আফগানিস্তানে ইসলামী ও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার দলের উন্মেষ ও কম্যুনিস্ট মতবাদের অনুপ্রবেশ

আফগানিস্তানের রাজনৈতিক দল পরিচিতি

দলব্যবস্থা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই মূলত শাসনকার্য পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনৈতিক দল বলতে একই রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী এমন একদল নাগরিককে বোঝায় যারা সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে তৎপর হয়। দলীয় রাজনীতির উদ্ভব অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিককালের ঘটনা। গণতন্ত্রের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও রাজনৈতিক দল সম্পর্কিত আলোচনা বেশি দিনের নয়। প্রাচীন যুগে বিশেষ বংশ ও গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন করেছে। মধ্যযুগে এ দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিল অভিজাত শ্রেণি, পুরোহিত, বণিক ও সমসাময়িক প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের ওপর। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে রানী এলিজাবেথের আমলে আধুনিক অর্থে রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ও বিকাশের সাথে সংশ্লিষ্ট সমাজের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বিষয়াবলি জড়িত থাকে। এহেন প্রেক্ষিতে আমরা দেখি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আফগানিস্তানে অনেক রাজনৈতিক দলের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে।

আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকলেও গোত্রীয় চেতনার পাশাপাশি গণচেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিংশ শতাব্দীর মধ্যপর্ব থেকেই এখানে রাজনৈতিক মত ও দল গঠনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যা সমসাময়িক রাজতন্ত্রশাসিত মুসলিম বিশ্বে দুর্লভ। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও মুসলিম বিশ্বে রাজনীতি চর্চা বিশেষ শ্রেণির মধ্যেই অনেকটা কুক্ষিগত ছিল। জহির শাহের শাসনের প্রথমার্ধ থেকেই রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ ও দল গঠনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এ অধ্যায়ে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক দল ও জোটের রাজনৈতিক দর্শন ও কার্যকলাপের উপর আলোকপাত করা হল।

আল হিযবুল ইসলামি (হিযবে ইসলামি) : আল হিথুবল ইসলামি বা হিযবে ইসলামি আফগানিস্তানের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল। জহির শাহের আমলে এ দলটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ দলের লক্ষ্য ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে একটি আধুনিক কল্যাণকামী আফগানিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কট্টরবাদী এ দলটি মিসরের ইসলামিক ব্রাদারহুড বা আল ইখওয়ান আল মুসলমিন এর আদর্শে লালিত। (ইখওয়ানুল মুসলিমিন ১৯২৯ সালে মিশরে হাসান আল বান্না ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ভ্রাতৃত্ব আন্দোলন শুরু করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ইসলামি আদর্শের প্রতিফলন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষে উন্নীত হয়। শীঘ্রই সংগঠনটির প্রভাব অন্যান্য আরব রাষ্ট্রে সম্প্রসারিত হয়। এই সংগঠনের ওপর প্রচণ্ড সরকারি নির্যাতন চাপিয়ে দেয়ার প্রেক্ষিতে জনৈক ইখওয়ান কর্মী ১৯৪৮ সালে তৎকালীন মিশরীয় প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে। পরবর্তীতে সরকারের ভয়াবহ শ্বেতসন্ত্রাসের পরিণতিতে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্না নিজেও নিহত হন। ১৯৫২ সালে মিশরীয় রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জেনারেল নাজিব ক্ষমতায় এলে ইখওয়ান প্রথম দিকে নাজিব সরকারকে সমর্থন করে। কিন্তু নাজিব-নাসের পাশ্চাত্য ভাবধারা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিলে ইখওয়ান সরকারের বিরোধিতা শুরু করে। ১৯৫৪ সালে ইখওয়ান জামাল আবদুন নাসেরের জীবননাশের চেষ্টা করলে নাসের’ ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ইখওয়ান সদস্যদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন এর নেতা-কর্মীদের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন চালান। এমতাবস্থায়, ইখওয়ানের তৎকালীন নেতা হাসান আল হোদায়বি কায়রো থেকে দামেস্কে এর প্রধান কার্যালয় স্থানান্তরিত করেন। কিছুদিন পরে পুনরায় মিশরে ইখওয়ানের কর্মকাণ্ড শুরু হয় এবং এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ সাইয়িদ কুতুব। প্রেসিডেন্ট নাসের ১৯৬৬ সালে সাইয়িদ কুতুবসহ কয়েকজন ইখওয়ান নেতার ফাঁসি দেন ও ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, এবং কঠোর হস্তে এই আন্দোলন দমন করেন। কিন্তু এতো নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও ইখওয়ানের কার্যক্রম এখনও বলবৎ আছে।) এ দলটিই আফগানিস্তান সবচেয়ে সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত দল। এ দলের সদস্য সংখ্যা ৬০,০০০ – ৭০,০০০ হাজার। সমস্ত আফগানিস্তানব্যাপী এ দলের শাখা রয়েছে। তবে পশতু ভাষী যুবকদের মধ্যে এর প্রভাব অত্যাধিক। হিযবে ইসলামি দল দুভাগে বিভক্ত, এর বৃহত্তর অংশের নেতৃত্ব ছিলেন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী। আফগান জেহাদের সময় মুসলিম বিশ্বে তিনি ‘কুলবুদ্দিন’ অর্থাৎ ইসলামের হৃদপিণ্ড’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৬৯ সালে কম্যুনিজম বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ইসলামি আন্দোলনের নেতারা ‘জওয়ানে মুসলেমিন’ নামক একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তরুণ হিকমতিয়ার এ আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৮ মাস কারাযাপন করেন। এছাড়া পরবর্তীকালে এ দলটি নাম পরিবর্তন করে জমিয়তে ইসলামি নামকরণ করা হয়। কারবন্দী হেকমতিয়ার এর সামরিক প্রধান নিযুক্ত হন। সর্দার দাউদের সময় তিনি কারামুক্ত হন। কারামুক্ত হয়ে তিনি সামরিক বাহিনীর যোগসাজসে জেনারেল দাউদের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভ্যুত্থানে সাফল্য লাভে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানে আত্মগোপন করেন। তারাকি বিরোধী অনেকগুলো সামরিক অভ্যুত্থানের নেপথ্যেও ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি আফগান প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আফগান জিহাদে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রবাসী মুজাহিদ সরকারের প্রতি মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়ের উদ্দেশ্যে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশে আসেন। জেনারেল এরশাদ এ সময় আফগান প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও তার সাথে সোহাদমূলক সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব সফর করেন। পরবর্তীকালে মন্ত্রীত্ব থেকে অপসারিত হয়ে তার সুশিক্ষিত ৭০,০০০ হাজার মুজাহিদ নিয়ে রুশ বিরোধী যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। জেহাদ শেষ হওয়ার পর অন্তবর্তীকালীন আফগান সরকার তাকে প্রধানমন্ত্রীত্ব পদ গ্রহণে অনুরোধ করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। আফগান যুদ্ধে হিকমতিয়ারের দল প্রথম থেকে শেষাবধি পাকিস্তানের সামরিক সহায়তা পেয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালে তার বিরুদ্ধে ১৬টি স্ট্রিংগার মিসাইল এক মিলিয়ন ডলারে বিক্রির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে এ দলটি মদ ও অস্ত্র চোরাচালানে লিপ্ত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৮৪ সালে হিকমতিয়ার জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ভাষণ দেন। এরপর থেকে নাটকীয়ভাবে আমেরিকার সাথে তার ও দলের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

