Table of Contents
শঙ্গম যুগ (আনু. খ্রি.পূ. ৫০০ অব্দ – খ্রি. ৩০০ অব্দ)
দক্ষিণ ভারতের, বিশেষত তামিলনাড়ুর ইতিহাসে শঙ্গম যুগ এক অত্যুজ্জ্বল পৰ্বরূপে চিহ্নিত। এই সময় শুধু যে তামিল সাহিত্যেরই অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটল তা নয়, আয় ও স্থানীয় সংস্কৃতির মিলনে এক সমন্বিত সংস্কৃতির অভ্যুদয় হল। উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে ভাবের সেতুবন্ধ রচিত হল। কেবল দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে নয়, ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসেও এই যুগ বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
শঙ্গম সাহিত্য
সংজ্ঞা : শঙ্গম সাহিত্য বলতে তামিল সাহিত্যের আদি পর্যায় বা প্রাথমিক স্তর বােঝায়। এই পর্যায়ে বহু সংখ্যক কবিতা আছে। প্রাচীন তামিল কবিরা এসব কবিতা রচনা করেছেন। পরে কবি-গােষ্ঠী বা কবি-পরিষৎ এই কবিতাগুলোকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা অনুমােদন দান করেছে। শঙ্গম কথাটি এসেছে দ্রাবিড় শব্দভাণ্ডার থেকে। গােষ্ঠী, সমাজ, সমিতি বা পরিষৎ অর্থেই এর প্রয়ােগ হয়েছে। এই গােষ্ঠী, সমাজ বা পরিষৎ কবিগণের বা বিদ্বজ্জনের গােষ্ঠী, সমাজ বা পরিষৎ। কবি-গােষ্ঠী, কবি-পরিষৎ বা বিদ্বৎ-সমাজ এই সাহিত্যকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন বলে এই সাহিত্যের নাম শঙ্গম।
প্রথম শঙ্গম : ইরৈয়নার-এর লেখা ‘অহপ্পোরুল’-এর উপর টীকা লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত তামিল ভাষ্যকার নক্কীরর তিন তিনটি শঙ্গম বা কবি-পরিষদের কথা বলেছেন। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রথম শঙ্গম স্থাপিত হয়েছিল প্রাচীন মাদুরাই শহরে। বর্তমানে শহরটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে আছে। এই কবি-পরিষদের সভাপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন মহামুনি অগস্ত্য। তিরিপুরমেরিৎথ বিরিসদৈক্কবুল (শিব), কুনরমেরিন্দ মুরুগবেল (মুরুগ অথবা সুব্রহ্মণ্য) এবং মুরঞ্চিয়ুর মুদিনাগরায়র (আদিশেষ)-এর মতাে দেবতারা এই কবি-সংস্থার সদস্য ছিলেন। সর্বসমেত ৫৪৯ জন সভ্য এই পরিষদের সদস্য ছিলেন। কবি-সমাজ ৪৪৯৯ জন কবির কবিতা অনুমােদন করে। ৮৯ জন পাণ্ড্য রাজা এই শঙ্গমের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। পৃষ্ঠপােষক পাণ্ড্য রাজাদের মধ্যে ৯ জনই কবি ছিলেন। ৪৪০০ বছর এই কবি-পরিষৎ স্থায়ী হয়েছিল। অকত্তিয়ম, পরিপদাল, মৃদুনারৈ, মৃদুকুরুকু ও কলরিআরিয়ৈ এই পর্বের উল্লেখযােগ্য কবিতা সংকলন।
দ্বিতীয় শঙ্গম : দ্বিতীয় কবি-পরিষদের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কপাতপুরম বা অলৈবাই শহরে। বর্তমানে শহরটি সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে আছে। ৩৭০০ বছর স্থায়ী এই সংস্থার মােট ৪৯ জন সভ্য ছিলেন। অগস্ত্য, ইরুয়ুর কুরুঙ্গোলিমােসি ও বেল্লুরকাপিয়ন-এর মতাে ব্যক্তিত্বরা এই সভার সদস্য ছিলেন। ৩৭০০ জন কবির কবিতা এই সভায় অনুমােদিত হয়। ৫৯ জন পাণ্ড্য রাজা এই সভার পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। সমিতির বিশাল গ্রন্থাগারে ৮,১৪৯টি গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, গ্রন্থাগারের সব কটি গ্রন্থ সমুদ্রের জলে ভেসে গেছে। এ পর্বে রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে অকত্তিয়ম, তােলকাপ্পিয়ম, মাপুরানম ইসৈনুলুক্কম, ভূতপুরানম, কলি, কুরুকু, বোলি এবং ব্যালমালৈ। তােলকাপ্পিয়ম ব্যাকরণ গ্রন্থখানি ছাড়া বাকি সব কটি গ্রন্থই বিনষ্ট হয়ে গেছে।
তৃতীয় শঙ্গম : তৃতীয় শঙ্গম বা কবি-গােষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল উত্তর মাদুরাই শহরে। এই গোষ্ঠীর আয়ুষ্কাল ছিল ১৮৫০ বছর। ৪৯ জন সদস্যবিশিষ্ট এই কবি-পরিষৎ সমসংখ্যক পাণ্ড্য রাজার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছে। তিরুবল্লুবর তার বিখ্যাত কুরল গ্রন্থের শেষের দিকে তৃতীয় শঙ্গমের সদস্যদের নাম উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযােগ্য ছিলেন নক্কীরর, ইরৈয়নার, কপিলর, পরনর, শীত্তলৈ শাত্তনর এবং পাণ্ড্যরাজ উগ্র। অবশ্য ‘মণিমেকলৈ’ মহাকাব্যের রচয়িতা শীত্তলৈ শাত্তনরকে অনেকেই শঙ্গম যুগের কবি বলে স্বীকার করেন না। ইরৈয়নার এই পর্বে রচিত গ্রন্থসমূহের যে তালিকা দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে নেদুনথােকৈ, কুরুনথােকৈ, নত্রিনৈ, অইনকুরুনুরু, পদিত্রুপাত্তু, নূত্রৈংবথু, পরিপাদল, কুথু, বরি, পেরিসৈ এবং সিত্রিসৈ। এসব গ্রন্থের বেশির ভাগই আজ অবলুপ্ত, অল্পসংখ্যক কয়েকখানি গ্রন্থ এখনও বর্তমান।
কাল-সীমা ও বিতর্ক : ইরৈয়নার তিনটি শঙ্গম বা কবি-পরিষদের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে যুক্তির চেয়ে কল্পনা বা অন্ধবিশ্বাসই প্রাধান্য পেয়েছে –
- তার বর্ণনা অনুসারে শঙ্গম যুগ ৯৯৫০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। সাধারণত মনে করা হয়, ৩০০ বা ৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শঙ্গম যুগের সমাপ্তি ঘটেছিল। তাহলে ধরে নিতে হবে, ৯৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শঙ্গম সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল। এরূপ সিদ্ধান্ত অবশ্যই অনৈতিহাসিক।
- দ্বিতীয়ত, শঙ্গম যুগের আয়ুষ্কাল সম্পর্কে বিতর্ক আছে ঠিকই তবু দশ হাজার বছরব্যাপী এক শঙ্গম যুগের কল্পনা যুক্তিহীন, অবাস্তব বলেই মনে হয়।
- তৃতীয়ত, ইরৈয়নার তিন শঙ্গমের সভ্যরূপে যাদের নামােল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন দেবতা। শঙ্গমের সদস্যরূপে দেবতাদের উল্লেখ এ বর্ণনাকে অলৌকিকতা দান করেছে।
ইরৈয়নার-এর বিবরণ সম্পর্কে পণ্ডিত মহলে যতই সংশয় থাকুক না কেন, শঙ্গম সাহিত্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিন্তু সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। শঙ্গম সাহিত্যের সময় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ-মহলে বাগ-বিতণ্ডা আছে। এর প্রকৃত অবয়ব সম্পর্কেও বিতর্কের শেষ নেই। শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার মনে করেন, ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ এই দীর্ঘ হাজার বছর ধরে শঙ্গম সাহিত্যের সংকলনপর্ব অব্যাহত ছিল। পক্ষান্তরে নীলকান্ত শাস্ত্রীর মতাে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক খ্রিস্টীয় ১০০-৩০০ অব্দকে শঙ্গম পর্বরূপে চিহ্নিত করেছেন। শঙ্গম যুগের শুরু ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর সমাপ্তি ২০০ খ্রিস্টাব্দে, এরূপ একটি অভিমতও প্রচলিত আছে। বিষয়টি বিতর্কিত।
শঙ্গম সাহিত্যের অবয়ব নিয়ে বিতর্ক : বিতর্ক রয়েছে শঙ্গম সাহিত্যের অবয়ব সম্পর্কেও। শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার শঙ্গম সাহিত্যের এক বৃহত্তর অবয়বের কথা বলেছেন। তার মতে শঙ্গম সাহিত্যে রয়েছে তিনটি অঙ্গ। অঙ্গ তিনটি হল পথুপাস্তু বা বর্ণনামূলক দশটি কবিতা, এত্তুথােকৈ বা অষ্ট সংকলন এবং পদিনেলকীলকনক্কু বা অষ্টাদশ নীতিমূলক কবিতা-গ্রন্থ। তিরুবন্দুবর-এর বিখ্যাত গ্রন্থ কুরল এই অষ্টাদশ নীতিমুলক কবিতা-গ্রন্থেরই একটি। মানব-জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও শাশ্বত ভাবনার কথা কুরল গ্রন্থে ধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এই অষ্টাদশ নীতিমূলক কবিতাগুলোকে শঙ্গম সাহিত্যের অঙ্গ বলে স্বীকার করেন না। তাদের অভিমত পৎথুপাত্তু ও এত্তুথােকৈ, এই দু’ধরনের কবিতা নিয়েই শঙ্গম সাহিত্য গড়ে উঠেছে।
বর্ণনামূলক কবিতা-দশক :
- নক্কীরর : বর্ণনামূলক দশটি কবিতার মধ্যে দু’টিই নক্কীররের লেখা। এদের একটি তিরুমূরুকাৎত্রুপ্পদৈ, অন্যটি নেদুনলবাদৈ। প্রথম কবিতাটি দেবতা মুরুগ-এর প্রশস্তি। দেবতা মুরুগ যেসব মন্দিরে পূজিত হন, সেসব দেবালয়ের মনােরম বর্ণনা আছে এ কবিতায়। নক্কীররের দ্বিতীয় কবিতায় বর্ণিত হয়েছে রাজা নেদুঞ্চেলিয়ন ও তার রানির বিরহ-বেদনা। রাজা যুদ্ধক্ষেত্রে, আর নিঃসঙ্গ রানি রাজপ্রাসাদে। রাজা ও রানির মনােবেদনা মর্মস্পর্শী ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে এ কবিতায়।
- উরুত্তিরঙ্গয়ণ্ণনার : শঙ্গম যুগের আর একজন কবি দু’টি বর্ণনামূলক কবিতা লিখেছেন। তিনি উরুত্তিরঙ্গয়ণ্ণনার। তার লেখা এক কবিতা ‘পেরুম্পানাৎত্রুপদৈ’। এই কবিতাটি ৫০০ স্তবকের। কাঞ্চীপুরম শহরের এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আছে এ কবিতায়। এই প্রখ্যাত কবির লেখা আর একখানি কবিতা ‘পট্টিনপ্পালৈ’। এটি প্রেমের কবিতা। শােনা যায়, এই কবিতাটি রচনা করে তিনি রাজা করিকালের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ পুরস্কার পান। কবিতার নায়কের মনে দ্বন্দ্ব জেগেছে। নায়ক একদিকে দয়িতার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছেন। অন্যদিকে তার কাছে যুদ্ধে যােগদানের আহ্বান এসেছে। আবেগের কাছে কর্তব্যের ডাক হার মানল। নায়ক শেষ অবধি দয়িতার সান্নিধ্যই বেছে নিলেন। প্রাচীন চোল রাজধানী পুহার-এর এক অনুপম বর্ণনা আছে এ কবিতায়।
- মরুথনার : মরুথনার রচনা করেছেন ‘মদুরৈককাঞ্চি’ নামে এক বর্ণনামূলক কবিতা। এ কবিতায় রাজা নেদুঞ্চেলিয়নের রাজত্বের সপ্রশংস বর্ণনা আছে, প্রাচীন তামিল সমাজ-জীবনের নানা তথ্যের পরিবেশনা আছে।
- কন্নিআর : ‘পােরুনরাত্রুপ্পদৈ’ কবিতাখানি কন্নিআর-এর লেখা। এ কবিতায় কবিদের দারিদ্র-জর্জরিত জীবনযাত্রা বর্ণিত হয়েছে।
- নথ্থথনার : নথ্থথনার রচনা করেছেন ‘সিরুপানলুপ্পদৈ’ কবিতা। সমকালীন সমাজের খুঁটিনাটি তথ্য আছে এই কবিতায়। রাজা নল্লিঅ কোদন-এর বিবিধ চারিত্রিক গুণাবলি এই কবিতায় প্রশংসিত হয়েছে। আসলে কবি এখানে একজন আদর্শ নরপতির চিত্র একেছেন।
- নপ্পুথনার : নপ্পুথনার-এর রচনা ‘মুল্লৈপ্পা’ ১০০ স্তবকের এক কবিতা। এই কবিতায় বর্ণিত হয়েছে এক রানির তার প্রবাসী স্বামীর সান্নিধ্য লাভের তীব্র আকুলতা। রানি উদগ্রীব হয়ে আছেন, অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, কখন তার স্বামী ফিরে আসবেন, এই ভাবনায়। অবশেষে তার উৎকণ্ঠা দূর হল। রানি দূর থেকে তার স্বামীর বাদ্যধ্বনি শুনতে পেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বামী তার দৃষ্টির মধ্যে এসে পড়বেন।
- কপিলর : কপিলর-এর রচনা ‘কুরিঞ্চিপ্পাত্তু’। এক পার্বত্য সর্দার ও এক সুন্দরী রমণীর প্রণয় এ কবিতার বিষয়বস্তু। তাদের বিবাহের পথে বাধা ছিল বিস্তর। ধীরে ধীরে সব সমস্যার সমাধান হল। তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
- কৌসিকনার : কৌসিকনার-এর লেখা ‘মলৈপদুকদাম’ ছ’শাে স্তবকের এক কবিতা। প্রকৃতির অনুপম বর্ণনা আছে এই কবিতায়। নৃত্যকলা সম্পর্কেও সুন্দর মন্তব্য আছে এতে।
বর্ণনামূলক এই দশটি কবিতার সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। কবিরা প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ আকণ্ঠ পান করেছেন, মনুষ্যহৃদয়ের গহন করে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। প্রকৃতির বর্ণনায় ও হৃদয়বৃত্তির বিশ্লেষণে তারা অসামান্য পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। করিকাল চোল ও নেদুঞ্চেলিয়ন-এর উদ্দেশ্যে এই দশটির দু’টি করে কবিতা উৎসর্গিত হয়েছে। অধ্যাপক শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার মনে করেন, কবিতাগুলো খ্রিস্টীয় ২য় শতকে রচিত হয়েছিল।
অষ্ট সংকলন : অষ্ট সংকলনের এক একটিতে আছে কয়েকটি করে ছােটো গীতি-কবিতা। প্রথম সংকলনটির নাম ‘নত্রিনৈ’। এতে আছে চারশােটি ছােটো গীতিকবিতা। দ্বিতীয় সংকলনটির নাম ‘কুরুনথােকৈ’। প্রায় দু’শাে জন কবির লেখা প্রেম পর্যায়ের চারশাে কবিতা এই সংকলনে স্থান পেয়েছে। ‘ঐনকুরুনূরু’ এই পর্যায়ের তৃতীয় সংকলন। ৫ জন কবির ৫০০টি প্রণয়মূলক কবিতার সংকলন এটি। মিলন, বিচ্ছেদ, প্রতীক্ষা, বিলাপ ও অভিমান – প্রেমের এই পাঁচটি রূপকে আশ্রয় করেই কবিতাগুলো রচিত হয়েছে। চতুর্থ সংকলন ‘পদিত্রুপাত্তু’। আদিতে এটি ছিল দশ স্তবকের দশটি কবিতার সংকলন। কিন্তু বর্তমানে প্রথম ও সর্বশেষ কবিতাটি আর পাওয়া যায় না। মুখ্যত, চের রাজাদের শেীর্য-বীর্য ও চারিত্রিক গুণাবলি অবলম্বন করে কবিতাগুলো রচিত হলেও এদের সামাজিক গুরুত্ব কম নয়। বিনােদন, মৃতদেহ সৎকার ও নারীদের কেশচর্চার মতাে সামাজিক বিষয়ের অবতারণা আছে এই কবিতাগুলোতে। এই সংকলনে যেসব রাজাদের উল্লেখ আছে তারা খ্রিস্টীয় ২য়-৩য় শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। হয়তাে তখনই কবিতাগুলো রচিত হয়েছিল। পরনর, কপিলর, পলৈ, কৌথম্নার, কাক্কৈ পাদিনৈআর এই পর্বের কয়েকজন খ্যাতনামা কবি। এদের মধ্যে কাক্কৈ পাদিনৈআর ছিলেন মহিলা কবি। পঞ্চম গীতি সংকলন “পরিপাদল”। প্রথম দিকে সংকলনটিতে সর্বসমেত ৭০টি কবিতা ছিল কিন্তু এখন মাত্র ২৪টি কবিতা অবশিষ্ট আছে। সংকলন ‘কলিথােকৈ’। ১৫০টি প্রেম পর্যায়ের কবিতার সংকলন এটি। কপিলর ও তারও চারজন কবি এই কবিতাগুলো রচনা করেছেন। সপ্তম সংকলন ‘অহনানূরু’ এটির আর এক নাম ‘নেদুনথােকৈ’। এতে আছে ৪০০টি প্রণয়মূলক কবিতা। পরনর ও মামূলনার এই সংকলনের বেশির ভাগ কবিতা রচনা করেছেন। এই পর্যায়ের সর্বশেষ সংকলনটির নাম ‘পুরনানূরু’। ১৫০ জন কবির ৪০০টি কবিতা এই সংকলনে স্থান পেয়েছে। কপিলর, অবৈব, কোবর-কিলার, পেরুনথলৈ শাত্তনার, পেরুম-সিত্তিরনার এবং উরৈয়ুর এনিচেরি মুদমােসিয়ার এই সংকলনের খ্যাতনামা কবি। এই কবিতাগুলোতে একদিকে যেমন উন্নতমানের সাহিত্য কীর্তির অভিব্যক্তি ঘটেছে, অন্যদিকে তেমনি প্রাচীন তামিল সমাজের চালচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।
অষ্টাদশ নীতিমূলক কবিতাগ্রন্থ : অষ্টাদশ নীতিমূলক কবিতাগ্রন্থের প্রথমটির নাম ‘নালদিয়ার’। এটি একটি সংকলন বিশেষ। জৈন কবিদের লেখা ৪০০টি চতুস্পদী কবিতার সংকলন এটি। তবে এই পর্যায়ের সবকটি কবিতাই যে উন্নতমানের তা বােধ হয় না। দ্বিতীয়টিও একটি কবিতা-সংকলন। এর নাম ‘নানমনিক্কদৈকৈ’। এতে আছে কবি নাগনার-এর লেখা ১০০টি চতুষ্পদী কবিতা। পরবর্তী চারটি কবিতাগ্রন্থ হল “কারনারপথু’, ‘কলবলি নারপথু’, ‘ইনিঅবৈ নারপথু’ ও ‘ইন্ন নারপথু’। এদের সামগ্রিকভাবে ‘না নারপথু’ও বলে। প্রথম কবিতাটিতে জনৈকা প্রােষিতভর্তৃকার বিরহ-বেদনা অভিব্যক্ত হয়েছে। ‘কলবলি নারপথু’তে এক চেররাজ ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী চোল নৃপতির সংঘর্ষ বর্ণিত হয়েছে। অনেকে বলেন, তখনকার দিনের প্রখ্যাত বৈষ্ণব-সাধ্বী পৌইকৈ আড়বার এই কবিতাটি রচনা করেছেন। পরবর্তী চারটি কবিতাগ্রন্থ একত্রে ‘এনথিনৈ’ নামে পরিচিত। এই পর্যায়ের কবিতাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে নর-নারীর হৃদয়াবেগ ও তাদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন।
তিরুবল্লুবর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কুরল’ এই পর্যায়ের একাদশ কবিতাগ্রন্থ। ব্রহ্মার অবতাররূপে কল্পিত তিরুবল্লুবর তামিল সাহিত্য-গগনের এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। মানবজীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা ও শাশ্বত আদর্শের অভিব্যক্তি ঘটেছে তার এই অমর কবিতাগ্রন্থে। রাজনীতি, নীতিকথা, প্রেম, দাম্পত্যজীবন, নাগরিকত্ব, আইন-আদালত সব কিছুই সুনিপুণভাবে এই গ্রন্থে বিশ্লেষিত হয়েছে। বাচনভঙ্গির সৌন্দর্য, সারল্য, স্বকীয়তা ও পরিমিতিবােধ কবিতাগুলোকে মনােহারিত্ব দান করেছে। তামিলভাষীদের গৃহে গৃহে আজও এই কাব্যখানি সাগ্রহে পঠিত হয়। কাব্যখানি ১১৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত। আবার প্রতিটি অধ্যায়ে আছে দশটি করে দু’চরণের কবিতা। এই পর্যায়ের বাকি কবিতাগুলো হল ‘তিরিকদুকম’, ‘আচারকোবৈ’, ‘পলমােলি’, ‘সিরুপঞ্চমূলম’, মুদুমােলিক কাঞ্চি’, ‘ইন্নিনৈ’ এবং ‘এলাদি’। এসব কবিতায় মানবিক গুণের বিকাশ ও অনুশীলনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
শঙ্গম সাহিত্যের সর্বজনীনতা : উপরের আলােচনা থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, অসমিয়া, বাংলা, হিন্দি প্রভৃতি বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার জন্মের বহু পূর্বে তামিলনাড়ুতে এক সমুন্নত সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাক ও আদি খ্রিস্টীয় পর্বের সে সাহিত্যে শুধু ঠাকুর-দেবতা বা রাজা-মহারাজদের কথা বলা হয়নি, সমাজের সর্বস্তরের লোকেদের কথা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিরহ বেদনা ও ঘর বাঁধার স্বপ্নের কথাও বলা হয়েছে। এই সাহিত্য সৃষ্টির মহাযজ্ঞে যেসব কবি সামিল হয়েছিলেন তারা তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন, তাদের পেশা ছিল ভিন্ন, ধর্মমতও ছিল ভিন্ন। শঙ্গম সাহিত্য সর্ব অর্থেই সর্বজনীন সাহিত্য হয়ে উঠেছে। এই উদার, সর্বজনীন বাতাবরণের সঙ্গে পদ লালিত্যের মণিকাঞ্চন যােগ শঙ্গম সাহিত্যকে বিশিষ্টতা দান করেছে।
রাজনৈতিক জীবন
শঙ্গম সাহিত্যে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক জীবনের একটি ছবি পাওয়া যায়। এ ছবি পূর্ণাঙ্গ নয়, অসম্পূর্ণ। শঙ্গম সাহিত্যে রাজাদের নামােল্লেখ আছে, রাজাদের বংশ পরিচয়ও দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাজাদের বা রাজবংশের ইতিহাসের কোনও ধারাবাহিক বর্ণনা নেই। যে বিবরণ আছে তা সংক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া বাকি রাজাদের সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্যও পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা রাজাদের বীরত্ব, দানশীলতা ও যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পর্কিত প্রশস্তিবাচক মন্তব্য। পরবর্তী যুগের তামিল সাহিত্যে বা ১১শ-১২শ শতকের লেখমালায় এই পর্বের রাজনৈতিক জীবনের কিছু বর্ণনা আছে কিন্তু তা মূলত কল্পনাশ্রিত।
শঙ্গম সাহিত্যে যেসব রাজাদের উল্লেখ আছে বংশপরিচিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় – চের, পাণ্ড্য ও চোল। আবার চের, পাণ্ড্য ও চোল রাজারা সকলেই যে তাদের নিজ নিজ বংশের একই শাখাযুক্ত ছিলেন তা নয়, তারা বিভিন্ন শাখার সদস্য ছিলেন।
চের রাজবংশ
উদয়ঞ্জেরাল : শঙ্গম সাহিত্যে উল্লিখিত চের রাজাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রাচীন তার নাম উদয়ঞ্জেরাল। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে তিনি কৌরব ও পাণ্ডব সৈন্যদের ভূরিভােজে আপ্যায়িত করেছিলেন বলে শঙ্গম সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এসব উক্তি তাৎপর্যহীন। সাধারণত মনে করা হয়, খ্রিস্টীয় ২য় শতকের মধ্যভাগে তিনি কেরল ও সংলগ্ন তামিল ভূখণ্ডে অবস্থিত চের অঞ্চলে রাজত্ব করতেন।
নেদুঞ্জেরল : উদয়ঞ্জেরালের পরবর্তী চেরনৃপতি ইমৈয়বরমবন নেদুঞ্জেরল আদন। এই দুই রাজার মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল বা তারা আদৌ একই শাখাভুক্ত ছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত কিছু জানা যায় না। শঙ্গম যুগের বিভিন্ন কবিতায় নেদুঞ্জেরল এক বিখ্যাত রাজারূপে বর্ণিত হয়েছেন। তিনি যবনদের যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের বন্দি করে রাজধানীতে নিয়ে আসেন এবং পরে প্রচুর উপঢৌকনের বিনিময়ে তাদের মুক্তি দান করেন। নেদুঞ্জেরলের হাতে পরাজিত যবনেরা সম্ভবত গ্রিস বা আরবদেশীয় বণিক ছিলেন। তাদের রোমক হওয়াও বিচিত্র নয়। তিনি সমুদ্র নিকটবর্তী কদম্ব অঞ্চল অধিকার করেন। কদম্ব সম্ভবত কর্ণাটকের বনবাসির সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। কোনও কোনও কবিতায় তাকে আসমুদ্র হিমাচলের অধীশ্বররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনা অতিশয়ােক্তিমূলক। রাজত্বের শেষের দিকে তিনি জনৈক চোলরাজের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধে তিনি এ চোলরাজ উভয়েই মৃত্যুবরণ করেন। শােনা যায়, চেররাজের দুই রানি স্বামীর প্রজ্বলিত চিতাকুতে আত্মাহুতি দিয়ে সতীধর্ম পালন করেন। নেদুঞ্জেরলের প্রতিদ্বন্দ্বী চোলরাজের পরিচয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
শেনগুটুবন : নেদুঞ্জেরল আদনের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র পর পর রাজত্ব করেন। শেষােক্ত নরপতি শঙ্গম সাহিত্যে শেনগুটুবন নামে পরিচিত। তিনি আনুমানিক ১৮০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। অস্ত্রবিদ্যায় তার অসামান্য দক্ষতা ছিল, হস্তী ও অশ্ব চালনায় তার উল্লেখযােগ্য নৈপুণ্য ছিল। কয়েকটি যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেন। মােহূর-এর রাজাকে তিনি পদানত করেন, কোঙ্গু অঞ্চলে অবস্থিত কোডূকূর দুর্গ তিনি অধিকার করেন। তিনি সম্ভবত একটি নৌবাহিনীও গঠন করেন। শুধু সামরিক ক্ষেত্রে নয়, সাংস্কৃতিক জগতেও তিনি সুনাম অর্জন করেন। বহু জ্ঞানী গুণিজন তার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছেন, সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি পরনর তার অনুগ্রহভাজন ছিলেন। তিনি দেবী পত্তিনির পূজা প্রবর্তন করেন। কথিত আছে, দেবীর মূর্তি নির্মাণের জন্য তিনি উত্তর ভারত থেকে পাথর সংগ্রহ করেছিলেন।
রাজধানী : বনজি ছিল চেররাজ্যের রাজধানী। তবে শহরটির সঠিক অবস্থান জানা যায় না। অনেকে। বলেন, তিরুচিরাপল্লীর নিকটস্থ বর্তমান করূর প্রাচীন বনজির স্মৃতি বহন করছে। আবার কারাের মতে শহরটি কোচিনের নিকট তিরুবনজিকুলমে অবস্থিত ছিল। হয়তাে প্রথম মতই ঠিক।
শেল্বক্কডুঙ্গো : নেদুঞ্জেরল আদন ও তার বংশধরদের রাজত্বকালে আর একটি চের শাখা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই শাখার অন্তত তিনজন রাজার কথা জানা যায় – অন্দুবন, তার পুত্র শেল্বক্কডুঙ্গো বালি আদন ও পৌত্র তগডূরএরিন্দ পেরুঞ্চেরল ইরুমপােরৈ। এই চেররাজ্য কাবেরী অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। শেল্বক্কডুঙ্গো এই শাখার শ্রেষ্ঠ নরপতি। কবি কপিলর তার বহু কবিতায় এই রাজার প্রচুর বৈদিক যাগযজ্ঞ, দানশীলতা ও যুদ্ধজয়ের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। বিষ্ণুভক্ত এই নৃপতি ২৫ বছর রাজত্ব করেন। তিনি অপর চের রাজ্যের অধিপতি ইমৈয়বরমবন নেদুঞ্চেরল আদনের ভায়রাভাই ছিলেন।
তগডূরএরিন্দ : শেল্বক্কডুঙ্গোর মৃত্যুর পর তার পুত্র তগডূরএরিন্দ পেরুঞ্জেরল ইরুমপােরৈ আনুমানিক ১৯০ খ্রিস্টাব্দে পিতৃসিংহাসনে আরােহণ করেন। অরিশিল কিলার এবং মােশি কিরন-এর মতাে দু’জন খ্যাতনামা কবি তার অনুগ্রহভাজন ছিলেন। তিনি কলুবুল নামে এক উপজাতীয় দলপতিকে পরাজিত করে তার প্রশাসনিক কেন্দ্র কামুর অধিকার করেন। কামুরের অবস্থান জানা যায় না। তগড়ুর দুর্গ বিজয় তার রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা। চোল ও পাণ্ড্য রাজারা তগড়ুর দুর্গের অধিপতি অদিগমানকে সাহায্য করেন। তৎসত্ত্বেও অদিগমান যুদ্ধে পরাজিত হন এবং চেররাজের বশ্যতা স্বীকার করেন। এই রাজা ১৭ বছর রাজত্ব করেন।
পেরুঞ্জেরল ও ইরুমপােরৈ : আরও দু’জন চেররাজের কথা শােনা যায়। এদের একজন পেরুঞ্জেরল আদন, অন্যজন কণৈক্কাল ইরুমপােরৈ। প্রথমােক্ত জন প্রখ্যাত চোলরাজ করিকালের সমকালবর্তী, অপর জন উত্তর পর্বের। পূর্বোক্ত চেররাজদের সঙ্গে এই দুই রাজার কী সম্পর্ক ছিল বা এদের দুজনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কই-বা কী ছিল, সে সম্পর্কে শঙ্গম সাহিত্য সম্পূর্ণ নীরব। পেরুঞ্জেরল আদন বেণ্ণির যুদ্ধে করিকালের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে পিঠে আঘাত পেয়ে ক্ষোভে ও অপমানে প্রায়ােপবেশনে মৃত্যুবরণ করেন। কণৈক্কাল ইরুমপােরৈ চোলরাজ শেঙ্গণান-এর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন কিন্তু তিনি পরাজিত ও বন্দি হন। শেষে কবিবন্ধু পােয়গৈয়ার-এর সহায়তায় চোল কারাগার থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করেন।
চোল রাজবংশ
শঙ্গম সাহিত্যে চোল রাজাদের কথা বারবার উল্লিখিত হয়েছে। পরাক্রম, ব্রাহ্মণ্যধর্মানুরাগ, বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান, দানশীলতা, বিদ্যোৎসাহশীলতা প্রভৃতি গুণের জন্য চোল রাজারা শঙ্গম সাহিত্যে প্রশংসিত হয়েছেন।
ইলঞ্জেটচেন্নি : একজন চোলনৃপতি ইলঞ্জেটচেন্নি। কবি পরনর ও পেরুঙ্গুনরূর কিলার তার সুশাসনের প্রশংসা করেছেন। অনুমান করা হয়, ১৬৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেন।
করিকাল : ইলঞ্জেটচেন্নির পুত্র করিকাল। শঙ্গম যুগের শ্রেষ্ঠ রাজা এই করিকাল। সমকালীন যুগে তার সম্পর্কে বহু কবিতা রচিত হয়েছে। পরবর্তী তামিল সাহিত্য ও লেখমালায় তার সম্পর্কে সত্য মিথ্যা নানা কাহিনি পরিবেশিত হয়েছে। কেন তার নাম করিকাল তা নিয়ে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক আছে। অগ্নিদগ্ধ যার পা তিনি করিকাল, এই অর্থে অনেকে করিকাল শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন। আবার কলির যিনি কাল অর্থাৎ যম তিনিও করিকাল। আবার করি বলতে হস্তীও বােঝায়। এই অর্থে, শত্রুপক্ষীয় হস্তীদের যিনি মৃত্যুস্বরূপ, তিনিও করিকাল।
প্রথম জীবনে করিকালকে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। পিতৃসিংহাসনের উপর তার ন্যায্য অধিকার ছিল কিন্তু শত্রুরা তাকে বন্দি করেন। করিকাল নিজ বুদ্ধিবলে মুক্তি লাভ করেন এবং শত্রুদের পরাজিত করে সিংহাসন অধিকার করেন। ঘটনাকাল আনুমানিক ১৯০ খ্রিস্টাব্দ। করিকালের সিংহাসন উদ্ধারের বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনি পট্টিনপ্পালৈ কবিতায় বর্ণিত হয়েছে।
বেণ্ণির যুদ্ধে বিজয়লাভ করিকালের রাজত্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা। বেন্নির বর্তমান নাম কোবিল বেন্নি। স্থানটি তঞ্জাবুর শহরের ২৫ কি. মি. পূর্বে অবস্থিত। এখানে করিকালের সঙ্গে পাণ্ড্য ও চের রাজার সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয়। এই যুদ্ধে করিকালের প্রতিপক্ষ চেরনৃপতি পেরুঞ্জেরল আদন পিঠে আঘাত পান। যুদ্ধে পিঠে আঘাত পাওয়ার চেয়ে লজ্জাকর ঘটনা সৈনিকের আর কিছুই নেই। সৈনিক পলায়মান হলে তবেই শত্রুপক্ষের অস্ত্র তার পিঠে আঘাত হানে। অর্থাৎ, বেগতিক দেখে পেরুঞ্জেরল আদন যখন যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করেন তখনই চোলপক্ষের অস্ত্র এসে তার পৃষ্ঠদেশ বিদ্ধ করে। এ ঘটনায় চেররাজ মর্মাহত হন এবং আমৃত্যু অনশনে জীবন ত্যাগ করেন। পাণ্ড্য ও চের নরপতিদের বিরুদ্ধে জয়লাভের ফলে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক আকাশে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্করূপে আবির্ভূত হলেন চোল নৃপতি করিকাল।
বাহৈপ্পরন্দলৈর যুদ্ধে জয়লাভ করিকালের রাজত্বের আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এই যুদ্ধে ৯ জন ক্ষুদ্র নরপতি বা উপজাতীয় দলপতি চোলরাজের নিকট পরাজয় বরণ করেন। এই যুদ্ধের কারণ বা শত্রু রাজাদের পরিচিতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
কবি উরুত্তিরঙ্গণ্ণনার রচিত পটিনপ্পালৈ কবিতায় করিকালের রাজ্যজয়ের এক মনােজ্ঞ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। এই কবিতায় বলা হয়েছে, করিকাল এয়িনরদের পরাজিত করেন, ওলিয়রদের ক্ষমতা খর্ব করেন, অরুবালরদের দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেন, উদীচ্য দেশবাসীদের গৌরব হরণ করেন। এয়িনর গােষ্ঠী দক্ষিণ আর্কট জেলার তিনদিবনম ও উত্তর বিল্লুপুরম তালুক এবং চিপ লেপুট জেলার মাদুরান্তকম তালুকের শাসনকর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ওলিয়রদের সঠিক পরিচয় অজ্ঞাত। অনেকের মতে তারা আধুনিক রমানাথপুরম জেলার শাসনকর্তা ছিলেন। অধ্যাপক তেরলুণ্ডুর বেঙ্কটরাম মহালিঙ্গম তাদের কলভ্র বলে সনাক্ত করেছেন (Kalichipuram In Early South Indian History (Madras, 1969), পৃষ্ঠা ১২-৪)। কলভ্ররা সম্ভবত মাদুরাই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। অরুবালররা সম্ভবত কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপ অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন। যাদের উদীচ্যদেশবাসী বলা হয়েছে তারা হয়তাে নেল্লোর ও গুন্টুর জেলার পল্লব রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন (অধ্যাপক হালিঙ্গম এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন (তদেব, পৃষ্ঠা ১৫))। সন্দেহ নেই, তামিলনাড়ুর এক বিস্তীর্ণ ভুখণ্ড এবং অন্ধ্রপ্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল করিকালের অধিকারভুক্ত ছিল। দক্ষিণ ভারতে পূর্বে কখনও এত বড় রাজ্যের উদ্ভব হয়নি।
তােণ্ডৈমান ইলন্দিরৈয়ন : করিকালের সমকালীন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তােণ্ডৈমান ইলন্দিরৈয়ন। তিনি উরুত্তিরঙ্গণ্ণার রচিত “পেরুম্পানাৎক্রপদৈ” কবিতায় কাঞ্চীর অধিপতিরূপে বর্ণিত হয়েছেন। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, সমকালীন চোল, চের ও পাণ্ড্য রাজারা তার তুলনায় হীনপ্রভ ছিলেন। তিনি একজন যশস্বী কবিও ছিলেন। শঙ্গম সাহিত্য-সংকলনে তার কয়েকটি কবিতা স্থান পেয়েছে। শঙ্গম সাহিত্যে ইলন্দিরৈয়নের বংশ-পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি, করিকালের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্বন্ধেও কোনও মন্তব্য নেই। ফলে কাঞ্চীর রাজনৈতিক সত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কাঞ্চী কি করিকালের রাজ্যভুক্ত ছিল না তােণ্ডৈমান ইলন্দিরৈয়নের অধীনে এক স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাজ্য রূপে গড়ে উঠেছিল? ঐতিহাসিকেরা এ বিষয়ে বিভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছেন। শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার মনে করেন, ইলন্দিরৈয়ন করিকালের পৌত্র ছিলেন এবং করিকাল কাঞ্চী অধিকার করে পৌত্রকে বিজিত অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। নীলকান্ত শাস্ত্রীর মতে ইন্দিরৈয়ন কাঞ্চীর স্বাধীন রাজা ছিলেন এবং করিকালের রাজ্য কাঞ্চীর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ছিল। তেরলুর বেঙ্কটরাম মহালিঙ্গমের অভিমত, কাঞ্চী করিকালের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত তাে ছিলই, উপরন্তু চোলরাজ্য কাঞ্চীর সীমানা ছাড়িয়ে আরও উত্তরে প্রসারিত ছিল। কিন্তু শঙ্গম সাহিত্যে ইলন্দিরৈয়নের যে পরিচয় বেদেয়া হয়েছে তাতে তাকে কাঞ্চীর এক চোল স্বাধীন রাজা বলে বােধ হয়। আবার এ কথা সত্য, কাঞ্চীর উত্তরেও করিকাল রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। কাঞ্চী যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ যার চারদিক ঘিরে ছিল করিকালের রাজ্য। হয়তাে ইলন্দিরৈয়ন করিকালের কোনও কন্যা বা সহােদরাকে বিবাহ করেছিলেন বলেই নিরুপদ্রবে কাঞ্চীতে রাজত্ব করেন।
করিকাল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, বহুদিন পূর্বে কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন (R C Majumdar (Ed.): The Age of Imperial Unity (Bombay, 1960). পৃ. ২৩১)। বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে করিকাল বিজয়ী হয়েছিলেন এবং ১২ হাজার শ্রীলঙ্কীয়কে বন্দি করে স্বদেশে নিয়ে আসেন। লক্ষ করবার বিষয়, শঙ্গম সাহিত্যে চোলরাজের সপক্ষে এ ধরনের কোনও উত্তি নেই। তবু যদি এ অভিমত গ্রাহ্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে ১৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দে গজবাহুর মৃত্যুর পরই করিকাল শ্রীলঙ্কা আক্রমণ করেন।
করিকাল একদিকে যেমন নতুন নতুন অঞ্চল জয় করে চোলরাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করেন, অন্যদিকে তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে, নতুন নতুন জনপদ সৃষ্টি করে এবং চাষ-আবাদের ব্যবস্থা করে রাজ্যের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেন। পট্টিনপ্পালৈ কবিতায় তৎকালীন কাবেরীপট্টিনম ও সংলগ্ন অঞ্চলের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ছবি অঙ্কিত আছে। অনেক বনভূমিকে তিনি কৃষি ক্ষেত্রে পরিণত করেছেন, বহু অরণ্যাঞ্চলে তিনি নতুন বসতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। শঙ্গম সাহিত্যে তার এক নতুন শহর প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। শহরটিতে একটি দুর্গ স্থাপিত হয়, উঁচু প্রাকার দিয়ে শহরটিকে ঘেরা হয়, শহরে প্রবেশ ও বহির্গমনের জন্য কয়েকটি সুদৃশ্য তােরণও নির্মিত হয়। অনেকেই এই শহরটিকে কাবেরীপূমপট্টিনম বলে চিহ্নিত করেছেন। আবার অনেকের মতে এই শহরটি কাবেরীপুমপট্টিনম নয়, তােণ্ডৈমণ্ডলমের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত অন্য কোনও এক শহর। কৃষিকার্যে গতি সঞ্চারের জন্য এ সময় বহু কৃপ ও পুষ্করিণী খনন করা হয়। বিচারকার্যে অংশগ্রহণকালে তিনি নিরপেক্ষতার নীতি আনুসরণ করতেন। তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মানুরাগী ছিলেন। বহু যাগযজ্ঞের আয়ােজন করেন তিনি। তামিল সাহিত্যের তিনি পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। শঙ্গম সাহিত্যে তার যে ছবি আঁকা হয়েছে তা সত্য বলে বুঝতে হবে ভােগৈশ্বর্যময় জীবনযাত্রার প্রতি তার আগ্রহ কম ছিল না।
পরবর্তিকালে করিকালকে কেন্দ্র করে প্রচুর কাহিনি রচিত হয়। এসব কাহিনি অতিরঞ্জিত। ‘শিলপ্পদিকারম’ এবং ১১শ-১২শ শতকের বহু গ্রন্থে ও লেখমালায় এ ধরনের কাহিনি সন্নিবেশিত হয়েছে। এসব কাহিনিতে বলা হয়েছে করিকাল আসমুদ্রহিমাচল জয় করেছিলেন, বন্যা প্রতিরােধকল্পে অনুগত নৃপতিদের সহায়তায় কাবেরী নদীর বদ্বীপের মুখে অনেক জলাধার নির্মাণ করেছিলেন। করিকাল সারা ভারত জয় করেছিলেন, এ দাবি অবশ্যই অতিরঞ্জিত। বদ্বীপের মুখে কাবেরী নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে বিশাল বিশাল জলাধার নির্মাণের ইতিহাস অনেক প্রাচীন সন্দেহ নেই। এর ফলে বন্যাকে যেমন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় তেমনি জলাধারে সঞ্চিত জল বহু সংখ্যক খাল ও শাখা খালের মাধ্যমে কৃষি-জমিতে পাঠিয়ে কৃষিজ ফলন বাড়ানাে যায়। করিকাল এরূপ বৃহৎ সেচপ্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।
কিল্লি বল্বন, শেঙ্গণান ও ওয়মান নল্লিয়ক্কোডন : শঙ্গম সাহিত্যে করিকালােত্তর পর্বের কয়েকজন চোল রাজার কথাও বলা হয়েছে। এদের একজন কুরাপ্পল্লিত্তুঞ্চিয় পেরুন্দিকুমা বল্বন। তিনি কিল্লি বল্বন নামেও পরিচিত। বীরত্ব, দানশীলতা, প্রশাসনিক দক্ষতা প্রভৃতি বিভিন্ন গুণের সমাবেশ ঘটেছিল তার চরিত্রে। চেরদের রাজধানী বনজি তিনি জয় করেছিলেন বলে জানা যায়। নলঙ্গিল্লি এবং নেডুঙ্গিল্লি এই পর্বের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজকুমার। তারা উভয়েই চেয়েছিলেন সিংহাসনের উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। ফলে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন। শঙ্গম যুগের একেবারে শেষের দিকের এক চোলরাজ শেঙ্গণান। চেরনৃপতি কনৈক্কাল ইরুমপােরৈকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি করেন। চের রাজা শেষে নিজেকে মুক্ত করেন। যুদ্ধের স্থান সম্পর্কে বিতর্ক আছে। একটি কবিতায় স্থানটির নাম পাের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর একটি কবিতায় স্থানটিকে কলুমলম বলা হয়েছে। স্থান দুটির সঠিক অবস্থান জানা যায় না। শঙ্গম সাহিত্যে আর একজন চোল রাজার উল্লেখ আছে। তার নাম ওয়মান নল্লিয়ক্কোডন। দক্ষিণ আর্কট জেলায় তিনি রাজত্ব করতেন। তার রাজত্বকাল খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শেষ পাদ।
পাণ্ড্য রাজবংশ
শঙ্গম সাহিত্যে কয়েকজন পাণ্ড্য রাজার কার্যকলাপও বর্ণিত হয়েছে। এদেরই একজন মুদুকুভুমি পেরুবলুদি। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের একটি লেখেও তার কথা বলা হয়েছে। তিনি পরমেশ্বর অভিধা ধারণ করেছিলেন। তার আর একটি অভিধা ‘পল্যাগশালৈ’। বহুসংখ্যক যজ্ঞ-মণ্ডপের প্রতিষ্ঠিতা যিনি তারই নাম ‘পল্যাগশালৈ’। এতে তার ব্রাহ্মণ্যধর্মানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। শঙ্গম সাহিত্যে তার যুদ্ধ বিজয়ের উল্লেখ আছে। মুদুকুড়ুমি পেরুবলুদির এক উত্তরপুরুষ তলৈয়ালঙ্গানত্তুচ্চেরুবেন নেডুঞ্জেলিয়ন। এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পাণ্ড্য রাজা তিনি। আনুমানিক ২১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেন। তখন তিনি একজন তরুণ মাত্র। তার সিংহাসনে আরােহণের অল্পদিনের মধ্যে এক শক্তিশালী শত্রুজোট পাণ্ড্যরাজ আক্রমণ করে। এই জোটে চের, চোল, তিতিয়ন, এলিনি, এরুমৈয়ূরন, ইরুঙ্গোবেল্মান ও পােরুনন – এই সাতজন রাজা যােগদান করেন। শত্রু রাজারা ভেবেছিলেন, অনভিজ্ঞ পাণ্ড্য নৃপতি বিনা যুদ্ধে তাদের বশ্যতা স্বীকার করবেন। কিন্তু পাণ্ড্যরাজ অসীম সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন এবং আক্রমণকারীদের পশ্চাদ্ধাবন করে চোলরাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তলৈয়ালঙ্গানম-এর যুদ্ধে নেডুঞ্জেলিয়ন শত্রু বাহিনীকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। প্রাচীন তলৈয়ালঙ্গানমের বর্তমান নাম তলৈয়ালমকাডু। স্থানটি তঞ্জাবুর জেলার তিরুবালুর শহরের ১২.৮ কি. মি. উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে নেডুঞ্জেলিয়ন শুধু পিতৃসিংহাসনই নিষ্কণ্টক করলেন না, তিনি তামিল অঞ্চলেও নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। পরবর্তিকালে দুটি অঞ্চল জয় করে তিনি নিজ রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করেন। বিজিত অঞ্চল দু’টি হল মুত্তূরূকূররম ও কূররম। বিদ্যোৎসাহী রাজারূপেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি নিজে একজন কবি ছিলেন। মাঙ্গুডি কিলার ও নক্কীররের মতাে সে কালের বিখ্যাত কবিরা তার সম্পর্কে প্রশস্তি রচনা করেছেন। মাদুরাই ছিল তার রাজধানী। শঙ্গম সাহিত্যে এই শহরের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাস্তা-ঘাট ও জন-সমাবেশের মনােরম বর্ণনা আছে। আর একজন পাণ্ড্যরাজ ইলবন্দিগৈপ্পল্লিত্তুঞ্জিয় নন্মরন। কবি নক্কীরর-এর সমকালীন তিনি। তিনি বহু বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। কৌণ্ডিন্য গােত্রীয় ব্রাহ্মণ বিণ্ণন্দায়ন তার পুরােহিত ছিলেন।
প্রশাসন-ব্যবস্থা
রাজতান্ত্রিক প্রশাসন : শঙ্গমযুগে রাজতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। অরট্ট বা গণশাসনের প্রচ্ছন্ন উল্লেখমাত্র নেই শঙ্গম সাহিত্যে। রাজপদ ছিল পুরুষানুক্রমিক। পিতার মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজপদ লাভ করতেন। কখনও কখনও সিংহাসনের উপর অধিকার নিয়ে রাজপুত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিত।
রাজা : প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন রাজা। তিনি রাজপুরুষদের নিয়ােগ করেন, সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেন, প্রজাদের নিকট হতে রাজস্ব আদায় করেন, বিচারকার্যে মুখ্য বিচারকের ভূমিকা পালন করেন। এই পরিস্থিতিতে রাজতন্ত্র সাধারণত স্বৈরাচারের রূপ নেয়। তখনকার দিনে রাজাদের মধ্যে অনেকেই স্বৈরাচারী ছিলেন। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের পথে বাধা যে একদম ছিল না তা নয়। প্রথমত, প্রভাবশালী মন্ত্রী, বন্ধু ও কবিরা রাজকার্যে রাজাকে পরামর্শ দিতেন। রাজা তাদের উপদেশ সহসা অগ্রাহ্য করতেন না। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ প্রশাসনে সভা নামে এক প্রতিষ্ঠানের বড় রকমের ভূমিকা ছিল। এখানে শুধু যে গ্রামের বিচারকার্য সম্পন্ন হত তা নয়, গ্রামের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলােচিত হত। এর উপর ছিল দেশাচারের প্রভাব। দেশাচারের বিরুদ্ধাচরণ করা কোনও রাজার পক্ষে সহজ ব্যাপার ছিল না। দেশাচার রাজাকে সৎ, জিতেন্দ্রিয়, প্রজানুরঞ্জক ও নিরপেক্ষ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শঙ্গম যুগের কবিরা তাদের কবিতায় বার বার এই দেশাচারের কথাই ব্যক্ত করেছেন। কবিরা বলেছেন, রাজা প্রজাদের অভাব-অভিযােগ শুনবেন, অভিযােগের প্রতিকার করবেন, তাদের পুত্রস্নেহে পালন করবেন।
যুদ্ধবিগ্রহ : তখনকার দিনে রাজায় রাজায় প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। নানা কারণে যুদ্ধ হত । প্রতিবেশী রাজ্যের গবাদি পশু অপহরণ সে সময়ের এক নিয়মিত ঘটনা ছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি রাজ্যের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ বেধে যেত। কখনও কখনও কোনও রাজা অন্য রাজ্যের রাজকন্যার পাণিগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। কন্যার পিতা বা অভিভাবক এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে দুই রাজার মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিত। তৃতীয়ত, রাজ্যলিপ্সা ছিল শক্তিমান রাজার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। প্রতিবেশী রাজাদের পরাজিত করে নিজেদের বিজিগীষু নরপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করার আদর্শে তারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। সাত সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাকে পরাজিত করে তাদের মুকুটে তৈরি মালা নিজ গলায় ধারণ করেছেন, রাজাদের এ ধরনের চিত্র শঙ্গম সাহিত্যে অঙ্কিত আছে।
সেনাবাহিনী : রাজশক্তির মূল উৎস যে সৈন্যবাহিনী তা পেশাদার সেনাদের নিয়ে গঠিত ছিল। সৈন্যবাহিনীর চারটি বিভাগ – রথারােহী, গজারােহী, অশ্বারােহী ও পদাতিক। রথ টানত ঘােড়ায় ও বলদে। তরবারি, তির, ধনুক, ব্যাঘ্রচর্ম নির্মিত বর্ম, বর্শা ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহৃত হত। শঙ্গম সাহিত্যে এক ধরনের উৎক্ষেপণ অস্ত্রের উল্লেখ আছে। তাকে তােমরম বলা হয়েছে।
শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান : সাধারণত প্রশাসনের স্বার্থে রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশ বা বিভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি বিভাগ আবার কয়েকটি উপবিভাগে বিভক্ত হয়। এক একটি বিভাগ ও উপবিভাগের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির রাজপুরুষেরা নিযুক্ত হন। শঙ্গম সাহিত্যে এ ধরনের কোনও তথ্য নেই। কিন্তু রাস্তা-ঘাট তথা জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রশাসনের তৎপরতার উল্লেখ আছে এ সাহিত্যে।
সভা বা মনরম : সভা বা মনরম ছিল সে যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ সংস্থা। এই সভা বসত নির্দিষ্ট এক বৃক্ষতলে। এই সভায় যেমন খেলাধুলা ও অবসর বিনােদনের ব্যবস্থা ছিল তেমনি গ্রাম সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিও আলােচিত হত। মূলত সামাজিক সংস্থা হলেও গ্রামসভার রাজনৈতিক গুরুত্ব কম ছিল না। উরৈয়ূর-এর চোল সভা ন্যায়বিচারের জন্য সে সময় বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছিল। পরবর্তিকালে পরাক্রান্ত পল্লব ও চোল রাজাদের আমলে তামিলনাড়ুতে যে উন্নত স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তার বীজ এই পর্বেই বপন করা হয়।
সমাজ-জীবন
বহুজাতিক সমাজ : বহু জাতির লােক নিয়ে তখনকার দিনের তামিল সমাজ গঠিত ছিল। কিরাতরা এমনই এক জাতি। তাদের সে রকম শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না। কুড়ে ঘরে তারা বাস করতেন। হিংস্র কুকুর তাদের ঘর পাহারা দিত। পশুশিকার তাদের প্রধান উপজীবিকা হলেও যুদ্ধবৃত্তিও তারা গ্রহণ করতেন। তাদের ঘরে প্রচুর পরিমাণে তির, ধনুক, বর্শা ও অন্যান্য অস্ত্র মজুত থাকত। গােয়ালারা ভেড়া, গরু ও মহিষের দুধের ব্যবসা করতেন। গােয়ালাদের স্ত্রী কন্যারা বাজারে বা গ্রামবাসীদের বাড়িতে বাড়িতে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রি করতেন। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সৈন্যবাহিনীতে যােগ দিত। আজীবন যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থেকে জীবনসায়াহ্নে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেছেন এমন সৈনিকের কথাও শঙ্গম সাহিত্যে বলা হয়েছে। দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। বেশির ভাগ দাস-দাসী ছিলেন বিজিত অঞ্চলের অধিবাসী। ব্রাহ্মণেরা বেদশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। শাস্ত্র অধ্যয়নে ও যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠানেই তাদের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হত। ব্রাহ্মণীরা দেবতা ও অতিথিদের উদ্দেশ্যে সুস্বাদু খাবার তৈরি করতেন। ব্রাহ্মণদের বাড়ির সামনে একটি বাছুর বাঁধা থাকত। ঘরে থাকত দেবতাদের মূর্তি। ব্রাহ্মণেরা পায়রা পুষতেন। মাংস ও মদে তাদের অনীহা ছিল না। বন্দর ও সমুদ্র উপকূলে ছিল মৎস্যজীবীদের ভিড়। মাছ ধরতে তারা সমুদ্রে যেতেন। মাছের হাড়ের পুজো করতেন তারা। ভ্রমণশীল গায়কের দল স্থান থেকে স্থানান্তরে গান গেয়ে বেড়াত। তাদের মেয়েরা গানের তালে তালে নাচতেন। কখনও কখনও নৃত্য-গীত পরিবেশনের জন্য রাজদরবারে তাদের ডাক পড়ত। তখনকার দিনের কবিরা সংখ্যায় বেশ ভারী ছিলেন। তাদের মধ্যে ভাগ্যবান যারা তারা রাজাদের স্নেহধন্য ছিলেন কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় ছিলেন দরিদ্র ও বঞ্চিত। একজন কবি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সামান্য একটি উপহারের জন্য তাকে বহুক্ষণ রাজদরবারে অপেক্ষা করতে হয়েছে। রাজার বন্ধু ছিলেন, রাজাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করেছেন এমন কবিদের কথাও শঙ্গম সাহিত্যে উল্লিখিত আছে। সে সময় তামিলনাড়ুতে, বিশেষত তােণ্ডি, মুশিরি ও পুহারের মতাে বন্দরগুলোতে বহুসংখ্যক যবন ও ম্লেচ্ছদের বাস ছিল। সন্দেহ নেই, এরা ছিলেন মূলত গ্রিস, ইতালি ও আরব দেশাগত বণিক। তারা তামিল জানতেন না, অঙ্গভঙ্গির দ্বারা মনােভাব ব্যক্ত করতেন। তাদের রাজপ্রাসাদে রক্ষার কাজে বা রাতে রাস্তা-ঘাট প্রহরার কাজে নিয়ােগ করা হত। তারা সর্বদা সশস্ত্র থাকতেন।
সমন্বিত সংস্কৃতি : শঙ্গম সাহিত্যে তামিলনাড়ুর সাংস্কৃতিক জীবনের যে ছবি প্রতিফলিত হয়েছে তা এক সমন্বিত সাংস্কৃতিক জীবনের ছবি। এ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে দু’টি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির মিলনে। এদের একটি স্থানীয় তামিল সংস্কৃতি, অন্যটি উদীচ্য বা আর্য সংস্কৃতি। শঙ্গম যুগের কবিরা আর্যদের ধর্মবিশ্বাস, দর্শন, পৌরাণিক কাহিনি, রামায়ণ-মহাভারতের কথা, নীতিবােধ ও আচার-বিচারের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলেন এবং তারা তাদের কবিতায় সে পরিচয়ের অজস্র নিদর্শন রেখে গেছেন। তারা তামিল রাজাদের সঙ্গে কুরু-পাণ্ডবদের সম্পর্ক কল্পনা করেছেন, আর্য ধারণালালিত ঋণত্রয়ের কথা বলেছেন, পাণ্ডুতনয়দের হাতে ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের পরাভবের উল্লেখ করেছেন, অক্রূরের বীরত্বের প্রশস্তি গেয়েছেন, অর্জুনের খাণ্ডববন দাহের কথা বলেছেন, মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনের রন্ধনপটুত্ব, সাধ্বী অরুন্ধতী, চির শান্তির দেশ উত্তর কুরু, বিষ্ণুর নাভিপদ্ম হতে ব্রহ্মার আবির্ভাব, প্রতি প্রত্যুষে সূত, মাগধ ও বৈতালিকদের রাজবন্দনা, গৃহস্বামীর অতিথিকে প্রত্যুদগমন, কোনও প্রসঙ্গই শঙ্গম সাহিত্যে অনূক্ত রাখেননি। এ সময় বহু সংস্কৃত শব্দ অবিকৃতরূপে তামিল শব্দভাণ্ডারে অনুপ্রবিষ্ট হয়, সংস্কৃত শব্দের অনুকরণে বহু নতুন নতুন তামিল শব্দ তৈরি হতে থাকে। একটি উদাহরণ দেয়া যায়। পাদরক্ষা একটি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ পাদুকা। সংস্কৃত পারক্ষার অনুকরণে তামিল কবিরা এ পর্বে একটি নতুন শব্দ তৈরি করলেন। শব্দটি অভি-পুদৈ অরণম। তবে আর্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে শুধু যে তামিল সংস্কৃতিই সমৃদ্ধ হল তা নয়, আর্য সংস্কৃতিরও পরিপুষ্টি ঘটল।
নারী : শঙ্গম যুগের মহিলারা গৃহবন্দি ছিলেন না। গ্রামসভায় তারা নিয়মিত উপস্থিত হতেন, বিভিন্ন আমােদ-প্রমােদে অংশগ্রহণ করতেন। এ পর্বের কবিতায় গৃহবধূদের আলােকবর্তিকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মেয়েদের মধ্যে অনেকেই লেখাপড়া জানতেন। কেউ কেউ কবি বলে খ্যাতিলাভও করেছিলেন। সে যুগের এমনই এক মহিলা-কবি ঔবৈয়ার। তগড়ুর-এর অধিপতি আদিগমান তাকে দূত নিযুক্ত করে তােণ্ডৈমানের (ইলন্দিরৈয়ন?) দরবারে পাঠান। এ যুগের আর একজন মহিলা কবি বেল্লিবীদিয়ার। অনেক মহিলা নৃত্য ও গীতকে পেশারূপে গ্রহণ করেছিলেন। নর্তকীদের সঙ্গে গৃহস্বামীদের অশুভ ঘনিষ্ঠতা গৃহবধূদের ঘুম কেড়ে নিত। শঙ্গমােত্তর পর্বের রচনা মণিমেকলৈ কাব্যে গণিকাদের উল্লেখ আছে। তাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হত। দরবারি নৃত্য, লঘু নৃত্য, গান, বাঁশি ও বীণা বাদন, চিত্রাঙ্কন, সুগন্ধ প্রস্তুতি, ফুলের কাজ ও আরও অনেক বিষয় তাদের আয়ত্ত করতে হত। সালঙ্করা, লাস্যময়ী মহিলাদের রাজসভায় যাতায়াত ছিল। অতিথি-অভ্যাগতদের তারা মদ পরিবেশন করতেন। যুদ্ধে বন্দি মহিলাদের ক্রীতদাসীর জীবন যাপন করতে হত। মহিলাদের অনেকেই স্বামীর মৃত্যুতে স্বামীর প্রজ্বলিত চিতাকুণ্ডে আত্মাহুতি দিয়ে সতীধর্ম পালন করতেন। কিন্তু সন্তানসম্ভবা মহিলাদের এ কাজে নিরস্ত করা হত। যেসব মহিলা সহমরণে যেতেন তাদের কঠোর বৈধব্যজীবন যাপন করতে হত। তারা মস্তক মুণ্ডন করতেন, অলংকার পরিহার করতেন, নামমাত্র আহারে জীবন নির্বাহ করতেন।
বিবাহ : বিবাহাদি সম্পর্কে শঙ্গম সাহিত্যে যে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে তা অতি সংক্ষিপ্ত। মনে হয়, বিবাহের পূর্বে আত্মীয়স্বজনদের ভূরিভােজে আপ্যায়িত করা হত। স্বামী ও সন্তান বর্তমান এরূপ চারজন মহিলার একটি দল কন্যাকে স্নান করাত। মণ্ডপে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হত। এই উপলক্ষে গান-বাজনার আসর বসত। দেবতাদেরও পূজা দেয়া হত। শঙ্গমােত্তর পর্বের রচনা তােলকাপ্পিয়ম ও কলবিয়ল গ্রন্থ দু’টি থেকে জানা যায়, সাধারণত অভিভাবকেরাই পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করতেন। তবে কখনও কখনও তাদের বিনা অনুমতিতে বিবাহ অনুষ্ঠিত হত। সংস্কৃত গ্রন্থাদিতে যে আট প্রকার বিবাহের বিধান আছে তারও উল্লেখ আছে এই দু’টি গ্রন্থে। বয়সে ছােটো বরের সঙ্গে বয়স্কা কন্যার বিবাহ এবং গােষ্ঠী বা জাতির বাইরে বিবাহের কথাও বলা হয়েছে গ্রন্থ দু’টিতে। কিন্তু এ ছবি শঙ্গম যুগের ক্ষেত্রে কতটা প্রযােজ্য বলা কঠিন।
লােকাচার : শঙ্গম সাহিত্যে তখনকার দিনের লােকাচার সম্পর্কে কিছু তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। তখন লােকদের জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রচণ্ড বিশ্বাস ছিল। ফলে জ্যোতিষীদের উপার্জন বেশ ভালােই ছিল বলা চলে। মেয়েদের চুল অবিন্যস্ত রাখা অশুভ বলে বিবেচিত হত। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য ছেলে-মেয়েদের হাতে কবচ পরিয়ে দেয়া হত। যাতে দৈত্য-দানব কোনও ক্ষতি করতে না পারে, যাতে বৃষ্টিপাত হয়, যাতে মনস্কামনা সিদ্ধ হয়, তার জন্য বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হত। লােকদের বিশ্বাস ছিল বটগাছে দেবতারা বাস করেন, তাদের প্রতীতি ছিল সাপেরা ভক্ষণ করে বলে চন্দ্র ও সূর্যের গ্রহণ হয়। তারা মনে করতেন মােরগ ডাকলে বুঝতে হবে বাড়িতে অতিথি আসছেন বা প্রবাসী স্বামী তার নিঃসঙ্গ বধূর গৃহে প্রত্যাবর্তন করছেন। সম্ভবত প্রতি গৃহে মােরগ পােষা হত। দরিদ্রদের মাঝে মাঝে পঙক্তি ভােজনে আপ্যায়িত করা হত।
মৃতদেহ-সৎকার : মৃতদেহ-সৎকার সম্পর্কে শঙ্গম সাহিত্যে অল্প-বিস্তর তথ্য আছে। মৃতদেহ সাধারণত দাহ করা হত। আবার কখনও কখনও শবাধারে ভরে, কখনওবা বিনা আধারে, মৃতদেহ সমাহিত করা হত। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কিছু আচার-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিল।
অর্থনেতিক জীবন
শঙ্গম সাহিত্যে তামিলনাড়ুর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চিত্র আঁকা হয়েছে। সমৃদ্ধি ঘটেছিল কৃষিতে, শিল্পে ও বাণিজ্যে।
কৃষি ও শিল্প : কৃষিজ ফসলের মধ্যে ধানই ছিল প্রধান। কাবেরী নদীর বদ্বীপে প্রচুর ধান উৎপন্ন হত। বাঁশ, ইক্ষু, হলুদ এবং কাঠালও প্রচুর পরিমাণে জন্মাত। প্রচুর পরিমাণে মধু উৎপন্ন হত। এ সময় কূপ, পুষ্করিণী ও জলাধার নির্মাণ করে বহু জমিকে কৃষির আওতায় আনা হয়। এর ফলে ফলন বৃদ্ধি পায়। উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ রাজাকে রাজস্ব দিতে হত। তবে সেই অংশ মােট উৎপাদনের কত ভাগ তার কোনও ইঙ্গিত নেই। মাছ ও মাংস সহজলভ্য ছিল। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। ধনী মালিকেরা নিজেরা চাষ-আবাদের কাজ করতেন না, শ্রমিকদের নিয়ােগ করতেন। দরিদ্র ভূস্বামীরা নিজেরাই খেতের কাজ করতেন। মেয়েরা তাদের সহযােগিতা করতেন। এ সময় কার্পাস ও রেশম শিল্পে অগ্রগতি দেখা যায়। বিভিন্ন রঙের ও নকশার সুদৃশ্য কার্পাস ও রেশমি বস্ত্র তৈরি হতে থাকে। অভিজাত রােমক পরিবারে এসব বস্ত্রের বিস্তর চাহিদা ছিল। সােনা, রূপা ও বিভিন্ন মণি-রত্ন দিয়ে নানা প্রকার অলংকার তৈরি হত।
অন্তর্বাণিজ্য : অন্তর্বাণিজ্যে তৎপরতা লক্ষিত হয়। সার্থবাহদের দল শকটে পণ্য সাজিয়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে পণ্যাদি বিক্রি করত। সার্থবাহদের সঙ্গে কখনও কখনও তাদের পরিবারের লােকজনও থাকতেন। স্থান থেকে স্থানান্তরে চলাচল কালে পণ্যের উপর শুল্ক বসানাে হত। স্থানে স্থানে শুল্ক বিভাগের কর্মচারীরা মােতায়েন থাকতেন। শুল্ক আদায়ের ভার তাদের উপর ন্যস্ত ছিল। রাস্তা-ঘাটের সুরক্ষার জন্য দিবা-রাত্র প্রহরার ব্যবস্থা ছিল। পট্টিনপ্পালৈ গ্রন্থে এ যুগের বণিকদের প্রশংসা করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা প্রতারক নন, তারা সৎ ব্যবসায়ী, অল্প লাভেই তাদের তুষ্টি, তারা ন্যায়বান, সত্যবাদী, ক্রেতা সাধারণের স্বার্থ রক্ষায় তারা যত্নবান। জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয় হত নগদে, কখনওবা দ্রব্যের বিনিময়ে। তখন ধানের বিনিময়ে মাছ পাওয়া যেত, ইক্ষুর পরিবর্তে হরিণ পাওয়া যেত, মধু ও বৃক্ষমূল দিয়ে মাছের তেল ও তাড়ি কেনা যেত।
বহির্বাণিজ্য : এ সময় তামিলনাড়ু তথা দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে রােমক সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শঙ্গম সাহিত্যের সাক্ষ্য, ‘পেরিপ্লাস তাফ দি এরিথ্রিয়ান সি’র বর্ণনা, টলেমির বিবরণ এবং প্রত্নাবশেষ এই বহির্বাণিজ্য সম্পর্কে প্রভূত আলােকপাত করে। শঙ্গম পর্বে পশ্চিম উপকূলে কয়েকটি বন্দর গড়ে উঠেছিল। পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলোর মধ্যে নৌরা (ক্যান্নানাের), তিনডিস (পােন্নানি), মুজিরিস বা মুচিরিপত্তনম (ক্র্যাঙ্গানােরের নিকটবর্তী) ও নেলকিণ্ডা (কোট্টায়মের নিকটবর্তী) উল্লেখযােগ্য ছিল। পুহার (কাবেরীপট্টিনম), পােডুকা (পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকমেডু), মামল্লপুরম, সােপাৎমা (চেন্নাই?) ও কোরকৈ পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ছিল। কাবেরীপট্টিনমই সম্ভবত টলেমি উল্লিখিত খাবেরিস। সমকালীন সাহিত্যে কোমারি নামে আর একটি বন্দরের উল্লেখ আছে। এর অবস্থান ছিল সর্বদক্ষিণে। তীর্থস্থানরূপেও স্থানটির খ্যাতি ছিল। বর্তমান কন্যাকুমারী শহরটিই প্রাচীন কোমারি। রােমক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্যসামগ্রী বহন করে বড় বড় জাহাজ এই বন্দরগুলোতে এসে ভিড়ত। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে ছিল মুদ্রা, সূক্ষ্ম বস্ত্র, ক্ষৌম বস্ত্র, কাচ, তামা, টিন, শিলা, পােখরাজ, প্রবাল, মােমছাল, হরিতাল, মদ ও ঘােড়া। যেসব জিনিস বিদেশে রপ্তানি করা হত তাদের মধ্যে ছিল গােলমরিচ, মুক্তা, গজদন্ত, রেশমি বস্ত্র, মলম, মূল্যবান পাথর, নীলকান্ত মণি, কচ্ছপের খােল ও তেজপাতা। মিশরীয় নাবিক হিপ্পালাস ৪৫ খ্রিস্টাব্দে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহপথ আবিষ্কার করায় পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বহির্বাণিজ্যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এখন থেকে বড় বড় জাহাজগুলো মৌসুমি বায়ুর সহায়তায় আরব সাগর আড়াআড়ি পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ ভারতের বন্দরগুলোতে আসতে থাকে। পূর্বে জাহাজগুলো গমনাগমন করত উপকূল ধরে, নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই বেশি লাগত, উপরন্তু বিপদেরও আশঙ্কা ছিল। পেরিপ্লাস গ্রন্থটি থেকে জানা যায়, ছােটো, মাঝারি ও বড়, পূর্ব উপকূলে এই তিন প্রকার জলযান বা জাহাজের ব্যবহার ছিল। ছােটো জলযানগুলো বদ্বীপ ও নিকটস্থ উপকূল অঞ্চলে যাতায়াত করত। সাংগারা নামে মাঝারি মাপের জাহাজগুলো গাছের বড় গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হত। বড় জাহাজগুলোকে কোলান্দিয়া বলা হত। জলযানগুলো তামিলনাড়ুর বন্দর হতে গাঙ্গেয় ভূভাগ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অভিমুখে যাত্রা করত।
রােমক মুদ্রা ও তার গুরুত্ব : তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর রােমক স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলোর মধ্যে যেমন সম্রাট অগাস্টাসের (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২৭ – খ্রিস্টাব্দ ১৪), তেমনি টাইবেরিয়াস (খ্রিস্টাব্দ ১৪-৩৭) এবং নিরাের (খ্রিস্টাব্দ ৫৪-৬৮) মুদ্রাও আছে। রােমক সাম্রাজ্যের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্য উপলক্ষে এই রােমক মুদ্রাগুলো বুলিয়নরূপে ভারতে আমদানি হয়। মুদ্রার বিশ্লেষণে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের চতুর্থ পাদ হতে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত সময়ে রােম-ভারত বাণিজ্যে যে ব্যাপকতা দেখা দিয়েছিল খ্রিস্টীয় ২য়-৩য় শতকে তাতে মন্দা নেমে আসে। এই বাণিজ্য উপলক্ষে দক্ষিণ ভারতে কয়েকটি রােমক বসতি স্থাপিত হয়। পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকমেডুতে এরূপ একটি স্থায়ী রােমক বসতি গড়ে উঠেছিল। সম্ভবত মুজিরিস বন্দরেও আর একটি রােমক বসতি স্থাপিত হয়। বলা বাহুল্য, এই বহির্বাণিজ্যে ভারতই বেশি লাভবান হয়েছিল।
ধর্মীয় জীবন
বৈদিক ধর্মের প্রভাব : শঙ্গম যুগে তামিলনাড়ুতে বৈদিক ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। রাজা মহারাজরা প্রায়ই ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন। যজ্ঞানুষ্ঠানে পশুবলি দেয়া হত। শাস্ত্রজ্ঞান ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য ব্রাহ্মণেরা সমাজে সম্মানিত ছিলেন। বৈদিক ধর্মের তুলনায় তামিলনাড়ুতে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের তেমন প্রসার ছিল না। বৌদ্ধ ও জৈনদের সঙ্গে বৈদিক ধর্মাবলম্বীদের মাঝে মাঝে বিরােধ বেধে যেত।
বিভিন্ন দেব-দেবী : জনপ্রিয়তায় সুব্রহ্মণ্য (মুরুগন) ছিলেন দেবতাদের শীর্ষে। এই দেবতা শঙ্গম সাহিত্যে বার বার উল্লিখিত হয়েছেন, বার বার বর্ণিত হয়েছে তার অসুর নিধনের কথা, তার বীরত্বের কথা। সুব্রহ্মণ্যের পূজায় ভক্তরা বিভাের হয়ে নৃত্য করতেন। তাদের মধ্যে ভাবােন্মাদনা দেখা যেত। বিষ্ণুপূজারও বিশদ বর্ণনা আছে শঙ্গম সাহিত্যে। তুলসীপত্র সহযােগে, ঘণ্টাধ্বনির মধ্য দিয়ে এ পূজা সম্পন্ন হত। দেবতার প্রসন্ন দৃষ্টি লাভের জন্য ভক্তরা মন্দিরে উপবাস করতেন। স্ত্রীলােকেরা সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরে পুজো দিতেন। সুব্রহ্মণ্য ও বিষ্ণু ছাড়া শিব, বলরাম, কৃষ্ণ ও অর্ধনারীশ্বরেরও পুজো হত। প্রতি বছর পহারে ইন্দ্রোৎসব অনুষ্ঠিত হত। মণিমেকলৈ কাব্যে সরস্বতীর মন্দিরের উল্লেখ আছে, কঠোরপন্থী শৈব কাপালিকদেরও উল্লেখ আছে। তখনকার দিনের পূজা-অর্চনায় নৃত্য-গীতের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। তপশ্চর্যাকে সম্রমের চোখে দেখা হত। ত্রিদণ্ডী তাপসদের উল্লেখ আছে শঙ্গম সাহিত্যে।
জীবন-দর্শন : লােকদের পুনর্জন্মে বিশ্বাস ছিল। পূর্ব জীবনের কর্মফল পরজন্মে বর্তায়, এ ধারণাও তাদের ছিল। মানুষের জীবনে দৈব শক্তির এক বিরাট প্রভাব আছে, এ বিশ্বাসও তাদের ছিল। শঙ্গম যুগের প্রথম দিকের কবিতাগুলোতে ভােগবাদের আদর্শ প্রচারিত হয়েছে। তবে এ যুগের শেষের দিকের কবিতাগুলোতে দুঃখবাদ ধ্বনিত হয়েছে। জীবন, যৌবন, ধন, মান সবই ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুতেই জীবনের পরিসমাপ্তি। সম্ভোগ নয়, কামনা-বাসনা পরিহারের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ। ধর্মশাস্ত্রকার মনুর সেই বিখ্যাত উক্তিই যেন এখানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে : প্রবৃত্তিরেষঃ সর্বভূতানাং নিবৃত্তিপ্ত মহাফলা।
গ্রন্থপঞ্জি
- Mahalingam, T. V. : Kancipuram In Early South Indian History (Madras, 1969),
- Majumdar, R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960).
