ব্রিকস এর সাফল্যের সম্ভাব্যনা কেন অনেক কম, আর কম হলেও তা কেন উদ্বেগজনক হয়ে উঠতে পারে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, মার্কিন ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা। এর মূল অর্থ হ’ল ডলারকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হয়, এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের রিজার্ভে প্রচুর ডলার রাখে। রুশো-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রচুর ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা দেয়, যে কারণে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন কেবল রাশিয়াকেই নয়, বাকি বিশ্বকে ডলার থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রথমে এটি কেবল পুতিনের ব্যক্তিগত পরিকল্পনায় ছিল, কিন্তু তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধের পর থেকে বিষয়গুলিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তার সর্বশেষ ধারণাটি হচ্ছে ব্রিকস দেশগুলির মধ্যে একটি সাধারণ মুদ্রা। এই আর্টিকেলে ব্রিকস গ্ৰুপ, এর সাধারণ মুদ্রার প্রস্তাবনা ও তার সম্ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন দিককে তুলে ধরা হবে।

গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সি কী?

একটি গ্লোবাল রিজার্ভ মুদ্রা মূলত এমন কোনও মুদ্রা বোঝায় যা দিয়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য হয় এবং বিশ্বের সকল দেশ তা গ্রহণ করে। এখন এই মুদ্রাগুলি নিরাপদ হয় বলে একে নির্ভরযোগ্যভাবে অন্যান্য জিনিস কেনার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, রাষ্ট্র এবং ব্যাংকগুলি তাদের রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এই মুদ্রাগুলো রাখে, আর তাই একে রিজার্ভ মুদ্রা বলা হয়। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের পর থেকে, মার্কিন ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হয়ে উঠেছে। যেমন, আজ বেশিরভাগ তেল ক্রয় সহ সমস্ত আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রায় অর্ধেক ডলারে ডিনোমিনেটেড হয় এবং বেশিরভাগ লোক ডলারে অর্থ ধারও করে। আশ্চর্যজনকভাবে, এর অর্থ হ’ল ডলার মূলত বিশ্বের যে কোনও জায়গায় বৈধ মুদ্রা হিসাবে গৃহীত হয় যার জন্য বেশিরভাগ রিজার্ভে ডলার থাকে এবং এজন্য মানুষ সংকটের সময় কেবল ডলারই চায়।

উদাহরণস্বরূপ গত কয়েক বছরের কথা ধরুন, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিনিয়োগকারীরা তাদের ডলারের দিকে ফিরে আসে এবং ডলারকে ২০ বছরের জন্য অনেক উচ্চতায় নিয়ে যায়। তবে, রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে ডলারের মর্যাদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেয় ফরাসি অর্থমন্ত্রীর মতে “একটি অত্যধিক সুবিধা”। মূলত যেহেতু সবসময় ডলারের চাহিদা থাকে, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি ক্রয় ক্ষমতা তৈরি হয়, মার্কিন সরকার অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি অর্থ ধার করতে পারে। সেই সাথে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার শত্রুদের কার্যকরভাবে শাস্তি দেওয়ার জন্য ডলারের আধিপত্য এবং গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল সিস্টেমের উপর আমেরিকার আধিপত্যকে ব্যবহার করতে পারে যেমনটি তারা রাশিয়াকে সুইফট ইন্টার-ব্যাংক মেসেজিং সিস্টেম থেকে বহিষ্কার করার সময় করেছিল। তাছাড়া স্যাঙ্কশনের সুবিধা তো আছেই।

কেন কিছু লোক ডলারের হাত থেকে  বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে এত উদ্বিগ্ন?

ডলারের আধিপত্য এবং এই শক্তি এমন কিছু যা নিয়ে রাশিয়া এবং চীন উভয়ই অতীতে অভিযোগ করেছে। ৯০-এর দশকে আর্থিক সংকটের পরে অনেক রাশিয়ানক রুবলের পরিবর্তে ডলার ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিল। আর তারপর রাশিয়ান সংসদ সরকারী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্টের ইউনিট হিসাবে ডলার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল এবং দিমিত্রি মেদভেদেভ প্রকৃতপক্ষে ২০০৯ সালে ডলারের পরিবর্তে একটি তথাকথিত সুপার কারেন্সি প্রস্তাব করেছিলেন। এবং যখন চীনের কথা আসে, মাত্র কয়েক মাস আগে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমেরিকান আধিপত্যের বিপদগুলি নিয়ে মুখ খুলেছিল, আর অভিযোগ করেছিল যে, ডলার বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা এবং অনিশ্চয়তার প্রধান উত্স, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশকে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশল পূরণে বাধ্য করার জন্য ডলারকে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার করে।

এরপর রাশিয়া এবং চীন অবশেষে এই বিষয়ে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পুতিন রাশিয়া এবং এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে অর্থ প্রদানের জন্য ইউয়ানকে মুদ্রা হিসাবে গ্রহণ করার অঙ্গীকার করেন। একই সময়ে, ব্রাজিল, ফ্রান্স এবং সৌদি আরবও ডলার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বলে আরও বেশ কয়েকটি শিরোনাম দেখা গেছে। এরপর পুতিনকে ব্রিকস মুদ্রার ধারণা সামনে নিয়ে আসতে দেখা যায়। এটি আমেরিকায় একটি বড় উদ্বেগের সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, ফক্স নিউজ একটি আতঙ্ক সৃষ্টিকারী নিউজ কাভার করে উল্লেখ করেছিল যা অনেকটা এরকম ছিল “মার্কিন ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে তার মর্যাদা হারিয়ে ফেললে ইউএস-এ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে, এবং দেশটি তার সুপারপাওয়ারের মর্যাদা হারাবে।” ফরিদ জাকিরা সিএনএন দর্শকদের সতর্ক করে দিয়ে একই রকম দাবি করে উল্লেখ করেন, “মার্কিন ডলার যদি বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলে তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ঘাটতি বহন করতে সক্ষম হবে না।”

ব্রিকস কী?