জমিয়তে ইসলামি (Islamic Socicty) : আফগানিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জমিয়তে ইসলামি অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দল। জহির শাহের আমলে এ দলটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা বুরহানুদ্দিন রাব্বানি। তিনি বাদখাশনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাবুল ও আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন। তিনি হাসানুল বান্না ও মাওলানা মওদুদির চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হন। বুরহানুদ্দিন রাব্বানি আফগানিস্তানে ইসলামি আন্দোলনে পথিকৃৎ মাওলানা গোলাম মোহাম্মদ নিয়াযির সহকর্মী ও ভাবশিষ্য। এ দলের রাজনৈতিক আদর্শ হচ্ছে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে একটি আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এ দলটি হিযবে ইসলামির তুলনায় অনেক উদার ও অন্যদের সহযোগিতাকামী। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা বুরহানুদ্দিন রাব্বানি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন। উল্লেখ্য যে, বুরহানুদ্দিনসহ মওলানা মোহাম্মদ নিয়াযি, আব্দুর রসূল সাইয়াফ আতিশ, মাওলানা হাবিবুর রহমানের যৌথ প্রচেষ্টায় আফগানিস্তানে কম্যুনিস্ট বিরোধী ভাবাদর্শ প্রচার ও আফগানিস্তানে ইসলামি হুকমাত শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সর্দার দাউদ ও তার রুশ ক্রীড়নকদের সময়ে তিনি ও হেকমতিয়ার বেশকিছু ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর পাকিস্তানের পেশওয়ারে আত্মগোপন করেন। বুরহানুদ্দিনকে প্রবাসী সরকারের সভাপতি ও হিকমতিয়ারকে এর সেকেন্ড কমান্ড নিযুক্ত করা হয়। অচিরেই রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া গ্রহণে তাদের মাঝে মনোমালিন্য ও মতানৈক্য দেখা দেয়। ফলে জমিয়তে ইসলামি ভেঙ্গে যায়। হিকমতিয়ার হিযবে ইসলামি দল গঠন করেন। এ দলে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিশেষ প্রভাব ছিল। এ সংগঠনের বেশ কয়েকজন যোগ্য ও প্রভাবশালী কমান্ডার রয়েছে। তন্মধ্যে এ দলের প্রধান সেনাধ্যক্ষ আহমদ শাহ মাসুদ অন্যতম। সেপ্টেম্বর ৯, ২০০১ এ আহমেদ শাহ মাসুদ বিমান হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। এ দল তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পূর্ব পর্যন্ত কাবুলের গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পরবর্তীকালে নজিবুল্লাহর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আব্দুর রশিদ দোস্তাম এ দলে যোগ দেন। তাদের সাথে হিকমতিয়ারের বাহিনীর সংঘর্ষের ফলে কাবুল ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীতে পরিণত হয়। এ দলের প্রভাবিত এলাকা হচ্ছে উত্তরের বাদখাশান, টাকহার, বাগলান এবং পারওয়ান প্রদেশ। রাব্বানি ও মাসুদের তাজিক বাহিনী ও দোস্ত ামের উজবেক বাহিনী পশতুনদের উপর অমানবিক অত্যাচার ও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। রাব্বানি আফগান অন্তবর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতি ও আহমেদ শাহ মাসুদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন।

ইত্তেহাদ ই ইসলাম (Islamic Unity) : ইখওয়ানুল মুসলেমিন ও জামাতে ইসলামির সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রক্ষাকারী ড. আব্দুর রসূল সাইয়াফ বিন ফকির মোহাম্মদ ইত্তেহাদ ই ইসলাম ও ইসলামি ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা। কাবুলের পাগমান জেলায় জন্মগ্রহণকারী সাইয়াফ কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় ও জামি আল আজহারে শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্যুনিস্ট বিরোধী আন্দোলনের পথিকৃৎ ড. গোলাম মোহাম্মাদ নিয়াযির মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হন। সাইয়াফের বহু ভাষায় পাণ্ডিত্য এবং ভাব প্রকাশের পারঙ্গমতা, কর্মচাঞ্চল্য ও সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের যথোচিত যোগ্যতা রয়েছে। আফগান যুব সমাজের সাথে তিনি ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। ফলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভক্ত ও অনুরক্তদের সংখ্যা ব্যাপক। উল্লেখ্য যে, জিহাদি মনোভাবে সাইয়াফ ও হিকমতিয়ার একই চিন্তাধারায় লালিত। রুশ বিরোধী যুদ্ধে আফগান তথা মুসলিম বিশ্ব এ দুজনকেই ইসলামি আন্দোলনে বলিষ্ট প্রবক্তা বলে মনে করে। ছাত্রাবস্থা থেকেই সাইয়াফ ইসলামি আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। সর্দার দাউদের আমলে সরকার বিরোধী আন্দোলনে তাকে বন্দি করা হয়। নূর মোহাম্মদ তারাকির আমলে দেশীয় কম্যুনিস্টদের হাতে দু লাখ আফগান নিহত হন ও সাইয়াফকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। আফগান জনমতের চাপে ও নিজেকে গ্রহণযোগ্য করার স্বার্থে হাফিজুল্লাহ আমিন তারাকির আমলে নিহত ব্যক্তিদের যে তালিকা প্রকাশ করেন ভুলবশত সে তালিকায় সাইয়াফের নামটি ছত্রিশ নম্বরে ছিল। তবে ভাগ্যক্রমে সাইয়াফ বেঁচে যান। বারবাক কারমাল ক্ষমতায় এসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে অনেকের সাথে সাইয়াফও মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আফগান সমস্যা আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন ও মুসলিম মুজাহিদদের পক্ষে জনমত গঠনে সাইয়াফের অবদান অপরিমীত। এছাড়া সাক্ষাৎ যুদ্ধেও তার জুড়ি মেলা ভার। তার তৎপরতায় ক্ষুব্ধ হয়ে বারবাক কারমাল তার মাথার মূল্য তদানীন্তন মুদ্রায় দেড় কোটি টাকায় সাব্যস্ত করেন।

যাবাই ই নাজাত মিল্লি (National liberation Front) : কাবুলের ঐতিহ্যবাহী মুজাদ্দেদ বংশের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ সিবগাতুল্লাহ মোজাদ্দেদি এ দলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কাবুল ও মিসরে ইসলামি শরিয়তের উপর শিক্ষা লাভ করেন। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি দর্শন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সিবগাতুল্লাহ মোজাদ্দেদি একজন তরিকতপন্থি পীর। তার পূর্বপুরুষ নুরুল মাশায়েখ শায়খ ফজলে ওমর মোজাদ্দেদি যিনি শের আগা নামে আফগান ইতিহাসে সমাধিক প্রসিদ্ধ। তার ভাতা শায়খ মোহাম্মদ সাদিক মোজাদ্দেদি মধ্যপ্রাচ্যে আফগানিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও রাবেতা ই আলমে ইসলামির নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। মোজাদ্দেদির নেতৃত্ব ও বিক্ষোভের কারণে বাদশাহ আমানুল্লাহ সিংহাসন হারান। নকশবন্দি তরিকার এ পীর পরিবারের আফগানিস্তানে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ১৯৩৮ সাল প্রতিষ্ঠিত এ দলটির সদস্য সংখ্যা ১৫,০০০। আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় এ দলের ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। এ দলটি রাজতন্ত্রের সমর্থক। এ দলে তেমন কোনো বিখ্যাত মুজাহিদ কমান্ডার না থাকলেও মোজাদ্দেদির জ্ঞান-গরিমা ও বংশীয় ঐতিহ্যের জন্য আফগান সমাজে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। দাউদ খান কর্তৃক সংগঠিত সমাজতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের সময় তিনি বিদেশে ছিলেন। লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি কর্ণেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি তাকে বেলজিয়াম ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে মুবাল্লিগ হিসাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেন। ডেনমার্কে অবস্থানকালে তিনি ইমামতি করেন। আফগান জিহাদে তার ভূমিকা উজ্জ্বল। আফগানিস্তানে মস্কোপন্থীদের পতনের পর তিনি অন্তবর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।

