ফিলিস্তিন সমস্যা (১৯৭৫ সাল পর্যন্ত)

Table of Contents

ফিলিস্তিনের ওপর আরব ও ইহুদিদের দাবি এবং তাদের আদি ইতিহাস

ফিলিস্তিনের ওপর আরব ও ইহুদিদের দাবি ও দাবির ভিত্তি : ‘ফিলিস্তিন প্রশ্ন’ একটি সহজ-উচ্চারিত অথচ অত্যন্ত জটিল মানবিক সমস্যা। এই সমস্যার মূল কথা হল একই ভূখণ্ডের ওপর আরব ও ইহুদিদের দাবি এবং পরিণামে আরব জাতীয়তাবাদী ও ইহুদি জাতীয়তাবাদের মধ্যে সংঘাত। এই দুই জাতির পরস্পরবিরােধী দাবির প্রেক্ষিতে সংঘর্ষ হওয়া যে সম্ভব সেই কথা বিগত শতকের প্রারম্ভেই খ্রিস্টান আরব লেখক নজীব আজুরী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত তার পুস্তকে আজুরী মন্তব্য করেছিলেন : ‘Two important phenomena, of identical Character but never the less opposed … are now making their appearance in Asian Turkey : these are the awakening of the Arab nation and the latant efforts of the Jews to re-establish … the ancient kingdom of Israel. These two movements are destined to struggle Continuosly with one another, until one prevails over the other. The fate of the entire world depends on the result of this struggle between the two peoples …’ (Nejib Azouri, Le Reveil de la Nation Arabe dans l’Asie Turque (Paris, 1905). P. 5.)। ফিলিস্তিনের ওপর আরব ও ইহুদিদের দাবির ভিত্তি কি? ফিলিস্তিন প্রশ্নের সূত্র ও সমস্যার তীব্রতা অনুধাবন পরম্পরিক দাবির ভিত্তি সম্বন্ধে ধারণা থাকা প্রয়ােজন। ইহুদিদের দাবি প্রধানত ঐতিহাসিক স্মৃতি। এই অতীত স্মৃতির একদিক হচ্ছে। Old Testament-এ বর্ণিত বিশ্ব প্রভুর সাথে তার মনােনীত ইহুদি জাতির পবিত্র অঙ্গীকার। ইহুদিদের প্রভু আব্রাহামকে বলেন : “I am Yhwh that brought thee out of Ur of the Chaldess to give to thee this jand to inherit it.” (Genesis, 157)। অন্যত্র বলা হয়েছে : “And I will make of thee a great nation … and they went forth to go into the Land of Canaan …… and the Canaanite was then in the land. And the Lord appeared to Abraham and said : ‘Unto they seed will I give this land’. (Genesis, 12)। old Testament-এ বর্ণিত ঘটনাবলী গিডিয়ন, বােয়াজ ও ডেভিডের বীরত্ব; রূথের প্রেম ও আত্মত্যাগ; দেবােরা, লিয়াহ, রেবেকা, রাসেল ও অন্যান্য মহিলার কীর্তিকাহিনী এবং সল, ডেভিড ও সলেমান কর্তৃক ফিলিস্তিনে এক বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের স্মৃতি যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে। (সল, ডেভিড ও সলােমানের সময় যে প্যালেস্টাইনের সমগ্ৰ অংশে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ছিল না তা মনে রাখা প্রয়ােজন। দেশটিকে বোঝাতে ফিলিস্তিন ও প্যালেস্টাইন দুটি নামই ব্যবহৃত হয়েছে।)

ফিলিস্তিনে আরবদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য : আরবদের দাবির ভিত্তি দুটি ঐতিহাসিক স্মৃতি ও বাস্তব পরিস্থিতি। যে ঐতিহাসিক স্মৃতি ইহুদিদের উদ্বেলিত করে তার এক বড় অংশের উত্তরাধিকারী আরবগণও। বহু মহাপুরুষ দুই ধর্মাবলম্বীদের নিকটেই ঐশী পুরুষ রূপে সম্মানিত। তা ছাড়া কিছু ঐতিহাসিক স্মৃতি মুসলমান আরবদের নিজস্ব। মহানবীর মিরাজ গমনের সাথে জেরুজালেমের সম্পৃক্ততা, হযরত উমরের খিলাফতকালে প্যালেস্টাইনকে মুসলিম শাসনাধীনে আনয়ন, কুব্বাত উস-সাখরা ও মসজিদ আল-আকসার মতো ঐতিহ্যমণ্ডিত হর্মরাজী নির্মাণ এবং দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ক্রুসেডারগণের কাছ থেকে সালাহুদ্দীন আইয়ুবী মামলুক সুলতানগণ কর্তৃক ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার এই স্মৃতির কয়েকটি উল্লেখযােগ্য দিক। বাস্তব পরিস্থিতিও আরব দাবি সমর্থন করে। প্রথমত ৭ম শতকের ৩য় দশকে আরব মুসলমানগণ কর্তৃক বিজিত হবার পর থেকে ফিলিস্তিন আরব জাহানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য হয়ে আসছে। মাত্র ১৯০ বছরের কিছু বেশি সময়ের জন্য (১০৯৯-১২৯১) এই দেশের কিয়দংশ ক্রুসেডারদের দখলে ছিল। দীর্ঘকাল আরব শাসনাধীনে থাকিবার ফলে এখানে আরবীয় ইসলামি মূল্যবােধে পরিচালিত একটি সমাজের সৃষ্টি হয়েছিল। দ্বিতীয়ত দীর্ঘ শতক ধরে এখানে আরবীয় ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠিত থাকায় বিভিন্ন স্থানের আরব (মুসলমান ও খ্রিস্টান) এখানে বসতি স্থাপন করে। ফলে আরবগণ মােট জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশে পরিণত হয়। বাস্তবে সংখ্যাধিক্যের কারণে আরবগণ আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আলােকে দেশটির ওপর তাদের অধিকার দাবি করে। ফিলিস্তিন সমস্যার শেষ অংকে দেখা যায় যে, এই দেশটির ওপর কোনাে দলের দাবি কতটা ন্যায় ও ঐতিহাসিক সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত তা সমস্যা সমাধানের সূত্র হিসেবে গৃহীত হয়নি; বরং লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোন দল কতটা সুসংগঠিত হতে পেরেছে এবং বৃহৎ শক্তিসমূহের ওপর চাপ প্রয়ােগ করতে সক্ষম তাই সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে ইহুদিগণ অধিকতর সাফল্যের দাবিদার।

ইহুদিদের ছড়িয়ে পড়া ও ফিলিস্তিনের বাইরে ইহুদিদের অবস্থা : খ্রিস্টপূর্ব ৮ম ও ৬ষ্ঠ শতকে ইসরায়েল ও জুডা রাজ্যের ধ্বংসের পর ইহুদিরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। যে অল্পসংখ্যক ইহুদিরা ফিলিস্তিনে ছিল, তারা পর্যায়ক্রমে ব্যাবিলনীয় (খ্রি.পূ. ৫৮৬ – ৫৩৮ অব্দ), পারসিক (খ্রি.পূ. ৫৩৮-৩৩২ অব্দ), আলেকজান্দার (খ্রি.পূ. ৩৩২-৩২৩ অব্দ), টলেমী বংশ (খ্রি.পূ. ৩২৩-১৯৮ অব্দ), সেলুকাসের উত্তরাধিকারীদের (খ্রি.পূ. ১৯৮-১৬৮ অব্দ), মেক্কাবীদের (খ্রি.পূ. ১৬৮-৬৩ অব্দ), রােমানদের (খ্রি.পূ. ৬৩ খ্রিস্টাব্দ ৩৯৫). বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের (৩৯৫ খ্রি. – ৬৩৮ খ্রি.), আরব মুসলমানদের (৬৩৮-১৫১৭ খি.) এবং তুর্কি মুসলমানদের (১৫১৭-১৯১৮ খ্রি.) অধীনে শাসিত হয়। ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত ইহুদিগণ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। তবে প্রায় কোনাে দেশেই তারা স্থানীয় জনসাধারণের সাথে মিশে যায়নি। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রবণতা এবং সাধারণ খ্রিস্টানদের দ্বারা ইহুদিদেরকে “যিশুর হত্যাকারী” রূপে চিহ্নিত করার ফলেই ইহুদিগণ খ্রিস্টানদের সাথে মিলে মিশে এক সমাজ গড়ে তুলতে পারেনি। ভালাে ব্যবসায়ী বলে এবং কুসিদবৃত্তির মাধ্যমে প্রায় প্রত্যেক দেশেই ইহুদিগণ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়। ইহুদিদের প্রতি খ্রিস্টানদের রােষের ক্ষেত্রে এও ছিল একটি কারণ। অনেক খ্রিস্টান দেশেই খ্রিস্টানগণ সংঘবদ্ধভাবে ইহুদিদের মহল্লা আক্রমণ করে ‘যিশু হত্যার প্রতিশােধ’ নেবার চেষ্টা করত। এই ধরনের আক্রমণে বহু ইহুদির জীবন ও ধন-সম্পত্তি নষ্ট হত। খ্রিস্টান জগতে ইহুদিদের প্রতি ব্যবহারের তুলনায় মুসলিম দেশসমূহে তারা অনেক বেশি সহৃদয় ও মানবিক ব্যবহার পায়। অবাধে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ধর্ম-কর্ম ছাড়াও ইহুদিদের অনেকে রাষ্ট্রীয় চাকুরির ক্ষেত্রেও সুযােগ-সুবিধা লাভ করে।

ইহুদি জাতীয়তাবাদ বা জায়নবাদের উদ্ভব ও বিকাশ

ইহুদিদের মধ্যে প্রবল ধর্মীয় স্মৃতি, ইহুদি-বিদ্বেষ ও ইহুদি জাতীয়তাবাদী চিন্তা : মধ্যযুগে ইউরােপীয় দেশগুলোতে অত্যাচারিত হবার ফলেও ইহুদিদের মধ্যে ধর্মীয় ঐতিহাসিক স্মৃতি প্রবল হয়ে দেখা দেয়। হানুক্কা, প্যাসওভার ও ‘রােশ হাশােনা’র মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সল-ডেভিডের স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ জাগরূক রাখত। ফরাসি বিপ্লবই প্রথম ইহুদিদের ওপর থেকে বিভিন্ন প্রকারের বৈষম্যমূলক আইন-কানুন প্রত্যার করে তাদের অন্যান্য নাগরিকদের সমান সুযােগ সুবিধা দান করে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষায় তারা উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি লাভ করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়। এই সময় বিভিন্ন ইউরােপীয় দেশে কিছু কিছু ইহুদি উক্ত দে সমূহের জনসাধারণের সাথে মিশে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করলেও এবং তদনুযায়ী নিজেদের চালিত করলেও অনেকেই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে। ১৯শ শতকের শেষ পাদে খােদ ফরাসি দেশেই ‘ড্রেইফাস’ বিচারের মতো ঘটনা এবং ফলশ্রুতিতে ইহুদি-বিদ্বেষের বিস্তৃতি এই প্রয়ােজনীয়তা আরও স্পষ্ট করে তােলে। ফরাসি সেনাবাহিনী জার্মানির নিকট সামরিক তথ্য পাচারের অভিযােগে ইহুদি অফিসার ক্যাপ্টেন আলফ্রেড ড্রেইফাসকে অভিযুক্ত করে এবং সামরিক বিচারের পর নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এরপর ঘটনা পরম্পরায় ড্রেইফাসের নির্দোষিতা এবং সেনাবাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের অপরাধ প্রমাণিত হলেও সামরিক আদালত প্রদত্ত শাস্তি বহাল রাখা হবে কিনা এই প্রশ্নে সমগ্ৰ ফরাসি সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিছু কিছু সংবাদপত্রে এই সময় চরম ইহুদি বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। 

ইহুদি মনিষীদের ইহুদি-জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তা : এই সময় থেকেই ইহুদি জাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনেক ইহুদি মনীষী চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন। এদের মধ্যে মােজেজ হেস, হিরশ কালিশার (Hirsch Kaliscer) এবং থিওডাের হারৎজেলের নাম উল্লেখযােগ্য। 

  • মোজেজ হেস : বন-এ জন্মগ্রহণকারী হেস ১৮৪৮ সালের বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য প্রাশিয়ার সরকার কর্তৃক বিতাড়িত হন এবং প্যারিসে বসবাস করতে থাকেন। ১৮৬২ সালে প্রকাশিত একখানি পুস্তকে হেস ‘ইহুদি সমস্যা’ সমাধানের ইঙ্গিত দেন। জার্মান ভাষায় লিখিত হেসের পুস্তক Rome and Jernsalem নামে M. Waxman কর্তৃক অনুদিত হয়েছে (New York, 1918.)। তার মতে ইউরােপের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিগণ ফরাসি বিপ্লব প্রদত্ত মুক্তির নির্দেশ সত্ত্বেও স্বতন্ত্র সমাজ হিসেবে বাস করছে। চেষ্টা করেও তারা ঐ সমস্ত জাতির সাথে এক হয়ে যেতে পারছে না। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নতুন সমাজ গঠনের মাধ্যমেই কেবলমাত্র ইহুদি ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ও ইহুদি সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন। ক্রমে ক্রমে প্যালেস্টাইনে ইহুদি বসতি স্থাপনের তিনি জোর সুপারিশ করেন। প্রাশিয়ার দখলিকৃত পােল্যাণ্ডে জন্মগ্রহণকারী কালিশার ছিলেন একজন ইহুদি যাজক। তিনি প্রচার করেন যে, ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ইহুদিদের মুক্তি প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে লাভ করা অসম্ভব। নিজেদের প্রচেষ্টায় ফিলিস্তিনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যে মুক্তি নিহিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। ১৮৬৭ সালে অন্য একজন যাজকের সাথে একত্রে তিনি একটি আবেদন প্রকাশ করেন। এই আবেদনে বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের – বিশেষত ব্রিটিশ ইহুদিদের প্রতি সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে “শূন্য, প্রায়ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পবিত্র ভূমিতে’ ইহুদি বসতি স্থাপন করতে বলা হয়।
  • থিওডোর হারৎজেল : ১৮৬০ সালে বুদাপেস্তে জন্মগ্রহণকারী হারৎজেল বিভিন্ন ইউরােপীয় দেশে ইহুদি বিরােধী মনােভাব লক্ষ্য করে ইহুদিদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চিন্তা করতে থাকেন। ড্রেইফাস বিচারের সময় তিনি সাংবাদিক হিসেবে প্যারিসে ছিলেন। ফরাসি দেশেও ইহুদি-বিরােধী মনােভাবের গভীরতা তাকে ভাবিয়ে তােলে। প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই চিরন্তন ‘ইহুদি সমস্যার’ একটি গ্রহণযােগ্য সমাধান সম্ভব বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, জাতি হিসেবে ইহুদিদের বৈশিষ্ট্য সর্ববাদীসম্মত। মানব জাতির ইতিহাসের তাদের অবদানও অবিস্মরণীয়। এই বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ইহুদিদের একটি স্বাধীন আবাসভূমির প্রয়ােজনীয়তার ওপর তিনি জোর দেন। ওডােসার ইহুদি বুদ্ধিজীবী লিও পিকারও এই একই মত ব্যক্ত করেন। হারৎজেলের বিখ্যাত পুস্তক Judenstaat ১৯৯৬ সালে ভিয়েনায় প্রকাশিত হয়। 

ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আগমন বৃদ্ধি ও ধনাঢ্য ইহুদিদের সহায়তা : কিন্তু কল্পনা করা এক জিনিস-আর তার বাস্তবায়ন আলাদা ব্যাপার। ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে কিছু কিছু ইহুদি ফিলিস্তিনে আগমন করলেও কোনাে রাজনৈতিক সংস্থা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করা হয়নি। ১৮৭০ সালে ফরাসি ইহুদিদের সংস্থা Alliance Israelite Unverselle জাফায় একটি আধুনিক কৃষি বিদ্যালয় স্থাপন করে। জার্মান ইহুদিগণ জেরুজালেমে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ বিদ্যালয় স্থাপন করে এবং ইহুদি যাজকদের বিরােধিতা সত্ত্বেও তা সাফল্য অর্জন করে। ১৮৭৮ সালে পেতা তিক্ভা‌য় প্রথম ইহুদি কৃষিবসতি স্থাপন করা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনে জমি ক্রয় করে বসতি স্থাপন করার এই প্রয়াসের পরিধি ছিল অত্যন্ত সীমিত। ১৮৮১ সালে প্রতিক্রিয়াশীল তৃতীয় আলেকজান্দার সিংহাসনে আরােহণ করার পর রাশিয়ায় যে ইহুদি-বিরােধী অভিযান শুরু হয় তা পূর্ব ইউরােপের অন্যান্য দেশেও পরিব্যপ্ত হয়। হাজার হাজার ইহুদি পাশ্চাত্য দেশসমূহে – বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করতে থাকে। বেশ কিছুসংখ্যক ইহুদি প্যালেস্টাইনেও আগমন করে। প্রথমদিকে প্রধানত ইউরােপীয় দেশের ইহুদিগণই আগমন করে। এরা ‘আশকেনাজী’ ইহুদি এবং প্রাচ্যদেশ সমূহে বসবাসকারী ইহুদিগণ ‘সেফারদিম’ ইহুদি নামে পরিচিত। ১৮৮২ সালে একদল রুশ ইহুদি ছাত্র জাফার নিকটে একটি কৃষি-বসতি স্থাপন করে। এই দল ‘বিলু’ নামে পরিচিত। রাশিয়া ও রুমেনে থেকে আগত ইহুদিগণ সামারিয়ার সিকরণ জ্যাকবে ও গ্যালিলির ‘রস পিনায়’ কৃষি বসতি স্থাপন করে। কিন্তু স্থানীয় পরিবেশ সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকায় এই বসতিগুলো অতিশীঘ্রই অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং এদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে ওঠে। রুশ ইহুদিগণ এদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ‘জায়ন প্রেমিক’ (হােভেভি জায়ন) সংস্থা গঠন করে তারা অর্থ ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে বসতিগুলোকে সাহায্য করে। ব্রিটিশ ইহুদি স্যার মােজেজ মান্টিফিওরীর মতো স্বজাতিপ্রাণ ধনাঢ্য ব্যক্তিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে ফ্রান্সের ব্যারন এডমণ্ড দ্য রথ্‌স্‌চাইল্ডের অবদানই স্মর্তব্য। বহু কৃষি বসতিকে সাহায্য করা ছাড়াও তিনি একরন’ ও মেতুল্লায় সম্পূর্ণ নিজ ব্যয়ে দুটি বসতি স্থাপন করেন। রাশিয়ায় ইহুদি-বিরােধী আন্দোলনের ফলে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরােপীয় দেশসমূহ থেকে ১৯শ শতকের শেষপাদে ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে আগমনকে প্রথম ‘আগমন’ (আলিয়া) বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মােট পাঁচটি আলিয়ায় ইহুদিগণ প্যালেস্টাইনে প্রবেশ করে।

হারৎজেলের আন্তর্জাতিক জায়নবাদী আন্দোলন : পবিত্র ভূমিতে কিছুসংখ্যক ইহুদি কৃষি বসতি স্থাপনই যে ইহুদি সমস্যা সমাধানের শেষ কথা নয় এবং এর জন্য যে ইহুদি সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত করা প্রয়ােজন, তা হারৎজেল উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই আন্তর্জাতিক ‘জায়নবাদী’ আন্দোলন শুরু করেন। জেরুজালেমে ডেভিড ও তার উত্তরাধিকারীদের মন্দির ও প্রাসাদ যেখানে অবস্থিত ছিল সেই অনতিউচ্চ পাহাড় জায়ন নামে পরিচিত। একে ইহুদিদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করা হয়। সেই জায়ন থেকেই জায়নবাদী আন্দোলনের নামকরণ। এর উদ্দেশ্য হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ করে সেই সংঘবদ্ধ শক্তির সাহায্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। জায়নবাদী আন্দোলনের ফলে ইহুদি সমস্যা সমাধানের জন্য পৃথিবীর অন্য যেকোনাে স্থানের পরিবর্তে প্যালেস্টাইনেই ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকল্পে সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ইহুদি জাতিত্বের প্রশ্ন ও জায়নবাদের বিরোধিতা : জায়নবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ইহুদিদের জাতিত্বের দাবি সম্বন্ধে প্রশ্ন ওঠে। ইহুদি ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের অনেকে একটি ভৌগােলিক সীমারেখায় আবদ্ধ জাতীয়তাবাদকে ইহুদি ধর্মের আত্মিকতার প্রতি আঘাত বলে মনে করেন। জুডীয় ধর্মকে তারা প্রধানত মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য একটি ঐশী বিধান বলে মনে করতেন। দ্বিতীয়ত যে সমস্ত ইউরােপীয় দেশে ইহুদিগণ সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবন ধারার সাথে বহুলাংশে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল সেই দেশগুলোর ইহুদি নেতৃবৃন্দ জায়নবাদকে একটি ভারসাম্য বিনষ্টকারী আন্দোলন হিসেবে গণ্য করে। ব্রিটেনে ‘ব্রিটিশ ইহুদি প্রতিনিধি সভা’ এবং ‘ইঙ্গ-ইহুদি সংস্থা’ এই আন্দোলনের বিরােধিতা করে। ১৯১৭ সালে ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রে এই দুই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জায়নবাদের বিরােধিতা করে তাকে জুডীয় ধর্মের মর্মবাণীর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন। জায়নবাদ বিরােধী ব্রিটিশ ইহুদিদের মধ্যে এককালীন ভারত সচিব এডুইন মন্টেগুর নাম উল্লেখযােগ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিদের মধ্যেও ধনী ও দানশীল জ্যাকব শিফ (Jacob H. Schiff) সহ বেশ কিছু ইহুদিগণ জায়নবাদকে একটি বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন হিসেবে গণ্য করে তা সমর্থনের অযােগ্য বলে প্রচার করে। জার্মানিতেই সমাজতন্ত্রী ইহুদিদের সংখ্যা বেশি ছিল।

জায়নবাদীদের ফিলিস্তিনে ইহুদি স্থানান্তরের প্রচেষ্টা ও প্রচার : অপরপক্ষে হারৎজেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারপতি লুই ব্ৰাণ্ডাইস (Louis D. Brandeis) ও ডক্টর হাইম ওয়াইজম্যানের মতো জায়নবাদী নেতৃবৃন্দ ইহুদিদের বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য জায়নবাদী যে একমাত্র পন্থা ও উপায় তা প্রচার করেন। ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যাণ্ডের বাসল-এ প্রথম বিশ্ব জায়নবাদী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবলীর মধ্যে প্যালেস্টাইনে অধিক সংখ্যক কৃষি-বসতি ও ইহুদি মালিকাধীনে কল-কারখানা স্থাপন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকারের সংস্থা স্থাপনের মাধ্যমে ইহুদিদের জাতীয় ভাবধারায় উদ্দীপ্ত করার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং বিভিন্ন দেশের সরকারকে জায়নবাদের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন করে তোলার প্রয়াস অন্যতম। জায়নবাদ আন্দোলনের প্রথম বছরে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৮,০০০। ১৯০৫ সালে এই সংখ্যা দুই লক্ষে পৌঁছায়। কিছুসংখ্যক ইহুদির বিরােধিতা সত্ত্বেও এই আন্দোলন যে সাধারণ ইহুদিদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। প্যালেস্টাইনে কৃষি-বসতি স্থাপনের ব্যাপারে আরও অগ্রগতি সাধিত হয়। এখন থেকে কবলমাত্র ধনাঢ্য ইহুদিদের সাহায্যের ওপরেই এই প্রকল্প নির্ভরশীল ছিল না; আন্তর্জাতিক জায়নবাদ সংস্থার অধীনে ‘ইহুদি জাতীয় তহবিল’ (কেরেন কায়েমৎ) ও ‘প্যালেস্টান গঠন তহবিল’ (কেরেন হেইসদ) থেকে পরিকল্পিতভাবে জমি ক্রয় করে বসতি স্থাপন করা হতে থাকে। জায়নবাদ সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে অর্থনীতিবিদ ডক্টর আর্থার রুপিন প্যালেস্টাইনে অবস্থান করে ও অর্থ সাহায্যের প্রলােভন দেখিয়ে তার অনুমতি আদায় করার চেষ্টা করে; কিন্তু সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ বা নব্য তুর্কি সরকার কেউই এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। যদিও নব্য তুর্কি নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ বিশেষত তালাৎ বে জায়নবাদের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলেন।

ম্যাকমাহনের পত্র ও সাইকোপিকোঁর চুক্তি : প্রথম মহাযুদ্ধে জায়নবাদী নেতৃবৃন্দ প্রথমদিকে কোনাে পক্ষই গ্রহণ করতে চায়নি। তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনাে পক্ষে সাহায্য গ্রহণ করার জন্য জায়নবাদীগণ প্রস্তুত ছিল। যুদ্ধের গতিবিধি লক্ষ্য করে বিজয়ী দলের সাথে সহযােগিতা করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করার নীতি তারা গ্রহণ করে। যুদ্ধের প্রথমদিকে কয়েকটি চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি – বিশেষত প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার আবর্তে পতিত হয়। পূর্বে উল্লেখিত হুসায়েন ম্যাকমেহন পত্র-বিনিময় ও ‘চুক্তি’ অনুযায়ী আরব অঞ্চলগুলোতে এক বা একাধিক স্বাধীন আরব রাষ্ট্রের কথা বলা হলেও প্যালেস্টাইন সম্বন্ধে কোনাে স্পষ্ট কোনাে বক্তব্য রাখা হয়নি। উইনস্টন চার্চিলের মতো কোনাে কোনাে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ম্যাক-মাহনের পত্রে ব্যবহৃত একটি বিশেষ বাক্যাংশের উদ্ধৃতি দিয়ে মত প্রকাশ করেন যে, প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্র থেকে প্যালেস্টাইনকে বাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই চুক্তি অত্যন্ত দুর্বল এবং প্যালেস্টাইন প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে আরবদের দাবিই ন্যায়সঙ্গত মনে হয়। এরপরপরই ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে সাইকসপিকোঁ নামে যে গােপন চুক্তি হয় তাতে প্যালেস্টাইনে একটি আন্তর্জাতিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়। আবার ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার এই ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের সর্বাত্মক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। 

ব্যালফোর ঘােষণা

প্যালেস্টাইন সমস্যার ইতিহাসে ব্যালফোর ঘােষণা একটি উল্লেখযােগ্য দলিল। লঘু-চিত্তে এই ঘােষণা করা হয়নি। এই ঘটনার পেছনে বহুবিধ কারণ ছিল –

  • প্রথমত রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর বৈপ্লবিক সরকার ‘বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদী’ যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে। এই ইচ্ছা কার্যে পরিণত হলে পূর্ব ফ্রন্টে নিয়ােজিত বিপুল সংখ্যক জার্মান সৈন্য পশ্চিম ফ্রন্টে নিয়ােজিত হতে পারত। এর ফলে ফরাসি সীমান্তে মিত্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এই সম্ভাবনা দূর করার জন্য যেকোনাে উপায় আরও কিছুদিন রাশিয়াকে যুদ্ধে ব্যাপৃত রাখার নীতি গৃহীত হয়। বলশেভিক বিপ্লবে রাশিয়ার ইহুদিগণ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কম্যুনিস্ট দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যেও বেশ কিছুসংখ্যক ইহুদি ছিল। মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন যে, প্যালেস্টাইনে ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নেতৃস্থানীয় বলশেভিক ইহুদিদের সন্তুষ্ট করতে পারলে তাদের সহায়তায় রাশিয়াকে কিছুদিন যুদ্ধে ব্যাপৃত রাখা যাবে। 
  • দ্বিতীয়ত ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বেপরােয়া ডুবােজাহাজ ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যুদ্ধ ঘােষণা করলেও সীমিতভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘােষণা করেনি। অথচ এই সময় ইপারের তৃতীয় যুদ্ধে (৩১ জুলাই থেকে ১০ নভেম্বর) ব্রিটিশ বাহিনীর ৪ লক্ষ সৈন্য নিহত হয়। ইতালিতে ক্যাপােরেটো অভিযানে (২৪ অক্টোবর থেকে ২৬ ডিসেম্বর) জার্মান-অস্ট্রীয় যুগ্ম বাহিনী ইতালীয় বাহিনীকে পর্যুদস্ত করলে এবং প্রায় ৩ লক্ষ ইতালীয় সৈনিক বন্দী হয়। এই অবস্থায় মিত্রশক্তিবর্গ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকতর অংশগ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে। প্রেসিডেন্ট উইলসনসহ মার্কিন প্রশাসনের ওপর ইহুদি বুদ্ধিজীবী ও ধনী-বণিকদের প্রভাব সম্বন্ধে সকলেই জ্ঞাত ছিলেন। ব্যালফোর ঘােষণার একটি প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আমেরিকার ইহুদিদের সহানুভূতি লাভ করে তাদের মাধ্যমে মার্কিন সরকারকে পূর্ণভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করানো সম্ভব হবে বলে মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন। 
  • তৃতীয়ত, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরােপীয় দেশসমূহ থেকে যে হারে ইহুদিগণ পাশ্চাত্য দেশসমূহে আগমন করছিল তা এই সমস্ত দেশের সরকার খুব প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করতে পারেনি। ইহুদি বাস্তুত্যাগীদের প্যালেস্টাইনে পাঠিয়ে এই ‘কষ্টকর দায়িত্ব’ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে বলে তারা মনে করেছিলেন।
  • চতুর্থত, এই ঘােষণার পশ্চাতে নির্যাতিত ইহুদিদের প্রতি মানবিক সহানুভূতিও ক্রিয়াশীল ছিল। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত খ্রিস্টানদের হাতেই ইহুদি সম্প্রদায় নিপীড়িত হয়েছে বলে ইহুদিদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা নিজেদের দায়িত্ব বলে খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন। 
  • পঞ্চমত এর পেছনে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থও লুক্কায়িত ছিল। সুয়েজ খাল ও পাশ্ববর্তী এলাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য এত প্রয়ােজনীয় ছিল যে, এর নিরাপত্তার জন্য যেকোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্রিটিশ সরকার প্রস্তুত ছিল। আরবদের ওপর তারা আস্থা স্থাপন করতে পারেনি। পাশ্চাত্য ভাবাপন্ন ইহুদিদের যদি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে এই এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করা যায় তবে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজাব্যদী স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করবে বলে তাদের ধারণা হয়েছিল।

ঘােষণাটি বিশ্লেষণ করলেও পরস্পর-বিরােধী ভাব দেখা যায়; কোনাে কোনাে স্থানে অস্পষ্টতাও রয়েছে। ঘােষণায় তিনটি অংশ রয়েছে –

  • প্রথম অংশে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের একটি আবাসভূমির প্রতিষ্ঠা এবং এই প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ সরকারের সহানুভূতি ও সাহায্যের কথা বলা হয়েছে।
  • দ্বিতীয় অংশে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠিত হলেও এমন কিছুই করা হবে না যাতে ইহুদি নয় এমন সম্প্রদায়সমূহের সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
  • তৃতীয় অংশে বলা হয়েছে যে, ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ফলে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের নাগরিকত্ব ও নাগরিক অধিকার কোনাে দিক দিয়েই ক্ষুণ্ণ হবে না।

ঘোষণাটির সমস্যাগুলো –

  • প্রথম অংশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এখানে ‘আবাসভূমি’ কথাটা ব্যাখ্যা করা হয়নি। ইহুদি আবাসভূমির অর্থ কি ইহুদি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র, নাকি যেকোনাে প্রকার শাসনাধীনে ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বায়ত্তশাসন? আরও একটি প্রশ্ন এই প্রসঙ্গে উঠতে পারে, ইহুদি রাষ্ট্র অথবা স্বায়ত্তশাসিত ইহুদি সম্প্রদায় কি সমগ্র প্যালেস্টাইনের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করবে না তার বিশেষ কোনাে অংশে?
  • দ্বিতীয়ত সমগ্র জনসংখ্যার এক অতি বৃহৎ অংশ, মুসলিম ও খ্রিস্টান আরবদের ‘ইহুদি নয় এমন সম্প্রদায়সমূহ’ বলে অভিহিত করে তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের কথা বললেও তাদের কোনাে রাজনৈতিক অধিকার আছে কিনা, সেই প্রশ্নটি সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
  • তৃতীয়ত বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের নাগরিকত্ব অপরিবর্তিত সম্বন্ধীয় ঘােষণাও অর্থহীন। প্রতিষ্ঠিতব্য ইহুদি রাষ্ট্রে যদি বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার থাকে তবে ইহুদিদের আনুগত্য সম্বন্ধে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ইহুদি রাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য যে ইহুদিরা উদ্বেল, তারা যে বসবাসকারী দেশের প্রতি অনুগত সেই কথা বিশ্বাস করা কঠিন। 

