বেদান্ত দর্শন : ব্রহ্মসূত্র, অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ

Table of Contents

বেদান্ত দর্শনের উৎস ও বিকাশ

বেদান্ত বা উপনিষদের পরিচিতি

ভারতীয় ছয়টি আস্তিক দর্শনের মধ্যে ভাববাদী মতে বেদান্তদর্শনকে শ্রেষ্ঠ দর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা ভাববাদের চূড়ান্ত রূপ এই বেদান্তদর্শনের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘বেদান্ত’ বলতে বোঝায় বেদের অন্ত বা শেষ। বৈদিক সংস্কৃতির ধারক হিসেবে হিন্দুদের কাছে বেদ সকল জ্ঞানের আকর বলে বিবেচিত। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীন মুনি-ঋষিরা তাদের উপলব্ধ সত্যকে যে সাহিত্য-ভাণ্ডারে সঞ্চিত করে রেখেছেন, তা-ই বেদ। বেদই আস্তিক ষড়দর্শনের ভিত্তি ও উৎস। বেদের চারটি অংশ- মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ। সুতরাং বেদের অন্ত অর্থাৎ উপনিষদকেই মুখ্যত বেদান্ত নামে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ, উপনিষদ তত্ত্বের দার্শনিক ব্যাখ্যা ও সমর্থনই বেদান্তদর্শন।

বেদের চারটি অংশের মধ্যে সংহিতা ও ব্রাহ্মণকে কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক ও উপনিষদকে জ্ঞানকাণ্ড বলা হয়। কর্মকাণ্ড ক্রিয়া-প্রধান। এতে মন্ত্রের সংকলন ও বিভিন্ন যাগযজ্ঞের বর্ণনা রয়েছে। অপরদিকে জ্ঞানকাণ্ড বিচার-প্রধান। বেদের বিভিন্ন মন্ত্র ও ক্রিয়াকর্মের তাৎপর্য বিচারই এই অংশের প্রধান আলোচ্য বিষয়। এই বিচার চরম পরিণতি লাভ করেছে উপনিষদ অংশে। উপনিষদ বিভিন্ন কালে রচিত হয়েছে এবং তা সংখ্যায় বহু। এযাবৎ ১১২ খানা উপনিষদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান উপনিষদগুলি হলো ঈশ, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, প্রশ্ন, কেন, কঠ, মুণ্ডক, মাণ্ডূক্য, কৌষীতকি, মৈত্রী, শ্বেতাশ্বতর প্রভৃতি।

উপনিষদের অর্থ হলো গুরু কর্তৃক শিষ্যের নিকট বর্ণিত রহস্য। ঈশ ব্যতীত সর্বপ্রাচীন (আনুমানিক ৭০০ খ্রীষ্টপূর্ব) উপনিষদ ছান্দোগ্য এবং বৃহদারণ্যক গদ্যে রচিত, তার পরবর্তী উপনিষদসমূহ কেবল পদ্যে অথবা গদ্য-পদ্যের সংমিশ্রণে রচিত। বিভিন্ন উপনিষদে বেদের অন্তর্নিহিত দার্শনিক তত্ত্বকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন খ্যাত-অখ্যাত দার্শনিক কর্তৃক উপনিষদের ব্যাখ্যায় যথেষ্ট পার্থক্য আছে। উপনিষদগুলির মুখ্য বিষয় ছিলো লোক বা জগৎ, ব্রহ্ম, আত্মা বা জীব, পুনর্জন্ম এবং মুক্তি।

বৈদিক সাহিত্যের কালানুক্রমিক বিচারে উপনিষদ হলো বেদের সর্বশেষ স্তর। আবার পাঠক্রমের দিক থেকে উপনিষদকে সর্বশেষ স্তরের পাঠ বলা হয়। উৎকর্ষের দিক থেকেও উপনিষদ বৈদিক সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্তর বা পরিপূর্ণ বিকাশ বা সর্বশেষ পরিণতি বলা যায়। প্রাচীন আর্য বা হিন্দু সমাজ কর্তৃক প্রবর্তিত বর্ণাশ্রম ধর্মে মানুষের জীবনকাল চারটি আশ্রমে বিভক্ত, যথা- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। ব্রহ্মচর্য জীবনে বেদের মন্ত্রভাগ বা সংহিতা পাঠ করতে হয়। গার্হস্থ্য জীবনে ব্রাহ্মণ পাঠ এবং ব্রাহ্মণোক্ত যাগযজ্ঞাদি অনুষ্ঠান করতে হয়। বানপ্রস্থকালে কর্ম হতে অবসর প্রাপ্তি এবং এই সময়ে আরণ্যকই হলো পঠনীয় শাস্ত্র। শেষ পর্যায়ে ভোগ-বিরতির সন্ন্যাস জীবন। সন্ন্যাস আশ্রমে উপনিষদ পাঠের নির্দেশ রয়েছে। উপনিষদে বৈদিক চিন্তাধারার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে বলে উপনিষদভিত্তিক এই তত্ত্বদর্শনই বেদান্তদর্শন নামে পরিচিত।

বেদান্ত বা উপনিষদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

বৈদিক চিন্তাধারার সর্বোচ্চ ও পূর্ণ বিকাশ উপনিষদে ঘটলেও, বলা হয়ে থাকে, এই পরিপূর্ণ বিকাশ লাভের বীজ নিহিত রয়েছে ঋকবেদ সংহিতা প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থে। বেদের চারটি ভাগ, যথা ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। প্রতিটির আবার চারটি অংশ- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা অংশে বেদের মন্ত্রগুলি রয়েছে। ব্রাহ্মণ অংশে সংহিতায় উক্ত যাগযজ্ঞের বিররণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে। আরণ্যকে আছে যজ্ঞ সম্পর্কে রূপক কল্পনা ও প্রতীক উপমার আদেশ। আর উপনিষদে আছে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা।

ঋগ্বেদ

দর্শন বলতে আমরা যা বুঝি তা বৈদিক যুগে দেখা যায়নি। সর্বপ্রাচীন সাহিত্য হিসেবে ঋকবেদের বিভিন্ন মন্ত্রে একাধিক দেবতার স্তুতি করা হয়েছে। এই দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও বরুণ প্রভৃতি প্রধান। যেমন, অজস্র ঋকের মতোই ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের দ্বিতীয় সূক্তের (ঋগ্বেদ-১/২/১-৯) ঋকগুলিতেই আমরা দেখি – “১। হে দর্শনীয় বায়ু এসো, এ সোমরস সমূহ অভিযুত হয়েছে; তা পান করো, আমাদের আহ্বান শ্রবণ করো।  ২। হে বায়ু, যজ্ঞাভিজ্ঞ স্তোতাগণ সোমরস অভিযুত করে তোমার উদ্দেশে স্তুতিবাক্য প্রয়োগ স্তব করছে।  ৩। হে বায়ু, তোমার সোমগুণপ্রকাশক বাক্য সোম পানার্থ হব্যদাতা যজমানের নিকট আসছে, অনেকের নিকট আসছে।  ৪। হে ইন্দ্র ও বায়ু, এ সোমরস অভিযুত হয়েছে, অন্ন নিয়ে এসো; সোমরস তোমাদের কামনা করছে।  ৫। হে বায়ু ও ইন্দ্র, তোমরা অভিযুত সোমরস জানো, তোমরা অন্নযুক্ত হব্যে বাস করো; শীঘ্র নিকটে এসো।  ৬। হে বায়ু ও ইন্দ্র, অভিষবকারী যজমানের অভিযুত সোমরসের নিকটে এসো; হে বীরদ্বয়! এ কাজ ত্বরায় সম্পন্ন হবে।  ৭। পবিত্রবল মিত্র ও হিংসকশত্রুনাশক বরুণকে আমি আহ্বান করি; তারা ঘৃতাহুতি প্রদানরূপ কর্ম সাধন করেন।  ৮। হে যজ্ঞ বর্ধয়িতা যজ্ঞস্পর্শী মিত্র ও বরুণ, তোমরা যজ্ঞফল দানার্থ এ বৃহৎ যজ্ঞে রয়েছো।  ৯। ইন্দ্র ও বরুণ ঋত-সম্পন্ন, বহু লোকের হিতার্থে জাত ও বহু লোকের আশ্রয়ভূত; তারা আমাদের বল ও কর্ম পোষণ করেন।”

প্রজাপতি সূক্ত : যদিও প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন জড়বস্তু, বৃষ্টি, বন্যা, অগ্নি প্রভৃতির অধিষ্ঠাতারূপে এক একজন দেবতার কল্পনা করা হয়েছে, তবু ঋগ্বেদে কোনো একজন দেবতাকে সর্বোপরি মনে করা হতো না। ঋষিগণ ইন্দ্র, সোম, বরুণের স্তবকালে তন্ময়চিত্তে তাদের গুণ ও মহিমা কীর্তনের মাধ্যমে এই দেবতাদের পরিতুষ্ট করে এদের অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু ঋগ্বেদের সর্বশেষ দশম মণ্ডলের মন্ত্রগুলিতে বহুদেববাদ অপেক্ষা একেশ্বরবাদেরই বেশি প্রাধান্য দেখা যায়। যেমন ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের প্রজাপতি সূক্তের (ঋগ্বেদ-১০/১২১) ঋকগুলিতে বলা হয়েছে – “১। সর্বপ্রথমে তিনি কেবল হিরণ্যগর্ভই বিদ্যমান ছিলেন। তিনি জাত মাত্রই সর্বভূতের অদ্বিতীয় অধীশ্বর হলেন। তিনি এ পৃথিবী ও আকাশকে স্বস্থানে স্থাপিত করলেন। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো?  ২। যিনি জীবাত্মা দিয়েছেন, বল দিয়েছেন, যাঁর আজ্ঞা সকল দেবতারা মান্য করে, যাঁর ছায়া অমৃতস্বরূপ, মৃত্যু যাঁর বশ্যতাপন্ন। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো? ৩। যিনি নিজ মহিমাদ্বারা যাবতীয় দর্শনেন্দ্রিয়সম্পন্ন গতিশক্তিযুক্ত জীবদের অদ্বিতীয় রাজা হয়েছেন, যিনি এ সকল দ্বিপদ চতুষ্পদের প্রভু। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো?  ৪। যাঁর মহিমাদ্বারা এ সকল হিমাচ্ছন্ন পর্বত উৎপন্ন হয়েছে, সসাগরা ধরা যাঁরই সৃষ্টি বলে উল্লেখিত হয়, এ সকল দিক বিদিক যাঁর বাহুস্বরূপ। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো?  ৫। এ সমুন্নত আকাশ ও পৃথিবীকে যিনি স্বস্থানে দৃঢ়রূপে স্থাপন করেছেন, যিনি স্বর্গলোক ও নাকলোককে স্তম্ভিত করে রেখেছেন, যিনি অন্তরিক্ষলোক পরিমাণ করেছেন। কোন্ দেবকে হব্যদ্বারা পূজা করবো?  ৬। দ্যাবাপৃথিবী সশব্দে যাঁর দ্বারা স্তম্ভিত ও উল্লসিত হয়েছিলো, এবং সে দীপ্তিশীল দ্যাবাপৃথিবী যাঁকে মনে মনে মহিমান্বিত বলে বুঝতে পারলো, যাঁকে আশ্রয় করে সূর্য উদয় ও দীপ্তিযুক্ত হন। কোন্ দেবকে হব্যদ্বারা পূজা করবো?  ৭। ভূরি পরিমাণ জল সমস্ত বিশ্বভূবন আচ্ছন্ন করেছিলো, তারা গর্ভ ধারণপূর্বক অগ্নিকে উৎপন্ন করলো, তা হতে দেবতাদের একমাত্র প্রাণস্বরূপ যিনি, তিনি আবির্ভূত হলেন। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো?  ৮। যখন জলগণ বল ধারণপূর্বক অগ্নিকে উৎপন্ন করলো, তখন তিনি নিজ মহিমাদ্বারা সে জলের উপরে সর্বভাগে নিরীক্ষণ করেছিলেন, যিনি দেবতাদের উপরে অদ্বিতীয় দেবতা হলেন। কোন্ দেবকে হব্যদ্বারা পূজা করবো?  ৯। যিনি পৃথিবীর জন্মদাতা, যাঁর ধারণক্ষমতা যথার্থ অর্থাৎ অপ্রতিহত, যিনি আকাশকে জন্ম দিলেন, যিনি আনন্দবর্ধনকারী ভূরি পরিমাণ জল সৃষ্টি করেছেন তিনি যেন আমাদের হিংসা না করেন। কোন্ দেবকে হব্যদ্বারা পূজা করবো?  ১০। হে প্রজাপতি, তুমি ব্যতীত অন্য আর কেউ এ সমস্ত উৎপন্ন বস্তুকে আয়ত্ত করে রাখতে পারে নি। যে কামনাতে আমরা তোমার হোম করছি, তা যেন আমাদের সিদ্ধ হয়, আমরা যেন ধনের অধিপতি হই।”

স্পষ্টতই এখানে এমন একজন সত্তাকে কল্পনা করা হচ্ছে যিনি কিনা অন্যান্য দেবতাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে মনে করা হচ্ছে। আবার ঋগ্বেদের দেবতাগণ যে একই সত্তার বিভিন্ন রূপ, বিভিন্ন আকার তাও ঋগ্বেদের একটি ঋক বা মন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে এভাবে – “একই পরম তত্ত্ব এই আদিত্যকে মেধাবীগণ বা তত্ত্বদর্শী ব্রাহ্মণগণ ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ ও অগ্নি নামে অভিহিত করেন। ইনি স্বর্গীয়, পক্ষ বিশিষ্ট ও সুন্দর গমনশীল। ইনি এক হলেও একে বহু বলে বর্ণনা করে। একে অগ্নি, যম ও বায়ু বা মাতরিশ্বাও বলা হয়।” (ঋগ্বেদ-১/১৬৪/৪৬)

আত্মা সূক্ত : এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের এই দশম মণ্ডলের আত্মা সূক্তেরও (১০/১২৫) উল্লেখ করা যায়। এই সূক্তের দেবতা ‘বাক্’। আত্মাকেও এর দেবতা বলা হয়েছে। ঋকগুলিতে এই দেবতা নিজের বিষয়ে নিজেই বলছেন (ঋগ্বেদ-১০/১২৫) – “১। আমি রুদ্রগণবসুগণের সঙ্গে বিচরণ করি, আমি আদিত্যদের সঙ্গে এবং সকল দেবতাদের সঙ্গে থাকি, আমি মিত্রবরুণ এ উভয়কে ধারণ করি, আমিই ইন্দ্রঅগ্নি এবং দুই অশ্বিদ্বয়কে অবলম্বন করি।  ২। যে সোম আঘাত অর্থাৎ প্রস্তর নিষ্পীড়ন দ্বারা উৎপন্ন হন, আমিই তাকে ধারণ করি, আমি ত্বষ্টা ও পূষা ও ভগকে ধারণ করি, যে যজমান যজ্ঞসামগ্রী আয়োজনপূর্বক এবং সোমরস প্রস্তুত করে দেবতাদের উত্তমরূপে সন্তুষ্ট করে, আমিই তাকে ধন দান করি।  ৩। আমি রাজ্যের অধীশ্বরী, ধন উপস্থিত করেছি, জ্ঞানসম্পন্ন এবং যজ্ঞোপযোগী বস্তু সকলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এরূপে আমাকে দেবতারা নানা স্থানে সন্নিবেশিত করেছেন, আমার আশ্রয়স্থান বিস্তর, আমি বিস্তর প্রাণীর মধ্যে আবিষ্ট আছি।  ৪। যিনি দর্শন করেন, প্রাণধারণ করেন, কথা শ্রবণ করেন অথবা অন্ন ভোজন করেন, তিনি আমার সহায়তায় সে সকল কার্য করেন। আমাকে যারা মানে না, তারা ক্ষয় হয়ে যায়। হে বিদ্বান! শোন, আমি যা বলছি তা শ্রদ্ধার যোগ্য।  ৫। দেবতারা এবং মনুষ্যেরা যাঁর শরণাগত হয়, তার বিষয় আমিই উপদেশ দিই। যাকে ইচ্ছা আমি বলবান অথবা স্তোতা অথবা ঋষি অথবা বুদ্ধিমান করতে পারি।  ৬। রুদ্র যখন স্তোত্রদ্বেষী শত্রুকে বধ করতে উদ্যত হন তখন আমিই তার ধনু বিস্তার করে দিই। লোকের জন্য আমিই যুদ্ধ করি। আমি দ্যুলোকে ও ভূলোকে আবিষ্ট হয়ে আছি।  ৭। আমি পিতা, আকাশকে প্রসব করেছি। সে আকাশ এ জগতের মস্তকস্বরূপ। সমুদ্রে জলের মধ্যে আমার স্থান। সে স্থান হতে সকল ভূবনে বিস্তারিত হই, আপনার উন্নত দেহ দ্বারা এ দ্যুলোককে আমি স্পর্শ করি।  ৮। আমিই সকল ভুবন নির্মাণ করতে করতে বায়ুর ন্যায় বহমান হই। আমার মহিমা এরূপ বৃহৎ হয়েছে যে দ্যুলোককেও অতিক্রম করেছে, পৃথিবীকেও অতিক্রম করেছে।” (বাগ্দেবীর উক্তি)

বাগ্দেবীকে এ সূক্তের বক্তা অর্থাৎ ঋষি বলে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু বাক্ যে এ সূক্তের বক্তা, সূক্তের ভেতর তার কোনও নিদর্শন পাওয়া যায় না। এই সূক্তে বক্তা আপনাকে সর্বনিয়ন্তা ও সর্বনির্মাতা বলে পরিচয় দিচ্ছেন। তিনি বলছেন তিনি বিস্তর প্রাণীর মধ্যে আবিষ্ট আছেন। তিনি দ্যুলোকে ও ভূলোকে আবিষ্ট আছেন, তিনি সকল ভুবনে বিস্তারিত হন। ফলে এখানে অস্পষ্টভাবে সর্বেশ্বরবাদের ধারণার বীজ পাওয়া যায়, যা পরবর্তীকালে উপনিষদে ব্রহ্মবাদে পরিণতি লাভ করেছে বলে মনে করা যায়।

এখানে বলাবাহুল্য, একেশ্বরবাদের সাথে সর্বেশ্বরবাদের ধারণার মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য হলো,- ‘একেশ্বরবাদ একজন মাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাসী; কিন্তু তা ঠিক একবাদ নয়। তার পরিকল্পনায় ঈশ্বর ব্যক্তিত্ববিশিষ্ট এবং তিনি তার সৃষ্ট বিশ্ব হতে পৃথক। তিনি সর্বশক্তিমান বটে; কিন্তু তিনি সৃষ্ট বিশ্বকে বাহির থেকে নির্মাণ করেন। সাধারণত তাকে বিশ্বের নিমিত্তকারণ এবং নিয়ন্তা বলে কল্পনা করা হয়। ফলে তার মধ্যে একটি দ্বৈতভাব এসে পড়ে। তার পরিকল্পনায় দুটি পৃথক শ্রেণির সত্তা নিয়ে বিশ্ব গঠিত- একদিকে ঈশ্বর এবং অন্যদিকে তার সৃষ্টি। সর্বেশ্বরবাদ বিশ্বকে ঈশ্বর হতে পৃথক করে না। তা বলে, বিশ্ব ও ঈশ্বর অভিন্ন। ঈশ্বরই বিশ্বের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থেকে তাকে সৃষ্টি করেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। সুতরাং এখানে ঈশ্বর নৈর্ব্যক্তিক সত্তা হয়ে পড়েন। সর্বেশ্বরবাদই প্রকৃত একবাদের নিদর্শন।’- (হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, উপনিষদের দর্শন, পৃষ্ঠা-৭১)

পুরুষ সূক্ত : এবং এই অনেকটা সর্বেশ্বরবাদী প্রাথমিক চিন্তাই ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্তে (১০/৯০) আরও স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে এমন এক সর্বব্যাপী বিরাট পুরুষের কল্পনা করা হয়েছে, যাঁর সহস্র মাথা এবং সহস্র চরণ। পৃথিবীকে ব্যাপ্ত করেও তিনি তাকে অতিক্রম করেছেন, এতো বিরাট তিনি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তার অঙ্গ বা বিভিন্ন অংশ হতে চন্দ্র, সূর্য, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, স্বর্গ, ভূমি, ইন্দ্র, দিক ও ভুবন সবই সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ তার দেহই খন্ডিত হয়ে বিশ্বের নানা বস্তু ও জীবে পরিণত হয়েছে। তিনিই বিশ্বরূপে রূপান্তরিত হয়েছেন। এই পুরুষসূক্তে বিশ্বজগতের নিয়ন্তা হিসেবে বিরাট-পুরুষের যে কল্পনা তার প্রতিফলন বিভিন্ন উপনিষদেই দেখা যায়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের প্রসিদ্ধ এই পুরুষসূক্তটি (ঋগ্বেদ-১০/৯০) হলো – “১। পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। তিনি পৃথিবীকে সর্বত্র ব্যাপ্ত করে দশ অঙ্গুলি পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে অবস্থিত থাকেন।  ২। যা হয়েছে অথবা যা হবে সকলই সে পুরুষ। তিনি অমরত্বলাভে অধিকারী হন, কেননা তিনি অন্নদ্বারা অতিরোহণ করেন।  ৩। তার এরূপ মহিমা, তিনি কিন্তু এ অপেক্ষাও বৃহত্তর। বিশ্বজীবসমূহ তার একপাদ মাত্র, আকাশে অমর অংশ তার তিন পাদ।  ৪। পুরুষ আপনার তিন পাদ (বা অংশ) নিয়ে উপরে উঠলেন। তার চতুর্থ অংশ এ স্থানে রইলো। তিনি তদনন্তর ভোজনকারী ও ভোজনরহিত ( চেতন ও অবচেতন) সকল বস্তুতে ব্যাপ্ত হলেন।  ৫। তিনি হতে বিরাট জন্মিলেন এবং বিরাট হতে সে পুরুষ জন্মিলেন। তিনি জন্মগ্রহণপূর্বক পশ্চাদ্ভাগে ও পুরোভাগে পৃথিবীকে অতিক্রম করলেন।  ৬। যখন পুরুষকে হব্য রূপে গ্রহণ করে দেবতারা যজ্ঞ আরম্ভ করলেন, তখন বসন্ত ঘৃত হলো, গ্রীষ্ম কাষ্ঠ হলো, শরৎ হব্য হলো।  ৭। যিনি সকলের অগ্রে জন্মেছিলেন, সে পুরুষকে যজ্ঞীয় পশুস্বরূপে সে বহ্নিতে পূজা দেওয়া হলো। দেবতারা ও সাধ্যবর্গ এবং ঋষিগণ তা দ্বারা যজ্ঞ করলেন।  ৮। সে সর্ব হোমযুক্ত যজ্ঞ হতে দধি ও ঘৃত উৎপন্ন হলো। তিনি সে বায়ব্য পশু নির্মাণ করলেন, তারা বন্য এবং গ্রাম্য।  ৯। সে সর্ব হোম-সম্বলিত যজ্ঞ হতে ঋক ও সামসমূহ উৎপন্ন হলো, ছন্দ সকল তথা হতে আবির্ভূত হলো, যজু তা হতে জন্ম গ্রহণ করলো।  ১০। ঘোটকগণ এবং অন্যান্য দন্ত পঙক্তিদ্বয়ধারী পশুগণ জন্মিল। তা হতে গাভীগণ ও ছাগ ও মেষগণ জন্মিল।  ১১। পুরুষকে খণ্ড খণ্ড করা হলো, কয় খণ্ড করা হয়েছিলো? এর মুখ কী হলো, দু হস্ত, দু উরু, দু চরণ কী হলো?  ১২। এর মুখ ব্রাহ্মণ হলো, দু বাহু রাজন্য হলো, যা উরু ছিলো তা বৈশ্য হলো, দু চরণ হতে শূদ্র হলো।  ১৩। মন হতে চন্দ্র হলেন, চক্ষু হতে সূর্য, মুখ হতে ইন্দ্র ও অগ্নি, প্রাণ হতে বায়ু।  ১৪। নাভি হতে আকাশ, মস্তক হতে স্বর্গ, দু চরণ হতে ভূমি, কর্ণ হতে দিক ও ভূবন সকল নির্মাণ করা হলো।  ১৫। দেবতারা যজ্ঞ সম্পাদন কালে পুরুষস্বরূপ পশুকে যখন বন্ধন করলেন তখন সাতটি পরিধি অর্থাৎ বেদী নির্মাণ করা হলো এবং তিনসপ্ত সংখ্যক যজ্ঞকাষ্ঠ হলো।  ১৬। দেবতারা যজ্ঞ দ্বারা যজ্ঞ সম্পাদন করলেন, তাই সর্ব প্রথম ধর্মানুষ্ঠান। যে স্বর্গলোকে প্রধান প্রধান দেবতা ও সাধ্যেরা আছেন, মহিমান্বিত দেবতাবর্গ সে স্বর্গধাম প্রতিষ্ঠা করলেন।”

এই পুরুষ সূক্তটির বিশেষ উল্লেখযোগ্যতা হলো, ঋগ্বেদের অন্য কোনো অংশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার জাতির উল্লেখ নেই। এই সূক্তটিকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলে বিদ্বানেরা অভিমত ব্যক্ত করেন, কেননা ঋগ্বেদ রচনাকালে আর্যদের মধ্যে জাতি বিভাগ ছিলো না। এবং বিশ্বজগতের নিয়ন্তাকে বলিস্বরূপ অর্পণ করার যে অনুভব এটিও ঋগ্বেদের সময়ের নয়, এমনকি ঋগ্বেদে আর কোথাও তা পাওয়া যায় না। তাছাড়া ব্যাকরণবিদ পন্ডিতদের সুস্পষ্ট অভিমত হলো, এই পুরুষসূক্তের ভাষা বৈদিক ভাষা নয়, অপেক্ষাকৃত আধুনিক সংস্কৃত। তাই উপনিষদীয় চিন্তাজগত থেকে উদ্ভূত ধারণাই পরবর্তীকালে ঋগ্বেদে অর্বাচীন হিসেবে সংযোজিত হয়েছে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।

ঋত : তবে ঋগ্বেদের প্রাচীন পর্যায়ে বৈদিক ঋষিরা জড় প্রকৃতির উপাসক হলেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার অন্তরালে ‘ঋত’ নামে এক সর্বব্যাপী নিয়ম ও শৃঙ্খলার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। বেদে ‘ঋত’ একটি সর্বব্যাপী নৈতিক নিয়ম যা জীব জগতকে পরিচালিত করে। এই ‘ঋত’ সম্পর্কিত ধারণাটি ঋগ্বেদের প্রথমকালের রচনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে দৃষ্টিগোচর হলেও পরবর্তীকালের অর্বাচীন অংশে তা পাওয়া যায় না। যেমন-

  • “পদবিশিষ্ট মনুষ্যদের অগ্রে পদরহিতা ঊষা আসেন; হে মিত্রাবরুণ! এ যে তোমাদেরই কাজ তা কে জানে? তোমাদের সন্তান আদিত্য ঋতের পূরণ ও অনৃতের বিনাশ করে সমস্ত জগতের ভার বহন করেন। (সায়ণ ভাষ্যে, মিত্র ও বরুণ হলো দিবা ও রাত্রি। সূর্য ঐ দু কালের মধ্যকালে উদয় হন। এ জন্য মিত্রাবরুণের গর্ভ অর্থাৎ শিশু বলে বর্ণিত হয়েছে।)।” (ঋক-১/১৫২/৩)।
  • “পুরাকাল থেকে ঋত এর অনেক জল আছে। ঋতের স্তুতি পাপ নাশ করে। ঋত এর বোধযোগ্য ও দীপ্তিমান শ্লোকসমূহ বধির কর্ণদ্বয়ে প্রবেশ করে (ঋক-৪/২৩/৮)।  ঋত এর ধারণাগুলি দৃঢ়, ঋতের রূপগুলি মনোহর। স্তোতাগণ ঋতের নিকট প্রভূত অন্ন কামনা করে। ঋতের দরুন গাভীগুলি সংগৃহীত হয় এবং গাভীগুলি ঋততে (যজ্ঞে) প্রবেশ করে (ঋক-৪/২৩/৯)।  ঋত-কে তুষ্ট করে স্তোতাগণ বল ও জল লাভ করে। ঋতের জন্যই দ্যাবাপৃথিবী শ্রেষ্ঠ গাভীগুলি দান করে। ঋতের জন্যই বিস্তীর্ণ দ্যাবাপৃথিবী দূরবগাহ। (ঋক-৪/২৩/৮-১০)।
  • “তোমরা (মিত্র, বরুণ প্রভৃতি) ঋতের সংরক্ষক, ঋত হতে তোমাদের জন্ম এবং তোমরা ঋতের বর্ধক, অনৃতের তীব্র দ্বেষকারী। আমরা এবং অন্যান্য বীরেরা যেন তোমাদের আবাসস্থলে অন্নযুক্ত হয়ে সুখে থাকতে পারি।” (ঋক-৭/৬৬/১৩)

‘ঋত’ নামক এই নিয়ম দ্বারা ধর্ম ও নীতি সংরক্ষিত হয় বলে প্রাচীন বেদের ঋষিদের বিশ্বাস ছিলো। তাই কারো কারো মতে, ‘ঋগ্বেদের প্রাচীন পর্যায়ে প্রকৃত দার্শনিক চেতনার কোনো আভাস যদি সত্যিই স্বীকৃত হয়- তাহলে তার মূলসূত্র এই ঋতের মধ্যেই সন্ধান করতে হবে।’-( দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-১৮৫)।

নাসদীয় সূক্ত : তবে সহস্রাধিক বছরের ব্যবধানে এসে ঋষিদের এই ঋত-ধারণায় কোন পরিবর্তন এসে থাকতে পারে। তদুপরি বেদে কোনো সুবিন্যস্ত দার্শনিক চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যায় না। তবে দেববাদ ও ধর্মে বিশ্বাসী বৈদিক ঋষি যাগ-যজ্ঞ, দান-ধ্যান প্রভৃতি পুণ্যকর্মের বিনিময়ে অনন্ত সুখের প্রত্যাশী হলেও বিশ্বের সীমার পর কী, এই অনন্ত বিশ্বের কোনো চালকশক্তি আছে কি-না, সৃষ্টির প্রারম্ভে জগৎ কিরূপ ছিলো, এ সমস্ত প্রশ্নে আলোড়িত হয়েছেন নিশ্চয়ই। এসকল প্রশ্নের বিচারের একটা ক্ষীণ ও অস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তে। তাই ঋগ্বেদের এই নাসদীয় সূক্তকেই উপনিষদীয় দার্শনিক ভাবনার প্রাথমিক ভিত্তি বা বীজ হিসেবে গণ্য করা হয়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এই প্রসিদ্ধ নাসদীয় সূক্তটি (ঋগ্বেদ-১০/১২৯) হলো – “১। সেকালে যা নেই তাও ছিলো না, যা আছে তাও ছিলো না। পৃথিবীও ছিলো না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিলো না। আবরণ করে এমন কী ছিলো? কোথায় কার স্থান ছিলো? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিলো?  ২। তখন মৃত্যুও ছিলো না, অমরত্বও ছিলো না, রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিলো না। কেবল সে একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারিতা ব্যতিরেকে আত্মা মাত্র অবলম্বনে নিশ্বাস-প্রশ্বাসযুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিলো না।  ৩। সর্বপ্রথমে অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিলো। সমস্তই চিহ্নবর্জিত ও চতুর্দিকে জলমগ্ন ছিলো। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা সে সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন। তপস্যার প্রভাবে সে এক বস্তু জন্মিলেন।  ৪। সর্বপ্রথম মনের উপর কামের আবির্ভাব হলো, তা হতে সর্বপ্রথম উৎপত্তির কারণ নির্গত হলো। বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধি দ্বারা আপন হৃদয়ে পর্যালোচনাপূর্বক অবিদ্যমান বস্তুতে বিদ্যমান বস্তুর উৎপত্তি স্থান নিরূপণ করলেন।  ৫। রেতোধা পুরুষেরা উদ্ভব হলেন, মহিমা (পঞ্চভূত) সকল উদ্ভব হলেন। ওদের রশ্মি দু’পার্শ্বে ও নিম্নের দিকে এবং উর্ধ্ব দিকে বিস্তারিত হলো, নিম্নদিকে (নিকৃষ্ট) স্বধা (অন্ন) রইলো, প্রয়তি ( ভোক্তা পুরুষ) উর্র্ধ্বদিকে (উৎকৃষ্ট) রইলেন।  ৬। কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করবে? কোথা হতে জন্মিল? কোথা হতে এ সকল নানা সৃষ্টি হলো? দেবতারা এ সমস্ত নানা সৃষ্টির পর হয়েছেন, কোথা হতে যে হলো, তা কেই বা জানে?  ৭। এ নানা সৃষ্টি যে কোথা হতে হলো, কার থেকে হলো, কেউ সৃষ্টি করেছেন, কি করেন নি, তা তিনিই জানেন, যিনি এর প্রভুস্বরূপ পরমধামে আছেন, অথবা তিনিও না জানতে পারেন।”

সৃষ্টির আদি কারণ ও প্রণালীর পর্যালোচনা সমৃদ্ধ এই নাসদীয় সূক্তটির ভাব দেখে এটিকেও বেদের অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলে বিবেচনা করা হয়। সূক্তটির জ্ঞাতব্য হলো, সৃষ্টির পূর্বের অবস্থা বর্ণনা এবং পরমাত্মার অনুভব। প্রকৃতির যে কার্যসমূহ ও সৌন্দর্যকে ঋষিগণ দেবতা বলে পূজা করতেন, তারা আদি দেব নহেন, তারাও সৃষ্ট অর্থাৎ কার্য মাত্র, তা ঋষির মনে উদয় হয়েছে। তবে জগতের কারণ কে, আদি কে, এসব প্রশ্নের এক অব্যক্ত উত্তর যেন এই সূক্ত। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া যে মনুষ্যের সাধ্য নয়, বেদের ঋষি তাও স্বীকার করেছেন এখানে।

এই প্রশ্নসমূহ এবং তার উত্তর থেকেই বৈদান্তিক বা উপনিষদীয় দার্শনিক চিন্তার আবির্ভাব বলে ধরা হয়। বিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা কারও মতে ছিলো সৎ বা অস্তিত্ববান, কারও মতে অসৎ। আবার কেউ বাদ-প্রতিবাদ সংবাদ দ্বারা- ‘সৎ নয়, অসৎও নয়’- বলে প্রতিষেধের প্রতিষেধ করেছেন। ঋষি কল্পনা করেছেন বিশ্বের প্রাথমিক অবস্থায় সেই মহাশূন্যে এক সত্তার অস্তিত্বকে যিনি সেই মৃত-শূন্য জগতে ছিলেন একমাত্র সজীব সত্তা। প্রথমে বিশ্ব ছিলো অনন্ত জলরাশি, ঋগ্বেদোক্ত এই তথ্য প্রাচীন বৃহদারণ্যক উপনিষদেও দেখা যায় এভাবে- ‘আপ এব ইদমগ্র আসুঃ’ অর্থাৎ, প্রথমে বিশ্ব ছিলো অনন্ত জলরাশি। – (বৃহদারণ্যক: ৫/৫/১)

বৃহদারণ্যক উপনিষদ

এছাড়াও ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের কল্পনাকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্যেই হয়তো বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছিলো-

  • সৃষ্টির প্রথমে এসব কিছুই ছিলো না। যা ছিলো, তা আবৃত ছিলো মৃত্যুর (= জীবন শূন্যতা) দ্বারা। সেই মৃত্যু হলো ‘অশনায়া’-রূপ মৃত্যু। ‘অশনায়া’ হলো ভোগেচ্ছা-বুভুক্ষা-ক্ষুধার দাহ। এই মৃত্যু সংকল্প করলেন- ‘আমি আত্মন্বী হবো’। অর্থাৎ আমি আত্মবান বা অবয়বযুক্ত কায়াময় হবো। তিনি এই সংকল্পে স্থির থেকে নিজেই নিজের অর্চনা করতে করতে চতুর্দিক বিচরণ করে বেড়াতে লাগলেন। সেই অর্চনা বা আত্মানুশীলনের ফলে উৎপন্ন হলো জল। মৃত্যু তাই দেখে মনে মনে চিন্তা করলেন- অর্চনারত আমার জন্য কম্ অর্থাৎ জল বা সুখ উৎপন্ন হলো, এই কারণেই অর্কের অর্কত্ব। অর্ককে যিনি এইভাবে জানেন, জলের অভাব তিনি কখনোই অনুভব করেন না- জল হয় তার নিত্যসঙ্গি। (যদিও সাধারণ অর্থে অর্ক হলো তেজ বা অগ্নি, কিন্তু এখানে অর্ক-কে গৌন অর্থে জল এবং জলরূপে জানার কথা বলা হয়েছে।)। (বৃহদারণ্যক: ১/২/১)।
  • জলই অর্ক। জলের উপরিভাগ ক্রমশ কঠিন হলো। সংঘাতের মাধ্যমে জমতে শুরু করলো সরের মতো আস্তরণ। সেই আস্তরণ হলো পৃথিবী। অশনায়া মৃত্যু তার সৃষ্টিকার্যে বা ভোগ্যবস্তুর অভিলাষে অফুরন্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত হলেন। ক্ষিতি-তত্ত্বের উপর শয়ান সেই স্রষ্টাপুরুষ মৃত্যুর পরিশ্রান্ত এবং উত্তপ্ত রোমবিবর থেকে নির্গত হলো তেজের সার-অংশরূপে অগ্নি, বিরাটরূপী অগ্নি। (বৃহদারণ্যক: ১/২/২)।

এই কল্পনাকে প্রলম্বিত করে উপনিষদীয় ঋষি তার সৃষ্টিতত্ত্বকে আরো বিস্তৃত করলেন এভাবে- ‘তিনি নিজেকে তিনভাগে ভাগ করলেন। অর্থাৎ সেই বিরাট পুরুষ হলেন তিন- অগ্নি বা তেজ একভাগ; অপর দুটি হলো- আদিত্য আর বায়ু। সেই প্রাণ এইভাবে নিজেকে তিনভাগ করলেন। সেই বিরাট-পুরুষের পূর্বদিক হলো মাথা; অগ্নি আর ঈশান কোণ দুটি হলো ‘ঈর্মৌ’ অর্থাৎ দুটি বাহু; পশ্চিম দিক হলো পুচ্ছ; নৈর্ঋত আর বায়ুকোণ দুটি হলো তার দুই উরু; দক্ষিণ আর উত্তর দিক দুটি দুই পাশ; দ্যুলোক তার পিঠ; অন্তরিক্ষ হলো উদর; আর এই পৃথিবী হলো বুক। তিনি জলে প্রতিষ্ঠিত। অর্করূপী মৃত্যুকে যিনি জলে প্রতিষ্ঠিত বলে জানেন, তিনি যেখানেই যান না কেন সেখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।’ (বৃহদারণ্যক: ১/২/৩)।

এই বৃহদারণ্যকেরই আরেক জায়গায় সৃষ্টির বর্ণনায় বলা হয়েছে- ‘এই সৃষ্টির পূর্বমুহূর্তে ছিলো এক পুরুষ-রূপ। তিনি হলেন ‘আত্মা’। তিনি চতুর্দিকে দৃষ্টি-বিক্ষেপ করে নিজেকে ছাড়া দ্বিতীয় আর কাউকে দেখতে না পেয়ে বলে উঠলেন- ‘সোহহমস্মি’। অর্থাৎ সেই আমি (‘সোহং’) একমাত্র ‘আমি’- আমিই, তার উচ্চারিত এই ‘অহং’ বা ‘আমি’ হলো প্রথম নাম, যা আজও আমরা নিজের নামোচ্চারণের পূর্বে ব্যবহার করি। সেই ‘আমি’র সঙ্গে দ্বিতীয় নামের পরিচয় যোগ করে জবাব দেই- ‘আমি অমুক’। তিনি ‘পুরুষ’। কারণ তিনি পূর্বেই যাবতীয় পাপ দগ্ধ করে নিষ্পাপ হয়েছিলেন। দগ্ধ করে তিনি হয়েছিলেন পাপ-বর্জিত- তাই পুরুষ। সর্বশ্রেষ্ঠ এই পুরুষকে যিনি জানেন, তিনি সেই ব্যক্তিকে নিমেষে দগ্ধ করেন, যে তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ হতে চায়।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১)। ‘হঠাৎ একসময় তিনি বেশ ভীত হয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে তিনি শক্ত করে নিলেন এই বলে- ‘আমি ছাড়া আর যখন কোথাও কিছু নেই, তখন আমি এতো ভয় পাবো কেন?’ মন স্থির করার সঙ্গে সঙ্গে তার ভয়ও চলে গেলো। সেই থেকে মানুষ যখন একা থাকে, একটা ভয়-ভাব সে মনে মনে অনুভব করে। মন শক্ত করলেই সেই ভাব আর থাকে না।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/২)। ‘তিনি কিন্তু আনন্দ পেলেন না। সেই থেকে আজও কেউ একা থাকার সময় মানুষ কোন আনন্দ পায় না। সঙ্গি না থাকলে আনন্দ কোথায়? তাই তিনি আনন্দ রস আস্বাদ করার জন্য চাইলেন দ্বিতীয় সত্তাকে। এক সেই আত্মার মধ্যেই একটি পুরুষ আর একটি স্ত্রী-সত্তা ছিলো সমালিঙ্গিত- একে অপরকে জড়িয়ে। যেই মুহূর্তে মনে জাগলো আনন্দ-রস আস্বাদনের ইচ্ছা, অমনি তিনি নিজের দেহকেই ভাগ করলেন দুটি ভাগে। বিভক্ত সেই দুটি সত্তা হলো- পুরুষ আর স্ত্রী- পতি এবং পত্নী। এই কারণেই যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন- প্রত্যেকে নিজ ‘অর্ধবৃগলে’র মতো (অর্থাৎ সমান দুটি ভাগ নিয়ে গোটা একটি ডালের এক এক অংশ-র নাম হলো ‘বৃগল’ বা বিদল)। দুটি বিদল নিয়ে গোটা একটি ডালের মতোই আমাদের এই স্থূল-শরীর স্ত্রী-পুরুষে সমালিঙ্গিত। স্ত্রী-অর্ধাংশ। তাই অর্ধাঙ্গিনীই পূর্ণ করে থাকে পুরুষের শূন্যস্থান। রসময় সেই আত্মা, পুরুষ এবং স্ত্রীরূপে নিজেকে অভিব্যক্ত করে সৃষ্টি লীলাবিলাসে মেতে উঠলেন। সেই পুরুষ স্ত্রীর সঙ্গে হলেন মিথুন- স্ত্রীতে উপগত হলেন। তা থেকেই মানুষের উৎপত্তি।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৩)। ‘অর্ধ অঙ্গজাত সেই নারীর মনে এলো দ্বিধা, সংকোচ। মন তার হলো আলোড়িত। ভাবলেন- এ কী হলো, নিজের অর্ধ-অঙ্গ থেকে যিনি আমাকে সৃষ্টি করলেন, তিনিই কিনা আমার সঙ্গে করলেন রতিক্রিয়া? এই নিদারুণ লজ্জায় আত্মগোপন করা ছাড়া আর কি উপায় আছে, এই ভেবে তিনি ধরলেন গাভীর রূপ। প্রজাপতি পুরুষটির মধ্যে তখন সৃষ্টি সুখের উল্লাস। তিনিও তাই দেখে বৃষরূপ ধরে সেই গাভীতে উপগত হলেন। উৎপন্ন হলো গোজাতি। আবার আত্মগোপন করলেন নারী। ধরলেন ঘোটকীর রূপ, পুরুষটি হলেন ঘোটক, নারী হলেন গর্দভী, পুরুষ হলেন গর্দভ। উৎপন্ন হলো ‘একশফম্’ অর্থাৎ এক খুরবিশিষ্ট প্রাণী। আবার আত্মগোপন করলেন নারী। ধরলেন ‘অজা’ (ছাগলী)-র রূপ, পুরুষটি হলেন ‘অজ’ (ছাগল), নারী ধরলেন ‘অবা’ (মাদী ভেড়া)-র রূপ, পুরুষটি হলেন ‘মেষ’। এইভাবে ছোট্ট পিপীলিকা পর্যন্ত যতো-রকমের প্রাণীর রূপের মধ্যেই আত্মগোপন করুন না কেন নারী নিষ্কৃতি পেলেন না মৈথুনের হাত থেকে। সৃষ্টির আনন্দ প্রজাপতির মনে তখন লহরীর পর লহরী তুলে চলছিলো অবিরাম। মানুষ থেকে শুরু করে প্রাণী জগতের শেষ মিথুন প্রাণীটুকু পর্যন্ত এইভাবেই সৃষ্ট হলো।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৪)। ‘প্রজাপতি তার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে খুবই আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন। ভাবলেন- কে এই সৃষ্টির স্বরূপ? সে তো আমি। যা কিছু সৃষ্টি সবকিছু তো আমারই সৃজন। আমিই স্রষ্টা, আমিই সৃষ্টি। তাই তিনিই হলেন সৃষ্টি। সৃষ্টিতত্ত্বকে যিনি এইভাবে জানতে পারেন, সৃষ্টির মধ্যে তিনিই হতে পারেন স্রষ্টা, প্রজাপতি।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৫)।

সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে একাত্ম করে ধীরে ধীরে এক অদ্বৈত সত্তার উপলব্ধি উপনিষদীয় ঋষিদের চিন্তাজগতে যে অনেকটাই দানা বেঁধে উঠছিলো তা উপনিষদীয়-সাহিত্যে অপ্রকাশ্য নয়। বৃহদারণ্যকেই বলা হয়েছে – ‘প্রথমে সবই ছিলো অব্যাকৃত, অসৎ, অমূর্ত। বীজের অভ্যন্তরে ছিলো একাকার হয়ে। ছিলো না নানা নামে, নানা রূপে তার বহিঃপ্রকাশ। সৃষ্টির অভিলাষে, লীলা-বিলাসে, আনন্দের অভিসারে সেই এক তিনি হলেন ব্যাকৃত, ব্যক্ত, প্রকাশিত- হলেন নাম ও রূপ নিয়ে বহু। পৃথক পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে তিনিই হয়েছেন বহু। হলেন ‘ইদং’- অর্থাৎ, এই। প্রত্যেকের অভ্যন্তরে তাই তারই অধিষ্ঠান। নামে রূপে এই প্রকাশের ফলেই জগতের প্রতিটি বস্তুও এক-এক নাম, এক-এক রূপ। চিহ্নিত করে এই বলে- ‘এর এই নাম’, ‘এটির এই রূপ’। ক্ষুরের খাপে যেমন ক্ষুর, কাঠে যেমন বিশ্বম্ভর অগ্নি অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছে, দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তেমনিভাবে তিনি ( সেই লীলাভিলাষী) আত্মার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। বাইরের এই চোখ দিয়ে তাকে দেখা যায় না। এই চোখ যা দেখে তা সবই ‘অকৃৎস্ন’- অপূর্ণ, খণ্ডরূপ। কর্মরত অবস্থায় আত্মা কতো কর্মই না করে চলেছেন। ভিন্ন ভিন্ন কর্মের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন নামে তিনি নিজেকে প্রকাশ করছেন। যখন প্রাণন অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করছেন, তখন তিনি প্রাণ। যখন কথা বলছেন, তখন বাক্ । যখন দেখছেন, তখন চক্ষু। যখন শুনছেন, তখন কর্ণ। যখন মনন করছেন, তখন মন। সেই এক তিনি অথচ কর্মভেদে কতোই না নাম, এই কারণে যে আত্মাকে পৃথক ভেবে উপাসনা করে, সে প্রকৃত আত্মতত্ত্ব জানে না। যা পৃথক, তা অপূর্ণ। সবসময়ই উপাসনা করতে হবে এই ভেবে যে ‘ইনি আত্মা’। তখন পৃথক সত্তার অস্তিত্ব নিয়ে যাবে সমষ্টিতে, অপূর্ণতা পাবে পূর্ণতা, খণ্ড অখণ্ডের আনন্দে মধুর হয়ে উঠবে। কারণ, সবই আত্মার মধ্যে এক সেই আত্মাই ‘পদনীয়’ অর্থাৎ জ্ঞাতব্য বা অনুসন্ধানের একমাত্র বস্তু। নানা নামে রূপে যিনি নিজেকে প্রকাশ করে রেখে নিজে অদৃশ্য হয়ে আছেন, তাকে জানতে পারলে সবই জানা হয়ে যায়। আত্মতত্ত্বকে যিনি এইভাবে জানেন, তিনি অবশ্যই কীর্তিমান, যশস্বী হন।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৭)।

এই যে সমগ্র বিশ্বজগৎ একই পরম সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ, জগতের সব কিছুর মূলে এক চৈতন্য সত্তা অস্তিত্ববান, তিনিই সেই পরম পুরুষ। উপনিষদীয় চিন্তাসূত্রে তাকেই ব্রহ্ম নামে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। তিনিই জগতের আদি, তিনিই জগতের সকল কিছুর অধিষ্ঠান, এই উপলব্ধির সাথে একাত্ম হওয়াই উপনিষদীয় দার্শনিক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ – ‘এই জগৎ আগে ব্রহ্মরূপেই ছিলো, ছিলো ব্রহ্মময়। সর্বশক্তিমান তিনি যে মুহূর্তে নিজেকে নিজে জানালেন- ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’- অর্থাৎ ‘আমিই ব্রহ্ম’, অমনি তিনি সবকিছু হয়ে সর্বাত্মক হলেন। দেবতাদের মধ্যেও যিনি নিজেকে ব্রহ্ম সদৃশ বলে জেনে জাগ্রত হলেন, তারাও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। অতএব ঐ একইভাবে ঋষি ও মনুষ্যের মধ্যে যিনি নিজেকে ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ বলে জানেন তিনিই এই সব হন। ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে বলেছিলেন- ‘আমি মনু হয়েছিলাম’; ‘আমিই সূর্য হয়েছিলাম’। যিনি নিজেকে নিশ্চিত ভাবে জানেন ‘আমি ব্রহ্ম’, তিনি এইরকমই হন। কারণ তার আত্মা তখন সর্বব্যাপী। তাই দেবতারও সাধ্য থাকে না তার বিরুদ্ধে যাবার বা তার ক্ষতি করার। আর ব্রহ্মজ্ঞানে অজ্ঞানী মানুষ যাঁরা দেবতাকে নিজেদের থেকে স্বতন্ত্র ভেবে আরাধনা করেন তারা জানে না যে, তারা দেবতার নিকট পশুর তুল্য। এক এক দেবতার উপাসনা করেই তারা জীবনকে ধন্য মনে করে। মানুষ যেমন পশু-গৌরবে গৌরব-বোধ করে, দেবতারাও তেমনি একই রকমের মানুষ-পশু পেয়ে খুশিই থাকেন। একটি পশু চুরি গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে মানুষের যেমন ক্ষতি বোধ হয়, দেবতাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। কোন সেবক মানুষ-পশু যদি নিজেকে একবার পশুত্ব-পাশ থেকে মুক্ত করে তত্ত্বজ্ঞ, আত্মজ্ঞ, ব্রহ্মজ্ঞ হয়ে ওঠে, তাহলে দেবতারা তার সেবা আর পেতে পারে না। তাই দেবতারা চান না, মানুষ ব্রহ্মজ্ঞ হোক, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করুক।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১০)।

এখানে দেবতাদের প্রতি উপনিষদীয় ঋষির উপরিউক্ত মনোভাব বেশ কৌতুহলোদ্দীপক হলেও তা যে অযৌক্তিক ছিলো না তা বুঝতে এখানে উল্লেখ্য যে, বেদের সুপ্রাচীন অংশের কয়েকটি সূক্তের মধ্যে, যেমন নাসদীয় সূক্ত, বৈদান্তিক ভাবনার কিঞ্চিৎ সন্ধান পেলেও, প্রাচীন আর্য ভারতীয়রা যাগযজ্ঞ এবং অনুষ্ঠানাদির উপরই বেশি গুরুত্ব দিতেন। যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আধ্যাত্ম ফলপ্রাপ্তির প্রতি প্রচণ্ড আস্থা ও বিশ্বাস রেখে পুরোহিত শ্রেণীর ব্রাহ্মণেরা এইসব দীর্ঘমেয়াদী ও অতি ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞাদির খুঁটিনাটির উপর এতোটা গুরুত্ব আরোপ করতেন যে, এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পরবর্তী কালের যুক্তিবাদী মননশীল ব্যক্তিরা যজ্ঞীয় ক্রিয়াকাণ্ডের ফলের উপর সন্দিহান হয়ে উঠেন এবং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তারা আধ্যাত্মিক সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হন এবং পার্থিব সমস্যার ভিন্ন ভিন্ন সমাধানে উপনীত হন। বেদের সূক্তভাগে যে বেদান্ত ভাবনা বীজাকারে নিহিত ছিলো, তা-ই কালক্রমে বিবর্ধিত হয়ে উপনিষদ আকারে আত্মপ্রকাশ করে। এখানে কর্মকাণ্ডের চাইতে জ্ঞানকাণ্ডই হয়ে উঠে মুখ্য।

বেদের ক্রিয়াকাণ্ডের আচার অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মনোভাব ব্যক্ত করার নেতৃত্বে ছিলেন ক্ষত্রিয়রাই। চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে আর্য ভারতীয়রা যে খুবই বলিষ্ঠ ও সাহসিক চিন্তাবিদ ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সত্যের তত্ত্ব নির্ণয়ে তারা কোনো কিছুকেই ধর্মবিরুদ্ধ কার্য বলে মনে করতেন না। ফলে উপনিষদের প্রারম্ভ যুগেই বেদের মধ্যে বৈদিক ধর্মাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেরও সন্ধান পাওয়া যায়। যুক্তিবাদের প্রবল বন্যার ফলেই অতি বিরুদ্ধ চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদের মতো অনেকগুলি মতবাদের আবির্ভাব ঘটে, দার্শনিক ভাবনায় যেগুলি ছিলো অত্যন্ত বস্তুবাদী এবং ধর্ম-বিরোধী। ফলে যজ্ঞীয় পুরোহিত-বৃত্তি টিকিয়ে রেখেও সেইসব বিরোধী ভাবনাকে প্রতিহত করাটা ছিলো উপনিষদীয় চিন্তকদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। আর এভাবেই উপনিষদে দার্শনিক ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে গিয়েই ব্রহ্মবাদের উত্থান হয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও উপনিষদগুলি বিভিন্ন কালে রচিত হয়েছিলো বলে উপনিষদে আলোচিত দার্শনিক তত্ত্বের মধ্যে মূলগত ঐক্য থাকলেও কোনো কোনো বিষয়ে মতভেদও দেখা যায়।

এখানে উল্লেখ্য, প্রাচীন ত্রয়ীবিদ্যার অন্যতম যজুর্বেদের দুটি ভাগ- কৃষ্ণযজুর্বেদ ও শুক্লযজুর্বেদ। কৃষ্ণযজুর্বেদকে বলা হয় তৈত্তিরীয় সংহিতা আর শুক্লযজুর্বেদকে বলা হয় বাজসনেয়ী সংহিতা। এই দুটি ভাগে রয়েছে তিনটি শাখা এবং দুটি ব্রাহ্মণ। শাখা তিনটি হলো- তৈত্তিরীয়, মাধ্যন্দিন এবং কাণ্ব। আর ব্রাহ্মণ দুটির মধ্যে শুক্লযজুর্বেদের ব্রাহ্মণের নাম- শতপথ ব্রাহ্মণ, এবং কৃষ্ণযজুর্বেদের ব্রাহ্মণের নাম- তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ। মাধ্যন্দিন এবং কাণ্ব- এই শাখা দুটির একটিই ব্রাহ্মণ- প্রসিদ্ধ শতপথ ব্রাহ্মণ। বৃহদারণ্যক উপনিষদটি কাণ্বশাখার শতপথ ব্রাহ্মণেরই শেষ চতুর্দশ খণ্ড। যেমন বাজসনেয় সংহিতার শেষ আঠারোটি মন্ত্র নিয়ে ঈশোপনিষদ।

যাগযজ্ঞাদি কর্মে কোন্ সূক্তগুলির প্রয়োজন, কোনগুলি কিভাবে ব্যবহৃত হবে তা নির্দেশ করার জন্য সৃষ্টি করতে হয়েছে বেদের ব্রাহ্মণ ভাগ। তাই ব্রাহ্মণ হচ্ছে শ্রুতির কর্মকাণ্ড। ব্রাহ্মণ ভাগের পর আরণ্যক, তারপর উপনিষদ। ব্রাহ্মণভাগ যেমন কর্মকাণ্ড, উপনিষদ ভাগ তেমনি জ্ঞানকাণ্ড। ব্রহ্মচর্য নিয়ে বেদ সংহিতা পাঠের পর গুরুর কাছে অরণ্যাশ্রমে বেদসংক্রান্ত আলোচনা পাঠ করার রীতি ছিলো। অরণ্যে উপদিষ্ট বলে আরণ্যক। এই বৃহদারণ্যক (ন্যুনতম ৬০০ খ্রীঃপূর্ব) উপনিষদটি একদিকে যেমন শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের অন্তিম অংশ অর্থাৎ একটি আরণ্যক, অপরদিকে তা উপনিষদও। অর্থাৎ আরণ্যক-উপনিষদ। আকারেও সুবৃহৎ বলে এর নাম হয়েছে বৃহদারণ্যক উপনিষদ। ছান্দোগ্য উপনিষদের মতো প্রথমদিকের প্রাচীনতম উপনিষদের মধ্যে বৃহদারণ্যক অন্যতম। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই উপনিষদের বক্তব্যই পরবর্তী উপনিষদগুলির উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। উপনিষদের সর্বাপেক্ষা খ্যাতনামা ঋষি বা দার্শনিক যাজ্ঞবল্ক্যের চিন্তা এই বৃহদারণ্যকে পাওয়া যায়, তাই উপনিষদ-সাহিত্যে এর স্থান অত্যন্ত উচ্চে।

বৃহদারণ্যকের ছয়টি অধ্যায়ের দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়ে দার্শনিক আলোচনা রয়েছে; অবশিষ্ট অংশে শতপথ ব্রাহ্মণের কর্মকাণ্ডের ধারা চলেছে। প্রথম অধ্যায়ে যজ্ঞীয় অশ্বের সঙ্গে তুলনা করে সৃষ্টি পুরুষের বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর রয়েছে মৃত্যু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তত্ত্বজ্ঞানী কাশীরাজ অজাতশত্রু এবং আত্মাভিমানী ব্রাহ্মণ গার্গ্যের সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত গার্গ্যের দর্পচূর্ণ হয়েছে এবং তিনি ক্ষত্রিয় কাশীরাজের নিকট ব্রহ্মজ্ঞান শিক্ষার ইচ্ছায় তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে যাজ্ঞবল্ক্যের দর্শন। চতুর্থ অধ্যায়ে আছে রাজা জনকের প্রতি যাজ্ঞবল্ক্যের উপদেশ। পঞ্চম অধ্যায়ে ধর্মাচার এবং অন্যান্য বাণীর বিষয় আছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে যাজ্ঞবল্ক্যের গুরুর (উদ্দালক আরুণি) গুরু প্রবাহণ জৈবলির সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই অধ্যায়েই উত্তম সন্তান লাভের জন্য গর্ভবতী নারীগণকে ষাঁড়-বলদের মাংস ভক্ষণ করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় যে, সেকালে গো-মাংস ছিলো ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের প্রিয় খাদ্য। যেমন- ‘যদি কেউ এমন কামনা করে যে আমার এমন একটি পুত্র হোক, যে পণ্ডিত, সুগায়ক, ভালো বক্তা, সুভাষী হবে তাহলে মাংসান্ন পাক করে সেই মাংসমিশ্রিত অন্ন ঘি মিশিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খাবে। তাতে তারা তাদের মনোমতো পুত্রেরই জন্ম দিতে পারবে। তবে মাংসটি হওয়া চাই- উক্ষ অর্থাৎ বৃষ-মাংস। বৃষটি হয় তরুণ, নয়তো বৃদ্ধ হবে।’ (বৃহদারণ্যক: ৬/৪/১৮)।

অবশ্য গোটা বেদসংহিতা জুড়ে যজ্ঞের হব্য হিসেবে পশুবলি এবং তা সোমরস সহযোগে ভক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের তৃপ্তিকর প্রকাশের নমুনা হিসেবে অজস্র সূক্ত ও ঋক রচনার বিষয়টা বিবেচনায় রাখলে সেই বৈদিক উপনিষদ যুগে ষাঁড়-বলদের মাংস আর্যগোষ্ঠির প্রিয় খাদ্যের তালিকায় থাকা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং খুবই স্বাভাবিক ও সঙ্গত বলেই মনে হয়। মোটকথা, আস্তিক হিন্দু দার্শনিকেরা যেমন নিজেদের বিচারকে সত্য তথা নির্ভুল বলে প্রমাণ করার জন্য এখনো উপনিষদের দোহাই দেন, তেমনি যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ডে গভীর বিশ্বাস ও আস্থার সাথে কিঞ্চিৎ দার্শনিকতার মিশেলে বৃহদারণ্যক উপনিষদও বেদের জয়পতাকাকে উড্ডীয়মান রাখতে সদা তৎপর ছিলো। উপরন্তু তৎকালীন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেদ ও ব্রাহ্মণের প্রতি স্বাধীন চিন্তা-সম্পন্ন মানুষের শ্রদ্ধা যে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিলো সেটা মনে রেখেই ক্ষত্রিয় শাসক শ্রেণীর শ্রেয়ত্বে যথাযথ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেও বৃহদারণ্যক মনে করেছিলো যে, সমাজে ব্রাহ্মণদের স্থানই সর্বোচ্চ এবং সম্মানজনক। ফলে অদ্বৈত চৈতন্য-সত্তা ব্রহ্ম’র সর্বাত্মকবাদী হয়েও বৃহদারণ্যক ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণপ্রথারও অকৃত্রিম পরিপোষক ছিলো। যেমন- ‘এই সবকিছুর আগে ছিলেন একজন। ছিলেন ব্রহ্ম। এই জগৎ ছিলো ব্রহ্মময়। তিনি ছিলেন একা। দ্বিতীয় আর কেউ ছিলো না। জায়মান এই জগৎ-ব্যাপারকে নিয়মিত করার জন্য তিনি সক্রিয় হলেন। অব্যক্ত নিলেন ব্যক্তরূপ। ছিলেন অপ্রকট, হলেন প্রকট- প্রথমে বর্ণরূপে। শ্রেয়োরূপী ক্ষত্রিয়কে তিনি প্রথম সৃষ্টি করলেন। যেমন, দেবগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় দেবরাজ ইন্দ্র, জলচরগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় জলচরপতি বরুণ, ব্রাহ্মণগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় মনুজপতি সোম, পশুগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় পশুপতি রুদ্র, বিদ্যুৎ প্রভৃতি বস্তুর মধ্যে বস্তুপতি পর্জন্য অর্থাৎ মেঘ, পিতৃগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় পিতৃপতি যম, রোগাদির মধ্যে ক্ষত্রিয় মৃত্যু এবং দীপ্তিশালীদের মধ্যে ক্ষত্রিয় ঈশান। ক্ষত্রিয়রাই শ্রেষ্ঠ। রাজসূয় যজ্ঞে তাই ব্রাহ্মণ ঋত্বিকের স্থান ক্ষত্রিয়ের নিচে। ব্রাহ্মণ অসংকোচে তাকে উচ্চাসনে বসিয়ে নিজের যশ দিয়ে তাকে যশস্বী করেন। ক্ষত্রিয় হয় যশ-সমৃদ্ধ। আবার ব্রহ্ম অর্থাৎ ব্রাহ্মণই হলেন ক্ষত্রিয়ের উৎপত্তির কারণ। রাজসূয় যজ্ঞে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করলেও যজ্ঞের শেষে কিন্তু ব্রাহ্মণকেই আশ্রয় করে থাকে। তাই যে ব্রাহ্মণকে হিংসা করে, সে নিজের উৎপত্তিস্থলকেই হিংসা করে। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে হিংসা করলে যে পাপ হয়, তার চেয়েও বেশি পাপের ভাগী হয় সে, যে ব্রাহ্মণদ্বেষী।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১১)। ‘ক্ষত্রিয় সৃষ্টির পর দেখলেন তিনি, বিত্ত-ধনসম্পদ না থাকলে কেমনভাবে ক্ষত্রিয়রা করবেন যজ্ঞ, ব্রাহ্মণেরা করবেন তাদের কাজ, অসম্পূর্ণ থেকে যায় যে সবকিছু ‘বিশম্’ ( বৈশ্যজাতি)-র অভাবে, যাঁরা হবেন বিত্ত-মাধ্যম। তাই তিনি ক্ষত্রিয়ের পরেই সৃষ্টি করলেন বৈশ্যদের। গণদেবতারা হলেন বৈশ্যজাতির মধ্যে গণ্য। যেমন, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, ত্রয়োদশ বিশ্বদেব, ঊনপঞ্চাশ মরুৎ অর্থাৎ বায়ু।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১২)। ‘এরপর ব্রহ্ম দেখলেন, ক্ষত্রিয় করলো যজ্ঞ, ব্রাহ্মণ হলো ঋত্বিক, বিত্ত-সামর্থ্য জোগালো বৈশ্য- সবই ঠিক, কিন্তু এদের পোষণ করবে কে? সেবা দিয়ে পুষ্টি সামর্থ্য জোগাবে কে? তাই তিনি সব শেষে সৃষ্টি করলেন শূদ্রকে। তার ওপর দিলেন সকলের পোষণের ভার। এই পৃথিবীই পূষা। কারণ যেখানে যা কিছু আছে, পৃথিবীই সবকিছু পোষণ করে।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১৩)।

এইভাবে চারটি বর্ণ-বিভাগ করে সেই এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্ম বিশ্বে নিজেকে প্রকট করলেন। এই যে বর্ণ-বিভাজনের প্রাচীন ধারণা, তার উৎস হিসেবেও কিন্তু বেদসংহিতাকেই চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে ঋগ্বেদের প্রসিদ্ধ ‘পুরুষসূক্ত’ (১০/৯০/১১-১২) এই ধারণার উদ্গাতা। যদিও আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই পুরুষ সূক্তটির বিশেষ উল্লেখযোগ্যতা হলো ঋগ্বেদের অন্য কোনো অংশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার জাতির উল্লেখ নেই এবং এই সূক্তটিকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলে বিদ্বানেরা অভিমত ব্যক্ত করেন, কেননা ঋগ্বেদ রচনাকালে আর্যদের মধ্যে জাতি বিভাগ ছিলো না। তাই উপনিষদীয় চিন্তাজগত থেকে উদ্ভূত ধারণাই পরবর্তীকালে ঋগ্বেদে অর্বাচীন হিসেবে সংযোজিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।

এই যে ব্রহ্ম বিষয়ক উপনিষদীয় ভাবনার উন্মেষ, সেই ব্রহ্মের গুণের অন্ত নেই। যেমন,  বৃহদারণ্যক উপনিষদেই  ব্রহ্মবিদ্ বিদুষী গার্গীকে নিজের ব্রহ্মজ্ঞানের প্রমাণ দিতে গিয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের বয়ানে বলা হচ্ছে- ‘গার্গী, এই সেই অসীম অনন্ত অফুরন্ত শক্তিমান অক্ষরপুরুষ। ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তু নির্দ্বিধায় মেনে চলে তার নির্দেশ। সূর্য-চন্দ্র, দ্যুলোক-ভূলোক, নিমেষ, মুহূর্ত, অহোরাত্র, মাসার্ধ, মাস, ঋতু, সংবৎসর তারই প্রশাসন মেনে চলেছে। এই অক্ষরপুরুষের শাসনেই শ্বেতপর্বত থেকে শুরু করে অন্যান্য পর্বতে উৎপন্ন নদী পূর্বে-পশ্চিমে যে যার গতিপথে কলকল্লোলে বয়ে চলেছে। গার্গী, দানকারীরা যে প্রশংসিত হয়, দেবতারা যজমানের বা ভক্তের, পিতৃগণ দর্বী অর্থাৎ শ্রাদ্ধান্নের অনুগত হয়, তাও এই অক্ষরপুরুষের শাসনে।’ (বৃহদারণ্যক-৩/৮/৯)।

অনন্ত এই অসীম গুণের আধার যে ব্রহ্ম, তার স্বরূপ কী? লক্ষ্যণীয় হলো, বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্রহ্মের কোন সদর্থক বর্ণনা নেই। যেমন- ‘যাজ্ঞবল্ক্য বললেন- গার্গী, ব্রহ্মবিদ ব্রাহ্মণেরা বলেন, ইনিই সেই অক্ষরপুরুষ, যার ক্ষয় নেই। সেই অক্ষরপুরুষের পরিচয় দিতে গিয়ে ব্রহ্মবিদেরা বলেছেন, তিনি স্থূল নন, সূক্ষ্ম নন, তিনি খর্ব নন, দীর্ঘ নন; তিনি লোহিত নন, তরল নন; ছায়া নন, অন্ধকার নন, বায়ু নন, আকাশও নন। তিনি অসঙ্গত-অরস- কোন কিছুতে আসক্ত নন, রসসিক্তও নন, গন্ধহীন- ঘ্রাণেন্দ্রিয় যার সন্ধান পায় না; চক্ষুহীন, শ্রোত্রেন্দ্রিয়হীন, মনহীন, তেজহীন, মুখহীন। তিনি অপরিমেয়, অন্তর-বাহির অর্থাৎ ভিতর-বার বলে তার কিছু নেই। তিনি ভোক্তা নন আবার কারো ভোগ্যও নন।’ (বৃহদারণ্যক-৩/৮/৮)।

কিন্তু সর্বব্যাপী যে অফুরন্ত সত্তা অস্তিত্ববান- সৎ বলে স্বীকার করা হয়, তার বর্ণনা কেন এমন অভাবাত্মক হবে? এর উত্তর বৃহদারণ্যকেই দেয়া হয়েছে এভাবে- ‘মহারজন-বাস’- হলুদে ছোপানো বস্ত্রের মতো পীতবর্ণ। ‘পাণ্ডু-আবিকম্’- আবিকম অর্থাৎ ভেড়ার লোমে তৈরি বস্ত্রের মতো পাণ্ডুরবর্ণ। ‘ইন্দ্রগোপো’- ইন্দ্রগোপ কীটের মতো রক্তবর্ণ। ‘যথা অগ্নিঃ অর্চিঃ’- অগ্নিশিখার মতো। ‘যথা পুণ্ডরীকং’- শ্বেতপদ্মের মতো শুভ্র কান্তি। ‘যথা সকৃৎ বিদ্যুত্তম্’- একসঙ্গে অনেকগুলি বিদ্যুৎ চমকের মতো। যিনি সেই পুরুষকে এইভাবে জানেন, তিনি বিদ্যুৎ-ঝলকের মতোই শ্রী লাভ করেন। কিন্তু এতা কথা বলার পরেও কি তার রূপ প্রকাশ করা গেলো? গেলো না। মন ভরলো না। শুরু হলো বিচার। একটা শব্দ, একটা ভাষা। পরক্ষণেই- না। আবার একটা শব্দ, একটা ভাষা। আবার- না (না+ইতি=নেতি)। বললো ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার। শেষে, সিদ্ধান্তে হলো- ইনিই শ্রেষ্ঠ। এঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নেই। কিন্তু কোন্ অভিধায় তা প্রকাশ করা যাবে। বলা হলো- ইনি ‘সত্যের সত্য’। প্রাণসমূহ সত্য। ইনি সেই সত্য প্রাণসমূহ থেকেও সত্য।’ (বৃহদারণ্যক-২/৩/৬)।

তবে এ প্রেক্ষিতে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের উক্তিটিও প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়- ‘প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসীগণ মনে করতেন যে, কৃপা, ক্ষমা, প্রভৃতি ভাবাত্মক গুণে গুণী পুরুষগণই ঈশ্বরকে প্রাপ্ত হন কারণ ঈশ্বরও ঐরূপ গুণযুক্ত; কিন্তু মানুষ তখন শ্রদ্ধা থেকে অগ্রসর হয়ে বুদ্ধির রাজ্যে প্রবেশ করেছিল, কাজেই তাদের বোঝানোর জন্য এবং যুক্তির পথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ব্রহ্মকে অভাবাত্মক বলে প্রচার করাই উপযোগী বলে মনে করা হলো।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-৩৪)।

কিন্তু উপনিষদীয় ভাবনা-ধারায় এই জগত ব্রহ্ম থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এরূপ বেদাশ্রিত চিন্তাধারার উত্তরাধিকার হিসেবে উপনিষদকে পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে  হয়েছে যে, ব্রহ্মময় এই দৃশ্যমান জগতেরও একটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা রয়েছে। ফলে এক অদ্ভুত সমন্বয়-প্রচেষ্টাও উপনিষদে পরিলক্ষিত হয়। তাই বলা হচ্ছে, এই মহাবিশ্বে, এই ব্রহ্মাণ্ডে, এই দেহভাণ্ডে, যেখানে যা কিছু আছে ইন্দ্রিয়ের গোচরে, ইন্দ্রিয়ের অগোচরে; যা কিছু আছে প্রকট-অপ্রকট অবস্থায়, কোন কিছুই মিথ্যা নয়, অলীক নয়। সব সত্য। একই ব্রহ্ম দুটি রূপে বিরাজ করছেন সর্বত্র। এই দুটি রূপই সত্য। সত্যই ব্রহ্ম; ব্রহ্মই সত্য। সেই দ্বৈতরূপের মধ্যে অদ্বৈতরূপের সমন্বয়ক-চিন্তাটিই দেখা যায় বৃহদারণ্যকে- ‘ব্রহ্মের দুটি রূপ। একটি ‘মূর্ত’ অপরটি ‘অমূর্ত’। একটি ‘সৎ’ (সত্তাবান, ব্যক্ত) অপরটি ‘ত্যৎ’ (সত্তাহীন, অব্যক্ত)।’ (বৃহদারণ্যক-২/৩/১)।

ছান্দোগ্য উপনিষদ

বৃহদারণ্যকের ন্যায় ছান্দোগ্য উপনিষদও (ন্যুনতম ৭০০ খ্রীষ্টপূর্ব) প্রাচীন ও যুগসন্ধিক্ষণের প্রথমকালের উপনিষদ হিসেবে তাতেও যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ডের প্রশংসা রয়েছে। যেমন- ‘ধর্মের বিভাগ তিনটি। প্রথম- যজ্ঞ, বেদ-অধ্যয়ন, দান। দ্বিতীয়- তপস্যা। তৃতীয়- যতদিন দেহ ক্ষয় না হচ্ছে ততদিন অর্থাৎ যাবজ্জীবন গুরুকুলে বাস করে নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রহ্মচর্য পালন। যারা তা করে তারা পুণ্যলোকগামী হয়, ব্রহ্মনিষ্ঠ হয়ে তারা অমৃতত্ব লাভ করে।’ (ছান্দোগ্য-২/২৩/১)।

ছান্দোগ্য বৃহদারণ্যকেরও পূর্ববর্তী উপনিষদ। ছন্দ শব্দের অর্থ হলো বেদগান। যাঁরা বেদগানে পারদর্শী, তাদের বলা হয় ‘ছন্দোগ’। এই ছন্দোগদের শাস্ত্রকে বলে ‘ছান্দোগ্য’। গানের মাধ্যমে যে বেদ পাঠ করা হয়, তা হলো সামবেদ। কিন্তু সমগ্র সামবেদই ছান্দোগ্য নয়। বৈশম্পায়ন ঋষির ন’জন শিষ্যের মধ্যে একজনের নাম ছিলো তাণ্ড্য। তিনি সামবেদের একটি শাখা তাণ্ড্য শাখার প্রবর্তক। এই শাখারই অন্তর্গত একটি ব্রাহ্মণের নাম ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ। সেই ব্রাহ্মণে আছে দশটি প্রপাঠক বা অধ্যায়। তার শেষ আটটি অধ্যায় নিয়ে ছান্দোগ্য উপনিষদ- যার শুরু ব্রহ্মবাচী অক্ষরপুরুষ ‘ওঁ’ (ওম্)। এই প্রসঙ্গে ঋষি অরবিন্দ লিখেছেন- ‘ছান্দোগ্যের এই আরম্ভ থেকে বোঝা যায় যে, তার উদ্দেশ্য হল ব্রহ্মের জন্য সমগ্র আত্মনিয়োগ করবার যথাযথ ও সম্পূর্ণ পথনির্দেশ করা এবং তার উপযোগী সব মনোভাব ও তার সব উপায় স্পষ্ট করে বলা। বিষয়বস্তু ব্রহ্মা, কিন্তু বেদের পুণ্য অক্ষর ওঁ (ওম্) যার প্রতীক, সেই ব্রহ্ম। সুতরাং তার প্রতিপাদ্য কেবলমাত্র সর্বময় শুদ্ধসৎ নয়, আত্মার সব অংশ বা কলা- ভূর্ভুবঃ স্বঃ, জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি, ব্যক্ত-অর্ধব্যক্ত-নিগূঢ়, সব বিভাবই তার বর্ণনীয়, সেসব লোক অধিকার করা, ভোগ করা এবং অতিক্রম করে যাবার ঠিক পথ নির্দেশ করাও ছান্দোগ্যের উদ্দেশ্য।’- (সূত্র: উপনিষদ সংগ্রহ, সংকলন ও ভাষান্তর চিত্তরঞ্জন ঘোষাল, পৃষ্ঠা-৩৬৭)

ছান্দোগ্য উপনিষদের শুরুটা হলো এভাবে- ‘ওম্ এই অক্ষরকে উদ্গীথরূপে উপাসনা করবে। কারণ প্রথমে ওম্ উচ্চারণ করে পরে উদ্-গান করা হয়। (ওঁ বা ওম্ হলো পুরুষোত্তম অক্ষর- অক্ষরপুরুষ। উপনিষদের ঋষি প্রথমেই উদ্-গীথের উপাসনা করতে বলেছেন। উদ্-গীথ হলো সামবেদের একটি অংশ বা সামগানের একটি অবয়ব। উদ্-গীথ গানে প্রথমেই উচ্চারণ করতে হয় ওঙ্কার। অর্থাৎ গানের শুরুতেই ওঙ্কারের উচ্চারণ, তার পর গীত। ওঙ্কার এই শব্দের মধ্যেই ত্রিগুণাত্মক ব্রহ্মাণ্ডের স্থিতি; ওঙ্কার এই ধ্বনির মধ্যেই ব্রহ্মাণ্ড উদ্ভাসিত। উপনিষদের ঋষিমাত্রেই এই রহস্যেও দ্বার উদ্ঘাটনে তৎপর হয়েছেন।)’ (ছান্দোগ্য-১/১/১)।

ছান্দোগ্যের প্রধান দার্শনিক উদ্দালক আরুণি ( গৌতম) ছিলেন যাজ্ঞবল্ক্যের গুরু। বেশ কিছু কাহিনী এবং আখ্যায়িকায়, সেই সঙ্গে কথোপকথনের আঙ্গিকে এই উপনিষদটি সুসমৃদ্ধ। যেমন, চাক্রায়ণ-উষস্তির কাহিনী, কুকুরের সামগান, দেবকী-পুত্র কৃষ্ণকে ঘোর আঙ্গিরস ঋষির তত্ত্ব-উপদেশ, জানশ্রুতি-পৌত্রায়ণ ও শকট-চালক রৈক্কের আখ্যায়িকা, সত্যকাম-জাবালার আখ্যায়িকা, উপকোশলের কাহিনী, ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে বিবাদ এবং প্রাণের শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনী, শ্বেতকেতু-প্রবাহণ সংবাদ, অশ্বপতি-ষড়ব্রাহ্মণ সংবাদ, আরুণি-শ্বেতকেতুর কাহিনী, প্রজাপতি-ইন্দ্র-বিরোচন সংবাদ ইত্যাদি। তবে কোন কাহিনীই কেবলমাত্র গল্পকথা নয়, সবকটি আখ্যায়িকাই প্রতীকধর্মী। সবিশেষ বিদ্যা বা তত্ত্বকে সাধারণে বোধগম্য করার জন্যই উপনিষদের ঋষি এইসব কাহিনী বা আখ্যায়িকার মাধ্যম গ্রহণ করেছেন বলে মনে করা হয়।

প্রথম দুই অধ্যায় ব্রাহ্মণ অংশ থেকেই পুষ্ট হয়েছে। উপনিষদের সামগান এবং ‘ওম্’-এর মহিমা এতে কীর্তিত হয়েছে। তবে প্রথম অধ্যায়ের দ্বাদশ খণ্ডে, কারো কারো মতে, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যে পুরোহিতগণ সামগান করেন তাদের সম্পর্কে একটা পরিহাস করা হয়েছে কুকুরের সামগান আখ্যায়িকার মাধ্যমে। যদিও উপনিষদের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায় কুকুরকে প্রাণের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে দেখা যায়, পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের ব্যাখ্যায়-
‘ঋক দালভ্য বা গ্লাব মৈত্রেয় নামে এক ঋষি ছিলেন যিনি বেদপাঠের জন্য নির্জনে বাস করতেন। একদিন সেখানে সাদা রঙের একটি কুকুর আসে। পরে আরও কয়েকটি কুকুরের আবির্ভাব হয়। তারা সাদা কুকুরটিকে বলে, তুমি সাম্গান করো, হয়তো তাতে আমাদের ভালো আহার জুটবে। ঋষি এই কথাবার্তা শুনে তাদের সামগান শুনতে উৎসুক হন। পরের দিন তিনি দেখেন, এক কুকুর আরেক কুকুরের লাঙ্গুলে মুখ দিয়ে গাইছে- ‘হিং! খাবম্, ওম্ পানম্ করবম্; ওম্ দেবম্ মোদের খাদ্যম্ দাত্তম্!’ হে দেব আমাদের অন্ন দাও, এই দাও, ঐ দাও, হ্যান দাও, ত্যান দাও, ওম্! ইত্যাদি।  এই কৌতুক নকসায় সারিবদ্ধভাবে যে পুরোহিত সকল যজ্ঞের সময় শুধু দান-দক্ষিণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সামগান করে তাদের বিদ্রূপ করা হয়েছে, তাদের মনোযোগ দেবার্চনায় নয়, নিজ স্বার্থসিদ্ধির প্রতি।’ (দর্শন-দিগদর্শন, পৃষ্ঠা-২৬)

প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় যে, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের মধ্যে ছান্দোগ্যই সর্বপ্রথম পুনর্জন্ম বিষয়ক ধারণার অবতারণা করে। এ প্রেক্ষিতে রাহুল সাংকৃত্যায়নের মন্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন-
‘ঐ যুগের প্রথম প্রচারক সম্ভবত ভাবেননি, যে সিদ্ধান্ত তিনি প্রচার করছেন ভবিষ্যতে তা কত বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে, এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হওয়ার শক্তিকে রুদ্ধ করে সমাজকে স্রোতহীন এক বদ্ধ জলায় পরিণত করবে। মৃত্যুর পর স্বর্গসুখ লাভের প্রলোভন দেখানো দুঃখপীড়িত মানুষকে আশার কুহক দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। এর একমাত্র অভিসন্ধি হলো মানুষ যাতে তার দুরবস্থার জন্য দায়ী এই সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে মুখর না হয়ে ওঠে; একে সংযত রাখার জন্যই এই পুনর্জন্মের প্রলোভন। কিন্তু পুনর্জন্ম তো কষ্ট নিপীড়িত মানুষের কাছে আরও ভয়ঙ্কর। এখানে শুধু বর্তমানের দুঃখ ভুলে যেতে উপদেশ দেওয়া হয়নি, বরঞ্চ আরও বলা হয়েছে যে, সামাজিক বৈষম্য কিছু অন্যায় নয়, কেন না তোমারই গতজন্মের কর্মফলে আজ এই অবস্থা। সামাজিক বৈষম্য না থাকলে আজ যে কষ্ট তুমি করছ, পরজন্মে তার পুরস্কার পাবে কি করে?’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-৩০)।

ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রচারিত পুনর্জন্ম সম্বন্ধে সেই সর্বপ্রাচীন উক্তিটি হলো- ‘তাদের মধ্যে যারা (পূর্বজন্মে) রমণীয় আচরণ বা পুণ্যকর্ম করে তারা দেহান্তরে শীঘ্রই ব্রাহ্মণযোনিতে বা ক্ষত্রিয়যোগিতে বা বৈশ্যযোনিতে জন্মলাভ করে। আবার যারা (পূর্বজন্মে) কপূয়াচরণ অর্থাৎ কুৎসিত বা অশুভ কর্ম করে তাদের শীঘ্রই কুকুরযোনিতে বা শূকরযোনিতে বা চন্ডালযোনিতে পুনর্জন্ম হয়।’ (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭)।

বলার অপেক্ষা রাখে না, পুনর্জন্মের সাথে পুর্বজন্মের কর্মফল নামক এক অভূতপূর্ব কল্পনাকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যে অব্যর্থ ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন ছান্দোগ্যের প্রখ্যাত ঋষি উদ্দালক আরুণি, তারই অব্যর্থ প্রভাব অন্যান্য উপনিষদে তো বটেই, কালক্রমে সেটাই অপ্রতিরোধ্য গতিতে পল্লবিত হতে হতে পরবর্তীকালের গড়ে ওঠা দর্শনগুলোরও অবিচ্ছেদ্য তত্ত্বীয় অংশে পরিণত হয়েছিলো।

এই ছান্দোগ্য উপনিষদেই ব্রহ্মের জ্ঞানময় চিহ্ন বা প্রতীককে উপাসনা করার কথা সব থেকে বেশি বলা হয়েছে। এই প্রতীক কখনো সূর্য, কখনো ব্যোম, কখনো অন্যকিছু। তবে সবকিছুর মূলে সেই ব্রহ্মময় ওঙ্কার ওম্ (ওঁ)। যেমন- বাক্ হলো ঋক্ । প্রাণ হলো সাম। আর উদ্গীথ হলো ওম্ এই অক্ষর। যা বাক্ এবং প্রাণ অথবা ঋক্ এবং সাম, তা-ই যুগল বা মিথুন (ছান্দোগ্য-১/১/৫)।  যুগল-সম্মিলনের (বাক্ ও প্রাণ) এই তত্ত্বকে জেনে যে (ওম্) ওঙ্কারকে উদ্গীথরূপে উপাসনা করবে, তার কোন কামনাই অচরিতার্থ থাকবে না (ছান্দোগ্য-১/১/৭)।  এই অক্ষরই ত্রয়ীবিদ্যার ( বেদবিদ্যা) প্রবর্তক। ‘ওম্’ উচ্চারণ করে শ্রবণ করানো হয়, ‘ওম্’ উচ্চারণ করে মন্ত্রপাঠ করা হয়, ‘ওম্’ আগে উচ্চারণ করে পরে উদ্গান করা হয়। এই সবই মহিমা এবং রসের দ্বারা এই অক্ষরের (অক্ষরপুরুষের) পূজার জন্য (ছান্দোগ্য-১/১/৯)।  যা উদ্গীথ তা-ই প্রণব। আবার যা প্রণব তা-ই উদ্গীথ। আদিত্যই (সূর্য) উদ্গীথ, আদিত্যই প্রণব। কারণ আদিত্য ‘ওম্’ উচ্চারণ করে গমন করেন (ছান্দোগ্য-১/৫/১)।  এই নিখিলের যা কিছু, তা সবার উৎপত্তিস্থল আকাশ। আবার আকাশেই হয় লয়। সবার চেয়ে আকাশই শ্রেষ্ঠ। আকাশই সবার আশ্রয়, পরমা গতি (ছান্দোগ্য-১/৯/১)।  শ্রেষ্ঠ হতেও শ্রেষ্ঠ অনন্ত এই আকাশই উদ্গীথ। এইভাবে জেনে যে অনন্ত আকাশে প্রতিষ্ঠিত সেই মহা-মহিমময় উদ্গীথের উপাসনা করবে, সে সর্বশ্রেষ্ঠ লোক জয় করে সর্বশ্রেষ্ঠ বরণীয় জীবন লাভ করে ধন্য হবে। (ছান্দোগ্য-১/৯/২)।

ছান্দোগ্যের ঋষি ওঙ্কারের ব্যাপ্তির কথা বলতে গিয়ে আরো বলছেন- প্রজাপতি (সৃষ্টিভিলাষী হয়ে) লোকসমূহকে অভিধ্যান করলেন। তার ফলে সমুদয় লোক হতে ত্রয়ী-বিদ্যা অর্থাৎ  বেদবিদ্যা নিঃসৃত হলো। এরপর তিনি বেদবিদ্যার ধ্যান করলেন। ফলে সেই বেদবিদ্যা থেকে বেরিয়ে এলো তিনটি অক্ষর- ভূঃ (পৃথিবী), ভুবঃ (অন্তরিক্ষ) আর স্বঃ (দ্যুলোক)। (ছান্দোগ্য-২/২৩/২)। এরপর প্রজাপতি ঐ তিনটি অক্ষরকে অভিধ্যান করলেন। ফলে, অক্ষরগুলো থেকে নিঃসৃত হলো ওঙ্কার। গাছের পাতা-জুড়ে যেমন পাতার শিরা, বা পাতার সব অংশই যেমন শিরার সঙ্গে যুক্ত, তেমনি সব কিছুর মধ্যে ওঙ্কার ব্যাপ্ত। সব কিছুই যুক্ত ওঙ্কারের সঙ্গে। বিশ্ব-চরাচরে যা কিছু আছে, সবই আছে ওঙ্কারে। ওঙ্কারই বিশ্বরূপ। সবই ওঙ্কার…সবই ওঙ্কার। (ছান্দোগ্য-২/২৩/৩)।

এই যে ওঙ্কারময় বিশ্বজগত এবং ওঙ্কারময়তাই যে ব্রহ্মত্ব বা ব্রহ্মময়তা, তার সমন্বয়পূর্বক বিখ্যাত প্রাচীন শাণ্ডিল্য-বিদ্যারই প্রকাশ দেখা যায় ছান্দোগ্যের তৃতীয় অধ্যায়ের চতুর্দশ খণ্ডে (ছান্দোগ্য-৩/১৪/১-৪)- বিশ্ব-চরাচরে যা কিছু আছে, এই যে যা কিছু দেখছো- সব, সব কিছুই ব্রহ্ম। কারণ- তা থেকে স্থাবর-জঙ্গম সব কিছুরই সৃষ্টি, তাতেই সব কিছুর লয় আবার তাতেই সব কিছুর স্থিতি। ‘সবই ব্রহ্ম’, এইভাবে ভেবে শান্ত মনে, অচঞ্চল-চিত্তে তার উপাসনা করবে। প্রতিটি জীবনই ক্রতুময় অর্থাৎ কর্মময়। (সংকল্প, কর্ম বা অধ্যবসায় ছাড়া জীবন নেই। এগুলি এক-একটি যজ্ঞ।) এখানে এই পৃথিবীতে পার্থিব জীবন নিয়ে যেমন কর্ম করবে, (যেমন অধ্যবসায় নিয়ে চলবে, যেমন সংকল্প করবে,) জীবনের অবসানে পরকালে ঠিক তেমনটিই পাবে। তাই যা কিছুই করো না কেন, এটি ভেবে করবে (ছান্দোগ্য-৩/১৪/১)।  ব্রহ্ম হলেন মনোময়। [বৃহ+মন=ব্রহ্ম] মনোময় হলেও (লোকদৃষ্টিতে) তার শরীর প্রাণময়। তাকে দেখতে কেমন? তিনি ভারূপ অর্থাৎ জ্যোতির্ময়। তিনি সত্যসঙ্কল্প- সত্যই তার কর্মের প্রকাশ। তার আত্মা হলো আকাশের মতো সর্বব্যাপী, অষণ্ড। সব কর্মের আধার তিনি- সর্বকর্মা; সর্ব কামনার আধার- সর্বকাম। সমুদয় গন্ধ ও রসের মূল- সর্বগন্ধ, সর্বরস। তিনি এইভাবে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন সব কিছুর মধ্যে। বাক্য তার কথা বলতে পারে না। অনাদর তিনি অর্থাৎ নিত্যতৃপ্ত, অনপেক্ষ (ছান্দোগ্য-৩/১৪/২)।  সেই ব্রহ্মই আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে আত্মা। অণুরও অণু অর্থাৎ সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর। যব, সর্ষে, শ্যামাক-ঘাসের তণ্ডুল- এসবের থেকেও ছোট। আবার আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে আত্মারূপী এই ব্রহ্ম মহৎ থেকেও মহত্তর- মহীয়ান। সুবিপুল পৃথিবী, অন্তরিক্ষ, দ্যুলোক থেকেও মহীয়ান (ছান্দোগ্য-৩/১৪/৩)।  শাণ্ডিল্য এই উপদেশ বারবার দিয়েছেন- সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ, সর্বরস, বাক্রহিত, সর্বব্যাপী সেই ব্রহ্মই আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে, আমার আত্মা। ইহলোক পরিত্যাগ করে আমি যখন পরলোকে যাবো, আমি তাকেই তখন পাবো- এতে আমার কোন সংশয় নেই। আমার স্থির বিশ্বাস- ব্রহ্মকে আমি লাভ করবোই, নিশ্চয়ই লাভ করবো (ছান্দোগ্য-৩/১৪/৪)।

এভাবে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উপনিষদে ব্রহ্ম ও আত্মা নামক ধারণার একাকার উপলব্ধিরই প্রকাশ দেখা যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদে একেই বলা হয়েছে বৈশ্বানর আত্মা। যেমন- তিনি একই সময়ে প্রাদেশমাত্র অর্থাৎ পরিমাপের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে সসীম আবার অভিবিমান অর্থাৎ মাপজোখের বাইরে অসীম। যিনি সেই বৈশ্বানরকে এইভাবে জেনে উপাসনা করেন, তিনি সর্বলোকে, সর্বভূতে, সর্ব আত্মাতে অন্নভোজন করেন। তিনি সকলের সঙ্গে একত্ব অনুভব করেন। তখন, তার ভোগ-সুখ মানে সকলের ভোগ-সুখ আবার সকলের ভোগ-সুখ মানে তারই ভোগ-সুখ (ছান্দোগ্য-৫/১৮/১)।

এই যে সর্বব্যাপী ব্রহ্ম কিংবা বৈশ্বানর আত্মা, তিনি কি সবকিছুর পূর্বেও ছিলেন? কিংবা অন্যভাবে বললে, শরীরে যেমন তথাকথিত এই আত্মার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তেমনি বিশ্বের সৃষ্টির পশ্চাতেও নিশ্চয়ই কোনো বিস্ময়কর শক্তি কাজ করে এবং তা গুপ্তভাবে তো নয়ই বরং বিশ্বের প্রতিটি ক্রিয়াকে সেই শক্তিই দৃষ্টিগোচর করে। ফলে বস্তুর সৃষ্টি ও বিন্যাস থেকে মানব-মনেও এই জিজ্ঞাসার উদ্ভব হয়- বিশ্বসৃষ্টিরও নিশ্চয়ই কোনো উৎস আছে, এবং তারও আগে কি কিছু ছিলো? ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তকে (ঋগ্বেদ-১০/১২৯) বিবেচনায় রেখে বৃহদারণ্যক উপনিষদে সৃষ্টিতত্ত্বের একটা ব্যাখ্যা ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি। ছান্দোগ্য উপনিষদেও পুত্র শ্বেতকেতুকে পিতা উদ্দালক আরুণির উপদেশ বয়ানে এই প্রশ্নের দার্শনিকসুলভ উত্তর দেয়া হয়েছে ষষ্ঠ অধ্যায়ের দ্বিতীয় খণ্ডে (ছান্দোগ্য-৬/২/১-৪)। যেমন- হে সৌম্য! এই যে বিশ্ব-চরাচর দেখছো, সর্বপ্রথমে এটি ছিলো সৎ-স্বরূপে। সূক্ষ্ম বীজাকারে এর একটা অস্তিত্ব ছিলো। সেটি হলো সৎ বস্তু। এক এবং অদ্বিতীয় (সদ্) ভাবরূপ। তার থেকেই এই বিশ্ব-চরাচর। কেউ কেউ বলেন, সর্বপ্রথমে কিছুই ছিলো না- অসৎ। এক এবং অদ্বিতীয় (অসদ্ রূপ) অভাব থেকেই ভাবের অর্থাৎ এই বিশ্ব-চরাচর সৃষ্টি। (ছান্দোগ্য-৬/২/১)।  কিন্তু সৌম্য! তা কিভাবে সম্ভব, যা কিছুই সৃষ্টি হোক বা উৎপন্ন হোক, একটা কিছুকে তো অবলম্বন করতেই হবে। সবার আগে এক এবং অদ্বিতীয় একটি অষন্ড সত্তা- সৎবস্তু ছিলো, তা থেকেই এই জগৎ। (ছান্দোগ্য-৬/২/২)।  সেই এক অদ্বিতীয় সৎ-বস্তুটি মনে মনে সঙ্কল্প করলেন- ‘আমি বহু হবো, একাধিক হয়ে জন্ম নেবো।’ সঙ্কল্প মাত্রেই তার থেকে প্রথমে উৎপন্ন হলেন- তেজ। তেজের মনেও জাগলো একই সঙ্কল্প- ‘আমি বহু হবো, একাধিক হয়ে জন্ম নেবো।’ তার সেই সৎ-সঙ্কল্প থেকে উৎপন্ন হলেন জল। তাই পুরুষ যখন শোকে কাতর হয়, বা ঘামে, তখন তার ভেতরের তেজই চোখের কোলে, গায়ে জল হয়ে বেরিয়ে আসে। (ছান্দোগ্য-৬/২/৩)।  এবার সৎ-সঙ্কল্পজাত সেই জলও সঙ্কল্প করলেন তেজের মতোই- ‘আমি বহু হবো, আমি বহু হয়ে জন্ম নেবো।’ তার সেই সঙ্কল্প থেকে উৎপন্ন হলেন অন্ন। পুত্র নিশ্চয়ই ভাবছো যে পৃথিবী নেই, অন্ন কোথা থেকে উৎপন্ন হবে। তাই বলি, জেনে রাখো, অন্নই পৃথিবী; পৃথিবীই অন্নের স্থান। তাই যেখানে যখন বৃষ্টির ধারা নেমে আসে, তখন সেখানেই উৎপন্ন হয় অন্ন। (ছান্দোগ্য-৬/২/৪)।

এই উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, প্রথমত উপনিষদকার অসৎ থেকে সৎ-বস্তুর অর্থাৎ অভাব থেকে ভাবের উৎপত্তিকে মানেননি; দ্বিতীয়ত, বাস্তব উপাদানে তেজ বা অগ্নিকে মূল উপাদান বলে মানা হয়েছে। অথচ অত্যন্ত কৌতুহলের বিষয় হলো, ইতঃপূর্বে এই উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের উনবিংশ খণ্ডেই (ছান্দোগ্য-৩/১৯/১-৩) তিনি কিন্তু উল্টোভাবে সৃষ্টির প্রথমে অভাবরূপ অসৎ-কে স্বীকার করে নিয়ে সেই অসৎ থেকে সৎ-বস্তুর উদ্ভব হয়েছে বলে আলোচনা করেছেন। যেমন- আদিত্য অর্থাৎ সূর্যই ব্রহ্ম- এটি আদেশ অর্থাৎ উপদেশ। কিভাবে? তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা এই- এই জগৎ পূর্বে অসৎ অর্থাৎ নামরূপহীন ছিলো। তা সৎ অর্থাৎ সূক্ষ্ম সত্তাবান হলো, সম্ভূত হলো এবং ডিম্বরূপে পরিণত হলো। সেই অবস্থায় এক বছর রইলো স্পন্দনহীন। তারপর সেই ডিম্ব অর্থাৎ অণ্ড দুভাগে ভাগ হলো। একভাগ হলো রজতময়। অপরভাগ হলো সুবর্ণময় (ছান্দোগ্য-৩/১৯/১)।  রজতময় অংশটি হলো এই পৃথিবী আর সুবর্ণময় অংশটি হলো দ্যৌ অর্থাৎ দ্যুলোক। জরায়ু পর্বত। গর্ভবেষ্টনী হলো মেঘ এবং নীহার অর্থাৎ হিম। ধমনী হলো নদীসমূহ আর বস্তিদেশ হলো জলময় সমুদ্র (ছান্দোগ্য-৩/১৯/২)।  এর পর উৎপন্ন হলো আদিত্য। উৎপন্ন হলো সমুদয় ভূত (বিষয়) এবং কাম্যবস্তু। তাকে ‘জায়মান’ অর্থাৎ উৎপন্ন হতে দেখে মহানন্দে উঠলো ‘উলু…উলু’ ধ্বনি। সেই থেকে সেই কারণে অর্থাৎ সমুদয় ভূত এবং কাম্যবস্তুর উৎপাদক সূর্যকে দেখে সকলে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় ‘উলু…উলু’ ধ্বনি করে (ছান্দোগ্য-৩/১৯/৩)।

বেদকে আশ্রয় করে উপনিষদীয় চিন্তাজগতের বিকাশে কোনরূপ দার্শনিক শৃঙ্খলা না থাকলেও সৃষ্টিতত্ত্ব-সংশ্লিষ্ট এই সৎ-অসৎ সত্তা বিষয়ক প্রপঞ্চটি নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিলো, যা পরবর্তীকালের দার্শনিক-ভাবনাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে, এর ব্যাখ্যার ভিন্নতায় তত্ত্বীয় স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন দার্শনিক প্রস্থানগুলির মধ্যে। তবে উপনিষদীয় চিন্তাজগতের মূল লক্ষ্যই ছিলো পরম সত্তা হিসেবে ব্রহ্মভাবনা এবং ব্রহ্মের সাথে সবকিছুকে মিলিয়ে দেয়ার অনিবার্য প্রয়াস, যা বিপুলভাবে ছড়িয়ে আছে উপনিষদগুলির পরতে পরতে, সৃষ্টি হয়েছে বিপুল উপনিষদ সাহিত্যের। এই পরম সত্তাই উপনিষদে কখনো ব্রহ্ম, কখনো আত্মা, কখনো ভগবান, কখনো কেবলমাত্র সৎ বলে অভিহিত হয়েছেন। এখানে উদাহরণ হিসেবে প্রথমকালের দুই উপনিষদের নমুনা উপস্থাপন করা হলেও অন্যান্য উপনিষদেও অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে সৃষ্টি ও ব্রহ্ম বিষয়ক বর্ণনার অভাব নেই। বেদান্ত হিসেবে পরবর্তীকালের এসব উপনিষদ থেকে বিক্ষিপ্তভাবে তাদের ভাবনাধারার কিছু নমুনা দেখা যেতে পারে।

অন্যান্য উপনিষদসমূহ

ঐতরেয় উপনিষদ (আনুমানিক ৬০০-৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব) : এই উপনিষদ ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকের একটি ভাগ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং আরণ্যকের রচয়িতা মহীদাস ঐতরেয়। এই উপনিষদের তিনটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ের তিনটি খণ্ড বা অনুচ্ছেদে ব্রহ্মের সৃষ্টিকর্মের বর্ণনা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিন জন্মের বিবরণ এবং তৃতীয় অধ্যায়ে ব্রহ্মবাদ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এই উপনিষদের ভাবধারার নমুনা- এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যখন দৃশ্যমান কিছুই ছিলো না, তখন কিন্তু ছিলো এক সত্তা সকলের অগোচরে। সেই সত্তাটি ছিলো সর্বশক্তি নিয়ে শক্তিমান- আত্মা। সৃষ্টির আগে এই চৈতন্যময় আত্মা ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছুই ছিলো না। তিনি চিন্তা করলেন- আমি লোকালোক সৃষ্টি করবো; আমি সৃষ্টি করবো জগতের পর জগৎ (ঐতরেয়-১/১/১)।  তার চিন্তা সঙ্গে সঙ্গে রূপায়িত হলো। সৃষ্টি হলো চারটি লোকের- জগতের। প্রথম অম্ভোলোক (যে লোকে জলভরা মেঘের আনাগোনা। দ্যুলোক বা স্বর্গলোকের উপর থেকে আরো উপর পর্যন্ত যার বিস্তার), তারপর মরীচিলোক  যেখানে সাত ঘোড়ায় টানা একচক্র রথে সূর্যদেবের যাতায়াত অসংখ্য কিরণ নিয়ে), তারপর মরলোক অর্থাৎ এই পৃথিবী। তার নিচের লোক অপলোক অর্থাৎ জলময় জগৎ (ঐতরেয়-১/১/২)।  তার ইচ্ছায় স্থূল জগৎগুলি তো সৃষ্টি হলো। কিন্তু এগুলিকে রক্ষা করবে, পালন করবে কে? তাই তিনি ইচ্ছা করলেন লোকপাল সৃষ্টি করতে। এবারে তিনি জল থেকে তুলে নিলেন একটি পিণ্ড। (একজন মৃৎশিল্পীর মতো) সেই পিণ্ডটিকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে দিলেন পুরুষের রূপ (ঐতরেয়-১/১/৩)।  সেই পুরুষাকৃতিকে সম্পূর্ণ সপ্রাণ করে তুলতে তার দেহে কম্পন সৃষ্টি করে তাকে তপ্ত করলেন। তপ্ত করার পর তার মুখ বিকশিত হলো। মুখ থেকে নির্গত হলো বাক্, সৃষ্টি হলো অগ্নি। প্রকাশ পেলো নাসারন্ধ্র, নাসিকা থেকে নির্গত হলো নিঃশ্বাস, নিঃশ্বাস থেকে প্রাণ, প্রাণ থেকে বায়ু। প্রকাশিত হলো দুটি চক্ষুগোলক, চক্ষু থেকে সৃষ্টি হলো দৃষ্টিশক্তি, তা থেকে আদিত্য বা সূর্য। এরপর কর্ণযুগল, তা থেকে হলো শ্রবণক্ষমতা, শ্রুতি থেকে দিশা বা দিকসকল। ত্বক উৎপন্ন হলো, ত্বক থেকে রোম, রোম থেকে ওষধি বনস্পতি। হৃদয় স্ফুরিত হলো, সৃষ্টি হলো মন, মন থেকে চন্দ্রমা। নাভির উৎপত্তি হলো, তা থেকে অপান বায়ু, অপান থেকে মৃত্যু। এরপর উৎপত্তি হলো জননেন্দ্রিয়ের, তা থেকে বীর্য, বীর্য থেকে আবার সেই জল (ঐতরেয়-১/১/৪)।  অতঃপর ঐ পুরুষের মধ্যে তিনি যুক্ত করে দিলেন ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভূতি।
সেই প্রজ্ঞাবান আত্মাই হলেন বিরাট-স্বরাট- ব্রহ্ম। ইনিই ইন্দ্র, স্রষ্টা প্রজাপতি, ইনিই দেবরাজ্যের সব দেবতা। ইনিই জগৎ-সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান- পঞ্চমহাভূত (মাটি, বায়ু, আকাশ, জল, অগ্নি বা তেজ)। ইনিই ক্ষুদ্র কীটাণুকীট, উভচর থেকে সব কিছুর উৎপত্তিস্থল- বীজ। অণ্ডজ (পাখি ইত্যাদি), জরায়ুজ (মানুষ, পশু ইত্যাদি), স্বেদজ (মশা ইত্যাদি), উদ্ভিজ্জ (গাছপালা প্রভৃতি) থেকে শুরু করে ঘোড়া, গরু, মানুষ, হাতি- যত প্রাণী, এমনকি স্থাবর-জঙ্গমের মধ্যেও ইনিই হলেন সেই প্রাণ। প্রজ্ঞার সত্তা নিয়েই বিশ্বচরাচর সত্তাবান। প্রজ্ঞাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই প্রজ্ঞাই হলো সব কিছুর মূল। জীবজগৎ, জড়জগৎ, লোকালোক- সব কিছু আশ্রয় করে আছে এই প্রজ্ঞানকেই। বিরাট এই প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম (ঐতরেয়-৩/৩)।

তৈত্তিরীয় উপনিষদ (আনুমানিক ৬০০-৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব) : এটি কৃষ্ণ-যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকেরই একটি অংশ, যা তিনটি বল্লী বা অধ্যায়ে বিভক্ত- শিক্ষা বল্লী, ব্রহ্মানন্দ বল্লী ও ভৃগু বল্লী। প্রথম শিক্ষা বল্লীতে রয়েছে এগারোটি অনুবাক বা অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ব্রহ্মানন্দ বল্লীতে নয়টি এবং তৃতীয় ভৃগু বল্লীতে দশটি অনুবাক রয়েছে। ব্রহ্ম ও সৃষ্টি সম্পর্কিত বক্তব্যে এই উপনিষদে বলা হচ্ছে- যদি কেউ মনে করে ব্রহ্ম অসৎ অর্থাৎ অস্তিত্বহীন বা নেই, তাহলে সে নিজেও অসৎ বা অস্তিত্বহীন হয়। আর যে জানে ব্রহ্ম আছেন, ব্রহ্মবস্তু আছেন, তাহলে তাকে ব্রহ্মবিদরা ব্রহ্মস্বরূপ বলে বা সত্যস্বরূপ বলে জানেন (তৈত্তিরীয়-২/৬/১)।  এই যে দৃশ্যমান জগৎ তা সর্বপ্রথমে অসৎ-ই ছিলো। সেই অসৎ থেকেই সৎ উৎপন্ন হলো। তিনি নিজেই নিজেকে এইভাবে সৃষ্টি করলেন। সেইজন্য তাকে বলা হয়েছে সুকৃত (তৈত্তিরীয়-২/৭/১)।  সৃষ্টির ভেতরে অনুপ্রবেশ করে তিনি সৎ এবং তৎ (বহু) অর্থাৎ মূর্ত, অমূর্ত বা ব্যক্ত, অব্যক্ত- এই দুইয়ের মধ্যেই থেকে গেলেন। শুধু তাই নয়, নিরুক্ত অর্থাৎ সবিশেষ, অনিরুক্ত অর্থাৎ নির্বিশেষ, নিলয় অর্থাৎ আশ্রয়, অনিলয় অর্থাৎ নিরাশ্রয়; বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান অর্থাৎ চেতন-অচেতন, সত্য-অনৃত অর্থাৎ ব্যবহারিক সত্য এবং মিথ্যা- এইভাবে যা কিছু আছে (তা যতো বিপরীতধর্মীই হোক না কেন) সত্যস্বরূপ ব্রহ্ম (পরমাত্মা) সবার ভেতর থেকে নিজেই সব হয়েছেন। ব্রহ্মই এইসব হয়েছেন বলে ব্রহ্মবিদরা ব্রহ্মকে বলেন সত্য (তৈত্তিরীয়-২/৬/৫)।  তিনি ইচ্ছা করলেন- ‘আমি বহু হবো। আমি উৎপন্ন হবো।’ তিনি তপস্যা করলেন। এই সব কিছু তিনি সৃষ্টি করলেন- যা কিছু আছে, সব। সৃষ্টি করে আবার সব কিছুর মধ্যেই থেকে গেলেন (তৈত্তিরীয়-২/৬/৪)।  সেই পরমাত্মার ইচ্ছানুসারে প্রথম হলো আকাশ। আকাশ থেকে হলো বায়ু। বায়ু থেকে অগ্নি। অগ্নি থেকে জল। জল থেকে পৃথিবী। পৃথিবী থেকে ওষধি (নানাজাতীয় গাছপালা-লতা ইত্যাদি)। ওষধি থেকে হলো অন্ন (খাদ্যবস্তু)। অন্ন থেকে রেতঃ বা বীর্য বা রক্তমস্তু। সেই রেতঃ থেকে দেহ বা শরীর (মানুষ)। এই মানুষ হলো অন্নরসময় বা অন্নরসের বিকার (তৈত্তিরীয়-২/১/৩)।

