রাজনৈতিক একীকরণ এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন – মাইরন ওয়েনার

(পলিটিকাল সাইন্টিস্ট মাইরন ওয়েনার (Myron Weiner) ১৯৬৫ সালে The ANNALS of the American Academy of Political and Social Science নামক জার্নালে “Political Integration and Political Development” নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই “রাজনৈতিক একীকরণ এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন” প্রবন্ধটি সেটারই অনুবাদ। প্রবন্ধটির DOI: 10.1177/000271626535800107)

ভূমিকা

নতুন দেশ বা জাতিগুলোর একীকরণের সমস্যাগুলোকে (integration problems) রাজনৈতিক বিকাশের একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে দেখা উচিত যার মাধ্যমে পশ্চিমা রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলোও (Western political systems) বিকশিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিকাশের পরিবর্তনকালীন পর্যায়ে সরকারগুলো আরও কার্যাবলী গ্রহণ করতে শুরু করে বা গ্রহণ করার চেষ্টা করে। এই পর্যায়েই একীকরণের সমস্যাগুলো সবচেয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। সবচেয়ে সাধারণ একীকরণের সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিচয়, আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ, জনসাধারণের দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন ও রীতিনীতি (norm) প্রতিষ্ঠা, শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক, এবং সাধারণ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সকলকে সংগঠিত করার সমস্যা। এই প্রবন্ধে এই একীকরণ সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হবার জন্য সরকারের হাতে কী কী উপায় থাকে এই প্রবন্ধে তাই অন্বেষণ করা হবে। প্রায়শই বলা হয় যে উন্নয়নশীল দেশগুলো আসলে “অসংহত” (“unintegrated”), এবং তাদের কেন্দ্রীয় সমস্যা হলো “একীকরণ” (Integration) অর্জন, যা অনেক সময় অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেয়ে বেশি চাপের হয়। “ইন্টিগ্রেশন” শব্দটি এখন ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর একটি বিশাল পরিসরকে কভার করতে ব্যবহৃত হয়। এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য এই শব্দটির বিভিন্ন ব্যবহার বিশ্লেষণ করা, তারা কীভাবে সম্পর্কিত তা দেখানো, তারপর এই “ইন্টিগ্রেশন” সমস্যার প্রতিটিকে মোকাবেলা করার জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত কৌশলগুলো কী হতে পারে সেই বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া।

সংজ্ঞা

(১) একীকরণ দ্বারা সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলোকে একক টাররিটোরিয়াল ইউনিটে একত্র করাকে এবং একটি জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াগুলোকে বোঝাতে পারে। যখন এই অর্থে “একীকরণ” শব্দটি ব্যবহার করা হয় তখন সাধারণত একটি জাতিগতভাবে প্লুরাল সোসাইটি বা বহু জাতির সমাজের অস্তিত্ব অনুমান করা হয় যাতে প্রতিটি গোষ্ঠী তার নিজস্ব ভাষা বা অন্যান্য আত্মসচেতনতামূলক সাংস্কৃতিক গুণাবলী দ্বারা চিহ্নিত হয়, তবে এই সমস্যাটি এমন কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেও বিদ্যমান থাকতে পারে যা একসময় পৃথক স্বাধীন রাজনৈতিক এককসমূহ দ্বারা গঠিত ছিল, এবং মানুষেরা সেই সব রাজনৈতিক এককের পরিচয় দ্বারাই নিজেদের চিহ্নিত করত। তাই বিশেষভাবে এই অধস্তন সংকীর্ণ আনুগত্যকে (subordinate parochial loyalties) দূর করে  বা তাকে ছাপিয়ে গিয়ে মানুষের মধ্যে আঞ্চলগত জাতীয়তা তৈরি করার যে বাধা, বিশেষভাবে সেটাই হলো ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন বা জাতীয় একীকরণের সমস্যা। (এটাই বোধ হয় এই ইন্টিগ্রেশন বা একীকরণের সব থেকে সাধারণ ব্যবহার। “ন্যাশনালিটি” বা জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করার অনেক ভিন্ন ভিন্ন প্রচেষ্টা আছে, সেগুলোকে ভালভাবে জানতে Rupert Emerson এর গ্রন্থ “From Empire to Empire” (Boston: Beacon Press, 1960), বিশেষ করে এর দ্বিতীয় খণ্ড “The Anatomy of the Nation.” দেখুন। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ড স্টাফদের ন্যাশনালিজম নিয়ে বিভিন্ন স্টাডিকে একত্র করে K. H. Silvert “Expectant Peoples: Nationalism and Development” (New York: Random House, 1963) গ্রন্থটি লিখেছেন। সেখানে জাতীয়তাবাদের একটি ওয়ার্কিং ডেফিনিশন দেয়া হয়েছে, তা হলো “রাষ্ট্রকে মানব বিষয়াবলির নিরপেক্ষ ও চূড়ান্ত বিচারক বলে মেনে নেয়া” (“the acceptance of the state as the impersonal and ultimate arbiter of human affairs”) (p. 19)। Karl W. Deutsch এর লেখা Nationalism and Social Communication (New York: John Wiley and Sons, 1953) গ্রন্থটি, এবং Karl W. Deutsch ও William J. Foltz সম্পাদিত Nation-Building (New York: Atherton Press, 1963) গ্রন্থটিও দেখুন।

(২) প্রায়ই অধস্তন রাজনৈতিক একক বা অঞ্চলগুলোর উপর জাতীয় কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সমস্যাটি বোঝাতে ইন্টিগ্রেশন বা একীকরণ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে এই অধস্তন রাজনৈতিক একক বা অঞ্চলগুলোতে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীগুলো থাকতেও পারে, নাও পারে। যেখানে ন্যাশনাল এন্টিগ্রেশন বা “জাতীয় একীকরণ” বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী বা ঐতিহাসিকভাবে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক এককের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে জাতি বা রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তিগত অনুভূতি বা সাবজেক্টিভ ফিলিং এর সাথে সম্পর্কিত, সেখানে টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রেশন বা “আঞ্চলিক একীকরণ” দ্বারা বস্তুগত নিয়ন্ত্রণ বা অবজেক্টিভ কন্ট্রোলকে বোঝায় যা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ তার দাবিকৃত অধিকারভূক্ত অঞ্চলের ওপর প্রয়োগ করে। (আফ্রিকায় আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণের কিছু সমস্যার আলোচনার জন্য James S. Coleman এর গ্রন্থ “Problems of Political Integration in Emergent Africa,” Western Political Quarterly (March 1955) এর পৃষ্ঠা ৮৪৪-৮৫৭ দেখতে পারেন।)

(৩) “ইন্টিগ্রেশন” শব্দটি প্রায়শই শাসককে শাসিতদের সাথে সম্পর্কিত করার সমস্যাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই ব্যবহারে নিহিত এলিট (elite) এবং মাস (mass) এর মধ্যে একটি “ব্যবধান” এর খুব পরিচিত ধারণাকে ইঙ্গিত করে, যে ব্যবধানটি উভয় শ্রেণীর আকাঙ্ক্ষা এবং মূল্যবোধের লক্ষণীয় পার্থক্য দ্বারা চিহ্নিত (এলিট দ্বারা উচ্চতর বৌদ্ধিক, সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদার লোকজনকে বোঝায় আর মাস বলতে সাধারণ জনতাকে বোঝায় যাদের সেই মর্যাদাগুলো নেই। এখানে ইন্টিগ্রেশন শব্দটির এই ব্যবহারের ব্যাখ্যার জন্য Leonard Binder এর গ্রন্থ “National Integration and Political Development,” American Political Science Review (September 1964), pp. 622-631. দেখুন। James S. Coleman এবং Carl G. Rosberg সম্পাদিত Political Parties and National Integration in Africa (Berkeley: University of California, 1964) গ্রন্থেও এলিট-মাস ইন্টিগ্রেশন এর কথা এসেছে। তারা দুটি অর্থে ইন্টিগ্রেশন শব্দটি ব্যবহার করেছেন – “(১) পলিটিকাল ইন্টিগ্রেশন, যার দ্বারা একটি সমন্বিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং একটি অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক সম্প্রদায় বিকাশের সময় উল্লম্ব সমতলে (অর্থাৎ ওপর মহল ও নিচু তলার মধ্যে) এলিট-মাস ব্যবধানের মধ্যে প্রগতিশীল সেতুবন্ধনকে বোঝায়, এবং (২) টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রেশন বা আঞ্চলিক একীকরণ, যার দ্বারা একটি সমগোত্রীয় আঞ্চলিক রাজনৈতিক সম্প্রদায় (homogeneous territorial political community) প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় অনুভূমিক সমতলে সাংস্কৃতিক এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা ও বিচ্ছিন্নতার প্রগতিশীল হ্রাসকে বোঝায়” (পৃ. ৯)। এই দুটি সংজ্ঞা আমাদের প্রথম এবং তৃতীয় সংজ্ঞার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।) এই “ব্যবধান” বা গ্যাপ সবচেয়ে বেশি হয় যদি এর জনসংখ্যা নিষ্ক্রীয় বা পেসিভ থাকে, ও এলিটরা আধুনিকায়িত হতে থাকে। কিন্তু এদের মধ্যে একটি হতাশাপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও এই ব্যবস্থানটা স্থিতিশীল থাকতে পারে। অনেক সময় জনসাধারণ নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করে রাষ্ট্রে তাদের প্রভাব খাটাতে চান, আবার তখন এলিটরাও মাসের ওপর জোরজবরদস্তি, প্ররোচনা বা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এর প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই অবস্থায় এলিট ও মাসের সংঘাত অনেক সময় আভ্যন্তরীন যুদ্ধে পর্যবসিত হয়, যাকে আমরা “ডিসিন্ট্রিগেশন” বা বিভাজন বলি।

