্বালন্ধরীপা বা হাড়িফা তারই মাতা ময়নামতীর গুরু। এ সময় চট্টগ্রামে তীর্থিক ও বৌদ্ধদের সমান প্রাধান্য ছিল। তাই বৌদ্ধবিহারে ও তীর্থিক মন্দিরে চট্টগ্রাম ছিল আকীর্ণ। তান্ত্রিক মহাযান মতই তখন চট্টগ্রামে চালু ছিল। পরবর্তীকালে বর্মী-আরাকানী প্রভাবে হীনযান মত প্রাধান্য লাভ করে, আরো পরে হীনযান প্রসূত থেরবাদ চট্টগ্রামী বৌদ্ধদের ধর্ম হয়ে ওঠে। (Hall প্ৰা. ১২৪-২)। এই সময় চট্টগ্রামে জ্বালনধারা ছিল। সম্ভবত সীতাকুণ্ড ও বাড়বকুণ্ডই এই জ্বালনধারা বা তপ্তজল ধারা। এ থেকে দুটো অনুমিত সিদ্ধান্তে আসা যায় –

  • এক. সিন্ধুদেশীয় বালপাদ জ্বালন্ধরে বাস করেছিলেন বলে জ্বালন্ধরীপা নামে পরিচিত হন;
  • দুই. জ্বালন্ধর ও সামন্দর (সাম অগ্নি+অন্দর <অন্তর < অভ্যন্তর) একার্থবোধক হলে আরব ভৌগোলিকদের সামন্দর চট্টগ্রামই।

এমনও অনুমিত হয় যে নালন্দাবিহারের গৌরব ও প্রভাব ম্লান হওয়ার কালে চট্টগ্রামই বৌদ্ধ ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানকার পণ্ডিতবিহারের খ্যাতিও ছিল আন্তর্জাতিক। এই বিহার আধুনিক সীতাকুণ্ড কিংবা চক্রশালায় ছিল বলে লোকশ্রুতি আছে। আদিনাথ-চন্দ্রনাথ শিবও মূলত বৌদ্ধ দেবতা – তা নামেই প্রকাশ। খ্রিস্টীয় ১০ম শতকের প্রখ্যাত তান্ত্রিক সিদ্ধ তিলযোগী চট্টগ্রামেরই সন্তান। মগধের প্রধান আচার্য নরতোপা চট্টগ্রামে গিয়ে তিলযোগীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের ছগল রাজা বিশেষ প্রতাপশালী ছিলেন। তার দাপট বাঙলা থেকে দিল্লী অবধি অনুভূত হত। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের লোক ছিলেন, কিন্তু তার বৌদ্ধ-পত্নীর প্রভাবে মগধে এবং বৌদ্ধগয়ায় ও নালন্দায় নানা সৎকর্ম করেন। বৌদ্ধপণ্ডিত সারিপুত্রের সাহায্যে তিনি বৌদ্ধগয়ায় বুদ্ধপূজা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। ছগল তারানাথের গ্রন্থ রচনার তিনশ বছর পূর্বে (১৪শ শতকের শেষপাদে) বর্তমান ছিলেন।

চট্টগ্রামের পণ্ডিত বর্ণরত্ন একটি ভিক্ষুদল নিয়ে তিব্বত পরিভ্রমণে গমন করেন। চট্টগ্রামের আর একজন রাজা ববলাসুন্দর খগেন্দ্রে অবস্থানরত সিদ্ধ শান্তিগুপ্তের কাছে চট্টগ্রামবাসী একদল পণ্ডিত পাঠিয়েছিলেন, এরা সেখান থেকে মন্ত্র-তন্ত্রের অনেক গ্রন্থ চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। ববলাসুন্দরের চার সন্তান ছিল: চন্দ্রবাহন, অতীতবাহন, বালবাহন ও সুন্দর হচি। এরা সবাই বৌদ্ধধর্মের প্রতিপোষক ছিলেন। চন্দ্ৰবাহন আরাকানে, অতীতবাহন চাকমাদেশে (পার্বত্য চট্টগ্রামে), বালবাহন বর্মায় এবং সুন্দর হচি আসাম-কাছাড়-ত্রিপুরায় রাজত্ব করেন। এ থেকে চটল-সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির আভাস মেলে। পণ্ডিতবিহার এবং তীর্থিকদের সঙ্গে বৌদ্ধভিক্ষুদের শাস্ত্রীয় বিতর্কের উল্লেখ থেকে বোঝা যাচ্ছে খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের চট্টগ্রাম বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ছিল।

বাংলার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের আদি ইতিহাস

চট্টগ্রামের আদি ইতিহাস বা প্রাক-মুসলিম ইতিহাস জানতে হলে একে দুই দিক থেকে দেখতে হবে, বাংলা থেকে আর আরাকান থেকে। কেননা কেবল চট্টগ্রামের আদি ইতিহাস রহস্যে ঘেরা। বাংলা দিয়েই শুরু করা যাক।

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে কিংবা শাসনাদি লিপিতে চট্টগ্রামের নাম মেলে না। কিন্তু Strabo-র বর্ণনা ও Periplus of the Erythrean Sea থেকেও বোঝা যায়, খ্রিস্টীয় ১ম শতকেও চট্টগ্রাম বন্দর ছিল। পাহাড়পুরে খলিফা হারুন-অর-রশীদের নামাঙ্কিত একটি মুদ্রা পাওয়া গেছে। এ মুদ্রাটি ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদীয়া টাকশালে তৈরি। (Dikhsit K N : Memories of the Archaeological Survey of India (MASI) P. 87, Coin no 55.)। আব্বাসীয় খলিফার আর একটি মুদ্রা পাওয়া গেছে ময়নামতীতে। ওটির কোনো বর্ণনা আজো প্রকাশিত হয়নি। আরব বণিকেরা চট্টগ্রাম হয়েই বঙ্গের অভ্যন্তরে বাণিজ্য করত, এ অনুমান অসঙ্গত নয়। কাজেই খ্রিস্টীয় ৮ম শতকেও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বন্দর ছিল।

৭৮৮-১০১৮ খ্রিস্টাব্দ আরাকানের বেসালি বা বৈশালি নগরে এক চন্দ্রবংশ রাজত্ব করেছেন। এ বংশের আদিপুরুষ মহাসিংহচন্দ্র (৭৮৮-৮১০) আর এর বংশধর চূড়সিংহ চন্দ্র (Chula Thing Chan dra) (৯৫১-৫৭) চট্টগ্রাম জয় করেন বলে কথিত। পাট্টিকের ও বৈসালির চন্দ্ররা জ্ঞাতি হওয়া অসম্ভব নয়। বিশেষ করে ধান্যবতীতে এদের পূর্বে রাজত্ব করতেন ‘চন্দ্রসূর্য’ বংশীয়রা (১৪৬-৭৮৮)। এরা যে ভারতিক ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রভাবিত অথবা ভারত থেকে আগত তাতে সন্দেহ নেই। (Harvey, প্রা. 637,369-70.)। সংস্কৃত ভাষায় প্রাপ্ত লিপি, শিব লাঞ্ছন ও ভারতীয় হরফ তার প্রমাণ। বিশেষত আরাকানের চন্দ্র রাজাদের মুদ্রা পাওয়া গেছে ময়নামতীতে। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের বাঙলায় প্রচলিত ব্রাহ্মীলিপিতে ও সংস্কৃত ভাষায় ম্রোহঙ-এর সিথাওঙ প্যাগোডার স্তম্ভে উৎকীর্ণ রাজা আনন্দচন্দ্রের লিপি থেকে চন্দ্রবংশীয় রাজাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এটি পূর্বতন রাজাদের প্রশস্তিমূলক রচনা। এতে ৬৫টি শ্লোক আছে। (BLSOAS XI, P. 357 385, JASB 1950, 233)। ত্রিপুররাজ ছেঙথুমও একবার চট্টগ্রাম জয় করেন।

খ্রিস্টীয় ৯ম শতকের হরিখেল মণ্ডলের বৌদ্ধরাজা কান্তিদেবের একটি তাম্র-শাসনের অসম্পূর্ণ খসড়া চট্টগ্রামের এক মন্দিরে পাওয়া গেছে। (এই শাসনটি ঢাকা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। HE, I, 29, 31.126, 134)। কান্তিদেবের রাজধানী ছিল বর্ধমানপুর। হরিখেল হুগলী থেকে যশোর, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চল ব্যাপী ছিল বলে অনুমিত হয়।

খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে হিউএনৎসাঙের পর্যটনকালে সমতট রাজ্য উত্তরে পুরোনো নিম্নব্রহ্মাপুত্রনন্দ, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পশ্চিমে পদ্মানদী অবধি বিস্তৃত ছিল। কুমিল্লা জেলার লোকশ্রুতি অনুসারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে লালমাই পাহাড়ের ধার ঘেঁষে সমুদ্র ছিল। যুগীদিয়া ও ভুলুয়া ছিল দ্বীপ। ফেনী অঞ্চল ছাড়া নোয়াখালির অন্যান্য অংশ ছিল সমুদ্রগর্ভে। সমুদ্রে চর জাগার পর তিতাস নদীরূপে দেখা দেয়, ব্রহ্মপুত্রের মূলধারা কুমিল্লার দিকে প্রবাহিত ছিল। এ নদী ধ্রুম (ভলুয়া) নামে পরিচিত গতিহারা ধ্রুম বা ‘ভলুয়া’ নদীর চিহ্ন এখনো বর্তমান। চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু শেঙ চি’র পরিভ্রমণকালে সমতটের রাজা ছিলেন রাজভট্ট। (ঐ 86-87 note.)

কানিংহামের মতে ‘সমতট’ গঙ্গার বদ্বীপ যশোর অঞ্চল, Fergusson ও Watters-এর মতে যথাক্রমে ঢাকা ও ফরিদপুর। কিন্তু হিউএনৎসাঙ-এর বর্ণনা অনুসারে চট্টগ্রামও সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা : এবং খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে সম্ভবত উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পশ্চিমে পুরাতন গঙ্গা বা পদ্মা (তথা আধুনিক মধুমতী নদী) বেষ্টিত ছিল এই সমতটরাজ্য। (JASB N.S XIX 375 Basak R G History of north Eastern India Calcutta, 1934 (HNI) p. 203)।

কোনো কোনো বিদ্বানের মতে খ্রিস্টীয় ৯ম শতকে এবং কারো কারো মতে খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের শেষে ও খ্রিষ্টীয় ৮ম শতকের শুরুতে খড়্গরা সমতটে রাজত্ব করতেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে সম্ভবত খড়্গরাই সমতটে শাসক ছিলেন। (বন্দোপাধ্যায়, রাখাল দাস : বাঙলার ইতিহাস ১ম, ২৩৩, Memoirs of the Asiatic Society of Bengal (MASB) I, no-6, 85. JASB, NSX 87, XIX, 378HNT 202.)। -Tsing-এর বর্ণনা মতে ৭ম শতকের শেষার্ধে ছাপ্পান্ন জন ভিক্ষুর ভারত ভ্রমণকালে শেঙচি সমতটে রাজভট্টকে রাজা দেখেছিলেন। অতএব, ৭ম শতকেই খড়্গরা রাজত্ব করতেন। (HB, I 87: HNI 207)। খড়্গ সাধারণ কুলবাচী নয়। প্রথম বৌদ্ধ রাজা নৃপাধিরাজ খড়্গোদ্যমের সন্তুতি হিসেবেই পিতৃনামাংশ গ্রহণ করেছেন পরবর্তী দুজন রাজা—জাতখড়্গ ও দেবখড়্গ। দেবখড়্গর পুত্রের নাম রাজভট্ট। এদের পরিচয় পাওয়া গেছে ঢাকার ত্রিশ মাইল উত্তরপূর্বস্থিত আশরফপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে ও কুমিল্লা থেকে এগারো মাইল দূরে দেউলবাড়িতে প্রাপ্ত সর্বাণীমূর্তিলিপি থেকে। (MASB I no 6. 86.91 HB I, 16 Epigraphia India (EI) XVIL 357)। খড়্গরাজাদের রাজধানী ছিল ‘কর্মন্ত বাসক’। এটি বিদ্বানদের মতে কুমিল্লা জেলার বড়কমতা। ডক্টর নলিনীকান্ত ভট্টশালী নিজে এ অঞ্চল পরিদর্শন করে এই মতই পোষণ করতেন। (JASB N S X 86-91)।

খড়্গদের পরেই সমতটে চন্দ্রবংশীয়রা রাজত্ব করেন। এদের রাজধানী ছিল প্রথমে পাট্টিকের ও পরে বিক্রমপুর। খ্রিস্টীয় ১০ম ও ১১শ শতকের প্রথমার্ধ অবধি সমতটে চন্দ্ররাজারা রাজত্ব করেন। চন্দ্র রাজারা আরাকানী রাজাদের জ্ঞাতি হলে, এসময় চট্টগ্রাম চন্দ্ররাজাদের অধিকারে ছিল বলে অনুমান করা সম্ভব। বিশেষ করে লামা তারানাথ বলেছেন গোপচন্দ্র চট্টগ্রামেই জ্বালনধারায় রাজত্ব করতেন এবং ৭ম শতকেও হিউএনৎসাঙ চট্টগ্রামকে সমতট রাজ্যভুক্ত দেখেছেন। চন্দ্ররাজাদের প্রথম রাজা পূর্ণচন্দ্রের রাজধানী ছিল রোহিতগিরি (লালমাই, কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত)। তার পুত্র সুবর্ণচন্দ্রও লালমাইতে রাজত্ব করতেন। সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র ত্রৈলোক্য চন্দ্ৰ (আনু. ৯০০-৯২৯ খ্রী.) শক্তিমান হয়ে চন্দ্রদ্বীপ অধিকার করেন। (HB. I, 130-31.)। এ সময় থেকে সমতটের চন্দ্ররাজারা বঙ্গেরও এক অংশের শাসক হন। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পুত্র শ্রীচন্দ্র দিগ্বিজয়ী ছিলেন, তিনি প্রাগজ্যোতিষপুররাজকে পরাজিত করেন আর গৌড়রাজ গোপালকে সিংহাসনে পুনর্বহাল করেছিলেন। রাজ্যসীমা বিস্তৃত হওয়ায় তিনি বিক্রমপুরকে রাজধানী করে রাজত্ব করতে থাকেন (আনু ৯২৯-৯৭৫ খ্রী.)। এর পর আসেন তাঁর পুত্র কল্যাণচন্দ্র (৯৭৫-১০০০) তাঁর পুত্র লহড়চন্দ্ৰ (১০০০-১০২০) এবং তার পুত্র গোবিন্দচন্দ্র (১০২০-১০৫০) রাজত্ব করেন। তিরুমালাই শিলালিপির প্রমাণে রাজা রাজেন্দ্রচোল ১০২১-২৩ খ্রিস্টাব্দে বাঙলার রাজা গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেন। মদনপুর, ঢাকা, ভাড়েলা ও পাইকপাড়ায় প্রাপ্ত যথাক্রমে শ্রীচন্দ্র, কল্যাণচন্দ্ৰ, লড়হচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্রের তাম্র ও মূর্তিলিপির আলোকে তিরুমালাইর শিলালিপি ভিত্তি করে চন্দ্ররাজাদের প্রায় নিশ্চিত আনুমানিক রাজত্বকাল নির্ণিত হয়েছে। গোবিন্দচন্দ্রের পরে সমতট পালরাজ্যভুক্ত হয় এবং মহীপাল (১০৮০-৮৪) বাঘাউরা শিলালিপির প্রমাণে সমতটেরও অধিপতি ছিলেন। সম্ভবত সমতটে পাল অধিকার স্বল্পস্থায়ী ছিল।

চন্দ্রদের পরে বর্মণরাই সমতটের শাসনভার প্রাপ্ত হন। (ঐ ২০০: El. XII 37)। এরা রাঢ় অঞ্চলের সিংগুর বা সিংজোর (সিংহপুর) নগরে রাজত্ব করতেন বলেই কোনো কোনো পণ্ডিতের মত। ডি সি গাঙ্গুলীর মতে সিংহপুরা পূর্ববঙ্গের কোথাও অবস্থিত এবং এটি বর্মণ রাজাদের শাসনকেন্দ্র ছিল। (JASB 1910, 604-HB. I, 30, 197, 198 note : Indian Historical Quarterly (IHQ) XII, 608-9.)। ভোজবর্মণের বেলাব (Belava) তাম্র শাসনের আলোকে অনুমান করা চলে যে বজ্রবর্মার পুত্র জাতবর্মণ এই রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা। (EI, XII 37: Majumdar, NG Inscriptions of Bengal IB, III, 14.)। তৃতীয় বিগ্রহপাল ও জাতবর্মণ কর্ণের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। কাজেই বিগ্রহপাল ও জাতবর্ষণ সমসাময়িক। জাতবর্মণ খ্রিস্টীয় ১১শ শতকের তৃতীয় পাদে রাজত্ব করতেন। জাতবর্মণের পরে তার পুত্র হরিবর্মণ এবং পৌত্র ভোজবর্মণ এবং তার পরে জাতবর্মণের অপর পুত্র সামল বর্মণ রাজা হন। এরপর সমতট সম্ভবত সেন-অধিকারভুক্ত হয়। সেনেরা ও বর্মণেরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের লোক ছিলেন। পালেরা ও চন্দ্ররা ছিলেন বৌদ্ধ। এক রণবঙ্কমলহরিখেলদেবও (১২০৪-২০) সমতটে স্বাধীন নরপতি ছিলেন। তার এক তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। এবং পাট্টিকের বৌদ্ধবিহারে ভূমিদানই এর বিষয়। (HB, I, 199, 268)।

বর্মণদের পরে সমতটে দেববংশীয়রাই সম্ভবত রাজত্ব করেন। পুরুষোত্তম দেবের পুত্র মধুমথনদেবই প্রথম রাজা। তার পুত্র বাসুদেব ও তার পুত্র দামোদরদেব ও তার পুত্র দশরথদেব। এ বংশের দামোদর দেবের (সিংহাসন আরোহণ ১২৩৯ খ্রী.) তাম্রশাসন মেহের (১২৪৩) ও চট্টগ্রামে (১২৪৩) পাওয়া গেছে। দশরথদেবের তাম্রশাসন পাওয়া গেছে আদাবাড়িতে। দশরথ বিক্রমপুর থেকে তার তাম্রশাসন প্রদান করেছেন, তাতে মনে হয় কেশব সেনাদি সেন-সামন্তদের রাজ্যও তিনি অধিকার করেছিলেন। দামোদর দেব অন্তত ১২৪৩ সন অবধি রাজত্ব করেন। মিনহাজ বলেছেন লক্ষ্মণ সেনের বংশধররা ১২৪৫ কিংবা ১২৬০ সন অবধি রাজত্ব করেন। (ঐ 253, IB, 182)। অতএর দশরথ দেব তার পরই বিক্রমপুর জয় করে থাকবেন।

মার্কো পোলো বলেছেন, খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকের শেষপাদে (১২৭১-৯৫) মিয়েন (Mien) ও বাঙলার সঙ্গে কুবলাই খাঁর সৈন্যের যুদ্ধ হয়। ১০৪৪-৭৪ খ্রিস্টাব্দে পগাঁঁরাজ অনরঠার রাজ্যের উত্তরপূর্ব সীমা ছিল পাট্টিকের। কাজেই চট্টগ্রাম তখন অনরঠার রাজ্যভুক্ত ছিল। এর বংশধর নরসিংহপতি (Narathihapatci) কুবলাই খানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধে বাঙলার রাজাও তার সহায়ক ছিলেন। সম্ভবত বাঙলারাজ তথা সমতটরাজ তখন হয়তো নরসিংহপতির সামন্ত ছিলেন। কাজেই মার্কো পোলোর প্রত্যক্ষ জ্ঞানজ উক্তি উড়িয়ে দেব মতো নয়।

কুমিল্লার কাছে প্রাপ্ত তাম্রশাসনের প্রমাণে বলা যায় ১৩শ শতকেও পাট্টিকের রাজ্য বর্তমান ছিল। (ঐ ২৫৭-২৫৮ Harvey: প্রা. ৬-৭, ৩০)। পাট্টিকের রাজকন্যা ও বর্মীরাজ অলংসিথুর বিয়ে ও সে-কন্যার নরথু কর্তৃক হত্যাকাহিনী বর্মা ও আরাকানে সামান্য ভিন্নভাবে প্রচলিত এবং সে-কাহিনী Burma Chronicle-এ ও সাহিত্যে বিধৃত।

এবারে সমতট ও হরিখেলমণ্ডলের বিভিন্ন রাজবংশের ইতিহাস একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক, কারণ চট্টগ্রামের আদি ইতিহাস জানতে হলে এই অঞ্চলগুলো সম্পর্কে একটু ধারণা রাখা দরকার। সবার আগে সমতট নিয়ে কিছু কথা বলে নেয়া যাক।

সমতট

এলাহাবাদে প্রাপ্ত সমুদ্রগুপ্তের স্তম্ভলিপিতেই প্রথম সমতটের উল্লেখ পাওয়া যায়। একে গুপ্ত সাম্রাজ্যের এক সীমান্তে করদরাজ্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গুপ্তযুগের শেষের দিকে মালবের যশোধর্মান বিক্রমাদিত্যের রাজসভার নবরত্নের অন্যতম বরাহমিহির (৫০৫-৫৮৭ খ্রি.) রচিত বিশ্বকোষ বৃহৎসংহিতায় সমতট ও বঙ্গকে পৃথক অঞ্চল বলে নির্দেশ করা হয়েছে। (বৃহৎ সংহিতা অধ্যায় ১৫, শ্লোক ৬-৮)। সেই সময় গুপ্ত সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছিল। পূর্ববঙ্গে সমতটে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর কয়েকজন স্বাধীন নরপতি রাজত্ব করেন। কোটালিপাড়ার পাঁচখানি ও বর্ধমানের একখানি তাম্রলিপি ও মুদ্রা থেকে তিনজন রাজার নাম পাওয়া যায়। এঁরা গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচার দেব। এঁরা ৬ষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে রাজত্ব করতেন। (HB 1,17, 51 note)। কানিংহামের (Cunningham) মতে সমতট গঙ্গার বদ্বীপ যশোর। ফার্গুসন (Ferguson) ও ওয়াল্টার্সের (Walters) মতে সমতট ছিল বর্তমান ফরিদপুর ও ঢাকা। (Watters ed: Yuan Chunag II. 188; JASB 1914, 86, HB I, 17, 47, 49, 51)। সমতটের আদি রাজধানী ছিল কারমান্তা, এটি কুমিল্লা জেলার আধুনিক (বর) কামতা গ্রামে ছিল। (JASB 1914, 86-87 note.) এখানে রাজধানীসুলভ নিদর্শনাদি এখনো বর্তমান। এক পাণ্ডুলিপিতে প্রাপ্ত লোকনাথের আলেখ্য পরিচিতিতে চাম্পিতলাকে কুমিল্লা জেলায় সমতটের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে।

