উইচক্রাফট, উইচহান্ট এবং উইচহান্ট নিয়ে নারীবাদী ব্যাখ্যাসমূহ

Table of Contents

উইচক্রাফট বা ডাইনিবিদ্যা

(উইচক্রাফট হচ্ছে জাদু বা ম্যাজিকের একটি প্রকরণ। জাদু সম্পর্কে জানতে এখানে যান – জাদু বা ম্যাজিক (অতিপ্রাকৃত))

সাধারণ কথা

আচ্ছা, এই ‘ডাইনিবিদ্যা’ বা উইচক্র্যাফট (witchcraft) ব্যাপারটা আসলে কী? খুব সহজ করে বললে, এটা হলো এমন এক ক্ষমতা বা জাদু (magic) ব্যবহারের গল্প, যা নাকি ‘ডাইনি’ (witch) নামে পরিচিত মানুষেরা করে থাকে। পুরোনো দিনে লোকে বিশ্বাস করত, ডাইনিবিদ্যা মানেই হলো জাদু দিয়ে অন্যের ক্ষতি করা, অমঙ্গল ঘটানো। আর সত্যি বলতে কি, এই ধারণাটাই সবচেয়ে বেশি চালু (Hutton, 2017; Thomas, 1997)। বিখ্যাত এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (Encyclopedia Britannica) অবশ্য বলছে, এই যে ক্ষতি করার ডাইনিবিদ্যা, এটা আসলে মানুষের কল্পনার জগতেই বেশি বাস করে। তবে এটাও ঠিক, বহু যুগ ধরে বহু সংস্কৃতির মানুষ পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া খারাপ ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজেছে এই ডাইনিবিদ্যার ধারণার মধ্যে (Russell & Lewis, 2023)।

মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর প্রায় সব কোণাতেই, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ডাইনি আর ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসের দেখা মেলে। বেশিরভাগ সমাজ আবার এই ডাইনিবিদ্যা থেকে বাঁচতে বা একে ঠেকাতে নিজেরাই কিছু জাদুটোনা করত, যাকে বলে প্রতিরক্ষামূলক জাদু (protective magic) বা পাল্টা-জাদু (counter-magic)। আর যাদের ওপর ডাইনি বলে সন্দেহ হতো, তাদের কপালে জুটত শাস্তি—কখনও সমাজ থেকে বের করে দেওয়া, কখনও বন্দি করা, মারধোর, এমনকি মেরেও ফেলা হতো। আজকালকার দিনের নৃতাত্ত্বিকরা যখন বিভিন্ন সংস্কৃতির ক্ষতিকর গুপ্তবিদ্যা (harmful occult practices) নিয়ে গবেষণা করেন, তখন এই একই ধরনের বিশ্বাসের জন্য ‘উইচক্রাফট’ শব্দটাই ব্যবহার করেন (Singh, 2021; Thomas, 1997; Perrone et al., 1993)।

এই যে খারাপ বা অশুভ জাদু (malevolent magic) দিয়ে ক্ষতি করার বিশ্বাস, এর শিকড় কিন্তু অনেক গভীরে, সেই প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (Mesopotamia) পর্যন্ত পাওয়া যায় সেই শিকর। ইউরোপেও এই বিশ্বাস বহু পুরোনো, একেবারে ক্লাসিক্যাল যুগ (classical antiquity) থেকে চলে আসছে। মধ্যযুগে আর তার পরের আধুনিক যুগের শুরুর দিকে, ইউরোপে যাদের ডাইনি বলে ধরা হতো, তারা বেশিরভাগই ছিলেন নারী (Hutton, 2017)। ভাবা হতো, তারা নাকি লুকিয়ে কালো জাদু (black magic), যার আরেক নাম ম্যালিফিসিয়াম (maleficium), ব্যবহার করে খোদ নিজেদের প্রতিবেশীদেরই ক্ষতি করছে। এই অভিযোগগুলো সাধারণত প্রতিবেশীরাই আনত, আর এর পেছনে থাকত নানা সামাজিক রেষারেষি, মনোমালিন্য। কখনও সখনও এমনও বলা হতো, ডাইনিরা নাকি শয়তান (demons) বা সাক্ষাৎ ডেভিলের (Devil) সঙ্গে যোগাযোগ রাখে! যদিও নৃতাত্ত্বিক জাঁ লা ফঁতেইন (Jean La Fontaine) একটু ভিন্ন কথা বলেন। তার মতে, এই অভিযোগগুলো মূলত তাদের বিরুদ্ধেই তোলা হতো, যাদেরকে গির্জা বা চার্চ নিজেদের শত্রু (enemies of the Church) বলে মনে করত (La Fontaine, 2016)।

তবে লোকে শুধু ভয়ই পেত না, বাঁচার উপায়ও খুঁজত। বিশ্বাস ছিল, ভালো বা সাদা জাদু (white magic) দিয়ে ডাইনিবিদ্যাকে ঠেকানো যায়। এই ভালো জাদু যারা করতেন, তাদের বলা হতো ‘কানিং ফোক’ (cunning folk) বা ‘ওয়াইজ পিপল’ (wise people)। ডাইনি সন্দেহে যাদের ধরা হতো, তাদের প্রায়ই বিচার হতো, আর দোষী সাব্যস্ত হলে বা এমনকি শুধু দোষী বলে মনে হলেও শাস্তি পেতে হতো। ইউরোপে একসময় রীতিমতো ডাইনি-শিকার (witch-hunts) আর ডাইনি-বিচার (witch trials) চলত, যার ফলে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, যারা জাদু দিয়ে মানুষের উপকার করতেন, যেমন নিরাময়কারী (magical healers) বা ধাত্রী (midwives), তাদেরও কখনও কখনও ডাইনি বলে অভিযোগের শিকার হতে হয়েছে (Davies, 2003; Thomas, 1997; Riddle, 1997; Ehrenreich & English, 2010), কিন্তু অভিযুক্তদের মধ্যে তারা ছিলেন খুব কম। এরপর এলো আলোকিত যুগ (Age of Enlightenment), ধীরে ধীরে ইউরোপে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস কমতে শুরু করল।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে আদিবাসী সংস্কৃতিতেও (indigenous belief systems) ডাইনিবিদ্যার ধারণা পাওয়া যায়, আর সেখানেও ডাইনিদের দেখা হয় অশুভ শক্তি হিসেবেই। এসব সমাজে আবার নিজস্ব নিরাময়কারী (healers) আছেন, যেমন ঔষধ বিশেষজ্ঞ (medicine people) বা ডাইনি ডাক্তার (witch doctors), যাদের কাছে লোকে যায় জাদুটোনার (bewitchment) প্রভাব কাটাতে (Demetrio, 1988; Tan, 2008)। কিছু আফ্রিকান আর মেলানেশিয়ান (Melanesian) মানুষের বিশ্বাস আবার একটু অন্যরকম। তারা মনে করে, ডাইনিদের শরীরের ভেতরেই নাকি এক অশুভ আত্মা (evil spirit) বা বিশেষ পদার্থ (substance) থাকে, যা তাদের দিয়ে খারাপ কাজ করায়। আর হ্যাঁ, এই আধুনিক যুগেও আফ্রিকা আর এশিয়ার কিছু জায়গায় ডাইনি সন্দেহে মানুষ শিকার (witch-hunting) করার মতো ঘটনা ঘটে।

তবে সময় বদলেছে। ১৯৩০-এর দশকের পর থেকে আধুনিক পৌত্তলিকতাবাদের (modern paganism) কিছু অনুসারী এসেছেন, যারা নিজেদের ‘ডাইনি’ হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেছেন। তারা ‘ডাইনিবিদ্যা’ শব্দটাকে তাদের নব্য-পৌত্তলিক বা নিওপ্যাগান (neopagan) বিশ্বাস আর চর্চার আলোকেই নতুন করে ব্যাখ্যা করছেন (Kelly, 1992; Berger & Ezzy, 2009; Doyle White, 2016)। অবশ্য, অন্য কিছু নব্য-পৌত্তলিক আবার শব্দটার পুরোনো বদনামের কারণে একে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন (Lewis, 1996)।

উইচক্রাফটের ধারণা

তাহলে মূল কথাটা কী দাঁড়াল? সারা পৃথিবীতে ‘ডাইনিবিদ্যা’ (witchcraft) বলতে মানুষ মূলত বোঝে ক্ষতিকর জাদু (harmful magic) ব্যবহার করার ব্যাপারটাকেই (Hutton, 2017)। আর এই অশুভ জাদুতে বিশ্বাস, ডাইনিবিদ্যার ধারণা—এগুলো কিন্তু আজকের নয়, একেবারে ইতিহাসের শুরু থেকেই নানা সংস্কৃতিতে টিকে আছে, সভ্যতা এগিয়েছে কি পিছিয়েছে, তাতে কিছু এসে যায়নি (Singh, 2021; Ankarloo & Clark, 2001)। বেশিরভাগ সমাজেই এক ধরনের ভয় কাজ করেছে যে, কিছু মানুষ আছে যারা অতিপ্রাকৃত উপায়ে অন্যের জীবনে দুঃখ-দুর্দশা বা ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। এর কারণটা হয়তো মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে আছে। মানুষ চায়, জীবনে ঘটে যাওয়া ভালো-মন্দ, বিশেষ করে অদ্ভুত বা বড় ঘটনাগুলোর পেছনে কোনো না কোনো কারণ খুঁজে বের করতে, সেটা মানুষ হোক বা অতিমানবীয় কোনো শক্তি (Hutton, 2017)। ইতিহাসবিদ আর নৃতাত্ত্বিকরা মনে করেন, এই ‘ডাইনিবিদ্যা’র ধারণাটা হলো মানুষের অদ্ভুত সব দুর্ভাগ্য বা খারাপ ঘটনার ব্যাখ্যা খোঁজার একটা পুরোনো রাস্তা (Hutton, 2017; Moro, 2017)।

অবশ্য সব সংস্কৃতি যে ডাইনিবিদ্যাকে একইভাবে ভয় পেয়েছে, তা নয়। কারো কারো কাছে দুর্ভাগ্যের অন্য ব্যাখ্যা ছিল, তাই ডাইনি নিয়ে তাদের মাথাব্যথাও ছিল কম (Hutton, 2017)। যেমন ধরা যাক, আয়ারল্যান্ড আর স্কটিশ হাইল্যান্ডসের গেল (Gaels) সম্প্রদায়ের কথা। তারা ঐতিহাসিকভাবে পরীদের (fairy folk) ওপর খুব বিশ্বাস করত, ভাবত পরীরাও অতিপ্রাকৃত ক্ষতি করতে পারে। ফলে, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সেখানে ডাইনি খোঁজার ধুম বা ডাইনি-শিকার ছিল অনেক কম (Hutton, 2017, p. 245)।

ইতিহাসবিদ রোনাল্ড হাটন (Ronald Hutton) বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, যা প্রায় সব সংস্কৃতিতেই ডাইনি আর ডাইনিবিদ্যার সাথে জড়িয়ে আছে বলে মনে করা হয়। সেগুলো হলো:

১. অন্যের ক্ষতি বা অমঙ্গল করার জন্য জাদুর ব্যবহার।
২. এই জাদু ডাইনি ব্যবহার করত তার নিজের সম্প্রদায়ের লোকজনের বিরুদ্ধেই।
৩. বিশ্বাস করা হতো, ডাইনি এই ক্ষমতা পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে বা কোনো বিশেষ দীক্ষার (initiation) মাধ্যমে।
৪. কাজটাকে দেখা হতো অনৈতিক হিসেবে এবং প্রায়শই মনে করা হতো এর সঙ্গে মন্দ বা অশুভ শক্তির যোগাযোগ আছে।
৫. প্রতিরক্ষামূলক জাদু, বুঝিয়ে-শুনিয়ে, ভয় দেখিয়ে অথবা অভিযুক্ত ডাইনিকে শারীরিক শাস্তি দিয়ে এই ডাইনিবিদ্যাকে ঠেকানো বা প্রতিহত করা সম্ভব বলে ভাবা হতো (Hutton, 2017, p. 3-4)।

সারা দুনিয়ায় একটা সাধারণ বিশ্বাস হলো, ডাইনিরা নাকি নানা জিনিস, বিশেষ শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে অতিপ্রাকৃত ক্ষতি করে। আবার এমনও ভাবা হয়, তাদের হয়তো এমনিতেই, জন্মগতভাবেই (innate power) এই ক্ষমতা থাকে। হাটন বলছেন, অনেক সংস্কৃতিতে এই দুই ধরনের ডাইনির ধারণাই পাশাপাশি চলে। এমনও হতে পারে, যার জন্মগত ক্ষমতা আছে, সে আবার নানা জিনিসপত্র ব্যবহার করে সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগাচ্ছে (Hutton, 2017, p. 19-22)।

ডাইনিবিদ্যা আর জাদু নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, তার মধ্যে ই. ই. ইভান্স-প্রিচার্ডের (E. E. Evans-Pritchard) একটা বই খুব বিখ্যাত। বইটার নাম ‘উইচক্র্যাফট, ওরাকলস অ্যান্ড ম্যাজিক অ্যামং দ্য আজান্দে’ (Witchcraft, Oracles and Magic Among the Azande), প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। এতে তিনি আফ্রিকার আজান্দে (Azande) সম্প্রদায়ের ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তার দেওয়া সংজ্ঞাগুলো নৃতত্ত্বের জগতে বেশ প্রভাব ফেলেছিল, প্রায় নিয়ম বা প্রথা (convention) হয়ে দাঁড়িয়েছিল (Moro, 2017)। কিন্তু সবাই যে তার সংজ্ঞার সাথে একমত ছিল, তা নয়। কিছু গবেষক মনে করেন, ইভান্স-প্রিচার্ডের সংজ্ঞাগুলো গ্রহণ করার ফলে ডাইনিবিদ্যা, এমনকি জাদু বা ধর্ম নিয়ে আলোচনা হয়তো কিছুটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল, যা হয়তো ইভান্স-প্রিচার্ড নিজেও চাননি (Mills, 2013)। ইভান্স-প্রিচার্ড নিজে ‘উইচক্রাফট’ শব্দটা ব্যবহার করতেন শুধু তাদের জন্য, যারা তাদের জন্মগত ক্ষমতা দিয়ে ক্ষতি করে। আর যারা ক্ষতি করার জন্য নানা জিনিসপত্র বা পদ্ধতির সাহায্য নেয়, তাদের কাজের জন্য তিনি ব্যবহার করতেন ‘জাদুটোনা’ (sorcery) শব্দটি (Evans-Pritchard, 1937, p. 8-9)। ইতিহাসবিদরা অবশ্য ইউরোপের ডাইনিবিদ্যার ক্ষেত্রে এই পার্থক্যটা প্রয়োগ করতে গিয়ে মুশকিলে পড়েছিলেন। কারণ ইউরোপে বিশ্বাস করা হতো, ডাইনিরা নানা শারীরিক কৌশল বা জিনিসপত্র ব্যবহার করে, আবার কেউ কেউ নাকি শুধু চিন্তা দিয়েই ক্ষতি করতে পারে (Thomas, 1997, p. 464-465; Ankarloo & Henningsen, 1990, p. 1, 14)! আজকাল এই ‘ডাইনিবিদ্যা’ আর ‘জাদুটোনা’র পার্থক্যটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর করা হয় না, যদিও কিছু নৃতাত্ত্বিক এখনও নির্দিষ্ট কোনো সমাজ নিয়ে কাজ করার সময় এটাকে প্রাসঙ্গিক মনে করতে পারেন (Hutton, 2017, p. 22)।

বেশিরভাগ সংস্কৃতিতে যদিও ভাবা হয় ডাইনিবিদ্যা একটা ইচ্ছাকৃত কাজ, তবে আফ্রিকা আর মেলানেশিয়ার কিছু আদিবাসী মানুষ আবার অন্যরকম বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, ডাইনিদের শরীরের ভেতরেই এমন কোনো পদার্থ (substance) বা অশুভ আত্মা (evil spirit) থাকে, যা তাদের দিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্ষতি করিয়ে নেয় (Hutton, 2017, p. 18-19)। এমনও বিশ্বাস আছে যে, এই পদার্থ হয়তো ডাইনি যখন ঘুমিয়ে থাকে বা সে যখন কিছুই জানে না, তখনও নিজে নিজেই কাজ করতে পারে (Mills, 2013)! যেমন, ডোবু (Dobu) নামের এক সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, তাদের নারীরা ঘুমের মধ্যে ক্ষতিকর জাদু করে, আর পুরুষেরা সেটা করে জেগে থাকা অবস্থায় (Hutton, 2017, p. 18-19)। আবার, যেসব সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করা হয় শরীরের ভেতরের কোনো পদার্থ মানুষকে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা দেয়, সেখানে সেই পদার্থ ভালো, খারাপ, বা নৈতিকভাবে নিরপেক্ষও (morally neutral) হতে পারে (Umotong; Gbule & Odili, 2015)। হাটন এখানে একটা পার্থক্য করেছেন। যারা অনিচ্ছাকৃতভাবে কুনজর (evil eye) দেয়, আর যারা জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে দেয়—তিনি শুধু শেষের দলকেই ডাইনি বলছেন (Hutton, 2017, p. 10)।

এই যে ‘ডাইনি’ (witch) আর ‘ডাইনিবিদ্যা’ (witchcraft) শব্দ দুটো, এগুলো কি সব সংস্কৃতিতে একইভাবে ব্যবহার করা যায়? এদের কোনো সর্বজনীন অর্থ আছে কি? এ নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আছে (Moro, 2017)। হাটন বলছেন:

“(অশুভ জাদু) অবশ্য শব্দটার এখনকার ব্যবহারগুলোর মধ্যে মাত্র একটা। সত্যি বলতে কি, ইংরেজিভাষী জগতে এর এখন অন্তত চার রকম মানে দাঁড়িয়েছে, যদিও যেটার কথা আমরা এতক্ষণ বললাম (ক্ষতিকর জাদু), সেটাই মনে হয় সবচেয়ে চালু। অন্য মানেগুলো হলো: যে কোনো মানুষ যে জাদু ব্যবহার করে… অথবা যে প্রকৃতি-ভিত্তিক পৌত্তলিক ধর্ম পালন করে; অথবা যে স্বাধীন নারী কর্তৃত্ব আর পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রতীক। আজকের দিনে এই সবগুলো অর্থের পক্ষেই কিছু বলার আছে।” (Hutton, 2017, p. 10)।

জাতিসংঘের একজন বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ারও (Special Rapporteur) বলেছেন, বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে ‘ডাইনি’ বা ‘ডাইনিবিদ্যা’র সংজ্ঞা দেওয়া বেশ কঠিন। কারণ এই শব্দগুলোর সাথে জনপ্রিয় ধারণার পাশাপাশি নানা ধরনের ঐতিহ্যগত বা বিশ্বাস-ভিত্তিক নিরাময় চর্চাও (faith healing practices) জড়িয়ে থাকতে পারে (“Witchcraft and human rights”)।

নৃতাত্ত্বিক ফিওনা বোয়ি (Fiona Bowie) দেখিয়েছেন, পণ্ডিত আর সাধারণ মানুষ ‘ডাইনিবিদ্যা’ আর ‘ডাইনি’ শব্দ দুটোকে অন্তত চার রকমভাবে ব্যবহার করে (Moro, 2017)। আবার, নব্য-পৌত্তলিক বা নিওপ্যাগান লেখক আইজ্যাক বোনিউইটস (Isaac Bonewits) তো ডাইনিদের আরও অনেক ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যেমন: নব্য-পৌত্তলিক বা নিওপ্যাগান্ম, নারীবাদী, নিওগথিক, নিওক্লাসিক্যাল, ক্লাসিক্যাল, পারিবারিক ঐতিহ্যবাহী (Family Traditions), অভিবাসী ঐতিহ্যবাহী (Immigrant Traditions), এবং জাতিগত (Ethnic) ডাইনি (Adler, 2006, p. 65-68)!

উইচক্রাফট শব্দটির ব্যুৎপত্তি

আচ্ছা, এই যে ‘উইচক্র্যাফট’ (witchcraft) শব্দটা আমরা বলি, এটা কিন্তু মোটেও নতুন কোনো শব্দ নয়। হাজার বছরেরও বেশি এর বয়স! সেই পুরনো দিনের ইংরেজিতে (Old English) দুটো শব্দ ছিল – একটা হলো ‘উইচ্চে’ (wicce), মানে ডাইনি, আর অন্যটা ‘ক্র্যাফট’ (cræft), মানে হলো কৌশল বা ক্ষমতা। এই দুটো মিলেই হয়েছিল ‘উইচ্চেক্র্যাফট’ (wiccecræft) (Harper, “witchcraft (n.)”)। আর পুরুষ যদি এই জাদু বা কৌশল দেখাত, তাকে বলা হতো ‘উইক্কা’ (wicca) (“Home : Oxford English Dictionary”)।

ভাষাতাত্ত্বিকরা, যেমন অক্সফোর্ড ডিকশনারির লোকেরা, মনে করেন এই ‘উইচ্চে’ আর ‘উইক্কা’ শব্দ দুটো এসেছে পুরনো ইংরেজি ক্রিয়াপদ ‘উইচ্চিয়ান’ (wiccian) থেকে, যার মানে হলো ডাইনিবিদ্যা চর্চা করা (“witch”)। এই শব্দের আবার এক জ্ঞাতিগুষ্টি পাওয়া যায় অনেক পরে, তেরো শতকে, জার্মানির এক পুরোনো ভাষায় – ‘উইকেন’ (wicken)। কিন্তু এর আগের ইতিহাসটা একটু ধোঁয়াশে। অন্য জার্মান ভাষাগুলোতে এর তেমন কোনো খোঁজ মেলে না। কোথা থেকে যে এর আসল শুরু, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মত আছে।

তবে ‘ডাইনি’ বোঝাতে পুরনো ইংরেজিতে আরও একটা শব্দ ছিল – ‘হেগটেস’ (hægtes) বা ‘হেগটেসে’ (hægtesse)। এটাই পরে আধুনিক ইংরেজিতে হয়ে গেছে ‘হ্যাগ’ (hag), যার মানে কুৎসিত বুড়ি। আর এই একই মূল থেকে এসেছে ‘হেক্স’ (hex) শব্দটা, যার মানে জাদুটোনা বা অভিশাপ দেওয়া। মজার ব্যাপার হলো, জার্মানির মতো অনেক দেশেই ডাইনির প্রতিশব্দগুলো এই ‘হেগটেস’ থেকেই এসেছে, যেমন জার্মান ‘হেক্সে’ (Hexe) বা ডাচ ‘হেকস’ (heks) (Harper, “hag (n.)”)।

আজকাল অবশ্য আমরা যখন ‘উইচ’ (witch) বলি, তখন সাধারণত মহিলাদের কথাই ভাবি (“Definition of WITCH”)। পুরুষ জাদুকরদের জন্য অন্য শব্দ চালু আছে – যেমন ‘উইজার্ড’ (wizard) বা কখনো সখনো ‘ওয়ারলক’ (warlock)। তবে হ্যাঁ, আজকের দিনে যারা নিজেদের নব্য-পৌত্তলিক (neo-pagan) বলে পরিচয় দেন, যেমন উইক্কা (Wicca) ধর্মের অনুসারীরা, তারা যখন ‘উইচ’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন সেটা পুরুষ বা মহিলা যে কেউ হতে পারে (Cusack, 2009, p. 345)। শব্দেরও কেমন বিচিত্র জীবন, তাই না?

কী করত এই ডাইনিরা?

লোকে কী বিশ্বাস করত? তারা ভাবত, ডাইনিরা মূলত অভিশাপ (curses) দেয়। মানে, কিছু জাদুকরী কথা বা ইশারা ব্যবহার করে অন্যের জীবনে অলৌকিকভাবে খারাপ কিছু ঘটানোর চেষ্টা করে (Levack, 2013, p. 54)। অভিশাপ দেওয়ারও ছিল নানা তরিকা। হয়তো কোনো জিনিসের গায়ে বিশেষ চিহ্ন (runes or sigils) এঁকে দিত, অথবা যার ক্ষতি করতে চায়, তার একটা মোম বা মাটির পুতুল (poppet) বানিয়ে সেটা পোড়াত বা বাঁধত। আবার গাছ-গাছড়া, পশুর শরীরের অংশ বা এমন সব অদ্ভুত জিনিস দিয়ে হয়তো তৈরি করত জাদুকরী পানীয় (potions) বা বিষ (poisons) (Luck, 1985, p. 254, 260, 394; Kittredge, 1929, p. 172; Davies, 1999; Hutton, 2017, p. 19-22)।

মানুষের জীবনে যত রকমের খারাপ ঘটনাই ঘটুক না কেন, দোষটা প্রায়ই গিয়ে পড়ত ডাইনিদের ঘাড়ে। বিশেষ করে ইউরোপে, যদি কারও অসুখ হতো, বাচ্চা মারা যেত, বা গবাদি পশুর কিছু হতো – লোকে ভাবত, নির্ঘাত কোনো ডাইনির কাজ। কিছু নির্দিষ্ট সমস্যা তো ছিলই, যেগুলো শুনলেই লোকে ডাইনির কথা ভাবত – যেমন পুরুষদের পুরুষত্বহীনতা, মহিলাদের সন্তান না হওয়া, বা হঠাৎ গরুর দুধ দেওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। যেসব রোগের কারণ বোঝা যেত না, সেগুলোর দায় চাপানো হতো ডাইনিবিদ্যার ওপর। এডওয়ার্ড বেভার (Edward Bever) নামে একজন লিখেছেন, লোকে তখনই ডাইনিকে সন্দেহ করত, যখন দেখত রোগটা খুব হঠাৎ করে এসেছে, অনেক দিন ধরে সারছে না, ডাক্তাররা ঠিক ধরতে পারছে না কী হয়েছে, বা রোগের লক্ষণগুলো খুব অদ্ভুত (Levack, 2013, p. 54-55)।

সারা পৃথিবীতেই একটা খুব সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, ডাইনিরা যার ক্ষতি করতে চায়, তার শরীরের কোনো অংশ – যেমন চুল, কাটা নখ, পরা কাপড়, বা এমনকি শরীরের বর্জ্য – ব্যবহার করে জাদু করে (Hutton, 2017, p. 19-22)। ইউরোপ থেকে আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা – সবখানেই এই ধারণা পাওয়া যায়। আফ্রিকা আর উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে আবার আরেকটা বিশ্বাস চালু ছিল – ডাইনিরা নাকি অভিশপ্ত জাদুকরী জিনিস, যেমন ছোট ছোট হাড় বা ছাই, শিকারের শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষতি করে (Hutton, 2017, p. 19-22)। জেমস ফ্রেজার (James George Frazer) নামে এক বিখ্যাত পণ্ডিত এই ধরনের জাদুকে বলেছেন অনুকরণমূলক (imitative) জাদু। তার মতে, জাদুকররা দুটো নীতিতে বিশ্বাস করত: এক, একই রকম জিনিস একই রকম ফল দেয় (যেমন, শত্রুর পুতুল বানিয়ে ক্ষতি করলে শত্রুরও ক্ষতি হবে), আর দুই, যে জিনিসগুলো একবার একসাথে ছিল, আলাদা হওয়ার পরেও তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র থেকে যায় (যেমন, কারও চুল দিয়ে জাদু করলে সেই লোকটার ওপর তার প্রভাব পড়বে) (Frazer, 1922)। সহজ কিন্তু বেশ ভয়ংকর ধারণা, তাই না?

কিছু সংস্কৃতিতে আবার এমনও বিশ্বাস ছিল যে, ডাইনিরা তাদের জাদুতে মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে (Hutton, 2017, p. 19-22), আর এর জন্য তারা নাকি বাচ্চাও খুন করে! ইউরোপে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে মায়েরা মানসিক অসুস্থতার (আজকের দিনে যাকে বলে postpartum psychosis) কারণে নিজেদের সন্তানকে হত্যা করেছেন, কিন্তু তখনকার লোকে সেটাকে শয়তানের প্রলোভনে (diabolical temptation) পড়া বলেই ব্যাখ্যা করত (Burns, 2003, p. 141-142)। ভাবা যায়!

ডাইনিদের কাজকর্ম ছিল খুব গোপন। তারা নাকি একা একা অথবা অন্য ডাইনিদের সাথে মিলে কাজ করত। হাটন সাহেব বলছেন, লোকে ভাবত ডাইনিরা রাতে মিলিত হয়, যখন ভালো মানুষেরা ঘুমিয়ে থাকে আর সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় থাকে (Hutton, 2017, p. 22)। আর সেই সব গোপন সমাবেশে নাকি তারা সব সামাজিক নিয়মকানুন ভেঙে ভয়ানক সব কাজ করত – যেমন নরমাংস ভোজন (cannibalism), নিজেদের মধ্যে অবৈধ যৌন সম্পর্ক (incest), আর পোশাক-আশাক ছাড়া ঘুরে বেড়ানো (open nudity) (Hutton, 2017, p. 22)।

আরেকটা ব্যাপার হলো, ডাইনিদের সাথে জীবজন্তুর একটা অদ্ভুত যোগাযোগ আছে বলে বিশ্বাস করা হতো (Hutton, 2017, p. 264-277)। রডনি নীডহ্যাম (Rodney Needham) তো বলেইছেন, এটা নাকি ডাইনি চরিত্রের একটা মূল বৈশিষ্ট্য (Needham, 1978, p. 26, 42)। কোথাও কোথাও ভাবা হতো, ডাইনিরা ইচ্ছেমতো পশুর রূপ (shapeshift) ধরতে পারে (Hutton, 2017, p. 264)। আবার এমনও বিশ্বাস ছিল, ডাইনির আত্মা নাকি শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পশুর রূপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় – এই ধারণাটা আবার শামানদের (shamanism) মধ্যেও দেখা যায় (Hutton, 2017, p. 264)। এছাড়া প্রায় সবখানেই বিশ্বাস করা হতো, প্রত্যেক ডাইনির নাকি একটা পোষা প্রাণী থাকে, যে তাকে সাহায্য করে (animal helper) (Hutton, 2017, p. 264)। ইংরেজিতে এদের বলা হতো ‘ফ্যামিলিয়ার’ (familiars)। ভাবা হতো, এরা আসলে অশুভ আত্মা বা শয়তান, যারা পশুর ছদ্মবেশে থাকে (Hutton, 2017, p. 264)। পরে অবশ্য গবেষকরা যখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তের গল্প শুনলেন, তখন দেখলেন সেখানেও এমন পোষা আত্মার কথা আছে, তবে তারা ডাইনির নিজের আত্মারই অংশ (servant spirit-animals) (Hutton, 2017, p. 269)।

আরেকটা ভয়ানক চর্চা হলো নেক্রোম্যান্সি (Necromancy) – মানে মৃত মানুষের আত্মাকে ডেকে এনে তাদের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ জানা বা অন্য কোনো কাজ করিয়ে নেওয়া। বাইবেলের এন্ডোরের ডাইনির (Witch of Endor) গল্পে এমনটাই দেখা যায় (১ স্যামুয়েল ২৮)। পুরনো দিনের এক ইংরেজ যাজক, এলফ্রিক (Ælfric of Eynsham), ডাইনিদের এই কাজের খুব নিন্দা করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ডাইনিরা নাকি এখনো রাতের আঁধারে চৌরাস্তায় বা পুরনো কবরস্থানে গিয়ে তাদের জাদু দিয়ে শয়তানকে ডাকে, আর শয়তান তখন সেখানে কবর দেওয়া মানুষটার রূপ ধরে এসে হাজির হয়, যেন সে মরে গিয়ে আবার বেঁচে উঠেছে! (Meaney, 1984; Semple, 2003; Semple, 1998; Pope, 1968)।

ডাইনিবিদ্যা আর গ্রামের ওঝা বা ফোক হিলার

ব্যাপারটা কিন্তু একপেশে ছিল না। যেসব সমাজে লোকে কালো জাদু বা ক্ষতিকর ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস করত, তারাই আবার ভালো বা সাদা জাদুতেও (white magic) বিশ্বাস রাখত (Hutton, 2017, p. 24-25)। যেখানে খারাপ জাদুতে বিশ্বাস খুব বেশি, সেখানে সাধারণত আইন দিয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা করা হতো, আর সাধারণ মানুষও তাকে ভয় পেত, ঘৃণা করত। কিন্তু ভালো জাদু, যা দিয়ে উপকার হয় বা বিপদ আপদ দূর করা যায় (apotropaic magic), সেটাকে লোকে মেনে নিত, বা অন্তত সহ্য করত – এমনকি যদি সমাজের মাথা বা ধর্মগুরুরা তার বিরোধিতা করত, তাহলেও (Hutton, 2006, p. 203)।

এই ভালো জাদুকররা কী করতেন? তারা নাকি ডাইনিদের করা জাদু কাটাতেন, অসুস্থ লোকের চিকিৎসা করতেন, ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, হারানো বা চুরি যাওয়া জিনিস খুঁজে দিতেন, এমনকি প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারেও জাদু দিয়ে সাহায্য করতেন (Hutton, 2017, p. x-xi)। ব্রিটেনে আর ইউরোপের আরও কিছু জায়গায় এদের নাম ছিল ‘কানিং ফোক’ (cunning folk) বা ‘ওয়াইজ পিপল’ (wise people) (Hutton, 2017, p. x-xi)। অ্যালান ম্যাকফারলেন (Alan Macfarlane) নামে একজন লিখেছেন, এদের ‘কানিং ফোক’ নামটাই বেশি চালু ছিল, তবে কোথাও কোথাও ‘ব্লেসার’ (blessers) বা ‘উইজার্ড’ (wizards) নামেও ডাকা হতো। আবার ‘সাদা ডাইনি’, ‘ভালো ডাইনি’ বা ‘জাদু কাটানো ডাইনি’ (unbinding witches) – এমন নামও শোনা যেত (Macfarlane, 1999, p. 130)। যদিও ইতিহাসবিদ ওয়েন ডেভিস (Owen Davies) বলছেন, ‘সাদা ডাইনি’ (white witch) শব্দটা আসলে বিশ শতকের আগে তেমন একটা ব্যবহারই হতো না (Davies, 2003, p. xiii)। রোনাল্ড হাটন এদের সবার জন্য একটা সাধারণ নাম ব্যবহার করেন – ‘সেবা জাদুকর’ (service magicians) (Hutton, 2017, p. x-xi)। মজার ব্যাপার হলো, এই ভালো জাদুকররাই আবার অনেক সময় বলে দিতেন কে আসল ডাইনি বা কে ক্ষতি করেছে (Hutton, 2017, p. 24-25)।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই ভালো জাদুকররা ছিলেন সেই সব ডাইনিদের ঠিক উল্টো, যারা ম্যালিফিসিয়াম (maleficium) বা খারাপ জাদু করত (Willis, 2018, p. 27-28)। ইউরোপে যখন ডাইনি নিধনের হিড়িক পড়েছিল, তার প্রথম দিকে কিন্তু এই কানিং ফোকদের গির্জা, সরকার বা সাধারণ মানুষ – সবাই বেশ সহ্য করত (Willis, 2018, p. 27-28)। কিন্তু কিছু গোঁড়া পাদ্রী বা ক্ষমতাবান লোক ছিলেন, যারা এই গ্রামের ওঝা বা জাদুকরদের দেখতে পারতেন না। তারা চেষ্টা করতেন এদেরকেও ডাইনি বলে বদনাম দিতে, খারাপ জাদুর সাথে এদের নাম জড়াতে (Hutton, 2017, p. x-xi)। কিন্তু সাধারণ মানুষ সাধারণত সেই কথায় কান দিত না, তারা ঠিকই এদের কাছে সাহায্য নিতে যেত (Grell & Scribner, 2002, p. 45)। রেজিনাল্ড স্কট (Reginald Scot) নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক, যিনি এসব জাদুটোনায় বিশ্বাস করতেন না, তিনি তো তার বইতে (১৫৮৪ সালে লেখা) বলেই ফেলেছিলেন, “আজকাল ইংরেজিতে কাউকে ‘সে একজন ডাইনি’ বলা আর ‘সে একজন জ্ঞানী মহিলা’ বলার মধ্যে তেমন কোনো তফাত নেই” (Scot, 1584, Booke V, Chapter 9)। ইতিহাসবিদ কিথ থমাস (Keith Thomas) অবশ্য একটু বুঝিয়ে বলেছেন, সমাজে এমন এক ধরনের ‘ডাইনিবিদ্যা’ ছিল, যা দিয়ে লোকে লুকিয়ে অন্যের ক্ষতি করত, আর সেটা সবাই খারাপ চোখেই দেখত। এই অর্থে, ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস মানে হলো, কোনো খারাপ ঘটনা ঘটলে তার জন্য কোনো মানুষকে দায়ী করা, যে নাকি জাদু দিয়ে সেটা ঘটিয়েছে (Thomas, 1997, p. 519)।