(৪) সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মূল্যবোধ ঐকমত্য (minimum value consensus) বোঝাতে কখনও কখনও একীকরণ বা ইন্টিগ্রেশন শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এই মূল্যবোধ ঐকমত্য বা ভেল্যু কনসেনসাস হতে পারে ন্যায়বিচার ও সমতা সম্পর্কিত, লক্ষ্য হিসেবে আর্থিক উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কিত, সাধারণ ইতিহাস, নায়ক ও প্রতীক সম্পর্কিত, সামগ্রিকভাবে মিনিমাম ভেল্যু কনসেনসাস হলো আমাদের কাছে আকাঙ্ক্ষিত কী আর অনাকাঙ্ক্ষিত সোশ্যাল এন্ড বা সামাজিক পরিণাম কী তা নিয়ে সমাজের সকলের মধ্যে একটি চুক্তি। আবার এই মূল্যবোধ বা ভেল্যু উপায় বা মিন (mean) এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ও লক্ষ্য পুরণের জন্য যে ইনস্ট্রুমেন্টালিটিস (উপকরণ) ও পদ্ধতির দরকার  হয় সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ভেল্যু বা মূল্যবোধ তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয়টি হলো আইনি রীতিনীতি, সাংবিধানিক কাঠামোর বৈধতা ও সেইসব কৌশল যেগুলো আকাঙ্ক্ষিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে পরিচালিত হয়।

(৫) পরিশেষে, আমরা “ইন্টিগ্রেটিভ বিহ্যাভিওর” বা “সংহত আচরণের” কথা বলতে পারি, এর দ্বারা বোঝানো হয় একটি সমাজের জনগণের  দ্বারা কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য সাধন করার ক্ষমতাকে (capacity)। সব সমাজরই সবচেয়ে প্রাথমিক স্তরে যে যে ক্যাপাসিটি থাকে তা হলো একরকম কিনশিপ অরগানাইজেশন বা আত্মীয়তার সংগঠন তৈরি করা, যার দ্বারা সমাজের নতুনদেরকে সামাজিকীকরণ করা যায়। এরপর সমাজে অন্যান্য চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার উদ্ভব ঘটলে আমরা দেখতে পারি, সমাজে নতুন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নতুন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান তৈরির মতো ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা। কোন কোন সমাজে এই সংগঠিত করার ক্ষমতা একটি ক্ষুদ্র এলিট শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং এটি কেবল তাদের সাথেই সম্পর্কিত যাদের হাতে কর্তৃত্ব বা অথোরিটি রয়েছে। (সংগঠিত ক্রিয়াকলাপকে বাধা দেয় এমন মনোভাব বিশ্লেষণের জন্য Edward Banfield এর The Moral Basis of a Backward Society (Glen coe, Ill.: Free Press, 1958) দেখুন। যদিও ব্যানফিল্ডের গবেষণা ইতালির একটি মাত্র গ্রামে সীমাবদ্ধ, তিনি সাধারণ উদ্দেশ্যে সংগঠিত করার জন্য একটি জনগোষ্ঠীর ক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি বিশ্লেষণের সাধারণ সমস্যাটি উত্থাপন করেছেন)। অতএব, কেবল মাত্র রাষ্ট্রেরই নতুন কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য সম্প্রসারিত হবার ক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি রয়েছে। অনেক সমাজে সাংগঠনিক ক্ষমতা (organizational capacities) সমস্ত জনসংখ্যা জুড়ে আরও সমানভাবে ছড়িয়ে থেকে, এবং জবরদস্তিমূলক কর্তৃত্ব ছাড়াই সেই জনসংখ্যার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যদের সাথে সংগঠিত হওয়ার প্রস্তুতি থাকে। তবে এই সংগঠন তৈরির ঝোঁক একেক সমাজে একেক রকম হয়, কোন কোন সমাজে সংগঠনগুলো প্রকাশ্য হয়, আবার কোন কোন সমাজে তা কিনশিপ বা জ্ঞাতিত্বেই আটকে থাকে, আবার সংগঠনের মর্যাদা ও উদ্দেশ্যও একেক সমাজে একেক রকম হতে পারে।

“একীকরণ” শব্দটি এভাবে মানুষের সম্পর্ক এবং মনোভাবের একটি বিশাল পরিসরকে আচ্ছাদিত করে – বৈচিত্র্যময় এবং বিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক আনুগত্যের একীকরণ এবং জাতীয়তার অনুভূতির বিকাশ; কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারে এমন একটি সরকারের সাথে রাজনৈতিক এককগুলোকে একটি সাধারণ আঞ্চলিক কাঠামোতে একীভূত করা; শাসক ও শাসিতদের একীকরণ; একটি সাধারণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকবৃন্দের একীকরণ; এবং, পরিশেষে, উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়াকলাপের জন্য ব্যক্তিদেরকে সংগঠনে একীভূত করা। এই সংজ্ঞাগুলো বৈচিত্র্যময় হলেও এগুলো একটি সাধারণ সূত্র দ্বারা ঐক্যবদ্ধ।

এগুলো সবই এমন একটি বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করার প্রচেষ্টা যা একটি সমাজ এবং একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একসাথে ধরে রাখে। উন্নয়নশীল এলাকার (developing areas) পণ্ডিতরা একীকরণের এই জাতীয় কিছু ধারণার জন্য হাতড়ান, কারণ তারা স্বীকার করেন যে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের লক্ষ্যগুলো সম্পাদনের জন্য যা প্রয়োজন আর তারা রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলো নিয়ে যা অধ্যয়ন করছেন, একীকরনের কেবল একটি-দুটি অর্থ নিয়ে তার মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করা যায়না। যদি প্রত্যেক পণ্ডিতের মনে “একীকরণ” সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা থাকে, তবে এটি প্রায়শই এই কারণে যে, একীকরণ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এমন পরিচিত কোন এক বা একাধিক নির্দিষ্ট সমাজ থেকে তিনি সেই ধারণাটি সাধারণীকরণ করছেন। যেহেতু অনেক উপায়েই সিস্টেমগুলি ভেঙ্গে পড়তে পারে, তাই “একীকরণ”-কে সংজ্ঞায়িত করারও অনেক উপায় থাকে।

আরও বিভ্রান্তি এড়াতে আমরা এখন থেকে “ইন্টিগ্রেশন” বা একীকরণ শব্দটির পূর্বে গুণবাচক বিশেষণ পদ ব্যবহার করব, আর তার দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন একীকরণ সমস্যাকে চিহ্নিত করব। এভাবে আমরা ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন বা জাতীয় একীকরণ, টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রেশন বা আঞ্চলিক একীকরণ, ভেল্যু ইন্টিগ্রেশন মূল্যবোধ সংহতকরণ, এলিট মাস ইন্টিগ্রেশন বা অভিজাত-গণ সংহতকরণ এবং ইন্টিগ্রেটিভ বিহ্যাভিয়র বা একীভূত আচরণের কথা বলব এবং যখন আমরা একটি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাধারণীকৃত সমস্যার কথা বলব তখন কেবলমাত্র ইন্টিগ্রেশন বা একীকরণ শব্দটি ব্যবহার করব।

ধরণ ও কৌশলসমূহ

পরিবর্তনশীল (Transitional) বা উন্নয়নশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলো সাধারণত ঐতিহ্যবাহী বা আধুনিক সিস্টেমের চেয়ে কম সংহত। কারণ এই ব্যবস্থাগুলো জাতীয় নেতৃত্ব বা কিছু ক্ষেত্রে যে কাজগুলো সম্পাদন করবে তা সহজেই সম্পাদন করতে পারে না, জনগণও আশা করে যে তারা তা করবে। কারণ এই সিস্টেমগুলি জাতীয় নেতৃত্ব যে কাজগুলি সম্পাদন করতে চায় বা জাতীয় নেতৃত্ব যে কাজগুলো সম্পাদন করবে বলে জনগণ আশা করে তা সহজেই সম্পাদন করতে পারে না। অন্য কথায়, যখন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রসারিত হয়, বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রসারিত করতে চায়, তখন একীকরণের একটি নতুন মাত্রা বা লেভেলের প্রয়োজন হয়। তাই যখন আমরা রাজনৈতিক উন্নয়নের কথা বলি, তখন আমরা চিন্তা করি – প্রথমত, আমরা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রসারণশীল কার্যাবলী (expanding functions) নিয়ে, দ্বিতীয়ত এই কাজগুলো সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় একীকরণের নতুন স্তরগুলো নিয়ে, এবং পরিশেষে, একীকরণের এই নতুন সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষমতা (capacity) নিয়ে। তাই এটা প্রয়োজন যে আমরা এখন রাজনৈতিক উন্নয়নের সময় ঘটে যাওয়া প্রসারণশীল কার্যাবলীর (expanding functions) ধরণ, এগুলো যে একীকরণ সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসে সেগুলো, এবং এই একীকরণ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য শাসক এলিটিগণ (governmental elite) যে পাবলিক পলিসি নির্বাচন করে সেই দিকে আরও দৃঢ়ভাবে নজর দেয়া।

জাতীয় একীকরণ (National integration) 

