ভারতবর্ষে ঘোড়ার ইতিহাস ও প্রাগিতিহাস

ভূমিকা

ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়া, গণ্ডার এবং তাপিরের মত খুর বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিবর্তনগত উৎস রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের দিকের ১৯০০-১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের লেইট হরপ্পান প্রত্নস্থলগুলোতে ঘোরার ফসিল ও ঘোরার ব্যবহারের সাথে সম্পর্কিত আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া যায়, এগুলো নির্দেশ করে যে সিন্ধু যুগের শেষের দিকে ভারতবর্ষে ঘোড়ার প্রচলন ছিল। ১৫০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বৈদিক যুগে ভারতবর্ষেও ঘোড়ার ভালরকম প্রচলনই ছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার মূল যুগে বা সমৃদ্ধির যুগে ও তার পূর্বে সিন্ধু সভ্যতায় ঘোড়া তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি, যেমনটা বৈদিক যুগে পালন করেছিল। ইন্দো-আর্যদের কাছে ঘোড়া বা অশ্ব যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা তাদের ধর্মগ্রন্থ বেদে অশ্বের উল্লেখের দ্বারাই প্রমাণিত হয়।

প্রস্তর যুগ

যেটা বলছিলাম, ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়া, গণ্ডার এবং তাপিরের মত খুর বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিবর্তনগত উৎস রয়েছে। ভারতের ভূতত্ত্বের প্লেইস্টোসিন স্তরে ঘোড়ার পূর্বপুরুষ Equus namadicus এর ফসিল পাওয়া গেছে। এটি ঘোড়ার আরেক বিলুপ্ত পূর্বপুরুষ Equus sivalensis এর নিকটাত্মীয়, যারা প্রাগৈতিহাসিক কালে হিমালয়ের পাদদেশে বাস করত, এবং মনে করা হয় শেষ হিমযুগে এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

গৃহপালিতকরণ

খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের পূর্বে ঘোড়ার গৃহপালিতকরণ কেবলমাত্র ঘোড়ার স্থানীয় হ্যাবিটেট স্তেপ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। অনেক প্রমাণই এই অনুকল্পকে সমর্থন করে যে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ইউরেশীয় স্তেপে ঘোড়ার গৃহপালিতকরণ হয়েছিল। বর্তমান কাজাখস্তানের আকমোলা অঙ্গরাজ্যের বোতাই প্রত্নস্থলগুলোতে সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলো নির্দেশ করছে যে, বোতাই আর্কিওলজিকাল কালচার বা প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতিতেই ঘোড়ার সর্বপ্রথম গৃহপালিতকরণ হয়। বোতাই কালচারের সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দ। বোতাই এর ঘোড়াগুলো আসলে আমরা বর্তমানে ঘোড়া বলতে যাদের বুঝি তা ছিলনা, বরং তার কেবল ২.৭% ছিল। মানে বোতাই ঘোড়া আধুনিক ঘোড়ার জেনেটিক্সের মাত্র ২.৭%ই অবদান রেখেছে। তাদের ঘোড়াগুলো ছিল বর্তমান মঙ্গোলিয়ান বুনো ঘোড়া প্রেজওয়ালস্কিজ হর্স এর পূর্বপুরুষ। যাই হোক, বোতাই কালচারের প্রসঙ্গ যখন এলো তখন এদের নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। বোতাইরা কোন ভাষায় কথা বলত তা নির্ণয় করা শক্ত, তবে ভাকভাভ ব্লাজেক মনে করেন তারা ইয়েনেশিয়ান ভাষায় কথা বলতো, যার সাথে প্যালিওসাইবেরিয়ান বা ইস্ট-এশিয়ান রিলেটেড এনসেস্ট্রির (Baikal LN/EBA), সম্পর্ক আছে (তুর্কি-মোঙ্গলদের মত), যে জেনেটিক অ্যান্সেস্ট্রি প্যালিওলিথিক যুগে বৈকাল-সায়ান পর্বতমালা থেকে মধ্য এশিয়ায় চলে আসে। ঘোড়ার সাথে সম্পর্কিত বোতাই/ইয়েনিশিয়ান শব্দগুলো আশপাশের জাতির ভাষায় প্রবেশ করেছে, যেখান থেকে বোঝা যায় এদের থেকে ঘোড়া ধীরে ধীরে আশপাশের জাতিগুলোর কাছে ছড়িয়ে পড়ে। একটা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইয়েনেশিয়ান *ʔɨʔχ-kuʔs থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় *H1ek̂u̯os শব্দ এসেছে, যার অর্থ গৃহপালিত ঘোড়া। বোতাই কালচারের লোকেদের ফসিল থেকে জেনেটিক গবেষণা করে দেখা গেছে এরা জিনগতভাবে পূর্ব এশীয় ও ইউরোপীয়দের মাঝামাঝি ছিল, যদিও পিতৃত্বের দিক দিকে ইস্ট-এশিয়ানই বেশি ছিল। এদের মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয়দের উদ্ভব যেখানে সেই ইয়াম্নায়া পূর্বপুরুষত্ব পাওয়া যায়নি, তবে ইয়াম্নায়াদেরও পূর্বপুরুষ ANE বা অ্যানশিয়েন্ট নর্থ ইউরেশিয়ান পূর্বপুরুষত্ব এদের মধ্যে পাওয়া গেছে। মানে বলতে পারেন ANE এর একটা অংশ দক্ষিণ দিকে গিয়ে পূর্ব এশীয়দের সাথে মিশে বোতাই কালচার গঠন করেছে, আর একটি অংশ পশ্চিমে গিয়ে ইউরোপীয়দের সাথে মিশে ইন্দো-ইউরোপীয় কালচার গঠন করেছে, যারা আরও দক্ষিণ দিকে সরে এসে ইন্দো-আর্যদের গঠন করেছে। ঘোড়ার গৃহপালক বোতাইদের তাই একভাবে আমাদের দূরসম্পর্কের দাদু বলা যায়!

