Table of Contents
ভূমিকা
আচ্ছা, শুনুন তাহলে সেই খিলাফত আন্দোলনের (Khilafat Movement) সাতকাহন। সময়টা খুব বেশিদিন আগের নয়, ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া এক তুলকালাম কাণ্ড। এখন প্রশ্ন হলো, বিষয়টা আসলে কী ছিল? সোজা কথায়, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে (British India) যে মুসলিমরা ছিলেন, তারা জোট বেঁধে একটা রাজনৈতিক আন্দোলন (political campaign) ফেঁদে বসলেন। কিন্তু কেন? খামোখা তো আর কেউ রাস্তায় নামে না, তাই না? কারণ ছিল দুটো, বেশ গুরুতর। প্রথমত, ব্রিটিশরা তুরস্কের (Turkey) সাথে যে ব্যবহার করছিল, সেটা তাদের একেবারেই মনঃপুত হচ্ছিল না। আর দ্বিতীয়ত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (World War I) যখন থামল, তখন জয়ী মিত্রশক্তি (Allied forces) মিলেমিশে উসমানীয় বা অটোমান সাম্রাজ্যকে (Ottoman Empire) কেক কাটার মতো ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার যে পাঁয়তারা কষছিল, সেটাও তাদের বুকে শেলের মতো বিঁধেছিল (Hutchinson & Smith, 2000; Ali et al., 2019; Vipul, 2009)।
এই যে এত বড় একটা আন্দোলন, এর তো কিছু কারিগর থাকবেন। যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম না বললেই নয়—আহমদ সগীর হাজী ভারিয়ামী (Ahmad Sagheer Haji Variyami), মাওলানা শওকত আলী (Maulana Shaukat Ali), মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর (Maulana Mohammad Ali Jauhar) (যার কথা ‘মুহাম্মদ আলী জওহর অ্যান্ড দ্য মিউটিনি ট্রায়াল’-এ পাওয়া যায়, Muhammad Ali Jauhar and the Mutiny Trial, n.d.), বিচক্ষণ হাকিম আজমল খান (Hakim Ajmal Khan) (Hussain, n.d.; Andrews, n.d.), আর প্রজ্ঞাবান আবুল কালাম আজাদ (Abul Kalam Azad) (Khilafat movement | Indian Muslim movement | Britannica.com, n.d.)। এই গুণীজনেরা মিলে তুরস্কের ওপর আসা বিপদ কাটাতে, তাদের দুঃখ একটু হালকা করতে এই আন্দোলনের ঝান্ডা ধরেছিলেন (The Cambridge History of India, Volume 6, n.d.)।
আর হ্যা, মহাত্মা গান্ধীও (Mahatma Gandhi) কিন্তু এই আন্দোলনে জোরালোভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। তার আবার কী গরজ পড়ল? আসলে, তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (British Empire) ঘোর বিরোধী, আর সেই সময় তিনি নিজেও একটা বড়সড় অসহযোগ আন্দোলনের (non-cooperation movement) ছক কষছিলেন (Olson, 2007)। শুধু তিনিই নন, বল্লভভাই প্যাটেল (Vallabhbhai Patel), বাল গঙ্গাধর তিলক (Bal Gangadhar Tilak) এবং কংগ্রেসের আরও অনেক হিন্দু নেতাও কিন্তু এই স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন, সমর্থন জুগিয়েছিলেন (Inamdar, 1983; Jaffrelot, 2013)।
