Table of Contents
ভূমিকা
তো, এই সালাফী আন্দোলন (Salafi movement) বা সালাফিবাদ (Salafism) (আরবি: السلفية, রোমানাইজড: as-Salafiyya) জিনিসটা আসলে কী? এই নিয়ে আজকাল বেশ কথাবার্তা শোনা যায়, তাই না? সহজ কথায় বলতে গেলে, এটা হলো সুন্নি ইসলামের (Sunni Islam) ভেতরে গজিয়ে ওঠা বেশ কট্টরপন্থী বা গোঁড়া ধারার একটা পুনর্জাগরণ আন্দোলন (fundamentalist revival movement) (Joppke, 2013; Wagemakers, 2016; Harvard Divinity School, 2018; Esposito, 2004)। এর শুরুটা হয়েছিল উনিশ শতকের শেষের দিকে, মানে খুব বেশিদিন আগে নয়। কিন্তু এর ঝাঁঝ বা প্রভাব আজকের ইসলামী দুনিয়াতেও বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যায় (Mahmood, 2012; Curtis, 2010; Esposito et al., 2013)।
“সালাফিয়্যা (Salafiyya)” – এই খটমটে নামটা কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের দিয়েছে (Ali, 2019)। এর মানে হলো, তারা ইসলামের একেবারে শুরুর দিকের সেইসব “ধার্মিক পূর্বসূরিদের (pious predecessors)” বা ‘সালাফ’দের (salaf) দেখানো পথে ফিরে যেতে চায়। এখন প্রশ্ন হলো, এই সালাফ কারা? এরা হলেন ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মের মানুষজন – প্রথমে নবী মুহাম্মদ নিজে এবং তার সাথের লোকজন, মানে সাহাবারা (Sahabah)। তারপর তাদের পরের প্রজন্ম, যাদের বলা হয় তাবেঈন (Tabi’in)। আর সবশেষে, তারও পরের প্রজন্ম – তাবে আত-তাবেঈন (Tabi’ al-Tabi’in)। সালাফীদের বিশ্বাস, এই মানুষগুলোই ইসলামের সবচেয়ে খাঁটি, সবচেয়ে নিখুঁত রূপটা বুঝেছিলেন এবং পালন করেছিলেন (Turner, 2014)।
সালাফীরা বুক ফুলিয়ে দাবি করে, তারা কেবল তিনটা জিনিস মানে: কুরআন (Qur’an), সুন্নাহ (Sunnah) – মানে নবীর দেখানো পথ, আর হলো সেই সালাফদের ইজমা (Ijma) বা সবার মিলিত সিদ্ধান্ত। তাদের সাফ কথা, এর পরে যারা এসেছেন, তাদের দেওয়া ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে তারা অত পাত্তা দেয় না বা দেওয়া উচিত না (Bin Ali Mohamed, 2015; Anzalone, 2022)। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের ঘুম ভাঙিয়ে তাদের জীবনযাত্রাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলা। আর সত্যি কথা বলতে কি, ইসলামী বিশ্বের বহু চিন্তাভাবনা আর আন্দোলনের ওপর এই সালাফী ধারার বিরাট প্রভাব পড়েছে, পড়ছেও (Esposito, 1995; Esposito et al., 2013)।
সালাফী মুসলিমদের দুটো বিষয়ে ভীষণ আপত্তি। এক হলো বিদ’আত (bid’a), মানে ধর্মে নতুন কিছু চালু করা – সেটার তারা ঘোর বিরোধী। আর দুই, তারা চায় শরিয়া (sharia) বা ইসলামী আইন যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয় (The Economist, 2015)। রাজনীতির ময়দানে অবশ্য তাদের সবার পথ এক নয়। পশ্চিমা দুনিয়ার পণ্ডিত আর সাংবাদিকরা এদেরকে সাধারণত তিনটে দলে ভাগ করেন:
-
সবচেয়ে বড় দলটা হলো শুদ্ধতাবাদী (purists) বা শান্তিবাদী (quietists)। এরা রাজনীতি থেকে একশ হাত দূরে থাকে, ধর্মকর্ম নিয়েই ব্যস্ত।
-
দ্বিতীয় দলটা হলো সক্রিয় কর্মী (activists) বা ইসলামপন্থী (Islamists)। এরা দিব্যি রাজনীতিতে নাক গলায়, নিয়মিত এর সাথে জড়িত থাকে।
-
আর তৃতীয়, সংখ্যায় সবচেয়ে ছোট দলটা হলো জিহাদী (jihadists)। এরা মনে করে, ইসলামের সেই পুরনো রীতি ফিরিয়ে আনতে হলে সশস্ত্র সংগ্রাম বা মারামারি-কাটাকাটির পথ ধরতে হবে (The Economist, 2015)।
আইনকানুনের ব্যাপারে সালাফীরা ইজতিহাদ (ijtihad) বা নিজে নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে। ইসলামী আইনশাস্ত্রের যে চারটি প্রধান মাযহাব (madhahib) – হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলী – আছে, সেগুলোর তাকলিদ (taqlid) বা চোখ বুজে অনুসরণ করাকে এরা প্রত্যাখ্যান করে।
তবে এই সালাফিবাদের গোড়াটা কোথায়, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বেশ মতভেদ আছে। কেউ কেউ, যেমন ধরুন লুই মাসিগনন (Louis Massignon) নামের একজন পণ্ডিত, মনে করেন এর শুরুটা সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে। তখন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ (European imperialism) জেঁকে বসেছে, তাদের সংস্কৃতির (Westernization) চাপে ইসলামী দুনিয়া টালমাটাল। সেই চাপের বিরুদ্ধেই নাকি আল-আফগানি (Al-Afghani), মুহাম্মদ আবদুহ (Muhammad Abduh), আর রশিদ রিদা (Rashid Rida)-র মতো কিছু লোক একটা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলেন – এটাই নাকি সালাফিবাদের শুরু (Kepel, 2002; Jamestown, 2022)। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আফগানি বা আবদুহ – এরা নিজেরা কিন্তু কখনও বলেননি, “আমরা সালাফী (Salafi)”। তাই আজকাল তাদের এই নামে ডাকাটা একটু সেকেলে শোনায় (Bennett & Shepard, 2013)।
তবে হ্যাঁ, আবদুহের ছাত্র রশিদ রিদা কিন্তু বেশ কট্টরপন্থী সালাফিবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। তিনি সুফিবাদ (Sufism), শিয়াবাদ (Shi’ism) এসবের ঘোর বিরোধী ছিলেন, কিন্তু আবার ঐতিহ্যবাহী মাযহাব ব্যবস্থাকে (madh’hab system) আঁকড়ে ধরেছিলেন। এই রশিদ রিদা সাহেব পরে আবার ওয়াহাবি আন্দোলনের (Wahhabi movement) মস্ত বড় সমর্থক হয়ে ওঠেন এবং আজকের দিনের রক্ষণশীল সালাফীদের (conservative Salafis) ওপর তার বিশাল প্রভাব দেখা যায় (Bennett & Shepard, 2013; Djait, 2011; Wahba, 2022)।
আধুনিক লেখাপড়ার জগতে ‘সালাফিবাদ’ বলতে এখন মূলত বোঝানো হয় সমসাময়িক কিছু সুন্নি আন্দোলনকে, যারা ইসলামকে নতুন করে জাগিয়ে তুলতে বা সংস্কার করতে চায়। এদের মূল প্রেরণা আসে ইসলামের ক্লাসিক্যাল যুগের বা পুরনো দিনের ধর্মতাত্ত্বিকদের কাছ থেকে – বিশেষ করে ইবনে তাইমিয়া (Ibn Taymiyya) নামের একজন বিখ্যাত আলেমের (১২৬৩–১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ/৬৬১–৭২৮ হিজরি) শিক্ষা থেকে (Martin, 2016; Campo, 2009; Bennett & Shepard, 2013)। এই আধুনিক সালাফীরা আবার উনিশ শতকের সেই আফগানি-আবদুহদের মতো সংস্কারকদের খুব একটা পছন্দ করে না। তাদের মতে, ওই সংস্কারকরা ছিলেন যুক্তিবাদী (rationalists) এবং তারা ধর্মগ্রন্থের সবচেয়ে আসল, আক্ষরিক আর ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যাটা ধরতে পারেননি (Bennett & Shepard, 2013)।
এই সময়ের রক্ষণশীল সালাফীরা আবার সিরিয়ার কিছু পণ্ডিত, যেমন সেই রশিদ রিদা (মৃত্যু ১৯৩৫) আর মুহিব্ব আল-খাতিব (Muhibb al-Khatib) (মৃত্যু ১৯৬৯)–কে আরব দুনিয়ায় সালাফী চিন্তার পুনর্জাগরণকারী (revivalists) হিসেবে খুব মান্য করে (Wagemakers, 2016)। রশিদ রিদার নিজের ধর্মীয় চিন্তাভাবনাও গড়ে উঠেছিল সেই সব সালাফী আলেমদের সাথে মেলামেশা করে, যারা ইবনে তাইমিয়ার পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছিলেন। রিদা আর তার শিষ্যরা মিলে এই ধারণাগুলোকে পরে বেশ জনপ্রিয় করে তোলেন, যার ফলে আরব বিশ্বের অসংখ্য সালাফী সংগঠনের ওপর এর গভীর ছাপ পড়ে (Bennett & Shepard, 2013)।
আজকের ইসলামী বিশ্বে যে কয়টা বড় বড় সালাফী সংস্কার আন্দোলন চোখে পড়ে, তার মধ্যে কয়েকটা হলো:
-
আহলে হাদীস আন্দোলন (Ahl-i Hadith movement): এদের প্রেরণা শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (Shah Waliullah Dehlawi), আর এদের পালে হাওয়া লাগে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (Sayyid Ahmad Shahid)-এর দক্ষিণ এশীয় জিহাদের (South Asian jihad) মাধ্যমে (Haroon, 2021; Qasim Zaman, 2002)।
-
ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahhabi movement): এটা মূলত আরবের আন্দোলন।
-
পাদ্রি আন্দোলন (Padri movement): এটা ইন্দোনেশিয়ার ঘটনা।
-
আলজেরীয় সালাফিবাদ (Algerian Salafism): এর নেতৃত্বে ছিলেন আবদেলহামিদ বেন বাদিস (Abdelhamid Ben Badis)।
-
এছাড়াও আরও অনেক ছোটবড় আন্দোলন আছে (Bennett & Shepard, 2013)।
ব্যুৎপত্তি (Etymology)
‘সালাফী (Salafi)’ শব্দটা শুনলে মনে হতে পারে এটা বুঝি হাল আমলের কোনো ব্যাপার। কিন্তু না, শব্দটা কিন্তু বেশ পুরনো। সেই ক্লাসিক্যাল যুগেও এই বিশেষণ আর বিশেষ্য পদটা ব্যবহার করা হতো। তবে তখন এর মানে ছিল একটু ভিন্ন – তখন এটা দিয়ে মূলত ইসলামের শুরুর দিকের আহলে হাদীস আন্দোলনের (Ahl al-Hadith movement) ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তাধারাকে বোঝানো হতো (Meijer & Lacroix, 2013)। মধ্যযুগের একজন প্রোটো-সালাফিস্ট (proto-Salafist) ধর্মতাত্ত্বিক ছিলেন, নাম তাকি আল-দিন ইবনে তাইমিয়া (Taqi al-Din Ibn Taymiyya) (মৃত্যু ১৩২৮ খ্রি./৭২৮ হি.)। আহলে হাদীসদের আকীদা (creedal) বা বিশ্বাস, সমাজনীতি আর রাজনীতি নিয়ে যে ধ্যানধারণা, সেগুলোকে গুছিয়ে একটা পোক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে তার লেখাগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আর আজও সালাফী মাদ্রাসাগুলোতে (Salafi seminaries) তার বইপত্রই সবচেয়ে বেশি চলে বা পড়ানো হয় (Rabil, 2014)।
তবে ‘সালাফী’ শব্দটাকে একটা নির্দিষ্ট আন্দোলন বা একটা বিশেষ ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাসের (theological creed) তকমা হিসেবে ব্যবহার করাটা কিন্তু আধুনিক যুগের ঘটনা। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আজকের দিনে যারা আধুনিকতাবাদী (modernists) মুসলিম, তারাও নিজেদের সালাফী বলতে পারে, আবার যারা একদম কট্টর ঐতিহ্যবাদী (traditionalists), তারাও পারে! যদিও তাদের পথ হয়তো দুই মেরুর মতো আলাদা, কিন্তু দু’দলই মনে করে যে ইসলাম তার আসল রূপ থেকে কিছুটা সরে গেছে এবং ইসলামের সেই পুরনো রূপে, যা নাকি সালাফিয়্যারা (Salafiyya) চর্চা করত, সেই রূপে ফিরে যাওয়া দরকার (Hamdeh, 2021)।
মূলনীতি (Tenets)
বার্নার্ড হেইকেল (Bernard Haykel) নামের একজন পণ্ডিত বলছেন, অনেক সুন্নি মুসলিমের কাছেই ব্যাপারটা এরকম যে, “নবী মুহাম্মদ (Prophet Muhammad) এর যুগের যত কাছাকাছি সময়ের হবে, ততই সেটা ইসলামের সবচেয়ে খাঁটি রূপের কাছাকাছি হবে” (Haykel, 2009)। সালাফীরা নিজেদের প্রথমত এবং প্রধানত দেখে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারক হিসেবে। তাদের কাজ হলো ব্যক্তিগত আর সামাজিক – দুই ক্ষেত্রেই এক বিশেষ ধরনের কর্তৃত্ব আর পরিচিতি তৈরি করা এবং সেটাকে টিকিয়ে রাখা। তারা তাদের এই সংস্কারের কাজটাকে সংজ্ঞায়িত করে মূলত কিছু আকিদাগত মূলনীতির (creedal tenets) মাধ্যমে – মানে একটা ধর্মতত্ত্ব (theology) দিয়ে। তবে তাদের মানহাজ (manhaj) (আরবি: منهج মানে পদ্ধতি) এর ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট আইনি শিক্ষা আর সামাজিক আচার-ব্যবহার ও রাজনীতির ধরনও বেশ গুরুত্বপূর্ণ (Haykel, 2009)।
অনেকেই ভুল করে সালাফী দাওয়াহকে (da’wa) ফিকহ (fiqh) বা আইনশাস্ত্রের একটা মাযহাব (madhhab) বা সম্প্রদায় ভেবে বসেন। কিন্তু আসলে তা নয়। সালাফীরা বরং মালিকি (Maliki), শাফিঈ (Shafi’i), হাম্বলী (Hanbali), হানাফী (Hanafi) বা জাহিরী (Zahirite) – এই আইন সম্প্রদায়গুলোর তাকলিদ (taqlid) বা অন্ধভাবে মেনে চলার ঘোর বিরোধী। এই সালাফী সম্প্রদায়ের অনুসারীরা নিজেদের ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহ’ (Ahlul Sunna wal Jama’ah) – মানে সুন্নাহ ও জামা’আতের অনুসারী – হিসেবে পরিচয় দেয়। আবার এদেরকে ‘আহলে হাদীস’ (Ahl al-Hadith) নামেও ডাকা হয় (Asadullah al-Ghalib, 2012)। সালাফিয়্যা আন্দোলন আসলে ইসলামের শুরুর দিকের এই সুন্নি চিন্তাধারাকেই সমর্থন করে, যেটাকে আবার ঐতিহ্যবাদী ধর্মতত্ত্ব (traditionalist theology) নামেও চেনা যায় (Schmidtke, 2016)।
সালাফীরা যে শুধু নামাজ-কালামের ক্ষেত্রেই নবীর সুন্নাহ (sunnah) মেনে চলার ওপর জোর দেয়, তা কিন্তু নয়। তারা চায় দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ছোটখাটো কাজেও যেন সুন্নাহর প্রতিফলন থাকে। যেমন ধরুন, তাদের অনেকে খুব খেয়াল রাখে যেন খাওয়ার সময় সবসময় তিন আঙুল ব্যবহার করা হয়, অথবা বসে ডান হাতে তিন শ্বাসে জল পান করা হয় (Roy, 2004)। সেই যে ইবনে তাইমিয়ার কথা বলছিলাম, তার সম্প্রদায়ের কিছু মূল মতবাদ আছে, যেগুলোকে বিভিন্ন পণ্ডিত “আল-সালাফিয়্যাহ আল-তারিখিয়াহ” (al-Salafiyyah al-Tarikhiyah) বা “ঐতিহাসিক সালাফিবাদ” নামেও ডেকেছেন। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা হলো (Rabil, 2014):
-
ইসলামের প্রথম যুগের সেই সালাফ আস-সালিহদের (Salaf al-Salih) “খাঁটি বিশ্বাস ও অনুশীলন” আবার জাগিয়ে তোলা (revival)।
-
“তাওহীদ (tawhid)” বা আল্লাহর একত্বকে শক্ত করে ধরে রাখা।
-
ফিকহের যে বিভিন্ন মাযহাব (madh’habs) আছে, সেগুলোর কোনোটার প্রতিই অন্ধ পক্ষপাত (partisanship) না দেখানো।
-
ধর্মের কিতাবপত্র (religious scriptures) যা আছে, সেগুলোর একদম আক্ষরিক মানে (literalist adherence) মেনে চলা।
-
যেসব ইসলামী শাসক শরিয়াহ (Sharia) বা ইসলামী আইন মেনে দেশ চালান, তাদের প্রতি বিশ্বস্ত (loyalty) থাকা।
-
ইসলামে নতুন কিছু বা বিদ’আত (bid’ah) এবং ধর্মদ্রোহিতার (heresies) ঘোর বিরোধিতা করা।
তাকলিদ (আইনি নজিরের প্রতি আনুগত্য) বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি (Views on Taqlid (adherence to legal precedent))
সালাফী চিন্তাধারার একটা বড় লক্ষ্য হলো ফিকহ (Fiqh) বা ইসলামী আইনশাস্ত্রকে তাকলিদ (Taqlid) – মানে কোনো একটা নির্দিষ্ট মাযহাবের পুরনো আইনি সিদ্ধান্তের প্রতি অন্ধ আনুগত্য – থেকে বের করে আনা। তারা চায় মানুষ সরাসরি নবী (Prophet), তার সাহাবী (Companions) আর সেই প্রথম যুগের সালাফদের (Salaf) দিকে ফিরে তাকাক। নবীর দেখানো খাঁটি পথে ফিরে যাওয়ার এই পছন্দের রাস্তাটাকে তারা বলে “ইত্তিবা (Ittiba)” – যার মানে হলো, সরাসরি ধর্মগ্রন্থ ঘেঁটে নবীকে অনুসরণ করা (ElMasry, 2010)। আইনের ক্ষেত্রে, সালাফীরা সাধারণত নিজে নিজে যুক্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ (ijtihad) করাকে সমর্থন করে এবং আইনশাস্ত্রের যে চারটি বিখ্যাত সম্প্রদায় বা মাযহাব (madhahib) আছে, সেগুলোর কঠোর আনুগত্য বা তাকলিদকে (taqlid) প্রত্যাখ্যান করে (Al-Yaqoubi, 2015; Hamdeh, 2017; Böwering et al., 2013)।
যদিও মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব (Muhammad Ibn ‘Abd al-Wahhab) (মৃত্যু ১৭৯২) নিজে ব্যক্তিগতভাবে তাকলিদের চর্চা বাদ দিয়েছিলেন, কিন্তু তার অনুসারী ওয়াহাবী আলেমরা (Wahhabi scholars) মাঝে মাঝে হাম্বলী মাযহাব (Hanbali madhhab) মেনে চলার পক্ষে বলতেন, এমনকি ফতোয়া (fatwas) বা আইনি মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাকলিদের অনুমতি দিতেন (Warren, 2021)। ওয়াহাবীদের এই তাকলিদ প্রত্যাখ্যান করার নীতি পরবর্তীতে কিছু বিখ্যাত ওয়াহাবী উলেমার জন্ম দেয় – যেমন সা’দ ইবনে ‘আতিক (Sa’d ibn ‘Atiq), আবদ আল-রহমান আল-সা’দী (Abd al-Rahman al-Sa’dii), আল-উসাইমীন (al-Uthaymin), ইবনে বায (Ibn Baz) প্রমুখ। এরা কিন্তু হাম্বলী আইনের ধরাবাঁধা পথ থেকে বেশ খানিকটা সরে এসেছিলেন (Lacroix, 2011; Qadhi, 2014; Meijer, 2014; Gauvain, 2013)। আবার আরেকজন খুব পরিচিত সালাফী পণ্ডিত, আল-আলবানী (al-Albani), তিনি তো হানাফী, হাম্বলী, মালিকি বা শাফিঈ – এই চার মাযহাবের কোনোটাকেই অনুসরণ করার ঘোর বিরোধী ছিলেন (Alkatiri et al., 2023)।
তবে, সব সালাফী আন্দোলন একরকম নয়। কিছু আন্দোলন আছে যারা মনে করে তাকলিদ করাটাই বেআইনি এবং তারা আইনি সম্প্রদায়গুলোর কর্তৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে। তাদের যুক্তি হলো, যেহেতু মাযহাবগুলো ইসলামের প্রথম যুগের সালাফ আস-সালিহদের (Salaf al-Salih) বা ধার্মিক পূর্বসূরিদের সময়ের পরে তৈরি হয়েছে, তাই যে মুসলিমরা নিজে কিতাব না খুঁজে শুধু একটা মাযহাব মেনে চলে, তারা পথ হারিয়ে ফেলবে (Olidort, 2015; Cooke et al., 2005)। এই দলের মধ্যে আছেন আহলে হাদীস আন্দোলনের (Ahl-i Hadith movement) আলেমরা, যেমন মুহাম্মদ নাসির আল-দিন আল-আলবানী (Muhammad Nasir Al-Din al-Albani) (মৃত্যু ১৯৯৯), মুহাম্মদ হায়াত আল-সিন্ধী (Muḥammad Hayāt al-Sindhī) (মৃত্যু ১৭৫০), ইবনে আমির আল-সান’আনী (Ibn ‘Amir al-Șanʻānī) (মৃত্যু ১১৮২), আল-শাওকানী (al-Shawkānī) (মৃত্যু ১৮৩৪) প্রমুখ। এরা তাকলিদ বা অনুকরণকে একেবারে বাতিল করে দেন, আইনি সম্প্রদায়গুলোর কোনো ক্ষমতাই মানেন না, আর মুসলিমদের বলেন সরাসরি কুরআন ও হাদীসের ওপর ভিত্তি করে আলেমদের কাছ থেকে ফতোয়া নিতে, কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই (Bennett, 2013; Lacroix, 2011; Meijer, 2014)। আহলে হাদীস আলেমরা নিজেদেরকে হাম্বলী মাযহাব অনুসরণকারী ওয়াহাবীদের থেকে আলাদা মনে করতেন, কারণ তারা কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা মাযহাব মানতেন না (Krawietz et al., 2013)। এই আধুনিক যুগে এসে আল-আলবানী আর তার শিষ্যরা, হাম্বলী সম্প্রদায়ের প্রতি ওয়াহাবীদের টান দেখে, তাকলিদের ইস্যুতে তাদের সরাসরি সমালোচনা করেন এবং এমন এক নতুন ওয়াহাবিজমের ডাক দেন যা সালাফদের শিক্ষার বিরোধী সব উপাদান থেকে মুক্ত হবে (Meijer, 2014; Lacroix, 2011)।
আবার কিছু সালাফী পণ্ডিত আছেন, যেমন সাইয়্যেদ রশিদ রিদা (Sayyid Rashid Rida) (মৃত্যু ১৯৩৫), যারা একটা মাঝামাঝি পথ ধরেছেন। তারা বলেন, সাধারণ মানুষ (layperson), যার খুব বেশি জ্ঞানগম্যি নেই, সে প্রয়োজনে তাকলিদ করতে পারে। কিন্তু যখনই ধর্মগ্রন্থের কোনো প্রমাণ তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে, তখন তাকে অবশ্যই ইত্তিবা (Ittiba) বা সরাসরি কিতাব মেনে চলতে হবে। এদের আইনি পদ্ধতিটা কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নয়, বরং তারা সব মাযহাবের বইপত্রকেই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে। ইবনে তাইমিয়া আর তার ছাত্র ইবনে কাইয়িমকে (Ibn Qayyim) অনুসরণ করে, এই আলেমরা মনে করেন সুন্নি ফিকহের বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার খুবই মূল্যবান এবং চারটি সুন্নি মাযহাবের লেখালেখি এই যুগের সমস্যার সমাধানে ফতোয়া দেওয়ার জন্য খুব দরকারি সম্পদ (Shaham, 2018; Qadhi, 2014)। আবার একেবারে উল্টো দিকে, কিছু সালাফী আছেন যারা মনে করেন তাকলিদ করাটা আসলে শিরক (shirk) বা আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করার মতো পাপ (Bennett, 2013)!