এটা জিজ্ঞাসা করা দরকারী যে কেন বহুগোষ্ঠিক সমাজব্যবস্থা (প্লুরালিস্টিক বা প্লুরাল সোসাইটি বোঝাতে) থাকা নতুন রাষ্ট্রগুলোতে তাদের পূর্ববর্তী ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার তুলনায় অধিকতর জাতীয় একীকরণের প্রয়োজন। সুস্পষ্ট উত্তরটি হল ঔপনিবেশিক সরকারগুলো জাতীয় আনুগত্য নিয়ে চিন্তিত ছিল না বরং এমন শ্রেণী তৈরি করেছিল যারা ঔপনিবেশিক শক্তি হিসাবে তাদের প্রতি অনুগত থাকবে। অতএব, ঔপনিবেশিক সরকারগুলো “জাতীয় ভাষা বা সংস্কৃতি”-শিক্ষার প্রতি খুব কম মনোযোগ দিয়েছে বা কোনও মনোযোগ দেয়নি, বরং তারা ঔপনিবেশিক ভাষা ও সংস্কৃতির শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিল। আমরা সবাই এই সত্যের সাথে পরিচিত যে শিক্ষিত ভিয়েতনামী, ইন্দোনেশিয়ান, নাইজেরিয়ান, ভারতীয় এবং আলজেরীয়রা তাদের নিজস্ব ভাষা এবং ঐতিহ্যের পরিবর্তে ফরাসি, ইংরেজি এবং ডাচ ভাষায় শিক্ষিত হয়েছিল। যাই হোক জাতীয় আনুগত্যের (national loyalties) উন্নয়নকে উপনিবেশবাদীরা তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখতো, নতুন উত্তর-উপনিবেশবাদী নেতৃত্ব এটিকে তার নিজস্ব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করে। উপরন্তু, যেহেতু ঔপনিবেশিক শাসকরা স্থানীয়দেরকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে কেবল সীমিত অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছিল, তাই নীতি নির্ধারকদের অপরিহার্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তগ্রহণে স্থানীয় জনগণের সংকীর্ণ অনুভূতিগুলো (parochial sentiments) খুব কমই জায়গা করে নিতে পেরেছিল। এরপর যখন নতুন রাষ্ট্রগুলো জনসাধারণের অংশগ্রহণমূলক একটি বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রবেশ করার সুযোগ পায়, তখন দেখা গেল একীকরণের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। উপরন্তু, নতুন রাষ্ট্রগুলোর নতুন এলিটগণের জাতীয় একীকরণের জন্য স্ট্যান্টার্ডগুলো পূর্ববর্তী ঔপনিবেশিক শাসকদের চেয়েও অধিক, আর এটা নতুন ইন্টিগ্রেশন প্রবলেম বা একীকরণ সমস্যার সৃষ্টি করে।

উদাহরণস্বরূপ, এত দিন যেহেতু রপ্তানি-আমদানি শুল্ক একটি ঔপনিবেশিক শাসক দ্বারা আরোপ করা হয়েছিল যার প্রাথমিক উদ্বেগ ছিল তাদের বাণিজ্য ও বাণিজ্যের উপর বাণিজ্যিক নীতির প্রভাব নিয়ে, তাই তখন সেখানে কোন জাতীয় একীকরণের কোনও প্রশ্ন জড়িত ছিল না। যখন এই নীতির বা পলিসির এই ক্ষেত্রগুলো একটি জাতীয় শাসনের হাতে চলে গেল, তখন দেশের কোন অংশগুলো এবং কোন সম্প্রদায়গুলো বাণিজ্য নীতিগুলোর দ্বারা অনুকূল বা প্রতিকূলভাবে প্রভাবিত হবার ব্যাপারটি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। শিক্ষানীতি যখন থেকে ঔপনিবেশিক প্রয়োজনীয়তা থেকে জাতীয় প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া শুরু করে, তখন ভাষানীতি, শিক্ষা সংক্রান্ত ফ্যাসিলিটিসমূহের অবস্থান, শিক্ষাগত বিনিয়োগের স্তর, শিক্ষার ব্যয় কে বহন করবে – এসব প্রশ্ন ভিন্ন ভিন্ন বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। পরিশেষে, রাষ্ট্র যখন নতুন রাস্তা বা ডাকঘর বা ইস্পাত কল বা পাওয়ার ড্যাম তৈরির জন্য বিনিয়োগের দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন বহুগোষ্ঠিক রাষ্ট্র গঠন করা বিভিন্ন অঞ্চল, উপজাতি এবং ভাষাগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার সমতার প্রশ্ন ওঠে। এমনকি যদি এই জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সংগঠক গোষ্ঠীগুলোর সম্মতির প্রয়োজন না হয়, অর্থাৎ, যদি একটি কর্তৃত্ববাদী কাঠামো বজায় রাখা হয়, তখনও অন্তত তাদের সম্মতির জন্য আহ্বান জানানো হয়।

জাতিগুলো কীভাবে জাতীয় একীকরণের সমস্যাগুলো পরিচালনা করেছে তা ঐতিহাসিক রেকর্ডের বিষয়। ক্লিফোর্ড গিয়ার্জ (Clifford Geertz) উল্লেখ করেছেন যে প্রথম দৃষ্টান্তে বহুগোষ্ঠিক সমাজে সামাজিক সংগঠনের প্যাটার্ন দ্বারা জননীতি প্রভাবিত হয় (দেখুন Clifford Geertz এর “The Integrative Revolution: Primordial Sentiments and Civil Politics in the New States,” Old Societies and New Nations, ed., Clifford Geertz (New York: Free Prex of Glencoe, 1963))। এই প্যাটার্নগুলোর মধ্যে রয়েছে –

  • (১) সেইসব দেশ যেখানে একটি একক গোষ্ঠী সংখ্যা এবং কর্তৃত্বে প্রভাবশালী এবং সেখানে এক বা একাধিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ যুদ্ধপূর্ব পোল্যান্ড (৬৮ শতাংশ পোলিশ), সমসাময়িক শ্রীলঙ্কা (৭০ শতাংশ সিংহলী), এবং ইন্দোনেশিয়া (৫৩ শতাংশ জাভানিজ)।
  • (২) সেইসব দেশ যেখানে একক গোষ্ঠী কর্তৃত্বে প্রভাবশালী কিন্তু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। এরকম প্রভাবশালী সংখ্যালঘুর উদাহরণ হলো দক্ষিণ আফ্রিকা (২১ শতাংশ “শ্বেতাঙ্গ”)।
  • (৩) সেইসব দেশ যেখানে কোন একক গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় ও কোন একক গোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী নয়। কোন সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই সম্পূর্ণ বহুত্ববাদের সর্বোত্তম উদাহরণ হল ভারত, নাইজেরিয়া এবং মালয় এবং ইউরোপ, যুগোস্লাভিয়া এবং চেকোস্লোভাকিয়া।
  • (৪) সেইসব দেশ যেখানে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর মধ্যে যেকোন কম্বিনেশনের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু এর এক বা একাধিক মাইনোরিটি আন্তর্জাতিক সীমানার বাইরেও বিদ্যমান। সংখ্যালঘুদের মধ্যে যারা আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করেছে এমন উদাহরণগুলোর মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ পরিস্থিতিতে আছে কুর্দি, ম্যাসেডোনিয়ান, বাস্ক, আর্মেনিয়ান এবং পাঠানরা। সমসাময়িক আফ্রিকায় কয়েক ডজন উপজাতি রয়েছে যাদেরকে আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত করা হয়, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যথেষ্ট পরিমাণে চীনা এবং ভারতীয় সংখ্যালঘু রয়েছে।

সাধারণভাবে জাতীয় সংহতি বা জাতীয় একীকরণ (national integration) অর্জনের জন্য দুটি জননীতি কৌশল রয়েছে: (১) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে এক ধরণের “জাতীয়” সংস্কৃতিতে নির্মূল করা, সাধারণত সেই জাতীয় সংস্কৃতি হয় প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সংস্কৃতি – এই নীতিকে সাধারণত এসিমিলেশনিস্ট বা আত্মীকরণবাদী হিসাবে উল্লেখ করা হয় : “আমেরিকানাইজেশন”, “বার্মানাইজেশন”, “ডিট্রাইবালাইজেশন” এর উদাহরণ। (২) অধস্তন সংস্কৃতিকে নির্মূল না করে জাতীয় আনুগত্য প্রতিষ্ঠা “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য” নীতি, যা রাজনৈতিকভাবে “জাতিগত পাটিগণিত” (“ethnic arithmetic”) দ্বারা চিহ্নিত। বাস্তবে, অবশ্যই, রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলো খুব কমই বিশুদ্ধভাবে দুটো পন্থার একটিকে গ্রহণ করে, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই দুটো পন্থার একটি মিশ্রণকে দেখা যায়, প্রায়ই একই সাথে দুটো কৌশলের অনুসরণই দেখা যায়।

জাতীয় রাষ্ট্রগুলোতে জাতিগত সংখ্যালঘুদের ইতিহাস ট্র্যাজেডিতে পূর্ণ। যদি আজ পূর্ব আফ্রিকার ওয়াতুসি, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু, সাইপ্রাসের তুর্কি এবং তুরস্কের গ্রিক, এবং বার্মা ও সিলনের ভারতীয়দের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তাহলে আসুন আমরা পূর্ব ইউরোপের ভিন্নধর্মী অঞ্চলে (heterogeneous areas) সংখ্যালঘুদের ভাগ্যের কথা স্মরণ করি। ১৯২১ সালে পোল্যান্ডে মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ সংখ্যালঘু ছিল। তারপর থেকে ২.৫ মিলিয়ন পোলিশ ইহুদি নিহত হয়েছে বা দেশ ছেড়ে চলে গেছে এবং ৯০ লক্ষেরও বেশি জার্মানকে দেশে ফিরিয়ে আনা বা পুনর্বাসিত করা হয়েছে। সীমান্ত পরিবর্তন এবং জনসংখ্যা বিনিময়ের মাধ্যমে রুথেনিয়ান, শ্বেতাঙ্গ রাশিয়ান এবং লিথুয়ানিয়ান সংখ্যালঘুদেরও অপসারণ করেছে, যার ফলে আজ পোল্যান্ডের জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ জাতিগত সংখ্যালঘু। একইভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বুলগেরিয়ায় তুর্কি সংখ্যালঘুসংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস পায় যখন ১৯৫০ সালে ২,৫০,০০০ তুর্কি তুরস্কে অভিপ্রায়ণ করতে বাধ্য হয় এবং যুদ্ধের পর থেকে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ৩০ লক্ষ জার্মান এবং ২ লক্ষ হাঙ্গেরীয়কে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। হত্যা, জনসংখ্যার স্থানান্তর এবং আঞ্চলিক পরিবর্তন পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে যা ছিল তার চেয়ে আজ আরও সমগোত্রীয় বা হোমোজেনাস করে তুলেছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে কেবল যুগোস্লাভিয়া এবং চেকোস্লোভাকিয়াতেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠী নেই। (এই পরিসংখ্যানগুলো Lewis M. Alexander এর World Political Patterns (Chicago: Rand McNally), pp. 277–325 থেকে নেওয়া হয়েছে)।