এমা উইলবি (Emma Wilby) আবার বলছেন, ইউরোপের গ্রামের এই জাদুকরদের মানুষ ঠিক সোজাসুজি চোখে দেখত না। তাদের যেমন উপকার করার ক্ষমতা আছে বলে ভাবা হতো, তেমনি ক্ষতি করার ক্ষমতাও আছে বলে মনে করা হতো (Wilby, 2005, p. 51-54)। আর এই কারণেই হয়তো কখনও কখনও তাদেরও ডাইনি বলে অভিযুক্ত হতে হতো। উইলবি এমনও বলেছেন, ইংল্যান্ডে যে কিছু ‘ডাইনি’কে শয়তানের সাথে যোগাযোগ রাখার দায়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তারা হয়তো আসলে কানিং ফোকই ছিল। তাদের যে পরীদের (fairy familiars) সাথে যোগাযোগ আছে বলে বিশ্বাস করা হতো, সেটাকেই হয়তো শয়তানের সাথে যোগাযোগ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল (Wilby, 2005, p. 123)।

হাটন সাহেবও বলছেন, এই জাদু জানা নিরাময়কারীদের “কখনও সখনও ডাইনি বলে নিন্দা করা হতো ঠিকই, কিন্তু যত জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে, দেখা গেছে অভিযুক্তদের মধ্যে তারা ছিল খুবই নগণ্য” (Hutton, 2017, p. 24-25)। ডেভিসও একই কথা বলছেন, খুব কম কানিং ফোককেই ডাইনিবিদ্যার অভিযোগে সরকারি আদালতে তোলা হয়েছিল, আর তাদের সাথে ডাইনি বলে অভিযুক্তদের চেয়ে অনেক নরম ব্যবহার করা হতো। এমনকি পুরনো দিনের কিছু আইনেও (যেমন ১৫৩২ সালের জার্মানির আইন বা ১৬১৭ সালের ডেনমার্কের আইন) বলা ছিল যে, যারা গ্রামের সাধারণ জাদু জানে, তাদের বিচার যেন আসল ডাইনিদের মতো না করা হয় (Davies, 2003, p. 164)। রিচার্ড হর্সলি (Richard Horsley) একসময় বলেছিলেন, ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডে নাকি যারা ডাইনি বলে বিচারের শিকার হয়েছিল, তাদের মধ্যে এই ‘ভবিষ্যৎবক্তা-নিরাময়কারী’দের (diviner-healers) সংখ্যাটা বেশ বড় ছিল। কিন্তু পরের দিকের গবেষণা বলছে, সংখ্যাটা আসলে ২ শতাংশেরও কম ছিল (Davies, 2003, p. 167)। তবে হ্যাঁ, হাঙ্গেরির গল্পটা একটু অন্যরকম। ইভা পোকস (Éva Pócs) বলছেন, সেখানে নাকি অভিযুক্ত ডাইনিদের প্রায় অর্ধেকই ছিল নিরাময়কারী (Pócs, 1999, p. 12)। আবার নরওয়েতে, ক্যাথলিন স্টকার (Kathleen Stokker) এর মতে, অভিযুক্ত ডাইনিদের “বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠই” ছিল গ্রামের লোক নিরাময়কারী (Stokker, 2007, p. 81-82)।

বিভিন্ন ধর্মের চোখে ডাইনিবিদ্যা (Religious perspectives)

প্রাচীন মেসোপটেমিয়া: যেখানে শুরু (Ancient Mesopotamian religion)

বহু পুরনো সেই মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা। সেখানে জাদু কিন্তু ধর্ম আর সমাজের একটা খুব জরুরি অংশ ছিল। তারা ভালো জাদু (যা উপকার করে) আর খারাপ জাদু (যা ক্ষতি করে) – এই দুয়ের মধ্যে বেশ স্পষ্ট পার্থক্য করত (Hutton, 2017, p. 49-50)। খারাপ জাদু বা ডাইনিবিদ্যাকে (যার নাম ছিল কিশপু – kišpū (Reiner, 1995, p. 97)) ঠেকানোর জন্য তারা মূলত পাল্টা-জাদু ব্যবহার করত। তবে তাদের আইনেও ব্যবস্থা ছিল – কেউ ডাইনিবিদ্যায় দোষী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড (Hutton, 2017, p. 49-50)! জিভি আবুশ (Tzvi Abusch) নামে এক পণ্ডিত মনে করেন, মেসোপটেমিয়ায় ডাইনি নিয়ে ধারণাগুলো সময়ের সাথে সাথে বদলেছে। একেবারে শুরুর দিকে নাকি ব্যাপারটা ছিল অনেকটা ইউরোপের পুরনো শামানিক (shamanistic) ডাইনিবিদ্যার মতো (Abusch, 2002, p. 65-66)। তখন ডাইনিদের সবসময় খারাপ ভাবা হতো না। তারা ভালো-মন্দ দুই ধরনের কাজই করত, জাদু আর ওষুধের জ্ঞান দিয়ে মানুষের উপকারও করত। এরা সাধারণত থাকত গ্রামের দিকে, আর মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরণ করত, যাকে বলে ভাবোন্মত্ত (ecstatic) অবস্থা (Abusch, 2002, p. 65-66)।

তবে পরের দিকে, মেসোপটেমিয়ায় ডাইনি (পুরুষ হলে কাশশাপু – kaššāpu, মহিলা হলে কাশশাপ্তু – kaššāptu (Reiner, 1995, p. 97)) বলতে বোঝাত এমন একজনকে, যে কিনা লুকিয়ে সমাজের ক্ষতি করে, খারাপ উদ্দেশ্যে জাদু করে। এদের ঠেকানোর জন্য ছিলেন আসিফু (ašipu) – এরা ছিলেন সরকারি পুরোহিত বা ওঝা, যারা ভূত তাড়াতেন বা মন্ত্র পড়তেন (Abusch, 2002, p. 65-66)। এই আসিফুরা বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, রাষ্ট্রীয় ধর্মের প্রতিনিধি। তাদের কাজই ছিল এই ডাইনি বা অন্য অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জাদু করা (Abusch, 2002, p. 65-66)। আর ডাইনি বলে কাদের সন্দেহ করা হতো বেশি? সাধারণত সমাজের নিচু স্তরের, দুর্বল বা একঘরে মানুষদের – যেমন নারী, বিদেশি, অভিনেতা বা ফেরিওয়ালাদের (Hutton, 2017, p. 49-50)।

সেই বিখ্যাত হাম্মুরাবির আইন (Law Code of Hammurabi) (খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতক) – সেখানেও ডাইনিবিদ্যার কথা আছে। কেউ যদি ডাইনি বলে অভিযুক্ত হতো, তাকে এক কঠিন পরীক্ষার (trial by ordeal) মধ্যে দিয়ে যেতে হতো – পবিত্র নদীতে ঝাঁপ দিতে হতো! যদি ডুবে মরত, তাহলে সে দোষী। তার সম্পত্তি পেত অভিযোগকারী। আর যদি বেঁচে ফিরত, তাহলে উল্টো অভিযোগকারীর সম্পত্তি অভিযুক্তকে দিয়ে দিতে হতো (Hutton, 2017, p. 49-50)। কী অদ্ভুত বিচার!

মেসোপটেমিয়ায় ‘মাকলু’ (Maqlû) নামে একটা প্রাচীন বই পাওয়া গেছে, যার মানে হলো ‘পোড়ানো’। এটা লেখা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে। এতে ডাইনিবিদ্যা কাটানোর একটা লম্বা আচারের বর্ণনা আছে (Abusch, 2015, p. 5)। সেই আচারে নানা দেবতাকে ডাকা হতো, ডাইনির একটা পুতুল বানিয়ে পোড়ানো হতো, তারপর সেই ছাই ধুয়ে ফেলে দেওয়া হতো (Abusch, 2002, p. 15-16)। বোঝা যায়, ডাইনিবিদ্যা নিয়ে তাদের ভয় আর তা কাটানোর চেষ্টা কতটা গভীর ছিল।

আব্রাহামিক ধর্মগুলো: বিশ্বাস ও সংঘাত (Abrahamic religions)

মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ডাইনিবিদ্যার ধারণাটা নানা বাঁক নিয়েছে – সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা আর সমাজের নিয়মকানুন একে প্রভাবিত করেছে। একেবারে শুরুতে, নিকট প্রাচ্যে, ডাইনিবিদ্যা ছিল অনেকটা রহস্যময় ব্যাপার, প্রকৃতির সাথে এর যোগ ছিল, স্থানীয় বিশ্বাসের সাথে মিলিয়ে নানা আচার-অনুষ্ঠান আর মন্ত্র ছিল। প্রাচীন ইহুদি ধর্মে (Judaism) জাদুর ব্যাপারটা ছিল বেশ জটিল। কিছু কিছু জাদু, যা রহস্যবাদের (mysticism) সাথে যুক্ত, তা গ্রহণযোগ্য ছিল (Sanhedrin 67b), কিন্তু অন্যগুলোকে মনে করা হতো ধর্মবিরুদ্ধ (heretical) (“Catholic Encyclopedia: Witchcraft”, 1912)। মধ্যযুগে এসে ইসলাম (Islamic) আর খ্রিস্টান (Christian) ধর্মের প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ডাইনিবিদ্যা নিয়ে মানুষের ধারণা বদলাতে থাকে। কখনও একে নিরাময়ের ক্ষমতা বলে সম্মান করা হয়েছে, আবার কখনও ধর্মদ্রোহিতা বলে নিন্দা করা হয়েছে।

ইহুদি দৃষ্টিভঙ্গি (Jewish)

ইহুদি ধর্মে ডাইনিবিদ্যাকে দেখা হতো মূর্তিপূজা (idolatry) আর মৃতদের আত্মা ডাকার (necromancy) মতো নিষিদ্ধ কাজের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে। যদিও কিছু র‍্যাবাই (rabbis) নিজেরাই নির্দিষ্ট কিছু জাদুবিদ্যা করতেন (Green, 2011; Bilefsky, 2009)! তাদের ধর্মগ্রন্থ তানাখ (Tanakh) বা হিব্রু বাইবেলে (Hebrew Bible) জাদুকরী বিশ্বাসকে খুব কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে, একে বলা হয়েছে ‘ঘৃণ্য’ (abomination)। খ্রিস্টান ধর্মও প্রায় একইভাবে ডাইনিবিদ্যাকে নিন্দা করেছে, একে ঘৃণ্য কাজ বলেছে এবং আধুনিক যুগের শুরুতে ডাইনি-শিকারকে সমর্থন করার জন্য বাইবেলের কিছু নির্দিষ্ট অংশকে ব্যবহারও করেছে।

খ্রিস্টীয় দুনিয়া: ভয় ও বিচার (Christian)

খ্রিস্টানদের মধ্যে ডাইনিবিদ্যার ধারণাটা মূলত এসেছে ওল্ড টেস্টামেন্টে (Old Testament) এর বিরুদ্ধে থাকা আইনগুলো থেকে। মধ্যযুগে এবং তার পরে আধুনিক যুগের শুরুতে ইউরোপের বহু খ্রিস্টানই কিন্তু জাদুতে বিশ্বাস করত। তবে তারা গ্রামের ওঝাদের ভালো জাদুর (helpful magic of the cunning folk) থেকে ডাইনিবিদ্যাকে আলাদা করে দেখত। ডাইনিবিদ্যাকে মনে করা হতো শয়তানের (Satan) কাজ, ডেভিলের (Devil) উপাসনা। আর এই বিশ্বাসের ফল হয়েছিল ভয়ানক। বহু মানুষকে ডাইনি সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে, বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে (blame cast for misfortune) (Russell, “Witchcraft”; Pócs, 1999, p. 9-12)। বিশেষ করে প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপে বড় আকারে ডাইনি-বিচার আর ডাইনি নিধন চলেছে বহু বছর ধরে। আলোকিত যুগ (Age of Enlightenment) আসার পর এই বাড়াবাড়ি ধীরে ধীরে কমে আসে। আজকের দিনে খ্রিস্টানদের মধ্যে ডাইনিবিদ্যা নিয়ে নানা মত আছে। কেউ কেউ, বিশেষ করে মৌলবাদীরা, একে চরমভাবে বিশ্বাস করে এবং এর বিরোধিতা করে, আবার অনেকেই এসব আর বিশ্বাসই করে না। ঔপনিবেশিকতার যুগে যখন পশ্চিমা খ্রিস্টানরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল, তখন তাদের হাত ধরে সেখানকার সংস্কৃতিতেও ডাইনিবিদ্যা নিয়ে পশ্চিমা ধারণাগুলো ঢুকে পড়ে।

খ্রিস্টধর্মে, জাদুবিদ্যাকে (sorcery) একসময় ধর্মদ্রোহিতা (heresy) আর ধর্মত্যাগ (apostasy) এর সমতুল্য মনে করা হতো, একে দেখা হতো মন্দ হিসেবে। ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট আর তৎকালীন ইউরোপের শাসকরা সবাই ডাইনিবিদ্যা নিয়ে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিল, যার ফলে শুরু হয়েছিল ব্যাপক ডাইনি-শিকার। পনেরো শতকে এই ভয় আর আতঙ্ক যেন তুঙ্গে ওঠে। হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, আরও অনেকে জেল খাটে, নির্যাতনের শিকার হয়, গ্রামছাড়া হয়, তাদের সহায়-সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত হতো নারীরা, যদিও কিছু জায়গায় পুরুষদের সংখ্যাও কম ছিল না (Gibbons, 1998; Barstow, 1994, p. 23)। স্কটল্যান্ডে তো পুরুষ ডাইনি বোঝাতে ‘ওয়ারলক’ (warlock) শব্দটাই চালু হয়ে গিয়েছিল (McNeill, 1957; Sinclair, 1871)।

এই ডাইনি নিধনের যুগে একটা বই খুব কুখ্যাত হয়েছিল – ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum), ল্যাটিন ভাষায় যার মানে ‘ডাইনিদের হাতুড়ি’। ১৪৮৬ সালে দুই জার্মান পাদ্রী, হেইনরিখ ক্রেমার (Heinrich Kramer) আর জ্যাকব স্প্রেঙ্গার (Jacob Sprenger), এটা লিখেছিলেন। ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট নির্বিশেষে সবাই (Campbell, 2011, p. 27) কয়েকশো বছর ধরে এই বইটাকে ডাইনি চেনার, ধরার, বিচার করার আর শাস্তি দেওয়ার নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহার করেছে। বইটাতে ডাইনিকে শয়তান আর সাধারণত নারী হিসেবেই দেখানো হয়েছে। এটা ইউরোপের আদালতগুলোর জন্য প্রায় হ্যান্ডবুক হয়ে গিয়েছিল। যদিও মজার ব্যাপার হলো, চার্চের নিজস্ব তদন্তকারী সংস্থা, ইনকুইজিশন (Inquisition), কিন্তু এই বইটা ব্যবহার করত না, বরং এর ওপর বেশি নির্ভর করতে মানা করত (Jolly et al., 2002, p. 241)! তবুও, বাইবেলের পর এটাই নাকি ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই ছিল (History of Witches, 2020)! মানুষের ভয় আর অন্ধবিশ্বাসের কী প্রবল শক্তি!

ইসলামে ডাইনিবিদ্যা (Islamic)

ইসলাম ধর্মে জাদু নিয়ে নানা ধরনের ধারণা আর চর্চা (practices) আছে (Savage-Smith, 2004)। একদিকে যেমন কালো জাদু বা কুনজরে (evil eye) বিশ্বাস আছে, তেমনি এর চর্চার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞাও আছে (Khaldûn, 2015, p. 578)। কুরআন (Quran) জাদুর অস্তিত্ব স্বীকার করে, কিন্তু এর ক্ষতি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে বলে। ইসলামে জাদুর চর্চা নিষিদ্ধ (forbidden)। ধর্ম জোর দেয় আল্লাহর দেখানো অলৌকিক ঘটনার (divine miracles) ওপর, জাদু বা ডাইনিবিদ্যার ওপর নয় (Savage-Smith, 2021, p. 87)। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ডাইনিবিদ্যার টিকে থাকাটা দেখায় কীভাবে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস আর সমাজের নিয়মকানুন মিলেমিশে এক জটিল ছবি তৈরি করেছে।

আধুনিক পৌত্তলিকতা: নতুন পথে (Modern paganism)

বিশ শতকে এসে ইংরেজিভাষী দেশগুলো আর ইউরোপে ডাইনিবিদ্যার প্রতি মানুষের আগ্রহ আবার বাড়তে দেখা যায়। ১৯২০ এর দশক থেকে মার্গারেট মারে (Margaret Murray) নামে একজন লেখিকা একটা তত্ত্ব খুব জনপ্রিয় করে তোলেন – যার নাম ‘উইচ-কাল্ট হাইপোথিসিস’ (witch-cult hypothesis)। তার মতে, পুরনো দিনে যাদের ডাইনি বলে মারা হয়েছিল, তারা আসলে এক প্রাচীন, প্রকৃতি-প্রেমী পৌত্তলিক ধর্মের অনুসারী ছিল, যা খ্রিস্টধর্ম আসার পরেও লুকিয়ে টিকে ছিল। যদিও পরের দিকের ঐতিহাসিক গবেষণায় এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে (Adler, 2006, p. 45-47, 84-85; Hutton, 2017, p. 121; Rose, 1962; Hutton, 1993; Hutton, 1999)।

তবে এই তত্ত্বকে ভিত্তি করে বা এর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ১৯৩০ এর দশক থেকে কিছু নতুন দল বা গোষ্ঠী তৈরি হতে শুরু করে, যারা নিজেদের ধর্মকে এক ধরনের ‘ডাইনিবিদ্যা’ বলত। এরা ছিল অনেকটা গুপ্ত সমিতির (initiatory secret societies) মতো। তারা মারে-র তত্ত্ব, পুরনো দিনের জাদু চর্চা (ceremonial magic), অ্যালিস্টার ক্রোলি (Aleister Crowley) নামে এক রহস্যময় ব্যক্তির দর্শন (Thelema), আর প্রাচীন পৌত্তলিক ধর্ম – এইসব কিছু থেকে ধারণা নিত (Hutton, 1999, p. 205-252; Kelly, 1991; Valiente, 1989, p. 35-62)। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর পরিচিত আন্দোলনটার নাম হলো উইক্কা (Wicca)। আজকের দিনে কিছু উইক্কা অনুসারী এবং এই ধরনের আরও কিছু দলের সদস্যরা নিজেদের ‘ডাইনি’ (witches) বলে পরিচয় দেন। তারা ‘ডাইনিবিদ্যা’ (witchcraft) শব্দটাকে ব্যবহার করেন তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস আর জাদু চর্চা বোঝাতে, বিশেষ করে পশ্চিমা ইংরেজিভাষী দেশগুলোতে (Doyle White, 2016, p. 1-9, 73)। পুরনো একটা শব্দ কেমন করে নতুন অর্থ নিয়ে ফিরে এলো, তাই না?

কোথায় কেমন? (Regional perspectives)

২০২২ সালে একটা মজার গবেষণা হয়েছিল। তাতে দেখা গেল, এই যে ডাইনিবিদ্যা, মানে খারাপ জাদু বা ক্ষমতা দিয়ে অন্যের ক্ষতি করার বিশ্বাস – এটা কিন্তু পৃথিবীর নানা জায়গায় এখনও বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে! কোথাও হয়তো মাত্র ৯ শতাংশ লোক এটা বিশ্বাস করে, তো কোথাও আবার ৯০ শতাংশ! গবেষকরা দেখলেন, এই বিশ্বাসের সাথে দেশের অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, শিক্ষার হার, মানুষের গড় আয়ু, এমনকি কে কতটা ধার্মিক – এগুলোরও একটা যোগসূত্র আছে। যেখানে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না, আইনকানুন দুর্বল, শিক্ষার আলো কম, সেখানে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসও বেশি (Gershman, 2022; Witchcraft beliefs are widespread…, 2022)।

ভবিষ্যতে কী হবে এই বিশ্বাসের? গবেষকরা দুটো সম্ভাবনার কথা বলছেন (Gershman, 2022):

  • একটা মত হলো, যত দিন যাবে, দেশ উন্নত হবে, মানুষের নিরাপত্তা বাড়বে, স্বাস্থ্য ভালো হবে, শিক্ষার আলো ছড়াবে, বিজ্ঞান দিয়ে মানুষ সব ব্যাখ্যা করতে শিখবে – তখন ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস আপনাআপনি কমে যাবে। এটাই হলো আধুনিকতার স্বাভাবিক নিয়ম (standard modernization theory)।

  • আরেকটা মত হলো, উল্টোটাও হতে পারে! উন্নয়নের কিছু দিক, যেমন ধরুন ধনী-গরিবের তফাত বেড়ে যাওয়া, বিশ্বায়ন, নতুন নতুন প্রযুক্তি আসা, মানুষের এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া – এগুলো পুরনো সামাজিক নিয়মকানুনকে নাড়িয়ে দিতে পারে। আর তার ফলে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস কমার বদলে হয়তো আরও বেড়ে যেতে পারে! এই ধারণাটা এসেছে মূলত আফ্রিকার সাব-সাহারান অঞ্চলের পরিস্থিতি দেখে।

কে জানে, কোনটা সত্যি হবে!

আফ্রিকা: যেখানে বিশ্বাস এখনও জীবন্ত (Africa)

আফ্রিকা মহাদেশে ডাইনিবিদ্যা (African witchcraft) নিয়ে নানা রকম বিশ্বাস আর চর্চা দেখা যায়। এগুলো সেখানকার মানুষের জীবন, সমাজ, সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা বা আধ্যাত্মিক সাহায্য পাওয়ার চেষ্টার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তবে মুশকিল হলো, পশ্চিমা পণ্ডিতরা প্রায়ই আফ্রিকার এই বিশ্বাসগুলোকে ইউরোপের ডাইনিবিদ্যার ছাঁচে ফেলে বিচার করতে চেয়েছেন, যার ফলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে (Okeja, 2011)। যেমন, ক্যামেরুনের মাকা (Maka) জাতির লোকেরা ‘জাম্বে’ (djambe) নামে এক গুপ্ত শক্তিতে বিশ্বাস করে, যা নাকি মানুষের ভেতরেই থাকে। এটাকে প্রায়ই ‘ডাইনিবিদ্যা’ বা ‘জাদুটোনা’ (sorcery) বলা হয় বটে, কিন্তু এর অর্থ আরও ব্যাপক – এর মধ্যে ক্ষতি করা, সারিয়ে তোলা, এমনকি রূপ বদলানোর (shapeshifting) ক্ষমতাও পড়ে। এটা দেখায়, আফ্রিকার ধারণাগুলোকে ইউরোপীয় শব্দ দিয়ে বোঝা কতটা কঠিন (Geschiere, 1997, p. 13)।

একসময় ইউরোপীয় শাসকরা আফ্রিকায় ডাইনি নিধন বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল বটে, আইন করে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অনেক আফ্রিকান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজেরাই আবার ডাইনিবিদ্যা নিষিদ্ধ করে আইন করেছে! এর ফলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে ডাইনি সন্দেহে মানুষকে নির্যাতন (persecution) করার সুযোগ রয়ে গেছে (Igwe, 2020)।

মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে (Central African Republic) নাকি প্রতি বছর শত শত লোককে ডাইনিবিদ্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, আর অভিযুক্ত মহিলাদের ওপর অত্যাচার চলে (“The dangers of witchcraft”, 2010)। কঙ্গোর কিনশাসাতে (Kinshasa) শিশুদের ডাইনি বলে অভিযোগ করার এক ভয়ংকর প্রবণতা দেখা গেছে। সেখানে কিছু স্বঘোষিত পাদ্রী (self-styled pastors) শিশুদের ওপর নির্যাতন চালায়, ভূত তাড়ানোর (exorcisms) নামে অপব্যবহার করে (Kolwezi: Accused of witchcraft…, 2009)। ঘানাতে (Ghana) আবার আছে বিশেষ ‘ডাইনি শিবির’ (witch camps), যেখানে ডাইনি অভিযোগে গ্রামছাড়া মহিলারা আশ্রয় নিতে পারে – যদিও সরকার এগুলো বন্ধ করে দিতে চায় (Whitaker, 2012)।

পশ্চিম কেনিয়াতে (Kenya) তো আরও ভয়ানক অবস্থা, সেখানে ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্তদের ঘরের ভেতর পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে (Kanina, 2008)। মালাউইতে (Malawi) শিশুদের ডাইনি বলার সমস্যা খুব প্রকট। সেখানে গ্রামের ওঝা আর কিছু খ্রিস্টান পাদ্রী মিলে ভূত তাড়ানোর নামে শিশুদের বাড়িছাড়া করে, তাদের ওপর অত্যাচার চালায় (Byrne, 2011)। নাইজেরিয়াতে (Nigeria) কিছু পেন্টেকোস্টাল পাদ্রী (Pentecostal pastors) নাকি পয়সার লোভে খ্রিস্টধর্মের সাথে ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাসকে গুলিয়ে ফেলেছে, যার ফলে সেখানেও শিশুদের নির্যাতন আর হত্যা করা হচ্ছে (“Stepping Stones Nigeria 2007”)। তবে সিয়েরা লিওনের (Sierra Leone) মেন্ডে (Mende) জাতির লোকেরা আবার ডাইনি সাব্যস্ত হওয়াটাকে খারাপ চোখে দেখে না! তারা মনে করে, এতে বরং অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সাহায্য আর যত্ন পায় (West, 2007, p. 24)। কী বিচিত্র সব ধারণা!

দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু (Zulu) সংস্কৃতিতে আবার আছেন ‘সাঙ্গোমা’ (sangomas) নামে পরিচিত নিরাময়কারীরা। তারা নাকি ভবিষ্যদ্বাণী, আচার-অনুষ্ঠান আর আধ্যাত্মিক শক্তির (mediumship) মাধ্যমে মানুষকে ডাইনিবিদ্যা আর অশুভ আত্মা থেকে রক্ষা করেন (Cumes, 2004, p. 14)। তবে সব সাঙ্গোমাই আসল কিনা, তা নিয়ে সন্দেহও আছে।

আফ্রিকার কিছু জায়গায় লোকে এখনও বিশ্বাস করে যে অসুখবিসুখ হয় ডাইনিদের কারণে। এর ফলে আধুনিক চিকিৎসার প্রতি তাদের একটা গভীর সন্দেহ কাজ করে, যার পরিণাম হয় মারাত্মক। এইচআইভি/এইডস (HIV/AIDS) (Kielburger & Kielburger, 2008) বা ইবোলার (Ebola) (“Ebola outbreak: ‘Witchcraft’ hampering treatment…”, 2014) মতো ভয়ংকর রোগের চিকিৎসা আর প্রতিরোধে এই ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাস বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, যক্ষ্মা (tuberculosis), কুষ্ঠ (leprosy), মৃগীরোগ (epilepsy), এমনকি বুরুলি আলসার (Buruli ulcer) নামে এক ধরনের ঘা-এর চিকিৎসাতেও একই সমস্যা দেখা দেয় (“Social stigma as an epidemiological determinant…”, 2014; Akosua, 2014)। বিশ্বাস যখন জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়!

আমেরিকা: পুরনো আর নতুনের মিশেল (Americas)

উত্তর আমেরিকা: আদিবাসী ও আগন্তুকের গল্প (North America)

উত্তর আমেরিকাতেও ডাইনিবিদ্যা নিয়ে নানা রকম বিশ্বাস পাশাপাশি টিকে আছে। কিছু এসেছে সেখানকার আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে, কিছু আবার ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের সাথে এসেছে, আর সময়ের সাথে সাথে এই দুইয়ের মধ্যে দেওয়া-নেওয়াও হয়েছে (Breslaw, 2011; Berger, 2005)।

চেরোকি (Cherokee) (Kilpatrick, 1998), হোপি (Hopi) (Geertz, 2011), নাভাহো (Navajo) (Perrone et al., 1993) সহ আরও অনেক নেটিভ আমেরিকান (Native American) জাতির মানুষ অশুভ ‘ডাইনি’ চরিত্রে বিশ্বাস করত। তারা ভাবত, এই ডাইনিরা অতিপ্রাকৃত শক্তি দিয়ে তাদের সম্প্রদায়ের ক্ষতি করতে পারে। তাই ধরা পড়লে শাস্তি হতো খুব কঠিন, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হতো (Wall & Morgan, 1998)। তবে তাদেরও ছিল নিজস্ব রক্ষাকবচ – ‘মেডিসিন পিপল’ (medicine people), যারা ছিলেন একাধারে চিকিৎসক এবং ডাইনিবিদ্যার বিরুদ্ধে রক্ষাকর্তা (Kilpatrick, 1998; Geertz, 2011)।

ইউরোপ থেকে যারা এসেছিল, তারা সাথে করে নিয়ে এসেছিল ডাইনিবিদ্যা নিয়ে নিজেদের ধারণা আর ‘উইচক্র্যাফট’ (witchcraft) শব্দটা (Breslaw, 2011)। অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় পরে এই শব্দটাকেই গ্রহণ করে তাদের নিজেদের ক্ষতিকর জাদু বা অলৌকিক ক্ষমতা বোঝাতে। ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যেও ডাইনি নিধনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ম্যাসাচুসেটসের সালেম ডাইনি বিচার (Salem witch trials) সবচেয়ে কুখ্যাত। সেই বিচারগুলোতে বহু নিরীহ মানুষকে ডাইনি অপবাদে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সময়ের সাথে আইনকানুন বদলালেও, ডাইনি সন্দেহে অভিযোগ ওঠা কিন্তু উনিশ শতক পর্যন্তও বন্ধ হয়নি। যেমন, টেনেসি (Tennessee) রাজ্যে ১৮৩৩ সালেও নাকি ডাইনিবিদ্যার অভিযোগে বিচার হয়েছিল!

উত্তর আমেরিকার কিছু ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাস আবার লাতিন আমেরিকা বা এমনকি ক্রীতদাস বাণিজ্যের (slave trade) সূত্রে আফ্রিকা থেকেও প্রভাবিত হয়েছে (Wallace, 2015; Bachmann, 2021; Berger, 2005)। আদিবাসী সংস্কৃতিগুলো ইউরোপীয় ‘ডাইনিবিদ্যা’ শব্দটাকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে শুরু করে (Silverblatt, 1983)। আর তারপর, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, জন্ম নেয় উইক্কার (Wicca) মতো নব্য-পৌত্তলিক ডাইনিবিদ্যা চর্চা (Breslaw, 2011; Berger, 2005)। ইতিহাস কেমন করে বারবার নিজেকে ভাঙে আর গড়ে!

লাতিন আমেরিকা: যেখানে মিলেছে নানা ধারা (Latin America)

লাতিন আমেরিকায় ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাসে মিশে গেছে স্প্যানিশ ক্যাথলিক (Spanish Catholic) ধর্ম, আদিবাসী (Indigenous) ঐতিহ্য আর আফ্রিকান (African) সংস্কৃতির নানা উপাদান। যখন স্প্যানিশরা মেক্সিকো দখল করল, তাদের ইনকুইজিশন (Mexican Inquisition) বা ধর্মীয় আদালত কিন্তু ডাইনিবিদ্যা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। তারা ভাবত, এটা একটা ধর্মীয় ভুল মাত্র, যা স্বীকারোক্তি (confession) আর ক্ষমা (absolution) করলেই মিটে যায়। নৃতাত্ত্বিক রুথ বেহার (Ruth Behar) বলছেন, মেক্সিকোর ইনকুইজিশনের পুরনো দিনের মামলার কাগজপত্র দেখলে মনে হয়, সেখানে যৌনতা, ডাইনিবিদ্যা আর ধর্ম মিলেমিশে এক অদ্ভুত জগৎ তৈরি হয়েছিল, যেখানে স্প্যানিশ, আদিবাসী আর আফ্রিকান – তিন সংস্কৃতিরই ছোঁয়া ছিল (Behar, 1987)। এমনও ঘটনা আছে, যেখানে ইউরোপীয় আর আদিবাসী মহিলারা একসাথে মিলে পুরুষদের বিরুদ্ধে ‘প্রেমের জাদু’ (love magic) বা ‘যৌন ডাইনিবিদ্যা’ (sexual witchcraft) করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন (Lavrin, 1992, p. 192)! অধ্যাপক লরা লুইস (Laura Lewis) মনে করেন, ঔপনিবেশিক মেক্সিকোতে এই ‘ডাইনিবিদ্যা’ ছিল নারীদের, বিশেষ করে আদিবাসী নারীদের, শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের ওপর নিজেদের প্রভাব বা আধিপত্য (hegemony) জাহির করার একটা উপায়, বিশেষ করে তখনকার বর্ণভিত্তিক কাস্তা সমাজে (casta system) (Lewis, 2003, p. 13)। ক্ষমতার লড়াইয়ের এক অন্যরকম রূপ!