মোদ্দা কথা হলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বেচারা অটোমান সাম্রাজ্যের ওপর সেভ্রেস চুক্তি (Treaty of Sèvres) নামে একখানা মারাত্মক চুক্তি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যার শর্তগুলো ছিল কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো। মূলত সেইসব নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেই ছিল এই গর্জে ওঠা। তবে এই আন্দোলনের একটা চমৎকার দিকও ছিল কিন্তু—হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা দারুণ ঐক্য (Hindu-Muslim unity) গড়ে উঠেছিল (Tejani, 2021)। কিন্তু কপালে সুখ বেশিদিন সইল না। ১৯২২ সালে যেই না অসহযোগ আন্দোলনটা গুটিয়ে নেওয়া হলো, অমনি খিলাফত আন্দোলনও কেমন যেন মিইয়ে গেল, থেমে গেল তার পথচলা (Bandyopādhyāja, 2004; Dani, 1979; Minault, 1982; Stein, 2010; Vogt et al., 2011)।
পটভূমি (Background)
এই যে এত কাণ্ড, এর গোড়ার কথাটা বুঝতে হলে আমাদের একটু ইতিহাসের পাতা উল্টে পেছনে যেতে হবে। অটোমান সাম্রাজ্যের যিনি সুলতান ছিলেন, দ্বিতীয় আবদুল হামিদ (Abdul Hamid II) (জন্ম ১৮৪২, মৃত্যু ১৯১৮), তিনি একখানা প্যান-ইসলামিস্ট (pan-Islamist) কর্মসূচি, মানে সব মুসলিমকে এক ছাতার নিচে আনার একটা পরিকল্পনা হাতে নিলেন। তার মাথায় তখন দুটো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল: এক, পশ্চিমারা যেভাবে সাম্রাজ্যটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে চাইছে, তার থেকে বাঁচানো; আর দুই, দেশের ভেতরে যারা গণতন্ত্রের জন্য টু শব্দটি করছে, তাদের মুখ বন্ধ করা। এই মতলবে তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে জামালউদ্দিন আফগানি (Jamaluddin Afghani) নামে একজনকে তার দূত বানিয়ে ভারতেও পাঠিয়েছিলেন (Ahmed, S., n.d.)। অটোমান বাদশাহর এই ডাক ভারতীয় মুসলমানদের মনে বেশ একটা নাড়া দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ধর্মীয় আবেগ আর সহানুভূতি যেন উথলে উঠেছিল। কারণ, খলিফা (caliph) হিসেবে অটোমান সুলতান ছিলেন পৃথিবীর সব সুন্নি মুসলমানের কাছে নামে মাত্র হলেও সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আর রাজনৈতিক নেতা। যদিও সত্যি বলতে, এই ক্ষমতা তিনি খুব একটা ব্যবহার করতেন না বা করতে পারতেন না।
অনেক মুসলিম ধর্মগুরু তখন খিলাফতের (caliphate) জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন। তারা একদিকে যেমন সাধারণ মানুষকে বোঝাতে লাগলেন, তেমনি মুসলমানদের এই আন্দোলনে শামিল করার জন্যও চেষ্টার কসুর করলেন না। মাওলানা মাহমুদ হাসান (Maulana Mehmud Hasan) নামে এক ধর্মীয় নেতা তো অটোমান সাম্রাজ্যকে সমর্থন দিতে রীতিমতো একটা জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের (national war of independence) আয়োজন করার কথাও ভেবেছিলেন!
তবে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের দিনকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। তরুণ তুর্কি বিপ্লব (Young Turk Revolution) নামে একখানা বিপ্লব হয়ে গেল, যার চাপে পড়ে তাকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র (constitutional monarchy) ফিরিয়ে আনতে হলো। আর এর ফলেই শুরু হলো দ্বিতীয় সাংবিধানিক যুগ (Second Constitutional Era)। তার বিদায়ের পর তার ভাই পঞ্চম মুহাম্মদ (Mehmed V) (১৮৪৪-১৯১৮) সিংহাসনে বসলেন বটে, কিন্তু বিপ্লবের পর অটোমান সাম্রাজ্যের আসল কলকাঠি চলে গেল ওই