Table of Contents
ভূমিকা
ডাইনি বিচার নিয়ে নারীবাদীরা কী ভাবেন, সে এক বিরাট ফিরিস্তি। উনিশ আর বিশ শতক ধরে এই নিয়ে কত যে কথা, কত যে লেখালেখি! আর সময়ের সাথে সাথে এই ভাবনাগুলোও কিন্তু পাল্টেছে। নারীবাদী চিন্তাধারার যেমন বিভিন্ন ঢেউ (wave) এসেছে – যেমন ধরুন প্রথম তরঙ্গ (first-wave), দ্বিতীয় তরঙ্গ (second-wave feminism) এবং সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী (socialist feminist) আন্দোলন – এই ব্যাখ্যাগুলোও সেভাবেই একটু একটু করে চেহারা বদলেছে।
নারীবাদী ব্যাখ্যার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
আদি আধুনিক যুগের (early modern period) লেখালেখি থেকেই নারীবাদী ব্যাখ্যার একটা ভিত্তি তৈরি হয়ে ছিল। এইসব লেখায় ডাইনিদের একটা গতানুগতিক ছবি (stereotype) ফুটে ওঠে, বিশেষ করে তাদের মেয়েলি স্বভাবের বিষয়টা। এই ছবিটা তখনকার সমাজে বেশ গেঁড়ে বসেছিল। মূল কথা হলো, সেসময় যারা জাদুবিদ্যা বা ডাইনি বিদ্যার বিচার করত, সেই আইনকর্তাদের বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, আর যাদের বিচার হচ্ছিল, তাদের বেশিরভাগই নারী। এমনকি পুরুষদের করা অপরাধের ক্ষেত্রেও দেখা যেত, কারণে-অকারণে মেয়েদেরই বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে।
‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (The Malleus Maleficarum) – একখানা ভয়ংকর বই
ডাইনিবিদ্যা নিয়ে যতসব কেতাব লেখা হয়েছে, তার মধ্যে ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum) বোধহয় সবচেয়ে কুখ্যাত! ১৪৮৪ সালে ক্যাথলিক যাজক হেনরিখ ক্রেমার (Heinrich Kramer) এইখানা লেখেন। বইটা তিন ভাগে ভাগ করা। প্রথম ভাগে বলা হয়েছে, ডাইনিবিদ্যা নিয়ে কীভাবে ধর্মোপদেশ দিতে হবে, আর ধর্মের চশমায় বিষয়টাকে কীভাবে দেখা উচিত। এই অংশে আরও ব্যাখ্যা করা হয়েছে, ডাইনিবিদ্যা আদৌ সত্যি কি না। শেষে সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে, শয়তান যেহেতু সত্যি, তাই ডাইনিবিদ্যাও সত্যি হতে বাধ্য; দুটোকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলা হয়েছে আরকি।
দ্বিতীয় অংশে ডাইনিদের নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করা হয়েছে – তাদের মধ্যে কী কী বৈশিষ্ট্য সাধারণত দেখা যায়, তারা কীভাবে ডাইনিগিরি করে, আর কারা সহজেই ভূতে আছর (possession) হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এই অংশে ডাইনিবিদ্যা ঠেকানোর কিছু উপায়ও বাতলে দেওয়া হয়েছে। সবশেষে, কীভাবে ডাইনিদের বিচার করতে হবে, তার খুঁটিনাটি বর্ণনা করা হয়েছে (Mackay, 2009)। অভিযোগ কীভাবে সামলাতে হবে, কীভাবে জেরা করতে হবে, কীভাবে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে – সব পর পর সাজানো, প্রশ্ন আর উত্তরের ধরনে। বেশিরভাগ উত্তরই নেওয়া হয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। আজকাল এই ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ বইটাকে ডাইনি বিচারের নারীবিদ্বেষী (misogynistic) চরিত্রের একটা বড় প্রমাণ হিসেবে ধরা হয় (Mackay, 2009)। বইটা পড়লে বোঝা যায়, মেয়েদের ওপর পুরুষদের কী ভীষণ আধিপত্য ছিল, আর ডাইনি অপবাদে অভিযুক্ত হলে মেয়েদের বাঁচার কোনো আশাই থাকত না।
‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ বইতে বার বার জোর দিয়ে বলা হয়েছে, মেয়েরা নাকি এমন কিছু গুণের (আসলে দোষের) অধিকারী, যা শুধু তাদেরই আছে, আর সে কারণেই তারা ডাইনিবিদ্যা বা “জাদুটোনায়” (sorcery) বেশি ঝুঁকে পড়ে। মজার ব্যাপার হলো, ডাইনি বিচারের সময় কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগের জন্য তাকে কখনো অভিযুক্ত বা দায়ী করা হয়নি। দ্বিতীয় ভাগের একটা অংশে, যেখানে ডাইনিদের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেখানে লেখক মেয়েদের সম্পর্কে কী ভাবতেন, তার একটা ঝলক পাওয়া যায়:
“অন্যরা অবশ্য মেয়েরা কেন পুরুষদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় কুসংস্কারী হয়, তার ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখান, এবং তারা বলেন এর পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা সহজেই বিশ্বাস করে এবং যেহেতু শয়তান মূলত ধর্মবিশ্বাস (Faith) নষ্ট করতে চায়, তাই সে বিশেষ করে তাদেরই আক্রমণ করে। একারণেই ধর্মগ্রন্থে (Ecclesiasticus 19[4]) আছে: ‘যে দ্রুত বিশ্বাস করে, সে চপলমতি এবং ছোট হয়ে যাবে।’ দ্বিতীয় কারণ হলো, তাদের স্বভাবের পরিবর্তনের (flux) প্রবণতার কারণে তারা স্বভাবতই দেহহীন আত্মার প্রভাবে প্রত্যাদেশ লাভের জন্য বেশি সংবেদনশীল হয়, এবং যখন তারা এই স্বভাব ভালোভাবে ব্যবহার করে, তখন তারা খুব ভালো হয়, কিন্তু যখন খারাপভাবে ব্যবহার করে, তখন তারা আরও খারাপ হয়। একারণেই তাদের মুখ আলগা (loose tongues) এবং তারা তাদের নারী সঙ্গীদের কাছ থেকে মন্দ কৌশলে জানা জিনিসগুলো গোপন করতে পারে না, এবং যেহেতু তাদের শারীরিক শক্তি কম (lack physical strength), তাই তারা সহজেই জাদুটোনার মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে চায়… যেহেতু তারা চঞ্চলমতি (prone to flux), তাই তারা আরও দ্রুত শয়তানের কাছে সন্তানদের উৎসর্গ করতে পারে, যেমনটা তারা করেও থাকে।” (Mackay, 2009)
‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’-এর এই অংশটুকু পড়লেই বোঝা যায়, মেয়েদের কিছু বানানো স্বভাবের – যেমন “মুখ আলগা” বা “গায়ে জোর কম” – দোহাই দিয়ে বলা হচ্ছে, তারা নাকি শয়তানের পাল্লায় বেশি পড়ে, আর জাদু দিয়ে চটজলদি প্রতিশোধ নিতে চায়। যেহেতু এই কেতাবখানা আদি আধুনিক যুগে ডাইনি ঠেকানোর চেষ্টায় বিশাল ভূমিকা রেখেছিল (Mackay, 2009), তাই ধরে নেওয়া যায়, মেয়েদের সম্পর্কে এই ধারণাগুলো ইউরোপের বহু মানুষ বিশ্বাস করত। তার ওপর, এই লেখাটা এমন এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল, যখন ধর্মের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তাই একটা ধর্মীয় লেখা হিসেবে এটা আরও সহজে গৃহীত হয়ে থাকতে পারে। আর ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা যেহেতু পুরুষদের হাতেই ছিল, তাই মেয়েদের সামনে অভিযুক্ত না হওয়া বা ন্যায্য বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না।
ডাইনি ও আদি আধুনিক যুগের নারীবিষয়ক গতানুগতিক ধারণা
আদি আধুনিক যুগে ডাইনিদের যে একটা বাঁধাধরা ছবি তৈরি হয়েছিল, তার শিকড় কিন্তু ডাইনি বিচার শুরু হওয়ারও আগের। সেই পুরনো আমলে মানুষজনের মধ্যে ভূত-প্রেত-দৈত্যদানব (demonism) নিয়ে যেসব ধারণা ছিল, সেখান থেকেই এই ছবিটা এসেছে (Hutton, 2017)। সেই যুগে ধর্মীয় কেতাবের ওপর মানুষের বিশ্বাস ছিল অগাধ, আর সেগুলোকে যুক্তিসঙ্গতও মনে করা হতো। পণ্ডিতরা বলেন, বিশেষ করে মেয়ে ভূত বা নারী দৈত্যের ওপর বিশ্বাসকেই পরে মেয়েদের জাদুক্ষমতার অতিরঞ্জিত ধারণার সাথে জুড়ে দেওয়া হয় (Hutton, 2017)। জার্মানদের পুরনো আইনকানুনগুলোতেও (Germanic law codes) এমন কিছু নরখাদক নারীর কথা বলা আছে, যাদের সাথে আদি আধুনিক যুগের ডাইনিদের অদ্ভুত মিল (Hutton, 2017)। দু’দলকেই ভাবা হতো—তারা বুড়ি, গরিব, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, কিংবা যৌনতার দিক থেকে একটু অন্যরকম (sexually deviant) – সোজা বাংলায়, সমাজের বেঁধে দেওয়া মেয়েলি ভূমিকার বাইরে তাদের বিচরণ (Bever, 2002; Hutton, 2017)।
এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলেই যে মেয়েদের ডাইনি বলে দাগিয়ে দেওয়া হতো, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন বিচার বা ঘটনার নথিপত্রে। ১৫৯৭ সালের একটা ঘটনার কথাই ধরুন। ‘স্ট্যাপেন হিলের অ্যালস গুডারিজ নামের এক ডাইনির সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও সত্যি কাহিনি’ (“The most wonderfull and true storie, of a certaine witch named Alse Gooderige of Stapen hill”)—এই শিরোনামের একটা পুরনো নথিতে দেখা যায়, ঠিক এই ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকলেই মেয়েদের কীভাবে ডাইনি বলে দাগিয়ে দেওয়া হতো (“A true and most dread full discourse…”, 1886)। মেয়েদেরকে ঝগড়ুটে, ঝামেলা সৃষ্টিকারী এবং প্রতিবেশীদের প্রতি আক্রমণাত্মক হিসেবে দেখা হতো। ওই নথিতে গুডারিজ এবং একটি অল্পবয়সী ছেলের মধ্যে একটি ঘটনার বর্ণনা আছে, যেখানে গুডারিজের বিরুদ্ধে ছেলেটিকে জাদু করার অভিযোগ আনা হয়। নথিতে অভিযুক্ত ডাইনি হিসেবে গুডারিজের বর্ণনায় তাকে একজন বৃদ্ধা বিধবা এবং তার মুখে আঁচিলসহ দেখানো হয়েছে (“A true and most dread full discourse…”, 1886)। এই বর্ণনা এটাই দেখায় যে, মেয়েরা যদি সমাজের প্রত্যাশিত তরুণী, সুন্দরী এবং সামাজিক জীবনে জড়িত থাকার বাইরে চলে যেত, তবে তাদের ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকত।
