দ্বিতীয় লিবিয়ান গৃহযুদ্ধ

ভূমিকা

দ্বিতীয় লিবীয় গৃহযুদ্ধ (Second Libyan Civil War) একটি বহুপাক্ষিক গৃহযুদ্ধ ছিল যা ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত লিবিয়ায় বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্য সংঘটিত হয়, যেগুলোর মধ্যে হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস (এইচওআর) এবং ন্যাশনাল অ্যাকর্ড সরকারের মধ্যে চলা দ্বন্দ্বই প্রধান। জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস (জিএনসি) ছিল পশ্চিম লিবিয়া-ভিত্তিক, এটি বিভিন্ন মিলিশিয়াদের দ্বারা সমর্থিত ছিল এবং এটি কাতার ও তুরস্কের সাপোর্টও লাভ করে। এরা প্রাথমিকভাবে ২০১৪ সালের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেশনের নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করেছিল, কিন্তু সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কোর্ট লিবিয়ার ট্রাঞ্জিশনের রোডম্যাপ নিয়ে একটি সংশোধনী বাতিল করলে এরা তা প্রত্যাখ্যান করে। হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস (বা ডেপুটিজ কাউন্সিল) পূর্ব ও মধ্য লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ) এর আনুগত্য লাভ করে। সেই সাথে মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিমান হামলার দ্বারা এদেরকে সহায়তা প্রদান করে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিতর্কের কারণে এইচওআর ত্রিপোলিতে জিএনসি থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, যেখানে জিএনসি মিসরাতা থেকে সশস্ত্র ইসলামী গ্রুপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। পরিবর্তে এইচওআর তোব্রুকে তার সংসদ প্রতিষ্ঠা করে, যা জেনারেল হাফতারের বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে, স্খিরাতে (Skhirat) আলোচনার পর লিবিয়ার রাজনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলে ত্রিপোলি, তোব্রুক এবং অন্য কোথাও অবস্থিত প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শিবিরগুলির মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী আলোচনার ফলে জাতীয় চুক্তির সরকার বা গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে সম্মত হয়। ২০১৬ সালের ৩০শে মার্চ, গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএ এর প্রধান ফায়েজ সাররাজ ত্রিপোলিতে পৌঁছান এবং জিএনসির বিরোধিতা সত্ত্বেও সেখান থেকে কাজ শুরু করেন।

এই তিনটি দল ছাড়াও ছিল আনসার আল-শরিয়াহের নেতৃত্বে বেনগাজি বিপ্লবীদের ইসলামী শুরা কাউন্সিল, যা জিএনসির সমর্থন পেয়েছিল এবং ২০১৭ সালে বেনগাজিতে পরাজিত হয়েছিল; ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট (আইএসআইএল) এর লিবিয়ান প্রদেশসমূহ; ডারনাতে মুজাহিদিনের শুরা কাউন্সিল যা ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ডেরনা থেকে আইএসআইএলকে বিতাড়িত করেছিল এবং পরে ২০১৮ সালে তোব্রুক সরকারের কাছে ডারনায় পরাজিত হয়েছিল; সেইসাথে অন্যান্য সশস্ত্র গ্রুপ এবং মিলিশিয়া যাদের আনুগত্য প্রায়ই পরিবর্তিত হয়। ২০১৬ সালের মে মাসে, জিএনএ এবং জিএনসি আইএসআইএল থেকে সির্তে (Sirte) এবং তার আশেপাশের এলাকাগুলি দখল করার জন্য একটি যৌথ আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণের ফলে আইএস লিবিয়ায় পূর্বে অনুষ্ঠিত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। পরে ২০১৬ সালে, খলিফা আল-ঘাউইলের অনুগত বাহিনী ফায়েজ আল-সাররাজ এবং জিএনএ-এর প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল। ২০২০ সালের ২৩শে অক্টোবর, এলএনএ এবং জিএনএর প্রতিনিধিত্বকারী ৫+৫ যৌথ লিবীয় সামরিক কমিশন “লিবিয়ার সমস্ত অঞ্চলে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে” পৌঁছে। এই চুক্তিতে অবিলম্বে বলা হয় যে সমস্ত বিদেশী যোদ্ধাদের তিন মাসের মধ্যে লিবিয়া ত্যাগ করতে হবে এবং একটি যৌথ পুলিশ বাহিনী বিতর্কিত এলাকায় টহল দেবে। ত্রিপোলি ও বেনগাজির মধ্যে প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইটটি একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২১ সালের ১০ই মার্চ, একটি অন্তর্বর্তীকালীন ঐক্য সরকার বা ইন্টেরিম ইউনিটি গভর্নমেন্ট গঠন করা হয়েছিল, যা ১০ই ডিসেম্বর নির্ধারিত পরবর্তী লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পর্যন্ত বহাল থাকে। তবে নির্বাচনটি বেশ কয়েকবার বিলম্বিত হয়েছে ও কার্যকরভাবে ইউনিটি গভর্নমেন্টকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় এনে দিয়েছে, যার ফলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে যা যুদ্ধকে পুনরায় উস্কে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।

সাধারণ জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রতি অসন্তোষের পটভূমি

২০১৪ সালের শুরুতে, লিবিয়া জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস (জিএনসি) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল, যা ২০১২ সালের নির্বাচনে জনপ্রিয় ভোটে জয়লাভ করে। জিএনসি গঠিত ছিল দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল – ন্যাশনাল ফোর্সেস অ্যালায়েন্স (এনএফসি) এবং জাস্টিস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন পার্টি (জেসিপি) নিয়ে গঠিত। এনএফসি পার্টি লিবিয়ান ন্যাশনালিস্ট ও ইসলামিক ডেমোক্রেসি আইডিওলজি নিয়ে চলে। এটি ইসলামিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে তুলনামূলক লিবারাল বটে, তবে নিজেদেরকে কখনও সেক্যুলার দাবি করেনা। অন্যদিকে জেসিপি-কে বলা যায় মুসলিম ব্রাদারহুডের লিবিয়ান শাখা। মানে এরা ইসলামিজম ও ইসলামিক ডেমোক্রেসির উদ্দেশ্য ধারণ করে, শরিয়া আনতে চায়, সেই সাথে অবশ্যই চূড়ান্ত উদ্দেশ্য প্যান ইসলামিজম। এরা জিএনসি এর সবচেয়ে বেশি গোড়া ইসলামিস্ট।

