জাদু আর ধর্মের সম্পর্ক

ভূমিকা

আচ্ছা, জাদু টোনায় বিশ্বাস করে, এমন মানুষ কিন্তু সব সমাজেই খুঁজে পাওয়া যায়, বলুন? সেই সমাজে খুব গোছানো ধর্মীয় নিয়মকানুন, কেতাবি পাদ্রী-পুরোহিত (formal clergy) থাকুন বা নাই থাকুন, তাতে কিছু যায় আসে না। তবে হ্যাঁ, যেখানে দেবদেবীর সংখ্যা অনেক (polytheism), বা যেখানে মনে করা হয় গাছপালা, নদী-নালা সবকিছুরই প্রাণ আছে (animism), কিংবা যেখানে ওঝা-গুনিনরাই (shamanism) ভরসা, সেখানে জাদু-টাদুর ধারণাগুলো যেন একটু বেশিই ডালপালা মেলে।

মজার ব্যাপার হলো, পশ্চিমে কিন্তু একসময় ধর্ম আর জাদুকে একেবারে আলাদা দুটো জিনিস বলে ধরে নেওয়া হলো। ব্যাপারটা দাঁড়ালো এইরকম: গির্জা বা স্বীকৃত ধর্মীয় দল যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটাচ্ছে বা সমর্থন দিচ্ছে, সেগুলো হলো ধর্মের অংশ, ঐশ্বরিক ব্যাপার। আর অন্য কোনো উৎস থেকে আসা, বিশেষ করে লোকমুখে চলা বা গোপন চর্চার বিষয়গুলো হলো জাদু। খ্রিস্টধর্ম যখন বিস্তার লাভ করলো, তখন এই ভাগাভাগিটা আরও পোক্ত হলো। একদিকে ঈশ্বরের লীলাখেলা বা মিরাকল (divine miracles), আর অন্যদিকে গ্রামগঞ্জের মানুষের যুগ যুগ ধরে পালন করে আসা লোকধর্ম (folk religion), নানা রকমের কুসংস্কার (superstition), আর গুপ্তবিদ্যা চর্চা (occult speculation)।

পার্থক্যটা ঠিক কোথায়? (Distinction)

একদম শুরুর দিকে দুজন ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী, মার্সেল মউস (Marcel Mauss) আর হেনরি হুবার্ট (Henri Hubert), জাদু নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বললেন, জাদু জিনিসটা কোন সামাজিক পরিবেশে জন্মায়, সেটাই আসল কথা (Pasi, 2006)। তাদের মতে, ধর্ম হলো সমাজের প্রতিচ্ছবি, দশজনকে একসাথে বেঁধে রাখার একটা উপায় (তাই ধর্ম হলো সবার জন্য, প্রকাশ্য বা পাবলিক)। আর জাদু? সেটা হলো একদম নিজের ব্যাপার, একা একা করার জিনিস (তাই তা ব্যক্তিগত বা প্রাইভেট) (Pasi, 2006)।

এরপর এলেন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ র‍্যালফ মেরিফিল্ড (Ralph Merrifield)। বলা হয়, জাদু জিনিসটাকে শুধু ধারণা বা বিশ্বাসের পর্যায়ে না রেখে, এর সাথে জড়িত জিনিসপত্র (material approach) নিয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বইটা তিনিই লিখেছিলেন (Houlbrook & Armitage, n.d.)। তিনি ধর্ম আর জাদুর ফারাকটা বুঝিয়ে বললেন এইভাবে:

  • ‘ধর্ম’ (Religion) হলো অতিপ্রাকৃত বা আত্মিক কোনো সত্তায় বিশ্বাস রাখা।

  • ‘জাদু’ (magic) হলো এমন কিছু কাজ বা কৌশল যা দিয়ে গুপ্ত বা অদেখা শক্তিকে (occult forces) বশে এনে কোনো ঘটনা ঘটানো বা পাল্টে দেওয়া যায়।

  • ‘রিচুয়াল’ (ritual) মানে হলো কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে কাজ করা। এটা ধর্মীয় হতে পারে, যদি উদ্দেশ্য হয় অদৃশ্য শক্তিকে খুশি করা বা তার কৃপা পাওয়া। এটা জাদুকরী হতে পারে, যদি উদ্দেশ্য হয় সহানুভূতি বা সিমপ্যাথির (sympathy) মতো অদৃশ্য নিয়ম দিয়ে কাজ হাসিল করা বা সেই অদৃশ্য শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা। আবার এটা সামাজিকও হতে পারে, যদি উদ্দেশ্য হয় সমাজের বাঁধন শক্ত করা বা মানুষের মধ্যে মেলামেশা বাড়ানো (Merrifield, 1987)।