এবারে ব্রিকস এর সাধারণ মুদ্রার আলোচনায় যাবার পূর্বে ব্রিকস সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিতে হবে। ব্রাজিল রাশিয়া ভারত চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকস নামে পরিচিত আন্তঃসরকারী সংস্থা গঠন করে যা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনৈতিক গোষ্ঠী। ব্রিকস বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের ২৬.৭%, বিশ্ব জনসংখ্যার ৪১.৫% এবং বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের প্রায় এক চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যার সম্মিলিত জিডিপি ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এটি এই গোষ্ঠীটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে প্রতিটি মেট্রিকের দিক দিয়েই বৃহত্তর করে তোলে এবং সময়ের সাথে সাথে তারা কেবল বড়ই হয়ে উঠছে। ব্রিকস সদস্য দেশগুলি একে অপরের মধ্যে আরও নিবিড়ভাবে বাণিজ্য করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এমনকি তারা একটি সাধারণ মুদ্রা প্রবর্তনের কথাও বলেছে যা কার্যকরভাবে এই প্রধান বাণিজ্যিক দেশগুলির উপর পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করে দিতে পারে। এটি একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হতে পারে কারণ স্পষ্টতই এই দেশগুলির বাকি বিশ্বের সাথে সেরা রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই।

রাশিয়া বর্তমানে এমন একটি যুদ্ধে লিপ্ত যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দ্বারা সর্বজনীনভাবে সমালোচিত হয়েছে এবং চীন তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছে যে তারা তাইওয়ান আক্রমণ করতে চায় এবং মূল ভূখণ্ডের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে এই ধরনের সংঘাত প্রতিরোধ করার জন্য অব্যাহত অর্থনৈতিক সহযোগিতাটার দিকটি বিবেচিত হয়, কিন্তু সেটা যদি ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংকসনগুলো একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে, যা প্রধান পারমাণবিক পরাশক্তিগুলিকে সশস্ত্র সংঘাতে সক্রিয়ভাবে জড়িত হওয়া থেকে আটকায়, আর ব্রিকস এর বেশিরভাগ দেশেরই পারমাণবিক সক্ষমতা আছে। যদি এই দেশগুলি একটি বাণিজ্য ব্লক বা একটি ট্রেডিং ইট গঠন করতে পারে তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কেবল মাত্র বৈশ্বিক বাণিজ্যকেই প্রচুর পরিমাণে হারাবে তা না (যেগুলো গত শতাব্দীতে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম মূল চালিকাশক্তি ছিল), সেই সাথে এর ফলে সামরিক আগ্রাসনকে ঠেকাতে এখন যে অর্থনৈতিক বাণিজ্যকে ব্যবহার করা হয় সেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে, এবং এর ফলে এই দেশগুলিকে তাদের সামরিক আগ্রাসন প্রকাশ করা থেকে আটকানোর পথে বাঁধাও কমে যাবে।

অবশ্যই, এটি একটি খারাপ পরিস্থিতি, তবে এমনকি যদি এই গোষ্ঠীটি কেবল বাণিজ্য চুক্তিগুলিকে উত্সাহিত করার জন্য তার সম্পর্কটি ব্যবহার করে, তবে এর আকার এবং প্রভাবের কারণে এটি এখনও বৈশ্বিক অর্থনীতির আকারে আমূল পরিবর্তন এনে দিতে পারে। ব্রিকস ও তার দেশগুলোর স্ট্যাটিস্টিক্সগুলো বিচার করা যাক। একটি গ্ৰুপ হিসাবে ব্রিকসের সম্মিলিত জিডিপি ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যার ফলে তাদের জিডিপি বিশ্বের প্রথম স্থানে যাচ্ছে। তাদের জনসংখ্যাও ৩.২ বিলিয়ন হচ্ছে, এটাও তাদেরকে জনসংখ্যার দিকে ১ম স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথাপিছু জিডিপি হচ্ছে ৭,৮১২ মার্কিন ডলার, যা তাদের ১৪শ স্থানে রাখবে, মানে ভারতের ঠিক উপরে এবং চীনের নীচে। এবার স্বতন্ত্র দেশগুলোর কথা ভাবলে – ব্রাজিলের জিডিপি ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, জনসংখ্যা ২১১ মিলিয়ন এবং মাথাপিছু জিডিপি ৬,৬৩৪ ডলার। রাশিয়ার জিডিপি ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার, জনসংখ্যা ১৪৬ মিলিয়ন এবং মাথাপিছু জিডিপি ১০,২৩০ ডলার। ভারতের জিডিপি ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলার, জনসংখ্যা ১.৪ বিলিয়ন এবং মাথাপিছু জিডিপি ২,১৯১ ডলার। চীনের জিডিপি ১৭.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, জনসংখ্যা ১.৪ বিলিয়ন এবং মাথাপিছু জিডিপি ১২,৩৭৬ ডলার। দক্ষিণ আফ্রিকার জিডিপি ৩১৭ বিলিয়ন ডলার, জনসংখ্যা ৫৯ মিলিয়ন এবং মাথাপিছু জিডিপি ৫,৩৭৩ ডলার। সুতরাং, একটি গ্ৰুপ হিসাবে ব্রিকস খুব শক্তিশালী কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে তারা অনেক পিছিয়ে।

এই জোট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সহযোগিতার গতিশীলতার একটি সত্যিই আকর্ষণীয় কেস স্টাডি কারণ এই গোষ্ঠী সম্পর্কে একটি জিনিস মনে রাখতে হবে যে, তাদের মধ্যে অনেকেই একে অপরকে পছন্দ করে না। এই গ্রুপের সম্ভাবনা বিশাল কিন্তু তাদের কার্যকারিতা এবং সংহতি ভবিষ্যতে তাদের সাফল্য বা ব্যর্থতাকে ঠিক করে দেবে।

ব্রিকস এর অর্থনৈতিক লক্ষ্য

ব্রিকস অর্থনীতির কনসেপ্ট দিয়েছিল মূলত অর্থনীতিবিদরা। ব্রিকস হল ২০০১ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত রূপ, যে নামটির জন্মদাতা হচ্ছে গোল্ডম্যান স্যাকস। পৃথিবীর প্রধান ডেভলপিং ন্যাশনগুলোর অর্থনীতি বোঝানোর জন্য এই অর্থনীতিবিদরা সংক্ষেপে BRICS বা ব্রিকস শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করে। আর এভাবেই তারা একটি গ্ৰুপ তৈরী করেন। আর এরকম গ্ৰুপ তৈরী করা তাদের জন্য নতুন কিছুও ছিলোনা। প্রায়ই তারা এরকম গ্রূপ তৈরী করে নাম দেয়। যেমন এশীয় অর্থনীতিতে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যাওয়া দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর এবং হংকংয়ের গ্রুপকে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করতে অর্থনীতিবিদরা টাইগার নামটির প্রচলন করেছিল। অর্থনীতিবিদরা অন্যান্য বিষয়েও এটি করে। তারা মার্কিন ডলারকে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে উল্লেখ করবে তবে মার্কিন ডলারকে বিশ্ব রিজার্ভ বলার জন্য কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তি বা সরকারী নিয়ম নেই, মানে মার্কিন ডলারের এই ট্যাগটাও অর্থনীতিবিদদেরই দেয়া। দেশগুলি সর্বদা বাণিজ্যের জন্য অন্যান্য মুদ্রা ব্যবহার করে, কিন্তু মার্কিন ডলারকে তারা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে, কারণ এটি নিয়ে কাজ করা সবচেয়ে সহজ এবং সর্বাধিক ব্যাপকভাবে গৃহীত। কাজেই অর্থনীতিবিদরা মার্কিন ডলারকে গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সির ট্যাগ দিয়ে দেয়।