আজকের দিনের সালাফীরা সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের পুরনো নিয়মকানুন মেনে চলার অভ্যাসটাকে বাদ দিয়েছে। তারা তাকলিদের নীতিকে (অন্ধ অনুকরণ) বিদ’আত (bid’ah) বা নতুন উদ্ভাবন বলে নিন্দা করে। এদের ওপর জাহিরী সম্প্রদায়ের (Zahirite school) আইনি নীতির বেশ ভালো প্রভাব দেখা যায়। জাহিরীরা ঐতিহাসিকভাবেই মাযহাব-বিরোধী চিন্তাধারার জন্য পরিচিত ছিল এবং তারা আইনি সম্প্রদায়গুলোর এই গেঁড়ে বসা ব্যবস্থাকে মানতে চায়নি। ইসলামের শুরুর দিকের জাহিরী পণ্ডিত ইবনে হাযম (Ibn Hazm) তাকলিদের খুব সমালোচনা করতেন এবং বলতেন সরাসরি কুরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে ফিকহ তৈরি করে এই মাযহাবগুলোর ব্যাখ্যা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তার এই ডাক সালাফিয়্যা আন্দোলনের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে (Khan, 2020)। সালাফী আইনকানুনকে প্রায়শই চেনা যায় চারটি প্রধান সুন্নি মাযহাবের প্রতিষ্ঠিত বা মু’তামাদ (mu’tamad) নিয়ম থেকে তাদের সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখে। আর এটাও দেখা যায় যে, তারা প্রায়ই ইবনে হাযমের বিখ্যাত বই ‘আল-মুহাল্লা’ (Al-Muhalla)-তে লেখা জাহিরী মতামতের সাথে একমত হয় (Gauvain, 2013; Qadhi, 2014)।
পান্ডিত্যিক অনুক্রম (Scholarly hierarchy)
বার্নার্ড হেইকেল (Bernard Haykel) নামের সেই পণ্ডিত আবার বলছেন, সালাফীদের নিয়মকানুন বা পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম হওয়ার কারণে, তাদের মধ্যে আলেম-উলেমা বা পান্ডিত্যিক কর্তৃপক্ষের (ulema) যে অনুক্রম বা স্তরবিন্যাস থাকে, সেটা তুলনামূলকভাবে কম কড়াকড়ি। বেশিরভাগ সালাফী, পুরনো দিনের বা প্রাক-আধুনিক মুসলিমদের মতো নয়, তারা এমন কোনো উঁচু-নিচু স্তরবিন্যাসে বিশ্বাস করে না যা খুব কঠোরভাবে “কে কী মত দেবে বা ফতোয়া দেবে, সেটা নিয়ন্ত্রণ বা সীমাবদ্ধ করে”। একটা ব্যাখ্যামূলক গোষ্ঠী হিসেবে, সালাফী ঐতিহ্যটা, “ইসলামের অন্যান্য শিক্ষা পদ্ধতির তুলনায়”, “বেশ খোলামেলা, এমনকি কিছুটা গণতান্ত্রিকও” বলা চলে (Haykel, 2009)।
পদ্ধতি এবং ব্যাখ্যারীতি (Methodology and hermeneutics)
আজকের দিনে যারা আসারী (Athari) ধর্মতত্ত্ব সম্প্রদায়ের অনুসারী, তাদের বেশিরভাগই আসলে সালাফী আন্দোলন থেকেই এসেছেন। তারা ইবনে তাইমিয়ার (Ibn Taymiyya) আসারী ঘরানার লেখাগুলোকে খুব গুরুত্ব দেন (Halverson, 2010)। ইবনে তাইমিয়া নিজে তার সময়ে বেশ বিতর্কিত ছিলেন, অনেকে তাকে প্রত্যাখ্যানও করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি সালাফী আন্দোলনের অনুসারীদের কাছে একজন মহীরুহ পণ্ডিত হয়ে ওঠেন, এমনকি তাকে ‘শায়খ আল-ইসলাম (Shaykh al-Islam)’ বা ইসলামের শেখ উপাধিতেও ভূষিত করা হয়। এই ধারার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আছেন, যেমন ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত পণ্ডিত আহমদ ইবনে হাম্বল (Ahmad ibn Hanbal) (Cook, 1992)।
অন্যদিকে যারা কালাম (Kalam) বা যুক্তিবাদী ধর্মতত্ত্ব চর্চা করেন, তারাও কিন্তু ইসলামের প্রথম যুগের সালাফ আস-সালিহদের (Salaf al-Salih) সম্মান করেন। তারা নবী মুহাম্মদ এবং তার সাহাবাদের (Sahaba) ধর্মীয় জীবনে আদর্শ হিসেবে দেখেন। কিন্তু তারা সালাফদের অনুসরণ করেন পুরনো দিনের মাযহাবগুলোর ঐতিহ্য এবং সেগুলোর ধর্মীয় আলেম বা যাজকতন্ত্রের (religious clergy) চশমা দিয়ে। আর সালাফীরা? তারা চেষ্টা করে সালাফ আস-সালিহদের অনুসরণ করতে সরাসরি ধর্মগ্রন্থ বা স্ক্রিপচারের (scriptural evidences) প্রমাণ ঘেঁটে, প্রায়শই মাযহাবগুলোর পুরনো কেতাব বা ম্যানুয়ালগুলোকে পাশ কাটিয়ে। তবে একটা বিষয়ে সালাফী আর মুতাকাল্লিমুন (Mutakallimun) – উভয় পক্ষই একমত, আর তা হলো সুন্নি ঐতিহ্যে সালাফদের গুরুত্ব অপরিসীম (Wagemakers, 2016)।
সালাফী মুসলিমদের কাছে ইসলামের জ্ঞান আর আইনের জন্য একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস হলো কুরআন (Qur’an), সুন্নাহ (Sunnah) (যেটাকে তারা আবার ‘কুতুব আল-সিত্তাহ’ বা ছয়টি প্রধান হাদীসগ্রন্থের সাথে এক করে দেখেন), আর হলো সাহাবাদের কাজকর্ম বা কথাবার্তা (Evstatiev, 2021)। যদিও সালাফীরা মনে করে যে নতুন কোনো সমস্যা আসলে সেটার সমাধান ধর্মগ্রন্থ থেকেই খুঁজে বের করতে হবে, তবে সেটা করতে হবে আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে। কিন্তু তাই বলে তারা ধর্মগ্রন্থের যুক্তিবাদী ব্যাখ্যাকে (rationalist interpretations) একদমই পাত্তা দেয় না। ধর্মগ্রন্থ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যুক্তির ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি, সালাফী আলেমরা মধ্যযুগের আইনি বইপত্র আর কেতাবের গুরুত্বও কমিয়ে দিয়েছেন। তাদের কাছে সালাফদের যুগের লেখালেখিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সালাফীরা কোনো আয়াতের অর্থ নিয়ে তর্কাতর্কি করার চেয়ে সেটাকে কাজে লাগানো বা আমল করার ওপর বেশি জোর দেয়। তাদের মতে, অর্থ হয়তো একদম পরিষ্কার, অথবা সেটা মানুষের বোঝার ক্ষমতার বাইরে (Bin Ali Mohamed, 2015)।
যেহেতু তারা আসারী ধর্মতত্ত্বের অনুসারী, সালাফীরা মনে করে যে কালাম (kalam) বা অনুমানমূলক ধর্মতত্ত্বে (speculative theology) যুক্ত হওয়াটা একেবারেই হারাম বা নিষিদ্ধ (Halverson, 2010)। আসারীরা কুরআন আর হাদীসের একদম আক্ষরিক আর ভাবনাহীন (amodal) পাঠে বিশ্বাসী। তাদের কাছে আকীদা বা বিশ্বাসের প্রশ্নে শুধু কিতাবের স্পষ্ট বা আপাত অর্থেরই দাম আছে। যারা তা’বিল (Ta’wil) বা রূপক ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী, তাদের থেকে এরা আলাদা। আসারীরা কুরআনের অর্থকে যুক্তি দিয়ে বুঝতে বা ধারণাবদ্ধ করতে যায় না; তারা মনে করে আসল অর্থ কী, সেটা একমাত্র আল্লাহই জানেন, তাই সেটা আল্লাহর ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত (এই ছেড়ে দেওয়াকে বলে তাফবিদ – tafwid) (Halverson, 2010)। এই যে ব্যাখ্যার নিজস্ব রীতি, এর কারণে সালাফীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনটা জায়েজ বা অনুমোদিত (permissibility) আর কোনটা নয়, সেই প্রশ্নে অ-সালাফীদের থেকে ভিন্নমত পোষণ করে (Bin Ali Mohamed, 2015)।
সেই যে ইবনে তাইমিয়ার কথা হচ্ছিল, তিনি তার সময়ে সুফি (Sufis), জাহমাইট (Jahmites), আশ’আরী (Asha’rites), শিয়া (Shias), ফালসাফা (Falsafa) বা দার্শনিকদের মতো অনেক ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভুল ধরিয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বহু বইপত্র লিখে গেছেন (Rabil, 2014)। “সালাফিয়্যা (Salafiyya)”-র ধর্মতাত্ত্বিক পথটা কেমন, সেটা বোঝাতে গিয়ে ইবনে তাইমিয়া এক ফতোয়ায় বলেছিলেন:
“সালাফদের পথ হলো, আল্লাহর গুণাবলী (Divine attributes) সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত আর হাদীসগুলোকে সেগুলোর প্রকাশ্য বা আক্ষরিক অর্থে নেওয়া [ijra’ ayat al-sifat wa ahadith al-sifat ‘ala zahiriha], কিন্তু তার ওপর মানুষের মতো গুণাবলী (anthropomorphic qualities) আরোপ না করা [ma’ nafy al-kayfiyya wal tashbih]।”
– তাকি আল-দিন ইবনে তাইমিয়া, আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা (মহান ধর্মীয় আদেশ), খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৫২, (Rabil, 2014)
ইবনে তাইমিয়ার শিক্ষা (Teachings of Ibn Taymiyya)
সালাফিয়্যা ঘরানার অনুসারীরা মধ্যযুগের সেই বিখ্যাত ফকীহ (jurist) ইবনে তাইমিয়াকে (Ibn Taymiyya) ধর্মতত্ত্ব (theology) আর আধ্যাত্মিকতার (spirituality) জগতে তাদের সবচেয়ে বড় ক্লাসিক্যাল বা পুরনো দিনের পাণ্ডিত্যিক গুরু হিসেবে মানে। ইবনে তাইমিয়ার লেখা ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক বইপত্রগুলোই আজকের দিনের ওয়াহাবী (Wahhabi), আহলে হাদীস (Ahl-i Hadith) আর অন্যান্য নানান সালাফী আন্দোলনের মূল আকীদা বা বিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি করে। ইবনে তাইমিয়া তাওহীদ (Tawhid) বা আল্লাহর একত্বের ধারণাকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন:
-
আত-তাওহীদ আর-রুবুবিয়্যা (At-tawḥīd ar-rubūbiyya): প্রভুত্বে একত্ব (Oneness in Lordship) – মানে আল্লাহই একমাত্র রব বা প্রভু।
-
আত-তাওহীদ আল-উলুহিয়্যা (At-tawḥīd al-ulūhiyya): ইবাদতে একত্ব (Oneness in Worship) – মানে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে।
-
আত-তাওহীদ আল-আসমা ওয়াস-সিফাত (At-tawhid al-assmaa was-sifaat): নাম ও গুণাবলীতে একত্ব (Oneness in names and attributes) – মানে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী তার জন্যই নির্দিষ্ট, সেগুলোতে আর কারো অংশীদারিত্ব নেই।
ইসলামের মূল সাক্ষ্য বা শাহাদা (Shahada) কে ইবনে তাইমিয়া ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে – কেবল আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে, “শুধুমাত্র তিনি যা বিধান দিয়েছেন তার মাধ্যমে (only by means of what He has legislated)”, অন্য কারো বা কিছুর মাধ্যমে নয়, কোনো অংশীদার ছাড়া। সালাফীরা এই ব্যাখ্যাটাকেই তাদের ঈমানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই আধুনিক যুগে এসে ধর্মতত্ত্ব আর নতুন নতুন বিদ’আত (innovated practices) নিয়ে ইবনে তাইমিয়ার লেখাগুলো নানান ধরনের সালাফী আন্দোলনকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে (Hoover, 2019; Schmidtke, 2016)। বিশ শতকে এই আন্দোলনগুলোর বাড়বাড়ন্তের ফলে ইবনে তাইমিয়ার লেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ আবার নতুন করে জেগে উঠেছে, যা এখন আর শুধু সালাফী গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সালাফীরা সাধারণত ইবনে তাইমিয়াকে খুব সম্মান করে ‘শায়খ আল-ইসলাম (Shaykh al-Islām)’ উপাধিতে ডাকে। ইবনে তাইমিয়ার সাথে সাথে তার বিখ্যাত ছাত্র যেমন ইবনে কাইয়িম আল-জাওজিয়্যা (Ibn Qayyim al-Jawziyya), ইবনে কাসির (Ibn Kathir), আল-জাহাবী (Al-Dhahabi) প্রমুখের লেখালেখি সালাফী মহলে সবচেয়ে বেশি পড়া হয় এবং রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয় (Schmidtke, 2016; Martin, 2004; Bosworth et al., 1997; Leaman, 2006; Lauziere, 2010)।
ইবনে তাইমিয়ার লেখা বইপত্র, যেগুলো কিনা ঐতিহ্যবাদী (Traditionalist) আকীদার পক্ষে কথা বলে আর অন্যান্য ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়গুলোর কড়া সমালোচনা করে, সেগুলোই সালাফিয়্যা সম্প্রদায়ের ধর্মতত্ত্বের মূল নির্যাস ধারণ করে (Leaman, 2006)। ইবনে তাইমিয়া আবার একটা মজার কথা বলেছেন। তিনি আলেমদের একটা পুরনো ঐকমত্য বা ইজমা (Ijma) এর কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, কেউ যদি নিজেকে সালাফদের অনুসারী বলে পরিচয় দেয়, তাতে কোনো লজ্জা নেই, বরং সেটা গ্রহণ করা উচিত:
“নিজেকে সালাফের অনুসারী ঘোষণা করার মধ্যে, এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং এর জন্য গর্ববোধ করার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই; বরং পাণ্ডিত্যপূর্ণ ঐকমত্য অনুসারে, এটা অবশ্যই তার কাছ থেকে গ্রহণ করতে হবে। সালাফের মাযহাব বা পথ সত্য ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। যদি কোনো ব্যক্তি বাইরে ও ভেতরে – উভয় দিক থেকেই এটা মেনে চলে, তবে সে হলো সেই বিশ্বাসীর মতো, যে বাইরে ও ভেতরে – উভয় দিক থেকেই সত্যকে অনুসরণ করছে।” (Islam Helpline, n.d.; Ibn Taymiyya, n.d.)
ইতিহাসের পাতা থেকে (History)
গল্পটা শুরু করা যাক উনিশ শতকের শেষের দিকের আরব বিশ্ব থেকে। তখন চারদিকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর বেশ দাপট (Moussalli, 1999; Esposito & Shahin, 2013; Dubler, 2010; Campo, 2009)। সেই সময়টাতেই সালাফিয়্যা আন্দোলনের জন্ম হয়। এই আন্দোলনের কয়েকজন চেনা মুখের মধ্যে ছিলেন জামাল আল-দিন কাসিমি (Jamal al-Din Qasimi) (১৮৬৬–১৯১৪), ‘আব্দ আল-রাজ্জাক আল বিতর (‘Abd al-Razzaq al Bitar) (১৮৩৭–১৯১৭), তাহির আল-জাজাইরি (Tahir al-Jazai’iri) (১৮৫২–১৯২০) (Moussalli, 1999) আর মুহাম্মদ রশিদ রিদা (Muhammad Rashid Rida) (১৮৬৫–১৯৩৫) (Mattar, 2004)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই সালাফী দাওয়াতের কাজকর্ম চলত বেশ গোপনে। কিন্তু যুদ্ধের পর এদের চিন্তাভাবনাগুলো বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ ছড়িয়ে পড়ে এবং শিকড় গাড়তে শুরু করে (Moussalli, 1999)। রশিদ রিদার মতো কিছু আলেম, যারা রাজনীতির ব্যাপারে বেশ সচেতন ছিলেন, তারা জোর গলায় বলতে শুরু করলেন যে একটা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যেখানে ইসলামী আইন বা শরিয়া মেনে সবকিছু চলবে। এই ধারণাটা সালাফিয়্যার একটা আরও গোঁড়া ধারার জন্ম দেয়, যা আবার মিশরের বিখ্যাত মুসলিম ব্রাদারহুড (Muslim Brotherhood) সংগঠনকেও প্রভাবিত করে (Martin, 2016)।
‘সালাফিয়্যা’ নামটা, যা কিনা ইসলামের সেই পুরনো দিনের বা সালাফ আস-সালিহদের (Salaf al-Salih) শিক্ষা অনুযায়ী চলার কথা বলে, এটা জনপ্রিয় করে তোলেন তাহির আল-জাজাইরির কিছু সিরীয় শিষ্য। তারা ১৯০০ সালের দিকে মিশরে বেশ সক্রিয় ছিলেন। ১৯০৯ সালে কায়রোতে তারা একটা বিখ্যাত বইয়ের দোকান খোলেন, নাম “আল-মাকতাবা আল-সালাফিয়্যা” (al-Maktaba al-Salafiyya) বা “সালাফী বইয়ের দোকান”। রশিদ রিদা ১৯১২ সাল থেকে এই দোকানের মালিকদের সাথে হাত মেলান। তারা একসাথে পুরনো দিনের ইসলামী বই, ওয়াহাবী মতাদর্শের ছোট ছোট বই ইত্যাদি ছাপাতে শুরু করেন। তাদের একটা নিজস্ব পত্রিকাও ছিল, “আল-মাজাল্লা আল-সালাফিয়্যা” (Al-Majalla al-Salafiyya), যেখানে তারা প্রচুর লেখালেখি করতেন। সেই সময় ‘সালাফিয়্যা’ শব্দটা এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, লুই মাসিগনন (Louis Massignon) নামের একজন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ (Orientalist) ভুল করে জামাল আল-দিন আফগানি আর মুহাম্মদ ‘আবদুহকেও এই দলের লোক ভেবে বসেন। যদিও এই ধারণাটা আসলে ঠিক ছিল না, তবুও বহু বছর ধরে পশ্চিমা পণ্ডিতদের মধ্যে এটাই চালু ছিল (Bennett & Shepard, 2013)।
মজার ব্যাপার হলো, সালাফীরা নিজেরা বিশ্বাস করে যে তাদের এই “সালাফিয়্যা” ধারাটা কোনো নতুন জিনিস নয়, বরং ইসলামের একেবারে শুরু থেকেই এটা চলে আসছে (Dubler, 2010)। তাদের এই দাবির পক্ষে তারা পুরনো দিনের কিছু লেখা থেকে উদাহরণ দেয় যেখানে “সালাফী” শব্দটা পাওয়া যায়। যেমন, আল-সাম’আনী (al-Sam’ani) (মৃত্যু ১১৬৬) নামের একজন পুরনো লেখক তার বংশপরিচয়ের অভিধানে “আল-সালাফী” উপাধি নিয়ে লিখেছিলেন: “যতদূর শুনেছি, এই উপাধিটা নাকি বোঝায় যে এর অধিকারী ব্যক্তি সেই পুরনো দিনের ধার্মিক পূর্বপুরুষদের সাথে সম্পর্কিত এবং তাদের মতবাদ বা মাযহাব মেনে চলেন।” (al-Samʻani, 1976; Lauzière, 2008)। আবার আসারী ধর্মতত্ত্বের আরেকজন পণ্ডিত, আল-জাহাবী (Al-Dhahabi), তার শিক্ষক ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন যে, তিনি “খাঁটি সুন্নাহ এবং আল-তারিকা আল-সালাফিয়াহ (সালাফী পথ বা পদ্ধতি)” মেনে চলতেন। এটা দিয়ে তিনি ইবনে তাইমিয়ার সেই স্বতন্ত্র আইনশাস্ত্রীয় পদ্ধতির দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যা কিনা সরাসরি ধর্মগ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে ছিল এবং অনেক সময় প্রচলিত মাযহাবগুলোর মতের সাথে মিলত না (Rabil, 2014)।
তবে হেনরি লুজিয়ের (Henri Lauzière) নামের একজন আধুনিক পণ্ডিত আল-সাম’আনীর কথার ওপর একটু সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেন, সাম’আনী নাকি মাত্র দুজন লোকের (এক বাবা আর তার ছেলে) নাম বলতে পেরেছিলেন যারা ‘আল-সালাফী’ নামে পরিচিত ছিলেন। হেনরি লুজিয়ের এটাও বলছেন যে, সাম’আনীর লেখায় নাকি তাদের পুরো নামও নেই, শুধু ফাঁকা জায়গা! হয়তো সাম’আনী তাদের নাম ভুলে গিয়েছিলেন বা ঠিকঠাক জানতেনই না (Lauzière, 2008)। লুজিয়েরের মতে, সাম’আনীর অভিধান দেখে মনে হয় ‘আল-সালাফী’ উপাধিটা তখন খুব একটা প্রচলিত ছিল না। আর তারও ২০০ বছর পরে লেখা আল-জাহাবীর একটা মাত্র উদাহরণ দিয়ে সালাফীদের দাবি প্রমাণ করাটা একটু কঠিন (Lauzière, 2008)।
আসল উৎস কোথায়? (Origins)
সালাফী আন্দোলনের মূল কথা হলো ইসলামের সেই সোনালী দিনের দিকে ফিরে তাকানো, মানে সালাফ আস-সালিহদের (Salaf al-Salih) যুগের দিকে। এরা ছিলেন নবী মুহাম্মদ এর পরের প্রথম তিন প্রজন্মের মুসলিম। সালাফীরা মনে করে, সেই সময়ের মানুষদের বিশ্বাস আর কাজকর্মই ছিল সবচেয়ে খাঁটি আর অনুকরণীয়। তারা চেষ্টা করে নিজেদের জীবনেও সেই সালাফদের মতো মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে, যেন একটা নতুন ‘স্বর্ণযুগ’ তৈরি করা যায়। তারা চায় ইসলামের একটা আদিম, নিখাদ সংস্করণকে পুনরুজ্জীবিত করতে, যা নাকি পরবর্তীকালে যুক্ত হওয়া সব ভেজাল থেকে মুক্ত হবে – এর মধ্যে যেমন আছে ফিকহের চারটি প্রধান মাযহাব, তেমনি আছে জনপ্রিয় সুফিবাদও (popular Sufism)।
সালাফিবাদের উত্থানের সময়টা আবার মিলে যায় ইসলামী বিশ্বের অনেক জায়গায় পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার (Western colonialism) বাড়বাড়ন্তের সাথে। আঠারো থেকে বিশ শতকের মধ্যে, এই ধরনের সংস্কারবাদী আন্দোলনগুলো আওয়াজ তোলে – তারা সরাসরি ধর্মগ্রন্থ বা স্ক্রিপচারে (Scriptures) ফিরে যাওয়ার কথা বলে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটা নির্দিষ্ট মানে আনার (institutional standardisations) চেষ্টা করে, আর ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে জিহাদেরও (jihad) ডাক দেয় (Ridgeon, 2015)।
উনিশ শতকের শেষের দিকে ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যখন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের (European imperialism) চাপ বাড়ছে, ঠিক তখনই এর বিরুদ্ধে একটা ইসলামী প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই আন্দোলনটার বিকাশ ঘটে (Harvard Divinity School, 2018; Esposito & Shahin, 2013; Dubler, 2010; Campo, 2009)। এই সালাফী পুনর্জাগরণকারীদের মূল প্রেরণা ছিলেন মধ্যযুগের সিরিয়ার একজন বিখ্যাত হাম্বলী ধর্মতাত্ত্বিক, ইবনে তাইমিয়া (Ibn Taymiyya)। তিনি দর্শন (philosophy) আর সুফিবাদের (Sufism) অনেক রীতিনীতিকে ধর্মদ্রোহী (heretical) বা বিদ’আত বলে কড়া সমালোচনা করেছিলেন। ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাভাবনা ছিল বেশ বিপ্লবী – তিনি মুসলিমদের আহ্বান জানিয়েছিলেন সেই পুরনো দিনের সালাফ আস-সালিহদের (ধার্মিক পূর্বপুরুষ) আদিম, খাঁটি ইসলামে ফিরে যেতে, আর সেটা করতে হবে সরাসরি ধর্মগ্রন্থগুলো বুঝে (Ágoston et al., 2009)।
প্রাথমিক সালাফিয়্যার ওপর আরও কয়েকটা পুরনো আন্দোলনের প্রভাব ছিল। যেমন, আঠারো শতকের আরবের ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahhabi movement) (Tucker & Roberts, 2008), ভারতীয় উপমহাদেশের শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (Shah Waliullah Dehlawi), শাহ ইসমাইল দেহলভী (Shah Ismail Dehlawi) আর সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (Sayyid Ahmad Shaheed) এর নেতৃত্বে চলা সংস্কার আন্দোলন (Siyech, 2020; Khan, 2020), এবং ইয়েমেনের আল-সান’আনী (Al-San’aani) আর আল-শাওকানী (Al-Shawkani) এর নেতৃত্বে চলা ইসলাহ আন্দোলন (Yemeni islah movement) (Oxford Islamic Studies Online, n.d.; RRG, 2016)।
এই সবগুলো আন্দোলনের মূল বিশ্বাস ছিল যে, কুরআন আর সুন্নাহই হলো শরিয়ার প্রধান উৎস। তাই সমাজে বা ধর্মে যা কিছু চালু আছে, সেগুলোকে কুরআন-হাদীসের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখা উচিত। যদিও এই ধারণাটা নতুন কিছু ছিল না – হাম্বলী মাযহাবের মধ্যে এই ঐতিহ্যবাদী চিন্তাটা (traditionist thesis) আগে থেকেই চালু ছিল। মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন আঠারো শতকের আরবে এই হাম্বলী ঐতিহ্যবাদকে (Hanbali traditionism) বেশ জোরেশোরে পুনরুজ্জীবিত করে। ইবনে তাইমিয়া আর তার ছাত্র ইবনে কাইয়িম আল-জাওজিয়্যার লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের শিক্ষাগুলো আবার পুরনো দিনের হাম্বলী লেখক যেমন ‘আব্দ আল্লাহ ইবনে আহমদ বা আবু বকর আল-খাল্লাল, এমনকি অ-হাম্বলী পণ্ডিত যেমন ইবনে হাযম (যাকে তিনি প্রায়ই উদ্ধৃত করতেন) – তাদের চিন্তাভাবনার সাথেও বেশ মিলেমিশে গিয়েছিল।