সংসদের এই দুটি প্রধান দল জিএনসির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছিল। এই দলগুলির মধ্যে বিভাজন, রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আইন নিয়ে বিতর্ক এবং একটি ক্রমাগত অস্থিতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি – এসব লিবিয়ার জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নকে বাধাগ্রস্ত করল, যা ছিল প্রাথমিকভাবে এই গভর্নিং বডিরই কাজ। জিএনসিতে রক্ষণশীল ইসলামী দলগুলোর পাশাপাশি বিপ্লবী দলগুলোর (থুওয়ার বা thuwwar) সঙ্গে যুক্ত সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদিকে জিএনসি এর কিছু সদস্যদের ক্ষেত্রে কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট ছিল, কেননা তাদের সাথে মিলিশিয়া গোষ্ঠীদের সম্পর্ক ছিল, এবং গভর্নমেন্ট ফান্ডকে বিভিন্ন মিলিশিয়ার দিকে চ্যানেল করা এবং গুপ্তহত্যা ও অপহরণ ঘটানোর সাথে সংযোগেরও অভিযোগ ছিল।

সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন ধারণকারী দলগুলো ও কোন কোন সংখ্যালঘু আসনধারী পার্টি জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেসকে বয়কট করতে শুরু করে, বা বয়কট করার হুমকি দিতে শুরু করে। এর ফলে জিএনসিতে বিভাজন বৃদ্ধি পায়, এবং সবচেয়ে বড় কথা প্রাসঙ্গিক বিতর্কগুলোও এর ফলে স্তব্ধ হয়ে যায়। এটা কয়েকটি কারণে ঘটে, যার মধ্যে রয়েছে – (১) কংগ্রেশনাল এজেন্ডা থেকে এই বিতর্কগুলোকে বাদ দেয়া, (২) শরিয়া আইন ঘোষণা করার জন্য ভোটিং, এবং এক্সিস্টিং ল-গুলো ইসলামিক ল-গুলোর সাথে মেলে কিনা তা রিভিউ করার জন্য একটা স্পেশাল কমিটি প্রতিষ্ঠা করা, (৩) লিবিয়ান ইউনিভার্সিটিগুলোতে জেন্ডার সেগ্রেগেশন ইমপোজ করা এবং বাধ্যতামূলক হিজাব আরোপ করা, এবং (৪) ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ইলেক্টোরাল ম্যান্ডেট এক্সপায়ারড হয়ে যাবার পরও নতুন ইলেকশন হতে না দেয়া। এই সমস্যাগুলো চলার পর শেষে জেনারেল খলিফা হাফতার ২০১৪ সালের মে মাসে একটি বড় আকারের মিলিটারি অফেনসিভ শুরু করেন, যার কোড নেইম ছিল “অপারেশন ডিগনিটি”। এখন জিএনসি এর যে সমস্যাগুলোর কথা উল্লেখ করা হলো, সেগুলোর ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জানা যাক –

জিএনসি এর রাজনৈতিক বিভাজন

২০১২ সালে লিবিয়ার নির্বাচনটিকে ইউনাইটেড ন্যাশনস এর লিবিয়া নিয়ে স্পেশাল মিশন ও ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্টোরাল সিস্টেমস এর মত এনজিও-গুলো তদারক করেছিল। এসব কারণে বেশিরভাগ লিবিয়ানই এই নির্বাচনকে ফেয়ার এন্ড ফ্রি বলে ভেবেছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বিপ্লব-পরবর্তী লিবিয়ার পলিটিকাল পার্টিগুলো তেমন অরগানাইজড ছিলনা। এর ফলে পার্লামেন্ট বিভাজিত হয়ে যায়, আর সেজন্য নির্বাচনের পরও শক্তিশালী সরকার গঠিত হয়নি। জিএনসিতে দুটো প্রধান পার্টি ছিল – ন্যাশনাল ফোর্সেস অ্যালায়েন্স আর জাস্টিস এন্ড কনস্ট্রাকশন পার্টি। সেই সাথে অনেক ইন্ডিপেন্ডেন্ট লোক ছিল, যাদের কেউ কেউ মডারেট ছি , আর কেউ কেউ কনজারভেটিভ ইসলামিস্ট ছিল। এভাবে জিএনসি পরিণত হয় একটি বোর্ড-ভিত্তিক কংগ্রেসে। ২০১৩ সালে নুরি আবুসাহ্‌মেইনকে জিএনসি এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। তিনি একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইসলামিস্ট ছিলেন। পার্লামেন্টের লিবারাল মেম্বাররা তাকে কম্প্রোমাইজিং ভোটে জিতিয়েছিল, কারণ তিনি অন্যান্য মেজোর দলগুলোর মত অত ইসলামিস্ট ছিলেননা, এবং পার্লামেন্টে তার বেশ সমর্থন ছিল, ফলে বেশি ইসলামিস্টরা যাতে না জিততে পারে তাই লিবারালরা এই কম ইসলামিস্টদের ভোট দিয়ে দিতিয়েছিলেন। এটা প্রমাণিত হয় যখন তিনি ১৮৪ ভোটের মধ্যে মাত্র ৯৬ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন।