আর হিউএন সাঙ ও ইৎসিঙ সমতট রাজ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে হিউএন সাঙ (ভারতে ভ্রমণকাল ৬৩০-৬৪৫ খ্রি.) সমতট রাজ্যকে কামরূপের দক্ষিণস্থ নিম্ন ও আর্দ্রভূমি বলে বর্ণনা করেছেন। এবং তাঁর মতে রাজ্যের আয়তন ৩০,০০০ লি (প্রায় ৭০০ মাইল( এবং রাজধানীর আয়তন ২০ লি (প্রায় ৪-২/৩ মাইল)। হিউএন সাঙ যখন সমতট পর্যটন করেন, তখন তিনি সেখানে ত্রিশটি সঙ্ঘারাম ও দু’হাজার ভিক্ষু দেখেছিলেন, এবং সেখানে জৈনাদি সর্বধর্মের লোকের বাস ছিল ও শতেক মন্দির শোভা পেত। হিউএন সাঙের মতে তার শিক্ষক নালন্দার অধ্যক্ষ শীলভদ্র সমতটের রাজকুমার ছিলেন। (ঐ, পৃ. ৮৫-৮৭।)

ইৎসিঙ (ভারতে ভ্রমণকাল ৬৭১-৬৯৫ খ্রি.) তাঁর পর্যটনকালে রাজভট্টকে সমতটের রাজা দেখেছিলেন। ইৎসিঙের সহচারী শেঙচি-ও রাজা রাজভট্টের নাম করেছেন। ইৎসিঙ বলেন, রাজভট্ট বৌদ্ধ ছিলেন। নারায়ণগঞ্জে আশরফপুরে প্রাপ্ত তাম্রলিপিদ্বয় এঁরই পিতা দেব খড়্গের, অর্থাৎ এই রাজভট্ট খড়্গ-বংশীয় রাজা দেবখড়্গের পুত্র। কুমিল্লায় প্রাপ্ত সর্বাণীমূর্তি লিপিতে এঁর পূর্ব রাজাদের নাম আছে। দেবখড়্গ জাতখড়্গ আর জাতখড়্গ খড়েগাদ্মমের পুত্র। রাজভট্ট যদি ৭ম শতকের শেষপাদে রাজত্ব করে থাকেন তাহলে খড়েগাদ্মম ৬ষ্ঠ শতকের শেষপাদে সমতটের রাজা ছিলেন। (JASB (NS), XIX 378; HE I, 60, 85-56)। ইৎসিঙ দেববমের (দেব খড়্গ?) রাজ্যে শ্রীগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত চীনা-চৈত্য দেখেছিলেন। হিউএন সাঙের মতে মতে শীলভদ্র ও কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণ ব্রাহ্মণ ছিলেন। ডক্টর ভট্টশালী বলেছেন, বর্মণ যদি ব্রাহ্মণের কুলবাচী হয়, তাহলে খড়্গেরও ব্রাহ্মণ হতে বাধা নেই এবং খড়্গ সন্তানের রাজভট্ট নামও এ অনুমানের পরিপূরক। নারায়ণগঞ্জে আশরফপুরে প্রাপ্ত তাম্রলিপিদ্বয় নির্দেশ করছে, খড়্গদের আমলে সমতটরাজ্য নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সমতট শশাঙ্কের সময়ও স্বাধীন ছিল বলতে হয়, কেননা, হিউএন সাঙ (৬৩৮ খ্রী.) শীলভদ্রকে সমতটের রাজবংশীয় বলেছেন।

নানা জায়গায় প্রাপ্ত তাম্রপত্র ও মূর্তিলিপির প্রমাণে ও বিদ্বানদের বিশ্লেষণে সমতটের চন্দ্ররাজাদের একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ নাম তালিকা ও রাজত্বের প্রায় নিশ্চিত সময়কাল নির্ণিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে, বাড়েলা মূর্তিলিপি: EI XVII 149, (১৮শ রাজ্যাঙ্কে প্রদত্ত), রামপাল তাম্রশাসন শ্রীচন্দ্ৰ (ibid, XII, 136-42), কেদারপুর তাম্রশাসন: (ঐ) (ibid XVII 188-92), ধুলিয়া তাম্ৰশাসন ((ঐ), IB, ১৬৫-৬৬); ইদিলপুর তাম্রশাসন (El; XVII 189-90, IB পৃ ১৬৬-৬৭); বাঘাউরা মূর্তিলিপি (EL : XVII, 353-55); নারায়ণপুর মূর্তিলিপি (Indian culture IX 111-15), ময়নামতীতে প্রাপ্ত লড়হচন্দ্রের ২৩ ও ২৪ রাজ্যাঙ্কে মুদ্রিত দুইটি তাম্র শাসন; পাইকপাড়ায় প্রাপ্ত গোবিন্দচন্দ্রের এবং ঢাকায় দোকানে প্রাপ্ত কল্যাণচন্দ্রের তাম্রশাসন (ভারতবর্ষ ১৩88. IHQ XVI, 255)। মনে হয়, গোপচন্দ্র, সমাচারদেব এবং আদিত্য, দক্ষিণ বা নিম্নবঙ্গে তথা হরিখেল মণ্ডলে রাজত্ব করতেন, আর খড়্গরা করতেন সমতটে। সম্ভবত খড়্গদের পতনের পরে সমতট আরাকানের চন্দ্ররাজাদের অধিকারে আসে। আরাকানীসূত্রে দেখা যায়, বৈশালী নগরের চন্দ্ররা ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যচ্যুত হয় এবং উত্তর আরাকান সম্ভবত মহাবীর ও তাঁর পরবর্তী রাজাদের দখলে থাকে এবং সমতট অঞ্চলে হয় বিতাড়িত চন্দ্ররা অথবা তাদের জ্ঞাতি সামন্ত-শাসক বংশীয়রা প্রায় দেড়শ বছর অবধি রাজত্ব করতে থাকেন। বাঙলায় প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণাদির সাহায্যে তাদের রাজপরম্পরার একটি তালিকা দেয়া হল :

১. পূর্ণচন্দ্ৰ – ৭৮৮-৮২৮ সাল, রাজধানী পাট্টিকের
২. সুবর্ণচন্দ্ৰ – ৮২৮-৮৬৮ সাল, রাজধানী একই
৩. ত্রৈলোক্যচন্দ্ৰ – ৮৬৮-৯০৮ বা আ. ৯০৫-৩০ সাল, হরিখেল মণ্ডলপতি, কান্তিদেব এঁর আশ্রিত ছিলেন
৪. শ্রীচন্দ্ৰ – ৯০৮-৯৪৮ বা ৯৩০-৭৫ সাল, দিগ্বিজয়ী, রাজ্যসীমা বিস্তৃত করেন, দ্বিতীয় গোপাল তাঁর হাতে পরাজিত হন
৫. কল্যাণচন্দ্র – ৯৪৮-৯৮৩ বা ৯৭৫-১০০০ সাল, বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করেন
৬. লড়হচন্দ্ৰ – ৯৮৩-১০০৮ বা ১০০০-২০ সাল
৭. গোবিন্দচন্দ্ৰ – ১০০৮-১০৩৮ বা ১০২০-৫৫ সাল, ইনি চোলরাজ রাজেন্দ্র কর্তৃক ১০২১-২৩ সালে পরাজিত হন
৮. আত্মীয় ললিতচন্দ্ৰ – ১০৩৮-১০৭০ বা ১০৫৫-৭০ সাল

বৈদ্যকশাস্ত্র গ্রন্থ বৃক্ষায়ুর্বেদ, লৌহসর্বস্ব (লৌহ পদ্ধতি) ও শব্দপ্রদীপ লেখক এবং রাজা ভীমপালের চিকিৎসক সুরেশ্বর বা সুরপালের পিতা ভদ্রেশ্বর রাজা রামপালের (১০৭৭–১১২০) এবং তার পিতামহ ‘দেবগণ’ গোবিন্দচন্দ্রের চিকিৎসক ছিলেন। এই ভিত্তিতে গোবিন্দ চন্দ্রের রাজত্বকাল ১০৫০ খ্রিস্টাব্দ অবধি অনুমান করা সম্ভব। সম্ভবত রাজা দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭০-৭৫) চন্দ্রদের সমতট রাজ্যের অধিকাংশ জয় করেন। এঁর বাঘাড়াউড় মূর্তিলিপিই সমতট অঞ্চলে পাল প্রভাবের প্রথম সাক্ষ্য বহন করে। (HBI পৃ ১৩৭, বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, পৌষ-চৈত্র ১৩৬৭ : Indian culture, VII 812.) পূর্ণচন্দ্রাদির আমলে বৃক্ষচন্দ্ৰাদিই হয়তো চট্টগ্রামের সামস্ত শাসক ছিলেন।

দেব বংশ

দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় তথা সমতট ও হরিখেল বা কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলে ৮ম শতাব্দীতে দেব বংশের উদ্ভব হয়। তাঁদের উদ্ভবের পূর্বে এই স্থানে খড়্গ রাজবংশ শাসন করত বলে জানা যায়। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, দেবপর্বত কুমিল্লার নিকটবর্তী ময়নামতি পাহাড়ের দক্ষিণাংশে অবস্থিত ছিল এবং সম্ভবত এটিই ছিল দেববংশের রাজধানী। আনন্দদেব ও ভবদেবের শালবন বিহার তাম্রশাসন, ভবদেবের আনন্দবিহার তাম্রশাসন, শালবন বিহারে প্রাপ্ত ভবদেবের নামাঙ্কিত মৃৎ-সীল, শালবন বিহারে প্রাপ্ত আনন্দদেবের স্বর্ণমুদ্রা ও শালবন বিহারে প্রাপ্ত অন্য তিনটি তাম্রশাসন থেকে এই বংশের ইতিহাস সংগ্রহ করা হয়। এই উৎসগুলোর আলোকে দেববংশের ইতিহাস সম্পর্কে ইতিহাস পুনর্গঠন করা কিছুটা সম্ভব হলেও তা যথেষ্ট নয়। তাম্রশাসনে বেশ কিছু স্থানের নাম পাওয়া যায়, যা থেকে রমেশচন্দ্র ধারণা করেন যে, তাঁরা সমতটে রাজত্ব করতেন। এখান থেকে এই বংশের মোট চারজন রাজার নাম জানা যায়, যারা ক্রমান্বয়ে শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব, ও ভবদেব। প্রথমোক্ত দু’জন রাজা সম্পর্কে তেমন জানা যায় নি। চারজন রাজার ক্ষেত্রেই যা প্রযোজ্য তা হচ্ছে তাঁরা সকলেই ধর্মের দিক থেকে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন ও সকলেই পরমসৌগত, পরমভট্টারক, পরমেশ্বর এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করেছিলেন। তাঁরা সকলে স্বাধীন রাজা ছিলেন বলেই মনে করা হয়। দেব বংশের প্রথম রাজা ছিলেন শান্তিদেব। দ্বিতীয় রাজা ছিলেন শান্তিদেবের পুত্র বীরদেব।

রাজা আনন্দদেব ছিলেন বীরদেব ও রাণী সোমাদেবীর পুত্র ও দেববংশের তৃতীয় রাজা। তাঁকে এ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা হিসেবেও গণ্য করা যায়, যিনি অন্তত ৩৯ বছর রাজত্ব করেছিলেন। অন্যান্য উপাধি ছাড়া তাঁর বিশেষ উপাধি ছিল বঙ্গালমৃগাঙ্ক, যা তিনি তাঁর লিপি ও মুদ্রায় উৎকীর্ণ করতেন, আর এখান থেকে ধারণা করা যায় যে, বঙ্গ বা বাংলা তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল, আর তাই তিনি একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন। বাকপতিরাজের গৌড়বহ গ্রন্থ থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, এ সময়ে কনৌজরাজ যশোবর্মণ গৌড়-মগধের রাজাকে হত্যা করে পূর্বদিকে অগ্রসর হন এবং বঙ্গরাজকে পরাজিত করেন। আনন্দদেবও অন্যত্র স্বীকার করেন যে, তিনি একজন বহিঃশত্রু কর্তৃক পরাজিত হয়েছিলেন। আর আনন্দদেব ও যশোবর্মণ সমসাময়িক ছিলেন। তাই সম্ভবত যশোবর্মণের আক্রমণে তিনি রাজধানী দেবপর্বত পরিত্যাগ করে বসন্ত পুরে চলে যান ও সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। তবে তাঁর রাজ্যচ্যুতির কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। সম্ভবত তিনি কৌশলগত কারণে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন বা শত্রুর মোকাবেলায় অতি দ্রুতই তিনি বিজয় লাভ করেন এবং দেবপর্বত নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। আনন্দদেব তাঁর জারিকৃত একটি তাম্রশাসনে মৃগবনশীল শব্দ সংযুক্ত করেছিলেন, নামটি সারনাথের মৃগবনে গৌতমবুদ্ধ যে প্রথম ধর্ম প্রচার করেন তার স্মারকচিহ্ন। আনন্দদেব কুমিল্লার ময়নামতিতে জনশ্রুত একটি নাম। লালমাই পাহাড়, ময়নামতি আনন্দ বিহার এর পার্শ্বস্থ দিঘিটি তার স্মৃতিবিজড়িত। পণ্ডিত হারুনুর রশীদ সহ অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, আনন্দদেবই উক্ত আনন্দবিহারটি নির্মাণ করেছিলেন এবং সেই দিঘিটিও তিনিই খনন করেছিলেন। ময়নামতিতে খননকৃত বিহারগুলোর মধ্যে আনন্দবিহারই সর্ববৃহৎ, যার দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ ছিল ১৯৮ মিটার করে অর্থাৎ বর্গাকৃতিসম্পন্ন। এ বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরটি একটি ক্রুশাকৃতির স্থাপত্য।

বংশের চতুর্থ রাজা ও আনন্দদেবের পুত্র ছিলেন ভবদেব, যিনি আনন্দদেবের মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন। অন্যান্য অভিধা ছাড়াও তিনি বিশেষ অভিধা হিসেবে অভিনবমৃগাঙ্ক উপাধি ধারণ করেন। বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তিনি বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের নামে বিহারিকা নির্মাণের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং সেই মর্মে ভূমি দান করেছিলেন। ভেণ্ডামতি বিহারিকা নির্মাণেও তিনি ভূমি দান করেছিলেন। এ ভেণ্ডামতি বিহারিকাটির অবস্থান ময়নামতির রূপবান সূরায়। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ববিদ এম এইচ রশিদ এ স্থানে আবিষ্কৃত এ বিহারিকাটি শনাক্ত করেন। শালবন বিহার নামে সমধিক খ্যাত বিহারটি ভবদেব নির্মাণ করেছিলেন। এটি ভবদেব মহাবিহার নামে প্রথমে খ্যাত থাকলেও পরবর্তীতে শালবন মহাবিহার নামে সমধিক পরিচিতি অর্জন করে। ভবদেব এটি নিজ নামে নামকরণ করেছিলেন বলে জানা যায়। এটি ময়নামতির দ্বিতীয় বৃহত্তম বিহার। এ বিহারে ১১৫টি ভিক্ষু-কক্ষ ছিল। পূর্বে তাঁর নির্মিত শালবন বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরটি একটি কুশাকৃতির স্থাপনা ছিল। একটি গ্রিক ক্রমের কেন্দ্রে অবস্থিত পূর্ণগর্ভ স্তূপের মুখ্য চারদিকেই একটি করে বহির্মুখী মণ্ডপযুক্ত গর্ভগৃহের সমন্বয়ে এ মন্দির স্থাপনাটি নির্মিত ছিল। এ মন্দিরগাত্রের পোড়ামাটির ফলকগুলোতে শোভিত ছিল আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতি।

ময়নামতি-দেবপর্বতের দেববংশ বাংলার অন্যতম একটি রাজবংশ। বাংলার রাজবংশদের ইতিহাসে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। দেববংশের রাজাগণ যেভাবে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তাতে এ ধর্মের সংস্কৃতি ও সভ্যতা অনেকাংশে রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেছিল। তাঁদের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী বাংলার চন্দ্র ও পাল রাজগণ তাঁদেরই অনুসরণ করে গেছেন। রাজা আনন্দদেবের আনন্দ বিহার এবং রাজা ভবদেবের শালবন বিহারের ক্রুশাকৃতির মন্দির স্থাপত্য বরেন্দ্র ও মগধের স্থাপত্য শিল্পকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। বলা যায়, দেব রাজবংশের আমলে বাঙালির সাফল্য ও উদ্ভাবনী প্রতিভা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাকে সোনার বাংলায় পরিণত করেছিল। ঐতিহাসিক এম. এইচ. রশিদ দেব আমলকে বাংলার স্বর্ণযুগ হিসেবে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

হরিখেল রাজবংশ

চট্টগ্রামে কান্তিদেব নামে একটি তাম্রশাসন থেকে জানা গেছে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় দেব বংশ ছাড়াও আরো একটি রাজবংশ ছিল। এছাড়া গৌরিশ্বর ভট্টাচার্য লিখিত একটি প্রবন্ধ ‘Essays on Buddhist Hindu, Jaina Iconography & Epigraphy Dhaka :ICSBA’ এবং সুনীতিভূষণ কানুনগো রচিত ‘প্রাচীন হরিখেল রাজ্যের অবস্থান’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ৮ম শতকে দেবরাজগণের পরে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় হরিখেল রাজ্যের উদ্ভব ও বিস্তার হয়। হরিখেল রাজ্যের তিনজন রাজার নাম জানা যায় – দেবাতিদের (৮ম শতক), কান্তিদেব (৯ম শতক), ও আত্তারকর দেব (আনু. ১০ম শতক)।

দেবাতিদেব (৮ম শতক, আনু. ৭১৫ খ্রি. – ?) ছিলেন খস অনার্য জাতিসত্তার পরিচয়ধারী মানুষ। তিনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, ধার্মিক ও ন্যায়নিষ্ঠ, দানশীল ছিলেন। হরিকত ধর্মসভা বিহারে তিনি ভূমি দান করেছিলেন। গৌরিশ্বর ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন ৮ম শতকে তিনি তিনি হরিখেল রাজ্য তথা চট্টগ্রাম অঞ্চল শাসন করতেন। তার সম্পর্কে সামান্য কিছু জানা গেলেও তাঁর আগের ও পরের কোন রাজা সম্পর্কে জানা যায় নি। তিনি ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন কি না তা স্পষ্ট নয়। তাঁর প্রায় শতাধিক বছর পরের একই বংশের রাজা হিসেবে কান্তিদেবকে মনে করা হয়।

তাম্রশাসনে কান্তিদেব (৯ম শতকের প্রথম পাদ) নামক একজন রাজার নাম উল্লেখ পাওয়া যায়, যার পিতার নাম ধনদত্ত এবং পিতামহের নাম ভদ্রদত্ত। ভদ্রদত্ত বুদ্ধের উপাসক ছিলেন এবং তিনি বহু যুদ্ধে বিজয়ের নায়ক ছিলেন। ভদ্রদত্তের পুত্র ধনদত্ত কোন এক শক্তিশালী রাজার কন্যা বিন্দুরতিকে বিয়ে করেন, যাদের সন্তান হিসেবে কান্তিদেবের জন্ম হয়। ধারণা করা হয় যে, কান্তিদেব হয় মাতামহের উত্তরাধিকার ছিলেন নয়তো নিজেই তিনি রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তার উপাধি ছিল পরমসৌগত, পরমেশ্বর, মহারাজাধিরাজ, অর্থাৎ তিনি স্বাধীন-স্বার্বভৌম রাজা ছিলেন। তিনি ৯ম শতকের প্রথম পাদে রাজত্ব করতেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, তাঁর রাজত্বের প্রধান নগরী ছিল বর্ধমানপুরী, যা রাজ্যটির রাজধানী ছিল। তাঁর রাজত্বকালে তাঁর রাজ্য কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তা নিয়ে অনেক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, কারণ এ সময়ের হরিখেলের সীমানা সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় নি। চীনা পরিব্রাজক ইৎসিঙ বলেছেন, হরিখেল ছিল পূর্ব ভারতের প্রান্ত সীমায়। কেউ কেউ বলেন, তাঁর রাজ্য শ্রীহট্ট বা সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কেউ কেউ মনে করেন, শ্রীহট্ট এবং হরিখেল অভিন্ন। কোন কোন চীনা লেখক সমতট ও উড়িষ্যার মধ্যবর্তী অঞ্চলকে হরিখেল বলে বর্ণনা করেছেন। কান্তিদেবকে অনেক ঐতিহাসিক এ বংশের প্রথম রাজা হিসেবে মনে করে থাকেন। তিনি হরিখেল রাজবংশের শাসক ছিলেন না দেববংশের শাসক ছিলেন তা নিয়েও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না।

১০ম শতকে হরিখেলে রাজা আত্তারকরদেব (১০ম শতক) রাজত্ব করতেন। তিনি রাজাধিরাজ এবং সমরমৃগাঙ্ক উপাধি ধারণ করেছিলেন। তিনিও স্বাধীন-সার্বভৌম রাজা ছিলেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তিনি একটি বৌদ্ধ ছোট মঠ নির্মাণের জন্য ভূমিদান করেন। বর্ধমানপুর তাঁর রাজধানী ছিল, তবে এর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের সঙ্গে এ বর্ধমানপুর অভিন্ন বলে মনে করা যায় না। সুনীতিভূষণ কানুনগোর মতে, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বড়-উথন গ্রামই হচ্ছে প্রাচীন বর্ধমানপুর। কোন কোন ঐতিহাসিক একে যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচনা করেছেন।

