রাজা দ্বিতীয় জেমস (১৬৮৫–১৬৮৮ খ্রি.) ও ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব

সিংহাসনারোহণ ও বিদ্রোহ দমন

নতুন পার্লামেন্ট আহ্বান : ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় চার্লসের মৃত্যু হলে তার ভাই দ্বিতীয় জেমস ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার অনুকূলেই ছিল। দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বের শেষভাগে হুইগ দলের আচরণে জনমত তাদের বিপক্ষে গিয়েছিল। সুতরাং দ্বিতীয় জেমস জনগণের সমর্থনপুষ্ট হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের পর জেমস একটি নতুন পার্লামেন্ট আহ্বান করেন। এতে টোরি দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সুতরাং নতুন পার্লামেন্টও রাজ সমর্থক ছিল। এটা পোপিশ ষড়যন্ত্রের গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে নিন্দামূলক প্রস্তাব পাস করে; টিটাস ওটস্‌কে কারাগারে নিক্ষেপ এবং যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পার্লামেন্ট রাজাকে বাৎসরিক ১৯ লক্ষ পাউন্ডের রাজস্ব যাবজ্জীবনের জন্য মঞ্জুর করে। স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের পার্লামেন্টও রাজভক্ত ছিল। জেমস নিজেকে নিরাপদ করার জন্য একটি সেনাবাহিনী এবং শক্তিশালী নৌবহরও গঠন করেন। অতএব সিংহাসনে আরোহণের পর জেমসের মর্যাদা পূর্ববর্তী রাজাদের অপেক্ষা উন্নত ছিল। কিন্তু তার নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্যই তিনি এ মর্যাদা বেশি দিন রক্ষা করতে পারেননি।

চরিত্র ও লক্ষ্য : দ্বিতীয় জেমস তার পিতা প্রথম চার্লসের মত একগুঁয়ে, বদমেজাজী এবং কঠোর ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন দৈবস্বত্বে বিশ্বাসী গোঁড়া রোমান ক্যাথলিক। ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক ধর্মমতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র স্থাপনই ছিল তার জীবনের লক্ষ্য। ভাইয়ের শাসন কালে তিনি নৌ-সেনাপতি ছিলেন। তার সামরিক প্রতিভার খ্যাতিও ছিল যথেষ্ট। কিন্তু তিনি কৌশলী ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন না, অথচ খোদায়ী রাজাধিকারে পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন। এজন্য তিনি শেষ রক্ষা করতে পারেননি। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তিনি সিংহাসন হারিয়েছেন।

অর্গাইলের বিদ্রোহ দমন : হুইগ দল জেমসের সিংহাসনারোহণে নিরাশ হয়েছিল। তাদের প্রাধান্য নষ্ট হলেও তারা তখনও নিরস্ত্র হয়নি এবং জেমসকে সিংহাসনচ্যুত করে ডিউক অব মনমাউথকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় রত ছিল। জেমসের সিংহাসনারোহণের অব্যবহিত পরেই মনমাউথ হল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে প্রত্যাগমন করে সিংহাসনের দাবিতে বিদ্রোহ করেন। তাকে সাহায্য করার অভিপ্রায়ে আর্ল অব অর্গাইল স্কটল্যান্ডে বিদ্রোহ করেন (জুন, ১৬৮৫ খ্রি.)। কিন্তু তিনি সহজেই ধৃত হয়ে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। মনমাউথ পশ্চিম ইংল্যান্ডকে তার পক্ষে বিদ্রোহ করার উদ্দেশ্যে কিছুসংখ্যক অনুচর সমভিব্যহারে ডোরস্টেটের লাইন রেজিমে উপস্থিত হন। বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণকালে কৃষক ও খনি শ্রমিকরা দলে দলে তার পক্ষে যােগদান করে। টটন ও ব্রিজওয়াটার শহরে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানানাে হয় এবং রাজা বলে ঘােষণা করা হয়। কিন্তু ভদ্র ও অভিজাত সম্প্রদায় তার পক্ষে যােগদান করেনি এবং বাথ ও ব্রিস্টল শহর তাকে প্রত্যাখ্যান করে। জুলাই মাসের প্রারম্ভে তিনি সেজমুরের যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন। তাকে বন্দী করে লন্ডনে আনা হয়। সেখানে টাওয়ার হিলে তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয় (জুলাই, ১৬৮৫ খ্রি.)। তারপর প্রধান বিচারপতি জেফ্রিঞ্জ ও অন্য চারজন বিচারককে বিদ্রোহীদের বিচারের জন্য পশ্চিমাঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। জেফ্রিঞ্জ বিচারের নামে অবিচারে তিনশত ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ড দেন এবং আটশত ব্যক্তিকে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসিত করেন। এ ঘটনা ইতিহাসে রক্তমাখা আখর (Bloody Assize) নামে পরিচিত। 