- Sastri, K. A. N (Ed.): A Comprehensive History of India, Vol. II, Part I (Calcutta, 1958); A History of South India (Madras, 1966).
সাতবাহন রাজবংশ (খ্রি.পূ. ২য় শতকের শেষ – খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শুরু)
বংশ ও জাতি পরিচয়, আদি নিবাস ও প্রথম রাজ্য স্থাপন
ওড়িশায় যখন চেদি রাজবংশের পত্তন ঘটছিল তখন মহারাষ্ট্রে (মতান্তরে অন্ধ্রপ্রদেশে) এক নতুন রাজবংশের অভ্যুদয় হয়। ক্ষুদ্র এক অঞ্চলের অধিপতিরূপে আত্মপ্রকাশ করে ধীরে ধীরে এই বংশের রাজারা পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের এক শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হন। প্রায় তিন শতাব্দী কাল এই রাজবংশ পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত ছিল। ইতিহাসে এই রাজবংশ সাতবাহন বা শাতবাহন নামে প্রসিদ্ধ।
বংশের নামকরণ : কেন এই বংশের নাম সাতবাহন তার সঠিক উত্তর আজও মেলেনি। কিছু কিছু উত্তর অবশ্যই এসেছে কিন্তু তা আনুমানিক বৈ তাে নয়। সাতবাহন পদটি মুণ্ডা ‘সাদম’ এবং ‘হপন’ হতে নিষ্পন্ন বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। ‘সাদম’-এর অর্থ ঘােড়া, ‘হপন’-এর অর্থ পুত্র। তারা মনে করেন, অশ্বমেধ যজ্ঞ যিনি অনুষ্ঠান করেছেন তার পুত্র এই অর্থে সাতবাহন। আবার কেউ কেউ বলেন, অশােকের অনুশাসনে যাদের সত্যপুত্র বলা হয়েছে তারাই সাতবাহন। দেববাচক তামিলপদ ‘শাওন’ হতে সাতবাহন বা শাতবাহন উদ্ভূত, এরূপ মতও প্রচলিত। আবার অনেকে সাতবাহন কথাটি সূর্যের সপ্তবাহন অভিধা হতে এসেছে বলে মনে করেন। সাত ঘােড়ার রথে চড়ে সূর্যদেব ব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমা করছেন এ কাহিনি সুপরিচিত। হয়তােবা সাতবাহন রাজারা নিজেদের সূর্য বা ইক্ষ্বাকুবংশীয় বলে মনে করতেন। আবার বিষ্ণুর সপ্তবাহন নাম হতে বংশের নাম সাতবাহন হয়েছে, এমন অভিমতও আছে।
জাতি-পরিচয় : সাতবাহন রাজাদের জাতি-পরিচয় সম্পর্কেও ঐতিহাসিক মহলে বাগ বিতণ্ডা আছে। অনেকে সূর্যের প্রতিশব্দরূপে সাতবাহন পদের ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের ধারণা সাতবাহনরা জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন। এই বংশের এক রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণিকে রাজমাতা বলার নাসিক প্রশস্তিতে ‘এক-ব্রাহ্মণ’ এবং ‘ক্ষত্রিয়-দর্প-মান-মর্দন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে সাতবাহনরা ব্রাহ্মণ ছিলেন এরকম একটি মতও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এক ‘ব্রাহ্মণ’ এবং ‘ক্ষত্রিয়’ পদ দুটির ভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে অন্ধ্ররা ‘দস্যু’ বলে ধিকৃত হয়েছেন। মনু সংহিতায় তাদের নিচ জাতিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পুরাণে সিমুককে ‘বৃষল’ অর্থাৎ পতিত বা বর্ণচত বা শূদ্র আখ্যা দেয়া হয়েছে। সালিবাহন বা সাতবাহন রাজাদের ধমনীতে যে ব্রাহ্মণ ও নাগ রক্ত প্রবাহিত ছিল তা ‘দ্বাত্রিংশৎপুত্তলিকা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে। সম্ভবত সাতবাহনরা অনার্য গােষ্ঠীর লােক ছিলেন কিন্তু পরে নিজেদের ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দেন। তবে অন্ধ্রদের সম্পর্কে ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থাদিতে যেসব মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় রক্ষণশীল সমাজ সাতবাহনদের ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বলে স্বীকার করেনি।
সাতকর্ণি বা শাতকর্ণি পদের অর্থ : সাতবাহন রাজাদের অনেকেই সাতকর্ণি বা শাতকণি পদবি গ্রহণ করেছেন। ‘সাতটি তীর’, ‘সূর্যের সাত রশ্মি’, সাত বা শতেক কান আছে যার ইত্যাদি অর্থে পদটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যুক্তি নয়, কল্পনাই যেন ব্যাখ্যাগুলোকে আশ্রয় করে আছে। সংস্কৃত ‘শত’ থেকে ‘শাত’ কথাটি এসেছে
আদি নিবাস অন্ধ্রে : পুরাণাদি গ্রন্থে সাতবাহন রাজাদের অন্ধ্র, অন্ধ্রজাতীয় এবং অন্ধ্রভৃত্য আখ্যা দেয়া হয়েছে। এ থেকে অনেকে অনুমান করেন সাতবাহনরা অন্ধ্রপ্রদেশের অধিবাসী ছিলেন। আবার অনেকের ধারণা সাতবাহনরা অন্ধ্রজাতীয় ছিলেন কিন্তু অন্ধপ্রদেশের অধিবাসী নন। তারা মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব যুগে অন্ধ্ররা বিন্ধ্যের দক্ষিণে বিদর্ভ বা বেরারের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাস করতেন, অন্ধ্রে তারা বসতি স্থাপন করেন আরও কিছুকাল পর, খ্রিস্টীয় ২য় শতকে। আবার কেউ কেউ মনে করেন সাতবাহনদের অন্ধ্রপ্রদেশ বা অন্ধ্রজাতি কোনওটির সঙ্গেই সংযােগ ছিল না, পুরাণ সংকলনের সময় তারা অন্ধ্রপ্রদেশে রাজত্ব করায় ভুলক্রমে তাদের অন্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। এই মত যারা পােষণ করেন তারা অন্ধ্রভৃত্য পদটিকে অন্ধ্রদের ভৃত্য অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে সাতবাহন রাজারা কন্নড় ভাষাভাষী ছিলেন, কর্ণাটকের বেল্লারি জেলায় তাদের আদি বাসস্থান ছিল। তবে সাতবাহনরা জাতিতে যে অন্ধ্র ছিলেন তা বােধহয় স্বীকার করাই ভালাে। পুরাণে তাদের শুধু অন্ধ্রভৃত্যই বলা হয়নি, অন্ধ্র ও অন্ধ্রজাতীয় বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। অন্ধ্রভৃত্য কথাটি সম্ভবত যে অন্ধ্ররা ভৃত্য ছিলেন এই অর্থেই কর্মধারয় সমাসরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হয় সাতবাহনরা প্রথম দিকে কাণ্ব বা অন্য কোনও রাজবংশের প্রতি অনুগত ছিলেন। অনেকে তাদের মৌর্যদের অধীনস্থ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন আর সাতবাহন রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মধ্যে সময়ের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। অন্ধ্রজাতি প্রাক্-খ্রিস্টীয় যুগে বিন্ধ্যাঞ্চলে বসবাস করতেন, এ মত সমর্থনযােগ্য নয়। অনেক পূর্বে এ অঞ্চলে হয়তাে তাদের বাস ছিল। অশােকের লেখমালায় অন্ধ্রকে মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। গােদাবরী-কৃষ্ণা বিধৌত বা তেলুগু ভাষাভাষী অঞ্চলে অশােকের কয়েকখানি অনুশাসনও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশেই সাতবাহন রাজাদের আদি বাসভূমি ছিল বলে মনে হয়।
সর্বপ্রথম রাজ্য স্থাপন মহারাষ্ট্রে :
- অন্ধ্র? : অন্ধ্রপ্রদেশ সাতবাহন রাজাদের আদি বাসভূমি হলেও এই অঞ্চলেই তারা সর্বপ্রথম রাজ্য স্থাপন করেছিলেন এমনটি মনে হয় না। আর. জি, ভাণ্ডারকর ও ভিনসেন্ট স্মিথের মতাে পণ্ডিতেরা কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশেই সাতবাহন রাজারা প্রথমে রাজত্ব করেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। প্রথম জনের মতে সাতবাহন রাজ্যের রাজধানী ছিল ধরণিকোট, দ্বিতীয় জনের মতে শ্রীকাকুলম। এসব মতের সমর্থনে বিশেষ কোনও যুক্তি নেই।
- মহারাষ্ট্র? : অন্ধ্রপ্রদেশের অমরাবতী গ্রামে সাতবাহন যুগের কয়েকখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখসমূহে যেসব রাজাদের নাম উল্লিখিত আছে তাদের কেউই সাতবাহন যুগের আদি পর্বে আবির্ভূত হননি। পক্ষান্তরে সাতবাহন রাজত্বের প্রথম পর্বের কয়েকখানি লেখ মহারাষ্ট্রে পাওয়া গেছে। এই বংশের আদি রাজা সিমুকের পুত্রবধু নাগনিকা পশ্চিমঘাট পর্বতমালার নানাঘাট গিরিপথের গায়ে একখানি লেখ উৎকীর্ণ করেছিলেন। সিমুকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কৃষ্ণের লেখ নাসিকে পাওয়া গেছে। নাসিকে রাজা শক্তিশ্রীর একখানি লেখেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। শক্তিশ্রী সম্ভবত রানি নাগনিকার পুত্র ছিলেন। সাতবাহন আমলের প্রথম দিকে উৎকীর্ণ কিছু মুদ্রাও মহারাষ্ট্রে আবিষ্কৃত হয়েছে। কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাথীগুম্ফা লেখে সাতবাহন রাজ্যটিকে কলিঙ্গের পশ্চিমে অবস্থিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। জৈন গ্রন্থাদি থেকে জানা যায় প্রতিষ্ঠান শহরটি প্রথম থেকেই সাতবাহন রাজ্যের রাজধানী ছিল। ঔরঙ্গাবাদ জেলার বর্তমান পৈঠান প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের স্মৃতি বহন করছে। এর থেকে অনুমান করা যায় সাতবাহন রাজ্যটি প্রথমে মহারাষ্ট্রেই গড়ে উঠেছিল।
- প্রথমে অন্ধ্র, পরে মহারাষ্ট্র? : অজয়মিত্র শাস্ত্রী মনে করেন সাতবাহন রাজারা প্রথমে অন্ধ্রপ্রদেশেই রাজত্ব করতেন কিন্তু পরে তারা মাহারাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তার করেন (A M Shastri. Early History Of The Deccan: Problems And Perspectives (Delhi, 1987), পৃ. ১১-১২)। স্বমতের সমর্থনে তিনি কয়েকটি যুক্তির অবতারণা করেছেন – প্রথমত, অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার কোটলিঙ্গলে সিমুক, প্রথম সাতকর্ণি ও সাতবাহনের কয়েকটি মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। তাছাড়া এ রাজ্যের মেডক জেলার কোণ্ডাপুর ও কুর্ণল জেলার শাতনিকোটে যথাক্রমে সাতবাহন ও শক্তিকুমারের একটি করে মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। দ্বিতীয়ত, অন্ধ্রপ্রদেশে প্রাপ্ত দু’খানি লেখে সাতবাহনদের নামে আহার ও রাষ্ট্র নামে দু’টি প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ, কুর্ণল জেলায় শাতনিকোট নামে একটি স্থানের নামকরণ ও সাতবাহন রাজাদের রৌপ্যমুদ্রায় দ্রাবিড় ভাষার ব্যবহার নির্দেশ করছে সাতবাহন রাজারা অন্ধ্রপ্রদেশেই রাজত্ব শুরু করেন।
- মহারাষ্ট্রে হওয়াই গ্রহণীয় বলে মনে হচ্ছে : অন্ধ্রপ্রদেশে আদি সাতবাহন রাজ্যের অবস্থিতির সপক্ষে উত্থাপিত যুক্তিগুলো যে সুপ্রতিষ্ঠিত তা বােধ হয় না। বলা হচ্ছে, এ অঞ্চলে সিমুক প্রমুখ আদি সাতবাহন রাজাদের মুদ্রা পাওয়া গেছে। কিন্তু মুদ্রা কখনও এককভাবে কোনও রাজার রাজনৈতিক অধিকার বা তার রাজ্যের বিস্তৃতির সঠিক প্রমাণ নয়। তখনকার দিনে তীর্থযাত্রী ও বণিক-সম্প্রদায় মুদ্রা সঙ্গে নিয়ে স্থান হতে স্থানন্তিরে যাতায়াত করতেন। এভাবেই হয়তো আদি সাতবাহন রাজাদের কিছু মুদ্রা আন্ধ্রপ্রদেশে এসেছিল। মনে করা হচ্ছে, শাতনিকোট নামটি সাতবাহন-কোট্ট হতে এসেছে। এ ধারণা প্রমাণসিদ্ধ নয়। অন্ধ্রপ্রদেশে সাতবাহনের নামে একটি আহার ও রাষ্ট্রের অবস্থান সে অঞ্চলে আদি সাতবাহন রাজ্যের অবস্থিতির কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নয়। সাতবাহন রাজারা দ্রাবিড় ভাষাভাষী ছিলেন বলেই হয়তাে তাদের মুদ্রায় কখনও কখনও দ্রাবিড় ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। এ কথা ভুললে চলবে না, আদি সাতবাহন নরপতিদের প্রায় সব কটি লেখ মহারাষ্ট্রেই আবিষ্কৃত হয়েছে, অন্ধ্রপ্রদেশে সেরূপ একখানি লেখেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। মহারাষ্ট্রে সাতবাহন রাজত্বের শুরু, অন্ধ্রপ্রদেশে নয়, এ অভিমতই বর্তমানে গ্রহণীয় বলে মনে হয়।
প্রতিষ্ঠাকাল
পুরাণ মতে খ্রি.পূ. ৩য় শতক : সাতবাহন রাজারা ঠিক কতদিন রাজত্ব করেছিলেন, তাদের রাজত্বের শুরুই বা কখন হয়েছিল সে সম্পর্কে পণ্ডিতরা সহমত নন। অনেকে মনে করেন মৌর্য সম্রাট অশােকের মৃত্যুর অল্পকাল পরই অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের শেষ ভাগে এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। এ মতের সমর্থনে যে যুক্তি নেই তা নয়। কোনও কোনও পুরাণে বলা হয়েছে সাতবাহনরা ৪৫৬ বা ৪ ৬০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ২২৫ অব্দ নাগাদ সাতবাহন শাসনের যে অবসান ঘটেছিল তা প্রায় সুনিশ্চিত। পুরাণের উক্তি সঠিক হলে বুঝতে হবে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের শেষপর্বেই সাতবাহন রাজ্যটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
পুরাণ নিয়ে সন্দেহ : কিন্তু পুরাণােক্ত তথ্যটির সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কোনও কোনও পুরাণে সাতবাহনরা ৪৫৬ বা ৪৬০ বছর রাজত্ব করেছিলেন বলে বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এমন পুরাণও আছে যেখানে সাতবাহন রাজারা তিন শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। সাতবাহন রাজাদের সংখ্যা সম্পর্কেও বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। কোনও কোনও পুরাণে ত্রিশজন রাজার কথা বলা হয়েছে। উনিশজনের নামােল্লেখ আছে এমন পুরাণও আছে। এই ধরনের পরস্পর বিরােধী পৌরাণিক তথ্যের উপর নির্ভর করে সাতবাহন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকাল নির্ধারণ করা যায় না। সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক কাগরাজ সুশর্মাকে পরাজিত করেছিলেন একথা প্রায় সব পুরাণে বলা হয়েছে। মৌর্য, শুঙ্গ বা কাণ্ব রাজারা যে যথাক্রমে ১৩৭, ১১২ ও ৪৫ বছর রাজত্ব করেছিলেন সে সম্পর্কেও সব কটি পুরাণ মােটামুটি একমত। এই যুক্তিতে ৩২৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ মৌর্যরাজ্য প্রতিষ্ঠার ২৯৪ বছর পর অর্থাৎ ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাতবাহন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলা চলে।
লেখ ও উৎখনন থেকে অনুমান : সাতবাহন রাজত্বের একেবারে গােড়ার দিকে নানাঘাট, নাসিক ও সাটীতে কয়েকখানি লেখ উৎকীর্ণ হয়েছিল। এই লেখগুলো নিঃসন্দেহে হেলিওডােরাসের বেসনগর গরুড়স্তম্ভ লেখের পরবর্তী। হেলিওডােরাসের লেখখানি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের শেষভাগে উৎকীর্ণ হয়েছিল। ফলে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলা চলে। মহারাষ্টের আহম্মদনগর জেলার নেভাসায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাহায্যে শান্তারাম বালচন্দ্র দেও (H. D, Sankalia (Ed.), From History to Pre-lis/ory at Nvasa (Poona, 1960), পৃ. ১৬২) সাতবাহন রাজত্বের সূচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৩য়-২য় শতকে ধার্য করেছেন। নেভাসায় উৎখননের ফলে যে কয়েকটি জনবসতি-পর্ব আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের চতুর্থ ও পঞ্চম পর্ব দু’টির কালসীমা যথাক্রমে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথমার্ধ হতে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের প্রারম্ভ ও খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর সূচনা হতে ২য় – ৩য় শতক। চতুর্থ পর্বের ভূমিসংস্তরে সাতকর্ণি ও সাতবাহন নামে যে দু’জন সাতবাহন রাজার মুদ্রা পাওয়া গেছে তারা সকলেই আদি পর্বের। পঞ্চম পর্বে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি ও যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির মতাে উত্তরকালীন দু’জন সাতবাহন নৃপতির মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। নেভাসায় চতুর্থ জনবসতি পর্বের যে কালসীমা নির্দিষ্ট হয়েছে তারই ভিত্তিতে সাতবাহন রাজবংশের অভ্যুদয় খ্রিস্টপূর্ব ৩য়-২য় শতকে নির্ধারিত হয়েছে।
নেভাসার উৎখনন নিয়ে বিতর্ক : কিন্তু যে পদ্ধতিতে নেভাসায় আদি-ঐতিহাসিক পর্বগুলোর সময়রেখা নির্ণীত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বিতর্কিত, ত্রুটিপূর্ণ। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, যেসব উপাদানের উপর নির্ভর করে এই পর্ব সমূহের কালক্ৰম চিহ্নিত হয়েছে তাদের একটি হল সাতবাহন মুদ্রা। অর্থাৎ মূলত সাতবাহন মুদ্রার সম্ভাব্য তারিখের ভিত্তিতেই নেভাসার জনবসতি-পর্বগুলোর সময়সীমা নির্দিষ্ট হয়েছে যে মুদ্রার তারিখ সম্পর্কে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে সে মুদ্রা ভূ-সংস্তর তথা পর্বের কালক্ৰম ধার্যের দিকচিহ্নরূপে বিবেচিত হতে পারে না। তাছাড়া যে যুক্তির ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত খাড়া করা হয়। সেই সিদ্ধান্তকেই আবার সেই একই যুক্তির প্রমাণরূপে উপস্থাপন করা অর্থহীন হয়ে পড়ে। নেভাসায় নির্বাহিত উৎখনন হতে প্রাপ্ত আর একটি তথ্য সাতবাহন রাজত্বের এই প্রাচীনত্বের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। রাজা সাতবাহনের সবকটি মুদ্রাই আবিষ্কৃত হয়েছে চতুর্থ পর্বের উচ্চতম ভূ-সংস্তরে। এই স্তর খ্রিস্টীয় ১ম শতকের অতি নিকটবর্তী।
খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্যান্য তথ্য : খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষার্ধে সাতবাহন পর্বের শুরু, এ অভিমতের সপক্ষে পুরাণদি ছাড়া আরও কিছু তথ্য আছে –
- প্রথমত, অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্ণল জেলার শাতনিকোটে শক্তিকুমারের নামাঙ্কিত একটি মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে (Indian Araliaeology (1977-78); A Review, পৃ. ৩-১১)। এ শক্তিকুমার সাতবাহন রাজবশের চতুর্থ নরপতি। মুদ্রাটি যে ভূমি-সংস্তরে আবিষ্কৃত হয়েছে তা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের সমকালীন।
- দ্বিতীয়ত, কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্রে যজ্ঞসেন এবং মাধবসেনকে দ্বিখণ্ডিত বিদর্ভের দু’জন রাজরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা ছিলেন শুঙ্গরাজ পুষ্যমিত্রের (আনুমানিক ১৮৭-৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অনুগত। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথম পর্বে সাতবাহন রাজত্ব শুরু হলে সে সময় বিদর্ভে সাতবাহন রাজারা রাজত্ব করতেন, যজ্ঞসেন ও মাধবসেন নন।
- তৃতীয়ত, সাতবাহন রাজাদের মুদ্রায় রাজার নাম ও অভিধার উল্লেখ আছে। গ্রিক মুদ্রার প্রভাবেই ভারতীয় মুদ্রায় এ রীতির প্রচলন হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের পূর্বে এমনটি ঘটা সম্ভব ছিল না।
রাজবৃত্তান্ত
রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক
সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক বা শ্রীমুখ। কোনও কোনও পুরাণে তাকে কাপ্তদের ভৃত্য বলা হয়েছে। মনে হয় কাণ্বদের অধীনে এক রাজকর্মচারিরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন কিন্তু কালক্রমে সম্ভবত মহারাষ্ট্রে তিনি এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সিমুক শুঙ্গ এবং কাণ্বদের নির্মূল করে পৃথিবী জয় করেন বলে পুরাণে বলা হয়েছে। অনেকের ধারণা তিনি শুঙ্গ এবং কাদের কাছ থেকে বিদিশা অঞ্চল অধিকার করেন। মগধ বা উত্তর ভারতের অন্য কোনও অঞ্চল যে তার রাজ্যভুক্ত ছিল না, তা নিশ্চিতরূপে বলা যায়। জৈন গ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে, শেষ জীবনে সিমুক স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় পরিণামে তাকে সিংহাসন ও প্রাণ দুই-ই হারাতে হয়। জৈন বিবরণ কতখানি বস্তুনিষ্ঠ তা বলা কঠিন। পৌরাণিক তথ্য অনুসারে সিমুক ২৩ বছর রাজ্য শাসন করেন। ছিমুকের নামাঙ্কিত কতিপয় মুদ্রা অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার কোটলিঙ্গলে আবিষ্কৃত হয়েছে (Numismatic Digesi. Vol. II. Part 1, পৃ. ১০)। ছিমুক নিঃসন্দেহে সিমুক। সিমুকের পর রাজা হন তার অনুজ কৃষ্ণ। তার রাজত্বকালে বৌদ্ধ শ্ৰমণদের বসবাসের জন্য নাসিকে একটি গুহা খনন করা হয়। পৌরাণিক মতে তিনি ১৮ বছর রাজত্ব করেন।
প্রথম সাতকর্ণি
পিতা : সাতবাহন বংশের তৃতীয় রাজা প্রথম সাতকর্ণি। পুরাণে তাকে কৃষ্ণের পুত্র বলা হয়েছে। নানাঘাট গিরিপথের গায়ে সাতবাহন রাজপরিবারের অনেক সদস্যেরই মূর্তি খােদিত আছে। প্রতিটি মূর্তির শীর্ষদেশে পরিচয়জ্ঞাপক লেখও আছে। বর্তমানে এই মূর্তি ও লেখগুলোর সিংহভাগই বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাহলেও প্রথম ও দ্বিতীয় মূর্তি যে যথাক্রমে সিমুক এবং প্রথম সাতকর্ণির সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কৃষ্ণ প্রথম সাতকর্ণির পিতা হলে তার মূর্তি অবশ্যই সিমুক ও প্রথম সাতকর্ণির মূর্তির মাঝখানে খােদিত থাকত। তা না থাকায় অনেকে মনে করেন, কৃষ্ণ নন, সিমুকই সাতকর্ণির পিতা।
প্রথম সাতকর্ণির প্রতিপত্তি ও রাজ্যবিস্তার : প্রথম সাতকর্ণির রাজত্বকালে সাতবাহন রাজবংশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। প্রভাবশালী মহারঠি পরিবারের কন্যা নায়নিকা বা নাগনিকাকে বিবাহ করে তিনি আপন শক্তি বৃদ্ধি করেন। তার আমলের একখানি লেখ সাচীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে সাতবাহন রাজ্যের বিস্তারের সপক্ষে এটি একটি জোরালাে প্রমাণ। সাত নামাঙ্কিত মালবশ্রেণির কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। অনেকের মতে এই সাত প্রথম সাতকর্ণি। ফলে মধ্যপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ উত্তর মহারাষ্ট্র যে তার রাজ্যভুক্ত ছিল মুদ্রার তথ্যে তার সমর্থন পাওয়া যায়। নানাঘাট গিরিপথের গায়ে মহিষী নাগনিকার একখাটি লেখ খােদিত আছে। ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থখানি একজন অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিক ৭০-৮০ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন। এই গ্রন্থে সােপারা এবং কল্যাণ নামে থানা জেলার দু’টি বাণিজ্যকেন্দ্রকে বর্ষীয়ান স্যারাগেনাস-এর রাজ্যভুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। স্যারাগেনাস কথাটি সম্ভবত সাতকর্ণি পদের গ্রিক অপভ্রংশ। বর্ষীয়ান স্যারাগেনাস সম্ভবত প্রথম সাতকর্ণি। আবার অনেকে মনে করেন এই বর্ষীয়ান স্যারাগেনাস প্রথম সাতকর্ণি নন, তার এক উত্তরসূরি। লেখে প্রথম সাতকর্ণিকে ‘দক্ষিণাপথপতি’ ও ‘অপ্রতিহতচক্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনার মধ্যে হয়তাে অতিশয়ােক্তি আছে। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের বৃহদংশের তিনি অধিপতি ছিলেন, সমগ্র দক্ষিণ ভারতের নয়।
কলিঙ্গরাজ খারবেলের সাথে যুদ্ধ : প্রথম সাতকর্ণির সময় পূর্ব উপকূলবর্তী কলিঙ্গ রাজ্যটি পরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। চেদিবংশীয় খারবেল তখন কলিঙ্গের অধিপতি। তিনি তার হাথীগুম্ফা লেখে দাবি করেছেন, সাতকর্ণির কথা না ভেবে তিনি পশ্চিম দিকে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠান এবং কৃষ্ণা তীরবর্তী অসিকনগর জয় করেন। হাথীগুম্ফা লেখে যে সাতকর্ণির কথা বলা হয়েছে তিনি সম্ভবত প্রথম সাতকর্ণি। সাতকর্ণির সঙ্গে খারবেলের ঠিক কী সম্পর্ক ছিল হাথীগুম্ফা লেখে তার কোনও স্পষ্ট আভাস নেই। ফলে খারবেলের উক্তির প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। এ সম্পর্কে তিনটি সম্ভাবনার কথা মনে হয় :
- এক. মিত্র প্রথম সাতকর্ণির রাজ্যের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে খারবেল অসিকনগর জয় করেছিলেন;
- দুই. সাতবাহন রাজার হাত থেকে কলিঙ্গরাজ অসিকনগর অধিকার করেন;
- তিন, খারবেল সাতকর্ণির প্রকৃত সামর্থ অনুধাবন করতে পারেননি, ফলে প্রতিপক্ষের নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি অসিকনগর অভিমুখে অগ্রসর হন।
নানাঘাট লেখে বলা হয়েছে প্রথম সাতকর্ণি একটি রাজসূয় ও দুটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তাছাড়া তিনি আরও অনেক যাগযজ্ঞের আয়ােজন করেন। অশ্বমেধ যজ্ঞ দু’টির মধ্যে প্রথমটি সম্ভবত তার সিংহাসন লাভের অব্যবহিত পর এবং দ্বিতীয়টি রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। খারবেলকে তিনি যদি সত্যই পরাজিত করে থাকেন তাহলে হয়তাে সেই বিজয় উপলক্ষে তিনি একটি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়ােজন করেন।
দুর্দিনের আবির্ভাব
মনে হয়, প্রথম সাতকর্ণির মৃত্যুকালে তার দুই পুত্র বেদী ও শক্তিশ্রী নাবালক ছিলেন। ফলে তার বিধবা পত্নী নাগনিকা প্রথমে বেদশ্রী এবং পরে বেদশ্রীর মৃত্যুতে শক্তিশ্রীর অভিভাবিকারূপে রাজ্য শাসন করেন। এই সময় থেকে প্রায় শতাব্দী কাল পর্যন্ত সাতবাহন রাজ্যের ইতিহাস অনেকটাই তমসাচ্ছন্ন। পুরাণে শক্তিশ্রীর নাম নেই, সাতকর্ণির উত্তরাধিকারী রূপে সেখানে পূর্ণোৎসঙ্গের উল্লেখ আছে। পুরাণে এর পর দ্বিতীয় সাতকর্ণির নাম করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এই দ্বিতীয় সাতকর্ণি সাঁচী এবং হাথীগুম্ফা লেখের সাতকর্ণি। বলা বাহুল্য, এ মত অনেকে স্বীকার করেন না।
দ্বিতীয় সাতকর্ণির পর যারা ক্রমান্বয়ে সাতবাহন সিংহাসনে আরােহণ করেন পুরাণে তাদের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই রাজাদের প্রকৃত নাম এবং সংখ্যা নিয়ে পরাণে পুরাণে মতভেদ। আর তারা সকলেই অতি সাধারণ মানের রাজা ছিলেন, তাদের না ছিল যােগ্যতা, না ছিল সদিচ্ছা। তাদের দুর্বলতার সুযােগে পরাক্রান্ত শকরা সাতবাহন রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজের অধিকারভুক্ত করেন।
‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থখানি থেকে জানা যায়, সােপারা এবং কল্যাণ বন্দর দুটি পূর্বে সাতবাহন রাজাদের অধীন ছিল কিন্তু পরে তা স্যান্ডারেস-এর হস্তগত হয়। খ্রিস্টীয় ১ম শতকের মাঝামাঝি সময় এই রাজনৈতিক পালা বদল ঘটে। স্যান্ডারেস সম্ভবত একজন শক শাসক ছিলেন।
কোঙ্কণ উপকূলসহ মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই শক আধিপত্য বেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। শক রাজা নহপানের (খ্রিস্টাব্দ ১০০-২৪) বেশ কিছু মুদ্রা এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে। নহপানের জামাতা ঋষভদত্তের কয়েকখানি লেখ পুণা জেলার নাসিক ও কার্লেতে পাওয়া গেছে। মনে হয়, অধিকৃত মহারাষ্ট্রের শাসনভার নহপান জামাতার হাতে তুলে দেন। সাতবাহন রাজারা এই সময় মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। সেখানেও নহপানের পূর্বেই ক্ষত্রপ ভূমক শক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি
সিংহাসনে আরোহন : নহপানের ক্ষত্রপপদে অভিষিক্ত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি সাতবাহন সিংহাসনে আরােহণ করেন। আনুমানিক ১০৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৩০ অব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন বলে অনেকে মনে করেন। ইতিহাসে গৌতমীপুত্র সর্বশ্রেষ্ঠ সাতবাহনরাজরূপে স্বীকৃত।
শকরাজ নহপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ : যে সাফল্যের জন্য তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি সেই সাফল্য এসেছিল তার রাজত্বের শেষ পর্বে। তার রাজত্বের প্রথম সতেরাে বছর তাকে শক্তি সঞ্চয়ের কাজে ব্যয় করতে হয়। নহপান ও তার জামাতা ঋষভদত্ত সাতবাহন ভূখণ্ডের এক বিস্তীর্ণ অংশ অধিকার করে আছেন। অধিকৃত ভূখণ্ড হতে শকদের উচ্ছেদ করা সহজসাধ্য ছিল না। এর জন্য প্রয়ােজন ছিল পরিপূর্ণ প্রস্তুতির। সে কাজ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে সাফল্যের বাতায়ন খুলে যায়। তার রাজত্বের অষ্টাদশ বছর থেকে বিজয়লক্ষ্মী তার প্রতি প্রসন্ন হন। ওই বছরে উৎকীর্ণ তার নাসিক লেখ থেকে জানা যায়, ক্ষহরাতগণের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি সসৈন্যে কিছুকাল নাসিক জেলার বেনাকটক গ্রামে অবস্থান করেন। তখন ত্রিরশ্মি পর্বতবাসী সন্ন্যাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি একখণ্ড জমিও প্রদান করেন। জমিখানি পূর্বে ঋষভদত্তের অধিকারভুক্ত ছিল। ওই একই বছরে উৎকীর্ণ তার কার্লা লেখ থেকে জানা যায়, তিনি বলুরকগুহাবাসী সন্ন্যাসীদের মামাল আহারের অন্তর্ভুক্ত করজক গ্রাম দান করেন। এই গ্রামটিও পূর্বে ঋষভদত্তের অধীনস্থ ছিল। নাসিক ও কালার লেখ দুখানি গৌতমীপুত্রের সাফল্যের দু’টি সুনিশ্চিত প্রমাণ। এই লেখ দু’টি হতে জানা যায়, গৌতমীপুত্র তার রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে অর্থাৎ আনুমানিক ১২৪ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্র হতে নহপানদের উচ্ছেদ করেন। গৌতমীপুত্র যে নহপানকে যুদ্ধে পরাজিত করেন তা নাসিক জেলার জোগলথেম্বি গামে পাওয়া মুদ্রার সাক্ষ্যেও প্রমাণিত। এই গ্রামে সর্বসমেত ১৩২৫০টি রূপার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলোর এক তৃতীয়াংশ নহপানের। বাকি মুদ্রাও নহপানের কিন্তু সেগুলো গৌতমীপুত্র কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত। মহারাষ্ট্রের ক্ষহরাত অধিকারভুক্ত অঞ্চলে নহপানের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। সে অঞ্চলে নিজের অধিকার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পুরােনাে মুদ্রায় নিজের নাম এবং প্রতীক অঙ্কিত করে গৌতমীপুত্র সেগুলো পুনরায় প্রচার করেন। পুত্র গৌতমীপুত্র ক্ষহরাত বংশ নিধন করেছেন বলে রাজমাতা গৌতমী বলশ্রী নাসিক প্রশক্তিতে দাবি করেছেন। গৌতমীপুত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নহপান সম্ভবত নিহত হন।
শক, যবন ও পহ্লবদের সংহার : নহপানের বিরুদ্ধে জয়লাভ গৌতমীপুত্রের একমাত্র কৃতিত্ব নয়। তিনি শক, যবন ও পহ্লবদের সংহার করেছেন বলে নাসিক প্রশস্তিতে দাবি করা হয়েছে (সক-পহলব-যবন-নিসুদনস)। ক্ষহরাতরাই শক। যে গ্রিক ও পহ্লবগণকে গৌতমীপুত্র পরাজিত করেন তারা সম্ভবত নহপানের বেতনভুক সৈন্য ছিলেন। নাসিক প্রশস্তিতে ঋষিক (কৃষ্ণা তীরবর্তী), অশ্মক (মহারাষ্ট্রের গােদাবরী-তীরবর্তী অঞ্চল বা অন্ধ্রপ্রদেশের বােধন অঞ্চল), মূলক (ঔরঙ্গাবাদ জেলা), সুরাষ্ট্র, কুকুর (গুজরাতে অবস্থিত), অপরান্ত (উত্তর কোঙ্কণ), অনূপ (নর্মদা তীরবর্তী মান্ধাতা বা মহেশ্বর অঞ্চল), বিদর্ভ (পূর্ব মহারাষ্ট্র), আকর (মধ্য মধ্যপ্রদেশ) এবং অবন্তি (দক্ষিণ-পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থান) অঞ্চল গৌতমীপুত্রের রাজ্যভুক্ত বলা হয়েছে। অপরান্ত, অনূপ, সুরাষ্ট্র, কুকুর, আকর ও অবন্তি পূর্বে নহপানের অধীনস্থ ছিল। উত্তরে গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশ হতে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী এবং পূর্বে বিদর্ভ থেকে পশ্চিমে কোঙ্কণ উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগের অধিপতি হলেন গৌতমীপুত্র। দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এত বড় রাজ্য এর আগে কখনও গড়ে ওঠেনি।
নাসিক প্রশস্তি : নাসিক প্রশস্তিতে গৌতমীপুত্রের রাজ্যকে অবশ্য আরও বর্ধিত আকারে দেখানাে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তার যুদ্ধের অশ্ববাহিনী তিন সমুদ্রের জল পান করেছিল। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরকে নিয়েই তিন সমুদ্র। নাসিক প্রশস্তিতে আরও বলা হয়েছে, বিন্ধ্য, পারিযাত্র, মলয়, মহেন্দ্র, চকোর প্রভৃতি পর্বত গৌতমীপুত্রের রাজ্যমধ্যে অবস্থিত ছিল। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার দক্ষিণ ভাগের নাম মলয় পর্বত। পূর্বঘাট পবর্তমালার মহানদী ও গােদাবরী নদীর মধ্যবর্তী অংশ মহেন্দ্র। চকোর পর্বতের অবস্থান ছিল সম্ভবত পূর্বঘাট পর্বতমালার দক্ষিণাংশে। নাসিক প্রশস্তির বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মনে করেন ওড়িশা এবং অন্ধপ্রদেশ গৌতমীপুত্রের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এ ধারণা যথার্থ নয়; প্রশস্তিকার নিঃসন্দেহে গৌতমীপুত্রের কার্যকলাপের এক অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়েছেন।
শকরাজ চষ্টনের নিকট পরাজয় : গৌতমীপুত্রের এই সাফল্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। জীবনের একেবারে পড়ন্তবেলায় তিনি মহাক্ষত্রপ চষ্টনের নিকট পরাজিত হন। প্রতিষ্ঠান শহরটি শ্রীপুলুমাবি এবং উজ্জয়িনী চষ্টনের রাজধানী বলে গ্রিক লেখক টলেমি তার ভূগােল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় চষ্টনের বাজত্বকালে কার্দমকরা সাতবাহন-অধিকারভুক্ত অবন্তি অধিকার করেন। রুদ্রদামার জুনাগড় লেখে দাবি করা হয়েছে, শুধু অবন্তি নয়, আকর, অনুপ, অপরান্ত, সুরাষ্ট্র এবং আনর্তও (গুজরাতের দ্বারকা অঞ্চল) কার্দমকরা অধিকার করেন। এসব অঞ্চল এক সময় গৌতমীপুত্রের শাসনাধীন ছিল। সম্ভবত গৌতমীপুত্রকে পরাজিত করে চষ্টন এসব অঞ্চলে আপন প্রভুত্ব বিস্তার করেন। জুনাগড় লেখে এসব অঞ্চল জয়ের কৃতিত্ব যদিও রুদ্রদামার উপর অরােপিত হয়েছে, তবু মনে হয় চষ্টনের আমলেই এসব ঘটনা ঘটেছিল। রুদ্রদামা সম্ভবত তা পিতামহ চষ্টনকে গৌতমীপুত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয় সহযােগিতা করেছিলেন।
শকরাজ রুদ্রদামার সাথে সম্পর্ক : জুনাগড় লেখে সাতকর্ণির সঙ্গে রুদ্রদামার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উল্লেখ আছে (জুনাগড় লেগের সাতকর্ণি যে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি তা র্যাপসন স্বীকার করেন না। তার মতে এই সাতকর্ণি বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবি (Catalogue of the Coins of The Andhra Dynasty, The Western ksatrapas, The Traikutaka Dynasty And The Bodhi Dynasty, পৃ. ৫১))। কানহেরি লেখ থেকে জানা যায়, বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণি এক মহাক্ষত্রপের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। এই মহাক্ষত্রপ সম্ভবত রুদ্রদামা। বাশিষ্ঠীপুত্র গৌতমীপুত্রেরই এক সন্তান ছিলেন। সম্ভবত আত্মরক্ষার তাগিদে গৌতমীপুত্র নিজ সন্তানের সঙ্গে রুদ্রদামার কন্যার বিবাহ দেন।
স্বাস্থ্যজনিত কারণে রাজ্য পরিচালনায় অপারগতা : তার রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে গৌতমীপুত্র স্বাস্থ্যজনিত কারণে রাজ্য পরিচালনায় অপারগ হয়ে পড়েছিলেন, এরূপ সম্ভাবনার ইঙ্গিত মেলে তার রাজত্বের চতুর্বিংশতি বছরে উৎকীর্ণ নাসিক গুহালেখে এই লেখে রাজমাতা গৌতমী বলশ্রীকে ‘জীবসূতা’ (যার পুত্র জীবিত) বলা হয়েছে। গােবর্ধনের অমাত্যকে রাজমাতা তার পুত্রের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আশ্বস্ত করছেন, এ ধরনের কথাও এই লেখে বলা হয়েছে। এ থেকে মনে হয়, পুত্রের অসুস্থতার কারণে গৌতমী বলশ্রী সাময়িকভাবে রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে ধারণ করেছিলেন। এই অসুস্থতাই সম্ভবত শেষ পর্যন্ত গৌতমীপুত্রের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে তথ্য এত অপ্রতুল যে এ সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত করা যায় না।
পণ্ডিতমহলে ভ্রান্ত ধারণা : গৌতমীপুত্র সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে –
- বিক্রমাবিদ্য : অনেকের মতে এই গৌতমীপুত্রই কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য। কিন্তু এ মত নিতান্তই অমূলক। বিক্রমাদিত্যের রাজধানী উজ্জয়িনী, কিন্তু সাতবাহনদের রাজধানী প্রতিষ্ঠান। বিক্রমাব্দের প্রতিষ্ঠাতারূপে বিক্রমাদিত্যের খ্যাতি। পক্ষান্তরে গৌতমীপুত্র বা তার কোনও উত্তরপুরুষ কোনও অব্দ প্রচলন করেননি, তাদের রাজ্যবর্ষের উল্লেখ করেছেন মাত্র। তাছাড়া গৌতমীপুত্রের বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণের সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই।
- নাগার্জুনের পৃষ্ঠপােষক : অনেকের বিশ্বাস গৌতমীপুত্র প্রখ্যাত দার্শনিক নাগার্জুনের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। এ মতও সত্য নয়। শুয়েন চাঙের বর্ণনা হতে জানা যায়, নাগার্জুনের পৃষ্ঠপােষক দক্ষিণ কোসলের অধিপতি ছিলেন। গৌতমীপুত্র কখনও দক্ষিণ কোসলে রাজত্ব করেননি।
- বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবির সঙ্গে যুগ্মভাবে রাজ্য শাসন : গৌতমীপুত্র তার সন্তান বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবির সঙ্গে যুগ্মভাবে রাজ্য শাসন করেছিলেন, এ মত কেউ কেউ পােষণ করেন। এ মতও সমর্থনযােগ্য নয়। পিতা ও পুত্র যৌথভাবে উৎকীর্ণ করেছেন এমন কোনও লেখ বা মুদ্রার সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠান পুলুমাবির রাজধানী ছিল, এ কথা টলেমি স্পষ্ট করেই বলে গেছেন। কিন্তু পুলুমাবির প্রসঙ্গে টলেমি গৌতমীপুত্রের কোনও উল্লেখ করেননি। পিতা ও পুত্র একযােগে রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করলে টলেমির উক্তিতে তার সমর্থন পাওয়া যেত।
বাশিষ্ঠীপত্র পুলুমাবি
রাজ্যবিস্তার : গৌতমীপুত্রের মৃত্যুর পর তার পুত্র বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবি আনুমানিক ১৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজপদে অভিষিক্ত হন। তিনি তিন দশকের কিছু কম সময় রাজত্ব করেছিলেন বলে পুরাণে উল্লেখ আছে। শক-কার্দমকদের কবল হতে পুলুমাবি অধিকৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে পারেননি সত্য, কিন্তু তারই রাজত্বকালে সাতবাহন রাজ্য পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে। অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার অমরাবতী গ্রামে তার লেখ পাওয়া গেছে। তার নামাঙ্কিত অসংখ্য মুদ্রা করমণ্ডল উপকূল সহ অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত পুলুমাবির রাজত্বকালেই অন্ধপ্রদেশ সাতবাহনদের অধিকারে চলে আসে। কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে রাজ্য বিস্তার পুলুমাবির আর একটি উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব। কর্ণাটকের বোরি জেলায় তার একখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজিত অঞ্চল ‘সাতবাহনীয় আহার’ নামে পরিচিত হয়। মহারাষ্ট্র তাে পুলুমাবির রাজ্যভুক্ত ছিলই। নাসিক ও কার্লাতে তিনি বেশ কয়েকখানি লেখ উৎকীর্ণ করেন।
রুদ্রদামার কাছে পরাজয় : অনেকে মনে করেন, গৌতমীপুত্র নন, বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবিই রুদ্রদামার হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। জুনাগড় লেখ থেকে জানা যায় রুদ্রদামা সাতকর্ণি নামে জনৈক রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। পুলুমাবি সাতকর্ণি নাম ধারণ করেছিলেন বলে জানা যায় না।
পরবর্তী সাতবাহন রাজন্যবৃন্দ ও পতন
শিবশ্রী সাতকর্ণি : পুলুমাবির পর রাজা হন তার সহােদর শিবশ্রী সাতকর্ণি (আনু. ১৫৯-১৬৬ খ্রি.)। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতাে তিনিও বাশিষ্ঠীপুত্র নামে পরিচিত ছিলেন। কৃষ্ণা ও গােদাবরী জেলায় তার নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে। তার কানহেরি লেখ থেকে জানা যায় তিনি জনৈক মহাক্ষত্রপের এক কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। কানহেরি লেখে সেই মহাক্ষত্রপের সম্পূর্ণ নামের উল্লেখ নেই, আছে তার নামের আদ্যাক্ষর রু-এর উল্লেখ। এই লেখে তিনি কার্দমক বলে বর্ণিত হয়েছেন। এ থেকে মনে হয় সাতবাহনরাজ বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণি মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামার কন্যারই পাণিগ্রহণ করেছিলেন। শ্বশুরের মৃত্যুর পর সাতকর্ণি সম্ভবত শক রাজ্যের কিছু অঞ্চল অধিকার করেন।
শিবস্কন্দ সাতকর্ণি : তারপর শিবস্কন্দ সাতকর্ণি (আনু. ১৬৬-১৭৪ খ্রি.) সিংহাসনে আরােহণ করেন। পুরাণের শিবস্কন্দ সাতকর্ণি, অমরাবতী লেখের শিবস্কন্দ সাতকর্ণি এবং মুদ্রার স্কন্দ সাতকর্ণি সম্ভবত এক ও অভিন্ন ব্যক্তি।
যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণি ও শকদের বিরুদ্ধে জয় : শিবস্কন্দের পর যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণি (আনু. ১৭৪-২০৩ খ্রি.) সিংহাসনে আরোহন করেন। যজ্ঞশ্রীর লেখ মহারাষ্ট্রের নাসিক ও কানহেরিতে এবং অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে তার নামাঙ্কিত মুদ্রাও পাওয়া গেছে। যজ্ঞশ্রী শুধু দাক্ষিণাত্যের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় প্রান্তে রাজত্ব করেননি, কার্দমকদের নিকট হতে ওজরাতের একাংশও অধিকার করেন। কার্দমকদের বিরুদ্ধে তার সাফল্য মুদ্রার সাক্ষ্যেও পরােক্ষ ভাবে সমর্থিত হয়। তার রূপার মুদ্রা রুদ্রদামার মুদ্রার প্রায় হুবহু অনুকরণ। গুজরাতের যে অঞ্চল হতে যজ্ঞশ্রী কার্দমকদের উচ্ছেদ করেন সেই অঞ্চলে প্রচলনের উদ্দেশ্যেই সাতবাহনরাজ এই মুদ্রা চালু করেন। এই সময় গৃহবিবাদের ফলে কার্দমাক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বিরােধ ছিল জীবদামা এবং প্রথম রুদ্ৰসিংহের মধ্যে। তারা প্রথমে একযােগে কাজ করে পরে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। মহাক্ষত্রপ ঈশ্বরদত্তের অভ্যুত্থানের ফলে কার্দমকরা আরও হীনবল হয়ে পড়েন। কার্দমক শক্তির দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে যজ্ঞশ্রী গুজরাতের একাংশে নিজের অধিকার বিস্তার করেন। যজ্ঞশ্রী সম্ভবত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলও সম্ভবত যজ্ঞশ্রীর রাজ্যভুক্ত ছিল। অনেকে মনে করেন রাজত্বের শেষপর্বে যজ্ঞশ্রী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাদের ধারণা রাজা ঈশ্বরসেন যজ্ঞশ্রীকে পরাজিত করে উত্তর-পশ্চিম মহারাষ্ট্রে আভীর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ঈশ্বরসেন খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মধ্যভাগে আবিভূর্ত হয়েছিলেন, ২য় শতকের শেষ-পর্বে নয়।
যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির উত্তরাধিকারী রূপে পুরাণে বিজয়, চন্দ্ৰশ্ৰী বা চণ্ডশ্রী এবং পুলােমা বা পুলুমাবির উল্লেখ আছে। পুরাণের বিজয় এবং মুদ্রার বিজয় সাতকর্ণি সম্ভবত একই ব্যক্তি। চন্দ্র বা চণ্ড সাতকর্ণির একখানি লেখ গােদাবরী জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এই অঞ্চলে তার নামাঙ্কিত মুদ্রাও পাওয়া গেছে। পুলুমাবির অষ্টম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি লেখ কর্ণাটকের বেল্লারি জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশে রুদ্র সাতকর্ণির মুদ্রা পাওয়া গেছে। পুরাণে রুদ্র সাতকর্ণির নাম নেই। এই রাজার সমগ্র সাতবাহন রাজ্যের, না তার খণ্ডিত অংশের রাজা ছিলেন, তা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। এই পর্বের একজন রাজা মাঠরীপুত্র শকসেন। তার একখানি লেখা কানহেরিতে আবিষ্কৃত হয়েছে। কৃষ্ণা ও গােদাবরী জেলায় প্রাপ্ত শকসেন বা শকসাত নামাঙ্কিত মুদ্রা সম্ভবত তিনিই উৎকীর্ণ করেন। তার রাজ্যটি আয়তনে বেশ বড়ই ছিল বলে মনে হয়। বাশিষ্ঠীপুত্র চতরপন সাতকর্ণি নামে জনৈক রাজার ত্রয়ােদশ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি লেখ নানাঘাটে পাওয়া গেছে। পূর্ববর্তী রাজগণের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল তা জানা যায় না।
সাতবাহন রাজত্বের অবসান : আনুমানিক ২২৫ খ্রিস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশে সাতবাহন শাসনের অবসান ঘটে। শান্তমূলের নেতৃত্বে সেখানে স্বাধীন ইক্ষ্বাকু রাজ্য গড়ে ওঠে। এই সময় কর্ণাটকেও সাতবাহন আধিপত্যের অবসান হয়। সেখানে মহারঠিদের বিতাড়িত করে প্রথমে মুডানন্দ (মতান্তরে মুলানন্দ) এবং পরে চুটুকুলানন্দ স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে মনে করেন চুটুরা অপরান্তও অধিকার করেন। শেষােক্ত মত অবশ্য সকলে স্বীকার করেন না। সাতবাহনরা তখনও মহারাষ্ট্রে এবং সম্ভবত মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশে রাজত্ব করছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরসেন খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মাঝামাঝি সময় মহারাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আভীর শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মহারাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল ও মধ্যপ্রদেশে বাকাটক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী কাল অস্তিত্ব ও প্রভুত্বের লড়াই করে সাতবাহন রাজ্য এভাবে ধসে পড়ল।
প্রশাসন, সমাজব্যবস্থা, কৃষি ও কারিগরি শিল্প
প্রশাসন-ব্যবস্থা
- রাজা : প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন রাজা। তিনি একাধারে মুখ্য প্রশাসক ও সেনা বাহিনীর অধ্যক্ষ। রাজারা বহুপত্নীক ছিলেন। সে কারণে রাজকুমারেরা অনেক সময় মায়ের নাম গ্রহণ করতেন। গৌতমীপুত্র, বাশিষ্ঠীপুত্রেরা তাই করেছেন। পিতার সিংহাসনে জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই অধিকার ছিল। সাতবাহন রাজারা নিজেদের কখনও দেবতা বা দেবপ্রতিনিধি বলে পরিচয় দেননি। অমরাবতীর ভাস্কর্যে রাজার পদমর্যাদা সম্পর্কে কিছু ধারণা প্রকাশ পেয়েছে। রাজাকে সেখানে প্রায়ই ছত্র ও চামরধারী পরিবৃত দেখা যায়, রাজার আসনও সিংহচিহ্নিত, রাজপদের স্বাতন্ত্র ও মর্যাদা অমরাবতীর ভাস্কর্যে পরিস্ফুট।
- জনকল্যাণকর কাজ : জনকল্যাণকর কাজে রাজার ঐকান্তিক আগ্রহ ছিল। প্রজাদের সুখে-দুঃখে গৌতমীপুত্রের সহানুভূতির কথা নাসিক প্রশস্তিতে বলা হয়েছে। পীড়নমূলক কর ধার্য না করা এবং ব্রাহ্মণ ও অন্য সকলের স্বার্থরক্ষায় তার আগ্রহ এই লেখে প্রকাশ পেয়েছে।
- দু’রকম শাসনব্যবস্থা : সাতবাহন রাজ্যে দু’রকম শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এক অংশের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন অনুগত মহারঠি, মহাভােজ এবং কুর পরিবারের লােকেরা। বাকি অংশ ছিল রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন। মহারঠিরা ছিলেন কর্ণাটকের দায়িত্বে, মহাভােজেরা উত্তর কোণের আর কুরেরা কোলাপুর অঞ্চলের। তাদের ভূমিদানের অধিকার ছিল। স্বনামে তারা মুদ্রাও প্রচলন করেছেন। আইনত তারা রাজার অধীনস্থ হলেও কার্যত তারা স্বাধীনই ছিলেন বলা যায়।
- আহারে বিভক্তি : রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল আবার অনেকগুলো আহারে বিভক্ত ছিল। গােবর্ধন, সােপারা, মামাল, সাতবাহনীয় প্রভৃতি কয়েকটি আহারের উল্লেখ লেখে আছে। আহার শাসনের ভার ছিল অমাত্য পদবির কর্মচারীদের উপর। তাদের উপর রাজার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। আহারস্থিত কোনও জমি হস্তান্তরের অধিকার তাদের ছিল না। স্বনামে মুদ্রা চালু করার ক্ষমতাও তাদের ছিল না। সম্ভবত অমাত্যরা এক আহার হতে তান্য আহারে বদলি হতেন। অনেকগুলো গ্রাম নিয়ে ছিল এক একটি আহার। গ্রামিকের উপর গ্রামের ভার ছিল।।