যাই হোক, এরপর ব্রিকস দেশগুলি, বা অরিজিনালি ব্রিক দেশগুলি (যেহেতু প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তর্ভুক্ত ছিলনা) নিজেদেরকে একটি নামের অন্তর্গত গ্রূপ হিসেবে দেখেছিল, আর এরপর তারা ভেবেছিল যে, এটা একটা গুড আইডিয়া, তাদের আসলেই একত্রিত হওয়া উচিত। ব্রিকস গ্রুপের প্রথম প্রকৃত উল্লেখ ছিল ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে, কিন্তু ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত রাশিয়ায় প্রথম আনুষ্ঠানিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি, যেখানে BRIC এর চারটি দেশের নেতারা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে মিলিত হন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কার করেন। একই সাথে তারা ভবিষ্যতে কীভাবে তাদের দেশগুলি আরও ভালভাবে সহযোগিতা করতে পারে সে সম্পর্কেও কথা বলেছেন। প্রথম শীর্ষ সম্মেলনের এক মাস পরে, ব্রিক দেশগুলি একটি নতুন গ্লোবাল রিজার্ভ মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেছিল যা স্থিতিশীল ও প্রেডিক্টেবল হবে। তাদের ঘোষণায় সরাসরি মার্কিন ডলারের কথা উল্লেখ করা হয়নি তবে প্রতিটি পৃথক দেশ অতীতে এর আধিপত্যের সমালোচনা করেছিল। এক বছর পরে, সেই সময়ে দ্রুত বিকাশমান একটি দেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, এই গোষ্ঠীতে যোগ দেয়, এবং দেশটি বিভিন্ন অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনাকরার জন্য বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন শুরু করে। এভাবেই গ্রূপটির নাম BRIC (ব্রিক) থেকে BRICS (ব্রিকস) হয়ে গেল।

গোষ্ঠীটি গঠনের পর থেকে চালু হওয়া বৃহত্তম প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি হ’ল নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, যা সাধারণত ব্রিকস ব্যাংক নামে পরিচিত। এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো একটি সংস্থা যা উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে তাদের অর্থনৈতিক আউটপুট বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ করে এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের বৈশ্বিক বাণিজ্যে মূল্য সংযোজনকারী বা ভেল্যু-এডিং অংশীদার করে তোলে কেননা এটি অনুসারে কোন দেশের স্বচ্ছল হবার জন্য সব বিষয় এদের মধ্যে সমান সমান হওয়া উচিত। ব্রিকস ব্যাংক বা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হচ্ছে ব্রিকস দেশগুলি ও পাশাপাশি বাংলাদেশ, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং উরুগুয়ে দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যাংক যা আইএমএফ এর একটি বিকল্প। ব্রিকস ব্যাংকের সদস্যপদ আইএমএফের সদস্যপদের চেয়ে অনেক বেশি সীমিত, যা মূলত কিউবা, উত্তর কোরিয়া, মোনাকো, ভ্যাটিকান সিটি, লিচটেনস্টাইন এবং অবশেষে তাইওয়ান ব্যতীত পৃথিবীর প্রতিটি দেশ নিয়ে গঠিত কারণ চীন সেটা হতে দেবে না। এটা ঠিক যে, এই ব্রিকস ব্যাংক এর সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিও অনেকে শত্রুভাবাপন্ন, কিন্তু এইএমএফও ব্যতিক্রম কিছু না, এবং অনেক দেশ ও অর্গানাইজেশন আছে যারা আইএমএফ-কে পছন্দ করেনা। আইএমএফ যে শর্তগুলো দেয় সেগুলোকে অনেক দেশই অতিরিক্ত চাপ বলে মনে করে, এবং এরা এর ব্যতিক্রম চায়।

ব্রিকস দেশগুলির সমস্ত সদস্য দেশকে সরাসরি সংযুক্ত করার জন্য সমুদ্রের নীচে তাদের নিজস্ব অপটিক্যাল ফাইবার কেবল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা করে। এটি রাশিয়া, চীন, ভারত এবং এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য তেমন বড় বিষয় নয় কারণ তারা সবাই ভৌগোলিকভাবে তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি, তবে এটি ব্রাজিলের জন্য একটু চ্যালেঞ্জিং যা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে রয়েছে এবং দক্ষিণ আমেরিকার প্রান্তে না গিয়ে সরাসরি এটি সমুদ্র অ্যাক্সেস থেকে বিচ্ছিন্ন, ফলে এটি একটি বিশাল প্রকল্প হয়ে যায়। সমস্ত ব্রিকস দেশগুলিকে সরাসরি আন্ডার-সি ক্যাবলের মাধ্যমে সরাসরি সংযুক্ত করার কারণ ছিল এই যে, এটি প্রকাশিত হয় যে, ইউএস ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি ইউএস টেরিটরি দিয়ে ফ্লো করা ডেটা ইন্টারসেপ্ট করে। তাই এই দেশগুলো একটি প্রাইভেট কমিউনিকেশন চ্যানেলের পেছনে যে ইনভেস্ট করবে সেটা স্বাভাবিক।

এই দেশগুলি ব্রিকস গেমসের জন্যও জোর দিয়েছে যা অলিম্পিক বা কমনওয়েলথ গেমসের মতোই, তবে সেটা কেবল ব্রিকস সদস্যদের জন্যই উন্মুক্ত। এই সংস্থার সাধারণ প্রবণতা স্পষ্ট, তারা তাদের নিজস্ব অলিম্পিক, তাদের নিজস্ব ক্যাবল, তাদের নিজস্ব আইএমএফ এবং তাদের নিজস্ব রিজার্ভ মুদ্রা চায়। গ্রুপটিনতুন সদস্যদের জন্যও উন্মুক্ত। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইরান, মিশর, বাহরাইন, আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া ইত্যাদি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছে। ইরান, আলজেরিয়া এবং আর্জেন্টিনা ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনের পরে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছিল যা একটি খুব শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ করে, আর তা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে দুটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক দল গঠিত হতে যাচ্ছে।

কেন এই দেশগুলো এরকম অর্থনৈতিক জোট তৈরী করতে চায়? কেন এরা অন্যদের  প্রভাবের বাইরে থাকতে চায়?

