আমেরিকা বনাম চীন: এক দীর্ঘ বাণিজ্য যুদ্ধের ইতিবৃত্ত

শুরুটা হয়েছিল ফিসফাস দিয়ে, প্রশান্ত মহাসাগরের এপার-ওপার জুড়ে। আমেরিকার পুরনো কারখানা শহরগুলোতে কানাঘুষা চলত হাওয়া হয়ে যাওয়া চাকরি আর সস্তায় বাজার ছেয়ে ফেলা ‘মেড ইন চায়না’ ছাপ মারা জিনিস নিয়ে। ওদিকে বেইজিংয়ের ঝকমকে বাজারেও একটা গুঞ্জন ছিল – এক নতুন উঠতি শক্তির অহংকার আর সন্দেহ, বুঝি তাদের এই উত্থান দূর দেশের কেউ ভালো চোখে দেখছে না। এই ফিসফাস, এই গুঞ্জনই যেন একসময় ঝড়ের রূপ নিল, ২০১৮ সালে, যখন আমেরিকার এক একরোখা নতুন নেতা ঠিক করলেন, বিশ্ব বাণিজ্যের পুরনো নিয়মগুলো নতুন করে লিখবেন। আর এভাবেই শুরু হলো মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ – অর্থনীতি, রাজনীতি আর প্রযুক্তির এক আধুনিক মহাকাব্য, যা দুটো দেশকেই আমূল বদলে দিয়েছে, আর রেখে গেছে এক দীর্ঘশ্বাস।

এই ঝগড়ার বীজ কিন্তু বোনা হয়েছিল বহু বছর ধরে, যখন দুটো দেশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছিল। ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (World Trade Organization) যোগ দেওয়ার পর থেকে দুই দেশের বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠল। আমেরিকার মানুষ পেল সস্তা জিনিস, আর চীনের কলকারখানাগুলো হয়ে উঠল আরও ব্যস্ত। কিন্তু এই মুদ্রার উল্টো পিঠে ছিল বেদনাও। আমেরিকার মধ্য-পশ্চিম আর দক্ষিণের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, মানুষের মনে হতে লাগল চীনের এই রকেট গতির উত্থান বুঝি আমেরিকার বুকের ওপর দিয়েই হচ্ছে (Hass & Denmark, 2020)। অর্থনীতিবিদরা এর নাম দিলেন ‘চায়না শক’ (China Shock) – যেন চীনের সস্তা পণ্যের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে গোটা মার্কিন মুলুক, আর তার সাথে মানুষের রুজি-রোজগার। এই ক্ষোভ থেকেই জন্ম নিল এক ধরনের জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির, যা ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প কাজে লাগালেন। তিনি চীনের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বাণিজ্য ঘাটতি (trade deficit) – অর্থাৎ আমেরিকা যা আমদানি করে তার থেকে রপ্তানি কম হওয়া – নিয়ে তিনি সরব হলেন, আর বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে মেধাস্বত্ব চুরির (intellectual property theft) মতো গুরুতর অভিযোগ আনলেন। মার্কিন কর্মকর্তাদের হিসেবে, চীনের প্রযুক্তি হস্তান্তর (tech transfer) – অর্থাৎ প্রায়শই চাপের মুখে প্রযুক্তি জ্ঞান হাতিয়ে নেওয়া – এবং মেধাস্বত্ব চুরির কারণে আমেরিকার বছরে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছিল (Mistreanu, 2025)। চীনের উচ্চাভিলাষী শিল্প পরিকল্পনা ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ (Made in China 2025) – যার লক্ষ্য ছিল আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বে সেরা হওয়া – ওয়াশিংটনের ভয় আরও বাড়িয়ে দিল। তাদের মনে হলো, বুঝি প্রযুক্তির দুনিয়ায় তাদের একক রাজত্ব এবার শেষ হতে চলল।

২০১৮ সালের শুরুতে কথার লড়াই সত্যিকারের যুদ্ধের রূপ নিল। আমেরিকা প্রথম গোলা দাগল – চীনের সৌর প্যানেল আর ওয়াশিং মেশিনের ওপর বসাল মোটা অঙ্কের শুল্ক (tariffs), অর্থাৎ আমদানি কর। বেইজিংও ছেড়ে কথা বলল না। তারাও আমেরিকার ফল, বাদাম আর ওয়াইনের ওপর পাল্টা শুল্ক বসাল – যেন বুঝিয়ে দিল, ছোট্ট একটা আঘাতও তারা বিনা জবাবে ছেড়ে দেবে না (Mistreanu, 2025)। কয়েক মাসের মধ্যেই এই টিট ফর ট্যাট বা ‘ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’ অবস্থাটা ভয়াবহ রূপ নিল। আমেরিকা চীনের প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রপাতি আর শিল্পাংশের ওপর শুল্ক চাপাল; চীনও তার উত্তর হিসেবে আমেরিকার সয়াবিন, উড়োজাহাজ আর গাড়ির ওপর সমপরিমাণ শুল্ক বসিয়ে দিল। দুই পক্ষই ভাবছিল, অন্য পক্ষ বুঝি এবার নুয়ে পড়বে। কিন্তু কেউই দমল না। ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ আমেরিকা চীনের প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের ওপর আর চীন আমেরিকার ১১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের ওপর শুল্ক চাপিয়ে বসেছিল। এগুলো আর ছোটখাটো আঁচড় ছিল না, বরং বড় বড় শিল্পের ওপর ছিল দগদগে ঘা।