অন্যান্য ব্যাখ্যাও আছে, যেমন ধরুন শিল্পকলার দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানেও ডাইনিদের একটা চেহারা খাড়া করার চেষ্টা হয়েছে (Burns, 2003)। বেশিরভাগ সময়ই এই ছবিগুলো আসত ধর্মীয় কেতাব থেকে। আদি আধুনিক বা আর্লি মডার্ন যুগের বইপত্রে ডাইনিদের যে ছবি আঁকা হতো, তার অনেকটা জুড়ে ছিল গ্রিক পুরাণের জাদুকরী সার্সি (Circe)-কে নিয়ে আগ্রহ (Burns, 2003)। যেহেতু মেয়েদের নগ্নতা খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রেই দেখানো যেত, তাই ডাইনিবিদ্যার দিকে মানুষের ঝোঁক বাড়ে (Burns, 2003)। এই নগ্ন নারীদেহ দেখার আগ্রহ থেকেই ডাইনিদের সেভাবেই আঁকা হতো (Burns, 2003)। যেহেতু নগ্নতাকে পাপ বলেই মনে করা হতো, তাই ডাইনিবিদ্যাও শুরু থেকেই পাপের সাথেই জুড়ে গিয়েছিল।
আবার মেয়েদের নিয়ে অন্য ধরনের কিছু পুরনো ধারণাও ছিল, বিশেষ করে যখন পৌত্তলিক প্রথা (pagan practices) আর নানা আচার-অনুষ্ঠানের (rituals) কথা উঠত (Burton, 2019)। অনেকেই বলতেন, পৌত্তলিক উৎসবগুলোতে কিছু লোক মেয়েদের মতো পোশাক পরে এক ধরনের পানীয় (potion) পান করত (Burton, 2019)। একারণে ডাইনিবিদ্যার অনেক পুরনো ধারণাই এসব আচার থেকে এসেছে। এছাড়াও, রাসেল বার্টন (Russel Burton), ‘মধ্যযুগে ডাইনিবিদ্যা’ (Witchcraft in the Middle Ages) বইয়ের লেখক, এমন কিছু আচরণের কথা বলেছেন যা প্রাচীন রোমে নিন্দনীয় ছিল। অনেকেই বিশ্বাস করত, মেয়েরা শুধু রবিবারেই গির্জায় যেত পৌত্তলিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে (Burton, 2019)। এর মধ্যে নাচ, গান ইত্যাদির মতো সাধারণ কাজও ছিল।
যেসব মেয়েদের ডাইনিবিদ্যার সাথে জড়িত বলে মনে করা হতো, তাদের প্রায়শই শয়তানের সাথে বিভিন্ন কাজে লিপ্ত বলে ভাবা হতো, যেমন যৌন মিলন (sexual intercourse) (Burton, 2019)। যৌনতা বা যৌন চিন্তাভাবনার বেশিরভাগই নিষিদ্ধ ছিল, যা ডাইনিবিদ্যার প্রতি নেতিবাচক ধারণাকে আরও উসকে দিয়েছিল। তবে মেয়েদের একেবারে সরাসরি শয়তানের সাথে জড়ানোর আগে, অনেক ডাইনিকেই রোমান দেবী ডায়ানার (Diana) অনুসারী ভাবা হতো (Burton, 2019)। ডায়ানা, যিনি ছিলেন উর্বরতার দেবী, তিনিই আবার কুমারী শিকারী এবং পশুদের রক্ষাকর্ত্রীও ছিলেন (Burton, 2019)। এতসব গুণের পরেও, ডায়ানাকে পাতালপুরীর (underworld) সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ভাবা হতো, যেখানে তাকে হেকাটির (Hecate) সাথে এক করে দেখা হতো (Burton, 2019)। ডায়ানার এই অন্ধকার, আরও জটিল রূপটাই ছিল মধ্যযুগে ডাইনিবিদ্যার আদি নেত্রী, আর তৎকালীন সমাজে মেয়েদের আরেক প্রতিচ্ছবি (Burton, 2019)।
ডাইনি বিচারের দিকে তাকালে দেখা যায়, অভিযুক্তদের বেশিরভাগই ছিলেন নারী এবং তারাই ছিলেন মোট অভিযুক্তের একটা বড় অংশ (Karlsen, 1987)। পুরুষদের খুব কমই অভিযুক্ত করা হতো, আর তাদের কখনোই মূল চরিত্র হিসেবে দেখা হতো না, বরং শিকার হিসেবেই দেখানো হতো। নিউ ইংল্যান্ডের ঘটনাগুলো যদি আরও কাছ থেকে দেখি, কার্লসন তার ‘দ্য ডেভিল ইন দ্য শেপ অফ এ ওম্যান’ (The Devil in the Shape of a Woman) বইতে বিভিন্ন দলের তথ্য দিয়েছেন (Karlsen, 1987)। ১৬২০ থেকে ১৭২৫ সাল পর্যন্ত নিউ ইংল্যান্ডে ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্তদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছিল ১৫৬ জন, আর পুরুষের সংখ্যা মাত্র ৪৯ (Karlsen, 1987)। শুধু নিউ ইংল্যান্ডেই, ওই একই সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৩৪৪ জনকে ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, যার মধ্যে আটাত্তর শতাংশই ছিলেন নারী (Karlsen, 1987)। কঠিন সাজাগুলোও কিন্তু সেসময় মেয়েদের জন্যই বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ছিল সমাজ থেকে বহিষ্কার, কারাবাস, গৃহবন্দীত্ব বা মৃত্যুদণ্ড (সাধারণত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে) (Karlsen, 1987)।
প্রথম ও দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদে
প্রথম দিকের নারীবাদী ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে একজন ছিলেন আমেরিকান ম্যাটিল্ডা জসলিন গেজ (Matilda Joslyn Gage), একজন লেখিকা যিনি নারীদের ভোটাধিকারের জন্য প্রথম তরঙ্গের (first-wave) নারীবাদী আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। ১৮৯৩ সালে তিনি ‘নারী, গির্জা ও রাষ্ট্র’ (Woman, Church and State) নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইতে গেজ যুক্তি দেখান যে, আদি আধুনিক যুগে যাদের ডাইনি বলে মারা হয়েছিল, তারা আসলে এক প্রাচীন ধর্মের পুরোহিত (pagan priestesses) ছিলেন, যারা এক মহান দেবীর (Great Goddess) উপাসনা করতেন। তবে তিনি একটা ভুল তথ্যও প্রচার করেন, যা তিনি কয়েকজন জার্মান লেখকের কাজ থেকে নিয়েছিলেন – যে ডাইনি শিকারে নব্বই লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল (Hutton, 2017)।
১৯৭৩ সালে, আমেরিকার দ্বিতীয় তরঙ্গের (second-wave) দুই নারীবাদী, বারবারা এহরেনরাইখ (Barbara Ehrenreich) ও দেইরদ্রে ইংলিশ (Deirdre English) একটা লম্বা পুস্তিকা প্রকাশ করেন। সেখানে তারা বলেন, যাদের ডাইনি বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তারা আসলে ছিলেন সম্প্রদায়ের চিরায়ত সেবিকা ও ধাত্রী (healers and midwives), যাদেরকে পুরুষদের তৈরি করা চিকিৎসা ব্যবস্থা (male medical establishment) পরিকল্পনা করে সরিয়ে দিচ্ছিল (Ehrenreich & English, 1973)। এই তত্ত্বটা অবশ্য একটু প্রশ্নসাপেক্ষ, কারণ যাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই ধাত্রী বা সেবিকা ছিলেন না। যদিও তারা প্রথমে নিজেরাই এই লেখাটা প্রকাশ করেছিলেন, এটি এত সাড়া ফেলেছিল যে ‘ফেমিনিস্ট প্রেস’ (Feminist Press) এর প্রকাশনার দায়িত্ব নেয়। এরপর লেখাটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান, হিব্রু, ড্যানিশ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয় (Purkiss, 2003)। ২০১০ সালে এহরেনরাইখ ও ইংলিশের এই প্রকাশনার একটি পরিমার্জিত সংস্করণ পুনরায় ছাপা হয়।
তবে অন্য নারীবাদী ঐতিহাসিকরা এই ব্যাখ্যা মানতে চাননি। ঐতিহাসিক ডায়ান পারকিস (Diane Purkiss) একে ‘রাজনৈতিকভাবে সহায়ক নয়’ (not politically helpful) বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, কারণ এটি নারীদের ক্রমাগত ‘পিতৃতন্ত্রের অসহায় শিকার’ (helpless victims of patriarchy) হিসেবে দেখায় এবং সমসাময়িক নারীবাদী সংগ্রামে কোনো সাহায্য করে না (Purkiss, 2003)।
অন্যান্য ব্যাখ্যা
আজকের দিনের এক পণ্ডিত, নাম তার এডওয়ার্ড বেভার (Edward Bever), তিনি ভাবেন, এত যে মেয়েদের ডাইনি বলে ধরা হচ্ছিল, তার পেছনে কলকাঠি নাড়ছিল তখনকার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে থাকা নারীবিদ্বেষ (misogyny) (Bever, 2002)। তিনি আবার জোর গলায় বলেন, এই যে পুরুষদের দাপটওয়ালা সমাজ (patriarchal society), সেখানে শুধু যে পুরুষরাই মাতব্বরি করত তা নয়; এই পুরুষালি আর মেয়েদের ছোট করে দেখার মানসিকতা কিন্তু গোটা সমাজেই ছড়িয়ে পড়েছিল, এমনকি মেয়েদের মধ্যেও! সেকালে ইউরোপে ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু বাঁধা নিয়মকানুন (gender expectations) ছিল, আর যারা সেসব মানত না, তাদের কপালে জুটত দুর্ভোগ (Bever, 2002)।
যেমন ধরুন, একটা কথা চালু আছে যে, যে মেয়েদের ডাইনিগিরির দায়ে অভিযুক্ত করা হতো, তারা হয়তো সমাজের বেঁধে দেওয়া মেয়েলি চালচলনের (gender roles) বাইরে পা ফেলেছিল। হয়তো তারা একটু বেশি খোলামেলা স্বভাবের (overtly sexual) ছিল আরকি (Garrett, 2013)। মেয়েদের নিয়ে এই যে সমাজের হাজারটা প্রত্যাশা, আর সেই সাথে ডাইনিদের নিয়ে চালু থাকা গৎবাঁধা ধারণা – এই দুটো মিলেই হয়তো এত এত মেয়েকে বিপদে ফেলেছিল (Hester, 1996)। এমনকি যারা সমাজের নিয়ম মেনে, লক্ষ্মী মেয়ের মতো থাকত, তারাও হয়তো ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত – কখন না জানি তাদের ওপর ডাইনির অপবাদ এসে পড়ে! তাই হয়তো, অন্য কেউ দোষ চাপানোর আগেই তারা নিজেরাই কাউকে মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসিয়ে দিত, আত্মরক্ষার তাগিদে (Bever, 2002)।
মেয়েদের সম্পর্কে এই যে এতসব বাঁকা চিন্তাভাবনা, এটাই হয়তো বলে দেয় কেন কিছু কিছু জায়গায়, যেমন ধরুন ইউরোপের এক্কেবারে কোণার দিকের দেশগুলো – নরম্যান্ডি, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, আর রাশিয়া – সেখানে আবার পুরুষদেরই বেশি করে ডাইনি বলে ধরা হচ্ছিল (Behringer, 2004; Thurston, 2013)। যদি ওইসব জায়গায় মেয়েদের নিয়ে এত কড়াকড়ি না থাকত, তাহলে এটা বোঝাই যায় যে সেখানে মেয়েলি ব্যাপারস্যাপার আর ডাইনি অপবাদের মধ্যে অতটা দহরম-মহরম ছিল না।
