ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস

(পরিবর্ধিত হবে)

রেনেসাঁর যুগ

থমাস মোর (১৪৭৮-১৫৩৫)

রেনেসা যুগের প্রথম মানবতাবাদী টমাস মুর ১৪৭৮ খ্রীষ্টাব্দে লন্ডনে জন্মগ্রহণ। করেছিলেন । অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখেছিলেন। ল্যাটিন ভাষার তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। ল্যাটিন ভাষাতে ভাল লিখতে পারতেন। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় একজন বিদেশী মানবতাবাদীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। সেই বিদেশী মানবতাবাদী মানুষের স্বাধীন চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি শিক্ষা দিতেন যে পিতা, পিতামহ, পাদরি, পুরােহিত, পােপ যা বলবে তাই সত্য বলে মেনে নেওয়া উচিত নয়। সেগুলিকে যুক্তি দিয়ে বিচার করা দরকার। টমাস মুরের উপর ইরাসমাস-এর প্রভাব যে পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কি? তাছাড়া এদের দু’জনের মধ্যে চিঠির আদান-প্রদানও চলত।

টমাস মুর আইনজীবী হিসেবে জীবন শুরু করেন। সপ্তম হেনরীর রাজত্বকালে পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছিলেন। তিনি তার যুগের ঘটনার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ভেড়ার লােমের ব্যবসায় ধনী জমিদাররা বেশ মুনাফা অর্জন করছে। ছােট চাষীরা যারা তাদের জমি চাষ করত তাদেরকে ধনী জমিদাররা তাড়িয়ে দিয়ে জমিকে গােচারণ ভূমিতে পরিণত করেছিল। সেই সাথে সরকারী জমিও তারা দখল করে গােচারণ ভূমি করেছিল। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে টমাস মুর জোরাল প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।

চোদ্দ বছর পরে অষ্টম হেনরী যখন রাজা হলেন তখন টমাস মুর হাউস অব কমন্সের স্পিকার হয়েছিলেন। সে সময় হাউস অব কমন্সের ক্ষমতা ছিল সীমিত। কিন্তু অর্থ মঞ্জুরের জন্য রাজাকে অবশ্যই হাউসের ওপর নির্ভর করতে হত। রাজা একটা বিরাট অঙ্কের টাকা দাবী করেছিলেন। সে দাবী ছিল অন্যায় দাবী। টমাস মুর এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং পার্লামেন্ট তার বক্তব্য অনুসারে অর্ধেক টাকা মঞ্জুর করে। টমাস মুর পােপের বিরােধী ছিলেন। সুতরাং পােপ তার শত্রু ছিল। হেনরী স্বয়ং পােপের বিরােধী ছিলেন। সুতরাং টমাস মুরকে তাঁর পক্ষে আনার জন্য তিনি তাঁকে লর্ড চ্যান্সেলর করেছিলেন। কিন্তু মুর হেনরীর স্বৈরাচারী শাসন বিরােধী ছিলেন। তাই হেনরী তাঁকে কারারুদ্ধ করেন এবং বিশ্বাসঘাতকতার অজুহাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

টমাস মুর ইংরেজি এবং ল্যাটিন উভয় ভাষাতেই রচনা করেছেন। সে সময়ে সারা ইওরােপের মানবতাবাদীরা ল্যাটিন ভাষায় আদান-প্রদান বা মত বিনিময় করত। তিনি ইংরেজিতে যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলি হল, “ডিসকাসন অন পলিটিক্যাল সাবজেক্ট’, “বায়ােগ্রাফিস” এবং “কবিতা”। তবে যে গ্রন্থটির জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সে গ্রন্থটি হল “ইউটোপিয়া”, রচনা কাল ১৫১৬ খ্রীষ্টাব্দ, লিখেছেন ল্যাটিন ভাষায়। ইদানীং কালে সমস্ত ইওরােপীয় ভাষায় এই গ্রন্থ অনুদিত হয়েছে। “ইউটোপিয়া”র গ্রীক অর্থ হচ্ছে “কোথাও না”। অর্থাৎ কোথাও কোনদিন যা ছিল না। কি ছিল না? একটি দেশ, যে দেশটি কোথাও কোনদিন ছিল না। টমাস মুর সেই দেশটির একটি চিত্র অংকন করেছেন। সেই দেশটির চিত্র অংকন করতে গিয়ে তিনি আর একটি দেশের চিত্র অংকন করেছেন যে দেশটিকে তিনি দেখেছেন এবং জেনেছেন ভালভাবে। তাই গ্রন্থটির দুটি অংশ। প্রথম অংশে আছে চেনা-জানা দেশের চিত্র, দ্বিতীয় অংশে আছে অচেনাঅজানা-অদেখা দেশের চিত্র। প্রথম অংশের চেনা-জানা দেশটি হল ইংলণ্ড যে দেশের নিপীড়িত, নির্যাতিত, দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষের চিত্র এঁকেছেন, এঁকেছেন সামাজিক দুর্নীতির যারা ধারক-বাহক তাদের চিত্র। দ্বিতীয় অংশে এক আদর্শ সমাজের চিত্র অংকন করেছেন।

বর্তমান কালে “ইউটোপিয়া” শব্দটি একটা কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ইংরেজিতে যার অর্থ হল কাল্পনিক আদর্শ বা স্বপ্নরাজ্য। কিন্তু বিখ্যাত লেখক এইচ জি ওয়েলস এই গ্রন্থটির সর্বশেষ সংস্করণের ভূমিকা লেখার সময় মন্তব্য করেছেন। যে “ইউটোপিয়া’ শব্দটি মুরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য থেকে অনেক দূরে কারণ তার ভাবনার জগত ছিল বাস্তব আদর্শে পরিপূর্ণ। আসলে গ্রন্থটির মধ্যে কোথাও কল্পনার ছায়ামাত্র নেই, আছে নিরেট বাস্তবতার চিত্র। “ইউটোপিয়া” গ্রন্থটির মধ্যে একরকম সাম্যবাদী নীতির ভিত্তিতে রচিত একটি আদর্শ সমাজের বর্ণনা দেখা যায়।

ইউটোপিয়া গ্রন্থের প্রথম অংশে দেখা যাচ্ছে, ব্যবসা উপলক্ষে লেখক যখন ফ্লাণ্ডার্সে গিয়েছেন, সেখানে হিথ্‌লােডে নামে কোন নাবিকের সাথে পরিচয় হল যে বিখ্যাত অভিযাত্রী আমেরিগাে ভেসপুচির সাথে বহু দেশ ভ্রমণ করেছে। সুতরাং দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তার অনেক কিছু বলার আছে। টমাস মুর, র‍্যাফেল হিথলােডে এবং একজন কার্ডিনাল একসঙ্গে একটি বাগিচার মধ্যে বসে নানা সমস্যা নিয়ে আলােচনা করতে লাগল। র‍্যাফেল হিথলােডে ইংলণ্ড ভ্রমণ করেছে। সুতরাং তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সে ইংলণ্ডের আইনের নির্দয়তা এবং সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যের ভয়াবহতার বর্ণনা করল। সে দুর্নীতির কথা বলে বলল “তােমাদের দেশে চুরির মূল কারণ কি জান?” কার্ডিনাল শুধাল, “কি সেটা?” র‍্যাফেল বলল, “দেখুন মশাই, আপনার দেশের যে ভেড়াগুলি এত শান্ত, পােষমানা। আর সামান্য আহার করত, সেই ভেড়াগুলি এখন এত অবাধ্য আর পেটুক হয়েছে, যে তারা এখন ঐদেশের মানুষকে ধরে ধরে খেয়ে ফেলছে। ফলে জমি থেকে চাষীকে উৎখাত করা হয়েছে। তারা কোথাও থাকবার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। যখন সর্বস্ব খােয়া গেছে তখন আর কি করতে পারে, আর চুরি করলেই ফাঁসি।” এই হচ্ছে তদানীন্তন ইংলণ্ডের ছবি। গরীবের বিরুদ্ধে ধনীর শােষণের ষড়যন্ত্রের ছবি।

ইউটোপিয়া গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে ইংলণ্ডের ভয়াবহ অবস্থার কথা মনে রেখেই র‍্যাফেল হিথলােডে অজানা সমুদ্রের মাঝে এক অজানা দেশের অবস্থার কথা বর্ণনা করতে লাগল। র‍্যাফেল সেই দেশের সমস্ত ভাল আইন এবং ভাল সামাজিক ব্যবস্থার কথা বর্ণনা করল। সেই অজানা দেশে কোন দারিদ্র নেই। সামাজিক সমস্ত সম্পত্তি ও বেঁচে থাকার উপকরণ সর্বসাধারণের ব্যক্তিগত মালিকানা বলতে কিছু নেই। প্রত্যেকে প্রতিবেশীর কল্যাণের কথা চিন্তা করে এবং প্রত্যেকের জন্য একটা সুন্দর ছিমছাম বাড়ী আছে। প্রত্যেকেই শ্রম করে, তবে নয় ঘন্টার অধিক শ্রম করতে হয় না। শ্রমের শেষে খেলাধুলা, লেখাপড়া করে। শিক্ষাব্যবস্থা অবৈতনিক। ম্যাজিষ্ট্রেটরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। নির্বাচিত সরকার গঠন করা হয়। সামান্য আইন প্রচলিত আছে কিন্তু উকিল নেই। অন্যের ধর্মমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা নেই। প্রত্যেকে আইন মেনে চলে। এই হচ্ছে তার ভাবীকালের আদর্শ সমাজ। মুরের এই গ্রন্থটি ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। এমনকি সমাজতন্ত্রীদের কাছেও আদর্শস্বরূপ ছিল। মুর এই গ্রন্থটি যখন রচনা করেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ৩৮ বৎসর। নিছক কল্পনার সৃষ্টি নয়। মানব-প্রেমিক মানুষ তিনি। মানব কল্যাণের জন্যই তিনি প্লেটোর রিপাবলিকের ধরনে এঁকেছেন আদর্শ পার্থিব রাজ্যের ছবি। তিনি এমন সুন্দর গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় রচনা করেননি বলে অনেকের দুঃখ। তিনি লিখেছেন ল্যাটিন ভাষায়। তাও শিক্ষিত মানুষের জন্য। তবু এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে ইংলরে সাহিত্য জগতে বিশুদ্ধ মানবতাবাদের এটি একটি মূল্যবান দলিল।

টমাস মুরের ইংরেজি রচনার মধ্যে, “সাবলিমেশন অব সেলিস্” এবং “হিষ্ট্রি অব রিচার্ড দি থার্ড” বিশেষ উল্লেখযােগ্য এই কারণে যে উক্ত রচনাগুলি শিল্প-নৈপুণ্য ও সার্থকতার আশ্চর্য নিদর্শন। “হিষ্ট্রি অব রিচার্ড দি থার্ড” সত্যই যদি তার রচনা হয় তাহলে বলতে হয় যে তিনি গ্রীক ঐতিহাসিক ট্যাসিটাসের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার যােগ্য। কারণ এতে আছে নিখুঁত চিত্র, বলিষ্ঠ বর্ণময়তা এবং তীব্র আক্রমণ। সম্ভবতঃ শেক্সপীয়র নাটক ‘রিচার্ড দি থার্ড’ রচনার ব্যাপারে এই গ্রন্থটির সাহায্য নিয়েছিলেন। মুরের ইংরেজি গদ্য সাবলীল, সুন্দর, স্বচ্ছ, ছন্দোময় ও ধ্বনিমাধুর্যে ভরা। টমাস মুরের জামাতা উইলিয়ম রােপার শ্বশুরের জীবন চরিত রচনা করেছেন যা এক কথায় অনবদ্য। মুরের জীবনের শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলি গদ্যের ভাষায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আসলে মুর আদর্শবাদী ছিলেন এবং আদর্শের জন্য প্রাণ দিয়ে তিনি সক্রেটিসের মত আদর্শ শহীদ হয়েছেন।

রোমান্টিক যুগ

চার্লস ল্যাম্ব (১৭৭৫-১৮৩৪)