আমেরিকার কৃষকেরা এই যুদ্ধের আঁচ প্রথম টের পেলেন। চীন একসময় আমেরিকার সয়াবিনের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল। তারা যখন সয়াবিন কেনা প্রায় বন্ধ করে দিল, সয়াবিনের দাম পড়ে গেল হু হু করে, অবিক্রিত ফসলের স্তূপ জমতে লাগল। আমেরিকার এক কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “চীনে আমাদের ২৪ বিলিয়ন ডলারের যে বিশাল বাজার ছিল, কৃষকেরা তার প্রায় পুরোটাই হারিয়েছেন” (Hass & Denmark, 2020)। অনেক কৃষককে সরকারি সাহায্যে টিকে থাকতে হয়েছে। কলকারখানা আর মালবাহী কোম্পানিগুলোর ব্যবসাও মন্দা হয়ে গেল, কারণ আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম বেড়ে গিয়েছিল আর চীনের দিক থেকে চাহিদাও কমে গিয়েছিল। ২০১৯ সাল নাগাদ আমেরিকার শিল্পোৎপাদন গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছাল, আর ব্যবসায়িক বিনিয়োগ প্রায় থেমেই গেল (Hass & Denmark, 2020)। এক সাংবাদিক তো ঠাট্টা করে লিখেছিলেন, ট্রাম্পের এই শুল্কের বোঝা আসলে আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম বড় একটা ট্যাক্স বৃদ্ধির সামিল – শুধুমাত্র এই ট্যাক্সটা দিচ্ছিল খোদ মার্কিনিরাই, চড়া দামের মাধ্যমে (Hass & Denmark, 2020)। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শুল্কের বেশিরভাগ বোঝাই বহন করতে হয়েছে আমেরিকার কোম্পানি আর সাধারণ মানুষকে, হয় বেশি দাম দিয়ে অথবা কম লাভের মাধ্যমে। এতে প্রমাণ হয়ে যায় যে বাণিজ্য যুদ্ধ জেতা অতটা সহজ কাজ নয় (Hass & Denmark, 2020)।

প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারে, চীনের কর্মকর্তারা মুখে শান্ত কিন্তু দৃঢ় ভাব বজায় রাখলেন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং শুরুতেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, “বাণিজ্য যুদ্ধ বা শুল্ক যুদ্ধে কেউই জেতে না,” তিনি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর জোর দিয়েছিলেন (Wu & Ghosal, 2025)। কিন্তু পর্দার আড়ালে বেইজিং ঝড়ের জন্য তৈরি হচ্ছিল। চীনের রপ্তানি কেন্দ্রগুলোর কারখানাগুলো টের পেতে শুরু করল মার্কিন অর্ডার কমে যাওয়ার ধাক্কা। ২০১৯ সালে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াল প্রায় ৬.১ শতাংশে – যা ছিল গত প্রায় ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল – আর এর পেছনে বাণিজ্য যুদ্ধকেই দায়ী করা হলো (Qiu & Yao, 2020)। তবুও, চীন সরকার তাদের মূল নীতি থেকে একচুলও নড়ল না। বরং, তারা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়িয়ে এবং নতুন বাণিজ্য সহযোগী খুঁজে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করল। মজার ব্যাপার হলো, ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বেইজিং কিন্তু অন্যান্য দেশের জন্য শুল্ক কমিয়ে দিয়েছিল, যাতে আমেরিকার বাজার হারানোর ক্ষতিটা ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা বা অন্য কোনো অঞ্চল থেকে পুষিয়ে নেওয়া যায় (Hass & Denmark, 2020)। বার্তাটা ছিল পরিষ্কার: চীন দরকার হলে স্বল্পমেয়াদী কষ্ট সইবে, কিন্তু বিদেশি চাপের মুখে নিজেদের নীতি বিসর্জন দেবে না।

যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন মাঝে মাঝে আলোচনার গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছিল। ২০১৮ সালের শেষের দিকে, এক উত্তপ্ত জি-২০ সম্মেলনের পর, ওয়াশিংটন আর বেইজিং একটা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলো – ৯০ দিনের জন্য নতুন কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না, এই সময়ে একটা চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। আশা জেগেছিল অনেকের মনে; বিশ্বজুড়ে শেয়ার বাজারগুলোও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু এই যুদ্ধবিরতি ছিল ঠুনকো। ২০১৯ সালের মে মাস নাগাদ আলোচনা ভেস্তে গেল, দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ আনল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যিনি কি না কখনোই বাড়িয়ে বলতে ছাড়তেন না, টুইট করলেন যে চীন “চুক্তি ভেঙেছে,” অন্যদিকে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানাল যে আমেরিকা নাকি বাড়াবাড়ি রকমের দাবি জানাচ্ছে। শুল্কের গোলাগুলি আবার পুরোদমে শুরু হলো: সে মাসেই আমেরিকা ২০০ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ১০% থেকে বাড়িয়ে ২৫% করে দিল, কারণ আলোচনা ভেস্তে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, যেন দুই পক্ষই কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার কামানে নতুন গোলা ভরেছে।

