
(রবীন্দ্রনাথের দর্শন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক কাইজার হক এশিয়াটিক জার্নালে (Asiatic: IIUM Journal of English Language and Literature) একটা পেপার পাবলিশ করেছিলেন (Vol. 4 No. 1 (2010): June সংখ্যায়) “The Philosophy of Rabindranath Tagore” শিরোনামে। সেটাই অনুবাদ করলাম)
লেখক – কাইজার হক (Kaiser Haq)1
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
ভূমিকা
এই যে আমরা আজ আলোচনায় বসেছি, এর একটাই উদ্দেশ্য – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একজন চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে আরেকটু কাছ থেকে দেখা। তাঁর মাথায় কত রকমের ভাবনা কিলবিল করত! এই যেমন ধরুন, জগৎ আর জীবনের গভীর সব ব্যাপার (metaphysics) বা ঐ যে গুঢ় রহস্যময় জগৎ (mysticism), সেসব নিয়ে তাঁর ভাবনাগুলো কেমন ছিল। আবার অন্যদিকে, রাজনীতি (political theory) বা ধরুন নারী-পুরুষের সম্পর্ক (gender relations) – এসব একেবারে আটপৌরে ব্যাপার নিয়েও তিনি কী বলে গেছেন, সেটাও একটু ঘেঁটে দেখা। আমাদের এই আলোচনার শুরুটা হবে সেই বিখ্যাত ঘটনাটা দিয়ে – সত্য জিনিসটা আসলে কী (nature of truth), এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইনের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল। তারপর আমরা ডুব দেবো তাঁর ভাবনার আরেক জগতে, যাকে পণ্ডিতেরা বলেন অধিবিদ্যামূলক ভাববাদ (metaphysical idealism)। উইলিয়াম র্যাডিস (William Radice) বা তাঁর মতো যাঁরা রবি ঠাকুরের ভাবনাকে অন্যভাবে দেখেছেন, তাঁদের কথাও শুনবো, দেখবো তাঁদের যুক্তি কতটা টেকে। রবি ঠাকুরের মনের মরমী দিকটা, আর বাংলার বাউলদের (Bauls of Bengal) সাথে তাঁর যে একটা টান ছিল, সেটা বোঝার চেষ্টা করবো সুধীর কাকারের (Sudhir Kakar) মনোবিশ্লেষণ তত্ত্বের (psychoanalytic theories) আলোয়। তাঁর ঐ গভীর দার্শনিক চিন্তার (metaphysics) সাথে মেয়েদের অধিকার নিয়ে তাঁর যে ভাবনা (feminism), তার যোগসাজশটাও খুঁজে দেখবো। আর সব শেষে, জাতীয়তাবাদ (nationalism) নিয়ে রবি ঠাকুর যে খাঁটি কথাগুলো বলে গেছেন, সেগুলোকে আশীষ নন্দী (Ashis Nandy) আর নীটশে (Nietzsche) – এই দুই দিকপালের ভাবনার পাশে রেখে একটা তুলনামূলক চিত্র আঁকার চেষ্টা করা হবে।
মূল শব্দ
বাউল, ভাববাদ (idealism), নারীবাদ, মরমীবাদ (mysticism), জাতীয়তাবাদ, সত্য।
এই লেখার শিরোনামটা আমি এমন একজনের কাছ থেকে ধার করেছি, যাঁকে আধুনিক ভারতের সবচেয়ে নামকরা দার্শনিক বলা চলে। কেন ধার করলাম? কারণ, রবি ঠাকুরের চিন্তা নিয়ে আমার যে ধারণা, সেটা তাঁর চেয়ে অনেকটাই আলাদা। ঠাকুরের লেখালেখির বহর দেখলে তো মাথা ঘুরে যায়, এত বিশাল তাঁর কাজের পরিধি! ছোট্ট একটা লেখায় সেই সবটা তুলে আনা কি আর মুখের কথা? তাই প্রথমেই ঠিক করে নিচ্ছি, কোন কোন লেখার ওপর ভর করে আমাদের এই আলোচনাটা এগোবে। ঠাকুরকে তো প্রায়ই বলা হয়, তিনি যেন পূব আর পশ্চিমের সেরা জিনিসগুলোর এক চমৎকার মিলন ঘটিয়েছেন। শুধু ইংরেজিতে পাওয়া যায়, এমন বইগুলোর কথাই যদি ধরি, তাহলেও তাঁর পাঁচখানা বই – ‘সাধনা’ (Sadhana, or The Realization of Life, 1913), ‘পার্সোনালিটি’ (Personality, 1917), ‘ন্যাশনালিজম’ (Nationalism, 1917), ‘ক্রিয়েটিভ ইউনিটি’ (Creative Unity, 1922), আর ‘দ্য রিলিজিয়ন অফ ম্যান’ (The Religion of Man, 1930) – এর সাথে তাঁর আরও যে অজস্র বক্তৃতা আর প্রবন্ধ রয়েছে, সেগুলোই তাঁকে বিশ শতকের একজন প্রধান চিন্তাবিদ হিসেবে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তবে একটা মুশকিল আছে, বুঝলেন? রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গেলেই তাঁর ভাষাটা নিয়ে একটু হোঁচট খেতে হয়। ধরুন, তিনি যখন বলেন তাঁর ভেতরে নাকি “এক না-বলা ঐক্যের রহস্য” (some untold mystery of unity) খেলা করে, যা আবার “অসীমের মতোই সহজ” (has the simplicity of the infinite) (The English Writings, Vol. 2, p. 494), তখন বার্ট্রান্ড রাসেলের (Bertrand Russell) কড়া কথাটা কানে না বেজে পারে না। রাসেল সোজাসাপ্টা বলেছিলেন, “অসীম নিয়ে তাঁর যত কথা, সব ধোঁয়াটে, মানে হয় না ওসবের।” (His talk about the infinite is vague nonsense.) রাসেল এখানেই থামেননি, আরও বলেছিলেন, “যে ধরনের ভাষা শুনে অনেক ভারতীয় আহা-উহু করেন, সেগুলোর আদতে কোনো মানে খুঁজে পাওয়া ভার, বড়ই দুঃখের কথা!” (Dutta and Robinson, p. 96-তে যেমনটা বলা আছে)। (আজকাল অবশ্য এই ধমকটা খাওয়ার জন্য হোমি ভাবা (Homi Bhabha), গায়ত্রী স্পিভাক (Gayatri Spivak) বা ওই গোত্রের আরও কেউ কেউ দিব্যি লাইনে দাঁড়িয়ে যেতেন!) রাসেলের এই ঝাঁকুনিটা পাওয়ার পর ডক্টর এস. রাধাকৃষ্ণনের (Dr. S. Radhakrishnan) লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন’ (The Philosophy of Rabindranath Tagore) বইটা খোলার আগে আমার আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল, তাই না? বইটা খুলেছিলাম যদি কিছু পরিষ্কার ধারণা পাই এই আশায়। কিন্তু পেলাম কী? পেলাম এমন সব কথা – “মানুষ হলো এক সসীম-অসীম সত্তা” (Man is a finite-infinite being)। আর পেলাম এমন সব কবিত্ব মেশানো উচ্ছ্বাস – “রবীন্দ্রনাথ বলেন, প্রকৃতির বুকে, খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটালেই নাকি আধ্যাত্মিক উন্নতি তরতর করে এগিয়ে যায়। কারণ, ধার্মিক চোখে প্রকৃতিতে নাকি অসীমকে দেখা যায়, চুপচাপ, শান্ত হয়ে সে শুয়ে আছে!” (Radhakrishnan, 1961, p. 13)। এসব পড়লে কার না ইচ্ছে করে ঘর ছেড়ে সোজা দৌড় দিতে!