ব্যালফোর ঘােষণা শুধু প্যালেস্টাইনে সমস্যার ইতিহাসে নয় পরবর্তী সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। জায়নবাদীদের জন্য এই ঘােষণা এক বিরাট বিজয়। এরপর জায়নবাদীদের লক্ষ্য হয় : (ক) অন্যান্য মিত্রশক্তি কর্তৃক ব্যালফোর ঘােষণা অনুমােদন, এবং (খ) সাইকাস-পিকোঁ চুক্তিতে প্যালেস্টাইনে যে আন্তর্জাতিক প্রশাসন প্রবর্তিত করার কথা ছিল তার পরিবর্তে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসন চালু করা। প্রথম লক্ষ্য সহজেই অর্জিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইতালি ঘােষণাটি অনুমােদন করে। দ্বিতীয় লক্ষ্য অর্জনের পথে একমাত্র ফরাসি সরকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু ফরাসি জায়নবাদীগণ তাদের সরকারের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়ায় সম্ভাব্য ফরাসি বিরােধিতা দূরীভূত হয় এবং স্যান রেমাে সম্মেলনে ব্রিটেনকে প্যালেস্টাইনের ওপর ম্যান্ডেটরি শাসন কর্তৃপক্ষ প্যালেস্টাইনে ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইহুদি পর্ষদের (Jewish Agency) সহযােগিতায় কাজ করবে। 

ম্যান্ডেটরি শাসনামলে ইহুদিদের শক্তিবৃদ্ধি

ইহুদিদের অব্যাহত আগমন : ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসন প্রবর্তিত হবার পর প্যালেস্টাইন সমস্যা এক নতুন রূপ নেয়। ব্রিটিশ সরকার এই সমস্যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়ে। ইহুদিদের আগমন অব্যাহত থাকে। প্রথম সংঘবদ্ধ আগমন (আলিয়া) ম্যান্ডেটরি শাসনের পূর্বে ঘটিলেও বাকি চারিটি আলিয়া ব্রিটিশ শাসনামলেই ঘটে। পঞ্চম এবং শেষ আলিয়াতেই সর্বাপেক্ষা বেশি সংখ্যক ইহুদি প্যালেস্টাইনে প্রবেশ করে। নিম্নের পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে : 

  • প্রথম আলিয়া (১৮৮২-১৯০৩) – আগত ইহুদি ৩০,০০০ জন
  • দ্বিতীয় আলিয়া (১৯০৪-১৯১৪) – আগত ইহুদি ৪০,০০০ জন
  • তৃতীয় আলিয়া (১৯১৯-১৯২৩) – আগত ইহুদি ৩৫,০০০ জন
  • চতুর্থ আলিয়া (১৯২৪-১৯৩১) – আগত ইহুদি ৮২,০০০ জন
  • পঞ্চম আলিয়া (১৯৩২-১৯৪৮) – আগত ইহুদি ৩০০,০০০ জন (S. N. Eiesnstadt, Israeali Society (London: Weidenfeld and Ncolson, 1967). P. 11)

ইহুদিদের কর্মপন্থা ও সংগঠন : শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অসম দুটি সম্প্রদায়ের ওপর ব্রিটিশ সরকার তাদের ম্যান্ডেটরি শাসন প্রতিষ্ঠা করে। প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ সরকারের নীতি অনুধাবন করতে হলে ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতাদের জায়নবাদী মনােভাব ছাড়াও এই দুই সম্প্রদায়ের সংগঠন কর্মপন্থা ও নেতৃত্ব ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা প্রয়ােজন। জায়নবাদী মূলত আশকেনাজী ইহুদিদের আন্দোলন। জার্মানি ও পূর্ব ইউরােপীয় দেশসমূহের উচ্চ শিক্ষিত এইসব ইহুদি আধুনিক জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে ভালােভাবে জ্ঞাত ছিলেন। সমষ্টিগত যেকোনাে কাজের সাফল্য যে সংগঠনের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল সেই ধারণা তাদের ছিল। জায়নবাদী আন্দোলনের প্রথম থেকেই তাই উপযুক্ত সংগঠন সৃষ্টি করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। 

  • ১. মাটির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইহুদিগণ সমবায়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের কৃষি খামার গড়ে তােলে। সদস্যসংখ্যা, জমির পরিমাণ ও কতখানি সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করা হয়েছে তার ভিত্তিতে ‘মােশাভ’ ‘কাভূৎজ’ ও ‘কিবুজ’ স্থাপন করা হয়। সুসংগঠিত এই খামারগুলোতে যৌথ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও যৌথ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ ইহুদিদের মধ্যে একতার ভাব বৃদ্ধি করে।
  • ২, প্রতিবেশীদের প্রধানত আরবদের আক্রমণ থেকে যৌথ খামারগুলো রক্ষা করার জন্য জায়নবাদীগণ নিজেদের মধ্য থেকে রক্ষী দল গড়ে তােলে। ‘হাসােমার’ নামে পরিচিত এই দল খামারগুলোর নিরাপত্তা বিধানে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করে। পরবর্তীকালে এটাই ‘হাগানা’ নাম নিয়ে ইহুদি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
  • ৩, শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য ২০শ শতকের প্রথমদিক থেকেই একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়। ‘কুপাত পােয়ালাই এরেৎজ ইসরায়েল’ নামে পরিচিত এই তহবিল থেকে শ্রমিকদের কল্যাণমূলক প্রকল্পাদি গ্রহণ করা হত।
  • ৪. শ্রমিকদের চাকুরি নিশ্চিত করার জন্য এবং চাকুরি সম্পর্কিত তথ্য প্রদানের জন্য ১৯১৩ সালে ‘চাকুরি বিনিয়ােগ কেন্দ্র’ (মিশরাদ হা-ভদা) প্রতিষ্ঠিত হয়।। 
  • ৫. বিভিন্ন শিল্পে নিয়ােজিত শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার জন্য ১৮১৩ সালে ‘প্যালেস্টাইন সংযুক্ত শ্রমিক সংস্থা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। 
  • ৬. সুপরিকল্পিতভাবে প্যালেস্টাইনে জমি ক্রয় করার জন্য ‘ইহুদি জাতীয় তহবিল’ এবং ‘প্যালেস্টাইন গঠন তহবিল’ ছাড়াও ‘জমি ক্রয় সম্পর্কিত সংস্থা’ (হেভারাত হাসারাত হা-ইশুভ’) বা Anglo Palestine Bank প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • ৭, প্রতিটি ইহুদি বসতিতে অত্যাধুনিক শিক্ষা কেন্দ্র, চিকিৎসালয়, অবসর বিনােদন কেন্দ্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম থেকেই ইহুদি বসতিগুলো প্রগতি ও আধুনিকতার ধারক হিসেবে চিহ্নিত হয়। সাংস্কৃতিক ঐক্য স্থাপন করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ইহুদিদের ভাষার ওপর জোর না দিয়ে প্রাচীন হিব্রু ভাষাকে শিক্ষা ও অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়। মৃতপ্রায় একটি ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ সাধ্য নয়, তা সত্ত্বেও জায়নবাদীদের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে এই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। 
  • ৮. ১৯২০ সালে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন (হিস্‌টাদ্রুত) প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রমে এই ইউনিয়ন প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের এবং পরবর্তীকালে ইসরায়েলের অর্থনৈতিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সাধারণ অর্থে ট্রেড ইউনিয়ন বলতে যা বােঝায় ‘হিস্তাদ্রুত’ তা থেকে আলাদা। শুধু শ্রমিকেরাই যে এর সদস্য হতে পারে তা নয়; এর সংবিধান অনুযায়ী যে কেউ জীবিকার জন্য অন্যের শ্রমের ওপর নির্ভর না করে নিজে পরিশ্রম করে, সেই হিস্তাদ্রুতের সদস্য হবার উপযুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই কৃষিশ্রমিক ও কল-কারখানার শ্রমিক ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিয়ােজিত ব্যক্তিবর্গ এর সদস্য। এদের মধ্যে সকল শ্রেণীর সরকারি ও বেসরকারি, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, লেখক, গায়ক, শিক্ষক ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। এটি সদস্যদের স্বাস্থ্যবিমা, বাসস্থানের সুযােগ-সুবিধা, বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও আরও নানা প্রকারের সুযােগ-সুবিধা দান করে। শ্রমিকদের নিযুক্তি ও তাদের সুযােগ-সুবিধার ব্যাপারে হিস্তাদ্রুত দর কষাকষি সংস্থা হিসেবে কাজ করে। এর ব্যবস্থাপনায় ‘বহু ব্যবহারকারীদের সমবায়’ (হামাশবির), সমবায় বাজার (তেনুভা) ও বহু কল-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘সােলেল বােনেহ’ নামে পরিচিত এর একাংশ রাস্তা-ঘাট ও দালান-কোঠা নির্মাণের ঠিকাদারি কার্যে নিয়ােজিত। এর আর একটি অংশ ‘জিম’ নামে পরিচিত এবং জাহাজ চলাচলের বা সামুদ্রিক পরিবহণের সামগ্রিক দায়িত্ব এর ওপর ন্যস্ত।
  • ৯. ইহুদি বসতিগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সংস্থা গড়ে উঠলেও সমগ্র প্যালস্টাইনে ইহুদিদের কার্যকলাপ সমন্বিত করার জন্য কোনাে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী কর্তৃক প্যালেস্টাইনের কিয়দংশ বিজিত হলে সেই অংশেই ইহুদিগণ একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সংসদ’ (ভাআদ হায্মা‌নী) প্রতিষ্ঠা করে। পরে সমগ্র প্যালেস্টাইন অধিকৃত হলে এবং ১৯১৮ সালে ওয়াইজম্যানের নেতৃত্বে একটি জায়নবাদী ইহুদিদের ‘জাতীয় সংসদ’ (ভাআদ লিউমী) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম থেকেই এই সংস্থা প্যালেস্টাইনে ইহুদি সমাজের সংসদ হিসেবে কাজ করতে থাকে। 

আরব সমাজের পশ্চাদপদতা : তুলনামূলকভাবে আরব-সমাজ মধ্যযুগীয়, সামন্ততান্ত্রিক এবং সকল দিক থেকেই পশ্চাৎপদ। মধ্যপ্রাচ্যে – সাধারণভাবে প্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতাে প্যালেস্টাইনেও মধ্যযুগীয় ভূমি ব্যবস্থ্য বিদ্যমান থাকায় অধিকাংশ কৃষকই ছিল ভাগ-চাষি। দারিদ্র ও সামাজিক অচলায়তন তাদের জীবনকে সঙ্কুচিত করে রেখেছিল। শহরে বসবাসকারী জামিদারবৃন্দ নিজেদের স্বার্থ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত লােকেরাও শহরে গিয়ে বাস করতে থাকে। ফলে শহরবাসী ও গ্রামীণ লােকদের মধ্যে দূরত্ব ব্যবধান সৃষ্টি হয়। সমস্ত সমাজকে এক সূত্রে গ্রথিত করার মতাে সংস্থা গড়ে ওঠেনি। ব্যাপক অক্ষরজ্ঞানহীনতা আরব সমাজের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ছিল। আধুনিক ভাবধারার সাথে পরিচয়ের অভাবের কারণে সমাজ সংগঠনের মৌলিক সূত্রগুলোর সাথে তাদের পরিচয় ঘটেনি – অন্তত আধুনিক সূত্রগুলোর সাথে তাে নয়ই। প্যালেস্টাইনের মুসলিম আরব জনসাধারণের শিক্ষায় অনগ্রসরতার বড় প্রমাণ এই যে, সংখ্যায় তারা প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টান আরবদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হলেও তাদের মধ্যে মােট শিক্ষিতের সংখ্যা ও বিদ্যালয়ের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। নিচের পরিসংখ্যান থেকে এই সত্যটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে :

  • ১৯২১-২২ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ৪২টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৩৯টি; মুসলিম শিক্ষক ১১৪ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ৬৮৮ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ২,২৮৭ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১১,৯৫২ জন।
  • ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ৩৮টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৭২টি; মুসলিম শিক্ষক ১১২ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ৭৮৬ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ২,৪৭৭ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৩,৩৪৮ জন।
  • ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ৪৭টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৭৯টি; মুসলিম শিক্ষক ১৩১ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ৮৪৩ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ৩,০৪৪ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৪,৩২৮ জন।
  • ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ৫০টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৮৪টি; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ৩,৫৬৫ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৫,৩২১ জন।
  • ১৯২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ৪৫টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৮৩টি; মুসলিম শিক্ষক ১৪০ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ৮৬৬ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ৩,৪৪৫ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৪,৩৮৫ জন।
  • ১৯২৬-২৭ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ৫৩টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৯২টি; মুসলিম শিক্ষক ১৮৪ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ১,০০৪ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ৪,৫২২ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৪,৯১৯ জন।
  • ১৯২৭-২৮ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ৭৩টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৯১টি; মুসলিম শিক্ষক ১৮১ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ৯৯৭ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ৪,৫২৫ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৩,৫৯৭ জন।
  • ১৯২৮-২৯ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ৭৫টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৬২টি; মুসলিম শিক্ষক ১৯৫ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ১,০২৩ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ৪,৭১৯ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৪,০৯৬ জন।
  • ১৯২৯-৩০ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ৯৪টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৪৯টি; মুসলিম শিক্ষক ২৩৭ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ১,০২১ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ৫,৬৪৪ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৪,১২৪ জন।
  • ১৯৩০-৩১ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ১৩৭টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৮১টি; মুসলিম শিক্ষক ২৭১ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ১,০৯১ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ৭,২৪৩ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৪,৩৬০ জন।
  • ১৯৩১-৩২ শিক্ষাবর্ষ – মুসলিম বিদ্যালয় ১৫৭টি, খ্রিস্টান বিদ্যালয় ১৫১টি; মুসলিম শিক্ষক ৩৩০ জন, খ্রিস্টান শিক্ষক ১,০৬১ জন; মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ৯,১২৭ জন, খ্রিস্টান ছাত্র সংখ্যা ১৪,১০০ জন। (Y. Porath The Emergence of the Palestinian-Arab National Movement. 1918-1927 (London : Frank Cass 1974.) p. 21)

শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসরতার ফলে প্যালেস্টাইনের আরব অধিবাসীদের মধ্যে আধুনিক ভাবধারা বিস্তার লাভ করেনি, ক্রমবর্ধমান হারে জায়নবাদীদের প্যালেস্টাইনে আগমনের ফলে শঙ্কিত হয়ে আরবগণ আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষার দিকে পা বাড়ালেও তাদের অগ্রগতি ছিল অত্যন্ত মন্থর। প্রতিবেশী খ্রিস্টানদের তুলনায়ই তারা পশ্চাৎপদ ছিল; বিভিন্ন ইউরােপীয় দেশ থেকে আগত শিক্ষিত ও প্রযুক্তি বিদ্যার অধিকারী জায়নবাদীদের সাথে তুলনায় তারা ছিল মধ্যযুগীয়। 

আরব ও ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের গুণগত পার্থক্য : সমাজ সংগঠনে নেতৃত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আরব ও ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের মধ্যে বিরাট গুণগত পার্থক্য ছিল। প্যালেস্টাইন সমস্যার বিবর্তনে এই পার্থক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে –

  • জায়নবাদী আন্দোলনে এবং প্যালেস্টাইনে ইহুদি সমাজ গড়ে তোলার ব্যাপারে নেতৃত্বদান করে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরােপীয় দেশগুলো থেকে আগত আশকেনাজী ইহুদিগণ। নেতৃত্বদানকারী প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। আধুনিক সমাজের সমস্যাবলী সম্পর্কে তারা পুরাপুরি জ্ঞাত ছিলেন। যুক্তি ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়ােগে সমাজের সমস্যা সমাধান করার মতাে যােগ্যতা ও মনােভাব তাদের ছিল। প্যালেস্টাইনকে একটি প্রগতিশীল ইহুদি রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য প্রথম থেকেই সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করার মতাে দুরদৃষ্টি তাদের ছিল। অধিক সংখ্যক ইহুদি প্যালেস্টাইনে আগমন করার পূর্বে ডক্টর আর্থার রূপিনের মতো অর্থনীতিবিদের সহায়তায় দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক জরিপ চালান হয়। দেশের সেচ ব্যবস্থা কিভাবে উন্নত করা যায়, সেই সম্বন্ধেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ইহুদি নেতৃবৃন্দের অনেকেই পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কৃতি ছাত্র ছিলেন। যেকোনাে আন্তর্জাতিক সমস্যা অনুধাবন করার এবং যেকোনাে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নিজেদের সমস্যা যােগ্যতার সাথে উপস্থাপিত করার ক্ষমতা তাদের ছিল। এই প্রসঙ্গে বহু ভাষাবিদ ইহুদি নেতা মােশে শারেট ও আবা ইবানের নাম উল্লেখযােগ্য।
  • সামন্ততান্ত্রিক আরব সমাজে সামন্তগণই নেতৃত্বদান করে। আধুনিক শিক্ষা ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এই সামন্তগণ মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণারই ধারক ও বাহক ছিল। আরব সমাজের রাজনৈতিক সংগঠন ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ফলে নেতৃবৃন্দের মধ্যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। এই প্রসঙ্গে হুসাইনি ও নাশাশিবী বংশের মধ্যে জেরুজালেম শহরের নেতৃত্বের প্রশ্নে বিরােধ উল্লেখ্য। আন্তঃআরব সম্পর্কের প্রশ্নেও প্যালেস্টাইন নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিরােধ প্যালেস্টাইন আরবদের ঐক্যের পক্ষে বাধা সৃষ্টি করে। প্যালেস্টাইন সিরিয়ার অংশ মাত্র নাকি এর পৃথক কোনাে সত্তা আছে – এই প্রশ্নে প্যালেস্টাইনের নেতৃবৃন্দ একমত হতে পারেননি।
  • তৃতীয়ত আরব নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি উল্লেখযােগ্য অংশের চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল না। জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটি প্রশ্নকে বিবেচনা না করে অনেক সময় ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রেক্ষিতে বিচার করা হয়েছে। জেরুজালেম শহরের মেয়রের পদ লাভ করার জন্য নাশাশিবী বংশ ব্রিটিশের সমস্ত কার্যকলাপের সমর্থন করেছে। সুবিখ্যাত হুসাইনি বংশের সম্মানিত সদস্য ও এককালে জেরুজালেম শহরের মেয়র মুসা কাজিম আল-হুসাইনি সামান্য সুযােগ-সুবিধার বিনিময়ে ফিলিস্তিনি আরবদের স্বার্থ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। এই কথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, জায়নবাদী কার্যকরী সংসদের সদস্য এইচ. এম. কাভারিস্কির কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণের পর থেকেই তিনি জায়নবাদীদের সাথে সমঝােতা স্থাপনের প্রয়ােজনীয়তার কথা বলতে শুরু করেন। (জায়নবাদী কার্যকরী সংসদকে লিখিত কালভারিস্কির পত্র, Zionist Archives, S/25, 4380, July 18, 1923)।
  • চতুর্থত আরব নেতৃবৃন্দের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক ছিলেন ধর্মীয় নেতা। এদের মধ্যে পরবর্তীকালে জেরুজালেমের মুখ্য মুফতি হিসেবে আখ্যায়িত আমিন আল-হুসাইনি ও কামাল আল-কাসাবের নাম উল্লেখযােগ্য। ধর্মের নামে জনসাধারণকে উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা থাকলেও আধুনিক সমাজের সমস্যা সম্বন্ধে তাদের ধারণা ছিল যেমন অগভীর, সেই সমস্যা সমাধানের উপায সম্বন্ধে তাদের পদ্ধতিও ছিল মধ্যযুগীয়।

ম্যান্ডেট শাসন ও ফিলিস্তিনে দেশ-বিভাগ

ম্যান্ডেট শাসনে ইহুদিদের ক্ষমতাবৃদ্ধি : অটোমান সৈন্যদের বিতাড়নের পর থেকেই প্যালেস্টাইনে ব্রিটেনের সামরিক বাহিনী অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত করে। লীগ অব নেশনস ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৯ তারিখে ফিলিস্তিনের ওপর ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসন অনুমােদন করে। অনুমােদন পত্রেই বলা হয় যে, ব্যালফোর ঘােষণাকে বাস্তবায়িত করা ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের অন্যতম কর্তব্য। তবে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করার পর থেকেই (১৯১৮) ব্রিটেন ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের মতো ব্যবহার করতে থাকে, এবং তখন থেকেই ইহুদিদের নানা প্রকার সুযােগ সুবিধা দেয়া হতে থাকে। ফিলিস্তিন ম্যান্ডেট সংক্রান্ত দলিলের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছিল যে, ইহুদিদের স্বার্থের সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী ইহুদি সংস্থার সাথে আলাপ আলােচনার মাধ্যমে সম্পাদন করতে হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যান্ডেট ব্যবস্থা চালু হবার পূর্বেই আন্তর্জাতিক জায়নবাদী সংস্থার এক প্রতিনিধিদল ফিলিস্তিনে আগমন করে এবং ব্রিটিশ সামরিক প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়। ব্যালফোর ঘােষণায় ফিলিস্তিন তাদের হাতে প্রদান করা হয়েছে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা ফিলিস্তিনি আরব এমন কি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার শুরু করে। এতদিন নিরীহভাবে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি ইহুদিগণও তাদের সাথে যােগ দেয়। যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবদের সাথে এতদিন তারা অনুগত নাগরিক হিসেবে বাস করত, এখন থেকে তারা দেশের সর্বময় কর্তৃত্বের দাবিদারের মতো ব্যবহার করতে শুরু করল। ১৯১৯ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি লুই ব্ৰাণ্ডাইস ফিলিস্তিনে আগমন করেন। একজন প্রখ্যাত জায়নবাদী নেতা হিসেবে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্বার্থ তদারক করাই ছিল তার সফরের উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ সামরিক প্রশাসনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল লুই বােলস-এর কাছে দাবি করেন যে, সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত যেকোনাে সিদ্ধান্ত ও অধ্যাদেশ কার্যকরী করার পূর্বে জায়নবাদী সংস্থার অনুমােদন লাভ করতে হবে। এই অস্বাভাবিক অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করা হলে ব্রান্ডাইস মন্তব্য করেন যে, বিষয়টি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গােচরীভূত করা হবে। (Joseph M. N. Jeffries, Palestine the Reality (New York : Longmens, Green and C)., 1939.) P. 314)। হিব্রু ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসাব স্বীকৃতি দান, মুদ্রা ও অন্যান্য সরকারি দলিলপত্রে হিব্রু ভাষা ব্যবহার ছাড়াও, “এরেৎজ ইসরায়েল” (ইসরায়েল রাষ্ট্র) শব্দ ব্যবহার, জায়নবাদী সংস্থার সদস্যদের বিনা ভাড়ায় রেল ভ্রমণের সুযােগ – এই ধরনের বহু দাবি দাওয়া জায়নবাদী সংস্থা পেশ করে। এবং এদের অনেকগুলো গৃহীত হয়। এই সমস্ত দাবি দাওয়ার কিছু কিছু গ্রহণও ন্যায়সঙ্গত কিনা সেই ব্যাপারে সামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার কর্মকর্তাদের মনে সন্দেহ ছিল। তার ওপর জায়নবাদী নেতৃবৃন্দ ব্রিটেন ও আমেরিকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে সামরিক প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়ােগ অব্যাহত রাখে। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে জেনারেল বােল্স পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লিখিত এক প্রতিবেদনে অভিযােগ করেন : “My own authority and that of every department of my Administration is claimed or impinged upon by the Zionist Commission, and I am definitely of the opinion that this state of affairs cannot continue without great denger to the public peace and to the prejudice of my administration.” (Nevill Barbour. Nisi Dominus (London: George G. Harrap & Co., 1946.) P-97)।

ব্রিটিশ সরকারের সুস্পষ্ট নীতির অভাব : ফিলিস্তিন সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের সুস্পষ্ট নীতির অভাব ছিল। ব্যালফোর ঘােষণার অস্পষ্টতা ছাড়াও ইহুদিদের আবাসভূমির পরিধি সম্বন্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কোনাে ধারণা ছিল না। জায়নবাদীদের দাবি যে প্যালেস্টাইন সীমানার বাহিরেও পরিব্যপ্ত ছিল সেই সম্বন্ধে অনেকেই জ্ঞাত ছিলেন না। ১৯১৯ সালে প্যারিসে শান্তি সম্মেলনে জায়নবাদীগণ যে স্মারকলিপি পেশ করেন তাতে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের পূর্ণ সীমানা বিস্তারিতভাবে দেয়া হয়। এই সীমানার মধ্যে পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শাসনাধীন সমগ্র ফিলিস্তিন ছাড়াও

  • (ক) হারমন পর্বতে জর্দান নদীর উৎপত্তিস্থল এবং লিনী নদীর দক্ষিণ অংশসহ দক্ষিণ লেবানন;
  • (খ) ইয়ারমুক নদী, কনেত্রা শহর ও গােলান উচ্চভূমিসহ দক্ষিণ-পশ্চিম সিরিয়া;
  • (গ) জর্দান উপত্যকা ডেডসী এবং আম্মানের পশ্চিম অঞ্চল থেকে আকাবা পর্যন্ত ভূভাগ এবং
  • (ঘ) আল-আরিশ থেকে আকাবা উপসাগর পর্যন্ত এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। (Ben Halpern, the Idea of the Jewish state (Cambridge, Mass : Harvard University Press, 1961, pp, 303-304))।

জায়নবাদীদের স্বার্থ এবং আরবদের স্বার্থ পরস্পরের পরিপূরক ছিল না। জায়নবাদীদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অর্থ যে আরবদের সীমাহীন দুর্গতি তা আরবেরা ভালােভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাই প্রথম থেকেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়। সমস্ত ম্যান্ডেট শাসনকাল এই ধরনের সংঘাতে পূর্ণ। যখনই কোনাে সংঘাত শুরু হয়েছে, তখনই ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত পরিষদ গঠন করেছে, আবার সঙ্কট কেটে গেলে তদন্ত পরিষদের প্রস্তাবাবলীর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়েছে। ১৯২০ সালে দুই সম্প্রদায়ের সংঘর্ষের পর পালিন কমিশন, ১৯২১ সালে হেক্রাফট কমিশন, ১৯২৯ সালে ‘অশ্রু প্রকারের’ সংঘর্ষের পর ১৯৩০ সালে শ’ কমিশন, ১৯৩৬ সালে পীল কমিশন ও ১৯৩৮ সালে উডহেড কমিশন গঠিত হয়। 

‘অশ্রু প্রাকারের’ সংঘর্ষ : ১৯২৯ সালের ‘অশ্রু প্রাকারের’ সংঘর্ষ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মসজিদ উল আকসা সংলগ্ন প্রাকারটিকে সােলায়মানের মন্দিরের ভগ্নাবশেষ মনে করে একটি বিশেষ দিনে ইহুদি নর-নারী নিজেদের পূর্ব ইতিহাস স্মরণ করে প্রাকারের অশ্রু বিসর্জন করেন। এই ধর্মীয় কাজে আরবগণ বাধা দান করেনি। কিন্তু ১৯২৯ সালের এইদিনে ইহুদিগণ এর পাশে বসার ব্যবস্থা করে। এই এলাকার ওপর নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইহুদিদের এটা একটি সূক্ষা ব্যবস্থা মনে করে আরবগণ প্রতিবাদ করে এবং পরিণামে সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সংঘর্ষে ১৩৩ জন ইহুদি এবং ১১৬ জন আরব নিহত হয়। 

নাৎসিদের ইহুদি দমন ও আরবদের বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়া ও ব্রিটিশদের সহায়তা : ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর “আর্যেতর জাতিসমূহের” বিরুদ্ধে যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তার ফলে দলে দলে ইহুদি সেই দেশ ত্যাগ করে ইউরােপের বিভিন্ন দেশ ও ফিলিস্তিনে আসতে থাকে। ক্রমবর্ধমান হারে ইহুদিদের আগমনের ফলে আরবদের ধূমায়িত অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও আরব জনসাধারণ ১৯৩৬ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। এই সময় ফিলিস্তিনি আরবগণ ছয়টি দলে বিভক্ত ছিল; জামাল আল-হুসাইনির নেতৃত্বে ‘ফিলিস্তিনী আরব দল’, রাগীব নাশাশিবীর নেতৃত্বে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা দল’, ডঃ খালিদীর নেতৃত্বে ‘সংস্কার দল’, আবদুল লতিফ বে সালিহ-এর নেতৃত্বে ‘জাতীয় দল’, ইয়াকুব গুসাইনের নেতৃত্বে ‘জাতীয়তাবাদী যুব কংগ্রেস’ এবং আউনী আবদুল হাদীর নেতৃত্বে ‘স্বাধীনতা দল’। যাই হোক, ১৯৩৬ সালের সংগ্রামে আরবদের একাধিক শত্রুর মােকাবিলা করতে হয়। ইহুদিগণ ইতােমধ্যে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে তাদের বসতিগুলোতে প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে। অরডি উইংগেটের মতো কিছুসংখ্যক ব্রিটিশ সামরিক অফিসার প্রকাশ্যভাবে ইহুদিদের সাথে যােগ দিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে তােলে। তাদের কৌশলগত দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে আরবদের বিদ্রোহ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করে। জায়নবাদীদের চাপের মুখে বার বার আরবদের ন্যায়সঙ্গত দাবি প্রত্যাখ্যাত হবার পর বিদ্রোহ করা ছাড়া আরবদের সম্মুখে অন্য কোনাে পথ ছিল না।

ইহুদিদের ফিলিস্তিনে প্রবেশের পক্ষে শ’ কমিশন, ও তার বিরুদ্ধে প্যাসফিল্ড শ্বেতপত্র ও শেষে নতি স্বীকার : ১৯৩০ সালের শ’ কমিশনের প্রস্তাবের আলােকে স্যার জন হােপসিম্পসনের প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বিরাজমান পরিস্থিতিতে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে প্রবেশ করার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। এই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ‘প্যাসফিল্ড শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করে। ম্যান্ডেট ব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য ইহুদিদের জন্য আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা এবং ইহুদি নয় ফিলিস্তিনের এই শ্রেণীর অধিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সরকারের দায়িত্ব নয় বলে যে প্রচারণা করা হয়, তা খণ্ডন করে শ্বেতপত্রে বলা হয় : “This is a conception which His Majesty’s Government have always regarded as tatally erroneous” (British White Paper, Command, 3692.)। চার্চিল এ্যামেরী, বলডুইন ও অস্টেন চেম্বারলেনের মতো ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের সমর্থনে জায়নবাদীরা এই শ্বেতপত্রের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন চালায়। ফলে প্রধানমন্ত্রী র‍্যামজে ম্যাকডােনাল্ড নতি স্বীকার করে এক পত্রে ওয়াইজম্যানকে জানিয়ে দেন যে, ইহুদিগণ বিনা বাধায় ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে পারবে। ১৯৩৫ সালে ফিলিস্তিনি আরব নেতৃবৃন্দ অন্যান্য আরব দেশের মতো নির্বাচিত সংসদের দাবি করলে পুনরায় ইহুদিদের চাপের মুখে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ইহুদিদের মধ্য থেকে প্রায় তিন হাজার ‘স্বেচ্ছা সেবক’ নিয়ােগ করা ছাড়াও ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ সৈন্যের সংখ্যা প্রায় ২০,০০০ এ উন্নীত করা হয়। ফলে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি আরব দেশ থেকে কিছুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক এলেও এই সংঘর্ষে আরবদের প্রভূত ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মাত্র ৮০ জন ইহুদি ও ২৮ জন ব্রিটিশ সৈন্য এই সংঘর্ষে নিহত হয়; অপরপক্ষে আরবদের পক্ষে নিহতের সংখ্যা আট শতাধিক।

১৯৩৬ সালের পীল কমিশন এবং ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণ ও দেশ-বিভক্তির প্রস্তাব : এই গােলযােগের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। লর্ড পীলের নেতৃত্বে গঠিত এই রাজকীয় কমিশন যখন ফিলিস্তিনে আগমন করে তখনও আরবদের সংগ্রাম চলছিল। আরবগণ কমিশনের সাথে সহযােগিতা করেনি। তবে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে কমিশনকে বেগ পেতে হয়নি। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত এই কমিশনের রিপাের্ট এই ব্যাপারে প্রকাশিত রিপাের্টসমুহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ব্যাপকভিত্তিক, বিশ্লেষণধর্মী এবং নিরপেক্ষ রিপাের্টে বলা হয় যে, ইহুদি ও আরবদের নিকট দেয়া প্রতিশ্রুতি পরস্পর-বিরােধী এবং সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতির ভিত্তিতে ম্যান্ডেট ব্যবস্থা চলতে পারে না। ম্যান্ডেট ব্যবস্থা যদি চালু রাখতেই হয় তবে দেশের কোনাে কোনাে অঞ্চলে ইহুদিগণ কর্তৃক জমি ক্রয় বন্ধ করার ক্ষমতা হাইকমিশনারের কাছে থাকতে হবে, ইহুদিদের আগমন নিয়ন্ত্রিত করতে হবে এবং আগামী পাঁচ বছরের জন্য বাৎসরিক বার হাজারের বেশি ইহুদি আগমন করতে পারবে না। এই ব্যবস্থা সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয় মনে করে কমিশন এই সমস্যা ফিলিস্তিনের বিভক্তির মাধ্যমেই মাত্র সমাধান করা সম্ভব বলে মন্তব্য করে এবং একটি ইহুদি-প্রধান রাষ্ট্র, একটি আরব-প্রধান রাষ্ট্র ও জাফা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত এলাকা ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের অধীনে রাখার প্রস্তাব করে। আন্তর্জাতিক জায়নবাদী সম্মেলন সংস্থার কার্যকরী সংসদকে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের পরিসীমা সম্বন্ধে আলােচনা করার ক্ষমতা প্রদান করে। 

