সােনার বাংলা : কিংবদন্তি ও বাস্তব

(প্রায়ই প্রাক-ব্রিটিশ যুগের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দাবি করা হয়, ও ‘সোনার বাংলা’ টার্মটির মাধ্যমে সেই সময়ের সমৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়া হয়। কিন্তু এরকম দাবির প্রতিষ্ঠা আদৌ বাস্তবসম্মত কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আকবর আলী খান এইসব তাত্ত্বিক ভিত্তি ও ঐতিহাসিক প্রমাণসমূহকে পরীক্ষা করেছেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত ও মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা – থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, ২য় খণ্ড : অর্থনৈতিক ইতিহাস’ গ্রন্থটি থেকে তার প্রবন্ধটি তুলে দেয়া হচ্ছে। তথ্যসূত্রসমূহ সব লেখাটিতেই প্রবিষ্ট করা হয়েছে। )

ভূমিকা

বিক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে বাংলার নিরবচ্ছিন্ন সমৃদ্ধিকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় : বিদেশী পর্যটকরা ও ঐতিহাসিকরা প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাকে পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্যে উচ্ছলিত অমরাবতী রূপে বর্ণনা করেছেন। সােনার বাংলার কিংবদন্তি সম্পর্কে যেসব কাহিনী প্রচলিত রয়েছে তা বাস্তব। (উদাহরণস্বরূপ সুশীল চৌধুরী প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, বাংলা কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্যে এবং যােগাযােগের ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি অর্জন করে এবং এর ফলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা এত উন্নত হয় যে বাংলাকে আলঙ্কারিক ভাষায় “স্বর্গরাজ্য”, “ভারতের বেহেশত”, “বিশ্বের জান্নাত” ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। শুধু স্থানীয় ভদ্র লােকরাই এ ধরনের ধারণার জন্ম দেন নি, এতে সমকালীন বৈদেশিক পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের অবদান রয়েছে। এই স্বর্গরাজ্য তত্ত্ব আরাে জোরদার হয় ঔপনিবেশিক সমাজে সনাতন অর্থনীতির অবক্ষয় এবং পরবর্তীকালে বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে। এই পর্যায়ে এখানে প্রামাণ্য অর্থনৈতিক তত্ত্বের আলােকে এই স্বর্গরাজ্য তত্ত্ব ও ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ বিশ্লেষণ করা হবে। তবে এই বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার তুলানামূলক সমৃদ্ধি সম্পর্কে সুশীল চৌধুরীর বক্তব্য অস্বীকার করা নয়।) কিন্তু বাংলার নিরবচ্ছিন্ন সমৃদ্ধি সম্পর্কে যে ব্যাপক সরলীকৃত বক্তব্য রয়েছে তা বিক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। স্কট গর্ডন যথার্থই বলেছেন, “… তত্ত্ববিহীন বর্ণনা অন্তঃসারশূন্য। যেসব বিজ্ঞানী এ ধরনের কাজ করেন তারা ভিন্ন ধরনের মােহে বিভ্রান্ত, তারা বিশ্বাস করেন যে তারা কোন তত্ত্ব ব্যবহার করছেন না, কেননা অন্তর্নিহিত যে তত্ত্ব তারা ব্যবহার করেছেন সে সম্পর্কে তারা নিজেরাই সজাগ নন।” (Scott Gordon. The History and Philosopy of Social Science (London and New York 1993), 10)। তাই বাংলার আর্থিক বিবর্তন সম্পর্কে সনাতন ব্যাখ্যার অন্তর্নিহিত অনুমানসমূহ সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করা অত্যাবশ্যক।

ঐতিহাসিকদের মতবাদের সাথে অসঙ্গতি : সােনার বাংলা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতবাদ অর্থনীতির প্রামাণ্য তত্ত্বের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে তাত্ত্বিক মতভেদ সত্ত্বেও সকল ধরনের অর্থনীতিবিদই সােনালী যুগ তত্ত্বকে কিংবদন্তি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। পক্ষান্তরে ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, সােনার বাংলার ব্যাখ্যা অকাট্য তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং সােনার বাংলা সম্পর্কে ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়ােজন রয়েছে। ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যায় সােনার বাংলা তত্ত্বের চারটি অনুসিদ্ধান্ত রয়েছে –

  • প্রথমত ঐতিহাসিকগণ বিশ্বাস করেন যে, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাংলা অব্যাহত সমৃদ্ধি উপভােগ করেছে। এর অর্থ হলাে, বাংলায় কখনাে দুর্ভিক্ষ ঘটে নি এবং সমসাময়িক সমাজে অর্থনৈতিক চক্রের ফলে যে ধরনের ওঠানামা দেখা যেতাে তা ছিল বাংলায় অনুপস্থিত।
  • দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে বাংলা ছিল ‘প্রাচুর্য ও সস্তা দামের দেশ’ (Muhammad Abdur Rahman, Social und Cultural History of Bengal, Vol. I, (Karachi 1963), 404)।
  • তৃতীয়ত, বাংলার আপামর জনগণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল ভােগ করেছে। ফলে বাংলার জনগণের কাছে দারিদ্র ছিল অপরিচিত।
  • চতুর্থত, সমসাময়িক সমাজের তুলনায় প্রাক-ব্রিটিশ বাংলা ছিল সমৃদ্ধতর। 

তত্ত্ব ও প্রমাণসমূহের পরীক্ষা : এখানে ‘সােনার বাংলা’ তত্ত্বের তাত্ত্বিক ভিত্তি ও ঐতিহাসিক প্রমাণসমূহ পরীক্ষা করা হবে, যা চারটি অংশে বিভক্ত –

  • প্রথম অংশে প্রাক-ব্রিটিশ বাংলাতে কথিত অব্যাহত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করা হবে।
  • দ্বিতীয় অংশে সােনার বাংলায় সুলভ দ্রব্যমূল্যের অর্থনৈতিক তাৎপর্য আলােচিত হবে।
  • তৃতীয় অংশে প্রাক-ব্রিটিশ বাংলাতে দারিদ্র্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক উপাদানসমূহ পর্যালােচনা করা হবে।
  • সর্বশেষ অংশে থাকবে এই প্রবন্ধের মূল বক্তব্যসমূহের সারসংক্ষেপ এবং বাংলার অতীত ইতিহাসের ব্যাখ্যায় উপরের বক্তব্যসমূহের তাৎপর্য সম্পর্কে আলােচনা। 

নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্পর্কে কিংবদন্তি 

নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অনুসিদ্ধান্তসমূহ : ‘সােনার বাংলা’ তত্ত্বের প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন যে, ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে বাংলায় নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিরাজ করতাে। এ তত্ত্বের দুটি স্পষ্ট অনুসিদ্ধান্ত রয়েছে –

  • প্রথমত, প্রাক-ব্রিটিশ আমলে কখনাে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় নি।
  • দ্বিতীয়ত, এ ধরনের কৃষিপ্রধান সমাজে মাঝে মাঝে অর্থনীতিতে যে ধরনের ওঠানামা দেখা যেতে তা ছিল অনুপস্থিত। 

বিভিন্ন অর্থনৈতিক মতবাদের বিরোধিতা : প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজ সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা প্রামাণ্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের সর্বস্বীকৃত ধারণার সাথে মােটেও মেলে না। তাত্ত্বিক মতবিরােধ সত্ত্বেও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজ সম্পর্কে বিস্ময়কর মতের মিল রয়েছে। এ ধরনের সমাজ সম্পর্কে ধ্রুপদী, নব্য-ধ্রুপদী, কেইনসীয় (Keynesian) ও মার্কসীয় অর্থনীতিবিদদের ধারণায় কোন মতবিরােধ নেই।

  • ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের মত : ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের মতে প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজ ছিল ম্যালথুসীয় (Malthusian) ফাঁদে বন্দী। এ ধরনের সমাজে বেশিরভাগ লােক কোন রকমে বেঁচে থাকতাে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল নিয়ন্ত্রক ছিল জনসংখ্যা। ম্যালথুসের পূর্বসূরি এডাম স্মিথ বিশ্বাস করতেন যে, “অন্যান্য পণ্যের মতাে মানুষের উৎপাদন তার চাহিদা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।” (Quoted in Robert L. Heilbroner. The Worldly Philosophers, (New York 1986), 65)। ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের মতে, মজুরির হার বেড়ে গেলে শ্রমের চাহিদা বেড়ে যেতাে। রিকার্ডোর মজুরি সম্পর্কে অমােঘ নিয়মের (iron law) বক্তব্য হলাে, দীর্ঘদিন ধরে মজুরির হার বেঁচে থাকার জন্য যে ন্যূনতম মজুরি প্রয়ােজন তার চেয়ে বেশি থাকতে পারে না। মজুরি বাড়লে জনসংখ্যা বাড়বে; জনসংখ্যা বাড়লে মজুরি আবার কমে যাবে। কাজেই প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজের অর্থনীতিতে ওঠানামা ছিল, কিন্তু কোন দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব ছিল না। ম্যালথুসীয় বিশ্লেষণে প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করত দুর্ভিক্ষ। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়ােজনীয় ন্যূনতম মজুরির চেয়ে মজুরি বেড়ে গেলেই জনসংখ্যার অতিসরবরাহ দেখা যেতাে। এর পরিণামে শুরু হতাে মজুরি হ্রাস আর সবশেষে দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষে জনসংখ্যা কমে গেলে আবার মজুরির হার বেড়ে যেতাে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতাে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ও দুর্ভিক্ষের পরবর্তী চক্র।
  • নব্য-ধ্রুপদী ও কেইনসীয় অর্থনীতিবিদদের মত : যদিও নব্য-ধ্রুপদী ও কেইনসীয় অর্থনীতিবিদরা শিল্পপ্রধান সমাজে ধ্রুপদী মডেলের প্রয়ােগ যথার্থ মনে করেন না, তবু প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজের ক্ষেত্রে ধ্রুপদী বিশ্লেষণ সম্পর্কে তাদের কোন আপত্তি নেই। তাই নব্য-ধ্রুপদী ধারার দু’জন ইতিহাসবেত্তা এ ধরনের সমাজ সম্পর্কে লিখেছেন : ‘যদি আমরা মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসের চিত্র তুলে ধরি এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের অর্থনৈতিক জীবন আধুনিক মানদণ্ডে বিচার করি, তা হলে দেখতে পাবাে যে জীবন ছিল বিরামহীন দুর্দশা। … দুর্দশার যুগকে কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং সেসব যুগকে গ্রাম্য সারল্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সেসব যুগ স্বর্ণযুগ ছিল না।’ (Nathan Rosenberg and L.E. Birdzwell, Jr., How the West Grew Rich, (New York 1986), 1)। অনুরূপ মত কেইনও ব্যক্ত করেছেন। কেইনস্ লিখেছেন : ‘প্রাচীনতম সময় যখন থেকে লিখিত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, ধরুন খ্রিস্টজন্মের দু’হাজার বছর আগে থেকে ১৮শ শতকের শুরু পর্যন্ত পৃথিবীর সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের কোন বড় পরিবর্তন হয় নি। ওঠানামা হয়েছে নিশ্চয়ই। প্লেগ, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধও দেখা দিয়েছে। কখনাে এসেছে সােনালী বিরতি। কিন্তু অগ্রগতিশীল কোন পরিবর্তন দেখা যায় নি।’ (J. M. Keynes, “Economic Possibilities of Our Grand Children“, Essays in Persuasion (London 131), 360)।
  • মার্ক্সীয় অর্থনীতিবিদদের মত : প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে কার্ল মার্কসের ধারণাও ছিল অনুরূপ। তিনি স্পষ্টই বলেছেন যে, হিন্দুস্থানের সােনালী যুগে যারা বিশ্বাস করে তিনি তাদের দলে নন। (Karl Marx, “The Future Results of British Rule in India”, in Karl Marx and Frederick Engels, Selected Works, Vol I. (Moscow 1962), 345)। তিনি প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের জীবনকে “মর্যাদাহানিকর, স্থবির ও প্রগতিহীন” বলে চিহ্নিত করেছেন এবং গ্রাম্য সমাজকে “ক্ষুদ্র, আধা-বর্বর, আধা-সভ্য সমাজ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (ঐ, 358)।

“কৃষকরা সর্বত্র একই ধরনের”। (Quoted from Fernard Braudel, The Wheels of Commerce Civilization wd Capitalsın of 15th-18th Century Vol. II, translated by Sian Reynolds, (New York 1982), 253)। ম্যাক্সিম গাের্কীর এ স্মরণীয় উক্তি প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজের রূঢ় বাস্তবকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