প্রাচীন বাংলায় একেক সময়ে একেক রাজ্য বৃহৎ পরিসরের অধিকারী হয়ে উঠত, আবার কখনো কখনো তা আবার ছোট হয়ে যেত। শক্তিশালী রাজার আমলে এ ধরনের রাজ্য বড় হবার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। হরিখেল রাজ্য এক সময়ে বঙ্গ-সমতট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ড. আবদুল মমিন চৌধুরীর মতে, হরিখেল রাজ্যের রাজাগণের পর দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে শক্তিশালী চন্দ্র রাজবংশের রাজত্ব সূচিত হয়।

চন্দ্র বংশ

চন্দ্রবংশের উৎপত্তি : ৯ম শতাব্দীর শেষার্ধে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্রবংশ প্রতিষ্ঠিত হয় ও প্রায় দু’শ বছর পর্যন্ত এ বংশ রাজত্ব করে। যতটুকু জানা যায়, চন্দ্রবংশীয় রাজারা সকলেই এই অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। এ বংশের রাজাদের তালিকা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত লেখ হতে সংগ্রহ করা হয়েছে বলে পূর্ববঙ্গেরই কোন এক স্থানে চন্দ্রবংশের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস অবস্থিত ছিল বলা যায়, যা কুমিল্লার লালমাই অঞ্চল কিংবা নিকটবর্তী অন্য কোন অঞ্চল হতে পারে। এ সময়ে রোহিতাগিরি একটি ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। চন্দ্রবংশের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পূর্ণচন্দ্র। অনেক ঐতিহাসিক তাঁকেই স্বাধীন-সার্বভৌম নৃপতি হিসেবে উল্লেখ করলেও তার স্বাধীন হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়, কেউ কেউ তাঁকে এবং তাঁর পুত্র সুবর্ণচন্দ্রকে রোহিতাগিরির ভূস্বামী ধরে ত্রৈলোক্যচন্দ্রকেই চন্দ্রবংশের প্রথম স্বাধীন-সার্বভৌম শাসক বলে মনে করেন। পূর্ব ও মুল চন্দ্রবংশের প্রথম দুই রাজা পূর্ণচন্দ্র ও সুবর্ণচন্দ্র সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য জানা যায় নি। পূর্ণচন্দ্ৰ ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁর পরে রোহিতাগিরির শাসক হন তাঁরই পুত্র সুবর্ণচন্দ্র। পিতার মতো তাঁর রাজ্যও রোহিতাগিরিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। রামপালে প্রাপ্ত লেখ অনুসারে তিনি পিতৃধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। চন্দ্রবংশের পরবর্তী শাসকগণ সকলেই বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন বলে জানা যায়। পূর্ণচন্দ্র এবং সুবর্ণচন্দ্রের রাজত্বকাল এবং তাঁদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তেমন কোন কিছুই জানা যায় নি।এই বংশের রাজারা হলেন ক্রমান্বয়ে পূর্ণচন্দ্ৰ, সুবর্ণচন্দ্ৰ, ত্রৈলোক্যচন্দ্ৰ (আ. ৯০৫-৩০ খ্রি.), শ্রীচন্দ্ৰ (আ. ৯৩০-৭৫ খ্রি.), কল্যাণচন্দ্ৰ (আ. ৯৭৫-১০০০ খ্রি.), লড়হচন্দ্ৰ (আ. ১০০০-২০ খ্রি.) ও গোবিন্দচন্দ্ৰ (আ. ১০২০-৫৫ খ্রি.)।

ত্রৈলোক্যচন্দ্র (৯০৫-৯৩০ খ্রি.) : ক্রমে রোহিতাগিরির ভূস্বামী পিতা সুবর্ণচন্দ্র এবং পিতামহ পূর্ণচন্দ্রের অবস্থার উন্নতি হতে থাকলে ও হরিখেল রাজগণের অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকলে ত্রৈলোক্যচন্দ্রের নিজস্ব শক্তিমত্তা ও বুদ্ধিমত্তার জোরে নিজের অবস্থানকে উন্নততর পর্যায়ে উপনীত করতে সক্ষম হন ও স্বীয় সামরিক শক্তি এবং প্রজা দ্বারা রোহিতাগিরি রাজ্যকে একটি শক্তিশালী ও বৃহৎ রাজ্যে পরিণত করতে সক্ষম হন, আর এর মাধ্যমেই তিনি চন্দ্রবংশের স্বাধীন সার্বভৌম শাসক হয়ে ওঠেন। পুত্র শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে তাকে চন্দ্রদ্বীপের (বরিশালের) অধিপতি এবং হরিখেল রাজলক্ষ্মীর আধার বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, চন্দ্রদ্বীপের রাজা হিসেবে তাঁর প্রতিপত্তি এতই বেড়ে যায় যে, তিনি হরিখেল রাজ্যেরও ক্ষমতার আধারস্বরূপ হয়ে উঠেন, যা থেকে ধারণা করা যায় যে, তিনি হরিখেল রাজ্য জয় করেছিলেন, অথবা হরিখেল রাজ্য রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের অধীনে শাসিত হয়েছে। সব মিলে তিনি এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে একজন স্বাধীন নৃপতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি প্রথমে চন্দ্রদ্বীপে স্বাধীন হন ও তারপর বঙ্গ অঞ্চল জয় করেন। শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন অনুসারে, তিনি সমতট জয় করেছিলেন। সিলেটের তাম্রশাসনেও তার সমতট ও বঙ্গ জয়ের উল্লেখ আছে। এ সময় কম্বোজ জাতির আক্রমণে গৌড় থেকে বহু লোক বিতাড়িত হয়ে বঙ্গের রাজধানী ক্ষিরদা নদীর তীরস্থ দেব পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ত্রৈলোক্যচন্দ্র রাজ্যজয় ও সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে তৎকালীন পাল রাজা কিংবা কাম্বোজদের সাথে তাঁকে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়েছিল কি না সে সম্পর্কে কোন উল্লেখ পাওয়া যায় নি। তবে দেব পর্বতে আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষদের মুখে মুখে ত্রৈলোক্যচন্দ্রের সেনাবাহিনী কাম্বোজদের অনেক উদ্ভট কর্মকাণ্ডের বিবরণী শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাবার কথা জানা যায়। লড়হচন্দ্রের (আ. ১০০০-২০ খ্রি.) ময়নামতি তাম্রশাসন অনুসারে, ত্রৈলোক্যচন্দ্রের শাসনকালে বঙ্গ খুবই উন্নত অঞ্চল ছিল। শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে বর্ণিত ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক আর জি. বসাক এবং এন. জি. মজুমদার পরস্পর বিপরীত মতো ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ত্রৈলোক্যচন্দ্র চন্দ্রদ্বীপ ও হরিখেল রাজ্য জয় করে পিতৃরাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করেন এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন।

৮ম শতকে দেবরাজগণের পরে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় হরিখেল রাজ্যের উদ্ভব ও বিস্তার হয়, যার রাজাদের হরিখেল রাজবংশের রাজা বলে মনে করা হয়। এই বংশের দেবাতিদেব (৮ম শতক, আনু. ৭১৫ খ্রি. – ?) ছিলেন খস অনার্য জাতিসত্তার পরিচয়ধারী মানুষ। তিনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, ধার্মিক ও ন্যায়নিষ্ঠ, দানশীল ছিলেন। হরিকত ধর্মসভা বিহারে তিনি ভূমি দান করেছিলেন। গৌরিশ্বর ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন ৮ম শতকে তিনি তিনি হরিখেল রাজ্য তথা চট্টগ্রাম অঞ্চল শাসন করতেন। তার সম্পর্কে সামান্য কিছু জানা গেলেও তাঁর আগের ও পরের কোন রাজা সম্পর্কে জানা যায় নি। তিনি ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন কি না তা স্পষ্ট নয়। কান্তিদেবকে তাঁর প্রায় শতাধিক বছর পরের একই বংশের রাজা হিসেবে মনে করা হয়। তাম্রশাসনে কান্তিদেব (৯ম শতকের প্রথম পাদ) নামক একজন রাজার নাম উল্লেখ পাওয়া যায়, যার পিতার নাম ধনদত্ত এবং পিতামহের নাম ভদ্রদত্ত। ধারণা করা হয় যে, কান্তিদেব হয় মাতামহের উত্তরাধিকার ছিলেন নয়তো নিজেই তিনি রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তার উপাধি ছিল পরমসৌগত, পরমেশ্বর, মহারাজাধিরাজ, অর্থাৎ তিনি স্বাধীন-স্বার্বভৌম রাজা ছিলেন। তিনি ৯ম শতকের প্রথম পাদে রাজত্ব করতেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, তাঁর রাজত্বের প্রধান নগরী ছিল বর্ধমানপুরী, যা রাজ্যটির রাজধানী ছিল। তাঁর রাজত্বকালে তাঁর রাজ্য কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তা নিয়ে অনেক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, কারণ এ সময়ের হরিখেলের সীমানা সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় নি। চীনা পরিব্রাজক ইৎসিঙ বলেছেন, হরিখেল ছিল পূর্ব ভারতের প্রান্ত সীমায়। কেউ কেউ বলেন, তাঁর রাজ্য শ্রীহট্ট বা সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কেউ কেউ মনে করেন, শ্রীহট্ট এবং হরিখেল অভিন্ন। কোন কোন চীনা লেখক সমতট ও উড়িষ্যার মধ্যবর্তী অঞ্চলকে হরিখেল বলে বর্ণনা করেছেন। কান্তিদেবকে অনেক ঐতিহাসিক এ বংশের প্রথম রাজা হিসেবে মনে করে থাকেন। তিনি হরিখেল রাজবংশের শাসক ছিলেন না দেববংশের শাসক ছিলেন তা নিয়েও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। উল্লেখ করা যেতে পারে, হরিখেল বংশীয় রাজা কান্তিদেবের পরে তাঁর রাজ্য চন্দ্রবংশীয় রাজাদের হস্তগত হয় এবং এর কৃতিত্ব ত্রৈলোক্যচন্দ্রেরই বলা যায়।

আবদুল মমিন চৌধুরীর মতে, ত্রৈলোক্যচন্দ্রের ক্ষমতার উৎস ছিল দেবপর্বত। দেবপর্বতের অধিবাসীদের নিয়েই তিনি সমতট অধিকার করেছিলেন। উপর্যুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে জানা যায় যে, ত্রৈলোক্যচন্দ্র বঙ্গ, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্র আনুমানিক পঁচিশ অথবা ত্রিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের রাণীর নাম কাঞ্চিকা দেবী বা কাঞ্চনা, যার গর্ভে তার পুত্র শ্রীচন্দ্রের জন্ম হয়। চন্দ্রবংশের স্বাধীন শাসক হিসেবে ত্রৈলোক্যচন্দ্র বঙ্গ সমতটের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

শ্রীচন্দ্ৰ (৯৩০-৯৭৫ খ্রি.) : চন্দ্রবংশের প্রথম স্বাধীন শাসক এবং বলা যায় প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের (আ. ৯০০-৩০ খ্রি.) মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ও চন্দ্রবংশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রশংসনীয় শাসক শ্রীচন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর স্ত্রী বসুমতি। শ্রীচন্দ্র অনেক যুদ্ধবিগ্রহে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং পিতা কর্তৃক প্রাপ্ত সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে তিনি যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর আমলে চন্দ্র সাম্রাজ্য প্রতিপত্তি ও উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল এতে সন্দেহ নেই। তাই বলা যায় যে, শ্রীচন্দ্র ছিলেন চন্দ্রবংশের শ্রেষ্ঠ শাসক। শ্রীচন্দ্র চন্দ্রবংশের একজন স্বাধীন শাসক হিসেবে যে উপাধিগুলো গ্রহণ করেছিলেন তা হলো, পরমসৌগত, পরমেশ্বর, পরমভট্টারক এবং মহারাজাধিরাজ, যেগুলো তার এক একটি ক্ষমতা বা গুণাবলির দিক নির্দেশ করে। চন্দ্রবংশের যে দশটি তাম্রশাসন এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে ছয়খানিই শ্রীচন্দ্র কর্তৃক জারিকৃত। ঢাকা জেলার অন্তর্গত রামপাল ও ধুল্লা এবং ফরিদপুর জেলার ইদিলপুর ও কেদারপুর অঞ্চলে শ্রীচন্দ্রের চারটি লেখ পাওয়া গেছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, লেখের উপর ভিত্তি করে শ্রীচন্দ্রের রাজ্য বিস্তৃতির যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে ধারণা করা যায়, তাঁর প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রদ্বীপ ও হরিখেল রাজ্য প্রায় সমগ্র পূর্ববঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্র উপকূল নিয়ে গঠিত ছিল।

শ্রীচন্দ্রের ধুল্লা তাম্রশাসন মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার ধুল্লা গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি মানিকগঞ্জ-ঢাকার কোথাও অবস্থিত প্রাচীন জোলামণ্ডলে ভূমি দান করেছিলেন। শ্রীচন্দ্রের ইদিলপুর ও কেদারপুর তাম্রশাসন দুটি বর্তমান শরিয়তপুর জেলায় পাওয়া গেছে, যেগুলো দিয়ে তিনি সতত পদ্মাবতী বিষয়ের (পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চল) অন্তর্গত কুমারতালক মণ্ডলে (কুমার নদীর অববাহিকা অঞ্চল) ভূমিদান করেন। ঢাকা জেলায় পাওয়া গেছে শ্রীচন্দ্রের রামপাল তাম্রশাসন, যা দ্বারা নান্যমণ্ডলের নেহকাষ্ঠিতে এবং মদনপুর তাম্রশাসন দ্বারা জোলামণ্ডলের বঙ্গসাগরসম্ভাণ্ডারিয়ক অঞ্চলে ভূমিদান করেন। মৌলভিবাজারে প্রাপ্ত শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্বলিত লেখ, যা দ্বারা তিনি শ্রীহট্টমণ্ডলে বা বৃহত্তর সিলেটে ভূমিদান করেছিলেন, অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে শ্রীচন্দ্রের সেনাবাহিনী লৌহিত্য নদী তথা ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করে কামরূপে প্রবেশ করেছিল। লড়হচন্দ্রের (আ. ১০০০-২০ খ্রি.) চারপত্রমুরা তাম্রশাসনেও শ্রীচন্দ্রের এ সাফল্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদিকে কামরূপে ৯০০ সালে শালস্তম্ভের (৬৫০-৭০ খ্রি.) ম্লেচ্ছ রাজবংশের অবসান ঘটেছে এর শেষ রাজা ত্যাগসিংহের (আ. ৮৯০-৯০০ খ্রি.) উত্তরাধিকারী না থাকায়, ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে ব্রহ্মপাল (আ. ৯০০-২০ খ্রি.) কামরূপের রাজা হিসেবে মনোনীত হয়ে সেখানে কামরূপের পাল রাজবংশের সূচনা ঘটান। শ্রীচন্দ্র কত সালে শ্রীহট্ট অধিকার করেন জানা যায়না, কিন্তু তার আমলে কামরূপের রাজা ছিলেন রত্নপাল (আ. ৯২০-৯৬০ খ্রি.) ও ইন্দ্রপাল (আ. ৯৬০-৯৯০ খ্রি.)। এই রাজাদের কোন একজনের শাসনকালে শ্রীচন্দ্র কামরূপে এক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন ও সেই অভিযানে শ্রীচন্দ্র সাফল্যও লাভ করেছিলেন। তবে এ অভিযানের ফলে কামরূপের কোন অংশ শ্রীচন্দ্রের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল কি না তা নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তবে এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, উক্ত অভিযানের সফলতা প্রমাণ করে শ্রীচন্দ্র অনেক শক্তিশালী শাসক ও শৌর্যবীর্যের অধিকারী ছিলেন। শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন অনুসারে, তিনি যমন (যবন), হূণ ও উৎকলদের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। লড়হচন্দ্রের চারপত্রমুরা তাম্রশাসনে শ্রীচন্দ্র গৌড়ের বিরুদ্ধেও সাফল্য অর্জন করেছিলেন বলে জানা যায়। লেখ অনুসারে, তাঁর এ বিজয়ের ফলে গৌড়ের রমণীদের হাসি-আনন্দ হতাশায় রূপ নেয়। কল্যাণচন্দ্রের ঢাকা তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, শ্রীচন্দ্র গৌড়রাজ তৃতীয় গোপালকে (আ. ৯৫২-৬৯ খ্রি.) সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং তাঁর বন্দিনী রাজমহিষীকে ফেরত বা মুক্তি দিয়েছিলেন। পাল রাজা দ্বিতীয় গোপালের সঙ্গে কাম্বোজদের সংঘর্ষে দ্বিতীয় গোপাল পরাজিত ও বিতাড়িত হন। কাম্বোজগণ গৌড় তথা উত্তর-পশ্চিম বাংলায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। শ্রীচন্দ্র তৃতীয় গোপালের পক্ষাবলম্বন করেন। ফলে শ্রীচন্দ্র কাম্বোজদের বিতাড়িত করে তৃতীয় গোপালকে সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে শ্রীচন্দ্র তৃতীয় গোপালের সাহায্য করে পাল বংশের আসন্ন পতনকে বিলম্বিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

শ্রীচন্দ্রের সাম্রাজ্যের পরিসীমা ছিল মানিকগঞ্জ সহ বৃহত্তর ঢাকা-ফরিদপুরের পদ্মা তীরবর্তী এলাকা তথা বঙ্গের প্রায় সমগ্র অঞ্চল। বরিশাল বা চন্দ্রদ্বীপ এবং কুমিল্লা, নোয়াখালী বা সমতট অঞ্চল তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। শ্রীহট্টমণ্ডল বা সিলেট তিনি অভিযানে সফলতা অর্জনের মাধ্যমে বিজয় লাভ করেছিলেন। তিনি কামরূপ এবং গৌড়ে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তবে কামরূপ ও গৌড়ে তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ধারণা করা যায় যে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলও তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আবদুল মমিন চৌধুরী বলেন, নিঃসন্দেহে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় শ্রীচন্দ্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রীচন্দ্রের বিক্রমপুরকে রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন। বিক্রমপুর ছিল শ্রীচন্দ্রের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল। এখান থেকেই শ্রীচন্দ্রের ছয়টি তাম্রশাসনসহ চন্দ্রবংশের পরবর্তী সকল তাম্রশাসন জারি করা হয়। শ্রীচন্দ্র তাঁর রাজত্বকালের চুয়াল্লিশ রাজ্যাংকে মদনপুর তাম্রশাসন জারি করেন বলে ধরে নেয়া যায় তিনি অন্ততপক্ষে চুয়াল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। অনেকে মনে করেন শ্রীচন্দ্র পঁয়তাল্লিশ বছর কিংবা ছিচল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। পিতার মতো তিনিও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শাসক ছিলেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের নামে ব্রাহ্মণদের ভূমি দান করতেন। শ্রীচন্দ্র একজন ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ এবং সেই ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও তিনি তার প্রজাদের মধ্যে অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল ছিলেন, যা তার সাম্রাজ্যের মধ্যে বাস্তুচ্যুত ব্রাহ্মণদের বসতি স্থাপনের প্রচেষ্টার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছিল। ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের সিলেট অনুদান অনুযায়ী, শ্রীচন্দ্র তার সাম্রাজ্যে ৬০০০ ব্রাহ্মণকে বসতি স্থাপন করেন।

কল্যাণচন্দ্ৰ (৯৭৫-১০০০ খ্রি.) : শ্রীচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কল্যাণচন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর মাতা ছিলেন রাণী বসুমতি। তার রাজত্বকালের প্রাপ্ত একটি মাত্র তাম্রশাস থেকে এ সময়কালের তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় নি, তবে মনে করা হয় তাঁর শাসনামলে চন্দ্রবংশের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ ছিল। তাকে দানের ক্ষেত্রে বা সত্যবাদিতায় যুধিষ্ঠির এবং বীরত্বে অর্জুনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বলা যায় যে, চন্দ্রবংশের শ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। লড়হচন্দ্রের চারপত্রমুরা তাম্রশাসন অনুসারে, কল্যাণচন্দ্ৰ ম্লেচ্ছ রমণীদের চোখের জল ঝরিয়েছিলেন এবং গৌড়ের রমণীদের মুখের হাসি বিলীন করেছিলেন। গোবিন্দচন্দ্রের (আ. ১০২০-৫৫ খ্রি.) চারপত্রমুরা তাম্রশাসন অনুসারে, কল্যাণচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে যেসব ম্লেচ্ছ নিহত হয় তাঁদের স্ত্রীদের চোখের জলে ব্রহ্মপুত্রের জল চারগুণ বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে লিপিতে উল্লেখ আছে, কল্যাণচন্দ্র গৌড়ের রাজার বিরুদ্ধেও জয়লাভ করেন। কল্যাণচন্দ্র যে ম্লেচ্ছদের চোখের জল ঝরিয়েছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায় তারা ছিলেন সম্ভবত আসামের কোন এক উপজাতি আর গৌড়রাজ বলতে যাদেরকে বুঝানো হয়েছে তাঁরা হলেন, উত্তরবঙ্গের কোন এক কাম্বোজরাজ, কারণ কাম্বোজরাজ এসময়ে পালদের কাছ থেকে উত্তরবঙ্গ দখল করে নিয়েছিলেন। তাই হতে পারে, পালদের পক্ষ নিয়ে কল্যাণচন্দ্র গৌড়ে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এবং এর ফলেই পালরাজ প্রথম মহিপালের পক্ষে পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার সহজ হয়েছিল।