একটি অপ্রীতিকর ঐতিহাসিক সত্য বর্ণনা করা দুঃখজনক যে, খুব কম দেশই সফলভাবে রাজনৈতিক আনুগত্যকে (political loyalties) সাংস্কৃতিক আনুগত্য (cultural loyalties) থেকে পৃথক করেছে। যারা সাধারণত সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা তাদের আনুগত্যকে প্রভাবশালী সামাজিক গোষ্ঠীগুলো সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছে, যদিও সঙ্গত কারণেই সবসময় নয় (তবে এখানেও, আমাদের কর্মক্ষেত্রে self-fulfilling prophecy কাজ করে)। যেখানে হত্যা, জনসংখ্যা, স্থানান্তর বা আঞ্চলিক পরিবর্তন ঘটেনি, সেখানে সাধারণ প্যাটার্নটি হল জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রভাবশালী সংস্কৃতিতে শোষণ করে নেয়া বা একটি নতুন মিশ্রণ সংস্কৃতি তৈরি করা। ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক এবং বর্ণগত বৈচিত্র্য অব্যাহত থাকতে দেখা যায়, কিন্তু সেখানে সেই বৈচিত্র্যের সাথে সাধারণত রাজনৈতিক উত্তেজনাও লক্ষ্য করা যায়। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে নতুন দেশগুলোর অনেক নেতা আত্মীকরণ এবং সমগোত্রীয়তাকে কাম্য বলে মনে করেন এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন সাইপ্রাস, ভারত এবং পাকিস্তানে জনসংখ্যা স্থানান্তরের জন্য চাপ দেয় এবং সাব-সাহারান আফ্রিকায় এর গুরুত্ব বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন দেখার বিষয় যে ঐক্য ও বৈচিত্র্যের আদর্শ, অর্থাৎ রাজনৈতিক ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর ভিত্তি হতে পারে কিনা, সম্ভবত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সম্ভাবনাগুলো হল সেই গুলো যেখানে কোনও একক জাতিগোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তার করে না, উদাহরণস্বরূপ, নাইজেরিয়া, ভারত এবং মালয়েশিয়া। প্রাক-যুদ্ধ পূর্ব-ইউরোপে ফ্যাক্টরগুলো অনেক উন্নয়নশীল দেশেই হতে দেখা যাচ্ছে যা দুঃখজনক, এই ফ্যাক্টরগুলো হলো – রাষ্ট্রের জাতিগত নির্ধারণের জন্য সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন ও অভিপ্রায়ণ, নতুন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ প্রচেষ্টা, সংস্কৃতি মুছে না ফেলে এবং জনগণকে আত্মীকরণ, জনসংখ্যা স্থানান্তর বা গণহত্যা বা অন্য কোন উপায়ে সংখ্যালঘুর সংস্কৃতিকে না বিলোপ করে ইন্টিগ্রেশন বা সংহতি বা একীকরণ অর্জনের ব্যর্থতা, এবং পরিশেষে, বৃহত্তর অধিক শক্তিশালী রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা অসংহত ও ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে শোষণ করে নেয়া।

আঞ্চলিক একীকরণ (Territorial integration) 

স্থির অঞ্চলসহ রাষ্ট্রসমূহের সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে আধুনিক ঘটনা। ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যের ওঠানামা করা “সীমানা”, এবং পরিধির অস্পষ্টতা, যেখানে জ্ঞাতিত্বের সম্পর্ক এবং উপনদী ব্যবস্থা একটি রাষ্ট্রের সীমা চিহ্নিত করত – এমন ব্যবস্থা বিশ্বে আর গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নয়। এখন তার বদলে সার্বভৌমত্ব অঞ্চলের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ দ্বারাই রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করা হয়। সময়ের সাথে সাথে অঞ্চলটির উপর নিয়ন্ত্রণের সাথে সাধারণ জাতীয়তার অনুভূতি তৈরি হয়ে থাকতে পারে, যাকে “জাতীয় একীকরণ” বা নাশনাল ইন্টিগ্রেশন দ্বারা প্রকাশ করা হয়, তবে সবার আগে আঞ্চলিক একীকরণ বা টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রেশন প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। অধিকাংশ নতুন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, এমনকি ঐতিহাসিক রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রেও ব্যক্তিকেন্দ্রিক আনুগত্য প্রতিষ্ঠার আগে একটি অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়। কঙ্গো রাষ্ট্র না থাকলে কঙ্গো জাতি অর্জন করা যায় না, এবং কঙ্গো জাতি নিয়ে প্রথম কাজটিই ছিল এর অন্তর্ভূক্ত আঞ্চলিক এককসমূহের (constituent territorial unit) ওপর কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। কোন কোন পণ্ডিত রাষ্ট্র এবং জাতির মধ্যে পার্থক্য করেছেন, তারা রাষ্ট্র বলতে বোঝান একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব, যার একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকবে, এবং জাতি বলতে বোঝায় সেই রাষ্ট্রের জনসংখ্যার একটি অংশের সেই রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তিবাচক আনুগত্য। অবশ্যই এমন কিছু উদাহরণ রয়েছে যেখানে “জাতি” এই অর্থে “রাষ্ট্রের” পূর্ববর্তী – যেমন ইজরায়েলের ক্ষেত্রে, ও অনেকের মতে পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও। কিন্তু সাধারণভাবে রাষ্ট্রই জাতির আগে আসে। “ন্যাশন বিল্ডিং” বা জাতি গঠন একটি ক্রমবর্ধিষ্ণু জনপ্রিয় ফ্রেজ, এই শব্দটির দ্বারাই বোঝায় যে আগে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল, আর তারপর সেই রাষ্ট্রে জাতি গঠনের বিষয়টি এসেছে, আগে থেকেই সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুনির্দিষ্ট হয়ে আছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র দ্বারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অঞ্চলকে বোঝায়। এভাবে টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রেশন বা আঞ্চলিক একীকরণ স্টেট বিল্ডিং বা রাষ্ট্র গঠনের সাথে সম্পর্কিত, যা ন্যাশন বিল্ডিং বা জাতি গঠন থেকে আলাদা।

ঔপনিবেশিক শাসকরা আইনত তাদের নিয়ন্ত্রণের অধীনে পুরো অঞ্চলের ওপর সর্বদা কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই আইনত এবং কার্যত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ব্যবধান মেটাবার দায়িত্ব স্বাধীনতার পর নতুন শাসকদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তাই ঔপনিবেশিক শাসকদের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলো স্বাধীন সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে আসে, উদাহরণ হিসেবে ভারত, পাকিস্তান, মালয় ও আফ্রিকার অনেক অঞ্চলের কথা বলা যায়। এই প্রক্রিয়াটি তুলনামূলকভাবে কম রক্তপাত এবং কম আন্তর্জাতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে – যদিও কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম, কারণ ঔপনিবেশিক শাসকরা কর্তৃত্বের এই আধা-স্বাধীন পকেটগুলোকে তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী তৈরির অধিকার অস্বীকার করেছিল।

আঞ্চলিক একীকরণের আরও গুরুতর সমস্যা হচ্ছে নতুন রাষ্ট্রগুলোর সীমান্ত এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রচেষ্টা যা পূর্বে ঔপনিবেশিক সরকার দ্বারা পরিচালিত হত না, কেননা প্রায়শই সীমানার উভয় দিক একই ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা (যেমন ফ্রেঞ্চ ওয়েস্ট আফ্রিকা) বা দুটি দুর্বল স্বাধীন শক্তি দ্বারা (যেমন ভারত-তিব্বতী এবং ভারত-চীনা সীমানায়) পরিচালিত হত। ঔপনিবেশিক সরকার প্রায়শই কার্যত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোনও প্রচেষ্টা গ্রহণ করত না। উপরন্তু, এই সীমান্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে কোন কোন স্থান প্রায়শই বিরূপ উপজাতিদের দ্বারা দখলকৃত ছিল, যারা বলপূর্বক একটি বৃহত্তর জাতি রাষ্ট্রে তাদের নিজেদের অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করত।

বিউপনিবেশায়নের পর নবগঠিত সরকারগুলো প্রথমেই সেই রাষ্ট্রের সকল অঞ্চলের ওপর তার কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব প্রদর্শন করতে চায়নি বা পারেনি, কেননা সেটা করার ক্ষমতা (capacity) তাদের ছিল না, তাদের এই ক্ষমতা ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের কিছু কিছু অঞ্চল থেকে যাচ্ছে যেখানে রাষ্ট্রটির আইন-কানুন মানা হচ্ছে না – এরকম পরিস্থিতি কোনও আধুনিক সরকারই বেশিদিন সহ্য করতে পারে না। নতুন রাষ্ট্র তার ফাংশন বা কার্যকলাপ বৃদ্ধি করতে থাকলে বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। আভ্যন্তরীন বাজার (internal market) প্রতিষ্ঠিত হলে, আদালত বা বিচারালয়ে একটি সার্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য আইন তৈরি করা প্রয়োজন; রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে, রাষ্ট্রকেও এমন পদক্ষেপের দিকে যেতে হয় যাতে কোনও অঞ্চলই কর সংগ্রাহকদের কাছ থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে না, সকল অঞ্চলের লোকই কর প্রদানে বাধ্য থাকে; পরিবহন ও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে যোগাযোগ ও পরিবহন সুবিধার জনস্বার্থে ডাক ব্যবস্থা ও পরিবহন সুবিধাসমূহ প্রতিষ্ঠার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। পরিশেষে, এখানে গর্বেরও ব্যাপার আছে, কারণ একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকা রাষ্ট্র কখনই স্বেচ্ছায় স্বীকার করবে না যে তার অধীনে থাকা কোন অঞ্চলে তা কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারছে না, কারণ এটি স্বীকার করার অর্থ হবে, বাইরের শক্তিশালী রাষ্ট্রের সেই দুর্বল অঞ্চলে প্রবেশ করার জন্য আমন্ত্রণ করা।