লিবিয়ার রেভোল্যুশনারিস অপারেশনস রুম এবং আলী জেইদানকে অপহরণ

ত্রিপোলিতে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে জিএনসি সংকটে পড়ে। জিএনসি নিজেই মিলিশিয়াদের এবং সশস্ত্র বিক্ষোভকারীদের দ্বারা বহুবার আক্রান্ত হয়েছিল, যারা জিএনসি সমাবেশ হলে হামলা চালিয়েছিল। আবুসাহমেইনের নিয়োগের পর, তার ওপর জিএনসি-কে নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি লিবিয়া রেভোলিউশনারিস অপারেশনস রুম (এলআরওআর) প্রতিষ্ঠা করেন, যা ঘারিয়ান বিদ্রোহীদের নিয়ে গঠিত ছিল, যাদেরকে প্রাথমিকভাবে ২০১৩ সালের আগস্টে ত্রিপোলিকে রক্ষা ও সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল, এদের আইডিওলজি ইসলামিজমের দিকেই ছিল। এর কমান্ডার ছিলেন আদেল ঘারিয়ানি। এই সময়ে, আবুসাহমেইন রাষ্ট্রীয় তহবিল বিতরণের তদন্ত বন্ধ করে দেন এবং অভিযোগ করা হয় যে আবুসাহমেইন এই এলআরওআর-এর দিকে সরকারী তহবিল চ্যানেলিং করছেন।

অক্টোবরে লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলী জেইদানকে অপহরণ করা হয়। এর পেছনে এলআরওআর এর হাত ছিল বলে মনে করা হয়, যদিও এমন প্রমাণ রয়েছে যে এই কাজ আসলে ডুরু৩ এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর। অপহরণের পরে, আবুসাহমেইন জিএনসির এজেন্ডা পরিবর্তন করার জন্য তার প্রেসিডেন্সি ব্যবহার করেছিলেন যাতে তারা এলআরওআরকে ভেঙ্গে দিতে না পারে। একই সময়ে, তিনি এলআরওআর এবং অন্যান্য বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ৯০০ মিলিয়ন লিবীয় দিনার (৭২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দের তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠনের অনুরোধ বাতিল করেন।

এসবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জিএনসি আবুসাহমেইনকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয় এবং এলআরওআরকে তার নিরাপত্তার ভূমিকা থেকে বরখাস্ত করে। তবে এই সশস্ত্র গ্রুপটিকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এবং এই ঘটনার জন্য কাউকেই বিচার করা হয়নি।

জিএনসির মেয়াদকালে সশস্ত্র গোষ্ঠীসমূহের সম্প্রসারণ

লিবিয়ার অনেক নাগরিক দেশটিতে ক্রমাগত নিরাপত্তার অভাবের জন্য জিএনসি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দোষারোপ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিপ্লবের সময় প্রতিষ্ঠিত সুসজ্জিত মিলিশিয়া এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে দমন করার জন্য সংগ্রাম করেছিল। বিশেষ করে বেনগাজির লিবিয়ানরা হত্যা ও অপহরণের সাক্ষী হতে শুরু করে এবং মনে করতে থাকে যে, জিএনসি পূর্বাঞ্চলের অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির দিকে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু সারা দেশে নিরাপত্তা উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে ত্রিপোলি এবং পূর্ব দিকে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি প্রসারিত হতে শুরু করে। যেমন, ২০১২ সালে, আনসার আল-শরিয়া লিবিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করে; ২০১৩ সালের অক্টোবরে, এলআরওআর প্রধানমন্ত্রী আলী জেইদানকে অপহরণ করে; ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এলআরওআর মিশরীয় কূটনীতিকদের অপহরণ করেছিল। ২০১৪ সালের মার্চে এলআরওআর-এর সাথে জড়িত সশস্ত্র বিক্ষোভকারীরা জিএনসি সংসদ ভবনে হামলা চালায়, দুই আইনপ্রণেতাকে গুলি করে আহত করে এবং সাথে বেশ কয়েকজনকে আহত করে। আবদ আল-মুহসিন আল-লিবির (যিনি ইব্রাহিম তান্তুস নামেও পরিচিত) নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধরত বাহিনী ২০১৪ সালের এপ্রিলে ত্রিপোলি ও তিউনিশিয়ার সীমান্তের মধ্যে অবস্থিত “ক্যাম্প ২৭” নামে একটি সন্ত্রাসবিরোধী প্রশিক্ষণ ঘাঁটি দখল করে নেয়। এই ইব্রাহিম তান্তুশ দীর্ঘদিন ধরে আল-কায়েদা সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন, এবং তিনি লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপের সাবেক সদস্য। ক্যাম্প ২৭-এর ইসলামী বাহিনীকে পরবর্তীতে লিবিয়া শিল্ড ফোর্সের অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ২০১২ সালের গোড়ার দিকে লিবিয়া শিল্ড ফোর্সকে কিছু পর্যবেক্ষক আল-কায়েদার সাথে যুক্ত হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।

জিএনসির রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আইন বা পলিটিকাল আইসোলেশন ল

জিএনসিতে উদারপন্থী ও মধ্যপন্থীদের তুলনায় ইসলামপন্থীদের সংখ্যা বেশি থেকে থাকলেও ২০১৩ সালের মে মাসে তারা একটি আইনের জন্য লবিং করেছিল যা “গাদ্দাফির সরকারে অংশ নেওয়া প্রায় প্রত্যেককে সরকারী পদে অধিষ্ঠিত হওয়াকে নিষিদ্ধ করবে”। বেশ কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং স্বতন্ত্ররা এই আইনটিকে সমর্থন করেছিল, কারণ সাধারণত গাদ্দাফি শাসনের সাথে তাদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। সেই সাথে আইনটি শক্তিশালী জনসমর্থনও উপভোগ করেছিল। তবে আইনটি বিশেষ করে অভিজাত প্রবাসী এবং উদারপন্থী দলগুলির নেতাদেরকে প্রভাবিত করে। আর এ ধরনের আইন সে সময় লিবিয়াকে তার প্রয়োজনীয় টেকনোক্র্যাটিক দক্ষতা থেকে বঞ্চিত করবে বলেও পার্লামেন্টের অনেকে মনে করেছিলেন, ফলে তারা এর বিরোধিতা করেন। সশস্ত্র মিলিশিয়ারা সরকারী মন্ত্রণালয়ে হামলা চালায়, জিএনসিকে বন্ধ করে দেয় এবং আইনটি পাসের দাবি জানায়। এটি জিএনসিকে আইনটি পাস করার জন্য ভীত করে তোলে যেখানে ১৬৪ জন সদস্য বিলটি অনুমোদন করে, মাত্র চারজন বিরত থাকে এবং কোনও সদস্য এর বিরোধিতা করে না।