আবার ১৯৯১ সালে হেঙ্ক ভার্সনেল (Henk Versnel) নামে আরেকজন পণ্ডিত যুক্তি দিলেন, জাদু আর ধর্মের কাজের ধরনটাই আসলে ভিন্ন। তিনি চারটা দিকের কথা বললেন:

  1. উদ্দেশ্য (Intention): জাদুর লক্ষ্য খুব পরিষ্কার আর চটজলদি ফল পাওয়ার জন্য – সাধারণত কোনো একজন ব্যক্তির জন্য। কিন্তু ধর্মের লক্ষ্য অতটা নির্দিষ্ট বা তাৎক্ষণিক নয়, এর নজর থাকে আরও দূরের ভবিষ্যতের দিকে, দীর্ঘমেয়াদী মঙ্গলের দিকে।

  2. মনোভাব (Attitude): জাদু হলো অনেকটা যন্ত্রের মতো, যে ব্যবহার করছে তার হাতেই সব নিয়ন্ত্রণ (manipulative), অনেকটা জোর করে কাজ আদায় করার মতো (“instrumental coercive manipulation”)। অন্যদিকে, ধর্মের মনোভাব হলো মিনতিপূর্ণ, বোঝাপড়ার চেষ্টা (“personal and supplicative negotiation”)।

  3. কাজ (Action): জাদু প্রায়শই একটা কারিগরি ব্যাপার (technical exercise), যার জন্য বিশেষ দক্ষতা বা জ্ঞানের দরকার হয়। কিন্তু ধর্ম এসবের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে দেবদেবী বা ঈশ্বরের ইচ্ছা আর দয়ার ওপর।

  4. সামাজিক (Social): জাদুর লক্ষ্য অনেক সময় সমাজের দশজনের ভালোর বিপরীতে যায় (কারণ কেউ একা একা লাভবান হলে অন্যদের তুলনায় সে অন্যায় সুবিধা পায়)। কিন্তু ধর্মের কাজগুলো সাধারণত সমাজের জন্য ভালো, সবার মঙ্গল বয়ে আনে (Versnel, 1991)।

কিন্তু আসলেই কি দুটো আলাদা? সংযোগটা কোথায়? (Connection)

কাজকর্মের দিক থেকে ধর্ম আর জাদুকে এভাবে আলাদা করে ফেলার ব্যাপারটা নিয়েও কিন্তু বিতর্ক কম হয়নি। কেউ কেউ বলেন, এই ‘জাদু’ (magic) শব্দটা নিয়ে এত না ভেবে যদি আমরা বরং “আত্মিক শক্তিতে বিশ্বাস” (belief in spiritual beings) নিয়ে কথা বলি, তাহলে এই জাতীয় সব আচার-অনুষ্ঠান (ritual practices) বোঝাটা আরও সহজ হবে (Otto, 2013)। তবে এটাও ঠিক, ‘ধর্ম’ শব্দটার পাশাপাশি ‘জাদু’ শব্দটা ব্যবহার করেও তো আমরা এই অতিপ্রাকৃত জগৎটাকে বোঝার চেষ্টা করি। কে জানে, ভবিষ্যতে হয়তো এর চেয়ে ভালো কোনো শব্দও আমরা পেয়ে যেতে পারি (Versnel, 1991)।

তবে আধুনিক নৃবিজ্ঞানীরা (modern anthropology), অন্তত ১৯৩০-এর দশক থেকেই, মোটামুটি একমত যে জাদু আর ধর্মের মধ্যে আসলে কোনো ছেদ নেই, বরং একটা ধারাবাহিকতা (complete continuity) আছে।

যেমন ধরুন, রবার্ট রেনালফ ম্যারেট (Robert Ranulph Marett) ১৯৩২ সালে কী বলেছিলেন:

অনেক নামকরা নৃবিজ্ঞানী, যেমন ধরুন ‘দ্য গোল্ডেন বাউ’-এর লেখক, হয়তো এইসব অতি সাধারণ মানুষের প্রায় অবোধ্য অনুষ্ঠানগুলোকে (ceremonies) ধর্মের মর্যাদা দিতে চাইবেন না, বা দিলেও খুব কমই দেবেন। কিন্তু আমার মনে হয়, আমি তাদের সাথে একমত হতে পারছি না। […] এগুলো রহস্যময় (mysteries), আর তাই অন্তত গোত্রীয়ভাবে এগুলো ধর্মের সাথেই সম্পর্কিত। শুধু তাই নয়, এগুলো সমাজে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়, হয় এদের নিজেদের যোগ্যতার জন্য, নয়তো এদের প্রভাবের জন্য। কাজেই, এগুলোকে ‘জাদু’র মতো একটা খারাপ নাম দিয়ে দেগে দেওয়া, যেন এগুলো সেইসব ভণ্ডামির সমতুল্য যা দিয়ে কিছু ধূর্ত লোক বোকাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়, এটা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক কাজ হবে। কারণ এটা দুটো জিনিসকে গুলিয়ে ফেলছে যা মানব সংস্কৃতির গবেষককে কঠোরভাবে আলাদা রাখতে হবে: একটা হলো সামাজিক জীবনের স্বাভাবিক বিকাশ, আরেকটা হলো এর থেকে তৈরি হওয়া একটা অসুস্থ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তাই আমার কাছে এগুলো ধর্মেরই অংশ, অবশ্যই সেটা একেবারে গোড়ার দিকের বা প্রাথমিক ধর্ম (rudimentary religion) – সেই বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠানটারই একটা আদি পর্যায়, যা আমরা নিজেদের মধ্যে এই নামে চিনি। আমি এখানে যা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি, সেই বিকাশের পর্যায়গুলোর মধ্যে যে একটা নিবিড় ধারাবাহিকতা আছে, সেটা আমাকে ধরে নিতেই হবে, কারণ আমি এটাকে একটা স্বাভাবিক বৃদ্ধি (natural growth) হিসাবেই দেখছি (Marett, 1932)।

আবার আর্নস্ট কাসিরের (Ernst Cassirer) ১৯৪৪ সালে লিখেছিলেন:

মনে হয়, আধুনিক নৃবিজ্ঞানের এটা একটা স্বতঃসিদ্ধ যে জাদু আর ধর্মের মধ্যে একটা সম্পূর্ণ ধারাবাহিকতা আছে। [টীকা ৩৫: উদাহরণস্বরূপ দেখুন, আর.আর. ম্যারেট, ফেইথ, হোপ, অ্যান্ড চারিটি ইন প্রিমিটিভ রিলিজিয়ন, গিফোর্ড লেকচারস (ম্যাকমিলান, ১৯৩২), লেকচার ২, পৃ. ২১ এফএফ।] আমাদের হাতে এমন কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই যা দিয়ে বলা যায় যে, সত্যিই কোনো এককালে শুধু জাদুর যুগ ছিল, আর তারপর ধর্মের যুগ এসে সেটাকে সরিয়ে দিয়েছে (Cassirer, 1944)।

