চলমান আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘর্ষ কি রাশিয়ার দুর্বলতা, এবং তুরস্ক-আজারবাইজানদের বিশেষ প্যান-তুর্কিস্ট পরিকল্পনাকে নির্দেশ করছে?

গত কয়েক দিন ধরে আর্মেনিয়ান ও আজারবাইজানের বাহিনীর পুনরায় সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, যেখানে দুপক্ষে মৃতের সংখ্যা এখন ২৮২ জন (নিজেদের দাবি), আর আহতের সংখ্যা আরও অনেক। এমনকি সিভিলিয়ানদের মধ্যেও হতাহতের সংখ্যা অনেক। যাইহোক, ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা দ্বন্দ্বপূর্ণ এই লড়াইটি আসলে কী, এখানে প্রধান আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের কীভাবে রয়েছে এবং এই দ্বন্দ্বে এই আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো উভয় পক্ষের সাথে কিভাবে ডিল করছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। সেই সাথে দেখা উচিৎ মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রতিযোগিতার ব্যাপারেও।

যুদ্ধের ব্যাকগ্রাউন্ড

ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে শুরু করছি। এই আলোচনাটা একটু বোরিং আর বড় হবে। আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান উভয়ই ১৯১৮ সালের ২৮শে মে একই দিনে ট্রান্সককেশিয়ান ডেমোক্রেটিক ফেডারেটিভ রিপাবলিক থেকে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে, রাশিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পর। কিছু কিছু অঞ্চলের ক্ষেত্রে দেখা যায় তার দাবিদার উভয় রাষ্ট্রই, যা দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে ওঠে। যাইহোক, এই যুদ্ধ শেষ হয় যখন ১৯২০ সালের দিকে উভয় রাষ্ট্রই সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা সংযুক্ত হয়। সমস্যাটি হ’ল এই উভয় রাষ্ট্রের দ্বারা দাবিকৃত অঞ্চলটি জাতিগত আর্মেনীয়দের দ্বারাই পূর্ণ ছিল এবং এখনও রয়েছে। এই অঞ্চলটাই হলো বিতর্কিত নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চল। এটি হচ্ছে দক্ষিণ ককেশাসের একটি স্থলবেষ্টিত ও পর্বতঘেরা অঞ্চল। এই অঞ্চলটি মূলত একটি পাহাড়ি ও বনভূমি অঞ্চল, আয়তন ৪,৪০০ বর্গ কিমি। এখন এটি একটি বিতর্কিত অঞ্চল, যা আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের অংশ হিসাবে স্বীকৃত, তবে এর বেশিরভাগই প্রথম নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধের পর থেকে অস্বীকৃত আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়, যা নাগোর্নো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্র নামেও পরিচিত। এই রিপাবলিক অফ আর্টসাখ একটি এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা সহ একটি প্রেসিডেন্সিয়াল গণতন্ত্র। দেশটি আর্মেনিয়ার উপর নির্ভরশীল এবং ঘনিষ্ঠভাবে সংহত, অনেক উপায়ে আর্মেনিয়ার অংশ হিসাবে কার্যত কাজ করে। দেশটির জনসংখ্যার ৯৯.৭% জাতিগত আর্মেনীয়, এবং প্রাথমিক কথ্য ভাষা আর্মেনিয়ান ভাষা। এই জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে খ্রিস্টান, বেশিরভাগই আর্মেনিয়ান অ্যাপোস্টোলিক চার্চের সাথে যুক্ত। ১৯৯৪ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সরকারের প্রতিনিধিরা এই অঞ্চলের বিতর্কিত অবস্থা নিয়ে ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এর ইতিহাসে যাওয়া যাক। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরে এই বিরোধটি মূলত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং ১৯২৩ সালে আজারবাইজান এসএসআরের মধ্যে নাগোরনো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্ট তৈরি করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই অঞ্চলটি আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে বিরোধের উৎস হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়। ১৯৯১ সালে নাগোরনো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্ট এবং পার্শ্ববর্তী শাহুমিয়ান প্রদেশে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটের ফলে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। জাতিগত সংঘাতের ফলে ১৯৯১-১৯৯৪ সালের নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৮৭-৮৮ সালে নাগোর্নো-কারাবাখ এবং সোভিয়েত আর্মেনিয়ায় একটি গণআন্দোলন শুরু হয়, যাতে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে এই অঞ্চলটি আর্মেনিয়ায় স্থানান্তর করার আহ্বান জানানো হয়। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আজারবাইজানের সুমগাইত শহরে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যা থেকে শুরু করে, এই সংঘাত ক্রমবর্ধমান সহিংস হয়ে ওঠে এবং মস্কোর পক্ষ থেকে বিরোধ সমাধানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৮৮ সালের গ্রীষ্মে, সোভিয়েত আর্মেনিয়ার আইনসভা এবং নাগোরনো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্ট আর্মেনিয়ার সাথে নাগোর্নো-কারাবাখকে একীভূত করার ঘোষণা দিয়ে রেজোলিউশন পাস করে, যা আজারবাইজানি এবং কেন্দ্রীয় সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে, নাগোর্নো-কারাবাখের আর্মেনীয়রা সদ্য স্বাধীন আর্মেনিয়ার সাথে পুনরায় একত্রিত হওয়ার উদ্দেশ্যে নাগোর্নো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্র হিসাবে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। নতুন স্বাধীন আজারবাইজান এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে, যার ফলে আর্মেনিয়া এবং নাগোর্নো-কারাবাখ এর সাথে আজারবাইজানের সাথে ফুল-স্কেল যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৯৪ সালের মে মাসে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে প্রথম নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ শেষ হয়, আর্মেনীয় বাহিনী সাবেক নাগোর্নো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্টের পুরো অঞ্চল এবং আজারবাইজানের সাতটি সংলগ্ন জেলার বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র একটি কার্যত স্বাধীন দেশে পরিণত হয়, যদিও আর্মেনিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংহত হয়, যদিও এর অঞ্চলটি আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসাবে স্বীকৃত ছিল।

উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক পরিবর্তন ছাড়াই ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতির পরে এই অঞ্চলের উপর বিরতিহীনভাবে লড়াই অব্যাহত ছিল। ১৯৯৪ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সরকারের প্রতিনিধিরা এই অঞ্চলের বিতর্কিত অবস্থা নিয়ে ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা চালিয়ে যায়। তবে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চলছিলই। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে নভেম্বরে ঘটে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধটি, যা ২০২০ নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ নামে পরিচিত। প্রথম নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধের (১৯৮৮-১৯৯৪) পরে প্রতিষ্ঠিত যোগাযোগের লাইন বরাবর আজারবাইজানের আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়, যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ নাগোরনো-কারাবাখের কম পার্বত্য জেলাগুলি পুনরুদ্ধার করা, যা এই অঞ্চলের সুপ্রতিষ্ঠিত অভ্যন্তরের চেয়ে গ্রহণ করা সহজ ছিল। ২০২০ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া নাগোর্নো-কারাবাখ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে ঘটা এই নতুন যুদ্ধে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার সশস্ত্র বাহিনী উভয়ই সামরিক ও বেসামরিক দিক দিয়ে ব্যাপক হতাহতের শিকার হয়। আর্মেনিয়ার প্রায় ৩৮০০ ও আজারবাইজানের প্রায় ২৮০০ সৈন্য মারা যায়, দুই পক্ষেরই ১১,০০০ এর মত সৈন্য আহত হয়। যুদ্ধের সময় আজারবাইজান উল্লেখযোগ্য অর্জন করে। যুদ্ধে আজারবাইজান ৫টি শহর, ৪টি শহর, ২৮৬টি গ্রাম দখল করে এবং সমগ্র আজারবাইজান-ইরান সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এভাবে আজারবাইজান নাগোর্নো-কারাবাখের আশেপাশের বেশিরভাগ দখলকৃত অঞ্চল এবং নাগোর্নো-কারাবাখের বড় অংশ তারা পুনরুদ্ধার করে, যার মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর শুশাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০২০ সালের ১০ই নভেম্বর যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে, যখন আজারবাইজান, আর্মেনিয়া এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা আর্মেনিয়াকে নাগোর্নো-কারাবাখের আশেপাশের অবশিষ্ট সমস্ত দখলকৃত অঞ্চল ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করে। সব মিলে যুদ্ধ বিরতির পর আজারবাইজান যুদ্ধের সময় দখলকৃত অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, নাগোর্নো-কারাবাখের আশেপাশের সমস্ত আর্মেনীয়-অধিকৃত অঞ্চলগুলি ১ ডিসেম্বর ২০২০ সালের মধ্যে আজারবাইজানে ফিরে আসে। সেই সাথে যুদ্ধ বিরতির চুক্তির ফলে এই অঞ্চলের সমস্ত অর্থনৈতিক ও পরিবহন সংযোগ অবরোধমুক্ত করা হয়, যার মধ্যে তুরস্কের বর্ডারের নিকট আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন এনক্লেইভ নাখচিভান এবং আজারবাইজানের মেইনল্যান্ডের মধ্যে পরিবহন সংযোগও রয়েছে, যার জন্য পূর্বে আজারবাইজানকে ইরানের ওপর নির্ভর করতে হতো।

যাই হোক, যুদ্ধবিরতির পরও সংঘর্ষ চলতে থাকে। ২০২১ সালের ১২ ই মে আজারবাইজানের সৈন্যরা সুনিক ও গেঘরকুনিক প্রদেশের কয়েক কিলোমিটার অতিক্রম করে আর্মেনিয়ায় প্রবেশ করে এবং আর্মেনিয়ান ভূখণ্ডের প্রায় ৪১ বর্গ কিলোমিটার দখল করে নেয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, সেইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স – ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের তিনটি সহ-সভাপতির মধ্যে দুটি – আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আর্মেনিয়ান অঞ্চল থেকে আজারবাইজানকে তার সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। এরপর জুলাই ও নভেম্বরে আরও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, উভয় পক্ষ থেকে হতাহতের খবর পাওয়া যায়। ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর এক যৌথ বিবৃতিতে ইইউ সংবাদদাতারা আজারবাইজানের ১৬ নভেম্বরে শুরু করা সামরিক অভিযানকে ২০২০ সালের নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধবিরতি চুক্তির তখন পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে। এরপরই শুরু হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন করে নাগার্নো-কারাবাখ কনফ্লিক্ট, যা নিয়ে আজকের প্রধান আলোচনা।

যুদ্ধের বিবরণ

শুরু করা যাক। প্রথমত এই যুদ্ধটা আগেরগুলোর চেয়ে ভিন্ন, কেননা এখানে আক্রমণটা হয়েছে একেবারে আর্মেনিয়াতেই, যা আগে হয়নি। শুরুটা হয় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের পাল্টাপাল্টি দোষারোপের মধ্য দিয়ে। ১২ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আর্মেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায় যে আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনীর ইউনিটগুলি গোরিস, আর্তানিশ, সোটক, জারমুক, কাপান এবং ইশখানাসারের আর্মেনীয় অবস্থান এবং বেসামরিক এলাকার দিকে আর্টিলারি এবং ভারী অস্ত্র দিয়ে তীব্রভাবে গুলি বর্ষণ শুরু করেছে। আর্মেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও উল্লেখ করেছে যে আজারবাইজানের পক্ষ থেকে ইউএভি (আনম্যানড এয়ার ভেহিকল) ব্যবহার করা হয়েছিল এবং কিছু দিক থেকে তারা আর্মেনিয়ার দিকে তাদের অবস্থানগুলোর অগ্রগতির অপারেশন, অর্থাৎ অঞ্চলগুলো দখল করার অভিযান পরিচালনা করেছিল। এদিকে আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে যে আর্মেনিয়া দাশকাসান, কালবাজার এবং লাচিন অঞ্চলের কাছে “বড় আকারের উস্কানি” প্রদর্শন করেছে এবং সেনাবাহিনী পাঠানোর সড়কের পাশে মাইন স্থাপন করেছে। তারা আরও জানায়, তারা ‘আর্মেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর ফায়ারিং পয়েন্টগুলো দমন করতে এবং সংঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি রোধ করতেই’ এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে। যাই হোক, এরপর রাশিয়া ১৩ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করে যে তারা যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মধ্যস্থতাটি সফল হয়নি। কিন্তু উভয় পক্ষই নিশ্চিত করে যে, মধ্যস্থতাটি কার্যকর হবার কয়েক মিনিট পরে ভেঙে যায়।

১৩ই সেপ্টেম্বর দুপুর দুটোয় আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে আর্মেনিয়ান-আজারবাইজান সীমান্তের কিছু অংশে পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে কারণ আজারবাইজান অবস্থানগত অগ্রগতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে নেরকিন হ্যান্ড, ভেরিন শোরঝা, আরতানিশ এবং সোটকের দিকে। আর্মেনীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলেছে যে আজারবাইজানের গোলাবর্ষণের ফলে, কুট গ্রামে অনেক আবাসিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং নারী ও শিশুদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর্মেনিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে, হামলার প্রথম দিনে আজারবাইজানের বেসামরিক এলাকায় গোলাবর্ষণের ফলে তিনজন বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছে। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের মতে, কমপক্ষে ২০৪ জন আর্মেনিয়ান সেনা নিহত বা নিখোঁজ হয়েছে। এদিকে আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তার ৮০ জন সৈন্যের মৃত্যুর ঘোষণা দেয়, যাদের মধ্যে ৪২ জন আজারবাইজানি সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং ৮ জন রাষ্ট্রীয় সীমান্ত পরিষেবার লোক ছিলেন।