ঔপনিবেশিক ব্রাজিলের (colonial Brazil) ইতিহাসেও ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস ছিল খুব স্পষ্ট। সেখানকার ধর্মীয় আদালতের কাছে দেওয়া নানা অভিযোগ আর স্বীকারোক্তি তার প্রমাণ (Ribeiro Júnior, p. 48-49)।

লাতিন আমেরিকায় ‘ব্রুহিরিয়া’ (Brujería) নামে এক ধরনের ডাইনিবিদ্যা প্রচলিত আছে। এটা আসলে ক্যারিবীয় অঞ্চলের আদিবাসী জাদু আর ধর্মীয় প্রথা, ক্যাথলিক বিশ্বাস এবং ইউরোপীয় ডাইনিবিদ্যার এক অদ্ভুত মিশেল (syncretic Afro-Caribbean tradition) (Herrera-Sobek, 2012, p. 174)। ব্রুহিরিয়া ভালো এবং খারাপ – দুই কাজেই ব্যবহার করা হয় বলে মনে করা হয় (Herrera-Sobek, 2012, p. 175)। পুরুষ জাদুকরকে বলে ‘ব্রুজো’ (brujo), আর মহিলাকে ‘ব্রুজা’ (bruja) (Herrera-Sobek, 2012, p. 175)। যারা মূলত চিকিৎসা বা নিরাময়ের কাজ করেন, তাদের আবার ‘কুরিওসো’ (kurioso) বা ‘কুরাডো’ (kuradó) বলা হয়। তারা ছোটখাটো সমস্যা (‘ট্রাবাউ চিকি’ – trabou chikí) থেকে শুরু করে বড় বড় সমস্যা (‘ট্রাবাউ গ্রান্ডি’ – trabou grandi) – যেমন স্বাস্থ্য ফেরানো, সৌভাগ্য আনা বা দুর্ভাগ্য দূর করা, প্রেমে সাহায্য করা – এসবের জন্য জাদু করেন। এই জাদুতে প্রায়ই ‘আলমাসোলা’ (almasola) বা ‘হম্বার চিকি’ (homber chiki) নামে কোনো এক রহস্যময় সত্তার সাহায্য নেওয়া হয় (Blom et al., 2015)।

এশিয়া: প্রাচ্যের রহস্য (Asia)

পূর্ব এশিয়া: নানা রূপ, নানা বিশ্বাস (East Asia)

চীনের সংস্কৃতিতে আছে ‘গং টাউ’ (Gong Tau) নামে এক ধরনের কালো জাদু, যা লোকে ব্যবহার করে প্রতিশোধ নিতে বা টাকা-পয়সা লাভ করতে। জাপানের লোককথায় এমন ডাইনিদের গল্প আছে, যারা নাকি শেয়ালকে পোষা প্রাণী বা ফ্যামিলিয়ার (familiars) হিসেবে ব্যবহার করে। কোরিয়ার ইতিহাসেও এমন মানুষের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাদের মন্ত্র ব্যবহার করার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। আর ফিলিপাইনের (Philippines) আছে ডাইনিদের নিজস্ব ঐতিহ্য, যা পশ্চিমা গল্পগুলোর থেকে একদম আলাদা। সেখানে আবার আদিবাসী শামানরা (indigenous shamans) আছেন, যারা এই ডাইনিদের জাদু কাটানোর চেষ্টা করেন।

মধ্য প্রাচ্য: ইতিহাসের গভীরে (Middle East)

মধ্যপ্রাচ্যে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস বহু পুরনো। জাদু ছিল সেখানকার প্রাচীন সভ্যতা আর ধর্মের অঙ্গ (Hutton, 2017, p. 47-54)।

সেই প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় (সুমেরিয়া, অ্যাসিরিয়া, ব্যাবিলনিয়া) ডাইনি (পুরুষ: কাশশাপু, মহিলা: কাশশাপ্তু) বলতে বোঝাত এমন কাউকে, যে কিনা লুকিয়ে সমাজের ক্ষতি করে, খারাপ উদ্দেশ্যে জাদু করে (Abusch, 2002, p. 65-66)। তারা মূলত ডাইনিবিদ্যা (কিশপু) ঠেকানোর জন্য পাল্টা-জাদু ব্যবহার করত, তবে আইনে ডাইনিদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধানও ছিল (Hutton, 2017, p. 49-50)।

প্রাচীন হিট্টাইটদের (Hittites) মধ্যে আবার নিয়ম ছিল, জাদু করতে হলে রাষ্ট্রের অনুমতি লাগবে। তাই ডাইনিবিদ্যার অভিযোগকে প্রায়ই রাজনৈতিক শত্রু দমনের কাজে লাগানো হতো (Hutton, 2017, p. 50-51)।

প্রাচীন হিব্রুরা (Hebrews) যখন একেশ্বরবাদী হয়ে উঠল, তখন ইহুদি ধর্ম (Judaism) জাদুবিদ্যার কিছু রূপকে (যা রহস্যবাদের সাথে যুক্ত) মেনে নিলেও, অন্যগুলোকে নিষিদ্ধ বা ধর্মবিরুদ্ধ ঘোষণা করল, আর সেগুলোকেই ‘ডাইনিবিদ্যা’ বলে দাগিয়ে দিল (Hutton, 2017, p. 51-52)।

মধ্যযুগে ইসলাম আর খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে এই অঞ্চলে ডাইনিবিদ্যা নিয়ে ধারণা আবার বদলাতে থাকে – কখনও একে চিকিৎসার ক্ষমতা বলে সম্মান করা হয়েছে, তো কখনও ধর্মদ্রোহিতা বলে নিন্দা করা হয়েছে। আজকের দিনেও মধ্যপ্রাচ্যে ডাইনিবিদ্যা নিয়ে নানা ধরনের বিশ্বাস ও সম্প্রদায় দেখা যায়।

ইউরোপ: যেখানে জ্বলেছিল আগুন (Europe)

প্রাচীন রোম: আইনের চোখে জাদু (Ancient Roman world)

ইউরোপে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসের শিকড় খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই ক্লাসিক্যাল যুগে (classical antiquity)। তখন জাদু আর ধর্ম প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে চলত। প্রাচীন রোমের (ancient Rome) পৌত্তলিক যুগেও কিন্তু ক্ষতিকর জাদুর বিরুদ্ধে আইন ছিল (Dickie, 2003, p. 138-142)। বিখ্যাত লেখক প্লিনি (Pliny) জানিয়েছেন, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকেই রোমের আইনে (Twelve Tables) ক্ষতিকর মন্ত্র বলার জন্য বা জাদু দিয়ে অন্যের জমির ফসল নষ্ট করার জন্য শাস্তির বিধান ছিল (Dickie, 2003, p. 138-142)। গাইউস ফিউরিয়াস ক্রেসিমাস (Gaius Furius Cresimus) নামে এক ব্যক্তির বিচারের ঘটনাই শুধু এই আইনের অধীনে নথিভুক্ত আছে (Dickie, 2003, p. 138-142)।

ল্যাটিন ভাষায় ‘ভেনেফিসিয়াম’ (veneficium) শব্দটার দুটো মানে ছিল – বিষ দেওয়া এবং জাদু দিয়ে ক্ষতি করা (যেমন জাদুকরী পানীয় তৈরি), যদিও সেকালের লোকেরা হয়তো এই দুটোর মধ্যে খুব একটা তফাত করত না (Hutton, 2017, p. 59-66)। ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে এক ভয়ংকর মহামারী দেখা দিলে কমপক্ষে ১৭০ জন মহিলাকে এই ‘ভেনেফিসিয়াম’-এর দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়! আবার ১৮৪-১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইতালিতে আরেক মহামারীর সময় প্রায় ৫,০০০ জনকে একই অভিযোগে মারা হয়েছিল (Hutton, 2017, p. 59-66)! হাটন সাহেব বলছেন, এই রিপোর্টগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে রিপাবলিকান রোমানরা যে মাত্রায় ডাইনি নিধন করেছিল, তেমনটা প্রাচীন বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায়নি (Hutton, 2017, p. 59-66)।

৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেক্স কর্নেলিয়া (Lex Cornelia) নামে এক আইন পাশ হয়, যাতে ভেনেফিসিয়ামের মাধ্যমে হত্যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। পরে, সাম্রাজ্যের যুগে, এই আইনটাকেই আরও নানা ধরনের জাদুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে থাকে (Hutton, 2017, p. 59-66), যেমন খারাপ উদ্দেশ্যে পশুবলি দেওয়া। ধরা পড়লে জাদুকরদের নাকি জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো (Dickie, 2003, p. 138-142)!

প্রাচীন রোমান সাহিত্যে, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকেই, আমরা ভয়ংকর সব ডাইনি চরিত্রের দেখা পাই। এরা সাধারণত কুৎসিত বুড়ি, যারা খারাপ মন্ত্র পড়ে, গাছপালা বা পশুপাখি আর মানুষের শরীরের অংশ দিয়ে বিষাক্ত পানীয় বানায়, বাচ্চাদের বলি দেয়, মরা মানুষ বাঁচিয়ে তোলে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, নিজেদের বা অন্যকে পশু বানিয়ে ফেলতে পারে, আর পাতালের দেবতা বা আত্মাদের ডেকে আনে! লুকানের (Lucan) এরিকথো, হোরেসের (Horace) ক্যানিডিয়া, অভিডের (Ovid) ডিপসাস বা অ্যাপুলিয়াসের (Apuleius) মেরো – এরা হলো সেইসব ভয়ংকর ডাইনির উদাহরণ (Hutton, 2017, p. 59-66)। সাহিত্যের পাতাতেও কেমন জীবন্ত হয়ে আছে মানুষের ভয়!

আধুনিক ইউরোপ: উন্মাদনা থেকে নতুন ভাবনা (Early modern and contemporary Europe)

এরপর এলো ইউরোপের আধুনিক যুগ। আর তার সাথেই শুরু হলো বড় আকারে ডাইনি নিধন আর ডাইনি বিচার। এর পেছনে ছিল নানা কারণ – ধর্মীয় রেষারেষি, সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সমস্যা। এই সময়ে ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum) (১৪৮৬) নামের বইটি যেন আগুনে ঘি ঢালল। ডাইনিদের তখন দেখা হতো এমন মানুষ হিসেবে, যারা কালো জাদু দিয়ে ক্ষতি করে, আর প্রায়ই ভাবা হতো তারা শয়তানের সাথে চুক্তি (pact with the Devil) করেছে (Ehrenreich & English, 2010, p. 29, 54)। অভিযোগগুলো আসত মূলত প্রতিবেশীদের কাছ থেকে, আর তার মূলে থাকত সামাজিক টানাপোড়েন। অভিযোগের শিকার হতো প্রায়শই সমাজের দুর্বল মানুষজন – নারী, বুড়ো, বা যারা একটু অন্যরকম ছিল। নারীরা যেমন অভিযোগ করত, পুরুষরাও করত। সাধারণ মানুষ অবশ্য বিশ্বাস করত গ্রামের ওঝা বা ‘কানিং ফোক’রা জাদুবিদ্যা কাটাতে পারে। হাটন বলছেন, এই ওঝাদেরও কখনও কখনও ডাইনি বলে নিন্দা করা হতো, কিন্তু অভিযুক্তদের মধ্যে তারা ছিল সংখ্যালঘু (Hutton, 2017, p. 24-25)। এই ডাইনি-উন্মাদনা (witch-craze) সবচেয়ে বেশি চরমে উঠেছিল ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীতে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল! ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়টা আমাদের দেখায়, কীভাবে কুসংস্কার, ভয় আর ক্ষমতা মিলেমিশে জটিল সমস্যার জন্য সহজ বলির পাঁঠা খুঁজে বের করে। নারীবাদীরা (feminist interpretation) আবার বলেন, এর পেছনে ছিল নারীবিদ্বেষী (misogynist) মনোভাব, যা নারীদেরকেই অশুভ ডাইনিবিদ্যার সাথে জুড়ে দিয়েছিল (Ehrenreich & English, 2010, p. 29, 54)।

স্কটল্যান্ডে (Scotland) এই ডাইনি নিধন ছিল ভয়াবহ। ১৬ শতক থেকে ১৮ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেখানে নাকি ৪০০০ থেকে ৬০০০ লোককে ডাইনি অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল, যা ইউরোপের অন্য জায়গার চেয়ে অনেক বেশি (The Oxford companion to Scottish history, p. 644-645; Cartwright, 2010, p. 32)।

রাশিয়াতেও (Russia) ১৭ শতকে ডাইনি বিচারের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে ডাইনিদের প্রায়ই জাদুবিদ্যা আর অলৌকিক কাজ করার দায়ে অভিযুক্ত করে সমাজচ্যুত (excommunication) বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। রাশিয়ার বিচার পদ্ধতিতে গির্জা আর রাষ্ট্র হাত ধরাধরি করে চলত, যা দেখায় ধর্ম আর রাজনীতির ক্ষমতা কীভাবে মিলেমিশে গিয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে, ডাইনি নিয়ে ভয়টা নিছক কুসংস্কার থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়। যারা শাসকদের জন্য হুমকি হয়ে উঠত, তাদেরকেই ডাইনি অপবাদ দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হতো (Zguta, 1977)।

তবে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপে আবার নতুন হাওয়া বইতে শুরু করে। নব্য-পৌত্তলিক (neopagan) ডাইনিবিদ্যা আন্দোলন শুরু হয়, যারা পুরনো দিনের পৌত্তলিক আর রহস্যময় প্রথাগুলোকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। এর মধ্যে জেরাল্ড গার্ডনারের (Gerald Gardner) হাত ধরে শুরু হওয়া উইক্কা (Wicca) আন্দোলনটিই সবচেয়ে প্রভাবশালী। এরা পুরনো দিনের জাদু, পৌত্তলিক বিশ্বাস আর মার্গারেট মারের (যদিও ভুল প্রমাণিত) উইচ-কাল্ট তত্ত্ব থেকে অনুপ্রেরণা নেয়। উইক্কা জোর দেয় প্রকৃতি, ঈশ্বরত্ব আর ব্যক্তিগত উন্নতির ওপর। ইতালিতেও ‘স্ট্রেঘেরিয়া’ (Stregheria) নামে একই রকম একটা আন্দোলন দেশের পৌত্তলিক অতীতের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। এই নতুন আন্দোলনের অনেকেই নিজেদের ‘ডাইনি’ বলে পরিচয় দেন। ইউরোপের নব্য-পৌত্তলিক ডাইনিবিদ্যা এখন নানা রূপে, নানা ঐতিহ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

ওশেনিয়া: দ্বীপপুঞ্জের জাদু (Oceania)

প্রশান্ত মহাসাগরের কুক দ্বীপপুঞ্জের (Cook Islands) মাওরি (Māori) ভাষায় কালো জাদুকে বলে ‘পুরেপুরে’ (purepure) (Buse, 1995, p. 372)। আর তাদের পুরোহিত বা ওঝাদের নাম হলো ‘তা’উঙ্গা’ (ta’unga) (Buse, 1995, p. 471)।

পাপুয়া নিউ গিনিতে (Papua New Guinea) ডাইনি সন্দেহে মানুষ হত্যার ঘটনা আজও ঘটে। অনুমান করা হয়, সেখানে প্রতি বছর ৫০ থেকে ১৫০ জন অভিযুক্ত ডাইনিকে মেরে ফেলা হয় (“Papua New Guinea’s ‘Sorcery Refugees’…”, 2015)! ২০০৮ সালে তো সেখানকার দুটো প্রদেশেই পঞ্চাশ জনের বেশি মানুষকে ডাইনিবিদ্যা করার অভিযোগে হত্যা করা হয়েছিল বলে খবর বেরিয়েছিল (“Woman suspected of witchcraft burned alive”, 2009)।

পাপুয়া নিউ গিনির মিলনে বে প্রদেশে (Milne Bay Province) ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস আর তার চর্চা দুটোই খুব চালু আছে (Lawrence, 2015)। তবে মজার ব্যাপার হলো, দেশের অন্য জায়গার তুলনায় এই প্রদেশে আর পাশের সামারাই দ্বীপপুঞ্জে (Samarai Islands) ডাইনি অভিযোগে বা সাধারণভাবে মহিলাদের ওপর অত্যাচার অনেক কম হয় (Lawrence, 2015)। কেউ কেউ মনে করেন, এই অঞ্চলে ডাইনিবিদ্যার দীর্ঘ ইতিহাস হয়তো সেখানকার সমাজে মহিলাদের মর্যাদা বাড়াতে সাহায্য করেছে (Lawrence, 2015)। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য!

শিল্প আর সাহিত্যে ডাইনি (Witches in art and literature)

ডাইনিরা কি শুধু মানুষের মুখে মুখে ফেরে? না, তারা শিল্পীর তুলিতে, লেখকের কলমেও বারবার ফিরে এসেছে। যদিও তাদের সবচেয়ে পুরনো ছবিগুলো পাওয়া যায় ইউরোপের আধুনিক যুগের শুরুর দিকে, বিশেষ করে মধ্যযুগ আর রেনেসাঁসের সময়ে। পণ্ডিতরা মনে করেন, ক্যানন এপিস্কোপি (Canon Episcopi) নামে পুরনো এক বই, যেখানে শয়তান আর ভূতপ্রেতের কথা ছিল, আর সেই কুখ্যাত ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum) (১৪৮৭) – এইগুলোই নাকি শিল্পীদের ডাইনি আঁকতে বা লেখকদের ডাইনি নিয়ে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল (Simons, 2014)। গল্প-উপন্যাসে ডাইনিরা নানা রূপে এসেছে। বেশিরভাগ সময়ই তারা মহিলা, তবে সবসময় নয়। কখনও তারা ভয়ংকর খলনায়িকা (villains), আবার কখনও বা শক্তিশালী নায়িকা (heroines) (Hutton, 2018)। ডাইনিরা যেন মানুষের কল্পনা আর ভয়ের এক চিরন্তন প্রতিচ্ছবি।

উইচহান্ট বা ডাইনি নিধন

সাধারণ কথা

যেসব সমাজে লোকে ডাইনি আর জাদুটোনায় বিশ্বাস করত, তারা কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকত না। তারা ভাবত, এই অশুভ শক্তিকে ঠেকানোর নানা পথ আছে। একটা খুব চালু উপায় ছিল নিজেদের বাঁচানোর জন্য বিশেষ ধরনের জাদু (protective magic) করা বা ডাইনির করা জাদুর বিরুদ্ধে পাল্টা জাদু (counter-magic) করা। এর জন্য প্রায়শই গ্রামের ওঝা, ‘কানিং ফোক’ (cunning folk) বা ‘উইচ-ডাক্তার’দের (witch-doctors) ডাক পড়ত (Hutton, 2017, p. 24-25)। তারা নানা রকম আচার-অনুষ্ঠান করত, মন্ত্র পড়ত, আর তাবিজ (talismans) বা কবচ (amulets) দিত। আবার ধরুন, ঘরের দেওয়ালে বিশেষ ধরনের চিহ্ন (anti-witch marks) এঁকে দেওয়া, কাঁচের বোতলে (witch bottles) বা গোল বলের (witch balls) মধ্যে বিদঘুটে সব জিনিস ভরে রাখা, এমনকি বাড়ির দেওয়ালের ভেতরে ঘোড়ার মাথার খুলি পুঁতে রাখার মতো অদ্ভুত সব কাজও করা হতো (Hoggard, 2004, p. 167)।

আরেকটা পথ ছিল, যাকে ডাইনি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাকে গিয়ে ধরা। তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বা জোরজবরদস্তি করে রাজি করানো হতো যাতে সে তার করা জাদু ফিরিয়ে নেয় (Hutton, 2017, p. 24-25)। অনেক সময় আবার উত্তেজিত জনতা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিত। অভিযুক্ত ডাইনিকে শারীরিকভাবে শাস্তি দিত – গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিত, মারধোর করত, অকথ্য নির্যাতন করত, এমনকি মেরেই ফেলত। তবে, ইতিহাসবিদ হাটন সাহেব বলছেন, বেশিরভাগ সমাজেই লোকে এই নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার চেয়ে আইনি পথে যাওয়াই বেশি পছন্দ করত। অভিযুক্ত ডাইনিকে আদালতে হাজির করা হতো, বিচার হতো, আর দোষী সাব্যস্ত হলে আইন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হতো (Hutton, 2017, p. 24-25)। বিচারব্যবস্থা! সে যুগেও ছিল, তবে তার ধরন ছিল আজকের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।

ভাবছেন, ডাইনি নিধন বা ডাইনি নিধন (witch purge) ব্যাপারটা কী? সহজ কথায়, কিছু মানুষকে ‘ডাইনি’ (witch) বলে দাগিয়ে দিয়ে তাদের খুঁজে বের করা। উদ্দেশ্য? হয় তাদের বিচার করা, নয়তো তাদের ডাইনিগিরির (witchcraft) কোনো প্রমাণ যদি পাওয়া যায়, সেই আশায়। সেই সুদূর অতীতে, যখন মানুষ সবেমাত্র গুছিয়ে বসতে শুরু করেছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে, তখন এই নিয়ে বেশ কড়া আইনকানুন ছিল। কেউ যদি আজেবাজে মন্ত্রতন্ত্র (evil spells) বা উল্টোপাল্টা জাদুটোনা (incantations) করত, তাহলেই বিপদ! সেটা ছিল একেবারে নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে শাস্তিও ছিল বেশ কঠিন।

ইউরোপে যখন মধ্যযুগ (medieval Europe) এলো, তখন বিষয়টা অন্য দিকে মোড় নিল। খ্রিস্টধর্মের (Christianity) চোখে যারা একটু অন্যরকম, মানে ধর্মবিরোধী (heresy), তাদের ওপর প্রায়ই ডাইনি হওয়ার দায় চাপানো হতো। এরপর এলো এক ভয়ঙ্কর সময়। ইউরোপ জুড়ে সে কী ডাইনি খোঁজার হিড়িক! সময়টা মোটামুটি ১৪৫০ থেকে ১৭৫০ সাল। একদিকে চলছে ধর্ম নিয়ে বিরাট গোলযোগ (Counter Reformation), আরেকদিকে ত্রিশ বছরের যুদ্ধ (Thirty Years’ War) – সব মিলিয়ে এক চরম অস্থির পরিস্থিতি। আর এর মধ্যেই, ভাবা যায়, প্রায় ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার মানুষকে ডাইনি সন্দেহে মেরেই ফেলা হলো! (Golden, 1997; Levack, 2006)। সংখ্যাটা শুনলেই গা শিউরে ওঠে। ইউরোপে ডাইনি নামের কলঙ্ক নিয়ে শেষ মৃত্যুদণ্ডটা কার্যকর হয়েছিল ১৮ শতকে।

কিন্তু কার ঘাড়ে পড়ত এই দোষ? কেন লোকে একজনকে ডাইনি বলে আঙুল তুলত? এর পেছনে প্রায়ই থাকত সমাজের নানা রকম খিটিমিটি, অভাব-অনটন আর ব্যক্তিগত রেষারেষি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের শিকার হতেন নারীরা, যদিও কিছু কিছু জায়গায় আবার পুরুষদেরই বেশি করে ডাইনি বলে ধরা হতো, যেমন আইসল্যান্ডে (Witchcraft in 17th century Iceland, 2019)। অনেক সমাজে আবার বয়স্ক মানুষদের ওপর দোষ চাপানো হতো বেশি। তবে সব জায়গায় বয়সটাই যে বড় কথা ছিল, তা নয়; এমনকি কোথাও কোথাও কিশোর-কিশোরীদেরও ডাইনি বলে অভিযুক্ত করার নজির আছে (Hutton, 2017, p. 15)। কী অদ্ভুত ব্যাপার!

হাঙ্গেরিয়ান গবেষক ইভা পোকস (Éva Pócs) বলছেন, ডাইনি বলে অভিযোগ তোলার পেছনে সাধারণত চার ধরনের কারণ দেখা যায়। এর প্রথম তিনটি কারণ অবশ্য আগেই উল্লেখ করেছিলেন রিচার্ড কিকহেফার (Richard Kieckhefer) নামে আরেকজন, চতুর্থটি যোগ করেছেন ক্রিস্টিনা লার্নার (Christina Larner) (Pócs, 1999, p. 9-10):

১. কাউকে হয়তো হাতেনাতে ভালো বা খারাপ কোনো জাদুটোনা (sorcery) করতে দেখা গেছে।
২. হয়তো কোনো ভালো ওঝা বা নিরাময়কারী তার রোগী অথবা গ্রামের মোড়লদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে (যেমন, তার চিকিৎসায় কোনো কাজ হয়নি)।
৩. লোকটা হয়তো আর কিছুই করেনি, শুধু তার প্রতিবেশীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল, তাদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত।
৪. অথবা, লোকটার হয়তো আগে থেকেই ডাইনি বলে একটা দুর্নাম ছিল; তার চালচলন বা কথাবার্তায় লোকে অলৌকিক বা গুপ্তবিদ্যার (occultism) আভাস পেত।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, কারণগুলো সবসময় যে সরাসরি জাদুটোনাকে কেন্দ্র করেই হতো, তা নয়; বরং সামাজিক সম্পর্ক, বিশ্বাস আর সন্দেহই অনেক সময় বড় ভূমিকা রাখত।

ভাবছেন, ডাইনি নিধন বুঝি শুধু সেকেলে গল্প? মোটেই না। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজও পৃথিবীর নানা প্রান্তে ডাইনি সন্দেহে মানুষ খোঁজা, তাদের বলির পাঁঠা বানানো (scapegoating), সমাজ থেকে বের করে দেওয়া বা এমনকি মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে (Pearlman, 2013)। অনেক সংস্কৃতিতেই এখনও ‘ডাইনিবিদ্যা’ বা অশুভ জাদুতে বিশ্বাস বেশ শক্তভাবেই টিকে আছে (Ankarloo & Clark, 2001)। শুধু যে সাধারণ মানুষ আইন হাতে তুলে নেয় তা-ই নয়, কিছু দেশে তো খোদ সরকারই ডাইনিবিদ্যা বা জাদুবিদ্যা করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়! যেমন সৌদি আরবের কথা বলা যায়, সেখানে ২০১৪ সালেও এই অভিযোগে মানুষের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে (Saudi woman beheaded…, 2011; Saudi man executed…, 2012; di Giovanni, 2014)। পৃথিবীর অন্য কোণে, যেমন আফ্রিকায় (Africa), এশিয়ায় (Asia), বিশেষ করে সাহারার দক্ষিণের আফ্রিকায় (sub-Saharan Africa) বা পাপুয়া নিউগিনিতে, আজও নাকি ডাইনি খোঁজাখুঁজি চলে। এমনকি সৌদি আরব, ক্যামেরুন বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে ডাইনিবিদ্যার বিরুদ্ধে রীতিমতো সরকারি আইনও রয়েছে!

আরেকটা ভয়াবহ দিক হলো, ডাইনি সন্দেহে যে অত্যাচার চালানো হয়, তার শিকার প্রায়শই হয় নারীরা। এটাকে তাই নারীদের ওপর হওয়া সার্বিক সহিংসতারই (violence against women) একটা অংশ হিসেবে দেখা হয় (“A Global Issue that Demands Action”, 2013; Diwan, 2004; Witch Hunts in Modern South Africa, 2009; Nepal: Witchcraft as a Superstition…, 2011; Adinkrah, 2004)। যেমন ধরুন, তানজানিয়ার কথা। ২০১৪ সালের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, সেখানে ডাইনি সন্দেহে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ জন বয়স্ক মহিলাকে খুন করা হয় (“World Report on Violence and Health”, 2014)! কী মর্মান্তিক! শুধু বয়স্ক মহিলারাই নন, শিশুরাও এর শিকার হয়। আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ তুলে শিশুদের ওপরও ভয়ানক অত্যাচার চালানো হয় (Bussien et al., 2011; Cimpric, 2010; Molina, 2006; Human Rights Watch, 2006)। এমনকি উন্নত দেশ যেমন ব্রিটেনেও, অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেছে। ভিক্টোরিয়া ক্লিম্বি (Victoria Climbié) নামের শিশুটির হত্যার ঘটনা তো বেশ আলোড়ন তুলেছিল (Witchcraft murder…, 2012; Dangerfield, 2012)।

এখন অবশ্য ‘উইচ-হান্ট’ (witch-hunt) শব্দটা শুনলে আমরা একটু অন্য জিনিসও বুঝি। ধরুন, খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে একটা তদন্ত (investigation) হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে, বিরাট কোনো ষড়যন্ত্র (subversive activity) বা বিশ্বাসঘাতকতা (disloyalty) ধরা হবে। কিন্তু আসল মতলব হয়তো অন্য – কাউকে হেনস্তা করা বা অপদস্থ করা। এর মধ্যে মিশে থাকতে পারে অহেতুক ভয় বা আতঙ্ক (moral panic) (Goode & Ben-Yehuda, 2010), এমনকি গণ হিস্টিরিয়াও (mass hysteria) (Martin, 2010)। সেই পুরনো দিনের ডাইনি নিধনের ছায়া যেন আজও নানা রূপে আমাদের তাড়া করে ফেরে!

উইচহান্টের নৃতাত্ত্বিক কারণসমূহ (Anthropological causes)

আচ্ছা, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? ইউরোপ, আফ্রিকা, নিউ গিনি – পৃথিবীর কত দূরে দূরে এই জায়গাগুলো! সংস্কৃতিও কত আলাদা। অথচ সেই ১৯৬০ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, সবখানেই এই ডাইনি নিধনের চল (practice) আছে। নৃতাত্ত্বিকরা (anthropologists) তো এই মিল দেখে অবাক! তারা এর পেছনের কারণটা জানতে খুব আগ্রহী হয়ে উঠলেন।

আসলে, জাদু (magic) বা ভবিষ্যদ্বাণীতে (divination) বিশ্বাস, কিংবা নিজের ভালো চেয়ে (যেমন আয়ু বাড়ুক, প্রেম হোক) জাদু দিয়ে কিছু করার চেষ্টা – এগুলো কিন্তু কমবেশি সব মানব সমাজেই (human cultures) পাওয়া যায়।

আর ডাইনিবিদ্যায় (witchcraft) বিশ্বাসটাও পৃথিবীর নানা সমাজে অনেকটা একই রকম। যেন একটা তৈরি করা ছক (framework)। জীবনে হঠাৎ করে খারাপ কিছু ঘটলে – অসুখবিসুখ, মৃত্যু – মানুষ এই ছকে ফেলে তার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। আর বেচারা ডাইনি বা যাদুকর (witch sorcerer), সে হয়ে যায় সব মন্দের প্রতীক (image of evil) (La Fontaine, 1998)।

যখন ইউরোপীয়রা পৃথিবী ঘুরতে বেরোল (Age of Exploration), আমেরিকা (Americas), এশিয়া, আফ্রিকার নানা জাতির কথা লিখল, তখন তাদের লেখা পড়ে মনে হতে পারে, শুধু ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসই নয়, এই যে মাঝে মাঝে ডাইনি নিধনের (witch-hunts) ধুম পড়ে যায়, এটাও বোধহয় সব মানুষের মধ্যেই আছে – একটা সার্বজনীন ব্যাপার (human cultural universal) (Behringer, 2004)।

একটা গবেষণায় তো দেখা গেছে, যারা ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস করে, তাদের মধ্যে সমাজবিরোধী ভাব (antisocial attitudes) বেশি। তারা অন্যদের কম বিশ্বাস (trust) করে, দানধ্যান (charitable giving) কম করে, দল বেঁধে কোনো কাজেও (group participation) তেমন থাকে না (Gershman, 2016)। আরেকটা মজার (আসলে তো ভয়ঙ্কর!) তথ্য পাওয়া গেছে তানজানিয়া (Tanzania) থেকে। সেখানে যখন খুব বেশি বৃষ্টি হয়ে আয় রোজগারে টান পড়ে, তখন ‘ডাইনি’ সন্দেহে মানুষ খুন করার ঘটনা হু হু করে বেড়ে যায় (Miguel, 2005)!

উইচহান্টের ইতিহাস

প্রাচীন নিকট প্রাচ্য (Ancient Near East)

শাস্তির ব্যাপারটা কিন্তু আজকের নয়। সেই প্রাচীন মিশর (ancient Egypt) বা ব্যাবিলনেও (Babylonia), একদম পুরনো দিনের আইনগুলোতেও (earliest law codes), কেউ খারাপ জাদু (malevolent magic) করলে তার শাস্তির কথা লেখা আছে। হাম্মুরাবির কোড (Code of Hammurabi) (সময়টা সেই খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১৮০০ বছর আগে) তো একেবারে খোলাখুলিই বলছে:

যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কারো উপর জাদু (spell) করে এবং তা প্রমাণিত না হয়, তবে যার উপর জাদু করা হয়েছে সে পবিত্র নদীতে (holy river) যাবে; পবিত্র নদীতে সে ডুব দেবে। যদি নদী তাকে গ্রাস করে আর সে ডুবে যায়, তবে যে জাদু করেছিল সে তার বাড়িঘরের মালিক হবে। আর যদি নদী তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে এবং সে অক্ষত থাকে, তবে যে জাদু করেছিল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। যে নদীতে ডুব দিয়েছিল, সে ঐ লোকটির বাড়িঘরের মালিক হবে যে তার উপর জাদু করেছিল। (The Avalon Project; “Witchcraft”, Catholic Encyclopedia)

হিব্রু বাইবেলেও (Hebrew Bible) জাদুবিদ্যাকে (sorcery) ভালো চোখে দেখা হয়নি। যেমন, দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ১৮:১০-১২ অংশে আছে: ‘তোমাদের মধ্যে এমন কাউকে যেন পাওয়া না যায় যে… ভাগ্য গণনা করে (divination)… বা যাদুকর (sorcerer)… বা মন্ত্র পড়ে (casts spells)… কারণ যে এই কাজগুলো করে, সে প্রভুর (Lord) কাছে ঘৃণ্য।’ আবার যাত্রাপুস্তকে (Exodus) ২২:১৮ তো সোজাসাপ্টা নির্দেশ: ‘ডাইনিকে বাঁচতে দিয়ো না’ (“Witchcraft”, Catholic Encyclopedia)। ১ স্যামুয়েলের (1 Samuel) ২৮ অধ্যায়ে শৌলের (Saul) গল্প আছে, যিনি ‘ফ্যামিলিয়ার আত্মাওয়ালা (familiar spirits) আর জাদুকরদের (wizards) দেশছাড়া করেছিলেন’ (1 Samuel 28:3)। এসব থেকে বোঝা যায়, জাদুবিদ্যা করলে কপালে অন্তত নির্বাসন (exile) জুটত।

আবার দেখুন, জুডিয়ার দ্বিতীয় মন্দির যখন ছিল (Judaean Second Temple period), সেই ১ম খ্রিস্টপূর্বাব্দে, রাব্বি শিমন বেন শেতাখ (Rabbi Simeon ben Shetach) নামে একজন নাকি আসকালন (Ascalon) শহরে একদিনেই আশি জন মহিলাকে ডাইনি সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন! তবে গল্প এখানেই শেষ নয়। পরে ওই মহিলাদের আত্মীয়রা মিথ্যে সাক্ষী সাজিয়ে রাব্বির ছেলেরই মৃত্যুদণ্ড ঘটিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল (Yerushalmi Sanhedrin, 6:6)। বোঝো ঠ্যালা!