রাজত্বের প্রথম কয়েক মাসের এ সকল সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে জেমস অতঃপর রাজনৈতিক দিক থেকে এক মারাত্মক ভুল করে বসেন। তিনি ইংল্যান্ড রােমান ক্যাথলিক ধর্মমত পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টায় এমন সব স্বৈরাচারী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যার ফলে ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে গৌরবময় বিপ্লব নামে এক মহাবিপ্লব সংঘটিত হয় এবং ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক ধর্ম পুনঃপ্রবর্তনের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়।

১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের গৌরবময় বিপ্লব 

বিপ্লবের কারণ ও ঘটনাবলি

ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় জেমসের স্বেচ্ছাচারী কার্যাবলিই ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের কারণ। ক্যাথলিক ধর্মমতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র স্থাপনই ছিল গোঁড়া ক্যাথালিক রাজা দ্বিতীয় জেমসের প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি জনমতের তােয়াক্কা না করে দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে একের পর এক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকেন। এরই ফলে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব সংঘটিত হয়।

দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্ট ‘টেস্ট অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করে সকল রাজকর্মচারীর জন্য ইংল্যান্ডের জাতীয় চার্চের ধর্মমতের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করাকে বাধ্যতামূলক করেন। এর ফলে কোন ক্যাথলিকই রাজকর্মচারীর পদে নিযুক্ত হতে পারত না। সুতরাং জেমসের উদ্দেশ্য সাধনের পথে এ টেস্ট অ্যাক্ট ছিল অন্তরায়। তাই তিনি প্রথম ‘টেস্ট অ্যাক্ট’ বাতিল করতে মনস্থ করেন এবং এর জন্য পার্লামেন্টের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু পার্লামেন্ট জেমসের ডিসপেন্সিং ক্ষমতা (Dispensing Power – যে কোন ব্যক্তি বিশেষের উপর কোন আইন প্রয়োগ স্থগিত রাখার ক্ষমতা) প্রয়ােগ করে টেস্ট অ্যাক্টকে অকার্যকর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি স্যার এডওয়ার্ড হেলস নামক একজন রােমান ক্যাথলিক সরকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে টেস্ট আইন ভঙ্গ করার অপরাধে এক মামলার সৃষ্টি করেন। হেলস আদালতে বলেন যে, তিনি রাজার আদেশে টেস্ট আইন ভঙ্গ করেছেন। হেলসের অনুগত ব্যক্তিগণ বিচারক ছিলেন। সুতরাং আদালত হেলসকে নির্দোষ এবং রাজার ডিসপেনসিং ক্ষমতাকে বৈধ ঘােষণা করেন। আদালতের রায়ের সুযােগে জেমস নির্ভয়ে রাজদরবার ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদে রােমান ক্যাথলিকদের নিযুক্ত করেন এবং স্থায়ী সৈন্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। 