এই দেশগুলো এরকম অর্থনৈতিক জোট তৈরী করতে চায় কারণ এরা  বাকি বিশ্ব এবং বিশেষত ওয়েস্ট, এবং সম্ভবত আরও বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে যেতে চায়। আর এখানে আরেকটা প্রশ্ন আসছে। কেন এই দেশগুলো অন্য সবার প্রভাবের বাইরে থাকতে চায়? এর কারণটাও অভিয়াস। যদি দেশগুলোর সরকার এমন কোন জিওপলিটিকাল স্বার্থ বা রাজনৈতিক স্বার্থ অর্জন করতে চায় যা পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পছন্দ করেনা, সেক্ষেত্রে সেটা ঠেকাবার জন্য তাদের ওপর তারা যে ফাইনান্সিয়াল স্যাঙ্কশন বা আর্থিক নিষেধাজ্ঞা বা অন্য কোন রকম ইকোনোমিক টুল ব্যবহার করতে পারে, তা যাতে সফল না হয়। যদি এই দেশগুলো নিজেদের মধ্যেই বাণিজ্য করতে পারে, তবে তারা একটি বিশাল অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর শেয়ার করা সমস্ত সম্পদ এবং জনশক্তিতে এক্সেস পেতে পারে। সুতরাং যদি তারা অন্য দেশগুলো থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নও হয়ে যায়, তবুও সেটা এই দেশগুলোর জন্য কোন সমস্যা হবে না, কারণ এই দেশগুলির মধ্যে প্রায় সমস্ত অর্থনৈতিক ফ্যাক্টর আছে, যেগুলো এদের কখনও প্রয়োজন হতে পারে।

এটা অন্যায্যও নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ যদি বিনিময় বা রিজার্ভ সম্পদের মাধ্যম হিসাবে চীনের মুদ্রা ব্যবহারের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হতো তবে তারাও তাদের নিজস্ব বিকল্প চাইতো। এক রাশিয়াকে গ্লোবাল পেমেন্ট নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারটা দেখে অনেক দেশই বুঝেছে যে, যদি তারা এমন কিছু করে যা পশ্চিমারা বা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পছন্দ করেন, তাহলে তাদের রিজার্ভও অকেজো হয়ে যেতে পারে। এখন ইউক্রেইনের মতো একটি সার্বভৌম দেশকে আক্রমণ করার মতো কাজ কোন দেশ সচরাচর করেনা ঠিকই, কিন্তু এরকম একটি স্যাঙ্কশন রাশিয়ার মতো একটি শক্তিধর দেশকে যে অবস্থা করেছে তা দেখে ভয় পাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই দেশগুলো ভাবতেই পারে যে, এমনটা যে ভবিষ্যতে সেই দেশের সাথে হবেনা, তার কোন গ্যারান্টি নেই। আর যে কোনও দায়িত্বশীল সরকারই নিশ্চিত করতে চাইবে যাতে তারা যেসব রিসোর্স আমদানির ওপর নির্ভরশীল তার একটি উৎস্য বন্ধ হয়ে গেলে যেন অন্য উৎস্য ঠিক থাকে, তারা যেসব রিসোর্স রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, তার একটি ক্রেতার কাছে যাবার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে, অন্য ক্রেতাকে সহজে পাওয়া যায়। ব্রিকস তাদেরকে এই সিকিউরিটি দেবে।

ব্রিক্স মুদ্রা আসলে কেমন?

ব্রিকসকে ব্যাপকভাবে পশ্চিম জি-৭ ব্লকের ভূ-রাজনৈতিক কাউন্টার-পয়েন্ট হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং তারা গত এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে প্রতি বছর বার্ষিক বৈঠক করে আসছে। যাই হোক, পুতিন গত বছরের জুনে ব্রিকস মুদ্রার ধারণার কথা প্রথম উল্লেখ করেছিলেন যখন ব্রিকস বিজনেস ফোরামে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে ব্লকটি একটি নতুন গ্লোবাল রিজার্ভ মুদ্রার জন্য কাজ করছে। গত অক্টোবরে মস্কোর ভালদি ক্লাবে রাশিয়ার এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক এ কথা বলেন। জানুয়ারিতে অ্যাঙ্গোলায় এক সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছিলেন, পরবর্তী ব্রিকস বৈঠকে এই ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হবে এবং এপ্রিলে নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার স্টেট ডুমার ডেপুটি চেয়ারম্যান দাবি করেছিলেন যে প্রকল্পটির কাজ ভালভাবেই চলছে।

তো এই ব্রিকস মুদ্রাটি আসলে কেমন হবে? অবশ্যই এটি একটি সাধারণ মুদ্রা হবে, অর্থাৎ, একক মুদ্রার পরিবর্তে বিদ্যমান মুদ্রার পাশাপাশি ব্যবহৃত একটি নতুন মুদ্রা, অর্থাৎ, এমন একটি মুদ্রা যা ইউরোর মতো বিদ্যমান মুদ্রাগুলিকে প্রতিস্থাপন করে। এটা ছাড়া এই মুদ্রা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়না। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এটি আইএমএফের এসডিআরের সমতুল্য হতে পারে, যা একটি রিজার্ভ সম্পদ যা আইএমএফ দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতির জন্য ইস্যু করে, যা তারপরে ডলার, ইউরো, পাউন্ড, ইয়েন বা এমনকি জাতিসংঘের জন্য ট্রেড করা যেতে পারে। অন্যান্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে নতুন মুদ্রাটি ব্রিকস মুদ্রার মূল্যের সাথে নয়, বরং সোনা বা তেলের মতো পণ্যগুলির কিছু বাস্কেটের সাথে আবদ্ধ হবে। মুদ্রাটির সম্ভাব্য নামগুলির মধ্যে রয়েছে ব্রিক, ব্রিক কয়েন বা আর-5 (এই কারণে যে ব্রিকস এর দেশগুলোর সব দেশের মুদ্রার নাম R দিয়ে শুরু হয়)।

(To be continued)

পুতিনের ব্রিকস মুদ্রাটির ধারণা নিয়ে আসার কারণ কি?