প্রশ্ন উপনিষদ (আনুমানিক ৫০০-৪০০ খ্রীষ্ঠপূর্ব) : প্রশ্ন আর উত্তরের মধ্য দিয়ে এখানে ব্রহ্মতত্ত্ব বলা হয়েছে বলে এই উপনিষদটির নাম প্রশ্নোপনিষদ। এই উপনিষদের বিষয়বস্তু হলো মহর্ষি পিপ্পলাদ-এর নিকট সুকেশা, সত্যকাম, সৌর্যায়ণী, কৌসল্য, ভার্গব, কবন্ধী নামে ছয়জন ব্রহ্মনিষ্ঠ ঋষির প্রশ্ন-উত্তর সম্বলিত ছয়টি প্রশ্ন-অধ্যায়। প্রশ্নোপনিষদের কিছু উদাহরণ- মহর্ষি পিপ্পলাদ বললেন- এ সবই প্রজাপতির তপস্যার ফল। প্রজাপতি ঈশ্বর সৃষ্টি-কামনায় তপস্যা করলেন, ‘এই জগৎ-সংসার সৃষ্টি করবো’- এইরকম প্রবল বাসনা দিয়ে তিনি একটি মিথুন সৃষ্টি করলেন। একটির নাম ‘রয়ি’, অন্যটির নাম ‘প্রাণ’। তাদের দেখে তিনি নিজে নিজেই বলে উঠলেন- ‘এই দুটি-ই বহু হবে, বহু হবে। অনেক, অনেক প্রজা এই মিথুন (যমজ) থেকেই উৎপন্ন হবে (প্রশ্নোপনিষদ-১/৪)।  প্রাণ হলো আদিত্য অর্থাৎ সূর্য। চাঁদ হলো রয়ি। বিশ্বে মূর্ত, অমূর্ত যা কিছু আছে সবই রয়ি। মূর্ত হলো প্রত্যক্ষ, রয়ি বা জড় পদার্থ মূর্তি ছাড়া নেই। একটা না একটা অবয়ব তার আছে। তবে এতো সূক্ষ্ম যে চোখে দেখা যায় না (প্রশ্নোপনিষদ-১/৫)।  পিপ্পলাদ বললেন- সত্যকাম, ওঙ্কারের উপাসনা হলো ব্রহ্মেরই উপাসনা, সে পর-ব্রহ্মই বলো, আর অপর-ব্রহ্মই বলো। ব্রহ্মর এই দুটি রূপের স্বরূপই হলো ওঙ্কার। যে তাকে যেভাবে ধ্যান করবে, সে তাকে সেইভাবেই পাবে (প্রশ্নোপনিষদ-৫/২)।  রথনাভি যেমনি নিজের দেহ থেকে চারিদিকে বেরিয়ে যাওয়া শলাকা দিয়ে রথচক্রকে ধরে আছে, পরমপুরুষও তেমনি নিজের দেহ থেকে এক-একটি শক্তিকণা দিয়ে আলাদা আলাদা করে ধরে রেখেছেন বিশ্বব্যাপী এই প্রাণচক্রকে। তাকে জানা অর্থাৎ তার স্বরূপকে জানা ছাড়া এ সংসারে জানার মতো দ্বিতীয় কিছু নেই। তাকে জানলে, মৃত্যুর সাধ্য কি ব্যথা দেয় (প্রশ্নোপনিষদ-৬/৬)।  এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেলেন মহর্ষি পিপ্পলাদ। বললেন- আমার জ্ঞান এই পর্যন্তই। সেই পরমব্রহ্মকে এর বেশি জানি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এর চেয়ে ভালোভাবে জানাও যায় না (প্রশ্নোপনিষদ-৬/৭)।

কেন উপনিষদ (আনুমানিক ৫০০-৪০০ খ্রীষ্ঠপূর্ব) : প্রশ্নময় ‘কেন’ দিয়ে শুরু হয়েছে বলে এই উপনিষদটির নাম হয়েছে কেনোপনিষদ। চার খণ্ডে বিভক্ত এ উপনিষদের প্রথম দু’খণ্ড পদ্যে রচিত, শেষ দু’খণ্ড গদ্যে। এই উপনিষদের কিছু ভাষ্য- বাক্য যাঁকে প্রকাশ করতে পারে না, বরং যাঁর প্রেরণায় বাক্য উচ্চারিত হয়, তিনিই ব্রহ্ম, তাকে জানো। জগতে যে বস্তুর স্থায়িত্ব নেই, যা শাশ্বত বা সনাতন নয়, তার উপাসনা করলে ব্রহ্মর উপাসনা করা হয় না (কেনোপনিষদ-১/৫)।  যাঁকে মন দিয়ে মনন করা যায় না, অথচ যিনি প্রাণীর মন-নামক বস্তুটিকে বিলক্ষণ জানেন, তিনিই ব্রহ্ম। তাকে জানো। সংসারে অনিত্য বস্তুকে উপাসনা করলে ব্রহ্মর উপাসনা করা হয় না (কেনোপনিষদ-১/৬)।  চোখ যাঁকে দেখতে পায় না অথচ যাঁর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে চোখ দেখার মতো বস্তুকে দেখতে পায়, সেই শক্তিই (তিনিই) ব্রহ্ম। তাকে জানো। সাধারণ চোখ দিয়ে যাকে দেখে ব্রহ্ম বলে উপাসনা করছো, তিনি ব্রহ্ম নন (কেনোপনিষদ-১/৭)।  যাঁকে আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই না অথচ আমাদের এই কর্ণ নামক ইন্দ্রিয়টিকে যিনি ভালোভাবে জানেন, তিনিই ব্রহ্ম। তাকে জানো। জাগতিক কোন বস্তুও উপাসনা করলে তার উপাসনা হয় না (কেনোপনিষদ-১/৮)।  প্রাণ যাঁর সন্ধান জানে না বা নাক যার আঘ্রাণ নিজে নিতে পারে না, যিনি আঘ্রাণ-শক্তি জোগালে তবে নাক আঘ্রাণ নিতে পারে, তিনিই ব্রহ্ম। তাকে জানো। নশ্বর বস্তুর উপাসনা করলে তাকে জানা যায় না (কেনোপনিষদ-১/৯)।  তিনি কানেরও কান, মনেরও মন, প্রাণেরও প্রাণ, চক্ষুরও চক্ষু। তাকে যিনি জেনেছেন, তিনি ধীর, জ্ঞানী। এই লোক পরিত্যাগ করে তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন (কেনোপনিষদ-১/২)।  প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই আত্মা আছেন। তারই শক্তি নিয়ে আমরা শক্তিমান- এই পরম সত্য আত্মজ্ঞানে যারা জ্ঞানী, তারাই বীর্যশালী, তারাই অমর (কেনোপনিষদ-২/৪)।

কঠ উপনিষদ (আনুমানিক ৫০০-৪০০ খ্রীষ্ঠপূর্ব) : কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় অংশে কঠ বা কাঠক নামে একটি ব্রাহ্মণ আছে। এই উপনিষদ তার অন্তর্গত বলে এর নাম হয়েছে কঠোপনিষদ। কঠ গদ্যে রচিত। ভগবদ্গীতায় কঠ-উপনিষদ থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করা হয়েছে। এই উপনিষদেই মৃত্যুর অধিপতি  যমের সঙ্গে বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণ কিশোর নচিকেতার কথোপকথনকে কেন্দ্র করে প্রসিদ্ধ আখ্যায়িকার মাধ্যমে আত্মজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৩৫ সূক্তে অনুরূপ একটি উপাখ্যান আছে।

এই উপনিষদে এমন অনেক মন্ত্র রয়েছে, যা প্রায়শই প্রবাদবাক্যের মতো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এতে দুটি অধ্যায়ের প্রতিটিতে তিনটি করে বল্লী বা অনুচ্ছেদ রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে একাত্তরটি মন্ত্র আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছাপ্পান্নটি মন্ত্রে আখ্যায়িকার আঙ্গিকে আত্ম-তত্ত্বকথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন- (যম বলছেন), সংসারী মানুষ মাত্রই পরিবার, ধন-সম্পদে আসক্ত। সংসার তাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের বুদ্ধি অপরিণত। তারা তাদের চারপাশের দৃশ্যমান জগৎকেই সত্য মনে করে। এর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সে খোঁজ তারা রাখে না। ইহলোকই আছে পরলোক বলে কিছু নেই- যে-ব্যক্তি এ কথা মনে করে সে বারবার আমার অধীন হয়। অর্থাৎ তার পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু ঘটে থাকে (কঠোপনিষদ-১/২/৬)।   ব্রহ্মকে লাভ করার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো ওঙ্কার ‘ওম্’। অপরা ব্রহ্ম (সগুণ ব্রহ্ম) এবং পরা ব্রহ্ম (নির্গুণ ব্রহ্ম) উভয়কেই এই পথে পাওয়া যায়। অপরা ব্রহ্মের সাধনার দ্বারা মানুষ ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়, ব্রহ্মের সমমর্যাদা লাভ করে। পরা ব্রহ্মের দ্বারা মানুষ ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যায় (কঠোপনিষদ-১/২/১৭)।  আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আত্মার কোন উৎপত্তি নেই, আবার আত্মা থেকেও কোন বস্তু উৎপন্ন হয় না। আত্মা জন্মরহিত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং সদা বিরাজমান। দেহের নাশ হয়, কিন্তু আত্মা অবিনাশী (কঠোপনিষদ-১/২/১৮)।  আত্মা সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর এবং বৃহতের চেয়েও বৃহত্তর। অন্তরাত্মারূপে প্রত্যেকের হৃদয়গুহাতে তিনি বিরাজ করেন। যে সব মানুষ সকল কামনা-বাসনা ত্যাগ করেছেন এবং নিজ মন ও ইন্দ্রিয় যাঁর বশে, তিনিই এই আত্মার মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন। তখন তার সকল সংশয় অতিক্রম করে যান (কঠোপনিষদ-১/২/২০)।  আত্মা নিরাকার হয়েও সাকার। সকল অনিত্য বস্তুর মধ্যে তিনিই একমাত্র নিত্য; এই আত্মা বৃহৎ এবং সর্বব্যাপী। এই আত্মার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি শোক-দুঃখকে অতিক্রম করেন (কঠোপনিষদ-১/২/২২)।  জীবাত্মাকে রথের রথী এবং শরীরকে রথ বলে জেনো; বুদ্ধিকে সারথি এবং মনকে বল্লা (লাগাম) বলে জেনো (কঠোপনিষদ-১/৩/৩)।  ইন্দ্রিয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বিষয় (রূপ, রস, ইত্যাদি); ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মন; মনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি; বুদ্ধির চেয়ে শ্রেষ্ঠ সেই মহান আত্মা (কঠোপনিষদ-১/৩/১০)।  মহান আত্মার চেয়ে শ্রেষ্ঠ অব্যক্ত; অব্যক্তের চেয়ে শ্রেষ্ঠ পরমাত্মা। পরমাত্মার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু হতে পারে না। জীবের সমস্ত বিকাশের এখানেই চূড়ান্ত পরিণতি। পরমাত্মাই মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য (কঠোপনিষদ-১/৩/১১)।  নিজ কর্ম ও জ্ঞান অনুসারে, কোন কোন জীবাত্মা পুনর্জন্মের মধ্য দিয়ে বারবার জীবদেহ প্রাপ্ত হয়। আবার কেউ কেউ বৃক্ষ লতাদি স্থাবরদেহ প্রাপ্ত হয় (কঠোপনিষদ-২/২/৭)।

মুণ্ডক উপনিষদ (আনুমানিক ৫০০-৪০০ খ্রীষ্ঠপূর্ব) : মুণ্ডক শব্দের আক্ষরিক অর্থ যিনি মুণ্ডিত। অর্থাৎ মুণ্ডিত মস্তক গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। ধারণা করা হয়, এই উপনিষদে নিজের এবং জগতের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করে ব্রহ্ম বিষয়ক তত্ত্বজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে মুণ্ডিত মস্তক তথা সন্ন্যাসীদের জন্য। অজ্ঞতা দূর করাই মুণ্ডক উপনিষদের লক্ষ্য। এই উপনিষদের বক্তা ঋষি হচ্ছেন অঙ্গিরা, আর শ্রোতা ছিলেন ঘোর সংসারী শৌনক যিনি আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে পরে ঋষি হয়ে গিয়েছিলেন।

মুণ্ডকোপনিষদের তিনটি অধ্যায় যা মুণ্ডক নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিটি মুণ্ডকে বা অধ্যায়ে দুটি করে খণ্ড বা অনুচ্ছেদ। মোট মন্ত্র চৌষট্টি, কিছু গদ্যে এবং কিছু পদ্যে রচিত। এই উপনিষদেই খুব স্পষ্টভাবে দৃষ্ট হয় যে, ব্রাহ্মণের যাজ্ঞিক কর্মকাণ্ড প্রধানত মুণ্ডকের বিরক্তি উৎপাদন করেছিলো। এইসব যজ্ঞরূপী কর্মকাণ্ড থেকে ব্রহ্মতত্ত্ব জ্ঞান লাভই যে শ্রেষ্ঠ এবং কাম্য তা-ই এ উপনিষদের বিবেচ্য। যেমন- কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চূড়ান্ত নির্বোধ। তারা মনে করেন যাগযজ্ঞ এবং (কূপ, দীঘি খনন ইত্যাদি) জনহিতকর কর্মই সর্বোত্তম। এর চেয়ে মহত্তর কিছু থাকতে পারে তা তারা জানেন না। এই সব সৎ কর্মের ফলে মৃত্যুর পর তাদের স্বর্গলাভ হয়, এবং নির্দিষ্ট কাল ব্যাপী তারা স্বর্গসুখ ভোগ করেন। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তারা আবার এই জগতে ফিরে আসেন (এবং মনুষ্যরূপে অথবা ইতর প্রাণী রূপে তাদের পুনর্জন্ম হয়) (মুণ্ডকোপনিষদ-১/২/১০)।  আনুষ্ঠানিক উপাসনার ফল যে ক্ষণস্থায়ী একথা ব্রহ্মজিজ্ঞাসু জানেন। তাই এই জাতীয় অনুষ্ঠান তাকে আকর্ষণ করে না। যা নিত্য তা অনিত্য-ক্রিয়াকর্মের দ্বারা পাওয়া যায় না, একথা তিনি জানেন। এই জন্যই তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ বেদজ্ঞ আচার্যের অনুসন্ধান করেন। নম্রতার প্রতীক হিসেবে সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে তিনি আচার্যের নিকট উপস্থিত হন (মুণ্ডকোপনিষদ-১/২/১২)।  নিজ মনন শক্তি দ্বারা ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেন। প্রথমে সৃষ্টির বীজ সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই বীজ থেকে আসে প্রাণ, প্রাণ থেকে আসে মন, সমষ্টি মন। তারপর আসে পঞ্চভূত এবং শেষে এই জগৎ। কর্ম থাকলেই তার ফল থাকবে, তাই কর্মফল অনন্ত ও অবিনাশী (মুণ্ডকোপনিষদ-১/১/৮)।  যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি সর্ববিৎ, জ্ঞানই যাঁর তপস্যা সেই পরা ব্রহ্ম থেকেই এই অপরা ব্রহ্ম (হিরণ্যগর্ভ) এবং নাম, রূপ ও অন্নাদি এসেছে (মুণ্ডকোপনিষদ-১/১/৯)।  সেই অক্ষরপুরুষ ব্রহ্মই সত্য। জ্বলন্ত অগ্নি থেকে যেমন অগ্নিময় স্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, হে সৌম্য, সেই ভাবেই ব্রহ্ম থেকে বিবিধ বস্তুর উদ্ভব হয়, এবং সেগুলি আবার ব্রহ্মেই লোপ পায় (মুণ্ডকোপনিষদ-২/১/১)।

উপসংহার

এভাবে আরো বিভিন্ন উপনিষদ থেকেও অজস্র নমুনা-উদাহরণ টানা যেতে পারে হয়তো। কিন্তু সত্য সন্ধানী হিসেবে উপনিষদীয় ঋষিরা যে পরম সত্তার উপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছেন সেগুলিতেও বর্ণনা বা উপস্থাপনার ভিন্নতা ছাড়া বিষয়গত ঐক্যে খুব একটা পার্থক্য পাওয়া যায় না। এই পরম সত্তাকে উপনিষদে কখনো ব্রহ্ম, কখনো আত্মা, কখনো ভগবান, কখনো বা সৎ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন ঋষির চৈতন্যে উপলব্ধ সত্যকে যদি এক বলেও ধরে নেওয়া হয়, তবুও তাদের উপলব্ধির বা অনুভূতির রূপ যে সব সময় এক হবে এমন কথা নেই। বস্তুতপক্ষে পরম সত্য বা তত্ত্ব যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋষির কাছে বিভিন্ন প্রকারে ধরা দিয়েছে, তা প্রমাণিত হয় বিভিন্ন উপনিষদের বিভিন্ন উক্তি থেকে। মূলত, উপনিষদগুলিতে দার্শনিক তত্ত্বাবলী আলোচিত হলেও সে-আলোচনা বহুলাংশেই বিক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট। তাছাড়া এ-আলোচনা যুক্তিতর্কমূলক সুসংবদ্ধ দার্শনিক আলোচনা নয় এবং নানা উপনিষদে নানা রকম আলোচনার মধ্যে ঠিক কোন্ তত্ত্বকে প্রকৃত উপনিষদ-প্রতিপাদ্য তত্ত্ব বলা হবে সে-কথা নির্ণয় করাও সহজ নয়। পরমাত্মা বা পরমব্রহ্মই যদিও সাধারণভাবে উপনিষদের প্রতিপাদ্য বিষয়, তবুও বিভিন্ন উপনিষদে একধরনের সপ্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদ, নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদ, ব্রহ্মপরিণামবাদ, ব্রহ্মবিবর্তবাদ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের উন্মেষ ও পরিচয় পাওয়া যায় এবং ব্রহ্ম, জীব ও জগতের পারস্পরিক সম্বন্ধ, এমনকি জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হিসেবে মোক্ষের স্বরূপ ও উপায় নিয়েও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত লক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে উপলব্ধ সত্য সম্পর্কে সৃষ্ট উপনিষদীয় ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের ভিন্নতার কারণে উদ্ভূত বিরোধ উপনিষদীয় সত্য সম্পর্কে সন্দেহের পাশাপাশি তৎকালীন ভারতীয়দের মনে ব্রাহ্মণের কর্মকাণ্ডই নয়, উপনিষদীয় অধ্যাত্ম-দর্শনের প্রভাবকেও স্পষ্টতই দুর্বল করে দিয়েছিলো। এসব দুর্বলতার পাশাপাশি যুক্তির উপর গড়ে ওঠা অন্যান্য ভিন্নমতবাদীদের তীক্ষ্ণ তর্কের আঘাতে উপনিষদীয় দর্শন পরাস্ত হবার উপক্রম হয়। ফলে, কালক্রমে বিভিন্ন উপনিষদে প্রকাশিত বিভিন্ন তত্ত্বের এই বিরোধ যে আপাত এবং বিভিন্ন উপনিষদের মধ্যে যে একটি মূলগত ঐক্য আছে, তা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এরই ফলস্বরূপ কিছু যুক্তিনির্ভর অধ্যাত্ম-দর্শন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। ন্যায়, বৈশেষিক, যোগ এবং সাংখ্য দর্শনের মাধ্যমে তারা তাদের সাধ্যমতো যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাও যথেষ্ট ছিলো না। বৈদিক জ্ঞান ও কর্মকাণ্ড থেকে উত্থিত বিরোধ ও শঙ্কার উত্তর তারা দিতে না পারলে যে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অসারতাই প্রমাণ হয়ে যায়। বেদান্ত-সম্প্রদায়ের প্রধানতম প্রচেষ্টাই হলো উপনিষদ-প্রতিপাদ্য তত্ত্বেও দার্শনিক ব্যাখ্যা ও সমর্থন। স্বভাবতই, উপনিষদের অনুগামী পরবর্তী দার্শনিকেরা উপনিষদ-প্রতিপাদ্য মূল দার্শনিক তত্ত্বকে সনাক্ত করবার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন এবং এই তত্ত্বের সুসংবদ্ধ দার্শনিক ব্যাখ্যা দিতে চাইলেন। ফলে তাদের স্বধর্মকে রক্ষা করার তাগিদে উপনিষদগুলির মধ্যে নিহিত চিন্তাগুলিকে সুশৃঙ্খলভাবে সংবদ্ধ করার প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন মহর্ষি বাদরায়ণ তার ব্রহ্মবাদী সূত্রগ্রন্থ ‘ব্রহ্মসূত্র’ নিয়ে। এই ব্রহ্মসূত্রই বেদান্ত দর্শনের সূত্রগ্রন্থ এবং তা বেদান্তসূত্র নামেও পরিচিত।

বেদান্তের এই ক্রমবিকাশে ব্রহ্ম-সূত্র বা বেদান্ত-সূত্রের সংকলক বাদরায়ণই যে শুধু উপনিষদের দার্শনিক চিন্তাকে সংবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন তা নয়। এই ব্রহ্মসূত্রেই দেখতে পাওয়া যায় যে, তখন বেদান্তের আরও বহু শাখা এবং সেই সব মতবাদের বহু অনুগামীও ছিলেন। ঔডুলোমি, কাশকৃৎস্ন, বাদরি, জৈমিনি, কার্ষ্ণাজিনি, আষ্মরথ্য প্রমুখ আরও বহু নামের উল্লেখ ব্রহ্মসূত্রেই পাওয়া যায়। তবে এ বিষয়ে বাদরায়ণের সূত্র সংকলনকেই সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। কেননা ব্রহ্মসূত্রকে বাদ দিয়ে ব্রহ্মবাদী মতবাদ ব্রহ্মবাদ প্রতিষ্ঠার কথা অচিন্ত্যনীয়ই বলা যায়।

বাদরায়নের ব্রহ্মসূত্র

মহর্ষি বাদরায়ণের ‘ব্রহ্মসূত্র’ ব্রহ্মবাদ বা বেদান্ত-দর্শনের সূত্রগ্রন্থ বলে এটিকে ‘বেদান্তসূত্র’ নামেও অভিহিত করা হয়। এতে জগৎ ও ব্রহ্মকে দেহ এবং দেহধারী অর্থাৎ শারীরকের ভিত্তিতে বর্ণনা করা হয়েছে বলে এটিকে  ‘শারীরকসূত্র’ও বলা হয়। এছাড়া ‘বাদরায়ণসূত্র’, ‘শারীরক-মীমাংসা’, ‘উত্তরমীমাংসা’, ‘ব্রহ্মমীমাংসা’ প্রভৃতি নামেও তা পরিচিত।

ব্রহ্মসূত্রের সুত্রকার বাদরায়ণের সময়কাল সম্পর্কে তেমন স্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। পৌরাণিক পরম্পরা মতে মহর্ষি বাদরায়ণ ও মহাভারতের গ্রন্থকার মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকে একই ব্যক্তি বলে মনে করা হয় এবং এও মনে করা হয় যে তিনি পাঁচ হাজার বছরেরও পূর্বের অর্থাৎ মহাভারতের যুগের ব্যক্তি। তাছাড়া হিমালয়ের অন্তর্গত বদরি নামক স্থানে বেদব্যাসের আশ্রম ছিলো বলেও তাকে বাদরায়ণ বলা হতো। কিন্তু আচার্য শঙ্কর তার ভাষ্যগ্রন্থে ব্যাসকে মহাভারতের এবং বাদরায়ণকে ব্রহ্মসূত্রের রচয়িতা বা গ্রন্থকার বলে উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত তার মতে এই দুই ব্যক্তি ভিন্ন। আবার শঙ্করের অনুগামী বাচস্পতি, আনন্দগিরি এবং আরও অনেকে ব্যাস এবং বাদরায়ণকে একই ব্যক্তি বলেই মনে করেন। অন্যদিকে রামানুজ এবং অন্যান্য ভাষ্যকারগণ ব্রহ্মসূত্রকে ব্যাসদেবেরই রচনা বলে উল্লেখ করেছেন।

তবে এই দুই ব্যক্তি যে এক নয় তা স্বয়ং ব্রহ্মসূত্রকারের সূত্রেই প্রমাণ পাওয়া যায় বলে রাহুল সাংকৃত্যায়ন উল্লেখ করেন। কেননা এই ব্রহ্মসূত্রে শুধু বৌদ্ধদর্শনেরই নয়, বুদ্ধের মৃত্যুর ছয়-সাত শতাব্দি পরবর্তীকালের বৌদ্ধদার্শনিক সম্প্রদায় যেমন বৈভাষিক, যোগাচার, মাধ্যমিক মতসমূহের খণ্ডন রয়েছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে-
‘প্লেটোর দর্শনে প্রভাবিত হয়ে বৌদ্ধগণ তাদের বিজ্ঞানবাদের বিকাশ নাগার্জুনের আগেই করেছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাতে পরিপূর্ণতা এনেছিলেন পেশাওয়ারের পাঠান ভ্রাতৃদ্বয় অসঙ্গ এবং বসুবন্ধু (৩৫০ খ্রীস্টাব্দ)। যদিও সূত্রে যেভাবে বিজ্ঞানবাদের (= যোগাচারের) খণ্ডন করা হয়েছে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ হয় যে, বেদান্তসূত্র হয়ত সত্যিই অসঙ্গের পরবর্তী যুগে রচিত হয়নি, তথাপি আরও সুনিশ্চিত প্রমাণের অভাবে আমরা এইটুকুই বলতে পারি যে, বাদরায়ণ, কণাদ, নাগার্জুন; যোগসূত্রকার পতঞ্জলির পরবর্তী এবং জৈমিনির সমসাময়িক ছিলেন। এটা মনে রাখা দরকার যে ৩৫০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার দর্শন-সমালোচক বৌদ্ধদার্শনিকগণের গ্রন্থে এমন কথা জানা যায় না যে, তাদের যুগে বেদান্তসূত্র বা মীমাংসাসূত্র ছিল।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-১৭৩)।

ব্রহ্মসূত্রে চারটি অধ্যায়- সমন্বয়, অবিরোধ, সাধন ও ফল। প্রতিটি অধ্যায়ে আবার চারটি করে পাদ রয়েছে, যার মোট সূত্রসংখ্যা পাঁচশ পঞ্চান্নটি (৫৫৫)। প্রথম অধ্যায়ে বিভিন্ন উপনিষদের বাক্যসমূহে প্রকাশিত অর্থের সমন্বয়সাধন করে এক অদ্বিতীয়, নির্গুণ, নির্বিশেষ ব্রহ্মের স্বরূপ ও ব্রহ্মের সঙ্গে জগৎ ও জীবের সম্বন্ধ প্রতিপাদন করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিরোধী মত খণ্ডনপূর্বক ব্রহ্মের প্রাতিভাসিক, ব্যবহারিক ও পারমার্থিক সত্তার মধ্যে যে কোনো বিরোধ নেই এবং তারা যে এক অবিরোধী সত্তাকেই নির্দেশ করে, তা প্রতিপাদন করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায় (উপাসনা, সাধন ইত্যাদি) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর চতুর্থ অধ্যায়ে ব্রহ্মবিদ্যার ফলস্বরূপ ব্রহ্মপ্রাপ্তি বা মোক্ষের স্বরূপ আলোচনা করা হয়েছে।

ব্রহ্মসূত্রের সূত্রগুলি অতি সংক্ষিপ্ত, অনেক সময় পূর্ণাঙ্গ বাক্যও নয়। এক একটি সূত্রে দুটি বা তিনটি শব্দ আছে। স্বাভাবিকভাবেই সূত্রগুলি অতি দুর্বোধ্য। শব্দগুলি অনেক ক্ষেত্রেই দ্ব্যর্থক ও কোন কোন ক্ষেত্রে অনেকার্থক। তাই শুধুমাত্র এই সূত্রগ্রন্থটি পাঠ করে প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা একান্তই কঠিন।  সুতরাং কালক্রমে সূত্রকে ব্যাখ্যা করবার জন্য রচিত হয়েছে নানা ভাষ্যগ্রস্থ। বেদান্তমত ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে রচিত ভাষ্যগ্রন্থগুলির মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো শঙ্করাচার্যের ‘শারীরকভাষ্য’। শঙ্করাচার্য ছাড়াও ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনায় শঙ্করের পরবর্তীকালে যাদব প্রকাশ, ভাস্কর, বিজ্ঞানভিক্ষু, রামানুজ, নীলকণ্ঠ, শ্রীপতি, নিম্বার্ক, মধ্ব, বল্লভ এবং বলদেব প্রমুখ অনেকেই আবির্ভূত হন। সূত্রের ভাষ্যকাররা সূত্রগুলির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নানান ভাষ্যগ্রন্থে নিজ নিজ বদ্ধমূল ধারণার বশবর্তী হয়ে এতাটাই বৈচিত্র্যের স্বাধীনতা পেয়েছিলেন যে, এই ব্যাখ্যার ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে বেদান্ত দর্শনে নানান উপসম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। তাদের সকলেই প্রমাণ করতে সচেষ্ট যে, তাদেরই মতবাদ বাদরায়ণ তার সূত্রের মাধ্যমে প্রচার করেছিলেন। এই উপসম্প্রদায়গুলির মধ্যে আচার্য শঙ্করের ‘অদ্বৈতবাদ’, রামানুজের ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’, মধ্বের ‘দ্বৈতবাদ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বেদান্তের অন্যান্য উপসম্প্রদায়গুলির মধ্যে নিম্বার্কের ‘ভেদাভেদবাদ’, বল্লভাচার্যের ‘শুদ্ধাদ্বৈতবাদ’, ভাস্করের ‘ঔপাধিক ভেদাভেদবাদ’, শ্রীকণ্ঠের ‘বিশিষ্টশিবাদ্বৈতবাদ’, বলদেব বিদ্যাভূষণের ‘অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ’ উল্লেখযোগ্য। যেহেতু বাদরায়ণ তার নিজস্ব কোন মত প্রকাশের ব্যাপারে বহুক্ষেত্রেই নিরব, এমনকি কোন মৌলিক প্রশ্নের ক্ষেত্রেও নিরব, কেবল বিভিন্ন বেদান্তবাদীর মত মাত্র উপস্থাপন করেই আলোচনা শেষ করেছেন, তাই বাদরায়ণ তার সূত্রে যে-সকল প্রাচীন বৈদান্তিক মতবাদসমূহের উল্লেখ করেছেন, সূত্রভাষ্যকারদের উপসম্প্রদায়ভিত্তিক মতবাদগুলিও বাদরায়ণোক্ত কোন না কোন শাখার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে অনুমিত হয়।

এখানে উল্লেখ্য, সূত্রকার বাদরায়ণ যেখানে যেখানে বেদান্ত-বহির্ভূত মতবাদকে আক্রমণ করেছেন, সে-সকল ক্ষেত্রে সূত্রভাষ্যকাররাও অল্প বিস্তর একই মত প্রকাশ করেন। এছাড়া, ব্রহ্মই এ বিশ্বের কারণ, ব্রহ্মজ্ঞান হতেই জীবের পরম কাম্য মোক্ষ লাভ হয়; একমাত্র শাস্ত্রের মাধ্যমেই ব্রহ্মকে জানা সম্ভব, শুধু তর্কের দ্বারা নয়- এ সকল বিষয়ে সকল ভাষ্যকারই ঐকমত্য পোষণ করেন। কিন্তু ব্রহ্মের স্বরূপ, জগতের সঙ্গে ব্রহ্মের কার্যকারণ সম্বন্ধ, জীবাত্মার সঙ্গে ব্রহ্মের সম্পর্ক, এবং মুক্ত অবস্থায় আত্মার স্বরূপ কী ইত্যাদি বিষয়ে ভাষ্যকারদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ রয়েছে।

আচার্য শঙ্করের মতে ব্রহ্ম নির্গুণ, শাশ্বত, শুদ্ধ-চৈতন্য স্বরূপ। অদ্বৈতবেদান্ত মতে নির্গুণ ব্রহ্মই একমাত্র বা অদ্বিতীয় সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব এবং ব্রহ্ম অভিন্ন। অজ্ঞানবশে আমরা পরিদৃশ্যমান জগৎ এবং নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তাকে সত্য বলে মনে করি, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানের উদ্ভব হলে বোঝা যাবে চিৎস্বরূপ আমি একমাত্র সত্য। তারই নাম ব্রহ্ম। এই ব্রহ্ম নির্গুণ। ব্রহ্ম ছাড়া দ্বিতীয় কিছুর কল্পনা অজ্ঞানের পরিণাম। এই অজ্ঞানের নামান্তর মায়া; তাই অদ্বৈতবাদকে মায়াবাদ বলেও উল্লেখ করা হয়। শঙ্করের মতে ঈশ্বর হলেন মায়া সৃষ্ট নির্গুণ ব্রহ্মের জীবাত্মার বুদ্ধিগ্রাহ্য সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ। জগৎ হলো নির্গুণ ব্রহ্মেরই মায়াসৃষ্ট বিবর্ত- যার কোন বাস্তব সত্তা নেই। প্রকৃতপক্ষে জীব হলো সর্বব্যাপী এবং ব্রহ্ম হতে অভিন্ন। যদিও অন্তরেন্দ্রিয় দ্বারা উপাধি বিশিষ্ট হয়ে সে নিজেকে অণু, কর্তা এবং ঈশ্বরের অংশ বলে মনে করে। নির্গুণ ব্রহ্মকে যাঁরা জানেন তারা প্রত্যক্ষভাবেই তাকে লাভ করেন, তাদের ‘দেবযানের’ মাধ্যমে যেতে হয় না। যাঁরা সগুণ ব্রহ্মকে জানেন তাদেরই দেবযানের মাধ্যমে ব্রহ্মলোকে যেতে হয়। ব্রহ্মলোক হতে তাদের আর প্রত্যাবর্তন করতে হয় না- কল্পান্তে তারা ব্রহ্মেই লীন হন। জ্ঞানই হলো মোক্ষলাভের একমাত্র উপায়।

অন্যদিকে, রামানুজ এবং অন্যান্য ভাষ্যকারদের মতানুসারেও যদিও ব্রহ্মই চূড়ান্ত সত্য, তবুও ব্রহ্মকে নির্গুণ আখ্যা দেয়া ভুল, বরং তাকে অনন্ত কল্যাণ-গুণসম্পন্ন সাকার ঈশ্বর মনে করতে হবে। তারা মনে করেন, যদিও মানুষের ব্যক্তিত্ব সসীমরূপেই অনুভূত হয়, তবুও শঙ্করের মতানুযায়ী এটিকে যদি অবিকলভাবে ঈশ্বরের ব্যক্তিত্বে আরোপ না করা হয়, তবে আর তার অসীমত্বে আপত্তি আসে না। তারা শঙ্করের মায়াবাদকে স্বীকার করেন না। কারণ তাদের মতে জগৎ সত্য এজন্য যে, জগৎ ব্রহ্ম হতেই উৎপন্ন হয়েছে।

বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত মতে ব্রহ্মই ঈশ্বর; উপাসনাদি সৎকর্মের সাহায্যে তার করুণার উদ্রেক করতে পারলেই জীবের মুক্তি। পরিদৃশ্যমান জড়জগৎ এবং জীবাত্মার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য মিথ্যা নয়। কেননা, ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের মধ্যেই চিৎ এবং অচিৎ- অর্থাৎ চেতনা এবং জড়- উভয় বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। চিৎ বৈশিষ্ট্য থেকেই জীবাত্মার সৃষ্টি এবং অচিৎ থেকে জড়জগতের। ব্রহ্ম চিৎ-অচিৎ বিশিষ্ট। জীবাত্মার সঙ্গে জড়দেহের সম্পর্কই বন্ধনের স্বরূপ এবং তার মূলে আছে জন্মজন্মান্তরের কৃতকর্মজনিত অজ্ঞান। ঈশ্বরের করুণায় জীবাত্মা এই অজ্ঞান কাটিয়ে মুক্তিলাভ করবে।

তবে মধ্বাচার্য কিন্তু ব্রহ্মকে জগতের নিমিত্ত-কারণ মাত্র বলেই গ্রহণ করেন, উপাদান-কারণ হিসেবে নয়। তাদের মতে জীব বাস্তবিকই অণু, কর্তা এবং ঈশ্বরেরই অংশ বিশেষ। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ দেবযানের পথে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মে লীন হন এবং আর মর্ত্যলোকে প্রত্যাবর্তন করেন না। তারা শঙ্করের মতো জ্ঞানকে উচ্চ বা নিম্ন বলে পার্থক্য করেন না। তাদের মতে জ্ঞান নয়, ভক্তিই মুক্তিলাভের প্রধান উপায়।

এভাবে তাদের সবার কাছে ব্রহ্ম, জগৎ এবং জীব সব কিছুই সত্য। তবে রামানুজ এ তিনটিকে একই অঙ্গবিশিষ্ট বলে মনে করেন, কেননা তাদের মতে জগৎ এবং জীব ব্রহ্মেরই দেহ। আবার ভেদাভেদবাদের মতানুসারে নিম্বার্কাচার্য ভেদ এবং অভেদ এই উভয় কল্পনা করে ব্রহ্ম, জগৎ এবং জীব এই তিনটিকে ব্রহ্মের সঙ্গে একীভূত করে বলেছেন যে, চেতন এবং অচেতন জগৎ ব্রহ্ম হতে ভিন্নও বটে অভিন্নও বটে। আর কট্টর দ্বৈতবাদী মধ্বাচার্য এ তিনটিকে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং নিত্য বলে মনে করেন, তবে তার মতে ব্রহ্মই হলেন অপর দুটির নিয়ন্তা। বল্লভাচার্যের মতে জীব এবং জগৎ ব্রহ্মেরই অভিন্ন স্বরূপ। তারা সকলেই সত্য- ব্রহ্ম হতে তারা অভিন্ন, তবে ব্রহ্ম হলেন পূর্ণ, আর অপর দুটি হলো তার অংশ।

বেদ থেকে শুরু করে বেদান্ত দর্শন পর্যন্ত চলে আসা বিবর্তিত চিন্তাধারার এই যে ক্রমবিকাশ, তার পর্যালোচনা করলে বেদান্ত চিন্তাধারার তিনটি স্তর বা ধাপ লক্ষ্য করা যায়। বেদ ও উপনিষদ হলো বেদান্ত চিন্তাধারার প্রথম স্তর, ব্রহ্মসূত্র বেদান্ত চিন্তাধারার দ্বিতীয় স্তর এবং বিভিন্ন ভাষ্যগ্রন্থ বেদান্ত চিন্তাধারার তৃতীয় স্তর। বলা বাহুল্য, এই তিনটি স্তর কোন বিচ্ছিন্ন চিন্তার প্রতিফলন নয়, বরং বিভিন্ন স্তরে একই চিন্তাধারারই পরিণতির প্রতিফলন ঘটেছে। এগুলিই মূলত বেদান্ত-দর্শনের উৎসমুখ।

এ প্রসঙ্গে একথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্র (ভাষ্যসহ) ছাড়াও বেদান্ত দর্শনের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসমুখ রয়েছে, সেটি হলো- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। অর্জুনের উদ্দেশ্যে জীব, জগৎ ও পরমাত্মা বিষয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত জ্ঞান-বাণীর সংকলনই ভগবদ্গীতা। ভগবদ্গীতাই বেদান্ত চিন্তাধারার চরম ও পরম পর্যায় বলে মনে করা হয়। তাই বলা হয়ে থাকে, উপনিষদ হলো বেদান্ততত্ত্বের ‘শ্রুতিপ্রস্থান’, ব্রহ্মসূত্র বেদান্ততত্ত্বের ‘ন্যায়প্রস্থান’ এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বেদান্ততত্ত্বের ‘স্মৃতিপ্রস্থান’। এই তিন শাস্ত্রকে একসাথে বলা হয় ‘প্রস্থান-ত্রয়ী’। এই প্রস্থানত্রয়কে সাধনকর্মে যথাক্রমে শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের নির্দেশক বলে আখ্যায়িত করা হয়।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা

বলা হয়, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী। এটি মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে সংক্ষেপে ভগবদ্গীতা বা শ্রীগীতা বা আরো সংক্ষেপে গীতা বলা হয়। ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গনে কৌরবসৈন্য ও পাণ্ডবসৈন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধার্থে সজ্জিত হলে, যুদ্ধে প্রতিপক্ষে অবস্থানকারী আত্মীয়বর্গকে হত্যা করতে হবে ভেবে অন্যতম পাণ্ডব সেনাধ্যক্ষ ধনুর্ধর অর্জুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আত্মীয়হত্যা অসঙ্গত বিবেচনা করে ক্ষণিক বৈরাগ্যের মোহাক্রান্ত অর্জুন যুদ্ধে নিবৃত্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার রথের সারথিরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে বিশদ তত্ত্বসমৃদ্ধ উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে অর্জুনের মোহ দূর করে স্বকর্মে প্রবৃত্ত করেছিলেন, মুখ্যত তা-ই ভগবদ্গীতা।

গীতার গুরুত্ব বোঝাতে গীতামাহাত্ম্যে বলা হয়েছে- ‘সমস্ত উপনিষদ গাভী, শ্রীকৃষ্ণ দোহনকর্তা, অর্জুন বৎস ও সুধীগণ ভোক্তা, গীতামৃত উপাদেয় দুগ্ধ।’

এদ্বারা এটাই প্রতিপন্ন করা হচ্ছে যে, ভগবদ্গীতা উপনিষদের সারগ্রন্থ মাত্র। এছাড়াও ভাগবতের বরাহপুরাণোক্ত দীর্ঘ গীতামাহাত্ম্যের একটি শ্লোকে ভগবান বিষ্ণুর উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে- ‘আমি গীতার আশ্রয়ে অবস্থান করি এবং গীতা আমার উত্তম গৃহ। গীতাজ্ঞান আশ্রয় করে আমি ত্রিলোক পালন করি।’

গীতার এ গুরুত্ব বিবেচনা করেই বেদান্তশাস্ত্রে গীতাকে প্রাচীন বারোটি উপনিষদের সমশ্রেণীর কাতারে ত্রয়োদশ উপনিষদ বলেও গণ্য করা হয়। বেদের মতো গীতা সব সম্প্রদায়েরই মান্য। এজন্যেই পরবর্তীকালের শঙ্করাচার্য, রামানুজ, শ্রীধরস্বামী, মাধবাচার্য, বলদেব প্রমুখ শ্রেষ্ঠ আচার্যরা সকলেই গীতার জ্ঞানকে শিরোধার্য করেছেন। তারা নিজ নিজ উপসম্প্রদায়ের মতের পরিপোষণের জন্য ভগবদ্গীতার টীকাভাষ্যও রচনা করেছেন। এর মধ্যে শাঙ্করভাষ্য এবং শ্রীধরস্বামীর টীকাই সমধিক প্রসিদ্ধ। তবে শঙ্করাচার্যের শাঙ্করভাষ্যকে পরিপূর্ণ উপনিষদানুসারী বলে বিবেচনা করা হয়।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আঠারটি যোগ বা অধ্যায়ে মোট ৭০০ শ্লোক রয়েছে। গীতার অধ্যায়সমূহ যথাক্রমে- (১) অর্জুন বিষাদযোগ, (২) সাংখ্যযোগ, (৩) কর্মযোগ, (৪) জ্ঞানযোগ, (৫) সন্ন্যাসযোগ, (৬) ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ, (৭) জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ, (৮) অক্ষর-ব্রহ্মযোগ, (৯) রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগ, (১০) বিভূতিযোগ, (১১) বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ, (১২) ভক্তিযোগ, (১৩) ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ, (১৪) গুণত্রয়-বিভাগযোগ, (১৫) পুরুষোত্তমযোগ, (১৬) দৈবাসুরসম্পদ-বিভাগযোগ, (১৭) শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগযোগ, (১৮) মোক্ষযোগ।

এই আঠারটি অধ্যায়ের মোট ৭০০ শ্লোকের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের উদ্ধৃতিতে ১টি, সঞ্জয়ের উদ্ধৃতিতে ৪০টি, অর্জুনের উদ্ধৃতিতে ৮৫টি এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্ধৃতিতে ৫৭৪টি শ্লোক রয়েছে। এসব শ্লোকের মাধ্যমে মূলত অর্জুনের জিজ্ঞাসু মনের সশ্রদ্ধ প্রশ্ন ও তার প্রেক্ষিতে যথাযোগ্য উত্তর দিতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ভক্তি, প্রেম, আত্মা, জ্ঞান, সকাম-কর্ম, নিষ্কাম-কর্ম, সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্ম প্রভৃতি সম্পর্কিত যাবতীয় দর্শন ও তত্ত্বজ্ঞান উপস্থাপন ও তার বিশ্লেষণ করে অর্জুনের সকল কৌতুহল ও জ্ঞানতৃষ্ণা নিবৃত্ত করেন। এজন্যেই গীতাকে পরম ভক্তি সহকারে সকল শাস্ত্রের সার বলা হয়।

জীবের চূড়ান্ত লক্ষ্য মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে গীতা কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়ে সম্পূর্ণ সাধনতত্ত্ব প্রচার করে।  কর্মের সাথে জ্ঞানের এবং জ্ঞানের সাথে ভক্তির সংযোগে সাধনা সম্পূর্ণতা লাভ করে। তবে কর্মযোগই গীতার মুখ্য আলোচ্য বিষয়। কিন্তু এই কর্ম হবে নিষ্কাম কর্ম, অর্থাৎ ফলের আশা না করে কর্ম করে যাওয়া। যেমন- কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়। অতএব কর্ম করো। সুতরাং কর্মফল-প্রাপ্তির হেতু হয়ো না। আবার কর্মত্যাগেও তোমার প্রবৃত্তি না হোক (গীতা-২/৪৭)।

কিন্তু কেন এই কর্মফল-প্রাপ্তির হেতু না হয়ে অর্থাৎ কাম্য-কর্ম বাদ দিয়ে কেবল নিষ্কাম কর্ম করে যাওয়া? শ্রীকৃষ্ণ বলছেন- হে ধনঞ্জয়, কাম্য-কর্ম নিষ্কাম-কর্ম অপেক্ষা নিতান্ত নিকৃষ্ট। অতএব তুমি কামনাশূন্য হয়ে সমত্ব বুদ্ধির (সম্যক জ্ঞানের) আশ্রয় গ্রহণ করো। যারা ফলাকাঙ্ক্ষী হয়ে কর্ম করে তারা অতি হীন (গীতা-২/৪৯)।  নিষ্কাম কর্মযোগী মনীষিগণ কর্মজাত ফল ত্যাগ করে জন্মরূপ বন্ধন হতে মুক্ত হন এবং সর্বপ্রকার উপদ্রবরহিত (পাপ ও পুণ্য উভয় হতে মুক্ত হয়ে) ব্রহ্মপদ লাভ করেন (গীতা-২/৫১)।

গীতার মতে ফলাসক্তি ও কর্তৃত্বাভিমান বন্ধনের কারণ। আসক্তি ও অহংবুদ্ধি ত্যাগ করে ফলাফলে উদাসীন হয়ে কর্ম সম্পাদনে বন্ধন হয় না। অর্থাৎ সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ করে ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন ও অহংবুদ্ধি বা কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করাই নিষ্কার্ম কর্মের লক্ষণ। কিন্তু আত্মজ্ঞান ব্যতীত এই আসক্তি ও কর্তৃত্বাভিমান দূর হয় না। তাই শ্রীকৃষ্ণ বলেন- যখন তোমার বুদ্ধি (জ্ঞান) মোহাত্মক অবিবেকরূপ কলুষ অতিক্রম করবে, তখন তুমি শ্রোতব্য ও শ্রুত কর্মফল বিষয়ে বৈরাগ্যলাভ করবে (নিষ্পৃহ হবে) (গীতা-২/৫২)।  নানা কর্মফল শ্রবণে বিক্ষিপ্ত তোমার চিত্ত যখন পরমাত্মাতে স্থির ও অচল হবে, তখন তুমি তত্ত্বজ্ঞান লাভ করবে (গীতা-২/৫৩)।

অতএব কর্মযোগ সিদ্ধিলাভের জন্য জ্ঞানলাভের দরকার। আত্মজ্ঞান লাভ হলে ভগবানে পরমভক্তি জন্মায়। এর মাধ্যমেই সমত্ব-বুদ্ধি বা সম্যক-জ্ঞান জন্মায়। এই সমত্ব বুদ্ধিকেই বলা হয় স্থিতপ্রজ্ঞা। গীতায় এই স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি সম্পর্কে শ্রীভগবান বলেন- হে পার্থ, বাহ্যলাভে নিরপেক্ষ ও পরমার্থদর্শনে প্রত্যগাত্মাতেই পরিতৃপ্ত হয়ে যখন যোগী সমস্ত মনোগত বাসনা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন, তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলে উক্ত হন (গীতা-২/৫৫)।  দুঃখে উদ্বেগহীন, সুখে নিঃস্পৃহ এবং আসক্তিশূন্য ভয়মুক্ত ও ক্রোধরহিত মুনিই স্থিতপ্রজ্ঞ বলে উক্ত হন (গীতা-২/৫৬)।

এখানে প্রশ্ন আসে, কর্মযোগ অপেক্ষা সমত্ব-বুদ্ধি বা সম্যক-জ্ঞানই যদি শ্রেষ্ঠ হয় তাহলে সব কামনা বর্জন করে সাম্যবুদ্ধি বা সম্যকজ্ঞান লাভ করলেই তো জীবের মোক্ষ লাভ হয়, কর্মের আবশ্যকতা কী? তাই অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে জনার্দন, যদি আপনার মতে কর্ম অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেষ্ঠ হয়, তবে আমাকে এই হিংসাত্মক (যুদ্ধ) কর্মে নিযুক্ত করছেন কেন? (গীতা-৩/১)

বলাবাহুল্য, গীতায় কর্মকেই সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এমনকি ইহলোকে মোক্ষলাভের যে দুটি মার্গ রয়েছে- সন্ন্যাস মার্গ ও কর্মযোগ মার্গ, সেখানেও কর্মযোগকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিপাদন করা হয়েছে। কেননা, সন্ন্যাস মার্গে যে মোক্ষ লাভ হয় তা জ্ঞানের ফলে, কর্ম ত্যাগের জন্য নয়। যেমন গীতার সন্ন্যাসযোগে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- সন্ন্যাস বা কর্মের ত্যাগ ও কর্মের অনুষ্ঠান উভয়ই মুক্তিমার্গ; কিন্তু তাদের মধ্যে জ্ঞানহীন কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান উৎকৃষ্টতর (গীতা-৫/২)।  হে মহাবাহো, নিষ্কাম কর্মযোগ ব্যতীত জ্ঞানযুক্ত পরমার্থ সন্ন্যাস লাভ করা অসম্ভব। নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হলেই নিষ্ঠ ব্যক্তি সন্ন্যাসী হয়ে অচিরে পরব্রহ্ম প্রাপ্ত হন (গীতা-৫/৬)।

এছাড়াও জ্ঞান ও কর্মের পরস্পর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বোঝাতে গীতায় জ্ঞানযোগে বলা হয়েছে যে- জ্ঞানের তুল্য পবিত্র বস্তু ইহজগতে নেই। দীর্ঘকাল প্রযত্ন দ্বারা কর্মযোগে চিত্ত শুদ্ধ হলেই মুমুক্ষু ব্যক্তি সেই আত্মজ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান) লাভ করেন (গীতা-৪/৩৮)।

তাই কর্ম নাকি জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন- হে অনঘ অর্জুন, ইহলোকে জ্ঞানাধিকারিগণের জন্য জ্ঞানযোগ এবং নিষ্কাম কর্মিগণের জন্য কর্মযোগ- এই দুই প্রকার নিষ্ঠার বিষয় সৃষ্টির প্রারম্ভে আমি বেদমুখে বলেছি (গীতা-৩/৩)।  কর্মানুষ্ঠান না করে কেউ নৈষ্কর্ম্য বা মোক্ষ লাভ করতে পারে না। আবার কর্মযোগে চিত্তশুদ্ধি ও আত্মবিবেক না হলে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি হয় না। কেবলমাত্র জ্ঞানশূন্য কর্মত্যাগ দ্বারা এ অবস্থালাভ অসম্ভব (গীতা-৩/৪)।  কর্ম না করে কেউই ক্ষণকালও থাকতে পারে না। অ-স্বতন্ত্র প্রকৃতির (মায়াজাত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের) প্রভাবে সকলেই কর্ম করতে বাধ্য হয় (গীতা-৩/৫)।

এ প্রেক্ষিতে শ্রীকৃষ্ণ আরো বলেন- যে ব্যক্তি কর্মেন্দ্রিয়গুলিকে কর্মবিরত করে মনে মনে তাদের বিষয় চিন্তা করে তারা মিথ্যাচারী (গীতা-৩/৬)।  কিন্তু যারা ইন্দ্রিয়গুলি সংযত করে অনাসক্তভাবে কর্ম করেন তারাই শ্রেষ্ঠ (গীতা-৩/৭)।  তুমি শাস্ত্রবিহিত নিত্যকর্ম করো। কর্ম না করা অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেয়। কর্মহীন হলে তোমার দেহযাত্রাও নির্বাহ হবে না (গীতা-৩/৮)।

তাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আসক্তিহীন হয়ে কর্তব্যরূপে সবসময় বিহিত কর্মের অনুষ্ঠান করার উপদেশ দেন। যে কর্ম যার পক্ষে বিহিত তাই তার পক্ষে যজ্ঞস্বরূপ। অনাসক্ত হয়ে কর্ম করলে মানুষ মোক্ষ লাভ করে। কারণ এই যথার্থ কর্ম ঈশ্বরের প্রীতির জন্যেই করা হয়- যজ্ঞার্থে বা ঈশ্বরের প্রীতির জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম ব্যতীত অন্য কর্ম বন্ধনের কারণ হয়। অতএব, তুমি ভগবানের উদ্দেশ্যে অনাসক্ত হয়ে বর্ণাশ্রমোচিত সকল কর্ম করো (গীতা-৩/৯)।

এবং বিহিত কর্মযোগের সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে গীতার সেই প্রসিদ্ধ শ্লোকটি উচ্চারিত হয় এভাবে- স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। (বর্ণাশ্রমবিহিত) স্বধর্মসাধনে নিধনও কল্যাণকর; কিন্তু অন্যের (বর্ণাশ্রমোচিত) ধর্মের অনুষ্ঠান অধোগতির কারণ বলে বিপজ্জনক (গীতা-৩/৩৫)।

বর্ণাশ্রমে বিভক্ত সমাজে জন্মজাত চারটি বর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের জন্য ঈশ্বরবিহিত যে যে কর্ম নির্ধারণ করা আছে প্রত্যেকের জন্য তা-ই স্বধর্ম অনুষ্ঠান। কারণ এই বর্ণগুলি ঈশ্বরসৃষ্ট এবং তাদের কর্মবণ্টনও ঈশ্বরই করে রেখেছেন প্রকৃতিজাত বা স্বভাবজাত করে- গুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি চারটি বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) সৃষ্টি করেছি। আমি মায়িক (মায়ারূপ) ব্যবহারে চতুর্বর্ণের সৃষ্টিকর্তা হলেও আমাকে পরমার্থদৃষ্টিতে অব্যয় অকর্তা ও অসংসারী বলে জানবে (গীতা-৪/১৩)।  পৃথিবীতে বা স্বর্গে এমন কোন প্রাণী (মানুষ বা দেবতা) বা বস্তু নেই, যা এই প্রকৃতিজাত ও বন্ধনের কারণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই) ত্রিগুণ থেকে মুক্ত (গীতা-১৮/৪০)।  হে পরন্তপ, প্রকৃতিজাত ত্রিগুণানুসারেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রেরও কর্মসমূহ পৃথক পৃথক রূপে ভাগ করা হয়েছে (গীতা-১৮/৪১)।  বাহ্যেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযম, বাচিক ও মানসিক তপস্যা; অন্তর্বহিঃ শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্বানুভূতি এবং শাস্ত্রে ও ভগবানে বিশ্বাস- এই সকল ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত (রজোমিশ্রিত সত্ত্বগুণ দ্বারা বিহিত) কর্ম (গীতা-১৮/৪২)।  পরাক্রম, তেজ, ধৃতি, কর্মকুশলতা, যুদ্ধে অপরাঙ্মুখতা, দানে মুক্তহস্ততা ও শাসনক্ষমতা- এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত (স্বভাবজ সত্ত্বমিশ্রিত রজোগুণ দ্বারা বিহিত) কর্ম (গীতা-১৮/৪৩)।  কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যের স্বভাবজাত (স্বভাবজ তমোমিশ্রিত রজোগুণ দ্বারা বিহিত) কর্ম। (অন্য বর্ণের) সেবা বা পরিচর্যা শূদ্রদের স্বভাবজাত (রজোমিশ্রিত তমোগুণের দ্বারা বিহিত) কর্ম (গীতা-১৮/৪৪)।  মানুষ নিজ নিজ বর্ণ ও আশ্রমের কর্মে নিরত থেকে জ্ঞান, নিষ্ঠা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সিদ্ধিলাভ করে (গীতা-১৮/৪৫)।

সহজভাবে বললে, বিহিত কর্ম মানে আরোপিত কর্ম যা ঈশ্বরকর্তৃক নির্দেশিত। কর্মফলের আশা ত্যাগ করে আসক্তিহীন কর্মযোগে চিত্তশুদ্ধির মাধ্যমে জ্ঞানরূপ সন্ন্যাসমার্গে উত্তীর্ণ হওয়াই গীতার মতে জীবের মোক্ষ বা সংসার-মুক্তির অনিবার্য শর্ত। কিন্তু ভক্তি বিনে জ্ঞান হয় না। এই ব্রহ্মজ্ঞান লাভে পরমেশ্বর পরমব্রহ্মের প্রতি অবিচল ভক্তি থাকা আবশ্যক। তাই গীতায় শ্রীভগবান বলছেন- তুমি আমাতে চিত্ত স্থির করো, ভজনশীল ও পূজনশীল হও। আমাকে নমস্কার করো। আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি, এভাবেই তুমি আমাকে পাবে (গীতা-১৮/৬৫)।

কিন্তু যা-ই করো না কেন, কোনভাবেই কর্মযোগ উপেক্ষা করে নয়। সকল শাস্ত্রের সারগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সার-কথাটাও সম্ভবত এই যে- অবিবেচকপূর্বক অভ্যাস অপেক্ষা শ্রুতি (বেদোক্ত শাস্ত্রাদি) ও যুক্তি দ্বারা আত্মনিশ্চয় উৎকৃষ্ট। আত্মনিশ্চয় অপেক্ষা জ্ঞানপূর্বক ধ্যান শ্রেষ্ঠ। জ্ঞানপূর্বক ধ্যান অপেক্ষা কর্মফলত্যাগ শ্রেষ্ঠ। কর্মফল ত্যাগের অব্যবহিত পরেই সহেতুক সংসার নিবৃত্তিরূপ পরম শান্তিলাভ হয় (গীতা-১২/১২)।

মূলত, কর্মযোগকে ঘিরেই গীতার মুখ্য আলোচ্য বিষয় গীতার মূলতত্ত্ব, মূলনীতি, আত্ম-তত্ত্ব, বিশ্বতত্ত্ব, ব্রহ্মতত্ত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে যত প্রকার জ্ঞান উপদিষ্ট হয়েছে, অর্জুনকে তা উপলব্ধি করতে হয়েছে। এবং তার উপলক্ষ হয়ে এটি একটি অন্যতম পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবেও ভারতীয় লোকসমাজে সর্বাদৃত হয়েছে।

বেদান্তের অনুবন্ধ

বেদান্ত মতে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ভিন্ন মুক্তি হয় না। কিন্তু ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ব্রহ্মবিচার সাপেক্ষ। এই ব্রহ্মবিচার মননাত্মক। ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের জন্যই বেদান্তদর্শনে ব্রহ্মবিচার প্রদর্শিত হয়েছে। তাই বেদান্তদর্শনের অপর নাম ব্রহ্মবিচারশাস্ত্র। তবে বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকেরা কিছু পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, যা অবগত থাকা আবশ্যক। বেদান্ত আলোচনার এই পূর্ব-প্রস্তুতির পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবন্ধ’।

‘অনুবন্ধ’ শব্দের অর্থ হলো নিমিত্ত। যে নিমিত্তে কোন শাস্ত্রেও আলোচনা করা হয়, সেই নিমিত্তই ঐ শাস্ত্রের অনুবন্ধ। বেদান্তে এই অনুবন্ধ চারপ্রকার- অধিকারী, বিষয়, সম্বন্ধ ও প্রয়োজন। এই চারপ্রকার অনুবন্ধ একসঙ্গে ‘অনুবন্ধ চতুষ্টয়’ নামে পরিচিত।

যে ব্যক্তি বেদান্তশাস্ত্র আলোচনা করার যোগ্যতা ও ক্ষমতাবিশিষ্ট, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বস্তু হলো এই শাস্ত্রের বিষয়। বেদান্তের প্রতিপাদ্য বস্তুর সঙ্গে এই শাস্ত্রের সম্পর্ক বা যোগসূত্র হলো সম্বন্ধ। সবশেষে বেদান্তশাস্ত্র আলোচনার উদ্দেশ্য ও ফল হলো এই শাস্ত্রের প্রয়োজন। বলা হয়, এই চারপ্রকার পূর্ব-প্রস্তুতির অভাবে বেদান্তশাস্ত্রের আলোচনা নিরর্থক। তাই বেদান্তশাস্ত্রের এই চারটি পূর্ব-প্রস্তুতি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকা আবশ্যক।

অধিকারী : ‘অধিকারী’ বলতে এখানে বেদান্তশাস্ত্রের তাৎপর্য অনুধাবনের অধিকারসম্পন্ন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যিনি বেদান্তশাস্ত্রের বিষয় বুঝতে, শাস্ত্রের নির্দেশ যত্নসহকারে পালন করতে এবং সদা সৎকর্মে ব্যাপৃত থাকতে সক্ষম, তিনিই বেদান্ত দর্শনের মর্মকথা অনুধাবনের অধিকারী। এজন্যেই অধিকারীকে প্রথমত ব্রহ্মচর্যাদির অনুষ্ঠানপূর্বক শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিঃশাস্ত্র এবং ছন্দঃশাস্ত্র, এই ছয়টি অঙ্গের সাথে বেদ অধ্যয়ন করবে। এভাবে বেদ অধীত হলে আপাতত বেদার্থের অবগতি হবে। কাম্যকর্ম ও নিষিদ্ধকর্মের অনুষ্ঠান করলে অনুষ্ঠিত কর্মের ফলভোগের জন্য শরীর-পরিগ্রহ বা জন্ম অবশ্যম্ভাবী। শরীরপরিগ্রহ এবং কর্মফলভোগ, উভয়ই বন্ধনের হেতু বা বন্ধন। বন্ধনাবস্থায় মুক্তি অসম্ভব। কারণ, বন্ধন ও মুক্তি পরস্পরবিরুদ্ধ। অতএব কাম্য ও নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করবে। এবং নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করবে। তাই ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যিনি বিধিপূর্বক বেদ-বেদান্ত অধ্যয়ন করে তার মূলমর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ইহজন্মে বা জন্মান্তরে কাম্য কর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগপূর্বক কেবল নিত্য কর্ম, নৈমিত্তিক কর্ম ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হয়েছেন, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তের অধিকারী সাধন-চতুষ্টয়ের অনুসরণ করে থাকেন। এই সাধন-চতুষ্টয় হলো- (১) বিবেক, (২) বৈরাগ্য, (৩) সাধন-সম্পত্তি ও (৪) মুমুক্ষুত্ব।

  • ১। ‘বিবেক’ বলতে বোঝায় নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক। অর্থাৎ কোন্ বস্তু নিত্য, কোন্ বস্তু অনিত্য, নিত্য ও অনিত্য বস্তুর ভেদ কী প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানই হলো বিবেকজ্ঞান। এই জ্ঞানের দ্বারাই কোন্ বস্তু গ্রহণীয় এবং কোন্ বস্তু বর্জনীয়, তা নির্ধারণ করা সম্ভব।
  • ২। ‘বৈরাগ্য’ বলতে বোঝায় ঐহিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার সুখের প্রতি বিরাগ।
  • ৩। ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা।
  • ৪। ‘মুমুক্ষুত্ব’ বলতে বোঝায় ব্রহ্মোপলব্ধি তথা মোক্ষলাভের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা।

এখানে উল্লেখ্য, আত্মসাক্ষাৎকারের উপযোগী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন এবং তার অনুকুল বিষয় ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বিষয় থেকে অন্তঃকরণের নিয়ন্ত্রণ বা নিগ্রহের নাম শম, এবং এসব বিষয় থেকে বাহ্যকরণ অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহকে দম বলা হয়। উপরতি হলো সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণপূর্বক শাস্ত্রবিহিত কার্যকলাপ পরিত্যাগ। তিতিক্ষা হলো শীত-তাপ, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান ইত্যাদি পরস্পরবিরুদ্ধ প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও কষ্টসহিষ্ণু থাকা। দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি এবং তার অনুকুল বিষয়ে মনের সমাধি বা একাগ্রতা অর্থাৎ তৎপরতার নাম সমাধান। আর গুরুবাক্য এবং বেদান্তবাক্যে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা বলা হয়।

বিষয় : প্রতিটি শাস্ত্রেরই প্রতিপাদ্য বিষয় আছে। শাস্ত্রের কোন বিষয় না থাকলে তা পাঠ করা নিষ্প্রয়োজন। বেদান্তশাস্ত্রের বিষয়কে তাই বেদান্তের দ্বিতীয় অনুবন্ধ বলা হয়েছে। বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের প্রতিপাদ্য বিষয় বিভিন্ন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্ত-সম্প্রদায়ের মতে বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান।

সম্বন্ধ : প্রতিপাদক শাস্ত্র বা শাস্ত্রবাক্যের সঙ্গে প্রতিপাদ্য বিষয়ের সম্বন্ধই হলো বেদান্তশাস্ত্রের তৃতীয় অনুবন্ধ। এই সম্বন্ধের স্বরূপ হলো প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদক বা বোধ্য-বোধক ভাবরূপ।

প্রয়োজন : বেদান্ত শাস্ত্রের প্রয়োজন বিষয়ে বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সাধারণভাবে শাশ্বত মুক্তিই বেদান্তশাস্ত্রের প্রয়োজন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্তমতে অবিদ্যার সমূলনিবৃত্তি এবং আনন্দময় ব্রহ্মস্বরূপপ্রাপ্তিই হলো বেদান্তশাস্ত্র পাঠের ফলস্বরূপ প্রয়োজন।

বাদরায়নের ব্রহ্মবাদ

ব্রহ্মসূত্র ও সূত্রচতুষ্টয়

বেদান্তের ব্রহ্ম বিষয়ক তত্ত্ব ও বিবিধ ধারণার উৎস উপনিষদ হলেও একই বিষয়ে বিভিন্ন উপনিষদগুলির নিজস্ব ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন ঋষির মধ্যে উপলব্ধ সত্য সম্পর্কে পারস্পরিক যে আপাত বিরোধ দেখা দেয়, তা নিরসনকল্পে উপনিষদগুলির মধ্যে নিহিত চিন্তাগুলিকে সমন্বয় করে সুশৃঙ্খলভাবে সংবদ্ধ করার প্রয়োজনে মহর্ষি বাদরায়ণ ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্র রচনা করেন। এই ব্রহ্মসূত্রই ব্রহ্মবাদ বা বেদান্তদর্শনের মূল সূত্রগ্রন্থ। ব্রহ্মসূত্রের অতিসংক্ষিপ্ত শ্লোকবিশিষ্ট সূত্রগুলি স্বাভাবিকভাবেই অতি দুর্বোধ্য হওয়ার কারণে পরবর্তীকালে সূত্রগুলির ব্যাখ্যাকল্পে বিভিন্ন আচার্য কর্তৃক যেসব ভাষ্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে তাতে বেদান্ত ভাষ্যকারদের নিজস্ব বিশ্বাস, ধারণা ও মতভেদ অনুযায়ী অধিকারীভেদে বিভিন্ন উপসম্প্রদায়েরও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু উপনিষদগুলি যেহেতু পূর্বাপর কোন একটি বিশেষ মতবাদের শিক্ষা দেয়নি, বরং আধ্যাত্মিক সাধনার বিভিন্ন স্তরে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যক্তির উপযোগী বিভিন্ন প্রকার মতবাদই উপনিষদগুলিতে স্থান পেয়েছে, তাই বিভিন্ন উপনিষদের মধ্যে একটি মূলগত ঐক্য আছে বলে বাদরায়ণ মনে করেন। এই মূলগত ঐক্যই হলো ব্রহ্মবাদ। এই ব্রহ্মবাদকে কেন্দ্র করেই মহর্ষি বাদরায়ণ কয়েকটি মূল সূত্র সংবদ্ধ করেন। এবং এই সূত্রগুলি ঘিরেই তার ব্যাখ্যা-বিস্তৃতি হিসেবে বাকি সব সূত্র-সমন্বয়ে গোটা ব্রহ্মসূত্র রচিত।

সমগ্র ব্রহ্মসূত্রের মধ্যে প্রথম অধ্যায়ের প্রথম চারটি সূত্র চতুঃসূত্র বা সূত্রচতুষ্টয় নামে পরিচিত। এই চারটি সূত্রকেই ব্রহ্মসূত্রের প্রধান ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সূত্র বলে মনে করা হয়। এমনও বলা হয় যে, চতুঃসূত্রীর সঠিক উপলব্ধি হলেই সমগ্র ব্রহ্মসূত্রের উপলব্ধি হবে। এই চারটি সূত্র হলো-

  • (১) যজ্ঞাদি ক্রিয়ার ফল ক্ষণস্থায়ী জানার পর আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজনীয় গুণগুলি অর্জন করে সর্বপ্রকার সংশয় মুক্ত হয়ে ‘অতঃপর এখান থেকে ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’ শুরু হলো। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১)।।
  • (২) জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যাঁর থেকে ঘটে, তিনিই ব্রহ্ম। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২)।।
  • (৩) ব্রহ্ম সম্পর্কিত যথার্থ জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় উপনিষদ শাস্ত্র, কারণ শাস্ত্রই তার প্রমাণ এবং তা সর্বসম্মত। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩)।।
  • (৪) কারণ ব্রহ্ম হলেন সেই উপনিষদ শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৪)।।

মহর্ষি বাদরায়ণ তার ব্রহ্মসূত্রে সর্বসমন্বয় প্রমাণ করতে গিয়ে একদিকে যেমন উপনিষদগুলির অভ্যন্তরীণ বিরোধ পরিহার করতে চেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ভিন্ন ভিন্ন উপনিষদ-বক্তা যে ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ে বিশেষ উপদেশ দিয়েছেন, সেসবই এক ব্রহ্মের বিষয়ে। মোটকথা, ব্রহ্ম, জীব, জগৎ ইত্যাদি সম্বন্ধে নিজ সিদ্ধান্ত কী, এবং বিরোধী দার্শনিক সিদ্ধান্ত যে যুক্তিসঙ্গত নয় এই হলো বেদান্তসূত্রের প্রতিপাদ্য।

উপনিষদের বিরোধ নিষ্পত্তি

উপনিষদের ঋষিরা সৃষ্টির মূল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সকলেই এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। প্রথমকালের উপনিষদে কেউ কেউ জলকে মূল কারণ বলে মেনেছেন, আবার পরবর্তীকালে উপনিষদে কেউ কেউ সাংখ্যসূত্রকার কপিলের মতের সাথে মিল রেখে প্রধান বা প্রকৃতিকে মূল কারণ বলে মেনেছেন। সেই জন্য বাদরায়ণের নিকট এ ধরনের পরস্পর-বিরোধী বক্তব্যকে দূর করা প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। তাই তিনি ব্রহ্মসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পাদের পঞ্চম সূত্র থেকেই যাবতীয় বিরোধ নিষ্পত্তি শুরু করেছিলেন। যেমন-

প্রধান নয়, ব্রহ্মই প্রথম ও মূল কারণ 

সাংখ্যবাদীরা প্রকৃতি বা প্রধানকে জগতের মূল কারণ বলে স্বীকার করেন।  ব্রহ্মসূত্রের ৫-১১ সূত্রগুলিতে সাংখ্যবাদীদের মতকে খণ্ডন করে ব্রহ্মকেই প্রথম কারণ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানকার আলোচনাটি প্রধানত ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়কে অবলম্বন করেই করা হয়েছে। ছান্দোগ্যে ঋষি উদ্দালক আরুণি তার পুত্রকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করতে গিয়ে বলেছেন- ‘ইহা প্রথম ছিলো এক অদ্বিতীয় সৎ রূপ।… তিনি কামনা করলেন বহু হবো।’- (ছান্দোগ্য-৬/২/১)। এখানে যে সৎ এক অদ্বিতীয় অস্তিত্বকে সৃষ্টির মূল বলে আরুণি স্বীকার করেছেন, তা হয়তো সাংখ্যসূত্রকার কপিল-প্রতিপাদিত প্রধানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু কোথাও ব্রহ্ম থেকে জগৎ সৃষ্টি, কোথাও বা প্রধান থেকে, এ ধরনের পরস্পর-বিরোধী মতও আছে। এই বিরোধকে দূর করতে গিয়ে বাদরায়ণ বলেছেন- জগতের আদি কারণের ঈক্ষণ অর্থাৎ চিন্তা, দর্শন ইত্যাদির কথা শাস্ত্রে আছে। কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত অচেতন প্রধানের কথা শাস্ত্রে নেই বলে প্রধানকে প্রথম কারণ বললে তা অ-শব্দ বা অশাস্ত্রীয় উক্তি হবে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)।

এখানে বিরুদ্ধ যুক্তি উত্থাপিত হতে পারে যে, মূল শ্রুতিতে সৎ-কর্তৃক ঈক্ষণাদি কার্য যা বর্ণিত হয়েছে তাতে শব্দের প্রয়োগ মুখ্যভাবে নয়, গৌণ করা হয়েছে। যেমন- ‘সেই তেজ (অগ্নি) ঈক্ষণ করলেন ‘আমি বহু হবো, আমি জাত হয়ে প্রকট হবো’। তেজ জল সৃষ্টি করলেন; জল ইচ্ছা করলেন…। তা থেকে ক্ষিতি (মৃত্তিকা) সৃষ্ট হলো।’- (ছান্দোগ্য-৬/২/৩-৪)। এভাবেই পরবর্তী বক্তব্যকে আলঙ্কারিক ভাষায় ঋষিরা ‘ঈক্ষণ করেছেন’ বলেছেন। এই যুক্তি খণ্ডন করতে বাদরায়ণ বলেন- শ্রুতি গৌণ অর্থে ‘ঈক্ষণ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন বললে তা যুক্তিসিদ্ধ হবে না, কারণ শ্রুতি অবশেষে জগতের আদি কারণ সম্বন্ধে আত্ম শব্দের ব্যবহার করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৬)।

এখানেও প্রশ্ন আসে। যেমন, ছান্দোগ্যে বর্ণিত হয়েছে- ‘তিনি (সৎস্বরূপ সত্তা) সঙ্কল্প করলেন, ‘এখন আমি এই তিন দেবতায় (পূর্বোক্ত অগ্নি, জল ও ক্ষিতিতে) জীবাত্মারূপে প্রবেশ করে নাম ও রূপে প্রকাশিত হবো’ (সেয়ং দেবতৈক্ষত হন্তাহমিমাস্তিস্রো দেবতা অনেন জীবেনাত্মনাহনুপ্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরবাণীতি)।’- (ছান্দোগ্য-৬/৩/২)। সাংখ্যবাদিরা এই দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে চান যে, ‘আত্মা’ শব্দটি চেতন অচেতন উভয় প্রকার বস্তু বুঝাতেই ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন এটি ভূতাত্মা, ইন্দ্রিয়াত্মা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং তা প্রধান প্রসঙ্গেও ব্যবহৃত হতে পারে। এর উত্তরে যুক্তি খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলেন- আত্মনিষ্ঠ ব্যক্তি মুক্ত হন, শাস্ত্রে এরূপ উপদেশ থাকায় অচেতন প্রকৃতিতে (প্রধানে) ‘সৎ’ ও ‘আত্মা’ শব্দ প্রযুক্ত হতে পারে না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৭)। যদি অচেতন প্রধান শ্রুতির দ্বারা সৎ প্রভৃতি শব্দের বাচ্য হতেন, তাহলে শ্রুতি এই সকলকে হেয় (ত্যাজ্য) বলে অবশ্যই উপদেশ করতেন (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৮)।

বাদরায়ণের মতে প্রধান যথার্থ আত্মা নন। এবং আলোচ্য শ্রুতিশাস্ত্রে প্রধানকে আত্মা হিসেবে গণ্য করে এ জাতীয় কোন উক্তিরও উল্লেখ নেই। বরং বিপরীতক্রমে ছান্দোগ্য উপনিষদের যে অধ্যায়ে এই শ্রুতি আছে তার সর্বত্রই আত্মাকে সৎ ব্যতীত আর কিছুই বলা হয়নি। উপরন্তু এই অধ্যায়টির সূচনা হয়েছে এই প্রশ্ন দ্বারা- ‘সেই বস্তুটি কী, যাঁকে জানলে সবই জ্ঞাত হওয়া যায়?’- যার দ্বারা অশ্রুতবিষয় শোনা যায়, অচিন্তনীয় বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায়- ভগবন্, কী সেই বিষয়? (ছান্দোগ্য-৬/১/৩)। হে সৌম্য, যেমন একখন্ড মাটিকে জানলেই মাটির তৈরি সব জিনিসকে জানা যায় (তেমনি আত্মাকে জানলেই সবকিছুকেই জানা যায়)। জিনিসগুলি নামে আলাদা, কেবলমাত্র মাটিই সত্য (ছান্দোগ্য-৬/১/৪)।

বাদরায়ণের মতে, যদি প্রধানই প্রথম কারণ হতেন তাহলে প্রধানকে জানলেই সব জানা হয়ে যেতো। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তা হয় না। ভোক্তা (পুরুষ) তা থেকে ভিন্ন। পুরুষ ভোগ্যবস্তুর ন্যায় প্রধান হতে উৎপন্ন নন। সুতরাং প্রধানকে জানলে পুরুষকে জানা সম্ভব নয়। তাই শাস্ত্র ‘যাঁকে জানলে সব জানা হয়’ বলেছেন সেই প্রথম কারণ প্রধান বা প্রকৃতি নন। আবার ছান্দোগ্য উপনিষদে দেখা যায়- উদ্দালক আরুণি পুত্র শ্বেতকেতুকে বললেন- সোম্য, আমার কাছ থেকে সুষুপ্তি-তত্ত্ব জানো। যখন কাউকে বলা হয় ‘ইনি ঘুমোচ্ছেন’, তখন হে সোম্য, তিনি সৎ-এর সঙ্গে একীভূত হন এবং স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হন। সেইজন্য লোকে একে ‘সুষুপ্ত’ (স্বপিতি) বলেন, কারণ তখন তিনি স্ব-স্বরূপে থাকেন (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)।

এখানে উপদেশ করা হয়েছে যে, জীবাত্মা সৎ-এর সঙ্গে মিশে এক হয়ে যান। যেহেতু চৈতন্যবান আত্মার পক্ষে অচেতন প্রধানের মধ্যে বিলীন হওয়া অসম্ভব, সেজন্যই শাস্ত্র যাঁকে সৎ শব্দ দ্বারা নির্দেশ করেছেন সেই প্রথম কারণ কিছুতেই অচেতন প্রধান হতে পারেন না। তাই বাদরায়ণ বলেন- ‘সুষুপ্তিকালে জীব সৎ-এ অর্থাৎ আত্মাতে লীন হয়’- এরূপ শ্রুতি থাকায় প্রধান জগতের কারণ হতে পারেন না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৯)।

প্রধান যদি জগৎ-কারণ না-ই হন, তাহলে জগতের প্রথম কারণ কে? বাদরায়ণ বলেন- সমস্ত শ্রুতিবাক্যের তাৎপর্য হতে ব্রহ্মের জগৎকারণত্ব অবগত হওয়া যায়। সুতরাং অচেতন প্রধানকে জগৎকারণ বলা যায় না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।

বাদরায়ণের এ সূত্রের অনুকুলে বিভিন্ন শ্রুতিশাস্ত্রের তাৎপর্য দেখা যেতে পারে। যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে- এই প্রকার (ব্রহ্মজ্ঞানী) দ্রষ্টা, মননকারী ও বিজ্ঞাতার নিকট এ জগতের সবকিছুই আত্মা থেকে এসেছে। প্রাণ, আশা, স্মৃতি, আকাশ, তেজ, জল, আবির্ভাব-তিরোভাব, অন্ন, বল, বিজ্ঞান, ধ্যান, চিত্ত, সংকল্প, মন, বাক্, নাম, মন্ত্র এবং কর্মসমূহ- এ সবকিছুর উৎস হলো আত্মা (ছান্দোগ্য-৭/২৬/১)।

তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে- যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি বস্তুত পরব্রহ্মকে জানেন। এই বিষয়ে একটি মন্ত্র আছে ‘সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তম্ ব্রহ্ম’ অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত। আমাদের গুহারূপ হৃদয়াকাশে (অর্থাৎ বুদ্ধিতে) তার অধিষ্ঠান। যিনি হৃদয়ে এই আত্মাকে উপলব্ধি করেন, তিনি যে শুধু সর্বজ্ঞ ব্রহ্মকেই উপলব্ধি করেন তা নয়, তিনি যা কামনা করেন তাই লাভ করেন। এই আত্মা থেকে আসে আকাশ। আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে পৃথিবী, পৃথিবী থেকে উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম, উদ্ভিদাদি থেকে খাদ্য এবং খাদ্য থেকে আসে মানুষ। বস্তুত মনুষ্যদেহ খাদ্য থেকেই উৎপন্ন (তৈত্তিরীয়-২/১/১)।

প্রশ্ন উপনিষদে বলা হয়েছে- প্রাণ আত্মা থেকে আসেন। দেহকে আশ্রয় করে যেমন ছায়া থাকে তেমনি আত্মায় প্রাণ নিহিত রয়েছেন। ইচ্ছা হলে এই প্রাণ স্থূল শরীর ধারণ করেন (প্রশ্ন-৩/৩)।

কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে- মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ; কিন্তু তারাও আত্মার কাছে খাদ্যের সমান। মৃত্যুর কাছে সকলেই পরাস্ত; কিন্তু সেই মৃত্যুও আত্মার কাছে মুখরোচক খাদ্য মাত্র। আত্মাই সর্বশ্রেষ্ঠ। সাধারণ মানুষ তার সীমিত শক্তি দিয়ে আত্মার মহিমা বর্ণনা করতে পারে না, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরা পারেন (কঠ-১/২/২৫)।

এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে- এই জগতে তার প্রভু বলে কেউ নেই, তাকে শাসন করতে পারে এমন কেউ নেই, আবার এমন কোন রূপ বা চিহ্ন নেই যা দিয়ে তাকে চিহ্নিত করা যায়। তিনিই সবকিছুর কারণ। যে জীবাত্মা সকল ইন্দ্রিয়ের প্রভু, তিনি (ব্রহ্ম) সেই জীবাত্মারও প্রভু। তার কোনও স্রষ্টা বা নিয়ন্তা নেই (শ্বেতাশ্বতর-৬/৯)।

মহর্ষি বাদরায়ণের কাছে এই আত্মা বা পরম চৈতন্যময় সত্তা ব্রহ্মই জগতের আদি কারণ। তাই তার সিদ্ধান্ত হলো- ব্রহ্মই যে জগৎ-কারণ তা সমস্ত বেদই (শ্রুতি শাস্ত্রই) স্পষ্টরূপে বলেছেন। সুতরাং প্রধানের জগৎকারণত্ব সিদ্ধ হতে পারে না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১১)।

এবং যুক্তিশাস্ত্রের কার্য-কারণ সম্পর্ক অনুযায়ী আদি-কারণ হিসেবে সৎ বস্তু ব্রহ্ম যে নিজে কোন কার্য হতে পারেন না, অর্থাৎ তার উৎপত্তি হতে পারে না এর যুক্তি দেখিয়ে বাদরায়ণ বলেন- সৎবস্তু ব্রহ্মের উৎপত্তি সম্ভব নয়। কারণ সৎ-এর উৎপত্তি স্বীকার করলে- তার উৎপত্তি- তার পূর্ববর্তীর উৎপত্তি- ইত্যাদিভাবে ‘অনবস্থা’ দোষ ঘটে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৯)।

এর মধ্য দিয়ে বাদরায়ণ এটাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান ব্রহ্মই হলেন জগতের আদি কারণ, অচেতন প্রধান বা অন্য কিছুই আদি কারণ নন।

জীবাত্মাও মূল কারণ নয় 

অচেতন প্রধানকে আদি কারণ বলে স্বীকার করা না হলেও উপনিষদে (যেমন তৈত্তিরীয় উপনিষদে-২/২/১) উল্লিখিত আত্মা থেকে যে আকাশাদির উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে আত্মাকে কি মূল কারণ বলে মনে করা যেতে পারে?  এই তৈত্তিরীয় উপনিষদের দ্বিতীয় খন্ড ব্রহ্মানন্দবল্লীতেই দেখা যায়- বুদ্ধিরূপে ব্রহ্মই বিজ্ঞানময় আত্মা। এই কোষ পূর্বোক্ত মনোময় কোষের আত্মা। বিজ্ঞানময় কোষের মধ্যে বুদ্ধিরূপ আত্মা আছেন। এই কোষের অভ্যন্তরে আনন্দময় কোষ এবং তার মধ্যে আনন্দময় আত্মা আছেন। বিজ্ঞানময় কোষ এই আনন্দময় কোষ দ্বারা পূর্ণ। আনন্দময় কোষের আকৃতিও মনুষ্যদেহের অনুরূপ। বিজ্ঞানময় কোষের আকৃতি যেরকম মানুষের মতো, অনুরূপভাবে আনন্দময় কোষও মানুষের মতো। প্রিয় জিনিস দেখার যে আনন্দ তা যেন (পাখির) মাথা, প্রিয়বস্তু লাভ করার আনন্দ এর ডান দিকের ডানা, প্রিয়বস্তু ভোগ করার আনন্দ এর বাঁ দিকের ডানা, আর বিশুদ্ধ আনন্দ যেন আত্মা (দেহের মধ্যভাগ)। অদ্বয় ব্রহ্ম হলেন এর পুচ্ছ- যা এই দেহকে ধারণ করে রাখে। এই সম্পর্কে (ব্রাহ্মণে) একটি শ্লোক আছে (তৈত্তিরীয়-২/৫/১)।

এই শ্রুতিতে মূল কারণ আত্মার ক্ষেত্রে ‘আনন্দময়’, ‘কায়যুক্ত’ ধারণা প্রযুক্ত হওয়া থেকে বোঝা যেতে পারে যে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্ম নয় জীবাত্মা। এর উত্তরে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে যে, আনন্দময় এখানে জীবাত্মা নয় ব্রহ্ম, কারণ তৈত্তিরীয় উপনিষদের এই প্রকরণ- ব্রহ্মানন্দবলীতে আনন্দ শব্দটিকে ব্রহ্মের ক্ষেত্রেই বারংবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বাদরায়ণ বলেন- ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ, এটাই শাস্ত্রসম্মত সিদ্ধান্ত এবং শাস্ত্রে পুনঃ পুনঃ এই কথাই বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)। ময় প্রত্যয় যে শুধু বিকার (যেমন, স্বর্ণ থেকে স্বর্ণালঙ্কার) বাচক নয়, তা প্রাচুর্য বা আধিক্যের জন্যেও ব্যবহৃত হয় (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৩)। ব্রহ্মই জীবের আনন্দের হেতু- শাস্ত্রে (ঐ তৈত্তিরীয়তেও) এরূপ উল্লেখ থাকায় ‘আনন্দময়’ শব্দের বাচ্য ব্রহ্মই, অংশ বা জীব নন (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৪)। যে ব্রহ্মকে শাস্ত্রের মন্ত্র অংশে উল্লেখ করা হয়েছে সেই ব্রহ্মকেই এই ব্রাহ্মণ অংশে পুচ্ছ বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৫)। শ্রুতি ‘আনন্দময়’কে লক্ষ্য করে যেসব বৈশিষ্ট্যের (সর্বশক্তিমত্তা এবং সর্বজ্ঞাতা) কথা বলেছেন তা একমাত্র ব্রহ্মেই থাকা সম্ভব, জীবে বা অন্য কিছুতে নয় (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৬)। যেহেতু ‘আনন্দময়’ ব্রহ্ম এবং জীবাত্মার ভেদ সম্পর্কে উপদেশ আছে তাই ‘আনন্দময়’ অর্থ ব্রহ্মই, জীব নয় (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৭)। …‘তিনি কামনা করেছেন’- এখানে যে কামনার কথা আসে তা অন্য নিরপেক্ষ ব্রহ্মের স্বীয় ইচ্ছাই কারণ- শ্রুতিতে এরকমই উক্ত হওয়ায় অনুমানকল্পিত প্রধান আনন্দময় শব্দবাচ্য হতে পারেন না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৮)। আনন্দময়ের সংযোগে জীবও আনন্দময়ত্ব লাভ করে; শ্রুতি এরকমই বলেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৯)। এভাবেই আত্মা শব্দ থেকে এখানে যেমন জীবকে তার কারণ বলে মানা যায় না, তেমনি ‘ময়’ প্রত্যয়ের বিকারবাচক অর্থকে নিয়ে সাংখ্য শাস্ত্রোক্ত প্রধানকেও গ্রহণ করা যায় না। এইভাবে উপনিষদ ব্রহ্মকেই বিশ্বসৃষ্টির আদি কর্তা মেনেছে, এটা খুবই স্পষ্ট।

ব্রহ্মবোধক প্রাকৃতিক শব্দ

উপনিষদে ‘অন্তন’, ‘আকাশ’, ‘প্রাণ’, ‘জ্যোতি’ প্রভৃতি এমন কিছু প্রকৃতিবাচক শব্দ রয়েছে যাকে সৃষ্টিকর্তার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হলেও প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক পদার্থের ভ্রম হতে পারে। যেমন, ছান্দোগ্য উপনিষদে দেখা যায়- শিলক শালাবত্য প্রবাহণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই পৃথিবীর আশ্রয় কী?’ প্রবাহণ বললেন, ‘আকাশ। এই সমস্ত ভূতবর্গ আকাশ থেকে উৎপন্ন হয় এবং আকাশেই লয় হয়। আকাশ এই সব কিছুর থেকে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আকাশই পরমা গতি (ছান্দোগ্য-১/৯/১)। পূর্বে উদ্গীথকে শ্রেষ্ঠ এবং অনন্ত বলা হয়েছে। যিনি উদ্গীথকে এইভাবে জেনে উপাসনা করেন, তিনি উত্তরোত্তর উচ্চতর লোকসমূহ লাভ করেন এবং মানুষ হিসেবেও ক্রমে উন্নততর হন (ছান্দোগ্য-১/৯/২)।

কিন্তু সৃষ্টির উৎপত্তি ও প্রলয়ে বিলয়স্থল হিসেবে যে বিশেষণ আকাশের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছে তা যে প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মেরই গুণ সেই ভ্রম দূর করতে বাদরায়ণ বলেন- আকাশ অর্থ পরমাত্মা বা ব্রহ্মই। কারণ উল্লিখিত গুণগুলি ব্রহ্মেরই গুণ- অন্য কারও নয় (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২২)। কেননা আকাশ শব্দটি যে ব্রহ্মকেই বোঝানো হয়েছে তা অন্য শ্রুতিতেও হয়েছে, যেমন- যিনি আকাশ এই নামে প্রসিদ্ধ তিনিই নাম ও রূপকে প্রকাশ করেন। যিনি এই নাম ও রূপের অভ্যন্তরে আছেন তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই আত্মা (ছান্দোগ্য-৮/১৪/১)।

আবার, ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রাণের মাহাত্ম্য বর্ণনার আখ্যানভাগে দেখা যায়- প্রস্তোতা তখন তার (উষস্তির) কাছে এসে বললেন ‘হে দেব, আপনি আমাকে বলেছিলেন, “হে প্রস্তোতা, প্রস্তাবের উদ্দিষ্ট দেবতা সম্পর্কে কিছুই না জেনে যদি তুমি তার সম্বন্ধে সামগান করো তাহলে তোমার মুন্ডপাত হবে।” অনুগ্রহ করে বলুন সেই দেবতা কে?’- (ছান্দোগ্য-১/১১/৪)।  উষস্তি বললেন, ‘তিনি প্রাণ। আমাদের চারপাশে (স্থাবর-জঙ্গম) যা কিছু আছে, সবই (প্রলয়কালে) সম্পূর্ণভাবে প্রাণে বিলীন হয় এবং (প্রকাশের সময়) তারা প্রাণ থেকেই উদ্গত হয়। প্রাণ দেবতার উদ্দেশ্যেই প্রস্তাব গান নিবেদিত। আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করে, প্রস্তাবের উদ্দিষ্ট দেবতাকে না জেনে যদি তুমি স্তুতি করতে, তাহলে অবশ্যই তোমার মুন্ডপাত হতো (ছান্দোগ্য-১/১১/৫)।

এই উপনিষদে প্রাণ বলতে কি জীবনীশক্তিকে বোঝানো হয়েছে, না কি ব্রহ্মকেই বোঝানো হয়েছে? ‘তিনিই প্রাণের প্রাণ’-(বৃহদারণ্যক-৪/৪/১৮) বা ‘…ব্রহ্ম থেকে বিবিধ বস্তুর উদ্ভব হয়, এবং সেগুলি আবার ব্রহ্মেই লোপ পায়’-(মুন্ডকোপনিষদ-২/১/১) জাতীয় শ্রুতিগুলি যেহেতু ব্রহ্মেরই লক্ষণ বোঝায়, তাই এখানে প্রাণ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে এই বিরোধ নিষ্পত্তি করতে মহর্ষি বাদরায়ণ বলেন- প্রাণ শব্দও ব্রহ্মবাচকই, কারণ ঐসব লক্ষণ ব্রহ্মেরই, প্রাণবায়ুর হতে পারে না (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৩)।

একইভাবে ছান্দোগ্য উপনিষদের অন্যত্র দেখা যায়- অতঃপর এই দ্যুলোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, বিশ্বের উপরে, সব কিছুর উপরে, সর্বোত্তম লোকে, যেই লোকের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোন লোক নেই, সেখানে যে জ্যোতি দীপ্তি পায়, সেই একই জ্যোতি মানুষের দেহের অভ্যন্তরেও দীপ্যমান (ছান্দোগ্য-৩/১৩/৭)।

ছান্দোগ্যে সাধক পুরুষকে সেই জ্যোতির ধ্যান করার কথা বলা হয়েছে। এখানে প্রশ্ন আসে, এই জ্যোতি কি সাধারণ আলোক? এই বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বাদরায়ণ বলেন- জ্যোতি শব্দও ব্রহ্মবোধক, কারণ পরে চরণ বা পাদ শব্দের উল্লেখ রয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৪)। অর্থাৎ, এই জ্যোতি মানুষের দৃষ্টির সহায়ক প্রাকৃত আলোক নয়, এই জ্যোতি বলতে ব্রহ্মকেই বোঝানো হয়েছে। কারণ পূর্ববর্তী কোন শ্রুতিতে চরণ (পাদ) শব্দের উল্লেখ আছে, যেমন- এই গায়ত্রী চারপাদ বিশিষ্ট (ভূত, পৃথিবী, শরীর ও হৃদয়) ও প্রতিটি পাদ ছয় প্রকার (বাক্, সর্বভূত, পৃথিবী, শরীর, হৃদয় ও প্রাণ)। ঋকমন্ত্রেও একথা বলা হয়েছে (ছান্দোগ্য-৩/১২/৫)। এই গায়ত্রী-ব্রহ্মের মহিমা যে পরিমাণ, সর্বব্যাপী পূর্ণব্রহ্ম পুরুষের মহিমা এর থেকেও ব্যাপক ও মহত্তর। সর্বভূত এই পুরুষের এক পাদ মাত্র। অবশিষ্ট তিন পাদ স্বর্গে অমৃতরূপে প্রতিষ্ঠিত (ছান্দোগ্য-৩/১২/৬)।

বাদরায়ণের মতে মূল কথা হলো, শ্রুতির যে অংশে (ছান্দোগ্য-৩/১৩) এই ব্রহ্মবোধক জ্যোতির কথা বলা হয়েছে, তাকেই এই শ্রুতির প্রথমাংশেও স্বীকার করা হয়েছে। সেখানেও যে জ্যোতির কথা বলা হয়েছে সেই জ্যোতিও স্বর্গের সঙ্গে যুক্ত। ব্রহ্ম যে শুধু পূর্বোক্ত শ্রুতিরই বিষয়বস্তু তা-ই নয়, পরবর্তী শ্রুতিতেও ব্রহ্মেরই বিষয় আলোচিত হয়েছে। কেননা আলোচ্য অংশের অব্যবহিত পরের (ছান্দোগ্য-৩/১৪) শ্রুতিতেও ব্রহ্মই হলেন মুখ্য বিষয়। যেমন- জগতে যা কিছু আছে সবই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম থেকেই সব আসে, আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়। সবকিছু ব্রহ্মকেই আশ্রয় করে আছে। অতএব, শান্তভাবে ব্রহ্মকে ধ্যান করা উচিত। প্রতিটি মানুষের মন স্বতন্ত্র। ইহজগতে যার যা ভাব, মৃত্যুর পরে মানুষ তাই হয়ে যায়। একথা মনে রেখে তদনুসারে ধ্যান করবে। (ছান্দোগ্য-৩/১৪/১)।

বাদরায়ণ মতে, জ্যোতি শব্দটি ব্রহ্মের দ্যোতক হিসেবেই ব্যবহার করা যায়, কারণ ব্রহ্ম যেমন জগৎকে প্রকাশ করেছেন জ্যোতিও তেমনি সমস্ত বস্তুকে প্রকাশ করে থাকে। ‘জ্যোতি’ এই সসীম বিশেষণকে ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে শুধুমাত্র উপাসনার জন্য। তাই বাদরায়ণ বলেন- গায়ত্রী ছন্দের উল্লেখ থাকায় জ্যোতিঃশব্দ ব্রহ্মবোধক নয় এরূপ আশঙ্কার কোন কারণ নেই। কারণ তাতে মনোনিবেশের যে কথা আছে তার অর্থ হলো গায়ত্রী ছন্দের দ্বারা ব্রহ্মে মনোনিবেশ করতে হবে (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৫)।  কেবল চিত্ত সমাধানের কথা আছে বলেই নয়; এই গায়ত্রীকে ভূত, পৃথিবী, শরীর এবং হৃদয় এরূপ চারপাদসম্পন্ন বলাতেও গায়ত্রীর অর্থ এখানে ব্রহ্মই (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৬)। উপদেশের ভিন্নতাহেতু তা ব্রহ্ম নয় এমন আশঙ্কার কোন কারণ নেই। কারণ ঐ দ্বিবিধ উপদেশের অর্থ প্রকৃতপক্ষে একই (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২৭)। অতএব, জ্যোতি শব্দটিকে ব্রহ্ম অর্থেই বুঝতে হবে।

উপনিষদে স্পষ্ট ও অস্পষ্ট জীববাচী শব্দও ব্রহ্মকে বোঝায়

বিভিন্ন উপনিষদের মতোই যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে- মনই তার সকল কর্মের নিয়ন্তা। সূক্ষ্মশরীর তার দেহ, জ্যোতির্ময় তার রূপ। তার সঙ্কল্প কখনও ব্যর্থ হয় না। আকাশের মতো সর্বব্যাপী ও নিষ্কলঙ্ক তার আত্মা। এই সমুদয় জগৎ তারই সৃষ্টি। জগতে যতো বাসনা আছে সব বাসনার উৎস তিনি। তিনিই আবার সকল প্রকার গন্ধ ও সর্বরসের আধার। সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত করে তিনি রয়েছেন। তিনি সব ইন্দ্রিয়বর্জিত ও সকল বাসনামুক্ত (ছান্দোগ্য-৩/১৪/২)।

বাদরায়ণের মতে, এরকম বিভিন্ন শ্রুতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, উপনিষদের ঋষিরা ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য কিছু আত্মাবাচক শব্দ প্রয়োগ করেছেন। এসব শব্দের জন্য উপনিষদ আত্মাকেই জন্মাদির কারণ তথা উপাস্য বলে মানে এমন ভ্রম যেন না হয়। এগুলির মধ্যে কিছু শব্দ স্পষ্টত জীব (আত্মা) বাচক শব্দ নয়। মনোময়, অত্তা (ভক্ষক), অন্তর (ভিন্ন), অন্তর্যামী, অদৃশ্য, বৈশানর এরকম ব্যবহৃত শব্দ যেগুলি কয়েকবারই আত্মাকে বোঝাতে প্রযুক্ত হলেও এমন স্থানও আছে যেখানে সেগুলি ব্রহ্মের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে, এজন্য বিরোধ ঘটেছে বলে ভ্রম না হওয়াই উচিত বলে বাদরায়ণ মনে করেন। তাই সূত্রকার বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে এই অস্পষ্ট জীববাচক শব্দ নিয়ে আলোচনার মধ্যে এই ছয়টি শব্দকে ব্রহ্মবাচী বলে দাবি করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ব্রহ্মসূত্রের কিছু নমুনা দেখা যেতে পারে- ব্রহ্মের যেসব লক্ষণ (মনোময়ত্ব, কারণত্ব ইত্যাদি) শ্রুতিতে সর্বত্র আছে, এখানেও তারই উপদেশ রয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/১)।  উপাস্যের যেসব গুণ থাকা শাস্ত্রোপদিষ্ট এবং বাঞ্ছিত, এখানেও সেসব গুণের কথাই বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/২)।  পূর্বোক্ত গুণসকল শারীর জীবাত্মায় সম্ভব নয় বলেও এখানে ব্রহ্মই উপদিষ্ট হয়েছেন বুঝতে হবে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/৩)।  শ্রুতিতে যে তাকে অত্তা (ভোক্তা) বলা হয়েছে- তা কর্মফল ভোক্তা নয়- তিনি চরাচর জগতের সংহার কর্তা, এই অর্থে তাকে অত্তা বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/৯)।  শ্রুতির যে প্রকরণে ‘অত্তা’ শব্দ উল্লিখিত হয়েছে তা ব্রহ্মপ্রকরণ; সুতরাং ‘অত্তা’ অর্থ ব্রহ্মই, জীব নয় (ব্রহ্মসূত্র-১/২/১০)।  ‘অধিদৈবত’- ‘অধিলোক’ ইত্যাদি শ্রুতিতে যিনি ‘অন্তর্যামী’ বলে বর্ণিত, তিনি পরমাত্মাই, কারণ পরমাত্মার গুণসমূহই তাতে বর্ণিত হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/১৮)।  বৈশ্বানর শব্দও পরমাত্মাবাচক, কারণ সাধারণ অর্থ ব্যতীত এখানে তার বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/২/২৪)।  মুণ্ডক উপনিষদে যাঁকে অদৃশ্য, অগ্রাহ্য ইত্যাদি গুণবিশিষ্ট বলা হয়েছে তিনি ব্রহ্ম, কারণ শ্রুতি তাকে সর্বজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/২/২১)।

উল্লেখ্য, মুণ্ডক উপনিষদে ব্রহ্ম সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য শ্রুতিটি হচ্ছে- যিনি অদৃশ্য (জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অতীত), অগ্রাহ্য (কর্মেন্দ্রিয়ের অতীত), স্বয়ম্ভূ, অরূপ, সকল ইন্দ্রিয়ের উর্ধ্বে অবিনাশী এবং সর্বব্যাপী এবং যিনি সূক্ষ্মতম ও সকল সৃষ্টির উৎস- সেই ব্রহ্মকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সর্ববস্তুতে এবং সর্বত্র দেখেন (মুণ্ডক-১/১/৬)।  যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি সর্ববিৎ, জ্ঞানই যাঁর তপস্যা সেই পরা ব্রহ্ম থেকেই এই অপরা ব্রহ্ম (হিরণ্যগর্ভ) এবং নাম, রূপ ও অন্নাদি এসেছে (মুণ্ডক-১/১/৯)।

বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় পাদে বলা হয়েছে যে, উপনিষদে স্পষ্ট জীববাচক শব্দও ব্রহ্ম অর্থে প্রযুক্ত। দ্যুলোক ও ভূলোকে অধিষ্ঠিত ভূমা (অনেক), অন্তর ও ইক্ষণকারী, ক্ষুদ্র অঙ্গুষ্ঠমাত্র, দেবগণের মধু, অঙ্গুষ্ঠ, আকাশ প্রভৃতির ন্যায় জীবাত্মা-বাচক বেশ কয়েকটি শব্দই উপনিষদে এসেছে এবং তাতেও ‘জন্মাদিকর্তা’র মতো বিশেষণ আছে, তৃতীয় পাদে একেই ব্রহ্মবাচক বলে সিদ্ধ করে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। যেমন- স্বর্গলোক, পৃথিবী প্রভৃতির আধার বলে শ্রুতি যাঁকে বর্ণনা করেছেন তিনিই ব্রহ্ম। কারণ ব্রহ্মবাচক ‘আত্মা’ শব্দ ঐ শ্রুতি তার সম্বন্ধে প্রয়োগ করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১)।  ভূমা শব্দের বাচ্য প্রাণ নয়- ব্রহ্ম। কারণ শ্রুতি প্রাণের উপরে এই ভূমার স্থিতি উপদেশ করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৮)।  ভূমার যেসব গুণ ও ধর্ম উল্লিখিত হয়েছে তা একমাত্র পরমাত্মাতেই সম্ভব, তাই ভূমা অর্থ এখানে পরমাত্মা-ই (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৯)।  অক্ষর অর্থ ব্রহ্ম, কারণ আকাশ পর্যন্ত সমস্ত পদার্থকেই তিনি ধারণ করে আছেন- শ্রুতিতে এরূপ উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১০)।  ঈক্ষণ অর্থাৎ দর্শনক্রিয়ার কর্মরূপে যে ধ্যেয় পুরুষের কথা বলা হয়েছে, তিনি কার্য ব্রহ্ম নন, তিনি পরব্রহ্ম (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১৩)।  ছান্দোগ্য উপনিষদে যে দহরাকাশের কথা আছে, তা ব্রহ্মই- কারণ পরবর্তী শ্রুতিতে এমনই উপদেশ করা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/১৪)।  ঋষি বাদরায়ণ বলেন যে, সূর্যাদি দেবতারও মধুবিদ্যায় অধিকার আছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৩)।  শ্রুতিশাস্ত্রেও শব্দ থেকেই জানা যায় যে, তিনি ‘অঙ্গুষ্ঠমাত্র’-পরিমিত পুরুষ (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৪)।  শাস্ত্রপাঠে এবং উপাসনায় একমাত্র মানুষেরই অধিকার, তাই সকল মানুষের হৃদয়ের পরিমাণ অনুসারে উপাসনার নিমিত্ত তাকে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৫)।

উল্লেখ্য, অঙ্গুষ্ঠমাত্র-পরিমিত পুরুষ সম্পর্কিত কঠোপনিষদের সেই উল্লেখযোগ্য শ্রুতিটি হলো- অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ পুরুষরূপে যিনি শরীর মধ্যে অবস্থিত তিনিই ত্রিকালের নিয়ন্তা। সাধক যখন ব্রহ্মকে জানেন তখন তিনি নিজেকে আর গোপন করেন না। তিনিই সেই আত্মা (কঠ-২/১/১২)।

এইভাবে ব্রহ্মসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম তিন পাদে ব্রহ্মই জিজ্ঞাস্য তথা জ্ঞাতব্য, এবং উপনিষদে একে বলা হয়েছে জন্ম-স্থিতি-প্রলয়ের কারক, তা সমর্থন করে সূত্রকার বাদরায়ণ পারস্পরিক বিরোধ দূর করেছেন। বেদান্তসূত্রে উপনিষদের যেসব শ্রুতির ওপর অধিক বিতর্ক করা হয়েছে, তা হলো- কঠ, মুণ্ডক, তৈত্তিরীয়, ঐতরেয়, প্রশ্ন, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, কৌষীতকি। যার মধ্যে ছান্দোগ্যের উক্তিই অধিকতর বিতর্কের বিষয় হয়েছে।

অধিবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যা

বায়রায়ণ প্রকৃতপক্ষে উপনিষদের বিভিন্ন শ্রুতিকেই অবিসম্বাদিত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উপনিষদের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন এবং উপনিষদের বিভিন্ন ঋষির মতভেদকে দূর করে সর্বসমন্বয় করতে চেয়েছেন। কিন্তু উপনিষদে যেহেতু মতভেদের যথেষ্ট বীজ ছিলো, যার ফলে অনুগামীরা গুরুর সর্বসমন্বয় নীতিকে খণ্ডন করতে উদ্যোগী হওয়ায় বেদান্তের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু শক্তিশালী মতভেদেরও সৃষ্টি হয়েছিলো। তবু বাদরায়ণের সর্বসমন্বয় তত্ত্বের মধ্যেও তার কিছু সুস্পষ্ট মতামত সিদ্ধান্ত আকারে পরিদৃষ্ট হয়, যাকে বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদ বলা যায়। এখানে ব্রহ্ম, জগৎ, আত্মা প্রভৃতি সম্বন্ধে বাদরায়ণের সিদ্ধান্ত রয়েছে। যেমন-

ব্রহ্মই উপাদান কারণ

বেদান্তসূত্রের দ্বিতীয় চতুঃসূত্রীতেই ব্রহ্মের লক্ষণে বলা হয়েছে- ‘জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যা থেকে হয় তিনিই ব্রহ্ম’। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২)। এই সূত্রে ব্রহ্মের কর্ম- সৃষ্টির উৎপাদন, ধারণ বা স্থিতি ও বিনাশ-কে ব্যক্ত করা হয়েছে। এবং ব্রহ্ম যে জগতের আদি কারণ এ ব্যাপারে বেদান্তসূত্রে স্পষ্ট উক্তিই রয়েছে- ব্রহ্মই যে আকাশাদি সৃষ্ট পদার্থের একমাত্র আদি কারণ সে বিষয়ে শ্রুতিতে কোন মতভেদ নাই (ব্রঃসূঃ-১/৪/১৪)। এখানে প্রশ্ন আসে, কার্য-কারণ সম্পর্ক অনুযায়ী যেকোন কার্যের দুটি কারণ থাকে- নিমিত্ত কারণ ও উপাদান কারণ। এক্ষেত্রে ব্রহ্ম কী জাতীয় কারণ হবেন? প্রাথমিক বিচারে ব্রহ্ম একমাত্র নিমিত্ত-কারণ বলেই মনে হয়, কারণ প্রশ্ন উপনিষদে বলা হয়েছে- তিনি হিরণ্যগর্ভকে (প্রাণাত্মা) সৃষ্টি করলেন। হিরণ্যগর্ভ বা প্রাণ থেকে সৃষ্টি হলো শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা থেকে আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী এবং ইন্দ্রিয় সৃষ্টি হলো। তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন মন এবং অন্ন। অন্ন থেকে ক্রমে বীর্য, বেদসমূহ, কর্ম (যাগযজ্ঞ), স্বর্গ এবং অন্যান্য লোক, এবং লোকসমূহে বিভিন্ন নাম বা পদসমূহ সৃষ্টি হলো (প্রশ্ন-৬/৪)।