প্রাচীন মিশরের (ancient Egypt) কথাই ধরুন না! তাদের ধর্ম বিশ্বাস করত, দেবতারা যা করেন, তাতেই জগতের ভারসাম্য বা ‘মাত’ (maat) বজায় থাকে, আর সবকিছু সৃষ্টি হয় ও টিকে থাকে (Tobin, 1989)। আর এই বিশাল কাজটা তারা করতেন এক বিশেষ শক্তি দিয়ে, মিশরীয়রা যাকে বলতো ‘হেকা’ (heka)। এটাকে সাধারণত “জাদু” (magic) বলেই অনুবাদ করা হয়। ‘হেকা’ ছিল এক মৌলিক শক্তি, যা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা খোদ জগৎ এবং দেব-দেবীদেরই তৈরি করেছিলেন (Hornung, 1982)! ভাবা যায়? জাদু (যা দেবতা ‘হেকা’ রূপে পূজিত হতো) ছিল তাদের ধর্ম আর সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মিশরীয় ঐতিহ্যের বিশাল লেখালেখির ভাণ্ডার থেকে আমরা তা জানতে পারি (Bell et al., n.d.)। যদিও আজকের দিনের মিশর বিশেষজ্ঞরা (Egyptology) এই ‘জাদু’ শব্দটা ব্যবহার করা নিয়ে একটু দ্বিধায় ভোগেন, কিন্তু প্রাচীন মিশরীয়দের লেখালেখিতেই এর ব্যবহারের যথেষ্ট প্রমাণ আছে (Ritner, 2001)। কপটিক (Coptic) ভাষার ‘হিক’ (hik) শব্দটা ঐ ফারাওদের যুগের ‘হেকা’ থেকেই এসেছে। কিন্তু ফারাওদের ‘হেকা’ শব্দটায় কোনো অধার্মিকতা বা বেআইনি কিছুর ইঙ্গিত ছিল না, যা কপটিক শব্দটায় পরে যুক্ত হয়েছিল। ওল্ড কিংডম থেকে শুরু করে রোমান আমল পর্যন্ত ‘হেকা’র ব্যবহার পাওয়া যায় (Ritner, 2001)। ‘হেকা’কে নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ভাবা হতো – মানে, ভালোও না, মন্দও না – আর এটা মিশরীয় বা বিদেশী, সবার আচার-বিশ্বাস বোঝাতেই ব্যবহৃত হতো (Ritner, 2001, pp. 321–322)। মেরিকারের জন্য লেখা উপদেশে (Instructions for Merikare) বলা আছে, ‘হেকা’ ছিল সৃষ্টিকর্তার দেওয়া একটা উপহার, যেন মানুষ “…দুর্ঘটনার আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অস্ত্র হিসাবে” এটা ব্যবহার করতে পারে (Ritner, 2001, p. 322)। শুধু যে লেখাপড়া জানা পুরোহিতরাই জাদু ব্যবহার করতেন তা নয়, নিরক্ষর কৃষক বা পশুপালকরাও এর চর্চা করত। আর এই ‘হেকা’র নীতিটাই ছিল মন্দিরের বা ব্যক্তিগত জীবনের সব ধরনের আচার-অনুষ্ঠানের (ritual activity) মূল ভিত্তি (Ritner, 2001, p. 323)।

ইংরেজি ‘ম্যাজিক’ (magic) শব্দটার জন্ম কিন্তু প্রাচীন গ্রীসে (ancient Greece) (Bremmer, 2002)। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ আর পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে পারস্যের ‘মাগুশ’ (maguš) শব্দটা গ্রিক ভাষায় ঢুকে গিয়ে হয়ে গেল ‘মাগোস’ (μάγος) আর ‘মাগেয়া’ (μαγεία) (Otto & Stausberg, 2013)। আর এই রূপান্তরের সাথে সাথে এর অর্থটাও গেল বদলে, হয়ে গেল বেশ নেতিবাচক। ‘মাগোস’ বলতে বোঝানো হতো এমন এক ধোঁকাবাজকে (charlatan), যার কাজকর্ম সব জালিয়াতি, অদ্ভুত, চিরাচরিত রীতির বাইরের এবং বিপজ্জনক (Otto & Stausberg, 2013)। ডেভিস যেমনটা বলেছেন, প্রাচীন গ্রিকদের—এবং পরে রোমানদের—কাছে “জাদু আসলে ধর্ম থেকে আলাদা কিছু ছিল না, বরং ছিল ধর্মেরই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত, বেঠিক প্রকাশ—অন্যদের ধর্ম” (Davies, 2012, p. 41)। ইতিহাসবিদ রিচার্ড গর্ডন (Richard Gordon) তো বলেই দিয়েছেন, প্রাচীন গ্রিক সমাজে কারো বিরুদ্ধে জাদু করার অভিযোগ আনাটা ছিল “এক ধরনের অপমান” (a form of insult) (Gordon, 1999)। তবে প্লিনি দ্য এল্ডার (Pliny the Elder) নামের একজন রোমান লেখক মনে হয় মানতেন যে ‘ম্যাগি’রা (Magi) হলো ভিনদেশী এক ধর্মের পুরোহিত, যেমনটা ব্রিটেন আর গলের সেল্টিক (Celts) জাতির ড্রুইডরা (druids) ছিল (Pliny the Elder, 1963)।