ভ্রান্ত দুর্ভিক্ষহীনতার দাবি : ঐতিহাসিকদের স্বাভাবিক অনুমান হওয়া উচিত যে, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় বিরামহীন দারিদ্র্য বিরাজ করতাে। ঐতিহাসিকগণ পক্ষান্তরে বলেন যে, প্রাপ্ত ঐতিহাসিক আকরসমূহ হতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাক-ব্রিটিশ যুগে বাংলাতে আদৌ কোন দুর্ভিক্ষ হয় নি। মধ্যযুগের বাংলা সম্পর্কে একজন ঐতিহাসিক দাবি করেছেন, “দেশে সব সময় প্রচুর খাদ্য থাকতাে। এর ফলে উত্তর ভারতের অন্যত্র মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া গেলেও সমগ্র মুসলমান শাসনামলের ঐতিহাসিক উপাদানসমূহে একটি দুর্ভিক্ষেরও উল্লেখ নেই।” (Mohammad Mohar Ali, History of the Muslims of Bengal, Val IB. (Riyadh 1985), 960)। ঐতিহাসিক আকরসমূহ পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় অন্তত তিনটি দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে নির্ভরযােগ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কৌতূহলের বিষয় এই যে, বাংলার প্রাচীনতম লিপিতে রয়েছে দুর্ভিক্ষের উল্লেখ –

  • মহাস্থানলিপি সম্ভবত খ্রিস্টের জন্মের তিন শত বছর আগে রচিত হয়েছিল। লিপিটিতে দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণকে রাজার ভাণ্ডার হতে খাদ্যশস্য প্রদানের আজ্ঞা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। লিপিতে পুণ্ড্রনগরের মহাজাতককে দুর্ভিক্ষের ত্রাণব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। (Radha Krishra Chaudhury, Inscriptions of Ancieni India, (New Delhi 1983). 91)।
  • আনুমানিক ৯ম শতকে রচিত মঞ্জুশ্রী মূলকল্প গ্রন্থে গৌড়ের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশসমূহে ‘মহা দুর্ভিক্ষের’ উল্লেখ রয়েছে। (K P. Jayaswal, An Imperial History of India in a Sanskrit Text (Lahore 1934). 32)। নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন যে, দুর্ভিক্ষটি শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বিরাজমান অরাজকতাকালে (৬৫০-৭৫০ খ্রি.) দেখা দেয়। (নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস, আদি পর্ব (সংক্ষেপিত), (কলিকাতা ১৩৮২ বা, স.), ২৪১)। আরেকজন ঐতিহাসিক মনে করেন যে, দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল গুপ্ত শাসনের প্রথম পর্বে অর্থাৎ আনুমানিক ৪র্থ শতাব্দীতে। (K P Jayaswal , Imperial History. 52)।
  • তৃতীয় দুর্ভিক্ষের উল্লেখ রয়েছে ফতিয়া ইবরিয়া গ্রন্থে, যাতে ১৬৬১-১৬৬৩ সালের দুর্ভিক্ষ বর্ণিত হয়েছে। (Quoted from Jadu Nath Sarkar (cd.), The History of Bengal Vol II. (Patna 1973), 343-344)। প্রথমােক্ত দুর্ভিক্ষটি ঘটেছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে। তৃতীয় দুর্ভিক্ষটি ছিল মনুষ্যসৃষ্ট। এ দুর্ভিক্ষে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতার জন্য খাদ্যদ্রব্য চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং গ্রাম্য চৌকিদার ও অভ্যন্তরীণ শুল্কের কর্মকর্তাদের অত্যাচার। দুর্ভিক্ষের ফলে দুর্দশা ছিল তীব্র। তালিশ লিখেছেন, “রুটির চেয়ে জীবনের দাম ছিল সস্তা আর রুটি পাওয়াই যাচ্ছিল না।” (ঐ, 344)।

ইতিহাসে দুর্ভিক্ষের কম উল্লেখ : যুক্তি দেখানাে যেতে পারে যে, দু’হাজার বছরে মাত্র তিনটি দুর্ভিক্ষের উল্লেখ এ কথাই প্রমাণ করে যে, বাংলায় কদাচিৎ দুর্ভিক্ষ হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক আকরসমূহে যতাে দুর্ভিক্ষ হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের অনুমানের পক্ষে জোরালাে যুক্তি রয়েছে –

  • প্রথমত, বাংলার ইতিহাসের উপাদানসমূহ রচনা করেছেন বিদেশী সভাসদগণ ও বিদেশী পর্যটকগণ। সভাসদদের মূল লক্ষ্য ছিল তাদের প্রভুদের গুণকীর্তন। যেহেতু পর্যটকরা সমাজের উচ্চস্তরের লােকদের সাথে মেলামেশা করেছেন, সেহেতু এ দেশের সাধারণ লােকদের জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল ভাসা-ভাসা ও অস্পষ্ট।
  • দ্বিতীয়ত, রােজেনবার্গ ও বার্ডজেল যথার্থই উল্লেখ করেছেন, সাহিত্য, কবিতা, রােমান্স ও কিংবদন্তির কল্যাণে আমরা অনেক সময় অতীতে দুর্দশার প্রাধান্যের কথা ভুলে যাই। এসব উপাদানে যারা ভাল করে বেঁচেছিল তাদেরই স্মরণ করা হয়েছে আর নীরব দারিদ্র্যে যারা কালাতিপাত করেছে তাদের ভুলে যাওয়া হয়েছে। (Nathan Rosenberg und L.E. Birdzwell, Jr., How’ the West Grew Rich, 1)।
  • তৃতীয়ত ঐতিহাসিক উপাদানে উল্লেখ না থাকলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলায় বন্যা, খরা ও ঝড়ের মতাে প্রাকৃতিক দুর্বিপাক বারবার আঘাত হেনেছে। এসব দুর্বিপাকের ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে সময় সময় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত প্রাপ্ত ঐতিহাসিক উপাদানসমূহে অধিকাংশ প্রাকৃতিক দুর্বিপাকই উল্লেখিত হয় নি। 

সাহিত্যিক উপাদানে প্রায়শ দুর্ভিক্ষের উল্লেখ : সাহিত্যিক উপাদানসমূহও বাংলায় মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ হওয়ার অনুমান সমর্থন করে। ১৩শ শতকের প্রথমদিকে শ্রীধর দাস সংকলিত সদুক্তিকর্ণাত গ্রন্থে ক্ষুধার্ত সন্তানকে খাদ্যদানে অক্ষম মায়ের আর্তি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। (নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস, ১৯৭)। ১৬শ শতকের কবি জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থে একটি দুর্ভিক্ষের নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেন (জয়ানন্দ, চৈতন্যমঙ্গল, সম্পাদনা বিমানবিহারী মজুমদার ও সুখময় মুখখাপাধ্যায়, (কলিকাতা ১৯৭১), নদীয়া খণ্ড) : 

শ্রীহট্ট দেশে অনাচার দুর্ভিক্ষ জন্মিল
ডাকা-চুরি অনাবৃষ্টি মড়ক লাগিল।
উচ্ছন্ন হইল দেশ অরিষ্ট দেখিয়া
নানা দেশে সৰ্ব্বলােক গেল পালাইয়া।  

জয়ানন্দের পূর্বপুরুষরা এর ফলে সিলেট হতে নবদ্বীপে বসতি স্থানান্তর করেন। জয়ানন্দের বর্ণনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, অনাবৃষ্টির ফলে মড়ক ও নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। ১৬শ শতকের অন্য এক কবি চন্দ্রাবতী তাঁর মলুয়া আখ্যানে আরেকটি দুর্ভিক্ষের বর্ণনা দিয়েছেন। (চন্দ্রাবতী, মলুয়া, ময়মনসিংহ গীতিকা, সম্পাদনা সুখময় মুখােপাধ্যায়, (কলিকাতা ১৯৭০), ৪৪-৬)। এক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষের কারণ হলাে বন্যা। আখ্যানটিতে বন্যায় উদ্ভূত নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আশ্বিনের বন্যায় চাঁদ বিননাদের জমির ফসল ভেসে যায়। ধানের দাম বেড়ে টাকায় ছয় মণে দাঁড়ায়। ধান ক্রয়ের ক্ষমতা চাদবিননাদের নেই। প্রথমে তার হালের বলদ বিক্রি হয়, তারপর মহাজনের কাছে জমিজমা বন্ধক দেয়া হয়। সবশেষে খাদ্য ও অর্থের সন্ধানে চাঁদবিনােদ গ্রাম ছেড়ে চলে আসে। ষােড়শ শতকের আরেকজন কবি বৃন্দাবন দাস রচিত চৈতন্যভাগবতেও দুর্ভিক্ষের উল্লেখ রয়েছে। (Quoted in Momtazur Rahman Tarafder, Husain Shan Bengal · A Soiro Political Study ( Dhaka 1965), 61-62)।

বাংলায় দুর্ভিক্ষের সংখ্যা ও নিবিড়তা কম ছিল : উল্লিখিত সাক্ষ্যসমূহ প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় দুর্ভিক্ষের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতির অনুমান অগ্রাহ্য করে। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতাে বাংলায় ঘনঘন দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। বাংলায় অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে দুর্ভিক্ষের সংখ্যা ও নিবিড়তা কম ছিল। এ অনুমানের পক্ষে দুটি যুক্তি রয়েছে –

  • বন্যার ফলে সমান ক্ষতি হতাে না : প্রথমত বাংলায় প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের মধ্যে বন্যা সবচেয়ে ঘনঘন হতাে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয় ছিল খরা। উপদ্রুত অঞ্চলে খরার ফলে সব ফসল নষ্ট হয়ে যেতাে; বন্যার ফলে ক্ষতি কম হতাে। একই গ্রামের ভেতরে ও একই অঞ্চলে সব জমির উচ্চতা সমান ছিল না। এর ফলে সব জমিতে বন্যার ফলে সমান ক্ষতি হতাে না। উচ্চতর জমিতে বন্যায় আদৌ কোন ক্ষতি হতাে না, কখনাে কখনাে যথেষ্ট বৃষ্টিপাতের জন্য বন্যাপরবর্তী ফলন ভাল হতাে। পক্ষান্তরে নিচু জমিতে সকল ফসল তলিয়ে যেতাে। এর ফলে সচ্ছল কৃষকরা, যারা সাধারণ ও ভাল জমির মালিক, তারা বন্যায় ফসলের দাম বেড়ে গেলে লাভবান হতাে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা, যারা বন্যাপ্রবণ জমির মালিক, বন্যার ফলে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়তাে। বন্যা তাই সমাজে মেরুকরণ প্রক্রিয়াকে জোরদার করে। সাহিত্যিক উপাদানসমূহেও উপরােক্ত প্রবণতাসমূহ লক্ষ্য করা যায়। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে দেখা যায় যে, খরার ফলে দুর্ভিক্ষ হলে নীলাম্বর চক্রবর্তীকে দেশান্তরে যেতে হয়। স্পষ্টতই খরার ফলে তার পূর্বতন বাসস্থান বাসের অযােগ্য হয়ে পড়ে। চন্দ্রাবতীর মলুয়াতে দেখতে পাই যে, যদিও বন্যায় শস্যহানির দরুন চাঁদবিনােদের গ্রামে দুর্দশা বিরাজ করছে, তবুও মহুয়ার গ্রাম বা চাদবিনােদের ভগ্নির গ্রামে খাদ্যাভাব নেই। বাংলায় বন্যার ফলে বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে দরিদ্র লােকদের মধ্যে খাদ্যাভাব দেখা যেত। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে খরার ফলে ব্যাপক দুর্দশা দেখা দিত। 
  • উন্নত নৌপরিবহন ব্যবস্থা : দ্বিতীয়ত দক্ষিণ এশিয়াতে দুর্ভিক্ষ অত্যন্ত ক্ষুদ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকতাে। ব্রিটিশ প্রশাসনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, যেখানে পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ছিল সেখানে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ ততাে কম ছিল। কার্ল মার্কস যথার্থই বলেছেন, ‘ভারতের মতাে অন্য কোথাও পরিবহনের অভাবে প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের মধ্যে সামাজিক দুর্দশা দেখা যায় না। ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সের একটি কমিটির কাছে ১৮৪৮ সালে প্রমাণ করা হয় যে, যখন খান্দেশে ৮ বুশেল খাদ্যের দাম ছিল ৬ থেকে ৮ শিলিং, তখন পুনাতে এর দাম ছিল ৬৪ থেকে ৭০ শিলিং। পুনার রাস্তায় লােক মরছিল, কিন্তু কাদার রাস্তাতে খান্দেশ থেকে খাদ্য নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না।’ (Karl Marx, “The Future Results of British Rule in India”, 354)। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলায় একটি কার্যকর অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহনব্যবস্থা ছিল। এর ফলে বাংলার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে খাদ্য পাঠানাে সহজ ছিল। তাই বাংলায় দুর্ভিক্ষের ব্যাপকতা ও নিবিড়তা কম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। 