ফিলিস্তিনে দেশ-ভাগের প্রস্তাবে ইহুদি ও আরবদের প্রতিক্রিয়া : দক্ষিণ ফিলিস্তিন প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় অনেক জায়নবাদী ক্ষুব্ধ হয়। তা সত্ত্বেও ডক্টর ওয়াইজম্যান এই প্রস্তাব গ্রহণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, “দক্ষিণ ফিলিস্তিন তাে পালিয়ে যাবে না” (Neoill Barbour, op. cit., p. 184.)। আরব নেতৃবৃন্দ দেশ বিভক্তির এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে অনতিবিলম্বে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও ইহুদি আগমন এবং ভূমি ক্রয় বন্ধের দাবি করেন। গ্যালিলির জেলা প্রশাসককে দেশ বিভক্তি পরিকল্পনার অন্যতম উদ্যোক্তা মনে করে আরব সন্ত্রাসবাদীগণ তাকে হত্যা করে। ফলে সর্বোচ্চ মুসলিম পরিষদের সভাপতির পদ থেকে আমিন আল-হুসাইনিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। আরব উচ্চতর পরিষদ’ও ভেঙ্গে দেয়া হয়। আরব সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা পুনরায় শুরু হয়; ইহুদিগণও এই ধরনের তৎপরতায় লিপ্ত হয়। ত্রিমুখী সংঘর্ষ এবং রক্তপাত ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ৬৯ জন ব্রিটিশ, ৯২ জন ইহুদি এবং ১,৬২৪ জন আরব নিহত হয়। তার ওপর শতাধিক আরবকে বিদ্রোহের অভিযােগে বন্দী করা হয় এবং সামরিক বিচারের পর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। 

দেশ-ভাগের প্রস্তাবের ভিত্তিতে উডহেড কমিশন, বিভক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে ম্যান্ডেটের অধীনে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব : পীল কমিশন কর্তৃক বিভক্তি প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে উডহেড কমিশন নিয়ােগ করা হয়। দেশ বিভক্তির খুঁটিনাটি পর্যালােচনা করে প্রস্তাবটির সহজ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ করাই ছিল এই কমিশনের কাজ। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তের পর কমিশন দেশ বিভক্তির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে। কয়েকটি কারণে কমিশন প্রস্তাবটির বিরােধিতা করে – প্রথমত প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রকে একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়ােজনীয় ন্যূনতম এলাকা দিলেও এর ভেতরে অতি বৃহৎ আরব সম্প্রদায় ও আরবদের কমলা বাগানের বৃহত্তম অংশ পড়ে। দ্বিতীয়ত প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় থাকবে। উডহেড কমিশনের বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয় যে দুটি এলাকা স্বায়ত্তশাসন লাভ করবে এবং ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে দুটি এলাকার মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ফিলিস্তিনে ইহুদি-প্রবেশের  জন্য দাবি, বিদ্রোহ, ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ ও ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের দুরবস্থা ও জায়োনবাদীদের ফিলিস্তিনে ইহুদিদের প্রবেশ করানোর জন্য দাবি ও বিদ্রোহ : দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে জায়নবাদী নেতৃবৃন্দ তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য মিত্রশক্তির সাথে সহযােগিতার নীতি গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে শ্বেতপত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাবার নীতি গৃহীত হয়। ব্রিটেনে চার্চিলের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকার জায়নবাদীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হলেও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষত মিশরে জার্মান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আরবদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। জার্মানি ও পূর্ব ইউরােপীয় দেশগুলোতে ইহুদিদের দুরবস্থা ও অপরদিকে ফিলিস্তিনে ইহুদি প্রবেশের ওপর বিধি-নিষেধ আরােপের ফলে জায়নবাদীদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৪২ সালের মে মাসে নিউইয়র্কে আমেরিকার জায়নবাদীদের সম্মেলনে এই মনােভাব প্রকাশ পায়। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলীর মধ্যে অনতিবিলম্বে সমগ্র ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, একটি ইহুদি সেনাবাহিনী গঠন, ১৯৩৯ সালের শ্বেতপত্র বাতিলকরণ এবং ফিলিস্তিনে ইহুদি আগমন সংক্রান্ত দায়িত্ব ইহুদি পর্ষদের ওপর ন্যস্তকরণ উল্লেখযােগ্য। নিউ ইয়র্কের বিল্টমাের হােটেলে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বলে এই প্রস্তাবাবলী “বিল্টমাের কর্মসূচি” নামে রচিত। জায়নবাদীগণ সংঘবদ্ধভাবে পূর্ব ইউরােপের দেশগুলোতে দুর্দশাগ্রস্ত ইহুদিদের অবৈধভাবে ফিলিস্তিনে আনয়নের প্রয়াস পায়। শ্বেতপত্রে নির্ধারিত সংখ্যা অপেক্ষা অনেক বেশি সংখ্যক ইহুদিকে জাহাজে করে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করান হয়। ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষ এই অবৈধ লােক পাচার বন্ধ করার চেষ্টা করলে জায়নবাদীগণ অতি নাটকীয়তার সাথে কয়েকটি যাত্রীবাহী জাহাজ নিজেরাই সমুদ্রবক্ষে নিমজ্জিত করে তাদের আন্দোলনের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস পায়। ঘটনাটি পেট্রিয়া ডিজাস্টার নামে পরিচিত। ১৯৪০ সালে নাৎসি জার্মানি থেকে উদ্বাস্তু ইহুদিদের নিয়ে আসা ফ্রেঞ্চ-নির্মিত ওশিন লাইনার জাহাজ পেট্রিয়া এসএস-কে জিউইশ প্যারামিলিটারি অর্গানাইজেশন হাগানা ডুবিয়ে দিয়েছিল। এর ফলে ২৬৭ জন যাত্রী মারা যায় ও ১৭২ জন যাত্রী আহত হয়।

জায়নবাদীদের সন্ত্রাসবাদী নীতি ও চার্চিলের বিরোধিতা : এর কিছু পূর্ব থেকেই জায়নবাদীদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ নীতি হিসেবে গৃহীত হয়। জাবোটিন্‌স্কির নেতৃত্বে একদল জায়নবাদী ট্রান্সজর্দানকেও ব্যালফোর ঘােষণার আওতায় আনার জন্য আন্দোলন শুরু করে। শক্তিতে বিশ্বাসী এই দল ‘সংশােধনবাদী? (Revisionsts) নামে পরিচিত। মেনাহেম বেগিনের নেতৃত্বে অন্য একটি সন্ত্রাসবাদী দল ‘ইরগুন ভাই লিউমি’ (Ergun Zvai Leumi) বা সংক্ষেপে ‘ইরগুন’ নামে পরিচিত। পােল্যাণ্ড থেকে আগত ইহুদি আব্রাহম স্টার্নের নেতৃত্বে আর একটি দল ‘স্টার্নের বেপরােয়া দল’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এছাড়া ইহুদি সম্প্রদায়ের আত্মরক্ষামূলক আধা-সামরিক বাহিনী হাগানা – ক্রমে একটি আক্রমণাত্মক বাহিনীতে পরিণত হয়। ‘বিল্টমাের কর্মসূচিকে’ বাস্তবায়িত করার জন্য ১৯৪৩ সাল থেকেই এই দলগুলো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা শুরু করে। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার হ্যারল্ড ম্যাকমাইকেলের জীবন নাশের চেষ্টা করা হয়; অল্পের জন্য তিনি রক্ষা পান। ঐ বছর নভেম্বর মাসের কায়রােয় অবস্থানরত মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ ব্রিটিশ প্রতিনিধি লর্ড মােনকে (Lord Moyne) হত্যা করা হয়। ১৯৪৪ সালের নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখে কমন্স সভায় এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মন্তব্য করেন যে, মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা ইহুদিদের দাবি-দাওয়া সমর্থন করা সত্ত্বেও জায়নবাদীগণ যে ধরনের সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছে তা নাৎসী বর্বরতার অনুরূপ। (চার্চিলের বক্তৃতার উদ্ধৃতি Government of Palestine, A Survey of Palestine, 1945-1946, part. 1, pp. 67-68)। জায়নবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সন্ত্রাসবাদীদের সমূলে উৎখাত করা উচিৎ বলে তিনি মন্তব্য করেন।২৫ কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ রােপিত বিষবৃক্ষকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি।

হিটলারের ইহুদি-বিরোধী নীতিকে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনে ইহুদি আনয়ন, এবং ইংল্যান্ড ও ইউএসে ইহুদিদেরকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি : যুদ্ধের অব্যবহিত পরে পূর্ব ইউরােপে ইহুদি সমস্যার তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। হিটলারের ইহুদি-বিরােধী নীতির ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছিল। তদুপরি পূর্ব ইউরােপের ওপর রুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর ঐ সমস্ত দেশও ইহুদিদের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তবে ইহুদি-বিরােধী মনােভাব বা আন্দোলন এই সমস্ত দেশে নতুন কিছু নয়; অতীতে এই ধরনের ঘটনার ফলে খুব অল্পসংখ্যক ইহুদিই দেশত্যাগ করেছে। কিন্তু এদের দুরবস্থাকে মূলধন করে জায়নবাদীগণ এদের প্যালেস্টাইনে নিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে প্রয়াস পায়, যাতে তাদের আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্বরান্বিত হয়। বেআইনিভাবে বহু ইহুদিকে দেশে আনয়ন করা হয়। জায়নবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল শ্রমিক দল ব্রিটেনে এবং হ্যারি ট্রুম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ইহুদিগণ তাদের লক্ষ্য অর্জন সম্বন্ধে নিশ্চিত হয় বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সময় ইহুদিদের দাবির সমর্থনে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়। ১৯৪৪ সালের নির্বাচনে ডিমােক্রাটিক ও রিপলিকান উভয় দলই তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় ফিলিস্তিনে অবাধ ইহুদি আগমন ও একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক (ইহুদি) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেসের নিম্ন ও উচ্চ পরিষদে এই মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে ফিলিস্তিনে ইহুদি আগমন ও একটি ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিৎ। এছাড়া বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর, বড় বড় শহরের মেয়র, ব্যবসায়ী, সম্পাদক, অধ্যাপক ও ধর্মীয় নেতা বিবৃতি ও বক্তৃতার মাধ্যমে অবিলম্বে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। (এই সম্বন্ধে দেখুন Richard P. Stevens, American Zionism and U.S. Foreign Policy (New York, 1962) এবং Alfred Lilienthal, What Price Israel ? (Chicago, 1953))।

ব্রিটিশ ও আমেরিকান সদস্যদের নিয়ে যুক্ত কমিটি, ট্রুম্যানের চাপ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পূর্ব ইউরােপের বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে অবস্থানরত ইহুদিদের মধ্য থেকে এক লক্ষ জনকে অনতিবিলম্বে ফিলিস্তিনে প্রবেশের ছাড়পত্র দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে অনুরােধ করলে সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করে। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে একটি যুক্ত ব্রিটিশ-মার্কিন তদন্ত কমিটি গঠিত হওয়া উচিৎ বলে ব্রিটিশ সরকার মন্তব্য প্রকাশ করে। ১৯৪৫ সালের শেষদিকে ছয়জন ব্রিটিশ ও ছয়জন আমেরিকান সদস্য নিয়ে যুক্ত কমিটি গঠিত হয়। পূর্ব-ইউরােপ ও ফিলিস্তিন সফর করার পর কমিটি একটি রিপাের্ট প্রণয়ন করে। এতে মন্তব্য প্রকাশ করা হয় যে, ফিলিস্তিনকে পুরাপুরি আরব বা পুরাপুরি ইহুদি দেশ মনে করা যুক্তিযুক্ত নয়। কোনাে সম্প্রদায়ের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করে রিপাের্ট এমন একটি প্রশাসন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে যা পবিত্র ভূমির স্বার্থ রক্ষা করার সাথে সাথে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পথে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ১৯৪০ সালের জমি হস্তান্তর আইনে জমির ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর যে বাধা-নিষেধ আরােপিত হয়েছিল তা তুলে নেয়ার এবং এক লক্ষ ইহুদি শরণার্থীর ফিলিস্তিনে আগমনের অনুমতি দানের জন্য সুপারিশ করা হয়। রিপাের্টের অন্যান্য দিক উপেক্ষা করে শুধু এক লক্ষ শরণার্থীর প্যালেস্টাইন প্রবেশ সংক্রান্ত সুপারিশের আলােকে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এই পরিমাণ অনুমতিপত্র দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগ করলে ব্রিটিশ সরকার বিশেষত পরারষ্ট্রমন্ত্রী বেভিন ক্ষুব্ধ হন। একদিকে মার্কিন সরকার ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে এবং অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার ও জায়নবাদীদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ইঙ্গ মার্কিন কমিশনের সুপারিশসমূহের বাস্তবায়নের উপায় উদ্ভাবনের জন্য দুই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সমন্বয়ে একটি নতুন কমিশন গঠিত হয়। “গ্রেডি-মরিসন কমিশন” প্রস্তাব করে যে, দুই জাতির স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি ফেডারেল ধরনের রাষ্ট্র গঠন করা উচিৎ। ইহুদি শরণার্থীদের আগমন দুই সম্প্রদায়ের সম্মতির ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিৎ বলেও কমিশন মত প্রকাশ করে।

লেবর পার্টির দীর্ঘসূত্রিতা ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ : শ্রমিক দলীয় সরকারের এই “দীর্ঘসূত্রিতায়” জায়নবাদীগণ অধৈর্য হয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের চরমপন্থী অংশ ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করার জন্য নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ দিতে থাকে। ১৯৪৬ সালের আন্তর্জাতিক জায়নবাদী সম্মেলনে ব্রিটিশ-ঘেঁষা নীতি অনুসরণ করার অভিযােগে সংস্থার সভাপতি ওয়াইজম্যানের কঠোর সমালােচনা করা হয়। ইহুদি সন্ত্রাসবাদী সংস্থাসমূহ ব্রিটিশ প্রশাসন ব্যবস্থা নস্যাৎ করার জন্য একযােগে বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালায়। ১৯৪৬ সালের ১৬ জুন হাগানা ফিলিস্তিনের সাথে পাশ্ববর্তী দেশগুলোর যােগাযােগ রক্ষাকারী ১১টি সেতু ধ্বংস করে। ২৯ তারিখে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ইহুদি সংস্থার সদর কার্যালয় ঘেরাও করে মােশে শারেট, বার্নার্ড যােসেফ ও অন্যান্য কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করে। কয়েকটি ইহুদি বসতিতে তল্লাশী চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্র উদ্ধার করা হয়। জুলাই মাসের ২২ তারিখে জেরুজালেমের কিং ডেভিড হােটেলের একাংশ ইরগুন দলভুক্ত সন্ত্রাসবাদীগণ ধ্বংস করে। এখানে অবস্থিত সরকারি দফতরে কর্মরত শতাধিক ব্রিটিশ, আরব ও ইহুদি নিহত হয়।

সন্ত্রাসবাদী দলগুলোর অস্ত্রের মুখে ব্রিটিশ সরকারের ফিলিস্তিন ত্যাগ : ইঙ্গ-মার্কিন বিশেষজ্ঞ কশিনের ফেডারেল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপায় সম্বন্ধে আলােচনার জন্য ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে যে সম্মেলন আহ্বান করে তাতে আরব দেশসমূহের কিছুসংখ্যক প্রতিনিধি যােগদান করলেও ফিলিস্তিনি আরব বা ইহুদি অংশগ্রহণ করেনি। ফলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। হাগানা, ইরগুন ও অন্যান্য দলের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চলতেই থাকে এবং যুদ্ধংদেহী মনােভাবাপন্ন জায়নবাদীগণ ১৯৪৬ সালে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জায়নবাদী সম্মেলনে সমগ্র ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প সমন্বিত প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালের প্রথমদিকে সন্ত্রসাবাদী তৎপরতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে একটি দল ব্রিটিশ পুলিশ ফাঁড়ির ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৫ জনকে নিহত ও ৩৪ জনকে আহত করে। ২৭ জানুয়ারি একজন ব্রিটিশ বিচারক ও অন্য একজন নাগরিককে ইহুদি সন্ত্রাসবাদীগণ অপহরণ করে এবং হাই কমিশনার কর্তৃক চরমপত্র দেয়ার পূর্বে তাদের মুক্তি দেয়া হয়নি। সন্ত্রাসবাদী দলগুলো অস্ত্রের মুখে ব্রিটিশ সরকারকে ফিলিস্তিন ত্যাগ করতে বাধ্য করার নীতি গ্রহণ করে। ব্রিটিশ মহিলা ও শিশুদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ব্রিটিশ সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীবৃন্দ নিরাপত্তার জন্য কাঁটাতারের মধ্যে বাস করতে থাকে।