প্রাচীন গ্রেকো-রোমান জগৎ (Ancient Greco-Roman world)

প্রাচীন এথেন্সে (Classical Athens) আবার জাদু নিয়ে কোনো আলাদা আইন পাওয়া যায় না (Collins, 2008, p. 133)। তবে ‘ফার্মাকা’ (pharmaka) নিয়ে মামলার নজির আছে। এই শব্দটার মানে ঠিক পরিষ্কার নয় – হতে পারে ‘বিষ’ (poison), ‘ওষুধ’ (medicine), আবার ‘জাদুকরী দাওয়াই’ও (magical drug) হতে পারে। গণ্ডগোল হতো তখনই, যখন এই ফার্মাকা কারো ক্ষতি করত বা মেরে ফেলত (Collins, 2008, pp. 133-134)। যেমন ধরুন, অ্যান্টিফোন (Antiphon) নামে একজন এক ভাষণে (“সৎ মায়ের বিরুদ্ধে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ”) এক মহিলার কথা বলছেন, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ফার্মাকন দিয়ে স্বামীকে খুন করার ফন্দি এঁটেছেন। যদিও এক দাসকে আগেই এই দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, মৃতের ছেলে বলছিল, আসল দোষী তার সৎ মা-ই (Collins, 2008, p. 135)।

ক্লাসিক্যাল গ্রীসে ডাইনিবিদ্যার দায়ে সবচেয়ে বিখ্যাত বিচার বোধহয় লেমনোসের থেওরিসের (Theoris of Lemnos) ঘটনাটা। বেচারিকে তার ছেলেমেয়ে সমেত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটু আগে। অভিযোগ? তিনি নাকি মন্ত্র পড়তেন (casting incantations) আর ক্ষতিকর ওষুধপত্র (harmful drugs) ব্যবহার করতেন (Collins, 2001)।

প্রাচীন রোমেও (ancient Rome), যখন প্যাগান ধর্ম (pagan era) চালু, তখনও ক্ষতিকর জাদুর (harmful magic) বিরুদ্ধে আইন ছিল (Dickie, 2003)। প্লিনি (Pliny) লিখেছেন, সেই খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকের টুয়েলভ টেবিলসের আইনে (laws of the Twelve Tables) খারাপ মন্ত্র পড়লে বা জাদু দিয়ে অন্যের জমির ফসল নষ্ট করলে শাস্তির কথা বলা ছিল (Dickie, 2003)। তবে এই আইন দিয়ে বিচার হয়েছে বলে মাত্র একজনের কথাই জানা যায় – গাইয়ুস ফিউরিয়াস ক্রেসিমাস (Gaius Furius Cresimus) (Dickie, 2003)।

ল্যাটিন ভাষায় ‘ভেনেফিসিয়াম’ (veneficium) বলে একটা শব্দ ছিল। এর মানে দুটোই হতে পারত – বিষ দেওয়া (poisoning), আবার জাদু দিয়ে ক্ষতি করাও (causing harm by magic), যেমন ধরুন জাদুকরী পানীয় খাইয়ে। সেকালের লোকেরা হয়তো এ দুটোর মধ্যে খুব একটা তফাৎও করত না (Hutton, 2017)। ঘটনা শুনুন, ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে এক সাংঘাতিক মহামারী (deadly epidemic) হলো। আর তার জন্য ‘ভেনেফিসিয়াম’-এর দায়ে প্রায় ১৭০ জন মহিলাকে দেওয়া হলো মৃত্যুদণ্ড! (Livy, Book VIII, Chapter xviii)। আবার ১৮৪ থেকে ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ইতালিতে আরেক মহামারী, আর তাতে প্রায় পাঁচ হাজার লোককে একই দায়ে বিচার করে মেরে ফেলা হলো (Hutton, 2017)। ঐতিহাসিক হাটন (Hutton) তো লিখেই ফেলেছেন, এই রিপোর্ট যদি সত্যি হয়, ‘তাহলে রিপাবলিকান রোমানরা (Republican Romans) এমনভাবে ডাইনি নিধন করেছিল, যা প্রাচীন দুনিয়ার অন্য কোথাও ভাবাই যায় না’ (Hutton, 2017)।

পরে, ৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এল লেক্স কর্নেলিয়া (Lex Cornelia de sicariis et veneficis) আইন। এই আইন অনুযায়ী, ‘ভেনেফিসিয়াম’ দিয়ে কাউকে মারলে শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড (Hutton, 2017)। শুধু তাই নয়, ক্ষতিকর ওষুধ বা বিষের লেনদেন বা নিজের কাছে রাখা, জাদুটোনার বই (magical books) বা ঐসব হাবিজাবি গুপ্ত জিনিসপত্র (occult paraphernalia) রাখাও বারণ ছিল। সম্রাট অগাস্টাস (Emperor Augustus) এসব বন্ধ করতে আইন আরও কড়া করলেন। যেমন, ৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি রোমের প্রায় দু’হাজার জাদুকরী বই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন, শুধু সিবিলিন বইয়ের (Sibylline Books) কিছু জরুরি অংশ বাদে (Suetonius; Garnsey & Saller, 1987)। সম্রাট ক্লডিয়াসের (Tiberius Claudius) আমলে ৮৫ জন মহিলা আর ৪৫ জন পুরুষকে জাদুবিদ্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (Ogden, 2002)। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের দিকে এসে লেক্স কর্নেলিয়া আইনটা আরও নানা ধরনের ক্ষতিকর জাদুর বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে লাগল (Hutton, 2017)। আর জাদুকরদের (magicians) শাস্তি? পুড়িয়ে মারা (burnt at the stake) (Dickie, 2003)।

এই যে রোমান সাম্রাজ্যে (Roman Empire) ডাইনিদের ধরে ধরে শাস্তি দেওয়া, এটা চলেছিল সেই চতুর্থ শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত। তারপর যখন ৩৯০ সালের দিকে খ্রিস্টধর্মই হয়ে গেল রাজ্যের প্রধান ধর্ম (Roman state religion), তখন এই বাড়াবাড়িটা একটু কমল (Behringer, 2004)।

মধ্যযুগ (Middle Ages)

সেই শুরুর দিনগুলো: যখন খ্রিস্টধর্ম এল

এক জার্মান লেখক ছিলেন, উইলহেম গটলিব সোল্ডান (Wilhelm Gottlieb Soldan)। তিনি তার ‘হিস্ট্রি অফ দ্য উইচক্র্যাফ্ট ট্রায়ালস’ (History of the Witchcraft Trials) বইয়ে একটা ভারী মজার (অথবা দুঃখের) কথা বলেছেন। হাইপেশিয়া (Hypatia) নামে একজন বিদুষী মহিলা ছিলেন, গণিত জানতেন, দর্শন বুঝতেন। ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে কিছু লোক তাকে মেরে ফেলে, কারণ তারা ভাবত তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার সিরিলের (Cyril of Alexandria) প্রভাবের জন্য হুমকি। সোল্ডান সাহেব বলছেন, এই হাইপেশিয়াই নাকি খ্রিস্টান শাসকদের (Christian authorities) হাতে শাস্তি পাওয়া প্রথম নামকরা ‘ডাইনি’! (Soldan, 1843)। যদিও, সিরিলের হাত ছিল কিনা, তা নিয়ে সেকালেও কথা ছিল (Watts, 2008), আর ঘটনার যে মূল বিবরণ সক্রেটিস স্কলাস্টিকাস (Socrates Scholasticus) লিখে গেছেন, তাতে ধর্মটর্মের কোনো ব্যাপারই নেই (Cameron, Long, & Sherry, 1993)। কে জানে সত্যিটা কী!

আবার ষষ্ঠ শতকে জর্ডানেস (Jordanes) নামে একজন ‘গেটিকা’ (Getica) বলে একটা বই লেখেন। তাতে হুন (Huns) জাতির উদ্ভবের এক গল্প আছে। সেখানে গথ (Goths) জাতির মধ্যে ডাইনি তাড়ানোর কথা পাওয়া যায়। এক কিংবদন্তীর রাজা, নাম ফিলিমার (King Filimer), তিনি নাকি:

…তার লোকেদের মধ্যে কিছু ডাইনি খুঁজে পেলেন, যাদের তিনি নিজের ভাষায় বলতেন হালিউরুনাই (Haliurunnae)। এদের সন্দেহ হওয়ায় তিনি তাদের দল থেকে বের করে দিলেন, তার সেনাবাহিনী থেকে দূরে, একা একা বনেবাদাড়ে ঘুরতে বাধ্য করলেন। সেখানে ঘুরতে দেখে কিছু নোংরা আত্মা (unclean spirits) তাদের পেয়ে বসল, আর জন্ম হলো এক বুনো জাতির। তারা থাকত জলা জায়গায়, ছিল বেঁটেখাটো, নোংরা আর দুর্বল – মানুষ বলে চেনার জো নেই। তাদের কোনো ভাষাও ছিল না, কেবল মানুষের কথার মতো সামান্য কিছু আওয়াজ করত। (Jordanes, § 24)

শুরুর দিকে চার্চের (Church) হাবভাব কিন্তু বেশ নরমসরমই ছিল। এলভিরা (Elvira) (৩০৬ খ্রি.), অ্যানসিরা (Ancyra) (৩১৪ খ্রি.), ট্রুলো (Trullo) (৬৯২ খ্রি.) – এসব জায়গায় যে কাউন্সিল বা সভা বসেছিল, সেখানে শয়তানের পুজোআচ্চা (devil-worship) করলে কিছু ধর্মীয় শাস্তির (ecclesiastical penances) বিধান দেওয়া হয়। ব্যস, ওইটুকুই। অনেক কাল ধরে চার্চের এটাই ছিল দস্তুর। পাদ্রিরা (Catholic Church’s clergy) বরং চাইতেন ডাইনিবিদ্যা বা কালো জাদু (necromancy) নিয়ে লোকের বাড়াবাড়িটা (fanaticism) একটু কমাতে। যেমন, পাডারবোর্নের কাউন্সিল (Council of Paderborn) ৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে পরিষ্কার বলে দিল, কাউকে ডাইনি বলাটাই বেআইনি, আর কেউ যদি ডাইনি পোড়ায়, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের লোম্বার্ড আইনেও (Lombard code) লেখা ছিল:

কোনো বিদেশি দাসী বা মহিলা চাকরকে ডাইনি বলে মেরে ফেলার সাহস যেন কেউ না দেখায়, কারণ এটা সম্ভবই না, আর খ্রিস্টান মনে (Christian minds) এসব বিশ্বাস করা উচিতও নয়। (Hutton, 1993)

এই কথারই প্রতিধ্বনি মেলে প্রায় ৯০০ খ্রিস্টাব্দের ক্যানন এপিস্কোপি (Canon Episcopi) নামের এক নথিতে (লোকে বলত এটা নাকি ৩১৪ খ্রিস্টাব্দের)। সেখানে সাফ বলা হয়েছে – ডাইনিবিদ্যা বলে আসলে কিছু নেই, আর এটা যে সত্যি, তা শেখানোটাও একটা মস্ত ভুল আর ধর্মবিরুদ্ধ (heterodox) কাজ। এরকম আরও উদাহরণ আছে, যেমন ৮০০ খ্রিস্টাব্দের এক আইরিশ সভা (Irish synod) (Behringer, 2004), বা লিয়নের অ্যাগোবার্ডের (Agobard of Lyons) ধর্মোপদেশ (sermon) (৮১০ খ্রি.) (Behringer, 2004)।

হাঙ্গেরির রাজা ক্যালমান (King Kálmán (Coloman)) তো আরও এক কাঠি সরেস। ১১০০ সালে তার জারি করা আইনের ৫৭ নম্বর ধারায় তিনি ডাইনি নিধন বন্ধ করে দিলেন। কারণ? তিনি বললেন, ‘আরে, ডাইনি বলে কিছু আছে নাকি!’ (“witch hunts”, Bible Apologetics; Behringer, 2004)। ওয়ার্মসের বিশপ বুর্চার্ডের (Burchard, Bishop of Worms) (সময়কাল ১০২০ খ্রি. নাগাদ) লেখা ‘ডিক্রেটাম’ (Decretum), বিশেষ করে এর ১৯ নম্বর বইটা (যেটাকে লোকে ‘সংশোধনকারী’ বা Corrector বলত), খুব জরুরি। বুর্চার্ড সাহেব লিখছেন লোকে কী সব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে – জাদুকরী পানীয় (magical potions) নাকি পুরুষত্ব নষ্ট করে (impotence), গর্ভপাত (abortion) ঘটায়! এসব অবশ্য অন্য অনেক চার্চ ফাদারও (Church Fathers) মানা করেছিলেন (“Abortion, Contraception and the Church Fathers”, 2012)। কিন্তু বুর্চার্ড আরও এগিয়ে গেলেন। তিনি ডাইনিদের নিয়ে চালু থাকা অনেক গালগল্পই উড়িয়ে দিলেন। যেমন? রাতে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো, কারো মন ভালোবাসা থেকে ঘৃণায় বদলে দেওয়া, ঝড়বৃষ্টি-রোদ নিয়ন্ত্রণ করা, মানুষকে পশু বানিয়ে দেওয়া, ইনকিউবি-সাকিউবি (incubi and succubi) নামে ভূতের সাথে মানুষের মেলামেশা – এসবই তার কাছে ছিল বাজে কুসংস্কার। বুর্চার্ডের মতে, এসব করার চেষ্টা করা তো বটেই, এমনকি এসব যে সম্ভব, তা বিশ্বাস করাটাও মিথ্যে আর কুসংস্কার (false and superstitious)।

এমনকি পোপ সপ্তম গ্রেগরিও (Pope Gregory VII) ১০৮০ সালে ডেনমার্কের রাজা তৃতীয় হ্যারাল্ডকে (King Harald III of Denmark) চিঠি লিখে মানা করেছিলেন, ঝড়-বাদলা বা ফসল নষ্টের জন্য যেন ডাইনিদের দায়ী করে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া হয়। নিরপরাধ মানুষকে বাঁচানোর এমন চেষ্টা কিন্তু আরও অনেক হয়েছে (Behringer, 2004)। অনেক বড় বড় পাদ্রিও (ecclesiastics) চেষ্টা করেছেন লোকের মন থেকে ডাইনিবিদ্যার আজগুবি বিশ্বাস দূর করতে (Migne, Patrologia Latina, CIV, 147; Behringer, 2004)। রাশিয়ায়ও একই অবস্থা। ভ্লাদিমিরের সেরাপিয়ন (Serapion of Vladimir) (১২৭৪-৭৫ সালের লেখা) এক ভাষণে লোকের এই কুসংস্কারকে ধিক্কার দিচ্ছেন যে ডাইনিরাই নাকি ফসল নষ্টের জন্য দায়ী (Behringer, 2004)।

এদিকে হিপ্পোর অগাস্টিন (Augustine of Hippo) বা তার মতো পুরনো দিনের ধর্মগুরুদের (theologians) লেখায় ডাইনিবিদ্যার নিন্দেমন্দ পাওয়া যায়। তারা আবার ডাইনিবিদ্যা আর পুরনো পৌত্তলিক ধর্মগুলোর (pagan religions) মধ্যে খুব একটা ফারাক করতেন না (Kieckhefer, 2014)। অনেকে আবার ভাবতেন, ডাইনিবিদ্যা ব্যাপারটা আসলে দার্শনিক দিক থেকে নেই বললেই চলে। এ সবই নাকি চোখের ধাঁধা (illusions), শয়তানের খেল (powers of evil)। অগাস্টিন শয়তানের শক্তিকে তুলনা করতেন অন্ধকারের সাথে – মানে, আলোর না থাকা, একটা শূন্যতা (non-entity) (Kieckhefer, 2014)। কিন্তু মজা হলো, অগাস্টিন আর তার সাগরেদরা, যেমন ধরুন সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস (Saint Thomas Aquinas), তারাই আবার শয়তান নিয়ে বিশাল বিশাল তত্ত্ব (demonologies) ফাঁদলেন। বললেন, মানুষ নাকি শয়তানের (demons) সাথে চুক্তিও (pacts) করতে পারে! আর এটাই হয়ে দাঁড়াল ভবিষ্যতের ডাইনি নিধনের মস্ত বড় ভিত্তি (Davies, 2017; Kieckhefer, 2014)। আরও মজার ব্যাপার কী জানেন? মধ্যযুগের অনেক পাদ্রি নিজেরাই কিন্তু প্রকাশ্যে বা লুকিয়ে ‘গোয়েটিয়া’ (goetia) বা ঐ জাতীয় জাদুবিদ্যা করতেন। তাদের যুক্তি ছিল, স্বয়ং খ্রিস্ট যখন তার শিষ্যদের শয়তানকে আদেশ করার ক্ষমতা দিয়েছেন, তখন শয়তান ডেকে আনা বা বশ করা আর পাপ কিসের? (Kieckhefer, 2014)।

তাই, কে কী ভাবছে তাতে কী আসে যায়! ডাইনি নিধন কিন্তু লোকের মধ্যে একটা সংস্কৃতির (cultural phenomenon) মতো চলতেই থাকল। মধ্যযুগের শুরুর দিকে অনেক বড় বড় রাজা-বাদশা ডাইনিবিদ্যা আর পুরনো ধর্ম দুটোই নিষিদ্ধ করেছিলেন, প্রায়ই বলতেন ধরা পড়লে গর্দান যাবে (pain of death)। যেমন, শারলামেনের (Charlemagne) আমলে কোনো খ্রিস্টান ডাইনিবিদ্যা করলে তাকে চার্চের গোলাম (enslaved by the Church) হতে হতো, আর যারা শয়তানের (Devil) পুজো করত (মানে পুরনো জার্মানিক দেবদেবী), তাদের সটান মেরে ফেলা হতো (Kieckhefer, 2014)। সেকালের গল্প-সাহিত্যেও ডাইনি নিধনের কথা আছে। স্নোরি স্টারলুসন (Snorri Sturluson) লিখেছেন, রাজা ওলাফ ট্রিগভাসন (King Olaf Trygvasson) নাকি নরওয়েকে খ্রিস্টান বানানোর জন্য পুরনো দিনের জাদুকরদের ভোজের নেমন্তন্ন করে ডেকে আনতেন, তারপর দরজা বন্ধ করে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারতেন! যারা কোনোমতে পালাত, তাদের ধরে এনে পরে জলে ডুবিয়ে মারা হতো (“Heimskringla: King Olaf Trygvason’s Saga”)।

রাজা অ্যাথেলস্টানও (King Athelstan) (৯২৪-৯৩৯) ডাইনিবিদ্যা নিয়ে আইন করেছিলেন। তাতে লেখা ছিল:

আর আমরা ডাইনিবিদ্যা (witch-crafts), লাইব্যাকস [“জাদুবিদ্যা”] (lybacs [“sorcery”]), আর মর্থডেডস [“হত্যা”] (morthdaeds [“murder”]) নিয়ে এই আদেশ দিচ্ছি: যদি এসব করে কেউ মারা যায়, আর দোষী তা অস্বীকার করতে না পারে, তবে তার জান যাবে। কিন্তু যদি সে অস্বীকার করে, আর তিনবার অগ্নিপরীক্ষায় (threefold ordeal) দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে তাকে ১২০ দিন জেলে থাকতে হবে। তারপর আত্মীয়রা তাকে ছাড়িয়ে আনবে, রাজাকে দেবে ১২০ শিলিং, মৃতের আত্মীয়কে দেবে ক্ষতিপূরণ (wer), আর তার হয়ে জামিন দেবে (enter into borh for him) যে সে আর কোনোদিন এমন কাজ করবে না। (“Internet History Sourcebooks Project”)

কিছু ক্ষেত্রে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগে অত্যাচার বা নির্যাতন (torture) করা হতো (রোমান আইনে এর অনুমতি ছিল)। তবে পোপ প্রথম নিকোলাস (Pope Nicholas I) ৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কিন্তু নির্যাতনের ব্যবহার একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। একই রকম নির্দেশ নাকি সিউডো-ইসিডোরিয়ান ডিক্রেটালসেও (Pseudo-Isidorian Decretals) পাওয়া যায় (“Witchcraft”, Catholic Encyclopedia)।

মধ্যযুগের শেষ ভাগ (Later Middle Ages)

রোমান ক্যাথলিক ইনকুইজিশন (Roman Catholic Inquisition) যখন চালু হলো, তাদের কেতাবপত্রে কিন্তু ডাইনি ধরার ব্যাপারে বেশ দ্বিধা (skeptical) দেখা যায়। তবে হ্যাঁ, ধর্মদ্রোহিতার (heresy) অভিযোগ আর ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ মাঝে মাঝে মিলেমিশে যেত। বিশেষ করে ১৩ শতকে, যখন ইনকুইজিশনকে পাঠানো হলো দক্ষিণ ফ্রান্সের ক্যাথার (Cathars of Southern France) সম্প্রদায়ের মোকাবেলা করতে। ক্যাথারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের ধর্মশিক্ষার মধ্যে নাকি ডাইনিবিদ্যা আর জাদুও আছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, ইউরোপে ডাইনি নিধনের বাড়াবাড়িটা শুরু হয়েছিল ১৪ শতকের গোড়ায়, ক্যাথার আর নাইটস টেম্পলারদের (Knights Templar) দমন করার পর। কিন্তু ইতিহাসবিদরা প্রায় সবাই এই তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছেন (Cohn 1975; Kieckhefer 1976)।

১২৫৮ সালে পোপ চতুর্থ আলেকজান্ডার (Pope Alexander IV) তো ঘোষণাই করে দিলেন, ইনকুইজিশন ডাইনিবিদ্যার মামলায় নাক গলাবে না, যদি না তার সাথে ধর্মদ্রোহিতার সম্পর্ক থাকে (Selwood, 2016; Cross & Livingstone, 2005)। যদিও পরে, ১৩২০ সালে, পোপ দ্বাবিংশ জন (Pope John XXII) ইনকুইজিশনকে জাদুকরদের বিচার করার অনুমতি দেন (Russell, 1972), কিন্তু বাস্তবে ইনকুইজিটরদের আদালত (inquisitorial courts) ডাইনিবিদ্যার মামলা খুব কমই দেখত, কেবল অন্য কোনো ধর্মবিরোধী (heterodoxy) মতবাদ তদন্ত করার সময় প্রসঙ্গক্রমে যা আসত।

একটা উদাহরণ দিই। ম্যাডোনা ওরিয়েন্টে (Madonna Oriente) নামে এক ঘটনা। ১৩৮৪ সালে মিলানের ইনকুইজিশন (Inquisition of Milan) দুজন মহিলাকে নিয়ে পড়ল বিপাকে। মহিলারা স্বীকার করেছিল তারা নাকি সিগনোরা ওরিয়েন্টে (Signora Oriente) বা ডায়ানা (Diana) নামের এক দেবীর আরাধনার দলে ছিল। তাদের কথায় বেরিয়ে এল সাদা জাদুর (white magic) সব পুরনো লোকবিশ্বাসের কথা। ইনকুইজিশন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে। পরে ১৩৯০ সালে তাদের আবার ধরা হলো, এবার ইনকুইজিটর তাদের দোষী সাব্যস্ত করলেন। শেষমেশ রাজদরবারের লোকেরা (secular arm) তাদের মৃত্যুদণ্ড দিল (Cohn, 2000)।

আরেকটা কুখ্যাত ঘটনা ঘটেছিল ১৪২৫ সালে। সেল্যের কাউন্ট দ্বিতীয় হারমান (Hermann II, Count of Celje) তার নিজের পুত্রবধূ, ভেরোনিকা অফ ডেসেনিসকে (Veronika of Desenice), ডাইনি বলে অভিযুক্ত করলেন। আদালত অবশ্য ভেরোনিকাকে নির্দোষ বলল, কিন্তু হারমান তাতে দমবার পাত্র নন, তিনি তাকে জলে ডুবিয়ে মেরেই ফেললেন! লোকে বলে, আসলে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগটা ছিল একটা অজুহাত। ভেরোনিকা ছিলেন একটু নিচু ঘরের মেয়ে, তাই হারমানের চোখে ছেলের বউ হিসেবে তিনি ছিলেন ‘অযোগ্য’, তাকে সরানো দরকার ছিল আরকি!

সেকালে ডাইনিবিদ্যার বিরুদ্ধে খুব প্রচার চালাতেন এক ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক, নাম সিয়েনার বার্নার্ডিনো (Bernardino of Siena) (১৩৮০-১৪৪৪)। তিনি ছিলেন ফ্রান্সিসকান সাধু, লোকে তার কথা খুব শুনত। তার ধর্মোপদেশগুলো পড়লে বোঝা যায়, একদিকে যেমন লোকে নানা কুসংস্কারে (superstitious practices) বিশ্বাস করত, তেমনি আবার সেগুলোর বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়াও (over-reaction) দেখাত (Mormando, 1999)। তবে বার্নার্ডিনো শুধু ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র (spells and enchantments) বা এই জাতীয় ছেলেমানুষি নিয়েই চিন্তিত ছিলেন না। তার মাথায় ছিল আরও ভয়ঙ্কর সব অপরাধের কথা – খুন (murder), শিশুহত্যা (infanticide)। ১৪২৭ সালের এক বিখ্যাত ভাষণে তিনি বলছেন:

তাদের একজন কোনো চাপ ছাড়াই স্বীকার করেছে, সে নাকি ত্রিশটা বাচ্চাকে রক্ত ঝরিয়ে (bleeding them) মেরে ফেলেছে… আবার বলেছে, নিজের ছেলেকেও নাকি খুন করেছে… আমায় বলুন তো: আপনাদের কি সত্যিই মনে হয়, যে লোকটা এমন বিশ-ত্রিশটা কচি বাচ্চাকে অমন নৃশংসভাবে মেরেছে, সে এত ভালো কাজ করেছে যে শেষমেশ যখন তাকে বিচারসভার (Signoria) সামনে আনা হলো, তখন আপনাদের উচিত তার হয়ে সুপারিশ করা, তার জন্য করুণা চাওয়া?

ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে নাম কুড়ানো (নাকি বদনাম কুড়ানো?) ডাইনি বিচার (witch trial) বোধহয় জোয়ান অফ আর্কের (Joan of Arc) বিচার। মানছি, এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ (politically motivated) ছিল, আর সেই রায় পরেও বাতিল করা হয়। কিন্তু জোয়ানের মেয়ে হওয়াটা, আর তার উপর ডাইনি বলে অভিযোগ আসা – এগুলো তার মৃত্যুদণ্ডের (execution) পেছনে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল (Harrison, 2014)। জোয়ানকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার শাস্তি দেওয়া হয়েছিল (সাধারণত পোড়ানোর আগে শ্বাসরোধ করে মারা হতো)। এই শাস্তিটা দেওয়া হতো শুধু ডাইনি আর ধর্মদ্রোহীদেরই (heretics)। এর পেছনের ভাবনাটা ছিল – পোড়া শরীর নাকি শেষ বিচারের দিনে (Judgment Day) আর পুনরুত্থিত হতে পারে না! (Harrison, 2014)।

নতুন যুগের ডাইনি নিধনের দিকে (Transition to the early modern witch-hunts)

মধ্যযুগের শেষ দিকে এই যে ডাইনি নিধন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল (resurgence), তাতে চার্চের কিছুটা হলেও সায় বা অন্তত নীরব সম্মতি ছিল। এর সাথে সাথে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বেও (Christian doctrine) কিছু নতুন ভাবনা যোগ হলো। যেমন, ডাইনিবিদ্যাকে শয়তানের কারসাজি (Satanic influence) বলে মেনে নেওয়া হলো, আর একে ধর্মদ্রোহিতার (heresy) পর্যায়ে ফেলা হলো। যখন রেনেসাঁ যুগের গুপ্তবিদ্যা (Renaissance occultism) শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে লাগল, তখন ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস – যা কিনা মধ্যযুগে ছিল মূলত গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের লোকধর্মের (folk religion) অংশ – সেটা ঢুকে পড়ল এক বিশাল ধর্মতত্ত্বের (theology) মধ্যে। এই তত্ত্বে বলা হলো, সব খারাপ কাজের (maleficium) মূলে আছে ওই শয়তান (Satan) (Hinson, 1992; Larner, 2002)। এই চিন্তাভাবনার বদলটা (doctrinal shifts) ঘটল মোটামুটি ১৫ শতকের মাঝামাঝি, বিশেষ করে বাসেলের কাউন্সিলের (Council of Basel) পরে। এর কেন্দ্র ছিল পশ্চিম আল্পস (western Alps) অঞ্চলের স্যাভয়ের ডিউকের এলাকা (Duchy of Savoy) (Behringer, 2004)। আর এর ফলেই ১৫ শতকের শেষার্ধে সরকারি আদালত (secular courts) আর চার্চের আদালত (ecclesiastical courts) – দুই জায়গাতেই শুরু হলো ডাইনি বিচারের (witch trials) এক নতুন পর্ব (Behringer, 2004)।

১৪৮৪ সালে পোপ ইনোসেন্ট অষ্টম (Pope Innocent VIII) একটা ফরমান জারি করলেন – ‘সুমিস ডিসাইডার‍্যান্টিস অ্যাফেক্টিবাস’ (Summis desiderantes affectibus) নামে এক প্যাপাল বুল (Papal bull)। এতে শয়তানের চ্যালাদের (devil-worshippers) – যারা নাকি “শিশু হত্যা” (slain infants) সহ আরও নানা অপরাধ করেছে – তাদের “সংশোধন করা, জেলে পোরা, শাস্তি দেওয়া আর শায়েস্তা করার” (“correcting, imprisoning, punishing and chastising”) হুকুম দেওয়া হলো। পোপ এটা করেছিলেন হেইনরিখ ক্রেমার (Heinrich Kramer) নামে এক ইনকুইজিটরের অনুরোধে। ক্রেমারকে আবার জার্মানির স্থানীয় বিশপরা তদন্ত করতে দিচ্ছিলেন না (Levack)। তবে ইতিহাসবিদ লুডভিগ ফন পাস্টর (Ludwig von Pastor) মনে করেন, এই ফরমান নতুন কিছু বলেনি, আর এটা মানাটাও সবার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না (von Pastor, Vol. 5, pp. 349-350)। এর তিন বছর পর, ১৪৮৭ সালে, ক্রেমার সাহেব সেই কুখ্যাত বইটা ছাপালেন – ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum), মানে ‘দুষ্টদের দমন করার হাতুড়ি’। সদ্য আবিষ্কৃত ছাপাখানার (printing presses) দৌলতে বইটা হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল। ১৫২০ সালের মধ্যে ১৪ বার ছাপা হলো! আর সরকারি আদালতগুলোতে (secular courts) এর প্রভাব পড়ল সাংঘাতিক রকম (Jolly, Raudvere, & Peters, 2002)।

ইউরোপের সব জায়গায় কিন্তু ডাইনি নিধনের মাতামাতি একরকম ছিল না। স্পেন, পোল্যান্ড বা পূর্ব ইউরোপে এটা তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু জার্মানি, সুইজারল্যান্ড আর ফ্রান্সে এর প্রকোপ ছিল সাংঘাতিক (Nachman Ben-Yehuda, 1980)।

আধুনিক ইউরোপের শুরু আর আমেরিকার উপনিবেশ (Early Modern Europe and Colonial America)

আধুনিক ইউরোপের (Early Modern Europe) শুরুর দিকে এই ডাইনি বিচারগুলো যেন ছিল জোয়ার-ভাটার মতো। আসত, আবার চলেও যেত। পনেরো শতকে, ষোলো শতকের গোড়ায় বিচার-আচার হলো বটে, কিন্তু তারপর ডাইনি নিয়ে ভয়টা (witch scare) একটু কমল। কিন্তু সতেরো শতকে এসে আবার যেন ভূতে ধরল! ব্যাপারটা চরম আকার নিল, বিশেষ করে যখন চলছিল সেই ত্রিশ বছরের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ (Thirty Years’ War)।

আগে লোকে ভাবত, কিছু মানুষের হয়তো বিশেষ ক্ষমতা (supernatural abilities) আছে, যা দিয়ে তারা কখনও কখনও অন্যের উপকারও করে। কিন্তু এই সময়ে এসে ধারণাটা গেল পাল্টে। এখন ভাবা হতে লাগল, এই বিশেষ ক্ষমতার মানে হলো শয়তানের (devil) সাথে পাকাঁপোক্ত চুক্তি (pact)! আর এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে ঠিক প্রমাণ করার জন্য সেকালের কিছু খ্রিস্টান আর তাদের হয়ে কাজ করা রাজ-রাজড়ারা (secular institutions) কী করত জানেন? তারা ডাইনিবিদ্যাকে জুড়ে দিত ভয়ঙ্কর সব শয়তানী জলসার (wild Satanic ritual parties) সাথে। গল্প ছড়ানো হতো, সেখানে নাকি চলে উদ্দাম নাচ (naked dancing), এমনকি মানুষের মাংস খাওয়া, কচি বাচ্চা মেরে ফেলা (cannibalistic infanticide)! (Ellerbe, 1995)। ভাবা যায়! আবার কখনও বলা হতো, এটা নাকি ঈশ্বরের দশ আদেশের (Ten Commandments) প্রথমটার লঙ্ঘন (“আমার আগে তোমার অন্য কোনো দেবতা থাকবে না”) – মানে ধর্মদ্রোহিতা (heresy)। অথবা বলা হতো, এ হলো মহিমা লঙ্ঘন (violating majesty), তবে রাজার নয়, স্বয়ং ঈশ্বরের (divine majesty) (Meewis, 1992)। ধর্মগ্রন্থ থেকেও লাইন তুলে আনা হতো প্রায়ই, বিশেষ করে যাত্রাপুস্তকের সেই আদেশটা – “ডাইনিকে বাঁচতে দিয়ো না” (Exodus 22:18)। অনেকেই এটা খুব মানত।

এই ডাইনি নিধনের ঢেউ কিন্তু সে সময় পুরো ইউরোপেই লেগেছিল। তবে সবচেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হয়েছিল সম্ভবত মধ্য আর দক্ষিণ জার্মানিতে (central and southern Germany) (“The History Today Archive”, 2007)। যদিও জার্মানি কিন্তু এই বিচারে নেমেছিল অন্যদের চেয়ে একটু দেরিতেই। আসল মাতামাতিটা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডে, সেই চোদ্দ আর পনেরো শতকে। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানিতে ডাইনি নিধন চরমে উঠেছিল ১৫৬১ থেকে ১৬৭০ সালের মধ্যে (Midelfort, 1972)। ইউরোপে প্রথম বড়সড় নিপীড়ন, যেখানে ডাইনিদের ধরা, বিচার করা, দোষী বানানো আর পুড়িয়ে মারা হলো, সেটা ঘটেছিল ১৫৬৩ সালে, দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির উইসেনস্টেইগে (Wiesensteig)। ঘটনাটা লেখা আছে “৬৩ জন ডাইনির সত্যি আর ভয়ঙ্কর কাণ্ডকারখানা” (“True and Horrifying Deeds of 63 Witches”) নামে একটা ছোট্ট বইয়ে (Behringer, 2004)। এই ডাইনিবিদ্যার নামে অত্যাচার ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপের কোণায় কোণায়। শিক্ষিত ইউরোপীয়দের মধ্যে ডাইনিবিদ্যা আর শয়তান নিয়ে যেসব কেতাবি ধারণা ছিল, সেগুলো উত্তরের দেশগুলোতেও ডাইনি নিধনে ইন্ধন জুগিয়েছিল (Willumsen, 2013)। আর এই শিকারের পেছনে নাকি অর্থনৈতিক কারণও (economic factors) ছিল। যেমন বাভারিয়া (Bavaria) বা স্কটল্যান্ডের (Scotland) মতো জায়গায় যখন আর্থিক টানাটানি (economic pressure) পড়ত, তখন ডাইনি ধরার হিড়িক বেড়ে যেত – এমন একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে (Baten & Woitek)।