ঠাকুরের অন্য গুণমুগ্ধরা অবশ্য তাঁর চিন্তার ভারসাম্যের (balance) দিকটাতেই বেশি জোর দেন। যেমন ধরুন, ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফি’ (Encyclopaedia of Philosophy, Vol. 8) বলছে, তিনি নাকি মানবতাবাদীদের (humanists) সেরা ভাবনা আর পরকাল নিয়ে যাঁরা ভাবেন (otherworldly seekers), তাঁদের ভাবনা; প্রকৃতিবাদীদের (naturalists) ভাবনা আর যাঁরা আত্মাকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখেন (extreme partisans of spirit), তাঁদের ভাবনা; যাঁরা সবকিছুকেই নিয়তির হাতে ছেড়ে দেন (determinists) আর যাঁরা স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসী (defenders of free will), তাঁদের ভাবনা; যাঁরা ভোগে সুখ খোঁজেন (hedonists) আর যাঁরা কঠোর তপস্যা করেন (ascetics), তাঁদের ভাবনা; এবং রোমান্টিক (romantics) আর বাস্তববাদীদের (realists) (p. 75) সেরা দিকগুলো কেমন সুন্দর করে মিলিয়েছিলেন। তাঁরা ঠাকুরকে প্রাচ্যের ঋষি (Oriental sage) হিসেবে যে একটা ছাপ দেওয়া হয়েছে, সেটাকে তেমন পাত্তা দিতে চান না। অমর্ত্য সেন যেমনটা বলছেন, “কিছুটা হলেও, এই ঠাকুরকে তো পশ্চিমারাই তৈরি করেছিল। প্রাচ্য থেকে, বিশেষ করে ভারত থেকে, একটা বার্তা পাওয়ার যে পুরনো অভ্যেস তাদের ছিল, তারই অংশ এটা। হেগেলের (Hegel) ভাষায় যা কি না হাজার বছর ধরে ইউরোপীয়দের মনে গেঁথে ছিল” (Dutta and Robinson, p. xviii)। এই “কিছুটা হলেও” কথাটার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা বোধহয় নীরদ চৌধুরী দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, ঠাকুর নিজেই নিজেকে গুরু (guru-hood) সাজানোর মোহে পড়েছিলেন (Chaudhuri, 1987, p. 87)।
কিন্তু ঠাকুরের ঐ আধ্যাত্মিক কথাবার্তাগুলোকে যদি আমরা একেবারেই ঝেড়ে ফেলি, তাহলে কিন্তু একটা বড় ভুল হয়ে যাবে। কারণ, তিনি ওগুলোকে সত্যিই খুব গুরুত্ব দিতেন। ওগুলো তাঁর দর্শনের এমন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তাঁর বিশাল সাহিত্যকর্মের প্রতিটি লেখার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আর এই যে জীবনের মতো বেড়ে ওঠার (organic metaphor) ধারণা, এটাই তাঁর জগৎ দেখার মূল চাবিকাঠি, যেমনটা রোমান্টিক মনের মানুষদের হয়ে থাকে।
ঠাকুরের যে ভাববাদী দর্শন (idealist philosophy), সেটাই তাঁর “কবির ধর্ম” (poet’s religion)-কে রূপ দিয়েছে। এই ধর্ম কোনো ধরাবাঁধা নিয়মের বেড়াজালে বন্দি নয়, বরং নদীর স্রোতের মতো বহমান, যাকে বলে নেতিবাচক সক্ষমতা (negative capability) দিয়ে গড়া। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই তাঁর বিজ্ঞান সম্পর্কিত ভাবনার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে – যদিও তার ফল খুব একটা ভালো হয়নি। এর প্রমাণ মেলে আইনস্টাইনের (Einstein) সাথে তাঁর সেই বিখ্যাত কথোপকথনে, যা ‘দ্য ইংলিশ রাইটিংস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’-এর তৃতীয় খণ্ডে (The English Writings of Rabindranath Tagore, Vol. 3, pp. 911-16) ছাপা হয়েছে। সে এক অসাধারণ আলোচনা বটে! একজন ভাষ্যকার যেমন বলেছেন, তাঁরা যেন “সরাসরি দ্বিমত না করলেও, একে অপরের কথা না বুঝেই পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন” (they “talked past each other, when they did not openly disagree”) (Dutta and Robinson, p. 530)। আইনস্টাইন কথা বলেছেন খুব মেপে মেপে, যেন পরীক্ষা করে দেখছেন; আর ঠাকুর বেশ সাবলীলভাবে আইনস্টাইনকে মহাবিশ্বের রহস্য নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শোনাচ্ছেন। তাঁদের মতের অমিলটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে “সত্য কী?” (What is truth?) আর “বাস্তবতার আসল রূপটা কী?” (What is the status of reality?) – এই দুটো প্রশ্নে।
আইনস্টাইন: তাহলে সত্য, বা সৌন্দর্য, মানুষের ওপর নির্ভরশীল নয়?
ঠাকুর: না।
আইনস্টাইন: যদি পৃথিবীতে আর কোনো মানুষ না থাকত, তাহলে কি অ্যাপোলো অফ বেলভেদের (Apollo of Belvedere) মূর্তিটা আর সুন্দর থাকত না?
ঠাকুর: না।
আইনস্টাইন: সৌন্দর্যের এই ধারণার সাথে আমি একমত, কিন্তু সত্যের ব্যাপারে আমার দ্বিমত আছে।
ঠাকুর: কেন বলুন তো? সত্য তো মানুষের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।
অমর্ত্য সেন এই প্রসঙ্গে বলেছেন: “কেউ কেউ হয়তো ঠাকুরের এই অবস্থানকে বাস্তবতার প্রকৃতি নিয়ে হাল আমলের কিছু দার্শনিক কাজের সাথে মেলাতে চাইবেন, বিশেষ করে হিলারি পাটনামের (Hilary Putnam) যুক্তির সাথে, যেখানে বলা হয়েছে ‘সত্য নির্ভর করে ধারণাগত কাঠামোর (conceptual schemes) ওপর, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা ‘আসল সত্য’ (real truth)” (Dutta and Robinson, p. xxiii)।
এই কথাটা কিন্তু বেশ গোলমেলে। পাটনামের “ধারণাগত আপেক্ষিকতাবাদ” (conceptual relativism) একটা জিনিস, আর ঠাকুরের সত্যের ধারণা একেবারেই অন্য। ধারণাগত আপেক্ষিকতাবাদীরা খুব যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলেন যে, যেহেতু সত্য হলো কোনো বিবৃতির একটা গুণ, আর বিবৃতি নির্ভর করে ধারণাগত কাঠামোর ওপর, তাই আমরা কোনটাকে সত্য বলে মানব, সেটা ধারণাগত কাঠামোর সাথে পাল্টে যাবে। একটা সোজা উদাহরণ দিই, আমার শরীরের তাপমাত্রা এখন ৯৮.৬ – এই কথাটা সত্যি, যদি আমরা সেলসিয়াস স্কেল ব্যবহার করি। ঠাকুর কিন্তু এমনটা ভাবেননি। তাঁর কাছে, “সত্য হলো সেই পরম মন বা বিশ্বজনীন মনের (Universal Mind) নিখুঁত উপলব্ধি,” এবং “মানুষের যে অসীম ব্যক্তিত্ব (infinite personality of Man), সেটাই এই গোটা মহাবিশ্বকে ধারণ করে। এমন কিছুই থাকতে পারে না যা এই মানব ব্যক্তিত্বের বাইরে, আর এটাই প্রমাণ করে যে মহাবিশ্বের সত্য আসলে মানবিক সত্য (human truth)” (The English Writings, Vol. 3, p. 912)।
এখানেই শেষ নয়। জন সার্ল (John Searle) তাঁর ‘দ্য কনস্ট্রাকশন অফ সোশ্যাল রিয়ালিটি’ (The Construction of Social Reality) বইতে যেমন দেখিয়েছেন, ধারণাগত আপেক্ষিকতাবাদ কিন্তু “বাহ্যিক বাস্তবতাবাদ” (external realism)-এর সাথে দিব্যি খাপ খেয়ে যায়। অর্থাৎ, মানুষ বা অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব না থাকলেও একটা বাস্তব জগৎ থেকেই যায় – এই বিশ্বাস। কিন্তু ঠাকুর সে পথে হাঁটবেন না; তিনি এক্ষেত্রে বিশপ বার্কলের (Bishop Berkeley) সাথেই একমত:
আইনস্টাইন: …যদি এই বাড়িতে কেউ নাও থাকে, তবুও এই টেবিলটা এখানেই থাকবে।
ঠাকুর: হ্যাঁ, এটা ব্যক্তিগত মনের (individual mind) নাগালের বাইরে থাকবে, কিন্তু বিশ্বজনীন মনের (universal mind) বাইরে নয়। আমি যে টেবিলটা দেখছি, সেটা সেই একই রকম চেতনা (consciousness) দিয়েই অনুভব করা সম্ভব, যে চেতনা আমার নিজের আছে। (The English Writings, Vol. 3, p. 912)
আমি এই কথাবার্তার প্রসঙ্গটা আনলাম শুধু এটা বোঝানোর জন্য যে, ঠাকুর প্রায়শই আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের (common sense) সীমানা ছাড়িয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াতেন। তবে এই কথার পিঠে আর একটা কথাও জুড়ে দেওয়া দরকার: তিনি কিন্তু আবার দারুণ কাণ্ডজ্ঞানও দেখিয়েছেন, যখন তিনি ভারতে বর্ণপ্রথার (caste system) মতো একটা জঘন্য প্রথা টিকে থাকার জন্য ভূমিকম্পকে ঈশ্বরের শাস্তি বলে গান্ধীর (Gandhi) ব্যাখ্যাকে সপাটে নিন্দা করেছিলেন (Selected Letters, p. 434)।