মূল্যবোধ সংহতকরণ (Value integration) 

মূল্যবোধের সংহতকরণ বা একীকরণ এর অর্থ যাই হোক না কেন, অন্তত পক্ষে এর দ্বারা এটা বোঝায় যে, কোন দ্বন্দ্বের নিরসনের জন্য গ্রহণযোগ্য উপায় রয়েছে। গতানুগতিক সমাজ (traditional society) সহ সকল সমাজেই দ্বন্দ্ব আছে, এবং সকল সমাজেই এই দ্বন্দ্ব নিরসনের  জন্য উপায় রয়েছে। কিন্তু যখন সমাজ আধুনিকায়িত হতে শুরু করে, তখন এই দ্বন্দ্বের পরিমাণও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়, এবং এই দ্বন্দ্বসমূহের নিরসনের উপায় সবসময় সন্তোষজনক হয়না। কোন কোন সমাজে আধুনিকায়নের শুরুর দিকেও দ্বন্দ্ব নিরসনের ওপর গতানুগতিক কর্তৃত্বের (traditional authority) অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে, উদাহরণস্বরূপ জাপান, আর এর মাধ্যমেই সেই সব সমাজে বড় মাপের সহিংসতা রদ করা সম্ভব হয়। কিন্তু এগুলো ব্যতিক্রম। কেন সমাজব্যবস্থায় ভেল্যু ইন্টিগ্রেশন বা মূল্যবোধ সংহতকরণের নতুন মাত্রার প্রয়োজন?

প্রথমত, সমাজ যত বেশি আধুনিক হবে, তাতে দ্বন্দ্বের মাত্রা ও পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষার ফলে নতুন পেশাগত সুযোগ উন্মুক্ত হবার ফলে, ভোটাধিকারের ফলে সংখ্যার রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির ফলে, এবং শিল্পের প্রসারের ফলে নতুন কর্মসংস্থান ও সম্পদের সুযোগ সৃষ্টি হবার ফলে সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর মর্যাদা বারবার পরিবর্তিত হয় ও পাল্টে যায়। পূর্বে যে ট্রাইব বা উপজাতি এবং কাস্ট বা বর্ণের মর্যাদা ও সম্পদ নিম্নমানের ছিল, এই অবস্থায় তাদেরও উন্নতি হতে পারে, অন্তত এই অবস্থায় তারা নিজেদের উন্নতির  সুযোগ দেখতে পারে। আর যেসব সামাজিক গোষ্ঠীর ক্ষমতা, মর্যাদা ও সম্পদ এক সময় উচ্চ অবস্থানে ছিল, এবারে তারাও হুমকি অনুভব করতে পারে। এর ফলে গতানুগতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গভীরতর হয়, এবং সামাজিক সম্পর্ক বদলে যাওয়ায় নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা হয়।

আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াটি নতুন পেশাগত ভূমিকাও তৈরি করে এবং এই নতুন ভূমিকাগুলো প্রায়শই পুরানো ভূমিকাগুলোর সাথে বিরোধে লিপ্ত হয়। নতুন স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা আদিবাসী বা বর্ণের নেতার দ্বারা বিরোধিতার শিকার হতে পারেন। টেক্সটাইল প্রস্তুতকারক হস্ত-তাঁত কাপড় উৎপাদকের দ্বারা বিরোধিতার শিকার হতে পারে। একজন চিকিৎসক গতানুগতিক নিরাময়কারীর দ্বারা বিরোধিতার শিকার হতে পারেন। এভাবে আধুনিকায়নের ফলে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের বিশাল তালিকা তৈরি করা যায় : ব্যবস্থাপনা ও শ্রমের মধ্যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে শিল্প বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য, সেই সাথে সরকারের ভূমি-সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে  ভূস্বামীর বিরোধিতা; অঞ্চল, উপজাতি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব (কারণ তারা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতার প্রয়োজন মনে করে) – নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর প্রথম বারের মত এরকম দ্বন্দ্ব এত ব্যপকতা লাভ করে। আর এই গোষ্ঠীসমূহ সেই সাধারণ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, যেখানে সেই গোষ্ঠীগুলোর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানের জন্য রাষ্ট্রের নেয়া পাবলিক পলিসি বা জননীতি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। সবশেষে আমাদেরকে আইডিওলজিকাল কনফ্লিক্ট বা মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের কথাও বিবেচনা করতে হবে, যা প্রায়শই উন্নয়নশীল সমাজে দেখা যায়। এই সমাজের মানুষেরা সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং দ্বন্দ্বপূর্ণ সমাজের পরিবর্তনের জন্য একটি বৌদ্ধিকভাবে ও আবেগীয়ভাবে সন্তোষজনক সমাজকাঠামো মনে মনে গঠন করে যা তার মতাদর্শ হিসেবে পরিগণিত হয়। এরপর ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের লোকেরা একে অপরের সাথে তাদের মতাদর্শের বৈচিত্র্যের দরুন মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।

একটি উন্নয়নশীল সমাজে মূল্যবোধকে একীভূত করার জন্য দুটি মোডাল কৌশল (modal strategy) রয়েছে। এদের একটি ঐকমত্যের গুরুত্বের উপর জোর দেয় এবং সর্বাধিক অভিন্নতা অর্জন করার চেষ্টা করে। ঐকমত্যের এই দৃষ্টিভঙ্গি তার চরম পর্যায়ে, জোরজবরদস্তি বা প্রণোদোনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব এবং প্রতিযোগিতা উভয়ই এড়ানোতে জোর দেয়। সর্বাধিক একীকৃত মূল্যবোধ তৈরির দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর স্বার্থের পারস্পরিক ক্রিয়ার উপর জোর দেয়। এক্ষেত্রে জননীতি (Public policy) দ্বারা আর সকলে একমত হবে এমন “সঠিক” নীতিকে বোঝায় না, বরং এর দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ ও সেন্টিমেন্টের মধ্য থেকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম পরিস্থিতিকে গ্রহণ করাকেই বোঝায়, এটাই জননীতিকে নির্ধারণ করে। যেহেতু বেশিরভাগ উন্নয়নশীল সমাজে একীভূত মূল্যবোধের অভাব থাকে, তাই নতুন দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই তাদের কৌশল সম্পর্কে আত্মসচেতন হন। বাস্তবে, অবশ্যই, এই দুটি কৌশলের কোনটিই “বিশুদ্ধভাবে” অনুসরণ করা হয় না, কারণ যে নেতৃত্ব দ্বন্দ্ব ছাড়াই ঐকমত্যে বিশ্বাস করবে তা কিছু প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের অনুমতি দিতে ইচ্ছুক হতে পারে, আবার রাষ্ট্র অনেক সময়ই মুক্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, যার মাধ্যএম কোন দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের  সামনে প্রকাশিত হবে সে ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়, অর্থাৎ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলাফলই জননীতি ঠিক করে দেয়।

বেশিরভাগ সামাজিক আন্দোলন দ্বন্দ্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে বিকশিত হলেও কমিউনিস্টদের মতো কিছু গোষ্ঠী আছে যারা মনে করে শ্রেণী সম্প্রীতি বা ক্লাস হারমোনি গঠনের জন্য শ্রেণী-সংগ্রামকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, আর এধরণের আন্দোলন দ্বন্দ্বে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করে। দ্বন্দ্ব পরিচালনার জন্য গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সন্ধানও একটি সমস্যা। আধুনিক সমাজে বর্ধিষ্ণু দ্বন্দ্ব-নিরসনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপস্থিতি লক্ষণীয়। যখন এই সংস্থাগুলো সফল হয়, তখন প্রায়শই একটি দেশের রাজনৈতিক জীবনে দ্বন্দ্ব প্রবেশ রোধ করা সম্ভব হয়। এইসব দ্বন্দ্ব-নিরসনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (despute settling institution) মধ্যে রয়েছে সামাজিক-কর্ম সংস্থা (social work agencies), গির্জা এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংস্থা (religious bodies), আইনজীবী এবং আদালত (lawyers and the courts), শ্রম-ব্যবস্থাপনা সমঝোতা সংস্থা (labour management conciliation bodies) এবং কর্মচারী পরিষদ (employee councils), এবং আন্তবর্ণ এবং আন্তঃধর্মীয় সংস্থা (interracials and interreligious bodies), মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (psychiatrist), আইনজীবী (the lawyer), সমাজকর্মী (the social worker) এবং শ্রম মধ্যস্থতাকারী (labour mediator) – যারা সকলেই আধুনিক সমাজে একীভূত ভূমিকা পালন করে। যদি সমাজে এরকম প্রতিষ্ঠান ও ভূমিকা বা এগুলোর সমতুল্য কিছু না থাকে, তাহলে আধুনিক সমাজে যে হারে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে খুব সহজেই কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রাম থেকে রাজনৈতিক জীবনে স্থানান্তরিত হবে।

আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোন একক কৌশল নেই, কোন একক পদ্ধতি নেই, দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য কোন একক প্রতিষ্ঠান নেই। বরং দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য  আছে একাধিক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির উপস্থিতি রয়েছে, যা আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একই সাথে গণতান্ত্রিক ও সর্বগ্রাসী (totalitarian) করে তুলেছে। অন্যদিকে উন্নয়নশীল সমাজে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বের বিভিন্ন পরিসর ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে, যেখানে এই সব সমাজে এরকম দ্বন্দ্ব নিরসনকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি নেই। মনে হয় মানব জাতির দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার ক্ষমতা (capacity) দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় খুঁজে বের করার ক্ষমতার চেয়ে বেশি, আর এই দুই ক্ষমতার পার্থক্য সেই সব সমাজেই সবচেয়ে বেশি যেখানে মৌলিক অর্থনীতি ও সামাজিক সম্পর্কগুলো দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে।

এলিট-মাস ইন্টিগ্রেশন (Elite-mass integration) 

শাসক এলিট এবং শাসিত জনগণ বা মাসের মধ্যকার লক্ষ্য ও মূল্যবোধের ভিন্নতা কখনও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ হয়না বা তা রাষ্ট্রের ভাঙ্গন ঘটাতে পারেনা, যদি শাসিতরা তাদের ওপর শাসকদের শাসনের অধিকারকে মেনে নেয়। ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংস্কৃতি নাগরিকদের তাদের সরকারের প্রতি বাধ্যবাধকতার ওপর জোর দেয়; আমেরিকান রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক অংশগ্রহণের গুরুত্বের উপর জোর দেয়। উভয়ক্ষেত্রেই, এলিট-জনতা একীকরণ বা এলিট-মাস ইন্টিগ্রেশনের একটি উচ্চ মাত্রা বিদ্যমান। অন্য চরম পর্যায়ে এমন সমাজ দেখা যায় যেখানে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি চলমান। আর এই দুই চরমের মধ্যে এমন অনেক রাষ্ট্র রয়েছে যেখানে সরকার তার শাসিত জনতার থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন যে সরকার না পারে তাদেরকে সংহত বা সচল করতে, আর না পারে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হতে। শাসক এবং শাসিতদের মধ্যে, এলিট ও মাসের মধ্যে পার্থক্যগুলো অদৃশ্য হয়ে গেলেই তাদের মধ্যে একীকরণ বা ইন্টিগ্রেশন ঘটে না, একীকরণ ঘটে যখন তাদের মধ্যে একটি কর্তৃত্ব ও সম্মতির প্যাটার্ন (pattern of authority and consent) প্রতিষ্ঠিত হয়। কোন সমাজেই এত বেশি সম্মতি থাকে না যে সেখানে বিনা কর্তৃত্বে শাসন করা যেতে পারে, আবার একই সাথে কোনও সমাজেই একটি সরকার এতটাও শক্তিশালী এবং অভ্যন্তরীণভাবে সংহত হয়না যে এটি কেবল সংহত কর্তৃত্ব প্রয়োগের মাধ্যমেই দীর্ঘসময় টিকে যেতে পারে। আমাদের এখানে জোর দিতে হবে যে, সর্বগ্রাসী (totalitarian) এবং গণতান্ত্রিক উভয় শাসনব্যবস্থাই এলিট-গণ সংহতকরণ বা এলিট-মাস ইন্টিগ্রেশন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম এবং একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন রাজনৈতিক অংশগ্রহণ (political participation) ব্যাপক আকারে শুরু হচ্ছে তখন সরকার এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্কের একটি নতুন প্যাটার্ন প্রতিষ্ঠা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

নতুন উদ্ভুত জাতিগুলোর ক্ষেত্রে শাসক এবং শাসিতদের মধ্যে ব্যবধান বা গ্যাপের আলোচনাটা খুব চোখে পড়ে। এর অর্থ এই যে, এই নতুন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এলিট আর মাস পিপলের মধ্যে মৌলিক সাংস্কৃতিক ও প্রবণতাগত এটিচুডিনাল গ্যাপ রয়েছে। এখানে দেখা যায়, এলিটরা সেক্যুলার-মাইন্ডেড, ইংলিশ বা ফ্রেঞ্চ স্পিকিং, ওয়েস্টার্ন ওরিয়েন্টেড না হলেও ওয়েস্টার্ন স্পিকিং, আর মাস পিপল এখানে ট্রেডিশনাল ভেল্যুজ বা ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের প্রতি ওরিয়েন্টেড হয়, এরা ফান্ডামেন্টালি ধার্মিক গ্রুপ, এবং ভারনাকুলার বা নেটিভ ভাষায় কথা বলে। (পলিটিকাল ডেভলপমেন্ট সম্পর্কিত “গ্যাপ” থিওরিগুলোর ক্রিটিক এর জন্য অ্যান রুথ উইলনারের (Ann Ruth Willner) “The Underdeveloped Study of Political Development” (World Politics (April 1964), pp. 468–462.) প্রবন্ধটা দেখতে পারেন। অধিকতর কনক্রিট পলিটিকাল টার্মে বলা যায়, দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্যের জন্য সরকার সেভিংস ও ইনভেস্টমেন্ট বৃদ্ধি ও তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক স্তরায়ন বা ইকোনমিক স্ট্র্যাটিফিকেশন স্থগিত করার চেষ্টা করে, যেখানে পাবলিক তাদের তাৎক্ষণিক লাভ ও ইকুইটেবল ডিস্ট্রিবিউশন বা সোশ্যাল জাস্টিস চায়, যার ডেভেলপমেন্টাল কনসিকুয়েন্স বা ফলাফলগুলো নিয়ে তারা আগ্রহী নয়। সরকারী এলিটদের মধ্যেও একটা অংশ পপুলার সাপোর্ট গ্রহণ করবার জন্য পাবলিক ডিমান্ড সেটিস্ফাই করতে চায়, অন্য অংশটি সেখানে রাষ্ট্রের গ্রোথ রেইটকে ম্যাক্সিমাইজ করতে চাইবে, জনগণের সংকীর্ণ সেন্টিমেন্টকে এরা গায়ে লাগাতে চায় না, একটি সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তুলতে চায়, বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে চায়। এই এলিট-মাস গ্যাপটা এও নির্দেশ করে যে, এলিট আর মাস পিপলের মধ্যে যোগাযোগটাও পর্যাপ্ত নয়। অর্থাৎ এলিটরা এখানে মাস পিপকের ওরিয়েন্টেশন বা অভিমুখিতা পরিবর্তন করার জন্য প্ররোচিত করে ঠিকই, কিন্তু এক্ষেত্রে তারা মাস পিপলের পলিটিকাল ডিমান্ডগুলো বা তাদের ফিডব্যাক কখনও শোনে না, আর শুনলেও রেস্পন্ড করেনা। 

হয়তো শাসক ও শাসিতদের মধ্যে এডিচুডিনাল গ্যাপ নিয়ে বেশিই আলোচনা করা হচ্ছে। হয়তো এর চেয়ে নাগরিকদের ওপর সরকারের এটিচুডটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতার বাইরে থাকা জাতীয়তাবাদী নেতারা সাধারণত পপুলিস্ট বা জনতোষণবাদী হয়। তারা সাধারণত মাস পিপলের সাথে নিজেদেরকে আইডেন্টিফাই করে আর “সরল কৃষক” বা “শ্রমিক শ্রেণী” এর মধ্যেই একটি ভাল সমাজ গঠনের গুণগুলো খুঁজে পান। কিন্তু একবার এই ন্যাশনালিস্ট বা জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব ক্ষমতা গ্রহণ করলে ও তাদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস লাভের আকাঙ্ক্ষাটি সেটিস্ফাইড হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তারা মাস পিপলকে একটি “আধুনিক”, “একীভূত” এবং “ক্ষমতাশালী” রাষ্ট্র গড়ে তোলার পেছনে বাধা হিসেবে দেখতে শুরু করে। এভাবে এলিটরা মাস পিপলের চ্যাম্পিয়ন থেকে তাদের ডেট্রাক্টর বা নিন্দুকে পরিণত হয়।

ডেভলপিং থেকে ডেভলপড – সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই শাসক ও শাসিতদের আউটলুক বা দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হয়। কিন্তু একটি ডেভলপড সিস্টেমে দেখা যায়, একটা টোটালিটারিয়ান সিস্টেমেও শাসকেরা শাসিতদের দ্বারা প্রভাবিত হয়, আর সেই সাথে শাসিতরেও শাসকদের দ্বারা মোবিলাইজেশনের জন্য এভেইলেবল থাকে। আধুনিক সমাজের সরকারগুলো ইকোনমি, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ও ডিফেন্সে এতটাই জড়িত থাকে যে শাসক ও শাসিতদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের দরকার হয়। (কার্ল ডিউশ (Karl Deutsch) দেখিয়েছেন শিল্প সমাজের সরকার টোটালিটেরিয়ানই হোক বা গণতান্ত্রিকই হোক, তারা আন্ডারডেভলপড ইকোনমির তুলনায় বেশি মাত্রায় জিএনপির অংশ খরচ করে, সে তাদের আইডিওলজি যাই হোক না কেন)। শাসককে অবশ্যই শাসিতদেরকে সেভিং, ইনভেস্টমেন্ট, ট্যাক্স পেইং, আর্মি, আইন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির জন্য শাসকদের মোবিলাইজ করতে হবে। উন্নত দেশের আধুনিক সরকারগুলোকে এও হিসেব করে দেখতে হয় যে তারা কোন পলিসি গ্রহণ করলে পাবলিক তাকে কিভাবে দেখবে, কিরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। সেই সাথে উন্নত দেশগুলোর আধুনিক সরকারগুলো যত দিন যাচ্ছে তত বেশি করে ইকোনমিক অ্যানালাইসিস ও পাবলিক অপিনিয়ন সার্ভে এর পরিশীলিত সরঞ্জামগুলো তৈরি করছে, ফলে তাদের নেয়া ইকোনমিক ও পলিটিকাল একশনগুলোর ফল কী হতে পারে তার প্রেডিক্ট করার সক্ষমতা তাদের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে নতুন রাষ্ট্রগুলোর এলিটরা সবসময়ই তাদের মাস পিপলের সাথে কথা বলতে থাকে। এর মানে এই নয় যে তারা মাস পিপলের কথা শোনেনা, কিন্তু তারা যা শোনে তা প্রায়ই তারা যা করতে চায় তার জন্য ইন্যাপ্রোপ্রিয়েট। তারা যে কাজগুলো করে যেমন বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করা, সংবাদসংস্থাকে দমন করা, বাকস্বাধীনতা ও সভ-সমাবেশের স্বাধীনতাকে সীমিত করা – এসব এলিটদের সাথে মাস পিপলের যোগাযোগকে বন্ধ করে দেয়, আর তারা তাদের স্বার্থেই এগুলো করে।