এরপর জেমস অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় দুটির পরিচালনা কার্যে হস্তক্ষেপ করে প্রােটেস্টান্ট ধর্ম ও প্রতিষ্ঠিত চার্চের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণ শুরু করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আইজাক নিউটন প্রচলিত শপথ গ্রহণ ছাড়া জেমসের মনােনীত একজন বেনিডিকটাইন যাজককে এম.এ. ডিগ্রী প্রদান করতে অস্বীকার করলে জেমস তাকে পদচ্যুত করেন। অক্সফোর্ডে জেমস ডিসপেনসিং ক্ষমতার বলে অনেক রােমান ক্যাথলিককে বিভিন্ন পদে নিয়ােগ করেন। অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজের সদস্যরা জনৈক রােমান ক্যাথলিককে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত করতে অস্বীকার করলে জেমস তাদের পদচ্যুত করে তাদের শূন্য আসনগুলােতে রোমান ক্যাথলিকদের নিযুক্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলাের উপর এরূপ আক্রমণে ইংল্যান্ডের প্রতিটি লােক মর্মাহত হয়। 

ইতােমধ্যে স্কটল্যান্ডেও একই নীতি সমান উৎসাহের সাথে কার্যকর করা হয়। রােমান ক্যাথলিকদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হয় এবং প্রিভি কাউন্সিল ও রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান পদগুলােতে রােমান ক্যাথলিকদের নিযুক্ত করা হয়।

১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে জেমস তার ধর্মীয় নীতির বিরােধীদের শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে হাইকোর্টের (যা ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে লং পার্লামেন্ট কর্তৃক বাতিল করা হয়েছিল) অনুরূপ ‘ইক্লেসিয়াসূটিক্যাল কমিশন কোর্ট’ (Ecclesiastical Commission Court) নামে একটি বিচারালয় স্থাপন করেন। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ক্যাথলিকদের সঙ্গে ডিসেন্টারদের ও স্বপক্ষে আনার উদ্দেশ্যে একটি ডিক্লেয়ারেশন অব ইভালজেন্স (Declaration of Indulgence) জারি করেন। এর দ্বারা ক্যাথলিক ও ডিসেন্টারদের বিরুদ্ধে যাবতীয় শাস্তিমূলক আইন স্থগিত স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এরূপে জেমস ‘সাসপেন্ডিং ক্ষমতা’ও (Suspends Power – আইনকে স্থগিত রাখবার ক্ষমতা) প্রয়ােগ করেন। তার এরূপ আচরনে সকল শ্রেণীর লােক অসন্তুষ্ট হয়। ডিসেন্টারগণও এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কারণ তারা স্পষ্ট বুঝতে পারে যে, জেমস ক্যাথলিক ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কৌশলে তাদের দ্বারা কার্য সিদ্ধি করতে চান। তারপরও জেমস ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে আর একটি ডিক্লেয়ারেশন অব ইন্ডলিজেন্স জারি করে প্রত্যেক গির্জায় তা পাঠ করার জন্য যাজকগণকে আদেশ করেন। লন্ডনের ছয় জন বিশপ ক্যান্টারব্যারির আর্চবিশপ স্যানক্রফটের নেতৃত্বে উক্ত আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য জেমসের বরাবরে একটি দরখাস্ত পেশ করলে জেমস তাদের রাজদ্রোহের অভিযােগে গ্রেফতার করে বিচারের জন্য সােপর্দ করেন। এতে গােটা জাতির মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।

সপ্তবিশপের বিচার শেষ হওয়ার পূর্বেই ১০ জুন তারিখে জেমসের দ্বিতীয় রানী মেরী অব মােডেনা একটি পুত্র সন্তান জন্মদান করেন। এ সংবাদে ইংরেজ জাতি আরও বিচলিত হয়ে পড়ে। তারা এতকাল এ ভেবে আশ্বস্ত ছিল যে, জেমসের মৃত্যুর পর তার প্রোটেস্টান্ট কন্যা মেরী ইংল্যান্ডের রানী হবেন। কিন্তু এ শিশু জন্মলাভ করায় তারা নিরাশ হয়ে পড়ে। কারণ ক্যাথলিক রাজা-রানীর পুত্র ক্যাথলিক ধর্মমতই সমর্থন করবেন বলে তাদের অন্তরে আশঙ্কা জন্মে। 