মাহাজ ই মিল্লি ই ইসলামি (National Front of Afghanistan) : এ দলটি আফগানিস্তানের ধর্মীয় নেতা পীর সৈয়দ আহমদ জিলানির নেতৃত্বে পরিচালিত। তিনি কাদেরিয়া তরিকার পীর। উল্লেখ্য যে আফগানিস্তানে কাদেরিয়া তরিকার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। হযরত আব্দুল কাদের জিলানি আফগানিস্তানে পীর বাবা উপাধিতে খ্যাত। পাকাতিয়া প্রদেশে এ দল শক্তিশালী। এ দলের সদস্যরা তরিকতপন্থি এ ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত ও শ্রদ্ধাশীল। এ দলের যুদ্ধক্ষেত্র কান্দাহারে সীমাবদ্ধ থাকায় বাইরে এর খুব একটা প্রভাব ছিল না। এ দল রাজতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল । আফগান রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কিত এ নেতা প্রয়াত বাদশাহ জহির শাহের প্রত্যাবর্তনের একনিষ্ঠ সমর্থক। সৈয়দ আহমদ জিলানির অনুসারীরা খুবই ধর্মপ্রাণ ও শরিয়তে পাবন্দ। রুশ বিরোধী জিহাদের শুরুতেই তিনি নিজের মুরিদানসহ জিহাদে শরিক হন। তার উত্তরসূরী ও ভ্রাতুষ্পুত্র সৈয়দ হাসান জিলানি (১৯৫৩ খ্রি.) অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিবান তরুণ নেতা। এ দলের প্রখ্যাত কমান্ডারগণ হলেন রহিম ওয়ার্দক, শাহরুক ও হাজি আব্দুল লতিফ। হিজবে ইসলামি (Islamic party) : এ দলটি আফগানিস্তানের অন্যতম প্রাচীন দল আল হিযবুল ইসলামি থেকে উদ্ভূত। এ দলটি ১৯৭৮ সাল হিকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন দল থেকে বেরিয়ে নবরূপে আত্মপ্রকাশ করে। মাওলানা ইউনুস খালিস ১৯৭৮ সালে এ দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত প্রতিভাবান আলেম ও আফগান জেহাদের সর্বজ্যেষ্ঠ নেতা। মুজাহিদ জোটের শরিয়া বোর্ডের সদস্য হিসাবে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। মুজাহিদদের প্রাণপ্রিয় নেতা ইউনুস খালিস খুবই শ্রদ্ধাভাজন ও সর্বজনমান্য নেতা। এ দলের সদস্য সংখ্যা ৮,০০০। এ দলটি দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের নানগাহার প্রদেশে খুবই শক্তিশালী। দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসাবে এ দলের প্রতিটি সদস্যের খ্যাতি আছে। এ দলের দুর্ধর্ষ কমান্ডারদের মধ্যে আব্দুল হক প্রধান। তাকে মুজাহিদরা সিংহের সাথে তুলনা করতেন। এছাড়াও জালালুদ্দিন হাক্কানি, আব্দুল কাদের ওয়ার্দাক্, মোল্লা মালং এ দলের অন্যতম নেতা। তালেবান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মোল্লা আমির খান মুতওয়াক্কিল এ দলের কমান্ডার ছিলেন।

হারকাত ই ইনকিলাব ই ইসলামি (Islamic Revolutionary movement) : ধর্মীয় নেতা মৌলভি নবি মোহাম্মদ লুগারের নেতৃত্বাধীন এ দলটি আফগানিস্তানে রুশ বিরোধী শক্তিশালী প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর অন্যতম। নবি মোহামাদের জন্ম ১৯২৪ সালে। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত নবি মোহাম্মদ একজন শিক্ষিত রক্ষণশীল আলেম। কিছুটা রক্ষণশীল ও প্রাচীনপন্থি হলেও তিনি গণতান্ত্রিক ও বহুদলীয় পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। এ দলটি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামভিত্তিক এ সংগঠনের প্রভাব আলেম, উপজাতীয় নেতা, পীর, সুফি ও ভূস্বামীদের মাঝে বেশি। রুশ আগ্রাসনের পূর্বেও এ দলটি আফগান রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। নবি মোহাম্মদ লাগোর মসজিদের ইমাম ছিলেন। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই মাওলানা ১৯৬৭ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশের পর নিজের ভক্ত ও অনুসারীদের নিয়ে রুশ বিরোধী লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হিসাবে অবস্থানের কারণে এ দলে যোদ্ধার চেয়ে বোদ্ধার সমর্থন ও অন্তর্ভুক্তি বেশি। প্রথমদিকে এ দলটির সফলতা ছিল ঈর্ষণীয়, তবে পরবর্তীকালে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে এ দলের প্রভাব হ্রাস পায়। তালেবান আন্দোলনের স্থপতি মোল্লা ওমর ১৯৮০ সালে এ দলে যোগ দিয়ে এর উপ-সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন।

১৯৮১ সালে বিভিন্ন মুজাহিদ সংগঠন বিভিন্ন উপজাতীয় আঞ্চলিক ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে Islamic Alliance for the liberation of Afghanistan নামক একটি ঐক্যফ্রেন্ট গঠন করে। এ ফ্রন্টের ৫০ সদস্যের মজলিশ উশ শুরা আব্দুর রসূল সাইয়াফকে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মনোনীত করে। আফগান-পাক সীমান্তে ঐক্যফ্রন্টের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। বিশ্ব জনমত গঠন, সাংবাদিকদের আফগানিস্তান সফরের ব্যবস্থা করা, মুজাহিদ রিক্রুট, তহবিল সংগ্রহ ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি ফ্রন্টের কার্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত ছিল। জেহাদের শেষ বছরগুলোতে তার দল হিকমতিয়ারের দলের সাথে একীভূত হয়ে যায়। সাইয়াফ তার সংগঠনের জন্য সৌদি আরব, ইরাক ও অন্যান্য মুসলিম দেশের গোড়া ইসলামি দলগুলো থেকে প্রচুর অর্থ লাভ করেন। এর ফলে আফগান জিহাদের মূলধারা সূচিত হয়। জেহাদে তার কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ সৌদি বাদশাহ তাকে ‘বাদশাহ ফয়সাল’ পুরস্কারে ভূষিত করেন।

সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার দলগুলোর উন্মেষ ও বিকাশ

১৯৪৭ কতিপয় আফগান তরুণ বিপ্লবী সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের ভাবধারার উদ্বুদ্ধ হয়ে উইগ এ জালমায়া (জাগ্রত তরুণ দল) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৪৯ সালের নির্বাচনে ১২০ সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্টে ৫০টি আসনে বামপন্থিরা নির্বাচিত হয়। ফলে রক্ষণশীলরা এর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়। (সৈয়দ মনোয়ার ও অন্যান্য, আন্তর্জাতিক সমস্যা ও বিশ্বরাজনীতি, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃ. ১৩)। ১৯৫৩ সালে জেনারেল দাউদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আফগানিস্তানের দরজা রাশিয়ার জন্য খুলে দেন। কয়েক হাজার সৈন্যকে প্রশিক্ষণের জন্য রাশিয়ায় প্রেরণ করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পর্যাপ্ত শিক্ষক আফগানিস্তানে আনা হয়। নিজের দুর্বলতার কারণে জহির শাহ এসবের প্রতিবাদ করে ব্যর্থ হন। ১৯৫২ সালের নির্বাচনের পূর্বে দুপক্ষের নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে দমননীতি চালানো হয়। জহিরশাহ আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনীর আধুনিককায়নে প্রয়াস নেন। এর ফলে আফগানিস্তানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কম্যুনিস্ট চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে যা জহির শাহের শাসনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। অন্যদিকে আল আযহার হতে শিক্ষাপ্রাপ্ত ও কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়া আনুষদের অধ্যাপক ও ইসলামি আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী মাওলানা গোলাম মোহাম্মদ নিয়াযি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এবং কম্যুনিস্ট আগ্রাসনের পরিণতি সম্পর্কে যুব সমাজকে সচেতন করে তোলার পদক্ষেপ দেন। নতুন প্রজন্মকে ইসলামি বিপ্লবের শপথে উজ্জীবিত করে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ প্রতিহত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