তরুণ তুর্কিদের (Young Turks) হাতে। খিলাফতের এই ব্যাপারটা নিয়ে ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনে একটা সম্মেলনও (Conference of London) বসেছিল। কিন্তু আরব দেশের জাতীয়তাবাদীরা ভাবছিলেন, এ তো ভারি বিপদ! এর মানে তো দাঁড়ায়, আরব মুলুকে তুর্কিদের দাদাগিরি চলতেই থাকবে (Ghose, 1991)। তাদের এই আশঙ্কাও কিন্তু অমূলক ছিল না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (World War I) অটোমান সাম্রাজ্য বেচারা ভুল পক্ষে, মানে অক্ষশক্তির (Central Powers) দলে ভিড়েছিল। ফল যা হওয়ার তাই হলো—শোচনীয় একটা সামরিক পরাজয়। এরপর ১৯১৯ সালে হলো ভার্সাই চুক্তি (Treaty of Versailles)। এই চুক্তির ফলে সাম্রাজ্যের অনেকটাই হাতছাড়া হয়ে গেল, রাজনৈতিক প্রভাবও গেল কমে। তবে মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধে জেতা ইউরোপীয় শক্তিগুলো কিন্তু মুখে আশ্বাস দিয়েছিল যে তারা অটোমান সুলতানের খলিফা (caliph) হিসেবে যে মর্যাদা, সেটা অক্ষুণ্ণ রাখবে।
কিন্তু মুখের কথার দাম আর ক’জন রাখে! ১৯২০ সালে যখন সেভ্রেস চুক্তি (Treaty of Sèvres) হলো, তখন দেখা গেল প্যালেস্টাইন (Palestine), সিরিয়া (Syria), লেবানন (Lebanon), আর ইরাকের (Iraq) মতো বড় বড় অঞ্চলগুলো সাম্রাজ্য থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে!
ঠিক এই সময়েই তুরস্কের (Turkey) ভেতরে একটা অন্যরকম হাওয়া বইতে শুরু করল। মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক (Mustafa Kemal Atatürk) নামে এক তুখোড় নেতার অধীনে একটা প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (Turkish national movement) মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এরপর শুরু হলো তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ (Turkish War of Independence), চলল ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত। এই যুদ্ধে তুর্কি বিপ্লবীরা সেভ্রেস চুক্তির মতো অপমানজনক চুক্তিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে লুসান চুক্তির (Treaty of Lausanne) (১৯২৩) মাধ্যমে নতুন শর্ত আদায় করে নিলেন। আতাতুর্কের সংস্কার কর্মসূচির (Atatürk’s Reforms) অংশ হিসেবে ১৯২৪ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র (Republic of Turkey) খিলাফতের পদটাই তুলে দিল। ভাবা যায়! আতাতুর্ক তখন আহমদ শরীফ আস-সেনুসিকে (Ahmed Sharif as-Senussi) খিলাফতের পদটা দিতে চেয়েছিলেন, তবে শর্ত ছিল একটাই—তুরস্কের বাইরে থাকতে হবে। সেনুসি সাহেব সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে আবদুলমেজিদের (Abdulmejid) দিকেই তার সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিলেন (Özoğlu, 2011)। এরপর মক্কা আর হেজাজের শরীফ (Sharif of Mecca and Hejaz), যিনি আবার আরব বিদ্রোহেরও (Arab Revolt) নেতা ছিলেন, সেই হুসেন বিন আলী (Hussein bin Ali) খলিফার উপাধিটা নিজের বলে দাবি করে বসলেন। কিন্তু তার কপালও মন্দ, ১৯২৫ সালে ইবনে সৌদের (Ibn Saud) কাছে তার রাজত্বটাই খোয়াতে হলো। সব মিলিয়ে এক হুলুস্থুল ব্যাপার!