এটা মানতেই হবে যে, ঠাকুরকে এমন একজন স্বজ্ঞা-নির্ভর চিন্তাবিদ (intuitive thinker) (শব্দ দুটোকে একসাথে জুড়ে দিয়ে আমি নিজেই একটা আপাতবিরোধী ব্যাপার তৈরি করলাম বটে!) হিসেবে দেখানোর জন্য অনেকে খুব খেটেখুটে চেষ্টা করেছেন, যিনি নাকি বিজ্ঞানের অনেক বিষয়েই তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এর একটা উদাহরণ হলো উইলিয়াম র্যাডিসের (William Radice) বক্তৃতা, “কণা ও স্ফুলিঙ্গ: ঠাকুর, আইনস্টাইন এবং বিজ্ঞানের কবিতা” (Particles and Sparks: Tagore, Einstein and the Poetry of Science), যেটা ‘দ্য ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার কোয়ার্টারলি’-তে (The India International Centre Quarterly) ছাপা হয়েছিল। এই ধরনের চেষ্টার দাম কতটা, তা নিয়ে অবশ্য একটু সন্দেহ থেকেই যায়, কারণ এতে যুক্তির চেয়ে উৎসাহের আতিশয্যই বেশি চোখে পড়ে। আসুন, ওপরে যে সংলাপের অংশটুকু তুলে ধরা হয়েছে, সেটা নিয়ে র্যাডিস কী বলছেন, একবার দেখে নেওয়া যাক। র্যাডিস জোর গলায় বলছেন, “ঠাকুর কোনো বার্কলের মতো ব্যক্তিবাচকতার (Berkeleyan subjectivism) পক্ষে সওয়াল করছিলেন না… ঠাকুর অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতায় (objective reality) বিশ্বাস করতেন, এবং সত্যকে বুঝতে হলে মানব মনের একটা ভূমিকা আছে বলেও মানতেন। তবে, এই মনটা কোনো খামখেয়ালি আর এলোমেলো চিন্তায় ভরা ব্যক্তিগত মন নয়, বরং ‘বিশ্বমানবের মন’ (the mind of the Universal Man)।” এরপর তিনি “বিশ্বমানব” কথাটাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – এটা নাকি “একটা গালভরা, অস্পষ্ট শব্দবন্ধ… যা আসলে সেই সম্মিলিত মানব বোধকে (collective human understanding) বোঝায়, যা মেনে নেয় যে ২ আর ২ মিলে ৪ হয়।” বিষয়টা আরও পরিষ্কার করার জন্য র্যাডিস নিজেই একটা পার্থক্য টেনেছেন: “তথ্য (facts) আর সত্যের (truth) মধ্যে। এটা একটা তথ্য যে আমার বাঁ হাতে দুটো আপেল আর ডান হাতে দুটো আপেল থাকলে, আমার কাছে মোট চারটে আপেল আছে। কিন্তু যদি আমি এটাকে একটা গাণিতিক সমীকরণ হিসেবে লিখি, ২+২=৪, তাহলে আমি একটা সাধারণ সত্যে পৌঁছানোর জন্য সম্মিলিত মানব বোধ ব্যবহার করছি। এই ভৌত জগতে (physical universe) কিন্তু ২ বা ৪ বলে আলাদা কিছু নেই” (Radice, 1998, p. 142)। ঠিক যেমন শেক্সপিয়ার বা ঠাকুরের লেখাগুলো, এক অর্থে, “নেই” হয়ে যাবে যদি পড়ার মতো কেউ না থাকে, “ঠাকুরের মতে, বিজ্ঞানের দ্বারা বর্ণিত ও সংজ্ঞায়িত সত্যগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে, যেগুলোর উপলব্ধির (realization) জন্য মন – অথবা সম্মিলিত মানব মন – দরকার” (Radice, 1998, p. 143)।
র্যাডিস এখানে পরিষ্কারভাবেই “বার্কলীয় ব্যক্তিবাচকতা” এবং ঠাকুর দুজনকেই ভুল বুঝেছেন। বার্কলে বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি, যেমনটা ঠাকুরও করেননি। আর মজার ব্যাপার হলো, তাঁদের দুজনেরই এই বিষয়ে প্রায় একই রকম ধারণা ছিল বলে মনে হয়, যদিও তাঁরা সম্পূর্ণ ভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বার্কলের দর্শনে আমরা একটা অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানতত্ত্ব (empiricist epistemology) দেখতে পাই, যা একটা ভাববাদী অধিবিদ্যার (idealist metaphysics) ভিত্তি তৈরি করে। এই ব্যাপারটাকেই খুব রসিকতার সাথে একটা চমৎকার লিমেরিক-সংলাপে তুলে ধরা হয়েছে (রাসেলের বই থেকে নেওয়া, পৃ. ৬২৩) (qtd. in Russell, 1965, p. 623):
এক তরুণ অবাক হয়ে ভাবে, ‘ঈশ্বর,
নিশ্চয়ই তোমার কাছে এটা বড্ড অদ্ভূত লাগে,
যখন তুমি দ্যাখো এই গাছটা দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে,
তখনও, যখন এই চত্বরে (Quad) কেউকোথাও নেই!’
উত্তর এলো:
প্রিয় বৎস, তোমার এই বিস্ময়টাই তো অদ্ভূত!
আমি যে সবসময় এই চত্বরেই থাকি,
আর তাই তো গাছটাও…
(যেমন ছিল তেমনই থাকবে,
কারণ তার ওপর নজর রাখছে
তোমার বিশ্বস্ত,
ঈশ্বর।)
(Will continue to be,
Since observed by
Yours faithfully,
God.)
ঠাকুরের দার্শনিক চিন্তাভাবনার ভিত্তি হলো ঔপনিষদিক ভাববাদ (Upanishadic idealism)। কিন্তু সেখান থেকে এক পা এগিয়ে তিনি বাইরের জগতের বাস্তবতাকে – যেমন উদাহরণের ঐ টেবিলটা – অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই স্বীকার করে নিয়েছেন। ঠাকুরের “ব্যক্তিগত মন” (individual mind) যেন বার্কলের ঐ “তরুণ”-এর মতো, আর তাঁর “বিশ্বজনীন মন” (Universal Mind) (অথবা, সংলাপে ঠাকুরের ব্যবহার করা অন্য শব্দগুলো বললে, “বিশ্বমানবের মন” বা “অতি-ব্যক্তিক মানুষ” – super-personal man) যেন বার্কলের ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আমি যখন আমার অফিসঘরে তালা দিয়ে বাড়ি ফিরে যাই, তখন কোন ধরনের “বিশ্বজনীন মন” বা “সম্মিলিত মানব উপলব্ধি” (র্যাডিসের ভাষায়) আমার আসবাবপত্রের ওপর নজর রাখে, সেটা কল্পনা করা সত্যিই কঠিন। র্যাডিসের তথ্য আর সত্যের মধ্যেকার পার্থক্যটাও কেমন যেন গোলমেলে মনে হয়। যদি দুটো ঝুড়িতে দুটো করে আপেল থাকে, তাহলে মোট চারটে আপেল আছে – ফলগুলো কেন মানুষের হাতে রাখা হচ্ছে না, সে বিষয়টা একটু পরেই পরিষ্কার হবে। এখন, যদি ঝুড়িগুলো এমন জায়গায় রাখা হয় যেখানে কেউ দেখার নেই, তাহলেও সেগুলো দেখা হবে, ঠাকুর হয়তো বলবেন, “বিশ্বজনীন মন” দ্বারা। অন্য কথায়, ঠাকুরের “বিশ্বজনীন মন” শুধু ২+২=৪ এর মতো সাধারণ সত্যগুলোকেই নয়, বরং অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্যগুলোকেও সমর্থন জোগায়। তাছাড়া, যখন আমি কারও হাতে থাকা ফলের হিসেব কষে ২+২=৪ লিখি, তখন এটা বলা অর্থহীন যে আমি “সম্মিলিত মানব উপলব্ধি” ব্যবহার করেছি; আমি আসলে আমার পাটিগণিতের সাধারণ জ্ঞানটাই কাজে লাগিয়েছি। আরও একটা কথা বলা দরকার, যদি এটা একটা তথ্য হয় যে স্বাভাবিক হাত-পা ওয়ালা কেউ প্রত্যেক হাতে দুটো করে আপেল ধরে আছে, তাহলে ঐ ব্যক্তির হাতে চারটে আপেল আছে, এই প্রস্তাব বা বাক্যটা “সত্য”। অন্তত, যুক্তিশাস্ত্রে (logic) সত্যের ধারণাটা তো এভাবেই কাজ করে।
নীরদ চৌধুরী (Nirad Chaudhuri) তাঁর ‘দাই হ্যান্ড, গ্রেট অ্যানার্ক’ (Thy Hand, Great Anarch) বইতে একটা মোক্ষম প্রশ্ন তুলেছেন – ঠাকুর কি আদৌ মরমী (mystic) ছিলেন? চৌধুরী তাঁর স্বভাবসুলভ তেজ আর পাণ্ডিত্য দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তাঁর মতে, যেহেতু খাঁটি মরমীবাদ চায় “সত্তার বিলোপ” (annihilation of self), আর যেহেতু “ঠাকুর ঠিক এর উল্টো, সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজের সত্তা (self) নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, যদিও ঈশ্বরের সেবক হিসেবে,” এবং “কখনোই মানুষ আর ঈশ্বরের মধ্যেকার দ্বৈততাকে (duality) মুছে ফেলতে পারেননি,” তাই তিনি “আসল মরমী” (true mystic) ছিলেন না। চৌধুরীর মতে, ঠাকুর ছিলেন একাধারে সর্বেশ্বরবাদী (pantheist) এবং ঈশ্বরবাদী (deist), যিনি জগতের সাথে “আরও নিবিড় সম্পর্কের” (a closer contiguity) মাধ্যমে আত্ম-উপলব্ধি (self-realisation) করতে চেয়েছিলেন। ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কের ধারণায় ঠাকুরের মধ্যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা (agape) আর তীব্র আকাঙ্ক্ষা (eros) মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, যে ঈশ্বর একইসাথে অতীন্দ্রিয় (transcendental) এবং ব্যক্তিগতভাবে পূজনীয় (personal deity) ছিলেন (Chaudhuri, 1987, p. 615)।
“আসল মরমীবাদ”-এর এই যে কড়া সংজ্ঞা, এটা কিন্তু অনেক আপাতবিরোধী ব্যাপার-স্যাপারকে জায়গা দিতে পারে না। চৌধুরী নিজেই আবার অন্য একটা প্রবন্ধে ঠাকুরকে মরমী আর মানবতাবাদীর (humanist) একটা মিশ্রণ হিসেবে দেখিয়েছেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন: “হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ইতিহাসে, বিশেষ করে কিছু লোকায়ত ধর্মাচরণে (folk cults), যা গত তিন-চারশো বছর ধরে ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়, সেখানে দেখা যায় যে অলৌকিক জীবনের (supramundane life) প্রতি গভীর বিশ্বাসের পাশাপাশি নশ্বর জীবনের (mortal existence) প্রতিও একটা শিশুসুলভ টান কাজ করে। এমনকি যে সংসারত্যাগী ফকিরেরা ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তাঁরাও জীবনের মূল্য নিয়ে গভীর আবেগ আর প্রত্যয়ের সাথে গান গেয়েছেন, আবার জীবনের এই ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়েও সমান মর্মস্পর্শী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মরমীবাদ আর মানবতাবাদের মিশ্রণে প্রায়শই এই লোকায়ত বিশ্বাসগুলোর স্পষ্ট অনুরণন শোনা যায়” (Chaudhuri, The East is East and the West is West, p. 10)।