যাই হোক, ধীরে ধীরে বোতাইদের ঘোড়ার ব্যবহার আশপাশের অঞ্চলে যায়। যাতায়াত, কৃষি ও যুদ্ধের জন্য ঘোড়ার ব্যবহার গোটা ইউরেশিয়ায় ব্যাপৃত হয়। আনাতোলীয় ও তোখারীয় বাদে অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয়রা যে ইয়াম্নায়া কালচার (৩৩০০-২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের লোকেরা ঘোড়ায় চড়ত বলে আবিষ্কৃত হয়েছে, মানে বোতাই এর ঘোড়ার কালচার তাদের পশ্চিমের পন্টিক-কাস্পিয়ান স্তেপের ইয়াম্নায়ার ইন্দো-ইউরোপীয়দেরকে প্রভাবিত করেছিল। তবে ইয়াম্নায়ার পূর্বপুরুষ খ্‌ভালিনস্ক কালচারে (৪৯০০-৩৫০০ খ্রি.পূ.) দেখা যায় তারা ঘোড়াকে ধর্মীয় কারণে উৎসর্গ করত, কিন্তু ঘোড়াকে যে গৃহপালিত করেছিল তার প্রমাণ নেই। যে ঘোড়াকে ব্যবহার করে ইন্দো-ইউরোপীয়রা “ইউরোপ থেকে দক্ষিণ এশিয়া জয় করেছিল” বলা হয় সেই ঘোড়ার সংস্কৃতি তারা স্তেপের বোতাইদের থেকে পেয়েছিল যখন তারা ইয়াম্নায়া কালচারে অবস্থান করত। ইয়াম্নায়া কালচারে ঘোড়ার ব্যবহার ইন্দো-ইউরোপীয়দের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সম্পর্কিত। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-৩০০০ অব্দের মধ্যে ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে স্তেপ শুষ্ক ও শীতল হয়ে যায়। এর ফলে পশুর দলগুলোকে ঠিক ঠাক খাওয়াবার জন্য তাদেরকে বারবার স্থান পরিত্যাগ করাতে হয়। অশ্বারোহন ও ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহারই একে সম্ভব করে তোলে স্তেপবাসীদের জন্য। আর এখান থেকেই নতুন রকমের এক মোবাইল প্যাস্টোরালিজমের জন্ম হয়। এই ঘোড়ার ব্যবহার ইন্দো-ইউরোপীয়দের সহায়তা করেছিল বিভিন্ন কালচারের উপর সহজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণেও ঘোড়ার ব্যবহারের গুরুত্ব আছে। কলিন রেনফ্র্যু বলেছিলেন বটে যে, ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণে ঘোড়ার মূল্যায়নটা বাড়াবাড়ি রকমের, তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে তিনি তার নিজের আনাতোলিয়ান হাইপোথিসিজে বিশ্বাস করতেন যা আধুনিক মূলধারার স্কলারশিপ দ্বারা সমালোচিত। মেসোপটেমিয়ায় ঘোড়ার প্রচলন আসতে একটু দেরি হয়। ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেখানে ঘোড়ায় চড়া ও রথে ঘোড়ার ব্যবহারের ফেনোমেনাগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে।