১৪ ই সেপ্টেম্বর সকালে, আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রিপোর্ট করে যে আর্মেনীয় সশস্ত্র বাহিনী রাতে কেলবাজার এবং লাচিন দিক থেকে অবস্থিত আজারবাইজানের সেনা ইউনিটগুলিকে লক্ষ্য করে মর্টার ও আর্টিলারি গুলি চালিয়েছে এবং সেনাবাহিনী “পর্যাপ্ত প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা” নিচ্ছে। এদিকে আর্মেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এটিকে “আরেকটি ভুল তথ্য” বলে অভিহিত করে ও দাবি করে যে, আজারবাইজান “আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম অঞ্চলের মধ্যে সামরিক আগ্রাসন চালানোর জন্যই এসব প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।” তারা আরও জানায়, আজারবাইজান আর্টিলারি, মর্টার এবং বড় ক্যালিবারের ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে জেরমুক এবং ভেরিন শোরঝাকে গোলাবর্ষণ করছে। সকাল ১১টায় আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে দাবি করে যে আর্মেনিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর গোলাবর্ষণের ফলে আজারবাইজানের দুই বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছে। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান বলেন, আজারবাইজান আর্মেনীয় ভূখণ্ডের কিছু কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে… আর্মেনিয়া আর্মেনিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিএসটিও) ৪ নং অনুচ্ছেদে আবেদন করেছে। সেদিনই আর্মেনিয়ার এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, তারা আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছেন। এদিকে মস্কো টাইমস বলে, পুতিন আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী পাশিনিয়ানের সামরিক সহায়তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেখানে রাশিয়ান নেতৃত্বাধীন সিএসটিও এর নীতি অনুসারে চুক্তিতে স্বাক্ষর করা প্রত্যেকটি দেশই কারও ওপর আক্রমণ এলে সহায়তা একে অপরকে সহায়তা করার বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করেছিল।

এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ পুতিনকে বলেন, উত্তেজনা স্থিতিশীল করা হয়েছে। আর্মেনীয় এক এমপির বলেন, আর্মেনিয়া সীমান্তে এর আগে হারিয়ে যাওয়া ছয়টি অবস্থানের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া গেছে। কিন্তু এখানেই সব শেষ হয়ে যায়নি। ২১শে সেপ্টেম্বর আর্মেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনী সীমান্তের পূর্ব অংশে আর্মেনিয়ান অবস্থানগুলিতে মর্টার এবং বড় ক্যালিবার আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করেছে এবং এর ফলে একজন আর্মেনিয়ান সৈন্য আহত হয়েছে। ২২শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয় যে হামলার প্রথম দিনগুলিতে আহত বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে একজন হাসপাতালে মারা গেছে, যার ফলে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪। বেশ কয়েকটি বিদেশী প্রতিনিধি, মার্কিন দূতাবাস, ডাচ দূতাবাস, ফরাসি দূতাবাস হাই রিস্ক সিকিউরিটি অ্যালার্ট জারি করে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান বর্ডারের কাছে নন-এসেনশিয়াল ট্রাভেলে নিষেধাজ্ঞা দেয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নে ইউএস এম্বাসি থেকে আজারবাজানকে তাদের তাদের সৈন্যদেরকে ইনিশিয়াল পজিশনে ফিরে আসার ও সিজফায়ার মেইন্টেইন করতে পুনরায় বলা হয়।

এই ১৬ তারিখেই আজারবাইজানের সেনাদের দ্বারা বেশ কিছু নারকীয় যুদ্ধাপরাধ বা অসদাচরণের কথা জানা যায়। আজারবাইজানে কমপক্ষে সাতজন আর্মেনীয় যুদ্ধবন্দীকে আটক করা হয়েছিল বলে জানানো হয়, তবে ভিডিওভিত্তিক প্রমাণগুলো অনুসারে সংখ্যাটি আরও বেশি বলেই মনে হয়। সেদিনে টেলিগ্রামে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজে দেখা গেছে, আনুশ আবেতিয়ান নামে একজন নারী আর্মেনীয় সৈনিককে আজারবাইজানের বাহিনী বিকৃত করেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, ওই নারী নগ্ন, তার স্তন ও পেট জুড়ে বেশ কিছু শব্দ লেখা। তার চোখের সকেটটিতে একটি পাথর ঢোকানো, এবং তার মুখে একটি কাটা আঙুল স্থাপন করা হয়েছে। আর্মেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফরা বলেছিলেন যে “আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনী আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশের পরে নৃশংসতা চালিয়েছিল; তারা একজন মহিলা সেবা সদস্যের শরীরকে কর্তন করেছে, তার পা, আঙ্গুলগুলি কেটে ফেলেছে এবং তাকে নগ্ন করেছে। আর্মেনিয়া আজারবাইজানকে বন্দী অবস্থায় আরেকটি যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করার জন্য অভিযুক্ত করেছিল। আজারবাইজানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি অপেশাদার ভিডিওতে দাভিট গিশিয়ান নামে এক যুদ্ধবন্দীকে আহত ও অপমানিত হতে দেখা গেছে। পরে আর্মেনিয়ায় তার লাশ পাঠানো হয়।

আর্মেনিয়ার টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উপমন্ত্রী কর্তৃক প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, আজারবাইজানের গোলাবর্ষণের ফলে, আর্মেনীয় প্রদেশ সুনিক, গেঘরকুনিক এবং ভায়োতস ডিজোর-এ ১৯২টি আবাসিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর মধ্যে ৬০টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্মেনিয়ার মানবাধিকার কর্মী বলেন যে ৭,৫০০ এরও বেশি লোক তাদের বাড়িঘর থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ১৪ই সেপ্টেম্বর, এটি রিপোর্ট করা হয়েছিল যে আজারবাইজানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি গেঘরকুনিক প্রদেশে একটি রাশিয়ান এফএসবি অফিসেও আঘাত হেনেছে। ১৩ সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ার জরুরি অবস্থা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, আজারবাইজানের গোলাবর্ষণের ফলে জেরমুকে বনে আগুন ধরে যায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে আর্মেনিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মেহের মারগারিয়ান জারমুকে আজারবাইজানের হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন: “জারমুকের রিসোর্ট শহরের গোলাবর্ষণে কোন সামরিক লক্ষ্য নেই, এটি যুদ্ধাপরাধের চেয়ে কম কিছু নয়, এবং কেচুট জলাধারের বিরুদ্ধে হামলায় যেমন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি তার পরিবেশগত প্রভাবও রয়েছে।”