- রাজকর্মচারী : তাছাড়া লেখে রাজামাত্য, মহামাত্র, ভাণ্ডাগারিক, হেরণিক, লেখক, নিবন্ধকার, দূতক প্রভৃতি রাজকর্মচারীদের কথা বলা হয়েছে। রাজার বিশেষ আস্থাভাজন এবং উপদেষ্টাদের একজন ছিলেন রাজামাত্য। বিশেষ বিশেষ কাজের দায়িত্বে ছিলেন মহামাত্র। ভাণ্ডাগরিকের তার্থ ভাণ্ডারী। রাজকীয় দলিল-দস্তাবেজ রচনার দায়িত্বে ছিলেন লেখক। নিবন্ধকার সম্ভবত ভূমির রেজিষ্ট্রিসংক্রান্ত কাজের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। দুতব হলেন রাজার বার্তাবহ। হেরণিক হলেন কোষাধ্যক্ষ। সাতবাহন লেখে মহাসেনাপতির উল্লেখ আছে। তিনি কখনও লেখকরূপে, কখনওবা জনপদের প্রশাসকরূপে, বর্ণিত হয়েছেন। সমকালীন একখানি লেখে মহাতলবর-এর উল্লেখ আছে। তলবর দ্রাবিড় পদ। এর অর্থ প্রহরী। মহাতলবর সম্ভবত রক্ষা-বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন।
সামাজিক জীবন
- বর্ণাশ্রম : সেযুগের সমাজ-জীবনের কিছু ছবি ধরা পড়েছে সমকালীন লেখে, সাহিত্যিক উপাদানে এবং ভাস্কর্যে। সমাজে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। ব্রাহ্মণরা প্রধানত পুরােহিতের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। যুদ্ধবৃত্তি ক্ষত্রিয়দের উপজীবিকা ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি ছিল বৈশ্যদের উপজীবিকা। শূদ্ররা বিত্তবানদের গৃহে ও খেতে ভূতের কাজ করতেন। স্থানীয় গােষ্ঠীর অনেকে যেমন বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা গ্রহণ করে আর্য সমাজের সঙ্গে মিশে গেলেন তেমনি আবার অনেকে তাদের পৃথক সত্তা বজায় রাখেন। বিভিন্ন পেশাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শ্রেণির বা জাতির উদ্ভব হয়। এই প্রসঙ্গে হলিক বা কৃষক, শ্রেষ্ঠী বা বণিক, গান্ধিক বা সুগন্ধ দ্রব্যাদির প্রস্তুতকারক বা বিক্রেতা, কৌলিক বা তন্তুবায়, তিলপিষক বা ঘানিওয়ালা এবং কর্মকার প্রভৃতি জাতির উল্লেখ করা যায়।
- বর্ণাশ্রমের দুর্বল ভিত : সমাজে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা চালু ছিল ঠিকই কিন্তু এর ভিত বেশ দুর্বল ছিল। এর একটি কারণ হল বৌদ্ধধর্মের প্রসার। আর একটি কারণ শক-পহ্লব প্রভৃতি বৈদেশিক জাতির দক্ষিণ ভারতে আগমন। শক মহাত্ৰপ রুদ্রদামার সঙ্গে তাে সাতবাহন রাজপরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। তাছাড়া স্থানীয় গােষ্ঠীর তানেকে আর্য রীতি-নীতি ও বৃত্তি গ্রহণ করে আর্য সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। ফলে বিভিন্ন বর্ণ ও গােষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে যায়। নাসিকের এক লেখে বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রতিষ্ঠায় গৌতমীপত্রের আগ্রহের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নিজেদের ব্রাহ্মণত্বের দাবিতে এবং শক পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সাতবাহনদের সে ঐকান্তিক প্রকাশ পায়নি।
- যৌথ পরিবার : যৌথ পরিবার তখনকার সমাজের এক উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। বাবা-মা, ভাই-বােন, স্ত্রী-পুত্র, নাতি-নাতনিরা সবাই একযােগে দানধ্যান করছেন এরূপ বহু ঘটনার উল্লেখ আছে অমরাবতীর লেখমালায়। পরিবারের সদস্যরা তাদের গুরুত্ব অনুসারে পর্যায়ক্রমে লেখে উল্লিখিত হয়েছেন। অর্থাৎ মায়ের আগে বাবার উল্লেখ আছে, উল্লেখ আছে মেয়ের পূর্বে ছেলের, আর বােনের আগে ভায়ের। সেযুগে সম্ভ্রান্ত ও সাধারণ পরিবারের মেয়েরা যে প্রচুর দানধ্যান করতেন সমকালীন লেখে তার প্রমাণ আছে। নাসিক প্রশস্তি হতে জানা যায় মহিষী নাগনিকা বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন, স্বামীর মৃত্যুতে রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে ধারণ করেছেন। সেযুগে একজন মহিলার বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সমকালীন বৈদিক ভাষ্যকার জৈমিনি স্পষ্ট করে নির্দেশ দিয়েছেন, অশিক্ষিত হওয়ায় মহিলারা যাগযজ্ঞের অধিকারী নন। বৈদিক মন্ত্রের উচ্চারণ মেয়েদের পক্ষে নিষিদ্ধ বলে স্মৃতিকার মনুও বিধান দিয়েছেন। বােঝা যায়, জৈমিনি বা মনুর অনুশাসনা সাতবাহন রাজ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
- বসনভূষণ : অমরাবতী ও কালের ভাস্কর্যে সেযুগের বসনভূষণের পরিচয় মেলে। ভাস্কর্য মূর্তিগুলোর স্বল্পবাস এবং অলংকারের প্রাচুর্য বিশেষভাবে লক্ষ করার মতাে। মূর্তিগুলোর নিম্নাঙ্গ বস্ত্রসজ্জিত কিন্তু ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। পুরুষমূর্তির মাথায় উষ্ণীষ। অলংকারের প্রতি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই সমান আগ্রহ। অলংকারের মধ্যে রয়েছে দুল, বালা, ব্রেসলেট, হার এবং অনন্ত। প্রায় সব নারীমূর্তির পায়ে নূপুর।
কৃষি
- উৎপাদিত খাদ্য ও শিল্পদ্রব্য : সাধারণ লােকের আয়ের মূল উৎস ছিল কৃষি। লেখমালায় গাে-দান ও ভূমি-দানের অজস্র উল্লেখে জনজীবনে কৃষির গুরুত্বই আভাসিত হয়। মিলিন্দপঞ্চ্হো গ্রন্থে অপরান্ত বা কোঙ্কণ উপকূল অঞ্চলের কুমুদভণ্ডিকা ধানের উল্লেখ আছে। এ ধান ছিল মােটা ও সাধারণ মানের। গাথাসপ্তশতীতে ধান, গম, ছােলা, শন, কার্পাস ও ইক্ষুর উল্লেখ আছে। প্লিনির বিবরণী ও পেরিপ্লাস্-এর বর্ণনা থেকে জানা যায় মালাবার অঞ্চলে গােলমরিচ উৎপন্ন হত। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে যে দারুচিনি, এলাচ প্রভৃতি মশলা প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত পেরিপ্লাস গ্রন্থে তার ইঙ্গিত আছে। করমণ্ডল উপকুলে নারকেল চাষের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তামিলনাড়ুর আরিকমেডুতে আবিষ্কৃত হয়েছে।
- কৃষিযন্ত্র : কৃষির কাজে এই পর্বে দু’টি বিশেষ ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এদের একটি হল উদকযন্ত্র যার পরােক্ষ উল্লেখ রয়েছে নাসিক হতে পাওয়া একটি লেখে। যন্ত্রটির গঠন ও প্রকৃতি সম্পর্কে কোনও সুস্পষ্ট তথ্য নেই তবু মনে হয় জল সরবরাহের কাজে এটি ব্যবহার করা হত। হালের গাথাসপ্তশতীতে অরহট্টঘটিকা নামে অপর একটি জলযন্ত্রের উল্লেখ আছে। যন্ত্রটি দেখতে চক্রের মতাে, তার গায়ে ঘটিকা বসানাে। চক্রটি বসানাে হত কোনও বৃহৎ কূপে বা জলাশয়ের মধ্যে। চক্রটি ঘুরলে ঘটি জলে ভরে যেত এবং ঘুরন্ত চক্রের সঙ্গে ঘটি নিম্নমুখী হলে সে জল সেচের কাজে ব্যবহার করা যেত। উদকযন্ত্র ও অরহট্টঘটিকার ব্যবহারের ফলে কৃষির উৎপাদন নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পায়।
- জমির ব্যক্তিগত মালিকানা : সাতবাহন রাজ্যে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অবশ্য কয়েকটি গ্রাম যে এজমালি সম্পত্তি ছিল তারও প্রমাণ আছে। সাতবাহন লেখে রাজকীয় খেতেরও (রাজকং ক্ষেত্তং) উল্লেখ আছে। রাজা কখনও কখনও তার নিজস্ব জমি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দান করতেন, সাতবাহন লেখমালায় এ ধরনের ভূ-দানের প্রচুর উল্লেখ আছে। এসব ক্ষেত্রে গ্রহীতাকে রাজস্বদানের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হত কিন্তু প্রদত্ত জমি কার্যত রাজার মালিকানাধীনই ছিল। জমি কেনাবেচার যেসব তথ্য সাতবাহন লেখে পাওয়া যায় তা সবই ধর্মসম্পর্কিত। এর থেকে কেউ কেউ মনে করেন সেসময় ধর্ম ছাড়া অন্য কোনও কারণে জমির কেনাবেচা হত না। উল্লেখ নেই শুধু এই কারণে এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।
- রাজস্ব : সম্ভবত উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ রাজস্ববাবদ রাজভাণ্ডারে জমা পড়ত। লবণ উৎপাদনে রাষ্ট্র সম্ভবত সরাসরি অংশ গ্রহণ করত না, ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহ দিত। তবে রাষ্ট্র উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট ভাগ কর বা শুল্করূপে গ্রহণ করত। তত্ত্বগতভাবে রাজ্যের যাবতীয় খনি ও খনিজ দ্রব্য ছিল রাজকীয় তথা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি।
বৃত্তি ও কারিগরি শিল্প
- বিভিন্ন শরণের শিল্প : সমকালীন লেখমালায় এযুগের বিভিন্ন বৃত্তি ও কারিগরি শিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়। যারা উল্লিখিত হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন উদযান্ত্রিক (জলযন্ত্রনির্মাতা বা কর্মী), কুলরিক (কুম্ভকার), তিলপিষক (ঘানিওয়ালা), কৌলিক (তন্তুবায়), ধন্যিক (ধানের কারবারি), বংশকার (বাশের কারিগর), কাংস্যকার (কাসারি), গন্ধবণিক (গন্ধদ্রব্য-বিক্রেতা), চর্মকার (চর্মশিল্পী), পাষাণিক (প্রস্তর-কারিগর) এবং দন্তকার বা হাতির দাঁতের কারিগর।
- বস্ত্রশিল্প : কৌলিক বা তন্তুবায়েরা সংখ্যায় বেশ ভারীই ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের মধ্যভাগে অবস্থিত টের ও পৈঠান ছিল বস্ত্রশিল্পের দু’টি প্রধান কেন্দ্র। টেরে উৎখননের ফলে কাপড় রং করার বিশাল পাত্র আবিষ্কত হয়ে পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকমেড়ুতে উৎখনন চালিয়ে কাপড় রাঙানাের অনুরূপ আঠা আবিয়ে হয়েছে। সাঁচীর একটি লেখে জনৈক দন্তকারের উল্লেখ আছে যিনি সাতবাহনরাজ প্রথম সাতকর্ণির সমসাময়িক ছিলেন। সাঁচীসস্তুপের একটি তােরণ নির্মাণে তিনি অর্থ ব্যয় করেছিলেন।
- ধাতু, পাথর ও মৃৎশিল্প : সেযুগে অনেকেই ধাতু, পাথর ও মৃৎশিল্পকে জীবিকারূপে গ্রহণ করেছিলেন। সােনা প্রধানত পাওয়া যেত কর্ণাটকের কোলারের খনিগুলোতে। পৈঠান, মাসকি, কোণ্ডাপুর, ভট্রিপ্রােলু, অমরাবতী প্রভৃতি স্থানে পােড়ামাটির সুদৃশ্য মূর্তি, মূল্যবান পাথর, সােনা, তামা, হাতির দাঁতের ও শখের তৈরি বিভিন্ন গহনা, স্ফটিকের জিনিস, ছাঁচ ও মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। পােড়ামাটির মূতিগঠনে শিল্পী যে প্রখর বাস্তবতার পরিচয় দিয়েছেন তা সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। মূর্তিগুলোর কেশ বিন্যাসে রয়েছে নয়নমুগ্ধকর বৈচিত্র্য। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটিকে অজণ্টার সেরা চিত্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করা চলে। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী সমকালীন স্বর্ণ, মণি ও মৃৎশিল্পের অগ্রগতির সুস্পষ্ট স্বাক্ষর বহন করছে।
- গিল্ড : সাতবাহন লেখমালায় স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও মনে হয় এসব শিল্পী, কারিগর ও ব্যবসায়ীদের নিজস্ব সংগঠন বা ‘গিল্ড’ ছিল। নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যই এই সংগঠন। সাতবাহন লেখে শ্রেণি বা পূগের কথা নেই কিন্তু নিগমের উল্লেখ আছে (A. M. Shastri, Early History of the Deccan : Problem and Perspective. পৃষ্ঠা ১১৮)। দু’খানি লেখে আছে ‘ধান্যকটক-নিগমের’ উল্লেখ। আর একটি লেখে এক নিগমের কথা বলা হয়েছে যার প্রমুখ ছিলেন জনৈক শ্ৰেষ্ঠী। তন্ত্রশাস্ত্র, বেদ, নির্গমন, বাণিজ্য, নগর, বাজার, পথ, পৌরসভা, সংঘ, বণিকসংঘ ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে নিগম শব্দের ব্যবহার আছে। সাতবাহন রাজ্যের এক বিখ্যাত শহর ধান্যকটক। শহরটি বর্তমানে অমরাবতী বা ধরণিকোট নামে পরিচিত। ধান্যকটক-নিগম বলতে সম্ভবত ধান্যকটকের পৌরসভা বােঝানাে হয়েছে। যে নিগমটির কর্ণধার ছিলেন জনৈক শ্রেষ্ঠী সেটি সম্ভবত বাণিজ্যোপজীবী সংগঠন ছিল।
রোম ও পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য
ব্যবসা-বাণিজ্য : ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ নামের গ্রন্থখানি, টলেমি কৃত ‘ভূগােল’ এবং রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া রােমক ও দেশীয় মুদ্রা সেযুগের ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতির পরিচয় বহন করে। প্রথম গ্রন্থখানি থেকে জানা যায় সাতবাহন রাজ্যের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল ছিল জনবহুল ও সমৃদ্ধশালী কিন্তু মধ্যাঞ্চল তুলনায় অনগ্রসর ছিল। মরু ও পর্বতসংকুল মধ্যাঞ্চলে বাঘ, হাতি, সাপ প্রভৃতি বিভিন্ন হিংস্র জীবজন্তুর বাস ছিল। এসময় পশ্চিমাঞ্চলে যেসব বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে সােপারা, কল্যাণ, পৈঠান, টগর (বর্তমান টের), জুন্নার, নাসিক ও বৈজয়ন্তী বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। অমরাবতীর লেখসমূহে কেবুরুর, বিজয়পুর, কুদুর প্রভৃতি কয়েকটি বাণিজ্যকেন্দ্রের উল্লেখ আছে। টলেমির বিবরণে মাসালিয়া (আধুনিক মসুলিপত্তন) ও ঘণ্টকশালের মতাে পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি সমৃদ্ধশালী বন্দরের উল্লেখ আছে। স্থলপথে ও নদীপথের মাধ্যমে পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় উভয় অঞ্চলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শুধু যে পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল তা নয়, দক্ষিণ ভারতীয় বন্দর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোও পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর সঙ্গে সড়কপথে সংযুক্ত ছিল। সাতবাহনদের রাজধানী প্রতিষ্ঠান থেকে একটি পথ টগর, নাসিক, সেতব্য, বনসভয়, উজ্জয়িনী ও সাঁচী হয়ে উত্তরে একেবারে শ্রাবস্তী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পশ্চিম উপকূলের বিখ্যাত বন্দর ভৃগুচ্ছ হতে আর একটি পথ মালব, গাঙ্গেয় উপত্যকা, তক্ষশিলা ও পুষ্কলাবতী হয়ে কাবুল অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় স্থান থেকে স্থানান্তরে গমনাগমন সহজসাধ্য হয়। সমকালীন লেখমালায় দেখা যায় দশপুরের বণিক নাসিকে, বৈজয়ন্তী, ধান্যকোট ও সােপারার পণ্যবিক্রেতা জুন্নারে এবং সােপারার ব্যবসায়ী নানাঘাটে দানধ্যানাদি কাজে অংশগ্রহণ করছেন। এসব ঘটনায় বিভিন্ন শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রমাণিত হয়।
মুদ্রা : সাতবাহন রাজারা সিসা, তামা, রূপা ও মিশ্ৰধাতুতে অনেক মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। তারা। কোনও স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন বলে জানা যায় না। দ্রব্যাদির দৈনন্দিন ক্রয়বিক্রয়ের ক্ষেত্রেই তামা বা সিসার মুদ্রা ব্যবহার করা হত, দুরপাল্লার বাণিজ্যে তাদের কোনও ভূমিকা ছিল না। তবে আন্তর বা দৈনন্দিন বাণিজ্য যে শুধুমাত্র মুদ্রার মাধ্যমেই সম্পন্ন হত তা নয়, পণ্যবিনিময় প্রথাও প্রচলিত ছিল।
রােমের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক : সাতবাহন রাজ্যের সঙ্গে রােমের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ ভারতে যে সব খাদ্যশস্য ও বিলাসসামগ্রী উৎপন্ন হত রােমের বাজারে তার প্রচণ্ড চাহিদা ছিল। প্রথম প্রথম রােমক বণিকেরা মিশরীয় ও আরবি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যাদি সংগ্রহ করতেন। কিন্তু ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রােমক সম্রাট অকটেভিয়াস অগাস্টাসের মিশর জয়ের পর রােমক বণিকরা সরাসরি ভারতে আসতে শুরু করেন। ভারতীয় বণিকরাও যে সমুদ্র পাড়ি দিতেন না তা নয়। সাঁচীস্তূপের ভাস্কর্যে ভারতীয় বণিকদের সমুদ্রপথে যাতায়াতের কাহিনি রূপায়িত আছে। ঘন্টকশাল ও গুণ্ডুপল্লিতে প্রাপ্ত কয়েকখানি সমকালীন লেখে মহানাবিকের উল্লেখ আছে। মহানাবিক পদটিতে সমুদ্রযাত্রার ইঙ্গিত আছে। ৪৫ খ্রিস্টাব্দে হিপ্পালাস মৌসুমি বায়ুর প্রবাহপথ আবিষ্কার করে ফেলেন। ফলে প্রাচ্যের সঙ্গে রােমের বাণিজ্যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
পূর্ব আফ্রিকা ও রোমে রপ্তানি পণ্যসমূহ : দক্ষিণ ভারত থেকে যেমন চাল ও গমের মতাে খাদ্যশস্য পূর্ব আফ্রিকা তথা রােমে রপ্তানি হত তেমনি গােলমরিচ ও দারুচিনির মতাে মসলাপাতি, চন্দন, সেগুন ও মেহগনির মতাে দামি কাঠ, কার্পাস ও রেশমের বস্ত্র, মসলিন, সুতা, দামি ও আধাদামি পাথর, সুগন্ধি মসলা, গজদন্ত ইত্যাদি শৌখিন দ্রব্যাদিও রপ্তানি হত। রােমের বাজারে ভারতীয় দ্রব্যের চাহিদা এতই তীব্র ছিল যে ভারতীয় পণ্য সেখানে একশাে গুণ চড়াদামে বিক্রি হত। অন্যদিকে রােম তথা বিদেশ থেকেও কম জিনিস আমদানি হত না। আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে ছিল সুরা, তামা, টিন, সিসা, প্রবাল, পুষ্পরাগ মণি, স্বচ্ছ কাচ, মােমছাল, সুর্মা, স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা, গায়ক ও ক্রীতদাসীর দল। দক্ষিণ ভারত তথা ভারতের বাজারে ব্যাবিলােন ও আলেকজান্ড্রিয়ার সূচিশিল্পশােভিত কাপড়ের যথেষ্ট চাহিদা ছিল। বলতে দ্বিধা নেই, রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেনে লাভের পাল্লাটা ভারতের দিকেই ঝোকানাে ছিল। ২২ খ্রিস্টাব্দে রােমক সম্রাট টাইবেরিয়াস তাে স্পষ্টই অভিযোগ করেছিলেন, বিলাসব্যসনের জোগান দিতে রােমের সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এর প্রায় অর্ধশতাব্দী পর প্লিনি আক্ষেপের সঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ভারতীয় পণ্যের পেছনে রােমের বছরে ৫৫০, ০০০, ০০০ সেস্টারসেস পরিমাণ অর্থ বিনষ্ট হচ্ছে। সাতবাহন রাজ্য তথা ভারতের বিভিন্ন স্থানে সােনা ও রূপার অসংখ্য রােমক মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উপলক্ষে বুলিয়নরূপে এই মুদ্রাগুলো আমদানি হয়েছিল। রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যে লাভের পাল্লাটা যে ভারতের দিকেই নত ছিল তা এই মুদ্রাগুলোর সাক্ষ্যে সুপ্রমাণিত।
রোমের সাথে বাণিজ্যে ভাটা : মুদ্রার সাক্ষ্যে আর একটি সত্য উদঘাটিত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলোর বেশির ভাগই ৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (রােমক সম্রাট অগাস্টাসের সিংহাসন আরােহণ) হতে ৬৮ খ্রিস্টাব্দের (সম্রাট ২৮ নীরাের মৃত্যু) মধ্যে উৎকীর্ণ। আবার কিছু মুদ্রা ক্যারাকালা (২১৭ খ্রিস্টাব্দ) ও ম্যাক্রিনাস (২৩৬ – ৩৮ খ্রিস্টাব্দ)–এর সমকালীন। এর থেকে বােঝা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষ পাদ হতে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত রােম–ভারত বাণিজ্যে যে জোয়ার এসেছিল, খ্রিস্টীয় ২য় – ৩য় শতকে তাতে ভাটা পড়ে। স্তিমিত গতিতে হলেও আরও প্রায় দুই শতাব্দী ধরে রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য চলে। সম্রাট মার্সিয়ান (৪৫০ খ্রিস্টাব্দ), লিও (৪৭৪ খ্রিস্টাব্দ), এনাস্টেসিয়াস (৪৯১-৫১৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং জাস্টিন (৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) – এর নামাঙ্কিত রােমক মুদ্রাও ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছে।
শকদের সাথে সংঘর্ষের ফলে রোমের সাথে বাণিজ্যে অধপতন : শকদের সঙ্গে সাতবাহন রাজাদের সংঘর্ষ ভারত–রােম বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুভ হয়নি। ‘পেরিপ্লাস্ অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ এবং টলেমির ‘ভূগােল’ গ্রন্থখানিকে একসঙ্গে পাঠ করলে এই সত্য ধরা পড়ে। পেরিপ্লাস–এ ক্যালিয়েনা নামে কোঙ্কণ উপকূলের এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের উল্লেখ আছে। ক্যালিয়েনা নিঃসন্দেহে আধুনিক কল্যাণ। পেরিপ্লাস্–এর বর্ণনা থেকে মনে হয় বন্দরটি সাতবাহন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পেরিপ্লাসের লেখক জানাচ্ছেন জ্যেষ্ঠ স্যারাগেনাস অর্থাৎ সাতবাহনরাজ প্রথম সাতকর্ণির রাজত্বকাল পর্যন্ত ক্যালিয়েনা একটি সমৃদ্ধ বন্দর ছিল, দেশি বিদেশি বণিকদের আনাগােনায় সে স্থান ছিল সতত মুখর। কিন্তু স্যান্ডারেস কর্তৃত্ব লাভ করার পর মামবারাস এই বন্দরের উপর নৌ অবরােধ জারি করেন। ফলে কোনও গ্রিক জাহাজ এই বন্দরে প্রবেশ করতে পারত না। যদি–বা কোনও গ্রিক জাহাজ ভুলক্রমে অবরুদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়ত, ম্যামবারাসের নৌবাহিনী সেটিকে জোর করে ব্যারিগাজা বা ভৃগুকচ্ছে নিয়ে যেত। পেরিপ্লাসের এই বর্ণনা হতে মনে হয় সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে কল্যাণ বন্দরটির ব্যবসা–বাণিজ্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকেই মনে করেন, যে ম্যামবারাসের আগ্রাসী ভূমিকার ফলে কল্যাণ বন্দরে অরাজকতা নেমে আসে, তিনি শক ক্ষত্ৰপ নহপান। তারা আরও মনে করেন, পেরিপ্লাসে বর্ণিত স্যান্ডারেস হলেন সাতবাহনরাজ সুন্দর সাতকর্ণি। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। স্যান্ডারেস সম্ভবত একজন শক শাসক ছিলেন, আর ম্যামবারাসও নহপান নন। পেরিপ্লাস রচিত হওয়ার অন্তত দুই দশক পর নহপানের রাজত্ব শুরু হয়েছিল। ম্যামবারাস সম্ভবত একজন শক প্রশাসক ছিলেন এবং তিনি খ্রিস্টীয় ১ম শতকের মধ্যভাগ নাগাদ পশ্চিম ভারতের কিয়দংশে তার শাসনাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (স্যান্ডারেস সম্ভবত অপরান্ত অঞ্চলে ম্যামবারাসের প্রতিনিধি ছিলেন)। ১৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ টলেমি যখন তার ‘ভূগােল’ গ্রন্থে পশ্চিম ভারতীয় বন্দরগুলোর তালিকা দেন তখন তিনি কল্যাণের কোনও উল্লেখ করেননি। অনুমান করতে দ্বিধা নেই, ততদিনে কল্যাণ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
শঙ্গম সাহিত্যে ভারত-রােম বহির্বাণিজ্য : শঙ্গম সাহিত্যে ভারত–রােম বহির্বাণিজ্য সম্পর্কে কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যবন জাহাজগুলো মুচিরিপত্তনম বন্দরে স্বর্ণমুদ্রা ভরে নিয়ে আসত আর। পরিবর্তে গােলমরিচ ভর্তি করে দেশে ফিরে যেত। শঙ্গম সাহিত্যে যে বন্দরটিকে মুচিরিপত্তনম বলা হয়েছে পেরিপ্লাস্–এর লেখক এবং টলেমি তাকেই মুজিরিস আখ্যা দিয়েছেন। বন্দরটি আধুনিক ক্র্যাঙ্গানােরের নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে অবস্থিত ছিল। মুজিরিসে শুধু যে রােমক জাহাজগুলোর আনাগােনা ছিল তা নয়, এখানে সম্ভবত রােমক বণিকদের একটি স্থায়ী বসতিও গড়ে ওঠে। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের রচনা ট্যাবুলা বিউটিনজেরিয়ানা গ্রন্থে মুজিরিসে রােমক সম্রাট অগাস্টাসের স্মৃতিতে গড়া এক মন্দিরের উল্লেখ আছে। রােমকরা তাদের সম্রাটদের দেবতাজ্ঞানে পূজা করতেন। মুজিরিসে রােমকদের স্থায়ী বসতি না থাকলে সেখানে ওই জাতীয় মন্দির গড়ে উঠত না। পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকমেড়তেও রােমক বণিকদের আর একটি স্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছিল। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে খ্রিস্টীয় ১ম ও ২য় শতকের রােমক মৃৎপাত্র, পানপাত্র, বাতিদান ও কাঠের পাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। আধুনিক আরিকমেডু নিঃসন্দেহে পেরিপ্লাস-এর লেখক ও টলেমি বর্ণিত প্রাচীন পােডুকার স্মৃতি বহন করছে। আরিকমেডুর মতাে আর একটি বিখ্যাত বন্দর কাবেরীপট্টিনম যার উল্লেখ আছে শঙ্গম সাহিত্যে। এই কাবেরীপট্টিনমই টলেমির ভূগােল গ্রন্থে খাবেরােস নামে উল্লিখিত হয়েছে। কাবেরী নদীর মােহনায় অবস্থিত এই বন্দরটি চোল রাজ্যে অবস্থিত ছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য : পশ্চিম দিকে যেমন রােমক সাম্রাজ্যের সঙ্গে, পূর্ব দিকে তেমনি দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যগুলোর সঙ্গে এসময় দক্ষিণ ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পেরিপ্লাস্ ও টলেমির বিবরণে এই বহির্বাণিজ্যের কিছু ছবি ধরা পড়েছে। চিকাকোলের কাছাকাছি এক বড় বন্দরের উল্লেখ আছে গ্রন্থ দু’টিতে। পণ্যসম্ভার সাজিয়ে জাহাজগুলো এই বন্দর থেকে যাত্রা করে আড়াআড়িভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছত। দ্বিতীয় পুলুমাবি ও যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির অন্যান্য মদ্রার সঙ্গে বিশেষ এক শ্রেণির মুদ্রা করমণ্ডল উপকুলে পাওয়া গেছে। এই শ্রেণির মুদ্রায় দুই মাস্তুলযুক্ত জাহাজের ছবি অঙ্কিত রয়েছে। মুদ্রাগুলো সাতবাহন যুগের সামুদ্রিক ক্রিয়াকলাপের স্মৃতি বহন করছে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সে অঞ্চলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিও প্রসার লাভ করে।
ধর্মীয় জীবন
বৈদিক যাগযজ্ঞ : সাতবাহন রাজারা ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেন। তারা ছিলেন বৈদিক যাগযজ্ঞের একান্ত অনুরাগী। একজন সাতবাহনরাজ তাে যজ্ঞশ্রী নামই ধারণ করেছিলেন। প্রথম সাতকর্ণি অশ্বমেধ, রাজসূয়, অগ্ন্যাধেয় প্রভৃতি বিবিধ বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। যাগযজ্ঞাদি উপলক্ষে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে প্রথম সাতকর্ণির প্রচুর দানধ্যানের কথা নানাঘাট লেখে সবিস্তারে বর্ণিত আছে।
পৌরাণিক দেবতারা : সমাজে, বিশেষকরে অভিজাত মহলে, বৈদিক যাগযজ্ঞ যেমন সমাদর লাভ করেছিল তেমনি বাসুদেব এবং পশুপতির মতাে পৌরাণিক দেবতারাও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। নানাঘাট লেখে বাসুদেবের উল্লেখ আছে। লক্ষ করবার বিষয়, সেখানে কেবল বাসুদেবের নামেরই উল্লেখ নেই, বাসুদেবের সঙ্গে সংকর্ষণের নাম যুগপৎ উচ্চারিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেখানে বাসুদেবের নামের পূর্বেই সংকর্ষণের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত সাতবাহন রাজ্যে সংকর্ষণ বাসুদেবের যৌথ পূজার প্রচলন ছিল। এই যৌথ পূজায় সংকর্ষণেরই প্রাধান্য ছিল। বাসুদেবের অগ্রজ বলেই হয়তাে সংকর্ষণ বা বলরামের এই প্রাধান্য। সমকালীন যুগে রচিত গাথাসপ্তশতীতে কৃষ্ণ সম্পর্কে অনেক কাহিনির অবতারণা আছে। গাথাসপ্তশতীতে লক্ষ্মী ও নারায়ণের উল্লেখ আছে। সমকালীন লেখ ও সাহিত্যে আর যে সকল ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর কথা বলা হয়েছে তাদের। মধ্যে ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য, যম, বরুণ, কুবের এবং গৌরী বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তখনকার দিনে সাধারণ মানুষদের মধ্যে তীর্থযাত্রা, কূপ–পুষ্করিণী খনন, বৃক্ষরােপণ ইত্যাদি কাজে যথেষ্ট আগ্রহ দেখা যায়। এসব কাজ ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হত।
জৈনধর্ম : মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের নানা স্থানে প্রাচীন বহু জৈন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের অনেকগুলোই সাতবাহন আমলের। সাতবাহন রাজ্যে জৈনরা সংখ্যায় নগণ্য ছিলেন না।
মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসার, জন সাধারণের উদ্যোগ : এসময় মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। মহারাষ্ট্রের পিটল-খােরা, নাসিক, কার্লে, কানহেরি, জুন্নার, মাহার, কোল, ভাজা ও কোলাপুর এবং অন্ধ্রপ্রদেশের ঘণ্টকশাল, জগ্গয্যপেটা, অমরাবতী ও ভট্টিপ্রোলুতে অসংখ্য বৌদ্ধ নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন বৌদ্ধ গুহাগুলোর প্রায় সবকটিই এই পর্বে নির্মিত হয়। ব্রাহ্মণ্য–ধর্মের অনুরাগী হয়েও সাতবাহন রাজারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। বৌদ্ধ শ্ৰমণদের তত্ত্বাবধানের জন্য রাজা কৃষ্ণ নাসিকে একজন মহামাত্র নিযুক্ত করেছিলেন। রাজমাতা গৌতমী বলশ্রী ভদ্রযানীয় ভিক্ষুদের অনুকূলে একটি গুহা দান করেছিলেন। গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি ত্রিবশি পবর্তবাসী ভিক্ষুদের দ্বিশত নিবর্তনের একখণ্ড জমি প্রদান করেন, বলশ্রী ও গৌতমীপুত্র সমবেত ভাবে একশাে নিবর্তনের জমি তিরশ্নি পর্বতবাসী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দান করেন। দ্বিতীয় পুলুমাবির রাজত্বকালে কালার মহাসংঘিক ভিক্ষুদের ভরণপােষণের জন্য একখানি গ্রাম প্রদত্ত হয়। শুধু রাজা বা রাজপরিবারের সদস্যগণ নন, ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি জন সাধারণেরও সজাগ দৃষ্টি ছিল। ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের বসবাসের জন্য জনসাধারণের উদ্যোগেও প্রচুর লেণ বা গুহা এবং চৈত্যগৃহ নির্মিত হয়। ক্রমশ বিহার নির্মাণও শুরু হয়। ভিক্ষু সম্প্রদায়ের খাদ্য ও পরিধানের সংস্থানের জন্য কখনও কখনও জমি বা সমগ্র গ্রাম দান করা হত, তাদের নতুন বস্ত্রও দেয়া হত।
বুদ্ধের পদ, স্তূপ, প্রধান শিষ্যদের দেহাবশেষ প্রভৃতির উপাসনা : গাথাসপ্তশতীতে বুদ্ধের পদ–উপাসনার উল্লেখ আছে। বৌদ্ধরা প্রথম দিকে স্তুপ, শূন্য সিংহাসন সহ বােধিবৃক্ষ, বুদ্ধের পাদুকা, ত্রিশূল, ধর্মচক্র এবং বুদ্ধ ও তার প্রধান শিষ্যদের দেহাবশেষ পূজা করতেন কিন্তু মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভগবান বুদ্ধের মূর্তিপূজা শুরু হয়।
বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায় : বৌদ্ধধর্মের কিছু কিছু বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে ভিক্ষু–ভিক্ষুণীদের মধ্যে মতবিরােধ ও পরিণামে বৌদ্ধদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। সাতবাহন রাজ্যে কয়েকটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়–উপসম্প্রদায়ের জনপ্রিয়তা সবিশেষ লক্ষণীয়। নাসিক এবং কানহেরি অঞ্চলে ভদ্রযানীয় সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়, মহাসংঘিকদের প্রভাব বৃদ্ধি পায় কার্লা ও সন্নিহিত অঞ্চলে, ধর্মোত্তরীয়দের সােপারায় ও জুন্নারে, চৈত্যকদের অমরাবতীতে এবং পূর্ব শৈল ও অপর শৈলদের নাগার্জুনীকোণ্ডাতে। এদের মধ্যে ধর্মোত্তরীয় এবং ভদ্রযানীয়রা স্থবিরবাদী সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, অন্যান্যরা ছিলেন মহাসংঘিকদের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথমােক্তরা ছিলেন রক্ষণশীল, অন্যরা সংস্কারপন্থী বা উদারবাদী। কী রক্ষণশীল, কী উদারপন্থী, সকল সম্প্রদায়েরই বৌদ্ধধর্মের কয়েকটি মৌল বিষয় সম্পর্কে মনােভাব মােটামুটি একই ছিল। তারা সকলেই চারটি আর্যসত্যে বিশ্বাস করতেন, অষ্টাঙ্গিক-মার্গে তারা আস্থাবান ছিলেন, তারা কর্মকে জন্মান্তরের কারণ বলে মনে করতেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় ধীরে চলার নীতি বা প্রতীত্যসমুৎপাদ প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে মতবিভেদ ছিল। স্থবিরবাদীরা মনে করতেন, বুদ্ধ বিরলদৃষ্ট এক মহামানব, তিনি একবারই জন্মেছেন, ভবিষ্যতে আর জন্মাবেন না। মহাসংঘিকদের দৃষ্টিতে বুদ্ধ লােকোত্তর, অলৌকিক, সর্ব শক্তিমান এক সত্তা, মানবসাধারণের হিতার্থে তার শাক্য গৌতমের রূপকায় ধারণ, জন্ম–মৃত্যুর অতীত বুদ্ধ সর্বদাই সমাধিস্থ। বুদ্ধত্ব অর্জনই মহাসংঘিকদের লক্ষ্য, পক্ষান্তরে অর্হৎত্ব অর্জনকে স্থবিরবাদীরা জীবনের চরম সার্থকতা বলে মনে করেন। স্থবিরবাদীদের ধারণা বুদ্ধত্ব অর্জন মানুষের সাধ্যাতীত। মহাসংঘিকরা বােধিসত্ত্বের রূপ কল্পনা করেছেন। তারা মনে করেন বােধিসত্বের পর্যায় অতিক্রম করলেই বুদ্ধত্ব অর্জন সম্ভব হয়। তাছাড়া স্তুপ ও চৈত্যপূজার উপযােগিতা মহাসংঘিকরাই প্রথম তানুধাবন করেন।
মহাযান মতের উদ্ভব ও নাগার্জুন : বুদ্ধ ও ধর্ম সম্পর্কে মহাসংঘিক সম্প্রদায়ের মনােভাবের সঙ্গে মহাযান বৌদ্ধধর্মের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। অষ্টসাহত্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার মূল গ্রন্থখানি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম শতকে রচিত হয়েছিল। গ্রন্থখানিতে দক্ষিণাপথকে মহাযান বৌদ্ধধর্মের উদ্ভবস্থল বলা হয়েছে। এই উক্তি সত্য হলে সিদ্ধান্ত করতে হয় খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক নাগাদ অন্ধ্র-মহারাষ্ট্র অঞ্চলে মহাযান বৌদ্ধধর্ম অঙ্কুরিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ২য় শতকে নাগার্জুনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মহাযান ধর্মমত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাতবাহনপতি যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির সমকালীন এই বৌদ্ধ আচার্য শূন্যতা তথা মাধ্যমিক দর্শনের প্রবক্তারূপে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। দক্ষিণ ভারতে জীবন শুরু করলেও পরের দিকে তিনি নালন্দায় সংঘের আচার্যপদে বৃত হন। শুয়েন চাঙের বিবরণী হতে জানা যায়, তার জীবনের শেষ দিনগুলো সাতবাহনরাজের আনুকূল্যে দক্ষিণ কোসলে অতিবাহিত হয়েছিল। মধ্যমপন্থাকে নির্দেশ করে বলে নাগার্জুনের মতবাদকে মাধ্যমিক মতবাদ বলা হয়। এই মতবাদ অনুসারে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান তিনই শূন্য – কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই। এই মত অনুসারে জ্ঞেয়রূপ বাহ্য বস্তু মিথ্যা ও ক্ষণিক। যেহেতু জ্ঞেয় বস্তু বা বাহ্য জগতের কোনও অস্তিত্ব নেই। সেহেতু জ্ঞাতা বলে কোনও স্থায়ী চেতনার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। নাগার্জুন দেখিয়েছেন সব কিছুই পরিবর্তনশীল, ক্ষণস্থায়ী ও অনিত্য, সব কিছুই আপেক্ষিক, সব কিছুই শূন্যে পর্যবসিত।
সাহিত্য, স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য
সাহিত্য
- কাতন্ত্র ও বৃহৎকথা : ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে সাতবাহন যুগ এক স্মরণীয় অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। এসময়কার লেখা দু‘খানি গ্রন্থ – কাতন্ত্র ও বৃহৎকথা। প্রথমখানি সংস্কৃতে লেখা, লেখক সর্ববর্মা। দ্বিতীয়খানি পৈশাচী প্রাকৃতে লেখা, রচয়িতা গুণাঢ্য। এই গ্রন্থ দু‘খানির রচনা প্রসঙ্গে সােমদেবের কথাসরিৎসাগরে এক সুন্দর কাহিনির অবতারণা আছে। সর্ববর্মা ও গুণাঢ্য উভয়েই জনৈক সাতবাহন রাজার মন্ত্রী ছিলেন। রাজা একদিন জলক্রীড়ার সময় তার পত্নীকে লক্ষ্য করে বার বার জল নিক্ষেপ করতে থাকেন। বিরক্ত রাজপত্নী রাজাকে বললেন, মােদকৈঃ পরিতাড়য় মাম্। অর্থাৎ আমাকে জল ছিটিও না। মা এবং উদকৈঃ পদ দু’টি যুক্ত হয়ে মােদকৈঃ হয়েছে। সংস্কৃত না জানায় মােদকৈঃ সন্ধিবদ্ধ পদটির কদৰ্থ করে রাজা ভাবলেন, পত্নী বুঝি মােদক বা পিঠে চাইছেন। পিঠে সংগ্রহ করে রাজা পত্নীর উদ্দেশ্যে তা ছুড়তে থাকেন। স্বামীর কাণ্ডকারখানা দেখে রাজপত্নী তাকে উপহাস করেন। অপমানিত রাজা প্রতিজ্ঞা করলেন সংস্কৃত শিখবেন। গুণাঢ্য বললেন, তিনি ছয় বছরে রাজাকে সংস্কৃত শেখাবেন। সর্ববর্মা মাত্র ছয় মাস সময় চাইলেন। কাতন্ত্র রচনা করে সর্ববর্মা ছয় মাসের মধ্যেই রাজাকে সংস্কৃতজ্ঞ করে তােলেন। আর নিজের প্রতিশ্রুতি পালন করতে গুণাঢ্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বনে চলে গেলেন। বনবাসকালেই তিনি বৃহৎকথা রচনা করেন। সংস্কৃত ব্যাকরণের উপর লেখা কাতন্ত্র গ্রন্থটি আজও বঙ্গদেশে ও কাশ্মীরে সমাদৃত। বৃহৎকথা গ্রন্থখানি বর্তমানে বিলুপ্ত। ধনপাল, গােবর্ধন এবং সােমদেবের মতাে প্রাচীন সাহিত্যিকরা একবাক্যে বৃহৎ কথার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গােবর্ধন তাে গুণাঢ্যকে ব্যাস ও বাল্মীকির পরই স্থান দিয়েছেন। সর্ববর্মা ও গুণাঢ্য যার মন্ত্রী সেই সাতবাহন রাজা কে তা জানা যায় না।
- গাথাসপ্তশতী : এযুগের আর একটি উল্লেখযােগ্য সাহিত্যকীর্তি গাথাসপ্তশতী। গ্রন্থটি সাতশাে প্রাকৃত কবিতার সংকলন, সম্পাদনা করেছেন রাজা হাল। কবিতাগুলো শ্লেষ ও আদিরসে অভিষিক্ত। কবিতাগুলোর কয়েকটি স্বয়ং হালেরই রচনা। সুভাষিতের অবিনশ্বর সংকলন বলে বাণভট্ট গাথাসপ্তশতীর অকণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। সমকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি বিম্বিত হয়েছে এই সংকলনে।
- লীলাবতী-পরিণয় : এযুগে লেখা আর একখানি কাব্যগ্রন্থ ‘লীলাবতী–পরিণয়’। হাল ও লীলাবতীর বিবাহ এ কাব্যের উপজীব্য বিষয়। প্রাকৃতে লেখা এ কাব্যের রচয়িতার নাম অজ্ঞাত।
- লেখসমূহ : সাতবাহন যুগে প্রাকৃত সাহিত্যচর্চার আর একটি নিদর্শন সেযুগের লেখ। লেখাগুলো সবই প্রাকৃত ভাষায় রচিত। গৌতমী বলশ্রীর নাসিক প্রশস্তি সুললিত প্রাকৃতে রচিত।
- নাগার্জুনের রচনাসমূহ : শুধু প্রাকৃত নয়, সংস্কৃত সাহিত্য চর্চাতেও এসময় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়। কাতন্ত্রের কথা পূবেই উল্লেখ করা হয়েছে। সন্দেহ নেই, এযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক–সাহিত্যিক নাগার্জুন। সমসাময়িক সাতবাহন নৃপতির সঙ্গে তার সম্প্রীতির কথা নাগার্জুন ‘সুহৃল্লেখ’ গ্রন্থে ব্যক্ত করে গেছেন। বাণভট্টও নাগার্জুন ও সাতবাহন রাজার বন্ধুত্বের উল্লেখ করেছেন। তার সবগুলো গ্ৰন্থই সংস্কৃত ভাষায় রচিত। গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রজ্ঞাপারমিতাশাস্ত্র, মূলমাধ্যমিকশাস্ত্র, দ্বাদশ–নিকায়শাস্ত্র, শূন্যসপ্তথি এবং সুহৃল্লেখ। বর্তমানে মূল সংস্কৃত গ্রন্থগুলোর আর সন্ধান পাওয়া যায় না কিন্তু তাদের চিনা সংস্করণ আজও সহজলভ্য।
স্থাপত্য
বৌদ্ধ স্তুপ : অমরাবতী, ভটিপ্রােলু, জগ্গয্যপেটা, ঘণ্টকশাল, নাগার্জুনীকোণ্ডা প্রভৃতি স্থানে এ যুগে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ স্তুপ নির্মিত হয়। কালের প্রভাবে এদের কোনওটিই আজ আর অক্ষত নেই। কয়েকটির আবার বেদিকার অংশবিশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে পাথরের ফলকে স্তুপের চিত্র থেকে এ অঞ্চলের স্তুপগুলোর গঠনাকৃতির কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। চিত্রগুলো দেখে মনে হয় শুঙ্গযুগের মতাে এযুগেও ধূপের বেদি, অণ্ড, হমিকা ও ছত্র – এই চারটি অঙ্গ। এখানেও অণ্ড নিঃসন্দেহে প্রধানতম অঙ্গ। স্তূপের চারদিকে চারটি আয়তক্ষেত্রাকার মঞ্চ। প্রতিটি মঞ্চে পাঁচটি করে আর্যকস্তম্ভ। প্রতি মঞ্চের দু‘ধারে প্রদক্ষিণা পথে ওঠার সিঁড়ি। প্রদক্ষিণা পথ কারুকার্যখচিত পাথরের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। স্তূপের বেদি এবং অণ্ড অপরূপ কারুকার্যে মণ্ডিত।
সাঁচীর বৃহত্তম স্তুপ : ২৩ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট সাঁচীর বৃহত্তম স্তুপটির প্রস্তর বেষ্টনী এবং তার সুদৃশ্য চারটি তােরণ এই পর্বেই নির্মিত হয়। প্রস্তর বেষ্টনীর উচ্চতা ৩.২ মিটার। তােরণগুলোর মধ্যে দক্ষিণেরটিই সবচেয়ে পুরােনাে। প্রতি তােরণের দুদিকে দু’টি চতুষ্কোণ স্তম্ভ। এক একটি স্তম্ভের শীর্ষদেশে তিনটি করে হাতির মূর্তি। হাতিগুলোর পৃষ্ঠদেশে তােরণের উপরের অংশ স্থাপিত। উপরের অংশে আছে তিনটি সমান্তরাল ফলক। শীর্ষ ফলকটির উপরে রয়েছে সিংহমূর্তি, দু’টি চক্র এবং ত্রিশূল বা বজ্র।
চৈত্যগৃহ : পশ্চিমঘাট পর্বতমালার গা কেটে সাতবাহন যুগে বেশ কয়েকটি চৈত্যগৃহ নির্মিত হয়। এদের মধ্যে ভাজা, নাসিক ও কার্লার চৈত্যগৃহগুলো বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। ভাজার চৈত্যগৃহটি এ আমলে নির্মিত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
- ভাজার চৈত্যগৃহ : পুণার নিকটবর্তী ভাজার চৈত্যগৃহটি যেন একটি প্রলম্বিত কক্ষ। ভেতরের দেয়াল ঘেঁষে দুপাশে প্রদক্ষিণা পথ, মধ্যিখানে মূল অংশ আর মূল অংশের একেবারে পেছনের দিকে একটি স্তূপ নিয়েই এই চৈত্যগৃহ। প্রায় ৩ মিটার উঁচু ২৭টি অষ্টকোণস্তম্ভ প্রদক্ষিণা পথকে মূল অংশ থেকে পৃথক করেছে। মূল অংশের ছাদ অর্ধচন্দ্রাকার, বঙ্কিম। প্রদক্ষিণা পথের ছাদ অধিক বাঁকানাে। চৈত্যগুহের অভ্যন্তরে আলাে প্রবেশের জন্য তােরণে অশ্বক্ষুরাকৃতি গবাক্ষের সংযােজনা। এখানে চৈত্যগৃহের নিকট একটি বিহারও নির্মিত হয়েছিল।
- নাসিকের চৈত্যগৃহ : নাসিকের চৈত্যগৃহটি ভাজার চৈত্যগৃহের তুলনায় অনেক সুন্দর, উন্নত। চৈত্যগৃহটির সম্মুখভাগ অপরূপ কারুকার্যমণ্ডিত। ভেতরের অষ্টকোণস্তম্ভগুলোও আর সাদামাটা ও বঙ্কিম নয়, ঋজু ও অলংকৃত। ভেতরের স্তুপটির গঠনেও অভিনবত্ব লক্ষণীয়।
- কার্লার চৈত্যগৃহ : এ যুগের স্থাপত্যকীর্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কার্লার আশ্চৰ্য্যসুন্দর চৈত্যগৃহ। চৈত্যগৃহটি প্রায় ৩৭.৭৯ মিটার দীর্ঘ, ১৪.৩২ মিটার বিস্তৃত ও ১৩.৭১ মিটার উঁচু। অন্যান্য চৈত্যগৃহের মতাে এটিরও ভেতরের দেয়াল ঘেঁষে প্রদক্ষিণ পথ, মধ্যিখানে মূল অংশ আর মূল অংশের পেছনের দিকে স্তূপ। প্রদক্ষিণা পথ আর মূল অংশের মাঝখানে এক এক দিকে ১৫টি করে অলংকৃত স্তম্ভ আর স্তুপের পেছনে ৭টি নিরলংকার স্তম্ভ। প্রতি স্তম্ভের মাথায় চতুষ্কোণ বেদি। বেদির উপরে দুটি করে হাতি ও একটি করে ঘােড়া। হাতির পিঠে কোনও মাহুত নেই কিন্তু ঘােড়ার পিঠে আরােহী। চৈত্যগৃহের সামনে একটি বারান্দা। বারান্দার সামনে দু‘টি স্তম্ভের মাথায় চারটি করে সিংহমূর্তি। অপূর্ব কারুকার্যখচিত এই চৈত্যগৃহের তিনটি তােরণ। পাশের দু’টি প্রদক্ষিণা পথের, মাঝখানেরটি মূল অংশের।
বিহার : নাসিকে পাহাড়ের গা কেটে এযুগে কয়েকটি বিহারও নির্মিত হয়। এদের মধ্যে ঋষভদত্ত বিহার ও গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি বিহার সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। প্রতিটি বিহারে রয়েছে একটি করে স্তম্ভবিহীন প্রশস্ত হলঘর, তিনদিকে তিনটি ঘর আর সামনে সস্তম্ভ বারন্দা। কার্লাতে পাহাড় কেটে কয়েকটি বিহার নির্মাণ করা হয়। এদের কয়েকটি একাধিক তলবিশিষ্ট। পাহাড়কাটা বহুতল বিহার ভারতে পরবর্তিকালে খুবই জনপ্রিয় হয়। বস্তুত, বহুতল বিহার নির্মাণের সূত্রপাত ঘটে এই কার্লাতেই।
অজণ্টায় গুহা খোদাই : এ সময় অজণ্টায় ইন্ধ্যাদ্রি নামে এক অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়ের গা কেটে নবম ও দশম গুহা দু’টি খােদিত হয়। গুহা দুটির প্রতিটিতে রয়েছে এক একটি করে লম্বাটে চৈত্যকক্ষ। তাতে দু’দিকে দু’সারি স্তম্ভ। ছাদের ভার বহনের কাজে স্তম্ভগুলোর কোনও উপযােগিতা নেই। এ শুধু অলংকরণ। চৈত্যকক্ষের প্রবেশপথের উপরে একটি গবাক্ষ। একে বলে সূর্য গবাক্ষ। নবম গুহাটির শেষ প্রান্ত অর্ধগােলাকৃতি কিন্তু দশমটির শেষ প্রান্ত চৌকোণা। চৈত্যকক্ষের শেষ প্রান্তে রয়েছে একটি স্তুপ। স্তুপের সর্বনিম্ন অংশ বর্গাকার বেদিকা। এরপর ক্রমান্বয়ে অণ্ড, হমিকা, ছত্রাবলি ও কলশ। অজণ্টায় গুহাস্থাপত্যের কাজ শুরু হয় সাতবাহন রাজাদের আমলে। একাজ সম্পূর্ণ হয় খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে। অজণ্টা গুহাস্থাপত্যের প্রারম্ভিক পর্বরূপে সাতবাহন যুগকে চিহ্নিত করা যায়।
শিল্পীদের অবিনশ্বর ভাস্কর্যকীর্তি ও অমরাবতী
ভাজা, নাসিক ও কার্লার চৈত্যগৃহে এবং অমরাবতী, নাগার্জুনীকোণ্ডা প্রভৃতি স্থানের স্তুপে এ যুগের শিল্পীরা তাদের অবিনশ্বর ভাস্কর্যকীর্তির সাক্ষ্য রেখে গেছেন। ভাজার চৈত্যগৃহে উৎকীর্ণ দ্বারপাল, সূর্যদেব ও ঐরাবতের পিঠে উপবিষ্ট ইন্দ্র এবং কার্লার চৈত্যগৃহের দম্পতিমূর্তি সুঠাম দেহ–গঠনে ও দৃপ্ত, বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে সমুজ্জ্বল। তবে ভাজায় বা কার্লাতে নয়, অমরাবতীর ভাস্কর্যেই এ যুগের শিল্পসাধনার চরম অভিব্যক্তি ঘটেছে।ঈষৎ সবুজ চুণাপাথরে খােদিত অমরাবতীর ভাস্কর্যে আছে বিষয়-বৈচিত্র্য। বুদ্ধ ও জাতকের কাহিনি, পরিদৃশ্যমান প্রকৃতি ও চলমান জীবনপ্রবাহ সবই এখানে উপস্থাপিত। তবে ভারহুতের শিল্পে প্রকৃতি ও মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতার যে সুর অনুরণিত অমরাবতীতে তা ব্যাহত। এখানে প্রকৃতি গৌণ, মানুষই মুখ্য, পটভূমিরূপেই প্রকৃতির যা সার্থকতা। শিল্পী বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করেছেন সত্য কিন্তু সংযম, ব্রহ্মচর্য, ত্যাগ ও নির্বাণের মতাে বুদ্ধ প্রচারিত শাশ্বত সত্যের প্রতি তিনি উদাসীন। ধনৈশ্বর্যময়, আনন্দমুখর জীবনের তিনি জয়গান করেছেন। আধ্যাত্মিকতা নয়, ভােগবাদই মূর্ত হয়ে উঠেছে তার শিল্পকর্মে। সম্ভোগ বর্ণনায় শিল্পীর এই অত্যাসক্তির সংগত কারণ আছে বৈকি। একদিকে রােমক সাম্রাজ্য ও অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ফলে এ সময় দক্ষিণ ভারতে অভূতপুর্ব আর্থিক সমদ্ধি ঘটে। অঢেল অর্থাগমের সঙ্গে সঙ্গে বণিক ও অভিজাত মহলে জীবন সম্পর্কে নতুন ধারণা গড়ে ওঠে। এ ধারণা বিলাসব্যসনের ধারণা, ভােগৈশ্বর্যময় জীবনযাপনের ধারণা। বাণিজ্যসমৃদ্ধ নাগর সভ্যতার ছবি প্রতিফলিত হয়েছে শিল্পীর শিল্পকর্মে। বৃক্ষ, লতা, পাখি ও মানবদেহকে পাথরে রূপায়ণে শিল্পী যে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। বলিষ্ঠতার সঙ্গে প্রাণশক্তি, গতিশীলতা ও কোমলতার সংমিশ্রণে অমরাবতীর ভাস্কর্য অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত। উপবিষ্ট, দণ্ডায়মান, অবনত, দোদুল্যমান, নৃত্যরত, গমনশীল প্রভৃতি বিভিন্ন দেহভঙ্গি এবং উত্তেজনা, আনন্দ, অবসাদ, ক্রোধ ইত্যাদি জীবনের নানা মুহুর্ত উৎকীর্ণ নরনারীর মূর্তিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। নারীদেহের রূপায়ণে উচ্চারিত হয়েছে প্রেম, যৌবন ও সুন্দরের জয়গান। আধ্যাত্মিকতা নয়, পরিশীলিত ইন্দ্রিয়পরায়ণতার অভিব্যক্তি দেখা দিয়েছে অমরাবতীর ভাস্কর্যে। বুদ্ধের মূর্তিতেও সে আত্মনিমগ্ন ভাব নেই, পরিবর্তে আভাসিত হয়েছে পরিবেশ সচেতনতা। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের ভাস্কর্যে ধরা পড়েছে শিল্পীর রুচি ও অনুভূতির পরিপূর্ণ বিকাশ। কিন্তু পরবর্তিকালের ভাস্কর্যে সে ছন্দ ব্যাহত হয়েছে, অসংযম ও সুলতায় সে ভাস্কর্য মলিন। সাতবাহন রাজাদের রাজত্বকাল দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এসময় শুধু যে দক্ষিণ ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হল তাই নয়, এই অঞ্চলের সমাজজীবনে, অর্থনীতিতে, ধর্মে, সাহিত্যে, স্থাপত্যে এবং ভাস্কর্যেও গঠনমুখী, সৃজনধর্মী কর্মকাণ্ডের অভিব্যক্তি দেখা দিল।
গ্রন্থপঞ্জি
- রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)
- ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ–সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪)
- নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস (কলকাতা, ১৩৮৪)
- Chakraborti, Haripada : Trade And Commerce Of Ancient India (Calcutta, 1966)
- Chattopadhyaya, S. : Some Early Dynasties of South India (New Delhi, 1994)
- Majumdar, R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960)
- Narasimha Murthy, A. V. : Coins Of Karnataka (Mysore, 1975)
- Rama Rao: The Satavahana Coins In The Andhra Pradesh Government Museum, A. P. Government Series, No. 2 (Hyderabad, 1961)
- Rapson, E. J.: Catalogue Of The Coins Of The Andhra Dynasty, The Western Ksatrapas, The Traikutaka Dynasty And The Bodhi Dynasty (London, 1908)
- Raychaudhuri, H.C. : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
- Sarma, I. K. : Coinage Of The Satavahana Empire (Delhi, 1980)
- Sastri, K. A. N. (Ed.): A Comprehensive History of India. Vol. II (Calcutta, 1957)
- Sastri, A. M. (Ed.): Coinage Of The Satavahanas And Coins From Excavations (Nagpur, 1972): Early History of the Deccan : Problems And Perspectives (Delhi. 1987).