১৯৬৪ সালের সংবিধান অনুযায়ী ১৯৬৫ ও ১৯৬৯ সালে আফগানিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ সংবিধানে রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার স্বীকৃত হলেও কার্যত তা স্থগিত রাখা হয়। তবে জহির শাহ ১৯৬৫ সালে এক নতুন তথ্য আইন জারি করে। প্রকাশনার ক্ষেত্রে নীতি গ্রহণ করেন। এ সময়টিতে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে তাতে পরস্পর বিরোধী দুটি পক্ষ আবির্ভূত হয়। একটি সমাজতান্ত্রিক পক্ষ অন্যটি সমাজতন্ত্রের বিরোধী ধর্মীয় দলসমূহ। প্রথমদিকে সমাজতান্ত্রিকদের জনসমর্থন কম থাকলেও অচিরেই আফগান বুদ্ধিজীবি ও রাজনীতিবিদদের প্রচেষ্টায় অতি দ্রুতহারে সমাজতান্ত্রিক দলে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের বিপক্ষে ছিলেন গণতান্ত্রিক, উদারপন্থী, সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামী ও উদায়মান বুর্জোয়া গোষ্ঠী ও ধর্মীয় দলের অনুসারীরা। আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার, কম্যুনিস্ট রাশিয়ার প্রভাব ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে নানাবিধ মিথস্ক্রিয়ায় সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে আফগানিস্তানে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়। ফলে জহির শাহের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনরোষ তথা জনজাগরণ সৃষ্টি হয়। ফলে জহির শাহ তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তবে এ নিষেধাজ্ঞায় যুগপৎ সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যক্রমে অর্থাৎ দল গঠনের অনুমোদন ও প্রত্যাহারের মধ্যবর্তী সময়ে ১৯৬৪ সালে People Democratic party of Afganistan বা সংক্ষেপে PDPA এর আত্মপ্রকাশ ঘটে, যা পরবর্তীকালে আফগান রাজনীতির জন্য এক বিভীষিকারূপে দেখা দেয়।

এ পার্টির প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন নূর মোহাম্মদ তারাকি এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম ছিলেন বারবাক কারমাল। পরবর্তীকালে নেতৃত্বের কোন্দল, আদর্শগত দ্বন্দ্ব ও চ্যূতি, মস্কো ও পিকিং দ্বন্দ্ব, সুবিধাবাদ ও অস্তিত্ববাদে তাড়িত হয়ে PDPA দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার স্থগিত করলেও জহির শাহের নতুন প্রেস আইনে প্রকাশনা ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে উদার নীতিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ সময় আফগান কম্যুনিস্টদের একাংশ খালক (জনতা) নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করে, এর প্রকাশক ছিলেন নূর মোহাম্মদ তারাকি। এ পত্রিকা ভূমি সংস্কার ও সম্পদের সরকারি মালিকানার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বিপ্লবাত্মক প্রচারণায় লিপ্ত হয়। ফলে জহির শাহ মসনদ রক্ষা ও রক্ষণশীল সামন্তদের চাপে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। তথাপিও পরবর্তীকালে এ পত্রিকাকে ঘিরে উল্লেখযোগ্য সমাজতন্ত্রীরা ঐক্যবদ্ধ হয়। এরা চীনঘেঁষা সমাজতান্ত্রিক হলেও অনেকটা জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় প্রভাবিত ছিলেন। এভাবে খালক পত্রিকার নাম থেকেই পরবর্তীকালে কম্যুনিস্টবাদী খালক পার্টির উদ্ভব ঘটে। খালক পত্রিকা তথা পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ইন্সপেক্টর আলী আকবর খাইবাবের নেতৃত্বে পরচম (পতাকা) পার্টি গঠিত হয়। এ পার্টির টার্গেট ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও সেনাবাহিনী। এ পার্টি আদর্শগতভাবে অধিকতর কম্যুনিস্ট ও রূশঘেঁষা। পরচম এর পরিণতি খালক এর অনুরূপ ছিল। অর্থাৎ জহির শাহ খালক এর অনুরূপ পরচম পত্রিকা তথা দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বারবাক কারমাল ছিলেন পরচম দলের সভাপতি। এ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মির আকবর খাইবার দলীয় কোন্দলে মতান্তরে রক্ষণশীলদের আক্রমণে সত্তর বিপ্লবের দশ দিন পূর্বে নিহত হন। ১৯৬৯ সালে চরচমপন্থী কম্যুনিস্টদের মধ্যে আরেক দফা ভাঙ্গন দেখা দেয়। তারা গুলা এ জাভেদ (অনির্বাণ শিখা) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। পরবর্তীকালে পরচম হতে আরেকটি অংশ বের হয়ে সিতাম ই মিল্লি (জাতীয় নিপড়নের বিরুদ্ধে) নামে পৃথক দল গঠন করে। পরবর্তীকাল দল দুটো চীনপন্থি অবস্থান গ্রহণ করে।

১৯৬৪ সাল লয়াজিরগা প্রণীত সংবিধান মোতাবেক ১৯৬৫ ও ১৯৬৯ এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ১৯৭৩ এর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন হতে পারেনি। কেননা এর পূর্বেই কম্যুনিস্ট ভাবাপন্ন এবং খালক ও পরচম প্রভাবিত সর্দার দাউদ এক রক্তপাতহীন বিপ্লবের মাধ্যমে জহির শাহকে উচ্ছেদ করে একাধারে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর ফলে আফগান রাজতন্ত্রের পতন ঘটে ও জেনারেল দাউদ সোভিয়েত রাশিয়ার মন যুগিয়ে ও কম্যুনিস্ট এজেন্টদের দুই বিবাদমান গ্রুপকে (খালক ও পরচম) তুই রেখে যেভাবে চলেছেন তাকে Political Rope Dancing বলা যেতে পারে। ক্ষমতারোহণের গোড়ার দিকেই পরচম গ্রুপ সর্দার দাউদকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়। দাউদ তাতে মুগ্ধ হয়ে রাতারাতি ১৬০ জন পরচম কম্যুনিস্টকে প্রাদেশিক প্রশাসক পদসহ বড় বড় পদে নিযুক্ত করেন এবং নিজে আফগানিস্তানের সার্বিক ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণে অগ্রসর হন। ১৯৬৪ সালের সংবিধানকে তিনি ভূয়া বলে বাতিল করে দেন। ১৯৭৭ সালের নয়া সংবিধানে তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। উপরন্তু তিনি মিল্লি জিরগা বা জাতীয় পরিষদের নির্বাচন স্থগিত করে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে দেন। দাউদের এসব কার্যকলাপ তাকে তার কম্যুনিস্ট মিত্রদের নিকট থেকে অনেকটা দূরে ঠেলে দেয়।

দাউদ জানতেন যে, কম্যুনিস্টরা সুচ হয়ে ঢুকে আর ফাল হয়ে বের হয়। ঐসব বড় বড় পদ পেয়ে পরচমরা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হয়ে ওঠলে তখন তাদের কেটে ছেটে প্রমাণ সাইজ (Standard Form) করা ছাড়া দাউদের অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। ফলে মধ্য পচাত্তরেই তিনি পরচমদের ক্ষমতা ও প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস করেন। এর ফলে তখন থেকেই শুরু হয় তার ভাগ্য বিপর্যয়ের পালা। এ কম্যুনিস্ট চক্রের মোকাবেলা ও আত্মরক্ষার জন্য তিনি সৈয়দ আবদুল্লাহ, জেনারেল গোলাম হায়দার রসুল, আব্দুল কাদির নুরিস্তানি ও (স্বীয় সহোদর) মোহাম্মদ নাঈম প্রমুখ বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়ে একটি অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয় গঠন করেন। তিনি রিভিলিউশন্যারি পার্টির হিজব ই ইনকিলাবি মিল্লি ও একটি কেন্দ্রীয় কমিটি অর্থাৎ শুরা ই মাকরিযি গঠন করেন। এর ফলে বিরুদ্ধবাদীরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রীসভার ছয় জন সদস্য পদত্যাগ করেন। পরে তারা অবশ্য দাউদের অনুরোধে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন যদিও সেটা ছিল লোক দেখানো। (খোন্দকার আব্দুল হামিদ, আফগানিস্তান সোভিয়েতের ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা, সম্পাদনাঃ আল মাহমুদ ও আফজাল চৌধুরী, সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮৩)। সরকারের কাঁধে সওয়ার হওয়া কম্যুনিস্টদের কার্যকলাপে আফগানিস্তানের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে একযোগে সমাজতন্ত্র ও দাউদের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। ক্ষমতাসীনদের দমন ও পীড়নে দেশে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। সরকার ইসলামি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে হত্যা ও কারারুদ্ধ করে।