এই শুল্কের যুদ্ধের মধ্যেই বাণিজ্য যুদ্ধটা ধীরে ধীরে আরও বড় কিছুর দিকে মোড় নিচ্ছিল – দুই দেশের জাতীয় ইচ্ছা আর রাষ্ট্রব্যবস্থার এক ব্যাপক লড়াই। ট্রাম্পের লক্ষ্য শুধু বাণিজ্য ঘাটতি কমানো ছিল না; তার প্রশাসন চেয়েছিল চীন যেন তাদের কিছু দীর্ঘদিনের চর্চা বদলে ফেলে, যা নিয়ে মার্কিন ব্যবসায়ীরা বহুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিল: জোর করে প্রযুক্তি হস্তান্তর (forced technology transfer) – অর্থাৎ চীনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের তাদের প্রযুক্তির গোপন তথ্য জানাতে বাধ্য করা, বাজারে প্রবেশের সীমাবদ্ধতা, শিল্প খাতে সরকারি ভর্তুকি, আর দেদারসে মেধাস্বত্ব চুরি (Hass & Denmark, 2020)। বছরের পর বছর ধরে এই বিষয়গুলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শান্তশিষ্ট মিটিংয়ে আলোচনা হতো। এখন সেগুলো নিয়ে খোলাখুলি যুদ্ধ হচ্ছিল। ট্রাম্পের দল বিশ্বাস করত, চূড়ান্ত চাপ দিলে বেইজিং নতি স্বীকার করবে। কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা, যাদের ইতিহাসে বিদেশি “অপমান” প্রতিরোধের নজির রয়েছে, তারা কোনো আলটিমেটামের কাছে মাথা নোয়াতে নারাজ ছিলেন। চীনের আলোচকেরা কিছু কৌশলগত ছাড় দিয়েছিলেন – যেমন আরও বেশি মার্কিন জ্বালানি ও কৃষি পণ্য কেনার প্রস্তাব – কিন্তু এমন কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন মানতে রাজি হননি যা তাদের রাষ্ট্র-চালিত অর্থনৈতিক মডেলকে দুর্বল করে দেবে।

২০১৯ সালের মাঝামাঝি নাগাদ অচলাবস্থা স্পষ্ট হয়ে গেল। দুটো দেশ যেন দুই পোড় খাওয়া কুস্তিগীর, যারা একে অপরকে জাপটে ধরেছে, কিন্তু কেউই কাউকে মাটিতে ফেলতে পারছে না। পরিস্থিতি বদলাতে ট্রাম্প একটা নতুন ফ্রন্ট খুললেন: প্রযুক্তি যুদ্ধ (technological warfare)। জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ওয়াশিংটন চীনের টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়েকে (Huawei) কালো তালিকাভুক্ত করল, যার ফলে হুয়াওয়ে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন কম্পিউটার চিপ কিনতে পারছিল না (Mistreanu, 2025)। হুয়াওয়ে – বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫জি নেটওয়ার্ক সরবরাহকারী – হঠাৎ করেই মার্কিন সফটওয়্যার আর সিলিকন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, যা তাদের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপর এক মারাত্মক আঘাত ছিল। আমেরিকা তার মিত্র দেশগুলোকেও চাপ দিতে লাগল যেন তারা তাদের ৫জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ের সরঞ্জাম ব্যবহার না করে, এই বলে যে হুয়াওয়ের যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চীন গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে পারে। অনেকেই সেই ডাকে সাড়া দিল: জাপান থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশ ওয়াশিংটনের কথায় হুয়াওয়েকে তাদের ৫জি নেটওয়ার্ক থেকে নিষিদ্ধ করল (Berman et al., 2023)। বেইজিং এতে ক্ষিপ্ত হলো। চীনের চোখে, এটা ছিল নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের প্রযুক্তিগত উত্থানকে থামিয়ে দেওয়ার একটা নির্লজ্জ চেষ্টা। চীনা কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রকে “হুয়াওয়ে-ফোবিয়া”য় আক্রান্ত বলে অভিযুক্ত করলেন এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনের পরিকল্পনা আরও জোরদার করলেন। এই নাটকের একটা ব্যক্তিগত দিকও ছিল: যখন হুয়াওয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে আমেরিকার অনুরোধে কানাডায় গ্রেপ্তার করা হলো, তখন একটা কূটনৈতিক সংকট তৈরি হলো, এবং চীন এর প্রতিশোধ হিসেবে বিদেশি নাগরিকদের আটক করল। বাণিজ্য যুদ্ধটা একটা প্রযুক্তি যুদ্ধে রূপ নিল, সয়াবিন আর স্টিলের যুদ্ধক্ষেত্র প্রসারিত হয়ে মাইক্রোচিপ আর স্মার্টফোন পর্যন্ত পৌঁছে গেল।