- Sircar, D. C. : Select Inscriptions Bearing On Indian History And Civilization, (Calcutta, 1965),
- Yazdani, G. (Ed.): The Early History Of The Deccan, Part 1 (London, 1960)
বাকাটক রাজবংশ
ভূমিকা : সাতবাহন রাজ্যের পতনের পর মধ্যপ্রদেশের এক বৃহদংশ এবং মহারাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে এক শক্তিশালী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই রাজবংশ ভারতের ইতিহাসে বাকাটক রাজবংশ নামে পরিচিত। শুধু সমরকুশলী নরপতিরূপে নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকরূপেও বাকাটক রাজারা ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কাব্য ও সুভাষিতের রচয়িতারূপে এই বংশীয় রাজগণ সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাঁদের রাজত্বকালে নির্মিত অজন্তা ও গুলবাড়ার সুদৃশ্য গুহাবিহার ও চৈত্য এবং অনুপম ভাস্কর্য ও গুহাচিত্র এই যুগকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।
রাজবৃত্ত
বংশ পরিচয়, আদি রাজ্য ও আবির্ভাবকাল
বংশ-পরিচয় : বাকাটক বংশের আদি ইতিহাস রহস্যাবৃত। বংশের নাম কী করে বাকাটক হল তাও আমাদের অজানা। হয়তো কোনও ব্যক্তি বা স্থান বিশেষের নাম থেকে বংশের এই নামকরণ। ব্যক্তি বা স্থান বিশেষের নাম বকাট হওয়া সম্ভব। বকাটের বংশধর বা বকাটের অধিবাসী, এই অর্থে বাকাটক। বকাট নামে কোনও স্থানের অস্তিত্ব এখনও প্রমাণিত হয়নি। কাশী প্রসাদ জায়সওয়াল অভিমত প্রকাশ করেছেন, বুন্দেলখণ্ডের অন্তর্গত বাগাট স্থানটির নাম থেকেই বাকাটক পদটি নিষ্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বাগাট আর বকাট এক নয়। এই ব্যাখ্যা সে কারণে যুক্তিগ্রাহ্য নয়। বাকাটক রাজারা জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। লেখমালার সাক্ষ্যে তা স্পষ্ট। তাঁদের গোত্র বিষ্ণুবৃদ্ধ। অন্ধ্রপ্রদেশের গুণ্টুর জেলার অমরাবতীতে আবিষ্কৃত খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের একখানি ভগ্ন প্রাকৃত লেখে বাকাটক নামে জনৈক গৃহপতির উল্লেখ আছে। তিনি অমরাবতীতে তীর্থভ্রমণে এসেছিলেন। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি মনে করেন, গৃহপতি বাকাটকই বাকাটক বংশের আদি পুরুষ; তাঁর নাম থেকেই বংশের নাম হয়েছে বাকাটক এবং তিনি অমরাবতীর নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে বসবাস করতেন। তাঁর অভিমত, বাকাটক রাজগণের আদি বাসভূমি অন্ধ্রপ্রদেশেই অবস্থিত ছিল। কিন্তু এ অভিমত বিতর্কিত।
- প্রথমত, গৃহপতি বাকাটকের সঙ্গে বাকাটক রাজবংশের সম্পর্ক এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
- দ্বিতীয়ত, গৃহপতি বাকাটক অন্ধ্রপ্রদেশের অধিবাসী ছিলেন, এ কথাও নিঃসংশয়ে বলা যায় না।
আদি বাকাটক রাজ্য : আদি বাকাটক রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কেও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
- রাজ্যটি প্রথমে আর্যাবর্তে গড়ে ওঠে, এরূপ এক অভিমত আছে। বলা হয়ে থাকে, গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের হাতে পরাজিত আর্যাবর্তরাজ রূদ্রদেবই বাকাটক প্রথম রুদ্রসেন। কিন্তু মহারাষ্ট্রের এক বৃহদংশ প্রথম রুদ্রসেনের রাজ্যভুক্ত ছিল; তিনি ছিলেন মূলত দক্ষিণাপথের রাজা।
- আদি বাকাটক রাজ্য বিদিশার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল, এরূপ এক মতও ব্যক্ত হয়েছে। পৌরাণিক সাক্ষ্য এই মতের ভিত্তিস্বরূপ। পুরাণে বিদিশার নাগরাজগণের সঙ্গে বাকাটক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিন্ধ্যশক্তির নাম উল্লিখিত হয়েছে। এ থেকে অনুমিত হয়েছে, বিন্ধ্যশক্তি বিদিশার নিকটবর্তী অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। কিন্তু বিন্ধ্যশক্তি সম্পর্কে পৌরাণিক বর্ণনা খুব একটা স্পষ্ট নয়। বিদিশার নাগ রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সম্বন্ধেও কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ফলে পৌরাণিক তথ্যের ভিত্তিতে আদি বাকাটক রাজ্যের অবস্থান নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
- তবে মধ্যপ্রদেশের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল বাকাটক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে বাকাটক রাজাদের কয়েকখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। হয়তো আদি বাকাটক রাজ্য মধ্যপ্রদেশের একাংশে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু মধ্য ভারতে গুপ্ত আধিপত্য ক্রমশ বিস্তার লাভ করায় বাকাটকরা পরবর্তী কালে মহারাষ্ট্রে প্রভুত্ব স্থাপনে উদ্যোগী হন।
- লক্ষ করবার বিষয়, বাকাটক রাজ্যের দু’টি প্রতিষ্ঠিত রাজধানী নন্দিবর্ধন ও বৎস্যগুল্ম (বৎসগুল্ম), কোনওটিই মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত নয়। এদের অবস্থান যথাক্রমে মহারাষ্ট্রের নাগপুর ও অকোলা জেলায়। দু’টি রাজধানীই মহারাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় মনে হতে পারে, আদি বাকাটক রাজ্য বিদর্ভের কিয়দংশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখান থেকেই পরে বাকাটক আধিপত্য মধ্যপ্রদেশে বিস্তৃত হয়।
- আদি বাকাটক রাজ্য পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ না পূর্ব মহারাষ্ট্রে অবস্থিত ছিল, তা এখনও সুনিশ্চিত নয়। (অজয়মিত্র শাস্ত্রী (The Age Of The Vākālaks, পৃষ্ঠা ১০) অভিমত প্রকাশ করেছেন আদি বাকাটক রাজ্য মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড-বাঘেলখণ্ড অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। যে রাজ্য পশ্চিমে বুন্দেলখণ্ড থেকে পূর্বদিকে বাঘেলখণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত, সে রাজ্য আয়তনে বিশালই ছিল, বলতে হবে। বিন্ধ্যশক্তি এরূপ বিশাল রাজ্যের অধিপতি ছিলেন, এ ধারণা কষ্টকল্পিত। সম্ভবত বুন্দেলখণ্ডের পূর্বদিকবর্তী অঞ্চল তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল না।)
আবির্ভাব কাল :
- বাকাটক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিন্ধ্যশক্তি ২৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দের কলচুরি-চেদি অব্দের প্রতিষ্ঠাতা বলে বহুদিন পূর্বে কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বাকাটক লেখমালায় কলচুরি-চেদি অব্দের কথা নেই, আছে রাজাদের রাজ্যবর্ষের উল্লেখ ৷ বিন্ধ্যশক্তি কোনও অব্দ প্রচলন করলে বাকাটক লেখে তার ব্যবহার দেখা যেত। বিন্ধ্যশক্তি কোনও অব্দ প্রবর্তন করেছেন, এমনটি বোধ হয় না। শুধু একটিমাত্র বাকাটক লেখে এক প্রচলিত অব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সে অব্দ শকাব্দ। লেখটি মহারাজ দেবসেনের হিস্সে বোরালা প্রস্তর লেখ। ৩৮০ শকাব্দে (খ্রিস্টাব্দ ৪৫৮) লেখটি উৎকীর্ণ।
- পৌরাণিক সাহিত্যে বাকাটক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত আছে। পুরাণের রাজবংশাবলি সম্পর্কিত অধ্যায়ে গুপ্ত রাজপরিবারের কথা আছে ; প্রয়াগ, সাকেত ও মগধে গুপ্ত রাজ্য বিস্তারের উল্লেখ আছে কিন্তু গুপ্ত রাজাদের নাম অনুক্তই থেকে গেছে। এতে স্পষ্ট হয়, পুরাণের বংশানুচরিত অধ্যায় খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের দ্বিতীয় পাদে রচিত হয়েছিল। সমুদ্রগুপ্তের আর্যাবর্ত অভিযান তখনও শুরু হয়নি। পুরাণে বিন্ধ্যশক্তি এবং তাঁর পুত্র প্রবীরের উল্লেখ আছে। অনুমিত হয়, বিন্ধ্যশক্তি ও তাঁর পুত্রের রাজত্বপর্ব খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের দ্বিতীয় পাদের পূর্বেই সমাপ্ত হয়। সেক্ষেত্রে বিন্ধ্যশক্তি খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজত্ব করেন, এমন অনুমানই যুক্তিযুক্ত বোধ হয়।
- বিষয়টিকে একটু অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। বিন্ধ্যশক্তি ছিলেন প্রথম পৃথিবীষেণের বৃদ্ধ প্রপিতামহ। পৃথিবীষেণের এক পুত্রের সঙ্গে সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (আ ৩৭৬ ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ) কন্যা প্রভাবতীগুপ্তার বিবাহ হয়। পৃথিবীষেণ সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ পাদে রাজত্ব করেন। তাঁর সঙ্গে বিন্ধ্যশক্তির চার পুরুষের ব্যবধান। ফলে খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের তৃতীয় পাদে বিন্ধ্যশক্তি রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এমন ধারণাই সংগত বোধ হয়। বিন্ধ্যশক্তি প্রায় দু’দশক কাল রাজত্ব করেন। তাঁর রাজপদলাভের সম্ভাব্য তারিখ ২৫০ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করা যায়।
বিন্ধ্যশক্তি (আ ২৫০-৭০ খ্রিস্টাব্দ)
বাকাটক রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিন্ধ্যশক্তি। হরিষেণের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ অজন্তা লেখে তাঁকে ‘দ্বিজ’ এবং ‘বাকাটক-বংশ-কেতু’ বলে পরিচিত করা হয়েছে কিন্তু রাজা বা মহারাজরূপে বর্ণনা করা হয়নি। স্বহস্তে রাজদণ্ড ধারণ করলেও তিনি হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও রাজকীয় অভিধা গ্রহণ করেননি। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে সেনাপতি পুষ্যমিত্র রাজপদে সমাসীন হয়েও রাজা উপাধিতে ভূষিত হননি। বিদর্ভের একাংশে না পশ্চিম মধ্যপ্রদেশের খণ্ডিতাংশে কিংবা উভয় অঞ্চলের কিয়দংশে বিন্ধ্যশক্তি রাজত্ব করেন, তা সঠিক বলা যায় না। তবে সাতবাহন রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগেই যে তাঁর রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, তা নিশ্চিত।
প্রথম প্রবরসেন (আ. ২৭০-৩৩০ খ্রিস্টাব্দ)
বিন্ধ্যশক্তির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হারিতী পুত্র প্রথম প্রবরসেন পৈতৃক সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর রাজত্বকালে বাকাটক রাজ্য চতুর্দিকে প্রসারিত হয়। মহারাজ উপাধিধারী এই রাজা পুরাণে প্রবীর নামে প্রসিদ্ধ। বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা তিনি। পুরাণ থেকে জানা যায়, শিশুক নামে এক প্রতিদ্বন্দ্বী নরপতিকে পরাজিত করে তিনি পুরিকা অধিকার করেন। সম্ভবত সাতপুরা পাহাড়ের পাদদেশে শহরটি অবস্থিত ছিল। পৈতৃকসূত্রে যে রাজ্য তিনি লাভ করেন তা আয়তনে ছিল ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ। প্রবরসেন বাকাটক রাজ্যের সীমানা চতুর্দিকে বিস্তৃত করেন। মহারাষ্ট্রের প্রায় সর্বত্র বাকাটক অধিকার প্রসারিত হয়। বাকাটক রাজ্য উত্তর-পশ্চিমে নর্মদা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পূর্বদিকেও তিনি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেন। মধ্যপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁর পদানত হয়। দক্ষিণ কোসলও সম্ভবত তাঁর অধিকারভুক্ত হয়। এ সময় দক্ষিণ ভারতে কদম্ব ও পল্লব রাজগণ রাজত্ব করতেন। কৃষ্ণা নদীর উত্তর কূলে তাঁরা কখনও রাজ্য বিস্তার করেননি। কৃষ্ণা নদীর উত্তর তীরবর্তী অঞ্চল প্রবরসেনের রাজ্যভুক্ত ছিল। অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশের বৃহদংশ বাকাটক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। উত্তরে বুন্দেলখণ্ড থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডের অধিপতি ছিলেন প্রবরসেন। এ সময় গুজরাতে শক রাজারা রাজত্ব করতেন। শক শাসক দ্বিতীয় রুদ্রসিংহ ও দ্বিতীয়যশোদামা প্রবরসেনের সমকালীন ছিলেন। তাঁদের পূর্বসূরিরা সকলেই মহাক্ষত্রপ উপাধি ধারণ করেছেন কিন্তু তাঁরা দু’জনে আজীবন ক্ষত্ৰপ উপাধিতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা যে স্বাধীন, সার্বভৌম ছিলেন না, তাঁদের উপাধিতেই তা প্রমাণিত হয়। তাঁরা সম্ভবত প্রবরসেনের অনুগত ছিলেন। মধ্যপ্রদেশের পদ্মাবতীর ভারশিব বংশীয় নরপতি ভবনাগ তাঁর এক কন্যার সঙ্গে প্রবর সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র গৌতমীপুত্রের বিবাহ দেন। বাকাটক লেখে এই বৈবাহিক সম্পর্কের উপর প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ভবনাগ হয়তো প্রবরসেনকে রাজ্য বিস্তারে সহায়তা প্রদান করেন। বৈদিক ধর্মের অনুরাগী ছিলেন প্রথম প্রবরসেন। পুরাণে ও লেখমালায় তাঁর বহু যাগ-যজ্ঞানুষ্ঠানের উল্লেখ আছে। তিনি অগ্নিষ্টোম, আপ্তোর্যাম, জ্যোতিষ্টোম, বৃহস্পতিসব, সাদ্যসস্ক্র, উক্থ্য, ষোড়শী, অতিরাত্র ইত্যাদি বিভিন্ন বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। তাছাড়া তিনি চার চারটি অশ্বমেধ যজ্ঞেরও আয়োজন করেন। সামরিক প্রতিভা, সংগঠন শক্তি ও ধর্মানুরাগের সমন্বয় ঘটেছিল প্রথম প্রবরসেনের চরিত্রে। তৎকালীন ভারতে তাঁর মতো পরাক্রমশালী রাজা আর কেউ ছিলেন না। সংগত কারণেই পারিবারিক লেখমালায় তাঁকে সম্রাটরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এ প্রশংসা অপর কোনও বাকাটক রাজার ভাগ্যে জোটেনি। পুরাণে উল্লেখ আছে, তিনি ৬০ বৎসর রাজত্ব করেন। ঐতিহাসিকেরা পৌরাণিক সাক্ষ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
প্রথম রুদ্রসেন (আ. ৩৩০-৬০ খ্রিস্টাব্দ)
প্রথম প্রবরসেনের জীবদ্দশায় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গৌতমীপুত্রের দেহাবসান হয়। ফলে গৌতমীপুত্রের পুত্র প্রথম রুদ্রসেন তাঁর পিতামহের মৃত্যুর পর রাজপদ লাভ করেন। কিন্তু তিনি সমগ্র বাকাটক ভূখণ্ডের অধীশ্বর হলেন না, রাজ্যের একাংশের কর্তৃত্ব লাভ করলেন। রাজ্যের অপরাংশের রাজা হলেন প্রবরসেনেরই এক পুত্র সর্বসেন। বৎসগুল্ম (বৎস্যগুল্ম) বা অকোলা জেলার বর্তমান বাশিম হল তাঁর রাজধানী। বৎসগুল্মের বাকাটকরা গৌণ বাকাটক শাখা নামে পরিচিত। প্রাচীন নন্দিবর্ধনে বা নাগপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত আধুনিক নন্দর্ধন বা নগর্ধনে সম্ভবত প্রথম রুদ্রসেনের প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপিত হয়। (নগর্ধন বা নন্দধন নাগপুর শহরের আনুমানিক ২১ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত। এ প্রসঙ্গে আরও একটি স্থানের নাম করা হয়। সে স্থান নন্দপুর। স্থানটি নগর্ধন বা নন্দধন থেকে আরও ৩৩ কি.মি. উত্তরে। বিষয়টি অবশ্যই বিতর্কিত। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশির অভিমত, প্রথম রুদ্রসেনের রাজধানী ছিল পুরিকা, আর রুদ্রসেনের পুত্র প্রথম পৃথিবীষেণই সম্ভবত নন্দিবর্ধনে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ঠিক কখন নন্দিবর্ধনে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় সে সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সরকারেরও সংশয় রয়েছে। প্রথম পৃথিবীষেণ বা দ্বিতীয় রুদ্রসেনের কোনও অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়নি। দেওটেকে প্রথম রুদ্রসেনের যে লেখটি পাওয়া গেছে তা অতিশয় ভগ্ন, তাতে রাজধানীর উল্লেখ নেই। তথ্যের অপ্রতুলতায় এ মুহূর্তে এ সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। প্রথম রুদ্রসেন বা প্রথম পৃথিবীষেণের কোনও পূর্ণাঙ্গ লেখ আবিষ্কৃত হলে হয়তো এ সমস্যার সমাধান হবে।) রুদ্রসেনের বংশধারা মুখ্য বাকাটক শাখার পরিচিতি লাভ করেছে।
অখণ্ড বাকাটক রাজ্যের এই দ্বিধা বিভাজন প্রক্রিয়ার পিছনে অবশ্যই কোনও কারণ ছিল। হয়তো প্রবরসেনের এরূপই নির্দেশ ছিল। কিংবা হয়তো রাজ্যের অধিকার নিয়ে প্রথম রুদ্রসেন ও তাঁর খুল্লতাত সর্বসেনের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষের পরিণামেই এই বিভাজন। লেখমালায় প্রথম রুদ্রসেনের পরিচিতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তিনি ভবনাগের দৌহিত্র। হতে পারে, পিতামহের রাজ্যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি মাতামহ ভবনাগের অকুণ্ঠ সহযোগিতা লাভ করেছিলেন।
এ সময় রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে গোলযোগ দেখা দেয়। বাকাটক রাজ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগে কয়েকজন রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী বা পূর্বতন প্রশাসক দক্ষিণ কোসল এবং কলিঙ্গ অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলভাগে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কোসলের মহেন্দ্র, মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ, কুরালের মণ্টরাজ, পিষ্টপুরের মহেন্দ্রগিরি এবং আরও কয়েকজন। এদিকে মধ্যপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকেও বাকাটকরা বিতাড়িত হলেন। সেখানে কয়েকটি নতুন রাজতান্ত্রিক ও গণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম রুদ্রসেনের রাজ্য আয়তনে সংকুচিত হয়ে উত্তর বিদর্ভ এবং মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশে সীমাবদ্ধ হয়। গুজরাতের শক শাসকবৃন্দও আর বাকাটকদের অনুগত রইলেন না। আনুমানিক ৩৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁরা পুনরায় মহাক্ষত্রপ উপাধি ধারণ করতে থাকেন। শৈবধর্মের অনুরাগী ছিলেন রুদ্রসেন। লেখমালায় ‘মহাভৈরবভক্ত বলে তিনি বর্ণিত হয়েছেন। নাগপুরের কাছে দেওটেকে তিনি একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রথম পৃথিবীষেণ (আ. ৩৬০-৪০০ খ্রিস্টাব্দ)
প্রথম রুদ্রসেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম পৃথিবীষেণ নন্দিবর্ধনের সিংহাসনে আরোহণ করেন। পিতার মতো তিনিও শিবের ভক্ত ছিলেন। লেখে তাঁকে ‘ধর্মবিজয়ী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং সত্যনিষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
বুন্দেলখণ্ডের নাচনে কী তলাঈ ও গঞ্জ নামে দু’টি স্থানে জনৈক ব্যাঘ্রদেবের দু’খানি লেখ পাওয়া গেছে। লেখ দু’টিতে ব্যাঘ্রদেব নিজেকে পৃথিবীষেণের অনুগত (বাকাটকানাং মহারাজ শ্রীপৃথিবীষেণ-পাদানুধ্যাত) বলে পরিচয় দিয়েছেন। অনেকেই এই পৃথিবীষেণকে দ্বিতীয় পৃথিবী ষেণরূপে শনাক্ত করেছেন। এ অভিমত গ্রহণ করলে ব্যাঘ্রদেবের আবির্ভাবকাল খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ধার্য করতে হয়। তখন উচ্ছকল্প বংশীয় রাজগণ বুন্দেলখণ্ডে রাজত্ব করতেন। তাঁরা ‘মহারাজ’ অভিধায় ভূষিত ছিলেন। তাঁরা লেখে একটি অব্দও ব্যবহার করেছেন। অব্দটি সম্ভবত গুপ্তাব্দ। ব্যাঘ্রদেব কোনও অভিধা ব্যবহার করেননি। তাঁর লেখ দু’টিতে কোনও অব্দেরও উল্লেখ নেই। ব্যাঘ্রদেব দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের সমকালবর্তী ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রথম পৃথিবীষেণের অধীনস্থ এক আঞ্চলিক প্রশাসক। ব্যাঘ্রদেবের লেখ দু’টি প্রমাণ করছে, বুন্দেলখণ্ড প্রথম পৃথিবীষেণের অধিকারভুক্ত ছিল। তবে তিনি বুন্দেলখণ্ড অধিকার করেন, না উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত অচিরে এ অঞ্চল জয় করেন।
পৃথিবীষেণের পুত্র দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার বিবাহ বাকাটক রাজপরিবারের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। এই বিবাহ যে পৃথিবীষেণের রাজত্বকালেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এমন কথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। ঘটনাটি দ্বিতীয় রুদ্রসেনের রাজত্বকালেও অনুষ্ঠিত হতে পারে। উভয় পরিবারের রাজনৈতিক স্বার্থের খাতিরে এই বিবাহ জরুরি হয়ে দেখা দেয়। বুন্দেলখণ্ডে গুপ্ত প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাকাটকগণ আতঙ্কিত হন। গুপ্ত রাজপরিবারের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে দক্ষিণ দিকে গুপ্তদের আগ্রাসনের অবসান ঘটাতে তাঁরা বদ্ধপরিকর হলেন। এদিকে গুপ্ত সিংহাসনে তখন সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। শক মহাক্ষত্রপদের বিতাড়িত করে গুজরাত এবং সংলগ্ন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে তিনি সংকল্পবদ্ধ। শকদের প্রতিবেশী বাকাটকগণের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ প্রশস্ত করবে, এমনটি ভাবাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। অনুমান করা যায়, বাকাটকগণ শকদের বিরুদ্ধে অভিযানে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। লেখে প্রথম পৃথিবীষেণকে ‘পুত্রপৌত্ৰিণঃ’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি পুত্র-পৌত্র পরিবৃত ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন।
দ্বিতীয় রুদ্রসেন (আ. ৪০০-০৫ খ্রিস্টাব্দ)
প্রথম পৃথিবীষেণের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় রুদ্রসেন পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর পত্নী প্রভাবতীগুপ্তা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও রাজমহিষী কুবেরনাগার কন্যা ছিলেন। এতদিন বাকাটক রাজারা শৈবধর্মানুরাগী ছিলেন কিন্তু পত্নী ও শ্বশুরকুলের প্রভাবে দ্বিতীয় রুদ্রসেন চক্রপাণি বা বিষ্ণুর ভক্ত হন। দীনেশচন্দ্র সরকারের অভিমত, এ সময় থেকে নন্দি বর্ধনের বাকাটক রাজগণের আর স্বাধীন সত্তা থাকল না, তাঁরা গুপ্ত সম্রাটদের অনুগত মিত্রে পরিণত হন। লক্ষ করবার বিষয়, বাকাটক লেখে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উল্লেখ প্রসঙ্গে বার বার ‘মহারাজাধিরাজ’ অভিধা ব্যবহার করা হয়েছে অথচ বাকাটকেরা নিজেদের কেবল ‘মহারাজ’ রূপে বর্ণনা করেছেন। বাকাটক প্রশাসন উদ্দেশ্যহীনভাবে সরকারি নথিপত্রে ‘মহারাজ’ ও ‘মহারাজাধিরাজ’ অভিধা দু’টি ব্যবহার করেছেন, এটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু এ মত সঠিক নাও হতে পারে। বাকাটক লেখে সমুদ্রগুপ্তকেও ‘মহারাজ’ বলা হয়েছে। বাকাটক লেখমালায় গুপ্তাব্দের ব্যবহার নেই। ফলে বাকাটকরা গুপ্তদের অধীন ছিলেন, এ সিদ্ধান্তে সংশয়ের অবকাশ আছে।
অল্প দিন রাজত্ব করার পর দ্বিতীয় রুদ্রসেন অকালে প্রাণত্যাগ করেন। তখন তাঁর দুই পুত্ৰই নাবালক ছিলেন। তাঁরা হলেন দিবাকরসেন এবং দামোদরসেন। (দামোদরসেন এবং প্রবরসেন এক ব্যক্তি ছিলেন, এ মত কেউ কেউ স্বীকার করেন না। তাঁদের ধারণা, দ্বিতীয় রুদ্রসেনের তিন পুত্র–দিবাকরসেন, দামোদরসেন এবং প্রবরসেন। কিন্তু এ মত ভ্রান্ত।) এই দামোদরসেন পরবর্তী কালে সিংহাসনে আরোহণ করে প্রবরসেন নাম গ্রহণ করেন। পুত্ররা দু’জনেই মহিষী প্রভাবতী গুপ্তার গর্ভজাত।
প্রভাবতীগুপ্তার প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসনিক ভূমিকা (আ. ৪০৫-২০ খ্রিস্টাব্দ)
দ্বিতীয় রুদ্রসেনের মৃত্যুকালে তাঁর পুত্ররা নাবালক ছিলেন। রাজ্যের এই দুঃসময়ে জ্যেষ্ঠ পুত্র দিবাকরসেন যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হন। কিন্তু তিনি অল্পবয়স্ক হওয়ায় রানিমা প্রভাবতীগুপ্তা পুত্রের প্রতিনিধিরূপে বাকাটক রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনকালের ত্রয়োদশ বৎসরে নন্দিবর্ধন থেকে প্রদত্ত একখানি তাম্রশাসন মহারাষ্ট্রের পুণে শহরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখে তিনি যুবরাজ দিবাকরসেনের মাতারূপে বর্ণিত হয়েছেন। অর্থাৎ তখনও তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
পুণে তাম্রশাসনের বর্ণমালা গুপ্ত বর্ণমালার অনুরূপ। বাকাটক লেখেও একই বর্ণমালা তবে তা আকারে ও ধরনে একটু ভিন্ন। তাছাড়া পুণে লেখে গুপ্ত বংশ-তালিকা দেওয়া হয়েছে, বাকাটক বংশ তালিকার উল্লেখ নেই। মনে হচ্ছে, বাকাটক রাজ্যের পরিচালন ব্যবস্থায় গুপ্ত প্রশাসনের এক সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কন্যার কাজে সাহায্য করার জন্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সম্ভবত পাটলিপুত্র থেকে একদল সুদক্ষ রাজপুরুষকে নন্দিবর্ধনে প্রেরণ করেন। মহাকবি কালিদাসও হয়তো চন্দ্রগুপ্তের অনুরোধে কিছুকাল বিদর্ভে অবস্থান করেন। অনুমান করার যথেষ্ট কারণ আছে, এখানে অবস্থানকালে কালিদাস তাঁর অমর কাব্য মেঘদূত রচনা করেন। এই কাব্যে বিরহী যক্ষের নিবাসস্থল রামগিরির এক মনোজ্ঞ বর্ণনা আছে। নাগপুর শহরের নিকটবর্তী রামটেক পাহাড়ই ঐতিহ্যমণ্ডিত সেই রামগিরি।
পরবর্তী কালে প্রভাবতীগুপ্তা ঋদ্ধপুর তাম্রশাসন উৎকীর্ণ করেন। তখন তিনি বাকাটক রাজ্যের শাসনকর্ত্রী নন, তখন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্বের ঊনবিংশতি বৎসর। দিবাকরসেন সম্ভবত সিংহাসনে আরোহণ করেননি। অপ্রাপ্ত বয়সেই তিনি দেহত্যাগ করেন। প্রভাবতীগুপ্তা দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন। ঋদ্ধপুর লেখে তাঁকে ‘সাগ্রবর্ষশত-জীব-পুত্রপৌত্রা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, পুত্র-পৌত্র পরিবৃত প্রভাবতীগুপ্তা এক শতকেরও অধিককাল জীবিত ছিলেন। তাহলে স্বীকার করতে হয়, প্রভাবতীগুপ্তার ৩৪০ খ্রিস্টাব্দেরও পূর্বে জন্ম হয়েছিল। কিন্তু তখন হয়তো দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তেরই জন্ম হয়নি। বর্ণনাটি নিঃসন্দেহে অত্যুক্তিমূলক। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি কথাটিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
তাঁর অভিমত, ‘সাগ্রবর্ষশত’ কথাংশটি প্রভাবতীগুপ্তার পুত্র-পৌত্রদের বিশেষণ, এবং তাঁর পুত্র-পৌত্রদের শত বৎসরের পরমায়ু হোক, বৃদ্ধা রাজমাতার এই শুভকামনাই এখানে ধ্বনিত হয়েছে। রাজকার্য থেকে অবসর গ্রহণের পর রাজমাতা ধর্ম-কর্মে মনোনিবেশ করেন। ‘শ্রীরামচন্দ্রের পদরঞ্জিত’ রামগিরি পরিদর্শন করে কতিপয় ব্রাহ্মণদের অনুকূলে তিনি ভূমি ও গৃহ দান করেন। (এখানে সম্ভবত দেবতা রামস্বামীর একটি মন্দির ছিল।) ঋদ্ধপুর তাম্রশাসন এই উপলক্ষেই উৎকীর্ণ হয়। দ্বিতীয় প্রবরসেনের ২৩শ রাজ্যবর্ষে তিরোদি লেখ উৎকীর্ণ হয়। প্রভাবতীগুপ্তা তখনও জীবিত।
দ্বিতীয় প্রবরসেন (আ. ৪২০-৫৫ খ্রিস্টাব্দ)
বাকাটক বংশের পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় প্রবরসেন। অনেকেই মনে করেন, দ্বিতীয় প্রবরসেনের সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে তাঁর মধ্যম ভ্রাতা দামোদরসেন দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন। এ মতের সমর্থনে দু’টি যুক্তি দেওয়া হয়।
- প্রথমত, ঋদ্ধপুর তাম্রশাসনে প্রভাবতীগুপ্তাকে ‘মহারাজ শ্রীদামোদরসেন-প্রবরসেন-জননী’ বলা হয়েছে। এর অর্থ, প্রভাবতীগুপ্তা মহারাজ দামোদরসেন এবং প্রবরসেনের জননী ছিলেন।
- দ্বিতীয়ত, ঋদ্ধপুর লেখের সম্প্রচারকালে প্রভাবতীগুপ্তার বয়স একশো বছরেরও অধিক ছিল। তখন দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্ব সবেমাত্র ঊনবিংশতি বৎসরে পদার্পণ করেছে। দামোদরসেন দীর্ঘদিন রাজত্ব না করলে প্রভাবতীগুপ্তার অত বয়স হয় কী করে?
কিন্তু এ যুক্তি ঠিক নয়।
- দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্বকালেই ঋদ্ধপুর লেখখানি উৎকীর্ণ হয়। কিন্তু আলোচ্যমান বাক্যাংশে প্রবর সেনের নামের পূর্বে মহারাজ অভিধা নেই, মহারাজ উপাধি আছে দামোদরসেনের নামের পূর্বে। এর অর্থ, দামোদরসেন এবং প্রবরসেন একই ব্যক্তি ছিলেন। দামোদরসেনেরই অভিষেক নাম প্রবরসেন। প্রবরসেনের নামের পূর্বে ‘শ্রী’ শব্দের অনুল্লেখ এবং দামোদরসেনের নামের পূর্বে তার ব্যবহার একই ইঙ্গিত বহন করছে।
- দ্বিতীয়ত, প্রবরসেনের ঊনবিংশতি রাজ্যবর্ষে প্রভাবতীগুপ্তা শত বর্ষ অতিক্রম করেছিলেন, এ যুক্তিও ত্রুটিপূর্ণ।
মিরেগাঁও তাম্রশাসনের সিলমোহরে প্রসবতীগুপ্তাকে দু’জন পরাক্রান্ত বাকাটক ‘নরেন্দ্র’-এর জননী (বিক্রান্তয়ো = জর্নন্যা = স্তু বাকাটক-নরেন্দ্রয়োঃ) বলা হয়েছে। অজয় মিত্র শাস্ত্রী মনে করেন, দু’জন পরাক্রান্ত বাকাটক নরেন্দ্রের একজন দামোদরসেন, অন্যজন প্রবরসেন। (Ajay Mitra Shastri, Early History of The Deccan (Delhi, 1987), পৃষ্ঠা ৫১-৫২।) তাঁর অভিমত, দিবাকরসেন এই বাকাটক নরেন্দ্র দু’জনের একজনও নন, তিনি ছিলেন যুবরাজ। অজয়মিত্র শাস্ত্রীর এ অভিমত সম্পর্কে দু’চারটি কথা বলার আছে।
- প্রথমত, দামোদরসেন ও প্রবরসেনকে দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপে স্বীকার করলে শেষোক্ত জনের নামের পূর্বে মহারাজ ও শ্রী শব্দের অনুল্লেখ ইত্যাদি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অযথা লঘু ভাবে গ্রহণ করতে হয়।
- দ্বিতীয়ত, পুণে তাম্রশাসনে দিবাকরসেনকে যুবরাজ বলা হলেও তাঁকে সংশ্লিষ্ট সিলমোহরে উত্তরাধিকারসূত্রে নৃপশ্রী অর্থাৎ রাজৈশ্বর্যের অধিকারী রূপে (ক্রমপ্রাপ্ত-নৃপশ্রিয়ঃ) বর্ণনা করা হয়েছে। এ হেন পুত্র মরণোত্তর পর্বে তাঁর মায়ের দৃষ্টিতে নরেন্দ্ররূপে প্রতিভাত হবেন, এ তো স্বাভাবিক ঘটনা। মনে রাখতে হবে, বাকাটক রাজাদের আনুষ্ঠানিক রাজকীয় অভিধা মহারাজ, নরেন্দ্র নয়। প্রভাবতীগুপ্তা নিজেকে দু’জন মহারাজের জননীরূপে বর্ণনা করেননি, দু’জন নরেন্দ্রের জননী বলে নিজেকে আখ্যাত করেছেন। প্রশাসনিক তাৎপর্যে নরেন্দ্র ও মহারাজ পদ দু’টি ঠিক সমার্থক নয়।
- তৃতীয়ত, নরেন্দ্রয়োঃ পদটি নরেন্দ্র শব্দের ষষ্ঠি বিভক্তির দ্বিবচন। এর অর্থ নরেন্দ্র দু’জনের। অর্থাৎ প্রভাবতীগুপ্তা দু’জন নরেন্দ্রের জননী। ধরা যাক, দামোদরসেন ও প্রবরসেনই এই দুই নরেন্দ্র।
মিরেগাঁও তাম্রশাসনখানি যখন উৎকীর্ণ হয় তখন প্রবরসেনের রাজত্বের বিংশতি বৎসর। তখন আর দামোদরসেন জীবিত নন, দিবাকরসেন তো তাঁর অনুজের পূর্বেই লোকান্তরিত হয়েছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্বের বিংশতি বৎসরে প্রভাবতীগুপ্তা তাঁর পরলোকগত দুই পুত্রের মধ্যে শুধু কনিষ্ঠের কথাই বলছেন, জ্যেষ্ঠ সম্পর্কে নীরব রয়েছেন। এটা কি করে সম্ভব? তিনি তো জ্যেষ্ঠপুত্র দিবাকরসেনেরও জননী। নিজ সন্তানের প্রতি জননীর এ ধরনের বিমাতৃসুলভ আচরণ অনভিপ্রেত। বিশেষত সে সন্তান যখন লোকান্তরিত। সেক্ষেত্রে স্বভাবতই মনে হয়, দামোদরসেন ও প্রবরসেন দু’জন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হলে বিক্রান্ত ও নরেন্দ্র পদ দু’টি দ্বিবচনান্ত না হয়ে বহু বচনে ব্যবহৃত হত। তাহলে প্রভাবতীগুপ্তার তিন পুত্রেরই প্রচ্ছন্ন উল্লেখ থাকত। কিন্তু পদ দু’টি দ্বিবচনে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ রাজমাতা প্রভাবতীগুপ্তার দুই পুত্র। পুত্রদের একজন দামোদরসেন, যাঁর অভিষেক নাম প্রবরসেন, অপরজন দিবাকরসেন।
তাছাড়া আরও একটি কারণে দামোদরসেন ও প্রবরসেনকে দু’জন স্বতন্ত্র মহারাজরূপে ভাবতে অসুবিধে হচ্ছে। প্রবরসেনের কম করেও আঠারোখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে অথচ মহারাজ দামোদরসেনের একখানি লেখেরও সন্ধান পাওয়া গেল না। দামোদরসেন যদি প্রবরসেন হতে পৃথক ব্যক্তি হতেন তাহলে সম্ভবত তাঁরও লেখ পাওয়া যেত। কিন্তু তা হয়নি। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দামোদরসেন ও প্রবরসেনকে এক ও অভিন্ন ব্যক্তি বলেই মনে হয়।
দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ লেখগুলি মধ্যপ্রদেশের ছিন্দোয়ারা, সিওনি, বালাঘাট, ও বেতুল এবং মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা, নাগপুর, ইয়ত্খল, ভণ্ডারা ও অমরাবতী জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। লেখসমূহ তাঁর দ্বিতীয় রাজ্যবর্ষ থেকে দ্বাত্রিংশ রাজ্যবর্ষের মধ্যে উৎকীর্ণ। এ থেকে দু’টি জিনিস স্পষ্ট হচ্ছে। এক, মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও বিদর্ভ তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। দুই, তিনি অন্তত বত্রিশ বৎসর রাজত্ব করেন। বলা হয়, দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজ্য উত্তরে জবলপুরের নিকটবর্তী প্রাচীন ত্রিপুরী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সত্যি বটে, বাকাটকরাজের ইনদউর তাম্রশাসন ত্রিপুরী হতে সম্প্রদত্ত (ত্রিপুরীবাসকাৎ) হয়। লক্ষ করবার বিষয়, ত্রিপুরীকে আবাসরূপে বর্ণনা করা হয়েছে, স্কন্ধাবার বা জয়স্কন্ধাবাররূপে নয়। এরূপ বর্ণনা থাকলে দ্বিতীয় প্রবরসেনের ত্রিপুরী অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য জানা যেত। এ সময় জবলপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল গুপ্ত রাজাদের প্রভাবাধীন। তখন প্রথম কুমারগুপ্ত গুপ্তদের রাজা। মাতুল প্রথম কুমারগুপ্তের সঙ্গে ভাগিনেয় দ্বিতীয় প্রবরসেনের যে বৈরিতা ছিল তার কোনও প্রমাণ নেই। দ্বিতীয় প্রবরসেনের ত্রিপুরী গমনের পিছনে ধর্মীয় বা অন্য কোনও কারণ ছিল, রাজ্যজয় নয়।
তাঁর রাজত্বের আদি পর্বে উৎকীর্ণ লেখগুলি নন্দিবর্ধন থেকে সম্প্রচারিত হয়েছে কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ের বেশির ভাগ শাসনাবলি প্রবরপুর থেকে প্রদত্ত হয়েছে। প্রবরপুর শহরের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। নন্দিবর্ধন হতে প্রবরপুরেই রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। দ্বিতীয় প্রবরসেনের মানঢল তাম্রশাসন প্রবরপুর হতে সম্প্রদত্ত। এই লেখে যে জমিদানের উল্লেখ আছে তা তাঁর রাজত্বের ষোড়শ বৎসরে প্রদত্ত হয়। তাঁর বেলোয়া তাম্রশাসন রাজত্বের একাদশ বৎসরেনন্দি বর্ধন হতে বিজ্ঞাপিত হয়েছে। বোঝা যায় দ্বিতীয় প্রবরসেন তাঁর রাজত্বের একাদশ বৎসরের পর কিন্তু ষোড়শ রাজ্যবর্ষের কিছুকাল পূর্বে বা ষোড়শ রাজ্যবর্ষের প্রারম্ভে প্রবরপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। এখানে এক বিশাল রাম-মন্দির নির্মিত হয়। নতুন রাজধানী সম্ভবত বর্তমান ওয়ার্ধা শহরের সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। সম্ভবত আধুনিক পওনার প্রাচীন প্রবরপুর। এ স্থানে প্রাচীন যুগের বহু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।
প্রবরসেন তাঁর পুত্র যুবরাজ নরেন্দ্রসেনের সঙ্গে কুন্তলরাজের কন্যা অজ্ঝিতভট্টারিকার বিবাহ দেন। এই কুন্তলরাজ ছিলেন সম্ভবত কর্ণাটকের কদম্ব বংশীয় নরপতি কাকুৎস্থবর্মা। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি এই কুন্তল রাজকন্যাকে রাষ্ট্রকূটনৃপতি অবিধেয়ের কন্যারূপে শনাক্ত করেছেন। দ্বিতীয় প্রবরসেনের উপর তাঁর মাতামহের খুব একটা প্রভাব পড়েছিল বলে মনে হয় না। তাঁর মাতামহ ছিলেন পরমভাগবত। তাঁর প্রভাবে বাকাটক রাজ্যে বৈষ্ণবধর্ম প্রসার লাভ করে। প্রবরসেন কিন্তু আজীবন পরমমাহেশ্বর ছিলেন। সাহিত্যসেবী ছিলেন প্রবরসেন। অনেকেই মনে করেন, মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে রচিত ‘সেতুবন্ধ’ কাব্য তাঁরই রচনা। শোনা যায়, কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাস এই কাব্যটির পরিমার্জন করেন। বৈষ্ণবধর্ম অবলম্বনে ‘সেতুবন্ধ’ রচিত কিন্তু প্রবরসেন নিজে শৈব ছিলেন। প্রবরসেন সেতুবন্ধের রচয়িতা, এ কথা সকলে স্বীকার করেন না। তাঁর রচিত বহু প্রাকৃত গাথা ‘গাথাসপ্তশতী’তে স্থান পেয়েছে। সংস্কৃত ভাষায়ও তিনি বহু কবিতা রচনা করেন। কখনও কখনও বলা হয়, প্রবরসেন আদ্য ভাগে হস্তে রাজ্যভার সমর্পণ করে ভোগৈশ্বর্যময় জীবনযাপন করেন। কিন্তু এ মত অসমর্থিত, অপ্রমাণিত।
নরেন্দ্রসেন (আ. ৪৫৫-৭০ খ্রিস্টাব্দ)
দ্বিতীয় প্রবরসেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নরেন্দ্র সেন পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের বালাঘাট লেখের সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, নরেন্দ্রসেন তাঁর রাজত্বের প্রথম পর্বে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেন। লেখটিতে বলা হয়েছে, কোসলা, মেকলা এবং মালবের রাজারা নরেন্দ্রসেনের অনুগত ছিলেন। কোসলা এবং মেকলা সম্ভবত কোসল ও মেকল রাজ্যের রাজধানী ছিল। পুরোনো রায়পুর, বিলাসপুর ও সম্বলপুর জেলা নিয়ে প্রাচীন কোসল বা দক্ষিণ কোসল জনপদ গঠিত ছিল। অমরকণ্টক পর্বত ও সন্নিহিত অঞ্চলে মেকল রাজ্য অবস্থিত ছিল। মালবের অবস্থিতি ছিল মধ্যপ্রদেশে। দক্ষিণ কোসলে এ সময় শরভপুরীয় রাজগণ রাজত্ব করতেন। মেকল ছিল পাণ্ডুবংশী রাজাদের কর্তৃত্বে। এসব অঞ্চলের স্থানীয় রাজারা গুপ্ত রাজশক্তির প্রভাবাধীন ছিলেন। নরেন্দ্রসেন সম্ভবত এসব রাজ্যে গুপ্ত আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে বাকাটক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন।
তবে মালবে নরেন্দ্রসেনের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি কতদূর সত্য বলা কঠিন। নরেন্দ্রসেন স্বয়ং মালব জয় করেন বলে মনে হয় না। গুপ্ত সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের অন্তিমপর্বে গুপ্ত সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে মালবের স্থানীয় শাসকেরা সম্ভবত নিরাপত্তার খাতিরে নরেন্দ্রসেনের আনুগত্য স্বীকার করেন। কিন্তু মালবে বাকাটকদের এ আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অচিরে স্কন্দগুপ্তের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে গুপ্তাধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। হূণরাজ তোরমাণের সামরিক অভিযানের পূর্বকাল পর্যন্ত মালবে গুপ্তাধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে।
শুধু বালাঘাট নয়, দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের মানঢল ও মাহুরঝরী তাম্রশাসনেও নরেন্দ্রসেনের কোসলা, মেকলা ও মালবে আধিপত্য বিস্তারের উল্লেখ আছে। অনেকে এ দাবিকে অত্যুক্তিমূলক বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এ কথা স্বীকার্য, কোসল, মেকল ও মালব অঞ্চলে নরেন্দ্রসেন বা দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের কোনও লেখ আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে এ দাবির সত্যতা সম্পর্কে সংশয়ের যে অবকাশ নেই, তা নয়। তবে এ দাবিকে পুরোপুরি নস্যাৎ করাও হয়তো ঠিক হবে না। নরেন্দ্রসেন সম্পর্কে আরও কয়েকটি অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি কৌশলে পৈতৃক সিংহাসন অধিকার করেন কিন্তু পরবর্তিকালে তাঁর জনৈক ভ্রাতা কিংবা জ্ঞাতি, সমকালীন বৎসগুল্মরাজ তাঁর রাজ্যের সমগ্রাংশ বা কিয়দংশ অধিকার করেন। (অসমাপ্ত দুর্গ তাম্রশাসন পদ্মপুর হতে প্রদত্ত। শাসনখানি সম্ভবত দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের। বিপদের দিনে বাকাটকরাজ পদ্মপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এরূপ ধারণা সঙ্গত বোধ হয়। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি (Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. V (Ootcamund, 1963), পৃষ্ঠা ৭৭) মনে করেন, অসম্পূর্ণ এ লেখ নরেন্দ্রসেনের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ হয়েছে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় পৃথিবীষেণ নন, তাঁর পিতা নরেন্দ্রসেনই পদ্মপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।) বালাঘাট ইত্যাদি লেখে অস্পষ্ট ও বিনষ্ট অংশের এক বিশেষ পাঠের উপর এ মত প্রতিষ্ঠিত। সেই বিশেষ পাঠ অর্থাৎ ‘দায়াদ’ পদটি সংশ্লিষ্ট বাক্যাংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা সে সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ আছে। তাছাড়া নরেন্দ্রসেনের রাজত্বকালে তাঁর কোনও এক ভ্রাতা তাঁর রাজ্যাংশ অধিকার করেন বা বৎসগুল্মরাজ তাঁর রাজ্যের একাংশ আত্মসাৎ করেন, এ ধারণার সমর্থনে কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। তাঁর রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে নরেন্দ্রসেন সম্ভবত এক ঘোর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। ছত্তীসগঢ় অঞ্চলের নলবংশীয় রাজা ভবদত্তবর্মা বাকাটক রাজ্য আক্রমণ করেন এবং নন্দিবর্ধন অধিকার করেন। মহারাষ্ট্রের অমরাবতী জেলার ঋদ্ধপুরে ভবদত্তবর্মার পুত্র অর্থপতির একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। নন্দিবর্ধন হতে সম্প্রচারিত এই লেখ থেকে জানা যায়, ভবদত্তবর্মা ইয়মল অঞ্চলে একখানি গ্রাম দান করেছিলেন। বাকাটক রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুঃসময়ের মধ্যেই নরেন্দ্রসেনের জীবনাবসান হয়।
দ্বিতীয় পৃথিবীষেণ (আ.৪৭০-৯০ খ্রিস্টাব্দ)
নরেন্দ্রসেনের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় পৃথিবীষেণ রাজপদে অভিষিক্ত হন। বাকাটক রাজ্যে তখন সংকট। রাজধানী নন্দিবর্ধনসহ রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখনও নলদের অধিকারভুক্ত। বাকাটক রাজধানী তখন পদ্মপুরে স্থানান্তরিত। ভণ্ডারা জেলার বর্তমান পদমপুর প্রাচীন পদ্মপুর। পৃথিবীষেণ শক্তি সঞ্চয় করে নলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বাকাটক রাজ্য থেকে নলগণ বিতাড়িত হলেন। পৃথিবীষেণ নল রাজধানী পুষ্করী অবরোধ করেন। নল লেখে পুষ্করীর পতনের ইঙ্গিত আছে। বাকাটক রাজ্য বিপদমুক্ত হয়। অতঃপর পৃথিবীষেণ পদ্মপুর থেকেই রাজকার্য পরিচালনা করেন, না নন্দিবর্ধনে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, তা জানা যায় না। বালাঘাট লেখে দাবি করা হয়েছে, পৃথিবীষেণ দু’বার পারিবারিক লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করেন (দ্বি-ভগ্নবংশস্য উদ্ধঃ)। নলদের বিতাড়িত করে তিনি একবার বাকাটক রাজ্যকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন। হতে পারে, বৎসগুল্ম শাখার হরিযেণও মূল বাকাটক ভূখণ্ড আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু পৃথিবীষেণ তা প্রতিহত করেন। এমনও হতে পারে, উত্তর কোঙ্কণের ত্রৈকূটক নৃপতি ধরসেন (আ. ৪৪৫-৭৫ খ্রিস্টাব্দ) বাকাটক রাজ্যে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন কিন্তু পৃথিবীষেণ সতর্ক থাকায় তা ব্যর্থ হয়। পৃথিবীষেণই তাঁর বংশের সর্বশেষ রাজা। আনুমানিক ৪৯০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর এ রাজ্যটি বৎসগুল্ম শাখার বাকাটকরাজ হরিষেণের অধিকারভুক্ত হয়। সার্ধ শতাব্দী কাল রাজত্ব করার পর দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে প্রধান বাকাটক শাখাটির চিরপ্রস্থান ঘটল।
বৎসগুল্ম শাখার সর্বসেন, দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি, দ্বিতীয় প্রবরসেন, দ্বিতীয় সর্বসেন ও দেবসেন
সর্বসেন (আ.৩৩৫-৫০ খ্রিস্টাব্দ) : প্রথম প্রবরসেনের এক কনিষ্ঠ পুত্র সর্বসেন বৎসগুল্ম শাখার প্রতিষ্ঠাতা। বাশিম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তিনি রাজত্ব করেন। পুরাণে বলা হয়েছে, সর্বসেন তাঁর পিতার কাছ থেকেই এই রাজ্যটি লাভ করেন। বৎসগুল্ম হল নতুন রাজ্যের রাজধানী। অকোলা জেলার আধুনিক বাশিমই প্রাচীন বৎসগুল্ম। সাহিত্যানুরাগী ছিলেন সর্বসেন। প্রাকৃত ভাষায় তিনি ‘হরিবিজয়’ নামে একখানি কাব্য রচনা করেন। দণ্ডী, আনন্দবর্ধন ও অভিনবগুপ্তের মতো বিদ্বজ্জন এই কাব্যের সুখ্যাতি করেছেন। তিনি প্রাকৃতে বেশ কিছু গাথাও প্রণয়ন করেন। এরূপ কয়েকটি গাথা ‘গাথাসপ্তশতি’ সংকলনে উদ্ধৃত আছে। সর্বসেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি বৎসগুল্মের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি (আ. ৩৫০-৪০০ খ্রিস্টাব্দ) : দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি তাঁর ৩৭শ রাজ্যবর্ষে বাশিম লেখটি উৎকীর্ণ করেন। লেখটিতে একটি গ্রাম দানের কথা বলা হয়েছে। গ্রামটি নান্দীকট নামে এক প্রশাসনিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আধুনিক নান্দেড় প্রাচীন নান্দীকটের স্মৃতি বহন করছে। লেখটি থেকে দু’টি জিনিস প্রমাণিত হচ্ছে। প্রথমত, দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর রাজ্য মহারাষ্ট্রের অকোলা-নান্দেড় অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। অজন্তা গুহায় একটি ভগ্ন লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখটি একেই ভগ্ন, তার উপর অস্পষ্ট। লেখটির ব্যাখ্যা নিয়ে স্বাভাবিক কারণে পণ্ডিতমহলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, লেখটিতে প্রথম প্রবরসেন, তাঁর পৌত্র প্রথম রুদ্রসেন ও প্রপৌত্র প্রথম পৃথিবীষেণের নাম উল্লিখিত আছে। আবার অনেকের অভিমত, লেখে প্রবরসেন, তাঁর পুত্র সর্বসেন এবং সর্বসেনের পুত্র বিন্ধ্যসেনের নামোল্লেখ আছে। আবার কারোর ধারণা, লেখটিতে বিন্ধ্যসেনের নাম নেই, নাম আছে সর্বসেনের অপর এক পুত্র পৃথিবীষেণের। লেখটিতে যে রুদ্রসেনের নাম নেই, আছে সর্বসেনের নাম, তা বোধহয় মেনে নেওয়া ভালো। কিন্তু তৃতীয় রাজার নামটি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। অজন্তা লেখে যদি সর্বসেনের পুত্ররূপে বিন্ধ্যসেনের নামই উল্লিখিত হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, এই বিন্ধ্যসেনই বাশিম লেখের দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি। সেক্ষেত্রে বলা চলে, দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তির পুত্র-পৌত্ররাই পুরুষানুক্রমে বৎস গুল্মে রাজত্ব করেছেন। কিন্তু যদি নির্দিষ্ট নামটি পৃথিবীষেণেরই হয়, তাহলে স্বীকার করতে হবে, দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে বা তাঁকে পদচ্যুত করে তাঁরই অনুজ পৃথিবীষেণ বৎসগুল্মের সিংহাসন অধিকার করেন। তবে অজন্তা লেখের এই বাকাটক নৃপতি যিনিই হোন না কেন, লেখের সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, তিনি জনৈক কুন্তলরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। এই পরাজিত কুন্তলরাজ ছিলেন বনবাসির কদম্ব বংশীয় এক নরপতি।
দ্বিতীয় প্রবরসেন (আ. ৪০০-১৫ খ্রিস্টাব্দ) : বিন্ধ্যসেন বা পৃথিবীষেণের পুত্র দ্বিতীয় প্রবরসেন বৎসগুল্ম রাজ্যের পরবর্তী নৃপতি। তিনি অল্প বয়সে দেহত্যাগ করেন। (পৃথিবীষেণই যদি দ্বিতীয় প্রবরসেনের পিতা হন তাহলে আ. ৩৯০-৪০০ খ্রিস্টাব্দই হবে তাঁর রাজত্ব কাল। সেক্ষেত্রে স্বীকার করতে হবে, আনুমানিক ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তির রাজত্বের অবসান হয়।) তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আট বৎসর বয়স্ক এক বালক মাত্র।
দ্বিতীয় সর্বসেন (আ. ৪১৫-৪৫০ খ্রিস্টাব্দ) : দুর্ভাগ্যের বিষয়, দ্বিতীয় প্রবরসেনের এই পুত্র ও উত্তরাধিকারীর নাম অজন্তা লেখের যে অংশে উল্লিখিত ছিল, সে অংশের অক্ষরগুলির চিহ্নমাত্র নেই। ফলে অজন্তা লেখে উল্লিখিত এই বাকাটক রাজার নামটি আজ আর পড়া যায় না। কিন্তু তিনি যে সর্বসেন তা নিঃসন্দেহ। সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত দু’টি তাম্রশাসনে এই সর্বসেনের নাম উল্লিখিত আছে। তাম্রশাসন দু’টির একটি দেবসেনের বিদর তাম্রলেখ, অন্যটি দেবসেনপুত্র হরিষেণের থালনের তাম্রপট্ট। লেখ দু’টিতে সর্বসেনকে দেবসেনের পিতা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সর্বসেন অবশ্যই দ্বিতীয় সর্বসেন। বৎসগুল্ম শাখার প্রতিষ্ঠাতাই তো প্রথম সর্বসেন। দ্বিতীয় সর্বসেন আনুমানিক ৪১৫ থেকে ৪৫০ খ্রিস্টাব্দ কাল পর্যন্ত রাজপদে সমাসীন ছিলেন বলে অনুমিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবসেন বৎসগুল্মের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
দেবসেন (আ. ৪৫০-৭৫ খ্রিস্টাব্দ) : মহারাজ দেবসেনের একখানি তাম্রশাসন দক্ষিণ •বিদর্ভের কোনও এক স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। শাসনখানি বৎসগুল্ম থেকে প্রদত্ত হয়েছিল। শাসনকার্যে দেবসেন অনাগ্রহী ছিলেন। রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বিশ্বস্ত ও বিচক্ষণ মন্ত্রী হস্তিভোজ। দেবসেনের একখানি তাম্রশাসন কর্ণাটকের বিদরে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রমাণিত হয়, কর্ণাটকের কিয়দংশ এ সময় বাকাটক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
শেষ প্রধান রাজা হরিষেণ (আ. ৪৭৫-৫০০ খ্রিস্টাব্দ)
হরিষেণ (আ. ৪৭৫-৫০০ খ্রিস্টাব্দ) : দেবসেন লোকান্তরিত হলে তাঁর পুত্র হরিষেণ বৎস গুল্মের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। অশেষ পরাক্রমশালী নরপতি ছিলেন হরিষেণ। বরাহদেবের অজন্তা লেখে দাবি করা হয়েছে, হরিষেণ কুন্তল, অবন্তি (পশ্চিম মালব), কলিঙ্গ (শ্রীকাকুলম বিশাখাপত্তনম অঞ্চল), কোসল (রায়পুর-বিলাসপুর-সম্বলপুর অঞ্চল), ত্রিকূট (উত্তর কোঙ্কণ), লাট (নবসারী-ব্রোচ অঞ্চল) এবং অন্ধ্র (গোদাবরী ও কৃষ্ণা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল) জয় করেন বা উক্ত অঞ্চলসমূহে স্বীয় প্রভাব বিস্তার করেন। সন্দেহ নেই, হরিষেণের রাজত্বের শেষপর্বে এই লেখটি উৎকীর্ণ হয়েছে। অজন্তা অভিলেখের সাক্ষ্য সত্য হলে স্বীকার করতে হবে, হরিষেণের শাসনকালের শেষপর্বে মুখ্য বাকাটক শাখার রাজত্বের অবসান ঘটেছে। মুখ্য বাকাটক শাখাভুক্ত পৃথিবীষেণের রাজ্যটি অধিকার না করে হরিষেণের পক্ষে মালবে প্রভুত্ব বিস্তার করা সম্ভবপর ছিল না। সম্ভবত পৃথিবীষেণের মৃত্যুর পরই তাঁর রাজ্য হরিষেণের হস্তগত হয়। এমনও হতে পারে, পৃথিবীষেণকে পদচ্যুত করেই হরিষেণ তাঁর রাজ্য অধিগ্রহণ করেন। তবে সেরূপ সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তাঁর প্রভাবাধীন সমগ্র অঞ্চলে যে হরিষেণ প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ করেছিলেন, এমনটি মনে হয় না। কলিঙ্গে এ সময় একটি নতুন রাজবংশের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। বংশটির নাম কলিঙ্গনগরের গঙ্গ রাজবংশ। অন্ধ্রে সে সময় বিষ্ণুকুণ্ডী নামে এক নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই বংশের প্রথম দু’জন রাজা হলেন বিক্রমহেন্দ্র বা প্রথম বিক্রমেন্দ্রবর্মা এবং তাঁর পুত্র মহারাজ গোবিন্দবর্মা বিক্রমাশ্রয়। কোসলে তখন শরভপুরীয় রাজাদের রাজত্ব। অজন্তা লেখ ইঙ্গিত করছে, এসব রাজারা প্রথমদিকে হরিষেণের অনুগত ছিলেন। মহামহোপাধ্যায় বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি অভিমত প্রকাশ করেছেন, মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চল হরিষেণের রাজ্যভুক্ত ছিল। তাঁর অভিমত, যে অজ্ঞাতনামা রাজা অজন্তার সপ্তদশ গুহালেখ উৎকীর্ণ করেছেন তিনি ঋষিক অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন। এই লেখে হরিষেণ পৃথিবীপালরূপে বন্দিত হয়েছেন ঋষিকরাজ নিঃসন্দেহে হরিষেণের অনুগত ছিলেন। মহামহোপাধ্যায় মিরাশি মনে করেন, মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চল প্রাচীনকালে ঋষিক নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু খান্দেশ যে হরিষেণের অধিকারভুক্ত ছিল তা বোধহয় সুনিশ্চিত নয়। অজন্তার সপ্তদশ গুহালেখ যিনি উৎকীর্ণ করেন সেই অজ্ঞাতনামা রাজা ঋষিকের অধিপতি ছিলেন, লেখটিতে এ ধরনের কোনও তথ্য নেই। দণ্ডীর দশকুমারচরিতে অবশ্য বিদর্ভের এক করদরাজ্য রূপে ঋষিকের উল্লেখ আছে। দণ্ডীর বিদর্ভ হরিষেণের সমকালীন বিদর্ভ, প্রাচীন ঋষিক আধুনিক খান্দেশ আর অজন্তা লেখের অজ্ঞাতনামা রাজা ঋষিকের অধিপতি, এসব ভাবনা অবশ্যই কল্পনালালিত। মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চ হয়তো তাঁর শাসনভুক্ত ছিল কিন্তু হরিষেণের রাজনৈতি কর্তৃত্বের পরিমণ্ডল ছিল সুদূর বিস্তৃত। অপেক্ষাকৃত এক ক্ষুদ্র অঞ্চলেই কিন্তু তাঁর প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ ছিল। অনুমিত হয়, মহারাষ্ট্রের বৃহদংশ এবং মধ্যপ্রদেশ ও কর্ণাটকের কিয়দংশ তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনভুক্ত ছিল। হরিষেণের সচিব ছিলেন বরাহদের। তিনি সম্ভবত হস্তিভোজের পুত্র ছিলেন। অজন্তার ষোড়শ গুহালেখ এবং গুলবাড়ার ঘটোৎকচ গুহালেখ তিনিই উৎকীর্ণ করেন। বৎসগুল্ম শাখার ইতিহাসের উপর প্রভূত আলোকপাত করছে এই লেখ দু’খানি।
হরিষেণোত্তর পর্ব ও বাকাটকদের পতন
হরিষেণোত্তর পর্ব (আ. ৫০০-৫০ খ্রিস্টাব্দ) : হরিষেণের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র এবং সম্ভবত পৌত্ররা কয়েক বৎসর রাজত্ব করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁদের নাম এবং কীর্তিকলাপ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। পরাক্রমশালী বিষ্ণুকুণ্ডী নৃপতি প্রথম মাধববর্মা জনাশ্রয় (আ. ৫৩৫-৮৫ খ্রিস্টাব্দ) দাবি করেছেন, তিনি এক বাকাটক রাজকন্যার পাণিগ্রহণ করেন। হতে পারে, এই বাকাটক রাজকন্যা হরিষেণের পৌত্রী ছিলেন।
বাকাটকদের পতন : শাসকরূপে হরিষেণের উত্তরসূরিরা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। সুবিস্তীর্ণ রাজ্য রক্ষাকল্পে যে সাহস ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন ছিল, তাঁদের চরিত্রে তার একান্তই অভাব ছিল। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই বাকাটক রাজ্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ঐতিহ্যমণ্ডিত বাকাটক রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটল। পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্ব বাকাটক রাজ্যের পতনের অবশ্যই এক প্রধান কারণ। মূল শাখার সঙ্গে বৎসগুল্ম শাখার নিরন্তর সংঘর্ষে বাকাটক রাজশক্তি নিঃসন্দেহে দুর্বল হয়ে পড়ে। আভ্যন্তরীণ কলহে জীর্ণ বাকাটক রাজ্য বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ রচনায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। মাহিষ্মতীর কলচুরি রাজশক্তির অভ্যুত্থান বাকাটক রাজ্যের পতনের আর এক মুখ্য কারণ। কলচুরিরাজ কৃষ্ণরাজের নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। একদা এই অঞ্চল বাকাটক রাজগণের অধিকারভুক্ত ছিল। বোঝা যায়, কৃষ্ণরাজের আক্রমণে বাকাটক রাজ্য ধসে পড়ে। আনুমানিক ৫৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্বামিরাজ নামে এক আঞ্চলিক প্রশাসক নন্দিবর্ধন থেকে ভূদান-সম্পর্কিত একখানি তাম্রশাসন সম্প্রদান করেন। এই নন্দিবর্ধন একদিন বাকাটক রাজ্যের রাজধানী ছিল। স্বামিরাজ সম্ভবত কৃষ্ণরাজের অধীনস্থ এক পদস্থ রাজপুরুষ ছিলেন। কলিঙ্গে গঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশে বিষ্ণুকুণ্ডী, দক্ষিণ কোসলে পাণ্ডুবংশী বা সোমবংশী এবং কোঙ্কণ অঞ্চলে মৌর্য রাজবংশ স্বাধীন, সার্বভৌম রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করল। বস্তার-জয়পুর অঞ্চলেও নল রাজশক্তির পুনরভ্যুত্থান ঘটল। বাকাটক রাজ্যের পতন-প্রক্রিয়ায় এদের সকলেরই অল্পবিস্তর অবদান রয়েছে। সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী স্থায়ী বাকাটক রাজ্য অতীত স্মৃতিতে পর্যবসিত হল।
প্রশাসন-ব্যবস্থা
রাজা
বাকাটক রাজ্যটি ছিল রাজতান্ত্রিক। প্রশাসনের শীর্ষদেশে রাজার অবস্থান। আইনত তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তাঁকে পরম্পরা মেনে চলতে হত। এই পরম্পরা স্মৃতির অনুশাসনে বিধৃত। প্রজাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি তাঁদের ছিল সজাগ দৃষ্টি। লেখে প্রথম পৃথিবীষেণ ধর্মবিজয়ী, যুধিষ্ঠিরের ন্যায় সত্যনিষ্ঠ নৃপতিরূপে আখ্যাত হয়েছেন। দ্বিতীয় প্রবরসেন সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাঁর সুশাসনের ফলে রাজ্যে কৃতযুগের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। হরিষেণ সপ্তদশ গুহালেখে প্রজাসাধারণের হিতকারী রূপে পরিচিত হয়েছেন। অর্থাৎ, বাকাটক রাজারা স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন সুশাসক, প্রজাপালক। লেখমালায় বাকাটক রাজাদের এই ভাবমূর্তিই উপস্থাপিত হয়েছে। কালিদাস রঘুবংশ কাব্যে বিদর্ভকে ‘সৌরাজ্য-রম্য’ অর্থাৎ সুশাসন-সমৃদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন। হয়তো প্রজাকল্যাণকামী বাকাটক রাজগণের প্রতি মহাকবির এই প্রচ্ছন্ন স্তুতি। বাকাটক রাজারা প্রায় সকলেই মহারাজ বলে পরিচয় দিয়েছেন, গুপ্ত রাজাদের মতো পরম ভট্টারক, মহারাজাধিরাজ, পরমেশ্বর ইত্যাদি গালভরা অভিধা ধারণ করেননি। দেবত্বের দাবিদারও তাঁরা ছিলেন না। তাঁরা লেখমালায় বার বার অকপটে ব্যক্ত করে গেছেন, তাঁদের যা কিছু বৈভব, যা কিছু কৃতিত্ব, সবেরই মূলে রয়েছে ইষ্টদেবতার আশীর্বাদ। রাজপদ ছিল পুরুষানুক্রমিক। উত্তরাধিকারসূত্রে রাজপদ লাভ করেছেন (ক্রমপ্রাপ্তনৃপশ্রীঃ), বাকাটক রাজারা তাঁদের লেখে প্রায়ই এই দাবি করেছেন। রাজার মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজপদে অভিষিক্ত হতেন। প্রথম প্রবরসেন তাঁর রাজ্যটিকে পুত্রদের মধ্যে বিভক্ত করেন। কিন্তু এই বিভাজন রাজ্যের সার্বিক স্বার্থের পক্ষে শুভ হয়নি। ফলে পরবর্তী কালে এ ধরনের বিভাজন ব্যবস্থা আর কখনও কার্যকরী হয়নি।
রানি, যুবরাজ ও সচিব
রানি : বাকাটক লেখে মাত্র দু’জন রানির উল্লেখ আছে। এঁদের একজন প্রভাবতীগুপ্তা। অন্যজন নরেন্দ্রসেনের মহিষী অজ্ঝিতভট্টারিকা। অগ্রমহিষী প্রভাবতীগুপ্তা যুবরাজ দিবাকরসেনের প্রতিনিধি রূপে অন্যূন ত্রয়োদশ বৎসরকাল বাকাটক রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
যুবরাজ : যুবরাজেরা হয়তো শাসনকার্যে রাজাদের সহায়তা করতেন। এ বিষয়ে অবশ্য কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। যুবরাজ তথা রাজপুত্রদের সুশিক্ষার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া হত। কালিদাস সম্ভবত দ্বিতীয় প্রবরসেনের গৃহশিক্ষকের পদে নিযুক্ত ছিলেন।
