স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)

(অলোক রায় এর “উনিশ শতকে নবজাগরণ : স্বরূপ সন্ধান” গ্রন্থটির বিবেকানন্দকে নিয়ে তিনটি অধ্যায় থেকে নেয়া)

স্বামী বিবেকানন্দ : দেশকাল

শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৭০ সালকে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের সূচনাকাল বলে নির্দেশ করেছেন। হয়তো তার কিছু আগে থেকেই জাতীয় জীবনে ধর্মোন্মাদনার সূত্রপাত হয়েছে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরাজিয়ানার ব্যাপক প্রসার ঘটে। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের অনেক অনাচারের কাহিনী আমাদের জানা আছে। কিন্তু জোয়ারের পরে ভাটার মতো সব কিছু অস্বীকারের পরে সব কিছু মেনে নেওয়ার পালা শুরু হল। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের কৃষ্ণদয়াল একদা সন্ধ্যার সময়ে গোলদিঘিতে বসে মুসলমান দোকানের কাবাব খেতেন, হিন্দুধর্মের কোনও আচার মানতেন না, আর আজ হিন্দুয়ানির সব কিছু মানেন তাই নয়, আচার-অনুষ্ঠান পালনে নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণকে ছাড়িয়ে যান। এক সময়ে ইংরেজিনবিশ হিসেবে খ্যাতিমান রাজনারায়ণ বসু ১৮৬৬ সালে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় গৌরবেচ্ছা সম্মিলনী সভা স্থাপন করেন। নবগোপাল মিত্র এই একই উদ্দেশ্য নিয়ে হিন্দু মেলা প্রবর্তন করেন (১৮৬৭)। রাজনারায়ণ বসু হিন্দু ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠতা (১৮৭৩) প্রতিপাদনের জন্য বক্তৃতা দেন। কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেওয়ার পর সমাজ-দেহে নতুন প্রাণসঞ্চার হয়। কেশবচন্দ্র অনেক ব্যাপারে নব্যপন্থী হলেও সম্ভবত সমাজবিপ্লব বা ধর্মবিপ্লব চাননি। ফলে ১৮৮০ সালেও তাঁর মুখে শুনি, “হিন্দুধর্মের নিকটে তোমরা বিদায় লইতে পার না এবং নির্বোধের মত বলিতে পার না যে, উহাতে দিদিমার গল্প বিনা আর কিছু নাই। না, আমাদের ধর্ম জাতীয় হইবে।” ধর্মের সঙ্গে এইভাবে জাতীয়তাবোধ যুক্ত হয়েছে। তবে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের ভাঙন আটকানো যায়নি। কেশবচন্দ্র ক্রমে হিন্দুয়ানির দিকে ঝুঁকলেন, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমদর্শীদল নিয়মতন্ত্রদলের সঙ্গে বিরোধ বাধল। জন্ম নিল সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ (১৮৭৮)। ইতিমধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের পরিচয় ঘটেছে (১৮৭৫), ইণ্ডিয়ান মিরর পত্রিকায় তাঁর কথা ছাপা হয়েছে। সাধারণীদের মধ্যে শিবনাথ শাস্ত্রীও শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নিয়মিত যাওয়া-আসা করতেন। ব্রাহ্মসমাজে ভক্তিবাদের প্রসার ঘটল। বৈষ্ণবদের মতো ব্রাহ্মরাও মন্দিরে কীর্তনগান ও পথে নগরসংকীর্তন শুরু করেন। একদিকে সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভা, সুনীতি সঞ্চারিণী সভার মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রচার চলেছে। অন্যদিকে সাধারণী, বঙ্গবাসী, বেদব্যাস, ধর্মপ্রচারক প্রভৃতি পত্রিকা হিন্দুধর্মের মহিমা ঘোষণায় ব্যাপৃত থেকেছে। স্বামী বিবেকানন্দ এই সময় প্রবেশিকা (১৮৭৯), এফ. এ. (১৮৮১) আর বি. এ. (১৮৮৪) পরীক্ষা দিচ্ছেন। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে শুধু তাঁর যাতায়াত নেই, তিনি সমাজে উপাসনা সংগীত গেয়ে থাকেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী ব্রাহ্মসমাজের তিন ধারার তিন আচার্যের তিনি স্নেহানুকূল্য লাভ করেন।

১৮৮১ থেকে ১৮৮৪ এই সময়ের মধ্যে বাংলায় নব্য হিন্দু সম্প্রদায়ের আত্মপ্রসার যেমন দেখা গেছে তেমনি ইংরেজি-শিক্ষিত নব্য যুবাদের মধ্যে ইয়ং বেঙ্গল-ধারায় বিভ্রান্তি ও আত্মসংকটের পরিচয় মিলেছে। নরেন্দ্রনাথ দত্ত তখন জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনের ছাত্র। তিনি যখন এফ. এ. পরীক্ষা দিচ্ছেন, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল তখন বি. এ. পরীক্ষার্থী। নরেন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্রনাথ দুজনেই দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র ছিলেন। তবে ব্রজেন্দ্রনাথ যেমন পরবর্তীকালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনকে মিলিয়ে Quest Eternal (১৯৩৬) রচনা করেছেন, নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামী বিবেকানন্দ তেমন শ্রীরামকৃষ্ণকে অবলম্বন করে তত্ত্বদর্শনের কচকচিতে আবদ্ধ না থেকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতানির্ভর পরম সত্যোপলব্ধি লাভ করেছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল তাঁর ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণার সময়ে সতীর্থ নরেন্দ্রনাথের আত্মিক সংকটের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন—

“সত্তার আরও গভীরে প্রবেশ করল সংঘাত, কারণ সার্বিক হেতু ধারণা তাঁকে তাঁর শিল্পী ও বাউল স্বভাবের স্পর্শকাতরতা ও অভীপ্সাকে দমিত করতে আহ্বান করল। তীক্ষ্ণ ও তীব্র তাঁর অনুভূতি, আবেগে দুর্বার, যৌবনের স্পর্শ চেতনায় কোমল, বন্ধু সঙ্গে সদানন্দ মুক্তপ্রাণ। এ সকলকে দমন করার অর্থ নিজের স্বাভাবিক বিকাশকে রোধ করা, কার্যত আত্মহত্যা করা। তাঁর সংগ্রাম শীঘ্রই গভীর নৈতিক রূপ গ্রহণ করল–বাসনা ও ইন্দ্রিয়ের উপর হেতুর আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রাম। ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণ, যৌবনের আকাঙ্ক্ষাকে তাঁর মনে হল— অপবিত্র, স্থূল ও দৈহিক। তাঁর জীবনের ঘনতম সংঘাতের এই কাল। সঙ্গীত নৈপুণ্যের জন্য যে সব বন্ধু জুটেছিল, তাদের অনেকের স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে তাঁর মনে ছিল তিক্ততম প্রকাশ্য ঘৃণা। কিন্তু মজা-মজলিসের প্রতি তাঁর আগ্রহও ছিল অপরিসীম। তাই আমি যখন কোনো কোনো সন্ধ্যায় সংগীতের আসরে তাঁর সঙ্গী হতাম, তিনি আশ্বস্ত হতেন।

“তিনি স্বীকার করলেন, তাঁর বুদ্ধি যদিও নির্বিশেষ তত্ত্বের দ্বারা বিজিত, কিন্তু তাঁর হৃদয় ব্যক্তি-অহং-এর অনুগত। তাঁর অভিযোগ হল—রক্তহীন হেতুবাদ, যা বাস্তবতা নয়, শুধু পুঁথিগতভাবে সার্বভৌম— সে বস্তু প্রলোভন থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তিনি জানতে চাইলেন আমার দর্শন কি তাঁর ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি আনতে পারবে, আত্মার উদ্ধারের জন্যে কার্যতঃ শারীরিক মধ্যস্থতায় সমর্থ হবে? সংক্ষেপে তিনি যেন রক্ত মাংসে দর্শনীয় আকারভৃত সত্যকে চাইলেন, সর্বোপরি অধীর হয়ে আর্তনাদ করলেন এমন একটি শক্তির জন্য যার বাহু তাঁকে রক্ষা করবে, উন্নীত করবে, উদ্ধার করবে এই নিষ্ফলতা থেকে, তাঁর শূন্য ভুবনে আনবে মহিমার প্লাবন—তেমন একজন গুরু চাই, চাই দেহধারী পূর্ণতাকে, চাই বিক্ষুব্ধ আত্মার শান্তিদাতাকে।”

ব্রজেন্দ্রনাথ এরপর মন্তব্য করেছেন, “এমনই এক সংশয়ী সন্ধানই তাঁকে দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের কাছে হাজির করেছিল, যিনি অন্যের অসাধ্য অধিকারের সুরে কথা বলেছিলেন, নিজ শক্তিতে এনেছিলেন বিবেকানন্দের আত্মায় শান্তি, তাঁর সত্তার ক্ষতকে করেছিলেন নিরাময়।” নরেন্দ্রনাথের সন্ন্যাসগ্রহণ, ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ নাম পরিগ্রহণ, শিকাগো বক্তৃতা, রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা, বেলুড় মঠ—এ সবই আজ উনিশ শতকের শেষ কয় দশকের ইতিহাসের সামগ্রী।

হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান আন্দোলনের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের যোগ ছিল। যদিও শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে উদারতার অভাব ছিল না, তাঁর মতো স্বামী বিবেকানন্দও বিশ্বাস করতেন যত মত তত পথ, আর সেই সঙ্গে “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।” তবু দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে তো বটেই, এমনকি বেলুড় মঠ-মন্দিরে হিন্দু পূজাপদ্ধতি সেদিন থেকে আজও পুরোপুরি অনুসৃত হয়। স্বামী বিবেকানন্দের মুখেই শোনা গেছে,—“কালীকে আমি কী ঘৃণাই না করতুম।—কালীতত্ত্ব গ্রহণের আগে তাঁর সংশয়াচ্ছন্ন দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন— তাঁর সঙ্গে কালীর যাবতীয় বিধি-বিধান পথকেও। আমার ছ বছরের প্রতিরোধের মূল ছিল এই—যে আমি তাঁকে স্বীকার করব না। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁকে আমাকে মেনে নিতেই হল। রামকৃষ্ণ পরমহংস আমাকে কালীর কাছে উৎসর্গ করেছেন। এখন আমি বিশ্বাস করি যে, আমি যা করি না কেন তিনি আমাকে নিয়ন্ত্রিত করছেন ও তিনি যা চান আমার দিয়ে তাই করিয়ে নেন। তবু কী দীর্ঘকাল ধরেই না আমি যুঝেছিলুম। দেখ, রামকৃষ্ণদেবকে আমি ভালবাসতুম আর আমাকে বেঁধে রেখেছিল এটাই। আমি তাঁর বিস্ময়কর পবিত্রতা দেখেছিলুম, অনুভব করেছিলুম তাঁর আশ্চর্য ভালবাসা… তাঁর বিরাটত্ব তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। সে বোধ এসেছিল পরে, আমি যখন হার মানলুম তখন। সে সময়ে আমি তাঁকে ভাবতুম এক খ্যাপা শিশু—সে সর্বদাই নানা কাল্পনিক দৃশ্য ইত্যাদি দেখছে। আর, তারপর আমাকেও কালীকে মেনে নিতে হল।”

শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধান ১৮৮৬ সালে। ততদিনে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান সত্যই একটা আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে নিশ্চয় সাহায্য করেছিলেন। এর আগে ব্রাহ্মসমাজ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘প্রচারক নিয়োগ করে, যার পিছনে হয়তো খ্রিস্টধর্মপ্রচারক বা মিশনারিদের কার্যধারার প্রভাব ছিল। (ব্রাহ্মউপাসনালয় বা ব্রাহ্মমন্দিরকে ব্রাহ্মচার্চ বলার রেওয়াজের কথা মনে পড়বে)। পরে শুধু কেশবচন্দ্র সেনের নববিধান সমাজে নয়, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজেও ব্যক্তিপূজা ও ভক্তিবাদ প্রসার লাভ করে। শিবনাথ শাস্ত্রী অবশ্য ১৮৭০ সাল থেকে ব্রাহ্মসমাজের প্রভাবে হ্রাস দেখেছেন। কিন্তু ১৮৭৮ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের জন্মের সময় সমাজের প্রভাব হ্রাস পেয়েছিল এমন বলা যায় না। তবে এই সময় থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ দেখা যায়। ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে জাতীয়তাবোধের কোনও সম্পর্ক ছিল না এমন নয়। তবু বিপিনচন্দ্র পালের মতো ব্রাহ্মনেতার মনে হয়েছে, “চল্লিশ পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বাঙ্গালাদেশে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিকূল একটা প্রবল আন্দোলন জাগিয়া উঠে। এই আন্দোলনের ভিতরকার কথা ঠিক ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব নষ্ট করার উদ্দেশ্যও ছিল না। ইহার মূলে একটা নূতন পরজাতিবিদ্বেষ বিশেষতঃ ইংরেজ-বিদ্বেষই জাগিয়াছিল। ব্রাহ্মসমাজ বড্ড বেশী বিদেশী ঢং অবলম্বন করিয়াছিলেন। একটা কল্পিত সর্বজনীনতার সন্ধানে গিয়া ব্রাহ্মসমাজ স্বাদেশিকতাকে কেবল উপেক্ষা করিয়া চলিয়াছিলেন, তাই নয় প্রকাশ্যভাবে তাহার প্রতিকূলতাই করিয়াছিলেন। এই কারণেই চল্লিশ পঞ্চাশ পূর্বেকার এই স্বাদেশিকতার ভাবস্রোত ব্রাহ্মসমাজকে গুরুতর আঘাত করিতে আরম্ভ করে। এই আন্দোলনকে আমরা সেকালে হিন্দু পুনরুত্থান বা হিন্দু রিভাইভ্যাল নাম দিয়াছিলাম। এই আন্দোলনও আমাদের বর্তমান চিত্ত ভাব ও কর্মের ধারাকে নানা দিক দিয়া পুষ্ট করিয়া তুলিয়াছিল। অনেকেই এই পুনরুত্থানে শক্তি সঞ্চার করিয়াছেন। ব্রাহ্মসমাজ নিজেও এই কাজটি একেবারে করেন নাই, এমন নয়। খ্রিষ্টীয় ধর্মের প্রতিপক্ষতা করিতে গিয়া ব্রাহ্মসমাজই সর্বপ্রথমে আধুনিক যুগে হিন্দু পুনরুত্থান প্রবর্তিত করিয়াছিলেন।” (নবযুগের বাঙ্গলা, ১৯৫৫)