কিন্তু বাদরায়ণ এই মতামতকে খণ্ডন করে বলেন ব্রহ্ম জগতের উপাদান-কারণও বটেন। কারণ কার্য থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ব্রহ্ম যদি জগতের উপাদান-কারণ হন তাহলেই কেবল ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা সব কিছুকে জানা সম্ভব। যেমন শ্রুতিতে বলা হয়েছে- ‘ যার দ্বারা অশ্রুতবিষয় শ্রুত হয়, অচিন্তনীয় বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায়’- (ছান্দোগ্য-৬/১/৩) ইত্যাদি। সূত্রকার এই প্রসঙ্গে ‘হে সৌম্য যেমন একটি মৃত্তিকাপিণ্ডের দ্বারা মৃত্তিকার পরিণাম-ভূত সমস্তই জানা যেতে পারে’- (ছান্দোগ্য-৬/১/৪) ইত্যাদি উপনিষদের বচনের সাহায্যে একথাও বলতে চেয়েছেন যে মৃত্তিকা যেমন কলসীর উপাদান, ব্রহ্মও তেমনি বিশ্বের কারণ। তা নাহলে এই শ্রুতিবচনগুলি অর্থহীন হতো। আবার ‘এই দৃশ্যমান জগৎ প্রকাশের আগে একমাত্র ব্রহ্মই ছিলেন, এক এবং অদ্বিতীয় সৎরূপেই ছিলেন’- (ছান্দোগ্য-৬/২/১) ইত্যাদি শ্রুতিও প্রমাণ করে যে, ব্রহ্ম নিমিত্ত-কারণও বটেন- যেহেতু, যখন আর কিছুই ছিলো না তখন ব্রহ্ম ব্যতীত আর কে এরূপ কারণ হতে পারেন? তাই সূত্রকার বলেন- ব্রহ্ম জগতের শুধু নিমিত্ত-কারণ নন, উপাদান-কারণও, এরূপ সিদ্ধান্তেই শ্রুতির প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সামঞ্জস্য হয় (ব্রঃ-১/৪/২৩)।

ব্রহ্ম যে জগৎ থেকে ভিন্ন নয়, উদ্দালক আরুণির উক্তি- ‘মৃত্তিকাই সত্য, ঘড়া কলসী শুধু কতকগুলি নামমাত্র’- (ছান্দোগ্য-৬/১/৪)- থেকেই তা স্পষ্ট। কেননা মৃত্তিকা থাকাতেই যেমন ঘট পাওয়া যায় তেমনি ব্রহ্ম থেকেই জগৎ সৃষ্টি হয়। আবার কার্যের কারণ হওয়ার জন্য ব্রহ্ম জগৎ থেকে ভিন্ন নয়। যেমন সুতো বস্ত্র থেকে ভিন্ন নয়, তেমনি ব্রহ্ম জগৎ থেকে ভিন্ন নয়। বায়ুকে যেমন- প্রাণ, অপানাদি কয়েকটি রূপে দেখা যায়, ব্রহ্মকে তেমনি জগতের নানারূপে দেখা যায়। ‘তিনি (ব্রহ্ম) ইচ্ছা করলেন, ‘আমি বহু হবো, প্রকৃষ্টরূপে জাত হবো’- (ছান্দোগ্য-৬/২/৩) এই শ্রুতিতে ইচ্ছার কথা উল্লেখ থেকে বুঝা যায় ব্রহ্ম নিমিত্ত-কারণ, এবং পরবর্তী শ্রুতিবচন ‘আমি বহু হবো’- থেকে বুঝা যায় যে ব্রহ্ম নিজেই বহু হয়েছেন। সুতরাং তিনি উপাদান-কারণও বটেন। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন- ব্রহ্ম নিজেই বহুরূপে সৃষ্ট হবেন, এই বাক্য থেকেও তিনি যে নিমিত্ত এবং উপাদান উভয়বিধ কারণ তা বুঝা যায় (ব্রঃ-১/৪/২৪)।

যা থেকে কোন জিনিস উৎপন্ন হয়ে যাতে পুনরায় বিলীন হয় তা-ই হলো উপাদান-কারণ। সেক্ষেত্রে একটি বস্তুকে তার নিমিত্ত-কারণ থেকে উৎপন্ন বলা যেতে পারে, কিন্তু প্রলয়কালে বস্তুটি তাতে ফিরে যেতে পারে না, যদি না তা উপাদান-কারণও হয়। কার্যের সাথে কারণের এই সম্বন্ধকে বলা হয় সাক্ষাৎ সম্বন্ধ। ব্রহ্মকে জগতের উপাদান-কারণ হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সূত্রকার বাদরায়ণ শ্রুতির সাক্ষ্যকেই বিবেচনায় নিয়েছেন তা বলাই যায়। যেমন, ‘এই সমস্ত ভূতবর্গ আকাশ (ব্রহ্ম) থেকেই সমুৎপন্ন হয় এবং আকাশেই লয় হয়। আকাশ এই সব কিছুর থেকে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আকাশই পরমা গতি’- (ছান্দোগ্য-১/৯/১)। এবং তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে- যাঁর থেকে এই অখিল ভূতবর্গ উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হয়ে যাঁর দ্বারা বর্ধিত ও আশ্রিত হয়, এবং বিনাশকালে যাঁর কাছে ফিরে যায় এবং যাঁর মধ্যে বিলীন হয়, তাকেই জানতে ইচ্ছুক হও; তিনিই ব্রহ্ম (তৈত্তিরীয়-৩/১/১)।

সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের সাথে ব্রহ্মের এই সাক্ষাৎ সম্বন্ধরূপ এই শ্রুতিবচনগুলিই প্রমাণ করে যে, ব্রহ্ম উপাদান-কারণও বটেন। তা-ই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- শ্রুতি সাক্ষাৎ সম্বন্ধেই ব্রহ্মের নিমিত্ত ও উপাদান-কারণত্ব উভয়ই উপদেশ করেছেন (ব্রঃ-১/৪/২৫)।

আবার তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে- আদিতে জগৎ বলে কিছু ছিলো না। কেবল ব্রহ্ম ছিলেন। এই জগৎ তখন অব্যক্ত ব্রহ্মরূপে ছিলো। তারপর নামরূপের এই দৃশ্যমান জগৎ আত্মপ্রকাশ করলো। ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে এভাবে সৃষ্টি করলেন। তাই তিনি ‘সুকৃত’ (অর্থাৎ ‘সুন্দর সৃষ্টি’ বা ‘স্বয়ংকর্তা’) বলে খ্যাত (তৈত্তিরীয়-২/৭/১)।

এই শ্রুতি থেকে বুঝা যায় যে, স্বয়ং ব্রহ্ম নিজের অভ্যন্তর থেকেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন- এবং এই সৃষ্টি একটি পরিণামের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। শ্রুতির ’স্বয়ম্’ শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে, সেখানে অন্য কোন কারণ ক্রিয়াশীল ছিলো না। তাকে ভিত্তি করেই সূত্রকার বাদরায়ণ বলছেন- ‘ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে জগৎরূপে সৃষ্টি করলেন’- এই বাক্য থেকে ব্রহ্ম যে কর্তা ও কর্ম- নিমিত্ত ও উপাদান-কারণ তা বুঝা যায় (ব্রঃ-১/৪/২৬)।

এবং ব্রহ্মের উপাদান-কারণত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আরেকটি শ্রুতিকে প্রমাণ হিসেবে গণ্য করে সূত্রকার বলেন- শ্রুতি ব্রহ্মকেই জগতের ‘যোনি’ অর্থাৎ মূল কারণ বলেছেন, এজন্যও তার উপাদান-কারণত্বও সিদ্ধ হয় (ব্রঃ-১/৪/২৭)।

উল্লেখযোগ্য সেই শ্রুতিটি হলো- যিনি অদৃশ্য (জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অতীত), অগ্রাহ্য (কর্মেন্দ্রিয়ের অতীত), সর্বব্যাপী (আকাশের মতো) এবং যিনি সূক্ষ্মতম ও সকল সৃষ্টির যোনি বা উৎস- সেই (কারণ) ব্রহ্মকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সর্ববস্তুতে এবং সর্বত্র দেখেন (মুণ্ডক-১/১/৬)।

এই শ্রুতি থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, ব্রহ্ম এই জগতের উপাদান-কারণ। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, যেখানে ব্রহ্ম চেতন, শুদ্ধ, ঈশ্বর, স্বভাবযুক্ত, সেখানেও জগৎ অচেতন, অশুদ্ধ, পরাধীন, অতএব কারণ থেকে কার্য এতো অসম স্বভাবযুক্ত কেন? অর্থাৎ পূর্বপক্ষীয় যুক্তিটি হলো, অচেতন জগৎ চেতন ব্রহ্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, অতএব চেতন ব্রহ্ম অচেতন জগতের উপাদান-কারণ হতে পারেন না। এর সমাধানের জন্য বাদরায়ণ বলেছেন- চেতন থেকে অচেতন এবং অচেতন থেকে চেতনের উৎপত্তি অবশ্যই দৃষ্ট হয়ে থাকে (ব্রঃ-২/১/৬)।

এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয় যে, বৃশ্চিকাদি চেতনাসম্পন্ন জীব গোময়াদি অচেতন বস্তু থেকে উৎপন্ন হয়। আবার চেতনাসম্পন্ন মাকড়সা থেকে অচেতন তন্তু তার জালের জন্য সৃষ্ট হয়। একইভাবে অচেতন নখ কেশাদি চেতনাসম্পন্ন জীব মানুষ থেকেই উৎপন্ন হয়। সুতরাং তা সম্পূর্ণভাবেই সম্ভব যে, এই জড়জগৎ চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। অন্যদিকে কারণের সঙ্গে কার্যের অসাম্যের উদাহরণেও বলা হয়, পতঙ্গ বা মক্ষিকা যে কীটের জন্ম দেয় তা সম্পূর্ণ অ-সম, আবার এই কীট থেকে পুনরায় যে পতঙ্গ সৃষ্ট হয় তা তার মাতৃস্থানীয় ডিম্বকোষের বিপরীত। তবে কার্য ও কারণের মধ্যে যতো অ-সম বা বৈশাদৃশ্যই পরিলক্ষিত হোক না কেন, বাদরায়ণ কিন্তু কার্যকে ব্রহ্মের উপাদান-কারণ হিসেবেই কখনোই ভিন্ন বলে মানেন নি। তাই ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়- কারণ বিদ্যমান থাকে বলেই কার্যের উপলব্ধি হয় (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৫)।  (পরবর্তী) কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে কারণে অবস্থান করে বলেও কার্য-কারণ ভিন্ন নয় (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৬)।

ব্রহ্মই উপাদান-কারণ হিসেবে আরেকটি আপত্তি উত্থাপিত হয় ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি শ্রুতি নিয়ে- এই জগৎ পূর্বে অসৎ অর্থাৎ নামরূপহীন ছিলো। তা সৎ অর্থাৎ সূক্ষ্ম সত্তাবান হলো, প্রকাশিত হলো এবং ডিম্বাকার রূপ ধারণ করলো। এ অবস্থায় একবছর থাকার পর সেই ডিম্ব দুভাগে বিভক্ত হলো- একভাগ রজতময়, অপরভাগ সুবর্ণময় হলো (ছাঃ-৩/১৯/১)।

সৃষ্টির পূর্বে অসৎ অবস্থা সত্য হলে ব্রহ্মই আদি কারণ বা উপাদান-কারণ অসঙ্গত। তারই প্রতিষেধকল্পে এই শ্রুতির ব্যাখ্যায় বাদরায়ণ বলেন- শ্রুতি বলেন ‘এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অসৎ-ই ছিলো’- এর অর্থ এই নয় যে সৃষ্টির পূর্বে জগৎ ছিলো না। তা ব্রহ্মে সূক্ষ্মরূপে লীন হয়ে ছিলো তা পরবর্তী শ্রুতিবাক্য থেকে জানা যায় (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৭)।  যুক্তি এবং অন্য একটি শ্রুতি বচন থেকে ব্রহ্ম এবং জগতের মধ্যে কার্য কারণ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৮)। অর্থাৎ, ‘অসৎ’ এই শব্দটি সম্পূর্ণ অনস্তিত্বকে বুঝায় না, কিন্তু জগৎ পৃথক কোন সত্তারূপে ছিলো না- তাই বুঝায়। তা অভিন্ন অবস্থাতেই ছিলো- তখন পর্যন্ত কোন নাম-রূপের উদ্ভব হয়নি- এই অর্থে জগৎকে ‘অসৎ’ বলা হয়েছে। তখন তা সূক্ষ্ম অবস্থায় ছিলো এবং সৃষ্টির পর তা স্থূল আকার ধারণ করলো এবং নাম-রূপেরও উদ্ভব হলো। এই শ্রুতির অব্যবহিত পরের অংশে এই অর্থেই তার উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে উল্লেখকৃত অন্য শ্রুতি বচনটি হলো-
‘হে সৌম্য, সৃষ্টির পূর্বে এই জগৎ এক অদ্বিতীয় সৎ-রূপে (বিদ্যমান) ছিলো’- (ছান্দোগ্য-৬/২/১)।

ব্রহ্মের জগৎ-কারণত্বের বিরুদ্ধে আর একটি নতুন আপত্তি উত্থিত হয় তা হলো, ব্রহ্মকে সৃষ্টি কর্মে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মের বাইরে কোন উপকরণ নেই- কারণ ব্রহ্ম ব্যতিরিক্ত কোন কিছুই নেই। ব্রহ্ম ‘একমেব্যদ্বিতীয়ম্’, এক ও অদ্বিতীয়, সুতরাং সকল বাহ্য এবং আভ্যন্তরীণ ভেদরহিত। ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয় বলে তার কোন আনুষঙ্গিক উপকরণ নাই- সুতরাং তিনি সৃষ্টিকর্তা হতে পারেন না। এই আপত্তি খণ্ডন করে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন, ব্রহ্ম উপাদান এবং উপকরণরহিত হয়েও জগৎ-কারণ হতে পারেন- উপকরণের সাহায্য ভিন্ন কোন কিছুই নির্মাণ করা যায় না, অতএব বাহ্য উপকরণ ছাড়া ব্রহ্ম কিভাবে জগৎ সৃষ্টি করলেন?- যদি এরূপ আপত্তি হয়, তার উত্তরে আমরা বলবো- দুগ্ধ যেমন দ্রুতই দধিরূপে পরিণত হয়, ব্রহ্মও সেরূপ নিজেই জগৎরূপে পরিণত হয়েছেন (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৪)।  দেবতা এবং পৃথিবীর বহু সিদ্ধপুরুষও ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সৃষ্টি করতে পারেন। ব্রহ্মও সেরূপ পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৫)।  ব্রহ্ম যে সর্বশক্তিসম্পন্ন তা শ্রুতিসিদ্ধান্ত। অতএব তিনি জগতের অতীত হয়েও জগৎরূপে পরিণত হতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৭)।   জগৎ-কারণ হওয়ার জন্য যে-সব গুণ বা ধর্ম থাকা আবশ্যক তার সবগুলি ব্রহ্মেই বর্তমান। সুতরাং ব্রহ্মই জগৎ-কারণ (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৭)।

এখানে হয়তো আরো অনেক তর্কই উত্থিত হতে পারে যে, ব্রহ্মের সৃষ্টিক্ষমতার প্রমাণ-যুক্তি হিসেবে যে সিদ্ধপুরুষদের উপমা টানা হয়েছে, সত্যি কি সিদ্ধপুরুষেরা ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে যেকোন কিছু সৃষ্টি করতে পারেন? কিংবা সিদ্ধপুরুষ বলতেই বা কী বোঝায়? ইত্যাদি ইত্যাদি তর্কের দ্বারা আদৌ কি কোনো নিশ্চয়তায় পৌঁছা সম্ভব? বস্তুগ্রাহ্য প্রমাণ ছাড়া কেবল তর্কের দ্বারা আমরা কোনো নিশ্চয়তায় পৌঁছতে পারি না, কেননা তর্ক পরস্পরকে খণ্ডন করে। সেইজন্য পরিশেষে বিনা তর্কে উপনিষদের বচনকে স্বীকার করে ব্রহ্মকেই জগতের উপাদান বলে মেনে নেওয়া যুক্তিযুক্ত বলেই বাদরায়ণের সিদ্ধান্ত- তর্ক অপ্রতিষ্ঠ; অতএব শ্রুতিসিদ্ধ ব্রহ্মের কারণত্ববাদ কেবলমাত্র তর্কের দ্বারা খণ্ডন করা চলে না (ব্রঃ-২/১/১১)।

সৃষ্টিকর্তা

ব্রহ্মকেই সৃষ্টিকর্তা বলা হয়েছে। সেই নিত্য, মুক্ত, তৃপ্ত ব্রহ্ম কী প্রয়োজনে সৃষ্টি করেন? যদি ধরেও নেয়া হয় যে, ব্রহ্মের সৃষ্টিকার্যের সকল শক্তিই আছে, তবুও ব্রহ্মের সৃষ্টিকর্তৃত্ব বিষয়ে কিছু আপত্তি উত্থাপিত হয়। যেমন, উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন ছাড়া কেউই কর্মে প্রবৃত্ত হয় না। কিন্তু ব্রহ্ম হলেন আপ্তকাম, সুতরাং সৃষ্টি করে পাওয়ার মতো তার কিছুই থাকতে পারে না। সেজন্যেই ব্রহ্ম নিষ্প্রয়োজনে কোন কর্মে প্রবৃত্ত হবেন এরূপ প্রত্যাশা আমরা করতে পারি না। সুতরাং ব্রহ্ম জগৎ-সৃষ্টির কারণ হতে পারেন না। এই আপত্তির উত্তরে সূত্রকার বলেন- সাধারণ জগতে দৃষ্ট মানুষের ক্রীড়াদির মতো সৃষ্টিকার্যও ব্রহ্মের লীলা মাত্র (ব্রঃ-২/১/৩৩)।

বলা হয়, মনুষ্যগণের মধ্যে যেমন অপেক্ষাকৃত ‘নিত্য মুক্ত তৃপ্ত’- মহারাজগণ কেবল খেলার জন্য গেণ্ডুয়া খেলেন, ব্রহ্মও তেমনই লীলাচ্ছলেই সৃষ্টিকর্ম করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সৃষ্টির মধ্যে যে জাগতিক বৈষম্য বা ক্রূরতা দেখা যায়, যেমন কেউবা দরিদ্র আবার কেউবা ধনী হয়ে জন্মগ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে ঈশ্বর কারও প্রতি পক্ষপাতী। এছাড়া কাউকে নিরতিশয় সুখে রাখেন আবার কাউকে কষ্ট ভোগ করান, এক্ষেত্রে ঈশ্বরকে নিষ্ঠুরও বলা চলে। তিনি সৃষ্টিকর্তা হলে এই বৈষম্য বা নিষ্ঠুরতা থাকতে পারে না। এই আপত্তির উত্তরে সূত্রকার বলেন- জগতে সুখ দুঃখাদি দেখে ব্রহ্মকে পক্ষপাতযুক্ত বা নিষ্ঠুর বলা যায় না- কারণ শাস্ত্রে এই বৈষম্যের হেতু এবং ব্রহ্মের স্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে (ব্রঃ-২/১/৩৪)।

তাহলে এই বৈষম্য বা নিষ্ঠুরতার হেতু কী? বলা হয়, ঈশ্বরকে পক্ষপাতিত্ব এবং নিষ্ঠুরতার জন্য অভিযুক্ত করা চলে না, কারণ তিনি জীবের স্বকীয় পাপপুণ্য অনুযায়ীই ভালোমন্দের বিধান করে থাকেন। শ্রুতি শাস্ত্রেও এই মর্মে উক্তি রয়েছে- …মানুষ মারা গেলে বাক্ তার স্বস্থান অগ্নিতে, প্রাণ বায়ুতে, চোখ আদিত্যে, মন চন্দ্রে, কর্ম দিকসমূহে, শরীর পৃথিবীতে, আত্মা আকাশে, লোম ওষধিলতায়, মাথার চুল বনস্পতিতে, রক্ত, রেতঃ জলে ফিরে গিয়ে অবস্থান করে। তাহলে সে সময় আমাদের শারীরপুরুষ কোথায় থাকেন? …তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান… (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।

ভৃত্যগণকে স্ব স্ব কর্মানুযায়ী পারিতোষিক দেওয়ার উপর যেমন কোন রাজার পদমর্যাদা নির্ভর করে না, বা বৃষ্টির জল যেমন প্রত্যেকটি বীজকে স্ব স্ব প্রকৃতি অনুসারে অঙ্কুরিত হতে সাহায্য করে, তেমনি ঈশ্বরও প্রতিটি জীবের অন্তর্নিহিত সুপ্ত প্রবণতাগুলিকে বিকশিত করার জন্য নিমিত্ত-কারণরূপে বর্তমান আছেন। সুতরাং জাগতিক বৈষম্য বা ক্রূরতার জন্য ব্রহ্মের প্রতি দোষারোপ করা অনুচিত, কারণ ব্রহ্ম জীবের কর্ম থেকেই এরূপ জগৎ সৃষ্টি করেন। এই কর্ম অনাদিকাল থেকে চলে আসছে, বিশ্বসৃষ্টিও অনাদিকালের। এ প্রেক্ষিতে সূত্রকার বলেন- সৃষ্টির পূর্বে জীব ও ব্রহ্মে কোন ভেদ ছিলো না। সৃষ্টির সময়েই ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে ভেদ সৃষ্টি করেছেন যদি এরূপ বলা হয়, তাহলে তার উত্তরে বলা যায় যে, না জীবজগৎও অনাদি (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৫)।  জীব ও জগতের অনাদিত্বকে যুক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা যায়- এবং শাস্ত্রেও এর সপক্ষে উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৬)।

শাস্ত্রেও জগৎ যে সৃষ্টির পূর্ব-কল্পেও বর্তমান ছিলো তা এ-জাতীয় শ্রুতিতেই আছে- সৃষ্টিকর্তা পূর্ববৎ-ই সূর্য ও চন্দ্রকে সংস্থাপিত করলেন এবং স্বর্গ, পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি করলেন (ঋক-১০/১৯০/৩)। তাই সূত্রকার বাদরায়ণের মতে, সাংখ্যমতের প্রধান বা বৈশেষিক-মতের পরমাণুকে জগতের কারণ মেনে যে সকল বক্তব্য আছে, তা অধিকতর নির্দোষ রূপে সিদ্ধ হতে পারে যদি ব্রহ্মকেই একমাত্র নিমিত্ত-উপাদান-কারণ বলে মানা যায়।

‘এইভাবে বাদরায়ণ জগৎ, আত্মা ও ব্রহ্মকে এমন এক শরীর বলে মেনেছেন, যা এই তিনের সংমিশ্রণে পরিপূর্ণ হয়। এবং শুধু সজীব, স-শরীর ব্রহ্মই নয়, উপরন্তু যাতে এক ‘অবয়বের’ দোষ ত্রুটি সেই অখণ্ড ব্রহ্মকে স্পর্শ করে না। কেমন করে? বাদরায়ণের এই প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণ অসন্তোষজনক। তার ভিত্তি শব্দ ছাড়া আর কোনো প্রমাণ নয়।’- (রাহুল সাংকৃত্যায়ন, দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-১৮১)। প্রকৃতই বাদরায়ণের সিদ্ধান্তের ভিত্তি কেবলই শব্দ-প্রমাণ অর্থাৎ শ্রুতি-শাস্ত্রের অমোঘ বচনই !

জগৎ

বাদরায়ণের মতে জগৎ হলো ব্রহ্মের শরীর, কেননা জগতের উপাদান-কারণ ব্রহ্ম। উভয়ের মধ্যে বৈলক্ষণ্য আছে, কিন্তু কার্য-কারণের এই অসাম্য যে বাদরায়ণ স্বীকার করেছেন তা ইতঃপূর্বেই বলা হয়েছে। জগৎকে ব্রহ্মের শরীর হিসেবে স্বীকার করেই বাদরায়ণ জগৎকে কোথাও মারা বা কাল্পনিক বলে মানেননি। বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- মুখ্য প্রাণে যেমন প্রাণ, অপান প্রভৃতি বায়ুসকল লীন থাকে, তেমনি জগৎও ব্রহ্মে লীন থাকে (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২০)।  জগৎ-কারণ ব্রহ্ম হয় সম্পূর্ণভাবেই জগতে পরিণত হয়েছেন- তা মানতে হয়, অথবা শাস্ত্রের বিরোধিতা করতে হয়- যেহেতু শাস্ত্র বলেছেন ব্রহ্ম অংশরহিত (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৬)।

আবার, জগৎ ব্রহ্মে লীন থাকলেও জগৎ কিন্তু উৎপত্তিশীল। এবং পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ুই শুধু নয়, আকাশও উৎপত্তিশীল। অন্যান্য দর্শনের মতো বাদরায়ণ আকাশকে উৎপত্তিরহিত বলে মানেননি, এবং একে তিনি উপনিষদীয় শ্রুতি বাক্যসমূহ, যেমন- ‘…সেই আত্মা থেকে আকাশ সৃষ্ট। আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে পৃথিবী, পৃথিবী থেকে উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম, উদ্ভিদাদি থেকে খাদ্য এবং খাদ্য থেকে আসে মানুষ।…’-(তৈত্তিরীয়-২/১) এর দ্বারা সিদ্ধ করেছেন। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- শ্রুতি প্রমাণে আকাশাদি সব বিকারই ব্রহ্মেরই অভিন্ন রূপ। বিকার উৎপত্তিশীল হওয়ায় তা ব্রহ্মেরই বিকার বা কার্যবস্তু (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৭)।  যে যুক্তি বলে আকাশের উৎপত্তি সিদ্ধ হলো, বায়ু সম্পর্কেও সেই যুক্তি প্রযোজ্য। অর্থাৎ আকাশ থেকে বায়ু সৃষ্ট (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৮)।  বায়ু থেকে তেজের উৎপত্তি, তা শ্রুতিশাস্ত্রে বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১০)।  তেজ বা অগ্নি থেকে জলের উৎপত্তি (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১১)।  জল থেকে পৃথিবীর উৎপত্তি। প্রকরণ বা রূপ থেকে এবং অন্য শ্রুতি থেকেও জানা যায় যে, অন্ন শব্দও পৃথিবী-বোধক (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১২)।

তবে শ্রুতি-বচন বা বেদান্তসূত্রের উক্ত উদ্ধৃতি থেকে সৃষ্টিক্রমে এই যে আকাশ, বায়ু, তেজ, জল, পৃথিবী বা অন্নের উৎপত্তি বর্ণিত হয়েছে, তাতে মনে হতে পারে, কোন কোন পদার্থ স্বাধীনভাবেই কোন কোন পদার্থকে সৃষ্টি করে। এই বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে বাদরায়ণ বলেন, ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই এইসব পদার্থে অন্তর্নিহিত থেকে ধীশক্তির দ্বারা কিছু কার্য উৎপাদন করে থাকেন। যেমন, শ্রুতিতে এরকম বলা হয়েছে- ‘সেই তেজ ঈক্ষণ করলেন- আমি বহু হবো, আমি প্রকৃষ্টরূপে জাত হবো… সেই জল ঈক্ষণ করলেন…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।- (ছান্দোগ্য-৬/২/৩-৪)।

এই ‘ঈক্ষণ’ (ধ্যান-মনন) অচেতন পদার্থের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং এখানে বুঝতে হয় যে, পরমেশ্বরই এই পদার্থসমূহের অন্তর্বর্তী অধিদেবতারূপে থেকে ‘ঈক্ষণ’ করে কার্য উৎপাদন করেন। অর্থাৎ এই পদার্থসমূহ তাদের অন্তর্বর্তী পরমেশ্বরের কর্তৃত্বের মাধ্যমেই কারণরূপে বর্তমান থাকতে পারে। এই বক্তব্যই অন্য আরেক শ্রুতিতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়- যিনি পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবী থেকে ভিন্ন, পৃথিবীর অন্তরে থাকলেও পৃথিবী যাঁকে জানে না, স্থূল সূক্ষ্ম সবকিছু নিয়ে পৃথিবী যাঁর শরীর এবং সেই শরীরের অভ্যন্তরে নিত্য জাগরূক থেকে যিনি তাকে নিয়ন্ত্রিত করছেন, তিনিই আপনার আত্মা। তিনিই অন্তর্যামী, অমৃত (বৃহদারণ্যক-৩/৭/৩)।

তাই বেদান্ত সূত্রকার বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করেন- পরমেশ্বরের ধ্যানের দ্বারাই সৃষ্টি-ক্রমের ধারা চলছে। ব্রহ্মই আকাশাদির অন্তরাত্মারূপে বর্তমান থেকে পর পর সৃষ্টি রচনা করেন। ব্রহ্মেরই একমাত্র সৃষ্টিকর্তার লক্ষণ আছে, আকাশাদির নেই। আকাশাদির স্রষ্টৃত্ব মূলত ব্রহ্মেরই কর্তৃত্ব (ব্রঃ-২/৩/১৩)।

আকাশের মতো অন্যান্য মহাভূত- যেমন পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু এর ন্যায় ইন্দ্রিয় এবং মনও একইভাবে উৎপন্ন হয় এবং তার কারণও সেই ব্রহ্মই। কেননা, শ্রুতিতেই বলা হয়েছে- সেই আত্মা বা ব্রহ্ম থেকেই প্রাণ, মন ও সকল ইন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং সর্ববস্তুর আশ্রয় পৃথিবী সম্ভূত হয়েছে (মুন্ডক-২/১/৩)।

অতএব, বাদরায়ণের সিদ্ধান্ত হলো- পরব্রহ্ম থেকে আকাশাদির ন্যায় ইন্দ্রিয়াদিও উৎপন্ন হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১)।  ব্রহ্ম থেকে ইন্দ্রিয়াদির উৎপত্তি গৌণ অর্থে বলা হয়নি। কারণ এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট শ্রুতি বাক্য আছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/২)।  বাক্য ও মন ব্রহ্ম থেকেই সৃষ্ট, এরূপ উক্ত হওয়ায় বাক্য ও মনের ন্যায় প্রাণের জন্মও মুখ্য বলেই বুঝতে হবে (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৪)।

মনোবিদ্যা বা আত্মাতত্ত্ব

ভূমিকা

বাদরায়ণের মতে ব্রহ্ম থেইে জগৎ সৃষ্ট। জগতের মতো আত্মাও ব্রহ্মের শরীর, ব্রহ্ম উভয়েরই অন্তর্যামী আত্মা- এটিই বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদের ভিত্তি বলে মনে করা হয়। ব্রহ্ম ও জগতের অতিরিক্ত তৃতীয় আর একটি বস্তু আছে, বাদরায়ণ যার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন, তা হলো জীবাত্মা। এই জীবাত্মা বহুসংখ্যক। জীবাত্মাতে ব্রহ্ম স্বরূপেই কূটস্থ এবং নিত্য। আর জগৎ স্বরূপে নয়, প্রবাহে অনাদি। একে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সূত্রকার বলেন- জীবাত্মা উৎপন্ন হন একথা শ্রুতি বলেননি। বরং আত্মার নিত্যত্ব ও অজত্ব বিষয়ে শ্রুতি বলেছেন (ব্রঃ-২/৩/১৭)।

যেমন, শ্রুতিতে রয়েছে- ‘এই জন্মরহিত মহান আত্মা’ (বৃহদারণ্যক-৪/৪/২৫)। কিংবা কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে- আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আত্মার কোন উৎপত্তি নেই, আবার আত্মা থেকেও কোন বস্তু উৎপন্ন হয় না। আত্মা জন্মরহিত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং সদা বিরাজমান। দেহের নাশ হয়, কিন্তু আত্মা অবিনাশী (কঠ-১/২/১৮)।

এখানে আত্মা অর্থে জীবাত্মাকেই বোঝানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসে, এই জন্মরহিত আত্মা নিত্য বা অবিনাশী হলে তার সাথে জগতের আদি-কারণ পরমাত্মা ব্রহ্মের সম্বন্ধ বা পার্থক্য কীরূপ? কেননা, শ্রুতিশাস্ত্র জুড়ে উপনিষদগুলিতে আত্মাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে সার্বিক অর্থে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে করে পরমাত্মা ও জীবাত্মাকে বোঝাতে গিয়ে যে দ্ব্যর্থবোধক বিভ্রান্তি বা বিরোধ তৈরি হয়েছে তা নিষ্পত্তিকল্পে সূত্রকার বাদরায়ণকে সেগুলির জন্য বহু ব্যাখ্যাও হাজির করতে হয়েছে। এবং আত্মা বা জীবাত্মার সঙ্গে সর্বব্যাপী ব্রহ্ম বা পরমাত্মার ভেদ ও অভেদও চিহ্নিত করতে হয়েছে। যেমন একটি শ্রুতিতে আছে- সকল অনিত্যের মধ্যে যিনি নিত্য, সকল চেতন বস্তুর মধ্যে যিনি স্বয়ং চৈতন্য এবং যিনি একমাত্র সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণে সক্ষম, তিনিই পরমাত্মা। যে সব প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি এই পরমাত্মাকে নিজ আত্মারূপে দর্শন করেন, কেবল তারাই মনে অপার শান্তি লাভ করেন। অন্যেরা এই শান্তি থেকে বঞ্চিত হন (কঠ-২/২/১৩)।

পরমাত্মা স্বয়ং চৈতন্যস্বরূপ। সকল অনিত্য বস্তুর মধ্যে নিত্যবস্তু পরমাত্মাই নাম-রূপ আরোপিত হয়ে জীবাত্মারূপে প্রতিভাত হন। জীবাত্মার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। তাই পরমাত্মা ও জীবাত্মা যে অভিন্ন, এই সত্য উপলব্ধির কথাই আরো বিভিন্ন শ্রুতিতে বলা হয়েছে। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার এই অভেদাত্মক সম্বন্ধ নিশ্চয়ই বেদান্তের কাশকৃৎস্ন শাখায়ও বেদান্ত শ্রুতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তাই সূত্রকার বলেন- কাশকৃৎস্ন মুনি বলেন, পরমাত্মাই দেহ মধ্যে জীবাত্মারূপে অবস্থিত। সুতরাং জীব শব্দে এই স্থলে পরমাত্মাকেই বুঝতে হবে (ব্রঃ-১/৪/২২)।

কিন্তু জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার এই উপলব্ধিগত অভেদ সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে যে যথেষ্ট ভেদ বা পার্থক্যও রয়েছে তা স্বীকার করেই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- শ্রুতি যেমন জীব-ব্রহ্মের অভেদ নির্দেশ করেছেন সেরূপ ভেদের কথাও বলেছেন। তাই ব্রহ্ম জীব থেকে অধিকতর কিছুই (ব্রঃ-২/১/২২)।

যেসব ভেদ বা পার্থক্য জীবাত্মাকে পরমাত্মা থেকে পৃথক করে, সূত্রকার তাও চিহ্নিত করেছেন। সেগুলি নিম্নরূপ-

আত্মা অণু-স্বরূপ

শ্রুতিতে পরমাত্মা ব্রক্ষকে অদ্বিতীয় সর্বব্যাপী ঘোষণা করে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে তার যে স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে তা হলো- তিনি অদ্বিতীয়, তবু তিনি সর্বভূতে নিহিত। তিনি সর্বব্যাপী, সকলের অন্তরাত্মা। তিনিই সকল কর্মের ফলদাতা, তিনিই সকলকে পালন করছেন, তিনিই চৈতন্যদায়ক, নিরুপাধিক এবং নির্গুণ ও মুক্ত (শ্বেতাশ্বতর-৬/১১)।

আবার দেহত্যাগ করে জীবাত্মার লোকান্তরে গমন বিষয়ে অন্য একটি শ্রুতিতে বলা হয়েছে- পঞ্চাগ্নিবিদ্যায় যাঁরা বিদ্বান এবং এই জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তারা মৃত্যুর পর পূত হয়ে প্রথমে অর্চিলোকে যান। ক্রমে অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয়মাসে। তারপর সেখান থেকে দেবলোকে, দেবলোক থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে বিদ্যুৎলোকে যান। সেখানে আসেন এক মনোময় পুরুষ, তাকে নিয়ে যান ব্রহ্মলোকে। পরমলোক সেই ব্রহ্মলোকে তিনি থেকেই যান। আর শুক্র-শোণিতে ফিরে আসতে হয় না (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫)।

এটিকে বলা হয় দেবযান পথ। প্রায় অনুরূপ শ্রুতি ছান্দোগ্য (ছাঃ-৫/১০/১-২) উপনিষদেও রয়েছে। জীবাত্মাকে পরমাত্মার সাথে অভেদ মানলে এই দুটি শ্রুতির মধ্যে একটা বিরোধ দৃষ্ট হয়। কেননা, আত্মা অখণ্ড ও সর্বব্যাপী হলে জীবাত্মা একস্থান থেকে অন্যস্থানে গমনের বিষয়টাই বিভ্রান্তিকর হয়। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে গিয়ে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন- জীবাত্মার উৎক্রান্তি-গতি, এবং পুনরাগমনের কথা শ্রুতিতে থাকায়- তা ব্রহ্মের ন্যায় বিভু বা সর্বব্যাপী হতে পারে না (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)।   গতি এবং অগতি কর্তার সাথেই সম্বন্ধবিশিষ্ট। আত্মার সম্পর্কে-ই জীবের গতি-অগতি বিচার করা যায়। তাই জীবাত্মা সীমিত পরিমাণ (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)।

এই সীমিত পরিমাণ মানে কতটুকু? এক্ষেত্রেও শ্রুতির প্রমাণই সাক্ষ্য। যেমন- প্রাণবায়ু পাঁচভাগে ভাগ হয়ে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। একই দেহে অণু পরিমাণ আত্মাও রয়েছেন যা শুদ্ধ জ্ঞান বা বুদ্ধির গোচর। সকল বস্তু ও ইন্দ্রিয়ের মধ্যেও চৈতন্যরূপ শুদ্ধ আত্মা বিরাজ করেন। চিত্তশুদ্ধি হলে আত্মা তখন নিজেকে প্রকাশ করেন (মুণ্ডক-৩/১/৯)। একটি কেশাগ্রকে শতভাগে বিভক্ত করে তার প্রতি ভাগকে আবার শতভাগে ভাগ করলে যে এক একটি ভাগ হয়, জীবাত্মা তারই ন্যায় অতি ক্ষুদ্র অণুপরিমাণবিশিষ্ট। আবার এই জীবাত্মাই অনন্ত (শ্বেতাশ্বতর-৫/৯)। এ থেকেই প্রমাণ হয় যে, জীবাত্মা আকারে ক্ষুদ্রতম থেকেও ক্ষুদ্র অণুপরিমাণ-ই। তাই সূত্রকার সিদ্ধান্ত করেন- অণুবোধক এবং অণুপরিমাণবাচক স্পষ্ট শ্রুতিবাক্য থাকাতে বুঝতে পারা যায় যে, জীব অণুপরিমাণই (ব্রঃ-২/৩/২২)।

এখানে আপত্তি আসে যে, জীবাত্মা অণুপরিমাণ হওয়ায় দেহের অতিক্ষুদ্র একাংশে তার অবস্থিতি, ফলে সম্পূর্ণ দেহের উপর বিস্তীর্ণ সুখ-দুঃখাদি উপভোগ করা তার দ্বারা সম্ভব নয়। এই আপত্তির উত্তরে সূত্রকার বলেন- নিজ গুণের দ্বারা ক্ষুদ্র একটি দীপ যেমন বৃহৎ একটি ঘরকে আলোকিত করে, সেইভাবে বিজ্ঞানাদি গুণের দ্বারা ক্ষুদ্র আত্মা একস্থানে অবস্থান করেও সমগ্র দেহে কার্য করতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৫)।   পুষ্পের গন্ধ যেমন পুষ্পে অবস্থিত হয়েও তাকে অতিক্রম করে দূরবর্তী স্থানকেও আমোদিত করে, জীবাত্মাও তেমনি একাংশে থেকেও সর্বদেহে কার্যকর হতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৬)।  শ্রুতিশাস্ত্রেও তার সমর্থন রয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৭)।

যেমন, শ্রুতিশাস্ত্রে এর সমর্থন দেখা যায় কৌষীতকি উপনিষদে- যেমন ক্ষুর থাকে ক্ষুরের খাপের মধ্যে অথবা আগুন থাকে কাঠের মধ্যে তেমনি ঐ বিজ্ঞানময় বা প্রাজ্ঞ চেতন আত্মা এই দেহে প্রবিষ্ট হয়ে কেশ থেকে নখাগ্র পর্যন্ত সর্বত্র সঞ্চারিত হয়ে অবস্থান করছেন (কৌষীতকি-৪/১৯)।

গন্ধ যেমন নিজের দ্রব্য পৃথিবীর গুণ হয়েও তা থেকে ভিন্ন, জ্ঞানও তেমনি আত্মা থেকে ভিন্ন। যদিও কোথাও কোথাও আত্মাকে জ্ঞান বা বিজ্ঞান বলা হয়েছে, কিন্তু তা এজন্যেই বলা হয়েছে যে জ্ঞান আত্মার সার থেকে জাত গুণ, এবং সেইজন্যও যেখানে যেখানে আত্মা আছে, সেখানে সেখানে জ্ঞান অবশ্যই থাকবে। যেমন, কৌষীতকি উপনিষদে বলা হয়েছে- বাক্ বা বক্তব্যকে জানার চেষ্টা করবে না। বক্তাকে জানবে। গন্ধ বা গন্ধবস্তুকে জানার চেষ্টা করবে না। যিনি ঘ্রাণেন্দ্রিয় হয়ে আঘ্রাণ দিচ্ছেন তাকে জানবে। রূপকে জানতে চেষ্টা করবে না, দ্রষ্টাকে জানবে। শব্দকে জানতে চেষ্টা করবে না, শ্রোতাকে জানবে। অন্নরসকে জানতে চেষ্টা করবে না। তাকে যিনি জানেন, তাকে জানবে। কর্মকে জানতে ইচ্ছুক হবে না, কর্তাকে জানবে। সুখ-দুঃখকে জানতে চেষ্টা না করে, তার যে বিজ্ঞাতা, তাকে জানতে আগ্রহী হবে। আনন্দ, রতি, সন্তান-সন্ততির উপভোগ জানতে উৎসুক না হয়ে, এসবের বিজ্ঞাতাকে জানবে। গতিকে জানার জন্য আগ্রহী না হয়ে, গমনকারীকে জানবে। মনকে জানতে উদ্গ্রীব না হয়ে যিনি মনন করছেন তাকে জানার চেষ্টা করবে। কে সেই বক্তা, দ্রষ্টা, শ্রোতা, কর্তা, বিজ্ঞাতা? তিনি হলে প্রজ্ঞা, চৈতন্যময় আনন্দস্বরূপ, অমৃতময় আত্মা। তাই বলে প্রতর্দন, এমন কথা কখনো ভেবো না যে দুটি ভিন্ন। আপাতদৃষ্টিতে দুটি পৃথক হলেও আসলে কিন্তু পৃথক নয়। যেমন গাছের সঙ্গে ফুল-ফলের সম্পর্ক, এখানেও তাই (কৌষীতকি-৩/৬)। দশটি ভূতমাত্রা, নাম থেকে মন পর্যন্ত প্রজ্ঞাকে আশ্রয় করে আছে। তাই এদের বলা হয় ‘অধিপ্রজ্ঞ’। আবার দশটি প্রজ্ঞামাত্রা ঐ ভূতমাত্রাকে অবলম্বন করে আছে। তাই তারা হলো ‘অধিভূত’। স্বতন্ত্র হয়েও কেউ নিরপেক্ষ নয়। যদি নাম, দৃশ্য, গন্ধ ইত্যাদি ভূতমাত্রা অর্থাৎ বিষয় জগতের উপাদান না থাকতো, তাহলে মুখ, চোখ, ঘ্রাণ ইত্যাদি প্রজ্ঞামাত্রা অর্থাৎ বিষয়ীরাও থাকতো না। আবার বাক্, চোখ ইত্যাদি প্রজ্ঞামাত্রা ইন্দ্রিয়রা যদি না থাকতো তাহলে কথা, রূপ, গন্ধ এসব ভূতমাত্রা বিষয়ও থাকতো না। ইন্দ্রিয় আর বিষয় কেউ কারো সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত নয়। ইন্দ্রিয় না থাকলে বিষয়কে জানা যেতো না। আবার বিষয় না থাকলে ইন্দ্রিয়ও অর্থহীন হতো। তাই- আলাদা হলেও আসলে কিন্তু এক। যেমন রথের চাকা। গোলাকার কাঠের বেড় বা পরিধি। মাঝে একটা ‘অর’ নাভি, চলতি কথায় যাকে বলে ‘মাদল’। এই মাদলে আছে বেশ কয়েকটা গর্ত। সেই গর্ত থেকে এক-একটা কাঠের শলাকা বেরিয়ে পরিধি বা নেমির শরীর ফুটো করে তাকে ধরে রেখেছে এমনভাবে যে, নেমির সাধ্য নেই খসে আলাদা হয়ে যায়। কাঠের শলাকাগুলো হলো ইন্দ্রিয় আর নেমি হলো নামাদি বিষয়। এই প্রাণই হলো প্রজ্ঞা বা চেতন-আত্মা। আনন্দস্বরূপ, অৎর, অমৃত (কৌষীতকি-৩/৭)।

এইসব শ্রুতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রজ্ঞা (বিজ্ঞান) দেহ থেকে পৃথক- এদের মধ্যে করণ-কর্তা সম্পর্ক বর্তমান এবং এই বিশেষ গুণ সহায়েই আত্মা সর্বদেহব্যাপী হয়ে বর্তমান। তাই সূত্রকার বলেন- শ্রুতিতে জ্ঞান হতে জীবাত্মার পৃথকত্ব উপদেশ করা হয়েছে। অতএব বিজ্ঞানময়তায় জীব মহৎ হলেও জীব আসলে অণুই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৮)।   প্রাজ্ঞ পরমাত্মার বৃহৎগুণ থাকায় যেমন তাকে ব্রহ্ম বলা হয়, তেমনি জীবাত্মার গুণেও বিভুত্ব থাকায় কোন কোন শ্রুতি জীবকেও বিভু বলেছেন। কিন্তু জীবাত্মা অণুই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৯)।   গুণে জীবাত্মাকে বিভু বলা দোষযুক্ত নয়। কারণ আত্মা যতদিন থাকবে তার গুণও ততদিন থাকবে। আত্মা নিত্যহেতু তার গুণও নিত্য (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩০)।

তদুপরি বাদরায়ণ বলেন, এই জ্ঞান যদি দৃষ্টিগোচর না হয় তবে তাকে তুলনা করতে হবে বাল্যাবস্থায় শিশুর অপ্রকটিত পৌরুষের সঙ্গে। জ্ঞান শরীরের মধ্যেই অবস্থিত, এতেও প্রমাণিত হয় যে জীবাত্মা অণু। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- পুরুষের ধর্ম যেমন বাল্যে প্রকাশিত হয় না, তেমনি জীবের জ্ঞানও সুষুপ্তি অথবা প্রলয়ে অপ্রকাশিত থাকে। কিন্তু জাগ্রৎ-কালে প্রকাশিত হতে দেখা যায় (ব্রঃ-২/৩/৩১)।

কারণ, সুষুপ্তি অবস্থায় জ্ঞান যে অপ্রকাশিত থাকে তা শ্রুতিতেই বলা হয়েছে- …যখন কাউকে বলা হয় ‘ইনি ঘুমোচ্ছেন’, তখন হে সোম্য, তিনি সৎ-এর সঙ্গে একীভূত হন এবং স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হন। সেইজন্য লোকে একে ‘সুষুপ্ত’ (স্বপিতি) বলেন, কারণ তখন তিনি স্ব-স্বরূপে থাকেন (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)।

অর্থাৎ সুষুপ্তিকালে বুদ্ধির সঙ্গে আত্মার এই সংযোগ খুব সূক্ষ্ম এবং সম্ভাবনাপূর্ণ অবস্থায় বর্তমান থাকে। তা না হলে জাগ্রৎ অবস্থায় তা বিকশিত হয়ে উঠতে পারতো না। পুরুষত্ব শক্তিটি যৌবনে বিকশিত হয়, যদিও মাত্র তা সম্ভাবনাময় অবস্থায় শৈশবে বর্তমান থাকে। সুতরাং এই সংযোগটি বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত থাকে যে-পর্যন্ত ব্যাষ্টি সত্তার (জীবরূপে) অবস্থাটি বর্তমান থাকে।

আত্মা কর্তা

আত্মা কর্তা, শ্রুতিতে এর প্রচুর প্রমাণ আছে। কেননা, আত্মা কর্তা না হলে তাকে ভোক্তা বলে মানা ভুল। বেদশাস্ত্রে বা উপনিষদের শ্রুতিতে স্বর্গাদিলাভের উদ্দেশ্যে কিছু যাগযজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের কথা জীবের দ্বারা করণীয় বলে ব্যবস্থাপিত হয়েছে। যদি জীবাত্মা কর্তাই না হন, তাহলে শ্রুতির এজাতীয় উপদেশগুলি নিরর্থক প্রতিপন্ন হবে। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন- শাস্ত্র স্বর্গাদিলাভের জন্য যে যজ্ঞাদির কথা উপদেশ করেছেন তা সার্থক হয় তখনই যখন জীবকে এইসবের কর্তা বলে মান্য করা হয় (ব্রঃ-২/৩/৩৩)।

আবার শ্রুতিবচন থেকে জানা যায়, যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্রুতিতে বলা হয়েছে- মানুষ যখন ঘুমোতে যায়, তখনো তার দুটো অবস্থা। একটা হলো স্বপ্নাবস্থা। মানুষটি শুয়ে ঘুমোচ্ছে, সাধারণ চোখ দিয়ে যেমন দেখে সেরকম দেখছে না, সাধারণ কান দিয়ে যেমন শুনতে পাচ্ছিলো সেভাবে আর শুনতে পাচ্ছে না, ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস যেভাবে সে অনুভব করছিলো সেভাবে করতে পাচ্ছে না, অথচ সে সবকিছুই করে চলেছে। মহারাজ, মহাব্রাহ্মণের মতো ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে নিষ্ক্রিয়, কিন্তু ভেতরে রীতিমতো সক্রিয়। একজন মহারাজ যেমন তার অধীন প্রজাদের নিয়ে খেয়াল-খুশিমতো ঘুরে বেড়ায়। সেই বিজ্ঞানময় পুরুষ বা বলতে পারেন, স্বপ্নপুরুষ ইন্দ্রিয়দের নিজের অধীনে রেখে নিজের দেহের ভেতরে থেকেই ইচ্ছামতো ঘোরে-ফেরে, কাজ-কর্ম করে  (বৃহদারণ্যক-২/১/১৮)। এরপর সুষুপ্তি অবস্থা। জেগে থাকার সময় সমস্ত ইন্দ্রিয় নিয়ে ঐ বিজ্ঞানময় পুরুষ যেসব বিষয় উপভোগ করে, ঘুমোতে যাবার সময় স্বপ্নের মধ্যে সে যার আস্বাদ নেয়, সুষুপ্তির মধ্যে কোন বিষয়ই সে উপভোগ করে না। ঘুমের অতল সাগরে সে তখন তলিয়ে থাকে। কোন তরঙ্গই সে সময় তাকে স্পর্শ করে না… (বৃহদারণ্যক-২/১/১৯)।

শ্রুতি অনুযায়ী, এই যে স্বপ্নাবস্থায় জীবাত্মা ইন্দ্রিয়গুলিকে সাথে নিয়ে বিচরণ করে থাকেন, এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, জীব কর্তা। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন- বিহার বা বিচরণাদির উপদেশ থেকেও বুঝা যায় যে, জীব কর্তা (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৪)।  শ্রুতিতে ইন্দ্রিয়াদিকে গ্রহণরূপ কার্যের উপদেশ থাকায় জীব কর্তা-ই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৫)।

এখানে একটি আপত্তি উঠে যে, বুদ্ধি না হয়ে জীব বা আত্মা যদি কর্তাই হয়, তাহলে যা তার পক্ষে কল্যাণকর শুধু সেসব কর্মেরই অনুষ্ঠান করতো- শুভ-অশুভ উভয় কর্ম করতো না। এই আপত্তি খণ্ডন করে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন, বুদ্ধি আসলে করণ। যদি বুদ্ধিকে কর্তা বলা হয় তাহলে তা করণ হিসাবে কার্য সহায়ক হতে পারে না- ফলে আমাদের অন্য কিছুকে করণরূপে কল্পনা করতে হয়। আর জীব যেমন স্বাধীন হলেও প্রিয় ও অপ্রিয় উভয়কেই অনুভব করে, ঠিক তেমনি শুভ ও অশুভ উভয় প্রকার কার্যই করতে পারে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- জীব কর্তা হলেও শুভাশুভ কার্য সম্পাদনে তার কোন নিয়মিত কর্তৃত্ব বা নিয়ম নেই  (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৭)।  বুদ্ধিকে কর্তা বললে বুদ্ধির করণত্বও লোপ হয়- তা কর্তা হয়ে যায়। আসলে জীবেরই কর্তৃত্ব (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৮)।

তাছাড়া যদি আত্মা কর্তা না হন, তাহলে সাংখ্য-যোগ-সম্মত সমাধিরই বা কী প্রয়োজন? এছাড়া শ্রুতিশাস্ত্রে যে আছে সমাধির দ্বারা ‘আত্মাকে জানতে হবে’ (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫), তা অর্থহীন হয়ে যায়। সুতরাং আত্মার পক্ষে শাস্ত্রানুযায়ী ‘শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন’ ইত্যাদি সহায়ে সাধনা করে জ্ঞান উৎপাদন এবং সমাধিলাভ করাও সম্ভব হবে না। ফলে জীবাত্মার পক্ষে মোক্ষলাভ করাও হবে না। বরং আত্মাকে কর্তা বলে মেনে নিলে তাকে নিষ্ক্রিয় বসে থাকতে দেখলে দোষ হবে না। তাই বেদান্তসূত্রানুসারে- আত্মার কর্তৃত্ব স্বীকার না করলে আত্মজ্ঞানলাভের জন্য যে সমাধির উপদেশ আছে তা বৃথা হয়ে পড়ে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)।   সূত্রধর (কাষ্ঠশিল্পী) ইচ্ছানুসারে কর্তা এবং অকর্তা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু অচেতন বুদ্ধি তা পারে না। সুতরাং জীবই কর্তা (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪০)।

অর্থাৎ উপাধিযুক্ত জীবই কর্তা। কেননা, শাস্ত্রেও সকল উপদেশই হলো আত্মার বিশেষ গুণযুক্ত অবস্থা বিষয়ে। যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে- এই নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ অর্থাৎ বিজ্ঞানময় পুরুষ (=আত্মা) জন্মগ্রহণ করে যখন শরীর ধারণ করে তখন জাগতিক ধর্ম-অধর্মের নিয়মাধীন হয়ে পাপের সঙ্গে যুক্ত হন। আবার দেহান্তে অর্থাৎ এই শরীর ত্যাগ করার সময়, যাবতীয় পাপকেও পরিত্যাগ করে যান (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৮)।

আত্মা স্বভাবত নিষ্ক্রিয়- যখনই মন বুদ্ধি ইত্যাদি উপাধির সঙ্গে যুক্ত হয় তখনই আত্মা সক্রিয় হয়। যদি জীবাত্মা স্বভাবতই কর্তা না হন, তাহলে শাস্ত্রের উপদেশ ব্যর্থ হয়ে যায়। কর্তার মধ্যে কর্তৃত্ব ক্ষমতা থাকেই, সে তাকে কখনো ব্যবহার করে, কখনো করে না। শ্রুতিতে সিদ্ধ করা হয়েছে যে জীবাত্মার এই কর্তৃত্বশক্তি পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত। যেমন কৌষীতকি উপনিষদে বলা হয়েছে- এই যে আত্মা, শাস্ত্রবিহিত সাধু কাজ করলে যে তার লাভ হলো, বৃদ্ধি হলো- তা যেমন হয় না; আবার অশাস্ত্রীয় অসাধু কাজ করলে যে ক্ষতি হলো, হীন হলো, তাও হয় না। এই মহাপ্রাণ চেতন আত্মা চলেন নিজের ইচ্ছায়। তিনি যদি মনে করেন এ জগতে কাউকে মহান করে তুলবেন, তখন তিনিই তাকে দিয়ে সাধু কাজ করিয়ে নেন। আবার যদি মনে করেন, কারো অধঃপতন ঘটাবেন, তাহলে রাজ্যের অসাধু কাজ তিনিই তাকে দিয়ে করিয়ে নেবেন। ইনি লোকপাল- জীবের প্রভু। ইনি সর্বেশ- সমস্ত গুণসম্পন্ন। জানবে- সেই আত্মাই আমার আত্মা, আমার স্বরূপ। ‘তিনিই আমার আত্মা’- তাকে এইভাবে জানবে। ঐ আত্মাই আমার স্বরূপ (কৌষীতকি-৩/৮)।

অতএব, বাদরায়ণও বেদান্তসূত্রে এই সিদ্ধান্ত করেন- শ্রুতি বাক্যানুসারে জীবের কর্তৃত্ব পরমাত্মা পরমেশ্বরের অধীন (ব্রঃ-২/৩/৪১)।

কিন্তু শ্রুতি অনুযায়ী জীবের ক্রিয়া পরমেশ্বরের অধীন হলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, যেহেতু ঈশ্বর কোন কোন ব্যক্তিকে সৎকার্যে এবং কাউকে আবার মন্দ কার্যে প্রবৃত্ত করেন সেকারণে তাকে নিষ্ঠুর এবং অবিবেকী মনে হতে পারে। এই আপত্তি খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলেন- জীবের ধর্ম-অধর্ম কার্যানুসারেই ঈশ্বর তাকে শুভ-অশুভ কর্মে প্রবৃত্তি দিয়ে থাকেন। অতএব শাস্ত্রোক্ত বিধি-নিষেধের সার্থকতা আছে (ব্রঃ-২/৩/৪২)।

অর্থাৎ, শাস্ত্রানুসারে, ঈশ্বর জীবের পূর্ব পূর্ব জন্মের সুকৃতি  বা দৃষ্কৃতি অনুসারেই শুভাশুভ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এবং সংসার যেহেতু অনাদি, নিশ্চয়ই পুনঃপুনঃ পূর্ব জন্মগুলির কর্মফল তাতে থাকবেই- এবং ঈশ্বরই এসব কর্মফলানুসারে জীবের নিয়ন্তা। সুতরাং ঈশ্বরকে নিষ্ঠুর বা স্বৈরাচারী বলে দোষারোপ করা যায় না। এভাবে বুঝলেই শাস্ত্রের কর্তব্য-অকর্তব্যের বিধিনিষেধের সার্থকতা উপলব্ধি করা যায়। তা নাহলে জীব এসব শাস্ত্র উপদেশ পালন করে কোন লাভবান হতো না। এতে কিন্তু ঈশ্বরের স্বাধীনতার কোন হানি হয় না। যদিও বলা যেতে পারে যে, তিনি তো জীবের শুভাশুভ ক্রিয়ার উপরই ফলদান ব্যাপারে নির্ভরশীল- তিনি যা খুশি তা-ই করতে পারেন না। এর উত্তরে বলা হয়, একজন রাজা যেমন তার প্রজাকে তাদের কর্মানুসারে পুরস্কার বা শাস্তি দিয়ে থাকেন- কিন্তু এর দ্বারা রাজার সার্বভৌমত্বেও কোন হানি হয় না।

আত্মা ব্রহ্ম নয়, ব্রহ্মেরই অংশ

জীবাত্মা ব্রহ্মের অংশ, উপনিষদ সম্মত এই বিচার বাদরায়ণ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন- জীব পরমাত্মার অংশ, কারণ শ্রুতিও জীব এবং ব্রহ্মের ভেদ সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন; আবার অভেদও উপদেশ করেছেন। অতএব জীব ও ব্রহ্মের ভেদাভেদ সম্বন্ধ স্থিরীকৃত হয় (ব্রঃ-২/৩/৪৩)।

যেমন এ বিষয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্রুতি উপদেশে বলা হয়েছে- মৈত্রেয়ী, সর্বত্রই এই আত্মা। সকলকে ব্যাপ্ত করে রয়েছেন একই আত্মা। সেই আত্মাকেই দর্শন করতে হবে, শ্রবণ করতে হবে, মনন করতে হবে, নিদিধ্যাসন বা ধ্যান করতে হবে। এই আত্মার দর্শন, শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ঠিকমতো প্রত্যয়ের সঙ্গে করতে পারলেই তার সব জানা হয়ে যাবে। অমৃতের মধুমাখা অনুভূতি নিয়ে অখণ্ড-সত্তায় তার প্রাণ ভরে উঠবে। আত্মজ্ঞান যার হয়, সবকিছুর সঙ্গে যে একাত্ম হতে পারে, তার কাছ থেকে কি অমৃত দূরে থাকতে পারে? (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫)।

ভেদের মধ্যে এই অভেদের উপলব্ধির পাশাপাশি ছান্দোগ্য উপনিষদের সেই অন্যতম শ্রুতিটিও স্মরণ করা যেতে পারে- এই গায়ত্রী-ব্রহ্মের মহিমা যে পরিমাণ, সর্বব্যাপী পূর্ণব্রহ্ম পুরুষের মহিমা এর থেকেও ব্যাপক ও মহত্তর। সর্বভূত এই পুরুষের এক পাদ মাত্র। অবশিষ্ট তিন পাদ স্বর্গে অমৃতরূপে প্রতিষ্ঠিত (ছান্দোগ্য-৩/১২/৬)।

এখানে ভূত বলতে জীবকেই বোঝানো হয়েছে। এবং এই ভূতময় জীবসমূহকে পরমেশ্বরের একপাদ বা একটি অংশ বলা হয়েছে। একইভাবে জীবাত্মাকে পরমাত্মার অংশ হিসেবে বর্ণিত স্মৃতিশাস্ত্রেরও উদাহরণ রয়েছে, যেমন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পুরুষোত্তমযোগে বলা হয়েছে- সংসারে জীব আমারই সনাতন অংশ। দেহাদিসংঘাতের কর্তা জীব যখন শরীর থেকে উৎক্রমণ করে, তখন পঞ্চেন্দ্রিয় ও মনকে আকর্ষণ করে (গীতা-১৫/৭)।   বায়ু যেভাবে পুষ্পাদি হতে গন্ধ আহরণ করে, জীব সেভাবে শরীরান্তরগ্রহণকালে পূর্বদেহ থেকে মন ইন্দ্রিয়াদি সংস্কার সঙ্গে নিয়ে যায় (গীতা-১৫/৮)।

অতএব বেদান্তসূত্রে সূত্রকার বাদরায়ণের সিদ্ধান্ত হলো- শ্রুতিমন্ত্র থেকেও জীব যে পরমেশ্বরের অংশ তা প্রমাণিত হয় (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪৪)।  স্মৃতিশাস্ত্রও তাই বলেন (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪৫)।

কিন্তু জীব যদি পরমেশ্বরের অংশই হন, তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, পরমেশ্বরও জীবেরই মতো সুখ-দুঃখের অনুভব করে থাকেন- যেমন কোন বস্ত্রের সূতোগুলি যদি মলিন হয়, তবে বস্ত্রটিও মলিন হবে। এই আপত্তি খণ্ডন করতে গিয়ে সূত্রকার বলেন, পরমেশ্বর জীবের ন্যায় সুখ-দুঃখ অনুভব করেন না। কারণ- জীব ব্রহ্মের অভিন্ন অংশ হলেও অংশ-রূপ জীবের সুখ-দুঃখাদি ব্রহ্মকে বিচলিত (দূষিত) করতে পারে না- যেমন সূর্যের কিরণ অপবিত্র বস্তুতে স্পৃষ্ট হলেও দূষিত হয় না (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪৬)।   এবং জীব পরমাত্মার একটি আভাস বা প্রতিবিম্ব মাত্র। তাই জীবের সুখ-দুঃখ পরমাত্মাকে স্পর্শ করে না (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৫০)।

শাস্ত্রানুযায়ী, অবিদ্যাহেতু জীব নিজেকে দেহ এবং মনের সঙ্গে একীভূত করে নেয় বলেই সুখ-দুঃখ অনুভব করে থাকে। জলে যেমন প্রতিবিম্বিত সূর্যকে জলের তরঙ্গের কম্পনের সঙ্গে কম্পিত হচ্ছে বলে মনে হয়- কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তার কোন বিকার হয় না, ঠিক তেমনি পরমেশ্বরও তার কল্পিত অংশ জীবের সুখ-দুঃখ অনুভবের দ্বারা বিকারপ্রাপ্ত হয় না। ‘জীব ও পরমাত্মা এই দুয়ের মধ্যে পরমাত্মা হলেন শাশ্বত এবং নির্গুণ। পদ্মপত্রে জলের ন্যায় ইনি কর্মফলের দ্বারা লিপ্ত হন না…।’ এরকম সাক্ষ্য ‘স্মৃতিশাস্ত্রেও রয়েছে’ (‘স্মরন্তি চ’- ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪৭)। যেমন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় জ্ঞানবিজ্ঞানযোগে শ্রীভগবানের উক্তিতে বলা হয়েছে- প্রাণিদের যে সকল সাত্ত্বিক (শমদমাদি), রাজসিক (হর্ষাদি) ও তামসিক (শোক-মোহাদি) ভাব স্বকর্মফলে উৎপন্ন হয়, তা আমার থেকেই উৎপন্ন জানবে। যদিও তারা আমার থেকে উৎপন্ন, তবুও জীবের ন্যায় আমি সেসব ভাবের অধীন নই; কিন্তু সেসব ভাব আমার অধীন (বশীভূত) (গীতা-৭/১২)।

আবার বিভিন্ন শ্রুতিশাস্ত্রেও ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনায় ইতঃপূর্বে দেখেছি যে- ‘তিনি সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ ও সর্বরস’ (ছান্দোগ্য-৩/১৪/২); ‘ইনি অস্থূল, অনণু, অহ্রস্ব, অদীর্ঘ ইত্যাদি’ (বৃহদারণ্যক-৩/৮/৮)। কিংবা কঠ-উপনিষদের শ্রুতিতে যিনি- যা শব্দহীন, স্পর্শহীন, রূপহীন, গন্ধহীন, যা শাশ্বত ও অবিনাশী, অনাদি ও অনন্ত, যা হিরণ্যগর্ভের চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং নিত্যবস্তু- সেই আত্মাকে জেনে মানুষ মৃত্যুকে অতিক্রম করে (কঠ-১/৩/১৫)।

এবং এসব শ্রুতি-প্রামাণ্য মেনে ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনায় বাদরায়ণও স্পষ্টতই বলেছেন যে- ব্রহ্ম সুনিশ্চিতভাবেই নিরাকার। কারণ সকল শ্রুতিই ব্রহ্মের নিরাকারত্বকেই প্রতিষ্ঠা করতে চান (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/১৪)।   শাস্ত্রে যে ব্রহ্মের সাকারভাবের উপদেশ আছে তা নিরর্থক নয়। নিরাকার আলোক যেমন সাকার বস্তুর সান্নিধ্যে এসে আকার প্রাপ্ত হয়, সেভাবেই নিরাকার ব্রহ্মও উপাধিযুক্ত জীবের সান্নিধ্যে এসে সাকার হন (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/১৫)।   জীব সর্বাবস্থায় পরব্রহ্মের সাথে মিলিত হয়ে থাকলেও তার কোন দোষ (বিকার) ব্রহ্মে সঞ্চারিত হয় না, তা শ্রুতিপ্রমাণে অবগত হওয়া যায় (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/১১)।

অতএব এটা প্রমাণিত যে, জীবাত্মা ব্রহ্ম নয়। কিন্তু এখানে আবার প্রশ্ন উঠতে পারে যে, শুদ্ধ ব্রহ্মের অংশ হওয়ায় আত্মাও তো শুদ্ধ, অতএব তার পাপ-পুণ্য সম্বন্ধীয় বিধিনিষেধের আর কী আবশ্যকতা? এই প্রশ্নের সমাধানে দৈহিক ব্যাপারে ছ্যুৎ-অছ্যুৎ বিষয়ে বাদরায়ণের কট্টর পক্ষপাতিত্ব চোখে পড়ে। কেননা তিনি সমাধান করেছেন যে, দেহ-সম্বন্ধে বিধিনিষেধের আবশ্যকতা আছে, যেমন অগ্নি এক হলেও অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণের গৃহের অগ্নি যেমন গ্রাহ্য, শ্মশান বহ্নি তেমন ত্যাজ্য- দেহের সাথে সম্পর্ক থাকায় জীবের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য, যেমন জ্যোতি ইত্যাদির দৃষ্টান্তে ত্যাজ্য-গ্রাহ্য আছে (শ্মশানাগ্নি বর্জনীয়, যজ্ঞাগ্নি গ্রহণীয়) (ব্রঃ-২/৩/৪৮)।

পরমাত্মার সঙ্গে জীবের অভিন্নতাহেতু কর্মফল বিষয়ে এখানে একটি সংশয় দেখা দিতে পারে যে, প্রত্যেক জীবের কৃত কর্মফল অন্যান্য জীবও ভোগ করতে পারে। এই সংশয় দূর করতে বাদরায়ণ বলেন- জীব ব্রহ্মের অংশ হলেও ভিন্ন ভিন্ন শরীরে তা পৃথক পৃথক। তাই এক জীবের কর্মফল অন্য জীবে সংক্রামিত হতে পারে না (ব্রঃ-২/৩/৪৯)।

অর্থাৎ, জীবাত্মা বলতে বোঝায় কোন একটি বিশেষ দেহ, মন ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আত্মা এবং যেহেতু এই দেহগুলি পরস্পর থেকে ভিন্ন, একের মধ্যে অন্যটি অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই জীবাত্মাগুলিও পরস্পর ভিন্ন। সুতরাং একে অন্যের কর্মফল ভোগ করবে এমন সংশয় থাকা সম্ভব নয়। সাংখ্যবাদী, বৈশেষিক ও নৈয়ায়িক যারা আত্মার বহুত্বকে স্বীকার করেন- আবার সকল আত্মাকেই সর্বব্যাপী বলে মনে করেন, অদৃষ্ট বা কর্মফল ভোগের ব্যাপারে তাদের সংশয় থাকতেই পারে। তাই তাদের সম্পর্কে বাদরায়ণের অভিমত হলো- অদৃষ্ট পদার্থের স্থির কোন স্থিতি নেই। যাঁরা জীবাত্মার বহুত্বের সঙ্গে সকল জীবাত্মারই সর্বব্যাপিত্বে বিশ্বাস করেন- তাদের নানা সংশয় থাকতে পারে (ব্রঃ-২/৩/৫১)।

যদিও শরীর শরীরী-ভাব থেকেই বাদরায়ণ আত্মাকে ব্রহ্মের অন্তর্গত অভিন্ন অংশ বলে মেনেছেন, তথাপি আত্মা ও ব্রহ্মের স্বরূপের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রাখতে চেয়েছেন। বেদান্তসূত্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবাত্মার সাথে পরমাত্মা ব্রহ্মের ভেদের উল্লেখ থেকে বাদরায়ণ বলতে চেয়েছেন যে, ব্রহ্ম জীবের অধিক। যেমন- মুক্ত পুরুষ জগৎ সৃষ্ট্যাদি শক্তি ব্যতীত অন্যান্য সর্ববিধ শক্তির অধিকারী হন। সৃষ্টি প্রকরণে ঈশ্বরের উল্লেখ আছে। ঐ প্রকরণে মুক্ত পুরুষের কোন উল্লেখই নেই। মুক্ত পুরুষের ক্ষমতা সসীম (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১৭)। শুধু ভোগব্যাপারে মাত্র পরমেশ্বর এবং মুক্ত পুরুষের মধ্যে সাম্যভাব আছে- সর্ব শক্তিমত্তা বিষয়ে নয়। সৃষ্ট্যাদি পরমশক্তির অধিকারী একমাত্র পরমেশ্বর- মুক্ত জীব নয় (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/২১)।

অর্থাৎ, দেহমুক্ত হয়ে জীবাত্মার ব্রহ্মপ্রাপ্তির পর আত্মা যখন স্বরূপে প্রকটিত হয়, সেই মুক্ত হওয়ার পরেও জগৎ সৃষ্টি প্রভৃতির কথা ছেড়ে দিয়ে মাত্র আত্মা ও ব্রহ্মের মধ্যে ভোগের সমানতার কথা বললেও বাদরায়ণ আত্মা ও ব্রহ্মের ঐক্যকে কোন অবস্থাতেই সম্ভব বলে মানেননি। কেননা, নাম এবং রূপের সৃষ্টি পরমেশ্বরেরই কার্য, জীবের কার্য নয়- সৃষ্ট পদার্থের নাম ও রূপ কল্পনা ও ত্রিবিধ কর্তা পরমাত্মারই কার্য, কারণ শাস্ত্রে এমনই বলা আছে (ব্রঃ-২/৪/২০)।

আত্মার সাধন

বলা হয়, বিজ্ঞানময় ব্রহ্মই স্বয়ং উপাধিযুক্ত হয়ে, সসীম দেহ ইত্যাদি যুক্ত হয়ে- জীবরূপ ধারণ করেন। সেইজন্যই বিজ্ঞানময়তা জীবের স্বভাবধর্ম এবং মূর্চ্ছা বা সুষুপ্তি অবস্থায় এই বিজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় না। কারণ- (সৃষ্ট হননি বলেই) নিত্য আত্মা স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপ (ব্রঃ-২/৩/১৮)।

কিন্তু অণু পরিমাণযুক্ত আত্মার ক্রিয়া ও জ্ঞানের প্রকাশ বা উপায় হলো উপাধিযুক্ত ইন্দ্রিয়াদি। যেমন মাণ্ডূক্য উপনিষদে বলা হয়েছে- জাগ্রত অবস্থায় আমরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে সচেতন এবং ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা এই জগৎকে উপলব্ধি করি। যাঁর সাতটি অঙ্গ এবং উনিশটি মুখ বা উপলব্ধির দ্বারা জীব হিসেবে তিনিই এই স্থূলদেহ ভোগ করেন। এটিই আত্মার প্রথম প্রকাশ (মাণ্ডূক্য-উপ-৩)।

অধিকাংশ শ্রুতিতে ইন্দ্রিয় ‘প্রাণ’ বলেই আখ্যায়িত হয়। এই ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা কতো? মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে- সেই ব্র্হ্ম থেকেই সাতটি প্রাণ বা ইন্দ্রিয়ের উদ্ভব। এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি বিষয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসকল, সাত প্রকার বিষয় জ্ঞান, জীবদেহে এই সাত ইন্দ্রিয়ের সাতটি অধিষ্ঠান- এ সবই ব্রহ্ম থেকে এসেছে। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ইন্দ্রিয়সকল আত্মায় বিলীন হয়। আত্মা তখন (যেমন সুষুপ্তিকালে) হৃদয়াকাশে বিরাজ করেন (মুণ্ডক-২/১/৮)।

আবার কোন কোন শ্রুতিতে আট বা ততোধিক ইন্দ্রিয়ের উল্লেখ আছে। যেমন বৃহদারণ্যক উপনিষদেই বলা হয়েছে- প্রাণ গ্রহ (ইন্দ্রিয়)। অপানবায়ু অতিগ্রহ। প্রাণবায়ু অর্থাৎ ঘ্রাণেন্দ্রিয় যে আঘ্রাণ নেয়, গন্ধ গ্রহণ করে তা এই অপানবায়ুর সাহায্যে (বৃঃ-৩/২/২)।  বাগিন্দ্রিয় দ্বিতীয় গ্রহ। এই ইন্দ্রিয়ের বিষয়- নাম। বাক্ই নাম উচ্চারণ করে। তাই তার নাম অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৩)।  জিহ্বা তৃতীয় গ্রহ। এই রসনেন্দ্রিয়ের বিষয় হলো রস গ্রহণ করা। তাই রাস তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৪)।  দর্শনেন্দ্রিয় চক্ষু- চতুর্থ গ্রহ। চক্ষুই রূপ দেখে। রূপই তার দেখার বিষয়। তাই রূপ তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৫)।  শ্রোত্রেন্দ্রিয় কর্ণ হলো পঞ্চম গ্রহ। এর বিষয় হলো শব্দ। কানই শব্দ শোনে। তাই শব্দ তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৬)।  মন হলো ষষ্ঠ গ্রহ। মনই কামনা করে। মনই কামনার বশ। তাই কামনা হলো তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৭)।  হাত দুটি হলো সপ্তম গ্রহ। হাতের বিষয় হলো কর্ম। কারণ মানুষ হাত দিয়েই কর্ম করে। তাই কর্ম তার অতিগ্রহ (বৃঃ-৩/২/৮)।  আর ত্বক- এটি হলো অষ্টম গ্রহ। ত্বক-ইন্দ্রিয়ের বিষয় হলো স্পর্শ। মানুষ ত্বক দিয়েই যাবতীয় স্পর্শ অনুভব করে। তাই স্পর্শ হলো তার অতিগ্রহ। এই হলো আটটি গ্রহ আর আটটি অতিগ্রহ (বৃহদারণ্যক-৩/২/৯)।

এই শ্রুতিগুলির মধ্যে বিরোধ তৈরি হতে পারে বিধায় এই বিরোধ পরিহার ও সমন্বয় করে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন- অন্য শ্রুতিতে হস্তাদি প্রাণ বা ইন্দ্রিয়সমূহের উল্লেখ থাকায় প্রাণ বা ইন্দ্রিয়সংখ্যা সাতটি মাত্র নয়। একাদশ বলেই এদের সংখ্যা গণনা করা হয় (ব্রঃ-২/৪/৬)।

সুতরাং পূর্ব-উল্লিখিত সাতটির সাথে অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্, বাক্ এবং অন্তঃকরণের সাথে অন্য চারটিও অর্থাৎ হস্ত, পদ, পায়ু এবং উপস্থকে যোগ করে সর্বমোট ইন্দ্রিয় সংখ্যা হলো একাদশ। তবে অন্তরেন্দ্রিয়ের (অন্তঃকরণের) বিভিন্ন রূপান্তরগুলি, যথা- মন, বুদ্ধি, অহং এবং চিত্ত (স্মরণেন্দ্রিয়)-গুলি পৃথক কোন ইন্দ্রিয় নয়, সুতরাং ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা একাদশের বেশি হতে পারে না। তাই একাদশই হলো নির্দিষ্ট সংখ্যা। এগুলি হলো- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, নাসা ও ত্বক ; পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক্য, হস্ত, পদ, পায়ু বা মল-ইন্দ্রিয় ও উপস্থ বা মূত্র-ইন্দ্রিয় ; এবং অন্তঃকরণ। এসকল ইন্দ্রিয় অনিত্য ও একদেশী। বাদরায়ণের মতে ইন্দ্রিয়গুলি আকারে সূক্ষ্ম বা অণুপরিমাণ- প্রাণসমূহ (ইন্দ্রিয়সমূহ) সূক্ষ্ম-ই (ব্রঃ-২/৪/৭)।

সূক্ষ্ম বা অণু বলতে পরমাণু পরিমাণ বুঝায় না। আকারে সীমিতই বুঝায়। এবং ইন্দ্রিয়গুলি সূক্ষ্ম বলেই এগুলি দৃষ্টিগোচর হয় না। আমরা যেমন ইন্দ্রিয়সমূহ দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি না যে, বিশ্বের কোথায় কী সংঘটিত হচ্ছে, যদি ইন্দ্রিয়গুলি সর্বব্যাপী হতো তাহলে সেরূপ অনুভব করা যেতো। তাছাড়া ইন্দ্রিয়সমূহ যদি সর্বব্যাপী হতো, তাহলে শ্রুতিতে যে বলা হয়, এরা মৃত্যুর সময় উৎক্রান্ত ও বিগত হয় এবং জন্মের সময় পুনরায় আগত হয়, তা বিরুদ্ধ হতো। সুতরাং ইন্দ্রিয়গুলি সূক্ষ্ম এবং আয়তনে সীমিত।

একাদশ ইন্দ্রিয় ছাড়া মুখ্য প্রাণও আত্মার সাধনের মধ্যে গণ্য করা হয় এবং তাও অনিত্য ও অণু পরিমাণ। শাস্ত্রে এই মুখ্য প্রাণ যে বায়ু এবং ইন্দ্রিয়বৃত্তি থেকে পৃথক তা শ্রুতির বর্ণনায় পৃথকভাবে উল্লেখ করা থেকেই প্রমাণ হয়। যেমন- প্রাণ, মন, সকল ইন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং সর্ববস্তুর আশ্রয় এই পৃথিবী, সব এর থেকেই (অর্থাৎ সগুণ ব্রহ্ম থেকে) এসেছে (মুণ্ডক-২/১/৩)।

এসব শ্রুতি থেকে বুঝতে পারা যায় যে, তা কোন প্রাণশক্তি বা ইন্দ্রিয়াদির ক্রিয়া নয়। যদি তা হতো তাহলে তাকে ইন্দ্রিয় থেকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হতো না। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে সিদ্ধান্ত করেন- মুখ্য প্রাণও অন্যান্য প্রাণের মতো ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৮)।   মুখ্যপ্রাণ, বায়ু অথবা ইন্দ্রিয় অথবা ইন্দ্রিয়সমূহের সামান্য বৃত্তিও নয়; কারণ শ্রুতি প্রাণকে বায়ু ও ক্রিয়া থেকে পৃথক বলে নির্দেশ করেছেন (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৯)।   চক্ষু প্রভৃতির সাথে প্রাণের একসঙ্গে উল্লেখ থাকায় প্রাণ জীবের ন্যায় কর্তা-ভোক্তা নয়। ভোগোপকরণ মাত্র (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১০)।   মুখ্যপ্রাণ ছাড়া অন্য সকল প্রাণকেই শাস্ত্রে ইন্দ্রিয় বলেই অভিহিত করা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১৭)।   মুখ্যপ্রাণের ধর্ম এবং ইন্দ্রিয়াদির ধর্ম ভিন্ন বলে এরা এক নয় (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১৯)।

এই মুখ্যপ্রাণকে বেদান্তসূত্রে পঞ্চবৃত্তিবিশিষ্ট বলেও বাদরায়ণ উল্লেখ করেছেন- মন যেমন পঞ্চবৃত্তিবিশিষ্ট, প্রাণও তেমনি পঞ্চবৃত্তিবিশিষ্ট বলে শ্রুতিতে উপদেশ করা হয়েছে (ব্রঃ-২/৪/১২)।

শাস্ত্রানুযায়ী মুখ্যপ্রাণের পঞ্চধা বিভক্ত এই পঞ্চবৃত্তি হলো- প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান এবং সমান। এই প্রত্যেকটিরই একটি নির্দিষ্ট কার্য আছে, যেমন- নিঃশ্বাস, প্রশ্বাস, সর্বদেহের উপর ক্রিয়া ও শক্তির প্রকাশ, আত্মাকে দেহ থেকে নির্গত হতে সহায়ক করা, এবং ভুক্ত খাদ্যকে পরিপাক করে সর্বদেহে তা সঞ্চারিত করা। এই বিভক্ত হওয়ার ব্যাপারে অন্তঃকরণের সাথে প্রাণের সাদৃশ্য আছে। বলা হয়, অন্তঃকরণ একটি হলেও তা চারটি আকারে কার্যকারিতা হয়, যথা- মন, বুদ্ধি, অহং ও চিত্ত (স্মৃতি) রূপে।

এবং প্রাণের সূক্ষ্মতা বিষয়েও বাদরায়ণ তার সিদ্ধান্তে বলেন- মুখ্যপ্রাণও অণুপরিমাণ। সূক্ষ্মভাবেই তা উৎক্রান্ত হয় (ব্রঃ-২/৪/১৩)।

আত্মার অবস্থা

বাদরায়ণের মতে জীবের স্বপ্ন, সুষুপ্তি, জাগৃতি, মূর্চ্ছা প্রভৃতি হলো আত্মার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা। এক্ষেত্রেও তিনি বিভিন্ন শ্রুতিবাক্যকেই প্রামাণ্য স্বীকার করে সিদ্ধান্ত করেছেন।

(১) স্বপ্নাবস্থা : সুপ্তিতে স্বপ্নদৃষ্ট বস্তু মায়ামাত্র। তবে স্বপ্নে যে বস্তু দৃষ্ট হয়, স্বপ্নদ্রষ্টা জীবই এই স্বগ্নজগতের সৃষ্টিকার্যের কর্তা। অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থা হলো আত্মারই এক ভিন্ন অবস্থা। যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্রুতিতে বলা হয়েছে- সেই পুরুষ অর্থাৎ জীবাত্মার স্থান হলো দুটি- ইহলোক আর পরলোক। এই দুটি জগতের সন্ধি হয়েছে স্বপ্নস্থানে। এটি তৃতীয় স্থান। এই স্থানে অবস্থান করেই জীবাত্মা ইহলোক এবং পরলোক- এই দুটি জগৎকেই দেখেন। মানুষ যা আশ্রয় করে অর্থাৎ যে সাধনাকে অবলম্বন করে পরলোকে যায়, জীবাত্মাও তাকে অবলম্বন করেই পাপ (দুঃখ) এবং আনন্দ- এই দুটিকেই দেখেন। আবার যখন প্রসুপ্ত হন, তখন জীবাত্মার জন্ম-গ্রহণ; শরীর ধারণ থেকে শুরু করে ইহজগতের যতগুলি উপাদান সবগুলি আত্মসাৎ করে, তাকে ভেঙে-গুঁড়িয়ে আবার নতুনভাবে তৈরি করে এক অভিনব স্বপ্নরাজ্য গড়ে তোলেন- আপনার জ্যোতি দিয়ে নিজের মতো করে। এই অবস্থায় পুরুষ হন স্বয়ংজ্যোতি।  (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৯)। দুস্তর পথ পাড়ি দেবার রথ নেই, রথ টানার অশ্ব নেই, এই আত্মাই আপন ইচ্ছায় নির্মাণ করে নেন রথ, অশ্ব। যেখানে আমোদ নেই, প্রমোদ নেই, হর্ষ নেই, আনন্দ নেইইে স্বয়ংজ্যোতি আত্মা আপন লীলাবিলাসে সেখানে সে-সবও সৃজন করে নেন। যেখানে নেই জলাশয় বা ডোবা, নেই পুকুর, ইনিই সেখানে তা তৈরি করে নেন আপন ইচ্ছায়। তিনিই কর্তা। তার যা কিছু প্রয়োজন স্বয়ংজ্যোতি আত্মা ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তা সবই পূরণ করে নেন (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১০)।

এই শ্রুতিবচনই প্রমাণ করে যে, জীবই স্বপ্ন-জগতের সৃষ্টি-কার্য করে- পরমেশ্বর নন। এবং তারই অনুসরণে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন- শ্রুতিতে স্বপ্নাবস্থায় যে রথ প্রভৃতি সৃষ্টির উল্লেখ আছে, স্বপ্নদ্রষ্টা জীবই তার কর্তা, কারণ শ্রুতিতে অনুরূপ বাক্য আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/১)।   কিন্তু স্বপ্নে যে রথ ইত্যাদি কাম্যবস্তু সৃষ্ট হয়, তা মায়ামাত্র- কারণ তাতে জাগ্রত অবস্থার সকল লক্ষণ থাকে না (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩)।

স্বপ্নে সৃষ্টবস্তু মায়া হলেও স্বপ্নকে ব্রহ্মের সংকল্প হিসেবেই মনে করা হয়। তাই ভালোমন্দ নানা ঘটনার পূর্বসূচনা স্বপ্নেই হয়ে থাকে বলে শ্রুতিতেও স্বীকার করা হয়। যেমন, ছান্দোগ্য উপনিষদে একটি শ্রুতি আছে- এ বিষয়ে একটি শ্লোক আছে- কাম্যকর্মের অনুষ্ঠানকালে যদি স্বপ্নে স্ত্রীলোক দর্শন হয়, তবে জানবে কর্মে তোমার সিদ্ধিলাভ নিশ্চিত। এটিই হলো স্বপ্ন-নিদর্শনে; স্বপ্ন নিদর্শনে (ছান্দোগ্য-৫/২/৮)।

এবং এই শ্রুতিকে প্রামাণ্য ধরে বাদরায়ণও সিদ্ধান্ত করেন- স্বপ্ন ভাবী শুভাশুভের সূচনা করে, শ্রুতির এবং স্বপ্ন রহস্যবেত্তা পণ্ডিতদেরও এমন অভিমত (ব্রঃ-৩/২/৪)।

(২) জাগ্রৎ অবস্থা : জাগ্রৎ অবস্থা হলো জীবাত্মার বোধির জগত। আর স্বপ্নাবস্থা হলো স্বসৃষ্ট মায়ার জগৎ। কেননা, জাগ্রৎ অবস্থায় মানুষ যা দেখে, যা অনুভব করে, স্বপ্নে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে। তবে পার্থক্য হলো জীব তখন থাকে ‘অবিদ্যা’ বা মায়া-কবলিত। তাই স্বপ্ন ও জাগ্রৎ অবস্থা প্রসঙ্গে শ্রুতির ঋষিরা বলেন- এটি জীবের অবস্থান্তর। যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্রুতিতে বলা হয়েছে- সেই পুরুষ স্বেচ্ছাবিহার, স্বপ্নানন্দ উপভোগের পর, যে পথ ধরে গিয়েছিলেন নিদ্রাজগতে, সেই পথ ধরেই আবার ফিরে আসেন বোধের জগতে বা জাগ্রৎ অবস্থায়। স্বপ্নে তিনি যা কিছুই দেখুন না কেন, তাতে তার কোন আসক্তি থাকে না। তিনি নির্লিপ্ত, অসঙ্গ- স্বয়ংজ্যোতি… (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৬)।   বোধির জগতে অর্থাৎ জাগ্রৎ অবস্থায় এই দৃশ্যমান জগতে বিহার করে, পাপ-পুণ্য দেখে স্বপ্ন দেখার জন্য আবার সেই পুরুষ একই পথ ধরে স্বপ্নস্থানে ফিরে যান। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৭)। নদীর জলে এক মহামৎস্য অর্থাৎ বিশালাকায় মাছ যেমন এপাড় থেকে ওপাড়ে আবার এপাড়ে বিচরণ করে, এই পুরুষও ঠিক সেভাবেই বিহার করেন স্বপ্ন থেকে জাগরিত স্থানে- স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝে। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৮)।

স্বপ্নে বাহ্যবস্তু থাকে না, তবুও স্বপ্নে যা দেখা যায় তা যে মিথ্যা তা স্বপ্নাবস্থায় বুঝা যায় না। কিন্তু কিভাবে বুঝা যায় যে স্বপ্নাবস্থা ছিলো অবিদ্যায় মায়া কবলিত? কারণ স্বপ্নে যা দেখা যায়, তা জাগ্রৎ হয়ে জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞতার দ্বারা বাধিত হয়- দেখা যায় তা মিথ্যা ছিলো। অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থা একপ্রকার স্মৃতি, আর জাগ্রত অবস্থা হলো বাস্তব অনুভব। সুতরাং তাকে মিথ্যা বলে অগ্রাহ্য করা যায় না। ফলে দুই অবস্থার অভিজ্ঞা একরূপ নয়। তাই বাদরায়ণ বলেন- জাগ্রৎ ও স্বপ্নাবস্থার চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে বলে, জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞা স্বপ্নাবস্থার অভিজ্ঞার অনুরূপ নয় (ব্রঃ-২/২/২৯)।

(৩) সুষুপ্তি : এই স্বপ্নাবস্থা ও জাগৃতি ছাড়াও জীবাত্মার আরেকটি অবস্থা হলো সুষুপ্তি। এটা কী? শাস্ত্রে (বৃহদারণ্যক-২/১/১৮-১৯) আছে, সুপ্তি বা নিদ্রা দু’রকমের হয়। একটিতে মানুষ স্বপ্ন দেখে, অন্যটিতে দেখে না। স্বপ্নহীন এই নিদ্রাকেই ‘সুষুপ্তি’ বলে। এই সুষুপ্তির লক্ষণ ব্যাখ্যাকল্পে ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্রুতিতে বলা হয়েছে- সুতরাং কোন মানুষ যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয় তখন তার সমস্ত ইন্দ্রিয় শান্ত হয়ে যায়, তারা কোন কাজ করে না। সেই ব্যক্তির আর কোন দুঃশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা থাকে না। তখন সে স্বপ্নও দেখে না। ইন্দ্রিয়গুলি তখন তার নাড়ীতে প্রবেশ করে। তখন সূর্যরশ্মি তাকে ঘিরে থাকায় কোন পাপই তাকে স্পর্শ করতে পারে না (ছান্দোগ্য-৮/৬/৩)।

এবং বৃহদারণ্যকে জীবাত্মার পূর্বোল্লিখিত জাগৃতি ও স্বপ্নাবস্থার পরপরই সুষুপ্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে- আকাশপথে উড়তে-উড়তে, বিহারে-বিহারে শ্রান্ত শ্যেন বা বিচিত্রপক্ষ পাখি এক সময় ডানা গুটিয়ে যায় নিজের নীড়ের দিকে, তেমনি এই পুরুষও বিশ্রামের আশায় ছুটে চলে সুষুপ্তির দিকে। সেখানে কোন কামনা নেই, কোন স্বপ্নও নেই (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৯)।   আত্মার এই রূপটি হলো অতিচ্ছন্দা অর্থাৎ কামনারহিত, যাবতীয় পাপরহিত; এটি হলো অন্তরঙ্গ অভয় রূপ। প্রেমিক-প্রেমিকার যখন নিবিড় আলিঙ্গন হয়, তখন যেমন তার স্থান-কালের জ্ঞান থাকে না, দেখেও দেখে না সেখানে আছে ঘরের মানুষ কি বাইরের মানুষ, পরমাত্মার সঙ্গে মিলনে শারীর-পুরুষেরও তখন সেই অবস্থা। তখন সে বাহ্যজ্ঞান রহিত। এটি হলো আত্মার আপ্তকাম, আত্মকাম, কামনাহীন, শোকাতীত রূপ (বৃহদারণ্যক-৪/৩/২১)।

এই যে সুপ্তিতে জীবের বাহ্যজ্ঞান রহিত স্বপ্নহীন সুষুপ্তি অবস্থা, প্রশ্ন আসতে পারে, তখন জীবাত্মার অবস্থান কোথায় থাকে? শ্রুতিতে বলা হচ্ছে- ‘সুষুপ্তিকালে তিনি সতের সাথে একীভূত হন এবং নিজ স্বরূপে গমন করেন’ (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)। পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার এই একীভূত অবস্থার সাথে তাহলে দেহত্যাগী মুক্ত আত্মার ভিন্নতা কোথায়? এই সংশয় দূর করতেই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন- সুষুপ্তি অবস্থায় জীবাত্মা নাড়ী, পুরীতৎ এবং ব্রহ্ম এই তিনটি পৃথক বস্তুর সাথেই মিলিত হয়ে থাকে। তা শ্রুতি থেকে জানা যায় (ব্রঃ-৩/২/৭)।

কেননা, শ্রুতিতেই রয়েছে যে- জেগে থাকার সময় সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে ঐ বিজ্ঞানময় পুরুষ যেসব বিষয় উপভোগ করে, ঘুমোতে যাবার সময় স্বপ্নের মধ্যে সে যার আস্বাদ নেয়, সুষুপ্তির মধ্যে কোন বিষয়ই সে উপভোগ করে না। ঘুমের অতল সাগরে সে তখন তলিয়ে থাকে। কোন তরঙ্গই সে সময় তাকে স্পর্শ করে না। -রাজা বললেন, ব্রহ্মন্ এই সময় সেই পুরুষ কোথায় থাকে জানো? মানুষের হৃদপিণ্ড থেকে বাহাত্তর হাজার নাড়ী বেরিয়ে সারা শরীরকে হৃদয়ের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। প্রতিটি নাড়ীই হিতকর। তাই এই নাড়ীগুলিকে বলে ‘হিতা’ নাড়ী। সুষুপ্তিকালে সেই বিজ্ঞানময় পুরুষ এই নাড়ীগুলির সঙ্গে হৃদয়ে শুয়ে থাকে। তখন কারো কোন বোধশক্তিই তাকে সেখানে বিব্রত করতে পারে না। সুখ-দুঃখ, অভাব-অনটন কোন কিছুই সে সময় সে বোধ করে না। মহারাজ, মহাব্রাহ্মণের মহা আনন্দ তখন তার মধ্যে। সেই আনন্দ তার কিসের? পরমাত্মার মধ্যে নিশ্চিন্তে থাকতে পারার আনন্দ (বৃহদারণ্যক-২/১/১৯)।

সুষুপ্তিতে জীবাত্মা যেভাবে ব্রহ্মে লীন হয়, সুষুপ্তি অবস্থা থেকে যখন জাগ্রৎ অবস্থায় ফিরে আসে তখন সে সৎ বা ব্রহ্ম থেকেই ফিরে আসে। সুষুপ্তি থেকে জীবাত্মার জাগ্রৎ অবস্থায় ফিরে আসা বিষয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের (বৃহদারণ্যক-২/১/২০) মতোই কৌষীতকি উপনিষদের শ্রুতিতেও বলা হয়েছে- ঘুমন্ত মানুষ যখন কোন স্বপ্নই দেখে না, সুষুপ্তিতে মগ্ন, তখন সে এইসব হিতা নাড়ীর মধ্যে থেকে প্রাণের (ব্রহ্মের) সঙ্গে এক হয়ে যায়। জীবাত্মা তখন প্রাণের (ব্রহ্মের) মাঝে বিলীন। তখন তার যতো ইন্দ্রিয় আর ইন্দ্রিয়ের বিষয় আছে যেমন বাক্-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে নাম, চক্ষু-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে রূপ, কর্ণ-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে শব্দ, মন-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে চিন্তা- সব, সব তারই মাঝে বিলীন হয়ে যায়। যখন ঘুম ভাঙে, জেগে ওঠে, তখন জ্বলন্ত আগুন থেকে যেমন স্ফুলিঙ্গ চারদিকে ছিটকে যায়, সেইভাবে ঐ মহাপ্রাণ আত্মা থেকে জীবাত্মার প্রাণশক্তি অর্থাৎ ইন্দ্রিয়শক্তিগুলো ছিটকে বেরিয়ে এসে যে যার বিষয়ের দিকে ছুটে যায়। প্রাণসমূহ থেকে দেবতারা অর্থাৎ ইন্দ্রিয় দেবতারা আর ঐ দেবতাদের থেকে লোকালোকের প্রকাশ (কৌষীতকি-৪/১৯)।

তাই বেদান্তসূত্রে সূত্রকার বাদরায়ণ যদিও বলেন- ব্রহ্ম বা আত্মাই যখন জীবের সুষুপ্তিস্থান, তখন এই আত্মা থেকেই জীবের জাগরণও হয়ে থাকে (ব্রঃ-৩/২/৮)।

তবুও প্রশ্ন উঠে, সৎ হতে বা ব্রহ্ম হতে এসেও বা জাগরিত হয়েও জীব কেন জানতে পারে না যে সে ব্রহ্ম থেকেই এসেছে? কিংবা তার স্মৃতিতেই বা কেন তা থাকে না? এ বিষয়ে শ্রুতিতেও উক্ত হয়েছে যে- হে সোম্য, এই পূর্ববাহিনী নদীসমূহ পূর্বদিকে প্রবাহিত হয় এবং পশ্চিমবাহিনী নদীসমূহ পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হয়। সমুদ্র থেকে উৎপন্ন হয়ে তারা আবার সমুদ্রেই লীন হয় এবং সমুদ্রই হয়ে যায়। ঠিক যেমন এই সব নদী সমুদ্রে মিশে গিয়ে ‘আমি অমুক নদী, আমি অমুক নদী’ এরূপ পৃথক অস্তিত্ব আর জানতে পারে না-’ (ছান্দোগ্য-৬/১০/১)।   একইভাবে হে সোম্য, এইসব জীব সৎ থেকে আসে, কিন্তু তা তারা জানে না। তারা কখনো ভাবে না, ‘আমরা সৎ থেকে এসেছি।’ পূর্বজন্মে (বা সুষুপ্তির আগে) পৃথিবীতে তারা বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘ, শূয়োর, কীট-পতঙ্গ, মাছি বা মশা ইত্যাদি যে রূপেই থাকুক না কেন, তাদের প্রত্যেককেই আবার (কর্মফল অনুযায়ী) ফিরে আসতে হয় (ছান্দোগ্য-৬/১০/২)।

এখানে আপত্তিটি হলো, জীবের বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত সুষুপ্তিকালে ব্রহ্মের সাথে মিলিত বা আত্মার স্বরূপে ফিরে যাওয়ার সাথে দেহত্যাগী মুক্ত আত্মার ব্রহ্মে লীন হওয়ার মধ্যে যেহেতু পার্থক্য থাকে না, তাই সুষুপ্তির পর জাগৃতি অবস্থায় ফিরে আসার ক্ষেত্রেও একই জীব যে সুষুপ্তি হতে প্রত্যাবৃত্ত হয়, তার নিশ্চয়তা কোথায়? কেননা জীব পুনর্জন্ম নিয়ে পুর্বজন্মের কোন স্মৃতি যেমন মনে করতে পারে না, তেমনি সুষুপ্তিকালীন কোন বিষয়ও জীবের স্মৃতিতে থাকে না। তাই এমন কোন নিশ্চিত নিয়ম থাকতে পারে না যে, একই জীব ব্রহ্ম থেকে ফিরে আসে। এই আপত্তি নিষ্পত্তিকল্পেই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন, যেহেতু জীব মায়াদ্বারা আচ্ছন্ন থাকে, সেজন্য সুষুপ্তিকালে জীব ব্রহ্মের সাথে নিজের একত্বকে অনুভব করতে পারে না। এবং এ প্রসঙ্গে বেদান্তসূত্রের সিদ্ধান্ত হলো- সুষুপ্ত জীবই পুনরায় জাগ্রত হয়। তা তার কর্ম, স্মৃতি, শাস্ত্রীয় প্রমাণ এবং নৈতিক শিক্ষা থেকে জানা যায় (ব্রঃ-৩/২/৯)।

অর্থাৎ, এই সূত্রটি বলতে চায় যে, একই জীব সুষুপ্তির পর ব্রহ্ম হতে প্রত্যাগমন করে যেসব কারণে- (১) কোন ব্যক্তি নিদ্রার পূর্বে কোন অসমাপ্ত কাজকে নিদ্রা ভঙ্গের পর পুনরায় সম্পন্ন করে থাকে- তা আমরা দেখতে পাই। যদি সে একই জীব না হতো তা হলে অন্য জীবের কৃত অর্ধসমাপ্ত কাজকে সম্পন্ন করার জন্য তার কোন আগ্রহ থাকতো না। (২) নিদ্রার পূর্বে এবং পরে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের একত্বের অভিজ্ঞতা। (৩) আমাদের পূর্ববর্তী ঘটনার স্মৃতি। (৪) শ্রুতি প্রমাণ; যেমন এই শ্রুতিটি – জীবগণ (নিদ্রার পূর্বে) এই পৃথিবীতে যে যা ছিলো- বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, শূয়োর, কীট-পতঙ্গ, মশা, মাছি ইত্যাদি (নিদ্রার পরে) তারা সেভাবেই ফিরে আসে। (তারা কিন্তু জানে না তারা সৎ থেকে এসেছে) (ছান্দোগ্য-৬/৯/৩)। এখানে এই শ্রুতিতে দেখতে পাই যে, একই জীব সুষুপ্তির পর ব্রহ্ম হতে ফিরে আসে। এবং অন্য কারণটি হলো, (৫) যদি সুষুপ্তির পথে গতিশীল ব্যক্তিটি ব্যুত্থিত ব্যক্তিটি থেকে পৃথক হতো, তাহলে কর্ম বা জ্ঞান সম্পর্কে শাস্ত্রীয় উপদেশগুলি নিরর্থক হয়ে যেতো। কারণ, যদি কোন ব্যক্তি নিদ্রিত হওয়া মাত্র ব্রহ্মের সাথে চিরন্তনভাবে একীভূত হয়ে যেতে পারতো, তাহলে মুক্তিলাভের জন্য শাস্ত্রীয় উপদেশের কোন মূল্যই থাকতো না।

(৪) মূর্চ্ছা : জীবের অন্য আরেকটি অবস্থা রয়েছে, তা হলো মূর্চ্ছা। বাদরায়ণের মতে, মূর্চ্ছা হলো অর্ধ-মরণ। শরীরে অবস্থান কালে জীবের তিনটি মাত্র অবস্থা থাকে- জাগ্রৎ, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি। আর চতুর্থ অবস্থাটি হলো মৃত্যু। কিন্তু মূর্চ্ছা অবস্থাকে জীবের পঞ্চম অবস্থারূপে গণ্য করা যায় না- যেহেতু এরূপ কোন অবস্থার কথা আমাদের জানা নেই। তাহলে মূর্চ্ছা অবস্থার স্বরূপটি কী? তা কি জীবের একটি পৃথক অবস্থা, অথবা এই তিন অবস্থারই অন্যতম অবস্থা? তা জাগ্রৎ বা স্বপ্ন অবস্থা হতে পারে না, কারণ তাতে কোন চেতনা বা কোন কিছুর অনুভূতি থাকে না। তা সুষুপ্তিও নয়, কারণ সুষুপ্তি আনন্দ দেয়, মূর্চ্ছা আনন্দ দেয় না। তা মৃত্যুও নয়, কারণ জীব মূর্চ্ছার পর আবার প্রাণময় হয়ে ওঠে। সুতরাং একমাত্র বিকল্প অবশিষ্ট থাকে এই যে, মূর্চ্ছাবস্থায় জীব আংশিকভাবে সুষুপ্তির অবস্থাই প্রাপ্ত হয়। এর কারণ হলো, সে অবস্থায় জীবের কোন সংজ্ঞা থাকে না এবং পরবর্তীকালে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এ অবস্থাটি আংশিকভাবে মৃত অবস্থাও বটে, কারণ সে অবস্থায় জীব দুঃখ এবং বেদনা অনুভব করে যার প্রতিক্রিয়া তার বিকৃত মুখে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রকট হয়ে থাকে। ফলে এ অবস্থাটি একটি পৃথক অবস্থাই বটে, যদিও তা সাময়িকভাবে ঘটে। কিন্তু তা যে একটি পঞ্চম অবস্থা নয় তার কারণ হলো, মূর্চ্ছাবস্থা অপর দুটি অবস্থারই সংমিশ্রণ বিশেষ। তাই মূর্চ্ছা সম্পর্কে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- মূর্চ্ছা জীবের অর্ধেক মরণাবস্থা, এবং তা জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও মরণাবস্থার অতিরিক্ত একটি অবস্থা (ব্রঃ-৩/২/১০)।

কর্মফল ও পুনর্জন্ম

বেদান্তসূত্রে সৃষ্টিকর্তা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, জগৎকে সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মকেও জীবের কর্মের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। কেননা, এই সৃষ্টিজগৎ আপ্তকাম ব্রহ্মের লীলা (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩) হলেও, জগৎ-স্রষ্টা হিসেবে ব্রহ্মর পক্ষপাতিত্ব ও নিষ্ঠুরতার আপত্তি উত্থাপিত হয়। বস্তুত জগতে- মানব সমাজে- যে বৈষম্য দেখা যায়, অনেকেই শ্রম করতে করতে অনাহারে মৃতপ্রায় হলেও কেউ কেউ বিনা পরিশ্রমেই অন্যের শ্রমের ফল ভোগ করে বিলাসী জীবন কাটায়।  তাদের দেখেই পুরোহিতবর্গ দেবলোকের কল্পনা করেছেন। আবার মনুষ্য থেকে ক্ষুদ্রতম কীট পর্যন্ত প্রাণিজগতে যে ভীষণ সংহার দেখা যায় যায় তা জগৎ-স্রষ্টা ব্রহ্মকে বড়ই হৃদয়হীন বলে প্রমাণ করে, এবং তার থেকে আত্মরক্ষার জন্যই উপনিষদে পূর্বজন্মকৃত কর্মসিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে- ‘তাদের মধ্যে যারা (পূর্বজন্মে) রমণীয় আচরণ বা পুণ্যকর্ম করে তারা দেহান্তরে শীঘ্রই ব্রাহ্মণযোনিতে বা ক্ষত্রিয়যোনিতে বা বৈশ্যযোনিতে জন্মলাভ করে। আবার যারা (পূর্বজন্মে) কপূয়াচরণ অর্থাৎ কুৎসিত বা অশুভ কর্ম করে তাদের শীঘ্রই কুকুরযোনিতে বা শূকরযোনিতে বা চণ্ডালযোনিতে পুনর্জন্ম হয়।’- (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭)।

একই বিষয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদেও বলা হয়েছে এভাবে- ‘…তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান।’- (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)। অর্থাৎ পূর্বজন্মের কর্মফলই নির্ধারণ করে দিচ্ছে এজন্মে কিভাবে এই ফল ভোগ করতে হবে, এই জন্মে সুখ ভোগ করবে, না কি দুঃখ ভোগ করবে। তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থা- শোষক-শোষিত, প্রভু-ভৃত্য প্রথার- দৃঢ় সমর্থক বাদরায়ণও একে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বলেছেন- (বৈষম্যনৈর্ঘৃণ্যে ন, সাপেক্ষত্বাৎ, তথা হি দর্শয়তি), ‘জগতে সুখ দুঃখাদি দেখে ব্রহ্মকে পক্ষপাতযুক্ত বা নিষ্ঠুর বলা যায় না- কারণ শাস্ত্রে এই বৈষম্যের হেতু এবং ব্রহ্মের স্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে।’- (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৪)। এবং জীবের এই কর্মফল দাতা যে ঈশ্বরই, তা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত করেই তিনি বলেন- জীবের কর্মফলদাতা যে ঈশ্বর তাই যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত (ব্রঃ-৩/২/২৮)।

এখানে হয়তো একটি আপত্তি উঠতে পারে যে, কর্ম তো একটা সময়ে করা হয়ে থাকে, তার আবার আগের জগতের কথা কী করে আসে? কিংবা প্রশ্নটি এভাবেও হতে পারে যে, যেহেতু প্রথম সৃষ্টির পূর্বে জীবাত্মার পক্ষে তার পূর্বে কোন অবস্থান সম্ভব নয়, তাই কর্মফল থাকাও সম্ভব নয়, তাহলে প্রথম সৃষ্টির সময়েই জীবের মধ্যে অবস্থার পার্থক্য আসবে কোত্থেকে- যদি না ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে এই ভেদ সৃষ্টি করে থাকেন? এই আপত্তির উত্তরে বাদরায়ণ বলেন যে, সৃষ্টি অনাদি, অতএব কর্মও অনাদি- ‘সৃষ্টির পূর্বে জীব ও ব্রহ্মের কোন ভেদ ছিলো না। সৃষ্টির সময়েই ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে ভেদ সৃষ্টি করেছেন যদি এরূপ বলা হয়, তাহলে এর উত্তরে বলা যায় যে, না জীবজগৎও অনাদি।’- (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৫)।

পুনর্জন্মের বিষয়ে বাদরায়ণ উপনিষদের সিদ্ধান্তকে সু-ব্যবস্থিতরূপে একত্রিত করেছেন। ছান্দোগ্য উপনিষদের (ছাঃ-৫/১০/৭) শ্রুতিতে সুকৃতি-দুষ্কৃতির মাধ্যমে পুনর্জন্মের যে ধারণা অভিপ্রেত হয়েছে, তার থেকেই পরবর্তী উপনিষদগুলিতে জীবের পুনর্জন্মচক্রের একটা দার্শনিক রূপরেখাও তৈরি হয়ে গেছে। যেমন, প্রশ্ন-উপনিষদে বলা হয়েছে- অগ্নিই উদান। মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তার শরীর শীতল হয়ে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে লীন হয় এবং সে জন্মান্তরের জন্য প্রস্তুত হয় (প্রশ্ন-৩/৯)।   মৃত্যুকালে জীবাত্মা প্রাণে প্রবেশ করে। সঙ্গে থাকে মন এবং সেই সময়কার মনের যত সংস্কার বা চিন্তা ও বাসনা সমূহ। প্রাণ তখন অগ্নি অর্থাৎ উদানের সঙ্গে যুক্ত হয় (কেননা উদানই তাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়)। আত্মা যে লোক কামনা করে প্রাণ তাকে সেই লোকেই নিয়ে যায়। তারপরে আত্মা নতুন জন্ম গ্রহণ করে (প্রশ্ন-৩/১০)।