সচিব : বাকাটক লেখমালায় সচিবের উল্লেখ আছে কিন্তু মন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদের উল্লেখ নেই। তবে অন্যান্য সমকালীন রাজ্যগুলিতে যেমন ছিল, বাকাটক রাজ্যে রাজার সহকারী ও পরামর্শদাতারূপে একদল মন্ত্রী অবশ্যই ছিলেন।
কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ শাসন
বাকাটক রাজ্যের অনেকটা অংশেই কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ ছিল। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজারা কখনও কখনও বাকাটকদের আনুগত্য স্বীকার করেছেন সত্য কিন্তু স্ব স্ব রাজ্যে তাঁরা কার্যত স্বাধীনই ছিলেন। সেসব অঞ্চলে বাকাটক রাজারা নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বড় একটা আগ্রহ প্রকাশ করেননি। কিন্তু মূল রাজ্যের এক বৃহদংশে নিজেদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বাকাটক রাজারা যে উদ্যম গ্রহণ করেন ঠিক তেমনটি দেখা গিয়েছিল মৌর্য রাজাদের শাসনকালে। বাকাটক লেখে সম্ভবত রাজা উপাধিধারী কোও ও নারায়ণ নামে দু’জন পদস্থ রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। পদ মর্যাদায় সামন্ত হলেও এই দুই ব্যক্তি সীমিত কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। নিজেদের প্রশাসনিক এলাকায় জমিদানের অধিকার তাঁদের ছিল না। সে কাজে তাঁদের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি গ্রহণ করতে হত। কিন্তু কোণ্ড ও নারায়ণ যে সামন্তরাজের পর্যায়ভুক্ত ছিলেন তা সন্দেহাতীত নয়। এমনও হতে পারে, তাঁরা দু’জনে রাজান্ত নাম ধারণ করেছিলেন। (কোণ্ডরাজ ও নারায়ণরাজ। অনন্ত সদাশিব অলতেকর (গোলাম ইয়াজদানি সম্পাদিত The Early History Of The Deccan, Parts I-VI (London, 1960), পৃষ্ঠা ১৯২) অভিমত প্রকাশ করেছেন কোণ্ডরাজ ও নারায়ণ রাজা ও মহারাজ অভিধা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নামটি কোওরাজ হলে তাঁর রাজা উপাধি গ্রহণের কোনও সম্ভাবনা থাকে না। নামটি কোণ্ড হলেই সে সম্ভাবনা বর্তমান থাকে। লেখে নারায়ণকে মহারাজ আখ্যা দেওয়া হয়নি, তাঁকে নারায়ণরাজ বলা হয়েছে। কোণ্ডরাজ ও নারায়ণরাজ ব্যক্তিনামও হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাঁদের রাজা উপাধি ধারণের কোনও প্রশ্ন ওঠে না।)
রাজ্যের মুখ্য বিভাগ
প্রশাসন-কার্যের সুবিধার জন্য বাকাটক রাজ্য কয়েকটি মুখ্য বিভাগে বিভক্ত ছিল। লেখমালায় এই প্রশাসনিক বিভাগকে কখনও ‘রাষ্ট্র’, কখনওবা ‘রাজ্য’ বলা হয়েছে। অঞ্চলভেদে নামের এই বিভিন্নতা। ‘রাষ্ট্র’ বা রাজ্যগুলির মধ্যে পাক্কণ-রাষ্ট্র, ভোজকট-রাজ্য, বারুছ-রাজ্য এবং আরশ্মি রাজ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
- এক একটি ‘রাষ্ট্র’ বা ‘রাজ্য’ কয়েকটি ‘আহার’ এবং ‘ভোগ’-এ বিভক্ত ছিল। লেখে সুপ্রতিষ্ঠ-আহার, বেগ্গাকার্পর-ভোগ, লোহনগর-ভোগ এবং হিরণ্যপুর-ভোগের উল্লেখ আছে। ‘আহার’ ও ‘ভোগ’ সমার্থক, না স্বতন্ত্র দু’টি উপবিভাগ তা স্পষ্ট নয়।
- দ্বিতীয় প্রবরসেনের বেলোরা তাম্রশাসনে অসি-ভুক্তি নামে একটি ভুক্তির উল্লেখ আছে। কিন্তু এই ‘ভুক্তি’ রাষ্ট্র বা রাজ্যের সমার্থক নয়, ক্ষুদ্রায়তনের এক প্রশাসনিক বিভাগ মাত্র।
- বাকাটক রাজ্যের আর এক প্রশাসনিক বিভাগ মার্গ। দ্বিতীয় প্রবরসেনের বেলোরা তাম্রশাসনে একটি গ্রাম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে গ্রামটি শৈলপুরমার্গস্থিত অসিভুক্তির অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে বাকাটকরাজের পট্টন তাম্রলেখে বরদাখেট নামে একটি মার্গ লৌহনগরভোগের অঙ্গরূপে বর্ণিত হয়েছে। প্রমাণিত হয়, মার্গ ভুক্তির তুলনায় বৃহৎ কিন্তু ভোগ হতে অধস্তন এক প্রশাসনিক বিভাগ।
- বাকাটক রাজ্যের এক প্রশাসনিক বিভাগ পট্ট এরূপ এক অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাকাটক লেখে এ ধরনের কোনও প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ নেই। দ্বিতীয় প্রবরসেনের মানঢল তাম্রশাসনে ময়সগ্রাম সম্পর্কে বলা হয়েছে গ্রামটি ‘বেগ্গাতটস্য অপরপট্টে’ অবস্থিত ছিল। আবার একই বাকাটক নৃপতির তিরোডী লেখে কোশম্বখণ্ড গ্রামকে ‘বেগ্গাকস্য অপরপট্টে বিদ্যমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এখানে যে প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ আছে সেটি বেগ্গাতট বা বেগ্গাকট, অপরপট্ট বা পট্ট নয়। অপরপট্ট-এর অর্থ পশ্চিম ভাগ বা পশ্চিমাঞ্চল। অর্থাৎ গ্রামটি বেগ্গাতট বা বেগ্গাকটের পশ্চিমাংশে অবস্থিত ছিল। পট্ট শব্দ কোনও স্থানবাচক বিশেষ্যপদের সঙ্গে প্রযুক্ত হলে তবেই প্রশাসনিক বিভাগ অর্থে গৃহীত হবে। বাকাটক লেখে সে অর্থে বা প্রসঙ্গে পট্টের প্রয়োগ নেই।
- সর্বনিম্ন প্রশাসনিক বিভাগ গ্রাম। কখনও কখনও বলা হয়, বাকাটক রাজ্যে স্থান নামে এক প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। বস্তুত, বাকাটক লেখে নিছক স্থান বলে কোনও শব্দ নেই, আছে ‘ধর্মস্থান’ বা ‘বৈজয়িক-ধর্মস্থান’-এর উল্লেখ। ধর্মীয় স্থান বা তীর্থস্থান, এ অর্থে ‘ধর্মস্থান’ বা ‘বৈজয়িক-ধৰ্মস্থান।’ বাকাটক রাজারা অনেক সময় ধর্মীয় স্থান বা তীর্থক্ষেত্র হতে তাম্রশাসন প্রদান করতেন।
রাজপুরুষগণের বিভিন্ন শ্রেণি
বিভিন্ন শ্রেণির রাজপুরুষের কথাও পাওয়া যায় –
- বাকাটক লেখে সর্বাধ্যক্ষ নামে এক শ্রেণির পদস্থ রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি মনে করেন, তিনি কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক অধিকরণের অধ্যক্ষ ছিলেন। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের মতে, তিনি ছিলেন বাকাটক রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী।
- আর এক শ্রেণির রাজকর্মচারী কুলপুত্র। রাজ্যের শান্তি-শৃঙ্খলার রক্ষণাবেক্ষণ ছিল তাঁদের কাজ।
- এ কাজে ভট এবং চাট সংজ্ঞক রাজপুরুষেরা তাঁদের সাহায্য করতেন। ভটের অর্থ সৈন্য। আমরা যাঁদের পুলিশ বলি, চাটরা ছিলেন তাই। রাজস্ব সংগ্রহ তাঁদের আর একটি কাজ ছিল। কুলপুত্র, চাট এবং ভটরা কখনও কখনও তাদের এলাকা পরিদর্শনে বের হতেন। পরিদর্শনকালে গ্রাম ও শহরবাসীদের তাঁদের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হত। অনুমান করা যায়, তাঁরা অনেক সময় প্রজাদের উৎপীড়ন করতেন। ব্রাহ্মণদের অনুকূলে প্রদত্ত অগ্রহার গ্রামে তাঁদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তবে গ্রহীতা ব্রাহ্মণ হত্যা, ব্যভিচার, রাজদ্রোহ ইত্যাদি অপরাধে জড়িত হলে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হত। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের অভিমত, কুলপুত্ররা পরিদর্শক শ্রেণির রাজপুরুষ; কেন্দ্রীয় অনুশাসন রাষ্ট্রের অধস্তন রাজপুরুষেরা যথাযথ পালন করছেন কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করা ছিল তাঁদের কাজ। এ অভিমত গ্রাহ্য হলে বুঝতে হবে, বাকাটক রাজারা সারা রাজ্যে তাঁদের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় ও নিরঙ্কুশ করতে সচেষ্ট ছিলেন।
- বাকাটক লেখমালায় রজুক, সেনাপতি ও দণ্ডনায়ক নামে আরও তিন শ্রেণির রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। সেনানায়ক অর্থে সেনাপতি। ভূমিদান প্রসঙ্গে বাকাটক লেখে সেনাপতির কথা বলা হয়েছে। মনে হচ্ছে, তাঁকে বেসামরিক দায়িত্বও বহন করতে হত। দ্বিতীয় প্রবরসেনের অষ্টাদশ রাজ্যবর্ষের সিওনি ও তাঁর রাজত্বের পঞ্চবিংশ বর্ষে উৎকীর্ণ বড়গাঁও তাম্রশাসনে সেনাপতি বাপ্পদেবের উল্লেখ আছে। আবার তাঁর ত্রয়োবিংশ রাজ্যবর্ষের দুদিয়া তাম্রশাসনে নমিদাস নামে এক সেনাপতির কথা বলা হয়েছে। এ থেকে মনে হতে পারে, সামরিক প্রয়োজনে বাকাটক রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সেনাপতি নিযুক্ত হতেন। কিন্তু এ ধারণার ভিত্তিতে সেনাপতিকে প্রাদেশিক শাসনকর্তারূপে চিহ্নিত করা সমীচীন হবে না। সেনাপতির মূল কাজ যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাদেশিক শাসকের আশু কর্মকাণ্ড প্রশাসনকে ঘিরে অবর্তিত হয়। তাছাড়া এমনও হতে পারে, প্রথম তাম্রশাসন দু’টিতে একই নামের দু’জন স্বতন্ত্র সেনাপতির কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এক এক অঞ্চলে এক একজন সেনাপতি, এ অভিমত ভিত্তিহীন হয়। বস্তুত বাকাটক পর্বে সেনাপতিরা প্রদেশপালের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এ ধারণা নিতান্তই আনুমানিক। সেনাপতি ও সর্বাধক্ষ এক ও অভিন্ন, বহুদিন পূর্বে অনন্ত সদাশিব অলতেকর এ মত ব্যক্ত করেছেন। এ ধারণা ও ভ্রমাত্মক। রাষ্ট্রাধিকৃত সংজ্ঞক রাজপুরুষেরাই সম্ভবত প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন।)
- রজ্জু বা দড়ি থেকে রজুক। নাম থেকে মনে হয়, রজুক রাজস্ব বিভাগের এক কর্মচারী ছিলেন এবং রাজস্ব নির্ধারণের জন্য জমি মাপ-জোখ করতেন।
- সামরিক বা বিচার বিভাগের পদস্থ রাজপুরুষ দণ্ডনায়ক। তিরোডী
- তাম্রশাসনে ‘রাজ্যাধিকৃত’ নামে এক রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। তিনি সম্ভবত রাজ্য বা রাষ্ট্রের শাসনকর্তা ছিলেন।
- অনন্ত সদাশিব অলতেকর ‘সন্তক’ নামে জেলাপ্রশাসক পর্যায়ের এক শ্রেণির রাজপুরুষদের কথা বলেছেন। কিন্তু বাকাটক লেখমালায় এ ধরনের কোনও রাজপুরুষের উল্লেখ নেই। কুলপুত্রদের বিশেষণরূপে ব্যবহৃত ‘সচরন্তক’ (সঞ্চরন্তঃ) পদটিকে ভুলক্রমে ‘সন্তক’ পাঠ করা হয়েছে।
- বাকাটক লেখে গ্রামবৃদ্ধদের উল্লেখ আছে। গ্রামিক বা গ্রামপ্রধান গ্রামমহত্তর, গ্রামকুটুম্বী ও গ্রামবাসীদের সহায়তায় গ্রামের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। গ্রামিক বা গ্রামমহত্তরাদির কী ক্ষমতা ছিল, তাঁদের উপর জেলার বা ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কতখানি নিয়ন্ত্রণ ছিল, সে সম্পর্কে বাকাটক লেখে কোনও তথ্য পরিবেশিত হয়নি। কিন্তু একটি বিষয় সুনিশ্চিত, সমকালীন গুপ্তলেখে বিষয়, বীথী ও গ্রাম প্রশাসনে বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের যে ভূমিকার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে বাকাটক তাম্রশাসনে বা প্রস্তরলেখে তার কোনও আভাস নেই। তবে এ কথাও স্বীকার্য, বাকাটক লেখে প্রশাসনিক তথ্য বড়ই অপ্রতুল।
সমাজ-জীবন
অসবর্ণ বিবাহের চল : বাকাটক পর্বে বর্ণব্যবস্থা যে কঠোরতার সঙ্গে পালিত হত, তা বোধ হয় না। শাস্ত্রে ব্রাহ্মণের রাজপদ গ্রহণ নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাকাটকরা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েও রাজদণ্ড ধারণ করেছেন। বিবাহের ক্ষেত্রেও তাঁরা বর্ণধর্ম পালন করেননি। এ বিষয়ে হয়তো তাঁদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল।
- বাকাটক রাজা দ্বিতীয় রুদ্রসেন গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতীগুপ্তার পাণিগ্রহণ করেন। গুপ্ত রাজারা সম্ভবত জাতিতে বৈশ্য ছিলেন। সমকালীন যুগে অসবর্ণ বিবাহের উল্লেখ আছে হরিষেণের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ ঘটোৎকচ গুহালেখে।
- মন্ত্রী হস্তিভোজের এক পূর্বপুরুষ সোম। বল্লুরনিবাসী এই বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরিবারে বিবাহ করেন। তাঁর ব্রাহ্মণবংশীয় পত্নীদের গর্ভজাত সন্তানেরা অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু তাঁর ত্রিয় স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্ররা সামরিক বৃত্তি জীবিকারূপে গ্রহণ করেন।
বিদ্যাচর্চা : সে সময় ব্রাহ্মণদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। লেখে দু’টি বেদ (দ্বিবেদ) ও চতুর্বেদে বিশেষজ্ঞ (চাতুর্বৈদ্য) ব্রাহ্মণদের উল্লেখ আছে। আজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন, সমাজে এমন ব্রাহ্মণও ছিলেন। ব্রাহ্মণদের নামের শেষে সাধারণত শৰ্মা, আর্য, আচার্য বা স্বামী কথাটি থাকত। যজন, যাজন ও অধ্যাপনা ব্রাহ্মণদের প্রধান বৃত্তি ছিল। রাজকার্যেও তাঁরা অংশ গ্রহণ করতেন। বিদগ্ধ ব্রাহ্মণদের গৃহকে কেন্দ্র করেই এক একটি শিক্ষায়তন গড়ে উঠত। অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত ব্রাহ্মণেরা সাধারণত শহর ও তীর্থক্ষেত্রে বাস করতেন। উচ্চশিক্ষার্থী ছাত্ররা এসব স্থানেই ভিড় করতেন। কিছু কিছু ব্রাহ্মণ অবশ্য অগ্রহার গ্রামেই বাস করতেন। এ পর্বে নাসিক, প্রবরপুর, বৎসগুল্ম ও পৈঠান শিক্ষাকেন্দ্ররূপে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। অগ্রহার গ্রামগুলিও বিদ্যা-চর্চার কেন্দ্র ছিল।
নারী : সাধারণত ঋতুমতী হওয়ার পূর্বেই মেয়েদের বিবাহ হত। অন্তত ব্রাহ্মণ পরিবারে এটিই ছিল রীতি। অল্প বয়সে বিবাহ হওয়ায় মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। অজন্তার সমকালীন গুহাচিত্র থেকে মনে হয়, পরিবারে তথা সমাজে মহিলারা সম্মানের পাত্রী ছিলেন। সতীপ্রথা ছিল কিন্তু তা ব্যাপক ছিল না।
পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার : পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে ছিল অন্তরাবাসক বা অন্তরীয়ক (নিম্নাঙ্গের পরিধেয় বস্ত্র), উত্তরাসঙ্গ বা সঙ্কক্ষিকা বা উত্তরীয় এবং সংঘাটী বা ঢিলা আলখাল্লা। সম্পন্ন ঘরের মহিলারা সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করতেন। বস্তুগুলি এত সূক্ষ্ম ছিল যে একটু হাওয়াতেই তা উড়ে যেত (নিঃশ্বাস-হাৰ্য্য)। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই অলংকারের প্রতি আকর্ষণ ছিল। কুণ্ডল, অঙ্গদ, কনক বলয়, কণ্ঠহার, ললাটিকা, মণিমেখলা ইত্যাদি অলংকার নর-নারীর ভূষণরূপে অজন্তার চিত্রাবলিতে রূপায়িত হয়েছে।
অর্থনৈতিক ইতিহাস
ধান চাষ : বাকাটক লেখমালায় সমকালীন অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে অতি স্বল্প তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। সে সময়ের কৃষি ও কারিগরি শিল্প সম্পর্কে লেখমালা প্রায় নীরবই বলা চলে। বাকাটক রাজ্যের অচলপুর অঞ্চলে শালি ধান উৎপাদনের পরোক্ষ উল্লেখ আছে দ্বিতীয় প্রবরসেনের পৌনী তাম্রশাসনে। লেখে কতিপয় ব্রাহ্মণের অনুকূলে কৃষ্ণালেশালি কটক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত অচলপুর গ্রামের কিছু জমি দানের কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রশাসনিক বিভাগের নাম কৃষ্ণালেশালি-কটক। অনুমিত হয়, এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে শালি ধান উৎপন্ন হত বলে প্রশাসনিক বিভাগটির এরূপ নামকরণ হয়েছে। অনেকের মতে অমরাবতী জেলার বর্তমান এলিচপুর পৌনী তাম্রশাসনের অচলপুর। মনে রাখতে হবে, লেখটি আবিষ্কৃত হয়েছে মহারাষ্ট্রের ‘শস্যভাণ্ডার’ ভণ্ডারা জেলায়। লেখের অচলপুর সম্ভবত বর্তমান পৌনীরই সন্নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে অবস্থিত ছিল। বাকাটক লেখে গর্তসভা নামে এক প্রকার জমির উল্লেখ আছে। গর্তসভা বলতে নিচু জমি বোঝায়।
ভূমি ক্রয়-বিক্রয় : বাকাটক লেখে ভূমি ক্রয়-বিক্রয়ের উল্লেখ নেই, এরূপ একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু এ এক ভ্রান্ত ধারণা।
- দ্বিতীয় প্রবরসেনের ইনদউর তাম্রশাসনে চন্দ্র নামে জনৈক বণিকের (বাণিজক) উল্লেখ আছে। তিনি একটি গ্রামের অর্ধাংশ ক্রয় করে (ক্রয়ক্রীতং) তা কতিপয় ব্রাহ্মণের অনুকূলে প্রদান করেন।
- দ্বিতীয় প্রবরসেনের রামটেক লেখেও সম্ভবত জমি ক্রয়-বিক্রয়ের (ক্রয়োদ্ভবং) উল্লেখ আছে।
অগ্রহার-ব্যবস্থা : সমকালীন লেখে ব্রাহ্মণদের অনুকূলে বাকাটক রাজাদের নিষ্কর গ্রাম বা জমি দানের প্রচুর আছে। বেদবিদ ব্রাহ্মণ তিন গ্রাম গ্রহণ করেছেন এমন ব্রাহ্মণের যেমন উল্লেখ আছে তেমনি ৮ নিবর্তন পরিমাণ জমি দানসূত্রে লাভ করেছেন এমন ব্রাহ্মণদের সংখ্যাও বড় কম নয়। তবে কয়েকটি কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়।
- এক. গুপ্ত শাসন কালে উত্তর বাংলায় ব্রাহ্মণদের যে আয়তনের জমি দান করা হত বাকাটক রাজ্যে ব্রাহ্মণেরা তার তুলনায় বেশি পরিমাণ জমি লাভ করতেন। বিশেষ এক ব্রাহ্মণের অনুকূলে পুরো একটি গ্রাম দান করা হচ্ছে গুপ্তকালীন উত্তর বাংলায় এ দৃশ্য ছিল অভাবনীয় অথচ বাকাটক রাজ্যে এরূপ ঘটনা প্রায়শই ঘটত।
- দুই. উত্তর বঙ্গে জমি দানের পিছনে ধর্মের বিশেষ এক ভূমিকা ছিল কিন্তু বাকাটক রাজ্যে অগ্রহার ব্যবস্থাপনায় ধর্মের সেরূপ কোনও ভূমিকা ছিল বলে মনে হয় না।
- তিন. উত্তর বাংলায় যে জমি দান করা হত তা ছিল মূলত অনাবাদি, পতিত, কিন্তু বাকাটক রাজ্যে যে গ্রাম দান করা হত সেখানে ব্রাহ্মণ ও কুটুম্বীদের বাস ছিল, যে ভূখণ্ড দান করা হত তা ছিল চাষের জমি।
তবে কি বুঝতে হবে মূলত শিক্ষা ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রসারকল্পেই বাকাটক রাজ্যে অগ্রহার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে? এ কাজে সফল হতে হলে অধ্যাপক-ব্রাহ্মণকে শিক্ষার্থীদের ভরণ পোষণের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। যথোচিত পরিমাণ সম্পদের অধিকারী না হলে ব্রাহ্মণের পক্ষে এ কাজে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। হয়ত সে কারণেই বাকাটক রাজ্যে ব্রাহ্মণকে উর্বর বা অধিক পরিমাণ জমি দান করা হত। কখনও কখনও প্রদত্ত খেতে খামারবাড়ি (অভ্যন্তর-নিবেশন) ও চাষিদের ঘরবাড়িও (কর্ষক-নিবেশন) থাকত। জমি হস্তান্তরকালে খামারবাড়ি ও চাষিদের আবাসও হস্তান্তরিত হত। (Ajay Mitra Shastri (Ed.) : The Age Of The Vakārakas (New Delhi, 1992), পৃষ্ঠা ১০১-০৯।) দান গ্রহণের ফলে ব্রাহ্মণ যে গ্রাম বা জমির অধিকারী হলেন তা হত নিষ্কর, লেখের ভাষায় ‘অকরদায়ী’। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-গ্রহীতাকে কোনও রাজস্ব দিতে হত না। কিন্তু এতদিন গ্রামের যে রাজস্ব রাজা বা রাষ্ট্রের ভোগ্য ছিল এখন হতে তিনিই হলেন সে রাজস্বের অধিকারী। বাকাটক লেখে বারবার বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণকে প্রদেয় গ্রাম বা জমিতে চাট ও ভট নামের দু’শ্রেণির রাজপুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ (ভটচ্ছাত্রপ্রাবেশ্যঃ, অচাটভটপ্রবেশ্যঃ)। মহারাজ ভরতবলের বমহনী তাম্রশাসনে অচাটভটপ্রবেশ্যঃ কথা প্রসঙ্গে ‘চোরদণ্ডবজম্’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হয়, চাট ও ভটদের সাধারণত অগ্রহার গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও চোরের অনুসন্ধান বা চোরকে শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে তাঁদের অগ্রহার গ্রামে প্রবেশে কোনও বাধা ছিল না। চাট ও ভট বলতে সম্ভবত পুলিশ ও সৈন্যদের কথা বলা হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সরকার চাট ও ভটদের যথাক্রমে পাইক ও বরকন্দাজরূপে শনাক্ত করেছেন।
ব্রাহ্মণকে দেয়া ভূ-সম্পদ নিঃশর্ত ছিল না : বাকাটক রাজ্যে ব্রাহ্মণকে যে ভূ-সম্পদ দান করা হত তা নিঃশর্ত ছিল না। দ্বিতীয় প্রবরসেনের চন্মক তাম্রশাসনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, প্রদত্ত জমিতে নিজের অধিকার বলবৎ রাখতে হলে গ্রহীতাকে কয়েকটি আচরণ-বিধি অবশ্যই পালন করতে হবে। তাঁকে ব্রহ্মহত্যা, চৌর্য, ব্যভিচার ও রাজদ্রোহিতা হতে বিরত হতে হবে, যুদ্ধ বর্জন করতে হবে, অন্য গ্রামের ক্ষতি হতে পারে এরূপ কর্ম পরিহার করতে হবে। এসব নির্দেশ অমান্য করলে ব্রাহ্মণ গ্রহীতা জমিচ্যুত হতে পারেন। এরূপ ব্রাহ্মণকে ভূমিচ্যুত করলে নরপতি চৌর্যের অপবাদে কলঙ্কিত হবেন না (অতোঽন্যথা কুর্বতামনুমোদতাং বা রাজ্ঞঃ ভূমিচ্ছেদং কুর্বতঃ অস্তেয়মিতি)।
রাজস্ব : বাকাটক লেখে ‘ভাগকর’, ‘ভোগকর’, ‘উদ্ভঙ্গ’ বা ‘উপরিকর’ নামে কোনও রাজস্বের উল্লেখ নেই। আছে ‘ক্লিপ্ত’ ও ‘উপক্লিপ্ত’-এর উল্লেখ। এগুলোতেও ব্রাহ্মণ-গ্রহীতার মত গ্রহীতার রাজস্ব ভোগের অধিকারই সুপ্রমাণিত হচ্ছে।
- ক্লিপ্ত সম্ভবত ভাগের সমার্থক। তাহলে উৎপন্ন শস্যের যে ষষ্ঠাংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য, তা এই ক্লিপ্ত। এ রাজস্ব সম্ভবত শস্যে দিতে হত।
- মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, মাংস, মধু, ঘি, ওষধি, গন্ধদ্রব্য, বৃক্ষ, ফল, মূল, রসদ্রব্য, পুষ্প, তৃণ, পত্র, শাক, মৃন্ময়পাত্র, বংশপাত্র, চর্মপাত্র এবং প্রস্তর নির্মিত দ্রব্যাদির লাভের ষষ্ঠাংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য। এসব দ্রব্যাদিতে রাজপ্রাপ্য অংশই সম্ভবত উপক্লিপ্ত।
- হিরণ্য বর্তমান প্রসঙ্গে সোনা নয়, কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পণ্যের উপর নগদে প্রদেয় রাজস্বই হিরণ্য। প্রদত্ত গ্রামে ধনরত্নের (সনিধিঃ সোপনিধিঃ) সন্ধান পাওয়া গেলে গ্রহীতাই হতেন সে সম্পদের মালিক।
আয়ের আরও উৎস : তাছাড়া রাজা বা রাষ্ট্রের আয়ের আরও উৎস ছিল।
- বাকাটক লেখে দেখা যায়, গ্রহীতাকে প্রায়শই লবণের খনি, মৃত্তিকাগর্ভে নিহিত রত্ন ও খনিজ দ্রব্য এবং গ্রামের চারণভূমির উপর ভোগাধিকার দেওয়া হয়েছে। অনুমিত হয়, লবণখনি, গুপ্ত ধনরত্নাদি এবং রাজ্যের জলা বা ঊষর জমির উপর রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল। সম্ভবত বনাঞ্চলও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীন ছিল। বা
- স্তু ও কৃষির খেতে ভূস্বামীদের ব্যক্তিগত মালিকানা বলবৎ ছিল। রাজস্ব বাকি পড়লে বা ভূস্বামীর কোনও উপযুক্ত উত্তরাধিকারী না থাকলে সে জমি রাষ্ট্রায়ত্ত হত।
- রাজাদের নিজস্ব খাস জমি ছিল।
বেগার শ্রম : রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রজাদের বেগার শ্রমের জোগান দিতে হত। তখনকার দিনে রাজা বা রাষ্ট্রকে বেগার শ্রম (সর্ববিষ্টি) জোগানের যে রীতি ছিল তার দায়িত্ব হতে গ্রহীতাকে রেহাই দেওয়া হত, রাজা বা রাজপুরুষদের ব্যবহারের জন্য তাঁকে গরু ও বলদের সংস্থান করতে হত না, আপৎকালীন করের (প্রণয়) বোঝাও তাঁকে বহন করতে হত না। সর্বপ্রকার পরিহারমুক্ত (সর্ব-পরিহার-পরিহৃতঃ) ছিল সে গ্রাম।
ভূমি পরিমাণের একক ছিল নিবর্তন : বাকাটক রাজ্যে ভূমি পরিমাণের একক ছিল নিবর্তন। ১ নিবর্তন বলতে কি পরিমাণ জমি বোঝায় সে সম্পর্কে বিদ্বজ্জনেরা সুনিশ্চিত নন। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের মতে ১ নিবর্তন ৫ একরের সমতুল্য। অধ্যাপক মহালিঙ্গমের অভিমতে ১ নিবর্তন ২০০ বর্গহস্তের সমার্থক। এক বিশেষ পদ্ধতিতে জমি পরিমাপ করা হত। বাকাটক লেখে এ পদ্ধতিকে রাজমান, রাজন্যমান বা রাজকীয় মান আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
জল-প্রকল্প : সরকারি উদ্যোগে এ পর্বে কয়েকটি জল-প্রকল্প রূপায়িত হয়।
- দেবসেনের হিস্সে বোরালা প্রস্তরলেখে এরূপ একটি বৃহৎ জল-প্রকল্পের উল্লেখ আছে। ৩৮০ শকাব্দে বা ৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে দেবসেনের অধীনস্থ পদস্থ আধিকারিক (আজ্ঞাকর) স্বামিল্লদেব মহারাষ্ট্রের অকোলা জেলায় একটি হ্রদ নির্মাণ করেন। বপ্প নামে জনৈক কর্মোপদেষ্টা হ্রদের নির্মাণ কার্য পরিচালনা করেন। গুজরাতের ইতিহাস প্রসিদ্ধ সুদর্শন হ্রদের নামানুসারে জলাধারটির নামকরণ হয়।
- দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের মাহুরঝরী তাম্রশাসন পৃথিবীসমুদ্র নামে একটি স্থান হতে প্রদত্ত হয়। অনুমিত হয়, বাকাটকরাজ এ স্থানে স্বনামে এক বৃহৎ জলাশয় (সমুদ্র) খনন করান এবং জলাধারের মতো স্থানটিও পৃথিবীসমুদ্র নামে পরিচিত হয়। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে জলাধার দু’টি নির্মিত হয়েছিল? স্থানীয় অঞ্চলে পানীয় জলের সংস্থান, না খেতে চাষ-আবাদের কাজে জলের জোগান? এমনও হতে পারে দু’টি লক্ষ্য সাধনের উদ্দেশ্যেই জলাধার দু’টি খনন করা হয়। সে ক্ষেত্রে জলাধার দু’টির নির্মাণে সেচব্যবস্থা তথা কৃষির সম্প্রসারণে বাকাটক সরকারের গভীর আগ্রহই প্রতি ফলিত হয়েছে বলা যায়।
শুল্কবট : দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের মানঢল তাম্রশাসনে একটি অগ্রহার গ্রামের সীমানা চিহ্নিতকরণ প্রসঙ্গে শুল্কবটের উল্লেখ আছে। শুল্ক-চৌকির নিকটবর্তী হওয়ায় সম্ভবত বটবৃক্ষের এরূপ নামকরণ হয়েছে। অর্থাৎ মানঢল তাম্রশাসনে শুল্ক চৌকির ইঙ্গিত আছে।
কৃষির সম্প্রসারণ এবং বাণিজ্য ও নগরায়নের অবনতি : বাকাটক রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কৃষ্ণমোহন শ্রীমালী কিছু বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেন, এ সময় কৃষির সম্প্রসারণ হচ্ছে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ গড়ে উঠছে কিন্তু অবনতি ঘটছে শিল্পের ও বাণিজ্যের, রুদ্ধ হয়েছে নগরায়ণের গতি। সমকালীন লেখে ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখ নেই বললেই চলে ; রাজারাও মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি, বড় ধরনের সৌধও নির্মিত হয়নি এ যুগে; এ অঞ্চলে যা কিছু হয়েছে তা হয়েছে প্রাক্-বাকাটক পর্বে। বাকাটক পর্বে কৃষির সম্প্রসারণ সম্বন্ধে কৃষ্ণমোহন শ্রীমালীর বক্তব্য নিয়ে কোনও সংশয় নেই কিন্তু সংশয় আছে শিল্পের ও বাণিজ্যের তথাকথিত অবক্ষয় সম্পর্কিত তাঁর মন্তব্য সম্পর্কে। ভুললে চলবে না, কৃষির সম্প্রসারণ বাণিজ্যের পরিধি প্রসারিত করে, শিল্পোদ্যোগের পথ সুগম করে। বাণিজ্য শুধু শিল্পনির্ভর নয়, বাণিজ্যে কৃষিরও বিরাট ভূমিকা আছে। সমকালীন লেখে কাংস কারগ্রাম, সুবর্ণকারগ্রাম, কর্মকারগ্রাম, চর্মাঙ্কগ্রাম (চর্মকারগ্রাম), শঙ্খিকাগ্রাম, লবণ-তৈলকগ্রাম ও লোহনগরের যেমন উল্লেখ আছে তেমনি আছে পুর ও নগর নামান্ত বহু স্থানের কথা যা নগরায়ণের ইঙ্গিত দেয়। বাকাটক লেখে শুল্ক-চৌকিরও প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। বাকাটক রাজ্যে মুদ্রার প্রচলন ছিল না বা রাজারা কোনও মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি, এ ধরনের বক্তব্য সত্যবর্জিত। স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে এ পর্বে যে ব্যাপক সৃষ্টিধর্মী কর্মযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছে তা অবিস্মরণীয়। লেখে ও কালিদাসের রচনায় যে সমকালীন বিদর্ভের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সে বিদর্ভ ঐশ্বর্যময়, রম্য, ঋদ্ধ।
বাণিজ্য : বাণিজ্য যে লাভজনক বৃত্তি ছিল তার ইঙ্গিত আছে ইনদউর তাম্রশাসনে বর্ণিত বণিকচন্দ্রের দৃষ্টান্তে। গ্রামের অর্ধাংশ ক্রয় করে তা কতিপয় ব্রাহ্মণের অনুকূলে প্রদান করেন। বাণিজ্য যে লাভজনক বৃত্তি ছিল, এই দৃষ্টান্তে তার ইঙ্গিত আছে।
কারিগর, ভাস্কর ও চিত্রকর : অজন্তার ষোড়শ, সপ্তদশ ও ঊনবিংশ গুহা তিনটি এ পর্বে উৎকীর্ণ হয়। গুহাগুলি অপরূপ ভাস্কর্যমণ্ডিত এবং দৃষ্টিনন্দন চিত্রাবলিতে শোভিত। বাকাটক রাজ্যের কারিগর, ভাস্কর ও চিত্রকরেরা তাঁদের কালজয়ী শিল্প কর্মে অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। লেখে সুবর্ণকারদের উল্লেখ আছে। মূলত স্বর্ণ অলংকার নির্মাণ তাঁদের পেশা হলেও তাঁরা তাম্রপট্টও উৎকীর্ণ করতেন। হরিষেণের থালনের তাম্রশাসনে কাংসকার গ্রামের উল্লেখ আছে।
মুদ্রা : কতিপয় বাকাটক নৃপতি কিছু তাম্রমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। এঁদের একজন পৃথিবীষেণ। কিন্তু এই পৃথিবীষেণ প্রথম রুদ্রসেনের পুত্র প্রথম পৃথিবীষেণ না নরেন্দ্রসেনের পুত্র দ্বিতীয় পৃথিবীষেণ তা স্পষ্ট নয়। নরেন্দ্রসেনের নামাঙ্কিত তাম্রমুদ্রাও আবিষ্কৃত হয়েছে। তাছাড়া বাকাটক বা বাকাটক-অনুরূপ কিছু সংখ্যক তাম্রমুদ্রারও সন্ধান পাওয়া গেছে। ছোট-খাটো বেচা-কেনার কাজে নিম্নমানের এই তাম্রমুদ্রাগুলি ব্যবহৃত হত। অনুমিত হয়, বাকাটক রাজ্যে পশ্চিমা ক্ষত্রপ, ত্রৈকূটক, গুপ্ত এবং পুরোনো কার্যাপণ মুদ্রাও প্রচলিত ছিল। অনুমান করা যায়, বিভিন্ন শ্রেণির মুদ্রার আপেক্ষিক মূল্য নির্দিষ্ট ছিল। জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয় কার্যে কড়িও ব্যবহৃত হত। হয়তোবা দ্রব্য-বিনিময় ব্যবস্থারও চলন ছিল।
ধর্মীয় জীবন ও সাহিত্য
ধর্মীয় জীবন
যাগযজ্ঞ : বাকাটক রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। প্রথম প্রবরসেন অগ্নিষ্টোম, আপ্তোর্যাম, জ্যোতিষ্টোম, বৃহস্পতিসব, সাদ্যসন্ত্র, উথ্য, ষোড়শী, অতিরাত্র, বাজপেয়, অশ্বমেধ ইত্যাদি বহু বৈদিক যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। অন্য কোনও বাকাটক রাজা বৈদিক যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন বলে শোনা যায় না। হয়তো যাগ-যজ্ঞ অপেক্ষা মূর্তি প্রতিষ্ঠা, মন্দির নির্মাণ, তীর্থভ্রমণের মতো কার্যকলাপের প্রতি মানুষের দৃষ্টি অধিকতর আকৃষ্ট হয়।
শৈবধর্ম : বেশির ভাগ বাকাটক রাজাই ছিলেন পরমমাহেশ্বর অর্থাৎ ধর্মমতে শৈব। তাঁরা কয়েকটি শিবমন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন।
- প্রথম প্রবরসেন প্রবরেশ্বর নামে একটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন।
- তাঁর পৌত্র প্রথম রুদ্রসেনের উপাস্য দেবতা মহাভৈরব। ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যে তিনি একটি ধর্মস্থান বা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
বৈষ্ণবধর্ম : বিষ্ণুও রাজপরিবারে অনাদৃত ছিলেন না।
- মহিষী প্রভাবতীগুপ্তা বিষ্ণুর অনুরাগিণী ছিলেন। রাজধানীর অনতিদূরে শ্রীরামচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত রামগিরি পাহাড়ে রামগিরিস্বামীর এক মন্দির ছিল। প্রভাবতীগুপ্তা প্রায়ই এই মন্দির পরিদর্শন করতেন এবং দান-ধ্যানাদি কার্যে অংশগ্রহণ করতেন। প্রভাবতীগুপ্তার স্বামী দ্বিতীয় রুদ্রসেনও চক্রপাণি বা বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন।
- বেতুল জেলার পট্টনে আর একটি বিষ্ণুমন্দির নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয় প্রবরসেন এই মন্দিরে একটি সত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ভক্তজনদের নিখরচায় অন্ন বিতরণ করা হত। সত্রের এ খরচ নির্বাহের জন্য রাজা ৪০০ নিবর্তন পরিমাণ জমি দান করেন। ওয়ার্ধার নিকট রামস্বামীর আর একটি মন্দির ছিল।
সহনশীলতা : বাকাটক রাজারা মূলত শৈব হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। দ্বিতীয় প্রবরসেন ধর্মে শৈব ছিলেন। কিন্তু তাঁর লেখা সেতুবন্ধ কাব্যে রাম তথা বিষ্ণুর মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে।
একাদশী ব্রত : এ সময় ব্রাহ্মণ্য সমাজে একাদশী ব্রত সমাদৃত ছিল। একাদশীর পুণ্য তিথিতে মহিলারা উপবাস পালন করতেন এবং দান-ধ্যানাদি কার্যে অংশগ্রহণ করতেন। একাদশী তিথিসমূহের মধ্যে প্রবোধিনী বা কার্তিকী শুক্লা একাদশী পবিত্রতম। এই পুণ্য তিথি মেঘদূতের নির্বাসিত যক্ষের শাপাবসানের তিথি (মেঘদূত, উত্তরমেঘ, ৪৯)। কথিত আছে, এই পুণ্য তিথিতে বিষ্ণু চার মাস নিদ্রাসুখ উপভোগের পর অনন্তশয্যা ত্যাগ করে উত্থান করেন।
জৈনধর্ম : বাকাটক রাজ্যে জৈনধর্ম তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। এ পর্বের কোনও লেখে জৈনধর্মের উল্লেখ নেই। সন্দেহ নেই, বাকাটক রাজ্যে জৈনরা স্বল্পসংখ্যকই ছিলেন।
বৌদ্ধধর্ম : বাকাটক রাজ্যে বৌদ্ধধর্ম মোটামুটি জনপ্রিয়ই ছিল বলা চলে।
- হরিষেণের মন্ত্রী বরাহদেব অজন্তার ষোড়শ গুহা বিহারটি নির্মাণ করে তা বৌদ্ধসংঘের অনুকূলে প্রদান করেন। অজন্তার সপ্তদশ গুহা বিহার ও ঊনবিংশ গুহা চৈত্যটিও হরিষেণের রাজত্বকালে খোদিত হয়।
- গুলবাড়ায় বরাহদেব আর একটি বৌদ্ধবিহার খনন করেন। সেই গুহাবিহারে বুদ্ধদেবের এক ধর্মচক্র প্রবর্তন মূর্তি উৎকীর্ণ হয়।
- বরাহদেব সম্ভবত আরও একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন।
- বাকাটক রাজাদের শাসনকালে পাহাড় কুঁদে একাধিক বৌদ্ধ চৈত্য ও বিহার নির্মিত হয়। বাকাটক পর্বের তিনটি লেখে বৌদ্ধবিহার ও চৈত্য নির্মাণের উল্লেখ আছে। পক্ষান্তরে এ পর্বের কম করেও পনেরোটি লেখে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে দান-ধ্যানের কথা বলা হয়েছে। অথচ পূর্ববর্তী সাতবাহন যুগের বেশির ভাগ লেখই বৌদ্ধসংঘের অনুকূলে দান সম্পর্কিত। এতে বোঝা যায়, সাতবাহন যুগের তুলনায় এ পর্বে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।
সাহিত্য
প্রাকৃত ও সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে বাকাটক যুগ এক স্মরণীয় অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। বাকাটক রাজাদের অনেকেই সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
হরিবিজয় : বৎসগুল্ম শাখার সর্বসেন প্রাকৃত ভাষায় ‘হরিবিজয়’ নামে একখানি কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি বর্তমানে অবলুপ্ত। পত্নী সত্যভামার অনুরোধে কৃষ্ণের স্বর্গ হতে পারিজাত আহরণ সম্ভবত এ কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়। ‘হরিবিজয়’ কাব্য থেকে আনন্দবর্ধন তাঁর ধ্বন্যালোকে একটি শ্লোক উদ্ধার করেছেন। শ্লোকটি মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে রচিত। মনে হয়, ‘হরিবিজয়’ কাব্যখানি মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে রচিত হয়েছিল। আনন্দভট্ট, উদ্যোতন ও হেমচন্দ্রের মতো প্রাচীন ভারতের প্রথিতযশা লেখকেরা এই কাব্যের নামোল্লেখ করেছেন বা এর কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃতিরূপে ব্যবহার করেছেন। রচনা উচ্চশ্রেণির না হলে এরূপ সমাদর হয় না।
দিবাকরসেন রচিত একটি সুভাষিত : শ্রীধরদাসের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’-এ যুবরাজ দিবাকরসেন রচিত একটি সুভাষিতের উল্লেখ আছে। এই দিবাকরসেন সম্ভবত বাকাটক রাজকুমার দিবাকরসেন। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’-এ প্রবরসেন রচিত কয়েকটি সুভাষিতের উদ্ধৃতি আছে। এই প্রবরসেন বাকাটক নৃপতি দ্বিতীয় প্রবরসেন।
সেতুবন্ধ : দ্বিতীয় প্রবরসেন মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে ‘সেতুবন্ধ’ বা ‘রাবণবহো’ কাব্য রচনা করেন। টীকাকার রামদাস বলেন, বিক্রমাদিত্যের আদেশে কালিদাস প্রবরসেনের নামে এ কাব্যখানি রচনা করেন। সেতুবন্ধের প্রথম অধ্যায়ের নবম শ্লোকে বলা হয়েছে, প্রবরসেন সিংহাসনে আরোহণ করেই কাব্য রচনায় হাত দেন কিন্তু কাব্য রচনাকালে তিনি বিস্তর বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হন। সেতুবন্ধ রচনার কাজে দ্বিতীয় প্রবরসেন যে কোনও এক প্রতিভাবান কবির সাহায্য গ্রহণ করেন, তার হয়তো এক প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে এই শ্লোকে। অনুমান করা যায়, মহাকবি কালিদাস দ্বিতীয় প্রবরসেনের এ কাব্যখানিকে সংশোধিত ও পরিমার্জিত করে আরও সুষমামণ্ডিত করেন। ১৩৬২টি শ্লোকে রচিত ও পঞ্চদশ আশ্বাসে বিভক্ত এই কাব্যে রাবণের বিরুদ্ধে রামচন্দ্রের সামরিক অভিযান, সমুদ্র পারের জন্য সেতু নির্মাণ এবং পরিশেষে রাবণকে নিহত করে রামের সপরিবার অযোধ্যায়। প্রত্যাবর্তন, বর্ণিত হয়েছে। বাণভট্ট তাঁর হর্ষচরিত কাব্যে সেতুবন্ধের প্রশংসা করে বলেছেন, সেতুবন্ধ রচনা করায় প্রবরসেনের যশ সমুদ্র পেরিয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়। খ্রিস্টীয় ৯ম শতকে আনন্দবর্ধনও এই কাব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
গাথা : দ্বিতীয় প্রবরসেন বেশ কিছু প্রাকৃত গাথাও রচনা করেন। এরূপ ৯টি গাথা গাথাসপ্তশতীতে উদ্ধৃত আছে।
মেঘদূত : বাকাটক রাজধানী নন্দিবর্ধনে অবস্থানকালে কালিদাস সম্ভবত তাঁর অমর কাব্য মেঘদূত রচনা করেন। কাব্যের নায়ক যক্ষ বিরহ-সন্তপ্ত। কুবেরের অভিশাপে তিনি অলকা হতে নির্বাসিত হয়ে রামচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত রামগিরিতে দিন যাপন করছেন। তাঁর মন পড়ে রয়েছে অলকায় যেখানে তাঁর ‘তন্বী শ্যামা শিখরদশনা’ প্রিয়ার বাস। ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘ দেখে তাঁর চিত্ত উদ্বেল হয়ে উঠে। মেঘকে তিনি তাঁর বেদনাবার্তা অলকায় তাঁর প্রিয়ার নিকট পৌঁছে দেওয়ার মিনতি জানান। রামগিরি থেকে মেঘের অলকায় গমন, এই নিয়ে মেঘদূতের পূর্বমেঘ। অলকা ও বিরহিণী যক্ষ প্রিয়ার বর্ণনা হল উত্তরমেঘের বস্তুরূপ। রাজধানী নন্দিবর্ধনের অতি নিকটবর্তী এই রামগিরি। এখানে রামচন্দ্র বা রামগিরিস্বামীর একটি মন্দির ছিল। অগ্রমহিষী প্রভাবতীগুপ্তা কয়েকবারই রামগিরি পরিদর্শন করেন। এই স্থান দর্শন করেই কালিদাস সম্ভবত মেঘদূত রচনায় উদ্বুদ্ধ হন।
মহাভারত, পুরাণের সংকলন, স্মৃতিশাস্ত্রের প্রণয়ন : বাকাটক যুগে মহাভারত ও পুরাণগুলি সংকলিত হচ্ছিল; যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ ও কাত্যায়নের স্মৃতিগ্রন্থগুলি রচিত হচ্ছিল; পদার্থসংগ্রহ, শবরভাষ্য, ব্যাসভাষ্য, সাঙ্খ্যকারিকা, লঙ্কাবতারসূত্র ইত্যাদি গ্রন্থগুলি প্রণীত হচ্ছিল। এসব গ্রন্থকার ও সংকলকদের কেউই ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী বাকাটক রাজগণের আনুকূল্য লাভ করেননি, এমনটি ভাবা হয়তো ঠিক নয়। তবে এই প্রশ্নের সদুত্তর এই মুহূর্তে পাওয়া যাবে না।
নাট্যকার : শূদ্রক ও বিশাখদত্তের মতো যশস্বী নাট্যকারেরাও ঠিক এই সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাকাটক রাজগণের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক সম্বন্ধেও কোনও সুনিশ্চিত তথ্য নেই। কিন্তু একটি জিনিস সুনিশ্চিত।
কাব্য রচনায় বৈদর্ভী রীতি : সংস্কৃত ও প্রাকৃত সাহিত্যের ইতিহাসে বাকাটক পর্বের গুরুত্ব অপরিসীম। কাব্য রচনার যে আদর্শ বাকাটক রাজ্যে তথা বিদর্ভে অনুসৃত হয়েছিল তা বৈদর্ভী রীতি নামে সর্বভারতীয় খ্যাতি লাভ করে। আলংকারিক দণ্ডী (খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক) কাব্য রচনায় এই রীতিকে সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। স্বয়ং কালিদাস কাব্য রচনায় এই রীতি গ্রহণ করেন। বাকাটক যুগকে বৈদভী রীতির উদ্ভব ও বিকাশকাল বলে চিহ্নিত করা যায়।
স্থাপত্য, ভাষ্কর্য ও চিত্রকলা
মন্দির-স্থাপত্য
বাকাটক লেখমালায় সেযুগে নির্মিত কয়েকটি মন্দিরের উল্লেখ আছে। এই মন্দিরগুলির মধ্যে চিকম্বুরির ধর্মস্থান, প্রবেরশ্বর-ষড়বিংশতি-বাটকের প্রবরেশ্বর মন্দির, রামগিরির রামগিরিস্বামী মন্দির, অশ্বত্থখেটকের মহাপুরুষ মন্দির এবং প্রবরপুরের রামচন্দ্র মন্দির সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
- রামটেক পাহাড়ে সম্ভবত বাকাটক পর্বে নির্মিত এক প্রাচীন মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমানে এই মন্দিরের মণ্ডপটি ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। মণ্ডপটির ছাদ সমতল, ৬টি স্তম্ভ। ৪টি স্তম্ভেরই অবয়বে পদ্মের নকশার অলংকরণ। এটি সম্ভবত একটি বিষ্ণু মন্দির।
- বাকাটক যুগের আর একটি প্রাচীন মন্দির জবলপুর জেলার তিগোওয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্গক্ষেত্রাকার গর্ভগৃহ, ৪টি স্তম্ভসজ্জিত মণ্ডপ্ ও একটি মুখমণ্ডপ, এই ছিল মন্দিরটির আদি রূপ। কিন্তু পরবর্তী কালে মুখমণ্ডপটিকে একটি মণ্ডপে রূপান্তরিত করা হয় এবং এই মণ্ডপটির সম্মুখভাগে একটি নতুন মুখমণ্ডপ তৈরি করা হয়। আদি মণ্ডপটির ৪টি স্তম্ভ নির্মাণে শিল্পী তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। স্তম্ভগুলি পাদদেশে চতুষ্কোণ কিন্তু তারপর ক্রমান্বয়ে অষ্টকোণ, ষোড়শকোণ, বর্তুলাকার ও চতুষ্কোণ। স্তম্ভশীর্ষে খাঁজকাটা ঘণ্টা। মন্দিরটির নির্মাণকাল সম্ভবত খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের মধ্যভাগ।
- তিগোওয়ায় আরও কয়েকটি প্রাচীন মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
- নাচনা কুঠারার সমতল ছাদবিশিষ্ট দ্বিতল পার্বতী মন্দির এ পর্বের কীর্তি। এই মন্দিরে একটি প্রদক্ষিণা পথ রয়েছে। মন্দিরটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের শেষপাদে নির্মিত হয়েছিল।
গুহা-স্থাপত্য
বাকাটক পর্বে অজন্তার ষোড়শ ও সপ্তদশ গুহাবিহার দু’টি এবং ঊনবিংশ গুহাচৈত্যটি খোদিত ও অলংকৃত হয়।
- ষোড়শ গুহাবিহার : অজন্তার সুষমামণ্ডিত ষোড়শ গুহাবিহারটি মহারাজ হরিষেণের মন্ত্রী বরাহদেবের আনুকূল্যে খোদিত হয়। মণ্ডপ ও মুখমণ্ডপ, এই নিয়ে এই বৌদ্ধবিহার। মুখমণ্ডপ আয়তাকার কিন্তু মণ্ডপ বর্গক্ষেত্রাকার। মুখমণ্ডপের ৬টি নিরলংকার, আটকোনা স্তম্ভ, ২টি সুচারুরূপে অলঙ্কৃত অর্ধস্তম্ভ। মুখমণ্ডপ পেরলেই মণ্ডপ। মণ্ডপের তিনটি দরজা। মধ্যম দরজাটি প্রধান। প্রধান দরজার দু’পাশে দু’টি অর্ধস্তম্ভ। অর্ধস্তম্ভের গায়ে মকরবাহিনী গঙ্গার দণ্ডায়মান মূর্তি উৎকীর্ণ। মণ্ডপের ২০টি স্তম্ভ। এদের ১৬টিই নিরলংকার ও আটকোনা। সামনের ও পিছনের সারির মধ্যিখানে দু’টি করে স্তম্ভ ক্রমান্বয়ে চারকোনা, আটকোনা, ষোড়শকোনা ও চারকোনা। মণ্ডপের দু’পাশে ৬টি করে সর্বসমেত ১২টি, পিছনের দিকে ২টি এবং মুখমণ্ডপের দু’পাশে ২টি, এই নিয়ে সর্বসমেত ১৬টি কক্ষ। মণ্ডপের পিছন দিকে চৈত্যমন্দির বা গর্ভগৃহ। চৈত্যমন্দিরে ভগবান বুদ্ধদেবের প্রলম্বপাদ আসনে উপবিষ্ট ধর্মচক্রপ্রবর্তন মূর্তি। বুদ্ধদেবের ডান দিকে বজ্রপাণি, বাঁদিকে পদ্মপাণি। চৈত্য মন্দিরের চতুষ্পার্শ্বে প্রদক্ষিণা পথ।
- সপ্তদশ গুহাবিহার : হরিষেণের রাজত্বকালে খোদিত অজন্তার সপ্তদশ গুহাবিহার ষোড়শ গুহাবিহারেরই প্রায় অনুরূপ। এই গুহাবিহারের দু’টি অঙ্গ—আয়তক্ষেত্রাকার মুখমণ্ডপ এবং বর্গক্ষেত্রাকার মণ্ডপ। মুখমণ্ডপে ৬টি নিরলংকার, আটকোনা স্তম্ভ এবং দু’প্রান্তে দু’টি ভাস্কর্য খচিত অর্ধস্তম্ভ। মণ্ডপে সর্বসমেত ২০টি স্তম্ভ। এদের ১৬টিই আটকোনা ও নিরাভরণ। কিন্তু সামনের আর পিছনের সারির মাঝখানের দু’টি করে স্তম্ভ চিত্র ও ভাস্কর্যে সমুজ্জ্বল। অলংকৃত স্তম্ভগুলি ক্রমান্বয়ে চারকোনা, আটকোনা ও ষোড়শকোনা। মণ্ডপের পিছন দিকে আয়তাকার অন্তরাল। অন্তরালের পিছনেই বর্গাকার চৈত্যমন্দির বা গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের তোরণ দণ্ডায়মান ও উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তিতে অলংকৃত। তোরণের উপরদিকে দু’পার্শ্বে মকরবাহিনী গঙ্গার দণ্ডায়মান মূর্তি উৎকীর্ণ। গর্ভগৃহে পদ্মাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধদেবের এক বিরাট যোগাসীন, ধর্মচক্রপ্রবর্তন মূর্তি উৎকীর্ণ হয়েছে। বুদ্ধ দেবের ডান দিকে দণ্ডায়মান পদ্মপাণি, বাঁদিকে দণ্ডায়মান বজ্রপাণি। গুহাটিতে সর্বসমেত ১৮টি কক্ষ। মুখমণ্ডপের দু’পাশে দু’টি, মণ্ডপের দু’পাশে ৬টি করে মোট ১২টি, আর মণ্ডপের পিছন দিকে তোরণের দু’পাশে দু’টি করে মোট ৪টি কক্ষ। উৎকীর্ণ লেখ হতে জানা যায়, মণ্ডপে একটি জলাধার ছিল। সপ্তদশ গুহাবিহারের এক অমূল্য সম্পদ তার অতুলনীয় চিত্রসম্ভার।
- ঊনবিংশ গুহাচৈত্য : হরিষেণের সময় উৎকীর্ণ অজন্তার ঊনবিংশ গুহাটি একটি গুহাচৈত্য। লেখে এই গুহা চৈত্যটিকে গন্ধকূটী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গুহার সম্মুখভাগে বর্গাকার এক প্রশস্ত অঙ্গন। অঙ্গনের দু’পাশে দু’টি ক্ষুদ্রাকারের উপাসনা গৃহ। সম্মুখস্থ সুদৃশ্য মুখমণ্ডপ ও অভ্যন্তরস্থ ক্ষুদ্রাকারের এক আয়তাকার চৈত্যকক্ষ বা মণ্ডপ, যার পিছনটা অর্ধচন্দ্রাকার, এই নিয়ে এই গুহাচৈত্য। ৩.৩৫ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন ১৫টি সুদৃশ্য স্তম্ভ মণ্ডপটিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছে—পার্শ্বদেয়াল থেকে স্তম্ভসারি পর্যন্ত বিস্তৃত দু’টি পার্শ্বপথ এবং মধ্যবর্তী প্রশস্ত মূল অংশ। স্তম্ভগুলি ক্রমান্বয়ে বর্গাকার, আটকোনা ও বর্তুলাকার। স্তম্ভশীর্ষে আমলক ও উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি। স্তম্ভগাত্রে লতা, পাতা, ঘট, প্রস্ফুটিত পদ্ম, বুদ্ধ, আকাশবিহারী গন্ধর্ব, সিদ্ধযোগী ও পশুমূর্তি উৎকীর্ণ। পাহাড় কুঁদে মণ্ডপের ছাদের নিম্নতলকে কড়াই-এর অন্তর্ভাগের আকার দেওয়া হয়েছে। মণ্ডপের পিছন দিকে একটি স্তূপ। স্তূপটির সর্বনিম্ন অংশ বর্গাকার উঁচু মঞ্চ বা বেদিকা। এরপর ক্রমান্বয়ে মেধি, অণ্ড, হর্মিকা, ক্রমহ্রস্বায়মান ছত্রাবলি ও কলস। স্তূপের সামনের দিকে সুগভীর কুলুঙ্গির মধ্যে এক দণ্ডায়মান, নয়নাভিরাম বুদ্ধমূর্তি উৎকীর্ণ হয়েছে। মুখমণ্ডপের বহির্ভাগ অতি রমণীয়, অপূর্ব সুন্দর। পদ্ম পাপড়ির মতো আকৃতিবিশিষ্ট, দৃষ্টিনন্দন একটি চৈত্যগবাক্ষ মুখমণ্ডপের বহির্ভাগের ঠিক কেন্দ্রস্থলে বিরাজমান। গবাক্ষের চতুষ্পার্শ্বে রয়েছে অত্যাশ্চর্য ভাস্কর্যের উপস্থাপনা। গবাক্ষের ডান দিকে বিরাজ করছে যক্ষ পূর্ণভদ্র, আর বাঁদিকে দণ্ডায়মান যক্ষ পঞ্চিক। বীরত্বব্যঞ্জক তাদের ভঙ্গি; পেশল, গুরুভার তাদের দেহকাণ্ড। সপ্তদশ গুহাবিহারের মতো এই গুহাচৈত্যটিও চিত্র সম্ভাৱে অতি সমৃদ্ধ ৷
ভাস্কর্য
এ যুগের ভাস্কর্যের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে রামটেক পাহাড়, বিনোবাজির আশ্রম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, তিগোওয়া, নাচনা কুঠারা এবং অজন্তার ষোড়শ, সপ্তদশ ও ঊনবিংশ গুহায়।
- রামটেক পাহাড়ে এক পুরোনো বিষ্ণুমন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে একটি ত্রিবিক্রম মূর্তি পাওয়া গেছে। মূর্তিটির বহু স্থানই ভগ্ন। দেবতার মস্তকে মুকুট, মুখমণ্ডলে প্রভাবলি। দেবতার বাম পদ ভূমিতলে স্থাপিত। দক্ষিণ পদের নিম্নাংশ ভগ্ন। বীরত্বব্যঞ্জক, দৃপ্ত দেবতার ভঙ্গি। বলি ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিতে দেবতার পাদদেশে দণ্ডায়মান। পাশে তাঁর স্ত্রী। মূর্তিটির অনেকটাই বিনষ্ট হয়ে গেছে তবু বোঝা যায়, এটি প্রথমাবস্থায় তৎকালীন ভাস্কর্যশিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন ছিল।
- ধাম নদীর বামতটে বিনোবাজির আশ্রমের সন্নিকটে বাকাটক যুগের কয়েকখানি প্রস্তরফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের একটি ভরতভেট। ফলকের এই নামটি বিনোবাজির দেওয়া। এই ফলকে সীতা, রাম, ভরত ও লক্ষ্মণের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ। সীতা রামের বাহুলগ্না। রাম ও ভরত কথোপকথনরত। রামের বাম হস্ত ভরতের দক্ষিণ করতলে ন্যস্ত। রাম ও ভরত উভয়েরই মুখে আনন্দের দ্যুতি। অনাগ্রহী ও অপ্রসন্ন লক্ষ্মণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ।
- চিত্রকূট পাহাড়ে রাম-ভরতের মিলনদৃশ্য এই ফলকে সুন্দরভাবে রূপায়িত হয়েছে। বাকাটক পর্বীয় আরও বহু প্রস্তর ফলকের সন্ধান এখানে পাওয়া গেছে। রামের জন্ম, দশরথের তিরোধান, রামের বনবাসগমন, সুগ্রীব ও বালীর যুদ্ধের মতো রামায়ণের নানা ঘটনা এই ফলকগুলিতে সুনিপুণভাবে রূপায়িত হয়েছে।
- তিগোওয়া মন্দিরের সুদৃশ্য স্তম্ভগুলি ভাস্কর্যশিল্পের সুন্দর নিদর্শন। স্তম্ভগুলি ক্রমান্বয়ে চারকোনা, আটকোনা, ষোড়শকোনা এবং বর্তুলাকার হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। স্তম্ভশীর্ষ খাঁজকাটা ঘণ্টাকৃতি। সর্বোপরি বিপরীতমুখী উপবিষ্ট এক যুগল সিংহমূর্তি। মন্দির-তোরণে গঙ্গা ও যমুনা মূর্তি উৎকীর্ণ। মকরবাহিনী গঙ্গা দণ্ডায়মানা। কূর্মবাহিনী যমুনার ভঙ্গিও তাই। সালংকরা দেবীদের ছন্দায়িত, লীলায়িত দেহভঙ্গি। প্রসন্ন তাঁদের দৃষ্টি। নাচনা কুঠারার পার্বতী মন্দিরের গর্ভগৃহের তোরণও সুদৃশ্যরূপে অলংকৃত। গঙ্গ-যমুনা, মিথুন ও দেবীমূর্তিতে তোরণ সুসজ্জিত। পেলব ও রমণীয় নারীমূর্তির দেহগড়ন। দেহভঙ্গিমায় কোনও জড়তা বা আড়ষ্টতার চিহ্ন নেই। দেবী ও নারীমূর্তি রূপায়ণে পার্বতী মন্দিরের ভাস্কর শিল্পনৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।
- ভাস্কর্য-শিল্পোৎকর্ষের প্রকাশ ঘটেছে অজন্তার ষোড়শ ও সপ্তদশ গুহাবিহার এবং ঊনবিংশ গুহাচৈত্যের স্তম্ভ ও অর্ধস্তম্ভের, গড়নে ও অলংকরণে। গুহাত্রয়ের অভ্যন্তরস্থ মণ্ডপগুলিতে বিশাল বুদ্ধমূর্তি উপস্থাপিত হয়েছে। বুদ্ধদেব ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রায় রূপায়িত। বুদ্ধদেবের অনুগামী রূপে দর্শিত হয়েছেন বোধিসত্ত্বদ্বয় বজ্রপাণি ও পদ্মপাণি। অজন্তার বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব মূর্তিগুলি নিঃসন্দেহে সুষম ও বলিষ্ঠ দেহগঠনবিশিষ্ট। কিন্তু এই মূর্তিগুলিতে সারনাথ-বুদ্ধের সে দীপ্তি ও আত্মনিমগ্নতার পরিচয় নেই, প্রাণৈশ্বর্যেরও তেমন আভাস নেই।
- ঊনবিংশ গুহাচৈত্যের বহিরঙ্গে তক্ষণশিল্প স্বমহিমায় ভাস্বর। মুখমণ্ডপের বহিরঙ্গে ভাস্কর্যের ঐশ্বর্যে প্রথম দৃষ্টিপাতেই মন আনন্দে আপ্লুত হয়। বহিরঙ্গের ঠিক কেন্দ্রস্থলে, পদ্মপাপড়ির আকৃতির এক অতি দৃষ্টিনন্দন চৈত্যগবাক্ষ। চৈত্যগবাক্ষের দু’পাশে দৃপ্তভঙ্গিতে যক্ষ পূর্ণভদ্র ও যক্ষ পঞ্চিক দণ্ডায়মান। সমগ্র বহিরঙ্গ নানা ভঙ্গির বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব, নাগ, গন্ধর্ব, কিন্নর মূর্তিতে আপাদ মস্তক মণ্ডিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাতিদীর্ঘ চৈত্যগবাক্ষের অলংকরণ। সমস্ত কারুকার্যই সাধিত হয়েছে শক্ত পাহাড় কুঁদে, শিল্পীর ছেনি-হাতুড়ির সুনিপুণ ব্যবহারে।
চিত্রকলা
অজন্তার গুহাবিহার ও গুহাচৈত্যে বৌদ্ধ চিত্রকলা : বাকাটক পর্বের অনুপম চিত্রকলার সুমহান ইতিহাস বিধৃত আছে ষোড়শ ও সপ্তদশ গুহাবিহার আর ঊনবিংশ গুহাচৈত্যের স্তম্ভগাত্রে, দেয়ালে এবং ছাদের তলদেশে। বুদ্ধদেবকে কেন্দ্র করেই অজন্তার চিত্রজগৎ আবর্তিত হয়েছে। এই বুদ্ধ শুধু গৌতম বুদ্ধ নন, তিনি জন্ম জন্মান্তরের বুদ্ধ। ফলে মহর্ষি অসিতের দেবশিশু দর্শন, গৌতমের বিদ্যাভ্যাস, গৃহত্যাগ, উরুবিন্ধে নতজানু সুজাতার পায়সান্ন নিবেদন, বণিকদ্বয় তপস্সু ও ভল্লিকের বুদ্ধ সমীপে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ, নন্দের প্রব্রজ্যা গ্রহণ, কপিলবস্তু আগমন, সদ্ধর্ম প্রচার, বিম্বিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, অজাত শত্রুর বুদ্ধ দর্শনের মতো গৌতম বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনা যেমন চিত্রায়িত হয়েছে, তেমনি অসংখ্য জাতককাহিনিও শিল্পীর তুলিতে সুনিপুণরূপে রূপায়িত হয়েছে। একই সঙ্গে শিল্পী তুলে ধরেছেন পৃথিবীকে বর্ণময়, রূপময়, মহিমময় ও প্রাণবন্ত করে। বুদ্ধদেব তাঁর ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু, তবু পৃথিবীর রূপ, রস ও গন্ধে শিল্পী আমোদিত, উদ্বেলিত। লতা-পাতা, ফুল-ফল, পশু-পাখি, জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ, নর-নারী, নর্তক-নর্তকী, ধনী-দরিদ্র, রাজা-রানি, দেব-দেবী, যক্ষ যক্ষী, কিন্নর-কিন্নরী, সাধু-সন্ন্যাসী, যান-বাহন, বিলাস-বৈভব, প্রাসাদ-কুটির, বস্ত্র-অলঙ্কার—সব কিছুই শিল্পীর তুলির টানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
খণ্ড চিত্র ও কথা চিত্র : চিত্রাঙ্কনের পিছনে শিল্পীর মনে এক বিশেষ পরিকল্পনা কাজ করেছে। কখনও তিনি এঁকেছেন খণ্ড চিত্র। এগুলি একক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশেষ একটি মুহূর্তকে, বা বিশেষ একটি ভাবকে, শিল্পী তাঁর চিত্রে শাশ্বত করে রেখেছেন। ষোড়শ গুহার প্রসাধনরতা নারীত্রয়ের আলেখ্য বা সপ্তদশ গুহাবিহারের বুদ্ধদেব, গোপা এবং রাহুলের (মতান্তরে, বুদ্ধদেব, কৃপাপ্রার্থিণী জনৈকা রমণী ও তাঁর শিশুপুত্রের) চিত্রখানি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। আবার কখনও শিল্পী জাতকের এক একটি কাহিনি বা বুদ্ধদেবের জীবনের এক একটি ঘটনা অবলম্বন করে কথাচিত্র রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ঘটমান দৃশ্যকে কয়েকটি অঙ্কে বিন্যস্ত করে তারই চিত্ররূপ রূপায়ণে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন। এভাবে শিল্পী বহু চিত্রের মাধ্যমে বহু অঙ্কের এক একটি কাহিনির চিত্ররূপ রূপায়িত করেছেন। এখানে কোনও চিত্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; কাহিনিটির সঙ্গে পরিচিত হতে হলে চিত্র থেকে চিত্রান্তরে পরিক্রমণ করতে হয়। চিত্র থেকে চিত্রান্তরের মাঝখানের ফাঁকে শিল্পী উপস্থাপিত করেছেন কোথাও তোরণদ্বার, কোথাও তরুরাজি, কোথাও অলিন্দ, কোথাও স্তম্ভ, কোথাওবা দু’টি সমান্তরাল রেখা চিহ্ন। এগুলি ঘটনার পর্যায় থেকে পর্যায়ান্তরে, অঙ্ক থেকে অঙ্কান্তরে, সময় থেকে সময়ান্তরে যাবার ইঙ্গিত। আবার কখনওবা শিল্পী অতিরিক্ত দৃশ্যের অবতারণা না করে নারী বা পুরুষের মুখভঙ্গিমার যথাযথ রূপায়ণের মাধ্যমে দৃশ্যান্তরের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ঘটনার যবনিকাপাতের ইঙ্গিতের নিদর্শনও রেখেছেন শিল্পী। এক একটি কাহিনি চিত্রমালা যেন এক একটি কয়েক অঙ্কের নাটক।
ক্লান্তি বা একঘেয়েমিতা রুখতে চিত্র : ছবি দেখতে বসে দর্শকমনে যাতে ক্লান্তি বা একঘেয়েমি না আসে সে দিকে শিল্পীর সতর্ক দৃষ্টি। সে কারণেই গুহার দেয়ালে, স্তম্ভগাত্রে ও ছাদের তলদেশে ফুল-ফল, লতা-পাতা, পশু পাখি, কীট-পতঙ্গ, কাল্পনিক জীব-জন্তুর নকশা বা অলংকরণ-চিত্রের উপস্থাপনা। নানা ধরনের মনোহারী আলপনাও অঙ্কিত হয়েছে। এগুলিতে কোনও কাহিনি নেই, আছে ভাবের ব্যঞ্জনা। প্রতিটি নকশাই অভিনব ও মৌলিক। কেউ কারও অনুকৃতি নয়। প্রতিটি নকশাতেই শিল্পীর নিত্যনতুন সৃষ্টির স্বাক্ষর। শিল্পী তাঁর তুলির রেখা ও রঙের সাহায্যে এই নকশাগুলি অঙ্কন করেছেন। নকশাগুলির চিত্রায়ণে শিল্পী বাস্তবানুগতার দিকে দৃষ্টি দেননি, তিনি তাদের আপন মনের মাধুরীতে সুন্দরের বিচিত্র প্রকাশরূপেই উপস্থাপিত করেছেন।
বাস্তবের বদলে আদর্শ রূপায়ন : শুধু নকশার উপস্থাপনাতেই নয়, নরদেহের চিত্রায়ণেও শিল্পী বাস্তবানুগতার বশবর্তী হননি। তিনি তাঁর তুলিতে শাস্ত্র কাব্যে বর্ণিত, তাঁর ধ্যানদৃষ্টিতে উদ্ভাসিত আদর্শ নরদেহই রূপায়িত করেছেন। তাঁর ধ্যানের দৃষ্টিতে দেবতা ও মানুষের কোমর হবে সিংহকটি কিন্তু দেবী ও রমণীর কটিদেশ হবে ডমরুমধ্য। দেবী ও নারীর ঠোঁট হবে পরিপক্ক বিশ্বফলের মতো (বিম্বাধরৌষ্ঠী), গ্রীবা হবে কম্বু বা শাঁখসদৃশ, পদযুগল হবে পদ্ম (চরণকমল) বা পল্লবতুল্য (পদপল্লব)। তাঁরা হবেন মীননয়না। পুরুষের দেহকাণ্ড হবে গোমুখের মতো, হাতির মাথার মতো হবে স্কন্ধ, আজানুলম্বিত বাহু হবে কলাগাছের কাণ্ডের মতো, সর্বাঙ্গ জুড়ে থাকবে কোমলতা ও পেলবতার স্পর্শ। মানব দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গের নির্ভুল রূপায়ণে নয়, তাঁর ধ্যানদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষীভূত আদর্শ মানব-মানবীর দেহাবয়ব চিত্রায়ণের নির্মল আনন্দে অজন্তার শিল্পী মাতোয়ারা।
রাজকন্যা : ষোড়শ গুহাবিহারে চিত্রায়িত মরণাহতা রাজকন্যা জনপদকল্যাণীর শাশ্বত আলেখ্যটি অজন্তা চিত্রকলার এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ছন্দায়িত, কুসুম-কোমল রাজকুমারীর দেহখানি অর্ধশায়িত। সখী বা সেবিকারা তাঁর শুশ্রূষারত। তাঁদের সকলের চোখে-মুখে উদ্বেগ ও হতাশার ছায়া। একটু দূরে দণ্ডায়মান চিকিৎসক। তাঁর বাম হস্তে ঔষধ-ভৃঙ্গার, দক্ষিণ হস্তের করাঙ্গুলি নির্দেশের ভঙ্গিতে উত্তোলিত। অসীম মমতাভরে শিল্পী রাজকুমারীর চিত্র অঙ্কন করেছেন।
অপ্সরা : সপ্তদশ গুহাবিহারের কৃষ্ণা অপ্সরা অজন্তার আর এক শ্রেষ্ঠ নারীচিত্র। আকাশপথে ভেসে চলেছেন অপ্সরা। তাঁর কণ্ঠের শতনরী বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে ; মুকুটের মুক্তার ঝালরগুলিও একদিকে হেলে পড়েছে। এ চিত্রের আসল আবেদন কৃষ্ণা অপ্সরার অর্ধনিমীলিত দু’টি স্বপ্নালু নয়নের কটাক্ষপাতে।
সপ্তদশ গুহাবিহারে বুদ্ধদেব, যশোধরা ও রাহুলের চিত্র : বুদ্ধদেব, যশোধরা ও রাহুলের চিত্রখানি নিঃসন্দেহে সপ্তদশ গুহাবিহারের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্র। অতি মর্মস্পর্শী এই ছবিটি। কপিলবস্তুতে এসে ভিক্ষুর বেশে বুদ্ধদেব স্ত্রী যশোধরা ও পুত্র রাহুলের কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করছেন। চিত্রে দেখা যাচ্ছে, অতি বিশাল বুদ্ধদেবের সম্মুখে ক্ষুদ্রাকারের যশোধরা ও রাহুল দাঁড়িয়ে। বুদ্ধদেবের পরিধানে পীত অজিন, মাথায় প্রভাবলি, হাতে ভিক্ষাপাত্র। লক্ষ করবার বিষয়, শিল্পী বুদ্ধদেবের দেহাবয়বকে সুস্পষ্ট রেখায় চিহ্নিত করেননি। বুদ্ধদেব যেন কোনও রক্ত-মাংসের মানুষ নন, তিনি যেন এক অলৌকিক সত্তা। তিনি অতি বিশাল, মহিমময়, তিনি রঙ ও রেখার বন্ধনে ধরা দেন না। অপরপক্ষে গোপা ও রাহুল ক্ষুদ্রাকৃতি কিন্তু তাঁদের দেহরেখা, অলংকার ও পরিধেয়ের প্রতিটি পরিচয় সুস্পষ্ট। যশোধরার পিছনে একটি তোরণদ্বার। এই চিত্রের ভারসাম্য রক্ষা করছে। রাহুলের নিষ্পাপ দৃষ্টিতে অপার বিস্ময়। শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় যশোধরার হাতের করাঙ্গুলি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। অনেকে ছবিটির অন্য ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের অভিমত, এ চিত্রে যশোধরা ও রাহুল রূপায়িত হননি, রূপায়িত হয়েছেন এক ভক্তিমতী নারী ও তাঁর বিস্ময়াবিষ্ট এক নিষ্পাপ শিশু।
গ্রন্থপঞ্জি
- নারায়ণ সান্যাল অপরূপা অজন্তা (কলকাতা, ১৯৮৩)।
- Majumdar, R. C. (Ed.) : The Vakataka-Gupta Age (Lahore, 1946); The Classical Age (Bombay, 1962); A Comprehensive History of India, Vol. III, Part I (New Delhi, 1981).
