(শামানিজম এর সাথে soul ও spirit – এই দুটো কনসেপ্ট জড়িত। মুশকিল হলো বাংলায় এই দুটোরই অনুবাদ করা হয় “আত্মা”। কিন্তু দুটোকেই আত্মা বলা হলে দুটোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যাবে না। তাই এখানে soul এর বাংলা জীবাত্মা, এবং spirit এর বাংলা আত্মা বলা হচ্ছে।)
Table of Contents
ভূমিকা

আচ্ছা, এই যে শামানিজম (Shamanism) শব্দটা আমরা শুনি, এটা আসলে কী? সহজ করে বললে, এটা হলো একটা বিশেষ ধরনের আধ্যাত্মিক পথ। যারা এই পথে হাঁটেন, তাদের বলে শামান (shaman)। ব্যাপারটা হলো, এই শামানরা নাকি ধ্যান (trance) বা অন্য কোনো অদ্ভুত উপায়ে নিজেদের স্বাভাবিক চৈতন্য অবস্থা থেকে সরে গিয়ে অন্য এক জগতে পাড়ি জমান। সেই জগৎটা নাকি আত্মাদের (spirit world) জগৎ, যেখানে তারা দিব্যি ঘুরে বেড়ায় (Singh, 2018; Eliade & Diószegi, 2020)। এই যে তারা অন্য জগতে যান, এর পেছনে কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকে – আত্মাদের বা কোনো আধ্যাত্মিক শক্তিকে আমাদের এই চেনা পৃথিবীতে এনে মানুষের ভালো করা। সেটা হতে পারে কারও কঠিন রোগ সারিয়ে তোলা, কিংবা ভবিষ্যতের কোনো আভাস দেওয়া, অথবা অন্য কোনোভাবে মানুষের উপকারে আসা (Singh, 2018)।
শামানিজমের এই সব অদ্ভুত বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে পণ্ডিতমহলে কিন্তু বেশ শোরগোল। নৃতত্ত্ববিদ (anthropologist), প্রত্নতত্ত্ববিদ (archeologist), ঐতিহাসিক (historian), যারা ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেন (religious studies scholar), দার্শনিক (philosopher), এমনকি মনোবিদরাও (psychologist) – সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন এর ভেতরের রহস্যটা জানার জন্য। এ নিয়ে লেখা হয়েছে দিস্তার পর দিস্তা বই, অ্যাকাডেমিক গবেষণাপত্র। এমনকি, শামানিজম নিয়ে গবেষণার জন্য একটা পুরোদস্তুর পিয়ার-রিভিউড অ্যাকাডেমিক জার্নালও (peer-reviewed academic journal) নাকি আছে! ভাবুন একবার!
“শামানিজম” শব্দটি নিয়ে আলোচনা
শব্দের ব্যুৎপত্তি (Etymology)
এইবার আসুন, এই ‘শামানিজম’ শব্দটার নাড়ি-নক্ষত্র একটু জেনে নেওয়া যাক। আজকাল আমরা যে ইংরেজি ‘শামানিজম’ শব্দটা হরহামেশা ব্যবহার করি, সেটার জন্ম কিন্তু রুশ শব্দ ‘шаман’ (šamán) থেকে। আর এই রুশ শব্দটা আবার এসেছে তুঙ্গুসীয় কোনো একটা ভাষা (Tungusic language) থেকে – খুব সম্ভবত ‘সামান’ (samān) শব্দটা থেকে (Hutton, 2001)। তুঙ্গুসীয় ভাষা পরিবারের মধ্যে, ধরা যাক, দক্ষিণ-পশ্চিমের এভেঙ্কি (Evenki) উপভাষা, যেটা সিম এভেঙ্কি (Sym Evenki) মানুষেরা বলেন (Janhunen, 1986, p. 97), অথবা মাঞ্চু ভাষা (Manchu language) থেকেও এই শব্দটা এসে থাকতে পারে (Crossley, 1996)। কেউ কেউ আবার বলেন, এই শব্দের মূল নাকি তুঙ্গুসীয় শব্দমূল ‘সা-’ (sā-), যার মানে হলো “জানা” (Hoppál, 2005, p. 15; Diószegi, 1962, p. 13)। তবে, ফিনল্যান্ডের ভাষাতাত্ত্বিক জুহা জানহুনেন (Juha Janhunen) এই ব্যাপারে একটু সন্দিহান। তার মতে, ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে এই সংযোগটা খুব একটা পাকাঁপোক্ত নয়। তিনি বলেছেন, “এই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে কিনা চোখ বুজে মেনে নেওয়াও ঠিক হবে না, কারণ এখানে ধ্বনিগত কিছু গড়মিল আছে (বিশেষ করে স্বরবর্ণের পরিমাণে)” (Janhunen, 1986, p. 98)।
মির্চা এলিয়াদে (Mircea Eliade) সাহেব একটা বেশ মজার তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলছেন, সংস্কৃতে একটা শব্দ আছে – ‘শ্রমণ’ (śramaṇa)। এর মানে হলো ঘুরে বেড়ানো সন্ন্যাসী বা কোনো পবিত্র মানুষ। এই শব্দটা নাকি বৌদ্ধধর্মের সাথে সাথে মধ্য এশিয়ার অনেক ভাষাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। এলিয়াদে মনে করেন, এই ‘শ্রমণ’ শব্দটাই হয়তো ‘শামান’ শব্দের আদি পুরুষ (Eliade, 1989, p. 495)। গান্ধারী (Gandhari) ভাষায় এই শব্দটা পাওয়া গেছে ‘ষমন’ (Şamana) হিসেবে, তোখারিয়ান এ (Tocharian A) ভাষায় ‘ষামম’ (ṣāmam) হিসেবে, তোখারিয়ান বি (Tocharian B) ভাষায় ‘ষমানে’ (ṣamāne) হিসেবে, আর চীনা ভাষায় 沙門 (shāmén) হিসেবে (Baums & Glass, gandhari.org)।
সাইবেরিয়ার আদিবাসী মানুষদের সাথে ওঠাবসার ফলে রুশরা এই শব্দটাকে নিজেদের ভাষায় আপন করে নেয়। নির্বাসিত রুশ ধর্মযাজক আভাকুমের (Avvakum) আত্মজীবনীতে এর উল্লেখ পাওয়া যায় (Hutton, 2001, p. vii, তথ্যসূত্র ১৫-তে উল্লেখিত)। এর প্রায় বছর বিশেক পর, ডাচ কূটনীতিবিদ নিকোলাস উইটসেন (Nicolaes Witsen) এই শব্দটাকে পশ্চিম ইউরোপের মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি সাইবেরিয়ার তুঙ্গুসীয় আর সামোয়েডিক (Samoyedic) ভাষাভাষী আদিবাসীদের মধ্যে তার ঘোরাঘুরি আর বসবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন – ‘Noord en Oost Tataryen’ (১৬৯২) (Hutton, 2001, p. 32)। লুবেকের এক ব্যবসায়ী, নাম অ্যাডাম ব্র্যান্ড (Adam Brand), ১৬৯৮ সালে চীনে রুশ দূতাবাসের ভ্রমণ নিয়ে একটা বই ছাপান। সেই বছরেই বইটার ইংরেজি অনুবাদ বেরোয়, আর তার হাত ধরেই ‘শামান’ শব্দটা ইংরেজিভাষী মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে (Laufer, 1917; Bremmer, 2002)।
নৃতত্ত্ববিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ সিলভিয়া তোমাশকোভা (Silvia Tomášková) অবশ্য একটু অন্যরকম কথা বলেছেন। তার মতে, ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অনেক ইউরোপীয়ই উরাল পর্বতমালার ওপারে থাকা আদিবাসীদের অ-খ্রিস্টীয় রীতিনীতি আর বিশ্বাসকে আরবি শব্দ ‘শয়তান’ (shaitan) (মানে “অপদেবতা” বা “ডেভিল”) দিয়ে ব্যাখ্যা করত (Tomášková, 2013, pp. 76-78, 104-105)। তিনি মনে করেন, এই ‘শয়তান’ শব্দটাই হয়তো বিকৃত হতে হতে বিভিন্ন তুঙ্গুস উপভাষায় ‘শামান’ হিসেবে ঢুকে পড়েছিল। আর তারপর, যখন খ্রিস্টান মিশনারি, অভিযাত্রী, সৈন্য আর ঔপনিবেশিক শাসকেরা সেই আদিবাসীদের সংস্পর্শে আসতে শুরু করে, তখন ওই আদিবাসীরা নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে এই ‘শামান’ শব্দটাই ব্যবহার করতে শুরু করে।
মেয়ে শামানদের অনেক সময় ‘শামাঙ্কা’ (shamanka) বলা হয়। তবে এটা কিন্তু আদতে তুঙ্গুসীয় কোনো শব্দ নয়। এটা হলো ‘শামান’ শব্দের সাথে রুশ ভাষার মেয়েলি প্রত্যয় ‘-কা’ (-ka) জুড়ে দিয়ে তৈরি করা একটা শব্দ (Chadwick & Chadwick, 1968, p. 13)।
সংজ্ঞা (Definitions)
এই যে ‘শামানিজম’ শব্দটা, এর কোনো একটা বাঁধা-ধরা সংজ্ঞা কিন্তু নৃতত্ত্ববিদদের মধ্যে নেই। থমাস ডাওনসন (Thomas Downson) শামানিজমের তিনটে সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন: যারা এটা চর্চা করেন, তারা নিয়মিত নিজেদের চৈতন্য অবস্থা পাল্টে ফেলেন; তাদের সমাজ এই চৈতন্য পাল্টানোর ব্যাপারটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার বলে মনে করে; আর এই চর্চা সম্পর্কিত জ্ঞান খুব সাবধানে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ইংরেজ ঐতিহাসিক রোনাল্ড হাটন (Ronald Hutton) লক্ষ্য করেছেন, একুশ শতকের শুরুতে এই শব্দটা মোটামুটি চার রকম অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছিল (Hutton, 2001, pp. vii-viii):
- ১. খুব সাধারণভাবে, “যিনিই নিজের চৈতন্য অবস্থা পাল্টে ফেলে আত্মাদের জগতের সাথে যোগাযোগ করেন”, তাকেই বোঝাতে।
- ২. যারা অন্যের হয়ে, মানে অন্যের উপকারের জন্য, নিজেদের চৈতন্য অবস্থা পাল্টে আত্মাদের জগতের সাথে যোগাযোগ করেন।
- ৩. এই সংজ্ঞায় শামানদের অন্যান্য জাদু-ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের (magico-religious specialist) থেকে আলাদা করার একটা চেষ্টা দেখা যায়। যেমন – “মাধ্যম” (medium), “ওঝা” (witch doctor), “আধ্যাত্মিক আরোগ্যকারী” (spiritual healer) বা “ভবিষ্যৎদ্রষ্টা” (prophet)। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, শামানরা এমন কিছু বিশেষ কৌশল ব্যবহার করেন যা অন্যরা করে না। তবে, মুশকিল হলো, এই মতের সমর্থক পণ্ডিতরা সেই বিশেষ কৌশলটা ঠিক কী, তা নিয়ে একমত হতে পারেননি।
- ৪. সবশেষে, “শামানিজম” বলতে অনেক সময় সাইবেরিয়া আর এশিয়ার আশপাশের অঞ্চলের আদিবাসী ধর্মগুলোকেই বোঝানো হয়।
অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি (Oxford English Dictionary) বলছে, একজন শামান (উচ্চারণ হতে পারে /’ʃɑːmən/ SHAH-mən, /’ʃæmən/ SHAM-ən অথবা /’ʃeɪmən/ SHAY-mən) (Archived from the original, 2017) হলেন এমন একজন মানুষ, যাকে কিনা ভালো-মন্দ আত্মাদের জগতে ঢোকার এবং সেই জগতের উপর প্রভাব ফেলার ক্ষমতা আছে বলে মনে করা হয়। তিনি সাধারণত কোনো ধর্মীয় আচারের সময় ঘোরের (trance) মধ্যে চলে যান এবং ভবিষ্যৎবাণী ও রোগ সারানোর মতো কাজ করেন (Singh, 2018; Archived from the original, 2017)। ‘শামান’ শব্দটা সম্ভবত উত্তর এশিয়ার তুঙ্গুসীয় এভেঙ্কি ভাষা থেকে এসেছে। জুহা জানহুনেনের মতে, “এই শব্দটা সমস্ত তুঙ্গুসীয় ভাষাতেই পাওয়া যায়” – যেমন নেগিডাল (Negidal), লামুট (Lamut), উডেহে/ওরোচি (Udehe/Orochi), নানাই (Nanai), ইলচা (Ilcha), ওরোক (Orok), মাঞ্চু (Manchu) আর উলচা (Ulcha)। আর তার মতে, “এমন কিছুই নেই যা এই ধারণাকে নস্যাৎ করে যে ‘শামান’ অর্থটিও প্রোটো-তুঙ্গুসীয় (Proto-Tungusic) ভাষা থেকে এসেছে” এবং এর শিকড় হয়তো কমসে কম দুই হাজার বছরের পুরোনো (Janhunen, 1986, pp. 97-98)। ১৫৫২ সালে রুশ বাহিনী যখন শামানবাদী খানাত অফ কাজান (Khanate of Kazan) জয় করে নেয়, তারপর থেকেই এই শব্দটা পশ্চিমের মানুষের কাছে পরিচিত হতে শুরু করে।
“শামানিজম” শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন পশ্চিমের নৃতত্ত্ববিদরা। তারা যখন তুর্কি আর মঙ্গলদের প্রাচীন ধর্ম, আর তাদের আশেপাশে থাকা তুঙ্গুসীয় ও সামোয়েডিক ভাষাভাষী মানুষদের ধর্ম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন, তখনই এই শব্দটা চালু হয়। পরে, পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে কিছু পশ্চিমা নৃতত্ত্ববিদ এই শব্দটাকে খুব ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রালেশিয়া এমনকি আমেরিকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত, আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন, জাদু-ধর্মীয় কাজকারবারকেও এই নামে ডাকা হতে থাকে, কারণ তারা মনে করতেন এই সবকিছুর মধ্যে একটা মিল আছে (Alberts, 2015, pp. 73-79)। যদিও বাইরের লোকেরা অনেক আদিবাসী আধ্যাত্মিক আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভুল করে এই শব্দটা ব্যবহার করেছে, “শামান” এবং “শামানিজম” শব্দগুলো আসলে আদিবাসী আধ্যাত্মিকতার যে বিশাল বৈচিত্র্য আর জটিলতা, সেটাকে ঠিকঠাক বোঝাতে পারে না। প্রত্যেকটা জাতি আর উপজাতির নিজস্ব জীবনযাপন পদ্ধতি আছে, আর তারা নিজেদের ভাষাতেই নিজেদের পরিভাষা ব্যবহার করে (Hazlitt, 2018)।
মির্চা এলিয়াদে (Mircea Eliade) লিখেছেন, “এই যে জটিল একটা ব্যাপার, এর প্রথম এবং সম্ভবত সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ সংজ্ঞাটা হবে এরকম: শামানিজম = ‘ধর্মীয় ভাবোন্মত্ততার কৌশল’ (technique of religious ecstasy)” (Eliade, 1972, pp. 3-7)। শামানিজমের মূল কথাটা হলো, শামানরা হলেন মানুষ আর আত্মাদের জগতের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী বা বার্তাবাহক। বলা হয়, শামানরা আত্মার চিকিৎসা করে অসুস্থতা সারিয়ে তোলেন। বিশ্বাস করা হয় যে, জীবাত্মার ওপর যে আঘাত বা ট্রমা লেগেছে, সেটা সারিয়ে তুলতে পারলে শরীরটাও আবার আগের মতো সুস্থ আর স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। শামানরা আরও বলেন যে তারা নাকি সম্প্রদায়ের সমস্যা সমাধানের জন্য অতিপ্রাকৃত জগৎ বা মাত্রায় যান, অথবা বিপথগামী জীবাত্মাদের পথ দেখাতে এবং বাইরের কোনো অশুভ শক্তির কারণে জীবাত্মার যে অসুস্থতা হয়েছে, সেটা দূর করতে অন্য জগৎ বা মাত্রায় পাড়ি জমান। শামানরা মূলত আধ্যাত্মিক জগতেই কাজ করেন, আর তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, সেই আধ্যাত্মিক জগৎটাই আমাদের এই চেনা জগৎকে প্রভাবিত করে। আর যখন সেই ভারসাম্যটা আবার আগের মতো ঠিকঠাক হয়ে যায়, তখনই নাকি অসুস্থতা সেরে ওঠে (Eliade, 1972, pp. 3-7)।
শব্দটির সমালোচনা (Criticism of the term)
নৃতত্ত্ববিদ অ্যালিস কেহো (Alice Kehoe) তার ‘Shamans and Religion: An Anthropological Exploration in Critical Thinking’ বইতে “শামান” শব্দটা নিয়ে বেশ আপত্তি তুলেছেন। এই আপত্তির একটা বড় কারণ হলো সাংস্কৃতিক আত্মসাৎ বা কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন (cultural appropriation) সংক্রান্ত ধারণা (Kehoe, 2000)। এর মধ্যে পড়ছে শামানিজমের যে সব নব্য যুগ বা নিউ এইজ (New Age) আর আধুনিক পশ্চিমা ধ্যানধারণা চালু হয়েছে, সেগুলোর সমালোচনা। কেহোর মতে, এগুলো আদিবাসী রীতিনীতিগুলোকে ভুলভাবে তুলে ধরে বা সেগুলোর গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। কেহো আরও মনে করেন যে এই শব্দটা ‘নোবেল স্যাভেজ’ (noble savage) বা ‘মহৎ অসভ্য’-এর মতো কিছু বর্ণবাদী ধারণাকে আরও উস্কে দেয়।
মির্চা এলিয়াদে শামানিজমকে বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য জোগাড় করে তৈরি করা একটা কৃত্রিম জিনিস হিসেবে দেখিয়েছেন, যার পেছনে নাকি সরাসরি গবেষণার তেমন কোনো ভিত্তি নেই – কেহো এই ধারণার তীব্র সমালোচনা করেছেন। কেহোর মতে, ড্রাম বাজানো, ঘোরে চলে যাওয়া, মন্ত্র পড়া, বিশেষ ধরনের গাছগাছড়া (entheogen) বা মতিভ্রমকারী জিনিস (hallucinogen) ব্যবহার করা, আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করা আর রোগ সারানো – এইগুলোকে শামানিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে দাগিয়ে দেওয়াটা একটা বড় ভুল। কারণ, এই জিনিসগুলো শামানিজমের সংজ্ঞার বাইরেও অনেক সংস্কৃতিতে দেখা যায়, এমনকি অ-শামানবাদী সংস্কৃতিতেও এগুলো একই ধরনের ভূমিকা পালন করে, যেমন আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে মন্ত্র জপ করা হয়। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে এই আচার-অনুষ্ঠানগুলো প্রত্যেকটা সংস্কৃতির নিজস্ব ব্যাপার, আর সেগুলোকে এত সহজে, সঠিকভাবে বা কোনো কাজের মতো করে শামানিজমের একটা বিশ্বজনীন ধর্মে ফেলে দেওয়া যায় না। এই কারণে, কেহো এই ধারণারও ঘোর বিরোধী যে শামানিজম হলো সেই প্যালিওলিথিক (Paleolithic) যুগ থেকে চলে আসা একটা প্রাচীন, অপরিবর্তিত ধর্ম (Kehoe, 2000)।
এই শব্দটা তার অনুমিত ঔপনিবেশিক শিকড়ের জন্য এবং আজকের দিনের ভাষাগত ঔপনিবেশিকতাকে জিইয়ে রাখার একটা হাতিয়ার হিসেবে সমালোচিত হয়েছে। পশ্চিমের পণ্ডিতরা “শামানিজম” শব্দটা ব্যবহার করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নানা ধরনের সংস্কৃতি আর আচার-অনুষ্ঠানকে বোঝাতে, যেগুলো হয়তো একে অপরের থেকে অনেকটাই আলাদা এবং একটা মাত্র শব্দ দিয়ে সেগুলোকে ঠিকঠাক বোঝানো সম্ভব নয়। কানাডার ড্রিফটপাইল ক্রি নেশনের (Driftpile Cree Nation) লেখক ও পুরস্কারপ্রাপ্ত পণ্ডিত বিলি-রে বেলকোর্ট (Billy-Ray Belcourt) যুক্তি দিয়েছেন যে আদিবাসী সংস্কৃতি সম্পর্কে “সরল” কিছু বোঝানোর জন্য যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, সেটা আসলে আদিবাসী সংস্কৃতিকে ছোট করার একটা কৌশল। কারণ, এর ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়কে এমনভাবে দেখা হয় যেন তারা শুধুই হিংসার ইতিহাসে জর্জরিত একটা সংস্কৃতির ফসল, যে সংস্কৃতি কেবল সরলতা আর অমার্জিততার জন্ম দিতে পারে (Hazlitt, 2020)।
নৃতত্ত্ববিদ মিহাই হোপ্পাল (Mihály Hoppál) “শামানিজম” শব্দটি উপযুক্ত কিনা তা নিয়েও আলোচনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে অনেক পাঠকের কাছে “-ইজম” (-ism) উপসর্গটি বৌদ্ধধর্ম, ক্যাথলিকধর্ম বা ইহুদিধর্মের মতো একটি নির্দিষ্ট মতবাদকে বোঝায়। তিনি আলোচিত সংস্কৃতিগুলোর বৈচিত্র্য এবং নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলোর উপর জোর দেওয়ার জন্য “শামানহুড” (shamanhood) (ISSR, 2001) বা “শামানশিপ” (shamanship) (Hoppál, 2006a, p. 14) (বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পুরানো রুশ এবং জার্মান জাতিতত্ত্ব প্রতিবেদনে ব্যবহৃত একটি শব্দ) ব্যবহারের সুপারিশ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে এটি স্থানীয় বৈচিত্র্যের (Hoppál, 2005, p. 15) উপর আরও বেশি জোর দেয় এবং শামানিজম পবিত্র মতবাদের ধর্ম নয়, বরং ব্যবহারিক উপায়ে দৈনন্দিন জীবনের সাথে যুক্ত (Hoppál, 1998, p. 40) – এই বিষয়টি তুলে ধরে। একই ধরনের চিন্তাভাবনা অনুসরণ করে, তিনি একটি সমসাময়িক দৃষ্টান্ত পরিবর্তনের (contemporary paradigm shift) (ISSR, 2001) কথাও বলেছেন। পিয়ার্স ভিটেবস্কি (Piers Vitebsky) আরও উল্লেখ করেন যে, আশ্চর্যজনক মিল থাকা সত্ত্বেও, শামানিজমে কোনো ঐক্য নেই। বিভিন্ন, খণ্ডিত শামানবাদী অনুশীলন এবং বিশ্বাস সর্বত্র অন্যান্য বিশ্বাসের সাথে সহাবস্থান করে। বিশুদ্ধ শামানবাদী সমাজের কোনো রেকর্ড নেই (যদিও তাদের অস্তিত্ব অসম্ভব নয়) (Vitebsky, 1996, p. 11)। নরওয়েজিয়ান সামাজিক নৃতত্ত্ববিদ হাকান রিডভিং (Hakan Rydving) একইভাবে “শামান” এবং “শামানিজম” শব্দগুলোকে “বৈজ্ঞানিক বিভ্রম” (scientific illusion) হিসেবে পরিত্যাগ করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন (Rydving, 2011)।