ঠিক আছে, তাহলে এবার আসা যাক খোদ ভারতীয় উপমহাদেশে (Indian Subcontinent) এই খিলাফত আন্দোলনটা (Khilafat Movement) কেমন চেহারা নিয়েছিল, সেই গল্পে।
ভারতীয় উপমহাদেশে খিলাফত আন্দোলন (Khilafat Movement in Indian Subcontinent)
দেখুন, মুসলিম বিশ্বের (Muslim world) নানা প্রান্তে খিলাফতের জন্য মানুষ গলা ফাটাচ্ছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতাও কম ছিল না। কিন্তু সত্যি বলতে, সবচেয়ে জোরদার, সবচেয়ে ঝাঁঝালো আন্দোলনটা কিন্তু দানা বেঁধেছিল ভারতেই। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর (Maulana Muhammad Ali Johar) নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন, অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করা তুখোড় সাংবাদিক। ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলা আর খিলাফতের পক্ষে কলম ধরার ‘অপরাধে’ বেচারাকে চার-চারটে বছর জেলের ঘানি টানতে হয়েছিল। ওদিকে যখন তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ (Turkish War of Independence) শুরু হলো, তখন এখানকার মুসলিম ধর্মগুরুরা রীতিমতো আশঙ্কায় ভুগতে লাগলেন – খিলাফতের কী হবে! কারণ, ইউরোপের ক্ষমতাধর দেশগুলো এটাকে বাঁচানোর জন্য তেমন একটা গা লাগাচ্ছিল না। ভারতের কিছু মুসলমানের কাছে ব্যাপারটা ছিল খুবই স্পর্শকাতর; তুরস্কের মুসলমান ভাইয়েরা বিপদে, আর তাদের বিরুদ্ধে কিনা যুদ্ধে যেতে হবে – এ যেন ভাবাই যায় না! (তবে হ্যা, একটা তথ্য এখানে না বললেই নয়, উত্তর পাঞ্জাব আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বহু মুসলমান কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন)। এই আন্দোলনের যারা উদ্যোক্তা আর সমর্থক ছিলেন, তাদের কাছে খিলাফত কিন্তু ঠিক ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না; এটা ছিল বরং তুরস্কের মুসলমানদের দুঃসময়ে তাদের পাশে থাকার, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর একটা উপায় (Niemeijer, 1972)।
মোহাম্মদ আলী (Mohammad Ali) আর তার ভাই মাওলানা শওকত আলী (Maulana Shaukat Ali) – এই দুই ভাই মিলে আরও অনেক মুসলিম নেতাকে সাথে নিলেন। যেমন ধরুন, পীর গোলাম মুজাদ্দিদ সারহান্দি (Pir Ghulam Mujaddid Sarhandi), শেখ শওকত আলী সিদ্দিকী (Sheikh Shaukat Ali Siddiqui), ড. মুখতার আহমেদ আনসারী (Dr. Mukhtar Ahmed Ansari), রইস-উল-মুহাজিরীন ব্যারিস্টার জান মুহাম্মদ জুনেজো (Raees-Ul-Muhajireen Barrister Jan Muhammad Junejo), কবি ও বিপ্লবী হাসরত মোহানী (Hasrat Mohani), তেজোদীপ্ত সৈয়দ আতা উল্লাহ শাহ বুখারী (Syed Ata Ullah Shah Bukhari), মোহাম্মদ ফারুক চিশতী (Mohammad Farooq Chishti), প্রজ্ঞাবান মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (Maulana Abul Kalam Azad) আর বিচক্ষণ ড. হাকিম আজমল খান (Dr. Hakim Ajmal Khan)। এরা সবাই মিলে তৈরি করলেন সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটি (All India Khilafat Committee)। এই কমিটির মূল আস্তানাটা ছিল ভারতের লখনউতে (Lucknow), জমিদার শওকত আলী সিদ্দিকীর ‘হাতে শওকত আলী’ নামের বিশাল কম্পাউন্ডে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দুটো: এক, মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য (political unity) প্রতিষ্ঠা করা; আর দুই, নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে খিলাফতকে রক্ষা করা। ১৯২০ সালে তারা একটা খিলাফত ইশতেহারও (Khilafat Manifesto) বের করলেন। তাতে ব্রিটিশদের প্রতি আহ্বান জানানো হলো খিলাফতকে বাঁচানোর জন্য, আর ভারতীয় মুসলমানদের বলা হলো একজোট হয়ে ব্রিটিশদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে (Minault, The Khilafat movement, p. 92)। ওদিকে, বাংলার খিলাফত কমিটিতেও (Khilafat Committee in Bengal) কিন্তু কম রথী-মহারথী ছিলেন না – মোহাম্মদ আকরাম খান (Mohammad Akram Khan), মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (Manruzzaman Islamabadi), মুজিবুর রহমান খান (Mujibur Rahman Khan) এবং চিত্তরঞ্জন দাশ (Chittaranjan Das) (Razzaq, n.d.)। এদের সবার নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে।