এই ধারণারই আরেকটু বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদে- এই শারীর-পুরষ আত্মা দুর্বলতার কারণে যখন সংজ্ঞালোপ পাবার মতো অবস্থায় আসে তখন সবকটি প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় এসে জড়ো হয় আত্মার কাছে। যে তেজশক্তি নিয়ে ইন্দ্রিয়রা ছিলো প্রকাশমান, করছিলো আপন-আপন নির্দিষ্ট কাজ, তাদের সেই তেজকে নিয়ে প্রবেশ করে হৃদয়ে। সঙ্গত কারণেই চাক্ষুষ-পুরুষ আদিত্যের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে, চোখ আর কেমন করে রূপ দেখবে? তাই মুমূর্ষুর চোখে কোন রূপই ধরা পড়ে না (বৃঃ-৪/৪/১)।   আত্মার সঙ্গে এক হয়ে মিশে গেলে, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে কি আর স্বাতন্ত্র্য থাকে? একীভূত হয়ে থাকার ফলে, লোকে বলে শুনতে, চিন্তা করতে, স্পর্শ করতে পারছে না, কিছু জানতেও পারছে না। সেই সময় তার হৃদয়ের অগ্রভাব দীপ্তিযুক্ত হয়ে ওঠে, প্রকাশিত হয় হৃদয়পথে নির্গমন দ্বার। দেহকে ছেড়ে জ্যোতির সাহায্যে সেই আত্মা জীবের কামনা অনুযায়ী অনুরূপ পথ দিয়ে বেরিয়ে যান। যদি তার সাধনা থাকে আদিত্যলোকের তবে আত্মা নিষ্ক্রান্ত হন চক্ষুপথে, ব্রহ্মলোকের জন্য ব্রহ্মতালু পথে, আবার নানা-বাসনা, নানা কর্মানুসারে অনুরূপ অপরাপর ইন্দ্রিয়পথে। আত্মা নির্গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যপ্রাণ তার অনুগমন করে, সেই সঙ্গে অপরাপর প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ও তার অনুগমন করে। আত্মা তখন বিজ্ঞানময়। এই বিজ্ঞানময় আত্মার অনুগমন করে বিদ্যা, কর্ম আর সংস্কার (বৃঃ-৪/৪/২)।   জলায়ুক বা জলৌকা অর্থাৎ জোঁক যেমন ঘাসের এক ডগা ছেড়ে আর এক ডগায় গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নেয়, আত্মাও তেমনি দেহত্যাগের পর অবিদ্যা দূর করে, স্থূল শরীরটাকে পরিত্যাগ করে আশ্রয়রূপ অন্য দেহকে অবলম্বন করে (বৃহদারণ্যক-৪/৪/৩)।

এই শ্রুতিকেই প্রামাণ্য স্বীকার করে তাই বাদরায়ণও বলেন- জীব সূক্ষ্মভূত-সমন্বিত হয়ে দেহত্যাগান্তে অন্যদেহ প্রাপ্তির জন্য গমন করে- তা শ্রুতি বর্ণিত প্রশ্নোত্তর থেকে অবগত হওয়া যায় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১)। বৃহদারণ্যক শ্রুতি বলেন যে, জীব উৎক্রান্ত হলে জীবের সাথে ইন্দ্রিয়সকলও গমন করে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৩)।

এই প্রাণসকল বা সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়সহ উৎক্রান্ত জীব কোথায় গমন করে? এর একটা বিবরণ ছান্দোগ্য উপনিষদেই পাওয়া যায়। যেমন- (সন্তান) জন্মগ্রহণ করে যতদিন তার আয়ু ততদিন জীবিত থাকে। (তারপর যখন) যথানির্দিষ্ট রূপে (অর্থাৎ কর্মফল অনুযায়ী লোক লাভের জন্য) দেহত্যাগ করে, তখন (তার পুত্র ও শিষ্যরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য) তাকে ঘর থেকে সেই অগ্নিতে নিয়ে যায়- যে অগ্নি থেকে সে এসেছে, যে অগ্নি থেকে সে উৎপন্ন হয়েছে (ছাঃ-৫/৯/২)।  যাঁরা পঞ্চাগ্নিবিদ্যা জানেন এবং যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তারা মৃত্যুর পর অর্চিলোক অর্থাৎ জ্যোতির্লোক প্রাপ্ত হন। (অতঃপর) অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয় মাসে- (ছাঃ-৫/১০/১)।  সেখান থেকে সংবৎসরে, সংবৎসর থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে চন্দ্রলোকে এবং চন্দ্রলোক থেকে বিদ্যুৎ-লোক প্রাপ্ত হন। সেই স্থানে (ব্রহ্মলোক থেকে) এক অমানব অর্থাৎ জ্যোতির্ময় পুরুষ এসে তাদের ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। এই পথই দেবযান অর্থাৎ দেবলোকের পথ (ছাঃ-৫/১০/২)।  আর যে সকল গৃহস্থ যজ্ঞ, সমাজসেবামূলক কর্ম এবং দান ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন তারা (মৃত্যুর পর) ধূমকে প্রাপ্ত হন। (তারপর তারা) ধূম থেকে রাত্রি, রাত্রি থেকে কৃষ্ণপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ থেকে দক্ষিণায়ণের ছয়মাসে গমন করেন। এঁরা (দেবযানপথে গমনকারীদের মতো) সংবৎসরকে প্রাপ্ত হন না (ছাঃ-৫/১০/৩)।  দক্ষিণায়ণের ছয়মাস থেকে পিতৃলোকে, পিতৃলোক থেকে আকাশে, আকাশ থেকে চন্দ্রলোকে গমন করেন। ইনিই (অর্থাৎ উজ্জ্বল চন্দ্রই) রাজা সোম। ইনি দেবতাদের অন্ন, দেবতারা এঁকে ভোগ করেন (ছাঃ-৫/১০/৪)।  কর্মফল ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত চন্দ্রলোকে বাস করে তারপর যে পথে তারা গিয়েছিলেন সেই পথেই পুনরায় (পৃথিবীতে) ফিরে আসেন। তারা প্রথমে আকাশ ও পরে বায়ুকে প্রাপ্ত হন। বায়ু হয়ে ধূম, ধূম হয়ে কুয়াশা হন (ছান্দোগ্য-৫/১০/৫)।

শ্রুতিতে এই যে জীবের উৎক্রমণের পর আবার কর্মফল ভোগের জন্য পৃথিবীতে অবতরণ প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়, তাই বাদরায়ণও বলেন- শ্রুতি-স্মৃতি থেকে জানা যায় যে, জীব যে-পথে চন্দ্রলোকে গিয়েছিলো, কর্মফল ভোগের পর আবার সেই পথেই এবং অন্যভাবেও ভুক্তাবশিষ্ট কর্মসহ পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করে (ব্রঃ-৩/১/৮)।

কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে যে, এ সকল ব্যক্তির আত্মা কি বাস্তবিকপক্ষে আকাশ, ধূম ইত্যাদির সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়, অথবা এরা কি একটি প্রকৃতিগত সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয়? বিষয়টি স্পষ্ট করতে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন- চন্দ্রমণ্ডল হতে অবতরণকালে জীব আকাশাদির সদৃশ হয়। আকাশস্বরূপ হয় না- কারণ সদৃশ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত (ব্রঃ-৩/১/২২)।

অর্থাৎ, শ্রুতিটিতে আকাশ ইত্যাদির সাথে অভিন্নত্বের কথা বলা হয়নি। শ্রুতিটির অর্থ হলো, এরা আকাশ ইত্যাদির প্রকৃতিগত একটি সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয়- আকাশ, বায়ু প্রভৃতির মতো হয়ে যায়। তার মানে, জীব আকাশের মতো একটি সূক্ষ্ম আকার ধারণ করে বায়ুর অধীনে আসে এবং ধূম ইত্যাদির সাথে সংযুক্ত হয়। এই পুনর্জন্ম প্রক্রিয়ায় তারপরে ছান্দোগ্য উপনিষদে আরো বলা হয়েছে- কুয়াশা হয়ে মেঘ হন, মেঘ হয়ে বর্ষণ করেন। তারপর জীবগণ এই পৃথিবীতে ব্রীহি, যব, ওষধি, বনস্পতি, তিল ও মাষ ইত্যাদি রূপে জাত হন। এই শষ্যাদি থেকে নিষ্ক্রমণ দুঃসাধ্য। (সন্তান উৎপাদনে সমর্থ) যে যে প্রাণী ওই (ব্রীহি প্রভৃতি) অন্ন আহার করে এবং সন্তান উৎপন্ন করে, সেই সেই প্রাণিরূপে জীবগণ পুনরায় জন্মগ্রহণ করে (ছান্দোগ্য-৫/১০/৬)।

এখানে একটি প্রশ্ন উঠে যে, চন্দ্রলোক হতে প্রত্যাবর্তনকারী জীবাত্মা যখন আকাশ, বায়ু প্রভৃতির সাথে সাদৃশ্যপ্রাপ্ত হয় তখন কি তা বেশ দীর্ঘকালই ঐ অবস্থায় থাকে, না কি শীঘ্রই এক অবস্থা হতে অবস্থান্তর প্রাপ্ত হয়? এবং অন্য প্রশ্নটি হলো, জীবাত্মা কি ব্রীহি ইত্যাদি উদ্ভিজ্জরূপে জাত হয়? এ প্রেক্ষিতে বাদরায়ণ বলেন- শ্রুতি বলেন জীবের চন্দ্রলোক হতে নানা অবস্থার (ব্রীহি, যব ইত্যাদি) মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসতে বেশি বিলম্ব হয় না। এ বিষয়ে বিশেষ শ্রুতি তাই বলেন (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৩)।   জীব ব্রীহি ইত্যাদি রূপ প্রাপ্ত হয় বলা হয়েছে; তার অর্থ হলো সেই সেই ব্রীহিতে অবস্থান হয় মাত্র, কারণ শ্রুতিতে এ প্রসঙ্গে আকাশাদি সম্বন্ধে যেরূপ উল্লেখ আছে, ব্রীহির সম্বন্ধেও সেরূপই উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৪)।   চন্দ্রলোক-প্রত্যাগত জীব ধান ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পর যারা শুক্রনিষেক করে জন্মদান করতে সমর্থ তাদের দেহে প্রবিষ্ট হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৬)।  যোনিকে (গর্ভকে) আশ্রয় করেই জীব স্বীয় ভোগায়তনদেহ লাভ করে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৭)।।

অতএব, সংক্ষিপ্ত করে বললে, দেহত্যাগান্তে পরলোক ভ্রমণ করে প্রত্যাগত জীব কর্মফল অনুযায়ী ইহলোকে পুনরায় জীবন শুরু করে। পুণ্যবানগণ চন্দ্রলোকে যান। নবকলেবর ধারণের জন্য চন্দ্রমা থেকে মেঘ, জল, অন্নাদির যে রাস্তার কথা উপনিষদে বলা হয়েছে তাতে ফিরে আসতে দেরি হয় না। যে ধান্যশস্যাদির সঙ্গে জীব মাতৃগর্ভে প্রবিষ্ট তাতে সে নিজে নয়, অন্যজীবের অধিষ্ঠাতা হওয়ার সময় এরূপ করে। সুতরাং অবতরণকারী জীবাত্মা অন্য জীবাত্মার দ্বারা (সঞ্জীবিত) প্রাণবন্ত বৃক্ষাদির মধ্যে অবস্থান মাত্র করে- যে পর্যন্ত না নতুন কোন জন্মের সুযোগ পায়। সেই শস্য ভক্ষণের পর আবার রক্ত-বীর্য-যোনির সংযোগ হয়, যার ফলে হয় নতুন শরীর সৃষ্টি। অর্থাৎ পরিশেষে জীবাত্মা একজন সন্তান-উৎপাদনসক্ষম (রেতঃসিঞ্চনকারী) পুরুষের সংস্পর্শে এসে নারীর গর্ভে প্রবেশ করে এবং সেখানে একটি নতুন দেহ লাভ করে, যে দেহ (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭ অনুযায়ী) পূর্ব-কৃত-কর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য সমর্থ।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠে যে, ইহলোক থেকে যারা উৎক্রমণ করে তাদের সকলেই কি চন্দ্রলোকে গমন করে থাকে? যে-সকল জীবের কর্মফল চন্দ্রলোক গমনের পক্ষে যথেষ্ট নয়, অর্থাৎ যারা যজ্ঞাদি বা কোন ধর্মানুষ্ঠান করে না, কিংবা অনিষ্টকারী ব্যক্তি, মৃত্যুর পর তাদের কী গতি হয়? এ বিষয়ে ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে- যারা (অর্থাৎ যে জীবগণ উপাসনা বা ইষ্টপূর্তাদি কর্ম করে না) উভয় পথের কোন পথ দিয়েই যায় না, তারা পুনঃ পুনঃ (জন্ম-মৃত্যু চক্রে) আবর্তনশীল ক্ষুদ্র প্রাণিরূপে জন্মগ্রহণ করে। (এদের বিষয়ে বলা যায়)- জন্মাও আর মরো (অর্থাৎ এরা এতো ক্ষণস্থায়ী যে জন্মগ্রহণ করেই মরে যায়। জন্ম-মৃত্যু ছাড়া এদের জীবনে অন্য কোন ঘটনা নেই)। এই হলো তৃতীয় স্থান। এজন্যেই এই লোক (অর্থাৎ স্বর্গ বা চন্দ্রলোক) পূর্ণ হয় না। সুতরাং (এই গতিলাভকে) ঘৃণা করবে (ছান্দোগ্য-৫/১০/৮)।

অর্থাৎ অনিষ্টকারী ব্যক্তি স্বর্গে গমন করে না। তাহলে কোথায় যায়? সংশয় দূর করতে বাদরায়ণ বলেন- অনিষ্টকারী ব্যক্তি যমলোকে গমন করে; কারণ অনিষ্টকারীর সংযমী নামক যমপুরে যাওয়ার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে (ব্রঃ-৩/১/১৩)।

কারণ, কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে- যম বলছেন, সংসারী মানুষ মাত্রই নিজ নিজ পরিবারের প্রতি অতিশয় আসক্ত। ধন-সম্পদের মোহ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের বুদ্ধি অপরিণত। তারা তাদের চারপাশের জগৎকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করে। এর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সে খোঁজ রাখে না। ইহলোকই আছে, পরলোক বলে কিছু নেই- যে-ব্যক্তি এ কথা মনে করে সে বারবার আমার অধীন হয়। অর্থাৎ তার পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু ঘটে থাকে (কঠ-১/২/৬)।

চন্দ্রলোকে আরোহণ শুধুমাত্র শুভকর্মের ফল ভোগেরই জন্য- অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। সুতরাং অনিষ্টকারিরা চন্দ্রলোকে যায় না। তাদের গন্তব্য হয় নরকে। কৃতকর্মের কষ্টভোগের মাধ্যমে পাপমুক্ত হয়ে পূর্ব-কৃত-কর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য পুনরায় জন্মগ্রহণ করে জীব দেহধারী হয়। তাই বাদরায়ণ বলেন- স্মৃতিশাস্ত্রেও (যথা মনুস্মৃতি) পাপীদের নরক গমনের কথা দৃষ্ট হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৪)।  অধিকন্তু পাপীদের ভোগের জন্য সাতটি নরক আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৫)।  পাপীদের চন্দ্রলোকে গমন হয় না, কারণ, বিদ্যাদ্বারা দেবযান এবং কর্মের দ্বারা পিতৃযান প্রাপ্তির কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৭)।

মুক্তি বা মোক্ষ

ব্রহ্মপ্রাপ্তির পর আত্মা যখন স্বরূপে প্রকটিত হয় তখনই তাকে মুক্তি বলে। যেমন, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে- যখন কেউ পরমাত্মার সঙ্গে তার একাত্মতা উপলব্ধি করেন তখনি অবিদ্যাজনিত সকল বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত হয়ে যান; তখন আর তিনি জন্মমৃত্যুর নিয়মে বাঁধা নন। কিন্তু কেউ যদি শুধু পরমাত্মার ধ্যানই করে যান, তাহলে মৃত্যুর পর তিনি তৃতীয় স্তরে উঠে যান- সেখানে তিনি এবং ঈশ্বর অভিন্ন। তখন তিনি পরম পরিতৃপ্ত, আপ্তকাম। তখন তিনি অনুভব করেন তার যা কিছু পাওয়ার, সব পাওয়া হয়ে গেছে। তখন তিনি মুক্ত। (এভাবে ধাপে ধাপে সাধক পরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান) (শ্বেতাশ্বতর-১/১১)।

মূল কথা হলো- পরমেশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞতাই হলো বন্ধনের কারণ, এবং তার সম্পর্কে জ্ঞানই মুক্তির হেতু। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে বলেন- পরমেশ্বরের ধ্যানের দ্বারা পরমাত্মার সঙ্গে জীবের ঐক্যভাবের অনুভবের আবরণটি (অজ্ঞান) দূর হয়; পরমেশ্বরই জীবের বন্ধন এবং মুক্তির হেতু (তার ইচ্ছায়ই তা হয়) (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৫)।   (অজ্ঞান দূর হলে) জীব যে ব্রহ্মের সাথে লীন হয়ে অভিন্নত্ব অবস্থা প্রাপ্ত হয় তা শ্রুতিতে আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/২৬)।

অতএব, আত্মার স্বীয় রূপের উপর অবিদ্যার যে আচ্ছাদন থাকে, তাকে উন্মুক্ত করার জন্য উপনিষদ-বিদ্যার একান্ত প্রয়োজন। তাহলেই মুক্তির সাধন হবে। কেননা- দেহের সাথে সম্বন্ধহেতু (সসীম) জীবের সত্য সঙ্কল্পাদি শক্তি তিরোহিত হয় (ব্রঃ-৩/২/৬)।

মুক্তির সাধন

(১) ব্রহ্মবিদ্যা : বিদ্যা তথা ব্রহ্মজ্ঞানকে বাদরায়ণ মুক্তির বিশেষ সাধন বলে মেনেছেন, কর্মও যার সহায়ক বলে তিনি মনে করেন। এই বিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞান কী? শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে- ব্রহ্ম যে অন্তরতম সত্তা, সর্বদা তিনি যে ভেতরে রয়েছেন, এ সত্য জানতে হবে। এর চেয়ে উচ্চতর আর কোন জ্ঞান নেই। জীব (ভোক্তা), জগৎ (ভোগ্য), এবং অন্তর্যামী ঈশ্বর (প্রেরিতারম্)- এই তিনই যে ব্রহ্ম একথাটা জানতে হবে (শ্বেতাশ্বতর-১/১২)।

ব্রহ্মের এই স্বরূপ জানতে গিয়ে উপনিষদের বিভিন্ন ঋষিগণ ব্রহ্মকে সৎ, উদ্গীথ, প্রাণ, ভূমা, পুরুষ, দহর, বৈশ্বানর, আনন্দময়, অক্ষর, মধু প্রভৃতি বিভিন্ন নামে বর্ণনা করে জ্ঞান দ্বারা উপাসনার কথা বলেছেন। এ সকল নামকে কেন্দ্র করে এই বিষয়ে কৃত উপদেশসমূহের নাম হয়েছে সৎ-বিদ্যা, উদ্গীথ-বিদ্যা, প্রাণবিদ্যা, ভূমা-বিদ্যা ইত্যাদি। এই বিদ্যা দ্বারাই মোক্ষ তথা পুরুষার্থ প্রাপ্ত হয় বলে বাদরায়ণ মনে করেছেন। তাই বেদান্তসূত্রে তিনি বলেন- ভিন্ন ভিন্ন বেদান্ত গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্নরূপ উপাসনা উপদিষ্ট হলেও উপাস্য বিষয় একই (ব্রহ্ম) এবং ফল (ব্রহ্ম-উপলব্ধি) বিষয়েও এদের মধ্যে পার্থক্য নেই (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/১)।  উপাসনার প্রকার ভেদ আছে- অতএব সর্ব বেদান্তবর্ণিত উপাসনা এক নয়- এরূপ বলা সঙ্গত হবে না- কারণ, উপাসনা এক হলেও তার প্রকার ভেদ থাকতে পারে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/২)।  সকল শ্রুতিও উপাসনার এই একত্বের কথাই বলেছেন (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/৪)।

যেমন বৃহদারণ্যক উপনিষদে মর্ত থেকে স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তারিত বলে বর্ণিত যে বৈশ্বানররূপী সগুণ ব্রহ্মের উপাসনার কথা আছে তা-ই ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লেখ করে বলা হয়েছে- রাজা তারপর উদ্দালক আরুণিকে বললেন- ‘হে গৌতম, তুমি কাকে আত্মারূপে উপাসনা করো?’ উদ্দালক প্রত্যুত্তরে বললেন- ‘হে রাজা, আমি পৃথিবীকেই উপাসনা করি।’ রাজা আবার বললেন- ‘তুমি যাঁর উপাসনা করো তিনি প্রতিষ্ঠা নামে (অর্থাৎ আশ্রয়রূপে) খ্যাত বৈশ্বানর আত্মা। এই কারণেই তুমি সন্তান ও পশুসম্পদ লাভ করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছো’ (ছান্দোগ্য-৫/১৭/১)।

আবার ছান্দোগ্যেরই অন্য একটি শ্রুতিতে বলা হয়েছে- ‘ওম্’ই সবকিছুর আশ্রয়- এইভাবে যিনি অক্ষর ‘ওম্’কে উদ্গীথরূপে (ব্রহ্মরূপে) উপাসনা করেন, তিনি যা যা পেতে চান (পরিণামে) তাই লাভ করেন (ছান্দোগ্য-১/১/৭)।

তাই কঠ-উপনিষদেও বলা হয়েছে- সকল বেদসমূহ একবাক্যে যে ঈপ্সিত বস্তুর প্রতিপাদন করেন, যাঁকে পাবার জন্য সবরকমের তপস্যা, ব্রহ্মচর্যের সাধনা, তিনিই হলেন পরমাত্মা ব্রহ্ম- সংক্ষেপে ‘ওম্’ (কঠ-১/২/১৫)।

মীমাংসক জৈমিনি পুরুষার্থে তথা স্বর্গে কর্মের (যজ্ঞের) প্রাধান্যকে মেনেছেন এবং বিদ্যাকে মেনেছেন অর্থবাদ বলে। এর জন্য তিনি অশ্বপতি কৈকয় কিংবা রাজা জনকের মতো ব্রহ্মবেত্তার উদাহরণ উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, ব্রহ্মবেত্তাগণের যজ্ঞাচারও দেখা যায়। জৈমিনির মতের বিরুদ্ধে বাদরায়ণ বলেন যে, স্বর্গ অপেক্ষা ব্রহ্মবিদ্যাতেই অধিক মোক্ষলাভ হয়। ব্রহ্মজ্ঞানীর যজ্ঞাদিকর্ম সর্বত্র দৃষ্ট হয় না। উপনিষদের ঋষি কোথাও কোথাও বলেছেন যে গৃহস্থাদি কর্মকাণ্ডও ইচ্ছাকৃত। আবার কয়েকজন তো কর্মের ক্ষয়কেও এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সন্ন্যাস আশ্রমও তো রয়েছে, যাতে কর্মকাণ্ড নেই তবুও সেখানে বিদ্যা (ব্রহ্মজ্ঞান) প্রযুক্ত হয়। জৈমিনি অবশ্যই এ আশ্রমকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন, কিন্তু বাদরায়ণ এই আশ্রমকেও শ্রুতিপ্রতিপাদিত হওয়ার জন্য অনুষ্ঠেয় বলে স্বীকার করেছেন। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- ঋষি বাদরায়ণ বলেন যে, ব্রহ্মবিদ্যা থেকেই সাধকের পরম পুরুষার্থ লাভ হয়। শ্রুতিও তাই বলে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১)।  জ্ঞানী পুরুষের পক্ষে যজ্ঞাদি কর্মানুষ্ঠান করার এবং না করার উভয় বিধানই তুল্যরূপে শাস্ত্রে দেয়া আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৯)।  ব্রহ্মজ্ঞানের পর ব্রহ্মজ্ঞের কর্মানুষ্ঠান ঐচ্ছিক। জনকাদি ঋষিরা ব্রহ্মকর্ম করেছেন- আবার কেউ কেউ ব্রহ্মজ্ঞানের পর কর্ম করেননি (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১৫)।  বিদ্যা কর্মের অঙ্গ নয়। বরং জ্ঞানের দ্বারা কর্মফল ধ্বংশই হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১৬)।  সন্ন্যাস আশ্রমে বিদ্যাসাধনেরই উপদেশ শাস্ত্র বিধান করেছেন- কর্মের নয়। সুতরাং বিদ্যা কর্মাঙ্গ নয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১৭)।  ‘জ্ঞানেই মুক্তি’ শ্রুতিতে এরূপ উল্লেখ থাকায় সন্ন্যাসীর পক্ষে যজ্ঞাদি কর্ম নিষ্প্রয়োজন (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৫)।

বাদরায়ণ যেহেতু শব্দ-প্রমাণক অর্থাৎ শ্রুতিবচনকেই প্রামাণ্য হিসেবে গণ্য করেন, তাই বেদান্তসূত্রে স্বভাবতই শ্রুতি-প্রামাণ্যেও উদাহরণ টেনেছেন। যেমন, শ্রুতিতে বলা হয়েছে- আত্মজ্ঞানী শোক অতিক্রম করেন (ছান্দোগ্য-৭/১/৩)।  যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি পরব্রহ্মকে জানেন। এ বিষয়ে একটি মন্ত্র আছে- ‘ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত’ (তৈত্তিরীয়-২/১/১)।  এই আত্মাকে জেনে ব্রাহ্মণগণ পুত্রকামনা, বিত্তকামনা ও লোককামনা একেবারে পরিত্যাগ করে ভিক্ষাটন অর্থাৎ সন্ন্যাস অবলম্বন করবেন (বৃহদারণ্যক-৩/৫/১)।  কিছু সংযত-ইন্দ্রিয়, বিদ্বান ব্যক্তি আছেন যাঁরা অরণ্যে বাস করেন এবং ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করেন। পরম সত্য লাভ করার উদ্দেশ্যে তারা কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যা করেন। এভাবে তাদের চিত্ত শুদ্ধ হয়। মৃত্যুর পর সূর্যদ্বার পথে (উত্তরায়ণ মার্গে) তারা সেই লোকে যান যেখানে অবিনাশী অক্ষয় পুরুষ হিরণ্যগর্ভ বাস করেন। একেই বলে ব্রহ্মলোক (মুণ্ডক-১/২/১১)।

ব্রহ্মবিদ্যার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, বেদান্ত উপনিষদের শ্রুতিগুলিই যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞানের উৎস, তাই শ্রুতিকে অভ্রান্ত ও প্রামাণ্য বলেই মনে করা হয়। সেক্ষেত্রে, কোন কোন তত্ত্বজ্ঞানের বিষয়কে সহজবোধ্য করে উপলব্ধির সুবিধার্থে অনেক উপনিষদেই বিভিন্ন কাহিনী বা আখ্যায়িকার মাধ্যমে তত্ত্বজ্ঞান বিশ্লেষণ লক্ষ্য করা যায়। উল্লিখিত কাহিনীগুলি হলো যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী কাহিনী, প্রতর্দন কাহিনী, যম-নচিকেতা সংবাদ ইত্যাদি- যেগুলি বৃহদারণ্যক, কৌষীতকি এবং অন্যান্য উপনিষদে বর্ণিত আছে। এখান প্রশ্ন হলো, উপনিষদের এই কাহিনীগুলি শ্রুতি নির্ধারিত পারিপ্লব কিনা? জবাবে বাদরায়ণ বলেন- ‘পারিপ্লব’ হলো অশ্বমেধযজ্ঞে পঠিত কাহিনী-সমষ্টি। উপনিষদের কাহিনীগুলি পারিপ্লবার্থে ব্যবহৃত হয় না- কারণ পারিপ্লবের কাহিনীগুলি শ্রুতি নির্দিষ্ট করা আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৩)।  উপনিষদ্ বর্ণিত কাহিনীগুলি ঐগুলির নিকটতম বিদ্যার বিষয়কে বিস্তারিত করার জন্য এর (বিদ্যার) সাথে এক হয়ে সন্নিবিষ্ট আছে। এরা বিদ্যার সহায়ক, পারিপ্লবের অঙ্গ নয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৪)।

নিয়মানুযায়ী অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠানটি একবৎসর সময়ব্যাপী হয়ে থাকে। এ সময়ের মধ্যে যজ্ঞানুষ্ঠাতা এবং তার পরিবারবর্গকে কিছুদিন পর পর কতকগুলি কাহিনী শ্রবণ করতে হয়। এই কাহিনী-সমষ্টিকে বলা হয় পারিপ্লব, এবং এটি একটি যজ্ঞকর্মাঙ্গও বটে। কিন্তু উপনিষদে বর্ণিত কাহিনীগুলিও কি একই উদ্দেশ্যে গৃহীত হবে? যদি তাই হয়, তাহলে এরাও যজ্ঞকর্মের অংশ হয়ে যায়- এবং সেক্ষেত্রে এর অর্থ এই হয় যে, জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ডেরই অধীন। বাদরায়ণের মতে, উপনিষদের কাহিনীগুলি পারিপ্লব অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত নয়- কারণ পারিপ্লবের কাহিনীগুলি শ্রুতি দ্বারা নির্ধারিত। যেকোন কাহিনী এর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারে না। উপনিষদের কাহিনীগুলিকে এজাতীয় কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। উপনিষদের কাহিনীগুলি বিদ্যার ব্যাখ্যানের জন্যই উল্লিখিত। এই বিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমেই মোক্ষ বা মুক্তির সাধনকে সূত্রকার বাদরায়ণ সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন। এবং ব্রহ্মবিদ্যা বিহীন অন্য কর্মকে গুরুত্বহীন বলে বাদরায়ণ মনে করেন।

(২) কর্ম : ব্রহ্মজ্ঞানের প্রাধান্যকে স্বীকার করেও বাদরায়ণ কতিপয় উপনিষদীয় ঋষির মতো যজ্ঞাদি কর্মকাণ্ডকে তুচ্ছ করেননি, বরং কর্মে নিযুক্ত গৃহস্থাদি আশ্রমের মধ্যেও অগ্নিহোত্র প্রভৃতি ক্রিয়াকলাপকে ব্রহ্মজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছিলেন। বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- জ্ঞানলাভের সহায়ক হিসেবে সকল ক্রিয়ানুষ্ঠানের বিধানই শাস্ত্রে আছে, কিন্তু মোক্ষলাভের সঙ্গে যজ্ঞাদির সাক্ষাৎ কোন সম্পর্ক নেই। যেমন গমন কার্যের জন্য অশ্বের প্রয়োজন- কিন্তু উদ্দিষ্ট দেশ প্রাপ্ত হলে গমনের ফলের সঙ্গে অশ্বের সাক্ষাৎ কোন সম্পর্ক থাকে না (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৬)।  যজ্ঞাদি কর্মে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। বিদ্যার শেষ ফল মোক্ষলাভের জন্য শম, দম, তিতিক্ষা প্রভৃতি সাধন-অভ্যাস শাস্ত্রে বিহিত আছে। বিদ্যার অঙ্গীভূত রূপে শমদমাদি সাধনের বিধি থাকায় তা অবশ্যই অনুষ্ঠেয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৭)।

কারণ, এ বিষয়ে প্রামাণ্য শ্রুতিতেও বলা হয়েছে- ব্রাহ্মণগণ নিত্য স্বাধ্যায় যজ্ঞ, দান ইত্যাদি দ্বারা এঁকে জানতে ইচ্ছে করেন (বৃঃ-৪/৪/২২)।  এজন্যই এইরূপ জ্ঞানী, শান্ত, দান্ত, উপরত… হয়ে নিজের দেহেন্দ্রিয়ের মধ্যে আত্মাকে সন্দর্শন করেন (বৃঃ-৪/৪/২৩)।

অর্থাৎ জ্ঞানলাভের সহায়ক হিসেবে এসব যজ্ঞক্রিয়ার উপযোগিতা আছে- এবং শাস্ত্রেও এসবের বিধান আছে। কিন্তু জ্ঞানের ফল মোক্ষ বা মুক্তি সাধনে এসব কর্মানুষ্ঠানের কোন ভূমিকাই নেই। কেননা, মোক্ষলাভ একমাত্র জ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব- কর্মদ্বারা নয়। বলা হয়, শম, দম, যজ্ঞাদি ক্রিয়া মনকে শুদ্ধ করে, এবং এরূপ শুদ্ধ মনেই আত্মজ্ঞান প্রতিভাত হন। তাই জ্ঞান উৎপাদনের পরোক্ষ উপায়রূপে কর্মের উপযোগিতা আছে। শম-দমাদির সঙ্গে জ্ঞান যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কর্ম ঠিক, কিন্তু ব্রহ্মবিদ্যার দ্বারা তা অধিক শক্তিশালী হয়।

বাদরায়ণ কেবল যাগ-যজ্ঞাদি ইষ্ট কর্মই নয়, পানভক্ষণ সম্বন্ধীয় নিয়ম থেকেও ব্রহ্মবাদীগণকে মুক্ত করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তবে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকলে অন্য জাতির অন্ন গ্রহণের অনুমতি তিনি ঋষি উষস্তি চাক্রায়ণের মতোই দিয়েছেন। কেননা শ্রুতিভাষ্য অনুযায়ী জানা যায়, ঋষি চাক্রায়ণ খাদ্যাভাবে মৃত্যু উপস্থিত হলে এরূপ করেছিলেন। তবে সেই গ্রহণও হবে অজ্ঞাতে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- প্রাণোপাসকের পক্ষে ভক্ষ্য-অভক্ষ্য বিচারের কোন প্রয়োজন নেই। অন্নাভাবে প্রাণ বিনাশের আশঙ্কা দেখা দিলে অন্ন বিষয়ে বিচারের প্রয়োজন নেই, শাস্ত্রে এইরূপ নির্দেশ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৮)।  সর্বান্ন ভক্ষণের বিধি বিশেষ ক্ষেত্রে মাত্র দেয়া হয়েছে। তবে আহার শুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৯)।

এক্ষেত্রে শ্রুতি প্রামাণ্য হিসেবে ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্রুতিবচনে উল্লেখ করা হয়েছে- প্রাণ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার অন্ন কী হবে?’ অন্য ইন্দ্রিয়েরা উত্তর দিলেন, ‘কুকুর ও শকুনি থেকে আরম্ভ করে সকল জীবের যা কিছু খাদ্য আছে (সেই সমস্তই আপনার অন্ন)।’ এইসবই অনের অন্ন। অন এই শব্দটি (প্রাণের) সাক্ষাৎ নাম। যিনি এরূপ (অর্থাৎ নিজেকে সকল অন্নের ভক্ষক প্রাণরূপে) জানেন তার নিকট কিছুই অভক্ষ্য থাকে না (অর্থাৎ যে কোন প্রাণীর খাদ্যই তার অন্ন হয়) (ছান্দোগ্য-৫/২/১)।

শ্রুতির এই উক্তির অপূর্বত্বহেতু এটি প্রাণোপাসকদের পক্ষে একটি বিধি বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু বাদরায়ণ বলেন যে, এটি বিধি নয়, শুধু একটি ঘটনার বিবৃতি মাত্র, কেননা যেখানে বিধির অনুমানের কোন হেতু নেই সেখানে তার ধারণা অযৌক্তিক। নিষিদ্ধ খাদ্য তখনই ভক্ষণ করা যেতে পারে যখন জীবন বিপন্ন হয়। কারণ- মনুসংহিতাদি স্মৃতিশাস্ত্রেও প্রাণ সঙ্কটকালে নির্বিচারে খাদ্য গ্রহণের বিধি আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩০)।  শাস্ত্রসমূহ খাদ্য বিষয়ে যথেচ্ছাচারকে নিষেধই করেছেন। আপৎকাল ছাড়া খাদ্যের বিচার অবশ্যই করণীয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩১)।

উল্লেখ্য, মনুসংহিতায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- যে ব্রাহ্মণ অন্নাভাবে জীবনসংশয়ে পতিত হয়েছেন তিনি যদি যেখানে-সেখানে অন্ন ভোজন করেন (এই ক্ষেত্রে অন্নস্বামীর জাতি ও কাজ বিবেচনা করা অনাবশ্যক), তাহলে আকাশ যেমন পঙ্কলিপ্ত হয় না, তিনিও সেইরকম পাপে লিপ্ত হন না (মনু-১০/১০৪)।  ধর্মাধর্মবিচক্ষণ ঋষি বিশ্বামিত্র ক্ষুধায় কাতর হয়ে চণ্ডালের হাত থেকে কুকুরের জঘন মাংস (যা স্বভাবতঃ সকলরকম দোষযুক্ত) গ্রহণ করে ভোজন করতে উদ্যত হন, তবুও তিনি পাপে লিপ্ত হন নি (মনু-১০/১০৮)।

তবে সাধারণ ক্ষেত্রে ভক্ষ্য-অভক্ষ্যের শুদ্ধি বিচার প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় বলা আছে- নিজেকে শুদ্ধ রাখবার ইচ্ছা থাকলে অভক্ষ্য ভক্ষণ করা কখনোই উচিত নয়। যদি অজ্ঞানতাবশতঃ ঐরকম অখাদ্য খাওয়া হয়ে যায়, তাহলে তা তখনই বমি করে উগরিয়ে ফেলবে ; যদি বমি না করা যায় তাহলে তখনই (শাস্ত্রাযায়ী) প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ হবে (মনু-১১/১৬১)।

প্রকৃতপক্ষে বাদরায়ণ কর্মানুষ্ঠানকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেননি, তাই তিনি আশ্রমের কর্তব্য অর্থাৎ গৃহস্থাদি ধর্মকে ব্রহ্মজ্ঞানীর জন্যও ব্রহ্মবিদ্যার সাহায্যকারীর পটভূমিতে কর্তব্য বলে মেনেছেন। আপৎকালে তিনি নিয়ম-শৃঙ্খলাকে শিথিল করতে প্রস্তুত ছিলেন, এবং আশ্রমহীন অপেক্ষা আশ্রমবাসই শ্রেয় মনে করেছেন। এ প্রেক্ষিতে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- আশ্রমবিহিত কর্ম সকলেরই করণীয়, কারণ, তা-ই শাস্ত্রের বিধান (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩২)।  জ্ঞানলাভই পরম পুরুষার্থ। সুতরাং জ্ঞানলাভের সহায়ক বলেও এসকল কর্তব্য কর্ম অবশ্য পালনীয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৩)।  মুমুক্ষু এবং গৃহী উভয়ের পক্ষে যে যজ্ঞাদি কর্মের বিধান তা একই কর্ম, ভিন্ন ভিন্ন কর্ম নয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৪)।

আশ্রমোচিত এ সকল অবশ্য করণীয় কর্মানুষ্ঠান যে জ্ঞানেরও সহায়ক, স্মৃতি ও শ্রুতিশাস্ত্রেও প্রামাণ্য আছে। যেমন স্মৃতিশাস্ত্র শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে- শ্রীভগবান বললেন- কর্মফলের আশা না করে যিনি কর্তব্য (অগ্নিহোত্রাদি) নিত্যকর্ম করেন, তিনিও সন্ন্যাসী, তিনিও কর্মযোগী। অগ্নিহোত্রাদি শ্রৌত ও তপোদানাদি স্মার্ত কর্ম যিনি ত্যাগ করেছেন, কেবল তিনিই সন্ন্যাসী বা যোগী নন (গীতা-৬/১)।

আবার ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্রুতিতে আছে- অতঃপর, যাকে ‘অনাশকায়ন’ বা অনশনব্রত বলা হয় তাও ব্রহ্মচর্য। কারণ ব্রহ্মচর্যের দ্বারা যে আত্মাকে লাভ করা যায় তার নাশ হয় না (‘অনাশক’)। আবার যাকে ‘অরণ্যায়ন’ (অরণ্যে বাস) বলা হয় তাও ব্রহ্মচর্য। কারণ এই পৃথিবী থেকে তৃতীয়-সংখ্যক দ্যুলোকে অর্থাৎ ব্রহ্মলোকে ‘অর’ ও ‘ণ্য’ নামে দুটি সমুদ্র আছে। এছাড়াও সেখানে ঐরম্মদীয় নামে একটি সরোবর (যার জল আনন্দ-বর্ধক), একটি অশ্বত্থ গাছ যার থেকে সোমরস নিঃসৃত হয়, ‘অপরাজিতা’ নামে ব্রহ্মের পুরী এবং ব্রহ্মার দ্বারা নির্মিত স্বর্ণময় একটি মণ্ডপ আছে (ছান্দোগ্য-৮/৫/৩)।

এই শ্রুতি থেকে জানা যায় যে, ব্রহ্মচর্যাদির ন্যায় সমজাতীয় কর্মানুষ্ঠান জ্ঞানের সহায়ক। ব্রহ্মচর্যাদি গুণের দ্বারা ভূষিত সাধক ক্রোধ-ঈর্ষা প্রভৃতির দ্বারা পরাভূত হন না, এজন্য তার চিত্তও চঞ্চল হয় না এবং সেকারণে তিনি (জ্ঞানের) সাধনায় সক্ষম হন। আর তাই বাদরায়ণ আপৎকালে নিয়ম-শৃঙ্খলাকে শিথিল করতে প্রস্তুত হলেও আশ্রমহীন অপেক্ষা আশ্রমবাসই শ্রেয় বলে মনে করেছেন। ফলে এ প্রেক্ষিতে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- আশ্রম বহির্ভূত, অন্তরাস্থিত ব্যক্তিরাও ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী। যেমন শাস্ত্রে রৈক্ক বাচক্লবী প্রভৃতির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৬)।  যদিও অনাশ্রমী হয়েও বিদ্যালাভ করা যায় তবুও অনাশ্রমী না হয়ে কোন আশ্রমকে অবলম্বন করাই শ্রেয়, কারণ শ্রুতি এবং স্মৃতি শাস্ত্রে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবেই আশ্রম গ্রহণের উপদেশ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৯)।

তবে এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তির লক্ষ্যে জ্ঞানলাভের যে নানা উপায় রয়েছে, এসব সাধনোপায় থেকে উদ্ভূত জ্ঞান কি এ জন্মেই লাভ হয়, না কি জন্মান্তরে লাভ হয়, তা নিয়েও একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। তাই বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে এই জ্ঞানোৎপত্তি বিষয়ে বলেন- কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকলে এই জন্মেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। প্রতিবন্ধক থাকলে জন্মান্তরে হয়। এরূপ দৃষ্টান্ত শাস্ত্রে পাওয়া যায় (ব্রঃ-৩/৪/৫১)।

অর্থাৎ জ্ঞান এজন্মে বা জন্মান্তরে উৎপন্ন হতে পারে- তা নির্ভর করে কোন প্রতিবন্ধকতা আছে কি না এবং সাধকের যোগ্যতা কিংবা উপাসনার তীব্রতা কেমন তার উপর। যেমন, কঠ-উপনিষদেই বলা হয়েছে- আত্মার বিষয়ে অনেকে শোনারও সুযোগ পান না। আবার শুনেও অনেকে এর তাৎপর্য বুঝতে পারেন না। আসলে আত্মা সম্পর্কে শিক্ষাদানের যোগ্যতা অতি অল্প সংখ্যক মানুষেরই থাকে। কাজেই এই আত্মজ্ঞান অতি নিপুণ শিক্ষার্থীই লাভ করতে পারেন। এই কারণেই নিপুণ আচার্যের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়ে আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা সত্যিই বিরল (কঠ-১/২/৭)।

আবার শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ধ্যানযোগে বলা হয়েছে- যত্নশীল যোগী বহু প্রযত্নের চর্চায় নিষ্পাপ হয়ে অনেক জন্মের সাধনসঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধ মনোরথ হয়ে পরমগতি মোক্ষপ্রাপ্ত হন (গীতা-৬/৪৫)।

সাধনে প্রতিবন্ধকতা কিংবা সাধকের উপাসনার তীব্রতার বিষয় ছাড়াও এখানে আরেকটি সন্দেহ থাকতে পারে যে, হয়তো এমন কোন নিয়ম থাকতে পারে যার দ্বারা জ্ঞানের ফলশ্রুতি মোক্ষলাভ করা যায়। অথবা অন্যভাবে বললে, জ্ঞানলাভের পর মোক্ষ কি বিলম্বিত হতে পারে? এবং সাধকের গুণানুসারে জ্ঞানের কি মাত্রাগত ভেদ আছে? এসব সন্দেহ নিরসনকল্পে বাদরায়ণ বলেন, মোক্ষ বিষয়ে এরূপ কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম নাই। কারণ শ্রুতি বচনসমূহ দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে যে, চরম মোক্ষ অবস্থাটি একই প্রকার, এর মাত্রাগত কোন প্রভেদ নেই। কেননা চরম মুক্তির অবস্থা ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুই নয়। তাই বেদান্তসূত্রে খোলাখুলি উক্তি- মোক্ষলাভ কখন কিভাবে হবে- জ্ঞানের ফল কিভাবে দেখা দেবে- এই বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। শ্রুতি এই অবস্থাকে অনির্বচনীয় বা চিরন্তন বলেই ঘোষণা করেছেন। ব্রহ্মের সাথে একত্ব লাভ করাই মোক্ষ বা মুক্তি (ব্রঃ-৩/৪/৫২)।

(৩) উপাসনা : বিভিন্ন জ্ঞান দ্বারা কিভাবে ব্রহ্মোপাসনা করা যায়, উপনিষদের প্রকরণেই তা বলা হয়েছে- আত্মগতভাবে ব্রহ্মের উপাসনা করতে হয়, কোনো মূর্তি বা প্রতীকের মাধ্যমে করা নিষিদ্ধ, কারণ ঐগুলি ব্রহ্ম নয়। যেমন- মৈত্রেয়ী, সর্বত্রই এই আত্মা। সকলকে ব্যাপ্ত করে রয়েছেন একই আত্মা। সেই আত্মাকেই দর্শন করতে হবে, শ্রবণ করতে হবে, মনন করতে হবে, নিদিধ্যাসন বা ধ্যান করতে হবে। এই আত্মার দর্শন, শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ঠিকমতো প্রত্যয়ের সঙ্গে করতে পারলেই তার সব জানা হয়ে যাবে (বৃঃ-২/৪/৫)।   সমগ্র জগৎই ব্রহ্ম। এই জীবাত্মাও ব্রহ্ম। আপাতদৃষ্টিতে এই আত্মার চারটি অবস্থা (মাণ্ডুক্য-২)।   ‘মনই ব্রহ্ম’- এইভাবে যে উপাসনা, তা হলো অধ্যাত্ম উপাসনা। আর ‘আকাশ ব্রহ্ম’- এইভাবে যে উপাসনা, তা অধিদৈবত উপাসনা। কেননা, হৃদয়াভ্যন্তরে মনই আকাশ, বাইরের আকাশই সেই বৃহৎ মন (ছান্দোগ্য-৩/১৮/১)।

এসব শ্রুতিবচন অনুসরণ করেই বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে ব্রহ্মোপাসনার উপায় ব্যাখ্যা করে বলেন- ব্রহ্মবিদ্যালাভের জন্য শাস্ত্রবিহিত শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনাদির পুনঃপুনঃ অভ্যাস করতে হবে, কারণ এটাই শাস্ত্রের বহুল নির্দেশ (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১)।  কিন্তু শ্রুতিসমূহ ব্রহ্মকে উপাসকের আত্মারূপে জানেন এবং অপরকেও এরূপ ধারণা করতে উপদেশ দেন। ধ্যেয় ব্রহ্মই আমার আত্মা- এরূপ ধ্যানের উপদেশই শ্রুতিসমূহ দিয়ে থাকেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৩)।  উপাসক প্রতীকের সঙ্গে নিজের একত্ব কল্পনা করে ধ্যান করবেন না, কারণ সাধক প্রতীক নন (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৪)।  প্রতীককে ব্রহ্মরূপে দর্শন করা বিধেয়, কিন্তু ব্রহ্মকে প্রতীকরূপে ধ্যান করা বিধেয় নয় কারণ তা হলে প্রতীকটি ব্রহ্ম থেকে উৎকৃষ্ট হয়ে যায় (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৫)।

‘মনই ব্রহ্ম’, ‘আদিত্যই ব্রহ্ম’- ইত্যাদি প্রতীক উপাসনা প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন জাগে যে, এখানে আমরা প্রতীককেই কি ব্রহ্ম বলে মনে করবো, না ব্রহ্মকেই প্রতীক বলবো? বাদরায়ণ বলছেন, মন, আদিত্য ইত্যাদি প্রতীককেই ব্রহ্ম বলে গণ্য করতে হবে- কিন্তু এর বিপরীতক্রমটি নয়। যেহেতু আমাদের লক্ষ্য হলো নানাত্বেও ধারণা থেকে মুক্তি লাভ করে সর্বভূতে ব্রহ্ম দর্শন করা, সেহেতু আমাদের সেসব প্রতীককেই ব্রহ্মরূপে ধারণা করতে হবে।

আবার ধ্যান বা উপাসনার ভঙ্গি হিসেবে বাদরায়ণ বলেন, আসনে উপবিষ্ট হয়ে, স্থির দেহে, একাগ্রচিত্তে, ধ্যানের মাধ্যমে ব্রহ্মের উপাসনা করা দরকার এবং তা করতে হয় আবৃত্তি সহ, প্রত্যহ সারাজীবন। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- আসনে উপবেশন করেই উপাসনা বা ধ্যান করা কর্তব্য (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৭)।  ধ্যান এবং উপাসনা একই। আসনে না বসলে ধ্যান বা উপাসনা যথাযথ হয় না (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৮)।  পৃথিবীর স্থিরত্বকে লক্ষ্য করেই স্থির হয়ে ধ্যানের উপদেশ আছে। আসনে স্থির হয়ে ধ্যান কর্তব্য- শায়িত বা চলিত অবস্থায় নয় (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৯)।  ধ্যান বা উপাসনার স্থানবিশেষের কোন নির্দিষ্ট বিধি নাই। যেখানেই মনঃসংযোগ হবে সেখানেই ধ্যান করা যায় (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১১)।  মোক্ষলাভ না হলে মৃত্যুকাল পর্যন্ত আজীবন উপাসনা করে যাবার উপদেশ শাস্ত্রে আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১২)।

মুক্তিপ্রাপ্তের অন্তিম যাত্রা

বলা হয়, ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তির পর ভোগোন্মুখ না হলে পূর্বে ও পরে কৃত পাপ-পুণ্য বিনষ্ট হয়, তারা আর ব্রহ্মবিদকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু যে পাপ-পুণ্য ভোগোন্মুখ অর্থাৎ প্রারব্ধ হয়ে গেছে সেসব ভোগ করেই মোক্ষলাভ করতে হয়। বাদরায়ণ বলেন- ভোগের দ্বারা পাপ এবং পুণ্য উভয়প্রকার প্রারব্ধ ফল ক্ষয় করে ব্রহ্মজ্ঞ ব্রহ্মের সাথে একত্ব অনুভব করেন। ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মই হয়ে যান (ব্রঃ-৪/১/১৯)।

এভাবে ভোগের মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রারব্ধ কর্মরাশি নষ্ট বা নিঃশেষ হলে পরই মুক্ত আত্মা ব্রহ্মের সাথে একত্ব লাভ করতে শরীর ত্যাগ করে। মুক্ত আত্মার এই শরীর ত্যাগ একটি ক্রমপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে। প্রথমে বাক্ বা বাণী মনের মধ্যে লীন হয়, মন প্রাণের মধ্যে লয়প্রাপ্ত হয়, প্রাণ আত্মায় এবং আত্মা মহাভূতে। বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- মৃত্যুকালে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের বাগিন্দ্রিয় মনে লয়প্রাপ্ত হয়। এরূপ ঘটনা দৃষ্ট হয়- এবং শ্রুতিও তা-ই বলেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/১)।  মৃত্যুকালে বাক্-ইন্দ্রিয়ের ন্যায় সকল ইন্দ্রিয়ই একই কারণে মনে লয়প্রাপ্ত হয় (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/২)।  মৃত্যুকালে মন যে প্রাণে লয়প্রাপ্ত হয় তা উদ্ধৃত শ্রুতিবচনের পরের অংশ থেকেই জানা যায় (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৩)।  প্রাণ জীবাত্মায় লয়প্রাপ্ত হয়। কারণ, ছান্দোগ্য বৃহদারণ্যক প্রভৃতি শ্রুতিতে এরূপ উক্তি স্পষ্টতই আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৪)।  জীবসংযুক্ত প্রাণ শুধুমাত্র তেজের সাথেই মিলিত হয় না, বরং পৃথিব্যাদি পঞ্চভূতেই মিলিত হয়- শ্রুতিতেও এরূপ উক্তি আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৫)।।  উৎক্রান্ত জীব শুধুমাত্র তেজের সূক্ষ্ম অবস্থাতেই লীন হয় না- শ্রুতি ও স্মৃতি উভয়ই তাকে পঞ্চভূতের সূক্ষ্মরূপে বিলীন হয়ে অবস্থান করার কথা বলেছেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৬)।

শ্রুতির সাক্ষ্য থেকে মুক্ত আত্মার এই শরীর ত্যাগের ক্রমপ্রক্রিয়াটি যাচাই করে দেখা যেতে পারে। ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত আছে- জল ছাড়া এই দেহরূপ অঙ্কুরের মূল আবার কোথায় হতে পারে? হে সোম্য, জলরূপ অঙ্কুর দ্বারা কারণরূপ তেজের অনুসন্ধান করো। তেজরূপ অঙ্কুর দ্বারা কারণরূপ সৎ-এর অনুসন্ধান করো। হে সোম্য, চরাচর এই সমস্তই সৎ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, সৎ-কে আশ্রয় করে আছে এবং সৎ-এই প্রতিষ্ঠিত। এই তিন দেবতা (অর্থাৎ অগ্নি, জল ও পৃথিবী) মানুষের দেহে প্রবেশ করে প্রত্যেকে তিন ভাগে বিভক্ত হয় একথা আগেই বলা হয়েছে। হে সোম্য, মানুষ যখন মুমূর্ষু হয়, তখন তার বাক্ মনে, মন প্রাণে, প্রাণ তেজে এবং তেজ পরম দেবতায় অর্থাৎ ব্রহ্মে মিলিত হয় (ছান্দোগ্য-৬/৮/৬)।

এই শ্রুতি অনুসারে বাক্ মনে লয়প্রাপ্ত হয়, মন প্রাণে, এবং এভাবে পরপর লয় হয়। স্বভাবতই এখানে প্রশ্ন আসে, বাগিন্দ্রিয় কি ইন্দ্রিয়রূপেই মনে লয়প্রাপ্ত হয়, না কি এর ক্রিয়ামাত্র লীন হয়? মনে হতে পারে, যেহেতু শ্রুতিতে বাক্-ক্রিয়ার লীন হওয়ার কথা স্পষ্টত উল্লেখ নেই, সেহেতু বাক্-ইন্দ্রিয়ই মনে লয়প্রাপ্ত হয়। সূত্রকার বাদরায়ণ সূত্রের সাহায্যে বলছেন যে, শুধুমাত্র বাগিন্দ্রিয়ের ক্রিয়াটিই মনে লয়প্রাপ্ত হয়। মন ইন্দ্রিয়সমূহের উপাদান কারণ নয়- এবং সেজন্যই এরা মনে লীন হতে পারে না। শুধুমাত্র উপাদানকারণেই কার্যগুলি লীন হতে পারে, এবং যেহেতু মন ইন্দ্রিয়সমূহের উপাদান কারণ নয়, সেজন্যে আমাদের বুঝতে হবে যে, এখানে ‘বাক্’ বলতে ইন্দ্রিয়কে নয়, বাক্ ক্রিয়াকেই বলা হয়েছে। যেহেতু ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া ইন্দ্রিয় থেকে ভিন্ন, তাই তা (বাক্ ক্রিয়া) মনে লয়প্রাপ্ত হতে পারে- যদিও মন বাক্-ক্রিয়ার কারণ নয়, যেমন অগ্নির দাহিকাশক্তির বিষয়গুলি কাঠের মধ্যে নিহিত থাকলেও অগ্নি জলেই নির্বাপিত হয়ে লীন হয়। সুতরাং শ্রুতিশাস্ত্রের উক্তিটি বাক্-ক্রিয়াকেই বুঝাচ্ছে- যেহেতু বস্তুটি এবং বস্তুর ক্রিয়াটিকে একইরূপে দেখা যাচ্ছে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এটা লক্ষ্য করা যায় যে, একজন মুমূর্ষু ব্যক্তি প্রথমেই তার বাক্শক্তি হারায়- যদিও তার মন তখনও পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে। অতএব বুঝতে হবে যে, বাক্ ক্রিয়াই- বাগিন্দ্রিয় নয়- মনে লয়প্রাপ্ত হয়।

আবার যখন মন প্রাণে বিলীন হয়, তখন পৃথিবীর জলে বিলীন হওয়ার মতো তাও একই ব্যাপার; কারণ, মনই হলো অন্ন বা পৃথিবী, এবং প্রাণ হলো জল। কারণ, ছান্দোগ্যেই বলা হয়েছে- হে সোম্য, মন অন্নময় অর্থাৎ খাদ্যের দ্বারা পুষ্ট হয়, (অন্ন) প্রাণ জলময় অর্থাৎ জলের দ্বারা এবং বাক্ তেজের দ্বারা… (ছান্দোগ্য-৬/৬/৫)।

অতএব পূর্বোক্ত শ্রুতি অনুসারে মন যখন প্রাণে বিলীন হয়, তখনও বুঝতে হবে, মন বলতে মনের ক্রিয়াকেই বোঝানো হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতায়ও দেখা যায় যে, মুমূর্ষু ব্যক্তির মনের ক্রিয়াটি যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, তখনও তার প্রাণশক্তি ক্রিয়াশীল থাকে। এরপর প্রাণ তেজ বা জীবাত্মায় লয়প্রাপ্ত হয়। শ্রুতিতেও বলা হয়েছে- রাজা যখন ফিরে যেতে চান, তখন যেমন শান্তিরক্ষক, বিচারক, রথচালক, নেতারা সব একজায়গায় সমবেত হয়ে তাকে বিদায় জানায়, সেই রকম এই শারীর-আত্মাও উর্ধ্বশ্বাসী হলে, অর্থাৎ তার এই দেহত্যাগের সময় এলে সমস্ত প্রাণ, যাদের আমরা ইন্দ্রিয় বলি, সবাই তার চারদিকে এসে হাজির হয় (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৩৮)। কিংবা, ‘প্রাণ উৎক্রমণ করলে সকল ইন্দ্রিয় উৎক্রান্ত হয়’- (বৃহদারণ্যক-৪/৪/২)।

বাদরায়ণের সূত্র (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৬) মতে, মৃত্যুকালে যখন জীবাত্মা একটি দেহ পরিত্যাগ করে অন্য দেহে আশ্রয় নিতে চায় তখন তা পঞ্চভূতের সূক্ষ্মরূপের মধ্যেই আশ্রয় করে অবস্থান করে, শুধুমাত্র তেজের মধ্যে নয়- কারণ ভাবী দেহ গঠনের জন্য তার পঞ্চভূতেরই প্রয়োজন হয়। এজন্যই সগুণ ব্রহ্মজ্ঞানী এবং অজ্ঞানী মানুষের মৃত্যুকালীন যাত্রাটি একই রকম হয়, যে পর্যন্ত না তারা নিজ নিজ মার্গে যাত্রা আরম্ভ করে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- মৃত্যুর পর নিজ নিজ মার্গে গমনের পূর্ব পর্যন্ত সগুণ ব্রহ্মবিদের এবং বদ্ধজীবের গতি একই প্রকার। যেহেতু সগুণ ব্রহ্মবিদের অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়নি, তাই তার অমৃতত্ব (ব্রহ্ম-উপলব্ধি) আপেক্ষিক মাত্র (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৭)।   মৃত্যুর পর ব্রহ্মজ্ঞান লাভ পর্যন্ত এই সূক্ষ্মদেহ বর্তমান থাকে। কারণ শাস্ত্রে মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত জীবের সূক্ষ্মদেহে অবস্থানের কথা আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৮)।  সূক্ষ্ম দেহটি স্বচ্ছ এবং স্থূল উপাদানরহিত বলেই স্থূলদেহের ধ্বংস হলেও সূক্ষ্মদেহটির বিনাশ বা পরিবর্তন হয় না (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/১০)।

তবে সম্পূর্ণ কর্মরাশিকে বিনষ্ট করে মুক্ত আত্মা পূর্ববর্ণিত যে ক্রমপ্রক্রিয়ায় শরীর ত্যাগ করে, এই সাধারণ পথে মুক্তির গতির বৈশিষ্ট্য হলো- ব্রহ্মজ্ঞানে সমর্থ শতাধিক নাড়ী থেকে মূর্ধাযুক্ত নাড়ী দ্বারা আত্মা হৃদয়াসন ত্যাগ করে বহির্গত হয় এবং সূর্যকিরণকে অনুসরণ করে প্রস্থান করে। নিশাকাল বা দক্ষিণায়ন কোনো সময়ই মৃত্যুর পর মুক্ত পুরুষের পথের বাধা নয়। এবং মৃত্যুর পর মুক্ত পুরুষকে এক দূর দেশে যাত্রা করতে হয়। তবে এই গন্তব্য যে ব্রহ্মলোক, তা ইতঃপূর্বে উল্লিখিত ছান্দোগ্য (ছাঃ-৫/১০/১), বৃহদারণ্যক (বৃঃ-৬/২/১৫) কিংবা মুণ্ডক (মুঃ-১/২/১১) উপনিষদের শ্রুতি থেকেই জানা যায়। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে স্পষ্ট করেই বলেছেন- বিদ্বান্ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ দেহান্তে অর্চিরাদি মার্গকে অবলম্বন করে ব্রহ্মলোকে গমন করেন। শ্রুতিতে তার প্রমাণ আছে (ব্রঃ-৪/৩/১)।

কিন্তু মুক্ত আত্মার এক দীর্ঘ গমন পথ পেরিয়েই বিভিন্ন লোক হয়ে এই ব্রহ্মলোকে যেতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন উপনিষদের মধ্যে এই গমন পথের বর্ণনায় কিছু কিছু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হওয়ায় উপনিষদের বিক্ষিপ্ত সামগ্রিকে একত্রিত করে বাদরায়ণ সেই জ্যোতির্লোকের একটা সমন্বিত রূপ কল্পনা করেছেন। যেমন, ছান্দোগ্য উপনিষদে মুক্ত পুরুষের গমন-পথের বর্ণনায় বলা হয়েছে- অতঃপর যাঁরা এরূপ জানেন (অর্থাৎ অধিষ্ঠিত আত্মাকে জানেন) তাদের দেহত্যাগের পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হোক বা না হোক, তারা অর্চিতে (অর্থাৎ জ্যোতিতে বা অর্চিলোকে) গমন করেন। তারপর অর্চি থেকে দিবসে, দিবস থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয় মানে, সেই ছয়মাস থেকে সংবৎসরে, সংবৎবসর থেকে সূর্যে, সূর্য থেকে চন্দ্রে এবং চন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ-লোকে যান। সেখানে একজন অমানব (জ্যোতির্ময়) পুরুষ এসে তাদের ব্রহ্মলোকে (হিরণ্যগর্ভের কাছে) নিয়ে যান। এই পথই দেবযান ও ব্রহ্মযান। ঐ পথে গেলে মানুষকে আর সংসাররূপ আবর্তে ফিরে আসতে হয় না (ছান্দোগ্য-৪/১৫/৫)।

অন্যদিকে, বৃহদারণ্যক উপনিষদে মুক্ত আত্মার যাত্রাপথ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘পুরুষ যখন ইহলোক থেকে প্রস্থান করেন, তখন বায়ুকে প্রাপ্ত হন। সেখানে বায়ুকে ত্যাগ করে তিনি উর্ধ্বলোকে, তথা হতে সূর্যলোকে গমন করেন’ (বৃহদারণ্যক-৫/১০/১)।

এই উভয় প্রকার মতকেই সঠিকভাবে গ্রহণ করার জন্য বাদরায়ণ সম্বৎসর থেকে বায়ুলোকে গমনের কথা বলেছেন। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- সগুণ ব্রহ্মবিদের দেহ নির্গত আত্মা প্রথমে বৎসরাভিমানী দেবতার নিকট যায় এবং সেখান থেকে বায়ুদেবতার নিকট যায়- বিশেষ উল্লেখের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি হেতু এরূপই বুঝতে হবে, (কারণ নানা শ্রুতিতে নানাভাবে তা বর্ণিত আছে) (ব্রঃ-৪/৩/২)।

আবার কৌষীতকি উপনিষদে এই উৎক্রান্ত মুক্ত আত্মার গমন পথের বর্ণনায় বলা হয়েছে- ব্রহ্মজ্ঞ মুক্ত আত্মা আয়ুশেষে সুষুম্নাপথে ব্রহ্মরন্ধ্র বিদীর্ণ করে, দেবযান পথে অগ্নিলোক, তারপরে বায়ুলোক, তারপরে আদিত্যলোক, তারপরে ক্রমে বরুণলোক, ইন্দ্রলোক, প্রজাপতিলোক, শেষে ব্রহ্মলোকে গিয়ে হাজির হয় (কৌষীতকি-১/৩)।

ফলে মুক্ত আত্মার গমন পথের ব্যাখ্যায়  আবার এই কৌষীতকির পাঠ সংযুক্ত করে বিদ্যুৎ-লোক থেকে উর্ধ্বে বরুণলোকে যাওয়ার কথা বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- বিদ্যুতের সাথে বরুণের সম্বন্ধ আছে বলে বুঝতে হবে যে, আত্মা বিদ্যুৎ-লোকের পরেই বরুণলোকে যান। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/৩)।।

অতএব, বাদরায়ণ কর্তৃক বর্ণিত উৎক্রান্ত ব্রহ্মজ্ঞ মুক্ত আত্মার সমন্বিত গমন পথ অর্থাৎ দেবযানের অবস্থানগুলি হলো- অর্চি থেকে দিন, দিন থেকে শুক্লপক্ষ, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণ, উত্তরায়ণ থেকে সংবৎসর, সংবৎসর থেকে বায়ুলোক, বায়ুলোক থেকে সূর্যলোক, সূর্যলোক থেকে চন্দ্রলোক, চন্দ্রলোক থেকে বিদুৎলোক, বিদ্যুৎলোক থেকে বরুণলোক, বরুণলোক থেকে ইন্দ্রলোক, ইন্দ্রলোক থেকে প্রজাপতিলোক এবং সবশেষে ব্রহ্মলোক।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, রাহুল সাংকৃত্যানের উক্তিতে, ‘সম্ভবত বাদরায়ণ তার থেকে সহস্র বৎসর পূর্ব-যুগের জ্যোতিষজ্ঞানকে কিছুটা অক্ষুণ্ন মেনেই জ্যোতির্লোকের মধ্যে বায়ুলোক থেকে সূর্য তার পরে চন্দ্র, বরুণ এবং ব্রহ্মলোককে মেনেছেন। ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মলোক পর্যন্ত জ্ঞান এই ঋষিদের নিকট ছিল বাঁ হাতের খেলা, কিন্তু বাস্তব বিশ্ব-সম্পর্কিত জ্ঞানে বেচারাদের সর্বজ্ঞতা যথেষ্ট পিছিয়ে ছিল’ (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা১৮৫)।

উল্লেখ্য যে, এখানে প্রশ্ন হতে পারে, উৎক্রান্ত আত্মার গতিপথ বর্ণনায় গতির লক্ষ্যবস্তু যে ব্রহ্মলোকের কথা বলা হয়েছে, এই ব্রহ্ম কি সগুণ ব্রহ্ম, না কি নির্গুণ বা পর ব্রহ্ম? জবাবে বাদরায়ণ বলেন- বাদরি মুনি মনে করেন যে, দেবযানের মধ্য দিয়ে, নানা দেবতার সাহায্যে নীত হয়ে উৎক্রান্ত আত্মা যে ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন তিনি সম্ভাব্য ধারণায় সগুণ ব্রহ্মই। কারণ নির্গুণ ব্রহ্ম হলে, তিনি সর্বব্যাপী বলে তাকে প্রাপ্ত হওয়ার কোন প্রসঙ্গই উঠে না। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/৭)।। অর্থাৎ, বাদরির মতে, শুধুমাত্র সগুণ ব্রহ্মকে লক্ষ্য করেই এই যাত্রা বা গতি সম্ভবপর হতে পারে- কারণ, সগুণ (আপেক্ষিক) ব্রহ্ম হলেন সসীম এবং সেজন্যই তিনি একটি নির্দিষ্ট স্থান অধিকার করে অবস্থান করছেন- যে স্থানে আত্মা গিয়ে উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু এরূপ গতি বা প্রাপ্তি নির্গুণ ব্রহ্ম সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়- কারণ নির্গুণ ব্রহ্ম সর্বব্যাপী। তবে বিভিন্ন উপনিষদ শ্রুতিতে যেহেতু বলা আছে, মুক্ত আত্মা ব্রহ্মলোক থেকে আর প্রত্যাগমন করেন না, তাই বাদরায়ণ বলতে চেয়েছেন যে- ব্রহ্মলোকে বিলীন হওয়ার সময় আত্মাসমূহ ইতোমধ্যে জ্ঞানলাভ হেতু সগুণ ব্রহ্মের সাথে তার অপেক্ষা উচ্চতর পরব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন। কেননা, পরব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুতেই স্থায়িত্ব নেই। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- ব্রহ্মলোকে বিলীন হওয়ার পর উৎক্রান্ত আত্মা- ব্রহ্মলোকের অধ্যক্ষ সগুণ ব্রহ্মের সাথে পরব্রহ্মেই লীন হয়ে যান- কারণ শ্রুতিতে এরূপই আছে যে, ‘তিনি আর প্রত্যাবৃত্ত হন না।’ একমাত্র পরব্রহ্মে লীন হলেই প্রত্যাবর্তন হয় না (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১০)।   স্মৃতিশাস্ত্রও ঘোষণা করেছেন যে, জীবাত্মা পরব্রহ্মেই লীন হয়ে- ব্রহ্মস্বরূপত্বলাভ করেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১১)।   জৈমিনি মুনির মতে (ছান্দোগ্য) উপনিষদে ব্রহ্ম বলতে পরব্রহ্মকেই বুঝিয়েছে। কারণ, এটাই ‘ব্রহ্ম’ শব্দের মুখ্যার্থ। সুতরাং আত্মা পরব্রহ্মেই লীন হন- অন্যত্র নয় (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১২)।

মুক্তের বৈভব

ব্রহ্মকে প্রাপ্ত মুক্তাত্মা তার স্ব-স্বরূপে অধিষ্ঠিত হয়। বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- মুক্ত জীব ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়ে স্ব-স্বরূপেই প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রুতির ‘স্ব’ শব্দ থেকেই বুঝতে পারা যায় যে জীব এবং ব্রহ্ম স্বরূপত অভিন্ন। সুতরাং মুক্তি বা ব্রহ্মলাভের অর্থ হলো স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া (ব্রঃ-৪/৪/১)।

কারণ, ছান্দোগ্যের শ্রুতিতে বলা আছে- আচার্য বললেন,- আবার এই বিদ্বান ব্যক্তি, সুষুপ্তি হেতু যিনি আনন্দঘন মূর্তি, এই শরীর থেকে উত্থিত হয়ে, অর্থাৎ দেহাত্ম অভিমান ত্যাগ করে, পরম জ্যোতি লাভ করে স্ব-স্বরূপে বিরাজ করেন। ইনিই আত্মা। এই আত্মা অমর, নির্ভয়। ইনি ব্রহ্ম। ব্রহ্মের আরেক নাম ‘সত্য’ (ছাঃ-৮/৩/৪)।

তবে মুক্তজীব ব্রহ্মকে লাভ করলেও তার সঙ্গে সংযুক্ত না হয়েই থাকে। তাহলে প্রশ্ন, ঐ সময়ে আত্মার অবস্থা কিরূপ থাকে? শাস্ত্র অনুসারে ব্রহ্মের দুটি অবস্থা আছে, একটি হলো প্রজ্ঞাঘন শুদ্ধচৈতন্যরূপ অবস্থা, আর অন্যটি হলো ব্রহ্মের গুণাদিসম্পন্ন। যেমন, ব্রহ্মের গুণাদি সম্পর্কে ছান্দোগ্যের শ্রুতিতেই বলা হয়েছে- প্রজাপতি একবার বলেছিলেন,- আত্মা নিষ্পাপ, জরাহীন, মৃত্যুহীন, শোকহীন, ক্ষুধাহীন ও তৃষ্ণাহীন। আত্মাই সত্যকে জানার ও সত্যনিষ্ঠার প্রেরণাস্বরূপ। এই আত্মাকে অনুসন্ধান করতে হবে, তাকে বিশেষভাবে জানতে হবে। যিনি এই আত্মার অনুসন্ধান করে তাকে বিশেষরূপে জানতে পারেন, তিনি সমস্ত লোক ও সকল কাম্যবস্তু লাভ করেন (ছাঃ-৮/৭/১)।

অতএব, মুক্ত জীবাত্মা ব্রহ্মের গুণাদিসম্পন্ন হয়ে যে নিষ্পাপ, বিজর, বিমৃত্যু, বিশোক, ক্ষুধাহীন, তৃষ্ণাহীন, সত্যকাম ও সত্যসঙ্কল্প হয়ে উঠেন, আত্মার এই অবস্থাকে জৈমিনি বলেছেন ব্রহ্মরূপী। তাই বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে- ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পর ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরা ব্রহ্মের মতোই গুণাদিসম্পন্ন হয়ে অবস্থান করেন। তা জৈমিনির মত এবং শাস্ত্রেও এই মতের সমর্থন আছে (ব্রঃ-৪/৪/৫)।

কিন্তু, ব্রহ্মকে লাভ করে মুক্ত জীবাত্মার অবস্থা সম্পর্কে ঔডুলোমি আচার্য বলেন যে তা হলো চৈতন্যস্বরূপ মাত্র- ঔডুলোমি মুনি মনে করেন যে, ব্রহ্মবিদ্ বিশুদ্ধ চৈতন্যরূপেই লীন থাকেন- এটাই তার যথার্থ স্বরূপ। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৬)।।

তবে বাদরায়ণ এই দুটি মতের অর্থাৎ জৈমিনি ও ঔডুলোমির মতের মধ্যে কোনো বিরোধ খুঁজে পাননি। কারণ- যদিও মুক্তাত্মা বিজ্ঞানমাত্র স্বরূপ বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন, তবু তার বিজ্ঞানরূপ স্বীয় স্বরূপ নিষ্পাপত্ব ইত্যাদি গুণবিশিষ্ট বলেও শ্রুতি সর্বত্র উল্লেখ করেছেন। সুতরাং আত্যন্তিক দৃষ্টিতে তিনি গুণাদিরহিত হলেও আপেক্ষিক দৃষ্টিতে তার গুণকল্পনা অসঙ্গত নয়। বাদরায়ণ এই উভয় মতকেই (জৈমিনি ও ঔডুলোমির) সমর্থন করেছেন। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৭)।।

অর্থাৎ, মুক্ত জীবাত্মা কখনও নিজেকে সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী ইত্যাদি বলে মনে করেন না, কিন্তু বিশুদ্ধচৈতন্যরূপেই অবস্থান করেন। আবার ব্যবহারিক দিক থেকে আমরা বলতে পারি যে, এরূপ মুক্ত আত্মা সর্বজ্ঞত্বাদি গুণসম্পন্ন হতে পারেন, কারণ বিশুদ্ধচৈতন্য আমাদের ধারণার অতীত। এই দুটি মত দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্ত আত্মার বর্ণনা করেছে- সুতরাং মূলত এদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। এটাই বাদরায়ণের মত।

মুক্তের বৈভবের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, মুক্ত পুরুষের ভোগ্য-সামগ্রী তার সংকল্পমাত্রই উপস্থিত হয়। এ ক্ষেত্রে সে নিজেই নিজের প্রভু। যেমন, শ্রুতির সাক্ষ্যে বলা হয়েছে- আত্মজ্ঞ সেই ব্যক্তি যদি পিতৃপুরুষের সঙ্গ পেতে চান, তাহলে তার ইচ্ছানুযায়ী তারা তার সামনে আবির্ভূত হন। সেই লোকে পিতৃপুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি মহিমান্বিত হন (ছান্দোগ্য-৮/২/১)।   আর তিনি যদি সুগন্ধী পুষ্পমালার জগত কামনা করেন, তবে তার সঙ্কল্পমাত্রই তারা তার সামনে হাজির হয়। সেই লোকে বহু সুগন্ধী মালা পেয়ে তিনি মহিমান্বিত হন (ছান্দোগ্য-৮/২/৬)।  আর তিনি যদি খাদ্য ও পানীয় ভোগ করতে চান, তবে তার সঙ্কল্পমাত্রই সেই সব জিনিস তার সামনে এসে হাজির হয়। সেই লোকে খাদ্য ও পানীয় পেয়ে তিনি মহিমান্বিত হন (ছান্দোগ্য-৮/২/৭)।   আর তিনি যদি সঙ্গীত লোক কামনা করেন, তবে তার সঙ্কল্পমাত্রই সেই লোক তার কাছে আবির্ভূত হয়। সেই লোকে সঙ্গীত উপভোগ করে তিনি মহিমান্বিত হন (ছান্দোগ্য-৮/২/৮)।   আর যদি তিনি নারীলোক কামনা করেন, তবে তার সঙ্কল্পমাত্রই নারীরা তার কাছে উপস্থিত হয়। সেই নারীলোক লাভ করে তিনি মহীয়ান হন (ছান্দোগ্য-৮/২/৯)।   তিনি যে যে প্রদেশ কামনা করেন, যে যে কাম্যবস্তু পেতে চান তা তার সঙ্কল্পমাত্রই তার কাছে উপস্থিত হয়। তা পেয়ে তিনি মহীয়ান হন (ছান্দোগ্য-৮/২/১০)।

অতএব, খুব স্বাভাবিকভাবে বেদান্তসূত্রেও বাদরায়ণ এই সিদ্ধান্তই বহাল রাখেন- শ্রুতির বহু উক্তি থেকেই জানতে পারা যায় যে, ব্রহ্মজ্ঞ মুক্ত পুরুষগণ ইচ্ছামাত্র তাদের সঙ্কল্প সিদ্ধ করতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৮)।  মুক্ত পুরুষ ইচ্ছামাত্র সর্বময় কর্তা হতে পারেন, সুতরাং তার কোন নিয়ন্তা বা কর্তা থাকতে পারেন না (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৯)।

একজন মুক্ত পুরুষ যে নিজেই নিজের অধিপতি- স্বরাট্, অন্য শ্রুতিতেও তার সাক্ষ্য প্রমাণ মেলে, যেমন- এই জগতে কঠোর পরিশ্রম করে আপনি যা অর্জন করেছেন তাও যেমন নশ্বর, তেমনি পুণ্যকর্ম করার ফলে আপনি যদি উচ্চলোকে যান সেখানকার ভোগও একদিন না একদিন শেষ হতে বাধ্য। আত্মাকে না জেনে, অথবা যে সত্য মানুষের জানা উচিত তা না জেনে যাঁরা দেহত্যাগ করেন, তারা যে লোকেই যান না কেন, তাদের মুক্তি হয় না। কিন্তু যাঁরা আত্মজ্ঞান লাভ করে কৃতকৃত্য হয়ে দেহত্যাগ করেন তারা যেখানেই থাকুন না কেন, তারা মুক্ত, তারা সকললোকেই স্বচ্ছন্দগতি হন (ছান্দোগ্য-৮/১/৬)।

মুক্তপুরুষের এই সঙ্কল্প এবং ভোগ্য-সামগ্রি ভোগের যে সামর্থ্য ও প্রতিপত্তি, তাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ব্রহ্মের নিকট অবস্থানকালে মুক্ত পুরুষ কায়াযুক্ত না কায়াহীন? এ ব্যাপারে বাদরির বক্তব্য হলো, কায়াহীন- বাদরি মুনির মতে মুক্ত জীবাত্মা শরীররহিত অবস্থাতেই বিরাজ করেন, কারণ শাস্ত্র এরূপ উক্তিই করেছেন (ব্রঃ-৪/৪/১০)।

যেমন, শাস্ত্র প্রমাণ হিসেবে ছান্দোগ্যের শ্রুতিতে আছে- আবার যিনি জানেন ‘আমি চিন্তা করছি’ তিনিই আত্মা। মন এই আত্মার দিব্য চক্ষু। এই মুক্ত আত্মা মনরূপ দিব্যচক্ষুর সাহায্যে সকল কাম্য বস্তু, যা ব্রহ্মলোকে আছে তা দেখে আনন্দিত হন (ছাঃ-৮/১২/৫)।

অন্যদিকে ব্রহ্মের নিকট অবস্থানকালে মুক্ত পুরুষকে জৈমিনি মেনেছেন সৎ-ভাব বলে- জৈমিনি মুনি মনে করেন যে, মুক্ত আত্মা ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন বলে যে-কোন রূপ ধারণ করতে পারেন, এবং শাস্ত্রেও এরূপ বিচিত্র দেহধারণের সপক্ষে উক্তি আছে (ব্রঃ-৪/৪/১১)।

যেমন, ছান্দোগ্যের শ্রুতিতেই আছে- এ বিষয়ে এই শ্লোক আছে- ‘তত্ত্বদর্শী মৃত্যু দর্শন করেন না, রোগদুঃখও দর্শন করেন না। আবার তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি সবই দেখেন, এবং সর্বতোভাবে সবই লাভ করেন।’ তিনি সৃষ্টির পূর্বে এক। তারপরে তিন, পাঁচ, সাত, নয় প্রকার হন। আবার এগারো, একশো দশ, এবং একহাজার বিশও বলা যায়… (ছান্দোগ্য-৭/২৬/২)।

এ প্রেক্ষিতে বাদরায়ণ উভয় মতকেই গ্রহণ করে বলেছেন যে, ব্রহ্মজ্ঞ মুক্ত আত্মার কায়া থাকে না বটে, তবে সংকল্প মাত্র তা উপস্থিত হয়। শরীরের অভাবে সে স্বপ্নের ন্যায় ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পদকে সম্ভোগ করে, শরীর যুক্ত হলে জাগ্রত অবস্থার মতো থাকে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- বাদরি এবং জৈমিনি মুনি দুজনই শাস্ত্র থেকে ভাব এবং অভাবসূচক দুই প্রকার উক্তি প্রদর্শন করে নিজ নিজ মত ব্যক্ত করেছেন। এখানে ঋষি বাদরায়ণ বলছেন যে, উভয়ই সত্য- যেমন দ্বাদশাহ যজ্ঞের দুইটি নাম (সত্ত্র এবং অহীন) একই বস্তুকে বুঝিয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১২)।  মুক্ত আত্মা অ-শরীর হলে স্বপ্নের ন্যায় এবং স-শরীর হলে জাগ্রৎ অবস্থায় কামনা সম্ভোগের ন্যায় ইচ্ছেমতো বাসনার পূরণ করতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১৩-১৪)।  একটি প্রদীপ যেমন নিজ দেহে বর্তমান থেকে অনুরূপ বহু প্রদীপকেই প্রজ্জ্বলিত করতে পারে, সেরূপ মুক্ত পুরুষ অন্যন্য বহু দেহকেও উদ্দীপ্ত করতে পারেন- এরূপ দৃষ্টান্ত শ্রুতিতে আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১৫)।

স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হয় বলেই মুক্তজীবকে ব্রহ্মের নিকট থেকে আর ফিরে আসতে হয় না অর্থাৎ তার পুনর্জন্ম হয় না। তবে ব্রহ্মলোকে স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হয়ে মুক্ত পুরুষ ব্রহ্মের ন্যায় গুণাদিসম্পন্ন হলেও, আমরা ইতঃপূর্বে জেনেছি যে, জগৎ সৃষ্ট্যাদি ব্যাপার ছাড়া অপর সর্ববিধ শক্তির অধিকারী হন। বেদান্তসূত্র অনুযায়ী- মুক্ত পুরুষ জগৎ সৃষ্ট্যাদি শক্তি ছাড়া অপর সর্ববিধ শক্তির অধিকারী হন। সৃষ্টি প্রকরণে ঈশ্বরের উল্লেখ আছে। ঐ প্রকরণে মুক্ত পুরুষের কোন উল্লেখই নাই। মুক্ত পুরুষের ক্ষমতা সসীম (ব্রঃ-৪/৪/১৭)। অর্থাৎ, মুক্ত পুরুষের পক্ষে ব্রহ্মের মতো সৃষ্টিকর্ম সম্ভব নয়, শুধুমাত্র ব্রহ্মের নিকট থেকে ভোগের সমানতা প্রাপ্তিই সম্ভব।

বেদ নিত্য

মীমাংসা সূত্রকার মহর্ষি জৈমিনি বেদকে অপৌরুষেয় বলে মানলেও ব্রহ্মসূত্রকার বাদরায়ণ বেদকে অপৌরুষেয় মানেননি, কিন্তু বেদের নিত্যতা সম্বন্ধে একমত ছিলেন। কেননা বেদও যদি অন্যান্য শাস্ত্রের মতো অনিত্য বলে প্রমাণিত হয়ে যায়, তাহলে প্রামাণ্যের অভাবে যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক, বৌদ্ধ প্রভৃতির মতো তার্কিকগণের সম্মুখে আত্মপক্ষ সমর্থনে সক্ষম হতে পারবে না। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে বেদের নিত্যতা প্রসঙ্গে বলেন- সৃষ্টি শব্দ-পূর্বিকা, অতএব বৈদিক শব্দ ও তার অর্থ উভয়ই নিত্য। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৯)।। কারণ, ঋগ্বেদ-সংহিতাতেই উদ্ধৃত আছে যে- বুদ্ধিমানগণ যজ্ঞদ্বারা ভাষার পথ প্রাপ্ত হন। ঋষিদের অন্তকরণ মধ্যে যে ভাষা সংস্থাপিত ছিলো তা তারা তাদের পূর্বকৃত সুকৃতির জন্য প্রাপ্ত হলেন। সে ভাষা আহরণপূর্বক তারা নানাস্থানে বিস্তার করলেন। সপ্তছন্দ সে ভাষাতেই স্তব করে (ঋক-১০/৭১/৩)।

বলা হয়, ঋষিগণ বেদের দ্রষ্টা মাত্র, বেদের কর্তা বা রচয়িতা নন। তাই পূর্ব থেকেই সংস্থাপিত বা অবস্থিত বেদের শব্দরাশির উল্লেখ থেকেই প্রমাণ হয় যে, বেদ নিত্য। আবার স্মৃতিশাস্ত্র হিসেবে মনুসংহিতায় বলা আছে- সৃষ্টির প্রারম্ভে হিরণ্যগর্ভরূপে অবস্থিত এই পরমাত্মা বেদ থেকে (পূর্ব-পূর্ব কল্পের যার যেমন নামাদি ছিলো তা) অবগত হয়ে সকলের নাম (যেমন, গোজাতির অন্তর্গত গো, অশ্ব-জাতির অশ্ব প্রভৃতি), কর্ম (যেমন ব্রাহ্মণের অধ্যয়নাদি, ক্ষত্রিয়ের প্রজারক্ষণাদি), এবং নানারকম লৌকিকী ক্রিয়া (যেমন, ব্রাহ্মণের যাজনাদি, কুলালের ঘটনির্মাণ, তন্তুবায়ের পটনির্মাণ প্রভৃতি) পৃথক পৃথক ভাবে (অর্থাৎ পূর্বকল্পের যার যেমন ছিলো সেইভাবে) নির্দেশ করলেন (মনুসংহিতা-১/২১)।

এখানে বোঝানো হয়েছে যে, প্রলয়কালেও পরমাত্মার মধ্যে বেদরাশি সূক্ষ্মরূপে বিদ্যমান থাকে, এটাই শাস্ত্রসিদ্ধান্ত। অতএব, বেদ নিত্য।

তাছাড়া আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, ব্রহ্মের উপাসনা করার সুবিধার জন্য উপনিষদে (কঠ-২/১/১২) মনুষ্যের হৃদয়ে অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ ব্রহ্মের কথা স্বীকার করে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- শ্রুতিশাস্ত্রের শব্দ থেকেই জানা যায় যে, তিনি ‘অঙ্গুষ্ঠমাত্র’- পরিমিত পুরুষ (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৪)।  শাস্ত্রপাঠে এবং উপাসনায় একমাত্র মানুষেরই অধিকার, তাই সকল মানুষের হৃদয়ের পরিমাণ অনুসারে উপাসনার নিমিত্ত তাকে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৫)।

কিন্তু এ প্রেক্ষিতে যে সন্দেহটির উদ্রেক হতে পারে তা হলো, যেহেতু বলা হয়েছে একমাত্র মানুষই শাস্ত্রপাঠ অর্থাৎ বেদাধ্যয়নের অধিকারী, তাহলে কি বেদপাঠে দেবতাদের কোন অধিকার নেই? এ প্রেক্ষিতে বেদান্তসূত্র বলছে- বাদরায়ণ বলেন যে, মনুষ্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দেবতাগণেরও এই অধিকার আছে ; কারণ তাদের পক্ষেও মোক্ষলাভেচ্ছু হওয়া সম্ভব (ব্রঃ-১/৩/২৬)।

অর্থাৎ, বাদরায়ণের মতে দেবতারাও বেদপাঠের অধিকারী। কিন্তু তাদের পক্ষে কিভাবে তা সম্ভব? তা সম্ভব এজন্যেই যে, দেবতারাও দেহধারী, তাদেরও ব্রহ্মলোক অথবা পরাজ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা আছে- এবং এই জ্ঞানলাভের জন্য সাধনচতুষ্টয়সম্পন্ন হবার যথাযোগ্য গুণ আছে। কেননা, শ্রুতিতেও দেখতে পাওয়া যায় যে, ইন্দ্রাদি দেবগণ ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য ব্রহ্মচর্য-জীবন যাপন করছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ- দেবতা ও অসুরগণ উভয়েই লোকমুখে প্রজাপতির এই উপদেশের কথা শুনেছিলেন। তারা বললেন, ‘যে আত্মাকে অনুসন্ধান করলে সমস্ত লোক ও সকল কাম্যবস্তু লাভ করা যায়, আমরা তার অনুসন্ধান করবো।’ এই উদ্দেশ্যে দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র ও অসুরদের মধ্যে বিরোচন প্রজাপতির কাছে গেলেন। তারা পরস্পরের অজ্ঞাতসারেই যজ্ঞের কাঠ হাতে প্রজাপতির নিকট উপস্থিত হলেন (ছান্দোগ্য-৮/৭/২)।  তারা দুজনে কঠোর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে বত্রিশবছর সেখানে বাস করলেন… (ছান্দোগ্য-৮/৭/৩)।

এ পর্যায়ে এখানে আরেকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, যদি দেবতারা সাকার বা দেহধারী হন, তাহলে এই ইন্দ্রাদি দেবতাদের পক্ষে একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে একাধিক যজ্ঞে উপস্থিত থাকা কী করে সম্ভব? উত্তরে বলা হয়েছে- দেবতারা দেহধারী হলেও একই দেবতার যজ্ঞাদিতে একই সময়ে বহু স্থানে উপস্থিতি কিভাবে সম্ভব হতে পারে? হা, তা সম্ভব। কারণ শাস্ত্রপাঠে জানা যায় যে, তারা একই সময়ে বহু দেহ ধারণ করতে পারেন (ব্রঃ-১/৩/২৭)।

কিন্তু এবারও দেবতাদের শরীরধারণত্ব বিষয়ে আপত্তি দেখা দেয়। বলা হয়, যদি দেবতারা দেহধারী হন তাহলে তারাও মনুষ্যের ন্যায় জন্ম মৃত্যুর অধীন হবেন। সেক্ষেত্রে যেহেতু নাম ও নামীর সম্পর্ক নিত্য, তাই অনিত্য দেবতার নাম বেদে উক্ত হওয়ায় বেদও অনিত্য হবে। এই আপত্তি খণ্ডন করে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- দেবতারা শরীরবিশিষ্ট হলে বৈদিক শব্দের নিত্যতা কী করে সম্ভব?- হাঁ, সম্ভব। কারণ শ্রুতি-স্মৃতি প্রমাণে ‘সৃষ্টি শব্দপূর্বিকা’- তা জানা যায় (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৮)।  পূর্বকল্পে সৃষ্টি যেমন নামরূপবিশিষ্ট ছিলো পরকল্পেও তা সেইরূপ নামরূপবিশিষ্ট হয়েই প্রকাশিত হয়- তা শ্রুতি স্মৃতি পাঠে জানা যায় (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩০)।

অর্থাৎ, এখানে বলা হচ্ছে, অনিত্য দেবতার নাম বেদে উক্ত হওয়ায় বেদও অনিত্য হবে এরূপ আশঙ্কার কোনো কারণ নেই, কারণ বেদ ইন্দ্র থেকে এই শব্দ গ্রহণ করেনি, বরং বেদের শব্দ থেকেই ইন্দ্র নামটি পাওয়া গেছে। বস্তুত দেবতাদের দ্যোতক শব্দের বাচ্য বস্তুগুলি কোন ব্যক্তি-বিশেষ নয়- এটি একটি সাধারণধর্মী জাতি। যেমন রাজা বলতে কোন ব্যক্তি বিশেষকে বুঝায় না; রাজত্বধারী যে-কোন ব্যক্তিকেই বুঝায়, তেমনি ইন্দ্র বলতে যে-কোন ব্যক্তিকেই বুঝায়- যিনি সেই পদে উন্নীত হতে পারেন। সুতরাং বৈদিক শব্দের মধ্যে কোন স্ববিরোধিতা নেই। অতএব, বেদ নিত্য। ইন্দ্রাদির একই নাম ও একই রূপ হওয়াতে, বারংবারতার আবৃত্তি হতে থাকলেও বেদের নিত্যতার কোনো হানি হয় না।

বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ

ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণাশ্রম ধর্ম ও জাতিভেদ প্রথার প্রতি বাদরায়ণের ছিলো প্রচণ্ড পক্ষপাতিত্ব। ফলে বাদরায়ণের ব্রহ্মবিদ্যায় যে শূদ্রের প্রতি কোনো রকম সহানুভূতি বা উদারতা আশা করা শেষপর্যন্ত নিষ্ফল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, ব্রহ্মবিদ্যায় শূদ্রদের অধিকার নিষিদ্ধ করে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- দ্বিজাতির ক্ষেত্রে সংস্কারের উল্লেখ আছে এবং শূদ্রের পক্ষে এই ক্রিয়াদির নিষেধ আছে বলে শূদ্রদের ব্রহ্মবিদ্যার অধিকার নাই (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৬)।

উপনয়নাদি সংস্কার ক্রিয়া যে-কোন জ্ঞান বা বিদ্যা অর্জনের জন্যই আবশ্যিক প্রয়োজন বলে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। কিন্তু এসব বিধান শুধু উচ্চবর্ণের লোকদের জন্যই বিহিত। শূদ্রদের ক্ষেত্রে এইসব সংস্কার প্রযোজ্য নয়- এমন কথা শাস্ত্রে পুনঃ পুনঃ উল্লেখ আছে। মনুসংহিতাতেই এর ভুরিভুরি প্রমাণ মেলে, যেমন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন ধর্মের পক্ষে উপনয়ন সংস্কারের বিধান থাকায় এরা ‘দ্বিজাতি’ নামে অভিহিত হয়। আর চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উপনয়ন-সংস্কার বিহীন হওয়ায় দ্বিজাতি নয়, তারা হলো ‘একজাতি’। এছাড়া পঞ্চম কোনও বর্ণ নেই অর্থাৎ ঐ চারটি বর্ণের অতিরিক্ত যারা আছে তারা সকলেই সঙ্করজাতি (মনু-১০/৪)।

এই সঙ্করজাতিরা ব্রহ্মাসৃষ্ট চতুবর্ণেরও বাইরে। অর্থাৎ এদের থেকেই অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। উত্তর-ভারতীয় ভাষায় যাকে বলে দলিত সম্প্রদায়। এরাই বৈদিক সমাজের ব্রাত্য জনগোষ্ঠী। প্রাসঙ্গিকভাবেই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত চারজাতীয় মানুষই হলো চারটি বর্ণ। এ ছাড়া বর্বর, কৈবর্ত প্রভৃতি অন্যান্য যে সব মানুষ আছে তারা সঙ্কীর্ণযোনি বা বর্ণসঙ্কর। চারটি বর্ণের মধ্যে তিনটি বর্ণ ‘দ্বিজাতি’ অর্থাৎ এদের দুবার জন্ম হয়; কারণ দ্বিতীয়-জন্ম উৎপাদক উপনয়ন-সংস্কার কেবল ঐ তিনটি বর্ণের পক্ষেই শাস্ত্রমধ্যে বিহিত আছে। শূদ্র হলো একজাতি অর্থাৎ ওদের একবার মাত্র জাতি বা জন্ম হয়, কারণ শূদ্রের পক্ষে উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নেই। অতএব অনিবার্যভাবে শূদ্ররা হলো নিম্নবর্ণ। ফলে এরা ব্রত যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি পালনের যোগ্য হতে পারে না।  তাই মনুর বক্তব্য হলো- শূদ্রকে কোন মন্ত্রণা-পরামর্শ দেবে না। শূদ্রকে উচ্ছিষ্ট দান করবে না। যজ্ঞের হবির জন্য যা ‘কৃত’ অর্থাৎ সঙ্কল্পিত এমন দ্রব্য শূদ্রকে দেবে না; শূদ্রকে কোনও ধর্মোপদেশ করবে না এবং কোনও ব্রত বা প্রায়শ্চিত্ত করতেও উপদেশ দেবে না (মনু-৪/৮০)।

কারণ, শূদ্রজন্ম যে প্রকৃত অর্থেই দাসজন্ম, এ বিষয়টা যাতে কারো কাছে অস্পষ্ট না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে- ক্রীত অর্থাৎ অন্নাদির দ্বারা প্রতিপালিত হোক্ বা অক্রীতই হোক্ শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবেন। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন (মনু-৮/৪১৩)।  প্রভু শূদ্রকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও শূদ্র দাসত্ব কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। দাসত্বকর্ম তার স্বভাবসিদ্ধ কর্ম (অর্থাৎ জন্মের সাথে আগত)। তাই ঐ শূদ্রের কাছ থেকে কে দাসত্ব কর্ম সরিয়ে নিতে পারে? (মনু-৮/৪১৪)

আবার অন্য স্মৃতিতেও দেখা যায়, শূদ্রের পক্ষে বেদপাঠ কিংবা শ্রবণ সম্বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলা হচ্ছে- শূদ্রকে বেদপাঠ বা শ্রবণ করতে দেখলে তার জিহ্বা কর্তন করে কানে গরম সীসা ঢেলে দেওয়া উচিত এবং বেদ ধারণ করতে দেখলে দৈহিকভাবেই হত্যা করা প্রয়োজন (গৌতম-ধর্মসূত্র-২/১২/৩)।

এছাড়া বিভিন্ন শ্রুতিতেও শূদ্রের বেদ শ্রবণ-পঠনে নিষেধ করে বলা আছে- ‘শূদ্র শ্মশানতুল্য, তার বেদপাঠ অনুচিত।’  কিংবা, ‘শূদ্র যদি প্রভূত ধন-সম্পদের মালিকও হয় তবুও যজ্ঞের অধিকার তার নেই।’ এবং যেহেতু মনুর বক্তব্য হলো- চারটি বর্ণ, তিন লোক, পৃথক পৃথক চারটি আশ্রম এবং ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান- এগুলি সব একমাত্র বেদ থেকেই প্রচারিত হয় (মনু-১২/৯৭)।

অতএব এ বিধান অন্যথা হবার নয়, কিংবা তা কারো অমান্য করারও উপায় নেই। কেননা শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রের বক্তব্যের বিষয়ে শাস্ত্রীয়ভাবেই কোন সন্দেহ বা প্রশ্ন করার অধিকারও সীমিত করে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে- ‘বেদ’ বলতে ‘শ্রুতি’ বোঝায় এবং ‘ধর্মশাস্ত্রের’ নাম ‘স্মৃতি’। সকল বিষয়েই (অর্থাৎ সকল রকম বিধি-নিষেধের স্থানে) এই দুই শাস্ত্র বিরুদ্ধতর্কের দ্বারা মীমাংসার অতীত, কারণ, শ্রুতি ও স্মৃতি থেকেই ধর্ম স্বয়ং প্রকাশিত হয়েছে (মনু-২/১০)।

আর তাই খুব সঙ্গত কারণেই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাতঃস্মরণীয় প্রতিভূ ও শব্দ-প্রমাণক হিসেবে বাদরায়ণও শূদ্রের ব্রহ্মবিদ্যার অধিকার প্রসঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টেনে বেদান্তসূত্রে বলেন- যেহেতু স্মৃতি শাস্ত্রেও শূদ্রদের বেদের শ্রবণ, অধ্যয়ন এবং তদর্থজ্ঞান নিষিদ্ধ, তাই শূদ্রদের ব্রহ্মজ্ঞানলাভেরও অধিকার নাই (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৮)।

মূলত এর মাধ্যমেই সূত্রকার বাদরায়ণ তার সমকালীন সামাজিকতায় বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা অমানবিক জাতিভেদ প্রথাকে সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীর কট্টর সমর্থক হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

অন্যান্য দর্শন-মত খণ্ডন

বাদরায়নের অন্যান্য দর্শন বিচার ও শ্রেণীবিভাগ

বাদরায়ণ তার বেদান্তসূত্রে উপনিষদ সিদ্ধান্তের সমন্বয় ও বিরোধ নিষ্পত্তির পাশাপাশি একইসঙ্গে অন্যান্য দর্শনের সিদ্ধান্তগত দুর্বলতার দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশের চেষ্টা করেছেন। এই দর্শনগুলির মধ্যে সাংখ্য ও যোগ এমনই দর্শন, যার মূল কর্তা কপিলকে সেই যুগ পর্যন্ত ঋষি বলেই মানা হতো। কেননা, ঋষিপ্রোক্ত হওয়ায় কপিলের মতকে স্মৃতিশাস্ত্রের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছিলো। আর ধারণা করা হয়, পাশুপত ও পাঞ্চরাত্র মত আর্যদের ভারতে আসার আগেই প্রাচীন সিন্ধুসভ্যতায় সৃষ্ট, তাই ঈশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও অ-ঋষিপ্রোক্ত হওয়ায় সেগুলিকে বৈদিক আর্যক্ষেত্রে সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। অন্যদিকে বৈশেষিক, বৌদ্ধ ও জৈন মত অ-ঋষিপ্রোক্ত তথা নিরীশ্বরবাদী দর্শন হওয়ায় বাদরায়ণের মতো আস্তিকের নিকট সেগুলি আরো ঘৃণার বিষয় হয়েছিলো বলে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত।

যে দর্শনের প্রতিস্থাপকরা ঋষির মর্যাদা পেয়েছিলেন এবং তাদের মতকে স্মৃতিশাস্ত্রের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছিলো, সেগুলিই ঋষিপ্রোক্ত দর্শন নামে পরিচিত। কিন্তু তাদের মত যেক্ষেত্রে ব্রহ্মবাদী উপনিষদীয় দর্শন বা শ্রুতিবাক্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে তথা বেদবিরোধী মনে হয়েছে, বাদরায়ণ সেক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে তা খণ্ডনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঋষিপ্রোক্ত সাংখ্য ও যোগদর্শনে এই বিরোধ প্রত্যক্ষ হওয়ায় বাদরায়ণ তা খণ্ডনে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এখানে সাংখ্যকে নিরীশ্বরবাদী এবং যোগকে ঈশ্বরবাদী দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এদিকে আর্য-সম্মানহীন দর্শনগুলিই মূলত অ-ঋষিপ্রোক্ত দর্শন। এসব দর্শনের প্রতিস্থাপক ঋষি-শ্রেণীভুক্ত নন। অ-ঋষিপ্রোক্ত দর্শনেও দুটি ভাগ রয়েছে- ঈশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদী। সম্ভবত আর্যদের ভারতে আসার আগেই এতদঞ্চলে পাশুপত ও পাঞ্চরাত্র দর্শনের উদ্ভব। কিন্তু এ দর্শনগুলি ঈশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও অ-ঋষিপ্রোক্ত হওয়ায় সেগুলিকে বৈদিক আর্যক্ষেত্রে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। কেননা, এগুলি অনার্য দর্শন। কিন্তু বাদরায়ণের সমকালীন ও লোকপরম্পরায় বহুল চর্চিত ও প্রচলিত দর্শন হিসেবে সেগুলিকে খণ্ডনের প্রয়োজন হয়েছিলো। এদিকে নিরীশ্বরবাদী দর্শনের মধ্যে বৈশেষিক, বৌদ্ধ এবং জৈনদর্শনের বিরুদ্ধেই বাদরায়ণ তাদের মত খণ্ডনে মনোযোগী হয়েছিলেন। তার সময়ে হয়তোবা চার্বাক দর্শনের বিরোধিতা ক্ষীণ হয়ে আসায় সে বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, বৈশেষিকসূত্রকার কণাদকে যদিও পরে কপিলের মতো ঋষি বলে মেনে নেয়া হয়েছিলো, তবুও বাদরায়ণের যুগে হয়তো এমন অবস্থা ছিলো না যাতে তাকে ঋষি-শ্রেণীভুক্ত করা যেতো। সব মিলে বাদরায়নের চোখে অন্যান্য দর্শনের বিচারভেদে শ্রেণীবিভাগ করতে চাইলে প্রধাণত পাই – ঋষিপ্রোক্ত দর্শন ও অঋষিপ্রোক্ত দর্শন। এই দুটোর মধ্যেই আবার নিরীশ্বরবাদী ও ঈশ্বরবাদী দর্শন রয়েছে। সব মিলে বাদরায়নের বিচারে দর্শন চার শ্রেণীর হচ্ছে –

  • ঋষিপোক্ত নিরীশ্বরবাদী – সাংখ্যদর্শন
  • ঋষিপ্রোক্ত ঈশ্বরবাদী – যোগ দর্শন
  • অঋষিপ্রোক্ত নিরীশ্বরবাদী – বৈশেষিক, জৈনবৌদ্ধ দর্শন
  • অঋষিপ্রোক্ত ঈশ্বরবাদী – পাশুপাত দর্শনপাঞ্চরাত্র দর্শন

বাদরায়ন এই সকল প্রকার দর্শনই খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন –

সাংখ্যদর্শন খণ্ডন

কপিলের সাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে সৃষ্টির উপাদান কারণ প্রকৃতি বা প্রধান, এবং পুরুষ বা ঈশ্বর হলেন নিমিত্ত কারণ। ফলে উপনিষদের ব্রহ্মকারণবাদের সঙ্গে সাংখ্যের প্রধানকারণবাদের কয়েকটি ক্ষেত্রে মতবিরোধ ছিলো। উপনিষদ বা বেদান্তবাদী বাদরায়ণ কারণ থেকে কার্যকে বিলক্ষণ বা ভিন্ন বলে গণ্য করেছেন, অন্যদিকে সৎ-কার্যবাদী সাংখ্যমতে কার্য-কারণ সংলক্ষণ বা অভিন্ন বলে মানা হয়েছে। সাংখ্যের পুরুষ নিষ্ক্রিয়, কিন্তু বেদান্তের পুরুষ সক্রিয়।

উপনিষদ আবির্ভাবের ক্রমপঞ্জিতে প্রাচীনতম ঈশ-উপনিষদ থেকে শুরু করে প্রথম কালের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০-৬০০) ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, দ্বিতীয় কালের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৫০০) ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, তৃতীয় যুগের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০-৪০০) প্রশ্ন, কেন, কঠ, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য এবং চতুর্থ কালের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০-১০০) কৌষীতকি, মৈত্রী ও শ্বেতাশ্বতর পর্যন্ত এই তেরটি প্রাচীন উপনিষদ সাংখ্য-সংস্থাপক কপিলকে ঋষি বলে মেনে নিয়েছে। তাই উপনিষদের প্রামাণ্য বা শব্দ-প্রমাণকে অভ্রান্ত না বলে ধাঁধা বলে মানা বাদরায়ণের মতো দার্শনিকের নিকট খুবই অসুবিধাজনক ছিলো। তাছাড়া প্রাচীন সাংখ্যবাদীরা বেদবাদী না হলেও পরবর্তীকালের কেউ কেউ নিজেদের বেদবাদী বলেছেন এবং উপনিষদের মতকে পুষ্ট করার কাজে তৎপর হতে দেখা গিয়েছিলো। ফলে বাদরায়ণ বলার চেষ্টা করেছেন যে, উপনিষদ না সাংখ্যের প্রধানকে মেনেছে, না মেনেছে তার নিষ্ক্রিয় পুরুষকে। অর্থাৎ সাংখ্যমতের শ্রুতিপ্রামাণ্য নেই।

এক্ষেত্রে সমস্যাটি হলো, বিরুদ্ধবাদীদের মতে, যদি সাংখ্যের প্রধানের কারণত্বের মতবাদকে অস্বীকার করা হয়, তাহলে মহামুনি কপিল প্রচারিত এবং অপর বহু বিদগ্ধ ঋষি স্বীকৃত সাংখ্য দর্শনটিই অপ্রামাণ্য হয়ে যায়। সুতরাং এটাই যুক্তিসঙ্গত যে, বেদান্ত শ্রুতিগুলিকে এমনভাবেই ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন যাতে স্মৃতির প্রামাণ্যও রক্ষিত হয় এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে বিরুদ্ধ বলেও মনে না হয়। বিরুদ্ধপক্ষের এই অভিমতের উত্তরে বাদরায়ণের বক্তব্য হলো, যদি বেদবিরুদ্ধ সাংখ্য শ্রুতিকে মান্য করার জন্য ব্রহ্মকে সৃষ্টির আদি-কারণরূপে গ্রহণ করার মতবাদকে পরিহার করতে হয়, তাহলে এই মতবাদ পরিহারের দ্বারা মনুসংহিতা, গীতা ইত্যাদি বহু স্মৃতিকেই গ্রহণ করা সম্ভব হবে না, অথচ এ সকল স্মৃতি শ্রুতিভিত্তিক হওয়ায় অধিকতর প্রামাণ্য এবং এদের সকলেই বিজ্ঞানময় ব্রহ্মকেই জগতের আদি-কারণ হিসেবে গ্রহণ করার মতবাদকে অনুসরণ করেন। সুতরাং এই উভয়ের মধ্যে শ্রুতিবিরুদ্ধ অর্থাৎ বেদরিরোধী স্মৃতিগুলিকে পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন- যদি সাংখ্যসম্মত নয় বলে ব্রহ্মের জগৎ-কারণত্বকে অস্বীকার করা হয়, তাহলে বেদের অনুকূল মনু ইত্যাদি স্মৃতির উল্লেখের সম্ভাবনাও থাকে না; সেক্ষেত্রে স্মৃতিগুলির পরস্পরের মধ্যেই একটা বিরোধ সৃষ্টি হয় (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১)।

এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যবাদীরা একটি আপত্তি উত্থাপন করে বলেন যে, প্রধানও শাস্ত্রপ্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, কারণ কোন কোন বেদের শাখা যেমন কঠ-শাখা এমন কতকগুলি শ্রুতিবচন উল্লেখ করেছেন যেখানে প্রধানকেই লক্ষ্য করে হয়েছে বলে মনে হয়, যেমন- মহৎ থেকে অব্যক্ত শ্রেষ্ঠ, অব্যক্তের চেয়ে পুরুষ শ্রেষ্ঠ। পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু হতে পারে না। তিনিই পরাকাষ্ঠা, চূড়ান্ত পরিণতি। তিনিই শ্রেষ্ঠ গতি বা গন্তব্যস্থান (কঠ-১/৩/১১)।

