নর্ড স্ট্রিমে লিকেজের জন্য সম্ভাব্য দায়টা কার? আর এর গুরুত্বটাই বা কী?

সোমবার, নর্ড স্ট্রিমের উভয় পাইপলাইনই প্রায় একই সাথে লিকেজের শিকার হয়। পাইপলাইনে এরকম কিক হবার ব্যাপারটা খুব রেয়ার, সবসময় হয়না, আর এটা কিনা ঠিক এমন সময়ই হলো যখন রাশিয়া তার এনার্জিকে উইপনাইজ করতে চাইছে যুদ্ধের জন্য। এর ফলে রাশিয়ার ওপর সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ইউক্রেইন ইতিমধ্যেই পাইপলাইনগুলো স্যাবোটাজ করার জন্য রাশিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। এদিকে এটা স্পষ্ট নয় যে, রাশিয়া যদি লিকেজ করেই থাকে তাহলে এখান থেকে রাশিয়ার লাভ কী হবে, যেখানে দেশটি গ্যাস সাপ্লাই জাস্ট বন্ধ করেই দিতে পারে। এরকমও স্পেক্যুলেশন আছে যে, এই লিকেজের কাজটি ইউএস করে থাকতে পারে। লিকেজ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে আসছে, যেমন এই লিকেজের কাজটি ইচ্ছাকৃত নাকি এক্সিডেন্টাল ছিল, আর যদি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়ে থাকে তবে কারা এটা করল? আলোচনা করা যাক…

১ম লিক হয় সোমবার সকালে নর্ড স্ট্রিম ২-এ, পরে ২য় ও ৩য় লিক হয় সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় নর্ড স্ট্রিম ১-এ। এগুলো ঘটে বাল্টিক সাগরের ড্যানিশ আইল্যান্ডের বর্নহোমের মোটামুটি ৩০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। লিকগুলো একে অপরের থেকে ৫০ মাইল দূরে ছিল, প্রতিটি লিক প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ, যেগুলো ঘণ্টায় প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন মিথেন নির্গত করে। ডেনমার্কের শক্তি সংস্থা আশা করছে যে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই লিক অব্যাহত থাকবে। যাইহোক, এই লিকগুলো বেশ কয়েকটি কারণে সন্দেহজনক। সন্দেহের প্রথম কারণ হচ্ছে লিকগুলোর টাইমিং। এই পাইপলাইনগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী যার প্রায় ৪ সেমি পুরু স্টিল ওয়াল আছে, এরও চারদিকে প্রায় ১০ সেমি পুরু স্টিল রিইনফোর্সড কনক্রিট আছে। একারণে পূর্বে এই দুই পাইপলাইনে মাইনোর লিক হলেও কখনই এর আগে এরকম ব্যাপক মাত্রায় লিকেজ ঘটেনি। আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এরকম বিশাল ম্যাগনিচুডের তিনটি লিকের সম্ভাবনা একেবারেই কম। তার ওপরে, যেহেতু লিকগুলো একটি অপরটি থেকে ৫০ মাইল দূরে দূরে ঘটেছে, সেক্ষেত্রে বলতে হয় যে লিকগুলো একটি নির্দিষ্ট ঘটনার কারণে ঘটেনি, আলাদা আলাদা কারণেই ঘটেছে। ড্যানিশ জিওলজিক্যাল সার্ভিস এবং সুইডিশ সিসমিক ইন্সটিটিউট উভয়ই এই অঞ্চলে দুটি পৃথক বিস্ফোরণ রেকর্ড করেছে, যার থেকে লিকগুলোর সংগঠনের সঠিক সময়গুলো জানা যায়। এছাড়াও নর্ড স্ট্রিম ২ এর লিকটি বোর্নহোম উপকূল থেকে মাত্র ১২ নটিক্যাল মাইল দূরে ঘটেছে, এবং তাই, ডেনমার্কের আঞ্চলিক জলসীমার ঠিক বাইরে একটি সুবিধাজনক স্থানেই এই ঘটনাটি ঘটেছে। এর মানে হল, যে এই কাজটি করেছে সে দাবি করতেই পারে যে, এই কাজটি ডেনমার্কের জলসীমায় আনা কোন আক্রমণ ছিল না, আর তাই এটি, নিয়ে নাক গলানো ডেনমার্ক বা ন্যাটোর এখতিয়ারের বাইরে। অবশেষে, লিকগুলোর অবস্থানের পাইপলাইনগুলি প্রায় ৭০ মাইল গভীর, যার মানে হল, যে এটি করেছে তার এর জন্য সাবমেরিনের প্রয়োজন ছিল না, কেবল ভাল প্রশিক্ষিত ডুবুরিদের দিয়েই কাজটি করা যেতে পারে। সুইডেন এবং ডেনমার্ক উভয়ই ইতিমধ্যে বলেছে যে তারা মনে করে যে লিকগুলি ইচ্ছাকৃত ছিল তবে তারা তাদের সমালোচনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সংযম দেখাচ্ছে। ডেনমার্ক বলেছে, এটা কোনো যুদ্ধ ঘোষণা নয়। সুইডেন বলেছে যে এটি সুইডেনকে লক্ষ্যবস্তু করার উদ্দেশ্যে ছিল না। আর দুই দেশের কোনটাই তাদের সন্দেহের তীর থেকে রাশিয়াকেও বাদ দেয়নি।