জন্ম, লন্ডন শহরে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা জন লক সম্ভবতঃ একজন ব্যারিস্টারের ভৃত্য ছিলেন। ল্যাম্ব ছিলেন কনিষ্ঠ সন্তান। চার্লস-এর বয়স যখন সাত বছর তখন তাকে ক্রাইষ্ট হাসপাতালের দাতব্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। নিরীহ, লাজুক, শান্ত প্রকৃতির ছেলে চার্লস। সাত বৎসর বিদ্যালয়ে বিদ্যা-শিক্ষা করেন। এখানে যে কয়েক জনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে কোলরীজ অন্যতম। চৌদ্দ বছর বয়সে ১৭৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে স্কুল ত্যাগ করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তার হল না। কারণ প্রধানতঃ সংসারের আর্থিক দুরবস্থা। চার্লস-এর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জন ল্যাম্ব ছিলেন অত্যন্ত স্বার্থপর। সাউথ-সী হাউসে তিনি উচ্চপদে চাকুরি করতেন। কিন্তু সংসারের মুখের দিকে তিনি চেয়ে দেখেন নি। ফলে সংসারের সব দায়দায়িত্ব চার্লস ঘাড়ে তুলে নিলেন। সাময়িকভাবে তিনিও একটা চাকরি পেলেন সাউথ-সী হাউসে। সেটা কেরানীর কাজ। দুবছর পরে তিনি বিখ্যাত ইণ্ডিয়া হাউসে কেরানীর চাকরি পান। এখানে তিনি তেত্রিশ বৎসর চাকরি করেন। অর্থাৎ ১৮২৫ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে তিনি অবশ্য ছ’সপ্তাহের জন্য পাগলাগারদে ছিলেন। সেটা সম্ভবতঃ ১৭৯৫-৯৬ সালের শীতকালে। ব্যর্থ প্রণয়ের জন্য ল্যাম্ব পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সেরে উঠতে বেশি সময় লাগেনি ল্যাম্বের। কিন্তু ল্যাম্ব আজীবন অকৃতদার রয়ে গেলেন। শুধু কি তাই, বােন মেরী ল্যাম্বকে নিয়ে কম যন্ত্রণা ভােগ করতে হয়নি। ল্যাম্বের বাড়ীর অবস্থা মােটেই ভাল ছিল না। বাবা শয্যাশায়ী, মা পঙ্গু ও বড়দা সংসার থেকে ভিন্ন হয়ে গেছেন, আর্থিক অনটন, তার ওপর বংশগত ব্যাধি। চরম অশান্তি। মেরীর পরিশ্রমের সীমা নেই। এরকম একটা অবস্থায় পড়ে মেরী হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে মাকে হত্যা করল, বাবাকে করলাে আহত। জুরির বিচারে মেরী উন্মাদ রােগগ্রস্ত বলে সাব্যস্ত হল এবং তাকে পাগলা গারদে পাঠানাে হল। কিছুটা আরােগ্য হলে চার্লস তাকে বাড়ীতে আনলেন। কিন্তু উন্মাদ রােগে প্রায়ই আক্রান্ত হতেন মেরী। ১৭৯৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর উন্মাদিনী বােনের সব দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। এতসব ঝঞ্ঝাট সত্ত্বেও ল্যাম্বের মনে ক্ষোভ বা ক্লান্তি ছিল না। তিনি হাসিমুখে প্রশান্ত চিত্তে বাণীর সাধনা করেছেন। সেই নিরলস সাধনায় তিনি সিদ্ধিও লাভ করেছিলেন। তবে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বেশিদিন জীবিত থাকেন নি। কোলরীজের মৃত্যুতে তিনি বড় বেশি আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আঘাত ছিল অত্যন্ত গভীর। তাঁকে প্রায়ই বলতে শােনা যেত “কোলরীজ নেই”। ইতিমধ্যে মেরী আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ১৮৩৪ সালে ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ তিনি আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিষিয়ে উঠল তাঁর শরীর। তাতেই তাঁর মৃত্যু। বােন জানতেও পারল না। কারণ তাঁর তখন বােধশক্তি বলে কিছু ছিলনা। তিনিও মারা যান ১৮৪৭ সালে। মেরী সম্বন্ধে হ্যাজলিটের মন্তব্য হল, “তার জানা মহিলাদের মধ্যে মেরী ছিলেন সব থেকে জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমতী”।

ল্যাম্ব কবিতা রচনা করে শুরু করেছিলেন তাঁর সাহিত্যিক জীবন। সনেট রচনা করেছেন। কাব্য রচনার প্রেরণা পেয়েছিলেন কোলরীজের কাছ থেকে। তাঁর বিখ্যাত কবিতা হল “দি ওল্ড ফ্যামিলিয়ন ফেসেস” এবং “টু হেস্টর”। কবিতা দুটি প্রথম শ্রেণীর নয়। তবে পরিচিত মানুষের জন্যে রয়েছে এক সুগভীর মর্মবেদনা। এলিজাবেথীয় নাট্যকারদের অনুসারে ট্র্যাজেডী রচনা করার চেষ্টা করেছিলেন। রচনা করেছিলেন “জন উডভিল” নাটক (১৮০২) কিন্তু সফল হননি। মঞ্চাভিনয় নাটকটি ব্যর্থ হয়েছে তেমনি ব্যর্থ হয়েছে শিল্পরূপ রচনায়। কিন্তু শেক্সপীয়রের নাট্যরস আস্বাদনে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ভক্ত। তাই ভগ্নী মেরীর সহযােগিতায় তিনি শেক্সপীয়রের নাটকের গল্পগুলোর গদ্যরূপ দান করেছিলেন। অনবদ্য, এই রচনা “টেলস্ ফ্রম শেক্সপীয়র” (১৮০৭) গ্রন্থে শেক্সপীয়রের জটিল কাহিনীগুলিকে ভারহীন ভাষায় সহজের রসরূপ জীবন্ত করে তুলেছেন। এই রচনাটি তার শিরে যশের মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল। কারণ এইটি তাঁর সত্যকারের সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা। এর পরেই ল্যাম্ব হয়ে গেলেন সমালােচক। ১৮০৭ থেকে ১৮১৭ সালের মধ্যে অর্থাৎ প্রায় দশ বছর ধরে তিনি সমালােচনা সাহিত্য রচনা করেছেন। শুধু শেক্সপীয়র নয়, শেক্সপীয়রের যুগের নাটক রচয়িতাদের তিনি নতুন করে তাদের শিল্প রচনার চমকৃতিকে তুলে ধরলেন। তাঁর সমালােচনামূলক প্রবন্ধ দুটি হল “স্পেসিমেনস্ অব ইংলিশ ড্রামাটিক পােয়েটল হু লিভ্‌স এবাউট দি টাইম অব শেক্সপীয়র” এবং “অন দ্য ট্রাজেডিস্ অব শেক্সপীয়র কনসিডারড উইথ রেফারেন্স টু দেয়ার ফিটনেস ফর ষ্টেজ রিপ্রেজেন্টেশন্”। প্রথম গ্রন্থটিতে শেক্সপীয়রের যুগের নাট্যকারদের নাটকের বিশেষ বিশেষ অংশ নমুনাস্বরূপ সংকলন করেছেন। টীকা-টিপ্পনীও যুক্ত করেছেন। এই রচনাটি মূল্যবান। কারণ শেক্সপীয়রের যুগের নাট্যকারদের তিনি যথাযােগ্য মর্যাদায় পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বাসন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে তিনি শেক্সপীয়রের নাটকের মঞ্চাভিনয় প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে, শেক্সপীয়রের নাটক মঞ্চাভিনয়ের চেয়ে পাঠ করে বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। বক্তব্য যাই হােক, তার ঐ দুটি রচনাকে সমালােচনা না বলে রসগ্রাহী আলােচনা বলা যেতে পারে। কারণ সাহিত্য সমালােচনা বলতে যা বােঝায় তা হল সাহিত্যের নীতি-নিয়ম অনুসারে সাহিত্যের শিল্প ও রসরূপের আলােচনা। এ আলােচনায় ব্যক্তিগত ভালাে-লাগা বা মন্দ-লাগার কোন স্থান নেই। কিন্তু রসগ্রাহী আলােচনা হল কেবলমাত্র ব্যক্তি মনের ভাললাগার রসে জারিত করে তার ব্যাখ্যা করা। রসগ্রাহী আলােচনা করা সাহিত্যের বিচার নয়, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়, আস্বাদন।

ল্যাম্বের সাহিত্য জীবনের ক্রান্তিকাল শুরু হয়েছে ১৮২০ সাল থেকে, যখন বন্ধু সমালােচক হ্যাজলিট তাকে লন্ডন ম্যাগাজিনের সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই পত্রিকাতে তিনি “ইলাইয়া” ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। এই প্রবন্ধগুলিই “দি এসে অব ইলাইয়া” (১৮২৩) এবং “দি লাস্ট এসেস অব ইলাইয়া” (১৮৩৩) হল তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সােনার ফসল। প্রবন্ধগুলো তিনি তিন বৎসর ধরে রচনা করেছিলেন। এছাড়া অনেকগুলি নাটক রচনা করেছিলেন। ল্যাম্বের প্রতিভার সম্যক বিকাশ ঘটেছে নাটকে নয়, কাব্য কবিতায় নয়, নিবন্ধ রচনায়। কবি প্রতিভার অভাব ছিল তা নয়, তবে যার জীবনটা ছিল কঠিন কঠোর গদ্যময়, তার পক্ষে কাব্য রচনা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ল্যাম্বের ভাবনার জগৎ কোন অতি উচ্চ আকাক্ষার প্রবল তাড়নায় সচকিত হয়ে ওঠেনি। রাজনীতির সঙ্গে কোন যােগ ছিল না ল্যাম্বের। প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় যে আলোচনা চক্রে ল্যাম্ব যােগ দিতেন সেখানে আর যারা যােগ দিতেন তারা হলেন হ্যাজলিট, কীন, কোম্বেল, গডউইন, কোলরীজ এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থ। এই আলােচনা চক্রে রাজনীতির কোন আলোচনা হত না। ল্যাম্ব রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন শান্ত শিষ্ট অতি প্রশান্ত-চিত্ত বিশিষ্ট একজন একনিষ্ঠ চাকুরীজীবী। কিন্তু তাঁর বন্ধুরা কেউ কেরানী ছিলেন না। অনেকেই বরং তদানীন্তন যুগের রাজনীতির চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবার কেউ কেউ ব্যর্থ রাজনীতিক ছিলেন। যাইহোক ল্যাম্বের রচনায় রাজনীতির গন্ধ নেই। তিনি রাজনীতি, সমাজনীতি, আদর্শ বা মতবাদের থেকে দূরে বহুদূরে সরে গিয়ে পরিচিত বাস্তব জীবনের বুকে বসে তার জীবন্ত ছবি এঁকেছেন। যা দেখেছেন তা সমবেদনার স্পর্শে প্রদীপ্ত করে আত্মর কল্পনায় সমৃদ্ধ করেছেন। তার ইলাইয়া নিবন্ধগুলিতে কি আছে? আছে স্মৃতির পাতা থেকে ছিনিয়ে আনা শৈশবকালের কাহিনী, আছে সাহিত্য সম্বন্ধে সরস আলোচনা, আত্মীয়-পরিজন সম্বন্ধে দরদভরা বর্ণনা, কখনও জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতার সকরুণ প্রকাশ, কখনাে বা কৌতুক ঘটনার করুণ অভিব্যক্তি। আছেন ল্যাম্ব অর্থাৎ লেখক স্বয়ং এবং তার ভালবাসার বাসভূমি লন্ডন। লন্ডনকে বড় ভালবেসেছিলেন তিনি। তাই লন্ডনের রাস্তাগুলি ছিল তার কাছে তীর্থপথ, তার সুউচ্চ প্রাসাদগুলি ছিল তার রহস্যের জগৎ। লন্ডনের জীবনকেই তিনি রূপ দিয়েছেন। প্রকৃতি প্রেমিক তিনি ছিলেন না এমন নয় তবে তিনি একান্তভাবে লন্ডন প্রেমিক। ওয়ার্ডসওয়ার্থকে এক পত্র দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “আপনার সঙ্গ সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে আমার কিছু যায় আসে না যদি আমার জীবনে আমি একটা পর্বত কখনও না দেখি। লন্ডনেই আমার অতীত দিনগুলি কেটেছে, স্থানীয়ভাবে আরাে গভীরভাবে গড়ে তুলব সে সম্পর্ক যতদিন পর্যন্ত না তােমার কোন পর্বতারােহী মৃত প্রকৃতির সঙ্গ ত্যাগ করবে।”