২০১৯ সাল যখন ২০২০-এর দিকে গড়াচ্ছে, এই অর্থনৈতিক লড়াইয়ের মাসুল স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা আমেরিকা-চীন নাটকের প্রতিটি মোড় দেখছিল যেন কোনো ট্রেন দুর্ঘটনার আশঙ্কায়। আর অনেক দিক দিয়েই এটা একটা দুর্ঘটনাই ছিল: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) সতর্ক করে দিয়েছিল যে এই বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি গত অর্থনৈতিক সংকটের পর থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, ২০১৯ সালের জন্য তাদের পূর্বাভাস কমিয়ে মাত্র ৩.০% করা হয়েছিল (Lawder & Shalal, 2019)। আইএমএফ হিসাব করে দেখাল যে ২০২০ সাল নাগাদ এই শুল্ক আর অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৭০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে – যেন কেউ সুইজারল্যান্ডের পুরো অর্থনীতিটাই মুছে ফেলেছে (Lawder & Shalal, 2019)। একসময় যে সরবরাহ শৃঙ্খল (supply chains) অনায়াসে সীমান্ত পেরিয়ে যেত, তা এই চাপের মুখে ছিঁড়ে যেতে শুরু করল। কিছু আমেরিকান কোম্পানি, শুল্কের ভয়ে, তাদের সরবরাহ শৃঙ্খল ভিয়েতনাম, মেক্সিকো বা থাইল্যান্ডের মতো দেশে সরিয়ে নিতে শুরু করল – এটা ছিল সরবরাহ শৃঙ্খল বিচ্ছিন্নকরণের (supply chain decoupling) প্রাথমিক পর্যায়, অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো একটি দেশের ওপর থেকে নির্ভরতা কমানো। চীনা রপ্তানিকারকেরাও, শুল্ক এড়াতে, তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পণ্য পাঠানোর চেষ্টা করল, অথবা কিছু কারখানা বন্ধুভাবাপন্ন দেশে সরিয়ে নিল। স্বল্পমেয়াদে, এই বিশৃঙ্খলার মানে ছিল বাড়তি খরচ আর বিভ্রান্তি – মার্কিন সংস্থাগুলো নতুন সরবরাহকারী খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছিল এবং পণ্যের ঘাটতির মুখে পড়ছিল, আর চীনা কারখানাগুলো অর্ডার কমে যাওয়ায় সমস্যায় পড়ছিল। এক অর্থনীতিবিদ সতর্ক করে বলেছিলেন, “মূল্য দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন,” কারণ এই পরিবর্তনগুলোর ফলে মূল্যস্ফীতি (inflation) বা জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে এবং অদক্ষতা দেখা দেবে, যা হবে এক নতুন বাস্তবতার দাম (Bown, 2022)। সত্যি বলতে, আমেরিকা আর চীনের মধ্যে বাণিজ্য কমলেও, বাকি বিশ্ব থেকে আমেরিকার আমদানি বেড়ে গিয়েছিল, যা কিছুটা হলেও ঘাটতি পূরণ করেছিল (Bown, 2022)। যেন এক খালের জল আটকে দিলে তা অন্য খালে বইতে শুরু করে।

জানুয়ারি ২০২০-তে, এই অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেই, একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল: একটা যুদ্ধবিরতি। বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে আমেরিকা আর চীন একটা “প্রথম দফা” (Phase One) বাণিজ্য চুক্তি সই করল। হোয়াইট হাউসের জমকালো অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটাকে একটা অসাধারণ চুক্তি বলে অভিহিত করলেন, আর চীনের আলোচক, উপ-প্রধানমন্ত্রী লিউ হে, প্রেসিডেন্ট শি-র বার্তা পৌঁছে দিলেন যে সহযোগিতাই একমাত্র পথ। চুক্তিটা আসলে ছিল পরে আরও আলোচনার একটা চুক্তি। চীন পরের দুই বছরে অতিরিক্ত ২০০ বিলিয়ন ডলারের আমেরিকান পণ্য – সয়াবিন থেকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত – কেনার প্রতিশ্রুতি দিল, আর মেধাস্বত্ব সুরক্ষা জোরদার করার ব্যাপারে কিছু অস্পষ্ট আশ্বাস দিল (Mistreanu, 2025)। আমেরিকাও এর বিনিময়ে নতুন শুল্ক আরোপ বন্ধ করল এবং কিছু শুল্ক অর্ধেক কমিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল, এটা বুঝি অনেক কষ্টের পর অর্জিত একটা যুদ্ধবিরতি। কিন্তু শুভংকরের ফাঁকিটা ছিল চুক্তির বিস্তারিত বিবরণে। সমালোচকেরা বললেন যে কেনার লক্ষ্যমাত্রাগুলো অবাস্তব রকমের বেশি, আর চীন কঠিন কাঠামোগত বিষয়গুলোতে কোনো ছাড় দেয়নি। সত্যিই, ২০২১ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষে দেখা গেল, চীন প্রতিশ্রুত মার্কিন পণ্যের মাত্র ৬০% কিনেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম (Bown, 2022)। আর সেইসব কাঁটাযুক্ত বিষয় যেমন ভর্তুকি আর রাষ্ট্র পরিচালিত কোম্পানি? সেগুলো ভবিষ্যতের দ্বিতীয় দফার জন্য রেখে দেওয়া হলো, যা আর কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। তবুও, কিছুক্ষণের জন্য হলেও, বিশ্ব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। আঠারো মাসের লড়াইয়ের পর, হয়তো দৈত্যরা অবশেষে শান্তি স্থাপন করবে।