উনিশ শতকের সাতের দশকে বিলাতে ও আমেরিকায় প্রেততত্ত্ব অর্থাৎ স্পিরিচুয়ালিজম ও ব্রহ্মবিদ্যা অর্থাৎ থিওলজি ব্যাপক প্রসার লাভ করে। লন্ডনে ব্রিটিশ ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ স্পিরিচুয়ালিস্টস ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হল দুই ডিরোজিও শিষ্য শিবচন্দ্র দেবপ্যারীচাঁদ মিত্র প্রেততত্ত্ব আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৮৮২ সালে লন্ডনে সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশন অফ স্পিরিচুয়ালিস্টস্ গড়ে উঠলে তার সঙ্গেও শিবচন্দ্র ও প্যারীচাঁদ অনারারি মেম্বার হিসেবে যুক্ত হন। তারপর ১৮৮০ সালে কলকাতায় স্থাপিত হল ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অফ স্পিরিচুয়ালিস্টস্। জে. কি. মিউগেখ সভাপতি, প্যারীচাঁদ মিত্র সহ-সভাপতি, নরেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রায় এই সময়েই আমেরিকায় ব্যাপকভাবে থিয়সফি চর্চা শুরু হয়। গঠিত হয় থিয়জফিক্যাল সোসাইটি, যার সভাপতি ছিলেন ওলকট্, যদিও মূল চালিকাশক্তি ছিলেন মাদাম রাভাস্কি। প্রাচ্যের গুহ্য ধর্মদর্শনচর্চা আমেরিকা থেকে এল ভারতবর্ষে। ১৮৮২ সালে যখন কলকাতায় হিন্দুধর্মের জয়জয়কার, সেই সময় থিয়জফিক্যাল সোসাইটির বঙ্গীয় শাখা গঠিত হয়। সভাপতি হন প্যারীচাঁদ মিত্র, সহ-সভাপতি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাজা শ্যামশঙ্কর রায়, সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ নরেন্দ্রনাথ সেন, সহ-সম্পাদক বলাইচাঁদ মল্লিক ও মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়। ভলকটের পরে আনি বেসান্ট বিলাতের থিয়জফিক্যাল সোসাইটি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আনি বেসান্ট ভারতবর্ষে আসার পর ব্রহ্মবিদ্যা ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। হিন্দু বা ব্রাহ্ম কারও পক্ষে থিয়জফিক্যাল সোসাইটিতে যোগ দেওয়ার বাধা না থাকায় সদস্য সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তবে স্বামী বিবেকানন্দ স্বদেশে বা বিদেশে থিয়জফি নিয়ে মাতামাতি পছন্দ করেননি। আমেরিকায় থাকার সময় তিনি চিঠিতে লিখেছেন “আমেরিকার থিয়সফিস্টরা অন্যান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এখন তারা ভারতকে খুব ঘৃণা করে। বেচারীরা।” (৬মে ১৮৯৫)। তার অল্পদিন আগে লেখা একটি চিঠিতেও পাই, “থিয়সফিস্টদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।” (১১ জানুয়ারি, ১৮৯৫)। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে থিয়জফিস্টদের এক কৌতুককর চিত্র পাওয়া যায়।

এর পাশে শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন সেনের আর্যধর্ম-প্রচারিণী সভা কিছুটা ঢাকঢোল পিটিয়ে ধর্মপ্রচারে অগ্রসর হয়। এই সভা থেকে শশধর তর্কচূড়ামণিকে ‘ধর্মাচার্য’ পদে নিযুক্ত করা হয়। শশধর হিন্দুধর্মের প্রচারের জন্য কলকাতায় নিয়মিত সভার আয়োজন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রও দু-একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন, তবে অনতিপরে তাঁর মনে হয় “পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি মহাশয় যে-হিন্দুধর্ম প্রচার করিতে নিযুক্ত, তাহা আমাদের মতে কখনই টিকিবে না। এবং তাঁহার যত্ন সফল হইবে না।” তিনি বলেন “তর্কচূড়ামণি মহাশয় ব্রাহ্মাণ পণ্ডিত, তিনি এখনও বুঝিতে পারে নাই যে, নানা সূত্রে প্রাপ্ত নূতন শিক্ষার ফলে, দেশ এখন তাহা অপেক্ষা উচ্চ ধৰ্ম্ম চায়।” বঙ্কিমচন্দ্র শশধরকে বাতিল করলেও বঙ্কিম-অনুগামী সেকালের বুদ্ধিজীবী অনেককে শশধর আকৃষ্ট করেছিলেন, যেমন চন্দ্রনাথ বসু, অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রভৃতি। স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু নব্যহিন্দুদের এই ছেলেমানুষি পছন্দ করেননি। ভাববার কথা বইয়ের সেই কৌতুকচিত্রের কথা মনে পড়বে, “গুড়গুড়ে কৃষ্ণব্যাল ভট্টাচার্য-মহাপণ্ডিত, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের খবর তাঁর নখদর্পণে। কৃষ্ণব্যাল মহাশয় না জানেন এমন জিনিসটিই নাই, বিশেষ টিকি হতে আরম্ভ করে নবদ্বার পর্যন্ত বিদ্যুৎ প্রবাহ ও চৌম্বকশক্তির গতাগতিবিষয়ে তিনি সর্বজ্ঞ। আর এ রহস্যজ্ঞান থাকার দরুণ দুর্গাপূজার বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকা হতে মায় কাদা, পুনর্বিবাহ, দশ বৎসরের কুমারীর গর্ভাধান পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতে তিনি অদ্বিতীয়। আবার প্রমাণ-প্রয়োগ—সে তো বালকেও বুঝতে পারে, তিনি এমনি সোজা করে দিয়েছেন। বলি ভারতবর্ষ ছাড়া অন্যত্র ধর্ম হয় না, ভারতের মধ্যে ব্রাহ্মণ ছাড়া ধর্ম বুঝবার আর কেউ অধিকারী নয়, ব্রাহ্মণের মধ্যে আবার কৃষ্ণব্যালগুটি ছাড়া বাকী সব কিছুই নয়, আবার কৃষ্ণব্যালদের মধ্যে গুড়গুড়ে।”

বিজ্ঞান কিছুই না পড়ে, না জেনে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রবণতার মধ্যে হিন্দু রিভাইভ্যালের একটা দিক ধরা আছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায়—“আমরা beautiful muddle, a queer amalgam of শশধর, Huxley and goose রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে হিন্দুয়ানির বাড়াবাড়ির মধ্যে বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যা যেমন দেখেছেন তেমনি আর্যত্ব নিয়ে বাঙালির আস্ফালনের হাস্যকরতা প্রত্যক্ষ করেছেন। আমি আর্য, আমার বাবা শ্রীনকুড় কুণ্ডু আর্য, তাঁর বাবা নফর কুণ্ডু আর্য, তাঁর বাবা—” এই গর্ববোধ থেকে পরম আর্য শ্রীচিন্তামণি কুণ্ডু বলেন, “য়ুরোপীয়েরা অতি নিকৃষ্ট জাতি এবং বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের পূর্বপুরুষ আর্যদের তুলনায় তারা নিতান্ত মূর্খ—আমি প্রমাণ করে দেব।” আর্যবংশীয়েরা তেল মাখার পূর্বে অশ্বত্থামাকে স্মরণ করে কেন তিন বার তৈল নিক্ষেপ করে, হাই তোলবার সময় আর্যরা তুড়ি দেন কেন, আর্য মেয়েরা বাতাস করতে করতে পাখা গায়ে লাগলে ভূমিতে একবার ঠেকায় কেন ইত্যাদি সব কিছুর পিছনে আছে ম্যাগনেটিজ্ম ও ফোর্স। চিন্তামণি বিজ্ঞান পড়ার সময়-সুযোগ না পেলেও “চিন্তাশক্তির প্রভাবে আমাদের আর্যজাতির হাঁচি কাশি তুড়ি আঙুল মটকানো প্রভৃতি আচার-ব্যবহারের সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সকল আয়ত্ত” করেছেন। এই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘বঙ্গবীর’ কবিতাটির কথাও মনে পড়বে, “মোক্ষমূলর বলেছে ‘আর্য’/ সেই শুনে সব ছেড়েছি কাৰ্য,/ মোরা বড়ো বলে করেছি ধার্য—/ আরামে পড়েছি শুয়ে।/মনু নাকি ছিল আধ্যাত্মিক,/ আমরাও তাই করিয়াছি ঠিক—/ এ যে নাহি বলে ধিক্ তারে ধিক্/শাপ দি পইতে ছুঁয়ে।” (১৮৮১)

স্বামী বিবেকানন্দ নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের আলোচনায় দেখিয়েছেন ভারতবর্ষের সব মানুষ নিজেদের আর্য বলে দাবি করতে পারে না। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো তিনিও মনে করতেন বাঙালি মিশ্রজাতি। পরিব্রাজক বইতে স্বামী বিবেকানন্দ কিছুটা কঠোর ভাষায় বাঙালির আর্যত্ব নিয়ে আস্ফালনকে ভর্ৎসনা করেছেন, “আর্যবাবাগণের জাঁকই কর, প্রাচীন ভারতের গৌরব ঘোষণা দিনরাতই কর, আর যতই কেন তোমরা ‘ডম্মম্’ বলে ডাই কর, তোমরা উচ্চ বর্ণেরা কি বেঁচে আছ? তোমরা হচ্ছ দশ হাজার বছরের মমি!! যাঁদের চলমান শ্মশান’ বলে তোমাদের পূর্বপুরুষরা ঘৃণা করেছেন, ভারতে যা কিছু বর্তমান জীবন আছে, তা তাদেরই মধ্যে। আর ‘চলমান শ্মশান’ হচ্ছ তোমরা।” ইউরোপীয়দের আর্য বলে নিজেদের দাবি করা যেমন হাস্যকর, তেমনি ‘কেউ চার পো আর্য, কেউ এক ছটাক কম, কেউ আধ কাঁচ্চা” বলা সমান অসংগত। স্বামী বিবেকানন্দের পক্ষে জাতিভেদ মানা ছিল অসম্ভব। তবে কায়স্থ বলে নিজেকে শূদ্রই বিবেচনা করতেন। বিদেশে যাওয়ার সময়ে এমিগ্রেসনের আইনের জালে—“মহারাজা, রাজা, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—সব এক জাত, সরকারের কাছে সব ‘নেটিভ’। কুলির আইন, কুলির যে পরীক্ষা, তা সকল নেটিভের জন্য ধন্য ইংরেজ সরকার। এক ক্ষণের জন্যও তোমার কৃপায় সব ‘নেটিভে’র সঙ্গে সমত্ব বোধ কল্লেম। বিশেষ কায়স্থকুলে এ শরীরের পয়দা হওয়ায়, আমি তো চোরের দায়ে ধরা পড়েছি।”

১৮৮৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র যখন প্রচার পত্রিকা প্রকাশ করেন, তখন তিনি দেখেছেন, “সম্প্রতি সুশিক্ষিত বাঙ্গালিদিগের মধ্যে হিন্দুধর্মের আলোচনা দেখা যাইতেছে। অনেকেই মনে করেন যে, আমরা হিন্দুধর্ম্মের প্রতি ভক্তিমান্ হইতেছি। যদি এ কথা সত্য হয়, তবে আহ্লাদের বিষয় বটে। জাতীয় ধর্মের পুনরুজ্জীবন ব্যতীত ভারতবর্ষের মঙ্গল নাই, ইহা আমাদিগের দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু যাঁহারা হিন্দুধর্মের প্রতি এইরূপ অনুরাগযুক্ত, তাঁহাদিগকে আমাদিগের গোটাকত কথা জিজ্ঞাসা আছে। প্রথম জিজ্ঞাসা, হিন্দুধর্ম্ম কি? হিন্দুয়ানিতে অনেক রকম দেখিতে পাই। হিন্দু হাঁচি পড়িলে পা বাড়ায় না, টিকটিকি ডাকিলে সত্য সত্য বলে, হাই উঠিলে তুড়ি দেয়, এ সকল কি হিন্দুধৰ্ম্ম? অমুক শিয়রে শুইতে নাই, অমুক আস্যে খাইতে নাই। শূন্য কলসী দেখিলে যাত্রা করিতে নাই, অমুক বারে ক্ষৌরী করিতে নাই, অমুক বারে অমুক কাজ করিতে নাই এ সকল কি হিন্দুধর্ম্ম? অনেকে স্বীকার করিবেন যে, এ সকল হিন্দুধর্ম নহে। মূর্খের আচার মাত্র। যদি ইহা হিন্দুধর্ম্ম হয়, তবে আমরা মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে, আমরা হিন্দুধর্ম্মের পুনর্জীবন চাহি না।” ঠিক এই কথাগুলি স্বামী বিবেকানন্দ বলতে পারতেন, বলেওছেন অন্যভাবে, অন্যভাষায়।

হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে শশধর শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন প্রধান অংশ নিলেও, সেইসঙ্গে স্পিরিচুয়ালিস্ট থিয়জফিস্ট, ভূদেব, বঙ্কিম, শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বলাবাহুল্য, এঁরা কেউ কারও মতো নয়। তবে একটা ব্যাপারে হয়তো সকলের মধ্যেই মিল ছিল, সকলেই ছিলেন স্বদেশপ্রেমী। দেশ-জাতি-ধর্ম পরস্পরসংশ্লিষ্ট। স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বদেশের ধর্ম রক্ষার জন্য সচেষ্টতা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলতত্ত্বে ‘দেশপ্রীতি সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম’ বলে পরিগণিত হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মপ্রচারের সময় সাধারণভাবে রাজনীতি প্রসঙ্গ পরিহার করেছেন। তিনি ১৮৯৪ চিঠিতে লিখছেন, “কলকাতায় প্রকাশিত আমার বক্তৃতা ও নানা উক্তি সম্বলিত গ্রন্থসমূহে একটি জিনিস লক্ষ করছি। তার কতকগুলি এমনভাবে ছাপানো হয়েছে যে, তাতে রাজনীতিক মতামতের আভাসটাই স্পষ্ট, অথচ আমি রাজনীতিজ্ঞ নই, রাজনৈতিক আন্দোলন আমার নয়। আমার সমগ্র প্রয়াস আধ্যাত্মিকতা নিয়ে—এইটি ঠিক হলে আর সব কিছু আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে।… ক্রিশ্চিয়ান গভর্নমেন্টের সম্পর্কে সততাপূর্ণ সমালোচনা প্রসঙ্গে সাধারণভাবে আমি কিছু কড়া কথা বলেছি, তদ্দ্বারা একথা প্রমাণ হয় না যে, রাজনীতি বা ঐধরনের ব্যাপার নিয়ে আমি খুব মাথা ঘামাচ্ছি বা ঐ সব ব্যাপারের সঙ্গে আমার খুব সম্পর্ক আছে। ঐ সব বক্তৃতার অংশ বিশেষ ছাপিয়ে যারা বাহবা নিতে চায় এবং প্রমাণ করতে চেষ্টা করে যে, আমি একজন রাজনীতির প্রবক্তা, তাদের উদ্দেশে আমি বলি, আমার বন্ধুদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো।” (দ্র. আলাসিঙ্গাকে লেখা চিঠির ভাষান্তর, বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ)। এই সময়ে এবং এর পরেও স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাইদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সম্ভবত তিনি রাজনীতি ও ধর্মকে মেশাতে চাননি, অন্তত রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যধারায়। তবে শিষ্যা সম্ভবত গুরুর পরামর্শ গ্রহণ করেননি, ভগিনী নিবেদিতা এক সময়ে বিপ্লবী কর্মধারার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। বিপ্লবীরা স্বামী বিবেকানন্দের রচনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, বিদেশি শাসকেরা চিরদিন রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের সন্দেহের চোখে দেখেছে। আর ভগিনী নিবেদিতাকে অনেকটা এইজন্যই রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করতে হয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দ যদিও বারবার বলেন, “আমি সংগঠন নই, আমার ধাতে রয়েছে বিদ্যাচর্চা এবং ধ্যান।” এবং “আমি অদ্বৈতবাদী; আমাদের লক্ষ্য জ্ঞানার্জন-সেখানে কোনো অনুভূতি, কোনো ভালোবাসার স্থান নেই, কারণ এই সবই বস্তু, কুসংস্কার এবং বন্ধনের বাহন। আমি শুধু অস্তিত্ব এবং জ্ঞান।” (মিস মেরী হালেকে লেখা চিঠি, ২৩ জুন ১৯০০)। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের পরিব্রাজক ও বর্তমান ভারত পড়লে বোঝা যায় (তাঁর চিঠিপত্রে আরও বেশি) তাঁর মধ্যে ইতিহাসবোধ ও সমাজবোধ প্রবল। তিনি একই সঙ্গে স্বপ্নদ্রষ্টা ভাবুক ও বাস্তবদৃষ্টি সম্পন্ন কর্মী। শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীপ্রচার তাঁর জীবনের লক্ষ্য হলেও কখনও তিনি প্রভু ও গুরুকে দেবতা বানাতে চাননি। চিঠিতে তিনি লেখেন “রামকৃষ্ণের অলৌকিক কীর্তিকলাপ নিয়ে কী সব বাজে কথা বলা হচ্ছে। অলৌকিক কীর্তিকলাপের কিছু আমি জানি না বুঝিও না। সুরাকে (ডি.) গুপ্তর পাচনে পরিণত করা ছাড়া কি এই পৃথিবীতে রামকৃষ্ণের আর কিছুই করবার ছিল না?” (আলাসিঙ্গাকে লেখা, ৩০ নভেম্বর ১৮৯৪)। অন্য সময়ে তিনি লিখবেন, “আমার আইডিয়া বাস্তবায়িত হোক আমি তাই চাই। সকল ধর্ম প্রবক্তারই শিষ্যমণ্ডলী তাদের গুরুকে আর গুরুর আইডিয়াকে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়ে ফেলেছিল। পরিণামে তারা গুরুর খাতিরে তাদের আইডিয়াকে হত্যা করেছে। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের ঐ রকম পরিণাম থেকে সতর্ক থাকতে হবে। কাজ কর আইডিয়ার জন্য, ব্যক্তির জন্য নয়।” (১২-০১-১৮৯৫)। শিকাগো বক্তৃতায় এই আইডিয়ার প্রকাশ ঘটে— “To proclaim and make clear the fundamental unity underlying all religions was the mission of my Master Other) teachers have taught special religions which bear their names, but this great. teacher of the nineteenth century made no claim for himself He left every religion undisturbed because he had realised that in reality they are all part and parcel of the one eternal religion.” (My Master)

স্বামী বিবেকানন্দ যে-হিন্দুধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় লেখালিখি করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, মঠ-মিশন স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পূজা-অৰ্চনা মন্ত্রপাঠ মন্দিরে আরাধ্যা দেবীমূর্তির কোনও যোগ নেই। তিনি প্রতীকোপাসনা এবং অনুষ্ঠানাদিকে হিন্দুধর্মের সারবস্তু মনে করতেন না। তিনি বলতেন, “কোনো ধর্মপালনে কালীপূজা আবশ্যিক নয়। কালীপূজা আমার নিজের একটা বিশেষ খেয়াল।” (মেরী হালেকে লেখা চিঠি, ১৭,০৬১৯০০)। আসলে চিত্তের প্রসার এমন এক জায়গায় পৌঁছয়, যখন বলতে পারা যায় “আস্তিক, সর্বেশ্বরবাদী, অদ্বৈতবাদী, বহু দেবতায় বিশ্বাসী, অজ্ঞেয়বাদী অথবা নাস্তিক কারো মতবাদকে আমরা নাকচ করি না, — শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য হওয়ার একমাত্র শর্ত হল হৃদয়কে উদারতায় আর গভীরতায় পূর্ণ করতে হবে।” (আমরা কি বিশ্বাস করি, বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ-৫)। ফলে বাইরে সন্ন্যাসীর বেশভূষা গ্রহণ করলেও জীবনাচরণে গুরুর মতো কোনও ধর্মীয় বিধিবিধানে বাঁধা পড়েননি। আমেরিকা থেকে তিনি চিঠিতে লেখেন, ভারতবর্ষে যদি তাঁর সম্বন্ধে অহিন্দু খাদ্যগ্রহণের অভিযোগ ওঠে তাহলে তাঁর জন্য হিন্দু-পাচক ও তার ভরণপোষণের জন্য টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হোক। শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে যেরকম বর্ণ-বিদ্বেষী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, হৃদয়হীন, ভণ্ড, নাস্তিক, কাপুরুষ দেখা যায় আমি তাদের মতো জীবনযাপন করে তাদেরই মতো মরব বলে জন্মগ্রহণ করেছি বলতে চাও নাকি? উদ্বোধন পত্রিকার প্রস্তাবনায় তিনি লেখেন পাশ্চাত্যের রজোগুণ ও ভারতবর্ষের সত্ত্বগুণের সম্মিলন ও মিশ্রণে যথাসাধ্য সহায়তা করা তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি জানতেন উনিশ শতকে “বিজাতীয় ও প্রাচীন স্বজাতীয় ভাবসংঘর্ষে অল্পে অল্পে দীর্ঘসুপ্ত জাতি বিনিদ্র হইতেছে।” কিন্তু তিনি বারবার আমাদের সচেতন করে দিয়েছেন, “হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘূর্ণিত জঘনা নিষ্ঠুরতা— এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে। এই লজ্জাকর কাপুরুষতাসহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে?” তবে স্বামী বিবেকানন্দের ‘স্বদেশ মন্ত্রের মধ্যে শূদ্রজাগরণের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে সীতা সাবিত্রী দময়ন্তী, সর্বত্যাগী শঙ্করের আদর্শ অনুসরণের কথা। এই দ্বৈধতা উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরণের মধ্যে যেমন দেখা গেছে, স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যেও তা দুর্নিরীক্ষ্য নয়।

নির্বিকল্প সমাধি বনাম স্বদেশোদ্ধার

ভারতবর্ষে সাধু-সন্ন্যাসীর অভাব নেই। সিমলের দত্তবাড়িতে সন্ন্যাসী সমাগম হত নিয়মিত। বনেদি বর্ধিষ্ণু পরিবারে স্বাভাবিকভাবে পূজার্চনার চল ছিল। শিশু নরেন্দ্রনাথ শিবমূর্তি ঘিরে ধ্যানে বসতেন, বিবেকানন্দ চরিতকার জানিয়েছেন, সদাচঞ্চল ক্রীড়াপ্রিয় নরেন্দ্রনাথ ধ্যানে বসিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিবার সঙ্গে সঙ্গেই বাহাজগৎ বিস্তৃত হইতেন—–আহ্বান দূরে থাকুক, অনেক সময়ে অঙ্গ হস্তার্পণ করিলেও টের পাইতেন না। সংযতমনা যোগীর বহু বর্ষ সাধনার ফল বালক কেমন করিয়া লাভ করিলেন?’ ধ্যানযোগ ছিল বালকের স্বভাবসিদ্ধ। তবে ক্রমশ তাঁর মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। বিশেষত কলেজে পড়ার সময়ে জীবনজিজ্ঞাসা তাঁকে ক্রমশ সংশয়ী অবিশ্বাসী করে তোলে। ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াতের ফলে তিনি পৌত্তলিকতা বিরোধী হয়ে ওঠেন। জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশনে তাঁর এক ক্লাস ওপরে পড়তেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। ব্রজেন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে তাঁর স্মৃতিচারণে সতীর্থ নরেন্দ্রনাথের মানসিক অস্থিরতা–সংশয়বাদ ও অজ্ঞেয়বাদ থেকে বিশ্বাসের জগতে উত্তরণ প্রয়াসের কথা সবিস্তারে জানিয়েছেন। আসলে অপরোক্ষ অনুভূতির জন্য ব্যাকুলতা জেগেছে নরেন্দ্রনাথের মনে, হেতুবাদের সঙ্গে তিনি মেলাতে চেয়েছেন অনুভূতি ও স্বভাবধর্মকে—’অধীর হয়ে আর্তনাদ করলেন এমন একটি শক্তির জন্য যার বাহু তাঁকে রক্ষা করবে, উন্নীত করবে, উদ্ধার করবে এই নিষ্ফলতা থেকে, তাঁর শূন্য ভুবনে আনবে মহিমার প্লাবন—তেমন একজন গুরু চাই, চাই দেহধারী পূর্ণতাকে, চাই বিক্ষুব্ধ আত্মার শাস্তিদাতাকে।’ (শঙ্করীপ্রসাদ বসু কৃত ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের প্রবন্ধের ভাষাত্তর। দ্র. বিশ্ববিবেক।)