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে জাদুর প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে; কখনো এটাকে ভালো চোখে দেখা হয়েছে, কখনো খারাপ (Bailey, 2018, pp. 1–5)। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে (Western culture) জাদুকে প্রায়শই যুক্ত করা হয়েছে ‘অপর’ (Other) (Bogdan, 2012; Graham, 2018), ‘ভিনদেশী’ (foreignness) (Bailey, 2018, p. 89), এবং ‘আদিম’ বা সেকেলে (primitivism) (Davies, 2012, p. 1) ধারণার সাথে। এর মানে দাঁড়ায়, জাদু হলো “অন্য সংস্কৃতির থেকে নিজেদের আলাদা ভাবার একটা জোরালো চিহ্ন” (a powerful marker of cultural difference) (Styers, 2004, p. 14), আর একই সাথে, এটা যেন আধুনিক যুগের কোনো ব্যাপারই নয় (non-modern phenomenon) (Styers, 2004, p. 8)। উনিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিমা পণ্ডিতরা ভাবতেন, যারা জাদু চর্চা করে, তারা মানসিকভাবে আদিম (primitive mentality), এবং সাধারণত সমাজের পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক মানুষদেরই (marginalised groups of people) এই দলে ফেলা হতো (Styers, 2004, p. 14)।

যেখানে পথ মিলে যায় (Intersections)

এমনকি যখন বা যেখানে ধর্ম আর জাদুকে দুটো আলাদা জিনিস হিসাবে ভাবা হয়, তখনও কিন্তু ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা বা সময় এসেছে যখন একটায় থাকা কোনো বিষয় অন্যটার সাথে মিলেমিশে একাকার (syncretized) হয়ে গেছে বা একটা অন্যটা থেকে কিছু ধার করেছে।

আচার-অনুষ্ঠান (Rituals)

দেখুন, ধর্ম আর জাদু – দুটোতেই কিন্তু আচার-অনুষ্ঠান বা রিচুয়ালের (rituals) ছড়াছড়ি (Merrifield, 1987)। পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই অতীতে বা বর্তমানে কোনো না কোনো ধরনের জাদু বিশ্বাস (magical tradition) ছিল বা আছে, যা মনে করে জগতের সবকিছুর আত্মার মধ্যে একটা শামানিক যোগাযোগ (shamanistic interconnectedness of spirit) রয়েছে। হয়তো সেটা ছিল বহু পুরোনো এক লোক ঐতিহ্য (folk tradition), যা পরে বড় বড় বিশ্বধর্ম – যেমন ইহুদিধর্ম (Judaism), খ্রিস্টধর্ম (Christianity), ইসলাম (Islam) বা বৌদ্ধধর্ম (Buddhism) – আসার পর হারিয়ে গেছে। অথবা এমনও হতে পারে, সেই ঐতিহ্য এখনো এই বড় ধর্মগুলোর পাশাপাশিই টিকে আছে (Magic and Religion, n.d.)। যেমন, কপ্টিক খ্রিস্টানরা (Coptic Christians), যারা মিশরের আদি খ্রিস্টান, তারা ১ম থেকে ১২শ শতাব্দী পর্যন্তও জাদুকরী মন্ত্র (magical spells) লিখতো! ভাবা যায়? (Meyer, 1999)।

আসল নামে কি আসলেই শক্তি আছে? দেবতাদের নাম… (Names of the gods as true names)

অনেক পুরোনো একটা বিশ্বাস আছে যে, কারো আসল নামে (true names) নাকি অনেক শক্তি। এই বিশ্বাসটা প্রায়শই আসে জাদুকরী ধারণা থেকে: যদি কারো আসল নাম জানা যায়, তবে নাকি তার ওপর ক্ষমতা (power) খাটানো যায় (Fischer, 1981)।

তাহলে ভাবুন তো, যদি নামের এতই শক্তি হয়, তবে কোনো ধর্মের যিনি সবচেয়ে বড় দেবতা, তার নাম জানলে তো সবচেয়ে বেশি শক্তি পাওয়ার কথা! এই বিশ্বাসটা দেখা যায় ঐতিহ্যবাহী উইক্কা (Wicca) ধর্মে। সেখানে তাদের প্রধান দেবী (Goddess) আর শিংওয়ালা দেবতার (Horned God) নাম সাধারণত খুব গোপন রাখা হয়, শুধু দীক্ষা নেওয়ার পরই তা জানা যায়। একই রকম বিশ্বাস কিন্তু প্রাচীন ইহুদিধর্মেও (Judaism) ছিল। তারা ঈশ্বরের নাম সরাসরি না নিয়ে তানখ-এ (Tanakh) ব্যবহার করত চার অক্ষরের এক প্রতীক (Tetragrammaton) (YHWH), যা সাধারণত ইংরেজিতে ছোট হাতের অক্ষরে “LORD” লেখা হয়। আবার হিন্দুধর্মেও এই বিশ্বাস আছে, কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তটা ভিন্ন। তারা মনে করে, ঈশ্বরের শক্তি লাভ করা বা তার সাথে একাত্ম হওয়াটা তো ভালো কথা! তাই অনেক হিন্দু তাদের প্রিয় দেবতার নাম, যেমন কৃষ্ণ (Krishna), যত বেশি সম্ভব জপ করেন (Gonick, n.d.)।