নারী অধিকার দমন

জিএনসির বিরোধীরা বলছেন, তারা নারীদের বিরুদ্ধে ইসলামী পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে। লিবিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি সাদিক ঘারিয়ানি ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি মুসলিমদেরকে জিএনসি-কে মেনে চলার নির্দেশ দিয়ে ফতোয়া জারি করেছিলেন, সেই সাথে তিনি মুসলিমদেরকে হাফতারের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করারও ফতোয়া দান করেন। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে সাদিক ঘারিয়ানি ইউনাইটেড ন্যাশনস এর নারী ও বালিকা নির্যাতন বিষয়ক প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেন। তিনি ‘ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের’ পাশাপাশি ‘অনৈতিকতা ও অশালীনতার’ পক্ষে কথা বলা এবং ‘কুরআন ও সুন্নাতের আইনের প্রতি স্পষ্ট আপত্তি’ করার জন্য ইউনাইটেড ন্যাশনস এর প্রতিবেদনের নিন্দা জানান। এর পরপরই গ্র্যান্ড মুফতি একটি ক্লেয়ারিফিকেশন ওপ-এড জারি করে বলেন যে, পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে কোনও বৈষম্য থাকা উচিত নয় তবে পরিবারে মহিলাদের আরও বড় ভূমিকা রয়েছে। পরে ২০১৩ সালে নারী অধিকারের পক্ষে আইনজীবী হামিদা আল-হাদি আল-আসফারকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। অভিযোগ করা হয় যে গ্র্যান্ড মুফতির ঘোষণার সমালোচনা করার জন্য তাকে টার্গেট করা হয়েছিল। কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ২০১৩ সালের জুন মাসে, দুই রাজনীতিবিদ, আলী টেকবালি এবং ফাতি সাগার, নারী অধিকার প্রচারের নিমিত্তে একটি কার্টুন প্রকাশের জন্য “ইসলামকে অপমান” করার জন্য আদালতে হাজির হন। শরিয়াহ্‌ আইন অনুযায়ী তাদের সম্ভাব্য মৃত্যুদন্ডের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। মামলাটি ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের মার্চ মাসে তাদের বেকসুর খালাস করা হয়েছিল। জিএনসি নতুন নির্বাচন গ্রহণ করতে বাধ্য হবার পরে আলী টেকবালি নতুন হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে নির্বাচিত হন। জিএনসির নূরি আবুসাহমাইনের রাষ্ট্রপতিত্বের সময় এবং ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শরিয়া আইন প্রয়োগের জন্য জিএনসির সিদ্ধান্তের পর ২০১৪ সালের গোড়ার দিকে লিবিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লিঙ্গ পৃথকীকরণ এবং বাধ্যতামূলক হিজাব আরোপ করা হয়েছিল, যা নারী অধিকার গ্রুপগুলোর দ্বারা তীব্রভাবে সমালোচনার শিকার হয়েছিল। কর্ডেইড (Cordaid) নামে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি গ্লোবাল এডভোকেসি অর্গানাইজেশন জানিয়েছে, জঙ্গী বা মিলিশিয়াদের হাতে লিবিয়ার নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রায়ই বিনা শাস্তিতেই থেকে যায়। কর্ডেইড আরও উল্লেখ করে যে, সহিংসতার ভয়ের কারণে মানুষের চলাচলে সীমাবদ্ধতা এসেছে, আর এর ফলে নারী ও বালিকাদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণ কমে গেছে।

জিএনসি নির্বাচন ছাড়াই তার ম্যান্ডেট প্রসারিত করে

জিএনসি ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে তার নির্বাচনী ম্যান্ডেট শেষে ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি দিতে ব্যর্থ হয়, একতরফাভাবে ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর কমপক্ষে এক বছরের জন্য তারা তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভোট দেয়। এর ফলে ব্যাপকভাবে অশান্তি এবং কিছু বিক্ষোভ দেখা দেয়। পূর্ব দিকের শহর শাহাতের বাসিন্দারা, বায়দা এবং সাউসের বিক্ষোভকারীদের সাথে, জিএনসির সম্প্রসারণ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে এবং একটি বৈধ সংস্থায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা স্থানান্তরের মাধ্যমে কংগ্রেসের পদত্যাগ দাবি করে একটি বড় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা নিরাপত্তার অভাবের প্রতিবাদ করে, সেনাবাহিনী ও পুলিশ গঠনে ব্যর্থ হওয়ার জন্য জিএনসিকে দোষারোপ করে। প্রস্তাবিত ম্যান্ডেট প্রত্যাখ্যানকারী অন্যান্য লিবীয়রা ত্রিপোলির মার্টার স্কয়ারে এবং বেনগাজির তিবেস্তি হোটেলের বাইরে সমাবেশ করে ও রাজনৈতিক দলগুলোকে স্থগিত করার এবং দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনরায় সক্রিয় করার আহ্বান জানায়। ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জেনারেল খলিফা হাফতার জিএনসিকে ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং নতুন নির্বাচন তদারকির জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কমিটি গঠনের আহ্বান জানান। তবে তার কাজগুলো জিএনসিতে খুব কম প্রভাব ফেলেছিল, আর জিএনসি হাফতারের কাজগুলোকে “অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা” বলে অভিহিত করেছিল ও তাকে “হাস্যকর” বলে অভিহিত করে একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বৈরশাসক হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। জিএনসি আগের মতোই কাজ করে যায়। কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। হাফতার তিন মাস পর ১৬ই মে অপারেশন ডিগনিটি শুরু করেন।

হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস বনাম জিএনসি

খলিফা হাফতার জিএনসি এর বিরুদ্ধে তার “অপারেশন ডিগনিটি” শুরু করার প্রায় এক সপ্তাহ পরে ২০১৪ সালের ২৫শে মে-তে নতুন নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ইসলামপন্থীরা তাতে মাত্র ১৮% ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছিল, ফলে তারা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। তারা নতুন হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস পার্লামেন্টকে গাদ্দাফির সমর্থকদের দ্বারা ডোমিনেটেড হবার অভিযোগ করে এবং ২০১৪ সালের ৪ঠা আগস্টে কাউন্সিল আনুষ্ঠানিকভাবে জিএনসি-কে প্রতিস্থাপিত করার পরও তারা পুরানো জিএনসিকে সমর্থন করা অব্যাহত রাখে। ২০১৪ সালের ১৩ই জুলাই ত্রিপোলির ইসলামপন্থী ও মিসরাতান মিলিশিয়া ত্রিপোলি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দখল করার জন্য “অপারেশন লিবিয়া ডন” শুরু করে এবং ২৩শে আগস্ট জিন্টান মিলিশিয়াদের কাছ থেকে এটি দখল করে নেয়। এর পরপরই, জিএনসির সদস্যরা, যারা জুনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারা একটি নতুন সাধারণ জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস হিসেবে পুনরায় মিলিত হয় এবং নবনির্বাচিত হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভকে প্রতিস্থাপন করার জন্য নিজেদেরকে ভোট দেয়। এরা ত্রিপোলিকে তাদের রাজনৈতিক রাজধানী হিসাবে, নুরি আবসাহমেইন রাষ্ট্রপতি হিসাবে এবং ওমর আল-হাসিকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত করে। ফলস্বরূপ, হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের বেশিরভাগই তোব্রুকে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়, তারা হাফতারের বাহিনীর সাথে নিজেদেরকে সংযুক্ত করে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে মনোনীত করে। ৬ই নভেম্বর, ত্রিপোলির শীর্ষ আদালত, নতুন জিএনসি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস এই রায়কে “হুমকির মুখে গৃহীত” দাবি করে প্রত্যাখ্যান করে। ২০১৫ সালের ১৬ই জানুয়ারি অপারেশন ডিগনিটি অ্যান্ড অপারেশন লিবিয়া ডন দল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। তারপর দেশটি দুটি পৃথক সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। ত্রিপোলি এবং মিসরাতা ত্রিপলির লিবিয়া ডন এবং ত্রিপোলির নতুন জিএনসির অনুগত বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আবদুল্লাহ আল-থানির সরকার এবং তোব্রুকে এর পার্লামেন্টকে স্বীকৃতি দান করে। বেনগাজি নিয়ে হাফতারপন্থী বাহিনী এবং উগ্র ইসলামপন্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে।

ফলাফল

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যুদ্ধের ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্ষতি এবং বিশৃঙ্খলা ঘটে। ঘন ঘন বৈদ্যুতিক বিভ্রাট ঘটে, ব্যবসায়িক কার্যকলাপ খুব কমে যায়, এবং তেল থেকে আয়ের ৯০% ক্ষতি হয়। ২০১৬ সালের শেষের দিকে এই যুদ্ধে ৫,৭০০ জনেরও বেশি লোক মারা যায় এবং কিছু সূত্র দাবি করে যে দেশটির জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ শরণার্থী হিসাবে তিউনিসিয়ায় পালিয়ে যায়। ফিল্ড মার্শাল খলিফা হাফতার লিবিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি ন্যাশনাল অয়েল কর্পোরেশন, এস সিডার এবং রা’স লানুফের বন্দর দখল করার পর থেকে তেল উৎপাদন প্রতিদিন ২,২০,০০০ ব্যারেল থেকে বেড়ে প্রায় ৬,০০,০০০ ব্যারেল হয়।

এই যুদ্ধের ফলে দেশটির বিপুল সংখ্যক বিদেশী শ্রমশক্তি দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়, কারণ আইএসআইএল-এর মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। মিশরীয় শ্রম মন্ত্রণালয় অনুমান করে, ২০১১ সালের আগে লিবিয়ায় ২০ লক্ষ মিশরীয় কাজ করছিল, তবে মিশরীয় শ্রমিকদের উপর আক্রমণ বৃদ্ধির পর মিশরীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমান অনুসারে, ৮ লক্ষেরও বেশি মিশরীয় মিশরে ফিরে যাওয়ার জন্য লিবিয়া ছেড়ে চলে গেছে। ল্যান্ড মাইনগুলি দেশে একটি স্থায়ী হুমকি হিসাবে রয়ে গেছে কারণ অসংখ্য মিলিশিয়া, বিশেষ করে আইএসআইএল, ল্যান্ড মাইন এবং অন্যান্য লুকানো বিস্ফোরক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল ফ্রন্ট লাইনগুলোর অর্থ হলো এই ডিভাইসগুলির মধ্যে অনেকগুলোই সক্রিয় যুদ্ধ অঞ্চলগুলোর বাইরের অঞ্চলে রয়েছে। রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটির (আইসিআরসি) মতে, বেসামরিক নাগরিকরা সাথে ল্যান্ড মাইনগুলোর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। কেবল মাইনের কারণেই ১৪৫ জন নিহত এবং আরও ১,৪৬৫ জন আহত হয়েছে।

ইউনাইটেড ন্যাশনস এর শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা ২০১৯ সালে লিবিয়ায় ৪৫,৬০০ শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীর নাম নথিভুক্ত করেছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সংঘাতের সময় আনুমানিক ৪,৩৫,০০০ মানুষ তাদের বাড়িঘর থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর ইউএন-এর শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) জানায়, লিবিয়াসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের অপুষ্টিতে ভুগছে। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ২০২০ সালের ১৮ই জানুয়ারি বলেন, লিবিয়ায় চলমান সংঘাতের কারণে হাজার হাজার লিবিয়ার শিশু প্রাণনাশের ঝুঁকিতে রয়েছে। ত্রিপোলি ও পশ্চিম লিবিয়ায় লিবিয়ার সরকার ও হাফতারের এলএনএ বাহিনীর (সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরের সহায়তায়) মধ্যে বৈরী সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে শিশু ও বেসামরিক নাগরিকদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