দুলাম বুমোচির (Dulam Bumochir) তুলনামূলক উদ্দেশ্যে তৈরি একটি পশ্চিমা নির্মাণ হিসেবে “শামানিজম” এর উপরোক্ত সমালোচনাগুলোকে সমর্থন করেছেন এবং একটি বিস্তৃত প্রবন্ধে, মঙ্গোলদের নিজেদের ভূমিকা, বিশেষ করে ১৯৯০-পরবর্তী/কমিউনিস্ট-পরবর্তী মঙ্গোলিয়ায় “শামানিজমের পুনর্গঠনে পণ্ডিত এবং শামানদের অংশীদারিত্ব”-কে নথিভুক্ত করেছেন (Bumochir, 2014)। এই প্রক্রিয়াটিকে সুইস নৃতত্ত্ববিদ জুডিথ হ্যাংগার্টনার (Judith Hangartner) মঙ্গোলিয়ার দারহাদ (Darhad) শামানদের উপর তার যুগান্তকারী গবেষণায় নথিভুক্ত করেছেন (Hangartner, 2011)। ঐতিহাসিক কারেনা কোলমার-পোলেনজ (Karena Kollmar-Polenz) যুক্তি দেন যে শামানিজমকে একটি ধর্মীয় “অপর” (other) হিসেবে সামাজিক নির্মাণ এবং বাস্তবায়ন প্রকৃতপক্ষে মঙ্গোলিয়ায় অষ্টাদশ শতাব্দীর তিব্বতি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লেখার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তীতে “সম্ভবত শামানিজম সম্পর্কে ইউরোপীয় ডিসকোর্সে প্রভাব ফেলেছিল” (Kollmar-Polenz, 2012)।
ইতিহাস (History)
শামানিজম একটি ধর্মীয় অনুশীলনের পদ্ধতি (Encyclopædia Britannica, 2018)। ঐতিহাসিকভাবে, এটি প্রায়শই আদিবাসী এবং উপজাতীয় সমাজের সাথে যুক্ত, এবং এতে এমন বিশ্বাস জড়িত যে শামানরা, পরকালের সাথে সংযোগের মাধ্যমে, অসুস্থদের সুস্থ করতে, জীবাত্মার সাথে যোগাযোগ করতে এবং মৃতদের আত্মাকে পরকালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। শামানিজমের উৎপত্তি মঙ্গোলিয়া এবং উত্তর ইউরোপ ও সাইবেরিয়ার সুদূর উত্তরের আদিবাসীদের থেকে (Hutton, 2001; Price, 2001)।
ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদের কাঠামোগত প্রভাব আদিবাসী জনগণের ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিকতা অনুশীলনের ক্ষমতা সীমিত করলেও, অনেক সম্প্রদায় আত্মনিয়ন্ত্রণ (Using the United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples in Litigation, 2011) এবং গতিশীল ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের (Oosten, Laugrand & Remie, 2006) মাধ্যমে পুনরুত্থান ঘটাচ্ছে। অন্যান্য গোষ্ঠী তাদের বিচ্ছিন্নতার কারণে এই কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাগুলোর কিছু এড়াতে সক্ষম হয়েছে, যেমন যাযাবর তুভান (Tuvan) (এই উপজাতি থেকে আনুমানিক ৩০০০ লোক বেঁচে আছে) (Lonely Planet, 2014)। তুভা রাশিয়ার সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন এশিয়াটিক উপজাতিগুলোর মধ্যে একটি যেখানে শামানিজমের শিল্প আজ পর্যন্ত তার বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের কারণে সংরক্ষিত হয়েছে, যা এটিকে অন্যান্য প্রধান ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে দিয়েছে (The Diplomat, 2018)।
বিশ্বাস (Beliefs)
সাধারণ বিশ্বাসসমূহ
দেখুন, সারা পৃথিবীতে শামানিজমের কিন্তু হাজারো রকমফের আছে। একেক জায়গায় একেক রকম নিয়মকানুন, আচার-অনুষ্ঠান। তবে মজার ব্যাপার হলো, এত বৈচিত্র্যের মধ্যেও কিছু সাধারণ বিশ্বাস কিন্তু সব ধরনের শামানিজমের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। মির্চা এলিয়াদে (১৯৭২) সাহেব এই রকম কিছু সাধারণ বিশ্বাসের কথা বলেছেন (Eliade, 1972, pp. 3-7):
- প্রথম কথা হলো, আত্মারা সত্যিই আছেন। তারা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে তো বটেই, পুরো মানব সমাজেই নাকি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অনেকটা অদৃশ্য সুতোর মতো, যা দিয়ে সবকিছু বাঁধা।
- আর এই যে আত্মাদের জগৎ, তার সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা নাকি শুধু শামানদেরই আছে। তারা যেন সেই জগতের গোপন দরজাটা চেনেন।
- এই আত্মারা আবার দু’রকমের হতে পারে – কেউ কেউ ভালো, উপকার করেন; আবার কেউ কেউ বেশ দুষ্টু, ক্ষতি করার তালে থাকেন। অনেকটা আমাদের চেনা পৃথিবীর মানুষদের মতোই, তাই না?
- শামানরা নাকি সেই দুষ্টু আত্মাদের কারণে যে সব অসুখ-বিসুখ হয়, সেগুলো সারিয়ে তুলতে পারেন। তাদের হাতে যেন জাদুর কাঠি থাকে!
- শামানরা এমন সব অদ্ভুত কৌশল জানেন, যাতে তারা দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন এক ধরনের ভাবাবেশে (visionary ecstasy) চলে যেতে পারেন। আর সেই ঘোরের মধ্যেই তারা নাকি দিব্যদৃষ্টির সন্ধানে (vision quest) বেরিয়ে পড়েন, অজানা সব রহস্যের খোঁজে।
- আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, শামানের আত্মা নাকি তার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে অতিপ্রাকৃত জগতে (supernatural world) ঘুরে আসতে পারে। সেখানে গিয়ে সে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আনে, অনেকটা গোয়েন্দার মতো।
- শামানরা প্রায়শই পশু-পাখির ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করেন। এগুলো নাকি তাদের আত্মিক পথপ্রদর্শক (spirit guide), ভবিষ্যতের ইঙ্গিত (omen) বা কোনো বার্তা (message-bearer) বয়ে আনে। যেন পশু-পাখিরাও তাদের এই রহস্যময় জগতের অংশীদার।
- আর হ্যা, শামানরা নাকি বিভিন্ন ধরনের ভবিষ্যৎবাণীও (divination) করতে পারেন। স্ফটিকের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখা (scry), হাড় ছুঁড়ে ভাগ্য গণনা করা (throw bones) – এই সব অদ্ভুত উপায়ে তারা নাকি ভবিষ্যতের ঘটনা সম্পর্কে আগাম বলে দিতে পারেন। ভাবা যায়!
শামানিজমের মূল ভিত্তিটাই হলো এই বিশ্বাস যে, আমাদের এই যে চারপাশের চেনা জগৎ, এটা আসলে অদৃশ্য নানা শক্তি বা আত্মাদের দ্বারা পরিপূর্ণ। আর এই আত্মারা নাকি আমাদের, মানে জীবিতদের জীবনকে প্রভাবিত করে (Salak, National Geographic Adventure)। যদিও অসুখ-বিসুখের কারণটা আধ্যাত্মিক জগতেই লুকিয়ে থাকে বলে মনে করা হয় – মানে, দুষ্টু আত্মাদের কারসাজিতেই রোগ হয় – তবুও রোগ সারানোর জন্য আধ্যাত্মিক আর শারীরিক, দু’রকম পদ্ধতিই কাজে লাগানো হয়। সাধারণত, একজন শামান আধ্যাত্মিক অসুস্থতার মোকাবিলা করার জন্য এবং সেই সংক্রামক আত্মাকে তাড়িয়ে রোগ সারানোর জন্য রোগীর “শরীরে প্রবেশ করেন”। ব্যাপারটা বেশ গা ছমছমে, তাই না?
অনেক শামান আবার তাদের এলাকার স্থানীয় গাছগাছড়া আর ঔষধি লতাপাতা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন। তারা প্রায়শই ভেষজ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করেন। অনেক জায়গায় শামানরা নাকি সরাসরি গাছপালা থেকেই শেখেন – তাদের গুণাগুণ, রোগ সারানোর ক্ষমতা, সবকিছু। তবে তার আগে তারা নাকি সেই গাছের ভেতরে থাকা বা তাকে রক্ষা করা আত্মার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নেন। যেন গাছপালারও নিজস্ব একটা আত্মা আছে, নিজস্ব একটা সত্তা আছে! পেরুর আমাজন অঞ্চলের শামান আর কুরান্দেরোরা (curandero) আত্মাদের ডাকার জন্য ইকারোস (icaros) নামে এক ধরনের বিশেষ গান ব্যবহার করেন। কোনো আত্মাকে ডাকার আগে সেই আত্মাকে নাকি শামানকে তার গানটা শিখিয়ে দিতে হয়। অনেকটা গানের মাধ্যমে বন্ধুত্ব করার মতো ব্যাপার! বিশেষ ক্ষমতাশালী পাথর বা অন্য কোনো টোটেমিক (totemic) বস্তু, যার মধ্যে নাকি আত্মা বাস করে, সেগুলোর ব্যবহারও খুব সাধারণ একটা ব্যাপার।
লাতিন আমেরিকায় ব্রুজেরিয়া (brujería) নামে পরিচিত ডাকিনীবিদ্যা আর জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস অনেক সমাজেই বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে। কিছু কিছু সমাজ আবার দাবি করে যে সব শামানদেরই রোগ সারানো আর মানুষ মারার – দু’রকম ক্ষমতাই থাকে। যাদের শামানিক জ্ঞান আছে, তারা সাধারণত তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ ক্ষমতা আর সম্মান পান। তবে তাদেরকে আবার অনেকে সন্দেহের চোখেও দেখে, বা ভয় পায়। কারণ, তারা নাকি ইচ্ছে করলেই অন্যের ক্ষতিও করতে পারেন (Wilbert & Vidal, 2004)। অনেকটা দু’ধারী তলোয়ারের মতো, তাই না?