যাই হোক, মনে হয়েছিল এখানেই দুই দেশের সংঘর্ষের ইতি ঘটেছে। কিন্তু না তা ঘটেনি। এরপর ২৩শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পুনরায় একটি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের খবর দেয়, যেখানে বলা হয়, আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনী আর্মেনিয়ান সীমান্তের পূর্ব দিকে অবস্থিত আর্মেনীয় যুদ্ধ ঘাঁটিগুলির একটির পেছন দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল। আর এরপর আবার আজারবাইজানের আক্রমণের কথা শোনা গেল এই ২৯শে সেপ্টেম্বরে। ২৯শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রিপোর্ট করেছে যে আজারবাইজানি বাহিনী আর্মেনিয়ান-আজারবাইজান সীমান্তের পূর্ব অংশে গোলাবর্ষণ করে, বড় ক্যালিবারের মর্টার এবং অস্ত্র ব্যবহার করে, যার ফলে ৩ জন আর্মেনিয়ান সৈন্য মারা যায়। আর্মেনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই ঘটনাটি আজারবাইজানের “যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ইউনাইটেড ন্যাশনস এর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলির আহ্বানের প্রতি স্পষ্ট অসম্মান”। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এর জন্য “আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সীমান্তে একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিশন স্থাপনের” আহ্বান জানান।

সমগ্র সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে নিহত ৮০ ও আহত ২৮১ জন। অন্যদিকে আর্মেনিয়ায় নিহত বা নিখোঁজ ২০২ জন, আহত ২৯৩ জন ও ধৃত ২০ জন। তবে আজারবাইজান বলছে, আর্মেনিয়ার ৪৫০ সৈন্য নিহত হয়েছে ও তাদের দুটো এস-৩০০ লাঞ্চারকে তারা ধ্বংস করেছে। এগুলো ছাড়াও ৪ জন আর্মেনিয়ান সিভিলিয়ান নিহত হয়েছে, ২ জন সিভিলিয়ান নিখোঁজ, ৭ জন আর্মেনিয়ান সিভিলিয়ান আহত হয়েছে। আজারবাইজানি সিভিলিয়ানদের মধ্যে আহত ৩ জন। সব মিলে আর্মেনিয়ানদের ক্ষতি তুলনায় অনেক বেশি। যাই হোক, ২৯ তারিখের এই ঘটনা নির্দেশ করছে যে সংঘর্ষের ইতি এত সহজে ঘটছে না, এটা চলতেই থাকবে। আর মনে হচ্ছে সংঘর্ষের দোষটা আজারবাইজানের ঘাড়েই বেশি যায়।

কিন্তু আজারবাইজান কেন সংঘর্ষটা বাঁধাচ্ছে? লরেন্স ব্রোয়ার্সের মতে, আজারবাইজান এখন আক্রমণ করেছে কারণ এখনই যতটা পারা যায় তাদের ক্ষমতার ব্যবহার করার সুযোগ। কারণ যে রাশিয়া এতদিন যাবৎ আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে আসছিল, সেই দেশ ইউক্রেনে তার যুদ্ধের জন্য ব্যস্ত। আর্মেনিয়া সিএসটিও এর নীতি অনুসারে রাশিয়ার কাছে সহায়তা চাইলেও রাশিয়া থেকে কোন সহায়তা আসেনি। তিনি বলেন, আর্মেনিয়ার অন্তত দক্ষিণাঞ্চলে নতুন বাফার জোন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং বাইরের প্লেয়াররা এটি ঘটতে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন দুর্বল। এই বিষয়টা নিয়েই নিচে ডিটেইলে লিখছি…

বাইরের শক্তিরা

এই ছিল যুদ্ধের কথা। কিন্তু আমাদের আলোচনা কেবল যুদ্ধটা নিয়ে নয়, সেই সাথে যুদ্ধের উত্তেজনা সীমানার বাইরে কিরকম প্রভাব ফেলছে তা নিয়েও। আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের মধ্যে এই উত্তেজনা উভয়ের সীমানার বাইরেও প্রভাব ফেলেছে, কারণ আর্মেনিয়া রাশিয়া নেতৃত্বাধীন সিএসটিও বা সমষ্টিগত নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থার একটি অংশ। সিএসটিও কিছুটা হলেও ন্যাটোর বিরুদ্ধে রাশিয়ার একটি জোট হিসেবে কাজ করে। সিএসটিও মূলত একটি সামরিক জোট, এটি ন্যাটোর কাউন্টারপার্ট, এবং এর একটি ম্যুচুয়াল ডিফেন্স ক্লজ আছে যা আর্টিকেল ফোর নামে পরিচিত, যার ফাংশনটাও ন্যাটোর মতই। অনুচ্ছেদ ৪ এর অধীনে সিএসটিও এর কোন একটি দেশের উপর আক্রমণ হলে যদি প্রয়োজন হয় তখন সিএসটিও এর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে অবিলম্বে সামরিক সহায়তা সহ অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। অন্য কথায়, অনুচ্ছেদ ৪ এর প্রবর্তনের পরে রাশিয়া এবং এর অন্যান্য সদস্যদেরকে আর্মেনিয়ার সমর্থনে আসতে হবে। কিন্তু সময়টা এখন রাশিয়ার জন্য ভাল চলছে না। রাশিয়ান বাহিনী বর্তমানে ইউক্রেনে তাদের হৃত বেশ কিছু অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে। ফলে এখন রাশিয়ার পক্ষে আর্মেনিয়ায় শত শত সৈন্য পাঠানোর জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা নেই, নেই আর্মেনিয়াকে সমর্থন দানের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জামও। আর যদি রাশিয়ার সেই সক্ষমতা থেকেও থাকে, তাহলেও প্রশ্ন আসে এদের সেটা করার রাজনৈতিক ইচ্ছা নিয়ে।

শুধু সিএসটিও এর কারণে নয়, আরেকটা কারণেও এই সংঘাতটি রাশিয়ার জন্য খুব একটা ভাল নয়। সেটা হচ্ছে আজারবাইজানের সাথে তুরস্কের ঘনিষ্ঠতা। এই দুই দেশ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বলেই মনে করা যায় যে, আজারবাইজানের পক্ষ থেকে শুরু হওয়া যেকোন রকম ওয়ার এস্কেলেশনে এরদোয়ানেরও ভূমিকা রয়েছে। এখন আপনি মনে করতে পারেন, এরদোয়ানের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক মোটামুটি ভালই, সুতরাং এরদোয়ান উলটে আজারবাইজানকে সতর্ক করে থাকবে যাতে এখন তারা বাড়াবাড়ি না করে, নাহলে অন্ততপক্ষে এরদোয়ান অন্তত এই আক্রমণের জন্য আজারবাইজানকে নিন্দা জানাবে। কিন্তু সেটা হয়নি। প্রথমত তুরস্কের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক এখন আর সেরকম ভাল না, এই ব্যাপারটা নিয়ে পরে বিস্তারিত লিখব। দ্বিতীয়ত তুরস্কের কাছে সবসময়ই “অন্য স্বার্থ” আগে, যার কারণে তারা উলটে আজারবাইজানকেই সমর্থন করবে ও আর্মেনিয়াকে নিন্দা করবে। আর তারা করেছেও ঠিক তাই। তুরস্কের ডিফেন্স মিনিস্টার উলটে আর্মেনিয়াকেই তার “এগ্রেসিভ এটিচুড” ও “উষ্কানিমূলক কাজের” জন্য নিন্দা জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, আজারবাইজানের ওপর তুরস্কের সাপোর্টও রয়েছে। যুদ্ধের একটি ফুটেজে দেখা গেছে আজারবাইজানিরা এই যুদ্ধে তুর্কি টিবি২ বায়রাক্তার ড্রোন ব্যবহার করছে! সেই সাথে অনেক আগে থেকেই তুরস্ক আজারবাইজানকে সম মিসাইল সহ গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র প্রদান করে আসছে, যেগুলো তারা এখন আর্মেনিয়ার ওপর ব্যবহার করছে।