অন্যদিকে, ভারতের হাদীস বিশেষজ্ঞ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী তাকলিদ বা অন্ধ অনুসরণ প্রত্যাখ্যান করলেও, তিনি মনে করতেন ফুকাহা বা আইনজ্ঞদের হাদীস অধ্যয়নে, ব্যাখ্যায় এবং যুক্তিতর্কে অংশ নেওয়া উচিত। তাই তিনি ফিকহের পুরনো কাঠামোর প্রতি বেশ নমনীয় ছিলেন (Brown, 1999)। কিন্তু ইয়েমেনে আবার প্রভাবশালী আলেম মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-শাওকানী (১৭৫৯–১৮৩৪) তাকলিদকে আরও অনেক বেশি কঠোরভাবে নিন্দা করেন। তার আন্দোলন ফিকহের পুরনো সব কাঠামোকে পুরোপুরি বাদ দেওয়ার পক্ষে ছিল। এই আন্দোলনগুলো একদিকে যেমন ইজতিহাদ বা স্বাধীন যুক্তির ওপর জোর দিয়েছিল, তেমনি অন্যদিকে কুরআন ও হাদীসের কঠোর অনুসরণের কথাও বলেছিল (Brown, 1999; Ahsan, 1987)।
অটোমান সাম্রাজ্যের গল্প (Ottoman Empire)
এবার একটু সতেরো শতকের অটোমান সাম্রাজ্যের দিকে তাকানো যাক। সেই সময়ে কাদিজাদেলি (Kadızadelis) (কাযিযাদালিও বলে অনেকে) নামে একটা বেশ শুদ্ধতাবাদী বা পিউরিটান ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এদের নেতা ছিলেন কাদিজাদে মেহমেদ (Kadızade Mehmed) (১৫৮২-১৬৩৫) নামে একজন পুনর্জাগরণবাদী ইসলামী প্রচারক। কাদিজাদে আর তার চেলারা ছিলেন সুফিবাদ আর সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত লোকধর্মের ঘোর বিরোধী। অটোমানদের অনেক চালু রীতিনীতিকেই কাদিজাদে বিদ’আত বা “ইসলাম-বহির্ভূত নতুনত্ব” বলে উড়িয়ে দিতেন। তারা চাইতেন ইসলামের সেই প্রথম যুগের (প্রথম/সপ্তম শতক) মুসলিমদের বিশ্বাস আর কাজকর্মকে আবার ফিরিয়ে আনতে – মানে সোজা কথায় “ভালো কাজের আদেশ দেওয়া আর মন্দ কাজে বাধা দেওয়া” (Evstatiev, 2016)।
কাদিজাদে মেহমেদের কথাবার্তায় ছিল আগুনের মতো তেজ। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হয়ে বহু লোক তার দলে ভিড়েছিল, অটোমান সাম্রাজ্যের ভেতরকার সব দুর্নীতি দূর করার শপথ নিয়ে। এই আন্দোলনের নেতারা এমনকি বাগদাদের বড় বড় মসজিদের প্রচারক হিসেবে সরকারি পদও পেয়েছিলেন। তারা একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন, তেমনি অটোমান রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরের লোকদেরও পাশে পেয়েছিলেন (Cook, 2003)। ১৬৩০ থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যে এই কাদিজাদেলিদের সাথে তাদের অপছন্দের লোকদের প্রচুর মারামারি আর ঝগড়াঝাঁটি লেগেছিল। আন্দোলন যত এগিয়েছে, এর কর্মীরাও তত বেশি হিংস্র হয়ে উঠেছে। এমনও শোনা যায়, কাদিজাদেলিরা নাকি মসজিদ, সুফিদের আস্তানা বা টেক্কে, এমনকি অটোমান কফিহাউসগুলোতেও ঢুকে পড়ত আর যারা তাদের গোঁড়া মতবাদ মানত না, তাদের ধরে ধরে শাস্তি দিত।
বদলের হাওয়া (Evolution)
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ ভারতে আহলে হাদীস আন্দোলন আবার শাহ ওয়ালিউল্লাহ আর আল-শাওকানীর পুরনো শিক্ষাগুলোকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে। তারা তাকলিদ বা অন্ধ অনুসরণ বাদ দিয়ে সরাসরি হাদীস পড়ার ওপর জোর দেয়। তবে তারা শাহ ওয়ালিউল্লাহর দেখানো পথ থেকে একটু সরে গিয়ে হাদীসের একদম আক্ষরিক অর্থ করা শুরু করে এবং পুরনো আইনি কাঠামো গুলোকে প্রত্যাখ্যান করে জাহিরী সম্প্রদায়ের (Zahirite school) দিকে ঝুঁকে পড়ে।
একই সময়ে, উনিশ শতকে ইরাকে হাম্বলী ঐতিহ্যবাদ আবার জেগে ওঠে প্রভাবশালী আলুসি পরিবারের হাত ধরে। এই পরিবারের তিন প্রজন্ম – মাহমুদ আল-আলুসি (মৃত্যু ১৮৫৩), নু’মান আল-আলুসি (মৃত্যু ১৮৯৯) আর মাহমুদ শুকরি আল-আলুসি (১৮৫৭–১৯২৪) – আরব বিশ্বে ইবনে তাইমিয়া আর ওয়াহাবী আন্দোলনের মতবাদ ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখেন। মাহমুদ শুকরি আল-আলুসি, যিনি নিজে ওয়াহাবী আন্দোলনের একজন বড় সমর্থক আর ইতিহাসবিদ ছিলেন, তিনি আবার সালাফিয়্যা আন্দোলনেরও একজন নেতা ছিলেন। এই সব ছোট-বড় সংস্কারের স্রোতগুলো মিলেমিশে উনিশ শতকের শেষের দিকে আর বিশ শতকের প্রথম দিকে আরব বিশ্বে একটা বড় ধর্মতাত্ত্বিক দল হিসেবে প্রাথমিক সালাফিয়্যা আন্দোলনের জন্ম দেয়, যার সাথে আবার সাইয়্যেদ রশিদ রিদার (১৮৬৫–১৯৩৫) কাজের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল (Brown, 1999)।
উনিশ শতকের শেষ দিককার কথা (Late nineteenth-century)
সালাফিয়্যা আন্দোলনের প্রথম ঢেউটা লাগে উনিশ শতকের শেষের দিকে, অটোমান সাম্রাজ্যের আরব প্রদেশগুলোর সংস্কারমনা আলেম বা উলেমাদের মধ্যে। এই আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিলেন হাম্বলী ধর্মতাত্ত্বিক আহমদ ইবনে তাইমিয়া। তিনিই বলেছিলেন ইসলামের প্রথম যুগের সালাফদের পথ অনুসরণ করতে, আর সেই থেকেই এই নামটার উৎপত্তি। শুরুর দিকে এই আন্দোলন চেষ্টা করেছিল জ্ঞান বা ‘ইলম’ আর সুফিবাদ বা ‘তাসাউউফ’ এর মধ্যে একটা ভারসাম্য এনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে। দামেস্ক শহর তখন মুসলিম বিশ্বের জ্ঞানচর্চার একটা বড় কেন্দ্র ছিল। শহরটি সালাফিয়্যার এই প্রাথমিক ধারণাগুলোর জন্ম আর প্রসারে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
এই সময়ের কিছু পণ্ডিত, যেমন আমির ‘আব্দ আল-কাদির আল-জাজাইরি, আবার ইবনে আরাবীর মতো রহস্যময় সুফিদের বিশ্বাসকে নতুন করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, যাতে সেটা ইবনে তাইমিয়ার আপাত বিরোধী ধর্মতত্ত্বের সাথে মিলে যায় আর নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যায়। এই আন্দোলনের আরও কিছু পরিচিত মুখ ছিলেন ‘আব্দ আল-রাজ্জাক আল-বিতার, জামাল আল-দিন আল-কাসিমি, তাহির আল-জাজাইরি প্রমুখ। ‘আব্দ আল-রাজ্জাক আল-বিতার (যিনি আবার রশিদ রিদার শিষ্য মুহাম্মদ বাহজাত আল বিতারের পিতামহ ছিলেন) সংস্কার আন্দোলনের একটু বেশি ঐতিহ্যবাহী ধারার নেতৃত্ব দেন, যা পরে দামেস্কের সালাফিয়্যা নামে পরিচিত হয়। অনেক বছর পর রশিদ রিদা তাকে “সিরিয়ায় পুরনো দিনের মতবাদের পুনরুজ্জীবিতকারী” বা “মুজাদ্দিদ মাযহাব আল-সালাফ ফিল-শাম” বলে বর্ণনা করবেন। যদিও এই সংস্কারকরা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত সুফিবাদের অনেক কিছুর সমালোচনা করতেন, কিন্তু তারা সুফিবাদকে পুরোপুরি বাতিল করে দেননি।
এরই মধ্যে, ১৮৮০-র দশকে কায়রোতে মুহাম্মদ আবদুহের নেতৃত্বে আরেকটি ধারা গড়ে ওঠে, যা দামেস্কের সালাফিয়্যা আর মু’তাজিলা দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। আবদুহের আন্দোলন চেয়েছিল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য একটা যুক্তিবাদী পথ খুঁজে বের করতে। আবদুহ নিজেও কিছু সুফি আচারের সমালোচক ছিলেন, কিন্তু তার লেখালেখিতে সুফিবাদের ছোঁয়া ছিল আর তিনি আল-গাজ্জালীর বাতলে দেওয়া “সত্য সুফিবাদ”কে বেশ পছন্দ করতেন (Weismann, 2001; Ridgeon, 2015)।
দামেস্কের সালাফিয়্যা আবার বাগদাদের সংস্কারবাদীদের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিল, বিশেষ করে আলুসি পরিবারের আলেমদের দ্বারা। আবু সানা’ শিহাব আল-দিন আল-আলুসি (১৮০২–১৮৫৪) ছিলেন এই পরিবারের প্রথম আলেম যিনি সংস্কারের কথা বলেন। তিনি তার শিক্ষক ‘আলী আল-সুওয়াইদী এর মাধ্যমে ওয়াহাবিজমের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি আবার তার লেখায় সুফি আর মুতাকাল্লিমুন বা যুক্তিবাদী ধর্মতাত্ত্বিক, যেমন রাজী-র চিন্তাভাবনাকেও মেলাবার চেষ্টা করেছিলেন। তার ছেলে নু’মান খায়র আল-দিন আল-আলুসি আবার আহলে হাদীস আন্দোলনের প্রথম দিকের নেতা সিদ্দিক হাসান খানের লেখা দ্বারা খুব প্রভাবিত হন। তিনি নিয়মিত সিদ্দিক হাসান খানের সাথে চিঠি চালাচালি করতেন, তার কাছ থেকে পড়ানোর অনুমতিও পান এবং ইরাকে সালাফী ধারার নেতা হয়ে ওঠেন। পরে তিনি তার নিজের ছেলে ‘আলা’ আল-দিনকে (১৮৬০–১৯২১) হাসান খানের কাছে পড়তে পাঠান। খায়র আল-দিন আলুসি ইবনে তাইমিয়ার শিক্ষার পক্ষে অনেক লেখালেখি ও তর্কবিতর্ক করেন। ইরাকের এই সংস্কারকরা আইন মানার ক্ষেত্রে তাকলিদ বা অন্ধ অনুসরণকে মানতেন না, বরং ইজতিহাদের বা নিজে নিজে যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তারা মাজার জেয়ারতের মতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকেও নিন্দা করতেন (Commins, 1990)।
১৮৮০-র দশকের মধ্যেই সিরিয়ায় সালাফিয়্যা ঐতিহ্য বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল, কারণ দামেস্কের সংস্কারমনা আলেমরা এটা খুব পছন্দ করছিলেন। তাছাড়া, সিরিয়ার বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক ইবনে তাইমিয়ার পুরনো দিনের বেশিরভাগ বইপত্র দামেস্কের বিভিন্ন মসজিদেই সংরক্ষিত ছিল। জাহিরিয়্যা লাইব্রেরি (মাকতাবাত জাহিরিয়্যা) ছিল সেই সময়ের অন্যতম সেরা ইসলামী গ্রন্থাগার। সালাফী আলেমরা পুরনো দিনের সেই বইগুলো জোগাড় করে জাহিরিয়্যা লাইব্রেরিতে সেগুলোর একটা তালিকা বা আর্কাইভ তৈরি করেন। এই সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী সালাফী আলেমদের মধ্যে ছিলেন তাহির আল-জাজাইরি, ‘আব্দ আল-রাজ্জাক আল-বিতার আর জামাল আল-দিন কাসিমি। এরা সবাই আঠারো শতকের সেইসব সংস্কারকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন যারা আবার ইবনে তাইমিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন – যেমন আল-শাওকানী, ইবনে ‘আব্দ আল-ওয়াহাব, শাহ ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখ। তারা ইসলামের সেই পুরনো দিনের সালাফ আস-সালিহদের (ধার্মিক পূর্বপুরুষ) খাঁটি পথে ফিরে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। তেরো শতকের ইবনে তাইমিয়ার মতোই তারাও নিজেদের দেখতেন তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ব রক্ষার সৈনিক হিসেবে। তারা বিদ’আত বা নতুনত্বের বিরুদ্ধে লড়তেন, অটোমান রাজতন্ত্র আর তার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা করতেন, আর জাতীয়তাবাদের মতো পশ্চিমা ধারণাগুলোর কঠোর নিন্দা করতেন (Weismann, 2001; Mubarak, 2022)। ইতিহাসবিদ ইতজাক ওয়েইসম্যানের (Itzchak Weismann) ভাষায়:
“দামেস্কের সালাফী ধারাটা আসলে ছিল একটা ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া। কাদের বিরুদ্ধে? একদিকে ছিল দ্বিতীয় সুলতান আব্দুল হামিদের আধুনিকতাবাদী স্বৈরাচারী অটোমান রাষ্ট্র, আর অন্যদিকে ছিল সেইসব গোঁড়া সুফি শায়খ আর উলেমারা যারা কিনা সুলতানের সমর্থনে জনগণকে রাস্তায় নামাতে রাজি ছিল – এই দুইয়ের মধ্যে যে রাজনৈতিক আঁতাত গড়ে উঠেছিল, তারই বিরুদ্ধে ছিল এই প্রতিক্রিয়া।” (Weismann, 2001)।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের যুগ (Post-WWI Era)
উনিশ শতকের শেষের দিকেই এই সংস্কারকরা “সালাফী” নামে পরিচিত হতে শুরু করেন। এই নামটা তাদের বিরোধীদের ছোঁড়া ‘ওয়াহাবী’ তকমা থেকে নিজেদের বাঁচানোর একটা উপায়ও ছিল বটে – এটা বোঝানোর জন্য যে তারা নজদের ওয়াহাবীদের থেকে আলাদা। ইবনে ‘আরাবী আর সুফিবাদের বিরুদ্ধে সালাফীদের কঠোর অবস্থানটা আরও পরিষ্কার হয় এক দশক পরে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে, রশিদ রিদার নেতৃত্বে। সালাফিয়্যার এই দ্বিতীয় পর্বের কাণ্ডারি ছিলেন রশিদ রিদা আর সারা ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তার শিষ্যরা। তারা ধর্মগ্রন্থের একদম আক্ষরিক ব্যাখ্যার ওপর জোর দিতেন। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ আর সংস্কৃতির প্রতি তাদের ছিল তীব্র বিরোধিতা আর শত্রুতা। মাজার জেয়ারত, লোকমুখে চলা সুফি আচার, পীর-মুরিদী, কারামত বা অলৌকিক ঘটনা, রহস্যময় তরিকা – এগুলোর নিন্দার পাশাপাশি সুফিবাদের প্রতি রিদার সমালোচনা তার অন্য সালাফী ভাইদের চেয়েও বেশিদূর গিয়েছিল। তিনি সুফিদের মুরিদ-মুর্শিদ সম্পর্ক, এমনকি যে সিলসিলা বা বংশপরম্পরার ওপর ভিত্তি করে তরিকাগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিশেষ করে, রিদা বিভিন্ন সুফি তরিকার রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা আর শান্তিবাদী নীতির কঠোর সমালোচনা করেন। রিদা আর তার শিষ্যরা চাইতেন সালাফদের আমলের ধর্ম আর রাজনীতির পথে পুরোপুরি ফিরে যেতে (Weismann, 2001; Ridgeon, 2015)। সালাফদের পথে ফেরার আহ্বান জানিয়ে রশিদ রিদা ইসলামের প্রথম চার খলিফা, অর্থাৎ খুলাফায়ে রাশিদুনের পথের ওপর জোর দেন এবং তাদের নীতিগুলো আবার চালু করার কথা বলেন। রিদার এই পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা একটা কল্পিত কিন্তু বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সালাফী সম্প্রদায়ের ধারণা তৈরিতে সাহায্য করে, যা কোনো দেশের সীমানা মানে না। এই কারণেই তাকে সালাফিয়্যা আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ধরা হয় আর তার চিন্তাভাবনা অনেক ইসলামী পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল (Frampton, 2018; Ismail, 2021)।
রশিদ রিদার ধর্মীয় চিন্তার মূল ভিত্তি ছিল ইবনে তাইমিয়ার ধর্মতত্ত্বকে পুনরুজ্জীবিত করা। তিনি মনে করতেন, ইসলামী বিশ্বের পতন আর অনৈক্যের সমাধান এটাই। রিদার নেতৃত্বে সালাফিয়্যা আন্দোলন আরও বেশি রক্ষণশীল হয়ে ওঠে এবং আলেম সমাজের কড়া সমালোচক বনে যায়। রিদার এই চিন্তাধারা মুসলিম ব্রাদারহুডের মতাদর্শীদের, যেমন হাসান আল-বান্না (মৃত্যু ১৯৪৯) আর সাইয়্যেদ কুতুবকে (মৃত্যু ১৯৬৬), ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। তারাও ওয়াহাবী আন্দোলনের মতো একটা ইসলামী রাষ্ট্র আর সমাজের স্বপ্ন দেখতেন (Martin, 2016; Mubarak, 2022)। মুসলিম ব্রাদারহুডের সিরীয় নেতারা, যেমন মুস্তফা আল-সিবাই আর ‘ইসাম আল-‘আত্তারও এই আন্দোলনে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন এবং তাদের চিন্তাভাবনা জর্ডানের অনেক ছাত্রকে প্রভাবিত করে। দামেস্কের সালাফিয়্যার মধ্যে তখন মুহাম্মদ বাহজাত আল-বিতার আল-আসারী, ‘আলী আল-তানতাভি, নাসির আল-দিন আল-আলবানী, ‘আব্দ আল-ফাত্তাহ আল-ইমাম, মাযহার আল-‘আজমা, আল-বাশির আল-ইব্রাহিমি, তাকিয় আল-দিন আল-হিলালি, মুহিয় আল-দিন আল-কুলাইবি, ‘আব্দ আল্লাহ আল-কালকায়লি সহ আরও অনেক বড় বড় আলেম ছিলেন। এই আন্দোলনের প্রচুর বইপত্র লেবাননের জুহাইর শাওয়িশের মালিকানাধীন ইসলামিক বুকস্টোর থেকে ছাপা ও প্রকাশিত হতো (Moussalli, 1999)।
সালাফিয়্যার প্রথম দিকের নেতারা, যেমন সাইয়্যেদ রশিদ রিদা (মৃত্যু ১৯৩৫) বা জামাল আল-দিন কাসিমি (মৃত্যু ১৯১৪) ঐতিহ্যবাদী ধর্মতত্ত্বকেই তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কারের মূল ভিত্তি মনে করতেন। যেমন, রশিদ রিদা যুক্তি দেখাতেন যে আসারী ধর্মতত্ত্বই হলো আসল সুন্নি পথ, এটা কম বিভেদ তৈরি করে এবং আশ’আরীবাদের চেয়ে ঈমানের জন্য বেশি নির্ভরযোগ্য ভিত্তি দেয়। রিদার মতে, সালাফী আকীদা কালাম বা যুক্তিতর্কের চেয়ে বোঝা অনেক সহজ, আর তাই এটা নাস্তিকতা বা অন্য ধর্মদ্রোহিতার বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য একটা শক্ত ঢাল। সালাফী সংস্কারকরা মধ্যযুগের সেই বিখ্যাত আলেম ইবনে তাইমিয়াকেও সুন্নি অর্থোডক্সের আদর্শ বলে খুব প্রশংসা করতেন। তারা জোর দিয়ে বলতেন যে, ইবনে তাইমিয়ার তাওহীদের কঠোর ধারণাই হলো সালাফদের বা পুরনো দিনের মানুষদের মূল মতবাদ।
তবে এত কিছুর পরেও, সেই সময়ের সালাফী সংস্কারকরা প্যান-ইসলামিক বা বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের ব্যাপারে বেশি চিন্তিত ছিলেন। তাই তারা সাধারণত তাদের অন্য মুসলিম ভাইদেরকে সহজে ধর্মদ্রোহী বা কাফের বলে অভিযুক্ত করতেন না; বরং তাদের ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তিগুলো বেশ সংযমের সাথেই পেশ করতেন। জামাল আল-দিন কাসিমি অন্যদের চিন্তাকে পুরোপুরি ঠিক মনে করতেন না। তবুও তিনি আসারী আর অন্য মতের অনুসারীদের মধ্যে যে তিক্ত বিবাদ আর বিভেদ ছিল, সেটার ঘোর নিন্দা করতেন। রশিদ রিদার কাছেও আসারী আর আশ’আরীদের মধ্যে এই অন্তঃ-সুন্নি বিভেদটা ছিল একটা বড় সমস্যা, যা মুসলিম উম্মাহর শক্তি কমিয়ে দিয়েছিল আর বিদেশীদের মুসলিম দেশগুলো দখল করার সুযোগ করে দিয়েছিল। তাই, বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে রিদা আশ’আরীদের বিরুদ্ধে একটা একান্ত বর্জনীয় মনোভাব নেওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতেন (Lauziere, 2016)।
আজকের দিনের কথা (Contemporary era)
উনিশ শতকের শেষ দিকে সিরিয়ায় যে সালাফিয়্যা ঐতিহ্যের শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে দুটো আলাদা ধারা দেখা যায়: একটা হলো অরাজনৈতিক, শান্তিবাদী (Quietist) ধারা, আর অন্যটা হলো “সালাফী-ইসলামপন্থী হাইব্রিড (Salafi-Islamist hybrid)”। রশিদ রিদার নেতৃত্বে শুরুর দিকের সালাফিয়্যা ছিল মূলত বিপ্লবী প্যান-ইসলামিস্টদের দখলে। তাদের লক্ষ্য ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটা ইসলামী খিলাফত ফিরিয়ে আনা।
কিন্তু আজকের দিনের সালাফিয়্যাতে শুদ্ধতাবাদী বা পিউরিস্টদের (Purists) প্রভাবই বেশি। এরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকে আর ইসলামী রাজনৈতিক শান্তিবাদ (Islamic Political Quietism) সমর্থন করে। এই সমসাময়িক শুদ্ধতাবাদী সালাফিবাদ, যা কিনা “সালাফী মানহাজ (the Salafi Manhaj)” নামে বেশি পরিচিত, এটা আসলে ১৯৬০-এর দশক থেকে তিনটা কাছাকাছি কিন্তু আলাদা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের একটা মিশ্রণ হিসেবে গড়ে উঠেছে: আরবের ওয়াহাবী আন্দোলন, ভারতের আহলে হাদীস আন্দোলন, আর উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুর দিকের আরব বিশ্বের সালাফিয়্যা আন্দোলন। এই বদলের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন আলবেনিয়ান ইসলামী হাদীস পণ্ডিত মুহাম্মদ নাসির আল-দিন আল-আলবানী। তিনি ছিলেন রশিদ রিদারই এক অনুগামী (বা protégé)। আজকের দিনের শুদ্ধতাবাদী সালাফী ধারার লোকেরা তাকে তাদের “আধ্যাত্মিক পিতা (spiritual father)” হিসেবে মানে আর প্রায় সব সমসাময়িক সালাফীই তাকে “তার প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ হাদীস পণ্ডিত (the greatest hadith scholar of his generation)” হিসেবে সম্মান করে (Meijer, 2014; Olidort, 2015; Mubarak, 2022; Murray-Miller, 2022)।
২০১৭ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, সাংবাদিক গ্রায়েম উড (Graeme Wood) বলেছিলেন যে, সারা দুনিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে সালাফীরা “সম্ভবত ১০ শতাংশেরও কম” (Wood, 2017)। কিন্তু একুশ শতকে এসে সালাফী শিক্ষা আর ধারণাগুলো এতটাই জনপ্রিয় আর মূলধারার (mainstreamised) হয়ে গেছে যে, অনেক আধুনিক মুসলিম, যারা হয়তো নিজেদের সরাসরি সালাফী বলে পরিচয়ও দেয় না, তারাও সালাফিবাদের অনেক কিছুই গ্রহণ করে নিয়েছে (Haykel, 2009)।
মাঝে মাঝে সালাফিবাদকে আবার ওয়াহাবিজম আর ১৯৬০-এর পরের অন্যান্য আন্দোলনের একটা মিশ্রণ বা হাইব্রিড (hybrid) বলেও মনে করা হয় (Lacroix, 2008)। কিছু শিক্ষাবিদ আর ইতিহাসবিদ “সালাফিবাদ” শব্দটা ব্যবহার করেন সেই চিন্তাধারাকে বোঝাতে যা “উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপীয় ধারণার বিস্তারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে” ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যা “মুসলিম সভ্যতার মধ্যেই আধুনিকতার আসল শিকড় খুঁজে বের করতে চেয়েছিল” (Kepel, 2006; Stanley, 2005)। ফরাসি পণ্ডিত লুই মাসিগনন থেকে শুরু করে, বিশ শতকের প্রায় পুরোটা জুড়েই পশ্চিমা পণ্ডিতরা উনিশ শতকের মুহাম্মদ আবদুহ আর জামাল আল-দিন আল-আফগানির (যারা কিনা আশ’আরী যুক্তিবাদী ছিলেন) ইসলামী আধুনিকতাবাদী আন্দোলনকে বৃহত্তর সালাফিয়্যা আন্দোলনেরই অংশ মনে করতেন (Kepel, 2006; Haykel, 2007; Meijer & Haykel, 2013; Lauziere, 2010)।
কিন্তু আজকের দিনের সালাফীরা চলে একদম আক্ষরিক পথে, তারা হাদীসের ওপর খুব বেশি নির্ভর করে। তারা ইবনে তাইমিয়া আর তার শিষ্য যেমন ইবনে কাসির, ইবনে কাইয়িম প্রমুখকে তাদের ক্লাসিক্যাল যুগের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গুরু হিসেবে মানে (Leaman, 2006; Lauziere, 2010)। এই আন্দোলনের আজকের দিনের কিছু প্রধান মুখের মধ্যে আছেন আল-আলবানী, তাকি আল-দিন আল-হিলালি, ইবনে ‘উসাইমীন, ইবনে বায, এহসান এলাহী জহির, মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম, রশিদ রিদা, সানা উল্লাহ অমৃতসরী, আব্দ আল-হামিদ বিন বাদিস, জুবাইর আলী জাই, আহমদ শাকির, সালেহ আল-ফাওজান, জাকির নায়েক, আব্দুল-গাফফার হাসান, সাইয়্যিদ সাবিক, সালিহ আল-মুনাজ্জিদ, আব্দ আল-রহমান আব্দ আল-খালিক, মুহাম্মদ আল-গোন্দালভী সহ আরও অনেকে (Gauvain, 2013; Lauziere, 2016; Meijer, 2014; Umm-ul-Qura Publications, 2017)।
এই আধুনিক যুগে এসে কিছু সালাফী আবার নিজেদের নামের সাথে “আল-সালাফী” উপাধি জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখায়। তারা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে “সালাফিয়্যা” লেবেলটা ব্যবহার করে ইসলামের একটা নির্দিষ্ট রূপ বা বোঝাপড়াকে তুলে ধরতে চায়, যা তাদের মতে আকীদা (বিশ্বাস) আর ফিকহ (আইন)-এর ক্ষেত্রে অন্য সুন্নিদের থেকে আলাদা (Lauzière, 2008)।
সালাফী দুনিয়ার রকমফের: রাজনীতির মাঠে কে কোথায়?