সাংখ্যবাদীরা বলেন যে, এই শ্রুতিতে অব্যক্ত শব্দটি প্রধানকেই লক্ষ্য করা হয়েছে- কারণ, মহৎ, অব্যক্ত এবং পুরুষ শব্দগুলিকে যে ক্রমানুক্রমিকভাবে সাংখ্যদর্শনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই শ্রুতিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং শ্রুতি ব্যবহৃত এই শব্দগুলিকে সাংখ্যে ব্যবহৃত শব্দগুলির একই পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু সাংখ্যবাদীর এ যুক্তি বাদরায়ণ মানতে নারাজ। তিনি তা খণ্ডন করে বলেন, কঠোপনিষদের মহৎ এবং অব্যক্ত সাংখ্যের ধারণার অন্তর্গত নয়- যদি বলা হয় যে, কাঠক শ্রুতি অনুসারে অনুমানগম্য সাংখ্যোক্ত প্রধানও শ্রুতিসিদ্ধ বলে মনে হয়, তার উত্তরে আমরা বলবো, ‘না, তা হতে পারে না। কারণ, রূপকের সাহায্যে অব্যক্ত শব্দদ্বারা শরীরকেই এখানে লক্ষ্য করা হয়েছে, সাংখ্যের প্রকৃতি বা প্রধানকে নয়’ (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/১)।

বাদরায়ণের বক্তব্য হলো, শ্রুতিতে ‘অব্যক্ত’ শব্দটি শরীরসংক্রান্ত উপমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, তার লক্ষ্য প্রধান নন। কেননা, কঠোপনিষদের উল্লিখিত এই শ্রুতিটির (কঠ-১/৩/১১) পূর্ববর্তী শ্রুতি (কঠ-১/৩/১০) এর সাথে তুলনা করলেই বুঝা যায় যে, পূর্ববর্তী শ্রুতির আত্মা-কেই পরবর্তী শ্রুতিতে পুরুষ বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পূর্ববর্তী শ্রুতিটি হলো- ইন্দ্রিয়ের চেয়ে ইন্দ্রিয়ের বিষয় (রূপ, রস, ইত্যাদি) শ্রেষ্ঠ, বিষয়ের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ, মনের চেয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধি থেকে শ্রেষ্ঠ সেই মহান আত্মা (যিনি বুদ্ধির সমষ্টিরূপ) (কঠ-১/৩/১০)।

কঠোপনিষদের সংশ্লিষ্ট এই দুটি শ্রুতিকে যথানিয়মে পর্যাক্রমিকভাবে স্থাপন করলেই দেখা যায় যে, ইন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধি পূর্ববর্তী শ্রুতিতে যাদের উল্লেখ করা হয়েছে তা-ই পরবর্তী শ্রুতিতেও পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ববর্তী শ্রুতির আত্মাকেই পরবর্তী শ্রুতিতে পুরুষ বলা হয়েছে। পরবর্তী শ্রুতির মহৎ বলতে মহাবিশ্বের সামগ্রিক বুদ্ধিকেই বুঝিয়েছে এবং তা পূর্ববর্তী শ্রুতিতে উল্লিখিত বুদ্ধিরই অন্তর্ভুক্ত। এখানে তা ব্যষ্টি এবং সমষ্টিগত বুদ্ধির সামগ্রিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এখন শুধু অবশিষ্ট আছে পূর্বশ্রুতির শরীর এবং পরবর্তী শ্রুতির অব্যক্ত; এবং সেজন্যই এখানে অব্যক্ত বলতে শরীরকে বুঝিয়েছে, প্রধানকে নয়। কেননা, এই শ্রুতিদ্বয়কে পাশাপাশি রেখে একসাথে ব্যাখ্যা করলে এরকমই হয়- ‘ইন্দ্রিয়ের চেয়ে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ শ্রেষ্ঠ, বিষয়ের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ, মনের চেয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধির চেয়ে মহৎ বা সেই মহান আত্মা শ্রেষ্ট। মহতের চেয়ে অব্যক্ত শ্রেষ্ঠ, অব্যক্তের চেয়ে পুরুষ শ্রেষ্ঠ। পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই।’
বাদরায়ণের মতে, কোন শ্রুতিবাক্যকে বুঝার জন্য স্মৃতির বচনের সাথে তুলনা করা সমীচিন নয়, দৃষ্টান্ত অনুযায়ী কোন সমজাতীয় শ্রুতির তুলনা করাই যুক্তিযুক্ত। তাই তিনি বলেন- সাংখ্যোক্ত মহৎ এবং শ্রুতিতে উপদিষ্ট মহৎ একার্থ-বাচক নয় (ব্রঃ-১/৪/৭)।

এখানে আবার আপত্তি উঠে যে, শরীর হলো স্থূল এবং পরিবর্ধিত। তাকে কিভাবে অব্যক্ত (অপরিবর্ধিত) বলা যেতে পারে? এর উত্তরে বাদরায়ণ বলেন, এখানে স্থূল শরীরকে বুঝানো হয়নি, যে পঞ্চ উপাদানে শরীরটি গঠিত সেই কারণ-বস্তুগুলিকে বুঝানো হয়েছে। এই উপাদানগুলি সূক্ষ্ম এবং সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত নয় এবং যেহেতু এরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় সেজন্য এদেরকে যথার্থভাবেই ‘অব্যক্ত’ শব্দ দ্বারা অভিহিত করা যেতে পারে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন- ‘অব্যক্ত’ শব্দ সূক্ষ্ম পদার্থবাচক। স্থূল শরীরও সূক্ষ্মেরই স্থূলাবস্থা মাত্র। কাজেই শ্রুতিতে অব্যক্ত অর্থ শরীরই (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২)।

আবার, সাংখ্যমতে মানুষ তখনই মুক্তিলাভ করে, যখন সে পুরুষ এবং অব্যক্তের (প্রকৃতির) মধ্যে পার্থক্যকে জানতে পারে। সুতরাং অব্যক্ত তাদের নিকট জ্ঞেয়। এ প্রেক্ষিতে তারা শ্রুতির যে দৃষ্টান্তটি তুলে ধরেন- যিনি শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ-বিহীন, যিনি অক্ষয় শাশ্বত অনাদি ও অনন্ত, যিনি মহত্তত্বের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ও কূটস্থ নিত্য- তাকে অবগত হলেই সাধক মৃত্যুমুখ থেকে বিমুক্ত হন (কঠ-১/৩/১৫)।

সাংখ্যবাদীদের মতে, এই শ্রুতিতে প্রধানকে জ্ঞাত হয়েই মুক্তিলাভ করার কথা উপদিষ্ট হয়েছে, তার সাথে প্রধানের সাদৃশ্য আছে এবং প্রধানও মহৎ থেকে উর্ধ্বে। সাংখ্যের এই মত খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলতে চেয়েছেন যে, ‘মহতঃ পরং’ বলতে এখানে বিজ্ঞানময় পরমাত্মাকেই বুঝিয়েছে- এবং পরমাত্মাই কঠোপনিষদের এই অধিকরণের আলোচ্য বিষয়। তাই বেদান্ত সূত্রে বলা হয়েছে- যদি বলা হয় যে, শ্রুতিতে অব্যক্তের জ্ঞেয়ত্ব উল্লিখিত আছে, তার উত্তরে বলা যায় যে, প্রকরণ হতে পরমাত্মাকেই জ্ঞেয় বলে বুঝতে পারা যায় (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/৫)।  এই প্রকরণে মাত্র তিনটি প্রশ্ন এবং তিনটি প্রাসঙ্গিক উত্তর। এখানে প্রধানের কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/৬)।

অর্থাৎ কঠোপনিষদের সংশ্লিষ্ট এই অধিকরণে নচিকেতা যমকে মাত্র তিনটি প্রশ্ন করেন- অগ্নি সম্পর্কে, জীবাত্মা সম্পর্কে এবং পরমাত্মা সম্পর্কে। এখানে প্রধানের কোন উল্লেখই নেই। সুতরাং নিশ্চয়ই আশা করা যায় না যে, যম তার মূল বক্তব্যকে অতিক্রম করে যে-প্রধান সম্পর্কে কোন প্রশ্নই করা হয়নি সে সম্পর্কে উপদেশ দেবেন।

সাংখ্যকার জৈমিনির সাথে বাদরায়ণের অন্য মতবিরোধটি হলো, সাংখ্যকার জৈমিনি তার দর্শনকে কেবলমাত্র শব্দ-প্রমাণের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত বলে মানেননি অর্থাৎ বেদকেই একমাত্র প্রমাণ বলে মানেননি, তার জন্য যুক্তিতর্কও উপস্থিত করেছেন। এর উত্তর দিতে গিয়ে বাদরায়ণ বলেন যে, অনুমান সিদ্ধ প্রধানকে মানা যুক্তিসঙ্গত নয়, কারণ প্রধান জড় হলে তার পক্ষে বিশ্বের বিচিত্র বস্তুসমূহ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, এবং এরূপ সৃষ্টিতে প্রবৃত্তিও হতে পারে না- জগৎ-সৃষ্টির পরিকল্পনায় জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োজন। প্রধান অচেতন। সুতরাং অচেতন প্রধানের পক্ষে জগৎ রচনার কল্পনা অনুমান করা চলে না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১)।  অচেতন প্রধানের পক্ষে কোন কার্যে রত হবার প্রবৃত্তি (ইচ্ছা) থাকা সম্ভব নয় (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২)।

এক্ষেত্রে সাংখ্যবাদীরা দুধ এবং জলের দৃষ্টান্ত গ্রহণ করে প্রধানের জগৎকারণত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টায় বলেন, জল যেমন নদীতে এবং দুগ্ধ যেমন গাভীর স্তন হতে নিজে নিজেই বাছুরের মুখে প্রবাহিত হয়, কিংবা গাভীভুক্ত তৃণ যেভাবে স্বতই দুধে পরিণত হয়, তেমনিভাবে অচেতন প্রধান স্বতই রূপান্তরিত হয়ে অন্যের কর্তৃত্ব ছাড়াই বুদ্ধি অহঙ্কার প্রভৃতিতে পরিণত হতে পারে। সাংখ্যবাদীদের এই যুক্তি খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলেন যে, এই জল এবং দুগ্ধের প্রবহমানতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত- যদি এরূপ বলা হয় যে, দুগ্ধ যেমন আপনা থেকে বৎসমুখে এবং মেঘজল যেমন স্বতই পৃথিবীবক্ষে পতিত হয় সেরূপ প্রধান স্বতই পরিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি করেন- না তা হতে পারে না- সেক্ষেত্রেও অন্যের কর্তৃত্ব প্রয়োজন (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩)।  সাংখ্যমতে প্রধানের নিজ বহির্ভূত কোন কর্তা নাই এবং বহির্ভূত কোন কিছুর উপর তা নির্ভরশীলও নন। সেক্ষেত্রে অচেতন প্রধানের কর্তৃত্ব বা অকর্তৃত্ব কিছুই নাই। অতএব প্রধান আদিকারণ নন (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪)।  তৃণ যেমন গাভীর উদরে স্বতই দুগ্ধে পরিণত হয়, সেরূপ প্রধানও স্বয়ংই জগতে পরিণত হন- যদি এরূপ বলা হয়? তার উত্তরে বলা যায় যে, এখানে অন্য কারণ আছে, তা না হলে ষাঁড় যে তৃণ ভক্ষণ করে তা তো দুগ্ধে পরিণত হয় না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৫)।

সাংখ্যবাদীরা হয়তো যুক্তি দেখাতে পারেন যে, অন্ধ ও পঙ্গু ব্যক্তিদ্বয় যেমন একে অন্যের সাহায্যে দেখতে ও চলতে পারে, অথবা লৌহ ও চুম্বক পৃথক বস্তু হয়েও যেমন পরস্পরকে আকৃষ্ট করতে পারে সেরকম প্রকৃতি ও পুরুষও স্বতন্ত্র রূপে নিষ্ক্রিয় থাকলেও একটি অপরটির সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশ্ববৈচিত্র্য সৃষ্টিতে সক্ষম। এর উত্তরে বাদরায়ণ বলেন, তবুও গতি সম্ভব নয়, কারণ প্রকৃতি-পুরুষের সঙ্গম আকস্মিক নয়, নিত্য ঘটনা; আবার গতি অবিরাম, কিন্তু বস্তু-সৃষ্টির জন্য গতি এবং গতি রোধ দুইয়েরই প্রয়োজন। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণের আধিক্য বা স্বল্পতা মেনে নিলেও কার্যসিদ্ধি হবে না। কেননা, নিষ্ক্রিয় পুরুষের বদলে কোন নিয়ন্ত্রণকারী সক্রিয় সত্তা স্বীকার করা না হলে, সর্বদা পুরুষের সমীপস্থ প্রকৃতির মধ্যে এই ত্রিগুণের মাত্রা ভেদ সুশৃঙ্খল থাকে না, যার ফলে কোথাও বা সত্ত্বগুণের আধিক্যে কোমলতা আরো প্রকট হবে, রজঃগুণের আধিক্যে গতি ও স্থিতি অনিয়ন্ত্রিত হবে, আবার তমঃগুণের আধিক্যে কাঠিন্য ও নিষ্ক্রিয়তা ভারসাম্যহীন হবে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- সাংখ্যমতে জগৎসৃষ্টির মূলে একটা উদ্দেশ্য আছে; তা হলো- ভোগ এবং মোক্ষসাধন। কিন্তু অচেতন প্রধানের কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। সেজন্য প্রধান আদিকারণ হতে পারেন না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৬)।  পঙ্গু ও অন্ধ পুরুষের অথবা লৌহ ও চুম্বকের দৃষ্টান্ত অনুযায়ী যদি প্রধানের কর্মপ্রবৃত্তি থাকা সম্ভব ধরেও নেয়া হয়- তা হলেও প্রধানের পক্ষে জগৎ-কর্তৃত্ব সিদ্ধ হয় না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৭)।  সাংখ্যমতে গুণ সকলের ‘অঙ্গ-অঙ্গী’ ভাব ধরে নিয়ে প্রধানের জগৎরূপে পরিণত হওয়ার ব্যাখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু তাও যুক্তিসিদ্ধ নয়। কারণ প্রলয়ে সকল গুণই সাম্যভাবে অবস্থান করে (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৮)।

সাংখ্যমতে প্রধান সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ- এই তিন গুণসম্পন্ন। এই তিনটি গুণই পরস্পর স্বতন্ত্র এবং সৃষ্টির পূর্বে সাম্যাবস্থায় অবস্থান করে। সৃষ্টিকার্য তখনই আরম্ভ হয়, যখন এই সাম্যাবস্থার মধ্যে একটা বিপর্যয় ঘটে; যখন একটি গুণ অপর দুইটি গুণকে অতিক্রম করে ক্রিয়াশীল হয়। বাইরের কোন শক্তি ছাড়া এই সাম্যাবস্থার বিপর্যয় হতে পারে না।

আবার যদি প্রধানকে মেনে নেয়া যায় তবুও তাতে কোনো লাভ হবে না, কারণ, পুরুষ (জীব) তো স্বতঃনিষ্ক্রিয়, নির্বিকার-চেতন, প্রধানের কার্যের জন্য তার বিশেষ কোনো ইচ্ছা থাকতে পারে না। এছাড়াও বাদরায়ণের মতে সাংখ্যদর্শনে বহুবিধ বিরুদ্ধভাব আছে বলে সাংখ্যের প্রধান গ্রহণযোগ্য নয়- শ্রুতি-স্মৃতির সাথে সাংখ্যের বহু বিরোধ আছে এবং সাংখ্যদর্শনের নিজের চিন্তার মধ্যেও স্ববিরুদ্ধভাব আছে। সুতরাং সাংখ্যের প্রধান গ্রহণযোগ্য নন। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১০)।।

মোটকথা, সাংখ্যদর্শনে বহু বিরুদ্ধভাব আছে, যেমন সাংখ্যে কখনও ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা বলা হয়েছে একাদশ, কোথাও বলা হয়েছে সাত। আবার একজায়গায় বলা হয়েছে যে, মহৎ থেকে তন্মাত্রের সৃষ্টি হয়েছে- অন্যত্র বলা হয়েছে যে, এগুলি অহঙ্কার থেকে জাত- এ ধরনের বহু অসঙ্গতি ছাড়াও শ্রুতি ও স্মৃতির সাথে তার বিরোধ সুপ্রসিদ্ধ। সুতরাং সাংখ্যবাদীদের প্রধানের জগৎকারণত্ব মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।

যোগদর্শন খণ্ডন 

সাংখ্যের প্রকৃতি-পুরুষের সঙ্গে পুরুষ-বিশেষ ঈশ্বরকে সংযুক্ত করায় তা ঈশ্বরবাদী সাংখ্যদর্শনে পরিণত হয়েছে। তাই যোগদর্শনকে সেশ্বর-সাংখ্যও বলা হয়। ফলে যোগদর্শনকে খণ্ডন করার জন্য বাদরায়ণের অধিক পরিশ্রম করার প্রয়োজন হয়নি, কারণ, সাংখ্য-সম্মত প্রধান তথা পুরুষের বিরুদ্ধে একই যুক্তিই এখানে প্রযোজ্য। তাই যোগদর্শনকে খণ্ডন করতে গিয়ে বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন- একই যুক্তিতে সাংখ্য মতানুসারী যোগ স্মৃতি-শাস্ত্রের প্রামাণ্যকেও খণ্ডন করা হলো (ব্রঃ-২/১/৩)।

যোগ ঈশ্বরকে বিশ্বের উপাদান কারণ বলে মানেননি। কিন্তু বাদরায়ণ উপনিষদের শ্রুতি-প্রমাণ দ্বারা তাকে (ব্রহ্মকে) নিমিত্ত ও উপাদান-কারণ বলে সিদ্ধ করেছেন। বাদরায়ণের মতে, ঈশ্বর (ব্রহ্ম) জাগতিক রূপে পরিণত হন, এতেই তার বৈচিত্র্যময় শক্তির কথা জানা যায়, এবং তিনি যোগসম্মত নির্বিকার ঈশ্বর নন।

পাশুপত মত খণ্ডন 

শিবের আরেক নাম পশুপতি। পাশুপতরা শিব ও শিবলিঙ্গকেই ইষ্টদেবতা বলে মানতেন। শিব শব্দটি যদিও বৈদিক, কিন্তু যে লিঙ্গ চিহ্নকে (অর্থাৎ পুরুষ জননেন্দ্রিয়) সামনে রেখে শিবপূজা করা হয়, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে- ‘তা মহেঞ্জোদড়ো যুগের (এখন থেকে ৫০০০ বছর পূর্বেকার) অনার্যকাল থেকে চলে আসছে; এবং এমন একটা সময়ও ছিল যখন লিঙ্গপূজা করার জন্য অনার্যদের ‘শিশ্নদেব’ বলে অপমানও করা হতো। কিন্তু যুগের হাওয়ায় যা এক সময় অপমানকর তা পরে সম্মানজনক বলে অভিহিত হতেও দেখা যায়। এই লিঙ্গ-পূজা-ধর্ম কালান্তরে পাশুপত (= শৈব) মতের রূপে বিকশিত হয়েছিল, এবং এর দার্শনিক সিদ্ধান্তও প্রস্তুত হয়েছিল। আজ যদিও শৈবগণ পাশুপতের অধিকারী, তথাপি দর্শনক্ষেত্রে তারা শঙ্করের মায়াবাদী অদ্বৈতবাদেরই অনুসরণ করেছেন।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-১৯০)।

বাদরায়ণের যুগে পাশুপতদের নিজস্ব এক দর্শন ছিলো, যার খণ্ডন করতে গিয়ে বাদরায়ণকে কয়েকটি সূত্র রচনা করতে হয়েছিলো। বর্তমানের আর্য-সমাজীদের মতো পাশুপতও ত্রৈতবাদ- জীব (মানে পশু), জগৎ ও ঈশ্বর (মানে পশুপতি)-কে মানতেন। বাদরায়ণের বেদান্ত মতে ব্রহ্ম (ঈশ্বর) হলেন জগতের নিমিত্ত ও উপাদান উভয় কারণ। কিন্তু পাশুপত মতে, পশুপতি (ঈশ্বর) হলেন জগতের নিমিত্ত কারণ এবং তিনিই প্রধান ও জীবাত্মাগুলির নিয়ন্তা, যাঁরা তার থেকে ভিন্ন। তাই পাশুপত দর্শনের বিরুদ্ধে বাদরায়ণের প্রথম আপত্তি হলো যে তা বেদ বা শ্রুতি বিরুদ্ধ। এই মতবাদ গ্রহণীয় নয়। ফলে বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন- (পাশুপত দর্শন মতে) ঈশ্বর জগতের নিমিত্তকারণ মাত্র, উপাদানকারণ নন- শ্রুতিবিরুদ্ধ এই মতবাদ গ্রহণীয় নয় (ব্রঃ-২/২/৩৭)।

কেননা, পাশুপতদের এই মত গ্রহণ করলে অসঙ্গতির সম্মুখীন হতে হয়। কিভাবে? এই মত গ্রহণ করলে ঈশ্বরের উপর পক্ষপাতিত্বদোষ আরোপ করা হয়; কারণ তিনি তাহলে এই জগতে কারো প্রতি সদয় হয়ে সুখী করেছেন এবং অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে তাদেরকে অসুখী করেছেন, ধরে নিতে হয়। বেদান্তবাদী বাদরায়ণের মতে, ঈশ্বর নিরপেক্ষ, সমদর্শী- কিন্তু তিনি জীবগণকে তাদের পূর্বকৃত কর্মের শুভাশুভ ফলানুসারে নিয়ন্ত্রণ করেন (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৪-৩৫)। কারণ এটাই শাস্ত্রসম্মত, এবং যদি এ বিষয়ে শাস্ত্রের প্রামাণ্যকে মান্য করা হয়, তাহলে ‘বহু স্যাং প্রজায়েয় ইতি’ অর্থাৎ ‘আমি বহু হবো’- (তৈত্তিরীয়-২/৬) এই উপনিষদীয় শ্রুতিবচনকে সত্য বলে গ্রহণ করতে হবে। এই শ্রুতি থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ঈশ্বর জগতের অভিন্ন-নিমিত্তোপাদান।

আবার, ঈশ্বর যেহেতু অংশরহিত, এবং প্রধান ও জীবাত্মাগুলিও সেইরূপ, সেজন্য ঈশ্বর এবং তাদের মধ্যে কোন সম্বন্ধস্থাপন সম্ভব নয়। কার্যত সেকারণেই এরা ঈশ্বরকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। অথবা ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে পরম্পরাগত অবিচ্ছেদ্য অংশ-অংশী ভাব, দ্রব্য এবং তার অবিচ্ছেদ্য গুণগত ভাব ইত্যাদি সম্পর্কও স্থাপন করা সম্ভব হয় না। বেদান্ত-মত গ্রহণ করলে কিন্তু এজাতীয় আপত্তি উঠতে পারে না। কারণ বেদান্ত মতে এই সম্বন্ধ হলো অনির্বচনীয়-তাদাত্ম্য, এবং প্রামাণ্য বিষয়ে বেদান্তীরা শ্রুতি-নির্ভর। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- ঈশ্বর এবং জীবের মধ্যে কোন সম্বন্ধ সম্ভবপর না হওয়ায় (পাশুপতদের) এই মত গ্রহণীয় নয় (ব্রঃ-২/২/৩৮)।

পাশুপতগণ ঘড়া বা গৃহরূপী কার্যের অধিষ্ঠাতা হিসেবে কুম্ভকার ইত্যাদির মতো জগতেরও কোন অধিষ্ঠাতা আছেন, এভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অনুমান করেন। কিন্তু বাদরায়ণের মতে এরকম অনুমানের দ্বারা ঈশ্বরের সত্তাকে সিদ্ধ করা যায় না। কেননা, নিরাকার ঈশ্বরকে অধিষ্ঠাতা বলে সিদ্ধ করা যায় না। এবং প্রধান ইত্যাদি মৃৎপিণ্ডের ন্যায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থ নয়, সুতরাং ঈশ্বর তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- (পাশুপত মতে) ঈশ্বর অধিষ্ঠান (উপাদান-কারণ) না হওয়ার জন্য (তার পক্ষে) নিয়ন্ত্রিত্ব অসম্ভব (ব্রঃ-২/২/৩৯)।

এ প্রেক্ষিতে পাশুপতরা বলেন, নিরাকর জীব (আত্মা) যেমন ইন্দ্রিয়, শরীর ইত্যাদির অধিষ্ঠাতা, এগুলিকে পরিচালনা করেন- পশুপতি ঈশ্বরও তেমনি প্রধান প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অনুমান করি। এই যুক্তি খণ্ডনে বাদরায়ণ বলেন, উপমাটি যথার্থ নয়, কারণ জীবের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, জীব সুখ-দুঃখাদির ভোক্তা, ফল-ভোগাদির কারণে জীবকে অধিষ্ঠাতা হতে হয়। কর্ম-বন্ধন-মুক্ত পশুপতিকে ফল ভোগ করতে হয় না, তার শরীর ধারণ করারও প্রয়োজন নেই। আর যদি পশুপতির ভোগ ইত্যাদি আছে বলে মানা হয় তবে তাকে সান্ত বা সসীম এবং অ-সর্বজ্ঞ বলে মানতে হবে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন- জীব অশরীরী হয়েও ইন্দ্রিয়সমূহের অধিষ্ঠাতারূপে যেমন ভোগ করে, ঈশ্বরও সেইরূপ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করেন- যদি এরূপ বলা হয়- তা ঠিক নয়, কারণ জীব ভোক্তা নয় (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪০)।  তা হলে ঈশ্বরও জীবের ন্যায় জন্ম-মৃত্যুর অধীন এবং অসর্বজ্ঞ হয়ে পড়েন। অতএব পাশুপতমত অগ্রাহ্য (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪১)।

পাঞ্চরাত্র মত খণ্ডন

পাশুপত মতের ন্যায় পাঞ্চরাত্র মতও প্রাচীন অনার্য ভারতেরই সৃষ্টি। পাশুপতগণ যেমন শিব ও শিবলিঙ্গকেই ইষ্টদেবতা বলে মানতেন, পাঞ্চরাত্রগণ বিষ্ণু-ভগবান-বাসুদেবকে ইষ্টদেবতারূপে আরাধনা করতেন। তাই এঁদেরকে বৈষ্ণব ও ভাগবত নামেও অভিহিত করা হয়। ভাগবত ধর্মের মূল গ্রন্থকেই পাঞ্চরাত্র বলে, তবে তা শুধু একটিমাত্র পুস্তক নয়, গ্রন্থ-সংগ্রহ। এর মধ্যে অহির্বুধন্য, পৌষ্কর, সাত্বত, পরমসংহিতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য দুর্লভ গ্রন্থ।

যেভাবে পাশুপতগণের পূজা ও ধর্ম আর শৈবদের পূজা ও ধর্মের রূপে পরিণত হয়েছে (যদিও তার দর্শন সম্পূর্ণ নতুন)- তেমনি পাঞ্চরাত্র ভাগবত ধর্ম বর্তমানের বিষ্ণু-পূজক বৈষ্ণব ধর্মের রূপে পরিণত হয়েছে, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে- ‘যদিও তা নিজস্ব বৈভবের সময়ে গুপ্তযুগে যতটা পরিবর্তিত হয়েছিল, আজ তা থেকেও তাতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তবুও বর্তমানের অনেক বৈষ্ণবমতের মধ্যে রামানুজের বৈষ্ণবমত পাঞ্চরাত্র আগমকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে এবং একদিক থেকে তার উত্তরাধিকারীও বটে। এ কেমন বিড়ম্বনা? এ সম্প্রদায়ের এক প্রধান প্রবক্তা রামানুজ, বাদরায়ণ কর্তৃক পাঞ্চরাত্র মতের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনাকে সমর্থন করেছেন, এবং পাঞ্চরাত্র দর্শনের পরিবর্তে বাদরায়ণের দর্শনকে স্বীকার করেছেন !’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-১৯১)।

পাঞ্চরাত্র বা ভাগবত মতবাদ ঈশ্বরের নিমিত্ত এবং উপাদান উভয় কারণত্বকেই স্বীকার করে। এই মতে বাসুদেবই পরমেশ্বর, এবং জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ। বাসুদেবের পূজা করে, তার ধ্যান করে এবং তাকে জেনেই জীবের মুক্তি হয়। বাসুদেব থেকেই সঙ্কর্ষণ জীব, জীব থেকে প্রদ্যুম্ন মন, এবং মন থেকে অনিরুদ্ধ অহঙ্কারের জন্ম হয়েছে। এই হলো পরমেশ্বর বাসুদেবের চতুর্ব্যূহচারি বিগ্রহ। এ সম্বন্ধে পরমসংহিতায় বলা হয়েছে- বাসুদেব, সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ ক্রমান্বয়ে ব্রহ্ম, জীব, মন ও অহঙ্কারেরই নামান্তর। ব্রহ্ম কর্তৃক জীব (সংকর্ষণ) উৎপন্ন হয়, তা থেকে মন ও মন থেকে অহঙ্কার (-পরমসংহিতা)।

পাঞ্চরাত্রের চারটি বিগ্রহের মধ্যে বাসুদেবই যে পরমেশ্বর এবং তাকেই পূজা-অর্চনাদি করতে হবে- এসব মতবাদকে বেদান্তবাদীরা স্বীকার করতে পারেন, কারণ তা শ্রুতিবিরুদ্ধ হয় না। কিন্তু বাদরায়ণ জীবের সৃষ্টি ইত্যাদি ব্যাপারকে প্রত্যাখ্যান করেন- কারণ, শ্রুতিতে জীবকে নিত্য বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৭), তার উৎপত্তি সম্ভব নয়। তাই পাঞ্চরাত্রের মত প্রত্যাখ্যান করে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- (পুরুষ সংযোগ বিনা শুধু শক্তির দ্বারা) উৎপত্তি অসম্ভব বলে (পাঞ্চরাত্র মতবাদ অগ্রাহ্য) (ব্রঃ-২/২/৪২)।

আবার পাঞ্চরাত্র মতবাদে জীব থেকে অন্তরেন্দ্রিয় বা মনের উৎপত্তি এবং মন থেকে অহং-এর উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে। এই মতও প্রত্যাখ্যান করে বাদরায়ণ বলেন, মন হলো কর্তা জীবের (আত্মার) কারণ বা উপায়, এবং কর্তা থেকে কারণ জন্মে না। অতএব জীব (সংকর্ষণ) থেকে মনের উৎপত্তির কথা বলা ভুল এবং এ বিষয়ে কোন শ্রুতি-প্রমাণও নেই। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- পুরুষ ইন্দ্রিয়াদি করণবিহীন। এরূপ কোথাও দৃষ্ট হয় না যে, কর্তা থেকে করণের সৃষ্টি হয়েছে (ব্রঃ-২/২/৪৩)।

অবশ্য একইসাথে বাদরায়ণ তাও বলেন যে, যদি বাসুদেবকে আদি চৈতন্য বলে গ্রহণ করা হয় তাহলে পাঞ্চরাত্রের মত নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু পরস্পর-বিরোধী কথার জন্যেও পাঞ্চরাত্র দর্শন ত্যাজ্য। কেননা, ভাগবতগণ বলতে পারেন যে, বিশ্বের সব কিছুই বাসুদেব ভগবানের মূর্তি এবং সব কিছুই সমানভাবেই ঈশ্বরের জ্ঞান, কর্তৃত্ব, শক্তি, সাহস ইত্যাদি সম্পন্ন এবং দোষ ও অপূর্ণতা থেকে মুক্ত। কিন্তু এরূপ মনে করলে একাধিক ঈশ্বরকে স্বীকার করতে হয়; যা বাহুল্য-সমন্বিত এবং স্বসিদ্ধান্ত-বিরোধী। কেননা তার সব কিছুই মেনে নিলেও একটি থেকে আরেকটির উৎপত্তি ব্যাপারটি অচিন্তনীয় হয়ে দাঁড়ায়। সর্বতোভাবে সমান বলে এদের কোনোটাই অপর কিছুর কারণ হতে পারবে না; যেহেতু কার্যের মধ্যে এমন কতকগুলি গুণ পাওয়া দরকার যা কারণে অনুপস্থিত। তাছাড়া বাসুদেবের মূর্তি শুধুমাত্র চারটি আকারেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, যেহেতু ‘আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত’ সমগ্র জগৎ-ই পরমেশ্বরের বিরাট মূর্তি। অতএব, বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণের সিদ্ধান্ত হলো- যদি স্বীকার করা হয় যে, পুরুষ বিজ্ঞানাদি গুণসম্পন্ন, তা হলেও পূর্বের আপত্তির প্রতিবিধান হয় না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪৪)।  ভাগবত (শক্তি কারণাদি বাদ) বেদাদি শাস্ত্রসম্মত নয় বলে গ্রহণীয় নয় (ব্র্হ্মসূত্র-২/২/৪৫)।

বৈশেষিক দর্শন-মত খণ্ডন

কণাদের বৈশেষিক মতে জগতের চরম অবস্থা হলো অণুময়ত্ব- এই জগতের সব বস্তুই বিভিন্ন প্রকার অণুর সমবায় মাত্র। এই অণু বা পরমাণু হলো সনাতন এবং জগতের মৌলিক কারণ। এখানে উল্লেখ্য যে, বর্তমান সমকালীন বিজ্ঞান-জ্ঞানস্তরে অণু ও পরমাণুর সংজ্ঞা ভিন্ন হলেও প্রাচীন ভারতীয় দর্শনজগতের বৈশেষিক দর্শনে অণু ও পরমাণু শব্দদ্বয়কে অভিন্ন অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। পরমাণুকে কণাদ ছয়টি পার্শ্বযুক্ত গোলাকৃতি কণা বলে মানতেন এবং বলেছিলেন যে, এই ছয়টি পার্শ্বযুক্ত দুটি পরমাণু যুক্ত হয়ে ছোট ছোট দ্ব্যণুক সৃষ্টি করে। পুনরায় তিনটি দ্ব্যণুক একত্র মিলিত হয়ে একটি ত্র্যণুকের (ত্রসরেণুর) সৃষ্টি করে, এবং চারটি দ্ব্যণুক একটি চতুরণুর সৃষ্টি করে এভাবে স্থূল অবয়ববিশিষ্ট বস্তুর সৃষ্টি করে। বিভিন্ন পদার্থের স্ব-স্ব অণু-দ্ব্যণু হতে অনুরূপভাবে স্থূল আকারের সৃষ্টি হয়। এইসব ক্ষুদ্র গোলকাকৃতির অণু যুক্ত হয়ে বৃহৎ ও দীর্ঘ পরিমাণযুক্ত বস্তুর উৎপত্তি হয় তথা বিশ্ব সৃষ্টি হয়।

এই দার্শনিক মতবাদানুসারে একটি পরমাণু হলো অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম সত্তা, একটি দ্ব্যণুক হলো খুব সূক্ষ্ম এবং হ্রস্ব, এবং ত্র্যণুক হতে শুরু করে পরবর্তী সংমিশ্রিত বস্তুগুলি হলো মহৎ এবং দীর্ঘ। এখানে আপত্তি হলো- যদি অণু দুটি গোলাকারবৎ হয় এবং তারা যদি একটি দ্ব্যণুকের সৃষ্টি করে সেই দ্ব্যণুকটি হবে সূক্ষ্ম এবং হ্রস্ব, তাতে আর সেই অণুর গোলত্ব উৎপাদিত হবে না। অথবা যদি চারটি সূক্ষ্ম ও হ্রস্ব দ্ব্যণুক একটি চতুরণু পদার্থ সৃষ্টি করে যা মহৎ এবং দীর্ঘ- সেক্ষেত্রে নতুন সৃষ্ট এই বস্তুতে দ্ব্যণুকের সূক্ষ্মত্ব এবং হ্রস্বত্ব সঞ্চারিত হবে না। তা হতেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, কারণের সবগুলি গুণই কার্যে সঞ্জাত হয় না। তাই বাদরায়ণ বলেন, কারণের গুণ অনুসারে কার্যের গুণের উৎপত্তিকে বৈশেষিকেরা মানেন, কিন্তু অবয়বহীন পরমাণু থেকে সাবয়ব হ্রস্ব দ্ব্যণুকের উৎপত্তি অসম্ভব এবং (দীর্ঘ পরিমাণরহিত) হ্রস্ব পরিমণ্ডল (দ্ব্যণুক কণা) দ্বারা বৃহৎ, দীর্ঘ (পরিমাণ) যুক্ত পদার্থের উৎপত্তিও সম্ভব নয়।

জড় পরমাণুর মধ্যে যখন ক্রিয়া বা গতি থাকে তখনই সে বস্তুর উৎপাদনে সক্ষম হয়। কণাদের বৈশেষিক মতে জগৎ-সৃষ্টির জন্য অদৃষ্টের প্রেরণায় পরমাণুর মধ্যে ক্রিয়া উৎপন্ন হয়, যা দুটি পরমাণুকে পরস্পর সংযুক্ত করে দ্ব্যণুক নির্মাণ করে তা তার মধ্যে স্বীয় কর্মও প্রয়োগ করে; এই সংক্রমণ অগ্রসর হতে হতে জগৎ সৃষ্টি করে। এখন প্রশ্ন ওঠে- পরমাণুতে যে আদিম ক্রিয়া উৎপন্ন হচ্ছে, তা কি পরমাণুর (জড়ের) নিজের ভিতরকার অদৃষ্ট থেকে উৎপন্ন হয়, না কি চেতনার (আত্মার) অভ্যন্তর থেকে? তাই বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করেন- ‘অদৃষ্ট’ অণুর মধ্যে অথবা জীবের মধ্যে যেখানেই অবস্থান করেন বলে ধরে নেয়া হোক না কেন- এই উভয় ক্ষেত্রেই অণুর পক্ষে কোন কার্য করা সম্ভব নয়। সুতরাং অণু জগৎ সৃষ্টি করতে পারে না (ব্রঃ-২/২/১২)।

অর্থাৎ, বৈশেষিক মতে যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কোন প্রচেষ্টাই হতে পারে না। যেহেতু সৃষ্টির পূর্বে কোন স্থূল দেহ বা মন উভয়ই অবর্তমান, সুতরাং সেখানে কোন কর্মপ্রচেষ্টা থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে কোন প্রতিক্রিয়াও হতে পারে না। যদি ‘অদৃষ্ট’ই কারণ হন, তাহলে বাদরায়ণের মতে, ‘অদৃষ্টে’র অবস্থান আত্মায় অথবা অণুতে যেখানেই থাকুক না কেন, এই উভয় ক্ষেত্রেই ‘অদৃষ্ট’ অণুর প্রথম কর্ম প্রেরণার কারণ হতে পারেন না। কারণ, পূর্বজন্মের কর্মফল এই অদৃষ্ট হলেন অচেতন, এবং সেজন্য তিনি স্বয়ং কোন কার্য করতে পারেন না। যদি বলা যায় যে, এই আত্মায় অবস্থান করেন- তাহলে আত্মা নিজে তখন অচেতন বলে তার মধ্যে অদৃষ্টকে পরিচালনা করার মতো কোন বুদ্ধি (চেতনা) নাই। সুতরাং আত্মার ক্ষেত্রে কর্মের অদৃষ্ট পরমাণুর মধ্যে কেমন করে প্রবিষ্ট হবে? অণুর মধ্যে কর্ম হতে পারে না।

আবার যদি বলা যায় যে, সর্বদা সহবাসরত পদার্থের মধ্যে যে সমবায় সম্বন্ধ নিত্য ঘটে, তা থেকেই মানতে হবে যে পরমাণুতেই অদৃষ্ট নিহিত; তবে সমবায়ের স্বীকৃতি থেকেও সেই কথাই এসে পড়ে যে, সমবায় সম্বন্ধ সেখানেই বা কেন? বৈশেষিকেরা সাতটি পদার্থ স্বীকার করেন। তার মধ্যে একটি হলো সমবায় বা নিত্যসম্বন্ধ। তাদের মতে, একই সমবায়ই দ্ব্যণুককে তার অঙ্গীভূত দুটি অণুর সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়। কারণ দ্ব্যণুক এবং অণু হলো পৃথক গুণসম্পন্ন দুইটি বস্তু। সেক্ষেত্রে এই সমবায়ও স্বয়ং সংযুক্ত এই দ্ব্যণুক এবং অণু থেকে ভিন্ন হওয়ার কারণে তাদের সঙ্গে সমবায়কে যুক্ত করার জন্য অপর একটি সমবায় কারণের প্রয়োজন হবে, আবার এই সমবায়কে প্রথম সমবায়ের সাথে যুক্ত করার জন্য অপর একটি সমবায় কারণের প্রয়োজন হবে- এবং এভাবে অনন্ত সমবায়ের প্রয়োজন হবে। এভাবে অনবস্থা দোষ ঘটবে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন- সমবায় সম্বন্ধকে স্বীকার করার জন্য কার্য-কারণের মধ্যে একটা ‘অনবস্থা’ দোষ দেখা যায় বলে বৈশেষিক মতবাদ গ্রহণীয় নয় (ব্রঃ-২/২/১৩)।

আবার এমন নয় যে সমবায় সম্বন্ধ নিত্য, তাই পরমাণু এবং তার অদৃষ্ট উভয়েই নিত্য থাকবে। কেননা, যদি অদৃষ্ট অণুর মধ্যেই নিত্য অবস্থান করে বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে তা সর্বদা বর্তমান বলে তার প্রলয়াবস্থা সম্ভবপর হতে পারে না। এতে করে জগতের নিত্য থাকাই প্রমাণিত হবে এবং জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়কে যাঁরা মানেন তাদের পক্ষেও তা স্বীকার করা সম্ভব হবে না। তাই বাদরায়ণ বলেন- পরমাণুগুলি যদি নিত্য প্রবৃত্তি-প্রবণ হয়, তাহলে সৃষ্টি অনন্তকালই চলতে থাকবে, প্রলয় কখনও হবে না। আর তাদের মধ্যে নিত্য নিবৃত্তিগুণ কল্পনা করলে কখনও সৃষ্টি সম্ভব হবে না (ব্রঃ-২/২/১৪)।

অর্থাৎ, যদি অণুগুলি স্বভাবতই ক্রিয়াশীল হয়, তাহলে সৃষ্টি হবে চিরস্থায়ী, কারণ সেক্ষেত্রে প্রলয়ের অর্থ হবে অণুগুলির স্বভাবের পরিবর্তন মেনে নেয়া, যা অসম্ভব। পক্ষান্তরে যদি ধরে নেয়া হয় যে, অণুগুলি স্বভাবত নিষ্ক্রিয়, তাহলে প্রলয়াবস্থাকেই চিরন্তন বলে মেনে নিতে হয় এবং সেজন্য আর সৃষ্টিও হবে না। কিন্তু অণুগুলি পরস্পর বিরুদ্ধ গুণসম্পন্ন সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় উভয়ই হতে পারে না। যদি তারা এই উভয়ের একটা গুণসম্পন্নও না হয়, তাহলে তাদের সক্রিয়-নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপারটি অদৃষ্টের ন্যায় অন্য কোন নিমিত্ত কারণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে,- যেহেতু অদৃষ্ট সর্বদাই অণুগুলির সাথে সংযুক্ত সেজন্য সর্বদাই তারা ক্রিয়াশীল থাকবে এবং সৃষ্টিও চিরস্থায়ী হয়ে পড়বে। অপরপক্ষে, যদি আবার সেখানে কোন নিমিত্ত-কারণ না থাকে, তাহলে অণুগুলির কোন ক্রিয়াশীলতাও থাকে না এবং ক্রিয়াশীলতার অভাবে সৃষ্টিও থাকবে না। ফলে বৈশেষিকের এই পরমাণুবাদ পুনরায় অগ্রাহ্য বলে গণ্য হয়।

বাদরায়ণ বৈশেষিক মতকে বিভিন্ন কৌণিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন। যেমন আরেকটি যুক্তি হলো, বৈশেষিকমতে একদিকে পরমাণুকে নিত্য, সূক্ষ্ম, অবয়বহীন বলে মানা হয়েছে, অন্যদিকে কারণের গুণানুযায় কার্যগুণ উৎপন্ন হয় বলে স্বীকার করা হয়। অর্থাৎ অণুগুলির রূপ ইত্যাদি আছে বলে ধরা হয়, কারণ, তা না হলে কার্যগুলিতে অণুর সেই সকল গুণ পাওয়া যেতো না- যেহেতু কারণের গুণগুলিই কার্যে দৃষ্ট হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বাদরায়ণের মতে, অণুগুলি অণুগুণসম্পন্ন (ক্ষুদ্র) এবং স্থায়ী হবে না। কারণ যা রূপ-বিশিষ্ট তা-ই স্থূল হয়- সূক্ষ্ম নয় এবং তা তার কারণের তুলনায় অস্থায়ী। সেহেতু রূপাদিবিশিষ্ট অণুও স্থূল এবং অস্থায়ী হয়ে পড়ে। কাজেই বৈশেষিক দর্শন মতে অণুর ক্ষুদ্রত্ব এবং স্থায়িত্ব তার দ্বারা বাধিত হয় বলে তা স্ববিরোধী। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- বৈশেষিক মতে পরমাণুর রূপাদি গুণ আছে। সুতরাং তা সূক্ষ্ম এবং নিত্য হতে পারে না। স্ববিরোধী বলে অণু জগতের কারণ নয় (ব্রঃ-২/২/১৫)।

আবার এই দার্শনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং বায়ু এই চারটি স্থূলভূত অণু থেকে উৎপন্ন হয়। গুণগত বিচারে এই চারটি পদার্থ ভিন্ন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়- ক্ষিতির মধ্যে স্পর্শ, রস, গন্ধ এবং রূপ এই চারটি গুণ বর্তমান, অপরপক্ষে অপ বা জলের আছে মাত্র তিনটি গুণ, তেজ বা অগ্নিতে আছে দুটি এবং বায়ুতে একটি। যদি ধরে নেয়া হয় যে, পদার্থগুলির নিজ নিজ অণুর মধ্যেও পদার্থের গুণগুলি বর্তমান, তাহলে বায়ুর অণুতে থাকবে একটি গুণ এবং ক্ষিতির অণুতে থাকবে চারটি গুণ। চারটি গুণের সমবায়ে ক্ষিতির অণুটি আকারে অন্য পদার্থের অণু থেকে বৃহত্তর হবে- কারণ অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পাওয়া যায় যে, গুণের বৃদ্ধি হলে আয়তনের বৃদ্ধি না হয়েই পারে না, এবং এই আয়তন বৃদ্ধির ফলে অণু আর অণু থাকতে পারে না। অপরপক্ষে যদি ধরে নেয়া হয় যে, প্রত্যেক পদার্থের অণুরই সমসংখ্যক গুণ আছে, তাহলে অণুগুলির সৃষ্ট পদার্থের গুণগুলির মধ্যেও কোন পার্থক্য থাকবে না- কারণ বৈশেষিক তত্ত্বটি হলো এই যে, কারণের গুণগুলিই কার্যের মধ্যে সঞ্জাত হয়ে বর্তায়। এই উভয় ক্ষেত্রেই বৈশেষিক মতবাদ ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়। তাই বাদরায়ণ বলেন- অণুর রূপাদি গুণের স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি উভয়ই দোষযুক্ত। সেজন্য পরমাণু কারণবাদ অগ্রাহ্য (ব্রঃ-২/২/১৬)।

তর্কযুক্তি দ্বারা কণাদের পরমাণুবাদকে আক্রমণ করাই বাদরায়ণের যথেষ্ট বলে মনে হয়নি, তাই শেষ পর্যন্ত বাদরায়ণ স্বরূপ ধারণ করে বলছেন- মনু প্রমুখ স্মৃতিকার মুনিগণ অণু-বাদকে স্বীকার করেন নাই। সুতরাং বেদমতাবলম্বীদের পক্ষে এই মতবাদ সর্বতোভাবে বর্জনীয় (ব্রঃ-২/২/১৭)।

এইভাবে, রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভাষ্যে- ‘ইউরোপের যান্ত্রিক বস্তুবাদের মতো গুণাত্মক পরিবর্তনের মাধ্যমে কারণ থেকে কার্য সৃষ্টিকে না মানার ফলে পরমাণুবাদের মধ্যে যে দুর্বলতা ছিল বাদরায়ণ তাকে খণ্ডন করেছেন।’

জৈন দর্শন-মত খন্ডন

জৈনদর্শনের দুটি মুখ্য সিদ্ধান্ত- স্যাৎবাদ এবং আত্মার (পুদ্গল) শরীর অনুসারে ছোট-বড় হওয়া। এই দুটি সিদ্ধান্তের উপরই বাদরায়ণ আক্রমণ করে জৈনমত খণ্ডনে প্রয়াসী হয়েছেন।

জৈনরা সাতটি পদার্থকে স্বীকার করেন, যেগুলিকে আত্মা ও অনাত্মা হিসেবে দুই ভাগ করা যায়। আবার সাতটি পদার্থের সত্যতা সম্পর্কে পৃথক সাতটি মত পোষণ করেন। জৈনমতে প্রত্যেকটি বস্তুই সৎ, অসৎ, সদসৎ উভয়, সদসৎ উভয় থেকে ভিন্ন, অবর্ণনীয় (অসংজ্ঞেয়)- এবং এরূপ অনেক কিছুই হতে পারে। অর্থাৎ একই বস্তু সম্পর্কে এই যে ‘হয়তো আছে’, ‘হয়তো নেই’, ‘হয়তো আছেও, নেইও’, ‘হয়তো আছেও, নেইও, তাও নয়’, ‘অবক্তব্য’ এরকম সাতটি পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব বা সম্ভাবনা মানা হয়েছে, জৈনদের এই তত্ত্বকে বলা হয় স্যাদবাদ বা সপ্তভঙ্গিনয়। এই স্যাদবাদকে আক্রমণ করেই বাদরায়ণ বলেন যে, পদার্থ সম্পর্কে এই মতবাদ গ্রহণীয় হতে পারে না, কারণ এটা চিন্তা করা অবাস্তব যে, একই বস্তু ‘আছেও নেইও’ এরকম সত্য-মিথ্যাদি বিপরীত গুণযুক্ত হতে পারে। ফলে জৈন মতানুসারে আমরা কোন সুনির্দিষ্ট জ্ঞানে উপনীত হতে পারি না- এবং সেজন্যই এই জগৎ, স্বর্গ এবং এমনকি মুক্তি পর্যন্ত সন্দেহের বস্তু হয়ে যাবে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- একই সময়ে একই বস্তুতে বিরুদ্ধ ধর্মের সমাবেশ সম্ভব নয়। তাই পরস্পরবিরোধী উক্তিসম্পন্ন জৈনমত যথার্থ নয় (ব্রঃ-২/২/৩৩)।

জৈনমতে বলা হয়, আত্মা (পুদ্গল) শরীরেরই সমান আয়তন-বিশিষ্ট। অর্থাৎ আত্মার আকার অনিশ্চিত, যখন ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ শরীরে প্রবিষ্ট হয় তখন সেইরূপ আকৃতিই ধারণ করে। এই মতের খণ্ডন করতে গিয়ে বলা হয়-  জৈনদের মতানুসারে যদি মানতে হয় যে, আত্মা শরীরের সমান আয়তনবিশিষ্ট, তাহলে আত্মা হবে সসীম এবং সাংশ বা অংশ-সম্বলিত- এবং এজন্যই তা চিরন্তন (অবিনাশী) হতে পারবে না। তাছাড়া আরো একটি অসুবিধা হবে যে, যদি কোন পিপীলিকার আত্মা অতীত কর্মফলহেতু গজত্ব-লাভ করে, তাহলে এই পিপীলিকাদেহ দ্বারা গজদেহের পরিমাণকে পূর্ণ করা সম্ভব হবে না; এবং বিপরীতক্রমে একটি গজ বা হাতী যদি পিপীলিকাত্ব প্রাপ্ত হয় তাহলে গজ দেহটাকে পিপীলিকার দেহে সন্নিবিষ্ট করা যাবে না। কোন ব্যক্তিবিশেষের একই দেহে বাল্য, যৌবন, বার্ধক্য ইত্যাদি অবস্থা সম্পর্কেও একই সমস্যা দেখা দেবে।  তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেছেন- জৈনগণ আত্মাকে যে দেহ পরিমাণ বলেন তাতে আত্মা (ক্ষুদ্র) অসর্বজনীন হয়ে যাবেন (ব্রঃ-২/২/৩৪)।

আবার, যদি মানা হয় যে, আত্মা গৃহীত শরীরের পরিমাণ ধারণ করে- তাহলে এটাও মানতে হবে যে, আত্মার অংশ বিভাগ আছে এবং পর্যায়ক্রমে তার হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। সেক্ষেত্রে আরেকটি বাধা দেখা দেয়- তা হলে বলতে হবে যে, আত্মার বিকার আছে এবং সেজন্যই আত্মা অচিরস্থায়ী। যদি আত্মা অশাশ্বত এবং সদা পরিবর্তনশীল হন, তাহলে আত্মার বিষয়ে বন্ধন বা মুক্তি কিছুই অনুমান করা যায় না। তাই বাদরায়ণ বলেছেন- অবস্থাবিশেষে পর্যায়ক্রমে আত্মার হ্রাস বৃদ্ধি আছে ধরে নিলেও আত্মার অনিত্যাদি দোষ থেকেই যায় (ব্রঃ-২/২/৩৫)।

অন্যদিকে, মুক্তির সময় আত্মার আকার অপরিবর্তনীয় থাকে বলে জৈনরা মনে করেন। সেক্ষেত্রে, যদি এই আকার নিত্যই হয়, তাহলে আত্মা কোন সৃষ্ট পদার্থ হতে পারে না- কারণ যা কিছু সৃষ্ট, তা-ই অনন্তকাল স্থায়ী হয় না। আর এটি যদি সৃষ্ট পদার্থ না হয় তাহলে তা সৃষ্টির আদিতে এবং মধ্যেও অবশ্যই বর্তমান ছিলো। অন্যভাবে বলা যায়, আত্মার আকারটি সর্বদাই একরূপ ছিলো- তা ক্ষুদ্রই হোক বা বৃহৎ-ই হোক। তাই বাদরায়ণের বক্তব্য হলো- মোক্ষ অবস্থায় প্রাপ্ত দেহের পরিমাণ যখন অপরিবর্তনীয় বলে জানা যায়, তখন আদি বা মধ্য কোন অবস্থাতেই আত্মার আকারের পরিবর্তন হয় না- তা স্বীকার করতেই হয় (ব্রঃ-২/২/৩৬)।

সুতরাং শরীরের আকার অনুযায়ী আত্মার আকারের পরিবর্তন হয়- জৈনদের এই মতবাদ যুক্তিসিদ্ধ নয় বলে জৈনমত অগ্রহণযোগ্য।

বৌদ্ধ দর্শন-মত খণ্ডন

বৌদ্ধদর্শনের চারটি শাখা-

  • (ক) সর্বাস্তিবাদী বৈভাষিক, যাঁরা বাহ্য এবং আন্তর উভয় জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন- বাহ্যবস্তুর সমবায়ে বাহ্য-জগৎ এবং চিত্ত ও চিত্তের বিভিন্ন অবস্থা বা চিত্তবৃত্তি নিয়ে অন্তর্জগৎ;
  • (খ) বাহ্যার্থবাদী সৌত্রান্তিক, যাঁরা বাহ্যবস্তুর ক্ষণিক অস্তিত্বকে স্বীকার করেন;
  • (গ) (চিত্ত-চৈত্তিক) বিজ্ঞানবাদী যোগাচার, যাঁরা বিজ্ঞপ্তি চিত্ত বা বিজ্ঞান-প্রবাহকেই একমাত্র সত্য বলে স্বীকার করেন;
  • (ঘ) শূন্যবাদী মাধ্যমিক, যাঁরা মনে করেন বাহ্য ও আন্তর সবকিছুই শূন্য এবং অসৎ। তবে এই মতবাদগুলির সবকটিই বুদ্ধের মৌলিক সিদ্ধান্ত অনিত্যতা ও ক্ষণিকতার তত্ত্ব মেনে বিশ্বাস করে যে, জগতের সব কিছুই ক্ষণিক- কিছুই এক মুহূর্তের অধিক স্থায়ী নয়।

বাদরায়ণ বৌদ্ধদর্শনের এই চারটি শাখার নিজস্ব মতকেই খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তা খণ্ডনের জন্য প্রথমে বৈভাষিক দর্শনকে নিয়ে এরপর সমগ্র বৌদ্ধদর্শন শাখার সিদ্ধান্তগুলি আলোচনা করেছেন। পরে, ভিন্ন ভিন্ন সমান দর্শন শাখার, বিশেষ বিশেষ সিদ্ধান্তগুলি খণ্ডন করেছেন।

বৈভাষিক বৌদ্ধমত খণ্ডন : বৈভাষিকে বাহ্যবস্তুর সমন্বয়ে বাহ্যিক জগৎ এবং আভ্যন্তরীণ বস্তুর অর্থাৎ চিত্ত ও চিত্তের বিভিন্ন অবস্থানসমূহের সমন্বয়ে অন্তর্জগতের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। ভেতরের এবং বাইরের সব পদার্থের সর্ব-অস্তিত্বকে স্বীকার করার জন্য এর প্রাচীন সর্বাস্তিবাদী নামও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এছাড়াও প্রাচীন সাহিত্যে এটি বস্তুবাদী বা প্রপঞ্চবাদী বৌদ্ধদর্শন নামেও খ্যাত। কিন্তু সকলের অস্তিত্বকেই বৈভাষিকে বুদ্ধের মৌলিক সিদ্ধান্ত অনিত্যতা- ক্ষণিকতার- সঙ্গে মানা হয়েছে। অর্থাৎ সবকিছুই ক্ষণিক- কিছুই এক মুহূর্তের অধিক স্থায়ী নয়। বাদরায়ণ মূলত এই ক্ষণিকতাবাদের ওপরেই আঘাত করেছেন।

বৌদ্ধদর্শনের ক্ষণিকবাদ অনুযায়ী জাগতিক বস্তু প্রতিক্ষণে পরিবর্তিত হয় এবং কোন বস্তুই একক্ষণের অধিককাল স্থায়ী হয় না। একটি বস্তু যে ক্ষণে উৎপন্ন হয় তার পরক্ষণেই বিনষ্ট হয়। বস্তুর বিনাশক্ষণেই ঐ বস্তুর সদৃশ অপর একটি বস্তু উৎপন্ন হয়। আমরা বস্তুর এই উৎপত্তি ও বিনাশক্ষণের রহস্য জানি না বলেই বস্তুকে স্থির ও অচঞ্চল বলে মনে করি।

বৈভাষিক বৌদ্ধরা দুটি ‘সমুদায়’কে স্বীকার করেন- বাহ্য বস্তুজগৎ (ভূত-ভৌতিক) এবং আন্তর মনোজগৎ (চিত্ত-চৈত্তিক)- এই উভয়ের সমন্বয়ে বিশ্বজগৎ। বাহ্য জগৎ অবিভাজ্য পরমাণু সমুদয় নিয়ে গঠিত। এই পরমাণু চার প্রকার- পার্থিব পরমাণু যা কঠিন, জলীয় পরমাণু যা তরল, তেজঃ পরমাণু যা উষ্ণ এবং বায়বীয় পরমাণু যা সদা গতিময়।

আর অন্তর্জগতের উপাদান হলো পঞ্চ স্কন্ধ। এই পঞ্চ স্কন্ধ হলো- (১) রূপ স্কন্ধ- যা ইন্দ্রিয় এবং তার বিষয় নিয়ে গঠিত; (২) বিজ্ঞান স্কন্ধ- যা অহংবোধের জন্ম দেয় এমন কতকগুলি ধারাবাহিক প্রত্যক্ষ জ্ঞান দ্বারা গঠিত; (৩) বেদনা স্কন্ধ- যা সুখ-দুঃখ ইত্যাদি অনুভূতি দ্বারা গঠিত; (৪) সংজ্ঞা স্কন্ধ- সে একজন মানুষ ইত্যাদি নাম রূপের জ্ঞানসমবায়ে গঠিত এবং (৫) সংস্কার স্কন্ধ- যা আকর্ষণ-বিকর্ষণ, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি বোধের দ্বারা গঠিত। এই স্কন্ধগুলির সমবায়ে আন্তর সমুদায় বা মনোজগতের সৃষ্টি।

এখানে বাদরায়ণের প্রশ্ন হলো, কিভাবে এই দুটি সমুদায়ের উৎপত্তি হলো? এই সমুদায়ীকরণের পশ্চাতে কি কোন চৈতন্যময় কারণরূপী পরিচালক সত্তা আছেন? অথবা তা কি স্বতই উৎপন্ন হয়েছে? যদি তা স্থিতিশীল হয়, তাহলে বৌদ্ধদের ক্ষণিকত্ববাদের বিরোধিতা করা হয়। আর যদি তাকে ক্ষণিক মনে করা হয়, তাহলে আমরা বলতে পারি না যে, তা প্রথমে উৎপন্ন হয়ে পরে পরমাণুগুলিকে একত্র সংহত করলো। কেননা তাহলে বুঝতে হবে যে, কারণ এক মুহূর্তের অধিককালই স্থায়ী। আর যদি এই সমুদায়ের পেছনে কোন চৈতন্যময় সত্তা নিয়ন্তারূপে না থাকেন, তাহলে কিভাবে এই অচেতন এবং স্কন্ধগুলি এমন সুশৃঙ্খলভাবে সংহত হয়ে সমুদায় সৃষ্টি করতে পারে? তাছাড়া, এই ক্রিয়াশীলতা হতো চিরন্তন এবং সেক্ষেত্রে কোন ধ্বংস বা প্রলয় থাকতো না। এসব কারণেই এই সমুদায় সৃষ্টির কোন কারণ নির্ণয় করা যায় না এবং তা করতে না পারার জন্যই জাগতিক অস্তিত্বের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহও বর্তমান থাকতে পারে না। ফলে বৌদ্ধদের এই মতবাদটি গ্রাহ্য হতে পারে না। তাই বাদরায়ণ বলেন- বৌদ্ধমতে অণুহেতু বাহ্য প্রপঞ্চ এবং চিত্তহেতু আন্তর প্রপঞ্চ- এই উভয়ের মিলনে ‘সমুদায়’ ব্যাপারটি নিষ্পন্ন হয়। এই মতও অগ্রাহ্য- কারণ, তাদের মতে ঐ সকলের মিলন হতে পারে না (ব্রঃ-২/২/১৮)।

বৈভাষিক দর্শনের পরিভাষায় ‘সমুদয়’ শব্দটির মানে হলো কার্য এবং ‘প্রত্যয়’ হলো কারণ, এবং এরা অবশ্যই পরস্পর সম্পর্কিত। সেক্ষেত্রে কোন ঘটনার মধ্যে যেটি ঘটবার পর অপরটি ঘটে সেই প্রথমটি দ্বিতীয়টির প্রত্যয় বা কারণ। আর দ্বিতীয়টি হলো প্রথমটির সমুদায়।

সেক্ষেত্রে বৌদ্ধদর্শনে কার্য-কারণ তত্ত্ব হিসেবে প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতিতে যে দ্বাদশাঙ্গের শৃঙ্খল পরম্পরাটি রয়েছে, যথা- অবিদ্যা, সংস্কার (আকর্ষণ, বিকর্ষণ ইত্যাদি), বিজ্ঞান (আত্ম-সচেতনতা), নামরূপ (ক্ষিতি, জল প্রভৃতি স্থূল শরীরের সূক্ষ্ম উপাদানসমূহ), ষড়ায়তন (দেহ এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়), স্পর্শ (বিষয় সংযোগ), বেদনা (সুখ-দুঃখাদি বিষয় সংবেদন), তৃষ্ণা (বিষয় কামনা), উপাদান (বিষয়াসক্তি), ভব (পুনর্জন্ম গ্রহণের প্রবণতা), জাতি (পুনর্জন্ম) ও জরা-মরণ (বিবিধ দুঃখ), এই শৃঙ্খলা পরম্পরায় অব্যবাহিত পূর্ববর্তীটি হলো পরবর্তীটির (সমুদায়ের) কারণ। অতএব, কোন সমুদয়-সম্পাদক চৈতন্যময় সত্তা ছাড়াই এই সমুদায়গুলি সৃষ্টি করে একটি অপ্রতিহত কার্য-কারণ শৃঙ্খল, যা অবিরতভাবে চক্রাকারে ঘুরছে বলে বৈভাষিকরা মনে করেন। এবং এই চক্রে একটি ‘সমুদায়’ না থাকলে তা সংঘটিত হতে পারে না। সুতরাং ‘সমুদায়’ হলো একটি বাস্তব সত্তা।

কিন্তু বৈভাষিকদের এই যুক্তি খণ্ডন করতে বাদরায়ণ বলেন, যদিও এই শৃঙ্খলে পূর্ব-পূর্ববর্তীটি পর-পরবর্তীটির কারণ, তবুও সমগ্র সমুদায়ের কারণ বলে কিছু বর্তমান নাই। তাছাড়া বৌদ্ধমতের ক্ষণিকত্ববাদ যদি স্বীকার করা হয়, তাহলে যে জীবাত্মার ভোগ ইত্যাদির জন্য দেহ-সমুদায় ইত্যাদির প্রয়োজন- সেই জীবাত্মাও ক্ষণিক এবং ক্ষণিকত্বের জন্য জীবও ভোক্তা হতে পারে না। জীবাত্মা যদি ক্ষণিকই হলো, তাহলে এই মুক্তির প্রয়োজনই বা কার জন্য? সুতরাং এই প্রতীত্য-সমুৎপাদ শৃঙ্খল যদিও পরস্পর কার্যকারণ সম্বন্ধে সম্বন্ধ- তবুও তা সমুদায়ের কারণ হতে পারে না, এবং যেহেতু স্থায়ী কোন ভোক্তা নেই, সেহেতু এই সমুদায় প্রপঞ্চেরও প্রয়োজন নেই। সুতরাং বৌদ্ধদের ক্ষণিকত্ববাদ অসিদ্ধ। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেছেন- যদি বলা হয় যে, অবিদ্যা-সংস্কার প্রভৃতি পরস্পর পরস্পরের প্রতি কারণ বলে তাদের সঙ্গতি আছে- তার উত্তরে বলা যায় যে, তা হতে পারে না কারণ তার উৎপত্তির পরক্ষণেই ধ্বংস হয় বলে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না এবং কারণ হলেও তারা নিমিত্ত-কারণ মাত্র (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১৯)।

আবার যদি সব কিছুই ক্ষণিক ধরা হয়, তাহলে পূর্ববর্তী জিনিসটি জন্মমুহূর্তের পরক্ষণে আর থাকবে না- তাই তা পরবর্তী কোন বস্তুর কারণ হতে পারবে না। কারণ ততক্ষণে তা অসৎ হয়ে গেছে। যদি তখনও তাকে কারণ বলা হয়, তাহলে ধরে নিতে হয় যে, নাস্তি বা শূন্য থেকে অস্তি (কিছু) উৎপন্ন হয়, যা অসম্ভব। তাই বাদরায়ণ বলেছেন- সংস্কার, বিজ্ঞান ইত্যাদি পরপর বস্তুসমূহ যখন উৎপন্ন হয় তখন তার অব্যবহিত পূর্বপূর্ব অবিদ্যাদি পদার্থসমূহ অনস্তিত্বশীল হয়ে যায়। সুতরাং পূর্বপূর্ব অবিদ্যাদি দ্রব্যসমূহ পরপর সংস্কারাদির উৎপাদক কারণ হতে পারে না (ব্রঃ-২/২/২০)।

কিন্তু যদি এই আপত্তিকে পরিহার করতে গিয়ে বৌদ্ধরা বলেন যে, কারণ ছাড়াই কার্য উৎপন্ন হয়, তাহলে তারা নিজেদের প্রতিজ্ঞাকেই ভঙ্গ করবেন যে, প্রতিটি কার্যেরই একটি কারণ আছে। অন্যদিকে, যদি একটি কারণকে স্বীকার করে নেয়া হয, তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, কার্য এবং কারণ একই সময়ে বর্তমান থাকে- পরবর্তী মুহূর্তটিতে- অর্থাৎ কারণ একাধিক মুহূর্তকাল স্থায়ী হয়। এতে করে ক্ষণিকত্ববাদ মতটিই নস্যাৎ হয়ে যায়। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- কার্য উৎপত্তিকালে কারণস্বরূপ পূর্বক্ষণ থাকে না তা স্বীকার করলে বৌদ্ধদের- ‘অন্তর্জগতের চিত্ত-চৈত্য পদার্থসমূহ চার প্রকারে উৎপন্ন হয়’- এই প্রতিজ্ঞাটি ভঙ্গ হয়। আর কারণের বিদ্যমানতা স্বীকার করলে কার্যকারণের একই সময়ে অবস্থিতি মানতে হয়। তাহলে পদার্থমাত্রই ক্ষণিক এই সিদ্ধান্ত গ্রাহ্য হয় না (ব্রঃ-২/২/২১)।

বৌদ্ধমতে চিরকাল যাবৎ একটি সামগ্রিক ধ্বংস (বিনাশ) চলে আসছে; এবং এই ধ্বংস হলো দুই প্রকার- বুদ্ধিপূর্বক (প্রতিসংখ্যা) এবং অবুদ্ধিপূর্বক (অপ্রতিসংখ্যা)। বুদ্ধিপূর্বক বিনাশ হলো যেমন চিন্তাভাবনা করে একটি লোক লাঠি দ্বারা একটি ঘটকে ভাঙলো; আর অবুদ্ধিপূর্বক বিনাশ হলো বস্তুসমূহের স্বাভাবিক বিনষ্টি।

কিন্তু বাদরায়ণের মতে এই উভয় প্রকারের বিনাশই অসম্ভব, কারণ এই ধ্বংসের জন্য হয় এই ক্ষণিক সত্তার একটি ধারাবাহিক অবস্থানের প্রয়োজন অথবা এই সমুদায়ের অন্তত একটিরও প্রয়োজন। এই সমুদয় পরম্পরা সদা প্রবহমান, তাকে কখনও স্তব্ধ করা যাবে না। কেন?- কারণ এই ধ্বংসের পূর্ববর্তী শেষতম মুহূর্তের অবস্থানকে কল্পনা করতে হবে এভাবে যে, হয় তা কার্য উৎপাদন করে, অথবা কোন কার্য উৎপাদন করে না। যদি তা কার্য উৎপাদন করে- তাহলে এই কার্যকারণ পরম্পরার শৃঙ্খল সৃষ্টি করেই চলতে থাকবে এবং তার বিনাশ হবে না। আর তা যদি কোন কার্য উৎপাদন না করে, তাহলে- শেষতম মুহূর্তের অবস্থানটি মোটেই কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা হবে না- কারণ বৌদ্ধদের মতে সত্তার অর্থ হলো কারণের কার্যকারিতা। আবার শেষতম মুহূর্তের অস্তিত্বের অনস্তিত্ব আমাদেরকে পেছনের দিকে পূর্ব পূর্ববর্তী ক্ষণিক অস্তিত্বের অনস্তিত্বের দিকে নিয়ে যাবে…। এভাবে এই কার্যকারণ শৃঙ্খলের সব অবস্থানের অনস্তিত্বের দিকেই যাত্রা হবে।

আবার, এই দুই প্রকারের বিনাশ এই সমুদায়ের বিশেষ কোন পদার্থের মধ্যেও দৃষ্ট হয় না। কারণ এই সমুদায়ের প্রত্যেকটি পদার্থই ক্ষণিক হওয়ার জন্য তার বুদ্ধিপূর্বক বিনাশ কখনও সম্ভব নয়। অথবা তার অবুদ্ধিপূর্বক বিনাশও সম্ভব নয়, কারণ তার অন্তর্গত কোন পদার্থ বিশেষেরই সম্পূর্ণ বিনাশ সম্ভব নয়। যেমন একটি ঘট যখন ধ্বংশ হয় তখন তার খণ্ডগুলির মধ্যে আমরা মৃৎপিণ্ডের অস্তিত্বকে দেখতে পাই। এমনকি অন্যক্ষেত্রেও  যেখানে আমরা বস্তুটি অদৃশ্য হয়ে গেল বলে মনে করি, সেখানেও; যেমন যদি উত্তাপের ফলে জলবিন্দুকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখি তা হলেও আমরা ধারণা করতে পারি যে, সেটি অন্যরূপে- বাষ্পরূপে অবস্থান করছে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেছেন- পরস্পর সম্বন্ধ কার্যকারণ পরম্পরায় বিচ্ছেদ হয় না বলে বুদ্ধিপূর্বক বিনাশ ও অবুদ্ধিপূর্বক বিনাশ উভয়ই অসম্ভব হয় (ব্রঃ-২/২/২২)।

বৌদ্ধমতে অবিদ্যা (মায়া) হলো ক্ষণিক বস্তুতে চিরন্তনত্বের আরোপজনিত ভ্রান্তি বা মিথ্যা দৃষ্টি। বৌদ্ধরা বলেন যে, এই অবিদ্যার বিনাশেই মোক্ষ বা নির্বাণলাভ হয়। বাদরায়ণের মতে, এখন এই অবিদ্যার বিনাশ (বুদ্ধিপূর্বক বা অবুদ্ধিপূর্বক) এই দুই প্রকারের বিনাশের মধ্যে একটির দ্বারা অবশ্যই হবে। যদি এই অবিদ্যার বিনাশ বুদ্ধিপূর্বক কোন ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব চেষ্টা, তপস্যা এবং জ্ঞানের দ্বারা হয়, তাহলে তা বৌদ্ধ ক্ষণিকত্ববাদের বিরোধী হবে। কারণ, ক্ষণিকত্ববাদের মতে অবিদ্যাও ক্ষণিক, এবং অবিদ্যাও উৎপত্তির এক মুহূর্ত পরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু যদি বলা হয় যে, অবিদ্যার বিনাশ স্বতই হয়ে থাকে, তাহলে বৌদ্ধদের নির্বাণলাভের সাধনা অষ্টাঙ্গ মার্গাদির উপদেশ ব্যর্থ হয়। সুতরাং উভয় ক্ষেত্রেই বৌদ্ধদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এ প্রসঙ্গে বাদরায়ণ বলেন- বুদ্ধিপূর্বক অথবা অ-বুদ্ধিপূর্বক, যেভাবেই অবিদ্যার বিনাশ হোক না কেন, উভয় ক্ষেত্রেই নানা দোষ থাকায় বৌদ্ধমত অসঙ্গত (ব্রঃ-২/২/২৩)।

আবার, বৌদ্ধ মতানুসারে দুই প্রকার নিরোধ বা বিনাশ ছাড়াও আকাশ হলো তৃতীয় অভাব-বস্তু। এর তাৎপর্য হলো, আকাশের কোন সাধারণ আবরণ অথবা স্থানাধিকারী কোন শরীর নাই। যেহেতু ইতঃপূর্বে দেখানো হয়েছে যে, দুই প্রকারের বিনাশ সম্পূর্ণভাবে অস্তিত্বগুণরহিত নয়, সুতরাং তা অভাব-পদার্থ হতে পারে না। আকাশের ব্যাপারটিও ঠিক অনুরূপ। যেমন ক্ষিতি, বায়ু প্রভৃতিকে তাদের প্রকৃতিগত মৌলিক গুণরাশি গন্ধত্বাদি দ্বারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা হিসেবে উপলব্ধি করা যায়- ঠিক সেভাবেই আকাশকেও শব্দগুণের আশ্রয়স্থল বলে একটি সত্তাত্মক পদার্থ হিসেবে উপলব্ধি করা সঙ্গত হবে। ক্ষিতি প্রভৃতির প্রতীতি হয় তাদের গুণ হতে এবং আকাশের অস্তিত্বও অনুভূত হয় তার শব্দগুণ হতে। সুতরাং কার্যকারণে এটিও অবশ্যই একটি ভাব-পদার্থ। অতএব, বাদরায়ণের বক্তব্য হলো- বৌদ্ধমতে আকাশ কোনরূপ ভাববস্তু নয়। কিন্তু এই মত ঠিক নয়। কারণ পৃথিব্যাদির ন্যায় তারও উপলব্ধি হয় (ব্রঃ-২/২/২৪)।

বস্তুসমূহের ক্ষণিকত্ববাদের বিরুদ্ধে আরেকটি আপত্তি হলো, যদি সবকিছুই ক্ষণিক হয়, তাহলে সকল অভিজ্ঞতাকারী অথবা কোন কিছুর ভোক্তাও অবশ্যই ক্ষণিক হবে। কিন্তু ভোক্তা যে ক্ষণিক নয় এবং দীর্ঘতর কাল স্থায়ী, তা এ বিষয় থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, মানুষের অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতি পরবর্তী কালেও থাকে। স্মৃতি একমাত্র সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রেই সম্ভব যার এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে- কারণ যা এক ব্যক্তির অভিজ্ঞতার বিষয় তা অন্য ব্যক্তির স্মৃতির বিষয় হতে পারে না। সুতরাং ভোক্তা এবং স্মর্তা বা স্মরণকারী একই ব্যক্তি হওয়ার জন্য সে অন্ততপক্ষে দুটি মুহূর্তের সঙ্গে যুক্ত থাকে- যা ক্ষণিকত্ববাদকে খণ্ডন করে। তাই বাদরায়ণ বলেন- দ্রষ্টার পূর্বদৃষ্ট পদার্থ স্মরণে থাকে। অতএব ক্ষণিকত্ববাদ যুক্তিযুক্ত নয় (ব্রঃ-২/২/২৫)।

সৌত্রান্তিক বৌদ্ধমত খণ্ডন : সৌত্রান্তিক বৌদ্ধরা বাহ্যার্থবাদী, অর্থাৎ তারা বাহ্যিক বস্তুর ক্ষণিক সত্তার বাস্তবিকতাকে স্বীকার করেন, এবং বিজ্ঞান প্রবাহ তার মধ্যেই নিহিত। বৌদ্ধমতে যা চিরন্তন এবং অপরিবর্তনশীল, তা থেকে কোন কার্য উৎপন্ন হতে পারে না; কারণ যার পরিবর্তন নাই তা কার্য উৎপাদন করতে পারে না। এজন্যই বৌদ্ধরা বলেন যে, কার্য উৎপত্তির পূর্বক্ষণেই কারণটি ধ্বংস হয়ে যায়। যেহেতু বাহ্যবস্তু ক্ষণিক, তাই আমরা যখন কোন বস্তুর অস্তিত্ব টের পাই, তখন কিন্তু তা নষ্ট হয়ে অবিকল সমরূপী বস্তুতে পরিণত হয়েছে। যেমন একটি ঘড়ার অস্তিত্ব টের পাওয়ার সময় হয়তো তা নষ্ট হয়ে সেই উপাদান তথা মৃত্তিকার দ্বারা সমরূপী আর একটি ঘড়ায় পরিণত হয়েছে। এভাবে এ সময়ে যে ঘড়ার অস্তিত্ব অনুভব করছি তা পূর্বের নিরন্বয় বা বিনষ্ট হয়ে যাওয়া ঘড়ার। এটা কী করে হয়, তার উত্তরে সৌত্রান্তিকেরা বলেন- ঘড়া দৃষ্টিগ্রাহ্য বিজ্ঞানে (=ভাবে) স্ব-আকৃতিকে পরিত্যাগ করে বিনষ্ট হয়েছে, সেই বিজ্ঞানময় আকারকে প্রাপ্ত হয়ে তার দ্বারা ঘড়ার সত্তা অনুমিত হয়।

এই যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে বাদরায়ণ বলতে চেয়েছেন- বৌদ্ধমতে, বীজটি ধ্বংস হলে পরই অঙ্কুরের উৎপত্তি হয়। অন্যভাবে বললে, তাদের মতে অসৎ থেকেই সতের উৎপত্তি হয়। কিন্তু যদি তাই হতো, তাহলে বিশেষ কারণের অনুমান নিরর্থক হতো। সেক্ষেত্রে যা কিছু হতে যে-কোন কিছু উৎপন্ন হতে পারতো, কারণ যেহেতু অবিদ্যমান বস্তুর কোনো আকার নেই, তাই সর্বক্ষেত্রেই অনস্তিত্ব অবস্থাটি একইরূপ। একটি আমের আঁটি এবং একটি আপেলের বীজের অনস্তিত্বের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফলে আমরা একটি আমের আঁটি থেকে একটি আপেল গাছের উৎপত্তিকে প্রত্যাশা করতে পারি। আর যদি অনস্তিত্বের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে তাহলে তার ফল হবে এমন যে, একটি আম্র বীজের অনস্তিত্ব একটি আপেলের বীজের অনস্তিত্ব হতে ভিন্ন হবে। সেক্ষেত্রে তারা একটা সুনিশ্চিত নির্দিষ্ট ফলই উৎপন্ন করবে, তাহলে তারা আর অসৎ-বস্তু হবে না- অবশ্যই একটা সদ্-বস্তু হবে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণের আপত্তি হলো- অনস্তিত্বশীল বস্তু হতে ভাববস্তুর উৎপত্তি হয় না। কারণ, এরূপ দৃষ্টান্ত কোথাও নেই (ব্রঃ-২/২/২৬)।

আবার বিনষ্ট বা অবিদ্যমান বস্তু থেকে যদি এভাবে বস্তু উৎপন্ন হতে পারে, তাহলে কেবল কর্মহীনতা থেকেও উদ্দেশ্য পূর্ণ হতো- যেহেতু কারণরূপ কর্মপ্রচেষ্টার কোন প্রয়োজনই হতো না। একইভাবে যারা উদাসীন অর্থাৎ কোনো বিষয় জানতে প্রচেষ্টা করে না তারাও সে বিষয়ে জ্ঞাত হবে। এমনকি চরম মুক্তি বা নির্বাণ লাভ পর্যন্ত চেষ্টা ব্যতীত সম্ভব হতো। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন- যদি অভাববস্তু থেকে ভাববস্তুর উৎপত্তি হতো তাহলে নিশ্চেষ্ট ব্যক্তিও কার্যসিদ্ধি করতে পারতো (ব্রঃ-২/২/২৭)।

যোগাচার বৌদ্ধমত খণ্ডন : বৈভাষিক মতে বাহ্যার্থ ও বিজ্ঞান উভয়কেই মানা হয়েছে। সৌত্রান্তিকেরা বাহ্যার্থকেই মুখ্য বলে মেনেছেন, বিজ্ঞান তার মধ্যেই নিহিত। অন্যদিকে বিজ্ঞানবাদী যোগাচার-মত সৌত্রান্তিকের সম্পূর্ণ বিপরীত। যোগাচার মতে বাহ্য জগতের কোন অস্তিত্বই নাই। ক্ষণিক বিজ্ঞানই বাস্তব পদার্থ; বাহ্য বস্তুসমূহ, জগৎ- তারই বাহ্যিক বিক্ষেপ।

এখানে প্রশ্ন আসে, তবে কি বাহ্য জগৎপ্রপঞ্চ শশশৃঙ্গের ন্যায় সম্পূর্ণ অলীক, অথবা তা কি স্বপ্নদৃষ্ট জগতের ন্যায় মিথ্যা? যদি শশশৃঙ্গের ন্যায় অলীকই হতো তাহলে আমরা এই জগৎপ্রপঞ্চকে উপলব্ধিই করতে পারতাম না। বাহ্য জগৎকে আমরা ইন্দ্রিয়াদির সাহায্যে উপলব্ধি করে থাকি, সুতরাং তাকে সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন বলতে পারি না। এর উত্তরে যোগাচারী বৌদ্ধরা বলতে পারেন যে, তারা কোন বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন নন একথা নিশ্চিতরূপে বলতে পারেন না, তবে তারা চিত্ত-চেতনায় অন্তরে বিজ্ঞানরূপে যা উপলব্ধি করেন তাই তাদের নিকট বাহ্য জগতে বিমূর্তরূপে প্রতিভাত হয়। কিন্তু এই যুক্তি খণ্ডন করে বলা যায়, তাহলে বিজ্ঞানের নিজস্ব লক্ষণটিই প্রমাণ করবে যে, বাহ্য জগতের বস্তুনিচয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণাটি আন্তর জগতের বিজ্ঞান থেকে ভিন্ন। কারণ, মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্য বস্তুনিচয়ের সম্পর্কেই সচেতন, কেউই তার শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা সম্পর্কে সচেতন নয়। বৌদ্ধরা যে বলেন চিত্ত-চৈত্তিক অভিজ্ঞাই ‘বাহ্য কোন কিছুর রূপবিশিষ্ট হয়ে’ প্রতীয়মান হয়, তা থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, বাহ্য জগৎটি বাস্তব। যদি বাহ্যজগৎ বাস্তব না হতো, তাহলে ‘বাহ্য কিছুর ন্যায়’- এই তুলনা অর্থহীন হতো। যেমন, কেউই বলে না যে, দেবদত্ত এক বন্ধ্যা-পুত্রের ন্যায়। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন- বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধদের মতে বিজ্ঞান মাত্রই সত্য, অন্য কিছু নয়। কিন্তু যেহেতু উপলব্ধি হয়, তাই বাহ্য জগৎ অনস্তিত্ব বা অলীক নয় (ব্রঃ-২/২/২৮)।

এক্ষেত্রে যোগাচারী বৌদ্ধরা বলতে পারেন যে, বাহ্য জগতের অভিজ্ঞা স্বপ্নজগতে দৃষ্ট অভিজ্ঞার ন্যায়ই মনে করতে হবে। স্বপ্নে বাহ্যবস্তু থাকে না; তবুও ধারণাগুলি দুটি রূপ ধারণ করে উপস্থিত হয়- একটি জ্ঞাতা এবং অপরটি জ্ঞেয়। বাহ্যজগতের রূপটি একইভাবে বাহ্যবস্তু নিরপেক্ষ। কিন্তু এই যুক্তি খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলতে চেয়েছেন যে, জাগ্রৎ-অবস্থা এবং স্বপ্নাবস্থার মধ্যে পার্থক্য আছে। স্বপ্নে যা দেখা যায়, তা জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞতার দ্বারা বাধিত হয়- দেখা যায় তা মিথ্যা। স্বপ্নবস্থা হলো একপ্রকার স্মৃতি, আর জাগ্রৎ অবস্থা হলো বাস্তব অনুভব। সুতরাং তাকে মিথ্যা বলে অগ্রাহ্য করা যায় না। তাছাড়া, অভিজ্ঞতা ব্যতীত জ্ঞানের অস্তিত্বেও আর প্রমাণ কী? যদি তাই হয়, তাহলে যার সম্পর্কে আমাদের কোন অভিজ্ঞতা হলো তাকে অস্তিত্বশীল বলে গ্রহণ করতে আপত্তি কোথায়? তাই বাদরায়ণ বলেছেন- জাগ্রৎ এবং স্বপ্নাবস্থার চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে বলে, জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞা স্বপ্নাবস্থার অভিজ্ঞার অনুরূপ নয় (ব্রঃ-২/২/২৯)।

যদিও বৌদ্ধমতে বাহ্য বস্তুর নিজের কোন অস্তিত্ব নেই, তবু ঘট-পটাদির বাস্তব বিচিত্র ধারণাগুলির ব্যাখ্যা করা যেতে পারে আমাদের পূর্ব সংস্কার অথবা পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ মানসিক ধারণার (বাসনার) প্রভাবের দ্বারা- যেমন আমাদের জাগ্রৎ অবস্থার ধারণাগুলিই স্বপ্নাবস্থায় বিচিত্ররূপে উপলব্ধ হয়। কিন্তু বাহ্য বস্তুর অভিজ্ঞতা ছাড়া মানসিক ধারণা (সংস্কার) সম্ভব নয়। কিন্তু যোগাচারী বৌদ্ধরা তা অস্বীকার করেন। অথচ অনাদি কার্যকারণ শৃঙ্খলের প্রতীত্য-সমুৎপাদ ধারণার অনুমানকে স্বীকার করলে আমাদেরকে ‘অনবস্থাদোষে’ই উপনীত হতে হবে- এতে সমস্যার কোন সমাধান হবে না। তাই বাদরায়ণ বলেছেন- বস্তুর অভাবে তার বিষয়ে উপলব্ধি সম্ভব নয় এবং উপলব্ধির অভাবে বাসনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না (ব্রঃ-২/২/৩০)।

বাসনা বা মনের সংস্কারের অবশ্যই একটা আশ্রয় থাকা প্রয়োজন। আশ্রয় ছাড়া তারা থাকতে পারে না। কিন্তু ক্ষণিকত্ববাদ সবকিছুরই স্থায়িত্বকে অস্বীকার করে। এমনকি, যেহেতু আলয়-বিজ্ঞান বা অহংজ্ঞানও ক্ষণিক, সেজন্য তাও সংস্কারের আশ্রয় হতে পারে না। কেননা, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যে স্থায়ী সংযোগ রক্ষাকারী যদি কোন সত্তা বর্তমান না থাকে, তাহলে বিশেষ কোন সময়ে এবং স্থানে উদ্ভূত কোন অভিজ্ঞতার স্মৃতি বা সংস্কার থাকা সম্ভবপর নয়। আবার যদি আলয়-বিজ্ঞানকে স্থায়ী কিছু বলে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা হবে ক্ষণিকত্ববাদের বিরুদ্ধ। তাই বাদরায়ণের বক্তব্য হলো- বৌদ্ধমতে বাসনা ও সংস্কারের আশ্রয় অহংও ক্ষণিক। তাই তা সংস্কার বা বাসনার আশ্রয় হতে পারে না (ব্রঃ-২/২/৩১)।

মাধ্যমিক বৌদ্ধমত খণ্ডন : বৌদ্ধদর্শনে বৈভাষিকেরা ক্ষণিকত্ববাদকে এক সমান মেনে জড়, অজড় উভয়ের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন, সৌত্রান্তিকেরা স্বীকার করেছেন শুধু বাহ্য জড় উপাদানের, যোগাচার মেনেছেন মাত্র অভ্যন্তরীণ অ-জড় সত্তাকে; কিন্তু শূন্যবাদী মাধ্যমিক-মতে বাহ্য-অন্তর সমস্ত সত্তার অস্তিত্বজাত জ্ঞান পরস্পর সাপেক্ষ হওয়ায় সবকিছুকেই শূন্য বলে মানা হয়েছে। এজন্য মাধ্যমিক মতবাদকে শূন্যবাদও বলা হয়।

নাগার্জুনের শূন্যবাদী মাধ্যমিক দর্শন খণ্ডনে বাদরায়ণ একটি সূত্রের বেশি লেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। হয়তো তিনি বৌদ্ধ ক্ষণিকত্ববাদকে খণ্ডনের মাধ্যমেই জবাব দেয়া হয়েছে বলে মনে করেছেন। এ প্রেক্ষিতে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে- বৌদ্ধমত যেমন যুক্তি-বিরুদ্ধ তেমনি শাস্ত্র-বিরুদ্ধও বটে। তাই সর্বথা অসঙ্গত হওয়ায় তা অগ্রাহ্য (ব্রঃ-২/২/৩২)।

এই সূত্রটিকে শূন্যবাদের খণ্ডনকারী হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। সেক্ষেত্রে বাদরায়ণের বক্তব্যটি হবে- বৌদ্ধদের শূন্যবাদ সব কিছুরই বিরোধী। তা শ্রুতি, স্মৃতি, প্রত্যক্ষজ্ঞান, অনুমান অথবা অন্য সর্বপ্রকার যথার্থ জ্ঞানেরই বিরোধী। এবং সেজন্যই যাঁরা আত্মকল্যাণ কামনা করেন তাদের সকলের পক্ষেই তা সর্বতোভাবে অশ্রদ্ধেয়।

অদ্বৈতবাদ

ভূমিকা

অদ্বৈতবাদকে উপনিষদীয় চিন্তাধারার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি বলে মনে করা হয়। এই মতবাদের সূত্রপাত শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০ খ্রি.) আবির্ভাবের পূর্বে ঘটলেও এই মতবাদ শঙ্করাচার্যের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শঙ্করাচার্যের গুরু ছিলেন আচার্য গোবিন্দ। গোবিন্দের গুরু গৌড়পাদ যিনি প্রথম উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র ও গীতার প্রতিপাদ্য বিষয়কে অবলম্বন করে একটি যুক্তিসঙ্গত অদ্বৈত মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার বিখ্যাত গৌড়পাদকারিকা রচনা করেন (এটি অদ্বৈতকারিকা বা মাণ্ডুক্যকারিকা নামে প্রসিদ্ধ)। শঙ্করাচার্য বারবার গৌড়পাদ ও তার কারিকার কাছে ঋণ স্বীকার করায় গৌড়পাদকেই তার শিক্ষাগুরু বলতে হয় (যেখানে গোবিন্দ ছিলেন তার দীক্ষাগুরু)। তবে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ কেবলমাত্র তার পূর্বসূরীর পুনরাবৃত্তি ছিলো না, তিনি বেদ, উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র, গীতা ও গৌড়পাদকারিকাকে ভিত্তি করে ও যুক্তিপ্রয়াসের মাধ্যমে এক সুসংহত অদ্বৈত দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অদ্বৈতবাদকে এমন এক যুক্তিভিত্তিক ও মর্যাদাপূর্ণ ভাববাদীয় স্তরে উন্নীত করেছেন যে, বেদান্তের আলোচনা বলতে প্রথমেই তার মতবাদের আলোচনাই মনে পড়ে।

মাণ্ডূক্য উপনিষদ (খ্রিস্টপূর্ব ৫ম – খ্রিস্টীয় ২য় শতক)

মাণ্ডূক্য উপনিষদের দার্শনিক সিদ্ধান্তসমূহ   –

  • ওম, ওঙ্কার, প্রণব একই। ওম-কে ভাঙলে পাওয়া যায় অ, উ এবং ম। অর্থাৎ ওঙ্কার বা প্রণব অকার, উকার ও মকারের সমষ্টি।
  • কোন শব্দ ও তার অর্থ উভয়ই ওঙ্কার। ব্রহ্মকে অভিধান ও অভিধেয় এর সাহায্যেই জানা যায়, তাই ব্রহ্মও ওঙ্কার। কাউকে জানতে হলে তার নামের সাহায্যেই জানতে হয়। এই নাম ও নামের অধিকারী বা নামী এক বা অভিন্ন। ব্রহ্মকে যখন কার্যসমূহের কারণরূপে চিন্তা করা হয় তখনই তিনি বাচ্য বা অভিধেয় বা নামী রূপে প্রতিভাত হতে পারেন। তখন ব্রহ্মকে জানা যায়। কিন্তু কার্যকারণের অতীত চিন্মাত্র বা কেবল চেতনাময় ব্রহ্মকে জানা যায়না, কোন অভিধেয় দিয়ে তাকে প্রকাশ করা যায়না। তাই তখন তিনি ওঙ্কারেরও বাচ্য থাকেন না বা তাকে ওঙ্কার দিয়ে প্রকাশ করা যায়না। (প্রশ্নোপনিষদ প্রভাব)
  • ওঙ্কার দিয়ে কার্যকারণরূপী ব্রহ্মকে জানা যায়, কিন্তু কার্যকারণাতীত চেতনমাত্র ব্রহ্মকে জানা যায়না বা ওঙ্কারের দ্বারা তাকে প্রকাশ করা যায়না। ওঙ্কার তাই ব্রহ্মকে জানার একটি উপায় মাত্র, কিন্তু নিজে পূর্ণাঙ্গভাবে ব্রহ্ম বা ব্রহ্মের প্রকাশক নয়। ওঙ্কার তাই ব্রহ্মের নিকটবর্তী।
  • অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবই ওঙ্কার; এবং আর যা কিছু ত্রিকালের অতীত তাও ওঙ্কারই।
  • যে সমস্ত বিষয় ‘ওম্’ সেগুলোর সবই ব্ৰহ্ম। পূর্বে ওঙ্কারকে মূলত বাচকরূপে ধরে বাচ্য অর্থসমূহের, অর্থাৎ ব্রহ্মের সাথে তার ঐক্য দেখানো হয়েছে, সেক্ষেত্রে ওঙ্কার ব্রহ্মকে প্রকাশ করার জন্য একটি শব্দ মাত্র ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওম কেবল ব্রহ্মপ্রকাশক শব্দ নয়, অর্থাৎ ওম কেবল বাচক নয়, এটি একই সাথে তার বাচ্যও। অর্থাৎ বাচক ওম হলো তার বাচ্য ব্রহ্মের স্বরূপ। এভাবে ওঙ্কার ও ব্রহ্মের ঐক্য প্রতিপাদিত হয়। এখানে ওঙ্কার ব্রহ্মকে প্রকাশ করার জন্য একটি শব্দমাত্র নয়, ওঙ্কার শব্দটি নিজেই ব্রহ্ম। এভাবে বাচ্য ও বাচকের একত্ববােধ হলে বাচ্য ব্রহ্মের সাথে বাচক ওঙ্কার একত্রে বিলীন হয়ে যায়। এখানে “ওঙ্কার” ব্রহ্মের প্রকাশক মাত্র নয়, “ওঙ্কার” নিজেই ব্রহ্মস্বরূপ।
  • পরোক্ষভাবে যে ব্রহ্ম সর্বস্বরূপ বা সবকিছু, প্রত্যক্ষভাবে সেই ব্রহ্মই আত্মা।
  • আত্মা ব্রহ্ম, এই আত্মা চতুষ্পাৎ, অর্থাৎ চারটি পাদ বা অংশবিশিষ্ট। উপনিষদ অনুসারে ব্রহ্মকে জানার অর্থই ব্রহ্মকে লাভ করা বা মোক্ষলাভ করা। “পাদ” শব্দের অর্থ হচ্ছে যে উপায়ে ব্রহ্মকে পাওয়া যায় বা জানা যায়। এই অর্থে প্রথম তিন পাদ হচ্ছে ব্রহ্মকে জানার উপায়। আবার যাকে পাওয়া যায় তিনিও পাদ শব্দেরই বাচ্য। আর বাচ্য ও বাচক যেহেতু একরূপ তাই ব্রহ্ম নিজেই চতুর্থ পাদ। সব মিলে ব্রহ্ম চারটি পাদ বিশিষ্ট।
  • এই চারটি পাদের তিনটি প্রকৃতপক্ষে আত্মার অংশ যাদের সাহায্যে আত্মা (১) বাহ্যজগৎ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ, (২) অন্তর্জগৎ সম্পর্কে প্রজ্ঞালাভ ও (৩) সুষুপ্তির সময় আনন্দলাভ করে, কিন্তু চতুর্থটি লোকাতীত ব্রহ্মই। আত্মার এই তিনটি অংশের জন্য আমার নিজেকে আমি মনে হয়, যেখানে আমার এই আত্মা বা আত্ম বা আমিত্ব ব্রহ্মেরই বিবর্ত বা অবভাস বা মায়া মাত্র। আত্মার এই তিনটি অংশ ব্রহ্ম বা ওঙ্কারের তিনটি মাত্রা (অ, উ এবং ম) নির্দেশক। তবে এই ওঙ্কারে তিনটি মাত্রাই আছে, তা আত্মার তিনটি পাদকেই নির্দেশ করে। ওঙ্কার দ্বারা আত্মার চতুর্থ পাদকে নির্দেশ করা যায়না, যা হল তুরীয় বা সমাধিলব্ধ বা লোকাতীত ব্রহ্ম, কোন শব্দের দ্বারাই এই ব্রহ্মের এই অংশকে প্রকাশ করা যায়না। চতুর্থ পাদকে প্রকাশ করতে পারেনা বলে ওঙ্কার আংশিক ব্রহ্মস্বরূপ, পূর্ণাঙ্গ ব্রহ্মস্বরূপ নয়। তাই ওঙ্কার পূর্ণাঙ্গভাবে ব্রহ্মের প্রকাশক নয়, ব্রহ্মের নিকটবর্তী। আত্মার তিনটি অংশকে প্রকাশ করে এই ওঙ্কার নিজেকে ব্রহ্মের অংশ হিসেবে জ্ঞানদান করে বলে এই ওঙ্কার একই সাথে ব্রহ্মকে জানার উপায়ও বটে। ব্রহ্মের চতুর্থ অংশকে জানা যায়না বলে ওঙ্কারও পূর্ণাঙ্গ ব্রহ্ম নয়, এটি আংশিক ব্রহ্ম, কারণ ওঙ্কারে ব্রহ্মের চারটি অংশের তিনটি প্রতিধ্বনিত হয়, অতিরিক্ত চতুর্থ অংশটি প্রকাশিত হয়না, কারণ তাকে প্রকাশ করাই অসম্ভব। সেই অংশটি তুরীয় বা সমাধিলব্ধ বা ভাবসম্ভব বা লোকাতীত।
  • প্রথম তিনটি পাদ আত্মারই অংশ। আত্মার এই পাদগুলোর দ্বারা আত্মা বাহ্যজগৎ, অন্তরের বাসনা বা সংস্কাররূপ প্রজ্ঞা ও সুষুপ্তাস্থায় আনন্দ লাভ করে। এই আত্মাই ব্রহ্ম। তাই আমরা আমাদের আত্মার দ্বারা যে এই জ্ঞান, প্রজ্ঞা, আনন্দ লাভ করি তা আসলে ব্রহ্মই লাভ করে থাকে। আত্মার এই পাদগুলোর সাথে ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন থাকে। কিন্তু ব্রহ্মকে জানতে হলে প্রথমে আত্মার পাদকে জানতে হয়, এরপর এগুলো যে অবভাস আমার আত্মার অবভাস বা বিভ্রম বা বিবর্ত তা অনুধাবন করতে হয়।
  • আত্মার যে পাদ বা অংশ বহির্বিষয়ে বা বাহ্য বস্তুর বিষয়ে অনুভূতিসম্পন্ন, ব্যক্তির জাগ্রত অবস্থাতেই বাহ্যজগৎ সম্পর্কিত জ্ঞানলাভ বা জ্ঞানের ভোগ করে তাই আত্মার প্রথম পাদ। এর অপর নাম বৈশ্বানর। দশটি ইন্দ্রিয়; পাঁচটি প্রাণ; মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও চিত্ত – সব মিলে এর ১৯টি মুখ। ছান্দোগ্য উপনিষদে ব্রহ্মের যে ৭টি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে, এই সাত অঙ্গ আসলে ব্রহ্মের এই পাদেরই অঙ্গ। স্বর্গ এর মাথা, সূর্য এর চোখ, বায়ু এর প্রাণ, আকাশ এর শরীর, জল এর মূত্রাশয়, পৃথিবী এর পা, তাকে আহ্বান করার অগ্নি হলো এর মুখ। এই সাতটি হলো এই পাদের অঙ্গ। এই পাদের আরেক নাম বৈশ্বানর। বৈশ্বানর দ্বারা নিখিল-নরস্বরূপ, সর্বজীবাত্মা, বিরাটকে বোঝানো হয়। এখানে জাগ্রত অবস্থায় অবস্থিত বিশ্বের বা ব্যষ্টি প্রাণীর অবস্থা হলো বৈশ্বানর বা বিরাট। এক্ষত্রে বিশ্ব ও বৈশ্বানর এক। এই বৈশ্বানর বা বিরাট স্থুল বিষয় ভোগ অরে, তাই এই প্রথম পাদ হলো বৈশ্বানর। প্রপঞ্চের মিথ্যাত্ববােধকালে, অর্থাৎ যখন সব বাহ্যবস্তু, আত্মা, ঘটনাকে মিথ্যা বা অবভাস বা মায়া বলে বোধের সঞ্চার ঘটে, তখন এই বিশ্বেস্বররূপ বৈশ্বানরই প্রথমে লীন হয়, বা তার অনস্তিত্বের বোধ হয়। তাই এটাই প্রথম পাদ।
  • আত্মার যে পাদ স্বপ্নাবস্থাতেই অন্তঃস্থ মনের বাসনা বা সংস্কাররূপ প্রজ্ঞাকে জানেন বা প্রজ্ঞাকে ভোগ করেন তা হলো আত্মার দ্বিতীয় পাদ (বৃহদারোণ্যক উপনিষদেও এর কথা আছে)। এই পাদকে তৈজস বলা হয়েছে ও একে ব্রহ্মের সাথে অভেদ বা অভিন্ন কল্পনা করা হয়েছে। এখানে তৈজস দ্বারা স্বপ্নাবস্থায় পাওয়া ব্যষ্টি প্রাণীর কথা বোঝানো হচ্ছে। স্বপ্নাবস্থায় দেখা বিষয়গুলো জাগ্রত অবস্থায় দেখা বিষয়ের মত হয় না। প্রকৃতপক্ষে এটি হল বিষয়শূন্য ও কেবল প্রকাশস্বরূপ। এই বিষয়শূন্য ও কেবল প্রকাশস্বরূপ প্রজ্ঞার যিনি আশ্রয় সেই ব্রহ্ম হলো আত্মার দ্বিতীয় পাদ। এই তৈজস ও হিরণ্যগর্ভের ঐক্য রয়েছে। এরও সাত অঙ্গ, ঊনিশ মুখ।
  • আত্মার যে অংশের কারণে ব্যক্তি তার ঘুমন্ত অবস্থায় বা সুষুপ্তিতে বিশেষরকমের আনন্দ ভোগ করতে পারেন তা হলো আত্মার তৃতীয় পাদ। ঘুমন্ত ব্যক্তি যে সময়ে কোনও কাম্য বস্তু প্রার্থনা করে না এবং কোনও স্বপ্ন দেখে না, তাই সুষুপ্তি। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ মতে, জাগরণ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থাই নিদ্রা; জীব তিন অবস্থাতেই নিদ্রিত। কারণ কোন অবস্থাতেই আত্মা ব্রহ্মকে অনুভব করতে পারে না। জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থায় দোষ আরও বেশি কারণ তাতে ব্রহ্মকে সঠিকভাবে না অনুভব করে ভুলভাবে অনুভব করা হয়। এভাবে চিরসুপ্ত জীবেরও প্রতিদিনকার স্বপ্ন ও সুষুপ্তিতে একটি বিশেষত্ব আছে। জাগরণ ও স্বপ্নাবস্থায় জগতকে ব্রহ্মের থেকে, আত্মাকে পরমাত্মার থেকে আলাদা বলে মনে হয়, এটাই মনোবিক্ষেপ। এজন্যই জগৎ ও ব্রহ্মের এবং আত্মা ও পরমাত্মার দ্বৈততাকে সত্য মনে হয়। কিন্তু সুষুপ্ত অবস্থায় সেই অনুভূতি থাকেনা। এখানে তাই আত্মা পরমাত্মার সাথে একীভূত হয়ে যায়। তাই এই অবস্থায় আত্মা অ-বিক্ষিপ্ত বা বিক্ষেপ-রহিত বা একীভূত থাকে। কিন্তু এই অবস্থায় পুরোপুরিভাবে দ্বৈততা লীন হয়না, কারণ ঘুম ভাঙলে পুনরায় দ্বৈত জগতের উৎপত্তি হয়। সুষুপ্তাভিমানী প্রাজ্ঞ থেকে স্বপ্ন ও জাগরণ উৎপন্ন হয়। এখানে এই প্রাজ্ঞ (অর্থাৎ জীব) ও ঈশ্বরের অভেদ দেখা যায়। এই প্রাজ্ঞই সর্বেশ্বর, ইনি সর্বজ্ঞ, ইনি অন্তর্যামী, ইনি সকলের উপাদানকারণ; তাই ইনিই জগতের মূল উপাদানগুলোর (ভূতসমূহ) উৎপত্তি ও বিলয়-স্থান। এখানে অধিবিদ্যিক ঈশ্বরের সাথে এই প্রাজ্ঞের অভেদ দেখা যাচ্ছে।
  • আত্মার যে অংশকে অন্তরে অনুভব করা যায়না, বাহ্য বিষয়ে অনুভব করা যায়না, স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যে অনুভব করা যায়না, প্রাজ্ঞ নন, সর্ববিষয়ের জ্ঞাতা নন, যাকে শব্দের দ্বারা কোন অভিধায় ভূষিত করা যায়না, যাকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে দেখা যায়না, অনুমান করা যায়না, চিন্তা করা যায়না, অন্য কোন কিছুর সাথে বিক্রিয়া বা মিথোস্ক্রিয়া করেনা তাই হলো আত্মার চতুর্থ বা তুরীয় পাদ। এই পাদ কেবল আত্মা প্রতীতিতে গম্য, কেননা সব অবস্থায় একই আত্মা আছেন এই ধারণার দ্বারাই তাকে অনুসন্ধান করা যায়, তিনি জাগরণ সহ সকল প্রপঞ্চের বিশ্রামস্থান, তিনি মঙ্গলময় ও তিনি অদ্বিতীয় কেননা সব এক, জগৎ ও ব্রহ্ম, আত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন নয়। তাকে তুরীয় বলা হয় কারণ সমাধিমগ্ন ও ভাববিহ্বল অবস্থায় তাকে ধারণা করা যায়। তিনি লোকাতীত বা লোকের অতীত। ভ্রান্তিবশত রজ্জুকে (রশি) সাপ, দণ্ড এবং জলধারা বলে মনে হলে, সাপ, দণ্ড ও জলধারা – এই তিনটির সাথে রজ্জুকে যে অর্থে চতুর্থ বলা যায়, সেই অর্থেই অবিদ্যা-কল্পিত তিনটি পাদের সাথে অবিচ্ছেদ্য পরমাত্মাকে তুরীয় (চতুর্থ) বলা হয়। প্রথম তিনটি পাদে আত্মার বিভিন্ন পাদের সাহায্যে আত্মার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে, আমরা আত্মার সাহায্যে যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আনন্দ লাভ করি তার কথা বলা হয়েছে। এগুলো অসর্পভূত রজ্জুতে সাপের ধারণা আরোপ করার মতো অধ্যারোপ, যার অর্থ বস্তুতে অবস্তু আরোপ। জ্ঞানের সাহায্যে ভ্রম দূর হলে রজ্জুর বিবর্ত (বিভ্রম রূপ) সর্প যেরকম রজ্জুমাত্ররূপে মনে হয়, সেরকম যে বিচারের ফলে জগদ্‌জ্ঞান (জগৎ সম্পর্কে বিভ্রম বা অবভাস) বিনষ্ট হয়ে ব্রহ্মের বিবর্ত জগৎ ব্রহ্মরূপ বলে মনে হয় তা হলো অপবাদ। চতুর্থ পাদে এভাবে প্রথম তিন পাদের অপবাদ হয়।
  • প্রথম পাদ বৈশ্বানর এবং ওঙ্কারের প্রথম মাত্রা “অ” বা অকার উভয়ই ব্যাপক। বৈশ্বানর ব্যাপক কারণ বাহ্যজগৎ ব্যাপক। এরা উভয়ই আদি। বাহ্যজগৎ ব্রহ্মের থেকে উদ্ভব বা বিবর্তের দিক থেকে আদি আর অ ওঙ্কার শব্দে আদি। যে উপাসক এটি জানেন, তিনি সমুদয় কাম্য বিষয় লাভ করেন, এবং সর্বাগ্রণী বা সর্বপ্রথম হয়ে থাকেন। স্বপ্নাবস্থায় প্রাপ্ত বিষয় বাহ্যবিষয়ের মত হয়না, স্বপ্নাবস্থায় দেখা বিষয় বা তৈজস আসলে বিষয়শূণ্য বা কেবল প্রকাশস্বরূপ, এর জ্ঞান তাই প্রজ্ঞা। এই জ্ঞান তাই বাহ্যজগতের বিষয় বা বৈশ্বানরের জ্ঞানের থেকে উৎকৃষ্ট। অন্যদিকে উকার অকারের থেকে উৎকৃষ্ট। আবার তৈজসের স্থান বৈশ্বানর ও প্রাজ্ঞের মধ্যবর্তী, অন্যদিকে ওঙ্কারে উকারের স্থান অকার ও মকারের মধ্যবর্তী, তাই আত্মার তৈজস-পাদ হলো ওঙ্কারের দ্বিতীয় মাত্রা উকার। যিনি এটি জানেন ও উপাসনা করেন তিনি বিজ্ঞানপ্রবাহকে (এই বিজ্ঞান অর্থ চেতনা) উৎকৃষ্ট বা বর্ধিত করে থাকেন এবং শত্ৰু ও মিত্রের কাছে তুল্যরূপ হন। তার বংশে অব্রহ্মজ্ঞের জন্ম হয় না। সুষুপ্তিতে আত্মার বৈশ্বানর ও তৈজস-পাদ লোপ পায় এবং সুষুপ্তি ভাঙলে পুনরায় বৈশ্বানর ও তৈজস-পাদের উদ্ভব ঘটে। এভাবে সুষুপ্তাভিমানী প্রাজ্ঞ-পাদের দ্বারা বৈশ্বানর ও তৈজস-পাদ পরিমিত হয়। এদিকে ওঙ্কার বা ওম শব্দটির সমাপ্তি হয় মকারের দ্বারা, আবার একবার ওম বলার পর যখন পুনরায় ওম উচ্চারণ করা হয় তখন নতুন অকার ও উকারের আগে মকারই আসে। এভাবে ওঙ্কারের অকার ও উকারকে মকার বাউন্ডারি হিসেবে পরিমিত করে। এসব কারণে প্রাজ্ঞ ও মকার উভয়ই পরিমাপক ও বিলয়ের আধার। তাই আত্মার তৃতীয় পাদ হলো ওঙ্কারের মকার। যিনি এটি জানেন, বা যে উপাসক এরকম উপাসনা করেন, তিনি সমস্ত জগতের পরিমাপক হন অর্থাৎ জগতের যাথাত্ম্য জানেন, যে ব্রহ্ম জগতের আশ্রয়স্বরূপ ও কারণস্বরূপ, তার সাথে তিনি নিজেকে অভেদ কল্পনা করেন। এভাবে আত্মার তিনটি পাদ ও ওঙ্কারের তিনটি মাত্রার একত্ব বা অভেদের জ্ঞান লাভ করার পর অবশেষে ব্যক্তির কাছে মাত্রাহীন ওঙ্কার চতুর্থ বা তুরীয় (সমাধিলব্ধ বা লোকাতীত), ব্যবহারাতীত বা প্রকাশ-অযোগ্য, জগতের নিবৃত্তিস্থল, মঙ্গলময় বা পরমানন্দস্বরূপ, এক বা অদ্বিতীয় আত্মরূপে পর্যবসিত হয়। যিনি এটা জানেন, তিনি স্বয়ং পরমাত্মায় প্রবেশ করেন। এখানে মাত্রাহীন ওঙ্কার বলতে এখানে ব্রহ্মের সেই অংশকে বোঝানো হচ্ছে যাকে ওঙ্কার বা ওঙ্কারের কোন মাত্রার দ্বারা প্রকাশ করা যায়না।

মাণ্ডূক্য উপনিষদের অনুবাদ পড়তে এখানে যান।

গৌড়পাদ (৫০০ খ্রি.)