সিন্ধু যুগ ও বৈদিক যুগ

ঋগ্বৈদিক সংস্কৃতি পশুপালনভিত্তিক ছিল ও ঘোড়া-ভিত্তিক ছিল, অন্যদিকে সিন্ধু সভ্যতায় ঘোড়া দেখা যায়না। আমরা জানি ইন্ডিজেনাস এরিয়ানিজম তত্ত্ব আজ আর চলে না, এই তত্ত্বে দাবি করা হতো সিন্ধু সভ্যতা আসলে আর্য ও বৈদিক। কিন্তু ঋগ্বৈদিক সংস্কৃতির ঘোড়ার ব্যবহার আর সিন্ধু সভ্যতার ঘোড়ার অভাবের দিকটিই এই দাবিকে ভুল প্রমাণ করে।

প্রাক-বৈদিক যুগে ভারতবর্ষে ঘোড়ার অভাবের কারণ হতে পারে এই যে ভারতবর্ষের জলবায়ু ঘোড়ার উপযোগী নয়, সেই সাথে সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা ঘোড়া খেতও না আর ধর্মীয় কারণে ঘোড়াকে উৎসর্গও করত না। তবে সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর অবশিষ্ট সিন্ধু যুগে, অর্থাৎ লেইট হরপ্পান কালে (১৯০০-১৩০০ খ্রি.পূ.) ঘোড়ার ব্যবহার দেখা যায়। উল্লেখ্য সেই সময়ে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে গান্ধার অঞ্চলে তখন ইন্দো-আর্যরা বাস করত, তারা গান্ধারে স্থানীয়দের সাথে মিশে গান্ধারা গ্রেইভ কালচার (১৪০০-৮০০ খ্রি.পূ.) তৈরি করেছিল। তারও পূর্বে দক্ষিণ তাজিকিস্তানে ইন্দো-আর্যদের বিশকেন্ত কালচার (১৭০০-১৫০০ খ্রি.পূ.) ছিল, যেখান থেকেই সম্ভবত গান্ধারে গান্ধারা গ্রেইভ কালচার বা সোয়াত কালচারের উদ্ভব হয়। এগুলো পাঞ্জাবের লেইট হরপ্পান কালচারের সমসাময়িক ছিল। তাই এসব কালচার থেকেই ঘোড়ার প্রচলন লেইট হরপ্পান কালচার বা শেষ সিন্ধু যুগের সংস্কৃতিতে চলে এসে থাকবে। তবে সেই সময়টা ছিল সিন্ধু লোকেদের পতনের কাল। এই লেইট হরপ্পান কালচারের শেষ দিকেই সিন্ধু লোকেরা ইন্দো-আর্যদের সাংস্কৃতি গ্রহণ করতে শুরু করে, তাদের মৃতদেহ সমাধিস্ত করার বদলে দাহ করতে থাকে, ক্রমশ তারা ইন্দো-আর্য দেবদেবী, অর্থাৎ ঋগ্বৈদিক দেবদেবীদেরকে গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার যুগে (২৬০০-১৯০০ খ্রি.পূ.) ঘোড়ার ব্যবহার তেমন না পাওয়া যাওয়ায় বলতে হয় সিন্ধু সভ্যতায় ঘোড়া কোন ভূমিকা পালন করেনি।

হরপ্পান সাইট সুর্কোটাডায় (Surkotada) (২৪০০-১৭০০ খ্রি.পূ.) এ. কে. শর্মা আধুনিক ঘোড়ার ফসিল আবিষ্কার করেছেন। আর হর্স স্পেশালিস্ট স্যান্ডর বোকোনি সেটার আপার ও লোয়ার চিক ও দাঁতের এনামেল প্যাটার্ন দেখে নিশ্চিত করেছেন যে এটি আধুনিক ঘোড়ারই ফসিল। এদিকে মিডো এর মত প্রত্নতাত্ত্বিকরা এর বিরোধিতা করে বলেন এই ফসিল দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে এটি আসলে ঘোড়া, না গাধা না ওনেজারের। যাই হোক, ফসিলটি ঘোড়ার হলেও এটি লেইট হরপ্পান কালচারের সময়কার হয়ে থাকতে পারে। এরকম কিছু প্রমাণ মোহেনজোদারো, লোথাল, কালিবঙ্গন, কুন্তাসি সাইটেও পাওয়া গেছে। মোহেনজোদারো, হরপ্পা ও লোথালে ২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকের টেরাকোটা ফিগারিন ও মোলার দাঁত পাওয়া গেছে, যেগুলোকে ঘোড়ার সাথে সম্পর্কিত করা হয়, কিন্তু ঘোড়ারই যে তা নিশ্চিত নয়। সিন্ধুর এলাকা থেকে বের হয়ে এলাহাবাদের কাছে মহাগড়ে ও কর্ণাটকের হালুরেও লেইট হরপ্পান যুগের ফসিল পাওয়া গেছে যেগুলোকে ঘোড়ার বলে দাবি করা হয়। গুজরাটের দৈমাবাদে লেইট হরপ্পান পিরিয়ডের একটি সিল পাওয়া যায়, যেখানে ঘোড়া একটি ঘোড়ার গাড়ি টানছে এরকম চিত্র পাওয়া যায়। দৈমাবাদে একটি ব্রোঞ্জের রথ-সদৃশ গড়িও পাওয়া গেছে যার জোয়াল গরুর বদলে ঘোড়ার সাথেই ম্যাচ করে। অনেক পণ্ডিতই যে সেখানকার অনেক খিলানাকৃতি ঘাড়ের প্রাণীর তাম্র খেলনাগুলোকে ষাঁড়ের বলে ব্যাখ্যা করেছেন, সেগুলো আসলে ঘোড়ার হয়ে থাকতে পারে।

