যুক্তরাজ্যের ক্ষমতায় ঋষি সুনাক, কিন্তু তিনি কি ট্রাসের চেয়ে বেশি “সফল” হবেন?

সোমবার, বরিস জনসন এবং পেনি মর্ডান্ট শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ানোর পরে, ঋষি সুনাক ডিফল্টভাবে কনজারভেটিভ নির্বাচনে জয়ী হন। সুনাক কয়েক বছরের মধ্যে চতুর্থ রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন এবং তিনি অফিসে প্রবেশ করে অন্তত ২০০৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। তো প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে সুনাক নেতৃত্বের নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন, কীভাবে তিনি বাজারের অস্থির অবস্থার সাথে মোকাবেলা করতে যাচ্ছেন এবং তিনি আদৌ ব্রিটেইনের কনজারভেটিভ পার্টিকে একত্রিত করতে সক্ষম হবেন কিনা।

সামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে শুরু করছি। ৪৪ দিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার পর বৃহস্পতিবার লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন, যা তাকে ব্রিটিশ ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ের প্রধানমন্ত্রীতে পরিণত করে। এখন, এই অবস্থায় অনেক সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকারই আরেকটি লিডারশিপ ইলেকশন আশা করেন নি, কারণ, প্রথমত, শেষবারের নির্বাচনে লিজ ট্রাসের মত একজন ক্ষমতায় আসেন, এবং দ্বিতীয়ত, দেশটি অর্থনৈতিক সঙ্কটে আছে, আর তাই দেশটিতে নতুন করে লিডারশিপ ইলেকশন দেবার সময় নেই। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত, ১৯২২ কমিটি নামে একটা গ্রুপ, যারা মূলত কনজারভেটিভ পার্টি পরিচালনা করে, তারাই সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা আরও একটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। তবে শর্ত ছিল, প্রার্থিতা বা ক্যান্ডিডেসির জন্য প্রার্থীর কাছে ন্যুনতম ১০০ জন কনজারভেটিভ এমপি সমর্থক থাকতে হবে, আর ব্যালট পেপারে করে সোমবার দুপুর ২:০০ টার মধ্যেই ভোটটি দিতে হবে। যেহেতু মাত্র ৩৬০ জন রক্ষণশীল সংসদ সদস্য ছিলেন, তাই বোঝাই যাচ্ছে, সর্বাধিক তিনজন প্রার্থীই দাঁড়াতে পারবেন। তো এখানে দুজন সুস্পষ্ট প্রার্থী ছিলেন – ঋষি সুনাক এবং পেনি মর্ডান্ট, যারা মাত্র কয়েক মাস আগে শেষ লিডারশিপ ইলেকশনে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। কিছুটা প্রত্যাশিতভাবেই, জল্পনা-জল্পনা ছিল যে এবারে বরিস জনসনও প্রার্থী হতে পারেন। কিন্তু বেশিরভাগ কনজারভেটিভ এমপিই ব্যাপারটা সুনজরে দেখেননি, এমনকি জনসনের প্রাক্তন সমর্থকরাও। যেমন, চার্লস মুর বললেন, বরিসের এখান থেকে সরে থাকাই উচিৎ, ডেভিড ফ্রস্ট বললেন, গত বছরের বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি করা ঠিক হবে না। যাইহোক, শনিবার, জনসন তার ছুটি থেকে ফিরে আসেন এবং তার প্রার্থিতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য তার মিত্রদের সাথে একটি বৈঠক করেন এবং রবিবার সকালে, জনসন সমর্থক এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের সেক্রেটারি ক্রিস হিটন-হ্যারিস স্কাই নিউজকে নিশ্চিত করেন যে, জনসন শেষ পর্যন্ত এই লিডারশিপ ইলেকশনে দাঁড়াতে চলেছেন, তিনি তার পেছনে ১০০ জন কনজারভেটিভ সমর্থকও পেয়ে গেছেন। কিন্তু ১০০ জনের সমর্থন থাকার ব্যাপারটা কতটা সত্য ছিল তা নিয়ে সন্দেহ ছিল, কারণ রবিবার বিকেলের মধ্যে প্রায় ৬০ জন সংসদ সদস্য জনসনের সমর্থনে প্রকাশ্যে এসেছিলেন।