কিন্তু নিয়তির মনে অন্য কিছু ছিল। প্রথম দফার চুক্তির মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিকে ওলটপালট করে দিল। বাণিজ্য যুদ্ধ হঠাৎ করেই এক আরও ভয়াবহ সংকটের ছায়ায় ঢাকা পড়ল। কিন্তু ভাইরাস যখন কলকারখানা আর বন্দর বন্ধ করে দিচ্ছিল, তখনও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধিকিধিকি করে জ্বলছিল। বরং, মহামারী দুটো দেশকেই একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে আরও বেশি সন্দিহান করে তুলল। আমেরিকান নীতিনির্ধারকেরা খালি দোকানের তাক আর চীন থেকে আসা জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলেন; সরবরাহ শৃঙ্খল দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি আরও জোরালো হলো। চীনেও কানাঘুষা ছড়াল যে আমেরিকা হয়তো মহামারীর বিশৃঙ্খলার আড়ালে চীনকে আরও একঘরে করার চেষ্টা করবে, যা প্রযুক্তি আর খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতার পরিকল্পনাকে ত্বরান্বিত করল। প্রকাশ্য শত্রুতার এই বিরতি বিশ্বাস পুনরুদ্ধারে তেমন কোনো কাজেই এল না। যখন তাৎক্ষণিক আতঙ্কটা কমল, বাণিজ্য যুদ্ধের অঙ্গার তখনও জ্বলজ্বল করছিল।

২০২১ সালে, আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট, জো বাইডেন, দায়িত্ব নিলেন। কেউ কেউ আশা করেছিলেন তিনি হয়তো এই হিমশীতল বাণিজ্য সম্পর্কের বরফ গলাবেন। বাইডেনের কথার সুর অবশ্যই অন্যরকম ছিল – আরও সংযত, কম আক্রমণাত্মক – কিন্তু আদতে তিনি অবরোধ তোলেননি। চীনে মার্কিন নীতির ব্যাপারে বিরল এক দ্বিদলীয় ঐকমত্য দেখে বাইডেন ট্রাম্পের চাপানো প্রায় ৩৬০ বিলিয়ন ডলারের শুল্ক বহাল রাখলেন (Hass & Denmark, 2020)। সত্যি বলতে, তিনি কিছু ক্ষেত্রে আরও কড়া অবস্থান নিলেন: ধুঁকতে থাকা মার্কিন শিল্পগুলোকে বাঁচাতে বাইডেন চীনের ইস্পাত আর অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক বাড়ালেন, আর আমেরিকার সবুজ প্রযুক্তি শিল্পকে চাঙ্গা করতে তিনি চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর শুল্ক চারগুণ করে দিলেন (Hunnicutt et al., 2024)। এরই মধ্যে, বাইডেন প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী আক্রমণ শুরু করলেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে, ওয়াশিংটন এমন ব্যাপক রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি করল যাতে চীন অত্যাধুনিক সেমিকন্ডাক্টর (semiconductors) এবং চিপ তৈরির সরঞ্জাম থেকে বঞ্চিত হয় – কার্যত চীনকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আর সুপারকম্পিউটারের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক কম্পিউটার চিপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো (Schuman, 2022)। এটা ছিল চীনের প্রযুক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার মূলে এক সাহসী, সম্ভবত নজিরবিহীন আঘাত। এক ভাষ্যকার এটাকে চীনের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ওপর “হাতুড়ির ঘা” মারার সাথে তুলনা করেছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল প্রযুক্তিগত সমতার দিকে বেইজিংয়ের অগ্রযাত্রাকে মন্থর করা (Schuman, 2022)। মার্কিন কর্মকর্তারা খোলাখুলিই বললেন যে তারা শুধু খেলার মাঠ সমান করছেন না; তারা গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে চীনের চেয়ে বছরের পর বছর এগিয়ে থাকতে চাইছেন। বেইজিং ক্ষুব্ধ হয়ে একে প্রযুক্তিগত সন্ত্রাসবাদ বলে অভিহিত করল। তবুও, প্রতিবাদের পাশাপাশি চীন নিজেদের চিপ গবেষণা আর স্টার্টআপ সংস্থাগুলোতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালতে লাগল, পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা শেষ পর্যন্ত ভাঙার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে।