জাতিসংঘের দায়িত্বগ্রহণ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অসন্তুষ্টি এবং ফিলিস্তিনে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে ব্যর্থতার ফলে ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি জাতিসংঘের কাছে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেভিন বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের কাছে পেশ করেন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে জাতিসংঘের সাধারণ এবং পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে ফিলিস্তিন সমস্যা আলােচিত হয় এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। ১১ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে কোনাে বৃহৎ শক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চেকোশ্লোভাকিয়া,  গুয়াতেমালা, ভারত, ইরান, হল্যাণ্ড, পেরু, সুইডেন, উরুগুয়ে ও যুগােশ্লোভিয়া থেকে কমিটিতে প্রতিনিধি নেয়া হয়েছিল। কমিটি ফিলিস্তিন পরিদর্শন করে ৩১ আগস্ট রিপাের্ট পেশ করে। ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সদস্যবৃন্দ একমত হতে পারেননি। কানাডা, চেকোশ্লোভাকিয়া, গুয়াতেমালা, হল্যাণ্ড, পেরু, সুইডেন ও উরুগুয়ের প্রতিনিধিবৃন্দ ফিলিস্তিনকে একটি আরব ও একটি ইহুদি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তারা জেরুজালেম শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষেও মত প্রকাশ করেন। অপরপক্ষে ভারত, ইরান ও যুগােশ্লাভিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দ আরব ও ইহুদি এলাকার স্বায়ত্তশাসনসহ একটি ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

জায়নবাদীগণ স্বাভাবিকভাবেই ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন দান করে এবং সাধারণ পরিষদে এই প্রস্তাব যাতে গৃহীত হয়, সেই ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠে। প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রে ইহুদি মালিকানাধীন অঞ্চলসমূহ ছাড়াও আরব-অধ্যুষিত বীরশেবা ও পূর্ব গ্যালিলি জেলা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আরবগণ বিভিন্ন কারণে এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে –

  • তাদের প্রধান যুক্তি ছিল যে, ফিলিস্তিন-আরব ভূমি এবং সেই ভূমিকে একটি বহিরাগত জনসমষ্টির জন্য রাজ্য স্থাপন ন্যায় ও নীতিবিরােধী।
  • দ্বিতীয়ত প্রতি বছর ফিলিস্তিনে ইহুদি আগমন সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে ইহুদি জনসাধারণ ফিলিস্তিনের মােট জনসংখ্যার শতকরা ৩৩ ভাগের বেশি ছিল না। শতকরা ৬৭ ভাগ লােকের মতামত উপেক্ষা করে একটি দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ গণতান্ত্রিক নীতি বিরােধী।
  • তৃতীয়ত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘের যেকোনাে প্রস্তাব একটি সুপারিশ মাত্র; কোনাে দেশের ওপর সেই প্রস্তাব চাপিয়ে দেয়া জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী।

আরবগণ প্রধানত ন্যায়-নীতির দৃষ্টিকোণ থেকেই এই প্রস্তাবের সমালােচনা ও বিরােধিতা করেছে কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ন্যায়-নীতিকে সযত্নে দূরে রেখে ও গােষ্ঠীগত স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া হয়ে এসেছে। ১৯৪৭ সালের শেষদিকে প্রস্তাব দুটি সাধারণ পরিষদে ও জাতিসংঘের বিভিন্ন কমিটিতে আলােচিত হতে থাকে। এই পর্যায়ে মার্কিন সরকার-বিশেষত প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফিলিস্তিন বিভক্তির পক্ষে ভােট সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হয়। তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জায়নবাদীগণ প্রয়ােজনীয় দুই তৃতীয়াংশ ভােট সম্বন্ধে নিশ্চিত না হওয়ায় দুবার অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়। লাইবেরিয়া ফিলিপিনস ও আরাে কয়েকটি দেশের ওপর চাপ প্রয়ােগ করে ফিলিস্তিন বিভক্তির পক্ষে ভােট দিতে বাধ্য করা হয়। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর তারিখে সাধারণ পরিষদে বিভক্তি প্রস্তাব দুই তৃতীয়াংশ দেশের সমর্থন লাভ করতে সমর্থ হয়। আফগানিস্তান, কিউবা, মিশর, গ্রিস, ভারত, ইরান, লেবানন, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সিরিয়া, তুরস্ক ও ইয়েমেন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভােট দেয়। ভােটদানে বিরত থাকে-আর্জেন্টিনা, চিলি, টনি, কলম্বিয়া, এল সালভেদর, ইথিওপিয়া, হন্দুরাস, মেক্সিকো, ব্রিটেন ও যুগােশ্লাভিয়া। সাধারণভাবে পাশ্চাত্য দেশগুলো প্রস্তারেব পক্ষে ভােট দেয়।

মার্কিন সরকার জায়নবাদীদের সমর্থনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল তা ন্যায়-নীতি ও শালীনতা বিরােধী। এই সম্বন্ধে মার্কিন নিম্নপরিষদের সদস্য লরেন্স স্মিথ (Lawrence H. Smith) কংগ্রেসের অধিবেশনে মন্তব্য করেন – “The decisive votes for partition were cast by Haiti, Liberia and the philippines. These votes were sufficient to make the two-thirds majority. Previously these countries opposed this move… The presure by our delegates, by our officials, and by the private citizens of the United States Constitutes reprehensible conduct against them and us.” (U.S. Congressional Record, 18 December, 1947, p. 1176)। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপসচিব সামনার ওয়েলস এই সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন, “By direct order of the White House, every form of pressure, direct or indirect, was brought to bear by American officials upon those countries outside the Moslem world that were known to be either uncertain of opposed to partition.” (Summer welles, We Need Not, Fail (Boston, 1948), p. 63)।

আরবদের সতর্কতা প্রদান ও ইহুদিদের ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চল দখল ও হত্যালীলা

আরব নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিনের বিভক্তির বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। লন্ডন সফররত আরব লীগের সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রহমান আযম এক সাংবাদিক সম্মেলনে মন্তব্য করেন যে, আরবেরা ফিলিস্তিনের বিভক্তি সহ্য করবে না এবং দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য জীবনপণ সংগ্রাম করবে। বিভক্তি-প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সংবাদ ফিলিস্তিনে পৌঁছানোর সাথে সাথেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আরবেরা তিনদিনের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেয়। বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড সংঘর্ষ চলতে থাকে। প্রতিবেশী আরব দেশগুলো থেকে কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে এবং সংঘর্ষ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। বিভক্তি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আরবদের বিরােধিতার তীব্রতা অনুধাবন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব করে যে, বিভক্তি প্রস্তাব বাস্তবায়নে অসুবিধার কারণে ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের অছি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়া উচিৎ। ইহুদি সংস্থা অছি ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে এবং বিভক্তি প্রস্তাব অনুযায়ী নির্ধারিত ইহুদি রাষ্ট্রের এলাকায় নিজেদের অবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য ব্যাপক সামরিক তৎপরতা চালায়। এ সম্বন্ধে প্রখ্যাত জায়নবাদী নেতাও পরবর্তীকালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ন মন্তব্য করেছেন, “As April (1948) began, our War of Independence swung decisively from defence to attack.” (David Ben Gurion. Rebirth and Destiny of Israel (New York, 1954), P-296)।

এপ্রিল মাসেই ‘পালমাক’ ও অন্যান্য ইহুদি বাহিনী উপকূলীয় ইহুদি বসতিগুলো থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে এবং রাস্তার দুই পাশে আক্রমণ চালিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে। হাইফা, জাফা তাইবেরিয়া, সাফাদ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আরব গেরিলাদের বহিষ্কৃত করা হয়। স্মর্তব্য যে, আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনে সৈন্য প্রেরণের বহু পূর্ব থেকেই ইহুদি সামরিক ও আধাসামরিক দলগুলো আরব গ্রামগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। উদ্দেশ্য ছিল আরবদের মনে ভীতির সঞ্চার করে তাদের ফিলিস্তিন ত্যাগ করতে বাধ্য করা। ব্রিটিশ প্রত্যক্ষদশী মেজ ও ব্যালান্স মন্তব্য করেন “It was the Jewish policy to encourage the Arabs to quite their homes, and they ejected those who clung to their villages,” (Edgar O’Ballance, The Arab-Israeli war. 1948 (New York, 1957). p. 64)। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ইরগুন কর্তৃক ৯ এপ্রিলে দায়ির ইয়াসিন গ্রামের মহিলা ও শিশুসহ সকল লােককে নির্বিবাদে হত্যা উল্লেখযােগ্য। ইহুদি লেখক জন কিমশে একে “the darkest stain on the Jewish record” বলে আখ্যায়িত করলেও এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নায়ক এবং বর্তমানে ইসরায়েল পার্লামেন্টের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী মেনাহিম বেগিন একে ‘বিজয়’ বলে অভিহিত করেছে। (Jon Kimche, The Seven Fallen Pillars (New York, 1953), p. 228. এবং Menachem Beigin, The Revolt: Story of the Irgun (New York, 1951))।

সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ব্রিটেন অভূতপূর্ব বিশৃঙখলা ও হত্যাকাণ্ডের মধ্যে কোনাে পক্ষের হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করে ফিলিস্তিন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিভাগীয় প্রধানদের এক সভায় শেষ মুখ্যসচিব স্যার হেনরী গুরনী এই সিদ্ধান্তের কথা জানালে বিভাগীয় প্রধানগণ আপত্তি জানান। কিন্তু সরকার পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল থেকে মে মাসের ১৪ তারিখে ম্যান্ডেটের সমাপ্তি ঘােষণা করে ফিলিস্তিন ত্যাগ করে। জায়নবাদীগণ এই অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল। তাদের একটি ছায়া সরকার সব সময়ই ছিল। অতি সহজেই সেই সরকার ঐ দিনই ‘ইসরায়েল’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম ঘােষণা করে। ডেভিড বেন গুরিয়ন এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও ডক্টর ওয়াইজম্যান প্রেসিডেন্ট মনােনীত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান অত্যল্পকালের মধ্যে এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।

আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ

ইতােমধ্যে প্রায় চার লক্ষের বেশি বিতাড়িত ফিলিস্তিনি আরব পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রগুলোতে উপস্থিত হয়ে এক বিরাট মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। আরব রাষ্ট্রগুলোর নেতৃবৃন্দ এই অবস্থা বা একটি ইহুদি রাষ্ট্রের সৃষ্টি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। এই রাষ্ট্রের জন্ম ঘােষণার দিনেই মিশর, সিরিয়া, লেবানন, ট্রান্সজর্দান ও ইরাকের সৈন্যদল ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। সৈন্য প্রেরণের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে আরব লীগের সাধারণ সম্পাদক জাতিসংঘের সাধারণ সম্পাদকের কাছে একটি তারবার্তা প্রেরণ করেন। এতে বলা হয় যে, ফিলিস্তিনে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই হাতক্ষেপ করা হয়েছে। আরাে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে, এর উদ্দেশ্য হল “to prevent the spread of disoder and lawlessness into the neighbouring Arab lands; and to fill the vacuum created by the termination of the Mandate” (U. N. Document no. 956.9-A/658)।

এক সপ্তাহ যুদ্ধ চলার পর মে মাসের ২২ তারিখে নিরাপত্তা পরিষদ অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানায়। খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকলে ২৯ তারিখে পুনরায় এই আহ্বান জানালে ১১ জুন থেকে সাময়িকভাবে যুদ্ধ বন্ধ থাকে। বিরতির সময় পর্যন্ত আরবদের সামরিক কিছুটা সুবিধা ছিল; কিন্তু এই বিরতির সুযােগে ইসরায়েল পক্ষ বিভিন্ন দেশ, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও কয়েকটি বিমান সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে অস্ত্র আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকায় আরবরা প্রয়ােজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশও সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে ৪ সপ্তাহ যুদ্ধবিরতির পর জুলাই মাসের ৯ তারিখ থেকে পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হলে ইহুদিগণ প্রতিটি রণাঙ্গনে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে। আরব অঞ্চলের বহু জায়গাও তারা নিজেদের দখলে আনতে সমর্থ হয়। ১৮ তারিখে আবার অস্ত্র-সংবরণের আদেশ দেয়া হয়। দুই পক্ষই অস্ত্র সংবরণে স্বীকৃত হলেও খণ্ড যুদ্ধ চলতেই থাকে। এক সময় ইসরায়েল দক্ষিণ ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়ে মিশরীয় বাহিনীর প্রায় সবগুলো অবস্থানই দখল করে। ১৬ নভেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ এই প্রস্তাবে যুধ্যমান দলগুলোকে আলােচনার মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য অনুরােধ করে। তদনুযায়ী ১৯৪৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে ৩ এপ্রিল ট্রান্সজর্দান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জাতিসংঘ ও পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ এই যুদ্ধ বিরতিকে একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তিচুক্তির প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করে। পক্ষান্তরে আরবেরা একে সার্বিক সংগ্রামের পূর্বে সাময়িক বিরতি বলে মনে করে। ফিলিস্তিনের আরব-চরিত্র পরিবর্তন করে ইহুদি রাষ্ট্রের সৃষ্টি তারা কোনাে মতেই গ্রহণ করতে পারেনি। ভবিষ্যতে শক্তি সঞ্চয় করে ‘সাম্রাজ্যবাদ-রােপিত এই বিষবৃক্ষকে’ উৎপাটিত করা যাবে বলে তারা মনে করতে থাকে। 

যুদ্ধের মধ্যে জাতিসংঘ দুই বিবদমান দলের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য একজন মধ্যস্থতাকারী নিয়ােগ করে একদা সুইডেনের রেড ক্রসের প্রেসিডেন্ট এবং জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা কাউন্ট ফক বারনাডােটকে এই পদের দায়িত্ব দেয়া হয়। সমস্যার সাথে সম্যক পরিচিত হবার পর তিনি এই সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘের নিকট যে রিপাের্ট পেশ করেন তাতে আরব বাস্তুত্যাগীদের স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তনের অধিকার এবং তাদের সম্পত্তি বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়ার সুপারিশ করা হয়। তিনি আরাে প্রস্তাব করেন যে, দক্ষিণের নেগেভ মরু অঞ্চল আরব রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। এর পরিবর্তে গ্যালি ও জাফা এবং তৎসন্নিহিত এলাকা ইহুদি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়। লিন্দা ও রামলা শহর আরবদের কাছে প্রত্যর্পণের কথা বলা হয় এবং সমগ্র জেরুজালেমের ওপর জাতিসংঘের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার সুপারিশও করা হয়। এই ধরনের মতামত জায়নবাদীদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং স্টার্নের বেপােরােয়া দলের সন্ত্রাসবাদীগণ প্রকাশ্য দিবালােকে তাকে হত্যা করে। পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যমগুলোর ওপর ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণ এতই নিরঙ্কুশ যে, এই ধরনের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকেও যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়নি।

আরব মানসিকতার ওপর আঘাত ও তাদের পরাজয়ের কারণ

যুদ্ধে আরব দেশগুলোর পরাজয় আরব মানসিকতার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। প্রতিটি আরব দেশেই জনমত এত বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর পক্ষে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয়নি। আরবদের এই পরাজয়ের ফলে জায়নবাদীগণ বিভক্তি পরিকল্পনায় তাদের জন্য যতখানি ভূখণ্ডে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি জায়গা দখল করে। আরবগণ এই দখলকৃত এলাকা প্রত্যর্পণের দাবি করলেও পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েল এই দাবির প্রতি কোনাে গুরুত্ব প্রদর্শন করেনি। আরবদের এই শােচনীয় পরাজয়ের বহুবিধ কারণ ছিল –