যুগপৎ কম্যুনিস্ট ও মুজাহিদদের কার্যকলাপে দাউদ অতীষ্ট হয়ে ওঠেন। এটা তার জন্য ছিল অনেকটা জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘের মতো দূরবস্থার ন্যায়। অন্যদিকে রাশিয়ার সহযোগিতায় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করলেও পরে তিনি সে বিশ্বস্ত তা ও কৃতজ্ঞতা রক্ষা করতে পারেননি। ১৯৭৩-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দাউদ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সাথে সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন করেন। তিনি ইরান ও আমেরিকার সহায়তায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পাওনাদি পরিশোধ করেন। খালককে গণ্য করা হতো ‘প্রোপিকিং’ আর পরচমকে ‘প্রোমস্কো’ পন্থিবলে। এদের ‘সাপে নেউলে’ সম্পর্ক সম্বন্ধে রাজনৈতিক, কূটনীতিক ও আফগানগণ সকলেই অবগত ছিল। কিন্তু কথায় বলে “In Politicis strange bed fellowes Sleep together.” (আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা, আল মাহমুদ ও আফজাল চৌধুরী, সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃ ৩৫)। এর ফলে আমরা চোখ রাশিয়ার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিতে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে প্রতিদ্বন্দ্বি ও বিরুদ্বাভাবাপন্ন দল দুটো (খালক ও পরচম) পুনরায় PDPA এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়। চারদিকে থেকে আক্রান্ত ও বিপদাপন্ন দাউদ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আর্থিক ও সামরিক সহায়তার আশায় ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা প্রত্যাশা করেন। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে তার বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে আফগান সেনাবাহিনীতে কম্যুনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা দখলের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭৩ সালে জহির শাহের ক্ষমতাচ্যুতির ফলে যে পটপরিবর্তন সাধিত হয় তাতে রুশ সম্প্রসারবাদের গোপন তৎপরতা প্রবলভাবে কার্যকর ছিল। রাজতন্ত্রের কারণে আফগান শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় আদর্শের ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন ছিলেন। এর ফলে রুশপন্থিরা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখলে নিতে থাকে। আফগানিস্তানের পাকিস্তান বিদ্বেষের কারণে সামরিক কর্মকর্তাদের দলে দলে রাশিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। এসব কর্মকর্তাগণ ‘মগজ ধোলাই”-এর (Brain Wash) পর দেশে ফিরে এসে প্রকৃতপক্ষে ‘রাশিয়ার চর’ হিসাবে কাজ করে। যা পরবর্তীকালে আফগানিস্তানের জন্য ‘খাল কেটে কুমির আনার’ মতোই প্রতিভাত হয়। এহেন পটভূমিতেই ১৯৭৩ সালে এক রক্তপাতহীন বিপ্লব তথা বিদ্রোহের মাধ্যমে জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। (মগজ ধোলাই বা Brain Wash হল কোনো ব্যক্তির আদর্শগত বিশ্বাস বা মতবাদকে পরিবর্তন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া। শারীরিক ও মানসিক চাপ, ভালো ব্যবহার, মনস্তাত্ত্বিক ওরিয়েন্টেশন, অর্থনৈতিক ও ভোগবিলাসের সুবিধাদান, বিশেষ মর্যাদা প্রদান, প্রশিক্ষণ, প্রোগাগান্ডা ইত্যাদিই হল মগজ ধোলাইয়ের প্রধান নিয়ামক। পাশ্চাত্য বিশ্বের অভিযোগ ছিল এই যে, কম্যুনিস্ট দেশসমূহে অকম্যুনিস্ট বন্দিদের ও সাধারণ মানুষের ওপর মগজ ধোলাইয়ের প্রক্রিয়া চালানো হয়, যাতে তারা রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। কোরিয়া যুদ্ধের সময় মার্কিন সরকারের একটি কমিশন লক্ষ্য করে যে, কম্যুনিস্টদের হাতে বন্দি মার্কিন সেনাদের অনেকেরই চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটেছে। কেননা তারা কম্যুনিস্টদের যুক্তির বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী যুক্তি দিয়ে এঁটে উঠতে সক্ষম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধেও মগজ ধোলাইয়ের অভিযোগ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। অপরদিকে, পাশ্চাত্য দুনিয়া, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও মগজ ধোলাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দুনিয়া তাদের প্রাচুর্য দেখিয়ে, প্রচার চালিয়ে ওরিয়েন্টেশনের মাধ্যমে এবং সর্বোপরি বিবিধ প্রকার উৎকোচ দিয়ে অনুন্নত বিশ্বের রাজনীতিবিদ, সমাজবিদ অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের অহরহ মগজ ধোলাই করছে যাতে তারা পুঁজিবাদী দেশসমূহের ওপর অর্থনৈতিকভাবে চিরকাল নির্ভরশীল থাকে। এ ছাড়া, অনুন্নত বিশ্বের যে সমস্ত ছাত্র বা গবেষক পাশ্চাত্যে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায়, তাদেরও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মগজ ধোলাই করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। তদুপরি পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারকাজ চালিয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের নাগরিকদের মতবাদে পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা চালায় বলেও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব অভিযোগ করে।) যারা সত্যিকারভাবে এ অভ্যুত্থানের সংগঠক ছিল তারা কেউই ক্ষমতায় না বসে জহির শাহের নিকটাত্মীয় সর্দার দাউদ খানকে ক্ষমতায় বসায়। দাউদ খান প্রেসিডেন্ট হলেও সত্যিকারের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালিত হতো রুশঘেষা আফগান সমাজতন্ত্রী দল PDPA এর মাধ্যমে এবং আফগানিস্তানের সার্বিক নীতি নির্ধারণ হতে থাকে রাশিয়া থেকে।

দাউদের ক্রমবর্ধমান পাশ্চত্য ও মধ্যপ্রাচ্যমুখি নীতির জন্য রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয়। ফলে রাশিয়া আফগান সেনাবাহিনী ও সমাজতন্ত্রী দলগুলোর মাধ্যমে দাউদকে উৎখাতের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় বিবাদমান খালক ও পরচমরা নিজেদের বিবাদ বিসম্বাদ ভুলে কম্যুনিস্ট ভাবাপন্ন কিন্তু গণতন্ত্রমনা সর্দার দাউদকে অপসারণের জন্য পুনরায় PDPA -এর ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সওর বিপ্লবের মাধ্যমে দাউদকে উৎখাত করে। ১৯৭৮ সালের ৩০ এপ্রিলে বিপ্লবী পরিষদ ১নং ডিক্রিবলে ৩৫ সদস্যের বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে। এ যুক্তফ্রন্টের খালক অঙ্গদলের ৬১ বছর বয়স্ক সেক্রেটারি জেনারেল নূর মোহাম্মদ তারাকিকে “The great national and revolutionary leader of Afghanistan’ উপাধিতে ভূষিত করে বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে। তারাকি ১৯৭৮ সালের ২৮ মার্চ দাউদ বিরোধী অভ্যুত্থানের হোতা ও খালক গ্রুপের হাফিজুল্লাহ আমিনকে ভাইস চেয়ারম্যান ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিয়োগ করেন। পরদিন বিপ্লবী পরিষদ ২নং ডিক্রিবলে ২১ সদস্যের মন্ত্রীসভা গঠন করে। পরচম নেতা বারবাক কারমালকে মন্ত্রীসভার সদস্য ও উপপ্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।