ভূ-রাজনৈতিক দাবার ছকও বদলেছিল। আমেরিকা চীনের চারপাশে সমমনা অংশীদারদের একটা জাল তৈরি করতে চাইল: ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আরও অনেকে, যারা চীনের বাণিজ্য নীতি এবং দ্রুত সামরিক অগ্রগতি নিয়ে আমেরিকার মতোই উদ্বিগ্ন ছিল। তারা একসাথে চীনা বিনিয়োগ এবং সংবেদনশীল প্রযুক্তির রপ্তানির ওপর নজরদারি কঠোর করল। ওয়াশিংটন এমনকি চীনের সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্ত প্রযুক্তি খাতে কিছু মার্কিন বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করার নতুন নিয়মও পাস করল (Hass & Denmark, 2020)। চীন দেখল এটা তাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা; আমেরিকা দেখল বিচক্ষণ আত্মরক্ষা। এই পরিবেশে, এমনকি সাধারণ অ্যাপগুলোও রেষারেষির গুটি হয়ে উঠল। চীনা মালিকানাধীন অ্যাপ টিকটক (TikTok), যা আমেরিকান কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয়, ২০২০ সালে ট্রাম্পের দ্বারা নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। বাইডেনের অধীনে চাপ আরও বাড়ল – ২০২৩ সাল নাগাদ আমেরিকা টিকটকের চীনা মূল কোম্পানিকে অ্যাপটি কোনো আমেরিকান কোম্পানির কাছে বিক্রি করার অথবা নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়ার দাবি জানাচ্ছিল, যে আদেশের ফলে আইনি চ্যালেঞ্জ এবং বেইজিং থেকে “গুণ্ডামি”-র আরও জোরালো অভিযোগ উঠল (Hass & Denmark, 2020)। মনে হচ্ছিল, এমন কোনো ক্ষেত্র বাকি নেই যেখানে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়া পড়েনি।

২০২০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, “বিযুক্তকরণ” (decoupling) – অর্থাৎ চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা – এই আলোচনা প্রান্তিক নীতি নির্ধারকদের গণ্ডি পেরিয়ে মূলধারার বিতর্কে চলে এল। যা কয়েক বছর আগেও অকল্পনীয় শোনাত, তা এখন বোর্ডরুম এবং সরকারি অফিসে খোলাখুলি আলোচনা হচ্ছিল: বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতি কি সত্যিই তাদের পারস্পরিক নির্ভরতা ছিন্ন করতে পারবে? উত্তরটা মনে হচ্ছিল হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে – তবে তার জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে। বাণিজ্য তথ্য একটা মিশ্র চিত্র তুলে ধরছিল। বাণিজ্য যুদ্ধের তুঙ্গে চীন থেকে মার্কিন আমদানি তীব্রভাবে কমে গিয়েছিল এবং ২০২২ সাল নাগাদ সবেমাত্র যুদ্ধের আগের স্তরে ফিরে এসেছিল (Bown, 2022)। মার্কিন আমদানিতে চীনের অংশ কমে গিয়েছিল, তার জায়গা নিয়েছিল অন্যান্য দেশ (Bown, 2022)। আমেরিকান কোম্পানিগুলো সরবরাহকারী পরিবর্তন করছিল, আর চীনা রপ্তানিকারকেরা নতুন বাজার খুঁজে নিচ্ছিল। তবুও অন্যান্য দিক দিয়ে দুটো অর্থনীতি তখনও অবিচ্ছেদ্য ছিল। চীন তখনও আমেরিকার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার ছিল, এবং অনেক পণ্য – স্মার্টফোন থেকে আসবাবপত্র পর্যন্ত – তাদের যাত্রাপথের কোনো না কোনো পণ্য  চীনা সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। একটা সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ যে একটা ঝগড়ার চেয়ে অনেক বেশি জটিল, তা প্রমাণিত হচ্ছিল। এক বিশ্লেষক তো ঠাট্টা করে বলেছিলেন, আমেরিকা আর চীন একটা শক্ত “অর্থনৈতিক আলিঙ্গনে” (economic embrace) আবদ্ধ, যা হয়তো আলগা হচ্ছে কিন্তু পুরোপুরি ছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব (Bown, 2022)। দুটো দেশই আবিষ্কার করল যে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল, লতানো গাছের মতো, অনেক দেশকে জড়িয়ে ধরেছে – একটা লতা ছিঁড়লে দেখা যাবে সেটা অন্য কোথাও গজিয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন শুল্কের কারণে চীনা তৈরি ইলেকট্রনিকস দামি হয়ে গেলেও, ভিয়েতনাম আর মেক্সিকো থেকে ওইসব পণ্যের আমদানি বেড়ে গেল – প্রায়শই সেগুলো চীনা সম্পর্কযুক্ত বা চীনা যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি কারখানায় তৈরি হতো, শুধু জায়গাটা বদলে গিয়েছিল। কার্যত, বাণিজ্য নিজের পথ খুঁজে নিয়েছিল, বিযুক্তকরণের প্রচেষ্টাকে ভোঁতা করে দিয়েছিল। আর স্বনির্ভরতার এত কথার পরেও, চীন তখনও গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ প্রযুক্তির উপকরণ আমদানি করত, আর মার্কিনিরাও তাদের সাশ্রয়ী চীনা তৈরি পণ্য ভালোবাসত। দুই দেশের নীতিনির্ধারকেরাই বুঝতে শুরু করলেন যে বিযুক্তকরণের প্রচেষ্টাগুলো যে সমস্যা সমাধানের জন্য করা হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি বেদনাদায়ক হতে পারে, যদি না আরও বেশি (Council on Foreign Relations, 2025)।