তো, এই যে সালাফী সালাফী এত কথা হচ্ছে, এরা কি সবাই এক রকম? মোটেই না! বিশেষ করে রাজনীতির ময়দানে কে কোথায় দাঁড়াবে, তা নিয়ে এদের মধ্যে বেশ কিছু ভাগ আছে। পশ্চিমা দুনিয়ার গবেষকরা, যেমন ধরুন কুইন্টান ভিক্টোরোভিচ (Quintan Wiktorowicz) নামের একজন, ২০০৬ সালের এক লেখায় দেখিয়েছেন, সালাফীদের মূলত তিনটে দলে ভাগ করা যায় – তাদের রাজনীতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা কেমন, তার ওপর ভিত্তি করে (Wiktorowicz, 2006; DeLong-Bas)।
-
শুদ্ধতাবাদী (Purists): এরা হলেন সেই দলের লোক যারা মনে করেন, আসল কাজ হলো তাওহীদ (Tawhid) বা আল্লাহর একত্ববাদকে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া। তাই তারা মন দেন শিক্ষা আর ইসলাম প্রচারের (da’wah) কাজে। রাজনীতি থেকে তারা শত হাত দূরে থাকতে চান।
-
কর্মী (Activists): এরা মনে করেন, বসে থাকলে চলবে না। সমাজ বদলাতে হলে রাজনৈতিক সংস্কার দরকার, এমনকি ইসলামী খিলাফতও ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে হ্যাঁ, এরা মারামারি বা সহিংসতার পথে যেতে নারাজ। এদের কাজকর্মকে অনেকে সালাফিস্ট অ্যাক্টিভিজমও (Salafist activism) বলে।
-
জিহাদী (Jihadists): এই দলটার লক্ষ্যও অনেকটা কর্মীদের মতোই – পুরনো ইসলামী শাসন ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তাদের পথ ভিন্ন। তারা মনে করে, এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সহিংস জিহাদ বা সশস্ত্র সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই। এদেরকে অনেকে সালাফী জিহাদী (Salafi jihadism) বা কুতুবপন্থীও (Qutbism) বলে থাকেন (Wiktorowicz, 2006)।
আরব বসন্তের (Arab Spring) পর থেকে আবার একটা নতুন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আরব বিশ্বের দেশে দেশে সালাফীরা রীতিমতো রাজনৈতিক দল খুলে বসেছে এবং বেশ সক্রিয়ভাবেই ইসলামী সামাজিক আর রাজনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে মাঠে নেমেছে (Abdo, 2017)।
যারা শুদ্ধতার খোঁজে: শুদ্ধতাবাদী বা পুরিস্টরা (Purists)
এই “শুদ্ধতাবাদী” বা পুরিস্টরা হলেন সেইসব সালাফী, যাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসলামের দাওয়াত দেওয়া, মানুষকে শেখানো, আর তাদের মতে ধর্মে ঢুকে পড়া ভুল বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠানগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা (“ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনের পরিশুদ্ধি”)। তারা সালাফী আকীদা বা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকেন (Hamid)। রাজনীতিকে তারা দেখেন একটা ঝামেলা হিসেবে, একটা “বিচ্যুতি বা এমনকি নতুনত্ব (innovation) যা মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়” (Roy & Boubekeur, 2012)। এদেরকে অনেকে রক্ষণশীল সালাফীও (conservative Salafism) বলে। এরা রাজনীতি থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলেন। এদের সব মনোযোগ থাকে ইসলামী শরিয়া শেখা, সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করা আর তাদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার দিকে। এই পথটা অনেক ধর্মভীরু মুসলিমকে বেশ টানে, যারা শুধু ধর্মীয় লক্ষ্যেই জীবন কাটাতে চান, রাজনৈতিক প্যাঁচে পড়তে চান না। রক্ষণশীল সালাফীরা মনে করেন, আগে দরকার মুসলিম সমাজকে ভেজালমুক্ত, “বিশুদ্ধ” (pure, uncontaminated Islamic society) করে তোলা। আর সেটা করতে হবে দীর্ঘ সময় ধরে “পরিশুদ্ধি ও শিক্ষা”র (purification and education) মাধ্যমে। যখন সমাজ ঠিক হয়ে যাবে, তখন নাকি এমনিতেই ইসলামী রাষ্ট্র (Islamic state) প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে (Abu Rumman et al., 2010)।
এই দলের সবাই কিন্তু শাসকদের বিরোধিতা করেন না। যেমন, মাদখালিজম (Madkhalism) নামে একটা ধারা আছে, যারা কিনা মধ্যপ্রাচ্যের একনায়ক বা স্বৈরাচারী শাসকদের (authoritarian regimes) সমর্থন করে বলে পরিচিত (Gauvain, 2013; Meijer, 2009; Joffé, 2013)। এই নামটা এসেছে রাবী আল-মাদখালি (Rabee al-Madkhali) নামের একজন বিতর্কিত সৌদি আলেমের নাম থেকে। তবে সৌদি আরবেই এই আন্দোলন একসময় হোঁচট খায়, যখন কিনা দেশের বড় আলেমদের কমিটি (স্থায়ী কমিটি) মাদখালিকে ব্যক্তিগতভাবে নিন্দা জানায় (Boekhoff-van der Voort et al., 2011)। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এই মাদখালি আন্দোলন আর তার নেতাদের প্রভাব মুসলিম বিশ্বে প্রায় নেই বললেই চলে। বিশ্লেষকরা তো বলেই দিয়েছেন, এটা এখন মূলত ইউরোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ একটা ঘটনা (European phenomenon) (Boekhoff-van der Voort et al., 2011)।
মাঠের কর্মী: সালাফী অ্যাক্টিভিস্টরা (Salafi activists)
রাজনীতির বর্ণালীতে আরেকটু এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে সালাফী-অ্যাক্টিভিস্টদের (Salafi-Activists) (এদেরকে ‘হারাকি’ও (haraki) বলা হয়)। এরা বিশ্বাস করে, সমাজ বদলাতে হলে রাজনৈতিকভাবেই এগোতে হবে। এদের মধ্যে আছে মুসলিম ব্রাদারহুড, মিশরের হিজব আল-নূর (আলোর দল), ইয়েমেনের আল ইসলাহ পার্টি, বাহরাইনের আল আসালাহ-র মতো বড় বড় ইসলামপন্থী সংগঠন। আবার আল-সাহওয়া আল-ইসলামিয়্যা (ইসলামী জাগরণ) নামে পরিচিত আন্দোলনের সাথে যুক্ত আলেমরাও এই দলেই পড়েন। তাদের মূলমন্ত্র হলো, সমাজের সব সমস্যার একটাই সমাধান – “ইসলামী সমাধান (the Islamic solution)”। এরা ধর্মনিরপেক্ষতা (secularism), ইসরায়েল আর পশ্চিমা দুনিয়ার ঘোর বিরোধী। তাদের কাজের ধরণ হলো, বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতরে থেকেই কাজ করে যাওয়া, যাতে শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থাকে বদলে ফেলে একটা পুরোপুরি ইসলামী রাষ্ট্র (Islamic state) কায়েম করা যায় (Morrissey, 2021)।
এই কর্মীরা কিন্তু সালাফী-জিহাদীদের থেকে আলাদা, কারণ তারা সহিংসতা পছন্দ করে না। আবার শুদ্ধতাবাদীদের থেকেও তারা আলাদা, কারণ তারা আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় (modern political processes) অংশ নেয় (Meijer)। সালাফী-অ্যাক্টিভিস্টদের রাজনৈতিক মাঠে কাজ করার ইতিহাস বেশ পুরনো, বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড আর তার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মতো বড় আরব ইসলামপন্থী আন্দোলনে (Economist, 2015)। এই ধারার জন্ম বলা যায় ১৯৫০-৬০ এর দশকে সৌদি আরবে। তখন মিশরের নাসের সরকারের অত্যাচারে অনেক মুসলিম ব্রাদারহুড সদস্য সৌদি আরবে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল (Commins, 2006)। সেখানেই তারা তাদের ব্রাদারহুডের চিন্তার সাথে সালাফিজমের একটা মিশেল ঘটায়। এর ফলেই জন্ম নেয় সালাফী অ্যাক্টিভিস্ট ধারা, যার একটা বড় উদাহরণ হলো ৮০-র দশকের সাহওয়া আন্দোলন (Sahwa movement) (Mohie-Eldin, 2015), যার প্রচারক ছিলেন সাফার আল-হাওয়ালি (Safar Al-Hawali) আর সালমান আল-আওদা (Salman al-Ouda)।
আরব বসন্তের পর থেকে এই অ্যাক্টিভিস্টরা সুন্নিদের অধিকার আদায়ে বেশ সোচ্চার হয়েছে। একই সাথে তারা আরব বিশ্বে ইরানের প্রভাব বিস্তার আর হস্তক্ষেপ নিয়েও নিয়মিত হুঁশিয়ারি দেয়। তারা ইরানের ‘শিয়া ক্রিসেন্ট’ (Khomeinist Shia Crescent) প্রকল্প আর ইরাক, সিরিয়া, লেবাননের মতো দেশগুলোতে জনসংখ্যা বদলের মাধ্যমে শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার কড়া সমালোচনা করে। এমনকি ১৯৮০-র দশকের শুরুতেই সিরিয়ার সালাফী ইসলামপন্থী আলেম মুহাম্মদ সুরুর ইরানের খোমেনির কঠোর সমালোচনা শুরু করেছিলেন, তাকে আরব বিশ্বের ওপর ইরানী আধিপত্য বিস্তারের হোতা বলে নিন্দা করেছিলেন (Abdo, 2017)।
মুসলিম ব্রাদারহুড, জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোর ওপর এই অ্যাক্টিভিস্ট সালাফী চিন্তার গভীর প্রভাব রয়েছে (Lenz-Raymann, 2014)। সালাফিয়্যা ঘরানার অনুসারীদের মধ্যে এই ধারাটি খুবই জনপ্রিয়, আর একে প্রায়ই “মূলধারার সালাফিবাদ (mainstream Salafism)” বলা হয়। অ্যাক্টিভিস্ট সালাফীরা সহিংসতাকে নিন্দা করে, কিন্তু নিজেদের সমাজে শরিয়া (shari’a) প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় (Sazanov et al., 2021)। ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে, সালাফীদের মধ্যে এই অ্যাক্টিভিস্টরাই সংখ্যাগুরু (Joffé, 2013)।
তবে এই অ্যাক্টিভিস্টদের আবার তীব্র আক্রমণের শিকার হতে হয় শান্তিবাদী সালাফিজমের সেই মাদখালিস্ট ধারার অনুসারীদের হাতে, যারা কিনা রাজনীতি থেকে পুরোপুরি দূরে থাকে (Abukhadeejah.com, 2017)। অনেক সালাফী অ্যাক্টিভিস্ট আবার উপসাগরীয় দেশগুলোর সরকারের নীতির কড়া সমালোচক। তারা মাদখালিদের দোষ দেয় এই বলে যে, তারা চোখ বুজে উপসাগরীয় রাজাদের রাজনৈতিক লাইনে চলে (Abdo, 2017)। এই অ্যাক্টিভিস্ট ধারা, যাদেরকে কেউ কেউ “পলিটিকো (politicos)” বা রাজনীতিক বলে ডাকে, তারা রাজনীতিকে দেখে “এমন আরও একটা ক্ষেত্র হিসেবে যেখানে সালাফী আকীদা প্রয়োগ করতে হবে”। কেন? যাতে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় আর “এটা নিশ্চিত করা যায় যে দেশের শাসনব্যবস্থা শরিয়ার ওপর ভিত্তি করে চলছে” (Roy & Boubekeur, 2012)। যেমন, আল-সাহওয়া আল-ইসলামিয়্যা বা ইসলামী জাগরণ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কারের সাথে জড়িত ছিল। সাফার আল-হাওয়ালি, সালমান আল-আওদা, আবু কাতাদা, জাকির নায়েকের মতো ব্যক্তিরা এই ধারারই প্রতিনিধি। সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ সক্রিয় থাকার কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এদের কিছু সমর্থনও জুটেছে (Abukhadeejah.com, 2017; Qadhi; Washington Post, 2014)।
“ব্যাপারটা খুব সহজ। আমরা শরিয়া চাই। অর্থনীতিতে শরিয়া, রাজনীতিতে, বিচার ব্যবস্থায়, আমাদের দেশের সীমানায়, আর আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কেও।”
– মোহাম্মদ আবদেল-রহমান (ওমর আবদেল-রহমানের ছেলে), টাইম ম্যাগাজিন, অক্টোবর ৮, ২০১২ (Ghosh, 2012)
আরব বসন্তের পর থেকে সালাফী মুসলিমরা রাজনীতির মাঠে আরও বেশি করে সক্রিয় হয়ে উঠছে, বিভিন্ন ইসলামী দাবিদাওয়া নিয়ে সরব হচ্ছে। সালাফী অ্যাক্টিভিস্টরা পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্র নীতি আর সেই সাথে এই অঞ্চলে ইরানের আগ্রাসী কার্যকলাপ, যেমন সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে বাশার আল-আসাদের আলাওয়াইট সরকারের (যা কিনা সুন্নিদের বিরুদ্ধে ছিল) পক্ষ নেওয়া – এগুলোর তীব্র সমালোচনা করে। এমনকি কিছু শান্তিবাদী সালাফীও এখন রাজনৈতিক দল গড়া শুরু করেছে, কারণ তারা মনে করছে আরব দেশগুলোতে যুদ্ধ আর বাইরের হস্তক্ষেপের হুমকি বাড়ছে। এর উদাহরণ হলো মিশরের আল-নূর পার্টি আর সুদানের আনসার আল-সুন্না (Abdo, 2017)।
যারা জিহাদের পথে: সালাফী জিহাদীরা (Salafi jihadists)
“সালাফী জিহাদিজম (Salafi Jihadism)” – এই শব্দবন্ধটা প্রথম চালু করেন জিল কেপেল (Gilles Kepel) নামের একজন ফরাসি পণ্ডিত (Kepel, 2006)। তিনি এটা ব্যবহার করেছিলেন সেইসব সালাফী দলগুলোকে বোঝাতে, যারা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সশস্ত্র জিহাদের (armed jihad) দিকে ঝুঁকে পড়ে। এদের অনুসারীদের নানা নামে ডাকা হয় – “সালাফী জিহাদী”, “সালাফী জিহাদিস্ট”, “বিপ্লবী সালাফী”, বা সোজাসাপ্টা “সশস্ত্র সালাফী”। সাংবাদিক ব্রুস লিভেসি হিসেব করে দেখিয়েছেন, সারা দুনিয়ার প্রায় ১২০ কোটি মুসলিমের মধ্যে এই সালাফী জিহাদীদের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম – মানে বড়জোর এক কোটির মতো হবে (Amghar et al., 2023; Livesey)।
আরেকজন পণ্ডিত, মোহাম্মদ এম. হাফেজ, সালাফী জিহাদিজমের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে: এটা হলো “সুন্নি ইসলামিজমের একটা চরম রূপ, যা গণতন্ত্র আর শিয়া শাসন দুটোকেই প্রত্যাখ্যান করে”। হাফেজ এদেরকে একদিকে যেমন অরাজনৈতিক, রক্ষণশীল সালাফী আলেমদের (যেমন আল-আলবানী, ইবনে উসাইমীন, ইবনে বায, বা আব্দুল-আজিজ আল আশ-শাইখ) থেকে আলাদা করেছেন, তেমনি আবার সালমান আল-আওদা বা সাফার আল-হাওয়ালির সাথে যুক্ত সাহওয়া আন্দোলন থেকেও আলাদা করেছেন (Hafez, 2017)। ডঃ জোয়াস ওয়েগমেকার্স আবার সালাফী-জিহাদিস্টদের নিয়ে বলছেন, এরা হচ্ছে সেইসব সালাফী, যারা সশস্ত্র, বিপ্লবী পথে হেঁটে ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বলে (Deschamps-Laporte, 2023)। আবু মুহাম্মদ আল-মাকদিসি, আবু আব্দুল্লাহ আল-মুহাজির, আবু মুস’আব আল-জারকাওয়ি, আবুবকর আল-বাগদাদীর মতো লোকেরা এই আন্দোলনের হালের বাঘা বাঘা নেতা। আর ইসলামিক স্টেট (আইএস), বোকো হারাম, আল-শাবাব হলো এই ধারার কয়েকটি পরিচিত জঙ্গি সংগঠন (Wagemakers, 2009; Elmaz, 2011; Cakmaktas, 2024)।
এই সালাফী-জিহাদিস্টদের সবার একটা বিষয়ে মিল আছে – তারা চায় সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে বর্তমান শাসনব্যবস্থা উল্টে ফেলে তার জায়গায় একটা বিশ্বজনীন খিলাফত (Global Caliphate) প্রতিষ্ঠা করতে। তারা মনে করে, জিহাদ হলো ঈমান আর ধার্মিকতার একটা অপরিহার্য অংশ, প্রত্যেক মুসলিমের ওপর এটা একটা ব্যক্তিগত ফরজ বা বাধ্যবাধকতা (ফার্দ ‘আল-আইন)। ফিলিস্তিনি জিহাদী পণ্ডিত ‘আব্দুল্লাহ ‘আযযাম (১৯৪১–৮৯) তো জিহাদকে “ইবাদতের সেরা রূপ” বলেই দাবি করেছিলেন। সালাফী-জিহাদিস্টরা নিজেদেরকে সাইয়্যেদ কুতুবের যোগ্য উত্তরসূরি মনে করে। কুতুব ছিলেন একজন প্রভাবশালী ইসলামপন্থী চিন্তাবিদ, যিনি ষাটের দশকে মুসলিম ব্রাদারহুডের সবচেয়ে কট্টর অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইবনে তাইমিয়ার লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে এই জিহাদীরা তাকফির (কাউকে কাফের ঘোষণা করা) আর আল-ওয়ালা’ ওয়া’ল- বারা’ (ইসলামের শত্রুদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ আর বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব) নীতির কড়া সমর্থক। কুতুবের মতোই তারাও মনে করে, একমাত্র আল্লাহরই সার্বভৌম ক্ষমতা (হাকিমিয়্যা) আছে এবং এটাই তাওহীদের মূল কথা। অন্য সব রাজনৈতিক মতবাদকে তারা জাহিলিয়্যা বা অন্ধকার যুগ বলে বাতিল করে দেয়। সাইয়্যেদ কুতুব তার লেখা পুস্তিকা ‘আল-মা’আলিম ফি’ল-তারিক’ (পথের দিশা বা The Milestones)-এ জাহিলিয়্যা ধ্বংস করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার এক জঙ্গি কৌশলের রূপরেখা দিয়েছিলেন, সেটা সালাফী-জিহাদী মহলে ভীষণ প্রভাবশালী একটা বই হয়ে ওঠে (Morrissey, 2021)।
২০০৩ সালে আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমণ করে, তখন ককেশাস এমিরেট নামে একটা সালাফী জিহাদী দলের উদ্ভব হয়। ২০১৪ সালে ড্যারিয়ন রোডস এই দলটিকে নিয়ে একটি বিশ্লেষণ লেখেন। তিনি দেখান, দলটি কীভাবে কঠোরভাবে তাওহীদ মেনে চলে এবং শিরক, তাকলিদ আর বিদ’আত প্রত্যাখ্যান করে। তাদের বিশ্বাস, জিহাদ বা পবিত্র যুদ্ধই হলো পৃথিবীতে আল্লাহর উদ্দেশ্য পূরণের একমাত্র পথ (Rhodes, 2014)। তবে মজার ব্যাপার হলো, সেই শুদ্ধতাবাদী আর অ্যাক্টিভিস্ট সালাফীরা কিন্তু প্রায়শই এই জিহাদীদের কাজকর্মকে একদমই সমর্থন করে না, এমনকি তাদের ইসলামী পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন তোলে (Abou El Fadl, 2005)। যদিও এই জিহাদী চিন্তাভাবনার কিছু কিছু সূত্র হয়তো কুরআন আর হাদীসের কিছু প্রান্তিক ব্যাখ্যার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু পণ্ডিতরা বারবার বলেছেন যে, সালাফী-জিহাদী দৃষ্টিভঙ্গিটা মোটেই বৃহত্তর ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে না। সুন্নি, শিয়া, সালাফী, সুফি, ওয়াহাবী, আধুনিকতাবাদী, নব্য-ঐতিহ্যবাদী – সব ঘরানার আলেম, চিন্তাবিদ আর বুদ্ধিজীবীরাই বিভিন্ন সালাফী-জিহাদী গোষ্ঠী আর তাদের মতবাদের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে কথা বলেছেন। তারা এগুলোকে ইসলামী শিক্ষার এক ধরনের “বিকৃতি” বা ভুল ব্যাখ্যা বলেই মনে করেন (Morrissey, 2021)।
কে ঠিক, কে ভুল: একাডেমিক পর্যালোচনা (Academic review)
সেই যে ভিক্টোরোভিচ সালাফীদের তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন – শান্তিবাদী, রাজনীতিবিদ আর বিপ্লবী – সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই ভাগাভাগিটা বড্ড বেশি সরল হয়ে গেছে। সমালোচকরা বলছেন, এই মডেলটা ধর্মকে বড্ড সরল চোখে দেখেছে, আর মুসলিম বিশ্বের দ্রুত বদলে যাওয়া সামাজিক, রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে ঠিকমতো ধরতেই পারেনি। বেশ কয়েকজন গবেষক এই শ্রেণিবিন্যাসের সমালোচনা করেছেন কারণ এটা সালাফিয়্যার ভেতরের গতিশীলতা, যেমন রাজনীতির সাথে এর বদলাতে থাকা সম্পর্ক, বা সালাফী মুসলিমদেরকে এমন অনমনীয় খোপে ফেলার প্রবণতাকে ঠিকমতো ধরতে পারেনি (Springer, 2023; Amghar et al., 2023)। সামির আমগার আর ফ্রান্সেস্কো কাভাতোর্তা বলছেন:
“গবেষণাগুলো শান্তিবাদী, রাজনীতিবিদ আর বিপ্লবীদের মধ্যে এই যে বিভাজন, এর তাত্ত্বিক আর বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। তারা বলছে, এই মডেলটাকে এখন পরিমার্জন করা খুব দরকার, কারণ এটা দিয়ে আর আজকের দিনের সালাফিবাদকে ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না… ভিক্টোরোভিচের এই বিভাজনের হয়তো একটা সুবিধা আছে যে, এটা একটা আন্দোলনের বহুত্ববাদী আর স্ববিরোধী চরিত্রটাকে তুলে ধরে, যেটাকে প্রায়ই ভুলভাবে বা একপেশেভাবে দেখানো হয়। কিন্তু এটা আবার আমাদেরকে এর গতিশীল আর পরিবর্তনশীল চরিত্রটা নিয়ে ভাবতে বাধা দেয়। আরব বিশ্ব আর তার বাইরে বাস্তবে যা ঘটছে, তাতে পুরনো এই খোপগুলোকে নতুন করে ভাবা ছাড়া আর উপায় নেই।” (Amghar et al., 2023)।
মিশরের সালাফী আর তথাকথিত “শান্তিবাদী” আল-নূর পার্টির ওপর গবেষণা করে লরেন্স ডেসচ্যাম্পস-লাপোর্টে দেখিয়েছেন যে ভিক্টোরোভিচের এই “অ-গতিশীল মডেল” আসলে কোনো পাকাঁপোক্ত পরিচয় বোঝায় না, বরং বোঝায় “নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নেওয়া কিছু বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক কৌশল”। লরেন্স প্রস্তাব করেছেন, এই “শান্তিবাদী, অ্যাক্টিভিস্ট আর জিহাদিস্ট” এর ত্রিমুখী বিভাজনটাকে বদলে “প্রচারকারী, রাজনৈতিক আর বিপ্লবী” হিসেবে দেখা হোক। আর এই বিভাগগুলোকে কোনো স্থায়ী আধ্যাত্মিক পরিচয় না ভেবে, বরং “অস্থায়ী কৌশল” হিসেবে দেখা হোক। তিনি আরও বলছেন, এমন একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার যা “সালাফী গোষ্ঠীগুলোর নমনীয়তা, বৈচিত্র্য আর বিবর্তনকে” হিসেবে ধরবে এবং শুধু তাদের আকীদা বা বিশ্বাসের ওপর জোর না দিয়ে, বরং তারা তাদের নিজ নিজ পরিবেশে কীভাবে কৌশলগতভাবে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, সেদিকে বেশি মনোযোগ দেবে (Deschamps-Laporte, 2023)। ইউরোপের সালাফী আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করে সামির আমগার তো বলেই দিয়েছেন, জিহাদিজমকে আর ঠিকঠাক সালাফিজমের অংশ বলাই চলে না। কারণ তার মতে, এই দুটো আন্দোলন কয়েক দশক ধরে এতটাই আলাদা পথে হেঁটেছে যে তাদের মধ্যে এখন আর কোনো “একই মতাদর্শিক ভিত্তি” নেই (Amghar et al., 2023)।
ভিক্টোরোভিচের আরেকটা প্রস্তাবনা ছিল যে, সব স্ব-ঘোষিত সালাফী দলের নাকি একই “আকীদা” বা বিশ্বাস। কিন্তু এই দাবিটাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ম্যাসিমো রামাইওলি নামের একজন পণ্ডিতের মতে:
“ভিক্টোরোভিচ যেমনটা দাবি করেছিলেন, সালাফীরা শুধু সামাজিক বাস্তবতা পাঠ আর তার সাথে জড়িত সামাজিক-রাজনৈতিক প্রকাশের (মানে তাদের মানহাজ) ক্ষেত্রেই ভিন্নতা দেখায়, আর তাত্ত্বিক দিক থেকে একই রকম থাকে, ব্যাপারটা তেমন নয়। প্রায়োগিক দর্শনের দিক থেকে দেখলে, আমরা আকীদার যে বৈচিত্র্য দেখি, তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ঈমান (বিশ্বাস), কুফর (অবিশ্বাস), তাকফীর (কাফের ঘোষণা), আল-ওয়ালা’ ওয়া আল-বারা’ (বন্ধুত্ব ও শত্রুতা), আর অবশ্যই সহিংসতা ও জিহাদের মতো বিষয়ে সালাফীরা যে স্পষ্টতই একমত নয়, তার কারণ হলো তারা সামাজিক বাস্তবতাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পাঠ করে, আর ফলস্বরূপ, তাদের আচরণও ভিন্ন হয়… রাজনীতির চাপ আর সুযোগগুলো সালাফীদেরকে বাধ্য করে গভীর আর মাঝে মাঝে কষ্টকর মতাদর্শিক (পুনরায়) অবস্থান নিতে… রাজনীতি সালাফিবাদকে দুই দিক থেকেই প্রভাবিত করে: ধারণাগত দিক থেকেও, আবার পদ্ধতিগত বা বাস্তব প্রয়োগের দিক থেকেও।” (Ramaioli, 2023)।
দেশ-বিদেশের সালাফী দলগুলো: কে কোথায়?