এ মন্ত্রীসভায় ১১ জন খালক ও ১০ জন পরচম গ্রুপের ছিলেন। এ যেন এক অদ্ভূত রাজনৈতিক জগাখিচুড়ি। বিশেষ স্বার্থান্ধ লক্ষা ছাড়া মত ও পথের কোনো মিল ছিল না দল দুটির। আতাউর রহমান খান তাঁর ‘ওজারতির দুই বছর’ গ্রন্থে বলেন পাঁচমিশালী দল নিয়ে কীর্তন গাওয়া চলে, কিন্তু দেশ চালানো যায় না। খালক ও পরচমের অবস্থা তথা দশাটা পুরো তাই হলো। (খোন্দকার আব্দুল হামিদ (স্পষ্ট ভাষা) আফগানিস্তান সোভিয়েতের ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা, আল মাহমুদ ও আফজাল চৌধুরী, সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, পৃ. ৩৬)। সত্তর বিপ্লবের পরপরই তারাকির খালক পার্টি থেকে বারবাক কারমাল বেরিয়ে যান। তখন তার সঙ্গে গিয়েছিলেন মির আকবর খাইবার, মোহাম্মদ সোলেমান, আনাহিতো রাতেরজাদ প্রমুখ বামপন্থিরা। বারবাক কারমাল আগাগোড়াই কাবুলে সোভিয়েত দূতাবাস ও ক্রেমলিনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। খালক ও পরচমের মধ্যে যেখানে অনেকদিনের অহিনকুল সম্পর্ক সেক্ষেত্রে ১৯৭৭ সাল এ দুটি দলের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট গঠন সম্ভব হয় সাধারণ শত্রু (Common Enemy) সর্দার দাউদকে অপসারণের বৃহত্তর স্বার্থে। সপরিবারে দাউদকে নিধনের পর অবশ্য খালক ও পরচম এর পুনর্মিলন, পুনঃবিরোধ অবশেষে পুনঃভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে তাদের ঐক্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ক্ষমতালিপ্সু তারাকি, বারবাক কারমালসহ সকল পরচমদের মন্ত্রীসভা থেকে বহিষ্কার করেন।

নয়া সরকারের এহেন নীতিতে আফগান সমাজ ও রাজনীতিতে সংকটাবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সুযোগে তারাকির স্বদলীয় ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিন গোপনে গোপনে শক্তি অর্জন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর বিরোধী পরচমরাও তাকে সহযোগিতা করে। ফলে পূর্বাপেক্ষা রাতারাতি আফগান রাজনীতির অবস্থা পাল্টে যায়। আমিন তারাকির কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদটি কেড়ে নেন। তারাকি পাল্টা আমিনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। উপরন্তু আমিন ক্ষমতা সুসংহত করার প্রচেষ্টায় সশস্ত্র বাহিনীকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এর ফলে কার্যত তারাকি বিপ্লবী কাউন্সিলের নামমাত্র প্রধানে পরিণত হন। ১৯৭৯-এ হাভানায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে তারাকি মস্কো হয়ে হাভানায় যান। তখন এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতে ব্রেজনেভ প্রাগে নির্বাসিত বারবাক কারমালাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে তারাকিকে পরামর্শ দেন। কিন্তু তারাকি এতে আপত্তি জানিয়ে বলেন যে, কৌশলগত কারণে তাকে আপাতত ফেরত নেয়া সম্ভব নয়।

আফগানিস্তানে কম্যুনিস্ট মতবাদের অনুপ্রবেশ

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের বলশেভিক বিপ্লব আধুনিক যুগ তথা বিশ্ব সমাজ সভ্যতার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। (বলশেভিক বিপ্লব Bolshevik, রুশ শব্দ। বলশেভিনস্টভো বা সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে বলশেভিক শব্দের উৎপত্তি। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেসে বিপ্লবপন্থি এবং আপোসকামীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে। লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবপন্থিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বলশেভিক নামে পরিচিতি লাভ করে। অপরপক্ষ মেনশেভিকরা ‘মেনশিনস্টভো বা সংখ্যালঘু শব্দ থেকে উদ্ভুত হয়ে আলাদাভাবে সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এই বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বেই ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সংগঠিত হয়। এই পার্টি পরবর্তীকালে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (CPSU) নামে রূপান্তরিত হয়। Bolshevism, রাশিয়ার বলশেভিক দলের মতবাদ ও কর্মপন্থা। বনেদি কমিউনিস্টদের কাছে বলশেভিকবাদই হল খাঁটি সমাজতন্ত্র ও সঠিক বিপ্লবের লাইন।) এর ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উন্মেষ ঘটে। পরবর্তীকালে এ মতবাদের ধারক বাহকরা এ বিপ্লব বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তনকারী রাশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান আফগানিস্তানের অতি নিকটে। ফলে সঙ্গত কারণেই আফগানিস্তানের উপর তাদের নজর পড়ে। এছাড়া আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট যেমন— রাজতন্ত্রের নিষ্পেষণ, আর্থিক দৈন্যতা, উদীয়মান শ্রেণির সমাজতন্ত্রের প্রতি অনুরাগ, প্রতিবেশি মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অসহযোগিতা, স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব ও আফগান শাসকদের দ্বৈত ও স্বৈরাচারী নীতির প্রভাবে আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, ভৌগোলিক অবস্থান ও অধিবাসীদের মানসিক বৈশিষ্ট্য ও আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা অনুপ্রবেশের জন্যও দায়ী ছিল। কেননা ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ ভূখণ্ডটি অন্যান্য সন্নিহিত এলাকার চিরায়ত প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর অধিবাসীরা রক্ষণশীল ও জেদি হলেও যুগের হাওয়াকে স্বীকার করে নেয়ার মতো মনোভাব সর্বদাই তাদের মাঝে ছিল। এর ফলে বহিরাগত শক্তি, ধর্মীয় ও অন্যান্য চিন্তাধারাকে তারা বরাবরই স্বাগত জানিয়েছে এবং সে সকল শক্তি ও চিন্তাধারা সর্বদা আফগানিস্তানে আত্তীকৃত হয়েছে।