ভারতের মরমীবাদের (Indian mysticism) যে ঐতিহ্য, তার নিরিখে ঠাকুরের মরমী অভিজ্ঞতাগুলোকে (mystical experiences) বিচার করাটা বেশ জরুরি। সুধীর কাকার (Sudhir Kakar) মনে করেন, ভারতীয়দের এই যে মরমী হওয়ার প্রবণতা, এর পেছনে বেশ জোরালো মনোবিশ্লেষণমূলক (psychoanalytic) কারণ আছে। তাঁর মতে, ভারতীয়দের অহংবোধ (egos) নাকি তেমনভাবে বিকশিত হয় না, আর “মায়ের সাথে সেই নিবিড় একাত্মতার সম্পর্ক হারানোর” (loss of a symbiotic relationship with the mother) যন্ত্রণাটা তাদের জন্য “প্রথম মাত্রার আত্মপ্রেমের আঘাত” (narcissistic injury of the first magnitude) হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে তাদের মধ্যে “আত্মপ্রেমের দুর্বলতা বেড়ে যায়” (heightened narcissistic vulnerability), যা মরমী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা “সারা জীবন ধরে কাউকে খুঁজে ফেরা, কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতা বা গুরুর” (the lifelong search for someone, a charismatic leader or guru) জন্ম দিতে পারে। “পরম” সত্যের (ultimate reality) যে ভারতীয় ধারণা (অর্থাৎ, ব্রহ্মাণ্ডের দিক থেকে ব্রহ্ম (Brahman) আর ব্যক্তিগত দিক থেকে আত্মা (atman)), তার শিকড় নাকি “হিন্দুদের শৈশবে” (Hindu infancy) প্রোথিত (Kakar, The Inner World, p. 128)। কাকার মরমীবাদকে “হিন্দুদের ধর্মচর্চার মূল ধারা” (the mainstream of Hindu religiosity) হিসেবে দেখেন। তাই, “একজন হিন্দু মরমী… সাধারণত তাঁর মতামত প্রকাশে বেশ স্বচ্ছন্দ হন এবং তাঁর কথাগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত গোঁড়ামির (officially-interpreted orthodoxy) বিরুদ্ধে যাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে তাঁকে বিশেষ ভাবতে হয় না” (Kakar, The Analyst and the Mystic, p. 3)।
ঠাকুরের বাবার এমন একটা মরমী অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যেখানে ধন-সম্পদের অসারতা নিয়ে হঠাৎ করে জেগে ওঠা সচেতনতার সাথে মিশে ছিল এক গভীর আনন্দের অনুভূতি। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে সে কথা লিখেও গেছেন। ঠাকুর নিজেও বলেছেন যে তাঁর ছোটবেলাটা কেটেছিল প্রকৃতির সাথে নিবিড় একাত্মতায় (communion with nature):
প্রায় প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই আমি বিছানা ছেড়ে দৌড়ে যেতাম বাগানের ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাম গাছের কাঁপা কাঁপা ডালের ফাঁক দিয়ে ভোরের প্রথম গোলাপি আভাটাকে বরণ করে নিতে। ঘাসের ডগায় ভোরের প্রথম কম্পন ছুঁয়ে যাওয়া শিশিরবিন্দুগুলো তখন চিকচিক করত। আকাশটা যেন আমার কাছে ব্যক্তিগত সখ্যের (personal companionship) ডাক নিয়ে আসত, আর আমার সারা হৃদয় – সত্যি বলতে কি, আমার পুরো শরীরটাই – সেই শান্ত, নীরব মুহূর্তগুলোর উপচে পড়া আলো আর শান্তি এক চুমুকে পান করে নিত…। আমি আমার নিজের সত্তার এক বৃহত্তর অর্থ খুঁজে পেতাম, যখন আমার আর আমার বাইরের জগতের মধ্যেকার দেয়ালটা মিলিয়ে যেত। (The English Writings, Vol. 2, p. 590)
এটাকে কাকার হয়তো বলবেন “‘অজানা কিছুর অনুভূতি’র (sense of Beyond) সাথে সংযোগের” এক “হালকা” মরমী অভিজ্ঞতা, যা অনেক “একেবারে স্বাভাবিক মানুষের” (completely normal people) হয়ে থাকে; একটা গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৫% আমেরিকানদের এমন অভিজ্ঞতা হয়। চূড়ান্ত মরমী অভিজ্ঞতাগুলো – আর পার্থক্যটা আসলে পরিমাণের – চেনা যায় “অবাস্তব দৃশ্য আর সমাধির” (visions and trances) মাধ্যমে, “ভেতরের জগতের প্রসারণ” (expansion of the inner world) দিয়ে, “মন আর শরীরের অনুভূতিগুলো তীব্র হয়ে ওঠা” (heightened intrapsychic and bodily sensations) দিয়ে, সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়া আনন্দ (all-absorbing joy) দিয়ে, আর জগৎটা যেন স্বচ্ছ (transparent) হয়ে গেছে এমন অনুভূতি দিয়ে (Kakar, The Analyst and the Mystic, p. 2)।
ঠাকুর আঠারো বছর বয়সে এমনই এক দিব্যদর্শনের (epiphany) কথা লিখে গেছেন (অনুবাদ করছি): “আমার জীবনে প্রথমবারের মতো ধর্মীয় অভিজ্ঞতার এক আচমকা বসন্তের বাতাস বয়ে গেল, আর আমার স্মৃতিতে রেখে গেল আধ্যাত্মিক সত্যের (spiritual reality) এক সরাসরি বার্তা। একদিন ভোরবেলা আমি যখন গাছের আড়াল থেকে সূর্যের প্রথম রশ্মি বেরিয়ে আসতে দেখছিলাম, হঠাৎ আমার মনে হলো যেন কোনো পুরোনো কুয়াশার পর্দা এক মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে সরে গেছে, আর পৃথিবীর মুখে ভোরের আলো এক অন্তর্গত আনন্দের জ্যোতি (inner radiance of joy) ছড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণের সেই অদৃশ্য চাদরটা আমার চারপাশের সব জিনিস আর সব মানুষ থেকে সরে গিয়েছিল, আর তাদের আসল তাৎপর্য (ultimate significance) আমার মনে আরও গভীর হয়ে উঠেছিল – আর এটাই তো সৌন্দর্যের মানে। এই অভিজ্ঞতায় যা সবচেয়ে মনে রাখার মতো ছিল, তা হলো এর মানবিক আবেদন, মানুষের অতি-ব্যক্তিক জগতে (super-personal world of man) আমার চেতনার হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া। আমার সেই বিস্ময়ের প্রথম দিনে আমি যে কবিতাটা লিখেছিলাম, তার নাম ছিল ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। ঝর্ণাটা, যার প্রাণশক্তি বরফের কারাগারে ঘুমিয়ে ছিল, সূর্যের স্পর্শে জেগে উঠে স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল, সাগরের সাথে অবিরাম আত্মত্যাগে, অবিরাম মিলনে সে তার সার্থকতা খুঁজে পেল। চারদিন পর সেই দিব্যদর্শন মিলিয়ে গেল।” (The English Writings, Vol. 3, p. 121)
এই অভিজ্ঞতার সাথে রামকৃষ্ণের (Ramakrishna) প্রথম মরমী দর্শনের (mystical vision) বিবরণটা মিলিয়ে দেখলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে (অনুবাদ করছি): “আমি ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পথ ধরে যাচ্ছিলাম। মুড়ি চিবোতে চিবোতে আকাশের দিকে তাকালাম। দেখলাম, একটা বিশাল কালো মেঘ হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছে, যতক্ষণ না সেটা পুরো আকাশটাকে ঢেকে ফেলল। হঠাৎ সেই মেঘের কিনার ঘেঁষে একঝাঁক ধবধবে সাদা বক আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। এই বৈপরীত্যটা এত সুন্দর ছিল যে আমার মনটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আমি জ্ঞান হারালাম আর মাটিতে পড়ে গেলাম। মুড়িগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। কেউ একজন আমাকে তুলে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেল। আনন্দ আর আবেগের এক তীব্র ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল…। এই প্রথমবার আমি সমাধিস্থ (ecstasy) হয়েছিলাম।” (কাকারের বই থেকে নেওয়া, The Analyst and the Mystic, পৃ. ১০) (Qtd. in Kakar, The Analyst and the Mystic, p. 10)
কাকার এটাকে বর্ণনা করেছেন “‘প্রকৃতি-কেন্দ্রিক’ মরমীবাদের (nature’ mysticism) একটা ঘটনা… যা আসলে নান্দনিকভাবে মনকে নাড়িয়ে দেওয়া একটা অনুভূতির (aesthetically transcendent feeling) ফল” (Kakar, The Analyst and the Mystic, p. 10)। ঠাকুরের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে, শুধু এর প্রভাবটা স্নায়ুতন্ত্রের ওপর অতটা জোরালো ছিল না, একটা কবিতার জন্ম দিয়েছিল, আর এর পরে এর চেয়ে তীব্র কিছু ঘটেনি। রামকৃষ্ণ, যেমনটা আমরা সবাই জানি, পরে একজন পুরোদস্তুর মরমী হয়ে উঠেছিলেন, যিনি যখন-তখন “সমাধি”-তে (Samadhi) চলে যেতে পারতেন।