সহজ যোগাযোগব্যবস্থা দুর্ভিক্ষ বন্ধের জন্য যথেষ্ট ছিল না : তবে সহজ যােগাযােগব্যবস্থা দুর্ভিক্ষ বন্ধ করার জন্য প্রয়ােজনীয় হলেও যথেষ্ট ছিল না। প্রাকৃতিক বাধা ছাড়াও মানুষের সৃষ্ট বাধা (যার উল্লেখ তালিশ করেছেন) খাদ্যশস্য চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া উপদ্রুত এলাকাতে খাদ্যশস্য পাঠানাে যথেষ্ট নয়, খাদ্যশস্য কেনার জন্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতা থাকতে হবে। দৃশ্যতই ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত ছিল। এর ফলে এরা ছিলেন খাদ্যাভাবের প্রধান শিকার।কাজেই বাংলায় দুর্ভিক্ষের নিবিড়তা কম হলেও বাংলায় দুর্ভিক্ষ অজানা ছিল একথা বলা ঠিক হবে না। কয়েকজন ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলায় স্থানীয় খাদ্যাভাব ঘটতাে, দুর্ভিক্ষ নয়। (Mohar Ali, Muslims of Bengal, 925)। দুর্ভিক্ষ ও স্থানীয় খাদ্যাভাবের মধ্যে মাত্রার তফাৎ রয়েছে, কিন্তু এদের প্রকৃতি অভিন্ন। উপরন্তু প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় কোন জাতীয় বাজার ছিল না, সকল বাজারই ছিল খণ্ডিত ও স্থানীয়। এ ধরনের পরিবেশে স্থানীয় খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে অর্থবহ পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। 

মুদ্রার বিশ্লেষণে বাংলার অর্থনৈতিক ওঠানামার আভাস : সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও দুর্দশা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বারবার ব্যাহত করেছে। কৃষিতে এ ধরনের অস্থায়ী ওঠানামা ছাড়াও বাংলার অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী ওঠানামা দেখা গেছে। বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করেছে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অবস্থা, বাণিজ্যিক সড়কে রাজনৈতিক অবস্থা ও বৈদেশিক চাহিদা। বিভিন্ন সময়ে বাংলায় প্রাপ্ত মুদ্রা বিশ্লেষণ করলে বাংলার অর্থনৈতিক ওঠানামার আভাস পাওয়া যায়। ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে অনেক স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। কিন্তু ৭ম শতক থেকে ১২শ শতক পর্যন্ত যখন পাল ও সেন রাজারা রাজত্ব করতেন তখন কোন স্বর্ণমুদ্রা চালু করা হয় নি। ১৩শ শতকে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর আবার স্বর্ণমুদ্রা চালু হয়। এই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে নীহাররঞ্জন রায় অনুমান করেন যে, ৭ম শতক হতে ১২শ শতক এই পাঁচশত বছর ধরে বাংলার অর্থনৈতিক জীবনে স্থবিরতা বিরাজ করে। (নীহাররঞ্জন বায়, বাঙালীর ইতিহাস, ৯৩-৯৭)। এই স্থবিরতার কারণ দুটি –

  • প্রথমত, রােমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরােপে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় এবং এর ফলে বাংলার পণ্যের চাহিদা দ্রুত কমে যায়।
  • দ্বিতীয়ত, ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য আরব বণিকদের একচেটিয়া বাণিজ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং এ বাণিজ্য থেকে ভারতীয় বণিকদের উচ্ছেদ করা হয়। এর ফলে বাণিজ্যে মুনাফা উল্লেখযােগ্যভাবে হ্রাস পায়।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মন্দার সাক্ষ্য ও ৫ম থেকে ১২শ শতক পর্যন্ত স্বর্ণমুদ্রার অনুপস্থিতি বাংলায় অব্যাহত সমৃদ্ধির অনুমান মােটেও সমর্থন করে না। এমনকি, মুসলিম শাসনামলে যখন যথেষ্ট স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করা হয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুনরায় চালু করা হয়, তখনাে বাংলার অর্থনীতিতে অবশ্যই ওঠানামা ছিল। নিশ্চয়ই রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিকে প্রভাবিত করেছে। কাজেই ১৪শ শতক থেকে ১৮শ শতক পর্যন্ত পাঁচ শত বছর ধরে একই ধরনের সমৃদ্ধি বিরাজ করছিল (Mohar Ali, Muslims of Bengal, 925) – এ ধরনের দাবি মেনে নেয়া কঠিন। একথা বিশ্বাস করা শক্ত যে, হাবশী ক্রান্তিকালের (১৪৮৭-১৪৯৩) মতাে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে নি। সম্ভবত অর্থনৈতিক ওঠানামা ও রাজনৈতিক ওঠানামা একই সাথে ঘটেছে। 

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাংলায় অব্যাহত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিরাজ করে নি। প্রথমত, অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী ওঠানামা ছিল। বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্যেও উল্লেখযােগ্য ওঠানামা দেখা গেছে। দ্বিতীয়ত, খাদ্যশস্যের মূল্যে স্বল্পস্থায়ী ওঠানামা ছিল। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক ও মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতার জন্য খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে। দুর্ভিক্ষ এবং আকাল বারবার প্রাচুর্যের ধারাবাহিকতা রূঢ়ভাবে ছিন্ন করেছে। 

সুলভ দ্রব্যমূল্যের অর্থনৈতিক তাৎপর্য

ঐতিহাসিক উপাদানসমূহে সুলভ দ্রব্যমূল্যের উল্লেখ : মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, ঐতিহাসিক উপাদানসমূহ স্পষ্টত প্রমাণ করে যে, খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের দাম অবিশ্বাস্যভাবে সুলভ ছিল। (Mohar Ali, Muslims of Bengal, 960)। ১৪শ শতকে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা লিখেছেন, “পৃথিবীর আর কোথাও এত সস্তা দাম দেখি নি”। (Ibn Batuta. Travels in Asia and Africa, 1325-1351, translated by H.A.R Gibb. (New York 1969), 207)। চীনা পরিব্রাজক ওয়াং তু ওয়ান, যিনি ১৪শ শতকে বাংলায় এসেছিলেন, তিনি লিখেছেন, বাংলায় দ্রব্যমূল্য মােটামুটি সস্তা ছিল (সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাসের দুশাে বছর: স্বাধীন সুলতানদের আমল, (কলিকাতা ১৯৮০), ৩১৮-৩১৯)। ১৬২৮ থেকে ১৬৪১ সাল পর্যন্ত ভারত ভ্রমণ করেছিলেন সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক। তাঁর সাক্ষ্য অনুসারে বাংলায় খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের দাম ছিল অত্যন্ত সস্তা। (Mohar Ali, Muslims of Bengal, 962)। ১৭শ শতকের পর্যটক ফ্ৰাঁসােয়া বার্নিয়ের বাংলায় নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের সস্তামূল্য লক্ষ্য করেছেন। বাংলায় দ্রব্যমূল্যের সুলভতার কারণ হিসেবে কৃষি ও শিল্পে বাংলার অসাধারণ উৎপাদনশীলতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালের একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, ‘কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের প্রাচুর্যের কারণ হচ্ছে ভূমির উর্বরতা, শিল্পের বিকাশ এবং জনগণের শ্রম ও কারিগরি নৈপুণ্য। বাংলায় দ্রব্যাদি এত প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতাে যে দেশের লােকের চাহিদা মেটানাের পরও সমৃদ্ধিশালী বহির্বাণিজ্যের জন্য যথেষ্ট উদ্বৃত্ত থাকতাে। এ উদ্বৃত্তের বিনিময়ে বিদেশ হতে সােনা-রূপা এসে এ প্রদেশকে আরাে সমৃদ্ধ করে তােলে।’ (Francois Bernier, Travels in the Moghal Empire, irans Archibald Constabie, (Lahore 1976), 439-439)।

সস্তাদাম একটি আপেক্ষিক ধারণা : সস্তাদাম একটি আপেক্ষিক ধারণা, কেননা – প্রথমত, একটি দেশের দ্রব্যমূল্য অন্য দেশের তুলনায় সস্তা হতে পারে। কিন্তু এ উপাত্তের ভিত্তিতে দুটি দেশের জীবনযাত্রার মানের তুলনা সম্ভব নয়, কারণ জীবনযাত্রার মান শুধু দ্রব্যমূল্যের উপর নির্ভর করে না, আয়ের স্তর ও বণ্টনের উপরও নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত, একটি দেশের লােকের আয়ের তুলনায় সে দেশের দ্রব্যমূল্য সস্তা হতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলার ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে এ দুটি স্বতন্ত্র ধারণাকে অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা হয় যে, মধ্যযুগের বাংলা সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, ‘তবু একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে শতাব্দীর পর শতাব্দী খাদ্য সহ প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম ছিল এবং তার ফলে স্বল্প আয়ে একজন লােক তার নিজের ও তার পরিবারের ভরণপােষণের সংস্থান করতে পারতাে।’ (Abdur Rahim, Social and Cultural History of Bengal, 404. ৩২. Mohar Ali, Muslims of Bengal, 963)। এ ধরনের যুক্তির মূল ত্রুটি এই যে, দ্রব্যমূল্যের সুলভতা দেশের লােকের আয়ের তুলনায় নির্ণয় না করে বিদেশী দামের তুলনায় নির্ণয় করা হয়। স্পষ্টতই বস্ত্রের মূল্য সস্তা হলে তাঁতির মজুরি বেশি হতে পারে না, কৃষিপণ্যের মূল্য সস্তা হলে খামার-শ্রমিকের মজুরি কম হবে। তাই দ্রব্যমূল্যের সুলভতা জীবনযাত্রার উচ্চমানের জন্য প্রয়ােজনীয় কিংবা যথেষ্ট নয়। 

ভ্রমণবৃত্তান্তসমূহের উল্লেখের সীমাবদ্ধতা : ভ্রমণবৃত্তান্তসমূহে দ্রব্যমূল্যের সুলভতার উল্লেখ বিক্ষিপ্ত ও সংক্ষিপ্ত। এসব বৃত্তান্তে শুধু বাংলার দ্রব্যমূল্যের উল্লেখ আছে। কিন্তু এগুলাে বাংলার জনগণের আয় ও মজুরি সম্পর্কে নীরব। এসব ত্রুটি সত্ত্বেও ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তে দ্রব্যমূল্যের সুলভতার তাৎপর্য সম্পর্কে অর্থবহ ইঙ্গিত রয়েছে। এই ভ্রমণবৃত্তান্ত হতে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলার তুলনায় দিল্লীতে আয় ও দ্রব্যমূল্য বেশি ছিল। বাংলায় সবচেয়ে উত্তম ক্রীতদাসী এক দিনারে বিক্রি হতাে, একটি দাস বালকের মূল্য ছিল দুই দিনার। (Ibn Batuta, Travels, 267)। দিল্লীতে ইবনে বতুতা একজন তুর্কীর কাছে একটি ক্রীতদাস একশ দিনারে বিক্রয় করেন (ঐ, ১৯৬)। এ সময়ে দিল্লীতে দাসী বালিকার দাম ছিল আট দিনার, উপপত্নীর দাম ছিল ১৫ টঙ্কা। (Irfan Habib, “Non Agricultural Production and Urban Economy”. The Cambridge Econonic History of India, Vol, 1, (ed), Tapan Ray Chaudhuri and Irfan Habib, (New York 1982). 92)। ইবনে বতুতা বাংলার লােকদের আয় সম্পর্কে কিছু বলেন নি। তার ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে দেখা যায় যে, দিল্লীর আমিরদের আয় ছিল অনেক বেশি। তিনি লিখেছেন যে, দিল্লীর উজির তাঁর প্রতিটি ক্রীতদাসকে পঁয়ষট্টি রৌপ্যদিনার (৬.৫ স্বর্ণদিনারের সমান) বখশিস দিয়েছিলেন। অথচ বাংলায় দুই দিনারে একজন ক্রীতদাস ক্রয় করা যেতাে (Ibn Batuta, Travels, 210)। বাংলায় দ্রব্যমূল্যের তুলনায় ইবনে বতুতার আয় ছিল প্রচুর। সুলতান বছরে ইবনে বতুতাকে সতেরাে হাজার দিনার ভাতা দিতেন (ঐ ২০৬-২০৭)। ঋণ শোধ করার জন্য সুলতান তাকে পঞ্চান্ন হাজার দিনার দেন। প্রথমবার সালাম জানাতে গেলে দিল্লীর উজির তাকে দুই হাজার রৌপ্যমুদ্রা (দুশ’ স্বর্ণমুদ্রার সমান) উপহার দেন। সুতরাং ইবনে বতুতা যে বাংলায়্য দ্রব্যমূল্য সস্তা বিবেচনা করবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। 

বাংলায় লােকের আয়ের তুলনায় দ্রব্যমূল্য সস্তা ছিল না : বাংলায় লােকের আয়ের তুলনায় দ্রব্যমূল্য সস্তা ছিল না – এ ধরনের ইঙ্গিত ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তেই রয়েছে –