যাইহােক মানবজীবনকে কেন্দ্র করেই তার ভাব ও ভাবনাগুলি প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হিউমার। হিউমার হচ্ছে স্নিগ্ধ কৌতুকরস। সমবেদনার লােকে বিচ্ছুরিত। অর্থাৎ হিউমার হচ্ছে মুখের হাসি ও চোখের জল মিলিয়ে একপ্রকার করুণ কৌতুক। এমনি এক কৌতুকরসের উদাহরণ হল তার রচিত “দ্য ডিকে অব বেগার্স”। লন্ডনের রাস্তা থেকে ভিখারী তুলে দেওয়া হবে এই সংবাদ শুনে ল্যাম্ব মন্তব্য করেছেন তাহলে দয়া-দাক্ষিণ্য দেখানাের ব্যাপারটা কি হবে? সেটাও কি দেশ থেকে উঠে যাবে? তার চেয়ে ওগুলিকে থাকতে দাও আর যে যেভাবেই ভিক্ষার আবেদন করুক না কেন তাকে প্রশ্ন না করে সাহায্য দাও। “দি প্রেজ্‌ অব চিমনি সুইপারস” নিবন্ধে ঠিক একই কথা তিনি বলেছেন, “দর্শনের কচকচির চেয়ে গরীবদের প্রতি সমবেদনা দেখানাে ভাল”। অর্থাৎ ল্যাম্ব যেন বলতে চাইছেন, অবস্থার উন্নতি হলে গরীবদের ভুলে যেও না। ল্যাম্ব রােমান্টিক, রােমান্টিক ভাবাদর্শের দ্বারা পরিচালিত। তাই ঐ সব কথা রােমান্টিক কথা। গরীবদের সাহায্য করার মধ্যেই রয়েছে সহৃদয়তার লক্ষণ, এই ভাবনার দ্বারা তিনি পরিচালিত হয়েছেন। এ তাে সেই বাইবেলেরই বাণী। বুর্জোয়া ভাবাদর্শের দ্বারা পরিচালিত বলেই তিনি নতুনকে বা নতুন ধ্যান-ধারণাকে গ্রহণ করতে পারেননি। তাই যেখানে তিনি জন্মেছিলেন সেখানকার ধনী-ব্যক্তিদের পুরাতন প্রাসাদগুলিকে তিনি ভালবাসতেন। ভালবাসতেন পুরাতন গ্রন্থগুলিকে। ভালবাসতেন প্রাচীন লেখকদের, নতুন লেখকদের বই তার হাতে দিলে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। তবু তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। তিনি ছিলেন গরীবদের মরমীবন্ধু । যাই থাকুন, আসল ল্যাম্বের রচনার যে প্রধান গুণ হিউমার, সেই হিউমার ইতিপূর্বে কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি। কারণ ল্যাম্বের হিউমারে যেমন বিষয় আছে, তেমনি প্রচ্ছন্নভাবে আছে বিষয়ী এবং প্রকাশ্যভাবে আছে মানুষ। সব মিলিয়ে এ এক নতুন সৃষ্টি। তবে ল্যাম্ব থেকে শুরু হল একটা যুগ। যে যুগে কেরানী, চাকুরিজীবীরা হবে সাহিত্য রচয়িতা।

টমাস রবার্ট ম্যালথাস (১৭৬৬-১৮৩৪)

ম্যালথাস একজন অ্যাংলিকান পাদ্রী ছিলেন। খুব পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন; অর্থনীতি আর ইতিহাসে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। ছিলেন হাইলিবেরী কলেজের অধ্যাপক। গডউইনের সাম্যবাদী মতবাদের বিরুদ্ধে তিনি একট প্রবন্ধ রচয়ান করেছিলেন, নাম হলো “এসে অন দ্য প্রিন্সিপল অফ পপুলেশন” (১৮০৩)। ছদ্মনামেই রচনাটি প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু ছিল “খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে জনসংখ্যার দ্রুত বেড়ে যাবার একটা প্রবণতা আছে।” সুতরাং অভাব থাকবেই। এই অভাবের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি যে দাওয়াই বাৎলেছেন তা হলো “ছটি ছেলেকে ভরণপোষণ করার ক্ষমতা না থাকলে বিয়ে করো না।” জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও তার প্রতিরোধের সমস্যা তাকে খুব চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, তাই তার এই তত্ত্ব। রচনার গুণে লেখাটি আজও সমাদৃত, আর চিন্তা-ঐতিহ্যে তার এই রচনা পরবর্তী অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক এমনকি জীববিজ্ঞানীদেরকেও প্রভাবিত করে।

ভিক্টোরীয় যুগের সাহিত্য

ভিক্টোরীয় যুগ (১৮৩২-১৯০০ খ্রি.)

রোমান্টিক যুগের অবসানের পর আরেকটি নতুন যুগের শুরু হল। এই যুগকে বলা হয় ভিক্টোরীয় যুগ। এই যুগ ১৮৩২ সাল থেকে ১৯শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই যুগকে প্রগতির যুগ বলা যেতে পারে। কিন্তু কেন? ফরাসী বিপ্লব স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে যেমন আগুন জ্বালিয়েছিল তেমনি ফরাসী বুর্জোয়া শ্রেণীর মনে সাম্রাজ্য বিস্তারের লোভ ও আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিল। সেই লােভ সমগ্র ইউরােপের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে করেছিল বিপন্ন। কিন্তু স্বাধীনতাকামী দেশগুলো ফ্রান্সের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করল। ১৮১৫ সালের ১৮ই জুন ওয়াটারলুর যুদ্ধে ডিউক অব ওয়েলিংটনের কাছে নেপোলিয়নের পরাজয়ের ফলে ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণীর সীমাহীন লােভের আকাঙ্ক্ষা চিরতরে নির্মূল হয়ে গেল। ইংল্যান্ড স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল।

ব্রিটেনের বুর্জোয়া শ্রেণী যারা ইতিমধ্যে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তারা পূর্ণ ক্ষমতা প্রচেষ্টায় সচেষ্ট হয়ে উঠল। এতদিন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে অভিজাত ভূস্বামীদের ছিল সংখ্যাধিক্য। তাদের স্বার্থের প্রতি তারা ছিল সজাগ। সেদিকে লক্ষ্য রেখে পার্লামেন্টে প্রতিনিধি প্রেরণের জন্য যে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তাকে বলা হত “রটন্‌বরো”। সে পদ্ধতিতে পরিবর্তন করার এবং ভূস্বামীদের কায়েমী স্বার্থকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সংকল্প নিয়ে ব্রিটেনের বুর্জোয়া শ্রেণী সার্বজনীন ভােটাধিকারের দাবীতে আন্দোলন শুরু করল। সে আন্দোলনে ব্রিটেনের শ্রমিক শ্রেণীও যােগ দিল। রক্ষণশীল টোরীদল এবং তার নেতা ডিউক অব ওয়েলিংটনের ভয় বাধা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ১৮৩২ সালে প্রথম সংস্কার আইন পার্লমেন্টে পাশ হয়ে গেল। ফলে ভূস্বামীদের একচেটিয়া ক্ষমতা হল খর্বিত, বুর্জোয়া শ্রেণীর ক্ষমতা হল প্রতিষ্ঠিত।

টোরিদলের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হল হুইগদলের হাতে। হুইগ দল গণতান্ত্রিক উপায়ে কতকগুলো পুরাতন আইনের সংস্কার সাধন করল। যেমন “ফ্যাক্টরী অ্যাক্ট” (১৮৩৩) সষ্টি করে ন’ বছরের নীচে শ্রমিক নিয়ােগের উপর বিধিনিষেধ আরােপিত হল এবং কাজের সময়ও নয় ঘন্টা নির্ধারিত করে দেওয়া হল। ১৮৩৪ সালে “পুওর ল এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট” পাশ করে মান্ধাতা আমলের সাহায্যের ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা হল। ১৮৩৫ সালে “মিউনিসিপ্যাল করপােরেশন অ্যাক্ট” এর মাধ্যমে পৌরসভার নির্বাচন পদ্ধতিকে গণতন্ত্রীকরণ করা হল। সুতরাং সাংবিধানিক উপায়ে দেশশাসনের জন্য যে প্রবল আগ্রহ দেখা দিল তা শুরু হল ১৮৩৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন লাভের মধ্য দিয়ে। কারণ ভিক্টোরিয়া নিজেকে সাংবিধানিক রাণী হিসাবে মনে করতেন এবং সেইভাবে মন্ত্রিসভা ও পার্লামেন্টের সঙ্গে সহযােগিতা করতেন।

ভিক্টোরীয় যুগে একদিকে যেমন রাজার ক্ষমতা নিঃশেষে ক্ষয় হয়ে গেল তেমনি বুর্জোয়া শাসনের পুরােপুরি ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হল। ১৮৬৭ সালে দ্বিতীয় সংস্কার আইনের বলে সংসদীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা আরো সহজ হয়ে গেল এবং ১৮৮৪ সালে তৃতীয় সংস্কার আইনের বলে সার্বজনীন ভােটের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হল। সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে বুর্জোয়া শাসন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে ধনতান্ত্রিক যুগ শুরু হয়ে গেল। নামে ভিক্টোরীয় যুগ হলেও আসলে এযুগ হচ্ছে ধনতান্ত্রিক শাসন ও শােষণ ব্যবস্থার বিকাশের যুগ। তাই এই যুগ প্রগতির যুগ। বিশেষ করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে উন্নতির যুগ। উন্নতি তখনই সম্ভব যদি রাষ্ট্রে থাকে স্থিতিশীলতা। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ছাড়া ওয়াটারলুর পর আর কোন বড় রকমের যুদ্ধে ব্রিটেনকে জড়িয়ে পড়তে হয়নি। ফলে বৈষয়িক উন্নতির ভাবনাই ছিল তখন সকলের ভাবনা। “The condition of England’s happiness in the Nineteenth century and cause of that peculiar belief in “Progress” as a law of history which cheered the victorin mind, was the fact that we were not engaged in any great war for a hundred years after waterloo”

সুতরাং ১৮৩২ সাল থেকে শুরু হয়েছিল প্রগতির পথে যাত্রা। অবশ্য শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকে, প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে। কিন্তু ১৯শ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে দ্রুততর হল তার গতি। গতির প্রচণ্ড শক্তির জোরে সারা বিশ্বে জেগেছে প্রবল প্রাণের স্পন্দন। নতুন জীবনের ও যুগের ভাবনা ও সৃষ্টি গতিরােধের ছন্দে হল দোলায়িত। রাজনৈতিক জীবনে যারা প্রগতিপন্থী সেই হুইগদল “লিবারেল” বা উদারনৈতিক দল নামে পরিচিত হতে লাগল এবং যারা বিরােধী সেই টোরী দল রক্ষণশীল দল নামে আখ্যাত হল। অবশ্য এই যুগেই মূলনীতির ব্যাপারে হুইগ এবং টোরী দল অনেক কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছিল। তার প্রথম নিদর্শন দেখা ক্রীতদাস প্রথা রহিত করার ব্যাপারে। রক্ষণশীল টোরীদলও প্রগতির পক্ষে রায় দিয়েছিল। যাইহােক এই যুগে ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা বিদেশী বাজারের লােভে বিরাট উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। ব্রিটিশ বুর্জোয়াদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে শেষপর্যন্ত আমেরিকা হাত ছাড়া হলেও এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে গড়ে উঠেছিল বিরাট উপনিবেশ। চীনেও গড়ে তুলেছিল তারা নিজেদের বাজার। আফিম যুদ্ধে ইংল্যান্ডের জয়লাভের ফলে তা সম্ভব হয়েছিল। ১৮৫৮ সালে সারা ভারতবর্ষ ইংল্যান্ডের দখলে এসে গিয়েছিল। দখলে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং আফ্রিকার বহুদেশ। সারা বিশ্ব জুড়ে ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা উপনিবেশ সৃষ্টি করে সেখানকার অধিবাসীদের দমন পীড়ন করে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। সক্ষম হয়েছিল সেই সমস্ত উপনিবেশে স্বদেশীয় শ্বেতাঙ্গদের বসতি স্থাপন করাতে। এই সমস্ত কার্যকলাপের মধ্যে ইংল্যান্ডের বুর্জোয়ারা জাতীয়তাবাদের মন্ত্রকে ইংল্যান্ডের জনগণমানসে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।