ঠাকুর কিন্তু ভক্তিমূলক গোষ্ঠীগুলোর (devotional cults) বিপদ সম্পর্কে বেশ সজাগ ছিলেন। রামকৃষ্ণের গোষ্ঠী ছিল এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যা প্রকৃত আত্ম-উপলব্ধির (self-realisation) পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত। এই ব্যাপারটা তাঁর ‘চতুরঙ্গ’ (Chaturanga, 1915) (পেঙ্গুইন টেগোর অমনিবাস প্রথম খণ্ডে “Quartet” নামে পরিচিত) উপন্যাসে খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এটা দুই কলেজ বন্ধু, শ্রীবিলাস আর শচীশের বুদ্ধি, নীতি আর আধ্যাত্মিকতার বিবর্তনের এক টানটান, কাব্যিক গল্প। এখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে পশ্চিমের নাস্তিক্যবাদী মানবতাবাদ (Western atheistic humanism) আর গোঁড়া হিন্দুধর্মের (orthodox Hinduism) মধ্যে, মানবতাবাদ আর ভারতের ভক্তিমূলক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে, মরমীবাদ আর জীবনের টানের (demands of the life force) মধ্যে নাটকীয় সংঘাতের পথ পেরিয়ে ঠাকুরের দেখানো ভারসাম্যের অবস্থানে পৌঁছানো যায়।
ঠাকুর নিজে, তাঁর সেই মরমী অভিজ্ঞতার পর, তাঁর বাবার নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্ম সমাজের (Brahmo society) একটা অংশে ধর্মীয় পূর্ণতা (religious fulfilment) খুঁজেছিলেন। সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে তিনি খুব উৎসাহের সাথে কাজ শুরু করেন, দলের সভার জন্য গানও লেখেন। কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারেন যে, একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তাঁর সেই অভিজ্ঞতার মতো জাগরণকে জায়গা দিতে পারবে না। একটা প্রতিষ্ঠান, তিনি অভিযোগ করেন, “একটা কৃত্রিম গড়পড়তাকে তুলে ধরে, যার সত্যের মান একেবারে নীচের স্তরে স্থির থাকে, আর তার সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া যেকোনো সজীব বৃদ্ধিকে সে সন্দেহের চোখে দেখে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ধর্মে, এবং শিল্পকলাতেও, যা একটা দলের কাছে সাধারণ, তা আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়।” এমন একটা দলে আমরা যা পাই তা হলো “একে অপরের নকল করার সংক্রামক প্রবণতা” (a contagion of mutual imitation) (The English Writings, Vol. 3, p. 129)।
তিনি ব্রাহ্ম সমাজ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, যার পেছনে ছিল এক ধরনের জ্ঞান অন্বেষণের (Gnostic) তাগিদ। তিনি বাংলার বাউলদের “লোকধর্মের” (folk religion) প্রতি আকৃষ্ট হলেন। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নিম্নবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা বাউলরা সমাজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারা হয়তো ভ্রাম্যমাণ চারণকবির মতো জীবন কাটাত, ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে। তাদের গান, যা তাদের দর্শনের একমাত্র প্রকাশ, তার মধ্যে ঠাকুর খুঁজে পেলেন “এমন এক ধর্মীয় অভিব্যক্তি যা স্থূলভাবে মূর্তও নয়… আবার তার সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয়তায় অধিবিদ্যামূলকও নয়। একই সাথে তা ছিল এক আবেগপূর্ণ আন্তরিকতায় জীবন্ত। তা মানুষের হৃদয়ের গভীর আকুলতার কথা বলত সেই ঈশ্বরের জন্য, যিনি মন্দিরে বা শাস্ত্রে, মূর্তিতে বা প্রতীকে নন, বরং মানুষের মধ্যেই বিরাজমান” (The English Writings, Vol. 3, p. 129)।
ঠাকুর বাউলদের এই ধারাকে (cult of the Baul) জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, যদিও নিন্দুকেরা হয়তো একে অন্য চোখে দেখবেন। বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা একটি উদীয়মান জাতীয় চেতনার জীবন্ত শিকড় খুঁজছিলেন, তাঁরা বাউলদের মধ্যেই তা খুঁজে পেয়েছিলেন। পরে, ঠাকুর বাউলকে এক অত্যন্ত আদর্শায়িত রূপে চিত্রিত করতে শুরু করেন – জ্ঞানান্বেষী একাকী সাধক, কোনো আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন, নীল আকাশ আর সবুজ পৃথিবীর মাঝে, তালি দেওয়া বহির্বাস পরিহিত এক রোমান্টিক চরিত্র, লাউ আর বাঁশের চাঁচ দিয়ে তৈরি একতারা বাজিয়ে তাঁর আবেগময় সুর গাইছেন। জেন ওপেনশ (Jeanne Openshaw), সুধীর চক্রবর্তী বা শক্তি নাথ ঝা-এর মতো সমসাময়িক সমালোচকেরা, যাঁরা পুঁথিগত গবেষণার সাথে নৃতাত্ত্বিক ক্ষেত্র-গবেষণা (anthropological field-work) যুক্ত করেন, তাঁরা ঠাকুরের এই দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন। বাউলরা কোনো একাট্টা গোষ্ঠী নয়, বরং তারা হিন্দু ও বৌদ্ধ তান্ত্রিকতা (Tantricism), বৈষ্ণব ভক্তিবাদ (Vaishnavite devotionalism) এবং সুফিবাদ (Sufism) বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে নিয়েছে। আর তারা সবাই যে ভিক্ষাজীবী, তাও নয়। ঠাকুর তাদের বর্ণনা করেছেন এমন কিছুর অন্বেষী হিসেবে, যাকে তিনি অনুবাদ করেছেন “মনের মানুষ” (the Man of the Heart) বলে, এবং ব্যাখ্যা করেছেন ব্যক্তির মধ্যেকার ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ (divine spark) হিসেবে। আরও সঠিক অনুবাদ হতে পারত “হৃদয়ের মানুষ” (Person of the Heart)। এই শব্দটি প্রায়শই প্রেমিক বা প্রেমিকাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, এবং বাউলদের ক্ষেত্রে সেই সঙ্গীকে বোঝায় যার সাথে তান্ত্রিক কামাচার (Tantric erotic rites) পালন করা হয়।
আশ্চর্যজনক নয় যে, ঠাকুর, যিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি ভিক্টোরীয় যুগের (Victorian age) ধ্যানধারণায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিকভাবে গড়ে উঠেছিলেন, তিনি এই ধরনের আচারের কথা খোলাখুলি বলতে পারেননি। “এই বাউলদের একটা দর্শন আছে, যাকে তারা বলে দেহের দর্শন (philosophy of the body),” তিনি স্বীকার করেছেন, “কিন্তু তারা এর রহস্য গোপন রাখে; এটা কেবল দীক্ষিতদের (initiated) জন্যই” (The English Writings, Vol. 2, p. 527)। আসলে, অন্তত এর মূল বিষয়গুলো অনেক দিন ধরেই একটা প্রকাশ্য রহস্য। আমরা নির্দ্বিধায় ঠাকুরের এই নীরবতাকে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের (Sudhindranath Datta) ভাষায় তাঁর আজীবন “ভিক্টোরীয় সুরুচির” (Victorian decorum) প্রতি আনুগত্য (adherence) বলে ধরে নিতে পারি (Datta, p. 249)।
ঠাকুর বাউলদের এই চিত্রকে মহাযান বৌদ্ধধর্মের (Mahayana Buddhism) এমন এক ব্যাখ্যার সাথে যুক্ত করেছেন যা এটিকে ঔপনিষদিক ভাববাদ (Upanishadic idealism) থেকে আলাদা করতে দেয় না। অথচ, এটা তো সবারই জানা যে বুদ্ধ তাঁর শিক্ষা দিয়েছিলেন উপনিষদের অধিবিদ্যাকে (metaphysics) আপসহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে সবকিছুই অস্থায়ী (impermanent), এবং কোনো স্থায়ী আত্মা (বা আত্মান – atman) নেই। তাঁর শিষ্যরা যখন তাঁকে চারটি বেশ প্যাঁচালো প্রশ্ন করেছিলেন – যেমন, জগৎ কি শাশ্বত না নশ্বর, জগৎ সসীম না অসীম, মৃত্যুর পর কি কেউ থাকে, আত্মা কি দেহের সাথে এক না আলাদা – তিনি তখন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে নীরবতা পালন করেছিলেন, যে বিষয়ে বুদ্ধিমানের মতো কথা বলা যায় না, সে বিষয়ে চুপ থাকাই শ্রেয় এই নীতি মেনে।
যখন বৌদ্ধধর্ম নিজেই অধিবিদ্যার জালে জড়িয়ে পড়ল, তখন প্রথম শতাব্দীতে নাগার্জুন (Nagarjuna) নামে একজন এক আমূল তাত্ত্বিক সংস্কার আনলেন। তিনি শূন্যতার (emptiness or the void – sunya) ধারণা সামনে আনলেন। এটা আসলে সবকিছুর মধ্যেকার আপতিকতার (all-embracing contingency) একটা তত্ত্ব, যা বেশ অলঙ্কারিকভাবে, এমনকি কাব্যিকভাবেও প্রকাশ করা হয়েছে। এই তত্ত্ব বলে যে কোনো কিছুর মধ্যেই কোনো স্থায়ী সারবস্তু (substantiality) নেই। এটা উপলব্ধি করতে পারলেই মুক্তি, নির্বাণ (nirvana) লাভ করা যায়। তাই নাগার্জুনের সেই চমকে দেওয়া উক্তি: “সংসারের যা সীমা, নির্বাণেরও তাই সীমা।” (The limits of samsara are the limits of nirvana.) ক্রিস গুডমানসেন (Chris Gudmunsen) তাঁর ‘ভিটগেনস্টাইন অ্যান্ড বুদ্ধিজম’ (Wittgenstein and Buddhism) নামের ছোট্ট কিন্তু গভীর বইটাতে এই দুজনের মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পেয়েছেন। তবে শূন্যতাকে বোঝার জন্য আমার সবচেয়ে পছন্দের লেখা হলো এমিল সিওরান (Emile Cioran) এর একটা প্রবন্ধ, যিনি আমাদের আধুনিক গুরুদের মধ্যে সবচেয়ে কম পরিচিত।