পুতিন এবং রাশিয়ার রাজনৈতিক শ্রেণি সর্বদা এই সত্যকে ঘৃণা করে এসেছে যে মার্কিন ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশাল ফিস্কাল স্পেস বা আর্থিক স্থান দেয়, আর সেজন্যই দেশটি ইউক্রেইনকে এতো বেশি সহায়তা প্রেরণ করতে পারে, এবং রাশিয়া সহ মূলত যে কোনও দেশের উপর একতরফাভাবে শাস্তিমূলক ফাইনান্সিয়াল স্যাংকসন বা আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। পুতিন সম্ভবত ১৯৯৮ সালের আর্থিক সংকটের পরে রাশিয়ার অর্থনীতির অপমানজনক ডলারাইজেশনের কথাও মনে করেন, যখন রাশিয়ান রাষ্ট্র তার বৈদেশিক ঋণ খেলাপি করেছিল, রুবলকে পঙ্গু করে দিয়েছিল এবং সাধারণ রাশিয়ানদেরকে রুবলের পরিবর্তে ডলার ব্যবহার করতে বাধ্য করেছিল। ২০০০ সালের মধ্যে, মার্কিন ডলার রাশিয়ায় প্রচলিত সমস্ত মুদ্রার মূল্যের ৮৭% হয়ে যায়, এবং রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদেরকে ডলারেই কর প্রদান করতে হয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, এর অর্থ ছিল এই যে, তখন রাশিয়াই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম ডলার-ভিত্তিক অর্থনীতি। এক দশকেরও কম সময় আগে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা একটি দেশের জন্য এটি কেবল গভীর অপমানজনকই ছিল না, এটি সাময়িকভাবে রাশিয়ার আর্থিক সার্বভৌমত্বও কেড়ে নিয়েছিল। যদিও বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি এবং রুবলকে তুলনামূলকভাবে দ্রুত পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল, এই প্রেক্ষাপটে পুতিন ১৯৯৯ সালে রাশিয়ার ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং সম্ভবত এই কারণেই তিনি তখন থেকে ডলারের উপর রাশিয়ার নির্ভরশীলতা হ্রাস করার চেষ্টা করছেন।

বছরের পর বছর ধরে, পুতিন রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ডলারের অংশ হ্রাস করার চেষ্টা করছেন এবং বাকি বিশ্বকে তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে, বিশেষ করে তাদের তেল বিক্রয় এর ক্ষেত্রে ডলারে ডিনোমিনেশন বন্ধ করতে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখানে তিনি তেমন সফল হননি। যুদ্ধের আগে, রাশিয়ার রিজার্ভের প্রায় অর্ধেক তখনও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জন্য সংবেদনশীল ছিল এবং রাশিয়ার বেশিরভাগ রফতানি তখনও ডলারে মূল্যায়িত ছিল। যদিও এই ভগ্নাংশটি হ্রাস পেয়েছিল, যার কারণ মূলত এই যে, রাশিয়া আরও বেশি করে ইউরোতে তার বিক্রিগুলো করছিল, যদিও যখন তিনি ডিডলারাইজেশনের কথা বলছিলেন তখন ঠিক এটা, মানে ইউরোতে বিক্রির মাধ্যমে ডিডলারাইজেশন করার কথা ভাবেননি। আশ্চর্যজনকভাবে, পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর নজিরবিহীন আর্থিক নিষেধাজ্ঞা বা ফাইনান্সিয়াল স্যাংকসন আরোপ করার পর থেকে পুতিন এবং রাশিয়ার রাজনৈতিক শ্রেণি ক্রমবর্ধমানভাবে ডি-ডলারাইজেশনের দিকে ঝুঁকছে, যে স্যাঙ্কশনগুলোর মধ্যে রয়েছে ৩০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করা এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্টার-ব্যাংক মেসেজিং সিস্টেম সুইফট থেকে রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংককে বহিষ্কার করা। পুতিন স্পষ্টতই স্বীকার করেছেন যে রুবল শীঘ্রই ডলারকে প্রতিস্থাপন করবে না, এবং তার সর্বশেষ ধারণাটি হচ্ছে একটি নতুন ব্রিকস মুদ্রা।

ব্রিকস নতুন মুদ্রা তৈরির চেয়ে কেন চীনের ইউয়ানকে নিজেদের রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ব্যবহার করছে না?

গত কয়েক মাস ধরে এই আলোচনা সামনে এসেছে যে, ডলারের আধিপত্য ইউয়ান এর দ্বারা হুমকির মুখে পড়ছে। সুতরাং বিশ্লেষক এবং উভয় পক্ষের রাজনীতিবিদরা চাপ দিতে শুরু করেছেন যে এটি বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে ডলারের শেষের শুরু হতে পারে এবং সম্ভবত মার্কিন আর্থিক আধিপত্যেরও সমাপ্তি সূচনা করতে পারে। তাছাড়া একটি অর্থনৈতিক সত্তা হিসাবে ব্রিকসকে যদি পশ্চিমারা কোন কারণে উদ্বেগজনক বলে মনে করেই তবে তা করবে মূলত চীনের জন্য, কারণ অর্থনীতির দিক দিয়ে ব্রিকসকে আসলে মূলত চীন বলেই মনে হয়। এই গ্রুপের অন্যান্য দেশগুলির মোট উৎপাদনের দ্বিগুনেরও বেশি চীন একাই উৎপাদন করে। সুতরাং ব্রিকস পশ্চিমাদের জন্য একটি সম্ভাব্য বৈরী অর্থনৈতিক শক্তি, কিন্তু চীন যতটা উদ্বেগজনক, পুরো ব্রিকস তার চেয়ে বেশি উদ্বেগজনক নয়। সেক্ষেত্রে ব্রিকস যদি নতুন মুদ্রার দিকে যাবার চেয়ে চীনা মুদ্রা রেনমিনবি বা ইউয়ানের দিকে যেতেই পারত। কিন্তু তারা সেদিকে যায়নি। কেননা সেটা কার্যকর হতোনা।

ব্রিকস গ্রুপটি ১৪ বছর ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যমান হলেও এটি কাজের বেলায় খুব বেশি কার্যকর হয়নি। চীনা মুদ্রা ইউয়ান বা রেনমিনবি এখনও বৈশ্বিক রিজার্ভের মাত্র ২.৭% শতাংশ, কানাডিয়ান এবং অস্ট্রেলিয়ান ডলারের রিজার্ভের অনুরূপ। আর ব্রিকস এর অন্যান্য মুদ্রাগুলির সমষ্টি রিজার্ভে রাখা অন্যান্য সমস্ত মুদ্রার ৩.৪%-এ নেমে গেছে। যদি এরা কোন নতুন মুদ্রা তৈরির দিকে না যায়, তবে রেনমিনবীকেই তাদের রিজার্ভ কারেন্সি বানাতে পারে, কিন্তু এতোদিনেও বিশ্বের মোট রিজার্ভ কারেন্সিতে রেনমিনবির পার্সেন্টেজ এরা তেমন বাড়াতে সক্ষম হয়নি।