ডেনমার্কে (Denmark) দেখুন, ১৫৩৬ সালে ধর্মসংস্কারের (reformation) পর ডাইনি পোড়ানো বেড়ে গেল। বিশেষ করে রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান (Christian IV of Denmark) এই ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন। তার আমলে শ’য়ে শ’য়ে লোককে ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। উত্তর নরওয়ের ফিনমার্ক (Finnmark) অঞ্চলে ১৬০০ থেকে ১৬৯২ সাল পর্যন্ত চলেছিল ভয়ঙ্কর সব ডাইনি বিচার (Willumsen, 2010)। সেই হতভাগ্য শিকারদের স্মরণে সেখানে এখন একটা আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতিসৌধও (Steilneset Memorial) তৈরি হয়েছে (Andreassen & Willumsen, 2014)। ইংল্যান্ডে ১৫৪১ সালে একটা আইন (Witchcraft Act 1541) হলো ডাইনিদের শাস্তির নিয়মকানুন নিয়ে। স্কটল্যান্ডের নর্থ বারউইক ডাইনি বিচার (North Berwick witch trials) তো এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড! ৭০ জনেরও বেশি লোককে ডাইনি বলে ধরা হলো, কারণ? কারণ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস (James VI of Scotland) (ডেনমার্কের রাজার মতো তারও ডাইনি বিচারে খুব উৎসাহ ছিল) যখন তার হবু বউ ডেনমার্কের অ্যানের (Anne of Denmark) সাথে দেখা করতে ডেনমার্কে যাচ্ছিলেন, তখন নাকি আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল! “স্কটল্যান্ড থেকে খবর” (“Newes from Scotland”) নামে এক চটি বইয়ে লেখা আছে, রাজা জেমস নিজে নাকি ডক্টর ফিয়ান (Doctor Fian) নামে একজনকে নির্যাতন করা আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সময় হাজির ছিলেন! (“Daemonlologie by King James the First and Newes from Scotland”)। শুধু তাই নয়, জেমস সাহেব তো ডাইনি ধরার নিয়মকানুন নিয়ে ‘ডিমনোলজি’ (Daemonologie) নামে একটা বই-ই লিখে ফেলেছিলেন! তাতে একটা বিখ্যাত লাইন আছে: “রোজকার অভিজ্ঞতা দেখায়, মার না খেলে ওরা স্বীকার করতে চায় না।” এর পরে, ১৬১২ সালের পেন্ডল ডাইনি বিচার (Pendle witch trials) তো ইংরেজি ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত ঘটনা হয়ে রইল (“Follow the Pendle Witches trail”, 2009)।

ইংল্যান্ডে ডাইনি নিধন একেবারে তুঙ্গে উঠেছিল ১৬৪৪ থেকে ১৬৪৭ সালের মধ্যে। এর নায়ক ছিলেন ম্যাথিউ হপকিন্স (Matthew Hopkins) নামে এক পিউরিটান ভদ্রলোক। সরকারি কোনো হুকুমনামা (Parliament commission) ছাড়াই তিনি নিজেকে ‘উইচফাইন্ডার জেনারেল’ (Witchfinder General) ঘোষণা করে দিয়েছিলেন! তিনি আর তার দলবল ইংরেজি গৃহযুদ্ধের (English Civil War) সময় বিভিন্ন শহরে গিয়ে ডাইনি ধরে দেওয়ার নামে মোটা টাকা কামাতেন। হপকিন্সের এই তাণ্ডব চলেছিল অল্প কিছুদিন, কিন্তু তার ফল ছিল মারাত্মক – প্রায় ৩০০ জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং মারা গিয়েছিলেন তার জন্য! (Sharpe, 2002)। হপকিন্স আবার তার কাজের পদ্ধতি নিয়ে একটা বইও লিখেছিলেন। তাতে ছিল কীভাবে তিনি এই লাইনে এলেন, কীভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করতেন, আর কীভাবে অভিযুক্তদের পরীক্ষা করতেন: যেমন, ডাইনিদের শরীরে বিশেষ চিহ্ন (Witches’ mark) খোঁজার জন্য তাদের বিবস্ত্র করা, জলে ডোবানোর পরীক্ষা (“swimming” test), আর চামড়ায় ছুঁচ ফোটানো (pricking the skin)। ওই জলে ডোবানোর পরীক্ষাটা (যেখানে ডাইনিকে চেয়ারে বেঁধে জলে ফেলে দেখা হতো সে ভাসে কিনা) অবশ্য ১৬৪৫ সালে আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। ১৬৪৭ সালে লেখা তার বই ‘দ্য ডিসকভারি অফ উইচেস’ (The Discovery of Witches) খুব তাড়াতাড়ি একটা প্রভাবশালী আইনের বই (legal text) হয়ে ওঠে। বইটা আমেরিকার উপনিবেশগুলোতেও (American colonies) পৌঁছে গিয়েছিল। ১৬৪৭ সালের মে মাসেই ম্যাসাচুসেটসে (Massachusetts) মার্গারেট জোন্স (Margaret Jones) নামে একজনকে ডাইনিবিদ্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (Jewett, 1881)। তিনি ছিলেন ১৬৪৭ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে ডাইনি সন্দেহে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে প্রথম (Fraden & Fraden, 2008)।

মজার ব্যাপার হলো, হপকিন্স যখন ইংল্যান্ডে ডাইনি খুঁজছেন, ঠিক তখনই উত্তর আমেরিকাতেও (North America) একই কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। ১৬৪৫ সালে, সেই কুখ্যাত সালেম ডাইনি বিচারের (Salem witch trials) পুরো ৪৬ বছর আগে, ম্যাসাচুসেটসের স্প্রিংফিল্ড (Springfield, Massachusetts) শহরে আমেরিকার প্রথম ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ ওঠে। স্বামী-স্ত্রী হিউ আর মেরি পার্সন্স (Hugh and Mary Parsons) একে অপরকে ডাইনি বলে দোষারোপ করে! আমেরিকার প্রথম সেই ডাইনি বিচারে হিউ নির্দোষ প্রমাণিত হন, মেরিকে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও তার সন্তানের মৃত্যুর জন্য ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ হয়। তবে ফাঁসিতে ঝোলার আগেই তিনি জেলে মারা যান (“Springfield’s 375th: From Puritans to presidents”, 2011)। ইংল্যান্ডের ম্যাসাচুসেটস বে কলোনিতে (Massachusetts Bay Colony) প্রায় আশি জনের বিরুদ্ধে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। তেরোজন মহিলা আর দুজন পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই ডাইনি নিধন চলেছিল নিউ ইংল্যান্ড (New England) জুড়ে, ১৬৪৫ থেকে ১৬৬৩ সাল পর্যন্ত (Fraden & Fraden, 2008)। এর পরেই ১৬৯২-৯৩ সালে আসে সেই সাঙ্ঘাতিক সালেম ডাইনি বিচার।

একবার মামলা শুরু হলে, সরকারি উকিলরা (prosecutors) লেগে পড়ত আরও সঙ্গীসাথী (accomplices) খুঁজে বের করতে। জাদুর ব্যবহারটাকে ভুল মনে করা হতো, কিন্তু তা কাজ করে না বলে নয়, বরং ভুল কারণে কাজ করে বলে! ডাইনিবিদ্যা কিন্তু তখন রোজকার জীবনের অঙ্গ। অসুখ হলে বা বাচ্চা হওয়ার সময় লোকে যেমন পুরুতঠাকুরকে (religious ministers) ডাকত, তেমনি ডাকত ডাইনিদেরও। সমাজে তাদের একটা আধ্যাত্মিক ক্ষমতাও (spiritual power) ছিল। গণ্ডগোল বাধলে কেউ কিন্তু পুরুত বা ডাইনির ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলত না। তারা বরং ভাবত, ডাইনি কি ইচ্ছে করে ক্ষতি (inflict harm) করতে চেয়েছিল? (Wallace, 2004)।

আজকের দিনের পণ্ডিতরা হিসেব করে দেখেছেন, এই ৩০০ বছরে ডাইনিবিদ্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া লোকের সংখ্যাটা ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজারের মধ্যে হবে (“Estimates of executions”; Russell & Lewis, 2000)। ইউরোপে যতগুলো ডাইনি বিচার মৃত্যুদণ্ডে শেষ হয়েছে বলে পাকা খবর আছে, তার সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার (Hutton, 1999)। সেকালে কিন্তু এই ডাইনি নিধনের বিরুদ্ধে বলার লোকও ছিলেন। যেমন জিয়ানফ্রান্সেস্কো পনজিনিবিও (Gianfrancesco Ponzinibio), জোহানেস উইয়ার (Johannes Wier), রেজিনাল্ড স্কট (Reginald Scot), কর্নেলিয়াস লুস (Cornelius Loos), অ্যান্টন প্রিটোরিয়াস (Anton Praetorius), আলোনসো সালাজার ওয়াই ফ্রিয়াস (Alonso Salazar y Frías), ফ্রেডরিখ স্পি (Friedrich Spee), বালথাসার বেকার (Balthasar Bekker) – এরা সবাই এর সমালোচনা করেছিলেন (Hoyt, 1989)। সবচেয়ে বড় আর নামকরা বিচারগুলোর মধ্যে ছিল ট্রিয়ার (Trier) (১৫৮১-৯৩), ফুলদা (Fulda) (১৬০৩-০৬), ওয়ারজবার্গ (Würzburg) (১৬২৬-৩১) আর ব্যামবার্গের (Bamberg) (১৬২৬-৩১) ডাইনি বিচার।

এই যে এত বিচারের কথা বললাম, এর বাইরেও কিন্তু লোকের হাতে ডাইনি নিধন চলত। কিছু লোক স্বনির্ভর আইনরক্ষক বা নিজ উদ্যোগে বিচার করা ব্যক্তি (vigilantes) হয়ে ডাইনি ধরত, মেরেও ফেলত হয়তো। যেমন স্কটল্যান্ডে, গরুমোষ মড়ক (cattle murrains) লাগলে দোষ পড়ত ডাইনিদের ঘাড়ে, মানে গ্রামের গরিব মহিলাদের। তাদের শাস্তিও দেওয়া হতো। একটা চালু রেওয়াজ ছিল “স্কোরিং অ্যাবাভ দ্য ব্রেথ” (“scoring above the breath”) – মানে, মহিলার কপালে ছুরি দিয়ে আঁচড় কেটে দেওয়া! ভাবা হতো এতে নাকি তার জাদুর ক্ষমতা চলে যাবে। এটা ছিল একরকম জরুরি ব্যবস্থা (emergency procedure), বিচারক ভূমিকা বা কর্তৃত্ব (judicial authorities) না থাকলেও করা যেত (Westwood, 2011)।

ডাইনিদের এই হেনস্তার পেছনে আরেকটা বড় কারণ ছিল লোকের নামে অভিযোগ, নিন্দা লাগানো (denunciations)। “ইংল্যান্ডে তো দেখা গেছে, যারা অভিযোগ করত বা ডাইনিদের বিরুদ্ধে লিখিত নালিশ জানাত, তাদের বেশিরভাগই ছিল মহিলা!” (“Witchcraft: Eight Myths and Misconceptions”, English Heritage)। কে নালিশ করেছে, তা অভিযুক্তকে জানানোর নিয়ম ছিল না। এটাই ডাইনি বিচারগুলোকে সফল হতে সাহায্য করত। আসলে হতো কী, একজন নালিশ করলে, আরও সাক্ষী খোঁজা হতো, ফলে একের পর এক লোক জুড়ে যেত। দোষী সাব্যস্ত হলে, যে নালিশ করেছে সে কখনও কখনও অভিযুক্তের সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ পেত, নিদেনপক্ষে ২ গিল্ডার তো বটেই! এর একটা চমৎকার উদাহরণ হলো বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলারের (Johannes Kepler) মা, ক্যাথারিনা কেপলারের (Katharina Kepler) ঘটনা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি নাকি শয়তানের সাথে চুক্তি করেছেন আর ডাইনিবিদ্যা করেন। ১৬১৫ সালে, ভ্যুরটেমবের্গে (duchy of Württemberg) এক প্রতিবেশী মহিলা তার নামে এই অভিযোগ আনে। ঝগড়া হয়েছিল, কারণ ক্যাথারিনা নাকি তাকে একটা তেতো পানীয় খাইয়েছিলেন যা খেয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বেচারিকে এক বছরের বেশি জেলে আটকে রাখা হয়েছিল, ভয় দেখানো হয়েছিল অত্যাচার করার। কিন্তু শেষমেশ তার ছেলের চেষ্টায় তিনি ছাড়া পান (Akademie Schloss Solitude)।

মৃত্যুর হিসেবনিকেশ (Execution statistics)

আজকের পণ্ডিতরা হিসেব কষে বলেন, ইউরোপে ডাইনি নিধনের সেই ৩০০ বছরে মোটমাট ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার মানুষকে ডাইনি সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছিল (Levack, 2006; Gaskill, 2010)। যাদের ধরা হতো, তাদের বেশিরভাগই ছিল সমাজের গরিবগুর্বো মানুষ (lower economic classes), যদিও কালেভদ্রে বড় ঘরের লোকও (high-ranking individuals) বাদ যায়নি। এই দেখেই স্কার আর ক্যালো (Scarre and Callow) বলেছেন, “সাধারণ ডাইনি বলতে বোঝাত গ্রামের খেটে খাওয়া মজুর বা ছোটখাটো চাষীর বউ বা বিধবা, আর সে পরিচিত ছিল বেশ ঝগড়াটে আর দজ্জাল স্বভাবের (quarrelsome and aggressive nature) জন্য” (Scarre & Callow, 2001)।

জুলিয়ান গুডারের (Julian Goodare) মতে, ইউরোপে ডাইনি হিসেবে শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ছিল মহিলা। তবে এস্তোনিয়া (Estonia), নরম্যান্ডি (Normandy) বা আইসল্যান্ডের (Iceland) মতো কিছু জায়গায় আবার পুরুষদের উপর অত্যাচারটা বেশি হয়েছিল (Goodare, 2016)। আইসল্যান্ডে তো অভিযুক্তদের ৯২% ছিল পুরুষ, এস্তোনিয়ায় ৬০%, আর মস্কোতে (Moscow) দুই-তৃতীয়াংশ! ফিনল্যান্ডে (Finland) অবশ্য ১০০ জনের বেশি মৃত্যুদণ্ড পাওয়াদের মধ্যে পুরুষ-মহিলা প্রায় সমান সমান ছিল, কিন্তু অ্যালান্ড দ্বীপপুঞ্জে (Ålanders) যাদের ডাইনিবিদ্যার দায়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তারা সবাই ছিল মহিলা (“Noituus – Kuolemantuomiot”, Finnish)।

ওয়ারজবার্গের বিচারে (Würzburg trials) ১৬২৯ সালে একটা সময় এমনও গেছে যখন অভিযুক্তদের ৬০ শতাংশই ছিল শিশু! যদিও বছর গড়াতে গড়াতে সেটা ১৭ শতাংশে নেমে এসেছিল (Scarre & Callow, 2001)। র‍্যাপলি (Rapley) (১৯৯৮) তো বলছেন, মোট “৪০ থেকে ৫০ হাজার” শিকারের মধ্যে “৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ” ছিল মহিলা (Rapley, 1998)। তবে এই যে লোকে বলে ইউরোপে নাকি “লাখ লাখ ডাইনি” (কেউ কেউ বলে “নয় মিলিয়ন”!) মারা হয়েছিল – এটা একেবারেই আজগুবি কথা। যদিও চটি বইপত্রে এটা মাঝে মাঝে দেখা যায়। আসলে এই ভুল ধারণাটা ছড়িয়েছিল গটফ্রিড ক্রিশ্চিয়ান ভয়গট (Gottfried Christian Voigt) নামে একজনের লেখা ১৭৯১ সালের একটা প্যামফলেট থেকে (Gaskill, 2010)।

ইউরোপে ১৪৫০-১৭৫০ সালে ডাইনিবিদ্যার বিচার (Monter, 2002; Levack, 2006)

অঞ্চল (Region) আনুমানিক বিচার (Trials approx) আনুমানিক মৃত্যুদণ্ড (Executions approx)
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ (British Isles) ৫,০০০ ১,৫০০-২,০০০
পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য (Holy Roman Empire) (জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, লোরেন, অস্ট্রিয়া, চেকিয়া) ৫০,০০০ ২৫,০০০-৩০,০০০
ফ্রান্স (France) ৩,০০০ ১,০০০
স্ক্যান্ডিনেভিয়া (Scandinavia) ৫,০০০ ১,৭০০-২,০০০
মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ (Central & Eastern Europe) (পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া, হাঙ্গেরি, রাশিয়া) ৭,০০০ ২,০০০
দক্ষিণ ইউরোপ (Southern Europe) (স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি) ১০,০০০ ১,০০০
মোট (Total) ৮০,০০০ ৩৫,০০০

বেশ, এইবার আসা যাক শেষ পর্বটায়। কীভাবে থামল ইউরোপের সেই ডাইনি নিধনের যুগ? আর এখনকার দুনিয়ায় এর কী হাল?

ইউরোপে ডাইনি নিধনের শেষ দিনগুলো (End of European witch-hunts in the 18th century)

আঠারো শতক আসতে আসতে ইউরোপে ডাইনি নিধনের সেই রমরমা ভাবটা কমে এল। ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডে ১৫৪২ থেকে ১৭৩৫ সালের মধ্যে ডাইনিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা আইন (Witchcraft Acts) হয়েছিল বটে – শাস্তি মানে প্রায়ই মৃত্যু, কখনও বা জেল (Gibson, 2006)। ইংল্যান্ডে ডাইনিবিদ্যার দায়ে শেষ ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৬৮২ সালে। এক্সেটার (Exeter) শহরে তিনজনকে – টেম্পারেন্স লয়েড (Temperance Lloyd), মেরি ট্রেম্বেলস (Mary Trembles) আর সুসানা এডওয়ার্ডস (Susanna Edwards)। এর কিছু বছর পর, ১৭১১ সালে, জোসেফ অ্যাডিসন (Joseph Addison) নামে এক নামকরা লেখক ‘দ্য স্পেক্টেটর’ (The Spectator) নামের এক সম্ভ্রান্ত পত্রিকায় লিখলেন। তিনি বললেন, এই যে বৃদ্ধা, দুর্বল মহিলাদের (“মল হোয়াইট” বা Moll White নামে ডাকা হতো) ডাইনি বলে ধরা হচ্ছে, এটা একেবারে অর্থহীন আর অন্যায় (irrationality and social injustice) (Addison, 1711; Summers, 2003)। এর পরের বছরই, ১৭১২ সালে, জেন ওয়েনহাম (Jane Wenham) নামে একজনকে ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, কিন্তু ভাগ্য ভালো, তাকে ক্ষমা (pardoned) করে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্কটল্যান্ডে শেষ মৃত্যুদণ্ডটা হয় ১৭২৭ সালে, জ্যানেট হর্ন (Janet Horne) নামে একজনের।

শেষমেশ ১৭৩৫ সালে একটা চূড়ান্ত আইন (Witchcraft Act 1735) এল। এই আইনটা মজার। এতে বলা হলো, ডাইনিবিদ্যা বলে কিছু নেই, কেউ যদি দাবি করে সে ডাইনি বা জাদু জানে, তাহলে সেটা আসলে ধাপ্পাবাজি (fraud)! কারণ লোকে আর বিশ্বাস করত না যে কারও সত্যিই আজগুবি ক্ষমতা থাকতে পারে বা শয়তানের সাথে যোগাযোগ (traffic with Satan) থাকতে পারে। তাই শাস্তিটা এখন ডাইনিবিদ্যার জন্য নয়, বরং জালিয়াতির জন্য। মজার ব্যাপার হলো, এই আইনটা কিন্তু ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল, আর এটা দিয়ে মাঝেমধ্যে প্ল্যানচেট করা লোক (spiritualists) বা জিপসিদের (gypsies) ধরা হতো। শেষ পর্যন্ত ১৯৫১ সালে গিয়ে এই আইন বাতিল হয় (Gibson, 2006)।

অন্যান্য দেশেও ধীরে ধীরে এই প্রথা বন্ধ হতে লাগল। ডাচ প্রজাতন্ত্রে (Dutch Republic) শেষ ডাইনি মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল সম্ভবত ১৬১৩ সালে (“Laatste executie van heks in Borculo”, 2003)। ডেনমার্কে ১৬৯৩ সালে আনা পালেস (Anna Palles) ছিলেন শেষ শিকার (“Last witch executed in Denmark”, 2010)। নরওয়েতে শেষ ঘটনাটা ঘটে ১৬৯৫ সালে, জোহানে নিলসড্যাটারের (Johanne Nilsdatter) সাথে (Hagen, 2018), আর সুইডেনে (Sweden) ১৭০৪ সালে আনা এরিকসডটারের (Anna Eriksdotter) মৃত্যুদণ্ড হয়। ফ্রান্সে ডাইনি হিসেবে শেষ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন ১৭৪৫ সালে লুই দেবারাজ (Louis Debaraz) (“Timeline The Last Witchfinder”, 2010)।

ক্রোয়েশিয়াতে (Croatia) শেষ মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পান ম্যাগদা লোগোমার (Magda Logomer) ১৭৫৮ সালে। তবে সে বছরই সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসা (Maria Theresa) তাকে খালাস দেন, আর ক্রোয়েশিয়াতে ডাইনি বিচারের যুগ শেষ হয় (Kern, 1999; Balog, 2017)। জার্মানিতে আনা শোয়েগেলিনকে (Anna Schwegelin) ১৭৭৫ সালে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলেও, তা আর কার্যকর করা হয়নি (Petz, 2007)।

সরকারিভাবে শেষ ডাইনি বিচারটা হয়েছিল সম্ভবত ১৭৮৩ সালে, পোল্যান্ডের ডোরুচো-তে (Doruchów witch trial)। যদিও এই বিচারের রায় নিয়ে অধ্যাপক জানুস তাছবির্জ (Prof. Janusz Tazbir) প্রশ্ন তুলেছেন (Tazbir, 1994)। এরপর আর কোনো মৃত্যুদণ্ডের নির্ভরযোগ্য খবর নেই। তবে ১৭৯৩ সালে পোল্যান্ডের পজনানে (Poznań) আইনি বৈধতা নিয়ে সন্দেহ আছে এমন এক বিচারে দুজন নাম না জানা মহিলাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল (Gijswijt-Hofstra, 1999)।

সুইজারল্যান্ডের আনা গোল্ডিকে (Anna Göldi) ১৭৮২ সালে (“Last witch in Europe cleared”, 2008) আর প্রুশিয়ার বারবারা জডুঙ্ককে (Barbara Zdunk) ১৮১১ সালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (Klimczak, 2017)। এদের দুজনকেই ইউরোপের শেষ ডাইনি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বলা হয়। কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই সরকারি রায়ে ডাইনিবিদ্যার কোনো উল্লেখ ছিল না। কারণ ততদিনে ডাইনিবিদ্যা আর কোনো অপরাধই (criminal offense) ছিল না!

ভারত (India)

এবার একটু ভারতের দিকে তাকানো যাক। এখানে ১৭৯২ সালের আগে ডাইনি নিধনের কোনো পাকাপোক্ত প্রমাণ নেই। প্রথম যে ঘটনার কথা জানা যায়, সেটা হলো ১৭৯২ সালের সাঁওতাল ডাইনি বিচার (Santhal Witch Trials) (Archer, 1979; Crooke, 1969)। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে (Company-ruled India) ছোট নাগপুর অঞ্চলের (Chota Nagpur Division) সিংভূম জেলায় (Singhbhum District) শুধু ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্তকেই নয়, তার আত্মীয়স্বজনকেও মেরে ফেলা হতো, পাছে তারা বদলা নেয়! (Roy Choudhary ১৯৫৮: ৮৮)। ছোটনাগপুরে সাঁওতাল (Santhals) নামে এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস ছিল। ডাইনি আছে – এটা তাদের গভীর বিশ্বাস ছিল। ডাইনিদের তারা খুব ভয় পেত, ভাবত তারা সমাজের শত্রু (anti-social activities)। গুজব ছিল, ডাইনিরা নাকি মানুষের নাড়িভুঁড়ি (entrails) খায়, গরুর জ্বর (fevers) বাধায়! তাই আদিবাসীরা ভাবত, অসুখবিসুখ সারাতে হলে এই ডাইনিদের শেষ করে ফেলাই একমাত্র উপায় (Sinha, 2007)।

সাঁওতালদের ডাইনি নিধনের ধরনটা ছিল ইউরোপের চেয়েও ভয়ঙ্কর (brutal)। ইউরোপে তো পোড়ানোর আগে গলা টিপে মারত, কিন্তু সাঁওতালরা নাকি অভিযুক্তদের “…আগুনে ফেলার আগে মানুষের মল খেতে আর রক্ত ​​পান করতে বাধ্য করত!” (Varma, 2007)। ভাবা যায়!

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (EIC) অবশ্য ১৮৪০-৫০ এর দশকে গুজরাট (Gujarat), রাজপুতানা (Rajputana) আর ছোটনাগপুরে ডাইনি নিধন বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। লোকে এটাকে অপরাধ বলেই মনে করত না, তাই অভিযোগও তেমন আসত না। সাঁওতালরা বরং ভাবত, এই নিষেধাজ্ঞার জন্যই ডাইনিদের উৎপাত আরও বেড়েছে! কোম্পানির উদ্দেশ্য গেল ভেস্তে। ১৮৫৭-৫৮ সালে, যখন সিপাহী বিদ্রোহ (Indian Rebellion of 1857) চলছে, তখন ডাইনি নিধন আবার বেড়ে গেল। কেউ কেউ মনে করেন, এটা ছিল কোম্পানির শাসনের (Company rule) বিরুদ্ধে একরকম প্রতিবাদ (resistance) (Sinha, 2007)।

আজকের দিনের ঘটনা (Modern cases)

বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, কিন্তু আজও পৃথিবীর অনেক জায়গায়, যেখানে লোকে জাদুটোনায় (belief in magic) বিশ্বাস করে, সেখানে ডাইনি নিধন চলে। বেশিরভাগ সময়েই এটা গণপিটুনি (lynching) বা পুড়িয়ে মারার (burnings) মতো ঘটনা। সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশ থেকে, সৌদি আরব থেকে, পাপুয়া নিউগিনি থেকে এমন খবর প্রায়ই আসে। কিছু দেশে তো জাদুবিদ্যার (sorcery) বিরুদ্ধে এখনো আইন আছে। আর সৌদি আরব হলো একমাত্র দেশ, যেখানে ডাইনিবিদ্যার শাস্তি আইনত মৃত্যুদণ্ড (legally punishable by death)!

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) বারবার বলছে, এই আধুনিক ডাইনি নিধন হলো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন (massive violation of human rights)। যাদের অভিযুক্ত করা হয়, তাদের বেশিরভাগই মহিলা বা শিশু। তবে বয়স্ক মানুষ বা সমাজের কোণঠাসা লোকেরাও (marginalised groups) – যেমন অ্যালবিনো (albinos) বা এইচআইভি আক্রান্তরা (HIV-infected) – এর শিকার হন (UNHCR, 2009)। এদেরকে সমাজের বোঝা (burdens to the community) ভাবা হয়। ফলে প্রায়ই তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, না খাইয়ে মারা হয়, বা খুব নৃশংসভাবে খুন করা হয় – কখনও কখনও নিজের বাড়ির লোকেরাই এই ‘সমাজ সাফাই’ (social cleansing) করে (Miguel, 2005)! এর পেছনের কারণগুলো হলো দারিদ্র্য (poverty), রোগ মহামারী (epidemics), সামাজিক অস্থিরতা (social crises), আর শিক্ষার অভাব (lack of education)। এই ডাইনি নিধনের যারা মাথা, তারা প্রায়ই হয় গ্রামের মাতব্বর বা কোনো ‘ডাইনি ডাক্তার’ (witch doctor)। তারা ভূত ছাড়ানোর (exorcism) নামে টাকা নেয়, অথবা খুন হওয়া মানুষের দেহাংশ (body parts) বিক্রি করেও পয়সা কামায় (UNHCR, 2011a; UNHCR, 2011b)!

মধ্যপ্রাচ্য (Middle East)

লেভান্ট (Levant)

২০১৫ সালের জুন মাসের শেষের দিকে, আইএসআইএস (ISIS) নামের এক ভয়ঙ্কর দল দেইর ইজ-জোর প্রদেশে (Deir ez-Zor province) দুটো দম্পতিকে গলা কেটে (beheaded) মেরে ফেলে। অভিযোগ? জাদুবিদ্যা আর “ওষুধের জন্য জাদু” (“magic for medicine”) ব্যবহার! (Mezzofiore, 2015)। এর আগেও আইএসআইএল সিরিয়া (Syria), ইরাক (Iraq) আর লিবিয়াতে (Libya) বেশ কয়েকজন “জাদুকর” (magicians) আর রাস্তার ভেল্কিবাজদের (street illusionists) একইভাবে মেরেছিল (Armstrong, 2015)।

সৌদি আরব (Saudi Arabia)

সৌদি আরবে ডাইনিবিদ্যা বা জাদুবিদ্যা এখনও ফৌজদারি অপরাধ (criminal offense), যদিও ঠিক কোন কাজটাকে অপরাধ বলা হবে, তা পরিষ্কার নয় (undefined) (Human Rights Watch, 2008)।

সারা দেশে বছরে ক’টা এমন মামলা হয়, তা জানা মুশকিল। তবে ২০০৯ সালের নভেম্বরে খবর বেরিয়েছিল, সে বছর মক্কা প্রদেশে (province of Makkah) ১১৮ জনকে জাদু করা আর “আল্লাহর কিতাবকে অসম্মানজনকভাবে ব্যবহার করার” (“using the Book of Allah in a derogatory manner”) দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৪% ছিল মহিলা! (“Distance witch finally caught”, 2009)। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (Human Rights Watch) ২০০৯ সালে জানায়, ডাইনিবিদ্যা আর জাদুবিদ্যার মামলা বাড়ছে আর “সৌদি আদালতগুলো সে দেশের ধর্মীয় পুলিশকে (religious police) দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ডাইনি নিধন করাচ্ছে” (“Saudi Arabia: Witchcraft and Sorcery Cases on the Rise”, 2009)।

২০০৬ সালে ফাওজা ফালিহ (Fawza Falih) নামে এক নিরক্ষর সৌদি মহিলাকে পুরুষত্বহীন করার মন্ত্র (impotence spell) পড়া সহ ডাইনিবিদ্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে শিরশ্ছেদের হুকুম দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল, তাকে নাকি পিটিয়ে আর জোর করে একটা মিথ্যে স্বীকারোক্তিতে (false confession) টিপসই দিতে বাধ্য করা হয়েছিল, যা তাকে পড়েও শোনানো হয়নি! (“King Abdullah urged to spare Saudi ‘witchcraft’ woman’s life”, 2008)। আপিল আদালত রায়টা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও, নিচের আদালত অন্য কারণ দেখিয়ে সেই একই সাজা বহাল রাখে! (“Letter to HRH King Abdullah”, 2008)।

২০০৭ সালে মুস্তাফা ইব্রাহিম (Mustafa Ibrahim) নামে এক মিশরীয়কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার অপরাধ? তিনি নাকি জাদু দিয়ে এক বিবাহিত দম্পতিকে আলাদা করার চেষ্টা করেছিলেন, আর সেই সাথে ব্যভিচার (adultery) ও কুরআন অবমাননাও (desecrating the Quran) করেছিলেন (“Saudi executes Egyptian for practising ‘witchcraft'”, 2007)।

একই বছর, আব্দুল হামিদ বিন হুসাইন বিন মুস্তাফা আল-ফাক্কি (Abdul Hamid Bin Hussain Bin Moustafa al-Fakki) নামে এক সুদানী ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি নাকি এমন এক মন্ত্র (spell) তৈরি করছিলেন যা দিয়ে এক তালাকপ্রাপ্ত দম্পতির আবার মিল হয়ে যাবে! (“Sudanese man facing execution”, 2010)।

২০০৯ সালে আলী সিবাত (Ali Sibat) নামে এক লেবানিজ টিভি উপস্থাপককে সৌদি আরবে হজে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার করা হয়। টিভিতে ভাগ্য গণনা (fortune-telling) করার অপরাধে তাকে ডাইনিবিদ্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (“Lebanese TV host Ali Hussain Sibat faces execution”, 2010)। তার আপিল একবার মঞ্জুর হলেও, মদিনার অন্য এক আদালত ২০১০ সালের মার্চে আবার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। যুক্তি? তিনি নাকি বহু বছর ধরে লক্ষ লক্ষ লোকের সামনে টিভিতে জাদু দেখিয়েছেন! (“Lebanese PM should step in to halt Saudi Arabia ‘Sorcery’ execution”, 2010)। তবে ২০১০ এর নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট এই রায় নাকচ করে দেয়, কারণ তার কাজে অন্যের ক্ষতি হয়েছে এমন যথেষ্ট প্রমাণ (insufficient evidence) ছিল না (“Saudi court rejects death sentence for TV psychic”, 2010)।

২০১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর, আমিনা বিনতে আব্দুলহালিম নাসারকে (Amina bint Abdulhalim Nassar) আল জাওফ প্রদেশে (Al Jawf Province) ডাইনিবিদ্যা আর জাদু করার দায়ে শিরশ্ছেদ করা হয় (“Saudi Arabia: Woman Is Beheaded”, 2011)। একই রকম ঘটনা ঘটে মুরি বিন আলী বিন ইসা আল-আসিরির (Muree bin Ali bin Issa al-Asiri) সাথেও, তাকে ২০১২ সালের ১৯শে জুন নাজরান প্রদেশে (Najran Province) শিরশ্ছেদ করা হয় (“Saudi man executed for ‘witchcraft and sorcery'”, 2012)।

ওশেনিয়া (Oceania)

পাপুয়া নিউগিনি (Papua New Guinea)

পাপুয়া নিউগিনিতে ভালো জাদু (white magic) – যেমন ঝাড়ফুঁক করে রোগ সারানো (faith healing) – আইনত বৈধ। কিন্তু ১৯৭৬ সালের জাদুবিদ্যা আইন (Sorcery Act) অনুযায়ী খারাপ জাদু (black magic) করলে দু’বছর পর্যন্ত জেল হতে পারত। অবশ্য ২০১৩ সালে আইনটা বাতিল করা হয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার জানায়, ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্তদের – বেশিরভাগই একা থাকা মহিলা – কোনো বিচার ছাড়াই অত্যাচার (extrajudicial torture) আর খুন করার ঘটনা পাহাড়ি এলাকা থেকে শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে, কারণ গ্রামের লোকেরা শহরে আসছে (migrate to urban areas) (“Unreported World”, 2009)। যেমন, ২০১৩ সালের জুনে, চারজন মহিলাকে ডাইনি বলা হলো, কারণ তাদের পরিবারের “কাঠের তৈরি একটা পাকা বাড়ি (‘permanent house’) ছিল, আর ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়েছে, সমাজে মানসম্মানও (high social standing) ছিল”! চারজনকেই অত্যাচার করা হয়, আর হেলেন রুম্বালি (Helen Rumbali) নামে একজনকে তো গলা কেটেই ফেলা হয়। মানবাধিকার কর্মী হেলেন হাকেনা (Helen Hakena) বলেছেন, এই সব অভিযোগের মূলে ছিল খনি ব্যবসার (mining boom) কারণে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক হিংসা (economic jealousy) (McGuirk, 2013)।