তবে এটা অনেকটা সুস্পষ্ট যে আফগানিস্তানে কম্যুনিজমের অনুপ্রবেশ যতটা না হয়েছে নিজের স্বার্থে তার চেয়ে বেশি হয়েছে রাশিয়ার পরিকল্পনায়। কেননা আফগান সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণিবিভেদ বা শ্রেণি বিদ্বেষ একটি অর্বাচীন ধারণা। যে যৎসামান্য শিল্পকারখানা রয়েছে তাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামীণ এলাকার লোকজনই কাজ করে থাকে এবং তাদের সবারই কিছু না কিছু জমি আছে। তবে আফগানিস্তানে তেমন বিশাল ভূস্বামী নেই। অন্যদিকে আফগানিস্তান হল রক্ষণশীল মুসলমানদের দেশ সেখানে ইসলামি শরিয়া মোতাবেক জীবনযাত্রা পরিচালিত হয়। সুতারাং সোভিয়েত প্রচারণা আফগানিস্তানের সাধারণ লোকের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। (এ. কে. এম মহিউদ্দিন, আফগান রণাঙ্গনে, কাদেরিয়া পাবলিকেশন্স এন্ড প্রোডাক্টরস লিঃ, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ. ৩৬)। ইসলামের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আনুগত্যের জন্য আফগান সমাজে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ বিশেষ স্থান লাভ করতে পারেনি। পরম্ভ সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম বিদ্বেষী নীতির ফলে রাশিয়ার মুসলিম প্রজাতন্ত্রসমূহ থেকে দলে দলে মুসলমানরা জীবন ও ধর্ম রক্ষার্থে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। এর ফলে আফগান সমাজের এক ক্ষুদ্রাংশের সমাজতন্ত্রের প্রতি যে দুর্বলতা গড়ে ওঠেছিল তাতেও অনেকটা ভাটা পড়ে। কিন্তু কম্যুনিস্টদের অনুপ্রবেশের পথটি খোলা হয়ে যায় সর্দার দাউদের ক্ষমতালিপ্সা ও তার দোসর কম্যুনিস্টভাবাপন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর যোগসাজশে। এছাড়াও পাশ্চত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী, তরুণ সমাজ, সামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বিকশিত হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আফগানিস্তানের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ রাশিয়ার কম্যুনিস্ট মতবাদ ও তাদের আফগান দোসরদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বিরক্ত হয়ে পিকিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ রুশ বিপ্লবের পর রুশ নেতৃবৃন্দ বিশ্বব্যাপী কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। এবং তা বাস্তবায়নের জন্য বুলগেরিয়া চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লোভিয়া ভিয়েতনাম, কিউবা, রুমানিয়া ইত্যাদি দেশে আগ্রাসন চালায়। একই প্রক্রিয়ায় আফগানিস্তানেও তারা প্রত্যক্ষ পরোক্ষ আগ্রাসন চালায়। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অবস্থিতির কারণে রাশিয়া বহু পূর্ব থেকেই আফগানিস্তানের আধিপত্য বিস্তারে উদ্যোগ নেয় যাতে সারা বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মধ্য এশিয়ায় ইসলামের পুনর্জাগরণ রোধ করাও রাশিয়ার বিশেষ পরিকল্পনা ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকা যেমন তুর্কোমেনিস্তান, কাজাকিস্তান, আজারবাইজান প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলমানগণ কম্যুনিস্ট শাসনে ভীত ও নির্যাতিত হয়ে ধর্ম ও আত্মরক্ষার জন্য আফগানিস্তানে আসে। এ জনস্থানান্তর (Migration) রোধকল্পেও আফগানিস্তানে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি ছিল। ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ব্রাদারহুডের আন্দোলনের প্রভাবে যাতে মধ্য এশিয়ার মুসলিম জাগরণ ঘটাতে না পারে সেজন্যও রাশিয়ার নিকট আফগানিস্তান যে কোনো অন্য ভূখন্ডের তুলনায় অধিক মূল্যবান ছিল। আফগানিস্তানে কম্যুনিস্ট ভাবধারার অনুপ্রবেশে জহির শাহও কম দায়ী ছিলেন না। সজ্জন ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তার সুদীর্ঘ চার দশকের শাসনামলে তিনি ক্রীড়নক হিসেবেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় তার নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সংবিধান প্রদান ও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের কথা বললেও জনদ্রোহের ভয়ে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের অনুমোদন দেননি। ফলে সঙ্গত কারণেই আফগান জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ফলে তারা মুক্তির মোহে কম্যুনিস্ট মতবাদে প্রভাবিত হয়।

রুশ বিপ্লবের প্রভাবে আফগানিস্তানে উইখ ই খালমায়া, নিদায়ে খালাক, ওয়াতন ইত্যাদি গ্রুপ গড়ে ওঠে। এরা মেধা-মননে কম্যুনিস্ট না হলেও, দলগুলো ছিল রুশঘেষা সংস্কারপন্থী। তবে আফগান আমিরদের কঠোর নজরদারির জন্য এরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তবে আফগানিস্তানে কম্যুনিজমের বীজবপনে এদের ভূমিকা রয়েছে। জহির শাহ প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক দলকে কাজ করতে না দেয়ায় গণতন্ত্র কাম্য লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। রাজনীতি ও চিন্তার ক্ষেত্রে এহেন বন্ধাত্যতা কম্যুনিজম প্রবেশের উপযোগি ছিল। রাজনৈতিক দল ও মতবাদ গঠনের অধিকার হরণের লক্ষ্যে জহির শাহ ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে নতুন তথ্য আইন জারি করেন। যা স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বাধারোপ করে। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের পহেলা জানুয়ারিতে Peoples Democratic Party of Afghanistan বা PDPA নামে সরকার অননুমোদিত একটি দল গঠিত হয়। দলটি ছিল সোভিয়েতঘেষা ও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার। এর নেতৃত্বে ছিলেন নূর হোমাম্মদ তারাকি, হাফিজুল্লাহ আমিন ও বারবাক কারমাল। PDPA-এর মুখপাত্র ছিল ‘খালক’ নামক একটি পত্রিকা। যার সম্পাদক ছিলেন মির আকবর খাইবার। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল হতে ১৬ মে পর্যন্ত এ পত্রিকাটি মোট ৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ভূমি সংস্কার ও সম্পদের সরকারি মালিকানা দাবি তোলা ছাড়া পত্রিকাটি তেমন বিপ্লবাত্মক কোনো প্রচারণা চালায়নি তা সত্ত্বেও রক্ষণশীলদের চাপে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করা হয়।

আদর্শগত ও নেতৃত্বের কোন্দলে PDPA ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি অংশ পার্টির পত্রিকা ‘খালক’ (জনতা) এর নামে আত্মপ্রকাশ করে এর নেতৃত্বে ছিলেন নূর মোহাম্মদ তারাকি ও হাফিজুল্লাহ আমিন। বারবাক কারমালের নেতৃত্বে একটি অংশ ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে পরচম (পতাকা) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। এ উপদলটিও পত্রিকার নামে অর্থাৎ পরচম নামেই আত্মপ্রকাশ করে। অর্থাৎ পত্রিকা দুটির নামানুসারেই PDPA-এর উপদল দুটি আত্মপ্রকাশ করে। দুটি দলই সমাজতান্ত্রিক হলেও এদের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য ছিল। খালক ছিল পুরোপুরি সোভিয়েতঘেষা ও আন্তর্জাতিকতাবাদী অন্যদিকে পরচমও সোভিয়েতঘেঁষা হলেও এর কতিপয় সদস্য পিকিংপন্থিও ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক এ দলটি জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উজ্জীবিত ছিল। PDPA থেকে বেরিয়ে একটি গ্রুপ শুলা এ জাভেদ (অনির্বাণ শিখা) আরেকটি সিতাম ই মিল্লি (জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে) নামে দুটি পৃথক দল হিসেবে আফগান রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। শেষোক্ত দল দুটি চীনপন্থি অবস্থান গ্রহণ করে। পরস্পর বিরোধী সমাজতান্ত্রিক এ দলগুলোর সম্পর্ক ছিল অনেকটা সাপে-নেউলের সম্পর্কের ন্যায়।

জহির শাহ কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে পদচ্যুত হয়ে সর্দার দাউদ শাহের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এ সময়ে সকল সমাজতান্ত্রিক গ্রুপগুলো রাশিয়ার অদৃশ্য কলকাঠির ইশারায় দাউদ খানকে সহযোগিতা করে। দাউদের প্রাথমিক মন্ত্রীসভা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে গঠন করা হয়েছিল যাতে খালক ও পরচম পন্থিদের ভারসাম্য থাকে। ফলে নূর মোহাম্মদ তারাকি প্রধানমন্ত্রী, বারবাক কারমাল সিনিয়র উপ-প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। দাউদের ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে পরচম অধিকতর সহযোগিতা করে। এ দলের নেতা বারবাক কারমাল ছিলেন দাউদ খানের একজন বিশ্বস্ত সামরিক কর্মকর্তা। ফলে পূর্ব থেকেই পারিবারিক ও রাজনৈতিক সূত্রে তাদের মধ্যে যথেষ্ট বোঝাপড়া ছিল। ফলে সর্দার দাউদ রাতারাতি ১৬০ জন পরচম কম্যুনিস্ট কর্মীকে প্রাদেশিক প্রশাসক পদ সহ বড় বড় পদে নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে তিনি পরচমদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার নীতি গ্রহণ করেন। যদিও দাউদের ক্ষমতা দখলের পর তার সমর্থনে পরচমরা এগিয়ে আসে, তাদের যুক্তি ছিল দাউদের শাসন রাজতন্ত্রের চেয়ে অন্তত গুণগতমানে কয়েক ধাপ আগানো। দাউদ তার ক্ষমতার প্রথমদিকে ভূমি সংস্কার ও শিল্প জাতীয়করণের উদ্যোগ নিলেও অচিরেই তা থেকে সটকে পড়ে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। দাউদের এসব কার্যক্রমে পরচমরা তার থেকে দূরে সরে যায়।