এরূপ উত্তেজনাপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে ৩০ জুন তারিখে সপ্তবিশপের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়। আদালত তাদের নির্দোষ ঘােষণা করে মুক্তি দেন। তাদের মুক্তিতে সমগ্র সপ্তবিশপের মুক্তিলাভে আনন্দের বন্যা নেমে আসে। এমন কি সেনাবাহিনীও এ আনন্দে যােগদান করে। উক্ত তারিখেই সন্ধ্যায় হুইগ ও টোরি দলের সাতজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জেমসের জামাতা হল্যান্ডের রাজা উইলিয়ামকে জেমসের অত্যাচার থেকে দেশকে মুক্ত করার অনুরােধ জানিয়ে একটি পত্র লেখেন। এডমিরাল হার্বাট সাধারণ নাবিকের ছদ্মবেশে হল্যান্ডে উইলিয়ামের কাছে পত্র পৌঁছে দেন। ৫ নভেম্বর, ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম সসৈন্যে ইংল্যান্ডে আগমন করেন। জেমস তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে একে একে প্রায় সকলেই উইলিয়ামের পক্ষে যােগদান করে। জেলে সৈন্যাধ্যক্ষ লর্ড চার্চিল এবং অপর কন্যা অ্যানও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন। সকালের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে জেমস আপােষের নিষ্ফল চেষ্টা করেন। এরপর তিনি  পলায়নের চেষ্টা করে বনী হন। কিন্তু প্রহরীরা উইলিয়ামের ইচ্ছানুসারে তাকে নির্বিঘ্নে ফ্রান্সে পলায়নের সুযােগ দেয়। ২৩ ডিসেম্বর তারিখে জেমস ফ্রান্স অভিমুখে পলায়ন করেন। তার পলায়নের পর একটি কনভেনশন পার্লামেন্ট উইলিয়াম ও মেরীকে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে। এরূপে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা – ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের গৌরবময় সংঘটিত হয়। এ বিপ্লব ছিল আত্মরক্ষামূলক; তা বিনা রক্তপাতে সংঘটিত হয়েছিল। এছাড়া, এর ফলে ইংল্যান্ডে শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। এসব কারণে এ বিপ্লব ‘গৌরবময় বিপ্লব’ (Glorious Revolution) নামে প্রসিদ্ধ। বিনা রক্তপাতে সংঘটিত হয়েছিল বলে একে ‘রক্তপাতহীন বিপ্লব’ও (Bloodless Revolution) বলা হয়। 

বিপ্লবের ফলাফল ও গুরুত্ব

১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক ঘটনা। এর ফলে খােদায়ী রাজাধিকার মতবাদ এবং স্টুয়ার্ট যুগের সর্বপ্রধান ঘটনা রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান হয়। ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কে?-এ প্রশ্নই স্টুয়ার্ট আমলে রাজা ও পার্লামেন্টের দ্বন্দে মীমাংসার বিষয়বস্তু ছিল। এ বিপ্লবে পার্লামেন্টই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে স্থির হয়। পার্লামেন্ট উইলিয়াম ও মেরীকে শর্তাধীনে সিংহাসন দান করায় খােদায়ী রাজাধিকার মতবাদের অবসান হয় এবং পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রমাণিত হয়। বিপ্লব পরবর্তী বিল অব ব্রাইটস, মিউটিনি অ্যাক্ট প্রভৃতি আইন পার্লামেন্টের সার্বভৌম ক্ষমতাকে আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং ইংল্যান্ডে প্রকৃত নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। 