  • প্রথমত ইবনে বতুতা লিখেছেন, বাংলায় করের হার খুব বেশি ছিল। পূর্ব বাংলা সফরের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “এখানকার প্রজারা মুসলমান রাজার বিধর্মী প্রজা। এদের ফসলের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ নিয়ে নেয়া হয়। তার উপরে তাদের কর দিতে হয়।” (ঐ ২৭১)। যেহেতু আদায়কৃত কর জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হতাে না, বরং দিল্লীকে নজরানা প্রদান এবং যুদ্ধের জন্য ব্যয় করা হতাে, সেহেতু করের উচ্চহার জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বিশেষভাবে হ্রাস করে। এ ধরনের করব্যবস্থা চালু থাকলে দ্রব্যমূল্য কম হতে বাধ্য।
  • দ্বিতীয়ত, ইবনে বতুতা বলেছেন, “আমি তাদের বলতে শুনেছি যে এ দামও তাদের জন্য বেশি”। (উদ্ধৃতি দেখুন, Mohar Ali, Muslims of Bengal, IA, 130)। এই উক্তি জনগণের সীমিত ক্রয়ক্ষয়তা সম্পকে অনুমান সমর্থন করে। বাংলায় জনগণের আয়ের তুলনায় দ্রব্যের মূল্য সস্তা ছিল না।
  • তৃতীয়ত, দাসদের স্বল্পমূল্য প্রমাণ করে যে, বাংলায় মজুরির হার কম ছিল। একজন দাস সারা জীবনে যা আয় করতাে তার উপর নির্ভর করে দাসের দাম। যদি মজুরির হার বেড়ে যেতাে তবে দাসের দামও বাড়তাে। বস্তুত দিল্লীতে ঘােড়ার দাম বাংলায় দাসের দামের চেয়ে বেশি ছিল। ঐতিহাসিক বারানী লিখেছেন যে, দিল্লীতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঘােড়ার দাম ছিল দশ থেকে বারাে টঙ্কা। (Irfan Habib, “Non Agricultural Production”, 92)। ইবনে বতুতা লিখেছেন, মুলতানে ঘােড়ার জন্য সাত দিনার শুল্ক দিতে হতাে। (Ibn Batuta, Travels , 186)। এসব থেকে প্রমাণিত হয় যে, বাংলায় দাসদের উৎপাদনশীলতা ছিল অত্যন্ত সীমিত।

ইবনে বতুতা বাংলায় দ্রব্যমূল্য তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, বাংলার জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। ইবনে বতুতা বাংলায় দ্রব্যমূল্য নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেন, আমি আট দিরহামে আটটি তাজা মােরগ বিক্রয় হতে দেখেছি, এক দিরহামে পনেরােটি কচি কবুতর পাওয়া যেতাে, দুই দিরহামে পাওয়া যেতাে একটি মােটাসােটা ভেড়া। আমি আরাে দেখেছি, ত্রিশ হাত লম্বা সর্বোত্তম মানের মিহি তুলার কাপড় দু’দিনারে বিক্রয় হয়েছে, সুন্দরী ক্রীতদাসী বিক্রয় হয়েছে এক দিনারে, যা মরক্কোর মুদ্রায় আড়াই দিনারের সমান। (ঐ, 267)।

বিনিময়ের জনপ্রিয় মাধ্যম কড়ি : ইবনে বতুতা বাংলায় দ্রব্যাদির দাম সােনার দিনার এবং দিরহামে উল্লেখ করেছেন। তার সময়ে বাংলায় স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা বিনিময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল না, কড়ি ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। তিনি নিজে তা জানতেন এবং কড়ি সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন, ‘এসব দ্বীপের (মালদ্বীপের) অধিবাসীরা কড়ির খােলস মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করে। কড়ি হচ্ছে এক ধরনের প্রাণী যা সমুদ্র থেকে সংগৃহীত হয়। এগুলো গর্তে রেখে দিলে বাইরের খােল থেকে যায় আর মাংস শুকিয়ে যায়। কেনাবেচার জন্য এক স্বর্ণদিনারের বদলে এক হাজার কড়ি দেয়া হয়। চালের বদলে কড়ি বাংলার এবং ইয়ামনের সাথে বিনিময় করা হয়। বাংলায় কড়ি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ইয়ামনের লােকেরা বালির বদলে (ভার হিসেবে) জাহাজে কড়ি ব্যবহার করে। নিগ্রোরা তাদের দেশে কড়ি ব্যবহার করে। মল্লি এবং গ্যগ্যতে আমি এক স্বর্ণদিনারের বদলে ১১৫০টি কড়ির বিনিময় দেখেছি। (ঐ 243)। ইবনে বতুতা মােরগ বা কবুতরের দাম কড়িতে উল্লেখ করেন নি। এতে স্পষ্টতই বােঝা যাচ্ছে যে, ইবনে বতুতা যারা দিনারে আয় করে তাদের দৃষ্টিকোণ হতে দ্রব্যমূল্যের কথা চিন্তা করেছিলেন, যারা কড়িতে আয় করতেন তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।

স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা দুষ্প্রাপ্যতা ও দুর্দশার ইঙ্গিত : ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিক উপাদানসমূহ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, বাংলায় দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে কড়ি ছিল বিনিময়ের মাধ্যম। স্পষ্টতই যারা কড়িতে বেচাকেনা করতাে তারা আয়ও কড়িতেই করতাে, সােনা বা রূপার মুদ্রায় নয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক কড়ির ব্যাপক ব্যবহার বিভ্রান্তিকর মনে করেন। প্রাক-মুসলিম বাংলাতে ব্যাপক কড়ির ব্যবহারের কারণ স্বর্ণ ও রৌপামুদ্রার দুষ্প্রাপ্যতা। ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যে আরবদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার বহির্বাণিজ্য ব্যাহত হয়। ফলে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পরও কড়ির ব্যবহার কেন চালু ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরােধ রয়েছে। একটি ব্যাখ্যা অনুসারে, মধ্যযুগের বাংলায় সােনা ও রূপার পর্যাপ্ত সরবরাহ পুনরায় শুরু হলেও বাঙালিরা অন্ধ আনুগত্যের জন্য কড়ির ব্যবহার চালু রাখে। (সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, ৩৫৫-৩৫৬)। এটি একটি জটিল বিষয়ের অতি সরলীকৃত ব্যাখ্যা বলে মনে হয়। একথা সত্য যে, মধ্যযুগের জাকালাে বহির্বাণিজ্যের ফলে বাংলায় প্রচুর পরিমাণ সােনা ও রূপা আমদানি করা হয়। কিন্তু এসব মূল্যবান ধাতু বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় নি। স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা হতে দিল্লীতে রাজস্ব প্রেরণের জন্য। আবুল ফজল লিখেছেন যে, বাংলার লােকেরা মােহর ও টঙ্কা খাজনা দেয়ার জন্য নির্ধারিত স্থানে নিয়ে আসতো। (উদ্ধৃত, Mohar Ali, Muslims of Bengal, 928)। যেহেতু রাষ্ট্রের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার ছিল সীমাহীন, সেহেতু অনেক সময় স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হতাে। এজন্য দৈনন্দিন ক্রিয়াকাণ্ড এবং ছােটখাটো বিনিময়ের জন্য স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা ব্যবহৃত হতাে না। একজন ঐতিহাসিক ঠিকই বলেছেন যে, বাংলায় স্বর্ণমুদ্রা ছিল সখের মুদ্রা (Abdul Karın, Murshid Quli Khan und His Times. (Dhaka 1963). 93), এবং এ মুদ্রা বাদশাহ-আমিরদের নজরানা দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতাে। তাই বাংলার জাঁকালাে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাইরে থেকে যে সােনা ও রূপা নিয়ে আসতাে তা ব্যবহৃত হতাে দিল্লীতে রাজস্ব পাঠানাের জন্য। বাংলা থেকে দিল্লীতে অর্থ পাচারের ফলে বাংলার লােক আরাে দরিদ্র হতাে। রাজস্ব প্রশাসন অধিকতর কার্যকর হলে বাংলা হতে অধিকতর সম্পদ চলে যেতাে। কাজেই দিল্লীর প্রতিনিধিদের আদায়ের পরিমাণ বেড়ে গেলে বাংলার জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেলে স্বভাবতই দ্রব্যমূল্য হ্রাস পাবে। এক্ষেত্রে সুলভ মূল্যের তাৎপর্য হচ্ছে জনগণের দুর্দশা, সমৃদ্ধি নয়। 

শায়েস্তা খানের আমলের সমৃদ্ধির উল্লেখ : উপরােক্ত বিশ্লেষণের আলােকে শায়েস্তা খানের সুবাদারিকালের (১৬৬৪-১৬৮৮) সমৃদ্ধি সম্পর্কে কিংবদন্তি পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। ক্যাপ্টেন চার্লস স্টুয়ার্ট শায়েস্তা খান সম্পর্কে নিম্নলিখিত কিংবদন্তি লিপিবদ্ধ করেছেন, ‘বলা হয়ে থাকে যে, তাঁর শাসনামলে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য এত সস্তা ছিল যে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেতাে। এ ঘটনার স্মৃতি রক্ষা করার জন্য তিনি যখন ঢাকা ছেড়ে চলে যান তখন ঢাকার পশ্চিম তােরণ, যার মধ্য দিয়ে তিনি শহর ছেড়ে যান, তা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন। তােরণটিতে একটি লিপি খােদাই করা হয়, যাতে লেখা হয় যে ভবিষ্যতে কোন সুবাদার যদি চালের দাম অনুরূপ পর্যায়ে কমাতে পারে তবেই এ তােরণ খােলা হবে। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে নবাব সরফরাজ খানের প্রশাসন পর্যন্ত এ তােরণ বন্ধ ছিল।’ (উদ্ধৃত, Jadunath Sarkar, History of Bengal. 386-87)। একজন সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক শায়েস্তা খানের সময় চালের দামের নাটকীয় হ্রাসের দু’টি কারণ চিহ্নিত করেছেন – (১) পর্তুগীজ-আরাকানী জলদস্যুদের হুগলীস্থ আখড়া ১৬৩২ সালে ভাঙ্গার পর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ফলে বাণিজ্যে তেজীভাব এবং (২) আরাকানীদের হাত থেকে ১৬৬৭ সালে চট্টগ্রাম দখল। (Mohar Ali, Muslims of Bengal. 748)। কিন্তু এ ব্যাখ্যার তিনটি স্পষ্ট ত্রুটি রয়েছে –

  • প্রথমত, শায়েস্তা খান বাংলায় ১৬৬৪ হতে ১৬৭৭ এবং ১৬৭৯ হতে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছেন। ১৬৩২ সালে পর্তুগীজ আরাকানীদের দমন করা হলে শায়েস্তা খানের শাসনামলে দ্রব্যমূল্যের উপর তার প্রভাব কেন পড়বে তা বােঝা যায় না।
  • দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম জয়ের ফলে চালের মূল্য কমে যাবে যদি চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে চালের বড় রপ্তানিকারক হয়। এ অনুমানের সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।
  • সবশেষে উপরােক্ত ব্যাখ্যায় চালের চাহিদার কথা একেবারে উপেক্ষা করা হয়েছে। যখন চালের চাহিদা কমে যায় তখন চালের দামও কমে যাবে। চালের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে চালের দাম কমে যাওয়ার জন্য এক্ষেত্রে অধিকতর গ্রহণযােগ্য ব্যাখ্যা বলে মনে হয়।

শায়েস্তা খানের জোরজবরদস্তিমূলক আদায় : শায়েস্তা খান একজন যােগ্য ও দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। বাদশাহকে খুশি করার জন্য ও নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য তিনি জনগণের কাছ থেকে যতােটুকু সম্ভব অর্থ আদায় করতেন। শায়েস্তা খানের জোরজবরদস্তিমূলক আদায় (Jadunath Sarkar, History of Bengal, Vol. II, (Patna : 1973), 373-374) – 

  • ১। মাস্টারের হিসেবে ও আসামের ঐতিহ্যগত ইতিহাসে শায়েস্তা খানের ধন-দৌলতের পরিমাণ যথাক্রমে – ৩০০০ লাখ ও ১৭০০ লাখ
  • ২। ১৬৮০ সালে বাদশাহকে প্রদত্ত ঋণ, যা মাফ করে দেয়া হয় – ৭ লাখ
  • ৩। পাঁচ লাখ টাকা করে চার বছর (১৬৮২-১৬৮৫) বাদশাহকে প্রদত্ত অতিরিক্ত রাজস্ব – ২০ লাখ
  • ৪। ১৬৮২ সালে দিল্লীকে প্রদত্ত জিজিয়া – ১লাখ
  • ৫। ১৬৭৮ সালে বাদশাহকে প্রদত্ত নজরানা – ৩৪ লাখ
  • ৬। মাস্টারের হিসেবে ও আসামের ঐতিহ্যগত ইতিহাসে ২২ বছরে মোট জবরদস্তিমূলক আদায়ের পরিমাণ যথাক্রমে – ৩০৬২ লাখ ও ১৭৬২ লাখ
  • ৭। মাস্টারের হিসেবে ও আসামের ঐতিহ্যগত ইতিহাসে শায়েস্তা খানের গড়ে বার্ষিক আদায়ের পরিমাণ যথাক্রমে ১৭৫.৫ লাখ ও ৮০.০৯ লাখ

এখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, শায়েস্তা খান গড়ে প্রতি বছর জনগণের কাছ থেকে রাজস্বের অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করতেন তার পরিমাণ ৮০ লক্ষ থেকে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লক্ষ টঙ্কা পর্যন্ত ওঠানামা করতাে। শায়েস্তা খানের সময় সরকারিভাবে আদায়কৃত রাজস্বের কোন নির্ভরযোগ্য হিসাব নেই। তবে শায়েস্তা খানের আগে ও পরে যে রাজস্ব আদায় হয়েছে তা থেকে শায়েস্তা খানের শাসনামলে রাজস্বের পরিমাণ অনুমান করা যেতে পারে। ১৫৮২ সাল থেক ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলায় ভূমিরাজস্বের পরিমাণ ছিল (উৎস – ১৫৮২ ও ১৬৫৮ সালের উপাত্তের জন্য, মােহাম্মদ মােহর আলী, History of The Muslims of Bengal, Vol. IB (Riyadh 1985), 748; ১৭০০ হতে ১৭৫৬ সালের উপাত্তের জন্য, সুবােধকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাক-পলাশী বাঙলা, (কলিকাতা ১৯৮২), ৬৯) – 