১৯২০ সালে খিলাফত নেতাদের সাথে ভারতের তৎকালীন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের (Indian National Congress) একটা দারুণ বোঝাপড়া হলো (Mylonas & Tudor, 2021)। কংগ্রেসের ডাকসাইটে নেতা মহাত্মা গান্ধী (Mahatma Gandhi) আর খিলাফত নেতারা হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন, খিলাফত আর স্বরাজের (Swaraj) – মানে নিজেদের শাসন নিজেদের হাতে ফিরিয়ে আনার – জন্য একসাথে লড়বেন, একসাথে কাজ করবেন। ঔপনিবেশিক সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়ানোর জন্য খিলাফতপন্থীরা তখন অসহযোগ আন্দোলনের (non-cooperation movement) এক বিরাট শক্তি হয়ে উঠলেন। দেশজুড়ে শুরু হলো গণআইন অমান্যের (civil disobedience) এক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি। কেউ কেউ তো আবার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (North-West Frontier Province) থেকে সে সময়ের আফগানিস্তানের (Afghanistan) শাসক আমানুল্লাহ খানের (Amanullah Khan) ছত্রছায়ায় প্রতিবাদ হিসেবে দেশত্যাগও (protest emigration) করেছিলেন (Clements & Adamec, 2003)। সে এক এলাহি কাণ্ড!
এই আন্দোলনে সাধারণ ভারতীয়রাও কিন্তু পিছিয়ে ছিলেন না। তারা সাধ্যমতো টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন (Thakur, 2006; Selected Subaltern Studies, n.d.)। এমনকি, মুস্তফা কামালের (Mustafa Kemal) আঙ্কারা সরকারকে (Ankara government) সাহায্য করার জন্য তহবিল পাঠানোর উদ্দেশ্যে একটা কমিটিও তৈরি করা হয়েছিল (Minault, 1982, p. 137)।
অসহযোগ আন্দোলনটা প্রথমে বেশ জাঁকিয়েই বসেছিল। আইন পরিষদ (legislative councils) বয়কট করা হলো, সরকারি স্কুল-কলেজ (government schools, colleges) আর বিদেশি জিনিসপত্র সব বাতিল। সরকারি অনুষ্ঠান কেউ মাড়াচ্ছে না, উপাধি আর সম্মাননা সব ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সারা ভারতে তখন বিক্ষোভ, ধর্মঘট আর আইন অমান্যের ঢেউ। হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই আন্দোলনে নেমেছেন, আর শুরুটা ছিল বেশ শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার কি আর চুপ করে বসে থাকবে? গান্ধী, আলী ভাইয়েরা (Ali brothers) আর অন্য নেতাদের ঝটপট জেলে পুরে দিল। তেহরিক-ই-খিলাফতের (Tehrik-e-Khilafat) পতাকাতলে, মাওলানা মনজুর আহমেদ (Moulana Manzoor Ahmed) আর মাওলানা লুৎফুল্লাহ খান ডানকৌরীর (Moulana Lutfullah Khan Dankauri) নেতৃত্বে পাঞ্জাব খিলাফত প্রতিনিধি দল সারা ভারতে, বিশেষ করে পাঞ্জাবের সিরসা, লাহোর, হরিয়ানা এসব জায়গায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আউজলা খুর্দের (Aujla Khurd) মতো ছোট ছোট গ্রামের মানুষও কিন্তু এই আন্দোলনের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
কিন্তু এত কিছুর পরেও, ঔপনিবেশিক সরকারের সাথে আলোচনা আর নিজেদের কার্যকলাপ চালিয়ে গেলেও, খিলাফত আন্দোলনটা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ল। ভেতরের কারণটা ছিল বেশ জটিল। মুসলমানরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না, তারা কি কংগ্রেসের হয়ে কাজ করবেন, নাকি খিলাফতের জন্য লড়বেন, নাকি মুসলিম লীগের (Muslim League) পতাকাতলে যাবেন – এই দোটানায় পড়ে তারা যেন তিন দিকে বিভক্ত হয়ে গেলেন (Minault, The Khilafat movement, p. 184)।