এরদোয়ান জানে যে, তার এই কাজ রাশিয়ার মনে বিরক্তির সঞ্চার করবে। ইতিমধ্যেই একটা আর্গুমেন্ট শুরু হয়ে গেছে, যা বলছে রাশিয়া এই অঞ্চলের রেজিওনাল সিকিউরিটি গ্যারান্টর ছিল বলেই এই সংঘাতটা আবার শুরু হয়েছে, যা কেবল রাশিয়ার জন্য অপমানজনকই নয়, সাথে বর্তমানে রাশিয়ার দুর্বলতা, অক্ষমতা ও দীনতাও প্রকাশ করে। ইউক্রেইনে আক্রমণের পূর্বে রাশিয়াকে একটি মিলিটারি সুপারপাওয়ার ভাবা হতো। যদি বা ভাবা নাও হতো, তাহলেও অন্তত মিলিটারি সুপারপাওয়ারের কাছাকাছি কিছু ভাবা হতো। সারা পৃথিবী এক্সপেক্ট করত যে, রুশ বাহিনী খুব দ্রুত ইউক্রেনীয় ডিফেন্সকে ধ্বংস করে দিয়ে দেশটির বিশাল অংশ কব্জা করে নেবে। কিন্তু বলাই বাহুল্য যে এটা ঘটেনি। ইউক্রেইনের যুদ্ধটি দেখিয়ে দিয়েছে যে, রাশিয়াকে এই অঞ্চলের স্ট্যাবিলিটি ও সিকিউরিটির আয়রনগার্ড ভাবাটা একটা ফ্যালাসি ছিল। আর ঠিক এই ফ্লসটাই আজারবাইজানকে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এর ফলেই দেশটি তার ধারণা অনুসারে আনরিজলভড টেরিটোরিয়াল ডিসপুটকে রিজল্ভ করতে চাইছে। এই আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার নতুন সংঘাতটি তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কিছু কঠিন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।

যাই হোক, তুরস্ক যে তার অন্য স্বার্থ্যের কথা ভেবেই এই কাজগুলো করছে তা উল্লেখ করেছিলাম। তার এই অন্য স্বার্থ্য কী সেই ব্যাপারে একটু আঁচ পাওয়া যাবে আজারবাইজানের এই যুদ্ধে স্বার্থ কী সেই ব্যাপারে অনুমান করার মাধ্যমে। অনেকে বলছিলেন, আজারবাইজান আর্মেনিয়ার কিছু অঞ্চল নিয়ে একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হতে পারে, কিন্তু রাশিয়া যদি এটার অনুমোদন না দেয় তবে এটা হওয়া কঠিন। আজারবাইজান আসলে চায় আর্মেনিয়া নাগারনো-কারাবাখে তার সব দাবি ত্যাগ করুক। সেই সাথে আজারবাইজান চায় তুরস্কের বর্ডারে আজারবাইজানের যে নাকিচেভান নামের এনক্লেইভটি আছে সেটার সাথে এর মেইনল্যান্ডের ট্রান্সপোর্ট কোরিডর, সেই সাথে পাসপোর্ট ও কাস্টোম কন্ট্রোলের অব্যাহতি। এটা হলে তুরস্কের সাথে আজারবাইজানের যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে যাবে। এদিকে আর্মেনিয়া সেটা চায়না, কেননা এটা তাদের টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রিটিকে দুর্বল করবে। অনেকে ভয় পান যে, এর মাধ্যমে আজারবাইজান আর্মেনিয়ার অনেক অঞ্চলও দখল করে নেবে। আরেকটা সুবিধা আছে এতে, তা হচ্ছে আজারবাইজান থেকে তুরস্কের ওপর দিয়ে এই পরিকল্পিত জাঙ্গেজৌর (Zangezour) কোরিডরটির আরমেনিয়ার সাথে ইরানের বর্ডার একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যাবে, কেননা কোরিডরটি একেবারে ইরান-আর্মেনিয়ার বর্ডার দিয়ে যাবে। যার ফলে আর্মেনিয়া তার বর্ডার অঞ্চলে থাকা মিত্র ইরানের সাথে সরাসরি সংযোগ হারাবে।

উল্লেখ্য, ইরান আর্মেনিয়ার মিত্র ও আজারবাইজানকে এরা হুমকি ভাবে। এই ব্যাপারটা ডিটেইলে লেখার মত বিষয়, কিন্তু আপাতত জাস্ট একটা পয়েন্ট সামনে আনছি। ইরান ও আজারবাইজান উভয়ই শিয়া মুসলিম হলেও এদের মধ্যে কিছু শত্রুতাও রয়েছে। ইরান আজারবাইজানের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করে, কিন্তু সেক্যুলার আজারবাইজান এইসব রিলিজিয়াস এক্সট্রিমিস্ট গোষ্ঠীকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য থ্রেট মনে করে। অন্যদিকে আজারবাইজানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আবুলফাজ এলচিবে-র সময়কালে আজারবাইজানে প্যান-তুর্কি রাজনৈতিক রেটোরিকগুলো বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে ইরানে রয়েছে প্রচুর জাতিগত আজেরি বা আজারবাইজানি জনসংখ্যা। ইরান এতে ভীত হয়, কেননা আজার বাইজানে প্যান তুর্কী জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইরানের আজেরিদের মধ্যেও এই জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পেতে পারে, যা এদেরকে ইরানের থিওক্রেসির বিরুদ্ধে সঞ্চালিত করবে। ফলে ইরান আজারবাইজানকে হুমকি হিসেবে গ্রহণ করে ও এদের থ্রেটকে সামাল দিতে তারা আর্মেনিয়ার সাথে শক্তিশালী মৈত্রী স্থাপন করে।