মরুর দেশ সৌদি আরব (Saudi Arabia)
আজকের দিনের সালাফীরা আঠারো শতকের একজন বিখ্যাত আলেম, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব (Muhammad ibn Abd al-Wahhab) আর তার ছাত্রদের নিজেদের লোক বলেই মনে করে (Wiktorowicz)। এই ইবনে আব্দুল ওয়াহাব সাহেব নজদের (Najd) সেই রুক্ষ, মরুভূমির মতো, কম জনবসতির এলাকায় একটা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন (Commins, 2006)। তার মূল ডাক ছিল তাওহীদ (Tawhid) বা এক আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার। তিনি সেই সময়ে প্রচলিত মাজার পূজা, কবরে মানত করা – এইসব প্রাণবাদী রীতিনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন, যেগুলো কিনা নজদের যাযাবর বেদুইনদের মধ্যে খুব চালু ছিল (Commins, 2006; Stump, 2008)। ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের মতে, এইসব কাজ হলো স্রেফ মূর্তিপূজা (idolatry), অপবিত্রতা আর ইসলামে নতুন আমদানি করা জিনিস (inappropriate innovations in Islam), যা তাওহীদের একেবারে উল্টো (Esposito, 2003)।
যদিও তিনি শরিয়া (sharia) বা ইসলামী আইন মেনে চলার ওপর খুব জোর দিতেন, কিন্তু তিনি চাইতেন মুসলিমরা যেন নিজেরাই ধর্মগ্রন্থ (Scriptures) পড়ে আর সেগুলো অনুসরণ করে শরিয়া পালন করে। তাদের আদর্শ গুরু ইবনে তাইমিয়ার মতোই ওয়াহাবীরাও তাকলিদ বা চোখ বুজে কারো কথা মেনে নেওয়ায় বিশ্বাস করতেন না। তারা চাইতেন ইজতিহাদ (Ijtihad) বা নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কুরআন-হাদীস বোঝার চেষ্টা করতে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে তারা খুব সরলতার ওপর জোর দিতেন। তাই পুরনো দিনের ফকীহ বা আইনজ্ঞদের (Fuqaha) লেখা কেতাবগুলোকে তারা ধর্মগ্রন্থের সমান মর্যাদা দিতেন না। তাদের মতে, ফকীহদের লেখা তো মানুষের ব্যাখ্যা, কিন্তু কুরআন হলো আল্লাহর নিজের বাণী – শাশ্বত, চিরন্তন (Jackson, 2006)।
সৌদি আরবের আজকের সালাফী আন্দোলন মূলত সেই মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের সংস্কারেরই ফল। তবে অন্যান্য সংস্কার আন্দোলনের সাথে এর একটা বড় পার্থক্য আছে। ইবনে আব্দুল ওয়াহাব আর তার শিষ্যরা তৎকালীন শাসক মুহাম্মদ ইবনে সৌদ (Muhammad Ibn Saud) আর তার পরিবারের সাথে একটা দারুণ বোঝাপড়া বা ধর্মীয়-রাজনৈতিক চুক্তি (religio-political pact) করতে পেরেছিলেন। এর ফলেই তারা সামরিক শক্তি ব্যবহার করে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে (military expansionism) এবং আরব উপদ্বীপে একটা ইসলামী রাষ্ট্র (Islamic state) প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আন্দোলনের বেশিরভাগ লোকই শিক্ষা আর সমাজসেবার মাধ্যমে ইসলামের পুনর্জাগরণে বিশ্বাস করত, কিন্তু একটা উগ্র অংশও ছিল। তারা স্থানীয় যেসব রীতিনীতিকে বিদ’আত বা নতুনত্ব মনে করত, সেগুলোকে নির্মূল করার জন্য রীতিমতো সশস্ত্র অভিযান (armed campaigns) চালাত আর অসংখ্য পীর-আউলিয়ার মাজার আর সমাধি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল (Jackson, 2006)।
অনেকেই মনে করেন, ওয়াহাবিজম হলো সালাফিজমেরই একটা অধিকতর কট্টর, অধিকতর সৌদি সংস্করণ (Murphy, 2006; Lewis, 2006)। মার্ক ডুরি (Mark Durie) নামে একজন তো বলেই দিয়েছেন, সৌদি নেতারা তাদের কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যবহার করে “সারা দুনিয়ায় সালাফিজমকে পয়সা জুগিয়ে আর এর প্রচারে খুব সক্রিয় আর সচেষ্ট” (Durie, 2013)। আহমদ মুসাল্লিও (Ahmad Moussalli) অনেকটা একমত। তিনি বলছেন, ব্যাপারটা হলো, “সাধারণত সব ওয়াহাবীই সালাফী, কিন্তু সব সালাফী ওয়াহাবী নয়” (Moussalli, 2009)।
তবে অনেক পণ্ডিত আর সমালোচক আবার সৌদি সালাফিজমের পুরনো রূপ (যাকে ওয়াহাবিজম বলা হয়) আর এখনকার নতুন সালাফিজমের মধ্যে একটা পার্থক্য টানেন। যেমন, প্যারিসের সায়েন্সেস পো-র গবেষক স্টেফান ল্যাক্রোয় (Stéphane Lacroix) বলছেন, “ওয়াহাবিজমের বিপরীতে, সালাফিজম বলতে বোঝায় সেইসব মিশ্রণ বা হাইব্রিড রূপগুলো যা ১৯৬০-এর দশক থেকে মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের শিক্ষার সাথে অন্যান্য ইসলামী চিন্তাধারার মিলনে তৈরি হয়েছে”। হামিদ আলগার আর খালেদ আবু এল ফাদল মনে করেন, ষাট আর সত্তরের দশকে ওয়াহাবিজম আসলে নিজেকে সালাফিজম নামে নতুন করে বাজারে ছেড়েছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল, ওয়াহাবী নামে থাকলে “আধুনিক মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া” সম্ভব হবে না (Dillon, 2009; Abou El Fadl, 2005)।
এই নতুন পরিচয়ের পেছনে সৌদি অর্থের বিরাট ভূমিকা ছিল। সাংবাদিক দাউদ আল-শিরিয়ানের মতে, মুসলিম বিশ্বের “পুরো ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের আনুমানিক ৯০ ভাগ খরচ” নাকি সৌদি আরবই জুগিয়েছে (al-Shirian, 2003)! একেবারে শিশুদের মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বড় বড় আলেমদের গবেষণা – সবখানেই তাদের টাকা পৌঁছেছে (Abou al Fadl, 2005)। বইপত্র, স্কলারশিপ, ফেলোশিপ, নতুন নতুন মসজিদ (যেমন, বলা হয় “গত ৫০ বছরে সৌদি সরকারি টাকায় ১,৫০০-র বেশি মসজিদ বানানো হয়েছে”) – সবকিছুর জন্যই অর্থায়ন করা হয়েছে (Kepel)। যেসব সাংবাদিক আর গবেষক তাদের লাইনে চলতেন, তারাও পুরস্কৃত হয়েছেন। এমনকি মিশরের আল আজহারের মতো প্রাচীন আর প্রভাবশালী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও তারা বিভিন্ন দেশে শাখা ক্যাম্পাস বানিয়ে দিয়েছে (Murphy, 2002)। ইয়াহইয়া বার্ট হিসেব করে দেখিয়েছেন, ১৯৭৫ সাল থেকে সৌদি আরব বছরে প্রায় ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে “১,৫০০ মসজিদ, ২১০টা ইসলামিক সেন্টার আর ডজন ডজন মুসলিম একাডেমী আর সম্প্রদায়” বানানোর পেছনে (Coolsaet, 2013)। তুলনা করলে বোঝা যাবে ব্যাপারটা কত বড় – সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরো প্রচার বাজেটই ছিল বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার (Coolsaet, 2013)!
এই বিপুল খরচের ফলে যা হয়েছে, ইসলামের অন্যান্য স্থানীয়, তুলনামূলকভাবে কম কট্টর ব্যাখ্যাগুলো বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে – এমনটাই মনে করেন দাউদ আল-শিরিয়ান বা লি কুয়ান ইউ-এর মতো পর্যবেক্ষকরা (al-Shirian, 2003; Lee Kuan Yew & Wyne, 2012)। এর ফলে সৌদি ব্যাখ্যাটা (যাকে অনেকে মজা করে “পেট্রো-ইসলাম”ও বলে) (Wahhabism: A deadly scripture, 2007) অনেক মুসলিমের মনে ইসলামের আসল বা সঠিক ব্যাখ্যা – বা বলা যায় ইসলামের “খাঁটি সোনার মান (gold standard)” – হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে (Radical Islam in Central Asia; Lee Kuan Yew & Wyne, 2012)।
সালাফীদেরকে তাদের বিরোধীরা, বিশেষ করে অন্য মতের লোকেরা, অনেক সময় ব্যঙ্গ করে বা গাল দেওয়ার ছলে “ওয়াহাবী” বলে ডাকে (Bonnefoy, 2011)। কিছু পশ্চিমা সমালোচকও প্রায়ই ওয়াহাবী আর সালাফীদের এক করে ফেলেন, যদিও অনেক পশ্চিমা গবেষকই এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আসল কথা হলো, যদিও ওয়াহাবিজমকে আরব উপদ্বীপের একটা সালাফিস্ট আন্দোলন হিসেবে দেখা হয়, যার প্রেরণা ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব আর তার উত্তরসূরিরা (আল আশ-শাইখ পরিবার), কিন্তু বৃহত্তর সালাফিস্ট আন্দোলনের শিকড় আসলে মুসলিম বিশ্বের আরও অনেক গভীরে প্রোথিত। আর প্রায়শই দেখা যায়, অন্য জায়গার সালাফীরা উপসাগরীয় অঞ্চলের ওয়াহাবীদের অনেক মতের সাথে একমত হয় না এবং তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে থাকে (Abdo, 2017)।
ভারতবর্ষের দিকে: ভারতীয় উপমহাদেশ (Indian subcontinent)
ভারতীয় উপমহাদেশেও সালাফী চিন্তার বেশ কয়েকটি ধারা চালু আছে। যেমন, আহলে হাদীস (Ahl i Hadith) আর কেরালা নদওয়াতুল মুজাহিদীন (Kerala Nadvathul Mujahideen)। আহলে হাদীস আন্দোলনটার শুরু উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ভারতে (Esposito, 2014)। এদের মূল কথা হলো, ধর্ম মানতে হলে শুধু কুরআন, সুন্নাহ আর হাদীসই মানতে হবে, ইসলামের একেবারে শুরুর দিকের পর যা কিছু নতুন এসেছে, সেগুলোর কোনো দাম নেই (Olivier & Sfeir, 2007)। বিশেষ করে, তারা তাকলিদ বা কোনো মাযহাবের পুরনো সিদ্ধান্ত চোখ বুজে মেনে নেওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে, আর তার বদলে ইজতিহাদ বা সরাসরি ধর্মগ্রন্থ থেকে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে (Esposito, 2014)। এই আন্দোলনের লোকেরা নিজেদেরকে সালাফী বলতেই ভালোবাসে, যদিও অন্যরা অনেক সময় এদেরকে ওয়াহাবী বলে ডাকে (Rabasa), অথবা ওয়াহাবী আন্দোলনেরই একটা রকমফের মনে করে (Lieven, 2011; Van Linschoten & Kuehn, 2012)। সাম্প্রতিক সময়ে এই আন্দোলন পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর আফগানিস্তানেও বেশ ছড়িয়ে পড়েছে (Esposito, 2014; Olivier & Sfeir, 2007)।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীকে (১৭০৩–১৭৬২) এই আন্দোলনের পথপ্রদর্শক বা বুদ্ধিবৃত্তিক গুরু হিসেবে মানা হয়, আর তার অনুসারীরা তাকে খুব সম্মান করে শায়খ আল-ইসলাম বলে ডাকে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাকলিদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আর তার ছেলে শাহ আব্দুল আজিজ (১৭৪৬–১৮২৪) এবং তারও পরের উত্তরসূরিরা, যেমন শাহ ইসমাইল (১৭৭৯–১৮৩১), এই প্রত্যাখ্যানকে আরও কট্টরভাবে সামনে নিয়ে আসেন। তারা শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তার উদার আর যুক্তিবাদী দিকগুলোকে বাদ দিয়ে দেন। এই ধারার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় সাইয়্যেদ আহমদ বেরেলভীর (১৭৮৬–১৮৩১) জিহাদ আন্দোলনে। এই আন্দোলনটা ছিল মূর্তি বা প্রতীক-বিরোধী (iconoclastic)। তারা শাহ ওয়ালিউল্লাহর তাকলিদ প্রত্যাখ্যানকে একেবারে আকীদার বা মৌলিক বিশ্বাসের অংশ বানিয়ে ফেলে। তারা অমুসলিমদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ বা শারীরিক জিহাদের ওপর জোর দেয় আর মুসলিমদের মধ্যে চালু থাকা বিভিন্ন মিশ্র রীতিনীতি (syncretic rituals) বন্ধ করার চেষ্টা করে। যদিও সাইয়্যেদ আহমদের নেতৃত্বে চলা ভারতীয় মুজাহিদীন আন্দোলনের সাথে আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের অনেক মিল ছিল, আর ব্রিটিশরা এদেরকে “ওয়াহাবী” বলেই ডাকত, কিন্তু দুটো আন্দোলনই মূলত স্বাধীনভাবেই গড়ে উঠেছিল।
১৮৩১ সালে সাইয়্যেদ আহমদের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরা – উইলায়াত আলী, ইনায়েত আলী, মুহাম্মদ হুসাইন, ফারহাত হুসাইন – ব্রিটিশ ভারত জুড়ে এই “ওয়াহাবী” জিহাদ চালিয়ে যান। চট্টগ্রাম থেকে পেশোয়ার, মাদ্রাজ থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে (Rebellion of 1857) তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বলা হয়, ১৮৫০-এর দশকে ব্রিটিশদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটাই এসেছিল এদের ব্রিটিশ-বিরোধী জিহাদ থেকে। কিন্তু বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর ব্রিটিশরা একের পর এক অভিযান, “ওয়াহাবী” বিচার আর রাষ্ট্রদ্রোহ আইন চাপিয়ে দিয়ে মুজাহিদীনদের পুরোপুরি দমন করে ফেলে। ১৮৮৩ সাল নাগাদ এই আন্দোলনটা একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, আর কোনো রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে এটি টিকে থাকে না। আন্দোলনের অনেক অনুসারী তখন সশস্ত্র জিহাদের পথ ছেড়ে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় বা শান্তিবাদী (political quietism) হয়ে যায়। আহলে হাদীস আন্দোলন মূলত এই ধর্মীয় কর্মীদের মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছিল (Brown, 1999; Ahmed, 2020; GK Today, 2016)।
উনিশ শতকের ব্রিটিশ ভারতে, এই পুনর্জাগরণবাদী আহলে হাদীস আন্দোলন আসলে ছিল সেই পুরনো ভারতীয় মুজাহিদীনেরই একটা সরাসরি কিন্তু শান্তিবাদী রূপ। আন্দোলনের প্রথম দিকের নেতারা ছিলেন বিখ্যাত হাদীস পণ্ডিত সাইয়্যেদ নাজির হুসাইন দেহলভী (১৮০৫–১৯০২) আর ভোপালের সিদ্দিক হাসান খান (১৮৩২-১৮৯০)। তারা দুজনেই শাহ ওয়ালিউল্লাহ আর ভারতীয় মুজাহিদীন আন্দোলনের ধারার আলেমদের কাছে সরাসরি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। যেমন, সৈয়দ নাজির হুসেইন ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর নাতি শাহ মুহাম্মদ ইসহাকের ছাত্র এবং তিনি “মিয়াঁ সাহেব” উপাধি পেয়েছিলেন, যা শাহ ওয়ালিউল্লাহর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারীদের সাথে জুড়ে গিয়েছিল। আবার সিদ্দিক হাসান খান ছিলেন সদর আল-দিন খানের ছাত্র, যিনি কিনা শাহ ‘আব্দ আল-আজিজ আর শাহ ‘আব্দ আল-কাদির – শাহ ওয়ালিউল্লাহর দুই ছেলের কাছে পড়েছিলেন। তার বাবাও শাহ ‘আব্দ আল আজিজের সরাসরি শিষ্য ছিলেন। এমনকি সিদ্দিক হাসান খানের ভোপালের দরবারে ইয়েমেনি আলেমরাও আসতেন। তিনি নিজে বেনারসের মুহাদ্দিস ‘আব্দ আল-হক্কের ছাত্র হন, যিনি আবার ইয়েমেনে শাওকানীর শিষ্য ছিলেন। আল-শাওকানীর লেখা তাকে এতটাই প্রভাবিত করে যে, তিনি দাবি করতেন স্বপ্নে প্রায়ই শাওকানীর সাথে তার কথা হয় এবং এভাবেই তিনি নাকি শাওকানীর বইপত্র প্রচার করার অনুমতি বা ইজাজা পেয়েছিলেন!