ডলারকে বিদ্যমান কোন মুদ্রা দিয়ে রিপ্লেস করার ব্যাপারটা নতুন নয়। চীন ও রাশিয়া ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিল এবং উভয় ক্ষেত্রেই খুব বেশি কিছু ঘটেনি। এছাড়াও, ব্রাজিল ডলার ত্যাগ করেছে বলে যে দাবি করা হয়েছে তাও আসলে সত্য নয়। যা ঘটেছে তা হ’ল ব্রাজিলের ওয়ান ব্যাংক চীনের নতুন ইন্ট্রা-ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমে যোগ দিতে সম্মত হয়েছিল। দেশটির একটি মাইনর প্রেস রিলিজের ৮ম বুলেট পয়েন্টে এই ঘোষণাটি দেয়া হয়েছি, আর ব্রাজিলিয়ান ব্যাংকটি ২০০৯ এবং ২০১৩ সালেও একই কাজ করার চেষ্টা করেছিল। এদিকে যখন একাধিক ছোটখাটো সংবাদ মাধ্যম রিপোর্ট করেছে যে ফ্রান্স ইউয়ানে এলএনজি কিনছে, তারা সবাই একই লেখকের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করেছে এবং মূল প্রতিবেদনটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওদিকে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের নিবন্ধে কেবল দাবি করা হয়েছে যে সৌদিরা ইউয়ানে স্যুইচ করার কথা ভাবছে কিন্তু বাস্তবে এখনও কিছুই ঘটেনি। এটাও বলার মতো যে, এই শিরোনামগুলি কয়েক বছরে পুনরায় ঘটে। ২০০৪ সালে, ২০০৭ সালে, ২০১১ সালে, ২০১৮ সালে এরকম সংবাদ পাওয়া গেছে, এবং এমনকি ১৯৭৫ সাল থেকে এরকম খবর পাওয়া যাচ্ছে, এবং প্রতিবারই এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলি ভুল হয়েছে। মূল কথা হল, চীন সহ অনেক দেশই তাদের মুদ্রা দিয়ে ডলারকে রিপ্লেস করার কথা বলেছে, কিন্তু কেউই তা করে দেখতে পারেনি।

এখন যদিও এটি সত্য যে বিশ্বব্যাপী রিজার্ভের ডলারের অনুপাত ১৯৯৯ সালের ৭২% থেকে আজ ৫৯%-এ নেমে এসেছে, এর কারণ মূলত এই যে, উন্নয়নশীল দেশগুলি এখন আর তাদের মুদ্রাকে ডলারের সাথে তুলনা করে না, তবে ডলার এখনও বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় মুদ্রা। এটি ইউরোপ ব্যতীত বিশ্বের সর্বত্র বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হয় (ইউরোপ ইউরো ব্যবহার করে)। উদাহরণস্বরূপ, ইউয়ান বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ পোর্টফোলিওর প্রায় ৩% এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাত্র ২% ইউয়ানে ডিনোমিনেটেড করা হয়। আর ইউয়ান নিয়ে যা বলা হলো সেটাও আসলে ওভারস্টেটমেন্ট, কেননা সেই ২% এর ৭৫%-ই রয়েছে হংকং এবং মূল ভূখণ্ড চীনের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং যদি আপনি এটি বাদ দেন তবে দেখা যাবে ইউয়ান দিয়ে আসলে মেক্সিকান পেসো বা পোলিশ জল্টির চেয়েও কম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়।

তার মানে এই নয় যে, এটা সবসময় ই সত্য হবে। ইউয়ান ভবিষ্যতে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে কারণ রাশিয়া এখন এটি ব্যবহার করতে সম্মত হচ্ছে এবং পিপলস ব্যাংক অফ চায়না বা পিবিওসি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলিতে সোয়াপ লাইন প্রসারিত করে ইউয়ানের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এই প্রবণতাগুলিকে মার্কিন ব্যাংকিং সিস্টেমে ক্রমাগত বিশৃঙ্খলা বা সম্ভবত ডিজিটাল ইউয়ান আরও বাড়িয়েও দিতে পারে। কিন্তু মৌলিকভাবে, ইউয়ান ডলারকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না কারণ এর জন্য পিবিওসিকে মানুষকে ইউয়ানকে অবাধে ট্রেড করার অনুমতি দিতে হবে। এখন বর্তমানে পিবিওসি এটি ঘটতে দেয় না কারণ তারা লেনদেনের এক প্রান্তের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পছন্দ করে, আর তার কারণ এই যে, চীন তাদের মুদ্রাকে কম মূল্যায়িত করতে পছন্দ করে কারণ তারা একটি রফতানি-ভিত্তিক অর্থনীতি এবং এই ভাবে একটি কম মূল্যায়িত মুদ্রা তাদের রফতানিকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে। (এটা নিয়ে আগেই লিখেছি)। যেমন পিবিওসি যদি এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায় তবে ইউয়ান বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত হতে পারবে না, কারণ বর্তমানে দেশগুলি সহজেই এটি কিনতে এবং বিক্রি করতে সক্ষম নয়।

সর্বোপরি, কোন মুদ্রার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হওয়া মানে সাধারণত এই যে, এটি সেই মুদ্রাকে অতিমূল্যায়িত বা ওভারভেল্যুড করে তোলে, আর ইউয়ানের (রেনমিনবি) সাথে এটা হওয়া মানে হল চীনের অর্থনীতির সম্পূর্ণ পুনর্গঠনের। সর্বোপরি, স্পষ্টতই ডলার এবং মার্কিন অর্থনীতির জন্য কিছু সাধারণভাবে হুমকি থাকলেও, মনে হচ্ছে না যে চীনা ইউয়ান বা অন্য কোনও মুদ্রা ডলারের আধিপত্যকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে।

ব্রিকস এর সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার সম্ভাবনা

ব্রিকস দেশগুলো ২০০৯ সাল থেকেই একটি নতুন মুদ্রা তৈরির কথা বলছে এবং এখন পর্যন্ত খুব বেশি কিছু ঘটেনি। এমনকি যদি তারা এই নতুন মুদ্রাটি প্রবর্তন করতে সক্ষম হয় তবে এটি সম্ভবত কেবল তাদের নিজস্ব বিদ্যমান মুদ্রাতে বাণিজ্যকে কঠোর এবং জটিল করে তুলবে। তো, ব্রিকসের নতুন মুদ্রার তৈরির মাধ্যমে ডলারকে রিপ্লেস করার প্রকল্পটি কি সফল হতে পারে? অন্তত কিছু ব্রিকস দেশে অবশ্যই এই মুদ্রাটির আকাঙ্ক্ষা আছে, এবং আর্থিক নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংকসনের প্রতি আমেরিকার নতুন আগ্রহ এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির উপর ফেডারেল রিজার্ভের হার বৃদ্ধির উপর প্রভাব দেশগুলোকে ডিডলারাইজেশনের জন্য উত্সাহিত করেছে। ব্রাজিলের লুলা বছরের পর বছর ধরে ডলারের বিপরীতে অবস্থান করছেন এবং চীন কিছুদিন ধরে তার মুদ্রা ইউয়ানকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা করছে। দুর্ভাগ্যবশত, পুতিন, লুলা এবং শি ছিনপিং এর জন্য ডলারের পরিবর্তে ব্রিকস মুদ্রার দিকে  যাবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কথাটিকে অযৌক্তিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এই ধারণাটিতে বেশ কয়েকটি সমস্যা থেকে যাচ্ছে। মূল কারণগুলো হচ্ছে –