লড়হচন্দ্ৰ (আ. ১০০০-২০ খ্রি.) : চন্দ্রবংশের ইতিহাসখ্যাত রাজাদের মধ্যে লড়হুচন্দ একজন, যিনি কল্যাণচন্দ্রের মৃত্যুর পর চন্দ্রবংশের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল সৌভাগ্যদেবী। লড়হচন্দ্র তাঁর চারপত্রমুরা তাম্রশাসনদ্বয় দ্বারা পট্টিকেরায় অবস্থিত শ্রীলডহমাধবভট্টারক মন্দিরে ভূমিদান করেন। শ্রীলডহমাধবভট্টারক মন্দিরটি ময়নামতির চারপত্রমুরায় আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মন্দিরটি একটি বৈষ্ণববাদী হিন্দু মন্দির। কুমিল্লায় ভারেল্লায় প্রাপ্ত নাতেশ্বর-শিব মূর্তিটি লড়হচন্দ্রের রাজত্বের অষ্টাদশ বর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদেশে প্রাপ্ত শিবনটরাজ বা নার্ভেশ্বর শিবের আদিমতম নিদর্শন হচ্ছে এটি। তাই এ কথা প্রমাণিত যে, লড়হচন্দ্রের আমলে এদেশে নটরাজ শিবের পূজা প্রচলিত ছিল। মূর্তিলিপিতে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে বলা যায় যে, লড়হচন্দ্ৰ অন্ততপক্ষে ১৮ বছর রাজত্ব করেছিলেন। আবদুল মমিন চৌধুরীর মতে লডহচন্দ্র রাজত্ব করেন ২০ বছর। ভারেল্লা মূর্তিলিপিতে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে আরো জানা যায় যে, কর্মান্তপাল কুসুমদেবের পুত্র ভবদেব নতেশ্বর মূর্তিটি উৎসর্গ করেছিলেন। ধারণা করা হয় যে, এ ভবদেব লড়হচন্দ্রের অধীনে কুমিল্লার সামন্ত বা শাসক ছিলেন। রাজা লড়হচন্দ্র এবং পালরাজ প্রথম মহীপাল (আ. ৯৭৭-১০২৭ খ্রি.) সমসাময়িক শাসক ছিলেন। তাঁরা উভয়েই হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন ও বারাণসী তীর্থ ভ্রমণ করেছিলেন। বলা যায় তাঁর উভয়েই হিন্দুধর্মের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। লড়হচন্দ্ৰ অত্যন্ত শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে চন্দ্ৰ সাম্রাজ্য একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। লড়হচন্দ্র অনেক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বলে ধারণা পাওয়া গেলেও তাঁর সামরিক কৃতিত্বের কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। শেষজীবনে তিনি শান্তিপূর্ণ ও ধর্মীয় কাজে আত্মনিয়োগ করেন। চন্দ্রবংশের ইতিহাসে লড়হচন্দ্ৰ একটি আকর্ষণীয় শাসক।

গোবিন্দচন্দ্ৰ (আ. ১০২০-৫৫ খ্রি.) : গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন চন্দ্রবংশের শেষ রাজা। লড়হচন্দ্রের মৃত্যুর পর তার পুত্র গোবিন্দচন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর মাতার নাম সৌভাগ্যদেবী। চন্দ্রবংশের ইতিহাসে গোবিন্দচন্দ্র একজন দুর্বল রাজা হিসেবে পরিচিত। চোলদের আক্রমণ, কলচুরি আক্রমণ ইত্যাদির ধকল তাকে সহ্য করতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আর চন্দ্রবংশের হাল ধরে রাখতে পারেন নি। তাঁর পরাজয়ের সাথে সাথে চন্দ্রবংশের পতন সম্পন্ন হয়। গোবিন্দচন্দ্রের চারপত্রমুরা তাম্রশাসন, পাইকপাড়া বাসুদেব মূর্তিলিপি, কুলকুরি সূর্য মূর্তিলিপি, শব্দপ্রদীপ গ্রন্থ, রাজেন্দ্রচোলের তিরুমূলাই লিপি থেকে গোবিন্দচন্দ্রের তথ্য পাওয়া যায়। গোবিন্দের চারপত্রমুরা তাম্রশাসনে তাঁর বংশ পরিচিতি, জ্ঞান-গরিমা, পাণ্ডিত্য পারদর্শিতা ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তার রাজত্বকালের প্রথম দিকে বিষ্ণু ও ব্রহ্মা সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন। তাঁর প্রবর্তিত চারপত্রমুরায় বিষ্ণু ও ব্রহ্মা তাঁর রাজত্বকালকে দীর্ঘায়িত করবে বলে আশা করা হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, তাঁর চারপত্রমুরা তাম্রশাসনটি তাঁর রাজত্বের প্রারম্ভকালেই জারি করা হয়েছিল। এছাড়া বিক্রমপুর বা মুন্সিগঞ্জে পাইকপাড়া-বাসুদেব মূর্তিলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। মাদারিপুর জেলায় কুলকুরি সূর্যমূর্তি পাওয়া গেছে। প্রাপ্তির সূত্র ধরে অনুমান করা যায় যে, বৃহত্তর ঢাকা-ফরিদপুর অঞ্চলে গোবিন্দচন্দ্রের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল। দাক্ষিণাত্যের শক্তিশালী চোলরাজ রাজেন্দ্রচোলের তিরুমূলাই লিপি কর্তৃক জানা যায় যে, গোবিন্দচন্দ্র একবার চোল আক্রমণে পরাজিত হয়েছিলেন। এ যুদ্ধে চোল সেনাপতির আক্রমনে বঙ্গাল রাজা গোবিন্দচন্দ্র পরাজিত হয়ে হস্তীর পীঠ থেকে নেমে পলায়ন করতে বাধ্য হন। এ লিপিতে আরো উল্লেখ পাওয়া যায় যে, বঙ্গাল দেশ অবিরাম বৃষ্টির দেশ। চোলদের বঙ্গাল আক্রমণের ফলাফল স্থায়ী ছিল না। তবে তাঁদের এ আক্রমণের ফলে রাজা গোবিন্দচন্দ্রের শক্তি অনেকটাই হ্রাসপ্রাপ্ত হয়।

গোবিন্দচন্দ্রের শাসনকালে একবার কলচুরিরাজ লক্ষ্মীকর্ণ (১০৪১-১০৭৩ খ্রি.) বঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন ও এই আক্রমণের ফলেই সম্ভবত চন্দ্রবংশের পতন সম্পন্ন হয়েছিল। এর পরে চন্দ্রবংশের আর কোন শাসকের নাম জানা যায় নি বলে ধরে নেয়া যায়, গোবিন্দচন্দ্রই চন্দ্রবংশের শেষ শাসক। এ সময়ে গোপীচন্দ্রের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, যিনি অনেকের মতে গোবিন্দচন্দ্রই। তবে পিতৃনামের পার্থক্য থাকায় এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

ধর্মের দিক থেকে গোবিন্দচন্দ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও হিন্দুধর্মের প্রতি তাঁর উদার মনোভাব ছিল। তিনি হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন। গোবিন্দচন্দ্র রাজা বা শাসক হিসেবে দক্ষ ও শক্তিশালী না হলেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শাসক। গোবিন্দচন্দ্রের গান, মানিকচন্দ্রের গান ইত্যাদি জনসমাজে সে সময়ের অনেক পরেও বেশ জনপ্রিয় ছিল। গোবিন্দচন্দ্র আনুমানিক পঁচিশ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর মৃত্যু বা পরাজয়ের পর পরই চন্দ্রবংশের পতন হয়। দ্বিতীয় মহিপালের আমলের বাঘাউরা ও নারায়ণপুর মূর্তিলিপি অনুসারে চন্দ্রবংশের পরে বঙ্গ-সমতটে কিছুকালের জন্য পাল শাসন চালু বলে অনুমান করা হয়। এরপর বরেন্দ্রে সামন্ত বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১১শ শতকের শেষভাগে এখানে বর্মবংশের শাসন শুরু হয়।

বঙ্গে চন্দ্রবংশের শাসন একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। আনুমানিক ৯ম শতাব্দীর শেষার্ধ হতে ১১শ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত চন্দ্রবংশের রাজত্ব কার্যকর ছিল। এ বংশের মোট সাতজন রাজার নাম জানা যায়। তাঁদের মধ্যে প্রথম দু’জন স্বাধীন সার্বভৌম ছিলেন কি না তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্র চন্দ্রবংশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা ছিলেন। তাঁকে চন্দ্রবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। অনেক ঐতিহাসিক তাঁকেই চন্দ্রবংশের প্রথম স্বাধীন-সার্বভৌম শাসক হিসেবে মনে করে থাকেন। প্রতিষ্ঠাতা রাজা পূর্ণচন্দ্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পরবর্তী এ বংশের সকল রাজাগণই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এতদসত্ত্বেও তাঁরা সকল ধর্মেরে প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও উদার। বঙ্গের ইতিহাসে তাই চন্দ্রবংশ বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে।

বর্ম রাজবংশ

আনুমানিক ৯ম শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে ১১শ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত চন্দ্রবংশের রাজত্ব কার্যকর ছিল, যা কালের প্রবাহমানতায় এক সময় দুর্বল হয়ে পড়লে জাতবর্ম নামক এক ব্যক্তি এদেশে বর্ম রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত চন্দ্রবংশের পতন এবং পালবংশের দুর্বলতার প্রেক্ষিতেই বর্মরাজবংশের প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। এ বংশের ইতিহাস অনেকটাই কুয়াশাচ্ছন্ন ও সমকালীন সাহিত্যে এর সম্পর্কে তেমন কোন বিবরণ পাওয়া যায় নি। হরিবর্মার সামন্তসার তাম্রশাসন, সামলবর্মার বজ্রযোগিনী তাম্রশাসন, ভোজবর্মার বেলাব তাম্রশাসন ও ভট্টভবদেবের ভুবনেশ্বর লেখ এ বংশের ইতিহাসের প্রধান অবলম্বন। হরিবর্মার সামন্তসার তাম্রশাসনটি অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ও সামলবর্মার বজ্রযোগিনী তাম্রশাসনটির খণ্ডিত অংশ পাওয়া গেছে। ভোজবর্মার বেলাব তাম্রশাসন এবং ভট্টভবদেবের ভুবনেশ্বর লেখের আলোকেই ধর্মরাজবংশের ইতিহাস উদ্ধার করা হয়। তবে এগুলোর মধ্যে ভোজবর্মার বেলাব তাম্রশাসনটিই বর্মরাজবংশের ইতিহাস লিখনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর।

বেলাব তাম্রশাসনে উল্লিখিত বর্ণনানুসারে বর্ম পূর্বপুরুষগণ সিংহপুরের যাদব বংশজাত, যেখানে যাদব হলো পৌরাণিক রাজা যদুর বংশ। লেখটি অনুসারে, ব্রহ্মা থেকে পুত্র পৌত্রাদিক্রমে অত্রি, চন্দ্র, বুধ, পুরূরবা, আয়ু, নহুষ এবং যযাতি ও যদুর জন্ম হয়েছে ও যদুবংশেই হরির জন্ম হয়েছে, আর হরির জ্ঞাতিবন্ধুই ছিলেন সিংহপুরের বর্মরাজগণ। সিংহপুর বর্মবংশের আদি বাসস্থান ছিল, যার অবস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। শ্যুয়েন ৎসাঙের বিবরণ অনুসারে এটি পাঞ্জাবের অন্তর্গত সিংহপুর। সিংহলি কিংবদন্তিতে রাঢ়ের অন্তর্গত অপর একটি সিংহপুর নামক স্থানের অবস্থান পাওয়া যায়। অনেকের মতে, রাঢ়ের সিঙ্গুর থেকে বর্মগণ বঙ্গে এসে রাজ্য স্থাপন করেন। অন্যদিকে উড়িষ্যার কলিঙ্গে সিংহপুর নামক একটি রাজ্যের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায় যা ৫ম থেকে ১২শ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখের মতে কলিঙ্গের সিংহপুরই বর্মরাজাদের আদি বাসস্থান, তাই বর্মরাজাগণ বাংলার আদি বাসিন্দা নন, বরং কলিঙ্গের সিংহপুর থেকে এসে বাংলায় আধিপত্য স্থাপন করেছেন। পাঞ্জাব বা কলিঙ্গের মতো দূর অঞ্চল থেকে বাংলায় রাজ্য স্থাপন অসম্ভব কিছু না হলেও রাজ্য প্রতিষ্ঠা ছিল খুবই কষ্টকর। কলচুরিরাজ লক্ষ্মীকর্ণের পিতা গাঙ্গেয়দেব উড়িষ্যার কলিঙ্গ অধিকার করেছিলেন ও এরপর লক্ষ্মীকর্ণ সম্ভবত কলিঙ্গ থেকেই বঙ্গ বিজয় করেছিলেন। তার আক্রমণের ফলে তাঁর মিত্র হিসেবে জাতবর্মা দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে সহজেই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। এ থেকেও ধারণা করা যায়, বর্মগণ উড়িষ্যার সিংহপুর থেকে বঙ্গে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন।

জাতবর্মা (১১শ শতকের শেষার্ধ) : বঙ্গদেশে বর্মবংশের প্রতিষ্ঠা করেন বজ্রবর্মার পুত্র জাতবর্মা। ভোজবর্মার বেলাব তাম্রশাসন অনুসারে, “জাতবর্মার পিতা বজ্রবর্মা একজন বীরযোদ্ধা, একজন বিখ্যাত কবি ও পণ্ডিত ছিলেন। জাতবর্মা লক্ষ্মীকর্ণের (১০৪১-১০৭৩ খ্রি.) কন্যা বীরশ্রীকে বিবাহ করেন। তিনি অঙ্গে তাঁর রাজ্যবিস্তার করেন। তিনি কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করে এর সম্মান ক্ষুণ্ন করেন। তিনি শক্তিশালী দিব্যকে পরাজিত করেন। গোবর্ধনের সৌভাগ্যকে দুর্ভাগ্যে পরিণত করেন। তিনি একজন দানশীল শাসক ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণদেরকে ধনরত্ন দান করেন এবং রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন।”

জাতবর্মা ছিলেন বজ্রবর্মার পুত্র এবং মনে করা হয় যে জাতবর্মা লক্ষ্মীকর্ণের বাংলার অভিযানে তাঁর সাথেই ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি সিংহপুর রাজ্যের ক্ষমতায় আরোহণ করেন। তাঁর পিতা এবং প্রথম দিকে তিনিও ছিলেন কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেব এবং লক্ষ্মীকর্ণের সামস্ত রাজা। জাতবর্মার সামরিক বিজয়ের বিবরণ ভোজবর্মার বেলাব তাম্রশাসনে পাওয়া গেছে। লক্ষ্মীকর্ণের কন্যা বীরশ্রীর সাথে জাতবর্মার বিবাহ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এবং সম্ভবত বর্মণ রাজবংশের রাজনৈতিক ভাগ্যের উত্থানের একটি বড় কারণ ছিল। বীরশ্রীকে তিনি বিবাহ করার ফলে তাঁর ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন দেখা দেয় ও শ্বশুরের সাহায্য ও সমর্থনে বলীয়ান হয়ে তিনি এদেশে বহু যুদ্ধ ও অভিযানে জয়লাভ করে এতদঞ্চলে সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা করেন।

ভোজবর্মা কর্তৃক উৎকীর্ণ বেলাব তাম্রশাসনে জাতবর্মা কর্তৃক পূর্ববঙ্গ দখলের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কলচুরিরাজ লক্ষ্মীকর্ণের এক লেখ অনুসারে, তিনি পূর্বদেশীয় একটি রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন, যা থেকে ধারণা করা যায়, চন্দ্রবংশীয় সাম্রাজ্য ধ্বংস করে লক্ষ্মীকর্ণ জাতবর্মাকে ঐ রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অভিষিক্ত করেন ও প্রথমাবস্থায় জাতবর্মা স্বাধীন শাসক ছিলেন না। জাতবর্মার এই পূর্ববঙ্গ দখলের সময়কাল অজ্ঞাত।

লক্ষ্মীকর্ণের কন্যা বীরশ্রীর সাথে জাতবর্মার বিয়ে এবং পালদের কাছ থেকে উত্তর বাংলা কেড়ে নেয়া কৈবর্ত প্রধান দিব্যের সাথে জাতবর্মার যুদ্ধের উল্লেখ আমাদেরকে ১০৫০ থেকে ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জাতবর্মার ক্ষমতায় উত্থানের সময়কাল নির্ধারণে সহায়তা করে। এদিকে পালরাজ তৃতীয় বিগ্রহপাল (আ. ১০৪৩-৭০ খ্রি.) কলচুরিরাজ লক্ষ্মীকর্ণের সমসাময়িক ছিলেন এবং তিনি লক্ষ্মীকর্ণের আরেক কন্যা যৌবনশ্রীকে বিবাহ করেছিলেন। তাই অনুমিত হয়, লক্ষ্মীকর্ণ ১০৪১ থেকে ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করে গেছেন, এদিকে জাতবর্মা কর্ণের সাহায্যে বঙ্গদেশ জয় করে ১১শ শতাব্দীর শেষার্ধকালে রাজত্ব করেছেন।

রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, জাতবর্মা কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেব ও লক্ষ্মীকর্ণের অধীনস্থ সামন্তরাজরূপে তাঁদের সঙ্গে পাল রাজ্য আক্রমণ করেন এবং অঙ্গদেশে পালরাজ ও বরেন্দ্রে কৈবর্তরাজ দিব্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন।” যদিও সেখানে কৈবর্ত শাসনের কোনও ক্ষতি হয়নি, তবে বেলাব তাম্রশাসন অনুসারে তিনি দিব্যকে পরাজিত করেন। দ্বিতীয় মহীপালের (আ. ১০৭০-৭১ খ্রি.) মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পাল সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় রাজা জাতবর্মা এর পূর্ণ সুযোগ নিয়ে পাল রাজ্য আক্রমণ করেন। বেলাব তাম্রশাসনে উল্লিখিত অঙ্গদেশে জাতবর্মার আক্রমণ অবশ্যই পাল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তার টানাপোড়েনের সৃষ্টি করে, তবে তিনি অঙ্গের কিছু অঞ্চল দখল করার মাধ্যমে নিজেকে এই অঞ্চলে শক্তিশালী করে তুলতে সক্ষম হন। যাই হোক, তার আক্রমণে সোমপুরের বৌদ্ধ বিহারের একটি অংশ তার সেনাবাহিনীর আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। বিপুলশ্রীমিত্রের নালন্দা তাম্রশাসনে উল্লিখিত আছে যে, ১১শ শতক পর্যন্ত বঙ্গাল এর সেনাবাহিনীর অভিযানের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সোমপুর মহাবিহার সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান ছিল। এবং বিপুলশ্রীমিত্রের পূর্বপুরুষ করুণাশ্রীমিত্র সোমপুর মহাবিহার ত্যাগে রাজী না হওয়ায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। এই আক্রমণ জাতবর্মার এই অভিযানই হয়ে থাকবে। যাই হোক, ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার একশ বছর পরে বিপুলশ্রীমিত্র সংস্কার কাজের মাধ্যমে এই বিহারের হূতগৌরব পুনরুদ্ধার করেন, এবং এখানে একটি তারা মন্দিরও নির্মাণ করেন।

জাতবর্মার অন্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গোবর্ধন এবং কামরূপের রাজা। তিনি পুন্ড্রবর্ধনের একটি অংশ কেড়ে নিয়েছিলেন, যা তখন কামরূপের সার্বভৌম শাসনের অধীনে ছিল। বেলাব তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, জাতবর্মা বঙ্গদেশে স্বীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে কামরূপ বিজয়ে সাফল্য লাভ করেছিলেন, রাজা দিব্যের অহঙ্কারকে ভূলুণ্ঠিত করেছিলেন এবং গোবর্ধন নামক এক রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। তাম্রশাসনের বিবরণে অতিশয়োক্তি থাকলেও জাতবর্মা যে শক্তিশালী ছিলেন তা অনুমেয়। তিনি প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে নিজ রাজ্যে সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

হরিবর্মা : সামন্তসার তাম্রশাসন অনুসারে জাতবর্মার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হরিবর্মা সিংহাসনে আরোহণ করেন। বেলাব তাম্রশাসনে অবশ্য হরিবর্মার নাম সুস্পষ্ট করে উল্লেখ না থাকলেও অপর পুত্র সামলবর্মার উল্লেখ থেকে ধারণা করা হয় দুই ভাইয়ের মধ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব থেকে থাকতে পারে। তবে সমসাময়িক পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক, সান্ধিবিগ্রহিক, সাহসী যোদ্ধা ও হরিবর্মার যুদ্ধ ও শাস্তি বিষয়ক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ভট্টভবদেবের ভুবনেশ্বর লেখে হরিবর্মার নামের উল্লেখ আছে, যেখানে তিনি নিজের সাত পূর্বপুরুষের পরিচয় উল্লেখ করেছেন। ভট্টভবদেবের লিখিত গ্রন্থ মীমাংসা ও স্মৃতি বিষয়ক রচনা পরবর্তীকালেও বেশ আলোড়ন তুলেছিল ও তিনি কবিকলা, সর্বআগম (বেদ), অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, অস্ত্রবেদ প্রভৃতি শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের কারণেই রাজা হরিবর্মা দীর্ঘদিন রাজ্যসুখ লাভ করেছিলেন। ধারণা করা যায় যে, হরিবর্মা খুবই করিৎকর্মা লোক ছিলেন। তিনি যোগ্য ও পারদর্শী লোকদের তাঁর দরবারের উচ্চাসনে নিয়োগ দান করতেন। তার রাজত্বের ১৯ ও ৩৯ বছরে লিখিত দুটি বৌদ্ধ পুঁথি থেকে ধারণা করা যায় যে, তিনি অন্তত ৩৯ বছর পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে তিনি শক্তিশালী একজন শাসক ছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত অনুসারে, পালসম্রাট রামপাল (আ. ১০৭২-১১২৬ খ্রি.) বিদেশি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে একজন পূর্বদেশীয় শাসককে হাতি ও রথ উপহার দিয়ে এ মনস্তুষ্টির চেষ্টা করেছিলেন, হরিবর্মাকেই এই পূর্বদেশীয় সম্রাট বলে মনে করা হয়।