খিলাফতের নেতারাও আর এক সুরে কথা বলতে পারছিলেন না, তাদের মধ্যেও নানা রাজনৈতিক মতপার্থক্য দেখা দিল। সৈয়দ আতা উল্লাহ শাহ বুখারী (Syed Ata Ullah Shah Bukhari) তখন চৌধুরী আফজাল হকের (Chaudhry Afzal Haq) সমর্থনে মজলিস-ই-আহরার-ই-ইসলাম (Majlis-e-Ahrar-e-Islam) নামে একটা নতুন দল গড়লেন। ড. আনসারী (Dr. Ansari), মাওলানা আজাদ (Maulana Azad) আর হাকিম আজমল খানের (Hakim Ajmal Khan) মতো নেতারা গান্ধী আর কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সমর্থক হয়েই রইলেন। আর আলী ভাইয়েরা? তারা যোগ দিলেন মুসলিম লীগে (Nasr, 2006)। ঐক্যের সুতোটা যেন ছিঁড়ে যেতে শুরু করল।
ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ (Challenges to British colonization)
বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত সিন্ধু প্রদেশে (Sindh) ব্রিটিশদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণটা বেশ জাঁকিয়েই বসেছিল, যাকে বলে কিনা পোক্ত ব্যবস্থা। কিন্তু খিলাফত আন্দোলনের সময় ব্রিটিশরা তাদের শাসনের সামনে আরেকটা বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলো (“Challenge to the system: the Khilafat movement, 1919–1924,” 1992)।
খিলাফত আন্দোলনটা ছিল সিন্ধুর ইতিহাসে প্রথম এমন একটা ঘটনা, যেখানে সেখানকার বহু পীর (pirs) – মানে ধর্মীয় নেতারা – একজোট হয়ে ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের এই অংশগ্রহণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, তারা কীভাবে ধীরে ধীরে বৃহত্তর ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলোর সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছেন। অন্য জায়গার মুসলমানদের মতো, এই পীরদের অনেকেই তখন প্যান-ইসলামিক ভাবধারার (pan-Islamic sentiment) উত্থান আর দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিলেন। এই আন্দোলনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সিন্ধুতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিতটাকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে, পীরদের এত প্রভাব আর খিলাফতের প্রতি তাদের এত সমর্থন থাকা সত্ত্বেও, ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা কিন্তু শেষমেশ নিজেদের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছিল। তারা এই হুমকিটাকে একটা সামাল দেওয়ার মতো পর্যায়ে (manageable proportions) নামিয়ে আনতে পেরেছিল (“Challenge to the system: the Khilafat movement, 1919–1924,” 1992)।
খিলাফত আন্দোলনে সিন্ধি পীরদের এই জড়িয়ে পড়াটা ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সত্যিই একটা বড়সড় ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ১৯১৯ সালের আগের কয়েক বছর ধরে প্যান-ইসলামিক বিষয়গুলোতে আগ্রহ বাড়ার ফলে প্রদেশের ধর্মীয় নেতৃত্বের একটা বড় অংশ এই আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেই সময়ে বৃহত্তর ইসলামিক স্বার্থের প্রতি এই সমর্থনটা আসলে সিন্ধু অঞ্চলের সাথে বাইরের দুনিয়ার যোগাযোগের বাধাগুলো যে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল, তারই একটা প্রতিফলন ছিল (“Challenge to the system: the Khilafat movement, 1919–1924,” 1992)।
উত্তরাধিকার (Legacy)