  • প্রথমত আরব দেশগুলোর অধিকাংশই ছিল হয় সদ্য স্বাধীন না হয় বিদেশী নিয়ন্ত্রণাধীন। সিরিয়া ও লেবানন মাত্র দুই বছর পূর্বে স্বাধীনতা লাভ করে; মিশর ও ইরাকে তখন পর্যন্ত ব্রিটেনের সেনাবাহিনী ও প্রভাব বিদ্যমান ছিল। ফলে এই সমস্ত দেশের সরকারগুলোর রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কোনাে অভিজ্ঞতা ছিল না। আধুনিক যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে অভিজ্ঞতা প্রয়ােজন তার সাথেও তাদের কোনাে পরিচয় ছিল না।
  • দ্বিতীয়ত অভিজ্ঞতা ছাড়াও আরবদের মধ্যে একতাবােধের অভাব ছিল। বিভিন্ন আরব দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনাে সমঝােতা বা অভিন্ন কার্যক্রম ছিল না। ফলে ইহুদিগণ তাদের সুবিধামতাে স্থানে ও সময়ে আলাদা আলাদা এক একটি আরব বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ােগে করে জয়ী হয়েছে। ফিলিস্তিনের মানবতাবাদী শিক্ষাবিদ মূসা আলামী এই সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন, “The Jews took full advantage of our disunity and the anarchy of our set-up; when the time was opportune they collected all their forces and…dealt us heavy concentrated blows… Thus the Country fell, town, after town village after village,position after position, as a result of this fragmentation, lack of unity and of a common command.” (Musa Alami, “The Lesson of Palestine Middle East Journal, October, 1949)। এই সাময়িক অনৈক্য বহুলাংশে রাজনৈতিক অনৈক্য ও ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রতিফলন। আরব লীগের নেতৃত্বের জন্য মিশর ও ইরাকের মধ্যে কোন্দল সামরিক সহযােগিতার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ট্রান্সজর্দানের আমির আবদুল্লাহ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আরব স্বার্থ বিসর্জন দিতে সর্বদাই প্রস্তুত ছিল। তার ইচ্ছা ছিল ব্রিটিশ সৃষ্ট ‘আরব লিজিয়নের’ সাহায্যে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের কিছু ভূভাগ দখল করে নিজের রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করা। মুফতি আমিন আল হােসায়নিকে তার পরিকল্পনার পথে প্রতিবন্ধক মনে করে মুফতিকে শায়েস্তা করার জন্য ইহুদি সংস্থার নেত্রী গােল্ডা মায়ারসনের সাথে গােপনে ষড়যন্ত্র করতেও তিনি পশ্চাৎপদ হননি। (এই সম্বন্ধে দেখুন, Pamela Ferguson, The Palestine Problem (London: Martin Brian, 1973.) p. 55)।
  • তৃতীয়ত আরব রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের দুর্নীতি তাদের পরাজয়ের পথ প্রশস্ত করেছিল। মিশরের বাদশাহ ফারুক ও তার পার্শ্বচরগণ সেনাবাহিনীর জন্য অকেজো অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করে নিজেদের জন্য বিপুল অর্থ উপার্জন করে, কিন্তু এই অস্ত্র নিয়ে মিশরীয় বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে সাফল্য প্রদর্শন করা সম্ভব ছিল না। সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী জামিল মারদামের ভ্রাতা ক্যাপ্টেন ফুয়াদ মারদাম সিরীয় জনসাধারণের থেকে নেয়া অর্থে ইতালিতে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করে উৎকোচের বিনিময়ে অস্ত্র ভর্তি জাহাজগুলো ইহুদিদের হাতে সমর্পণ করে। এই ধরনের বহু উদাহরণ থেকে এই কথাই প্রতীয়মান হয় যে, ইহুদিগণ যে উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ও স্বজাতিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছিল তা আরব নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিল না। 
  • চতুর্থত ভৌগােলিক অবস্থা আরবদের বিপক্ষে কাজ করেছিল। কয়েকটি আরব দেশের বাহিনী বহু দূর থেকে এসে এত ক্লান্ত ছিল যে, তাদের পক্ষে যুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। এই সম্বন্ধে ট্রান্সজর্দানের আরব লিজিয়নের সেনাপতি গ্লাব পাশা মন্তব্য করেছেন, “It is not redized that the distance from Baghdad to Haifa is seven hundred miles, as far as from Calais to vienna of London to Berlin. Moreover, the greater part of this distance is across waterless desert.” (Sir John Bagot Glubb, A Soldier with the Arabs (London: Hodder & Stoughton, 1959, pp 94-95.))। পক্ষান্তরে ইহুদিদের সীমিত এলাকার মধ্যে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ম্যান্ডেট শাসনামলে এই এলাকায় চমৎকার যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ফলে ইহুদিদের পক্ষে এক রণাঙ্গণ থেকে অন্য রণাঙ্গণে অতি দ্রুত সৈন্য প্রেরণ করা সম্ভব ছিল। রসদপত্র ও যন্ত্রাংশের জন্য কোনাে ইহুদি বাহিনীকেই বেশি দূরে যেতে হয়নি। যুদ্ধের সময় এই ধরনের সুযােগ সুবিধাই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করতে বহুলাংশে সাহায্য করে। 

১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর ইজরায়েলের সীমারেখা বৃদ্ধি

অস্ত্রমুক্ত এলাকা : আরব দেশসমূহ ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে কয়েকটি অস্ত্রমুক্ত এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল এই সমস্ত এলাকা যুদ্ধের উস্কানি হ্রাস করবে এবং কালক্রমে বিবদমান দলগুলোর মধ্যে শান্তি স্থাপিত হবে। পরবর্তী ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে যে, এই ধরনের আশা চরম অবাস্তবতার ওপর রচিত হয়েছিল। 

জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য পুরোনো সীমারেখা গ্রহণ করা কিন্তু পরে অস্বীকার : ১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি মধ্যস্থতাকারী সংস্থা (Conciliation Commission) গঠন করে এবং বিবদমান দলগুলোর সাথে আলাপ আলােচনার মাধ্যমে একটি চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পথ পরিষ্কার করার দায়িত্ব এর ওপর অর্পণ করে। ইসরায়েল রাষ্ট্র ও প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন-আরব রাষ্ট্রের সীমানা নিয়েই তারা কাজ শুরু করে। সংস্থা বৈরুতে একটি অধিবেশনের পর সুইজারল্যান্ডের লজানে মিলিত হয়। সংস্থার সাথে আলােচনায় ইসরায়েলি ও আরব দেশগুলোর প্রতিনিধি দলসমূহ ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের বিভক্ত পরিকল্পনার গৃহীত সীমারেখা গ্রহণ করতে সম্মত হয়। ১৯৪৯ সালের ১২ মে তারিখে দুই পক্ষই এই মর্মে একটি ঘােষণাপত্র স্বাক্ষর করে। কিন্তু ইসরায়েলি প্রতিনিধিদল পরে বিভক্তি পরিকম্পার সীমারেখা গ্রহণ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। কারণ ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে তারা অনেক বেশি জায়গা দখল করেছিল, ইসরায়েলি প্রতিনিধদল সাময়িকভাবে ১৯৪৭ সীমারেখা গ্রহণ করেছিল, কারণ ঠিক এই সময়ে জাতিসংঘে ইসরায়েলের সদস্যপদ সম্পর্কে আলােচনা চলছিল এবং প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের জায়গা ইসরায়েল কর্তৃক দখল সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য হচ্ছিল। সদস্যপদ লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল সমঝােতার মনােভাব ত্যাগ করে নিজ মূর্তি ধারণ করে। অবশ্য জাতিসংঘ ইসরায়েলের সদস্যপদ দান করার সময় এই মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, ইসরায়েল তার সীমারেখার ব্যাপারে জাতিসংঘের ১৯৪৭ সালের নভেম্বরের প্রস্তাব এবং উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন ও ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরের প্রস্তাব কার্যকরী করবে। (U. N. Resolution 273 (III), May 11, 1949 )। কিন্তু এই দুটি প্রস্তাবের একটিও ইসরায়েল বাস্তবায়িত করার প্রয়াস পায়নি। ইসরায়েলের এই অনমনীয় মনােভাব ফিলিস্তিনি সমস্যাকে আরাে জটিল করে তুলেছে এবং ফলশ্রুতিতে অভূতপূর্ব মানবিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন

উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের সহায়তা ও প্রত্যাবর্তন নিয়ে জাতিসংঘের ব্যর্থ প্রচেষ্টা : ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন শেষ হবার পূর্বেই অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের ফিলিস্তিন বিভক্তি প্রস্তাবের সময় থেকে ১৯৪৮ সালের মে মাসের মধ্যভাগে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘােষিত হওয়ার সময় পর্যন্ত প্রায় ৪ লক্ষ ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোতে চলে যায়। ১৯৪৮-৪৯ সালে আরাে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ লােক বাস্তুত্যাগীদের দলে যােগ দেয়। এদের কিয়দংশ ট্রান্সজর্দান অধিকৃত জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে, কিয়দংশ মিশর-নিয়ন্ত্রিত গাজা এলাকায়, বেশ কিছুসংখ্যক জর্দান ও লেবাননে এবং কেউ কেউ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রায় ৮ লক্ষের মতাে এই হতভাগ্য বাস্তুহারা দল অববর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। এদের অবস্থা কিছুটা লাঘব করার জন্য জাতিসংঘ ‘ত্রাণ ও কর্মসংস্থা’ (United Nations Relief and Works Agency) গঠিত হয়। এই সংস্থার পক্ষ থেকে কিছুসংখ্যক তাবু ও মাঝে মাঝে রেশন দেয়ার ব্যবস্থা না করলে বহু লােক যে মৃত্যুবরণ করত তাতে সন্দেহ নেই। এই ভাগ্যাহতদের স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন অথবা ক্ষতিপূরণ দান সম্পর্কে ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৮ বার প্রস্তাব গ্রহণ করলেও বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনীতির ফলে এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। 

ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের যুক্তি : নিজেদের দায়িত্ব এড়াবার জন্য ইহুদিগণ প্রধানত দুই ধরনের যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে – প্রথমত, ফিলিস্তিনি আরব জনগণ আরব নেতৃবৃন্দের আহ্বানে তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করে পাশ্ববর্তী দেশসমূহে চলে যায়। সুতরাং তাদের দেশত্যাগ স্বেচ্ছাকৃত এবং ইহুদিদের ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের অংশ বিশেষ। তাই তাদের ফিরে আসার প্রশ্ন অবান্তর। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুগণ পার্শ্ববর্তী যে দেশগুলোতে গমন করেছে, সেই সমস্ত দেশে তাদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করা উচিত। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আরব দেশগুলো উদ্বাস্তুদের দুঃখ-দুর্দশা জিইয়ে রাখছে এবং একে মূলধন করে ইসরায়েল বিরােধী প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছে। এই দুটি যুক্তিই উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ও অগ্রহণযােগ্য। তাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ফলে ফিলিস্তিনি আরবগণ ঘরবাড়ি ছেড়ে যায়নি, তা প্রমাণ করার জন্য জায়নবাদীগণ এই কথা প্রচার করেছেন যে, তাদের দেশত্যাগ স্বেচ্ছাকৃত এবং প্রধানত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নেতৃবৃন্দই তাদের দেশত্যাগের জন্য আহবান জানায়। পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যমগুলোতেও এই ধরনের মতামত প্রচার করা হয়েছে। 

ইজরায়েলের যুক্তির খণ্ডন : কিন্তু ব্রিটিশ লেখক আরস্কিন চাইল্ডার্স সমস্ত নথিপত্র ও সেই সময়কার বেতার ঘােষণা পরীক্ষা করে কোথায়ও কোনাে আরব নেতার এই ধরনের বিবৃতি নির্দেশ দেখতে পাননি; বরং ফিলিস্তিনিদের নিজেদের বাড়ি-ঘরেই থাকতে বলা হয়েছে। তিনি মন্তব্য করেছেন, “There was not a single order or appeal or suggestion about evacuation from Palestine from any Arab radio station, inside or outside Palestine, in 1948. There is repeated monitored record of Arab appeals, even flat orders to the civilans of Palestine to stay put.” (Os Erskine B. Childers, “The Other Exodus,” London Spectator, 12 May, 1961)। প্রকৃতপক্ষে কোনাে নেতার নির্দেশের নয়, জায়নবাদী সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপে ভীত-সন্ত্রস্ত আরব গ্রামবাসীগণ নিছক প্রাণের মায়ায়ই পালাতে বাধ্য হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী গ্লাব পাশা মন্তব্য করেছেন, “The fact is that the majority left in panic flight, to escape massacre, They were in fact helped on their way by the occasional massacres-not of very many at a time, but just enough to keep them running. ” (John Bagot Glubb, A Solider with the Arabs (London, 1957), p. 251)। দ্বিতীয়ত মুষ্টিমেয় কয়েকজন ফিলিস্তিনি ছাড়া বাস্তুত্যাগীগণ কোনাে আরব রাষ্ট্রে পুনর্বাসিত হতে অনিচ্ছুক। বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থার পরিচালকবৃন্দ মন্তব্য করেছেন যে, বাস্তুত্যাগীগণ তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ১৯৬৩-৬৪ সালে তার রিপাের্টে এই সংস্থার প্রধান লরেন্স মিশেলমাের মন্তব্য করেন, “… The refugees in general strongly maintain their insistence on the idea and aspiration of returning to their homes.” (U. N. Document A/5813-UNRWA Report, 1963-1964)।

সন্ত্রাসবাদের উদ্ভব ও ইজরায়েলে আরবদের দুরবস্থা

বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিদের অবস্থা : বছরের পর বছর এক দুঃখসহ ও অমানবিক অবস্থায় জীবন কাটাবার ফলে বাস্থত্যাগীদের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে তাদের মাতভূমিতে ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়েছে, অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবে তার মানব-চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে নৈরাজ্যবাদী হয়ে নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য হয় সন্ত্রাসবাদ গ্রহণ করেছে, না হয় নিজেদের অবস্থা ভুলবার জন্য মরমিবাদী হয়ে পড়েছে। প্রথমােক্ত মনােভাব ঈসা আন-নায়ুরীর উপন্যাস বায়ত ওয়ারা আল-হুদুদ (সীমান্তের ওপারে বাড়ি) এ পরিস্ফুট হয়েছে। দ্বিতীয় মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায় হালিম বারাকাতের গল্প সংকলন আস-সাত ওয়া আল-মাতার (নীরবতা ও বৃষ্টি) ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর প্রকাশিত তার আউদাত আততায়ির ইলা আল-বাহার (নাবিক সমুদ্রে ফিরে গেল) নামক উপন্যাসে। উপন্যাসের এক জায়গায় নায়ক রামজী তার এক সহকর্মীর সাথে আলােচনায় এইভাবে নিজেদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন – “আমাদের এখানে ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যে কোনাে যােগসূত্র আছে? নেই। এটা আমাদের ধাতেই নেই। অতীত রােমন্থন করেই আমরা বেঁচে আছি। নল খাগড়ার মধ্য দিয়ে চোখ বুজে চলেছি। পড়ে গিয়ে কাদামাটিও মুখে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাথর ও মাজারের কাছে প্রার্থনা করছি মুক্তির জন্য।” হালিম বারাকাত, আউদাত আত-তায়িব ইলা আল-বাহার (বৈরুত, ১৯৬৯), পৃ. ২৩। এই সম্বন্ধে আরাে দেখুন, Fawaz, Turki, The Disinherited : Journal of a Palestinian Exile (New York, 1972.)।

ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি : উদ্বাস্তুদের কারও মধ্যে নৈরাজ্যবাদের সৃষ্টি হলেও অনেকের ভেতরেই প্রতিশােধের স্পৃহা দেখা দেয়। প্রথমদিকে বাস্তুত্যাগীদের কেউ কেউ কৃত্রিম সীমারেখা অতিক্রম করে নিজেদের কিছু জিনিস আনতে গিয়ে নিহত হয়। এইসব বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং যে আরব দেশ থেকে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদীগণ তৎপরতা চালায়, সেই দেশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা হয়। এই শতকের ৫ম ও ৬ষ্ঠ দশকে এই ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও প্রতিশােধমূলক আক্রমণ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাড়ায়। ইসরায়েল কর্তৃর্ক এই ধরনের হামলা বহুবার নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দিত হলেও অবস্থার কোনাে পরিবর্তন হয়নি। এই ধরনের সীমান্ত সংঘর্ষ এই পর্যন্ত তিনটি সার্বিক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে – ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদ এক নতুন রূপ লাভ করে। পরাজয় জনিত চরম হতাশা ও দুর্নীতিপরায়ণ আরব সরকারগুলোর ওপর অনির্দিষ্টকাল নিজেদের ভাগ্য সমর্পণ করতে অসম্মতির ফলেই ফিলিস্তিনি যুবকদের মধ্যে যুদ্ধংদেহী মনােভাবের সৃষ্টি হয়। এর ফলে যুদ্ধের পূর্বেই গঠিত সংস্থা আল-ফাতাহ ও Popular Front for the Liberation of Palestine বা PELP-এ নতুন প্রাণসঞ্চার হয়। আল-ফাতাহ ও PFLP ছাড়া জর্দানের মার্কসবাদী নাইফ হাওয়াতমের নেতৃত্বে Popular Democratic Front (PDF) ও কাজ করতে থাকে।