বিশ্বজুড়ে ব্যাপক উপনিবেশ সৃষ্টির ফলে ইংল্যান্ডে শিল্প প্রসার ঘটেছিল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। কারণ উপনিবেশগুলো থেকে সস্তা দরে কাঁচামাল আসার ফলে ইংল্যান্ডে সম্পদের অভাব হয়নি। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল বিরাট বিরাট কলকারখানা। ক্ষুদ্র শিল্পেরও অভাব ছিল না। সেই উৎপাদনজাত দ্রব্য আবার যথারীতি উপনিবেশগুলোতে রপ্তানি করে বিরাট, বিশাল মূলধনের মালিক হয়ে গেল ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা। বিভিন্ন দেশে তারা মূলধন নিয়ােগ করে মুনাফা অর্জন করতে লাগল। সুতরাং ইংল্যান্ডের শিল্প বিকাশে সেদিন এসেছিল প্রবল জোয়ার। বস্ত্র শিল্প, কয়লা শিল্প, লৌহ শিল্প, যানবাহন শিল্প, জাহাজ শিল্প ইত্যাদি নানা ধরনের শিল্প ও কলকারখানায় দেশ ছেয়ে গেল। কলের চিমনির কালাে ধোঁয়ায় আকাশ গেল ছেয়ে, বাতাস উঠল ভারী হয়ে। বাষ্পচালিত বিদ্যুৎ শক্তি গড়ে উঠল।

শিল্প বিকাশের ফলে গড়ে উঠল বড় বড় শিল্পনগরী। বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেষ্টার, শেফিল্ড, লীডস, ল্যাংকাস্টার, নিউকাসেল, নর্দাম্বারল্যাণ্ড, ডারহাম প্রভৃতি স্থানে শহর গড়ে উঠল । শহরগুলোতে জনসংখ্যার চাপও বৃদ্ধি পেতে লাগল। গ্রামের কৃষক গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে হল মজুর। ১৮৭০ সালে ইংল্যান্ডে মোট জনসংখ্যার সত্তর ভাগ হয়ে গেল মজুর আর তিরিশ ভাগ রয়ে গেল কৃষক। জনসংখ্যার রূপ দেখলেই বােঝা যায় যে ইংল্যান্ডে কি ব্যাপক হারে শিল্প বিকাশ ঘটেছিল। শুধু তাই নয়, শহরগুলোর সঙ্গে শহরগুলোর এবং শহরতলির গ্রামগুলোর সঙ্গে যােগাযােগ ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিল সুন্দরভাবে। রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা স্থাপিত হওয়ায় এডিনবরা থেকে লন্ডন আসা যেত একদিনে। নদী বক্ষের ওপর লৌহসেতু নির্মাণের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটে গেল। রাজপথ, জনপথগুলো শক্তি ইটের তৈরী হওয়ার ফলে ঝকঝকে হয়ে উঠল। যানবাহন চলাচল বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে গেল। সমগ্র ইংল্যান্ড হয়ে উঠেছিল কর্মচঞ্চল। শহরগুলো লােকের ভিড়ে গিজগিত করতে লাগল। সাজানাে সুন্দর ছিমছাম শহরের বুকে গড়ে উঠল নােংরা অস্বাস্থ্যকর বস্তি। নােংরা বস্তিতে বাস করত কলকারখানার শ্রমিকেরা বা নিম্ন আয়ের কর্মচারীরা। শ্রমিকদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শােচনীয়। কারখানায় তাদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হত। পরনে ছিল জীর্ণ পােশাক। এক একটা আলাে-বাতাসহীন দমবন্ধ করা ঘরে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন শ্রমিককে বিচালির ওপর শয্যা রচনা করে নিদ্রা দিতে হত। খাদ্য ছিল পোড়া রুটি আর মালিকের প্রহার। কখন ঘােড়ার আস্তাবলেও তাদের জীবন কাটাতে হত। জীবনের সকলরকম আনন্দ উপভোগ থেকে বঞ্চিত ছিল তারা, তারা সর্বহারা।

এইসব বঞ্চিত সর্বহারা শ্রমিক ছাড়াও এক দল সুবিধাভােগী শ্রেণীও গড়ে উঠেছিল। তারা মােটা মাইনের চাকুরে, ইনজিনীয়ার, অফিসার, সরকারী কর্মচারী, কেরাণী, বড় বড় অফিসার ইত্যাদি। এছাড়া ছিল ম্যানেজার, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ছােট ছােট ব্যবসায়ের মালিক ইত্যাদি। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবলমাত্র শ্রমিক বা মালিক এই দুটি শ্রেণীরই জন্ম দেয়নি, দিয়েছে নানা ধরনের সুবিধাবাদী শ্রেণীর। জীবনের আনন্দের ভোগে এরা বঞ্চিত ছিলনা। এই যুগে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিসাধনের গড়ে উঠল ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকলাপ। শ্রমিকদের বিভিন্ন ধরনের দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠল কলে-কারখানায়। বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিকেরা নিজ নিজ ইউনিয়ন গঠন করে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ল; ১৮৫০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে প্রায় ১৬০০ শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল। ১৮৬০ সালে বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিকেরা মিলিত হয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ সংস্থা গড়ে তুলেছিল। এই যুগে ইংল্যান্ডের সমাজ জীবনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে যেতে লাগল। প্রথমত, পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক যুগের একান্নবর্তী পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে লাগল। ব্যক্তিগতভাবে নিজের নিজের জন্য বাঁচার তাগিদটা বেড়ে গেল। ফলে যে যেমনভাবে পারে সে তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি বিধানে সচেষ্ট হল। সুতরাং সকলের মুখেই একটি বাণী শােনা যেতে লাগল, তার নাম হল “প্রগ্রেস’ (progress). আর সেই প্রগ্রেসের নেশা মানুষকে এমনভাবে পেয়ে বসল যে মানুষের সঙ্গে মানুষের পরিচয় যেন বিকৃত রূপ নিল। প্রত্যেকেই এক একটি বিচ্ছিন্ন মানুষে পরিণত হল। মানুষ হল ভীষণ রকমের আত্মকেন্দ্রিক। গ্রাম্য জীবনের সহজ স্বাভাবিকতা হারিয়ে মানুষ হয়ে উঠল কৃত্রিম। দ্বিতীয়ত, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে পরিবারবন্ধনও যেমন শিথিল হয়েছে, তেমনি কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনও তার অন্যতম কারণ। সামন্ততান্ত্রিক যুগে আবাদযােগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ছিল সামান্য। বেশিরভাগ ছিল গােচারণ ভূমি। কিন্তু ধনতান্ত্রিক যুগে ইংল্যান্ডে কোন জমিই আর অনাবাদী পড়ে রইল না। বৈজ্ঞানিক উপায়ে নানা ধরনের চাষ-আবাদ শুরু হয়ে গেল। জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হতে লাগল এবং নানাধরনের যন্ত্রপাতিও ব্যবহৃত হতে লাগল। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার মানেই শিল্প কারখানার প্রসার। ফলে সাধারণ মানুষের যে জীবন ছিল কৃষিনির্ভর তা হল শিল্পনির্ভর। অন্যদিকে কৃষির আধুনিকীকরণ করার ফলে শিল্প কলকারখানার এত ব্যাপক প্রসার ঘটল যে ইংল্যান্ড হয়ে উঠল “Workshop of the world”। যন্ত্র বিজ্ঞানের দুর্জয় অগ্রগতিতে ইংল্যান্ডে শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে যে বিপুল অগ্রগতি হয়েছিল তার চিত্র ১৮৫১ সালে বিরাট শিল্প প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল।

শিল্প বিস্তারের ফলে সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থাও এইযুগে প্রবর্তিত হয়েছিল। এই শিক্ষা মূলত ছিল কারিগরী শিক্ষা। কলকারখানার প্রয়োজনে কারিগরী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিশেষ ভাবে অনুভূত হয়েছিল। ফলে ইনজিনীয়ারিং বা পলিটেকনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে গড়ে উঠেছিল। কেবলমাত্র যন্ত্রবিজ্ঞানের মধ্যেই মানুষের চিন্তাভাবনা আবদ্ধ ছিল না। বিজ্ঞানের নানা শাখায় তা ছড়িয়ে পড়েছিল। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সর্ব বিভাগেই বিজ্ঞানের সদর্প পদচারণা শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে রসায়নবিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি শিল্প প্রসারের ক্ষেত্রে প্রভূত সাহায্য করেছিল । শিল্পের সঙ্গে রসায়নবিজ্ঞানের সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। শিল্পের ক্ষেত্রে রসায়ন ব্যবহার হল অপরিহার্য। ইংল্যান্ডে বিজ্ঞান চর্চার বেগবান প্রবাহ ছিল ১৭শ শতক থেকে। বিজ্ঞান চর্চার জন্য লন্ডনে ১৬৬০ সালে “রয়েল সোসাইটি” প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৬৬৫-তে “ল অব গ্রাভিটেশন”-এর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে পদার্থ বিজ্ঞানে যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন নিউটন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে “রক্তের সংবহন” তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা চিলেন উইলিয়ম হার্ভে। ১৯শ শতাব্দীতে ভূ-বিজ্ঞানে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন লাইয়েল। ১৮৩৩ সালে তিনি “প্রিন্সিপলস্ অব জিওলজি” গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক কারণগুলো তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এই গ্রন্থে। পৃথিবীতে যেসব পরিবর্তন ঘটে তার পিছনেও যে নিয়ম আছে, পৃথিবী যে নিয়মের অধীন তারও ব্যাখ্যা তিনি করেছেন। এ ব্যাখ্যাকে আরাে সমৃদ্ধ করেছেন ওয়ার্নার, হাটন এবং উইলিয়ম স্মিথ। ১৮৪২ সালে পদার্থ বিজ্ঞানী জুল প্রমাণ করেছিলেন যে এনার্জি কখন ধ্বংসও করা যায় না, তা সৃষ্টি করাও যায় না। এক পদার্থ থেকে অন্য পদার্থের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটে । শারীর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক আবিষ্কার করেন চার্লস ডারুইন এবং টমাস হাস্কলে। চার্লস ডারুইন (১৮০৯-১৮৮২) তার রচিত গ্রন্থ “দি ওরিজিন অব স্পিসিস” (১৮৫৯) এবং “দি ডিসেন্ট অব ম্যান” (১৮৭১)-এ প্রমাণ করলেন যে, পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব ঈশ্বরের কৃপায় ঘটেনি। তার আবির্ভাব ঘটেছে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে। মানুষেরও আবির্ভাব ঘটেছে ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ সুদূর কালে নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে নানা বিবর্তনের ফলে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে পৃথিবীতে। ডারুইনের এই আবিষ্কার ভীষণভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ধর্মযাজকদের মনে। কারণ ধর্মযাজকেরা এতদিন ধরে মানুষের উপর প্রভাব, প্রতিপত্তি ও প্রভুত্ব বজায় রেখে আসছিল যে বাণী শুনিয়ে, সে বাণী হল যে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং প্রাকৃতিক জগতে যা কিছু পরিবর্তন ঘটে তা ঘটে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে। ধর্মযাজকদের এই কথা যে কতবড় মিথ্যা তা ডারুইনের আবিষ্কারে প্রমাণ হয়ে গেল। ফলে ধর্মযাজকেরা চটে গেল, ক্রোধে ফেটে পড়ে ডারুইনের “বুলডগ” হাস্কলেকে প্রশ্ন করে বসল, “তাহলে আপনার ঠাকুর্দা এবং দিদিমা কি বানর-মানুষ থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন? হাস্কলে উত্তরে বললেন, “একজন মস্ত বড় প্রতিভাধর এবং সমাজের খ্যাতনামা ব্যক্তি যার বিজ্ঞান সম্বন্ধে কোন ধ্যান-ধারণা নেই অথচ বিষয়ে নাক গলান এবং কুসংস্কারকে যিনি সেবা করেন এবং সত্যকে বিকৃত করেন তার বংশধর হওয়ার থেকে একজন দুর্বল মস্তিষ্কসম্পন্ন বানর-মানুষের বংশধর হতে আমার আদৌ লজ্জা করবে না।”