সিন্ধুতে ইন্দো-আর্য প্রভাবের প্রসঙ্গ এলে অক্সাস সিভিলাইজেশন বা ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিকাল কমপ্লেক্সে ইন্দো-আর্য প্রভাবও চলে আসে। সেটি মধ্য এশীয় কালচার। এই কালচারের একটি প্রত্নস্থল হচ্ছে বর্তমানে তুর্কমেনিস্তানের মার্ভ-এ অবস্থিত গোনুর দেপ, যা ২৪০০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বর্তমান ছিল। সেখানে ইন্দো-ইউরোপীয়রা প্রথম প্রবেশ করে ইন্দো-ইরানীয় অ্যান্দ্রোনোভো কালচারের (২০০০-১৪৫০ খ্রি.পূ.) মাধ্যমে। এই অ্যান্দ্রোনোভো কালচার ছিল ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা অঞ্চলের উত্তরে অবস্থিত, ইন্দো-ইরানীয় ভাষী, অর্থাৎ ইন্দো-আর্য ও ইরানীয়দের পূর্বপুরুষ। ১৮০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গোনুর দেপে তাদের প্রবেশ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়, এদের সাংস্কৃতিক প্রভাবও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বৈদিক সাহিত্যে যে সোম রসের ধারণা পাওয়া যায়, গবেষকদের একটি শক্তিশালী ধারণা হলো সেটার অরিজিন আসলে এখানেই। ঘোড়ার প্রচলনও তখনই গোনুর দেপ সহ অন্যান্য ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা অঞ্চলে বৃদ্ধি পায়, যা পূর্বে কম ছিল। কিন্তু তবুও যে একেবারে ছিলনা, তা নয়। এই গোনুর দেপেই খ্রিস্টপূর্ব ২২৫০ অব্দে প্রথম একটি সমাধিস্থলে ঘোড়ার ফসিল পাওয়া যায়, একটি রথের সাথে যুক্ত অবস্থায়, আর এই সময় অ্যান্দ্রোনোভো কালচার তো দূরের কথা, তাদের পূর্বপুরুষ প্রোটো ইন্দো ইরানিয়ান সিনতাশতা কালচারেরও (২০৫০-১৯০০ খ্রি.পূ.) জন্ম হয়নি। তারা এই ঘোড়ার ব্যবহার অ-ইন্দো-ইউরোপীয় কোন উৎস থেকেই নিয়ে থাকতে পারে।

যাই হোক একটু আগে যে, ইন্দো-আর্যদের বিশকেন্ত কালচারের কথা বললাম তার পূর্বপুরুষ ছিল ভক্ষ কালচার (২৫০০-১৬৫০ খ্রি.পূ.), এটাও দক্ষিণ তাজিকিস্তানের কালচার ছিল। সেটা ছিল আসলে ব্যাক্ট্রিয়ানা মার্জিয়ানা আর্কিওলজিকাল কমপ্লেক্স বা বিম্যাক কালচার ও ইন্দো-ইরানীয় কালচারের মিশ্রণ, তবে বেশিরভাগের মতে আসলে ইন্দো-আর্য ও বিম্যাকের মিশ্রণ ছিল, যেখানে ইন্দো-আর্য প্রভাবটাই বেশি। শুধু তাই নয় আলেকজান্ডার লুবোটস্কির মতে বিম্যাক কালচারের সাথে ইন্দো-আর্যরাই মিথোস্ক্রিয়া করেছিল, বর্তমানে সংস্কৃত ভাষায় বহু বিম্যাক শব্দ দেখা যায়, যেগুলোর মধ্যে গন্ধ, গন্ধর্ব, ইষ্টক, সোম, ভেষজ ইত্যাদি রয়েছে। ইরানীয় ভাষাতেও বিম্যাক শব্দ রয়েছে, কিন্তু লুবোটস্কির মতে এই শব্দগুলো ইন্দো-আর্যরাই বিম্যাক থেকে গ্রহণ করে ইরানীয় ভাষায় দান করেছে। খুব সম্ভবত বিম্যাকের অঞ্চলে এসে ইন্দো-ইরানীয়রা ইরানীয় ও ইন্দো-আর্যে ভাগ হয়ে যায়, ইন্দো-আর্যরা বিম্যাক কালচারের সাথে মিথোস্ক্রিয়া করে তাদের থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করে, ও দক্ষিণ তাজিকিস্তানের ভক্ষ কালচারের শেষের দিকে, তা আরও শক্তিশালী হয়, ইন্দো-আর্য প্রভাব বৃদ্ধি পায়, ও সেখান থেকে তারা ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ইন্দো-আর্য বিশকেন্ত কালচার তৈরি করে ও সেখানকারই কিছু লোক ১৯০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে পর্বত পাড়ি দিয়ে গান্ধারে এসে স্থানীয়দের সাথে মিশে ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গান্ধারা গ্রেইভ কালচার তৈরি করে। অন্যদিকে ইরানীয়রা নিজেদেরকে তুলনামূলকভাবে স্বতন্ত্র রেখেছিল ও পূর্ব দিকে তারা আলাদা চুশ্ত ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ইয়াজদ কালচার গড়ে তোলে, যেগুলো থেকে পরে বিভিন্ন ইরানীয় ট্রাইব তৈরি হয়, যাদের অনেকগুলোই আরও পরে ইন্দো-আর্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আবেস্তা তৈরি করে।