জীবাত্মা ও আত্মা সম্পর্কিত ধারণা (Soul and spirit concepts)
জীবাত্মা (Soul): এই যে আত্মা, এটা কিন্তু শামানিজমের আরও অনেক আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে (Merkur, 1985, p. 4; Vitebsky, 1996, pp. 11-14, 107; Hoppál, 2005, pp. 27, 30, 36):
আরোগ্য (Healing): রোগ সারানোর ব্যাপারটা শামান যাদের সেবা করেন, তাদের বিশ্বাস ব্যবস্থার জীবাত্মা সম্পর্কিত ধারণার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে (Hoppál, 2005, p. 27)। এটা হতে পারে অসুস্থ মানুষটার হারিয়ে যাওয়া জীবাত্মাকে খুঁজে এনে সারিয়ে তোলা (Hoppál, 2005, p. 27)। যেন জীবাত্মাটাই হলো আসল, শরীরটা তার বাহন মাত্র।
শিকার করা পশুর অভাব (Scarcity of hunted game): কখনও যদি শিকার করার মতো পশুর অভাব দেখা দেয়, তখন শামানরা নাকি তাদের গোপন আস্তানা থেকে পশুদের জীবাত্মাকে “ছেড়ে দিয়ে” সেই সমস্যার সমাধান করতে পারেন। এছাড়াও, পশুদের প্রতি মানুষের আচরণ কেমন হবে, তা নিয়ে অনেক ট্যাবু (taboo) বা বিধিনিষেধ থাকতে পারে। এর কারণ হলো, যাতে পশুদের জীবাত্মা রাগ না করে বা কষ্ট না পায়। অথবা এমনও হতে পারে যে ইতিমধ্যে মারা যাওয়া শিকারের জীবাত্মা খুশি হয়ে অন্য জীবিত পশুদের বলে দেবে যে তারাও যেন ধরা দেয় আর মারা যায় (Kleivan & Sonne, 1985, pp. 7, 19-21; Gabus, 1970)। প্রকৃতির সাথে কী অদ্ভুত এক বোঝাপড়া!
আত্মা (Spirits): স্পিরিটরা হলো অদৃশ্য সত্তা, যাদের নাকি কেবল শামানরাই দেখতে পান। তাদের এমন ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখা হয় যারা মানুষ বা পশুর রূপ ধারণ করতে পারে (Swancutt & Mazard, 2018, p. 102)। তাদের শারীরিক রূপে কিছু প্রাণী, যেমন ঈগল, সাপ, জাগুয়ার আর ইঁদুরকেও আত্মা হিসেবে দেখা হয় (Swancutt & Mazard, 2018, p. 102)। আত্মার সাথে সম্পর্কিত বিশ্বাস দিয়ে অনেক ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায় (Hoppál, 2007c, p. 18)। উদাহরণস্বরূপ, গল্প বলার গুরুত্ব, বা গায়ক হিসেবে কাজ করার তাৎপর্য আরও ভালোভাবে বোঝা যায় যদি পুরো বিশ্বাস ব্যবস্থাটা খতিয়ে দেখা হয়। যে মানুষটা অনেক লম্বা কাহিনি বা গান মুখস্থ করতে পারে, আর কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে, তাকে হয়তো আত্মাদের সাথে যোগাযোগের বিশেষ সুবিধা পাওয়া একজন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় (যেমন খান্তি (Khanty) জাতির মানুষেরা) (Hoppál, 2005, p. 99)।
অনুশীলন (Practice)
সাধারণত, শামানরা এক্সিস মুন্ডি (axis mundi) বা জগতের কেন্দ্রবিন্দু দিয়ে যাতায়াত করেন এবং নিজেদের চৈতন্য অবস্থা পাল্টে ফেলে “আত্মার জগতে” প্রবেশ করেন। এটা তারা করতে পারেন হয় নিজেদের সম্মোহিত করে (autohypnotically), অথবা বিশেষ ধরনের গাছগাছড়া (entheogen) ব্যবহার করে, কিংবা কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের (ritual performance) মাধ্যমে ভাবাবেশে (ecstatic trance) গিয়ে (Buenaflor, 2019)। তারা যে সব পদ্ধতি ব্যবহার করেন, সেগুলো বেশ বৈচিত্র্যময়, আর প্রায়শই একাধিক পদ্ধতি একসাথে কাজে লাগানো হয়।
সংগীত এবং গান (Music and songs)
ঠিক যেমন শামানিজম নিজেই নানারকমের (Hoppál, 2005, p. 15), তেমনই বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এর সাথে জড়িত গান আর সুরও অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই, শামানিজমের সাথে সম্পর্কিত গানগুলো তৈরি করা হয় প্রকৃতির বিভিন্ন শব্দ অনুকরণ করে, যাকে বলে ধ্বন্যাত্মক শব্দ (onomatopoeia) (healthCheck, PDF)। যেন প্রকৃতির ভাষাতেই প্রকৃতির সাথে কথা বলা!
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এই যে শব্দ অনুকরণ (sound mimesis) করার ব্যাপারটা, এটা কিন্তু শামানিজমের বাইরেও অন্য অনেক কাজে লাগতে পারে। যেমন, শিকারে পশুপাখিকে আকৃষ্ট করার মতো ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে (Nattiez, n.d., p. 5); অথবা নিছক বিনোদনের জন্য (যেমন ইনুইটদের গলা-গান বা থ্রোট সিংগিং (Inuit throat singing)) (Nattiez, n.d., p. 5; Inuit Throat-Singing, 2015)।
দীক্ষা এবং শিক্ষা (Initiation and learning)
শামানরা প্রায়শই বলেন যে তাদেরকে নাকি স্বপ্ন বা কোনো বিশেষ লক্ষণের মাধ্যমে এই পথে ডাকা হয়েছে। অনেকটা অদৃশ্য কোনো শক্তি যেন তাদেরকে হাত ধরে নিয়ে যায় এই রহস্যময় পথে। তবে, কেউ কেউ আবার বলেন যে তাদের এই ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। ঐতিহ্যবাহী সমাজে শামান হওয়ার জন্য যে প্রশিক্ষণ নিতে হয়, তার সময়কাল বিভিন্ন রকম হতে পারে, তবে সাধারণত এতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। সহজ কাজ নয় মোটেও!
টার্নার এবং তার সহকর্মীরা “শামানিক দীক্ষামূলক সংকট” (shamanistic initiatory crisis) (Turner et al., 1995, p. 440) নামে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। এটা হলো আসলে হবু শামানদের জন্য একটা উত্তরণের আচার (rite of passage), যার মধ্যে সাধারণত শারীরিক অসুস্থতা বা মানসিক সংকট জড়িয়ে থাকে। উত্তর-পূর্ব চীনের তুঙ্গুস জাতির মানুষদের মধ্যে যারা শেষ শামান ছিলেন, তাদের একজন হলেন চুওন্নাসুয়ান (Chuonnasuan)। তার জীবনের ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, শামান হওয়ার ডাকে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে এই দীক্ষামূলক অসুস্থতার একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে (Noll & Shi, 2004)।
আহত আরোগ্যকারী (wounded healer) হলো শামানিক পরীক্ষা আর যাত্রাপথের একটা প্রতীকী চরিত্র। এই প্রক্রিয়াটা তরুণ শামানদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা এমন এক ধরনের অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে যান যা তাদেরকে প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায় নিয়ে যায়। বলা হয়, এটা দুটো কারণে ঘটে (Halifax, 1982):
-
প্রথমত, শামান পাতালপুরীতে (underworld) যান। এটা ঘটে যাতে শামান সেই গভীর থেকে অসুস্থ মানুষ আর তাদের সম্প্রদায়ের জন্য জরুরি তথ্য নিয়ে ফিরতে পারেন। অনেকটা ডুবুরির মতো, যিনি সমুদ্রের অতল থেকে মণিমুক্তো তুলে আনেন।
-
দ্বিতীয়ত, শামানকে অসুস্থতা বোঝার জন্য নিজেকে অসুস্থ হতে হয়। যখন শামান নিজের অসুস্থতা জয় করে ফেলেন, তখন তারা বিশ্বাস করেন যে পৃথিবীর সমস্ত দুঃখকষ্ট সারানোর ক্ষমতা তারা লাভ করেছেন। নিজের যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েই যেন তারা অন্যের যন্ত্রণা অনুভব করতে শেখেন।
আধ্যাত্মিক অনুশীলনে ব্যবহৃত সামগ্রী (Items used in spiritual practice)
শামানরা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে তাদের আধ্যাত্মিক কাজকর্ম সারার জন্য নানারকম জিনিসপত্র ব্যবহার করতে পারেন। যেন একেকজন কারিগরের একেক রকম যন্ত্রপাতি!
সাইবেরিয়ার বেশ কিছু জাতির শামানরা ড্রাম (drum) ব্যবহার করেন (Barüske, 1969, pp. 24, 50-51; Kleivan & Sonne, 1985, p. 25)। ড্রামের শব্দ নাকি শামানকে তার চৈতন্য অবস্থা পাল্টে ফেলতে বা এই চেনা জগৎ আর আত্মাদের জগতের মধ্যে যাতায়াত করতে সাহায্য করে। শামানদের জন্য ড্রামের আওয়াজের (acoustics) যে কী ভূমিকা, তা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। শামানদের ড্রামগুলো সাধারণত একটা বাঁকানো কাঠের কাঠামোর ওপর পশুর চামড়া টেনে বেঁধে তৈরি করা হয়, আর সেই কাঠামোর এপাশ-ওপাশ জুড়ে একটা হাতল লাগানো থাকে।
ভূমিকা (Roles)
শামানদের এমন মানুষ হিসেবে ভাবা হয় যারা কিনা আধ্যাত্মিক জগৎ বা মাত্রায় গিয়ে জ্ঞান আর রোগ সারানোর ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। বেশিরভাগ শামানই নাকি স্বপ্ন বা বিশেষ দর্শন লাভ করেন, যার মাধ্যমে তারা নির্দিষ্ট বার্তা পান। শামানরা বলতে পারেন যে তাদের অনেক আত্মিক পথপ্রদর্শক (spirit guide) আছে বা তারা অর্জন করেছেন, যারা নাকি তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, আত্মার জগতে তাদের যাত্রাপথে পথ দেখান আর পরিচালনা করেন। এই আত্মিক পথপ্রদর্শকরা সব সময় শামানের ভেতরেই থাকেন বলে মনে করা হয়, যদিও কেউ কেউ বলেন যে শামান যখন ঘোরের মধ্যে থাকেন, তখনই কেবল তাদের দেখা পান। আত্মিক পথপ্রদর্শক শামানদের শক্তি জোগান, তাদের আধ্যাত্মিক মাত্রায় প্রবেশ করতে সাহায্য করেন। শামানরা বলেন যে তারা সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং আধ্যাত্মিক মাত্রায় মানুষের জীবাত্মার যে অংশগুলো হারিয়ে গেছে, সেগুলো যেখান থেকেই হোক না কেন, ফিরিয়ে এনে সারিয়ে তোলেন। শামানরা আরও বলেন যে তারা অতিরিক্ত খারাপ শক্তি পরিষ্কার করেন, যা নাকি জীবাত্মাকে বিভ্রান্ত বা দূষিত করে। শামানরা তাদের সংস্কৃতিতে মধ্যস্থতাকারী (mediator) হিসেবে কাজ করেন (Hoppál, 2005, p. 45; Boglár, 2001, p. 24)। শামানরা বলেন যে তারা মৃতদের আত্মা (spirit) সহ সম্প্রদায়ের হয়ে আত্মাদের সাথে কথা বলেন। শামানরা বিশ্বাস করেন যে তারা অস্থিরতা, অমীমাংসিত সমস্যা দূর করতে এবং আত্মাদের কাছে উপহার পৌঁছে দিতে জীবিত আর মৃত – দু’পক্ষের সাথেই যোগাযোগ করতে পারেন।