সামলবর্মা : হরিবর্মার পরে তাঁর ভাই জাতবর্মা ও বীরশ্রীর পুত্র সামলবর্মা বর্মসিংহাসনে আরোহণ করেন। বেলাব তাম্রশাসন অনুসারে, সামলবর্মার অনেক রাণীদের মধ্যে মালব্যদেবী প্রধান মহিষী ছিলেন। পুত্রের নাম উদয়িন ও ভোজবর্মা। ত্রৈলোক্যসুন্দরী নাম্নী তাঁর একজন কন্যা থাকার কথাও অনেক ঐতিহাসিক ধারণা করে থাকেন। বৈদিক ব্রাহ্মণদের কুলজী গ্রন্থসমূহ অনুসারে, বাংলার ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষগণ সামলবর্মার যুগে মধ্যদেশ থেকে ব্রাহ্মণদের দেশে অভিভাষণ করেছিলেন। এগুলো ভোজবর্মার বেলাব তাম্রশাসনেও উল্লেখ পাওয়া যায়।

ভোজবর্মা : পিতা সামলবর্মার মৃত্যুর পর ভোজবর্মা পূর্ববঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ভোজবর্মা ছিলেন রাণী মাল্যদেবীর পুত্র। ভোজবর্মার রাজত্বের পঞ্চম বছরে বিক্রমপুর জারি করা বেলাব তাম্রশাসনে তিনি পরম বৈষ্ণব, পরমেশ্বর ও পরম ভট্টারক উপাধি গ্রহণ করেম, যেগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী শাসক ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে বৈষ্ণব হলেও তিনি বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।

১১শ শতকের শেষভাগ থেকে ১২শ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বর্মরাজাগণ পূর্ববঙ্গ শাসন করেছিলেন। এ রাজবংশের চারজন রাজার নামই জানা যায়। এদের মধ্যে ভোজবর্মাই সর্বশেষ রাজা হিসেবে নাম পাওয়া যায়। বর্মদের পরে তাঁদের রাজ্য সেনবংশীয়রা দখল করে নিয়েছিলেন। সেন রাজারা সমগ্র বাংলায় রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। ফলে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সত্তার বিলোপ সাধিত হয়।

দেব রাজবংশ

দেব রাজবংশ (খ্রিস্টীয় ১২শ-১৩শ শতাব্দী) ছিল মধ্যযুগীয় বঙ্গের একটি হিন্দু রাজবংশ। সেন রাজবংশের পরে পূর্ববঙ্গে এই রাজবংশ রাজত্ব করেছিল। দেব রাজবংশের রাজধানী ছিল অধুনা বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে। এই রাজবংশের সমাপ্তির সঠিক সময়কাল এবং কারণ জানা যায় না। ইতিহাসে দুটি দেব রাজবংশের উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি খ্রিস্টীয় ৮ম-৯ম শতাব্দীতে সমতট অঞ্চলে রাজত্বকারী রাজবংশ। যার রাজধানী ছিল দেবপর্বত। আর বিক্রমপুরের এই রাজবংশটি ছিল হিন্দু বৈষ্ণব রাজবংশ। শিলালিপি থেকে এই রাজবংশের চারজন রাজার নাম পাওয়া যায়: শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব ও ভবদেব। দেব শাসন প্রকৃতপক্ষে শান্তি , সমৃদ্ধি , এবং সৃজনশীল শ্রেষ্ঠত্ব একটি নির্দিষ্ট সময়ের ছিল , এবং এই রাজ্যকালকে প্রাচীন বাংলার ‘ স্বর্ণযুগ ‘ মনোনীত করা যেতে পারে।

১১৫৬, ১১৫৮ ও ১১৬৫ শতাব্দে রাজা দামোদরদেব যে তিনটি তাম্রলিপি খোদাই করিয়েছিলেন (তাঁর রাজত্বের ৪র্থ, ৬ষ্ঠ ও ১৩শ বছরে) তা থেকেই এই রাজবংশের ইতিহাস জানা যায়। ১১৬৫ শতাব্দের দামোদরদেবের চট্টগ্রাম তাম্রলিপি থেকে এই রাজবংশের প্রথম তিন রাজার কথা জানা যায়।যদিও এই রাজবংশ সম্পর্কে অনেক কাল্পনিক কাহিনী আছে , তবে তার কোন শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই রাজবংশের প্রথম রাজা ছিলেন পুরুষোত্তমদেব। তিনি ছিলেন গ্রাম-প্রধান বা “গ্রামণী”। তাঁর পুত্র মধুমথন বা মধুসূদন্দেব ছিলেন এই রাজবংশের প্রথম সার্বভৌম রাজা। তিনি “নৃপতি” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পুত্র ছিলেন ছিলেন বাসুদেব। বাসুদেবের পুত্র ছিলেন দামোদরদেব (শাসনকাল ১২৩১-৪৩ খ্রিস্টাব্দ) তিনি ছিলেন এই রাজবংশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা। তিনি “অরিরাজ-চানূর-মাধব-সকল-ভূপতি-চক্রবর্তী” উপাধি গ্রহণ করেছিলে। কুমিল্লা তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, তাঁর রাজ্য আধুনিক বাংলাদেশের কুমিল্লা-নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রসারিত ছিল। পরবর্তীকালে “অরিরাজ-দনুজ-মাধব” দশরথদেব নামে এক রাজা এই রাজ্যকে বিক্রমপুর পর্যন্ত প্রসারিত করে সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি এখানে একটি লেখ স্থাপন করেছিলেন। ইয়াহিয়া বিন আহমেদ তাঁর তারিখ-ই-মুবারক শাহি গ্রন্থে উল্লেখ করেন, তিনি (ইয়াহিয়া তাঁকে সোনারগাঁওয়ের দনুজ রায় বলে উল্লেখ করেন) ১২৮১ সালে গিয়াসুদ্দিন বলবনের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে তার ভাই বিক্রমাদিত্য দেব রাজ্যসীমার পূব অংশে স্থানান্তর করেন। নথিভুক্ত তথ্য থেকে এই পযন্ত জানা যায়।

ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিবৃত্তের সংক্ষেপ বিবরণ

দেব রাজবংশের পর চট্টগ্রামের কী হয় তা জানতে একটু ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিবৃত্তে যেতে হবে।  ত্রিপুরা রাজ্য অতি পুরাতন, এটি প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু নরপতিগণ কর্তৃক শাসিত হয়ে আসছিল। পুরাতত্ত্ব আলোচনায়, প্রতীয়মান হয়, আর্যগণ ভারতে আসার পূর্ব থেকে এই দেশ পরাক্রান্ত “কিরাত” নামক এক জাতির বাসস্থান ও কিরাতরাজার শাসনাধীন ছিল। সেইজন্য পুরাণে ত্রিপুরাসুরের উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকে বলেন সেই ত্রিপুরাসুরের নামানুসারে এই দেশ ত্রিপুরা নামে কথিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন কিরাতগণ নিজেদেরকে “তিপ্রা” বলত, তুই শব্দ জলকে বুঝায় তুই + প্রা = তুইপ্রা বা তৃপা (তিপ্ৰা), সেই “তিপ্রা” থেকে ত্রিপুরা শব্দ হয়েছে। প্রাচীন আর্যগণ কামরূপ ও আরাকানের (রাক্ষেয়াং) মধ্যবর্তী চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরাকে সুহ্মদেশ বলতেন বলে কমল চৌধুরীর মত। একসময়ে এই রাজ্য উত্তরে তৈরঙ্গ নদী থেকে দক্ষিণে রোশাং (রাক্ষেয়াং) দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্রহ্ম ভাষায় একে “পাটীকোড়া” বা “পাটীকোকায়া”; আরকানী ভাষায় “খরতুন” ও মণিপুরি ভাষায় “তকলেও” বলে। হিউয়াং সাং তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে “সিউকি” নামক গ্রন্থে এই দেশকে কমলাঙ্ক (কুমিল্লা) ও চট্রলকে সিংলি-চটলো বা শ্রীচটলো উল্লেখ করেছেন। তিপ্রাগণ ১০ শাখায় বিভক্ত – ১। তিপ্ৰা ২। বাছাল ৩। দৈত্যসিং ৪। কুওয়াতিয়া ৫। সিউক ৬। ছত্ৰতিয়া ৭। গালিম ৮। আপাইশ ৯। ছিলটিয়া ১০। সেনা। ৯ নম্বর জাতি ছিলটিয়া সম্পর্কে বলতে হয়। রাজমালা অনুসারে শ্রীহট্ট বা সিলেট পূর্বকালে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। দেখা যায় ছিলটিয়া নামক ত্রিপুরা জাতি এই অঞ্চলে বাস করত, এই ছিলটিয়া থেকে সিলেট ও তার সংস্কৃতকরণে শ্রীহট্ট হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। যাই হোক, তিপ্রাদের সংখ্যা ৪০ সহস্রের অধিক। বর্তমান ত্রিপুরা-রাজবংশ মহাভারতোক্ত যযাতির বংশধর বলে কথিত এবং যযাতি থেকে রাজা কল্যাণমাণিক্য পর্যন্ত ১১৭ পুরুষ দেখা যায়। এদের পূর্বে “ফা” উপাধি ছিল। কেউ কেউ বলেন ত্রিপুরারাজ “ছেংথম-ফা” প্রথম চট্টগ্রাম অধিকার করেন, কেউ কেউ বলেন ত্রিপুরারাজ “রত্ন-ফা” চট্টগ্রাম অধিকার করেন, কিন্তু ইতিহাস আলোচনায় দেখা যায় ত্রিপুরারাজ তার ভাই এর দ্বারা বিতাড়িত হয়ে মুসলমান সেনাপতি বলবনের সাহায্যে ত্রিপুরারাজ্য অধিকার করেন, এবং তিনি “ফা” উপাধি পরিত্যাগ করে “মাণিক্য” উপাধি ধারণ করেন, এবং ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ বা তার কিছুকাল পরে চন্দ্রবংশীয় রাজা দামোদর দেবের বংশধরের হাত থেকে চট্টগ্রাম অধিকার করেন।

হরিখেল

হরিখেলকে বাংলার আরেকটি জনপদ ধরা হয়। চট্টগ্রামের ইতিহাস আলোচনায় এই অঞ্চলটি নিয়েও বিশেষভাবে আলোচনা করতে হয়। হরিখেল মণ্ডল এলাকা আজো অনির্ণিত। ইৎসিঙের (ভারতে ভ্রমণকাল ৬৭১-৬৯৫ খ্রি.) মতে হরিখেল ভারতের পূর্ব প্রত্যন্ত অঞ্চল। কর্পূরমঞ্জরী লেখক রাজশেখর দত্ত (৯ম শতক) হরিখেলকে পূর্বদেশ বলেই পরোক্ষভাবে নির্দেশ করেছেন। (HBI, 17) যশোধারার জয়মঙ্গলে আছে: ‘বঙ্গালোহিত্যাং পূর্বেন’। এসব গুলোই কামরূপ ও সমতট মধ্যস্থ শ্রীহট্টকে নির্দেশ করে। আবার যাদবানন্দ কবিরাজের রসরূপচিন্তামনি (১৫৯৩ খ্রী.) বাসুদের কবিকঙ্কন চক্রবর্তীর ‘রুদাক্ষ মাহাত্ম্যে’ (পাণ্ডুলিপি: ঢা. বিশ্ববিদ্যালয়) এবং কেশব কৃতৎসরের ‘কল্পদ্রু’তে ও আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পে শ্রীহট্ট বা সিলেটকেই হরিখেল বলে নির্দেশ করা হয়েছে। (শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা ১৩৪৯ : JASP, VI 1961, 272; Paul PL Early History of Bengal (1939) introduction II-IV)

কিন্তু চীনাসূত্রে এও জানা যায় যে সমতট ও উড়িষ্যার মধ্যবর্তী হরিখেল কোনো উপকূল অঞ্চল। হেমচন্দ্রের ‘অভিধান চিন্তামনি’ গ্রন্থে ‘বঙ্গাস্তু হরিখেলিয়ঃ’ উক্তিতে বঙ্গকেই হরিখেল বলা হয়েছে। আবার চট্টগ্রামে খ্রিস্টীয় ৯ম শতকের হরিখেল মণ্ডলপতি কান্তিদেবের অসম্পূর্ণ তাম্রলিপি পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় তার রাজধানী ছিল বর্ধমানপুর। এই বর্ধমানপুরের কোনো ঐতিহ্য সিলেটে কিংবা দক্ষিণবঙ্গে মেলে না। শ্রীচন্দ্রের রামপালে প্রাপ্ত তাম্রপত্রেও হরিখেলের উল্লেখ আছে। অতএব (ক) সিলেট (খ) ফরিদপুর-বরিশাল-খুলনা প্রভৃতি উপকূল অঞ্চল (গ) চট্টগ্রাম (ঘ) ঢাকা-ময়মনসিংহ এলাকা – এর যে কোনো একটি হরিখেল বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।

তবে ‘খেল’ < ‘কেল’ যদি < ‘কের’ থেকেই হয়ে থাকে তাহলে পাট্টিকের এর যে-কোনো একপাশেই ‘হরিখেল’ বিদ্যমান ছিল বলে মনে হয়। মনে হয়, দক্ষিণবঙ্গের উপকূলাঞ্চলই হরিখেল ছিল, এখান থেকেই কান্তিদেব সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম জয় করেন, কিন্তু সমতট রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের কাছে পরাজিত হওয়ায় তার তাম্রপত্রটি চট্টগ্রামে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এদিকে দক্ষিণবঙ্গ (চন্দ্রদ্বীপাদি) জয় করে ত্রৈলোক্যচন্দ্র রাজ্যসীমা বিস্তৃত করায় পাট্টিকের থেকে বিক্রমপুরে রাজধানী স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়েছিল। দ্বিতীয় গোপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপালের সময় দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ চন্দ্ররাজাদের অধিকারে ছিল। ত্রৈলোক্যচন্দ্ৰ যখন বিক্রমপুরে রাজধানী করেন, তখন তার সামন্ত কুসুমদেব বা তার পিতা পাট্টিকের অঞ্চল শাসনের ভারপ্রাপ্ত হন। নটেশ্বর শিবের মূর্তিলিপি থেকে অনুমিত হয়, এঁরই সন্তান ভাবুদেব লড়হ চন্দ্রের সময়ে কারমন্তার শাসক ছিলেন। চন্দ্ররাজারা দক্ষিণ-দেশীয় রাজাদের দ্বারা বারবার পর্যুদস্ত হন। রাজেন্দ্ৰ চোল (১০২১-২৩) গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেন বলে তিডুমালাই লিপি থেকে জানা যায়, আবার কলচুরি রাজারাও চন্দ্ররাজ্যে বারবার হানা দেন। কোক্কল্ল (আনু. ৮৪০-৯০) ও তার পৌত্র লক্ষ্মণ রাজা এবং পরবর্তী কলচুরি রাজা কর্ণ (১০৪১-৭০) বঙ্গরাজার উপর জয়ী হয়েছিলেন। বাঘাউড়া লিপির প্রমাণে জানা যায় দ্বিতীয় মহীপাল সমতটের কতেকাংশ জয় করেছিলেন, কিন্তু এ জয় স্থায়ী হয়নি। মনে হয় ইনি কর্ণ-বিধ্বস্ত বঙ্গ-সমতট জয় করবার সুযোগ পেলেও রক্ষা করতে সমর্থ হননি, কারণ দেখা যায়, পূর্ববঙ্গরাজ জাতবর্মণ কলচুরিরাজ কর্ণের কন্যা বীরশ্রীকে বিয়ে করেছিলেন, অর্থাৎ মহীপালের বিজয়ের সময় কর্ণ ও জাতবর্মণ উভয়েই জীবিত। (HB, I, 128. 135, 193-199 note; Bheraghat inscription El, II 11, 15 : Rewa stone inscription, XXIV, 105, 112)

বেলাভা (Belava) তাম্রপত্রের আলোকে অনুমান করা সম্ভব যে ললিত চন্দ্রের স্বল্পকাল রাজত্বের পরেই (কলিঙ্গ দেশজ বা পশ্চিমবঙ্গীয় হরি বর্মণের মন্ত্রী ভবদেব ভট্ট রাঢ়ের সিদ্ধিতলা গায়ের লোক, তার পিতামহ আদিদেব বঙ্গরাজের মন্ত্রী ছিলেন) উচ্চপদস্থ কর্মচারী বজ্রবর্মণ বা তার পুত্র জাতবর্মণ চন্দ্ৰ সিংহাসন দখল করেন। সম্ভবত ১০৭০ খ্রিস্টাব্দের পরেই বর্মণ অভ্যুত্থান ঘটে। জাতবর্মণ দিগ্বিজয়ী ছিলেন। “বৈনর পুত্র পৃথুর গৌরব মুছে দিয়ে, কর্ণের মেয়ে বীরশ্রীকে বিয়ে করে, অঙ্গগণের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, কামরূপের গর্ব খর্ব করে, দিব্যের বাহুবলকে লজ্জা দিয়ে গোবর্ধনের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটিয়ে এবং বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদেরকে ধনদান করে তিনি তার সার্বভৌমত্ব বিস্তার করেন। (ELXIL 37. IB)। এই উক্তির মধ্যেকার কলচুরিরাজ কর্ণ ও কৈবর্তদের পরিচয় জানা। এই দিব্য দ্বিতীয় মহীপালের সময়ে (১০৭০-৭৫) বিদ্রোহী হয়ে বরেন্দ্রে স্বাধীনভাবে কিছুকাল রাজত্ব করার সুযোগ পান। জাতবর্মণের পরে তার পুত্র হরিবর্মণ ও সামলবর্মণ রাজত্ব করেন। এদেরও রাজধানী বিক্রমপুরেই ছিল। কিন্তু খুব সম্ভব বর্মণদের আদি নিবাস কলিঙ্গে, যেখান থেকে তারা রাঢ়ের সিংগুর অঞ্চলে বাস করতে থাকেন এবং বজ্রবর্মার আমলে বিশেষ ক্ষমতাশালী হন। হরিবর্মণের মন্ত্রী ভবদেব ভট্টরাও রাঢ়বাসী এবং বঙ্গরাজ মন্ত্রী। বর্মণরা ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈষ্ণব ছিলেন। সামলবর্মণের পুত্র ভোজবর্মণই Belava তাম্রশাসনটি তার রাজত্বের পঞ্চম বছরে রাজধানী বিক্রমপুর থেকে প্রদান করেন। তিনি ১২শ শতকের প্রথমার্ধেই হয়তো রাজত্ব করেন। ভোজবর্মণের পর পাট্টিকের রাজ্যের তথা সমতট অঞ্চলের বিশেষ কোনো সংবাদ পাওয়া যায়না। কেবল রণবঙ্কমল্ল হরিখেল দেবের (১২০৪-২১) তাম্রশাসনই (১২২১ খ্রী.) পাওয়া যায়। এ তাম্রপত্রে রণবঙ্কমল্ল পাট্টিকেরের বৌদ্ধবিহারে ভূমিদান করেছেন।

তিনটি তাম্রশাসনের প্রমাণে বঙ্গ-সমতটে এক দেববংশের রাজত্ব স্বীকার করতে হয়। কিন্তু হরিখেলদেবের সঙ্গে এ বংশের সম্পর্ক নির্ণয় করবার মতো তথ্য পাওয়া যায়নি (দামোদর দেবের মেহের ও চাটিগাঁও তাম্রশাসন (১১৫৬, ১১৬৫ শকাব্দ; দশরথ দেবের আদাবাড়ী তাম্রশাসন।)। পুরুষোত্তমদেব, মধুসূদন (মথন) দেব, বাসুদেব দামোদরদেব, দশরথদেব—এ পাঁচজনের নাম তাম্রশাসন থেকে পাওয়া যায়, যারা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের আমলে পাট্টিকের সামন্ত কুসুমদেবের বংশধর, এবং লখনৌতিতে মুসলিম অধিকারের সুযোগে সমতট অঞ্চলে বর্মণদের পরে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। হরিখেলদেব সম্ভবত পুরুষোত্তমের ভাই। তাঁর মৃত্যুর পর পুরুষোত্তমের পুত্র মধুসূদনই সিংহাসন লাভ করেন। দামোদরদেবের মেহের তাম্রলিপি তাঁর রাজত্বের চতুর্থ বছরে তৈরি। অতএব, তাঁর সিংহাসনারোহণ কাল হচ্ছে ১২৩০ খ্রিস্টাব্দ। এতে অনুমান করা যায়, মধুসূদন ও তাঁর পুত্র বাসুদেব দশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। ‘অরি-রাজা চান্দর মাধব’ দামোদরদেবের অধিকার যে চট্টগ্রাম অবধি বিস্তৃত ছিল তার তাম্রশাসনেই প্রমাণ। দামোদরের পরবর্তী রাজা ‘অরিরাজ দনুজমাধব’ দশরথদেব (ওর্ফে দনুজ রায়) সেনদের বিক্রমপুরাদি অধিকারেও আধিপত্য বিস্তার করেন। কিন্তু দশরথদেব ১২৮৩ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসুদ্দীন বলবনের প্রতি সন্ধিসূত্রে আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তাম্রপত্র সূত্রে মনে হয় হয়তো এই বংশেরই গোকুলদেব, নারায়ণদেব, কেশবদেব ও ঈশানদেব সম্ভবত সিলেট অঞ্চলে আরো অনেকদিন স্বাধিকার বজায় রেখেছিলেন। (HB I. 251-257.)