এই খিলাফত আন্দোলন কিন্তু একটা বড় কাজ করে গিয়েছিল – হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে বেশ একটা ঐক্য (unity) গড়ে তুলেছিল। ব্রিটিশদের সেই পুরোনো ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ (divide and rule) নীতির জবাবে কংগ্রেসও এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল (Singh & Raj, 2012)। ১৯১৯ থেকে ১৯২২ – এই সময়টাকে অনেকেই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের স্বর্ণযুগ (heyday of Hindu-Muslim unity) বলে থাকেন (Tejani, 2021)। এমনকি, তুরস্কের সেই বিখ্যাত নেতা মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক (Mustafa Kemal Atatürk) কংগ্রেসকে তাদের সহানুভূতির জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন আর আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, তারা তাড়াতাড়ি স্বরাজ (Swaraj) – মানে নিজেদের শাসন – লাভ করবে (Bryant, 1924)।
এই আন্দোলনটাকে মুসলিম জাতীয়তাবাদের (Muslim nationalism) বিকাশে (Khimjee, 2013) এবং ভারতে আইন অমান্যের (civil disobedience) ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা মাইলফলক হিসেবে দেখা হয়। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ (Muhammad Ali Jinnah) – যিনি ১৯১৬ সালের লখনউ চুক্তির (Lucknow Pact) পর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একজন বড় সমর্থক ছিলেন (Pakistan Day: How Gandhi’s support for Khilafat Movement made a separate homeland for Indian Muslims inevitable, 2017) – তিনি কিন্তু খিলাফত আন্দোলনের ধর্মীয় দিকটার সাথে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীনতা আন্দোলনের জট পাকানোটা পছন্দ করেননি। এই নিয়ে তিনি কংগ্রেসকে সতর্কও করেছিলেন, কিন্তু কেউ কান দেয়নি। ফলস্বরূপ, তিনি কংগ্রেস ছেড়ে দেন এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলনের (Pakistan Movement) অন্যতম প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন (The Multiple Facets of Muhammad Ali Jinnah, 2020)। অবশ্য, কিছু সমালোচক আবার অন্য কথা বলেন। তাদের মতে, খিলাফত আন্দোলনটা আসলে জাতীয়তাবাদী বা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কোনোটাই ছিল না; এর ধর্মীয় কথাবার্তার আড়ালে একটা দুর্বল আর অনিশ্চিত ধর্মীয় উদ্দেশ্য (religious agenda) লুকিয়ে ছিল (Barlas, 2019)।
তুরস্কের একটা খবরের কাগজ, ডেইলি সাবাহতে (Daily Sabah) ওমাইর আনাস (Omair Anas) নামে একজন লিখেছিলেন, “গান্ধী যে সেই সময়ে ভেঙে পড়তে থাকা অটোমান সাম্রাজ্যের ঐক্য আর অখণ্ডতার জন্য সমর্থন দিয়েছিলেন, সেটা উল্লেখ না করে তুরস্কের ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রামের কথা বলাটা প্রায় অসম্ভব।” (Anas, 2021)।
তথ্যসূত্র (References)
-
Ali, A., Sahni, J., Sharma, M., Sharma, P., & Goel, P. (2019). IAS Mains Paper 1 Indian Heritage & Culture History & Geography of the world & Society 2020. Arihant Publications India limited.
-
Anas, O. (2021, October 4). Turkey in Gandhi’s anti-colonial struggle. Daily Sabah. Retrieved from https://www.dailysabah.com/opinion/op-ed/turkey-in-gandhis-anti-colonial-struggle
-
Andrews, C.F. (n.d.). Hakim Ajmal Khan.
-
Ahmed, S. (n.d.). Khilafat Movement. In Banglapedia. Bangladesh Asiatic Society. Retrieved from http://en.banglapedia.org/index.php?title=Khilafat_Movement
-
Bandyopādhyāja, Ś. (2004). From Plassey to Partition: A History of Modern India. Orient Blackswan.
-
Barlas, A. (2019). Democracy, Nationalism, And Communalism: The Colonial Legacy In South Asia. Taylor & Francis.
-
Bryant, J.F. (1924). Gandhi & the Indianisation of the Empire. J. Hall & Son.
-
Challenge to the system: the Khilafat movement, 1919–1924. (1992). In Sufi Saints and State Power. Cambridge University Press. doi:10.1017/cbo9780511563201.007
-
Clements, F., & Adamec, L. W. (2003). Conflict in Afghanistan: A Historical Encyclopedia. ABC-CLIO.