শামানরা তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে নানারকম কাজ করে থাকেন (Hoppál, 2005, p. 25); যেমন – রোগ সারানো (Hoppál, 2005, pp. 27-28; Sem, Shamanic Healing Rituals), বলিদান পরিচালনা করা (Hoppál, 2005, pp. 28-33), গল্প আর গানের মাধ্যমে ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা (Hoppál, 2005, p. 37), ভাগ্য গণনা করা (Hoppál, 2005, pp. 34-35), আর সাইকোপম্প (psychopomp) বা “জীবাত্মার পথপ্রদর্শক” হিসেবে কাজ করা (Hoppál, 2005, p. 36)। একজন শামান একাই এই সব কাজগুলোর বেশ কয়েকটা করতে পারেন (Hoppál, 2005, p. 25)।
বিভিন্ন ধরনের শামান আছেন যারা আরও বিশেষ ধরনের কাজ করেন। যেমন, নানাই (Nanai) জাতির মানুষদের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের শামান আছেন যিনি সাইকোপম্পের কাজ করেন (Hoppál, 2005, pp. 61-64)। অন্যান্য বিশেষ শামানদের আলাদা করা যেতে পারে তারা কোন ধরনের আত্মার সাথে, বা আত্মার জগতের কোন অংশের সাথে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ করেন, তার ওপর ভিত্তি করে। এই ভূমিকাগুলো নেনেট (Nenets), এনেট (Enets), আর সেল্কুপ (Selkup) শামানদের মধ্যে বিভিন্ন রকম হয় (Hoppál, 2005, pp. 87-95; Shamanism in Siberia: Part III)।
ওরোকেন (Oroqen) শামানের যিনি সহকারী হন (তাকে জারদালানিন (jardalanin) বা “দ্বিতীয় আত্মা” (second spirit) বলা হয়), তিনি এই সব বিশ্বাস সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। তিনি আচার-অনুষ্ঠানের সময় শামানের সাথে থাকেন এবং শামানের কাজকর্মের মানে বুঝিয়ে দেন (Noll & Shi, 2004, p. 10, footnote 10)। এতসব কাজ করা সত্ত্বেও, জারদালানিন কিন্তু নিজে শামান নন। আর এই ব্যাখ্যাকারী সহকারীর জন্য ঘোর বা ট্রেন্সের (trance) মধ্যে চলে যাওয়াটা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ব্যাপার (Noll & Shi, 2004, pp. 8-9)।
শামানিজমের জগৎটা বেশ অদ্ভুত আর রহস্যে ঘেরা। আসুন, এবার সেই জগতের পরিবেশ আর অর্থনীতির দিকটা একটু খোলাসা করে দেখি, আর সাথে এটাও বোঝার চেষ্টা করি যে আজকের দিনে পণ্ডিতরা এই বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন।
পরিবেশগত দিক (Ecological aspect)
শুনলে অবাক হবেন, শামানরা কিন্তু তাদের সম্প্রদায়ের প্রতীকী জ্ঞানের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পরিবেশ বাঁচানোর ব্যাপারেও একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা হয়তো শিকার আর মাছ ধরার ওপর কড়াকড়ি নিয়মকানুন চাপিয়ে দেন। যেমন ধরুন, টুকানো (Tucano) জাতির মানুষদের মধ্যে পরিবেশের সম্পদ সামলানো আর বেশি বেশি শিকার করে যাতে সব শেষ না হয়ে যায়, তার জন্য একটা বেশ জটিল ব্যবস্থা চালু আছে। এই ব্যবস্থাটা দাঁড়িয়ে আছে পৌরাণিক কাহিনি আর প্রতীকী বিশ্বাসের ওপর। তারা মনে করেন, শিকারের নিয়ম ভাঙলে নাকি অসুখ হতে পারে! আর শামানরা তাদের গোপন আস্তানা থেকে শিকারযোগ্য পশু বা তাদের আত্মাকে “ছেড়ে দিতে” পারেন (Reichel-Dolmatoff, 1999; Vitebsky, 1996, p. 107)। পিয়ারোয়া (Piaroa) জাতির মানুষদের শামানিজমের সাথেও পরিবেশ নিয়ে কিছু ভাবনাচিন্তা জড়িয়ে আছে (Boglár, 2001, p. 26)। আবার দেখুন, ইনুইটদের (Inuit) মধ্যে আঙ্গাক্কুক (angakkuq) বা শামানরা দূর-দূরান্ত থেকে শিকারের আত্মা নিয়ে আসেন (Merkur, 1985, p. 5; Vitebsky, 1996, p. 108), অথবা সমুদ্রের দেবীর (Sea Woman) মতো পৌরাণিক চরিত্রের কাছে শিকারের জন্য জীবাত্মা-ভ্রমণ (soul travel) করেন (Kleivan & Sonne, 1985, pp. 27-28)। প্রকৃতির সাথে কী নিবিড় এক সম্পর্ক!
অর্থনীতি (Economics)
শামানরা কীভাবে তাদের পেট চালান আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটান, সেটা কিন্তু একেক সংস্কৃতিতে একেক রকম। অনেক ইনুইট দলে, তারা সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন কাজ করেন আর তার বিনিময়ে একটা “ন্যায্য পারিশ্রমিক” (due payment) পান। তারা আবার বিশ্বাস করেন যে এই পারিশ্রমিকটা আসলে সাহায্যকারী আত্মাদের (helping spirit) কাছে যায় (Merkur, 1985, p. 3)। একটা গল্পে আছে, শামান যে সব উপহার আর টাকা-পয়সা পান, সেগুলো নাকি তার সঙ্গী আত্মা (partner spirit) তাকে দেয়। যেহেতু এই আত্মা শামানকে তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে আর নিয়মিত এই কাজ করতে বাধ্য করে, তাই আত্মা তাকে পাওয়া জিনিসপত্র দিয়ে খুশি রাখে (Oelschlaegel, 2016, p. 206)। তবে এই জিনিসগুলো শুধুমাত্র “বাড়তি পাওনা” (welcome addenda) মাত্র। এগুলো দিয়ে একজন শামান পুরো সময় ধরে শুধু এই কাজ করেই চলতে পারেন না। শামানরা আসলে দলের অন্য যে কোনো সদস্যের মতোই শিকারী বা গৃহবধূ হিসেবে সাধারণ জীবন কাটান। তবে হ্যা, দক্ষিণ আমেরিকায় আজকাল আয়াহুয়াস্কা পর্যটনের (ayahuasca tourism) খুব চল হয়েছে। তাই, ব্যাকপ্যাকাররা যে সব জায়গায় বেশি যান, সেখানে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা এই ধরনের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেই তাদের রুটিরুজি রোজগার করেন (Kleivan & Sonne, 1985, p. 24; Merkur, 1985, p. 3)।
আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, পুরুষদের তুলনায় মহিলা শামানদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে, শামানিজম মহিলাদের অর্থনৈতিক মুক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় ছিল এবং এখনও আছে। কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেওয়ার প্রথা থাকায় শামানিজম প্রায়শই একটা অর্থনৈতিক উৎস হিসেবে কাজ করে। এই অর্থনৈতিক আয় মহিলা শামানদের জন্য খুবই জরুরি ছিল, বিশেষ করে যারা কোরিয়ার চসুন রাজবংশের (Chosun Dynasty) (১৩৯২-১৯১০ খ্রিস্টাব্দ) সময় বেঁচে ছিলেন। এমন একটা সংস্কৃতিতে যেখানে মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে ভালো চোখে দেখা হতো না, সেখানে শামানিজমের চর্চা মহিলাদের আর্থিকভাবে এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছিল, যা তাদের জন্য আগে কখনও সম্ভব ছিল না (Lee, 2009)।
একাডেমিক গবেষণা (Academic study)
জ্ঞানীয় এবং বিবর্তনীয় পদ্ধতি (Cognitive and evolutionary approaches)
শামানিজম কেন টিকে আছে, এই রহস্য ভেদ করার জন্য জ্ঞানীয় (cognitive) আর বিবর্তনবাদী (evolutionary) বিজ্ঞানীরা দুটো প্রধান তত্ত্বের কথা বলেছেন। প্রথমটা দিয়েছেন নৃতত্ত্ববিদ মাইকেল উইঙ্কেলম্যান (Michael Winkelman)। এটাকে বলা হয় “নিউরোথিওলজিক্যাল তত্ত্ব” (neurotheological theory) (Winkelman, 2000; Winkelman, Cambridge Archaeological Journal)। উইঙ্কেলম্যানের মতে, শামানিজম মানব সমাজে এত সহজে ছড়িয়ে পড়েছে কারণ এটা যিনি চর্চা করেন, তার দল এবং তার মক্কেল বা ক্লায়েন্ট – সবার জন্যই বেশ কিছু মূল্যবান সুবিধা বয়ে আনে। বিশেষ করে, নাচ, মতিভ্রমকারী গাছগাছড়া এবং অন্যান্য উদ্দীপক দিয়ে যে ঘোরের (trance) অবস্থা তৈরি করা হয়, সেটার নাকি আমাদের চিন্তা-ভাবনার ওপর একটা “সমন্বিত” (integrative) প্রভাব আছে। এর ফলে আমাদের মনের বিভিন্ন অংশ, যেমন – অন্যের মন বোঝার ক্ষমতা (theory of mind), সামাজিক বুদ্ধি (social intelligence) আর প্রকৃতির জ্ঞান (natural history) – এদের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হয় (Winkelman, 1986)। এই জ্ঞানীয় একীকরণের ফলে, শামান পশুদের গতিবিধি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন, দলের মধ্যে ঝগড়া মেটাতে পারেন, দলবল নিয়ে কোথায় যাবেন তার পরিকল্পনা করতে পারেন, আর অন্যান্য দরকারী কাজও করতে পারেন।
এই নিউরোথিওলজিক্যাল তত্ত্বের সাথে আবার হার্ভার্ডের নৃতত্ত্ববিদ মানভির সিংয়ের (Manvir Singh) দেওয়া শামানিজমের “বাই-প্রোডাক্ট” (by-product) বা “ব্যক্তিগত অনুভূতি-নির্ভর” (subjective) মডেলের একটা বিরোধ আছে (Singh, 2018; Singh, 2018b; Reuell, 2018)। সিংয়ের মতে, শামানিজম হলো একটা সাংস্কৃতিক কৌশল যা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে (বা হ্যাক করে) আমাদেরকে বিশ্বাস করায় যে একজন বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে প্রভাবিত করতে পারেন যা আসলে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না (Singh, 2019)। জাদু আর কুসংস্কারের মনোবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কথা উল্লেখ করে সিং যুক্তি দিয়েছেন যে মানুষ অনিশ্চিত ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় খোঁজে, যেমন – রোগ সারানো, বৃষ্টি নামানো বা পশু আকর্ষণ করা। বিশেষজ্ঞরা যখন তাদের মক্কেলদের এই সব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করার জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করেন, তখন তারা এমন সব জাদুকরী রীতিনীতির জন্ম দেন যা মানুষের মনের গভীরে থাকা পক্ষপাতগুলোর সাথে খাপ খেয়ে যায়। সিংয়ের মতে, শামানিজম হলো এই সাংস্কৃতিক বিবর্তন প্রক্রিয়ারই চূড়ান্ত ফল – অনিশ্চয়তা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা মনস্তাত্ত্বিকভাবে আকর্ষণীয় পদ্ধতি। যেমন, কিছু শামানিক আচার-অনুষ্ঠান আমাদের মানবতা সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে কাজে লাগায়: যারা এই চর্চা করেন, তারা ঘোরের মধ্যে গিয়ে আর নাটকীয় দীক্ষার মাধ্যমে নিজেদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা একটা সত্তা হিসেবে তুলে ধরেন। এর ফলে তাদেরকে সেই সব অদৃশ্য শক্তির সাথে যোগাযোগ করার জন্য আরও বেশি যোগ্য বলে মনে হয়, যারা নাকি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। প্যাসকেল বোয়ার (Pascal Boyer) আর নিকোলাস হামফ্রির (Nicholas Humphrey) মতো প্রভাবশালী জ্ঞানীয় আর নৃতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা সিংয়ের এই মতকে সমর্থন করেছেন (Boyer, 2018; Humphrey, 2018), যদিও অন্য কিছু গবেষক সিংয়ের এই ধারণার সমালোচনা করেছেন যে শামানিজমের কোনো ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সুবিধা নেই (Watson-Jones & Legare, 2018)।