অতএব এ আলোচনা থেকে আমরা নিম্নলিখিত তথ্যগুলো পাই –

  • ক. প্রাচীন সংস্কৃত-সাহিত্যে কিংবা তাম্রপত্রে চট্টগ্রামের নাম পাওয়া যায়না। স্ট্র্যাবো (Strabo) ও পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সি নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় চট্টগ্রাম খ্রীস্টীয় ১ম শতকেও আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বন্দর ছিল।
  • খ. খ্রীস্টীয় ৪র্থ-৫ম শতক অবধি আরাকান-চট্টগ্রাম একক অঞ্চলরূপে ছিল, এবং ১০ম শতক অবধি আরাকানে চট্টগ্রামে মহাযান (সর্বাস্তিবাদী বা বিজ্ঞানবাদী) মত চালু ছিল। তবে তখনো ব্রাক্ষণ্যবাদ ম্লান হয়নি, প্রবলই ছিল। আনোরহটার রাজত্বকালে পগাঁঁয় রাজকীয় সমর্থনে শিন অরহন গুরুবাদী মহাযান ‘আরি’ মত উচ্ছেদ করে হীনযানী থেরবাদ ( গুরুবাদ) প্রবর্তন করেন। আনোরহটা (১০৪৪-৭৭) আরাকান ও চট্টগ্রামাদি অঞ্চল পট্টিকেরের সীমা অবধি জয় করে সেখানেও থেরবাদ চালু করেন। (Harvey op cit 6-7; Hall op cit 124-126.)
  • গ. চট্টগ্রাম গোড়া থেকেই সম্ভবত আরাকানী শাসনে ছিল। আর ৯ম শতকের শেষপাদে ৮৭৭ অব্দের পূর্বে কোনো সময়ে সমগ্র সমতট আরাকানী শাসনভুক্ত ছিল। সেই সনে বৈশালীর চন্দ্ররা আরাকানে ক্ষমতাচ্যুত হন আর পাট্টিকের অঞ্চলে সম্ভবত বৃক্ষচন্দ্রের বংশধর পূর্ণচন্দ্র ও তার বংশ গোটা সমতট, বঙ্গ ও হরিখেলে রাজত্ব করতে থাকেন। ময়নামতীতে আরাকান রাজের মুদ্রা পাওয়া গেছে। (JASP, VI, 1961, 169)
  • ঘ. ৭ম শতকে চট্টগ্রাম সমতটের খড়্গ রাজবংশের রাজ্যভুক্ত ছিল। ইৎসিঙ ও শেঙচির পর্যটনকালে রাজা ছিলেন রাজভট্ট। এ সময়–হিউএন সাঙের মতে-সমতটরাজ্য উত্তরে পুরোনো নিম্নব্ৰহ্মপুত্র নদ, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পশ্চিমে পদ্মানদী। খড়্গদের পরেই চন্দ্ররা রাজত্ব করেন।
  • ঙ. পাহাড়পুরে ৮ম শতকের খলিফা হারুন-অর-রশিদের আমলের মুদ্রা পাওয়া গেছে। আরব বণিকেরা সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দর হয়েই বঙ্গ-কামরূপের অভ্যন্তরে বাণিজ্য করতেন এ অনুমান অসঙ্গত নয়।
  • চ. বঙ্গীয়সূত্রে জানা যায়, খ্রিস্টীয় ৯ম শতকের হরিখেল মণ্ডলের বৌদ্ধ রাজা কান্তিদেব একবার চট্টগ্রামে অধিকার বিস্তার করেন। চট্টগ্রামের এক মন্দিরে তার একটি অসম্পূর্ণ তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। কান্তিদেবের রাজধানী ছিল বর্ধমানপুরা। ফরিদপুর খুলনা প্রভৃতি উপকূলাঞ্চলই সম্ভবত হরিখেল মণ্ডল। এখান থেকেই সমুদ্রপথে হয়তো কান্দিদেব স্বল্পকালের জন্য চট্টগ্রামের অধিকার পান এবং তাম্রপত্র সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বিতাড়িত হন।
  • ছ. চন্দ্ররাজ শ্রীচন্দ্রের আমলে বৈশালীরাজ চূড়চন্দ্ৰসিংহ (৯৫১-৫৭) চট্টগ্রাম জয় করতে এসে চিৎ-তৎ-গঙ (যুদ্ধ করা অন্যায়) –এই আপ্তবাণী স্তম্ভে উত্তীর্ণ করে ফিরে যান। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা থুরতন < সুরচন্দ্র (?) তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। এমনও হতে পারে যে আনন্দচন্দ্রের পরবর্তী সুরচন্দ্র বাচীর কোনো লোক চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের মতে এই থুরতন নামটি সুলতান শব্দের অপভ্রংশ, যিনি চট্টগ্রামের আরব বণিক শাসক। আবার ত্রিপুরা রাজ্যকেও থুরতন বলা হত।
  • জ, চূড়চন্দ্র সিংহের চট্টগ্রাম বিজয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সম্ভবত চন্দ্র-সামন্তরাই চট্টগ্রাম শাসন করতে থাকেন এবং জাতবর্মণ আধিপত্য বিস্তার করেন। কেননা, পগাঁঁরাজ অনোরহটা (১০৪৪-৭৭) ১০৫৯ সনে বা তার কিছু পরে উত্তর-আরাকান জয় করেন। আনোরহটার রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমা ছিল পট্টিকের। পট্টিকের অঞ্চল অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। চট্টগ্রামে অনোরহটা নিজেই সম্ভবত এসেছিলেন। তিনি বাংলা ভ্রমণ করেন, সম্ভবত চট্টগ্রাম ভ্রমণ করেন, এবং সেখানে মানুষের ম্যাজিকাল ইমেইজ স্থাপন করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। চট্টগ্রাম অনেককাল আনোরহটা বংশীয়ের দখলে ছিল। একারণেই সীমান্তের পট্টিকের রাজপরিবারের সঙ্গে পগাঁরাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। পট্টিকেরের এক রাজকুমার পগাঁরাজ কিয়ানজিত্তের (Kyanzittha, ১০৮৪-১১১২) কন্যা শেরপে এইনথি (Sherpe einthi) এর প্রেমে পড়েছিলেন। প্রতিবেশী রাজ্যের কুমারের সঙ্গে একমাত্র সন্তান সিউই (Shewe) এর বিয়ে হলে রাজ্যের অধিকার ভিনদেশী জামাতার হাতে চলে যাবে – এ বিবেচনায় তাকে বিমুখ করা হলে রাজপুত্র আত্মহত্যা করে। আর এই রাজকন্যারই সন্তান রাজা আলাউংসিথু (Alaungsithu, ১১১২–৬৭) পট্টিকের রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। সে কন্যার সৎপুত্র নরথু কর্তৃক হত্যাকাহিনী বর্মা ও আরাকানে ভিন্নভাবে চালু আছে। বর্মারাজ ইতিবৃত্তে ও সাহিত্যে এ কাহিনী বিবৃত রয়েছে। আলাউংসিথুর বংশধর নরসিংহপতি (১২৫৪–৮৭) ১২৭৭ সনে কুবলাই খানের বাহিনীর সঙ্গে Ngasaunggyan–এ যুদ্ধ করেন। (Yule, ed Marco polo 197, 204; Harvey op cit 30, 49, 65-67)। মার্কো পোলো বলেছেন মিয়েনের (Mien) রাজার সঙ্গে বাঙলার রাজাও যোগ দিয়েছিলেন এই যুদ্ধে। হল (Hall) প্রভৃতি সবাই মার্কো পোলোর এ স্থলে বাঙলার উল্লেখ করা ভুল হয়েছে বলে মনে করেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় মার্কো পোলো স্বয়ং কুবলাই খাঁর দরবারে উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন এবং তিনি বাঙলার যে-পরিচয় দিয়েছেন তাতে অজ্ঞতার ছাপ নেই। কাজেই এ যুদ্ধের প্রতিপক্ষ নির্দেশে তার ভুল হবার কথা নয়। সম্ভবত চট্টগ্রামের সামন্তশাসক তখনো পগাঁরাজের অনুগত এবং এ যুদ্ধে সহায়তা করতে বাধ্য ছিলেন। ১২৮৩ সনে দ্বিতীয় মোঙ্গল আক্রমণের ফলে কেন্দ্রীয় শাসন শিথিল হয়ে পড়ে, তার ফলে উত্তর আরাকান (এবং এ সঙ্গে চট্টগ্রামও) স্বাধীন হয়ে যায়। এ সময় পগাঁরাজ্যে মুসলিম প্রভাবও লক্ষণীয়। ঝড়ে বাণিজ্যতরী ভঙ্গ হলে বুত্তা (Butta) নামে এক আরব বণিক বা নাবিকও এ সময় পগাঁঁয় বাস করতে থাকেন। এর এবং রামান কান (Raman kan, রহমান খান) এর দরবারে প্রতিপত্তি ছিল, এ ছাড়া সৈন্যদলে অনেক মুসলিম ও ভারতীয় থাকতো। (Hall, op, cit 132: Harvey op cit 24, 31.)
  • ঝ. ১১শ-১২শ শতকে চট্টগ্রাম সম্ভবত পগাঁ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৩শ শতকের প্রথমার্ধে মধুসূদনদেব, বিশেষ করে দামোদরদেবের (১২৪৩) শাসনে ছিল, দামোদরদেবের তাম্রশাসনই তার প্রমাণ। এর পরেও হয়তো পগাঁরাজ চট্টগ্রাম শাসকের আনুগত্য পেতেন, নইলে ১২৭৭ সনে তাকে কুবলাই খানের সঙ্গে যুদ্ধে পগাঁরাজের সহায়করূপে পাওয়া যেত না।
  • ঞ. রাজমালা সূত্রে জানা যায়, ত্রিপুরারাজ ছেঙথুমফাই প্রথম চট্টগ্রাম জয় করেন। এটা ১০ম শতকের কথা, কিন্তু তার অধিকার স্থায়ী হয়েছিল বলে মনে হয় না। অবশ্য রত্নফা ও তাঁর পিতা বা ভাতার আমলে চট্টগ্রাম ত্রিপুরা শাসনে ছিল বলে মনে করা হয়। পগাঁর বিপর্যয়ের সুযোগে আরাকান রাজ মিহনতি (Mihnti) প্রবল হয়ে ওঠেন। তিনি চট্টগ্রাম জয় করেন এবং সোনারগাঁয়ের সেন রাজা তার বশ্যতা স্বীকার করে করদান করতেন। মার্কো পোলো এবং ১৩১৩ সনে স্যার জন হার্বাট চট্টগ্রাম পর্যটন করেন। হার্বাট চট্টগ্রামকে সমৃদ্ধ ও জনবহুল নগরীরূপে দেখেছেন। মিহনতি (Mihnti) বা মেঙদির আমলে উত্তর বঙ্গের চাকমা রাজধানী মাইচাগির (১৩৩৩-৩৪) আরাকান অধিকারে আসে। যুদ্ধে কাঁইচার ত্রিশ হাজার বাঙালি মজুর হিসেবে যোগদান করে। (সৈয়দ আহমাদুল হক : A short history of chittagong পৃ. ২; মাহমুদুল আলম : চট্টগ্রামের ইতিহাস, পুরানা আমল (৩য় সং) পৃ. ৩৪, ৩৯)।

আরাকানের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের আদি ইতিহাস

বিদ্বানদের মতে অস্ট্রো-এশীয় এবং ভোট-চীন গোত্রীয় মানুষই সম্ভবত চট্টগ্রাম ও তার সংলগ্ন আরাকানের খ্রিস্টপূর্ব যুগের আদি অধিবাসী। (JASB (Letters) XVI 1950 232)। আর খ্রিস্টীয় সনের গোড়ার দিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরা তাদের উন্নততর ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এসব অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে। এভাবে খাসী ও কুকী চীনাদের সাথে আর্যজাতির ভাষা ধর্ম ও সংস্কৃতির পরিচয় ঘটে। আরাকানী সূত্রে জানা যায়, আরাকানে খ্রিস্টপূর্ব ১০ম কিংবা ১২শ শতকের পূর্বে বর্মী অনুপ্রবেশ ঘটেনি। (JASB 19, 14, 90 phayre, A History of Burma 15-17, 293-304: Harvey, G E. History of Burma 137-313, 269-70, Hall, D. E; History of South East Asia. 121, 328-29: Bulletin of the School of Oriental and African Studies (BLSOAS) XI, 357-85)। পক্ষান্তরে উত্তরভারতীয় আর্যেরা খ্রিস্টীয় সনের গোড়া থেকেই আরাকানে বসতি নির্মাণ করে। আরাকানে প্রথমে ব্রাহ্মণ্য ও পরে বৌদ্ধপ্রভাব বিস্তৃত হয়। এর পুরোনো রাজধানীর নাম দিল্লাওয়াতী ধান্যবতী বা তৃণবতী এবং বেসালি (বৈশালী), চন্দ্রবংশীয় রাজাদের সংস্কৃত ও বিকৃত সংস্কৃত নাম-সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার, আরাকানীদের মাগধী বলে আত্মপরিচয় দান, (Bengal past and present. XXXIII, 1927, 139) বৃষ মূর্তি, ধ্বজ ও লাঞ্ছন প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যপ্রভাবের ও ভারতিক জনবসতির স্বাক্ষর বহন করে। সম্ভবত বিহারের বৈশালী থেকে আগত চন্দ্রারাজা পিতৃভূমের নামানুসারে রাজধানীর নাম বৈশালী রাখেন। (Harvey, প্রাগুক্ত, ২৩,১৩৭-৩১৬: phayre প্ৰা ২২, Hall প্ৰা ৩২৯)। আরাকানের ইতিহাসের আলোকে চট্টগ্রামের পুরোনো ইতিহাসের কাঠামো তৈরি করা সম্ভব। Phayre ও Harvey-র সংযোজিত তালিকায় দেখা যায় চন্দ্রবংশীয়দের রাজত্বকাল সাময়িক ছেদ থাকলেও—–১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি প্রসারিত।

পর্বত ও সাগরবেষ্টিত চট্টগ্রাম একটি প্রাচীন ভূখণ্ড। এর সঙ্গে আরাকানের সম্পর্কও সুপ্রাচীন। প্রকৃতপক্ষে আরাকান ও চট্টগ্রাম একই ভূখণ্ড। মধ্যে কেবল পর্বতমালার ব্যবধান। এই দুরতিক্রম্য বাধাই উভয় অঞ্চলে অভিন্ন গোত্রীয় জনবসতির অন্তরায় ছিল। তাই আরাকানে যেমন ভোট চীনা গোত্রীয় কিরাত-জাতীয় লোকের আধিক্য দেখা যায়, তেমনটা চট্টগ্রামে দেখা যায়না। আর দুর্লঙ্ঘ্য পর্বতবেষ্টিত বলেই আরাকান ব্রহ্মদেশ থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে অনেক কাল ধরে আরাকানের রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হয়েছিল। তবু আরাকান অঞ্চলের শাসক গোষ্ঠীর এবং আভিজাত্যকামী জনগণের মাগধী-ঐতিহ্যপ্রীতি ধর্মসূত্রে উত্তর-ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রভাব দেখা যায়, যা থেকে বোঝা যায়, প্রায় দু’হাজার বছর আগে হিন্দু-বৌদ্ধ জনসমষ্টি তাদের ভাষা, লিপি, ধর্ম ও সাংস্কৃতি নিয়ে এ পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং অপেক্ষাকৃত অনুন্নত স্থানীয় জনগণকে ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতিতে দীক্ষা দান করে। সমগোত্রীয় বলে চট্টগ্রামবাসীরা ধর্মে, ভাষায় ও সংস্কৃতিতে উত্তরভারতীয় জাতীয়তা স্বীকার করে নিলেও অনেককাল রাষ্ট্রীয় অভিন্নতা সাধন সম্ভব হয়নি, যার মুখ্য কারণ ছিল সম্ভবত ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা। বর্তমান বাংলার অঞ্চলগুলোর মধ্যে উত্তরবঙ্গের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্যই প্রাচীনতম, রাঢ় অঞ্চলও প্রাচীন। কিন্তু সেখানকার জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কিংবা রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য সুপ্রাচীন নয়। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে দেখা যায় “ব্যাধ গোহিংসক জাতিতে চোয়াড়। কেহ না পরশ করে লোকে বলে রাঢ়।” এবং জৈন-বৌদ্ধ গ্রন্থেও রাঢ়বাসীর নিন্দা রয়েছে। এই উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রামের বিশেষ সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না, কেননা সমতট (Plain coastal land) অঞ্চল সম্ভবত অনেক পরে সাগরগর্ভ থেকে গড়ে ওঠে। হুএনৎসাঙ কিংবা ইংসিঙের বর্ণনাসূত্রে জানা যায়, সমতট অঞ্চলে দিগন্তবিসারী হাওড় বা জলাভূমি ছিল। খ্রিস্টীয় ১ম শতকের গোড়ার দিকে (১৮-২৪ খ্রী.) পর্যটক স্ট্রাবোও লোনা জলের উপদ্রব দেখেছিলেন। কাজেই এ অঞ্চল জনবিরল ছিল বলেই মনে হয়।

উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার ফলেই চট্টগ্রাম মৌর্য, গুপ্ত কিংবা পাল শাসনভুক্ত হয়নি বলে মনে হয়। এ সুযোগে সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্রমবিকাশে চট্টগ্রামে অধিকার বিস্তার করে চট্টগ্রাম-সংলগ্ন আরাকানের সুপ্রতিষ্ঠিত রাজশক্তি, যা পরে সমতট অবধি পরিব্যাপ্ত হয়। এ অনুমানের সমর্থন মেলে ((JASB, XVL, 1950 232-33: বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, ৪র্থ বর্ষ ৩য় সংখ্যা, ১৩৬৭ পৃ. ২৪-৩৫।) –

  • আনন্দচন্দ্রের স্তম্ভলিপিতে
  • ময়নামতীর চন্দ্ররাজাদের ঐতিহ্যে
  • পগাঁঁরাজ অনারঠার আরাকান-পাট্টিকের-এ আধিপত্য লাভের ইতিকথায় কুবলাই খাঁর বাহিনীর সঙ্গে Mien ও বাঙালি সৈন্যের যুদ্ধের উল্লেখে
  • পাট্টিকের রাজকন্যার সাথে পগাঁঁরাজ অলংসিথুর বিয়ের বর্ণনায় এবং
  • পাট্টিকের রাজপুত্রের পঁগারাজকন্যার পাণি প্রার্থনার কাহিনীতে

মহাভারতীয় যুগের পর ও বৌদ্ধযুগের কিছুকাল পূর্ব থেকে এবং তার অনেক পরে পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও আরাকান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষত্রিয় রাজগণ কর্তৃক শাসিত হত, আরাকানের রাজোয়াং ইতিহাসে দেখা যায় আরাকান রাজ্যের দৈর্ঘ্য ৩৫০ মাইলেরও বেশি ছিল। আরাকানের রাজোয়াং গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, অতি পুরাকালে আরাকান রাজ্যে কাশীধামের কোন নৃপতি এসে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার অনেক পুত্রগণের মধ্যে কোমিসিংহ আরাকান রাজ্য প্রাপ্ত হন, এবং বর্তমান চাঁদা সহরের নিকট রামাবতী বা রামরী নামক স্থানে তার রাজধানী স্থাপন করেন। সেখানে তার বংশধরগণ অনেক বছর সেই রাজ্য শাসন করে আসছিলেন। তার পরবর্তী কোনো নৃপতির দশজন পুত্রের হাতে রাজসিংহাসন পতিত হলে তাদের অত্যাচারে রাজ্যে ঘোর অশান্তি জন্মে। সেইজন্য প্রজাগণ বিদ্রোহী হয়ে এদেরকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে দেয়, এবং কয়েকজনকে হত্যা করে। পরে তাদের ভগ্নী ঐ সিংহাসনের অধিকারিণী হন। তিনি জনৈক ব্রাহ্মণের সাথে  রামাবতী ত্যাগ করে আরাকানে এসে উপনীত হন এবং সেই ব্রাহ্মণকে পতিত্বে বরণ করেন ও আরকানে রাজধানী স্থাপন করেন। এর ধন্যবর্তী নামক এক পরমা সুন্দরী কন্যা জন্মে, তাকে আরাকানের উত্তর দিকস্থ কলদান নদীর তীরবর্তী মরুবংশীয় কোন রাজকুমার বিবাহ করেন, এবং সেখানে সেই কন্যার নামে ধন্যবতী নামক একটি নগর স্থাপন করেন। মহারাজোয়াং মতে এই মরু বা মৌরিয় বংশের রাজগণের সিংহাসন অধিরোহণের কাল খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ বছর। এই বংশীয়গণ ১৮৩৩ বছর সেখানে রাজত্ব করেন। অতঃপর রাজ্যে বিদ্রোহ উপস্থিত হলে রানি দুটি কন্যাসহ পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

মহারাজোয়াং গ্রন্থে আরও দেখা যায় যেই বংশে শাক্য বুদ্ধদেব জন্মগ্রহণ করেন, সেইবংশে তার জন্মাবার বহু বছর পূর্বে অভিরাজ নামক এক নরপতি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার রাজ্যে অন্তর্বিপ্লব উপস্থিত হওয়ায় তিনি নিজ রাজ্য কপিলাবস্তু নগর ত্যাগ করে ইরাবতী নদীর তীরে “টাগাউন” নগর স্থাপন করে সেখানে রাজত্ব করেন। তার দুই পুত্র ছিল। “কানরাজগজি” ও “কানরাষ্ট্রী”। অভিরাজের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে এই দুই ভ্রাতার বিবাদ উপস্থিত হয়; পরে এটা ঠিক হল যে যিনি রাত্রি মধ্যে ধর্মমন্দির তৈরি করতে পারবেন, তিনিই সিংহাসনে অধিরোহণ করবেন। চতুর কনিষ্ঠ “কানরাঞ্জী” কৌশলে রাত্রি মধ্যে ধর্মমন্দির তৈরি করে রাজ্যেশ্বর হলেন। জ্যেষ্ঠ “কানরাজগজি” আপন সৈন্যগণ নিয়ে ইরাবতীর নিম্নদিকে চলে যান ও সেখানে গিয়ে এক রাজ্য স্থাপন করেন; এবং উক্ত রাজ্যে তার পুত্রকে রাজা করার পর তিনি আরাকানের উত্তর দিকের কাউকপাণ্ডায়ুং পর্বতে রাজধানী স্থাপন করেন। আরকানীরা উক্ত রাজা ও তার সমভিব্যাহারী সৈন্যসামন্তগণের বংশধর বলে নিজেদের পরিচয় দিয়া থাকেন, ও বর্মাবাসীগণদের (বার্মিজ) থেকে আসা পুরনো ক্ষত্রিয় শাখা সম্ভূত বলে দাবি করেন। “কানরাজগজি” মৌরীয়বংশের এক কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। আরাকানের ইতিহাস রাজোয়াং মতে ৬২ জন রাজা এই বংশে ক্রমাগত রাজত্ব করেছিলেন। এই বংশীয়গণেরই রাজত্ব সময়ে বুদ্ধদেব (গৌতম) শিষ্য সমভিব্যাহারে আরাকান পরিভ্রমণে এসেছিলেন। “কানরাজগজি” বৃদ্ধ বয়সে উক্ত রাজধানী পরিত্যাগ করে চট্টগ্রামের দক্ষিণপূর্ব পাহাড়ে বাসস্থান নির্দিষ্ট করেছিলেন। এখনও সেই পাহাড়ের দুর্গম পথ অতিক্রম করে প্রবেশ করলে রাজবাটীর ভগ্নাবশেষ দেখা যায়।