এই জাঙ্গেজৌর কোরিডর হয়ে গেলে ইরান তার দুটো জিওপলিটিকাল এডভান্টেজ থেকে বঞ্চিত হবে। প্রথমত, ইরানের ইউনিক পজিশন তাদেরকে আজারবাইজানের এনক্লেইভ নাখচিভান ও আজারবাইজানের মেইনল্যান্ডকে ইরানিয়ান টেরিটোরি থেকে এক্সেস দেয়। দ্বিতীয়ত, ইরানের সাথে আর্মেনিয়ার ল্যান্ড বর্ডার। কয়েক দশক ধরে আজারবাইজান তাদের এনক্লেইভ নাখচিভানে যাবার জন্য ইরানের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যা ২০২০ সালের যুদ্ধের পর চলে যায়। কারণ, ২০২০ সালের যুদ্ধে জয়ের পর আজারবাইজানে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি অনুযায়ী নাখচিভানের সাথে আজারবাইজানের মেইনল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয়। এখন ইরান-আর্মেনিয়ান বর্ডারের ওপর দিয়ে যদি আজারবাইজানের কোরিডর যায় তাহলে তা আর্মেনিয়া আর ইরান উভয়ের জন্যই ক্যাটাস্ট্রফি হবে, আর আজারবাইজান ও তুরস্কের জন্য লাভজনক। কিন্তু তুরস্কের স্বার্থ কেবল এটা দিয়েই বোঝা যাবে না, সেই সাথে বোঝা যাবে না রাশিয়ার ওপর আসা তুরস্ক ও অন্যান্য তুর্কিক রাষ্ট্রসমূহের থ্রেট সম্পর্কে। এটা সম্পর্কে জানতে হলে জানতে হবে প্যান-তুর্কিজম নামে এক বিশেষ মতাদর্শ সম্পর্কে। এটা নিয়ে পরে লেখা হবে…

তুরস্কের ও অন্যান্য তুর্কিক রাষ্ট্রের প্যান-তুর্কিজম

এবারে যাচ্ছি তুরস্কের নিজস্ব স্বার্থের ব্যাপারে। এই ব্যাপারে যা লিখব তাতে কিছুটা স্পেক্যুলেশন থাকবে। পোস্ট-সোভিয়েত জগতে এখন প্যান-তুর্কিজমের একটি পুনরুজ্জীবন দেখা যাচ্ছে, যা এমনকি মস্কোকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ২০১৯ সালে আজারবাইজানের বাকুতে অরগানাইজেশন অফ তুর্কিক স্টেইটস এর তুর্কিক কাউন্সিলের সপ্তম শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বেশ সাহসিকতার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা ছয়টি রাষ্ট্র, এক জাতি হিসেবে সবচেয়ে শক্তিশালী হব।” উল্লেখ্য, অর্গানাইজেশন অফ তুর্কিক স্টেইটসের সদস্য সংখ্যা ৫টি দেশ (তুরস্ক, আজারবাইজান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক) আর অবজারভার দেশ ২টি (হাঙ্গেরি ও তুর্কমেনিস্তান)। হাঙ্গেরী বাদে বাকি ৬টি তুর্কিক রাষ্ট্রের কথাই এরদোয়ান উল্লেখ করেছেন।

আপনার মনে হতে পারে, হাঙ্গেরীয়রা তো তুর্কিক জাতি নয়, অর্থাৎ তারা তো তুর্কিক ভাষায় কথা বলেনা, বা হাঙ্গেরীয় ভাষা তুর্কিক না, তবে তারা কেন এই অর্গানাইজেশন যোগ দিল। আসলে হাঙ্গেরীয়রা নিজেদেরকে আত্তিলা দ্য হান এর উত্তরসুরি বলে ভাবে, আর হানদেরকে তারা তুর্কিদের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করে, আর তাই হাঙ্গেরীয় ভাষাকেও তারা তুর্কী ভাষার রিলেটিভ মনে করে। কিন্তু এই ধারণাটি ভুল। ডিটেইলে ব্যাখ্যায় যাচ্ছিনা। সংক্ষেপে বলছি, হাঙ্গেরীয় ভাষা একটি উরালিক ভাষা, যা তুর্কিক ভাশাগুলো থেকে খুবই আলাদা, এদের অরিজিন এক নয়। পূর্বে মনে করা হতো উরালিক ভাষাপরিবার ও “আলতাইক ভাষাপরিবার” দুটি একই ভাষা-পরিবার উরাল-আলতাইক ভাষা পরিবার থেকে উদ্ভূত, তাই হাঙ্গেরীয়রা ও তুর্কিকরা সম্পর্কিত। কিন্তু পরে দেখা গেল, উরালিক ও আলতাইক ভাষার সাধারণ উৎপত্তির ধারণাটি যে ভুল শুধু তাই নয়, সেই সাথে আলতাইক ভাষা পরিবারের ধারণাটিই ভুল, কেননা যেসব ভাষাকে আলতাইক ধরা হয়, সেই তুর্কিক, মঙ্গোলিক, তুঙ্গুসিক ভাষা পরিবারগুলো (কখনও কখনও জ্যাপোনিক ও কোরিয়ানিক ভাষাপরিবারগুলো ও খুব কম সময়ে আইনু ভাষাপরিবারকেও আলতাইক ধরা হয়) পরিবারগুলোরও উৎপত্তি এক নয়। ফলে এরকম ধারণা ভিত্তিহীন। কিন্তু হাঙ্গেরীয় সরকার এখনও এই ধারণাটি ধরে রেখেছে। আর এই ধারণাটির সাথে বিশেষ রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী মতাদর্শও জড়িত, যার নাম হলো তুরানিজম বা প্যান-তুরানিজম। এটি একটি প্যান-ন্যাশনালিস্ট কালচারাল ও পলিটিকাল মুভমেন্ট, যা ইনার এশিয়া ও সেন্ট্রাল এশিয়ান অরিজিনের কালচারালি, লিংগুইস্টিকালি বা এথনিকালি রিলেটেড জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বা রাজনৈতিক একীকরণ দাবি করে, যাতে তারা শেয়ারড ইন্টারেস্টে কাজ করতে পারে এবং ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের বিরোধিতা করতে পারে। এই জাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিন বা ফিনিশ, সামি, সামোয়েড, বুলগেরিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান, তুর্ক, মোঙ্গল, মাঞ্চু ও অন্যান্য ছোট ছোট গোষ্ঠী। ১৯শ শতকে প্যান-জার্মানিজমের মত আদর্শের বিরোধিতা করতে গিয়ে এর জন্ম হয়, আর এই প্যান-তুরানিজম ধারণার বিকাশে প্যান-স্লাভিজমের প্রভাব আছে, তুরানিয়ান ব্রাদারহুড এন্ড কলাবরেশনের ধারণাটি স্লাভিক ব্রাদারহুড এন্ড কলাবরেশনের প্যান-স্লাভিক কনসেপ্টটি থেকেই ধার করা।