জাতিসংঘ (U.N. agencies), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (Amnesty International), অক্সফাম (Oxfam) আর নৃতাত্ত্বিকদের রিপোর্ট বলছে, “অভিযুক্ত জাদুকর আর ডাইনিদের উপর হামলা – কখনও পুরুষ, তবে বেশিরভাগই মহিলা – প্রায়ই ঘটে, খুব নৃশংসভাবে ঘটে, আর প্রায়শই তাতে মৃত্যু হয়” (Chandler, 2017)। হিসেব বলছে, শুধু পাপুয়া নিউগিনির সিম্বু প্রদেশেই (province of Simbu) বছরে প্রায় ১৫০টা এরকম হিংসা আর খুনের ঘটনা ঘটে (Gibbs, 2012)! রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, এই ডাইনি নিধন কোথাও কোথাও যেন “আরও ভয়ঙ্কর, বিকৃত আর বীভৎস” (“something more malignant, sadistic and voyeuristic”) রূপ নিয়েছে (Chandler, 2017)। এক মহিলার ঘটনা শোনা যায়, যাকে পাশের গ্রামের কিছু যুবক আক্রমণ করেছিল। তারা নাকি “তার যৌনাঙ্গ পুড়িয়ে দিয়েছিল আর গরম লোহা (red-hot irons) বারবার ঢুকিয়ে এমন অবস্থা করেছিল যে তা আর কোনোদিন ঠিক হওয়ার নয় (fused beyond functional repair)” (Chandler, 2017)! ২০১২ সালের আইন সংস্কার কমিশন (Law Reform Commission) বলছে, এসব ঘটনার খুব কমই বাইরে আসে, আর ১৯৮০ সাল থেকে এগুলো বেড়েই চলেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশ (Indian Subcontinent)

ভারত (India)

ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে, এখনও অনেকে বিশ্বাস করেন ডাইনিবিদ্যা বা কালো জাদুতে (black magic) বিরাট ক্ষমতা আছে। একদিকে যেমন শরীর খারাপ, টাকা-পয়সার টানাটানি বা বিয়ের সমস্যায় (marital problems) লোকে ওঝা বা ডাইনি ডাক্তারদের (witch doctors) কাছে ছোটে পরামর্শের জন্য (“Black Magic practices in India”, 2012), তেমনি অন্যদিকে, বিশেষ করে মহিলাদের, ডাইনি অপবাদ (witchcraft accusation) দিয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণ করা হয়, এমনকি মেরেই ফেলা হয় (“Village ‘witches’ beaten in India”, 2009; “‘Witch’ family killed in India”, 2008)! খবর পাওয়া যায়, বেশিরভাগ সময়েই বিধবা (widows) বা তালাকপ্রাপ্তা (divorcees) মহিলাদের নিশানা করা হয়, আসল উদ্দেশ্য থাকে তাদের সহায়সম্পত্তি (property) হাতিয়ে নেওয়া (“Bengal tribesmen kill ‘witches'”, 2003)। শোনা যায়, গ্রামের মান্যিগণ্যি ওঝাদের নাকি টাকা দিয়ে ভাড়া করা হয় কাউকে ‘ডায়েন’ (dayan) বলে চিহ্নিত করার জন্য, যাতে পরে তাকে মেরে ফেললে কোনো ঝামেলা না হয়! দেশের যে আইনকানুন আছে, তা এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে তেমন কার্যকর নয় (ineffective) (Schnoebelen, 2009)। ২০১৩ সালের জুন মাসে জাতীয় মহিলা কমিশন (NCW) জানায়, সরকারি হিসেব (NCRB statistics) অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে ডাইনি সন্দেহে ৭৬৮ জন মহিলাকে খুন করা হয়েছে! তারা নতুন আইন আনার কথাও ঘোষণা করে (“NCW demands stringent law against witch-hunts”, 2013)।

ভেবে দেখুন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে শুধু আসাম রাজ্যেই (state of Assam) প্রায় ৩০০ জনকে খুন করা হয়েছে ডাইনি সন্দেহে! (“Killing of women, child ‘witches’ on rise, U.N. told”, 2009)। ২০০৫ থেকে ২০১০ এর মধ্যে ওড়িশার সুন্দরগড় জেলায় (Odisha’s Sundergarh district) ডাইনি সংক্রান্ত খুনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৩৫টি (“Witch Killings in Orissa District Cause Concern”, 2010)। ২০০৩ সালের অক্টোবরে বিহারের মুজাফফরপুর জেলার (Muzaffarpur district in Bihar) কামালপুরা গ্রামে তিনজন মহিলাকে ডাইনি বলে এমন অপমান করা হলো যে তারা তিনজনই আত্মহত্যা (committed suicide) করলেন (“Three ‘witches’ kill themselves”, 2003)। ২০১৩ সালের আগস্টে আসামের কোকরাঝাড় জেলায় (Kokrajhar district in Assam) এক দম্পতিকে একদল লোক কুপিয়ে খুন করে (“In Assam, a rising trend of murders on allegations of witchcraft”, 2013)। সেই বছরই সেপ্টেম্বরে ছত্তিশগড়ের জশপুর জেলায় (Jashpur district of Chhattisgarh) এক মহিলাকে খুন আর তার মেয়েকে ধর্ষণ (raped) করা হলো – কারণ? তারা নাকি কালো জাদু (practising black magic) করত! (“Girl raped, mom killed for her alleged indulgence in black magic in Chhattisgarh”, 2013)।

একটা হিসেব বলছে, ২০১০ সাল নাগাদ ভারতে প্রতি বছর ১৫০ থেকে ২০০ জন মহিলাকে ডাইনি অপবাদে খুন করা হয়। মানে, ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত মোট প্রায় আড়াই হাজার! (The Hindu, 2010; Herald Sun, 2010)। ঝাড়খণ্ড (Jharkhand), বিহার (Bihar), ছত্তিশগড়ের (Chhattisgarh) মতো গরিব রাজ্যগুলোতে এই গণপিটুনি (lynchings) খুব বেশি দেখা যায় (“Witch hunts targeted by grassroots women’s groups”, 2012)। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার (Jalpaiguri district, West Bengal) চা বাগানের শ্রমিকদের (tea garden workers) মধ্যেও এই ডাইনি নিধন চলছে (Witches, Tea Plantations, and Lives of Migrant Laborers in India)। জলপাইগুড়ির ঘটনাগুলো হয়তো কম আলোচিত, কিন্তু এর পেছনে আছে চা শিল্পের (tea industry) চাপে পিষ্ট আদিবাসী (Adivasi) শ্রমিকদের জীবনের যন্ত্রণা (stress) (Witches, Tea Plantations, and Lives of Migrant Laborers in India)।

ভারতে আসলে ব্যাপারটা কী দাঁড়িয়েছে জানেন? কাউকে ডাইনি বলে দাগিয়ে দেওয়াটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জমি দখলের (grab land), পুরনো শত্রুতার শোধ (settle scores) নেওয়ার, এমনকি প্রেম বা যৌন প্রস্তাবে (sexual advances) রাজি না হওয়ায় শাস্তি দেওয়ার একটা সহজ উপায়! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, যে মহিলার উপর এই অপবাদ আসে, তার পক্ষে সাহায্য পাওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়। তাকে হয় ঘরবাড়ি, পরিবার ছেড়ে পালাতে হয়, নয়তো আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়। আর কত ঘটনাই তো চাপা পড়ে যায়! গরিব, নিরক্ষর মহিলারা দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাবেন কী করে? ঝাড়খণ্ডের একটা সংস্থা আছে, ফ্রি লিগ্যাল এইড কমিটি (Free Legal Aid Committee), যারা ভুক্তভোগীদের নিয়ে কাজ করে। তাদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডাইনি নিধনে অভিযুক্তদের মধ্যে সাজা হয় মাত্র ২ শতাংশেরও কম লোকের! (Womensnews.org; Bailey, 1994)। কী সাংঘাতিক অবস্থা!

নেপাল (Nepal)

নেপালেও (Nepal) ডাইনি নিধন বেশ প্রচলিত। আর সেখানেও শিকার হন মূলত নিম্নবর্ণের মহিলারা (low-caste women) (Shrestha, 2010; “Nepal – A study on violence due to witchcraft allegation and sexual violence”, 2013)। এর পেছনের কারণগুলোও প্রায় একই রকম: কুসংস্কারের (superstition) প্রতি গভীর বিশ্বাস, শিক্ষার অভাব, সচেতনতার (public awareness) অভাব, নিরক্ষরতা (illiteracy), জাতপাতের ভেদাভেদ (caste system), পুরুষতান্ত্রিকতা (male domination), আর পুরুষদের উপর মহিলাদের আর্থিক নির্ভরতা (economic dependency)। যাদের ডাইনি বলে সন্দেহ করা হয়, তাদের কপালে জোটে মারধর, অত্যাচার, সবার সামনে অপমান (publicly humiliated), এমনকি মৃত্যু। কখনও কখনও অভিযুক্তের বাড়ির লোকজনকেও ছাড় দেওয়া হয় না (“Nepal – A study on violence due to witchcraft allegation and sexual violence”, 2013)। ২০১০ সালে নেপালের নারী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী (Minister for Women and Social Welfare) সর্ব দেব প্রসাদ ওঝা (Sarwa Dev Prasad Ojha) বলেছিলেন, “কুসংস্কার আমাদের সমাজে এমনভাবে গেঁড়ে বসেছে, আর ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস হলো এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকগুলোর একটা” (“Witch-hunt victim recounts torture ordeal”, 2010)।

সাহারার দক্ষিণের আফ্রিকা (Sub-Saharan Africa)

আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের অনেক দেশেই ডাইনি নিয়ে মানুষের মনে ভীষণ ভয়। আর এই ভয় থেকেই থেকে থেকে শুরু হয় ডাইনি নিধন। কিছু বিশেষ লোক থাকে, যারা নাকি ডাইনি চিনতে পারে (specialist witch-finders)। তারা কাউকে সন্দেহভাজন বলে চিহ্নিত করলেই ব্যস, শুরু হয়ে যায় গণপিটুনি, যার শেষ হয় প্রায়শই মৃত্যুতে (Diwan, 2004)। দক্ষিণ আফ্রিকা (South Africa) (Ally, 2014), ক্যামেরুন, কঙ্গো, গাম্বিয়া, ঘানা, কেনিয়া, সিয়েরা লিওন, তানজানিয়া, জাম্বিয়া – এই দেশগুলোতে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে (de Waal, 2012)।

এমনকি শিশুদেরও ডাইনি অপবাদ দিয়ে অত্যাচার করা হয়! ১৯৯৯ সালে কঙ্গোতে (Congo) (“Congo witch-hunt’s child victims”, 1999) আর তানজানিয়াতে এমন খবর পাওয়া গিয়েছিল। তানজানিয়াতে তো মহিলাদের লাল চোখ (red eyes) দেখলেই ডাইনি বলে হামলা করা হতো, সরকারকে শেষে ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল (“Tanzania arrests ‘witch killers'”, 2003)। ঘানাতেও ডাইনি নিধন খুব সাধারণ ঘটনা। ২০০১ সালে সেখানে একজন মহিলা, যাকে ডাইনি বলা হয়েছিল, তিনি মামলা দায়ের করেছিলেন (“Tanzania arrests ‘witch killers'”, 2003)। আফ্রিকায় অনেক সময়েই দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পত্তি (property) হাতানোর লোভে তার আত্মীয়রাই এই ডাইনি নিধনের কলকাঠি নাড়ে!

অড্রে আই রিচার্ডস (Audrey I. Richards) নামে একজন নৃতাত্ত্বিক ১৯৩৫ সালে ‘আফ্রিকা’ (Africa) জার্নালে জাম্বিয়ার বেম্বা জাতির (Bemba people of Zambia) একটা ঘটনার কথা লিখেছিলেন (Richards, 1935)। সেখানে বামুকাপি (Bamucapi) নামে এক নতুন ধরনের ডাইনি-শনাক্তকারীর দল গ্রামে গ্রামে ঘুরত। তারা পরত ইউরোপীয় পোশাক (European clothing)! গ্রামের মোড়লকে (headman) ডেকে বলত সবার জন্য ভোজের (ritual meal) আয়োজন করতে। সবাই এলে, তারা একটা আয়না (mirror) দিয়ে সবাইকে দেখত আর দাবি করত, এভাবেই নাকি ডাইনি চেনা যায়! যাদের ডাইনি বলে ধরা হতো, তাদের নাকি নিজেদের “শিং জমা দিতে” (“yield up his horns”) হতো – মানে, অভিশাপ (curses) আর খারাপ ওষুধের (evil potions) জন্য ব্যবহার করা শিংয়ের কৌটাগুলো (horn containers) তাদের দিয়ে দিতে হতো। তারপর বামুকাপিরা সবাইকে কুচাপা (kucapa) নামে একটা ওষুধ খাওয়াত। বলা হতো, কোনো ডাইনি যদি আবার এসব করার চেষ্টা করে, তাহলে এই ওষুধ খেয়ে সে মরে ফুলে উঠবে!

গ্রামের লোকেরা বলত, বামুকাপিরা নাকি ভুল করত না। কারণ তারা যাদের ধরত, তাদেরকেই তো গ্রামসুদ্ধ লোক আগে থেকে ভয় পেত! বামুকাপিরা নিজেদের ক্ষমতার ব্যাখ্যা দিত খ্রিস্টান আর স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসের (Christian and native religious traditions) মিশেল দিয়ে। বলত, ঈশ্বর (God) (কোন ঈশ্বর, তা অবশ্য বলত না!) তাদের ওষুধ বানাতে সাহায্য করেন। আরও বলত, যে ডাইনিরা ধরা পড়ার ভয়ে ভোজে আসবে না, তাদের পরে তাদের ‘মাস্টার’ (master) ডাকবে – যে কিনা কবর থেকে উঠে এসেছে! মাস্টার নাকি ড্রাম বাজিয়ে (drums) ডাইনিদের কবরস্থানে (graveyard) যেতে বাধ্য করবে, আর সেখানেই তারা মরবে! রিচার্ডস খেয়াল করেছিলেন, বামুকাপিরা গ্রামের সব শিং – তা সে ডাইনি তাড়ানোর তাবিজ (anti-witchcraft charms), ওষুধ, নস্যি (snuff) রাখার জন্যই হোক, বা সত্যিই কালো জাদুর (black magic) জন্যই হোক – সব কেড়ে নিয়ে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করত।

বেম্বা জাতির লোকেরা ভাবত, যুদ্ধবিগ্রহ (wartings), ভূতের উপদ্রব (hauntings) বা দুর্ভিক্ষ (famines) – এসব হলো তাদের প্রধান দেবতা লেসার (High-God Lesa) দেওয়া শাস্তি, এর পেছনে কারণ আছে। কিন্তু বিনা কারণে ক্ষতি করতে পারে কেবল একজনই – ডাইনি! যার নাকি প্রচুর ক্ষমতা (enormous powers), আর যাকে চেনা খুব মুশকিল। আফ্রিকায় যখন শ্বেতাঙ্গ শাসন (white rule of Africa) এল, তখন জাদু আর ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস যেন আরও বেড়ে গেল। হয়তো নতুন ধ্যানধারণা, রীতিনীতি, আইনের চাপে মানুষের মধ্যে একটা টানাপোড়েন (social strain) তৈরি হয়েছিল বলে। আবার এটাও কারণ হতে পারে যে, তখন আর আদালতে ডাইনিদের বিচার করা যেত না।

দক্ষিণ আফ্রিকার বান্টু উপজাতিদের (Bantu tribes of Southern Africa) মধ্যে ডাইনি চেনার কাজটা করত ‘ডাইনি গন্ধগ্রাহক’রা (witch smellers)! দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু জায়গায় ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ডাইনি নিধনে মারা গেছে (Hayes, 1995)।

ক্যামেরুন তো ১৯৬৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর আবার আদালতেও ডাইনিবিদ্যা সংক্রান্ত অভিযোগ (witchcraft-accusations) শোনার ব্যবস্থা করেছে! (Levack, 2004; Fisiy, 2001; Afrik.com)।

২০০৮ সালের মে মাসে খবর এল, কেনিয়াতে (Kenya) একদল জনতা ডাইনি সন্দেহে অন্তত ১১ জনকে পুড়িয়ে মেরেছে (burnt to death)! (“Mob burns to death 11 Kenyan ‘witches'”, 2008)।

২০০৯ সালের মার্চে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানাল, গাম্বিয়াতে সরকারি মদতপুষ্ট “ডাইনি ডাক্তাররা” (“witch doctors”) প্রায় ১০০০ লোককে ডাইনি অপবাদে অপহরণ (abducted) করে আটক কেন্দ্রে (detention centers) নিয়ে গেছে আর সেখানে তাদের জোর করে বিষাক্ত জিনিস (poisonous concoctions) খাইয়েছে! (“The Gambia: Hundreds accused of ‘witchcraft'”, 2009)। সেই বছরই মে মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস (The New York Times) রিপোর্ট করল, এই কাণ্ডটা নাকি ঘটিয়েছেন গাম্বিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জামেহ (Yahya Jammeh) নিজে! (Nossiter, 2009)।

সিয়েরা লিওনে আবার ডাইনি নিধনটা হয়ে দাঁড়ায় নীতিশিক্ষার উপলক্ষ্য! কেমামোই (kɛmamɔi) নামে স্থানীয় মেন্ডে জাতির ডাইনি-শনাক্তকারী (native Mende witch-finder) এসে লোকজনকে বোঝায়: “ডাইনিবিদ্যা… মানুষের জীবনে তখনই ঢোকে যখন মানুষ মন খুলে মেশে না। যত খারাপ কাজ, তার মূলে আছে ঘৃণা, হিংসা, সন্দেহ বা ভয়। এই সব অনুভূতিই মানুষকে সমাজবিরোধী (act antisocially) করে তোলে” (Gittins, 1987, p. 197)। আর লোকেরা নাকি তার কথা শুনে বলত, “তারা তার কাজকে সম্মান করে এবং সামাজিক দায়িত্ব আর সহযোগিতার যে শিক্ষা তিনি দিতে এসেছেন, তা তারা শিখবে” (Gittins, 1987, p. 201)। বিচিত্র ব্যাপার!

অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘উইচ-হান্ট’ শব্দের ব্যবহার (Use of the term in other contexts)

আজকাল অবশ্য ‘উইচ-হান্ট’ শব্দটা শুধু আসল ডাইনি নিধন বোঝাতে ব্যবহার হয় না। যখন কোনো কারণ ছাড়াই হন্যে হয়ে কিছু লোককে দোষী খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়, আর তারপর তাদের হেনস্তা করা হয়, তখন সেটাকেও ‘উইচ-হান্ট’ বলা হয়। যেমন ধরুন, স্ট্যালিনের আমলের অত্যাচার (Stalinist witch-hunts) (Mansky, 2017) বা আমেরিকায় ম্যাকার্থিজমের সময়কার কমিউনিস্ট খোঁজা (McCarthyite witch-hunts) (Miller, 1996)। গবেষক জেমস মোরোন (James Morone) ঠিকই বলেছেন, “একটা ঘটনাকে উইচ-হান্ট বানায় আসলে ডাইনিরা (বা কমিউনিস্ট বা শিশু নির্যাতনকারীরা) নয়। বরং যারা শিকার করছে, তাদের স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নিয়মগুলো (normal rules of justice) ছুঁড়ে ফেলার মানসিকতাই একে উইচ-হান্ট বানায়” (Morone, 2022)।

রাজনীতিতেও এই শব্দটা খুব চলে। কেউ যখন বোঝাতে চায় যে তাকে বা তার দলকে অন্যায়ভাবে কোণঠাসা (oppressed) বা একঘরে (ostracised) করা হচ্ছে, তখন তারা প্রায়ই ‘উইচ-হান্ট’ বলে চিৎকার করে। দ্য টেলিগ্রাফ (The Telegraph) পত্রিকা তো ‘ক্যানসেল কালচার’কে (cancel culture) বলেছে “আজকের দিনের ডাইনি বিচার” (“modern-day witch trials”)! (Telegraph Video, 2021)। আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) তো কথায় কথায় টুইটারে এই শব্দটা ব্যবহার করতেন – তার বিরুদ্ধে হওয়া নানা তদন্ত (investigations) (Shear, Savage, & Haberman, 2017; Al-Arshani, 2021) বা অভিশংসনের প্রক্রিয়াকে (impeachment proceedings) তিনি ‘উইচ-হান্ট’ বলতেন (“Trump calls impeachment effort ‘greatest witch hunt'”, 2021; “Trump calls impeachment case a ‘witch hunt'”, 2021; Markham-Cantor, 2019)। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি নাকি ৩৩০ বারেরও বেশি এই শব্দ ব্যবহার করেছেন! (Almond, 2020)। এমনকি আমেরিকার ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনও (NRA) এই শব্দ ব্যবহার করে নিউ ইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেলের করা একটা মামলা খারিজ করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল (Gregorian, 2022)।

ডাইনি বিচারের তালিকা (List of witch trials)

  • Aberdeen witch trials of 1596–1597
  • Akershus witch trials
  • Amersfoort and Utrecht witch trials
  • Baden-Baden witch trials
  • Basque witch trials
  • Bideford witch trial
  • Bo’ness witches
  • Bredevoort witch trials
  • Bury St Edmunds witch trials
  • Channel Islands Witch Trials
  • Copenhagen witch trials
  • Derenburg witch trials
  • Doruchów witch trial
  • Eichstätt witch trials
  • Ellwangen witch trial
  • Esslingen witch trials
  • Fulda witch trials
  • Fürsteneck witch trial
  • Geneva witch trials
  • Great Scottish Witch Hunt of 1597
  • Great Scottish witch hunt of 1649–50
  • Great Scottish Witch Hunt of 1661–62
  • Islandmagee witch trial
  • Kasina Wielka witch trial
  • Kastelholm witch trials
  • Katarina witch trials
  • Kirkjuból witch trial
  • Liechtenstein witch trials
  • Lisbon witch trial
  • Lukh witch trials
  • Mergentheim witch trials
  • Mirandola witch trials
  • Mora witch trial
  • Newcastle witch trials
  • Nogaredo witch trial
  • North Berwick witch trials
  • Northamptonshire witch trials
  • Northern Moravia witch trials
  • Orkney witch trials
  • Paisley witches
  • Pappenheimer witch trial
  • Peelland witch trials
  • Pittenweem witches
  • Pendle witches
  • Põlula witch trials
  • Ramsele witch trial
  • Roermond witch trial
  • Rosborg witch trials
  • Rottenburg witch trials
  • Rottweil Witch Trials
  • Rugård witch trials
  • Salem witch trials
  • Spa witch trial
  • St Osyth Witches
  • Szeged witch trials
  • Terrassa witch trials
  • Thisted witch trial
  • Torsåker witch trials
  • Trier witch trials
  • Valais witch trials
  • Val Camonica witch trials
  • Vardø witch trials (1621)
  • Vardø witch trials (1651–1653)
  • Vardø witch trials (1662–1663) as part of the Christianization of the Sámi people
  • Wiesensteig witch trial
  • Witches of Warboys
  • Würzburg witch trials

উইচ হান্ট বা ডাইনি নিধন নিয়ে নারীবাদী ব্যাখ্যা

ডাইনি বিচার নিয়ে নারীবাদীরা কী ভাবেন, সে এক বিরাট ফিরিস্তি। উনিশ আর বিশ শতক ধরে এই নিয়ে কত যে কথা, কত যে লেখালেখি! আর সময়ের সাথে সাথে এই ভাবনাগুলোও কিন্তু পাল্টেছে। নারীবাদী চিন্তাধারার যেমন বিভিন্ন ঢেউ (wave) এসেছে – যেমন ধরুন প্রথম তরঙ্গ (first-wave), দ্বিতীয় তরঙ্গ (second-wave feminism) এবং সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী (socialist feminist) আন্দোলন – এই ব্যাখ্যাগুলোও সেভাবেই একটু একটু করে চেহারা বদলেছে।

নারীবাদী ব্যাখ্যার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

আদি আধুনিক যুগের (early modern period) লেখালেখি থেকেই নারীবাদী ব্যাখ্যার একটা ভিত্তি তৈরি হয়ে ছিল। এইসব লেখায় ডাইনিদের একটা গতানুগতিক ছবি (stereotype) ফুটে ওঠে, বিশেষ করে তাদের মেয়েলি স্বভাবের বিষয়টা। এই ছবিটা তখনকার সমাজে বেশ গেঁড়ে বসেছিল। মূল কথা হলো, সেসময় যারা জাদুবিদ্যা বা ডাইনি বিদ্যার বিচার করত, সেই আইনকর্তাদের বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, আর যাদের বিচার হচ্ছিল, তাদের বেশিরভাগই নারী। এমনকি পুরুষদের করা অপরাধের ক্ষেত্রেও দেখা যেত, কারণে-অকারণে মেয়েদেরই বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে।

‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (The Malleus Maleficarum) – একখানা ভয়ংকর বই

ডাইনিবিদ্যা নিয়ে যতসব কেতাব লেখা হয়েছে, তার মধ্যে ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum) বোধহয় সবচেয়ে কুখ্যাত! ১৪৮৪ সালে ক্যাথলিক যাজক হেনরিখ ক্রেমার (Heinrich Kramer) এইখানা লেখেন। বইটা তিন ভাগে ভাগ করা। প্রথম ভাগে বলা হয়েছে, ডাইনিবিদ্যা নিয়ে কীভাবে ধর্মোপদেশ দিতে হবে, আর ধর্মের চশমায় বিষয়টাকে কীভাবে দেখা উচিত। এই অংশে আরও ব্যাখ্যা করা হয়েছে, ডাইনিবিদ্যা আদৌ সত্যি কি না। শেষে সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে, শয়তান যেহেতু সত্যি, তাই ডাইনিবিদ্যাও সত্যি হতে বাধ্য; দুটোকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলা হয়েছে আরকি।

দ্বিতীয় অংশে ডাইনিদের নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করা হয়েছে – তাদের মধ্যে কী কী বৈশিষ্ট্য সাধারণত দেখা যায়, তারা কীভাবে ডাইনিগিরি করে, আর কারা সহজেই ভূতে আছর (possession) হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এই অংশে ডাইনিবিদ্যা ঠেকানোর কিছু উপায়ও বাতলে দেওয়া হয়েছে। সবশেষে, কীভাবে ডাইনিদের বিচার করতে হবে, তার খুঁটিনাটি বর্ণনা করা হয়েছে (Mackay, 2009)। অভিযোগ কীভাবে সামলাতে হবে, কীভাবে জেরা করতে হবে, কীভাবে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে – সব পর পর সাজানো, প্রশ্ন আর উত্তরের ধরনে। বেশিরভাগ উত্তরই নেওয়া হয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। আজকাল এই ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ বইটাকে ডাইনি বিচারের নারীবিদ্বেষী (misogynistic) চরিত্রের একটা বড় প্রমাণ হিসেবে ধরা হয় (Mackay, 2009)। বইটা পড়লে বোঝা যায়, মেয়েদের ওপর পুরুষদের কী ভীষণ আধিপত্য ছিল, আর ডাইনি অপবাদে অভিযুক্ত হলে মেয়েদের বাঁচার কোনো আশাই থাকত না।

‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ বইতে বার বার জোর দিয়ে বলা হয়েছে, মেয়েরা নাকি এমন কিছু গুণের (আসলে দোষের) অধিকারী, যা শুধু তাদেরই আছে, আর সে কারণেই তারা ডাইনিবিদ্যা বা “জাদুটোনায়” (sorcery) বেশি ঝুঁকে পড়ে। মজার ব্যাপার হলো, ডাইনি বিচারের সময় কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগের জন্য তাকে কখনো অভিযুক্ত বা দায়ী করা হয়নি। দ্বিতীয় ভাগের একটা অংশে, যেখানে ডাইনিদের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেখানে লেখক মেয়েদের সম্পর্কে কী ভাবতেন, তার একটা ঝলক পাওয়া যায়:

“অন্যরা অবশ্য মেয়েরা কেন পুরুষদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় কুসংস্কারী হয়, তার ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখান, এবং তারা বলেন এর পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা সহজেই বিশ্বাস করে এবং যেহেতু শয়তান মূলত ধর্মবিশ্বাস (Faith) নষ্ট করতে চায়, তাই সে বিশেষ করে তাদেরই আক্রমণ করে। একারণেই ধর্মগ্রন্থে (Ecclesiasticus 19[4]) আছে: ‘যে দ্রুত বিশ্বাস করে, সে চপলমতি এবং ছোট হয়ে যাবে।’ দ্বিতীয় কারণ হলো, তাদের স্বভাবের পরিবর্তনের (flux) প্রবণতার কারণে তারা স্বভাবতই দেহহীন আত্মার প্রভাবে প্রত্যাদেশ লাভের জন্য বেশি সংবেদনশীল হয়, এবং যখন তারা এই স্বভাব ভালোভাবে ব্যবহার করে, তখন তারা খুব ভালো হয়, কিন্তু যখন খারাপভাবে ব্যবহার করে, তখন তারা আরও খারাপ হয়। একারণেই তাদের মুখ আলগা (loose tongues) এবং তারা তাদের নারী সঙ্গীদের কাছ থেকে মন্দ কৌশলে জানা জিনিসগুলো গোপন করতে পারে না, এবং যেহেতু তাদের শারীরিক শক্তি কম (lack physical strength), তাই তারা সহজেই জাদুটোনার মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে চায়… যেহেতু তারা চঞ্চলমতি (prone to flux), তাই তারা আরও দ্রুত শয়তানের কাছে সন্তানদের উৎসর্গ করতে পারে, যেমনটা তারা করেও থাকে।” (Mackay, 2009)

‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’-এর এই অংশটুকু পড়লেই বোঝা যায়, মেয়েদের কিছু বানানো স্বভাবের – যেমন “মুখ আলগা” বা “গায়ে জোর কম” – দোহাই দিয়ে বলা হচ্ছে, তারা নাকি শয়তানের পাল্লায় বেশি পড়ে, আর জাদু দিয়ে চটজলদি প্রতিশোধ নিতে চায়। যেহেতু এই কেতাবখানা আদি আধুনিক যুগে ডাইনি ঠেকানোর চেষ্টায় বিশাল ভূমিকা রেখেছিল (Mackay, 2009), তাই ধরে নেওয়া যায়, মেয়েদের সম্পর্কে এই ধারণাগুলো ইউরোপের বহু মানুষ বিশ্বাস করত। তার ওপর, এই লেখাটা এমন এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল, যখন ধর্মের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তাই একটা ধর্মীয় লেখা হিসেবে এটা আরও সহজে গৃহীত হয়ে থাকতে পারে। আর ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা যেহেতু পুরুষদের হাতেই ছিল, তাই মেয়েদের সামনে অভিযুক্ত না হওয়া বা ন্যায্য বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না।

ডাইনি ও আদি আধুনিক যুগের নারীবিষয়ক গতানুগতিক ধারণা

আদি আধুনিক যুগে ডাইনিদের যে একটা বাঁধাধরা ছবি তৈরি হয়েছিল, তার শিকড় কিন্তু ডাইনি বিচার শুরু হওয়ারও আগের। সেই পুরনো আমলে মানুষজনের মধ্যে ভূত-প্রেত-দৈত্যদানব (demonism) নিয়ে যেসব ধারণা ছিল, সেখান থেকেই এই ছবিটা এসেছে (Hutton, 2017)। সেই যুগে ধর্মীয় কেতাবের ওপর মানুষের বিশ্বাস ছিল অগাধ, আর সেগুলোকে যুক্তিসঙ্গতও মনে করা হতো। পণ্ডিতরা বলেন, বিশেষ করে মেয়ে ভূত বা নারী দৈত্যের ওপর বিশ্বাসকেই পরে মেয়েদের জাদুক্ষমতার অতিরঞ্জিত ধারণার সাথে জুড়ে দেওয়া হয় (Hutton, 2017)। জার্মানদের পুরনো আইনকানুনগুলোতেও (Germanic law codes) এমন কিছু নরখাদক নারীর কথা বলা আছে, যাদের সাথে আদি আধুনিক যুগের ডাইনিদের অদ্ভুত মিল (Hutton, 2017)। দু’দলকেই ভাবা হতো—তারা বুড়ি, গরিব, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, কিংবা যৌনতার দিক থেকে একটু অন্যরকম (sexually deviant) – সোজা বাংলায়, সমাজের বেঁধে দেওয়া মেয়েলি ভূমিকার বাইরে তাদের বিচরণ (Bever, 2002; Hutton, 2017)।

এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলেই যে মেয়েদের ডাইনি বলে দাগিয়ে দেওয়া হতো, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন বিচার বা ঘটনার নথিপত্রে। ১৫৯৭ সালের একটা ঘটনার কথাই ধরুন। ‘স্ট্যাপেন হিলের অ্যালস গুডারিজ নামের এক ডাইনির সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও সত্যি কাহিনি’ (“The most wonderfull and true storie, of a certaine witch named Alse Gooderige of Stapen hill”)—এই শিরোনামের একটা পুরনো নথিতে দেখা যায়, ঠিক এই ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকলেই মেয়েদের কীভাবে ডাইনি বলে দাগিয়ে দেওয়া হতো (“A true and most dread full discourse…”, 1886)। মেয়েদেরকে ঝগড়ুটে, ঝামেলা সৃষ্টিকারী এবং প্রতিবেশীদের প্রতি আক্রমণাত্মক হিসেবে দেখা হতো। ওই নথিতে গুডারিজ এবং একটি অল্পবয়সী ছেলের মধ্যে একটি ঘটনার বর্ণনা আছে, যেখানে গুডারিজের বিরুদ্ধে ছেলেটিকে জাদু করার অভিযোগ আনা হয়। নথিতে অভিযুক্ত ডাইনি হিসেবে গুডারিজের বর্ণনায় তাকে একজন বৃদ্ধা বিধবা এবং তার মুখে আঁচিলসহ দেখানো হয়েছে (“A true and most dread full discourse…”, 1886)। এই বর্ণনা এটাই দেখায় যে, মেয়েরা যদি সমাজের প্রত্যাশিত তরুণী, সুন্দরী এবং সামাজিক জীবনে জড়িত থাকার বাইরে চলে যেত, তবে তাদের ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকত।

অন্যান্য ব্যাখ্যাও আছে, যেমন ধরুন শিল্পকলার দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানেও ডাইনিদের একটা চেহারা খাড়া করার চেষ্টা হয়েছে (Burns, 2003)। বেশিরভাগ সময়ই এই ছবিগুলো আসত ধর্মীয় কেতাব থেকে। আদি আধুনিক বা আর্লি মডার্ন যুগের বইপত্রে ডাইনিদের যে ছবি আঁকা হতো, তার অনেকটা জুড়ে ছিল গ্রিক পুরাণের জাদুকরী সার্সি (Circe)-কে নিয়ে আগ্রহ (Burns, 2003)। যেহেতু মেয়েদের নগ্নতা খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রেই দেখানো যেত, তাই ডাইনিবিদ্যার দিকে মানুষের ঝোঁক বাড়ে (Burns, 2003)। এই নগ্ন নারীদেহ দেখার আগ্রহ থেকেই ডাইনিদের সেভাবেই আঁকা হতো (Burns, 2003)। যেহেতু নগ্নতাকে পাপ বলেই মনে করা হতো, তাই ডাইনিবিদ্যাও শুরু থেকেই পাপের সাথেই জুড়ে গিয়েছিল।