জাদু ও আব্রাহামিক ধর্মগুলো (Magic and Abrahamic religions)

ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম – এই আব্রাহামিক ধর্মগুলোর (Abrahamic religions) সাথে জাদুর সম্পর্কটা বেশ ঘোলাটে, বলা চলে। বাইবেলের বিখ্যাত কিং জেমস সংস্করণে (King James Version) তো লেখাই আছে, “Thou shalt not suffer a witch to live” অর্থাৎ “কোনো ডাইনিকে বাঁচতে দিও না” (Exodus 22:18) (King James Version, 1611)। আবার দেখুন, রাজা সৌলকে (Saul) ঈশ্বর বকাঝকা করেছিলেন কারণ তিনি এক ভবিষ্যৎবক্তার (diviner) কাছে পরামর্শ চাইতে গিয়েছিলেন যে কিনা আত্মাদের সাথে কথা বলতে পারত।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বাইবেলেই আবার এমন ঘটনার উল্লেখ আছে যা দেখতে অনেকটা জাদুর মতোই। যেমন, মিশরের ফারাও জাদুকরদের (sorcerers) লাঠি যেমন সাপে পরিণত হয়েছিল, তেমনি নবী মোশি বা মূসা (Moses) আর তার ভাই হারোনের (Aaron) লাঠিও সাপে পরিণত হয়েছিল (Exodus 7:8-13)। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? স্কট নোয়েগেল (Scott Noegel) নামে একজন পণ্ডিত বলছেন, আসল পার্থক্যটা হলো কীভাবে লাঠিটা সাপ হলো, সেই পদ্ধতিতে। ফারাও এর জাদুকররা ব্যবহার করেছিল “তাদের গোপন কলা” (their secret arts), কিন্তু মোশি? তিনি শুধু তার লাঠিটা মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন, আর ওমনি সেটা সাপ হয়ে গেল! একজন প্রাচীন মিশরীয়র চোখে এটাই হতো সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় – মোশি কোনো গোপন কলা বা জাদুমন্ত্র (magical words) কিছুই ব্যবহার করলেন না! নোয়েগেল আরও বলছেন, ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তোরাহ (Torah) অনুযায়ী, তাদের ঈশ্বর YHWH-এর কোনো কাজ করার জন্য কোনো জাদুকরী আচারের (magical rituals) দরকারই পড়ে না (Noegel, 1996)।

বাইবেলের কিছু ইংরেজি অনুবাদে ‘উইচ’ (witch) বা ‘উইচক্র্যাফট’ (witchcraft) শব্দগুলো পাওয়া যায়। যেমন কিং জেমস সংস্করণে এক্সোডাস ২২:১৮ (Exodus 22:18)-এ আছে: “Thou shalt not suffer a witch to live”। এখানে যে হিব্রু শব্দটাকে (‘মেকশেফা’ – mechshepha, যার মূল ‘কাশাফ’ – kashaph) ‘উইচ’ বা ডাইনি অনুবাদ করা হয়েছে, সেটার আসল মানে কী, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রাচীন গ্রিক অনুবাদে (Septuagint) এটাকে লেখা হয়েছিল ‘ফার্মাকেইয়া’ (pharmakeia), যার মানে দাঁড়ায় ‘ওষুধ তৈরি’ বা ‘ফার্মাসি’ (pharmacy)। এই যুক্তিতে, ১৬ শতকে রেজিনাল্ড স্কট (Reginald Scot) নামে একজন লেখক দাবি করেছিলেন যে ‘উইচ’ অনুবাদটাই ভুল, আসলে বোঝানো হয়েছিল যারা বিষ প্রয়োগ করে (poisoners), তাদের (Scot, c. 1580)।

তথ্যসূত্র

  • Bailey, M. D. (2006). The Meanings of Magic. Magic, Ritual, and Witchcraft, 1(1), 1–23. https://doi.org/10.1353/mrw.0.0052

  • Bailey, M. D. (2018). Magic: The Basics. Routledge.