সিলভিয়া ফেদেরিচির কাজ
এবার আসা যাক সিলভিয়া ফেদেরিচি (Silvia Federici) নামের আরেক বিদুষী মহিলার কথায়। তিনি ২০০৪ সালে একখানা বই লিখেছিলেন, নাম তার ‘ক্যালিবান অ্যান্ড দ্য উইচ: উইমেন, দ্য বডি অ্যান্ড প্রিমিটিভ অ্যাকুমুলেশন’ (Caliban and the Witch: Women, the Body and Primitive Accumulation)। এই বইতে তিনি ডাইনি নিধনের ঘটনাটাকে একেবারে অন্য চোখে দেখেছেন, যাকে বলে বস্তুবাদী নারীবাদী (materialist feminist) দৃষ্টিকোণ থেকে (Federici, 2017; “Les trois livres…”, 2014)। তার বইটা পুঁজিবাদের হাঁটি হাঁটি পা পা করার সময়টাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে। তিনি দেখিয়েছেন, এই ডাইনি নিধনের ঘটনাটা ঘটেছিল ঠিক যখন গরিব মানুষের জমিজমা কেড়ে নেওয়ার আইন (Inclosure Acts) চালু হচ্ছিল। এর ফলে মেয়েরা তাদের চাষবাসের জমি (commons lands) হারিয়ে ফেলেছিল, আর অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভর হয়ে পড়েছিল। ফেদেরিচি আরও বলেছেন, এই যে নতুন গজিয়ে ওঠা পুঁজিবাদ, সে মেয়েদের কাজেকর্মে একটা বিভাজন (sexual division of labor) তৈরি করেছিল, আর তাতে মেয়েদের ওপর মানসিক চাপও বেড়েছিল বিস্তর।
ক্যালিবান অ্যান্ড দ্য উইচ (Caliban and The Witch)
ফেদেরিচি তার ‘ক্যালিবান অ্যান্ড দ্য উইচ’ বইতে সোজাসাপ্টা বলেছেন, এই যে ডাইনি নিধন, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর মাধ্যমে মেয়েদের শরীরকে বানানো হচ্ছিল স্রেফ বাচ্চা পয়দা করার যন্ত্র (work machines), যারা কিনা বড় হয়ে কলকারখানায় সস্তা শ্রমিক হবে। আর এটা ছিল পুরনো দিনের নিজে খেয়েপরে বাঁচার অর্থনীতি (subsistence economy) থেকে সরে এসে টাকাপয়সার অর্থনীতির (monetary economy) দিকে যাওয়ার একটা জরুরি ধাপ। তিনি আরও দেখিয়েছেন, যে সময়ে দুনিয়াজুড়ে এই ডাইনি নিধন চলছিল, ঠিক সেই সময়েই আমেরিকা মহাদেশ দখল করা হচ্ছিল, দাস ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছিল, আর গরিব চাষিদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল। এই সবকিছুই কিন্তু পুঁজিবাদের উত্থানের দিকেই আঙুল তোলে। ফেদেরিচির মতে, এই ডাইনি নিধনটাই ছিল পুঁজিবাদের উত্থানের ইতিহাসের সেই হারিয়ে যাওয়া টুকরো, সেই রহস্যের জট।
তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট
ফেদেরিচির সাফ কথা হলো, পুরনো দিনের নিজে উৎপাদনের অর্থনীতি (production-for-use) থেকে সরে এসে মুনাফার জন্য উৎপাদনের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে (production-for-profit) উত্তরণ খেটে খাওয়া মানুষদের অভাব-অনটন থেকে মুক্তি দেয়নি, বরং উল্টোটা ঘটিয়েছে। অর্থনীতি তখন হয়ে দাঁড়িয়েছিল মজুরি দিয়ে সস্তায় খাটিয়ে নেওয়ার (wage labor exploitation), মেয়েদের দিয়ে বিনা পয়সায় খাটিয়ে নেওয়ার (unpaid work of women) আর প্রকৃতির বারোটা বাজানোর (degradation of environmental nature) এক বিশাল ফাঁদ। যেহেতু অর্থনৈতিক সম্পর্কের এই ওলটপালট আর পুঁজিবাদের প্রথম ধাক্কায় জমি হারানোর (enclosures) বোঝাটা মূলত মেয়েদের ঘাড়েই চেপেছিল, তাই তারাই নিজেদের জমি, সামাজিক মানসম্মান আর পুরনো দিনের চাষবাস বাঁচানোর জন্য লড়েছিল।
কিন্তু ইউরোপের সরকারগুলো তখন এক নতুন ভয়ংকর অপরাধ চালু করল – ডাইনিবিদ্যার (witchcraft) অভিযোগ, যা ছিল কিনা একেবারে রাষ্ট্রদ্রোহিতার (high treason) সামিল (a crimen exceptum)। এর মাধ্যমে তারা মেয়েদের এই প্রতিরোধ আর সামন্ততন্ত্রের বাইরে অন্য কোনো বিকল্প পথের সম্ভাবনাকে একেবারে পিষে ফেলতে চেয়েছিল। শুধু তাই নয়, এর ফলে সমাজের উৎপাদনের জন্য যা কিছু সহজলভ্য ছিল, সেগুলোকে তারা প্রকৃতির দানের মতোই মুফতে পাওয়া অশেষ ভাণ্ডার হিসেবে ধরে নিয়েছিল। আর এভাবেই আদিম সঞ্চয়নের (primitive accumulation) পথ পরিষ্কার হয়েছিল।