তো, এভাবেই আহলে হাদীস আন্দোলন সরাসরি শাহ ওয়ালিউল্লাহ আর আল-শাওকানীর শিক্ষা থেকেই জন্ম নেয়। তারা তাকলিদ প্রত্যাখ্যান করে আর হাদীসের পুনরুজ্জীবনের কথা বলে। তবে তারা শাহ ওয়ালিউল্লাহর পুরনো আইনি তত্ত্বের সাথে সমঝোতা করার পথ থেকে সরে আসে। তারা জাহিরী বা আক্ষরিক সম্প্রদায়ের সাথে নিজেদের যুক্ত করে এবং হাদীস বোঝার ক্ষেত্রেও একদম আক্ষরিক পদ্ধতি গ্রহণ করে। তারা চারটি প্রধান মাযহাবের কর্তৃত্ব মানতে চায় না এবং ইজমা বা ঐকমত্যকে শুধু সাহাবীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। তাদের জীবনের আদর্শ হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীর দেখানো পথের হুবহু অনুসরণ করে একটা ধার্মিক আর নৈতিক জীবনযাপন করা (Brown, 1999)।
কেরালার দিকে তাকালে দেখা যায় কেরালা নদওয়াতুল মুজাহিদীন (KNM) এর কথা। এটি ১৯৫০ সালে কেরালা জমিয়ত আল উলামা (KJU) দ্বারা একটি জনপ্রিয় সংস্কার আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর শিকড় পাওয়া যায় ১৯২২ সালে ভাক্কম মৌলভী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কেরালা আইক্যা সঙ্গমে (Kerala.com, 2017)। ২০০২ সাল থেকে KNM এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ভাঙন ধরেছে, তবে এর সবকটি অংশই আরব বিশ্বের সালাফী গোষ্ঠীগুলোর সাথে, বিশেষ করে সৌদি আরব আর কুয়েতের সালাফীদের সাথে, ভালো যোগাযোগ বজায় রাখে (Miller, 1976)।
সাধারণ গরিব আর খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে যে লোকজ ইসলাম (Folk Islam) আর সুফিবাদ (Sufism) বেশ জনপ্রিয়, সেটা আহলে হাদীসদের কাছে একদমই অপছন্দের, তাদের বিশ্বাস আর রীতিনীতির পরিপন্থী (anathema)। সুফিবাদের প্রতি এই বিরূপ মনোভাবের কারণে তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী বেরেলভী আন্দোলনের বেশ সংঘাত লাগে, এমনকি বেরেলভীদের পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী দেওবন্দীদের চেয়েও বেশি (Buehler, 1998)। আহলে হাদীস অনুসারীরা নিজেদেরকে জাহিরী মাযহাবের লোক বলেই পরিচয় দেয় (Brown, 1996)। এই আন্দোলন সৌদি আরব থেকে একদিকে যেমন অনুপ্রেরণা পায়, তেমনি অর্থ সাহায্যও পায় (Rubin; Sareen, 2005)। জামিয়া সালাফিয়া হলো ভারতে তাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
নীল নদের তীরে: মিশর (Egypt)
মিশরীয় সালাফী আন্দোলনকে সালাফী দুনিয়ার একটা বেশ প্রভাবশালী শাখা বলা চলে। এদের চিন্তাভাবনা আরব বিশ্বের ধর্মীয় স্রোতকে, এমনকি খোদ সৌদি আরবের আলেমদেরও বেশ প্রভাবিত করেছে (Mandaville & Lacroix, 2022)। তবে মিশরের সালাফীরা কোনো একটা নির্দিষ্ট দলের ছাতার তলায় বা এক নেতার অধীনে চলে না। মিশরের প্রধান সালাফী ধারাগুলোর মধ্যে আছে আল-সুন্না আল-মুহাম্মাদিয়্যা সোসাইটি, সালাফিস্ট কলিং, আল-মাদখালিয়্যা সালাফিজম, অ্যাক্টিভিস্ট সালাফিজম, আর আল-গাম’ইয়্যা আল-শার’ইয়্যা (islamopediaonline.org, 2015)।
সিরিয়ার আলেম মুহাম্মদ রশিদ রিদা ১৯২০-এর দশক থেকে মিশরে সালাফী-ওয়াহাবী মতবাদ আমদানি করতে শুরু করেন (Monthly Review, 2011)। রশিদ রিদা মিশরের উদারপন্থী এলিটদের পশ্চিমা সংস্কৃতি ঘেঁষা চালচলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনাগুলোকে ইসলামী ঐক্য নষ্ট করার একটা ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতেন। রিদা আর তার শিষ্যরা মিলে সালাফী নীতির ওপর ভিত্তি করে একটা ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার জন্য প্রচারণা চালান। এর ফলে তারা তৎকালীন মিশরীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আর জাতীয়তাবাদীদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষে পরিণত হন (Youssef, 1985)।
আল-সুন্না আল-মুহাম্মাদিয়্যা সোসাইটি (Al-Sunna Al-Muhammadeyya Society): আনসার আল-সুন্না নামেও পরিচিত এই দলটি ১৯২৬ সালে শেখ মোহাম্মদ হামেদ এল-ফিকি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন আল-আজহারের ১৯১৬ সালের গ্র্যাজুয়েট আর বিখ্যাত মুসলিম সংস্কারক মুহাম্মদ আবদুহের ছাত্র। মিশরের প্রধান সালাফী গোষ্ঠী হিসেবে এদেরকেই ধরা হয়। এল-ফিকির চিন্তাভাবনা সুফিবাদের প্রতি বেশ বিরূপ ছিল। কিন্তু মুহাম্মদ আবদুহের সাথে তার পার্থক্য হলো, আনসার আল-সুন্না ইবনে তাইমিয়ার দেখানো তাওহীদের পথ অনুসরণ করে (islamopediaonline.org, 2015)। অনেক সৌদি আলেম আবার আনসার আল-সুন্নার বড় বড় উলেমা, যেমন ‘আব্দ আল-রাজ্জাক ‘আফিফি আর মুহাম্মদ খলিল হাররাসের শিষ্য হয়েছিলেন (Mandaville & Lacroix, 2022)।
মিশরের বেশিরভাগ সালাফীই আনসার আল-সুন্না আল-মুহাম্মাদিয়্যার সাথে যুক্ত। মুহাম্মদ হামিদ আল-ফিক্কি (যিনি ছিলেন সালাফী আলেম রশিদ রিদার ছাত্র) ঐতিহ্যবাদী সালাফিজমকে রক্ষা করার জন্য এই আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন। আরব বিশ্বের ওয়াহাবী আলেমদের সাথে এদের বেশ উষ্ণ সম্পর্ক এবং ১৯৭০-এর দশক থেকে সালাফী জাগরণের ক্ষেত্রে এরা বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। এদের সাথে ওয়াহাবীদের প্রথম যোগাযোগ ঘটে রশিদ রিদার মাধ্যমেই। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেও আনসার আল-সুন্নার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এদের প্রথম দিকের বেশিরভাগ নেতাই ছিলেন আজহারী গ্র্যাজুয়েট আর এখনকার অনেক আলেমও আল-আজহারেই পড়াশোনা করেছেন। এই আন্দোলনের বিখ্যাত আলেমদের মধ্যে আছেন রশিদ রিদা, মুহাম্মদ হামিদ আল-ফিক্কি, আব্দ আল-রাজ্জাক ‘আফিফি, সাইয়্যিদ সাবিক, মুহাম্মদ খলিল হারাস প্রমুখ (Gauvain, 2013)।
সালাফিস্ট কল (আল-দাওয়া আল-সালাফিয়্যা) (Salafist Call (al-dawa al-salafiyya)): এটি আরেকটি প্রভাবশালী সালাফী সংগঠন, যার জন্ম ১৯৭০-এর দশকের ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যদিও অনেক ছাত্র কর্মী মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দিয়েছিল, কিন্তু মোহাম্মদ ইসমাইল আল-মুকাদ্দিমের নেতৃত্বে একটা দল (সৌদি আরবের সালাফিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত) ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে সালাফিস্ট কলিং প্রতিষ্ঠা করে (Jadaliyya, 2011)। মিশরের সালাফী সংগঠনগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে জনপ্রিয় আর স্থানীয় পর্যায়ে প্রোথিত। যেহেতু এটা একটা দেশীয় গণআন্দোলন এবং বিভিন্ন বিষয়ে এর কড়া রাজনৈতিক অবস্থান আছে, তাই সৌদি আরবের সাথে এর সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। আনসার আল-সুন্নার চেয়ে এরা নিজেদের মিশরীয় ঐতিহ্যকে বেশি করে তুলে ধরে। তারা তাদের ইতিহাস খুঁজে পায় মিশরে ইবনে তাইমিয়ার ওপর হওয়া অত্যাচার আর কারাবরণের মধ্যে, আরবে মুওয়াহিদুন আন্দোলনের কষ্টের মধ্যে, আর শেষ পর্যন্ত সাইয়্যেদ রশিদ রিদা, মুহিব্ব আল-দিন আল-খাতিবের মতো সেইসব আলেমদের মধ্যে যারা বিশ শতকের শুরুর দিকে মিশরে ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাকে জনপ্রিয় করেছিলেন। আনসার আল-সুন্না যেখানে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার কথা বলে, সেখানে সালাফিস্ট কল হলো একটা পুরোদস্তুর রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় আন্দোলন (Mandaville & Lacroix, 2022)।
আল-নূর পার্টি (The Al-Nour Party): ২০১১ সালের মিশরীয় বিপ্লবের পর সালাফিস্ট কল এই দলটি তৈরি করে। এদের মতাদর্শ বেশ অতি-রক্ষণশীল আর ইসলামপন্থী। তারা কঠোর শরিয়া আইন চালু করায় বিশ্বাসী (Ashour, 2012)। ২০১১-১২ সালের সংসদ নির্বাচনে আল-নূর পার্টির নেতৃত্বে ইসলামপন্থী জোট প্রায় ২৮% ভোট পেয়েছিল এবং ৪৯৮টা আসনের মধ্যে ১২৭টা জিতেছিল, যা ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (Brown, 2011)। আল-নূর পার্টি একাই পেয়েছিল ১১১টা আসন। কিন্তু ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে তারা ধীরে ধীরে মোহাম্মদ মুরসির ব্রাদারহুড সরকার থেকে দূরত্ব বাড়াতে থাকে এবং সেই বছরের জুলাই মাসে যে সামরিক অভ্যুত্থানে মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হন, তার আগে জুনের শেষের দিকে হওয়া বড় ধরনের বিক্ষোভেও তারা অংশ নেয় (Kingsley, 2013)। দলটির বিরুদ্ধে আনা একটি মামলা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে খারিজ হয়ে যায় কারণ আদালতের নাকি এই বিষয়ে কোনো এখতিয়ারই ছিল না (Ahram Online, 2014a)। দলটিকে নিষিদ্ধ করার আরেকটি মামলা ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি রাখা হয়েছিল (Ahram Online, 2014b)। পরে দলটিকে ভেঙে দেওয়ার জন্য আরও একটি মামলা করা হলে (Daily News Egypt, 2014), সেটাও ২০১৪ সালের নভেম্বরে আলেকজান্দ্রিয়ার আদালত এখতিয়ারের অভাব দেখিয়ে খারিজ করে দেয় (Auf, 2014)।
আল-আহরাম পত্রিকার আম্মার আলী হাসানের মতে, যদিও সালাফী আর মুসলিম ব্রাদারহুড অনেক বিষয়ে একমত, যেমন সমাজকে “ইসলামীকরণ” করা বা সব মুসলিমের জন্য যাকাত দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, কিন্তু কিছু বিষয়ে তাদের বেশ অমিলও আছে। যেমন, ব্রাদারহুড যেখানে নারী বা খ্রিস্টানদের উচ্চ পদে থাকা নিয়ে কিছুটা নমনীয়, সালাফীরা সেটা মানতে নারাজ। আবার ইরানের প্রতি ব্রাদারহুডের যে তুলনামূলক নরম মনোভাব, সেটাও সালাফীরা প্রত্যাখ্যান করে (Hassan, 2012)।
সমুদ্র পেরিয়ে: মালয়েশিয়া (Malaysia)
১৯৮০ সালের কথা। সৌদি আরবের প্রিন্স মোহাম্মদ বিন ফয়সাল আল সৌদ মালয়েশিয়াকে ১০০ মিলিয়ন ডলার অফার করেন একটা সুদ-বিহীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য। এর দুই বছর পর সৌদিরা মালয়েশিয়ার সরকার-সমর্থিত ব্যাংক ইসলাম মালয়েশিয়া গড়তেও সাহায্য করে (Pipes, 2009)। ২০১৭ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, সালাফী মতবাদ মালয়েশিয়ার এলিট বা উঁচু তলার লোকদের মধ্যে বেশ ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি সরকারি সম্প্রদায়গুলোতে যে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হতো, সেটাও নাকি বদলে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে আসা সালাফী ধারার ধর্মতত্ত্বের দিকে ঝুঁকছে (freemalaysiatoday.com, 2017; thestar.com.my, 2016)। মালয়েশিয়ায় এই সৌদি-সমর্থিত সালাফী ঢেউয়ের প্রভাবটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে শিয়া-বিরোধী কথাবার্তার বাড়বাড়ন্ত আর মালয় সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান আরবীকরণের (Arabization) মধ্যে (Alatas, 2014; Musa & Hui, 2017; Tarrant & Sipalan, 2017; Kingston, 2019; Hunter, 2022)।
পাহাড় আর মরুভূমির দেশ: ইয়েমেন (Yemen)
ইয়েমেনের সালাফীরা ইসলামী পণ্ডিত মুহাম্মদ ইবনে ‘আলী আশ-শাওকানীকে (১৭৫৯–১৮৩৯) তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পথপ্রদর্শক হিসেবে মানে। তারা তার লেখাগুলোকে সালাফী পুনর্জাগরণের ধারণা প্রচারের জন্য কাজে লাগায় (Salmoni et al., 2010)। শুধু ইয়েমেনেই নয়, শাওকানীর লেখা সালাফী সম্প্রদায়গুলোতে বিশ্বজুড়েই বেশ সমাদৃত (Oxford University Press, 2010)। তিনি আবার ভারতীয় উপমহাদেশের আহলে হাদীসের মতো পৃথিবীর অন্যান্য সালাফী আন্দোলনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন (Böwering et al., 2013)।
ভূমধ্যসাগরের তীরে: তিউনিসিয়া (Tunisia)
তিউনিসিয়ার সালাফী আন্দোলনকে ২০১১ সালের বিপ্লবের পরের প্রেক্ষাপটে ফিলিপ নেয়লর “অতি-রক্ষণশীল” বলে চিহ্নিত করেছেন (Naylor, 2015)।
তুরস্কের দিকে একটু তাকাই (Turkey)
আন্তর্জাতিক সালাফিজম নিয়ে আজকাল যত লেখালেখি হচ্ছে, তার মধ্যে তুরস্কের নামটা তেমন একটা আসে না। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত, তাই না? আসলে, তুর্কি ইসলামের মধ্যে সালাফিজম একটা বেশ ছোট বা সংখ্যালঘু ধারা। এর শুরুটা হয়েছিল ১৯৮০-র দশকে। তখন তুরস্কের সরকার চেষ্টা করছিল তুর্কি জাতীয়তাবাদের সাথে ধর্মকে মিলিয়ে একটা নতুন সমীকরণ তৈরি করতে। সেই প্রেক্ষাপটেই এর বিকাশ ঘটে। যদিও মিডিয়াতে বা তুরস্কের ধর্মতত্ত্বের পণ্ডিতদের মধ্যে সালাফিজম নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু এর নামের বানান নিয়েই তো ঠিক নেই! কেউ লেখে সেলফিয়ে, কেউ সেলেফিয়্যে, কেউ বা আবার সেলফিয়েসিলিক বা সেলেফিজম! এই বানানের গড়মিলটাই যেন বলে দেয়, তুরস্কে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কতটা দ্বিধা আছে, আর সেই সাথে কামাল পাশার গড়া প্রজাতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষতা জনজীবন থেকে ধর্মকে কতটা দূরে সরিয়ে দিতে সফল হয়েছে।
তবে হ্যাঁ, ১৯৮০-র দশক থেকে সৌদি আরবে ট্রেনিং পাওয়া কিছু সালাফী প্রচারক ঠিকই নিজেদের জন্য একটা জায়গা করে নিয়েছে। তারা কিছু প্রকাশনা সংস্থা খুলেছে, যারা সৌদি সালাফী ঘরানার আরবি বইপত্র তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করে তুরস্কের ধর্মীয় আলোচনার ধারাটাকেই বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ১৯৯৯ সালে তো তুরস্কের সরকারি ধর্মীয় সংস্থা ‘দিয়ানাত’ সালাফিজমকে সুন্নি চিন্তাধারার একটা অংশ হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়ে দেয় (The Reference Paris, 2018)! এরপর থেকেই সালাফী প্রচারকরা তুর্কি সমাজে ধীরে ধীরে ঢুকতে শুরু করে।
পরে যখন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্কের নাগরিক আর একেপি (AKP) সরকার জড়িয়ে পড়ল, তখন জনমনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল – সালাফিজম কি আসলেই তুরস্কের বাইরের জিনিস? দেখা গেল, সালাফিজম তুরস্কের ধর্মীয় আলোচনার একটা দৃশ্যমান অংশ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যখন সামরিক শাসকেরা কামাল পাশার সেক্যুলারিজমের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠা আন্দোলনগুলোকে – যেমন বামপন্থী, নেকমেত্তিন এরবাকানের ইসলামিজম, কুর্দি জাতীয়তাবাদ, আর ইরানকে – কোণঠাসা করার চেষ্টা করছিল, তখন সালাফিজম যেন একটা বিকল্প হিসেবে উঠে আসে।
সরকার তখন ‘তুর্কি-ইসলামিক সিন্থেসিস’ নামে একটা তত্ত্ব দাঁড় করায়। এর মাধ্যমে ১৯২৩ সাল থেকে চলে আসা কট্টর বৈজ্ঞানিক ইতিবাচকতার নীতি কিছুটা নরম করা হয়, যাতে তুর্কি জাতীয় সংস্কৃতির একটা অংশ হিসেবে ইসলাম জায়গা করে নিতে পারে। সামরিক কর্তৃপক্ষ দিয়ানাতের বাজেট ৫০ শতাংশেরও বেশি বাড়িয়ে দেয়, কর্মী সংখ্যা ১৯৭৯ সালের ৫০,০০০ থেকে বাড়িয়ে ১৯৮৯ সালে ৮৫,০০০ করে ফেলে। সৌদি আরবের সাথে মাখামাখি বাড়িয়ে তুরস্ক তখন প্যান-ইসলামিক সংস্থাগুলোতেও (যেগুলো মূলত সৌদির অধীনেই চলত) বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি দিয়ানাত মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ থেকে টাকা পায় যাতে ইউরোপে থাকা তুর্কি অভিবাসীদের মধ্যে ধর্মীয় প্রচার চালানো যায়। ব্যাংকিং, প্রকাশনা, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, বাচ্চাদের বই – সব ক্ষেত্রেই সৌদি ব্যবসা আর প্রতিষ্ঠানের সাথে একটা বাণিজ্যিক আর সাংস্কৃতিক যোগাযোগ তৈরি হয়।
যারা মদিনার ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে এসেছেন এবং নিজেদের সালাফী বলে পরিচয় দেন, তারাও প্রকাশনা সংস্থা আর দাতব্য সংস্থা (যাকে তুর্কিতে বলে ‘ডেরনেক’) খুলে বসেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন ইরাকি-তুর্কি বংশোদ্ভূত সালাফী আলেম ও প্রচারক আব্দুল্লাহ ইয়োলকু, যিনি ‘গুরাবা’ প্রকাশনা সংস্থার ব্যানারে কাজ করেন (Al-Rasheed, 2018)। প্রথমদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তাদের কিছু হয়রানি আর গ্রেপ্তার হতে হলেও, ২০০২ সালে একেপি নির্বাচনে জিতে সামরিক বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার পর তারা বেশ প্রকাশ্যে চলে আসে। তুর্কি সালাফীরা ইউটিউব, টুইটার, ফেসবুকে ভীষণ সক্রিয় হয়ে ওঠে, নিজেদের প্রকাশনার প্রচারের জন্য ওয়েবসাইটও খোলে।
তাদের মূল রেফারেন্স হলো সৌদি আরবের আলেমরা, যেমন বিন বায, আল-আলবানী, সালেহ আল-ফাওজান, মুহাম্মদ ইবনে আল-উসাইমীন। কিন্তু তারা আবার মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে যুক্ত সমসাময়িক আলেম, যেমন কাতারে থাকা মিশরীয় পণ্ডিত ইউসুফ আল-কারাদাউইকে এড়িয়ে চলেন। তারা মূলত তুর্কি ভাষাতেই কথা বলেন বা লেখেন, কিন্তু তাদের ওয়েবসাইটে আরবি ভাষার জন্য আলাদা বিভাগ থাকে, বইয়ের দোকানে প্রচুর আরবি সালাফী বই পাওয়া যায়, আর তাদের তুর্কি লেখালেখিতেও আরবি পরিভাষার খুব ব্যবহার দেখা যায়। এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলেন সেই আব্দুল্লাহ ইয়োলকু, যার সম্পর্কে বলা হয় তিনি নাকি “আরবি বই থেকে তুর্কি সালাফিজম তৈরি করেন”। যদিও আন্তর্জাতিক সালাফিজমের আলোচনায় তুরস্কের নামটা তেমন আসে না, কিন্তু মেয়ারের সেই কথাটা – যে সালাফিজম তখনই সফল হয় ‘যখন এর শান্তিবাদী ধারা একটা জায়গা খুঁজে পায় অথবা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ব্যর্থ হয়’ – তুরস্কের ক্ষেত্রে যেন বেশ খেটে যায় (Al-Rasheed, 2018)।
প্রাচীরের ওপারে: চীন (China)
চীনে আবার সালাফিজমের গল্পটা অন্যরকম। সেখানে গেদিমু, সুফি খাফিয়া, জাহরিয়্যা সহ হুই মুসলিমদের বেশ কয়েকটি পুরনো দল সালাফিজমের ঘোর বিরোধী। এমনকি ইহওয়ানি (বা ইখওয়ান) নামে যে কট্টরপন্থী চীনা মুসলিম দলটা সালাফী অনুপ্রেরণায় মা ওয়ানফু গড়ে তুলেছিলেন, তারাও মা দেবাও আর মা ঝেংকিং নামের দুজনকে ধর্মদ্রোহী বলে ঘোষণা দেয়, যখন তারা সালাফিজমকেই ইসলামের প্রধান রূপ হিসেবে চালু করার চেষ্টা করেছিল। এই মা দেবাও পরে লানঝৌ আর লিনসিয়াতে ‘সাইলাইফেংয়ে’ (মানে সালাফী) নামে একটা সালাফী সম্প্রদায় খোলেন। এটা চীনের অন্য সব মুসলিম দল থেকে একেবারেই আলাদা (Dillon, 1999)।
চীনে ঠিক কতজন সালাফী আছেন, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না (Esposito, 1999)। একসময় কুওমিনতাং সরকারের সুফি মুসলিম জেনারেল মা বুফাং (যিনি ইহওয়ানিদের সমর্থন করতেন) সালাফীদের ওপর বেশ নির্যাতন চালান আর তাদের লুকিয়ে পড়তে বাধ্য করেন। তাদের প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা বা ইবাদত করার কোনো অনুমতি ছিল না। ইহওয়ানিরা ততদিনে বেশ সেক্যুলার আর চীনা জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিল। তারা সালাফিয়্যাকে ‘হেটেরোডক্স’ বা ভুল পথ (xie jiao) আর বিদেশীদের শেখানো জিনিস (waidao) বলে মনে করত। পরে যখন কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসে, তখন সালাফীরা আবার প্রকাশ্যে তাদের ধর্ম পালনের অনুমতি পায় (Rubin, 2000)।
দূরের দেশ: ভিয়েতনাম (Vietnam)
ভিয়েতনামের মুসলিম চাম সম্প্রদায়ের মধ্যে সালাফিস্টরা একটু প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ভিয়েতনামী সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণের কারণে সেটা বেশিদূর এগোতে পারেনি। তবে চামদের মধ্যে সালাফীদের এই পিছিয়ে পড়াটা আবার তাবলিগী জামায়াতের জন্য সুবিধাজনক হয়েছে (Féo, 2009)।
ছোট্ট ধনী দেশ: কাতার (Qatar)
সৌদি আরবের মতো কাতারের বেশিরভাগ নাগরিকও সালাফিজমের একটা কঠোর ধারা মেনে চলে, যা ওয়াহাবিজম নামে পরিচিত (BBC News, 2011)। কাতারের জাতীয় মসজিদের নামই হলো ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব মসজিদ, অর্থাৎ ওয়াহাবিজমের প্রতিষ্ঠাতার নামে (Doha News, 2011)। সৌদি আরব যেমন সালাফিজমের প্রচারে পয়সা খরচ করে, কাতারও তেমনি ওয়াহাবী সালাফিজম প্রচারকারী মসজিদ বানাতে অর্থায়ন করেছে।
তবে সৌদি আরবের কট্টর ওয়াহাবী রীতিনীতির তুলনায় কাতার ওয়াহাবিজমের একটা একটু ভিন্ন, খানিকটা উদার চেহারা দেখিয়েছে। কাতারে মেয়েরা আইনত গাড়ি চালাতে পারে, অমুসলিমরা সরকারি দোকান থেকে শুয়োরের মাংস আর মদ কিনতে পারে, আর সেখানকার ধর্মীয় পুলিশ নামাজের সময় দোকানপাট জোর করে বন্ধ করায় না (Economist, 2016)। তাছাড়া, কাতার বেশ কয়েকটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুলেছে, এমনকি একটা “চার্চ সিটি”ও বানিয়েছে যেখানে বিদেশি শ্রমিকরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে (Top Universities, 2016; Doha News, 2011a)। ওয়াহাবিজমের এই উদার ব্যাখ্যাটা গ্রহণের কৃতিত্ব মূলত কাতারের তরুণ আমির তামিম বিন হামাদ আল থানিকে দেওয়া হয়।
কিন্তু সৌদি আরবের তুলনায় কাতারের এই একটু নরম মনোভাব আবার দেশের ভেতরে আর বাইরে দুই জায়গাতেই সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা লিখেছে, একজন কাতারি আলেম সরকারের এই অ-ইসলামিক কাজকর্মকে (যদিও সেগুলো লোকচক্ষুর আড়ালেই রাখা হয়) মেনে নেওয়ার নীতির সমালোচনা করেছেন এবং অভিযোগ করেছেন যে কাতারের নাগরিকরা আসলে নির্যাতিত (Economist, 2016)। যদিও কাতারে লিঙ্গ পৃথকীকরণ সৌদি আরবের মতো অতটা কঠোর নয়, তবুও সেখানকার একমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ে একসাথে ক্লাস করার পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছিল, কারণ ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় বয়কট করার হুমকি দিয়েছিল (Economist, 2016)। আবার কাতারে মদ বিক্রির বিষয় নিয়েও স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষের খবর পাওয়া গেছে (Delmar-Morgan, 2012)।
কাতার আবার তার এই কট্টর ধর্মীয় ব্যাখ্যা সামরিক আর অসামরিক – দুই পথেই ছড়ানোর চেষ্টা করছে, এই নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। সামরিক দিক থেকে দেখলে, কাতার লিবিয়া আর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিদ্রোহী ইসলামপন্থী চরমপন্থী যোদ্ধাদের অর্থ দেওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছে। লিবিয়ায়, তারা আনসার আল-শরিয়ার মিত্রদের পয়সা জুগিয়েছে – এই আনসার আল-শরিয়াই নাকি প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন্সকে হত্যার পেছনে ছিল। আবার সিরিয়ায় তারা ইসলামপন্থী আহরার আল-শাম গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র আর টাকা পাঠিয়েছে (Spencer & Blair)। এছাড়াও, ঈদ চ্যারিটি আর মাদিদ আহল আল-শামের মতো কাতার-ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা আর অনলাইন প্রচারণার মাধ্যমে সিরিয়ার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ দেওয়ার অভিযোগও আছে (CATF; FDD’s Long War Journal, 2015)। কাতার গাজার হামাস সরকারকেও বারবার আর্থিক সাহায্য দিয়েছে, আর হামাসের বড় নেতারা দোহা সফর করেছেন বা কাতারের নেতারা গাজায় গিয়েছেন (Reuters, 2016; NPR, 2015)। এমনকি মোহাম্মদ মুরসির সময়ে কাতার মিশর সরকারকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছিল (Law, 2013)।
অসামরিক দিক থেকে, কাতারের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল আল জাজিরা প্রায়শই সমালোচিত হয় যে তারা নাকি কাতারের পররাষ্ট্র নীতির সাথে তাল মিলিয়ে বেছে বেছে খবর দেখায় (Washington Post, 2011b)। এর ফলে প্রতিবেশী পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো – সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত – কাতারের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেছে। ২০১৪ সালে এই তিন দেশ কাতার থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, কাতার উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (GCC) এর অন্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে (Al-Arabiya, 2014)। সৌদি আরব তো কাতারকে স্থল আর সমুদ্রপথে পুরোপুরি অবরোধ করার হুমকিও দিয়েছিল (Arabian Business, 2016)। অবশ্য এই অবরোধ ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি শেষ হয়, যখন কুয়েতের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব আর কাতার একটা সমঝোতায় আসে (Ng, 2021)।
কিছু পরিসংখ্যান (Statistics)