পরিবেশগত পদ্ধতি এবং সিস্টেম তত্ত্ব (Ecological approaches and systems theory)
জেরার্ডো রাইখেল-ডলমাটফ (Gerardo Reichel-Dolmatoff) এই ধারণাগুলোকে আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, আধুনিক বিজ্ঞান (যেমন – সিস্টেম থিওরি, পরিবেশবিদ্যা, নৃতত্ত্ব আর প্রত্নতত্ত্বে নতুন নতুন পদ্ধতি) আজকাল কার্যকারণ সম্পর্ককে আর আগের মতো সরলরৈখিকভাবে দেখে না (Reichel-Dolmatoff, 1999)। তিনি আরও বলেছেন যে আধুনিক বিজ্ঞান আর আদিবাসী জ্ঞানের মধ্যে একটা সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠা উচিত (Reichel-Dolmatoff, 1999)।
ঐতিহাসিক উৎস (Historical origins)
শামানিক আচার-অনুষ্ঠানগুলোর শুরুটা হয়তো সেই প্যালিওলিথিক বা প্রস্তর যুগে, যখন কিনা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা অরগানাইজড রিলিজিয়নের জন্মই হয়নি (Clottes, 2008; Narr, 2008), আর নিশ্চিতভাবেই নিওলিথিক বা নব্য প্রস্তর যুগেও (Narr, 2008) এর অস্তিত্ব ছিল। একজন শামানের সবচেয়ে পুরনো যে অবিসংবাদিত সমাধির খোঁজ পাওয়া গেছে (আর সেই সূত্রে শামান আর শামানিক আচার-অনুষ্ঠানের সবচেয়ে পুরনো অবিসংবাদিত প্রমাণ), সেটা হলো আজকের চেক প্রজাতন্ত্রে, উচ্চ প্রাচীন প্রস্তর বা আপার প্যালিওলিথিক যুগের (প্রায় ৩০,০০০ বছর আগের) (Tedlock, 2005)।
সংস্কৃত পণ্ডিত আর তুলনামূলক পুরাণ বিশেষজ্ঞ মাইকেল উইটজেল (Michael Witzel) মনে করেন যে পৃথিবীর সমস্ত পৌরাণিক কাহিনি, আর শামানদের ধারণা ও আচার-অনুষ্ঠানগুলোর উৎস খুঁজে পাওয়া যেতে পারে দুটো প্রাগৈতিহাসিক জনগোষ্ঠীর অভিবাসনের মধ্যে: একটা হলো “গন্ডোয়ানা” (Gondwana) ধরনের (প্রায় ৬৫,০০০ বছর আগে), আর অন্যটা হলো “লরেশিয়ান” (Laurasian) ধরনের (প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে) (Witzel, 2011)।
নভেম্বর ২০০৮ সালে, জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ইসরায়েলে ১২,০০০ বছরের পুরনো একটা জায়গা আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন, যেটাকে কিনা সবচেয়ে পুরনো শামান সমাধিক্ষেত্রগুলোর একটা বলে মনে করা হচ্ছে। একজন বৃদ্ধা মহিলাকে তার পাশে কাত করে শোয়ানো হয়েছিল, তার পা দুটো ফাঁক করা আর হাঁটুর কাছে ভাঁজ করা ছিল। দশটা বড় পাথর তার মাথা, কোমর আর হাতের ওপর রাখা ছিল। তার সমাধির সাথে পাওয়া অদ্ভুত জিনিসগুলোর মধ্যে ছিল ৫০টা আস্ত কচ্ছপের খোল, একটা মানুষের পা, আর একটা গরুর লেজ ও ঈগলের ডানার মতো কিছু পশুর দেহাংশ। অন্যান্য পশুর অবশেষ এসেছিল শূকর, চিতাবাঘ আর দুটো মার্টেন থেকে। গবেষকরা বলেছেন, “দেখে মনে হচ্ছে, ওই মহিলা… এই সব পশু-আত্মার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে ছিলেন বলে মনে করা হতো।” সমাধিটা ছিল নিম্ন গ্যালিলির একটা গুহায়, যেখানে অন্তত ২৮টা সমাধি পাওয়া গেছে। এগুলো নাটুফিয়ান (Natufian) সংস্কৃতির অংশ, তবে বলা হচ্ছে যে এপিপ্যালিওলিথিক নাটুফফিয়ানদের মধ্যে বা প্যালিওলিথিক যুগে পাওয়া অন্য কোনো সমাধির সাথে এর কোনো মিল নেই (Reuters via Yahoo! News, 2008)।
সংকেততত্ত্ব ও ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতি (Semiotic and hermeneutic approaches)
“শামান” শব্দটার একটা মানে নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে – কেউ কেউ বলেন এর মানে হলো “যিনি জানেন” (Diószegi, 1962, p. 13; Hoppál, 2005, p. 14)। এই কথার মধ্যে আরও অনেক কিছুর সাথে এটাও বোঝায় যে, শামান হলেন সমাজের বিভিন্ন ধরনের সংকেত বা কোডগুলোকে একসাথে ধরে রাখার ব্যাপারে একজন ওস্তাদ। আর ঠিকঠাক কাজ করতে হলে শামানকে তার মনের মধ্যে একটা পরিষ্কার ধারণা রাখতে হয়, যা তাকে জ্ঞানের ব্যাপারে নিশ্চিত করে (Hoppál, 2005, p. 15)। এই মত অনুযায়ী, শামান নানারকম কোড ব্যবহার করেন (আর দর্শকরাও সেটা বোঝেন) – কথা দিয়ে, গান দিয়ে, ছবি এঁকে, নেচে – বিভিন্নভাবে তিনি অর্থ প্রকাশ করেন। তাবিজের (amulet) মতো জিনিসের মাধ্যমেও অর্থ প্রকাশ পেতে পারে (Hoppál, 2005, p. 14)। যদি শামান তার সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি খুব ভালোভাবে জানেন (Boglár, 2001, p. 24; Hoppál, 2005, pp. 25-26, 43; Pentikäinen, 1995, p. 270), আর সেই অনুযায়ী কাজ করেন, তাহলে তার দর্শকরাও ব্যবহৃত প্রতীক আর তার মানেগুলো বুঝবে, আর তাই তারা শামানিক কর্মীর ওপর ভরসা রাখবে (Hoppál, 2005, pp. 25-26, 43)।
শামানিজম নিয়ে সংকেততত্ত্বের (semiotic) দৃষ্টিকোণ থেকে, মানে প্রতীক আর তার অর্থ নিয়ে, কিছু তাত্ত্বিক আলোচনাও (Hoppál, 2005, pp. 13-15, 58, 197; Hoppál, 2006a, p. 11) আছে। সাইবেরিয়ার লোককথার ওপর করা গবেষণায় “পরস্পরবিরোধী প্রতীক” (mutually opposing symbol)-এর উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন, একজন “সাদা” শামান দিনের বেলায় ভালোর জন্য আকাশের আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করেন, আর একজন “কালো” শামান রাতের বেলায় মন্দের জন্য দুষ্ট আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করেন (Hoppál, 2007c, pp. 24-25)। (এই ধরনের পরস্পরবিরোধী প্রতীকগুলোর পেছনে একটা বিশেষ বিশ্বদর্শন কাজ করে। ঠিক যেমন ব্যাকরণ শব্দ সাজিয়ে অর্থ প্রকাশ করে আর একটা জগৎ তৈরি করে, তেমনই এটাও একটা জ্ঞানীয় মানচিত্র (cognitive map) তৈরি করে) (Hoppál, 2005, p. 15; Hoppál, Mihály: Nature worship in Siberian shamanism)। শামানের জ্ঞান তার সম্প্রদায়ের লোককথার মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত থাকে, যা একটা “পৌরাণিক মানসিক মানচিত্র” (mythological mental map) তৈরি করে (Hoppál, 2007b, pp. 12-13; Hoppál, 2007c, p. 25)। জুহা পেনটিকাইনেন “মনের ব্যাকরণ” (grammar of mind) – এই ধারণাটা ব্যবহার করেছেন (Hoppál, 2007c, p. 25; Pentikäinen, 1995, pp. 270-71)।
আরমিন গের্টজ (Armin Geertz) হারমেনিউটিকস (hermeneutics) (Merkur, 1985, p. v) বা ব্যাখ্যার বিজ্ঞান, অথবা “এথনোহারমেনিউটিকস” (ethnohermeneutics) (Hoppál, Mihály: Nature worship in Siberian shamanism) বা জাতিগত ব্যাখ্যার ধারণা তৈরি করেন এবং সবার সামনে তুলে ধরেন। হোপ্পাল এই শব্দটার পরিধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটা শুধু মুখে বলা বা লেখা পাঠ্যবস্তুর ব্যাখ্যাই নয়, বরং “দৃশ্যমান পাঠ্যবস্তুরও (যেমন – নড়াচড়া, অঙ্গভঙ্গি আর আরও জটিল আচার-অনুষ্ঠান, যা কিনা শামানরা পালন করেন) ব্যাখ্যা” (Hoppál, 2007b, p. 13)। এর মাধ্যমে শামানিজমের মধ্যে যে সর্বপ্রাণবাদী (animistic) বা সবকিছুতে আত্মা আছে এমন বিশ্বাস, সেটা যেমন প্রকাশ পায়, তেমনই আজকের দিনের পৃথিবীর সাথে তার প্রাসঙ্গিকতাও ফুটে ওঠে, যেখানে পরিবেশগত সমস্যাগুলো ভারসাম্য আর সুরক্ষার ধারণাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে (Hoppál, 2007c, p. 25)।
চিকিৎসা নৃতত্ত্ব পদ্ধতি (Medical anthropology approaches)
অনেক সমাজেই যেখানে শামানিজম প্রচলিত, সেখানে অসুস্থতা বোঝা আর তার চিকিৎসা করার ব্যাপারটা সামাজিক আর সাংস্কৃতিক রীতিনীতির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। রোগকে সেখানে প্রায়শই শুধু একটা শারীরিক সমস্যা হিসেবে দেখা হয় না, বরং আধ্যাত্মিক আর সামাজিক সম্পর্কের ভারসাম্যের অভাব হিসেবে দেখা হয়। এই সব ক্ষেত্রে শরীরের ধারণাটাও অনেক ব্যাপক – এর মধ্যে শারীরিক, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক দিকগুলোও জড়িয়ে থাকে (Joralemon, 2017)। নৃতত্ত্ববিদ ন্যান্সি শেপার-হিউজেস (Nancy Scheper-Hughes) আর মার্গারেট লক (Margaret Lock) এই ধারণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে “তিনটি শরীর” (the three bodies)-এর কথা বলেছেন: “ব্যক্তিগত শরীর” (individual body), যা আমাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত; “সামাজিক শরীর” (social body), যা স্বাস্থ্যকে সামাজিক আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সাথে জুড়ে দেয়; আর “রাজনৈতিক শরীর” (body politic), যা দেখায় কীভাবে ক্ষমতার কাঠামো স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে (Scheper-Hughes & Lock, 1987)।