যাইহোক, প্রথম নজরে রাশিয়াকে দোষী বলে মনে হয়। ক্রেমলিন পূর্বে তার এনার্জিকে উইপনাইজ করতে চেয়েছিল, আর পাইপলাইন সাবোটাজ করা তাদের হাইব্রিড ওয়ারফেয়ারের অংশ হতেই পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট হচ্ছে না যে, এটা করে রাশিয়ার লাভটা কোথায়। নর্ড স্ট্রিমকে পুরোপুরি ব্লো আপ করলে রাশিয়ার সাথে জার্মানির ভবিষ্যৎ গ্যাস রিলেশনশিপটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, যার আশা ক্রেমলিন কখনও ত্যাগ করেনি। তারা গ্যাস না পাঠানোর জন্য একের পর এক টেকনিকাল এক্সকিউজ দিয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু কখনো বলেনি যে আমরা তোমাদেরকে আর কোনদিন গ্যাস পাঠাব না। আর এটাও স্পষ্ট নয় যে, কেবল ট্যাপ বন্ধ করলেই যখন তারা গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ করতে পারত সেখানে এই ব্লো আপ করায় তারা কী এমন বাড়তি সুবিধা লাভ করবে, যেখানে এরা অলরেডি ট্যাপ বন্ধ করে দিয়েছে। এইসব কারণে অনেকে এও মনে করছে যে পাইপলাইনের এই স্যাবোটাজটা করেছে আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাতে জার্মানি আরও বেশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, এবং ন্যাটোও যুদ্ধে জড়াবার এক্সকিউজ লাভ করে। উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারিতে বাইডেন রিপোর্টারদেরকে বলেছিলেন, চাইবামাত্র নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইনকে বন্ধ করার ক্ষমতা থাকা উচিৎ। তাই এই কথাটা এখন সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে সারকুলেট করছে।