প্রায়শই বিভিন্ন সূত্র থেকে শোনা যায়, এমনকি জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও, যে সালাফিজম নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ইসলামী আন্দোলন (Grant; Shuster, 2013; Christian, 2012; AFP, 2012)। জার্মানির সাউড্ডয়েচে জাইটুং পত্রিকাও বলছে, আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় বিষয়ে সালাফিজম দিন দিন বেশ নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকায় চলে আসছে (sueddeutsche.de)।
তুরস্কেও ১৯৮০-র দশক থেকে সালাফিয়্যা আন্দোলন বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, একটা “সম্মানিত সুন্নি ঐতিহ্য” হিসেবে। তখন তুর্কি সরকার সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ করে তোলে। এর ফলে সালাফী মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ আর তুর্কি দিয়ানাতের মধ্যে সহযোগিতাও বাড়ে। দিয়ানাত তো সালাফিজমকে একটা ঐতিহ্যবাহী সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায় হিসেবে স্বীকৃতিই দিয়ে দেয়, আর এভাবেই তুর্কি সমাজে সালাফী শিক্ষার প্রবেশ ঘটে। বিশ্বজুড়েই দেখা গেছে, ইসলামী ধর্মীয় আলোচনার এই সালাফীকরণটা ঘটেছে প্যান-ইসলামিস্ট আন্দোলনের উত্থানের সাথেই, যেখানে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের ধারণার ওপর খুব জোর দেওয়া হয়েছিল (mei.edu, 2018; Hammond, 2017)।
অন্যান্য ব্যবহার: একটু অন্যরকম সালাফিজম (Other usage)
আল-সালাফিয়্যা আল-তানভিরিয়্যা (আলোকিত সালাফিজম)
এতক্ষণ ধরে আমরা যে কট্টর বা ঐতিহ্যবাদী সালাফিজমের কথা বললাম, তার বাইরেও “সালাফিজম” শব্দটার আরেকটা ব্যবহার আছে, বিশেষ করে পশ্চিমা গবেষকদের মধ্যে। তারা এই শব্দটা ব্যবহার করেন আধুনিকতাবাদীদের (modernists) বোঝাতে। তাদের মতে, এটা হলো “উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপীয় ধারণার বিস্তারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভূত একটি চিন্তাধারা” যা “মুসলিম সভ্যতার মধ্যেই আধুনিকতার আসল শিকড় খুঁজে বের করতে চেয়েছিল” (Kepel, 2006; Stanley, 2005)। এদেরকে মডার্নিস্ট সালাফীও বলা হয় (oxfordbibliographies.com; Kjeilen, 2020; Tony Blair Faith Foundation)। এই ধারাটা, যা আল-সালাফিয়্যা আল-তানভিরিয়্যা বা আলোকিত সালাফিজম নামেও পরিচিত, এর প্রধান মুখ ছিলেন জামাল আল-দিন আফগানি (১৮৩৯–১৮৯৭) আর মুহাম্মদ ‘আবদুহ (১৮৪৯–১৯০৫)। তাদের লেখালেখিতে মু’তাজিলা বা যুক্তিবাদী আর সুফি রহস্যময় চিন্তার স্পষ্ট ছাপ ছিল, যা কিনা কট্টর সালাফিজমের একেবারেই বিপরীত (Ridgeon, 2015)।
কেউ কেউ বলেন, আজকের দিনের সালাফিজমের গোড়া আফগানি আর আবদুহের এই আধুনিকতাবাদী “সালাফী আন্দোলন”-এর মধ্যেই আছে (Jamestown.org; Dillon)। আবার অন্যরা বলেন, ইসলামী আধুনিকতাবাদ কেবল আজকের সালাফিজমকে একটু প্রভাবিত করেছে, এর উৎস নয় (muslimmatters.org, 2014)। তবে বেশিরভাগ গবেষকই প্রথম ধারণাটা নাকচ করে দিয়েছেন (Wiktorowicz, 2006; conflictsforum.org, 2014; Lauziere, 2010)। কুইন্টান ভিক্টোরোভিচের মতে:
“সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটু বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে কারণ ইসলামী আধুনিকতাবাদী আর আজকের দিনের সালাফী – দু’দলই নিজেদেরকে আল-সালাফিয়্যা বলে (বা বলত)। এর ফলে কিছু পর্যবেক্ষক ভুল করে ভেবে বসেছেন যে এদের আদর্শিক উৎস একই। কিন্তু আগের সালাফিয়্যা (মানে আধুনিকতাবাদীরা) ছিল মূলত যুক্তিবাদী আশ’আরী।” (Wiktorowicz, 2006)।
আজকের সালাফিজমের ওপর প্রভাব (Influence on contemporary Salafism)
নিজেদের জন্ম আর বিকাশের দিক থেকে দেখলে, ওয়াহাবিজম আর সালাফিজম কিন্তু বেশ আলাদা। ওয়াহাবিজম চেয়েছিল ইসলামকে সব আধুনিক প্রভাব থেকে মুক্ত করে একটা সরল রূপে ফিরিয়ে আনতে। আর সালাফিজম চেয়েছিল ইসলামকে আধুনিকতার সাথে মেলাতে। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা বড় মিল ছিল – দু’দলই ইসলামের পুরনো দিনের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাগুলোকে বাদ দিয়ে সরাসরি ধর্মগ্রন্থের একটা ‘মৌলবাদী’ বা আক্ষরিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেয়েছিল। যদিও সালাফিজম আর ওয়াহাবিজম দুটো আলাদা আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সালাফী (মূলত মুসলিম ব্রাদারহুড প্রভাবিত) প্যান-ইসলামিজমকে গ্রহণ করার ফলে একটা মিশ্রণ ঘটে যায়। ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের তাওহীদ, শিরক আর বিদ’আত নিয়ে কঠোর চিন্তাভাবনার সাথে সালাফীদের হাদীসের ব্যাখ্যার একটা লেনদেন বা ক্রস-পলিনেশন হয়। কিছু সালাফী তখন ইবনে আব্দুল ওয়াহাবকে সালাফদেরই একজন বলে মেনে নেয় (যেন ওয়াহাবিজমকে তারা পেছনের দরজা দিয়ে সালাফিজমের অন্তর্ভুক্ত করে নিল!), আর ওদিকে মুওয়াহিদুন বা ওয়াহাবীরাও নিজেদেরকে সালাফী বলে ডাকা শুরু করে (Jamestown.org)।
আরও বৃহত্তর অর্থে (In the broadest sense)
একটা খুব সাধারণ বা বিস্তৃত অর্থে দেখলে, সালাফিজম অনেকটা অ-মাযহাবী ইসলাম (Non-denominational Islam – NDM) এর মতো। কারণ এর কিছু অনুসারী কোনো একটা নির্দিষ্ট আকীদা বা বিশ্বাস অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে না (Račius, 2018)। সালাফী (মানে সালাফের অনুসারী) শব্দটা দিয়ে আসলে যেকোনো সংস্কার আন্দোলনকেই বোঝানো যেতে পারে যা কিনা ইসলামের একেবারে মূল উৎসে ফিরে গিয়ে একে পুনরুজ্জীবিত করার ডাক দেয়। ওয়াহাবিজমের সাথে তাল মিলিয়ে তারা ইসলামের পবিত্র গ্রন্থগুলোর একদম আক্ষরিক ব্যাখ্যার ওপর জোর দেয়, আর মুহাম্মদ আবদুহ বা মুহাম্মদ ইকবালের মতো উদারপন্থী সংস্কারকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত আন্দোলনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে (Fukuda, 2013; conflictsforum.org, 2014)।
সমালোচনা: কারা কী বলছেন? (Criticisms)
ইসলামের ভেতর থেকে সমালোচনা
যেহেতু সালাফিয়্যা তাকলিদ বা মাযহাব মানাকে প্রত্যাখ্যান করে, তাই আশ’আরী আর মাতুরিদি সম্প্রদায়ের কিছু আলেম (যারা নিজেদেরকেই আসল সুন্নি বা অর্থোডক্স বলে মনে করেন) সালাফিয়্যাকে বিচ্যুত বা ভুল পথ বলে মনে করেন। এই আলেমরা বিশ্বাস করেন, ফিকহ বা আইনশাস্ত্রের ক্ষেত্রে চারটি মাযহাবের তাকলিদ করা ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক (Esposito, 2003; Martin, 2004)। এদের কেউ কেউ আবার সালাফীদের বিরুদ্ধে আকীদার ক্ষেত্রে তাজসিম (আল্লাহকে দেহধারী মনে করা) বা তাশবীহ (আল্লাহর সাথে সৃষ্টির তুলনা করা) এর মতো ভুল করার অভিযোগও তোলেন, যদিও তারা এটাও স্পষ্ট করে দেন যে, এই ভুলের কারণে সালাফীরা ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায় না (Opwis & Reisman, 2011; Izutsu, 1984; noor-book.com, 2021; albijory; iium.edu.my)।
কায়রোর বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু আলেম তো রীতিমতো ‘আল-রাদ’ (অর্থাৎ জবাব) নামে একটা বই লিখে সালাফী মতবাদের বিভিন্ন দিক খণ্ডন করেছেন (Gauvain, 2012a)। এই বইতে সালাফীদের অনেক বিচ্যুতি তুলে ধরা হয়েছে। শুধু নামাজের কথাই যদি ধরা হয়, তাহলে বইটি নীচের সালাফী দাবিগুলোর সমালোচনা করেছে (Gauvain, 2012a):
-
অযু করার সময় বিসমিল্লাহ বলা বা আল্লাহর নাম নেওয়া নাকি নিষিদ্ধ [ফতোয়া ৫০];
-
শুক্রবার পুরুষ-মহিলা সবার জন্য গোসল করা নাকি ফরজ [ফতোয়া ৬৩];
-
শিকার ছাড়া অন্য কোনো কারণে কুকুর পোষা নাকি হারাম [ফতোয়া ১৩৪];
-
পারফিউম বা আতরে অ্যালকোহল ব্যবহার করা নাকি নিষিদ্ধ [ফতোয়া ৮৫]।
‘আল-রাদ’ বইয়ের একজন লেখক, আইনের অধ্যাপক আনাস আবু শাদী বলছেন, “ওরা [সালাফীরা] সবকিছুই হতে চায়। ওরা শুধু প্রকাশ্য বা জাহিরি অর্থ নিয়েই আগ্রহী নয় (যদিও ওদের বেশিরভাগ আইনকানুন জাহিরী আলেম ইবনে হাযমের ‘মুহাল্লা’ থেকে নেওয়া), ওরা আবার এটাও বিশ্বাস করে যে, লুকানো বা বাতিনি অর্থটাও নাকি শুধু ওরাই বোঝে!” (Gauvain, 2012b)।
সালাফিজমের সুন্নি সমালোচকরা আরও অভিযোগ করেন যে, সালাফীরা নাকি আহমদ ইবনে হাম্বল আর অন্য তিন মাযহাবের ইমামদের আসল শিক্ষাকে বিকৃত করেছে (Cook, 1992)। “ওয়াহাবী” শব্দটা তো অনেক সময় বিরোধীরা সালাফীদেরকে ছোট করার জন্য বা গাল দেওয়ার ছলেই ব্যবহার করে (Davis, 2018)। সিরিয়ার আশ’আরী আলেম মোহাম্মদ সাইদ রমজান আল-বুতি সালাফিজম খণ্ডন করে বেশ কয়েকটা বই লিখেছেন। তার মধ্যে বিখ্যাত হলো ‘আল-লা মাযহাবিয়্যা (মাযহাব না মানা) হলো ইসলামী শরিয়াকে হুমকির মুখে ফেলা সবচেয়ে বিপজ্জনক বিদ’আত’ আর ‘আল-সালাফিয়্যা একটি বরকতময় যুগ ছিল, কোনো চিন্তার সম্প্রদায় নয়’। বলা হয়, শেষের বইটিই নাকি বিশ শতকে সালাফিজমের সবচেয়ে জোরালো খণ্ডন (Gauvain, 2012a; Lauzire, 2015)।
ইংরেজিতেও সালাফিজমের অনেক একাডেমিক সমালোচনা হয়েছে। যেমন, আধুনিকতাবাদী খালেদ আবু এল ফাদল (ইউসিএলএ সম্প্রদায় অফ ল) আর সুফি বুদ্ধিজীবী টিমোথি উইন্টার (কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি) ও জি.এফ. হাদ্দাদ এই বিষয়ে লিখেছেন (Gauvain, 2012a)। এল ফাদলের মতে, আল-কায়েদার মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো তাদের ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তি পায় “ওয়াহাবী আর সালাফী মতবাদের অসহিষ্ণু শুদ্ধতাবাদ” থেকে (Fish, 2011)। তিনি দাবি করেন, ওয়াহাবিজম আর সালাফিজমের কিছু উগ্র অংশের মধ্যে যে অসহিষ্ণুতা আর সন্ত্রাসবাদের প্রতি সমর্থন দেখা যায়, তার কারণ হলো তারা ইসলামের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য থেকে সরে গেছে (Fish, 2011)। এল-ফাদল আরও বলেন, ১৯৬০-এর দশকে সালাফী পদ্ধতিটা একটা “দমবন্ধকর ক্ষমাপ্রার্থনা” বা কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে চলে গিয়েছিল। তারা একদিকে যেমন “ইসলামকে আধুনিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ” দেখানোর জন্য উদ্গ্রীব ছিল, তেমনি পশ্চিমা সংস্কৃতির আক্রমণ থেকে ইসলামী ঐতিহ্যকে বাঁচানোর চেষ্টাও করছিল; আবার একই সাথে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব আর আধুনিকতার সাথে এর সামঞ্জস্যও বজায় রাখতে চাইছিল। কিন্তু এল ফাদলের মতে, এই চেষ্টাগুলো দিন দিন রাজনৈতিক সুবিধাবাদ আর ইসলামী ঐতিহ্যের সাথে খোলা মনে সমালোচনামূলক আলোচনা করার অনিচ্ছার দ্বারা কলঙ্কিত হচ্ছিল (Abou El Fadl, 2005)।
সৌদি সরকারকে নিয়েও সমালোচনা কম হয়নি। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’-এ জেরোম টেলর লিখেছেন, সৌদি সরকার আরবে ইসলামের প্রাথমিক যুগের বহু ঐতিহাসিক স্থান ধ্বংস করে ফেলছে। মক্কা আর মদিনায় বড় বড় দালান, শপিং মল আর বিলাসবহুল হোটেল বানানোর জন্য নাকি এইসব ঐতিহাসিক নির্দশন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সৌদি সরকারের এই কাজ সারা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সালাফী, সুফি, শিয়া সহ সব ঘরানার মুসলিম কর্মীরাই এর নিন্দা জানিয়েছে (The Independent, 2012; Taylor, 2018)।
আবু আম্মার ইয়াসির কাযী, যিনি একসময় সালাফী ছিলেন, তিনিও এই আন্দোলনের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই আন্দোলন অ-সালাফী মুসলিমদের প্রতি বড্ড বেশি বিদ্বেষ পোষণ করে এবং এর মধ্যে গভীর চিন্তাভাবনা বা বুদ্ধিবৃত্তিকতার অভাব রয়েছে (Elliot, 2011; YouTube, 2019; YouTube, 2013)। যদিও তিনি নিজে বিশ্বাস করেন যে সালাফ বা পূর্ববর্তী প্রজন্মকে অনুসরণ করাটা ইসলামী বিশ্বাসের “একটা মৌলিক অংশ”, কিন্তু তিনি সালাফিজমের নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা কর্মপন্থার সাথে একমত নন (YouTube, 2015)।
পশ্চিমের চোখে সমালোচনা (Western criticism)
২০১২ সালে জার্মানির সরকারি কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছিলেন যে, জার্মানির সালাফী মুসলিমদের সাথে বিভিন্ন ইসলামপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগ আছে। যদিও পরে তারা স্পষ্ট করে দেন যে, সব সালাফীকেই তারা সন্ত্রাসী মনে করেন না (Federal Office for the Protection of the Constitution, 2012)। এই নিয়ে জার্মান কর্মকর্তাদের সমালোচনামূলক বক্তব্যগুলো ২০১২ সালের এপ্রিলে ডয়েচে ভেলে টিভিতে প্রচারিত হয় (Deutsche Welle, 2012; Pipeline, 2012)। জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থরস্টেন জেরাল্ড স্নাইডার্স মনে করেন, যদিও সালাফীরা ইসলামী মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা আর ইসলামী সংস্কৃতি রক্ষার কথা বলে, কিন্তু আন্দোলনের কিছু লোক এটাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যা ইসলামের আসল ঐতিহ্যের সাথে মেলে না। তারা মুসলিম সংস্কৃতির অনেক উপাদান, যেমন কবিতা, সাহিত্য, গান, দর্শন ইত্যাদিকে শয়তানের কাজ বলে মনে করে (Schneiders, 2014)। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অলিভিয়ের রয় বলছেন, পশ্চিমে বেড়ে ওঠা তৃতীয় প্রজন্মের মুসলিম অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই সালাফিজমের দিকে ঝুঁকছে। এদের কেউ কেউ নাকি তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে, বাবা-মায়ের পছন্দ করা দেশের মেয়ের বদলে অন্য ধর্মান্তরিতদের বিয়ে করছে (Stevens et al., 2015)। প্রাক্তন সিআইএ কর্মকর্তা মার্ক সেজেম্যান তো বলেছেন, সালাফী আন্দোলনের কিছু অংশের সাথে আল-কায়েদার মতো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা জিহাদী গোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগ আছে (Sageman, 2003)।
তবে অন্য বিশ্লেষকরা আবার বলছেন, সালাফীরা কিন্তু সহজাতভাবেই রাজনৈতিক নয়। তারা কোন পরিবেশে আছে, তার ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক নানারকম হতে পারে – ঠিক যেমনটা হয় যেকোনো সাধারণ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। একটা দল হিসেবে তারা যে সবাই খুব সহিংসতাপ্রিয়, এমন কোনো প্রমাণ নেই। যে অল্প কিছু সালাফী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা সশস্ত্র বিদ্রোহে জড়ায়, তারা সেটা করে আরও বড় কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যের অংশ হিসেবে (Li, 2015)। ইতিহাসবিদ রোয়েল মেয়ারের মতে, কিছু পশ্চিমা সমালোচক যে সালাফী মুসলিমদের সহিংসতার সাথে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তার উৎস হলো ২০০০-এর দশকের শুরুতে বিভিন্ন পশ্চিমা সরকার কর্তৃক পরিচালিত “নিরাপত্তা গবেষণা” এবং সেই সাথে ঔপনিবেশিক আমলের প্রাচ্যবাদী লেখালেখি, যেখানে ইসলামী পুনর্জাগরণবাদীদের সহিংসতার সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করা হতো (Meijer, 2014)।
বিশিষ্ট সালাফী (Prominent Salafis)
-
আব্দুর-রহমান আল-মু’আল্লিমি আল-ইয়ামানি (Abdur-Rahman al-Mu’allimee al-Yamani), ইয়েমেনি আলেম এবং মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদের লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান (মৃত্যু ১৯৬৬)
-
আব্দ আল-আজিজ ইবনে বায (Abd al-Aziz Ibn Baz), সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি (মৃত্যু ১৯৯৯) (Encyclopedia Britannica)
-
আলী ওয়ারসেম (Ali Warsame), সোমালি ইসলামী আলেম, প্রচারক এবং দাওয়াহের পণ্ডিত (মৃত্যু ২০২২) (Voice of America, 2022; alshahid.net, 2014)
-
‘আব্দ আল-হামিদ ইবনে বা দিস (‘Abd al-Hamid ibn Baadis), একজন আলজেরীয় আলেম (মৃত্যু ১৯৪০) (Esposito, 1998; Lauzière, 2008)
-
‘আব্দ আল-রাহিম গ্রীন (‘Abd al-Rahim Green) (Bowen, 2014a)
-
আব্দুল্লাহ আল-ঘুদায়্যান (Abdullah al-Ghudayyan), সৌদি আরবীয় সালাফী আলেম (মৃত্যু ২০১০)
-
আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম (Abdullah Yusuf Azzam), আরব ইসলামপন্থী, জিহাদী এবং ধর্মতাত্ত্বিক, ওসামা বিন লাদেনের পরামর্শদাতা (মৃত্যু ১৯৮৯)
-
আবু কাতাদা (Abu Qatada), ফিলিস্তিনি-জর্ডানীয় আলেম (aljazeera.com, 2016; Cesari, 2013)
-
আলী আল-তামিমি (Ali al-Tamimi), সমসাময়িক আমেরিকান ইসলামী নেতা (Bowen, 2014b)
-
বিলাল ফিলিপস (Bilal Philips), কানাডীয় সালাফী ইমাম (The Globe and Mail, 2014)
-
এহসান এলাহী জহির (Ehsan Elahi Zaheer), পাকিস্তানি আলেম (মৃত্যু ১৯৮৭) (Syed et al., 2016)
-
ফেইজ মোহাম্মদ (Feiz Mohammad) (Schmitt et al., 2013)
-
হাইথাম আল-হাদ্দাদ (Haitham al-Haddad), ব্রিটিশ সালাফী আলেম (Bowen, 2014a)
-
মুহাম্মদ আল-আমিন আল-শান কিতি (Muhammad al-Amin al-Shanqiti), একজন মৌরিতানীয় আলেম (মৃত্যু ১৯৭৪)
-
মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব (Muhammad Asadullah Al-Ghalib), একজন বাংলাদেশী সংস্কারবাদী ইসলামী আলেম এবং সালাফী সংগঠন আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা (ahlehadeethbd.org; ahlehadeethbd.org (Bengali), 2016; At-tahreek.com, 2016)
-
মুহাম্মদ ইবনে সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (Muhammad ibn Salih al-Munajjid), ইসলামকিউএ ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা (Al Jazeera Studies, 2013)
-
মুহাম্মদ ইবনে আল-উসাইমীন (Muhammad ibn al-Uthaymeen), সৌদি আরবীয় আলেম (মৃত্যু ১৯৯৯) (Murphy, 2010)
-
মুহাম্মদ নাসির আল-দিন আল-আলবানী (Muhammad Nasir al-Din Al-Albani), সিরীয়-আলবেনিয়ান হাদীস আলেম এবং ধর্মতাত্ত্বিক (মৃত্যু ১৯৯৯) (Lacroix, 2008)
-
মুহাম্মদ রশিদ রিদা (Muhammad Rashid Rida), একজন সিরীয়-মিশরীয় আলেম (মৃত্যু ১৯৩৫) (Frampton, 2018)
-
রাবী আল-মাদখালি (Rabee al-Madkhali), মাদখালিস্ট আন্দোলনের নেতা (The Muslim 500; Abdel-Latif, 2009)
-
সালেহ আল-ফাওজান (Saleh Al-Fawzan), একজন সৌদি আরবীয় ইসলামী আলেম
-
উমর সুলাইমান আশকার (Umar Sulaiman Ashqar), ইসলামিক ক্রিড সিরিজের লেখক
-
জাকির নায়েক (Zakir Naik), ভারতে সালাফী মতাদর্শী (Swami, 2011)
-
জুবাইর আলিজাই (Zubair Alizai) (১৯৫৭–২০১৩); পাকিস্তানি হাদীস আলেম এবং হাফিজ (Syed et al., 2016)
-
ওথমান আল-খামীস (Othman al-Khamees), কুয়েতে সালাফী মতাদর্শী
-
আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ (Abdur Razzaque Bin Yusuf), একজন বাংলাদেশী সংস্কারবাদী ইসলামী আলেম, আহলে হাদীস নেতা এবং আল জামিয়াহ আস সালাফিয়াহের প্রতিষ্ঠাতা (agami24.com)
রেফারেন্স
-
Abdo, G. (2017). The New Sectarianism: The Arab Uprisings and the Rebirth of the Shi’a-Sunni Divide. Oxford University Press.
-
Abou El Fadl, K. (2005). The Great Theft: Wrestling Islam from the Extremists. Harper San Francisco.
-
Abu Rumman, A. H., Mohammad, H., & Hassan, H. (2010). Jordanian Salafism: A Strategy for the “Islamization of Society” and an Ambiguous Relationship with the State. Friedrich-Ebert-Stiftung.
-
Abukhadeejah.com. (2017, March 23). Jamal al-Din al-Afghani, Muhammad Abduh, Rashid Rida, Hasan al-Banna: Modernism, Revolution and the Muslim Brotherhood. Retrieved August 28, 2019, from https://www.abukhadeejah.com/jamal-aldin-afghani-muhammad-abduh-rashid-rida-hasan-albanna-radicals-modernists/
-
AFP. (2012, April 16). Uproar in Germany Over Salafi Drive to Hand Out Millions of Qurans. AINA. Archived from the original on August 18, 2014. Retrieved June 9, 2014.
-
Agami24.com. আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ-Biography of Abdur Razzak bin Yousuf. Retrieved from https://agami24.com/biography/articles/2081/abdur-razzak-bin-yousuf
-
Ahlehadeethbd.org. আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ. Retrieved from http://www.ahlehadeethbd.org/index.html
-
Ahlehadeethbd.org (Bengali). (2016). আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ. Archived from the original on February 5, 2016. Retrieved February 2, 2016.
-
Ahmed, I. (2020, August 15). From Wahabi Movement to 1857 Revolt: Muslims in India’s Freedom Struggle. The Milli Chronicle. Archived from the original on March 9, 2021.
-
Ahram Online. (2014a, September 22). Egypt court says it has no power to dissolve Nour Party. Archived from the original on November 29, 2014. Retrieved September 22, 2014.
-
Ahram Online. (2014b, November 15). Cairo court adjourns case on dissolution of Islamist Nour Party. Archived from the original on November 29, 2014. Retrieved November 15, 2014.
-
Al Jazeera Studies. (2013). Arab World Journalism in a Post-Beheading Era by Thembisa Fakude. Archived from the original on March 23, 2019.
-
Al-Arabiya. (2014, March 5). Gulf trio pull Qatar ambassadors – why now? Retrieved September 28, 2018.
-
Al-Rasheed, M. (2018). Salman’s Legacy: The Dilemmas of a New Era in Saudi Arabia. Oxford University Press.
-
Al-Shirian, D. (2003, May 19). What Is Saudi Arabia Going to Do? Al-Hayat.
-
Alatas, S. F. (2014, July 30). Salafism and the Persecution of Shi’ites in Malaysia. Middle East Institute. Archived from the original on June 29, 2022. Retrieved June 29, 2022.
-
Albijory. تحقيق المقام علي كفايه العوام في علم الكلام. Retrieved from http://archive.org/details/albijory
-
Alshahid.net. (2014, July 11). علي ورسمه حسن (عالم وداعية صومالي) | الصومال – شبكة الشاهد الإخبارية. Archived from the original on July 11, 2014. Retrieved January 2, 2025.
-
Amghar, S., Cavatorta, F. (2023). Salafism in the contemporary age: Wiktorowicz revisited. Contemporary Islam, 17(2), 195–204. https://doi.org/10.1007/s11562-023-00524-x
-
Arabian Business. (2016). Saudi threatens to block Qatar’s land, sea borders. Archived from the original on December 1, 2016. Retrieved November 30, 2016.
-
Ashour, O. (2012, January 6). The unexpected rise of Salafists has complicated Egyptian politics. The Daily Star. Archived from the original on October 23, 2021. Retrieved December 19, 2013.
-
At-tahreek.com. (2016, January). মাসিক আত-তাহরীক – জানুয়ারী ২০১৬. Retrieved February 2, 2016.
-
Auf, Y. (2014, November 25). Political Islam’s Fate in Egypt Lies in the Hands of the Courts. Atlantic Council. Archived from the original on January 20, 2023. Retrieved December 1, 2014.
-
BBC News. (2011, May 1). Tiny Qatar’s growing global clout. Archived from the original on March 12, 2015. Retrieved November 30, 2016.
-
Bennett, C., & Shepard, W. (2013). Salafi Islam: The Study of Contemporary Religious-Political Movements. In The Bloomsbury Companion to Islamic Studies (pp. 163-179). Bloomsbury.
-
Boekhoff-van der Voort, N., Versteegh, K., & Wagemakers, J. (Eds.). (2011). The Transmission and Dynamics of the Textual Sources of Islam: Essays in Honour of Harald Motzki. Brill Publishers.
-
Bonnefoy, L. (2011). Salafism in Yemen: Transnationalism and Religious Identity. Columbia University Press/Hurst.
-
Böwering, G., Crone, P., & Mirza, M. (Eds.). (2013). The Princeton Encyclopedia of Islamic Political Thought. Princeton University Press.
-
Bowen, I. (2014a). Medina in Birmingham, Najaf in Brent: Inside British Islam. Hurst.
-
Bowen, I. (2014b). Medina in Birmingham, Najaf in Brent: Inside British Islam. Hurst.