যাইহােক এইসব আবিষ্কার এবং যন্ত্রবিজ্ঞানের বলিষ্ঠ অগ্ৰগতি ধনিক শাসকশ্রেণীর মনে দারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। কারণ মানুষের মন থেকে যদি অলৌকিক ভাবনা এবং কুসংস্কারের কালো দাগগুলো মুছে যায় এবং বিজ্ঞান চেতনার আলােকে মানুষের মন যুক্তি-নির্ভর হয়ে – শাসকশ্রেণী হিসেবে তাদের টিকে থাকা বা অস্তিত্ব বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই তাদেরই আশ্রয়পুষ্ট জ্ঞানী পণ্ডিতেরা বৈজ্ঞানিক ভাবনা ও যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছিল। যারা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল তাদের আন্দোলনকে অক্সফোর্ড আন্দোলন নামে আখ্যাত করা হয়। কার্যত এই যুগে পণ্ডিতেরা দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল হল বৈজ্ঞানিক ভাবনা ও যুক্তিবাদের সমর্থক যারা পুরাতন জীর্ণ-ধ্যান-ধারণা এবং অলৌকিক বিশ্বাস বিরােধী, অন্যদল রক্ষণশীল ভাবনা ও অন্ধ গোড়ামির ও সনাতন বিশ্বাসের অনুরাগী। যে দল রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী সেইদল বৈজ্ঞানিক যুক্তিকে খণ্ডন করার মত কোন যা খুঁজে পাচ্ছিল না। ফলে তাদের সংগ্রাম ছিল অনেকটা রক্ষণাত্মক।

বিজ্ঞান ভাবনা কেবলমাত্র যন্ত্রবিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা প্রসারিত হল সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জগতের মধ্যেও। অর্থাৎ সৃষ্টি হল সমাজ বিজ্ঞান বা ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে লন্ডনে যেদিন কার্ল মার্কসের “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো” আত্মপ্রকাশ করল সেদিন বুর্জোয়া জগতে একটা বিরাট বিস্ফোরণ ঘটে গেল। কারণ কার্ল মার যুক্তি ও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, সমস্ত কিছু সৃষ্টির মূলে রয়েছে বিরােধ দিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে, নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে। বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে বলেই তার মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন, উত্তাপের সঙ্গে জলের বিরােধের ফলে পরিণত হচ্ছে আবার বাম্পের সঙ্গে শৈত্যের বিরােধের ফলে বাষ্প জলে পরিণত হচ্ছে। তেমনি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে বুর্জোয়াদের বিরােধের ফলে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সষ্টি হতে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর প্রত্যক্ষ বিরােধের ফলে সাম্যবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য। কার্ল মার্কসের এই তত্ত্ব সেদিন ধনিক শ্রেণীকে এত বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করে তলে ধনিক শ্রেণী সামন্ততান্ত্রিক অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে বিরােধের অবসান ঘটাতে বাধ্য হয়েছিল। রক্ষণশীল দল ও উদারনৈতিক দলের মধ্যে নীতিগত কোন পার্থক্য ছিল না।

বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণা ও বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধেও সেদিন ভাববাদী শিবির গড়ে উঠেছিল। ফলে এই দ্বন্দ্ব ও বিরােধের কোলাহলে সমাজজীবন মুখরিত। কিন্তু বিরােধ প্রধানত ছিল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েনি। তবে মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী শ্রেণী বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণাকে অবজ্ঞা করে সরকারী ক্ষমতা ভােগদখলের প্রচণ্ড প্রতিযােগিতায় নেমে পড়েছিল। সুতরাং গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাকে ইষ্টমন্ত্র করে তারা নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থকে বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছিল। একদিকে বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে তারা যেমন আক্রমণ করছিল, অন্যদিকে তেমনি ধর্মীয় কুসংস্কারের সঙ্গে আপস করে আত্মরক্ষায় ছিল সক্রিয়, সচেষ্ট। তাদেরই প্রচেষ্টায় ক্যাথলিক ধর্মের পুনরাবির্ভাব ঘটেছিল। ধর্ম থেকে গোঁড়ামিকে হ্রাস করা হল, অলৌকিক ধ্যান-ধারণাকেও কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হল, প্রত্যেকের মধ্যে কর্তব্যের চেতনাকে জাগিয়ে দেওয়া হল। অর্থাৎ ধর্মীয় চেতনাকে বেশ খানিকটা যুক্তির আলােকে পরিশােধিত করা হল।

এ যুগে পত্র-পত্রিকার ঘটেছিল ব্যাপক প্রসার। প্রথম দৈনিক পত্রিকার আবির্ভাব ঘটেছিল এই যুগে। অধিকাংশ পত্র-পত্রিকাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কবলে ছিল। জনগণের মনের মধ্যে তাদের ভাবনাকে অনুপ্রবেশ করানাের জন্য পত্র-পত্রিকাগুলোকে তারা ভীষণভাবে কাজে লাগিয়েছে। যদিও মনে রাখা দরকার যে, সে যুগে সর্বসাধারণ নামক শিক্ষার ঘটেছিল ব্যাপক প্রচলন। বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণা ও বিজ্ঞান চেতনার সঙ্গে ভাববাদী ধ্যান-ধারণা ও আধ্যাত্মিক চেতনার বিরোধ ভিক্টোরীয় যুগের ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তারপর ধীরে ধীরে বিরােধ স্তিমিত হয়ে যেতে যেতে ১৯শ শতাব্দীর শেষ দশকে স্তব্ধ হয়ে গেল। কারন দুটি। প্রথম কারণ হল জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ বস্তুবাদীরা যেমন জ্ঞানের শেষ কথা বলেননি, তেমনি বাইবেলও জ্ঞানের শেষ কথাটি বলতে পারেনি। এই ধরনের একটা আপস রফা করে আপাতত বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপারটা সামলে দিলেন। “ Both sides acknowledge that the whole truth about the universe cannot be discovered in the laboratory or dividend by the church.” (English Social History, G. M. Trevelyan, P. 566)। উভয়পক্ষ বলতে এখানে ভাববাদী ও বস্তুবাদী পক্ষকে বোঝানো হয়েছে। তবে বস্তুবাদী পক্ষের সকলেই এ ব্যাপারে একমত ছিলেন না। সুবিধেভােগী বস্তুবাদীরা ও বিজ্ঞানীরাই কেবল আপস করেছিলেন। আজো তারা করে যাচ্ছেন।

দ্বিতীয় কারণ হল সার্বিক উন্নতি। ব্যাপক শিল্প প্রসারের ফলে ইংল্যান্ডের যে বিশাল অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছিল তাতে করে শ্রমিক শ্রেণীর আয় বেড়ে গিয়েছিল। ভিক্টোরীয় যুগের শেষ তিনটি দশকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে জাতীয় সম্পদ সকলে কিছু কিছু ভােগ করতে পরেছিল। যে সব ভােগ্যপণ্য ভিক্টোরীয় যুগের প্রথম দিকে বেশ বিলাসের বস্তু বলে মনে হত সেগুলো সাধারণ ভােগ্য পণ্যে পরিণত হল। তাছাড়া অন্ন, বস্ত্র, শয্যা দ্রব্যের ও আসবাবপত্রের অভাব ছিল না। এমনকি শ্রমিকদের জন্য গৃহনির্মাণ হতে শুরু করেছিল। যে শ্রমিকেরা একদিন ঘোড়ার আস্তাবলে রাত্রিযাপন করত তারাই এখন তাদের নির্মিত কোয়ার্টারগুলোতে বাস করতে লাগল। আর্থিক অবস্থার উন্নতি ও ভােগ্যপণ্যের চাহিদা মিটে যাবার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে অবসর বিনােদনের জন্য একটা তাগিদ এল। সমুদ্র তীরে ছুটি উপভােগ করা তাে রীতিমত একটা জরুরী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি সপ্তাহের শেষ দিনটিতে বাইরে আনন্দ উপভােগ করাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যাকে বলা হয় “Week-end out of town’. এ সময় বাইসাইকেলের বেশ প্রচলন হওয়ায় মানুষের ভ্রমণের নেশা সৃষ্টি হয়েছিল। খেলাধুলারও ব্যাপক প্রচলন হয়েছিল। বৈদ্যুতিক আলাের রােশনাই সকলকে করেছিল চমকিত। মানুষ এখন ভােগের নেশায় উন্মত্ত। বুর্জোয়া সভ্যতা মানুষকে এত বেশি আরাম দিল যে সেই আরামের শয্যা ছেড়ে কেউ নতুন কোন সমাজের কথা চিন্তা করে বিপদসাগরে ঝাঁপ দিতে রাজি হল না। ফলে ইংল্যান্ডের শ্রমিকশ্রেণী পৃথিবীর অন্যান্য শ্রমিকের তুলনায় বেশ ভালভাবে জীবন অতিবাহিত করত। নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীও ছিল অর্থনৈতিক উন্নতিতে লাভবান। সুতরাং বুর্জোয়া শিক্ষা সভ্যতার বিপুল স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে জনসাধারণ যখন ভেসে চলল, তখন বুর্জোয়ারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, নিশ্চিন্ত হল সুবিধেভােগী ধর্মীয় যাজক সম্প্রদায়, নিশ্চিন্ত হল সুবিধেভােগী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। পরম নিশ্চিন্তে সমগ্র দেশের মানুষ ১৮৮৭ সালে এবং ১৮৯৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়ার জুবিলী উৎসব মহাসমারােহে উদ্যাপন করেছিল।

সুতরাং ভিক্টোরীয় যুগ হল বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যুগ, বুর্জোয়া শিল্প সভ্যতা বিকাশের যুগ, বুজোয়া গণতন্ত্র ও ধ্যান-ধারণা প্রসারের যুগ, শ্রমিকশ্রেণীর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকার অর্জনের যুগ, সমাজিক জীবনে মুখ্যত দুটি শ্রেণীর অর্থাৎ ধনী ও শ্রমিকের মধ্যে আপস রক্ষার যুগ, যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির জন্য ব্যাপক শিক্ষাপ্রসারের যুগ, বিজ্ঞানের সঙ্গে ভাববাদের আপস-রক্ষার যুগ, ইংল্যান্ডের জাতীয় ভাবনার ট্রাডিশন্যাল স্রোতধারাটিকে আরাে স্ফীত, আরাে বেগবান, আরাে মহীয়ান করে তােলার যুগ, জীবনকে সম্ভোগের বৈচিত্র্যে ভরিয়ে তােলার যুগ, গ্রাম ও শহরের ব্যবধান ঘুচিয়ে আধুনিক সভ্যতার বিজয়ী-বৈজয়ন্তী উড়িয়ে দেবার যুগ।

ভিক্টোরীয় যুগের উপন্যাস

এ যুগের উপন্যাস প্রধানত বাস্তব-নিষ্ঠ এবং মানব জীবনের রসধারায় পরিপুষ্ট। কারণ যুগ ও যুগের ভাবনা যেমন আছে তেমনি আছে মানুষের বহু বৈচিত্রময় জীবন। বাস্তব মানুষের বৈচিত্র্যভরা জীবনের রহস্য পাঠককে যে কি গভীরভাবে আকর্ষণ করে তা ভিক্টোরীয় উপন্যাসের জনপ্রিয়তা দেখলেই বােঝা যায়। ১৬শ শতাব্দী, ১৭শ শতাব্দীতে নাটকের জনপ্রিয়তা যেমন ছিল সর্বোচ্চ তেমনি ১৯শ শতাব্দীতে উপন্যাসের চাহিদা, আস্বাদন ও জনপ্রিয়তা ছিল সর্বোচ্চ। কারণ মানব মনের গভীর রহস্যের খবর উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছিল অঙ্কিত। সুতরাং জীবন এবং মনােবিশ্লেষণ দুই-ই এ যুগের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। এযুগের উপন্যাস যে পরাদর্শ সৃষ্টি করেছিল পরবর্তকিালে সে আদর্শই অনুসৃত হল। তবে বাস্তব বােধের ভাবনা যে সকলের এক ধরনের ছিল তা বলা যায় না। বাস্তবের ভাবনাকে কেউ বা আদর্শায়িত করেছেন, কেউ বা বাস্তবের যথাযথ চিত্রাংকন করেছেন। যাইহােক রােমান্টিক যুগের মত যেমন অতীত যুগের বাস্তবতায় ফিরে যাবার তাগিদ ছিল না, তেমনি ছিল না অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক কল্পনার বিস্তার। এ যুগের উপন্যাস মৃত্তিকা দিয়ে মানুষের এবং সমাজের মূর্তি অংকন করেছে, কল্পনা দিয়ে নয়।

চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০)

জীবন ও সংগ্রাম

১৮১২ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী হ্যাম্পশায়ারের অন্তর্গত ল্যাণ্ডপাের্টে ডিকেন্স জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা ছিলেন পাের্টমাউথের নৌবাহিনীর পে অফিসের কেরাণী। ডিকেন্সরা ভাইবোনে মিলে আটজন, ডিকেন্স মেজো। সংসারের অর্থনৈতিক অবস্থা আদৌ সচ্ছল ছিল না। সংসারের সব অভাব মেটানো বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মাঝে মাঝে বদলি হতে হত। ১৮২৩ সালে বাবা লন্ডনে বদলি হয়ে এলেন। বাস করতেন বস্তি বাড়িতে। সংসারের অভাব অনটন বেড়েছে। বাবা সংসার চালাতেন। ঋণ পরিশােধ করতে না পারার জন্য মার্শালসীতে কারারুদ্ধ হলেন। বাধ্য হয়ে সংসারের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে এগার বছরের ছেলে ডিকেন্সকে পড়া ছেড়ে দিয়ে পথে পথে গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করতে হল। তারপর একটা কারখানায় বােতলের গায়ে লেবেল আঁটার কাজ পেয়ে গেলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি বা পরিশ্রম করতে হত। পারিশ্রমিক হিসাবে সপ্তাহে যে কয়েক শিলিং উপার্জন করতেন তা দিয়ে অতিকষ্টে সংসার চলত। কিছুদিনের মধ্যে বাবার দণ্ডভােগ শেষ হলে ১৮২৪ সালে ডিকেন্স পুনরায় স্কুলে ভর্তি হলেন। কি কষ্টের জীবন! ডিকেন্স যখন আশ্রয়হীন বেড়ালের মত কারখানায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কাউন্টারের তলায় শুয়ে রাত্রি যাপন করতেন তখন টেনিসন আর ব্রাউনিং আরামে আর সুখে লেখাপড়া শিখেছেন। যাইহােক ওয়েলিংটন হাউস একাডেমিতে তার বেশিদিন অতিবাহিত করতে হয়নি। ১৮২৭ সালে স্কুল ছেড়ে তিনি এটর্নি অফিসে কেরাণীর চাকুরি পেলেন। এ সময় তিনি শর্টহ্যান্ড লেখায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দ্রুত-লিপি লেখার দক্ষতার জন্য তিনি ১৮৩২ সালে একটি সান্ধ্য পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ পেয়ে গেলেন। ১৮৩৪ সালে “মর্নিং ক্রনিকেল” পত্রিকার সাংবাদিক নিযুক্ত হন। লঘু কথাচিত্র রচনা করতে লাগলেন। সাফল্য হল করায়ত্ত। এরপর ব্যাঙ্গ চিত্রের জন্য কথা রচনার ডাক এল। ধারাবাহিকভাবে কথা ও কাহিনী রচনা পত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকল এবং পাঠক তার রচনার গুণে মুগ্ধ এবং ভক্ত হয়ে পড়ল। ছড়িয়ে পড়ল তার খ্যাতি। প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন তিনি। আর সেই প্রতিষ্ঠার মূলে ছিল যে রচনা সে রচনা ‘পিকউইক পেপার’ নামে খ্যাত। এই সময়ে ডিকেন্স ‘মর্নিং ক্রনিকেল’ পত্রিকার একজন সহকর্মীর কন্যাকে বিবাহ করেন। অর্থাৎ জীবন ও জীবিকার মসৃণ যাত্রাপথে তার সৃষ্টির জয়রথ দ্রুতবেগে ধাবিত হল। সম্মান এবং অর্থ দুই সমানভাবে বর্ষিত হতে লাগল। দেশ-বিদেশ থেকেও এল আমন্ত্রণ। আমেরিকা, কানাডা প্রভৃতি দেশ ঘুরে এলেন। কিন্তু অমিতব্যয়ী ডিকেন্সের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর ছিল না। ১৮৫৮ সালে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে গেল। সাময়িক যন্ত্রণার হাত থেকে তিনি সুস্থ হয়ে পুনরায় রচনায় মনােনিবেশ করলেন। তারই মধ্যে একবার ইতালি ঘুরে এলেন। সাহিত্য পাঠের জন্য তিনি প্রচুর খ্যাতি ও অর্থলাভ করেছিলেন। রচনার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করতে হত। তার শেষ উপন্যাস রচনার সময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে সেই যে মেঝেয় লুটিয়ে পড়লেন আর উঠলেন না। ওয়েষ্টমিনিষ্টার অ্যাবিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। বয়স তখন আটান্ন।

ডিকেন্সের রচনাসমগ্র ও রচনার বৈশিষ্ট্য

প্রায় কুড়িখানা উপন্যাস রচনা করেছেন, দু’ একখানা নক্সাচিত্রও আছে। তার রচনাগুলো হল – “স্কেচেস বাই বজ” (১৮৩৬), “দি পিকউইক পেপারস” (১৮৩৬), “অলিভার টুইস্ট” (১৮৩৭), “নিকোলাস নিকলবি” (১৮৩৮), “দি ওল্ড কিউরিওসিটি সপ” (১৮৪০), “বারনাবাই রুজ” (১৮৪১), “আমেরিকান নোটস্ (১৮৪২), “মার্টিন চুজেলউইট” (১৮৪৩), “এ ক্ৰীষ্টমাস কেরল” (১৮৪৩), “ডম্বে এণ্ড সন” (১৮৪৬), “ডেভিড কপারফিল্ড” (১৮৫০-৫১), “ব্লিক হাউস” (১৮৫২), “হার্ড টাইমস” (১৮৫৪), “লিটল্ ডােরিট” (১৮৫৫), “এ টেল অব টু সিটিজ” (১৮৫৯), “গ্রেট এক্সপেকটেশন” (১৮৬০), “আওয়ার মিউচুয়েল ফ্রেণ্ড” (১৮৬৪), “দি মিস্ট্রী অব এডুইন ড্রুড” (অসমাপ্ত)।

ডিকেন্স দরিদ্র ঘরের সন্তান। দারিদ্র্যের সঙ্গে ছিল তার প্রত্যক্ষ পরিচয়। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও ও বাসস্থানের অভাবে শৈশবকাল নিদারুণ কষ্টের মধ্যে কেটেছে। উপবাস, অর্ধাসন, অনশন কাটাতে হয়েছে কখন কখন। বাবাকে জেল খাটতে হয়েছে। একমুঠো অন্নের জন্য কারখানায় খাটতে গিয়ে মালিকের নিষ্ঠুর আচরণ যেমন সহ্য করতে হয়েছে তেমনি অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত জীবন কাটাতে হয়েছে। কিন্তু শৈশবকালের এই নির্মম অভিজ্ঞতা এবং অবজ্ঞার দরুণ অপমানের তীব্র জ্বালা তার মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল কি? তার জীবনের লক্ষ্য ও পথের নিশানা ঠিক করার কাজে কোন প্রভাব বিস্তার করেছিল কি? কষ্টের সাথে সংগ্রাম করে যাকে চোখের জলে পেটের অন্ন পুরণের বাস জোগাড় করতে হয়েছে, আশ্রয়হীন কুকুরের মতাে যাকে অবজ্ঞার শুষ্কতাপে জর্জরিত হতে হয়েছে, অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, তার জীবনের ভবিষ্যত লক্ষ্যপথের রচনায় এসব কোন প্রভাব বিস্তার করেনি। কারণ ডিকেন্সের জীবনে লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে মধ্যবিত্ত মানুষের মত জীবনটাকে ভােগ করার বাসনা। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উত্তরণই ছিল তার লক্ষ্য। দারিদ্রকে তিনি ঘৃণা করতেন। দারিদ্রর হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি প্রচণ্ড অধ্যবসায় সহকারে দ্রুত লিপি লেখার কাজ শিখেছেন, নানা সাহিত্যিকের উপন্যাস কবিতা পাঠ করেছেন এবং সাহিত্যিক হবার স্বপ্নে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। শৈশব কাল দারিদ্রের জ্বালাকে তিনি কখনও ভুলতে পারেননি দারিদ্রের কবল থেকে পরবর্তীকালে মুক্তি পাওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু তাই বলে দারিদ্র্য সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী সেই ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেননি। দারিদ্রবিহীন, শােষণহীন কোন নতুন সমাজ সৃষ্টির কথাও তিনি কোথাও উচ্চারণ করেননি। দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার যে পথ তিনি গ্রহণ করেছিলেন সে পথ ভাববাদের পথ। সে পথ মধ্যবিত্তসুলভ সুবিধাবাদী আপোসকামী পথ। তাই তিনি ভাবে ও ভাবনায়, চিন্তায় ও কর্মে ছিলেন কার্লাইলের শিষ্য, রাসকিনের কাছাকাছি অর্থাৎ এ যুগের মধ্যবিত্ত পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর যা জীবনাদর্শ ছিল ডিকেন্সেরও তাই ছিল। মধ্যবিত্ত পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী শােষণ ব্যবস্থাকে বজায় রেখে চেয়েছিল শ্রমিকশ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ও বিভিন্ন সুযােগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি। ১৮৫০ সালে কার্ল মার্কস এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “the democratic petty-bourgeois only desire better wages and a more secure existence for the workers.” এদের সদিচ্ছা এবং মানবতাবােধ এই ভাবনার উপর প্রতিষ্ঠিত। ডিকেন্সও প্রতিবাদ করেছিলেন ইংল্যান্ডের শ্রমিকশ্রেণীর জন্য “ওয়ার্কহাউস সিস্টেম,” “পুওর ল” বা দরিদ্র আইনের বিরুদ্ধে, প্রায়শ্চিত্ত সংক্রান্ত কঠিন দণ্ডবিধির বিরুদ্ধে, আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে, বিচারের দীর্ঘসূত্রতার বিরুদ্ধে, শিশুদের উপেক্ষার বিরুদ্ধে, একটা বিরাট সংখ্যক প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষকদের নিষ্ঠুরতা ও অবহেলার বিরুদ্ধে, শহরের গরীবদের জন্য বাসস্থানের অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, শ্রমিক সংগঠনের কার্যকলাপের বাড়াবাড়ি এবং মালিক শ্রেণীর একগুঁয়েমি মনােভাবের বিরুদ্ধে, অবাধ ব্যবসা বাণিজ্যের অর্থনৈতিক নাত এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, কারাগারের শােচনীয় অবস্থা, বিচার পদ্ধতি এবং আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সুতরাং ডিকেন্স তার যুগের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি। কোন সমালােচকের মতে, “An ardent believer in progress, moderate in his views, and of an option turn of mind, he lives and thinks in complete accord with the me class opinions of his day.” প্রগতিতে প্রচণ্ড বিশ্বাসী, দৃষ্টিভঙ্গীতে মধ্যমপন্থী, চিন্তায় আশাবাদী ডিকেন্স তার জীবনে এবং ভাবনায় তার যুগের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাবনা ও মতের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতি রেখেই বাস করেছেন।