প্রথমত, যে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে চালিত করার জন্য এই গ্রুপের অকার্যকারিতাও এই গ্রুপের সাধারণ কার্যকারিতার একটি ইঙ্গিত দেয়। ব্রিকস অর্থনীতি ব্যর্থ অর্থনীতি। ব্রিকস শব্দটি যখন প্রথম জনপ্রিয় হয়েছিল, তখন এই গোষ্ঠীটির দেশগুলির অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং উন্নত শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিল। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে সত্যিকারের প্রত্যাশা ছিল যে এই গোষ্ঠীটি এখন পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করবে। অবশ্যই, তারা সম্মিলিতভাবে এখনও চীন ছাড়াই খুব শক্তিশালী, কেবল মাত্র একটি বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বরং সম্পদের কারণেও। তাদের যেমন জনশক্তি এবং প্রযুক্তি আছে, তেমনি পারমাণবিক অস্ত্রও আছে। তবে ব্রিকস এর বেশিরভাগ দেশ উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর গতিতে চলে গেছে। যুদ্ধের ফলে স্যাঙ্কশনের আগে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি স্থবির ছিল এবং ইউক্রেন আক্রমণের পরে, এটি কেবল হ্রাসই পাচ্ছে। ব্রাজিল গত ১০ বছরে তার অর্থনৈতিক উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক হারিয়েছে এবং চলমান রাজনৈতিক ইস্যুগুলির কারণে কোভিড থেকে তার পুনরুদ্ধারও ধীর ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার ইকোনোমি উল্টে কমছে (এটা নিয়ে  ইতিমধ্যেই একটি লেখা দিয়েছি)। এমনকি চীন, যা একসময় আপাতদৃষ্টিতে অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক শক্তি ছিল, তার অর্থনীতি পরিপক্ক হওয়ার সাথে সাথে আরও বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই দেশগুলোর অবস্থা আগের মতো ভাল নয়, যদিও সামগ্রিকভাবে বিশ্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দেশগুলি যদি তাদের নিজস্ব অর্থনীতিকে ঠিক মতো পরিচালনা করতে না পারে তবে বিশ্ব অর্থনীতির সুতা নিয়ন্ত্রণ করাটাও তাদের জন্য সমস্যা হবে, এবং গ্রুপ ডায়নামিকও তাদের সাহায্য করবে না। এটা নিয়ে একটি বিশেষ উদাহরণ হতে পারে এই যে, ব্রিকসের কোনও দেশই এখন আর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে কারেন্সি ইউনিয়ন শুরু করতে চাইবে না, যা দেখতে অনেকটা ইকোনমিক বাস্কেট কেসের মতো। (দক্ষিণ আফ্রিকা বর্তমানে কিরকম অর্থনৈতিক ক্রাইসিসে আছে তা নিয়ে একটি লেখা ইতিমধ্যেই পোস্ট করেছি)।

দ্বিতীয়ত, দলটি আসলে একটি সুবিধার জোট, মানে এলায়েন্স অফ কনভেনিয়েন্স। মানে জোটটি ইইউ এর মতো প্রাকৃতিক হচ্ছে না যেখানে দেশগুলোর মধ্যে আইডিওলজি ও প্রিন্সিপলে মিল রয়েছে। এখানে ছোট ইকোনমির সদস্যরা বড় অর্থনৈতিক উদ্যোগের অংশ হতে চায়, আর বড় ইকোনমির সদস্যরা চায় বিশ্বের মেজর ইকোনমির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ। এখন নতুন ইনিশিয়েটিভগুলো ব্রিকস এর লক্ষ্যগুলির সাথে সাংঘর্ষিক হয় বলে ব্রিকস উদ্যোগগুলিকে দেশগুলো তেমন প্রায়োরিটি দেয়নি। ইউরোর মতো কোন সাধারণ মুদ্রা কেবল তখনই কাজ করে যখন দেশগুলিতে কমপক্ষে তুলনামূলকভাবে অনুরূপ অর্থনীতি থাকে এবং এটা বিবেচনায় রাখতে হবে যে, এখানে ছোট ছোট ট্রেড ইমব্যালেন্সও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। কেবল ইউরোজোনের তথাকথিত ঘাটতিযুক্ত দেশগুলির ক্ষেত্রে কী হয়েছে তা দেখুন। আর্জেন্টিনার সাথে একটি সাধারণ মুদ্রা গঠনের জন্য লুলার আরও বিনয়ী পরিকল্পনা এখনও বাস্তবায়িত না হওয়ার অন্যতম কারণ এটাই। সত্যি বলতে, ব্রিকস সদস্য দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ভারসাম্যহীন, এবং দেশগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থনীতি। উদাহরণস্বরূপ, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা উভয়ই অন্যান্য সদস্যদের সাথে ধারাবাহিক এবং বড় ঘাটতিতে চলছে, যার অর্থ তারা অন্যান্য সদস্যদের সাথে বিক্রির চেয়ে বেশি ক্রয় করে এবং ভারত রাশিয়ার তুলনায় ভীষণভাবে উন্মুক্ত অর্থনীতি।

তৃতীয়ত, সমস্ত ব্রিকস দেশ এবং এই গোষ্ঠীর সম্ভাব্য সদস্যরা যে একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র – তাও না। এই গ্রুপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারত আক্ষরিক অর্থেই তাদের বিতর্কিত সীমান্তে সামরিক সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। চীন এবং ভারত দুটি কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী, যারা স্বেচ্ছায় একটি মুদ্রা ইউনিয়নে যোগ দিতে পারে এমন ধারণাটি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।

চতুর্থত, ব্রিকসকে সফল হতে হলে রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলিকে এটি কার্যকর করার জন্য মূলধন প্রবাহকে উদার করতে হবে, যা খুব অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। (চীনের জন্য কেন এটি সমস্যার তা নিয়ে আগে একটি আর্টিকেল লিখেছি)।

শেষ পর্যন্ত, পুতিনের ব্রিকস মুদ্রা কখনও বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম বলে মনে হচ্ছে, ডলারকে প্রতিস্থাপন করা তো দূরের কথা।