যাইহোক, কয়েক দিনের তীব্র জল্পনা-কল্পনার পরে, রবিবার সন্ধ্যায়, ঋষি সুনাক এবং পেনি মর্ডান্ট উভয়ের সাথে আলোচনা করার পরে, জনসন হঠাৎ ঘোষণা করেন যে তিনি এই নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছেন। তার বিবৃতিটি বেশ আত্মবিশ্বাসীই ছিল। এতে তিনি বলেন, তার পক্ষে দাঁড়ানো এত কনজারভেটিভ সমর্থকদের দেখে তিনি অভিভূত, সেই সাথে তিনি শ্রোতাদের এও মনে করিয়ে দেন যে, তিন বছরেরও কম সময় পূর্বের নির্বাচনটিতে তিনি তার দলকে একটি বিশাল জয় এনে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তার কাছে এই কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যদের সাথে নির্বাচনে সাফল্যের সাথে সাথে তার জন্য ২০২৪ সালের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দলটির বিজয় এনে দেবারও সুযোগ ছিল। কিন্তু তারপরও তিনি তার দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন না, তাই তিনি নির্বাচন থেকে সরে আসারই সিদ্ধান্ত নিলেন। যাইহোক, জনসনের সরে আসার পর তার বেশিরভাগ সমর্থক দ্রুত সুনাকের দিকে চলে যায়, এবং দুপুর ২:০০ টার দিকে, পেনি মর্ডান্ট স্বীকার করেন যে তার সমর্থক সংখ্যা তেমন নেই, আর নির্বাচন থেকে তিনিও সরে দাঁড়ান। এদিকে ঋষি সুনাকের পক্ষে অর্ধেকেরও বেশি সমর্থন ছিল, ফলে তিনি করোনেশনের মাধ্যমে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হয়ে ওঠেন। করোনেশনের পর বক্তৃতায় তিনি বর্তমান দেশটির বিশাল ইকোনমিক চ্যালেঞ্জের কথা জানান। যাই হোক, সুনাক হচ্ছেন ডিজরাইলির পর (শেফারদিক ইহুদি ছিলেন) যুক্তরাজ্যের প্রথম জাতিগত সংখ্যালঘু প্রধানমন্ত্রী। সেই সাথে ১৮১২ সালে লিভারপুলের দ্বিতীয় আর্লের পর সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী।