শুধু তাই নয়, ডিকেন্স ছিলেন প্রচণ্ড জাতীয়তাবাদী। জাতীয়তাবাদের যে স্রোতটি ধীরে ধহীরে স্তিমিত হয়ে এসেছিল তাকে তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি যেমন উগ্র জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, তেমনি উগ্র জাতীয়তাবোধহীন ছিলেন না। তিনি উগ্রতা থেকে শতহস্ত দূরে ছিলেন বলেই ফরাসী বিপ্লবের ভাল এবং মন্দের উগ্রতাকে তিনি পছন্দ করেননি। যেটুকু ভাল বা মন্দ ছিল সেটুকু তিনি বর্ণে ও রেখায় তুলে ধরেছেন। প্রাচীন সামন্ত মহাপ্রভুদের সকলেই মন্দ চরিত্রের মানুষ ছিল একথা তিনি মনে করেন না। আবার বিপ্লবীদের মধ্যেও যে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ ছিল – একথাও তিনি বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন উগ্রতার পরিণাম অতি ভয়ঙ্কর। তার জন্য অনেক মানষকে মূল্য দিতে হয়। বিশ্বাস করতেন যে উগ্রতার যুপকাষ্ঠের বেদীমূলে প্রাণ দিয়ে সত্যকে রক্ষা করেন যারা তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি, “I am the resurrection and the life, saith The Lord : he that believeth in me though he were dead, yet shal he live; and who ever liveth and believeth in me, shall never die.” “এ টেল অব টু সিরিজ” উপন্যাসের সিডনি কার্টন চরিত্রটিকে তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে সৃষ্টি করেছেন। যে চরিত্রটি ঈশ্বরের প্রতি আস্থা রেখেই উগ্রতার যুপকাষ্ঠে প্রাণ দিয়েছে। ফরাসী বিপ্লবকে তিনি রক্ষণশীলতার দৃষ্টিতেই দেখেছেন।

যাইহােক ডিকেন্স জীবনের যন্ত্রণাকে পান করে নীলকণ্ঠ হতে পেরেছিলেন বলে জীবনের মতকে আস্বাদন করতে পেরেছেন। মানব প্রেমের করুণাধারায় সমস্ত গরলকে অমৃতে পরিণত করতে পেরেছিলেন বলে তার সাহিত্যে অশ্রু আছে, অশ্রুর কালিমা নেই, দীপ্তি আছে দাহ নেই, প্রাণ আছে প্রাণের চাঞ্চল্য নেই। কারণ তার চরিত্রের স্বভাব ধর্ম হল রাজহংসের মত। বাস্তবের জলে সাঁতার কেটেছেন, ডুব দিয়েছেন কিন্তু বাস্তবের তিক্ত জলকণাগুলোকে পালক থেকে ঝরিয়ে দিয়ে জীবনের নীলাকাশে ডানা মেলে দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন হিউমারিষ্ট। হিউমার হল এক ধরনের কৌতুকরস। কার্লাইলের ভাষায়, “Humour is a sympathy with the seamy side of things.” হিউমার হল বস্তুর জোড়া দেওয়া অংশের প্রতি সমবেদনা। মানুষের জীবনে জ্বালা আছে, যন্ত্রণা আছে, আর সুখ বা আনন্দ আছে। কিন্তু হিউমারিষ্টের জীবনে জ্বালা যন্ত্রণার প্রতি কোন অসূয়া বা বিদ্বেষ নেই। বরং আছে সমবেদনা। প্রসন্নচিত্তের আলােকধারায় স্নাত হয়ে জীবনের ক্ষতগুলো মিলিয়ে যায়, আর তার পরিবর্তে সৃষ্টি হয় মানবিক রস। হিউমারের মধ্যে হৃদয়ের স্পর্শ আছে, আছে দরদ ও ভালােবাসা। হিউমার হল কান্নাহাসির গঙ্গাযমুনার মিলনস্থল। এখানে চোখের জল ফেলতে হাসি পায়। হিউমার মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার সঙ্গে নিবিড় যােগসূত্র রচনা করে। হিউমারের আবেদন হৃদয়ের গভীরে, ভালােবাসার মধুর মর্মলােকে। কার্লাইলের ভাষায়, “True humour springs not more from head, than from the heart, it is not contempt.its essence is love.”

ডিকেন্স হিউমারকে সাহিত্য রচনার রীতি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং রঙ্গচিত্রের কাহিনী রচনায় তাকে প্রয়ােগ করেছিলেন। এবং তিনি এমন নিষ্ঠার সঙ্গে প্রয়ােগ করেছিলেন যে তাতেই তার আসন বিশ্বসাহিত্যের আঙ্গিনায় চিরকালের জন্য পাতা হয়ে গেল। সাহিত্যিক জীবনের প্রথম ও কারাে কারাে মতে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি রচনার নাম “পিকউইক পেপারস”। মিঃ পিকউইক নিজ নামের একটি ক্লাবের সভাপতি। ক্লাবের উদ্দেশ্য হল যে সদস্যদের নিজের নিজের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে এক একটি বৈঠকে বর্ণনা করে শােনাতে হবে। সকল সদস্যই শুনিয়েছেন। পিকউইকও শুনিয়েছেন। পিকউইক যে সমস্ত কাহিনী শুনিয়েছেন সেগুলো পিকউইকের অভিজ্ঞতার চেয়ে পিকউইককে বিশেষভাবে স্পষ্ট করে তুলেছে। ডিকেন্স পিকউইককে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তা এককথায় অদ্বিতীয়। পিকউইকের অভিজ্ঞতাও বহু বৈচিত্র্যময়। পিকউইক জীবনকে দেখেছে নদীস্রোতের ফেনাপুঞ্জের মত, শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলার মত। তাই প্রাণের ছন্দে আত্মহারা। বিশ্বের কোন জ্বালা যন্ত্রণাই তার হৃদয়ের আকাশে কালােছায়া ফেলতে পারে না। এই বিশ্বের মানবলােকে আপনাকে বিলিয়ে দিয়ে, ছড়িয়ে দিয়ে সে সুখী। এই প্রাণভরা গান আর খেয়ালী মনের খুশিতে ভরা হৃদয় নিয়ে মানব প্রেমের মহৎ প্রেরণায়, স্নেহে-প্রেমে-করুণায় বিগলিত চিত্তটিকে সবুজে সবুজ, শ্যামলে শ্যামল সতেজ করে নিয়ে অপরের দুঃখ-বেদনাকে অপনােদন করার অহেতুক স্পৃহায় সদাশিব আত্মভােলা এই মানুষটি সব সময় নিয়ােজিত রেখেছে। এর ফলে তাকে নানাভাবে বিপদগ্রস্ত হতে হয়েছে। প্রতারিত হতে হয়েছে। লাঞ্ছিত হতেও হয়েছে, এমনকি কারদণ্ডও ভােগ করতে হয়েছে। তা সত্বেও সে দৃঢ়, অবিচলচিত্ত, অকলঙ্কিত চরিত্র। মিথ্যাকে সে সহ্য করতে পারে না। মিথ্যা মামলায় জরিমানা দিতে অস্বীকার করে কারাদণ্ড ভােগ করতে সে ভয় পায় না। ব্যর্থতাকে কণ্ঠের মণিহার করে রাখে। এরকম চরিত্রের মানুষকে উপলব্ধি করা যায়, উপভােগ করা যায়, ধরা বা ছোঁয়া যায় না। তার সব চেয়ে মহৎ পরিচয় জনপ্রিয়তায় “He is known by all the poor people about who net who never fail to take their hats off, as he passes, with great respect.” তার শেষ বয়েসের রচনা “ডেভিট কপারফিল্ড”। এটি তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। এখানেও তিনি সমবেদনার অশ্রুধারায় অভিষিক্ত করে বিভিন্ন চরিত্র অংকন করেছেন। বিশেষভাবে মিঃ মিকবারের চরিত্রটি হিউমারের হাস্যরসের করুণা ধারায় সমুজ্জ্বল। ডেভিড কপারফিল্ড চরিত্রটিও সমবেদনার অশ্রুজলে বিধৌত হয়ে সৃষ্ট। কপারফিল্ডের জীবনে যন্ত্রণার সমস্ত কাটা ধন্য হয়ে ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে। দুঃখের জ্বালা সুখের মাধুর্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ দুঃখ জীবন থেকে উত্তরণের পথ চলার কাহিনীকে রূপ দেওয়া হয়েছে। তার অধিকাংশ উপন্যাসেই এই নীতি অনুসৃত হয়েছে।

ডিকেন্স কয়েকটি উপন্যাসে প্রচণ্ড কারুণ্য সৃষ্টি করে পাঠকের হৃদয় জয় করতে চেয়েছেন। এ পদ্ধতিতে পাঠকের হৃদয় জয় করা যেতে পারে কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে তা অক্ষমতা ছাড়া কিছুই নয়। কারণ কাহিনী সৃষ্টি হল একটা কঠিন ব্যাপার। জটিল কাহিনী রচনায় ডিকেন্সের কোন কৃতিত্ব নেই। সহজ সরল কাহিনী তিনি রচনা করেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তা অতিনাটকীয় হয়ে উঠেছে। ‘নিকোলাস নিকলবি’, ‘অলিভার টুইস্ট’ প্রভৃতি কাহিনীর পরিসমাপ্তি যেমন অতিনাটকীয়ভাবে শেষ হয়েছে, তেমনি কারুণ্যের ছড়াছড়িতে প্লাবন ঘটেছে। নাটকীয়তার প্রতি তার ছিল বিশেষ আগ্রহ। সে আগ্রহেই তিনি অতিনাটকীয় কাহিনী নির্মাণ করেছেন। “লিটল ডরিট” উপন্যাসের কাহিনী তাে রীতিমত অতিনাটকীয়। কারুণ্য সৃষ্টির ব্যাপারে অতিনাটকীয়তা একান্ত অপরিহার্য।

চরিত্র সৃষ্টির ব্যাপারে বলা যায় যে, তার সাহিত্যে ইংল্যান্ডের গােটা সমাজের নানা চরিত্রের মানুষ ভিড় করেছে। পুঁজিপতি, উচ্চ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, কেরাণী, শিক্ষক, প্রতারক, বিচারক, উকিল, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, গুণ্ডা, চোর, বদমায়েস কি নয়? সব আছে। কিন্তু ডিকেন্স নিম্নশ্রেণীর মানুষের চরিত্র বর্ণনায় যত বেশি সহজ স্বাভাবিক তত বেশি কৃত্রিম উপরতলার মানুষের চরিত্র বর্ণনায়। মনে হয় উপরতলার মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা ছিল কিন্তু অপ্রত্যক্ষ, কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল নিম্নশ্রেণীর মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে। তবে তিনি আদর্শায়িত করেছেন যে সব চরিত্র সহজেই মানুষের সমবেদনা লাভ করতে পারে। সেই সব দুঃখী মানুষের চরিত্রই তিনি গভীর সমবেদনার সাথে বর্ণনা করেছেন। যদিও কোন নায়ক চরিত্রই তার সমবেদনা থেকে বঞ্চিত হয়নি। এমন কি দুর্দান্ত; প্রকৃতির হৃদয়হীন ধনী ডােম্বে, “হার্ড টাইমস”-এর টমাস গ্যাডগিন্ডও তার সমবেদনা থেকে বঞ্চিত হন নি। সমবেদনা সবার প্রতি বর্ষিত হয়েছে বলেই ডিকেন্স ব্রিটিশ সমাজে কবি, জাতির কবি। আর এই গুণের জন্য তিনি ইংল্যান্ডের মানুষের আপনার জন হতে পেরেছেন। ইংল্যান্ডকে ভালবেসে, ইংল্যান্ডের ভালর জন্য তিনি দরদ দিয়ে অসঙ্গতিগুলোকে তুলে ধরে শুধরে নেবার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

তবে কোন চরিত্রই যেন ইউনিভার্সাল হয়ে ওঠেনি। দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে তা নির্বিশেষ হয়ে হয়ে ওঠেনি। তাই তার রচনায় জীবন জিজ্ঞাসার কোন গভীরতর ইঙ্গিত নেই, নেই জীবনের সুগভীর ভাবব্যঞ্জনা। পাঠককে জীবন রহস্যের সন্ধানে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় না। পাঠককে ভাবিয়ে তােলে না তার রচনা, তার কোন চরিত্র। পাঠক শেষ পর্যন্ত তৈরি উত্তর পেয়ে খুশি হয়ে যান। বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনার পরিবর্তে আবেগের স্থূল পরিবেশনায় তার রচনা সমৃদ্ধ। দার্শনিক ভাবনায় তার হৃদয় ভারী হয়ে ওঠেনি। কোন সত্যের মর্ম উদঘাটন করা তার লক্ষ্য ছিলনা। জীবন দৃষ্টিতে গভীরতার অভাব ছিল বলেই তার রচনায় সাংবাদিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। যা দেখছেন তাকেই মনের মতাে করে সাজিয়ে যেন রিপাের্টিং করেছেন। এই জন্যই ডিকেন্সের যে রচনায় শিল্প চমৎকারিত্বের অপূর্ব কারিগরী দক্ষতা, ভাবনার গভীরতা, জটিল চরিত্র সৃষ্টির প্রজ্ঞা এবং সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের অভাব দেখা যায়। 