যাই হোক, আলোচনাটি প্যান-তুর্কিজম নিয়ে। তো এরদোয়ান ৬টি রাষ্ট্রকে এক জাতি ধরে যে বক্তব্যটা দিল সেই এক জাতির ব্যাপারটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে কেবলই একটি রেটোরিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সম্ভবত এটি রেটোরিকের চেয়ে বেশি কিছুই, যা প্যান-তুর্কিজমকে ইঙ্গিত করে। এরদোয়ানের কথাগুলো সাধারণ ভাষাগত ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের একটি সাধারণ স্বীকৃতির চেয়েও বেশি কিছু ছিল, যা গত তিন দশক ধরে সোভিয়েত-পরবর্তী বিশ্বে তুরস্কের প্যান-তুর্কিজম মতাদর্শকে মূর্ত করে তুলছে। ১৮৮০ এর দশকে রাশিয়ার কাজান, ককেশাস (বর্তমান আজারবাইজান), ও অটোমান সাম্রাজ্যের (বর্তমান তুরস্ক) ইন্টেলেকচুয়ালরা ধারণাটির উত্থান ঘটায়, যা পৃথিবীর সকল তুর্কিক জনগোষ্ঠীর লোকেদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক একীকরণকে তাদের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে। একটু আগে যে তুরানিজমের কথা বললাম, প্যান-তুর্কিজম তার থেকে আরও বিশেষ, কারণ এটি কেবল তুর্কিক জনগোষ্ঠীসমূহের একীকরণ চায়। তবে দেখা যায়, প্যান-তুর্কিজম ও তুরানিজম শব্দগুলো আসলে অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। তুরানিজমের সাথে যেমন উরালিক-আলতাইক ভাষাপরিবারের বাতিল থিসিজগুলো সম্পর্কিত, তেমনি প্যান-তুর্কিজম সম্পর্কিত স্যুডো-তুর্কোলজি নামক কিছু উদ্ভট ও বানোয়াট মানবেতিহাসের কাহিনী, যেখানে নেটিভ আমেরিকানদের পর্যন্ত তুর্কিক বলে দাবি করা হয়। তবে সেই দিকে আর আলোচনা বাড়াব না। আপাতত যেটুকু জানা ইম্পরটেন্ট তা হচ্ছে, প্যান-তুর্কিজমকে বিশ্বজুড়ে তুর্কিক জনগণ, যেমন আজেরি, তাতার, কাজাখ, উজবেক এবং কিরগিজ জাতি, যারা একটি শেয়ারড তুর্কিক ঐতিহ্য বহন করে, তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী জোট তৈরি করা যা, ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক শৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়। ২০০৯ সালে তুর্কি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার পেছনে এটিই ছিল মূল ধারণা। আর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে এই প্যান-তুর্কিজমের সাথে রাজনৈতিক ইসলামও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। উদাহরণ হিসেবে তুরস্ক ও আজারবাইজানের গ্রে ওল্ভস রিলেটেড পার্টিগুলোর কথা বলা যায় যারা প্যান-তুর্কিজম আদর্শ প্রমোট করে। এই পার্টিগুলো একই সাথে তুর্কিশ-ইসলামোন্যাশনালিজমও প্রমোট করে। তাছাড়া গ্রে ওলভস ছাড়াও তুরস্কের এরদোয়ানের পার্টি জাস্টিস এন্ড ডেভলপমেন্ট পার্টিরও তুর্কিশ-ইসলামিজমের আদর্শ রয়েছে।

অনেকে প্যান-তুর্কিজম আর নিও-অটোমানিজমকে গুলিয়ে ফেলেন। বর্তমানে প্যান-তুর্কিজম বিশেষভাবে সোভিয়েত-পরবর্তী জগত, অর্থাৎ পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেসব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত সেসব অঞ্চল নিয়ে ভাবিত। অন্যদিকে নিও-অটোমানিজম ভাবিত হয় অটোমান সাম্রাজ্য যেসব অঞ্চল পূর্বে নিয়ন্ত্রণ করত সেগুলো নিয়ে। এখন সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকা অঞ্চলগুলোর ওপর অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিলনা, আর তাই যেসব তুর্কিক রাষ্ট্রের কথা বলা হচ্ছে সেগুলোতে তুর্কি-প্রভাবের জন্যও নিও-অটোমানিজমের আদর্শ যথেষ্ট নয়, তাই প্যান-তুর্কিজমই তাদের দরকার। ASRIE Analytica এর ফাউন্ডার গিউলিয়ানো বিফোলচি বলছেন, তুরস্কে এখন নিও-অটোমানিজম ওল্ড ফ্যাশনড হয়ে গেছে, তাদের এজেন্ডার সামনের সারিতে রয়েছে এখন প্যান-তুর্কিজমের মাধ্যমে সেন্ট্রাল এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে আলোচ্য তুর্কিক অঞ্চলগুলো নিজেদের দখলে রেখেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্টরা ছিল এথনো-ন্যাশনালিজম ও রিলিজিয়াস আইডেন্টিটির বিরোধী, তাই তাদের সময়ে এরকম প্যান-তুর্কিজম বা তুর্কিক এথনিক জাতীয়তাবাদ এরকম মাথাচাড়া দেয়নি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো তাদের পুরনো তুর্কী ও ইসলামিক ঐতিহ্যকে রিভাইভ করতে থাকে, আর সেই সাথে শক্তিশালী হতে থাকে প্যান-তুর্কিজমের আদর্শ। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াও প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চলগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে চায়, আলেকজান্ডার দুগিন ও অন্যান্যদের নিও-ইউরেশিয়ানিজম বা ইউরেশিয়া মুভমেন্ট দিয়ে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্যান-তুর্কিজমের আদর্শের সাথে এর সংঘাত লাগছে। ফলে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যেও সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মূর্ত হয়ে উঠছে ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধের পর। যাই হোক, ২০০৯ সালের তুর্কিক কাউন্সিল গঠনের পর থেকে কাজাখস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি নুরসুলতান নাজারবায়েভ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুরূপ ভাবে একটি “তুর্কিক ইউনিয়ন” এর ধারণাটি উত্থাপন করেছেন।