“আমি রূপক অর্থে একজন ‘সত্তা’,” সিওরান তাঁর ‘দ্য নিউ গডস’ (The New Gods) বইয়ের “দ্য আনডেলিভারড” (The Undelivered) প্রবন্ধে বলছেন, “আমরা এতটাই অস্থায়ী যে তা উপহাসের যোগ্য” (Cioran, 1969, p. 69)। তিনি এরপর নাগার্জুনের এই পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন: “শূন্যতা আমাদের সত্তার ধারণাকে ক্ষয় করতে সাহায্য করে; কিন্তু এই ক্ষয় প্রক্রিয়ায় শূন্যতা নিজে জড়িয়ে পড়ে না… শূন্যতা কোনো ধারণা নয়, বরং এমন কিছু যা আমাদের যেকোনো ধারণা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে…। শূন্যতা – অর্থাৎ আমি নিজে, আমিকে বাদ দিয়ে – হলো ‘আমি’-এর অভিযানের অবসান – এটা হলো সত্তার কোনো চিহ্ন ছাড়াই সত্তা। (বিপদটা হলো শূন্যতাকে সত্তার বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানো, এবং এর মাধ্যমে তার আসল কাজ, যা হলো আসক্তির প্রক্রিয়াকে বাধা দেওয়া, সেটাকে ব্যর্থ করে দেওয়া…)” (Cioran, 1969, p. 71)।
উপনিষদের চিন্তাবিদেরা এবং ঠাকুর একদিকে, আর অন্যদিকে বুদ্ধ, নাগার্জুন এবং সিওরান – এঁরা সবাই আমাদের একসময়ের কেন্দ্রীয় সমস্যা বলে যা মনে করা হতো, তার প্রতি সাড়া দিয়েছেন। সেই সমস্যাটা হলো আমাদের অস্তিত্বের দীনতা (ontological indigence) – আমরা সত্তার স্বপ্ন দেখি, অথচ নিয়তির বিধানে আমরা কেবলই হয়ে ওঠার (Becoming) প্রক্রিয়ায় বাঁধা। প্রথম দলের চিন্তাবিদেরা (তাঁদের মতো লোকেরা একসময় প্রচণ্ডভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন) এই সমস্যাটাকেই অস্বীকার করেন। তাঁরা বলেন, আমরা যদি শুধু চোখ মেলে তাকাই, তাহলেই মহাবিশ্বে এবং আমাদের নিজেদের ভেতরে সত্তার অফুরন্ত ভাণ্ডার দেখতে পাব। দ্বিতীয় দলটি, যাঁরা সবসময়ই সংখ্যালঘু, কিন্তু সবসময়ই সময়ের চেয়ে এগিয়ে, এমনকি উত্তর-আধুনিক (postmodern)ও বটে, তাঁরা প্রথম পথটাকে অচল বলে মনে করেন। সিওরানের ভাষায়, “যেহেতু এটা আমাদের স্থায়িত্বের একটা ভ্রম দেয়, যেহেতু এটা এমন প্রতিশ্রুতি দেয় যা এটা পূরণ করতে পারে না, তাই পরম বা চূড়ান্তের (absolute) ধারণাটাই সন্দেহজনক, এমনকি ক্ষতিকরও বটে” (Cioran, 1969, p. 75)।
যদি এর মানে দাঁড়ায় যে আমাদের ঠাকুরের অধিবিদ্যাকে (metaphysics) আগাগোড়া ঢেলে সাজাতে হবে, তাহলে কাকার (Kakar) কিন্তু আমাদের সেই পরামর্শই দিয়েছেন তাঁর মনোবিশ্লেষণমূলক (psychoanalytic) দৃষ্টিকোণ থেকে। কারণ তিনি মনে করেন, ভারতীয় মনস্তত্ত্ব (Indian psyche) তখনই পরিণত হতে পারবে, যদি আমরা “‘পরম’ বাস্তবতার উপযোগিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করি, হিন্দু শৈশবে এর উৎস সম্পর্কে সচেতন হই, এবং এর অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রকাশকে একটি প্রাচীন ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক অতীতের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি” (Kakar, The Inner World, p. 187)।
কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ঠাকুরকে যতই কাটছাঁট করতে চাই না কেন, তাঁর চিন্তাভাবনার যে অখণ্ডতা (integrity), তাকে আমাদের সম্মান করতেই হবে, তারিফ করতেই হবে। তাঁর চিন্তার যে দিকগুলো পরকালমুখী (otherworldly), সেগুলোও কিন্তু যা কিছু একেবারেই এই পৃথিবীর (this-worldly), তার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যেমন ধরুন, জাতীয়তাবাদ (Nationalism) নিয়ে তাঁর বক্তৃতাগুলো। সেখানে তাঁর যুক্তিগুলো যেমন স্বচ্ছ, তেমনি, ই.পি. থম্পসন (E.P. Thompson) যেমন উচ্ছ্বাসের সাথে বলেছেন, “সেকেলে হওয়া তো দূরের কথা, ঠাকুরের অ-রাজনীতির (anti-politics) প্রতি অঙ্গীকার এবং নাগরিক সমাজের (civil society) প্রতি তাঁর যে উদ্বেগ, তা তাঁকে মাঝে মাঝে একজন উল্লেখযোগ্যভাবে আধুনিক – অথবা সম্ভবত উত্তর-আধুনিক (post-modern)? – চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিভাত করে।” আমরা যদি তাঁর ভাববাদী অধিবিদ্যার যৌক্তিক প্রয়োগের দিকে ঠিকমতো নজর না দিই, তাহলে কিন্তু একটা জরুরি জিনিস আমাদের চোখ এড়িয়ে যাবে। ঠাকুর একটা জাতিকে (nation) সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে – “একটা জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মিলন… সেই রূপে, যা একটা গোটা জনসমষ্টি কোনো যান্ত্রিক উদ্দেশ্যে (mechanical purpose) সংগঠিত হলে ধারণ করে” (Tagore, Nationalism, p. 15)। ই. পি. থম্পসন খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন “সংগঠিত” (organized) আর “যান্ত্রিক” (mechanical) শব্দ দুটোর ওপর স্বাভাবিকভাবেই যে জোর পড়ে, সেদিকে। মনে করে দেখুন, ফুকো (Foucault) ঘোষণা করেছিলেন, “ক্ষমতা সর্বত্র,” “সবকিছুতেই পরিব্যাপ্ত।” এই ক্ষমতাই সেইসব কলকব্জা, সংগঠন, কাঠামোর পেছনে কাজ করে, যা মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করে দেয়। ঠাকুরের কাছে, “আত্মা সর্বত্র।” এই আত্মা মানুষে মানুষে, মানুষে আর মহাবিশ্বে সেতুবন্ধন করে; এটা “সমস্ত সামাজিক সম্পর্ককে [যা] যান্ত্রিক ও নৈর্ব্যক্তিক নয়” প্রাণবন্ত করে তোলে (Tagore, Nationalism, p. 15)। ফুকোর সেই ক্ষমতা, যা সমস্ত “আধুনিক” আর্থ-সামাজিক সংগঠনকে চালিত করে, তার অধীনেই সমস্ত বাস্তবতা নিমজ্জিত – এই বিশ্বাসে বেঁচে থাকা মানে, ঠাকুর হয়তো বলতেন, অজ্ঞতায় বেঁচে থাকা; আর আত্মা যে মহাবিশ্বকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে – এটা উপলব্ধি করা মানে আরও প্রাণবন্ত সম্পর্কে প্রবেশ করতে পারা।
একইভাবে, ঠাকুরের আপাতদৃষ্টিতে দুর্বোধ্য দর্শন তাঁর সুপরিচিত “নারীবাদ” (feminism)-এর ভিত্তি রচনা করেছে। ঠাকুর বিবর্তনকে (evolution) দেখেন পরিমার্জনের (refinement) একটা প্রক্রিয়া হিসেবে, জড় থেকে পশুর মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিকতার (spiritual) দিকে এগিয়ে যাওয়া – এই ভাবনার পেছনে বার্গসোঁর (Bergson) কিছু প্রভাব আছে – এবং তিনি মনে করেন, ঠিক যেমন হোমো সেপিয়েন্স (homo sapiens) আরও বড় আর শারীরিকভাবে শক্তিশালী প্রজাতিদের ছাড়িয়ে গেছে, তেমনই এই প্রজাতির মধ্যেও একই ধরনের একটা পালাবদল ঘটবে, যেখানে নারীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে যাবে। যেহেতু ক্ষমতা – ফুকোর সেই ক্ষমতা – এতদিন ধরে মূলত পুরুষদের হাতেই ছিল, তাই তিনি তাদেরকেই দোষারোপ করেন “বিশাল আর দানবীয় সব সংগঠন” – যেমন এই জাতি, যার সংজ্ঞা তিনি দিয়েছেন – গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু এখন, “নারীরা তাদের সতেজ মন আর তাদের সমস্ত সহানুভূতি (sympathy) নিয়ে এই নতুন আধ্যাত্মিক সভ্যতার (spiritual civilization) কাজে এগিয়ে আসতে পারে।” এটা আদৌ ঘটবে কি ঘটবে না, সে কথা আলাদা। তবে তাঁর এই সাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী, যে নারীরা “তাদের জায়গা করে নেবে, আর সেইসব বড় বড় প্রাণীদের [অর্থাৎ পুরুষদের] পথ ছাড়তে হবে” (The English Writings, Vol. 2, p. 416), সেটার কথা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল একটা বিবিসি টিভি ডকুমেন্টারি দেখে। সেখানে একটা ব্রিটিশ স্কুলে একই রকম সাধারণ বুদ্ধিমত্তার ছেলে আর মেয়েদের কর্মজীবনের তুলনা করা হয়েছিল। ছেলেরা ধীরে ধীরে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল, আধা-দক্ষ সব পেশার (semi-skilled occupations) দিকে ঝুঁকেছিল আর একটা আধা-বোকার মতো হাবভাব (semi-moronic demeanour) রপ্ত করতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে, তাদের বয়সী মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করেছিল, বিশ্ববিদ্যালয় বা পেশাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছিল এবং বেশ লাভজনক পেশায় ঢুকেছিল। এখানে অবশ্য মেয়েদের সাফল্যটা ফুকোর ক্ষমতার জগতে, আত্মার জগতে নয়।