শেলির কবিতা পছন্দ করলেও ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন নরেন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রিয় কবি। জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশনের তিনি যখন ছাত্র, তখন ক্লাসে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় trance or meditation এর ব্যাখ্যা করার সময়ে অধ্যাপক (অধ্যক্ষ) উইলিয়াম হেস্টি বলেন, ওয়ার্ডসওয়ার্থের সৌন্দর্যানুভব এক ধরনের ভাবসমাধি—’ছাত্রগণ সমাধির কথা বুঝিতে না পারায় তিনি তাহাদিগকে উক্ত অবস্থার কথা যথাবিধি বুঝাইয়া পরিশেষে বলিয়াছিলেন, চিত্তের পবিত্রতা ও বিষয়বিশেষে একাগ্রতা হইতে উক্ত অবস্থার উদয় হইয়া থাকে। ঐ প্রকার অবস্থার অধিকারী বিরল দেখিতে পাওয়া যায়। একমাত্র দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মধ্যে ঐরূপ অবস্থা দেখিয়াছি। তাঁহার উক্ত অবস্থা একদিন দর্শন করিয়া আসিলে তোমরা এ বিষয়ে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবে।’ (স্বামী সারদানন্দ, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ)। হেস্টির এই নির্দেশের ফলে নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনাভিলাষী হন, এবং ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ মিত্রর গৃহে প্রথম তাঁকে দেখেন। এরপর দক্ষিণেশ্বরে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি সেই বিখ্যাত সাক্ষাৎকার–পরমহংসদেব তাঁকে দেখেই বললেন, তুই এতদিন কেমন করে ভুলে ছিলি! তুই আসবি বলে আমি কতদিন ধরে পথ পানে চেয়ে বসে আছি। বিষয়ী লোকের সঙ্গে কথা কয়ে আমার মুখ পুড়ে গেছে, আজ থেকে তোর মতো যথার্থ ত্যাগীর সঙ্গে কথা কয়ে শান্তি পাব। আর নরেন্দ্রনাথের প্রশ্ন, আপনি কি ঈশ্বর দর্শন করেছেন? এরপর পরমহংসদেবের স্পর্শে নরেন্দ্রের শুধু ঈশ্বর দর্শন নয় ব্রহ্মোপলব্ধি পর্যন্ত সম্ভব হল। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন। তিনি গুরুর কাছে আত্মজ্ঞান লাভের জন্য নির্বিকল্প সমাধি বার বার প্রার্থনা করেছেন যোগিভিষ্ঠানগমাম্। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট অবস্থায় মাঝে মাঝে সমাধিস্থ হলেও নির্বিকল্প সমাধি কাম্য বিবেচনা করেননি। তাঁর তিরোধানের পর অন্তরঙ্গ ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে কয়েকজন নরেন্দ্রনাথকে নিয়ে এগারো জন–বিরজাহোম করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এই সন্ন্যাসীদের উদ্যোগে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ স্থাপিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ সংসারত্যাগী মহাসাধক হওয়া সত্ত্বেও ভারতবর্ষে সন্ন্যাসীদের যে কয়েকটি ধারা বা গোষ্ঠী আছে, তার মধ্যে কোনও ধারায় তাঁকে চিহ্নিত করা যায় না। নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাস গ্রহণ করে যখন স্বামী বিবিদিষানন্দ বা স্বামী বিবেকানন্দ নাম গ্রহণ করেন, তখন তিনি অধিকাংশ সময়ে নরেন্দ্রনাথ বলেই নিজের পরিচয় দিতেন। (দ্রষ্টব্য পত্রাবলী)। আসলে ভারতবর্ষে সন্ন্যাসীরা আত্মনো মোক্ষার্থং’ জীবন উৎসর্গ করেন। গভীর বৈরাগ্য ও অন্তরের অন্বেষণ থেকেই তাঁদের সংসার ত্যাগ–সন্ন্যাস গ্রহণ। সন্ন্যাসী আত্মার মুক্তিসাধনে সচেষ্ট।

শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাস গ্রহণ করা সত্ত্বেও নিজের মুক্তির কথা কখনও ভাবেননি। (শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের মুক্তির কথা ভাবতে নিষেধ করতেন) অথচ যখন মঠ মিশন তৈরি হল, তখন শুধু গুরুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে মন্দির নির্মিত হল, তাই নয়, সাধন পূজন ভজন-আরাধনার উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া হল। পূজার্চনা হয়তো সাধারণ ভক্তমণ্ডলী বা দর্শকদের জন্য। কিন্তু নীরবে নিভৃতে কয়েক ঘণ্টা ধ্যান সন্ন্যাসীর অবশ্যকৃত্য। আসলে সন্ন্যাসীরা যোগী। স্বামী বিবেকানন্দ নিজে যোগ সাধন করতেন ও অন্যকে যোগ শিক্ষা দিতেন। বিদেশে এমনও ঘটেছে, যোগশিক্ষা দেওয়ার জন্য মুমুক্ষ ভক্তদের সমাধি দেখানোর সময়, এমন ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ এমন সমাধি ঘটেছে তা প্রদর্শনের সামগ্রী নয়। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের পরিকল্পনায় স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন, যাঁহারা সাধন ভজন করিতে চাহেন, তাঁহাদের আপন আপন ঘরে সাধন ভজনের যাহা আবশ্যক—তাহার সহায়তা করা ইত্যাদি। কিন্তু একজন সাধন করেন বলিয়া আর কাউকেও যে পড়িতে দিবেন না, অথবা প্রচার করিতে দিবেন না—এ প্রকার না হয়। স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাস জীবনের সূচনায় প্রভূত সাধন-ভজন করেছেন। গৃহে-মঠে-পরিব্রাজক জীবনে তাঁর ধ্যানমগ্ন রূপ ও কঠোর সন্ন্যাস জীবন অনেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ভগিনী নিবেদিতার মনে হয়েছে, “To his disciples, Vivekananda will remain the archetype of the Sannyasin.’ তবে সম্ভবত আমাদের চারপাশে ভারতবর্ষে যে হাজার হাজার সাধু সন্ন্যাসীকে দেখি, স্বামী বিবেকানন্দ ঠিক তাঁদের মতো নন। অন্যদিকে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য হলেও তিনি গুরুর প্রতিরূপ নন। তাঁর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য অপরিসীম, বহু ভাষায় তাঁর অধিকার (ফরাসি ও জার্মান ভাষা শেখার জন্য তাঁর অধ্যবসায়ের কথা আমরা জানি), বিশ্বপরিব্রাজক, অসামান্য বাগ্মী, সংগঠনী শক্তির অধিকারী (মঠ-মিশন তাঁর নিজের হাতের সৃষ্টি), উনিশ-বিশ শতকে শ্রেষ্ঠ ধর্মব্যাখ্যাতা ও সমাজসংস্কারক, সর্বোপরি ভগিনী নিবেদিতার ভাষায়, ‘His great acumen was yoked to a marvellous humanity’ এখানে আমাদের মনে পড়বে, মহাপ্রয়াণের মাত্র দু’দিন আগে কথাপ্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের পর আমি একমাত্র বিদ্যাসাগরকে অনুসরণ করব। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা থেকে স্বামী বিবেকানন্দ লিখছেন, ‘আমাদের একটা বড় দোষ সন্ন্যাসের গরিমা। ওটা প্রথম প্রথম দরকার ছিল এখন আমরা পেকে গেছি, ওটার আবশ্যক একেবারেই নেই। বুঝতে পেরেছ? সন্ন্যাসী আর গৃহস্থে কোন ভেদ থাকবে না, তবে যথার্থ সন্ন্যাসী। হাঁ হে বাপু, সন্ন্যাসী ফন্ন্যাসী মিছে কথা—মুকং করোতি ইত্যাদি। বাবা, কার মধ্যে কি আছে বুঝা যায় না। গৈরিক বসন ধারণ করেও তথাকথিত মুক্তির সন্ধানে জগৎ জীবন থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হননি তিনি। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব হয়তো এখানেই সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। এমনকি যেন অনেক সময়ে গুরুর ভাষা শিষ্যের মুখে শোনা যায়—“দাদা, মুক্তি নাই বা হল, দু’চারবার নারককুণ্ডে গেলেই বা। নাই বা হল তোমাদের মুক্তি। মুক্তি-ভক্তির ভাব দূর করে দে। এই একমাত্র রাস্তা আছে দুনিয়ায়— পরোপকারায় হি সত্যৎ জীবিতং পরার্থং প্রাজ উৎসজেৎ। তোমার ভাল করলেই আমার ভাল হয়, দোসরা উপায় নেই, একেবারেই নেই। হে ভগবান, হে ভগবান!! আরে ভগবান হেন করবেন তেন করবেন আর তুমি বসে বসে কি করবে।” (স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা চিঠি, (১৮৯৫)) স্বামী বিবেকানন্দ ভক্তিযোগ-এর দীক্ষা পেয়েছিলেন সম্ভবত গুরুর কাছ থেকে। সেখানে তিনি দ্বৈতবাদী—কোনও ভক্ত প্রেম ছাড়া আর কিছু চায় না–চায় কেবলমাত্র ভগবৎ প্রেমের আনন্দ। ঈশ্বরপ্রেম বৃদ্ধি পেতে পেতে হয়ে ওঠে পরাভক্তি বা পরমভক্তি আকার মিলিয়ে যায়, ধর্মকর্মকাণ্ড উবে যায়। তবে স্বামী বিবেকানন্দ জানতেন, কর্মচক্র থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে পারেন কোটিতে গুটিক-বাসনার বিলুপ্তি বড়ো কঠিন কাজ। তিনি চেয়েছেন কর্মচক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কর্মযোগ শিক্ষা করতে। কর্মযোগী বলে, কল্যাণ করা ভালো বলেই করা। যে স্বর্গের জন্য সৎ কাজ করে, সেও বদ্ধ হয়। এতটুকু স্বার্থ নিয়ে যে কাজ করা হয়, তা আমাদের মুক্ত করার বদলে পায়ে আর একটি শৃঙ্খল পরিয়ে দেয়। বৌদ্ধধর্ম দর্শনের সবটুকু স্বামী বিবেকানন্দ গ্রহণ করতে পারেননি, কিন্তু বুদ্ধদেবকে তিনি মনে করেছেন আদর্শ কর্মযোগী–সম্পূর্ণ বিনা স্বার্থে, অর্থ-খ্যাতি বা অন্য কিছুর অপেক্ষা না করে কাজ করে সে-ই যথার্থ কর্মযোগের অধিকারী। বুদ্ধদেবের মতোই স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, আমি ঈশ্বর সম্বন্ধে তোমাদের বিভিন্ন তত্ত্ব জানাতে চাই না, আত্মার বিষয়ে সূক্ষ্ম মতের আলোচনায় লাভ নেই—সৎ কাজ করো সৎ হও – এতে তোমরা মুক্তি ও সত্যলাভ করবে।

আসলে ধর্ম ও কর্মের সম্মিলন তাঁর কাম্য ছিল। ধর্মের দিক থেকে তিনি বৈদান্তিক সন্ন্যাসী, কর্মের দিক থেকে তিনি স্বদেশোদ্ধারে ব্রতী, এমনকী কখনও পলিটিক্যাল ম্যান। তাঁর মুখেই আমরা শুনেছি, ‘এ দেশের প্রাণ ধর্ম, ভাষা ধর্ম, ভাব ধর্ম, আর তোমার রাজনীতি, সমাজনীতি, রাস্তা ঝোঁটানো, প্লেগ নিবারণ, দুর্ভিক্ষগ্রস্তকে অন্নদান, এসব চিরকাল এদেশে যা হয়েছে, তাই হবে, অর্থাৎ ধর্মের দিক দিয়ে হবে তা হবে, নইলে ঘোড়ার ডিম, তোমার চেঁচামেচিই সার, রামচন্দ্র।” (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য)। রাজনীতির নামে পাশ্চাত্য দেশে যে অনাচার তিনি দেখেছেন, ভারতবর্ষে তিনি তা কাম্য বিবেচনা করেননি। তবে শুরুর কথামতো যিনি বলেন, যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি, তিনি পাশ্চাত্য রাজনীতি থেকে কিছুই গ্রহণ করেননি এমন নয় (ভোট-ব্যালটের সঙ্গে প্রজাদের যে একটা শিক্ষা হয় তা তিনি জানেন) শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের নিয়মাবলীর মধ্যে ভোট-ব্যালটের কথা তিনিই বলেন। তিনি হয়তো চাননি মঠের সন্ন্যাসীরা প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিক (তিনি না চাইলেও পরে শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে মঠ ও মিশন জড়িয়ে পড়েছে)। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি আমেরিকা থেকে পত্রে লিখেছেন, ‘পলিটিক্যাল বিষয় তোমরা কেউ ছুঁয়ো না এবং তুলসীরামবাবু যেন পলিটিক্যাল পত্র না লেখে। এখন পাবলিক ম্যান, অনর্থক শত্রু বাড়াবার দরকার নেই। যদি পুলিশ-ফুলিশ পেছনে লাগে তোদের ‘দাঁড়িয়ে জান দে’। ওরে বাপ, এমন দিন কি হবে যে, পরোপকারায় জান যাবে? ওরে হতভাগারা, এ দুনিয়া ছেলেখেলা নয়-বড় লোক তাঁরা, যাঁরা আপনার বুকের রক্ত দিয়ে রাস্তা তৈরি করেন। এই হয়ে আসছে চিরকাল। একজন আপনার শরীর দিয়ে সেতু বানায়, আর হাজার হাজার লোক তার উপর দিয়ে নদী পার হয়।