কিন্তু মাস পিপলকে তারা যতই ভয় পাক না কেন, এদেরকে ছাড়া এই সব নতুন রাষ্ট্রের শাসক এলিটরা চলতে পারবে না। মাস পিপলের প্রতি এই এলিটরা সিম্প্যাথেটিক টা হলেও তাদের লক্ষ্য পুরণের জন্যই তাদেরকে এই মাস পিপলকে মোবিলাইজ করতে হয়। কোন কোন ডেভলপিং সমাজে, একটি অরগানাইজেশনাল রেভোল্যুশন ঘটছে, যেখানে মানুষেরা পলিটিকাল পার্টি, সংবাদপত্র, করপোরেশন, ট্রেড ইউনিয়ন, কাস্ট ও ট্রাইবাল অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করার অধিকতর জটিল কাজগুলো করার জন্য একত্র হয়। এই অবস্থায় শাসক এলিটদের হাতে দুটো চয়েস থাকে – এই অরগানাইজেশনগুলোকে তাদের কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর ইনস্ট্রুমেন্ট বা সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করা, অথবা এদেরকে সায়ত্তশাসিত অরগানাইজেশন হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেয়া, তা পলিটিকালি নিউট্রাল হোক বা সরকারকে ইনফ্লুয়েন্স করতেই কনসার্নড হোক। যে সব উত্তর-ঔপনিবেশিক বা পোস্ট কলোনিয়াল সোসাইটির প্রাথমিক দশায় একটি শক্তিশালী ব্যুরোক্রেটিক লেগেসি থাকে, সেই সব ক্ষেত্রে দেখা যায় রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়, কিন্তু সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো হয় দুর্বল। এই অবস্থাতেই শাসক অভিযাত নেতৃত্বের কাছে এই দুটো অপশন প্রকট হয়। যখন রাষ্ট্র শক্তিশালী হয় এবং সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল হয়- একটি অবস্থা প্রায়শই একটি শক্তিশালী আমলাতান্ত্রিক উত্তরাধিকার সহ উত্তর ঔপনিবেশিক সমাজের প্রাথমিক পর্যায়ে পাওয়া যায় তখন সরকারী নেতৃত্বের স্পষ্টতই এই জাতীয় বিকল্প রয়েছে। (এই থিমটি ফ্রেড ডব্লিউ রিগস (Fred W. Riggs) তারBureaucrats and Political Development: A Paradoxical View, Bureaucracy and Political Development”-এ বিস্তৃত আকারে ব্যাখ্যা করেছেন (ed., Joseph LaPalombara (Princeton, NJ: Princeton University Press, 1963)। এই মুহুর্তে স্বাধীনতা এবং কর্তৃত্বের সম্পর্কের ক্লাসিক বিষয়টি উত্থাপিত হয়, এবং অভিজাতরা অন্য দিকে না গিয়ে এক দিকে এগিয়ে যেতে পছন্দ করতে পারে। লিবার্টি বনাম অথোরিটির ক্লাসিক ইস্যুটা সামনে এলে এলিটদেরকে এই দুটোর একটি পথ বাছাই করতেই হয়।

এখন এরা কোন চয়েসটা গ্রহণ করবে সেটা প্রায়ই সেই সময়কার ডড়াভাটিক ডমেস্টিক বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিসের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সেটা এলিট-মাস সম্পর্কের সমাজের ট্রেডিশন দ্বারাও প্রভাবিত হয়। ঐতিহ্যগত ঘৃণা, যেমন ভিয়েতনামের জনগণের প্রতি মান্দারিন ব্যুরোক্রেসি, এবং বুদ্ধিস্ট ও ক্যাথলিক ভিয়েতনামিজদের মন্টাগনার্ড বা প্যাগান পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রতি ঐতিহ্যগত অবজ্ঞা সম্ভবত ভিয়েতনামের এলিট-মাস রিলেশনের ক্ষেত্রে সেই সরকারের স্ট্র্যাটেজিক বা আইডিওলজিকাল কারণের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিল। একইভাবে, অনেক আফ্রিকান লিডারদের আচরণকেই বেশি বোঝা যায় তাদের ট্রেডিশনাল ট্রাইবাল সোসাইটির অথোরিটির রীতিগত কর্তৃত্বের প্যাটার্ন দিয়ে, তাদের ডেভেলপমেন্ট প্রসেসের মধ্যে থাকা কম্পালশন দিয়ে নয়।

এলিট-মাস সম্পর্কের বিশ্লেষণে “ইনফ্রা-স্ট্রাকচার” অর্থাৎ রাজনৈতিক দল, সংবাদপত্র, বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই জাতীয় বিষয়গুলোর বিকাশের দিকে অনেক মনোযোগ দেওয়া হয়, যেগুলো শাসক ও শাসিতের মধ্যকার দ্বিমুখী যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করতে পারে। (রাজনৈতিক উন্নয়নে ইনফ্রা-স্ট্রাকচারের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার জন্য দেখুন এডওয়ার্ড শিলসের (Edward Shils), Political Development in the New States (The Hague: Mouton, 1962))।

লিংক হিসেবে কাজ করা নিউজপেপারম্যান, লবিস্ট, পার্টি বসেস, ও প্রিসিংক্ট ওয়ার্কারদের “মিডল স্ট্রাটা” এর বিকাশকেও অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়। দীর্ঘমেয়াদে এই উন্নয়নগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও স্বল্প মেয়াদে শাসক এলিটদের এটিচুড বা মনোভাবের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে, যেমন এলিটরা মৌলিকভাবে কেমন অনুভব করে, আচরণ করে, মাস পিপলের থেকে তারা কতটা এলিয়েনেটেড বা বিচ্ছিন্ন, বা তাদের প্রতি এলিটরা কতটা শত্রুভাবাপন্নন, বা তারা মাস পিপলের মূল্যবোধকে বোঝে কিনা, আর এলিটদের কাজ তাদের নিজেদের লক্ষ্যের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা।

সংহত আচরণ (Integrative behavior) 

সাধারণ উদ্দেশ্যে সংগঠিতভাবে একসাথে কাজ করার জন্য মানুষের প্রস্তুতি এবং এই সাধারণ উদ্দেশ্যগুলোকে অর্জনের জন্য অনুকূল ফ্যাশনে আচরণ করা হচ্ছে আধুনিক জটিল সমাজের একটি অপরিহার্য আচরণগত প্যাটার্ন। আধুনিক সমাজগুলোর সবগুলই কিছু ক্ষেত্রে সাংগঠনিক বিপ্লবের মুখোমুখি হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মতো অপরিহার্য এবং বৈপ্লবিক বিষয়গুলোও আছে যেগুলো আধুনিক বিশ্বকে গঠন করেছে। বাইরের মহাকাশে একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রেরণ করা, বছরে লক্ষ লক্ষ অটোমোবাইল উৎপাদন করা, গবেষণা ও উন্নয়ন পরিচালনা করা, জটিল গণমাধ্যম পরিচালনা করা – সবকিছুর জন্যই নতুন সাংগঠনিক দক্ষতার প্রয়োজন। গত কয়েক দশকে আমরা পরিচালকীয় দক্ষতার প্রকৃতি এবং সংস্থাগুলোর জটিলতা সম্পর্কে, অর্থাৎ কীভাবে তারা তাদের অনেক উদ্দেশ্য পালন করে, কীভাবে তারা পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় এবং কীভাবে তারা সেই পরিবেশের পরিবর্তন করে তা বুঝতে শুরু করেছি। তবে আমরা এটা কম জানি যে, কেন কিছু সমাজ সাধারণ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য জটিল সংগঠন প্রতিষ্ঠা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং অভিযোজনের জন্য সক্ষম পুরুষ ও মহিলা তৈরিতে অন্যান্য সমাজের চেয়ে বেশি সফল হয়।

এভাবে কোন সমাজের সাংগঠনিক বিষয়গুলো যদি অন্য সমাজগুলোর চেয়ে পিছিয়ে পড়ে তাহলে তা তাদের বিকাশে কেমন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তা বেশ স্পষ্ট। অনেক নতুন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক নেতাদের তাদের দলকে মেইনটেইন করতে ও দেশে সরকারী ঐক্য বজায় রাখতে ব্যর্থতার ফলে সংসদীয় সরকারের পতন হয়েছে এবং সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর বহু চর্চিত সাংগঠনিক দক্ষতাও প্রায়শই অনেক নতুন দেশগুলোতে ব্যর্থ হয়েছে। সিলনে একটি পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থান ভেঙ্গে পড়ে যখন বেশ কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী তাদের পরিকল্পনার কথা এত খোলাখুলিভাবে বলে যে তার ফলে একটি অগোছালো বেসামরিক সরকারও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় পেয়ে যায়, আর অনেক ল্যাটিন আমেরিকান দেশ ও ভিয়েতনামে সামরিক বাহিনী তাদের বেসামরিক পূর্বসূরিদের মতো সংহত কর্তৃত্ব বজায় রাখতে অক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে।