ফেদেরিচি পুঁজিবাদের উদ্ভবের মার্ক্সীয় ব্যাখ্যাটাকে আরও খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে মেয়েদের সামাজিক অবস্থান বদলে গিয়েছিল আর কীভাবে তাদের বাচ্চা পয়দা করার ক্ষমতাকে (production of labor-power) কাজে লাগানো হয়েছিল। কাজের ক্ষেত্রে এই যে লিঙ্গভিত্তিক ভাগাভাগি (division of labor), সেটাও যে কতটা প্রকট (gendered) ছিল, সেদিকে তিনি জোর দিয়েছেন। মেয়েদের খাটুনি আর তাদের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকে (reproductive function) দাবিয়ে রেখে, পয়সার বিনিময়ে কাজ (waged work) থেকে তাদের সরিয়ে দিয়ে, তাদের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে, আর কলকারখানার যন্ত্রপাতির (mechanization of workforce) সাথে সাথে মেয়েদের শরীরকেও নতুন শ্রমিক তৈরির যন্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করা হয়েছিল – এভাবেই গড়ে উঠেছিল শ্রমের নতুন এক যৌন বিভাজন। ফেদেরেচি এবং আরও অনেক পণ্ডিত মনে করেন, মেয়েদের শরীরের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ আর শ্রমের এই যৌন বিভাজনই ছিল বাড়তি মুনাফা (surplus value) তৈরির মূল শর্ত। সমাজে টিকে থাকার জন্য যে কাজগুলো হয় (social reproductive theory), সেই তত্ত্ব অনুযায়ী, পুঁজিবাদ আসলে মেয়েদের দিয়ে ঘরের বাইরের সেইসব অদৃশ্য, নমনীয় আর বিনা পয়সার খাটুনি খাটিয়ে নেয় (Bhattacharya, 2017)।
বাচ্চা পয়দা করা আর মেয়ে-পুরুষের সম্পর্কের এই কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি ফেদেরেচি আরও বলেন, পুঁজি জমানোর এই যে হাজারটা ফন্দিফিকির, এর ফলে পুরনো দিনের একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসার (communal mutual aid) প্রবণতা কমে গিয়েছিল। আগেকার দিনে ধাত্রীরা ভেষজ (herbs) দিয়ে মানুষের অসুখ সারাত, গাছগাছালির গুণাগুণ জানত, আর এসবের জন্য সমাজে তাদের একটা বিশেষ কদর ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদের এই যে কূটচাল (infra-politics of capitalism), এর কোপে পড়ে এই আরোগ্যকারীরা (healer) বিপদে পড়ল। সমাজের কাছ থেকে টিকে থাকার আর উৎপাদনের পুরনো কৌশলগুলো কেড়ে নেওয়া হলো। এতে করে পারস্পরিক সাহায্যের যে বাঁধনটা ছিল, সেটা হয় আলগা হয়ে গেল, নয়তো একেবারেই ছিঁড়ে গেল।
সিলভিয়া ফেদেরিচি আবার মিশেল ফুকো (Michel Foucault) নামের আরেক দিকপাল পণ্ডিতের কিছু কথার সমালোচনা করেছেন, মোট তিনটে দিক থেকে। প্রথমত, ফুকোর অনেক আগেই, সেই ১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকেই নারীবাদী কর্মী আর তাত্ত্বিকরা সমাজে মেয়ে-পুরুষের জায়গাটা বোঝার জন্য শরীরকে (body) একটা খুব জরুরি বিষয় হিসেবে দেখতেন। দ্বিতীয়ত, ফুকো বলেছিলেন যে আধুনিক যুগে গায়ে হাত তোলা বা শারীরিক অত্যাচার (physical violence) কমে গেছে, তার জায়গায় এসেছে মানসিক অত্যাচার (Psychological abuse) (Federici, 2004: 16; “Archived copy”, 2023)। কিন্তু ফেদেরিচি ডাইনি নিধন থেকে শুরু করে আজকের দিনের উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক কায়দায় মেয়েদের ওপর অত্যাচার কিন্তু চলতেই থেকেছে, যেটা ফুকোর আলোচনায় বেমালুম গায়েব। তৃতীয়ত, ফেদেরিচি ফুকোকে এই বলে দোষারোপ করেছেন যে, তিনি যখন “যৌনতার ইতিহাস” (History of Sexuality) (১৯৭৮) লিখলেন, তখন তিনি এমন এক “সবার জন্য প্রযোজ্য, ধরাছোঁয়ার বাইরে, লিঙ্গহীন কর্তা”র (“universal, abstract, asexual subject”) দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন যে, ডাইনি নিধনের মতো মেয়েদের ওপর হওয়া এত বড় একটা ঐতিহাসিক হিংসার ঘটনাকে তিনি পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পেরেছেন (Federici, 2004: 16)।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট (ফেদেরিচির মতে)
সেই যে ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালের মধ্যে ব্ল্যাক ডেথ (Black Death) নামের মহামারী ইউরোপের বেশিরভাগ কর্মক্ষম মানুষকে শেষ করে দিয়েছিল, তার ফলে সামন্ত প্রভুদের পক্ষে গরিব চাষিদের ওপর খবরদারি করা বা তাদের শায়েস্তা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। কাজ করার মতো লোকের যখন এত অভাব, তখন যারা কাজ করত, তারা দুর্নীতিবাজ প্রভুদের জব্দ করার জন্য নানা ফন্দি আঁটত – যেমন ধরুন, ফসল পচতে দিত বা ইচ্ছে করেই কাজ শেষ করত না। এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ তখনকার অর্থনীতি ছিল নিজে খেয়েপরে বাঁচার (subsistence economy) ওপর নির্ভরশীল। কাজের বিনিময়ে মিলত ফসল আর জমিতে চাষ করার অধিকার, এখনকার মতো টাকাপয়সা (monetary economy) নয়। তারা নিজেদের খাবার নিজেরাই ফলাত, আর দরকারি জিনিসপত্র কেনার জন্য টাকার ওপর ভরসা করতে হতো না।