  • Bell, H. I., Nock, A. D., & Thompson, H. (n.d.). Magical Texts From A Bilingual Papyrus In The British Museum. Proceedings of The British Academy, Vol, XVII, London. p 24. (Note: The OCR didn’t capture a year, assuming it refers to a specific publication cited by Ritner).

  • Bogdan, H. (2012). Introduction: Modern Western Magic. Aries, 12(1), 1–16. https://doi.org/10.1163/147783512X614812

  • Bremmer, J. N. (2002). The Birth of the Term Magic. In J. N. Bremmer & J. R. Veenstra (Eds.), The Metamorphosis of Magic from Late Antiquity to the Early Modern Period (pp. 1–2). Peeters.

  • Cassirer, E. (1944). An Essay On Man (pt. II, ch. 7 Myth and Religion, pp. 122-3). Yale University Press.

  • Davies, O. (2012). Magic: A Very Short Introduction. Oxford University Press.

  • Fischer, E. (1981). The Necessity of Art: A Marxist Approach. Penguin Books. p. 31.

  • Gonick, L. (n.d.). The Cartoon History of the Universe. Doubleday. (Note: OCR didn’t capture publication year, standard APA would require it).

  • Gordon, R. (1999). Imagining Greek and Roman Magic. In B. Ankarloo & S. Clark (Eds.), The Athlone History of Witchcraft and Magic in Europe. Vol. 2: Ancient Greece and Rome (pp. 159–275). Athlone Press.

  • Graham, E. (2018). Do You Believe in Magic?. Material Religion: The Journal of Objects, Art and Belief, 14(2), 255–257. https://doi.org/10.1080/17432200.2018.1443843

  • Hornung, E. (1982). Conceptions of God in Egypt: The One and the Many (J. Baines, Trans.). Cornell University Press. (Original work published 1971)

  • Houlbrook, C. & Armitage, N. (n.d.). ‘Introduction: The materiality of the materiality of magic’. In C. Houlbrook & N. Armitage (Eds.), The Materiality of Magic: An artefactual investigation into ritual practices and popular beliefs (pp. 1-13). Oxbow Books. (Note: OCR didn’t capture publication year, standard APA would require it).

  • King James Version of the Bible. (1611).

  • Magic and Religion. (n.d.). White Magic Witch. Archived from http://whitemagicwitch.com/magic-and-religion/ (Original URL seems defunct, citing archive is appropriate).

  • Marett, R. R. (1932). Faith, Hope and Charity in Primitive Religion (Gifford Lectures). Macmillan.

  • Merrifield, R. (1987). The Archaeology of Ritual and Magic. Guild Publishing.

  • Meyer, M. W. (1999). Ancient Christian Magic Coptic Texts of Ritual Power. Princeton University Press.

  • Noegel, S. B. (1996). Moses and Magic: Notes on the Book of Exodus. Journal of the Ancient Near Eastern Society, 24, 45–59. http://faculty.washington.edu/snoegel/PDFs/articles/Noegel%2019%20-%20JANES%201996.pdf

  • Otto, B-C. (2013). Towards Historicizing ‘Magic’ in Antiquity. Numen, 60, 308-347.

  • Otto, B-C., & Stausberg, M. (2013). Defining Magic: A Reader. Equinox.

  • Pasi, M. (2006). Magic. In K. von Stuckrad (Ed.), The Brill Dictionary of Ancient Religion. Volume III. M-R (pp. 1134-1140). Brill.

  • Pliny, the Elder. (1963). Natural History (H. Rackham, D. E. Eichholz, & W. H. S. Jones, Trans.). Heinemann.

  • Ritner, R. K. (2001). Magic: An Overview. In D. B. Redford (Ed.), Oxford Encyclopedia Of Ancient Egypt. Oxford University Press. (pp. 321-323 referenced).

  • Scot, R. (c. 1580). The Discoverie of Witchcraft (Booke VI Ch. 1). (Note: Exact publication year varies).

  • Styers, R. (2004). Making Magic: Religion, Magic, and Science in the Modern World. Oxford University Press.

  • Tobin, V. A. (1989). Theological Principles of Egyptian Religion. P. Lang.

  • Versnel, H. S. (1991). Some Reflections on the Relationship Magic-Religion. Numen, 38(2), 177-195.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.