  • ১৫৮২ সাল – ৬৬,৪৪,২০০ টাকা
  • ১৬৫৮ সাল – ১৩১,১৫,৯০৭ টাকা
  • ১৭০০ সাল – ১১৭,২৮,৫৪১ টাকা
  • ১৭০৭ সাল – ১২৬,৭৭৬,৬৪৭ টাকা
  • ১৭১২ সাল – ১৩৪,২৬,৯৩৮ টাকা
  • ১৭১৬ সাল – ১৩৯,৩৯,৪০১ টাকা
  • ১৭২৮ সাল – ১৪২,৪৫,৫৬১ টাকা
  • ১৭৫৬ সাল – ১৪২,৪৫,৫৬১ টাকা

১৬৫৮ ও ১৭০০ সালের রাজস্বের গড়ের ভিত্তিতে শায়েস্তা খানের শাসনামলে বাংলায় ভূমিরাজস্বের পরিমাণ ১২৫ লাখ টঙ্কা নির্ধারণ করা যেতে পারে। আবুল ফজল জানাচ্ছেন যে, মুগল আমলে ভূমির উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব হিসেবে আদায় হতাে (উদ্ধৃত, Mohar Ali, Muslims of Bengal, 748) – এ দুটি তথ্যের ভিত্তিতে বাংলায় তৎকালীন কৃষি-উৎপাদনের মূল্য ৩৭৫ লাখ টঙ্কা নির্ধারণ করা যেতে পারে। কৃষিখাতে জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগ উৎপন্ন হতে অনুমান করলে শায়েস্তা খানের আমলে মােট জাতীয় উৎপাদন (GNP) সম্ভবত ৪৬৮ লাখ টঙ্কার কাছাকাছি ছিল। মােট রাজস্ব ও শায়েস্তা খানের অতিরিক্ত আদায়ের মােট পরিমাণ ২০৫ লাখ টঙ্কা (১২৫ লাখ রাজস্ব+ ৮০ লাখ জোরজবরদস্তি করে আদায়) হতে ৩০০ লাখ টঙ্কা (১২৫ লাখ রাজস্ব +১৭৫ লাখ জোরজবরদস্তি করে আদায়) হতে পারে। এই হিসাব থেকে মনে হয় যে, তার শাসনামলে রাষ্ট্র মােট জাতীয় উৎপাদনের কমপক্ষে ৪৩.৮% আদায় করেছে এবং এই আদায়ের পরিমাণ মােট জাতীয় উৎপাদনের ৬৪% পর্যন্ত হতে পারে। 

সীমিত ক্রয়ক্ষমতাই দ্রব্যমূল্য কম থাকার কারণ : তর্কের অবতারণা করে বলা যেতে পারে যে, উপরােক্ত হিসাবে বাংলার মােট জাতীয় উৎপাদনের মূল্য কম ধরা হয়েছে, কারণ যােগাযােগব্যবস্থার অসুবিধার জন্য সম্ভবত সকল স্থান হতে নির্ধারিত হারে কর আদায় করা সম্ভব হয় নি। যদি ধরেও নেয়া যায় যে, মােট জাতীয় উৎপাদনের পরিমাণ উপরােক্ত হিসাবে বেশি ছিল, তবু মােট জাতীয় উৎপাদনের কর ও জবরদস্তিমূলক আদায়ের হার সম্ভবত পূর্বোক্ত হিসাবের খুব কম হবে না, কারণ উপযুক্ত হিসাবে অধস্তন কর্মকর্তা এবং মধ্যস্বত্বভােগীরা জোরজবরদস্তি করে যে অর্থ আদায় করতাে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। বাংলা সাহিত্যে অধস্তন কর্মচারীদের ব্যাপক অত্যাচারের বর্ণনা রয়েছে। মুকুন্দরাম তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে রাজস্ব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ও বণিক এবং স্বর্ণকারদের জোরজবরদস্তিমূলক আদায়ের চমৎকার চিত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। (উদ্ধৃত, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, (ঢাকা ১৯৬৫), ১১৮-১১৯)। বিভিন্ন বর্ণনা হতে দেখা যাচ্ছে যে, জাতীয় উৎপাদনের অংশ হিসেবে কর ও জোরজবরদস্তিমূলক আদায়ের পরিমাণ ছিল যথেষ্ট বেশি। এ ধরনের পরিবেশে যেখানে রাষ্ট্র সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যেতাে, সেখানে সাধারণ লােকের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত হতে বাধ্য। কাজেই মধ্যযুগের বাংলায় অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য দ্রব্যমূল্য কম ছিল না, দ্রব্যমূল্য কম থাকার বড় কারণ ছিল জনগণের ক্রয়ক্ষমতার অভাব। 

প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় দারিদ্র্য

দারিদ্র্যের অনুপস্থিতির ভ্রান্ত ধারণা : অর্থনৈতিক দিক থেকে কোন দেশ সমৃদ্ধ হলেই দারিদ্র্য পুরােপুরি দূর হয়ে যায় না। যদি সম্পদের সুষম বণ্টন না হয়, তবে ধনী দেশেও দারিদ্রের সুযােগ থাকে। বাংলার ইতিহাসের প্রামাণ্য পাঠ্যপুস্তকসমূহের বক্তব্য এই যে, বাংলা শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই সমৃদ্ধ ছিল না, সব দিক দিয়েই বাংলায় দারিদ্র ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ সম্পর্কিত গ্রন্থে বারবার জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, প্রাক-ব্রিটিশ আমলে বাংলায় সাধারণ লােকের খাওয়া পরার কোন সমস্যা ছিল না। যুক্তি দেখানাে হয় যে, প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলায় জনসংখ্যা ছিল কম, কিন্তু প্রচুর পরিমাণ অনাবাদি উর্বর জমি ছিল। কাজেই সাধারণ লােকের খাদ্যাভাবের প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু এই বক্তব্য আয়-বন্টনের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে। যদি আয়ের সুষম বণ্টন না হয়, তবে দেশে অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের উৎপাদন সত্ত্বেও কিছু লােক দরিদ্র থেকে যাবে। বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের চিরাচরিত ব্যাখ্যার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ দু’ধরনের ঐতিহাসিক উপাত্ত রয়েছে –

  • প্রথমত, প্রাক-ব্রিটিশ আমলের বাংলায় দাসপ্রথা চালু ছিল। সকল লােক সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকলে দাসপ্রথা চালু থাকতে পারে না।
  • দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের আকরসমূহে বারবার তাঁতিদের ‘সর্বজনীন’ এবং ‘প্রচণ্ড’ দারিদ্র্যের কথা বলা হয়েছে। (K. N. Chaudhuri, The Trading World of Asia and the English East India Company, (Cambridge 1978), 268-27)। প্রাক-ব্রিটিশ আমলে তাঁতিরা ছিল সবচেয়ে দক্ষ শ্রমিক। এদের মজুরি কম হলে স্বভাবতই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, বাংলায় অকৃষি শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দিক থেকে সচ্ছল ছিল না। 

বাংলায় দাসপ্রথা : বাংলায় দাসপ্রথা প্রাচীনকাল হতে চালু ছিল। বাৎসায়নের কামসূত্রে দাসপ্রথার উল্লেখ রয়েছে। আইনজ্ঞ জীমূতবাহন (আনুমানিক খৃঃ ১২/১৩ শতক) দাসত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশ লিপিবদ্ধ করেছেন। জীমূতবাহনের দায়ভাগ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, যদি উত্তরাধিকারসূত্রে একাধিক ব্যক্তি একজন ক্রীতদাসী লাভ করে, তবে মালিকদের সম্পত্তিতে ভাগ অনুসারে দাসীকে পর্যায়ক্রমে সকল মালিকের কাজ করতে হবে। (R.C. Majumdar (ed ), History nf Bengal, Vol. I, (Dhaka 1943), 618)। বিদেশী পর্যটকরা দাসপ্রথার উল্লেখ করেছেন। ১৪শ শতকের ৪র্থ দশকে বাংলা ভ্রমণ করে ইবনে বতুতা লিখেছেন, “আমি ‘শয্যাভূষণ’ ক্রীতদাসীদের এক দিনার অর্থাৎ মরক্কোর আড়াই দিনারে বিক্রয় হতে দেখেছি। আমি ঐ দামে আশুরা নামে একজন ক্রীতদাসী ক্রয় করেছিলাম। মেয়েটি ছিল অপরূপ সুন্দরী। আমার একজন সহযাত্রী দুই দিনার দিয়ে লুলু নামে একজন দাস বালক ক্রয় করেছিল।” (উদ্ধৃত, Mohar Ali, Muslims of Bengal, 131)। পর্তুগীজ ব্যবসায়ী বারবােসা ১৬শ শতকে বাংলায় দাস ব্যবসার নিম্নরূপ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন, ‘এই শহরের (বাঙ্গালায়) মুরিশ (মুসলমান) বণিকরা দেশের ভেতরে গিয়ে বহু পৌত্তলিক বালককে তাদের পিতামাতার অথবা যারা তাদের চুরি করে, তাদের কাছ থেকে ক্রয় করে এবং তাদের নপুংসক বানায়। তাদের (ঐ বালকদের) মধ্যে কেউ কেউ এতে মারা যায়। যারা বেঁচে যায়, তাদের এরা খুব ভালােভাবে মানুষ করে এবং পণ্য হিসেবে ইরানীদের কাছে জনপ্রতি কুড়ি বা ত্রিশ ডুকাট দামে বিক্রি করে, তারা (ইরানীরা) তাদের স্ত্রীদের এবং ঘরবাড়ির রক্ষক হিসেবে এদের খুব মূল্যবান জ্ঞান করে’। (উদ্ধৃত, সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, ৩৪৫-৩৪৬)। আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন যে, সিলেট ও ঘােড়াঘাট অঞ্চল অনেক খােজা সরবরাহ করতাে। (উদ্ধৃত, Abdur Rahim, History of Bengal, 299)। জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনীতে বাংলার দাসপ্রথা সম্পর্কে উল্লেখ আছে, ‘হিন্দুস্থানে, বিশেষ করে বাংলার উপনিবেশ সিলেট প্রদেশে লােকদের মধ্যে একটি প্রথা ছিল যে তারা তাদের ছেলেদের খােজা করে সুবাদারকে রাজস্বের বদলে খােজা দিত। ক্রমে এই প্রথা অন্য প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি বছর কিছু কিছু ছেলের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং তারা প্রজননক্ষমতা হারাচ্ছে। এই প্রথা সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। এ পর্যায়ে আমি আদেশ জারি করলাম যে, এরপর আর কেউ এ প্রথা অনুসরণ করবে না এবং ছােট ছােট ছেলেদের খােজা করে বিক্রি করার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। (Emperor Nur-Al-Din Muhammad Jahangir, The Tuzuk-1 Juhangiri, translated by Alexander Rogers , (Delhi 1968), 150)।

অবাঙ্গালি দাসের ভ্রান্ত দাবি : কোন কোন ঐতিহাসিক বাংলায় দাসপ্রথার প্রচলন সম্পর্কে উপরােক্ত সাক্ষ্যে সন্তুষ্ট নন। (Mohar Ali, Muslims of Bengal, 964)। তাঁরা বলেন, যদিও বাংলায় দাসপ্রথা চালু ছিল তবু বাংলার বাজারে যে- সব দাসদাসী বেচাকেনা হতাে তাদের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছিল, তারা বাঙালি নয়। তারা বলেন যে, বাংলায় শ্রমিকের অভাব থাকায় বাইরে থেকে দাস আমদানি করা হতাে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ইলিয়াস শাহী শাসকরা আবিসিনীয় দাস আমদানি করেছিলেন। তারা অবশ্য স্বীকার করেন যে, পর্তুগীজ জলদস্যুরা কখনাে কখনাে স্থানীয় লােকদের জোর করে দাসে পরিণত করেছে। একজন ঐতিহাসিক জোর দিয়ে বলেছেন, “বাংলাতে কোন স্থানীয় লােককে অন্য স্থানীয় লােকের কাছে দাস হিসেবে বিক্রয় করার নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।” (ঐ)। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দাস বিক্রয়ের যেসব দলিল পাওয়া গেছে তা প্রত্যক্ষভাবে উপরােক্ত উক্তির পরিপন্থী। মিত্র জানাচ্ছেন যে, চন্দননগরে ফরাসী শাসকদের মহাফেজখানায় দাস বিক্রয়ের কমপক্ষে একশ’টি দলিল রয়েছে। (সুধীরকুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গ সমাজ, (কলিকাতা ১৯৬২), ২৯২)। দাস বিক্রয়ের দলিল পাওয়া গেছে সিলেটে (Siva Ratan Mitra, Types of Early Bengali Prose, (Calcutta 1922), 87). হুগলী জেলায় (সুধীরকুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস, ২৮৩-২৯৬), এবং ত্রিপুরা রাজ্যে (আনিসুজ্জামান, পুরােনাে বাংলা গল্প, (ঢাকা ১৯৮৪), ১২৮)। কলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত একটি দলিল হতে দেখা যাচ্ছে যে, কায়স্থপাড়া গ্রামের জনৈক গােপীনাথ মজুমদার ১০৭৪ বঙ্গাব্দের ২৯ শ্রাবণ (অর্থাৎ ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে নিজেকে ইসিদ্দর খানের কাছে বিক্রয় করে। (সুধীরকুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস, ২৮৬)। বলা হয়েছে যে, আর্থিক দুরবস্থার জন্য গােপীনাথ নিজেকে বিক্রয় করেছে। শায়েস্তা খানের শাসনামলকে বাংলার স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। অথচ গােপীনাথের আত্মবিক্রয় শায়েস্তা খানের শাসনামলের চতুর্থ বছরে ঘটেছে। ১৬৪৯ থেকে ১৭৫৪ সাল পর্যন্ত দশটি দাসবিক্রয় দলিলের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো (উৎস্য, শিবরতন মিত্র, Tupes of Eartg Bengalt Prose, (University of Calcutta 1922). 29-90; সুধীরকুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস, ২৮৬-৮৭; তরিকুল আলম খান বাংলায় দাস প্রথা; কতিপয় অপ্রকাশিত দলিল, Journal of Asiatic Society of Bangladesh Vol. III December 1985) –