পরিচয় 

খ্রিষ্টীয় ৫ম শতাব্দীকে গৌড়পাদের সময়কাল বলে ধারণা করা হয়, এবং তিনি ছিলেন নর্মদাতীরস্থ স্থানের অধিবাসী। নর্মদা নদী ভারতের মধ্যপ্রদেশ, মালব ও গুজরাট পর্যন্ত বহমান হলেও ঠিক কোন জায়গায় গৌড়পাদের নিবাস ছিলো তা নিশ্চিত করা যায়নি। গৌড়পাদ মাণ্ডুক্য উপনিষদকে ভিত্তি করে বিখ্যাত আগমশাস্ত্র বা মান্ডুক্যকারিকা রচনা করেন। ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকার ওপরেও গৌড়পাদের একটি ক্ষুদ্র টীকা আছে বলে জানা যায়। তবে তার মহান কীর্তি হলো আগমশাস্ত্র বা মাণ্ডুক্য-কারিকা। মাণ্ডুক্য-কারিকার চারটি অধ্যায় যার প্রথম অধ্যায়টিই শুধু মাণ্ডুক্য উপনিষদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, আর বাকি তিনটি অধ্যায়ের মাধ্যমে গৌড়পাদ স্বীয় দার্শনিক মত প্রকাশ করেছেন। মাণ্ডুক্য উপনিষদটি একটি অতি ক্ষুদ্র বারোটি মন্ত্রে পঁচিশ পঙক্তির উপনিষদ। গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য-কারিকার প্রথম অধ্যায় আগম প্রকরণে মাণ্ডুক্য উপনিষদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায় বৈতথ্য প্রকরণে জগতের মিথ্যাত্বের প্রমাণ রয়েছে। তৃতীয় অধ্যায় অদ্বৈত প্রকরণে জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য সম্পর্কীয় আলোচনা রয়েছে। আর চতুর্থ অধ্যায় অলাতশান্তি প্রকরণে মায়ার কারণে যে জগৎ সত্য বলে প্রতিভাত হয় তারই আলোচনা রয়েছে।

পন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ‘গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য উপনিষদের ওপর কারিকা রচনা প্রমাণ করে যে তিনি উপনিষদকে তার দর্শনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত মনে করতেন কিন্তু সেই সঙ্গে বুদ্ধও যে তার নিকট সমান মর্যাদা ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন এ কথা তিনি গোপন করতে চাননি।’ অর্থাৎ এখানে বৌদ্ধ প্রভাব স্পষ্ট। রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেন- ‘চতুর্থ অধ্যায়ের (“আলাতশান্তি-প্রকরণ” যা কি-না বস্তুত বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদের এক স্বতন্ত্র গ্রন্থ) প্রারম্ভিক কারিকাতেই তিনি বলেছেন : “আমি দ্বিপদাম্বরকে (=মনুষ্যশ্রেষ্ঠ) প্রণাম করি, যিনি তার আকাশ-সদৃশ বিস্তৃত জ্ঞানের দ্বারা জেনেছেন (সম্বুদ্ধ করেছেন) যে, সকল ধর্মই (= ভাব, বস্তুসমূহ) আকাশসম শূন্য।” এই প্রকরণের ১৯তম কারিকায় পুনরায় বুদ্ধের নাম নেওয়া হয়েছে (“সর্বথা বুদ্ধৈরজাতিঃ পরিদীপিতা।”) এ ছাড়াও তিনি বুদ্ধের উপদেশের কথা দ্বিতীয় কারিকায় (৪/২) আলোচনা করেছেন। ৪২তম কারিকায় (৪/৪২) তিনি আবার বুদ্ধ এবং ৯০তম কারিকায় অগ্রযানের (=মহাযান) নাম গ্রহণ করেছেন। ৯৮ ও ৯৯তম কারিকায় (নাগার্জুনের ন্যায়) বুদ্ধের নাম করে বলেছেন যে বস্তুসমূহ স্বভাবত শুদ্ধ ও অনাবৃত; বুদ্ধ তাকে অধিক স্পষ্টভাবে জানেন। অন্তিম কারিকায় (৪/১০০) আবার তিনি পর্যায়ক্রমে বুদ্ধের বন্দনা করে গ্রন্থ সমাপ্ত করেছেন।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-২৫৫)। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, রাহুল সাংকৃত্যায়ন উদ্ধৃত ‘বুদ্ধ’ শব্দটিকে কারিকার তর্জমা বা ব্যাখ্যায় বেদান্তবাদীরা কিন্তু প্রাজ্ঞ বা জ্ঞানী অর্থেই ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ যেমন, অন্তিম কারিকাটি হলো- এই তত্ত্ব ধারণা করা কঠিন। এই তত্ত্ব সুগভীর, অনাদি, সদা অপরিবর্তনীয়, শুদ্ধ এবং অদ্বৈত। আমি এই তত্ত্বকে বোঝার (বুদধ্বা) জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছি। আমি তাকে নমস্কার করি। (আগমশাস্ত্র-৪/১০০)।।

কারিকা রচনার জন্য মাণ্ডুক্য উপনিষদকেই নির্বাচন করার পেছনে গৌড়পাদের কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য ছিলো বলে মনে করা হয়; যেমন- প্রথমত, মাণ্ডুক্য একটি অতি ক্ষুদ্র বারো মন্ত্রে পঁচিশ পঙক্তির উপনিষদ হওয়ায় সেখানে তার নিজের মতকে অধিক স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করা সহজসাধ্য ছিলো। দ্বিতীয়ত, মাণ্ডুক্যে মাত্র ‘ওম্’ এবং তার চারটি অক্ষর দ্বারা আত্মার (=জীবের) জাগ্রতাদি চার অবস্থার (=চতুর্বর্গ) বর্ণনা করা হয়েছে, এটা এমনই একটা বিষয়, যাতে তার মাধ্যমিক-যোগাচারী বৌদ্ধমত বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না। যেমন, মাণ্ডুক্য-উপনিষদে বলা হয়েছে- সবকিছুই ‘ওম্’ অক্ষরাত্মক। এই যে সমুদয় জগৎ, যা আমাদের ইন্দ্রিয় চোখ দিয়ে দেখা যাচ্ছে, আবার ইন্দ্রিয়ের অগোচরেও যে জগৎ রয়েছে, সবই ‘ওম্’ এই অক্ষরের স্বরূপ। ‘ওম্’ এই অক্ষরের মধ্যে যে রূপ আছে, এইসব জগতের মধ্যেও সেই একই রূপ। এখানে তারই ব্যাখ্যা। এই জগৎ তিনটি কালের অধীন- অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। এই তিন কালই ওঙ্কার। আবার এই তিন কালের বাইরে যে অনন্ত কাল আছে, তাও ওঙ্কার। ওঙ্কারই সব। (‘ওম্’- পরমাত্মা বা ব্রহ্ম-ও প্রতীক শব্দ) (মাণ্ডুক্য-১)।।  তিনি পরিসীমার মধ্যেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি বৃহৎ। তাই তিনি ব্রহ্ম। এই আত্মা ব্রহ্ম। সবই ব্রহ্ম। এই আত্মার চারটি অংশ জীবদেহে অবস্থান করে তাকে চালনা করছেন। সেই চারটি অংশকে বলা হয়েছে চতুষ্পাদ। (মাণ্ডুক্য-২)।।

সেই চারটি অংশ বা অবস্থা হলো জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এবং তূরীয়। আত্মা জীবের এই চার অবস্থার মধ্যে থেকে কী কী কাজ করছেন সেই সম্পর্কে মাণ্ডুক্য-উপনিষদে তার বর্ণনায় বলা হয়েছে- জীবের যখন জাগ্রত অবস্থা, সব ইন্দ্রিয় সজাগ অর্থাৎ অতন্দ্র, আত্মা তখন বাইরের বিষয়-জ্ঞানে মত্ত। বাইরের বিষয় হলো- শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ। জীব তা থেকেই জ্ঞানসঞ্চয় করে। জ্ঞানই হলো আত্মার খাদ্য। আত্মা তখন সাতটি অঙ্গ, আর উনিশটি মুখ দিয়ে বিশ্বের যাবতীয় স্থূল পদার্থ অনুভব করেন, ভোগ করেন। সাতটি অঙ্গ আর উনিশটি মুখ হলো মাথা, দুই চোখ, প্রাণ, মূত্রাশয় আর দুই পা। পরমপুরুষ আত্মার মাথা হলো দ্যুলোক (স্বর্গলোক), সূর্য-চন্দ্র দুই চোখ, বায়ু প্রাণ, জলাশয় মূত্রাশয়, আর পৃথিবী দুই পা। উনিশটি মুখ হলো- দশটি ইন্দ্রিয় (পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়), পাঁচটি প্রাণ আর বাকি চারটি হলো মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহঙ্কার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে, কোনটাই এর বাইরে নয়। তাই জীব যখন জাগ্রত অবস্থায় থাকে তখন প্রতিটি বস্তুর জ্ঞান নিয়ে আত্মা হন বৈশ্বানর। সর্বব্যাপী আত্মার এটি হলো প্রথম পাদ বা অবস্থা। (মাণ্ডুক্য-৩)।।  আত্মার দ্বিতীয় পাদ বা স্বপ্নময় অবস্থাটি হলো তৈজস। বাইরের জগৎ তখন তার পুষ্টিসাধন করে না, খোরাক যোগায় অন্তর্জগৎ। তাই তৈজস আত্মাকে বলা হয় প্রবিবিক্তভুক অর্থাৎ সূক্ষ্মবস্তুকে আশ্রয় করে আত্মা তখন অন্তরে থেকে অন্তরপ্রজ্ঞ- অন্তর জগতের জ্ঞানে জ্ঞানী। মানুষ কতো না কামনা-ধারণা-বাসনা-কল্পনা নিয়ে দিন কাটায়। যার হয়তো অনেক কিছুই সে প্রত্যক্ষ ভোগ করতে পারে না। ঘুমন্ত অবস্থায় সেগুলো স্বপ্নজগতে ভেসে ওঠে। আর এই সাত অঙ্গ, উনিশ মুখ বাইরে যদিও ঘুমোচ্ছে, ভেতরে কিন্তু সক্রিয়ভাবে থেকে সেগুলি উপভোগ করছে। (মাণ্ডুক্য-৪)।।  মানুষ যখন কোন কামনা না নিয়ে ঘুমোয়, ঘুমন্ত অবস্থায় কোন স্বপ্ন না দেখে বেশ একটি পরিচ্ছন্ন ঘুমের মধ্যে ডুবে থাকে, তখন তার সেই ঘুমন্ত অবস্থাকে বলে সুষুপ্ত অবস্থা। এই সুষুপ্তির মধ্যে এখানে কোন বিচ্ছেদ নেই, সব বিষয়ের সব জ্ঞান একসঙ্গে মিশে গিয়ে ঘন এক হয়ে যায়, আনন্দঘন- জ্ঞান এবং আনন্দকে উপভোগ করে আত্মা এখানে প্রাজ্ঞ হয়ে যান। এই প্রাজ্ঞ আত্মাই হলো তার তৃতীয় পাদ বা অবস্থা। আত্মার তৃতীয় অবস্থা হলো প্রাজ্ঞ, চেতোমুখ। আনন্দই তার খাদ্য। জ্ঞানমুখ। সুষুপ্তিকালে প্রাজ্ঞ আত্মা এই আনন্দকে আশ্রয় করে আনন্দময় হয়ে থাকেন। (মাণ্ডুক্য-৫)।।  তৃতীয় ক্ষেত্রে এই যে প্রাজ্ঞ-আত্মা, ইনিই হলেন সর্বেশ্বর- সকলের প্রভু, স্রষ্টা, নিয়ন্তা- সর্বশক্তিমান। ইনিই সর্বজ্ঞ- বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কিছু নেই, যা এর অগোচর। ইনিই অন্তর্যামী- যেমন বাইরের জগতে ইনি আছেন, তেমনি দেহ-জগতের ভেতরে থেকে আমাদের পরিচালনা করছেন। যাবতীয় বস্তুর ইনিই যেমন উৎপত্তিস্থল, তেমনি আবার লয়স্থান। (মাণ্ডুক্য-৬)।।  (মানুষের ক্ষেত্রে যে অবস্থা মৃত্যুর নামান্তর, সাধকের কাছে সে অবস্থা হলো তুরীয় অবস্থা।) এই চতুর্থ পাদে তুরীয় অবস্থাতেই সাধকের সমাধি। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনে জীব শিব- শান্ত, অদ্বৈত- এক। এখানে আর কোন ভেদাভেদ নেই। ‘আমি’-‘তুমি’-‘সে’- এসবের বালাই নেই। সাধকের এখানে একটাই অনুভূতি, একটাই পরিচয়- ‘আমিই পরমাত্মা, পরমাত্মাই আমি’। কিন্তু এই যে অদ্বৈত-আত্মা, বিশাল অখণ্ড সত্তা, আত্মার আগের যে রূপ- অন্তঃপ্রজ্ঞ, বহিঃপ্রজ্ঞ, প্রজ্ঞানঘন প্রজ্ঞ- এসবের কোন মাত্রাই সেখানে নেই। তাকে দেখা যায় না- অদৃশ্য, ব্যবহার করা যায় না- অব্যবহার্য, কোনভাবে তাকে চিহ্নিত করা যায় না- অচিন্তনীয়, অকল্পনীয়। কোন বিশেষণ তার নেই, কোন গুণও নেই- নির্গুণ। (মাণ্ডুক্য-৭)।।

তার মানে হলো, যখন তিনি মাত্রাযুক্ত অর্থাৎ উপাধি নিয়ে, গুণ নিয়ে তখন তিনি সগুণ, সবিশেষ। আবার যখন মাত্রাহীন, উপাধিহীন, গুণহীন, তখন তিনি নির্গুণ বা নির্বিশেষ ব্রহ্ম। রাহুল সাংকৃত্যায়ন মনে করেন, মাণ্ডুক্য-উপনিষদে আত্মার প্রতি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে (নির্গুণ ব্রহ্মে) যে সমস্ত বিশেষণ, যেমন- অ-দৃষ্ট, অ-ব্যবহার্য, অ-গ্রাহ্য, অ-লক্ষণ, অ-চিন্তা- প্রভৃতি আসে, তা নাগার্জুনের তত্ত্বের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারিকা রচনায় গৌড়পাদের চেষ্টা ছিলো বৌদ্ধদর্শনের প্রাধান্য বজায় রেখে তাকে উপনিষদের সঙ্গে সংযুক্ত করা। শূন্যবাদের মধ্যে পড়ে ক্ষণিকতা-অক্ষণিকতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার প্রয়োজন তার ছিলো না। তাই গৌড়পাদের কারিকা রচনার জন্য মাণ্ডুক্য-উপনিষদই বেছে নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।

রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ‘শঙ্করও বৌদ্ধদার্শনিক মতকে পুরোপুরি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তা তিনি সম্পূর্ণত উপনিষদীয় বস্তুতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আবার একই সঙ্গে তাকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে চেয়েছেন, এইজন্য তাকে যোগাচারের বিজ্ঞানবাদকে স্বীকার করে নিতে হয়েছিল, কিন্তু বিজ্ঞান (=চিত্ত)-তত্ত্বের ঘোষণা করতে গিয়ে তাকে ক্ষণিকতা-অ-ক্ষণিকতার মধ্যে একটি বেছে নিতে হয়েছিল; শঙ্কর অ-ক্ষণিক (=নিত্য) চিত্ত-তত্ত্বকে স্বীকার করে নিজেকে শুদ্ধ ব্রাহ্মণ দার্শনিকরূপে প্রমাণিত করার প্রযত্ন করেছিলেন।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-২৫৬)।

দার্শনিক মত

গৌড়পাদ মনে করতেন, একটি অদ্বয় (বিজ্ঞান) আছে, জগৎ মায়া এবং ভ্রম মাত্র, এবং আত্মা অস্তিত্বহীন, কেউই জন্ম-মৃত্যু-কর্মফল ভোগ করে না। মাণ্ডুক্য-কারিকায় গৌড়পাদ বলেছেন- একটি জ্বলন্ত মশালকে ঘোরালে তার আলোর রেখা কখনো সোজা, কখনো বাঁকা আবার কখনো বা অন্য কিছু বলে মনে হয় (যদিও প্রকৃতপক্ষে আলোকরশ্মি সবসময় সোজা)। ঠিক একইভাবে চৈতন্যের পরিবর্তনও প্রতিভাত হয়- একই চৈতন্য (=বিজ্ঞান) কখনো জ্ঞাতা, কখনো জ্ঞেয়, কখনো কারণ, কখনো কার্য (যদিও চৈতন্য সতত অপরিবর্তিত)।- (আগমশাস্ত্র-৪/৪৭)। ‘ঘূর্ণায়মান বস্তুকে যেমন সোজা ও বক্র দুইভাবেই দেখা যায় তেমনি বিজ্ঞানও (=ভাব) ঐ রকম দ্রষ্টা এবং দৃশ্যকে দেখে।’- গৌড়পাদের এই অদ্বয় মত যে শঙ্করের ব্রহ্ম অপেক্ষা নাগার্জুনের বৌদ্ধ শূন্যবাদেরই অধিক নিকটবর্তী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও গৌড়পাদের যে দার্শনিক মতকে ভিত্তি করে মূলত শঙ্করাচার্য তার দর্শনের প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন, সংক্ষেপে সেই মত নিম্নরূপ। যেমন-

জগৎ মিথ্যা : গৌড়পাদ জগৎকে মূলত মিথ্যা বলেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মাণ্ডুক্য-কারিকায় বলা হয়েছে- স্বপ্ন ও জাগ্রৎ এই উভয় অবস্থাতেই জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কটি একই থাকে। এই দুই অবস্থায় যেসব বস্তুর অভিজ্ঞতা হয় সেই বস্তুগুলি অভিন্ন। এই কারণেই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থার বস্তুকেই মিথ্যা বলে মনে করেন। (আগমশাস্ত্র-২/৫)।।  স্বতন্ত্রভাবেই হোক বা কারও মাধ্যমেই হোক, কোন কিছুরই জন্ম হয় না। কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকুক বা নাই থাকুক, অথবা যার অস্তিত্ব আছেও বটে আবার নেইও বটে- যাই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই কোন বস্তুর জন্ম হয় না। (আগমশাস্ত্র-৪/২২)।।  যদি এমন বস্তু থেকে থাকে, যা শুরুর আগেও ছিলো না, আবার শেষ হয়ে গেলেও থাকবে না, তবে তাকে মিথ্যা বলেই ধরে নিতে হবে। মরীচিকার মতোই এও এক দৃষ্টিভ্রম- মনে হয় সত্য, কিন্তু আসলে সত্য নয়। যা সত্য তা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ- এই তিনকালেই সত্য। (আগমশাস্ত্র-৪/৩১)।। অতএব, যে বস্তু আদিতে নেই, অন্তেও নেই, তার বর্তমান অবস্থাও তথৈবচ, মিথ্যারূপী হয়ে তাকে মিথ্যা বলেই দেখা যায়। গৌড়পাদের দৃষ্টিতে জগৎ তাই।

সকলই মায়া : এই জগৎ বা সবকিছুই যে দৃষ্টিবিভ্রম বা মায়াই কেবল তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাণ্ডুক্য-কারিকায় বলা হয়েছে- স্বপ্নে আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। তবু মন দুই (দ্রষ্টা ও দৃশ্য) দেখে ও সেই অনুরূপ কাজ করে। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থাতেও মন অবিদ্যার প্রভাবে দুই দেখে ও সেই অনুযায়ী চিন্তা ও কাজ করে। (বস্তুত দুই নেই, এক। অজ্ঞানতার ফলেই এই ভুল হয়।) (আগমশাস্ত্র-৪/৬১)।।  স্বপ্নকালে মন নিঃসঙ্গ থাকে, তবু দুয়ের (জ্ঞাতা-জ্ঞেয়) অভিজ্ঞতা হয়। সেইভাবে জাগ্রত অবস্থাতেও মনের দ্বৈতভূমিকা থাকে, এবং জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের ধারণা সৃষ্টি করে। এর ফলে বহু দেখা যায়। আর এই বহুর অস্তিত্ব সম্পর্কে দ্রষ্টার মনে সংশয়মাত্র থাকে না। কিন্তু স্বপ্ন ও জাগ্রত- এই দুই অবস্থার অভিজ্ঞতাই দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। (আগমশাস্ত্র-৪/৬২)।। এখানে গৌড়পাদের বক্তব্য হলো, বস্তুসমূহের মধ্যে যাদের উৎপন্ন বলা হয় তা কি বস্তুত ভ্রম থেকে নয়? তাদের জন্ম মায়ারূপী এবং মায়ার কোন সত্তা নেই। যেমন স্বপ্নের মধ্যে চিত্ত মায়াবশত দুটি রূপ (দ্রষ্টা ও দৃশ্য) গ্রহণ করে, জাগ্রত অবস্থাতেও চিত্ত মায়াবশত ঐ রকম করে। অতএব এই জগৎ এবং এর সবকিছুই মায়া মাত্র।

আত্মা (=জীব) নেই : জীবাত্মা সম্বন্ধে গৌড়পাদের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক মনে হয়। মাণ্ডুক্য-কারিকায় তিনি বলেন- স্বপ্নে কাউকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়। একইভাবে জাগ্রত অবস্থাতেও সকল প্রাণীর জন্ম বা মৃত্যু দেখা যায়। (আগমশাস্ত্র-৪/৬৮)।।  মায়ার মধ্যে বা জাদুখেলায় অনেক সময় কাউকে জন্মাতে বা মারা যেতে দেখা যায়। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থাতেও এইসব প্রাণীকে জন্মগ্রহণ বা মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়। (আগমশাস্ত্র-৪/৬৯)।।  জীবাত্মার জন্ম হয় না। সুতরাং সেক্ষেত্রে অমর বা মরণশীল এই শব্দগুলি প্রযোজ্য নয়। যা বর্ণনা করা যায় না তাকে শাশ্বত বা অশাশ্বত কিভাবে বলবো? (আগমশাস্ত্র-৪/৬০)।। গৌড়পাদ হয়তো বলতে চেয়েছেন যে, স্বপ্নময় বা মায়াময় আত্মাকে যেমন জন্মাতে ও মরতে দেখা যায় তেমনভাবে এই আত্মাসমূহ আছে আবার নেই-ও বটে। জীবাত্মা সম্বন্ধে তার এই অবর্ণনীয় সংশয়কে হয়তো শেষতক নেতিবাচক বলেই বর্ণনা করা চলে। প্রকৃতপক্ষে গৌড়পাদ হয়তো জীবাত্মার স্থলে বিজ্ঞান বা চৈতন্যকেই স্বীকার করেন বলে মনে হয়। যেমন, মাণ্ডুক্য-কারিকাতে বলা হয়েছে- ঘট যখন ভেঙে যায় তখন ঘটের ভিতরের আকাশ বাইরের আকাশে মিশে যায়। সেইভাবে যে দেহের সঙ্গে জীবাত্মা যুক্ত সেই দেহের যখন নাশ হয় তখন জীবাত্মা (চৈতন্য) পরমাত্মাতে (চৈতন্যে) লয় হয়। (আগমশাস্ত্র-৩/৪)।।  ঘটাকাশ অনন্ত আকাশের অংশ বা বিকার নয়। বস্তুত ঘটাকাশ অখণ্ড আকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। একইভাবে, জীবাত্মা পরমাত্মা ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ নয়, আবার বিকারও নয়। (আগমশাস্ত্র-৩/৭)।।

পরমতত্ত্ব : গৌড়পাদ যে এক অদ্বয় সত্তা বা অদ্বৈত পরমসত্তায় বিশ্বাস করেছেন তা অদ্বৈত সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকারীদের সমালোচনার মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। কেননা, মাণ্ডুক্য-কারিকায় বলা হয়েছে- নির্বোধ ব্যক্তি কখনো মনে করে তিনি (=পরমসত্তা) আছেন, কখনো মনে করে নেই, আবার কখনো মনে করে আছেনও বটে নেইও বটে। আর কখনো বা মনে করে আছেও নেইও তাও নয়, এইভাবে চার কোটিতে কখনো স্থির, কখনো চঞ্চল, কখনো দুই-ই, কখনো তাও নয়, ইত্যাদি ভেবে নির্বোধ ব্যক্তি পরমতত্ত্বকে আবৃত করে রাখে। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৩)।।   এই চারটি গোষ্ঠির কাছে ভগবান (=পরমসত্তা) সর্বদাই নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। এর কারণ নিজ নিজ মতের প্রতি এঁরা মোহমুগ্ধ। কিন্তু এই চার মতবাদের উর্ধ্বে গিয়ে যে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি জ্যোতির্ময় সত্তার দর্শন লাভ করেন তিনি প্রকৃতই সর্বজ্ঞ। (আগমশাস্ত্র-৪/৮৪)।।

গৌড়পাদ এখানে অদ্বৈতবিরোধী চারটি প্রধান দার্শনিক মতকে চিহ্নিত করেছেন। এদের মধ্যে বৈশেষিকরা বলেন, আত্মার অস্তিত্ব আছে কিন্তু আত্মার পরিবর্তন হয়। আত্মা কখনো সুখী কখনো দুঃখী। যদিও তাদের মতে আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র। আর এক বিরোধী দার্শনিক মত হলো বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধদর্শন। তারা বিশ্বাস করেন বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী। এই মত অনুসারে আত্মা বা পরমসত্তা বলে কিছু নেই। আবার অন্য মতগোষ্ঠি দিগম্বর জৈনরা বলেন, আত্মা আছেও বটে, নেইও বটে। যতক্ষণ দেহের অস্তিত্ব আছে ততক্ষণই আত্মার অস্তিত্ব। দেহের মৃত্যুর সঙ্গেই আত্মারও মৃত্যু হয়। আবার দেহ বড় বা ছোট হলে আত্মাও বড় বা ছোট হয়। বৌদ্ধদের আরেকটি শাখা যা মাধ্যমিক শূণ্যবাদী বলে পরিচিত, তাদের মতে আত্মা বলে কিছু নেই। পরম সত্য হলো শূন্য। এঁদের বলা হয় নিহিলিস্ট বা নাস্তিবাদী। গৌড়পাদের মতে এইসব তর্কবিচার নিরর্থক। এতো বাগবিতণ্ডায় তাদের অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। এঁদের আত্মজ্ঞান লাভের আশা সুদূরপরাহত। তার মতে, যিনি বুঝেছেন তা বিতর্কের বিষয় নয় তিনি এই পরমসত্তাকে জানেন। তিনি যথার্থই প্রাজ্ঞ। গৌড়পাদের এই দার্শনিক মত শঙ্করাচার্যের ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মস্বরূপ’- এই মতের সঙ্গে যথেষ্ট ব্যবধান বজায় রাখলেও শঙ্করের মায়াবাদের সমস্ত মৌলিক সামগ্রীই এর মধ্যে নিহিত আছে বলে মনে করা হয়।

শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০ খ্রি.)

পরিচয়

৮ম শতকে দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম উপকূলে মালাবার অঞ্চলে তথা কেরলের এক নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ পরিবারে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে বৈশাখী শুক্ল৫মী তিথিতে শঙ্করের জন্ম হয়। তার পিতার নাম শিবগুরু এবং মাতার নাম বৈশিষ্টা। মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই তার পিতার দেহান্ত হয়, ফলে তার লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার গুরু দায়িত্ব তার মাতাকেই বহন করতে হয়। শঙ্করের প্রতিভা ছিলো অতুলনীয় এবং অসাধারণ কর্মদক্ষতার অধিকারী ছিলেন তিনি। মাত্র আট বৎসর বয়সেই তিনি সম্পূর্ণ বেদ অধ্যয়ন করেন বলে জানা যায় এবং এই বয়সেই তিনি সংসারত্যাগী সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। গৃহত্যাগ করে নর্মদা নদীর তীরে বৈদুর্যমণি পর্বতের গুহায় গোবিন্দপাদ নামক একজন বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার কাছে অদ্বৈততত্ত্ব আয়ত্ত করেন। এই গোবিন্দ ছিলেন আগমশাস্ত্র বা মাণ্ডুক্য-কারিকাকার গৌড়পাদের শিষ্য। তাই শঙ্করের দীক্ষাগুরু গোবিন্দ হলেও শিক্ষাগুরু ছিলেন গৌড়পাদ। সেখান থেকে তিনি কাশী এবং পরে বদরিকাশ্রমে যান। এই বদরিকাশ্রমে থেকে বারো বছর বয়সেই শঙ্করাচার্য বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের উপর তার বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ শারীরকভাষ্য রচনা করেন বলে কথিত আছে। শঙ্কর যে কতোটা মেধাবী ছিলেন, মাত্র বত্রিশ বছর আয়ুকালের মধ্যেই ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্র, ভগবদ্গীতা এবং ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, তৈত্তিরীয় ও শ্বেতাশ্বতর এই দশটি প্রধান উপনিষদের ওপর বিদগ্ধ ভাষ্যরচনাই তার প্রতিভার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

শঙ্করের আবির্ভাবকালে তখন বৌদ্ধ ও জৈনমতের প্রবল প্রতাপ। ফলে বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রতি লোকের শ্রদ্ধাও কমে যাচ্ছিলো। দাক্ষিণাত্যে জৈন ধর্মের প্রসার লাভ করেছিলো। শৈব আদিয়াব ও বৈষ্ণব আলোয়ারগণ ভক্তিধর্ম প্রচার করছিলেন। মীমাংসকগণ বৈদিক যাগযজ্ঞ প্রচারের চেষ্টা করেন। অপরদিকে কুমারিল ও মণ্ডনমিশ্র সন্ন্যাসের তুলনায় গার্হস্থ্য ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বলা যায়, এটা ছিলো সেই সময় যখন বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, জৈন সকল ধর্মই মানুষকে সাধুতে পরিণত করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলো। প্রকৃত ব্যাখ্যাতার অভাবে হিন্দুমত তখন শাস্ত্রের বিরোধ এবং আচার-অনুষ্ঠানের কুসংস্কারে আবদ্ধ ছিলো। হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত এবং শাস্ত্রের আপাতবিরোধ দূর করাকে প্রাথমিক দায়িত্ব মনে করে শঙ্কর নানা শাস্ত্রের মূলতত্ত্বকে মানুষের কাছে তুলে ধরে দেখান যে, শাস্ত্রের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন বিরোধ নেই। বিভিন্ন উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করে অদ্বৈতবাদকে সুদৃঢ়ভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি দেখান যে, বিভিন্ন শাস্ত্র বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই পরমতত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। এই পরমতত্ত্ব এক অনির্বচনীয় পরমসত্তা। বেদান্ত দর্শনে এই পরমসত্তাকে বলা হয় ব্রহ্ম।

বেদান্তের শাঙ্করভাষ্য অনুযায়ী, অজ্ঞানবশতই জীব সখণ্ডকে সত্য বলে মনে করে এবং পরমসত্তার কথা কখনও চিন্তা করে না। সখণ্ড প্রতিভাত জগৎ না সত্য, না অলীক। অখণ্ড পরমসত্তাই যেহেতু একমাত্র সত্য, সেহেতু প্রতিভাত সখণ্ড জগৎ সত্য নয়। আবার জগৎ শশশৃঙ্গের ন্যায় অলীকও নয়। জগৎ অনির্বচনীয়। জগতের এই অনির্বচনীয়তারই পারিভাষিক নাম হলো ‘মায়া’। জীব স্বরূপত ব্রহ্মস্বরূপ। প্রকৃত জ্ঞানের উদয়ে জীব এই সকল সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।

শঙ্করাচার্য উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র এবং গীতা এই প্রস্থানত্রয়েরই ভাষ্য রচনা করেন। তার রচিত প্রধান ‘দশটি উপনিষদের ভাষ্য’, ব্রহ্মসূত্রের ‘শারীরকভাষ্য’ এবং ভগবদ্গীতার ‘গীতাভাষ্য’ বেদান্ত দর্শনের অমূল্য সম্পদ। এছাড়াও তিনি অনেক স্বতন্ত্র গ্রন্থ ও স্তোত্র রচনা করেন। পরবর্তীকালে বহু মনীষী শঙ্করাচার্যের ভাষ্যের উপর টীকা রচনা করেন। ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যের উপর বাচস্পতি মিশ্রের লেখা ‘ভামতী’ টীকা প্রসিদ্ধ। এছাড়া শঙ্করের সাক্ষাৎ শিষ্য পদ্মপাদাচার্য ‘পঞ্চপাদিকা’ বা ‘বিবরণ’ নামে শঙ্করভাষ্যের উপর একটি মনোরম টীকা রচনা করেন। কিন্তু শঙ্করের শারীরকভাষ্যের উপর টীকাকারদের মতপার্থক্যহেতু পরবর্তীকালে অদ্বৈতমতের সমর্থকরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে (বেদান্তের উপ-উপসম্প্রদায়) বিভক্ত হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে পদ্মপাদাচার্যের ‘বিবরণ সম্প্রদায়’ এবং শ্রীবাচস্পতিমিশ্রের ‘ভামতী সম্প্রদায়’ প্রধান। বিবরণ সম্প্রদায় ‘পঞ্চপাদিকা’ টীকার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং ভামতী সম্প্রদায় ‘ভামতী’ টীকার উপর প্রতিষ্ঠিত।

পদ্মপাদাচার্যের ‘পঞ্চপাদিকা’, প্রকাশাত্মযতি রচিত ‘পঞ্চপাদিকা-বিবরণ’ এবং বিদ্যারণ্য’র ‘বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ’ বিবরণ সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বাচস্পতিমিশ্রের ‘ভামতী’, অমলানন্দ’র ‘ভামতী-কল্পতরু’ ও ‘শাস্ত্রদর্পণ’ এবং অপ্পয়দীক্ষিত-এর ‘কল্পতরুপরিমল’ ভামতী সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। অদ্বৈত চিন্তাধারায় শাঙ্করভাষ্যের উপর আরো অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তার মধ্যে সুরেশ্বর আচার্যের ‘তৈত্তিরীয়ভাষ্যবার্ত্তিক’, শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্’, চিৎসুখাচার্য’র ‘চিৎসুখী’, মধুসূদন সরস্বতীর ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’, ব্রহ্মানন্দ’র ‘লঘুচন্দ্রিকা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সদানন্দ যোগীন্দ্রের ‘বেদান্তসার’ ও ধর্ম্মরাজাধবরীন্দ্রের ‘বেদান্ত পরিভাষা’ যথাক্রমে বেদান্ততত্ত্ব ও বেদান্তজ্ঞানতত্ত্বের উপর বহুলপ্রচলিত দুখানি উল্লেখযোগ্য প্রকরণগ্রন্থ।

শঙ্করের দার্শনিক মত অদ্বৈতবাদ

শঙ্কর তার সকল গ্রন্থেই তার মৌলিক চিন্তা তুলে ধরেছেন। তবে তার শারীরকভাষ্যে বাদরায়ণের বেদান্তসূত্রের প্রথম চারটি সূত্রের ভাষ্যের মধ্যে তিনি অধিক মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, বৌদ্ধের সংবৃত্তি-সত্য এবং পরম-সত্যকে উপজীব্য করে ব্রহ্মকেই একমাত্র সৎ (অদ্বৈত) পদার্থ বলে মানতে গিয়ে তিনি ব্যবহারিক সত্যের পটভূমিতে বুদ্ধি-এবং-অবুদ্ধিগম্য সব ব্রাহ্মণ-সিদ্ধান্ত স্বীকার করে নিয়েছেন। এই সবকিছু মিলিয়ে তাই বর্তমানে শঙ্করের দার্শনিক মত বলতে তার শারীরকভাষ্যে প্রস্তাবিত অদ্বৈতবাদকেই বোঝানো হয়, যার অন্য দার্শনিক নাম অদ্বৈত-বেদান্ত।

বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন শঙ্করাচার্য। অদ্বৈতবাদের মূল বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য বলেছেন- কোটি কোটি গ্রন্থ যে সত্য প্রতিপাদন করতে ব্যস্ত, আচার্য তা শ্লোকার্ধেই ব্যক্ত করেছেন। এই মূল সত্য হলো : ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন’।

বস্তুত ব্রহ্ম, জগৎ ও জীবের স্বরূপ ব্যাখ্যাই সমগ্র বেদান্ত দর্শনের প্রতিপাদ্য বিষয়। অদ্বৈতবাদে জগৎ ও জীবকে ব্রহ্মে লীন করে একমাত্র ব্রহ্মকেই সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। ব্রহ্মই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ। জগৎপ্রপঞ্চ স্ব স্ব কারণে লীন হয়ে ব্রহ্মমাত্রে অবশিষ্ট থাকে। যেহেতু এই মতে ব্রহ্ম একমাত্র সত্য, সেহেতু জগৎ মিথ্যা। ব্রহ্ম হলেন চৈতন্যস্বরূপ। জগতে আমরা সবাই চেতন জীব। তাহলে চেতন জীবের সাথে ব্রহ্মের সম্বন্ধ কী? উত্তরে বলা হয়েছে যে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। জীবও মায়ামুক্ত হলে নিজেকে ব্রহ্ম বলেই জানে। সুতরাং ব্রহ্মই প্রকৃতপক্ষে সৎ। সংক্ষেপে এই হলো অদ্বৈততত্ত্ব।

আচার্য শঙ্কর উপনিষদীয় নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মতত্ত্বের অন্যতম প্রধান সমর্থক। তার মতে ব্রহ্ম নির্গুণ, নির্বিকার, নিরাকার, এক এবং অদ্বিতীয়। সাধারণত লক্ষণ এবং প্রমাণের দ্বারা বিষয় সিদ্ধ হয়। তাহলে ব্রহ্মের লক্ষণ বা প্রমাণ কী? নির্গুণ ব্রহ্মের সদর্থক লক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। বস্তুর অসাধারণ ধর্মের দ্বারা লক্ষণ নির্দেশ করা হয়। ব্রহ্ম নির্ধর্মিক হওয়ায় তার লক্ষণ সম্ভব নয়। এ কারণে অদ্বৈতপন্থীরা এক বিশেষ যুক্তিপ্রণালীর সাহায্যে ব্রহ্মোপদেশ দিয়ে থাকেন। এই বিশেষ যুক্তিপ্রণালী ‘অধ্যারোপ-অপবাদ’ নামে পরিচিত।

অধ্যারোপ = অধি + আরোপ। অর্থাৎ ভ্রমের আরোপকে বলা হয় অধ্যারোপ। যথার্থ বস্তুতেই ভ্রমের আরোপ হয়। কিন্তু যথার্থ বস্তুতে কি যথার্থ বস্তুর আরোপ সম্ভব? এ বিষয়ে শাঙ্করভাষ্যে বলা হয়েছে- ‘অস্মৎ’ বা ‘আমি’ এই প্রকার বুদ্ধির বিষয় যে চৈতন্যময় আত্মা- তাতে ‘তুমি’ বা ‘তোমরা’ বা ‘এগুলি’ এই প্রকার বুদ্ধির বিষয় যে জড়জগৎ এবং যেসব জড়ধর্ম- তাদের আরোপ হবার সম্ভাবনা নেই। এভাবে বিপরীতক্রমেও আবার জড়বস্তুতেও চৈতন্য এবং চৈতন্যের ধর্ম প্রকাশ ও সত্তা প্রভৃতির আরোপ কোনোভাবেই সম্ভবপর নয়। (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-১)।

শঙ্করমতে যথার্থ বস্তুতে যথার্থ বস্তুর আরোপ সম্ভব নয়, কেবল ভ্রমাত্মক আরোপই হতে পারে। তাই বেদান্তমতে অধ্যারোপ হলো বস্তুতে অবস্তুর আরোপ। আর অপবাদ হলো কার্যমাত্র পদার্থেরই মিথ্যাত্ব প্রতিপাদন। এই ভ্রমাত্মক আরোপের এবং কার্যপদার্থের মিথ্যাত্ব প্রতিপাদনের মাধ্যমে অদ্বৈতমতে গুরু শিষ্যকে ব্রহ্মের পরিচয় ও উপদেশ দেন এবং সৎ বস্তুকে অবস্তু থেকে পৃথক করেন। এই প্রণালীই ‘অধ্যারোপ-অপবাদ’। বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় আত্মতত্ত্বজ্ঞান। তাই এই আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভ্রমাত্মক ধারণাই এখানে অধ্যারোপ। বেদান্ত-বিরোধী এই মতগুলির অসারতা প্রতিপাদনের মাধ্যমে বেদান্তমতের পরিচয় তুলে ধরা হয়।

দার্শনিক দৃষ্টিতে এই ভ্রমাত্মক আরোপ বা অধ্যারোপ কিভাবে হয়? অদ্বৈতমতে বস্তুর ভিন্নরূপ প্রতীতি বা অবস্তুর বস্তুরূপে প্রতীতিকে বলা হয় ভ্রম বা অধ্যাস। আমরা যখন রজ্জুকে সর্প বলে জানি, তখন পূর্বদৃষ্ট সর্পের সদৃশ বস্তু রজ্জুতে সর্পের আপাত-প্রতীতি ঘটে। রজ্জু এখানে বস্তু, সর্প অবস্তু। বস্তুতে অবস্তুর এই অবভাসকে বলা হয় বিবর্ত। বেদান্তসূত্রের শাঙ্করভাষ্যে এই ভ্রম-প্রতীতি বা অধ্যাস সম্পর্কে বলা হয়েছে – এই অধ্যাস কী রকম? ভিন্ন-বস্তুতে ভিন্ন-বস্তুর জ্ঞানই অধ্যাস। পূর্বানুভব থেকে সংস্কার হয়- এই সংস্কার থেকে যেমন স্মরণ হয়, তেমনি এই অধ্যাসও পূর্বানুভবজনিত সংস্কারের ফল- একারণে এর নাম স্মৃতিরূপ (কারণ সংস্কার হতে উৎপন্ন হওয়াই স্মৃতির রূপ বা ধর্ম)। এই যে বিভিন্ন-বস্তু, যার অবভাসকে অধ্যাস বলা হচ্ছে- তা পূর্বদৃষ্টবৎ অর্থাৎ পূর্বে যা অনুভবের বিষয় হয়েছে তার সাথে এর সাদৃশ্য আছে মাত্র; প্রকৃতপক্ষে তা পূর্বদৃষ্ট নয়। (কেননা পূর্বদৃষ্টাবভাস মানে পূর্বদৃষ্টবৎ অবভাস বোঝায়।) (শাঙ্করভাষ্য : বেদান্তসূত্র-১)

তার মানে, যার সাথে যার কোনো সম্বন্ধ নেই, কেবল পূর্বদৃষ্ট বস্তুর সাদৃশ্য আছে, সেই বস্তুতে সেই পূর্বদৃষ্ট বস্তুর ভ্রমাত্মক আরোপকেই অধ্যাস বলা যায়। অধ্যাসের আরেকটি স্বভাব হলো- যে বস্তুর উপর যার অধ্যাস বা আরোপ হয়,- সেই বস্তু- সেই বস্তুর অণুমাত্র দোষ বা গুণের সংসৃষ্ট হতে পারে না। আত্মা ও জড়-প্রপঞ্চের এরকম পরস্পরের উপর পরস্পরের অধ্যাসই অবিদ্যা। (শাঙ্করভাষ্য : বেদান্তসূত্র-১)

যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রমের ক্ষেত্রে রজ্জুতে যখন সর্পের আরোপ বা অধ্যাস হয়- তখন সর্পের কোনো গুণ বা দোষ রজ্জুতে কিছুতেই সংক্রান্ত হয় না,- রজ্জুকে আমরা সর্প বলে বুঝি কেবল। কিন্তু তাই বলে রজ্জু সর্প হয়ে যায় না, কিংবা সর্পের গুণ বা দোষও রজ্জু গ্রহণ করে না। তাই রজ্জু এখানে বস্তু, সর্প অবস্তু। বেদান্তের ভাষায় বস্তুতে অবস্তুর এই অবভাসকে বলা হয় বিবর্ত। অবভাসের কারণ সত্য, কিন্তু অবভাস সত্য নয়। ভ্রমীয় বস্তু সৎ নয়। অদ্বৈতবেদান্ত মতে অবভাস বা ভ্রমীয় বস্তু হলো অপূর্ব। এই মতে, ভ্রমীয় বস্তু সৎ নয়, আবার অসৎও নয়। তবে কি ভ্রমীয় বস্তু সদসৎ? অদ্বৈতমতে ভ্রমীয় বস্তু সদসৎও নয়। ভ্রমীয় বস্তু প্রকৃত বস্তু সম্বন্ধে অবিদ্যা বা অজ্ঞানের পরিণাম এবং তা অনির্বাচ্য। রজ্জুর অজ্ঞান থেকেই রজ্জুতে সর্পের বিবর্ত ঘটে। রজ্জুর প্রকৃত জ্ঞানে অধ্যস্ত সর্প মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়। বিষয়ের প্রকৃতজ্ঞানে ঐ বিষয়ের অজ্ঞান বিনষ্ট হয়। কিন্তু তাই বলে প্রতিভাত সর্প অসৎ নয়। আসলে অধ্যস্ত সর্পটির রজ্জু-অতিরিক্ত কোন সত্তা নেই। যথার্থ জ্ঞানে প্রতিভাত সর্প রজ্জুতে বিলীন হয়ে যায়। একইভাবে, অদ্বৈত মতানুসারে জীব ও জগৎ প্রকৃতজ্ঞানে ব্রহ্মে বিলীন হয়।

অন্যদিকে ব্রহ্ম নির্গুণ ও নির্ধর্মিক হওয়ায় সদর্থকভাবে বা বিধিমুখে ব্রহ্মের লক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য ব্রহ্মের নিষেধমূলক বা নঞর্থকভাবে লক্ষণ করা হয়। কেনোপনিষদে বলা হয়েছে (কেনোপনিষদ : ১/৫-৯) যে,- দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, বিষয় প্রভৃতি দৃশ্যমান বস্তুর অতিরিক্ত সত্তাই ব্রহ্ম। এবং কেনোপনিষদে আরো বলা হয়েছে- সব পরিচিত ও জ্ঞাত বস্তু থেকে ‘তৎ’ অর্থাৎ সেই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র ; ব্রহ্ম অজ্ঞাত বস্তু থেকেও স্বতন্ত্র। প্রাচীন (আচার্য) যাঁরা এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা- আমরা তাদের কাছ থেকে একথা শুনেছি (কেন-১/৪)।

অনেক ক্ষেত্রে ব্রহ্মকে সচ্চিদানন্দ বা সত্য, জ্ঞান ও আনন্দ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদেও বলা হয়েছে- ‘সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জান ও অনন্ত। (তৈত্তিরীয়-২/১/১)

এসব ক্ষেত্রেও নিষেধের মাধ্যমেই ব্রহ্মকে বুঝতে হবে। সদর্থকভাবে এইসব লক্ষণকে গ্রহণ করা হলে ব্রহ্মের সৎ-ত্ব, চিৎ-ত্ব, আনন্দত্ব, জ্ঞানত্ব, সত্যত্ব, অনন্তত্ব প্রভৃতি গুণকে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু নির্গুণ ব্রহ্মের এইসব গুণ থাকা সম্ভব নয়। তাই অদ্বৈতমতে ব্রহ্মকে সচ্চিদানন্দ বলতে ব্রহ্ম অসৎ নয়, অচিৎ নয় এবং দুঃখরূপ নয় বলে বুঝতে হবে। জগতের অসৎ-বস্তু, অচিৎ-বস্তু, দুঃখরূপ-বস্তু, অজ্ঞানরূপ-বস্তু, মিথ্যাবস্তু, সসীমবস্তু প্রভৃতি বস্তুর সঙ্গে জীব পরিচিত। এইসব পরিচিত বস্তুর নিষেধের মাধ্যমে সাধারণ জীবের পক্ষে নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা সহজতর। এই কারণেই অপবাদ-ন্যায়ে ব্রহ্মকে নিষেধের মাধ্যমে বোঝানো হয়। নিষেধের মাধ্যমে ব্রহ্মের লক্ষণ করা হয় বলে ব্রহ্মকে প্রত্যগাত্মা বলে। সুতরাং অপবাদ ন্যায় নেতিবাচক ব্যাখ্যার মাধ্যমে ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ নির্ধারণ করে।

এইভাবে উপরিউক্ত উপায়ে অধ্যারোপ ও অপবাদ ন্যায়ের সাহায্যে অদ্বৈতবেদান্তীরা ব্রহ্মের পরিচয় দেন। অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নির্বিশেষ, নিরাকার, নিরবয়ব, অদ্বয়, সর্বব্যাপক, অসীম, স্বয়ম্ভূ, স্বপ্রকাশ ইত্যাদি। ব্রহ্মের সকল বর্ণনাই নঞর্থক, অথচ ব্রহ্ম সৎ। ব্রহ্ম মাধ্যমিক বৌদ্ধমতের শূন্য থেকে পৃথক। ব্রহ্ম সম্পর্কিত সদর্থক শব্দের নেতিমূলক ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও ব্রহ্ম ভাবাত্মক পরমার্থ সৎ। ব্রহ্ম শূন্য হলে ব্রহ্ম মিথ্যা জগতের অধিষ্ঠান হতে পারেন না। মিথ্যা অধিষ্ঠানে মিথ্যার অবভাসও সম্ভব নয়। এখানে প্রশ্ন আসে- ভাবাত্মক সৎ ব্রহ্মের সদর্থক ব্যাখ্যা সম্ভব নয় কেন? উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন- কোন বিশেষ বস্তুরই সদর্থক ব্যাখ্যা সম্ভব। ঘট-পটাদি যাবতীয় জাগতিক বিষয় সসীম, বিশেষ বস্তু। এই বিশেষ বস্তু থেকে ক্রমশ সামান্য এবং সামান্য থেকে ক্রমশ সামান্যতর বস্তুর ধারণা থেকে আমরা এক মহাসামান্য সত্তার পরিচয় পাই। এই মহাসামান্য সত্তার মধ্যে সকল বিশেষ বস্তু অন্তর্গত হওয়ায় কোন বিশেষ বস্তুর মাধ্যমে এই মহাসামান্যের পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। যে কোন বিশেষ (সে সামান্যই হোক বা সামান্যতরই হোক) অন্য বস্তুর দ্বারা সীমিত। যে মুহূর্তে আমরা সীমাকে অতিক্রম করি, সেই মুহূর্তে এমন একটা অসীম সত্তায় আমরা উপনীত হই, যার সার্বিক ও সার্বত্রিক রূপকে কোন সীমিত বস্তুর রূপের ন্যায় সদর্থকভাবে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু সেই অসীম পরমসত্তা যে, যে কোন সীমিত বস্তুর রূপ থেকে ভিন্ন, সে কথা আমরা অতি সহজেই বলতে পারি।

অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম

অনাদিকাল ধরে প্রচলিত অবিদ্যার বা অজ্ঞানতার ফলস্বরূপ নানা প্রকার ভেদ প্রতীতি হয় বলে শঙ্করের অভিমত, যা থেকে উৎপন্ন হয় জন্ম, জরা, মৃত্যু ইত্যাদি সাংসারিক দুঃখসমূহ। এই সমস্ত দুঃখের জড়তাকে কাটানোর জন্য শুধুমাত্র ‘এক আত্মাই সত্য’ এই জ্ঞান প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। এই আত্মার একত্ব বা ‘ব্রহ্ম-অদ্বৈত’ জ্ঞানের প্রতিপাদনকেই শঙ্কর তার গ্রন্থের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছেন। তাই বিশুদ্ধ অদ্বৈবাদের প্রধান প্রবর্তক শঙ্করাচার্য বলেছেন- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’। অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মস্বরূপ। অতএব, এই মতে ব্রহ্ম হলেন একমাত্র সত্য।

ব্রহ্মের স্বরূপ : ‘বৃহ্’ ধাতুর উত্তর ‘মন্’ প্রত্যয় যোগ করে ব্রহ্ম শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। বৃহ ধাতুর অর্থ হলো বড় বা ব্যাপক এবং মন্ প্রত্যয়ের অর্থ হলো অতিশয়। সুতরাং ধাতুগত অর্থে ব্রহ্ম হলেন, তিনিই, যাঁর থেকে অতিশয় ব্যাপক বা বৃহত্তম আর কিছুই নেই। ঋগ্বেদের পুরুষ-সূক্তের ‘পুরুষ’ ধারণার মধ্যে এই বৃহত্তম রূপেরই পরিচয় পাওয়া যায়।  সাধারণভাবে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। তাই শঙ্করাচার্য বলেছেন- ‘বৃহত্তমত্বাৎ ব্রহ্ম’, অর্থাৎ, যা বৃহত্তম তাই ব্রহ্ম। এবং নিরুক্তকারের মতে- ‘বর্হতি, বৃংহয়তি তদুচ্যতে পরং ব্রহ্ম’। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ বা সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সত্তাই ব্রহ্ম (নিরুক্ত)। আর ভামতীকার বাচস্পতিমিশ্র তার ভামতী-টীকায় বলেছেন- যা নিরতিশয় বৃহৎ কিংবা যা দেহাদির পরিণামঘটক আত্মাস্বরূপ, তাই ব্রহ্ম। (ভামতী)।

ব্রহ্মের এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকে বোঝা যায় যে, ব্রহ্ম অনন্ত, অসীম, সর্বব্যাপী, পরিপূর্ণ, এক ও অদ্বয় সত্তা। এই অদ্বয় সত্তা একদিকে যেমন নিরাকার, নির্গুণ, নির্বিশেষ, নিরবয়ব, অনির্বচনীয়, ভেদরহিত ও পরিণামরহিত, তেমনি অপরদিকে স্বপ্রকাশ, স্বয়ম্ভূ, সর্বগত, সর্বোচ্চ, সর্বব্যাপক ও সচ্চিদানন্দময়। শারীরকভাষ্যেও দেখা যায় শঙ্করাচার্য বলেছেন- সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিসমন্বিত, নিত্যশুদ্ধ, নিত্যবুদ্ধ ও নিত্যমুক্তস্বভাব ব্রহ্ম আছেন। কারণ, ব্রহ্ম শব্দটির যদি ব্যুৎপত্তি করা যায়, তাহলেও ঐ সব অর্থই পাওয়া যায়। ‘মহান্’ এই অর্থবোধক বৃহ ধাতু থেকেই তো ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া, ব্রহ্ম- যেহেতু সকলেরই আত্মা, এ কারণে, সবার নিকট সর্বদা ব্রহ্মের অস্তিত্ব প্রসিদ্ধ রয়েছে। সকলেই নিজের আত্মার অস্তিত্ব অনুভব করে থাকে। আমি নাই- এরকম জ্ঞান কখনও কারও হয় না। যদি এভাবে আমার অস্তিত্ব প্রসিদ্ধ না হতো- তাহলে সকলেই আমি নাই- এভাবে বুঝতো। আত্মাই তো ব্রহ্ম। (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-১)।

ব্রহ্মকে বলা হয়েছে- নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব। যেহেতু ব্রহ্মের উৎপত্তি বা বিনাশ নেই, সেহেতু ব্রহ্ম হলেন নিত্য। যেহেতু কোন প্রকার দোষ বা মালিন্য তাকে স্পর্শ করে না, সেহেতু তিনি হলেন শুদ্ধ। যেহেতু তিনি জড়বস্তু নন, সেহেতু তিনি হলেন বুদ্ধ বা সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। যেহেতু তার কোন সীমা নেই, সেহেতু তিনি হলেন নিত্যমুক্ত। ব্রহ্মকে বলা হয়েছে অদ্বিতীয়, কারণ দ্বিতীয় কোন পদার্থ স্বীকার করলে অদ্বৈত হানি হয়। ব্রহ্মের কোন অংশও নেই। এই কারণে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে নির্বিশেষ। ব্রহ্ম হলেন অসীম। কারণ তার বাইরে কোন কিছু নেই। বিশ্বের যাবতীয় পদার্থ ব্রহ্মের মধ্যেই অবস্থিত। তাই বলা হয়েছে- ‘সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম’। অর্থাৎ, এই বিশ্বে সবই ব্রহ্ম অথবা এই বিশ্বে ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় সত্তা নেই।

ব্রহ্ম ভেদশূন্য : শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম হলেন সকল প্রকার ভেদরহিত বা ভেদশূন্য। ভেদ বা পার্থক্য প্রধানত তিন প্রকার- স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদ। এক জাতীয় দুটি ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে যে ভেদ তাকে বলা হয় স্বজাতীয় ভেদ। যেমন, একটি মানুষের থেকে অপর একটি মানুষের ভেদ হলো স্বজাতীয় ভেদ। দুটি ভিন্ন জাতীয় ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে যে ভেদ তাকে বলে বিজাতীয় ভেদ। যেমন, একটা কুকুরের থেকে একটা গরুর ভেদ বিজাতীয় ভেদ। আবার একই বস্তু বা ব্যক্তির বিভিন্ন অঙ্গ বা অংশের মধ্যে যে ভেদ তাকে বলা হয় স্বগত ভেদ। যেমন একজন মানুষের হাত, পা, মুখ প্রভৃতির মধ্যে ভেদ হলো স্বগত ভেদ। ব্রহ্ম নির্বিশেষ মহাসামান্য হওয়ায় তিনি এই তিনপ্রকার ভেদরহিত।
যেহেতু ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, সেহেতু ব্রহ্ম হলেন স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদরহিত। আবার যেহেতু ব্রহ্মের কোন অংশ নেই, সেহেতু ব্রহ্মের স্বগত ভেদও নেই। এই কারণে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে- ‘একম্ এব অদ্বিতীয়ম্’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। এক্ষেত্রে ‘একম্’ বা এক শব্দটির দ্বারা ব্রহ্মের স্বজাতীয় ও স্বগত ভেদশূন্যতা সূচিত হয়েছে। আবার ‘অদ্বিতীয়’ শব্দটির দ্বারা ব্রহ্মের বিজাতীয় ভেদশূন্যতা সূচিত হয়েছে। সুতরাং, ব্রহ্ম হলেন স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদশূন্য। তিনি সাংশ বা অংশযুক্ত নন, অপরপক্ষে তিনি অংশবিহীন। অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম একমাত্র সৎ ও নিরবয়ব সত্তা। একমাত্র ও নিরবয়ব সত্তার কোনপ্রকার ভেদের প্রশ্নই ওঠে না।

অদ্বৈত বেদান্তমতে ব্রহ্ম হলেন স্বরূপত নির্গুণ এবং নিরাকার। ব্রহ্ম নির্গুণ, কারণ তাকে কোন গুণ বা বিশেষণ দ্বারা ভূষিত করা যায় না। কোন পদার্থে বিশেষ প্রয়োগ করার অর্থ হলো তার মধ্যে ভেদরেখা টানা। যেমন, যদি বলা হয় ‘কলমটি লাল’, তাহলে এর দ্বারা বোঝানো হয় যে কলমটির লাল রং ছাড়া অন্য কোন রং নেই। অর্থাৎ, রং-এর দিক থেকে কলমটিকে এক বিশেষ গন্ডীর মধ্যে সীমিত করা হলো। তাছাড়া যেহেতু কলম এবং লাল রং এক নয়, সেহেতু কলম এবং লাল রং এর মধ্যে একটি ভেদ বা পার্থক্য টানা হলো। সুতরাং, যদি বিশেষ্যকে কোন গুণ বা বিশেষণের দ্বারা বিশিষ্ট করা হয়, তাহলে বিশেষ্যটি সীমিত হয়ে পড়ে এবং তার মধ্যে একটা ভেদরেখা টানা হয়। যেহেতু ব্রহ্ম অসীম, সেহেতু তিনি নির্গুণ, স্বগুণ নন। কারণ ব্রহ্মকে স্বগুণ বললে তিনি সীমাযুক্ত হয়ে পড়েন।

ব্রহ্মের তটস্থ ও স্বরূপ লক্ষণ : ভারতীয় দর্শনের রীতি অনুসারে ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য ব্রহ্মের দু’প্রকার লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। একটি হলো তটস্থ লক্ষণ এবং অপরটি হলো স্বরূপ লক্ষণ। যে লক্ষণ কোন তত্ত্বের স্বরূপকে প্রকাশ করে, সেই লক্ষণকে বলা হয় স্বরূপ লক্ষণ। অপরদিকে যে লক্ষণ তত্ত্বের আপাত রূপকে প্রকাশ করে, তাকে বলা হয় তটস্থ লক্ষণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কোন ব্যক্তি যখন রাজা হরিশ্চন্দ্রের অভিনয় করেন, তখনো ঐ ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় যা, তা হলো তার স্বরূপ লক্ষণ। কিন্তু অভিনয়ে রাজা হরিশ্চন্দ্রের পরিচয় তার তটস্থ পরিচয়। অতএব, ব্রহ্মের ক্ষেত্রে, যে লক্ষণ ব্রহ্মে আপাত থাকে, কিন্তু সর্বদা ব্রহ্মে থাকে না, তাই ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ। ব্রহ্মের তটস্থ হলো- ব্রহ্ম জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের কারণরূপ ঈশ্বর। অর্থাৎ, ব্রহ্ম জগতের সৃষ্টির কারণ, স্থিতির কারণ এবং লয়ের কারণ। এই লক্ষণটিকে ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ বলা হয়। কারণ, বেদান্ত দর্শন সর্বমুক্তিবাদে বিশ্বাসী। অর্থাৎ, তাদের মতে কোন একটা সময় আসবে যখন সকল মানুষ মুক্তিলাভ করবে। এই অবস্থায় ব্রহ্মের সৃষ্টি করার কিছু থাকবে না। ব্রহ্ম যদি সৃষ্টিকর্তা না হন, তাহলে তিনি স্থিতি বা লয়ের কর্তাও হবেন না। সুতরাং, সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কর্তৃত্ব ঐ অবস্থায় ব্রহ্মের থাকবে না। এ কারণে উক্ত লক্ষণটিকে ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ বলা হয়েছে।

ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- সচ্চিদানন্দস্বরূপ অর্থাৎ, ব্রহ্ম হলেন সৎস্বরূপ, চিৎস্বরূপ এবং আনন্দস্বরূপ। সৎ শব্দের অর্থ হলো অস্তিত্ব, চিৎ শব্দের অর্থ হলো চৈতন্য বা জ্ঞান, এবং আনন্দ শব্দের অর্থ হলো ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে ঐশ্বরীক আনন্দের অনুভূতি। সৎ, চিৎ এবং আনন্দ কিন্তু ব্রহ্মের গুণ নয়। অর্থাৎ, ব্রহ্মের সঙ্গে সৎ, চিৎ ও আনন্দের কোন বিশেষ্য-বিশেষণ সম্পর্ক নেই। এগুলি হলো ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ, অর্থাৎ, এগুলির দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হয়। এই তিনটি পদের দ্বারা ব্রহ্মকে কখনোই বিশেষিত করা হচ্ছে না। ব্রহ্ম সৎস্বরূপ বা অস্তিত্বস্বরূপ- একথার অর্থ হলো ব্রহ্ম অসৎ বা অস্তিত্বহীন নয়। এখানে সৎ বা অস্তিত্বের অর্থ হলো যা কোনদিন লয়প্রাপ্ত হয় না। সুতরাং, অসৎ বা অস্তিত্বহীনের ভিত্তি হলো সৎ। ব্রহ্ম কখনও অভাব পদার্থ হতে পারেন না। কারণ অভাব থেকে কখনও ভাবের উৎপত্তি হতে পারে না। সুতরাং, পরম সত্য বা ব্রহ্মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ব্রহ্ম চিৎ বা চৈতন্যস্বরূপ- একথার অর্থ হলো ব্রহ্ম অচিৎ অর্থাৎ, জ্ঞানাভাব নন। ব্রহ্ম চৈতন্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ ও স্বপ্রকাশ। তিনি নিজেই নিজেকে প্রকাশ করেন। সুতরাং, ব্রহ্ম বা চৈতন্য সর্বকালে প্রকাশিত।

এ প্রসঙ্গে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, চৈতন্য সব সময় প্রকাশিত হয় না। যেমন, মূর্চ্ছা ও নিদ্রাতে চৈতন্য প্রকাশিত হয় না। কারণ মূর্চ্ছা বা নিদ্রাভঙ্গের পর কোন ব্যক্তি মূর্চ্ছা বা নিদ্রিত অবস্থার কোন জ্ঞান পুনরুজ্জীবিত করতে পারে না। কিন্তু অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। কারণ নিদ্রাভঙ্গের পর আমরা অনেক সময় বলি যে সুখনিদ্রা হয়েছিলো। এই স্মৃতি থেকে প্রমাণ হয় যে, নিদ্রা বা সুষুপ্তি প্রভৃতি অবস্থায় চৈতন্য থাকে। ব্রহ্মের প্রকাশ অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে না। ঘট, পট ইত্যাদি অন্যান্য বিষয় প্রকাশিত হওয়ার জন্য চৈতন্যের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যিনি ‘চৈতন্যস্বরূপ’ তিনি নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অন্যের উপর নির্ভর করেন না। যেমন সূর্যকে প্রদীপের সাহায্যে দেখার প্রয়োজন হয় না। সুতরাং, ব্রহ্ম কখনও জ্ঞানের বিষয় হতে পারেন না। তিনি জ্ঞানমাত্র।

ব্রহ্মকে আনন্দস্বরূপও বলা হয়েছে। যেহেতু ব্রহ্ম নিত্যতৃপ্ত, সেহেতু তিনি আনন্দস্বরূপ। ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ- একথার অর্থ হলো ব্রহ্ম আনন্দাভাব বা দুঃখস্বভাব নন। ব্রহ্ম বা আত্মা যে আনন্দস্বরূপ, বেদান্তবাদীদের মতে তার একটা প্রমাণ হলো- নিদ্রিত অবস্থায় কোন বিষয়ের জ্ঞান থাকে না। তখন কেবলমাত্র আত্মা থাকে। নিদ্রিত অবস্থায় আনন্দের কারণ হলো এই আত্মা বা ব্রহ্ম।

নির্গুণ ও সগুণ ব্রহ্ম : অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারে ব্রহ্মকে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করা যায়। পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্রহ্ম হলেন নির্গুণ। কিন্তু ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্রহ্ম হলেন সগুণ অর্থাৎ, গুণযুক্ত। ব্রহ্মকে যখন কোনরকম শক্তিসম্পন্ন নয় বা সকল গুণের উর্ধ্বে বলে আমরা ভাবি তখন ব্রহ্ম হলেন নির্গুণ। এই নির্গুণ ব্রহ্ম হলো পরমসত্তার আধিবিদ্যক রূপ। যদি পরমসত্তার কোন গুণ বা শক্তি থাকতো, তাহলে সেই সত্তা আনন্দ বা অসীম হতে পারতো না। ব্রহ্মের একটি নির্দিষ্ট গুণ আছে- একথা বললে স্বীকার করতে হবে যে, ব্রহ্মে সেই গুণের বিপরীত গুণটি নেই। তখন ব্রহ্ম একটি সীমিত সত্তায় পরিণত হবেন। একারণে অদ্বৈত বৈদান্তিকরা পারমার্থিক সত্তাকে নির্গুণ ব্রহ্ম বলেছেন।

শ্রুতিতেও ব্রহ্মকে নির্গুণ হিসেবে দেখা হয়েছে। শ্রুতিতে আছে- ‘তদেজতি ও তন্নৈজতি তদ্দুরে তদবদন্তিকে’ অর্থাৎ, সে চলে আবার সে চলে না, সে দূরে আবার সে কাছে। এরূপ বাক্যের দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, ব্রহ্মে কোন নির্দিষ্ট গুণ নেই। কারণ পরস্পর বিপরীত গুণগুলি থাকার অর্থ হচ্ছে কোন গুণ না থাকা।

অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারে ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যতক্ষণ আমাদের কাছে ব্রহ্ম একমাত্র সত্য- এই উপলব্ধি না হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাধারণ বিশ্বাস অনুযায়ী ব্রহ্মকে জগতের স্রষ্টা, পালক এবং সংহারক ঈশ্বররূপে ভাবা হয়। বেদান্ত এই সাধারণ ধারণার বিরোধিতা করে ঈশ্বরের ধারণাকে অবিদ্যাপ্রসূত বলে ঘোষণা করেছেন। বেদান্তমতে এই ঈশ্বর সগুণ ব্রহ্ম। এই সগুণ ব্রহ্মই মায়াশক্তির দ্বারা জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর পূর্ণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। তিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান। তিনি আমাদের উপাসনার বস্তু। তিনি দীনবন্ধু, করুণাসিন্ধু, জগৎপতি, অনাথের নাথ, ভক্তের ভগবান ইত্যাদি।

উপনিষদকে অনুসরণ করে শঙ্করাচার্য নির্গুণ ব্রহ্ম এবং সগুণ ব্রহ্মের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে অপর ব্রহ্ম এবং নির্গুণ ব্রহ্মকে পর ব্রহ্ম নামে অভিহিত করা হয়েছে। সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর হলো ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ। অন্যদিকে নির্গুণ ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ অর্থাৎ, ব্রহ্ম স্বরূপত নির্গুণ। নির্গুণ ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য ক্লীবলিঙ্গ এবং সগুণ ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য পুংলিঙ্গের ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ‘শান্তং নিরঞ্জনং নিষ্কলং ব্রহ্ম’ হলো নির্গুণ ব্রহ্মের বর্ণনা। অপরপক্ষে ‘যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্ যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ’ হলো সগুণ ব্রহ্মের বর্ণনা।

শঙ্করের মতে পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিই সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গি, যাঁরা নির্গুণ ব্রহ্মকেই একমাত্র সত্য বলে জানেন। তাই যারা জগৎকে সত্য বলে মনে করেন তারা ব্রহ্মকে জগৎস্রষ্টা বলে মনে করেন। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানী যারা জগৎকে অবভাস বলে মনে করেন তারা ব্রহ্মকে জগৎস্রষ্টা বলে মনে করেন না। বিজ্ঞ বা তত্ত্বজ্ঞানীদের কাছে ব্রহ্ম বিশ্বাতীত। উপনিষদে ব্রহ্মকে বিশ্বগত ও বিশ্বাতীত বলা হয়েছে। শঙ্করও বলেন যে ব্রহ্ম বিশ্বগত ও বিশ্বাতীত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অদ্বৈতবেদান্তে সগুণ ব্রহ্ম ও নির্গুণ ব্রহ্ম- দুটি ভিন্ন তত্ত্ব নয়। এই মতে ব্রহ্মের সগুণ ভাব তার লীলা মাত্র। নির্গুণ ব্রহ্মই মায়ারূপ উপাধি গ্রহণ করে সগুণরূপে প্রতিভাত হন। সুতরাং, মায়াবিশিষ্ট ব্রহ্মকেই অদ্বৈতবেদান্তে ঈশ্বর বা সগুণ ব্রহ্ম নামে অভিহিত করা হয়।

ব্রহ্মের উপলব্ধি : ব্রহ্মকে কিভাবে উপলব্ধি করা যায়? উত্তরে শঙ্করাচার্য বলেন- ‘ব্রহ্ম অবাঙমনসগোচর’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম বাক্য ও মনের অতীত। সুতরাং, বাক্য বা সাধারণ বুদ্ধির দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায় না। কেবলমাত্র অপরোক্ষ অনুভূতির সাহায্যে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা যায়। শঙ্করাচার্যের মতে, ব্রহ্মের উপলব্ধিই হলো মুক্তি। এই মুক্তি কোন নতুন অবস্থাপ্রাপ্তি নয়। এটি হলো প্রাপ্তের প্রাপ্তি। জীবাত্মা নিত্যমুক্ত এবং জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার কোন ভেদ নেই। সুতরাং, ব্রহ্মকে জানার অর্থ হলো ‘ব্রহ্ম হওয়া’।

অজ্ঞ জীবের পক্ষে সব সময় সরাসরি পারমার্থিক শুদ্ধ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। জড়বুদ্ধিসম্পন্ন জীবের কাছে প্রাথমিকভাবে জগৎই সৎরূপে প্রতীয়মান। ক্রমশ সে যখন এই জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়ের কারণ আবিষ্কার করতে চায়, তখন সে এক সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে উপনীত। জড়বাদী মন তখন ঈশ্বরবাদী হয়ে ওঠে। তা হলো অবিদ্যাপ্রসূত ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি। ঈশ্বরবাদী মনের কাছে ঈশ্বর ও জগৎ উভয়ই সত্য বলে প্রতিভাত হয়। এরপর ক্রমশ ঈশ্বরবাদী মন তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে অতিক্রম করে এক সর্বব্যাপী মহাসামান্য শুদ্ধ ব্রহ্মে উপস্থিত হয়। এই শুদ্ধ ব্রহ্মের উপলব্ধিতে জগৎ, ঈশ্বর ও জীব ব্রহ্মে লীন হয়ে যায় এবং সেই পরম ব্রহ্মই একমাত্র সৎ ও সবকিছুর অধিষ্ঠানরূপে বিরাজ করে।

অদ্বৈতমতে জগৎ

বেদান্তদর্শনের সূত্রগ্রন্থ ব্রহ্মসূত্র বা শারীরকসূত্রের দ্বিতীয় সূত্রটি হলো- জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যা থেকে হয় (তাহাই ব্রহ্ম)। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/২)। এই সূত্রটির ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে অদ্বৈতবেদান্তের প্রধান প্রবর্তক শঙ্করাচার্য বলেন- এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অব্যক্ত ছিলো, কিন্তু সৃষ্টিদশায় সেই অব্যক্তই নাম ও রূপ এই দ্বিবিধ উপাধি দ্বারা ব্যক্ত বা ব্যবহারগোচর হয়েছে। এই জগতের ভোক্তা এবং কর্তা অসংখ্য। এই জগতের অন্তঃপাতি প্রত্যেক বস্তুই নিয়ত দেশে, নিয়ত কালে এবং নিয়ত নিমিত্তের দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে; এবং প্রত্যেক বস্তুরই ফল নিয়ত দেশে ও নিয়ত কালেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কী উপাদান থেকে- কী ভাবে এই জগতের উৎপত্তি প্রভৃতি হয়ে থাকে, তা মনে মনে ভেবেও স্থির করবার কোন সম্ভাবনা নেই। এই (বিচিত্র কৌশলময়) জগতের উৎপত্তি, স্থিতি এবং প্রলয়ের যা একমাত্র কারণ- সেই সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিসম্পন্ন কারণই- ব্রহ্ম। এটাই হলো এই (সূত্রদ্বারা সূচিত) বাক্যের অবশিষ্ট অংশ (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-২)।

আবার, প্রমাণ শাস্ত্রের দৃষ্টিতে বিচার করলে বোঝা যায় যে জগৎ দৃশ্যমান কিন্তু তা শুধু বর্তমানের মধ্যেই। জগতের পরিবর্তনশীলতা প্রমাণ করে যে পূর্বে তা কখনও ছিলো না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। এইভাবে- সর্বকালের মধ্যে তার অস্তিত্ব আছে- এই তত্ত্ব ভুল মনে হয়। তাই শঙ্করাচার্য মাণ্ডুক্য-কারিকাকার গৌড়পাদের এই মতকেই মেনে নিয়েছেন যে- যদি এমন বস্তু থেকে থাকে যা শুরুর আগেও ছিলো না, আবার শেষ হয়ে গেলেও থাকবে না, তবে তাকে মিথ্যা বলে ধরে নিতে হবে। (আগমশাস্ত্র-৪/৩১)।

বস্তুত শঙ্করের মতে ত্রিকালের মধ্যে জগৎ নেই। তিনি বলেন, ‘জগৎ আছে’- এই বাক্যের মধ্যে জগতের কল্পনা ভ্রান্তিমূলক, এবং ‘আছে’ (=সৎ) ব্রহ্মের মৌলিক স্বরূপ। সৎ না থাকলে যা জগতের ছলনা তাও থাকে না, এজন্যই ব্রহ্ম জগতের ভ্রান্তির অধিষ্ঠান বা ভ্রমস্থান, যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রমের ক্ষেত্রে সর্পের ভ্রান্তির অধিষ্ঠান রজ্জু।

শঙ্করাচার্যের মতে যেহেতু নির্গুণ ব্রহ্ম একমাত্র সত্তাবিশিষ্ট, সেহেতু জগত বা জগতের বিষয়গুলি মিথ্যা। অর্থাৎ, যেহেতু এক অদ্বয় ব্রহ্মই সত্য সেহেতু বহুত্ব সত্য নয়। কিন্তু যদি একমাত্র এক অদ্বয় ব্রহ্মই সত্য হয়, তাহলে তো জগতের বিষয়গুলির জ্ঞান হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ঐ বিষয়গুলির যেহেতু জ্ঞান হয় সেহেতু অদ্বৈতমতে ঐ জ্ঞান কিভাবে হয় তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন।

অদ্বৈতবেদান্ত বিবর্তবাদী। বিবর্তবাদ অনুযায়ী অধ্যাস বা ভ্রান্তিবশত অবস্তু বস্তুরূপে প্রতীয়মান হয়। যেভাবে ভ্রান্তিবশতই রজ্জুতে সর্প প্রতীয়মান হয়, অনুরূপভাবে ব্রহ্মে এই জগৎ-প্রপঞ্চ অধ্যস্ত হয়। চৈতন্যে অচৈতন্যের, আত্মা বা বিষয়ীতে বিষয়ের, আরোপই অধ্যাস। অধ্যাসই মিথ্যাকে উৎপন্ন করে। রজ্জুতে সর্পের অধ্যাস যেমন মিথ্যা, ব্রহ্মে জগৎ-প্রপঞ্চের অধ্যাসও তেমনি মিথ্যা। অদ্বৈতবেদান্তীর পক্ষে বিবর্তবাদের মাধ্যমেই জগতের গ্রহণযোগ্য ও সুসংগত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

বেদান্তদর্শনে অসৎকার্যবাদপরিণামবাদ বেদান্তের দ্বৈতবাদবিশিষ্টাদ্বৈতবাদের নির্দেশক। অসৎকার্যবাদ অনুযায়ী পূর্বস্থিত উপাদান থেকেই চেতন-কর্তা কার্য উৎপন্ন করে। সুতরাং এই মতবাদ দ্বৈতবাদের নির্দেশক। আর পরিণামবাদ অনুযায়ী কারণ বাস্তবিকই কার্যে পরিণত হয়। সুতরাং এই মতে কারণ পরিণামী ও কার্যসমসত্তাবিশিষ্ট। ফলে শঙ্করাচার্য বিবর্তবাদের সাহায্যে জগৎ ও জীবকে ব্রহ্মে লীন করে অদ্বৈতব্রহ্মবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই অদ্বৈতবেদান্তীর পক্ষে বিবর্তবাদ অনিবার্য বলেই মনে হয়।

অদ্বৈতবাদীদের বিবর্তবাদের উৎস খুঁজতে হলে একটু পেছনে যেতে হয়। বেদান্ত প্রস্থানের উৎসগ্রন্থ বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়েছে- ব্রহ্ম জগতের শুধু নিমিত্ত-কারণ নন, উপাদান-কারণও, এইরূপ সিদ্ধান্তেই শ্রুতির প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সামঞ্জস্য হয়। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৩)।

এখানে যে দৃষ্টান্তের কথা বলা হয়েছে তা হলো- ‘হে সৌম্য, যেমন একটি মৃত্তিকাপিণ্ডের দ্বারা মৃত্তিকার পরিমাণ-ভূত সমস্তই জানা যায় যেতে পারে (কারণ) সমস্ত বিকারই বাচাবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য;… হে সৌম্য, এইরূপেই উক্ত উপদেশ হয়ে থাকে।’ (ছান্দোগ্য-উপনিষদ-৬/১/৪-৬)। শ্রুতি এখানে ‘বিকার’ শব্দটি ব্যবহার করে বোঝাতে চেয়েছেন যে, মূল উপাদান মৃত্তিকা ছাড়া ঘটাদির পৃথক কোন সত্তা নেই। এরা পৃথক কোন বস্তু নয়, তা বিভিন্ন অবস্থা মাত্র, যেমন একই দেবদত্তের বাল্য, যৌবন ইত্যাদি অবস্থা মাত্র কিন্তু এদের কোনটাই সত্য নয়। সুতরাং মৃৎপিণ্ডের জ্ঞানলাভ করেই ঘটাদির আসল স্বরূপকে জানতে হয়। বিভিন্ন রূপকে জানতে না পারলেও কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, কারণ এরা অসৎ বলে জ্ঞাতব্যই নয়। যদিও ঘটাদি বস্তুগুলি আমাদের ইন্দ্রিয়ের বিষয়, তথাপি বিচার করে দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে, মৃত্তিকা ছাড়া অন্য কোন সত্য এদের মধ্যে নেই। এরা বাক্য থেকে উদ্ভূত কতকগুলি নামমাত্র- এর বেশি কিছু নয়। যেহেতু এগুলি অবিদ্যার মাধ্যমেই জ্ঞাত হয়- সেজন্যে এরা অসৎ। অপরপক্ষে মৃৎপিণ্ডকে নাম এবং রূপ থেকে পৃথকভাবেও জানা যায়, সুতরাং তা সত্য। একইভাবে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং এই জগৎ অসৎ। জগৎ তার কারণ ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন বলে সত্য হলো এই যে, তা এক, অদ্বিতীয় ব্রহ্মই- ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। তাই ব্রহ্মসূত্রকার বাদরায়ণ বলেন- ‘বাচারম্ভণ’ ইত্যাদি শব্দ থেকে অবগত হওয়া যায় যে, এই কার্যভূ জগৎ তৎ-কারণ ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৪)

ভারতীয় আচার্যরা উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে ধাপে ধাপে শিষ্যকে চরম সত্য উপলব্ধির দিকে নিয়ে যান, এটাই প্রচলিত রীতি। এই সর্বসম্মত রীতি অনুসরণ করে সূত্রকার বাদরায়ণ তার ব্রহ্মসূত্রে বিভিন্ন সূত্রে ব্রহ্মকে পরিণাম মতানুসারে জগৎকারণ বলে বর্ণনা করে উপরিউক্ত সূত্রের মাধ্যমে বিবর্তমতের প্রতিষ্টা করেছেন বলে মনে করা হয়। কেননা এই সূত্রগুলি থেকেই আচার্য শঙ্কর তার বেদান্তসূত্রভাষ্য বা শারীরকভাষ্যে ব্রহ্ম এবং মায়া উভয়কে জগতের কারণ বলে নির্দেশ করেছেন। ব্রহ্ম বিবর্তের মাধ্যমে এবং মায়া পরিণামের মাধ্যমে জগৎরূপ কার্যে বর্তমান, কারণ তাদের উভয়ের গুণগুলিই কার্যে দৃষ্ট হয়। তাই অদ্বৈতবাদের মূল সূত্র হিসেবে শঙ্কর বলেন- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম হলেন অভিন্ন।

অদ্বৈতমতে জগৎ মিথ্যা। কিন্তু জগৎকে মিথ্যা বললেই জগতের ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। তাহলে ‘জগৎ মিথ্যা’- এ কথার অর্থ কী? জগৎ কি আকাশকুসুমের ন্যায় অসৎ, না স্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাস? অদ্বৈতমতে জগৎ এই দুই-এর কোনটিই নয়। এই মতে জগৎ সদসৎ-বিলক্ষণ অনির্বচনীয়। জগতের যথার্থ স্বরূপ বোঝার জন্য অদ্বৈতবেদান্তীর সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ বা ত্রিবিধ সত্তা জানা দরকার। সত্তার ত্রৈবিধ্য অর্থাৎ তিনপ্রকার সত্তা সম্বন্ধে জানলেই অদ্বৈতবেদান্তীর জগতের প্রকৃতস্বরূপ ও মিথ্যাত্বের যথার্থ তাৎপর্য পরিস্ফুট হতে পারে।

সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ : অদ্বৈতবেদান্ত মতে আকাশকুসুম বা বন্ধ্যাপুত্রের ন্যায় অলীকের কোন সত্তা নেই। অলীক নিঃস্বভাব অসৎ। অসৎ কখনো ভাবরূপে প্রতিভাত হয় না। কিন্তু যা কিছু ভাবরূপে প্রতিভাত হয়, তা-ই সমানসত্তাবিশিষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য তিনপ্রকার সত্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন- পারমার্থিক, ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক।

ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ, ব্রহ্ম বিষয়ে সাক্ষাৎ উপলব্ধি হলে যার সত্যতা জানা যায়, সেই পদার্থ পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। এই দৃষ্টিতে বিভু, নিত্য ও যাবতীয় বস্তুর স্বরূপ-সত্তারূপে ব্রহ্ম পারমার্থিক সৎ। অপরপক্ষে ব্রহ্মজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত যে সকল পদার্থ সত্যরূপে প্রতীয়মান হয়, তার সত্যতা হলো ব্যবহারিক সত্যতা। তার মানে, প্রতীয়মান সকল বস্তুই সেই বস্তুরূপে ব্যবহারিক সৎ, যেমন, রজ্জুরূপে রজ্জু। আর ভ্রমজ্ঞানের বিষয় হলো প্রাতিভাসিক সত্তা। প্রাতিভাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা সত্য। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন সর্পের সত্তাটি প্রাতিভাসিক।

অদ্বৈতমতে কেবল ব্রহ্মের পারমার্থিক সত্যতা আছে। জগতের ব্যবহারিক সত্যতা আছে, কিন্তু পারমার্থিক সত্যতা নেই। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন সর্পের সত্তাটি প্রাতিভাসিক। আবার যখন সর্পের যথার্থ জ্ঞান হয়, তখন সর্পের সত্তাটি ব্যবহারিক। বস্তু বিষয় না থাকলে বিষয়ের জ্ঞান হয় না। যেমন আকাশকুসুমের জ্ঞান হয় না। সেহেতু আকাশকুসুম নেই। কিন্তু প্রাতিভাসিক ও ব্যবহারিক জগতের জ্ঞান আমাদের হয়। সুতরাং, প্রাতিভাসিক এবং ব্যবহারিক দুটি জগৎ আছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই যে যদি একমাত্র এক অদ্বয় ব্রহ্মই সত্য হয়, তাহলে প্রাতিভাসিক এবং ব্যবহারিক জগতের বিষয়গুলির জ্ঞান কিভাবে হয়?
উত্তরে শঙ্করাচার্য এবং তার অনুগামী অদ্বৈতবাদীরা বলেন, প্রাতিভাসিক এবং ব্যবহারিক জগৎ হলো অবিদ্যার রূপান্তর। ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিকের ভেদ হলো যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা ও ভ্রমের ভেদ। অবিদ্যা বা মায়ার দ্বারা এই ব্যবহারিক জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। রজ্জুকে যখন রজ্জুরূপে জানা হয়, তখন রজ্জুর ব্যবহারিক সত্তা সমষ্টিগতভাবে স্বীকৃত হয় অর্থাৎ ঐ সত্তা অন্যেরাও স্বীকার করেন। কিন্তু রজ্জুকে যখন সর্পরূপে জানা হয়, তখন সর্পের প্রাতিভাসিক সত্তা সমষ্টিগতভাবে স্বীকৃত হয় না। রজ্জুতে সর্পের প্রতিভাস সর্পের সত্তা অবিদ্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বিশেষের নিকটই স্বীকৃত। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন সেই সর্পের কোন অস্তিত্ব থাকে না। কেবলমাত্র রজ্জুর বা মিথ্যা সর্পের অধিষ্ঠানটির অস্তিত্ব থাকে। এক্ষেত্রে সর্পটি হলো রজ্জুর প্রতিভাস, বিবর্ত বা অসত্য রূপান্তর। অনুরূপভাবে ব্যবহারিক জগৎ ব্রহ্মের সত্য পরিণাম নয়, ব্রহ্মের বিবর্তমাত্র। মায়া বা অবিদ্যার প্রভাবে জগতের প্রকৃত অধিষ্ঠানটিকে আমরা জানতে পারি না, কেবলমাত্র জগৎ প্রপঞ্চকেই জানতে পারি। এভাবে ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক সত্তার ভেদের মাধ্যমে অদ্বৈতবেদান্তী সর্বজনসিদ্ধ ভ্রমের বিষয় ও প্রমার বিষয়ের ভেদকেই ব্যক্ত করেছেন। ভ্রমের বিষয় প্রাতিভাসিক সৎ, কিন্তু প্রমার বিষয় ব্যবহারিক সৎ।

আবার প্রাতিভাসিক সত্তা ও ব্যবহারিক সত্তা ভিন্ন হলেও উভয় সত্তাই সৎ ও অসৎ থেকে ভিন্ন। যা সৎ ও অসৎ থেকে ভিন্ন , তাকেই অদ্বৈতবেদান্তী মিথ্যা বলেন। তাই প্রাতিভাসিক ও ব্যবহারিক সত্তাবিশিষ্ট উভয়প্রকার বিষয়ই অদ্বৈতমতে মিথ্যা। উভয়প্রকার সত্তাই পরবর্তীকালে বাধিত বা খণ্ডিত হয়। অন্যদিকে অসৎ ভাবরূপে প্রতিভাতই হয় না। যা চৈতন্যের সঙ্গে কোনভাবে যুক্ত নয়, তা প্রতিভাত হতে পারে না। কিন্তু মিথ্যা বিষয় ভাবরূপে প্রতিভাত হয়। মিথ্যা বিষয় চৈতন্যময় ব্রহ্মে অধ্যস্ত এবং ব্রহ্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে মিথ্যা বিষয়ের মধ্যে প্রমার বিষয় (ব্যবহারিক সৎ) সমষ্টিগতভাবে সমর্থিত, কিন্তু ভ্রমের বিষয় (প্রাতিভাসিক সৎ) একান্তই ব্যক্তিগত। মিথ্যামাত্রই অবিদ্যাজন্য, তাই ব্যবহারিক ও প্রাতিভাসিক উভয় সত্তাই অবিদ্যাজন্য। ব্যবহারিক সত্তার জনক অবিদ্যাকে বলা হয় মূলাবিদ্যা এবং প্রতিভাসিক সত্তার জনক অবিদ্যাকে বলা হয় তুলাবিদ্যা।

এবার প্রশ্ন হলো, অদ্বৈতমতে কী অর্থে জগৎ মিথ্যা? সাধারণ চিন্তার যে আকার তা শঙ্করাচার্যের জগৎ সম্পর্কিত বক্তব্যকে ধারণ করতে পারে না। কেননা আমরা যখন কোন বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন সেই চিন্তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাসটি এরকম যে, হয় সেই বিষয়টির অস্তিত্ব আছে, কিংবা সেই বিষয়টির অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব পরস্পরবিরোধী। এই কারণে একটি বিষয় আছে আবার নেই, এরূপ চিন্তা আমরা করতে পারি না। কিন্তু শঙ্করাচার্যের মতে এই জগৎ আছে আবার নেইও, এই জগৎ কাল্পনিক, আবার কাল্পনিক নয়। যতদিন আমরা বদ্ধ অবস্থায় থাকি, ততদিন আমাদের আত্মোপলব্ধি হয় না। অর্থাৎ, ততদিন আমরা এই জগৎ সংসারকে তুচ্ছ বলে ভাবতে পারি না। শঙ্করাচার্য একমাত্র ব্রহ্মকেই সৎ বলেছেন। একমাত্র ব্রহ্মেরই প্রকৃত সত্তা আছে। জগতের ব্যবহারিক সত্যতা আছে; কিন্তু পারমার্থিক সত্যতা নেই। তিনি আরো বলেন, যা সৎ বা সত্য তা কোন দেশে এবং কোন কালেই বাধিত হয় না। যা অসৎ বা তুচ্ছ, আকাশকুসুমের মতো কোন কালেই জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। বদ্ধ অবস্থায় মোক্ষলাভ না হওয়া পর্যন্ত এই জগতকে কেউ অসৎ বা তুচ্ছ মনে করতে পারে না। তাই জগৎকে অসৎরূপে বর্ণনা করা যায় না। মোক্ষলাভ বা ব্রহ্মলাভ হবার পরেই এই জগৎ অন্তর্হিত হয়। যেহেতু এই জগৎ সর্বস্তরে থাকে না এবং সর্বকালেও থাকে না, সেহেতু এই জগতকে সৎ বলাও যায় না। পারমার্থিক সত্তায় জগৎ নেই, কেবল ব্যবহারিক সত্তাতেই জগৎ থাকে। যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞানের পরবর্তীকালে জগতের অস্তিত্ব থাকে না; ফলে জগতকে সৎ বলা যায় না। আবার অসৎও বলা যায় না। সুতরাং, জগৎ অনির্বচনীয়। ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ সৎ, কিন্তু পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ অসৎ।

উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, জগৎ মিথ্যা হলেও আকাশকুসুমের ন্যায় অসৎ নয়। আবার ব্রহ্মের ন্যায় অবাধিত ত্রিকালসৎও নয়। জগৎ তথা জাগতিক বিষয় ভাবরূপে প্রতীত হয়ে ব্যবহৃত হয়। অথচ ব্রহ্মোপলব্ধিতে জগৎ বাধিত ও খণ্ডিত হয়। জগতের সত্তা ব্রহ্ম-সাপেক্ষ। ব্রহ্ম-সংশ্লিষ্ট হয়েই জগৎ সত্তাযুক্ত হয়। শুদ্ধচৈতন্যই একমাত্র নিরপেক্ষ সৎ। জগৎ তাই নিরপেক্ষ সৎ নয়। জগৎ ব্রহ্মে অধ্যস্ত অর্থাৎ শুদ্ধচৈতন্য নামক সৎ অধিষ্ঠানে জগৎ আরোপিত। সৃষ্টির অর্থ এখানে আরোপ। অদ্বৈতবেদান্তে সৃষ্টি মানে উৎপন্ন নয়, সৃষ্টি বলতে আরোপ বা প্রক্ষেপকে বোঝানো হয়। তাই অদ্বৈতবেদান্তে জগতের সৃষ্টি বলতে ব্রহ্মে জগতের আরোপকে বোঝানো হয়েছে। রজ্জুর অধিষ্ঠানে সর্প যেমন আরোপিত হয়ে প্রতিভাত হয়, তেমনি জগৎ ব্রহ্মে আরোপিত হয়ে সৎ রূপে প্রতিভাত হয়। রজ্জুর জ্ঞানে সর্প যেমন মিথ্যা বলে জ্ঞাত হয়, তেমনি ব্রহ্মের জ্ঞানে জগৎ মিথ্যা বলে জ্ঞাত হয়। রজ্জুতে সর্পের আবির্ভাবের কারণ হলো অজ্ঞান বা অবিদ্যা। এই অবিদ্যার ফলেই ব্রহ্মের অধিষ্ঠানে ব্রহ্মের জ্ঞান না হয়ে ঘট-পটাদি জাগতিক বস্তু সৎরূপে আবির্ভূত হয়। অদ্বৈতমতে এরই নাম জগৎ-সৃষ্টি, যা বস্তুত অজ্ঞান, অবিদ্যা বা মায়ার ফল।

তবে এই অবিদ্যা বা মায়ার প্রেক্ষাপটে জগতের সংস্থান সম্পর্কে অদ্বৈত বৈদান্তিক দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। এ বিষয়ে দুটি মতের পরিচয় পাওয়া যায়। একটি সৃষ্টিদৃষ্টিবাদ এবং অপরটি হলো দৃষ্টিসৃষ্টিবাদ।

সৃষ্টিদৃষ্টিবাদ : সৃষ্টিদৃষ্টিবাদের প্রবক্তা হলেন অদ্বৈতবেদান্ত দর্শনের বিবরণ সম্প্রদায়ের দার্শনিকরা। তাদের মতে জগতের ভিত্তি মায়া বা অবিদ্যার অধিষ্ঠান হলো ব্রহ্ম। মায়া ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তি এবং বিকার বা বিভিন্ন প্রকারের পরিবর্তন সাধনে সমর্থ। এই জগৎ জীবাশ্রয়ী অবিদ্যার পরিণাম নয়, এই জগৎ হলো ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তির বা মায়ার পরিণাম। সুতরাং, সৃষ্টি কোন অর্থেই জীবের উপর নির্ভর করে না। ঈশ্বরের জড়াত্মিকা শক্তি মায়া এই জগৎকে সৃষ্টি করে। ফলে বদ্ধ জীবের কাছে এই ব্যবহারিক জগৎ সত্য ও প্রদত্ত বলে মনে হয়। ঈশ্বর বদ্ধজীবদের নিয়ন্ত্রণ করেন। এইজন্য ব্যবহারিক জগতে একজন ব্যক্তির জন্য ঈশ্বর যা সৃষ্টি করেছেন তা সেই ব্যক্তির অভিজ্ঞতার বিষয় হয়। ঈশ্বর তার সৃষ্টিশক্তি মায়ার দ্বারা জগতের যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি করেছেন। বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে- দেবতা এবং পৃথিবীর বহু সিদ্ধপুরুষও ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সৃষ্টি করতে পারেন। ব্রহ্মও সেরূপ পারেন। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৫)

জগৎকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায়। শ্রুতি ও জ্ঞানের দৃষ্টিতে জগৎ তুচ্ছ ও অসৎ। ব্যবহারিক যুক্তি পদ্ধতির বিচারে জগৎ অনির্বচনীয় এবং ব্যবহারিক জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ সত্য ও সৎ। অর্থাৎ, জগতের সত্তা ও অস্তিত্ব আছে- মায়ার সত্তা। মায়া জগতের আকারে পরিণত হয়, কিন্তু জগৎ মায়ার উপর নির্ভর করে না। ব্রহ্মই জগতের একমাত্র অবলম্বন। যেমন, প্রথমে তুলো থেকে সুতো প্রস্তুত হয়। তারপর সুতোগুলি কাপড়টি উৎপন্ন করে। সুতোগুলি কাপড়ের অধিষ্ঠান নয়, কাপড়ের প্রকৃত অধিষ্ঠান হলো তুলো। জগতের সৃষ্টির সঙ্গে জীবের কোন সম্পর্ক নেই। তাই এই জগৎ জীবের উপর কোনভাবেই নির্ভর করে না। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধানে তার মায়াশক্তি জগৎ সৃষ্টি করে। বেদান্তসূত্রানুযায়ী- জগৎ-কারণ ব্রহ্ম হয় সম্পূর্ণভাবেই জগতে পরিণত হয়েছেন- তা মানতে হয়, অথবা শাস্ত্রের বিরোধিতা করতে হয়- যেহেতু শাস্ত্র বলেছেন ব্রহ্ম অংশরহিত। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৬)

কিন্তু অদ্বৈতমতে জগতের ব্যবহারিক সত্তা অস্বীকার করা না গেলেও জগতের পারমার্থিক সত্তা থাকতে পারে না। কারণ জগতের বিষয়মাত্রই স্ববিরোধী। ব্যবহারিক স্তরে কোন অভিজ্ঞতার বিষয়েই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। যেমন, ‘লাল ফুল’ একটি ব্যবহারিক স্তরের অভিজ্ঞতার বিষয়। এখানে ‘লাল’ এবং ‘ফুল’ সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন নয়। কারণ ‘লাল’ ও ‘ফুল’- এই দুটি সম্পূর্ণ পৃথক শব্দ। আবার দুটি যে সম্পূর্ণ পৃথক, তাও বলা যায় না। কারণ ‘লাল রং’ অবলম্বনহীন অবস্থায় থাকতে পারে না। আবার লাল ও ফুলের সম্পর্কটি একটি গরুর সঙ্গে একটি ঘোড়ার বিজাতীয় সম্পর্কের মতোও নয়। লাল ও ফুল পরস্পরের সঙ্গে সমবায় সম্পর্কেও যুক্ত নয়। কারণ দুটির মধ্যে যদি সমবায় সম্বন্ধ স্বীকার করা হয়, তাহলে সেই সমবায় ‘লাল’ ও ফুলের সঙ্গে যুক্ত করতে আরেকটি তৃতীয় সম্বন্ধের প্রয়োজন হবে এবং এই প্রক্রিয়া অন্তহীনভাবে চলতে থাকবে। সুতরাং, ‘লাল ফুল’ এর প্রকৃতি কী তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যেহেতু স্ববিরোধী কোন বিষয়ের পারমার্থিক বা আধিবিদ্যক সত্তা থাকতে পারে না, সুতরাং, জগতের ব্যবহারিক সত্যতা আছে কিন্তু পারমার্থিক সত্যতা নেই। তাই জগৎকে মিথ্যা বা অধ্যস্ত বলার তাৎপর্য হলো এই যে, জগৎ অনির্বচনীয়।

শ্রুতিতে এই জগতের কারণ মায়াকেও ‘সদসৎ-বিলক্ষণানির্বচনীয়া’ বলা হয়েছে। যেহেতু মায়া সৎ থেকে পৃথক এবং অসৎ থেকেও পৃথক, সেহেতু অনির্বচনীয়। মায়া এই জগতের কারণ এবং জগৎ মায়ারই পরিণাম। সুতরাং, জগৎ সৎও নয়, অসৎও নয়, অতএব, সদসৎ বিলক্ষণ অনির্বচনীয়া।

দৃষ্টিসৃষ্টিবাদ : এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় মতবাদ অর্থাৎ, দৃষ্টিসৃষ্টিবাদের প্রবর্তক হলেন ভামতী সম্প্রদায়। বাচস্পতিমিশ্র এই মতের প্রবক্তা। তিনি বলেছেন যে, জীব যেহেতু বহু, অবিদ্যাও বহু। জীবই অবিদ্যার আশ্রয় বা অধিষ্ঠান এবং এই জগৎ ঐ জীবাশ্রয়ী অবিদ্যারই পরিণাম। জীব ও অবিদ্যা যেহেতু বহু, সেহেতু জগতে এতো বৈচিত্র্য। ব্রহ্ম জীবমাত্রেরই অধিষ্ঠান বলে অবিদ্যাগুলিরও অধিষ্ঠান এবং এই কারণে জগতেরও অধিষ্ঠান। এই কারণেই শ্রুতিতে ব্রহ্মকে জগতের উপাদানকারণ বলা হয়েছে। এবং এই একই কারণে শঙ্করাচার্য অবিদ্যাকে ‘পরমেশ্বরাশ্রিতা’ রূপে বর্ণনা করেছেন।

বাচস্পতিমিশ্র আরো বলেন যে অবিদ্যা দু’প্রকার- মূলাবিদ্যা এবং তুলাবিদ্যা। মূলাবিদ্যা হলো ঈশ্বরের উপাধি এবং তুলাবিদ্যা জীবাত্মায় অধিষ্ঠিত। বস্তুত তুলাবিদ্যাই জগৎ সৃষ্টি করে থাকে। অনাদিকাল থেকে জীবের সঞ্চিত সংস্কারই তুলাবিদ্যা। জগতের বহুত্ব তুলাবিদ্যারই সৃষ্টি, জীবাশ্রিত তুলাবিদ্যা বহুত্বকে ব্রহ্মের উপর আরোপ করে থাকে। ব্যবহারিক জগতের বহুত্বের ব্যাখ্যার জন্য বাচস্পতিমিশ্র মায়া বা মূলাবিদ্যার উপর গুরুত্ব দেননি। তার মতে মূলাবিদ্যা জগৎ সৃষ্টির সহকারি কারণ, মূল কারণ নয়। প্রতিটি জীব তার নিজস্ব অবিদ্যা সংস্কার অনুসারে নিজের জ্ঞানের ও ভোগের বিষয় সৃষ্টি করে থাকে।

এই মতে আমাদের অভিজ্ঞতার বিষয় যে জগৎ, তা সত্য নয়। কারণ পারমার্থিক সত্তায় এই জগৎ বাধিত হয়। বাচস্পতিমিশ্রের মতে যতক্ষণ একটা বিষয়ের জ্ঞান হয়, ততক্ষণ সেই বিষয়টির সত্তা প্রতীয়মান হয়। এক অর্থে জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়েরই কেবল প্রাতিভাসিক সত্তা আছে। তুলাবিদ্যার ক্রিয়ার ফলে জ্ঞান ও জ্ঞানের বিষয়ের উৎপত্তি হয়। ভ্রান্তপ্রত্যক্ষের বিষয়টি, উদাহরণস্বরূপ রজ্জুতে সর্পভ্রমে সর্পটি যেমন ব্যবহারিক জগতের অভ্রান্ত প্রত্যক্ষের দ্বারা বাধিত হয়, তেমনি সেই অভ্রান্ত প্রত্যক্ষটিও পারমার্থিক জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয়। কোন জ্ঞানের বিষয়েরই জ্ঞানাতিরিক্ত সত্তা বা অপ্রতীয়মান সত্তা নেই। সুতরাং, পারমার্থিক বিচারে সৃষ্টি নেই, ধ্বংস নেই, জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। জগৎ হলো জীবের অন্তর্ভুক্ত এক বিরাট ভ্রম। এইজন্যই জগৎ একটি অনির্বচনীয় প্রপঞ্চ। সুতরাং, এই মতে জীবাশ্রিত তুলাবিদ্যা হলো মূলাবিদ্যারই একটি অবস্থা বা কার্য। তুলাবিদ্যাগুলি মূলাবিদ্যা থেকে উদ্ভূত। ধ্বংসের পর তার আবার মূলাবিদ্যায় লীন হয়ে যায়। তুলাবিদ্যা এবং মূলাবিদ্যার মধ্যে সম্পর্কটি হলো যথাক্রমে অংশ এবং সমগ্রের সম্বন্ধ। অংশের ক্রিয়া বা ধর্মকে সমগ্রের ক্রিয়া বা ধর্মরূপ গণ্য করা হয়। যেমন একটা সাদা কাপড়ের কোন একটা অংশে একটা কালো দাগ থাকলে আমরা সমস্ত কাপড়টাকেই দাগযুক্ত মনে করি এবং ঐ দাগের জন্য সমস্ত কাপড়টিই অব্যবহার্য হয়ে যায়।

বস্তুতপক্ষে পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকেই জগৎ ও জাগতিক বিষয়কে মিথ্যা বলা যায়। এই মতবাদীরা সমষ্টিগত অনুভবসিদ্ধ, তা অবিদ্যাজন্য হলেও, জাগতিক বিষয়ের দৈনন্দিন ব্যবহারকে কখনোই অস্বীকার করেননি। উচ্চতর স্তর থেকেই জাগতিক বিষয়ের সত্তাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি। এই উচ্চতর স্তর হলো  পারমার্থিক স্তর। ব্যবহারিক স্তর থেকে জাগতিক বস্তুর ব্যবহারকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এজন্যই এই মতে ব্যবহারিক সত্তার জনক অবিদ্যা মূলাবিদ্যাকে প্রাতিভাসিক সত্তার জনক অবিদ্যা তুলাবিদ্যা থেকে পৃথক করা হয়েছে। তুলাবিদ্যার বিনাশে মূলাবিদ্যার বিনাশ হয় না। বরং মূলাবিদ্যার দ্বারাই তুলাবিদ্যা খণ্ডিত হয়। একমাত্র নিত্য, শুদ্ধ, চৈতন্যের উপলব্ধিতেই তুলাবিদ্যার সঙ্গে মূলাবিদ্যাও বিনষ্ট হয় এবং জগৎ ও জাগতিক বস্তু ব্রহ্মে বিলীন হয়ে এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মই সৎরূপে বিরাজ করে। পারমার্থিক জ্ঞানের দ্বারা জগৎ বাধিত হয় বলেই জগৎকে মিথ্যা বলা হয়- ‘জ্ঞানান্তরম্ বাধিতত্বম্ মিথ্যাত্বম্’।

জগৎ-সৃষ্টির প্রক্রিয়া : অদ্বৈতমতে জগতের যেহেতু ব্যবহারিক সত্যতা আছে, সেহেতু তারা জগতের সৃষ্টির পর্যায়গুলির বর্ণনাও দিয়েছেন। আগেই বলা হয়েছে, অদ্বৈতবেদান্তী বিবর্তবাদী। জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত। অজ্ঞান বা মায়াশক্তি আবরণরূপে ব্রহ্মকে আবৃত করে এবং বিক্ষেপ রূপে নশ্বর জগৎ-প্রপঞ্চ সৃষ্টি করে। শুদ্ধ চৈতন্য ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। উপাধি মায়া, ব্রহ্মকে আবৃত করে নিজের রূপকে ব্রহ্মে আরোপ করে। মায়া-উপাধিযুক্ত হয়ে ব্রহ্ম তখন সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সর্বনিয়ন্তা, সর্ববীজস্বরূপ জগৎ-কারণ ঈশ্বররূপে আবির্ভূত হন। ঈশ্বর ব্রহ্মাণ্ডের অব্যক্ত অন্তর্যামী কারণ। ক্রমশ তিনি ব্যক্ত, সূক্ষ্ম কারণ রূপ পরিগ্রহ করে হিরণ্যগর্ভ হন। তারপর তিনি ব্যক্ত স্থূলরূপ পরিগ্রহ করে বৈশ্বানর বা বিরাট হন। বিরাটরূপে তিনি স্থূলজগৎকে বিকশিত করেন।