-
Brown, D. W. (1996). Rethinking Tradition in Modern Islamic Thought (Vol. 5). Cambridge University Press.
-
Brown, D. W. (1999). Rethinking Tradition in Modern Islamic Thought. Cambridge University Press.
-
Brown, J. (2011, December 20). Salafis and Sufis in Egypt. Carnegie Endowment for International Peace. Archived from the original on October 7, 2022.
-
Buehler, A. F. (1998). Sufi Heirs of the Prophet: the Indian Naqshbandiyya and the Rise of the Mediating Sufi Shaykh. University of South Carolina Press.
-
Cakmaktas, N. (2024). Abu Abdullah al-Muhajir: ‘the jurisprudence of blood’ and the ideology of ISIS. Politics, Religion & Ideology, 25(1), 93–110. https://doi.org/10.1080/21567689.2024.2315423
-
CATF. Eid Charity’s Al Baraka Initiative: Admirable or Alarming? Archived from the original on September 17, 2016. Retrieved November 30, 2016.
-
Cesari, J. (2013). Why the West Fears Islam: An Exploration of Muslims in Liberal Democracies. Palgrave Macmillan.
-
Christian, C. (2012, September 12). The Salafi Moment. Foreign Policy. Archived from the original on November 2, 2013. Retrieved June 9, 2014.
-
Commins, D. (1990). Islamic Reform: Politics and Social Change in Late Ottoman Syria. Oxford University Press.
-
Commins, D. (2006). The Wahhabi Mission and Saudi Arabia. I.B.Tauris.
-
Conflictsforum.org. (2014). Wahhabism, Salafismm and Islamism Who Is The Enemy? Archived from the original on June 23, 2014.
-
Cook, M. (1992). On the Origins of Wahhābism. Journal of the Royal Asiatic Society, Third Series, 2(2), 191-202.
-
Cook, M. (2003). Forbidding Wrong in Islam: An Introduction. Cambridge University Press.
-
Coolsaet, R. (Ed.). (2013). Jihadi Terrorism and the Radicalisation Challenge: European and American. Ashgate Publishing Ltd.
-
Curtis, E. (2010). Encyclopedia of Muslim-American History. Infobase Publishing.
-
Daily News Egypt. (2014, November 26). Court claims no jurisdiction over religiously affiliated parties. Archived from the original on April 3, 2022. Retrieved December 1, 2014.
-
Davis, R. (2018). Western Imaginings: The Intellectual Contest to Define Wahhabism. The American University in Cairo Press.
-
Delmar-Morgan, A. (2012, January 7). Qatar, Unveiling Tensions, Suspends Sale of Alcohol. The Wall Street Journal. ISSN 0099-9660. Archived from the original on May 3, 2019. Retrieved November 30, 2016.
-
DeLong-Bas, N. J. Wahhabi Islam: From Revival and Reform to Global Jihad.
-
Deschamps-Laporte, L. (2023). Exploring the fluidity of Egyptian Salafsm: from quietism to politics and co-optation. Contemporary Islam, 17(2), 223–241. https://doi.org/10.1007/s11562-023-00518-9
-
Deutsche Welle. (2012, May 8). Salafist extremism spreading in Germany.
-
Dillon, M. (1999). China’s Muslim Hui community: migration, settlement and sects. Curzon Press.
-
Dillon, M. R. (2009, September). Wahhabism: Is It a Factor in the Spread of Global Terrorism? [PDF]. Naval Post-Graduate School. Archived from the original on April 7, 2014. Retrieved April 2, 2014.
-
Djait, H. (2011). Islamic Culture in Crisis: A Reflection on Civilizations in History (J. Fouli, Trans.). Transaction Publishers.
-
Doha News. (2011a, May 16). Qatar’s ‘Church City’ grows as Christianity loses taboo status. Archived from the original on December 1, 2016. Retrieved November 30, 2016.
-
Doha News. (2011b, December 16). Photos: Qatar’s state mosque opens to the public. Archived from the original on June 19, 2015. Retrieved November 30, 2016.
-
Durie, M. (2013, June 6). Salafis and the Muslim Brotherhood: What is the difference? Middle East Forum. Archived from the original on March 24, 2015. Retrieved March 28, 2015.
-
Economist. (2015, June 27). Salafism: Politics and the puritanical. Archived from the original on June 28, 2015. Retrieved June 29, 2015.
-
Economist. (2016, June 4). The other Wahhabi state. ISSN 0013-0613. Archived from the original on November 30, 2016. Retrieved November 30, 2016.
-
Elliot, A. (2011, April 17). Why Yasir Qadhi Wants to Talk About Jihad. The New York Times. Archived from the original on April 27, 2013.
-
Elmaz, O. (2011). Jihadi-Salafist Creed: Abu Muhammad al-Maqdisi’s imperatives of faith. In R. Lohlker (Ed.), New Approaches to the Analysis of Jihadism: Online and offline (pp. 15–36). Vienna University Press.
-
Encyclopedia Britannica. ‘Abd al-Aziz ibn Abdallah ibn Baz | Saudi Arabian cleric.
-
Esposito, J. L. (1998). Islam: the straight path. Oxford University Press.
-
Esposito, J. L. (1999). The Oxford History of Islam. Oxford University Press US.
-
Esposito, J. L. (2003). The Oxford Dictionary of Islam. Oxford University Press.
-
Esposito, J. L. (Ed.). (2014). Ahl-i Hadith. In The Oxford Dictionary of Islam. Oxford University Press.
-
Evstatiev, S. (2016). The Qādīzādeli Movement and the Revival of takfīr in the Ottoman Age. In Accusations of Unbelief in Islam (pp. 213–214). Brill. https://doi.org/10.1163/9789004307834_010
-
FDD’s Long War Journal. (2015, August 19). Analysis: Qatar still negligent on terror finance. Archived from the original on April 17, 2021. Retrieved November 30, 2016.
-
Federal Office for the Protection of the Constitution. (2012, July 18). latest 2011 report on Islamic Salafist extremism in Germany (English). Archived from the original on February 17, 2013. Retrieved July 17, 2012.
-
Féo, A. D. (2009). Les musulmans de Châu Đốc (Vietnam) à l’épreuve du salafisme. Moussons. Recherches en sciences sociales sur l’Asie du Sud-Est, (13-14), 359–372. https://doi.org/10.4000/moussons.976
-
Fish, M. S. (2011). Are Muslims Distinctive?: A Look at the Evidence. Oxford University Press, US.
-
Frampton, M. (2018). The Muslim Brotherhood and the West: A History of Enmity and Engagement. The Belknap Press of Harvard University Press.
-
Freemalaysiatoday.com. (2017, January 14). Wahabism spreading among Malaysia’s elite. Archived from the original on November 21, 2021. Retrieved June 29, 2022.
-
Fukuda, S. (2013). Wahhābis and the Development of Salafism [PDF]. Institute of Developing Economies. Archived from the original on September 24, 2015.
-
Gauvain, R. (2012a). Salafi Ritual Purity: In the Presence of God. Routledge.
-
Gauvain, R. (2012b). Salafi Ritual Purity: In the Presence of God. Routledge.
-
Gauvain, R. (2013). Salafi Ritual Purity: In the Presence of God. Routledge.
-
Ghosh, B. (2012, October 8). The Rise Of The Salafis. Time, 180(15). Archived from the original on May 7, 2014. Retrieved May 6, 2014.
-
GK Today. (2016, June 13). What was Wahabi Movement? Archived from the original on September 13, 2021. Retrieved September 13, 2021.
-
Grant, B. Center wins NEH grant to study Salafism. Arizona State University. Archived from the original on July 14, 2014. Retrieved June 9, 2014.
-
Hafez, M. M. (2017). Suicide Bombers in Iraq: The Strategy and Ideology of Martyrdom. US Institute of Peace Press.
-
Hamid, S. (2008). The development of British salafism. ISIM Review, 21(1), 10–11.
-
Hammond, A. (2017). Salafi Thought in Turkish Public Discourse Since 1980. International Journal of Middle East Studies, 49(3), 417–435. https://doi.org/10.1017/S0020743817000319
-
Hassan, A. A. (2012, June 6-12). Muslim Brothers and Salafis. Al Ahram Weekly. Archived from the original on February 28, 2018. Retrieved May 19, 2013.
-
Haykel, B. (2007, May 11). Sufism and Salafism in Syria. Syria Comment. Archived from the original on October 19, 2013. Retrieved May 22, 2013.
-
Haykel, B. (2009). On the Nature of Salafi Thought and Action. In R. Meijer (Ed.), Global Salafism: Islam’s New Religious Movement (pp. 33-57). Columbia University Press.
-
Hoover, J. (2019). Ibn Taymiyya (Makers of the Muslim World). Oneworld Academic.
-
Hunter, M. (2022, June 13). Malaysia: Power Struggle Between Wahhabi-Salafism And Muslim Brotherhood – Analysis. Eurasia Review. Archived from the original on June 29, 2022. Retrieved June 29, 2022.
-
Iium.edu.my. Islam: Basic Principles and Characteristics. Archived from the original on April 5, 2023. Retrieved December 4, 2021.
-
Islamopediaonline.org. (2015). Salafi Groups in Egypt. Archived from the original on October 18, 2017. Retrieved April 4, 2015.
-
Ismail, R. (2021). Transnational Networks. In Rethinking Salafism: The Transnational Networks of Salafi Ulama in Egypt, Kuwait, and Saudi Arabia. Oxford University Press.
-
Izutsu, T. (1984). Sufism and Taoism: A Comparative Study of Key Philosophical Concepts. University of California Press.
-
Jackson, R. (2006). Muhammad Ibn Abd Al-Wahhab (1703–1792). In Fifty Key Figures in Islam. Routledge: Taylor & Francis Group.
-
Jadaliyya. (2011). Al-Nour Party. Archived from the original on December 2, 2011. Retrieved December 19, 2013.
-
Jamestown.org. Understanding the Origins of Wahhabism and Salafism. Archived from the original on February 13, 2017. Retrieved May 9, 2022.
-
Jamestown.org. Understanding al-Khajnadee, Muhammad Abduh, the Origins of Wahhabism and Salafism. Archived from the original on March 29, 2016.
-
Joffé, G. (2013). Islamist Radicalisation in Europe and the Middle East: Reassessing the Causes of Terrorism. I.B. Tauris.
-
Joppke, C. (2013). Legal Integration of Islam. Harvard University Press.
-
Kepel, G. (2006). Jihad: The Trail of Political Islam. I.B. Tauris.
-
Kerala.com. (2017). Kerala Celebrity,Celebrity of the week. Archived from the original on October 2, 2017. Retrieved October 2, 2017.
-
Kingsley, P. (2013, July 7). Egypt’s Salafist al-Nour party wields new influence on post-Morsi coalition | World news. The Guardian. Retrieved December 19, 2013.
-
Kingston, J. (2019, December 23). How Arabization changed Islam in Asia. Asia Times. Archived from the original on August 18, 2022. Retrieved June 29, 2022.
-
Kjeilen, T. (2020, December 30). Salafism – LookLex Encyclopaedia. i-cias.com. Archived from the original on August 31, 2017. Retrieved March 10, 2015.
-
Lacroix, S. (2008, Spring). Al-Albani’s Revolutionary Approach to Hadith. Leiden University’s ISIM Review, (21). Archived from the original on October 10, 2017.
-
Lauziere, H. (2008). The Evolution of the Salafiyya in the Twentieth Century through the life and thought of Taqi al-Din al-Hilali [PhD Dissertation]. Georgetown University.
-
Lauziere, H. (2010). The Construction Ofsalafiyya: Reconsidering Salafism from the Perspective of Conceptual History. International Journal of Middle East Studies, 42(3), 369–389. https://doi.org/10.1017/S0020743810000401
-
Lauzire, H. (2015). The Making of Salafism: Islamic Reform in the Twentieth Century. Columbia University Press.
-
Lauziere, H. (2016). The Making of Salafism: Islamic Reform in the Twentieth Century. Columbia University Press.
-
Law, B. (2013, July 5). Egypt crisis: Fall of Morsi challenges Qatar’s new emir. BBC News. Archived from the original on March 8, 2021. Retrieved November 30, 2016.
-
Leaman, O. (2006). The Qur’an: An Encyclopedia. Routledge: Taylor & Francis.
-
Lee Kuan Yew, & Wyne, A. (2012). Lee Kuan Yew: The Grand Master’s Insights on China, the United States, and the World. MIT Press.
-
Lenz-Raymann, K. (2014). Salafi Isalm: Social Transformation and Political Islam. In Securitization of Islam: A Vicious Circle: Counter-Terrorism and Freedom of Religion in Central Asia. Transcript Verlag. JSTOR j.ctv1fxgjp.7.
-
Lewis, B. (2006, April 27). Islam and the West: A Conversation with Bernard Lewis (transcript). Pew Research Center. Archived from the original on September 10, 2013. Retrieved August 5, 2014.
-
Li, D. (2015). The Universal Enemy: Jihad, Empire, and the Challenge of Solidarity. Stanford University Press.
-
Lieven, A. (2011). Pakistan: A Hard Country. PublicAffairs.
-
Livesey, B. Salafism: A faith of intolerance.
-
Mahmood, S. (2012). Politics of piety: The Islamic Revival and the Feminist Subject. Princeton University Press.
-
Mandaville, P., & Lacroix, S. (2022). Unpacking the Saudi-Salafi Connection in Egypt. In Wahhabism and the World: Understanding Saudi Arabia’s Global Influence on Islam. Oxford University Press.
-
Martin, C. R. (Ed.). (2004). Encyclopedia of Islam and the Muslim World. Macmillan Reference.
-
Martin, C. R. (Ed.). (2016). Encyclopedia of Islam and the Muslim World (2nd ed.). Gale Publishers.
-
Mei.edu. (2018, February 16). Salafism Infiltrates Turkish Religious Discourse. Archived from the original on September 11, 2021.
-
Meijer, R. (2009). Introduction. In R. Meijer (Ed.), Global Salafism: Islam’s New Religious Movement. Columbia University Press.
-
Meijer, R. (2014). Between Revolution and Apoliticism: Nasir al-Din al-Albani and his Impact on the Shaping of Contemporary Salafism. In Global Salafism: Islam’s New Religious Movement. Oxford University Press.
-
Meijer, R., & Haykel, B. (2013). Between Revolution and Apoliticism: On the Nature of Salafi thought and Action. In Global Salafism: Islam’s New Religious Movement. Oxford University Press.
-
Miller, R. E. (1976). Mappila Muslims of Kerala: Study in Islamic Trends. Orient Longman Limited.
-
Mohie-Eldin, F. (2015, Fall). The Evolution of Salafism A History of Salafi Doctrine. Al-Noor, 44–47.
-
Monthly Review. (2011, June 2). 2011: An Arab Springtime?
-
Morrissey, F. (2021). A Short History of Islamic Thought. Oxford University Press.
-
Moussalli, A. (1999). Historical Dictionary of Islamic Fundamentalist Movements in the Arab World, Iran and Turkey. The Scarecrow Press.
-
Moussalli, A. (2009, January 30). Wahhabism, Salafism and Islamism: Who Is The Enemy? [PDF]. A Conflicts Forum Monograph. Archived from the original on June 23, 2014. Retrieved March 10, 2015.
-
Mubarak, H. (2022). Rebellious Wives, Neglectful Husbands: Controversies in Modern Qur’anic Commentaries. Oxford University Press.
-
Murphy, C. (2002). Passion for Islam – Shaping the Modern Middle East: the Egyptian Experience. Simon & Schuster.
-
Murphy, C. (2006, September 5). For Conservative Muslims, Goal of Isolation a Challenge. Washington Post. Archived from the original on February 10, 2021. Retrieved September 11, 2017.
-
Murphy, C. (2010, July 15). A Kingdom Divided. GlobalPost. Archived from the original on May 5, 2014. Retrieved May 6, 2014.
-
Murray-Miller, G. (2022). Empire Unbound: France and the Muslim Mediterranean, 1880–1918. Oxford University Press.
-
Musa, M. F., & Hui, T. B. (2017, June 20). State-backed discrimination against Shia Muslims in Malaysia. Critical Asian Studies, 49(3), 308–329. https://doi.org/10.1080/14672715.2017.1335848
-
Muslimmatters.org. (2014, April 22). On Salafi Islam. Archived from the original on January 17, 2017.
-
Naylor, P. (2015). North Africa Revised. University of Texas Press.
-
Ng, A. (2021, January 6). End of Qatar blockade is ‘a win for the region,’ Saudi foreign minister says. CNBC. Archived from the original on January 19, 2021. Retrieved February 21, 2021.
-
Noor-book.com. (2021). Detailed Response to Ash’aris (pdf). Archived from the original on June 2, 2021. Retrieved May 29, 2021.
-
NPR. (2015, June 18). Why Israel Lets Qatar Give Millions To Hamas. Archived from the original on November 27, 2023. Retrieved November 30, 2016.
-
Olidort, J. (2015). A New Curriculum: Rashīd Ridā and Traditionalist Salafism. In Defense of Tradition: Muhammad Naşir Al-Dīn Al-Albānī and the Salafi Method. Princeton University.
-
Olivier, R., & Sfeir, A. (Eds.). (2007). The Columbia World Dictionary of Islamism. Columbia University Press.
-
Opwis, F., & Reisman, D. (2011). Islamic Philosophy, Science, Culture, and Religion: Studies in Honor of Dimitri Gutas. Brill.
-
Oxford University Press. (2010). Islam in Yemen: Oxford Bibliographies Online Research Guide. Oxford University Press.
-
Oxfordbibliographies.com. Salafism. Archived from the original on December 24, 2018.
-
Pipes, D. (2009). In the Path of God: Islam and Political Power (5th ed.). Transaction Publishers. (Original work published 1980)
-
Pipeline. (2012, June 17). Verfassungsschutzbericht warnt vor Salafisten. Archived from the original on May 20, 2013.
-
Qadhi, Y. On Salafism.
-
Rabasa, A. M. The Muslim World After 9/11.
-
Račius, E. (2018). Islamic Law in Lithuania? Its Institutionalisation, Limits and Prospects for Application. In Exploring the Multitude of Muslims in Europe: Essays in Honour of Jørgen S. Nielsen (p. 109).
-
Radical Islam in Central Asia. Archived from the original on March 4, 2016. Retrieved November 13, 2014.
-
Ramaioli, M. (2023). Salafism as Gramscian informed vanguardism. Contemporary Islam, 17(2), 297–318. https://doi.org/10.1007/s11562-023-00514-z
-
Reuters. (2016, July 22). Qatar says gives $30 million to pay Gaza public sector workers. Archived from the original on December 1, 2016. Retrieved November 30, 2016.
-
Rhodes, D. (2014, March). Salafist-Takfiri Jihadism: the Ideology of the Caucasus Emirate. International Institute for Counter-terrorism. Archived from the original on September 3, 2014.
-
Ridgeon, L. (2015). Sufis and Salafis in the Contemporary Age. Bloomsbury Academic.
-
Roy, O., & Boubekeur, A. (Eds.). (2012). Whatever Happened to the Islamists? Columbia University Press.
-
Rubin, B. (2000). Guide to Islamist Movements. M.E. Sharpe.
-
Rubin, B. Guide to Islamist Movements.
-
Sageman, M. (2003, July 9). Statement of Marc Sageman to the National Commission on Terrorist Attacks Upon the United States. Third public hearing of the National Commission on Terrorist Attacks Upon the United States. Retrieved from http://govinfo.library.unt.edu/911/hearings/hearing3/witness_sageman.htm
-
Salmoni, B. A., Loidolt, B., & Wells, M. (2010). Regime and Periphery in Northern Yemen: The Huthi Phenomenon. Rand Corporation.
-
Sareen, S. (2005). The Jihad Factory: Pakistan’s Islamic Revolution in the Making. Har Anand Publications.
-
Sazanov, P. V., & Illimar, P. (2021). Some Remarks on the Ideological Core and Political Pillars of the So-Called Islamic State. Modern Management Review, 26(1), 59–80. https://doi.org/10.7862/rz.2021.mmr.06
-
Schmitt, E., Schmidt, M. S., & Barry, E. (2013, April 20). Bombing Inquiry Turns to Motive and Russian Trip. The New York Times.
-
Schmidtke, S. (Ed.). (2016). The Oxford Handbook of Islamic Theology. Oxford University Press.
-
Schneiders, T. G. (2014). Salafismus in Deutschland: Ursprünge und Gefahren einer islamisch-fundamentalistischen Bewegung. transcript Verlag.
-
Shuster, S. (2013, August 3). Comment: Underground Islam in Russia. Slate. Archived from the original on November 27, 2013. Retrieved June 9, 2014.
-
Spencer, D. B., & Richard. How Qatar is funding the rise of Islamist extremists. The Telegraph. Archived from the original on March 30, 2019. Retrieved November 30, 2016.
-
Springer. (2023). Revisiting Wiktorowicz – Salafism, Politics and Violence in the Contemporary World. Archived from the original on May 5, 2023.
-
Stanley, T. (2005, July 15). Understanding the Origins of Wahhabism and Salafism. Terrorism Monitor, 3(14). Archived from the original on March 3, 2011.
-
Stevens, D. O., O’hara, K., & Kieron, D. (2015). The Devil’s Long Tail: Religious and Other Radicals in the Internet Marketplace. Oxford University Press.
-
Stump, R. W. (2008). The Geography of Religion: Faith, Place, and Space. Rowman & Littlefield Publishers, Inc.
-
Sueddeutsche.de. Islamische Mystik: Warum der Sufismus gar nicht so friedlich ist. Retrieved from https://www.sueddeutsche.de/kultur/islamische-mystik-warum-der-sufismus-gar-nicht-so-friedlich-ist-1.3109023
-
Swami, P. (2011). Islamist terrorism in India. In K. Warikoo (Ed.), Religion and Security in South and Central Asia (p. 61). Taylor & Francis.
-
Syed, P. I., Kamran, Z., Jawad, Z., Edwina, T., Tahir, A., & Sewag, Z. (2016). The Intra-Sunni Conflicts in Pakistan. In Faith-Based Violence and Deobandi Militancy in Pakistan (pp. 324). Palgrave Macmillan. https://doi.org/10.1057/978-1-349-94966-3
-
Tarrant, T., & Sipalan, J. (2017, December 21). Worries about Malaysia’s ‘Arabisation’ grow as Saudi ties strengthen. Reuters. Archived from the original on June 29, 2022. Retrieved June 29, 2022.
-
Taylor, J. (2012, October 28). Why don’t more Muslims speak out against the wanton destruction of Mecca’s holy sites? The Independent. Archived from the original on July 25, 2020.
-
Taylor, J. (2018, October 22). Mecca for the rich: Islam’s holiest site ‘turning into Vegas’. Independent. Archived from the original on November 4, 2021. Retrieved October 2, 2021.
-
The Globe and Mail. (2014, September 15). Controversial imam Bilal Philips says banning him won’t stop his message.
-
The Muslim 500. Profile: Sheikh Rabi’ Ibn Haadi ‘Umayr Al Madkhali. The Royal Islamic Strategic Studies Centre (MABDA). Archived from the original on March 22, 2013. Retrieved December 19, 2015.
-
The Reference Paris. (2018, October 4). Future of Salafism in Turkey. Archived from the original on June 3, 2020. Retrieved June 3, 2020.
-
Tony Blair Faith Foundation. Salafism. Archived from the original on March 11, 2015.
-
Top Universities. (2016, September 14). Study in Qatar. Archived from the original on December 1, 2016. Retrieved November 30, 2016.
-
Turner, J. (2014). Religious Ideology and the Roots of the Global Jihad: Salafi Jihadism and International Order. Springer.
-
Umm-ul-Qura Publications. (2017, April 3). Biography of Shaykh Al-Islam Thanaullah Amritsari. Archived from the original on January 15, 2020.
-
Van Linschoten, A. S., & Kuehn, F. (2012). An Enemy We Created: The Myth of the Taliban-Al Qaeda Merger in Afghanistan. Oxford University Press.
-
Voice of America (in Somali). (2022, May 28). Sheekh Cali Warsame oo ahaa caalim weyn oo Soomaaliyeed oo geeriyooday. Retrieved September 10, 2024.
-
Wagemakers, J. (2009). A Purist Jihadi-Salafi: The Ideology of Abu Muhammad al-Maqdisi. British Journal of Middle Eastern Studies, 36(2), 281–297. https://doi.org/10.1080/13530190903007327
-
Wahba, M. (2022). Fundamentalism and (K. Beshara & R. Beshara, Trans.). Bloomsbury Academic.
-
Wahhabism: A deadly scripture. (2007, November 1). The Independent. Archived from the original on October 5, 2015. Retrieved October 4, 2015.
-
Washington Post. (2011b, May 8). Al-Jazeera TV network draws criticism, praise for coverage of Arab revolutions. Archived from the original on December 1, 2016. Retrieved November 30, 2016.
-
Washington Post. (2014). Saudi Arabia’s Muslim Brotherhood predicament. Archived from the original on October 12, 2015.
-
Weismann, I. (2001). Between Șūfī Reformism and Modernist Rationalism: A Reappraisal of the Origins of the Salafiyya from the Damascene Angle. Die Welt des Islams, 41(2), 206–237. https://doi.org/10.1163/1570060011201286
-
Wiktorowicz, Q. (2006). Anatomy of the Salafi Movement. Studies in Conflict & Terrorism, 29(3), 207-239.
-
Wood, G. (2017). The Way of the Strangers. Random House.
-
YouTube. (2013, April 8). [Ex-Salafi] Yasir Qadhi talks about Salafies & Wahabies. Archived at Ghostarchive and the Wayback Machine.
-
YouTube. (2015, April 9). Have you left the way of the Salaf? ~ Dr. Yasir Qadhi. Archived at Ghostarchive and the Wayback Machine. Retrieved July 7, 2020.
-
YouTube. (2019, November 10). Dr. Yasir Qadhi on why he left Salafi or Wahabi movement of Muhammad Ibn Abd al-Wahab. Archived at Ghostarchive and the Wayback Machine.
-
Youssef, M. (1985). Revolt Against Modernity: Muslim Zealots and the West. E.J. Brill.
Leave a Reply