লিবিয়ার ন্যাশনাল অয়েল কর্পোরেশনের মতে, হাফতারের বাহিনী লিবিয়ার প্রধান তেলক্ষেত্র এবং প্রোডাকশন ইউনিটগুলোর ওপর অবরোধের ফলে ২৩শে জানুয়ারি শেষ হওয়া ছয় দিনের মধ্যে ২৫৫ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হয়েছে। এনওসি এবং ইএনআই লিবিয়ায় মেল্লিতাহ্‌ অয়েল এন্ড গ্যাস চালায়। হাফতারের এলএনএ প্রোডাকশন ফ্যাসিলিটিগুলোতে ব্লকেড আরোপ করায় এটি দৈনিক ১৫৫,০০০ ব্যারেল প্রোডাকশন লস করেছে। সংস্থাগুলি দাবি করে যে প্রতিদিন প্রায় ৯.৪ মিলিয়ন ডলার লস হয়েছে। লিবিয়ার সংঘাতের শুরু থেকে হাজার হাজার শরণার্থী ডিটেনশন সেন্টারে বসবাস করতে বাধ্য হয়, তারা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে যারা যুদ্ধে তাদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার জন্য স্ট্রাগল করছে। ২০২০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি ইউএনএইচসিআর জানায়, ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় গত জানুয়ারিতে লিবিয়ার কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়া অভিবাসীদের মোট সংখ্যা ১২১% বেড়েছে।

এই যুদ্ধ দেশটিকে আফ্রিকা ও মধ্য প্রাচ্যে সহিংসতা ও দারিদ্র্য থেকে পালিয়ে আসা অভিবাসীদের জন্য একটি বিশাল স্বর্গে পরিণত করে। ৬ই এপ্রিলে একটি সশস্ত্র দল শ্য়েরিফের (Shwerif) একটি কন্ট্রোল স্টেশনে আক্রমণ করে, গ্রেট ম্যান-মেড নদী প্রকল্প, ত্রিপোলিতে পাম্প করা থেকে জল বন্ধ করে দেয় এবং শ্রমিকদের হুমকি দেয়। সশস্ত্র দলটির এই পদক্ষেপ ছিল আটক পরিবারের সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগ ও জোরপূর্বক মুক্তি দিতে বাধ্য করার একটি উপায়। ২০২০ সালের ১০ই এপ্রিল লিবিয়ায় ইউএন-এর মানবিক সমন্বয়ক ইয়াকুব এল হিলো জল সরবরাহ বন্ধ করাকে “বিশেষভাবে নিন্দনীয়” বলে নিন্দা জানান। ২০২০ সালের ২১শে এপ্রিল ইউনাইটেড ন্যাশনসের ত্রিপোলির ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গোলাবর্ষণের “নাটকীয় বৃদ্ধিকে” তাদের বিবেচনায় নিয়ে আসে, এবং দাবি করে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া লিবিয়ার মানবিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে। সংগঠনটি সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধের কারণ হতে পারে। লিবিয়ায় ইউএন-এর সহায়তা মিশন (ইউএনএসএমআইএল) লিবিয়ায় বেসামরিক হতাহতের বিষয়ে ২০২০ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে ২০২০ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চের মধ্যে প্রায় ১৩১ জন নিহত হয়েছে। এই পরিসংখ্যানে ৬৪ জন নিহত এবং ৬৭ জন আহত হয়েছেন, যাদের সকলেই খলিফা হাফতারের সেনাবাহিনী, সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত এলএনএ-র নেতৃত্বে স্থলযুদ্ধ, বোমা হামলা এবং টারগেটেড কিলিং এর ফলে ঘটেছে।

২০২০ সালের ৫ই মে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর ফাতোউ বেনসুদা ত্রিপোলিতে হাফতারের ক্রমাগত হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রসিকিউটর বলেন যে পদক্ষেপগুলো জীবনকে বিপন্ন করে তোলে এবং বর্তমান বিষয়গুলোর কারণে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে সতর্ক করে দেয়। তিনি বলেন, ‘আমার অফিসের জন্য বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বেশি, যা মূলত বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণের কারণে ঘটেছে বলে জানা গেছে। ২০২০ সালের ১০ই নভেম্বর, লিবিয়ার বিশিষ্ট কর্মী, হান্নান আল-বারাসি বেনগাজিতে নিহত হন। ৪৬ বছর বয়সী বারাসী সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পূর্ব অঞ্চলে সংঘটিত মানবিক নির্যাতনের একজন স্পষ্ট সমালোচক ছিলেন। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ভিডিওগুলোর মাধ্যমে সহিংসতার শিকার মহিলাদের কণ্ঠ দান করার জন্য পরিচিত ছিলেন।

শান্তি প্রক্রিয়া

২০১৫ সালের প্রথমার্ধে ইউনাইটেড ন্যাশনস লিবিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারগুলো ও যুদ্ধরত মিলিশিয়াদের একত্রিত করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি আলোচনার সুযোগ করে দেয়। ২০১৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মাল্টার ভ্যালেটার আউবার্গ ডি ক্যাস্টিলে প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারগুলোর মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৭ই ডিসেম্বর দুই দেশের সরকারের প্রতিনিধিরা মরোক্কোর স্খিরাতে ইউএন এর সহায়তায় একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যদিও উভয় পক্ষের মধ্যে এর বিরোধিতা ছিল। এই চুক্তির ফলে গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) বা জাতীয় চুক্তির সরকার গঠিত হয়েছিল এবং ২০১৬ সালের ২রা জানুয়ারি তিউনিসে এর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বর জেনারেল খলিফা হাফতার স্খিরাত চুক্তিকে অকার্যকর ঘোষণা করেন। লিবিয়ায় নির্বাচন ও শান্তি প্রক্রিয়া আয়োজনের জন্য গাদামেসে লিবিয়ার ন্যাশনাল কনফারেন্স নামে একটি বৈঠকের পরিকল্পনা করা হয়। সম্মেলনটি ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ১৮ মাস ধরে প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং ২০১৯ সালের ১৪-১৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের পশ্চিম লিবিয়া অভিযানের সামরিক পদক্ষেপের ফলে ২০১৯ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে এটি স্থগিত করা হয়েছিল।