জাতীয়তাবাদ নিয়ে ঠাকুরের যে সমালোচনা, তা নীটশে (Nietzsche) আর রাসেলের (Russell) মতো আধুনিক যুগের দিকপাল চিন্তাবিদদের নিয়ে গঠিত এক বিশ্বজনীন ঐতিহ্যে সম্মানের আসন পাওয়ার যোগ্য। সত্যি বলতে কি, নীটশের সাথে তুলনা করলে ঠাকুরের কৃতিত্ব আরও বেড়ে যায়। নীটশে যে জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তা তাঁর “ভালো ইউরোপীয়” (good European)-এর ধারণার সাথে যুক্ত। এই ধারণা আমরা তাঁর প্রথম দিকের সেরা কাজগুলোতে পাই – যেমন ‘হিউম্যান, অল টু হিউম্যান’ (Human, All Too Human, 1878), ‘দ্য গে সায়েন্স’ (The Gay Science, 1882), ‘দ্য ওয়ান্ডারার অ্যান্ড হিজ শ্যাডো’ (The Wanderer and His Shadow, যা Human, All Too Human-এর ১৮৮৬ সালের পরিবর্ধিত সংস্করণের দ্বিতীয় খণ্ড), ‘বিয়ন্ড গুড অ্যান্ড ইভিল’ (Beyond Good and Evil, 1886) এবং ‘একি হোমো’ (Ecce Homo, 1888) – তাঁর সেই মর্মান্তিক মানসিক বিপর্যয়ের আগে লেখা শেষ বইগুলোর মধ্যে একটি। ভালো ইউরোপীয় হলেন তিনি, যিনি আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের (nation-state) আত্মাকে সংকীর্ণ করে দেওয়া আনুগত্যের দাবিকে অতিক্রম করেছেন এবং ইউরোপ নামক বৃহত্তর সভ্যতাগত সত্তার (civilisational entity) মূল্যকে স্বীকার করেন।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ‘হিউম্যান, অল টু হিউম্যান’ বইটির উপশিরোনাম হলো “মুক্তমনাদের জন্য একটি বই” (A Book For Free Spirits)। এই বইয়ের “ইউরোপীয় মানুষ এবং জাতিসমূহের বিলোপ” (European Man and the Abolition of Nations) নামের একটি অংশে কল্পনা করা হয়েছে যে, “কিছু রাজবংশ এবং কিছু ব্যবসায়ী ও সামাজিক শ্রেণীর” কায়েমি স্বার্থের দ্বারা “জাতিতে জাতিতে শত্রুতা সৃষ্টির” (production of national hostilities) অবসান ঘটবে। একবার “এই কৃত্রিম জাতীয়তাবাদ” (this artificial nationalism) ভেঙে ফেলা হলে, “নিজেকে সহজভাবে একজন ভালো ইউরোপীয় হিসেবে ঘোষণা করতে এবং জাতিসমূহের একত্রীকরণের (amalgamation of nations) জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে ভয় পাওয়া উচিত নয়” (Nietzsche, 1986, pp. 174-75)।
নীটশেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) এবং তার কল্যাণ অর্থনীতির (welfare economy) একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ, তিনি ‘দ্য ওয়ান্ডারার অ্যান্ড হিজ শ্যাডো’-তে স্পষ্টভাবে একটি “ইউরোপীয় জাতিসমূহের সংঘ” (European League of Nations) গড়ে ওঠার কথা বলেছেন, যেখানে প্রতিটি স্বতন্ত্র জাতি… একটি সৃষ্টির মর্যাদা ও অধিকার লাভ করবে।” এর সাথে থাকবে এমন এক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, যা “শ্রমিকের শোষণ” (exploitation of the worker) বর্জন করবে এবং “শ্রমিকের মঙ্গল, তার শরীর ও আত্মার তৃপ্তি” (wellbeing of the worker, his contentment of body and soul) নিশ্চিত করার কথা ভাববে (Nietzsche, 1986, p. 382)।
আমি নিশ্চিত, আমাদের মধ্যে অনেকেই নীটশের এই সভ্যতার নীলনকশাটিকে বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক বলে মনে করবেন। কিন্তু নীটশের এই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে একটা গুরুতর কিন্তু (caveat) আছে বলে আমার বিশ্বাস। ‘দ্য ওয়ান্ডারার অ্যান্ড হিজ শ্যাডো’-তে নীটশে তাঁর পাঠকদের আরও উৎসাহিত করেছেন “সেই এখনও বহু দূরের অবস্থার জন্য পথ তৈরি করতে, যখন ভালো ইউরোপীয়রা তাদের মহান দায়িত্ব: পৃথিবীর সমগ্র সংস্কৃতির (total culture of the earth) নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানের (direction and the supervision) অধিকারী হবে।” যে কেউ নীটশের এই প্রকল্পের বিরোধিতা করবে, সে “জনগণকে আরও বেশি করে জাতীয়তাবাদী হওয়ার পথ দেখাচ্ছে। সে এই শতাব্দীর অসুস্থতা বাড়িয়ে তুলছে এবং সে সমস্ত ভালো ইউরোপীয়র শত্রু, সমস্ত মুক্তমনার শত্রু” (Nietzsche, 1986, p. 332)। এটুকু শুনলেই আমাদের থমকে দাঁড়াতে হয়। নীটশের নতুন ইউরোপ একটা অতি-রাষ্ট্র (super-state) হয়ে উঠছে, যা বাকি বিশ্বের ওপর তার আধিপত্য (hegemony) চাপিয়ে দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী জাতি-রাষ্ট্রের জায়গায় আসছে এক নব্য-সাম্রাজ্যবাদী মহাদেশীয় রাষ্ট্র (neo-imperialist continental state)।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে নীটশের স্বপ্নের এই পরিণতি দেখে আমরা আঁতকে উঠব। পশ্চিমা জাতি-রাষ্ট্রের মূল্যবোধকে যখন নবজাত ভারতীয় ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনের (Indian anti-colonial movement) একটা বড় অংশ তাদের ধর্ম (dharma) হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে, তার কিছুদিন পরেই মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজের মাধ্যমে এই রাজনৈতিক দর্শনের একটা সমালোচনাও উঠে এসেছিল। সেই সমালোচনাকে আমাদের সময়ে আরও বিশদভাবে এবং সমৃদ্ধ করে তুলেছেন আশীষ নন্দী (Ashis Nandy)। তাঁর বই ‘দ্য ইললিজিটিমেসি অফ ন্যাশনালিজম: রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড দ্য পলিটিক্স অফ দ্য সেলফ’ (The Illegitimacy of Nationalism: Rabindranath Tagore and the Politics of the Self) এই আলোচনার এই পর্যায়ে বেশ কাজে আসবে।
নন্দী দেখিয়েছেন যে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই জাতীয়তাবাদের মূল্য এবং “একসংস্কৃতির জাতি-রাষ্ট্র” (a monocultural nation-state) নিয়ে সন্দেহ ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অংশের মধ্যে দানা বেঁধেছিল। তবে, জাতীয়তাবাদের এই সমালোচকেরা কিন্তু তাঁদের মতামতের দিক থেকে একাট্টা ছিলেন না। তাঁদের বেশিরভাগই জাতীয়তাবাদকে “একটি প্রাক-আধুনিক ধারণা (pre-modern concept) হিসেবে দেখতেন, যা বিশ্ব পুঁজিবাদের (global capitalism) একটি রোগগ্রস্ত উপজাত (pathological by-product) হিসেবে নতুন করে গজিয়ে উঠেছিল। মানবজাতি একবার এই অবশিষ্ট মধ্যযুগীয়তার (vestigial medievalism) আকর্ষণীয় মোহ কাটিয়ে উঠে স্বাধীনতার আলোকায়নের (Enlightenment) ধারণাটি গ্রহণ করলেই, তাঁরা আশা করেছিলেন যে জাতিসমূহের এই আত্ম-প্রকাশের ধরনটি এমনিতেই মিলিয়ে যাবে। এর জায়গায় তাঁরা আশা করেছিলেন একটি নতুন, আলোকিত, ধর্মনিরপেক্ষ সার্বজনীনতা (secular universalism) ভবিষ্যতের এক বিশ্বের (One World) সাংস্কৃতিক ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠবে, যা সমস্ত জাতিগত ও আঞ্চলিক আনুগত্য (ethnic and territorial loyalties) থেকে মুক্ত হবে” (Nandy, 1998, p. vi)। নীটশের সেই ভালো ইউরোপীয় মানুষটি এই জাতি-রাষ্ট্রের বিরোধীদের দলেই পড়েন।
কিন্তু আরও কিছু লোক ছিলেন: “ভারতীয়দের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ” যাঁরা “বিরোধীদের মধ্যেও বিরোধী… হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা জাতীয়তাবাদকে পশ্চিমা জাতি-রাষ্ট্র ব্যবস্থার এবং পশ্চিমা বিশ্বদৃষ্টির ফলে ছড়িয়ে পড়া সমজাতীয়করণের (homogenization) শক্তির একটি উপজাত হিসেবে দেখতেন। তাঁদের কাছে, একটি সমজাতীয় সার্বজনীনতা, যা নিজেই ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ফলে সৃষ্ট শিকড়হীনতা এবং সংস্কৃতিহীনতার (uprootedness and deculturation) ফল, তা জাতীয়তাবাদের কোনো বিকল্প হতে পারত না। তাঁদের বিকল্প ছিল সার্বজনীনতার একটি স্বতন্ত্র সভ্যতাগত ধারণা, যা একটি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, বহুত্ববাদী সমাজে (plural society) বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জীবনধারায় অন্তর্নিহিত সহনশীলতার (tolerance) মধ্যে প্রোথিত ছিল” (Nandy, 1998, pp. vi-vii)। ঠাকুর ছিলেন এমনই এক বিরল গোত্রের বিরোধী।