নৃতত্ত্ববিদ ডোনাল্ড জোরালেমনের (Donald Joralemon) মতে, চিকিৎসা ব্যাপারটা শামানবাদী সমাজ হোক বা আজকের দিনের বায়োমেডিসিন (biomedicine) – দুটো ক্ষেত্রেই আসলে একটা সামাজিক প্রক্রিয়া (Joralemon, 2017)। জোরালেমন যুক্তি দিয়েছেন যে রোগ সারানোর আচার-অনুষ্ঠান, রোগ নির্ণয় আর চিকিৎসা – এগুলো সবই একটা সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক রীতিনীতি আর সামাজিক প্রত্যাশার মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত থাকে। এটা শামানিজমের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সত্যি, যেখানে শামান শুধু শারীরিক লক্ষণই নয়, অসুস্থতার আধ্যাত্মিক আর সাম্প্রদায়িক দিকগুলোও দেখেন। শামানের ভূমিকা হলো ব্যক্তি আর সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা, আর সেই সব সামাজিক বন্ধনকে আরও মজবুত করা, যেগুলো স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে বলে বিশ্বাস করা হয়। জোরালেমন জোর দিয়ে বলেছেন যে ঐতিহ্যবাহী হোক বা আধুনিক – দুটো চিকিৎসা পদ্ধতিতেই রোগ শুধু একটা শারীরিক ব্যাপার নয়, বরং একটা সামাজিক ঘটনা, যা কিনা যে সাংস্কৃতিক আর সামাজিক পরিবেশে এটা ঘটছে, তার দ্বারাই গঠিত হয় (Joralemon, 2017)।
যেখানে একটা সম্প্রদায়ের মধ্যে শামান থাকেন, সেখানে সেই সম্প্রদায়ই ঠিক করে দেয় যে কে আসল শামান আর কে নয়। সম্প্রদায়ই আবার ঠিক করে যে কেউ অসুস্থ কিনা বা জাদুর দ্বারা অভিশপ্ত কিনা। আর তখনই শামানকে ডাকা হয় সেই অসুস্থতা দূর করার জন্য। শামান কাউকে সারিয়ে তুলেই মহান শামান হয়ে যান না, বরং সম্প্রদায় তাকে মহান শামান হিসেবে চেনে বলেই তিনি মহান। স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে পরিচিত সম্প্রদায়ের সদস্যরাও নাকি অন্যের ব্যক্তিগত কথাবার্তা শুনে তাদের অসুস্থতার খবর রটিয়ে দেন (Lévi-Strauss, 2016)।
অবক্ষয় এবং পুনরুজ্জীবন এবং ঐতিহ্য-সংরক্ষণ আন্দোলন (Decline and revitalization and tradition-preserving movements)
সারা বিশ্বেই নাকি ঐতিহ্যবাহী, আদিবাসী শামানিজম ধীরে ধীরে কমে আসছে। ইনুইট সম্প্রদায়ের সাথে যারা প্রায়শই তিমি ধরতে যেতেন, তারাই নাকি ওই অঞ্চলে এই অবক্ষয়ের একটা বড় কারণ (Oosten, Laugrand & Remie, 2006)। অনেক জায়গায়, যারা আগে শামান ছিলেন, তারা আর তাদের পুরনো কাজগুলো করছেন না। কারণ, তারা হয়তো নিজেদের সম্প্রদায়ের কাছেই হাসির পাত্র হয়েছেন (Boglár, 2001, pp. 19-20), অথবা নিজেদের অতীতকে অবজ্ঞার চোখে দেখছেন আর জাতিতাত্ত্বিকদের কাছে সেই সব নিয়ে কথা বলতে চাইছেন না (Diószegi, 1960, pp. 37-39)।
প্রাক্তন শামানদের ব্যক্তিগত কথাবার্তা ছাড়াও, লোককথার গল্পেও এই অবক্ষয়ের ছবিটা সরাসরি ফুটে ওঠে। যেমন, একটা বুরিয়াত (Buryat) মহাকাব্যে প্রাচীন “প্রথম শামান” কারা-গুর্গানের (Kara-Gürgän) অসাধারণ সব কাজের বর্ণনা আছে (Eliade, 2001, p. 76): তিনি নাকি ঈশ্বরের সাথেও টক্কর দিতে পারতেন, নতুন জীবন তৈরি করতে পারতেন, এমনকি ঈশ্বরের অনুমতি ছাড়াই অসুস্থ মানুষের আত্মা ঈশ্বরের কাছ থেকে চুরি করে ফিরিয়ে আনতে পারতেন! আর একটা পরের লেখায় দুঃখ করে বলা হয়েছে যে পুরনো দিনের শামানরা অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলেন, তাদের নাকি সর্বদর্শনের (omnividence) (Omnividence: এই শব্দটা এডউইন এ. অ্যাবট তার ‘ফ্ল্যাটল্যান্ড’ বইতে তৈরি করেছিলেন) ক্ষমতা ছিল, তারা বহু বছর পরের কথাও বলে দিতে পারতেন, আর বুলেটের মতো দ্রুত ছুটতে পারতেন (Diószegi, 1960, pp. 88-89)।
বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শামানিক আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, সত্যিকারের শামানরা মারা গেছেন, আর তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও তাদের সাথেই হারিয়ে গেছে। স্মৃতি হারিয়ে যাওয়ার দুঃখটা সবসময় এই ভেবে কমে না যে শামানই বুঝি সম্প্রদায়ের একমাত্র মানুষ ছিলেন যিনি স্থানীয় শামানিক বিশ্বাস আর উদ্দেশ্যগুলো জানতেন (Noll & Shi, 2004, pp. 8-9, 10, footnote 10)। যদিও শামানকে প্রায়শই বিশ্বাস করা হয় আর ভরসা করা হয় ঠিক এই কারণে যে তারা সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের সাথে “মানিয়ে নেন” (Hoppál, 2005, pp. 25-26, 43), তবুও স্থানীয় শামানিক জ্ঞানের অনেক অংশই শামানের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা তাদের পারিবারিক জীবনের (Hoppál, 2005, p. 224) ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। তাই, তাদের মৃত্যুর সাথে সাথে সেই জ্ঞানও হারিয়ে যায়। এছাড়াও, অনেক সংস্কৃতিতে পুরো ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস ব্যবস্থাটাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে (প্রায়শই ভাষার আংশিক বা সম্পূর্ণ পরিবর্তনের সাথে সাথে)। যারা এই সব বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠান (বা ভাষাই) মনে রাখতেন, তারা বৃদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, অনেক লোককথা, গান আর কাহিনি বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। এর ফলে, যারা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত নিজেদের বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে পেরেছিলেন, যেমন নগানাসান (Nganasan) উপজাতি, তাদেরও ঐতিহ্য আজ হুমকির মুখে (Nagy, 1998, p. 232)।
কিছু কিছু এলাকা হয়তো তাদের দুর্গমতার কারণে অনেকদিন পর্যন্ত এই অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে পেরেছিল।
-
ইনুইটদের মধ্যে শামানিজমের বিভিন্ন রূপ একসময় খুব ব্যাপক (আর খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ) একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু আজকাল এটা খুব কমই দেখা যায়। এমনকি যখন প্রথম বড় ধরনের জাতিতাত্ত্বিক গবেষণা চালানো হচ্ছিল, তখনও অনেক দলের মধ্যেই এটা কমে আসছিল (Merkur, 1985, p. 132)। যেমন, ইনুইটদের মধ্যে, উনিশ শতকের শেষের দিকে, সাগলোক (Sagloq) নামে একজন আঙ্গাক্কুক ছিলেন, যাকে কিনা শেষ মানুষ বলে বিশ্বাস করা হতো যিনি আকাশে আর সমুদ্রের নিচে ভ্রমণ করতে পারতেন – তিনি মারা যান। আর সেই সময়েই ভেন্ট্রিলোকুইজম (ventriloquism) বা না তাকিয়ে কথা বলার ভান করা আর হাতের কৌশলের (sleight of hand) মতো অনেক পুরনো শামানিক ক্ষমতাও হারিয়ে গিয়েছিল (Merkur, 1985, p. 134)।
-
নগানাসান (Nganasan) জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন অবস্থানের কারণে বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও তাদের মধ্যে শামানিজম একটা জীবন্ত ব্যাপার ছিল (Hoppál, 2005, p. 92)। শেষ উল্লেখযোগ্য নগানাসান শামানের আচার-অনুষ্ঠানগুলো ১৯৭০-এর দশকে ফিল্মে রেকর্ড করা হয়েছিল (Hoppál, 1994, p. 62)।
এমনকি সবচেয়ে দুর্গম এলাকাগুলোতেও যে সাধারণ একটা পতনের ধারা দেখা যাচ্ছে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছু পুনরুজ্জীবন বা ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টাও হচ্ছে। পুরনো স্মৃতিগুলো সংগ্রহ করার (Hoppál, 2005, p. 88) পাশাপাশি, ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার (Hoppál, 2005, p. 93) এবং এমনকি নতুন করে তাকে ফিরিয়ে আনারও (Hoppál, 2005, pp. 111, 117-19, 128, 132, 133-34, 252-63) চেষ্টা চলছে। এই সব চেষ্টা চালাচ্ছেন সত্যিকারের প্রাক্তন শামানরা (যেমন সাখা (Sakha) জাতির মানুষেরা (Hoppál, 2005, pp. 257-58) আর তুভানরা (Tuvan) (Hoppál, 2005, p. 259))।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী আমেরিকানরা তাদের ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক পথকে “শামানিজম” বলেন না। তবে, চেরোকি নেশনের (Cherokee Nation) গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষক রিচার্ড এল. অ্যালেনের (Richard L. Allen) মতে, তাদেরকে প্রায়শই ভুয়া শামানদের (fraudulent shaman) (যাদেরকে “প্লাস্টিক মেডিসিন পিপল” (plastic medicine people) বা নকল ওঝা বলা হয়) সম্পর্কে আর তাদের দ্বারা জিজ্ঞাসিত প্রশ্নে নাজেহাল হতে হয় (Hagan, 2013)। তিনি আরও বলেছেন, “যদি কেউ নিজেকে চেরোকি ‘শামান, আধ্যাত্মিক আরোগ্যকারী, বা পাইপ-বাহক’ বলে দাবি করে, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে সে আজকের দিনের ওষুধ বিক্রির ভ্রাম্যমাণ দোকান আর সাপের তেল বিক্রেতার (snake-oil vendor) মতোই একটা ব্যাপার” (Pseudo Shamans Cherokee Statement, 2008)।
তথ্যসূত্র
- Alberts, T. (2015). Shamanism, Discourse, Modernity. Farnham: Ashgate.
- Archived from the original (https://en.oxforddictionaries.com/definition/shaman) on April 2, 2017.
- Barüske, H. (1969). Eskimo Märchen. Die Märchen der Weltliteratur. Düsseldorf • Köln: Eugen Diederichs Verlag.
- Baums, S., & Glass, A. șamana. gandhari.org. Retrieved March 5, 2024, from https://gandhari.org/dictionary/1șamana
- Boglár, L. (2001). A kultúra arcai. Mozaikok a kulturális antropológia köreiből [The faces of culture. Mosaics from the area of cultural anthropology]. TÁRStudomány. Budapest: Napvilág Kiadó.
- Boyer, P. (2018). Missing links: The psychology and epidemiology of shamanistic beliefs. Behavioral and Brain Sciences, 41, e71.
- Bremmer, J. N. (2002). Travelling souls? Greek shamanism reconsidered. In J. N. Bremmer (Ed.), The Rise and Fall of the Afterlife (pp. 7–40). London: Routledge.