এটা সুস্পষ্ট যে তারাকির ‘খালক’ পার্টি প্রাক অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ‘পরচম’-এর ন্যায় দাউদকে সহায়তা করেনি। তবে তারা দাউদের বিরোধিতাতেও লিপ্ত হয়নি। কেননা তারা দাউদের শ্রেণি চরিত্র সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্ধিহান ছিল। তবে দাউদ কর্তৃক পরচমদের অপসারণের প্রেক্ষিত সৃষ্ট শূন্যতায় খালকরা পুরোপুরি ক্ষমতা অধিকারে তৎপর হয়। প্রথমদিকে দাউদ খালকদের ক্ষমতা প্রদানে বিরোধী ছিলেন। তিনি নিজের স্বজন ও যোগ্য লোকদের পরচমদের শূন্য পদগুলো প্রদান করেন। কিন্তু রাশিয়ার চাপ অগ্রাহ্য করতে না পেরে তিনি কৈ-এর তেলে কৈ ভাজা’র উদ্যোগ নেন। (আল মাহমুদ ও আফজাল চৌধুরী, সম্পাদিত, আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা)। অর্থাৎ খালকদের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও দায়িত্ব প্রদান করেন। খালক এর প্রভাবে কারমালকে চেকোশ্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। অন্যদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এহেন রদ-বদলের ফলে সর্বাপেক্ষা লাভবান হন হাফিজুল্লাহ আমিন। তিনি তারাকির পরই ক্ষমতার দ্বিতীয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। সর্দার দাউদ খালকের প্ররোচণায় তার বিরোধী পক্ষের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাইওয়ান্দওয়ালকে এতো বেশি নির্যাতন করা হয় যে, তিনি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।

সর্দার দাউদ মূলত ছিলেন একাধারে সমাজতান্ত্রিক, সংস্কারবাদী ও জাতীয়তাবাদী নেতা। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য ছিল যে, তার পূর্বেকার শাসকদের সময় থেকেই আফগানিস্তান রাশিয়ার কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। দাউদ রাশিয়ার মন যুগিয়ে ও আফগান কম্যুনিস্টদের দুই বিবাদমান গ্রুপকে (খালক, পরচম) তুই রেখে যেভাবে চলতে থাকেন তাকে Political Dancing বলা যেতে পারে। ইচ্ছে করলেই দাউদের পক্ষে রাশিয়ার জিঞ্জির ভাঙ্গা সম্ভব ছিল না। উপরন্তু তিনি রুশপন্থিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েন। KGB এর এজেন্টরা তাকে দিয়ে রাশিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করে। এ সময়ে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার সাধ্য তার ছিল না। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে দাউদ লয়াজিরগায় অধিবেশন আহ্বান করেন। এখানেও কম্যুনিস্টরা প্রভাব খাটিয়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয়ে দাউদকে বাধ্য করেন। এ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উপজাতিদের মধ্যে বিলিয়ে তিনি পাকতুনিস্তান সমস্যাকে তীব্রতর করেন। তথাপিও ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকেই রুশ আধিপত্য থেকে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে প্রতিবেশি দেশ ইরান, চীন, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তখন থেকেই শুরু হয় তার ভাগ্য বিপর্যয়ের পালা।

প্রসঙ্গক্রমে PDPA-এর উপদল দুটো সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত প্রয়োজন। জনপ্রিয়তার দিক থেকে উভয় ছিল সমানে সমান। তবে পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও মন্ত্রীসভায় প্রাধান্যের কারণে, কাবুলে সুধী ও ছাত্র সমাজে পরচমের তুলনামূলক বেশি জনপ্রিয়তা ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপদল দুটির মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। তবে পরচমের সাথে সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টি ও আফগান রাজতন্ত্রের সম্পর্ক এতো ঘনিষ্ঠ ছিল যে শিক্ষিত আফগানরা একে ‘Royal Communist Party’ বলে অভিহিত করতো। অন্যদিকে চীনের সাথেও এদের সুসম্পর্ক ছিল। সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনে পরচমের প্রভাব এত বেশি ছিল যে, দাউদ এদের ভয় করতেন। খালক তুলনামূলকভাবে বেশি স্বাতন্ত্র ও স্বাধীন ছিল। তৃণমূল পর্যায়ে এদের সমর্থন ছিল বেশি। এদের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক থাকলেও পরচমের ন্যায় তীব্র ছিল না। অপর দিকে পরচম নেতৃবর্গ খালককে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট বলে অভিহিত করে। এ দলের নেতা নূর মোহাম্মদ তারাকি ও হাফিজ উল্লাহ আমিনকে তারা CIA এর চর বলে অভিহিত করে।

দাউদ তার ক্ষমতার শেষ অধ্যায়ে PDPA-এর দুটি উপদলের প্রতিই ক্ষুব্ধ হন এবং তাদেরকে নানাভাবে নাজেহাল করেন। অন্যদিকে দল দুটিও আন্তঃকোন্দলে লিপ্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ করতে থাকে। তবে রাজনৈতিক আদর্শের অভিন্নতার কারণে ও রাশিয়ার মধ্যস্থতায় নিজেদের দ্বন্দ্ব সংঘাত ভুলে গিয়ে ১৯৭৭ এর জুলাইয়ে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রতি দল থেকে ১৫ জন সদস্য নিয়ে ৩০ দস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। নূর মোহাম্মদ তারাকি সভাপতি এবং বারবাক কারমাল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরচম উপদলের প্রভাব প্রতিপত্তি তুলনামূলক বেশি হলেও আদর্শগত নেতৃত্বের জন্য খালকরা মূল নেতৃত্ব অর্জন করে। এভাবে উপদল দুটো মূল দল PDPA-এর ছত্রছায়ায় দাউদের বিরুদ্ধে লড়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খালক ও পরচম এর এ নয়া ঐক্য আফগানিস্তানের রাজনীতিকে অশান্ত করে তোলে। ১৯৭৭-৭৮ এ রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সহযোগিতায় PDPA প্রকাশ্যে দাউদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে উস্কে দিতে থাকে। এপ্রিল ১৭, ১৯৭৮ এ পরমচপন্থি নেতা মির আকবর খাইবারের রহস্যজনক মৃত্যুতে আফগান নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। দাউদ সেনাবাহিনী দ্বারা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এমতাবস্থায় দাউদ সরকার ডিক্রির পর ডিক্রি জারি করে। এর মধ্যে ছিল নারী পুরুষের সমতা, ভূমি ও শিল্পনীতি। রক্ষণশীল ও সমাজতান্ত্রিক উভয় গ্রুপই এগুলো প্রত্যাখ্যান করে। মির আকবর খাইবারের জানাযায় তারাকি ও কারমালের জ্বালাময়ী বক্তব্য ও কর্মসূচি আফগানিস্তানে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে তাদের গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করা হলে অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আফগান কম্যুনিস্ট ও রাশিয়ার প্রত্যক্ষ যোগসাজশে PDPA-এর ঐক্য প্রক্রিয়ায় ৯ মাসের মধ্যেই সওর বিপ্লবের মাধ্যমে দাউদকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করা হয়। ১৯৯২ এর ১৬ এপ্রিল নাজিবুল্লাহ পদত্যাগে বাধ্য হন। মুজাহিদ নেতা আহমদ শাহ মাসুদ ও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে।

তথ্যসূত্র

আফগানিস্তানের ইতিহাস, খোন্দকার বদিউল আলম, নিউএজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০১৮

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.