ঠাকুর আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের যে রূপ, তার বিরোধিতা করেছেন। ই.পি. থম্পসন যাকে বর্ণনা করেছেন “যান্ত্রিক বা নৈর্ব্যক্তিক নয় এমন সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক” (all social relations that were not mechanical or impersonal) বলে, ঠাকুর সেগুলোর কথাই বলেছেন। তিনি বেশ কিছু দ্বৈত বিপরীতের (binary opposites) ধারণা তৈরি করেছেন, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে তিনি সামনে-পেছনে আসা-যাওয়া করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত একটা আপসের (reconciliation) পথ দেখিয়েছেন। থম্পসন এই বিপরীতগুলোকে এভাবে তালিকাভুক্ত করেছেন: “আধ্যাত্মিক ও বস্তুবাদী (spiritual and materialist), প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য (East and West), জাতি ও অ-জাতি (Nation and no-nation), পুরুষালী ও মেয়েলি (masculine and feminine), বিমূর্ত ও ব্যক্তিগত (abstract and personal)” (Tagore, Nationalism, p. 15)। কিন্তু বিভিন্ন সভ্যতা যে এই বিপরীতগুলো অনুযায়ী সরলরৈখিকভাবে সারিবদ্ধ নয়, এই বিষয়টা নন্দীর লেখাতেও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যেমন তাঁর ‘দ্য ইন্টিমেট এনিমি’ (The Intimate Enemy) বইতে। “এইজন্য,” থম্পসন বলছেন, “পশ্চিমেরও একটা বিরাট আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য (spiritual inheritance) আছে, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের একে অপরের পরিপূরক হওয়া উচিত, ঠিক সেভাবেই নারী ও পুরুষ, যুক্তি ও আত্মা (অথবা বিজ্ঞান ও কবিতা) একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা না করে বরং সামঞ্জস্যপূর্ণ (harmonize) হওয়া উচিত” (Tagore, Nationalism, p. 15)। আমরা যখন এই উপমহাদেশে এবং বৃহত্তর বিশ্বে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ থেকে জন্ম নেওয়া সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি, তখন ঠাকুরের এই সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনা আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নে (EU) যে সমাধান মূর্ত হয়েছে, তার মতোই, অথবা তার চেয়েও ভালো, একটা সমাধান খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে পারে।
যেহেতু জাতীয়তাবাদ নিয়ে ঠাকুরের এই সমালোচনা – যা সম্ভবত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গভীর এবং মানবিক – তাঁর অধিবিদ্যা (metaphysics) থেকেই এসেছে, তাই এই প্রবন্ধের শুরুতে আমি যে বেশ একটা উদ্ধত সমালোচনা করেছিলাম, তার অন্তত কিছুটা হলেও সংশোধন করে শেষ করাটাই সমীচীন হবে। প্রথমত, আইনস্টাইনের সাথে সংলাপে ঠাকুর যে আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মতামতগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলোকেই ধরা যাক। তিনি যে প্রতিটি কথা বলেছিলেন, তার কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে, সেই বিচার না করে, আমি বরং একটা সামগ্রিক মূল্যায়নের (holistic appraisal) প্রস্তাব করছি। তাহলে আমরা বৈজ্ঞানিক সত্যের সমস্ত আবিষ্কারে মানুষের যে ভূমিকা, তার ওপর ঠাকুরের এই জোর দেওয়াটাকে যান্ত্রিক যুক্তির (instrumental rationality) একতরফা বিজয়ের বিরুদ্ধে একটা রক্ষাকবচ (safeguard) হিসেবে দেখতে পারব। দ্বিতীয়ত, ঠাকুরের ভাষাভঙ্গি নিয়ে রাসেলের সেই তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যের পেছনের ঘটনাটা একটু খুঁটিয়ে দেখলে একটা জরুরি মনস্তাত্ত্বিক দিক (psychological dimension) চোখে পড়ে। ১৯১২ সালের অক্টোবরে রাসেল ‘হিবার্ট জার্নাল’-এ (Hibbert Journal) “ধর্মের সারমর্ম” (The Essence of Religion) নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, “ধর্মের আসল কথাটা হলো… আমাদের জীবনের সসীম অংশটাকে অসীম অংশের (infinite part) অধীন করে দেওয়া” (যেমনটা দত্ত ও রবিনসনের বইতে, পৃ. ৯৫-তে বলা আছে) (qtd. in Datta and Robinson, 1997, p. 95)। ঠাকুর সেটা পড়ে রাসেলকে চিঠি লেখেন, এবং উপনিষদের (Upanishads) ভাবনার সাথে এর মিলের কথা বলেন, যে ভাবনা ঠাকুরেরও ছিল। কিন্তু রাসেল খুব তাড়াতাড়িই বৈজ্ঞানিক কঠোরতা (scientific exactitude) থেকে এই সরে আসার জন্য অনুতপ্ত হন এবং প্রবন্ধটা আর কখনও ছাপাননি। এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি সেই তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যগুলো করেছিলেন, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। যেকোনো আনাড়ি মনোবিশ্লেষকও (pop psychoanalyst) আপনাকে বলবে, রাসেল যেন তাঁর মনের মরমী দিকটাকে অস্বীকার (denial) করতে শুরু করেছিলেন, আর তারপর থেকে কিছুটা হলেও খণ্ডিত ব্যক্তিত্বের (fragmentary personality) অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। এর বিপরীতে, ঠাকুরের ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত সুসংহত (highly integrated personality), যাঁর মধ্যে মরমীবাদ, ধর্ম, শিল্পকলা, রাজনীতি, রোমান্টিকতা, যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞান – সবকিছুই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমরা যদি তাঁকে আদর্শ হিসেবে নাও মানি, তাহলেও তাঁর কাছ থেকে আমরা অনুপ্রেরণা খুঁজে নিতেই পারি।
তথ্যসূত্র (Works Cited)
Chaudhuri, N. C. (1987). Thy Hand, Great Anarch. London: Chatto and Windus.
Chaudhuri, N. C. (1996). The East is East and the West is West. Calcutta: Mitra & Ghosh.
Chaudhuri, N. C. (1997). From the Archives of a Centenarian. Calcutta: Mitra & Ghosh.
Cioran, E.M. (1969). The New Gods. New York: Quadrangle/N.Y. Times Book Co.
Datta, K., & Robinson, A. (Eds.). (1997). Selected Letters of Rabindranath Tagore. With a Foreword by Amartya Sen. Cambridge: Cambridge UP.
Encyclopedia of Philosophy, Vol. 8. (1967). New York: Macmillan.
Gudmunsen, C. (1977). Wittgenstein and Buddhism. London: Macmillan.
Kakar, S. (1981). The Inner World: A Psycho-analytic Study of Childhood and Society in India (2nd ed.). Delhi: Oxford UP.
Kakar, S. (1991). The Analyst and the Mystic. Delhi: Viking.
Nandy, A. (1998). “The Illegitimacy of Nationalism.” In A. Nandy, Return from Exile. Delhi: OUP.
Nietzsche, F. (1986). Human, All Too Human. Cambridge: Cambridge UP.
Radhakrishnan, S. (1961). The Philosophy of Rabindranath Tagore. Baroda: Good Companions.
Radice, W. (1998). “Particles and Sparks: Tagore, Einstein and the Poetry of Science.” The India International Centre Quarterly, 25(2-3), Summer-Monsoon.
Russell, B. (1965). History of Western Philosophy. London: Allen and Unwin.
Searle, J. R. (1995). The Construction of Social Reality. Harmondsworth: Penguin.
Tagore, R. (1991). Nationalism (Original work published 1917). With an Introduction by E.P. Thompson. London: Macmillan.
Tagore, R. (1996). The English Writings of Rabindranath Tagore (Vols. 2 and 3). (S. K. Das, Ed.). Delhi: Sahitya Akademi.
- কাইজার হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক। তাঁর সাতটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শীঘ্রই প্রকাশিতব্য ‘ওড অন দ্য লুঙ্গি: নিউ অ্যান্ড কালেক্টেড পোয়েমস’ (Ode on the Lungi: New and Collected Poems)। তিনি শামসুর রাহমানের ‘নির্বাচিত কবিতা’, ঠাকুরের উপন্যাসিকা ‘চতুরঙ্গ’ (পেঙ্গুইন টেগোর অমনিবাস প্রথম খণ্ডে ‘কোয়ার্টেট’ নামে), মির্জা শেখ ইতিশামুদ্দীনের ‘ওয়ান্ডার্স অফ বিলায়েত’ (পিপল ট্রি, লিডস, ও ক্রনিকলবুকস, দিল্লি) অনুবাদ করেছেন; এবং ‘কনটেম্পোরারি ইন্ডিয়ান পোয়েট্রি’ (ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি প্রেস) ও ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা: মডার্ন পোয়েট্রি ফ্রম বাংলাদেশ’ (ফাউন্ডেশন অফ সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচার) সম্পাদনা করেছেন। তিনি কমনওয়েলথ স্কলার, সিনিয়র ফুলব্রাইট স্কলার, ভিলাস ফেলো, রয়্যাল লিটারেরি ফান্ড ফেলো এবং ইউকে পোয়েট্রি সোসাইটির পোয়েট্রি ক্যাফেতে ক্যাফে পোয়েট হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একজন কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন।
Leave a Reply