অবিদ্যা-উপহিত ঈশ্বর চিৎ ও অচিৎবিশিষ্ট। সর্বপ্রথম ঈশ্বর মায়ার সহযোগে নামরূপ সমন্বিত সমগ্র বিশ্বের ধারণা সৃষ্টি করেন। তারপর তিনি সংকল্প করেন যে তিনি বহু হবেন। ঐ সংকল্পে অবিদ্যা-উপহিত ঈশ্বর থেকে ক্ষিতি (পৃথিবী বা মাটি), অপ্ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ)- এই পাঁচটি অপঞ্চীকৃত মহাভূত উপাদান বা তন্মাত্রের আবির্ভাব হয়। ব্যোমের ধর্ম হলো শব্দ। মরুতের ধর্ম হলো শব্দ এবং স্পর্শ। তেজের ধর্ম হলো শব্দ, স্পর্শ ও বর্ণ। অপ্-এর ধর্ম হলো শব্দ, স্পর্শ, বর্ণ ও স্বাদ। ক্ষিতির ধর্ম হলো শব্দ, স্পর্শ, বর্ণ, স্বাদ এবং গন্ধ। অবিদ্যাপ্রসূত বলে এই পঞ্চতন্মাত্র ত্রিগুণাত্মক বা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণবিশিষ্ট। সত্ত্বপ্রধান তন্মাত্র থেকে আবার পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় আবির্ভূত হয়- আকাশ থেকে শ্রোত্র বা কর্ণ, বায়ু থেকে ত্বক্, তেজ থেকে চক্ষু, অপ্ থেকে রসনা এবং ক্ষিতি থেকে নাসিকা।
পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও সত্ত্বপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র মিলিত হয়ে মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত উৎপন্ন হয়। অন্তঃকরণের এই চারটি অংশ হলো প্রকাশাত্মক অর্থাৎ, স্বচ্ছ। সুতরাং, এই অংশগুলিকে স্বত্ত্বগুণের কার্যরূপে গণ্য করতে হবে। অন্তঃকরণের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি হলো বুদ্ধি। যেমন একই ব্যক্তি পাচক, ছাত্র, শিক্ষকরূপে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে থাকে, তেমনি একই অন্তকরণকে তার কাজের ভিন্নতা অনুসারে মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকার বলা হয়।

আবার রজোগুণপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র থেকে বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ- এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়। রজঃপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র ও পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় মিলিতভাবে প্রাণ, অপান্, ব্যান, উদান ও সমান- এই পাঁচটি প্রাণ উৎপন্ন করে। আর তমোগুণপ্রধান পঞ্চতন্মাত্র থেকে উৎপন্ন হয় সূক্ষ্ম-শরীর ও আকাশাদি পঞ্চস্থূলভূত। স্থূলভূতগুলি পঞ্চীকৃত অর্থাৎ পঞ্চীকরণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন। পঞ্চীকৃত ভূতগুলি হলো যৌগিক উপাদান।

অদ্বৈত-বেদান্ত যেহেতু উপনিষদানুসারী দর্শন, তাই এর দার্শনিক ধারণাগুলির উৎস কিন্তু প্রাচীন উপনিষদগুলিই, যেমন- ব্রহ্মচক্রের সাধারণ পরিধি বা প্রান্তভাগ হলো মায়া বা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণের দ্বারা আবৃত। এর যোলটি অঙ্গ বা কলা (যথা- মন, পঞ্চমহাভূত, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়)। এই ব্রহ্মচক্রের পঞ্চাশটি দণ্ড বা শলাকা (অর্থাৎ, মায়াজনিত প্রমাদ ও বৈকল্য), কুড়িটি খিল বা খোঁটা, ছয় শ্রেণীর বৈচিত্র যার প্রতিটি আবার আট প্রকারের (অষ্টসিদ্ধি অলৌকিক শক্তি- অণিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাককাম্যম্, মহিমা, ঈশিত্বম্, বশিত্বম্ ও কামাবসায়িত)। এইসব দণ্ড, খিল ও বিভিন্ন অংশ যেগুলি বহুবিধ বন্ধনের প্রতীক, তারই উপর ব্রহ্মচক্র দাঁড়িয়ে আছে। এই চক্রের বিচরণভূমি তিনটি (পুণ্য বা ধর্ম, পাপ বা অধর্ম এবং জ্ঞান)। ইন্দ্রিয়ের প্রতি দুই আসক্তিই (সুখ-দুঃখের) মূল কারণ। আমরা সেই ব্রহ্মচক্রের ধ্যান করি (শ্বেতাশ্বতর-১/৪)। পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক) যে নদীর পাঁচটি ধারা। পঞ্চভূত (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি) জ্ঞানেন্দ্রিয়-রূপ নদীকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আঁকাবাঁকা ও খরস্রোতা করে তোলে। পঞ্চপ্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান ও সমান) এই নদীর ঢেউ। পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, উপস্থ ও পায়ু) এই নদীর তরঙ্গ এবং ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের উৎস যে মন, সেই মনই আবার এই নদীর উৎসমুখ। পাঁচটি গুণ (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ) যেন এই নদীর আবর্ত এবং পাঁচ রকমের দুঃখ (মাতৃগর্ভে থাকা, জন্ম, জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যু) এই নদীর তরঙ্গ-সংক্ষুব্ধ ঢাল। এই নদীর পাঁচটি ভাব (অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা, আমিত্ব বা অহঙ্কার, আসক্তি, দ্বেষ বা বিতৃষ্ণা, এবং কোনকিছু নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি) এবং পঞ্চাশ রকম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এর গতি। তবে একথা ভুললে চলবে না মনই বিচিত্র ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান, যাকে আমরা জগৎ বলি, তার কারণ (শ্বেতাশ্বতর-১/৫)।

অদ্বৈতমতে পঞ্চীকরণ প্রক্রিয়া হলো প্রতিটি স্থূলভূতেই পঞ্চভূতের সংমিশ্রণ। এই সংমিশ্রণ একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে হয়ে থাকে। প্রতিটি স্থূলভূতে সেই সূক্ষ্মভূতের অর্ধাংশ এবং অপর চারটি সূক্ষ্মভূতের এক-অষ্টমাংশ করে থাকে। অর্থাৎ স্থূল আকাশ = ১/২ সূক্ষ্ম আকাশ + ১/৮ সূক্ষ্ম বায়ু + ১/৮ সূক্ষ্ম অগ্নি + ১/৮ সূক্ষ্ম জল + ১/৮ সূক্ষ্ম পৃথিবী। এভাবে স্থূল বায়ু = ১/২ সূক্ষ্ম বায়ু + ১/৮ সূক্ষ্ম আকাশ + ১/৮ সূক্ষ্ম অগ্নি + ১/৮ সূক্ষ্ম জল + ১/৮ সূক্ষ্ম পৃথিবী ইত্যাদি। বিভিন্ন স্থূলভূত থেকে উৎপন্ন হয় চতুর্দশ ভুবন বা লোক (ভুঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্য- এই সপ্ত উর্ধ্বলোক এবং অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল, মহাতল এং পাতাল- এই সপ্ত নিম্নলোক), চতুর্বিধ স্থূলশরীর (জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ ও উদ্ভিজ্জ) এবং এই সব শরীরের উপযোগী অন্নপানাদি।

যৌগিক বা স্থূলভূতগুলির তমোগুণ প্রাধান্য পেলে সেগুলি বিশ্বের বস্তুতে পরিণত হয় এবং স্থূল শরীরগুলি গঠিত হয়। সরল ভূতগুলি থেকে সূক্ষ্ম শরীরগুলির সৃষ্টি হয়। সূক্ষ্ম শরীর দুই প্রকার, যথা- হিরণ্যগর্ভের সূক্ষ্ম শরীর এবং জীবের সূক্ষ্ম শরীর। হিরণ্যগর্ভের সূক্ষ্ম শরীর উৎকৃষ্ট এবং একে বলা হয় মহৎ তত্ত্ব। অপরপক্ষে জীবের সূক্ষ্ম শরীর হলো নিকৃষ্ট। ঈশ্বর হলেন পাঁচটি সূক্ষ্মভূতের অর্থাৎ, পঞ্চতন্মাত্র, পঞ্চমহাভূত, সপ্তদশ উপাদানবিশিষ্ট সূক্ষ্ম শরীর এবং হিরণ্যগর্ভের স্থূলশরীর উৎপাদনের অপরোক্ষ কারণ। বিশ্বের অন্যান্য বিষয়ের সৃষ্টি তিনি হিরণ্যগর্ভ, প্রজাপতি প্রভৃতির মাধ্যমে করেন।

পঞ্চতন্মাত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় উৎপন্ন দ্রব্যই অবিদ্যাসৃষ্ট, ব্রহ্মের উপাধি। এই সব উপাধি দ্বারা উপহিত ব্রহ্মই ‘জীব’ নামে অভিহিত। ব্রহ্মজ্ঞানে সকল উপাধি বিনষ্ট হয় এবং শুদ্ধচৈতন্য ব্রহ্ম আবরণমুক্ত হয়ে পুনঃপ্রকাশিত হন। তাছাড়া অদ্বৈতবেদান্তীরা সৃষ্টি ও ধ্বংসের পুনরাবৃত্তিতে বিশ্বাস করেন। ধ্বংসের প্রক্রিয়া সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীত। মূর্ত প্রপঞ্চ, অমূর্ত প্রপঞ্চে লীন হয়ে যায় এবং অমূর্ত প্রপঞ্চ অব্যাক্তৃত প্রপঞ্চে লীন হয়। অব্যাক্তৃত অর্থাৎ, অপ্রকাশিত অবশ্য অন্য কিছুতে লীন হয় না। কারণ তার কোন উপাদান কারণ নেই। একমাত্র মোক্ষলাভের সময়েই অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে নাশ হয়। উপনিষদীয় শ্রুতিতেও শাঙ্করদর্শনের এই প্রাক-ধারণাটুকু পাওয়া যায়- সর্বজ্ঞ ঈশ্বর এবং অজ্ঞ জীব উভয়ই অজাত (জন্মরহিত)। জীবের ভোগের জন্য মায়া-প্রকৃতি নানাবিধ ভোগ্যবস্তু সৃষ্টি করেন। কিন্তু পরমাত্মা অসীম, তাই তিনি সাক্ষীস্বরূপ। ভোক্তা, ভোগ্যবস্তু এবং ভোগ স্বয়ং- অর্থাৎ ‘জীব’, ‘প্রকৃতি’ (মায়া) এবং ঈশ্বর (পরমাত্মা)- এই তিনই ব্রহ্মে একাত্ম। এই সত্য উপলব্ধি করতে পারলে জীব মুক্ত হয় (শ্বেতাশ্বতর-১/৯)।

অদ্বৈতমতে মায়া বা অবিদ্যা

অদ্বৈত-বেদান্ত মতবাদের অন্যতম স্তম্ভ হলো মায়াবাদ। তবে মায়াবাদ একটি প্রাচীনতম ধারণা। বেদ এবং উপনিষদের মধ্যেই প্রথম মায়াবাদের ধারণা পরিলক্ষিত হয়। ঋগ্বেদে দুটি অর্থে ‘মায়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘প্রথমত, যে শক্তি বিভিন্ন রূপ সৃষ্টি করতে পারে তা-ই মায়া। দ্বিতীয়ত, যে শক্তি সত্যকে আবৃত করে রাখে তা-ই মায়া।’- (নীলিমা মণ্ডল, ভারতীয় দর্শন পরিচয়, পৃষ্ঠা-১৮৯)। আবার শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বরের মায়াশক্তি থেকেই জগতের উৎপত্তি হয়েছে।  যেমন- সেই পরমাত্মা যিনি মায়াবী (জালবান), যিনি নিজের মায়াশক্তিতে সকল জগৎ শাসন করেন, সেই একই শক্তিতে যিনি এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি অথবা বিনাশের কারণ, তিনি অদ্বিতীয়। যাঁরা এই সত্য জানেন, তারা অমর হন (শ্বেতাশ্বতর-৩/১)।  চারটি বেদ, বৈদিক যাগযজ্ঞ, সবরকমের উপাসনা এবং ধর্মীয় সাধনা, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ- সংক্ষেপে বেদে যা যা বলা হয়েছে তার সবকিছুই ব্রহ্ম থেকে এসেছে। নিজের মায়াশক্তি দিয়ে ব্রহ্ম এই জগৎ-সংসার সৃষ্টি করেন। আবার সেই একই শক্তির প্রভাবে জীবাত্মা মায়াময় জগৎ-সংসারে বাঁধা পড়ে (শ্বেতাশ্বতর-৪/৯)।  প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বরকে (তথা ব্রহ্মকে) মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ (অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র এবং সর্বজীবে বিরাজিত) (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)।

শঙ্করাচার্য ও তার অনুগামী দার্শনিকরা বেদ এবং উপনিষদের এই মায়াবাদকে যুক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছেন। অঘটন-ঘটনপটীয়সী যে শক্তি ব্রহ্মকে আবৃত করে তার উপর জগৎ-প্রপঞ্চকে আরোপ করে, অদ্বৈতবেদান্তে তাকে অজ্ঞান, অবিদ্যা বা মায়া বলা হয়েছে। এই অবিদ্যা, অজ্ঞান বা মায়ার দ্বারা উপহিত হয়েই স্বরূপত নির্গুণ ব্রহ্ম কল্যাণগুণাধার হয়ে সগুণ ঈশ্বর বা জগৎ-কারণ হন। মায়া নিজের ক্রিয়া ব্রহ্মে আরোপ করে বলেই মায়াকে ব্রহ্মের উপাধি বলা হয়েছে। মায়া-উপহিত এই চৈতন্যসত্তা জগৎপ্রপঞ্চের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ।

অদ্বৈতমতে উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। আর সব কিছুই- এই বিচিত্র জগৎ মিথ্যা- শুধু আপাত প্রতীয়মান সত্তামাত্র। জীব এবং ব্রহ্ম অভিন্ন, এক এবং অদ্বিতীয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে- সত্য যদি একই হন, তাহলে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা এই নানাত্ব অনুভব করি কেন? সত্য তো অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে যেতে পারে না। এজন্যেই শঙ্কর সত্য এবং আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে অদ্বৈতমতে আপাত বিরোধের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, জগতের এই নানাত্ব হলো মায়া। যখনই আমাদের ব্রহ্ম সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান জন্মে তখনই নানাত্ব থাকে না- সুতরাং তার কোন সত্যতা নেই। অন্ধকারে রজ্জুতে সর্প দর্শনের ন্যায় তা একটি ভ্রম। অবিদ্যার জন্যেই এই ভ্রান্তি। এই অবিদ্যা অনাদি। এই অবিদ্যাই যাবতীয় নানাত্ব দর্শনের কারণ- এজন্যই ব্রহ্মকে জগৎ বলে ভ্রম হয়। এই অবিদ্যার কারণেই জীবাত্মা নিজেকে উপাধিযুক্ত অর্থাৎ দেহ, ইন্দ্রিয়াদি যুক্ত বলে মনে করে। উপাধিগুলি জীবের উপর আরোপিত মাত্র। উপাধির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্যই জীব নিজেকে কর্তা ভোক্তা ইত্যাদি মনে করে। যদিও যথার্থত জীবাত্মার সঙ্গে উপাধির কোন সম্পর্কই নেই- তবু তা মায়াবলে সংসারাবদ্ধ হয়ে নিজেকে জন্ম, মৃত্যু, সুখ দুঃখাদির অধীন বলে মনে করে।

এখানে উল্লেখ্য, আচার্য শঙ্কর তার শারীরকভাষ্যে যদিও ‘মায়া’ ও ‘অবিদ্যা’ শব্দদ্বয়কে সমার্থকরূপে ব্যবহার করেছেন, তথাপি ভামতী সম্প্রদায়ের বাচস্পতিমিশ্রের মতো কোন কোন অদ্বৈতবেদান্তী এই শব্দদ্বয়ের পৃথক প্রয়োগ করেছেন। তাদের মতে জগৎ বিক্ষেপকারী, ঈশ্বরের উপাধি, সমষ্টিগত অজ্ঞান, মূলাবিদ্যাই হলো মায়া; আর জীবের উপাধি, আবরণকারী, ব্যক্তিগত অজ্ঞান, তুলাবিদ্যাই হলো অবিদ্যা।

মায়ার স্বরূপ : এখন প্রশ্ন হলো- এই উপাধি বা মায়ার স্বরূপ কী। অদ্বৈতবেদান্তে মায়ার স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে- ‘সদসদভ্যাম, অনির্বচনীয়ম্, ত্রিগুণাত্মকম্, জ্ঞানবিরোধী, ভাবরূপম্, যৎকিঞ্চিৎ’।

  • সদসদভ্যাম : বেদান্তমতে ব্রহ্মের অতিরিক্ত কোন সৎ বস্তু নেই। যা সৎ, তা নিত্য। অজ্ঞান পরমসত্তার জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়। কারণ, মায়া বা অজ্ঞান ব্রহ্মের মতো অবাধিত বা পারমার্থিক সত্তা নয়। সৎ বস্তু কখনো বাধিত বা বিনাশ হয় না। কিন্তু অজ্ঞান জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয়। যেমন রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন রজ্জুতে সর্পের জ্ঞান হয়েছিলো। কিন্তু পরে আমরা জানি যে ঐ সর্প মিথ্যা। অতএব আমার অজ্ঞান ধ্বংস হয়। সুতরাং অজ্ঞানকে সৎ বলা যায় না। আবার দৃশ্যমান জগতের বিক্ষেপক অজ্ঞানকে অসৎও বলা যায় না যেহেতু সর্পের জ্ঞান হয়েছিলো। অজ্ঞানের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রত্যক্ষানুভব প্রমাণ। রজ্জুতে সর্পভ্রম প্রভৃতি অজ্ঞানের বিষয় প্রত্যক্ষীভূত ঘটনা। এইজন্য ঐ সর্পটি আকাশ-কুসুমের মতো সম্পূর্ণ অসৎ বা অলীক নয়। অলীক কখনো প্রত্যক্ষ হয় না। আবার অজ্ঞানকে একইসঙ্গে সৎ ও অসৎ অর্থাৎ সদসৎও বলা যায় না। কারণ একই বস্তুতে সত্তা ও সত্তার অভাবরূপ পরস্পর বিরোধী ধর্ম একসঙ্গে থাকতে পারে না। সৎ ও অসৎ পরস্পর বিরুদ্ধ, এবং বিরুদ্ধভাবের অভিন্ন আশ্রয় অসম্ভব। তাই অজ্ঞান বা মায়াকে সদসৎও বলা যায় না।
  • অনির্বচনীয়ম্ : যেহেতু অজ্ঞান সৎ, অসৎ ও সদসৎ নয়, সেহেতু অদ্বৈতমতে অজ্ঞান সদসৎ ভিন্ন বা অনির্বচনীয়। যাকে সৎ, অসৎ ও সদসৎ- কোন রূপেই নির্দেশ করা যায় না, তা-ই অনির্বচনীয়। এই অর্থে কোন বস্তু হয় সৎ অথবা অসৎ হবে, এমন কোন কথা নেই। এমন বস্তুও থাকতে পারে, যা সৎও নয়, আবার অসৎও নয়। মায়া বা অজ্ঞান এরূপ সদসদবিলক্ষণ। সদসদবিলক্ষণকেই অদ্বৈতমতে অনির্বচনীয় বলা হয়। তাই বেদান্তসার গ্রন্থে মায়াকে বলা হয়েছে- ‘সদসদভ্যাম অনির্বচনীয়ম্’। অর্থাৎ, মায়া সৎরূপে, অথবা অসৎরূপে অথবা সদসৎরূপে বচনীয় নয়।
  • ত্রিগুণাত্মকম্ : অদ্বৈতমতে মায়া হলো ত্রিগুণাত্মক। অর্থাৎ, সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ- এই তিনটি গুণ দিয়ে মায়া গঠিত। যেহেতু মায়ার দ্বারা সৃষ্ট এই জগতের বস্তুগুলির মধ্যে সত্ত্ব, রজো এবং তমো গুণগুলি দেখা যায়, সেহেতু এই জগতের কারণ মায়াকে ত্রিগুণাত্মক বলা হয়েছে। সত্ত্ব প্রভৃতি গুণগুলির কার্য আমরা আমাদের সুখ, দুঃখ ও অবসাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করি। মায়া সম্পূর্ণরূপে অবোধ্য নয় যেহেতু মায়ার ত্রিগুণাত্মক ধর্মটি আছে। অজ্ঞানজন্য যাবতীয় পদার্থেই এই ত্রিবিধ গুণ পরিলক্ষিত হয়।
  • জ্ঞানবিরোধী : মায়া বা অজ্ঞান জ্ঞানবিরোধী। জ্ঞানের উদয়ে মায়া বা অজ্ঞান বাধিত বা অন্তর্হিত হয়। জ্ঞান ও অজ্ঞান পরস্পরবিরোধী। একটা বিশেষ অধিষ্ঠানে অজ্ঞান থাকলে তা বিষয়কে আবৃত করে। সেই একই অধিষ্ঠানে একই বিষয়ের অভ্রান্ত জ্ঞান হলে অজ্ঞানটি বাধিত হয়। রজ্জুর সম্যগ্জ্ঞানে রজ্জুতে আভাসিত সর্প যেমন বিলুপ্ত হয়, সেরূপ জ্ঞানের আবির্ভাবে অজ্ঞান দূর হয়। এ কারণে মায়া বা অজ্ঞানকে জ্ঞানবিরোধী বলা হয়েছে।
  • ভাবরূপম্ : মায়া বা অজ্ঞানকে ভাবরূপ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, মায়া বা অজ্ঞান জ্ঞানের অভাব নয়, এটি ভাবরূপ বা ভাব পদার্থের মতো। কিন্তু মায়া যেহেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, সেহেতু এটি সম্পূর্ণ ভাব পদার্থ নয়। মায়া ভাবপদার্থ এ কারণে যে, মায়া বন্ধ্যাপুত্র বা আকাশকুসুমের মতো অলীক নয়। মায়া যদি আকাশকুসুমের মতো অভাবপদার্থ হতো, তাহলে তার অভিজ্ঞতা আমাদের কখনোই হতো না। আবার অজ্ঞান কেবল বস্তুর স্বরূপ আচ্ছাদন করে না, এক বস্তুতে অন্য বস্তুর প্রতিভাসের সৃষ্টি করে। বিক্ষেপকর্ম সব সময় ভাবাত্মক। তাই অজ্ঞান শুধু জ্ঞানের অভাব নয়, মিথ্যাজ্ঞানও বটে। অবশ্য অজ্ঞানের এই ভাবরূপ চিৎ আত্মার ভাবরূপ থেকে পৃথক। চিৎ আত্মার ভাবরূপ নিত্য, অজ্ঞানের ভাবরূপ অনিত্য। অজ্ঞান ভাবরূপ হলেও তা ব্রহ্মের ন্যায় পারমার্থিক ভাবপদার্থ নয়। ব্রহ্মের ন্যায় পারমার্থিক ভাবপদার্থ হলে অজ্ঞানের বিনাশ সম্ভব হতো না, কিন্তু আমরা জানি যে, প্রকৃতজ্ঞানের আবির্ভাবে অজ্ঞান বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া শ্রুতিতেও বলা হয়েছে যে, মায়া বহু বিচিত্র বিশ্ব সংস্কারের ভিত্তি। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে- মায়াপ্রকৃতি (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ) নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল, কেউ বা সাদা আবার কেউ কালো (অর্থাৎ, তারা আগুন, জল আর মাটি দিয়ে তৈরি)। (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)। অজা অর্থ হলো মায়া যার জন্ম নেই অর্থাৎ অনাদি। লোহিত বা লাল রজো গুণ, শুক্ল বা সাদা সত্ত্ব গুণ এবং কৃষ্ণ বা কালো তমো গুণকে নির্দেশ করে। মায়া ঐ তিনটি গুণস্বরূপ। সুতরাং, মায়া যেহেতু ভাব পদার্থের ভিত্তি সেহেতু মায়া কখনোই অভাব পদার্থ নয়।
  • যৎকিঞ্চিৎ : মায়াকে বলা হয়েছে ‘যৎ কিঞ্চিৎ ইতি’। অর্থাৎ, মায়ার প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারি না। মায়া অস্থির ও অনির্বচনীয় কিছু। ব্রহ্মের থেকে মায়া সম্পূর্ণ পৃথক নয়। শ্রুতিতে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-৩/১, ৪/৯) মায়াকে ব্রহ্মের শক্তি বলা হয়েছে। মায়া ব্রহ্মের থেকে অপৃথকও নয়। কারণ চৈতন্য ও জড়ের অভেদ সম্ভব নয়। ভেদ ও অভেদ পরস্পর বিরোধী সম্পর্ক বলে একই পদার্থে একই সঙ্গে ভেদ ও অভেদ থাকতে পারে না। আবার মায়া নিরবয়ব বা অংশহীন নয়। যেহেতু কোন নিরংশ পদার্থ কোন কিছুর কারণ হতে পারে না। অথচ মায়া জগতের কারণ। আবার মায়ার অংশ আছে- একথাও বলা যায় না। কারণ তাহলে মায়া একটি উৎপন্ন দ্রব্যে পরিণত হবে। সেক্ষেত্রে যেহেতু উৎপন্ন দ্রব্য মাত্রেরই আরম্ভ আছে, সেহেতু মায়ার আরম্ভকে স্বীকার করতে হবে। তাহলে মায়াতে প্রতিফলিত ব্রহ্মও সাদি অর্থাৎ, সীমিত হয়ে পড়বে। এই কারণে মায়াকে অনির্বচনীয় বলা হয়েছে এবং ‘যৎ কিঞ্চিৎ ইতি’ রূপে মায়াকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

মায়ার শক্তিদ্বয় : শঙ্করাচার্যের মতে মায়া ও অবিদ্যা এক ও অভিন্ন। জীবের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা অবিদ্যা, ব্রহ্মের দিক থেকে তাই মায়া। অজ্ঞ ব্যক্তির কাছে মায়া হলো অবিদ্যা। অবিদ্যার দুটি শক্তি- একটি আবরণশক্তি এবং অপরটি বিক্ষেপশক্তি। আবরণ শক্তির দ্বারা অবিদ্যা প্রথমে তার অধিষ্ঠানকে আবৃত করে। বিক্ষেপ শক্তি দ্বারা অবিদ্যা সেই অধিষ্ঠানে অন্য এক মিথ্যা বস্তুকে আরোপ করে। যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম। এই অধ্যাস বা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রথমে রজ্জুর যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ঘটে এবং পরে রজ্জুতে মিথ্যা সর্পকে আরোপ করা হয়। ঠিক একইভাবে অবিদ্যাবশত নির্গুণ ব্রহ্মে জগৎ বা ঈশ্বর ভ্রম হয়। অর্থাৎ, ব্রহ্মের মায়াশক্তির বলে ‘এক’ ব্রহ্মের স্থলে বহু বস্তু দৃষ্ট হয়। সুতরাং, জগৎ মিথ্যা। এক্ষেত্রে ‘জগৎ মিথ্যা’ অর্থ হলো ‘বহু মিথ্যা’ বা ‘ভেদ মিথ্যা’।

আবরণশক্তির কাজ সত্যকে আচ্ছাদন করে রাখা। অজ্ঞানের এই আবরণশক্তি আত্মার যথার্থ স্বরূপকে আবৃত করে রাখে। বিক্ষেপশক্তির কাজ মিথ্যাকে প্রকাশ করা। অজ্ঞানবশত রজ্জু যেমন সর্পেরূপে প্রকাশিত হয়, সেরূপ অজ্ঞানবশতই পরমাত্মায় কর্তৃত্ব, ভোক্তৃত্ব ইত্যাদি প্রকাশ পায়। কোন বস্তু আবরণশক্তি দ্বারা বাধিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তার মিথ্যারূপ প্রকাশ পায়। অদ্বৈতমতে বিক্ষেপশক্তি হলো সৃষ্টিশক্তি। অজ্ঞানের এই বিক্ষেপশক্তি অনিত্য জগৎ সৃষ্টিকারী। অদ্বৈতমতে অজ্ঞানের আবরণশক্তি ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপকে আবৃত করে এবং বিক্ষেপশক্তি ব্রহ্মকে জগৎরূপে প্রকাশ করে।

মায়া ও অবিদ্যায় ভেদ-অভেদ : শঙ্করাচার্য এবং কিছু অদ্বৈত বৈদান্তিকদের (বিবরণ সম্প্রদায়) মতে মায়া ও অবিদ্যা এক ও অভিন্ন হলেও অন্য কিছু অদ্বৈত বৈদান্তিকদের (ভামতী সম্প্রদায়) মতে মায়া এবং অবিদ্যা এক নয়। তাদের মতে মায়া সদর্থক এবং ভাবরূপ, যদিও সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল এবং ব্রহ্ম থেকে অবিচ্ছেদ্য। অপরপক্ষে অবিদ্যা সম্পূর্ণ নঞর্থক ও অভাবরূপ। কারণ অবিদ্যার অর্থ হলো বাস্তব সত্তার জ্ঞানের অভাব।
দ্বিতীয়ত, মায়া ঈশ্বরকে সীমিত করে। কিন্তু ঈশ্বর অবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত বা আচ্ছন্ন হন না। অবিদ্যা হলো ব্যক্তির জ্ঞানের অভাব। অবিদ্যা জীবকে অবচ্ছিন্ন বা সীমিত করে। মায়াতে প্রতিফলিত ব্রহ্ম হচ্ছে ঈশ্বর এবং অবিদ্যায় প্রতিফলিত ব্রহ্ম হচ্ছে জীব। তাই জ্ঞানের দ্বারা ব্যক্তির অবিদ্যা দূর হয়। কিন্তু মায়া ব্রহ্মের অন্তর্নিহিত শক্তি বলে ব্যক্তির জ্ঞানের দ্বারা মায়া অপসারিত হয় না।
তৃতীয়ত, মায়া প্রধানত সত্ত্ব গুণসম্পন্ন। কিন্তু অবিদ্যা সত্ত্ব, রজো ও তমো গুণের দ্বারা গঠিত।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উক্ত দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ অদ্বৈতবেদান্তের মূল তত্ত্বগুলি উভয়পক্ষই গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া উভয়পক্ষই স্বীকার করেন যে, ঈশ্বর অজ্ঞানের নঞর্থক দিকের দ্বারা প্রভাবিত হন না। এবং তার মধ্যে সত্ত্ব গুণেরই প্রাধান্য আছে। সুতরাং, আবরণকে তুলাবিদ্যা বলা হলে এবং বিক্ষেপকে মায়া বা মূলাবিদ্যা বলা হলেও প্রকৃত তত্ত্বটি অবিকৃত থেকে যায়।

অজ্ঞানের অস্তিত্ব প্রমাণ : অজ্ঞানের অস্তিত্ববিষয়ে প্রত্যক্ষানুভব ও শ্রুতি হলো প্রমাণ। আমরা প্রত্যেকেই ‘আমি অজ্ঞ’ এইরূপ অবস্থা সরাসরি উপলব্ধি করি। তাছাড়া শ্রুতিতেও বলা হয়েছে- ‘দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈঃ নিগূঢ়াম্’।

প্রশ্ন হতে পারে যে, মায়া বা অজ্ঞান এক না বহু? বেদান্তসারের বক্তব্য অনুসারে মায়াকে এক এবং বহু, উভয়রূপেই চিন্তা করা সম্ভব। সমগ্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অজ্ঞান হলো এক। আবার প্রতিটি জীবকে পৃথকভাবে চিন্তা করলে অজ্ঞান বহু। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, অজ্ঞান দু’ধরনের- সমষ্টি অজ্ঞান ও ব্যষ্টি অজ্ঞান। বন বললেই যেমন বিশেষ বিশেষ বৃক্ষের সমষ্টি সমস্ত গাছের একযোগে প্রতীতি হয়, জলাশয় যেমন জলবিন্দুর সমষ্টি, অনুরূপভাবে অন্তঃকরণ উপাধিভেদে জীবগত অজ্ঞান বহু হয়েও সমষ্টিরূপে অজ্ঞান এক। আবার সমষ্টিরূপে অজ্ঞান এক হলেও বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ হিসেবে বৃক্ষ যেমন বহু, বিন্দু বিন্দু জলকণা হিসেবে জল যেমন বহু, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন জীবের অজ্ঞান হিসেবে ব্যষ্টিরূপে অজ্ঞান বা মায়া হলো বহু।

অদ্বৈতমতে সমষ্টি অজ্ঞান ঈশ্বরের উপাধি। ব্যষ্টি অজ্ঞান অজ্ঞ জীবের উপাধি। ঈশ্বরের উপাধিরূপে সমষ্টি অজ্ঞান বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণপ্রধান। অর্থাৎ ঈশ্বরের উপাধিরূপে সমষ্টি অজ্ঞানে সত্ত্বগুণ বেশি পরিমাণে বর্তমান থাকে। ব্যষ্টি জীবের উপাধিরূপে, অজ্ঞান মলিনসত্ত্বপ্রধান। অর্থাৎ অজ্ঞ জীবের উপাধি হিসেবে ব্যষ্টি অজ্ঞানে সত্ত্বগুণ অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে থাকে। ব্যষ্টি অজ্ঞানে রজঃ ও তমঃ গুণ মিশ্রিত থাকায় জীবের প্রকাশশক্তি কম। এজন্য জীবকে প্রাজ্ঞ বলা হয়। ঈশ্বর হলেন সর্বজ্ঞ।

অন্যভাবে সমষ্টি অজ্ঞানকে মূলাবিদ্যা এবং ব্যষ্টি অজ্ঞানকে তুলাবিদ্যা বলা হয়। অজ্ঞানের এই যে সমষ্টি ও ব্যষ্টি বিভাগ, তা কল্পিত বিভাগমাত্র। বন ও বৃক্ষ যেমন বস্তুত এক, জল ও জলাশয় যেমন বস্তুত এক, তেমনি সমষ্টি ও ব্যষ্টি অজ্ঞান বস্তুত এক ও অভিন্ন। একই মায়াশক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুযায়ী নামের এই ভিন্নতা। অদ্বৈতবেদান্তী এই উভয়প্রকার উপহিত চৈতন্যের উর্ধ্বে এক ও অদ্বিতীয় তুরীয়চৈতন্যবাদী। সেই তুরীয়চৈতন্যই পরমাত্মা বা ব্রহ্ম। অঘটন-ঘঁটন-পটীয়সী জগৎ বিক্ষেপকারী অনাদি মায়া যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ব্রহ্মের অতিরিক্ত তার কোন সত্তা নেই। এই অবিদ্যাতত্ত্ব, মায়াতত্ত্ব বা বিবর্ততত্ত্ব যে কেবলাদ্বৈতবাদীর জগৎ ব্যাখ্যার পক্ষে এক অপরিহার্য তত্ত্ব, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মায়ার সাথে ব্রহ্ম ও জগতের সম্বন্ধ : মায়ার সঙ্গে ব্রহ্মের সম্বন্ধ কী?  শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম মায়া শক্তির প্রভাবে জগৎরূপে প্রতিভাত হয়। মায়া ব্রহ্মেরই শক্তি। আগুনের দাহিকা শক্তিকে যেমন আগুন থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়, তেমনি ব্রহ্মের মায়াশক্তিকে ব্রহ্ম থেকে পৃথক করা যায় না। বস্তুত মায়ার আশ্রয় এবং বিষয় উভয়ই ব্রহ্ম। তবে ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হন না। এই প্রেক্ষিতে শ্বেতাশ্বতর-এ একটি উপমাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়-
যাদুকর ইন্দ্রজাল রচনা করেন। যাঁরা অজ্ঞ ব্যক্তি তারাই যাদুকরের ঐন্দ্রজালিক ঘটনাগুলিকে সত্য বলে মনে করেন। কিন্তু যাদুকর তার ইন্দ্রজালের দ্বারা অপরকে প্রভাবিত করলেও নিজে প্রভাবিত হন না। সুতরাং, মায়া এবং ব্রহ্ম দুটি পৃথক সত্তা নয়।

মায়ার সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ কী?  অদ্বৈতবেদান্ত অনুসারে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা। মায়া সগুণ ব্রহ্মের শক্তিরূপে তার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং, মায়া এই জগতের কারণ। জগৎ হলো মায়ার পরিণাম। অদ্বৈতমতে সত্তাত্রৈবিধ্যবাদ অনুসারে অদ্বৈত সত্তাকে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করা হয়। যথা- পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রাতিভাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। ব্রহ্মজ্ঞান হলে যাকে একমাত্র সৎ বলে প্রতীয়মান হয় তার সত্তা হলো পারমার্থিক সত্তা। এই অর্থে ব্রহ্ম হলেন পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। কিন্তু যতক্ষণ আমিই ব্রহ্ম- এরূপ উপলব্ধি না হয়, ততক্ষণ যে সব পদার্থ সৎরূপে প্রতীয়মান হয়, সেগুলি হলো ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। এই কারণে অদ্বৈতমতে জগতের ব্যবহারিক সত্তা স্বীকার করা হয়েছে। জগতের যেহেতু ব্যবহারিক সত্তা আছে, জগতের কারণ মায়াও ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৎ। কারণ এবং কার্যের সত্তা যদি সমান হয় তাহলে কার্যটি হয় কারণের পরিণাম। সুতরাং, জগৎ হলো মায়ার পরিণাম। কিন্তু উপাদান কারণ এবং কার্যের সত্তা যদি ভিন্ন হয় তাহলে কার্যটি হলো কারণের বিবর্ত। সুতরাং, জগৎ হলো ব্রহ্মের বিবর্ত।

বস্তুত মায়ার আশ্রয়রূপে সগুণ ব্রহ্ম জগতের অপরিবর্তনশীল উপাদান কারণ বা বিবর্ত উপাদান কারণ। কারণ, যদি ব্রহ্মকে উপাদান কারণ বলে গণ্য করা না হয়, তাহলে কয়েকটি শ্রুতিবাক্যের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় না। যেমন ‘এক বিজ্ঞানেন সর্ববিজ্ঞানম্’ বা ‘এক বিজ্ঞানেই সর্ববিজ্ঞান সিদ্ধ হয়’, ‘ব্রহ্মৈবেদম্ অসর্বম্’ ‘আত্মৈবেদম্ অসর্বম্’- এই বাক্যগুলিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। আবার মায়ারূপ উপাধিযুক্ত ব্রহ্ম মায়াতে প্রতিফলিত হলে তার ঈক্ষণবৃত্তির উদয় হয়। ঈক্ষণবৃত্তি হলো জগৎ সৃষ্টির সংকল্প। এই কারণে শঙ্করাচার্য ব্রহ্মকে জগতের নিমিত্ত কারণও বলেছেন। তার মতে ব্রহ্মকে উপাদান ও নিমিত্ত- এই দ্বিবিধ কারণ বলা উচিত। কারণ তাহলে শ্রুতির প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের বিরোধ হয় না। শ্রুতিতে এরকম প্রতিজ্ঞা আছে- এক বিজ্ঞানেই সর্ববিজ্ঞান সিদ্ধ হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা হয়েছে- ঘট প্রভৃতির উপাদান কারণস্বরূপ এক মৃৎপিণ্ডকে জানলে যেমন সমস্ত মৃন্ময় বস্তুরই জ্ঞান হয় ইত্যাদি। উপাদান কারণের জ্ঞান না থাকলে এক বিজ্ঞানে সর্ববিজ্ঞান হয় না। অতএব জগতের অন্য অধিষ্ঠাতা না থাকায় আত্মাই অধিষ্ঠাতা বা নিমিত্তকারণ এবং অন্য উপাদান না থাকায় আত্মাই জগতের উপাদান কারণ।

অদ্বৈতমতে জীব

শঙ্করাচার্য বর্ণিত অদ্বৈতবেদান্তের মূল সূত্রেই জীব সম্পর্কেও বলা আছে- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। তার মানে, শঙ্করের তৃতীয় বাণীটি হলো- ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ অর্থাৎ, জীব এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন তথা জীব ব্রহ্মস্বরূপ। এখন প্রশ্ন হলো, অদ্বৈত মতানুসারে সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ এবং অনন্ত সত্তাবিশিষ্ট। কিন্তু জীব তো সত্যস্বরূপ নয়, জ্ঞানস্বরূপ নয় এবং অনন্ত সত্তাবিশিষ্ট নয়। তাহলে জীব ও ব্রহ্মকে কিভাবে এক ও অভিন্ন বলা যাবে? উত্তরে বলা হয়, জীবেরও ব্রহ্মের মতোই সচ্চিদানন্দস্বরূপ হওয়া উচিত। অর্থাৎ আগুন এবং আগুনের একটা ফুলকি যে অর্থে এক, জীব ও ব্রহ্ম সেই অর্থেই অভিন্ন। কিন্তু জীবের ব্রহ্মস্বরূপতা আমাদের উপলব্ধি হয় না। কারণ দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি এবং বিষয়-বাসনার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ফলে জীবের জ্ঞান, ঐশ্বর্য ইত্যাদি তিরোহিত হয়। সংসারদশায় অবিদ্যা জীবের ব্রহ্ম-স্বভাবকে আবৃত করে রাখে। এই অবিদ্যা মলিনসত্ত্বপ্রধান-ব্যষ্টি-অবিদ্যা। এর ফলে জীব নিজেকে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।

জীবের সংসারদশা : ব্যবহারিক স্তরে ‘আমি’কে আমরা প্রত্যেকেই জানি। এই ‘আমি’ই হলো আমাদের জ্ঞান অনুভূতি ইচ্ছা ইত্যাদির অধিষ্ঠান ও কর্তা। ‘আমি জানি’, ‘আমি অনুভব করি’, ‘আমি ইচ্ছা করি’- এইসব বাক্যগুলির মধ্য দিয়ে সেই ব্যবহারিক আত্মা বা জীবের অস্তিত্ব বা বোধ প্রকাশিত হয়। আমার জ্ঞান, অনুভূতি ও ইচ্ছার কর্তা হলো আমি বা অহং। সুতরাং, এখানে জীব কর্তা এবং ভোক্তা। কিন্তু ব্রহ্ম কর্তা নয়, এবং জ্ঞানের বিষয়ও নয়। জানা, অনুভব করা এবং ইচ্ছা করা- এগুলি সবই চৈতন্যের ক্রিয়া। কিন্তু এই চৈতন্য শুদ্ধ চৈতন্য নয়। এগুলি মায়া বা অবিদ্যার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন বা সীমিত চৈতন্যের ক্রিয়া। শুদ্ধ-চৈতন্য থেকে ভিন্ন জীবাত্মাকে তাই সাক্ষী-চৈতন্য বলে। জ্ঞান, অনুভূতি ও ইচ্ছায় দ্বৈতভাব থাকে। যেমন- জ্ঞাতা ও বিষয়ের সম্পর্ক, অনুভব ও তার বিষয়ের সম্পর্ক, ইচ্ছা ও ইচ্ছার বিষয়ের সম্পর্ক। ব্রহ্ম কিন্তু অদ্বয় ও সকল প্রকার ভেদশূন্য। অপরপক্ষে কিছু জানতে গেলে, অনুভব করতে গেলে এবং কিছু ইচ্ছা হলে বিষয়ী ও বিষয়ের মধ্যে ভেদ অবশ্যম্ভাবী। তাই আমাদের অহং বা আমি-টি ব্রহ্ম নয়। অহং হলো অবিদ্যার দ্বারা সীমিত ব্রহ্ম বা জীব।

এ প্রেক্ষিতে শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলেন- আমাদের মধ্যে কারও পুত্র বা স্ত্রী প্রভৃতি যদি পীড়িত অথবা সুস্থ হয়, তাহলে, সে যথাক্রমে নিজ আত্মাকেই পীড়িত বা সুস্থ বলে বোধ করে থাকে- এটাই আত্মার উপর বাহ্যধর্মসমূহের অধ্যাস। এভাবে আমি স্থূল, আমি কৃশ, আমি গৌড়বর্ণ, আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমি চলছি ইত্যাদি নানাভাবে জীব নিজের উপর দেহের ধর্মগুলির আরোপ করে থাকে। এভাবে আমি মূক, আমি ক্লীব, আমি বধির, আমি কাণ, আমি অন্ধ ইত্যাদি নানাভাবে জীব নিজের উপর ইন্দ্রিয়গুলির ধর্মগুলিকে আরোপিত করে থাকে। এভাবেই আবার অন্তঃকরণের ধর্মগুলি অর্থাৎ কাম, সংকল্প, সংশয় ও নিশ্চয় প্রভৃতি- আত্মাতে আরোপ করে থাকে। এভাবেই আবার সেই আমি- এই প্রত্যয়যুক্ত জীবকে সকলপ্রকার মানসবৃত্তির সাক্ষী- সেই সর্বভূতের অন্তরাত্মাতে আরোপিত করা যায়, এবং বিপরীতভাবে আবার সেই সর্ববৃত্তির সাক্ষীস্বরূপ- প্রকাশময় পরমাত্মাকে- সেই আমি-প্রত্যয়ের বিষয় জীবাত্মার উপর আরোপিত করা হয়ে থাকে। এই যে পরস্পরের উপর পরস্পরের অধ্যাস- তার আদি খুঁজে পাওয়া যায় না- তার অন্তও নাই। এই অধ্যাস আমাদের নৈসর্গিক- এটাই মিথ্যাজ্ঞান অর্থাৎ অবিদ্যা। এই অধ্যাসই আমাদেরকে কর্তা ও ভোক্তা এই দুভাবে সংসারে প্রবর্তিত করে থাকে। তা সব লোকেরই প্রত্যক্ষসিদ্ধ। এই সকল প্রকার অনর্থের হেতু অধ্যাসকে বিধ্বস্ত করতে হলে- অদ্বিতীয় আত্মতত্ত্বজ্ঞানই একমাত্র আবশ্যক (শাঙ্করভাষ্য: ব্রহ্মসূত্র-১)

ব্যবহারিক জগতে জ্ঞান, অনুভূতি বা ইচ্ছার কর্তা যে অহং তা সর্বদাই একটি শরীরের সঙ্গে যুক্ত। শরীরের সঙ্গে অহং-এর যোগ আছে বলেই আমি জানি, আমি অনুভব করি এবং আমি ইচ্ছা করি। এই অহংকে শরীর থেকে পৃথক করা যায় না। যদি কল্পনা করি যে শরীর নেই, তাহলে প্রশ্ন ওঠে- কার জ্ঞান? কার অনুভূতি? কার ইচ্ছা? যে শরীর অন্যান্যদের ইন্দ্রিয়গোচর তা হলো ‘স্থূলশরীর’। এই স্থূলশরীর ছাড়াও সূক্ষ্মশরীর ও কারণশরীর আছে। পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি- এই সতেরোটি উপাদানের সমন্বয়ে জীবের সূক্ষ্মশরীর নির্মিত। তবে এই তিনরকম শরীরই মায়ার সৃষ্টি। শরীরমাত্রই নশ্বর অর্থাৎ, চিরকাল থাকে না।

জীবত্বের উৎপত্তি : শঙ্করাচার্যের মতে, জীব হলো আত্মা ও অনাত্মার সংমিশ্রণ। শুদ্ধ আত্মায় অনাত্মার অধ্যাসের ফলে অর্থাৎ, যখন আত্মার উপর অনাত্মা আরোপিত হয়, তখনই শুদ্ধ চৈতন্য বা আত্মা সাক্ষী-চৈতন্য জীবে পরিণত হয়। শরীর, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, অহংকার প্রভৃতি হলো অনাত্মা। সাক্ষী-চৈতন্য অন্তঃকরণের (মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকারের সমষ্টি হলো অন্তঃকরণ) সঙ্গে যুক্ত হলে ভ্রান্তিবশত যখন আত্মা-অনাত্মার অভেদ বোধ হয়, তখনই অহং-রূপ জীবত্বের সৃষ্টি হয়। যেমন আমরা বলি- ‘আমি রোগা’ বা ‘আমি মোটা’ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে আত্মা এবং শরীরের অবস্থার অভেদের বোধ থাকে। আবার যখন বলি- ‘আমি অন্ধ’ বা ‘আমি খোঁড়া’, তখন আত্মার সঙ্গে জ্ঞানেন্দ্রিয় বা কর্মেন্দ্রিয়ের অভেদ বোধ থাকে। তেমনি যখন বলি- ‘আমি সুখী’ বা ‘আমি দুঃখী’, তখন আত্মা ও মানসিক অবস্থার অভেদের বোধ থাকে। আত্মার উপর অনাত্মার অধ্যাস বা আরোপের ফলেই জীব দুঃখ ভোগ করে। আত্মা বা ব্রহ্ম কিন্তু স্বরূপত রোগা, মোটা, অন্ধ, খোঁড়া, সুখী, দুঃখী- এসব কিছুই নয়। চৈতন্য মায়ার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন বা উপহিত হলেই এইরকম অভেদ বোধ জন্মায়। দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও অহংকারের দ্বারা সীমিত বা অবচ্ছিন্ন আত্মা প্রকৃত বা শুদ্ধ আত্মা নয়। পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বর, জীব ও জাগতিক বিষয় সবই মিথ্যা, ব্রহ্মের বিক্ষেপমাত্র। এ প্রেক্ষিতে অদ্বৈতবেদান্তের আধুনিক প্রবক্তা স্বামী বিবেকানন্দ’র বাণীতেও উক্ত হয়েছে- ‘অদ্বৈতবাদীদের কাছে জীবাত্মার কোন স্থান নেই। তাহাদের মতে জীবাত্মা মায়ার সৃষ্টি; আসলে জীবাত্মার কোন (পৃথক) অস্তিত্ব থাকিতে পারে না।’– (স্বামীজীর বাণী ও রচনা ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৪৭)

অদ্বৈতমতে অবিদ্যাপ্রসূত, উপাধি-উপহিত আত্মাই জীব। শঙ্করের ভাষ্য অনুযায়ী যেহেতু জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন, এবং বিভিন্ন শ্রুতিতে জীবাত্মার উৎপত্তিকে অস্বীকার করা হয়েছে, তাই অদ্বৈতমতেও জীবাত্মা অবিনাশী। বেদান্তসূত্রকার বাদরায়ণও বলেছেন- জীবাত্মা উৎপন্ন হন এ কথা শ্রুতি বলেন নি। বরং আত্মার নিত্যত্ব ও অজত্ব বিষয়ে শ্রুতি বলেছেন। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৭)

জীবের স্বরূপ-উপলব্ধি : অদ্বৈতমতে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে উপলব্ধ বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনার মাধ্যমে অদ্বৈতবেদান্তী জীব ও ব্রহ্মের এই অভিন্নতাকে পরিস্ফুট করার চেষ্টা করেছেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে জীব জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি- এই তিনটি ভিন্ন অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করে। জাগ্রত অবস্থায় জীবের ইন্দ্রিয়, অন্তঃকরণ প্রভৃতি সক্রিয় থাকে। তাই এই অবস্থায় আমরা যতক্ষণ জাগ্রত থাকি, ততক্ষণ আমরা আমাদের স্থূলশরীর, ইন্দ্রিয়, মন প্রভৃতির সঙ্গে আত্মার অভিন্নতা বোধ করি এবং নানা বিষয়কে জানি। জাগ্রত অবস্থায় যেমন বিষয়ী ও বিষয়ের (অর্থাৎ, জ্ঞাতা ও জ্ঞানের বিষয়ের) ভেদ থাকে, তেমনি স্বপ্নেও জ্ঞান ও তার বিষয়ের মধ্যে ভেদের বোধ থাকে। স্বপ্নাবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু অন্তঃকরণ সক্রিয় থাকে বলে জাগ্রত অবস্থার অনুভবের সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বপ্নাবস্থায় জীব বিষয়কে জানে। এই অবস্থায় জীবের জ্ঞান অনুভবের সংস্কারের দ্বারা সীমিত। সুষুপ্তিতে ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ নিষ্ক্রিয় থাকে। তাই সুষুপ্তিকালে অর্থাৎ, স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রার সময় কোন বিষয়ের ধারণা থাকে না। ফলে সুষুপ্তির সময় আমরা জ্ঞাতা হই না। তখন বিষয়ী ও বিষয়ের, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে ভেদ সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয় এবং শরীর, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ইত্যাদির দ্বারা সীমিত হবার কোন বোধ থাকে না। কিন্তু তখনও চৈতন্য থাকে। যদি চৈতন্য না থাকতো, তবে সুষুপ্তির থেকে জেগে আমরা কখনোই বলতে পারতাম না যে, গভীর নিদ্রা হয়েছিলো। এ অবস্থা সম্পর্কে বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে- পুরুষের ধর্ম যেমন বাল্যে প্রকাশিত হয় না, তেমনি জীবের জ্ঞানও সুষুপ্তি অথবা প্রলয়ে অপ্রকাশিত থাকে। কিন্তু জাগ্রৎ কালে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩১)

আত্মা স্বরূপত কেমন, তা সুষুপ্তির অবস্থাটি বিশ্লেষণ করলে আংশিক পরিচয় পাওয়া যায়। সেই অবস্থায় আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে না। তখন আত্মা সীমিত এবং দুঃখ যন্ত্রণাক্লিষ্ট নয়। আত্মা তখন সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। এই অবস্থায় আমরা আত্মার অনন্দজ্ঞান, বিষয়হীনতা, আনন্দস্বরূপতা উপলব্ধি করি। কিন্তু এই উপলব্ধি ক্ষণিকের জন্য। জাগ্রত হবার পর জীব আবার ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ-সংশ্লিষ্ট হয়ে জগৎভ্রমে পতিত হয়।

শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম শরীর ও অন্তঃকরণের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে জীবে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। ব্রহ্মের পারমার্থিক সত্তা আছে এবং জীবের ব্যবহারিক সত্তা আছে। অবিদ্যা-সংশ্লিষ্ট আত্মাই জীব। তত্ত্বজ্ঞান লাভের দ্বারা অবিদ্যা দূরীভূত হলে জীব ও ব্রহ্মের ভেদ লোপ পায় এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন- এই উপলব্ধি হয়।

জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ : পারমার্থিক দিক থেকে যদিও জীব ব্রহ্মস্বরূপ, তবুও ব্যবহারিক দিক থেকে জীব ব্রহ্ম-ভিন্ন। এ বিষয়ে বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে- জীব পরমাত্মার অংশ, কারণ শ্রুতিও জীব এবং ব্রহ্মের ভেদ সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন; আবার অভেদও উপদেশ করেছেন। অতএব জীব ও ব্রহ্মের ভেদাভেদ সম্বন্ধ স্থিরীকৃত হয়। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪৩)

অদ্বৈতমতে, অবিদ্যা-উপহিত ব্রহ্মই জীব। এই অবস্থায় জীব ব্রহ্মস্বরূপতা বিস্মৃত হয়। জীব তাই ব্রহ্মের সঙ্গে ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়ই। অদ্বৈতবেদান্তী একদিকে যেমন জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভিন্নতা দেখিয়েছেন, তেমনি অপরদিকে জীব ও ব্রহ্মের ব্যবহারিক ভিন্নতা দেখিয়েছেন। তবে এই ব্যবহারিক ভিন্নতা ব্যাখ্যায় অদ্বৈতবেদান্তীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। বেদান্তসূত্রের যে সূত্রটিকে কেন্দ্র করে ঐ মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিলো, সেটি হলো- এবং জীব পরমাত্মার একটি আভাস বা প্রতিবিম্ব মাত্র। তাই জীবের সুখ-দুঃখ পরমাত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৫০)

জীব ও ব্রহ্মের আপাত ভেদ- এই সূত্রকে কেন্দ্র করে জীব ও ব্রহ্মের ব্যবহারিক ভিন্নতা সম্পর্কে বিভিন্ন অদ্বৈতবেদান্তী বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ব্যাখ্যাগুলি প্রধানত তিনটি মতবাদ সৃষ্টি করেছে। মতবাদ তিনটি হলো- অবচ্ছেদবাদ, প্রতিবিম্ববাদ এবং আভাসবাদ।

  • অবচ্ছেদবাদ : অবচ্ছেদবাদ অনুযায়ী স্বরূপত অভিন্ন বস্তু অবচ্ছেদভেদে ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হয়। যেমন আকাশকে ঘর ইত্যাদির দ্বারা সীমিত বোধ হয়, তেমনি এক ও অদ্বয় সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মও বিভিন্ন অন্তঃকরণের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবরূপে প্রতিভাত হয়। প্রকৃতপক্ষে আকাশ যেমন বিভিন্ন কক্ষের দ্বারা সীমিত হয় না, তেমনি ব্রহ্মও বুদ্ধির দ্বারা সীমিত হয় না। অন্তঃকরণ অবিদ্যাজন্য। অবিদ্যা দূর হলে সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্ম অবচ্ছেদমুক্ত হয়ে একক সৎরূপে উপলব্ধ হয়।
  • প্রতিবিম্ববাদ : আয়নার মতো স্বচ্ছ পদার্থে বস্তু প্রতিবিম্বিত হয়। বিভিন্ন স্বচ্ছ পদার্থে একই বস্তুর বিভিন্ন প্রতিবিম্ব পড়ে। সূর্য বিভিন্ন জলাশয়ে প্রতিবিম্বিত হয়, কিন্তু জলাশয়ের প্রকৃতির দ্বারা সূর্য প্রভাবিত হয় না। তেমনি একই ব্রহ্ম ভিন্ন ভিন্ন অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবরূপে আবির্ভূত হয়। ব্রহ্ম বিম্ব, জীব তার প্রতিবিম্ব। বিম্ব ও প্রতিবিম্বের ব্যবহারিক ভিন্নতা সর্বজনসিদ্ধ। প্রতিবিম্বের কারণ দূর হলে কেবল বিম্বই অবশিষ্ট থাকে। প্রতিবিম্ববাদের সমর্থকদের মধ্যে নৃসিংহাশ্রম ও তার অনুগামী বিবরণ-সম্প্রদায়ের অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, ব্রহ্ম মায়াতে প্রতিবিম্বিত হলে ঈশ্বররূপে প্রতীয়মান হন। আবার ব্রহ্ম অবিদ্যায় প্রতিবিম্বিত হলে জীবের সৃষ্টি হয়।
  • আভাসবাদ : বস্তুর আপাত প্রতীয়মান রূপকে বলা হয় আভাস। আভাস মিথ্যা হলেও বস্তু থেকে তার ভিন্ন ব্যবহার স্বীকৃত। প্রতিবিম্ব বিম্বের আভাস। জীব ব্রহ্মের আভাস। আভাসের কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যা দূর হলে আভাসের ভিন্ন অস্তিত্ব থাকে না। আভাসবাদ বস্তুত প্রতিবিম্ববাদেরই নামান্তর। এই কারণে আভাসবাদ ও প্রতিবিম্ববাদকে একই মতবাদ রূপেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
    এই মতের সমর্থকরা যেমন সর্বজ্ঞাত্মমুনি প্রভৃতি প্রতিবিম্ববাদ সমর্থকদের মতো মায়া ও অবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য করেননি। তারা বলেছেন যে, ব্রহ্ম অজ্ঞানে প্রতিবিম্বিত হলে ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় এবং অজ্ঞানের দ্বারা উৎপন্ন অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত হলে জীব উৎপন্ন হয়।

বস্তুত প্রতিবিম্ববাদ এবং অবচ্ছেদবাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। অদ্বৈতবেদান্তের মূল বক্তব্য হলো জীব এবং ব্রহ্ম এক। জীব এবং ব্রহ্ম যে এক তা জীব বদ্ধ অবস্থায় উপলব্ধি করতে পারে না। মোক্ষই হলো সেই অভেদের উপলব্ধি। অদ্বৈতবেদান্তীদের মধ্যে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিলো, তা ঐ অভেদের ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করেই হয়েছিলো। প্রতিবিম্ববাদের সমর্থক দার্শনিকরা বলতে চেয়েছেন যে, ব্রহ্ম ও জীবের অভেদের উপলব্ধিই মোক্ষ। তাদের মতে বস্তু ও তার প্রতিবিম্ব এক। কিন্তু অবচ্ছেদবাদের সমর্থকরা বলতে চেয়েছেন যে, প্রতিবিম্বের মিথ্যাত্ব প্রতিপন্ন করলে মোক্ষলাভ হয়। যেমন রজ্জুতে সর্পের প্রত্যক্ষ ভ্রান্ত প্রমাণিত হলে রজ্জুর প্রকৃত জ্ঞান হয়, তেমনি ব্রহ্মে অহং এর আরোপ মিথ্যা প্রতিপন্ন হলেই মোক্ষলাভ সম্ভব হয়। অর্থাৎ, ‘আমিত্ব’ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রতিপন্ন হলে ব্রহ্মোপলব্ধি বা মোক্ষলাভ হয়।

জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভেদ-অদ্বৈতমতে জীব ও ব্রহ্মে বস্তুত কোন ভেদ নেই, অর্থাৎ, জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। তবুও আমরা যে জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে সম্পূর্ণই অবিদ্যাবশত ব্যবহারিক ভেদের কল্পনা করি, বেদান্তের সূত্রগ্রন্থ বেদান্তসূত্রে মহর্ষি বাদরায়ণ তাই বলেছেন- স্থান এবং পাত্রের দ্বারা আলোক আকাশ যেমন সীমিত হয়, তেমনি নিরাকার অসীম ব্রহ্মও উপাধিহেতু রূপবান বলে কল্পিত হন। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩৪)

এক্ষেত্রে বিভিন্ন উপনিষদের জীব ও ব্রহ্মের অভেদ প্রতিপাদক উপদেশ উদ্ধৃত করে অদ্বৈতবেদান্তীরা জীব ও ব্রহ্মের পারমার্থিক অভিন্নতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। বিভিন্ন উপনিষদে জীব ও ব্রহ্মের অভিন্নতার কথা বলা হয়েছে। অদ্বৈত-বেদান্তীদের মতে, সকল সাধনার সিদ্ধি ও সকল উপদেশের সারস্বরূপ বিভিন্ন উপনিষদে চারটি মহাবাক্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই চারটি মহাবাক্য হলো- (১) ‘তত্ত্বমসি’ অর্থাৎ, তুমিই সেই– (ছান্দোগ্য উপনিষদ), (২) ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, আমিই ব্রহ্ম– (বৃহদারণ্যক উপনিষদ), (৩) ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম– (ঐতরেয় উপনিষদ), (৪) ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অর্থাৎ, আত্মাই ব্রহ্ম– (মাণ্ডুক্য উপনিষদ)।

যেসব শ্রুতিতে এই চারটি মহাবাক্যের আবির্ভাব হয়েছে, সেই শ্রুতিগুলো হলো-

  • (১) (সত্যনিষ্ঠার জন্য) সেই ব্যক্তি তপ্ত কুঠার দ্বারা দগ্ধ হয় না। এই সৎ বস্তুই সব কিছুর আত্মা। তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, ‘তত্ত্বমসি’- তুমিই সেই (ছান্দোগ্য-৬/১৬/৩)।
  • (২) এই জগৎ আগে ব্রহ্মরূপেই ছিলো। ছিলো ব্রহ্মময়। সর্বশক্তিমান তিনি যে মুহূর্তে নিজেকে নিজে জানালেন- ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’- আমিই ব্রহ্ম, অমনি তিনি সবকিছু হয়ে সর্বাত্মক হলেন। দেবতাদের মধ্যেও যিনি নিজেকে ব্রহ্মসদৃশ বলে জেনেছিলেন তিনিও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। এই একইভাবে ঋষি এবং মানুষদের মধ্যেও যাঁরা নিজেকেই ব্রহ্ম বলে জানতে পেরেছিলেন, তারাও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে বলেছিলেন- ‘আমি মনু হয়েছিলাম’; ‘আমিই সূর্য হয়েছিলাম’। যিনি নিজেকে নিশ্চিতভাবে জানেন ‘আমি ব্রহ্ম’, তিনি এইরকমই হন। কারণ তার আত্মা তখন সর্বব্যাপী (বৃহদারণ্যক-১/৪/১০)।
  • (৩) সেই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মাই হলেন বিরাট-স্বরাট- ব্রহ্ম। ইনিই ইন্দ্র, স্রষ্টা প্রজাপতি, ইনিই দেবরাজ্যের সব দেবতা। ইনিই জগৎ-সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান- পঞ্চমহাভূত।… প্রজ্ঞার সত্তা নিয়েই বিশ্বচরাচর সত্তাবান। প্রজ্ঞানই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই প্রজ্ঞাই হলো সবকিছুর মূল। জীবজগৎ, জড়জগৎ, লোকালোক- সবকিছু আশ্রয় করে আছে এই প্রজ্ঞানকেই। বিরাট এই প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। তিনি এক অখণ্ড সত্তা, অদ্বিতীয় (ঐতরেয়-৩/৩)।
  • (৪) তিনি পরিসীমার মধ্যেও আছেন, আবার বাইরেও আছেন। যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি বৃহৎ। তাই তিনি ব্রহ্ম। এই আত্মা ব্রহ্ম। সবাই ব্রহ্ম। এই আত্মার চারটি অংশ বা (জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, তূরীয়) অবস্থা জীবদেহে থেকে তাকে চালনা করছেন। সেই চারটি অংশকে বলা হয়েছে চতুষ্পাদ (মাণ্ডুক্য-২)।

‘তত্ত্বমসি’, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ ও ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’- এই চারটি মহাবাক্য বস্তুত চতুর্বেদের প্রধান বাক্য। ‘তত্ত্বমসি’ সামবেদের, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ যজুর্বেদের, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ ঋগ্বেদের এবং ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অথর্ববেদের প্রধানবাক্য। চারটি মহাবাক্যেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক ও অভিন্ন। এই মহাবাক্য চতুষ্টয়ের তাৎপর্যের মধ্যেই জীব ও ব্রহ্মের অভেদপ্রতিপাদক প্রামাণ্য রয়েছে বলে অদ্বৈতবেদান্তীরা ঘোষণা করেন।

মহাবাক্যের তাৎপর্য : এক্ষেত্রে অদ্বৈতবেদান্তীরা কিভাবে অভেদপ্রতিপাদক ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের তাৎপর্য পরিস্ফুট করেছেন, তা সংক্ষেপে দেখা যেতে পারে। ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের বাক্যাংশগুলি হলো- ‘তৎ ত্বং অসি’। ‘তৎ’ মানে ‘সেই’, ‘ত্বং’ মানে ‘এই’। মহাবাক্যটিতে উক্ত ‘তৎ’ শব্দের দ্বারা ‘সেই’ নির্গুণ ব্রহ্ম এবং ‘ত্বং’ শব্দের দ্বারা ‘এই’ জীবাত্মাকে নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর অভিন্নতা তিনভাবে দেখানো যেতে পারে- সামানাধিকরণ্য, বিশেষ্য-বিশেষণভাব ও লক্ষ্যলক্ষণভাব সম্বন্ধ বা লক্ষণার দ্বারা।

  • সামানাধিকরণ্য : ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদুটি একই অধিকরণের অভিন্নবাচক শব্দ হিসেবে অর্থ প্রকাশ করে। যেমন, ‘এই সেই দেবদত্ত’- এই বাক্যের অন্তর্গত ‘এই’ শব্দ ও ‘সেই’ শব্দ দুটি ভিন্নার্থবোধক হয়েও যেমন একই অধিকরণ দেবদত্তকে নির্দেশ করে, তেমনি ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদ্বয় ভিন্নার্থবোধক হলেও একই পদার্থ ব্রহ্ম বা শুদ্ধচৈতন্যকে নির্দেশ করে।
  • বিশেষ্য-বিশেষণভাব : ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ শব্দদুটিকে বিশেষ্য-বিশেষণভাবে গ্রহণ করেও তাদের অভিন্নতা দেখানো যায়। যেমন, ‘শ্বেতপদ্মে’র জ্ঞানে ‘শ্বেত’ শব্দটি বিশেষণবোধক এবং ‘পদ্ম’ শব্দটি বিশেষ্যবোধক। ‘শ্বেত’ ও ‘পদ্ম’ পদদ্বয় ভিন্নার্থবোধক হলেও বস্তুত এই পদদ্বয় একটি পদার্থকেই নির্দেশ করে। পদ্ম নানা রকম রঙের হতে পারে, কিন্তু শ্বেতপদ্ম একই রকম। সেইরূপ ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ পরস্পর পরস্পরের বিশেষ্য-বিশেষণ রূপে এক ও অদ্বয় অখণ্ড চৈতন্যের প্রকাশক, এবং তিনিই ব্রহ্ম।
  • লক্ষণা : বাক্যের মুখ্য অর্থকে পরিত্যাগ না করে কিংবা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিত্যাগ করে তাৎপর্য অনুধাবন-পূর্বক গৌণ অর্থ গ্রহণকে বলে লক্ষণা। লক্ষণা তিনপ্রকার- জহৎ, অজহৎ ও জহদজহৎ। জহৎ-লক্ষণায় মুখ্য অর্থকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা হয়। অজহৎ-লক্ষণায় মুখ্যার্থকে অক্ষুণ্ন রেখে অন্য অর্থ যুক্ত করা হয়। আর জহদজহৎ অর্থাৎ জহৎ-অজহৎ-লক্ষণায় মুখ্যার্থের আংশিক ত্যাগ ও আংশিক গ্রহণ করা হয়।
    এক্ষেত্রে জহদজহৎ-লক্ষণার দ্বারা ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর অভেদ প্রতিপাদন করা হয়। ‘তৎ’ পরোক্ষ চৈতন্য, কিন্তু ‘ত্বং’ অপরোক্ষ চৈতন্য। পরোক্ষত্ব ও অপরোক্ষত্ব পরস্পর বিরুদ্ধ। কিন্তু চৈতন্যাংশে উভয়ে অবিরুদ্ধ। বিরুদ্ধাংশ পরিত্যাগ করে অবিরুদ্ধাংশে উভয়ের ঐক্য স্থাপিত হতে পারে। চৈতন্যাংশে ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’-এর কোন বিরোধ নেই। এই অবিরুদ্ধ চৈতন্যাংশই ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্য।

অদ্বৈতবেদান্তীরা সামানাধিকরণ্য ও বিশেষ্য-বিশেষণভাব পরিত্যাগ করে জহদজহৎ-লক্ষণার দ্বারাই ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্যকে গ্রহণ করেছেন। অপর তিনটি মহাবাক্যও অনুরূপভাবে জীব ও ব্রহ্মের অভেদ ঘোষণা করে। এই জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার ভেদাভেদ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, যেখানে তিনি বলেছেন- ‘তুমি যখন নিজেকে দেহমাত্র বলিয়া ভাব তখন তুমি বিশ্বজগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন; নিজেকে যখন জীব বলিয়া ভাব, তখন তুমি সেই শাশ্বত মহান জ্যোতির একটি কণিকামাত্র, আর যখন নিজেকে আত্মা বলিয়া ভাব, তখন তুমিই সবকিছু।’

জীব এক না বহু?: জীব এক না বহু, অদ্বৈতবেদান্তীদের কাছে এই প্রশ্নটি অন্যন্ত জটিল বলে মনে হয়। এদের কেউ কেউ বলেন যে অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মই জীব। অন্তঃকরণে যেহেতু এক নয় বহু, তাই জীবও এক নয়, বহু। এই সম্প্রদায় অনেকজীববাদী নামে পরিচিত। আবার অন্য অদ্বৈতবৈদান্তিকদের মতে অজ্ঞানে বা মায়ায় প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মই জীব। মায়া যেহেতু এক, সেহেতু জীবও এক। এই সম্প্রদায়কে একজীববাদী বলা হয়।

অনেকজীববাদীদের বক্তব্য হলো, যদি জীব এক হয় তাহলে একটি জীবের মুক্তি হলে সমস্ত জীবেরই মুক্তি হবে। কিন্তু সমস্ত জীবের কখনোই একসঙ্গে মুক্তি হয় না। সুতরাং, একজীববাদ গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, একজীববাদ স্বীকার করলে বলতে হবে যে, এক জীব যদি সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে একটি জীবের সুখদুঃখবোধ হলেই সকলেরই সুখদুঃখবোধ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। একজনের সুখে সর্বদা অন্যজনের সুখ উৎপন্ন হয় না। আবার একজনের দুঃখও অন্যের দুঃখ নয়। কিন্তু অনেকজীববাদীদের বিরুদ্ধে একজীববাদীদের বক্তব্য হলো, অনেক জীব স্বীকার করলে সৃষ্টি ও প্রলয়ের ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ প্রলয়ের সময় অন্তঃকরণগুলি তাদের উপাদান কারণে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায় এবং তার ফলে সমস্ত জীব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই বক্তব্যের উত্তরে অনেকজীববাদীরা বলেন যে, প্রলয়কালে অন্তঃকরণগুলি বিলীন হয়ে গেলেও তাদের সংস্কারগুলি যেহেতু থেকে যায়, সেহেতু সমস্ত জীবের ধ্বংসের আপত্তি হয় না।

একজীববাদীরা বলেন, বিভিন্ন মানুষের সুখদুঃখ ভোগের অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণ হলো অন্তঃকরণগুলির পার্থক্য। অজ্ঞানে প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মের বহু অন্তঃকরণ। এই কারণে একই জীবের অন্তঃকরণ বহু। প্রত্তোত্তরে বলা হয়, বস্তুত একজীববাদকে সত্য গ্রহণ করলে স্বীকার করতে হবে যে অন্যান্য জীবের অস্তিত্বের জ্ঞান ভ্রান্ত, যেহেতু একটিমাত্র জীবেরই অস্তিত্ব আছে। যেমন এক ব্যক্তি স্বপ্নে নানা বিষয় ও প্রাণী প্রত্যক্ষ করে, তেমনি এক জীব অন্যান্য ব্যক্তি ও বিষয়ের স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের বিষয়ের মতোই অন্যান্য জীবের প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। এই মতে ‘তুমি’ ও ‘সে’ হলো প্রকৃত আমির বিভিন্ন প্রতিভাসমাত্র।

অদ্বৈতমতে জীবের বন্ধন ও মুক্তি

অদ্বৈতমতে জীব স্বরূপত ব্রহ্মস্বরূপ হলেও অনাদি অবিদ্যাবশত অন্তঃকরণের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয় এবং দেহাদির সঙ্গে একাত্মবোধ করে। জীবের এই ব্রহ্মস্বরূপত্ব বিস্মরণ ও দেহাদির সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে জীবের ‘অহং বোধ’ জন্মায়। জীব তখন নিজেকে সকল বস্তু থেকে পৃথক করে ক্ষুদ্র, পরিচ্ছিন্ন, সসীম সত্তার অধিকারী হয়। এই পরিচ্ছিন্ন জীবই বদ্ধ জীব। বদ্ধ জীব নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে। বিদ্যার দ্বারা জীব যখন অবিদ্যাজনিত ভেদজ্ঞান দূর করে এবং দেহাদিসম্বন্ধ ছিন্ন করে, তখন সে নিজেকে ব্রহ্ম-অভিন্ন বলে জানে। নিজেকে ব্রহ্ম বলে জানাকেই জীবের মুক্তি বলা হয়। অদ্বৈতমতে তাই জীবের বন্ধন ও মুক্তির অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে- আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধি।

বিভিন্ন বেদান্তশাস্ত্রে নানা কাহিনীর মাধ্যমে জীবাত্মার এই দুই অবস্থা তথা আত্ম-বিস্মরণ ও আত্মস্বরূপ-উপলব্ধির কথা বোঝানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একটি এরকম- এক গর্ভবতী সিংহী একদল মেষশাবককে তাড়া করে পাহাড় থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ায় তার মৃত্যু হলো। কিন্তু ঐ সিংহীর গর্ভ থেকে জন্ম নিলো এক সিংহশাবক। সিংহশাবক নিরুপায় হয়ে মেষশাবকদের দলে আশ্রয় নিলো এবং দিনে দিনে মেষশাবকদের অনুসরণে তার প্রকৃতিও মেষশাবকদের অনুরূপ হয়ে ঊঠলো। সিংহের হুংকার ভুলে তখন সে মেষশাবকদের মতো করে ডাকতে শিখলো। এ যেন জীবের আত্ম-বিস্মরণ ও বন্ধন-দশা প্রাপ্তি। পরবর্তীকালে অন্য এক সিংহ মেষশাবক শিকার করতে এসে এই সিংহশাবককে আবিষ্কার করলো। অন্যান্য মেষশাবকদের মতো সিংহশাবকও তখন সিংহের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রাণভয়ে পলায়মান। সিংহ সেই সিংহশাবককে ধরে তার প্রকৃতস্বরূপ বুঝিয়ে দিলো। কয়েকবার চেষ্টার পর সিংহের অনুকরণে সিংহশাবকও তখন হুংকার দিয়ে উঠলো। এ যেনো গুরুর কাছ থেকে ‘তত্ত্বমসি’ বাক্য শ্রবণান্তর মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা জীবের আত্মসাক্ষাৎকার বা ব্রহ্মস্বরূপ-উপলব্ধি। আত্মসাক্ষাৎকার জীবের পরম পুরুষার্থ। আত্মসাক্ষাৎকারেরই অপর নাম ব্রহ্মোপলব্ধি। তাই বেদ-বেদান্তে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে- ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ, আত্মা বা নিজেকে জানো।

উপনিষদানুসারী দর্শন হিসেবে অদ্বৈতমতানুযায়ী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমেই জীবের বন্ধনদশা দূর হয় এবং জীব মোক্ষলাভ করে। এজন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনকেই মোক্ষলাভের উপায় বলা হয়। যেমন, শ্রুতিশাস্ত্রেই এই উপদেশ উক্ত হয়েছে- মৈত্রেয়ী, সর্বত্রই এই আত্মা। সকলকে ব্যাপ্ত করে রয়েছেন একই আত্মা। সেই আত্মাকেই দর্শন করতে হবে, শ্রবণ করতে হবে, মনন করতে হবে, নিদিধ্যাসন বা ধ্যান করতে হবে। এই আত্মার দর্শন, শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ঠিকমতো প্রত্যয়ের সঙ্গে করতে পারলেই তার সব জানা হয়ে যাবে। অমৃতের মধুমাখা অনুভূতি নিয়ে অখণ্ড-সত্তায় তার প্রাণ ভরে উঠবে। আত্মজ্ঞান যার হয়, সবকিছুর সঙ্গে যে একাত্ম হতে পারে, তার কাছ থেকে কি অমৃত দূরে থাকতে পারে? (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫)।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বেদান্তমতে বলা হয়ে থাকে, একমাত্র বেদান্তপাঠের অধিকারীই শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের অধিকারী। তাই শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের পূর্বে জীবকে বেদান্তপাঠের অধিকার অর্জন ও তার জন্য তৎকারণ বিধিপূর্বক বেদ-বেদাঙ্গ অধ্যয়ন, জন্ম ও জন্মান্তরে কাম্যকর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধকর্ম পরিত্যাগ এবং কেবলমাত্র নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্ত কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়াও বেদান্তের অধিকারীকে বিবেক, বৈরাগ্য, শমদমাদি ও মুমুক্ষুত্ব- এই সাধন-চতুষ্টয় অর্জন করতে হবে। এই সাধন-চতুষ্টয়-সমন্বিত ব্যক্তিই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের নিকট বেদান্তপাঠের অধিকারী। বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকরা এই যে পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, তার পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবদ্ধ’।

বেদান্তের অনুবন্ধ : বেদান্ত মতে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ভিন্ন মুক্তি হয় না। কিন্তু ব্রহ্মসাক্ষাৎকার ব্রহ্মবিচার সাপেক্ষ। এই ব্রহ্মবিচার মননাত্মক। ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের জন্যই বেদান্তদর্শনে ব্রহ্মবিচার প্রদর্শিত হয়েছে। তাই বেদান্তদর্শনের অপর নাম ব্রহ্মবিচারশাস্ত্র। তবে বেদান্ত আলোচনার জন্য বৈদান্তিকেরা কিছু পূর্ব-প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন, যা অবগত থাকা আবশ্যক। বেদান্ত আলোচনার এই পূর্ব-প্রস্তুতির পারিভাষিক নাম হলো ‘অনুবন্ধ’। ‘অনুবন্ধ’ শব্দের অর্থ হলো নিমিত্ত। যে নিমিত্তে কোন শাস্ত্রের আলোচনা করা হয়, সেই নিমিত্তই ঐ শাস্ত্রের অনুবন্ধ। বেদান্তে এই অনুবন্ধ চারপ্রকার- অধিকারী, বিষয়, সম্বন্ধ ও প্রয়োজন। এই চারপ্রকার অনুবন্ধ একসঙ্গে ‘অনুবন্ধ চতুষ্টয়’ নামে পরিচিত। যে ব্যক্তি বেদান্তশাস্ত্র আলোচনা করার যোগ্যতা ও ক্ষমতাবিশিষ্ট, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বস্তু হলো এই শাস্ত্রের বিষয়। বেদান্তের প্রতিপাদ্য বস্তুর সঙ্গে এই শাস্ত্রের সম্পর্ক বা যোগসূত্র হলো সম্বন্ধ। সবশেষে বেদান্তশাস্ত্র আলোচনার উদ্দেশ্য ও ফল হলো এই শাস্ত্রের প্রয়োজন। বলা হয়, এই চারপ্রকার পূর্ব-প্রস্তুতির অভাবে বেদান্তশাস্ত্রের আলোচনা নিরর্থক। তাই বেদান্তশাস্ত্রের এই চারটি পূর্ব-প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত থাকা আবশ্যক।

অধিকারী : ‘অধিকারী’ বলতে এখানে বেদান্তশাস্ত্রের তাৎপর্য অনুধাবনের অধিকারসম্পন্ন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যিনি বেদান্তশাস্ত্রের বিষয় বুঝতে, শাস্ত্রের নির্দেশ যত্নসহকারে পালন করতে এবং সদা সৎকর্মে ব্যাপৃত থাকতে সক্ষম, তিনিই বেদান্ত দর্শনের মর্মকথা অনুধাবনের অধিকারী। এজন্যেই অধিকারীকে প্রথমত ব্রহ্মচর্যাদির অনুষ্ঠানপূর্বক শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিঃশাস্ত্র এবং ছন্দঃশাস্ত্র, এই ছয়টি অঙ্গের সাথে বেদ অধ্যয়ন করতে হবে। এভাবে বেদ অধীত হলে আপাতত বেদার্থের অবগতি হবে। কাম্যকর্ম ও নিষিদ্ধকর্মের অনুষ্ঠান করলে অনুষ্ঠিত কর্মের ফলভোগের জন্য শরীর-পরিগ্রহ বা জন্ম অবশ্যম্ভাবী। শরীরপরিগ্রহ এবং কর্মফলভোগ, উভয়ই বন্ধনের হেতু বা বন্ধন। বন্ধনাবস্থায় মুক্তি অসম্ভব। কারণ, বন্ধন ও মুক্তি পরস্পরবিরুদ্ধ। অতএব কাম্য ও নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করবে। এবং নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করবে। তাই ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যিনি বিধিপূর্বক বেদ-বেদান্ত অধ্যয়ন করে তার মূলমর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ইহজন্মে বা জন্মান্তরে কাম্য কর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগপূর্বক কেবল নিত্য কর্ম, নৈমিত্তিক কর্ম ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হয়েছেন, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তের অধিকারী সাধন-চতুষ্টয়ের অনুসরণ করে থাকেন। এই সাধন-চতুষ্টয় হলো- (১) বিবেক, (২) বৈরাগ্য, (৩) সাধনসম্পত্তি ও (৪) মুমুক্ষুত্ব। ‘বিবেক’ বলতে বোঝায় নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক। অর্থাৎ কোন্ বস্তু নিত্য, কোন্ বস্তু অনিত্য, নিত্য ও অনিত্য বস্তুর ভেদ কী প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানই হলো বিবেকজ্ঞান। এই জ্ঞানের দ্বারাই কোন্ বস্তু গ্রহণীয় এবং কোন্ বস্তু বর্জনীয়, তা নির্ধারণ করা সম্ভব। ‘বৈরাগ্য’ বলতে বোঝায় ঐহিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার সুখের প্রতি বিরাগ। ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। ‘মুমুক্ষুত্ব’ বলতে বোঝায় ব্রহ্মোপলব্ধি তথা মোক্ষলাভের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা।

এখানে উল্লেখ্য, আত্মসাক্ষাৎকারের উপযোগী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন এবং তার অনুকুল বিষয় ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বিষয় থেকে অন্তঃকরণের নিয়ন্ত্রণ বা নিগ্রহের নাম শম, এবং এসব বিষয় থেকে বাহ্যকরণ অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহকে দম বলা হয়। উপরতি হলো সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণপূর্বক শাস্ত্রবিহিত কার্যকলাপ পরিত্যাগ। তিতিক্ষা হলো শীত-তাপ, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান ইত্যাদি পরস্পরবিরুদ্ধ প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও কষ্টসহিষ্ণু থাকা। দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি এবং তার অনুকুল বিষয়ে মনের সমাধি বা একাগ্রতা অর্থাৎ তৎপরতার নাম সমাধান। আর গুরুবাক্য এবং বেদান্তবাক্যে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা বলা হয়।

  • বিষয় : প্রতিটি শাস্ত্রেরই প্রতিপাদ্য বিষয় আছে। শাস্ত্রের কোন বিষয় না থাকলে তা পাঠ করা নিষ্প্রয়োজন। বেদান্তশাস্ত্রের বিষয়কে তাই বেদান্তের দ্বিতীয় অনুবন্ধ বলা হয়েছে। বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের প্রতিপাদ্য বিষয় বিভিন্ন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্ত-সম্প্রদায়ের মতে বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান।
  • সম্বন্ধ : প্রতিপাদক শাস্ত্র বা শাস্ত্রবাক্যের সঙ্গে প্রতিপাদ্য বিষয়ের সম্বন্ধই হলো বেদান্তশাস্ত্রের তৃতীয় অনুবন্ধ। এই সম্বন্ধের স্বরূপ হলো প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদক বা বোধ্য-বোধক ভাবরূপ।
  • প্রয়োজন : বেদান্ত শাস্ত্রের প্রয়োজন বিষয়ে বিভিন্ন বেদান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সাধারণভাবে শাশ্বত মুক্তিই বেদান্তশাস্ত্রের প্রয়োজন। যেমন, অদ্বৈতবেদান্তমতে অবিদ্যার সমূলনিবৃত্তি এবং আনন্দময় ব্রহ্মস্বরূপপ্রাপ্তিই হলো বেদান্তশাস্ত্র পাঠের ফলস্বরূপ প্রয়োজন।

মোক্ষ বা মুক্তির উপায় : শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন বেদান্ত-পাঠেরই ত্রি-অঙ্গ। প্রথমে আচার্যের নিকট বেদান্তপাঠ শ্রবণ, তারপর যুক্তি ও তর্কের দ্বারা আচার্যের উপদেশের যৌক্তিকতা প্রতিপাদন বা মনন এবং পরিশেষে আচার্য-উপদিষ্ট তত্ত্বের নিরন্তর ধ্যান বা নিদিধ্যাসনের দ্বারা মোক্ষকামী ব্যক্তির অবিদ্যাজন্য মিথ্যাজ্ঞান বিনষ্ট হয় এবং ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবনের মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি বা ব্রহ্মস্বরূপতার উপলব্ধি হয়। জীবের এই আত্মোপলব্দিই মোক্ষলাভ বা মোক্ষপ্রাপ্তি। অদ্বৈতমতে মোক্ষলাভ তাই জীবের পক্ষে নতুন কোন প্রাপ্তি-যোগ নয়। এ যেন নিজের হাতের মুঠোয় চাবিকাঠি রেখে সারা ঘরে চাবির অনুসন্ধান এবং অবশেষে মুঠোর ভিতর চাবির আবিষ্কার। তাই মোক্ষপ্রাপ্তি হলো প্রাপ্তের প্রাপ্তি।

অদ্বৈতমতে বলা হয়, উপাধি-উপহিত আত্মাই জীব। এই অধ্যাসের ফলেই জীব দুঃখাদি-জর্জরিত বদ্ধজীবন ভোগ করে। ব্রহ্ম যখন সূক্ষ্ম-শরীর, স্থূল-শরীর, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি- এই সকল উপাধির দ্বারা উপহিত (সীমিত) হন, তখনই তাকে জীব বলা হয়। সুতরাং ব্রহ্মে বিভিন্ন উপাধি আরোপের ফলেই জীবের আবির্ভাব হয়। এই আরোপ আবার অবিদ্যা-জনিত। ব্যষ্টি-অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছাদিত আত্মা ঐ সকল উপাধি-উপহিত হয়। উপাধিই জীবের দেহ, বর্ণ, জাতি ও আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে। অসংখ্য অন্তঃকরণ-উপহিত হয়ে একই আত্মা বহু জীবে রূপান্তরিত হয়। অন্তঃকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকাই জীবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকারের সমষ্টিকে বলা হয় অন্তঃকরণ। অন্তঃকরণের ভিন্নতার দ্বারাই জীবের ভিন্নতা নির্ণীত হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন জীব ভিন্ন ভিন্ন কর্মফল ভোগ করে।

উপাধি উৎপত্তি-বিনাশশীল। মৃত্যুতে জীবের স্থূলশরীর বিনষ্ট হয়। মৃত্যুর পর জীবের লিঙ্গ-শরীর বা সূক্ষ্ম-শরীর কর্মানুযায়ী বিভিন্ন লোকে গমন করে এবং ঐ কর্মানুযায়ীই পুনরায় নতুন স্থূল শরীর পরিগ্রহ করে। এরই নাম ‘পুনর্জন্ম’। সূক্ষ্ম শরীরেও জীব অন্তঃকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে। সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে জীবের কর্মফলও স্থূল-শরীরান্তরে গমন করে। শ্রুতিশাস্ত্রেও বলা হয়েছে- …মানুষ মারা গেলে বাক্ তার স্বস্থান অগ্নিতে, প্রাণ বায়ুতে, চোখ আদিত্যে, মন চন্দ্রে, কর্ম দিকসমূহে, শরীর পৃথিবীতে, আত্মা আকাশে, লোম ওষধিলতায়, মাথার চুল বনস্পতিতে, রক্ত, রেতঃ জলে ফিরে গিয়ে অবস্থান করে। তাহলে সে সময় আমাদের শারীরপুরুষ কোথায় থাকেন? …তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান… (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।

আবার দেহত্যাগ করে জীবাত্মার লোকান্তর-এ গমন বিষয়ে অন্য একটি শ্রুতিতে বলা হয়েছে- পঞ্চাগ্নিবিদ্যায় যাঁরা বিদ্বান এবং এই জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তারা মৃত্যুর পর পূত হয়ে প্রথমে অর্চিলোকে যান। ক্রমে অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয়মাসে। তারপর সেখান থেকে দেবলোকে, দেবলোক থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে বিদ্যুৎলোকে যান। সেখানে আসেন এক মনোময় পুরুষ, তাকে নিয়ে যান ব্রহ্মলোকে। পরমলোক সেই ব্রহ্মলোকে তিনি থেকেই যান। আর শুক্র-শোণিতে ফিরে আসতে হয় না (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫)।

অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারেও মোক্ষলাভে জীবের স্থূল-শরীরের নাশ হয় এবং জন্ম-প্রবাহ রুদ্ধ হয়। জীব তখন সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মে লীন হয়ে নিজেকে ব্রহ্ম বলে উপলব্ধি করে (সোহহম্)। অদ্বৈতবেদান্তমতে মুক্তি দুই ধরনের- জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি। এই মতে, মুক্ত অবস্থাতেও জীবের দেহ থাকতে পারে। দেহ থাকাকালীন জীবের যে মুক্তি, তাকে বলা হয় জীবন্মুক্তি। অন্যদিকে, দেহের বিনাশের পর যে মুক্তি, তাকে বলা হয় বিদেহমুক্তি। জীবন্মুক্তি সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় স্বীকার করেন না। বৌদ্ধ, সাংখ্য ও জৈন সম্প্রদায়ের সঙ্গে একমত হয়ে অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায় জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন। আত্মসাক্ষাৎকার বা ব্রহ্মোপলব্ধিতে জীবের মুক্তি হয়। মুক্তিলাভকালে জীবের সঞ্চিত কর্মফল শেষ হয়ে যায়। মুক্তজীব বাসনাহীন। সুতরাং তার কর্মজন্য কোন নতুন ফলোৎপত্তির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এই অবস্থায় তার প্রারব্ধ কর্মফলভোগ শেষ নাও হতে পারে। প্রারব্ধ কর্মফলভোগ শেষ না হলে সেই ফলভোগ শেষ করার জন্য মুক্ত পুরুষকে আরও কিছুকাল দেহ ধারণ করে থাকতে হয়। জীবের এইপ্রকার মুক্তিকে বলা হয় জীবন্মুক্তি।

জীবন্মুক্ত পুরুষকে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে হলেও তার দেহাত্মবুদ্ধি আর থাকে না। বরং সংসারের মায়ায় তিনি আর আবদ্ধ হন না। তিনি অনাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে জীবনযাপন করেন এবং বদ্ধজীবের হিতার্থে নিষ্কাম কর্ম করেন। মুক্তপুরুষের কাছে কর্মের সৎ-অসৎ বা পাপ-পুণ্যের ভেদ থাকে না। রাগ-দ্বেষ থেকেই অসৎ বা পাপকর্মের উৎপত্তি হয়। মুক্ত পুরুষ রাগ-দ্বেষহীন। তাই মুক্ত পুরুষের পক্ষে কোন অসৎ বা পাপকর্ম করার প্রশ্নই নেই। প্রারব্ধ কর্মফল নিঃশেষিত হলে মুক্ত পুরুষের স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পুরুষ বিদেহমুক্তি লাভ করে।

অদ্বৈতমতে মোক্ষের প্রকৃত স্বরূপ হলো ব্রহ্মসাযুজ্য অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন হয়ে যাওয়া। উপনিষদীয় মহাবাক্য ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, ‘আমিই ব্রহ্ম’ এই উপলব্ধির সাথে লীন হয়ে যাওয়া। এটাই জীবন্মুক্ত অবস্থা। কিন্তু বেদান্তের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ অবশ্য জীবের জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন নি। তিনি বিদেহমুক্তির সমর্থক। তার কাছে মুক্তির অর্থ ব্রহ্মস্বারূপ্য অর্থাৎ ব্রহ্মের সদৃশ হওয়া। ব্রহ্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন হওয়া নয়।

অদ্বৈত জ্ঞানতত্ত্ব

যথার্থ জ্ঞান বুদ্ধির অধীন নয় বস্তুর অধীন, কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান বস্তুর অধীন। যে বস্তু যেমন, সেরূপ জ্ঞানই তত্ত্বজ্ঞান। অদ্বৈতমতে পরমাত্মা ব্রহ্মই হলো নিত্য, আর জগৎ অনিত্য। একমাত্র ব্রহ্মেরই পারমার্থিক সত্তা আছে এবং পরাবিদ্যার সাহায্যেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। ব্রহ্মজ্ঞানই সত্যজ্ঞান বা পরাবিদ্যা। এ জ্ঞান নিরপেক্ষ জ্ঞান যাকে অনুভব করা যায়। বিচারবুদ্ধি অনুভবের একটি উপায়।

অদ্বৈতবেদান্তের প্রধান প্রবক্তা আচার্য শঙ্কর তার শারীরকভাষ্যে পারমার্থিক সত্তা ও ব্যবহারিক সত্তার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। তার মতে অবিদ্যার জন্যই জীব অনাত্মাকে আত্মার সঙ্গে অভিন্ন মনে করে। অবিদ্যা হলো ব্যবহারিক জ্ঞান। অবিদ্যায় জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতার পারস্পরিক ভেদ বর্তমান থাকে। শঙ্করের মতে ব্রহ্মেরই একমাত্র সত্তা আছে, ব্রহ্মের বাহিরে বা ভেতরে ব্রহ্ম ছাড়া আর কোন সত্তা নেই। ব্রহ্মের কোন প্রকার ভেদ নেই। পরাবিদ্যা সব রকমের ভেদরহিত জ্ঞান এবং নিরপেক্ষ জ্ঞান। আর অপরাবিদ্যা আপেক্ষিক জ্ঞান হলেও শঙ্করের মতে এ জ্ঞান পরাবিদ্যা বা অনপেক্ষ জ্ঞান লাভের সোপান স্বরূপ।

এই মতে, শ্রুতি থেকে ব্রহ্মের জ্ঞান হয়, তারপর যুক্তি-তর্কের সাহায্যে তার যৌক্তিকতা উপলব্ধ হয় এবং সর্বশেষ অনুভবের মাধ্যমে ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার হয়। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার জন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন হলো তিনটি উপায়। শ্রুতি ছাড়া অন্য কোন কিছু থেকে জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান লাভ হয় না। শ্রুতির প্রামাণ্য নিরপেক্ষ। বেদান্তসূত্রে মহর্ষি বাদরায়ণও বলেছেন- শাস্ত্ররাশিই হলো ব্রহ্ম সম্পর্কিত জ্ঞান লাভের উপায়। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩)।

শ্রুতিলব্ধ জ্ঞানের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করার জন্য যুক্তি-তর্কের প্রয়োজন হয়। কিন্তু শ্রুতির কথায় বিশ্বাস না থাকলে কেবলমাত্র যুক্তি-তর্কের দ্বারা আত্মোপলব্ধি হয় না। যে তর্ক শ্রুতির অনুগামী, সেই তর্কই গ্রহণযোগ্য। যেহেতু মানুষের বুদ্ধি এক প্রকার নয় সেজন্য তর্ক বিভিন্নরূপের হয়। একজন তার্কিক তার তর্কক্ষমতা দ্বারা কোন তত্ত্বকে সিদ্ধ করতে পারেন, আবার তার চেয়েও যুক্তিকুশল ব্যক্তি অধিকতর দক্ষতায় সেটার ত্রুটি প্রমাণ করে নিজ মতকে সিদ্ধ করতে পারেন। অতএব যুক্তি-তর্কের দ্বারা আমরা কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি না, কেবলমাত্র শ্রুতি বা উপনিষদ থেকেই আমরা সত্যকে প্রাপ্ত হতে পারি। যুক্তি তর্ককে আমরা শুধুমাত্র উপনিষদের অভিপ্রায়কে সঠিকভাবে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করতে পারি। শঙ্করের মতে তর্ক যেহেতু অপ্রতিষ্ঠা দোষে দূষিত সেজন্য তর্কের উপর নির্ভর করে শাস্ত্রের অর্থ নির্ণয় করা যুক্তিসঙ্গত নয়। বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণও বলেছেন- তর্ক অপ্রতিষ্ঠ; অতএব শ্রুতিসিদ্ধ ব্রহ্মের কারণত্ববাদ কেবলমাত্র তর্কের দ্বারা খণ্ডন করা চলে না। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১১)।

বেদান্ত-সিদ্ধান্তের সত্যতা তর্ক বা যুক্তিনির্ভর তো নয়ই বরং উপনিষদ প্রতিপাদিত। বেদ নিত্য, তাই বেদ থেকে প্রাপ্ত অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব কালই এক। শাস্ত্র মতে তর্কের দ্বারা সগুণ ব্রহ্মের জ্ঞান লব্ধ করা যাবে, কিন্তু পরব্রহ্মের বা নির্গুণ ব্রহ্মের জ্ঞান লাভ করা যায় না। তাই শঙ্করের মতে শ্রুতি বা শব্দই স্বত প্রমাণ। অন্যান্য প্রত্যক্ষ, অনুমানাদি প্রমাণসমূহ শব্দের (=বেদ) করুণা দ্বারাই প্রমাণিত হতে পারে। অতএব, প্রমাণ সম্পর্কে শঙ্করের ব্যাখ্যা জৈমিনি তথা ভাট্ট-মীমাংসকদের মতবাদেরই অনুরূপ। প্রমাণ হলো যথার্থ জ্ঞানলাভের উপায়। শঙ্কর ছয় প্রকার প্রমাণ স্বীকার করেন, যেমন- প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি।

কোন সৎ বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটলে যে জ্ঞান হয় তাই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। কোন জ্ঞান বিষয়ের উপরের নির্ভর করে এবং তার দ্বারা সমর্থিত হয়ে যদি কোন অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয় তাকে অনুমান বলে। বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বচন হলো শব্দ এবং এই বচনের উপর নির্ভর করে যে জ্ঞান লাভ হয় তাকে শব্দজ্ঞান বলে। সংজ্ঞা ও সংজ্ঞীর যে জ্ঞান তাই উপমান। নৈয়ায়িক ও মীমাংসকরা উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে মনে করেন। কোন বিষয়কে যখন জ্ঞাত কোন কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না তখন অন্য কোন অজ্ঞাত কারণকে কল্পনা করা হয়, এই অজ্ঞাত কারণকে কল্পনা করার নাম অর্থাপত্তি। কোন বস্তুর অভাবের জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুপলব্ধি নামক একটি স্বতন্ত্র প্রমাণকে শঙ্করাচার্য স্বীকার করেন। তবে অদ্বৈতমতে সকল প্রমাণের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ হলো শব্দ প্রমাণ, এবং শব্দই স্বত প্রমাণ।

সত্যতা : যে জ্ঞান অন্য জ্ঞানের দ্বারা বাধিত বা মিথ্যা প্রমাণিত হয় না তাই সত্য। তখন অদ্বয় অর্থাৎ অদ্বিতীয় আত্মজ্ঞান লাভ হয়। শঙ্করের মতে সত্যতা নির্ণয় করার মূল উপায় হলো আধিতত্ত্ব বা অবিরুদ্ধতা। অদ্বয়জ্ঞান যথার্থ, কারণ এ জ্ঞান অন্য জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয় না। ভাববাদী দার্শনিকদের মতে সঙ্গতি হলো সত্যতা নিরূপণ করার মাপকাঠি। শঙ্করও এই অভিমত সমর্থন করেন। তার মতে সঙ্গতি ছাড়াও অনুরূপতা এবং প্রবৃত্তি সামর্থও সত্যতা নিরূপণের উপায়। অনুরূপতা অর্থাৎ যখন কোন ধারণা বস্তুর অনুরূপ হয় তখন ধারণা সত্য হয়, এটাও ব্যবহারিক সত্যতা নিরূপণ করার মাপকাঠি। প্রবৃত্তি সামর্থ্য অর্থাৎ যখন ধারণা সফল প্রবৃত্তির কারণ হয় তখন ধারণা সত্য হয়।

ভ্রম : অদ্বৈতবেদান্ত মতে ভ্রমের কারণ হলো অবিদ্যা। ব্রহ্মে জগৎ ভ্রমেরও কারণ হলো অবিদ্যা। ভ্রম সম্পর্কে অদ্বৈতবাদীদের মতবাদ অনির্বচনীয় খ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। অন্যান্য দর্শন সম্প্রদায় ভ্রমের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা শঙ্কর স্বীকার করেন না।

মীমাংসকরা প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ভ্রমের সম্ভাবনাকে মোটেই স্বীকার করেন নি। তারা সব জ্ঞান, বিশেষ করে অপরোক্ষ জ্ঞানকে সত্য বলে মনে করেন। তাদের এই মত যথার্থ বলে স্বীকার করলে অদ্বৈতমতে দেয়া জগৎ ব্যাখ্যার কোন যুক্তি থাকে না। মীমাংসামতে রজ্জুতে যে সর্পভ্রম হয় সেখানে প্রত্যক্ষ এবং স্মৃতির মিশ্রণ ঘটে এবং দুটির মধ্যে পার্থক্য করা হয় না। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয় তখন আমরা রজ্জু প্রত্যক্ষ করি, যে রজ্জুর অস্তিত্ব আছে। তার সাথে সর্পের স্মৃতি মনে জাগরিত হয়। কারণ সর্পের সঙ্গে রজ্জুর সাদৃশ্য আছে। রজ্জুর প্রত্যক্ষ এবং সর্পের স্মৃতি দুটোর যে পার্থক্য বা বিবেকের অখ্যাতি তা ভ্রম সৃষ্টি করে।

আবার নৈয়ায়িকদের ন্যায়মতে ভ্রম হলো ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ। তাদের মতে ভ্রমের ক্ষেত্রে একটি বস্তুকে আর একটি বস্তুরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়। যখন রজ্জুতে সর্পভ্রম ঘটে তখন রজ্জু অন্য বস্তুরূপে দৃষ্ট হয়। অদ্বৈতবেদান্তীরা এই মত গ্রহণ করেন।

অন্যদিকে বৌদ্ধমতে ভ্রমের ব্যাখ্যা অদ্বৈতবাদীরা স্বীকার করেন না। বৌদ্ধমতে ভ্রমের ব্যাখ্যা আত্মখ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। তাদের মতে ভ্রমে মনের ধারণা বাহ্যবস্তু হিসেবে দৃষ্ট হয়। রজ্জুতে সর্পভ্রম একটি নিছক মনের ধারণা। সে জন্য সর্পকে অস্তিত্বশীল বাহ্যবস্তু হিসেবে দেখা যায়। এক্ষেত্রে বেদান্তীরা মনে করেন, ভ্রমের ক্ষেত্রে যদি কোন বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা না যায় তাহলে রজ্জুতে সর্পভ্রম না হয়ে যে কোন ভ্রম ঘটতে পারতো। অদ্বৈতমতে ব্রহ্মই জগৎভ্রম হয়।

অদ্বৈতবাদীদের ভ্রম সম্পর্কিত মতবাদ অনির্বচনীয় খ্যাতিবাদ অনুসারে, ভ্রমজ্ঞানকে সৎও বলা যায় না, অসৎও বলা যায় না। রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয় তখন সর্পকে অসৎ বলা যায় না, কারণ সর্প অসৎ হলে সর্পকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সর্পকে সৎও বলা যায় না, কারণ পরে রজ্জুজ্ঞান দ্বারা সর্পজ্ঞান বাধিত হয়। আবার সর্পকে সদসৎও বলা যায় না, কারণ সৎ এবং অসৎ পরস্পরবিরোধী, তাই সৎ ও অসৎ কারো ক্ষেত্রে একই সময়ে একই অর্থে সত্য হতে পারে না। কাজেই অদ্বৈতমতে সর্প অনির্বচনীয়। এই অনির্বচনীয় সর্প প্রাতিভাসিক। যতক্ষণ পর্যন্ত রজ্জুর জ্ঞান না হয় ততক্ষণ পর্যন্তই সর্প ভ্রান্তদর্শীর দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়। ভ্রম দূর হলে সর্পের কোন অস্তিত্ব থাকে না।

অদ্বৈতমতে জগতের যাবতীয় বস্তুই চৈতন্যে অধিষ্ঠিত। রজ্জু যে চৈতন্যে অধিষ্ঠিত সেই চৈতন্যে আশ্রিত অবিদ্যার তমোভাগ থেকে অনির্বচনীয় সর্পের উৎপত্তি। কাজেই অদ্বৈতবেদান্ত মতে সর্প অনির্বচনীয়। অবিদ্যার জন্যই রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়। একইভাবে ব্রহ্মে জগৎভ্রম এই অবিদ্যার জন্যই হয়ে থাকে। অবিদ্যা অপসারিত হলেই একই অদ্বয় ব্রহ্মের উপলব্ধি ঘটে।

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ

ভূমিকা

ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় বেদান্তের প্রভাব সহজেই পরিলক্ষিত হয়। তাদের নিকট সত্য বহুমুখী। বেদান্তীরা এই বহুমুখী সত্যকে বহুরূপে উপলব্ধির কথা ঘোষণা করেছেন। তাই বেদান্ত চিন্তা বহুমুখী। উপনিষদীয় ভাবধারায় পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তগুলিকে প্রয়োজনীয় মীমাংসার মাধ্যমে মহর্ষি বাদরায়ণ যেমন ব্রহ্মসূত্র রচনা করে অভিন্ন লক্ষ্যাভিমুখী করার উদ্যোগ নিয়ে একটি পরমতত্ত্বের মধ্যে সমন্বয়কৃত  ব্রহ্মবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন, আবার এই ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা ও ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন বেদান্তী দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যহেতু পরবর্তীকালে বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন মতবাদেরও সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে আচার্য শঙ্কর প্রবর্তিত অদ্বয় পরমব্রহ্মের ভাবনাপ্রসূত বিশুদ্ধাদ্বৈতবাদ যেমন অদ্বৈতবেদান্তের প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি এই ব্রহ্মসূত্রের ভিন্ন ব্যাখ্যা-ভাষ্যে জ্ঞানকাণ্ড-প্রধান অদ্বৈতবেদান্তের প্রতিক্রিয়ারূপে উদ্ভূত হয়েছে রামানুজাচার্য-প্রবর্তিত ভক্তিপ্রধান বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ।

শঙ্করের অদ্বৈতবাদ ও রামনুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এই উভয় বেদান্ত-চিন্তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরস্পর-নিরপেক্ষ। অদ্বৈতবেদান্তের জ্ঞানপ্রধান, নির্বিশেষ, বিমূর্তচিন্তা দার্শনিক বিচারে অতি উচ্চস্তরের হলেও এইমত সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক-তৃপ্তি সাধনে সক্ষম হয়নি। এই অক্ষমতাই হয়তো ভক্তিবাদী রামানুজাচার্যকে ভক্তিমার্গ অনুসরণ করে ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ নামে একটি স্বতন্ত্র বেদান্তমত প্রবর্তনে উদ্বুদ্ধ করেছে। রামানুজের মতবাদও অদ্বৈত মতবাদ, তবে তা নির্বিশেষ নয়। আচার্য শঙ্কর তার অদ্বৈতমতে এক অদ্বয় পরমব্রহ্ম ছাড়া পরমার্থত আর দ্বিতীয় কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। কিন্তু আচার্য রামানুজ বহুর অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদকে নির্গুণ ব্রহ্মবাদের সঙ্গে ঈশ্বরবাদের সমন্বয়ের প্রচেষ্টারূপে গণ্য করা যায়।

বলা বাহুল্য যে, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তা ভারতীয় চিন্তাধারায় কোন অভিনব বা নতুন সংযোজন নয়। নির্গুণ ব্রহ্মবাদ ও ঈশ্বরবাদ বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিলো। রামানুজাচার্যের বহুপূর্বে ভাগবতের ঈশ্বরবাদে, উপনিষদের সপ্রপঞ্চ-ব্রহ্মবাদে, মহাভারতের নারায়ণীয় অধ্যায়ে, ভগবদ্গীতায় ও বিষ্ণুপুরাণে এই চিন্তাধারার আভাস পাওয়া যায়। প্রাচীন বৈষ্ণব তামিল-কবি আলবারদের নানা গাথা ও গ্রন্থ, ভাস্কর, যাদবপ্রকাশ ও যমুনাচার্য’র চিন্তাধারা, ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত, ভাগবত ও মহাভারতের বৈষ্ণবপাদ রামানুজের চিন্তাধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করা হয়। বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদ যে তার পূর্বেকার লেখক যথা বোধায়ন, টঙ্ক, কপরদিন, ভারুচী প্রমুখের মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত, বেদান্তসূত্রভাষ্য ‘শ্রীভাষ্য’-এ রামানুজ তা স্বীকার করেছেন।

দর্শনের পরমব্রহ্মকে ভক্তের ভগবানরূপে কল্পনা করে রামানুজ বেদান্ত দর্শনে ভক্তিবাদের অপূর্ব সমাবেশ করেছেন। বাস্তবভাব সমন্বয়ের দ্বারা একটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করা এবং ঈশ্বরকে লাভ করার জন্য  মানুষের যে প্রবল বাসনা তার প্রতিষ্ঠা করাই রামানুজের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষার সঙ্গে রামানুজের মতে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই রামানুজ প্রচারিত দার্শনিক ভাবনা ও ধর্মমত সাধারণ মানুষের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলো।

রামানুজ (১০১৭-১১৩৭ খ্রি.)