২০১৯ সালের জুলাই মাসে লিবিয়ায় ইউএন-এর সহায়তা মিশনের (ইউএনএসএমআইএল) প্রধান ঘাসান সালামে তিন দফা শান্তি পরিকল্পনা (ঈদুল আযহার সময় একটি যুদ্ধবিরতি, সংঘাতে জড়িত দেশগুলির একটি আন্তর্জাতিক বৈঠক এবং লিবিয়ার জাতীয় সম্মেলনের অনুরূপ একটি অভ্যন্তরীণ লিবিয়ান সম্মেলন) প্রস্তাব করেছিলেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) শান্তি ও নিরাপত্তা পরিষদ (পিএসসি) লিবীয় সংকটের অবসানে পিএসসির বৃহত্তর ভূমিকা পালনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করে ও লিবিয়ায় এইউ-ইউএন এর একটি যৌথ দূত নিয়োগের প্রস্তাব উত্থাপন করে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন লিবিয়ায় প্রক্সি যুদ্ধ শেষ করতে ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে যুদ্ধবিরতির জন্য একটি যৌথ আহ্বান জানান। তবে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কয়েক ঘন্টা পরে ভেঙে ফেলা হয়েছিল বলে জানা গেছে। যুদ্ধরত উভয় পক্ষই তুরস্ক দ্বারা সমর্থিত জিএনএ এবং সৌদি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর এবং জর্ডান দ্বারা সমর্থিত এলএনএ – ত্রিপোলিতে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ বিদেশি শক্তিগুলোর সহায়তায় খলিফা হাফতার শান্তি চান না এবং দেশটিতে টানা যুদ্ধের সামরিক সমাধান খুঁজছেন।

লিবিয়ার ইউএন স্বীকৃত সরকার দাবি করে, হাফতার বাহিনী বন্দর নগরী মিসুরারতার কাছে আবু গুরাইন প্রদেশে হামলা চালায়। এই হামলাকে বার্লিন সম্মেলনে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি ইউএন-এর নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়ায় ‘স্থায়ী যুদ্ধবিরতির’ দাবিতে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ব্রিটেনের খসড়ায় তারা ১৪টি ভোট পেয়েছে, অন্যদিকে রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারির দিকে ত্রিপোলিতে রকেট হামলার পর সরকার শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসে। ইউএন-এর অনুরোধে, উভয় পক্ষই কোভিড-১৯ এর কারণে মার্চের শেষের দিকে একটি নতুন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল, তবে সেই যুদ্ধবিরতিও দ্রুত ভেঙ্গে যায়। ২৪শে মার্চ জিএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি এলাকার একটি কারাগারে শেল আঘাত হাতে, যার ফলে ইউএন নিন্দা প্রকাশ করে। জিএনএ ২৫শে মার্চের প্রথম দিকে “পাল্টা আক্রমণ” শুরু করে, যাকে জিএনএ “ত্রিপোলির দেখা সবচেয়ে ভারী বোমাবর্ষণ” বলে অভিহিত করে। ২০২০ সালের জুনে মিশরের রাষ্ট্রপতি আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি লিবিয়ার জাতীয় সেনাবাহিনীর সাথে সংযুক্ত দলগুলির সাথে একটি চুক্তি করেছিলেন, যাকে তিনি কায়রো ডেক্লারেশন বলে অভিহিত করেছিলেন – তবে এটাকেও দ্রুত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।

২০২০ সালের ২১ আগস্ট লিবিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। ত্রিপোলি-ভিত্তিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) একটি বিবৃতি প্রকাশ করে যা ২০২১ সালের মার্চ মাসে নির্বাচনের আহ্বান জানায়। ইউএন-এর নিরাপত্তা পরিষদ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে একটি গোপনীয় প্রতিবেদন পেয়েছে, যেখানে ২০২০ সালের শুরু থেকে লিবিয়ার উপর আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার ব্যাপক লঙ্ঘনের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। ইউএন নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গকারী আটটি দেশকে চিহ্নিত করেছে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত ও রাশিয়া ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি লিবিয়ায় অস্ত্র ভর্তি পাঁচটি কার্গো বিমান পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে, যখন বিশ্ব নেতারা বার্লিন সম্মেলনে লিবিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করছিলেন। পাঁচটি কার্গো বিমানের মধ্যে চারটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ছিল। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু সিএনএন তুর্ককে বলেন, তুরস্ক ও রাশিয়া আঙ্কারায় তাদের সর্বশেষ বৈঠকের সময় লিবিয়ায় যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সংক্রান্ত একটি চুক্তির কাছাকাছি চলে এসেছে। রয়টার্সের মতে, তুরস্ক ও রাশিয়া লিবিয়ার যুদ্ধে প্রধান শক্তি দালাল ছিল, যারা পরষ্পর-বিরোধী পক্ষকে সমর্থন করেছিল। রাশিয়া খলিফা হাফতারের পূর্ব-ভিত্তিক বাহিনীকে সমর্থন করেছিল, যখন তুরস্ক লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতীয় চুক্তির সরকারকে সমর্থন করেছিল।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন দু’জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, যারা পরোক্ষভাবে বা সরাসরি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ছিল। বেনগাজি-ভিত্তিক মাহমুদ আল-ওয়ারফালি হত্যা ও মৃত্যুদন্ডের মতো লঙ্ঘনে জড়িত ছিলেন, আর মুসা দিয়াব মানব পাচার এবং অভিবাসী ও শরণার্থীদের অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনটি কোম্পানি, তুর্কি সামুদ্রিক সংস্থা আভ্রসিয়া শিপিং, জর্ডান-ভিত্তিক মেড ওয়েভ শিপিং এবং কাজাখস্তান-ভিত্তিক একটি বিমান মালবাহী সংস্থা সিগমা এয়ারলাইন্সকেও লিবিয়ায় সামরিক সামগ্রী স্থানান্তরের মাধ্যমে ইউএন-এর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে সিগমা এয়ারলাইন্সকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্য থেকে খলিফা হাফতারের সরকারের জন্য বিমান-বাহিত হার্ড নগদ চালানের সাথেও জড়িত পাওয়া গেছে। সিগমা এয়ারলাইন্স সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউক্রেন, জর্ডান এবং বেলারুশের মাধ্যমে পরিচালিত একটি বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এলএনএর জন্য ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারীতে তৈরি একটি ব্যাংক-নোট বিতরণেও জড়িত ছিল। প্রায় ২২৭ মিলিয়ন ডলার ব্যাংক নোট পাঠানো হয়, যেগুলোর মধ্যে ইউকে থেকে আসে ৯১ মিলিয়ন ডলার, রাশিয়া থেকে ২৭ মিলিয়ন ডলার, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৫ মিলিয়ন দলার, যেগুলো জড়িত ১৪ টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।