ব্রিকসের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির ক্ষতির সম্ভাবনা

এখন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এই গোষ্ঠীর সম্ভাব্য প্রভাবকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা ঠিক না, তবে এটি আসলে একটি লুজ গ্রুপিংয়ের চেয়ে বেশি কিছু নয় যা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্য বছরে মাত্র একবার মিলিত হয়। কেবল মাত্র সদস্য দেশগুলোর কথা ভেবে এই গ্রূপকে অন্যান্য কয়েক ডজন অনুরূপ সংস্থার চেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে এটি কোনও উদ্বেগজনক প্রবণতা নয়। তবে সেটা ভিন্ন একটি কারণে যা হচ্ছে, গ্লোবাল কর্পোরেশনের ভাঙ্গন। এই ধরনের গ্রুপগুলি গঠনের সাথে সাথে বিশ্ব আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছে, যেখানে কেবল মাত্র একই স্বার্থের ছোট ব্লকগুলির মধ্যে তথ্য এবং রিসোর্সের বাণিজ্য হবে, আর এরকম ক্ষেত্রে আমরা সবাই স্ট্রাগল করবে।

বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং বৈশ্বিক আউটপুট ভীষণভাবে সম্পর্কিত। এই যে ব্রিকস গ্রুপের দেশগুলি এত দ্রুত তাদের অর্থনীতির বিকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল, এর কারণ ছিল বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তাদের একসেস। জাস্ট শুরু থেকে অর্থনীতি গড়ে তোলা খুব কঠিন, এখানে আপনাকে স্ক্র্যাচ থেকে সবকিছু করতে হবে। এটি এখনও খুব কঠিন তবে এটি অনেক সহজ যখন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আপনার দেশে আসতে পারে, আপনার দেশকে আধুনিক প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোতে একসেস দিতে পারে, তারপরে তারা এগুলোর আউটপুটগুলির গ্রাহকও তারা হতে পারে, যখন উৎপাদনকারী দেশগুলো বিকাশ করতে পারে তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারগুলোকে। অন্যদিকে কারণ যাই হোক, দেশগুলো যদি অন্য দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অধিকতর স্বাবলম্বী বা সেলফ-সাফিশিয়েন্ট হওয়ার চেষ্টা করে, তবে সেই দেশগুলোর জন্য সব কিছু আরও কঠিন এবং ধীর হয়ে যায়, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধীর করে দেয়। ব্রিকস ই একমাত্র গোষ্ঠী নয়, যারা এই বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারী এবং ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য উত্তেজনার অর্থ হ’ল বেশিরভাগ দেশ এবং সংস্থাগুলি যেখানে সম্ভব সেখানে সাপ্লাই চেইনকে অনশোর ও সিমপ্লিফাই করার চেষ্টা করছে। এই অনশোরিং ও সিম্পল সাপ্লাই চেইন দেশগুলোর স্ট্র্যাটেজিক ডিপেন্ডেন্সি কমিয়ে দেয় ও ভূরাজনৈতিক সংকট থেকে একরকম সিকিউরিটি ও রিডান্ডেন্সি দেয় ঠিকই, কিন্তু এর ফলে দেশগুলোকে প্রায়শই এফিসিয়েন্সি ও অপর্চুনিটিও খোয়াতে হয়।

তুলনামূলকভাবে সুশিক্ষিত এবং ইংরেজিভাষী মানুষের বিশাল জনসংখ্যার কারণে ভারত আজ বিশ্বের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল অর্থনীতি, যারা ব্যবসায়ের আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিতে দক্ষ অফশোর পরিষেবা সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু ব্রিকস এর মতো একটি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়াটা ভারতের সবচেয়ে বড় পোটেনশিয়াল কাস্টোমারদের ওপর বিরোধ সৃষ্টি করবে, আর এর মাধ্যমে সেই পরিষেবাগুলি থেকে আসা অর্থনীতির বৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। ভারতের কথা কেবল একটি উদাহরণ হিসেবে বলা হল, এরকম কম্প্রোমাইজ ব্রিকসভুক্ত অন্যান্য দেশকেও করতে হতে পারে। এটা ভাবা বাস্তবসম্মত নয় যে সব দেশ সব সময় একত্রিত হবে, কিন্তু গত শতাব্দীতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৈশ্বিক শান্তির অন্যতম বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন গ্ৰুপ এই প্রবণতার বিরুদ্ধে গেলে তা অবশ্যই উদ্বেগের সৃষ্টি করবে, এমনকি যদি এর সদস্যরা নির্দোষও হয়। আর ব্রিকস ও এর মুদ্রার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এই গ্রুপের সম্ভাবনা বিশাল কিন্তু তাদের কার্যকারিতা এবং সংহতি ভবিষ্যতে তাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ধারিত করে দেবে।

তথ্যসূত্র

1 – https://www.bis.org/publ/qtrpdf/r_qt2212x.htm
2 – https://www.bbc.co.uk/news/business-63040797
3 – https://www.reuters.com/article/uk-reserve-currency-russia-medvedev-sb-idUSTRE52S0Q520090329
4 – https://www.ft.com/content/f8f3b2cd-6690-4f26-b81e-e972751c8799
5 – https://www.wsj.com/articles/saudi-arabia-considers-accepting-yuan-instead-of-dollars-for-chinese-oil-sales-11647351541
6 – https://twitter.com/JavierBlas/status/1641366758073286657
7 – https://unherd.com/thepost/the-dollar-isnt-going-anywhere/
8 – https://twitter.com/JavierBlas/status/1641074551822987266/photo/1
9 – https://www.ft.com/content/f8f3b2cd-6690-4f26-b81e-e972751c8799
10 – Forbes, Yuan Pipe Dreams
11 – https://twitter.com/BaldingsWorld/status/1641428208007380999
12 – https://cepr.org/voxeu/columns/renminbis-unconventional-route-reserve-currency-status
13 – Adam Tooze, Crashed, Chapter 5
14 – https://financialtribune.com/articles/world-economy/86102/putin-calls-for-de-dollarization-in-oil-trade
15 – https://www.ft.com/content/a5187880-c553-11e8-8670-c5353379f7c2
16 – https://en.wikipedia.org/wiki/BRICS
17 – https://economictimes.indiatimes.com/news/economy/policy/brics-explores-creating-new-reserve-currency/articleshow/94628034.cms
18 – https://www.agenzianova.com/en/news/lavrov-the-hypothesis-of-a-common-currency-in-the-BRICS-countries-will-be-discussed-at-the-August-summit/
19 – https://cointelegraph.com/news/russia-talks-up-prospects-of-brics-countries-developing-new-currency
20 – https://www.imf.org/en/About/Factsheets/Sheets/2023/special-drawing-rights-sdr
21 – https://foreignpolicy.com/2023/04/24/brics-currency-end-dollar-dominance-united-states-russia-china/?tpcc=recirc_trending062921
22 – https://www.ft.com/content/ef0cac54-48f5-418f-9d7a-634634592724
23 – https://moderndiplomacy.eu/2022/12/21/a-brics-reserve-currency-exploring-the-pathways/

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.