-
Dani, A. H. (1979). World Scholars on Quaid-i-Azam Muhammad Ali Jinnah, Volume 1. Quaid-i-Azam University.
-
Ghose, S. (1991). Mahatma Gandhi. Allied Publishers.
-
Hussain, I. (n.d.). Ajmal e Azam.
-
Hutchinson, J., & Smith, A.D. (2000). Nationalism: Critical Concepts in Political Science. Routledge.
-
Inamdar, N.R. (1983). Political Thought and Leadership of Lokmanya Tilak. Concept.
-
Jaffrelot, C. (2013, December 7). Sardar and the Swayamsevaks. Carnegie Endowment for International Peace. Retrieved from https://carnegieendowment.org/posts/2013/12/sardar-and-the-swayamsevaks?lang=en
-
Khilafat movement | Indian Muslim movement | Britannica.com. (n.d.). Retrieved January 4, 2019, from https://www.britannica.com/event/Khilafat-movement
-
Khimjee, H. (2013). Pakistan: a Legacy of the Indian Khilafat Movement. iUniverse.
-
Minault, G. (1982). The Khilafat Movement: Religious Symbolism and Political Mobilization in India. Columbia University Press.
-
Muhammad Ali Jauhar and the Mutiny Trial. (n.d.). Oxford University Press. Retrieved December 5, 2013, from http://global.oup.com/academic/product/muhammad-ali-jauhar-and-the-mutiny-trial-9780195978940?cc=pk&lang=en&
-
Mylonas, H., & Tudor, M. (2021). Nationalism: What We Know and What We Still Need to Know. Annual Review of Political Science, 24(1), 109–132. doi:10.1146/annurev-polisci-041719-101841
-
Nasr, V. (2006). The Shia Revival. Norton.
-
Niemeijer, A. C. (1972). The Khilafat movement in India, 1919–1924. Nijhoff.
-
Olson, C. (2007). The Many Colors of Hinduism: A Thematic-historical Introduction. Rutgers University Press.
-
Özoğlu, H. (2011). From Caliphate to Secular State: Power Struggle in the Early Turkish Republic. ABC-CLIO.
-
Pakistan Day: How Gandhi’s support for Khilafat Movement made a separate homeland for Indian Muslims inevitable. (2017, March 23). The Nation. Retrieved from https://nation.com.pk/23-Mar-2017/pakistan-day-how-gandhi-s-support-for-khilafat-movement-made-a-separate-homeland-for-indian-muslims-inevitable
-
Razzaq, R. (n.d.). Khan, Mohammad Akram. In Banglapedia. Bangladesh Asiatic Society. Retrieved from http://en.banglapedia.org/index.php?title=Khan,_Mohammad_Akram
-
Selected Subaltern Studies. (n.d.). Oxford University Press.
-
Singh, M.P., & Raj, S.R. (2012). The Indian Political System. Pearson.
-
Stein, B. (2010). A History of India. John Wiley & Sons.
-
Tejani, S. (2021). Indian Secularism: A Social and Intellectual History, 1890–1950. Indiana University Press.
-
Thakur, B. (2006). Women in Gandhi’s Mass Movements. Deep and Deep Publications.
-
The Cambridge History of India, Volume 6. (n.d.). S. Chand Group.
-
The Multiple Facets of Muhammad Ali Jinnah. (2020, September 26). Outlook India. Retrieved from https://www.outlookindia.com/national/opinion-the-multiple-facets-of-muhammad-ali-jinnah-news-360961
-
Vipul, S. (2009). Longman History & Civics Icse 10. Pearson Education.
-
Vogt, K., Larsen, L., & Moe, C. (2011). New Directions in Islamic Thought: Exploring Reform and Muslim Tradition. Bloomsbury Publishing.
-
Note 21 from the original article mentions: “However, at the same time, note must also be made that in the North Punjab and part of the NWFP, a huge number of Muslims did actively volunteer to serve in the British Indian Army in World War I”. This specific point is woven into the narrative.
Leave a Reply