ভারতবর্ষে ঘোড়ার সর্বপ্রাচীন বিতর্কহীন ফসিলটি এই গান্ধারা গ্রেইভ কালচারেই পাওয়া গেছে, যা ইন্দো-আর্য ছিল। বিম্যাক কালচারে অ্যান্দ্রোনোভোরা যে ঘোড়ার প্রচলন বৃদ্ধি করেছিল, সেই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারই ভক্ষ কালচার হয়ে, বিশকেন্ত কালচার হয়ে, গান্ধারা গ্রেইভ কালচারের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। আর সেখান থেকে এই ঘোড়ার প্রচলন চলে আসে পাঞ্জাবের লেইট হরপ্পান কালচারে, যা ধীরে ধীরে ইন্দো-আর্যে পরিণত হয়। সেই সাথে হয়তো তা উত্তর ও দক্ষিণ ভারতেও চলে যেতে থাকে যার কর্ণাটক ও এলাহাবাদের সম্ভাব্য ঘোড়ার ফসিলকে ব্যাখ্যা করবে। একটা এক্সট্রা তথ্য দেই, ২০১৯ সালে নরসিমহার বিখ্যাত গবেষণায় গান্ধারা গ্রেইভ কালচারের সমাধিতে পাওয়া মানব ফসিলের ডিএনএ অ্যানালাইসিসে প্রমাণিত হয়েছে যে এদের মধ্যে স্তেপ পূর্বপুরুষত্ব আছে, মানে ওই বহিরাগত ইন্দো-আর্য আরকি। গান্ধারা গ্রেইভ কালচারে আবিষ্কৃত হর্স-ট্র্যাপিং নির্দেশ করে তাদের ইকোনমিতে ঘোড়া কত মূল্যবান ছিল। দুটো হর্স বিউরিয়াল নির্দেশ করে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের কাছে ঘোড়া কত মূল্যবান ছিল। এই হর্স বিউরিয়াল বা অশ্বসমাধির চর্চা কেবল গান্ধারা গ্রেইভ কালচারেই করা হতো না, এটি ইন্দো-ইরানীয় অ্যান্দ্রোনোভো কালচারেও দেখা যায়।