- Mirashi, V. V. Corpus Inscriptionum Indicarum (Calcutta, 1963).
- Shastri, A. M.: Early History Of The Deccan (Delhi, 1987).
- Shastri, A. M. (Ed) : The Age Of The Vākātakas (New Delhi, 1992).
- Sircar, D. C.: Select Inscriptions, I (Calcutta, 1965).
- Yazdani, G.: The Early History Of The Deccan, Parts I-VI (London, 1960)
রাষ্ট্রকূট রাজবংশ (৭৩৫-৯৮২ খ্রিস্টাব্দ)
রাজবৃত্ত
ভূমিকা
বাদামির চালুক্য রাজবংশের অবসানের পর মহারাষ্ট্র কর্ণাটক অঞ্চলে এক নতুন রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে। অচিরেই এই রাজবংশ সমকালীন ভারতের এক বৃহত্তম রাষ্ট্রশক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পশ্চিম ভারতের গুর্জর প্রতীহার ও বাংলা-বিহারের পাল রাজাদের সমকালবর্তী অশেষ প্রতাপশালী এই রাষ্ট্রশক্তি ভারতবর্ষের ইতিহাসে রাষ্ট্রকূট রাজবংশ নামে পরিচিত।
উদ্ভব ও আদি ইতিহাস : রাষ্ট্রকূট কথাটি ‘রাষ্ট্র’ শব্দ হতে উদ্ভূত। ‘রাষ্ট্র’ বলতে সাধারণত এক প্রশাসনিক বিভাগ বোঝায়। রাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ বা রাষ্ট্রমুখ্য রাষ্ট্রকূট নামে অভিহিত হতেন। অর্থাৎ প্রথম দিকে রাষ্ট্রকূট পদটি বৃত্তি অর্থে ব্যবহৃত হত কিন্তু পরবর্তিকালে এর অর্থের প্রসার ঘটে এবং এক বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠী অর্থে শব্দটি প্রযুক্ত হয়। ‘দেশমুখ’ ও ‘দেশাই’ পদ দু’টির উদ্ভব ঠিক এভাবেই হয়েছে।
- প্রাক্-দন্তিদুর্গ পর্বে দক্ষিণ-ভারতের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি রাষ্ট্রকূট রাজপরিবারের অভ্যুদয় হয়। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদ অঞ্চলে এক রাষ্ট্রকূট রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ৭ম শতকের মধ্যভাগে কর্ণাটকের উত্তরাঞ্চলে আর একটি রাষ্ট্রকূট রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে।
- প্রায় একই সময় মহারাষ্ট্রের বিদর্ভে এক রাষ্ট্রকূট রাজবংশের অভ্যুদয় হয়। প্রাচীন অচলপুর বা বর্তমান এলিচপুর ছিল সম্ভবত এই রাষ্ট্রকূট রাজ্যের রাজধানী। বাদামির চালুক্যদের হতমান করে যে রাষ্ট্রকূটরা মহারাষ্ট্র-কর্ণাটকে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁরা বিদর্ভের এই রাষ্ট্রকূটদেরই বংশধর।
কিন্তু বিদর্ভ এই রাষ্ট্রকূটদের আদি নিবাস নয়। রাষ্ট্রকূট রাজাদের অনেকেই ‘লট্টলূর পুরবরেশ্বর’ অভিধা ধারণ করেছেন। এ থেকে অনুমিত হয়, তাঁরা লট্টলূর শহরের অধিবাসী ছিলেন। মহারাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত লাটুরই প্রাচীন লট্টলূর। এ অঞ্চলে কন্নড় ভাষা প্রচলিত। রাষ্ট্রকূটরা কন্নড়ভাষী ছিলেন। প্রতীয়মান হয়, রাষ্ট্রকূটরা আদি বাসভূমি লট্টলূর ত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে বিদর্ভে গমন করেন এবং সেখানে কালক্রমে একটি রাজ্য স্থাপন করেন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এরূপ ঘটনা অভূতপূর্ব নয়। সেন রাজাদের আদি নিবাস কর্ণাটকে কিন্তু বাংলায় এসে তাঁরা রাজদণ্ড ধারণ করেন। গঙ্গরা কর্ণাটকের অধিবাসী ছিলেন; তাঁরা পরবর্তিকালে ওড়িশা-অন্ধ্রপ্রদেশে এক বিশাল রাজ্য গঠন করেন।
এলোরা দশাবতার গুহালেখে দন্তিদুর্গের পাঁচজন পূর্বসূরির নাম উল্লিখিত হয়েছে। তাঁরা হলেন দন্তিদুর্গের পিতা দ্বিতীয় ইন্দ্ৰ, পিতামহ প্রথম কর্ক, প্রপিতামহ গোবিন্দরাজ, বৃদ্ধ প্রপিতামহ প্রথম ইন্দ্র পৃচ্ছকরাজ এবং অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ দন্তিবর্মা। দন্তিবর্মা সম্ভবত বিদর্ভ অঞ্চলের আঞ্চলিক রাষ্ট্রকূটরাজ নন্নরাজের পুত্র বা ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। দন্তিদুর্গের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কিন্তু তাঁর পিতা দ্বিতীয় ইন্দ্র সম্পর্কে রাষ্ট্রকূট লেখমালায় কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। উচ্চাভিলাষী রাজা ছিলেন দ্বিতীয় ইন্দ্ৰ (আ. ৭১৫-৩৫ খ্রিস্টাব্দ)। সমকালীন চালুক্য সম্রাট বিজয়াদিত্যের (আ. ৬৯৬–৭৩৩ খ্রিস্টাব্দ) তিনি আনুগত্যাধীন ছিলেন। ইন্দ্রের শাসনভুক্ত অঞ্চলের ঠিক দক্ষিণেই রাজত্ব করতেন বিজয়াদিত্য। ইন্দ্রের এলাকার পশ্চিমে চালুক্যদের গুজরাত শাখার রাজ্য অবস্থিত ছিল। সে রাজ্যের রাজা ছিলেন মঙ্গলরাজ বিনয়াদিত্য (৭০০-৩২ খ্রিস্টাব্দ)। পশ্চিমে একটি গুর্জর রাজ্যও ছিল। তৃতীয় জয়ভট (আ. ৭০০-৩৫ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সেখানকার রাজা। তখন উত্তর গুজরাত ছিল বলভীরাজ পঞ্চম শীলাদিত্যের অধীন। ইন্দ্র চালুক্য রাজকুমারী ভবনাগাকে রাক্ষসমতে বিবাহ করেন। চালুক্যদের গুজরাত শাখাভুক্ত মঙ্গলরাজ বিনয়াদিত্য বা তাঁর অনুজ পুলকেশী সম্ভবত ভবনাগার পিতা ছিলেন। ঘটনাকাল সম্ভবত ৭২৫ খ্রিস্টাব্দ।
দন্তিদুর্গ (আ. ৭৩৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ)
আনুমানিক ৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইন্দ্রের মৃত্যু হলে তাঁর সুযোগ্য পুত্র দন্তিদুর্গ বা দস্তিবর্মা বিদর্ভের রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তখন বিশ বছরের এক অনভিজ্ঞ তরুণ। কিন্তু রাজনৈতিক নৈপুণ্য ও অসামান্য বীর্যবত্তা প্রদর্শন করে তিনি শীঘ্রই ক্ষুদ্র আঞ্চলিক পৈতৃক রাজ্যটিকে এক সার্বভৌম, পরাক্রান্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেন। রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই পশ্চিম-ভারতের রাজনৈতিক আকাশে দুর্যোগের কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হয়। সিন্ধুর তদানীন্তন আরব প্রশাসক জুনায়েদ এ সময় পশ্চিম ভারতে একাধিক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। বলভীর মৈত্রকরাজ পঞ্চম শীলাদিত্য ও গুর্জর নৃপতি তৃতীয় জয়ভট পরাজিত হন। বিজয়ী আরব বাহিনী নবসারী আক্রমণ করেন। এবার কিন্তু আরব সৈন্যদলের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটল। গুজরাতের আঞ্চলিক চালুক্যরাজ পুলকেশী ৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে বা তার কিছুকাল পূর্বে তাঁদের পরাজিত করেন। বাদামির চালুক্য নৃপতি দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য তাঁর অধীনস্থ এই আঞ্চলিক রাজার কৃতিত্বে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘চালুক্যকুলালঙ্কার’, ‘পৃথিবীবল্লভ’, ইত্যাদি অভিধায় বিভূষিত করেন।
মনে হয়, রাষ্ট্রকূটরাজ দন্তিদুর্গ আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পুলকেশীর দিকে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করেন। এ ধারণা সত্য হলে স্বীকার করতে হবে, আরবদের বিরুদ্ধে নবসারীর যুদ্ধে পুলকেশীর বিজয়লাভে দন্তিদুর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তাঁর এলোরা তাম্রশাসনে দন্তিদুর্গ ‘পৃথিবীবল্লভ’ ও ‘খড়্গাবলোক’ অভিধায় ভূষিত হয়েছেন। হতে পারে, আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পুলকেশীকে সহযোগিতা করায় চালুক্যরাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য তাঁকে অভিধা দু’টিতে ভূষিত করে সম্মানিত করেন। কিন্তু দন্তিদুর্গ যে আরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তা সংশয়াতীত নয়; ‘পৃথিবীবল্লভ’ এবং ‘খড়্গাবলোক’ অভিধা দু’টি তাঁর স্বোপার্জিতও হতে পারে।
নাতিদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহু যুদ্ধবিগ্রহে অংশগ্রহণ করেন দন্তিদুর্গ। যতদিন দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি চালুক্যদের তেমন বিরুদ্ধাচরণ করেননি। উপরক্ত তিনি নানাভাবে চালুক্যদের সহায়তাই করেছেন। দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে যুবরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মা পল্লব ও শ্রীশৈল রাজ্য দু’টি আক্রমণ করেন। তখন নন্দিবর্মা পল্লবমল্ল পল্লবদের রাজা। তেলুগু-চোলদের অধীনস্থ শ্রীশৈল রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্মুল অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। দন্তিবর্মা সম্ভবত উভয় যুদ্ধে দ্বিতীয় কীর্তিবর্মার সহযোগী ছিলেন এবং চালুক্য যুবরাজকে পল্লব ও তেলুগু-চোল রাজাদের পরাজিত করতে সাহায্য করেন। (নীলকান্ত শাস্ত্রী অভিমত প্রকাশ করেছেন, পল্লব ও শ্রীশৈল রাজাদের বিরুদ্ধে দস্তিদূর্গের সংঘর্ষ তাঁর রাজত্বের শেষ পর্বে অনুষ্ঠিত হয়।)
আনুমানিক ৭৪৪-৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য মৃত্যুমুখে পতিত হলে দন্তিদুর্গ নিজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হন। তাঁর মাতা চালুক্য রাজপরিবারের দুহিতা ছিলেন। চালুক্য রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের নৈকট্য তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষকে উদ্দীপ্ত করে। অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হন দন্তিদুর্গ। দ্বিতীয় কীর্তিবর্মার সঙ্গে কোনও প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অবতীর্ণ না হয়ে তিনি ধীর ও সুনিশ্চিত পদক্ষেপে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন।
তখন পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গুজরাতে অবস্থিত চালুক্য রাজ্য ও গুর্জর রাষ্ট্র জুড়ে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে ; আরব অভিযানের ফলে রাজ্য দু’টি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে দন্তিদুর্গ রাজ্য দু’টি আত্মসাৎ করেন। তাঁকে এ কাজে সাহায্য করেন তাঁর খুল্লতাত ধ্রুবের পুত্র গোবিন্দ। কৃতজ্ঞ দন্তিদুর্গ খুল্লতাতপুত্রকে দক্ষিণ গুজরাতের প্রশাসক পদে নিযুক্ত করেন।
এরপর দন্তিদুর্গের দৃষ্টি পড়ে পূর্বদিকে। তিনি মালব আক্রমণ করে উজ্জয়িনী অধিকার করেন। সেখানে হিরণ্যগর্ভ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। পরাজিত গুর্জর-প্রতীহার নৃপতি প্রথম নাগভট সে যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রতীহারীর দায়িত্ব পালন করেন। বিজিত মালবে স্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠা না করে তিনি অচিরে স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। মালবে তাঁর এই উদ্যম নিছকই এক ক্ষণস্থায়ী সামরিক অভিযান। অতঃপর তিনি মহাকোসল বা ছত্তীসগঢ় অঞ্চল বিজয়ে বহির্গত হন। তাঁর এক লেখে দাবি করা হয়েছে, তাঁর হস্তিবাহিনী মহানদীর জলরাশিতে অবগাহন করে। পরাজিত মহাকোসলরাজের পরিচয় অপরিজ্ঞাত। নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি সম্ভবত কলিঙ্গের কতিপয় আঞ্চলিক রাজাদের হতমান করেন। এভাবে দন্তিদুর্গ মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, কলিঙ্গ এবং মধ্য ও দক্ষিণ গুজরাতে নিজের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। বিদর্ভ তো পূর্ব থেকেই তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। তাঁর শক্তিবৃদ্ধিতে চালুক্য নৃপতি দ্বিতীয় কীৰ্তিবর্মা শঙ্কিত হন। তিনি উপলব্ধি করলেন, আর বিলম্ব নয়; দন্তিদুর্গকে যত শীঘ্র সম্ভব প্রতিহত করতে হবে।
শেষ পর্যন্ত বিবদমান দু’টি পক্ষ মধ্য মহারাষ্ট্রের কোনও এক স্থানে পরস্পরের সম্মুখীন হয়। রাষ্ট্রকূট লেখে সদম্ভে দাবি করা হয়েছে, দন্তিদুর্গ অবলীলাক্রমে চালুক্য বাহিনীকে পরাজিত করেন। চালুক্য লেখমালায় স্বীকার করা হয়েছে, দ্বিতীয় কীর্তিবর্মার রাজত্বকালে চালুক্য রাজ লক্ষ্মী অন্তর্হিতা হন। প্রমাণিত হয়, দন্তিদুর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কীর্তিবর্মা শোচনীয়রূপে ব্যর্থ হন। অনন্ত সদাশিব অলতেকর অভিমত প্রকাশ করেছেন, সুকৌশলে, বিনা রক্তপাতে দন্তিদুর্গ কীর্তি বর্মাকে পরাভূত করেন। এই যুদ্ধে বিজয়লাভের ফলে মহারাষ্ট্রে রাষ্ট্রকূট আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে দন্তিদুর্গ সাতারা জেলায় একটি গ্রাম সম্প্রদান করেন বলে একটি লেখে উল্লিখিত আছে। এই ঘটনা প্রমাণ করছে, মহারাষ্ট্রে দন্তিদুর্গের কর্তৃত্ব সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দন্তিদুর্গ মহারাষ্ট্র থেকে চালুক্যদের বিতাড়িত করলেন বটে কিন্তু কীর্তিবর্মাকে উচ্ছেদ করতে পারেননি। তখনও কর্ণাটকে চালুক্যরাজের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বাভাবিক কারণেই দন্তিদুর্গ কীর্তিবর্মাকে কর্ণাটক থেকে উচ্ছেদ করতে সংকল্পবদ্ধ হন। এ সংকল্প রূপায়িত হওয়ার পূর্বেই আনুমানিক ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি লোকান্তরিত হন। কীর্তিবর্মা তখনও কর্ণাটকে রাজত্ব করছেন। ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বক্কলেরি তাম্রশাসনখানি উৎকীর্ণ করেন। লেখটি থেকে জানা যায়, চালুক্য রাজ তখন ভীমা নদীর উত্তর তীরে অবস্থান করছেন।
গুণবান রাজা ছিলেন দন্তিদুর্গ। বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বহু বৈদিক যাগ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন তিনি। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অনুকূলে অজস্র গ্রাম অকাতরে দান করেন তিনি। প্রজাদের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম অনুরাগ। তাঁরই রণনৈপুণ্যে ও কুশলতায় বিদর্ভের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকূট রাজ্যটি এক বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় কীর্তিবর্মাকে তিনি সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করতে পারেননি সত্য কিন্তু পল্লবরাজ নন্দিবর্মা পল্লবমল্লের সঙ্গে নিজ কন্যা রেবার বিবাহ দিয়ে তিনি কাঞ্চীপুরম থেকে তাঁর প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য সাহায্যলাভের পথ অবরুদ্ধ করেন।
প্রথম কৃষ্ণ (আ. ৭৫৬-৭২ খ্রিস্টাব্দ)
দন্তিদুর্গ অপুত্রক অবস্থায় দেহত্যাগ করলে তাঁর পিতৃব্য প্রথম কৃষ্ণ আনুমানিক ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। (প্রথম কৃষ্ণের আরও দুই ভ্রাতা ছিলেন। তাঁরা হলেন ধ্রুব এবং নগ্ন।) ৮১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ বড়োদরা তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, প্রথম কৃষ্ণ এক অধার্মিক আত্মীয়কে উচ্ছেদ করে পারিবারিক স্বার্থে (গোত্রহিতায়) রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। অনুমিত হয়, দন্তিদুর্গের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রকূট রাজপরিবারেরই এক সদস্য সিংহাসন অধিকার করেন কিন্তু কৃষ্ণ তাঁকে পদচ্যুত করে রাজপদ গ্রহণ করেন। কে এই অধার্মিক রাজকুমার তা জানা যায় না। সিংহাসনে আরোহণ করে কৃষ্ণ ‘শুভতুঙ্গ’ ও ‘অকালবর্ষ’ অভিধা ধারণ করেন।
রাজপদ লাভ করেই প্রথম কৃষ্ণ দক্ষিণ গুজরাতে রাষ্ট্রকূট কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। দন্তিদুর্গ এতদঞ্চল জয় করে তাঁর খুল্লতাতপুত্র গোবিন্দকে অধিকৃত ভূখণ্ডের প্রশাসক পদে নিযুক্ত করেন। কিন্তু গোবিন্দের পুত্র দ্বিতীয় কর্ক ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কর্ককে পরাজিত করে প্রথম কৃষ্ণ পুনরায় দক্ষিণ গুজরাতে রাষ্ট্রকূট শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
অতঃপর কৃষ্ণ চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মার বিরুদ্ধে সসৈন্যে অগ্রসর হন। বিগতশ্রী কীর্তি বর্মার আধিপত্য তখন কর্ণাটক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। এই যুদ্ধ কতদিন ধরে চলে তা জানা যায় না। তবে ৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ কৃষ্ণের নিজের এক লেখে চালুক্যদের বিরুদ্ধে তাঁর বিজয়লাভের কোনও উল্লেখ নেই। মনে হয়, ৭৫৮ খ্রিস্টাব্দের অব্যবহিত পরই কৃষ্ণ দ্বিতীয় কীৰ্তিবর্মাকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। সপুত্র কীর্তিবর্মা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। চালুক্যসূর্য অস্তমিত হল। উত্তর কর্ণাটকে রাষ্ট্রকূট প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হল।
দক্ষিণ গুজরাত ও উত্তর কর্ণাটক অধিকার করেই কৃষ্ণ পরিতুষ্ট হলেন না; কোঙ্কণ, গঙ্গবাড়ি ও অন্ধ্রপ্রদেশে স্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কোঙ্কণ সহজেই তাঁর পদানত হয়। বিজিত অঞ্চলের শাসনভার শণফুল্ল নামে জনৈক সামন্তের স্কন্ধে ন্যস্ত হয়। এই সামন্ত শণফুল্লই কোঙ্কণের শিলাহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। গঙ্গবাড়ি অভিযানে কৃষ্ণ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হন। গঙ্গবাড়ির রাজা তখন শ্রীপুরুষ। গঙ্গ রাজকুমার সিয়গল্প রাজ্যরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শ্রীরেমনের মতো বিদ্বজ্জনেরা মসি ছেড়ে অসি ধারণ করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের ন্যায় মৃত্যু বরণ করেন। প্রথমদিকে কয়েকটি যুদ্ধে গঙ্গসৈন্যরা জয়লাভ করেন কিন্তু শেষপর্যন্ত কৃষ্ণের নিকট তাঁরা পরাজিত হন। রাষ্ট্রকূট রাজ গঙ্গরাজ্যের প্রচুর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেন। লুণ্ঠিত অর্থের কিয়দংশে গঙ্গ রাজধানী মান্যপুরমে কয়েকটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। রাষ্ট্রকূট নৃপতি এ স্থানে একখানি লেখও উৎকীর্ণ করেন।
শ্রীপুরুষকে পরাজিত করে কৃষ্ণ গঙ্গবাড়ির বৃহদংশ স্বীয় অধিকারভুক্ত করেন। গঙ্গবাড়ির এক ক্ষুদ্রাঞ্চলে শ্রীপুরুষ কৃষ্ণের সামন্তরূপে রাজকার্য পরিচালনা করেন। অন্ধ্রপ্রদেশে অবস্থিত বেঙ্গীর চালুক্যদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন যুবরাজ গোবিন্দ। তিনি সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে ৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে কৃষ্ণা ও মুসী নদীর সঙ্গমস্থলে উপনীত হন। বেঙ্গীর চালুক্যরাজ চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন রাষ্ট্রকূট বাহিনীর সম্মুখীন না হয়ে রাজ্যের এক বৃহদংশ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে গোবিন্দের সন্তোষবিধান করেন। গোবিন্দের বেঙ্গী অভিযানের ফলে অন্ধ্র প্রদেশের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল রাষ্ট্রকূটদের অধিকারভুক্ত হয়।
একাধিক রাষ্ট্রকুট লেখে ঘোষিত হয়েছে, রাজা রাহপ্পকে পরাভূত করে কৃষ্ণ পালিধ্বজ আত্মসাৎ করেন এবং রাজাধিরাজ ও পরমেশ্বর অভিধায় ভূষিত হন। ফ্লিট সাহেবের মতে রাহ ও দক্ষিণ গুজরাতের বিদ্রোহী প্রশাসক দ্বিতীয় কর্ক এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আবার রাহপ্প এবং দ্বিতীয় কীর্তিবর্মা একই ব্যক্তি ছিলেন, এরূপ অভিমত কোনও কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু রাহপ্পের সঠিক পরিচয় আজও রহস্যই রয়ে গেছে।
যুদ্ধবিগ্রহে সুনিপুণ এই রাজা শিক্ষা ও সংস্কৃতির অকৃত্রিম অনুরাগী ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে বহু গ্রাম ও জমি দান করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বহু সুউচ্চ ও দৃষ্টিনন্দন মন্দির নির্মিত হয়। কাঞ্চীপুরমের কৈলাসনাথ মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত এলোরার সুবিখ্যাত কৈলাস মন্দির তাঁরই কীর্তি। পূর্বে এই মন্দিরটি কৃষ্ণেশ্বর বা কন্নেশ্বর নামে পরিচিত ছিল। মন্দিরের কোথাও তাঁর নাম উৎকীর্ণ হয়নি। এতে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয় ও প্রচার বিমুখতাই প্রকাশ পেয়েছে।
দ্বিতীয় গোবিন্দ (আ. ৭৭২-৮০ খ্রিস্টাব্দ)
প্রথম কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় গোবিন্দ রাজপদে অভিষিক্ত হন। দৌলতাবাদ লেখ থেকে জানা যায়, তিনি গোবর্ধন ও পারিজাত নামে দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাকে পরাজিত করেন। কিন্তু এই রাজাদের বংশপরিচয় বা তাঁদের রাজ্যের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না।
সিংহাসনে আরোহণের কিছুকাল পরই দ্বিতীয় গোবিন্দ বিলাসব্যসনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন এবং রাজ্যের পরিচালন-দায়িত্ব তাঁর অনুজ ধ্রুবের হস্তে অর্পণ করেন। ধ্রুব ছিলেন নাসিক খান্দেশ অঞ্চলের প্রাদেশিক শাসনকর্তা। ক্ষমতা পেয়ে ধ্রুবের উচ্চাশা আরও বৃদ্ধি পায় এবং তিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে সিংহাসনচ্যুত করতে উদ্যত হন। দ্বিতীয় গোবিন্দ অনুজের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাঁকে পদচ্যুত করেন ও রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। ধ্রুব ভ্রাতাকে গদিচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। গোবিন্দ নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলেন না। তিনি গঙ্গবাড়ি, কাঞ্চীপুরম, বেঙ্গী ও মালবের রাজাদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। এই রাজগণের সঙ্গে রাষ্ট্রকূটদের ছিল চিরশত্রুতা। ফলে গোবিন্দের এই কাজে রাজ্যের বহু পদস্থ রাজপুরুষ ক্রুদ্ধ হন ও ধ্রুবের পক্ষে যোগদান করেন। মিত্র রাজাদের কাছ থেকে সাহায্য আসার পূর্বেই ধ্রুব দ্বিতীয় গোবিন্দকে পরাজিত করে সিংহাসন অধিকার করেন। গোবিন্দ সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন কিংবা অনুজের হাতে বন্দি হয়ে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি কারাগারে অতিবাহিত করেন। রাষ্ট্রকূট রাজ্যের ভাগ্যবিধাতারূপে আবির্ভূত হলেন ধ্রুব।
ধ্রুব ধারাবর্ষ (আ. ৭৮০-৯৩ খ্রিস্টাব্দ)
আনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ধ্রুব রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের এক শ্রেষ্ঠ রাজা তিনি। শুধু দক্ষিণ ভারতে নয়, বিন্ধ্য পর্বতমালা অতিক্রম করে উত্তর ভারতেও তিনি বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন। তাঁরই রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূট রাজ্যটি এক অপ্রতিরোধ্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ‘ধারাবর্ষ’, ‘নিরুপম’, ‘কলিবল্লভ’ ইত্যাদি অভিধায় তিনি ভূষিত হন।
রাজপদ অধিগ্রহণ করে তিনি রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনে মনোনিবেশ করেন। রাজপরিবারে গৃহবিবাদের সুযোগে অনেক পদস্থ রাজপুরুষ, সামন্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, কেউবা প্রকাশ্যে দ্বিতীয় গোবিন্দের পক্ষে যোগদান করেন। ধ্রুব তাঁদের সকলকে স্ববশে এনে রাজ্যে নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
এবার তাঁর দৃষ্টি পড়ল বিরুদ্ধাচারী প্রতিবেশী রাজন্যবৃন্দের প্রতি। গঙ্গবাড়ি, বেঙ্গী, কাঞ্চীপুরম ও মালবের রাজারা গোবিন্দের পক্ষ সমর্থন করায় স্বাভাবিক কারণেই তাঁর বিরাগভাজন হন। তাঁদের সমুচিত শিক্ষা দিতে অগ্রসর হন তিনি।
ধ্রুব গঙ্গবাড়ির রাজা শ্রীপুরুষ মুত্তরসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। শ্রীপুরুষ তখন বৃদ্ধ ও অশক্ত ; রাজ্যের প্রকৃত পরিচালক যুবরাজ শিবমার। রাজনীতি অপেক্ষা বিদ্যাচর্চাতেই যুবরাজের অধিক আগ্রহ। প্রথমদিকে কয়েকটি যুদ্ধে তিনি জয়লাভও করেন। কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন। শিবমার পরাজিত ও বন্দি হন। সমগ্র গঙ্গবাড়ি ধ্রুবের পদানত হয়। রাজকুমার স্তম্ভ রণাবলোক গঙ্গবাড়ির শাসনভার প্রাপ্ত হন।
ধ্রুবের বেঙ্গী অভিযানের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে পম্পভারত কাব্যে। এই অভিযানে তাঁকে সাহায্য করেন বেমুলবাড়ের বিশ্বাসভাজন সামন্ত প্রথম অরিকেশরী। যুদ্ধে বেঙ্গীরাজ চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন পরাজিত হন। শেষে বিবদমান রাজপরিবার দু’টির মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। বেঙ্গী রাজ্যের কিয়দংশ রাষ্ট্রকূট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অরিকেশরী বিজিত অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত হন। চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন নিজ কন্যা শীলমহাদেবীর সঙ্গে ধ্রুবের বিবাহ দেন। শীলমহাদেবী হন রাষ্ট্রকূটরাজের প্রধানা মহিষী।
এরপর ধ্রুব পল্লবরাজ দন্তিবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রকূট লেখে দাবি করা হয়েছে, একদিকে বিপুল বারিধি এবং অন্যপ্রান্তে সুবিশাল রাষ্ট্রকূট সৈন্যবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে পল্লবনৃপতি আতঙ্কিত হন এবং ধ্রুবকে প্রচুর রণহস্তী উপঢৌকনস্বরূপ প্রদান করেন। লক্ষ করবার বিষয়, রাষ্ট্রকূট লেখে কাঞ্চীপুরম বিজয়ের দাবি উত্থাপিত হয়নি। অনুমিত হয়, ধ্রুব পল্লব রাজ্যের সীমান্তে কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং পল্লবরাজের রণহস্তী উপহারে সন্তুষ্ট হয়ে বিজয়াভিযান প্রত্যাহার করেন। এ অভিযানে তাঁর শ্বশুর বেঙ্গীরাজ চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন তাঁকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন।
অতঃপর ধ্রুব তাঁর সুযোগ্য পুত্রদ্বয় গোবিন্দ ও ইন্দ্র সহ সসৈন্যে উত্তর ভারত অভিমুখে অগ্রসর হন। তখন উত্তর ভারতের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে মধ্য ও পশ্চিম ভারতের গুর্জর প্রতীহার এবং বাংলা-বিহারের পাল রাজাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। গুর্জর-প্রতীহার নৃপতি বৎসরাজ গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে পালনৃপতি ধর্মপালকে পরাজিত করেছেন। নিজের শক্তিকে সংহত করে ধর্মপাল পুনর্বার বৎসরাজের বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে চলেছেন।
ধ্রুব নর্মদা নদী অতিক্রম করে অবলীলাক্রমে বৎসরাজের রাজ্যভুক্ত মালব অধিকার করেন। এরপর তিনি কান্যকুব্জ অভিমুখে অগ্রসর হন। তাঁর লক্ষ্য বৎসরাজ। অনন্ত সদাশিব অলতেকর মনে করেন, ঝাঁসির সন্নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে উভয়পক্ষে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধে বৎসরাজ শোচনীয়রূপে পরাস্ত হন। রাজস্থানের মরু অঞ্চলে তিনি পলায়ন করেন। বৎসরাজের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের পর ধ্রুব ধর্মপালের সম্মুখীন হন। এ সময় পালরাজ সসৈন্যে গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে অবস্থান করছিলেন। ধর্মপাল যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন। রাষ্ট্রকূট লেখ দাবি করছে, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালনৃপতি রণে ভঙ্গ দেন।
যুদ্ধে জয়লাভ করে রাষ্ট্রকূটরাজ কিছুকাল দোয়াবে অবস্থান করেন। তিনি আর অগ্রসর হলেন না, কান্যকুব্জও অধিকার করলেন না। দীর্ঘদিন তিনি প্রবাসে। বার্ধক্যের ভারও ছিল। আর কালবিলম্ব না করে তিনি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। দোয়াবে বিজয়লাভের স্মারকরূপে এখন থেকে রাষ্ট্রকূট পতাকায় গঙ্গা ও যমুনার প্রতিকৃতি চিত্রায়িত হতে থাকে।
স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তনের পর ধ্রুব উত্তরাধিকার সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হন। তাঁর অন্যূন চার পুত্র–কর্ক, স্তম্ভ, গোবিন্দ ও ইন্দ্র। কর্ক পিতার জীবিতকালে পরলোক গমন করেন। ধ্রুব উপলব্ধি করেন, গোবিন্দ স্তম্ভের কনিষ্ঠ হলেও রাজকুমারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম, রাজ্যের গুরুভার বহনের যোগ্যতম পাত্র। স্বীয় সিদ্ধান্তে অটল থেকে তিনি গোবিন্দকেই তাঁর উত্তরাধিকারী রূপে মনোনীত করেন। স্তম্ভকে গঙ্গবাড়ির প্রদেশপালের পদে সম্মানিত করা হয়। ইন্দ্রকে দেওয়া হয় গুজরাত মালবের শাসনকর্তৃত্ব। ৭৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দে গোবিন্দ মহাসমারোহে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হন। এর অনতিকাল পর ধ্রুবের জীবনাবসান হয়।
প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক আকাশের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ধ্রুব। তিনি মাত্র ত্রয়োদশ বৎসরকাল রাজত্ব করেন। কিন্তু এই অত্যল্প সময়ের মধ্যেই রাষ্ট্রকূট রাজ্য গৌরব ও সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে আরোহণ করে। গঙ্গ, চালুক্য এবং পল্লবদের পরাভূত করে তিনি রাষ্ট্রকূট রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত করেন। বৎসরাজ ও ধর্মপালের মতো দু’জন সার্বভৌম নরপতিকে শোচনীয়রূপে পরাজিত করে তিনি উত্তর ভারতেও তাঁর পরাক্রম প্রদর্শন করেন। তাঁর সময়কালে অখিল ভারতে এমন কোনও রাজা ছিলেন না যিনি তাঁর সমকক্ষ হতে পারেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গোবিন্দকে সিংহাসনচ্যুত করায় তাঁর চারিত্রিক গৌরব কিছুটা নিষ্প্রভ হয়েছে ঠিকই কিন্তু এ কথাও সত্য, গোবিন্দের মতো দুর্বল ও তরলমতি ব্যক্তি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকলে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের অস্তিত্বই বিপন্ন হত।
তৃতীয় গোবিন্দ (আ. ৭৯৩-৮১৪ খ্রিস্টাব্দ)
ধ্রুবের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজপদ লাভ করেই তিনি ‘প্রভূতবর্ষ’ ও ‘জগত্তুঙ্গ’ অভিধায় ভূষিত হন। পরবর্তিকালে তিনি ‘জনবল্লভ’, ‘কীর্তিনারায়ণ’ এবং ‘ত্রিভুবনধবল’ অভিধা ধারণ করেন। তাঁর এক মহিষীর নাম গামুন্দব্বে।
রাষ্ট্রকূট রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি তিনি। ধ্রুবের নেতৃত্বে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের যে বিজয় যাত্রা শুরু হয়, তাঁরই সুদক্ষ পরিচালনায় তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। তৃতীয় গোবিন্দের রাজত্বকাল রাষ্ট্রকূট ইতিহাসের উজ্জ্বলতম পর্ব। রাজপদ গ্রহণ করেই তৃতীয় গোবিন্দ রাজ্যের পদস্থ রাজপুরুষ ও সামন্তবর্গের আনুগত্য লাভে সচেষ্ট হন। পিতা তাঁকে রাজপদে মনোনীত করায় তাঁদের অনেকেই তাঁর প্রতি রুষ্ট হন। গোবিন্দ আশ্বাস দিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর পিতৃপ্রতিম।
গোবিন্দের সিংহাসনলাভ স্তম্ভ হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করলেন না। তিনি তাঁর অনুজকে পদচ্যুত করতে বদ্ধপরিকর হন। একক শক্তিতে কার্যসিদ্ধি অসম্ভব জেনে তিনি কয়েকজন সামন্ত ও প্রতিবেশী রাজাদের নিয়ে এক শক্তিশালী বিরুদ্ধগোষ্ঠী গঠন করে ভ্রাতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে প্রস্তুত হন। স্তম্ভের দলে ছিলেন নোলম্ববাড়ির রাজা চরুপোন্নের, বনবাসির রাজা কত্তিয়ির, ধারবাড়ের সামন্তরাজ মারুশর্ব এবং আরও অনেকে।
গোবিন্দ গুপ্তচর মারফৎ স্তম্ভের গতিবিধির সব খবরই অবগত হন। গঙ্গবাড়িতে স্তম্ভের প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশ্যে তিনি শিবমারকে রাষ্ট্রকূট কারাগার থেকে মুক্তি দেন। তিনি ভেবেছিলেন, গঙ্গরাজকুমার স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে স্তম্ভের বিরুদ্ধাচরণ করবেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত। গঙ্গবাড়িতে ফিরে শিবমার স্তম্ভের পক্ষে যোগদান করেন।
গোবিন্দ আর বিলম্ব করলেন না। অনুগত ভ্রাতা ইন্দ্রের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করে তিনি স্তম্ভের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহির্গত হন। মিত্রদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য আসার পূর্বেই স্তম্ভ আক্রান্ত ও বন্দি হন। পরাজিত ভ্রাতার প্রতি গোবিন্দ সদয় আচরণ করেন। তাঁকে বোঝান, স্বর্গত পিতার ইচ্ছাক্রমেই তিনি রাজপদ গ্রহণ করেছেন। ইন্দ্রের প্রচেষ্টায় বিবদমান দুই ভ্রাতার মধ্যে হৃদ্যতা স্থাপিত হয়। স্তম্ভ পুনরায় গঙ্গবাড়ির প্রদেশপাল নিযুক্ত হন। কিন্তু বিদ্রোহী শিবমারের অবস্থা হল শোচনীয়। গোবিন্দ ও স্তম্ভ একযোগে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি পরাজিত ও বন্দি হন। শিবমারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাষ্ট্রকূট বাহিনীর বিপক্ষে আরও কিছুদিন যুদ্ধ পরিচালনা করেন কিন্তু শেষে তিনিও পরাজয় বরণ করেন। স্তম্ভ আর কখনও অনুজের বিরুদ্ধাচরণ করেননি।
গঙ্গবাড়ি অভিযানের পর গোবিন্দ নোলম্ববাড়ির রাজা চরুপোন্নেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। শিবমারের করুণ পরিণতি দেখে চরুপোন্নের বিনাযুদ্ধে গোবিন্দের বশ্যতা স্বীকার করেন। তাঁকে স্বরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়।
গোবিন্দ অতঃপর কাঞ্চীরাজ দন্তিগ বা দন্তিবর্মার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন ও তাঁকে পরাভূত করেন। এভাবে গোবিন্দ ৭৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নিজেকে দক্ষিণ ভারতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। দক্ষিণ ভারতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারতের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেন। তাঁর পিতার অভিযানের পর উত্তর ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে বহু দৃশ্য অভিনীত হয়েছে। ধ্রুব ধর্মপাল ও বৎসরাজ উভয় নৃপতিকেই পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ধর্মপাল তাঁর শক্তিকে সংগঠিত করেন, ইন্দ্রায়ুধকে বিতাড়িত করে অনুগত এবং বিশ্বাসভাজন চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের রাজসিংহাসনে মনোনীত করেন। ইতিমধ্যে বৎসরাজ পরলোকগমন করেন, তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নাগভট পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। দ্বিতীয় নাগভট ছিলেন এক শক্তিমান ও বিচক্ষণ নরপতি। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই প্রায় সমগ্র রাজস্থান, মালব এবং গুজরাতের উত্তরাঞ্চলে নিজের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন, শুধু তাই নয়, অন্ধ্র, সিন্ধু, বিদর্ভ ও কলিঙ্গের রাজাদের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে এক শক্তিশালী মিত্রজোট গঠন করেন। এক শক্তিধর রাষ্ট্ররূপে প্রতীহার রাজ্যের পুনরভ্যুদয় ঘটল।
ঠিক এই মুহূর্তে তৃতীয় গাবিন্দের উত্তর ভারত অভিযান। এই অভিযানের প্রকৃত কারণ আজও রহস্যাবৃত। অনেকে বলেন, পালরাজ ধর্মপাল তাঁকে ক্রমবর্ধমান প্রতীহাররাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করেন। এ মত কিন্তু প্রমাণসিদ্ধ নয়। হয়তো গুজরাত ও মালবে রাষ্ট্রকূট অধিকার বিস্তারের উদ্দেশ্যেই তৃতীয় গোবিন্দের এই উত্তরাপথ অভিযান।
উত্তর ভারত অভিযানের পূর্বে গোবিন্দ রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইন্দ্ৰকে লাট প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় নাগভট যাতে লাট বা মালবের পথে দক্ষিণ ভারত আক্রমণ না করেন, সেদিকে তাঁকে সতর্ক থাকতে বলা হয়। মধ্যপ্রদেশের কয়েকটি স্থানে সেনা-শিবির স্থাপন করা হয়। এর পিছনে দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। এক, স্থানীয় রাজারা রাষ্ট্রকূটদের বশীভূত থাকবেন। দুই, প্রয়োজনে এই সৈন্যবাহিনী অগ্রগামী রাষ্ট্রকুট সৈন্যদের সাহায্য করবে।
তৃতীয় গোবিন্দ ভুপাল ও ঝাঁসির পথে প্রতীহার রাজ্য অভিমুখে অগ্রসর হন। ঝাঁসি ও গ্বালিয়রের মধ্যবর্তী কোনও এক স্থানে দ্বিতীয় নাগভট গোবিন্দকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন কিন্তু শত্রুসেনার হাতে পরাজিত হন। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে, এই বিবেচনায় গোবিন্দ দ্বিতীয় নাগভটকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদের চেষ্টা থেকে বিরত হন। ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ বিনাযুদ্ধে গোবিন্দের নিকট আত্মসমর্পণ করেন।
উত্তর ভারত অভিযানকালে তৃতীয় গোবিন্দ কতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হন, তা এক বিতর্কিত বিষয়। পুত্র প্রথম আমোঘবর্ষের সঞ্জান তাম্রশাসনে সদম্ভে ঘোষিত হয়েছে, তৃতীয় গোবিন্দের হস্তী, অশ্ব ও রণবাদ্যের ধ্বনি হিমালয়ের গুহা কন্দরে প্রতিধ্বনিত হয়। এই বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে নীলকান্ত শাস্ত্রী অনুমান করেন, উত্তর ভারত অভিযানে গোবিন্দ হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত অগ্রসর হন। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের অভিমত, রাষ্ট্রকূট বাহিনী কান্যকুব্জে পৌঁছবার পূর্বেই চক্রায়ুধ বশ্যতা স্বীকার করেন; ফলে গোবিন্দ আর উত্তর দিকে অগ্রসর না হয়ে এলাহাবাদ, বারাণসী ও গয়ার মতো পবিত্র তীর্থস্থানসমূহ পরিদর্শন করে চিত্রকূট ও সগরের পথ ধরে স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। সে যা হোক, গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযান নিছকই এক ক্ষণস্থায়ী সমরাভিযান; উত্তরাপথে স্থায়ী রাষ্ট্রকূট আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই অভিযান পরিচালিত হয়নি। উত্তর ভারতে রাজ্য স্থাপনের বাসনা তাঁর ছিল না। বিজিত রাজাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতিতে সন্তুষ্ট চিত্ত হয়ে তিনি আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দে গ্রীষ্মাবসানে দক্ষিণ ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন।
অনুমিত হয়, রাষ্ট্রকূট সৈন্যদল উত্তর ভারত থেকে প্রস্থান করলে দ্বিতীয় নাগভট পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মপালকে পরাজিত করেন। তিনি রাষ্ট্রকূট অধিকৃত লাট অঞ্চলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেন কিন্তু স্থানীয় প্রশাসক কর্কের কর্মতৎপরতায় তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
দক্ষিণ ভারতে প্রত্যাবর্তনকালে তৃতীয় গোবিন্দ মধ্য ভারতে এসে উপনীত হন। সেখানে তাঁর সেনানায়কেরা ইতিমধ্যেই কতিপয় স্থানীয় রাজাদের পরাজিত করেছেন। চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন পরাজিত রাজাদের একজন। তিনি ছত্তীসগঢ় অঞ্চলের পাণ্ডুবংশী রাজা ছিলেন।
তৃতীয় গোবিন্দ নর্মদা নদীর তীরে শিবির স্থাপন করেন। দূতমুখে গোবিন্দের উপস্থিতির সংবাদ পেয়ে বিন্ধ্যাঞ্চলের অধিপতি শর্ব সভয়ে রাষ্ট্রকূটরাজের বশ্যতা স্বীকার করেন। গোবিন্দ শর্বের রাজধানী শ্রীভবন নগরে বর্ষাযাপন করেন। এখানে অবস্থানকালে তাঁর পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষের জন্ম হয়। মহাসমারোহে পুত্রের জন্মদিন উদযাপিত হয়। জ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, নবজাতক রাজচক্রবর্তী হবেন। ভরোচ জেলার সরভোনই প্রাচীন শ্রীভবন।
গোবিন্দের স্বরাজ্যে দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির সুযোগে পল্লব, চোল, পাণ্ড্য, কেরল ও গঙ্গ রাজারা এক মিত্র জোট গঠন করে সমবেতভাবে রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণ করেন। সংবাদ অবগত হয়ে গোবিন্দ ত্বরিতগতিতে নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে বিবদমান দু’টি পক্ষ পরস্পরের সম্মুখীন হয়। আনুমানিক ৮০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধে শত্রুবাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। গঙ্গরাজ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। রাষ্ট্রকূট সৈন্যগণ কাঞ্চীপুরম ও তঞ্জাবৃরে প্রবেশ করেন। ৮০৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গোবিন্দ সসৈন্যে রামেশ্বরমে উপস্থিত হন।
বিজয়ী রাষ্ট্রকূট বাহিনী যখন কাঞ্চীপুরম ও তঞ্জাবূরে অবস্থান করছেন তখন সিংহলনৃপতি গোবিন্দের মনোতুষ্টির জন্য তাঁর নিজের এবং প্রধানমন্ত্রীর দু’টি প্রতিমূর্তি তাঁকে উপঢৌকনস্বরূপ প্রেরণ করেন। গোবিন্দ মূর্তি দু’টি গ্রহণ করেন। রাজধানী মালখেড়ের এক শিবমন্দির চত্বরে মূর্তি দু’টি বিজয়স্তম্ভরূপে স্থাপিত হয়।
যতদিন মাতামহ চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন বেঙ্গীর রাজপদে সমাসীন ছিলেন ততদিন রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে চালুক্যদের মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আনুমানিক ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিজয়াদিত্যের বেঙ্গীর সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কের অবসান হয়। রাজা হয়েই দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য গোবিন্দের আনুগত্য অস্বীকার করেন, স্বাধীন রাজার ন্যায় আচরণ করেন। কিন্তু চালুক্য রাজপরিবারে শীঘ্রই অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বিজয়াদিত্যের অনুজ ভীম সলুকি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তৃতীয় গোবিন্দ কনিষ্ঠ রাজকুমারের পক্ষ অবলম্বন করেন। আনুমানিক ৮০২ খ্রিস্টাব্দে বিজয়াদিত্য রাষ্ট্রকূট বাহিনীর নিকট পরাজিত হন। ভীম বেঙ্গীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকূট আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
আনুমানিক ৮১৪ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় গোবিন্দ পরলোক গমন করেন। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি তৃতীয় গোবিন্দ। উত্তরে কান্যকুব্জ থেকে দক্ষিণে রামেশ্বরম এবং পূর্বে বারাণসী থেকে পশ্চিমে ব্রোচ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে তিনি সফলতার সঙ্গে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। দ্বিতীয় নাগভট ও ধর্মপালের মতো পরাক্রান্ত রাজারা তাঁর নিকট নতি স্বীকার করেন; কান্যকুব্জাধীশ চক্রায়ুধ তাঁর আনুগত্যাধীন ছিলেন ; বেঙ্গী রাজ্যে তাঁর কর্তৃত্ব অটুট ছিল; দ্রাবিড় রাজারা তাঁর নিকট পরাজয় বরণ করেন; সিংহলের রাজা তাঁর অনুগত ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে গঙ্গবাড়ি রাষ্ট্রকূট শাসনভুক্ত হয় ; মালব অঞ্চল রাষ্ট্রকূটদের অধীনতা পাশে আবদ্ধ হয়। সমরনৈপুণ্য, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সংগঠনশক্তির অপূর্ব সমন্বয় ঘটে ছিল তৃতীয় গোবিন্দের চরিত্রে। কান্যকুব্জ থেকে রামেশ্বরম পর্যন্ত বিস্তৃত শত্রুরাজাদের যেভাবে অবলীলাক্রমে তিনি পরাজিত করেছেন তা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। যে কৌশলে তিনি স্তম্ভকে স্বপক্ষে আনয়ন করেন তা তাঁর গভীর রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিচায়ক। মালব জয় করে তিনি রাষ্ট্রকূট রাজ্যের নিরাপত্তা নিচ্ছিদ্র করেন। ভারতে যত সমরনিপুণ ও বিচক্ষণ রাজা জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের পুরোভাগে গোবিন্দের অবস্থান।
প্রথম অমোঘবর্ষ (আ. ৮১৪-৮০ খ্রিস্টাব্দ)
তৃতীয় গোবিন্দের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্র শর্ব পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। রাজপদে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি ‘অমোঘবর্ষ’ অভিধা ধারণ করেন। পরবর্তিকালে এই অভিধাতেই তিনি সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ‘নৃপতুঙ্গ’, ‘রট্টমার্তগু’, ‘বীরনারায়ণ’, ‘অতিশয়ধবল’, ‘বল্লভ’, ‘পৃথিবীবল্লভ’ ইত্যাদি বহু অভিধায় তিনি ভূষিত হন।
চতুর্দশ বা পঞ্চদশ বৎসর বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর খুল্লতাত পুত্র কর্ক অভিভাবকরূপে রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
তাঁর সিংহাসনলাভের অনতিকালমধ্যে রাজ্যে বিদ্রোহের দামামা বেজে ওঠে। স্তম্ভের পুত্র শঙ্করগণ সম্ভবত এই বিদ্রোহের এক নায়ক ছিলেন। এই বিদ্রোহের আর এক হোতা বেঙ্গীর দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য। শিবমারও গঙ্গবাড়িতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রকূট রাজ্যের কতিপয় মন্ত্রী ও পদস্থ রাজপুরুষও বিদ্রোহীদের দলে যোগদান করেন। রাষ্ট্রকূট অভিলেখে বিদ্রোহীদের তালিকায় শৌল্কিক ও রাষ্ট্রকূটদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। রাষ্ট্রকূটেরা সম্ভবত রাজপরিবার বা বিভিন্ন রাষ্ট্রকূট শাখার সদস্য ছিলেন। কিংবা তাঁরা হয়তো রাষ্ট্র বা জেলার প্রশাসক ছিলেন।
প্রথমদিকে বিদ্রোহীদের সাফল্য ছিল রীতিমতো চমকপ্রদ। সর্বত্রই তাঁদের জয়জয়কার। অমোঘবর্ষ রাজধানী ছেড়ে পলায়ন করেন। সমকালীন এক রাষ্ট্রকূট লেখে এই ঘটনার উল্লেখ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘সূর্য অস্তমিত, আকাশে চন্দ্র-তারা দীপ্তোজ্জ্বল’। দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভীমকে পদচ্যুত করে বেঙ্গীর সিংহাসন অধিকার করেন। রাষ্ট্রকূট বাহিনী অবশ্য গঙ্গ বাড়িতে কিছুটা সাফল্য লাভ করে। টুমকুর জেলায় অবস্থিত কগিমোগেয়ুরের যুদ্ধে গঙ্গরাজ শিবমার নিহত হন। শিবমারের মৃত্যুতে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজমল্ল গঙ্গ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ অব্যাহত রাখেন।
কর্ক পাতালমল্লের নিরলস চেষ্টায় ৮২১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের মধ্যে বিদ্রোহ অনেকটা প্রশমিত হয়। প্রথম অমোঘবর্ষ সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু তখনও দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য বেঙ্গী অধিকার করে আছেন, গঙ্গবাড়িতে রাজমল্লের সঙ্গে রাষ্ট্রকূটদের যুদ্ধ চলছে।
শীঘ্রই গঙ্গবাড়ির উত্তরাঞ্চলে রাষ্ট্রকূট কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। সেনাপতি বঙ্কেয় অধিকৃত অঞ্চলের প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে রাজমল্লের সংঘর্ষ তখনও অব্যাহত। গঙ্গবাড়ির দক্ষিণার্ধ তাঁর অধিকারভুক্ত কিন্তু বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকুট বাহিনী অধিকতর সাফল্য লাভ করে। আনুমানিক ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য পরাজিত হন ও অমোঘবর্ষের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য হন। তিনি ও তাঁর পুত্র পঞ্চম বিষ্ণুবর্ধন উভয়েই দের অনুগত ছিলেন।
প্রায় এ সময় কর্কের মৃত্যু হয়। তিনি শুধু লাট-মালবের প্রদেশপালই ছিলেন না, প্রথম অমোঘবর্ষের অভিভাবকও ছিলেন। পিতৃব্য তৃতীয় গোবিন্দ তাঁকে অমোঘবর্ষের অভিভাবক রূপে মনোনীত করেছিলেন। কর্ক সে দায়িত্ব পরম নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেন।
কর্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ধ্রুব লাট-মালবের প্রদেশপালের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনকার্যের প্রথম পাঁচ বছর শান্তিতেই অতিবাহিত হয়। কিন্তু শেষে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। হয় উচ্চাভিলাষে তাড়িত হয়ে নতুবা অমোঘবর্ষের উদ্ধত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বিদ্রোহী হন। কিন্তু পিতার সামরিক প্রতিভা তাঁর ছিল না। আনুমানিক ৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে অমোঘবর্ষ তাঁকে পরাজিত ও নিহত করেন। ধ্রুবের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অকালবর্ষ অমোঘ বর্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি লাট-মালবের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। অকালবর্ষের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র তৃতীয় ধ্রুব অমোঘবর্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। তাঁকে সাহায্য করেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা গোবিন্দরাজ। বিপদ উপলব্ধি করে অমোঘবর্ষ সেনাপতি বঙ্কেয়কে গঙ্গবাড়ি থেকে ডেকে পাঠান, তাঁর হস্তে তৃতীয় ধ্রুবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের উত্তর সীমান্তে রাজা মিহির ভোজের নেতৃত্বে প্রতীহার রাজশক্তির পুনরভ্যুত্থানপর্ব শুরু হয়েছে। তৃতীয় ধ্রুব ও অমোঘবর্ষ উপলব্ধি করলেন, একক শক্তিতে ভোজের অগ্রগতি রুদ্ধ করা তাঁদের সাধ্যাতীত। আনুমানিক ৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বিবদমান দু’টি রাষ্ট্রকূট রাজপরিবারের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। প্রতীহারনৃপতি অবশ্য শেষপর্যন্ত তৃতীয় ধ্রুবকে উত্তর গুজরাত থেকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু দক্ষিণ গুজরাতে ধ্রুবের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে। অনুমিত হয়, ভোজের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে ধ্রুব প্রথম অমোঘবর্ষের সাহায্য লাভ করেন।
অমোঘবর্ষ যখন তৃতীয় ধ্রুবের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত প্রায় সেই সময় দ্বিতীয় বিজয়াদিত্যের পৌত্র গুণগ বিজয়াদিত্য বেঙ্গী পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। আনুমানিক ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাষ্ট্রকূট অধিকারভুক্ত কুর্ণল জেলায় অবস্থিত স্তম্ভপুরী আক্রমণ করেন। কিন্তু অমোঘবর্ষ কুত্তমের যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করেন। তৃতীয় বিজয়াদিত্য অমোঘবর্ষের বশ্যতা স্বীকার করেন। বেঙ্গীর সিংহাসন তাঁকে প্রত্যর্পণ করা হয়। পরবর্তিকালে গঙ্গরাজ নীতিমার্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি রাষ্ট্রকূট বাহিনীর সেনাধ্যক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
গঙ্গবাড়িতে রাজমল্লকে উচ্ছেদের চেষ্টায় প্রথম অমোঘবর্ষ বিশেষ সফলকাম হননি। যতদিন বঙ্কেয় উত্তর গঙ্গবাড়ির প্রাদেশিক শাসনকর্তা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ততদিন তিনি নানাভাবে রাজমল্লকে ব্যতিব্যস্ত করেন। বঙ্কেয়ের আক্রমণের তীব্রতায় রাজমল্ল কাবেরী নদীর উত্তর তট থেকে প্রস্থান করেন। কিন্তু শীঘ্রই অমোঘবর্ষের আদেশে বিদ্রোহ দমনের জন্য বন্ধেয় লাট-মালবে গমন করেন। এই সুযোগে রাজমল্ল তাঁর পৈতৃক রাজ্যের বৃহদংশ পুনরধিকার করেন। অমোঘবর্ষ গঙ্গবাড়ি জয়ের আশা বিসর্জন দিলেন না। তিনি তাঁর অনুগত মিত্র বেঙ্গীরাজ তৃতীয় বিজয়াদিত্যকে সসৈন্যে গঙ্গবাড়িতে প্রেরণ করেন। (অনন্ত সদাশির অলতেকর অভিমত প্রকাশ করেছেন, তৃতীয় বিজয়াদিত্য প্রথম অমোঘবর্ষের মৃত্যুর পর নতুন রাষ্ট্রকূটনৃপতি দ্বিতীয় কৃষ্ণের প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশ্যে নোলম্ববাড়ি ও গঙ্গবাড়ি আক্রমণ করেন। কিন্তু বেঙ্গীরাজের নোলম্ববাড়ি ও গঙ্গবাড়ি অভিযানের তারিখ সঠিক নির্ধারিত না হওয়ায় তাঁর এই দু’টি অভিযানের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে স্বভাবতই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।) নীতিমার্গ তখন গঙ্গবাড়ির সিংহাসনে। তিনি রাজমল্পের পুত্র। যুদ্ধে নীতিমার্গ পরাজিত হন এবং বেঙ্গালুরু জেলার শিবগঙ্গা পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অবশেষে দু’পক্ষে সন্ধি স্থাপিত হয়। অমোঘবর্ষের কন্যা চন্দ্রোব্বলব্বা বা অবলব্বার সঙ্গে গঙ্গ রাজকুমার বূতুগের বিবাহ হয়। এর ফলে দুই রাজপরিবারের দীর্ঘস্থায়ী বৈরিতার অবসান হয়।