আচার্য রামানুজ ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের শ্রীপেরম্বুদুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ ১২০ বছর জীবনধারণ করে ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার বাল্য নাম লক্ষ্মণ। পিতার নাম কেশব ভট্ট এবং মাতার নাম কান্তিমতি। শৈশবে তিনি পিতৃহীন হন। যমুনাচার্য তার মাতামহ এবং মহাপূর্ণ তার মাতুল। বাল্যকালে তিনি কাঞ্চিপুরীতে আচার্য যাদবপ্রকাশের কাছে বেদান্ত অধ্যয়ন শুরু করেন, কিন্তু পরে মতবিরোধ-হেতু তিনি গুরু কর্তৃক বিতাড়িত হন। তারপর তিনি মাতামহ যমুনাচার্যের কাছে বেদান্তের পাঠ গ্রহণ করেন এবং শঙ্কর, ভাস্কর ও যাদবপ্রকাশের মতবাদ খণ্ডন করে বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদ প্রচার করেন।

আচার্য রামানুজ ছিলেন অতীব ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তার পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে নানা অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে। মহর্ষি বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের উপর তিনি যে ব্রহ্মসূত্রভাষ্য রচনা করেন তা ‘শ্রীভাষ্য’ নামে সমধিক পরিচিত। এছাড়াও তিনি ‘গীতাভাষ্য’, ‘বেদান্তদীপ’, ‘বেদান্তসংগ্রহ’, ‘শরণাগতিগদ্য’, ‘শ্রীরঙ্গগদ্য’, ‘আগমপ্রামাণ্য’, ‘সিদ্ধিত্রয়’, ‘মহাপুরুষনির্ণয়’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।

রামানুজের পরেও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের সমর্থনে বহু গ্রন্থ রচিত হয়। রামানুজের পরবর্তীকালের রামানুজ-শিষ্য সুদর্শন সূরি’র শ্রীভাষ্যের ‘শ্রুতপ্রকাশিকাটীকা’, বেঙ্কটনাথ-এর ‘শতদূষণী’, ‘ন্যায়পরিশুদ্ধি’, ‘তত্ত্বটীকা’, মেঘনাদারির ‘ন্যায়দ্যুমণি’, আচার্য শ্রীনিবাস-এর ‘যতীন্দ্রমতদীপিকা’, লোকাচার্য’র ‘তত্ত্বত্রয়’ প্রভৃতি গ্রন্থ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের উপর অতি মূল্যবান গ্রন্থ।

রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের এক অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। পরম সদ্ববস্তুই পরম কল্যাণ এবং পরম অন্বিষ্ট সত্তা, কল্যাণ এবং পুরুষার্থ আত্যন্তিক অর্থে সমন্বিত, এই সত্যটিকে বিশিষ্টাদ্বৈত মতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। রামানুজের মতে ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। তবে- ‘বিশিষ্টাদ্বৈত মতে যদিও ব্রহ্মই চূড়ান্ত সত্য, তবুও ব্রহ্মকে নির্গুণ আখ্যা দেয়া ভুল। বরং ব্রহ্মকে অনন্ত-কল্যাণগুণের আধার মনে করতে হবে। তিনিই ঈশ্বর; উপাসনা সৎকর্মের সাহায্যে তার করুণার উদ্রেক করতে পারলেই জীবের মুক্তি। পরিদৃশ্যমান জড়জগৎ এবং জীবাত্মার স্বাতন্ত্র্য মিথ্যা নয়। কেননা, ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের মধ্যেই চিৎ এবং অচিৎ- চেতনা এবং জড়- উভয় বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। চিৎ বৈশিষ্ট্য থেকেই জীবাত্মার সৃষ্টি, অচিৎ থেকে জড়জগতের। ব্রহ্ম চিৎ-অচিৎবিশিষ্ট। জীবাত্মার সঙ্গে জড়দেহের সম্পর্কই বন্ধনের স্বরূপ এবং তার মূলে রয়েছে জন্মজন্মান্তরের কৃতকর্মজনিত অজ্ঞান। ঈশ্বরের করুণায় জীবাত্মা এই অজ্ঞান কাটিয়ে মুক্তিলাভ করবে।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৭)

ঈশ্বর, চিৎ-শক্তি এবং অচিৎ-শক্তি এই ত্রিতত্ত্বে রামানুজ বিশ্বাস করেন। তার মতে ঈশ্বরই পরমতত্ত্ব। ঈশ্বর বিশেষ্য, চিৎ ও অচিৎ তার বিশেষণ। প্রমাণ ও প্রমেয় বিচারে রামানুজের মতে বিশিষ্ট ব্রহ্মই একমাত্র জ্ঞেয় বস্তু। প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ জ্ঞানের ত্রিবিধ উপায়। তবে আচার্য রামানুজও শাস্ত্র বা শব্দপ্রমাণকেই প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন। যেমন, ব্রহ্মবাদী বাদরায়ণের সূত্রগ্রন্থ ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন- যে বিষয়ে শব্দ বা আগম প্রমাণের অভাব, তা-ই অশব্দ- আনুমানিক (শ্রীভাষ্য-৪-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)।

আবার অন্যত্র প্রত্যক্ষ-প্রমাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- শ্রুতি দ্বারা ব্রহ্মাতিরিক্ত বস্তুমাত্রেরই মিথ্যাত্ব জানা যায়। শাস্ত্র (শ্রুতি) দ্বারা নির্ধারিত বিষয়ে কখনোই প্রত্যক্ষের বিরোধ সম্ভাবিত হতে পারে না। কারণ পূর্বোক্ত প্রণালীতে সমস্ত জন্যপদার্থের (জগৎকার্যের) মিথ্যাত্ব নির্ধারিত হয়, আর প্রত্যক্ষ দ্বারা কেবল বস্তু-সত্তা মাত্র সিদ্ধ হয়। স্বভাবত নির্দোষ শাস্ত্র প্রত্যক্ষের পরভাবী, সুতরাং শাস্ত্রের অর্থ বুঝতে হলে প্রত্যক্ষের কথঞ্চিৎ অপেক্ষা থাকলেও কিন্তু শাস্ত্র-লব্ধ জ্ঞানে প্রত্যক্ষের কিছুমাত্র অপেক্ষা নাই; সুতরাং সে-অবস্থায় শাস্ত্র প্রত্যক্ষ-নিরপেক্ষ; নিরপেক্ষ বলেই সেই অংশে প্রত্যক্ষ অপেক্ষাও শাস্ত্রের বলবত্তা অধিক (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৫)।

রামানুজের মতে ব্রহ্মের ধারণা বা স্বরূপ

আচার্য শঙ্করের ন্যায় রামানুজও ব্রহ্মকেই চরম ও পরম সত্তা বা সত্যরূপে গ্রহণ করেছেন। তবে তার মতে ঈশ্বরই সর্বোচ্চ তত্ত্ব, কিন্তু একমাত্র তত্ত্ব নন। ঈশ্বরের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ- চিৎ এবং অচিৎ। জগৎ ব্রহ্মের অচিৎ অংশ এবং জীবাত্মা ব্রহ্মের চিৎ অংশ। চিৎ এবং অচিৎ ঈশ্বরের মতোই সত্য, তবে তারা ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। শরীর যেমন আত্মার উপর নির্ভর করে, তেমনি জড় ও আত্মা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে থাকে। বিশ্বের সব কিছুই ঈশ্বরের শরীর এবং ঈশ্বর হলেন অজৈব প্রকৃতি ও সকল জীবের আত্মা। চিৎ বা অচিৎ, ব্রহ্মের কোন অংশই মিথ্যা নয়। উভয় অংশই ব্রহ্মে বিধৃত। চিৎ ও অচিৎ-এর দ্বারা বিশিষ্ট বলেই রামানুজের ব্রহ্ম বিশিষ্টব্রহ্ম। অতএব, দার্শনিক বিচারে বলতে গেলে বলতে হয়, রামানুজ তিনটি তত্ত্ব স্বীকার করেছেন। রামানুজের দর্শনে ব্রহ্ম, চিৎ ও অচিৎ এই ত্রিতত্ত্ব স্বীকৃত, তবে এই ত্রিতত্ত্ব সমন্বিত হয়ে এক পরমতত্ত্বে পর্যবসিত। এই পরমতত্ত্বই বিশিষ্ট অদ্বৈত ব্রহ্ম বা সগুণ ব্রহ্ম।

আচার্য রামানুজ তার শ্রীভাষ্যের মঙ্গলাচরণেই বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের মূলতত্ত্বকে অতি সংক্ষেপে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘অখিল জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয় যাঁহার লীলা, শরণাগত বিবিধ জীবের রক্ষাই যাঁহার একমাত্র ব্রত এবং যিনি বেদান্তশাস্ত্রে বিশেষভাবে প্রতিপাদিত, সেই পরব্রহ্ম শ্রীনিবাস নারায়ণে আমার ভক্তিরূপা বুদ্ধি উৎপন্ন হউক।’- (যতীন্দ্র রামানুজাচার্যের তর্জমায়)। অর্থাৎ এই মঙ্গলাচরণে একথাই প্রতিপাদিত হয় যে, রামানুজের মতে ব্রহ্ম সগুণ, জগৎ-কারণ, রক্ষাকর্তা, ধ্বংসকর্তা ও ভক্তের পরমকরুণাময় ভগবান। এই পরমতত্ত্ব ভক্তির দ্বারাই বোধগম্য। তাই ভক্তিই তত্ত্বজ্ঞানলাভের উপায়।

রামানুজের মতে ভেদের দিক থেকে তত্ত্ব তিনটি- চিৎ, অচিৎ ও ব্রহ্ম। কিন্তু অভেদের দিক থেকে তত্ত্ব কেবলমাত্র একটি এবং তা হলো- চিৎ-অচিৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই পরম সত্তা এবং চিৎ ও অচিৎ হলো ব্রহ্মের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রহ্মের চিৎ অংশ থেকে জীব এবং অচিৎ অংশ থেকে জড় বস্তুর সৃষ্টি। সুতরাং ব্রহ্ম অংশী বা বিশেষ্য এবং চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মের অংশ বা বিশেষণ। অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ, তা হলো বিশিষ্ট অভেদ- আত্যন্তিক অভেদ নয়। এই কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম স্বগত ভেদযুক্ত কিন্তু অপৃথকসিদ্ধ, সগুণ ও সচ্চিদানন্দস্বরূপ। ব্রহ্মই জগতের কর্তা এবং পরিণামস্বরূপ। তিনি নিত্যতৃপ্ত, বিকারহীন ও অনন্ত-কল্যাণময়। ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেন- অতএব, এটাই স্থির হলো যে, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তি, সর্বপ্রকার দোষস্পর্শশূন্য, নিরবধি নিরতিশয় এবং অসংখ্য কল্যাণকর গুণের মহাসমুদ্রস্বরূপ সেই পুরুষোত্তম নারায়ণই সমস্ত জগতের কারণস্বরূপ জিজ্ঞাস্য (জিজ্ঞাসার বিষয়ীভূত) ব্রহ্ম (শ্রীভাষ্য-১-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।

ব্রহ্ম স্বগত-ভেদযুক্ত : রামানুজের নিকট ব্রহ্ম কোন অভেদতত্ত্ব নন। শঙ্করাচার্যের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে একমত যে, ব্রহ্মের কোন স্বজাতীয় বা বিজাতীয় ভেদ নেই। একই জাতির অন্তর্গত দুটি ব্যক্তির ভেদকে বলা হয় স্বজাতীয়ভেদ; যেমন- দুটি মানুষের পারস্পরিক ভেদ। অপরদিকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন জাতির অন্তর্গত ব্যক্তিদের মধ্যে যে ভেদ, তাকে বলা হয় বিজাতীয়ভেদ; যেমন- একটি গরু সঙ্গে একটি অশ্বের ভেদ। এই দু’প্রকার ভেদ ছাড়াও তৃতীয় যে ভেদ প্রসিদ্ধ তা হলো স্বগতভেদ। একই বস্তু বা ব্যক্তির বিভিন্ন অংশ বা অঙ্গের মধ্যে যে ভেদ, তাকে বলা হয় স্বগত ভেদ; যেমন- একই মানুষের হাত ও পায়ের ভেদ। একমাত্র ব্রহ্মই সত্য হওয়ায় বা ব্রহ্মের বাইরে কিছু না থাকায় ব্রহ্মের স্বজাতীয় বা বিজাতীয় ভেদ সম্ভব নয়। ব্রহ্মের স্বজাতীয় ভেদ নেই, কারণ ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। আবার ব্রহ্মের বিজাতীয় ভেদ নেই, যেহেতু ব্রহ্মের অসদৃশ কিছুই নেই। তবে রামানুজের মতে ব্রহ্মের স্বগত ভেদ বর্তমান। একই ব্রহ্মে বিধৃত চিৎ ও অচিৎ অংশের ভেদই হলো ব্রহ্মের স্বগত ভেদ। তাই ব্রহ্ম সবিশেষ বা বিশিষ্ট। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ব্রহ্মের অন্তর্গত চিৎ ও অচিৎ-এর ভেদ রামানুজ-মতে এমন দুটি অংশের ভেদ, যারা ভিন্ন হলেও তাদের সম্পূর্ণ পৃথক বা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। রামানুজ ব্রহ্মের সঙ্গে চিৎ ও অচিৎ-এর সম্বন্ধকে অপৃথকসিদ্ধি বলে উল্লেখ করেছেন।

ব্রহ্ম অপৃথকসিদ্ধ : ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সঙ্গে চিৎ ও অচিৎ-এর বিশেষ নির্ভরতার সম্বন্ধকে ব্যাখ্যা করার জন্য রামানুজ ‘অপৃথকসিদ্ধি’ নামে একটি পৃথক সম্বন্ধ স্বীকার করেছেন।

‘অপৃথকসিদ্ধি’ কথাটির অর্থ হলো ‘অবিচ্ছেদ্যতা’। রামানুজের মতে এই সম্বন্ধ দ্রব্য ও গুণের মধ্যে, কিংবা একটি দ্রব্য ও অন্য একটি দ্রব্যের মধ্যে থাকতে পারে। অপৃথকসিদ্ধি সম্বন্ধ ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়-স্বীকৃত সমবায় সম্বন্ধের সদৃশ। ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকেরা অবিচ্ছেদ্য বিষয়সমূহের সম্বন্ধকে ‘সমবায় সম্বন্ধ’ বলেছেন। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতবাদিরা সমবায় সম্বন্ধকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। তাদের মতে অবিচ্ছেদ্যতাই হলো দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের স্বরূপ বা প্রকৃতি।  তাই অপৃথকসিদ্ধিকে ঠিক সম্বন্ধ বলা যায় না; যদিও এটি সম্বন্ধরূপে অভিহিত হয়। ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকদের সমবায় সম্বন্ধ এবং রামানুজের অপৃথকসিদ্ধি সম্বন্ধ- এই দুটির মধ্যে সাদৃশ্য হলো, উভয় সম্বন্ধই স্বতন্ত্র ও বাস্তব বিষয়সমূহে সম্বন্ধযুক্ত করে। তবে অপৃথকসিদ্ধি হলো আভ্যন্তরীণ সম্বন্ধ, কিন্তু সমবায় সম্বন্ধ তা নয়।

রামানুজের মতে অপৃথকসিদ্ধি সম্বন্ধের দৃষ্টান্ত হলো- দেহ ও আত্মার সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধ আবার দ্রব্য ও গুণের মধ্যে, কিংবা একটি দ্রব্যের ও অন্য একটি দ্রব্যের মধ্যে থাকতে পারে। রামানুজ দেহের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘যাকে আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, যা আত্মাকে আশ্রয় করে থাকে এবং যাকে আত্মা আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য কাজে লাগায়।’ এক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্যতাই হলো দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের স্বরূপ বা প্রকৃতি। এই অপৃথকসিদ্ধির ধারণাটিকে রামানুজের দার্শনিক মতের কেন্দ্রভূমিরূপে গণ্য করা হয়।

চিৎ ও অচিৎ- উভয়ই হলো ঈশ্বরের শরীর। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং উভয়েই ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য বিদ্যমান। চিৎ, অচিৎ এবং ঈশ্বরের সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য। এই তিনটি বিষয় একই ঐক্যে আবদ্ধ। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রাণাধীন। রামানুজের পরমতত্ত্ব বা ব্রহ্ম হলেন এই ঈশ্বর। জীবের আত্মার সঙ্গে শরীরের যে সম্বন্ধ থাকে, ঈশ্বরের সঙ্গে চিৎ ও অচিৎ-এর সেই সম্বন্ধ আছে। একটি প্রাণীদেহে যেমন আত্মাই প্রাধান্য লাভ করে, তেমনি চিৎ ও অচিৎ-এর সঙ্গে ঈশ্বরের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ থাকলেও ঈশ্বরই প্রাধান্য লাভ করেন এবং চিৎ ও অচিৎকে নিয়ন্ত্রিত করেন। চিৎ ও অচিৎ- এই দুটি অধীন বিষয়কে বিশেষণরূপে এবং ঈশ্বরকে বিশেষ্যরূপে গণ্য করা হয়েছে। যেহেতু কোন বিশেষণ বিশেষ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না, সেহেতু যে সমগ্রের তারা অন্তর্ভুক্ত সেই সমগ্রটিকে অদ্বৈত বা এক বলা হয়েছে। চিৎ ও অচিৎ- এই বিশেষণের দ্বারা ঐ এক বা অদ্বৈত বিশিষ্ট হয় বলে রামানুজের দার্শনিক মতকে বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তদর্শন বলা হয়।

বিশিষ্টাদ্বৈতের ধারণাটিকে একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে পরিস্ফুট করা যায়। যেমন, একটি লাল গোলাপের লাল রংটি হলো গুণ, গোলাপটি দ্রব্য। দ্রব্য ও গুণ এক নয়। তাই লাল রংটি গোলাপটি থেকে স্বতন্ত্র। আবার লাল রংটি গোলাপের গুণ হবার জন্য গোলাপটি থেকে স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে না। রংটির অস্তিত্ব গোলাপ ফুলটির উপর নির্ভর করে। সেজন্য রংটি যে গোলাপের বাইরে আছে, তা বলা যায় না। রং ও অন্যান্য বিশেষণ নিয়ে গোলাপটি একটি সমগ্র এবং গুণগুলি ঐ সমগ্রের অন্তর্ভুক্ত। রামানুজ লাল রং ও গোলাপের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করেছেন। তিনি দ্রব্য ও গুণের এই পার্থক্যকে বলেছেন স্বগত ভেদ। রামানুজ ‘নীলোৎপল’ বা নীলপদ্মের উদাহরণ টেনেও বিষয়টির বিশ্লেষণ করে বলেছেন- ‘নীলবর্ণ উৎপল’ বললে এস্থলে বিশেষণ ও বিশেষ্য, উভয় পদেরই একমাত্র বিশেষ্য-বোধনে তাৎপর্য থাকায় ‘নীলত্ব’ ও ‘উৎপলত্ব’ এই দুটি বিশেষণ আর পৃথকভাবে বক্তার অভিপ্রেত হয় না। আর যদি নীলত্ব ও উৎপলত্বের পৃথক প্রতীতিই হতো, তাহলে নিশ্চয়ই উৎপলত্ব ধর্মবিশিষ্ট পদার্থটির (উৎপলের) নীলত্ব ধর্মবিশিষ্টরূপে অভেদ প্রতীতি অপরিহার্য হতো; অথচ তা সম্ভব হয় না; কারণ, উৎপল পদার্থটি কখনোই উৎপল পদ দ্বারা নীলত্ববিশিষ্টরূপে বিশেষিত হয় না; কেননা, তাহলে জাতি ও গুণের মধ্যে পরস্পর সমবায় সম্বন্ধের সম্ভাবনা হয়ে পড়ে। অতএব, বুঝতে হবে যে, নীলত্ব ও উৎপলত্ব ধর্মদ্বয়বিশিষ্ট বস্তুর কেবল একত্বই উক্ত সামানাধিকরণ্য দ্বারা প্রতিপাদিত হয় (শ্রীভাষ্য-১২-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।

ব্রহ্ম সগুণ ও সচ্চিদানন্দস্বরূপ : রামানুজের মতে ব্রহ্ম সগুণ। তিনিই ঈশ্বর। ঈশ্বর নির্বিশেষ বা নির্গুণ ব্রহ্ম নন। কারণ চিৎ ও অচিৎ তার বিশেষণ। চিৎ ও অচিৎ তার শরীর, তিনি তাদের আত্মা। রামানুজ চিৎ ও অচিৎ-এর সত্তা স্বীকার করেছেন, তবে তিনি তাদের স্ব-নির্ভর সত্তা স্বীকার করেননি। কারণ চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মাধীন এবং ব্রহ্ম-নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং ব্রহ্মই পরম তত্ত্ব এবং তিনটি মাত্রাত্মক অদ্বৈতসত্তা। রামানুজের মতে উপনিষদে যে নির্গুণ ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে, তার প্রকৃত অর্থ হলো ব্রহ্মের অজ্ঞতা, জড়তা, ক্ষুদ্রতা প্রভৃতি হেয় গুণগুলি নেই। রামানুজ অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের নির্গুণ বা নির্বিশেষ ব্রহ্মের অসিদ্ধি প্রতিপাদন করতে গিয়ে বলেন- অতএব, জিজ্ঞাস্য ব্রহ্মে পারমার্থিক (প্রকৃত সত্য) মুখ্য ঈক্ষণ (আলোচনা) প্রভৃতি গুণসম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ায় এটাও বুঝতে হবে যে, (ব্রহ্মসূত্রের) সূত্রকার (বাদরায়ণ) কর্তৃক উক্ত শ্রুতিসমূহ দ্বারা নির্বিশেষ চিন্মাত্র ব্রহ্মবাদও (শঙ্করমতও) প্রত্যাক্ষাত হয়েছে। কেননা, নির্বিশেষবাদে ঈশ্বরের সাক্ষিত্ব ধর্মও অপারমার্থিক বা অসত্য ; (সুতরাং গৌণ)। বেদান্ত-বেদ্য ব্রহ্মই এখানে জিজ্ঞাস্যরূপে প্রতিজ্ঞাত হয়েছেন ; সেই ব্রহ্ম যে চেতন বস্তু, তা-ই ‘ঈক্ষতেঃ নাশব্দম্’ এসব শব্দ দ্বারা প্রতিপাদিত হয়েছে। চেতনত্ব অর্থই চৈতন্যগুণের যোগ বা সম্বন্ধ ; অতএব, ঈক্ষণ-গুণহীন পদার্থ (ব্রহ্ম) তো সাংখ্যোক্ত প্রধানেরই সমান (শ্রীভাষ্য-২-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।

অতঃপর রামানুজ আরো বলেন- আরও এক কথা, ব্রহ্মকে নির্বিশেষ প্রকাশমাত্রস্বরূপ বললে, তার ‘প্রকাশত্ব’ই উপপাদন বা সমর্থন করা যায় না; কারণ, (অন্যের নিকট) নিজের ও অপরের ব্যবহার-যোগ্যতা সম্পাদক বস্তুবিশেষই প্রকাশ পদবাচ্য; নির্বিশেষ বস্তুতে সেই উভয়ই অসম্ভব; সুতরাং ঘটাদি পদার্থের ন্যায় তার অচিদ্রূপতাই (জড়তা) সিদ্ধ হতে পারে। যদি বলো, স্ব-পর ব্যবহার্যতারূপ এই অবস্থাদ্বয় না থাকলেও নিশ্চয়ই এ-বিষয়ে তার ক্ষমতা আছে। না- তা হয় না; কারণ, এ-বিষয়ে ক্ষমতা অর্থ- এ-বিষয়ে সামর্থ্য; ব্রহ্মে এই সামর্থ্যরূপ গুণের সম্বন্ধ স্বীকার করলে তো নির্বিশেষবাদ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে (শ্রীভাষ্য-৩-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১২)।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ। ব্রহ্ম অনন্ত গুণের অধিকারী। এই অনন্তগুণের মধ্যে সত্তা, চৈতন্য ও আনন্দ ব্রহ্মের একাধারে স্বরূপ ও গুণ। তাই ব্রহ্ম শুধু সৎ নন, সত্তাবানও বটে; শুধু জ্ঞান নন, জ্ঞানবান; আবার শুধু আনন্দ নন, আনন্দময়। চিৎ ও অচিৎ তার অংশ। চিৎশক্তির বিক্ষেপের দ্বারা জীবের এবং অচিৎশক্তির বিক্ষেপের দ্বারা জগতের সৃষ্টি হয়েছে। তাই তিনি জগতের নিমিত্ত ও উপাদান উভয়ই।

ব্রহ্ম সনাতন কর্তা ও পরিণামরূপ জগৎ-কারণ : রামানুজ সৎকার্যবাদী ও পরিণামবাদী। তার মতে জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত নয়, পরিণাম। ব্রহ্মই জীব ও জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ। ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে দুভাবে চিন্তা করা যায়- কারণরূপে ও কার্যরূপে। প্রলয়কালে জগৎ যখন ধ্বংস হয়, তখন জীব ও জড়, ব্রহ্মের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় অবস্থান করে। তখন ঈশ্বর কারণরূপে বিদ্যমান থাকেন এবং সূক্ষ্ম অচিৎ ও বিদেহ আত্মাগুলি ঈশ্বরের শরীররূপে থাকে। ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয় কারণ-ব্রহ্ম। সমগ্র বিশ্বসংসার এই সময় ব্রহ্মে লীন হয়ে থাকে। সৃষ্টির পরে যখন ব্রহ্মের চিৎ ও অচিৎ অংশ যথাক্রমে জীবজগৎ ও জড়জগতে ব্যক্ত হয়, তখন ব্রহ্মকে বলা হয় কার্য-ব্রহ্ম। সংক্ষেপে বললে, কারণ-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের অব্যক্ত অবস্থা এবং কার্য-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের ব্যক্ত অবস্থা। প্রমাণস্বরূপ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ শ্রুতিতেও বলা হয়েছে- ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই সবকিছুর মূল। জগৎ প্রকাশিত হলে সেই জগৎকে তিনিই পালন করেন। আবার প্রলয়কালে জগৎ তার কাছেই ফিরে যায়। তিনি সবকিছুর নিয়ন্তা। একমাত্র তিনিই ভক্তদের বর দেন। তিনিই একমাত্র আরাধ্য। এই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অনুভূতি হলে শাশ্বত শান্তি লাভ করা যায় (শ্বেতাশ্বতর-৪/১১)।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জগতের অন্তর্বর্তী এবং অতিবর্তী উভয়ই। তিনি জীব-জগতে উপাদান কারণ হিসেবে সংসারে অনুস্যুত থেকে জড় প্রকৃতি ও আত্মাসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কার্য-ব্রহ্ম হিসেবে এই বিশ্বসংসারের সব কিছুই ব্রহ্মাত্মক। আবার ঈশ্বর জগতের অতিবর্তীও। কারণ এই সসীম জগতে ঈশ্বরের সম্পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব নয়। বস্তুত ঈশ্বর হলেন একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তা। তিনি অপ্রাকৃত দেহ-বিশিষ্ট। রামানুজের মতে দেহ বন্ধনের কারণ নয়, কর্মই বন্ধনের কারণ। তাই ঈশ্বর দেহবিশিষ্ট হয়েও বদ্ধ নন। তিনি কর্মের অধ্যক্ষ ও নিয়ন্তা।

ব্রহ্ম নিত্য-তৃপ্ত ও বিকারহীন : ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের কোন পরিবর্তন হয় না। পরিণামবাদী রামানুজ ব্রহ্মের কোন বিকার স্বীকার করেন নি। ঈশ্বরের চিৎ ও অচিৎ অংশ নিত্য। তাই চিৎ ও অচিৎ-এর পরিণামের জন্য ঈশ্বরের কোন প্রকার বিকার হয় না। তিনি নিজে অপরিবর্তিত দ্রব্যরূপে অবস্থান করে বিশ্বসংসারের পরিবর্তন ঘটান। অপরপক্ষে ঈশ্বরের প্রকারগুলির অর্থাৎ আত্মা ও জড় পদার্থের বিভিন্ন রূপের পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে রামানুজ গুণ ও প্রকারের পার্থক্য করেননি। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের গুণ বা প্রকার। যেমন- একজন ব্যক্তির বাল্য যৌবন এভাবে দেহ ও মনের পরিবর্তন হলেও তার ব্যক্তিত্বের ঐক্য ও অভিন্নতা অক্ষুণ্ন থাকে, তেমনি চিৎ ও অচিৎ পরিবর্তিত হলেও ঈশ্বরের কোন পরিবর্তন হয় না। তাই অচিৎ বা জড়ের প্রকৃতিগত সীমাতে তিনি আবদ্ধ নন এবং জীবাত্মাগুলির দুঃখযন্ত্রণা তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। শ্রীভাষ্যে তাই রামানুজ বলেছেন- এইরূপে জীবাত্মা পরমাত্মার শরীরস্থানীয় হওয়ায় স্বীয় শরীরগত বালত্ব, যুবত্ব প্রভৃতি ধর্ম যেমন জীবকে স্পর্শ করে না, তেমনি জীবগত ধর্মসমূহও পরমাত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না (শ্রীভাষ্য-১৯-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১৩)।

রামানুজের মতে, ব্রহ্ম নির্বিকার হলেও নিষ্ক্রিয় নন। তিনি জীবের কর্মানুসারে জীবকে পরিচালনা করেন এবং জীবের সাধনায় বা উপাসনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে মুক্তি দান করেন। তবে জগতের সৃষ্টি বা পরিচালনার মাধ্যমে তার কোন প্রয়োজন সাধিত হয় না। জীবের প্রয়োজনেই তার জগৎ-পরিচালনা। তিনি নিত্য-তৃপ্ত এবং তার দিক থেকে জগৎসৃষ্টি লীলা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তিনি জগতে অন্তর্লীন হয়েও জগতের অতিরিক্ত। তাই শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে- পরমাত্মার যে চেতনাচেতনসমষ্টিরূপ জগদাকারে পরিণাম, তাতে পরমাত্মার শরীরস্থানীয় চেতনাংশগত সমস্তই অপুরুষার্থ, অর্থাৎ জীবের প্রকৃত মঙ্গলকর নয়; এবং পরমাত্মার শরীরভূত অচেতনপদার্থগত সমস্ত বিকার (পরিণাম), পরমাত্মগত কার্য্যত্ব এবং সেই অবস্থায় যে চেতন ও অচেতনের নিয়ামকরূপে আত্মত্ব; স্বশরীরভূত সেই চেতনাচেতনের নিয়ামকরূপে আত্মস্বরূপ পরমাত্মা কিন্তু স্বশরীরগত উক্ত অনর্থরাশি ও বিকার দ্বারা স্পৃষ্ট হন না; বরং অপরিচ্ছিন্ন জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ তিনি সর্বদা একরূপ থেকে জগতের পরিবর্তনরূপ লীলা সম্পাদনকারী হিসেবে অবস্থান করেন। এ কথাই ‘সেই সত্যরূপ পরমাত্মা সত্য ও অসত্যরূপ হলেন’-(তৈত্তিরীয়-৬/২) বাক্যে অভিহিত হয়েছে। (অভিপ্রায় এই যে,) ব্রহ্ম চেতনাচেতনরূপে বিকারপ্রাপ্ত হয়েও স্বয়ং সত্যই ছিলেন, অর্থাৎ সবধরনের দোষসম্বন্ধশূন্য ও অপরিচ্ছিন্ন জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপে একরূপই ছিলেন। সূক্ষ্মাবস্থাপন্নই হোক, আর স্থূলাবস্থাপন্নই হোক, চেতনাচেতন সমস্তই পরব্রহ্মের লীলোপকরণ। সৃষ্টি প্রভৃতি কার্য যে ভগবানেরই লীলা, তা ভগবন দ্বৈপায়ন এবং পরাশর প্রভৃতি মুনি বিভিন্ন স্মৃতিতেও বলেছেন (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৭)।

তাই ব্রহ্মসূত্রেও (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩) বলা হয়েছে- ‘লোকবত্তু লীলা-কৈবল্যম্’ অর্থাৎ, ‘লোকব্যবহারের ন্যায় সৃষ্টি কেবল ঈশ্বরের লীলা মাত্র’।

ব্রহ্ম পুরুষোত্তম ও অনন্ত-কল্যাণময় : রামানুজের মতে ব্রহ্ম পুরুষোত্তম বা পুরুষশ্রেষ্ঠ, কল্যাণগুণাধার, উপাস্য ভগবান। এই মতে ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান ও জগৎকর্তা একই সত্তার নামান্তরমাত্র। যেহেতু ঈশ্বর পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাই তার কোন দোষ-ত্রুটি নেই। তিনি পুণ্য ও ধর্মের আশ্রয়স্থল। তার জ্ঞান ও আনন্দ অনন্ত। তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ধ্বংসকর্তা। ঈশ্বরের জ্ঞান, শক্তি ও করুণা অনন্ত, নিত্য, অসীম ও অনুপম। তিনি অজ্ঞানের জ্ঞান, শক্তিহীনের শক্তি, ভক্তের ভগবান, অনাথের নাথ, অপরাধীর কাছে ক্ষমা, পীড়িতের কাছে করুণা, অশুচি ও অপবিত্র জনের কাছে স্নেহময় পিতা ও সকলের প্রতি সদয়। শ্রদ্ধা, প্রীতি ও ভক্তির মাধ্যমে এই পুরুষশ্রেষ্ঠকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। তার কৃপা বা করুণাতেই আমরা দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হই।

রামানুজ বলেন যে, ঈশ্বর যদিও স্বয়ং এক ও অদ্বৈত, তবুও তিনি ভক্তদের সাহায্য করার জন্য নিজেকে পঞ্চরূপে প্রকাশ করেন। তার এই পাঁচটি রূপ হলো- প্রথমত, তিনি জগতের ও জীবাত্মাসমূহের আত্মা বা অন্তর্যামীরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। তার দ্বিতীয় রূপটি হলো জগতের অতিবর্তী বৈকুণ্ঠবাসী নারায়ণ। তিনি হলেন পরম পুরুষ। ঈশ্বর তার তৃতীয় রূপটি আবার চারপ্রকার ব্যূহের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
প্রথম ব্যূহরূপটি হলো বাসুদেব, যিনি জগতের কর্তা। দ্বিতীয় ব্যূহরূপটি হলো সংকর্ষণ। এই রূপে তিনি জীবের বুদ্ধির কর্তৃত্ব করেন এবং জগতের সংহার করেন। তৃতীয় ব্যূহরূপটি হলো প্রদ্যুম্ন। এই রূপে তিনি জগৎ সৃষ্টি করেন এবং জীবসমূহের আবেগের কর্তৃত্ব করেন। চতুর্থ ব্যূহরূপটি হলো অনিরুদ্ধ। এই রূপে তিনি জগৎ পালন করেন এবং জীবদের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। চারটি ব্যূহরূপ হলো এককভাবে পরমেশ্বরের আংশিক প্রকাশ। যখন ঈশ্বর মানুষের বা পশুর শরীর ধারণ করে জগতে অবতরণ করেন, তখন তাকে বিভব বা অবতার বলা হয়। এটিই তার চতুর্থ রূপ।

রামানুজের মতবাদের সাথে ভগবদ্গীতার শিক্ষার প্রচুর সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, অবতার বিষয়ে শ্রীগীতায় উদ্ধৃত হয়েছে- হে ভারত, যখন প্রাণিগণের অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়সের কারণ বর্ণাশ্রমাদি ধর্মের অধঃপতন ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি স্বীয় মায়াবলে যেন দেহবান হই, যেন জাত হই (গীতা-৪/৭)।  সাধুদিগের রক্ষার জন্য, দুষ্টদিগের বিনাশের জন্য এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে নবাদিরূপে অবতীর্ণ হই (গীতা-৪/৮)।

আচার্য রামানুজও যেন তারই পুনরুক্তি করে বলেন, সাধুদের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতদের বিনাশের জন্য এবং ধর্মের পুনঃস্থাপনের জন্য ঈশ্বর অবতার হন। অবতার দু’প্রকারের- মুখ্য ও গৌণ অবতার। ঈশ্বর যখন স্বয়ং অবতীর্ণ হন, তখন তাকে মুখ্য অবতার বলা হয়। যেমন শ্রীকৃষ্ণ। কয়েকটি আত্মা যখন ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত হন, তখন তাদের ঈশ্বরের গৌণ অবতার বলা হয়। যেমন শিব, বুদ্ধ ইত্যাদি। পরমকারুণিক ঈশ্বর তার ভক্তদের সেবার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য তার পঞ্চম রূপটি ধারণ করেন। এই রূপটিকে বলা হয় অর্চাবতার। রামানুজের মতে ঈশ্বর মূর্তিকে আশ্রয় করে মন্দিরে অবস্থান করেন যাতে ভক্তগণ তার সেবার প্রত্যক্ষ সুযোগ পায়।

আচার্য রামানুজ তার শ্রীভাষ্যের সমন্বয়-অধিকরণের আলোচনান্তে বলেছেন- ‘যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে’ প্রভৃতি বেদান্তবাক্য একথাই নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, সকলপ্রকার দোষরহিত, অনন্ত কল্যাণ-গুণের আকর, নিরবধিক, নিরতিশয় ও আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মই জগতের একমাত্র কারণ।

রামানুজের মতে জগৎ ও মায়াবাদের বিরুদ্ধে আপত্তি

রামানুজের জগৎ

বেদান্তসূত্রের ভাষ্য গ্রন্থ হিসেবে রচিত শ্রীভাষ্যে আচার্য রামানুজ তার বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদে তিনটি তত্ত্ব স্বীকার করেছেন- ব্রহ্ম বা ঈশ্বর, চিৎ বা আত্মা এবং অচিৎ বা জড়। তার মতে ঈশ্বরই সর্বোচ্চ তত্ত্ব। কিন্তু ঈশ্বর একমাত্র তত্ত্ব নন। ঈশ্বরের দুটি অংশ- চিৎ এবং অচিৎ। অর্থাৎ ভেদের দিক থেকে তত্ত্ব তিনটি- চিৎ, অচিৎ ও ব্রহ্ম। কিন্তু অভেদের দিক থেকে তত্ত্ব কেবলমাত্র একটি এবং তা হলো চিৎ-অচিৎ বিশিষ্ট ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই পরম সত্তা এবং চিৎ ও অচিৎ হলো ব্রহ্মের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

রামানুজের মতে ব্রহ্মের চিৎ অংশ থেকে জীব এবং অচিৎ অংশ থেকে জড় বস্তুর সৃষ্টি। সুতরাং ব্রহ্ম অংশী বা বিশেষ্য এবং চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মের অংশ বা বিশেষণ। অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ, তা হলো বিশিষ্ট অভেদ, আত্যন্তিক অভেদ নয়। এ কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।

রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর যেহেতু যথার্থই জগৎ-স্রষ্টা, তাই সৃষ্ট-জগৎ যথার্থই সত্য। তার মতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তার মঙ্গলময় ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তার নিজের মধ্য থেকে জীব ও জড় সমন্বিত এই জগৎ সৃষ্টি করেন। মাকড়সা যেমন তার অভ্যন্তর থেকে তন্তু বের করে জাল বোনে, ঈশ্বরও তেমনি তার চিৎ অংশ থেকে জীবজগৎ এবং অচিৎ অংশ থেকে জড়জগৎ সৃষ্টি করেন। জড় অচিৎ এবং চেতন জীবাত্মাগুলি ঈশ্বরেই বিধৃত। ঈশ্বর জগতের উপাদান ও নিমিত্তকারণ। ঈশ্বরের চিৎ অংশ জীবের এবং অচিৎ অংশ জগতের উপাদান কারণ। আবার ঈশ্বর জীব ও জগতের নিমিত্তকারণ। কারণ তিনিই জীব ও জগতের আবির্ভাব নিয়ন্ত্রণ করেন। সৃষ্টির পূর্বে জীব ঈশ্বরের চিৎ অংশে এবং জড়জগৎ ঈশ্বরের অচিৎ অংশে অব্যক্ত রূপে বর্তমান থাকে।

জগৎ সৃষ্টির ব্যাখ্যায় রামানুজ পরিণামবাদের সমর্থক। তার মতে এই জগতের যাবতীয় জড় বস্তুর মূল উৎস হলো অচিৎ। এই অচিৎকেই ‘প্রকৃতি’ বলা হয়। এই ধরনের চিন্তা যে বিভিন্ন উপনিষদে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে, তা প্রদর্শন করে রামানুজ তার পরিণামবাদী তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। যেমন, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে- প্রকৃতি (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ) নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল (রজঃ গুণাত্মক), কেউ বা সাদা (সত্ত্ব গুণাত্মক) আবার কেউ কালো (তমঃ গুণাত্মক) (অর্থাৎ, তারা আগুন, জল আর মাটি দিয়ে তৈরি)। একজন অজ্ঞান জীব এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তা ভোগ করে। কিন্তু আরেকজন বুদ্ধিমান এবং বিচারশীল ব্যক্তি পূর্ব পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুন তিনি বুঝেছেন যে এই স্থূল জগৎ ক্ষণস্থায়ী; সেই কারণেই তিনি এই জগৎকে ত্যাগ করেন (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)। প্রকৃতি হলো সেই উপাদান যা দিয়ে জগৎ নির্মিত। প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বর (তথা ব্রহ্মকে) মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ। অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র এবং সর্বজীবে বিরাজিত (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)।

শ্রুতির মতো পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতেও প্রকৃতিকে জড়জগতের উৎসরূপে গণ্য করা হয়েছে। আবার সাংখ্যদার্শনিকরাও প্রকৃতিকে অজা অর্থাৎ যার জন্ম নেই বলেছেন এবং প্রকৃতিকেই জগতের কারণরূপে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সাংখ্যদর্শন প্রকৃতিকে ঈশ্বরের অংশরূপে স্বীকার করেনি। সাংখ্যমতে প্রকৃতি স্বনির্ভর, নিত্য এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্বতন্ত্র সত্তা। আর রামানুজের মতে প্রকৃতি নিত্য ও ত্রিগুণাত্মক, কিন্তু স্বনির্ভর সত্তা নয়। তার মতে প্রকৃতি ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের অংশ এবং ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন আকৃতির স্বর্ণালঙ্কার যেমন স্বর্ণ-নির্ভর, তেমনি এই বিচিত্র প্রকৃতি ব্রহ্ম-নির্ভর। মানুষের শরীরকে যেমন তার আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি ঈশ্বরও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ঈশ্বরের কোন অভাব নেই। তাই তিনি কোন অভাব পূরণের জন্য জগৎ সৃষ্টি করেননি। জগৎ সৃষ্টি তার লীলা।

রামানুজ সৎকার্যবাদী ও পরিণামবাদী। তার মতে উৎপত্তির পূর্বে কার্য তার উপাদানকারণের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় বর্তমান থাকে। সৃষ্টির পূর্বে অচেতন প্রকৃতি ঈশ্বরে লীন হয়ে থাকে এবং সুপ্ত ও অবিভক্ত অবস্থায় অবস্থান করে। ঈশ্বর জীবের পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে বিচিত্র বস্তু সমন্বিত জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সূক্ষ্ম ও অবিভক্ত অচিৎ তিনটি সূক্ষ্ম জড় পদার্থে পরিণত হয়। যথা অগ্নি, জল ও ক্ষিতি বা পৃথিবী। তিনটি সূক্ষ্ম জড় পদার্থ থেকে তিনটি গুণ প্রকাশ পায়- সত্ত্ব, রজো এবং তমো। এই তিনটি সূক্ষ্ম উপাদান ক্রমশ মিলিত হয়ে এই জগতের বিভিন্ন জড় বস্তু উৎপন্ন করে থাকে। এই প্রক্রিয়ার নাম ‘ত্রিবৃৎ-করণ’। জগতের প্রতিটি জড় বস্তুতে এই তিনটি উপাদান বর্তমান থাকে। তাই জগতের প্রতিটি বস্তুই হলো ঐ তিনটি সূক্ষ্ম উপাদানের সংমিশ্রণের ফল।

আবার উপনিষদে বলা হয়েছে- ‘মায়ি নং তু মহেশ্বরম্’ অর্থাৎ ঈশ্বরকে মায়া সৃষ্টির অধিকারী বলা হয়েছে। এই উক্তিটির ভাষ্যে রামানুজ বলেছেন যে, ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টি আমাদের বুদ্ধির অগম্য। ঈশ্বরের সৃষ্ট জগতের মতো তার মায়াশক্তিও সত্য। যাদুকরের যাদু সৃষ্টির কৌশল যেমন আমরা বুঝতে পারি না, তেমনি ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির কৌশল ও শক্তিকে আমরা বুঝতে পারি না। তাছাড়া ঈশ্বর যে বহু বিচিত্র বস্তু সমন্বিত জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই জগৎও ইন্দ্রজালের মতোই বিস্ময়কর। তাই উপনিষদে প্রকৃতিকে মায়া এবং ঈশ্বরকে মায়াধীশ বলা হয়েছে।

অদ্বৈতবাদীর ন্যায় রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মায়াকে মিথ্যা বলে না। বিশিষ্টাদ্বৈতমতে মায়া ব্রহ্মের প্রকৃত শক্তি। ব্রহ্ম যেমন সত্য, তেমনি তার জগৎ-সৃষ্টিকারী মায়াশক্তিও সত্য, আবার সৃষ্ট জগৎও সত্য। এই মতে কার্য হলো কারণশক্তির বিকাশ। এই বিকাশকেই বলা হয় পরিণাম। সৃষ্টির পূর্বে চিৎ ও অচিৎ সংকুচিত অব্যক্ত অবস্থায় ব্রহ্মে নিহিত ছিলো। এই অবস্থায় ব্রহ্মকে কারণ-ব্রহ্ম বলা হয়। এই কারণ-ব্রহ্মই জীব ও জগৎরূপে কার্যে পরিণত হয়। জীব ও জগৎ তাই কার্য-ব্রহ্ম। সৃষ্টির আদিতে প্রথম আবির্ভূত হয় মহৎ। তারপর ক্রমশ মহৎ থেকে অহংকার এবং অহংকার থেকে পর্যায়ক্রমে সূক্ষ্মভূত, স্থূলভূত প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।

শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের আপত্তি

অদ্বৈতবেদান্তে মায়াশক্তি অনির্বচনীয় ঐশ্বরিক শক্তি। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য মায়াকে মিথ্যা, অবিদ্যা বা অজ্ঞান বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে সগুণ ঈশ্বর কল্পিত এবং মায়া। মায়া সৎও নয়, অসৎও নয়; অনির্বচনীয়। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের নিকট মায়া যথার্থই ঐশ্বরিক শক্তি। এই শক্তি মিথ্যা, অজ্ঞান বা অনির্বচনীয় নয়। রামানুজের মতে ব্রহ্ম সগুণ ও সবিশেষ। বিচিত্রার্থ-সৃষ্টিকারী মায়াশক্তির সাহায্যে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এভাবে অদ্বৈতবাদীর ‘নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদ’ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীর নিকট ‘সপ্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদে’ পর্যবসিত হয়েছে।

আচার্য রামানুজ তার ‘শ্রীভাষ্যে’ শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি উত্তাপিত করেছেন। এই সাতটি আপত্তি ‘সপ্তধা অনুপপত্তি’ নামে পরিচিত। তবে অদ্বৈত বেদান্তীরা ঐসব আপত্তির উত্তরও দিয়েছেন। এই আপত্তি ও উত্তরগুলো নিম্নরূপ-

  • (১) আশ্রয়ানুপপত্তি : রামানুজের প্রথম অনুপপত্তিটি হলো আশয়ানুপপত্তি। অর্থাৎ, রামানুজের মতে শঙ্করাচার্যসম্মত মিথ্যা মায়া বা অবিদ্যার আশ্রয় উপপন্ন করা যায় না। মায়া শক্তিরূপা বলে এই শক্তির একটি আশ্রয় স্বীকার করা প্রয়োজন। রামানুজের মতে যদি সত্যই মায়া বা অবিদ্যার অস্তিত্ব থাকে, তাহলে প্রশ্ন হলো, মায়া বা অবিদ্যা কোথায় থাকে? কারণ আশ্রয় বা অধিষ্ঠান ছাড়া কোন বিষয়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এখন মায়া ব্রহ্মে থাকলে নির্গুণ অদ্বয় ব্রহ্ম স্বগত ভেদসম্পন্ন হয়ে যাবে। অথচ শঙ্করাচার্যের মতে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং ব্রহ্ম স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত-ভেদ বর্জিত। দ্বিতীয়ত, জ্ঞানবিরোধী অবিদ্যারূপ মায়া ব্রহ্মে অবস্থান করলে ব্রহ্মকে জ্ঞানস্বরূপ ইত্যাদি বলা যাবে না। অথচ শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম জ্ঞানস্বরূপ ও স্বপ্রকাশ। সুতরাং, ব্রহ্ম মায়ার আশ্রয় হলে অদ্বৈতবাদ মিথ্যা মতবাদে পরিণত হবে। আবার জীবকেও অবিদ্যার আশ্রয়রূপে গণ্য করা যাবে না। কারণ জীব স্বয়ং অবিদ্যার সৃষ্টি বা কার্য। যেহেতু কারণ কখনও নিজের অস্তিত্বের জন্য কার্যের উপর নির্ভর করে না, সুতরাং, ব্রহ্ম বা জীব কেউই অবিদ্যার আশ্রয়রূপে গণ্য হতে না পারায় শঙ্করাচার্যসম্মত মায়া বা অবিদ্যার কোন অস্তিত্ব নেই। উক্ত আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, জীব এবং ব্রহ্ম উভয়েই অবিদ্যার আশ্রয় হতে পারে। জীবকে অবিদ্যার আশ্রয়রূপে স্বীকার করলে অসুবিধা দেখা দেয় তখনই যখন আমরা একটিকে অন্যটির পূর্ববর্তী ভাবি। কিন্তু জীব ও অবিদ্যাকে যদি আমরা একই জিনিসের দুটি পরস্পর নির্ভরশীল দিক রূপে গণ্য করি, তবে ঐ অসুবিধার সৃষ্টি হয় না। যেমন একটা বৃত্তের পরিধি ও কেন্দ্র বৃত্তেরই দুটি দিক, একটা অন্যটার পূর্ববর্তী নয়। আবার ব্রহ্মকেও অবিদ্যার অধিষ্ঠানরূপে গণ্য করা যায়। মায়া বা অবিদ্যা ব্রহ্মেই অধিষ্ঠিত। ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা জগতের সত্যতার ভ্রম উৎপাদন করেন। কিন্তু তিনি জগৎপ্রপঞ্চ সৃষ্টি করে তার দ্বারা প্রভাবিত হন না।
  • (২) তিরোধানানুপপত্তি : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের দ্বিতীয় আপত্তিটি হলো  তিরোধানানুপপত্তি। তিরোধান শব্দের অর্থ হলো নাশ। শঙ্করাচার্যের মতে স্বয়ং-প্রকাশ ব্রহ্ম মায়াশক্তির দ্বারা আবৃত হন। রামানুজের আপত্তি হলো, এই অদ্বৈতমত স্বীকার করলে ব্রহ্মের স্বরূপ নাশপ্রাপ্ত হবে। কারণ, প্রথমত, স্বয়ং-প্রকাশ ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা আবৃত হতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, যদি ধরে নেয়া হয় যে, ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা আবৃত হন, তাহলে ব্রহ্মকে আর স্বয়ং-প্রকাশ বলা যায় না। অবিদ্যা তার স্বরূপ আবৃত করে বললে ব্রহ্মের স্বরূপ তিরোহিত হবে। কিন্তু স্বপ্রকাশ ব্রহ্মের তিরোধান বা নাশ সম্ভব নয়। সুতরাং, অদ্বৈতমতসম্মত মায়াবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে- নিত্যমুক্ত ও নিত্যপ্রকাশময় জ্ঞানস্বভাব ব্রহ্মের অবিদ্যা-জনিত আবরণের অপগম সম্ভব হয় না। কেননা, তিরোধান অর্থ- বস্তুর স্বরূপ বিদ্যমান সত্ত্বেও তার প্রকাশ বা প্রতীতিযোগ্যতা নিবৃত্তি, (উচ্ছেদ নয়); অতএব, ‘প্রকাশই ব্রহ্মের স্বরূপ’ একথা স্বীকার করলে হয় আবরণের অভাব, না হয়, ব্রহ্মেরই স্বরূপোচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২২)। এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, জীব অবিদ্যার বশীভূত হলে ব্রহ্মকে জানতে পারে না। কিন্তু অবিদ্যার ঐ আবরণের জন্য ব্রহ্মের স্বরূপ নাশ হয় না। কারণ ব্রহ্ম সর্বদাই স্বপ্রকাশ ও স্বয়ং-জ্যোতি। যেমন, মেঘ সূর্যকে আচ্ছন্ন করলে মানুষ সূর্যকে দেখতে পায় না। কিন্তু মেঘের দ্বারা প্রকৃতপক্ষে সূর্য প্রভাবিত হয় না।
  • (৩) স্বরূপানুপপত্তি : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের তৃতীয় আপত্তিটি স্বরূপানুপপত্তি নামে পরিচিত। অর্থাৎ, অদ্বৈতমত অনুসারে মায়ার স্বরূপ উপপন্ন করা যায় না। শঙ্করাচার্যের মতে মায়া অজ্ঞান। এখন প্রশ্ন হলো- এই অজ্ঞান জ্ঞানরূপ, না জ্ঞাতারূপ, না জ্ঞেয়রূপ? মায়া জ্ঞানরূপ হতে পারে না, কারণ মায়াকে জ্ঞান বলা হলে জ্ঞান নিজেই দোষদুষ্ট হয়ে পড়ে। তাছাড়া অদ্বৈতমতে একমাত্র ব্রহ্মই জ্ঞানরূপ, মায়া জ্ঞানরূপ হতে পারে না। জ্ঞানকে দোষদুষ্ট বলা হলে তার মূলে অপর একটি জ্ঞান এবং সেই জ্ঞানের মূলে অপর একটি জ্ঞান স্বীকারে অনবস্থা দোষ দেখা দেয়। মায়া জ্ঞাতা হতে পারে না, কারণ মায়া চেতন নয়। আবার মায়া জ্ঞেয়ও হতে পারে না, কারণ অজ্ঞানরূপ মায়াকে জ্ঞেয় বলা হলে জ্ঞান ও জ্ঞেয় সমানাধিকরণ হয়ে পড়ে। কিন্তু জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিরুদ্ধস্বভাব হওয়ায় এদের মধ্যে সামানাধিকরণ্য সম্ভব নয়, অর্থাৎ একই অধিকরণ বা অধিষ্ঠানে পরস্পরবিরোধী দুয়ের অবস্থান থাকতে পারে না। যেহেতু জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বিলক্ষণ কোন বস্তু থাকতে পারে না, অতএব মায়া স্বরূপতই অসিদ্ধ। আবার অন্যভাবে বললে, শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত মতানুসারে স্বপ্রকাশ চৈতন্য জ্ঞাতাও নয়, আবার জ্ঞেয়ও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঐ স্বপ্রকাশ চৈতন্য নিজের অভ্যন্তরস্থিত দোষের জন্য নিজেকে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়রূপে দেখে। রামানুজের প্রশ্ন হলো, ঐ দোষ সত্য, না মিথ্যা? ঐ দোষ সত্য নয় কেননা দোষের সত্যতা স্বীকার করা হয়নি। আবার ঐ দোষ মিথ্যাও নয়। কারণ যদি ঐ দোষ মিথ্যা হয়, তাহলে ঐ দোষটি জ্ঞাতা বা দ্রষ্টা, জ্ঞেয় বা দৃশ্য, কিংবা জ্ঞান বা দৃষ্টিরূপে গণ্য হবে। কিন্তু ঐ দোষ দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দৃষ্টির কোনটিই নয়। আবার দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দৃষ্টিকে যদি মিথ্যারূপে গণ্য করা হয়, তাহলে তাদের মিথ্যাত্বের ব্যাখ্যার জন্য আরও একটি দোষ স্বীকার করতে হবে। এইভাবে অনবস্থা দোষের সৃষ্টি হবে। সুতরাং, মায়ার স্বরূপ উপপন্ন করা যায় না। এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, উক্ত দোষ জ্ঞানেরই বিষয়। বস্তুত অদ্বৈতবেদান্তমতে মায়া বা অবিদ্যা (জীবরূপ) সাক্ষী-চৈতন্যের বিষয়। কিন্তু অবিদ্যা জ্ঞাতাও নয়, জ্ঞানও নয়। যদিও মায়া বা অবিদ্যা ভ্রমাত্মক, তবুও অনাদি  স্বনির্বাহকরূপে মায়া নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মায়া অন্য কোন দোষের অপেক্ষা করে না। সুতরাং, মায়া অনাদি বলে অনবস্থা দোষের আশঙ্কা নেই।
  • (৪) অনির্বচনীয়ত্বানুপপত্তি : শঙ্করের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের চতুর্থ আপত্তিটিকে বলা হয় অনির্বচনীয়ত্বানুপপত্তি। অর্থাৎ, মায়াকে যে অদ্বৈতবাদীরা অনির্বচনীয় বলেছেন, তা উপপন্ন করা যায় না। অদ্বৈতমতে মায়া সৎ নয়, যেহেতু মায়ার পারমার্থিক সত্তা নেই। আবার মায়া আকাশ-কুসুমের মতো একেবারে অসৎ বা অলীক নয়। কেননা আমাদের কিছু একটার জ্ঞান হয়। আবার মায়া সদসৎও বলা যায় না, যেহেতু সেটি পরস্পরবিরোধী ধর্ম। এইজন্য অদ্বৈতমতে মায়া সদসৎ ভিন্ন অনির্বচনীয়। কিন্তু রামানুজ বলেন, জাগতিক বস্তু হয় সৎ হবে কিংবা অসৎ হবে। ঐ দুটি ছাড়া তৃতীয় কোন বিকল্প থাকতে পারে না। সুতরাং, মায়া আছে এবং নেই- একথা বলা স্ববিরোধী। তাই সদসৎ-বিলক্ষণ অনির্বচনীয় বস্তুর ধারণা নিছক কল্পনামাত্র। কিন্তু এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, ‘মায়া সৎ নয় এবং অসৎ নয়’- এরূপ উক্তি স্ববিরোধী নয়। কারণ সৎ অর্থ হলো যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই কালত্রয়ে বাধিত হয় না। আবার অসৎ অর্থ হলো যা সর্বকালে মিথ্যা।
  • (৫) প্রমাণানুপপত্তি : অদ্বৈত মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের পঞ্চম আপত্তিটি হলো প্রমাণানুপপত্তি। অর্থাৎ, অবিদ্যা বা মায়ার সমর্থনে প্রমাণ অনুপপন্ন। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে মায়া ভাবরূপ এবং ‘আমি অজ্ঞ’ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ-প্রতীতি ভাবরূপ মায়ার অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ। রামানুজ এই মতের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করে বলেছেন, অজ্ঞানরূপ মায়া কখনোই ভাববস্তু হতে পারে না। ‘আমি অজ্ঞ’ এরূপ প্রত্যক্ষ-প্রতীতি অদ্বৈতবাদীর প্রমাণাভাস ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রত্যক্ষের দ্বারা কেবলমাত্র কোন বস্তুর অস্তিত্ব বা অভাবকে জানা যায়। ‘অজ্ঞ’ শব্দ অভাববোধক। অভাবরূপ বস্তু প্রত্যক্ষপ্রমাণলভ্য হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, অবিদ্যা যেহেতু সৎও নয় আবার অসৎও নয়, তাই অবিদ্যাকে অনুমানের দ্বারা জানা যাবে না। কারণ যে কোন অনুমানে হেতু থাকা অবশ্য প্রয়োজন। কিন্তু ঐ অনুমানে কোন হেতু নেই। তৃতীয়ত, শব্দ প্রমাণের দ্বারাও মায়াকে জানা যায় না। কারণ শ্রুতিতে মায়ার অর্থ হলো ঈশ্বরের সৃজনীশক্তি। এই শক্তিকে শ্রুতি মিথ্যা অনির্বচনীয়রূপে ঘোষণা করেনি। সুতরাং, প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ- কোন প্রমাণের দ্বারাই মায়ার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না বলে মায়া অসিদ্ধ। এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবাদীরা বলেন যে, অনুমানের দ্বারা মায়া বা অবিদ্যা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অনুমানের দ্বারা অবিদ্যার কেবল ভাবরূপত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরোক্ষ সজ্ঞার দ্বারা সাক্ষী চৈতন্য অনাদি অবিদ্যাকে জানে। সুতরাং, মায়া বা অবিদ্যার বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই একথা বলা যায় না।
  • (৬) নিবর্তকানুপপত্তি : মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের ষষ্ঠ আপত্তিটি নিবর্তকানুপপত্তি নামে পরিচিত। অর্থাৎ, অবিদ্যার নিবর্তক বা নাশক কে, তা উপপন্ন করা যায় না। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্মজ্ঞান মিথ্যা মায়ার নিবর্তক। নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবিদ্যা দূর হয়। কিন্তু রামানুজের আপত্তি হলো, ব্রহ্ম ও মায়া উভয়ই সৎ হওয়ায় ব্রহ্মজ্ঞান মায়ার নিবর্তক হতে পারে না। একটি সৎ বস্তু অপর একটি সৎ বস্তুর নিবর্তক হয় না। উপরন্তু সকল সৎ বস্তুই যেখানে সবিশেষ, সেখানে নির্বিশেষ ব্রহ্মের জ্ঞান কিভাবে মায়ার নিবর্তক হতে পারে? জীবের জ্ঞানও মায়ার নিবর্তক হতে পারে না। জীবের জ্ঞানমাত্রই যখন মায়াপ্রসূত, তখন জীবের জ্ঞানকে মায়ার নিবর্তক বলার প্রশ্নই ওঠে না।
    রামানুজ বলেন, জ্ঞান হবার জন্য জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে পার্থক্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। তাছাড়া অবিভক্ত, বৈশিষ্ট্যহীন কোন বিষয়ের জ্ঞান সম্ভব নয়। অতএব অদ্বৈতবেদান্তীদের নির্গুণ ব্রহ্ম বিষয়বিযুক্ত হবার জন্য ব্রহ্মজ্ঞান অসম্ভব। যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞান অসম্ভব, সেহেতু অবিদ্যার বিনাশও সম্ভব নয়। এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, শ্রুতিতে নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধিকেই অবিদ্যা দূর করার উপায় রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। সগুণ ব্রহ্মের উপাসনা ও উপলব্ধি নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধির সোপানমাত্র।
  • (৭) নিবৃত্তানুপপত্তি : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের সর্বশেষ আপত্তিটি হলো নিবৃত্তানুপপত্তি। নিবৃত্তি অর্থ নাশ। রামানুজের মতে অবিদ্যাকে দূর করা অসম্ভব। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে নির্বিশেষ জ্ঞানের দ্বারা অর্থাৎ, ‘জীব ও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন’- এই ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা মায়া বা অবিদ্যা নিবৃত্ত বা দূর হয়। কিন্তু রামানুজ আপত্তি করে বলেন, মায়ার নিবর্তকই যখন অসিদ্ধ, তখন মায়ার নিবৃত্তিরও কোন সম্ভাবনা নেই। রামানুজের মতে ঐরূপ জ্ঞান অসম্ভব। সুতরাং, অবিদ্যার নিবৃত্তি সম্ভব নয়। আর মায়ার নিবৃত্তি সম্ভব না হওয়ায় মায়াকে সৎ বলেই গ্রহণ করতে হবে। এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীদের বক্তব্য হলো, রামানুজের মতে জীবাত্মার বন্ধনের কারণ কর্ম, অবিদ্যা নয়। কিন্তু শ্রুতি ও স্মৃতিতে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে মায়ার জন্যই জীবের বন্ধন হয় এবং জ্ঞান কর্মকে বিনষ্ট করে। ব্রহ্মোপলব্ধিরূপ জ্ঞান অবিদ্যাকে নিবৃত্ত করে। অর্থাৎ, ব্রহ্মজ্ঞান হলে কর্ম ক্ষয় হয় এবং অবিদ্যাও নিবৃত্ত হয়। সুতরাং, মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের আপত্তিগুলি যুক্তিযুক্ত নয়।

রামানুজের মতে জীবের ধারণা

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রবর্তক রামানুজ তার মতবাদে তিনটি তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এই তিনটি তত্ত্ব হলো- ঈশ্বর, চিৎ এবং অচিৎ। রামানুজের মতে এই তিনটি তত্ত্বই সৎ বা পদার্থ। চিৎ হলো আত্মা বা জীবাত্মা। তার মতে দেহবিশিষ্ট আত্মাই জীব। জীবের আত্মা ব্রহ্মের চিৎ-অংশ এবং জীবের দেহ ব্রহ্মের অচিৎ-অংশজাত। জড়দেহ অনিত্য, কিন্তু চিৎ আত্মা নিত্য। তবে আত্মা নিত্য হলেও এই মতে আত্মা অসীম নয়। আত্মা নিত্য, সসীম ও সংখ্যায় বহু। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে আত্মা চৈতন্যস্বরূপ। ন্যায়মতে চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণ বা বহিরাগত ধর্ম। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে আত্মা চৈতন্যস্বরূপও নয়, আবার চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণও নয়, চৈতন্য আত্মার নিত্যগুণ।

আচার্য রামানুজকৃত মহর্ষি বাদরায়ণের বেদান্তসূত্র বা ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যায় বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ভাষ্যগ্রন্থ ‘শ্রীভাষ্যে’ জীব বা আত্মার স্বরূপ ও লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। এগুলোই জীব সম্বন্ধে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ধারণা প্রকাশ করে। যেমন-

জীবাত্মা নিত্য, সসীম ও স্বতন্ত্র

রামানুজের মতে জীবাত্মা ঈশ্বরের একটি অংশ বা প্রকাররূপে তার শরীরের উপাদানস্বরূপ। তবে প্রকার বা অংশ হলেও জীবাত্মা একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য এবং নিত্য। আত্মার সৃষ্টি এবং বিনাশ নেই। প্রলয়ের সময় জীবাত্মায় যে কর্ম নিহিত থাকে, সেই কর্ম অনুসারে পরবর্তী জন্মে সে অন্য শরীর পরিগ্রহ করে। প্রলয় ও সৃষ্টির মধ্যবর্তী কালে জীবাত্মা বিভিন্ন শরীর ধারণ করে পূর্বজন্মে কৃত কর্মের ফল ভোগ করে থাকে। রামানুজের মতে জীবাত্মার সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক অনাদি। একমাত্র জীবাত্মা মোক্ষলাভ করলেই কর্ম তার জ্যোতিকে ম্লান ও আচ্ছন্ন করতে পারে না। কারণ মোক্ষলাভ করলে আত্মা পৃথিবীতে অবতরণ করে শরীর গ্রহণ করে না।

রামানুজ বলেছেন যে, জীবাত্মা যদিও নিত্য ও সত্য, তবুও সীমিত। কারণ জীবাত্মা ঈশ্বরের অংশ বা প্রকার। সুতরাং আত্মা অণুপরিমাণ। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে- এই জীবাত্মা সর্বগত অর্থাৎ সর্বব্যাপী নয়; বরং এই আত্মা অণুপরিমাণই (সূক্ষ্মই) বটে; কারণ? যেহেতু তার উৎক্রান্তি, গতি ও আগতি (আগমন) বিষয়ে শ্রুতি রয়েছে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)।

তবে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আত্মাকে জানা যায় না। জ্ঞানই আত্মাকে প্রকাশ করে। আত্মা সকলপ্রকার জ্ঞানের সাক্ষী। যদিও আত্মা অণুপরিমাণ, কিন্তু আত্মার জ্ঞান বিভুপরিমাণ। এই কারণে জ্ঞান আত্মার সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। জ্ঞান একাধারে আত্মার ধর্ম ও স্বরূপ। অতএব, আত্মা প্রত্যক্ষগোচর নয় এবং তার কোন পরিবর্তনও হয় না। পৃথিবীতে অবস্থানের সময় দেহযুক্ত আত্মা অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে। তবে ঐ যন্ত্রণা আত্মার স্বরূপকে স্পর্শ করতে পারে না।

রামানুজের মতে আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র। প্রাণবায়ু ও জ্ঞান থেকেও আত্মা পৃথক। সংসারে অবস্থানকালে আত্মা অবিদ্যা ও কর্মের বশীভূত হয়ে ভুলবশত নিজেকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনরূপে গণ্য করে। যেমন, শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন- যারা সংসার-বন্ধন থেকে বিমুক্ত হন, তারাই পুণ্য-পাপ পরিত্যাগপূর্বক নিরঞ্জন হন, এবং নাম-রূপ থেকেও বিমুক্ত হন। পুণ্য-পাপ নিবন্ধন যে জড়পদার্থের সাথে সংসর্গ, অর্থাৎ ‘ইহা আমার’ এসব অভিমান, সেই জড়সংসর্গ বশত যে নাম ও রূপে আসক্তি, তাই জীবের সংসার, (তার অতিরিক্ত নয়) (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২)।

দেহ-যুক্ত আত্মার এইরকম জ্ঞান হলো ‘আমি রোগার্ত’, ‘আমি শোকার্ত’, ‘আমি বধির’ ইত্যাদি। এখানে ‘আমি’ শব্দটি আত্মাকে নির্দেশ করে। রোগ শরীরের একটি অবস্থা, শোক একটি মানসিক অবস্থা এবং বধিরতা একটি ইন্দ্রিয়ের বৈকল্য। সংসারে অবস্থানের সময় আত্মা নিজেকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনরূপে গণ্য করে। তাই দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের বৈকল্য তাকে দুঃখ দেয়। রামানুজ বলেন- অবিদ্যা ও কর্মের প্রভাবেই আত্মার এরকম ভ্রান্ত অভেদ বোধ জন্মায়।

জীবাত্মা জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা

জ্ঞাতারূপেই আত্মার পরিচয়। শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন- এই আত্মা (জীব) নিশ্চয়ই জ্ঞ, অর্থাৎ স্বরূপত জ্ঞাতাই বটে, কিন্তু কেবলই জ্ঞানস্বরূপ নয়, এবং জড়স্বরূপও নয়। কারণ? শ্রুতিপ্রমাণই কারণ (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)।

তাই জ্ঞান কেবলমাত্র আত্মার গুণ নয়, স্বরূপও বটে। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ আত্মাকে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তারূপে গণ্য করেছেন। তার মতে ক্রিয়া ও ভোগ হলো আত্মার দুটি পৃথক জ্ঞানের অবস্থা। জ্ঞান আত্মার সারভূত। আত্মা একাধারে স্বয়ং ভাস্বর দ্রব্য এবং আত্মসচেতন বিষয়ী বা জ্ঞানের কর্তা। আত্মাতে যে ধর্মভূতজ্ঞান থাকে, তা প্রসারিত ও সংকুচিত হয়। আত্মা তার জ্ঞানের মাধ্যমেই বিষয়সমূহে জানে। ঐ জ্ঞান নিজেকে এবং আত্মার জ্ঞেয় বিষয়গুলিকে প্রকাশ করে। আত্মার জন্যই জ্ঞানের অস্তিত্ব। জ্ঞান যদিও নিজেকে ও তার বিষয়গুলিকে প্রকাশ করে, তবুও ঐ দুটির কোনটিকেই জ্ঞান জানতে পারে না। একমাত্র আত্মাই জ্ঞান ও তার বিষয়কে জানতে পারে অর্থাৎ জ্ঞাতা। সুতরাং জ্ঞান বা চৈতন্য আত্মার সারভূত ধর্ম, আগন্তুক বা বহিরাগত ধর্ম নয়। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে- তদ্গুণসারত্ব অর্থ- যেহেতু বিজ্ঞানই আত্মার সারভূত গুণ, সেহেতু ‘বিজ্ঞান’ শব্দে আত্মার ব্যবহার হয়ে থাকে। বস্তুত বিজ্ঞানই তার সারভূত গুণ; আনন্দ যেমন প্রাজ্ঞ পরমাত্মার সারভূত গুণ বলে ঐ আনন্দ-শব্দে প্রাজ্ঞ আত্মা অভিহিত হয়ে থাকেন (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-৩/২/২৯)।

রামানুজের মতে আত্মা হলো জ্ঞানের আধার। দ্রব্যরূপ আত্মাতে জ্ঞান অবিচ্ছেদ্য ধর্মরূপে অবস্থান করে। এমনকি সুষুপ্তিতে এবং মোক্ষলাভ করার পরেও আত্মায় জ্ঞান থাকে। কিন্তু সুষুপ্তিতে জ্ঞান প্রকাশিত হয় না, কারণ তখন কোন বিষয় থাকে না। জ্ঞান অনন্ত ও সর্বব্যাপক। সংসারে বদ্ধ অবস্থায় আত্মার জ্ঞান কর্মের দ্বারা আচ্ছন্ন ও সীমিত থাকে। আত্মা মোক্ষলাভ করলে কর্ম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং কর্মজনিত বাধা অপসারিত হয় বলে আত্মার জ্ঞান সর্বব্যাপক হয়ে যায়। তাই মুক্ত অবস্থায় আত্মা সর্বজ্ঞ হয়। কেননা রামানুজের মতে আত্মা অণুপরিমাণ হলেও তার জ্ঞান অনন্ত।

আবার রামানুজ বলেছেন যে, আনন্দও আত্মার সারভূত অর্থাৎ আত্মা আনন্দরূপ। সংসারের দুঃখ-যন্ত্রণা আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। মোক্ষলাভ করলে আত্মা অনন্ত জ্ঞান ও নিত্য আনন্দের অধিকারী হয়।

এই মতে আত্মা হলো বিশুদ্ধ অহং বা আত্মসচেতন অহং। সংসারে বদ্ধ অবস্থায় যে আমি বা অহংবোধ থাকে, তা ব্যবহারিক। কর্ম ও অবিদ্যার প্রভাবে সংসারে বদ্ধ আত্মা নিজেকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে এক ও অভিন্ন বোধ করে। এই ব্যবহারিক আমি-বোধ বা অহং বোধকে অহঙ্কার বলা হয়। তাই রামানুজের মতে জীব কর্তা ও ভোক্তা। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে- আত্মা বাগাদি ইন্দ্রিয়সম্পন্ন থেকেও, যখন ইচ্ছা করে তখনই কার্য করে, আবার যখন ইচ্ছা না করে, তখন করে না (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)।

তবে এটাও ঠিক যে- পরমাত্মার অনুমতি বা অনুকুল ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোন কার্যেই জীবের প্রবৃত্তি সম্ভব হয় না (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪১)।

রামানুজের মতে জীব কর্তাই। জীব অকর্তা হলে জীবের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ অর্থহীন হয়ে পড়ে। আবার জীব সংসার-দশায় নিজ নিজ কর্মানুসারে ফলভোগ করে থাকে। সুতরাং জীব ভোক্তা। রামানুজের মতে জ্ঞাতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্ব আত্মার স্বাভাবিক গুণ। তাই বদ্ধজীবের ন্যায় মুক্তজীবও জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা।

জীবাত্মা ঈশ্বরাধীন ও বহু

রামানুজের মতে আত্মা একটি বাস্তব সত্তা হলেও এর সত্যতা ও বাস্তবতা ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। আত্মা সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের অধীন। ঈশ্বর আত্মার আত্মা। আর আত্মা অর্থাৎ জীবাত্মা ঈশ্বরের শরীর। ঈশ্বর জীবাত্মার নিয়ন্তা। রামানুজ বলেন, জীবাত্মা ঈশ্বরেরই প্রকার বা অংশ এবং ঈশ্বর প্রকারী বা অংশী। আবার জীবাত্মা হলো শরীর এবং ঈশ্বর শরীরী। তবে জীবাত্মা ঈশ্বরের অধীন ও ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হলেও তার ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে।

বিশিষ্টাদ্বৈতমতে জীবাত্মা এক নয়, কিন্তু বহু। তবে সকল জীবাত্মার প্রকৃতি ও স্বরূপ একই। যদিও রামানুজ অসংখ্য জীবাত্মা স্বীকার করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে জীবাত্মাগুলির গুণগত বা প্রকৃতিগত ঐক্যও স্বীকার করেছেন। রামানুজের মতে জীবাত্মা তিনপ্রকার- নিত্য-মুক্ত, মুক্ত ও বদ্ধ আত্মা।

প্রথমপ্রকার নিত্য-মুক্ত আত্মা কখনোই বদ্ধ হয়নি। কারণ তারা কর্ম ও প্রকৃতির অধীন কখনও হননি এবং হবেনও না। সকল প্রকার কর্ম-বন্ধনমুক্ত বৈকুণ্ঠ-নিবাসী নিত্য-মুক্ত আত্মারা নিরন্তর ঈশ্বরের সেবা করেন। শেষনাগ, গড়ুর প্রভৃতি এরূপ নিত্য-মুক্ত আত্মার দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয়প্রকার আত্মা হলো মুক্ত-আত্মা। যাঁরা একসময় বদ্ধ ছিলেন, কিন্তু জ্ঞান, কর্ম এবং ভক্তির দ্বারা মোক্ষলাভ করেছেন, তারা হলেন মুক্ত-আত্মা। অর্থাৎ, মুক্তজীব জ্ঞান ও ভক্তির বলে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত। তৃতীয়প্রকার আত্মা হলো বদ্ধ-আত্মা। বদ্ধ আত্মাগুলি কর্ম ও অবিদ্যাবশত বারবার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। কর্মবন্ধনে আবদ্ধ থেকে বদ্ধজীব সংসারচক্রে আবর্তিত হতে থাকে। বদ্ধজীব চারধরনের হয়- অতিমানব, মানব, পশু ও স্থাবর। এবং রামানুজের মতে বদ্ধজীব জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, মূর্ছা ও মরণ- এই পাঁচটি অবস্থা ভোগ করে। সুষুপ্তি আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য হলো মৃত্যু মানে জীবাত্মার দেহাশ্রয় ত্যাগ, অন্যদিকে সুষুপ্তি হলো দেহত্যাগ না করেই জীবাত্মার স্বরূপাবস্থায় অবস্থান, যেখান থেকে ফের জাগ্রৎ অবস্থায় জীবের প্রত্যাবর্তন ঘটে। এ প্রেক্ষিতে শ্রীভাষ্যে রামানুজ বলেছেন- জীবগণ সুষুপ্তিকালে যে নাম ও রূপ পরিত্যাগ করে সৎ-সম্মিলিত হয়, জাগ্রৎ-অবস্থায় আবার নাম ও রূপের সাথে সম্বন্ধ লাভ করে পুনশ্চ সেই-সেই নাম ও রূপভাগী হয়ে থাকে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।

জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই সর্বোচ্চ তত্ত্ব, কিন্তু একমাত্র তত্ত্ব নয়। ঈশ্বরের দুটি অংশ- চিৎ এবং অচিৎ। চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের মতোই সত্য, কিন্তু চিৎ ও অচিৎ ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। শরীর যেমন আত্মার উপর নির্ভর করে, তেমনি জড় ও আত্মা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে থাকে। এই বিশেষ নির্ভরতার সম্বন্ধকে ব্যাখ্যা করার জন্য রামানুজ ‘অপৃথকসিদ্ধি’ নামে এক স্বতন্ত্র অবিচ্ছেদ্যতার সম্বন্ধ স্বীকার করেছেন। এই সম্বন্ধের দৃষ্টান্ত হলো দেহ ও আত্মার সম্বন্ধ। কেননা দেহ বলতে রামানুজ বুঝিয়েছেন- ‘যাকে আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, যা আত্মাকে আশ্রয় করে থাকে এবং যাকে আত্মা আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য কাজে লাগায়।’

জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্ধ প্রকাশ করতে গিয়ে রামানুজ অংশ-অংশী, দেহ-দেহী, অবয়ব-অবয়বী, কার্য-কারণ, বিশেষণ-বিশেষ্য প্রভৃতি সম্পর্কের কথা বলেছেন। রামানুজের দর্শনে ব্রহ্ম হলেন সগুণ এবং তিনিই ঈশ্বর। রামানুজ ব্রহ্মের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ স্বীকার না করলেও ব্রহ্মের স্বগতভেদ স্বীকার করে চিৎ ও অচিৎকে ব্রহ্মেরই অংশরূপে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ ব্রহ্ম হলেন অংশী এবং জীব ও জড়জগৎ ব্রহ্মের অংশ বলে এদের মধ্যে যে সম্বন্ধ তা হলো বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ। এই বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ আসলে অপৃথকসিদ্ধির সম্বন্ধ। অংশ অর্থাৎ বিশেষণ কখনোই অংশী অর্থাৎ বিশেষ্য (ব্রহ্ম) থেকে পৃথকভাবে থাকতে পারে না। বস্তুত অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ তা হলো বিশিষ্ট অভেদ, আত্যন্তিক অভেদ নয়। এই কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।

বৃক্ষের সঙ্গে তার শাখা-প্রশাখার, আত্মার সঙ্গে তার দেহের, বা দ্রব্য উৎপলের সঙ্গে তার গুণ নীলরূপের যে সম্বন্ধ, ব্রহ্মের সঙ্গে জীব তথা জগতেরও সেই সম্বন্ধ। রামানুজ জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে সামানাধিকরণ্য স্বীকার করে বলেছেন যে, ব্রহ্ম ও জীব ভিন্ন ও অভিন্ন উভয়ই।
জীব ও জগৎ ব্রহ্মেরই দুটি অংশ হওয়ায় উপাদানস্বরূপ জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। আবার কার্য-কারণ সম্বন্ধেও জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। কেননা সৎকার্যবাদী ও পরিণামবাদী রামানুজের মতে জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত নয় পরিণাম হওয়ায় ব্রহ্মই জীব ও জগতের উপাদান ও নিমিত্তকারণ। এক্ষেত্রে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে দুভাবে চিন্তা করা হয়- কারণরূপে এবং কার্যরূপে। প্রলয়কালে জগৎ যখন ধ্বংস হয়, তখন জীব ও জড় ব্রহ্মের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। তখন ঈশ্বর কারণরূপে বিদ্যমান থাকেন এবং সূক্ষ্ম অচিৎ ও বিদেহ আত্মাগুলি ঈশ্বরের শরীর রূপে থাকে। ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয় কারণ-ব্রহ্ম। সমগ্র বিশ্বসংসার এই সময় ব্রহ্মে লীন হয়ে থাকে। অপরপক্ষে সৃষ্টির পরে যখন ব্রহ্মের চিৎ ও অচিৎ অংশ যথাক্রমে জীবজগৎ ও জড়জগতে ব্যক্ত হয়, তখন ব্রহ্মকে বলা হয় কার্য-ব্রহ্ম। অর্থাৎ, কারণ-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের অব্যক্ত অবস্থা এবং কার্য-ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের ব্যক্ত অবস্থা। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে- (শ্রুতির) সৃষ্টিবাক্য হতে জানা যায় যে, এই প্রকৃতি দুই প্রকার অবস্থায় অবস্থিত; তার একটি অবস্থা কার্যস্বরূপ, আর একটি অবস্থা কারণস্বরূপ; প্রকৃতি সেই উভয় অবস্থাতেই অনুগত। প্রলয়কালে ব্রহ্মে বিলীন সেই প্রকৃতিই নাম ও রূপ-বিনির্মুক্ত হয়ে সূক্ষ্মরূপে অবস্থান করে; সৃষ্টিসময়ে আবার সত্ত্বাদি গুণরূপে উদ্ভূত বা অভিব্যক্ত হওয়ায় এবং নাম ও রূপ তা থেকে পৃথক হওয়ায় অব্যক্ত প্রভৃতি শব্দবাচ্য সেই প্রকৃতিই তেজ, জল ও পৃথিবী ইত্যাদিরূপে পরিণত হয়ে লোহিত (রজঃ), শুক্ল (সত্ত্ব) ও কৃষ্ণরূপে (তমোগুণরূপে) অবস্থান করে। অতএব, কারণাবস্থায় অজা (প্রকৃতি), আর কার্যাবস্থায় জ্যোতিরূপক্রমা (ব্রহ্মোৎপন্না); (সুতরাং একই প্রকৃতির উভয়াবস্থা স্বীকারে) কোন বিরোধ নেই (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/১০)।

অন্যদিক থেকে জীব ও ব্রহ্ম ভিন্ন, কারণ জীব সীমিত বা অণুপরিমাণ ও সৃষ্টিশক্তিহীন। কিন্তু ব্রহ্ম বিভুপরিমাণ ও স্রষ্টা। এ প্রেক্ষিতে শ্রীভাষ্যে রামানুজের যে বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য- এই যে চেতন-অচেতন সর্বপদার্থের আশ্রয়ত্ব (ধারকতা), তা জীব হতে পৃথক পদার্থ পরমাত্মাতেই সম্ভব হয়, (জীবে হয় না) (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/৩০)।

এইভাবেই জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে ভেদ ও অভেদ সম্বন্ধের বিশিষ্টতা উপস্থাপন করে রামানুজ উপনিষদীয় মহাবাক্য ‘তত্ত্বমসি’-এর অর্থ নির্ণয় করেছেন। তার মতে, ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের দ্বারা জীব যে ব্রহ্মে থেকে ভিন্ন হয়েও অভিন্ন, একথাই বোঝানো হয়। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য জহৎ-অজহৎ লক্ষণার দ্বারা বিরুদ্ধধর্মের পরিত্যাগপূর্বক ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের অদ্বয় তাৎপর্য নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু রামানুজের মতে উক্ত মহাবাক্যের তাৎপর্য নির্ধারণের জন্য লক্ষণা করার কোন প্রয়োজন নেই। তার মতে ‘তৎ’ ও ‘ত্বম্’ পদদ্বয়ের বিশেষ্য-বিশেষণভাবজনিত সামানাধিকরণ্যের দ্বারাই ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের তাৎপর্য প্রতিপাদিত হতে পারে।

পুত্র শ্বেতকেতুকে তার পিতা উদ্দালকের উপদেশ হিসেবে ছান্দোগ্য উপনিষদের একাধিক শ্লোকে আছে- সেই সৎ পদার্থই সত্য, সেই পদার্থই আত্মা। হে শ্বেতকেতু তুমি হও সেই অর্থাৎ সেই সৎ পদার্থ ও আত্মা (ছান্দোগ্য-৬/১৬/৩)।

রামানুজ তার শ্রীভাষ্যে ছান্দোগ্য-উপনিষদের ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘ব্রহ্ম থেকে জীব স্বরূপতঃ অভিন্ন।’ তত্ত্বমসি বাক্যটির অর্থ হলো ‘তিনিই তুমি’ অর্থাৎ জীবাত্মাই ঈশ্বর। জীব ঈশ্বর থেকে ধর্মতঃ পৃথক হলেও স্বরূপতঃ এক ও অভিন্ন।

রামানুজ বলেন যে, ‘তৎ’ এবং ‘ত্বম্’-এর মধ্যে ঐক্য থাকলেও উভয়ের বিশিষ্টতা আছে। ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটিতে ‘ত্বম্’ শব্দটি জীবকে নির্দেশ করে এবং ঈশ্বরকেও নির্দেশ করে। কারণ ঈশ্বর জীবের অন্তর্যামী। জীব ও তার শরীর ঈশ্বরের প্রকার। ‘তৎ’ শব্দটিও জীব সমন্বিত জগতের কারণরূপে ঈশ্বরকে নির্দেশ করে। ‘ত্বম্’ অন্তর্যামীরূপে ঈশ্বরকে এবং ‘তৎ’ শব্দটি জগতের কারণরূপে ঈশ্বরকে বোধিত করছে। সুতরাং ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটির প্রকৃত তাৎপর্য হলো- যদিও জীব এবং জগৎ দুটি স্বতন্ত্র ও সত্য, তবুও তারা যে পরম সত্তার অন্তর্ভুক্ত তা এক ও অদ্বৈত। বস্তুত জীব ও জগৎ ঈশ্বরের শরীররূপে নিত্য।

উল্লেখ্য, রামানুজ কখনো ব্রহ্ম ও জীবের ভেদের উপর, আবার কখনো উভয়ের অভেদের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শ্রীভাষ্যে তিনি ব্রহ্ম ও জীবকে স্বরূপত পৃথক বলেও উল্লেখ করে বলেছেন- চিৎ ও অচিৎ- ব্রহ্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও ব্রহ্ম (ঈশ্বর) ও জীব স্বরূপত অভিন্ন নয়। (শ্রীভাষ্য-৯৫)

বস্তুত, রামানুজের মতে ব্রহ্ম ভেদের দ্বারা বিশেষিত রূপেই সৎ। ভেদ-নিরপেক্ষ অভেদ বা অভেদ-নিরপেক্ষ ভেদ সম্ভব নয়। এজন্যই এই মতবাদ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত।

রামানুজের মতে জীবের বন্ধন ও মোক্ষ

জীবের বন্ধন ও মুক্তি

জীবের বন্ধন : রামানুজের মতে কর্ম ও অবিদ্যার দ্বারা জীবাত্মা বদ্ধ হয়। জীবাত্মার সঙ্গে কর্ম ও অবিদ্যার যোগ অনাদি যেহেতু সংসার অনাদি। কৃতকর্মের জন্যই আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংসারদশা প্রাপ্ত হয়। এই অবস্থাই হলো আত্মার বন্ধন বা বদ্ধাবস্থা। এই যোগ বা সংশ্লিষ্টতার ফলে জীবের ‘অহং’, ‘মম’ প্রভৃতি বোধ জন্মায়। এ অবস্থায় জীবের স্বরূপ আচ্ছাদিত হয়। বদ্ধজীব তখন ‘অহংবোধ’ ও ‘ক্ষুদ্র-আমিত্বের’ বশবর্তী হয়। দেহ, ইন্দ্রিয়, মনের বিভিন্ন অবস্থা থেকে জীবাত্মা নিজেকে পৃথক করতে পারে না। আর পৃথক করতে না পারার জন্যই জীবাত্মা অবিদ্যার বশীভূত হয়। এই অবিদ্যাজনিত জীবাত্মার জ্ঞান হলো ‘আমি স্থূল’, ‘আমি বধির’, ‘আমি দুঃখিত’ ইত্যাদি।

‘মমত্ববোধ’ও ঐ অবিদ্যা থেকে উৎসারিত হয়। যে বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তি জীবের দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সুখ উৎপাদন করে সেই বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তি জীবাত্মার প্রিয় হয়। এই অবিদ্যাজনিত মমত্ববোধের দৃষ্টান্ত হলো- ‘আমার স্ত্রী’, ‘আমার পুত্র’, ‘আমার বাড়ি’ ইত্যাদি। বস্তুত ‘আমার’ সঙ্গে ঐ বিষয়গুলির কোন যোগ নেই। জীব কর্মের বন্ধনে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে ঐরূপ অবিদ্যার আশ্রয় হয়। তাই প্রিয় বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তির বিয়োগে এবং অপ্রিয় বস্তু, বিষয় ও ব্যক্তির সংযোগে জীবাত্মা দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে। এ প্রেক্ষিতে রামানুজের শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে- বস্তুতই মোক্ষ না হওয়া পর্যন্ত কেবল নাম ও রূপের সাথে সম্বন্ধবশতই জীবের স্ব-ভিন্ন বস্তু-বিষয়ে জ্ঞান সমুৎপন্ন হয়ে থাকে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/১/১০)।

রামানুজ বলেন যে, আত্মা প্রকৃতপক্ষে সর্বজ্ঞ, কর্তা ও ভোক্তা। কিন্তু দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আত্মা বদ্ধ হয়। সকাম কর্মের ফলভোগ করার জন্যই আত্মা দেহের মধ্যে আবদ্ধ হয়। দেহ ও আত্মার এই একত্রীকরণের নাম ‘অহঙ্কার’। এই অহঙ্কারের জন্যই জীবাত্মা পার্থিব সুখের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সকাম কর্ম সম্পাদন করে। আর তার ফলেই জীবাত্মাকে বারবার এই সংসারে জন্মগ্রহণ করতে হয়। রামানুজের মতে এই জন্মই হলো আত্মার ‘বন্ধন’ বা বদ্ধাবস্থা।

মুক্তি বা মোক্ষ : জীবের বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তিই হলো মোক্ষ। মোক্ষে জীবের স্বরূপ বিকশিত হয়। রামানুজের মতে মোক্ষ হলো জীবত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ। জীব স্বভাবতই জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা। বদ্ধাবস্থায় জীবের জ্ঞান, কর্ম ও ভোগ সীমিত হয়ে পড়ে। মোক্ষাবস্থায় জীব সর্বজ্ঞ, সর্বময়কর্তা ও পূর্ণ আনন্দময় ভোক্তা। সুতরাং জীবত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ হলো জীবের স্বাভাবিক গুণের চরম উৎকর্ষ লাভ।

জীবাত্মা মুক্তিলাভ করলে ব্রহ্ম-সাদৃশ্য লাভ করে অর্থাৎ ঈশ্বরের মতো হয়। তাই মুক্তজীব ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের ন্যায় সচ্চিদানন্দময় হয়। কিন্তু মোক্ষলাভের পর জীবের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হলেও তার জীবত্ব থাকে। তাই রামানুজের মতে মুক্তজীব ব্রহ্মের সদৃশ, কিন্তু ব্রহ্ম-স্বরূপ বা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন নয়। মুক্তজীব ঈশ্বর-সদৃশ হলেও প্রধানতঃ দুটি বিষয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে তার পার্থক্য থাকে। ব্রহ্মের সঙ্গে মুক্তজীবের এই দুটি প্রধান পার্থক্য হলো- (১) মুক্তজীব অণুপরিমাণ, কিন্তু ব্রহ্ম বা ঈশ্বর বিভুপরিমাণ এবং (২) জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মা বা ঈশ্বর এই জগতের কারণ এবং চিৎ ও অচিৎ-এর নিয়ন্তা, কিন্তু মুক্তজীব এই জগতের কারণ নয় এবং চিৎ ও অচিৎ-এর নিয়ন্তাও নয়। মুক্তজীব ব্রহ্মাশ্রিত, ব্রহ্মশাসিত, ব্রহ্মসেবক, সচ্চিদানন্দময়, কিন্তু ব্রহ্মভিন্ন।

রামানুজের মতে জীবের মুক্তি হলো বিদেহমুক্তি। ভারতীয় দর্শনে সাধারণত দুইপ্রকার মুক্তির কথা বলা হয়- জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি। জীবিত অবস্থায় যে মুক্তি, তাকে বলা হয় জীবন্মুক্তি। অপরদিকে দেহের বিনাশের পর যে মুক্তি, তাকে বলা হয় বিদেহমুক্তি। বৌদ্ধ ও অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায় যথাক্রমে বুদ্ধ ও শঙ্করাচার্যকে জীবন্মুক্ত পুরুষ বলে মনে করেন। জীবন্মুক্ত পুরুষ লোকহিতার্থে নিষ্কাম কর্মে ব্রতী হন। রামানুজের মতে জীবন্মুক্তি কোনভাবেই সম্ভব নয়। তার মতে যতদিন পর্যন্ত জীব দেহধারণ করে, ততদিন পর্যন্ত জীব বদ্ধ। এই অবস্থায় তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, জরা, বেদনা প্রভৃতির অধীন দেহাদি যতক্ষণ জীবে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে, ততক্ষণ জীব এই সকল অনুভূতি থেকে রক্ষা পেতে পারে না। তাই রামানুজ জীবন্মুক্তিতে বিশ্বাসী নন।

রামানুজের মতে দেহের সঙ্গে আত্মার বিচ্ছেদ হলে মুক্তিলাভ হয়। এই মুক্তিকে সাধারণত বিদেহ মুক্তি বলা হয়। কিন্তু তার মতে মুক্ত জীবেরও দেহ থাকে। সেই দেহ শুদ্ধ সত্ত্বের দ্বারা গঠিত। মোক্ষলাভের পর মুক্ত আত্মা ঐ দেহ ধারণ করে বৈকুণ্ঠে নারায়ণের অর্থাৎ ঈশ্বরের আপন ধামে গমন করে। অতএব রামানুজের মতে জীব কখনোই সম্পূর্ণ বিদেহ বা দেহ-বিযুক্ত হয় না। বৈকুণ্ঠে মুক্ত জীবাত্মা এবং নিত্য-আত্মা পূর্ণ আনন্দ ও শান্তিতে বাস করে। রামানুজ বলেন- মোক্ষ হলো এক বিশুদ্ধ আনন্দের অবস্থা। মোক্ষ অবস্থায় জীব ব্রহ্মসদৃশ হয়, কিন্তু ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যায় না। তাই রামানুজ ‘সামীপ্য মুক্তি’তে বিশ্বাসী।

মুক্তির উপায়

রামানুজ মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়ের উপর সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। মুক্তির উপায় প্রসঙ্গে রামানুজ বলেছেন, মুক্তি লাভের ইচ্ছাই মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। যে সকল জীব সকাম কর্ম ও তজ্জনিত ভোগে লিপ্ত, মুক্তিলাভের কোনরূপ ইচ্ছা যাদের নেই (বুভুক্ষু), তাদের মুক্তি সম্ভব নয়। সংসার থেকে মুক্তিলাভ করতে হলে জীবাত্মাকে সর্বপ্রথম কর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। মুক্তিকামী জীব (মুমুক্ষু) নিষ্কাম কর্ম প্রতিপালনের মাধ্যমে চিত্তশুদ্ধি করেন এবং জ্ঞান ও ভক্তির মাধ্যমে মোক্ষলাভে প্রবৃত্ত হন। রামানুজের মতে বেদ-নির্দেশিত কর্ম এবং যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা আত্মার বন্ধনমুক্তি হয়। বেদবিহিত কর্মের যথাযথ অনুষ্ঠান করলে জীবাত্মা কর্মজনিত মালিন্য দূর করতে পারে। তবে ঐ কর্মের অনুষ্ঠান নিষ্কামভাবে করতে হবে। বস্তুত গীতার নিষ্কাম কর্মবাদকে রামানুজ মোক্ষলাভের সহায়ক উপায়রূপে গ্রহণ করেছেন।

মুমুক্ষু জীব শাস্ত্রোপদিষ্ট নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম ছাড়াও সপ্তবিধ নিষ্কাম কর্ম করে থাকেন। এই সাতরকম নিষ্কাম কর্ম হলো- বিবেক, বিমোক, অভ্যাস, ক্রিয়া, কল্যাণ, অনবসাদ ও অনুর্ধর্ষ।
বিবেক হলো অশুদ্ধ পানাহার বর্জন। বিমোক হচ্ছে আসক্তিহীনতা। অভ্যাস মানে লক্ষ্যসাধনের জন্য বারবার অনুশীলন। ক্রিয়া হলো যজ্ঞানুষ্ঠান। কল্যাণ অর্থ দয়া, দান, অহিংসা, নির্লোভতা। অনবসাদ হলো মানসিক দৈন্য ও দুর্বলতা বর্জন। এবং অনুর্ধর্ষ অর্থ হলো উগ্র আত্মবিশ্বাস বা দাম্ভিকতার অভাব।

কিন্তু মোক্ষলাভের জন্য নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠানই যথেষ্ট নয়। ভক্তিবাদের সমর্থক রামানুজ কেবলমাত্র জ্ঞানকেও মুক্তিলাভের উপায় বলে মনে করেননি। তার মতে মোক্ষের জন্য জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ভক্তি বা ধ্যানও প্রয়োজন। সম্যগ্জ্ঞান লাভের পর মুমুক্ষু ধ্যান বা উপাসনায় রত হন এবং উপাসনায় তিনি ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেন। ব্রহ্মোপলব্ধির জন্য অবশ্য মুমুক্ষুর উপাসনা ছাড়াও ঈশ্বরের করুণা প্রয়োজন। ঈশ্বরের করুণা ছাড়া কোন জীবের পক্ষেই মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। একমাত্র ভগবৎ কৃপাই জীবকে মুক্তি দিতে সক্ষম। ভক্তি ও উপাসনার দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হলে ভগবানের কৃপালাভ সম্ভব। জ্ঞান ও কর্ম হলো এই ভক্তির সহকারি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মোক্ষলাভের ইচ্ছা, জ্ঞান, ভক্তি ও ঈশ্বরকরুণার সমন্বয়েই জীবের মুক্তি বা ব্রহ্মসাদৃশ্য লাভ হয়।

মোক্ষলাভের জন্য রামানুজ যে পথ নির্দেশ করেছেন তা হলো, যাঁরা নিষ্কাম কর্মযোগে সাফল্যলাভ করেছেন, কেবলমাত্র তারাই জ্ঞানযোগের আশ্রয় নেবার উপযুক্ত। সমর্থ গুরুর কাছে আত্মার প্রকৃত তত্ত্ব শ্রবণ করে আত্মার স্বরূপ ধ্যান করা জ্ঞানযোগের অন্তর্গত। ঐ ধ্যানের উদ্দেশ্য হলো দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন থেকে আত্মা যে পৃথক ও স্বতন্ত্র, তা উপলব্ধি করা। জ্ঞানযোগে সাফল্য লাভ করলেও ঈশ্বরের সঙ্গে জীবাত্মার কী সম্পর্ক, তা উপলব্ধি করার জন্য ধ্যানের অনুশীলন অব্যাহত রাখা কর্তব্য।

কিন্তু যাঁরা জ্ঞানযোগে সাফল্যলাভ করেছেন কেবলমাত্র তারাই ভক্তিযোগের আশ্রয় নেবার যোগ্য। ভক্তিযোগের ভিত্তি হলো সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের প্রতি যুক্তিসিদ্ধ আস্থা ও বিশ্বাস। ‘ভক্তি’ শব্দের দ্বারা রামানুজ উপনিষদগুলিতে বিবৃত উপাসনা বা ধ্যানকে বুঝিয়েছেন। অবশ্য তার মতে ভক্তি হলো উপনিষদে কথিত ধ্যানের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা বা প্রেমের মিশ্রণ। জীব ঈশ্বরের উপর তার সম্পূর্ণ নির্ভরতা বা শেষত্ব বোধ করে তাকে বিশ্বের নিয়ন্তারূপে অনুভব করে তার প্রতি প্রেমে আপ্লুত হয়ে তার স্বরূপ ধ্যান করবে। সুতরাং রামানুজের মতে ভক্তি হলো ঈশ্বরকে পুরুষোত্তমরূপে গণ্য করে প্রেমের সঙ্গে তার স্বরূপ ধ্যান করা। এই ধ্যানে সাফল্য লাভ করলে জীব ঐশী দৃষ্টির অধিকারী হয়।

তবে রামানুজ এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন যে, ভক্তিযোগ আশ্রয় করে সাফল্য লাভ করার পরও বেদ-বিহিত নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান অবশ্য কর্তব্য। কারণ নিত্যকর্মগুলি না করলে জীব আবার পাপগ্রস্ত হবে। রামানুজের মতে কর্মের মাধ্যমেই ভক্তি উৎসারিত হয় এবং ঐ ভক্তি ঈশ্বরের অপরোক্ষ উপলব্ধির কারণ হয়। তবে রামানুজ মুক্তির সহায়ক কারণরূপে কেবল বেদবিহিত কর্মের অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব দেননি। তিনি বৈষ্ণব শাস্ত্র-নির্দেশিত পূজা-উপাসনা-সমন্বিত ক্রিয়াযোগকেও প্রাধান্য দিয়েছেন।

এখানে উল্লেখ্য, রামানুজ মোক্ষলাভের জন্য যে যোগগুলির কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলিতে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনটি উচ্চশ্রেণীর মানুষের অধিকার আছে। নিম্নবর্ণের মানুষের এগুলিতে অধিকার নেই, যেহেতু নিম্নবর্ণের মানুষের বেদবিহিত আচরণের অধিকার নেই। যেমন, শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে- (ব্রহ্মবিদ্যায়) শূদ্রের অধিকার-সম্ভব হয় না; কারণ? যেহেতু তার সামর্থ নাই। কেননা, যে লোক ব্রহ্মের স্বরূপ এবং তার উপাসনা-প্রণালী জানে না; সুতরাং তারই অঙ্গস্বরূপ বেদানুবচন (বেদপাঠ) ও যজ্ঞাদি কার্যেও অনধিকৃত তার পক্ষে কখনোই উপাসনার অনুকুল সামর্থ সম্ভবপর হয় না। বেদাধ্যয়নের অভাবই তার সামর্থাভাবের কারণ। ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয়ের সম্বন্ধে বেদাধ্যয়ন বিহিত থাকায় তার-সম্পাদ্য জ্ঞানেও অধিকার প্রাপ্ত হওয়া যায়; এজন্য, কর্মবিধি সমূহ যেরূপ জ্ঞান ও সে-উপযোগী অপরাপর সাধনের অপেক্ষা করে না, ব্রহ্মোপাসনা বিধিগুলিও সেরকম। অতএব অধ্যয়নবিধিলব্ধ বেদাধ্যয়নজনিত জ্ঞানই যখন ব্রহ্মোপাসনার প্রধান উপায়, তখন সেই বৈদিক জ্ঞান না থাকায় শূদ্রের ব্রহ্মোপাসনা-সামর্থ কখনো সম্ভবপর নয়। আর ইতিহাস এবং পুরাণশাস্ত্রও বেদার্থের পরিপোষণ করে বলেই উপায়তা লাভ করে থাকে, কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে নয়। শূদ্রের পক্ষে যে ইতিহাস ও পুরাণপাঠে অনুমতি প্রদত্ত হয়েছে, তাও কেবল পাপক্ষয়াদি ফলসিদ্ধির জন্যই, কিন্তু উপাসনার্থে নয় (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৩)।

বিভিন্ন শাস্ত্রেই শূদ্রের উপনয়নাদি সংস্কার-অযোগ্যতা তথা যজ্ঞকর্মে অধিকারহীনতা প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে, যেমন- শূদ্রে কোন প্রকার পাতক নাই এবং শূদ্র কোনপ্রকার সংস্কারার্হও নয়, কোনও ধর্মে শূদ্রের নিয়ত অধিকার নেই (মনুসংহিতা-১০/১২৬)। চতুর্থ বর্ণ (শূত্র) একজাতি অর্থাৎ উপনয়নসংস্কার-জনিত দ্বিজত্বধর্ম-রহিত, এবং কোনও সংস্কারার্হও নয় (গৌতম-সংহিতা-১০/৯)।

এইজন্য নিম্নবর্ণের জীবাত্মাদের মুক্তির জন্য রামানুজ দুটি উপায় অবলম্বন করতে বলেছেন। এই উপায় দুটি হলো- প্রপত্তি ও শরণাগতি। প্রপত্তির অর্থ হলো ঈশ্বরকে একমাত্র আশ্রয় ও অবলম্বনরূপে গণ্য করা। অপরপক্ষে শরণাগতি অর্থ হলো ঈশ্বরে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। প্রপত্তি ও শরণাগতিকে ভিন্নরূপে যথাক্রমে মর্কটন্যায় ও মার্জারন্যায়ও বলা হয়। মর্কটন্যায়ে মর্কট বা বানর সন্তান যেমন নিজ প্রচেষ্টায় মাতৃক্রোড়ে নিজেকে নিবেদন করে, তেমনি জীব নিজেকে পরমেশ্বরের কাছে নিবেদন করে। আর মার্জারন্যায়ে মার্জার বা বিড়ালশাবক যেমন আত্মপ্রচেষ্টাহীনভাবে মাতার নিকট আত্মনিবেদন করে, জীবও তেমনি পরমেশ্বরের কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে।

অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, রামানুজের মতে কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি ও ঈশ্বরকরুণার সমন্বয়েই যদিও জীবের মুক্তি বা ব্রহ্মসাদৃশ্য লাভ হয়, তবুও শুধুমাত্র ঈশ্বরে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ বা ভক্তির মাধ্যমেও জীবের মুক্তিলাভ হতে পারে। তবে বিশিষ্টাদ্বৈত দার্শনিকরা প্রপত্তি ও শরণাগতিকে ভক্তির থেকে আরো কার্যকরি উপায়রূপে গণ্য করেন। কারণ ভক্তিযোগের জন্য শিক্ষণ ও অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রপত্তি ও শরণাগতির জন্য কোন শিক্ষা বা অনুশীলনের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া রামানুজ ভক্তিযোগের চূড়ান্ত পরিণতির জন্য প্রপত্তি ও শরণাগতিকে অবশ্য প্রয়োজনীয় মনে করতেন। বস্তুত রামানুজ যেহেতু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্ণের মানষের মুক্তির জন্য প্রপত্তি ও শরণাগতির সুগম পথের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাই তার দর্শন ও ধর্মমত জনপ্রিয় হয়েছিলো।

অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের পার্থক্য

ব্রহ্মবাদী বেদান্ত সূত্রকার মহর্ষি বাদরায়ণের একই ব্রহ্মসূত্র গ্রন্থের ভাষ্য রচনা করলেও দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু মৌলিক পার্থক্যের কারণে ব্যাখ্যার ভিন্নতায় আচার্য শঙ্করের শারীরকভাষ্যকে কেন্দ্র করে অদ্বৈত-বেদান্ত এবং আচার্য রামানুজের শ্রীভাষ্যকে কেন্দ্র করে বিশিষ্টাদ্বৈত-বেদান্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব। যদিও উভয় সম্প্রদায়ই দাবি করেন যে মহর্ষি বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রে তাদেরই নিজস্ব মতবাদ তথা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের এই দাবিকে বহাল রেখেও এক্ষেত্রে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের সঙ্গে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের কিছু মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন-

  • (১) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম নির্গুণ ও নির্বিশেষ। অন্যদিকে বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সগুণ ও সবিশেষ।
  • (২) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সক্রিয়, জগৎ-স্রষ্টা।
  • (৩) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সকল প্রকার ভেদরহিত। বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম স্বগতভেদযুক্ত, স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদরহিত।
  • (৪) অদ্বৈতমতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এই সত্যের কোন পরিমাণগত ও প্রকারগত ভেদ নেই। অপরদিকে বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম, জীব ও জগৎ সমানভাবে সত্য। এই পরিমাণগত ভেদ নেই, কিন্তু প্রকারগত ভেদ আছে।
  • (৫) অদ্বৈতমতে ব্রহ্মের মায়াশক্তি মিথ্যা বা অবিদ্যাপ্রসূত। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্মের মায়াশক্তি যথার্থই ব্রহ্মের শক্তি।
  • (৬) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ। আর বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম সৎ ও সত্তাবান, চিৎ ও চৈতন্যময়, আনন্দ ও আনন্দময়।
  • (৭) অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম ও জীব অভিন্ন। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে ব্রহ্ম ও জীব ভিন্নও বটে, অভিন্নও বটে।
  • (৮) অদ্বৈতমতে মুক্তজীব অভোক্তা ও অকর্তা। অন্যদিকে বিশিষ্টাদ্বৈতমতে মুক্তজীব ভোক্তা ও কর্তা।
  • (৯) অদ্বৈত মতানুযায়ী মোক্ষে জীব ব্রহ্মে বিলুপ্ত হয় অর্থাৎ মুক্তজীব ব্রহ্ম-সাযুজ্য লাভ করে। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈত মতানুযায়ী মোক্ষে জীব ব্রহ্মে লীন হয় না, বরং ব্রহ্ম-সদৃশ হয় অর্থাৎ, ব্রহ্ম-স্বারূপ্য লাভ করে।
  • (১০) অদ্বৈতমতে জীবিত অবস্থায় মুক্তি বা জীবন্মুক্তি সম্ভব। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে জীবন্মুক্তি অসম্ভব।
  • (১১) অদ্বৈতমতে শুদ্ধজ্ঞানই মুক্তির উপায়। বিশিষ্টাদ্বৈতমতে জ্ঞান, ভক্তি ও ঈশ্বরকরুণার সমন্বয় এবং প্রপত্তি ও শরণাগতি মুক্তির উপায়।
  • (১২) অদ্বৈতমতে আত্মা বিভুপরিমাণ। অন্যদিকে বিশিষ্টাদ্বৈতমতে আত্মা অণুপরিমাণ।
  • (১৩) অদ্বৈতমতে জহৎ-অজহৎ লক্ষণার সাহায্যে ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতমতে বিশেষ্য-বিশেষণভাবজনিত সামানাধিকরণ্যের দ্বারা ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের তাৎপর্য প্রতিপাদিত হয়।
  • (১৪) অদ্বৈতমতে জগৎ মিথ্যা। অথচ বিশিষ্টাদ্বৈতমতে জগৎ সত্য।

তথ্যসূত্র

  • চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শন-৪ (বেদান্ত), রণদীপম বসু, রোদেলা

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.