ইন্দো-ইউরোপীয়দের জীবনে ঘোড়া বরাবরই খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী ছিল। বেদ সহ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বারবার “অশ্ব” শব্দটি এসছে। ঋগ্বেদের অনেক ব্যক্তি-নামও অশ্বরর সাথে সম্পর্কিত। অশ্ব শব্দের কগনেটগুলো আবেস্তান, ল্যাটিন, গ্রিক ভাষায়ও পাওয়া যায়। বেদে অশ্বের প্রচুর রেফারেন্স রয়েছে। বিশেষ করে ঋগ্বেদে অশ্বের সাথে সম্পর্কিত প্রচুর কাহিনী আছে, যেখানে অশ্ব প্রায়ই রথের সাথে সম্পর্কিত। যজুর্বেদের একটি উল্লেখযোগ্য যজ্ঞ হলো অশ্বমেধ যজ্ঞ। প্রাচীনকালে উসুন (Wusun) নামে ইনার এশিয়ায় বসবাসরত একটি ইন্দো-ইউরোপীয় ককেশিয়ান জাতি ছিল। ক্রিস্টোফার বেকউইথের মতে ওরা আসলে ইন্দো-আর্য। চৈনিক শব্দ উসুনকে বেকউইথ রিকনস্ট্রাক্ট করে ওল্ড চাইনিজ ফর্ম *âswin তৈরি করেন, আর তার সাথে তিনি ওল্ড ইন্ডিক শব্দ aśvin এর তুলনা করেন, যিনি অশ্বসম্পর্কিত ঋগ্বৈদিক দেবতা। বেকউইথ বলেন, উসুনরা ছিল ইন্দো-আর্যদের অবশিষ্টাংশ, যারা খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দে ইরানীয় জনগোষ্ঠীর চাপে ইউরেশিয়ান স্তেপের এক্সট্রিমিটিতে চলে যেতে বাধ্য হয়। উত্তরাঞ্চলীয় সিরিয়া ও আনাতোলিয়ায় মিতান্নি সাম্রাজ্যের (খ্রি.পূ. ১৬০০-১২৬০ অব্দ) কথা জানা যায়। এদের ভাষায় ইন্দো-আর্য সুপারস্ট্রেট পাওয়া যায়, অর্থাৎ মিতান্নিদের শাসক সমাজ ইন্দো-আর্য ছিল। এই জাতির একটি হর্স ট্রেইনিং ম্যানুয়াল আবিষ্কৃত হয়েছে, যার লেখক কিক্কুলি নামে একজন। এই ম্যানুয়ালটায় বেশ কিছু ইন্দো-আর্য লোন-ওয়ার্ড পাওয়া গেছে। এভাবে মিতান্নি অভিজাত ইন্দো-আর্য ও তাদের হর্সম্যানশিপের সম্পর্ক থেকেই অনুমান হয় যে তারা মিতান্নির হুরিয়ান-ভাষী জনসাধারণকে কিভাবে শাসন করেছিল। তবে পরবর্তীতে এই ইন্দো-আর্য রথচালকরা হুরিয়ান ভাষা গ্রহণ করে তাদের মধ্যে মিশে গিয়েছিল।

তবে ইন্দো-আর্যরা ভারতবর্ষে ঘোড়া নিয়ে এলেও ভারতীয় জলবায়ুতে ঘোড়ার প্রতিপালন ছিল কঠিন। তাই ভারতকে বাইরে থেকে, বিশেষ করে মধ্য এশিয়া থেকে ঘোড়া আমদানি করতে হতো। অথর্ববেদ ১০০০-৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সময় গঠিত হয়। অথর্ববেদের ২.৩০.২৯-এ বাইরে থেকে ঘোড়া নিয়ে আসা ঘোড়ার বণিকদের কথার উল্লেক্ষ আছে। এর থেকে বোঝা যায় ইন্দো-আর্যরা নিজেদের সাথে ভারতবর্ষে ঘোড়া নিয়ে এলেও, অনুকূল জলবায়ুর অভাবে ভারতে প্রচুর সংখ্যায় ঘোড়ার প্রতিপালনে ব্যর্থ হয় ও ঘোড়ার জন্য তাদেরকে মূলত মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। ট্রটমান (১৯৮২) বলেন, ঘোড়ার সাপ্লাই ও আমদানি ভারতীয়দের জন্য সবসময়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকার ছিল। আর এর জন্য ভারত সবসময়ই পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল। আমদানি যে সবসময়ই সমানভাবে করা হয় ও সবসময়ই যে ভারতের সবজায়গায় ঘোড়ার সাপ্লাই সমান থাকে এমনটা হয়। আমদানির দিকটা বিভিন্ন রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা ও রাজনৈতিক শক্তির উপর নির্ভর করে। ভারতবর্ষে বৈদিক সংস্কৃতি-ভিত্তিক পেইন্টেড গ্রে অয়ার কালচার (১২০০-৬০০ খ্রি.পূ.) এর প্রথম দিকে কুরু রাজ্য বেশ শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এই কালচারের শেষের দিকে এই রাজ্য দুর্বল হয়ে আসে ও মহাজনপদের যুগে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কুরু রাজ্যের অবসান ঘটে। হস্তিনাপুর ছিল কুরু রাজ্যের রাজধানী। এই হস্তিনাপুরের প্রত্নস্থলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য সংগঠিত হয়েছে, আর খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকের যে অবশেষগুলো সেখানে পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে সেখানে ঘোড়ার অবশেষ অনেক কম। মানে কুরুরাজ্য ও হস্তিনাপুর ইন্দো-আর্য হলেও খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকেই সেখানে ঘোড়ার অভাব দেখা যায়, তা হয়তো কুরু রাজ্যের তদকালীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবনতিকেই নির্দেশ করে যা ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে তাদের পতনের কারণ হয়। মহাভারতে যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অশ্বের প্রতিপালন ও অশ্বারোহী সৈন্যের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে লেখা আছে।