বিদ্রোহ দমন ও রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে প্রথম অমোঘবর্ষ সদা ব্যস্ত ছিলেন। উত্তর ভারতে সমরাভিযান পাঠানোর অবকাশ তাঁর ছিল না। ৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ সিরুর অভিলেখে দাবি করা হয়েছে, অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধের রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছেন। তাঁর সমকালীন পালনৃপতি নারায়ণপালও দাবি করেছেন, তিনি দ্রবিড়নাথকে পরাভূত করেছেন। হয়তো কখনও কখনও কোসল বা ওড়িশায় পাল ও রাষ্ট্রকূট সৈন্যদলের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ ঘটত। সেক্ষেত্রে কখনও পালরা কখনওবা রাষ্ট্রকূটরা জয়লাভ করতেন।
মধ্য ভারতের কলচুরি-চেদি রাজবংশের সঙ্গে তিনি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। কলচুরি রাজ প্রথম কোক্কল্লের এক কন্যার সঙ্গে যুবরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
যুদ্ধবিগ্রহে নয়, ধর্মানুশীলন ও সাহিত্যচর্চায় প্রথম অমোঘবর্ষের অধিক আগ্রহ ছিল। তাঁর সঞ্জান তাম্রশাসনে ঘোষিত হয়েছে, সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি একাধিকবার রাজপদ থেকে অবসর গ্রহণ করে সাধুসঙ্গ ও উপাসনায় দিন যাপন করেন। বিদ্বান ও সুলেখক ছিলেন তিনি। বহু কবি ও বিদ্বজ্জনের তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন। অলংকারবিষয়ক আদি কন্নড় গ্রন্থ কবিরাজমার্গ। অমোঘবর্ষই সম্ভবত গ্রন্থখানির রচয়িতা। এমনও হতে পারে, তাঁরই আগ্রহে ও অনুপ্রেরণায় অন্য কোনও ব্যক্তি গ্রন্থখানি রচনা করেন। জীবনের সায়াহ্ন বেলায় তিনি জৈনধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। আদিপুরাণের রচয়িতা জিনসেন দাবি করেছেন, তিনি অমোঘবর্ষের আচার্য ছিলেন। তবে তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্ম সম্পূর্ণরূপে পরিহার করেছিলেন বলে মনে হয় না। সঞ্জান তাম্র শাসনে বলা হয়েছে, রাজ্য হতে অমঙ্গল দূরীকরণের উদ্দেশ্যে তিনি বামহস্তের একটি অঙ্গুলি মহা লক্ষ্মীকে উৎসর্গ করেন। ভট্টকলঙ্ক তাঁর কর্ণাটকশব্দানুশাসনম গ্রন্থে অমোঘবর্ষের এই ত্যাগকে শিবিরাজ ও দধীচির আত্মত্যাগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাজারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে অন্যদের রক্ত ঝরান; অমোঘবর্ষ প্রজাসাধারণের হিতার্থে নিজের রক্ত ঝরিয়েছেন। ইতিহাসে এরূপ ঘটনা বিরল বৈকি।
দ্বিতীয় কৃষ্ণ (আ. ৮৮০-৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)
আনুমানিক ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম অমোঘবর্ষের পুত্র দ্বিতীয় কৃষ্ণ রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে আরোহণ করেন। ‘শুভতুঙ্গ’, ‘অকালবর্ষ’, ‘বল্লভ’, ‘পৃথিবীবল্লভ’ ইত্যাদি অভিধায় তিনি ভূষিত হন।
সিংহাসনে আরোহণের পর দ্বিতীয় কৃষ্ণ বেঙ্গীরাজ তৃতীয় বিজয়াদিত্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। যতদিন প্রথম অমোঘবর্ষ জীবিত ছিলেন ততদিন তৃতীয় বিজয়াদিত্য রাষ্ট্রকূটদের প্রতি অনুগত ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় কৃষ্ণ রাজপদে অভিষিক্ত হলে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁকে বশীভূত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। উপরন্তু কৃষ্ণ বিজয়াদিত্যের নিকট শোচনীয়রূপে পরাজিত হন এবং চেদি রাজসভায় তাঁর শ্বশুর প্রথম কোক্কল্ল ও শ্যালক শঙ্করগণের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এবার বিজয়াদিত্য সেনাধ্যক্ষ পাণ্ডুরঙ্গকে সসৈন্যে চেদিরাজ্য অভিযানে প্রেরণ করেন। বেঙ্গী সৈন্যদল কলিঙ্গ ও দক্ষিণ কোসলের পথ ধরে চেদিরাজ্য অভিমুখে অগ্রসর হয়। কলিঙ্গ, কোসল ও বেমুলবাড়ের রাজারা সকলেই চেদি ও রাষ্ট্রকূটদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। পাণ্ডুরঙ্গকে প্রতিহত করার তাঁদের সব আয়োজন ব্যর্থ হয়। পাণ্ডুরঙ্গ চেদিরাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। ডাহল বিধ্বস্ত হয়, চেদিরাজ্যের দু’টি প্রধান শহর কিরণপুর ও অচলপুর অগ্নিদগ্ধ হয়। যুদ্ধে দ্বিতীয় কৃষ্ণ ও শঙ্করগণ পরাজিত হন। শেষে উভয়পক্ষে সন্ধি স্থাপিত হয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণ বেঙ্গী রাজের আনুগত্য স্বীকার করেন ও রাজধানী মান্যখেটে প্রত্যাবর্তন করেন। তৃতীয় বিজয়াদিত্য নিজেকে ত্রিকলিঙ্গ ও অখিল দক্ষিণাপথের অধীশ্বররূপে ঘোষণা করেন।
এ অপমান কৃষ্ণ বেশি দিন সহ্য করেননি। আনুমানিক ৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় বিজয়াদিত্যের মৃত্যুতে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র প্রথম ভীম রাজপদ লাভ করেন। ভীমের অভিষেক অনুষ্ঠানের পূর্বেই কৃষ্ণ সসৈন্যে বেঙ্গী আক্রমণ করেন। এ অভিযানে তাঁকে প্রভূত সাহায্য করেন বেমুলবাড়ের চালুক্যরাজ বড্ডেগ। ভীম বড্ডেগের হাতে বন্দি হন। তাঁকে অবশ্য মুক্তি দেওয়া হয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণের অনুগত মিত্ররূপে তিনি স্বপদে বহাল থাকেন। বেঙ্গীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল রাষ্ট্রকূট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
বছর দশেক বেঙ্গীরাজ্যে দ্বিতীয় কৃষ্ণের কর্তৃত্ব অটুট থাকে। ইতিমধ্যে ভীম নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন ও রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। যুদ্ধে রাষ্ট্রকূট সেনাধ্যক্ষ গুণ্ডয় নিহত হন। ভীমের বীরপুত্র ইরিমণ্ডিগণ্ড গুরুতররূপে আহত হন। অযথা লোকক্ষয় নিবারণের উদ্দেশ্যে উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। কৃষ্ণ বেঙ্গীরাজ্যের বিজিত অঞ্চল প্রত্যর্পণ করেন। ভীমও রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণের বাসনা পরিত্যাগ করেন। এরপর কৃষ্ণ ও ভীম আর কখনও পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি।
রাজত্বের প্রারম্ভিক পর্বে দ্বিতীয় কৃষ্ণ গুর্জর প্রতীহার নৃপতি প্রথম ভোজের সঙ্গে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। ভোজ যখন কাশ্মীররাজ শঙ্করগণের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত তখন সম্ভবত দক্ষিণ গুজরাতের রাষ্ট্রকূট প্রশাসক কৃষ্ণরাজ উজ্জয়িনী অবরোধ করেন। এই রাষ্ট্রকূট প্রশাসক দাবি করছেন, তিনি রাজা বল্লভ অর্থাৎ দ্বিতীয় কৃষ্ণের উপস্থিতিতে উজ্জয়িনীতে শত্রু রাজাকে পরাভূত করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভোজের প্রবল প্রতিরোধে কৃষ্ণরাজ পশ্চাদপসরণ করেন। কৃষ্ণ রাজকে পশ্চাদ্ধাবন করে ভোজ দক্ষিণ গুজরাতে এসে উপস্থিত হন। নর্মদা তীরে বিবদমান পক্ষ পরস্পরের সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণ তাঁর আঞ্চলিক প্রশাসক কৃষ্ণরাজকে ভোজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করেন। যুদ্ধে রাষ্ট্রকূট বাহিনী পরাজিত হয়। কৃষ্ণরাজ সম্ভবত যুদ্ধে নিহত হন। তিনিই রাষ্ট্রকূটদের গুজরাত শাখার সর্বশেষ আঞ্চলিক রাজা। খেটক-মণ্ডল প্রতীহারদের অধিকারভুক্ত হয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণ অবশ্য তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে অর্থাৎ ৯১০ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পূর্বে দক্ষিণ গুজরাত পুনরুদ্ধার করেন। রাষ্ট্রকূট লেখে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় কৃষ্ণ খেটক-মণ্ডল থেকে অমিত্রদের উচ্ছেদ করেন। রাষ্ট্রকূট লেখে যাঁদের অমিত্র বলা হয়েছে, তাঁরা নিঃসন্দেহে গুর্জর প্রতীহার। তখন প্রথম ভোজ লোকান্তরিত ; প্রতীহার সিংহানে প্রথম মহেন্দ্রপাল সমাসীন।
দ্বিতীয় কৃষ্ণ চোলসম্রাট প্রথম আদিত্যের সঙ্গে নিজের এক কন্যার বিবাহ দেন। রাষ্ট্রকূট রাজ কন্যার গর্ভে আদিত্যের একটি পুত্র হয়। তাঁর নাম কন্নরদেব। আদিত্যের মৃত্যুর পর পরান্তক রাজা হলে কৃষ্ণ তাঁর দৌহিত্র কন্নরদেবের দাবির সমর্থনে, বাণদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে, চোলরাজ্য আক্রমণ করেন। কিন্তু পরান্তক তাঁর গঙ্গমিত্র দ্বিতীয় পৃথিবীপতি বা পৃথ্বীপতির সহায়তায় উত্তর আর্কট জেলায় বল্লালের যুদ্ধে শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে পরাভবের ফলে বাণরাজ্যের স্বাধীনতা বিনষ্ট হয় ও বাণরাজ্য চোলদের অধিকারভুক্ত হয়। দ্বিতীয় পৃথিবীপতি অধিকৃত অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত হন। পরান্তকের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে দ্বিতীয় কৃষ্ণের লাভ কিছুই হয়নি বরঞ্চ তাঁকে পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হয়।
দ্বিতীয় কৃষ্ণের নিজস্ব লেখে পূর্ব ভারত বিজয়ের কোনও দাবি উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু উত্তরকালীন রাষ্ট্রকূট লেখমালায় ঘোষণা করা হয়েছে, গৌড়রাজকে তিনি সহবত শিক্ষা দেন ; অঙ্গ, কলিঙ্গ ও মগধের রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। কৃষ্ণের সভাকবি গুণচন্দ্র বলেন, তাঁর রণ হস্তীরা গঙ্গার সুমিষ্ট জলে তৃপ্ত হয় এবং কন্যাকুমারিকায় বনরাজির স্নিগ্ধ ছায়াতলে বিশ্রাম-সুখ উপভোগ করে। অতিশয়োক্তিমূলক এসব দাবির মধ্যে কোনও বাস্তব ঘটনার প্রতিফলন নেই, এ কথা অবশ্যই বলা চলে না। দক্ষিণ ভারতের প্রান্তসীমায় তিনি হয়তো কখনও পদার্পণ করেননি কিন্তু রাষ্ট্রকূট লেখে তাঁর গৌড়-মগধ অভিযানের যে দাবি ঘোষিত হয়েছে, তা সর্বৈব অসত্য বলে বোধ হয় না। তাঁর এই অভিযান পূর্ব ভারতের, বিশেষত পালরাজ্যের, ধন-সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ও পরিচালিত নিছকই এক সমরাভিযান। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, ধ্রুব বা তৃতীয় গোবিন্দের সামরিক নৈপুণ্য তাঁর ছিল না। কিন্তু পৈতৃক রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় তাঁর সাফল্য নিঃসন্দেহে সপ্রশংস উল্লেখের দাবি রাখে।
প্রায় চৌত্রিশ বৎসর রাজত্ব করার পর ৯১৪ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে দ্বিতীয় কৃষ্ণ পরলোক গমন করেন। তাঁর দুর্ভাগ্য, তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র জগত্তুঙ্গ প্রয়াত হন। জগত্তুঙ্গের দুই পুত্র ছিলেন। ইন্দ্র ছিলেন জ্যেষ্ঠ। তিনি চেদি রাজকুমারী লক্ষ্মীর গর্ভজাত। (লক্ষ্মী ছিলেন দ্বিতীয় কৃষ্ণের শ্যালক শঙ্করগণের কন্যা।) কনিষ্ঠ পুত্র অমোঘবর্ষ ছিলেন লক্ষ্মীর ভগিনী গোবিন্দম্বার সন্তান। দ্বিতীয় কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র ইন্দ্ৰ পিতা মহের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তৃতীয় ইন্দ্ৰ (আ. ৯১৪-২৮ খ্রিস্টাব্দ)
রাষ্ট্রকুট রাজবংশের এক পরাক্রান্ত নরপতি তৃতীয় ইন্দ্র। তাঁর মহিষী বিজম্বা। প্রথম কোক্কল্লের পৌত্র অম্মনদেবের কন্যা তিনি।
সিংহাসনে আরোহণ করেই ইন্দ্র মালব পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করেন। মনে হয়, দ্বিতীয় কৃষ্ণ যখন চোলরাজ পরান্তকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত তখন গুর্জর-প্রতীহাররা মালব অধিকার করে পরমারবংশীয় উপেন্দ্ররাজকে বিজিত অঞ্চলের শাসনকর্তারূপে নিযুক্ত করেন। উপেন্দ্ররাজ মালবের অধিকার পেয়েই সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি রাষ্ট্রকূট রাজ্যভুক্ত নাসিকের গোবর্ধন শহর অবরোধ করেন। ইন্দ্র গোবর্ধন হতে উপেন্দ্ররাজকে বিতাড়িত করে মালবে প্রবেশ করেন। উপেন্দ্ররাজ পুনরায় পরাজিত হয়ে ইন্দ্রের বশ্যতা স্বীকার করেন।
মালব পুনরুদ্ধার করে তৃতীয় ইন্দ্র ৯১৬ খ্রিস্টাব্দের শরৎকালে সসৈন্যে কান্যকুব্জ অভি মুখে যাত্রা করেন। তখন কান্যকুব্জের অধিপতি প্রতীহাররাজ প্রথম মহীপাল। ভুপাল ঝাঁসির পথ ধরে অগ্রসর হয়ে ইন্দ্র যমুনা নদী অতিক্রমপূর্বক কান্যকুব্জ আক্রমণ করেন। রাষ্ট্রকূট সৈন্যদের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ রচনা না করে মহীপাল রাজধানী অরক্ষিত রেখে পলায়ন করেন। ইন্দ্র বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্ত দ্বিতীয় নরসিংহকে মহীপালকে অনুসরণ করতে আদেশ দেন। দ্বিতীয় নরসিংহের পুত্র অরিকেশরীর অনুগ্রভাজন কবি পম্পের ‘বিক্রমার্জুনবিজয়’ কাব্যে বলা হয়েছে, মহীপাল যেন বজ্রাহত ; তাঁর আহার-বিশ্রামের সময় নেই; তিনি পলায়মান। মহী পালের পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে দ্বিতীয় নরসিংহ গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম পর্যন্ত অগ্রসর হন। সন্দেহ নেই, তৃতীয় ইন্দ্রের এই অভিযানের ফলে মহীপাল কান্যকুব্জের আধিপত্য বিসর্জন দেন এবং পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু তৃতীয় ইন্দ্রের দক্ষিণ ভারতে প্রস্থানের অব্যবহিত পরই প্রতীহাররাজ কান্যকুব্জ পুনরধিকার করেন। ৯১৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই মহীপাল কান্যকুব্জে স্বীয় কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেন।
উত্তর ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ইন্দ্র বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকূট প্রভুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। সুযোগও এসে উপস্থিত হয়। চালুক্যরাজ ভীম দেহত্যাগ করেন, তাঁর পুত্র চতুর্থ বিজয়াদিত্য বেঙ্গীর রাজপদ অলংকৃত করেন। ইন্দ্র নতুন বেঙ্গীরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বীর্যপুরী নামক স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। চালুক্য লেখে দাবি করা হয়েছে, যুদ্ধে চালুক্য সৈন্য জয়লাভ করেন কিন্তু বিজয়াদিত্য মৃত্যুবরণ করেন। অনুমিত হয়, তৃতীয় ইন্দ্রের বিজয়াভিযানের ফলে বেঙ্গীর একাংশ রাষ্ট্রকূটদের অধিকারভুক্ত হয়। বেঙ্গীর বৃহদংশ অবশ্য বিজয়াদিত্যের পুত্র ও উত্তরাধিকারী প্রথম অম্মের কর্তৃত্বাধীন থাকে।
এ পর্বে বেঙ্গীর রাজনৈতিক ইতিহাস ততটা স্পষ্ট নয়। রাজাদের রাজত্বের স্থায়িত্ব ও ঘটনার পারম্পর্য সম্পর্কে বিদ্বজ্জন বিভিন্ন মত পোষণ করেন। নীলকান্ত শাস্ত্রীর অভিমত, প্রথম অন্ম ৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সগৌরবে বেঙ্গীতে রাজত্ব করেন। কিন্তু অনন্ত সদাশিব অলতেকর মনে করেন ৯২৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রথম অম্লের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র পঞ্চম বিজয়াদিত্য বেঙ্গীর রাজপদ অলংকৃত করেন; তাঁকে পদচ্যুত করে তৃতীয় ইন্দ্র চালুক্য রাজপরিবারের সদস্য প্রথম তালপকে বেঙ্গীর সিংহাসন অর্পণ করেন; প্রথম ভীমের পুত্র দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য এক মাসের মধ্যেই তালপকে নিহত করে বেঙ্গীর সিংহাসন অধিকার করেন; ইন্দ্র তাঁকে বিতাড়িত করে ৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তালপের পুত্র যুদ্ধমল্লকে বেঙ্গীর রাজপদে নিযুক্ত করেন; রাষ্ট্রকূটদের সহায়তায় যুদ্ধমল্ল ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকেন। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের এ অভিমত গ্রাহ্য হলে স্বীকার করতে হবে, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তৃতীয় ইন্দ্র তাঁর রাজত্বের অন্তিম পর্বে বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকূট প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। আনুমানিক ৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগে তিনি লোকান্তরিত হন। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের একজন শ্রেষ্ঠ রাজা তৃতীয় ইন্দ্ৰ। তেজস্বিতা, বিচক্ষণতা ও উচ্চাভিলাষের সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর চরিত্রে। কান্যকুব্জ বিজয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। মালব ও বেঙ্গী পুনরুদ্ধার তাঁর কৃতিত্বের পরিচায়ক।
দ্বিতীয় অমোঘবর্ষ (আ. ৯২৮-৩০ খ্রিস্টাব্দ)
তৃতীয় ইন্দ্রের দুই পুত্র, দ্বিতীয় অমোঘ বর্ষ ও চতুর্থ গোবিন্দ। পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় অমোঘবর্ষ রাজপদ গ্রহণ করেন। তিনি মাত্র কিঞ্চিদধিক এক বৎসরকাল রাজত্ব করেন। কীভাবে তাঁর রাজত্বের অবসান হয় তা অনিশ্চিত। হয়তো তিনি অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। কিংবা হয়তো তিনি তাঁর অনুজের হাতে নিহত হন। তাঁর পুত্রদের কথা কিছু জানা যায় না। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের পরবর্তী রাজা তাঁর অনুজ চতুর্থ গোবিন্দ । তিনি আনুমানিক ৯৩০ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
চতুর্থ গোবিন্দ (আ. ৯৩০-৩৬ খ্রিস্টাব্দ)
গোবিন্দ উচ্চাভিলাষী ছিলেন কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তা বা বিচক্ষণতা কোনওটাই তাঁর ছিল না। উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের লোক ছিলেন তিনি। রাজকার্য অপেক্ষা নারীসঙ্গ ও লঘু আমোদ-প্রমোদে তাঁর অধিক আগ্রহ ছিল। এরূপ অমিতাচারী ও তরল মতির রাজা রাজ্য পরিচালনায় স্বভাবতই চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
চতুর্থ গোবিন্দের রাজত্বকালে যুদ্ধমল্ল বেঙ্গীর সিংহাসনে সমাসীন ছিলেন। তৃতীয় ইন্দ্ৰ তাঁকে বেঙ্গীর সিংহাসনে মনোনীত করেন। কিন্তু তিনি সুশাসক বা প্রজাবৎসল ছিলেন না। ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভীম তাঁকে বিতাড়িত করে সিংহাসন অধিকার করেন। বেঙ্গী পুনরুদ্ধারের কোনও চেষ্টাই করেননি চতুর্থ গোবিন্দ।
গোবিন্দ বেমুলবাড়ের আঞ্চলিক রাজা দ্বিতীয় অরিকেশরীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত হন। অরিকেশরী সম্পর্কে চতুর্থ গোবিন্দের ভগিনীপতি। তিনি বেঙ্গীর পূর্বতন নৃপতি পঞ্চম বিজয়াদিত্যকে আশ্রয় দান করে গোবিন্দের বিরাগভাজন হন। গোবিন্দ অরিকেশরীকে আদেশ করেন, বিজয়াদিত্যকে তাঁর হস্তে সমর্পণ করতে হবে। অরিকেশরী তাতে সম্মত না হওয়ায় গোবিন্দ তাঁকে আক্রমণ করেন। বহু রাষ্ট্রকূট মন্ত্রী ও সামন্তরাজ প্রকাশ্যে অরিকেশরীর পক্ষ অবলম্বন করেন। যুদ্ধে গোবিন্দ পরাজিত ও সম্ভবত নিহত হন। অরিকেশরীর সভাকবি পম্পের ‘বিক্রমার্জুনবিজয়’ কাব্যে এই যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে।
পম্প দাবি করেছেন, অরিকেশরী বড্ডেগ বা তৃতীয় অমোঘবর্ষকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন। পম্পের এই দাবি অত্যুক্তিমূলক। অনুমিত হয়, চতুর্থ গোবিন্দ যখন দক্ষিণ কর্ণাটকে অরিকেশরীর সঙ্গে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত তখন বড্ডেগ বা তৃতীয় অমোঘবর্ষ সসৈন্যে মান্যখেট অভিমুখে অগ্রসর হন। গোবিন্দের অনুগত সৈন্যবাহিনী তাঁর গতিরোধ করার চেষ্টা করে কিন্তু অমোঘবর্ষ তাঁদের পরাজিত করে রাজধানীতে এসে উপনীত হন। সেখানে মন্ত্রী ও সামন্তবর্গ তাঁকে সাদরে বরণ করেন ও রাজপদ গ্রহণে প্ররোচিত করেন। ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঘটনাটি ঘটে। ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তৃতীয় অমোঘবর্ষের একখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই তিনি রাজপদে অধিষ্ঠিত হন।
তৃতীয় অমোঘবর্ষ (আ. ৯৩৬-৩৯ খ্রিস্টাব্দ)
তাঁর ব্যক্তিগত নাম ছিল বড্ডেগ। তৃতীয় অমোঘবর্ষ নামেই অবশ্য তাঁর সমধিক প্রসিদ্ধি। তাঁর পত্নী কুন্তকদেবীচেদিরাজ প্রথম যুবরাজের কন্যা ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর পুত্রদের অনেকেই তখন বয়ঃপ্রাপ্ত ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণ। পিতার সিংহাসন অধিকারে তিনি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। অন্যান্য পুত্রদের মধ্যে ছিলেন জগত্তুঙ্গ, নিরুপম ও খোট্টিগ। অমোঘবর্ষের রেবকনিম্মডী নামে এক কন্যা ছিলেন। গঙ্গবাড়ির নৃপতি তৃতীয় রাজমল্লের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বুতুগের সঙ্গে তাঁর পরিণয় হয়।
আধ্যাত্মিক জগতের লোক ছিলেন তৃতীয় অমোঘবর্ষ। ধর্মভীরু ও সত্যনিষ্ঠ বলে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। প্রশাসনিক কার্য অপেক্ষা ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপেই তাঁর বেশি সময় অতিবাহিত হত। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তিনি বহু দান-ধ্যান করেন। বহু শিবমন্দিরের নির্মাতা তিনি। রাজ্য পরিচালনার ভার যুবরাজ তৃতীয় কৃষ্ণের স্কন্ধে অর্পিত হয়। মনে হয়, সিংহাসনে আরোহণ করেই অমোঘবর্ষ পুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন।
তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ দেওলি তাম্রশাসনে যুবরাজরূপে তাঁর সামরিক ক্রিয়া কাণ্ডের কিছু পরিচয় বিধৃত আছে। এই লেখে বলা হয়েছে, কৃষ্ণ অসাধু দন্তিগ ও বপ্পুগকে নিহত করেন; রচ্ছায়মল্লরূপ বিষবৃক্ষ উৎপাটন করেন, গঙ্গবাড়িতে ভূতার্থরূপ এক পবিত্র পাদপ প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর শৌর্য-বীর্যের কথা গুর্জরনাথের কর্ণগোচর হলে তিনি কালঞ্জর ও চিত্রকূট জয়ের আশা পরিত্যাগ করেন।
তৃতীয় কৃষ্ণের হস্তে দস্তিগ, বপ্পুগ ও রচ্ছায়মল্লের পরাজয় ও নিধন নিঃসন্দেহে তাঁর গঙ্গবাড়ি অভিযানে সাফল্যের পরিচায়ক। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে কৃষ্ণ গঙ্গবাড়িতে রাষ্ট্রকূট কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সংকল্প গ্রহণ করেন। তিনি তৃতীয় রাজমল্লকে পদচ্যুত করে ভগিনীপতি বূতুগকে গঙ্গবাড়ির রাজপদে অভিষিক্ত করতে উদ্যত হন। কৃষ্ণ প্রথমে তৃতীয় রাজমল্লের দুই মিত্র দন্তিগ ও বপ্পুগকে আক্রমণ ও নিহত করেন। অতঃপর তিনি গঙ্গবাড়ি অভিমুখে যাত্রা করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তৃতীয় রাজমল্ল মৃত্যুবরণ করেন। ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বূতুগ রাষ্ট্রকূটদের অনুগতরূপে গঙ্গবাড়ির শূন্য সিংহাসনে অভিষিক্ত হন।
গুর্জররাজ কালঞ্জর ও চিত্রকূট জয়ের আশা পরিত্যাগ করেন, রাষ্ট্রকূট লেখের এই উক্তির তাৎপর্য সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে বাগ্বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। অনন্ত সদাশিব অলতেকর মনে করেন, কৃষ্ণ ৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে চেদিদের পরাজিত করে বুন্দেলখণ্ডে প্রবেশ করেন এবং গুর্জরদের অধিকৃত কালঞ্জর এবং চিত্রকূট দুর্গ দু’টি অধিগ্রহণ করেন। কিন্তু চেদি রাজপরিবারের সঙ্গে রাষ্ট্রকূটদের সম্প্রীতির সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল; তৃতীয় অমোঘবর্ষ এবং যুবরাজ কৃষ্ণ উভয়েই চেদি রাজপরিবারে বিবাহ করেন। যে পরিবারের সঙ্গে তাঁর মিত্রতার সম্পর্ক সেই পরিবারের বিরুদ্ধাচরণ করে তাকে অযথা বৈরিভাবাপন্ন করবেন, কৃষ্ণ সম্পর্কে এমন ভাবনা সংগত বোধ হয় না। আসলে দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণের সাফল্য গুর্জররাজের মনে সমীহের উদ্রেক করে। কৃষ্ণ ছিলেন চেদিদের মিত্র। কালঞ্জর ও চিত্রকূট দুর্গ দু’টি তখন চেদিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথচ একদিন এই দু’টি দুর্গের উপর গুর্জরদেরই অধিকার ছিল। স্বভাবতই কৃষ্ণের প্রতিকূলতার ভয়ে সমকালীন গুর্জরনৃপতি দুর্গ দু’টি জয় করার বাসনা থেকে নিরস্ত হন। এই সমকালীন গুর্জর নৃপতি অবশ্যই বিনায়কপাল। ৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে তৃতীয় অমোঘবর্ষের মৃত্যু হয়।
তৃতীয় কৃষ্ণ (আ. ৯৩৯-৬৭ খ্রিস্টাব্দ)
তৃতীয় অমোঘবর্ষের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ তৃতীয় কৃষ্ণ রাজপদ গ্রহণ করেন। ‘অকালবর্ষ’, ‘বল্লভনরেন্দ্র’ এবং ‘পৃথিবীবল্লভ’ অভিধায় তিনি ভূষিত হন। পরবর্তিকালে কাঞ্চীপুরম ও তঞ্জাবূর অধিকার করে তিনি ‘কচ্চিয়ুম তঞ্জাইয়ুম-কোণ্ড’ উপাধি ধারণ করেন। অসামান্য সামরিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন তৃতীয় কৃষ্ণ। পিতার রাজত্বকালে তিনি তাঁর সামরিক প্রতিভা প্রদর্শন করেন। রাজপদ গ্রহণ করে তিনি বহুবার তাঁর সামরিক নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন।
পরাক্রমশালী চোলনৃপতি পরান্তকের বিরুদ্ধে বিজয়লাভ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক শ্রেষ্ঠ কীর্তি। পরান্তকের বিরুদ্ধে তাঁর সংঘর্ষ ঠিক কখন শুরু হয় তা অনিশ্চিত। অনন্ত সদাশিব অলতেকর মনে করেন, সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই রাষ্ট্রকূটরাজ চোলরাজ্য আক্রমণ করেন। দক্ষিণ আর্কট জেলায় প্রাপ্ত রাষ্ট্রকূটনৃপতির একখানি লেখের ভিত্তিতেই তাঁর এরূপ অভিমত। তিনি মনে করেন, লেখখানি তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বের পঞ্চম বৎসরে উৎকীর্ণ। কিন্তু লেখের এই তারিখের যাথার্থ্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। চোলরাজ্যে প্রাপ্ত তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বের সর্বাপেক্ষা পূর্ববর্তী লেখটি তাঁর রাজত্বের পঞ্চদশ বৎসরে অর্থাৎ ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। কিন্তু পরান্তকের সঙ্গে তৃতীয় কৃষ্ণের সংঘর্ষ ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের বেশ কয়েক বছর পূর্বে শুরু হয়।
গঙ্গবাড়ির রাজা দ্বিতীয় বূতুগের সহায়তায় তৃতীয় কৃষ্ণ চোলরাজ্য আক্রমণ করেন। বাণ ও বৈদুম্বরাও সম্ভবত রাষ্ট্রকূট পক্ষে যোগদান করেন। ৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আর্কট জেলার তক্কোলমের প্রান্তরে বিবদমান রাষ্ট্রকূট ও চোল বাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হয়। পরান্তকের পুত্র যুবরাজ রাজাদিত্য চোল সৈন্যদলের পরিচালনভার গ্রহণ করেন। কিন্তু এই যুদ্ধে তিনি নিহত হন, তাঁর সৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করেন। তক্কোলমের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে উত্তর ও দক্ষিণ আর্কট, চিঙ্গলেপুট ও ভেল্লোর অঞ্চলসহ চোলরাজ্যের একটি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড রাষ্ট্রকূট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই যুদ্ধের পর বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত এসব অঞ্চলে কোনও চোল লেখ উৎকীর্ণ হয়নি। অথচ এই অঞ্চলে তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বের পঞ্চদশ থেকে অষ্টাবিংশতি বৎসরের মধ্যে উৎকীর্ণ কয়েকখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব লেখে কৃষ্ণ নিজেকে ‘কচ্চিয়ুম-তঞ্জাইয়ুম কোণ্ড’ বা কাঞ্চীপুরম-তঞ্জাবূর-বিজেতা বলে বর্ণনা করেছেন। ভগিনীপতি বূতুগের অমূল্য সাহায্যের প্রতিদানস্বরূপ কৃষ্ণ তাঁকে বনবাসি ১২,০০০, বেলবোলা ৩০০, পুরিগেরে ৩০০, কিসুকদ ৭০ এবং বগেনদ ৭০ উপহার দানে সম্মানিত করেন।
করহাদ তাম্রশাসনে কৃষ্ণ দাবি করেছেন, চের, পাণ্ড্য ও সিংহলের রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছেন, রামেশ্বরমে তিনি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছেন। অনুমিত হয়, পরান্তককে পরাজিত করে কৃষ্ণ আরও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন এবং চের ও পাণ্ড্য রাজাদের পরাজিত করেন। আতঙ্কিত সিংহলরাজ সশরীরে উপস্থিত হয়ে তাঁর নিকট নতিস্বীকার করেন। তাঁর নির্মিত কৃষ্ণেশ্বর এবং গণ্ডমার্তণ্ডাদিত্য মন্দির দু’টি আজও রামেশ্বরমে তৃতীয় কৃষ্ণের বিজয়বার্তা ঘোষণা করছে।
অতঃপর তৃতীয় কৃষ্ণ বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকূট আধিপত্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। যতদিন দ্বিতীয় ভীম রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ততদিন তিনি বেঙ্গীর রাজনীতিতে কোনওরূপ হস্তক্ষেপ করেননি। কিন্তু ৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভীমের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বাদশবর্ষীয় বালকপুত্র দ্বিতীয় অম্ম পিতার স্থলাভিষিক্ত হলে কৃষ্ণ বেঙ্গীতে স্বকৰ্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর হন। তিনি যুদ্ধমল্লের দুই পুত্র বাদপ ও দ্বিতীয় তালপের পক্ষ সমর্থন করেন এবং সৈন্য দিয়ে তাঁদের সাহায্য করেন। কৃষ্ণের সহায়তায় বাদপ দ্বিতীয় অম্মকে সিংহাসনচ্যুত করে বেঙ্গীর রাজদণ্ড ধারণ করেন। দ্বিতীয় অম্ম স্বরাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর বেঙ্গীর রাজা হন তাঁর অনুজ দ্বিতীয় তালপ। কিন্তু তাঁকে নিহত করে দ্বিতীয় অম্ম পুনরায় বেঙ্গী অধিকার করেন। তৃতীয় কৃষ্ণ দ্বিতীয় অম্মের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দানার্ণবের পক্ষ অবলম্বন করেন। দানার্ণব দ্বিতীয় ভীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। সিংহাসনের উপর তাঁর ন্যায্য অধিকার ছিল। কিন্তু কোনও কারণে অনুজের অনুকূলে তাঁর দাবি উপেক্ষিত হয়। তৃতীয় কৃষ্ণের সাহায্যপুষ্ট হয়ে দানার্ণব ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে পরাজিত করে বেঙ্গীর রাজপদ অধিকার করেন। পরাজিত দ্বিতীয় অম্ম কলিঙ্গে পলায়ন করেন। দানার্ণবের সাহায্যার্থে একদল রাষ্ট্রকূট সৈন্য বেঙ্গীরাজ্যে মোতায়েন থাকে।
চোল অভিযানে যিনি কৃষ্ণের প্রধান সহায় ছিলেন সেই গঙ্গবাড়িরাজ দ্বিতীয় বূতুগ লোকান্তরিত হন। তাঁর মৃত্যুতে তদীয় পুত্র দ্বিতীয় মারসিংহ ৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গবাড়ির সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই নতুন রাজা কৃষ্ণের ভগিনী রেবকনিম্মডীর পুত্র নন, তিনি তাঁর সতীনপুত্র। কৃষ্ণ মারসিংহের রাজ্যাভিষেক অনুমোদন করেন এবং স্বয়ং সে অনুষ্ঠানে যোগদান করে গঙ্গরাজ পরিবারের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় করেন। পিতার মতো মারসিংহও কৃষ্ণের অনুগত ছিলেন।
দক্ষিণ ভারতে নিজকর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে তৃতীয় কৃষ্ণ উত্তর ভারত অভিমুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। ৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মারসিংহের অভিষেক অনুষ্ঠানের পরই তিনি উত্তর ভারত অভিযানে বহির্গত হন। হয়তো কালঞ্জর ও চিত্রকূট দুর্গ পুনরুদ্ধারের জন্য তাঁর এই উত্তর ভারত অভিযান। কিংবা হয়তো মালব পুনরধিকারের জন্যই তাঁর এই উদ্যোগ। উত্তর ভারত অভিযানে গঙ্গবাড়ির অধিপতি দ্বিতীয় মারসিংহ সদলে তৃতীয় কৃষ্ণের অনুগামী হন।
দ্বিতীয় মারসিংহ তাঁর শ্রবণবেলগোলা লেখে দাবি করেছেন, কৃষ্ণরাজের অনুকূলে উত্তর ভূখণ্ড জয় করে তিনি গুর্জরনাথরূপে পরিচিতি লাভ করেন। অনুমিত হয়, কৃষ্ণ গুর্জরদের আক্রমণ করেন। কৃষ্ণ সসৈন্যে মালবেও প্রবেশ করেন। মালব তখন পরমারনৃপতি সীয়কের অধীনস্থ। মালবের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল কৃষ্ণের অধিকারভুক্ত হয়।
৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে এই সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। তাঁর দুর্ভাগ্য, তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর সব কটি পুত্র অকালে দেহত্যাগ করেন। তাঁর এক পৌত্র ইন্দ্ৰ। কিন্তু তিনি অল্পবয়স্ক। তাই রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে বসলেন তাঁরই অনুজ খোট্টিগ।
রাষ্ট্রকূট রাজবংশের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান তৃতীয় কৃষ্ণ। উত্তর ভারত অভিযানে তিনি হয়তো ধ্রুব, তৃতীয় গোবিন্দ বা তৃতীয় ইন্দ্রের মতো সফল হননি কিন্তু দক্ষিণ ভারতে তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেন। রামেশ্বরমের কৃষ্ণেশ্বর ও গণ্ডমার্তণ্ডাদিত্য মন্দির দু’টি প্রমাণ করছে, দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলও একদা তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। অন্য কোনও রাষ্ট্রকূট নৃপতি দক্ষিণ ভারতে তাঁর মতো সাফল্য লাভ করেননি। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও স্বীকার্য, তাঁর অনুসৃত কিছু নীতি বা কর্মধারা রাষ্ট্রকূট রাজ্যের স্বার্থের পক্ষে শুভ হয়নি। তক্কোলমের যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি গঙ্গরাজ বূতুগকে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড প্রদান করে কৃতজ্ঞতা বা মিত্রপ্রীতির পরিচয় দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু এতে তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার দীনতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর এই কাজে তাঁর নিজের কর্তৃত্বের পরিধি সংকুচিত হয়েছে কিন্তু অনুগত, মিত্র রাজার ক্ষমতা প্রসারিত হয়েছে। সত্যাশ্রয় পরিবারভুক্ত আহবমল্ল তৈলপকেও তিনি অনুরূপভাবে জায়গির প্রদান করেন। এই তৈলপের নিক্ষিপ্ত মৃত্যুবাণেই রাষ্ট্রকূট রাজ্যের প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হয়।
খোট্টিগ (আ. ৯৬৭-৭২ খ্রিস্টাব্দ)
তৃতীয় কৃষ্ণের দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের সৌভাগ্যরবি পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে। সুবিস্তীর্ণ রাজ্য পরিচালনা ও প্রতিরক্ষায় যে দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব ও সামরিক নৈপুণ্যের প্রয়োজন তা তৃতীয় কৃষ্ণের উত্তরাধিকারীদের ছিল না। ফলে রাজ্যে অশান্তির দাবানল জ্বলে ওঠে, একটির পর একটি বৈপ্রান্তিক অভিযানের ঢেউ রাজ্যের উপর আছড়ে পড়ে। রাষ্ট্রকূট রাজ্যটির পতন আসন্ন হয়।
৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় কৃষ্ণের দেহাবসানের পর তাঁর অনুজ খোট্টিগ রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই পরমাররাজ হর্ষ সীয়ক রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণ করেন। সীয়ক তৃতীয় কৃষ্ণের হস্তে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। এবার তিনি প্রত্যাঘাত হানতে উদ্যত হন। রাষ্ট্রকুট বাহিনী সীয়কের বিরুদ্ধে নর্মদা নদীর তীরে প্রবল প্রতিরোধ রচনা করে। যুদ্ধে কঙ্কদেব নামে এক পরমার সেনাধ্যক্ষ নিহত হন। রাষ্ট্রকূটদের প্রবল চাপের মুখে নতিস্বীকার করে সীয়ক অভিযান প্রত্যাহার করেন।
প্রথম অভিযানে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত না হওয়ায় সীয়ক পুনর্বার রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণ করেন। সকল প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে তিনি নর্মদা নদী অতিক্রম করেন। সন্ত্রস্ত খোট্টিগ গঙ্গরাজ দ্বিতীয় মারসিংহের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু গঙ্গরাজ্য থেকে সাহায্য আসার পূর্বেই সীয়ক আনুমানিক ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মান্যখেট অধিকার করেন। রাজকোষাগার লুণ্ঠিত হল, রাষ্ট্রকূট রাজ্যের প্রচুর ধন-রত্ন সীয়কের হস্তগত হল।
এদিকে খোট্টিগের আবেদনে সাড়া দিয়ে মারসিংহ সসৈন্যে মান্যখেটে আগমন করেন। মারসিংহ মান্যখেট থেকে পরমারদের বিতাড়িত করেন, না ততদিনে পরমার সৈন্যগণ লুণ্ঠিত ধন রত্নসহ স্বরাজ্যে প্রস্থান করেছেন, তা স্পষ্ট নয়। সে যা হোক, মারসিংহের সহায়তায় খোট্টিগ মান্যখেটের সিংহাসনে পুনরধিষ্ঠিত হন। সীয়কের হাতে পরাজয়ের গ্লানি তাঁকে বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি ; কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ভগ্নহৃদয়ে প্রাণত্যাগ করেন। তিনি অপুত্রক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নিরুপমের পুত্র দ্বিতীয় কর্ক রাজপদে অভিষিক্ত হন।
দ্বিতীয় কর্ক (আ. ৯৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দ)
দ্বিতীয় কর্ক আনুমানিক ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করে ‘অমোঘবর্ষ’, ‘নুতনপার্থ’, ‘অহিতমার্তণ্ড’, ‘বীরনারায়ণ’, ‘নৃপতুঙ্গ’ ও ‘রাজত্রিনেত্র’ অভিধা গ্রহণ করেন। এ যেন ঝলমলে পোশাকে নিজের আর্থিক দীনতা আড়ালের ব্যর্থ প্রচেষ্টা! সমকালীন একটি লেখে তিনি ‘গুর্জরত্রাস’ এবং ‘চোল-পাণ্ড্যগর্বহরণ রূপে বর্ণিত হয়েছেন। কিন্তু এ বর্ণনা কৃতজ্ঞ রাজকবির রাজপ্রশস্তি।
অতি দুর্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন দ্বিতীয় কর্ক। রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় যে শৌর্য ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন তার একান্তই অভাব ছিল তাঁর চরিত্রে। উপরন্তু যে গঙ্গরাজ মারসিংহ এতদিন বিপদে-আপদে রাষ্ট্রকূটদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, শত ঝড়-ঝঞ্ঝার হাত থেকে রাষ্ট্রকূট রাজ্যতরণীকে রক্ষা করেছেন, তিনিও তাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন। তৃতীয় কৃষ্ণের পৌত্র চতুর্থ ইন্দ্ৰ ছিলেন তাঁর নিজের ভাগিনেয়। এই ইন্দ্রকে বঞ্চিত করে দ্বিতীয় কর্ক রাজপদ গ্রহণ করায় মারসিংহ স্বাভাবিক কারণেই রুষ্ট হন। তাছাড়া দ্বিতীয় কর্ক নিজের দুর্বিনীত ও নীতিবিহর্গিত আচরণের জন্য রাজ্যের পদস্থ রাজপুরুষ ও প্রজাসাধারণের নিকট অপ্রিয় হন।
এ সুযোগ পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করলেন চালুক্য দ্বিতীয় তৈলপ। ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে তিনি সসৈন্যে দ্বিতীয় কর্কের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। সম্ভবত উত্তর কর্ণাটকের কোনও এক স্থানে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দ্বিতীয় তৈলপ জয়লাভ করেন। দ্বিতীয় কর্ক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে কর্ণাটকের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে ৯৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি লেখ উৎকীর্ণ করেন। তখনও কাগজে-কলমে তিনি মহারাজাধিরাজ, পরমেশ্বর ও পরমভট্টারক।
চতুর্থ ইন্দ্র (আ. ৯৭৩-৯৮২ খ্রিস্টাব্দ)
দ্বিতীয় কর্কের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিতীয় তৈলপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকূটদের প্রতিরোধের সমাপ্তি ঘটল না। গঙ্গরাজ মারসিংহ তাঁর ভাগিনেয় চতুর্থ ইন্দ্রের সমর্থনে দ্বিতীয় তৈলপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মাতুল ও ভাগিনেয় উভয়েই পরাজিত হন এবং পরে জৈন রীতি অনুসারে প্রায়োপবেশনে মৃত্যুবরণ করেন। মারসিংহ দেহত্যাগ করেন ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে, চতুর্থ ইন্দ্ৰ ৯৮২ খ্রিস্টাব্দের মার্চে। ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে মারসিংহের মৃত্যুর পর তাঁর অনুগত সামন্ত পঞ্চালদের তৈলপকে রাষ্ট্রকূট রাজ্য থেকে উচ্ছেদের একবার শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি পরাজিত ও নিহত হন। রাষ্ট্রকূট রাজ্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। দ্বিতীয় তৈলপের নেতৃত্বে এক নতুন রাজ্যের অভ্যুদয় ঘটল। সে রাজ্য পাশ্চাত্য চালুক্য রাজ্য।
রাষ্ট্রকূট রাজধানী
রাষ্ট্রকূটরা প্রথম যখন বিদর্ভ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন তখন প্রাচীন অচলপুর বা বর্তমান এলিচপুর সম্ভবত তাঁদের রাজধানী ছিল। অনুমিত হয়, দন্তিদুর্গ তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে এলিচপুর থেকে এলোরা বা সন্নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। দন্তিদুর্গের বৃহত্তম লেখটি এলোরার দশাবতার গুহাগাত্রে উৎকীর্ণ হয়েছে। তাঁর পিতৃব্য প্রথম কৃষ্ণ সুবিখ্যাত কৈলাস মন্দির নির্মাণের জন্য এলোরাকেই নির্বাচন করেছিলেন। আরও পরবর্তিকালে প্রথম অমোঘবর্ষ মান্যখেট শহরটি প্রতিষ্ঠা করে তথায় রাজধানী স্থাপন করেন। কর্ণাটকের গুলবর্গা জেলার বর্তমান মালখেড়ই প্রাচীন মান্যখেট।
প্রশাসন-ব্যবস্থা
রাজপুরুষগণ
- রাজা : রাষ্ট্রকূট রাজ্য ছিল রাজতান্ত্রিক। প্রশাসনের শীর্ষদেশে রাজার অবস্থান। পরমভট্টারক, মহারাজাধিরাজ, পরমেশ্বর ইত্যাদি জাঁকজমকপূর্ণ উপাধিতে তিনি ভূষিত। তিনি নিজেকে পরমপূজ্য ও পরম বা মহান দেবতারূপে উপস্থাপিত করেছেন। প্রজাসাধারণ ও সামন্ত বর্গের আনুগত্য লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর দেবত্বের দাবি। তিনি শুধু রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসকই নন, নীতিগতভাবে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি ও সৈন্যবাহিনীর সর্বাধিনায়কও বটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজা সীমিত কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। প্রত্যক্ষ শাসনভুক্ত অঞ্চলে নিঃসন্দেহে তাঁর অধিকতর ক্ষমতা ছিল কিন্তু তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, উদ্যোগী ও বিচক্ষণ না হলে সেখানেও শক্তিশালী ও ক্ষমতালিপ্স আমলাতন্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠত। খুব কম রাজাদেরই সেই ব্যক্তিত্ব, উদ্যম ও বিচক্ষণতা ছিল। তাছাড়া রাজ্যের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল সামন্ত, মহাসামন্ত ও আঞ্চলিক, মিত্র রাজাদের অধীনস্থ। সামরিক শক্তির অধিকারী এসব পদাধিকারীরা স্বশাসিত অঞ্চলে স্বাধীন নরপতির ন্যায় আচরণ করতেন। দিগ্বিজয়ে বা শত্রুরাজার আক্রমণ মোকাবিলায় রাজা প্রায়ই শক্তিশালী সামন্তবর্গের দ্বারস্থ হতেন। সামন্তবর্গের উপর নির্ভরতা রাজশক্তিকে সুনিশ্চিতরূপে দুর্বল করেছিল।
- রাজপুত্র ও যুবরাজ : রাজপদ ছিল পুরুষানুক্রমিক। রাজার মৃত্যু হলে সাধারণত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজপদ লাভ করতেন। কখনও কখনও এই রীতি লঙ্ঘিত হত। ধ্রুবের মৃত্যুর পর তৃতীয় গোবিন্দ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন না। জ্যেষ্ঠ রাজকুমার বা পিতার ইচ্ছাক্রমে অন্য কোনও রাজপুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হলে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হতেন। যুবরাজ সাধারণত রাজধানীতে অবস্থান করতেন এবং পিতাকে প্রশাসনিক কাজকর্মে সাহায্য করতেন। তিনি যুদ্ধে পিতার অনুগমন করতেন, কখনওবা সৈন্যপরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করতেন। কনিষ্ঠ রাজকুমারেরা সাধারণত প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত হতেন। রাজকন্যারা শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করেছেন, এমন ঘটনা এ পর্বে বিরল। সমকালীন লেখে এরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। প্রথম অমোঘবর্ষের এক কন্যা চন্দ্রোবলব্বা। ৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি রায়চুর দোয়াবের প্রশাসিকার পদ অলংকৃত করেন।
- রাণী : রাজা নাবালক হলে রাজপরিবারের এক গুরুস্থানীয় ব্যক্তি তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন; কোনও রাষ্ট্রকূট মহিষী কখনও এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি। রানিরা ভূমিদান, মন্দির নির্মাণ ইত্যাদি বিভিন্ন দাতব্য কার্যে অংশগ্রহণ করেছেন। ধ্রুবের মহিষী শীলমহাদেবীর নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে।
- মন্ত্রী : রাজা নিছক যুবরাজের সহযোগিতায় রাজকার্য সম্পাদন করতে পারেন না, তাঁকে অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়। আশ্চর্যের বিষয়, রাষ্ট্রকূট লেখে সান্ধিবিগ্রহিক ছাড়া অন্য কোনও মন্ত্রীর উল্লেখ নেই। তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বকালে রচিত সোমদেবসূরির যশস্তিলক চম্পু কাব্যে অবশ্য বিভিন্ন মন্ত্রীদের উল্লেখ আছে, মন্ত্রীদের দুর্নীতি ও পদচ্যুতির কথাও আছে। রাষ্ট্রকূট রাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল, অনন্ত সদাশিব অলতেকর এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। রাষ্ট্রকূট লেখমালায় সেরূপ কোনও তথ্য নেই।
প্রশাসনিক বিভাগ
- প্রদেশ : রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। এই প্রদেশগুলিকে রাষ্ট্র বলা হত। রাষ্ট্রপাল বা রাষ্ট্রপতিদের সিংহভাগই ছিলেন রাজপরিবারের সদস্য, কেউবা ছিলেন দক্ষ সেনানায়ক। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা যথেষ্ট ক্ষমতাবান ছিলেন। তাঁদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী ছিল। রাষ্ট্রকূট লেখে রাষ্ট্রমহত্তরদের উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রপতিরা হয়তো প্রয়োজনবোধে রাষ্ট্র মহত্তরদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন।
- বিষয় বা জেলা : এক একটি রাষ্ট্র কয়েকটি বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল। লেখমালার সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, এক একটি বিষয়ে ১ হাজার থেকে ৪ হাজার গ্রাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুণক বিষয়ের গ্রামের সংখ্যা ছিল ১ হাজার। পক্ষান্তরে করহাটক-বিষয় ৪ হাজার গ্রাম নিয়ে গঠিত ছিল। বিষয়ের প্রধান যিনি তিনি বিষয়পতি। বিষয়পতি পরিস্থিতি অনুসারে বিষয়-মহত্তরদের সাহায্য গ্রহণ করতেন।
- ভুক্তি : প্রতিটি বিষয় আবার কয়েকটি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল। ৫০ থেকে ৭০টি গ্রাম নিয়ে এক একটি ভুক্তি গঠিত হত। ভুক্তির শাসনকর্তা ভোগপতি বা ভোগিক। ভুক্তিরও উপবিভাগ ছিল। ১০ থেকে ২০টি গ্রাম নিয়ে এক একটি উপবিভাগ গঠিত হত।
- গ্রাম ও মহাজনদের ভূমিকা : সর্বনিম্ন প্রশাসনিক বিভাগ গ্রাম। মহারাষ্ট্রে গ্রামপ্রধানেরা গ্রামকূট নামে পরিচিত ছিলেন। কর্ণাটকে তাঁদের গাবুণ্ড বলা হত। রাষ্ট্রকূট লেখে গ্রামপতিরও উল্লেখ আছে। গ্রামপতি ও গ্রাম কূটক সমার্থক নয়। গ্রামভোক্তা, এই অর্থে গ্রামপতি। আর গ্রামকূট তো গ্রামমুখ্য বা গ্রামপ্রধান। গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং গ্রাম থেকে আহৃত রাজস্ব সরকারি কোষাগার বা কোষ্ঠাগারে পাঠানোর দায়িত্ব ছিল তাঁর। প্রতিটি গ্রামে গ্রামপ্রধানের পরিচালনাধীন একটি রক্ষী বাহিনী ছিল। গ্রামপ্রধান নিষ্কর জমি ভোগ করতেন আর গ্রামবাসীদের রাজাকে দ্রব্যে প্রদেয় রাজস্বের একটি নির্দিষ্ট ভাগ গ্রহণ করতেন। গ্রামের প্রশাসন ও উন্নয়নে মহাজনদের এক বড় রকমের ভূমিকা ছিল। মহাজন বলতে কেবল পরিবারপ্রধানদেরই বোঝাত না, গ্রামের সকল বয়স্ক ব্যক্তিই মহাজনরূপে পরিচিত ছিলেন। মহাজনেরা তাঁদের কাজকর্ম সুসম্পাদনের উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্য থেকে সদস্য নিয়ে বিভিন্ন সমিতি গঠন করতেন। সাধারণত এক একটি সমিতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, কৃপ-পুষ্করিণী খনন, মন্দির নির্মাণ এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংরক্ষণের মতো এক একটি কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করত। সমিতির সদস্যরা গ্রামপ্রধানের সহযোগিতায় কাজকর্ম সম্পন্ন করতেন। এসব জনকল্যাণমুখী কাজকর্মে যে অর্থ বা সামর্থ্যের প্রয়োজন হত তা অনেক সময় মহাজনেরা নিজেরাই বহন করতেন ; কখনও কখনও গ্রামরাজস্বের একটি অংশ সেসব কাজে ব্যয় করা হত। গ্রামবাসীদের মধ্যে ছোটখাটো বিরোধ দেখা দিলে মহাজনেরা তার নিষ্পত্তি করতেন।
সমাজ-জীবন
বর্ণ ও সামাজিক শ্রেণী
রাষ্ট্রকূট রাজ্যে বহুজাতিক সমাজ গড়ে উঠেছিল। একদিকে ব্রাহ্মণ্য থেকে ইসলাম, অপরদিকে ব্রাহ্মণ থেকে হরিজন ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির লোক নিয়ে এই বহু জাতিক সমাজ গঠিত ছিল –
- ব্রাহ্মণ : সমাজে সর্বাগ্রে ছিল ব্রাহ্মণদের স্থান। যজন, যাজন এবং অধ্যাপনা ছিল তাঁদের প্রধান জীবিকা। কোনও কোনও ব্রাহ্মণ সাহিত্য রচনা ও জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করতেন, কেউবা রাজকার্যে অংশগ্রহণ করতেন। সমকালীন স্মৃতিগ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে, অবস্থার বিপাকে ব্রাহ্মণেরা কৃষি ও বাণিজ্য জীবিকারূপে গ্রহণ করতে পারেন। এ সময় বেঙ্গী, গুজরাত, পাটলিপুত্র, পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তর বঙ্গ প্রভৃতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল বা স্থান থেকে বহু ব্রাহ্মণ পরিবার রাষ্ট্রকূট রাজ্যে বসতি স্থাপন করেন। সরকারের পক্ষ থেকে এসব উচ্চশিক্ষিত পরিবারের অনুকূলে দরাজহস্তে জমি প্রদত্ত হয়। নবাগত ব্রাহ্মণ পরিবার ছাড়া রাজ্যে বসবাসকারী যেসব ব্রাহ্মণ যাগ-যজ্ঞ ও ধর্মীয় আচারে পারদর্শী ছিলেন বা বিদ্যানুশীলন ও অধ্যাপনাকার্যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, তাঁদের অনেককেই ভূসম্পত্তিদানে সম্মানিত করা হত। গ্রহীতা ব্রাহ্মণদের সাধারণত রাজস্ব দিতে হত না। সম্ভবত বিদ্বান ব্রাহ্মণদেরও রাজস্বের ভার বহন করতে হত না, রাজস্ব দিতে হত সাধারণ ব্রাহ্মণদের। রাজ্যে জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব হলে রাজা ব্রাহ্মণ ও দেবতার সম্পত্তির কিয়দংশ অধিগ্রহণ করবেন, সোমদেবসূরি এরূপ বিধান দিয়েছেন। ব্রাহ্মণদের শত অপরাধ সত্ত্বেও সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত না কিন্তু অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে তাঁদের নির্বাসনে পাঠানো হত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হত। আল বেরুনি বলেন, কোনও দুর্মূল্য দ্রব্য অপহরণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে ব্রাহ্মণদের দৃষ্টিশক্তি হরণ করা হত, তাঁদের দক্ষিণ হস্ত ও বাম পদ ছেদন করা হত। আল বেরুনির এই মন্তব্য কতদূর সত্য বলা কঠিন।
- ক্ষত্রিয় : সমাজে ব্রাহ্মণদের ঠিক নিচেই ক্ষত্রিয়দের অবস্থান। যুদ্ধোপজীবী ছিলেন তাঁরা। কোনও কোনও ক্ষত্রিয় চাষ-আবাদের কাজে জীবিকা নির্বাহ করতেন। লেখমালায় ব্রাহ্মণদের গোত্র ও প্রবরের উল্লেখ আছে কিন্তু ক্ষত্রিয়দের গোত্র-প্রবরের উল্লেখ নেই। বৈদিক যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠানে যজমানের গোত্র-প্রবরের উল্লেখ বাধ্যতামূলক কিন্তু পৌরাণিক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে তা নয়। হয়তো ক্ষত্রিয়সমাজে বৈদিক ধর্ম অপেক্ষা পৌরাণিক আচার-অনুষ্ঠান অধিক সমাদৃত ছিল।