“কানরাজজির” বংশধরগণ ১৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আরাকানে রাজত্ব করেন। তারপর রাখাইংমুরের চন্দ্রসূর্য নামক জনৈক নৃপতি আরাকান রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন, তিনিই আরাকানের চন্দ্র রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এক বৌদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার সময়ে বৌদ্ধধর্ম রাজধর্ম রূপে পরিগৃহীত হয় ও রাজ্য মধ্যে বিশেষভাবে বিস্তার লাভ করে। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মরাজ আরাকান অধিকার করে ঐ মূর্তি অমরাপুর শহরে নিয়ে যান। মহারাজ চন্দ্রসূর্যের রাজত্বের তিন শতাব্দীর পর চীন পরিব্রাজক ফাহিয়ান আরাকান আগমন করেছিলেন বলে তার “কো-কুই-ফি” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার ভ্রমণবৃত্তান্তে বুদ্ধদেব আরাকান রাজ্যের চারিস্থানে ধর্মচক্র প্রবর্তন (উপবেশন) করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন, এবং চার স্থানে চারিটি “ফো” বা মঠ দেখেছিলেন বলে লিখেছেন। তিনি সেই চারটি “ফো” বা মঠের মধ্যে তিনটি আরাকানে ও অন্যটি চম্পানগর থেকে বহু শত যোজন পূর্বদিকে বলে উল্লেখ করেছেন। এটাই চট্টগ্রামের অন্তর্গত হস্তিগ্রামের “ফোরাচেঙী” ফো বা মঠ” বলে অনেকে অনুমান করেন। তারপর খ্রিস্টিয় ৭ম শতাব্দীতে হিউয়াংসাং তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে শ্রীচটলো Sri Satalo বা সিহলিচটলো উল্লেখ করেন, ব্রহ্মদেশের ইতিহাস লেখক কর্ণেল ফাইয়ারের মতে হিউয়াং সাং আরাকান রাজ্যের ভেতর দিয়ে ব্রহ্মদেশ হয়ে দক্ষিণাভিমুখে গিয়াছিলেন, সেজন্য তিনি কমলাঙ্ক (কুমিল্লা)-কে রামলঙ্কা; ও চটলোকে পেণ্ড প্রভৃতি ব্রহ্মরাজ্যের অন্তর্গত দেশ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এটি তার ভ্রম, কল্পনা মাত্র”।

“কানরাজগজির” রাজ্যারম্ভের কাল ৮২৫ খ্রিস্টাব্দ। “কানরাজগজি” থেকে ৫৩ জন রাজার পর মহাসিংহচন্দ্র এইদেশের রাজা হন। তিনি আরাকানের অন্তর্গত বৈশালীনগরে রাজ্য স্থাপন করেন। এই স্থানে চন্দ্রসূর্য বংশীয় রাজগণ ১৬৯ বছর রাজত্ব করেছিলেন। ৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে মৌরীয় বংশীয় একজন রাজা আরাকানের সিংহাসনে অধিরোহণ করেন। তিনি ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র ৩৬ বছর রাজত্ব করেন। তারপর আবার চন্দ্রবংশীয় জনৈক নৃপতি পুনরায় আরাকান অধিকার করে রাজা হন। এর পর শানগণ আরাকান অধিকার করে ১০১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন।

শানগণের পর পুগান দেশীয় রাজা অনুরথ আরাকান আক্রমণ করে অধিকার করেন। তিনি ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রবংশীয় একজন রাজাকে রাজ্য দিয়ে স্বদেশে চলে যান; এই চন্দ্রবংশীর নরপতি পিংসা নগরীতে রাজধানী স্থাপন করেন। ৭০ বছর কাল পর্যন্ত এই দেশ পুগানগণের করদ রাজ্য ছিল; শেষ করদ রাজার নাম মেঙবিলু। তার মন্ত্রী তাকে হত্যা করে আরাকানের সিংহাসন অধিকার করেছিলেন, সেজন্য মেঙবিলুর উত্তরাধিকারী মেঙরেবয়া সপরিবারে পালিয়ে পুগানরাজ্যের রাজা খ্যানশিশার আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি পঁচিশ বছর কাল সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর লেট্যামেঙ নামক তার পুত্রকে পুগানসম্রাট্ আলঙশিশু একলক্ষ পুগানসৈন্য ও একলক্ষ প্য-সৈন্য দিয়ে আরাকান জয় করে লেট্যামেঙকে আরাকানের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজা লেট্যামেঙ পীরণ নগরে রাজধানী স্থাপন করেন। ৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ষোলসিংহ চন্দ্র আরাকানের রাজা হয়ে চট্টগ্রাম আক্রমণ করে অধিকার করেন। ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে চীন রাজদূত চেংহো ভারত ভ্রমণে আসেন। তার আরবদেশীয় দোভাষ মাহুয়ানের বর্ণনায় জানা যায়, তারা সুমাত্রা দ্বীপ থেকে ২১ দিনে জাহাজে চড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে উপনীত হন, এবং চট্টগ্রাম থেকে নৌকাযোগে ৫০০ লী সোণাকং (সোনারগাঁও) পৌঁছেছিলেন। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মরাজ “মেঙয়ামায়ুঙ” কর্তৃক আরাকানরাজ শোয়ানাংঙ্গি আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে গৌড়দেশে পলায়ন করেন, এবং ব্রহ্মরাজ তার জামাতা অনুরথকে আরাকানে রাজা করেন। কিন্তু পেগুরাজ অনুরথকে পরাজিত করে “দিবাৎ” নামক জনৈক ব্যক্তিকে রাজা করেন। ঐদিকে গৌড়েশ্বর, সেনাপতি ওয়ালীখাঁকে সঙ্গে দিয়ে আরাকান রাজ্য আক্রমণ করতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ওয়ালীখা শোয়ামাংজিকে আরাকান রাজ্য দিয়ে নিজে চট্টগ্রাম অধিকার করে বসেন। তার মৃত্যু হলে “মিনখারী” অলিখাঁ নাম ধারণ করে আরাকানের রাজা হন।

যাই হোক, আবার একটু পূর্বের চন্দ্রসূর্যের দ্বারা চন্দ্র রাজবংশের প্রতিষ্ঠার আলোচনায় ফিরে যাউ। চন্দ্রসূর্যের বংশধরেরা সূর্যাধিপতি -সূর্যপ্রতিপদ-সর্যরূপ-সূর্যমণ্ডল-সূর্যবর্ণ-সূর্যউষ্ণ-সূর্যনাথ-সূর্যবন্ত -সূর্যবন্ধু-সূর্য কল্যাণ-সূর্যমুখ্য-সূর্যতেজ-সূর্যপূণ্য-সূর্যকলা-সূর্যপ্রভা-সূর্যসিক্ত-সূর্যতীর্থ-সূর্যবিমল-সূর্যসেন-সূর্যগ্রন্থ -সূর্যস্বর্গ -সূর্যশ্রী -সূর্যক্ষিতি-সূর্যকূট-সূর্যকেতু নাম দিয়ে ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ অবধি রাজত্ব করেন। তারপর বৈশালীতে (Wesali) ৭৮৮ থেকে মহাসিং চন্দ্র-সূর্য সিংহচন্দ্ৰ-মৌলসিংহচন্দ্র, পুরুসিংহচন্দ্র, কালসিংহচন্দ্ৰ, তুবসিংহচন্দ্ৰ, শ্রীসিংহচন্দ্ৰ, তীক্ষ্ণসিংহচন্দ্ৰ, চূড়সিংহচন্দ্র প্রমুখ ৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ অবধি রাজত্ব করার পর মিউগোত্র প্রধান ‘অম্যহতু’ সিংহাসন দখল করেন। তার পুত্র যেপিউ (Yepyu) থেকে চূড়সিংহের সন্তান সিংহাসন ছিনিয়ে নেন। চূড়সিংহের ভ্রাতুষ্পুত্রের সন্তান Hkitrathin Pyinsa- কেই রাজধানী করেন। এখানে ১০১ থেকে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি এ বংশের রাজধানী থাকে। তারপর এ বংশেরই রাজা Leryminnau ১১০৩ কিংবা ১১১৮ সনে Parin কে রাজধানী করেন। এখান থেকে ১১৬৭ সনে এই বংশের Minaousa, Hkrit শহরে রাজধানী স্থাপন করেন। এ বংশের Misuthin Pyinsa-কে আবার রাজধানী করেন ১১০৮ খ্রীষ্টাব্দে। ১২৩৭ সনে Laungyer-এ রাজধানী হয় এবং ১৪৩৩ সন থেকে ১৭৮৫ সনে বর্মী বিজয় অবধি Mrohaung বা Mrauku-ই শাসনকেন্দ্র ছিল। তালিকা অনুসারে দেখা যায় চন্দ্রসূর্যের বংশধরেরাই প্রায় ১৬৫০ বছর ধরে রাজত্ব করেন। অবশ্য মাঝেমধ্যে তারা সাময়িকভাবে ক্ষমতাচ্যুতও হয়েছেন। এই তালিকার সঙ্গে আনন্দচন্দ্র প্রদত্ত তালিকার মিল নেই। আনন্দচন্দ্রের উৎকীর্ণ লিপিতে প্রাপ্ত পূর্ব রাজাদের অস্তিত্বেরও সন্দেহ করা যায় না, কারণ এর মধ্যকার কোনো কোনো নামের মুদ্রা পাওয়া গেছে। তাহলে এটাই বোঝা যায় যে, কোনো একটি বংশ গোটা আরাকান অঞ্চলের উপর Yoma পর্বতসীমা অবধি সব সময় রাজত্ব করেনি। কেন্দ্রীয় শাসন-শৈথিল্যের সময় বিভিন্ন সামন্ত স্বাধীনভাবে বংশ পরম্পরায় রাজত্ব করেছেন। রাজধানী পরিবর্তনের কারণও এটাই হবে। সম্ভবত ধান্যবতী ও বৈশালী বা অন্যত্র একই সময়ে অর্থাৎ ৩৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে চন্দ্রবংশীয় দুটো শাখা স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকে, এবং ৭৮৮ সনে হয় ধান্যবতী শাসকেরা (Phayre ও Harvey-র তালিকা অনুসারে) বৈশালী রাজ্যের শাসনভার প্রাপ্ত হয়ে স্থানীয় পূর্ববর্তী রাজাদের মতো ‘চন্দ্র’ বাচী নাম গ্রহণ করেন, অথবা এ সময়ে বৈশালীর চন্দ্ররা ধান্যবতী রাজ্য জয় করে গোটা অঞ্চলের অধিপতি হন।

প্রথমোক্ত অনুমান সত্য হলে, অর্থাৎ ধান্যবতী রাজ্য বৈশালীর শাসনভার নিয়ে চন্দ্র নাম গ্রহণ করলে বলতে হয় এই Dven চন্দ্রের রাজ্যসীমা সমতট অবধি বিস্তৃত ছিল। বৈশালীর চন্দ্র রাজবংশের পতনের পর পরপুর নামক উপকূল অঞ্চলের সামন্তরাজা (?) মহাবীর আরাকানের একাংশে রাজত্ব করেন। (পুরপুরা, পুরপুর, পুরপ্পুরা (Purappura: BLSOAS পৃ. ৩৬৯-৭০; টলেমীর Barakura ইবনে বত্তুতার Barakan; Katabeda সম্ভবত Kutabdia. এই Katabeda-র পরেই bara, এটিই সম্ভবত purapqura এবং আকিয়াব ও কুতুবদিয়ার মধ্যস্থলে।) সে অঞ্চলের রাজপরম্পরার নামই আনন্দের স্তম্ভলিপিতে উৎকীর্ণ হয়েছে। এরপরে ব্রয়জপ (Vrayajap) ও Sevinrcni উভয়েই বারো বছর করে ২৪ বছর রাজত্ব করেন। তারপর রাজা হন ধর্মশূর। তারপর বজ্রশক্তি-ধর্মবিজয়-নরেন্দ্রবিজয়-ধর্মচন্দ্র অথবা নরেন্দ চন্দ্র (বজ্রশক্তির অপর পুত্র আনন্দচন্দ্ৰ।

চন্দ্রদের রাজধানীর উল্লেখ আনন্দচন্দ্রের উৎকীর্ণ স্তম্ভলিপিতে নেই, এই স্তম্ভ কোথায় প্রতিষ্ঠিত ছিল তাও জানা নেই। স্থানান্তরিত হয়ে ম্রোহঙের Shitahaung প্যাগোডায় রক্ষিত আছে। (BLSOAS প্রা. পৃ. ৩৭০-৭১) কাজেই বৈশালীই আনন্দ-চন্দ্রের রাজধানী ছিল, তেমন কথাও বলা চলে না। তবে ম্রোহঙ-এ রক্ষিত আলোচ্য স্তম্ভলিপি থেকে অনুমান করা যায় যে, ম্রোহঙ-এ বা তার সন্নিহিত কোনো অঞ্চলে আনন্দ চন্দ্ররা রাজত্ব করতেন। সমতটের সঙ্গে ম্রোহঙ এর যে এর ধর্মীয় সাংস্কৃতিক যোগ ছিল তার প্রমাণ হচ্ছে –

  • উভয় অঞ্চলে চুণ্ডাদেবীর প্রতিষ্ঠা
  • মহাযান সর্বাস্তি মতের প্রাবল্য
  • Naulakka, Domgaha, Dankanganurganga, Duvara Bhuro kanaulakkalvaraka প্রভৃতি বঙ্গের অনার্য স্থান-নাম এবং
  • সমতট অঞ্চলে ময়নামতীতে আরাকানী চন্দ্ররাজাদের মুদ্রা প্রাপ্তি

E. H. Johnston-এর বিবৃত পাঠের অনুসরণে আমরা আনন্দের স্তম্ভলিপিতে উৎকীর্ণ রাজপরম্পরার নামের তালিকা –

  • ১। ১০১৬ বা ১০৬০ বছর ব্যাপী রাজত্ব করা ১৪ জন রাজা
    • ১. অজানা – ১২০ বছর
    • ২. অজানা – ১২০ বছর
    • ৩. অজানা – ১২০ বছর
    • ৪. বহুবলি – ১২০ বছর
    • ৫. রঘুপতি -১২০ বছর
    • ৬. অজানা – ১২০ বছর
    • ৭. চন্দ্রোদয় – ২৭ বছর
    • ৮. অন্নবেত – ৫ বছর
    • ৯. অজানা – ৭৭ বছর
    • ১০. রিম্ভ্যপ্প – ২৩ বছর
    • ১১. রানী কুবেরামী বা কুবেরা – ৭ বছর
    • ১২. তারস্বামী উমাবীর্য – ২০ বছর
    • ১৩. যজ্ঞ (Jugna) – ৭ বছর
    • ১৪. লাঙ্কী (Lanki) – ২ বছর
  • ২। চন্দ্রবংশীয় রাজা : এ বংশের উদ্ভবকাল আনু, ৩৩০-৬০ খ্রিস্টাব্দ, পতনকাল আনু. ৫৬০-৯০ খ্রিস্টাব্দ। এঁরা আনু, ৫৬০ বা ৫৯০ অবধি ২৩০ বছর রাজত্ব করেন।
    • ১. (Dven) দ্বেনচন্দ্র – ৫৫ বছর, তিনি ১০১ জন রাজাকে পরাভূত করেন
    • ২. রাজচন্দ্র – ২০ বছর
    • ৩. কালচন্দ্র – ৯ বছর, একটি প্রাপ্ত মুদ্রা কালচন্দ্রের বলে অনুমিত। (Johnston p.384) এই নামটি এবং ৯ বছর শাসনকাল বৈশালীর কালচন্দ্রের সঙ্গে মিলে যায়।
    • ৪. দেকচন্দ্ৰ – ২২ বছর, এঁর মুদ্রা পাওয়া গেছে।
    • ৫. যজ্ঞচন্দ্ৰ – ৭ বছর
    • ৬. চন্দ্ৰবন্ধু – ৬ বছর, কেউ কেউ এঁকে ভিন্নবংশীয়, অর্থাৎ জবরদখলকারী বলে অনুমান করেন।
    • ৭. ভূমিচন্দ্ৰ – ৭ বছর
    • ৮. ভূতিচন্দ্ৰ – ২৪ বছর
    • ৯. নীতিচন্দ্ৰ – ৫৫ বছর, এঁর ছোট-বড় অনেক মুদ্রা পাওয়া গেছে।
    • ১০. বীর্যচন্দ্র বা বীরচন্দ্র – ৩ বছর, মুদ্রায় তার ‘বীর’ নাম উৎকীর্ণ পাওয়া যায়।
    • ১১. প্রীতিচন্দ্ৰ – ১২ বছর, এঁর মুদ্রা পাওয়া গেছে।
    • ১২. পৃথিবীচন্দ্ৰ – ৭ বছর, এঁর মুদ্রা পাওয়া গেছে।
    • ১৩. ধৃতিচন্দ্ৰ – ৩ বছর, এঁর মুদ্রা পাওয়া গেছে।
  • ৩। পরবর্তী শাসকগণ
    • ১. মহাবীর – ১২ বছর
    • ২. ব্রজযপ (Vrajayap) – ১২ বছর
    • ৩. Sevinirin (Mevukaghatin) – ১২ বছর
    • ৪. ধর্মশূর – ১৩ বছর
  • ৪। ধর্মশূরের পরবর্তী শাসকবংশ
    • ১. বজ্রশক্তি – ১২ বছর, দেবাউজ বা শ্রীধর্মবাজাওজ তথা আদিনাথের বংশজ।
    • ২. ধর্মবিজয় – ৩৬ বছর, বিজ্ঞানবাদী বা সর্বাস্তিবাদী মহাযান পন্থী, এঁর মুদ্রা পাওয়া গেছে।
    • ৩. নরেন্দ্র বিজয় – ২ মাস
    • ৪. শ্রীধর্মচন্দ্র বা বীরনরেন্দ্রচন্দ্র – ১৬ বছর, এঁর মুদ্রা পাওয়া গেছে, (বজ্রশক্তির অপর সন্তান)
    • ৫. আনন্দচন্দ্ৰ, ৯ বছর, ইনি সিংহলের শিলামেঘ বর্ণ রাজার ও দাক্ষিণ্যাত্যের শ্রীতাম্র পত্তনের রাজা শৈব-অন্দের কন্যা Dhanda-কে বিয়ে করেছিলেন, এঁর রাজত্বের নবম বছরে আলোচ্য স্তম্ভলিপি উৎকীর্ণ হয়। আনন্দ্রচন্দ্র আনন্দোদয় আনন্দ মাধব, আনন্দেশ্বর নামের বহু মঠ মন্দির ও বিহার প্রতিষ্ঠাতা; সিংহলের ভিক্ষুদেরকেও দানে তুষ্ট করেন।
    • আনন্দচন্দ্ররা আনু, ৬৮৫ কিংবা ৭১৫ খ্রীষ্টাব্দ অবধি ১২৫ বছরকাল রাজত্ব করেন। (অষ্টসাহস্রিক প্রজ্ঞাপারমিতা (কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথি) : HB.) পরবর্তী দুজন রাজার নাম (আনু. দশ শতকের) সিংহ গণপতিশুর চন্দ্র এবং সিংহ বিক্রমশূর চন্দ্র।