২০২০ সালের ২৩শে অক্টোবর, এলএনএ এবং জিএনএর প্রতিনিধিত্বকারী ৫+৫ যৌথ লিবীয় সামরিক কমিশন “লিবিয়ার সমস্ত অঞ্চলে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে” পৌঁছে। এই চুক্তিতে অবিলম্বে বলা হয়, সমস্ত বিদেশী যোদ্ধাদের তিন মাসের মধ্যে লিবিয়া ত্যাগ করতে হবে এবং একটি যৌথ পুলিশ বাহিনী বিতর্কিত এলাকায় টহল দেবে। ত্রিপোলি ও বেনগাজির মধ্যে প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইটটি একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর যুদ্ধ শেষ হয়। ইউএন-পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তি আলোচনা হয়, তবে তা অনুযায়ী ২০২০ সালের ১৬ই নভেম্বরের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, যদিও উভয় পক্ষই এক সপ্তাহের মধ্যে আবার চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০২১ সালের ১৩-১৬ জানুয়ারি জেনেভায় লিবিয়া পলিটিক্যাল ডায়ালগ ফোরামের (এলপিডিএফ) উপদেষ্টা কমিটির আলোচনায় একটি সমন্বিত নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন করার জন্য একটি পদ্ধতির জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ১৮ জানুয়ারি এলপিডিএফ-এর ৭২ জন সদস্য এই প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে অংশ নেন। প্রস্তাবটি পাস হয়, যা ৬৩% সিদ্ধান্তের সীমার চেয়েও বেশি অর্জন করে, যেখানে ৫১ জন ভোটার পক্ষে, ১৯ জন বিপক্ষে, ও ২ জন বিরত ও ২ জন অনুপস্থিত থাকেন। বৈধ নির্বাচনী পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে ইলেক্টোরাল কলেজ, লিবিয়ার পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণের সমর্থন, ৬০% প্রাথমিক থ্রেশহোল্ড, এবং ৫০% প্লাস একটি দ্বিতীয়-রাউন্ড থ্রেশহোল্ড, প্রেসিডেন্সি কাউন্সিলের পদের জন্য এবং প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য পদ।

২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, ইউএন-এর একটি গোপনীয় প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয় যে ব্ল্যাকওয়াটারের প্রাক্তন সিইও, এরিক প্রিন্স খলিফা হাফতারকে অস্ত্র সরবরাহ ও সমর্থন করে লিবিয়ার অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেছিলেন, যার জন্য ৮০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল। ২০১৯ সালে, প্রিন্স পূর্ব লিবিয়ায় বিদেশী ভাড়াটে সৈন্য মোতায়েন করেছিলেন, যারা গানবোট, আক্রমণ বিমান এবং সাইবার যুদ্ধের সক্ষমতা ছিল। যদিও প্রতিবেদনটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়নি যে ভাড়াটে অপারেশনের জন্য কে অর্থায়ন করেছিল, বিশ্লেষক এবং পশ্চিমা কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছিলেন যে এটি সম্ভবত সংযুক্ত আরব আমিরাত ছিল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উপসাগরীয় দেশে ভাড়াটেদের অফিস, শেল কোম্পানি এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল। এফবিআই ২০১৯ সালের ব্যর্থ ভাড়াটে প্লটের বিষয়েও তদন্ত শুরু করেছিল। সংস্থাটি জর্ডান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত-সমর্থিত খলিফা হাফতারের কাছে বিমান এবং অন্যান্য ম্যাটেরিয়াল বিক্রির প্রচেষ্টায় এরিক প্রিন্সের ভূমিকা নির্ধারণের দিকেও নজর রাখছিল। পূর্ববর্তী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে জর্ডানের রাজপরিবারের ফয়সাল ইবনে আল-হুসেইন লিবিয়ায় অস্ত্র স্থানান্তর সংগঠিত করার জন্য প্রিন্সের সাথে কাজ করেছিলেন। কিন্তু জর্ডান সরকার এই বিক্রি বাতিল করে দেয়, যার পরে প্রিন্স তার ব্যবসায়িক সহযোগী ক্রিস্টিয়ান ডুরান্ট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একজন সদস্যের মধ্যে একটি বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। সাক্ষাতের সময়, ডুরান্ট হাফতারকে সমর্থন করার জন্য প্রিন্সের লিবিয়ার সমরাভিযান সম্পর্কে এনএসসি কর্মকর্তাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চেয়েছিলেন। ইউএন-এর এক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রিন্সের নিয়ন্ত্রণাধীন বা মালিকানাধীন তিনটি বিমান তার সঙ্গে সংযুক্ত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থিত একটি ভাড়াটে ফার্মে স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে প্রিন্সের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.