  • ১। ১৬৪৯ সালে শ্রী দৈবাকি শূদ্র নিজেকে ও তার পুত্রকে বিক্রি করেন
  • ২। ১৬৭১ সালে শ্রী রতি নন্দন তার দাসকে ২.৫ রুপিয়ায় বিক্রি করেন
  • ৩। ১৬৯৫ সালে শ্রী সনাতন দত্ত অনাহার ও ঋণের কারণে ৯ রুপিয়ায় নিজেকে বিক্রি করেন
  • ৪। ১৬৯৬ সালে শ্রী রাম ভদ্র চক্রবর্তী ৩.৫ রুপিয়ায় নিজেকে বিক্রি করেন
  • ৫। ১৭১৯ সালে শ্রী বোদাই এর স্ত্রী ৩ রুপিয়ায় তার ১১ বছরের কন্যাকে ৩ রুপিয়ায় বিক্রি করেন
  • ৬। ১৭২১ সালে শ্রী পার্বতী দাসী অনাহারের কারণে ৩ রুপিয়ায় ৬ বছর বয়সী কন্যা শ্রীমনি দাসীকে বিক্রি করেন
  • ৭। ১৭২৮ সালে শ্রী মুচিরাম চঙ্গ, শ্রীমতি তপী, শ্রী পঞ্চা চঙ্গ, শ্রী বারু চঙ্গ, শ্রী রঞ্জিত চঙ্গ ও শ্রীমতি কালি চঙ্গ প্রত্যেকে অনাহারের কারণে ১১ রুপিয়ায় নিজেদের বিক্রি করেন
  • ৮। ১৭৩৫ সালে শ্রী আত্মারাম বাগদী ৮ বছর বয়সী শ্রীশ্যাম বাগদীকে ৭ টঙ্কায়  বিক্রি করেন
  • ৯। ১৭৩৭ সালে শ্রী নন্দ রাম চন্দ্র তার দাসের কন্যাকে ১ রুপিয়ায় বিক্রি করেন
  • ১০। ১৭৫৪ সালে শ্রী সদারাম শূদ্র, শ্রী বামধন শূদ্র, শ্রীমতি মাধবী, শ্রী বলিরাম শূদ্র ও শ্রীমতি রতনি দুর্ভিক্ষের ফলে অনাহারের কারণে ২১ রুপিয়ায় নিজেদের বিক্রি করেন।

দাস বিক্রয়ের দলিল বিশ্লেষণ : এসব দলিল থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১৬৪৯ হতে ১৭৫৪ সালে বাঙালিদের দাস হিসেবে বিক্রয় করা হয়েছে। দশটি মনুষ্যবিক্রয় দলিলের মধ্যে তিনটি মাতাপিতা কর্তৃক শিশুসন্তান বিক্রয়ের দলিল। ১৭১৯ সালে এগারাে বছরের শিশুকন্যা এবং ১৭২১ সালে ছয় বছরের মেয়ে বিক্রয় করা হয়েছে। মধ্যযুগের বাংলায় পিতামাতার দ্বারা কন্যাসন্তান বিক্রয় ছিল অতি মামুলি ঘটনা। উদাহরণস্বরূপ চৈতন্য চরিতামৃত-এর নিয়ােক্ত শ্লোক স্মরণ করা যেতে পারে – “নাহা লুহা লবণ বেচিবে ব্রাহ্মণে/ কন্যা বেচিবেক যে সর্ব শাস্ত্রে জানে। (জয়ানন্দ, চৈতনাঙ্গল, ২১৬)। আসামের ঐতিহাসিক আকর হতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাক-ব্রিটিশ আমলে স্বামীরা স্ত্রী বিক্রয় করতাে। (Amalendu Guha. “The Mediaeval Economy of Assam”, The Cambridge Economic History of India, Vol.1, 503)। ১৯শ শতকে বাংলায় অনুরূপভাবে স্ত্রী বিক্রয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। (সুধীরকুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস, ২৮৬)। তালিকায় চারটি আত্মবিক্রয়ের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দলিলে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, দুর্দশা, অনাহার ও ঋণের কারণে দলিলদাতারা নিজেদের বিক্রয় করেছে। এ ধরনের লেনদেনের জন্য লিখিত দলিল কেন সম্পাদন করা হতাে তা স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে না। যদি পরবর্তী পর্যায়ে দাসদের পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে পলাতক দাসদের উপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের দলিলের প্রয়ােজন হতে পারে। ১৭৭০ সালের একটি দাস বিক্রয়ের দলিল উপরােক্ত অনুমান সমর্থন করে। দলিলটিতে শর্ত রয়েছে যে, যদি দাস পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তবে মালিক তাকে শাস্তি দিতে পারবেন। (Srya Ratan Mitra, Bengali Prose, 90)। এখানে উল্লেখিত দাসরা অধিকাংশই হলাে নিম্নবর্ণের শূদ্র। তবে উচ্চবর্ণের হিন্দু বা মুসলমানদের বিক্রয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। গােপীনাথ মজুমদার, যে নিজেকে শায়েস্তা খানের শাসনামলে বিক্রয় করেছিল, সম্ভবত সে একজন কায়স্থ ছিল, কারণ অনেক কায়স্থ মধ্যযুগের বাংলায় মজুমদার উপাধি ধারণ করতাে। (Abdur Rahim, History of Bengal, 309)। উপরন্তু ইবনে বতুতার কেনা ক্রীতদাসীর নাম ছিল আশুরা। নামটি মুসলমানের মনে হয়। যেহেতু শুধু পুরুষ দাসদের বাইরে থেকে আনা হতাে, তাই আশুরা সম্ভবত স্থানীয় মুসলমান ছিল। দশটি দাসবিক্রয় দলিলের মধ্যে চারটিতে অনাহার, ঋণ ও দুর্ভিক্ষকে মানুষ বিক্রয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ছয়টি দলিলে কোন কারণ উল্লেখ করা হয় নি। অবশ্য দুটি দলিল নাবালক সন্তান বিক্রয়ের। সম্ভবত মনে করা হতাে যে, পিতা-মাতার নাবালক সন্তান বিক্রয়ের অধিকার ছিল। এ কারণে হয়তাে এসব দলিলে বিক্রয়ের কারণ উল্লেখ করার প্রয়ােজন অনুভূত হয় নি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৭৫৪ সালের একটি দাসবিক্রয় দলিলে মহা দুর্ভিক্ষের উল্লেখ আছে। অন্যান্য ঐতিহাসিক দলিলে এ দুর্ভিক্ষের উল্লেখ দেখা যায় না। সম্ভবত দুর্ভিক্ষটি ছিল স্থানীয় এবং শহরে বসবাসরত ঐতিহাসিকগণ এ ঘটনাকে উপেক্ষা করেছেন। এই দলিল থেকে বাংলায় দাসপ্রথা চালু থাকার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়।

দাসত্বের ব্যাপকতা ও প্রকৃতি : তবে দাসত্বের বিস্তার ও প্রকৃতি সম্বন্ধে প্রশ্ন রয়ে গেছে। প্রথমত, দাসত্ব কি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল? দ্বিতীয়ত, এ দাসত্বের প্রকৃতি কি ছিল? 

  • দাসত্ব কি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল? : প্রাক-ব্রিটিশ আমলে বাংলার জনসংখ্যার কত শতাংশ লােক দাস ছিল তার কোন হিসাব পাওয়া যায় না, তবে প্রতিবেশী আসামে দাস, ভূমিদাস ও বন্ধকিদাসরা জনসংখ্যার ৫ শতাংশ হতে ৯ শতাংশ ছিল বলে অনুমান করা হয়। (Amalendu Guha, “Mediaeval Economy,” 503)। আসামে আনুপাতিক হারে বাংলার চেয়ে দাম বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। সিলেট জেলায় চাকরান ও নানকার ব্যবস্থা দাসব্যবস্থার স্মারক হিসেবে পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলা জমিদারি দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন বিধিবদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এতে মনে হয় যে, বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেটে দাসব্যবস্থা অনেক বেশি শিকড় গজিয়েছিল। তবে বাংলার জনসংখ্যায় দাসের সংখ্যার হার নেহায়েত নগণ্য ছিল অনুমান করা ঠিক হবে না। ১৭শ ও ১৮শ শতক থেকে দাস বিক্রয়ের যেসব দলিল এখনাে রয়ে গেছে সেসব দেখলে মনে হয় না যে বাংলায় নেহায়েত কালেভদ্রে দাস বিক্রয় হতাে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাগজপত্রে দেখা যায় যে, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় অনেকগুলাে দাস ক্রয়-বিক্রয়ের বাজার ছিল। (সুবােধকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাক-পলাশী বাংলা, (কলিকাতা ১৯৮২), ২৭)।
  • দাসত্বের প্রকৃতি কি ছিল? : চিরাচরিত দাসত্বের তুলনায় বাংলায় দাসত্বের প্রকৃতি ছিল ভিন্ন। এইচ. এ. আর. গীব যথার্থই বলেছেন, ‘এ কথা মনে রাখতে হবে যে দাসরা ছিল প্রভুদের দেহরক্ষী অথবা ব্যক্তিগত ভৃত্য এবং দাসত্ব কোন অর্থেই মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল না। রােমান ভূস্বামীদের সাথে দাসদের যে সম্পর্ক ছিল অথবা আমেরিকায় খামারমালিকদের সাথে দাসদের যে সম্পর্ক ছিল তার চেয়ে মুসলমান মনিব ও ভৃত্যের সম্পর্ক ছিল অনেক বেশি মনুষ্যত্বপূর্ণ। এর ফলে দাসত্ব ছিল অনেক কম কলঙ্কময়।’ (H. A. R. Gibb’s “Introduction” in Ibn Batuta, Travels, 39)। মুসলমান শাসিত বাংলায় উপযুক্ত যােগ্যতাসম্পন্ন দাসের পক্ষে অভিজাত সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে কোন বাধা ছিল না। এর ফলে দাসরা সিংহাসনও দখল করতে পেরেছে। হান্টার বাংলার দাসদের চুক্তিবদ্ধ শ্ৰামক (bonded labour) হিসেবে বর্ণনা করেছেন। (উদ্ধৃতি দেখুন, সুবােধকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাক-পলাশী বাংলা, ২৭)। বেশিরভাগ দাসদের গার্হস্থ্য কাজে ব্যবহার করা হতাে যদিও এদের মাঝে মাঝে কৃষি-উৎপাদনেও কাজে লাগানাে হতাে। যেহেতু বড় খামারের পরিবেশে তারা কাজ করতো, সেহেতু বাংলায় দাসদের সাথে সদয় ব্যবহার করা হতাে। ধ্রুপদী ধরনের অমানুষিক দাসত্ব বাংলায় ছিল অজানা। ক্রীতদাসীদেরকে বাড়িতে গৃহপরিচারিকা ও কখনাে কখনাে উপপত্নী হিসেবে সেবা করতে হয়েছে। ক্রীতদাসীদের যৌনদাসত্ব ছিল দাসত্বের একটি কালিমাময় দিক। 

বাংলায় নিম্ন মজুরির হার : তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, দাসের দাম ছিল খুবই কম। এক্ষেত্রে দাসের মূল্য হলাে একজন দাস সারাজীবন ধরে যে আয় করবে তার বর্তমান মূল্য। ইবনে বতুতার বিবরণ ও তালিকাটি ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলায় দাসদের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা ছিল খুবই কম। এর অর্থ হলাে, বাংলায় শ্রমিকের মজুরিও ছিল কম। বাংলায় প্রকৃত মজুরি সম্পর্কে উপাত্ত অপ্রতুল। বাংলায় মজুরির হার সম্পর্কে তথ্যের অভাবে কোন কোন ঐতিহাসিক দিল্লীর মজুরি-হারের ভিত্তিতে বাংলায় মজুরি অনুমান করার চেষ্টা করেছিলেন। (Abdur Rahım, History of Bengal, 410-411 and Mohar Ali, Muslims of Bengal, 963)। প্রকৃত মজুরির হার হিসাব করার জন্য দিল্লীর মজুরিকে বাংলার দ্রব্যমূল্যের ভিত্তিতে সংশােধনের চেষ্টা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখানাে হয়েছে যে, বাংলার তুলনায় দিল্লীতে আয় ও দ্রব্যমূল্য দুটিই ছিল বেশি। ফলে দিল্লীর মজুরির হার ও বাংলার দ্রব্যমূল্য ব্যবহার করে এসব ঐতিহাসিক বাংলায় মজুরিহার দু’ভাবে বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। 