নিজেদের লোকেদের সাথে সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা বা ক্ষমতার অভাব সমাজের একটি সাধারণ গুণ হতে পারে। উচ্চ সাংগঠনিক ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সমাজ শিল্প সংগঠন, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি তৈরিতে সাংগঠনিকভাবে দক্ষ বলে মনে হয়। জার্মানি, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, গ্রেট ব্রিটেনের কথা এক্ষেত্রে দ্রুত মনে আসে। বিপরীতে, অনেক নতুন দেশে দেখা গেছে সাধারণ অযোগ্যতার সমস্যা, যা ইকোনমিক গ্রোথের জন্য যন্ত্রপাতির ভাঙ্গনের চেয়েও বেশি সমস্যার বলে মনে হয়। কিছু নতুন দেশে শিল্প কারখানা, রেলপথ, টেলিগ্রাফ এবং ডাক ব্যবস্থার মতো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন প্রযুক্তিগুলোতে কাজ করা যোগ্য মানুষের বিকাশের চেয়ে আরও দ্রুত প্রসারিত হয়েছে, যার ফলে দেখা যায় চিঠিপত্র হারিয়ে যাচ্ছে, পরিবহন ব্যবস্থা কোনও নিয়মিততার সাথে কাজ করছে না, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজাররা তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে না, এবং সরকারী প্রশাসনিক বিধিগুলো সরকারী খাতের কারখানাগুলোর পরিচালনার সুবিধার্থে বাধা দেয়। যদিও কিছু পণ্ডিত যুক্তি দেখিয়েছেন যে জটিল প্রতিষ্ঠান তৈরি করার দক্ষতা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সাথে সাথেই চলবে বা অনুসরণ করবে, তবে এটা ভাবার উপযুক্ত কারণ রয়েছে যে সাংগঠনিক দক্ষতা অনেক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। বস্তুত, পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন অন্যদের তুলনায় কিছু ঐতিহ্যবাহী সমাজে সংগঠন গঠনের জন্য বেশি অনুকূল বলে মনে হয়। যেমন ঐতিহ্যবাহী সমাজে উদ্যোক্তা প্রতিভা বা আন্ট্রাপ্রিনিউরিয়াল ট্যালেন্টের উপস্থিতি সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে কি ঘটবে না তা নির্ধারণের একটি মূল উপাদান, তেমনই রাজনৈতিক দল, কোন ইন্টারেস্ট অ্যাসোসিয়েশন বা স্বার্থ সমিতি বা সরকার চালানোর ক্ষমতা সম্পন্ন নেতৃত্ব উদ্ভূত হবে কিনা তা নির্ধারণে সাংগঠনিক প্রতিভার উপস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। (সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ঐতিহ্যগত নিদর্শনগুলোকে আধুনিক পার্লি-বিল্ডিংয়ের সাথে সম্পর্কিত করার প্রচেষ্টার জন্য, মাইরন ওয়েনারেরই “Traditional Role Performance and the Development of Modern Political Parties: The Indian Case” গ্রন্থটি দেখতে পারেন (Journal of Politics (November 1964)। কোন নতুন দেশে দল গঠনের সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানতে মাইরন ওয়েনারের “Party-Building in a New Nation: The Indian National Congress” লেখাটি দেখতে পারেন।)

আশ্চর্যজনকভাবে কার্যকর রাজনৈতিক সংগঠনের উন্নয়নের শর্ত সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া যদি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করে, তাহলে কেন কিছু সমাজে এই সংগঠনগুলো কার্যকর এবং অন্যগুলোতে তারা নয়? কার্যকরভাবে, আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কিছু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করার জন্য পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ সংহতি এবং বাহ্যিক সমর্থন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সংস্থার ক্ষমতা বোঝাতে চাই। নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ফলে হয় একটি অত্যন্ত খণ্ডিত অখণ্ড রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তৈরি হয় যেখানে সরকার জননীতি তৈরি বা বাস্তবায়ন করতে অক্ষম হয়, অথবা এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয় যেখানে কর্তৃত্বপূর্ণ কাঠামোগুলো সরকারের বাইরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পরবর্তী ক্ষেত্রটিতে একটি দ্বৈত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা ডুয়েল পলিটিকাল প্রোসেস তৈরি হতে পারে, একটি সরকারের অভ্যন্তরে যা অর্থবহ এবং সরকারের বাইরে একটি যা নীতিগত দিক থেকে অর্থহীন।

কিছু পণ্ডিত পরামর্শ দিয়েছেন যে রাজনৈতিক সংগঠন হচ্ছে পেশাগত পার্থক্য বা অকুপেশনাল ডিফারেন্সিয়েশন বৃদ্ধির একটি ফলাফল, আর অকুপেশনাল ডিফারেন্সিয়েশন ঘটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে। আর অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনটা আসে বিদেশী আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়, আর অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে সামাজিক পরিবর্তন হয় – এমনটা বিবেচনার অসুবিধা হল, এই ক্রমটি যতই যৌক্তিক মনে হোক না কেন, ইতিহাসে পরিবর্তনের এই জাতীয় কোনও ক্রম অভিন্নভাবে বা ইউনিফর্মলি খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে, রাজনৈতিক সংগঠন প্রায়শই বড় আকারের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পূর্বে ঘটে থাকে, আর এই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোই দেশটিতে বড় আকারের অর্থনৈতিক পরিবর্তন হবে কি হবে না তা নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে থাকতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক সংগঠনের মনোসাংস্কৃতিক বা সাইকোকালচারাল উপাদানগুলোর প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের অস্তিত্ব এবং ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে জনকল্যাণ এবং নৈতিক আচরণের কিছু ধারণার সাথে সম্পর্কিত করার ক্ষমতার দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। এটি ব্যাখ্যার জন্য, মনোবিজ্ঞানীরা প্রাথমিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ার উপর মনোনিবেশ করেন। যদিও মনোবিজ্ঞানীরা মনের কাজের উপর মনোনিবেশ করেন, সমাজবিজ্ঞানী এবং সামাজিক নৃতত্ত্ববিদরা সমাজের কাজের সাথে সম্পর্কিত, এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এমন নিয়মগুলোর উপর মনোনিবেশ করেন, যেমন কেন এই সামাজিক সম্পর্কগুলো রক্ষিত হয়, কেন এগুলোর ভাঙ্গন ঘটে ইত্যাদি।

সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক সম্পর্ক সংগঠিত করে এমন নিয়মের জটিলতা, গোষ্ঠী এবং ব্যক্তিদের মধ্যে এবং তাদের মধ্যে শাসন এবং অধীনস্ততার প্যাটার্ন, কীভাবে এই পরিবর্তনগুলো ঘটে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কের উপর তাদের কী প্রভাব রয়েছে সে দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। যদিও মনোবিজ্ঞানীরা সামাজিকীকরণের প্রাথমিক প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেন, সমাজবিজ্ঞানী এবং সামাজিক নৃতত্ত্ববিদরা তার পুরো জীবনে কীভাবে কোন ব্যক্তি নিয়মগুলো শেখে এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কিভাবে সেই নিয়মগুলো ভাঙে তা নিয়ে স্টাডি করেন। মানুষের এই দুটি পরিপূরক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা রাজনৈতিকভাবে একীভূত এবং বিচ্ছিন্ন আচরণের আরও নিয়মতান্ত্রিক স্টাডি আশা করতে পারি।

উপসংহার

আমরা এই প্রবন্ধে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিভিন্ন ধরণের একীকরণ সমস্যার সম্মুখীন হয়, কারণ তাদের সমাজ এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলো ভেঙে পড়তে পারে এমন অসংখ্য উপায় রয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের একটি উচ্চ হার সরকারের জন্য নতুন দাবি ও নতুন কাজ তৈরি করে যা প্রায়শই অসংহত হয়। শাসক এলিট বা শাসিত মাস পিপলের সরকারের কার্যাবলী বাড়ানোর ইচ্ছা (যে কারণেই হোক না কেন) প্রায়শই একীকরণ সমস্যার কারণ হয়। যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি আধুনিক হচ্ছে এমন রাষ্ট্রগুলো প্রায়শই নতুন ফাংশন গ্রহণ করছে, তাই একীকরণ বা ইন্টিগ্রেশনকে কোন টার্মিনাল অবস্থা হিসেবে দেখা বেশ অনুপযুক্ত হবে। উপরন্তু, উন্নয়নশীল এলাকায় একীকরণের সমস্যাগুলো বিশেষভাবে তীব্র কারণ সেই দেশগুলোতে অনেক মৌলিকভাবে নতুন কাজ বা পুরানো কাজের বড় বৃদ্ধি বা এনলার্জমেন্ট এখন গ্রহণ করা হচ্ছে। একবার রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে সম্পদ সংগ্রহ এবং বরাদ্দ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলে, এলিট ও মাসের মধ্যে একীকরণের নতুন প্যাটার্ন সামনে আসে। একবার রাষ্ট্র জনশিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করলে এবং “জাতীয়” সংহতির অনুভূতিকে আহ্বান করলে সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে একে অপরের সাথে একীভূত করা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এবং একবার মানুষ তাদের কমোন একশনের দ্বারা নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য কর্পোরেশন, সংবাদপত্র, রাজনৈতিক দল এবং পেশাদার সমিতি তৈরি করার চেষ্টা করলে মূল্যবোধের একটি নতুন সেট চলে আসে, যার জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নতুন কাঠামোর একীকরণের চ্যালেঞ্জ চলে আসে। এভাবে একীকরণের চ্যালেঞ্জগুলো নতুন কাজ বা টাস্কগুলো থেকে উদ্ভূত হয় যেগুলো মানুষ নিজেদের জন্য তৈরি করে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.