আল-ফাতাহ : আল-ফাতাহ-এর গেরিলা বাহিনী ‘আল-আসিফা’ গাজা ও অন্যান্য এলাকা থেকে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে সন্ত্রসবাদী তৎপরতা চালিয়ে বিশ্বে চমক ও আরবদের মনে আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। আল-ফাতাহ অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংস্থা অপেক্ষা আরব দেশগুলোর সমর্থন লাভ করেছে। এর কারণ ফিলিস্তিনে আরব ও ইহুদিদের একটি মিলিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি ছাড়া কোনাে প্রকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের কথা এই দলের নেতৃবৃন্দ বলেনি।

PELP : পক্ষান্তরে Popular Front for The Liberation of Palestine মার্কসবাদে বিশ্বাসী। এই শতকের ৫ম দশকে জর্জ হাবাশের নেতৃত্বে ইহা আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নামে কাজ শুরু করে। হাবাশ তখন বৈরুতের মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্র। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর এই দল PFLP নাম গ্রহণ করে; আল-ফাতাহ ইসরায়েলকেই শত্রু বলে মনে করে; পক্ষান্তরে PFLP-এর সংগ্রাম প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধেও পরিচালিত। এই দলের অন্যতম চিন্তাবিদ গাসান কানাফনি মন্তব্য করেছিলেন ‘চার শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধে নিয়ােজিত আছি-ইসরায়েল, জায়নবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল আরব সরকারসমূহ’। দলের অন্য একজন চিন্তাবিদ কামাল নাসিরও একই ধরনের মত ব্যক্ত করেছিলেন। (কানাফানি ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই তারিখে ও নাসির ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে ইহুদি সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হন।) বিমান ছিনতাইসহ বিভিন্ন প্রকারের চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যাপারে PFLP-এর কোনাে দ্বিধা সংকোচ নেই। 

রক্ষণশীল আরব সরকারের সাথে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদী বা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতা : আল ফাতাহ-এর সদস্যবৃন্দ সিরিয়া ও আলজিরিয়ায় প্রশিক্ষণ পায়, পক্ষান্তরে PFLP দলের অনেকে ভিয়েতনাম, গণচীন ও উত্তর কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। এদের অস্ত্র-শস্ত্রও রাশিয়া এবং চীন থেকে সংগৃহীত। মাও সেতুং, চে গু ভারা, ফিদেল ক্যাস্ত্রো এবং রেজিস দেবরের লেখনী মুক্তিযােদ্ধাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারা বহুলাংশে প্রভাবিত করেছে। স্বাভাবিকভাবেই রক্ষণশীল আরব সরকারসমূহ এদের অস্তিত্ব হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে পারেনি। ১৯৭০ সালে জর্দানের এবং ১৯৭৫-৭৬ সালে লেবাননের ঘটনাবলী এই উক্তির সত্যতা বহন করে। ১৯৬৮ সালের মে মাসে কারামে উদ্বাস্তু শিবিরের ওপর ইসরায়েলি হামলা জর্দানি বাহিনী এবং মুক্তিযােদ্ধাগণ সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করে। কারামের সাফল্যের পর একদিকে জর্দানি সরকার ও জনসাধারণ এবং অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সুযােগ গ্রহণ করে মুক্তিযােদ্ধাগণ অস্ত্রশস্ত্রসহ যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে থাকে কোনাে কোনাে স্থানে তারা আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর লােকদের সাথে সংঘর্ষ হতে থাকে। ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে জর্দানি বাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি ও জুন মাসে এর পুনরাবৃত্তি হয়।

আরব নাগরিকরা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক : ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আরব নাগরিকদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে গণ্য করা হয়। আরব এলাকাগুলোতে সামরিক আইন জারি করা হয় এবং বিভিন্ন আরব এলাকা কাটাতার দিয়ে ঘেরা হয়। কোনাে আরব এলাকা থেকে বাহিরে যেতে হলে সেই এলাকার সামরিক কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতিপত্র গ্রহণ করতে হত। যাতায়ত বিঘ্নিত হওয়ার এই ব্যাপারটি থেকে অনেকেই তাদের বিপর্যস্ত সাধারণ জীবনযাত্রার অনুমান করেন। ব্যাপকভাবে আরবদের পরিত্যক্ত জমিজমা ও বাড়িঘর ব্যবহার করা ছাড়াও প্রায়শই ‘সামরিক প্রয়ােজনে’ ইসরায়েলে বসবাসকারী আরবদের ঘরবাড়ি অধিগ্রহণ করা হতে থাকে। অল্প সময়ের বিজ্ঞপ্তিতে আরবদের একটি বিশেষ এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। তাছাড়া ইসরায়েলের অভ্যন্তরে কোনাে সন্ত্রাসমূলক কার্য সংঘটিত হওয়ামাত্র সেই এলাকার আরবদের বন্দী করে নির্যাতন করা ও পাইকারি হারে বাড়িঘর ধ্বংস করা একটি নীতি হিসেবে গৃহীত হয়। চাকুরি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও আরবদের প্রতি বৈরী মনােভাবের পরিচয় দেয়া হয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে, গােলান মালভূমি, গাজা এলাকা ও সিনাই উপদ্বীপ দখলের পর এইসব বসবাসকারী আরবদের ওপর একই ধরনের ঔপনেবিশিক শাসন চাপিয়ে দেয়া হয়। বিজিত এলাকাগুলোতে জাতিসংঘের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে যে হারে ইহুদি বসতি স্থাপন করা হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে এই সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণতর হিসেবেই দেখা দেয়।

আরব-ইসরায়েল সংঘাতের বিভিন্ন ইস্যু

জেরুজালেম শহরের প্রশ্ন : জেরুজালেম শহরের প্রশ্ন আরব-ইসরায়েলি সম্পর্ক আরও জটিল ও তিক্ত করে তুলেছে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের বিভক্তি প্রস্তাব অনু্যায়ী সমগ্র শহরে আন্তর্জাতিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হবার কথা ছিল কিন্তু ইসরায়েল সরকার এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাদের রাজধানী পশ্চিম জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়। ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত পুরাতন জেরুজালেমও ইসরায়েলের দখলে আসে। ইহুদি-ধর্মের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে শতকের পর শতক ধরে এই শহরের ওপর ইহুদিদের যে আবেগানুভূতি ছিল, তার বাস্তবরূপ দান করার সুযােগ উপস্থিত হয়েছে বলে তারা মনে করতে থাকে। পুরাতন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের সাথে একীভূত করার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়; ইসরায়েলি মুদ্রা ও কর-ব্যবস্থা চালু করা হয়; জর্দানের পশ্চিম তীরে উৎপাদিত দ্রব্যাদি শহরে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়; বিদ্যালয়গুলোতে ইসরায়েলি শিক্ষাব্যবস্থা এবং আদালতগুলোতে ইসরায়েলি আইন চালু করা হয়। শহর দখল করার অব্যবহিত পরেই হারাম শরিফ সন্নিহিত ‘মাগরিবিয়া মহল্লা’ বুলডােজারের সাহায্যে ভাঙ্গিয়ে ফেলা হয়। ১১৯৩ সালে সালাহ্‌উদ্দীনের পুত্র এলাকাটি উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত আলেম ও হাজিদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেন। কালক্রমে এখানে উত্তর আফ্রিকা মহল্লা গড়ে ওঠে। ৭০০ বছরের অধিককাল বসবাসকারী লােকদের অল্প সময়ের বিজ্ঞপ্তিতে বের করে দিয়ে এই ঐতিহাসকি স্থানটিকে ‘আধুনিক’ করে ফেলা হয়। শহরটিকে যুদ্ধ-পূর্ব অবস্থায় রাখার জন্য এবং অধিকৃত এলাকায় বসতি স্থাপনের বিরােধিতা করে জাতিসংঘে প্রস্তাব গৃহীত হলেও ইসরায়েল সদর্পে এই দুটি কাজই করে চলেছে।

জর্ডান নদী নিয়ে সমস্যা : জর্দান নদীর জলর ব্যবহার ও আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক বিষাক্ত করে তুলেছে। তাইবেরিয়াস হ্রদ থেকে ‘ডেড সী’ পর্যন্ত বিস্তৃত জর্দান নদীই এই এলাকার জন্য উল্লেখযােগ্য লবণমুক্ত নদী। সেচকার্যে ব্যবহারের জন্য এই এলাকার প্রত্যেক দেশই জলর প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। জর্দান নদীর জলর কত ভাগ ইসরায়েল এবং কত ভাগ আরব দেশসমূহ বিশেষত জর্দান ও সিরিয়া-ব্যবহার করবে সেই প্রশ্নেই মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। উপকূলীয় এলাকার বসতিগুলো এবং দক্ষিণে নেগেভ মরু অঞ্চলের সেচকার্যে ব্যবহারের জন্য ইসরায়েল তাইবেরিয়াস হ্রদ ও জর্দান নদী থেকে বেশি পরিমাণ জল টেনে নিতে শুরু করলে সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যেকোনাে নদীর জল সেই নদীর দুই পাশের এলাকায় (Catchment area) ব্যবহৃত হওয়া উচিত। সেই হিসেবে জর্দানের পশ্চিমাঞ্চলে ইসরায়েলের পূর্বাঞ্চলে এবং সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেই জর্দান নদীর জল ব্যবহৃত হওয়া উচিত। কিন্তু এই নিয়ম লঙ্ঘন করে ইসরায়েল তার পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে এই জল পরিচালিত করে। জল ব্যবহারজনিত সঙ্কট নিরসনের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার ১৯৫৩ সালে তার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে এরিক জনস্টনকে এই এলাকায় প্রেরণ করেন। ব্যাপক তদন্তের পর জনস্টন যে রিপাের্ট দেন তাতে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর প্রাপ্য জলর পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু উভয় পক্ষই মনে করতে থাকে যে, তাদের ন্যায্য অংশের থেকে কম পরিমাণ জল নির্দিষ্ট করা হয়েছে। জনস্টনের প্রয়াস তাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ৫ম দশকের শেষভাগ ও ৬ষ্ঠ দশকের শুরুতে ইসরায়েল বৃহৎ ব্যাসার্ধের পাইপ স্থাপন করে অত্যধিক পরিমাণ জল নিয়ে যেতে শুরু করলে তাইবেরিয়াস হ্রদ ও জর্দান নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে জর্দানে (দেশ) ‘পূর্ব গাউর খাল পরিকল্পনা’ বানচাল হবার উপক্রম হয়। আরব নেতৃবন্দ মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে সিরিয়া ও লেবানন থেকে উৎপন্ন হয়ে জর্দান নদীতে পতিত ইয়ারমুক ও হাস্‌বানী নদীতে বাঁধ দিয়ে আরবেরা জলসেচের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এতে জর্দানের জলর প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিধায় ইসরায়েল হুমকি দেয় যে, এই ধরনের কোনাে বাধ নির্মাণ করা হলে ইসরায়েল যেকোনাে মূল্যে তা ধ্বংস করে দেবে। ফলে এই ধরনের বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি, এবং ইসরায়েল জর্দান নদীর জলর সিংহভাগ ব্যবহার করছে।

ইহুদিদের জায়নবাদ বিরোধিতা

ইহুদিদের জায়নবাদ বিরোধিতা : ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ও পরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যে জায়নবাদকে অন্ধ জাতিবিদ্বেষ (Recism) বলে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে তা জায়নবাদের প্রকৃত রূপ উদঘাটনে সাহায্য করেছে। ইসরায়েলে জায়নবাদ বিরােধী ইহুদি নেই তা মনে করা ভুল। এই ধরনের ইহুদিদের প্রধানত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় – 

  • (ক) ধর্মীয় কারণে জায়নবাদ বিরােধী
  • (খ) মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জায়ইনবাদ বিরােধী এবং 
  • (গ) বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে জায়নবাদ বিরােধী।

ধর্মীয় কারণে ইহুদিদের জায়নবাদ বিরোধিতা : প্রথমােক্ত শ্রেণীর মধ্যে ‘নাতুরাই কাত্য ধর্মীয় সম্প্রদায় উল্লেখযােগ্য। তেল আভিভের কাছে বিনাই বারাক ও জেরুজালেমের ‘মিয়া শারিম’ মহল্লায় বসবাসকারী এই সম্প্রদায় মনে করেন যে, মূসায়ী ধর্ম প্রধানত আত্মিক কল্যাণের জন্য জাতীয়তাবাদের সাথে এর কোনাে সম্পর্ক নেই। এই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা (Rabbi) আরন কাতজেনেলবােগেন ও তার উত্তরসূরি মােশে লিয়েব-হিরস (Lieb Hirsch) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জায়নবাদের সমালােচনা করেছেন। এক বক্তৃতায় লিয়েব-হিরশ মন্তব্য করেন “আরবেরা এই জায়নবাদী রাষ্ট্রকে স্বীকার করলেও আমরা করিব না”। (লিয়েব-হিরশের বক্তৃতার জন্য দেখুন, Israleft, March 1, 1975.) তবে এই সম্প্রদায় ক্ষুদ্র হওয়ায়, ইসরায়েলি রাজনীতিতে এরা কোনাে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। 

মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ইহুদিদের জায়নবাদ বিরোধিতা : মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ কিছুসংখ্যক ইহুদি ও জায়নবাদী নীতি ও কার্যকলাপের বিরােধিতা করেছে। শুধু ইসরায়েলে নয়, দেশের বাহিরে এই মনােভাবের ইহুদি রয়েছে। অন্য দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের মধ্যে প্রখ্যাত বেহালাবাদক ইয়াহুদী মেনুহিনের পিতা মােশে মেনুহিন, লেখক আলফ্রেড লিলিয়েনথল ও ধর্মীয় নেতা এলমার বার্জারের নাম উল্লেখযােগ্য। (Moshe Menuhin. The Decadence of Judaism in Our Time (Beirut, 1969); Alfred Lilienthal, The Other Side of the Coin Elmer Berger, Who Knows Belter Must Say So (New York, 1955))। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে মানবতাবাদীদের মধ্যে ভিটোল্ড ইয়াদলিৎজক, ডঃ ইসরায়েল শাহাক ও ফেলিসিয়া ল্যাংগারের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমােক্ত দুইজনই নাৎসী-নির্মিত ইহুদি নিধনকেন্দ্র থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তা সত্ত্বেও তারা উগ্র জায়নবাদী হয়ে যাননি। বরং এর মধ্যে নাৎসীবাদের ছায়া দেখে শঙ্কিত হয়েছেন। জায়নবাদকে ধর্মান্ধতা ও উপনিবেশবাদের সংমিশ্রণ মনে করে তারা এই মতবাদকে ইসরায়েলের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে বিদূরিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে জায়নবাদের বিরোধিতা : প্রকৃত বামপন্থী ইহুদিগণও জায়নবাদ বিরােধী। জায়নবাদীরা একে সমাজতন্ত্র বিরােধী ঔপনিবেশিক মতবাদ বলে মনে করে। ১৯৬২ সালে মােশে ম্যাকমােভার Israeli Socialist Organization (Matzpen) প্রতিষ্ঠা করেন। ‘ইসরায়েলের প্রত্যাবর্তন আইন’ (১৯৫০) এবং জাতীয়তা আইন’ (১৯৫২) বিশ্লেষণ করলেই এই রাষ্ট্র যে একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত তা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। (এ সম্বন্ধে দেখুন, Le Sionisme Contre Israel (paris, 1969.))। ম্যাজপেন এর বিরােধিতা করে। এই দলের মতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যে ইহুদি সমস্যার সমাধান করতে পারেনি তার কারণ এই রাষ্ট্র অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (ম্যাজপেনের মত সম্বন্ধে দেখুন, Arie Bober (ed.,) The Other Israel: The Radical Case Against Zionism (New York 1972.))। কিছুসংখ্যক বামপন্থী যুবক ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে কাজ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছে। এদের মধ্যে মারিয়াস শাতনার, জোরা নিউম্যান, রুবেন ল্যাসম্যান, ইরিস ইয়াকোবী, এহুদ আদিভ, ভ্যান ভেরেদ ও রামি লিভনের বিচার ও শাস্তি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ১৯৭০ সালে ম্যাজপেন কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তবে প্রতিটি উপদলই জায়নবাদের বিরুদ্ধে।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য, প্রথম খণ্ড (১৯৭৮), সফিউদ্দিন জোয়ারদার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.