পরবর্তী কাল

টো লুপ স্টিরাপের টেকনোলজিকাল ইনোভেশনটা ভারতে হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকে দাবি করে থাকেন, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দেও তা ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেইট ভারতবর্ষে আক্রমণ করার সময় আসসাকেনয় রাজ্যে ২০,০০০ সেনার অশ্বারোহী বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন বলা হয়, তবে তা অত্যুক্তি হতে পারে। সংস্কৃত নাটক মুদ্রারাক্ষসে বলা হয়েছে কিভাবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শক, যবন, কম্বোজ, কিরাত, পারসিক, বাহ্লিক জাতিদের সহায়তায় মগধ জয় করে সিংহাসন দখল করেন ও মৌর্য রাজবংশের সূচনা করেন। ভারতবর্ষীয় প্রাচীন সাহিত্যে অনেক রকমের অশ্বভিত্তিক যাযাবরের কথা বলা হয়েছে। শক, কম্বোজ, যবন, পহ্লভ ও পারাদা – এই পাঁচ হোর্ড বা পঞ্চগণহ্‌ এর কথা বলা হয়েছে, এদেরকে ক্ষত্রিয় গণহ্‌ও বলা হয়েছে। শকরা পন্টিক স্তেপের সিথিয়ান ও আরাল সাগরের মাসাগেটিদের থেকে আলাদা হলেও তারা বৃহত্তর সিথিয়ান কালচারের অংশ বলে ধরা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে ইউঝিরা স্তেপ থেকে অনেক শকদেরকে বিতাড়িত করায় তারা সোগডিয়ানা ও ব্যাক্ট্রিয়ায় চলে আসে, তারাই ইন্দো-সিথিয়ান নামে পরিচিত হয়। অন্যান্য শকরা পারথিয়ান সাম্রাজ্যে আক্রমণ করে সিস্তান অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। আবার অনেক শক চীনের ইউনান ও তারিম বেসিনের দিকে সরে যায়। ইন্দো-সিথিয়ানরা খ্রিস্টপুর্ব ২য় শতকে একরকম ইন্দো-সিথিয়ান রাজ্যের সূচনা করে ও খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে ভারতবর্ষে আক্রমণ করে। খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক পর্যন্ত ইন্দো-সিথিয়ান রাজ্য বর্তমান ছিল। এদের মধ্যে পাঞ্জাব ও মথুরাভিত্তিক নর্দার্ন সত্রপ ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ২য় শতক পর্যন্ত, আর গুজরাট, মালব, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ ভিত্তিক ওয়েস্টার্ন সত্রপ ছিল খ্রিস্টীয় ৩৫ অব্দ থেকে ৪১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। পাণিনির রচনা, মনুস্মৃতি ও মহাভারতে কম্বোজদের কথা শোনা যায়, তারা গান্ধারেরও দূরে বাস করত বলা হয়েছে। গান্ধারের পরের অঞ্চলে যারা থাকত সেই সময় তারা ছিল ব্যাক্ট্রিয়ান, যারা আকিমিনিদ যুগে পারশিয়ানদের দ্বারা ও সেলুসিড ও গ্রিকো-ব্যাক্ট্রিয়ান যুগে গ্রিকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। এরা ইরানীয় ভাষাভাষীদের পূর্ব শাখার লোক ছিল। তবে অনেকের মতে কম্বোজ বলতে আসলে শকদেরই রাজকীয় গোষ্ঠীদের বোঝানো হতো। যবন বলতে গ্রিকদের বোজানো হতো। গ্রিকরা প্রথম আলেকজান্ডারের সাথে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে আক্রমণ করে। পরে গ্রিকো-ব্যাক্ট্রিয়ানরা ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানে ইন্দো-গ্রিক রাজ্যের সূচনা ঘটায় যা খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করে। বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও উত্তর পশ্চিম ভারতে এরা শাসন করে। পহ্লভ ও পারাদা দ্বারা ইন্দো-পার্থিয়ানদেরকে বোঝানো। গ্রিক সেলুসিড সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে তারা পার্থিয়ানরা পারস্য ও আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পার্থিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে যা ২৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বর্তমান ছিল। এই পার্থিয়ানরা ভারতবর্ষেও আক্রমণ করে ও ইন্দো-পার্থিয়ান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে যা বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত তো ছিলই, সেই সাথে মথুরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এটি ১৯ থেকে ২২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বর্তমান ছিল। এভাবে বিভিন্ন বহিরাগত জাতি ভারতবর্ষে আক্রমণ ও শাসন করেছে। ভারতবর্ষে এদের সাফল্যের মূল কারণ ছিল ঘোড়া। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের রাজপুত, জাঠ ও গুজারদের মধ্যে এই বহিরাগত জাতিসমূহের এন্সেস্ট্রি বা পূর্বপুরুষত্ব আছে বলে দাবি করা হয়।