ইংল্যান্ডের ধর্মীয় ইতিহাসে এ বিপ্লব একটি বিখ্যাত ঘটনা। প্রথমত, এর ফলে ইংল্যান্ডে প্রােটেস্টান্ট ধর্মের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়। দ্বিতীয়ত, এ বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের জনসাধারণ ক্রমান্বয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্জন করে। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এ বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। স্কটল্যান্ড এ বিপ্লবে সহযােগিতা করায় পরবর্তী বিশ বছরের মধ্যে সুবিধাজনক শর্তে দুই দেশের সংযুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। অপরপক্ষে আয়ারল্যান্ড জেমসকে সমর্থন করায় এক শতাব্দীরও অধিককাল সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব ধরে তাকে ইংল্যান্ডের অধীনস্থ থাকতে হয় এবং অবশেষে দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মিলন হলেও তার শর্তাবলি আইরিশদের জন্য সন্তোষজনক ছিল না।

স্বদেশের মত ইউরােপের ইতিহাসেও ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব সমভাবে প্রথমত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তা ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতিতে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তনের সূচনা করে। এলিজাবেথের সময় থেকে ইংল্যান্ড মোটামুটিভাবে ফ্রান্সের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল এবং রাজা দ্বিতীয় চার্লস ও তার ভ্রাতার আমলে ফরাসিরাজ চতুর্দশ লুইয়ের আজ্ঞাধীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিপ্লবের ফলে উইলিয়াম ইংল্যান্ডের রাজা হওয়ায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দের সুচনা হয়। এরূপে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব ইউরােপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। উইলিয়াম কর্তৃক অনুসৃত নীতির ফলে ইউট্রেক্টের সন্ধিতে ইউরােপে ব্রিটিশ প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। দ্বিতীয়ত, এ বিপ্লবের ফলে ইউরােপীয় স্বৈরাচারী রাজাদের খােদায়ী রাজশক্তির বিশ্বাস প্রতিহত হয়। জনগণের হস্তেই যে সার্বভৌম ক্ষমতা নিহিত, তা ইউরােপের দেশগুলাের সম্মুখে উদ্ঘাটিত হয়। পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে ইংল্যান্ডের এ বিপ্লবের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের গৌরবময় বিপ্লব কি বিপ্লব, না গৌরবময়? 

১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবকে বিপ্লব বলা যায় কিনা এর বিচার করতে হলে এ মানদণ্ডেই করতে হয় যে, তা কোন উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন এনেছিল কিনা এবং এর পশ্চাতে জনসমর্থন ছিল কি না। কেননা বিপ্লব সব সময়ই নতুন কিছু আনয়ন করে এবং যে কোন সফল বিপ্লবের পশ্চাতে ব্যাপক জনসমর্থন থাকে। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব জনগণের মাধ্যমে সংঘটিত না হলেও এর পশ্চাতে যে ব্যাপক জনসমর্থন ছিল তা অনস্বীকার্য। উইলিয়াম ইংল্যান্ডে পদার্পণ করা মাত্রই ইংল্যান্ডের জনগণ যে ভাবে ও যে হারে তাকে স্বাগত জানায় এবং দ্বিতীয় জেমসের সেনাবাহিনীর লোকেরা যেভাবে দলে দলে তার পক্ষ ত্যাগ করে উইলিয়ামের পক্ষে যােগদান করে, তাই ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের পশ্চাতে ব্যাপক জনসমর্থনের স্পষ্ট প্রমাণ। এ বিপ্লব যে ইংল্যান্ডের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আনয়ন করেছিল তা নিমােক্ত দৃষ্টান্তসমূহ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। বিপ্লবপ্রসূত অধিকার আইন, বিদ্রোহ আইন, ধর্মসহিষ্ণুতা আইন, ত্রৈবার্ষিক আইন, উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদির মাধ্যমে ইংল্যান্ডের শাসনতন্ত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। এগুলাের দ্বারা স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের স্থলে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র এবং পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ বিপ্লবের ফলে পার্লামেন্টে উইলিয়াম ও মেরীকে শর্তাধীনে সিংহাসন দান করায় খােদায়ী রাজাধিকার মতবাদের অবসান হয় এবং সে সঙ্গে বংশগত উত্তরাধিকার নীতির ধারণারও পরিবর্তন হয়। এ সকল এবং নিম্নে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের কথা চিন্তা করলে ১৬৮৮ খ্রিষ্টাদের বিপ্লব যে প্রকৃতই বিপ্লব ছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। 