বাংলায় তাঁতিদের করুণ জীবন ও বস্ত্র খরচের কাঠামো : কিংবদন্তিখ্যাত মসলিন-তাঁতিদের জীবন সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে তা অত্যন্ত করুণ। মসলিন ব্যবসায়ে তাঁতিরা লাভবান হতাে না, লাভ করতে মূলত বিদেশী ব্যবসায়ীরা, তাদের দালালরা এবং সরকারি কর্মকর্তারা। ১৮শ শতকের শেষদিকে জন টেইলর ঢাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি লিখেছেন যে, মসলিনের দামের কমপক্ষে শতকরা বিশ ভাগ মুগল শাসকদের তত্ত্বাবধায়কদের কমিশন হিসেবে দিতে হতাে।(আবদুল করিম, ঢাকাই মসলিন, (ঢাকা ১৯৬৫), ১০৫)। কারখানায় অবস্থানরত মুকিমরা মসলিন ব্যবসায়ীদের নিয়ত তত্ত্বাবধান করতাে। কম দামে মসলিন তৈরি করার জন্য মুগল শাসকরা সবচেয়ে দক্ষ কারিগরদের বেঁচে থাকার মতাে মজুরি দিয়ে কাজ করতে বাধ্য করতেন। ফরাসী লেখক আবে রায়নাল বলেছেন যে, বাংলায় দক্ষ তাঁতি হওয়া দুর্ভাগ্যের লক্ষণ ছিল, কারণ তাদের নগণ্য মজুরির বদলে কাজ করতে বাধ্য করা হতাে (আবদুল করিম, ঢাকাই মসলিন, (ঢাকা ১৯৬৫), ১০৬)। কাজেই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, হিন্দু তাঁতিদের সবচেয়ে নিচু বর্ণে স্থান দেয়া হয়েছে। মুসলমান তাঁতিদের অবজ্ঞাভরে বলা হতাে জোলা (যার অর্থ হচ্ছে বোকা)। বাংলায় কাপড়ের মূল্য সম্পর্কে যেসব বিক্ষিপ্ত প্রমাণ রয়েছে, তা থেকে তাঁতিদের আয় সম্পর্কে কিছু অনুমান করা সম্ভব। ইবনে বতুতা লিখেছেন যে, সবচেয়ে ভালাে কাপড়, যা প্রায় ত্রিশ হাত লম্বা হতাে, তা মাত্র দু’দিনারে বিক্রি হতাে। বাংলার বস্ত্র খরচের কাঠামো ছিল – 

  • ১। ১৭৮৯ সালের পূর্বে কে. এন. চৌধুরীর প্রাক্কলন অনুযায়ী সুতার খরচ ৬৩-৬৯%, শ্রমের খরচ ৩৭-৩০%
  • ২। ১৭৮৯ সালে কে. এন. চৌধুরীর প্রাক্কলন অনুযায়ী সুতার খরচ ৭০-৮৩%, শ্রমের খরচ ৩০-১৭% (প্রথম দু’লাইনের জন্য K. N. Chaudhuri, The Trading World of Asia and the English East India Company, (Cambridge, Cambridge University Press 1974), 267)
  • ৩। ১৮০০ সালের পূর্বে আবদুল করিমের প্রাক্কলন অনুযায়ী সুতার খরচ ৫০-৪০%, শ্রমের খরচ ৫০-৬০% (তৃতীয় লাইনের জন্য, আবদুল করিম, ঢাকাই মসলিন, (ঢাকা, বাংলা একাডেমী ১৯৬৫), ১১০-১১১)। 

বাংলায় বস্ত্রের উৎপাদনব্যয়ের কাঠামাের প্রাক্কলন থেকে দেখা যায় যে, শ্রমের মজুরি কাপড়ের দামের শতকরা ১৭ হতে ৬০ ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। তাঁতিরা মসলিনের সম্পূর্ণ দাম পেতাে ও কোন কমিশন দিত না এবং শ্রমিকরা মসলিনের দাম শতকরা ৫০ ভাগ পেতাে এ দুটি অনুমান (দু’টি অনুমানে মজুরির হার বাড়িয়ে ধরা হয়েছে) প্রয়ােগ করলে একখণ্ড মসলিন তৈরির মজুরি বড়জোর এক দিনার হবে। জন টেইলরের মতে, একখণ্ড সূক্ষ্ম মসলিন তৈরির জন্য একজন ওস্তাদ তাঁতি, একজন সহকারী ও একজন শিক্ষানবিসের এক বছর সময় লাগতাে (ঐ, ১১০)। শিক্ষানবিস কোন মজুরি পেতাে না। সহকারী তাঁতি ওস্তাদ তাঁতির আয়ের ২৫ হতে ৫০ শতাংশ পেতো। ইবনে বতুতার সময় এক দিনারে ৮৭.৫ মণ চাল বিক্রয় হতাে। ওস্তাদ তাঁতির বার্ষিক মজুরি খুব বেশি হলে ৫৭.৮ মণ হতে ৭০ মণ চাল হবে। সহকারী বছরে পেতাে ১৭.৫ হতে ২৯,৭ মণ চাল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের হিসাব অনুসারে ১৯৮৭-৮৮ সালে একজন দক্ষ বস্ত্ৰকারিগর ৪৫.৭ মণ চাল আয় করেছে। (চালের বাজারদাম চারটি শহরের দামের গড়ের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়েছে এবং বস্ত্রশিল্পের দক্ষ কারিগরদের দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে মজুরি হিসাব করা হয়। দেখুন, Statistical Pocket Book of Bangladesh, 1989, (Dhaka 1989), 223-244)। ১৪শ শতকে বাংলার ওস্তাদ কারিগররা খুব বেশি হলে আজকের তাঁতিদের চেয়ে ২৬ থেকে ৫৩ শতাংশ বেশি আয় করতাে। তবে খুব সম্ভবত ১৪শ শতকের ওস্তাদ কারিগরদের আয় আজকের দক্ষ তাঁতিদের মজুরির চেয়ে খুব বেশি হবে না। ১৮শ শতকের মধ্যভাগে যখন মসলিনের চড়া চাহিদা ছিল তখনাে তাঁতিদের মজুরি ছিল খুবই কম। জন টেইলরের হিসেবে ১৭৬০ সালের দিকে একজন তাঁতি বছরে ১২ হতে ১৮ টাকা আয় করতে। (দেখুন, আবদুল করিম, ঢাকাই মসলিন, ১১১)। ১৭৫১-৫২ সালে টাকাপ্রতি চালের দাম ছিল ১.৪ হতে ১.৮ মণ। (সুবােধকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাক-পলাশী বাংলা, ৯০)। চালের হিসাবে ঐ সময়ে একজন তাঁতি ১৩.৬ হতে ৩২.৪ মণ চাল বছরে উপার্জন করতাে। এটি ইবনে বতুতার আমলে একজন তাঁতির সহকারীর আয়ের সমান। আরেকটি হিসাবে ১৭৬০ সালের দিকে সুতা কাটুনি ১৫ থেকে ৩০ টাকা (২১ হতে ৫৪ মণ চাল) বছরে আয় করতো (আবদুল করিম, ঢাকাই মসলিন, ১১২)। 

মসলিনের দামের সাথে খাদ্যদ্রব্যের দামের ধনাত্মক সহগমন, শ্রমের নিম্নমজুরি ও কারিগরি পরিবর্তনের তাগিদের অভাব : বাংলায় মজুরির স্বল্পতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষও লক্ষ্য করেছেন। ১৭শ শতক হতে মসলিনের দামের সাথে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যের খুবই নিবিড় ধনাত্মক সহগমন (correlation) লক্ষ্য করা গেছে। এর কারণ হিসেবে কোম্পানির কর্মচারীরা বলেছেন যে, তাঁতিরা কোনমতে বেঁচে আছে এবং খাদ্যের দাম বেড়ে গেলে মসলিনের দাম না বাড়িয়ে ওদের বেঁচে থাকা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে যখনি খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ে তখনি মসলিনের দাম বাড়ে। (K. N. Chaudhuri, Trading World, 112)। ফরাসী ও বাঙালি শ্রমিকের মজুরি হারের সরাসরি তুলনা করে ১৭৩৫ সালে কোর্ট অব ডিরেক্টরস লিখেছেন যে, ফরাসী শ্রমিকের মজুরির হার ভারতীয় শ্রমিকের মজুরির চেয়ে ছয়গুণ বেশি ছিল (ঐ, 273)। অকৃষিমজুরদের মজুরিহারের স্বল্পতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বাংলার অর্থনীতিতে লক্ষ্য করা গেছে। ব্রুঁদেল মনে করেন যে, “১৭শ ও ১৮শ শতকে ভারতীয় পণ্যসমূহ ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ পণ্যের চেয়ে শুধু মান ও সৌন্দর্যের জন্যই নয়, মূল্যের জন্যও আকর্ষণীয় ছিল। আজকে একই কারণে হংকং ও কোরিয়ায় তৈরি বস্ত্র বিশ্বের বাজার ছেয়ে ফেলেছে।” (Fancis Brandel, The Perspective of the World, Cronwn und Camalısm, 15th-18th Century, VOL 3, translated by Sian Reynolds, (New York. 1987), 521))। শ্রমের নিম্নমজুরি থাকায় শ্রম বাঁচানাের জন্য কারিগরি পরিবর্তনের প্রয়ােজন বাংলায় আদৌ অনুভূত হয় নি। পক্ষান্তরে বাংলার পণ্যের প্রতিযােগিতা বিলাতে কারিগরি পরিবর্তনের তাগিদ সৃষ্টি করে। কাজেই শিল্পবিপ্লব ছিল অংশত বাংলার সস্তা শ্রমিকদের প্রতিযােগিতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। 

উপসংহার 

প্রাক-ব্রিটিশ আমলের বাংলা স্বপ্নরাজ্য ছিল না। এ সমাজে সাধারণ প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজের বেশিরভাগ লক্ষণই প্রকাশ পায়। এখানে জীবন ছিল দার্শনিক হবসের বর্ণিত নরকের মতাে দরিদ্র, নােংরা, পাশবিক এবং হ্রস্ব। এ সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল ক্ষণভঙ্গুর এবং প্রকৃতির খেয়ালখুশিতে পরিচালিত। স্বাভাবিকভাবে অনুমান করা যায় যে, এ সমাজে মাঝে মাঝে সাময়িক দুর্দশা দেখা গেছে। তথাকথিত সােনার বাংলায় তাই দুর্ভিক্ষ অজানা ছিল না। কিন্তু প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় দারিদ্র্য ক্ষণস্থায়ী ছিল না। এ সমাজে দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্রের গহ্বর ছিল। দাসপ্রথার প্রচলন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ সমাজে অনেক জনগােষ্ঠী ছিল অর্থনৈতিকভাবে অসুবিধাজনক অবস্থায়। তারা বার বার দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে। 

বিদেশী পর্যটকদের রচনা থেকে “সোনার বাংলার” ধারণার উদ্ভব : প্রশ্ন থেকে যায় যে, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার অর্থনীতির সুস্পষ্ট সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কেন সােনার বাংলার কিংবদন্তি এতদিন চালু রয়েছে ঐতিহাসিকগণ বলবেন যে, সােনার বাংলা তাঁরা আবিষ্কার করেন নি। ইতিহাসের আকরসমূহে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার সমৃদ্ধি সম্বন্ধে ঐকমত্য রয়েছে। বাংলার প্রাচুর্য সম্বন্ধে কিংবদন্তি প্রচার করেছেন বিদেশী পর্যটকরা। এঁরা ছিলেন শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও ওয়াকিবহাল। ১৪শ শতকের ইবনে বতুতা হতে ১৭শ শতকের ফ্রাসোেয়া বার্নিয়ের। মরক্কো, চীন, ইতালি, পর্তুগাল ও ফ্রান্সের পর্যটকরা সকলে একই ধরনের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেছন। ইবনে বতুতার আমলে বাংলা ‘উপহারে পূর্ণ নরক’ (দোজখ-পুরে-নিয়ামত) বলে পরিচিত ছিল। (Ibn Batuta, Travels, 267)। নরক এজন্য যে, উত্তরের লােকেরা বাংলার আর্দ্র আবহাওয়াকে ঘৃণা করতাে। বাংলা উপহারে পূর্ণ ছিল বাংলার অভূতপূর্ব প্রাচুর্যের জন্য। ফ্ৰাসােয়া বার্নিয়ের ১৭শ শতকে বাংলায় দু’বার এসেছিলেন। তার মতে, বাংলা মিশরের চেয়ে সমৃদ্ধ ছিল, অথচ মিশরকে প্রতি যুগে সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে উৎপাদনশীল দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বার্নিয়ের লিখেছেন, “বাংলার অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের সমৃদ্ধি এবং বাংলার ললনাদের সৌন্দর্য ও শান্ত স্বভাব পর্তুগীজ, ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকদের মধ্যে কিংবদন্তির জন্ম দেয় যে, বাংলায় আগমনের জন্য শত শত তােরণ আছে, কিন্তু নির্গমনের জন্য একটি তােরণও নেই।” (Francois Bernier, Travels, 439)। বাংলার সমৃদ্ধি সম্পর্কে অনুরূপ ধারণা লিপিবদ্ধ করেছেন ১৪শ ও ১৫শ শতকের চৈনিক পর্যটকরা এবং ১৭শ শতকের ভেনিসীয় পর্যটকরা।