বাণিজ্য যুদ্ধের উপাখ্যান যখন তার সাম্প্রতিকতম অধ্যায়ে প্রবেশ করল, তখন এক অদ্ভুত পরিহাস দেখা দিল। ২০২৪ সালে, ডোনাল্ড ট্রাম্প – যিনি এই সংঘাত শুরু করেছিলেন – রাজনৈতিক মঞ্চে আবার আবির্ভূত হলেন, প্রেসিডেন্ট পদে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য। তিনি প্রথম দফার চুক্তিকে বড্ড নরম বলে সমালোচনা করলেন এবং বাইডেনকে ভীরু বলে অভিযুক্ত করলেন। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিলেন, নির্বাচিত হলে তিনি এমন এক শুল্কের সুনামি বইয়ে দেবেন যা আগে কখনো দেখা যায়নি: চীনের সমস্ত আমদানির ওপর ঢালাওভাবে ৬০% শুল্ক – অর্থাৎ চীন থেকে আমেরিকায় যা কিছু আসে, তার ওপরই কর (Mistreanu, 2025)। এটা এমন একটা হুমকি ছিল যা অর্থনীতিবিদদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল আর কিছু ভোটারকে উল্লসিত করেছিল। চীনের প্রতি আমেরিকার মনোভাব কতটা কঠোর হয়েছে তার প্রমাণ হিসেবে, এমনকি ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ, প্রেসিডেন্ট বাইডেনও নরমপন্থী ছিলেন না – তিনিও নির্দিষ্ট কিছু শুল্ক আর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বাড়াতে থাকলেন, চীনের অর্থনৈতিক শক্তিকে “বুদ্ধিদীপ্ত” উপায়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছিলেন (Hunnicutt et al., 2024)। ততদিনে ওয়াশিংটন আর বেইজিংয়ে একটা নির্মম উপলব্ধি জন্মেছিল: এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্ভবত যেকোনো একজন নেতার চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে। আর সত্যিই, যখন ট্রাম্প ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরলেন, তিনি তার জ্বালাময়ী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে বেশি সময় নিলেন না।

২০২৫ সালের শুরুতে, যে বাণিজ্য উত্তেজনা ধিকিধিকি করে জ্বলছিল, তা আবার খোলা আগুনে পরিণত হলো। ট্রাম্প “শুল্ক মুক্তি দিবস” (Tariff Liberation Day) ঘোষণা করলেন, যা শুধু চীনের বিরুদ্ধেই নয়, বরং তার মতে অন্যান্য অন্যায্য বাণিজ্য সহযোগীদের বিরুদ্ধেও এক নতুন ব্যাপক শুল্ক আরোপের সূচনা করল। প্রধান পদক্ষেপটি ছিল সমস্ত চীনা পণ্যের ওপর, বিদ্যমান সমস্ত শুল্কের উপরে, অতিরিক্ত ৩৪% শুল্ক আরোপ করা (Mistreanu, 2025)। এর মানে হলো, কিছু চীনা পণ্যের ওপর এখন দ্বিগুণ বা এমনকি তিনগুণ বেশি আমদানি কর চাপানো হলো। এটা ছিল এমন মাত্রার সংরক্ষণবাদ, যা আধুনিক বাণিজ্য ইতিহাসে দেখা যায়নি। মার্কিন ক্রেতা ও সংস্থাগুলো মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহ সংকটের জন্য কোমর বাঁধল, আর অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে মূল্যস্ফীতির সতর্কবার্তা ভেসে এল। কিন্তু ট্রাম্প এটাকে আমেরিকার অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবশেষে রুখে দাঁড়ানো হিসেবে চিত্রিত করলেন, জোর দিয়ে বললেন যে স্বল্পমেয়াদী কষ্ট দীর্ঘমেয়াদী লাভের পথ তৈরি করবে। বেইজিংয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রত্যাশিত এবং তীক্ষ্ণ। চীনা নেতারা, হতাশ কিন্তু অবিচল, তাদের নিজস্ব ব্যাপক পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিলেন: শূকরের মাংস, গরুর মাংস এবং সয়াবিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন রপ্তানির ওপর ১৫% পর্যন্ত নতুন শুল্ক (যা আবার মার্কিন কৃষি খাতকে আঘাত করল), এবং উচ্চ প্রযুক্তির উৎপাদনের জন্য অত্যাবশ্যক বিরল মৃত্তিকা খনিজ (rare earth minerals) রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করল (Mistreanu, 2025)। চীন এমনকি পুরনো কৌশলও ঝেড়ে ফেলল, কিছু মার্কিন কোম্পানিকে লক্ষ্য করে একটি “অনির্ভরযোগ্য সত্তা” তালিকা (unreliable entities list) ঘোষণা করল এবং চীনে কর্মরত মার্কিন সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নতুন করে অ্যান্টিট্রাস্ট তদন্ত শুরু করল (Mistreanu, 2025)। বেইজিং থেকে বার্তাটা ছিল দৃঢ় – যদি ওয়াশিংটন শেষ পর্যন্ত একটা অর্থনৈতিক লড়াই চায়, তবে চীন প্রতিটি রাউন্ডে লড়তে প্রস্তুত।