সমাজসেবার যে আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ গ্রহণ করেছিলেন, তার ভেতর যেমন তাঁর কর্মযোগের পরিচয় আছে, তেমনি তাঁর গভীর মানবপ্রেম ও স্বদেশপ্রেমের পরিচয় আছে “পরোপকারই ধর্ম, বাকি যাগযজ্ঞ সব পাগলামো—নিজর মুক্তি ইচ্ছাও অন্যায়। যে পরের জন্য সব দিয়েছে, সেই মুক্ত হয়, আর যারা আমার মুক্তি আমার মুক্তি করে দিনরাত মাথা ঘামায়, তারা ইতোনষ্টততোভ্রষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়ায়।” (৩০ মে ১৮৯৭)। মঠ মন্দিরের প্রয়োজন তিনি জানতেন, কিন্তু কাঁসর-ঘণ্টা-চামর ঠাকুরের জন্মোৎসব পালনে খিচুড়ি খাওয়ানোর মধ্যে জ্ঞান-ভক্তি-কর্ম কিছুই নেই—“যদি ভাল চাও তো ঘণ্টাফণ্টাগুলোকে গঙ্গার জলে সঁপে দিয়ে সাক্ষাৎ ভগবান নর-নারায়ণের মানবদেহধারী হরেক মানুষের পুজো করগে— বিরাট আর স্বরাট রূপ এই জগৎ, তার পুজো মানে তার সেবা-এর নাম কর্ম, ঘণ্টার উপর চামর চড়ানো নয়, আর ভাতের থালা সামনে ধরে দশ মিনিট বসব কি আধ ঘণ্টা বসব এ বিচারের নাম ‘কর্ম’ নয়, ওর নাম পাগলাগারদ। ক্রোর টাকা খরচ করে কাশী-বৃন্দাবনের ঠাকুরঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন, এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন, তো ঠাকুরের আঁটকুড়িদের বেটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন; এদিকে জ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা, বিদ্যা বিনা মরে যাচ্ছে।” (১৮৯৪) স্বদেশকে ভালোবেসে স্বদেশোদ্ধারের উপায় হিসেবে শ্রমজীবী মানুষ, তথা শূদ্র শ্রেণীর নব-জাগরণের ওপর স্বামী বিবেকানন্দ বেশি জোর দিয়েছেন। বর্তমান ভারত বইয়ের শেষে ‘স্বদেশমন্ত্র’ বলে যে উদাত্ত আহ্বানধ্বনি শোনা গেছে, তাকে বিপ্লবী শ্লোগান বললেও ভুল হয় না—’ভুলিও না—নীচজাতি, মুখ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই। হে বীর, সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল—আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল—মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই…।’ শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের মধ্যে অনেকে তথাকথিত জাতিবিভক্ত ভারতবর্ষে ‘শূদ্র’ বলে পরিগণিত হতেন, আর আমাদের তথাবিহিত শাস্ত্রগ্রন্থে শুদ্রের পক্ষে সন্ন্যাসগ্রহণ নিষিদ্ধ। স্বদেশোদ্ধারে যিনি আত্মনিয়োগ করেছেন, তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করবেন এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবে স্বামী বিবেকানন্দ সমাজবিপ্লব চেয়েছিলেন, এমন মনে করার কারণ নেই। মঠমিশনকে সমাজশৃঙ্খলের বাইরে রাখলে স্বদেশোদ্ধারের পথে বাধা সৃষ্টি হত। তিনি জানতেন, ‘ঐ যারা চাষাভূষা তাঁতি-জোলা ভারতের নগণ্য মানুষ বিজাতিবিজিত স্বজাতিনিন্দিত ছোট জাত, তারাই আবহমানকাল নীরবে কাজ করে যাচ্ছে (‘ওরা কাজ করে’), তাদের পরিশ্রমফলও তারা পাচ্ছে না। তবে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নিয়মে দুনিয়াময় কত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। দেশ, সভ্যতা, প্রাধান্য ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে।’ (পরিব্রাজক)। শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতবর্ষকে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর কর্মক্ষত্র বলে গ্রহণ করেছিলেন। স্বামী অখণ্ডানন্দকে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি লিখছেন, ‘খেতড়ি শহরের গরীব নীচ জাতিদের ঘরে ঘরে গিয়া ধর্ম উপদেশ করিবে আর তাদের অন্যান্য বিষয়, ভূগোল ইত্যাদি মৌখিক উপদেশ করিবে। বসে বসে রাজভোগ খাওয়ায়, আর ‘হে প্রভু রামকৃষ্ণ’ বলায় কোনও ফল নাই, যদি কিছু গরীবদের উপকার করিতে না পারো। মধ্যে মধ্যে অন্য অন্য গ্রামে যাও। উপদেশ কর, বিদ্যা শিক্ষা দাও। কর্ম, উপাসনা, জ্ঞান-ই কর্ম কর, তবে চিত্তশুদ্ধি হইবে, নতুবা সব ভস্মে ঘৃত ঢালার ন্যায় নিষ্ফল হইবে।’

স্বামী বিবেকানন্দ যে ‘শূদ্র জাগরণে’র আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাকে গণজাগরণ বললে ভুল হবে। আমেরিকায় গিয়ে মেয়েদের দেখে তাঁর মনে হয়েছে “এদেশের মেয়েদের মতো মেয়ে বড়ই কম। ‘যা শ্রীঃ স্বয়ং সুকৃতিনাং ভবনেষু’—যে দেবী সুকৃতী পুরুষের গৃহে স্বয়ং শ্রীরূপে বিরাজমানা। আর আমরা স্ত্রীলোককে নীচ, অধম, মহা হেয়, অপবিত্র বলি। তার ফল—আমরা পশু, দাস, উদ্যমহীন, দরিদ্র।” (২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৩)। জাতিভেদ ও নারীনিগ্রহের বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার। একদিকে আমাদের Mission হচ্ছে অনাথ, দরিদ্র, মুর্খ, চাষাভুষোর জন্য, আগে তাদের করে যদি সময় থাকে তো ভদ্রলোকের জন্য।’ (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯০০) অন্যদিকে “জগতের কল্যাণ স্ত্রীজাতির অভ্যুদয় না হইলে সম্ভাবনা নাই, এক পক্ষে পক্ষীর উত্থান সম্ভব নহে। সেইজন্যই রামকৃষ্ণাবতারে ‘স্ত্রীগুরু’ গ্রহণ, সেইজন্যই নারীভাবসাধন, সেইজন্যই মাতৃভাব-প্রচার। সেইজন্যই আমার স্ত্রী-মঠ স্থাপনের জন্য প্রথম উদ্যোগ। উক্ত মঠ গার্গী, মৈত্রেয়ী এবং তদপেক্ষা আরও উচ্চতরভাবাপন্না নারীকূলের আকরস্বরূপ হইবে।” (১৮৯৫) স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবেই এখন সব ভেদাভেদ উঠে গেল, অচণ্ডাল প্রেম পাবে। মেয়ে-পুরুষ-ভেদ, ধনী-নির্ধনের ভেদ, পণ্ডিত বিদ্বান-ভেদ ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-ভেদ সব তিনি দূর করে দিয়ে গেলেন। আর যিনি বিবাদভঞ্জন= হিন্দু-মুসলমান-ভেদ, ক্রিশ্চান-হিন্দু ইত্যাদি সব চলে গেল। ঐ যে ভেদাভেদ লড়াই ছিল, তা অন্য যুগের, এ সত্যযুগে তাঁর প্রেমের বন্যায় সব একাকার।’ স্বামী বিবেকানন্দ স্বদেশোদ্ধারের জন্য বেদাস্ত-প্রচারের জন্য মঠ-মিশন স্থাপন করেননি (বেদান্তচর্চার মধ্য দিয়েই তাঁর আত্মোপলব্ধি, বিশ্ব ও স্বদেশ চেতনার জন্ম হওয়া সম্ভব), তিনি ভারতের দুই মহা পাপ দূর করার জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন—মেয়েদের পায়ে দলানো আর ‘জাতি জাতি’ করে গরীবগুলোক পিষে ফেলা।’ শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি বলতেন, ‘He was the Saviour of women, Saviour of the masses, Saviour of all high and low কথাগুলি স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধেও সমানভাবে প্রযোজ্য। স্বদেশোদ্ধার একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। স্বামী বিবেকানন্দ নির্বিকল্প সমাধি লাভ করে ক্ষান্ত হননি। অধ্যাত্মলোক থেকে তিনি ফিরে এসেছেন কর্মজগতে। বিরোধ যদি কোথাও থাকে তা তিনি অতিক্রম করেছেন। সেখানেই তাঁর অনন্যতা।

কথাকার স্বামী বিবেকানন্দ

স্বামী বিবেকানন্দ সাহিত্যিক ছিলেন না। সচেতনভাবে সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াস বা অবসর তাঁর ছিল না। যদিও ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় তাঁর লেখনী ছিল অনায়াস গতি। সেকালে অনেক শিক্ষিত বাঙালির মতো ইংরেজিতে লিখতে সম্ভবত তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। অনেকগুলি ভাষা তিনি জানতেন। তাঁর শিক্ষক উইলিয়াম হেস্টির মতো তিনি বহুভাষী বা ভাষাবিদ ছিলেন না। কিন্তু দেশবিদেশের ভাষাসাহিত্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে তিনি মূলত সাহিত্য ও দর্শন পড়েছেন (তবে সেকালে বি.এ. ক্লাসের ছাত্রকে পড়তে হত অনেক, এবং তা শুধু সাহিত্য ও দর্শনে সীমাবদ্ধ ছিল না)। স্বামী বিবেকানন্দ সংস্কৃত খুব ভালো জানতেন। আমেরিকা যাওয়ার আগে ও পরে সংস্কৃতচর্চা চলেছে। ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন নিয়ে আলোচনার জন্য সংস্কৃতে লেখা মূল গ্রন্থাদি ও তার টীকাভাষ্য তাঁকে অধ্যয়ন করতে হয়েছে। (স্বামী বিবেকানন্দের সংস্কৃতে লেখা কয়েকটি চিঠি পত্রাবলীতে স্থান পেয়েছে)। ১৮৮৮ সালে প্রমদাদাস মিত্রকে তিনি লিখছেন, “পাণিনির ব্যাকরণ কেবল আমার নিমিত্ত প্রার্থনা করি নাই, প্রত্যুত এ মঠে সংস্কৃত শাস্ত্রের বহুল চর্চা হইয়া থাকে। বঙ্গদেশে বেদশাস্ত্রের একেবারে অপ্রচার বলিলেই হয়। এই মঠের অনেকেই সংস্কৃতজ্ঞ এবং তাঁহাদের বেদের সংহিতাদিভাগ সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করিবার একান্ত অভিলাষ। তাঁহাদিগের মত, যাহা করিতে হইবে তাহা সম্পূর্ণ করিব। অতএব পাণিনিকৃত সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাকরণ আয়ত্ত না হইলে বৈদিকভাষায় সম্পূর্ণ জ্ঞান হওয়া অসম্ভব। এই বিবেচনায় উক্ত ব্যাকরণের আবশ্যক। ‘লঘু’ অপেক্ষা আমাদের বাল্যাধীত ‘মুগ্ধবোধ’ অনেকাংশে উৎকৃষ্ট।” (বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ ১. পৃ.৬৪)। আমেরিকায় থাকার সময় (১৮৯৫) স্বামী বিবেকানন্দ ‘যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’ (ইংরেজিতে অনূদিত), কাশীতে ছাপা সংস্কৃত ‘নারদ ও শাণ্ডিল্য সূত্র’, সব সম্প্রদায়ের ভাষ্যসহ ‘বেদান্ত সূত্র’ চেয়ে পাঠিয়েছেন। বিলেতে তাঁর কাজে সহযোগিতা করার জন্য উত্তম ইংরেজি ও সংস্কৃত জানা দু’জন সন্ন্যাসীকে পাঠাতে অনুরোধ করেছেন ব্রহ্মানন্দকে (০৪ ১০ ১৮৯৫)। স্বামী বিবেকানন্দ নিজে ভালো সংস্কৃত ও ইংরেজি জানতেন বলে গুরুভাইদের তিনি মাঝে মাঝে সমালোচনা করেছেন— “পরকে মারিতে গেলে ঢাল খাঁড়া চাই, অতএব ইংরেজী ও সংস্কৃত বিশেষরূপে অধ্যয়ন করিবে। কালীর ইংরেজী দিনে দিনে বেশ পরিষ্কার হইতেছে। সারদার ইংরেজির অধোগতি হইতেছে, তাহাকে flowery style পরিত্যাগ করিতে কহিবে। বিজাতীয় ভাষায় flowery style লেখা বড় দুষ্কর। তাহাকে আমার লক্ষ ‘সাবাস’-ওহি মরকা কাম, তারকদাদাকেও grammar-টা একবার উল্টে নিতে বলবে। তারকদাদার ইংরেজী ক্রমশঃ দুরস্ত হয়ে আসছে।” (১৮১৫)