তখনকার সমাজটা ছিল আবার একে অপরের সাহায্যে চলার (solidarity economy) সমাজ। মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিত, যেমন ধরুন বাচ্চাদের দেখাশোনা করা (care work), আবার পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠেও কাজ করত। এই যে কাজের ভাগাভাগি, এটা কিন্তু তাদের জন্য শৃঙ্খল না হয়ে মুক্তির পথ খুলে দিয়েছিল, কারণ এতে তারা নিজেদের কাজ আর নিজেদের শরীরের ওপর নিজেদের অধিকার (autonomy) পেয়েছিল। সেই সমাজে মেয়েদের বেশ একটা রাজনৈতিক গুরুত্বও ছিল। কিন্তু যখন টাকাপয়সার অর্থনীতি চালু হলো, তখন শুধু ছেলেরাই পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকারী হলো। আর তারপর থেকেই সমাজের অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক ময়দান থেকে মেয়েদের খাটুনিকে একটু একটু করে কোণঠাসা (marginalization) করে দেওয়া শুরু হলো।
ফেদেরিচির মতে, বেশিরভাগ ডাইনি শিকারের ঘটনা ঘটেছিল ১৫০০ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে, আর এর সবচেয়ে ভয়াবহ সময়টা ছিল ১৬২০ সালের আশেপাশে। এটা সেই সময়, যখন মার্কেন্টিলিজম (Mercantilism) বা বাণিজাবাদের ধ্যানধারণা ইউরোপের উঁচু মহলের লোকজনের মগজে ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটা জবরদস্ত অর্থনীতির জন্য চাই বিশাল এক কর্মীবাহিনী (labor force) – এই ছিল তাদের মূলমন্ত্র। ব্ল্যাক ডেথের পর লোকবলের যে আকাল দেখা দিয়েছিল, তাতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের (population control) ব্যাপারটা তাদের কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তাই শুরু হলো “জনসংখ্যার হিসেব রাখা, আদমশুমারি করা, আর জনসংখ্যাতত্ত্বকে প্রথম ‘রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান’ (state science) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা” (Federici, 2004: 182)। লোকবল বাড়ানোর একটা পাকাপোক্ত রাস্তা খুঁজে বের করা তখন শাসক শ্রেণি আর সদ্য গজিয়ে ওঠা পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী শ্রেণির (bourgeoisie) জন্য একটা বিরাট রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
লোকবল বাড়ানোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা ছিল সমাজের বাচ্চা পয়দা করার ক্ষমতার (reproduction of society) ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। এই চশমা দিয়ে দেখলে, মেয়েদের তখন গণ্য করা হতো স্রেফ বাচ্চা পয়দা করার যন্ত্র (wombs) হিসেবে, যারা কিনা বড় হয়ে সস্তা শ্রমিক হবে। এই নিয়ন্ত্রণটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্রগুলো তখন “নানা ধরনের প্রচারমাধ্যম” (multi-media propaganda) ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের গণ উন্মাদনা (mass psychosis) তৈরি করেছিল (Federici, 2004: 168)। এই প্রচারণার যন্ত্রে টমাস হব্স (Thomas Hobbes) আর জঁ বোঁদ্যার (Jean Bodin) মতো নামজাদা লোকেরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন আরও অনেক সরকারি আমলা, যারা দেশ-বিদেশ ঘুরে ডাইনিদের নামে কুৎসা রটাতেন। রাষ্ট্র আবার আগের শতকগুলোতে ধর্মীয় বিচারসভা বা ইনকুইজিশনের (Inquisition) তৈরি করা পুলিশি কায়দাকানুন আর যন্ত্রপাতিও ব্যবহার করেছিল। তারা খুব সফলভাবেই মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস ছড়িয়েছিল, যার ফলে ছোট ছোট সমাজগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।
তাদের প্রধান নিশানা ছিল গরিব ঘরের মেয়েরা, যাদের কাছে এমন কিছু জ্ঞান ছিল যা তাদের সমাজের টিকে থাকা আর নিজেদের মতো করে চলার জন্য খুব দরকারি ছিল। অসুখ সারানো (healing), জন্ম নিয়ন্ত্রণ (birth control) আর ধাত্রীবিদ্যা (midwifery) – এই সব জ্ঞান রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আর নতুন যান্ত্রিক ধ্যানধারণার (mechanical paradigm) একেবারে বিরুদ্ধে যেত। এই মেয়েদের অনেককেই ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, অন্যায় বিচারে তাদের দোষী বানানো হয়েছিল, আর তারপর নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল।