এখন ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লব গৌরবময় ছিল কি না তাই বিচার্য বিষয়। বলা হয়, এই বিপ্লব এক আকস্মিক পরিস্থিতিতে সংঘটিত হয়, এ বিপ্লবের জন্য জনগণের কোন পরিকল্পনা ছিল না এবং কোন ত্যাগ স্বীকারেরও প্রয়ােজন হয়নি; এর সাফল্যের পশ্চাতেও জনগণের কোন স্বার্থত্যাগ ছিল না এবং তা ইংল্যান্ডের জনগণের মাধ্যমে সংঘটিত না হয়ে একজন বিদেশীর সাহায্যে সংঘটিত হয়। এ সকল কারণে কোন কোন ঐতিহাসিক একে ‘গৌরবময় বিপ্লব’ বলে স্বীকার করেন না। কিন্তু এ বিপ্লব যে ভাবেই সংঘটিত হােক না কেন এবং এর সাফল্য যেভাবেই আসুক না কেন ইংল্যান্ডের ইতিহাসে তার গুরুত্বই এটাকে গৌরবময় করেছে।

  • প্রথমত, এ বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। এ বিপ্লব খােদায়ী রাজাধিকার মতবাদের এবং স্বৈরাচারী রাজাদের স্বেচ্ছাচারের অবসান ঘটিয়ে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করে; রাজার বিশেষ অধিকারের ধারণাসমূহ বিনাশ করে রাজার বিশেষ অধিকারের উপর আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে এবং ইংরেজ জনগণের মৌলিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। এ বিপ্লবের ফলশ্রতিতেই ইংল্যান্ডে দলগত শাসন ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। ইংল্যান্ডের ধর্মীয় ইতিহাসেও এ বিপ্লব একটি বিখ্যাত ঘটনা। এর ফলে ইংল্যান্ডে প্রােটেস্টান্ট ধর্মের বিজয় সূচিত হয় এবং ইংল্যান্ডের জনসাধারণ ক্রমে ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্জন করে।
  • দ্বিতীয়ত, এ বিপ্লব ছিল রক্তপাতহীন। এজন্য কোন রক্তপাতের প্রয়ােজন হয়নি, অথচ এর ফলাফল ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী।
  • তৃতীয়ত, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এ বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে অল্পকালের মধ্যেই ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাষ্ট্রিক মিলন সম্ভব হয়েছিল।
  • চতুর্থত, এ বিপ্লব ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তনের সূচনা করে। এ বিপ্লবের ফলে উইলিয়াম ইংল্যান্ডের রাজা হওয়ায় ইংল্যান্ড ও ফ্যান্সের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্বের সূচনা হয় এবং এ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই ইংল্যান্ড সমগ্র ইউরােপে তথা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সামরিক, রাষ্ট্রিক ও ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়।
  • পঞ্চমত, এ বিপ্লব ইংরেজ জাতির ইতিহাসের শেষ বিপ্লব। এর পরে ইংল্যান্ডের জাতীয় ইতিহাসে শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোন ব্যাপক প্রতিবাদ, বিদ্রোহ বা বিপ্লব সংঘটিত হয়নি।
  • ষষ্ঠত, পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে এ বিপ্লবের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

সুতরাং এ সকল বিষয় বিবেচনা করে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব প্রকৃতপক্ষেই গৌরবময় বিপ্লব ছিল। 

তথ্যসূত্র

আধুনিক ইংল্যান্ডের ইতিহাস, তানজিমুল ইসলাম, বুক চয়েস, ঢাকা, ২০১৮, পৃ. ২৩৫-২৪১

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.