বিদেশী পর্যটকদের উল্লেখে ভ্রান্তি : স্বাভাবিকভাবেই এতগুলাে অকাট্য সাক্ষ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে না। তবু দুটি কারণে এসব বিবরণের ব্যাখ্যা পুনর্মূল্যায়নের অবকাশ রয়েছে। প্রথমত, একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দু’ভাবে পরিমাপ করা যেতে পারে – অনাপেক্ষিক সমৃদ্ধি ও আপেক্ষিক সমৃদ্ধি। এক্ষেত্রে আপেক্ষিক সমৃদ্ধির তাৎপর্য এই যে, সমসাময়িক অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলা সমৃদ্ধতর ছিল। অনাপেক্ষিক সমৃদ্ধির অর্থ এই যে, এ সমাজে দুর্দশা, দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্য অনুপস্থিত ছিল। কোন প্রকার সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই শুধু যুক্তির ভিত্তিতে একথা সুস্পষ্ট যে, কোন প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজে অবাধ সমৃদ্ধি বিরাজ করতে পারে না। বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ পাঠ করলে দেখা যাবে যে, তারা বাংলার আপেক্ষিক সমৃদ্ধির কথা বলেছেন, অনাপেক্ষিক সমৃদ্ধির কথা বলেন নি। এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাংলা সমৃদ্ধ ছিল এ ধারণা সমর্থন করার কারণ রয়েছে। বাংলায় জলের প্রাচুর্য ছিল। এখানে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে খরা অনেক কম ধ্বংসাত্মক ছিল। এর ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলায় দুর্ভিক্ষ কম হয়েছে। (উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ১৭৫০-১৯৫৭ সালে বাংলায় পাঁচটি দুর্ভিক্ষ হয়েছে, কিন্তু মহারাষ্ট্রে এ সময়ে দশটি দুর্ভিক্ষ হয়েছে। দেখুন, D. Kurinar (ed.), The Cambridge Economic History of India. Vol. I, (Cainbridge 1083), 528-530)। দ্বিতীয়ত, এ কথা অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত নয় যে, ঐতিহাসিক আকরসমূহে দারিদ্র্যের সঠিক প্রতিফলন পাওয়া যাবে। রবার্ট চেম্বারস যথার্থই বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়েও গ্রামীণ দারিদ্র্যকে রীতিমত কম করে দেখানাে হচ্ছে। (Kobert Chambers, Kurul Pewerty Unperceived Problems and Remedies, (Mimeo), World Bank Staff Working Paper No. 400, 1980, 2)। “দরিদ্র পরিবারগুলাে কেন্দ্র হতে দূরে থাকে, থাকে শহর থেকে দূরে, গ্রামের এক প্রান্তে অথবা বড় রাস্তা থেকে দূরে।” (ঐ ৬)। চেম্বার্সের বক্তব্য তাই যথার্থ যে, পক্ষপাত দুর করার সচেতন প্রয়াস না থাকলে ‘পল্লীউন্নয়ন পর্যটনের’ ফলে দারিদ্র্যের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। (ঐ ৬)। পর্যটকরা শুকনাে মওসুমে যখন মওসুমি দারিদ্র্য সবচেয়ে কম থাকে, তখন বড় বড় রাস্তা দিয়ে পৌরকেন্দ্রসমূহে চলাফেরা করেন। এর ফলে গ্রামীণ দারিদ্র্য কম করে দেখানাে হয়। এটা আশা করা অযৌক্তিক যে, আজকের পেশাদার পল্লীউন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা যা করতে পারেন না তা মধ্য ও প্রাচীন যুগের পর্যটকরা করতে পারতেন। এই আলােচনায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার অর্থনীতির দুর্বলতাসমূহ বিশ্লেষিত হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় শুধু নিরবচ্ছিন্ন দারিদ্র্য বিরাজমান ছিল। এ সমাজে দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধি পাশাপাশি দেখা যেতাে। প্রাক-শিল্পবিপ্লব সমাজে যারা সচরাচর প্রাপ্ত ফসলে ভালভাবে জীবন কাটাতে পারতাে তারাই প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়তাে। 

সাহিত্যে প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার তুলনামূলক বাস্তবভাবে প্রতিফলন : ঐতিহাসিক এবং পর্যটকদের বিবরণের তুলনায় সাহিত্যে প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার জীবন অনেক বাস্তবভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যে দেখা যায় যে, দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধি পাশাপাশি বিরাজ করতাে। সদুক্তিকর্ণামৃত-তে যেমন রয়েছে নিদারুণ দারিদ্র্যের বর্ণনা, তেমনি রয়েছে কৃষকের জীবনের অপরিমেয় আনন্দের কথা। সদুক্তিকর্ণামৃতের দুটি পরস্পরবিরােধী শ্লোক পাওয়া যায়। একবার সেখানে বলা হয়েছে, “শিশুরা ক্ষুধায় পীড়িত, তাদের দেহ শবের মতাে শীর্ণ, আত্মীয়-স্বজনেরা মন্দোদর, পুরাতন ভগ্ন জলপাত্রে এক ফোটা জল ধরে, গৃহিণীর পরিধানে শতচ্ছিন্ন বস্ত্র।” আবার সেখানেই বলা হয়েছে “বর্ষার প্রচুর জল পাইয়া ধান চমক্কার গজাইয়া উঠিয়াছে। ইক্ষুর সমৃদ্ধিও দেখা যাইতেছে। অন্য কোন ভাবনা আর নাই। ঘরে গৃহিণী সারাদিন প্রসাধনরতা। বাহিরে আকাশ হইতে জল ঝরিতেছে প্রচুর। গ্রাম্য যুবক সুখে নিদ্রা যাইতেছে।” (উদ্ধৃত, নীহাররঞ্জন রায়, বাঙলার ইতিহাস, ১৯৭)। অনুরূপ পরস্পরবিরােধী চিত্র চন্দ্রাবতীর মলুয়াতে দেখা যায়। দুর্ভিক্ষের সময় চাঁদবিনােদের ঘরে খাদ্য ছিল না। মলুয়ার বাড়িতে এধরনের কোন অভাব দেখা যায় না, সেখানে চাদবিননাদের সম্মানে বড় ভােজের ব্যবস্থা করা হয়। (চন্দ্রাবতী, “মলুয়া” ময়মনসিংহ গীতিকা, ৪২-৪৬ এবং ৫৬-৫৭)।

দাসত্ব থেকে দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাবের ইঙ্গিত : এ কথা সত্য যে, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার সমাজ আদৌ সমতাবাদী ছিল না। ধনবৈষম্যের ফলে সৃষ্ট পরিবেশে দাসত্ব টিকে থেকেছে। প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার দাসত্বকে মূলধারাবহির্ভূত প্রবণতা বলে আখ্যায়িত করা ঠিক হবে না। দাসত্ব শুধু বাইরে থেকে আমদানিকৃত দাস বা জলদস্যুদের অভিযানের শিকারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৭শ ও ১৮শ শতকের দাসবিক্রয়ের দলিলসমূহ প্রমাণ করে যে, দাসপ্রথা সমাজের মূলধারায় প্রােথিত ছিল। এ কথা সত্য যে, বাংলায় দাসদের প্রধানত ঘরের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, ক্রীতদাসীরা পরিচারিকা ও উপপত্নী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেসব সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল দাসত্ব, সেসব সমাজের তুলনায় বাংলায় দাসদের সঙ্গে অনেক বেশি মানবিক ব্যবহার করা হতাে। তবু প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় দাসত্বের অস্তিত্ব এ কথাই প্রমাণ করে যে, এ সমাজে অনেক দরিদ্র লােক ছিল, যারা নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায় অক্ষম ছিল। 

মজুরির নিম্নহার থেকে বহির্বাণিজ্যের সীমাবদ্ধ লাভের ইঙ্গিত : প্রাপ্ত তথ্য থেকে মনে হয় যে, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় মজুরির হার ছিল খুবই কম। তাঁতিদের দারিদ্র্য সম্পর্কে যেসব পরিমাণগত ও বর্ণনামূলক বিবরণ পাওয়া যায় সেসব এ অনুমানই সমর্থন করে। তবে নিম্নহারে মজুরি শুধু তাঁতিদের মধ্যেই চালু ছিল না। সম্ভবত এ ধরনের অর্থনীতি, যেখানে জীবনধারণের সর্বনিম্ন পর্যায়ের আয় ছিল, সেখানে সকল শ্রমিকেরই মজুরি ছিল কম। এর অর্থ হলাে, বাংলার জাঁকালো বহির্বাণিজ্যের সুফল ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। দুটি কারণে বাংলার বহির্বাণিজ্য সম্পর্কে চিরাচরিত ব্যাখ্যা পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

  • প্রথমত দেখা যাচ্ছে যে, তাঁতিরা তাদের কাপড়ের পুরাে দাম পেতাে না। কাপড়ের দামের একটা বড় অংশ আদায় করতাে মধ্যস্বত্বভােগীরা, সরকারের তত্ত্বাবধায়করা ও বিদেশী বণিকের দালালরা। মধ্যস্বত্বভােগীরা ও বিদেশী বণিকরাই প্রধানত বাংলার বহির্বাণিজ্যের মুনাফা লুটেছে।
  • দ্বিতীয়ত তারা কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের বিনিময়ে সােনা-রূপা আমদানি করতাে। বেশিরভাগ আমদানিকৃত সােনা-রূপা দিল্লীতে রাজস্ব হিসেবে পাঠানাে হতাে, অবশিষ্ট গােপনে মজুদ করা হতাে। প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার বহির্বাণিজ্য তাই প্রবৃদ্ধির যন্ত্র ছিল না, এ বাণিজ্যই ছিল সম্পদপাচারের মাধ্যম। 

স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার অভাব দ্বারা নিম্ন ক্রয়ক্ষমতার ইঙ্গিত : তথাকথিত সােনার বাংলায় দৈনন্দিন কাজে স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা ব্যবহার করা হতাে না। সাধারণ লােক বাড়িতে আয় করতে, ক্রয় করতে এবং বিক্রয় করতাে। স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রায় খাজনা দেয়া হতাে। কিংবদন্তির সুলভ মূল্য পণ্যের অতিরিক্ত সরবরাহ থেকে হয় নি, হয়েছে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে প্রাক ব্রিটিশ বাংলায় সুলভ মূল্য সমৃদ্ধির নয়, দুর্দশার নিদর্শন। 

বিতর্ক : সংক্ষেপে বলতে গেলে, সােনার বাংলা আপেক্ষিক অর্থে ‘সােনালী’ ছিল না। প্রাক শিল্পবিপ্লব সমাজের সকল দুর্বলতাই প্রাক-ব্রিটিশ বাংলাতে উপস্থিত ছিল। প্রাক-ব্রিটিশ বাংলা সমসাময়িক অন্যান্য সমাজের তুলনায় সচ্ছল ছিল – এ অনুমান প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা যায় না। অবশ্য এ সম্পর্কে প্রাপ্ত সাক্ষ্য বর্ণনামূলক ও দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্তে পৌঁছানাের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই প্রাক-ব্রিটিশ ভারত শিল্পবিপ্লবের পূর্বকালে পশ্চিম ইউরােপের দেশসমূহের তুলনায় সচ্ছল ছিল কিনা এ সম্পর্কে বিতর্ক চলছে। (এই বিষয়ে বিতর্ক সম্পর্কে দেখুন, Morris D. Morris,”Towards a Reinterpretation of Nineteenth Century Indian Economic History”, Journal of Economic History, XXIII: 4 (1963), 607-618 T Tapan Ray Chaudhri, “A Reinterpretation of Nineteenth Century Indian Economic History”, Indian Economic and Social History Review, v (1958), 77-100)। উপাত্তের অপ্রতুলতা ছাড়াও এ ধরনের তুলনায় প্রণালীগত জটিলতা রয়েছে। (প্রণালী সংক্রান্ত সমস্যাবলীর আলােচনার জন্য দেখুন, J. D. Gould, Economic Growth in History. (London 1972), 14-21)। সােনার বাংলার আপেক্ষিক ভাষ্য সম্পর্কে তাই আরাে গবেষণার প্রয়ােজন রয়েছে। 

তথ্যসূত্র

  • আকবর আলী খান, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, ২য় খণ্ড : অর্থনৈতিক ইতিহাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা, সম্পাদক – অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.