স্বামী বিবেকানন্দের ইংরেজি রচনার পরিমাণ বিপুল। (দ্র. The Complete Works of Swami Vivkananda)। বাংলার বাইরে বিদেশে এবং স্বদেশে তাঁকে এক সময়ে প্রচুর বক্তৃতা দিতে হয়েছিল। সেই সব বক্তৃতা পরে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়েছে, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘রাজযোগ’, ‘কর্মযোগ’ ও ‘ভক্তিযোগ’। সাময়িক প্রয়োজনে, অনেক সময়ে অর্থোপার্জনের তাগিদে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। তবে ভাষণের জন্য ভাষণ নয়। স্বামী বিবেকানন্দের অধ্যাত্মজীবনের সূচনা থেকে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত তাঁর যাবতীয় চিন্তাভাবনার পিছনে যে তত্ত্ব ও তথ্য কাজ করেছে তার উৎস একদিকে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থ, অন্যদিকে গুরু প্রদর্শিত মত ও পথ। ১৮৯৬ সালের ২৭ এপ্রিল বিলেত থেকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, “আমি নিজের কর্তৃত্বলাভের আশায় নয়, কিন্তু তোমাদের কল্যাণ ও প্রভুর অবতীর্ণ হবার উদ্দেশ্য সফলের জন্য লিখছি। তিনি তোমাদের ভার আমার উপর দিয়েছিলেন এবং তোমাদের দ্বারা জগতের মহাকল্যাণ হবে, যদিও অনেকেই এখন তা জানো না, এইজন্য বিশেষভাবে লিখছি, মনে রেখ।” এই কথাগুলি প্রত্যক্ষভাবে ‘মঠ’ পরিচালনার জন্য গুরুভ্রাতাদের উদ্দেশে লেখা, কিন্তু একে কিছুটা সম্প্রসারিত করে মানবকল্যাণ ও বিশ্বাত্মবোধ প্রচার স্বামী বিবেকানন্দের যাবতীয় রচনার ভিত্তি বলে গ্রহণ করতে পারি। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে আর একটি চিঠিতে তিনি লেখেন “Lecture-লেকচার ত কিছু লিখে দিই না. একটা লিখে দিয়েছিলুম, যা ছাপিয়েছে। বাকি সব দাঁড়াঝাপ, যা মুখে আসে গুরুদের জুটিয়ে দেন। কাগজপত্রের সঙ্গে কোন সম্বন্ধই নাই।” তবে আমরা আগে দেখেছি বিদেশে থাকার সময়ে সংস্কৃত গ্রন্থাদি তিনি চেয়ে পাঠাচ্ছেন (অন্যত্র, “একখানা ‘পঞ্চদশী’, একখানা ‘গীতা’, একখানা কাশীর ছাপা নারদ ও শাণ্ডিল্য-সূত্র, পঞ্চদশীর যদি তর্জমা থাকে ও শঙ্করভাষ্যের কালীবর বেদান্তবাগীশের তরজমা ও পাণিনিসূত্রের বা কাশিকাবৃত্তি বা ফণিভাষ্যের যদি কোনও বাংলা বা ইংরেজি তরজমা থাকে ত পাঠাবে।”১৮৯৫)। আসলে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ‘distribution and propagation of thought-currents’। এইজন্য দেশে-দেশে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো (অধিকাংশ সময়ে বক্তৃতাগুলি লেখার সময় হত না। জে. জে. গুডউইন শর্ট-হ্যান্ডে লিখতেন), এ নিয়ে তিনি অনেক সময় মজা করেছেন— “একবার ডেট্রয়েটে তিন খণ্ড ঝাড়া বুলি ঝেড়েছিলুম। আমি নিজে অবাক হয়ে যাই সময়ে সময়ে, মধ্যে, তোর পেটে এতও ছিল। এরা সব বলে, পুঁথি লেখ, একটা এইবার লিখতে ফিকতে হবে দেখছি। ঐ তো মুশকিল, কাগজ কলম নিয়ে কে হাঙ্গামা করে বাবা।” (১৮৯৪। দ্র. বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ, ১, পৃ. ১০৬)

স্বামী বিবেকানন্দের গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংস প্রথাগত বিদ্যায়তনিক লেখাপড়ার ধার ধারতেন না। কিন্তু সকল বিদ্যার সারবস্তু, অমৃতস্বরূপ ব্রহ্মানন্দ তিনি লাভ করেছিলেন। ম্যাসমূলারের লেখা Ramkrishna, His Life and Sayings, 1898 বইটি নিয়ে আলোচনার সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ দেখেছেন, “জীবনী অপেক্ষা উক্তি-সংগ্রহ এ পুস্তকের অধিক স্থান অধিকার করিয়াছে। ঐ উক্তিগুলি যে সমস্ত পৃথিবীর ইংরাজী-ভাষী পাঠকের মধ্যে অনেক ব্যক্তির চিত্তাকর্ষণ করিতেছে, তাহা পুস্তকের ক্ষিপ্র বিক্রয় দেখিয়াই অনুমিত হয়। উক্তিগুলি তাঁহার শ্রীমুখের বাণী বলিয়া মহাশক্তিপূর্ণ এবং তজ্জন্যই নিশ্চিত সর্বদেশে আপনাদের ঐশী শক্তি বিকাশ করিবে। ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ মহাপুরুষগণ আবির্ভূত হন— তাঁহাদের জন্ম-কর্ম অলৌকিক এবং তাঁহাদের প্রচারকার্যও অত্যাশ্চর্য।” (রামকৃষ্ণ ও তাঁহার উক্তি’, ভাববার কথা)। ১৮৮১-১৮৮৬ তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গ-সান্নিধ্য লাভ করেন। রামকৃষ্ণ উপদেশ দিতেন ‘কথা’র সাহায্যে। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রে ‘কথা’ কল্পিত কাহিনী, আধুনিক ছোটোগল্পের আদিরূপ। মাস্টারমহাশয় মহেন্দ্রনাথ [শ্রীম] ঠাকুরের কৃপা লাভ করেছিলেন। তিনি ঠাকুরের অমৃতময়ী বাণী তাঁর দিনপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন, যা অবলম্বনে পাঁচ খণ্ডে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত বা Gospel of Sri Ramakrishna (১৮৯৭) রচিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ শুধু মাস্টারমহাশয়কে পরম শ্রদ্ধা করতেন না, তাঁর সংকলিত কথামৃতকে প্রভুর যথার্থ জীবনী বিবেচনা করতেন। “I now understand why none of us at tempted His life before. It has been reserved for you this great work. Socratic dialogues are Plato all over You are entirely hidden” কথা-রচনার এই বিশেষ পদ্ধতিটি স্বামী বিবেকানন্দের তত্ত্বমূলক প্রবন্ধে (লেখায় বা ভাষণের লিখিত রূপে) কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে তার পরিচয় নেওয়ার দরকার আছে। রামকৃষ্ণ পরমহংস অনেক সময়ে বেদান্তের গভীর তত্ত্ব বোঝাবার সময়ে আখ্যানের আশ্রয় নিতেন। এর মধ্যে কিছু গল্প রামায়ণ-মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ থেকে নেওয়া। হাজার গল্পের মধ্যে যা ছড়িয়ে আছে তা থেকে প্রতিপাদ্য তত্ত্বের সন্ধান খুঁজে বার করতে পারেন একমাত্র মহাজ্ঞানী গুরু। অবধূতের শিক্ষা প্রসঙ্গে নিষ্কাম কর্মের আদর্শ বোঝাতে রামকৃষ্ণ এক গল্প শুনিয়েছেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও শিবনাথ শাস্ত্রীকে –

শ্রীমদ্ভাগবতে আছে যে অবধূত চব্বিশ গুরুর মধ্যে চিলকে একটি শুরু করেছিলেন। এক জায়গায় জেলেরা মাছ ধর্তে ছিল। একটি চিল এসে একটা মাছ ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। কিন্তু মাছ দেখে পেছনে পেছনে প্রায় এক হাজার কাক চিলকে তাড়া করে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কা কা করে বড় গোলমাল করতে লাগল। মাছ নিয়ে চিল যে দিকে যায়, কাকগুলোও তাড়া করে সেই দিকে যেতে লাগল। দক্ষিণ দিকে চিলটা গেল, কাকগুলোও সেই দিকে গেল; আবার উত্তরদিকে যখন গেল, ওরাও সেই দিকে গেল। এইরূপে পূর্বদিকে ও পশ্চিমদিকে চিল ঘুরতে লাগল। শেষে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাছটা তার কাছ থেকে পড়ে গেল। তখন কাকগুলো চিলকে ছেড়ে মাছের দিকে গেল। চিল তখন নিশ্চিত্ত হয়ে একটা গাছের ডালের উপর বসল। বসে ভাবতে লাগল— ঐ মাছটাই যত গোল করেছিল। এখন মাছ কাছে নাই আমি নিশ্চিত্ত হলুম।

অবধূত চিলের কাছে এই শিক্ষা করলেন যে যতক্ষণ সঙ্গে মাছ থাকে অর্থাৎ বাসনা থাকে ততক্ষণ কর্ম থাকে আর কর্মের দরুন ভাবনা চিন্তা, অশান্তি। বাসনা ত্যাগ হলেই কর্মক্ষয় হয় আর শাস্তি হয় (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত ১,১০৬-০৮)।

এইভাবে গল্পের অবতারণা ঘটেছে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-র পাতায় পাতায়। স্বামী বিবেকানন্দর মনে এই গল্পগুলি কতটা রেখাপাত করেছে তাঁর স্বদেশে ও বিদেশে প্রদত্ত ভাষণে তার পরিচয় মেলে। ছোটোভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “রাজযোগের বক্তৃতা শুনিয়া অনেকে ক্লান্ত হইয়া পড়েন, এইজন্য স্বামীজী ছোট ছোট উপাখ্যান তুলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন, তাহাতে বক্তৃতাটি বেশ সহজ ও সরল হইত এবং রাজযোগের ভাব ও উদ্দেশ্য সহজেই তাহারা বুঝিতে পারিতেন।” (লণ্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ)। স্বামী বিবেকানন্দ সম্ভবত নিজে কখনও গল্প লেখা বা গল্প বানানোর চেষ্টা করেননি। ভাববার কথা-র মধ্যে ‘শিবের ভূত’ নামে একটি অসম্পূর্ণ গল্প স্থান পেয়েছে। এটি স্বরচিত, না অনূদিত ঠিক বোঝা যায় না। তবে গল্পের জন্য যা একান্ত প্রয়োজন, সেই পর্যবেক্ষণ ও বর্ণন-শক্তি তাঁর ছিল। পরিব্রাজক পথ চলতে যা দেখেছেন তা নিয়ে অনায়াসে ছোটোগল্প তৈরি হতে পারে। এর সবচেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত ‘সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার’। এখানে শুধু গতিময় মুখের ভাষা নয়, নাটকীয়ভাবে ঘটনা উপস্থাপন ও সংলাপভঙ্গি যথার্থ কাহিনীরস সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে –

“কিন্তু নেহাত হতাশ হবার প্রয়োজন নেই–ঐ যে পলায়মান ‘বাঘা’র গা ঘেঁষে আর একটা ‘খাবড়ামুখো চলে আসছে। আহা হাঙ্গরদের ভাষা নেই। নইলে ‘বাঘা’ নিশ্চিত পেটের খবর তাকে দিয়ে সাবধান করে দিত। নিশ্চিত বলত, ‘দেখ হে সাবধান, ওখানে একটা নূতন জানোয়ার এসেছে, বড় সুস্বাদ সুগন্ধ মাংস তার, কিন্তু কি শক্ত হাড়। এতকাল হাঙ্গর-গিরি করছি, কত রকম জানোয়ার–জ্যাস্ত, মরা, আধমরা উদরস্থ করেছি, কিন্তু এ হাড়ের কাছে আর সব মাথম-হে-মাখম!! এই দেখনা, আমার দাঁতের দশা, চোয়ালের দশা কি হয়েছে বলে একবার সেই আকটিদেশ বিস্তৃত মুখ ব্যাদান করে আগন্তুক হাঙ্গরকে অবশ্যই দেখাত। সেও প্রাচীনবয়সসুলভ অভিজ্ঞতা সহকারে চ্যান্ডমাছের পিত্তি, কুঁজো ভেটকির পিলে, ঝিনুকের ঠাণ্ডা সুরুয়া ইত্যাদি সমুদ্রজ মহৌষধির কোন-না-কোনটা ব্যবহারের উপদেশ দিতই দিত। কিন্তু যখন ওসব কিছুই হল না, তখন হয় হাঙ্গরদের অত্যন্ত ভাষার অভাব, নতুবা ভাষা আছে, কিন্তু জলের মধ্যে কথা কওয়া চলে না। অতএব যতদিন না কোন প্রকার হাসুরে অক্ষর আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন সে ভাষার ব্যবহার কেমন করে হয় অথবা ‘বাঘা’ মানুষ-ঘেঁষা হয়ে মানুষের ধাত পেয়েছে, তাই ‘থ্যাবড়া’ কে আসল খবর কিছু না বলে মুচকি হেসে, “ভাল আছ ত হে’ বলে সরে গেল। আমি একাই ঠকবো?'”