সুতরাং, আমরা এখন এখানে দাঁড়িয়ে, যেখানে বাণিজ্য যুদ্ধটা যেন একটা পূর্ণ বৃত্ত সম্পন্ন করে আরও এগিয়ে গেছে। যা শুরু হয়েছিল কিছু শুল্কের গোলাগুলি দিয়ে, তা এখন এক বহুমাত্রিক বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়েছে। এটা অর্থনৈতিক – দুই পক্ষই একে অপরের ওপর খরচ চাপাচ্ছে আর তাদের অর্থনীতির সহনশীলতা পরীক্ষা করছে। এটা রাজনৈতিক – নেতারা জাতীয়তাবাদী উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে তাদের অ্যাজেন্ডা জোরদার করছেন, প্রত্যেকেই দাবি করছেন যে তারা অন্যের হুমকিতে দমে যাবেন না। আর এটা ক্রমবর্ধমানভাবে প্রযুক্তিগত – দ্রুত উদ্ভাবনের দৌড়, গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা, এবং সরবরাহ শৃঙ্খলকে সুরক্ষিত করা এই আশঙ্কায় যে অন্য পক্ষ সংকটের সময় তা বন্ধ করে দিতে পারে। মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের উপাখ্যান তাই কোনো ভিলেন আর ভিকটিমের সরল গল্প নয়, কিংবা কোনো পরিষ্কার বিজয়ী সম্বলিত পরিচ্ছন্ন নৈতিক নাটকও নয়। বরং, এটা একটা বিশাল মহাকাব্যের মতো, যেখানে দুই প্রধান চরিত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর অনিচ্ছুক পারস্পরিক নির্ভরতা – দুটোতেই আবদ্ধ।

পুরনো দিনের মহাকাব্যের মতোই, এই সংগ্রাম দুই পক্ষের চরিত্র আর সংকল্প পরীক্ষা করেছে। আমেরিকা অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ আর শিল্পনীতির প্রতি নতুন করে আগ্রহ খুঁজে পেয়েছে, তারা ভবিষ্যতের প্রযুক্তিতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে এবং কৌশলগত শিল্পগুলোকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে, চীন দেশীয় উদ্ভাবনের ওপর দ্বিগুণ জোর দিয়েছে এবং পশ্চিমা আধিপত্যমুক্ত এক বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার রক্ষক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছে – যদিও তাদের নিজেদের কিছু চর্চা মাঝে মাঝে সেই নিয়মগুলোকেই বাঁকিয়ে দেয়। অন্যান্য দেশগুলো সাবধানে পর্যবেক্ষণ করছে, যেন ঝড়ের মুখে পড়া ছোট নৌকার মতো মাঝখানে আটকে পড়েছে। কেউ কেউ দুই দৈত্যের কাছ থেকে ব্যবসা বাগিয়ে নিয়ে লাভবান হয়েছে; অন্যরা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আর অনিশ্চয়তার শিকার হয়েছে। অনেকেই নীরবে তাদের বাজি ধরছে, ওয়াশিংটন বা বেইজিং – কারও ওপরই খুব বেশি নির্ভরশীল হতে চাইছে না।

দক্ষিণ এশিয়ার কোনো এক নীতিকথার ঢঙে বলা যেতে পারে যে, দুই হাতি যখন লড়াই করে, তখন ঘাসেরই কষ্ট হয়। সত্যিই, তৃণমূল স্তরের মানুষ – সাধারণ মানুষ আর ব্যবসা – এই যুদ্ধের বেশিরভাগ ধাক্কাটাই সয়েছে। তবুও, এই গল্প এখনও লেখা হচ্ছে। আপাতত, আমেরিকান ঈগল আর চীনা ড্রাগন – দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে, ক্ষতবিক্ষত কিন্তু অবিচল। প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে যে ভবিষ্যতের জন্য তাদের স্বপ্নই জয়ী হবে – সেটা আমেরিকার অবাধ ও ন্যায্য বাজারের আদর্শ হোক, যা শোষণ থেকে সুরক্ষিত, অথবা চীনের জাতীয় পুনরুজ্জীবন আর প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্বের স্বপ্ন হোক।

এই উপাখ্যানের শেষটা কেমন হবে? কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। হয়তো, সময়ের সাথে সাথে, শান্ত মাথাগুলো একটা ভারসাম্য খুঁজে পাবে, প্রতিযোগিতা আর সহযোগিতার মধ্যে সহাবস্থানের এক নতুন দিগন্ত। অথবা হয়তো এই ফাটল আরও বাড়বে, আর বিশ্ব সত্যিই দুটো পৃথক অর্থনৈতিক বলয়ে বিভক্ত হয়ে যাবে, এমন এক সম্পূর্ণ বিযুক্তকরণ যা কয়েক প্রজন্ম আগেও অসম্ভব মনে হতো। আপাতত, মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের গল্পটা একটা জীবন্ত শিক্ষা হয়ে রইল যে আমাদের এই আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে, অর্থনীতি আর রাজনীতি এক সূক্ষ্ম সুতোয় বাঁধা। আর এই উপাখ্যান যখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে, শুল্ক আর প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞার এই কোলাহলের মধ্যেও একটা সত্য অনুরণিত হচ্ছে: যে যুদ্ধে কোনো বিজয়ী নেই, সেখানে একে অপরের সাথে বেঁচে থাকা – এবং বাণিজ্য করা – শেখা ছাড়া আর কোনো পথ নেই, নতুবা শুধু মুখের চেয়েও অনেক বেশি কিছু হারানোর ঝুঁকি থেকে যায় (Wu & Ghosal, 2025)।

তথ্যসূত্র (References)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.