আবার মেয়েদের নিয়ে অন্য ধরনের কিছু পুরনো ধারণাও ছিল, বিশেষ করে যখন পৌত্তলিক প্রথা (pagan practices) আর নানা আচার-অনুষ্ঠানের (rituals) কথা উঠত (Burton, 2019)। অনেকেই বলতেন, পৌত্তলিক উৎসবগুলোতে কিছু লোক মেয়েদের মতো পোশাক পরে এক ধরনের পানীয় (potion) পান করত (Burton, 2019)। একারণে ডাইনিবিদ্যার অনেক পুরনো ধারণাই এসব আচার থেকে এসেছে। এছাড়াও, রাসেল বার্টন (Russel Burton), ‘মধ্যযুগে ডাইনিবিদ্যা’ (Witchcraft in the Middle Ages) বইয়ের লেখক, এমন কিছু আচরণের কথা বলেছেন যা প্রাচীন রোমে নিন্দনীয় ছিল। অনেকেই বিশ্বাস করত, মেয়েরা শুধু রবিবারেই গির্জায় যেত পৌত্তলিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে (Burton, 2019)। এর মধ্যে নাচ, গান ইত্যাদির মতো সাধারণ কাজও ছিল।

যেসব মেয়েদের ডাইনিবিদ্যার সাথে জড়িত বলে মনে করা হতো, তাদের প্রায়শই শয়তানের সাথে বিভিন্ন কাজে লিপ্ত বলে ভাবা হতো, যেমন যৌন মিলন (sexual intercourse) (Burton, 2019)। যৌনতা বা যৌন চিন্তাভাবনার বেশিরভাগই নিষিদ্ধ ছিল, যা ডাইনিবিদ্যার প্রতি নেতিবাচক ধারণাকে আরও উসকে দিয়েছিল। তবে মেয়েদের একেবারে সরাসরি শয়তানের সাথে জড়ানোর আগে, অনেক ডাইনিকেই রোমান দেবী ডায়ানার (Diana) অনুসারী ভাবা হতো (Burton, 2019)। ডায়ানা, যিনি ছিলেন উর্বরতার দেবী, তিনিই আবার কুমারী শিকারী এবং পশুদের রক্ষাকর্ত্রীও ছিলেন (Burton, 2019)। এতসব গুণের পরেও, ডায়ানাকে পাতালপুরীর (underworld) সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ভাবা হতো, যেখানে তাকে হেকাটির (Hecate) সাথে এক করে দেখা হতো (Burton, 2019)। ডায়ানার এই অন্ধকার, আরও জটিল রূপটাই ছিল মধ্যযুগে ডাইনিবিদ্যার আদি নেত্রী, আর তৎকালীন সমাজে মেয়েদের আরেক প্রতিচ্ছবি (Burton, 2019)।

ডাইনি বিচারের দিকে তাকালে দেখা যায়, অভিযুক্তদের বেশিরভাগই ছিলেন নারী এবং তারাই ছিলেন মোট অভিযুক্তের একটা বড় অংশ (Karlsen, 1987)। পুরুষদের খুব কমই অভিযুক্ত করা হতো, আর তাদের কখনোই মূল চরিত্র হিসেবে দেখা হতো না, বরং শিকার হিসেবেই দেখানো হতো। নিউ ইংল্যান্ডের ঘটনাগুলো যদি আরও কাছ থেকে দেখি, কার্লসন তার ‘দ্য ডেভিল ইন দ্য শেপ অফ এ ওম্যান’ (The Devil in the Shape of a Woman) বইতে বিভিন্ন দলের তথ্য দিয়েছেন (Karlsen, 1987)। ১৬২০ থেকে ১৭২৫ সাল পর্যন্ত নিউ ইংল্যান্ডে ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্তদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছিল ১৫৬ জন, আর পুরুষের সংখ্যা মাত্র ৪৯ (Karlsen, 1987)। শুধু নিউ ইংল্যান্ডেই, ওই একই সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৩৪৪ জনকে ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, যার মধ্যে আটাত্তর শতাংশই ছিলেন নারী (Karlsen, 1987)। কঠিন সাজাগুলোও কিন্তু সেসময় মেয়েদের জন্যই বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ছিল সমাজ থেকে বহিষ্কার, কারাবাস, গৃহবন্দীত্ব বা মৃত্যুদণ্ড (সাধারণত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে) (Karlsen, 1987)।

প্রথম ও দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদে

প্রথম দিকের নারীবাদী ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে একজন ছিলেন আমেরিকান ম্যাটিল্ডা জসলিন গেজ (Matilda Joslyn Gage), একজন লেখিকা যিনি নারীদের ভোটাধিকারের জন্য প্রথম তরঙ্গের (first-wave) নারীবাদী আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। ১৮৯৩ সালে তিনি ‘নারী, গির্জা ও রাষ্ট্র’ (Woman, Church and State) নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইতে গেজ যুক্তি দেখান যে, আদি আধুনিক যুগে যাদের ডাইনি বলে মারা হয়েছিল, তারা আসলে এক প্রাচীন ধর্মের পুরোহিত (pagan priestesses) ছিলেন, যারা এক মহান দেবীর (Great Goddess) উপাসনা করতেন। তবে তিনি একটা ভুল তথ্যও প্রচার করেন, যা তিনি কয়েকজন জার্মান লেখকের কাজ থেকে নিয়েছিলেন – যে ডাইনি নিধনে নব্বই লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল (Hutton, 2017)।

১৯৭৩ সালে, আমেরিকার দ্বিতীয় তরঙ্গের (second-wave) দুই নারীবাদী, বারবারা এহরেনরাইখ (Barbara Ehrenreich) ও দেইরদ্রে ইংলিশ (Deirdre English) একটা লম্বা পুস্তিকা প্রকাশ করেন। সেখানে তারা বলেন, যাদের ডাইনি বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তারা আসলে ছিলেন সম্প্রদায়ের চিরায়ত সেবিকা ও ধাত্রী (healers and midwives), যাদেরকে পুরুষদের তৈরি করা চিকিৎসা ব্যবস্থা (male medical establishment) পরিকল্পনা করে সরিয়ে দিচ্ছিল (Ehrenreich & English, 1973)। এই তত্ত্বটা অবশ্য একটু প্রশ্নসাপেক্ষ, কারণ যাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই ধাত্রী বা সেবিকা ছিলেন না। যদিও তারা প্রথমে নিজেরাই এই লেখাটা প্রকাশ করেছিলেন, এটি এত সাড়া ফেলেছিল যে ‘ফেমিনিস্ট প্রেস’ (Feminist Press) এর প্রকাশনার দায়িত্ব নেয়। এরপর লেখাটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান, হিব্রু, ড্যানিশ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয় (Purkiss, 2003)। ২০১০ সালে এহরেনরাইখ ও ইংলিশের এই প্রকাশনার একটি পরিমার্জিত সংস্করণ পুনরায় ছাপা হয়।

তবে অন্য নারীবাদী ঐতিহাসিকরা এই ব্যাখ্যা মানতে চাননি। ঐতিহাসিক ডায়ান পারকিস (Diane Purkiss) একে ‘রাজনৈতিকভাবে সহায়ক নয়’ (not politically helpful) বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, কারণ এটি নারীদের ক্রমাগত ‘পিতৃতন্ত্রের অসহায় শিকার’ (helpless victims of patriarchy) হিসেবে দেখায় এবং সমসাময়িক নারীবাদী সংগ্রামে কোনো সাহায্য করে না (Purkiss, 2003)।

অন্যান্য ব্যাখ্যা

আজকের দিনের এক পণ্ডিত, নাম তার এডওয়ার্ড বেভার (Edward Bever), তিনি ভাবেন, এত যে মেয়েদের ডাইনি বলে ধরা হচ্ছিল, তার পেছনে কলকাঠি নাড়ছিল তখনকার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে থাকা নারীবিদ্বেষ (misogyny) (Bever, 2002)। তিনি আবার জোর গলায় বলেন, এই যে পুরুষদের দাপটওয়ালা সমাজ (patriarchal society), সেখানে শুধু যে পুরুষরাই মাতব্বরি করত তা নয়; এই পুরুষালি আর মেয়েদের ছোট করে দেখার মানসিকতা কিন্তু গোটা সমাজেই ছড়িয়ে পড়েছিল, এমনকি মেয়েদের মধ্যেও! সেকালে ইউরোপে ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু বাঁধা নিয়মকানুন (gender expectations) ছিল, আর যারা সেসব মানত না, তাদের কপালে জুটত দুর্ভোগ (Bever, 2002)।

যেমন ধরুন, একটা কথা চালু আছে যে, যে মেয়েদের ডাইনিগিরির দায়ে অভিযুক্ত করা হতো, তারা হয়তো সমাজের বেঁধে দেওয়া মেয়েলি চালচলনের (gender roles) বাইরে পা ফেলেছিল। হয়তো তারা একটু বেশি খোলামেলা স্বভাবের (overtly sexual) ছিল আরকি (Garrett, 2013)। মেয়েদের নিয়ে এই যে সমাজের হাজারটা প্রত্যাশা, আর সেই সাথে ডাইনিদের নিয়ে চালু থাকা গৎবাঁধা ধারণা – এই দুটো মিলেই হয়তো এত এত মেয়েকে বিপদে ফেলেছিল (Hester, 1996)। এমনকি যারা সমাজের নিয়ম মেনে, লক্ষ্মী মেয়ের মতো থাকত, তারাও হয়তো ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত – কখন না জানি তাদের ওপর ডাইনির অপবাদ এসে পড়ে! তাই হয়তো, অন্য কেউ দোষ চাপানোর আগেই তারা নিজেরাই কাউকে মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসিয়ে দিত, আত্মরক্ষার তাগিদে (Bever, 2002)।

মেয়েদের সম্পর্কে এই যে এতসব বাঁকা চিন্তাভাবনা, এটাই হয়তো বলে দেয় কেন কিছু কিছু জায়গায়, যেমন ধরুন ইউরোপের এক্কেবারে কোণার দিকের দেশগুলো – নরম্যান্ডি, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, আর রাশিয়া – সেখানে আবার পুরুষদেরই বেশি করে ডাইনি বলে ধরা হচ্ছিল (Behringer, 2004; Thurston, 2013)। যদি ওইসব জায়গায় মেয়েদের নিয়ে এত কড়াকড়ি না থাকত, তাহলে এটা বোঝাই যায় যে সেখানে মেয়েলি ব্যাপারস্যাপার আর ডাইনি অপবাদের মধ্যে অতটা দহরম-মহরম ছিল না।

সিলভিয়া ফেদেরিচির কাজ

এবার আসা যাক সিলভিয়া ফেদেরিচি (Silvia Federici) নামের আরেক বিদুষী মহিলার কথায়। তিনি ২০০৪ সালে একখানা বই লিখেছিলেন, নাম তার ‘ক্যালিবান অ্যান্ড দ্য উইচ: উইমেন, দ্য বডি অ্যান্ড প্রিমিটিভ অ্যাকুমুলেশন’ (Caliban and the Witch: Women, the Body and Primitive Accumulation)। এই বইতে তিনি ডাইনি নিধনের ঘটনাটাকে একেবারে অন্য চোখে দেখেছেন, যাকে বলে বস্তুবাদী নারীবাদী (materialist feminist) দৃষ্টিকোণ থেকে (Federici, 2017; “Les trois livres…”, 2014)। তার বইটা পুঁজিবাদের হাঁটি হাঁটি পা পা করার সময়টাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে। তিনি দেখিয়েছেন, এই ডাইনি নিধনের ঘটনাটা ঘটেছিল ঠিক যখন গরিব মানুষের জমিজমা কেড়ে নেওয়ার আইন (Inclosure Acts) চালু হচ্ছিল। এর ফলে মেয়েরা তাদের চাষবাসের জমি (commons lands) হারিয়ে ফেলেছিল, আর অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভর হয়ে পড়েছিল। ফেদেরিচি আরও বলেছেন, এই যে নতুন গজিয়ে ওঠা পুঁজিবাদ, সে মেয়েদের কাজেকর্মে একটা বিভাজন (sexual division of labor) তৈরি করেছিল, আর তাতে মেয়েদের ওপর মানসিক চাপও বেড়েছিল বিস্তর।

ক্যালিবান অ্যান্ড দ্য উইচ (Caliban and The Witch)

ফেদেরিচি তার ‘ক্যালিবান অ্যান্ড দ্য উইচ’ বইতে সোজাসাপ্টা বলেছেন, এই যে ডাইনি নিধন, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর মাধ্যমে মেয়েদের শরীরকে বানানো হচ্ছিল স্রেফ বাচ্চা পয়দা করার যন্ত্র (work machines), যারা কিনা বড় হয়ে কলকারখানায় সস্তা শ্রমিক হবে। আর এটা ছিল পুরনো দিনের নিজে খেয়েপরে বাঁচার অর্থনীতি (subsistence economy) থেকে সরে এসে টাকাপয়সার অর্থনীতির (monetary economy) দিকে যাওয়ার একটা জরুরি ধাপ। তিনি আরও দেখিয়েছেন, যে সময়ে দুনিয়াজুড়ে এই ডাইনি নিধন চলছিল, ঠিক সেই সময়েই আমেরিকা মহাদেশ দখল করা হচ্ছিল, দাস ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছিল, আর গরিব চাষিদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল। এই সবকিছুই কিন্তু পুঁজিবাদের উত্থানের দিকেই আঙুল তোলে। ফেদেরিচির মতে, এই ডাইনি নিধনটাই ছিল পুঁজিবাদের উত্থানের ইতিহাসের সেই হারিয়ে যাওয়া টুকরো, সেই রহস্যের জট।

তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট

ফেদেরিচির সাফ কথা হলো, পুরনো দিনের নিজে উৎপাদনের অর্থনীতি (production-for-use) থেকে সরে এসে মুনাফার জন্য উৎপাদনের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে (production-for-profit) উত্তরণ খেটে খাওয়া মানুষদের অভাব-অনটন থেকে মুক্তি দেয়নি, বরং উল্টোটা ঘটিয়েছে। অর্থনীতি তখন হয়ে দাঁড়িয়েছিল মজুরি দিয়ে সস্তায় খাটিয়ে নেওয়ার (wage labor exploitation), মেয়েদের দিয়ে বিনা পয়সায় খাটিয়ে নেওয়ার (unpaid work of women) আর প্রকৃতির বারোটা বাজানোর (degradation of environmental nature) এক বিশাল ফাঁদ। যেহেতু অর্থনৈতিক সম্পর্কের এই ওলটপালট আর পুঁজিবাদের প্রথম ধাক্কায় জমি হারানোর (enclosures) বোঝাটা মূলত মেয়েদের ঘাড়েই চেপেছিল, তাই তারাই নিজেদের জমি, সামাজিক মানসম্মান আর পুরনো দিনের চাষবাস বাঁচানোর জন্য লড়েছিল।

কিন্তু ইউরোপের সরকারগুলো তখন এক নতুন ভয়ংকর অপরাধ চালু করল – ডাইনিবিদ্যার (witchcraft) অভিযোগ, যা ছিল কিনা একেবারে রাষ্ট্রদ্রোহিতার (high treason) সামিল (a crimen exceptum)। এর মাধ্যমে তারা মেয়েদের এই প্রতিরোধ আর সামন্ততন্ত্রের বাইরে অন্য কোনো বিকল্প পথের সম্ভাবনাকে একেবারে পিষে ফেলতে চেয়েছিল। শুধু তাই নয়, এর ফলে সমাজের উৎপাদনের জন্য যা কিছু সহজলভ্য ছিল, সেগুলোকে তারা প্রকৃতির দানের মতোই মুফতে পাওয়া অশেষ ভাণ্ডার হিসেবে ধরে নিয়েছিল। আর এভাবেই আদিম সঞ্চয়নের (primitive accumulation) পথ পরিষ্কার হয়েছিল।

ফেদেরিচি পুঁজিবাদের উদ্ভবের মার্ক্সীয় ব্যাখ্যাটাকে আরও খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে মেয়েদের সামাজিক অবস্থান বদলে গিয়েছিল আর কীভাবে তাদের বাচ্চা পয়দা করার ক্ষমতাকে (production of labor-power) কাজে লাগানো হয়েছিল। কাজের ক্ষেত্রে এই যে লিঙ্গভিত্তিক ভাগাভাগি (division of labor), সেটাও যে কতটা প্রকট (gendered) ছিল, সেদিকে তিনি জোর দিয়েছেন। মেয়েদের খাটুনি আর তাদের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকে (reproductive function) দাবিয়ে রেখে, পয়সার বিনিময়ে কাজ (waged work) থেকে তাদের সরিয়ে দিয়ে, তাদের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে, আর কলকারখানার যন্ত্রপাতির (mechanization of workforce) সাথে সাথে মেয়েদের শরীরকেও নতুন শ্রমিক তৈরির যন্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করা হয়েছিল – এভাবেই গড়ে উঠেছিল শ্রমের নতুন এক যৌন বিভাজন। ফেদেরেচি এবং আরও অনেক পণ্ডিত মনে করেন, মেয়েদের শরীরের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ আর শ্রমের এই যৌন বিভাজনই ছিল বাড়তি মুনাফা (surplus value) তৈরির মূল শর্ত। সমাজে টিকে থাকার জন্য যে কাজগুলো হয় (social reproductive theory), সেই তত্ত্ব অনুযায়ী, পুঁজিবাদ আসলে মেয়েদের দিয়ে ঘরের বাইরের সেইসব অদৃশ্য, নমনীয় আর বিনা পয়সার খাটুনি খাটিয়ে নেয় (Bhattacharya, 2017)।

বাচ্চা পয়দা করা আর মেয়ে-পুরুষের সম্পর্কের এই কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি ফেদেরেচি আরও বলেন, পুঁজি জমানোর এই যে হাজারটা ফন্দিফিকির, এর ফলে পুরনো দিনের একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসার (communal mutual aid) প্রবণতা কমে গিয়েছিল। আগেকার দিনে ধাত্রীরা ভেষজ (herbs) দিয়ে মানুষের অসুখ সারাত, গাছগাছালির গুণাগুণ জানত, আর এসবের জন্য সমাজে তাদের একটা বিশেষ কদর ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদের এই যে কূটচাল (infra-politics of capitalism), এর কোপে পড়ে এই আরোগ্যকারীরা (healer) বিপদে পড়ল। সমাজের কাছ থেকে টিকে থাকার আর উৎপাদনের পুরনো কৌশলগুলো কেড়ে নেওয়া হলো। এতে করে পারস্পরিক সাহায্যের যে বাঁধনটা ছিল, সেটা হয় আলগা হয়ে গেল, নয়তো একেবারেই ছিঁড়ে গেল।

সিলভিয়া ফেদেরিচি আবার মিশেল ফুকো (Michel Foucault) নামের আরেক দিকপাল পণ্ডিতের কিছু কথার সমালোচনা করেছেন, মোট তিনটে দিক থেকে। প্রথমত, ফুকোর অনেক আগেই, সেই ১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকেই নারীবাদী কর্মী আর তাত্ত্বিকরা সমাজে মেয়ে-পুরুষের জায়গাটা বোঝার জন্য শরীরকে (body) একটা খুব জরুরি বিষয় হিসেবে দেখতেন। দ্বিতীয়ত, ফুকো বলেছিলেন যে আধুনিক যুগে গায়ে হাত তোলা বা শারীরিক অত্যাচার (physical violence) কমে গেছে, তার জায়গায় এসেছে মানসিক অত্যাচার (Psychological abuse) (Federici, 2004: 16; “Archived copy”, 2023)। কিন্তু ফেদেরিচি ডাইনি নিধন থেকে শুরু করে আজকের দিনের উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক কায়দায় মেয়েদের ওপর অত্যাচার কিন্তু চলতেই থেকেছে, যেটা ফুকোর আলোচনায় বেমালুম গায়েব। তৃতীয়ত, ফেদেরিচি ফুকোকে এই বলে দোষারোপ করেছেন যে, তিনি যখন “যৌনতার ইতিহাস” (History of Sexuality) (১৯৭৮) লিখলেন, তখন তিনি এমন এক “সবার জন্য প্রযোজ্য, ধরাছোঁয়ার বাইরে, লিঙ্গহীন কর্তা”র (“universal, abstract, asexual subject”) দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন যে, ডাইনি নিধনের মতো মেয়েদের ওপর হওয়া এত বড় একটা ঐতিহাসিক হিংসার ঘটনাকে তিনি পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পেরেছেন (Federici, 2004: 16)।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট (ফেদেরিচির মতে)

সেই যে ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালের মধ্যে ব্ল্যাক ডেথ (Black Death) নামের মহামারী ইউরোপের বেশিরভাগ কর্মক্ষম মানুষকে শেষ করে দিয়েছিল, তার ফলে সামন্ত প্রভুদের পক্ষে গরিব চাষিদের ওপর খবরদারি করা বা তাদের শায়েস্তা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। কাজ করার মতো লোকের যখন এত অভাব, তখন যারা কাজ করত, তারা দুর্নীতিবাজ প্রভুদের জব্দ করার জন্য নানা ফন্দি আঁটত – যেমন ধরুন, ফসল পচতে দিত বা ইচ্ছে করেই কাজ শেষ করত না। এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ তখনকার অর্থনীতি ছিল নিজে খেয়েপরে বাঁচার (subsistence economy) ওপর নির্ভরশীল। কাজের বিনিময়ে মিলত ফসল আর জমিতে চাষ করার অধিকার, এখনকার মতো টাকাপয়সা (monetary economy) নয়। তারা নিজেদের খাবার নিজেরাই ফলাত, আর দরকারি জিনিসপত্র কেনার জন্য টাকার ওপর ভরসা করতে হতো না।

তখনকার সমাজটা ছিল আবার একে অপরের সাহায্যে চলার (solidarity economy) সমাজ। মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিত, যেমন ধরুন বাচ্চাদের দেখাশোনা করা (care work), আবার পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠেও কাজ করত। এই যে কাজের ভাগাভাগি, এটা কিন্তু তাদের জন্য শৃঙ্খল না হয়ে মুক্তির পথ খুলে দিয়েছিল, কারণ এতে তারা নিজেদের কাজ আর নিজেদের শরীরের ওপর নিজেদের অধিকার (autonomy) পেয়েছিল। সেই সমাজে মেয়েদের বেশ একটা রাজনৈতিক গুরুত্বও ছিল। কিন্তু যখন টাকাপয়সার অর্থনীতি চালু হলো, তখন শুধু ছেলেরাই পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকারী হলো। আর তারপর থেকেই সমাজের অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক ময়দান থেকে মেয়েদের খাটুনিকে একটু একটু করে কোণঠাসা (marginalization) করে দেওয়া শুরু হলো।

ফেদেরিচির মতে, বেশিরভাগ ডাইনি নিধনের ঘটনা ঘটেছিল ১৫০০ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে, আর এর সবচেয়ে ভয়াবহ সময়টা ছিল ১৬২০ সালের আশেপাশে। এটা সেই সময়, যখন মার্কেন্টিলিজম (Mercantilism) বা বাণিজাবাদের ধ্যানধারণা ইউরোপের উঁচু মহলের লোকজনের মগজে ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটা জবরদস্ত অর্থনীতির জন্য চাই বিশাল এক কর্মীবাহিনী (labor force) – এই ছিল তাদের মূলমন্ত্র। ব্ল্যাক ডেথের পর লোকবলের যে আকাল দেখা দিয়েছিল, তাতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের (population control) ব্যাপারটা তাদের কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তাই শুরু হলো “জনসংখ্যার হিসেব রাখা, আদমশুমারি করা, আর জনসংখ্যাতত্ত্বকে প্রথম ‘রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান’ (state science) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা” (Federici, 2004: 182)। লোকবল বাড়ানোর একটা পাকাপোক্ত রাস্তা খুঁজে বের করা তখন শাসক শ্রেণি আর সদ্য গজিয়ে ওঠা পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী শ্রেণির (bourgeoisie) জন্য একটা বিরাট রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

লোকবল বাড়ানোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা ছিল সমাজের বাচ্চা পয়দা করার ক্ষমতার (reproduction of society) ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। এই চশমা দিয়ে দেখলে, মেয়েদের তখন গণ্য করা হতো স্রেফ বাচ্চা পয়দা করার যন্ত্র (wombs) হিসেবে, যারা কিনা বড় হয়ে সস্তা শ্রমিক হবে। এই নিয়ন্ত্রণটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্রগুলো তখন “নানা ধরনের প্রচারমাধ্যম” (multi-media propaganda) ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের গণ উন্মাদনা (mass psychosis) তৈরি করেছিল (Federici, 2004: 168)। এই প্রচারণার যন্ত্রে টমাস হব্‌স (Thomas Hobbes) আর জঁ বোঁদ্যার (Jean Bodin) মতো নামজাদা লোকেরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন আরও অনেক সরকারি আমলা, যারা দেশ-বিদেশ ঘুরে ডাইনিদের নামে কুৎসা রটাতেন। রাষ্ট্র আবার আগের শতকগুলোতে ধর্মীয় বিচারসভা বা ইনকুইজিশনের (Inquisition) তৈরি করা পুলিশি কায়দাকানুন আর যন্ত্রপাতিও ব্যবহার করেছিল। তারা খুব সফলভাবেই মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস ছড়িয়েছিল, যার ফলে ছোট ছোট সমাজগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।

তাদের প্রধান নিশানা ছিল গরিব ঘরের মেয়েরা, যাদের কাছে এমন কিছু জ্ঞান ছিল যা তাদের সমাজের টিকে থাকা আর নিজেদের মতো করে চলার জন্য খুব দরকারি ছিল। অসুখ সারানো (healing), জন্ম নিয়ন্ত্রণ (birth control) আর ধাত্রীবিদ্যা (midwifery) – এই সব জ্ঞান রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আর নতুন যান্ত্রিক ধ্যানধারণার (mechanical paradigm) একেবারে বিরুদ্ধে যেত। এই মেয়েদের অনেককেই ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, অন্যায় বিচারে তাদের দোষী বানানো হয়েছিল, আর তারপর নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল।

জনসংখ্যার এই প্রজনন ক্ষমতাকে কব্জা করার একটা উপায় ছিল ধাত্রীবিদ্যাকে (midwifery) রাষ্ট্রের কড়া নজরদারিতে নিয়ে আসা। অনেক ডাইনিই ছিলেন আসলে ধাত্রী বা “সবজান্তা মহিলা” (wise women), আর ষোড়শ-সপ্তদশ শতক পর্যন্ত ধাত্রীবিদ্যা আর প্রসূতিবিদ্যার (obstetrics) কাজটা ছিল একচেটিয়াভাবে মেয়েদের হাতেই। ষোড়শ শতকে ধাত্রী হওয়ার জন্য একটা নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হলো – মহিলাকে আগে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি একজন “খাটি ক্যাথলিক” (good Catholic) (Federici, 2004: 183)। সপ্তদশ শতকে প্রথম পুরুষ ধাত্রীদের আবির্ভাব ঘটল, আর “এক শতাব্দীর মধ্যেই ধাত্রীবিদ্যা প্রায় পুরোপুরি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল” (Federici, 2004: 183-184)।

এই ব্যাখ্যা যদি সত্যি হয়, তাহলে ইউরোপে এই যে ঢালাও ডাইনি বিচার, তার পেছনে ছিল আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, নিছক মেয়েদের প্রতি বিদ্বেষ, ধর্মীয় গোঁড়ামি বা অন্য কিছু নয়। তবে, এই ব্যাপক বিচারের এমন ব্যাখ্যাও কিন্তু শেষমেশ মেয়েদের ছোট করে দেখা আর তাদের ওপর খবরদারি করার সেই পুরনো মানসিকতারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

তথ্যসূত্র

  • Abusch, T. (2002). Mesopotamian Witchcraft: Toward a History and Understanding of Babylonian Witchcraft Beliefs and Literature. Brill Styx.

  • Abusch, T. (2015). The Witchcraft Series Maqlû. (Writings from the Ancient World, Vol. 37). SBL Press.

  • Addison, J. (1711). Their own imaginations they deceive. The Spectator, 2(117), 208–212.

  • Adinkrah, M. (2004). Witchcraft Accusations and Female Homicide Victimization in Contemporary Ghana. Violence Against Women, 10(4), 325–356. https://doi.org/10.1177/1077801204263419

  • Adler, M. (2006). Drawing Down the Moon: Witches, Druids, Goddess-Worshippers, and Other Pagans in America Today. Penguin Books.

  • Akademie Schloss Solitude. (n.d.). Kepler’s Witch Trial. Retrieved April 21, 2024, from https://www.akademie-solitude.de/de/online-publications/on-the-occult-and-the-supernatural/keplers-witch-trial/

  • Akosua, A. (2014, September 3). Ebola: Human Rights Group Warns Disease Is Not Caused By Witchcraft. The Ghana-Italy News. Archived from the original on September 3, 2014. Retrieved October 31, 2017.

  • Al-Arshani, S. (2021, May 25). Trump calls New York criminal probe a ‘witch hunt’ and claims a poll shows he is the frontrunner in 2024. Business Insider. Retrieved September 19, 2021, from https://www.businessinsider.com/trump-calls-new-york-criminal-probe-a-witch-hunt-2021-5

  • Ally, Y. (2014). Witchcraft accusations in South Africa: A feminist psychological exploration [Doctorate of Psychology thesis, University of South Africa]. UNISA Institutional Repository. https://uir.unisa.ac.za/handle/10500/13863

  • Almond, P. C. (2020, January 20). You think this is a witch hunt, Mr President? That’s an insult to the women who suffered. The Conversation. Retrieved September 19, 2021, from https://theconversation.com/you-think-this-is-a-witch-hunt-mr-president-thats-an-insult-to-the-women-who-suffered-129775

  • Andreassen, R. L., & Willumsen, L. H. (Eds.). (2014). Introduction. In Steilneset Memorial. Art Architecture History (pp. 1–10). Orkana.

  • Ankarloo, B., & Clark, S. (Eds.). (2001). Witchcraft and Magic in Europe: Biblical and Pagan Societies. University of Philadelphia Press.

  • Ankarloo, B., & Henningsen, G. (Eds.). (1990). Early Modern European Witchcraft: Centres and Peripheries. Oxford University Press.

  • Archived copy. (2023, December 3). Retrieved 2019-03-13, from https://web.archive.org/web/20231203164307/https://non.copyriot.com/maria-mies-silvia-federici-and-biopower/ (Original: https://non.copyriot.com/maria-mies-silvia-federici-and-biopower/)

  • Archer, W. G. (1979). The Santals: Readings in Tribal Life. Concept Publishing Company.

  • Armstrong, J. (2015, January 6). ISIS behead street magician for entertaining crowds in Syria with his tricks. Daily Mirror. Retrieved June 30, 2015, from https://www.mirror.co.uk/news/world-news/isis-behead-street-magician-entertaining-4929838

  • A true and most dread full discourse of a woman possessed with the Deuill. (1886-01-30). Notes and Queries, s7-I(5), 100. doi:10.1093/nq/s7-i.5.100c

  • The Avalon Project: Documents in Law, History, and Diplomacy. (n.d.). Code of Hammurabi. Yale Law School Lillian Goldman Law Library. Retrieved September 16, 2007, from http://www.yale.edu/lawweb/avalon/medieval/hamframe.htm (Archived link: https://web.archive.org/web/20070916163034/http://www.yale.edu/lawweb/avalon/medieval/hamframe.htm)

  • Bachmann, J. (2021). African Witchcraft and Religion among the Yoruba: Translation as Demarcation Practice within a Global Religious History. Method & Theory in the Study of Religion, 33(3–4), 381–409. https://doi.org/10.1163/15700682-12341522

  • Bailey, F. G. (1994). The Witch-Hunt, or the Triumph of Morality. Cornell University Press.

  • Balog, Z. (2017, February 1). Magda Logomer Herucina. Cris, XVIII. https://www.academia.edu/31623821

  • Barstow, A. L. (1994). Witchcraze: A New History of the European Witch Hunts. Pandora.

  • Baten, J., & Woitek, U. (n.d.). Economic determinants of witch-hunting. University of Tübingen Research Paper.

  • Behar, R. (1987). Sex and Sin, Witchcraft and the Devil in Late-Colonial Mexico. American Ethnologist, 14(1), 34–54. https://doi.org/10.1525/ae.1987.14.1.02a00030

  • Behringer, W. (2004). Witches and Witch-Hunts: A global history. Polity Press. (Also cited as Wiley publication with ISBN 978-0-7456-2718-2 and OCLC 779922479)

  • Berger, H. A. (Ed.). (2005). Witchcraft and Magic: Contemporary North America. University of Pennsylvania Press.

  • Berger, H. A., & Ezzy, D. (2009). Mass Media and Religious Identity: A Case Study of Young Witches. Journal for the Scientific Study of Religion, 48(3), 501–514. https://doi.org/10.1111/j.1468-5906.2009.01462.x

  • Bever, E. (2002). Witchcraft, female aggression, and power in the early modern community. Journal of Social History, 35(4), 955–988. doi:10.1353/jsh.2002.0042

  • Bhattacharya, T. (2017, October 17). “What is social reproduction theory?”. Retrieved from https://marxismocritico.com/2017/10/17/what-is-social-reproduction-theory/

  • Bible Apologetics. (n.d.). Witch hunts. Retrieved from http://bibleapologetics.wordpress.com/tag/witch-hunts-2/#_ftnref17

  • Bilefsky, D. (2009, May 10). Hard Times Give New Life to Prague’s Golem. The New York Times. Archived from the original on May 9, 2013. Retrieved March 19, 2013.

  • Blom, J. D., Poulina, I. T., van Gellecum, T. L., & Hoek, H. W. (2015). Traditional healing practices originating in Aruba, Bonaire, and Curaçao: A review of the literature on psychiatry and Brua. Transcultural Psychiatry, 52(6), 840–860. https://doi.org/10.1177/1363461515589709

  • Breslaw, E. G. (2011). Witchcraft in Early North America. Journal of American History, 98(2), 504. https://doi.org/10.1093/jahist/jar254

  • Burns, W. (2003). Witch Hunts in Europe and America: An Encyclopedia. Bloomsbury Publishing. (Also cited as Greenwood Publishing Inc. pp. 10–11)

  • Burton, J. R. (2019). Witchcraft in the Middle Ages. Cornell University Press. (pp. 45–48). ISBN 978-1-5017-2031-4. OCLC 1127179159.

  • Buse, J. (Ed.). (1995). Cook Islands Maori Dictionary. Cook Islands Ministry of Education.

  • Bussien, N., et al. (2011). Breaking the spell: Responding to witchcraft accusations against children. (New Issues in Refugee Research, 197). UNHCR.

  • Byrne, C. (2011, June 16). Hunting the vulnerable: Witchcraft and the law in Malawi. Consultancy Africa Intelligence.

  • Cameron, A., Long, J., & Sherry, L. (1993). Barbarians and Politics at the Court of Arcadius. University of California Press.

  • Campbell, H. M. (Ed.). (2011). The Emergence of Modern Europe: c. 1500 to 1788. Britannica Educational Publishing.

  • Cartwright, K. (2010). Witchcraft in Tudor and Stuart Scotland. Wiley.

  • Catholic Encyclopedia: Witchcraft. (1912, October 1). New Advent. Archived from the original on February 11, 2021. Retrieved October 31, 2013.

  • Chandler, J. (2017, October 24). It’s 2013, and they’re burning ‘witches’. The Global Mail. Archived from the original on October 2, 2013. https://web.archive.org/web/20131002115725/http://www.theglobalmail.org/feature/its-2013-and-theyre-burning-witches/558/

  • Cimpric, A. (2010). Children accused of witchcraft, An anthropological study of contemporary practices in Africa. UNICEF WCARO.