ঘটনা বর্ণনার মতো স্বল্পরেখায় চরিত্র পরিস্ফুটনেও স্বামী বিবেকানন্দ শিল্পীসুলভ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। ইউরোপে কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত তাঁর পথের সঙ্গী ছিলেন পেয়র হিয়াসাহ এবং তাঁর সহধর্মিণী। স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মদর্শন নিয়ে আলোচনায় আগ্রহবোধ করবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই, কিন্তু তাঁর রসবোধ (সেন্স অফ হিউমারও) অসামান্য। ক্যাথলিক পাদ্রিকে বিয়ে করার জন্য মঞ্চাভিনেত্রীর মন্তব্য কঠোর শ্লেষপূর্ণ। তবে এর মজাটা হয়তো ভারতবাসী ততটা উপভোগ করতে পারবে না।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের রসবোধ ছিল প্রবল। তিনি হাসতে এবং হাসাতে জানতেন। গুরুর কাছ থেকে এই গুণটি শিষ্যও পেয়েছেন। শিকাগোতে পঞ্চম দিনের অধিবেশনে সঙ্কীর্ণতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমেই বহুপ্রচলিত একটি গল্প বলেন— কুয়োর ব্যাঙ ছোটো কুয়োকেই বিশ্বজগৎ জ্ঞান করত। সমুদ্র থেকে একটি ব্যাঙ সেখানে এলে কুয়োর ব্যাঙ বিশ্বাসই করতে চায় না কুয়োর থেকে বড়ো কোনও জায়গা আছে। সে বলে, আমার কুয়োর থেকে বড়ো আর কিছু হতে পারে না, পৃথিবীতে এর থেকে বড়ো কিছু নেই। সমুদ্রের ব্যাঙ নিশ্চয় মিথ্যা কথা বলছে, তাই তাকে তাড়াও এখান থেকে। ‘সংকীর্ণতাই আমাদের মতভেদের কারণ এই সত্য প্রতিপাদনের জন্য গল্পটি অব্যর্থ। তবে গল্প বলার মাঝখানে স্বামীজীর একটি মন্তব্য চমকপ্রদ ঠেকবে, “এইভাবে দিনযাপন করতে করতে সে দেহে স্ফীত ও মসৃণ হয়ে উঠল, বোধহয় খানিকটা আমার মতনই।” নিজেকে নিয়ে এই কৌতুক করার ক্ষমতা সারা জীবন তাঁর কথায় ও লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। চিঠিতে নিজের মেদ বৃদ্ধি ও উদরদেশের বিস্ফার নিয়ে মজা করেছেন কখনও।

যাকে বলে হাসির গল্প, তার দিকে পরমহংসদেবের ঝোঁক ছিল। এ সব গল্প যে তাঁর মৌলিক সৃষ্টি তা নয় অধিকাংশই পরম্পরাগত লোকশ্রুতির নিদর্শন, যেমন স্যাকরার দোকানে কেশব। কেশব!’, ‘গোপাল, গোপাল।’ ‘হরি হরি।’ ‘হর। হর।” উচ্চারণের মধ্যে ভগবানের নামকীর্তন নয়, ব্যবসাদারদের আভাস-ইঙ্গিতময় কথোপকথন, কিংবা ব্যাঙের টাকা বা আধুলির গল্প, হাতি ব্যাঙকে ডিঙিয়ে যাওয়ায় ব্যাঙের লাথি দেখানো (দ্র ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কঙ্কাবতী)। পরিব্রাজক বইতে স্বামী বিবেকানন্দের এই ধারার একটি গল্প রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র বইতে একটি চিঠিতে কীভাবে ফিরে এসেছে ভাবলে অবাক লাগে “কোন গঙ্গাহীন দেশে নাকি কলকেতার এক ছেলে শ্বশুরবাড়ী যায়, সেখানে খাবার সময় নাকি চারদিকে ঢাকঢোল হাজির; আর শাশুড়ির বেজায় জেদ, ‘আগে একটু দুধ খাও।’ জামাই ঠাওরালে বুঝি দেশাচার, দুধের বাটিতে যেই চুমুকটি দেওয়া অমনি চারদিকে ঢাকঢোল বেজে ওঠা। তখন তার শাশুড়ি আনন্দাশ্রুপরিপ্লুতা হয়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললে, ‘বাবা! তুমি আজ পুত্রের কাজ করলে, এই তোমার পেটে গঙ্গাজল আছে, আর দুধের মধ্যে ছিল তোমার শশুরের অস্থি গুড়া করা, শ্বশুর গঙ্গা পেলেন’।” রবীন্দ্রনাথের সাজাদপুর থেকে লেখা চিঠিতে পোস্টমাস্টারের মুখে একই গল্পের ভাষাত্তর – “এ দেশের লোকের গঙ্গার উপর এমন ভক্তি যে এদের কোনো আত্মীয় মরে গেলে তার হাড় গুঁড়ো করে রেখে দেয়, কোনো কালে গঙ্গার গঙ্গার জল খেয়েছে এমন লোকের যদি সাক্ষাৎ পায় তা হলে তার পানের সঙ্গে হাড়গুঁড়ো খাইয়ে দেয় আর মনে করে তার আত্মীয়ের একটা অংশের গঙ্গালাভ হল।” রবীন্দ্রনাথের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য- ‘এটা বোধ হয় গল্প’, আর পোস্টমাস্টারের গম্ভীর প্রত্যুত্তর ‘তা হতে পারে – কম উপভোগ্য নয়। তবে স্বামী তুরীয়ানন্দকে (তু-ভায়া) নিয়ে স্বামীজির সকৌতুক মন্তব্য সম্ভবত আরও চমকপ্রদ—–“ভায়া যে গম্ভীরপ্রকৃতি, বক্তৃতাটা কোথায় দাঁড়াল – বোঝা গেল না।”

এখানে স্বামী বিবেকানন্দের ভাষাচিত্তার কথা সংক্ষেপে বলে নেওয়া যেতে পারে। প্রাণবান পুরুষ— ভাষায় প্রাণের সঞ্চার করবেন এটাই স্বাভাবিক। ভাষণের সময়ে তিনি ব্যবহার করেন উদাত্ত ভাষাভঙ্গি। সে ভাষা লেখ্য কিংবা কথা তাতে কিছু এসে যায় না– “বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই, তুমিও কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া, সদর্পে ডাকিয়া বল— ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী, বল ভাই- ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ, আর বল দিন-রাত, হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও: মা, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ, কর।” এখানে লক্ষণীয় তৎসম শব্দের বাহুল্য সত্ত্বেও মুখের ভাষার সঙ্গে এর খুব একটা তফাৎ নেই। এর কারণ ‘সংস্কৃতের গদাই লস্করি চাল’ পরিহার করে তিনি তাঁর ভাষাকে করেছেন সাফ ইস্পাতের মতো ধারালো। অন্যত্র স্বামীজির মুখে আমরা শুনেছি, “ভাষার গোপন কথা সরলতা। আমার গুরুদেবের ভাষাই আমার আদর্শ ভাষা, যা ছিল অত্যন্ত চলতি এবং গভীর অর্থবহ। কেন না চিন্তাধারাকে এমনভাবে অভিব্যক্ত করতে হবে যা অতি সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারে।” (“ভাষা প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ, ৮, পৃ. ৪০)।

অবশ্য স্বামী বিবেকানন্দের অধিকাংশ রচনা (ভাষণ, এবং অল্প কিছু প্রবন্ধ, এবং আরও অল্প কয়েকটি কবিতা) ইংরেজিতে প্রচারিত, পরে তার বাংলা ভাষান্তর স্থান পেয়েছে আট খণ্ডে সমাপ্ত বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ বইতে (অপিচ, উদ্বোধন প্রকাশিত স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা)। “আমরা প্রভুর দাস, প্রভুর পুত্র, প্রভুর লীলার সহায়ক”— এ কথা না বললেও চলে। ফলে স্বামী বিবেকানন্দের ইংরেজি রচনা মুখ্যত অবাঙালিদের কথা ভেবে লেখা (বা বলা) হলেও তার মধ্যে প্রভুর কথামৃতের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়। কোথাও পরমহংসের মুখে শোনা গল্প স্বামী বিবেকানন্দ প্রায় অপরিবর্তিত আকারে তাঁর ভাষণে ব্যবহার করেন, কোথাও সেই ধারা বা রীতি অনুসরণ করে তত্ত্বব্যাখ্যায় গল্পের আশ্রয় গ্রহণ করেন।

প্রথম ধারার নিদর্শন, একদল মেষের মধ্যে পালিত সিংহশাবক বৃহদাকার বলিষ্ঠ হয়েও মেষের মতো অতিশয় ভীরু ও তৃণভোজী হওয়ার গল্প। পরে অরণ্যের সিংহের সান্নিধ্যে এসে নিজের সিংহত্ব জানতে পেরেছে। এর মধ্যে নিহিত তত্ত্ব হল প্রত্যেকের মধ্যে যে আত্মন্ আছে, তা সর্বশক্তিমান। কিন্তু মানুষ তা ভুলে থাকে বলেই নিজেকে শক্তিহীন জ্ঞান করে, কিন্তু যদি সে নিজের আত্মার উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে তার দুর্বলতা দূর হয়ে সে স্বয়ং আত্মন্ হয়ে যায়। (বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ, ২, পৃ.৪৭ গল্পটির ভিন্নতর রূপ অষ্টম খণ্ড, পৃ.৮৩)। কাহিনীর উৎস শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ২, পৃ ৫১।

এর সঙ্গে আছে উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের গল্প। আরুণি পুত্র শ্বেতকেতু, জাবালা-সত্যকাম, দেবতা ও দানবের আত্মানুসন্ধান, যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ী এবং নচিকেতার গল্প স্বামীজির ভাষণে বারবার এসেছে। নচিকেতা উপাখ্যান একাধিক ভাষণে এসেছে। (বিবেকানন্দ রচনা সংগ্রহ, ৬, পৃ. ৮১-৮২, ৭, পৃ. ৭২-৭৫)। একই গল্প দু’বার বলার সময়ে তার উপস্থাপনে কিছু পার্থক্য ঘটেছে। মনে হয়েছে শুধু তত্ত্বের জন্য নচিকেতা উপাখ্যান নয়, এর মধ্যে চরিত্র পরিস্ফুটন, সরসভঙ্গিতে ঘটনা বর্ণন, আর সেই সঙ্গে নাটকীয়তার কথাও স্বামীজি মনে রেখেছেন। গল্পটির তিনি নাম দিয়েছেন ‘দিব্য আনন্দের পথ’। সামান্য ভূমিকা আছে প্রারম্ভে— “আজ রাত্রে আমি তোমাদের বেদ থেকে একটি গল্প বলব। বেদ হচ্ছে হিন্দুদের পবিত্র শাস্ত্র, এক বিশাল সাহিত্যসংগ্রহ, যার শেষাংশকে বলা হয় বেদাস্ত। এতে সব তত্ত্বকথা আছে, বিশেষ করে দর্শনের কথা, যাতে আমরা আগ্রহী। এটি প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় লেখা এবং তোমরা মনে রাখবে এটি হাজার হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল।”

এর পর শুরু হল গল্প। এক ব্যক্তি এক বিরাট যজ্ঞ করতে চেয়েছিলেন। হিন্দুদের ধর্মে যজ্ঞে এক বড়ো অংশ হল দান। যাতে বেদী নির্মাণ করে অগ্নিতে আহুতি দানের সঙ্গে নানা মন্ত্র আবৃত্তি করা হয়। যজ্ঞ শেষে ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রদের দান করা হয়। প্রত্যেক যজ্ঞের বিভিন্ন ধরনের দানের নিয়ম আছে। একটি যজ্ঞে মানুষকে সর্বস্ব দান করতে হয়। এখন ওই ব্যক্তিটি ধনী হলেও কৃপণ ছিল, অথচ সে নাম-যশের লোভে সবচেয়ে বড়ো যজ্ঞটি করতে চেয়েছিল। যজ্ঞ শেষে সর্বস্ব দানের পরিবর্তে সে তার কানা খোঁড়া বুড়ো গরুগুলি, যেগুলি আর দুধ দেয় না, সেগুলি দান করতে লাগল। নচিকেতা নামে তার এক বুদ্ধিমান বালক পুত্র ছিল। সে পিতার এই হীন দানকর্ম দেখে বুঝল, যে এতে পুণ্যের বদলে পাপই হবে। সে সংকল্প করল এর প্রতিকারের জন্য নিজেকে দান করার কথা বলবে।

সে তাই পিতার কাছে গিয়ে বলল, ‘আমাকে কাকে দান করবে??”