তো এবারে আসল কথায় আসা যাক। সুনাক এখন তার অফিসে বসে কী করতে যাচ্ছেন। তার দেয়া ইন্ট্রোর প্রথম যে জিনিসটি বাজারকে শান্ত করবে, তা সম্ভবত বাজেটের ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারটি। সৌভাগ্যবশত, সুনাক এবং সেই সাথে যুক্তরাজ্যের কেউই দেশটির সভারেইন ডিফল্ট চান না, মানে দেশটি তার ঋণ প্রদানে ব্যর্থ হোক তা কেউ চায়না। আর সেক্ষেত্রে ভাল খবর এই যে, সুনাকের জয়ের পর বাজার ইতিমধ্যেই ইতিবাচকভাবেই সাড়াপ্রদান করেছে। যুক্তরাজ্যে গভার্নমেন্ট লায়াবিলিটিকে গিল্ট বলে, তো ১০-বছরের গিল্টের ইল্ড ইতিমধ্যেই ৩০ বেসিস পয়েন্ট কমে গেছে, শুক্রবারে যা ৪.১% ছিল, সোমবারে দুপুর দুটোয় তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩.৮%-এ। দুটো কারণে এটা সুনাকের জন্য খুব ভাল খবর। প্রথমত, এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, তার বাজেটের প্রতি মারকেটের রেসপন্স সম্ভবত ভালোই হবে, আর দ্বিতীয়ত, এর মানে এই যে, ইতিমধ্যেই সুনাকের ফিসকাল স্পেইস ট্রাস ও কোয়ারটেং এর সময় যা ছিল তার থেকে বেশি। প্যানমিউর গর্ডনের ইকোনমিস্ট ও দ্য টাইমসের কলামিস্ট সাইমন ফ্রেঞ্চ বলছেন, যুক্তরাজ্যে গিল্ট ইল্ড হ্রাস পাচ্ছে, কারণ প্রতি বছর সাত বিলিয়ন পাউন্ডের ট্রিজারি সেইভ করার ক্ষেত্রে বাজার ট্রাসের চেয়ে সুনাককে বেশি বিশ্বাস করে। কিন্তু এখানেও সমস্যাটা থেকেই যায়। সুনাক ৭ বিলিয়ন পাউন্ড সেইভ করলেন, কিন্তু মাথার ওপর ৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের ফিসকাল ব্ল্যাকহোল ঘুরছে। আর সেটা ব্যালেন্স করতে হলে তাকে বেশ কিছু পেইনফুল কাট, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় খরচ কমানোর মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যা সুনাকের পপুলারিটির জন্য তেমন ভাল নাও হতে পারে। তিনি কী কী স্টেপ নেন তা দেখার জন্য তার প্রথম বাজেটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তাতেই বোঝা যাবে কোথায় কোথায় তিনি সরকারী খরচ কাট করছেন। কিন্তু স্পেন্ডিং কাট ছাড়াও তার কাছে আরও বেশ কিছু অপশনও আছে, যেমন ট্যাক্স বৃদ্ধি, ডিফেন্স স্পেন্ডিং কমানো, পেনশনের ট্রিপল লক তুলে দেয়া।

তবে সুনাক যে পথেই যান না কেন, এগুলো করে তিনি সাধারণ জনতা ও তার নিজ দলের মধ্যে কতটা জনপ্রিয় থাকেন তা নিয়ে শঙ্কা থাকছেই, বরং এত কিছুর মধ্য দিয়ে গিয়ে জনপ্রিয়তা ধরে রাখাটাই তার জন্য আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মত ব্যাপার হবে। সেই সাথে সুনাককে তার পার্টিটাকে একতাবদ্ধ হিসেবে ধরে রাখার জন্যেও স্ট্রাগল করতে হবে, বিশেষ করে যদি তার ক্ষমতায় আসার পর কনজারভেটিভ পার্টির পোল নাম্বারের উন্নতি না হয়। দলে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ফাটল ধরে গেছে। সুনাক বেশিরভাগ কনজারভেটিভ এমপি এর সাপোর্ট অর্জন করলেও তার বিরোধীরও অভাব নেই। নেডাইন ডোরিস, ক্রিস্টোফার চোপ তো একটি জেনারেল ইলেকশনই চেয়ে বসলেন। সুনাকের পলিসিগুলো যদি বেশি ডিভিসিভ হয়, আর পোল নাম্বার যদি সিগনিফিকেন্টলি না বৃদ্ধি পায়, তাহলে যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টিতে গৃহযুদ্ধ ঘটা অনিবার্য। এ প্রসঙ্গে পোলিং সম্পর্কেই কিছু কথা হয়ে যাক। জেএল পার্টনারস উইকেন্ডে হাইপোথেটিকাল পোলিং পরিচালনা করে, তাতে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা খুব একটা ভাল পাওয়া যায়নি, তারা লেবর পার্টির চেয়ে ১১ পয়েন্ট পিছিয়ে আছে। এটা তাও ভাল ছি , রেডফিল্ড-উইলটন পোলিং-এ তো সুনাকের পার্টি লেবর পার্টির চেয়ে ২০ পয়েন্ট পেছনে। তো সুনাকের সামনে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও কম নয়। ট্রাসের সময় কনজারভেটিভরা লেবরদের চেয়ে যতটা পিছিয়ে ছিল এখন অবস্থা তার থেকে ভাল। তবে গ্যাপটা নেহাতই কম নয়। পার্টির ইউনিটি মেইনটেইন করতে হলে সুনাককে এই গ্যাপটাকে বন্ধ করতে হবে। তাই সুনাকের সামনে সব দিক দিয়েই বিশাল চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.