  • Cohn, N. (2000). Europe’s Inner Demons: The Demonization of Christians in Medieval Christendom (Revised ed.). University of Chicago Press. (Original work published 1993)

  • Collins, D. (2001). Theoris of Lemnos and the Criminalization of Magic in Fourth-Century Athens. The Classical Quarterly, 5(1), 477. https://doi.org/10.1093/cq/51.2.477

  • Collins, D. (2008). Magic in the Ancient Greek World. Blackwell.

  • Crooke, W. (1969). The Popular Religion and Folklore of Northern India. Munshiram Manoharlal.

  • Cross, F. L., & Livingstone, E. A. (Eds.). (2005). The Oxford Dictionary of the Christian Church (3rd ed. revised). Oxford University Press.

  • Cumes, D. (2004). Africa in my bones. New Africa Books.

  • Cusack, C. M. (2009). The Return of the Goddess: Mythology, Witchcraft and Feminist Spirituality. In M. Pizza & J. Lewis (Eds.), Handbook of Contemporary Paganism. Brill.

  • Dangerfield, A. (2012, March 1). Government urged to tackle ‘witchcraft belief’ child abuse. BBC News. Archived from the original on October 8, 2014. Retrieved June 8, 2014.

  • Davies, O. (1999). Witchcraft, Magic and Culture, 1736–1951. Manchester University Press.

  • Davies, O. (2003). Cunning-Folk: Popular Magic in English History. Hambledon Continuum.

  • Davies, O. (Ed.). (2017). The Oxford illustrated history of witchcraft and magic (1st ed.). Oxford University Press.

  • de Waal, M. (2012, May 30). Witch-hunts: The darkness that won’t go away. Daily Maverick. Retrieved December 9, 2013, from http://www.dailymaverick.co.za/article/2012-05-30-witch-hunts-the-darkness-that-wont-go-away/#.UqWZe9IW2yg

  • Definition of WITCH. (n.d.). Merriam-Webster.com. Retrieved October 12, 2023.

  • Demetrio, F. R. (1988). Shamans, Witches and Philippine Society. Philippine Studies, 36(3), 372–380.

  • Dickie, M. (2003). Magic and Magicians in the Greco-Roman World. Routledge.

  • di Giovanni, J. (2014, October 14). When It Comes to Beheadings, ISIS Has Nothing Over Saudi Arabia. Newsweek. Archived from the original on October 16, 2014. Retrieved October 17, 2014.

  • Diwan, M. (2004). Conflict between State Legal Norms and Norms Underlying Popular Beliefs: Witchcraft in Africa as a Case Study. Duke Journal of Comparative & International Law, 14(2), 351–388. Archived from the original on February 25, 2021. (Also cited as https://scholarship.law.duke.edu/djcil/vol14/iss2/5)

  • Doyle White, E. (2016). Wicca: History, Belief, and Community in Modern Pagan Witchcraft. Liverpool University Press.

  • Ebola outbreak: ‘Witchcraft’ hampering treatment, says doctor. (2014, August 2). BBC News. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved June 22, 2018.

  • Ehrenreich, B., & English, D. (1973-10-02). Witches, Midwives, and Nurses. Monthly Review, 25(5), 25. doi:10.14452/mr-025-05-1973-09_2

  • Ehrenreich, B., & English, D. (2010). Witches, Midwives & Nurses: A History of Women Healers (2nd ed.). Feminist Press at CUNY.

  • Ellerbe, H. (1995). The Dark Side of Christian History. Morningstar & Lark.

  • English Heritage. (n.d.). Witchcraft: Eight Myths and Misconceptions. Retrieved August 8, 2024, from https://www.english-heritage.org.uk/learn/histories/eight-witchcraft-myths/

  • Evans-Pritchard, E. E. (1937). Witchcraft, Oracles and Magic Among the Azande. Oxford University Press.

  • Federici, S. (2004). Caliban and the Witch: Women, the Body and Primitive Accumulation. Autonomedia. (pp. 16, 168, 182-184).

  • Federici, S. (2017-06-30). Caliban And The Witch: Women, the Body and Primitive Accumulation. Autonomedia. ISBN 9781570270598.

  • Fisiy, C. F. (2001). Containing occult practices: Witchcraft trials in Cameroon. In B. P. Levack (Ed.), New Perspectives on Witchcraft, Magic, and Demonology: Witchcraft in the modern world (Vol. 6). Routledge.

  • Fraden, J. B., & Fraden, D. B. (2008). The Salem Witch Trials. Marshall Cavendish.

  • Frazer, J. G. (1922). The Golden Bough. Bartleby.com. (Original work published 1890)

  • Garnsey, P., & Saller, R. P. (1987). The Roman Empire: Economy, Society, and Culture. University of California Press.

  • Garrett, J. M. (2013). Witchcraft and Sexual Knowledge in Early Modern England. Journal for Early Modern Cultural Studies, 13(1), 32–72. doi:10.1353/jem.2013.0002

  • Gaskill, M. (2010). Witchcraft, a very short introduction. Oxford University Press.

  • Gbule, N. J., & Odili, J. U. (2015). Socio-Missiological Significance of Witchcraft Belief and Practice in Africa. African Research Review, 9(3), 99. https://doi.org/10.4314/afrrev.v9i3.9

  • Geertz, A. W. (2011). Hopi Indian Witchcraft and Healing: On Good, Evil, and Gossip. American Indian Quarterly, 35(3), 372–393. https://doi.org/10.1353/aiq.2011.a447052

  • Gershman, B. (2016). Witchcraft Beliefs and the Erosion of Social Capital: Evidence from Sub-Saharan Africa and Beyond. Journal of Development Economics, 120, 182–208. https://doi.org/10.1016/j.jdeveco.2015.11.005

  • Gershman, B. (2022). Witchcraft beliefs around the world: An exploratory analysis. PLOS ONE, 17(11), e0276872. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0276872

  • Geschiere, P. (1997). The Modernity of Witchcraft: Politics and the Occult in Postcolonial Africa (P. Geschiere & J. Roitman, Trans.). University of Virginia Press.

  • Gibbons, J. (1998). Recent Developments in the Study of the Great European Witch Hunt. The Pomegranate, 5. Archived from the original on January 26, 2009.

  • Gibbs, P. (2012). Engendered Violence and Witch-killing in Simbu. In Engendering Violence in Papua New Guinea (pp. 107–136). ANU Press. JSTOR j.ctt24hcwt.10

  • Gibson, M. (2006). Witchcraft in the Courts. In M. Gibson (Ed.), Witchcraft And Society in England And America, 1550–1750 (pp. 1–18). Continuum International Publishing Group.

  • Gijswijt-Hofstra, M. (1999). Witchcraft and Magic in Europe, Volume 5. A&C Black.

  • Gittins, A. J. (1987). Mende Religion (Studia Instituti Anthropos, Vol. 41). Steyler Verlag.

  • A Global Issue that Demands Action. (2013). Academic Council on the United Nations System (ACUNS) Vienna Liaison Office. Archived from the original on June 30, 2014. Retrieved June 7, 2014.

  • Golden, R. M. (1997). Satan in Europe: The Geography of Witch Hunts. In M. Wolfe (Ed.), Changing Identities in Early Modern France (p. 234). Duke University Press.

  • Goode, E., & Ben-Yehuda, N. (2010). Moral Panics: The Social Construction of Deviance. Wiley.

  • Goodare, J. (2016). The European Witch-Hunt. Routledge.

  • Green, K. (2011, February 1). The Golem in the Attic. Moment Magazine. Archived from the original on August 25, 2017. Retrieved August 25, 2017.

  • Gregorian, D. (2022, June 10). Judge dismisses NRA’s claims that it’s the victim of NY AG ‘witch hunt’. NBC News. Retrieved June 11, 2022, from https://www.nbcnews.com/politics/politics-news/judge-dismisses-nras-claims-victim-ny-ag-witch-hunt-rcna33010

  • Grell, O. P., & Scribner, R. W. (Eds.). (2002). Tolerance and Intolerance in the European Reformation. Cambridge University Press.

  • Hagen, R. B. (2018, May 28). Johanne Nielsdatter. Store norske leksikon. Retrieved January 8, 2019, from http://snl.no/Johanne_Nielsdatter

  • Harper, D. (n.d.-a). hag (n.). Online Etymology Dictionary. Retrieved from https://www.etymonline.com/word/hag

  • Harper, D. (n.d.-b). witchcraft (n.). Online Etymology Dictionary. Archived from the original on November 5, 2013. Retrieved October 29, 2013.

  • Harrison, K. (2014). Joan of Arc: a life transfigured (1st ed.). Doubleday.

  • Hayes, S. (1995, November). Christian responses to witchcraft and sorcery. Missionalia, 23(3), 339–354. Archived from the original on July 3, 2006. http://hayesfam.bravehost.com/WITCH1.HTM

  • Herald Sun. (2010, July 26). 200 ‘witches’ killed in India each year – report. http://www.heraldsun.com.au/news/breaking-news/witches-killed-in-india-each-year-report/story-e6frf7jx-1225897181523

  • Herrera-Sobek, M. (Ed.). (2012). Celebrating Latino Folklore: An Encyclopedia of Cultural Traditions. ABC-CLIO.

  • Hester, M. (1996). Patriarchal reconstruction and witch hunting. In S. Ankarloo & G. Henningsen (Eds.), Witchcraft in Early Modern Europe (pp. 288–306). Cambridge University Press. doi:10.1017/cbo9780511599538.012. ISBN 978-0-521-55224-0.

  • Hinson, E. G. (1992). Historical and Theological Perspectives on Satan. Review & Expositor, 89(4), 471-484.

  • History of Witches. (2020, October 20). History.com. Retrieved October 26, 2021.

  • The History Today Archive. (2007, November 12). Archived from the original. http://www.historytoday.com/MainArticle.aspx?m=12341&amid=12341

  • Hoggard, B. (2004). The archaeology of counter-witchcraft and popular magic. In Beyond the Witch Trials: Witchcraft and Magic in Enlightenment Europe. Manchester University Press.

  • Home : Oxford English Dictionary. (n.d.). Oed.com. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved July 18, 2021.

  • Hoyt, C. A. (1989). Witchcraft (2nd ed.). Southern Illinois University Press.

  • Human Rights Watch. (2006). Children in the DRC. (Human Rights Watch report, 18(2)).

  • Human Rights Watch. (2008). Precarious Justice – Arbitrary Detention and Unfair Trials in the Deficient Criminal Justice System of Saudi Arabia. https://www.hrw.org/en/node/62304/section/23

  • Hutton, R. (1993). The Pagan Religions of the Ancient British Isles. Blackwell Publishers. (Also cited as The Clash of Faiths (AD c. 300–ҫ, 1000). The Pagan Religions of the Ancient British Isles: Their Nature and Legacy (pbk. ed.). Blackwell. Original work published 1991)

  • Hutton, R. (1999). The Triumph of the Moon: A History of Modern Pagan Witchcraft. Oxford University Press. (Also cited as Triumph of the Moon. Oxford University Press.)

  • Hutton, R. (2006). Witches, Druids and King Arthur. A&C Black. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved November 22, 2020.

  • Hutton, R. (2017). The Witch: A History of Fear, from Ancient Times to the Present. Yale University Press. (pp. 147–211).

  • Hutton, R. (2018). Witches and Cunning Folk in British Literature 1800–1940. Preternature: Critical and Historical Studies on the Preternatural, 7(1), 27. https://doi.org/10.5325/preternature.7.1.0027

  • Igwe, L. (2020). Accused Witches Burned, Killed in Nigeria. Skeptical Inquirer, 44(5).

  • Internet History Sourcebooks Project. (n.d.). Dooms of King Athelstan. Fordham University. Retrieved from http://www.fordham.edu/halsall/source/560-975dooms.html

  • Jewett, C. F. (1881). The Memorial History of Boston: Including Suffolk County, Massachusetts. 1630–1880. Ticknor and Company.

  • Jolly, K., Raudvere, C., & Peters, E. (Eds.). (2002). Witchcraft and Magic in Europe: The Middle Ages. A&C Black. (Also cited as University of Pennsylvania Press).

  • Jordanes. (n.d.). The Origin and Deeds of the Goths (C. C. Mierow, Trans.). § 24.

  • Kanina, W. (2008, May 21). Mob burns to death 11 Kenyan ‘witches’. Reuters. Archived from the original on June 20, 2017. Retrieved September 15, 2016.

  • Karlsen, C. F. (1987). The devil in the shape of a woman: The witch in seventeenth-century New England. W. W. Norton & Company. (pp. 49–55). OCLC 320057946.

  • Kelly, A. A. (1991). Crafting the Art of Magic, Book I: a History of Modern Witchcraft, 1939–1964. Llewellyn Publications.

  • Kelly, A. A. (1992). An Update on Neopagan Witchcraft in America. In J. R. Lewis & J. G. Melton (Eds.), Perspectives on the New Age (pp. 136–151). State University of New York Press.

  • Kern, E. M. (1999, January). An End to Witch Trials in Austria: Reconsidering the Enlightened State. Austrian History Yearbook, 30, 159–185. https://doi.org/10.1017/S006723780001599X

  • Khaldûn, I. (2015). The Muqaddimah: An Introduction to History (Abridged ed.). Princeton University Press. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved May 4, 2021.

  • Kieckhefer, R. (2014). Magic in the Middle Ages (2nd ed.). Cambridge University Press.

  • Kielburger, C., & Kielburger, M. (2008, February 18). HIV in Africa: Distinguishing disease from witchcraft. Toronto Star. Archived from the original on October 19, 2017. Retrieved September 18, 2017.

  • Kilpatrick, A. (1998). The Night Has a Naked Soul – Witchcraft and Sorcery Among the Western Cherokee. Syracuse University Press.

  • Kittredge, G. L. (1929). Witchcraft in Old and New England. Russell & Russell.

  • Klimczak, N. (2017, October 27). Barbara Zdunk – The Last Executed Slavic Witch By Authorities In Prussia. Slavorum. Archived from the original on October 27, 2017. https://web.archive.org/web/20171027183407/https://www.slavorum.org/barbara-zdunk-the-last-executed-slavic-witch-by-the-inquisition-in-poland/

  • Kolwezi: Accused of witchcraft by parents and churches, children in the Democratic Republic of Congo are being rescued by Christian activists. (2009, September). Christianity Today. Archived from the original on November 14, 2011. Retrieved October 14, 2011.

  • La Fontaine, J. S. (1998). Speak of the Devil: Tales of satanic abuse in contemporary England. Cambridge University Press.

  • La Fontaine, J. S. (2016). Witches and Demons: A Comparative Perspective on Witchcraft and Satanism. Berghahn Books.

  • Larner, C. (2002). Crime of witchcraft in early modern Europe. In A. Oldridge (Ed.), The Witchcraft Reader. Routledge.

  • Lavrin, A. (Ed.). (1992). Sexuality and Marriage in Colonial Latin America (Reprint ed.). University of Nebraska Press.

  • Lawrence, S. E. (2015). Witchcraft, Sorcery, Violence: Matrilineal and Decolonial Reflections. In M. Forsyth & R. Eves (Eds.), Talking it Through: Responses to Sorcery and Witchcraft Beliefs and Practices in Melanesia. ANU Press.

  • Les trois livres de la semaine : la sélection du ” Monde des livres “. (2014, July 10). Le Monde.fr. Retrieved 2018-01-28, from http://www.lemonde.fr/livres/article/2014/07/10/les-trois-livres-de-la-semaine-la-selection-du-monde-des-livres_4454908_3260.html

  • Levack, B. P. (1987). The Witch Hunt in Early Modern Europe. Longman.

  • Levack, B. P. (2004). Section 251 of the Cameroonian penal code. In The Witch-Hunt in Early Modern Europe. Routledge.

  • Levack, B. P. (2006). The Witch Hunt in Early Modern Europe (3rd ed.). Pearson Longman.

  • Levack, B. P. (Ed.). (2013). The Oxford Handbook of Witchcraft in Early Modern Europe and Colonial America. Oxford University Press.

  • Lewis, J. R. (Ed.). (1996). Magical Religion and Modern Witchcraft. SUNY Press.

  • Lewis, L. A. (2003). Hall of mirrors: power, witchcraft, and caste in colonial Mexico. Duke University Press.

  • Livy. (n.d.). History of Rome, Book VIII, Chapter xviii. Perseus Digital Library. Retrieved January 15, 2021, from https://www.perseus.tufts.edu/hopper/text?doc=Perseus%3Atext%3A1999.02.0155%3Abook%3D8%3Achapter%3D18

  • Luck, G. (1985). Arcana Mundi: Magic and the Occult in the Greek and Roman Worlds; a Collection of Ancient Texts. Johns Hopkins University Press.

  • Macfarlane, A. (1999). Witchcraft in Tudor and Stuart England: A Regional and Comparative Study. Psychology Press.

  • Mackay, C. S. (2009). The hammer of witches: A complete translation of the Malleus Maleficarum. Cambridge University Press.

  • Mansky, J. (2017, October 10). The True Story of the Death of Stalin. Smithsonian.com.

  • Markham-Cantor, A. (2019, October 28). What Trump Really Means When He Cries ‘Witch Hunt’. The Nation. Retrieved September 19, 2021, from https://www.thenation.com/article/archive/trump-witch-hunt/

  • Martin, L. (2010). A Brief History of Witchcraft. Running Press.

  • McGuirk, R. (2013, June 10). Witch hunts in Papua New Guinea linked to jealousy. Associated Press. Archived from the original on May 17, 2021. https://news.yahoo.com/witch-hunts-papua-guinea-linked-jealousy-054301668.html

  • McNeill, F. M. (1957). The Silver Bough: A Four Volume Study of the National and Local Festivals of Scotland (Vol. 1). Canongate Books.

  • Meaney, A. L. (1984). Æfric and Idolatry. Journal of Religious History, 13(2), 119–135. https://doi.org/10.1111/j.1467-9809.1984.tb00191.x

  • Meewis, W. (1992). De Vierschaar. Uitgevering Pelckmans.

  • Mezzofiore, G. (2015, June 30). Isis in Syria: Islamic State beheads 2 women for sorcery reports Syrian Observatory for Human Rights. International Business Times. Retrieved June 30, 2015, from http://www.ibtimes.co.uk/isis-syria-islamic-state-beheads-2-women-sorcery-reports-syrian-observatory-human-rights-1508572

  • Midelfort, H. C. E. (1972). Witch Hunting in Southwestern Germany 1562–1684. Stanford University Press.

  • Migne, J.-P. (Ed.). (n.d.). Patrologia Latina, CIV, 147.

  • Miguel, E. (2005, October 1). Poverty and witch killing. The Review of Economic Studies, 72(4), 1153–1172. https://doi.org/10.1111/0034-6527.00365

  • Miller, A. (1996, October 13). Why I wrote ‘The Crucible’. The New Yorker.

  • Mills, M. A. (2013). The opposite of witchcraft: Evans-Pritchard and the problem of the person. The Journal of the Royal Anthropological Institute, 19(1), 18–33. https://doi.org/10.1111/1467-9655.12001

  • Molina, J. A. (2006). The Invention of Child Witches in the Democratic Republic of Congo. Save the Children.

  • Monter, W. (2002). Witch Trials in Continental Europe. In B. Ankarloo & S. Clark (Eds.), Witchcraft and magic in Europe (pp. 12 ff.). University of Pennsylvania Press.

  • Mormando, F. (1999). The Preacher’s Demons: Bernardino of Siena and the Social Underworld of Early Renaissance Italy. University of Chicago Press.

  • Moro, P. A. (2017). Witchcraft, Sorcery, and Magic. In The International Encyclopedia of Anthropology. https://doi.org/10.1002/9781118924396.wbiea1915

  • Morone, J. (2022). Conspiracies and American Democracy: What’s Old? What’s New? And What’s Dangerous? University of St. Thomas Journal of Law & Public Policy, 15(2), 412–432. https://researchonline.stthomas.edu/esploro/outputs/journalArticle/Conspiracies-and-American-Democracy-Whats-Old/991015132044303691

  • Nachman Ben-Yehuda. (1980, July). The European Witch Craze of the 14th to 17th Centuries: A Sociologist’s Perspective. American Journal of Sociology, 86(1), 1-31. http://www.jstor.com/stable/2778849

  • National Catholic Register. (2012, February 16). Abortion, Contraception and the Church Fathers. http://www.ncregister.com/daily-news/abortion-contraception-and-the-church-fathers

  • Needham, R. (1978). Primordial Characters. University of Virginia Press.

  • Nepal: Witchcraft as a Superstition and a form of violence against women in Nepal. (2011). Asian Human Rights Commission. Archived from the original on June 25, 2014. Retrieved June 7, 2014.

  • New Dictionary of the American Language. (n.d.). Witch hunt. Simon & Schuster. p. 1633.

  • Nossiter, A. (2009, May 20). Witch Hunts and Foul Potions Heighten Fear of Leader in Gambia. The New York Times. https://www.nytimes.com/2009/05/21/world/africa/21gambia.html?ref=africa

  • Ogden, D. (2002). Magic, Witchcraft, and Ghosts in the Greek and Roman Worlds: A Sourcebook. Oxford University Press.

  • Okeja, U. (2011). An African Context of the Belief in Witchcraft and Magic. In Rational Magic. Fisher Imprints.

  • The Oxford companion to Scottish history. (2001). Oxford University Press.

  • Papua New Guinea’s ‘Sorcery Refugees’: Women Accused of Witchcraft Flee Homes to Escape Violence. (2015, January 6). Vice News. Archived from the original on March 20, 2017.

  • Pearlman, J. (2013, April 11). Papua New Guinea urged to halt witchcraft violence after latest ‘sorcery’ case. The Telegraph. Archived from the original on February 11, 2018. Retrieved April 5, 2018.

  • Perrone, B., Stockel, H. H., & Krueger, V. (1993). Medicine women, curanderas, and women doctors. University of Oklahoma Press. Archived from the original on April 23, 2017. Retrieved October 8, 2010.

  • Peters, E. (See Jolly, K., Raudvere, C., & Peters, E.)

  • Petz, W. (2007, December 11). Anna Maria Schwägelin (Schwägele). Historicum.net. Archived from the original on May 31, 2008. http://www.historicum.net/themen/hexenforschung/lexikon/personen/art/Schwaegelin_Ann/html/artikel/5602/ca/e96896a58d/

  • Pócs, É. (1999). Between the Living and the Dead: A Perspective on Witches and Seers in the Early Modern Age. Central European University Press.

  • Pope, J. C. (Ed.). (1968). Homilies of Aelfric: a supplementary collection (Vol. II). (Early English Text Society 260). Oxford University Press.

  • Purkiss, D. (2003-09-02). The Witch in History. Routledge. doi:10.4324/9780203359723. ISBN 9780203359723.

  • Rapley, R. (1998). A Case of Witchcraft: The Trial of Urbain Grandier. Manchester University Press.

  • Raudvere, C. (See Jolly, K., Raudvere, C., & Peters, E.)

  • Reiner, E. (1995). Astral Magic in Babylonia. American Philosophical Society.

  • Ribeiro Júnior, J. (n.d.). O Que é Magia. Abril Cultural.

  • Richards, A. I. (1935). A Modern Movement of Witch Finders. Africa: Journal of the International Institute of African Languages and Cultures, VIII.

  • Riddle, J. M. (1997). Eve’s Herbs: A History of Contraception and Abortion in the West. Harvard University Press.

  • Rose, E. (1962). A Razor for a Goat. University of Toronto Press.

  • Russell, J. B. (n.d.). Witchcraft. Britannica.com. Archived from the original on May 10, 2013. Retrieved June 29, 2013.

  • Russell, J. B. (1972). Witchcraft in the Middle Ages. Cornell University Press.

  • Russell, J. B., & Lewis, I. M. (2000). Witchcraft. Encyclopedia Britannica. Retrieved August 27, 2021, from https://www.britannica.com/topic/witchcraft

  • Russell, J. B., & Lewis, I. M. (2023, July 28). Witchcraft. Encyclopedia Britannica. Archived from the original on June 28, 2023. Retrieved July 28, 2023.

  • Sacred Texts. (n.d.). Daemonlologie by King James the First and Newes from Scotland. Retrieved from https://www.sacred-texts.com/pag/kjd/index.htm

  • Sacred Texts. (n.d.). Heimskringla: King Olaf Trygvason’s Saga. Retrieved from https://www.sacred-texts.com/neu/heim/07olaftr.htm

  • Saudi Gazette. (2009, November 4). Distance witch finally caught; 118 detained this year. Archived from the original on January 10, 2012. http://www.saudigazette.com.sa/index.cfm?method=home.regcon&contentID=2009110453524&archiveissuedate=04%2F11%2F2009

  • Saudi man executed for ‘witchcraft and sorcery’. (2012, June 19). BBC News. Archived from the original on May 30, 2019. Retrieved June 7, 2014.

  • Saudi woman beheaded for ‘witchcraft and sorcery’. (2011, December 13). CNN. Archived from the original on May 21, 2020. Retrieved June 7, 2014.

  • Savage-Smith, E. (Ed.). (2004). Magic and Divination in Early Islam. Ashgate/Variorum. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved August 25, 2020.

  • Savage-Smith, E. (Ed.). (2021). Magic and divination in early Islam. Routledge.

  • Scarre, G., & Callow, J. (2001). Witchcraft and Magic in Sixteenth and Seventeenth-Century Europe (2nd ed.). Palgrave.

  • Schnoebelen, J. (2009, January). Witchcraft allegations, refugee protection and human rights: a review of the evidence (UNHCR Research Paper No. 169). UNHCR. http://www.unhcr.org/4981ca712.pdf

  • Scot, R. (1584). The Discoverie of Witchcraft.

  • Selwood, D. (2016, March 16). How Protestantism fuelled Europe’s deadly witch craze. The Telegraph. Archived from the original on May 28, 2014. http://blogs.telegraph.co.uk/news/dominicselwood/100269271/how-protestantism-fuelled-europes-deadly-witch-craze/

  • Semple, S. (1998). A fear of the past: The place of the prehistoric burial mound in the ideology of middle and later Anglo-Saxon England. World Archaeology, 30(1), 109–126. https://doi.org/10.1080/00438243.1998.9980400

  • Semple, S. (2003). Illustrations of damnation in late Anglo-Saxon manuscripts. Anglo-Saxon England, 32, 231–245. https://doi.org/10.1017/S0263675103000115

  • Sharpe, J. (2001). Witchcraft in Early Modern England. Pearson.

  • Sharpe, J. (2002). The Lancaster witches in historical context. In R. Poole (Ed.), The Lancashire Witches: Histories and Stories (pp. 1–18). Manchester University Press.

  • Shear, M. D., Savage, C., & Haberman, M. (2017, June 16). Trump Attacks Rosenstein in Latest Rebuke of Justice Department. The New York Times. Retrieved September 19, 2021, from https://www.nytimes.com/2017/06/16/us/politics/trump-investigation-comey-russia.html

  • Shrestha, D. (2010, February 15). Witch-hunts of low-caste women in Nepal. Telegraph.co.uk. Archived from the original on January 12, 2022. https://ghostarchive.org/archive/20220112/https://www.telegraph.co.uk/expat/expatnews/7241937/Witch-hunts-of-low-caste-women-in-Nepal.html

  • Silverblatt, I. (1983). The evolution of witchcraft and the meaning of healing in colonial Andean society. Culture, Medicine and Psychiatry, 7(4), 413–427. https://doi.org/10.1007/BF00052240

  • Simons, P. (2014). The Incubus and Italian Renaissance art. Notes in the History of Art, 34(1), 1–8. https://doi.org/10.1086/sou.34.1.23882368

  • Sinclair, G. (1871). Satan’s Invisible World Discovered. Edinburgh.

  • Singh, M. (2021). Magic, Explanations, and Evil: The Origins and Design of Witches and Sorcerers. Current Anthropology, 62(1), 2–29. https://doi.org/10.1086/713111

  • Sinha, S. (2007). Witch hunts, Adivasis, and the Uprising in Chhotanagpur. Economic and Political Weekly, 42(19), 1672–1676. JSTOR 4419566

  • Social stigma as an epidemiological determinant for leprosy elimination in Cameroon. (2011). Journal of Public Health in Africa, 2(1), e10. Archived from the original on July 31, 2017. Retrieved August 27, 2014.

  • Soldan, W. G. (1843). Geschichte der Hexenprozesse: aus dem Qvellen Dargestellt. Cotta.

  • Stepping Stones Nigeria 2007. Supporting Victims of Witchcraft Abuse and Street Children in Nigeria. (2007). Humantrafficking.org. Archived from the original on October 17, 2012.

  • Stokker, K. (2007). Remedies and Rituals: Folk Medicine in Norway and the New Land. Minnesota Historical Society Press.

  • Suetonius. (n.d.). The Life of Augustus.

  • Summerlands. (n.d.). Estimates of executions. Retrieved from http://www.summerlands.com/crossroads/remembrance/current.htm

  • Summers, M. (2003). Geography of Witchcraft. Kessinger Publishing. https://doi.org/10.4324/9781315822334

  • Swissinfo.ch. (2008, August 27). Last witch in Europe cleared. Retrieved September 22, 2010, from http://www.swissinfo.ch/eng/swiss_news/Last_witch_in_Europe_cleared.html?cid=662078

  • Tan, M. L. (2008). Revisiting Usog, Pasma, Kulam. University of the Philippines Press. Archived from the original on January 26, 2021. Retrieved September 17, 2020.

  • Tazbir, J. (1994). Opowieści prawdziwe i zmyślone. Twój Styl.

  • Telegraph Video. (2021, February 5). Is cancel culture the modern-day witch trials? The Telegraph. Archived from the original on January 12, 2022. https://ghostarchive.org/archive/20220112/https://www.telegraph.co.uk/news/0/cancel-culture-modern-day-witch-trials/

  • The dangers of witchcraft. (2010, February 4). Reuters Blogs. Archived from the original on March 12, 2010. Retrieved March 26, 2010.

  • The Hindu. (2010, July 26). Nearly 200 women killed every year after being branded witches. http://www.thehindu.com/news/article533407.ece

  • The Times. (2008, February 16). King Abdullah urged to spare Saudi ‘witchcraft’ woman’s life.

  • The Times. (2010, April 2). Lebanese TV host Ali Hussain Sibat faces execution in Saudi Arabia for sorcery. Retrieved January 18, 2025, from https://www.thetimes.com/article/lebanese-tv-host-ali-hussain-sibat-faces-execution-in-saudi-arabia-for-sorcery-9thsq55qzxb

  • Thomas, K. (1997). Religion and the Decline of Magic. Oxford University Press. (Original work published 1971)

  • Thurston, R. (2013). The Witch Hunts: A History of the Witch Persecutions in Europe and North America. Routledge. ISBN 9781317865018.

  • Umotong, I. D. (n.d.). Witchcraft in Africa: malignant or developmental? Nigerian Journals Online. Retrieved from https://www.nigerianjournalsonline.com/index.php/najp/article/download/1925/1881

  • UNHCR. (2009, January). Witchcraft allegations, refugee protection and human rights: a review of the evidence (Research Paper No. 169). http://www.unhcr.org/cgi-bin/texis/vtx/home/opendocPDFViewer.html?docid=4981ca712

  • UNHCR. (2011a, January). Breaking the spell: responding to witchcraft accusations against children (Research Paper No. 197). http://www.unhcr.org/4d346eab9.html

  • UNHCR. (2011b, May). Seeking meaning: an anthropological and community-based approach to witchcraft accusations and their prevention in refugee situations (Research Paper No. 235). http://www.unhcr.org/4d346eab9.html

  • Valiente, D. (1989). The Rebirth of Witchcraft. Robert Hale.

  • Varma, D. (2007). Witch-Hunt among Santhals. Economic & Political Weekly, 42(23), 2130. JSTOR 4419670

  • von Pastor, L. (n.d.). The History of the Popes, from the Close of the Middle Ages. Vol. 5.

  • Wallace, D. L. (2015). Rethinking religion, magic and witchcraft in South Africa: From colonial coherence to postcolonial conundrum. Journal for the Study of Religion, 28(1), 23–51. Retrieved September 15, 2023, from Academia.edu.

  • Wallace, P. G. (2004). The Long European Reformation. Palgrave Macmillan.

  • Wall, L., & Morgan, W. (1998). Navajo-English Dictionary. Hippocrene Books. (Original work published 1958)

  • Watts, E. J. (2008). City and School in Late Antique Athens and Alexandria. University of California Press. (Original work published 2006)

  • West, H. G. (2007). Ethnographic Sorcery. The University of Chicago Press.

  • Westwood, J. (2011). The lore of Scotland: A guide to Scottish legends. Arrow.

  • Whitaker, K. (2012, September 1). Ghana witch camps: Widows’ lives in exile. BBC News. Archived from the original on October 20, 2018. Retrieved September 1, 2012.

  • WHRIN. (2013, July 31). Nepal – A study on violence due to witchcraft allegation and sexual violence. Retrieved August 26, 2019, from http://www.whrin.org/nepal-a-study-on-violence-due-to-witchcraft-allegation-and-sexual-violence-2/

  • Wilby, E. (2005). Cunning Folk and Familiar Spirits: Shamanistic Visionary Traditions in Early Modern British Witchcraft and Magic. Sussex Academic Press.

  • Willis, D. (2018). Malevolent Nurture: Witch-Hunting and Maternal Power in Early Modern England. Cornell University Press.

  • Willumsen, L. H. (2010). The Witchcraft Trials in Finnmark, northern Norway. Skald.

  • Willumsen, L. H. (2013). Witches of the North. Brill.

  • Witchcraft accusations were an ‘occupational hazard’ for female workers in early modern England. (2023, September 19). University of Cambridge. Retrieved from https://www.cam.ac.uk/stories/witchcraft-work-women

  • Witchcraft and human rights. (n.d.). Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights. Retrieved from https://www.ohchr.org/en/special-procedures/ie-albinism/witchcraft-and-human-rights

  • Witchcraft beliefs are widespread, highly variable around the world. (2022, November 23). Phys.org. Retrieved December 17, 2022.

  • Witchcraft in 17th century Iceland. (2019, February 2). Penguin.co.uk. Retrieved from https://www.penguin.co.uk/articles/2019/02/witchcraft-in-17th-century-iceland-caroline-lea

  • Witchcraft murder: Couple jailed for Kristy Bamu killing. (2012, March 5). BBC News. Archived from the original on April 8, 2014. Retrieved June 8, 2014.

  • Witch Hunts in Modern South Africa: An Under-represented Facet of Gender-based Violence. (2009). MRC-UNISA Crime, Violence and Injury Lead Programm. Archived from the original on April 25, 2012. Retrieved June 7, 2014.

  • Woman suspected of witchcraft burned alive. (2009, January 8). CNN.com. Archived from the original on April 29, 2009.

  • Womensnews.org. (n.d.). Recourse rare witch hunt victims in India. Retrieved from http://www.womensenews.org/story/the-world/070716/recourse-rare-witch-hunt-victims-in-india

  • World Report on Violence and Health. (2014). World Health Organization. Archived from the original on January 24, 2014. Retrieved June 7, 2014.

  • Yerushalmi Sanhedrin, 6:6.

  • Zguta, R. (1977). Witchcraft Trials in Seventeenth-Century Russia. The American Historical Review, 82(5), 1187–1207. https://doi.org/10.2307/1856344

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.