পিতা কোনও জবাব দিল না। বালক দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার তাকে একই প্রশ্ন করল। বারবার এক প্রশ্ন করায় পিতা বিরক্ত হয়ে বললেন “তোকে যমকে দান করব।’

বালকটি সোজা যমলোকে গেল। যম সে সময় বাড়ি ছিল না, তাই সে সেখানে অপেক্ষা করতে লাগল।

তিনদিন পরে যম ফিরে এসে তাকে বলল, ‘হে ব্রাহ্মণ, আপনি আমার পূজার যোগ্য অতিথি হয়েও তিনদিন আমার গৃহদ্বারে অনাহারে আছেন। আপনাকে প্রণাম করি। এই কষ্ট স্বীকারের প্রতিদানে আপনাকে আমি তিনটি বর দেব।’

বালকটি প্রথম বর চাইল, ‘আমার উপর বাবার রাগ যেন চলে যায়। দ্বিতীয় বরে নচিকেতা কয়েকটি যজ্ঞ সম্বন্ধে জানতে চাইল। তারপর তৃতীয় বরের বেলায় সে বলল, “মানুষের মৃত্যুর পরে প্রশ্ন জাগে তার কী হয়। কেউ বলে তার অস্তিত্ব থাকে না, কেউ বলে থাকে। অনুগ্রহ করে আমায় যথার্থ উত্তর বলে দিন।”

মৃত্যুরাজ যম উত্তর দিলেন ‘প্রাচীনকালে দেবতারা এই রহস্যভেদ করতে চেয়েছিলেন। এই রহস্য এত সূক্ষ্ম যে জানা খুবই কষ্টকর। অন্য কোনও বর চাও, এটি চেয়ো না। শতবর্ষব্যাপী দীর্ঘজীবন প্রার্থনা করো। গবাদি পশু, অশ্ব প্রার্থনা করো। বিশাল সাম্রাজ্য প্রার্থনা করো। এর উত্তরের জন্য আমায় অনুরোধ কোরো না। মানুষ জীবন উপভোগের জন্য যা কিছু কামনা করে, সেই সব প্রার্থনা করো, আমি প্রার্থনা পূর্ণ করব। কিন্তু এই রহস্য জানতে চেয়ো না। বালকটি বলল, ‘না মানুষ সম্পদে তৃপ্ত থাকতে পারে না। এমনকি দীর্ঘতম জীবনও খুব সংক্ষিপ্ত। এইসব ঘোড়া, রথ, নাচ-গান, আপনার কাছে থাক। মানুষ সম্পদে সন্তুষ্ট হতে পারে না। আপনি যতদিন চান ততদিনই আমরা জীবিত থাকব। আমি যে বর প্রার্থনা করেছি সেইটি শুধু আমি চেয়েছি।’

যম এই উত্তরে খুশি হয়ে বললেন, ‘পূর্ণতা এক বস্তু, ভোগ অন্য বস্তু, এই দুয়ের লক্ষ্য আলাদা, এরা মানুষকে দু-ভাবে আকৃষ্ট করে। যে পূর্ণতা বেছে নেয়, সে শুদ্ধ হয়। যে ভোগকে বেছে নেয়, সে প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়। পূর্ণতা এবং ভোগ উভয়ই মানুষের কাছে আসে। জ্ঞানী দুটিকে পরীক্ষা করে একটিকে অন্যটির থেকে আলাদা করেন। তিনি পূর্ণতাকে ভোগের চেয়ে বড়ো বলে বেছে নেন, কিন্তু মূর্খ ব্যক্তি দেহের সুখের জন্য ভোগকে বেছে নেয়। হে নচিকেতা, যেসব বস্তু আপাতকাম্য, চিন্তা করে জ্ঞানীর মতো তুমি তা ত্যাগ করেছ।’ যম তখন নচিকেতাকে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন। কঠোপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় বল্লরীতে ‘আত্মতত্ত্ব’ তথা আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যাত হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ জ্ঞানযোগের অঙ্গ হিসেবে নচিকেতা কাহিনীর অবতারণা করেছেন।

রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ কাহিনী পরমহংসদেবের প্রিয় ছিল। ভারতীয় আদি কবির জীবনেতিহাস – দস্যু থেকে ঋষিতে রূপান্তর রামায়ণে একভাবে বর্ণিত আছে, যার কিছুটা বাল্মীকির রচনায়, কিছুটা কৃত্তিবাসের উদ্ভাবনায় আমাদের মনে গভীর রেখাপাত করেছে। স্বামী বিবেকানন্দ ক্যালিফোর্নিয়ায় শেক্‌সপিয়ার ক্লাবে রামায়ণের উপাখ্যান আধুনিক ভাষায় আধুনিক মন নিয়ে উপস্থিত করেছেন। তবে গল্প বলাই যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না তা বোঝা যায় রামায়ণের মধ্যে ভারতবর্ষীয় তথা প্রাচ্য জীবনাদর্শ সন্ধানে তাঁর শেষ কথা হল “আমার জীবনবাণী হল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে বলা পৃথক আদর্শ নিয়ে ঝগড়া না করতে, বরং তাদের দেখানো যে যতই বিপরীত বলে মনে হোক লক্ষ্য উভয়ক্ষেত্রেই এক। আপন আপন দিশায় বিভ্ৰমাচ্ছন্ন জীবন-উপত্যকা পরিক্রমায় আসুন আমরা পরস্পরের সাফল্য কামনা করি।” মহাভারত নিয়েও তিনি শেক্‌সপিয়ার ক্লাবে ভাষণ দিয়েছেন। মহাভারতের কাহিনীর মধ্যেও তিনি দেখেছেন প্রাচীন ভারতীয় জীবনাদর্শ। গল্পের সঙ্গে চলেছে চরিত্রব্যাখ্যা— ধর্মভীরু কিন্তু দুর্বল, অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মনে ন্যায়পরতা ও পিতৃস্নেহের মধ্যে আভ্যন্তরিক দ্বন্দ্ব, পিতামহ ভীষ্মের মহিমময় চরিত্র, রাজা যুধিষ্ঠিরের মহৎ ও ধর্মপ্রাণ স্বভাব, অন্য চার ভাই যেমন শৌর্যে, তেমনি ভক্তি ও আনুগত্যে মহৎ, মানবিক প্রজ্ঞায় অনতিক্রান্ত অতুলনীয় কৃষ্ণ, আর চির-বিশ্বস্তা ও সর্বংসহা দ্রৌপদী। জনক কন্যা সীতার পবিত্রতা, নিষ্ঠা, সহনশক্তি যেমন ভারতীয় নারীর আদর্শ, তেমনি সত্যবতীর মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেম, যার কাছে যম হার মানেন—এঁদের নিয়ে গল্পকথার শেষ নেই। স্বামী বিবেকানন্দকে এ সব কাহিনী লিখতে হয়েছে ইংরেজিতে। ইংরেজিতে লেখার ফলে স্বদেশি কাহিনী অনেক সময় একটু বিদেশি রূপ নিয়েছে। লোককথার ক্ষেত্রে এই রূপান্তর বিশেষভাবে চোখে পড়ে। ১৮৯৬ সালে বিলেত থেকে চিঠিতে তিনি লিখছেন, “কোনো বিদেশী খাঁটি ইংরেজি ইংরেজদের মতো তত ভালো লিখতে পারবে না, তার ওপর খাঁটি ইংরেজিতে লিখলে আইডিয়ার যা বিস্তার হবে হিন্দু-ইংরেজিতে তা হতে পারে না। তাছাড়া বিদেশী ভাষায় প্রবন্ধ লেখার চাইতে গল্প লেখা অনেক কঠিন।” (বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ, ৪, পৃ. ১৪৬)

জড়-ভরতের গল্প বা প্রহ্লাদের গল্প পরমহংসদেবের মতো স্বামী বিবেকানন্দর খুব ভালো লাগত। স্বামীজি অধিকাংশ গল্প শুরু করতেন এইভাবে আমার মনে পড়ছে একটা পুরনো গল্প’ বা “একটা পুরনো গল্প হল”। এই সব গল্প অধিকাংশ কল্পিত বা কখনও লোককথা থেকে নেওয়া। ভগিনী নিবেদিতাকে Cradle Tales of Hindusthan লেখার সময় স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন (দ্র. চিঠি ১৫.০২. ১৯০০ “তুমি গল্পগুলি পেয়েছ শুনে খুশী হলাম; ভালো মনে করো এগুলি আবার নতুন করে লেখ; কোনো প্রকাশক পেলে এগুলি ছাপিয়ে প্রকাশ করো, আর বিক্রয় করে কিছু লাভ হলে তা তোমার কাজের জন্য নাও। ও থেকে আমি কিছুই চাইনে।” (বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ, ৫, পৃ. ১৪০)।

লোককথা বলতে দু’ধরনের গল্প কথামৃতে ও স্বামী বিবেকানন্দের রচনায় দেখা যাবে। রাজার পুকুরে সভাসদদের এক কলসি করে দুধ ঢালতে বলা হলে সকলেই জল ঢালেন, কারণ দুধপুকুরে এক কলসি জল কেউ বুঝতে পারবে না। কিংবা জ্যোতিষী দক্ষিণার বিনিময়ে লক্ষপতি হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন (স্বামী বিবেকানন্দ বোস্টনে থাকার সময় একজন তাঁকে এসে বলে “পৃথিবীর সব সম্ভার তার সব সুখ তোমার, যদি জান, তা কি করে পেতে হয়। আমার কাছে যদি তুমি আস, তাহলে তা পাওয়ার উপায় তোমাকে শিখিয়ে দেব। দক্ষিণা ৫ ডলার।”) রাজাকে জ্যোতিষীর আসন্ন মৃত্যুর দিনক্ষণ জানানোর পর জ্যোতিষীর মৃত্যুর কাল জানতে চাওয়ায়, সঙ্গে সঙ্গে তার মুণ্ডচ্ছেদ ও জ্যোতিষগণনার মিথ্যা প্রমাণ। অনুরূপ আর একটি গল্প— একটা মশা একজনের মাথায় বসেছিল, এক বন্ধু তাকে মারবে বলে এমন এক আঘাত করল যে সে মশা ও মানুষ দুটিকেই মেরে ফেলল। এগুলি অণুগল্প বললে হয়তো খুব ভুল হয় না— “একজন ধনী লোকের বাগানে দুজন মালী ছিল। তার মধ্যে একজন ছিল খুব অলস, কোনো কাজই করত না, কিন্তু মনিব এসে গেলে সে উঠেই করজোড়ে ‘আমার মনিবের মুখখানি কি সুন্দর’ ইত্যাদি স্তুতি করে নাচানাচি শুরু করে দিত। অন্য মালীটি বেশি বলত না, বরং কঠোর পরিশ্রম করে ফল, শাকসবজি উৎপাদন করে অনেক দূরে মনিবের বাড়িতে মাথায় বয়ে নিয়ে যেত।” এখানে গল্পের নিহিতার্থ আদৌ অস্পষ্ট নয়, ফলে স্বামীজির মন্তব্যটি কিছুটা অনপেক্ষিত মনে হয় “এই দুজন মালীর মধ্যে কে বেশী মনিবের প্রিয় হবে?” (বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ, ৫. পৃ. ১৮৬)। সেই প্রেত বা জিনের গল্প আমাদের সকলেরই জানা আছে। আরব্য উপন্যাসে এ ধরনের অসংখ্য গল্প মিলবে। সেই প্রেতকে সব সময় কাজ দিয়ে যেতে হবে। তা না হলে বিনাশ। তখন সেই কুকুরের কুণ্ডলীকৃত লেজকে সোজা করার নিষ্ফল চেষ্টা এবং শেষে প্রেতের বিদায়গ্রহণ। স্বামী বিবেকানন্দের কৌতুকবোধের কথা আগে বলেছি। ‘কর্মযোগ’ কোনও পরিহাসের ব্যাপার নয়, এখানে কুকুরের লেজের প্রসঙ্গ উত্থাপনে স্বামীজির বক্তব্য হল— “কখনও ধর্মোন্মত্ততার ভাব এলে কুকুরের কোঁকড়ানো লেজের কথা মনে করো।”

সরস ও সহাস্য গুরু ও শিষ্যের কথোপকথন আজও আমরা উপভোগ করি। বেশ বুঝতে পারি শিষ্যমণ্ডলীর সামনে শুরু যখন এই রকম গল্পগাছা করতেন, তখন প্রাণপ্রিয় শিষ্যটি তা কেমন উপভোগ করতেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-র একাধিক পরিচ্ছেদে গুরু শিষ্য সংবাদ বর্ণিত হয়েছে। পরমহংসদেবের মুখে শুনি, “আমি নরেন্দ্রকে বলেছিলুম, দেখ, ঈশ্বর রসের সাগর। তোর ইচ্ছা হয় না কি যে, এই রসের সাগরে ডুব দিই? আচ্ছা মনে কর, এক খুলি রস আছে, তুই মাছি হয়েছিস; তা কোন্‌খানে বসে রস খাবি। নরেন্দ্র বললে ‘আমি খুলির কিনারায় বসে মুখ বাড়িয়ে খাব।’ আমি জিজ্ঞাসা কন্নুম কেন? কিনারায় বসবি কেন? সে বললে ‘বেশী দূরে গেলে ডুবে যাব, আর প্রাণ হারাব।’ এখন আমি বললুম, বাবা। সচ্চিদানন্দ সাগরে সে ভয় নাই। এ যে, অমৃতের সাগর, ঐ সাগরে ডুব দিলে মৃত্যু হয় না, মানুষ অমর হয়। ঈশ্বরেতে পাগল হলে মানুষ বেহেড হয় না।” (প্রথম ভাগ, পৃ ১৩০-৩১)। কথামৃতে রসসাগর রামকৃষ্ণ পরমহংস গল্প বলেন বটে, তাতে সরসতারও অভাব নেই। তবে তাঁকে কথাকার না বলে রসস্রষ্টাই বলা উচিত। স্বামী বিবেকানন্দ রসসমুদ্রে অবগাহন করেও মননে-দর্শনে, বর্ণনায় বিশ্লেষণে শুধু সত্যসন্ধানী নন, তিনি পথপ্রদর্শক— তিনি শিক্ষক। তবে তত্ত্বাশ্রয়ী রচনাকে আকর্ষণীয় করার জন্য তিনি কথা ও আখ্যানের আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি কথাশিল্পী।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.