জনসংখ্যার এই প্রজনন ক্ষমতাকে কব্জা করার একটা উপায় ছিল ধাত্রীবিদ্যাকে (midwifery) রাষ্ট্রের কড়া নজরদারিতে নিয়ে আসা। অনেক ডাইনিই ছিলেন আসলে ধাত্রী বা “সবজান্তা মহিলা” (wise women), আর ষোড়শ-সপ্তদশ শতক পর্যন্ত ধাত্রীবিদ্যা আর প্রসূতিবিদ্যার (obstetrics) কাজটা ছিল একচেটিয়াভাবে মেয়েদের হাতেই। ষোড়শ শতকে ধাত্রী হওয়ার জন্য একটা নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হলো – মহিলাকে আগে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি একজন “খাটি ক্যাথলিক” (good Catholic) (Federici, 2004: 183)। সপ্তদশ শতকে প্রথম পুরুষ ধাত্রীদের আবির্ভাব ঘটল, আর “এক শতাব্দীর মধ্যেই ধাত্রীবিদ্যা প্রায় পুরোপুরি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল” (Federici, 2004: 183-184)।
এই ব্যাখ্যা যদি সত্যি হয়, তাহলে ইউরোপে এই যে ঢালাও ডাইনি বিচার, তার পেছনে ছিল আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, নিছক মেয়েদের প্রতি বিদ্বেষ, ধর্মীয় গোঁড়ামি বা অন্য কিছু নয়। তবে, এই ব্যাপক বিচারের এমন ব্যাখ্যাও কিন্তু শেষমেশ মেয়েদের ছোট করে দেখা আর তাদের ওপর খবরদারি করার সেই পুরনো মানসিকতারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।
তথ্যসূত্র
-
Mackay, C. S. (2009). The hammer of witches: A complete translation of the Malleus Maleficarum. Cambridge University Press.
-
Hutton, R. (2017). The witch: A history of fear, from ancient times to the present. Yale University Press. (pp. 147–211).
-
Bever, E. (2002). Witchcraft, female aggression, and power in the early modern community. Journal of Social History, 35(4), 955–988. doi:10.1353/jsh.2002.0042
-
A true and most dread full discourse of a woman possessed with the Deuill. (1886-01-30). Notes and Queries, s7-I(5), 100. doi:10.1093/nq/s7-i.5.100c
-
Burns, W. (2003). Witch hunts in Europe and America. Greenwood Publishing Inc. (pp. 10–11).
-
Burton, J. R. (2019). Witchcraft in the Middle Ages. Cornell University Press. (pp. 45–48). ISBN 978-1-5017-2031-4. OCLC 1127179159.
-
Karlsen, C. F. (1987). The devil in the shape of a woman: The witch in seventeenth-century New England. W. W. Norton & Company. (pp. 49–55). OCLC 320057946.
-
Purkiss, D. (2003-09-02). The Witch in History. Routledge. doi:10.4324/9780203359723. ISBN 9780203359723.
-
Ehrenreich, B., & English, D. (1973-10-02). Witches, Midwives, and Nurses. Monthly Review, 25(5), 25. doi:10.14452/mr-025-05-1973-09_2
-
Garrett, J. M. (2013). Witchcraft and Sexual Knowledge in Early Modern England. Journal for Early Modern Cultural Studies, 13(1), 32–72. doi:10.1353/jem.2013.0002
-
Hester, M. (1996). Patriarchal reconstruction and witch hunting. In S. Ankarloo & G. Henningsen (Eds.), Witchcraft in Early Modern Europe (pp. 288–306). Cambridge University Press. doi:10.1017/cbo9780511599538.012. ISBN 978-0-521-55224-0.
-
Behringer, W. (2004). Witches and witch-hunts: A global history. Wiley. ISBN 978-0-7456-2718-2. OCLC 779922479.
-
Thurston, R. (2013). The Witch Hunts: A History of the Witch Persecutions in Europe and North America. Routledge. ISBN 9781317865018.
-
Les trois livres de la semaine : la sélection du ” Monde des livres “. (2014, July 10). Le Monde.fr. Retrieved 2018-01-28, from http://www.lemonde.fr/livres/article/2014/07/10/les-trois-livres-de-la-semaine-la-selection-du-monde-des-livres_4454908_3260.html
-
Federici, S. (2017-06-30). Caliban And The Witch: Women, the Body and Primitive Accumulation. Autonomedia. ISBN 9781570270598.
-
Bhattacharya, T. (2017, October 17). “What is social reproduction theory?”. Retrieved from https://marxismocritico.com/2017/10/17/what-is-social-reproduction-theory/
-
Archived copy. (2023, December 3). Retrieved 2019-03-13, from https://web.archive.org/web/20231203164307/https://non.copyriot.com/maria-mies-silvia-federici-and-biopower/ (Original: https://non.copyriot.com/maria-mies-silvia-federici-and-biopower/)
-
Federici, S. (2004). Caliban and the Witch: Women, the Body and Primitive Accumulation. Autonomedia. (p. 16, 168, 182-184).
Leave a Reply