এই পঞ্চগণহ্‌ এর আক্রমণ খ্রিস্টীয় ৫ম শতকেই শেষ। কিন্তু বহিরাগতদের আক্রমণ এখানেই শেষ হয়না। এর পর ভারতবর্ষে ঘটে হূণ সহ বিভিন্ন তুর্কিক গ্রুপ ও আরবদের আক্রমণ। খ্রিস্টীয় ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে হূণদের কিদারাইট ও আলকন হানরা ভারতবর্ষে আক্রমণ করে। আর গুপ্তদের পতনের পেছনে তাদের বড় ভূমিকা ছিল। এরপর হূণদের আরেক গ্রুপ হেফথালাইট ও ওয়েস্টার্ন তুর্কিক খানাতের উত্তরসুরি তুর্কিরা মিলে কাবুল, কপিশ, গান্ধার-ভিত্তিক বৌদ্ধ তুর্ক শাহী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে, যা ৬৬৫ থেকে ৮২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বর্তমান ছিল। পরে আরবদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে এরা দুর্বল হয়, এবং শেষে এক ব্রাহ্মণ এদের ক্ষমতা দখল করে হিন্দু শাহী ডাইনাস্টির সূচনা করে, যা ১০২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বর্তমান ছিল। হিন্দু শাহীরা অনেক দিন ধরেই মুসলিম আক্রমণকে প্রতিহত করছিল, তবে ১০২৬ সালে মুসলিম তুর্কিক ডাইনাস্টি গজনভিদদের হাতে এদের পরাজয় ঘটে। এদিকে খ্রিস্টীয় ৭ম শতক ও ৮ম শতকে আরবরা ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। ৭ম শতকেই এরা সিস্তান, জাবুলিস্তান জয় করে, পরে ৮ম শতকে সিন্ধু জয় করে। পরে এরা রাজস্থান ও গুজরাটের দিকে আক্রমণ করেছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়। এরপরে আরবরা আর ভারতে আক্রমণ করেনি, কিন্তু মুসলিম তুর্করা আক্রমণ করে। গজনভিদ ডাইনাস্টির সুলতান মাহমুদের জয়ের কথা বিশেষ কিছু বলার নেই। তিনি নগরকোট, থানেশ্বর, কনৌজ, গ্বালিয়র সহ অনেক জায়গায় আক্রমণ করে সফল হয়েছিলেন। এরপর ঘুরিদ ডাইনাস্টির মুহাম্মদ ঘুরি ১২শ শতকে দিল্লী-আজমের-রাজস্তানে সাফল্য পান। এই হূণ তুর্কি, আরব ও মুসলিম তুর্কিদের সাফল্যের পেছনেও ছিল ঘোড়াই। এমনকি ভারতবর্ষে তুর্কি শাসনামলের সময়ও তাদের সাথে সেন্ট্রাল এশিয়া ও আফগানিস্তানের সাথে বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল, ফলে ঘোড়ার সাপ্লাই লাইনে তেমন সমস্যা হয়নি, আর তা তাদের ভারত বিজয়েও সহায়তা করে। মুঘলদের গোলাবারুদের উপর নির্ভরশীলতা বেশি থাকলেও অশ্বের চাহিদা ফুরিয়ে যায়নি। মুঘল অশ্বারোহীর গানপাউডার উইপন ছিল, কিন্তু ট্রেডিশনাল কম্পোজিট তীর-ধনুকে রিপ্লেস করতে তাদের অনেক সময় লেগেছিল। ভারতবর্ষে ইউরোপীয় মিলিটারি সাফল্যের পর অনেক শাসক ইউরোপীয় মাসড কাভালরি চার্জের ট্যাক্টিক্স গ্রহণ করে। খ্রিস্টীয় ১৮শ শতকে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ফিল্ড ক্যাভালরি ব্যবহার করে, প্রধাণত হেভি ভ্যারাইটি।

তথ্যসূত্র

Bryant, Edwin (2001). The Quest for the Origins of Vedic Culture. Oxford University Press.
Bryant, Edwin F.; Patton, Laurie L. (2005). The Indo-Aryan Controversy: Evidence and Inference in Indian History. Routledge.
Kennedy, Kenneth A.R. (2000), God-Apes and Fossil Men: Palaeoanthropology of South Asia, Ann Arbor: University of Michigan Press
Reddy, Krishna (2006), Indian History, Tata McGraw-Hill Education
Narasimhan, Vagheesh M., et al. (2019). “The formation of human populations in South and Central Asia”
একাধিক রিলেটেড উইকিপিডিয়া আর্টিকেল

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.