- Buenaflor, E. (2019). Curanderismo Soul Retrieval: Ancient Shamanic Wisdom to Restore the Sacred Energy of the Soul. Simon and Schuster.
- Bumochir, D. (2014). Institutionalization of Mongolian shamanism: from primitivism to civilization. Asian Ethnicity, 15(4), 473–491.
- Chadwick, H. M., & Chadwick, N. K. (1968). The Growth of Literature. The University Press.
- Clottes, J. (2008, March 11). Shamanism in Prehistory. Bradshaw foundation. Archived from the original on April 30, 2008.
- Crossley, P. K. (1996). The Manchus. Blackwell Publishers.
- Diószegi, V. (1960). Sámánok nyomában Szibéria földjén. Egy néprajzi kutatóút története. Terebess Ázsia E-Tár. Budapest: Magvető Könyvkiadó.
- Diószegi, V. (1962). Samanizmus [Shamanism]. Élet és Tudomány Kiskönyvtár. Budapest: Gondolat.
- Eliade, M. (1972). Shamanism, Archaic Techniques of Ecstasy. Bollingen Series LXXVI. Princeton University Press.
- Eliade, M. (1989). Shamanism. Arkana Books.
- Eliade, M. (2001). A samanizmus. Az extázis ősi technikái. Osiris könyvtár. Budapest: Osiris.
- Eliade, M., & Diószegi, V. (2020, May 12). Shamanism. Encyclopædia Britannica. Retrieved May 20, 2020.
- Encyclopædia Britannica. (2018, September 7). Shamanism | religion.
- Gabus, J. (1970). A karibu eszkimók. Gondolat Kiadó. (Original work published 1944 as Vie et coutumes des Esquimaux Caribous, Libraire Payot Lausanne).
- Hagan, H. E. (2013, January 31). The Plastic Medicine People Circle. Sonoma Free County Press. Archived from the original on March 5, 2013.
- Halifax, J. (1982). Shaman: The Wounded Healer. London: Thames & Hudson.
- Hangartner, J. (2011). The Constitution and Contestation of Darhad Shamans’ Power in Contemporary Mongolia. Leiden: Global Oriental.
- Hazlitt. (2018, July 19). Fatal Naming Rituals. Retrieved March 5, 2020.
- Hazlitt. (2020, March 3). Fatal Naming Rituals. Retrieved March 3, 2020. (Referring to Belcourt, B-R. 2018)
- healthCheck. (PDF). Archived from the original (PDF) on April 2, 2015. Retrieved June 6, 2015.
- Hoppál, M. (1994). Sámánok, lelkek és jelképek [Shamans, souls and symbols]. Budapest: Helikon Kiadó.
- Hoppál, M. (1998). A honfoglalók hitvilága és a magyar samanizmus. Folklór és közösség [The belief system of Hungarians when they entered the Pannonian Basin, and their shamanism]. Budapest: Széphalom Könyvműhely.
- Hoppál, M. (2005). Sámánok Eurázsiában [Shamans in Eurasia]. Budapest: Akadémiai Kiadó.
- Hoppál, M. (2006a). Sámánok, kultúrák és kutatók az ezredfordulón [Shamans, cultures and researchers in the millenary]. In M. Hoppál, B. Szathmári, & A. Takács (Eds.), Sámánok és kultúrák [Shamans and cultures]. Budapest: Gondolat.
- Hoppál, M. (2007b). Is Shamanism a Folk Religion?. Shamans and Traditions. Bibliotheca Shamanistica, 13. Budapest: Akadémiai Kiadó.
- Hoppál, M. (2007c). Eco-Animism of Siberian Shamanhood. Shamans and Traditions. Bibliotheca Shamanistica, 13. Budapest: Akadémiai Kiadó.
- Hoppál, M. Nature worship in Siberian shamanism. folklore.ee.
- Humphrey, N. (2018). Shamans as healers: When magical structure becomes practical function. Behavioral and Brain Sciences, 41, e77.
- Hutton, R. (2001). Shamans: Siberian Spirituality and the Western Imagination. TPB.
- Inuit Throat-Singing. (2015, June 6). Retrieved from mustrad.org.uk
- ISSR. (2001, Summer). Abstract online in second half of second paragraph. folkscene.hu.
- Janhunen, J. (1986). Siberian shamanistic terminology. Mémoires de la Société Finno-Ougrienne, 194.
- Joralemon, D. (2017). Exploring Medical Anthropology (4th ed.). Routledge.
- Kehoe, A. B. (2000). Shamans and religion: an anthropological exploration in critical thinking. Prospect Heights, IL: Waveland Press.
- Kleivan, I., & Sonne, B. (1985). Eskimos: Greenland and Canada. Iconography of religions, section VIII, “Arctic Peoples”, fascicle 2. Leiden, The Netherlands: Institute of Religious Iconography • State University Groningen. E.J. Brill.
- Kollmar-Polenz, K. (2012). The Invention of “Shamanism” in 18th Century Mongolian Elite Discourse. Rocznik Orientalistyczny, LXV(1), 90–106.
- Laufer, B. (1917). Origin of the Word Shaman. American Anthropologist, 19, 361–71.
- Lee, J. (2009). Shamanism and Its Emancipatory Power for Korean Women. Affilia, 24(2), 186–198.
- Lévi-Strauss, C. (2016). The sorcerer and his magic. In Understanding and Applying Medical Anthropology. Routledge.
- Lonely Planet. (2014, August 21). Mongolia’s Lost Secrets in Pictures: The Last Tuvan Shaman.
- Merkur, D. (1985). Becoming Half Hidden: Shamanism and Initiation among the Inuit. Acta Universitatis Stockholmiensis • Stockholm Studies in Comparative Religion. Stockholm: Almqvist & Wiksell.
- Nagy, B. B. (1998). Az északi szamojédok [Northern Samoyedic peoples]. In M. Csepregi (Ed.), Finnugor kalauz [Finno-Ugric guide]. Panoráma. Budapest: Medicina Könyvkiadó.
- Narr, K. J. (2008, March 28). Prehistoric religion. Britannica online encyclopedia 2008. Archived from the original on April 9, 2008.
- Nattiez, J. J. (n.d.). Inuit Games and Songs / Chants et Jeux des Inuit. Musiques & musiciens du monde / Musics & musicians of the world. Montreal: Research Group in Musical Semiotics, Faculty of Music, University of Montreal.
- Noll, R., & Shi, K. (2004). Chuonnasuan (Meng Jin Fu), The Last Shaman of the Oroqen of Northeast China. 韓國宗教研究 (Journal of Korean Religions), 6. Seoul KR: 西江大學校 宗教研究所 (Sogang Taehakkyo Chonggyo Yõn’guso).
- Oelschlaegel, A. C. (2016). Plural World Interpretations. Berlin: LIT Verlag Münster.
- Omnividence: A word created by Edwin A. Abbott in his book titled Flatland.
- Oosten, J., Laugrand, F., & Remie, C. (2006). Perceptions of Decline: Inuit Shamanism in the Canadian Arctic. Ethnohistory, 53(3), 445–447.
- Pentikäinen, J. (1995). Saamelaiset: pohjoisen kansan mytologia. Finland: Suomalaisen Kirjallisuuden Seura.
- Price, N. S. (Ed.). (2001). The Archaeology of Shamanism. Routledge.
- Pseudo Shamans Cherokee Statement. (2008, June 23). Retrieved from thepeoplespaths.net
- Reichel-Dolmatoff, G. (1999, July). A View from the Headwaters. The Ecologist, 29(4). Archived from the original on October 27, 2004.
- Reuters via Yahoo! News. (2008, November 4). Earliest known shaman grave site found: study. Archived.
- Reuell, P. (2018). The mystery of the medicine man. Harvard Gazette.
- Rydving, H. (2011). Le chamanisme aujourd’hui: constructions et deconstructions d’une illusion scientifique. Études Mongoles et Siberiennes, Centrasiatiques et Tibétaines, 42(42).
- Salak, K. Hell and Back. National Geographic Adventure. kirasalak.com/Peru.html
- Scheper-Hughes, N., & Lock, M. M. (1987). The Mindful Body: A Prolegomenon to Future Work in Medical Anthropology. Medical Anthropology Quarterly, 1(1), 6–41.
- Sem, T. Shamanic Healing Rituals. Russian Museum of Ethnography. museum.state.il.us/exhibits/changing/journey/healing.html
- Shamanism in Siberia: Part III. Religion: Chapter IX. Types of Shamans. Retrieved June 6, 2015, from sacred-texts.com/sha/sis/sis05.htm
- Singh, M. (2018). The cultural evolution of shamanism. Behavioral & Brain Sciences, 41, e66, 1–61. (Singh 2018 refers to this paper for the general introduction, while specific points from it might be Singh 2018b or Singh 2019)
- Singh, M. (2018b). Why is there shamanism? Developing the cultural evolutionary theory and addressing alternative accounts. Behavioral and Brain Sciences, 41, e92.
- Singh, M. (2019, May 2). Modern shamans: Financial managers, political pundits and others who help tame life’s uncertainty. The Conversation.
- Swancutt, K., & Mazard, M. (2018). Animism beyond the Soul: Ontology, Reflexivity, and the Making of Anthropological Knowledge. New York: Berghahn Books.
- Tedlock, B. (2005). The Woman in the Shaman’s Body: Reclaiming the Feminine in Religion and Medicine. New York: Bantam.
- The Diplomat. (2018, October 19). Welcome to the Tuva Republic. (Referring to Jardine & Kupfer, 2016 for the specific date, but general knowledge by 2018)
- Tomášková, S. (2013). Wayward Shamans: The Prehistory of an Idea. University of California Press.
- Turner, R. P., Lukoff, D., Barnhouse, R. T., & Lu, F. G. (1995). Religious or Spiritual Problem. A Culturally Sensitive Diagnostic Category in the DSM-IV. Journal of Nervous and Mental Disease, 183(7), 435–44.
- Using the United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples in Litigation. (2011). In Reflections on the UN Declaration on the Rights of Indigenous Peoples. Hart Publishing.
- Vitebsky, P. (1996). A sámán. Bölcsesség • hit • mítosz. Budapest: Magyar Könyvklub • Helikon Kiadó.
- Watson-Jones, R. E., & Legare, C. H. (2018). The social functions of shamanism. Behavioral and Brain Sciences, 41, e88.
- Wilbert, J., & Vidal, S. M. (2004). In N. L. Whitehead & R. Wright (Eds.), In Darkness and Secrecy: The Anthropology of Assault Sorcery and Witchcraft in Amazonia. Durham, NC: Duke University Press.
- Winkelman, M. (1986). Trance states: A theoretical model and cross-cultural analysis. Ethos, 14(2), 174–203.
- Winkelman, M. (2000). Shamanism: The neural ecology of consciousness and healing. Westport, CT: Bergen & Gavey.
- Winkelman, M. (n.d.). Shamanism and cognitive evolution. Cambridge Archaeological Journal, 12(1), 71–101. (Though undated in OCR, citation 86 suggests 2002 for this specific paper)
- Witzel, M. (2011). Shamanism in Northern and Southern Eurasia: their distinctive methods and change of consciousness (PDF). Social Science Information, 50(1), 39–61.
- Znamensky, A. A. (2005). Az ősiség szépsége: altáji török sámánok a szibériai regionális gondolkodásban (1860–1920). In Á. Molnár (Ed.), Csodaszarvas. Őstörténet, vallás és néphagyomány, Vol. I. Budapest: Molnár Kiadó. (Cited via Hoppál, 2005 for image caption verification)
Leave a Reply