ডিকেন্স সাধারণ মানুষের কবি। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে রচনা করেছেন উপন্যাস। সাধারণের জন্য সাধারণভাবে রচনা করেছেন যা কিছু সাধারণ, সহজ এবং স্বাভাবিক। ডিকেন্স সই অর্থে অসাধারণ নন। তিনি সাধারণ মানুষের ভাবনাকে তাদের মত করে ভেবেছেন বলেই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন, “Feed before you moralise” অভুক্ত মানুষকে নীতিজ্ঞান শােনাবার চেয়ে তাদের মুখে ক্ষুধার অন্ন দেবার চেষ্টা কর।

জন রাস্কিন (১৮১৯-১৯০০)

১৮১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাস্কিন লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা ছিলেন কোন এক মদ ব্যবসায়ীর খামারের প্রধান কর্মচারী, মা ছিলেন ধর্মভীরু নারী। ছেলেকে প্রতিদিন দু-তিনটে পরিচ্ছেদ বাইবেল থেকে উচ্চৈস্বরে পড়ে যেতে বাধ্য করতেন। রাস্কিন বাল্যকালে গৃহেই লেখাপড়া করতেন। ১৫ বছর বয়সে ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াতেন। ১৮৪৬ সালে জন লকহার্টের কন্যা শার্লটির প্রেমে পড়লেন। শার্লটির প্রত্যাখ্যানের পর ১৮৪৮ সালে সুন্দরী বলে খ্যাত ইউফেমিয়া গ্রের সাথে তার বিবাহ হয়। বিয়ে সুখের হয়নি। ১৮৫৩ সালে বিচ্ছেদ ঘটে। ১৮৭১ সালে মায়ের মৃত্যুর পর অসহায় হয়ে যান, শরীর ভাল ছিলনা কোনদিনই। ১৯০০ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি মারা যান।

রাস্কিনের উল্লেখযােগ্য রচনা হল “মডার্ন পেন্টার্স” (১৮৪৮-৬০), “দি সেভেন ল্যাম্পস অব আর্কিটেকচার”—স্থাপত্যের সাতটি প্রদীপ (১৮৪৯), “দি স্টোনস অব ভেনিস” ভেনিসের পাথর (১৮৫১-৫৩), “আনটু দিস লাস্ট” (১৮৬২), “সিসেম এণ্ড লিলিস” (১৮৬৫), “দি ক্রাউন অব ওয়াইল্ড অলিভ” (১৮৬৬)।

রাস্কিন উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ। বাস্তব কঠিন জীবনের কোন অভিজ্ঞতা তার ছিল না। বরং জীবনটা ছিল তার কাছে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার মত সহজ, স্বচ্ছন্দ, সাবলীল। জীবনকে তাই দেখেছেন একটা বিঘ্নবিহীন শান্তরসের আধার রূপে। তার জীবন সাধনা বিরােধবিহীন সংশ্লেষমূলক আধ্যাত্মিক চেতনার রঙে রঞ্জিত। তিনি যেন মধ্যযুগের সন্ন্যাসীর মত শান্তিমন্ত্র পাঠ করে জীবনের ও সমাজের সব বিরােধ-বিসম্বাদকে, সমস্ত গরলকে অমৃতে পরিণত করতে চেয়েছেন। রাস্কিন প্রচণ্ডভাবে অধ্যাত্মবাদী। বাইবেল তার ভাবনার পাথেয়। শৈশব বয়সে মা যে মন্ত্রে তাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন সেই মন্ত্র তার জীবনের বীণা তন্ত্রে বারে বারে ধ্বনিত হয়েছে। রাস্কিন তাই ভাববাদী।

দ্যে রচিত তার প্রথম গ্রন্থ “মডার্ন পেন্টার্স”। চিত্রশিল্পের প্রতি রাস্কিনের ছিল প্রচণ্ড অনুরাগ। বিশেষত নিসর্গ প্রকৃতির চিত্রশিল্পী টারনারের চিত্র ভাবনার প্রতি ছিলেন অনুরক্ত। টারনার তার নিসর্গ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যকে রঙে রেখায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সৌন্দৰ্য্য পিপাসায় পিপাসার্ত রাস্কিন পিসা, ফ্লোরেন্স, ভেরােনা এবং ভেনিসের চিত্রশালার সৌন্দর্যকে আকণ্ঠভরে পান করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বলতে চেয়েছেন যে “জীবন্ত, বস্তুর সুখী অবস্থার সৌন্দর্যের রূপকে ফুটিয়ে তােলাই হল চিত্রকরের ধর্ম।” অর্থাৎ যা কিছু সুন্দর, শুচীশুভ্র পবিত্র তারই সাধক হলেন রাস্কিন। সেই সাধনার শুভ্ররূপকে তিনি সাতটি প্রদীপের আলােকে সমুজ্জ্বল করে তুলেছনে। সেই সাতটি প্রদীপ হল সত্য, সৌন্দর্য, শক্তি, ত্যাগ, আনুগত্য, শ্রম এবং স্মৃতি। এই সাতটি প্রদীপের আলােকে অতীতের যে জাতি নিজেকে আলােকিত করে তুলেছিল, ভেনিসের গােথিক স্থাপত্য শিল্পের সৌন্দর্য্য সেই জাতির আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক ধর্মবুদ্ধি ও পবিত্রতার এক অপূর্ব নিদর্শন।

রাস্কিন সমস্ত কিছুর মধ্যে ধর্মবুদ্ধির অস্তিত্বকে উপলব্ধি করেছেন এবং ধর্মবুদ্ধিকে আশ্রয় করে তার যুগের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন। এককথায় তিনি বাইবেলের বাণীকে সামাজিক রােগমুক্তির একমাত্র উপায় হিসাবে নির্দেশ দিয়েছেন। বাইবেলের বাণীকে তার গ্রন্থের নামকরণ হিসাবে ব্যবহার করেছেন। “আনটু দিস লাষ্ট” বাইবেলের একটি বাণীর তাত এই গ্রন্থটি রাস্কিনের রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র। এই অর্থশাস্ত্রের মূল বাণী হল মানবিক প্রীতি। মনুষ্য প্রীতিই সংসারের একমাত্র সঙ্গীত। মনুষ্যপ্রীতি ব্যতিরেকে সংসার সমাজ রাষ্ট্র অর্থহীন। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সামাজিক বন্ধন তা প্রীতির বন্ধন। রাস্কিনের মতে এই প্রীতি আছে বলেই ক্ষুধার জননী নিজে অভুক্ত থেকেও নিজের মুখের গ্রাস নিজের সন্তানকে খাইয়ে দেন। এই প্রীতির উপর নির্ভর করেই সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক এই প্রীতির পরেই গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে সমাজ ধ্বংস হতে বাধ্য। আর এই প্রীতি ধর্মবুদ্ধি থেকে জাগ্রত হয়, স্বার্থবুদ্ধি থেকে নয়। যে ধর্মবুদ্ধি মানুষকে শিক্ষা দেয় যে মালিক যেমন ঈশ্বরের সন্তান শ্রমিকও তেমনি ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বর প্রীতিময়। সুতরাং ঈশ্বরের সন্তানদের মধ্যেও থাকবে প্রীতিময়তা।

রাস্কিনের এই বক্তব্য গান্ধীকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং ভারতীয় রাজনীতিতে রাস্কিনের মতকেই তিনি প্রয়ােগ করার চেষ্টা করেছেন। রাস্কিনের রচনার প্রধান গুণ কাব্য সুষমা। অলংকারে বিভূষিত তার গদ্য, ছন্দের চঞ্চলতায় মুখর, ধ্বনিমাধুর্যে সুরের আবহ, আবেগের স্পন্দনে কলকল্লোলিত। রাস্কিনের গদ্য শান্তরসের বাহক, দীপ্তি আছে দাহ নেই, ঔজ্জ্বল্য আছে তীব্রতা নেই।

চার্লস রবার্ট ডারুইন (১৮০৯-৮২)

ডারুইনের জন্মস্থান শ্রুশবেরি। ঠাকুরদা ইরাসমাস ডারুইন ছিলেন কবি ও চিকিৎসক। স্থানীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেছিলেন। পরে এডিনবরায় এবং ১৮২৮ সালে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে স্নাতক হন।প্রাকৃতিক ইতিহাস অধ্যয়নের প্রতি ছিল প্রবল অনুরাগ। সেদিকেই তিনি মনপ্রাণ ঢেলে দেন। ১৮৩৯ সালে নিজের ভাগ্নী এস্মাওয়েজউডকে বিবাহ করেন। তার সেবা-সুশ্রুষায় তিনি যথেষ্ট লাভবান হয়েছিলেন। পৃথিবীও লাভবান হয়েছিল। ১৮৫১ সালে তিনি এইচ. এস. এস. বিগল জাহাজে দক্ষিণ আমেরিকায় যান এবং সেখানে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেন। বহু তথ্য সংগ্রহ করে তিনি গবেষণায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন এবং মূল্যবান কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৮১ সালে প্রচণ্ড পরিশ্রমের ফলে দেহ ভেঙ্গে পড়ল এবং ১৮৮২ সালে ১৯শে এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাকে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে সমাধিস্থ করা হয়।

তার উল্লেখযোগ্য রচনা হল “দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগল” (১৮৩৯), “দি অরজিজিন অফ স্পিসিজ” (১৮৫৯), এবং “দ্য ডিসেন্ট অফ ম্যান” (১৮৭১)। ডারউইনের গদ্য বিজ্ঞান ভাবনার গদ্য। সুতরাং সে গদ্য যে সাহিত্যরস বঞ্চিত হবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার বিষয়ের গুরুত্ব অসাধারণ। ক্রমে বিবর্তনের ফলে প্রাণীজগতের আবির্ভাব ঘটেছে এই তত্ত্ব একদিকে ঈশ্বরের প্রতি যেমন অনাস্থা এনেছে অন্যদিকে জীববিজ্ঞান সম্বন্ধে এনেছে নতুন আলোক। ডারুইনের মতবাদ প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কারের গভীর মূলে হেনেছিল আঘাত। ফলে যে টেনিসন বিজ্ঞানের অপ্রকৃতিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ১৮৪২ সালে রচিত “লকস্‌লে হল” কবিতার মধ্যে, সেই টেনিসন ১৮৮৬ সালে ” লক্সলে হল ষাট বছর পরের” কবিতায় তীব্রভাবে ডারুইনের বিবর্তনবাদের প্রতিবাদ জানালেন। ম্যাথু আরনল্ড মনে করতেন যে ডারুইন চিন্তাবিদ মানুষদের ধর্মকে বিনষ্ট করেছেন। সুইনবার্নের কবিতায় অবশ্য এর জন্য দু”খ প্রকাশের সুর নেই। তার ধারণায় ডারুইনবাদ কর্তৃক পুরাতন বিশ্বাসের বিনাশ হল অবসাদগ্রস্ত মানুষের জন্য চির বিশ্রামের প্রতিশ্রুতি। ডারুইনবিরোধী লেখক হলেন চার্লস রীড, ক্যাথারিন লাইডেল, উইল্কি কলিন্স, মেরী করেলি প্রভৃতি। অন্যদিকে ডারুইনবাদী লেখক হলেন মিসেস হামফ্রে ওয়ার্ড, জর্জ গিসিং, এবং স্যামুয়েল বাটলার প্রভৃতি। ইংরেজি সাহিত্যে ডারুইনের প্রভাব যে কত গভীর ছিল তা ১৯শ শতকের শেষেরদিকের উপন্যাসগুলোতেও লক্ষ্য করা যায়।

তথ্যসূত্র

ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস, ডঃ শীতল ঘোষ, ফ্রেন্ডস বুক কর্নার, ঢাকা, ২০০৬, পৃ. ২৫৮-৩০৮

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.