- বৈশ্য : কৃষি ও বাণিজ্য বৈশ্যদের উপজীবিকা ছিল। রাষ্ট্রকূট লেখে বৈশ্য মহাজনদের উল্লেখ আছে। তৃতীয় কৃষ্ণের একটি লেখ থেকে জানা যায়, রাজস্থানের ভিনমাল শহরবাসী একদল বৈশ্য রাষ্ট্রকূট নগর সঞ্জানে বসতি স্থাপন করেন। বেদাধ্যয়নে বৈশ্যদের অধিকার ছিল না।
- শূদ্র : বেদপাঠে শূদ্রদেরও অধিকার ছিল না। কিন্তু বৈশ্যদের মতো তাঁরাও পৌরাণিক আচার অনুষ্ঠানের অধিকারী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন। কোনও কোনও শূদ্র সেনানায়কের পদে উন্নীত হন, কেউবা আঞ্চলিক রাজার মর্যাদা লাভ করেন।
- অন্যান্য জাতি : এছাড়া সমাজে তন্তুবায়, বংশকার, ধীবর, রজক, ঝাড়ুদার, চণ্ডাল, নিষাদ প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির লোক ছিলেন। গ্রাম বা শহরের উপকণ্ঠে ছিল তাঁদের বাস। হাড়ি, ডোম, ঝাড়ুদার ও চণ্ডালেরা ছিলেন সকলের নীচে। তাঁরা ছিলেন অস্পৃশ্য।
- মুসলিম : বেশ কিছু সংখ্যক ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাস ছিল রাষ্ট্রকুট রাজ্যে। তাঁদের অনেকেই ছিলেন ব্যবসায়ী। সমকালীন মুসলমান পর্যটক সুলেমান (৮৫১ খ্রিস্টাব্দ) ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি রাষ্ট্রকূট রাজাদের সদয় ব্যবহারের প্রশংসা করেছেন। তৃতীয় ইন্দ্রের ‘চিঞ্চিনি তাম্রশাসনে’ এক বিষয়-প্রশাসকের উল্লেখ আছে। তিনি আরবদেশীয় মুসলমান ছিলেন। (চিঞ্চিনি তাম্রশাসনে উল্লিখিত এই ‘তাজীক’ প্রশাসকের নাম মধুমতি-সুগতিপ। আরবি শব্দ মোহাম্মদের সংস্কৃত রূপান্তর মধুমতি। এই প্রশাসক স্থানীয় অঞ্চলে একটি ব্রাহ্মণ্য মন্দির নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। মন্দিরের সঙ্গে একটি দাতব্য ভোজনাগারও স্থাপিত হয়।) অনুমিত হয়, রাষ্ট্রকূট রাজারা মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার ও সুবিচারের স্বার্থে কাজি নিয়োগ করতেন।
বিবাহ ও নারী
- বিবাহের ধরণ : সাধারণত পিতা বা অভিভাবকের তত্ত্বাবধানেই পুত্র-কন্যাদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হত। সমকালীন কাব্য মহাপুরাণ ও লেখে রাক্ষস বিবাহের উল্লেখ আছে। দন্তিদুর্গের পিতা প্রথম ইন্দ্র চালুক্য রাজকুমারী ভবনাগাকে রাক্ষসমতে বিবাহ করেন। মহাপুরাণে স্বয়ংবর বিবাহেরও কথা আছে। স্বয়ংবর বিবাহে কন্যা কখনও কখনও আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে বিশেষ কোনও একজনকে স্বেচ্ছায় পতিরূপে বরণ করতেন। কখনও কখনও কন্যা বা অভিভাবকের সম্মতিক্রমে স্বয়ংবর সভায় বিশেষ এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। এই প্রতিযোগিতায় যিনি জয়ী হতেন, কন্যা তাঁকেই পতিরূপে নির্বাচন করতেন।
- সবর্ণ ও অসবর্ণ বিবাহ : সবর্ণ বিবাহই বাঞ্ছনীয় ছিল। অসবর্ণ বিবাহও অনুষ্ঠিত হত। অসবর্ণ বিবাহ ছিল দু’প্রকারের, অনুলোম ও প্রতিলোম। আল বেরুনি সমকালীন ভারতে অনুলোম বিবাহের উল্লেখ করেছেন। উচ্চ বর্ণ বা জাতিভুক্ত পাত্রের সঙ্গে নিম্নতর বর্ণ বা জাতির পাত্রীর বিবাহই অনুলোম বিবাহ। এ যুগে প্রতিলোম বিবাহ প্রায় ছিল না বললেই চলে। নিম্ন বর্ণ বা জাতির পাত্রের সঙ্গে উচ্চতর বর্ণ বা জাতির পাত্রীর পরিণয় প্রতিলোম বিবাহ। এ ধরনের বিবাহ ভারতে নিষিদ্ধ ছিল বলে আল বেরুনি মন্তব্য করেছেন।
- বাল্যবিবাহ : বাল্যবিবাহের বহুল প্রচলন ছিল। সাধারণত ১২ বছরের পূর্বেই মেয়েদের বিবাহ হত; ছেলেদের বিবাহ হত ১৬ বছরের পূর্বে। স্বামীরা সাধারণত ১ থেকে ৪ জন পত্নী গ্রহণ করতেন।
- বিধবাবিবাহ : উচ্চবিত্ত সমাজে বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রচলিত ছিল না। সতীপ্রথা দক্ষিণ ভারতে জনপ্রিয় ছিল না। কোনও রানি স্বামীর প্রজ্বলিত চিতায় আত্মাহুতি দিয়েছেন, সমকালীন দক্ষিণ ভারতে এরূপ ঘটনা অশ্রুতপূর্ব। তবে নিঃসন্তান রমণী স্বেচ্ছায় সহমরণ বরণ করেছেন, এরূপ দুই একটি ঘটনার উল্লেখ আছে সমকালীন সাহিত্যে।
- মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার : মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার ছিল।
- পর্দাপ্রথা : সমাজে পর্দাপ্রথার প্রচলন ছিল না।
বিদ্যাচর্চা
রাষ্ট্রকূট রাজ্যে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার চর্চা হত। মহাপুরাণে বেদ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, সাহিত্য, মীমাংসা, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, ন্যায়, তন্ত্র, চিত্রাঙ্কন, দারুশিল্প, ভাস্কর্য, সংগীত, নাটক ও অস্ত্রানুশীলনের উল্লেখ আছে। মহিলাদের হস্তলিপি, গণিত, কাব্য, ভাষাবিজ্ঞান, যন্ত্রসংগীত ইত্যাদি বিষয়ের অনুশীলনের কথাও আছে এই কাব্যে। রাষ্ট্রকূট লেখমালায় বেদ, বেদাঙ্গ, ইতিহাস, পুরাণ, ব্যাকরণ, মীমাংসা, ন্যায়, নিরুক্ত প্রভৃতি শাস্ত্রে পারঙ্গম বহু ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে। সাধারণত মঠ, অগ্রহার গ্রাম ও ঘটিকাগুলিতে উচ্চশিক্ষার চর্চা হত। শুধু রাজা-মহারাজেরা নন, সাধারণ ব্যক্তিরাও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অকাতরে দান করতেন।
অর্থনৈতিক জীবন
কৃষি
কৃষিকার্যই ছিল লোকদের জীবিকার প্রধান উৎস। গত হাজার বছরে দক্ষিণ ভারতের জলবায়ুর বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি। সহজেই অনুমিত হয়, বর্তমানকালে এই অঞ্চলে যেসব ফসল উৎপন্ন হয় রাষ্ট্রকূটপর্বেও তার উৎপাদন অব্যাহত ছিল। কৃষিজাত দ্রব্যসমূহ –
- কার্পাস : খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকে মার্কো পোলো এবং আরও চার শতক পর টাভার্নিয়ের এ অঞ্চলে উৎপন্ন কার্পাসসুতো ও কার্পাসবস্ত্রের উল্লেখ করেছেন। খ্রিস্টীয় ১ম শতকে রচিত ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থেও এতদঞ্চলের কার্পাসশিল্পের উল্লেখ আছে। নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, এ সময় দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত গুজরাত ও বিদর্ভে প্রচুর পরিমাণ কার্পাস উৎপন্ন হত।
- নীল : খ্রিস্টীয় ১৩শ ও ১৭শ শতকে গুজরাত ও থানা থেকে বহির্দেশে নীল রপ্তানির উল্লেখ আছে। মনে হয়, রাষ্ট্রকূট রাজ্যে নীলের চাষ হত। কোঙ্কণ উপকূলে ধান, বার্লি, যব, নারকেল ও সুপারি জন্মাত।
- কাঠ : কর্ণাটকে উৎপন্ন হত চন্দন, সেগুন ও মেহগনি।
- ইক্ষু, তৈলবীজ, কমলালেবু, লেবু, আম : আরব পর্যটকদের বৃত্তান্তে ভারতে ইক্ষু, তৈলবীজ, কমলালেবু ও লেবু উৎপাদনের উল্লেখ আছে। আরব পর্যটকেরা প্রায় সকলেই পশ্চিম ভারতীয় উপকূল পরিদর্শন করেন। ভারতে সুমিষ্ট আমের উৎপাদন ও আরবের বাজারে তার বিপুল চাহিদার কথাও বলেছেন তাঁরা।
- জোয়ার, বাজরা, মধু : রাষ্ট্রকূট রাজ্যে জোয়ার, বাজরা এবং মধুও উৎপন্ন হত।
নর্মদা, তাপ্তী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, তুঙ্গভদ্রা এবং তাদের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা প্রবাহিত এই অঞ্চল স্বভাবতই কৃষিকার্যের অনুকূল ছিল। কিন্তু কৃষির খেতে ফলনের জন্য শুধু নদীর জলের উপরই নির্ভর করা হত না; সমকালীন লেখে কূপ, পুষ্করিণী ও খাল খনন ও সংস্কারের সুপ্রচুর উল্লেখ আছে। গ্রামবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দীর্ঘ পুষ্করিণীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, বিবাহ, উপনয়ন ও প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠানে নিজেদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট হারে সামগ্রী বা অর্থ সংগ্রহ করে পুষ্করিণীর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার বহন করেছেন, এরূপ ঘটনার উল্লেখ রাষ্ট্রকূট লেখমালায় বিরল নয়।
জমি ছিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। রাষ্ট্রকূট লেখে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের প্রসঙ্গ বার বার উত্থাপিত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বা রাজকীয় জমিও ছিল। বনাঞ্চল, পতিত জমি ও খনি ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য জমিকে কখনও কখনও দীর্ঘ মেয়াদে অকর্ষিত রাখা হত। কখনওবা সমুদ্রতীরবর্তী ভূমিতে উঁচু বাঁধ তুলে ফসল ফলানো হত।
কারিগরি শিল্প ও খনিজ দ্রব্য
- সুতিবস্ত্র : সুচারু ও অতিসূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র তৈরি হত রাষ্ট্রকূটরাজ্যে। প্রতিষ্ঠান এবং টগর সুতিবস্ত্রের প্রধান কেন্দ্র ছিল।
- চর্মশিল্প, রজ্জু ও নৌশিল্প : চর্মশিল্পেরও বিপুল চাহিদা ছিল। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে রজ্জু তৈরি হত। ভারতের পশ্চিম উপকূলে কয়েকটি নৌশিল্পকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
- সোনা : রাষ্ট্রকূটরাজ্য খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। কর্ণাটকের কোলার ও অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলার রামগিরিতে সোনার খনি ছিল।
- হীরা : অন্ধ্রপ্রদেশের হীরার সর্বভারতীয় খ্যাতি ছিল।
- লোহা ও তামা : কুড্ডাপা, কুর্মুল, বেল্লারি, চান্দা, আহম্মদনগর, বিজাপুর ও ধারবাড় অঞ্চলে লোহা ও তামা পাওয়া যেত।
- পাথর ও প্রস্তরশিল্প : গোলকোণ্ডা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল কার্নেলিয়ন, এ্যাগেট, ক্যালসেদনি, জ্যাসপারের মতো পাথরের উৎসভূমি। পুঁতি ও অলংকাররূপে দামি পাথর ব্যবহৃত হত। সমকালীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সে যুগের ধাতু ও প্রস্তরশিল্পের উন্নতির স্বাক্ষর বহন করছে। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের কাজেও প্রস্তরের বহুল প্রয়োগ ছিল।
- ধাতুশিল্প : ধাতু দিয়ে কৃষির যন্ত্রপাতি, যুদ্ধাস্ত্র ও গৃহস্থালির নানা উপকরণ তৈরি হত।
বণিক ও বাণিজ্য
এ পর্বের লেখে শ্রেষ্ঠীদের ব্রাহ্মণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে জমি ও অর্থদানের প্রসঙ্গ বারবার উত্থাপিত হয়েছে। শ্রেষ্ঠী-শ্রেণী বা বণিক সংগঠনের কথাও বলা হয়েছে। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বণিক সংগঠনে স্থায়িভাবে টাকা জমা রাখতেন। গচ্ছিত অর্থ থেকে বার্ষিক শতকরা ১২ টাকা হারে সুদ পাওয়া যেত। পূর্ব শর্ত মতো সুদের টাকা থেকে বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট পরিমাণে সাহায্য করা হত।
বণিকেরা বলদ এবং গাধার পিঠে পণ্যসম্ভার চাপিয়ে স্থান স্থানান্তরে যাতায়াত করতেন। রাষ্ট্রকূট রাজ্যের বিভিন্ন শহর বাণিজ্যিক পথে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কুবলয়মালাকহায় রাষ্ট্রকূট রাজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিম্নোক্ত অন্তর্বাণিজ্যিক পথের উল্লেখ আছে :
- ক. অযোধ্যা—বিজয়পুরী পথ। বিজয়পুরী বর্তমান রত্নগিরি জেলার বিজয়দুর্গ ;
- খ. উজ্জয়িনী—নর্মদা পথ ; গ. বারাণসী নর্মদা পথ ;
- ঘ. তক্ষশিলা—সোপারা পথ ;
- ঙ. বিন্ধ্যাবাস—ভরুকচ্ছ পথ ;
- চ. বিন্ধ্যাটবী—নর্মদা পথ ;
- ছ. দেব-অটবী—ভরুকচ্ছ পথ।
আল বেরুনির ভারত-বৃত্তান্তেও কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বাণিজ্যিক পথের উল্লেখ আছে। পথগুলি নিম্নরূপ :
- ক. কান্যকুব্জ—বনবাসি পথ ;
- খ. ধর—গোদাবরী পথ ;
- গ. ধর— থানা পথ ;
- ঘ. বাজানা— সোমনাথ পথ ;
- ঙ. অনহিলবাড়—থানা পথ।
এ সময় সোপারা, কল্যাণ, নবসারী, থানা ইত্যাদি পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত বন্দরগুলি বহির্বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এসব বন্দরে আরব বণিকদের বসতিও গড়ে ওঠে। বন্দররূপে সোপারার গুরুত্ব উদ্যোতনসূরির লেখা কুবলয়মালাকহা কাব্যেও স্বীকৃতি পেয়েছে। এই কাব্যে বলা হয়েছে, সোপারা বন্দরের সঙ্গে সমুদ্রপথে বব্বরকুল, সুবর্ণদ্বীপ, চিন, মহাচিন, মহিলারাজ্য ও রত্নদ্বীপের সংযোগ ছিল। দক্ষিণ ভারত থেকে বহির্দেশে চন্দন, সেগুন, মেহগনি, বাঁশ, বনৌষধি, সুগন্ধি, সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র, হীরা প্রভৃতি দ্রব্য রপ্তানি হত। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকে থানা ও ভারোচ থেকে আরব ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে চর্মজাত দ্রব্যের রপ্তানির কথা বলেছেন ইতালীয় পর্যটক মার্কো পোলো। এ সময় পশ্চিম এশিয়া থেকে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যসমূহে কাঁচ, রুপা, তামা, টিন, খেজুর, ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী, অশ্ব ইত্যাদি জিনিস আমদানি হত।
মুদ্রাব্যবস্থা
জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয়ে দ্রব্যবিনিময় ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল। তবে মুদ্রারও প্রচলন ছিল। রাষ্ট্রকূট লেখমালায় দ্রম্ম, কাঞ্চন-দ্রম্ম, সুবর্ণ, গদ্যাণ, কাশু প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণির মুদ্রার উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রকূট লেখে দ্রম্ম ও কাঞ্চন-দ্রন্মের উল্লেখ থেকে মনে হয়, রৌপ্য ও স্বর্ণ উভয় ধরনের দ্রম্মই রাষ্ট্রকূট রাজ্যে প্রচলিত ছিল। সাধারণত এক একটি দ্রম্মের ওজন ছিল ৬৫ গ্রেন। গদ্যাণও এক ধরনের স্বর্ণমুদ্রা। এক একটি গদ্যাণের ওজন ৯৬ গ্রেন। সুবর্ণ বলতে স্বর্ণমুদ্রা বোঝায়। কাশুও এক ধরনের স্বর্ণমুদ্রা। (দীনেশচন্দ্র সরকার (Studies In Indian Coins (Delhi, 1968), পৃষ্ঠা ১৭) কাশুকে এক শ্রেণির তাম্রমুদ্রারূপে চিহ্নিত করেছেন।) লেখ থেকে জানা যায়, ২০টি কাশু ৭টি কলঞ্জুর সমতুল্য ছিল। এক একটি কাশুর ওজন কিঞ্চিদধিক ১৬ গ্রেন। অনুমিত হয়, কলঞ্জু কোনও মুদ্রার নাম নয়, মূল্য বা ওজনের একক। এক একটি কলঞ্জু বিচির ওজন সম্পর্কে বিদ্বজ্জনেরা সহমত নন। ওয়াল্টার ইলিয়ট, আলেকজান্ডার কানিংহাম ও দীনেশচন্দ্র সরকার একটি কলঞ্জুর ওজন যথাক্রমে ৪৮, ৫৭.৩৬ এবং ৭৩.২ গ্রেনে ধার্য করেছেন। (তদেব, পৃষ্ঠা ৩)। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, ১ কলঞ্জ ওজনের স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রাও কলঞ্জু নামে অভিহিত হত। এ অভিমত বিতর্কিত।
রাষ্ট্রকূট রাজারা নিশ্চিতরূপে উৎকীর্ণ করেছেন এরূপ কোনও স্বর্ণ, রৌপ্য বা তাম্রমুদ্রার সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। মহারাষ্ট্রের নাসিক ও অন্যান্য কয়েকটি স্থানে কৃষ্ণরাজের নামাঙ্কিত কতিপয় রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। কেউ কেউ এই কৃষ্ণরাজকে রাষ্ট্রকূট বংশীয় প্রথম কৃষ্ণরূপে শনাক্ত করেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ পণ্ডিতের অভিমত, কলচুরিনৃপতি কৃষ্ণরাজ এই মুদ্রাগুলি খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উৎকীর্ণ করেন। মালখেড়ের সন্নিকটবর্তী এক গ্রামে ৪টি তাম্রমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলি দ্বিতীয় কর্ক উৎকীর্ণ করেছেন বলে দিনকর রাও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। দীনেশচন্দ্র সরকার মুদ্রাগুলিকে কাকতীয় রাজা প্রথম বা দ্বিতীয় প্রতাপ রুদ্রদেবের বলে মত প্রকাশ করেছেন। অধ্যাপক সরকারের অভিমতই গৃহীত হয়েছে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে পুণে জেলায় ‘গধিয়া’ মুদ্রার একটি ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে। মুদ্রাগুলি রাষ্ট্রকূট রাজারা উৎকীর্ণ করেছেন, এই মর্মে এক অভিমতও ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রকূট রাজ্যে এই ধরনের মুদ্রা কমই পাওয়া গেছে, পশ্চিম ও মধ্য ভারতেই এই মুদ্রার বহুল প্রচার ছিল। রাষ্ট্রকূট রাজারা এই মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন, এ কথা সম্ভবত ঠিক নয়। পশ্চিম বা মধ্য ভারত থেকে হয়তো কোনও বণিক বা তীর্থযাত্রী সঙ্গে করে মুদ্রাগুলি এনেছিলেন।
ধর্মীয় জীবন
বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম
বৌদ্ধধর্ম : খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে দক্ষিণ ভারতে প্রায় ২০০টির মতো বৌদ্ধবিহার বিরাজমান ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রকূট রাজাদের আমলে বৌদ্ধবিহারের সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস পায়। সমকালীন লেখে তিনটি মাত্র বৌদ্ধবিহারের উল্লেখ আছে। এদের একটি অবস্থিত ছিল কানহেরিতে, দ্বিতীয়টি শোলাপুর জেলার কম্বিলে, আর তৃতীয়টি ধারবাড় জেলার দম্বলে। বিহার তিনটির মধ্যে কানহেরি বৌদ্ধবিহারটিরই বেশি প্রসিদ্ধি ছিল। অমূল্য পুঁথিসম্ভারে এই বিহার সমৃদ্ধ ছিল। অজন্টা ও এলোরাতেও বৌদ্ধশাস্ত্রের চর্চা হত। এ দু’টি কেন্দ্রে এ পর্বে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ছিল ক্ষীয়মাণ।
জৈনধর্ম : এ সময় জৈনধর্ম বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর কারণও ছিল। রাজাদের মধ্যে অনেকেই জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জৈনধর্মের একান্ত অনুরাগী ছিলেন প্রথম অমোঘবর্ষ। তিনি তাঁর পুত্র দ্বিতীয় কৃষ্ণের সুশিক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেন তখনকার দিনের প্রখ্যাত জৈনাচার্য গুণভদ্রের উপর। দ্বিতীয় কৃষ্ণ এবং তাঁর উত্তরাধিকারী তৃতীয় ইন্দ্রও জৈন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অকাতরে দানধ্যান করেন। বহু রাষ্ট্রকূট প্রশাসক ও সেনাধ্যক্ষ জৈনধর্মাবলম্বী ছিলেন। সমকালীন অনেক গঙ্গ রাজা জৈনধর্মে দীক্ষিত ছিলেন। জৈন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে রাজপরিবারের দানধ্যান, রাজকার্য ও সামরিক বাহিনীতে বহু সংখ্যক জৈনদের নিয়োগ ও এ পর্বে রচিত জৈন সাহিত্যের বিপুল কলেবরের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমিত হয়, মহারাষ্ট্র কর্ণাটকে বিশাল সংখ্যক জৈনদের বসবাস ছিল। সন্দেহ নেই, এ অঞ্চলে জৈনধর্মের সম্প্রচারে গুণভদ্র, শাকটায়ন ও সোমদেবসূরির মতো আচার্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
ব্রাহ্মণ্যধর্ম
জৈনধর্মের অসাধারণ জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করতে হয়, রাষ্ট্রকূট রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষই ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী। রাষ্ট্রকূট রাজারা প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। শাস্ত্রবিদ ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মীয় সংস্থার অনুকূলে তাঁদের অকৃপণ দানের উল্লেখ আছে সমকালীন লেখে।
কিন্তু এ পর্বে বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান হ্রাস পায়। বৈদিক যাগযজ্ঞে রাজাদের তেমন উৎসাহ ছিল না। বৈদিক যাগযজ্ঞ যে একদম অনুষ্ঠিত হত না, তা নয়; কিন্তু এরূপ ঘটনা সেকালে বিরলই ছিল। কুমারিল খ্রিস্টীয় ৮ম শতকে বৈদিক যাগযজ্ঞের পুনরুজ্জীবনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। বৈদিক ধর্ম নয়, পৌরাণিক ধর্মই এই পর্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রতি নয়, পৌরাণিক দেবদেবী, আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডের প্রতিই লোকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। বৈদিক যাগযজ্ঞ ব্যয়সাধ্য, দীর্ঘস্থায়ী ; পশুবলি সে যজ্ঞের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পক্ষান্তরে পৌরাণিক অনুষ্ঠান ছিল সরল ও অনাড়ম্বর, পশুবলি ছিল অনভিপ্রেত। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রচারের ফলে সাধারণ লোক পশুবলির প্রতি বিতৃষ্ণ হন। ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের মধ্যে বিষ্ণু, শিব, লক্ষ্মী এবং সূর্যই প্রধান ছিলেন। এ পর্বে বিষ্ণু ও শিবের উদ্দেশ্যে বহু মন্দির নির্মিত হয়। এলোরার সুবিখ্যাত কৈলাস মন্দির প্রথম কৃষ্ণের রাজত্বকালে নির্মিত হয়। এই মন্দিরের সুবৃহৎ গর্ভগৃহে বিশাল শিবলিঙ্গ স্থাপিত, আর মন্দিরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঈশ্বরের অগণিত লীলামূর্তি সংরক্ষিত। শিবের মানবিক রূপ অপেক্ষা প্রতীক বা লিঙ্গসাধনাই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। শিবের বিভিন্ন রূপতত্ত্ব এ পর্বে অপরিজ্ঞাত ছিল না। শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তিও এ সময় অধিক সংখ্যায় নির্মিত হয়। সমকালীন এলিফ্যান্টা গুহামন্দিরের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। এই অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে একদিকে অভিব্যক্ত হয়েছে জগৎপিতার সৌম্য ও উগ্র রূপ, অপরদিকে প্রকাশিত হয়েছে জগৎপিতা ও জগন্মাতার সমন্বিত রূপতত্ত্ব।
মন্দিরগুলি ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি বিস্তারের কেন্দ্র। ভক্তজনেরা দলবদ্ধভাবে মন্দিরে সমবেত হতেন। মন্দিরে শুধু পূজা-অৰ্চনাই অনুষ্ঠিত হত না, ধর্ম, দর্শন, সদাচার ইত্যাদি বিষয়েও মনোগ্রাহী আলোচনা হত। উচ্চশিক্ষারও চর্চা হত মন্দিরে। সংগতিহীন ছাত্র, দীনদরিদ্র এবং সন্ন্যাসীদের অন্ন বিতরণ করা হত। মন্দিরে মনোরঞ্জনেরও যথেষ্ট আয়োজন ছিল। নিয়মিত নৃত্যগীত অনুষ্ঠিত হত। দেবদাসীরা নৃত্য ও সংগীত পরিবেশন করতেন। রাষ্ট্র এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ মন্দিরের অনুকূলে অকৃপণ হস্তে জমি ও অর্থ দান করতেন। এই দানেই মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহ হত। কথিত আছে, চতুর্থ গোবিন্দ তাঁর রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্দিরের উন্নতিকল্পে ৪০০টি গ্রাম এবং ৩২ লক্ষ মুদ্রা দান করেন। তখনকার দিনের লোকেরা বিশ্বাস করতেন, ধর্মীয় কার্যে দানধ্যান করলে দেবতারা প্রসন্ন হন। এ ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু ধনী ব্যক্তি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন, পুষ্করিণী ও কূপ খনন করেছেন, দাতব্য ভোজনালয় স্থাপন করে দরিদ্র নর-নারায়ণের সেবা করেছেন। তীর্থযাত্রা সমাজে জনপ্রিয় হয়। গোমাতার প্রতি সাধারণের ভক্তি বৃদ্ধি পায়।
শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০ খ্রিস্টাব্দ)
অদ্বৈতবাদের প্রখ্যাত প্রবক্তা শঙ্করাচার্য এই পর্বেই আবির্ভূত হন। জন্ম তাঁর কেরলে, নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণকুলে। গৌরপাদ তাঁর গুরু, পদ্মপাদ ও সুরেশ্বর তাঁর দুই স্বনামধন্য শিষ্য। মাত্র ৩২ বৎসরকাল তিনি জীবিত ছিলেন। এরই মধ্যে সারা ভারত তিনি পরিভ্রমণ করেছেন, ভারতের চার চারটি প্রান্তে মঠ স্থাপন করেছেন। এদের একটি শৃঙ্গেরী মঠ। কর্ণাটকের চিকমাঙ্গালুর জেলার শৃঙ্গেরীতে এই মঠ অবস্থিত। উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উপর জ্ঞানগর্ভ ভাষ্য রচনা করে তিনি অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। অদ্বৈতবাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য বলেন, “শ্লোকার্ধেন প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ। ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মেব নাপরঃ ॥”
কোটি কোটি গ্রন্থে যে কথা বলা হয়েছে, আমি শ্লোকার্ধেই তা বলছি : ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা। জীবই ব্রহ্ম। শঙ্করাচার্য মনে করেন, যে বস্তু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, এই তিনকালেই বর্তমান, জ্ঞানান্তরের দ্বারা অবাধিত, তাই সৎ, তাই সত্য। ব্রহ্মই একমাত্র সদ্বস্তু। কিন্তু জগৎ মিথ্যা। এর অর্থ এই নয়, জগৎ অলীক। ‘আকাশকুসুম’, ‘বন্ধ্যাসুত’ প্রভৃতি বস্তুর অস্তিত্ব লৌকিক জগতে নেই। আমাদের জ্ঞানের দৃষ্টিতেও তারা আভাসিত হয় না। তারা অসৎ বা অলীক। কিন্তু জীব ও জগৎ আমাদের বাহ্য চেতনায় বর্তমান। তাই তারা অলীক নয়। কিন্তু জীব ও জগৎ অনাদি নয়। এক সময় তাদের সৃষ্টি হয়েছে এবং যথাক্রমে মৃত্যু ও কল্পান্তে তাদের বিনাশ হবে। তারা ত্রৈকালিক সত্য নয়। তারা শুধু বর্তমানকালেই বিরাজমান। তাই শঙ্করের মতে জীব ও জগৎ সত্ত নয়, অসত্ত নয়, সদসৎ ভিন্ন এক অনির্বচনীয় বস্তু। ব্রহ্মজ্ঞানের উপলব্ধি হলে মানুষের অবিদ্যা দূর হয়, জগৎ আর সৎ বস্তুরূপে প্রতিভাত হয় না, ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা জগৎ বাধিত হয়। যা জ্ঞানান্তরের দ্বারা বাধিত তাই মিথ্যা। ‘জ্ঞানান্তরবাধিতত্বং মিথ্যাত্বম্’। সুতরাং জগৎ মিথ্যা। ব্রহ্মজ্ঞানীর নিকট সবকিছুই ব্রহ্ম। জীবও ব্রহ্ম। উপাস্য ও উপাসক অভেদ। নিখিল জগৎ ব্রহ্মময়।
ইসলামধর্ম
রাষ্ট্রকূট রাজ্যে ইসলামধর্ম যথেষ্ট সমাদৃত ছিল। মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের বন্দর সমূহে বহু সংখ্যক আরবদেশীয় মুসলমান বণিক বাস করতেন। তাঁদের অবাধ ধর্মাচরণের জন্য বেশ কয়েকটি মসজিদ এ সময় নির্মিত হয়। রাষ্ট্রকূট রাজারা মূলত ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেন কিন্তু ইসলাম ধর্মমতের প্রতি তাঁরা সশ্রদ্ধ ছিলেন। তাঁদের আমলে ইসলামধর্মাবলম্বী ব্যক্তি উঁচু প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সমকালীন লেখে এমন ঘটনার উল্লেখ আছে। তখনকার দিনের বহু আরব পর্যটক ইসলামধর্মের প্রতি রাষ্ট্রকূট রাজাদের উদার মনোভাবের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এ যুগের ধর্মীয় জীবনের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রকূট রাজ্যে বিভিন্ন ধর্মের লোক বাস করতেন; তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল প্রীতিপূর্ণ। মাঝে মাঝে বিতর্কসভার আয়োজন করা হত; সেখানে বিভিন্ন বক্তা নিজ নিজ ধর্মমত ব্যাখ্যা করতেন, স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হতেন। বক্তারা যুক্তিতর্কের সাহায্যে তাঁদের বক্তব্য পেশ করতেন, অন্ধবিশ্বাসের বশে নয়। তখন এটিই ছিল স্বাভাবিক। রাজন্যবর্গ ও পদস্থ রাজপুরুষেরা বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রথম অমোঘবর্ষ ব্রাহ্মণ্য ও জৈনধর্মের প্রতি সমান অনুরক্ত ছিলেন। গুজরাত রাষ্ট্রকূট শাখার দন্তিবর্মা স্বয়ং ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেন কিন্তু বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তিনি প্রচুর দানধ্যান করেন। বহু ব্রাহ্মণ জৈন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দান করেছেন। ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের অনুশাসন অনুসরণ করেছেন, লেখমালায় এমন ধার্মিক, সদাশয় ব্যক্তিদের উল্লেখ আছে। কখনও কখনও একই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে জৈন ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজা-অর্চনা অনুষ্ঠিত হত, এরূপ সন্দেশও সমকালীন লেখে পরিবেশিত হয়েছে। এ সময় ইসলামধর্মাবলম্বী আরব বণিকেরা পশ্চিম ভারতীয় উপকূলস্থ বন্দরগুলিতে বসতি স্থাপন করেন। আরব বণিকদের প্রতি রাষ্ট্রকূট রাজাদের সদয় আচরণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সমকালীন মুসলমান পর্যটকেরা। আরব বণিকদের নিরুপদ্রবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য বন্দরে বন্দরে মসজিদ নির্মিত হয়, মুসলমান অপরাধীদের ন্যায় বিচারের স্বার্থে কাজি নিযুক্ত হন। পক্ষান্তরে মুসলমান প্রশাসক ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বীদের সুবিধার্থে নিজে উদ্যোগী হয়ে মন্দির নির্মাণ করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত রাষ্ট্রকূটপর্বে অশ্রুতপূর্ব নয়।
ভাষা ও সাহিত্য
সংস্কৃত সাহিত্য
রাষ্ট্রকূটদের রাজত্বকালে মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে সংস্কৃত ভাষা বিপুল প্রসারলাভ করে। রাষ্ট্রকূট রাজারা সংস্কৃত ভাষার অনুরাগী ছিলেন। প্রথম অমোঘবর্ষের মতো কোনও কোনও রাষ্ট্রকূট নৃপতি তো সুসাহিত্যিকই ছিলেন। বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্তরাও সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এ পর্বের বেশির ভাগ লেখই সংস্কৃতে রচিত। ছন্দমাধুর্য, অর্থগৌরব ও পদলালিত্যে লেখের ভাষা কখনও কখনও রসোত্তীর্ণ সাহিত্যে উন্নীত হয়েছে। ধর্ম, দর্শন, ব্যাকরণ, গণিত, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ের উপর বহুসংখ্যক সংস্কৃত গ্রন্থ এ সময় রচিত হয়। রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে সংস্কৃতে কয়েকখানি কাব্যও রচিত হয়। এ যুগে রচিত বেশ কয়েকখানি গ্রন্থ আজও সমাদৃত।
- অদ্বৈতবাদের প্রখ্যাত প্রবক্তা শঙ্করাচার্য উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উপর জ্ঞানগর্ভ ভাষ্য রচনা করেন। তাঁর অমূল্য রচনাসম্ভারে ভারতীয় দর্শন মহিমান্বিত হয়েছে। তাঁর রচিত ভক্তিস্তোত্র আজও ভারতের মন্দিরে মন্দিরে পরিবেশিত হচ্ছে।
- শঙ্কর-শিষ্য পদ্মপাদ ‘পঞ্চপাদিকা’ নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
- শঙ্করের আর এক বিশ্রুতকীর্তি শিষ্য সুরেশ্বর রচনা করেন ‘বৃহদারণ্যক-শ্লোকবার্তিক’, ‘তৈত্তিরীয়-শ্লোকবাৰ্তিক’, ‘নৈষ্কর্মসিদ্ধি’ প্রভৃতি কয়েকটি গ্রন্থ। তাঁদের উভয়েরই কর্মভূমি কর্ণাটক।
- বিশ্বরূপের যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির উপর ‘বালক্রীড়া’ নামে একখানি বিখ্যাত টীকাগ্রন্থ আছে। অনেকের অনুমান, ‘বালক্রীড়া’-প্রণেতা বিশ্বরূপ এবং শঙ্করশিষ্য সুরেশ্বর একই ব্যক্তি।
- এ পর্বে কয়েকখানি ব্যাকরণ-গ্রন্থ রচিত হয়। সে যুগের এক যশস্বী বৈয়াকরণ দুর্গাসিংহ। তিনি কাতন্ত্রসূত্রের উপর একখানি প্রামাণ্য বৃত্তি বা টীকা প্রণয়ন করেন।
- প্রথম অমোঘবর্ষের প্রসাদ ধন্য জৈন বৈয়াকরণ শাকটায়ন ‘শব্দানুশাসন’ ও ‘অমোঘবৃত্তি’ নামে দু’খানি ব্যাকরণ-গ্রন্থ রচনা করেন।
- ৮ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মাণিক্যনন্দী তর্কশাস্ত্রের উপর ‘পরীক্ষামুখশাস্ত্র’ নামে একখানি গ্রন্থ লেখেন। প্রায় পাঁচ দশক পর প্রভাচন্দ্র এই গ্রন্থের একটি টীকা প্রকাশ করেন।
- প্রভাচন্দ্র ‘ন্যায়কৌমুদীচন্দ্রোদয়’ নামে আর একখানি গ্রন্থের রচয়িতা।
- সে যুগের এক শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ মহাবীরাচার্য। প্রথম অমোঘবর্ষের সমকালবর্তী তিনি গণিতশাস্ত্রের উপর লেখা তাঁর গ্রন্থটির নাম ‘গণিতত্সারসংগ্রহ’।
- প্রায় একই সময় উগ্ৰাদিত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর ‘কল্যাণকারক’ নামে একখানি প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
- সুসাহিত্যিক ছিলেন প্রথম অমোঘবর্ষ। আর্যা ছন্দে, সরল সংস্কৃতে ‘প্রশ্নোত্তররত্নমালিকা’ নামে তিনি প্রশ্নোত্তরমূলক একখানি নীতিকাব্য রচনা করেন। কাব্যকার স্বয়ং প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। প্রশ্নগুলি যেমন সুচিন্তিত, উত্তরগুলিও তেমনি মনোগ্রাহী। কয়েকটি প্রশ্ন ও তাদের উত্তর দৃষ্টান্তরূপে উল্লেখ করা যায় :
-
- প্রশ্ন : নরক কী?
- উত্তর : পরনির্ভরশীলতা।
- প্রশ্ন : মানুষের নিকট ভীতিপ্রদ বস্তু কী?
- উত্তর : মৃত্যু।
- প্রশ্ন : দারিদ্র্য কী? উত্তর : অতৃপ্তি।
- প্রশ্ন : কে বুদ্ধিমান?
- উত্তর : যিনি বুদ্ধির বড়াই করেন না।
- প্রশ্ন : কোন্ বস্তু অনুধাবন করা যায় না?
- উত্তর : নারীচরিত্র।
- প্রথম অমোঘবর্ষের গুরু জৈনাচার্য জিনসেন ‘আদিপুরাণ’ রচনার কাজ আরম্ভ করেন। গ্রন্থখানি তিনি অসম্পূর্ণ রেখে যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর খ্যাতিমান শিষ্য গুণচন্দ্র ৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থখানি সমাপ্ত করেন। বহু জৈনসাধুর জীবনী আলোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। পার্শ্বনাথের জীবনী অবলম্বন করে জিনসেন ‘পার্শ্বাভ্যুদয়’ কাব্য রচনা করেন। প্রথম অমোঘবর্ষের গুরু জিনসেন এবং জৈন হরিবংশ-পুরাণের প্রখ্যাত রচয়িতা আচার্য জিনসেন এক ব্যক্তি নন। শেষোক্ত ব্যক্তি খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত হন। হরিবংশ-পুরাণের রচনাকাল ৭৮৩-৮৪ খ্রিস্টাব্দ।
- তৃতীয় ইন্দ্রের সভাকবি ত্রিবিক্রম। গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণে তিনি চম্পু নামে এক নতুন ধরনের কাব্য রচনা করেন। পূর্ববর্তী যুগে গদ্য ও পদ্যের মিলনে বহু কাব্য ও নাটক রচিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে পদ্যের ভূমিকা গৌণ। চম্পুকাব্যে গদ্য ও পদ্যের সমান গুরুত্ব। বহুশ্রুত নল ও দময়ন্তীর কাহিনি আশ্রয় করে তিনি ‘নলচম্পু’ বা ‘দময়ন্তীকথা’ রচনা করেন। কাহিনিটি মূলত মহাভারত থেকে গৃহীত হলেও ত্রিবিক্রম ঘটনার বর্ণনা ও উপস্থাপনায় সৃজনশীলতার পরিচয় দেন।
- প্রখ্যাত সাহিত্যিক সোমদেবসূরি তৃতীয় কৃষ্ণের সমকালীন ছিলেন। তিনি ছিলেন বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্ত দ্বিতীয় অরিকেশরীর পুত্র তৃতীয় বড্ডেগ ও পৌত্র তৃতীয় অরিকেশরীর অনুগ্রহভাজন। রাজনীতি ও জৈনশাস্ত্রে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল। রায়চুর জেলার প্রাচীন গঙ্গধারা শহরে অবস্থিত শুভধাম জিনালয় জৈনমঠের অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা একখানি কাব্য ‘যশস্তিলকচম্পূ’ বা ‘যশোধর-চরিত’। উজ্জয়িনীর পৌরাণিক রাজা যশোধরের জীবনী এই কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়। জৈনধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত হলেও সমকালীন ধর্মীয় ও সমাজ-জীবনের এক মূল্যবান দর্পণরূপে গ্রন্থখানি সমাদৃত। তাঁর রাজনীতিবিষয়ক গ্রন্থ ‘নীতিবাক্যামৃত’। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের অনুকরণে গ্রন্থখানি রচিত। ‘স্যাদ্বাদোপনিষদ্’, ‘মহেন্দ্ৰমাতলিসঙ্কল্প’, ‘যুক্তিচিন্তামণিসূত্র’ ইত্যাদি আরও কয়েকখানি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন।
- হলায়ুধ তৃতীয় কৃষ্ণের সভায় ‘কবিরহস্য’ কাব্য রচনা করেন। কাব্যখানিতে তৃতীয় কৃষ্ণের গুণ কীর্তিত হলেও কাব্যটি মূলত ধাতুপ্রকরণ-সম্পর্কিত। তিনি ‘অভিধানরত্নমালা’ নামে একখানি অভিধান রচনা করেন। ছন্দপ্রকরণের উপর লেখা তাঁর একটি গ্রন্থ আছে। গ্রন্থটির নাম ‘মৃতসঞ্জীবনী’।
- দর্শনাচার্য কুমারিল, বৈয়াকরণ বাচস্পতি, স্মৃতিকার কাত্যায়ন ও যম এবং বিদগ্ধ কাব্যকার রাজশেখর এ পর্বেই আবির্ভূত হন। এসব লেখকদের সঙ্গে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের কোনওরূপ সম্পর্ক ছিল কিনা তা অনিশ্চিত। এঁদের অন্তত একজন মহারাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশেখর। তাঁর জীবনের সিংহভাগই উত্তর ভারতে অতিবাহিত হয়।
অপভ্রংশ
এ পর্বে অপভ্রংশেও কয়েকখানি কাব্য রচিত হয়। খ্রিস্টীয় ৮ম বা ৯ম শতকে চতুর্মুখ ‘পৌমচরিউ’ ও ‘রিট্ঠনেমিচরিউ’ নামে দু’খানি কাব্য রচনা করেন। কিন্তু অপভ্রংশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি পুষ্পদন্ত। রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় কৃষ্ণের সমকালবর্তী তিনি। সম্ভবত বিদর্ভে তাঁর জন্ম। আজীবন ব্রহ্মচারী এই কবি ধর্মমতে জৈন ছিলেন। তিনি ‘মহাপুরাণ’ কাব্যের রচয়িতা। গ্রন্থটির দু’টি খণ্ড, আদিপুরাণ ও উত্তরপুরাণ। সমগ্র গ্রন্থটিতে ৬৩ জন জৈন মহাপুরুষের জীবন কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। ছন্দ ও পদের অনুপম ব্যবহারে কাব্যখানি সুষমামণ্ডিত হয়েছে। পুষ্পদন্ত অপভ্রংশে ‘নয়কুমারচরিউ’ ও ‘যসহরচরিউ’ নামে আরও দু’খানি কাব্য রচনা করেন। পুষ্পদন্তের মহাপুরাণের অনুকরণে কনকামর ‘করকণ্ডচরিউ’ নামে একখানি কাব্য প্রণয়ন করেন।
কন্নড় সাহিত্য : রাষ্ট্রকূট রাজারা কন্নড় সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এ সময় কন্নড় সাহিত্যের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। কন্নড় ভাষায় রচিত এ যুগের গ্রন্থাদির মধ্যে ‘কবিরাজমার্গ’ নিঃসন্দেহে শীর্ষস্থানীয় । গ্রন্থখানি রচনা করেন রাষ্ট্রকূটরাজ প্রথম অমোঘবর্ষ। অনেকে মনে করেন, গ্রন্থখানির প্রকৃত রচয়িতা রাষ্ট্রকূটরাজের অনুগ্রহভাজন এক সাহিত্যসেবী; তিনি কৃতজ্ঞতাবশত তাঁর অন্নদাতা নৃপতুঙ্গ তথা প্রথম অমোঘবর্ষের নামে গ্রন্থটি রচনা করেন। কাব্যের প্রতিপাদ্য বস্তু, গুণাগুণ, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ের চিন্তাগর্ভ বিচার-বিশ্লেষণ আছে এই গ্রন্থে। বহু প্রাচীন কন্নড় কাব্যকারদের নাম এই গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে।
- প্রথম পম্প বা আদি পম্প এ পর্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কন্নড় কবি। খ্রিস্টীয় ১০ম শতকীয় এই কবি বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্ত তৃতীয় বড্ডেগ ও তাঁর পুত্র তৃতীয় অরিকেশরীর অনুগ্রহপুষ্ট ছিলেন। তাঁর লেখা দু’টি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ, ‘আদিপুরাণ’ ও ‘বিক্রমার্জুনবিজয়’ বা ‘পম্পভারত’। প্রথম কাব্যে তিনি জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের জীবনী বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় কাব্যখানি বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্ত বংশের ইতিহাস সম্পর্কিত। এই কাব্যে তৃতীয় অরিকেশরীকে পাণ্ডুতনয় অর্জুনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, তৃতীয় ইন্দ্রের উত্তর ভারত অভিযান সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। তাঁর কাব্যে বীরধর্ম ও হৃদয়বত্তার জয়গান ঘোষিত হয়েছে। তিনি বলেন, যে রাজা শত্রুদমনে ব্যর্থ, শরণাগতকে আশ্রয় প্রদানে অপারগ ও দান-ধ্যানে বিগতস্পৃহ, তিনি মনুষ্যপদবাচ্য নন। নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি নিছক একজন কবি নন, ক্ষাত্রধর্মে তিনি দীক্ষিত।
- এ যুগের অপরাপর কন্নড় লেখকদের মধ্যে রত্ন, নাগবর্মা, চামুণ্ডাচার্য, অসঙ্গ ও জিনচন্দ্রের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। রঙ রচনা করেন দু’খানি কাব্য, ‘অজিতপুরাণ’ ও ‘গদাযুদ্ধ’। নাগবর্মার ‘ছন্দোম্বুধি’ ছন্দবিষয়ক গ্রন্থ। চামুণ্ডাচার্যের ‘চামুণ্ডরায়-পুরাণ’ তীর্থঙ্করদের জীবনীগ্রন্থ। শেষোক্ত গ্রন্থটি আদ্যপ্রান্ত কন্নড় গদ্যে রচিত।
- এ পর্বের সাহিত্যাকাশের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক পোন্ন। সংস্কৃত, কন্নড় ও তেলুগু ভাষায় গ্রন্থ প্রণয়ন করে তিনি খ্যাতিলাভ করেন। তাঁর লেখা সংস্কৃত গ্রন্থ ‘শান্তিপুরাণ’। গ্রন্থখানিতে তীর্থঙ্করদের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। তাঁর আদিপুরাণ গ্রন্থটি তেলুগু ভাষায় রচিত। রাষ্ট্রকূট নৃপতি তৃতীয় কৃষ্ণ তাঁকে দু’টি ভাষায় ব্যুৎপত্তির জন্য ‘উভয়কবিচক্রবর্তী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ভাষা দু’টির একটি অবশ্যই সংস্কৃত। কিন্তু অন্য ভাষাটি কী? সেটি তেলুগু কিংবা কন্নড়।
স্থাপত্য, ভাষ্কর্য ও চিত্রকলা
স্থাপত্য
ভারতীয় গুহা-স্থাপত্যের ইতিহাসে রাষ্ট্রকূট পর্ব এক স্মরণীয় অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। এ পর্বে পাহাড় কুঁদে নির্মিত গুহা-মন্দিরের মধ্যে এলোরার দশাবতার, ইন্দ্রসভা, জগন্নাথসভা ও কৈলাস গুহা-মন্দির সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। গুহা-মন্দিরগুলির তুলনায় এ পর্বে নির্মিত সৌধ স্থাপত্যের নিদর্শনসমূহ শুধু ক্ষীণকলেবরই নয়, শৈল্পিক সৌকর্যেও হীনপ্রভ।
- দ্বিতল দশাবতার গুহা-মন্দির আয়তনে বিশাল। গুহা-মন্দিরের প্রবেশমুখে রাষ্ট্রকূট নৃপতি দন্তিদুর্গের একখানি লেখ উৎকীর্ণ আছে। অনুমিত হয়, এই গুহা-মন্দির খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের মধ্যভাগে খনিত হয়। গুহা-মন্দিরের সম্মুখবর্তী অঙ্গনের ঠিক কেন্দ্রস্থলে চারস্তম্ভের একটি বিচ্ছিন্ন নন্দিমণ্ডপ। মণ্ডপের সামনে ও পিছনদিকে সিঁড়ি। গুহা-মন্দিরের সামনের দিকে প্রতি তলেই এক সারির স্তম্ভ। উপর-নিচের দু’টি স্তম্ভসারি একই রেখায় বিন্যস্ত। স্তম্ভগুলি বর্গাকার। দ্বিতীয় তল একটি সস্তম্ভ মণ্ডপ। মণ্ডপের পশ্চাদ্ভাগে দেবকক্ষ বা গর্ভগৃহ। দেবকক্ষে বর্তুলাকার লিঙ্গপীঠে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। মণ্ডপের পশ্চাদভাগের কিয়দংশ দেবকক্ষের সম্মুখস্থ অন্তরাল বা অর্ধমণ্ডপের রূপ পরিগ্রহ করেছে। মণ্ডপ বর্গাকার ঔত্তরাজিতে সজ্জিত। দু’চারটি স্তম্ভ অলংকৃত, সিংহভাগই নিরাভরণ। মণ্ডপের অন্তর্দেয়ালে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি সুদৃশ্যরূপে উৎকীর্ণ।
- এলোরার ইন্দ্রসভা ও জগন্নাথসভা গুহা-মন্দির দু’টি পরস্পরের সন্নিকটবর্তী। দু’টিই জৈন মন্দির ও দ্বিতল। ইন্দ্রসভার সম্মুখভাগে একশিলা চৌমুখ মন্দির। গুহা-মন্দিরের সম্মুখ ভাগ সুচারুরূপে অলংকৃত। গুহা-মন্দিরের আদিতল অর্ধসমাপ্ত। দ্বিতল একটি নবরঙ্গ-মণ্ডপ। মণ্ডপে তীর্থঙ্করদের মূর্তি উৎকীর্ণ। মণ্ডপটির সম্মুখভাগ একটি সস্তম্ভ মুখমণ্ডপের মতো বিন্যস্ত।
- জগন্নাথসভা ইন্দ্রসভারই অনুরূপ। কিন্তু এর আদিতল সম্পূর্ণরূপে নির্মিত ও তিনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অঙ্গে বিন্যস্ত। প্রতিটি অঙ্গে রয়েছে দেবকক্ষ, মণ্ডপ এবং সম্মুখবর্তী অগ্রমণ্ডপ। দ্বিতল একটি নবরঙ্গ মণ্ডপ।
- এলোরার সুবিখ্যাত কৈলাস গুহা-মন্দির রাষ্ট্রকূট পর্বের শ্রেষ্ঠতম স্থাপত্যকীর্তিরূপে স্বীকৃত। পাহাড় কুঁদে নির্মিত সুবিশাল এই মন্দির কৈলাসনিবাসী শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। দন্তিদুর্গ সম্ভবত এই মন্দিরের নির্মাণকার্য শুরু করেন আর প্রথম কৃষ্ণের রাজত্বকালে মন্দিরটি পূর্ণতা লাভ করে। কাঞ্চীর কৈলাসনাথ মন্দির ও পট্টদকলের বিরূপাক্ষ মন্দিরের সঙ্গে এই গুহা মন্দিরের সাদৃশ্য সহজেই নজরে পড়ে। শেষোক্ত মন্দিরটিই হয়তো কৈলাস গুহা মন্দিরের আদর্শ সৌধরূপে গৃহীত হয়েছিল। কৈলাস গুহা-মন্দির একটি আয়তাকার প্রাঙ্গণে অবস্থিত। প্রাঙ্গণটি দৈর্ঘ্যে ৯১.৪৪ মি., প্রস্থে ৬০.৯৬ মি.। আচ্ছাদিত দেবকক্ষের একটি সারি প্রাঙ্গণটিকে পরিবেষ্টন করে আছে। প্রাঙ্গণের প্রবেশমুখে প্রায় গোপুরমের মতো একটি দ্বিতল প্রবেশকক্ষ। পশ্চিমাভিমুখী কৈলাস গুহা মন্দিরের প্রধান অঙ্গ তার সু-উচ্চ চতুস্তল বিমান ও সম্মুখস্থ মণ্ডপ। বিমান ও গ্রুপ ৭.৬২ মি. উঁচু একটি অধিষ্ঠানের উপর দণ্ডা যান। অধিষ্ঠানের নিম্ন ও উপরাংশ নকশা-খচিত। অন্তর্বর্তী অংশ হস্তী ও সিংহের মূর্তি-ভাস্কর্যে মণ্ডিত। মণ্ডপের সামনেই সিঁড়ি। মণ্ডপের ছাদ সমতল। ১৬টি স্তম্ভ ছাদের ভার বহন করছে। মণ্ডপ থেকে অন্তরাল বা অর্ধমণ্ডপ দিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করা যায়। বিমানের আদিতলস্থ গর্ভগৃহটি সন্ধার শ্রেণির। গর্ভগৃহকে ঘিরে রয়েছে একটি আচ্ছাদিত প্রদক্ষিণা পথ। গর্ভগৃহ ও প্রদক্ষিণা পথের তিনদিকে ৫টি ক্ষুদ্রাকৃতির দেবকক্ষ। বিমানশীর্ষে গম্বুজাকৃতির স্তূপিকা। বিমানটি উচ্চতায় ২৮.৯৫৬ মি.।
- মণ্ডপের সম্মুখবর্তী একটি বিচ্ছিন্ন, সমতল ছাদ বিশিষ্ট নন্দিমণ্ডপ। নন্দিমণ্ডপের দু’টি পাশে ১৫.২৪ মি. উচ্চতাবিশিষ্ট দু’টি ধ্বজস্তম্ভ। ধ্বজস্তম্ভের শীর্ষদেশে ত্রিশূল। পাহাড় কুঁদে এই গুহা-মন্দির নির্মাণে স্থপতি যে কারিগরি নৈপুণ্য ও পরিকল্পনা-সৌকর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। বিমান, মণ্ডপ, নন্দিমণ্ডপ ও দ্বিতল প্রবেশকক্ষ সবই যেন একসূত্রে গ্রথিত। অথচ নন্দিমণ্ডপ এবং প্রবেশকক্ষ মূল মন্দির থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও তারা এক বৃহৎ মন্দির-প্রকল্পের অত্যাবশ্যিক অঙ্গরূপে প্রতিভাত। মন্দিরটির সামগ্রিক পরিকল্পনায় এক ঐকতান অনুরণিত। তবু এই গুহা-মন্দিরে স্থাপত্য নয়, ভাস্কর্যই যেন মূল আকর্ষণ। এই গুহা-মন্দিরের অধিষ্ঠানে, স্তম্ভদেশে, দেয়ালগাত্রে ও বিমানের বহিরঙ্গে ভাস্কর্যশিল্প বৈচিত্র্য ও ঐশ্বর্যের সাবলীল অভিব্যক্তিতে স্বমহিমায় বিরাজমান। ভাস্কর্যের অত্যাশ্চর্য দ্যুতিতে স্থাপত্যশিল্প যেন হীনপ্রভ।
- রাষ্ট্রকূট পর্বীয় সৌধাবলির মধ্যে ৮ম শতকের শেষপাদে, পট্টদকলের নাতিদূরে মুখ্যত বালুপাথরে নির্মিত, ত্রিতল মন্দিরটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। মন্দিরের বিমান বর্গাকার, ত্রিতল। প্রধান গর্ভগৃহ আদিতলে অবস্থিত। একটি আচ্ছাদিত প্রদক্ষিণা পথ গর্ভগৃহকে পরিবেষ্টন করে আছে। গর্ভগৃহের সম্মুখভাগে একটি সংকীর্ণ অন্তরাল বা অর্ধমণ্ডপ। অন্তরালের সম্মুখবর্তী একটি নবরঙ্গ মণ্ডপ। মণ্ডপের পুরোভাগে বহু স্তম্ভশোভিত এক উন্মুক্ত মুখমণ্ডপ। বিমানের দ্বিতীয় তলেও একটি গর্ভগৃহ রয়েছে। গর্ভগৃহকে ঘিরে রয়েছে একটি উন্মুক্ত প্রদক্ষিণা পথ। দ্বিতীয় তলের সম্মুখভাগ থেকে প্রলম্বিত শুকনাসিকা অন্তরালের ছাদের উপরিদেশ পর্যন্ত প্রসারিত। তৃতীয় তলটি সংকীর্ণতর। তৃতীয় তলটিতেও শুকনাসিকা সংযোজিত হয়েছে। বিমানের বহিরঙ্গ ভাস্কর্যখচিত।
ভাস্কর্য
চালুক্য যুগের মতো রাষ্ট্রকুট পর্বের দেব-দেবীদের মূর্তিগুলিও গুরুভার ও বিশালকায়। দেব-দেবীদের বলিষ্ঠ দেহগঠনে আভাসিত হয়েছে শক্তিমত্ততা ও প্রাণশক্তির প্রকাশ। এই শক্তি মত্ততা ও প্রাণশক্তির অভিব্যক্তি প্রতিফলিত হয়েছে এ পর্বে নির্মিত দশাবতার ও কৈলাস গুহা মন্দিরের শৈব ও বৈষ্ণব ভাস্কর্যে।
- দশাবতার ও কৈলাস গুহা মন্দিরে বহু শৈব ও বৈষ্ণব ভাস্কর্য-ফলক খোদিত হয়েছে। বেশিরভাগ ফলকে শিব ও বিষ্ণুর সংহারমূর্তি রূপায়িত হয়েছে। দশাবতার মন্দিরের দ্বিতলে, প্রবেশমুখের সন্নিকটে ভৈরবমূর্তি উৎকীর্ণ আছে। মূর্তিটি বিশালকায়। দেবতার দেহগঠনে বলিষ্ঠতা ও শক্তিমত্ততার অভিব্যক্তি। ভৈরবের কণ্ঠে নরমুণ্ডমালা। ব্যদিত তাঁর মুখমণ্ডল। বিশাল বিশাল তাঁর দন্ত। ত্রিশূল দিয়ে তিনি রত্নাসুরকে নিধন করছেন। অপর একটি হাত দিয়ে তিনি আর এক অসুরকে নিপীড়ন করছেন। পৈশাচিক আনন্দে তিনি উন্মত্ত। হাতে তাঁর রক্ত। এই রক্ত তিনি পান করবেন। ভৈরবের পাশে কালী। তিনি কঙ্কালকায়া। বিরাট তাঁর মুখ। অবিন্যস্ত তাঁর কেশরাশি। কোটরগত তাঁর চক্ষু। তাঁর একহাতে ছুরি, অন্যহাতে পাত্র। অসুরের রক্তে তিনি তৃষ্ণা নিবারণ করবেন। ভাস্কর অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একটি নাটকীয় মুহূর্ত রচনা করেছেন।
- ভাস্কর শুধু শিবের সংহারমূর্তিই রূপায়িত করেননি তিনি শিবের সৌম্যমূর্তিও পরিবেশন করেছেন। এ প্রসঙ্গে কৈলাস গুহা মন্দিরের রাবণানুগ্রহমূর্তি ফলকটি স্মরণীয়। অমিতশক্তির অধিকারী রাবণ প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও কৈলাস পর্বতকে একচুলও নাড়াতে পারছেন না অথচ প্রশান্তচিত্ত শিব পদাঙ্গুলের মৃদু স্পর্শে পাহাড়টিকে তুলে ধরেছেন। শিল্পী সুনিপুণভাবে পরমেশ্বরের অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রকাশ রূপায়িত করেছেন।
- বিষ্ণুমূর্তির উপস্থাপনাতেও দেবতার শক্তিমত্ততা ও লীলা রূপায়িত হয়েছে। দশাবতার ও কৈলাস গুহা-মন্দিরে বিষ্ণুর বামনরূপে বলি দমন, নরসিংহরূপে হিরণ্যকশিপুকে নিধন এবং বরাহরূপে কালীয়নাগকে মর্দন ও পৃথিবীকে উদ্ধার রূপায়িত হয়েছে।
- কিন্তু এ যুগের ভাস্কর আবার এমন কিছু মূর্তি গড়েছেন যা নমনীয়, পেলব দেহগঠন ও মধুর ভঙ্গিমায় মহিমান্বিত। কৈলাস গুহা-মন্দিরে খোদিত আকাশবিহারী অপ্সরাদের মূর্তি অপূর্ব সুষমায় মণ্ডিত। মনোহর অপ্সরাদের দেহভঙ্গিমা, মনোমুগ্ধকর তাদের নবনীয়, পেলব দেহসৌষ্ঠব। তাদের আকাশবিহারের ভঙ্গি ছন্দায়িত, মনোরম।
চিত্রকলা
এ পর্বের কিছু চিত্র ইন্দ্রসভা গুহা-মন্দিরের ছাদের নিম্নতলদেশে অঙ্কিত আছে। চিত্রগুলি কুঙ্কুম বা সিন্দুর ও গাঢ় বাদামি রঙে তৈরি। এই গুহা-মন্দিরের অপ্সরাদের চিত্রগুলি দৃষ্টিনন্দন। সন্ধ্যা সমাগমে অপ্সরাদের দল মেঘের মধ্য দিয়ে স্বচ্ছন্দে বিহার করছে। কোমল, নমনীয় তাদের দেহ-গঠন, তাদের অঙ্গে অলংকরণ ও গহনার বাহার, অপরূপ তাদের দেহ ভঙ্গি। তবে অপ্সরাদের চিত্র চিত্রণে শিল্পী স্বকীয়তার পরিচয় দেননি, তিনি নিষ্ঠাভরে অজণ্টা শৈলীর অনুকরণ করেছেন মাত্র।
উপসংহার
রাষ্ট্রকূট পর্ব নিঃসন্দেহে ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। পরাক্রান্ত রাষ্ট্রকূট রাজারা মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক এবং মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এক শক্তিশালী রাজ্য গঠন করেন। এই রাজ্য কখনও কখনও উত্তরে মালব থেকে দক্ষিণে সুদূর তঞ্জাবূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। ধ্রুব, তৃতীয় গোবিন্দ ও তৃতীয় ইন্দ্রের মতো অশেষ পরাক্রমশালী রাজারা বাধার বিন্ধ্যাচল অতিক্রম করে উত্তর ভারতে সমরাভিযান পরিচালনা করেন, শক্তিশালী গুর্জর-প্রতীহার ও পাল নৃপতিদের পদানত করে সমকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে দক্ষিণা শক্তির প্রাধান্য স্থাপন করেন। শুধু সমরাঙ্গনে নয়, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রকূট রাজারা প্রশংসনীয় সাফল্যের পরিচয় দেন। তাঁদের আমলে বিদেশি বণিক সমাদরে গৃহীত হয়েছেন, ইসলামধর্মাবলম্বী পদস্থ রাজপুরুষের পদে নিযুক্ত হয়েছেন, রাষ্ট্রের আনুকূল্যে মসজিদ স্থাপিত হয়েছে, জৈনধর্মের অভূতপূর্ব বিস্তৃতি হয়েছে, জীব ও শিবের অভেদত্ব উচ্চারিত হয়েছে, দক্ষিণ ভারতে সংস্কৃত শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, কন্নড়, তেলুগু ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষা বিকশিত হয়েছে। এরূপ বিবিধ ঘটনার সমাবেশে রাষ্ট্রকূট যুগ অবিস্মরণীয় হয়েছে।
গ্রন্থপঞ্জি
- Altekar, A. S.: The Rashtrakutas And Their Times (Poona, 1967).
- Banerjea, J. N. : The Development of Hindu Iconography (New Delhi, 1985).
- Chattopadhyaya, B. D.: Coins And Currency System In South India: C. A. D. 225-1300 (New Delhi, 1977).
- Desai, P. B. : Jainism In South India And Some Jain Epigraphs (Sholapur, 1957).
- Majumdar, R. C. (Ed.) : The Age Of Imperial Kanauj (Bombay, 1955); A Comprehensive History of India, Vol. III, Pt. I (New Delhi, 1981).
- Mishra, Jayashri : Social And Economic Conditions Under The Imperial Rashtrakūtas (New Delhi, 1992).
- Murthy, A. V. N. The Coins Of Karnataka (Mysore, 1975).
- Murthy, H. V. Sreenivas & R. Ramakrishna: A History of Karnataka (Delhi, 1977).
- Rajan, K. V. Soundara: Art Of South India (Delhi, 1980).
- Ramesh, K. V. : A History of South Kanara (Dharwar, 1970).
- Sastri, K. A. Nilakanta: A History of South India (Oxford University Press, 1958).
- Srinivasan, K. R.: Temples Of South India (New Delhi, 1985).
- Yazdani, G.: The History Of The Deccan, Parts VII-XI (London, 1960).
সঙ্গম লেখে তো সর্বত্র। শ কেন?
অনেক ইনফরমেশন আছে এইখানে অনেক ধন্যবাদ