তো এই প্যান তুর্কিজমের প্রকাশ কিভাবে হচ্ছে? তুরস্ক এক্টিভলি হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে মধ্য এশিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার সাংস্কৃতিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার কাজের জন্য স্কলারশিপ দিচ্ছে। ২০১৭ সালে আজারবাইজান, তুরস্ক, কাজাখস্তান ও কিরগিজিস্তান মিডল স্কুল এইজড বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে, যার নাম হচ্ছে “জেনারেল তুর্কিক হিস্ট্রি” বা সাধারণ তুর্কী ইতিহাস। এটা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও একই রকম প্যান-তুর্কিক প্রোজেক্ট রয়েছে তাদের। এই সব বইতে যে ন্যারেটিভ শেখানো হয় সেগুলো ইনকন্সিস্টেন্সি ও হিস্টোরিকাল ফলসহুডে ভর্তি। এই ব্যাপারে বলতে শুরু করলে একটা বিশাল নিবন্ধ লেখা যাবে। ইউনিভার্সিটি অফ গেন্টের ঐতিহাসিক ব্রুনো ডে করডিয়ের বলছেন, এই ধরণের বিকৃত ন্যারেটিভ চাপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার, এরা সকল তুর্কিক জাতিগুলোর মধ্যে আইডিওলজিকাল ইন্টিগ্রেশন বা মতাদর্শিক একীকরণ চায়। যদিও রাশিয়া এখনও এই অঞ্চলে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রা বজায় রেখেছে, কিন্তু গিউলিয়ানো বিফোলচি মনে করেন, তুরস্ক এখানে এমন কিছু দিতে পারে, যা রাশিয়া কখনও দিতে পারেনা, তা হচ্ছে সেন্স অফ কমোনালিটি বা সাধারণতার অনুভূতি…  তুরস্ক তুর্কিক জাতিগুলোকে একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমি দিতে পারে, আর পারুক বা না পারুক, দেশটি তুর্কিক লোকেদেরকে এই ধারণাটি দান করতে পারে যে এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী জাতি শাসন করতে পারে, যা ইউরেশিয়ার “ন্যাটো” হয়ে উঠবে, যা রাশিয়া ও চীন উভয়কেই কাউন্টার করতে পারবে।

এর ফলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, কারণ এর ফলে তারা তাদের বেশিরভাগ প্রভাব হারাতে পারে। অনেক কারণেই মধ্য এশীয় লোকেরা এখন রুশদের চেয়ে নিজেদের ধর্ম ও ভাষাভাষী লোকেদেরই বেশি আপন মনে করে। এর একটি কারণ হিসেবে রাশিয়ায় মধ্য এশীয় অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি তাদের দুর্ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে অনেকে বলে থাকেন। মধ্য এশিয়া ও ককেশাসে তুরস্কের প্রভাব রাশিয়ার অর্থনৈতিক ইন্টারেস্টের জন্যেও ক্ষতিকর, কেননা রাশিয়া এখন প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোরর সাথে মিলিটারি ও ট্রেড ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে মস্কো নেতৃত্বাধীন এক্সিস তৈরি করতে চায়। এক্ষেত্রে রাশিয়ার অবজেক্টিভের দুটো প্রধান উপাদান হচ্ছে কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অরগানাইজেশন (সিএসটিও) এবং ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ)। কাজাখস্থান ও কিরগিজিস্তান এই উভয় সংগঠনেরই সদস্য। এখন মিলিটারি ও ইকোনমিক সেক্টরে তুর্কিক কাউন্সিল মেম্বারদের মধ্যকার শক্তিশালী পার্টনারশিপ এই সিএস্টিও ও ইএইইউ এর জন্যই ক্ষতিকর হবে। এদিকে তুর্কমেনিস্তান থেকে আজারবাইজান এবং তুরস্ক হয়ে ইউরোপে একটি গ্যাস পাইপলাইন যাবার প্রস্তাব আছে, যেটা, ইউরোপীয় গ্যাস বাজারে রাশিয়ার আধিপত্যের জন্য নিঃসন্দেহে একটি হুমকি। অবশ্য এটা এখনও একটি ধারণা মাত্র, অনেক কিছুর ওপরই এটা নির্ভর করছে। আর কেবল তুর্কিকরা হলে একটা কথা ছিল, কিন্তু এখন রাশিয়াকে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য চীনের সাথেও প্রতিযোগিতায় যেতে হবে। এর ফলে ককেশাস ও সেন্ট্রাল এশিয়ায় তুরস্ক, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে একটি নতুন খেলার সূচনা হয়েছে, যা আগামীতে পরিস্থিতিকে ক্রমশ উত্তপ্ত করবে।

এখান থেকেই বোঝা যায়, তুরস্কের সাথে আজারবাইজানের মেইনল্যান্ডে কোরিডরটা তৈরি হলে তুরস্কের লাভটা কোথায়। ভাল কথা, প্যান-তুর্কিজম নিয়ে আজারবাইজান একটু বেশিই আহ্লাদ দেখায়। তাদের প্যান-তুর্কিস্ট আদর্শ অনুসারে নাগার্নো-কারাবাখ আর আর্মেনিয়া আসলে পশ্চিম আজারবাইজান, এখানে আজেরি তুর্কিরাই আদি বাসিন্দা, আর আর্মেনীয়রা সেখানে বহিরাগত, যারা বর্তমান আর্মেনিয়ায় প্রবেশ করে আজেরিদের বিতাড়িত করেছে। এসবের কোন সত্যতা নেই, কিন্তু তারা এগুলোই শেখায় তাদের শিক্ষার্থীদের। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে কেবল আজারবাইজানই আর্মেনিয়ায় আক্রমণ করেনি, সাথে তাজিকিস্তান ও কিরগিজিস্তানের মধ্যেও বর্ডার ক্ল্যাশ ঘটেছে, যার শুরু হয় ১৪ই সেপ্টেম্বরে, আর ১৬ই সেপ্টেম্বরে তার সমাপ্তি ঘটে। উল্লেখ্য, তাজিকিস্তানের লোকেরা মূলত তাজিক, যারা একটি ইরানীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠী। অন্যদিকে কিরগিজিস্তানের লোকেরা তুর্কিক, যারা তুর্কিক কাউন্সিলের সদস্য। এটা অন্যান্য ক্ল্যাশের মত স্পোরাডিক ছিলনা, ভাল মতই এস্কেলেশন হয়েছিল। এতে কিরগিজরা তুরস্কের দেয়া ড্রোন ব্যবহার করে বলে জানা যায়। যুদ্ধে তাজিকিস্তানের ৭৪ জন ও কিরগিজিস্তানের ৫৯ জন নিহত হয়। তুজন তাজিক বর্ডার গার্ডকে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, কিরগিজিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেই বর্ডার গার্ডরা তাদের ডিমার্কেটেড এরিয়ার বাইরে এসে পড়েছিল। শেষে উজবেকিস্তানের সমরখন্দে অনুষ্ঠিত সাংহাই কোঅপারেশন অরগানাইজেশন (SCO) এর সামিটে দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে মিটমাট হয়। এই যুদ্ধটিও একইভাবে রাশিয়ার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে। হয়তো আমরা পশ্চিমা বিশ্বকে রাশিয়ার যত বড় শত্রু বলে মনে করছি, এর চেয়েও বড় শত্রুরা হয়তো রাশিয়ার ঘরের কাছেই বসে আছে…

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.