এভাবে ইউএস-কে দোষ দেয়াটাকে একটি কনস্পিরেসি থিওরি বলে মনে হলেও, কতিপয় সিরিয়াস লোকও একে গ্রহণ করেছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের একজন পোলিশ মেম্বার। টুইটারে তিনি পোস্ট করে বলেছেন, ইউএস পাইপলাইনকে ধ্বংস করে ইস্টার্ন ইউরোপের “উপকার” করেছে যার ফলে এই অঞ্চলটি রাশিয়ান আগ্রাসনের ক্ষেত্রে আরও বেশি ভালনারেবল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ইউএস দ্বারা এটি ঘটার তত্ত্বটিকে অসম্ভব বলে মনে হয়। প্রথমত, জার্মানি ইউএস এর তুলনায় ইউক্রেইনে অস্ত্র পাঠানোয় ধীরতা দেখাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেবার মত তাদের সেভাবে অত টেকনোলজি নেইও, যার কারণ হচ্ছে মেরকেলের সময়কার দেশে নিম্ন মাত্রায় ডিফেন্স স্পেন্ডিং। দ্বিতীয়ত, কয়েক দিনের মধ্যেই এই পাইপলাইনগুলো ফিক্সড হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে কস্ট বেনিফিট অ্যানালাইসিসেই দেখা যায় এতে আমেরিকার খুব একটা লাভ হচ্ছে না। আর আমেরিকা এখান থেকে যে হাইপোথেটিকাল এডভান্টেজই পেয়ে থাকুক, নর্ড স্ট্রিম ব্লো আপ করার রিস্ক তার থেকে অনেক বেশি। যদি তারা সেটা করে, তাহলে ইউরোপে কয়েক দশক ধরে ইউএস যে বিশ্বাস অর্জন করেছে তা হারিয়ে ফেলবে, সেই সাথে ন্যাটোও ধ্বংস হবে।

যেটা বেশি সম্ভাব্য বলে মনে হয় তা হচ্ছে, কাজটা রাশিয়ার, আর দেশটি রাশিয়া অন্যান্য আন্ডারসি বা সমুদ্রের নিচের ইন্টারকানেক্টেড ক্যাবলগুলো ধ্বংস করতে চাইছে যেগুলো ইউরোপে গ্যাস ও ইলেকট্রিসিটি সরবরাহ করে, যেগুলোর অনেকগুলোই ইউরোপের নরওয়ে থেকে ইউকে এর দিকে যায়। নর্ড স্ট্রিমে আক্রমণ ঠিক সেই দিনেই ঘটেছে যখন আরেকটি আন্ডারসি পাইপলাইন, বাল্টিক পাইপলাইন ওপেন করা হচ্ছে,, যা ডেন্মমার্কের বর্নহোম ও নর্ডস্ট্রিম ১ এর পাশ দিয়ে নরওয়ে থেকে পোল্যান্ডে যাবে। সেক্ষেত্রে বলতে হয়, এই সাবোটাজের মাধ্যমে পুতিন ইউরোপকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, যদি তারা ইউক্রেইনকে সাপোর্ট প্রদান অব্যাহত রাখে তাহলে রাশিয়া আরও ইন্টারকানেক্টকে ড্যামেজ করবে, যা ইউরোপের জন্য অনেকটাই ক্যাটাস্ট্রোফিক হবে, কেননা ইউরোপের গ্যাসের ২৫-৩০% নরওয়ে এর আন্ডারসি ক্যাবল দিয়েই আসে। উল্লেখ্য, ইউরোপ সফলভাবে রাশিয়ান গ্যাস  থেকে ট্রাঞ্জিশন করার কারণে পুতিনের লেভারেজ কমে এসেছে। তাই পুতিনকে বাধ্য হতে হচ্ছে ইউরোপের অন্যান্য সাপ্লাইগুলোকেও কেটে ফেলতে।

যাই হোক, সব মিলে ঠিক কারা পাইপলাইনে লিকেজ ঘটিয়েছে সে ব্যাপারে নিকট ভবিষ্যতে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে মনে হয়না, কেননা বিষয়টি অস্পষ্ট থাকলেই ন্যাটো ও রাশিয়া উভয়ের লাভ। কেননা উত্তরটা সামনে এলে তা ব্যাপক মাত্রায় মিলিটারি এস্কেলেশনের কারণ হয়ে উঠতে পারে…

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.