উপরে আলোচিত তথ্য থেকে কয়েকটি ধারণা গঠন করা যায় –

  • ক. ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও বোঝা যায় যে, ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি প্রভাবিত উত্তরভারতীয় লোকেরা আরাকানে উপনিবিষ্ট হয়। এদেরই ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত আদি রাজার নাম চন্দ্ৰসূর্য। ধান্যবতী (Dinnyawati> ধান্যবতী Johnston প্রদত্ত নাম) এঁর ও এঁর বংশীয়গণের ৮ম শতক অবধি রাজধানী ছিল।
  • খ. সম্ভবত খ্রিস্টিয় ৪র্থ শতক থেকে এদের জ্ঞাতিবংশীয় বা অপর চন্দ্র বংশীয় সামন্ত Dven (Devendra বা Dvija Singh) চন্দ্ৰ বৈশালীতে বা ম্রোহঙ-এ স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এবং ২৩০ বছর যাবৎ এ বংশীয়রা রাজত্ব করেছিলেন। এঁদের রাজ্যসীমা সম্ভবত সমতট অবধি বিস্তৃত ছিল।
  • গ. দেশীয় শ্রুতি-স্মৃতি অনুসারে ধান্যবতীর রাজারা ৭৮৮ সনে বৈশালীতে রাজধানী করেন। এ থেকে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না হয়তো যে ধান্যবতীর রাজা বৈশালী রাজ্য দখল করে এখানেই রাজধানী করলেন এবং পূর্ববর্তী স্থানীয় রাজাদের অনুকরণে ‘চন্দ্র’ বাচীও নামের সঙ্গে যুক্ত করলেন। সম্ভবত ধান্যবতীর রাজা গোটা চন্দ্র রাজ্য জয় করতে পারেননি। তার উত্তরাংশে ম্রোহঙ অঞ্চলে চন্দ্রদের পরপুরাস্থ সামন্ত রাজা মহাবীর স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। অথবা পরপুরা তাঁর নবার্জিত রাজ্যেরও শাসনকেন্দ্র হয়।
  • ঘ. পালি-সাহিত্যের ‘নিদ্দেস’ উক্ত পুরেপুর পরপুর> পুরপুর, Ptolemy র বরকুব ইবন বক্তৃতার বরকান, কুতবদিয়া ও আকিয়াবের মধ্যস্থিত কোনো বন্দর। কাজেই পরপুর, বৈশালী, Hkrit, পিনসা, পেরিন ও ম্রোহঙ-এর নিকটবর্তী হওয়ারই কথা। ঙ. মহাবীর বা তাঁর পরবর্তী রাজা বজ্রশক্তি বংশীয়দের রাজধানী কোথায় ছিল, তা স্তম্ভলিপি থেকে কিংবা মুদ্রা থেকে জানা যায় নি। বৈশালী ছাড়া উক্ত চারস্থানের যে-কোনো একটা অথবা পরপুরা এদের রাজধানী ছিল বলে মনে হয়।
  • চ. বজ্রবিক্রমের পরবর্তী রাজারা চট্টগ্রামের তথা সমতটে কতেকাংশ স্বাধিকারে এনে ছিলেন মনে হয়। ১০ম শতকে আরাকানে যখন এঁদের শাসনাধিকার লুপ্ত হয়, তখনো সম্ভবত চট্টগ্রাম অঞ্চল এ বংশীয়গণের করতলে ছিল। বৈশালীর রাজা চূড়সিংহচন্দ্র (Chulataing Chandra) হয়তো এমনি কোনো শূরচন্দ্র রাজা থেকে চট্টগ্রামের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। আরাকানী ইতিহাসে ইনিই হয়তো থুরতান (শূেরচান> শূরচান্দ), যাকে আরাকান রাজসভায় বাঙলা সাহিত্য গ্রন্থে (আরব) সুলতান (পৃ. ২-৩) বলে অভিহিত করা হয়েছে। কেউ কেউ থুরতন নামটি রাজ্যজ্ঞাপক বলে মনে করেন, তারা ‘থুরতন’ অর্থে ত্রিপুরা রাজ্য বুঝেছেন।
  • ছ, ধর্মে ও সংস্কৃতিতে, সংস্কৃতের ব্যবহারে, নাগরী হরফের প্রয়োগে, চুণ্ডাদেবীর প্রতিষ্ঠায় ও মহাযানমতের প্রাবল্যে সমতট ও আরাকানে কোনো পার্থক্য ছিল না। বৃষ শঙ্খ ও লাঞ্ছনাও তাদের অভিন্ন ছিল।
  • জ. তাই মনে হয়, সমতটের চন্দ্ররা সম্ভবত আরাকানের চন্দ্রদেরই জ্ঞাতি ছিল। ওখানে চন্দ্রদের অধিকার লুপ্ত হওয়ার পরেও এঁরা এখানে ১১শ শতকের প্রথমপাদ অবধি টিকে ছিলেন। সময়ের দিক দিয়েও প্রায় মিলে যায়। এ বংশের প্রথম রাজা বলে অভিহিত পূর্ণচন্দ্র সম্ভবত প্রথম রাজা নন; পূর্ণচন্দ্র-সুবর্ণচন্দ্র ও ত্রৈলোক্যচন্দ্র গড়ে ৪৪-৪৫ বছর ধরে রাজত্ব করতে থাকলে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে এরা সমতটে কখনো সামন্ত, কখনো বা স্বাধীন রাজা হিসেবে রাজত্ব করেছেন বলে অনুমান করবার যুক্তি আছে।
  • ঝ. লামা তারানাথও (জন্ম ১৫৭৩, গ্রন্থ সমাপ্তি ১৬০৮ খ্রী:) এক চন্দ্ৰবংশের উল্লেখ করেছেন : বৃক্ষচন্দ্ৰ, বিগমচন্দ্র, কামচন্দ্র (হর্ষবর্ধনের সময়ে বঙ্গরাজা ছিলেন) সিংহচন্দ্রের (হর্ষপুত্র শীলের কালে) প্রপৌত্র, বালচন্দ্রের পৌত্র বিমলচন্দ্রের পুত্র গোপীচন্দ্র চট্টগ্রামে রাজত্ব করতেন। তিনি ‘ছগল’ বলে এক রাজার নামও বলেছেন। আবার ববলা সুন্দর ও তার পুত্র চন্দ্রবাহন আদির নাম করেছেন। এতগুলো নাম নিছক কল্পনাপ্রসূত না হওয়ারই কথা, মনে হয় এরা চট্টগ্রামে সাধারণ বা সামন্ত শাসক ছিলেন। উপর্যুক্ত চন্দ্ররা আরাকানের অথবা সমতটের চন্দ্রদের প্রতিনিধি হওয়াও বিচিত্র নয়। বিশেষ করে আনন্দ চন্দ্রের স্তম্ভলিপির প্রথম নাম হীরানন্দ শাস্ত্রীর মতে বালচন্দ্র। (ঐ, পৃ ১৯৩, পাদটীকা।) এর পাঠোদ্ধার Johnston করেননি।

এই হলো মোটামুটিভাবে জানা চট্টগ্রামের আদি ইতিহাস বা প্রাক-মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের যা জানা আছে তার সারসংক্ষেপ। ইতিহাসকে এখান থেকেই বার করতে হবে। তবে এখানেই শেষ না করে এর পর চট্টগ্রামে কী হলো সেই মধ্যযুগে তার একটা কন্টিন্যুয়েশনও টানা উচিৎ বলে মনে হয় যে আলোচনাটা একটু সংক্ষিপ্ত হবে।

মধ্যযুগে চট্টগ্রামের ইতিহাসের কন্টিন্যুয়েশন

আরকানের ইতিহাস আলোচনায় জানা যায়, ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ষোলসিংহচন্দ্র নামক জনৈক ক্ষত্রিয় রাজা আরাকানে রাজত্ব করতেন। ঐ সনেই তিনি চট্টগ্রাম আক্রমণ করে অধিকারভুক্ত করেন, ও তার বিজয়রাজ্যের সীমান্তে বিজয়চিহ্ন স্বরূপ এক স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। ১২৪৩ খ্রিস্টাব্দের যে তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে জানা যায়, চন্দ্রবংশীয় দামোদর দেব চট্টগ্রামের হিন্দুরাজা ছিলেন। তিনি বাহুবলে মণিপুর পর্যন্ত আপন রাজ্য বিস্তার করে রাজচক্রবর্তী আখ্যা প্রাপ্ত হন, ইনি যজুর্বেদীয় পৃথ্বিধর শর্মাকে ভূমিদান করে ছিলেন, এবং শ্রীমংদত্ত নামক তার একজন মন্ত্রী ছিলেন। তার পূর্ববর্তীগণের মধ্যে মধুসূদন দেব, নারায়ণদেব ও পুরুষোত্তমদেবের নাম ও সেই তাম্রশাসনে রয়েছে।

ত্রিপুরাধিপতির ভাই রত্নফা ত্রিপুরা রাজা কর্তৃক ত্রিপুরারাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে মুসলমান সেনাপতি বলবনের আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং বলবনের সাহায্যে ত্রিপুরাদেশ অধিকার করে দামোদেরদেবের বংশধরের হাত থেকে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। সেই অবধি ত্রিপুরার রাজবংশ “ফা” উপাধি পরিত্যাগ করে “মাণিক্য” উপাধি ধারণ করেন। প্রবাদ আছে, উক্ত দামোদরদেবের বংশধর দনুজমর্দনদেব চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে চন্দ্রদ্বীপে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন, ও কেউ কেউ আরাকান শৈলশ্রেণির পূর্বদিকে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে বলে থাকেন।

অতি পুরাতন সময়ে চক্রশালা (চট্টগ্রাম) মণিভদ্ররাজার রাজধানী ছিল বলে প্রবাদ আছে; লক্ষ্মণ দিগ্বিজয় কাব্যেও এদের উল্লেখ দেখা যায়। বর্তমান চক্রশালা স্কুলের কিঞ্চিৎ উত্তরে রাজঘাটা’ নামক স্থান এখন বিদ্যমান আছে। স্কুলের পূর্বধারে ভগ্ন ইষ্টকরাশিপরিপূর্ণ এক উচ্চ ভিটী ছিল, এবং তাতে কেউ কেউ গুপ্তধন লাভ করার কথাও অনেকে অবগত আছেন। সেইজন্য সেটিকে নিকটবর্তী গ্রামের লোকেরা সদাগরের ভিটীও বলিত। ঐ স্থান এখন প্রায় সমতল করা হয়েছে। এটি চট্টগ্রাম শহর হতে বার মাইল দূরে অবস্থিত; কেউ কেউ সেটাকে দামোদর দেবের ও কেউ কেউ মণিভদ্ররাজার বাড়ি বলে অনুমান করেন।

সাতকানিয়া থানার এলেকাধীন গৌড়স্থান নামক একটি মৌজা (গ্রাম) আছে, সেই স্থানে বিশাল গড় ও ৫টি দিঘি এখনও বর্তমান আছে। প্রবাদ আছে, গৌড়স্থান থেকে জনৈক হিন্দুরাজা পালিয়ে এসে এখানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। সেজন্য উহাকে গৌড়স্থান ও কেউ কেউ গৌড়-রাজবাড়ি বলত। বর্তমান জরিপে অনভিজ্ঞ আমিনদের হাতে গৌড়স্থান গোরস্থান হয়েছে, কেউ কেউ তাকে দামোদর দেবের বাড়ি বলে অনুমান করেন। ১২৪২ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে চট্টগ্রামে হিন্দুরাজত্বের অবসান দেখা যায়; তারপর থেকে ত্রিপুরা, মগ, মুসলমান ও পর্তুগীজগণের পরস্পর সংঘর্ষ দেখা যায়। পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে ত্রিপুরারাজ, দামোদর দেবের বংশধরের কাছ থেকে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। এটা ১২৪৩ খ্রিস্টাব্দের পরে বলে অনুমিত হয়।

১৪৫১ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে আরাকানাধিপতি মিনখারি চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ অধিকার করেন। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র বাচপিউ বর্তমান চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত অধিকার করে নেন। সুতরাং ১৪৫৯ হতে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২০৩ বছর চট্টগ্রামে মগরাজত্ব দেখা যায়। এবং ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে তারা সম্পূর্ণরূপে নিস্তেজ হয়ে এখান থেকে পলায়ন করে। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ৩২ বছর ত্রিপুরারাজ, পর্তুগিজ, মুসলমানসেনাপতি ও বাদসাহগণের উপর্যুপরি আক্রমণ, লুণ্ঠন, কাটাকাটি, রক্তারক্তি হয়েছিল মাত্র, কিন্তু কেউ স্থায়ী রাজত্ব স্থাপন করিতে পারেননি। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজগণ ভারতবর্ষে আগমন করে, তার পর সনই চট্টগ্রাম এসে উপস্থিত হয়। আরাকানাধিপতি যুদ্ধ করে তাদেরকে আরাকান ও চট্টগ্রামের সীমা থেকে তাড়িয়ে দেন।

১৫১২ খ্রিস্টাব্দে হোসেন সাহ চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন। এই সময়ে মগে, মুসলমানে, হিন্দুতে ও পর্তুগিজে ভয়ানক কাটাকাটি মারামারি ও খণ্ড যুদ্ধ আরম্ভ হয়। সুযোগ বুঝে ত্রিপুরা রাজার প্রধান সেনাপতি রায় চয়চাগ চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন। হোসেন শাহ্‌ এর সৈন্যগণ পরাজিত হয়ে পলায়ন করে; এবং চয়চাগ মগদেরকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। তারপর হোসেন শাহ্‌ বহু সৈন্য নিয়ে ত্রিপুরারাজ্য আক্রমণ করেন, ত্রিপুরার সেনাপতি ঐ যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার সুযোগে আরাকানাধিপতি পুনরায় চট্টগ্রাম অধিকার করে নেন, কিন্তু সুচতুর চয়চাগ সেখানে হোসেন শাহ্‌ এর সৈন্যদেরকে পরাজিত করে আবার চট্টগ্রাম আক্রমণ ও অধিকার করে বহুসৈন্য বন্দি করে নিয়ে যান।

১৫২২-২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হোসেন শাহ্‌ এর পুত্র নসরত শাহ্‌ আলফা হোসেনী নামক জনৈক বোগদাদবাসী বণিকের উৎসাহে রাঢ়ীয় হিন্দু ও মুসলমানগণের সাহায্যে সেনাপতি পরাগল খাঁর বাহুবলে ত্রিপুরারাজ দেবমাণিক্যকে যুদ্ধে পরাজিত করে চট্টগ্রামের উত্তরাংশ অধিকার করে তাকে ফতেয়াবাদ নামে অভিহিত করেন। নবাগত সৈন্য ও মুসলমানগণের খাবার ও থাকবার সুবিধার জন্য তখন ভাটীয়ারী ও মেমানসরাই প্রস্তুত হয়েছিল, ও সেই নসরত শাহ্‌ এর সময়ে প্রসিদ্ধ ভেলুয়ার (বেলওয়ার) দিখি খোদিত হয়েছিল। নসরত শাহ্‌ এর সময়ে আড়াইটান নামক জনৈক সদাগর যমুনাতীরে বসবাস করতেন; ভেলুয়া তারই পুত্রবধূ। চট্টগ্রামের জনৈক সদাগর সেখানে বাণিজ্য করতে গিয়ে তাকে চুরি করে নিয়ে আসে। পরে উক্ত আড়াইটান সদাগরের পুত্র চট্টগ্রাম এসে উক্ত চোরসদাগরের সাথে লড়াই করতে উদ্যত হয়। এতি নসরত শাহ্‌ এর কর্ণগোচর হলে তিনি বিচার করে উক্ত চোরসদাগরের ভিটিতে তারই খরচে ভেলুয়ার নামে এক প্রকাণ্ড দিঘি খনন করিয়ে দেন, এবং চোরসদাগরের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে গরিবদেরকে দান করেন।

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা বিজয়মাণিক্য ত্রিপুরার সিংহাসনে আরোহণ করেন, এবং বহুদিন যুদ্ধের পর মুসলমান ও মগসৈন্য পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। এর কয়েকমাস পর উড়িষ্যাবিজয়ী মাহামদ শাহ্‌ চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন, ৮ মাস যুদ্ধের পর তিনি ত্রিপুরা রাজার সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হন। ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে আরাকানাধিপতি মেবেও চট্টগ্রাম অধিকার করে স্থায়ীরূপে রাজত্ব স্থাপন করেন, এবং কয়েক বছর জন্য শান্তি স্থাপিত হয়।

১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে আরাকানে মাংফুলা নামক জনৈক পরাক্রান্ত নরপতির নাম পাওয়া যায়। তিনি পর্তুগিজগণের সাহায্যে সমুদয় চট্টগ্রাম অধিকার করে ত্রিপুরা রাজ্য লুণ্ঠন করেন, এবং ঢাকা নগরী পর্যন্ত আপন অধিকার বিস্তার করে মেঘনার পারস্থ আলমদিয়া ও জুগদিয়া দুর্গ সুরক্ষিত করেন। ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুরাজা কেদার রায় সন্দ্বীপ আক্রমণ করে মগ ও পর্তুগিজগণকে জলযুদ্ধে পরাজিত করে সন্দ্বীপ অধিকার করেন, এর অল্পপরেই তিনি মানসিংহের সাথে যুদ্ধে পরলোক গমন করেন।

১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ নেতা গঞ্জালীস সন্দ্বীপে ও মনকুনান চট্টগ্রামে প্রবল হয়ে উঠে, তারা বাংলা ও আরাকানের জলপোেত সকল আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে আরম্ভ করে। এর কিছুদিন পরেই ফতেখাঁ বাংলায় পাঠান সৈন্য পরাজিত করে সন্দ্বীপ আক্রমন করেন। বহুদিন যুদ্ধের পরে ফতেখা পরাজিত হয়ে দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এমন সময় হঠাৎ একটি স্পেনদেশীয় সৈন্যবাহী জাহাজ এসে উপস্থিত হয়, এবং পর্তুগিজ ও স্পেনদেশীয় সৈন্যগণ একত্র হয়ে ফতেখাঁর দুর্গ আক্রমণ করে। ফতেখাঁর ভ্রাতা ধৃত ও বন্দি হয়। এই যুদ্ধে মুসলমানগণের অনেক সৈন্য হতাহত হয়েছিল। পর্তুগিজগণের ৮০ খানা রণতরী, এক হাজার পর্তুগিজ ও দুই হাজার দেশী সৈন্য ছিল। মুসলমানগণের ৬০ খানা রণতরী ও ৬০০ শত পদাতিক সৈন্য ছিল। এর পর পর্তুগিজগণ চট্টগ্রামের দক্ষিণে দেয়াং পর্যন্ত অধিকার বিস্তার করেছিল, ঠিক সেই সময়ে মিনরাজা গাঁইয়া আরাকানের রাজা ছিলেন; তিনি দেয়াং আক্রমণ করে অনেক পর্তুগিজকে হত্যা করেন। গঞ্জালীস প্রাণভয়ে সন্দ্বীপ পালিয়ে যান।

১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজার ভ্রাতা চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। গঞ্জালীস তার ভগ্নীকে বিবাহ করে, সেই সময়ে আরাকান রাজার সাথে চট্টগ্রামের শাসনকর্তার বিবাদ সূচনা হয়; এবং উক্ত শাসনকর্তা গঞ্জালীসের আশ্রয় গ্রহণ করে। গঞ্জালীস তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে সমুদয় সম্পত্তি হস্তগত করে। এই সময়ে বাংলার নবাবসৈন্য চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন। গঞ্জালীস ও আরাকানাধিপতি সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়ে মোগল সৈন্য বিতাড়িত করে দেয়, এবং আরাকানাধিপতি চট্টগ্রামে আপন অধিকার দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেন; কিন্তু গঙ্গালীস ছাড়বার পাত্র নয়, সে সুবিধা বুঝে আরাকানাধিপতির নৌসেনাপতিকে হত্যা করে যুদ্ধজাহাজ লুণ্ঠন করে, কিন্তু নবাব সৈন্য পুনরায় নুতন সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম আক্রমণ করায় আরাকানাধিপতি আকিয়াব (Myeaka) সরে যান, এবং সেখানে গিয়ে গঞ্জালীসের ভ্রাতষ্পুত্রকে হত্যা করেন; গঙ্গালীস এর প্রতিশোধ নেবার জন্য কালাডোনা নদী পর্যন্ত আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন। ঐ দিকে ত্রিপুরার সৈন্য আগমনে নবাব সৈন্য চলে যেতে বাধ্য হয়।

১৬১১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা অমরমাণিক্যের কুমারগণের মধ্যে আরাকানাধিপতি প্রদত্ত সুবর্ণ নির্মিত গজদন্তের মুকুট নিয়ে বিবাদ আরম্ভ হয়। সুযোগ বুঝে আরাকানরাজ চট্টগ্রাম অধিকার করে নেন। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে মিনথ্যাৎ আরাকানের রাজা হয়ে পর্তুগিজগণকে ধ্বংস করবার মনস্থ করেন। কিন্তু গঞ্জালীস তা জানতে পেরে গোয়ার শাসনকর্তার কাছ থেকে যুদ্ধজাহাজ নিয়ে আরাকান আক্রমণ করেন। আরাকানাধিপতি ওলন্দাজগণের সাহায্যে তাকে বিতাড়িত করে দেন।

১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে আরাকানাধিপতি পর্তুগিজগণের প্রধান আড্ডা সন্দ্বীপ আক্রমণ করত অনেক পর্তুগিজ ধ্বংস করেন এবং গঞ্জালিস প্রাণভয়ে পালিয়ে যান।তারপর তার ভাগ্যে কি ঘটেছিল তার কোন তথ্য জানা যায়নি। এর পর আরাকানাধিপতি মিনখ্যাং বাংলা আক্রমণ করত ঢাকা নগরী পর্যন্ত আপন অধিকার বিস্তার করেন। মিনথ্যাং জাতীয় বীর বলে এখনও আরাকানবাসী কর্তৃক পূজিত। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে মীনখ্যাং এর মৃত্যু হলে তার পুত্র শ্রীধর্মরাজ আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনিও ১৬ বছর যাবৎ তার পিতার অধিকৃত ঢাকা নগরী পর্যন্ত আপন অধিকার বজায় রেখেছিলেন।

১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খাঁ মসমদি মগসর্দার মুকুট রায়কে বশে নিয়ে চট্টগ্রামের কতেক অংশ অধিকার করেন, কিন্তু আরাকানরাজ তা জানতে পেরে তা পুনরায় কেড়ে নেন। ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে সন্দসুধর্ম (চন্দ্রসুধর্ম) আরাকানের সিংহাসনে অধিরোহন করেন। তার সময়ে শাহ সুজা বাংলা থেকে আরাকানে পালিয়ে যান। ১৬৮৪ সালে তার মৃত্যু হয়। আলোচনা প্রাক-মুঘল আমল ছাড়িয়ে গেছে বলে এখানেই ইতি টানা হলো।

তথ্যসূত্র

  • চট্টগ্রামের ইতিহাস, আহমদ শরীফ, আগামী প্রকাশনী, ISBN – 9789844016378, 3rd Printed, 2011
  • চট্টগ্রামের ইতিহাস, কমল চৌধুরী (সম্পাদক), দে’জ পাবলিশিং, ISBN – 9788129510228, 2nd Edition, 2016
  • প্রাচীন বাংলার ইতিহাস, ড. আবু নোমান, গ্রন্থ কুটির, ২০১৮
  • অন্যান্য তথ্যসূত্র লেখাটির মধ্যেই উল্লিখিত

1 Comment

  1. চমৎকার লেখা তবে আমার মনে হয় এটাকে চট্টগ্রামের ইতিহাস না বলে পূর্ববঙ্গের ইতিহাস বললে ভাল হবে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.